৪. মাইক্রোফার্ম

মাইক্রোফার্ম

মাইকোজেন… মাইকোজেনের মাইক্রোফার্মগুলো সেই সময়েই পরিণত হয়েছিল কিংবদন্তীতে, যদিও সেগুলোর অস্তিত্ব এখন টিকে আছে শুধু কয়েকটা প্রবাদ বাক্যে। যেমন মাইকোজেন-এর মাইক্রোফার্মের মতো উন্নত অথবা মাইকোজেনিয়ান ছত্রাকের মতো সুস্বাদু। সময়ের সাথে সাথে এই প্রবাদগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু হ্যারি সেলডন পালিয়ে বেড়ানোর সময় কয়েকটা মাইক্রোফার্মে গিয়েছিলেন, যা তিনি নিজের স্মৃতিকথাতে উল্লেখ করেছেন। তার বক্তব্য প্রচলিত জনমতকেই সমর্থন করে…
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা

.

৪১.

অসাধারণ, খুশীতে চিৎকার করে উঠলেন সেলডন। ক্লোউড যে খাবারগুলো এনেছিল তার চেয়ে এগুলো অনেক অনেক বেশি সুস্বাদু।

বোঝানোর সুরে ডর্স বলল, তোমাকে মনে রাখতে হবে ঘেক্লাউডের মেয়েমানুষেরা মাঝরাতে অল্প সময়ে খাবারগুলো তৈরি করে দিয়েছে। খানিক বিরতি দিয়ে আবার বলল, ওরা অন্তত মেয়েদের আরো খানিকটা সম্মান করতে পারে। এমনভাবে মেয়েমানুষ বলে যেন ব্যক্তিগত সম্পত্তির কথা বলছে। ভীষণ অপমানজনক।

আমি জানি। কিন্তু তারা স্ত্রী শব্দটাকেও একইরকমভাবে বলতে পারে। এটাই ওদের জীবন প্রণালী এবং সিস্টাররা মনে হয় তাতে কিছু মনে করে না। তুমি-আমি লেকচার দিয়ে তো এটা পাল্টাতে পারব না। যাইহোক দুই বোনের কাছ থেকে তুমি সব বুঝে নিয়েছ তো?

হ্যাঁ, দুইবোন এমনভাবে রান্না করেছে যেন খুব সহজ। তবে আমি বোধহয় সব মনে রাখতে পারব না। ওরা অবশ্য বলেছে যে মনে রাখার দরকারও নেই। প্রয়োজনে খাবারগুলো একটু গরম করে নিলেই হবে। রুটিতে কিছু একটা মেশানো আছে যার ফলে শেকার সময় দ্রুত ফুলে যায় এবং মচমচে হয়ে উঠে সেই সাথে একটা ঝাঁঝালো স্বাদ এনে দেয়। গোলমরিচের স্বাদ। তুমি টের পাওনি?

লক্ষ্য করিনি। তবে জিনিসটা যাইহোক, আমার আরো দরকার ছিল। আর স্যুপ। সবজিগুলো তুমি চিনতে পেরেছ?

না।

মাংসগুলো কীসের ছিল? বলতে পারবে?

মাংস ছিল কী না তাতেই আমার সন্দেহ আছে। সিনাতে ভেড়ার মাংসের একটা খাবার তৈরি করা হয়, জিনিসটার স্বাদ আমার কাছে সেইরকমই লেগেছে।

ভেড়ার মাংস ছিল না।

বললামই তো মাংস কী না তাই নিশ্চিত নই। আমার মনে হয় না মাইকোজেন-এর বাইরে এত স্বাদের খাবার কেউ খেয়েছে। এমনকি স্রাটও না। বাজী ধরে বলতে পারি ওরা যা বিক্রি করে সেগুলো হয়তো মাইকোজেনের হিসাবে নীচুমানের। সেরা খাবারগুলো নিজেদের জন্যই রেখে দেয়। আমাদের এখানে বেশিদিন থাকাটা ঠিক হবে না, হ্যারি। এই স্বাদে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তখন অন্যান্য সেক্টর যে জঘন্য খাবার তৈরি করে সেগুলো মুখে নিতে পারব না। বলেই হাসল সে।

সেলডনও হাসলেন। ফুট জুসের গ্লাসে চুমুক দিলেন। এত স্বাদের জুস তিনি কখনো খাননি। তারপর বললেন, শোনো, আমি আর হামিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পথে রাস্তার পাশের এক হোটেলে থেমেছিলাম। ওখানে যে খাবার খেয়েছি তার স্বাদ ছিল–বাদ দাও, স্বাদ কেমন ছিল তোমার জানার দরকার নেই, তবে আমি কল্পনাও করিনি যে মাইক্রোফুড এত সুস্বাদু হতে পারে। সিস্টাররা এখানে থাকলে ভালো হতো। একটা ধন্যবাদ ওদের পাওনা হয়ে আছে।

আমার ধারণা খাবারগুলো আমাদের কেমন লাগবে সেটা ওরা ভালো করেই জানে। রান্না করার সময়ই যে সুগন্ধ বেরিয়েছিল আমি প্রশংসা না করে পারিনি। তখনই ওরা বলেছিল যে খেতে আরো সুস্বাদু হবে।

নিশ্চয়ই বড়োজন বলেছিল।

হ্যাঁ। ছোটটা সারাক্ষণই হাসছিল। আর ওরা আসবে একটু পরেই। আমার জন্য একটা কার্টলেস আনতে গেছে। আমি তাহলে কেনাকাটা করার জন্য বেরুতে পারব এবং বেরনোর সময় অবশ্যই মুখ ধুয়ে নিতে হবে। প্রসাধনীর চিহ্ন থাকা চলবে না। ওরা আমাকে দোকান চিনিয়ে দেবে যেখানে ভালো কার্টলেস এবং তৈরি খাবার পাওয়া যায়। আমাদের শুধু গরম করে নিলেই চলবে। এটাও বলেছে যে ভালো সিস্টাররা কখনো দোকান থেকে তৈরি খাবার কেনে না। সবসময়ই কষ্ট করে ঘরে তৈরি করে। তবে আমরা যেহেতু ট্রাইবসপিওপিল এই নিয়মটা আমাদের না মানলেও চলবে। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছে যে বাজার সদাই এবং রান্নাবান্নার কাজ আমিই করব।

আমাদের গ্রহে একটা প্রবাদ আছে, ট্র্যান্টরে গিয়ে তোমাকে ঠিক সেভাবেই চলতে হবে যা ট্র্যান্টরের নিয়ম।

হ্যাঁ, আমি জানতাম তুমি এই কথাই বলবে।

আমিও তো সাধারণ মানুষ।

সবাই এই কৈফিয়তই দেয়।

পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে হেলান দিয়ে বসলেন সেলডন। তারপর বললেন, ট্র্যান্টরে তুমি দুই বছর ধরে বাস করছ, ডর্স। ফলে আমি যা বুঝতে পারছি না তার অনেক কিছুই হয়তো তুমি বুঝতে পারবে। তোমার কী মনে হয় মাইকোজেনিয়ান সমাজ আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

আধ্যাত্মিক!

হ্যাঁ। শুনেছ এইধরনের কোনো কথা?

আধ্যাত্মিক বলতে কী বোঝাতে চাইছ?

এমন এক শক্তি যা সব নিয়ম কানুনের উর্ধ্বে, প্রাকৃতিক নিয়ম বা কোনো রকম শর্ত দিয়ে যাকে বেঁধে রাখা যায় না।

ও, তুমি জানতে চাইছ মাইকোজেনিয়ান সমাজ ধর্ম বিশ্বাস নির্ভর কি না।

এবার সেলডনের অবাক হওয়ার পালা, ধর্ম বিশ্বাসী!

হ্যাঁ, অতি প্রাচীন একটা শব্দ, তবে আমরা ইতিহাসবিদরা এই শব্দটা ব্যবহার করি ব্যাপকভাবে আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাসের সাথে আধ্যাত্মিকতার কোনো সম্পর্ক নেই, যদিও ধর্মের ভেতরে প্রচুর আধ্যাত্মিক উপাদান আছে। যাইহোক, তোমার প্রশ্নের জবাব ঠিক দিতে পারব না। তবে মাইকোজেনিয়ানদের যতদূর দেখেছি এবং ইতিহাসে যা পেয়েছি তাতে এই সমাজ ধর্ম নির্ভর হলে আমি মোটেও অবাক হব না।

সেক্ষেত্রে, ওদের কিংবদন্তীগুলোও যদি ধর্ম নির্ভর হয় তুমি কী অবাক হবে?

না, মোটেই না।

এবং তাতে কোনো ঐতিহাসিক উপাদান নাও থাকতে পারে, তখন?

এই ব্যাপারে অবশ্য একমত হতে পারছি না। বিভিন্ন রকম বিকৃতি এবং আধ্যাত্মিক উপাদান মেশানোর পরেও মাইকোজেনিয়ান কিংবদন্তীর মূল বক্তব্যটুকু ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

হুম, গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন সেলডন।

দীর্ঘক্ষণের নীরবতা ভেঙে ডর্সই আবার কথা বলল, এটা অস্বাভাবিক কিছু না। অনেক গ্রহেই প্রচুর ধর্মীয় উপাদান বিদ্যমান। গত কয়েক শতাব্দীতে এটা ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী যখন এম্পায়ারে বিশৃঙ্খলা ছিল অনেক বেশি। সিনার মোট জনসংখ্যার অন্তত এক চতুর্থাংশ ধর্মে বিশ্বাস করে।

আরো একবার বিষণ্ণ মনে সেলডন উপলব্ধি করলেন ইতিহাস বিষয়ে তিনি কত অজ্ঞ। নিশ্চয়ই এমন একটা সময় ছিল যখন বর্তমানের তুলনায় ধর্মের প্রভাবই ছিল সবচেয়ে বেশি? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

অবশ্যই। তাছাড়া ক্রমাগতই নতুন নতুন ধারা তৈরি হয়েছে। মাইকোজেনিয়ান ধর্ম–সেটা যাইহোক না কেন–সম্ভবত একেবারেই নতুন এবং শুধু মাইকোজেনেই সীমাবদ্ধ। ব্যাপক গবেষণা ছাড়া আমি সঠিক বলতে পারব না।

এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক, ডর্স। তোমার কী মনে হয় পুরুষদের তুলনায় মেয়েরা ধর্মের প্রতি বেশি আগ্রহী?

ভুরু উঁচু করল ডর্স। চট করে এমন সহজ একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। খানিকক্ষণ ভাবল, আমার মতে জনসংখ্যার সেই অংশ যারা অসহায়, দরিদ্র, ভাগ্যবঞ্চিত, নিপীড়িত তারা মনের শান্তির জন্য এমন কিছু আঁকড়ে ধরে যাকে বলা হয় আধ্যাত্মিকতা। আধ্যাত্মিকতা বরাবরই ধর্মকে ছাপিয়ে অনেক বড়ো হয়ে দেখা দেয়। ব্যতিক্রম তো অবশ্যই আছে। অনেক নিপীড়িত মানুষই দেখা যাবে ধর্ম বিশ্বাস করে না অথচ ধনী, সফল এবং ভাগ্যবান অনেক মানুষই অন্ধের মতো বিশ্বাস করে।

কিন্তু মাইকোজেন-এর ক্ষেত্রে, সেলডন বললেন, যেখানে মেয়েদেরকে মানুষ বলে গণ্য করা হয় না। আমার কী কোনো ভুল হবে যদি ধরে নেই যে এখানে পুরুষদের তুলনায় মেয়েরাই বেশি ধার্মিক, এই সমাজ যে কিংবদন্তী গোপন করে রেখেছে তার সাথে মেয়েদের সংস্পর্শটাই বেশি?

সেটা জানার জন্য আমি সারাজীবন বাজী ধরতে পারব না, হ্যারি, তবে দুই এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে দেখতে পারি কিছু জানা যায় কিনা।

চমৎকার, চিন্তিত সুরে বললেন সেলডন।

ডর্স হাসল। সাইকোহিস্টোরির সামান্য একটু অংশ, হ্যারি। রুল নাম্বার ৪৭, ৮৫৪ : নিপীড়িত মানুষ ভাগ্যবান মানুষের তুলনায় বেশি ধার্মিক।

মাথা নাড়লেন সেলডন, সাইকোহিস্টোরি নিয়ে ঠাট্টা করবে না, ডর্স। তুমি জানোনা আমি শুধু কয়েকটা নিয়ম তৈরি করার চেষ্টা করছি না। আমি চেষ্টা করছি। সর্বজনীন রূপ দেওয়ার এবং এটাকে পরিচালনা করার কৌশল তৈরি করতে। নির্দিষ্ট কয়েকশ নিয়ম তৈরি করে দিলে এটা আরেকটা ধর্মে পরিণত হবে। আমি তা চাই না। আমি এমন একটা কৌশল তৈরি করতে চাই যেন গাণিতিক যুক্তি প্রয়োগ করে বলতে পারি, আঁহা, পরিস্থিতি এমন হলে মানুষের এই দলটা ওই দলের চেয়ে বেশি ধার্মিক হবে, এবং এই ধরনের উদ্দীপনায় মানবজাতি এইরকম আচরণ করবে।

কী ভয়ংকর। এমন একটা ছবি তৈরি করছ যাতে মনে হয় মানুষ আসলে যন্ত্র। বোতাম টিপলেই নাচতে শুরু করবে।

না, কারণ এক সাথে অনেকগুলো বোতাম টিপতে হবে, সেই সাথে বিভিন্ন রকমের অসংখ্য আচরণ বিতাড়িত করতে হবে যার ফলে সামগ্রিকভাবে ভবিষ্যতের পূর্বানুমান হয়ে উঠবে পরিসংখ্যানিক, এবং এই কারণেই ইন্ডিভিজুয়াল হিউম্যান বিয়িং থাকবে মুক্ত স্বাধীন।

তুমি কীভাবে জানো?

জানি না। আমি জানি না। কিন্তু আমার অনুভূতি বলছে এরকমই হবে, হওয়াই যৌক্তিক। যদি আমি অনুমিতিগুলো বের না করতে পারি বা বলতে পারো যদি আমি হিউম্যানিক্স-এর মূলনীতিগুলো নির্দিষ্ট করতে না পারি, তাহলেও সাইকোহিস্টোরি তৈরি করতে পারব। আমি প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে তাত্ত্বিকভাবে সেটা সম্ভব।

কিন্তু অবাস্তব, ঠিক?

প্রথম থেকেই আমি এই কথা বলে আসছি।

ডর্সের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটল, তুমি কী তাহলে এটাই খুঁজছ হ্যারি, এই সমস্যার একটা সমাধান?

আমি জানি না। বিশ্বাস করো, আমি জানি না। কিন্তু চ্যাটার হামিন একটা সমাধান পাওয়ার জন্য ভীষণ উদগ্রীব, আর কী এক অজানা কারণে আমি তাকে খুশী করার জন্য উদগ্রীব। মানুষকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা তার অসীম।

হ্যাঁ, আমি জানি।

মুখে কয়েকটা ভাজ পড়লেও মন্তব্যটা এড়িয়ে গেলেন সেলডন। বলতে লাগলেন, হামিন আমাকে বুঝিয়েছে যে এম্পায়ার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, ভেঙ্গে পড়ছে, সাইকোহিস্টোরিই এটাকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় বা সতর্কতার জন্য বা পরবর্তী সময়টাকে আরো উন্নত করার জন্য এবং এটা ছাড়া মানবজাতি টিকে থাকতে পারবে না বা টিকে থাকলেও তাদেরকে পোহাতে হবে দীর্ঘ যুগের দুর্ভোগ। মানবজাতিকে রক্ষার দায়িত্ব বোধহয় সে আমার কাঁধে চাপিয়েছে। আমার জীবদ্দশাতে এম্পায়ার-এর কিছুই হবে না, কিন্তু যদি আমি স্বস্তিতে বেঁচে থাকতে চাই তাহলে কাঁধ থেকে এই দায়িত্ব নামাতে হবে। আমাকে অবশ্যই নিজের কাছে প্রমাণ করতে হবে তার চেয়েও বড়ো কথা হামিনের কাছে প্রমাণ করতে হবে–যে সাইকোহিস্টোরি কোনোদিনও বাস্তবে পরিণত হবে না; এটাকে শুধু তাত্ত্বিকভাবে ডেভেলপ করা সম্ভব। কাজেই আমাকে যতগুলো পথ পাওয়া যায় খুঁজে দেখতে হবে এবং দেখাতে হবে যে তার সবগুলোই কানাগলি।

পথ? অর্থাৎ ইতিহাসের পথ ধরে পিছন দিকে যেতে হবে যখন মানব সমাজ ছিল বর্তমানের তুলনায় ছোট।

ভীষণ ছোট এবং অনেক কম জটিল।

এবং প্রমাণ করবে যে সমাধান যাইহোক না কেন তা অবাস্তব।

হ্যাঁ।

কিন্তু প্রাথমিক যুগের বিশ্বগুলোর তথ্য তোমাকে কে জানাবে? মাইকোজেনের কাছে যদি সেইরকম কিছু থাকেও নিশ্চিত থাকতে পারো সানমাস্টার সেটা তোমার কাছে প্রকাশ করবে না। কোনো মাইকোজেনিয়ানই করবে না। এরা পুরোপুরি আত্মকেন্দ্রিক সমাজ–কতবার বলতে হবে?–আর ট্রাইবসম্যানদের এখানকার বাসিন্দারা এত বেশি সন্দেহ করে যা প্রায় উন্মাদনার সমকক্ষ।

তাদের কারো কাছ থেকে তথ্য আদায় করার জন্য একটা উপায় বের করতে হবে। সিস্টারদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করে দেখা যায়।

ওরা তোমার কথাই শুনবে না, কারণ তুমি পুরুষ। আর বললেও তোমাকে দুই একটা উদ্ধৃতি ছাড়া আর কী জানাতে পারবে?।

কোনো এক জায়গা থেকে তো শুরু করতে হবে।

একটু চিন্তা করে দেখি। হামিন বলেছিল তোমাকে আমার রক্ষা করতে হবে। আর আমি কথাটার অর্থ দাঁড় করিয়েছি এভাবে যে যতদূর সম্ভব তোমাকে আমার সাহায্য করতে হবে। ধর্ম সম্পর্কে কী জানি আমি?–তুমি জানো এটা আমার বিষয় ছিল না, আমি দার্শনিক খাত নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি, সবসময়ই কাজ করেছি। অর্থনৈতিক খাতগুলো নিয়ে। তবে ইতিহাসকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করা যায়, প্রতিটা অংশের মাঝে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাবে। ধর্ম যখন। সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল তখন ধর্মের সাহায্যে প্রচুর ধন সম্পদ জমা করা যেত কিন্তু এর ফলে সমাজের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হতো। আসলে এটা মানব ইতিহাসের অসংখ্য নিয়মের মধ্যে একটা এবং এর সাহায্যে তুমি হিউম্যানিক্স না কী যেন বললে তার একটা মৌলিক নীতি তৈরি করে নিতে পারো। কিন্তু…।

ধীরে ধীরে ডর্সের কণ্ঠস্বর নিচু মাত্রায় নেমে গেল। সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সেলডন। গভীর চিন্তার কারণে ডর্সের চোখগুলো মাঝে মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

তারপর বলল, আমার যতটুকু মনে পড়ছে, প্রতিটি ধর্মেই এক বা একাধিক গ্রন্থ ছিল–ওগুলোকে বলা হতো ধর্মগ্রন্থ যার গুরুত্ব অপরিসীম। এই গ্রন্থগুলোতে নির্দিষ্ট ধর্মের মূলনীতি, আচার অনুষ্ঠান পালনের নিয়ম কানুন, পবিত্র বাণীসমূহ লিপিবদ্ধ করা থাকত। ধর্মগ্রন্থগুলো ছিল সর্বস্তরের মানুষের ব্যবহারের জন্য। আবার দুই একটা ধর্মের ক্ষেত্রে ওগুলো ছিল গোপনীয় ব্যাপার।

তোমার ধারণা মাইকোজেনেরও এইরকম কোনো ধর্মগ্রন্থ আছে?

সত্যি কথা বলতে কী, চিন্তিত সুরে বলল ডর্স, আমি কখনো শুনিনি। সবার জন্য উন্মুক্ত হলে হয়তো শুনতাম–তার মানে হয় এদের কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই অথবা সেটা গোপন করে রাখা হয়েছে। ঘটনা যাইহোক না কেন, আমার মনে হচ্ছে আসল ব্যাপারটা জানার সৌভাগ্য তোমার হবে না।

আমরা অন্তত কাজ শুরু করতে পারি, হাসি মুখে বললেন সেলডন।

.

৪২.

হ্যারি আর ডর্স লাঞ্চ শেষ করার দুই ঘণ্টা পর সিস্টাররা আবার এলো। দুজনেই হাসছে। রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ, দুজনের ভেতর যে সবচেয়ে বেশি গম্ভীর সে একটা কার্টলেস উঁচু করে ধরল যেন ডর্স ভালোভাবে দেখতে পারে।

খুব সুন্দর, প্রশস্ত হাসি আর আন্তরিক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে ডর্স বলল, এমব্রয়ডারীটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।

এটা তেমন কিছুই না, সুরেলা পাখির কণ্ঠে বলল রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ। আমার পুরনো একটা পোশাক। আপনার গায়ে ছোট হবে। তবে খানিক সময়ের জন্য এটা ব্যবহার করলে অসুবিধা নেই। এটা পড়ে আমাদের সাথে দোকানে যেতে পারবেন। সেখান থেকে আপনার পছন্দ মতো কার্টলেস কিনে নেবেন।

রেইনড্রপ ফরটি খ্রীর মুখে লাজুক হাসি, কিছু বলছে না সে, তাকিয়ে আছে। মাটির দিকে, নিখুঁতভাবে ভাঁজ করা সাদা রঙের একটা কার্টল ডর্সের হাতে তুলে দিল। ডর্স ভাজ খোলার কোনো চেষ্টা করল না বরং বাড়িয়ে ধরল সেলডনের দিকে। রং দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা তোমার জন্য, হ্যারি।

সম্ভবত, সেলডন বললেন। কিন্তু ফিরিয়ে দাও। ও তো আমাকে দেয়নি।

ওহ, হ্যারি, সামান্য মাথা নেড়ে ডর্স বলল।

না, সেলডনের গলায় দৃঢ়তা। ও আমাকে দেয়নি। জিনিসটা ওকে ফিরিয়ে দাও। আমি ওর হাত থেকে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।

একটু ইতস্তত করল ডর্স, তারপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও কার্টলটা ফেরত দেওয়ার জন্য বাড়িয়ে ধরল রেইনড্রপ ফরটি থ্রীর দিকে।

হাতদুটো শরীরের পেছনে লুকিয়ে ফেলল সিস্টার, নিজেও পিছিয়ে গেল, মুখ থেকে সমস্ত রক্ত সরে গিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে চেহারা। রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ দ্রুত একবার সেলডনের দিকে তাকালো, খুবই দ্রুত, তারপর এগিয়ে গিয়ে রেইনড্রপ ফরটি থ্রীকে জড়িয়ে ধরল।

শোনো, হ্যারি, ডর্স বলল, পরিবারের পুরুষ ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সাথে সিস্টারদের কথা বলার অনুমতি নেই। তাহলে এই মেয়েটাকে বিব্রত করে কী লাভ? ও কী নিয়মটা পাল্টাতে পারবে।

আমি বিশ্বাস করি না, কর্কশ কণ্ঠে বললেন সেলডন। কোনো নিয়ম থাকলেও তা শুধু ব্রাদারদের জন্য প্রযোজ্য। আমার সন্দেহ এই মেয়ের আগে কখনো ট্রাইবসম্যানের সাথে দেখা হয়নি।

ডর্স মোলায়েম সুরে জিজ্ঞেস করল, আমরা ছাড়া অন্য কোনো ট্রাইবসপিওপিলের সাথে তোমার কখনো দেখা হয়েছে?

দীর্ঘ সময় ইতস্তত করে ক্ষীণ ভাবে না-বোধক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সিস্টার।

বাহুগুলো দুপাশে ছড়িয়ে দিলেন সেলডন, বেশ, আমি ঠিকই বলেছি। চুপ থাকার কোনো নিয়ম থাকলেও সেটা ব্রাদারদের জন্য। যদি ট্রাইবসম্যানদের সাথে কথা বলা নিষেধই হতো তাহলে কী ওরা আমাদের সেবাযত্ন করার জন্য অল্পবয়সী দুটো মেয়েকে এই সিস্টারদের এভাবে পাঠাতো?

সম্ভবত ওরা শুধু আমার সাথে কথা বলবে আর আমি বলব তোমার সাথে।

ননসেন্স। আমি বিশ্বাস করি না এবং করবও না। আমি শুধু ট্রাইবসম্যানই নই, আমি মাইকোজেনের সম্মানিত একজন অতিথি। চ্যাটার হামিন আমাদের সাথে সেইরকমই ব্যবহার করার অনুরোধ জানিয়েছেন এবং সানমাস্টার ফোরটিন নিজে আমাদেরকে এখানে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। আমার কোনো অস্তিত্বই নেই এইধরনের আচরণ আমি মোটেই সহ্য করব না। সান মাস্টারের সাথে যখন দেখা হবে তখন আমি অভিযোগ জানাব এ ব্যাপারে।

রেইনড্রপ ফরটি থ্রী মাইকোজেনিয়ান স্বভাবের হলেও রেগে উঠল খানিকটা। রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।

ডর্স আরো একবার চেষ্টা করল সেলডনকে বোঝানোর কিন্তু সেলডন হাত তুলে বাধা দিলেন তাকে। তারপর কড়া চোখে তাকিয়ে রইলেন রেইনড্রপ ফরটি গ্রীর দিকে।

শেষ পর্যন্ত কথা বলল সে, তবে কণ্ঠস্বর এখন আর পাখির কণ্ঠের মতো সুরেলা নয়, বরং কাঁপাকাঁপা আর কর্কশ যেন একজন পুরুষের সাথে কথা বলতে তাকে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হচ্ছে এবং তাও সে করছে নিজের সকল অনুভূতি এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা ঠিক হবে না আপনার, ট্রাইবসম্যান। তা হবে চরম অবিচার। আপনি আমাকে বাধ্য করছেন আমাদের প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করতে। কী চান আপনি?

আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাসলেন সেলডন। হাত বাড়িয়ে বললেন, আমার জন্য যে পোশাকটা নিয়ে এসেছ সেটা।

নীরবে রেইনড্রপ ফরটি থ্রী কার্টলেসটা সেলডনের হাতে তুলে দিল।

সামান্য মাথা নোয়ালেন তিনি এবং নরম সুরে বললেন, ধন্যবাদ, সিস্টার। তারপর দ্রুত একবার ডর্সের দিকে তাকালেন অনেকটা, কী, দেখলে তো, এমন একটা ভাব নিয়ে। কিন্তু ডর্স রাগে চোখ ফিরিয়ে নিল।

ভাজ খুললেন সেলডন। জিনিসটার কোনো বৈশিষ্ট্য নেই (পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। সুন্দর কারুকাজ করা পোশাক শুধু মেয়েদের জন্য)।

আমি বাথরুমে যাচ্ছি পোশাক পাল্টানোর জন্য, তিনি বললেন। কয়েক মিনিটের বেশি লাগবে না।

ছোট চেম্বারে ঢুকলেন তিনি। কিন্তু দেখলেন দরজা বন্ধ হচ্ছে না কারণ ডর্স ভেতরে ঢোকার জন্য জোর খাটাচ্ছে। দুজন ঢোকার পরই দরজা বন্ধ হলো।

কী করেছ তুমি? রাগে ফোঁস-ফোঁস করে উঠল ডর্স। কসাইয়ের মতো আচরণ করেছ। বাচ্চা মেয়েটার সাথে ওরকম ব্যবহার না করলে হতো না।

আমি শুধু ওকে কথা বলাতে চেয়েছি। অধৈর্য সুরে বললেন সেলডন। তথ্য সংগ্রহের জন্য ওকেই বেছে নিয়েছি। একটু কঠোর হতে হয়েছে সেজন্য আমি দুঃখিত, কিন্তু এছাড়া আর কীভাবে তার লজ্জা ভাঙানো যেত। এবং তিনি ডর্সকে বেরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেন।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলেন ডসও তার কার্টলেস পড়ে নিয়েছে।

স্কিন ক্যাপ দিয়ে ঢাকা মাথা এবং পুরনো পোশাক সত্ত্বেও ডর্সকে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে। পোশাকের সেলাইগুলো শারীরিক কাঠামোর হালকা একটা ইঙ্গিত দিলেও কোনো কিছুই পরিস্কার বোঝা যায় না। ডর্সের বেল্ট তারটার চেয়েও চওড়া এবং পোশাকের চেয়ে খানিকটা ধূসর রঙের শেড। এছাড়াও সামনে আটকানোর জন্য উজ্জ্বল রঙের দুটো নীল পাথরের বোতাম রয়েছে (মেয়েরা কঠিন বিপদের মাঝেও নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে, সেলডন ভাবলেন)।

সেলডনের দিকে তাকিয়ে ডর্স বলল, তোমাকে পুরোপুরি মাইকোজেনিয়ানদের মতো দেখাচ্ছে। সিস্টারদের সাথে বাইরে যাওয়ার জন্য আমরা তৈরি।

হ্যাঁ, বললেন সেলডন, কিন্তু আমি চাই তারপরে রেইনড্রপ ফরটি থ্রি আমাকে তাদের মাইক্রোফার্মে নিয়ে যাবে।

বড়ো বড়ো চোখ করে দ্রুত কয়েক পা পিছিয়ে গেল রেইনড্রপ ফরটি থ্রী।

আমি ওগুলো দেখতে চাই, শান্ত সুরে বললেন সেলডন।

 রেইনড্রপ ফরটি থ্রী দ্রুত ডর্সের দিকে তাকালো, ট্রাইবসওম্যান-

সেলডন বললেন, তুমি বোধহয় ফার্মের ব্যাপারে কিছুই জানোনা, সিস্টার।

খোঁচাটা ঠিক জায়গামতো লাগল। রাগের সাথে চিবুক তুলল মেয়েটা, তবে এখনো সতর্কভাবে ডর্সকে সম্বোধন করেই কথা বলছে, আমি মাইক্রোফার্মে কাজ করেছি। সব ব্রাদার এবং সিস্টারকেই জীবনের কোনো না কোনো সময় ওখানে কাজ করতে হয়।

বেশ, আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে। তর্ক করবে না। আমি ব্রাদার নই যাদের সাথে তোমাদের কথা বলা নিষেধ। আমি একজন ট্রাইবসম্যান এবং সম্মানিত অতিথি। এই স্কিনক্যাপ এবং কার্টলেস পড়েছি যেন কারো দৃষ্টি আকৃষ্ট না হয়। কিন্তু আমি একজন স্কলার এবং যতক্ষণ এখানে আছি ততক্ষণ জানার চেষ্টা করে যাব। এই ঘরে বসে সারাক্ষণ ওই দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারব না। আমি একটা জিনিসই দেখতে চাই যা মাইকোজেনের আছে কিন্তু গ্যালাক্সির আর কোথাও নেই… তোমাদের মাইক্রোফার্মস। তোমরা নিশ্চয় এটা নিয়ে ভীষণ গর্বিত।

আমরা গর্বিত, রেইনড্রপ ফরটি থ্রী বলল, এবার সরাসরি সেলডনের মুখোমুখি হলো সে, এবং আমি আপনাকে দেখাবো। ভাববেন না যে দেখেই আমাদের গোপন ব্যাপারটা আপনি জেনে ফেলবেন। আগামীকাল সকালে আমি আপনাকে মাইক্রোফার্ম দেখাতে নিয়ে যাব। যাওয়ার ব্যবস্থা করতে কিছু সময় লাগবে।

আগামীকাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমি। কিন্তু তুমি প্রতিজ্ঞা করছ? কথা দিচ্ছ আমাকে?

আমি একজন সিস্টার এবং মুখে যা বলি তাই করি। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করব এমনকি সেটা একজন ট্রাইবসম্যানকে দেওয়া হলেও।

শেষ কথাটা বলার সময় তার কণ্ঠস্বর আরো শীতল হয়ে গেল, অথচ চোখ দেখে মনে হলো সে হাসছে। তার মনে কী ভাবনা চলছে বুঝতে পারলেন না সেলডন, অকারণ অস্বস্তি বোধ করলেন।

.

৪৩.

নির্ঘুম একটা রাত কাটালেন সেলডন। শুরুতেই ডর্স জানালো যে সেও সাথে যাবে এবং সেলডন একগুয়ের মতো অমত করলেন।

আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, তিনি বলেছিলেন, মেয়েটাকে একটা অস্বাভাবিক পরিবেশে ফেলে দিয়ে একজন পুরুষের সাথে একসাথে, হোক সে ট্রাইবসম্যান স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতে বাধ্য করা। একবার নিয়ম ভাঙলে তাকে দিয়ে আরো অনেক কিছু করানো সহজ হবে। তুমি সাথে থাকলে সে শুধু তোমার সাথেই কথা বলবে।

কিন্তু আমি না থাকলে যদি কোনো বিপদ হয়, আপারসাইডে যেমন হয়েছিল?

কিছুই হবে না। প্লীজ! যদি আমাকে সাহায্য করতে চাও তাহলে তুমি দূরে থাকবে। আর যদি না চাও, তোমাকে আমার দরকার নেই। এটাই আমার শেষ কথা, ডর্স। ব্যাপারটা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তোমার প্রতি আমি যতখানি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি ঠিক ততখানি গুরুত্বপূর্ণ, তুমি তাতে বাধা দিতে পারবে না।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজী হলো ডর্স। ঠিক আছে, কথা দাও তুমি ওর সাথে দুর্ব্যবহার করবে না, হ্যারি।

তুমি কী আমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করছ না মেয়েটাকে? নিশ্চিন্তে থাকো, আমি নিজের আনন্দের জন্য ওর সাথে দুর্ব্যবহার করিনি ভবিষ্যতেও করব না।

ডর্সের সাথে এই তর্কের স্মৃতিই তাকে রাতের বেশিরভাগ অংশ জাগিয়ে রাখল এটা প্রথম কারণ; দ্বিতীয় কারণ, সারাক্ষণই তিনি দুঃশ্চিন্তায় ভুগছেন। রেইনড্রপ ফরটি থ্রী যদিও কথা দিয়েছে তারপরেও দুই সিস্টার সকালে নাও আসতে পারে।

যাইহোক সকালের নাস্তা সবে মাত্র শেষ হয়েছে এমন সময় সিস্টাররা এলো (সেলডন ঠিক করেছেন পরিমিত আহার করবেন)। এরই মধ্যে তিনি কার্টলেস পরে নিয়েছেন কোনো সমস্যা ছাড়াই।

রেইনড্রপ ফরটি খ্রীর চোখ এখনো শীতল। বলল, আপনি তৈরি, ট্রাইবসম্যান সেলডন, আমার বোন ট্রাইবসওমেন ভেনাবিলির সাথে থাকবে। তার কণ্ঠ পাখির মতো সুরেলা নয় আবার কর্কশও নয়। বোধহয় সারারাত মনে মনে অনুশীলন করেছে পুরুষ কিন্তু ব্রাদার নয় এমন একজনের সাথে কীভাবে কথা বলা যায়।

মেয়েটা সারারাত ঘুমিয়েছে কী না অবাক হয়ে ভাবলেন সেলডন। বললেন, আমি তৈরি।

আধঘণ্টা পরে, রেইনড্রপ ফরটি থ্রী এবং হ্যারি সেলডন লেভেলের পর লেভেল নিচে নামছেন। ঘড়ি অনুযায়ী এখন দিন। কিন্তু ট্র্যান্টরের অন্যান্য অংশে যেমন দেখা যায় এখানে সেইরকম আলো নেই। বরং নিষ্প্রভ এবং আবছা।

কারণটা পরিস্কার বোঝা গেল না। নিঃসন্দেহে কৃত্রিম সূর্যালোকের যে ব্যবস্থা। ট্র্যান্টরে আছে মাইকোজেন সেক্টরও তার অন্তর্ভুক্ত। সম্ভবত এখানকার বাসিন্দারাই এইরকম আলো পছন্দ করে নিয়েছে, ভাবলেন সেলডন, অতি প্রাচীন কোনো অভ্যাস ধরে রেখেছে হয়তো। ধীরে ধীরে আবছা পারিপার্শ্বিকতার সাথে তার দৃষ্টি অভ্যস্ত হতে লাগল।

ব্রাদার বা সিস্টার যেই হোক না কেন তিনি সব পথচারীর চোখে চোখে তাকানোর চেষ্টা করছেন। পথচারীরা স্বাভাবিকভাবেই তাকে আর রেইনড্রপ ফরটি থ্রীকে ধরে নিয়েছে একজন ব্রাদার এবং তার মেয়েমানুষ। তিনি তেমন কিছু না করলে কারো মনোযোগ আকৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

দুর্ভাগ্যবশত রেইনড্রপ ফরটি থ্রী বোধহয় মনোযোগ আকৃষ্ট করতেই চায়। কথা বলছে খুব কম এবং যখন বলছে তখন নিচু গলায়, দাঁত কিড়মিড় করে। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে একজন বেগানা পুরুষের সাথে পথ চলা, যদিও ব্যাপারটা শুধু সে একাই জানে, তার আত্মবিশ্বাস কেড়ে নিয়েছে পুরোপুরি। সেলডনের মনে কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি যদি মেয়েটাকে স্বাভাবিক হতে বলেন তখন বরং আরো হিতে বিপরীত হবে (এখন যদি পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়ে যায় তখন কী করবে সে? নিচের লেভেলে পৌঁছে স্বস্তি বোধ করলেন সেলডন কারণ এখানে মানুষের সংখ্যা কম)।

নিচে নামার জন্য এলিভেটর নেই, রয়েছে জোড়ায় জোড়ায় চলমান সিঁড়ি, একটা উপর দিকে উঠছে আরেকটা নিচের দিকে নামছে। রেইনড্রপ ফরটি থ্রী বলল এগুলো। এসকেলেটর, শব্দটা তিনি কখনো শুনেননি।

যতই নিচে নামছেন সেলডনের অনুভূতি ততই প্রখর হয়ে উঠছে। অধিকাংশ গ্রহেই মাইক্রোফার্ম আছে। প্রতিটি গ্রহই তাদের নিজস্ব ধরনের মাইক্রোপ্রোডাক্টস উৎপাদন করে। হ্যালিকনে থাকতে সেলডন নিজেও বেশ কয়েকবার মাইক্রোফার্মে কেনাকাটা করেছেন। সবসময়ই তিনি এমন একটা গন্ধ পেতেন যা এক কথায় অসহ্য। গন্ধে তার পেটের নাড়িভুড়ি পাক দিয়ে উঠত।

মাইক্রোফার্মের কর্মীদের দেখে মনে হতো এই গন্ধ তাদের কাছে কোনো ব্যাপারই না। দর্শনার্থীরা যখন নাক মুখ কুঁচকে রেখেছে তারা দিব্যি সেখানে কাজ করে চলেছে। এই ভয়ানক গন্ধ সেলডন কখনো সহ্য করতে পারেননি এবং জানেন যে এবারেও সহ্য করতে কষ্ট হবে। তাই আগে থেকেই নিজের মনকে প্রবোধ দেওয়া শুরু করলেন এই বলে যে তিনি এত কষ্ট করছেন কারণ একটা উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তার জরুরি কিছু তথ্য প্রয়োজন, কিন্তু বুঝলেন লাভ হচ্ছে না। কারণ পেটের ভেতরে নাড়িভুড়ি সব গিটু লাগিয়ে দেওয়ার উপক্রম করেছে।

খেই হারিয়ে ফেললেন সেলডন, কতগুলো লেভেল নিচে নেমে এসেছেন হিসাব গুলিয়ে ফেলেছেন, কিন্তু বাতাস এখনো নির্মল তরতাজা। তাই জিজ্ঞেস করলেন, মাইক্রোফার্ম লেভেলে কখন পৌঁছাব আমরা?

অনেক আগেই পৌঁছে গেছি।

 জোরে শ্বাস নিলেন সেলডন। গন্ধ শুঁকে তো মনে হচ্ছে না আমরা পৌঁছে গেছি।

গন্ধ? কী বলতে চান আপনি? মারমুখো ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল রেইনড্রপ ফরটি থ্রী। এখন আর জোরে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে না সে।

আমি যতটুকু জানি, মাইক্রোফার্মগুলোতে সবসময়ই এক ধরনের তীব্র পচা গন্ধ তৈরি হয়। গন্ধটা তৈরি হয় ব্যাকটেরিয়া, ঈষ্ট, ফাঙ্গাস, সেপ্রোফাইটস ইত্যাদি উপাদানের জন্য যে সার প্রয়োগ করা হয় সেখান থেকে।

আপনি যতটুকু জানেন? মেয়েটা আবার নিচু স্বরে কথা বলছে। কোত্থেকে জেনেছেন?

আমার নিজের গ্রহে।

ভয়ানক ভঙ্গিতে মুখ বাঁকিয়ে সিস্টার যা বলল সেইসব শব্দ সেলডন আগে কখনো শুনেননি ঠিকই তবে অঙ্গভঙ্গি থেকে অর্থটা ঠিকই বুঝে নিতে পারলেন।

খাওয়ার জন্য যখন তৈরি হয়ে যায় তখন কিন্তু আর ওরকম গন্ধ থাকে না। তিনি বললেন।

আমাদের এখানে ওরকম গন্ধ কখনোই পাবেন না। আমাদের বায়োটেকনিশিয়ানরা প্রতিটি মাইক্রোপ্রডাক্টসের জন্য নিখুঁত পরিবেশ তৈরি করেছে। এই ফর্মুলা এবং রেসিপিগুলো ট্রাইবসপিওপিলরা কখনোই জানতে পারবে না। এদিকে চলুন। যত খুশি গন্ধ শুঁকে দেখতে পারেন। খারাপ কিছুই পাবেন না। এই কারণেই পুরো গ্যালাক্সিতে আমাদের খাবারের এত চাহিদা এবং আমরা শুনেছি যে সম্রাট নাকি এই খাবার ছাড়া অন্য কিছু মুখেই তুলেন না যদিও এগুলো একজন ট্রাইবসম্যান-এর জন্য অনেক বেশি ভালো এমনকি নিজেকে সম্রাট হিসেবে পরিচিত করার পরেও।

কথাগুলো সে প্রচণ্ড রাগ নিয়ে বলল এবং মনে হলো রাগের একমাত্র লক্ষ্য সেলডন। যথেষ্ট বলা হয়নি মনে করে সে আরো যোগ করল, এমনকি কেউ যদি নিজেকে সম্মানিত অতিথি হিসেবে দাবী করে তারপরেও।

একটা সরু করিডরের ভেতর ঢুকল দুজন। দুপাশে পাতলা কাঁচের তৈরি চৌবাচ্চা। ভেতরে ঘন সবুজ পানি ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে। ট্যাঙ্কগুলোতে এলগির চাষ করা হচ্ছে। গ্যাসের চাপে বুদবুদ তৈরি হচ্ছে পানিতে। এই গ্যাস সম্ভবত সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এগুলোতে প্রচুর কার্বনডাইঅক্সাইড আছে, স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন তিনি।

চৌবাচ্চাগুলোর উপরে উজ্জ্বল গোলাপী আলো জ্বলছে। করিডরের আলো থেকে অনেক বেশি উজ্জ্বল। চিন্তিত সুরে তিনি সেই ব্যাপারে মন্তব্য করলেন।

অবশ্যই, সিস্টার বলল, এলগি চাষের জন্য এইরকম আলোই প্রয়োজন।

আমার মনে হয়, সেলডন বললেন, সবকিছুই স্বয়ংক্রিয়।

 মেয়েটা শুধু কাঁধ নাড়ল, কোনো জবাব দিল না।

আমি কোনো ব্রাদার বা সিস্টারকে এখানে কাজ করতে দেখছি না, বললেন সেলডন, তথ্য আদায়ের চেষ্টা করছেন।

আপনি না দেখলেও ওরা যে যার কাজ করে চলেছে। খুঁটিনাটি আপনাকে জানানো যাবে না, কাজেই প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করবেন না।

দাঁড়াও। রাগ করো না। আমি আশা করি না যে তুমি রাষ্ট্রের গোপন ব্যাপার। আমাকে বলে দেবে। কাম অন, ডিয়ার। (মুখ ফসকে শব্দটা বেরিয়ে গেলো)।

মনে হলো সিস্টার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তাই তিনি তার হাত ধরে ফেললেন, মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেলো মেয়েটা, কিন্তু তিনি তার কাঁপুনি টের পেলেন, বিব্রত হয়ে ছেড়ে দিলেন হাত।

আসলে আমার মনে হচ্ছে সব স্বয়ংক্রিয়। তিনি বললেন।

যা খুশী তাই মনে করতে পারেন। যাইহোক অনেকেই এখানে কাজ করছে। প্রত্যেক ব্রাদার এবং সিস্টারকেই জীবনের একটা সময় এখানে কাজ করতে হয়। কেউ কেউ পরবর্তীকালে এটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয়।

সিস্টার এখন স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কথা বলছে, কিন্তু সেলডন আরো বিব্রত বোধ করলেন যখন লক্ষ্য করলেন যে সিস্টারের যে হাতটা তিনি ধরেছিলেন সেটা সে পোশাকে ঘষে মুছে নিল। যেন তার হাতে তিনি নোংরা লাগিয়ে দিয়েছেন।

করিডরগুলো কিলোমিটারের পর কিলোমিটার বিস্তৃত। তবে এই মোড়ে রয়েছে ফাঙ্গাল সেকশন। আপনার দেখা উচিত।

সেলডন খেয়াল করেছেন যে সবকিছুই অত্যন্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। গ্লাসগুলো চকচক করছে। টাইলস বসানো মেঝে দেখে মনে হয় ভেজা, কিন্তু এক পর্যায়ে থেমে নিচু হয়ে স্পর্শ করে বুঝতে পারলেন যে মেঝে খটখটে শুকনো। এমনকি পিচ্ছিলও না। অবশ্য তিনি এটাও জানেন না যে তার চপ্পলে পিচ্ছিল পথে চলার উপযোগী সোল লাগানো আছে কি না।

একটা কথা সত্যি বলেছে রেইনড্রপ ফরটি থ্রী। এখানে সেখানে ব্রাদার বা সিস্টাররা নিঃশব্দে কাজ করে চলেছে, কেউ মাপজোক করছে, কেউ যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করছে, কেউবা আবার যন্ত্রপাতি পরিস্কার করছে। প্রত্যেকেই গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে, অন্য কোনো দিকেই তাদের লক্ষ্য নেই।

ওরা কী করছে তা জিজ্ঞেস করলেন না সেলডন। তাতে করে সিস্টার বিপদে পড়তে পারে। একজন বহিরাগতকে বিনা অনুমতিতে এখানে নিয়ে আসার জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে হয়তো।

একটা সুইংগিং ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন দুজন। হঠাৎ করেই সেলডন হালকাভাবে সেই পরিচিত দুর্গন্ধটা পেলেন। সিস্টারের দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। তবে সিস্টার মনে হলো এ ব্যাপারে পুরোপুরি অচেতন, তিনি নিজেও কিছুক্ষণ পরে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন।

আলোর ধারাটা পাল্টে গেল হঠাৎ করেই। গোলাপী আভা আর উজ্জ্বলতা সরে গিয়েছে। তার জায়গা নিয়েছে গোধূলীর ধূসর আলো। শুধু যন্ত্রপাতিগুলোর উপর স্পট লাইট দিয়ে আলো ফেলা হয়েছে। বেশ কয়েকজন ব্রাদার এবং সিস্টার কাজ করছে। এখানে। কারো কারো মাথায় বাতিঅলা হেডব্যান্ড। ওগুলো থেকে মুক্তোর মতো আলো ছড়াচ্ছে। ঠিক মাঝখানে শুধু কতগুলো আলোক বিন্দুর ছুটোছুটি চোখে পড়ল সেলডনের।

হাঁটার সময় আড়চোখে সিস্টারের দিকে দ্রুত একবার তাকালেন তিনি এবং নতুন করে অনেক কিছুই আবিষ্কার করলেন। অন্য সময় তিনি একবারের জন্যও ন্যাড়া মাথার কথা মন থেকে তাড়াতে পারেননি। এখানকার সমাজ এই মেয়েটার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র কেড়ে নিয়ে তাকে পুরোপুরি অদৃশ্য করে দিয়েছে। কিন্তু খানিকটা ভিন্ন পরিবেশে তিনি নতুন করে অনেক কিছুই দেখতে পেলেন। নাক, চিবুক, নম্রতা, সৌন্দর্য। নিষ্প্রভ আলো হঠাৎ করেই যেন মরুভূমিতে প্রাণের সঞ্চার করেছে।

অবাক হয়ে ভাবলেন তিনিঃ মাথায় চুল গজালে মেয়েটার সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়ে যাবে। তারপরই মনে পড়ল যে এই মেয়ের মাথায় কোনোদিনই চুল গজাবে না, সারাজীবনই তাকে ন্যাড়া থাকতে হবে।

কেন? সানমাস্টার বলেছিলেন, কারণ একজন মাইকোজেনিয়ান যেন নিজেকে চিনতে পারে এবং সারাজীবন মাইকোজেনিয়ান হিসেবেই থাকতে পারে। কিন্তু নিজেদের পরিচয় তুলে ধরার জন্য এইভাবে কেশহীন হয়ে যাওয়াটা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

তারপর, যেহেতু মনে মনে তিনি দুই দিকেই যুক্তি দাঁড়া করান, ভাবলেন: ঐতিহ্য বা প্রথাই হলো আসলে মানুষের স্বভাব। ন্যাড়া মাথাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে, শুধু তাই নয় এটা যদি সামাজিক প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, তখন মাথায় চুল তাদের কাছে জঘন্য মনে হবে, বমির উদ্রেক করবে। তিনি নিজে প্রতিদিন শেভ করেন, মুখে যদি একটা দাড়িও থেকে যায় তিনি অস্বস্তি বোধ করেন। অথচ তারপরেও নিজের মুখটাকে তার কাছে এত বেশি কেশহীন বা অস্বাভাবিক মনে হয় না। ইচ্ছা করলেই তার মুখে দাড়ি গোঁফ গজাবে–কিন্তু সেরকম কোনো ইচ্ছা নেই।

জানেন অনেক গ্রহেই পুরুষরা শেভ করে না। কিছু কিছু গ্রহে তো তারা এমনকি দাড়ি গোঁফ ছাটেও না বরং অবাধে বেড়ে উঠতে দেয়। ওরা যদি তার নিখুঁতভাবে কামানো মুখ দেখে, কী ভাববে তখন।

এইসব ভাবতে ভাবতেই রেইনড্রপ ফরটি থ্রীর সাথে হাঁটছেন তিনি। পথ চলা মনে হলো শেষ হবে না কোনোদিন। মাঝে মাঝে কনুইয়ে খোঁচা মেরে তাকে পথের ইশারা দিচ্ছে মেয়েটা। পুরুষালী স্পর্শ বোধহয় এখন আর তাকে অস্বস্তিতে ফেলছে না, কারণ বেশ কয়েকবারই মেয়েটা তার কনুই মিনিট খানেক ধরে রাখল।

এদিকে! এদিকে চলুন। সিস্টার বলল।

 এটা আবার কী? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

একটা ট্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন। ট্রে ভর্তি গোলাকার বস্তু। প্রত্যেকটাই ডায়ামিটারে দুই সেন্টিমিটার হবে। একজন ব্রাদার মাত্র গোলাকার বস্তু বোঝাই ট্রেটা এনে রেখেছে, প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আগন্তুক দুজনের দিকে তাকালো সে।

রেইনড্রপ ফরটি থ্রী পাশ থেকে নিচু গলায় বলল, কয়েকটা চেয়ে নিন।

বুঝতে পারলেন সিস্টার অনুমতি ছাড়া কথা বলতে পারবে না। কিছুটা অনিশ্চয়তা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কিছু নিতে পারি, ব-ব্রাদার?

যত খুশী নিতে পারেন, ব্রাদার। দরাজ ভঙ্গিতে অনুমতি দিল লোকটা।

একটা গোল বস্তু তুলে নিলেন সেলডন। রেইনড্রপ ফরটি থ্রিকে দিতে গিয়ে দেখলেন, অনুমতি পেতেই যা দেরী, মেয়েটা দুই মুঠোতে যতগুলো পারে ট্রে থেকে তুলে নিচ্ছে।

গোল বস্তুটা চকচকে মসৃণ। কর্তব্যরত ব্রাদারের কাছ থেকে সরে আসতে আসতে সেলডন জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী খাওয়া যায়? বস্তুটা সাবধানে নাকের কাছে তুলে গন্ধ শুঁকলেন।

এগুলোর কোনো গন্ধ নেই। তীক্ষ্ণ গলায় বলল সিস্টার।

কী এগুলো?

এক ধরনের ফল। বাজারে বিক্রয়ের জন্য পরবর্তীকালে কৃত্রিম গন্ধ যোগ করা হয়। কিন্তু মাইকোজেনে আমরা এগুলোকে কাঁচাই খাই। যেভাবে উৎপন্ন হয় ঠিক সেভাবেই।

একটা ফল মুখে দিয়ে সে বলল, এই ফল আমি জীবনে খুব বেশি খাইনি।

সেলডন নিজেও একটা মুখে দিলেন। টের পেলেন জিনিসটা সাথে সাথেই গলে গিয়ে হালকা মিষ্টি রসে মুখ ভরিয়ে তুলল। তারপর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই খাদ্যনালী দিয়ে পেটে চলে গেল। খুবই সামান্য একটা তিক্ত স্বাদও টের পেলেন তিনি। কিন্তু মূল স্বাদটা তাকে কেমন নেশাগ্রস্ত করে তুলল।

বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি এক মুহূর্ত।

আরেকটা দেওয়া যাবে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

যত খুশি নিতে পারেন। হাত বাড়িয়ে বলল রেইনড্রপ ফরটি থ্রি। একই স্বাদ আপনি দ্বিতীয়বার পাবেন না এবং কোনো ক্যালরি নেই। শুধু স্বাদ।

ঠিকই বলেছে। একেকটা ফল মুখে দিয়ে তিনি কিছুক্ষণ রাখার চেষ্টা করলেন। দাঁত দিয়ে ফুটো করার চেষ্টা করলেন, ছোট ছোট টুকরা করার চেষ্টা করলেন। ফুটো করার কারণে ফলটা সাথে সাথে গলে গেল। দাঁত দিয়ে কয়েকটা টুকরা করার পর একটা টুকরা ধরে রাখতে পারলেন, বাকিগুলো পেটে চলে গেল। প্রতিটা স্বাদের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব এবং একটার স্বাদ থেকে আরেকটার স্বাদ একেবারেই পৃথক।

সমস্যা হচ্ছে, তৃপ্তির সাথে বলল সিস্টার, হঠাৎ হঠাৎ আপনি একটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক স্বাদ পাবেন, কিন্তু জীবনে আর কোনোদিন সেটা পাবেন না। নয় বছর বয়সে আমি সেইরকম একটা স্বাদ পেয়েছিলাম- হঠাৎ করেই সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। চমৎকার জিনিস। এটা আপনাকে শিক্ষা দেবে যে এই পার্থিব জগতের সকল বস্তুই নশ্বর।

এটা একটা সংকেত, ভাবলেন সেলডন। বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ তারা দুজন একসাথে লক্ষ্যহীনভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। মেয়েটা তার উপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং তার সাথে নিঃসংকোচে কথা বলছে। আর ঠিক এই মুহূর্তে আলোচনা একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে পৌঁছেছে। এখনই সময়।

.

৪৪.

সেলডন বললেন, সিস্টার, আমি এমন এক গ্রহ থেকে এসেছি যে গ্রহ একেবারেই উন্মুক্ত। সব গ্রহই তাই। ট্র্যান্টর বাদে। বৃষ্টি হতে পারে, নাও হতে পারে। নদীতে পানি থাকতে পারে নাও থাকতে পারে। তাপমাত্রা কম বা বেশি। তার মানে ফসল হয় ভালো হবে নয়তো খারাপ। কিন্তু এখানে পরিবেশ খুব নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রিত। ফসল এখানে ভালো হবেই। অন্য কোনো বিকল্প নেই। মাইকোজেন বেশ ভাগ্যবান।

অপেক্ষা করছেন তিনি। সিস্টারের জবাবের উপর নির্ভর করছে এরপরে তিনি কী করবেন।

মেয়েটা এখন নির্ভয়ে কথা বলছে এবং সে যে একজন মেয়ে এটা নিয়ে মনে হলো তার কোনো সংকোচ নেই। রেইনড্রপ ফরটি থ্রি বলল, পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ এত সহজ না। ভাইরাস ইনফেকশন হয়, কখনো বা অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্খিত মিউটেশনের ঘটনা ঘটে। দুএকবার এমনও হয়েছে যে উৎপাদনের পুরো ব্যাচটাই বাতিল হয়ে গেছে।

অবাক করলে। তো তখন কী করো তোমরা?

আক্রান্ত ব্যাচগুলো ধ্বংস করে ফেলা ছাড়া অন্য কোনো পথ থাকে না। যেগুলোতে সংক্রমণ ঘটেছে বলে সন্দেহ করা হয় সেগুলোও ধ্বংস করে ফেলা হয়। চৌবাচ্চা এবং ট্রেগুলো পুরোপুরি স্টেরিলাইজড বা প্রয়োজন হলে সব ধ্বংস করে ফেলা হয়।

নিখুঁত সার্জারি, বললেন সেলডন। রোগাক্রান্ত টিস্যুগুলো কেটে ফেলে দাও।

হ্যাঁ।

এইধরনের ঘটনা যেন না ঘটে সেটা ঠেকানোর জন্য তোমরা কী করো?

কী করতে পারি? সবসময় সতর্ক থাকি। যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের মিউটেশন, ভাইরাস আক্রমণ, রোগ সংক্রমণ বা পরিবেশের পরিবর্তন ঘটতে পারে। সতর্ক থাকার কারণে দুর্ঘটনা খুব কমই ঘটেছে–কিন্তু ছোটখাটো দুএকটা যা ঘটেছে। সেটাই আমাদের ডোবানোর জন্য যথেষ্ট। আসলে, নিখুঁত পূর্ব পরিকল্পনা এবং সবচেয়ে দক্ষ কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর সাহায্যেও আমরা সঠিক অনুমান করতে পারি না ভবিষ্যতে কী ঘটবে।

(সেলডনের পুরো শরীর কেঁপে উঠল। মনে হলো যেন মেয়েটা সাইকোহিস্টোরীর কথাই বলছে। তবে সে শুধু মাইক্রোফার্মের কথা বলছে যা মানবজাতির অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ। আর তিনি সুবিশাল গ্যালাক্টিক এম্পায়ার এবং এর যাবতীয় কার্যাবলী নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন)।

ভগ্ন হৃদয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নিশ্চয়ই কিছু না কিছু বিষয় অনুমান করা যায়। হয়তো কোন এক শক্তি আমাদের পথ দেখাচ্ছে, আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছে।

সিস্টার মূর্তির মতো নিশ্চল হয়ে গেল। ঘুরে তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকালো সেলডনের দিকে। কিন্তু মাত্র একটা কথাই বলল, কী?

অস্বস্তি বোধ করছেন সেলডন। ভাইরাস এবং মিউটেশনের কথা শুনে মনে হয়েছে এগুলো সবই প্রকৃতির স্বাভাবিক আইন। এখানে অতিপ্রাকৃত বা সুপার ন্যাচারাল কোনো ব্যাপার নেই, তাই না? অর্থাৎ এমন কোনো শক্তিতে তোমরা বিশ্বাস করনা যা প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, ঠিক?

সিস্টার এখনো এক দৃষ্টিতে সেলডনের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন তিনি হঠাৎ করেই অচেনা ভাষায় কথা বলা শুরু করেছেন। ফিসফিস করে আবারো বলল, কী?

অপরিচিত বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বারবার হোঁচট খেতে লাগলেন। তোমরা নিশ্চয় এমন এক মহাশক্তিশালী অস্তিত্ব, কোনো গ্রেট স্পিরিট, কোনো… জানি না কী বলা যায়, তার কাছে আত্মনিবেদন করো।

রেইনড্রপ ফরটি থ্রি কথা বলল নিচু স্বরেই কিন্তু তার কথাগুলো জোরালো এবং স্পষ্ট, আমি ঠিকই ভেবেছিলাম। আমি ঠিকই ভেবেছিলাম আপনি এই কথা বলবেন, অথচ নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনি আমাদেরকে ধর্ম পালনের দায়ে অভিযুক্ত করছেন। এত কথা না বলে সরাসরি বললেই তো হতো।

জবাবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সে, আর এই প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে দিশেহারা সেলডন আমতা আমতা করে বললেন, আমি ধর্মের কথা বলিনি। আমি বলেছি সুপারন্যাচারালিজম।

যা খুশী তাই বলেন। এটাই ধর্ম এবং আমাদের তা নেই। ধর্ম পালন করে ট্রাইবসম্যানরা। চারপাশে যারা পো-

দম নেওয়ার জন্য থামল সিস্টার, তবে সেলডন নিশ্চিত যে মেয়েটা বলতে চেয়েছিল পোকামাকড়।

নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল রেইনড্রপ ফরটি থ্রি। এবার স্বাভাবিকের চেয়েও নিচু গলায় কথা বলল, আমরা ধার্মিক নই। আমাদের এই রাজ্য গ্যালাক্সিরই ক্ষুদ্র একটা অংশ ছিল এবং এখনো তাই। যদি আপনাদের কোনো ধর্ম থাকে

ফাঁদে পড়ার মতো অনুভূতি হলো সেলডনের, অন্তত এটা তিনি আশা করেননি। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে হাত তুললেন, না, না, শোনো। আমি একজন গণিতবিদ এবং আমার রাজ্যও এই গ্যালাক্সিরই অংশ। আসলে তোমাদের সমাজের অলঙ্ঘনীয় নিয়ম কানুন দেখে আমি ভেবেছিলাম যে হয়তো বা।

কখনোই ভাববেন না, ট্রাইবসম্যান। আমাদের সামাজিক আইন অনেক কঠোর কারণ আমাদের সংখ্যা কম এবং আমাদেরকে চারপাশ থেকে যে ট্রাইবসপিওপিলরা ঘিরে রেখেছে তারা সংখ্যায় অসংখ্য। নিজেদের মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো না কোনোভাবে নিজেদেরকে আলাদা করে রাখা দরকার যেন ট্রাইবসম্যানদের জঞ্জালে আমাদের সমাজের মূল্যবান মানুষগুলো হারিয়ে না যায়। আমাদের কেশহীনতা, পোশাক, আচার ব্যবহার, জীবন যাত্রা সবকিছুই আমাদেরকে অন্য সবার কাছ থেকে আলাদা করে তুলেছে। আমরা জানি আমরা কে এবং এটাও নিশ্চিত করি যেন ট্রাইবসপিওপিলরাও জানে আমরা কে। কঠোর পরিশ্রম করে আমরা। ফার্মগুলো তৈরি করেছি যেন আপনারা আমাদের গুরুত্ব দেন এবং আমাদেরকে নিজেদের মতো করে থাকতে দেন। এই একটা জিনিসই আপনাদের কাছে চাই আমরা… আমাদেরকে নিজেদের মতো থাকতে দিন।

তোমার বা এই সমাজের অন্য কারো কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছা আমার নেই। আমি শুধু তথ্য চাই, এখান থেকে, সব জায়গা থেকে।

তাই ধর্মের কথা বলে আপনি আমাদের অপমান করছেন, যেন আমরা যা করতে পারি না তার জন্য কোনো রহস্যময়, অদৃশ্য কোনো শক্তির সাহায্য কামনা করি।

বিভিন্ন গ্রহে অনেক মানুষ কোনো না কোনো ধরনের সুপারন্যাচারালিজমে বিশ্বাস করে… ইচ্ছে হলে এটাকেই তুমি ধর্ম বলতে পারো। এই বিষয়ে আমাদের মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু ধর্মে বিশ্বাস করাটা যেমন ভুল হতে পারে তেমনি ধর্মে অবিশ্বাস করাটাও ভুল হতে পারে। যাইহোক বিশ্বাস করলে কোনো ক্ষতি নেই আর আমিও তোমাদের অপমান করার জন্য প্রশ্নটা করিনি।

কিন্তু সিস্টার এই কথাতেও শান্ত হলো না। আরো রাগের সাথে বলল ধর্ম! তার কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই।

প্রথম থেকেই সেলডনের আত্মবিশ্বাস কমছিল এবং হতাশা বাড়ছিল। সমস্ত আলোচনা, রেইনড্রপ ফরটি থ্রির সাথে এই ঘুরে বেড়ানো সবটাই ব্যর্থ হয়েছে।

এদিকে মেয়েটা কথা বলে চলেছে। তার থেকেও ভালো জিনিস আমাদের কাছে আছে। আমাদের আছে ইতিহাস।

শেষ মন্তব্যটা শুনে হতাশায় ভেঙে পড়া সেলডন নিমেষেই চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। সুন্দর এক টুকরা হাসি ফুটল মুখে।

.

প্রাচীন গ্রন্থ

হ্যান্ড-অন-থাই স্টোরি… কোনো এক উপলক্ষ্যে হ্যারি সেলডন একবার স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন যে এটাই ছিল সাইকোহিস্টোরি ডেভেলপমেন্টের পথে একটা টার্নিং পয়েন্ট। দুর্ভাগ্যবশত তার কোনো গ্রন্থেই এটার কোনো উল্লেখ করেননি যে গল্পের মূল বিষয় কী ছিল, এবং মানুষের ধারণা বা অনুমানও (অনেক রকমের ধারণা এবং অনুমান প্রচলিত রয়েছে) অস্পষ্ট। সেলডনের। পেশাগত জীবনের অনেক অজানা রহস্যের মতো এই গল্পটাও একটা রহস্য হিসেবেই থেকে যায়।
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা

.

৪৫.

রেইনড্রপ ফরটি থ্রি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সেলডনের দিকে তাকিয়ে আছে, নিঃশ্বাস ফেলছে ঘন ঘন।

এখানে আর থাকা যাবে না, সে বলল। চারদিকে ভালো করে দেখলেন সেলডন। কেউ তো আমাদের বিরক্ত করছে না। এমনকি যে ব্রাদারের কাছ থেকে ফলগুলো নিলাম সেও আমাদের স্বাভাবিক জোড়া ভেবেছে।

কারণ আমাদের ভেতর অস্বাভাবিক কিছু ছিল না–যতক্ষণ আলো কম থাকবে, আপনি নিচু গলায় কথা বলবেন যেন ট্রাইবসম্যান বাচনভঙ্গি কেউ ধরতে না পারে। আর আমি যতক্ষণ নিজেকে শান্ত রাখতে পারব কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু এখন- তার কণ্ঠ আরো কর্কশ হয়ে উঠল।

এখন আবার কী হলো?

এখন আমি ভয় পাচ্ছি, অস্থির লাগছে। আমি…।

 কেউ আমাদের খেয়াল করছে না। রিল্যাক্স। শান্ত হও।

এখানে আমি শান্ত হতে পারব না, যতক্ষণ কারো চোখে পড়ার ঝুঁকি থাকবে আমার ভয় কাটবে না।

কোথায় যাবে তাহলে?

বিশ্রামের জন্য ছোট ছোট অনেকগুলো শেড আছে। কিছুদিন এখানে কাজ করেছি। আমি জানি ওগুলো কোথায়।

দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করল সে, তাকে অনুসরণ করলেন সেলডন। ছোট একটা র‍্যাম্পের উপরে সারি সারি অনেকগুলো দরজা, সিস্টার সাথে না থাকলে গোধূলীর স্বল্প আলোয় সেলডন কোনোদিনও এগুলো খুঁজে পেতেন না।

একেবারে শেষ মাথারটা, ফিসফিস করে বলল সিস্টার যদি খালি থাকে।

খালিই ছিল। দরজার উপরে একটা তিনকোণা বাতির উপরে কিছু লেখা জ্বলজ্বল করছে যার অর্থ ভিতরে কেউ নেই।

দ্রুত চারপাশে তাকালো রেইনড্রপ ফরটি থ্রি, সেলডনকে ভিতরে ঢোকার জন্য ইশারা করল। নিজেও ঢুকে পড়ল চট করে, দরজা বন্ধ করে দিল। একটা স্বয়ংক্রিয় বাতি ছোট কামরার ভিতরটা আলোকিত করে তুলল।

আমরা যে ভিতরে আছি সেটা দরজার উপরে যে সাইন আছে তা কীভাবে বোঝাবে?

দরজা বন্ধ করার পর ভিতরে আলো জ্বলে উঠার সাথে সাথে দরজার সাইন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বদলে যাবে।

ভিতরে ঠাণ্ডা বাতাস প্রবাহের একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ পাচ্ছেন সেলডন। অবশ্য ট্র্যান্টরের সব জায়গাতেই এধরনের শব্দ আর আরামদায়ক পরিবেশ উপস্থিত।

কামরাটা আসলেই বেশি বড়ো নয়, তবে ছোট একটা বিছানা আছে। বিছানাতে যথেষ্ট মজবুত একটা ম্যাট্রেস এবং তার উপর একটা পরিস্কার চাদর পাতা। একটা চেয়ার, একটা টেবিল, একটা রেফ্রিজারেটর, আর থালার মতো দেখতে একটা বস্তু আছে, সম্ভবত জিনিসটা ফুড হিটার।

রেইনড্রপ ফরটি থ্রি পিঠ খাড়া করে চেয়ারে বসল, নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা তার চেহারাতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

কী করা উচিত বুঝতে না পেরে সেলডন দাঁড়িয়েই থাকলেন। রেইনড্রপ ফরটি থ্রির অধৈর্য ইশারা পেয়ে চট করে বসে পড়লেন বিছানাতে।

মৃদু সুরে কথা বলল রেইনড্রপ ফরটি থ্রি, যেন নিজের সাথেই কথা বলছে, যদি কেউ কখনো জানতে পারে যে আমি এখানে একা একজন পুরুষ মানুষের সাথে ছিলাম–একজন ট্রাইবসম্যানের সাথেতাহলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।

চট করে উঠে দাঁড়ালেন সেলডন। তাহলে এখানে থাকার দরকার নেই।

বসুন। এখন আমি বেরুতে পারব না। আপনি ধর্মের কথা বলছেন। আসলে আপনি কী চান?

সেলডনের মনে হচ্ছে মেয়েটা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। অস্থিরতা, অনুগত ভাবটা আর নেই। লজ্জাবোধ, অপরিচিত পুরুষের সামনে সংকোচ তার কিছুই নেই এখন। বরং খানিকটা সরু চোখে তাকিয়ে আছে।

তোমাকে বলেছি। তথ্য। আমি একজন স্কলার। তথ্য জানাই আমার কাজ। বিশেষ করে আমি মানুষকে বুঝতে চাই, আর সেজন্য আমাকে ইতিহাস জানতে হবে। সব গ্রহের সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক রেকর্ড–সত্যিকারের প্রাচীন রেকর্ড–কালের প্রবাহে যা আজ কিংবদন্তী বা পুরাকাহিনীতে পরিণত হয়েছে। যা পরিণত হয়েছে কোনো ধরনের ধর্ম বিশ্বাস বা অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসে। কিন্তু মাইকোজেনে যদি কোনো ধর্ম প্রচলিত নাই থাকে, তাহলে-

আমি বলেছি আমাদের আছে ইতিহাস।

দুবার বলেছ, কত পুরনো।

বিশ হাজার বছর পুরনো।

সত্যি? সত্যিকারের ইতিহাস নাকি কোনো ধরনের কিংবদন্তী?

সত্যিকারের ইতিহাস।

সে কীভাবে জানে এটা প্রায় জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলেন, কিন্তু সামলে নিলেন। এত প্রাচীন ইতিহাস থাকা আসলেই কী সম্ভব, থাকলেও তা কতখানি সঠিক? তিনি নিজে তো আর ইতিহাসবিদ নন কাজেই ডর্সকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

তবে তিনি জানেন যে প্রতিটি গ্রহের প্রাথমিক ইতিহাস ব্যক্তিগত দম্ভ আর বীরপূজায় পরিপূর্ণ। এবং সেগুলোকে সাহিত্য হিসেবে মূল্য দেওয়া যায়, ইতিহাস হিসেবে নয়। হ্যালিকনের বেলাতেও কথাটা সত্যি। অথচ এমন কোনো হ্যাঁলিকনিয়ানকে পাওয়া যাবে না যে মনে করে যে ওগুলো প্রকৃত ইতিহাস নয়। এমনকি হ্যালিকনে প্রথম বসতি স্থাপনের ব্যাপারে যে অদ্ভুত গল্পগুলো রয়েছে সেগুলো পর্যন্ত তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। ওই গল্পগুলোতে বলা হয়েছে যে একসময় হ্যালিকনে ভয়ংকর হিংস্র প্রজাতির এক উড়ুক্কু সরীসৃপ ছিল। সেগুলোর সাথে মরণপণ লড়াই করে মানুষকে এখানে সভ্যতা গড়ে তুলতে হয়েছে। যদিও উড়ুক্কু সরীসৃপ থাকার কোনো প্রমাণ কখনো পাওয়া যায়নি।

তোমাদের এই ইতিহাসের শুরুটা কীভাবে হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

কেমন একটা আনমনাভাব সিস্টারের দৃষ্টিতে, এমন একটা দৃষ্টি যা ঠিক সেলডনের উপরও নিবদ্ধ নয় বা কামরার কোনো বস্তুর উপরও নিবদ্ধ নয়। শুরু হয়েছে একটা গ্রহ থেকে আমাদের গ্রহ। একটাই গ্রহ।

একটাই গ্রহ? (সেলডনের মনে পড়ল হামিন একটা কিংবদন্তীর কথা বলেছিল। কোনো এক সময় পুরো গ্যালাক্সিতে মাত্র একটা গ্রহেই মানুষের বসবাস ছিল। সেটাকে বলা হতো মানবসভ্যতার জন্মস্থান। কারণ একমাত্র ঐ গ্রহেই সর্বপ্রথম এবং প্রধানত জীবনের উৎপত্তি এবং বিকাশ ঘটে। গ্যালাক্সির অন্য কোনো গ্রহে মৌলিকভাবে জীবনের উৎপত্তি বা বিবর্তন ঘটেনি। ঐ গ্রহ থেকেই মানুষ ক্রমান্বয়ে পুরো গ্যালাক্সিতে ছড়িয়ে পড়ে বসতি স্থাপন করে)।

একটা গ্রহ। পরে আরো অনেক গ্রহেই বসতি স্থাপিত হয়। কিন্তু আমাদেরটাই ছিল প্রথম। বহু হাজার বছর আমরা সেখানে বাস করি। একসময় বেরিয়ে পড়তে হয় সেখান থেকে। যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াতে থাকি এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে, যতদিন না ট্র্যান্টরের এক কোণায় নিজেদের জন্য একটা আশ্রয় খুঁজে পাই। এখানে আমরা খাদ্য উৎপাদন করতে শিখি যা আমাদের কিছুটা স্বাধীনতা এনে দেয়। এখানে এই মাইকোজেনে আমরা আমাদের নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করেছি–ধীরে ধীরে আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করছি।

আর তোমাদের ইতিহাসে সেই মূল গ্রহ বা সেই একমাত্র গ্রহের বিস্তারিত বর্ণনা আছে?

হ্যাঁ, অবশ্যই। একটা পবিত্র গ্রন্থে তা লেখা রয়েছে এবং আমাদের সবার কাছে। সেই গ্রন্থের একটা করে কপি সবসময়ই থাকে। তার ফলে আমাদের সবসময়ই মনে থাকে আমরা কে এবং কোনো একদিন আমরা নিজেদের গ্রহে ফিরে যাব।

তুমি কী জানো সেই গ্রহটা কোথায় এবং এখন সেখানে কারা বাস করছে?

রেইনড্রপ ফরটি থ্রি একটু ইতস্তত করল, তারপর মাথা নাড়ল জোরে জোরে। না, জানি না, কিন্তু একদিন ঠিকই খুঁজে পাবো।

পবিত্র গ্রন্থটা তোমার সাথে আছে এখন?

অবশ্যই।

আমি দেখতে পারি?

সিস্টারের মুখে বাকা একটা হাসি ফুটল। আপনি তাহলে এই চান। যখনই শুধু আমাকে নিয়ে মাইক্রোফার্মে আসার কথা বলেছিলেন তখনই বুঝেছিলাম যে আপনি কিছু একটা চান। কিন্তু সেটা যে আমাদের পবিত্র গ্রন্থ হবে তা আমি কল্পনাও করিনি।

আমি শুধু এটাই চাই, আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন সেলডন। আমার মনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তুমি যদি এই ভেবে আমাকে এখানে নিয়ে-।

সিস্টার তাকে কথা শেষ করতে দিল না। কিন্তু আমরা এখানে এসেছি। আপনি কী পবিত্র গ্রন্থটা দেখতে চান নাকি চান না?

তুমি আমাকে দেখানোর প্রস্তাব দিচ্ছ?

একটা শর্তে।

বিরতি নিলেন সেলডন, বোঝার চেষ্টা করলেন মেয়েটা তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে কী না। কী শর্ত? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

জিভ সামান্য বের করে দ্রুত একবার ঠোঁট ভিজিয়ে নিল রেইনড্রপ ফরটি থ্রি। তারপর বোঝা যায় কী যায় না এমনভাবে কাঁপা কাঁপা সুরে বলল, আপনার স্কিনক্যাপ খুলতে হবে।

.

৪৬.

বোকার মতো তাকিয়ে রইলেন সেলডন। রেইনড্রপ ফরটি থ্রি কী বলছে সেটা বুঝতে বেশ অনেকগুলো মুহূর্ত পেরিয়ে গেল। তিনি যে মাথায় একটা স্কিনক্যাপ পরে রেখেছেন কথাটা বেমালুম ভুলে গেছেন।

তারপর নিজের মাথায় হাত রাখলেন তিনি, এবং এই প্রথমবার সচেতনভাবে স্কিনক্যাপটাকে স্পর্শ করলেন। জিনিসটা মসৃণ, তার নিচে খোঁচা খোঁচা চুলের অস্তিত্ব টের পেলেন, তবে খুবই সামান্য।

মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই জিজ্ঞেস করলেন, কেন?

কারণ আমি চাইছি। কারণ পবিত্র গ্রন্থ দেখতে হলে আমার এই শর্ত মানতে হবে।

বেশ, তুমি যখন চাও, স্কিনক্যাপের একটা প্রান্ত খুঁজতে লাগলেন তিনি হাত দিয়ে, বিরক্তিকর বস্তুটা মাথা থেকে খোলার জন্য।

কিন্তু রেইনড্রপ ফরটি থ্রি বাধা দিল, না, আমাকে করতে দিন। আমি নিজের হাতে খুলব। তার চোখে ক্ষুধার্ত দৃষ্টি।

হাত নামিয়ে কোলের উপর রাখলেন সেলডন, ঠিক আছে।

দ্রুত উঠে দাঁড়ালো সিস্টার, বিছানায় পাশাপাশি বসল। ধীরে ধীরে এবং সাবধানে সেলডনের কানের পাশে স্কিনক্যাপটা সামান্য একটু সরালো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো আবার। কপালের কাছে স্কিনক্যাপ খোলার সময় হাঁপাতে শুরু করল। তারপর একটান দিয়ে পুরোটাই খুলে ফেলল। মুক্তির আনন্দে সেলডনের চুলগুলো নেচে উঠল।

অস্বস্তি বোধ করছেন তিনি। বললেন, স্কিনক্যাপ দিয়ে ঢেকে রাখার কারণে বোধহয় মাথা ঘেমেছে। তাহলে চুলগুলো নোংরা হয়ে থাকবে।

হাত তুললেন তিনি, ব্যাপারটা আসলেই সত্যি কি না দেখা দরকার, কিন্তু মাঝপথেই সিস্টার তার হাত ধরে ফেলল। আমি নিজে দেখব। বলল সে। এটাও আমার শর্তের অংশ।

আলতোভাবে এবং দ্বিধাগ্রস্ত আঙ্গুলে চুল স্পর্শ করেই আবার সরিয়ে নিল রেইনড্রপ ফরটি থ্রি। আবার স্পর্শ করল, এবং মোলায়েমভাবে হাত বোলাতে লাগল।

একেবারেই শুকনো, বলল সে। স্পর্শটা… চমৎকার।

এর আগে কখনো মানুষের স্বাভাবিকভাবে গজিয়ে উঠা চুল স্পর্শ করেছ?

শুধু বাচ্চাদের, তাও দুই একবার হবে। এগুলো… অন্যরকম।

কীভাবে? চরম বিব্রতকর অবস্থাতেও সেলডন কৌতূহল চাপা দিয়ে রাখতে পারলেন না।

বলতে পারব না। এগুলো শুধুই… অন্যরকম।

কিছুক্ষণ পরে তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, শখ মিটেছে?

না, আমাকে বাধা দেবেন না। আপনি আপনার চুল যেভাবে খুশি সেভাবে শোয়াতে পারেন?

না, চুলগুলোর মাথাতে পড়ে থাকার একটা স্বাভাবিক ভঙ্গি আছে, এবং তার জন্যও প্রয়োজন একটা চিরুনী, এই মুহূর্তে আমার কাছে তা নেই।

চিরুনী?

দাঁতওয়ালা একটা বস্তু… আর, দেখতে ফর্কের মতোই… তবে দাঁতের সংখ্যা অনেক বেশি এবং কিছুটা নরম।

আপনি আঙ্গুল দিয়ে করতে পারেন? নিজের আঙ্গুলগুলো সে সেলডনের চুলের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে।

করা যায়। তিনি বললেন। তবে খুব একটা ভালো হবে না।

পিছন দিকে কেমন শক্ত?

পিছনের চুলগুলো ছোট।

রেইনড্রপ ফরটি থ্রির বোধহয় কিছু একটা মনে পড়ল, ভুরু বলল সে, তাই তো বলা হয়, নাকি? চোখের উপরের কোমল লোমের উপর হাত বুলাতে লাগল সে।

খুব সুন্দর, বলল, তারপর উচ্চস্বরে হেসে উঠল, অনেকটা তার ছোটবোনের মতো। খুবই সুন্দর।

তোমার শর্তে কি আরো কিছু আছে? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

মৃদু আলোয় মনে হলো রেইনড্রপ ফরটি থ্রি বোধহয় নতুন কিছু যোগ করবে। কিন্তু কিছু বলল না। তার বদলে হাত নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকল।

কী অদ্ভুত। বলল সে। আমি… আমি করতে পারি, অন্য কোনো সময়?

যদি ভালোভাবে স্টাডি করার জন্য তোমাদের পবিত্র গ্রন্থ পর্যাপ্ত সময় আমার কাছে রাখতে দাও, তাহলে হয়তো বা আবার সুযোগ পাবে।

রেইনড্রপ ফরটি থ্রি তার কার্টলের একটা ফাঁক দিয়ে হাত ঢোকালো। ওখানে যে একটা ফাঁক আছে সেলডনের চোখেই পড়েনি। ভেতরের কোনো পকেট থেকে শক্ত বস্তু দিয়ে বাঁধাই করা একটা বই বের করে আনল সে। জিনিসটা নিলেন সেলডন, প্রাণপণ চেষ্টা করছেন উত্তেজনা দমিয়ে রাখার।

চুল ঢাকার জন্য তিনি যখন স্কিনক্যাপ পরছেন তখন রেইনড্রপ ফরটি থ্রি আবার নাকের কাছে আঙ্গুল তুলল। জিভ বের করে দ্রুত আলতোভাবে আঙ্গুল চাটল।

.

৪৭.

তোমার চুল ঘাটাঘাটি করেছে? বলল ডর্স ভেনাবিলি। সেলডনের চুলের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন নিজেও স্পর্শ করবে।

দ্রুত একপাশে সরে গেলেন সেলডন। রক্ষে করো। তুমিও আবার শুরু করো না। মেয়েটা যা করেছে আমার কাছে পুরোপুরি বিকৃত রুচির মনে হয়েছে।

আমার মতে মেয়েটার যে সামাজিক অবস্থান–তাতে এটা বিকৃত রুচিই। তুমি কোনো আনন্দ পাওনি?

আনন্দ? চরম বিরক্তিকর মনে হয়েছে। মেয়েটা থামার পরেই নিঃশ্বাস নিতে পারি। বারবারই ভাবছি : আর কী শর্ত আরোপ করতে পারে সে?

হাসল ডর্স। তুমি কি ভয় পেয়েছিলে যে সে তোমাকে দৈহিক মিলনে বাধ্য করবে? নাকি সেটাই আশা করেছিলে?

বিশ্বাস করো আমি কিছুই ভাবছিলাম না। শুধু যেকোনো মূল্যে বইটা পেতে চেয়েছিলাম।

নিজেদের কামরাতে বসে কথা বলছে দুজন। ডর্স তার ফিল্ড ডিজটর্টার চালু করে দিয়েছে যেন আড়ি পেতে তাদের আলোচনা কেউ শুনে ফেলতে না পারে।

রাত নামছে মাইকোজেনে। স্কিনক্যাপ এবং কার্টেল খুলে গোসল করেছেন। সেলডন। চুলের উপর বিশেষ যত্ন নিয়েছেন। সাবান ঘষে দুবার মাথা পরিস্কার করেছেন। ক্লজেটে হালকা রঙের একটা নাইটগাউন ছিল। সেটা গায়ে চাপিয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন এখন।

হ্যারি, তুমি কী জানো তোমার বুকেও পশম আছে? চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল ডর্স।

আশা করি সিস্টার তা জানে না।

আসলে এটাই স্বাভাবিক। কোনো ব্রাদারের সাথে একা থাকলে আমিও একটা বিপদে পড়তাম। বরং আরো খারাপ অবস্থা হতো। যেহেতু ব্রাদারদের দৃঢ় বিশ্বাস মাইকোজেনিয়ান নীতি অনুযায়ী একজন মেয়েমানুষ পুরুষদের যেকোনো আদেশ বিনা প্রশ্নে এবং সাথে সাথে পালন করতে বাধ্য।

না, ডর্স। তোমার কাছে স্বাভাবিক মনে হতে পারে কারণ এই অভিজ্ঞতাটা তোমার হয়নি। সিস্টার ঐ সময় পুরোপুরি যৌন সুখ উপভোগ করছিল। সমস্ত অনুভূতি সে এই কাজে নিয়োগ করেছিল… আঙ্গুলের গন্ধ শুকছিল, জিভ দিয়ে। চাটছিল।

আমি এটাকেই স্বাভাবিক বলছি। কোনো কিছুর উপর যদি তুমি কড়া বিধি নিষেধ আরোপ করো তখনই সেটা যৌন উত্তেজনা জাগিয়ে তোলে। মেয়েদের বুকের ব্যাপারে তোমার কোনো আগ্রহ থাকত যদি তুমি এমন কোনো সমাজে বাস করতে যেখানে বুক খোলা রাখাটাই রেওয়াজ?

হয়তো বা আগ্রহী হতাম।

তুমি কি আরো বেশি আগ্রহী হতে না যদি তা সবসময় গোপন করে রাখা হয়, অধিকাংশ সমাজেই যা স্বাভাবিক নিয়ম? শোনো, আমার জীবনের একটা ঘটনা বলি। সিনাতে আমি একবার লেক রিসর্টে গিয়েছিলাম… তোমাদের হ্যালিকনে নিশ্চয়ই রিসর্ট আছে, সাগর সৈকত, এই জাতীয় স্থান?

নিশ্চয়ই, বিরক্ত সুরে বললেন সেলডন। তুমি কি মনে করো হ্যালিকন শুধু পাহাড় পর্বত আর পাথরে বোঝাই গ্রহ? খাবার পানির জন্য কূপ খনন করতে হয়?

রাগ করো না, হ্যারি। আমি শুধু নিশ্চিত হতে চাইছি যে আমার গল্পের মূল বক্তব্যটা তুমি বুঝতে পারবে। সিনাতে আমাদের সমুদ্র সৈকতে আমরা কি পোশাক পরি বা একেবারেই পরি কিনা সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

ন্যুড বিচ?

ঠিক তাও না, তবে আমার মনে হয় কেউ যদি তার গায়ের সব কাপড় খুলে ফেলে বাকিরা তা মোটেও খেয়াল করবে না। আসলে ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু পোশাকই সবাই গায়ে রাখে। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে যে সেই ভদ্রতাটাও এত কম যে তুমি কল্পনা করতে পারবে না।

হ্যালিকনে আমাদের ভদ্রতা আরো উঁচু মানের।

আমার সাথে তোমার ব্যবহারেই সেটা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সবারই নিজস্ব নিয়ম কানুন থাকে। যাইহোক, লেকের পাশে ছোট সৈকতে আমি বসেছিলাম। এমন সময় এক তরুণ এগিয়ে আসে। আগের দিনই তার সাথে পরিচয় হয়েছিল। চমৎকার ভদ্রলোক, আমি কোনো দোষ পাইনি তার। সে এসে আমার চেয়ারের হাতলে বসে তার একটা হাত আমার উন্মুক্ত ডান উরুর উপর রাখে, অবশ্যই নিজের ভারসাম্য রক্ষার জন্য।

দুই একটা টুকটাক কথা বলার পর সে খানিকটা রসিকতার সুরেই বলল : তোমার সাথে আমার পরিচয় খুব অল্প সময়ের। এই অল্প সময়ে একজন মানুষের ভালোমন্দ বোঝা অসম্ভব। অথচ কী স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমি তোমার উরুর উপর হাত রেখে বসে আছি। তার চেয়েও বড়ো কথা, তোমার কাছেও এটা একেবারেই স্বাভাবিক মনে হয়েছে যেহেতু আমার হাত ওখানে রাখার জন্য তুমি কিছুই বলছ না।

শুধু তখনই আমার খেয়াল হয় যে লোকটা আমার উরুতে হাত রেখে বসে আছে। অসংখ্য মানুষের মাঝে এভাবে খালি গায়ে বসে থাকার কারণে হয়তো স্বাভাবিক যৌনাবেদনটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি তো বলেছিই, দৃষ্টি থেকে গোপন করে রাখাটাই গুরুত্ব তৈরি করে।

এবং সেই তরুণও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল, কারণ এরপর সে বলল, এখন যদি স্বাভাবিক কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে তোমার সাথে আমার দেখা হয়, তোমার পরনে থাকে চমৎকার একটা গাউন এটা তুমি স্বপ্নেও আশা করবে না যে আমি তোমার গাউন তুলে এখন ঠিক যেখানে হাত রেখেছি সেখানে হাত রাখব।

হেসে ফেললাম আমি। তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা হয়। যেহেতু তার হাতের অবস্থানের দিকে আমাদের দুজনেরই মনোযোগ আকৃষ্ট হয় সেহেতু ওখানে স্পর্শ করে থাকাটা তরুণের কাছে শোভন মনে হয়নি, হাত সরিয়ে নেয় সে।

সেদিন সন্ধ্যায় ডিনারের আগে নিজেকে সাজানোর জন্য স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি যত্ন নেই। আমার গাউন ছিল ডাইনিং রুমের অন্যান্য মহিলাদের চেয়ে আরো বেশি ফর্মাল। তরুণ একটা টেবিলে বসেছিল। সোজা তার কাছে এগিয়ে যাই। টুকটাক কিছু কথার পর আমি তাকে বলি, দেখো আমি একটা গাউন পরে এসেছি। তোমাকে অনুমতি দিলাম, আমার গাউন তুলে বিকালে ঠিক যেখানে হাত রেখেছিলে সেখানে হাত রাখতে পারো তুমি।

চেষ্টা করেছিল সে এবং সেজন্য তাকে বাহবা দিতেই হবে, কিন্তু ডাইনিং রুমের সবাই তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে। আমি তাকে বাধা দিতাম না এবং কোনো সন্দেহ নেই যে অন্যরাও বাধা দিত না, কিন্তু সে কাজটা করতে পারেনি। সৈকতে যে পরিমাণ মানুষ এবং যে মানুষগুলো ছিল ঠিক তারাই তখন ডাইনিং রুমে উপস্থিত। সবাই পরিস্কার বুঝতে পেরেছিল যে আমিই শুরু করেছি এবং আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু সামাজিক নিয়মটাকে সে ভঙ্গ করতে পারেনি। বিকালে সৈকতে হ্যান্ড অন-থাইয়ের যে শর্ত ছিল সন্ধ্যায় হ্যান্ড-অন-থাইয়ের জন্য শর্ত ছিল অন্যরকম এবং এই সামাজিক ব্যবস্থা তুমি কোনো যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবে না, অথচ এটাই সত্য।

আমি হলে ঠিকই হাত রাখতাম। সেলডন বললেন।

তাই?

হ্যাঁ।

এমনকি তোমার গ্রহে সমুদ্র সৈকতের নিয়ম আমার গ্রহের সমুদ্র সৈকতের চেয়ে অনেক বেশি ভদ্রোচিত হওয়ার পরেও?

হ্যাঁ।

হাতে মাথা রেখে বিছানায় আধশোয়া হলো ডর্স। তাহলে আমি যে শুধু একটা নাইটগাউন পরে রেখেছি নিচে অন্য কিছু পরিনি তাতে তুমি বিরক্ত বা অস্বস্তি বোধ করছ না।

সত্যি কথা বলতে কি আমি অবাক হইনি। আর বিরক্ত হওয়ার কথা যদি বল সেটা নির্ভর করছে শব্দটার সংজ্ঞার উপর। তুমি কোন পোশাক পরেছ এ ব্যাপারে আমি পুরোপুরি সচেতন।

বেশ, আমাদেরকে যদি এখানে একসাথে বেশ কিছুদিন থাকতেই হয় তাহলে এধরনের ছোটখাটো বিষয়গুলো কীভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় তা শিখতে হবে।

অথবা তার সুযোগ নিতে হবে, দন্ত বিকশিত হাসি দিয়ে বললেন সেলডন। আর তোমার চুলগুলো আমার খুব ভালো লাগে। সারাদিন তোমাকে ন্যাড়া মাথায়। দেখার পর আসলেই খুব ভালো লাগে।

তবে, ছুঁয়ে দেখার দরকার নেই। আমি এখনো মাথা পরিস্কার করিনি। তারপর আধবোজা চোখে সেলডনের দিকে তাকিয়ে বলল, বেশ অদ্ভুত। তুমি আমাদের মাঝে যে আনুষ্ঠানিক সৌজন্যতা ছিল সেই দেয়ালটা সরিয়ে দিয়েছ। তুমি নিজেই বলেছ হ্যালিকনের মানুষদের সৌজন্যবোধ অত্যন্ত প্রখর, তাই না?

আসলে আমি সেই তরুণ যে তোমার থাইয়ের উপর হাত রেখেছিল এবং আমার নিজের কথা বলছি। সিনিয়ান এবং হ্যাঁলিকনিয়ানদের মাঝে মিল কতখানি আমি বলতে পারব না। তবে একটা বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে দুই গ্রহেই নিপাট ভালোমানুষ ভদ্রলোক যেমন আছে তেমনি দুষ্টু প্রকৃতির লোকও আছে।

আমরা কথা বলছি সামাজিক প্রভাব নিয়ে। আমি সেরকম অর্থে গ্যালাক্টিক ট্রাভেলার নই কিন্তু সামাজিক ইতিহাস নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছি। এক সময় ডেউড গ্রহে বিবাহ পূর্ব অবাধ যৌনতা স্বীকৃত ছিল। বহুগামীতাও স্বীকৃত ছিল। জনসমক্ষে খোলাখুলি যৌনতা দেখে মানুষ শুধু তখনই ভুরু কুঁচকাতো যদি তা ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করত। অথচ বিবাহের পর বহুগামীতা ছিল পুরোপুরি নিষিদ্ধ এবং সামাজিক অপরাধ। তাদের যুক্তি ছিল যে একজন মানুষ তার যাবতীয় শখ এবং স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারলেই জীবনের সিরিয়াস বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিতে পারবে।

কোনো লাভ হয়েছিল তাতে?

প্রায় তিনশ বছর আগে এটা বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু আমার কয়েকজন সহকর্মীর মতে অন্যান্য গ্রহগুলো এটা বন্ধ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছিল কারণ ডেরউডের কাছে তাদের পর্যটন ব্যবসা মার খাচ্ছিল অনবরত। তাছাড়া সামগ্রিক গ্যালাক্টিক সামাজিক চাপও ছিল।

অথবা অর্থনৈতিক চাপ। অন্তত এই ক্ষেত্রে কথাটা সত্যি হতেও পারে।

হয়তোবা। যাইহোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুবাদে সামাজিক চাপ নিয়ে, কাজ করার অনেক সুযোগ আমার হয়েছে। ট্র্যান্টরের বিভিন্ন সেক্টরের এবং ট্র্যান্টরের বাইরের অন্যান্য গ্রহের বহু মানুষের সাথে কথা বলেছি। সমাজ বিজ্ঞানের সবচেয়ে মজার বিষয়গুলোর একটা হলো সামাজিক চাপসমূহের তুলনামূলক বিশ্লেষণ।

যেমন মাইকোজেনে আমার মতে যৌনতার ব্যাপারে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, এমনকি এই বিষয়ে কেউ আলোচনা পর্যন্ত করতে পারে না। স্ট্রিলিং সেক্টরে যৌন বিষয়ে কেউ কথা বলে না কিন্তু জিনিসটা সেখানে দোষেরও না। জেনাট সেক্টরে, গবেষণার কাজে আমাকে ওখানে এক সপ্তাহ থাকতে হয়েছিল, সেখানে সবাই সারাদিনই এই বিষয়ে কথা বলে চলেছে এবং তার একমাত্র উদ্দেশ্য অবাধ যৌনতা রহিত করা। আমার ধারনা ট্র্যান্টরে এমন দুটো সেক্টর পাওয়া যাবে না বা গ্যালাক্সিতে এমন দুটো গ্রহ পাওয়া যাবে না–যেখানে যৌনতার ব্যাপারে মানুষের মনোভাব হুবহু এক রকম।

তোমার কথা শুনে কী মনে হচ্ছে জানো? মনে হচ্ছে।

আমি বলছি কী মনে হচ্ছে। যৌনতা নিয়ে এই সমস্ত আলোচনা থেকে একটা বিষয় আমার কাছে পরিস্কার। তোমাকে আমি আর চোখের আড়াল হতে দিচ্ছি না।

কী?

দুবার আমি তোমাকে একা ছেড়ে দিয়েছি, প্রথমবার আমার বোকামী আর দ্বিতীয়বার তুমি আমাকে বাধ্য করেছ। প্রথমবার কী ঘটেছিল মনে আছে?

রেগে গেলেন সেলডন। হ্যাঁ। কিন্তু দ্বিতীয়বার কিছু ঘটেনি।

তুমি ভয়ংকর বিপদে পড়তে। একজন সিস্টারকে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে প্ররোচিত করার সময় ধরা পড়লে কী হতো?

এখানে যৌনতার কোনো

তুমি নিজেই বলেছ ওই সময় মেয়েটা শারীরিকভাবে চরম উত্তেজিত হয়েছিল।

কিন্তু

একটা কথা পরিস্কারভাবে তোমার মাথায় ঢুকিয়ে নাও, হ্যারি। এই মুহূর্ত থেকে। আমাকে সঙ্গে না নিয়ে তুমি কোথাও যাবে না।

শোনো, সেলডনের কণ্ঠে বরফের শীতলতা, আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মাইকোজেনিয়ান ইতিহাস সম্বন্ধে জানা এবং সিস্টারকে তোমার সেই তথাকথিত যৌন সম্পর্কে প্ররোচিত করার ফলশ্রুতিতে আমি একটা বই পেয়েছি–মাইকোজেনের পবিত্র গ্রন্থ।

পবিত্র গ্রন্থ! সত্যি, তাহলে ওটা দেখা যাক।

সেলডন বইটা বের করে দিলেন। উল্টে পাল্টে সেটা দেখতে লাগল ডর্স। চেহারায় গভীর চিন্তার ছাপ।

বোধহয় কোনো লাভ হবে না, হ্যারি। মনে হয় না এটা আমাদের পরিচিত কোনো প্রজেক্টরে ঢোকানো যাবে। তার মানে একটা মাইকোজেনিয়ান প্রজেক্টর লাগবে। আর ওদের কাছে চাইলেই জানতে চাইবে জিনিসটা তোমার কেন প্রয়োজন। আর তখনই জেনে যাবে যে তোমার কাছে ওদের পবিত্র গ্রন্থ আছে এবং সেটা কেড়ে নেবে।

মুচকী হাসলেন সেলডন। তোমার অনুমান সত্যি হলে তোমার বক্তব্য ঠিকই আছে। কিন্তু এই বইটা যেমন ভাবছ সেইরকম কোনো বই নয়। এটা পড়ার জন্য প্রজেক্টর লাগবে না। এই বইয়ে অনেকগুলো পৃষ্ঠা আছে। তথ্যগুলো তাতে ছাপানো। একটা পৃষ্ঠা পড়ার পর পাতা উল্টিয়ে পরের পৃষ্ঠায় যাওয়া যায়। রেইনড্রপ ফরটি থ্রি সব বুঝিয়ে দিয়েছে আমাকে।

ছাপানো বই! বোঝা গেল না ডর্স কি খুশী হয়েছে না বিস্মিত। এটা তো তাহলে প্রস্তর যুগের জিনিস।

প্রি-ইম্পেরিয়াল তাতে কোনো সন্দেহ নেই আবার ঠিক ততো প্রাচীনও বলা যাবে না। ছাপানো বই কখনো দেখেছ তুমি?

অবশ্যই। আমি একজন ইতিহাসবিদ, হ্যারি।

এটার মতো কোনো বই দেখেছ?

বইটা আবার তিনি ডর্সের হাতে দিলেন আর ডর্স হাসি মুখে পাতা উল্টাল তারপর পরের পাতায় গেল। তারপর আবার পাতা উল্টাল। কিছু নেই, খালি। বলল সে।

খালি দেখাচ্ছে। মাইকোজেনিয়ানরা একরোখার মতো অতীত আকড়ে রেখেছে, কিন্তু সব ক্ষেত্রেই অতীতকে প্রাধান্য দেয়নি। অতীতের নির্যাসটুকু তারা ঠিকই রাখবে কিন্তু নিজেদের সুবিধার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে কোনো আপত্তি নেই।

হয়তো ঠিকই বলেছো, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না।

পৃষ্ঠাগুলো খালি নয়। ওগুলো মাইক্রোপ্রিন্ট দিয়ে ঢাকা। দাও, আমার হাতে দাও। মলাটের ভেতরে এই যে ছোট চাকতি আছে এটা যদি ঘুরাই–দেখো।

খোলা পৃষ্ঠায় হঠাৎ করেই ছাপানো লাইন ফুটে উঠল, ধীরে ধীরে সেগুলো উপরে উঠছে।

তুমি কতো দ্রুত পড়তে পারো তার সাথে সঙ্গতি রেখে লাইনগুলোর উপরে উঠা এ্যাডজাস্ট করে নিতে পারবে। প্রথম লাইনটা যখন পৃষ্ঠার মাথায় উঠবে এবং তুমি যখন শেষ লাইনে পৌঁছবে তখন আবার বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর পরের পৃষ্ঠায় গিয়ে একইভাবে পড়তে হবে।

এনার্জি পায় কোত্থেকে।

ভিতরে একটা মাইক্রোফিউশন ব্যাটারী আছে। বইটা যতদিন টিকবে ব্যাটারীও ততোদিন টিকবে।

কতদিন টিকবে-

বইটা তুমি ফেলে দিতে পারো, ছিঁড়ে যেতে পারে এবং সেরকম কিছু হলে আরেকটা কপি সংগ্রহ করে নিতে পারবে। কিন্তু ব্যাটারী পাল্টাতে পারবে না কখনোই।

বইটা আরেকবার হাতে নিয়ে ভালোভাবে উল্টে পাল্টে দেখল ডর্স। স্বীকার করতেই হবে এই ধরনের বইএর কথা আমি কখনো শুনিনি।

আমিও না। সামগ্রিকভাবে গ্যালাক্সি দ্রুত ভিজুয়াল টেকনোলজির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। কিন্তু এই বইয়ে যে সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে তা কেউ ভেবে দেখেনি।

এটা ভিজুয়াল?

হ্যাঁ, কিন্তু আমাদের পরিচিত কোনো পদ্ধতি এটাতে নেই। এই ধরনের বইয়ের বড়ো একটা সুবিধা হচ্ছে এতে প্রচলিত ভিজুয়াল বইগুলোর তুলনায় অনেক বেশি তথ্য ধারণ করা সম্ভব।

কীভাবে চালু করে? দাঁড়াও, দেখি আমি পারি কিনা। একটা পৃষ্ঠা খুলে লাইনগুলো এ্যাডজাস্ট করল ডর্স। বোধহয় কোনো লাভ হবে না, হ্যারি। একেবারেই প্রি-গ্যালাক্টিক। বইয়ের কথা বলছি না, যে ভাষায় লেখা আছে সেটার কথা বলছি।

তুমি পড়তে পারবে, ডর্স? একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে।

একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে আমাকে সুপ্রাচীন অনেক ভাষা নিয়েই কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু তাও অনেক সীমিত। এই ভাষা আমার জন্যও অনেক অনেক বেশি প্রচীন। দুই একটা শব্দের অর্থ হয়তো বলতে পারব কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না।

চমৎকার, বললেন সেলডন। যতো প্রাচীন ততো বেশি লাভ।

পড়তে না পারলে কোনো লাভ হবে না।

পড়তে পারব। বইটা দুই ভাষায় লেখা। তুমি নিশ্চয়ই আশা করো না যে রেইনড্রপ ফরটি থ্রি এত প্রাচীন ভাষা পড়তে পারবে।

যদি সে সঠিকভাবে শিক্ষিত হয়, তাহলে পারবে না কেন?

কারণ, মাইকোজেনের মেয়েরা ঘর সংসারের কাজ ছাড়া অন্য কিছু শেখার সুযোগ পায় বলে মনে হয় না। হয়তো উচ্চ শিক্ষিত দুএকজন পুরুষ এই ভাষা পড়তে পারে। কিন্তু বাকি সবারই গ্যালাক্টিক অনুবাদ প্রয়োজন হবে। আরেকটা চাকতি ঘোরালেন তিনি। আর এই যে সেটা।

ছাপানো লাইনগুলো মুহূর্তেই প্রচলিত গ্যালাকিকে পাল্টে গেল।

 দারুণ, উফুল্ল সুরে বলল ডর্স।

মাইকোজেনিয়ানদের কাছ থেকে আমরা এটা শিখে নিতে পারতাম কিন্তু তা করা যাবে না।

হ্যাঁ, এই বইয়ের কথা তো আমাদের জানারই কথা না।

আমার বেশ অবাক লাগছে। তুমি আর আমি মাত্র এখন জানলাম। ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক কারণে মাইকোজেনে নিশ্চয় অনেক মানুষের যাওয়া আসা আছে। তারা অবশ্যই এক পলকের জন্য হলেও এই বই বা এটা কীভাবে কাজ করে দেখেছে। কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি কারণ এটা মাইকোজেনিয়ান।

কিন্তু এটার কি আসলেই কোনো গুরুত্ব আছে?

অবশ্যই। সবকিছুরই গুরুত্ব আছে। হামিন সম্ভবত এই সচেতনতার অভাবকেই বলেছিল এম্পায়ার-এর অধঃপতন।

বইটা তুলে একরাশ উত্তেজনা নিয়ে তিনি বললেন, কিন্তু আমি কৌতূহলি এবং এই বইটা পড়ে আমি শেষ করব। হয়তো এটাই আমাকে সাইকোহিস্টোরির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

আমিও তাই আশা করি, ডর্স বলল, কিন্তু আমার উপদেশ হলো, রাতটা ভালোভাবে ঘুমাও। সকালে তরতাজা মন নিয়ে পড়া শুরু করো।

ইতস্তত করলেন সেলডন, তারপর বললেন, তোমার ভেতর মাতৃসুলভ ভাবটা অনেক প্রবল।

আমি তোমার দেখাশোনা করছি।

কিন্তু আমার মা হ্যালিকনে বেঁচে আছে। তোমাকে আমি বন্ধু হিসেবে চাই।

একেবারে প্রথম দেখার পর থেকেই আমি তোমার বন্ধু।

ডর্স হাসল আর সেলডন অনিশ্চিত বোধ করছেন যে তিনিও হাসিতে যোগ দেবেন। কি না। শেষ পর্যন্ত বললেন, তাহলে তোমার পরামর্শ শুনব আমি–বন্ধু হিসেবে এবং ঘুমাব।

দুটো বিছানার মাঝখানের ছোট টেবিলে বইটা রাখতে গিয়েও দ্বিধা করলেন তিনি, ফিরে এসে নিজের বালিশের নিচে রাখলেন।

শব্দ করে হাসল ডর্স। আসলে ভয় পাচ্ছ তুমি ঘুমিয়ে পড়লে রাত জেগে আমি তোমার আগেই বইটা পড়ে ফেলব। ঠিক না?

আসলে, লজ্জা লুকনোর চেষ্টা করলেন সেলডন, হয়তো তাই। এই ব্যাপারে বন্ধুকেও খাতির করব না আমি। এটা আমার বই এবং আমার সাইকোহিস্টোরি।

আমি একমত এবং কথা দিচ্ছি এই ব্যাপারে কখনো আমাদের ঝগড়া হবে না, ভালো কথা একটু আগে তুমি যেন আমাকে কী বলতে চেয়েছিলে মনে আছে?

খানিকক্ষণ চিন্তা করে সেলডন বললেন, না।

অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে তিনি শুধু বইটার কথাই ভাবলেন। হ্যান্ড-অন-থাই স্টোরির কথা মোটেই ভাবলেন না। আসলে গল্পটার কথা তিনি ভুলেই গেছেন, অন্তত সচেতনভাবে কিছুই মনে নেই।

.

৪৮.

ঘুম ভেঙ্গে গেল ভেনাবিলির। টাইমব্যান্ড থেকে বোঝা গেল রাতের মাত্র অর্ধেকটা পার হয়েছে। পাশের বিছানায় হ্যারির নাক ডাকার শব্দ নেই। তার মানে সে বিছানাতেই নেই। এ্যাপার্টমেন্টের বাইরে না গেলে নিশ্চয়ই বাথরুমে গেছে।

ডর্স আস্তে দরজায় টোকা দিল, হ্যারি।

ভিতরে এস, ডাকলেন সেলডন। কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই ভেতরে ঢুকল সে।

টয়লেটের ঢাকনা ফেলে তার উপর বসে আছেন সেলডন। কোলের উপর মেলানো বই। পড়ছিলাম, কথাটা অপ্রয়োজনীয় তবুও বললেন তিনি।

তাতো দেখছিই। কিন্তু কেন?

ঘুম আসছিল না। দুঃখিত।

কিন্তু এখানে কেন?

ঘরের বাতি জ্বালিয়ে রাখলে তোমার ঘুমাতে অসুবিধা হবে।

বইটাকে ইলিউমিনেট করার কোনো ব্যবস্থা নেই?

না নেই। রেইনড্রপ ফরটি থ্রি যখন সব বুঝিয়ে দিয়েছিল তখন ইলিউমিনেশনের কথা কিছু বলেনি। তাছাড়া আমার মনে হয় ইলিউমিনেশন-এর জন্য এত বেশি এনার্জি প্রয়োজন হবে যে বইয়ের আয়ু ফুরানোর আগেই ব্যাটারী ফুরিয়ে যাবে। কথা শুনে মনে হচ্ছে তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট।

ঠিক আছে তুমি বেরিয়ে এসো এবার। আমাকে বাথরুম ব্যবহার করতে হবে।

হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে ডর্স দেখল পা ভাঁজ করে বিছানায় বসে আছেন সেলডন। এখনো পড়ছেন। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছেন।

তোমাকে বেশ অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে। বইটা কোনো কাজে আসছে না।

শূন্য দৃষ্টিতে ডর্সের দিকে তাকালেন সেলডন। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ। সামান্য পড়তে পেরেছি। পুরো জিনিসটাই হচ্ছে আসলে একটা এনসাইক্লোপেডিয়া। একগাদা মানুষ আর জায়গার তালিকা। সেগুলো আমার কোনো কাজেই আসবে না। গ্যালাক্টিক এম্পায়ার বা প্রি-ইম্পেরিয়াল কিংডম সম্বন্ধে এখানে কিছুই নেই। পুরো বইটাতেই একটামাত্র গ্রহের কথা বলা হয়েছে এবং যতদূর পড়েছি তার সবটাই হচ্ছে ঐ গ্রহের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সীমাহীন দ্বন্দ্ব সংঘাত।

তুমি সম্ভবত সময়ের ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দাওনি। হয়তো এই বইয়ে সেই সময়ের কথা বলা হয়েছে যখন মাত্র একটাই গ্রহ ছিল… মাত্র একটাই বাসযোগ্য গ্রহ।

হ্যাঁ, জানি। আমি আসলে ঠিক তাই চাইছি যেন নিশ্চিত হতে পারি যে এটা আসলেই সত্যিকারের ইতিহাস–কোনো কীংবদন্তী নয়।

সিঙ্গেল ওয়ার্ল্ড অরিজিন বর্তমানে বেশ আলোচিত বিষয়। সকল মানুষ একই প্রজাতির। তারা ছড়িয়ে আছে পুরো গ্যালাক্সিতে, কাজেই নিশ্চয়ই তাদের উৎপত্তি এক জায়গা থেকেই হয়েছে। একইরকম প্রজাতির উদ্ভব নিশ্চয়ই এক সাথে বিভিন্ন গ্রহে হতে পারে না।

কিন্তু এই মন্তব্য সত্যি হওয়ার কোনো যুক্তি আমি দেখি না। একাধিক গ্রহে বিভিন্ন ধরনের প্রজাতি হিসেবে মানুষের উদ্ভব ঘটলে, প্রজননের মাধ্যমে তারা শঙ্কর প্রজাতিতে পরিণত হতে পারবে না কেন। হয়তো বর্তমান মানব সমাজ সেই শঙ্কর প্রজাতি।

কারণ ভিন্ন রকম দুটো প্রজাতির মাঝে প্রজনন ঘটানো সম্ভব নয়।

কিছুক্ষণ ভাবলেন সেলডন, তারপর কাঁধ নেড়ে বললেন, বেশ, ব্যাপারটা বরং বায়োলজিস্টদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া যাক।

ঠিকই বলেছ, ওরাই পৃথিবীর ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী।

পৃথিবী? ওয়ার্ল্ড অব অরিজিনকে কি এই নামেই ডাকা হতো।

এটাই সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম, যদিও আসলে কী নামে ডাকা হতো সেটা বলার কোনো উপায় নেই। এবং এই গ্রহের অবস্থানও অজানা। কেউ জানে না।

পৃথিবী! অদ্ভুত শব্দ। যাইহোক বইটাতে এই গ্রহের কথা থাকলেও আমার চোখে পড়েনি। বানানটা বলতো।

ডর্সের কাছ থেকে বানান শুনে সেলডন দ্রুত বইয়ের সূচীপত্রে চোখ বোলালেন। না, কিছু নেই।

সত্যি?

আরো অনেক গ্রহের কথা বলা আছে কিন্তু কোনোটারই নাম নেই। সরাসরি তাদের সাথে সম্পৃক্ত না হলে বোধহয় অন্য গ্রহগুলোকে তারা খুব বেশি গুরুত্ব দিত। না… অন্তত আমি যতদূর পড়েছি তাতে সেরকমই ধারনা হয়। এক জায়গায় ওরা বলেছে দ্য ফিফটি। বুঝতে পারছি না কিসের কথা বলছে। পঞ্চাশজন নেতা নাকি পঞ্চাশটা শহর? আমার মনে হয় পঞ্চাশটা গ্রহের কথা বলছে।

নিজেদের গ্রহের নাম লিখেছে ওরা? জিজ্ঞেস করল ডর্স। পৃথিবী না হলেও গ্রহটার নিশ্চয়ই একটা নাম ছিল।

বেশ কয়েকটা। যেমন দ্য ওল্ডেস্ট, অথবা দ্য প্ল্যানেট, দুই একটা জায়গায় বলেছে দ্য ওয়ার্ল্ড অব দ্য ডন, বেশ কাব্যিক নাম। পুরো বইটা খুব ভালোভাবে পড়লে হয়তো কিছু কিছু বিষয় পরিস্কার হবে। বিরক্তি নিয়ে বইটার দিকে তাকালেন তিনি। যদিও অনেক সময় লাগবে তারপরেও লাভ হবে কিনা বুঝতে পারছি না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডর্স। কীভাবে তোমাকে সান্ত্বনা দেব, হ্যারি। বেশ হতাশ দেখাচ্ছে তোমাকে।

কারণ আমি আসলেই হতাশ। দোষ আমারই। এত বেশি আশা করা ঠিক হয়নি–এক জায়গায় মনে হয়েছে ওরা নিজেদের গ্রহের নাম লিখেছে অরোরা।

অরোরা, ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবল ডর্স। গ্যালাক্টিক এম্পায়ার-এর ইতিহাস বা এম্পায়ার যখন গড়ে উঠছে সেই সময়ের ইতিহাসে এই নামের কোনো গ্রহ পাইনি। অবশ্য পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহের সবগুলোর নাম আমি জানব এমনটা ভাবা ঠিক না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে খুঁজে দেখা যাবে–যদি কখনো স্ট্রিলিং-এ ফিরে যাই। মাইকোজেনে গ্রন্থাগার খুঁজে কোনো লাভ নেই। কেন যেন আমার মনে হচ্ছে তাদের শিক্ষা দীক্ষা এবং জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে এই বই। এটাতে যদি কিছু না থাকে ওদেরও জানার কোনো আগ্রহ হবে না।

হাই তুলতে তুলতে সেলডন বললেন, আমার মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ। যাইহোক, আর পড়ে কী হবে, চোখও খোলা রাখতে পারছি না। বাতি নিভিয়ে দিলে তোমার কোনো অসুবিধা হবে?

বরং খুশী হব, হ্যারি। আর অনেকটা বেলা পর্যন্ত ঘুমাব।

আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন সেলডন। তারপর মৃদু গলায় বললেন, বইটাতে অনেক অদ্ভুত কথা লেখা আছে। যেমন লিখেছে যে ওদের গ্রহে মানুষ তিন থেকে চার শতাব্দী বাঁচত।

শতাব্দী?

হ্যাঁ, প্রতি দশ বছর সমান এক বছর হতো ওদের হিসাবে। পড়ার সময় একটা অদ্ভুত অনুভূতি হবে তোমার। কারণ দেখবে যে নিজের অজান্তেই তুমি সব বিশ্বাস করে ফেলেছ।

আসলে সুপ্রাচীন যুগের কীংবদন্তীতে যেসব নায়কের কথা বলা হয়েছে তাদের সবাই অনেক বছর বেঁচেছিল। তারা যদি সত্যি সেরকম বীরপুরুষ হয়ে থাকে তাহলে তাদের জীবনকালটাও সেইভাবে মানানসই হতে হবে।

তাই নাকি? আবার হাই তুলতে তুলতে সেলডন বললেন।

হ্যাঁ, সবচেয়ে ভালো হয় এখন তুমি ঘুমাও। সকালে উঠে আবার নতুন করে চিন্তা ভাবনা শুরু করো।

চুপ করলেন সেলডন। মনে হয় এই গ্যালাক্সি পরিপূর্ণভাবে বোঝার জন্য একজন মানুষের এরকম সুদীর্ঘ জীবনকালই প্রয়োজন। ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার আগে এটাই ছিল তার শেষ ভাবনা।

.

৪৯.

পরেরদিন সকালে যথেষ্ট চাঙ্গা বোধ করলেন সেলডন। আবার বইটা পড়া শুরু করার। জন্য মনটা আকুপাকু শুরু করে দিয়েছে। ডর্সকে জিজ্ঞেস করলেন, দুই রেইনড্রপ বোনদের বয়স যেন কতো?

আমি জানি না। বিশ… বাইশ?

ধরো ওরা তিনশ থেকে চারশ বছর বাঁচবে-

হ্যারি, সেটা অসম্ভব।

আমি অনুমান করতে বলছি। গণিতে আমরা সবকিছুই ধরে নেই। তারপর বের করার চেষ্টা করি সেটা সত্যি কি না। জীবনকাল দীর্ঘ হলে তাদের শারীরিক বৃদ্ধিও দীর্ঘায়িত হবে। চেহারা দেখে মনে হবে বিশ-বাইশ বছর কিন্তু আসলে চলছে ষাট বছর।

ওদের বয়স কতো সেটা ওদেরকেই জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো?

এবং নিশ্চিত থাকো ওরা মিথ্যে কথা বলবে?

বার্থ সার্টিফিকেট দেখতে চাইবে।

আমার সবকিছু বাজী রেখে বলতে পারি, ওরা বলবে যে মাইকোজেনে জন্ম মৃত্যুর রেকর্ড রাখা হয় না বা রাখলেও ট্রাইবসপিওপিলরা সেটা দেখতে পারবে না।

বাজী ধরার দরকার নেই। আর কথাটা যদি সত্যিই হয় তাহলে ওদের বয়স নিয়ে মাথা ঘামানোরও দরকার নেই।

না, শোনো। মাইকোজেনিয়ানদের জীবনকাল যদি সাধারণ মানুষের জীবনকালের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি হয় তাহলে ওরা নিজেদের জনসংখ্যা না বাড়িয়েই পর্যাপ্ত সন্তানের জন্ম দিতে পারবে। মনে আছে সানমাস্টার বলেছিল যে তাদের জনসংখ্যা কখনো বিপদজনকভাবে বাড়ে না এবং কথাটা বলার সময় ভীষণ রেগে গিয়েছিল।

তুমি আসলে কী বোঝাতে চাইছ?

রেইনড্রপ ফরটি থ্রির সাথে থাকার সময় ছোট কোনো বাচ্চা দেখিনি আমি।

মাইক্রোফার্মে।

হ্যাঁ।

ওখানে বাচ্চারা থাকবে এটা তুমি কী করে আশা করো। রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ-এর সাথে আমি দোকানে গিয়েছি, আবাসিক লেভেলে গিয়েছি। ওখানে বিভিন্ন বয়সের অনেক বাচ্চা দেখেছি আমি। এমনকি কোলের শিশু পর্যন্ত, যদিও সংখ্যায় কম।

হা হা, উফুল্ল দেখালো সেলডনকে। অর্থাৎ ওরা এত দীর্ঘবছর বেঁচে থাকে না।

অবশ্যই না। তুমি কী আসলেই কথাটা বিশ্বাস করো?

না, না। কিন্তু একটা বিষয় ভালোভাবে যাচাই না করেই তুমি সেটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারো না।

যাচাই করতে গিয়ে তুমি অনেক সময়ও নষ্ট করতে পারো।

প্রথমে দেখে বা শুনে অনেক কিছুই অস্বাভাবিক মনে হয়। ভালো কথা তুমি তো একজন ইতিহাসবিদ, তাই না? রোবট, শব্দটা কখনো শুনেছ?

আহ! এবার আরেকটা কিংবদন্তীর কথা বলছ এবং এটা যথেষ্ট পরিচিত। অসংখ্য গ্রহ বলা যায় প্রায় সবগুলো গ্রহেই প্রি-হিস্টোরিক যুগে মানুষের আকৃতিতে তৈরি যন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করে। এগুলোকেই বলা হতো রোবট।

রোবট সম্পর্কে যত গল্প প্রচলিত আছে তার সবই সম্ভবত একটাই মূল কিংবদন্তী থেকে ছড়িয়েছে। কারণ প্রতিটা গল্পের মূল বক্তব্য একই। রোবট তৈরি করেছিল মানুষ এবং এক সময় সেগুলোই মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তখন সেগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। প্রতিটা ক্ষেত্রেই ধ্বংসের ঘটনাগুলো ঘটে ঠিক যে সময় থেকে মানুষ বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রাখতে শুরু করে তারও বহু বহুযুগ আগে। বিশ্লেষকদের মতে গল্পটা প্রতীকী এবং আমাদেরকে গ্যালাক্সিতে বসতি স্থাপনের ঝুঁকি এবং বিপদের কথাই মনে করিয়ে দেয়, যখন মানুষ সেই গ্রহ বা গ্রহগুলো থেকে–যা ছিল তাদের মূল বাসস্থান বেরিয়ে পড়ে তখন সবসময়ই নিজেদের থেকে উন্নত কোনো বুদ্ধিমত্তার মুখোমুখি হওয়ার ভয় ছিল।

হয়তো অন্তত একবারের জন্য হলেও অন্য কোনো বুদ্ধিমত্তার মুখোমুখি হয়েছিল মানুষ এবং সেখান থেকেই এই কিংবদন্তীর জন্ম।

কোনো গ্রহেই প্রিহিউম্যান বা ননহিউম্যান ইন্টেলিজেন্স-এর কোনো রেকর্ড নেই।

কিন্তু রোবট কেন? বিশেষ কোনো অর্থ আছে?

আমার জানা নেই, তবে এটা অটোমেটা শব্দের সমার্থক।

অটোমেটা! তাহলে এই শব্দটাই ব্যবহার করা হয় না কেন?

কারণ প্রাচীন কিংবদন্তী বলার সময় গল্পটাকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য মানুষ সেরকম প্রাচীন শব্দ ব্যবহার করতে ভালোবাসে। এত কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?

কারণ মাইকোজেনিয়ানদের এই প্রাচীন বইয়ে রোবট-এর কথা আছে। ডর্স, তুমি রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ-এর সাথে আজকে আবার বেরোচ্ছ?

যদি ওরা আসে।

কিছু প্রশ্নের উত্তর ওর কাছ থেকে জেনে নিতে পারবে?

চেষ্টা করে দেখতে পারি। প্রশ্নগুলো কী?

যতটা কৌশলে পারো জানার চেষ্টা করবে যে মাইকোজেনে এমন কোনো স্থাপনা বা ভবন আছে কী না যা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যার সাথে অতীতের নিবিড় সম্পর্ক, যা-

বাধা দিল ডর্স। তুমি আসলে জানতে চাইছ মাইকোজেনে কোনো উপাসনালয় আছে কি না।

উপাসনালয় কী?

আরো একটা প্রাগৈতিহাসিক শব্দ। এটারও উৎপত্তি কবে কখন কোথায় কেউ জানে না। উপাসনালয় আছে কী না এই একটা প্রশ্নের উত্তর পেলেই তোমার একগাদা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। ঠিক আছে, জিজ্ঞেস করব। তবে উত্তর দেবে কি না জানি না। কারণ আমরা তো ট্রাইবসপিওপিল।

যাইহোক, চেষ্টা করে দেখা যাক।

.

স্যাক্রাটোরিয়াম

অরোরা… কিংবদন্তীর এক গ্রহ, ধারণা করা হয়ে থাকে যে প্রাক ঐতিহাসিক যুগে সেখানে বসতি স্থাপন করা হয়, যখন আন্তঃমহাজাগতিক ভ্রমণ মাত্র শুরু হয়েছে। অনেকের মতে এই গ্রহটাই মানব সভ্যতার আদি বাসস্থান, দ্য ওয়ার্ল্ড অব অরিজিন যার আরেক নাম পৃথিবী। প্রাচীন ট্র্যান্টরের মাইকোজেন সেক্টরের অধিবাসীরা বিশ্বাস করত যে একমাত্র তারাই ছিল অরোরা গ্রহের পরবর্তী বংশধর এবং এই ধারণাটাই ছিল মাইকোজেনিয়ানদের সমাজ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। অবশ্য তাদের সামাজিক অবকাঠামোর ব্যাপারে সত্যিকার অর্থে আজ পর্যন্ত কিছুই জানা যায়নি…
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা

.

৫০.

দুই রেইনড্রপ এলো অনেকটা বেলা হওয়ার পর। রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ বরাবরের মতোই উৎফুল্ল, হাসিখুশি, কিন্তু রেইনড্রপ ফরটি থ্রি দরজার কাছে একবার থামল, নিজেকে আরো বেশি করে গুটিয়ে রেখেছে। দৃষ্টি নিবদ্ধ দৃঢ়ভাবে মেঝেতে, ভুলেও সেলডনের দিকে তাকাচ্ছে না।

অনিশ্চিত বোধ করলেন সেলডন, ডর্সকে ইশারা করলেন তার সাথে আসার জন্য। ডর্স আরো উস্ফুল্ল কণ্ঠে দুই বোনকে বলল, একটু অপেক্ষা করো, সিস্টার। আমার পুরুষমানুষকে বলে না দিলে সে বুঝতেই পারবে না সারাদিন নিজেকে নিয়ে কী করবে।

দুজন বাথরুমে ঢোকার পর ফিসফিস করে ডর্স জিজ্ঞেস করল, কিছু হয়েছে?

হ্যাঁ। রেইনড্রপ ফরটি থ্রি বোধহয় ভয় পাচ্ছে। ওকে বলে দিও বইটা আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেরত দেব।

বিনিময়ে ডর্স বিস্ময় মাখানো সুদীর্ঘ দৃষ্টি উপহার দিল সেলডনকে। তারপর বলল, হ্যারি, তুমি চমৎকার ভালোমানুষ কিন্তু একটা অ্যামিবার যে স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি আছে তোমার তাও নেই। আরে বোকা, এই কথা বললে মেয়েটা বুঝে নেবে যে গতকালের ঘটনা পুরোটাই আমাকে জানিয়েছ তুমি। তখন সত্যি সত্যি ভয় পাবে। তার চেয়ে বরং আমি ওর সাথে স্বাভাবিক আচরণ করব। সেটাই ভালো হবে।

মাথা নাড়লেন সেলডন। মিনমিনে গলায় বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ।

ডিনারের সময় ফিরে এসে ডর্স দেখল সেলডন তখনো বই পড়ছে। তবে আরো বেশি অস্থির মনে হলো তাকে।

ডর্সকে দেখে চোখমুখ কুঁচকে তিনি বললেন, এখানে যদি আরো কিছুদিন থাকতেই হয় তাহলে আমাদের দুজনের মাঝে যোগাযোগের জন্য একটা যন্ত্র প্রয়োজন। তোমার দেরি দেখে আমার চিন্তা হচ্ছিল।

এই তো ফিরে এসেছি, ডর্স বলল। মাথা থেকে স্কিনক্যাপ খুলে ঘৃণাভরা। দৃষ্টিতে তাকালো জঘন্য বস্তুটার দিকে। আমার জন্য তোমার চিন্তা হচ্ছিল শুনে খুব খুশী হলাম। আমি তো ভেবেছি সারাদিনই তুমি বইয়ে ডুবে ছিলে। এমনকি আমি কখন বেরিয়ে যাই সেটাও লক্ষ্য করোনি।

নাক দিয়ে শব্দ করলেন সেলডন।

আর আমার মনে হয় না মাইকোজেনে কোনো ধরনের কমিউনিকেশন ডিভাইস পাওয়া যাবে। কারণ এই ধরনের যন্ত্র থাকার মানেই হচ্ছে ট্রাইবসপিওপিলদের সাথে অনবরত যোগাযোগ এবং আমার মনে হয় মাইকোজেনের প্রশাসকরা সেক্টরের বাইরের সুবিশাল জগতের সাথে যোগাযোগ না রাখার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

হ্যাঁ, বইটা এক পাশে সরিয়ে রেখে সেলডন বললেন। বই-এ যা পড়েছি তাতে আমারও সেরকমই ধারণা তৈরি হচ্ছে। তুমি কি কিছু জানতে পেরেছ, ঐ যে কী যেন বলেছিলে… উপাসনালয়–সেই ব্যাপারে।

হ্যাঁ, বলল ডর্স। ভুরু ঢেকে রাখা প্লাস্টিকের বস্তুগুলো খুলছে। পুরো সেক্টরে ছোট বড়ো অনেক উপসনালয় আছে। কিন্তু প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাসনালয় একটাই।–জানো আমার ভুরু আছে টের পেয়ে এক মহিলা কী বলেছে। আমি যেন কোনো মানুষের সামনে না যাই। বোধহয় রুচিহীন দৃশ্য প্রদর্শনের জন্য সে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে।

ওসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামিও না। প্রধান উপাসনালয়টা কোথায় তুমি জানতে পেরেছ?

পথের হদিশ জেনে নিয়েছি, তবে রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ সতর্ক করে দিয়েছে। যে মেয়েরা ওখানে যেতে পারে না বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া এবং কাছাকাছি সময়ে সেই ধরনের কোনো অনুষ্ঠানও নেই। প্রধান উপাসনালয়টাকে বলা হয়। স্যাক্রাটোরিয়াম।

কী বলা হয়?

স্যাক্রাটোরিয়াম।

কী জঘন্য শব্দ। অর্থ?

মাথা নাড়ল ডর্স। শব্দটা জীবনে এই প্রথম শুনলাম। মনে হয় না রেইনড্রপরাও জানে। ওদেরকে স্যাক্রাটোরিয়াম অর্থ জিজ্ঞেস করা আর একটা দেয়ালকে কেন দেয়াল বলা হয় সেটা জিজ্ঞেস করা একই ব্যাপার।

ওরা কি কিছুই জানে না?

অবশ্যই জানে, হ্যারি। ওরা জানে স্যাক্রাটোরিয়াম কেন তৈরি করা হয়েছে। ওরা জানে যে এই স্যাক্রাটোরিয়াম উৎসর্গ করা হয়েছে এমন কিছুর জন্য যা মাইকোজেনে নেই। এটা উৎসর্গ করা হয়েছে অন্য এক গ্রহের প্রতি যে গ্রহ বহু আগে ছিল এবং ছিল আরো অনেক উন্নত।

অর্থাৎ ওরা এক সময় যে গ্রহে বাস করত?

ঠিক। রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ সব কথাই বলেছে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও শব্দটা মুখে আনতে পারেনি।

অরোরা?

হ্যাঁ, এই শব্দটাই, কিন্তু আমার মনে হয় মাইকোজেনিয়ানদের সামনে শব্দটা জোরে উচ্চারণ করলে তারা কষ্ট পাবে, ভয় পাবে। স্যাক্রাটোরিয়াম উৎসর্গ করা হয়েছে- এই পর্যন্ত বলেই থেমে যায় রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ; তারপর অত্যন্ত সাবধানে এক হাতের আঙ্গুল দিয়ে অপর হাতের তালুতে শব্দটা লিখে দেখায়। সেই সময় তার চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল যেন সে জঘন্য কোনো পাপ করছে।

অদ্ভুত। বইয়ে যা লেখা আছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে বোঝা যায় অরোরা হচ্ছে ওদের সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে মধুর স্মৃতি। তাহলে এই নাম উচ্চারণ করলে কেন পাপ হবে?–তোমার বুঝতে ভুল হয়নি তো।

মোটেই ভুল হয়নি। এবং সম্ভবত এতে কোনো রহস্যও নেই। খুব বেশি আলোচনা হলে তা ট্রাইবসপিওপিলদের কানে যাবে। গোপন রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে এই বিষয়ে যাবতীয় আলোচনার উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা।

প্রচীন যুগে কোনো সামাজিক আচরণ প্রতিহত করার জন্য কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করা হতো। এখানকার অবস্থা অনেকটা সেইরকমই। আমার মনে হয় এইরকম বিধিনিষেধের জন্যই মেয়েরা স্যাক্রাটোরিয়ামে যেতে পারে না। যদি কোনো সিস্টারকে বলি যে সে ভুল করে স্যাক্রাটোরিয়ামের চৌহদ্দির ভেতরে ঢুকে পড়েছে তাহলে ভয়েই মরে যাবে।

তুমি আমাকে ভালোভাবে বলে দিতে পারবে তো যেন একাই যেতে পারি?

প্রথম কথা, হ্যারি, তুমি একা যাচ্ছ না। আমিও যাচ্ছি। কারণ আমার কাছ থেকে অনেক দূরে থাকলে তোমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারব না। এই ব্যাপারটা সম্ভবত আমরা আগেই ফায়সালা করে নিয়েছি। দ্বিতীয় কথা, ওখানে হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। মাইকোজেন ছোট সেক্টর ঠিকই কিন্তু অত ছোট না।

তাহলে এক্সপ্রেসওয়েতে যাব।

মাইকোজেন টেরিটোরির ভেতর দিয়ে কোনো এক্সপ্রেস ওয়ে যায়নি। কারণ তাতে করে মাইকোজেনিয়ান এবং ট্রাইবসপিওপিলদের মাঝে খুব সহজে যোগাযোগ তৈরি হবে। তবে এক ধরনের পাবলিক কনভেন্স আছে। অনুন্নত গ্রহগুলোতে যেমন দেখা যায়। মাইকোজেন আসলেই তাই, অনুন্নত গ্রহের ছোট একটা অংশ কীভাবে যেন ট্রাক্টরের সাথে আটকে গেছে বা অন্যভাবে বলা যায় অতি উন্নত এক গ্রহের গায়ে কালো একটা দাগ। আর হ্যারি, বইটা দ্রুত শেষ করো। বেশি দেরি হলে রেইনড্রপ ফরটি থ্রি বিপদে পড়বে এবং বেশি দেরি হলে আমরাও বাঁচব না।

তুমি বলতে চাচ্ছ ট্রাইবসপিওপিলদের এই বই পড়া নিষিদ্ধ।

কোনো সন্দেহ নেই।

বেশ, বইয়ের পচানব্বই ভাগ আমি শেষ করে ফেলেছি। সমস্ত বর্ণনাই পুরোপুরি নীরস। এতে রয়েছে সীমাহীন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, কোনো এক ব্যক্তির তৈরি করা নীতি নিয়ে অসংখ্য আলোচনা যার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিনি। পরস্পরবিরোধী অসংখ্য নীতিবাক্য।

কথা শুনে মনে হচ্ছে বইটা এখন নিয়ে গেলে আমি তোমার একটা উপকার করব।

শুধু বইয়ের আরো পাঁচ পার্সেন্ট বাকি এবং সেই অংশেই মুখে না উচ্চারিত অরোরার ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। বারবারই মনে হচ্ছে ঐ অংশে এমন কিছু। পাব যা আমার কাজে লাগবে। সেজন্যই স্যাক্রাটোরিয়ামের ব্যাপারে জানতে চেয়েছি।

তুমি আশা করছ বইয়ে অরোরার ব্যাপারে যা বলা হয়েছে তাতে সমর্থন যোগানোর মতো কোনো প্রমাণ স্যাক্রাটোরিয়ামে পাবে?

অনেকটা সেইরকমই। এবং আমি জানতে চাই বইটাতে অটোমেটা বা রোবট সম্পর্কে আর কী বলা হয়েছে। এই বিষয়টা আমার বেশ আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে।

তুমি নিশ্চয়ই এটাকে সত্যি বলে ধরে নাওনি?

প্রায় সত্যি বলে ধরে নিয়েছি। বইয়ের কিছু কিছু অংশ যদি মেনে নাও, তাহলে এটাও মেনে নিতে হবে যে তখন কিছু কিছু রোবট ছিল পুরোপুরি মানুষের আকৃতির।

স্বাভাবিক। তুমি যদি মানুষের প্রতিকৃতি তৈরি করে সেটা দেখতে নিশ্চয়ই বানরের মতো হবে না, অবশ্যই মানুষের মতো হবে।

হ্যাঁ, প্রতিকৃতি মানে একইরকম দেখতে। কিন্তু তার মাঝে পার্থক্য থাকতে পারে। শিল্পী কয়েকটা রেখা দিয়ে একটা ছবি আঁকল এবং তুমি তা দেখে বুঝে নিলে যে সে আসলে মানুষের ছবি এঁকেছে। মাথার জন্য একটা বৃত্ত, বর্গক্ষেত্র দিয়ে পুরো দেহ, আঁকাবাকা কয়েকটা রেখা দিয়ে হাত আর পা। কিন্তু আমি এমন রোবটের কথা। বলছি যা দেখতে নিখুঁত মানুষের মতো।

অসম্ভব, হ্যারি। চিন্তা করে দেখো মানুষের দেহে মাংসপেশীর মাঝে যেরকম অসংখ্য ভাঁজ এবং মসৃণ বাঁক আছে ধাতু দিয়ে সেরকম নিখুঁত দেহ কাঠামো তৈরি করতে কত সময় লাগতে পারে?

ধাতুর তৈরি তোমাকে কে বলল, ডর্স? আমি যতদূর বুঝতে পারছি ওই রোবটগুলো ছিল অর্গানিক বা সিউডো-অর্গানিক। দেহ কাঠামো ঢাকা থাকত চামড়া দিয়ে, রক্তমাংসের মানুষের সাথে ওগুলোর কোনো পার্থক্য তুমি করতে পারতে না।

বইটাতে আসলেই এই কথা লেখা আছে?

এত বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে লেখা নেই। যাইহোক অনুমান-

তোমার অনুমান, হ্যারি। তার উপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।

আমাকে চেষ্টা করতে দাও। রোবট সম্বন্ধে বইটাতে চারটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট পেয়েছি আমি। প্রথমটা তো আগেই বলেছি যে ওগুলো–বা অন্তত কিছু দেখতে পুরোপুরি রক্তমাংসের মানুষের মতো; দ্বিতীয়, ওগুলোর বেঁচে থাকার বা জীবনের ব্যাপ্তি ছিল সুদীর্ঘ।

বরং বলো কার্যক্ষমতা নইলে ওগুলোকেও মানুষ ভাবা শুরু করবে।

তৃতীয়, ডর্সের রসিকতায় পাত্তা না দিয়ে সেলডন বলতে লাগলেন, কয়েকটা বা অন্তত একটা রোবট–আজও পর্যন্ত টিকে আছে।

হ্যারি, এটা হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে প্রচলিত কিংবদন্তী। প্রাচীন নায়কদের কেউ কখনো মরে না এবং মানবজাতিকে কোনো ভয়ানক বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট এক সময়ে আবার ফিরে আসবে।

চতুর্থ, সেলডন এখনো ডর্সের কথা গায়ে মাখছেন না, বইয়ের দুই একটা লাইনে বলা হয়েছে যে প্রধান উপাসনালয়ে বা স্যাক্রাটোরিয়ামে, যদিও এই শব্দটা বইয়ের কোথাও লেখা নেই–একটা রোবট আছে। কিছুক্ষণ বিরতি নিলেন সেলডন। তারপর আবার বললেন, বুঝতে পেরেছ?

না, কী বুঝব? ডর্স বলল।

চারটা পয়েন্ট থেকে একটা বিষয় পরিস্কার যে কিছু রোবট ছিল দেখতে নিখুঁত মানুষের মতো এবং অন্তত একটা আজো বেঁচে আছে। ধরে নাও ওটার বয়স বিশ হাজার বছর এবং আছে স্যাক্রাটোরিয়ামে।

শোনো, হ্যারি, তোমার এই বক্তব্য একেবারেই অবিশ্বাস্য।

সত্যি কথা বলতে কী আমি নিজেও বিশ্বাস করি না, কিন্তু এমনি এমনি ছেড়েও দিতে পারি না। যদি সত্যি হয়–অবশ্য সেই সম্ভাবনা দশ লক্ষ ভাগের একভাগ মাত্র তারপরেও যদি সেটা সত্যি হয়? তুমি বুঝতে পারছ না রোবটটা আমার কত কাজে আসবে? যে সময়গুলোর কোনো বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস আমাদের নেই সেই সময়ে গ্যালাক্সি কেমন ছিল তা সে মনে করতে পারবে। হয়তো সে সাইকোহিস্টোরি সম্ভব করে তুলতে আমাকে সাহায্য করতে পারবে।

যদি তা সত্যিও হয়, তোমার কী মনে হয় মাইকোজেনিয়ারা তোমাকে দেখতে দেবে বা রোবটের সাথে কথা বলতে দেবে।

ওদের কাছে অনুমতি চাওয়ার কোনো আগ্রহ নেই। আমি তো স্যাক্রাটোরিয়ামে গিয়ে দেখতে পারি যে ওখানে অন্তত কথা বলার মতো কিছু আছে কি না।

এখন না। আগামীকাল সকালে যাব আমরা।

তুমি বলেছিলে মেয়েরা ওখানে যেতে পারে না।

মেয়েরা ভিতরে যেতে পারে না। বাইরে থেকে দেখতে পারে। মনে হয় না তার বেশি সুযোগ আমরা পাব।

.

৫১.

স্বেচ্ছায় ডর্সের কাঁধে পথ দেখানোর দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন সেলডন। সে আগেও মাইকোজেনের রাস্তায় বেড়িয়েছে, পথঘাট কিছুটা চিনে ফেলেছে।

ডর্স ভেনাবিলির কপাল কুঁচকানো বিরক্তিতে। যেকোনো মুহূর্তে পথ হারাতে পারি, হ্যারি। বলল সে।

এই বুকলেটটা থাকার পরেও, বললেন সেলডন।

অধৈর্য ভঙ্গিতে তার দিকে তাকালো ডর্স। মনটা মাইকোজেনে ফিরিয়ে আনো হ্যারি। আমার দরকার ছিল একটা কম্পিউটার ম্যাপ। আর মাইকোজেনের এই বস্তুটা প্লাস্টিকের ভাজ করা একটা টুকরা ছাড়া কিছুই না। এটা দেখে বলতে পারব না আমি কোথায় আছি, কোথায় যাব। কারণ জিনিসটা ছাপানো।

তাহলে পড়ো কী লেখা আছে।

ঠিক তাই করার চেষ্টা করছি আমি, কিন্তু এটা তৈরি করা হয়েছে তাদের জন্যই যারা এটার সাথে পরিচিত। আমাদের বরং কাউকে জিজ্ঞেস করা উচিত।

না, ডর্স। ওটা হবে শেষ চেষ্টা। কারো মনোযোগ আকৃষ্ট করতে চাই না। বরং নিজেরাই চেষ্টা করি, দুই একবার পথ হারালেও ক্ষতি নেই।

মনোযোগ সহকারে বুকলেটের পাতা উল্টাতে লাগল ডর্স। তারপর গম্ভীর সুরে। বলল, এখানে স্যাক্রাটোরিয়াম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে দেখানো হয়েছে। স্বাভাবিক। আমার মনে হয় মাইকোজেনের প্রত্যেকেই দিনের কোনো না কোনো

সময় অন্তত একবারের জন্য হলেও ওখানে যায়। তবে সত্যি কথা বলতে কী, এখান থেকে ওখানে যাওয়ার জন্য কোনো কনভেন্স নেই।

কী?

অস্থির হয়ো না। আমি বলছি সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নেই। ওখানে পৌঁছতে হলে আমাদেরকে বেশ কয়েকবার গাড়ি পাল্টাতে হবে।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন সেলডন। মাত্র একটা এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে নিশ্চয়ই তুমি ট্র্যান্টরের অর্ধেক পেরোতে পারবে না। কোনো এক স্টেশনে নেমে আরেকটাতে চড়তে হবে।

আমি জানি। আসলে এই বুকলেটে সবকিছু পরিস্কারভাবে লেখা নেই। তাই চোখ এড়িয়ে গেছে।

ঠিক আছে। রাগ করো না। এতক্ষণে যদি বোঝা হয়ে থাকে যে কোনদিকে যেতে হবে তাহলে পথ দেখাও। আমি আসছি তোমার পিছন পিছন।

আক্ষরিক অর্থেই ডর্সের পিছনে থাকলেন সেলডন। কিছুক্ষণ পরেই দুজনে একটা ইন্টারসেকশনে পৌঁছলেন। দূর থেকেই সাদা কার্টলেট পরা তিনজন পুরুষ এবং ধূসর কার্টলেট পরা দুজন মহিলাকে দেখা গেল। সেলডন নির্দিষ্ট করে কারো দিকে না তাকিয়েই হাসলেন কিন্তু মাইকোজেনিয়ানরা শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

তারপর একটা কনভেন্স আসতে দেখা গেল। হ্যালিকনে যাতায়াতের জন্য গ্যাভি বাস ছিল। মাইকোজেনের এই বাহনটা সেটারই অনেক প্রাচীন রূপ। ভিতরে বিশটা বেঞ্চের মতো আসন। প্রতিটা বেঞ্চে চারজন করে যাত্রী বসতে পারবে। উঠা নামার জন্য প্রতিটি বেঞ্চেরই দুদিকে দরজা। যাত্রীরা দুদিক দিয়েই নামতে পারবে। রাস্তার মূল অংশের দিকের দরজা দিয়ে যে সব যাত্রী নামবে তাদের জন্য দুঃশ্চিন্তা বোধ। করলেন সেলডন। কিন্তু খেয়াল করলেন যে বাস যখন থেমে থাকে তখন রাস্তায় চলাচলকারী সকল যানবাহন সেটার কাছাকাছি এসে থেমে যায়।

ডর্সের ধাক্কা খেয়ে বাসে চড়লেন তিনি। পাশাপাশি দুটো খালি আসন পেয়ে সেখানে বসলেন। ডর্স তাকে অনুসরণ করল (নিয়ম অনুযায়ী পুরুষরা সবসময় আগে উঠে আগে নামে)।

মানুষ নিয়ে গবেষণা বন্ধ করো। আশেপাশে কী আছে সেদিকে মনোযোগ দাও। ফিসফিস করে কথাগুলো বলল ডর্স।

চেষ্টা করছি।

যেমন, ডর্স সরাসরি তাদের সামনের আসনের পিছন দিকে লাগানো চারকোণা একটা বস্তুর দিকে ইঙ্গিত করল। বাস চালু হতেই সেখানে পরবর্তী স্টেশন বা কাছাকাছি যে সকল গুরুত্বপূর্ণ ভবন বা সড়ক আছে সেগুলোর নাম ফুটে উঠতে শুরু করেছে।

যেখানে নেমে আমাদের বাস পাল্টাতে হবে এই যন্ত্রটাই আমাদের জানিয়ে দেবে যে সেখানে পৌঁছে গেছি। সেক্টরটা আসলে পুরোপুরি অনুন্নত নয়।

চমৎকার, বললেন সেলডন, তারপর ডর্সের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন, কেউ আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না। মনে হয় এইরকম কৃত্রিম প্রতিবন্ধক তৈরি হয়েছে যেন অনেক মানুষের মাঝেও নিজেদের প্রাইভেসি বজায় থাকে।

আমি অনেক আগেই তা বুঝতে পেরেছি। এটাকে যদি তোমার সাইকোহিস্টোরির কোনো নিয়ম বানাও তাহলে কেউ প্রভাবিত হবে না।

ডর্সের অনুমান সঠিক। সামনের বক্সে পরবর্তী স্টেশনের নাম ফুটে উঠল। এখানেই তাদের নামতে হবে। নেমে স্যাক্রাটোরিয়ামের সরাসরি বাস ধরতে হবে।

নেমে অপেক্ষা করতে লাগল দুজন। এরই মধ্যে কয়েকটা বাস ইন্টার সেকশন ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু আরেকটা গ্র্যাভি-বাস আসছে। আসলে তারা একটা ব্যস্ত মহাসড়কে পৌঁছেছেন। স্বাভাবিক। স্যাক্রাটোরিয়াম নিঃসন্দেহে মাইকোজেনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।

বাসে চড়ার সময় সেলডন ফিসফিস করে বললেন, আমরা কোথাও কোনো ভাড়া দিচ্ছি না।

এখানকার পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশনগুলো বিনা পয়সায় যাত্রীসেবা দিচ্ছে।

কী সভ্য জাতি।–কিন্তু কথা শেষ হলো না তার।

ডর্স তাকে একটা খোঁচা মেরে বলল, তোমার নিয়ম আর খাটছে না। ডান পাশের লোকটা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

.

৫২.

আড়চোখে একবার তাকালেন সেলডন। ডানদিকের লোকটা হালকা পাতলা গড়নের এবং বৃদ্ধ। বাদামী চোখ, গায়ের রং শ্যামবর্ণের। সেলডন নিশ্চিত যে স্থায়ীভাবে চুল ফেলে না দিলে লোকটার মাথায় কালো চুল গজাতো।

আবার সামনে তাকালেন তিনি। ভাবছেন, লোকটা একটু অন্যরকম। যে অল্প কয়েকজন ব্রাদারকে তিনি খুটিয়ে দেখেছেন তাদের সবাই ছিল লম্বা, ফ্যাকাশে চামড়া, নীল বা বাদামী চোখ। যদিও এটাই মাইকোজেনিয়ান পুরুষদের গড়পরতা দৈহিক বৈশিষ্ট্য কিনা তা বুঝার মতো যথেষ্ট সময় তিনি পাননি।

কার্টলের ডানদিকের হাতায় একটা টান অনুভব করলেন তিনি। ঘুরেই চোখের সামনে একটা কার্ড দেখলেন, তাতে লেখা, সাবধান, ট্রাইবসম্যান।

স্বয়ংক্রিয় ভাবেই মাথায় হাত চলে গেল তার। পাশের লোকটা শুধু ঠোঁট নেড়ে নিঃশব্দে বলল, চুল।

কানের পাশ দিয়ে কয়েকগোছা কখন বেরিয়ে গেছে তিনি নিজেও জানেন না। দ্রুত স্কিনক্যাপ ঠিক করে নিলেন। তারপর তিনিও নিঃশব্দে বললেন, ধন্যবাদ।

তার প্রতিবেশী এবার স্বাভাবিক স্বরে বলল, স্যাক্রাটোরিয়ামে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

আমিও। এক সাথেই যেতে পারি। লোকটার মুখে বন্ধুত্বের হাসি।

আমার সাথে সাথে

আপনার মেয়েমানুষ আছে। কোনো সমস্যা নেই। তাহলে তিনজন একসাথেই যাব।

কী করবেন বুঝতে পারলেন না সেলডন। আড়চোখে পাশে তাকিয়ে দেখলেন ডর্স সোজা সামনে তাকিয়ে আছে, পুরুষদের কথাবার্তায় কোনো মনোযোগ নেই আদর্শ সিস্টারের মতোই আচরণ। তবে বাম হাঁটুতে মৃদু একটা স্পর্শ অনুভব করলেন তিনি। ধরে নিলেন যে বোঝাতে চাইছে, ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা নেই।

তাই বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

তারপর আর কোনো কথা হলো না। স্যাক্রাটোরিয়াম আসতেই সেলডনের মাইক্রোজেনিয়ান বন্ধু নামার জন্য উঠে দাঁড়ালো।

স্যাক্রাটোরিয়ামকে ঘিরে বিশাল এক বৃত্ত রচনা করে গ্র্যাভি বাস থামল। আবার সেই পুরনো দৃশ্য। পুরুষরা নামল আগে, তাদের অনুসরণ করে মেয়েরা।

বয়সের কারণে মাইকোজেনিয়ানের কণ্ঠস্বর খানিকটা ভাঙ্গা তবে উফুল্ল। সে বলল, লাঞ্চের জন্য সময়টা একটু আগে হয়ে যায়… বন্ধু। তবে কিছুক্ষণের ভেতরেই জায়গাটা লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে। তখন আপনারা সুবিধা করতে পারবেন না। ইচ্ছে হলে কিছু খাবার কিনে বাইরে বসে খেতে পারি, কী বলেন? এখানে আমার প্রায়ই আসা হয়। ভালো একটা জায়গা চিনি।

সেলডন বুঝতে পারছেন না এটা ট্রাইবসম্যানদের বিপদে ফেলার কোনো কৌশল কী না। হয়তো তাদের কাছে দামী বা বাজে কোনো পণ্য গছাতে চাইছে। তবে তিনি সুযোগ নিয়ে দেখবেন বলে স্থির করলেন।

আপনি খুব ভালো মানুষ, বললেন তিনি। যেহেতু আমরা এখানে কিছুই চিনি না তাই আপনার সাহায্য পেলে খুব খুশী হব।

লাঞ্চের জন্য স্যান্ডউইচ এবং কোমল পানীয় কিনল সবাই। পানীয়টা দেখতে একেবারে দুধের মতো। দিনটা চমৎকার এবং যেহেতু তারা দর্শনার্থী তাই বৃদ্ধ মাইকোজেনিয়ান পরামর্শ দিল স্যাক্রাটোরিয়াম গ্রাউন্ডে বসেই লাঞ্চ সেরে নিলে ভালো হবে। তাতে আগন্তুকরা পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে।

লাঞ্চের প্যাকেট নিয়ে হাঁটার সময় সেলডন খেয়াল করলেন যে স্যাক্রাটোরিয়ামের সাথে ইম্পেরিয়াল প্যালেসের এবং চারপাশের গ্রাউন্ডের সাথে ইম্পেরিয়াল গ্রাউন্ডের খুব সামান্য মিল রয়েছে।

চমৎকার, তাই না, জিজ্ঞেস করল মাইকোজেনিয়ান। বলার সুরে গর্ব।

হ্যাঁ। এইরকম চকচক করছে কেন?

গ্রাউন্ডের কারণে। পুরোটাই আমাদের ডন ওয়ার্ল্ডের রাষ্ট্রীয় ভবনের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে–যদিও এটা অনেক ছোট।

আপনি ইম্পেরিয়াল গ্রাউন্ড কখনো দেখেছেন?

সেলডনের কথার অর্থ ঠিকই বুঝতে পারল মাইকোজেনিয়ান। কিন্তু তাতে মোটেই না দমে বলল, ওরা আমাদের ডন ওয়ার্ল্ডের অনুকরণে তৈরি করার চেষ্টা করেছে, যদিও খুব একটা নিখুঁত হয়নি।

মনে সন্দেহ জাগলেও কিছু বললেন না সেলডন।

পাথরের তৈরি কিছু অর্ধবৃত্তাকার আসনের কাছে এসে থামলেন তারা। আসনগুলো স্যাক্রাটোরিয়ামের মতোই দিনের আলোয় ঝিকমিক করছে।

চমৎকার, মাইকোজেনিয়ান বলল, তার গভীর চোখে খুশির ঝিলিক। আমার জায়গাটা কেউ দখল করেনি। বসার এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। কারণ এখান থেকে গাছের ফাঁক দিয়ে স্যাক্রাটোরিয়ামের পাশের দেয়ালের চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। বসুন। ঠাণ্ডা লাগবে না। আপনার সঙ্গিনী। তিনিও বসতে পারেন। আমি জানি তিনি ট্রাইবসওম্যান, তাদের নিয়মকানুন আলাদা। তিনি… ইচ্ছে হলে কথাও বলতে পারবেন।

তার দিকে একবার রাগ মিশ্রিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ডর্স বসল।

বুঝতে পারলেন সেলডন যে এই বৃদ্ধ মাইকোজেনিয়ানের সাথে তাদেরকে বেশ কিছুটা সময় কাটাতে হবে। হাত বাড়িয়ে তিনি বললেন, আমি হ্যারি আর আমার সঙ্গিনী ডর্স। আমরা নামের সাথে কোনো সংখ্যা ব্যবহার করি না।

আমি মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু। আমরা অনেক বড়ো গোত্র।

মিশেলিয়াম? খানিকটা দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন সেলডন।

অবাক হয়েছেন বোধহয়। তাহলে ধরে নিচ্ছি এর আগে শুধু প্রাচীন পরিবারগুলোর সাথে দেখা হয়েছে। যেমন ক্লাউড, সানশাইন এবং স্টারলাইন–সবই অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল নাম।

স্বীকার করছি- শুরু করলেন সেলডন।

বেশ, নিচু শ্রেণীর একজনের সাথে এইমাত্র পরিচয় হলো আপনার। আমরা আমাদের নাম বেছে নেই মাটি থেকে, মাইক্রোফার্ম থেকে এবং আমরাও শ্রদ্ধার পাত্র।

তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আপনাকে আবারো ধন্যবাদ গ্র্যাভি-বাসে আমাকে সাহায্য করার জন্য।

শুনুন, আমি আপনাকে বড়ো একটা বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছি। আমার আগে · কোনো সিস্টার দেখে ফেললে চিৎকার শুরু করে দিত আর ব্রাদাররা আপনাকে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিত তার জন্য এমনকি বাস থামারও অপেক্ষা করত না।

সামনে ঝুঁকল ডর্স যেন সেলডনের ওপাশে বসা মানুষটাকে দেখতে পারে। জিজ্ঞেস করল, আপনি সেরকম আচরণ করেননি কেন?

আমি? ট্রাইবসপিওপিলদের সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। আমি একজন স্কলার।

স্কলার?

আমার গোত্রের মধ্যে প্রথম। স্যাক্রাটোরিয়াম বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শুরু হয় আমার। যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট করি। সব ধরনের প্রাচীন শিল্পকলার বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ। ট্রাইবাল গ্রন্থাগারে ঢোকার লাইসেন্স আছে আমার, ওখানে।

ট্রাইবসপিওপিলদের লেখা বই এবং বুক-ফিল্ম আছে। আমি আমার ইচ্ছেমতো বই পড়তে পারি বা বুক-ফিল্ম দেখতে পারি। এমনকি আমাদের একটা কম্পিউটারাইজড রেফারেন্স গ্রন্থাগারও আছে। আমি তা ব্যবহার করতে পারি। এগুলো আসলে মানুষের মনকে আরো খোলামেলা করে তুলে। তাই সামান্য একটু চুল দেখলে আমার তেমন কিছু যায় আসে না। মাথায় চুল ভর্তি অনেক ট্রাইবসম্যানের ছবি দেখেছি। এমনকি মেয়েদেরও। বলেই আড়চোখে ডর্সের দিকে তাকালো।

নীরবে কিছুক্ষণ খাওয়াদাওয়া করল সবাই। তারপর সেলডন জিজ্ঞেস করলেন, স্যাক্রাটোরিয়ামে যে ব্রাদাররা ঢুকছে বা বেরুচ্ছে তাদের সবাই স্যাশ পড়ে রেখেছে?

ও, হ্যাঁ, বলল মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু। বাম কাধ দিয়ে পেচিয়ে ডান কাঁধের উপর দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। তাতে চমৎকার কারুকার্য করা।

কেন?

এটাকে বলা হয় ওবিয়াহ্। এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় স্যাক্রাটোরিয়ামে প্রবেশ করে একজন মাইকোজেনিয়ান কী পরিমাণ আনন্দ পায় এবং এটাকে রক্ষা করার জন্য সে শেষ রক্তবিন্দু বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করবে না।

রক্তপাত? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ডর্স।

প্রতীকী। আমি কখনো রক্তপাত ঘটাতে শুনিনি। কারণ তাতে কোনো আনন্দ নেই। আসলে ভিতরে সবাই লস্ট ওয়ার্ল্ডের জন্য দুঃখ করে, বিলাপ করে আর নিজেকে পরিপূর্ণভাবে তার কাছে নিবেদন করে। তারপর কণ্ঠস্বর নামিয়ে মোলায়েম সুরে বলল, অর্থহীন।

আপনি আসলে… এইসব বিশ্বাস করেন না। ডর্স বলল।

আমি একজন স্কলার। বলল সে। কণ্ঠে পরিস্কার গর্ব প্রকাশ পেল। মুখে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে হাসল। আবারো প্রমাণ করে দিল সে আসলে বৃদ্ধ। কত হতে পারে লোকটার বয়স–অবাক হয়ে ভাবলেন সেলডন। কয়েক শতাব্দী? না, সেটা অসম্ভব। তিনি আর ডর্স আগেই বুঝতে পেরেছেন।

আপনার বয়স কত? অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রশ্নটা করে ফেললেন তিনি।

মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু প্রশ্নটা শুনে রেগে উঠল না বা জবাব দেওয়ার সময় ইতস্ততও করল না, সাতাত্তর।

আমি শুনেছি যে আপনাদের পূর্বপুরুষরা একসময় বহু শতাব্দী বেঁচে থাকত।

আপনি কীভাবে জানলেন। বুঝেছি, কেউ হয়তো বলে দিয়েছে… তবে কথাটা সত্যি। এধরনের একটা বিশ্বাস মাইকোজেনে প্রচলিত। শুধু অশিক্ষিতরাই তা বিশ্বাস করে এবং এল্ডার্সরা তাতে ইন্ধন যোগায়। কারণ তাতে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায়। আসলে অন্যদের তুলনায় আমরা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারি কারণ আমরা নিখুঁত পুষ্টিকর খাদ্য খাই। কিন্তু তারপরেও এমনকি একশ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার ঘটনাও খুব কম।

ধরে নিচ্ছি মাইকোজেনিয়ানরা অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ এটা আপনি মানেন না।

মাইকোজেনিয়ানদের কোনো দোষ নেই। নিঃসন্দেহে তারা অন্যদের থেকে নীচু শ্ৰেণীর নয়। কিন্তু আমার মতে সব মানুষই সমান। এমনকি মেয়েরাও। ডর্সের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কথাগুলো বলল সে।

আমার মনে হয় না এই সমাজের কেউ আপনার সাথে একমত হবে।

আপনার সমাজের কেউও হবে না। তিক্ত স্বরে বলল মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু। যদিও আমি বিশ্বাস করি। প্রত্যেক স্কলারেরই তা করা উচিত। বলতে গেলে ট্রাইবসপিওপিলদের সব বিখ্যাত সাহিত্যই আমি পড়েছি। আপনাদের সংস্কৃতি আমি বুঝতে পারি। এই বিষয়ে অনেক আর্টিকেলও লিখেছি। আপনারা আমাদের সাথে যেরকম স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন আমিও ট্রাইবসপিওপিলদের সাথে সেইরকম স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারি।

ধারালো গলায় ডর্স জিজ্ঞেস করল, ট্রাইবসপিওপিলদের জীবনযাত্রা বুঝতে পারেন দেখে আপনি বোধহয় বেশ গর্বিত। কখনো মাইকোজেনের বাইরে গিয়েছেন?

মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিল। না।

কেন? তাহলে আপনি আরো ভালোভাবে আমাদের বুঝতে পারতেন।

সেটা ঠিক হতো না। সবসময় উইগ পরে থাকতে হবে। প্রতিনিয়ত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরতাম।

উইগ কেন? আপনি এমন টাক মাথাতেই থাকতে পারবেন।

না, আমি অত বোকা না। চুলওয়ালা মানুষগুলো তখন আমার সাথে খারাপ। ব্যবহার করত।

খারাপ ব্যবহার? কেন? ট্র্যান্টর বা অন্যান্য গ্রহে প্রচুর মানুষ আছে যাদের মাথায় প্রাকৃতিক নিয়মেই টাক পড়ে।

আমার বাবার মাথায় টাক ছিল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন সেলডন। আগামী দশ বছরে আমার মাথাতেও টাক পড়বে। চুল এখনই পাতলা হতে শুরু করেছে।

এটাকে টাক বলে না। কারণ আপনাদের শরীরে চুল থাকবে। টাক বলতে আমি বোঝাতে চাইছি শরীরের কোথাও কোনো চুল নেই।

আপনাদের শরীরের কোথাও কোনো চুল নেই? আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল ডর্স।

মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু এবার রেগে গেল কিছু বলল না।

সেলডন ভয় পেলেন আলোচনা না থেমে যায়। দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন, ট্রাইবসপিওপিলরা কী দর্শনার্থী হিসেবে স্যাক্রাটোরিয়ামের ভিতরে ঢুকতে পারে?

জোরে জোরে মাথা নাড়ল মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু। কখনোই না। ওটা শুধু ডন ওয়ার্ল্ড-এর পুত্রদের জন্য।

শুধু পুত্রদের জন্য? জিজ্ঞেস করল ডর্স।

মনে কষ্ট পেল মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু। ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল, বেশ, আপনারা ট্রাইবসপিওপিল। না জানাই স্বাভাবিক। ডন ওয়ার্ল্ডের কন্যারা শুধু নির্দিষ্ট দিনে এবং নির্দিষ্ট সময়ে ভিতরে যেতে পারে। এটাই নিয়ম। বলছি না যে এই নিয়ম আমি সমর্থন করি। আমার হাতে দায়িত্ব থাকলে বলতাম যাও যত খুশী উপভোগ করো। হয়তো কিছুদিনের ভেতরেই আমার সাথে অনেকেই যোগ দেবে।

আপনি কখনো ভেতরে যাননি?

ছোটবেলায় বাবা মার সাথে একবার গিয়েছিলাম, কিন্তু মাথা নাড়ল সে ভিতরে যারা যায় তারা শুধু পবিত্র গ্রন্থের দিকে তাকিয়ে থাকে, বিড়বিড় করে সেটা পড়ে, পুরনো দিনের জন্য দীর্ঘশ্বাস আর চোখের পানি ফেলে। আপনি কারো সাথে কথা বলতে পারবেন না, হাসতে পারবেন না। এমনকি কারো দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারবেন না। আপনার সমস্ত সত্তাকে পুরোপুরি নিবদ্ধ করতে হবে লস্ট ওয়ার্ল্ডের উপর। পুরোপুরি। বাতিল করে দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল সে। এসব আমার জন্য না। আমি একজন স্কলার এবং আমি চাই পুরো বিশ্বটাই আমার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

ঠিকই বলেছেন, বললেন সেলডন, একটা পথ পাওয়া গেছে বলে মনে হলো তার। আমরা আপনার সাথে একমত। ডর্স আর আমি, আমরা দুজনও স্কলার।

জানি।

জানেন? কীভাবে?

হতেই হবে। শুধু ইম্পেরিয়াল অফিসার আর কূটনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী এবং স্কলারদের মাইকোজেনে আসার অনুমতি দেওয়া হয়। আর আপনাদের চোখ দেখেই আমি বুঝে নিয়েছি। সেজন্যই তো আগ বাড়িয়ে পরিচিত হলাম। উফুল্ল ভঙ্গিতে হাসল সে।

ঠিকই ধরেছেন। আমি গণিতবিদ, ডর্স ইতিহাসবিদ। আপনি?

আমি… শিল্পকলা এবং সংস্কৃতির উপর বিশেষজ্ঞ। ট্রাইবসপিওপিলদের বিখ্যাত সব সাহিত্যকর্মই আমি পড়েছি :লীসার, মিনটোল, নোভিগর।

আর আমরা আপনাদের বিখ্যাত বইটি পড়েছি–লস্ট ওয়ার্ল্ড নিয়ে লেখা পবিত্র গ্রন্থ।

আপনারা পড়েছেন? কোথায়? কীভাবে?

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কপি আছে।

ভাবছি এল্ডার্সরা কথাটা জানে কী না।

এবং আমি রোবটের কথাও পড়েছি।

রোবট?

হ্যাঁ। সেজন্যই স্যাক্রাটোরিয়ামে ঢুকতে চাইছি। রোবটটাকে দেখতে চাই। (ডর্স সেলডনের গোড়ালীতে হালকা লাথি দিয়ে সতর্ক করার চেষ্টা করল, কিন্তু তিনি পাত্তা দিলেন না)।

আমি এগুলো বিশ্বাস করি না। কোনো শিক্ষিত মানুষই করবে না। অস্বস্তি নিয়ে বলল মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু। এমনভাবে চারদিকে তাকালো যেন ভয় পাচ্ছে তাদের কথা কেউ শুনে ফেলবে।

আমি পড়েছি যে স্যাক্রাটোরিয়ামের ভেতরে এখনো একটা রোবট আছে।

আমি এমন বাজে বিষয়ে কোনো কথাই বলতে চাই না।

স্যাক্রাটোরিয়ামের ভিতরে ঠিক কোন জায়গাটায় আছে? কথা বের করার চেষ্টা করলেন সেলডন।

থাকলেও আমি আপনাকে বলতে পারব না। কারণ খুব ছোট বেলায় মাত্র একবার ঢুকেছিলাম। তারপর আর কখনো যাইনি।

ভিতরে কী বিশেষ কোনো জায়গা আছে, গোপন কোনো স্থান?

এল্ডারদের জন্য সারি সারি খুপড়ি আছে। শুধু এল্ডাররাই ওখানে উঠতে পারে। কিন্তু ওখানে অস্বাভাবিক কিছু তো নেই।

আপনি কখনো গিয়েছিলেন ওদিকটাতে?

না, অবশ্যই না।

তাহলে আপনি কীভাবে জানেন?

আমি জানি না ভিতরে কোনো গাছ আছে কী না। জানি না ওখানে কোনো লেজার-অর্গান আছে কী না, জানি না আরো কোটি কোটি বস্তুর কোনোটা আছে কী না। কিন্তু আমার না জানাতে কি প্রমাণ হয় যে ওগুলো সেখানে আছে।

কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারলেন না সেলডন।

ভূতুড়ে একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ল মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু-র মুখে। স্কলাররা এভাবেই যুক্তি দাঁড় করায়। অর্থাৎ আমিও ফেলনার পাত্র নই। যাইহোক এল্ডার্সদের প্রকোষ্ঠে উঠার পরামর্শ আমি দেব না। কারণ জানি ধরা পড়লে যা ঘটবে সেটা আপনার পছন্দ হবে না।–ডন ওয়ার্ল্ড-এর আশীর্বাদ সর্বদা আপনাদের সাথে থাকুক। তারপর সে হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালো–দ্রুত চলে গেল–কিছু না বলেই।

তার চলে যাওয়া দেখে অবাক হলেন সেলডন। লোকটা হঠাৎ এভাবে চলে গেল। কেন?

আমার মনে হয়, ডর্স বলল, কেউ আসছে।

সঠিক অনুমান। লোকটা যথেষ্ট লম্বা এবং অনেক বড়ো একটা কার্টলেট পড়ে রেখেছে। কাঁধের স্যাশটা অনেক বেশি উজ্জ্বল এবং অবশ্যই লাল রংয়ের। গম্ভীরভাবে সে তাদের দিকে হেঁটে আসছে। লোকটার চোখ মুখ এবং আচরণে ফুটে বেরুনো কর্তৃত্বের আভা চিনতে ভুল করলেন না সেলডন। এটাও পরিস্কার বুঝতে পারলেন যে লোকটা কোনো কারণে ভীষণ রেগে আছে।

.

৫৩.

নতুন মাইকোজেনিয়ান কাছে আসতেই উঠে দাঁড়ালেন হ্যারি সেলডন। সেটা ঠিক হলো কী না তিনি বলতে পারবেন না তবে ধরে নিলেন এতে কোনো ক্ষতিও হবে না। ডর্স ভেনাবিলিও উঠে দাঁড়িয়েছে তার সাথে। সাবধানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। মাটির দিকে।

এই লোকটাও বৃদ্ধ, তবে মিশেলিয়াম সেভেন্টি টুর মতো বয়সের ছাপ ততটা প্রকট নয়। গোলাকার টাক মাথা, উজ্জ্বল নীল চোখ। লাল স্যাশের সাথে মিশে আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব এনে দিয়েছে সুদর্শন মুখে।

আপনারা ট্রাইবসপিওপিল, আগন্তুক বলল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর। সেলডন এতটা আশা করেন নি। কিন্তু কথা বললেন অত্যন্ত ধীরে যেন তার কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ না জাগে।

ঠিক ধরেছেন, মার্জিত কিন্তু দৃঢ় গলায় বললেন সেলডন। মাইকোজেনিয়ানকে খাটো করে দেখার কোনো ইচ্ছা তার নেই আবার তার নিজের মর্যাদা কেউ ক্ষুণ্ণ করুক সেটাও তিনি চান না।

আপনাদের নাম?

আমি হ্যালিকনের হ্যারি সেলডন। আমার সঙিনী সিনার ডর্স ভেনাবিলি। আপনার নাম?

রাগে ভুরু কুঁচকালো মাইকোজেনিয়ান, কিন্তু সে নিজেও বুঝতে পারছে সেলডন যথেষ্ট ক্ষমতাশালী।

আমি স্কাইস্ট্রিপ টু, মাথা উঁচু করে বলল সে। স্যাক্রাটোরিয়ামের একজন এল্ডার। আপনি ট্রাইবসম্যান?

আমরা, সর্বনামটার উপর জোর দিলেন সেলডন। স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলার। এখানে এসেছি মাইকোজেনের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে।

কার নির্দেশে?

সানমাস্টার ফোরটিন। তিনি নিজে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছেন।

স্কাইস্ট্রিপ টু একটু থামল। মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার মুখে। তারপর আগের চেয়ে মোলায়েম সুরে বলল, হাই এল্ডার। আমি তাকে ভালোভাবেই চিনি।

চিনলেই ভালো, কাঠখোট্টা ভঙ্গিতে বললেন সেলডন। আর কিছু, এল্ডার?

হ্যাঁ, এল্ডার তার মর্যাদা বজায় রাখার চেষ্টা করল, আপনাদের সাথে যে লোকটা ছিল এবং আমাকে দেখেই যে লোকটা পালিয়ে যায় সে কে?

মাথা নাড়লেন সেলডন, আমরা তাকে আগে কখনো দেখিনি, এল্ডার। অনেকটা দুর্ঘটনাক্রমেই তার সাথে পরিচয় হয়। আমরা স্যাক্রাটোরিয়ামের বিষয়ে দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করি তাকে।

কী জিজ্ঞেস করেছিলেন?

মাত্র দুটো প্রশ্ন, এল্ডার। জিজ্ঞেস করেছিলাম এই ভবনটাই কী স্যাক্রাটোরিয়াম এবং ট্রাইবসপিওপিলরা কী ওখানে ঢুকতে পারে। প্রথম প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ এবং দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে না বলে।

ঠিক জবাব দিয়েছে। আর স্যাক্রাটোরিয়ামের ব্যাপারে এত আগ্রহ কেন?

আমরা এখানে মাইকোজেন-এর সমাজ ব্যবস্থা, জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে এসেছি আর স্যাক্রাটোরিয়াম হলো মাইকোজেন-এর হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্ক, তাই নয় কী?

এটা আমাদের এবং শুধু আমরাই ওখানে যেতে পারি।

এমনকি একজন এন্ডার–হাই এল্ডার নির্দোষ জ্ঞান অন্বেষণের উদ্দেশ্যে অনুমতি দেয় তারপরেও আমরা ঢুকতে পারব না।

আপনাদের কাছে কী হাই এল্ডারের অনুমতি আছে?

ইতস্তত করতে লাগলেন সেলডন। ডর্স একবার আড়চোখে তাকালো। সিদ্ধান্ত নিলেন বেশি ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না, না, এখনো পাইনি। বললেন তিনি।

কখনো পাবেনও না, এল্ডার বলল, যদিও অনুমতি নিয়েই এখানে এসেছেন কিন্তু এমনকি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষও পাবলিক সেন্টিমেন্ট সামলাতে পারবে না। স্যাক্রাটোরিয়াম আমাদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। আমাদের জনগণ কোনো ট্রাইবসপিওপিলকে মাইকোজেনে দেখলে ক্ষেপে উঠতে পারে বিশেষ করে স্যাক্রাটোরিয়ামের সীমানার ভেতরে। শুধু যদি একজন মুখ ফসকেও বলে ফেলে যে আপনারা অনুপ্রবেশকারী তাহলে মুহূর্তের মধ্যে এই শান্তশিষ্ট মানুষগুলো হিংস্র উন্মাদ হয়ে উঠবে। আপনাদের আক্ষরিক অর্থেই ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলবে। হাই। এল্ডার যদিও আপনাদের যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছেন কিন্তু নিজেদের ভালোর জন্যই চলে যান এখান থেকে, এই মুহূর্তে।

কিন্তু স্যাক্রাটোরিয়াম- একরোখার মতো বললেন সেলডন, ডর্স তাকে থামানোর জন্য কার্টলের হাত ধরে হালকা টান দিল।

স্যাক্রাটোরিয়ামে এমন কী আছে যা আপনাকে আগ্রহী করে তুলেছে। বাইরে থেকে দেখেছেন। এবার চলে যান। ভেতরে আপনার দেখার কিছু নেই।

ভিতরে একটা রোবট আছে।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল এল্ডার, তারপর ঝুঁকে সেলডনের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, চলে যান এখনই নয়তো আমি নিজেই চিৎকার করে বলব আপনারা অনুপ্রবেশকারী। হাই এল্ডার সম্মান করেছেন বলেই আপনাদের আমি একটা সুযোগ দিচ্ছি।

আর ডর্স বিস্ময়কর শক্তিতে সেলডনকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল। হ্যাঁচকা টানে সেলডন একটা হোঁচট খেলেন। তারপর দ্রুত পায়ে ডর্সের পিছু পিছু হটতে বাধ্য হলেন।

.

৫৪.

পরেরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে গতদিনের ঘটনার কথা তুলল ডর্স–এবং তার বলার ভঙ্গিতে মনে আঘাত পেলেন সেলডন।

তো, পুরো দিনটাই মাটি হলো।

সেলডনের মতে এই বিষয়ে কথা না তুললেই ভালো হতো। বিরক্ত সুরে বললেন, মাটি হলো কীভাবে?

আমাদেরকে একরকম ঘাড় ধাক্কা দিয়েই বের করে দেওয়া হয়েছে। কেন? কী পেয়েছি আমরা?

শুধু এইটুকু জানতে পেরেছি যে ওখানে একটা রোবট আছে।

মিশেলিয়াম সেভেন্টি টুর মতে নেই।

সে তো এই কথা বলবেই। সে একজন স্কলার–অন্তত নিজেকে তাই মনে করে এবং স্যাক্রাটোরিয়ামের ব্যাপারে কিছু না জানলে তা সে গ্রন্থাগার থেকে জেনে নেয়। আমার কথা শুনে এল্ডার-এর চেহারা কেমন হয়েছিল তোমার মনে আছে?

অবশ্যই মনে আছে।

ভেতরে রোবট না থাকলে সে এত ভয় পেত না।

তোমার অনুমান হ্যারি। আর থাকলেও আমরা ভেতরে ঢুকতে পারছি না।

চেষ্টা করতে হবে। নাস্তা খেয়ে বেরুবো। দোকান থেকে একটা লাল স্যাশ কিনব, ওরা যেটাকে ওবিয়াহ বলে। সেটা গায়ে চাপিয়ে হেঁটে সোজা ভিতরে ঢুকে পড়ব। চোখ অবশ্যই একান্ত অনুগতের মতো মাটির দিকে থাকবে।

চুল ঢাকার জন্য স্কিনক্যাপ আর যা পরেছ ওগুলো। এক মাইক্রো সেকেন্ডেরও কম সময়ে তুমি ধরা পড়ে যাবে।

না, ধরা পড়ব না। প্রথমে যাব গ্রন্থাগারে, যেখানে ট্রাইবসপিওপিলদের সম্পর্কে সকল তথ্য রেখেছে ওরা। ওগুলোও আমার দেখার ইচ্ছে আছে। গ্রন্থাগারটা বোধহয় স্যাক্রাটোরিয়ামের বাড়তি অংশ এবং ওখান থেকে ভিতরে ঢোকার নিশ্চয় কোনো পথ আছে।

ঢোকার সাথে সাথেই তুমি ধরা পড়বে।

মোটেই না। মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু কী বলেছে তুমি শুনেছ। ভেতরে সবাই চোখ নামিয়ে রাখে, একমনে শুধু তাদের মহান লস্ট ওয়ার্ল্ড অরোরার কথা চিন্তা করে। কেউ কারো দিকে তাকায় না। তাকানোটা বোধহয় পাপ। তারপর আমি এল্ডারদের থাকার জায়গাগুলো খুঁজে বের করব।

এতই সোজা?

মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু বলেছিল যে সে আমাকে এল্ডারদের বাসস্থানগুলোতে উঠার পরামর্শ দেবে না। তার মানে উপরে উঠার কথা বলছিল। কাজেই আমার ধারণা এল্ডাররা টাওয়ারগুলোর উপরে থাকে, সম্ভবত কেন্দ্রীয় টাওয়ারে।

মাথা নাড়ল ডর্স, লোকটা কী বলেছিল তা হুবহু আমার মনে নেই। তবে দাঁড়াও। মাঝখানে কথা থামিয়ে ভুরু কুঁচকালো সে।

হ্যাঁ, বলো।

সে যে শব্দটা ব্যবহার করেছিল সেটা অনেক প্রাচীন একটা শব্দ যার অর্থ উঁচু জায়গায় নির্মিত বাসস্থান।

এই তো বের করে ফেলেছ। দেখলে তো তুমি যাকে ব্যর্থ বলছ সেখান থেকে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে গেলাম। এখন যদি একটা রোবট পেয়ে যাই যা বিশ হাজার বছরের পুরনো এবং যা এখনো কাজ করে চলেছে এবং সেটা যদি আমাকে বলতে পারে।

অবিশ্বাস্য হলেও ধরে নেওয়া যাক রোবট একটা পেলে। তখন নিজে ধরা না পড়ে ওটার সাথে কতক্ষণ কথা বলতে পারবে?

জানি না। যদি প্রমাণ হয় যে ওটা আছে তাহলে কথা বলার জন্য কোনো না কোনো পথ বের করে নেব। পিছিয়ে আসার জন্য এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। যখন বলেছিলাম যে সাইকোহিস্টোরি তৈরি করা সম্ভব নয় হামিনের উচিত ছিল তখনই আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়া। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হয়তো সম্ভব। কাজেই কোনো বাধাই আমাকে আর দমিয়ে রাখতে পারবে না। শুধু মৃত্যু ছাড়া।

মাইকোজেনিয়ানরা ভীষণ ক্ষেপে উঠবে, হ্যারি। এত বড়ো ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।

আর কোনো উপায় নেই।

না, হ্যারি। তোমার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার। কাজেই এই কাজ আমি তোমাকে করতে দেব না।

না দিয়ে উপায় নেই। আমার নিরাপত্তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাইকোহিস্টোরিকে কার্যকরী করে তোলার একটা পথ খুঁজে বের করা। আমার নিরাপত্তা শুধু একটা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে আমি হয়তোবা সাইকোহিস্টোরি ডেভেলপ করতে পারব। আর সেটা করতে আমাকে বাধা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে তোমার দায়িত্বটা অর্থহীন হয়ে পড়া চিন্তা করে দেখো।

নিজের ভেতরে এক নতুন উদ্যম আর বিশ্বাস অনুভব করছেন হ্যারি। সাইকোহিস্টোরি–তার যুগান্তকারী থিওরী। মাত্র কিছুদিন আগে তিনি নিজের মুখেই বলেছেন যে শুধু তাত্ত্বিকভাবেই সম্ভব কোনোদিন বাস্তবসম্মত হবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সম্ভব। অন্তরের অন্তঃস্থলে তিনি তা অনুভব করছেন। ছেঁড়া সুতোগুলো ধীরে ধীরে জোড়া লাগছে। যদিও পুরো প্যাটার্নটা তার কাছে এখনো পরিস্কার হয়নি এবং তিনি নিশ্চিত যে স্যাক্রাটোরিয়ামে অনেকগুলো ধাঁধার অন্তত একটার জবাব তিনি পাবেন।

তাহলে আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে, ইডিয়ট, যেন বিপদে পড়লে তোমাকে বের করে আনতে পারি।

মেয়েরা ভিতরে ঢুকতে পারে না।

আমি যে মেয়ে সেটা কীভাবে বুঝবে। এই ধূসর কার্টলেট দেখেই তো। এটার নিচে আমার বুক তুমি দেখছ। স্কিন ক্যাপ দিয়ে আমার লম্বা চুল ঢাকা পড়ে গেছে। পুরুষদের মতোই আমার মুখও প্রসাধনহীন। এখানকার পুরুষদের দাড়ি গোফ নেই। আমার শুধু দরকার একটা সাদা কাটল আর লাল স্যাশ। তাহলেই ঢুকতে আর কোনো সমস্যা হবে না। যেকোনো সিস্টারই এভাবে ঢুকতে পারত যদি না সামাজিক নিষেধাজ্ঞা অন্ধের মতো মেনে চলত। আমি কোনো সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ নই।

তুমি আমার নিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ। আমি তোমাকে এই ভয়ংকর বিপজ্জনক কাজ করতে দেব না কোনো অবস্থাতেই।

তোমার বিপদের চেয়ে বেশি না।

কিন্তু আমাকে ঝুঁকি নিতেই হবে।

তাহলে আমাকেও নিতে হবে। তোমার কাজ আমার কাজের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে কেন?

কারণ, চিন্তা করার জন্য থামলেন সেলডন।

কারণটা নিজেকেই শুনিও, দৃঢ় পাথুরে গলায় বলল ডর্স। আমাকে ছাড়া তুমি ওখানে যেতে পারবে না। যদি সেইরকম চেষ্টা করো ঘুষি মেরে তোমাকে অজ্ঞান করে হাত পা বেঁধে ফেলে রাখব। ব্যাপারটা তোমার পছন্দ না হলে ওখানে একা যাওয়ার পক্ষে ভালো কোনো যুক্তি দেখাও।

মুখ কালো করে মেনে নিলেন সেলডন। অন্তত এবারের মতো।

.

৫৫.

মেঘহীন আকাশের রং ফ্যাকাশে নীল, যেন চাদরের মতো কুয়াশা মুড়ে রেখেছে। শুভ লক্ষণ ধরে নিলেন সেলডন, কিন্তু হঠাৎ করেই নিখাদ সূর্যের আলো গায়ে মাখার ভীষণ একটা ইচ্ছা হলো তার। ট্র্যান্টরের কেউই গ্রহের আসল সূর্য দেখেনি যদি না সে কখনো আপারসাইডে যায় এবং সেই সময় যদি আকাশে মেঘ না থাকে।

ট্র্যান্টরের স্থানীয় বাসিন্দারা কী কখনো সূর্যের অভাব বোধ করে? ওরা কী কখনো এটা নিয়ে ভাবে? তাদের কেউ যদি কখনো অন্য গ্রহে বেড়াতে যায় যেখানে আসল সূর্য সবসময় আকাশে দেখা যায়, তখন কী তারা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ প্রায় অন্ধ করে ফেলে?

কেন, ভাবলেন তিনি অধিকাংশ মানুষ প্রশ্নের জবাব না খুঁজেই জীবনটা কাটিয়ে দেয়–এমনকি প্রশ্নটা কী হতে পারে তাও ভাবে না? জটিল সব প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়ানোর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে জীবনে?

গ্রাউন্ড লেভেলে দৃষ্টি নামিয়ে আনলেন তিনি। প্রশস্ত রাস্তার দুপাশে সারি সারি নিচু ভবন, বেশিরভাগই দোকান। অসংখ্য ব্যক্তিগত গ্রাউন্ড-কার রাস্তার দুদিকেই চলাচল করছে। জিনিসগুলোকে দেখে মনে হয় অ্যান্টিকস, কিন্তু সেগুলো চলে বিদ্যুতের সাহায্যে এবং শব্দহীন। অ্যান্টিকস শুনে সবসময়ই নাক কুঁচকানো ঠিক নয়, ভাবলেন সেলডন। এটাও তো হতে পারে যে ধীরে চলছে বলেই কোনো শব্দ হচ্ছে না? জীবনে কী আসলে তাড়াহুড়ার কিছু আছে?

ফুটপাথে প্রচুর শিশু দেখা গেল এবং সেলডন বিরক্তিতে মুখ বাঁকালেন। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে মাইকোজেনিয়ানদের বেঁচে থাকার মেয়াদ অস্বাভাবিক দীর্ঘ নয়। তা হলে এত শিশু দেখা যেত না। ছেলে এবং মেয়ে দু লিঙ্গের (যদিও বলা কঠিন কোনটা ছেলে কোনটা মেয়ে শিশুই চোখে পড়ল। তাদের কার্টল হাঁটুর মাত্র কয়েক ইঞ্চি নিচে নেমেছে। ফলে শৈশবের দুরন্তপনা করে বেড়াতে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না।

বাচ্চাদের সবার মাথাতেই চুল আছে তবে দৈর্ঘ্য এক ইঞ্চির বেশি হবে না। তারপরও এদের মধ্যে যারা বয়সে খানিকটা বড়ো তাদের কার্টলের সাথে হুড লাগানো। হুড দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। যেন তারা যথেষ্ট বড়ো হয়ে গেছে, এখন চুল দেখানোটা অশোভন।

হঠাৎ একটা চিন্তা ঢুকল সেলডনের মাথায়। জিজ্ঞেস করলেন, ডর্স, তুমি যখন কেনাকাটা করেছ তখন দাম দিয়েছে কে?

আমি দিয়েছি। রেইনড্রপদের ক্রেডিট টাইল নেই। তাছাড়া যা কিনেছি সে তো আমার জন্য। ওরা দাম দেবে কেন?

কিন্তু তোমার কাছে তো ট্র্যান্টরিয়ান ক্রেডিট টাইল–যা ট্রাইবস পিওপিলরা ব্যবহার করে।

নিশ্চয়ই, হ্যারি, কিন্তু কোনো সমস্যা হয়নি। মাইকোজেনিয়ানরা নিজেদের খেয়াল খুশি মতো চলতে পারে, কিছু আসে যায় না। তারা তাদের স্বাভাবিক চুল। ধ্বংস করে ফেলতে পারে। কার্টল পরতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রেডিট নিতে তারা বাধ্য। যদি না নেয় তাহলে ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে এবং কোনো সচেতন মানুষই তা করবে না। ক্রেডিট হচ্ছে সবকিছুর মেরুদণ্ড, হ্যারি, এবং সে এমনভাবে হাত তুলল যেন একটা অদৃশ্য ক্রেডিট ধরে রেখেছে।

ওরা তোমার ক্রেডিট টাইল নিয়েছে?

কোনো উচ্চবাচ্য করেই। এবং আমার স্কিনক্যাপ নিয়েও কথা তুলেনি। ক্রেডিট দেখেই সব ভুলে গিয়েছে।

ভালো। তাহলে আমিও কিছু কিনতে-

না, কেনাকাটার কাজটা আমি করব। হয়তো ক্রেডিট সবকিছু ভুলিয়ে দেয় কিন্তু ওরা একজন ট্রাইবসওম্যানের কথা আরো দ্রুত ভুলে যাবে। মেয়েদেরকে মানুষ বলে গণ্য না করার ব্যাপারে ওরা এত বেশি অভ্যস্ত যে আমার সাথেও ঠিক একইরকম ব্যবহার করবে।–ঐ যে, ঐ দোকানটা থেকেই আমি কাপড় কিনেছিলাম।

ঠিক আছে, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। আমার জন্য চমৎকার একটা স্যাশ নিয়ে আসবে।

ভান করো না যে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা তুমি ভুলে গেছ। দুটো কিনব আমি। এবং আরেকটা সাদা কার্টল–আমার মাপের।

একজন মেয়ে সাদা কার্টল কিনছে এটা দেখে ওরা অবাক হবে না?

মোটেই না। ধরে নেবে যে পুরুষ সঙ্গীর জন্য কিনছি। সত্যি কথা বলতে কী যতক্ষণ ক্রেডিট আছে ততক্ষণ আর অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামাবে না।

অপেক্ষা করছেন সেলডন, মনে খানিকটা আশা কেউ একজন এগিয়ে এসে তাকে ট্রাইবসম্যান বলে চিনতে পারবে, তার সাথে কথা বলবে। সেইরকম কিছু হলো না। সবাই নিরাসক্ত ভঙ্গিতে যার যার গন্তব্যে চলেছে। তিনি বেশি ভয় পাচ্ছেন ধূসর কার্টল–মেয়েদের ব্যাপারে। মেয়েগুলো যেন থেকেও নেই, একেবারে অস্তিত্বহীন। জোড়া বেঁধে বা কোনো পুরুষের সাথে হাঁটছে। তাকে দেখে চিৎকার করে উঠলে অন্তত একবারের জন্য হলেও নিজেদের অস্তিত্বটাকে জানান দিতে পারত। কিন্তু মেয়েরাও তাকে খেয়াল করল না।

আসলে ভাবলেন সেলডন, ওরা কোনো ট্রাইবসম্যানকে দেখার আশা করছে না, তাই চোখে পড়ছে না।

এটা হয়তো তাদের আসন্ন স্যাক্রাটোরিয়াম অভিযানে সহায়ক হবে। ওরা একজন ট্রাইবসম্যানকে স্যাক্রাটোরিয়ামের ভিতরে দেখার কথা মোটেও ভাববে না। তাই ধরা পড়ার সম্ভাবনাও কমবে।

ডর্স যখন ফিরে এলো তখন তিনি যথেষ্ট খোশমেজাজে।

পেয়েছ সব?

হ্যাঁ।

তাহলে রুমে চলো। তুমি কাপড় পালটে নিতে পারবে।

সাদা কার্টটা ডর্সের গায়ে ধূসর কার্টলের মতো ফিট হলো না। দোকানে সে পড়ে দেখেনি, তাহলে হয়তো দোকানদার বুঝে ফেলত।

কেমন দেখাচ্ছে, হ্যারি? জিজ্ঞেস করল সে।

ছোট বালকের মতো। সেলডন বললেন। এবার স্যাশ… নাকি ওবিয়াহ্ বলব পড়ে দেখি। মাইকোজেনিয়ানদের মতো বলার অভ্যাস করা উচিত।

এখন পড়ার দরকার নেই। ওটা পরে বেরুলে লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।

না, না। আমি শুধু কীভাবে পড়তে হয় সেটা দেখতে চাইছি।

ঠিক আছে। ওটা না। এটা অনেক বেশি সুন্দর।

ঠিকই করেছ, ডর্স। আমার দিকে ওদের মনোযোগ আকৃষ্ট হোক আপত্তি নেই। কিন্তু আমি চাই না ওরা তোমাকে মেয়েমানুষ বলে চিনে ফেলুক।

একসাথে দুজন ওবিয়াহ্ পরার অনুশীলন শুরু করল। করেই চলল যতক্ষণ পর্যন্ত না তাতে মাইকোজেনিয়ানদের মতো অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপর দুজন দুজনকে খুঁটিয়ে দেখল কোথাও কোনো ত্রুটি আছে কী না।

এবার, বললেন সেলডন। ওবিয়াহ্ ভাঁজ করে রাখলাম ভিতরের পকেটে। এই পকেটে রাখলাম আমার ক্রেডিট টাইল–আসলে হামিনের–আর এই ঘরের চাবি। অন্য পকেটটাতে পবিত্র গ্রন্থ।

পবিত্র গ্রন্থ। ওটাও তুমি সাথে নেবে নাকি?

অবশ্যই। আমার ধারণা স্যাক্রাটোরিয়ামে সবাই বইটা পড়বে। প্রয়োজন হলে তুমি আর আমি একসাথে পড়ব। কেউ খেয়াল করবে না, প্রস্তুত।

পুরোপুরি প্রস্তুত কখনোই হতে পারব না, তবে আমি তোমার সাথে যাব।

বিপজ্জনক অভিযান। তুমি আমার স্কিনক্যাপ পরীক্ষা করে দেখে বলো কোথাও চুল বেরিয়ে আছে কি না। আর তুমি মাথা চুলকাবে না।

চুলকাবো না। সব ঠিক আছে।

তোমারও সব ঠিক আছে।

তোমাকে নার্ভাস দেখাচ্ছে।

 এবং সেলডন ক্লান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, অনুমান করো, কেন?

হ্যারির হাতে হাত বুলালো ডর্স তারপর যেন নিজের আচরণে অবাক হয়ে হাতটা ফিরিয়ে নিল। চোখ নামিয়ে কার্টলের ভাঁজ ঠিক করতে লাগল। হ্যারি নিজেও অবাক হয়েছেন সেই সাথে খুশি। গলা পরিস্কার করে বললেন, চলো, যাওয়া যাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *