মধুচক্র – গৌড়জনে যাহে …
‘এসে গেছি। ভেবে দেখো ব্যাপারখানা, ওরা আমার নাম দিয়েছিলো মি হোন্ট! ঢাকঢোল না-পিটিয়ে যদি আসতে পারো, তা হলে চলে এসো। আমি এসে গেছি, এখনো সেটা লোকেদের জানতে দিতে চাইনে।’ ১৮৫৬ সালের দোসরা ফেব্রুআরি, শনিবার সকাল বেলায় বিশপস কলেজে পৌছে মাইকেল এই চিঠিটি লিখেছিলেন গৌরদাসের কাছে।
এই চিঠি পড়ে দুটো ব্যাপারে খটকা লাগে। তিনি তাঁর আগমনের কথা গোপন রাখতে চান কেন — বোঝা যায় না। তা ছাড়া, এ চিঠি লেখা খুব হাল্কা চালে। যে-মানুষটি মাত্র পাঁচ দিন আগে তাঁর সুখের সংসার তছনছ করে চলে এসেছেন, বিশেষ করে ফেলে এসেছেন এক গণ্ডা কচি বাচ্চাকে, তার অমন হালকা হবার কথা নয়। অবশ্য হতে পারে তখনো হেনরিয়েটার সঙ্গে তাঁর প্রণয়ের কথা প্রকাশ পায়নি অথবা রেবেকার সঙ্গে বিচ্ছেদ দেখা দেয়নি। কিন্তু কবি মাদ্রাস ত্যাগ করার অনতিকাল পরেই রেবেকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয় – এমন আভাস পাওয়া যায়। এবং তারপর রেবেকার সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার উদ্যোগও শুরু হয়। কবি মাদ্রাস ত্যাগের সাড়ে তিন মাস পরে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু চার্লস এগব্যর্ট কেনেট তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় আসেন।১ তাঁর এই আগমনের কারণ জানা নেই। কিন্তু অসম্ভব নয় যে, তাঁর কলকাতা সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো রেবেকা এবং মাইকেলের মধ্যে দৌত্য করা। এ ব্যাপারে তাঁর খানিকটা নৈতিক দায়িত্বও ছিলো। মাইকেল কলকাতার একটি প্রতিষ্ঠিত পরিবারের পুত্র – বিয়ের আগে তিনি কি সে সাক্ষ্য দেননি? এখন কার্যত বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় তিনি আপোশের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেছেন। তবে তথ্যের অভাবে চূড়ান্ত কোনো রায় দেওয়া শক্ত। কবি যে কলকাতায় আসার মাস খানেকের মধ্যে গৌরদাসের মধ্যস্থায় চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করেন – তা থেকেও মনে হয়, ততোদিনে সম্পত্তির জন্যে নয়, পারিবারিক কারণেই তিনি স্থায়ীভাবে কলকাতায় থাকার পরিকল্পনা করেন। কারণ গোড়াতে তিনি সম্পত্তি উদ্ধারের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না। তিনি এসেছিলেন নিতান্ত গৌরদাসের প্রেরণায়। তিনি মনে করেছিলেন, তাঁকে দেখে সম্পত্তি ভোগ দখলকারী আত্মীয়রা পালিয়ে যাবেন। মামলা করতে হবে অথবা তার জন্যে এতো সময় লাগবে, এটা ভাবতে পারেননি।
কলকাতায় থাকার খরচ চালানোর জন্যে তিনি তেমন টাকাপয়সা আনতে পারেননি। গৌরদাস তাঁর স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন যে, মধু যখন কলকাতায় ফেরেন, তখন তাঁর কাছে একটি পয়সাও ছিলো না।২এই উক্তির মধ্যে অতিরঞ্জন ছিলো। যেমন অতিরঞ্জন ছিলো, তিনি কলকাতায় এসেই গৌরদাসের কাছে ছুটে যান — এই উক্তিতে। কারণ আগের চিঠিতেই দেখতে পাচ্ছি, তিনি কলকাতায় এসে বিশপস কলেজে উঠেছিলেন এবং সেখান থেকে গৌরদাসকে চিঠি লিখেছিলেন। সে যাই হোক, ক দিনের মধ্যেই তাঁর পকেট গড়ের মাঠ। ধার চাইলেন বন্ধুর কাছে। গৌরদাসের কাছ থেকে টাকা পেয়ে তিনি যে-চিঠি লেখেন, তার তারিখ ১৭ ফেব্রুআরি – অর্থাৎ কলকাতায় আসার ঠিক পনেরো দিন পরে। গৌরদাস ধার দিয়েছিলেন মাত্র ৫০ টাকা, কিন্তু তিনি ধন্যবাদ দিলেন ‘এক হাজার’।৩ এ থেকে তাঁর অভাবেব মাত্রা খানিকটা আঁচ করা যায়। কিন্তু এই টাকা ফুরোনোর আগেই তিনি সম্ভবত একটা চাকরির চেষ্টা শুরু করেছিলেন। তাঁর একটা গতি করার জন্যে গৌরদাস এসময়ে তাঁর বাড়িতে কিশোরীচাঁদ মিত্র এবং দিগম্বর মিত্রকে ভোজনের নিমন্ত্রণ জানান। সেখানে তিনি মধুকে একটা চাকরি জোগাড় করে দেবার জন্যে এঁদের অনুরোধ করেন। কবি তখন গৌরদাসের বাড়িতে বাস করছিলেন। বন্ধুরা ভাবেন, সম্পত্তি উদ্ধারের জন্যে অনেক দিন কলকাতায় থাকতে হবে বলে তাঁর চাকরির প্রযোজন। কিন্তু কবি জানতেন, সম্পত্তি নয়, সংসারের কারণেই তাঁকে অতঃপর স্থায়ীভাবে কলকাতায় থাকতে হবে। যা ঘটেছিলো, তারপর তাঁর আর মাদ্রাসে যাবার মুখ ছিলো না।
কলকাতায় প্রতিযোগিতা মাদ্রাসের তুলনায় অনেক বেশি – জর্জ নর্টন তাঁকে সে কথা এক সময়ে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। যে-দুটি কাজে তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলো – শিক্ষকতা এবং সাংবাদিকতা – তার কোনোটাই তিনি পাননি। কোনো পত্রিকায় চাকরি জোটাতে চেষ্টা করেছিলেন কিনা, তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু হুগলি নর্মাল স্কুলের হেডমাস্টারের পদের জন্যে তিনি চেষ্টা করেছিলেন। আর এর জন্যে তাঁকে লিখিত পরীক্ষাও দিতে হয়েছিলো। পরীক্ষায় তিনি হেরে যান। চাকরিটি পান তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভূদেব মুখোপাধ্যায়।৪ ভূদেব খুব ভালো ছাত্র ছিলেন, মাইকেল তাঁর নানা গুণের সঙ্গে পরিচিতও ছিলেন। তা ছাড়া, বাল্যবন্ধু হিশেবে কবি তাঁকে আন্তরিকভাবে ভালোওবাসতেন। কিন্তু তিনি কি তাঁকে তাঁর নিজের মতো প্রতিভাবান মনে করতেন? কাজেই ভূদেব চাকরি পাওয়ায়, তিনি হতাশ হয়ে থাকবেন। তারপরে আর কোথাও শিক্ষকতা জোটানোর চেষ্টা করেছেন বলে জানা যায় না। চাকরি পেয়ে ভূদেব কাজে যোগদান করেন ২২ জুন।৫ সুতরাং এপ্রিল-মে মাসে এই পরীক্ষা হয়ে থাকবে। অরফ্যান অ্যাসাইলাম এবং মাদ্রাস স্কুলে তিনি যেভাবে চাকরি করেছিলেন, তাতে মনে হয় মাইকেল ভালো শিক্ষক ছিলেন। তদুপরি মাদ্রাস স্কুলে তিনি অন্তত সাড়ে তিন বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। হিন্দু কলেজ এবং বিশপস কলেজে তাঁর উচ্চশিক্ষা লাভ এবং মাদ্রাসে সাত-আট বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা দিয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজেও তাঁর পক্ষে চাকরি পাওয়া অসম্ভব ছিলো না। কিন্তু অজ্ঞাত কোনো কারণে তিনি কোথাও একটা ভদ্র-গোছের মাস্টারি জোটাতে পারেননি। পত্রিকা সম্পাদনায় তাঁর যে-দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিলো, কলকাতায় তা-ও কোনো কাজে লাগেনি।
শেষ পর্যন্ত, চাকরি পেলেন একবারে অপ্রত্যাশিত একটা জায়গায় — পুলিশ কোর্টে। পরে দেখা যাবে, সম্ভবত এই কাজের সূত্র ধরেই তিনি নিজের অধঃপতন ডেকে এনেছিলেন। এ সময়ে একটা ডেপুটিগিরি জোটাতে চেষ্টা করেছিলেন কিনা, জানা নেই। তবে যখনকার কথা বলছি, গৌরদাস তখন চাকরি করলেও ডেপুটির কাজ পাননি। তা পেয়েছিলেন আরও দু বছর পরে। সে যাই হোক, পুলিশ কোর্টে চাকরি পেতে সাহায্য করেছিলেন এই কোর্টেরই জুনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট, এক কালে হিন্দু কলেজের সহপাঠী, কিশোরীচাঁদ মিত্র। কিশোরীচাঁদ হিন্দু কলেজে মাইকেলের চেয়ে বছর দুয়েকের বড়ো ছিলেন। কিন্তু ভালো ছাত্র হিশেবে উভয়ের মধ্যে পরিচয় ছিলো বলে মনে হয়। কিশোরীচাঁদ এখন চীফ ম্যাজিস্ট্রেট জি এফ ককবার্নের কাছে সুপারিশ করে মাইকেলের বিপদের দিনে বন্ধুকৃত্য করলেন। জুলাই মাসে কবি কেবল কিশোরীচাঁদের কোর্টে সহায়ক কর্মচারীর কাজ নিলেন না, থাকতে আরম্ভ করলেন দমদমে, কিশোরীচাঁদের বাড়িতে। তাঁর স্ত্রী কৈলাসবাসিনী তাঁর বাল্যবয়সে খিদিরপুরে তাঁকে কাছ থেকে দেখেছিলেন।
মাইকেল প্রথম যে-চাকরিটি পেলেন, তাতে বেতন ছিলো খুব কম। এটি ছিলো সম্ভবত দোভাষীর কাজ। তবে অচিরে পুরোনো একজন কর্মচারী, মি. টাকার অন্যত্র বদলি হওয়ায়, তিনি জুডিশিয়াল ক্লার্কের চাকরি পান। বেতন এক শো পঁচিশ টাকা।৬ মাদ্রাসে তিনি যে-আয় করছিলেন, তার তুলনায় এ বেতন খুব খারাপ ছিলো না। বছর দুয়েক পরে নিজেই বলেছেন: ‘ডালভাতের জন্যে যথেষ্ট।’৭ কিন্তু তখন পুলিশ কোর্ট এবং অন্য কোর্টগুলোতে যেসব বাঙালি চাকরি করতেন, তাঁদের কারো কারো তুলনায় এ আয় ছিলো নিতান্তই কম। স্বয়ং কিশোরীচাঁদের বেতন ছিলো ৮০০ টাকা। স্মল কোর্টের বিচারক হরচন্দ্র রায়ের বেতন ১০০০ টাকা। কোর্টের দোভাষী শ্যামাচরণ সরকারের ৬০০ টাকা। সুপ্রিম কোর্টের কেরানি কৃষ্ণচন্দ্র ব্যানার্জির ২৬০ টাকা। স্মল কোর্টের গিরিশচন্দ্র দত্তের বেতন ২০০ টাকা আর রামকানাই সেনের ১৫০ টাকা। এমন কি, মাইকেল যে-কোর্টে চাকরি পেলেন, সেই কোর্টে একই সঙ্গে কাজ করতেন প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ, তাঁরও বেতন ১২৫ টাকা।৮ কবি হয়তো ভাবেন: মুড়ি-মুড়কির একই দর! ধারণা করি, নিজের সঙ্গে যখনই তুলনা করেছেন, তিনি কেবল নিজের আয় কম বলে যন্ত্রণা পাননি, বরং ‘অযোগ্য, অর্ধশিক্ষিত’ সহকর্মীদের তুলনায় তিনি অনেক কম পাচ্ছেন, এ চিন্তা করে আরো বেশি করে কষ্ট পেয়েছেন। কিশোরীচাঁদ মিত্র। এই চিন্তা থেকে তিনি এক সময়ে আইন অধ্যয়ন করে নিজের আয় বাড়ানোর সংকল্প নিয়েছেন। কিন্তু সে আলোচনায় আমরা পরে আসবো।
কিছুকাল ১ নম্বর দমদম রোডে কিশোরীচাঁদের বাড়িতে অতিথি হিশেবে থাকার পর, তিনি অন্যত্র চলে যান। ঠিক কবে থেকে তাঁর নিজের সংসার সাজিয়ে বসেন, বলা যাচ্ছে না। তবে, আমার বিশ্বাস, অগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে। কারণ কিশোরীচাঁদের স্ত্রী কৈলাসবাসিনী দেবীর আত্মকথা থেকে জানতে পাই যে, শ্রাবণ মাসে কিশোরীচাঁদ লিভারের অসুখে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্যে কৈলাসবাসিনী তাঁর স্বামীর বোতল-সঙ্গীদের স্বাভাবিকভাবেই দোষারোপ করতেন।৯ এঁদের মধ্যে মাইকেল ছিলেন অন্যতম। আর তিনি যেহেতু একই বাড়িতে বাস করতেন, সে জন্যে, তাঁকে যদি কৈলাসবাসিনী একটু বেশি করে দোষারোপ করে থাকেন, তা হলে অবাক হবার কারণ নেই। তাই মোটামুটি এ সময়েই তিনি নিজের বাড়িতে চলে যান বলে মনেকরা সঙ্গত। তবে কোথায় বলা যাচ্ছে না। তাঁর জীবনীকারদের মতে, তিনি এ সময়ে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন ৬ নম্বর লোয়ার চিৎপুর রোডে।১০ এটা ঠিক নয়। কারণ ১৮৫৬ সালের শেষ অবধি এই বাড়িতে ভাড়াটে হিশেবে অন্য লোকের নাম দেখতে পাই বেঙ্গল ডায়রেক্টরিতে। ১১ পরের বছর তিনি এ বাড়িতে গিয়ে থাকবেন।
কিশোরীচাঁদ মিত্র
কিশোরীচাঁদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেও, যাকে সত্যিকার গুছিয়ে বসা বলে, তা তিনি করতে পারেননি। লেখাপড়ায় তাঁর আগ্রহ ছিলো আগাগোড়া। ছাত্রজীবনের শেষে মাদ্রাসে যখন আপাত-দৃষ্টিতে লেখাপড়ার কোনো দরকার ছিলো না, তখনো তাঁকে আমরা কখনো কখনো দিনের মধ্যে বারো ঘণ্টা ভাষা-সাহিত্য অধ্যয়ন করতে দেখেছি। কলকাতায় ফিরে এ সময়ে তিনি তাঁর সেই অভ্যাস কতোটা বজায় রেখেছিলেন, এখন আর তা জানার উপায় নেই। কিন্তু মাদ্রাসে এক সময়ে পরিতৃপ্ত প্রেমের আনন্দে তাঁর মধ্যে সৃষ্টিশীলতার যে-বান ডেকেছিলো, সে ধারা এ সময়ে একেবারে শুকিয়ে গিয়েছিলো। গোটা ১৮৫৬ সালে তিনি কিছু লেখেননি। ১৮৫০ সাল থেকে তাঁর যে-বন্ধ্যা সময় শুরু হয়েছিলো, তখনো জের চলছিলো তারই। কিশোরীচাঁদের বাড়িতে থাকার সময়ে এক দিন — ১৮৫৬ সালের ২০ জুলাই — খেলার ছলে একটি ছড়া লিখেছিলেন কল্পিত ম্যাথনিয়াকে নিয়ে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই।
মাদ্রাসে তিনি নিজের পরিবারকে লণ্ডভণ্ড করে এসেছিলেন। সে জন্যে, কলকাতায় ফেরার পরও দীর্ঘদিন নিজের মনটাকে শান্ত করে কাব্যচর্চার মতো অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারেননি। রেবেকার বিরুদ্ধে মনটাকে বিষিয়ে তুলে একটা সান্ত্বনা পেতে হয়তো চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আদরের সন্তানগুলোকে ভোলা অতো সহজ ছিলো না। তদুপরি, নতুন প্রণয়িনীর বিরহ এবং দুশ্চিন্তাও তাঁকে বিষন্ন করে থাকবে। জ্ঞাতিদের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়েও এ সময়ে মামলা মকদ্দমা আরম্ভ হয়। গৌরদাস লিখেছেন যে, মধু কলকাতা ফেরার পরেই খিদিরপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিলো আত্মীয়দের জানিয়ে দেওয়া যে, তিনি ফিরে এসেছেন। খিদিরপুরের বাড়িতে গিয়ে তিনি তাঁর অসহায় তরুণী বিমাতাকে দেখে নাকি খুব বিচলিত বোধ করেছিলেন।১২ সম্পত্তির লোভে তাঁর আত্মীয়রা রাজনারায়ণ দত্ত মারা যাবার পরে, মৃত্যুর খবরটা পর্যন্ত তাঁকে জানাননি। তাঁরা বরং সবাইকে বলতেন। যে, মধু মারা গেছেন। এই বাড়ি নিয়ে আত্মীয়রা মামলা এবং পাল্টা-মামলা করায়, কাকতালীয় যোগাযোগবশত সেটা তদন্ত করার দায়িত্ব পড়েছিলো গৌরদাসের ওপর। বিষয়টা তদন্ত করার সময়ে গৌরদাস সেখানে গিয়ে শুনতে পান, মধু মারা গেছেন। এমন কি, খিদিরপুরে মধুর প্রতিবেশী রঙ্গলাল এবং গণেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ও এটাই বিশ্বাস করতেন। এই পরিবেশে গৌরদাস মরিয়া হয়ে মধুর কাছ চিঠি লিখেছিলেন। ১৩ আশা করেছিলেন, যদি বন্ধু বেঁচে থাকেন, তা হলে তিনি এ চিঠি পাবেন। কলকাতায় এসে কবি যখন খিদিরপুরে গিয়েছিলেন, তখন তিনি আশা করেছিলেন যে, তাঁকে দেখে তাঁর আত্মীয়রা অর্থহীন মনে করে মামলা-মকদ্দমা প্রত্যাহার করবেন। কিন্তু তাঁরা উৎসাহ হারাননি। বরং শেষ পর্যন্ত লড়েছিলেন। মিথ্যে উইল দেখিয়ে তাঁরা মামলায় জয়ী হবেন বলে আশা করেছিলেন। ১৮৪৯ সালে ধর্মান্তর এবং পৈতৃক সম্পত্তি সংক্রান্ত যে-আইন (৪ আইন নামে পরিচিত) প্রণীত হয়েছিলো, এই মামলা তা প্রয়োগের একটা দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। এই মামলা নিয়ে তিনি কম বিব্রত হননি। প্রাত্যহিক জীবনের নানা সমস্যা নিয়েও তিনি এ সময়ে সুস্থির ছিলেন না।
ওদিকে, তিনি কলকাতায় বাসা বাঁধার পর দেশে দু-তিনটি খুব আলোড়নকারী ঘটনা ঘটেছিলো। ২৫ জুলাই (১৮৫৬) প্রণীত হয়েছিলো বিধবাবিবাহ আইন – যে-আইনের সপক্ষে আগের ডিসেম্বর মাসে তিনি Madras Spectator পত্রিকায় ওকালতি করেছিলেন। (এ আইন প্রণয়নে হিন্দু কলেজে তাঁর অন্যতম পরীক্ষক মি গ্র্যান্ট বিশেষ সাহায্য করেছিলেন।) আইন গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনো বিধবার বিয়ে হয়নি। প্রতিটি বিয়ের জন্যে এক হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন – এ কথা ঘোষণা করেছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। ১৪ তবু সহজে কাউকে এ বিয়েতে রাজি করানো সম্ভব হয়নি। তা সত্ত্বেও রক্ষণশীল সমাজ এর বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন করেছিলো। আইন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে দেখে বিদ্যাসাগর এবং তাঁর বন্ধুরা বিধবাবিবাহের দৃষ্টান্ত স্থাপন করার একটা বড়ো রকমের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার ফলে সে বছর ডিসেম্বর মাসে রক্ষণশীলদের প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে ঘটা করে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো প্রথম বিধবাবিবাহ। এই ঘটনা সে-যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এতো গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে, রাজনারায়ণ বসু এ দিনের স্মৃতিচারণ করে লিখেছিলেন: ‘সেদিন কলিকাতার লোক এমন চমকিত হইয়াছিল যে, যুগ উল্টানোর ন্যায় কি একটি ভয়ানক ঘটনা হইতেছে।’১৫ উদারপন্থী শিক্ষিত ভদ্রলোকরা যে উল্লসিত হয়েছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। যখন আইন পাশ হয়, তখন মাইকেল থাকতেন কিশোরীচাঁদ মিত্রের বাড়িতে। সেদিন কিশোরীচাঁদ মিত্ৰ তাঁর ডাইরিতে যা লিখেছিলেন, তা থেকে খানিকটা আভাস পাওয়া যায়, কবির সঙ্গে তিনি কী ধরনের আলোচনা করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন: ‘আজকের দিন আমার দেশের ইতিহাসে নতুন যুগের প্রারম্ভ বলে গণ্য হবে।’১৬
আইন প্রণীত হবার পর, যিনি প্রথম বিধবাবিবাহ করেন, সেই শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ছিলেন সংস্কৃত কলেজের এক সময়কার ছাত্র এবং শিক্ষক। তাঁকে কলেজের অধ্যক্ষ এবং এ আন্দোলনের সবচেয়ে প্রধান নেতা বিদ্যাসাগর প্রভাবিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এ বিয়ে করার এক বছর পরে শ্রীশচন্দ্র ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন। কেউ কেউ অনুমান করেছেন যে, এ বিয়েতে রাজি হবার পেছনে তাঁর আর্থিক লোভ থাকা সম্ভব।১৭ কিন্তু তা সত্ত্বেও, সেই রক্ষণশীল সমাজে এ বিয়ে ছিলো একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। কবির বন্ধু রাজনারায়ণ বসুর দুই জেঠতুতো ভাই — দুর্গানারায়ণ এবং মদনমোহন বসু তৃতীয় এবং চতুর্থ বিধবাবিবাহের নজির স্থাপন করেন (ফেব্রুআরি ১৮৫৭) এবং এ ব্যাপারে রাজনারায়ণ তাঁদের উৎসাহিত এবং সাহায্য করেন। সত্যি বলতে কি, মাইকেলের বন্ধু অথবা বন্ধুস্থানীয় যাঁরা, তাঁরা প্রায় সবাই বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। একজন প্রগতিশীল মানুষ হিশেবে তিনিও এই আন্দোলন দিয়ে প্রভাবিত না-হয়ে পারেননি।
বিধবাবিবাহের হৈচৈ বন্ধ হতে না-হতে ১৮৫৭ সালের মে মাসে আরম্ভ হয় সিপাহী বিপ্লব। বঙ্গদেশে এই বিপ্লব বিশেষ সমর্থন পায়নি, বিশেষ করে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা অনেকে একে বিবেচনা করেছিলেন একটা উপদ্রব হিশেবে। ১৮ রাজনারায়ণ বসু সিপাহী বিপ্লবের মাত্র ৮ বছরের মধ্যে জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে মেদিনীপুরে জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা স্থাপন করেছিলেন। ১৯ নবগোপাল মিত্রের National Paper-এ শিক্ষিতদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ উদ্বুদ্ধ করার জন্যে তিনি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তা ছাড়া, কয়েক বছরের মধ্যে তিনি হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে একটি কট্টর জাতীয়তাবাদী বক্তৃতাও দিয়েছিলেন।২০ কিন্তু সেই রাজনারায়ণ বসুই ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবকে কোন দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, আত্মচরিতে তিনি তাঁর সকৌতুক কিন্তু আন্তরিক পরিচয় দিয়েছেন। ইংরেজ রাজত্ব স্থাপনের ফলে বাঙালি বর্ণহিন্দুরা জমিদারি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে যে-স্থিতিশীল মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে তুলেছিলেন, রাজনারায়ণ থেকে আরম্ভ করে স্বয়ং মাইকেল পর্যন্ত সবাই ছিলেন তার ফসল। সুতরাং বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা সেই কায়েমি ব্যবস্থার মধ্যে অব্যবস্থা নিয়ে আসার জন্যে সিপাহী বিপ্লবকে স্বাগত জানাতে তৈরি ছিলেন না।
যে-মাইকেল মাত্র তিন বছর আগে The Anglo-Saxon and the Hindu লিখেছিলেন এবং যিনি ইংরেজদের মনে করতেন ক্ষয়িষ্ণু ভারতবর্ষের ত্রাতা হিশেবে – তিনি এই বিপ্লবকে কী চোখে দেখেছিলেন, তা জানার জন্যে কৌতূহল না-হয়ে পারে না। ইংরেজদের তাড়িয়ে দিয়ে ভারতবর্ষে আবার মোগলদের অথবা দেশীয় কোনো রাজার শাসন চালু করার ধারণাকে তিনি যে মনে মনে সমর্থন করতে পারেননি, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। তবে সাধারণ শিক্ষিত বাঙালিরা সিপাহী বিপ্লব-বিরোধী যে-মনোভাব পোষণ করতেন, তাঁর ধারণা অতো সরল ছিলো বলে মনে হয় না। ইংরেজি সভ্যতা এবং ইংরেজ কর্তাদের তিনি একই দৃষ্টিতে দেখতেন না। উদার এবং যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রবর্তক এবং শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের স্রষ্টা এবং উত্তরাধিকারী হিশেবে তিনি ইংরেজি সভ্যতার একান্ত ভক্ত ছিলেন। তা না-হলে তিনি The Anglo-Saxon and the Hindu লিখতে পারতেন না। বস্তুত, এই বক্তৃতায় তাঁর ইংরেজি সভ্যতা-প্রীতি প্রায় অন্ধতার পর্যায়ে পড়ে। যে-জাতি শেকসপীয়রের মতো কবি-নাট্যকার, মিন্টনের মতো ধ্রুপদী কবি এবং বায়রন আর ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো রোম্যান্টিক কবির জন্ম দিযেছে, তিনি কি সে জাতির অবিমিশ্র প্রশংসা না-করে পারেন?
অপর পক্ষে, ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ সব সময়ে যে মধুর হয়েছে, তা নয়। জেমস ক্যরের মতো শিক্ষক তিনি ছাত্রজীবনে পেয়েছিলেন। বিশপস কলেজে দেশীয়, ফিরিঙ্গি এবং ইংরেজদের মধ্যে ভেদাভেদ ছিলো – কলেজের কাগজপত্র থেকে তার প্রমাণ পেয়েছি। তাঁর কোনো কোনো জীবনীকার কৃষ্ণমোহনের স্মৃতিচারণের ওপর নির্ভর করে বলেছেন যে, এই কলেজে তাঁর কিছু বর্ণবাদী অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।২১ এ সময়ে মিশনারি হিশেবে কাজ করতে চাইলে তাঁকে একাধিকবার বলা হয়েছিলো যে, তিনি পাবেন বিদেশীদের চেয়ে কম বেতন। কিন্তু তাঁর সত্যিকার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিলো মাদ্রাসে – এ প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ধরনের প্রথম অভিজ্ঞতা হয় রেবেকাকে তিনি যখন বিয়ে করতে চান। রেবেকার ষোলো আনা সম্মতি সত্ত্বেও, রেবেকার পরিচিত এবং বন্ধুরা অনেকে এ বিয়েতে প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন। তিনি যখন একাধিক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক হিশেবে মাদ্রাসে বেশ প্রতিপত্তির সঙ্গে লেখালেখি করছিলেন, তখনো তিনি বিরোধিতার সম্মুখীন হন। সহযোগী এক পত্রিকা-সম্পাদক তাঁর এ সময়ে নাম দিয়েছিলো Mr Dirt। ২২ একবার তিনি ভারতবর্ষের কথা আলোচনা করার সময়ে শ্রীলঙ্কাকে ভারতবর্ষের অংশ বলে বর্ণনা করেন। এই ন্যায্য বর্ণনাকে Spectator তীব্র ব্যঙ্গ করে।২৩ মাইকেলের পক্ষে তখন এগিয়ে আসেন Atheneum পত্রিকার সম্পাদক। ২৪ এ রকমের ঘটনা কতো ঘটেছিলো, তখনকার কাগজপত্রের নথি না-থাকায় সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। অথবা Mr Dirt নাম দেবার পেছনে কতোটা তিক্ততা কাজ করেছিলো, তার ব্যাপ্তি অথবা গভীরতার কথাও এখন কেবল অনুমান করতে পারি। মাদ্রাস স্কুলে চাকরি করতে যাবার সময়ে তিনি পত্রিকার কাজ চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কর্তাব্যক্তিরা তাতে অনুমতি দেননি। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও, মাদ্রাস স্কুলে তিনি ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ পাননি। এ ঘটনাকেও তাকে তাঁর পক্ষে বর্ণবাদের ঘটনা বলে চিহ্নিত করা অসম্ভব নয়। এমন কি, সেখানে তিনি খাঁটি ইংরেজ শিক্ষকদের সমান বেতনও পাননি।
সর্বোপরি, ইংরেজ রাজত্বের ঔপনিবেশিক চরিত্রও তাঁর কাছে অস্পষ্ট ছিলো না। মাদ্রাসে থাকার সময়ে তিনি মুসলিম এবং ইংরেজ শাসনামলের মধ্যে তুলনা করে মুসলিম আমলের চেয়ে ইংরেজ আমলের শোষণের বেশি নিন্দা করেছিলেন। তা ছাড়া, পরবর্তী আলোচনা থেকে দেখা যাবে, ভারতবর্ষের পরাধীনতার জন্যেও তাঁর মনে কম ক্ষোভ ছিলো না। মোট কথা, ইংরেজদের অবিমিশ্র প্রীতির চোখে, প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখার মতো মনোভাব তাঁর ছিলো না। সে জন্যে, সিপাহী বিপ্লবের প্রতি তাঁর মনোভাব কেমন ছিলো, তা এক কথায় বলা যায় না।
সিপাহী বিপ্লব উপলক্ষে দেশে যে-সংঘাত শুরু হয়েছিলো, তা পুরোপুরি শান্ত হবার আগেই আবার আরম্ভ হয় নীলকরদের অত্যাচার উপলক্ষে নতুন আন্দোলন। তখনকার বাঙলি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ অনেকাংশে গড়ে উঠেছিলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফল হিশেবে এবং ভদ্রলোকদের অস্তিত্ব অনেকটা নির্ভরশীল ছিলো কৃষকদের শোষণের ওপর। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভদ্রলোকদের মধ্যে কৃষকদের অথবা গ্রামের অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা একেবারে ছিলো না, তা নয়। তা না হলে হরিশচন্দ্র মুখার্জি অমন প্রবলভাবে হিন্দু পেট্রিয়টের পাতায় নীলকরদের অত্যাচারের কথা লিখতে পারতেন না। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মতো জমিদার-পরিচালিত একটি ধর্মীয় পত্রিকায় নীলকর এবং জমিদারদের অত্যাচারের জীবন্ত বর্ণনা প্রকাশিত হতে পারতো না। অথবা দীনবন্ধু মিত্রও নীলদর্পণ লিখতে পারতেন না। ‘সাহেব’ মাইকেলও বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ-র মতো প্রহসন লিখতে পেরেছিলেন এই সচেতনতা ছিলো বলেই। চা-বাগানের শ্রমিক থেকে আরম্ভ করে সমাজের নিচের তলার অনেক লোককে নিয়ে পরবর্তী দু দশকে অনেকগুলো প্রহসন রচিত হয়েছিলো — সেও এই সচেতনতারই পরিচায়ক। বস্তুত, এ ছিলো সমাজ-সংস্কার আন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
মাদ্রাসে যিনি প্রতিটি চলতি ঘটনার খবর রাখতেন এবং সে সম্পর্কে নিজের মতামত প্রকাশ করতেন পত্রিকার পাতায়, তিনি কলকাতায় এসে এসব ঘটনার প্রতি সামগ্রিকভাবে কী ধরনের সাড়া দিতেন, স্বভাবতই তা জানতে ইচ্ছে করে। এবং এসব ক্ষেত্রে তথ্যের অপ্রতুলতা আমাদের পীড়া দেয়। বাড়তি আয়ের জন্যে কলকাতার পত্রপত্রিকায় তিনি এ সময়ে লিখতেন কিনা, সে সম্পর্কেও কিছু বলার জো নেই। কলকাতার পত্রিকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো না। এক সময়ে তিনি মাদ্রাসের মতো জায়গায় পত্রিকার জগতে ডুবে থাকলেও, কলকাতায় ফেরার কিছুকাল পরে কলকাতার পত্রিকাগুলো সম্পর্কে যে-মন্তব্য করেছিলেন, তা থেকে তাঁর মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেছিলেন, কলকাতায় পত্রিকায় থাকে বস্তাপচা আবর্জনা।২৫
কলকাতায় ফিরে আসার পর তাঁর অন্তরে প্রবল বাত্যা দেখা দিয়েছিলো এবং বাইরে সমাজেও সংবর্ত সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু তাই বলে সময় দাঁড়িয়ে থাকেনি। দেখতে দেখতে দু বছর কেটে যায়। এবং এই বহমান সময় একটা শক্তিশালী ভেষজের মতো কাজ করে তাঁর অজ্ঞাতেই তাঁর সব দুঃখবেদনা অনেকাংশে ভুলিয়ে দিয়েছিলো। ধীরে ধীরে তার প্রভাবে তিনি তাঁর ব্যক্তিজীবনের শোচনীয় ট্র্যাজিডি কাটিয়ে উঠছিলেন। লেখার জন্যে মনও তৈরি হচ্ছিলো। সে রকম সময়ে-কলকাতায় আসার আড়াই বছর পরে — হঠাৎ তাঁর সুপ্ত সাহিত্যপ্রতিভা আবার জেগে উঠলো একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে। নাটক রচনার অথবা তার অভিনয়ের কোনো ঐতিহ্য তখনো বাঙালি সমাজে তৈরি হয়নি। ১৮৫২-৫৩ সাল থেকে আরম্ভ করে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত যে-কটি নাটক প্রকাশিত হয়, সেগুলি সঙ্গে সঙ্গে অভিনীত হয়নি। তারপর ১৮৫৮ সালে কৌলীন্য এবং বিধবাবিবাহের মতো জীবন্ত এবং বিতর্কিত সমস্যা নিয়ে লেখা দুটি নাটকের অভিনয় তখনকার কলকাতার সমাজে হঠাৎ একটা উৎসাহের জন্ম দেয়। সেই সঙ্গে পৌরাণিক নাটকও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে আরম্ভ করে। এ বছরের মার্চ মাসে প্রথমে জয়রাম বসাকের বাড়িতে কুলীনকুলসর্বস্ব এবং তারপর আশুতোষ দেবের বাড়িতে শকুন্তলার অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য এবং মঞ্চের নতুন ইতিহাস তৈরি হয়। ২৬ কয়েক জন ধনী নাট্যামোদী এতে যে-ভূমিকা পালন করেন, তা অভিনয় এবং নাটক রচনায় খুবই প্রেরণা দিয়েছিলো। এই প্রসঙ্গে কালীপ্রসন্ন সিংহ, পাইকপাড়ার দুই জমিদার-ভ্রাতা প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ এবং যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পরোক্ষভাবে এঁরা মাইকেলের অবরুদ্ধ প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়েছিলেন।
প্রতাপচন্দ্র এবং ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ বেলগাছিয়া নাট্যশালা স্থাপন করে রত্নাবলী নাটকের অভিনয় করান ১৮৫৮ সালের জুলাই মাসে। তাঁরা ঠিক করেছিলেন এই নাটকের তৃতীয় অভিনয়ের জন্যে বাংলার গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক হ্যালিডেসহ ইংরেজ কর্মকর্তা এবং অবাঙালি দর্শকদের নিমন্ত্রণ করবেন। কিন্তু এই দর্শকরা যেহেতু বাংলা নাটকের সংলাপ বুঝতে পারবেন না, সে জন্যে তাঁরা এই নাটকটি পুরো ইংরেজিতে অনুবাদ করানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা যখন এই অনুবাদ করার জন্যে একজন সত্যিকার যোগ্য লোক খুঁজছিলেন, তখন গৌরদাস বসাক মাইকেলের নাম প্রস্তাব করেন। গৌরদাসের সঙ্গে রাজাদের এমনি পরিচয় ছাড়াও, যোগাযোগের একটা কারণ এই যে, তিনি ছিলেন রাজাদের বেলগাছিয়া নাট্য সমাজের সদস্য। কবির ইংরেজি জ্ঞান সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ ছিলো না। তদুপরি, The Captive Ladie প্রকাশ এবং মাদ্রাসে একাধিক পত্রিকা সম্পাদনাব মাধ্যমে তিনি ইংরেজি ভাষা এবং সাহিত্যে পারদর্শিতার নির্ভুল প্রমাণ দিয়েছিলেন। রাজারা বরং সন্দেহ করেছিলেন তাঁর বাংলা জ্ঞান সম্পর্কে। কিন্তু গৌরদাসের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর তাঁরা এ কাজ তাঁকে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। অনুবাদ করার দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয় সম্ভবত জুন মাসে।
জেদ মাইকেলের চরিত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি রত্নাবলীর অনুবাদ করতে সমর্থ কিনা, এ নিয়ে রাজারা এবং তাঁদের পারিষদবর্গ সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। সেটাই তাঁর জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিলো। একারণে তিনি রত্নাবলীর অনুবাদ শুরু করেন খুব গুরুত্বের সঙ্গে। গৌরদাসকে এ সময়ে যে-দুটি চিঠি লেখেন, তা থেকে মনে হয়, তাঁর নিজের আত্মবিশ্বাস তখন তেমন জোরালো ছিলো না। ২৭ প্রথম দুই অঙ্কের অনুবাদ পাঠিয়ে দিয়ে তিনি তাই গৌরদাসকে তা খুব যত্নের সঙ্গে পড়ে দেখতে বলেন। আর সেই সঙ্গে অনুরোধ জানান পরামর্শ দেবার জন্যে। গৌরদাসের সাহিত্য-জ্ঞান যে খুব গভীর নয়, তা তিনি জানতেন; সে জন্যেই বলেছেন: ‘তোমার ইংরেজি নাট্যসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় কতোটা ঘনিষ্ঠ, তা আমার জানা নেই। কিন্তু অনুবাদ করতে গিয়ে আমি খাঁটি স্যাক্সন ইংরেজিতে লিখতে চেষ্টা করেছি, কারণ এটা হলো সর্বোত্তম নাটকগুলোর ভাষা।’২৮
সর্বোত্তম ভাষায় তিনি যে-নাটকের অনুবাদ করছিলেন, সে নাটক যে সত্যিকার উঁচু মানের নাটক নয়, এটা অবশ্য তিনি লক্ষ্য করেছিলেন। সে জন্যে, রামনারায়ণের রচনার মানের কথা মনে রেখে লিখেছেন: ‘মূলই নিম্নমানের, আমি করবো কী!!’ তিনি খুব ভালো করে বুঝেছিলেন, তিনি যেমনটা অনুবাদ করেছেন ঐ নাটকের ওর চেয়ে ভালো অনুবাদ আশা করা ঠিক নয়। তবে তিনি তাঁর নিজের অনুবাদ সম্পর্কে যাই মনে করেন না কেন, দেশী-বিদেশী যাঁরা রত্নাবলীর অনুবাদ দেখেছিলেন, সবাই এবভাষার খুব প্রশংসা করেছিলেন। যোগীন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন যে, Bengal Hurkaru-র সম্পাদক এই নাটকের অভিনয় দেখে লিখেছিলেন, ‘ইংরেজি ভাষায় কোনো বাঙালির এমন দখল আছে, তা তাঁর জানা ছিলো না। এমন কি, কলকাতায় যে-ইংরেজরা আছেন, তাঁদেরও অনেকে এমন ভাষায় লিখতে পারলে শ্লাঘা বোধ করবেন।’২৯ এই অনুবাদ অক্টোবর মাসের আগেই কোনো এক সময়ে প্রকাশিত হয়েছিলো।
রত্নাবলী অনুবাদ করতে গিয়ে কবির একাধিক লাভ হয়েছিলো। প্রথম লাভ: অনুবাদের জন্যে পাঁচ শো টাকা পারিশ্রমিক। তিনি তাঁর চাকরিজীবনে এর আগে এতো টাকা কখনো একত্রে হাতে পাননি। ভারী খুশি হলেন। তা ছাড়া, নতুন সংসার পাততে যে-ব্যয় হয়েছিলো, তার ধকলও সামলে উঠলেন। কিন্তু এই অব্যবহিত লাভের চেয়ে অনেক বেশি লাভ হলো অন্যত্র। রত্নাবলীর মহড়া দেখে তিনি খুব হতাশ হয়েছিলেন। ‘অলীক কুনাট্যরঙ্গে মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে, নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়!’৩০ কিন্তু এই হতাশা সত্ত্বেও, তিনি মহড়ায় নিয়মিত যেতেন। গৌরদাস বেলগাছিয়া থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনিও যেতেন সেখানে। তাঁকে জুলাই মাসের গোড়ার দিকে একদিন মধু বললেন: ‘রাজারা এতো বাজে একটা নাটকের জন্যে এতো টাকা খরচ করছেন! আহা, আমি যদি আগে জানতাম! তা হলে, আমি তোমাদের থিয়েটারের জন্যে যোগ্য একটা নাটক দিতে পারতাম।’ মধুর এ কথা শুনে গৌরদাস হেসে ফেলেন। তাঁকে খানিকটা ঠাট্টাও করেন। ‘তুমি কি চাও, আমরা বিদ্যাসুন্দরের মতো আর-একটা নাটকের অভিনয় করি?’৩১ গৌরদাস নিশ্চয় জানতেন মাইকেলের রুচি আর বিদ্যাসুন্দরের রুচি এক রকমের নয়। তিনি আসলে যা বলতে চেয়েছিলেন, তা হলো:তাঁর বন্ধু বাংলায় কিছু লিখতে পারবেন, এটা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। বা লিখলেও তা কিছু হবে না।
রত্নাবলীর অনুবাদ করতে পারবেন কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে রাজারা যেমন মাইকেলের জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, বাংলা নাটক লিখতে পারবেন কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে গৌরদাস একই কাজ করেছিলেন। বস্তুত, মাইকেলকে উস্কে দেবার জন্যে এই খোঁচাটুকুই যথেষ্ট ছিলো। পরের দিন সকালে তিনি যান এশিয়াটিক সোসাইটিতে। সেখানে কাজ করতেন গৌরদাসের এক জ্ঞাতি ভাই। তাঁর কাছ থেকে তিনি কয়েকখানি বাংলা আর সংস্কৃত বই, বিশেষ করে নাট্যরচনা, নিয়ে এলেন। তারপর সপ্তাহখানেকের মধ্যে একদিন গৌরদাসকে তিনি একটি নাটকের প্রথম কয়েকটি দৃশ্য পড়ে শোনালেন।৩২
পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ দেখেই গৌরদাস স্বীকার করলেন: হ্যাঁ, খাঁটি নাটকই বটে! তিনি বন্ধুর কীর্তি দেখে বিস্মিত এবং আনন্দিত হয়েছিলেন। তক্ষুণি সেই দৃশ্য কটি নিয়ে তিনি বেলগাছিয়ায় যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু কবি তাঁকে থামিয়ে দিলেন। তাঁকে লিখে জানালেন: ‘আগে শেষ করি প্রথম অঙ্ক। তারপর যেয়ো।’ গৌরদাস পাণ্ডুলিপি দেখাতে পারলেন না। কিন্তু তাই বলে নিজের উচ্ছাসও চেপে রাখতে পারলেন না। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের কাছে বললেন, মধুর কীর্তির কথা। যতীন্দ্রমোহন মধুকে চিনতেন না; কিন্তু The Captive Ladie পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সে জন্যে ১৬ জুলাই (১৮৫৮) গৌরদাসকে লিখলেন: ‘আপনার বন্ধুর পাণ্ডুলিপি পড়ার জন্যে আমি উদ্গ্রীব হয়ে আছি। যিনি একটি বিদেশী ভাষায় অমন চমৎকার লিখতে পারেন, তিনি যে নিজের ভাষায় অবদান রাখতে পারবেন, সে বিষয়ে আমার সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আপনার বন্ধু যদি যে-কোনোদিন আমার বাগানবাড়িতে আসেন, তা হলে আমি সম্মানিত বোধ করবো।’৩৩
বন্ধুদের এই পাণ্ডুলিপি দেখানোর জন্যে গৌরদাস কবিকে চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু কবির মনে তখনো নিজের বাংলা লেখার মান সম্পর্কে খানিকটা সংশয় থেকে গিয়েছিলো। সে কারণে তিনি তাঁর সংলাপে কোনো ব্যাকরণের ভুল থাকলে, তা সংশোধন করার জন্যে রামনারায়ণ তর্করত্নকে দিয়েছিলেন। রত্নাবলীর মহড়া দেখতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কবির পরিচয় হয়েছিলো। কিন্তু রামনারায়ণের সংশোধন দেখে তিনি খুব হতাশ হলেন। তক্ষুণি ঠিক করে ফেললেন, তাঁর সাহায্য নেবেন না। ‘নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবো, নয়তো ডুবে যাবো। … সাহিত্যের দরবারে আমি অন্যের ধার করা পোশাক পরে দাঁড়াতে চাইনে। আমি একটা টাই হয়তো নিতে পারি, একটা ওয়েস্ট কোটও নেওয়া সম্ভব; কিন্তু গোটা স্যুট নয়। …দুয়েক জায়গায় একটা-আধটা পরিবর্তন করতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু আমার বাক্যগুলোকে আমি ঢেলে সাজাবো? ছ্যা, তার চেয়ে আমি বরং ওটা পুড়িয়ে ফেলবো।’ আসলে, সংস্কৃত-পণ্ডিত রামনারায়ণ অনেক জায়গায় কবির বাক্যগুলো নিজের মতো করে লিখেছিলেন। সেটা স্বাধীন চিন্তা এবং নিজের স্টাইলে বিশ্বাসী মাইকেলের পছন্দ হয়নি। তিনি চেয়েছিলেন, ব্যাকরণের ভুল থাকেলে রামনারায়ণ কেবল সেগুলো শোধরাবেন, অন্য কিছু নয়। বিশেষ করে রামনারায়ণ তাঁর নায়িকা শর্মিষ্ঠার সংলাপ যেভাবে বদল করেছিলেন, সেটা তাঁর খুব খারাপ লাগলো: ‘আমার বেচারী শর্মিষ্ঠাকে দিয়ে রামনারায়ণ জঘন্য গদ্যে কথা বলিয়েছেন।’ তা ছাড়া, ‘একজনের স্টাইলের মধ্য দিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্বকে চোখে পড়ে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের বন্ধু আর আমার মধ্যে সামান্যই মিল রয়েছে।’ অবশ্য বিরক্ত হলেও রামনারায়ণের কিছু পরামর্শ তিনি মেনে নেবার সিদ্ধান্ত নেন। আর তাঁর সম্পর্কে নিজের এই মন্তব্যকেও তিনি গোপন রাখতে চান। গৌরদাসকে তাই লিখেছেন: ‘তোমার বন্ধুদের সঙ্গে এ নাটক সম্পর্কে কোনো কথা হলে দয়া করে রামনারায়ণের বিষয়ে কিছু বোলো না।’৩৪ কবি হয়তো তাঁর প্রতি প্রকাশ্যে অশ্রদ্ধা দেখাতে চাননি অথবা ভেবেছেন, তাঁর ভাষার সমালোচনা করলে লোকের কাছে নিজেরই হাস্যকর হতে হবে। মোট কথা, বাংলায় এ তাঁর প্রথম রচনা, সুতরাং একটু মাজাঘষা না-করে তিনি এ নাটক কাউকে দেখাতে চান না। ‘এমন অসম্পূর্ণ অবস্থায় পাণ্ডুলিপি দেখানোর কথাটা আমার ভালো লাগছে না। কিন্তু এসপ্তাহের শেষেই তোমাকে প্রথম তিন অঙ্ক দিতে পারবো।’৩৫
রামনারায়ণ তর্করত্ন
কবি জানতেন, নাটক জিনিশটা দেশী মাল নয়। বিশেষ করে তিনি লেখার সময়ে বিদেশী নাটকের আঙ্গিক এবং ভাবের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। রামনারায়ণ তর্করত্ন। অলীক কুনাট্য দিয়ে যাঁদের রুচি গড়ে উঠেছে, তাঁদের সেটা ভালো নাও লাগতে পারে। নিজেকে তাই সান্ত্বনা দিলেন:
ভাবনাগুলো যদি যথাযথ এবং উজ্জ্বল হয়, পুট যদি কৌতূহলোদ্দীপক হয়, আর চরিত্রগুলো যদি ঠিকমতো অঙ্কিত হয়, তাহলে বিদেশী আবহাওয়া আছে কি নেই, কে তার ধার ধারে? মূরেব কবিতায় প্রাচ্যের উপাদান, বায়রনের কবিতায় এশিয়ার ভাবধারা, কার্লাইলের রচনায় জার্মানবাদ দেখে কেউ কি তার নিন্দা করে! তা ছাড়া, আমি তো লিখছি আমার দেশের সেই লোকেদের জন্যে, পাশ্চাত্য ভাবধারায় যাঁদের মন লালিত হয়েছে। … ঘাবড়ে যেয়ো না, গৌর, যাঁরা মোটে ইংরেজি জানেন না, এমন কয়েক জনকেও আমি দ্বিতীয় অঙ্কটা দেখিয়েছি এবং তাঁরা যে-ভাষায় এ নাটকের প্রশংসা করেছেন, তাতে মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়েছে, এরা বোধ হয় আমাকে তোশামোদ করছেন। …দুশ্চিন্তা কোরো না দোস্তু্, আমি এমন একটা নাটক লিখবো, যা দেখে ঐ বুড়ো হতচ্ছাড়া পণ্ডিতগুলো থ হয়ে যাবে।
এই রচনা সম্পর্কে তাঁর আত্মবিশ্বাস ততোক্ষণে অনেকটা বেড়ে গেছে। তাই লিখলেন: ‘যতীন্দ্র বাবু আর রাজাদের দেখলে তুড়ি দিয়ে তুমি তাঁদের উড়িয়ে দিয়ো – ওভাবেই বাজারে একটা জিনিশের দাম বাড়াতে হয়।’ ৩৬
The Captive Ladie লিখেছিলেন তিন সপ্তাহের মধ্যে। শর্মিষ্ঠা লিখতেও তার চেয়ে খুব বেশি সময় লাগলো না। সৃষ্টির নেশা যখন তাঁর ওপর ভর করতো, তখন তিনি ধীরে-সুস্থে লিখতে পারতেন না। যা কিছু লেখার ঝড়ের গতিতেই লিখতেন। বছর দেড়েক পরে নিজেই কেশব গাঙ্গুলিকে জানিয়েছিলেন: ‘ধীমা তাল আমার তাল নয়, যা লিখবো ঝটপট লিখে ফেলবো।’৩৭ তোয়াক্কা না-করার ভাব দেখিয়ে শর্মিষ্ঠার দাম বাড়াতে হয়নি, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মাইকেল মেজে-ঘষে যখন তাঁর পাণ্ডুলিপি রাজাদের কাছে পাঠালেন, রাজারা তখন তা পড়ে মুগ্ধ না-হয়ে পারলেন না। এই নাটকের আঙ্গিক এবং ভাবধারায় যে-পাশ্চাত্য প্রভাব ছিলো, তা দেখে প্রাচীনপন্থী পণ্ডিতরা এর সমালোচনা করতে কুণ্ঠিত হননি। ৩৮ বস্তুত, এটা নাটক হয়নি – তাঁদের কেউ কেউ এমন কথাও বলেছিলেন। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত নব্যশিক্ষিত ব্যক্তিরা এই নাটকের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। তাঁরা স্বীকার করলেন যে, এমন একটি নাটকও বাংলা ভাষায় লেখা হয়নি। তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে জোরদার হলো রাজা-ভ্রাতাদের এবং যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের স্বীকৃতি। কারণ নাটক মঞ্চস্থ করা এবং প্রকাশ করার ব্যাপারে সরাসরি পৃষ্ঠপোষণা এলো তাঁদের কাছ থেকে। সত্যি বলতে কি, পরে দেখতে পাবো, তহবিল দিয়ে তাঁরা কবির রচনাবলীর ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
মাইকেল শর্মিষ্ঠার কাহিনী নিয়েছিলেন মহাভারত্বে আদিপর্ব থেকে। বিশেষ করে এ কাহিনী তিনি কেন বেছে নিলেন, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে তার উত্তর খোঁজার জন্যে খুব দূরে যাবার দরকার নেই। নাট্যকারের নিজের জীবনে এই নাটকের দৃশ্যগুলো আগেই অভিনীত হয়ে গিয়েছিলো। কবির নিজের জীবনের সঙ্গে শর্মিষ্ঠার অসাধারণ মিল চোখে না-পড়ে পারে না। যযাতি মানুষ হলেও, তিনি যে-দুই নারীর প্রেমে পড়ে তাঁদের বিয়ে করেন, তাঁদের একজন দৈত্যরাজের কন্যা, অন্যজন দৈত্যগুরুর কন্যা। মাইকেল নেটিভ হলেও, তিনি যে-নারীদের প্রেমে পড়েছিলেন, তাঁরা কেউই নেটিভ নন। যযাতির সঙ্গে দেবযানী ও শর্মিষ্ঠার যেমন ‘নৃতাত্ত্বিক’ পার্থক্য রয়েছে, তেমনি মাইকেলের সঙ্গে রয়েছে রেবেকা ও হেনরিয়েটার নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য। নাটকে শর্মিষ্ঠার কাহিনী এ রকম:
রাজা যযাতি যখন শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করেন, তখন পূর্ব শর্ত অনুযায়ী অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা দেবযানীর পরিচারিকা হয়ে যযাতির ঘরে আসেন। সেখানে যযাতি শর্মিষ্ঠার রূপলাবণ্য দেখে অচিরে তাঁর প্রেমে পড়ে তাঁকে গোপনে গান্ধর্বমতে বিয়ে করেন। তাঁর ঘরে যযাতির তিন পুত্র জন্মে। তারপর একদিন রাজা যখন দেবযানীর হাত ধরে বেড়াতে বেড়াতে শর্মিষ্ঠার বাড়ির কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন শর্মিষ্ঠার সন্তানরা এসে রাজাকে সংবর্ধনা জানায় এবং প্রশ্ন করে রাজা কেন, তাদের মা নন, এমন এক মহিলার হাত ধরে যাচ্ছেন।
নাটকে রাজার প্রেম এবং দ্বিতীয় বিবাহের খবর এভাবে প্রকাশ পায় দেবযানীর কাছে:
রাজা। কি আর বলবো ভাই! এবারে সর্ব্বনাশ উপস্থিত; এত দিনের পর রাণী আমার প্রেয়সী শর্মিষ্ঠার বিষয় সকলই অবগত হয়েছেন।
বিদূ। বলেন কি মহারাজ? তা এ যে অনিষ্ট ঘটনা, তার কোন সন্দেহ নাই; ভাল, রাজমহিষী কি প্রকারে এ সকল বিষয় জানতে পারলেন?
রাজা। সখে, সে কথা কেন জিজ্ঞাসা কর? বিধাতা বিমুখ হলে, লোকের আর দুঃখের সীমা থাকে না। মহিষী অদ্য সায়ংকালে অনেক যত্নপূর্বক তাঁর পরিচারিকাদের উদ্যানে ভ্রমণ করতে আমাকে আহ্বান করেছিলেন; আমিও তাতে অস্বীকার হতে পারলেম না। সুতরাং আমরা উভয়ে তথায় ভ্রমণ করতে করতে প্রেয়সী শর্মিষ্ঠার গৃহের নিকটবর্তী হলেম। ভাই হে, কালে আমার অন্তঃকরণ কি যে প্রকারে উদ্বিগ্ন হলো, তা বলা দুষ্কর।
বিদূ। বয়স্য! তার পরে?
রাজা। আমাকে দেখে প্রিয়তমা প্রেয়সী শর্মিষ্ঠার তিনটি পুত্র তাদেব বাল্যক্রীড়া পরিত্যাগ করে প্রফুল্লবদনে উর্ধ্বশ্বাসে আমার নিকটে এলো এবং রাজমহিষীকে আমার সহিত দেখে চিত্রার্পিতের ন্যায় স্তব্ধ হযে দণ্ডায়মান রইলো।
বিদূ। কি দুর্ব্বিপাক! তার পরে?
রাজা। রাজ্ঞী তাদের স্তব্ধ দেখে মৃদুস্বরে বললেন, বৎসগণ, তোমরা কিছুমাত্র শঙ্কা করো না। এই কথা শুনে সর্বকনিষ্ঠ পুরু, সক্রোধে স্বীয় কোমল বাহু আস্ফালন করে বল্লে, আমরা কাকেও শঙ্কা করি না, তুমি কে? তুমি যে আমাদের পিতার হাত ধরেছ? তুমি ত আমাদের জননী নও, তিনি হলে আমাদের কত আদর কত্যেন।
*
রাজমহিষী তৎকালে আমাকে আর প্রিয়তমা শর্মিষ্ঠাকে যে কত অপমান, কত ভৎসনা বলেন, তার আর সীমা নাই।
কবি মাদ্রাস থেকে গৌরদাসকে যখন লিখেছিলেন, চমৎকার স্ত্রী এবং চার সন্তান নিয়ে তিনি বেশ সুখে আছেন, তার ৩৯ দিন পরে তিনি সেই চমৎকার স্ত্রী এবং সন্তানদের ফেলে চিরতরে বিদায় নিতে বাধ্য হন। খুব সম্ভব হেনরিযেটার সঙ্গে তাঁর প্রণয়ের খবর আবিষ্কার হবার ফলেই তাঁর সংসার নাটকীয়ভাবে ভেঙ্গে গিয়েছিলো। দেবযানীর মতো বেবেকাও যদি এমনি আকস্মিকভাবেই হেনরিযেটার সঙ্গে কবির গোপন প্রেমের কথা জেনে থাকেন, তা হলে আশ্চর্য হবার কারণ নেই। এমন কি, এই গোপন কথা প্রকাশের ব্যাপারে তাঁর কোনো সন্তানের ভূমিকা থাকাও একেবারে অসম্ভব নয়।
নাটকে দেখতে পাই, রাজার সঙ্গে শর্মিষ্ঠার গোপন সম্পর্কের কথা জানাজানি হবার পরে, দেবযানী রাজাকে ত্যাগ করে পিতার কাছে চলে যান। নাটকের শেষে এসে শুক্রাচার্যের মধ্যস্থতায় রাজা দেবযানী এবং শর্মিষ্ঠার মধ্যে আপোশ করে দুই স্ত্রীকে নিয়ে ঘর করার একটা জোড়াতালি দেওয়া সমাধান বের করছেন।
রাজ্ঞী। (শর্মিষ্ঠাকে) সে যা হৌক, সখি, অদ্যাবধি আমাদের পূর্ব্বপ্রণয় সঞ্জীবিত হলো। এখন এসো, দুই জনেই পতিসেবায় কিছুদিন সুখে যাপনক রি। (রাজার প্রতি) মহারাজ, এক বিশাল তরুবর, মালতী আর মাধবী উভয় লতিকার আশ্রয়স্থল হলো।
রাজা। (প্রফুল্লমুখে উভয়কে উভয় পার্শ্বে বসাইয়া) অদ্য এক বৃন্তে যুগল পারিজাত প্রস্ফুটিত।
নাটকে যেমন সমাধানই দেখান না কেন, বাস্তব জীবনে মাইকেল কোনো সমাধান খুঁজে পাননি। তবে ১৮৫৮ সালের মাঝামাঝিও তাঁর তেমন চেষ্টা অব্যাহত ছিলো কিনা কে জানে? তিনি যখন শর্মিষ্ঠা রচনা করেন, হেনরিয়েটা তখনও কলকাতায় আসেননি। সে জন্যে তিনি কি তখনও রেবেকা আর হেনরিয়েটার মধ্যে আপোশ করে রেবেকার সঙ্গে সংসার করার কথা ভেবেছেন কিনা, তা বোঝা যায় না। তবে নাটকে দুই সতীনের মধ্যে আপোশ করানো এবং তাদের নিয়ে ঘর করানো সম্ভব হলেও বাস্তব জীবনে সেটা অনেক শক্ত। তাই দেখতে পাই, তিনি আর মাদ্রাসে ফিরে যেতে পারেননি। বরং মাদ্রাস থেকে এর অল্প পরেই হেনরিয়েটা এসে তাঁর জীবনসঙ্গিনী হয়েছেন।
১৮৪৮ সালের শেষ ভাগ থেকে ১৮৪৯ সালের শেষ দিক পর্যন্ত বছর খানেকের জন্যে তাঁর মধ্যে যে সৃজনশীলতার জোয়ার এসেছিলো, ঠিক দশ বছর পরে তার পুনরাবৃত্তি আরম্ভ হয় এ সময়ে। মাদ্রাসে তখন নতুন বিয়ে করা বৌ-এর সঙ্গে প্রেমে, তৃপ্তিতে তিনি উচ্ছসিত। ১৮৫৮ সালের শেষ দিকেও সে রকমের একটা সময় এলো। এবারে রেবেকা নন, তাঁর ঘরে হেনরিয়েটা। এ বছরের একেবারে শেষ দিকে হেনরিয়েটা কলকাতায় আসেন। জাহাজের যাত্রীদের তালিকা থেকে তাঁর নাম অবশ্য আমি বের করতে পারিনি। অবিবাহিত অবস্থায় তিনি মাইকেলের আহ্বানে কলকাতায় আসছিলেন পিতার বিনা অনুমতিতে।৩৯ রেবেকার বন্ধুদেরও তিনি নিশ্চয় জানাতে চাননি। সুতরাং তাঁর পক্ষে ছদ্মনামে আসা সম্ভব। তা ছাড়া, পুরুষপ্রধান সমাজের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে তখন যাত্রীদের তালিকায় অনেক সময়ে মেয়েদের নাম লেখা হতো না। কেবল লেখা থাকতো ‘এতোজন মহিলা এবং এতে জন শিশু।’ সুতরাং হেনরিয়েটার কলকাতা আগমনের নির্দিষ্ট তারিখ বলা সম্ভব নয়। তবে কবি তাঁর চিঠিতে হেনরিয়েটার কথা প্রথম বারের মতো উল্লেখ করেন পরের বছর — ১৮৫৯ সালের ৯ জানুআরি। এই চিঠির ভাষা থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, ‘মিসেস ডাট’ সদ্য এসেছেন। ‘তোমার চিঠি এবং আমাদের ব্যাপারে তুমি যে-আগ্রহ দেখিয়েছো, তার জন্যে মিসেস ডাট তাঁর আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তোমার চিঠিটা এসেছে গতকাল। তুমি আমাদের উভয়ের শ্রদ্ধা জেনো।’ ৪০ হেনরিয়েটা অনেক দিন আগে এলে এ পর্যায়ে আর ‘আমাদের ব্যাপারে তুমি যে-আগ্রহ দেখিযেছো’ –এই আগ্রহ দেখানোর প্রশ্ন উঠতো না।
তাঁর প্রথম সন্তান হবার তারিখ থেকেও হেনরিয়েটা কখন কলকাতায় আসেন, তার খানিকটা আঁচ করা যায়। এই সন্তান – শর্মিষ্ঠার জন্ম হয় ১৮৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। কলকাতায় আসার আট বছরের মধ্যে হেনরিয়েটার নিয়মিত বিরতিতে মোট চারটি সন্তান হয়েছিলো। সেভাবে বিবেচনা করলে, তিনি কলকাতায় আসার এক বছরের মধ্যেই প্রথম সন্তান হওয়া স্বাভাবিক। সে হিশেবে তিনি কলকাতায় আসেন ১৮৫৮ সালের সেপ্টেম্বরের পরে।
শর্মিষ্ঠার নামপএ
একবার কল্পনার পালে হাওয়া লাগার পর এক সময়ে তিনি যেমন The Captive Ladie-Visions of the past-Upsori-Rizia এবং তাঁর অনামী কাব্যটি (১৮৪৯) লিখেছিলেন নেশাগ্রস্তের মতো, তেমনি মত্ত হলেন, সৃষ্টির আনন্দে। শর্মিষ্ঠা রচনা শেষ হবার পর একটার পর একটা বড়ো কল্পনা তাঁর মাথায় এলো। তিনি, তাঁর ভাষায়, এই পর্বে রক্তের স্বাদ পেয়েছিলেন।৪১ এর পর তিনি আর পেছনে ফিরে তাকাননি। আত্মবিশ্বাসের কোনো সংকটও তাঁর মনকে বিহ্বল করেনি। যদিও মাঝেমধ্যে বন্ধু এবং পৃষ্ঠপোষকদের উৎসাহ এবং কখনো কখনো উৎসাহের অভাব তাঁর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে বৈকি!
মাদ্রাস থেকে এক চিঠিতে তিনি গৌরদাসকে লিখেছিলেন: তাঁর বড়ো কবি হবার পথে তেমন কোনো বাধা তো নেই, কেউ যদি শুধু মাসে মাসে কয়েক শো টাকা ব্যয় করতে রাজি থাকিতেন। রাজা প্রতাপচন্দ্র এবং রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ঠিক তেমন কল্পতরু ছিলেন না। কিন্তু তাঁর মনে হলো, এঁরা সাহিত্যের বেশ পৃষ্ঠপোষণা করতে চান। তাঁরা টাকা ব্যয় করতে রাজি ছিলেন; আবার আধুনিক সাহিত্য বোঝার মতো বিদ্যেও মোটামুটি এঁদের ছিলো। মধুসূদন সহজে বন্ধু হতে পারতেন। রাজাদের সঙ্গেও তাঁর দ্রুত বন্ধুত্ব হলো। রত্বাবলীর অনুবাদ করে বাজাদের কাছ থেকে যে-মোটা টাকা পেয়েছিলেন, তার জন্যেও তিনি রাজাদের কাছে কৃতজ্ঞ হয়েছিলেন। তাই ১৮৫৯ সালের জানুআরি মাসের মাঝামাঝি শর্মিষ্ঠা প্রকাশিত হলে তা উৎসর্গ করলেন রাজ-ভ্রাতাদের নামে।
হেনরিয়েটা: কবি-জীবনের শেষ পনেরো বছরের সুখদুঃখের ভাগিনী
শর্মিষ্ঠা প্রকাশ করে রত্নাবলীর মতো এক থোক টাকা পেলে তিনি নিশ্চয় খুশি হতেন। বিশেষ করে হেনরিয়েটা কলকাতায় আসায় তাঁর খরচ বেড়ে গিয়েছিলো, এমনটা মনে করা সঙ্গত। কিন্তু টাকা তিনি পাননি। বরং মুদ্রণের জন্যে রাজাদের কাছ থেকে যে-ঋণ নিয়েছিলেন, তা শোধ করতে সময় লেগেছে। অবশ্য যা তিনি পেয়েছিলেন, তা টাকার তুলনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ – স্বীকৃতি এবং আত্মবিশ্বাস। বই প্রকাশের কদিন আগেই গৌরদাসকে লিখেছেন: ‘শর্মিষ্ঠা ভারী সুন্দরী মেয়ে হয়েছে — তাকে যাঁরা দেখেছেন তাঁদের কথা যদি আমার বিশ্বাস করতে হয়। যতীন্দ্র ঠাকুর বলেছেন: এ হলো আমাদের ভাষার সবচেয়ে সেরা নাটক। আর ছোটো রাজা তিন সত্যি দিয়ে বলেছেন: এ নাটকটি ষোলো আনা সার্থক হয়েছে।’৪২ সবার কাছ থেকে এ ধরনের উচ্চ প্রশংসা শুনে শুনে তিনি এক সময়ে সত্যি বিশ্বাস করতে আরম্ভ করলেন যে, এই নাটকের মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রায় সর্বশ্রেষ্ঠ লেখকে পরিণত হয়েছেন। ‘এই নাটক আমাকে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী একটা আসন দেবে, তোমাকে এটা না-বললেও চলে। সবাই এর কাব্যগুণ নিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করছেন।’৪৩ ব্যাপারটা অবশ্য তাঁর কাছে অবিশ্বাস্যই ঠেকে। কারণ কিছু দিন আগে পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে তিনি শেখার মতো ভাষা বলেই গণ্য করেননি। বরং এ ভাষা ভুলে যাবার জন্যে চেষ্টা করেছেন প্রাণপণ। যে-ভাষাকে তিনি চরম অযত্ন করেছিলেন, সেই ভাষা যে তাঁকে এতো সৃষ্টির উপকরণ এবং এতো খ্যাতি এনে দিয়েছে – পরবর্তী দু বছর সে কথা তিনি বারবার বলেছেন। কেবল তাই নয়, যথাসময়ে দেখতে পাবো, এ চিন্তা তাঁকে এতোটা আবেগে উদ্দীপ্ত করেছিলো যে, তিনি এ নিয়ে একটি অসাধারণ কবিতাও লিখে ফেলেন। শর্মিষ্ঠা তাঁকে যে-অবিশ্বাস্য খ্যাতি এবং স্বীকৃতি দিয়েছিলো, তা দেখে গৌরদাসের কাছে তিনি অকপটে স্বীকার করেন: ‘তোমাকে যদি মনের কথাটা খুলে বলি, তা হলে বলতে হবে, আমি সত্যি সত্যি কল্পনা করিনি যে, এই একটি নাটকের মধ্য দিয়ে আমি এতো সব করতে পারবো।’ ৪৪ স্বীকৃতি এবং খ্যাতি লাভের মধ্যে কী আনন্দ The Captive Ladie লিখে তিনি তা যেমনটা চেয়েছিলেন, সেভাবে অনুভব করতে পারেননি। এখন শর্মিষ্ঠা তাঁকে সেই আনন্দে উচ্ছসিত হবার সুযোগ দিলো।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলায় লেখার কোনো অভিজ্ঞতা না-থাকা সত্ত্বেও প্রথম রচনায়ই তিনি এতো সফলতা দেখালেন কী করে? কাহিনীর পরিকল্পনা, চরিত্র চিত্রণ এবং সংলাপ রচনায় কোনো রকমের অনুশীলন ছাড়া, সাফল্যের এই চাবিকাঠি তিনি পেলেন কোথায়? এর একটা সহজ উত্তর আছে। আসলে মাদ্রাসে Rizia নাটক লেখার মাধ্যমেই নাটক রচনায় তিনি হাত মক্স করেছিলেন। এ ছাড়া, কাহিনী নির্মাণে তাঁর একটা স্বাভাবিক পটুত্বও ছিলো। হিন্দু কলেজের আমল থেকেই তিনি কবিতার মধ্যেও কাহিনী নিয়ে আসতে আরম্ভ করেছিলেন। এবং আগেই উল্লেখ করেছি, আখ্যানমূলক কবিতায় তাঁর হাত খুলতোও ভালো। The Captive Ladie-তে তিনি আখ্যানকাব্য লেখার ব্যাপারে বড়ো রকমের অনুশীলনের সুযোগ পেয়েছিলেন। যদিও স্বীকার না-করে উপায় নেই যে, Rizia-য় যে-নাটকীয়তা ছিলো, শর্মিষ্ঠায় তা অনেকাংশে অনুপস্থিত। তিনি এ কাহিনীর নাটকীয়তা পুরোপুরি কাজে লাগাতেও পারেননি। মনে হয়, এ ব্যাপারে ভাষা একটা বড়ো অন্তরায় হিশেবে কাজ করেছিলো। কোথাও কোথাও প্রতিদিনের মুখের ভাষার আভাস এবং সাবলীলতার বীজ দেখতে পেলেও, এক কথায় বলা যেতে পারে, এ নাটকের সংলাপের ভাষা খুব আড়ষ্ট। যে-সাবলীলতার বীজ এ নাটকে দেখা যায়, সেই বীজই পরে অন্যান্য নাটকে কমবেশি পল্লবিত হয়ে দেখা দিয়েছিলো। তদুপরি, রামনারায়ণের হস্তক্ষেপের ফলে সংলাপের ভাষা সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা তিনি পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজে লাগাতে পারেননি। সমকালীন বাংলা নাটকের আদর্শও তাঁকে প্রভাবিত করেছিলো। সে জন্যে কেবল শর্মিষ্ঠায় নয়, তাঁর অন্যান্য নাটকেও তিনি ভদ্রলোকদের মুখে কৃত্রিম এবং গুরুচণ্ডালী মেশানো আড়ষ্ট ভাষা, এবং নিম্নশ্রেণীর মানুষ আর মহিলাদের মুখে কথ্য ভাষা ব্যবহারের রীতি অনুসরণ করেছেন। অবশ্য রামনারায়ণ-সহ যে-বাঙালি নাট্যকারগণ সংলাপে এ ধরনের আদর্শ তাঁর আগেই অনুসরণ করতে আরম্ভ করেছিলেন, তাঁরা সে আদর্শ পেয়েছিলেন সংস্কৃত নাটক থেকে। সমকালীন বাংলা নাটক এবং সংস্কৃত নাট্য-সাহিত্যের প্রতি এই আনুগত্য না-দেখালে মাইকেলের নাটকের ভাষা গোড়া থেকেই অনেকটা স্বচ্ছন্দ হতে পারতো বলে অনুমান করি।
প্রতাপচন্দ্র সিংহ
সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, শর্মিষ্ঠা সম্পর্কে তিনি সমালোচনার বদলে প্রশংসা লাভ করেছিলেন অনেক বেশি। এই প্রশংসা থেকে তাঁর নিজের মনেও এ নাটকের মান সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা হয়েছিলো। এ নাটক নিয়ে তিনি কতোটা আত্মতৃপ্তি লাভ করেছিলেন, তার আর-একটা প্রমাণ: তিনি হেনরিয়েটার প্রথম কন্যার নাম রেখেছিলেন শর্মিষ্ঠা। কন্যা জন্মানোর মাত্র ক দিন আগেই শর্মিষ্ঠার খুব সার্থক অভিনয় হয়েছিলো। তা-ও তাঁকে এই নাম দিতে উৎসাহিত করে থাকবে।
শর্মিষ্ঠা নাটকের আগে পর্যন্ত বাংলায় বলতে গেলে কোনো নাটকই লেখা হয়নি। সে কারণে এই নাটক সবার দৃষ্টি কেড়েছিলো। তা না-হলে এ নাটক সাহিত্যের বিচারে উঁচু দরের কোনো নাটক বলে গণ্য হতে পারে না। চরিত্র অঙ্কন, দৃশ্য পরিকল্পনা এবং সর্বোপরি, সংলাপ রচনায় এ নাটকের দুর্বলতা সহজেই চোখে পড়ে। নাটকের আঙ্গিক সম্পর্কেও তিনি ঠিক মনঃস্থির করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। সে জন্যে প্রাচীনপন্থীরা এ নাটকে বিজাতীয় অর্থাৎ পশ্চিমা প্রভাব দেখতে পেলেও, আসলে এ নাটকে তিনি দেশীয় রীতির প্রতি যথেষ্ট আনুগত্য দেখিয়েছিলেন। পাশ্চাত্য নাট্যকলার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের অভাব নয়, আত্মবিশ্বাসের অভাবই এর জন্যে দায়ী। তিনি আশঙ্কা করেছেন, দেশীয় রীতি মেনে না-চললে তাঁর নাটক লোকেরা গ্রহণ করবেন না। তবে এই নাটক ব্যাপক স্বীকৃতি লাভের পর তিনি যে-আত্মবিশ্বাস অর্জন করেন, তা দিয়ে পরবর্তী নাটক এবং কাব্যে তিনি আপন চিন্তাধারার ছাপ আরো কর্তৃত্বের সঙ্গে এঁকে দিতে পেরেছিলেন। এমনকি, এ নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করার সময়েও তাঁর এই বর্ধিত আত্মবিশ্বাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই অনুবাদের ভূমিকায় তিনি যেভাবে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সমন্বয় করার সাধনায় তাঁর যৌবনের সবচেয়ে ভালো সময়টা উৎসর্গ করার কথা বড়াই করে বলেছেন,৪৫তা থেকে এই মনোভাবস্পষ্ট প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শর্মিষ্ঠা শ্রেষ্ঠ কোনো নাটক না-হওয়া সত্ত্বেও এর ঐতিহাসিক মূল্য অস্বীকার করা যাবে না। আর নাট্যকারের নিজের জীবনেও এই নাটক একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
শর্মিষ্ঠা যখন প্রকাশিত হয়, মোটামুটি তখনই হেনরিয়েটা গর্ভবতী হন। প্রায় ছ বছর প্রণয়লীলা চলার পর তাঁর সঙ্গে মাইকেলের মিলন হয়। অনুমান করি, তাঁদের এই মিলন ছিলো প্রচণ্ড আবেগ এবং উচ্ছাসে ভরা। গোড়ার দিকে, স্বাধিকারপ্রমত্ত যক্ষের মতো কবি পুলিশ কোর্টের নথিতে ভুল করেছিলেন কিনা, জানা নেই। তবে চীফ ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে কোর্ট থেকে নির্বাসন দেননি। বরং ম্যাজিস্ট্রিটদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিলো। হেনরিয়েটার সঙ্গে মিলনের পর প্রথম দিকে তাঁকে অনেকটা সময় দিতে হতো বলে মনে হয়। তাছাড়া, নতুন করে সংসার শুরু করতে গিয়ে মাদ্রাসের মতোই আর-একবার বেশ অর্থকষ্ট অনুভব করেন। নিজের আয় নিয়ে তিনি কখনো সন্তুষ্ট ছিলেন না এবং অন্যদের যোগ্যতার সঙ্গে নিজের যোগ্যতা এবং আয়ের তুলনা করে তিনি চিরকাল অসুখী বোধ করেছেন। এখন হেনরিয়েটার আগমনে সেই অসন্তোষ আর-একবার দাঁত মেলে দেখা দিলো। নানা জনের কাছে এ সময়ে তাঁর দেনা জমে ওঠে। পরেও দেখা যাবে, অভাবের সময়ে তিনি পাড়ার দোকানদার এবং বাড়িওয়ালা থেকে আরম্ভ করে অনেকের কাছ থেকে ধার করতেন।
আর্থিক অনটনের মুখে নাটক অথবা কাব্য রচনার কাজ বাদ দিয়ে তিনি আপাতত কিছু দিন নিজের আর্থিক অবস্থা ভালো করার জন্যে অন্য একটি পথে পা বাড়ালেন। আইনজীবী হিশেবে তিনি তাঁর পিতাকে প্রচুর অর্থ আয় করতে দেখেছেন। এখন দেখতে পাচ্ছিলেন তাঁর চার দিকে তাঁর চেনা অনেক বাঙালিকে যাঁদের আয় ছিলো তাঁর তুলনায় অনেক বেশি। তিনি ভাবলেন, উকিল হবার জন্যে তাঁর তো বেশি কিছু করার নেই। পুলিশ কোর্টে আড়াই বছর কাজ করার পর মামলা-মকদ্দমা তো তিনি ভালোই বোঝেন। এখন তিনি যদি আসন্ন আইন পরীক্ষায় অংশ নেন, তা হলে সমস্যার সমাধান হতে পারে! তাঁর চারদিকের ‘অর্ধশিক্ষিত’ এবং ‘মেধাবর্জিত’ লোকেরা যদি এ পরীক্ষায় পাশ করতে পারে, তা হলে তাঁর না-পারার কোনো কারণ নেই। সুতরাং কষে আইন পড়তে আরম্ভ করলেন। এ সময়ে আইন পরীক্ষা নেবার জন্যে সরকারের একটি কমিটি ছিলো আটজন সদস্যবিশিষ্ট। লিখিত পরীক্ষা নেবার পর, কারা উকিল হবার যোগ্য এই কমিটি তা নির্ধারণ করে একটা সার্টিফিকেট দিতো। গৌরদাসকে ১৮৫৯ সালের ৯ জানুআরি কবি লিখেছেন: ‘আমি ভীষণ ব্যস্ত, আগামী আইন পরীক্ষার জন্যে তৈরি হচ্ছি। এ পরীক্ষায় ফেল করতে পারি — এমন চিন্তা আমার আদপে ভালো লাগছে না। কিন্তু আমার ভাগ্যে কী আছে কে জানে!’ সত্যি, ভাগ্য তাঁর এ ব্যাপারে প্রসন্ন ছিলো না। অনেকে তাঁকে এ সময়ে বুদ্ধি দিলেন যে, আগে শর্মিষ্ঠা (এবং অন্য রচনা) থেকে যথেষ্ট খ্যাতি হোক, তার পরে আইন পরীক্ষা দিলেই চলবে। ৪৬ ততোদিন তাঁর উচিত হবে, এ ব্যাপারে চুপচাপ থাকা। তদুপরি, জানুআরি মাসের শুরু থেকে তিনি রাজা-ভাইদের কথায় উৎসাহিত হয়ে শর্মিষ্ঠর অনুবাদ করতে আরম্ভ করেন। তাও তাঁকে যথেষ্ট ব্যস্ত রাখছিলো বলে মনে হয়।
ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ
এই পরিবেশে ২৩ জানুআরি রাতের বেলা ঈশ্বর গুপ্ত মারা যান হঠাৎ করে। তাঁর বয়স হয়েছিলো মাত্র ৪৭ বছর। কবি অথবা সাহিত্যরসিক হিশেবে ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে মাইকেলের কোনো সাদৃশ্য ছিলো না। ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার বিষয়বস্তু অথবা কাব্যরুচিকেও তিনি শ্রদ্ধা করার মতো কারণ দেখেছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু কবিতার বিষয়বস্তুতে সমসাময়িকতা আমদানি করা এবং সাহিত্যকে সমকালীন জীবনের কাছাকাছি নিয়ে আসার ব্যাপারে ঈশ্বর গুপ্তের অবদান তিনি লক্ষ্য করেছিলেন। এক শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা এবং দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হিশেবে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তাঁর গুরুত্বের কথাও তিনি ভালো করে জানতেন। সে কারণে কয়েক বছরের মধ্যে তিনি ঈশ্বর গুপ্তকে লক্ষ্য করে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। এতে তিনি উত্তরসূরী হিশেবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।
আছিলে রাখালরাজ কাব্যব্রজধামে
জীবে তুমি; নানা খেলা খেলিলে হরষে;
ঈশ্বর গুপ্তের মৃত্যুর পর, তাঁর স্মরণে কোনো কিছু করার ব্যাপারে তাঁর বন্ধুরা অথবা বাঙালি সমাজ কোনো উদ্যোগ দেখাননি, কবি তাতে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেন।৪৭
ও দিকে কোনো কোনো বন্ধু তাঁকে নিরুৎসাহিত করলেও, তিনি আইন পরীক্ষা দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরীক্ষার জন্যে সেবারে দরখাস্ত করেছিলেন প্রায় ছ শো প্রার্থী। ২৪ জানুআরি পরীক্ষা দেবার জন্যে পাঁচ শোরও বেশি প্রার্থী গিয়ে হাজির হন টাউন হলে। কিন্তু যথেষ্ট প্রস্তুতি নিতে পারেননি বলে তিনি শেষ পর্যন্ত এই পরীক্ষা দিতে যাননি। কার্যকারণে এদিন পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয়নি। ৪৮ টাউন হল তৈরি হয়েছিলো এ ঘটনার প্রায় অর্ধ-শতাব্দী আগে – ১৮১৪ সালে। সেই পুরোনো টাউন হলে তখন মেরামত করার কাজ চলছিলো। যে অংশে মেরামত চলছিলো না, সে অংশে বসার মতো জায়গা ছিলো মাত্র দেড় শো লোকের। তদুপরি এই পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যরা খবর পেয়েছিলেন, ঐদিন সকালে নাকি এই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখা গেছে ভবানীপুর অঞ্চলে। সুতরাং তখনকার মতো পরীক্ষা স্থগিত রাখা হলো। সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হলো, অতঃপর কী করণীয়। সেই সঙ্গে এ-ও সুপারিশ করা হলো যে, যাঁরা প্রেসিডেন্সি কলেজে আইনের ক্লাস করেছেন, কেবল তাঁদেরই পরীক্ষা দেবার অনুমতি দেওয়া হোক। ৪৯ এর কদিন পরে কবি জানতে পারেন যে, সে বছর আর আইন পরীক্ষা হবে না। সুতরাং আর-এক বার তিনি নিশ্চয় তাঁর ভাগ্যকে দোষারোপ করেন।
এ অবস্থাতেই, গৌরদাসের কাছে এ সম্পর্কে আবার চিঠি লেখেন। তবে পরীক্ষার চেয়েও, তাঁর সমূহ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তাঁর পাওনাদারেরা। লোহার চিৎপুর রোডে সংসার করতে গিয়ে, বিশেষ করে হেনবিয়েটা আসার পর তাঁর ঋণ বেড়ে গিয়েছিলো। গৌরদাসের সাধ্য ছিলো না অতো টাকা ধার দিয়ে বন্ধুকে সাহায্য করেন। সেই পরিস্থিতিতে তাঁর আর-এক বন্ধু — শ্রীরাম চট্টোপাধ্যায় তাঁর এই আর্থিক অনটনের কথা খুলে বলেন পাইকপাড়ার রাজাদের কাছে। শ্রীরাম ছিলেন রাজাদের দেওয়ান। অমনি ছোটো রাজা, ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ তার বেশির ভাগ ঋণ শোধ করে দিলেন। ছোটো ছোটো পাওনাদারদের বদলে তিনি একজনের কাছে ঋণী হলেন, নাকি উদার এবং বন্ধুবৎসল একজন মানুষ বিপদগ্রস্ত এক কবিকে বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করলেন, স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে কবি যেভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, তাতে মনে হয়, এ টাকা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ফেরত পাওয়ার জন্যে দেননি। কবি টাকার তাগাদা থেকে বেঁচে গেলেন। খুব খুশি হয়ে গৌরদাসকে লিখলেন: ‘পরের বার যখন ছোটো রাজাকে লিখবে, তখন আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ো। রাজাকে কিন্তু বোলো না, আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে বলেছি।’৫০
আর্থিক অনটন, আইন পরীক্ষার চাপ, প্রণয়িনীর আগমন ইত্যাদি নানা কারণে শর্মিষ্ঠা প্রকাশের অব্যবহিত পরে তিনি নতুন কোনো রচনায় হাত দিতে পারেননি। তবে অনুবাদের কাজ অনেক সময়ে যান্ত্রিকভাবেও করা যায়। বোধ হয় সে জন্যেই, শর্মিষ্ঠা প্রকাশিত হবার কদিন আগে – ৯ জানুআরি, তিনি গৌরদাসকে লিখেছিলেন যে, শর্মিষ্ঠার অনুবাদ করা হবে। সৃজনশীল রচনার অভাবে পরবর্তী দু মাস তিনি শর্মিষ্ঠার অনুবাদ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মার্চের মাঝামাঝি গৌরদাসকে জানান, অনুবাদের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে।৫১ নিজের রচনা সম্পর্কে তাঁর ধারণা সব সময়ে একটু ফাঁপানো ছিলো। প্রাচীনপন্থী পণ্ডিতরা ছাড়া অন্য সবার প্রশংসা শুনে তিনি বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেন যে, তাঁর এ নাটকের এমন অনেক সাহিত্যিক মূল্য আছে, যা তাঁর নিজেরও চোখে পড়ছে না। অসম্ভব নয় যে, অনেকটা এ কারণে তিনি শর্মিষ্ঠার ইংরেজি অনুবাদ করার কথা চিন্তা করেন। তাছাড়া, শর্মিষ্ঠা অভিনয় করার সময়ে রাজারা ইংরেজ দর্শকদের নিমন্ত্রণ করবেন বলে এই নাটকের অনুবাদ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কবি তাঁর উদ্দেশ্যের কথা খুলে বলেননি। কিন্তু ইংরেজি শর্মিষ্ঠাও খুব সুন্দর হয়েছে, এ কথা তিনি গৌরদাসকে লিখেছিলেন।৫২ তাঁর পৃষ্ঠপোষকরা –রাজারা এবং যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর — শর্মিষ্ঠার অনুবাদ দেখে খুব প্রশংসা করেছিলেন। যতীন্দ্রমোহন ১৮৫৯ সালের ফেব্রুআরি মাসে লেখা একটি চিঠিতে বলেছিলেন, মাইকেল প্রথম দিকটা যেমন অনুবাদ করেছেন, তেমনভাবে শেষ পর্যন্ত অনুবাদ করতে পারলে Ratnavali-কেও তা হারিয়ে দেবে। ৫৩ অনুবাদ শেষ হলে রাজারা এবই ছাপার জন্যে টাকাও ধার দিয়েছিলেন। ফলে মে মাসের গোড়াতে ইংরেজি শর্মিষ্ঠা প্রকাশিত হয়।
ইংরেজি শর্মিষ্ঠা প্রকাশিত হবার পরের মাসে Indian Field পত্রিকায় এ নাটকের একটি সমালোচনা প্রকাশিত হয়। এতে লেখা হয়, ‘মিস্টার মাইকেল মধুসূদন ডাট দেশীয় ভাষায় একটি ধ্রুপদী নাটক লেখার প্রশংসনীয় চেষ্টায়, আমাদের বিবেচনায়, সাফল্য লাভ করায় কৃতিত্বের দাবিদার। বাংলা ভাষা এখনো উচ্চ শ্রেণীর সাহিত্য নিয়ে গর্ব করতে না-পারলেও, এবং এই ভাষা এখনো ত্রুটিমুক্ত না-হলেও নাটক লেখার জন্যে এ ভাষা যথেষ্ট উপযোগী।’ সমালোচক আরও খবর দিয়েছেন যে, এ নাটক ম্যানেজারের বাক্সে বন্দী থাকবে না, শিগগিরই রাজা প্রতাপচন্দ্র এবং ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ বাহাদুরের ব্যক্তিগত বেলগাছিয়া থিয়েটারে অভিনীত হবে। ৫৪ এ সমালোচনা ছিলো নিতান্ত সংক্ষিপ্ত। কবির প্রতি প্রংশসায়ও কোনো উচ্ছাস ছিলো না। বারবার লক্ষ্য করা গেছে যে, তাঁর রচনায় কেউ প্রশংসা করলে কবি বিশেষ খুশি হতেন এবং তা ফলাও করে বলতেন। কিন্তু এ প্রশংসার কথা তিনি কোথাও উল্লেখ করেননি। পত্রিকার সম্পাদক কিশোরীচাঁদ মিত্র কবিকে এককালে চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিলেন, বাড়িতে আশ্রয়ও দিয়েছিলেন; কিন্তু শর্মিষ্ঠার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে পারেননি। হতে পারে, সাহিত্যিক হিশেবে মাইকেল কতো বড়ো তিনি তা তখনো উপলব্ধি করতে পারেননি। পরে অবশ্য তিলোত্তমাসম্ভব এবং মেঘনাদ সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট উৎসাহ দেখিয়েছিলেন।
সংসারকে ঘিরে যেমন আগের কয়েক মাস ধরে ঘুরপাক খাচ্ছিলো, শর্মিষ্ঠা অনুবাদ শেষ হবার ঠিক পরে তা আবার দূরের আহ্বানে উদাস হয়। প্রাত্যহিকতার সীমানা পেরিয়ে তিনি দূরের সাগর এবং পর্বতের আহ্বান শুনতে পান। গৌরদাস তখন বালেশ্বরে। তাঁকে পূর্বোক্ত চিঠিতে লিখেছেন: ‘আমি যদি সাগর আর পর্বতের কাছে থাকতে পারতাম! সাগর, উন্মুক্ত সাগর, তোমাদের ওখান থেকে কতো দূরে? তুমি কি সাগরের অবিশ্রান্ত প্রবল গর্জন শুনতে পাও? আমার কাছে সে গর্জন অতি পরিচিত। তবে ঈশ্বরই জানেন, আর কোনোদিন সেই গর্জন শুনতে পাবো কিনা।’৫৫ ধারণা করি, কয়েক মাস হেনরিয়েটার সঙ্গে থাকার পর, আবার মনের গভীরে ক্লান্তি এসেছে। যাঁদের ফেলে এসেছিলেন, তাঁদের স্মৃতি আবার মনকে বিষন্ন করেছে। হেনরিয়েটার সঙ্গে ঘর করবেন, অথচ মাদ্রাসকে ভুলে থাকবেন, রেবেকা এবং আত্মজ-আত্মজাদের ভুলে থাকবেন, সেটা কী করে সম্ভব! কিন্তু পরে দেখবো, এসব শোক তাঁকে মন্থন করলেও, তিনি এসব মনের একান্ত গভীরে পুষে রাখতে শিখেছিলেন। বন্ধু অথবা জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে এই শোক ভাগাভাগি করে নিতে পারেননি। এর দেড় মাস পরে লেখা আর-একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন: ‘কলকাতা আমার আদপে ভালো লাগেনা। আমি ক্বচিৎ বাইরে যাই; অথবা আদৌ যাইনে। এর চেয়ে সুন্দরবনও আমার বেশি ভালো লাগে!’৫৬ তাঁর এই বৈরাগ্যওকি একেবারে বিচ্ছিন্ন ব্যাপার? আসলে, তাঁর চরিত্রের একেবারে গভীরে বৈরাগ্যের এই বীজ বপন করা ছিলো। তিনি ছিলেন আর-পাঁচজন মানুষের মতো বন্ধুবৎসল, প্রেমিক স্বামী এবং সন্তানবৎসল। কিন্তু সৃষ্টির বেদনা তাঁর অন্তরকে নিরন্তর নাড়া দিতো। তাঁর সেই অসাধারণ সৃষ্টিছাড়া হৃদয়ের জন্যেই জনারণ্যের মধ্যে থেকেও তিনি এক-এক সময়ে নিঃসঙ্গ এবং উদাস হয়ে যেতেন। তখন সবকিছু তাঁর কাছে তুচ্ছ মনে হতো। আসলে তিনি যেন দুটি আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্ব নিয়ে বাস করতেন। তাঁর মধ্যে কবি হবার প্রবল আকাঙক্ষা এবং বস্তুবাদী ভোগের আকাঙ্ক্ষাও যেন এই দ্বৈত ব্যক্তিত্বই তুলে ধরে। তাঁর জীবনের মাদ্রাস অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করার সমযেও আমরা আনন্দের মধ্যে তাঁর বিষাদ-মনস্কতা লক্ষ্য করেছি। পরেও তাঁর এই বৈশিষ্ট্য দেখা যাবে।
এই মানসিক সংকটের সময়ে, তিনি নতুন একটি নাটক লেখার কাজ আরম্ভ করেন। অবশ্য এ নাটকের ধারণা তাঁর মাথায় এসেছিলো কয়েক মাস আগে এক রোববার। প্লটটা পেয়েছিলেন বহু বার পড়া গ্রীক পুরাণ থেকে। কিন্তু সেই কাহিনী তিনি স্থাপন করলেন ভারতীয় পুরাণের পটভূমিতে। এই প্লট নিয়ে তিনি প্রতাপচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এবং কেশব গাঙ্গুলির সঙ্গে আলাপও করেছিলেন। যতীন্দ্র ঠাকুর আর রাজারা শুনেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন: চমৎকার!’৫৭ গৌরদাসকে লেখা আগের চিঠি থেকে জানতে পাই, এই নাটকের প্রথম অঙ্ক লেখার কাজ ১৯ মার্চের আগে শেষ করেছিলেন। এ নাটকের নাম তিনি তখনো বোধ হয় ঠিক করেননি। কিন্তু পরে এর নাম দিয়েছিলেন পদ্মাবতী। তিনি মন্থর গতিতে কোনো কাজ করতে পারতেন না। এ ছিলো তাঁর স্বভাবের বিরুদ্ধে। পদ্মাবতীও তিনি রচনা করেন প্রায় ঝড়ের গতিতে। ছ সপ্তাহ পরে তিনি আবার বন্ধুকে লেখেন: ‘চতুর্থ অঙ্ক লেখার কাজ শেষ হয়েছে। আজ সকালে এটা আমি যতীন্দ্র ঠাকুরের কাছে পাঠাচ্ছি।’৫৮ কার্যকালে তিনি যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের কাছে পাঠিয়েছিলেন, নাকি রাজাদের কাছে, তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। কারণ, ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ৮ মে তারিখে তাঁকে যে-চিঠি লেখেন, তা থেকে দেখা যায় প্রতাপচন্দ্র সিংহ তখন এই নাটকের তিন অথবা চার অঙ্কের পাণ্ডুলিপি পড়ে দেখছিলেন।৫৯
ইংরেজি শর্মিষ্ঠার নামপএ
যা রচনা করছেন, তাতে মগ্ন হয়ে থাকা তাঁর চরিত্রের একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য। যখন তিনি কোনো নাটক অথবা কাব্য রচনা করতে করতে বন্ধুদের কাছে চিঠি লিখেছেন, তখন সেই রচনা সম্পর্কে তিনি উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন। পদ্মাবতীও এর কোনো ব্যতিক্রম নয়। পদ্মাবতীর ধারণাটা যে নাটকের জন্যে খুব উপযুক্ত, সে সম্পর্কে গৌরদাসকে লিখেছেন: ‘আমি কেবল তোমাকে বলতে পারি, নাটকের জন্যে এর চেয়ে ভালো প্লট খুব কমই থাকতে পারে।’৬০ এই কাহিনী নিয়ে তিনি নিজে উচ্ছসিত হলেও, এর মধ্যে খুব মৌলিকত্ব ছিলো না। আসলে এ নাটকে তিনি গ্রীক পুরাণের স্বর্ণ আপেলের কাহিনী দেশীয় দেবদেবীর নাম দিয়ে দেশীয় চেহারায় চালিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মন লালিত হয়েছিলো পশ্চিমা সাহিত্যের রসে। যথার্থভাবেই দেশীয় সাহিত্যের তুলনায় পশ্চিমা সাহিত্যকে তিনি অনেক উঁচু দরের বলে বিবেচনা করতেন। এ দুইয়ের মধ্যে কোনো তুলনা চলতে পারে, তিনি আদৌ তা মনে করতেন না। অথচ তিনি নাটক লিখছিলেন দেশীয়দের জন্যে। তাঁরা কতোটা বিদেশী স্বাদের সাহিত্য বুঝে তার প্রশংসা করতে পারবেন, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। শর্মিষ্ঠায় তিনি যে-সামান্য বিদেশী রসের ভেজাল দিয়েছিলেন, তার জন্যে প্রাচীনপন্থীরা কেমন আঁতকে উঠেছিলেন, তিনি তা-ও লক্ষ্য করেছিলেন। সে জন্যে পদ্মাবতীর কাহিনী তিনি তৈরি করেছিলেন সুকৌশলে – যাতে তাঁর বিদেশী রুচি তৃপ্ত হয়, আবার দেশীয় দেবদেবীর নাম এবং আবহাওয়া দেখে পাঠক এবং দর্শকরাও খুশি হন।
দেশীয় মোড়কে কেবল বিদেশী মাল পাচার করার কৌশল তিনি নেননি, পদ্মাবতীতে দেশীয় উপাদানও তিনি কম রাখেননি। কারণ দেশীয় আঙ্গিক এবং রুচি তখনো তিনি যথেষ্ট পরিমাণে বর্জন করার সাহস জোগাড় করতে পারেননি। তবে এই নাটকে বড়ো রকমের পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। বিশেষ করে সংলাপ রচনার সময়ে তিনি পরীক্ষা করেছিলেন বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ চালু করা যায় কিনা। পদ্মাবতীতে তাঁর এই প্রচেষ্টা সীমিত সাফল্য লাভ করলেও, পরে তাঁর এই সাহস অনেক প্রশস্ত পথ খুলে দিয়েছিলো। তা ছাড়া, শর্মিষ্ঠার সঙ্গে তুলনা করলে কাহিনী সৃষ্টি, চরিত্র নির্মাণ, নাটকীয় পরিবেশ রচনা, সংলাপ তৈরি — সবকিছুতেই এ নাটকে তিনি অনেক বেশি সফল হয়েছিলেন। সংলাপের একটা দৃষ্টান্ত দিলেই আমাদের এ মন্তব্যের সত্যতা বোঝা যাবে:
শর্মিষ্ঠা
রাজা। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া স্বগত) আহা! কি কুলগ্লেই বা দৈত্যদেশে পদার্পণ করেছিলেম। (চিন্তা করিয়া) হে রসনে! তোমার কি এ কথা বলা উচিত? দেখ, তোমার কথায় আমার নয়নযুগল ব্যথিত হয়, কেন না, দৈত্যদেশগমনে তারা চরিতার্থ হয়েছে, যেহেতু তারা সেখানে বিধাতার শিল্পনৈপুণ্যের সার পদার্থ দর্শন করেছে। (পরিক্রমণ) বাড়বানলে পরিতৃপ্ত হলে সাগর যেমন উৎকণ্ঠিত হন, আমিও কি অদ্য সেই রূপ হলেম? হে প্রভো অনঙ্গ, তুমি কি হরকোপানলে দগ্ধ হয়েছিলে বলে, প্রতিহিংসার নিমিত্তে মানবজাতিকে কামাগ্নিতে সেইরূপ দস্থ কর?
পদ্মাবতী
রাজা। (চতুর্দিক অবলোকন করিয়া স্বগত) হরিণটা দেখ্তে দেখ্তে কোন্ দিকে গেল হে? কি আশ্চর্য! আমি কি নিদ্রায় আবৃত হয়ে স্বপ্ন দেখ্ছি? আর তাই বা কেমন করে বলি। এই ত ভগবান্ বিন্ধ্যাচল অচল হয়ে আমার সম্মুখে রয়েছেন। (চিন্তা করিয়া) এই পর্বতময় প্রদেশে রথের গতির রোধ হয় বল্যে, আমি পদব্রজে হরিণটার অনুসরণ ক্লেশ স্বীকার করে অবশেষে কি আমার এই ফল লাভ হলো যে আমি একলা একটা নির্জন বনে এসে পড়লে মরুভূমিতে মরীচিকা বারিরূপে দর্শন দেয়; তা এ স্থলে কি মায়ামৃগ হয়ে আমাকে এত ব্যথা দুঃখ দিলে?
শর্মিষ্ঠার তুলনায় পদ্মাবতীতে ভাষা যে অনেকটা চলিত রীতি দিকে এগিয়ে এসেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সত্যি বলতে কি, এখানে পদ্মাবতী থেকে যে-উদ্ধৃতি দিয়েছি, সেটি এ নাটকের সাবলীল ভাষার সবচেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত নয়। শর্মিষ্ঠার কেবল ক্রিয়াপদ এবং সর্বনামে চলিত ভাষার স্বাক্ষর দেখতে পাই এবং তা ভাষার অন্য অংশের সঙ্গে আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু পদ্মাবতীতে চলিত ভাষার এলাকা আরও সম্প্রসারিত হয়েছে — অন্য লৌকিক শব্দ ব্যবহার এবং হ্রস্ব বাক্য গঠনে। এরপরেও তিনি যার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি, তা হলো পৌরাণিক উপমা। অনেক সময়ে এসব উপমার কারণে তাঁর ভাষা যতোটা চলিত, ততোটা চলিত মনে হতো না।
পদ্মাবতী লিখতে আরম্ভ করেছিলেন খুব উৎসাহ এবং উচ্ছাসের সঙ্গে। তেসরা মের আগেই এ নাটকের চার অঙ্ক পর্যন্ত লেখাও হয়েছিলো। কিন্তু তারপরেই রচনায় হঠাৎ ছেদ পড়ে। দশবছর আগে একটি অনামী কাব্য এবং Rizia সম্পর্কেও তিনি প্রথমে খুব উচ্ছসিত হয়েছিলেন। কিন্তু কোনোটাই শেষ করতে পারেননি। পদ্মাবতী সম্পর্কেও উৎসাহে ভাঁটা পড়ার মতো তেমন কোনো কারণ ঘটেছিলো কিনা, বলা যাচ্ছে না। অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, রাজাদের অনুরোধে তিনি পদ্মাবতী লেখার কাজ ফেলে রেখে প্রহসন রচনায় হাত দিয়েছিলেন। পদ্মাবতী নাটক সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের যে-চিঠির কথা একটু আগেই উল্লেখ করেছি, তাতে তিনি পোশাকী নাটক রচনা আপাতত বন্ধ রেখে প্রহসন লেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিলো: ‘শর্মিষ্ঠা অভিনয়ের কাজ আমরা চালিয়ে যাবো। তবে শর্মিষ্ঠার পরে আমাদের প্রহসনও অভিনয় করা দরকার। আমরা দেখতে চাই যে, আমরা একই অভিনেতাদের দিয়ে একই সঙ্গে মহত্তম এবং হালকা বিষয়বস্তুর অভিনয় করাতে পারি।’৬১
লিখিত কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু ধারণা করা হয় যে, এই চিঠি পাওয়ার পরেই তিনি একেই কি বলে সভ্যতা? এবং বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসন দুটি রচনা করেন। এ সময়ে, তাঁর চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে, তাঁর কোর্টের অন্যতম ম্যাজিস্ট্রেট, মি হিউম প্রথমে সাত-আট সপ্তাহ অনুপস্থিত ছিলেন। তারপর চলে যান ইংল্যান্ডে। কাজ করছিলেন শুধু জি এস ফ্যাগান। খুব ভদ্র বলে তাঁর সঙ্গে কবি কাজ করতে পছন্দ করতেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও অফিসের কাজ নিয়ে তাঁকে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হচ্ছিলো। নিজেই লিখেছেন: ‘রোজ দশটা থেকে পাঁচটা/সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত অফিসের কাজ করতে হচ্ছে।’৬২ কিন্তু এতো ব্যস্ততা থাকলেও তিনি থামতে পারছিলেন না; কারণ তিনি একই সঙ্গে খ্যাতির আকর্ষণ এবং একটা নেশা অনুভব করতে পারছিলেন। রাজারা চেয়েছিলেন একটি প্রহসন, সৃষ্টির আনন্দে তিনি লিখে ফেললেন দুটি। এবং লেখা শেষ করে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দিলেন রাজাদের কাছে। শর্মিষ্ঠা অভিনীত হবার অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসের যথেষ্ট আগেই তিনি প্রহসন দুটি রাজাদের দিয়েছিলেন, এমন অনুমান সঙ্গত। তা ছাড়া, তিনি তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য রচনার কাজও জুন মাসের দিকে আরম্ভ করেছিলেন। তবে, যখনকার কথা বলছি — অর্থাৎ ১৮৫৯ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত, তিনি বন্ধু এবং রাজাদের কাছ থেকে যথেষ্ট প্রশংসার বাক্য শুনলেও, তাঁর কোনো নাটক তখনো অবধি মঞ্চস্থ হয়নি। কিন্তু নিজের নাটক মঞ্চস্থ হবার ব্যাপারে তাঁর অসাধারণ দুর্বলতা ছিলো। তাই রাজারা যখন শর্মিষ্ঠার অভিনয়ের উল্লেখ করে প্রহসন লেখার কথা বলেন, তখন তাঁর পক্ষে সে অনুরোধ উপেক্ষা করা শক্ত ছিলো। এভাবেই পদ্মাবতী রচনার কাজ তুলে রেখে তিনি প্রহসন লিখতে বসেছিলেন।
প্রহসন লিখতে গিয়ে তিনি কেন অমন সমকালীন সমস্যা বেছে নিলেন, প্রথমে তা স্পষ্ট না-হলেও, একটু তলিয়ে দেখলে কারণটা বোঝা যায়। আসলে ১৮৫০-এর দশকে প্রথমে বিধবাবিবাহ এবং পরে বহুবিবাহ নিয়ে কলকাতার হিন্দু সমাজে যে-জোর আন্দোলন আরম্ভ হয়, তা সাহিত্যের অন্য শাখার চেয়ে নাট্যরচনাকেই বেশি প্রভাবিত করেছিলো। এ ব্যাপারে রামনারায়ণের কুলীনকুলসর্ব(১৮৫৪) একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলো। তা ছাড়া, উমেশচন্দ্র মিত্রের বিধবাবিবাহ (১৮৫৬) নাটকের সাফল্যও এই ধারাকে জোরদার করেছিলো। বস্তুত, একদিকে সমাজসংস্কার আন্দোলন যেমন বাংলা প্রহসন রচনাকে উৎসাহিত করেছিলো, তেমনি তখন ব্যাঙের ছাতার মতো যে-প্রহসন গজিয়ে উঠেছিলো তাও সমাজসংস্কার আন্দোলনকে এগিয়ে দিয়েছিলো।৬৩ বিশেষ করে কুলীনকুলসর্বস্ব এবং বিধবাবিবাহ নাটক পাঠ্য এবং অভিনীত নাটক হিশেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো। কেবল তাই নয়, মনে রাখা দরকার যে, কুলীনকুলসর্বস্ব প্রথম অভিনীত বাংলা নাটক। মাইকেলও এটা নিশ্চয় লক্ষ্য করে থাকবেন। এবং অংশত সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখা নাটকের জনপ্রিয়তা এবং অংশত সমাজ সংস্কার আন্দোলনের জনপ্রিয়তা তাঁকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করেছিলো। তাই তিনি তাঁর প্রহসনের জন্যে নির্বাচন করেছিলেন সমকালীন সমাজের দুটি সমস্যা। অবশ্য তিনি বেশির ভাগ প্রহসন — রচয়িতাদের মতো সংস্কারের উদ্দেশ্যে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত কোনো সামাজিক বিষয় নির্বাচন না-করে, এমন বিষয়বস্তু পছন্দ করেছিলেন যা অসাম্প্রদায়িক এবং যার আবেদন আরো ব্যাপক — যে-সমস্যা হিন্দু সমাজের কোনো একটা ক্ষুদ্র অংশের নয়, বরং বৃহত্তর হিন্দু সমাজের। এর ফলে, নির্ভেজাল হাসির মাধ্যমে তিনি একই সঙ্গে কশাঘাত করলেন অত্যাধুনিক নব্যশিক্ষিতদের আর ধর্মেরনামে যারা আসলে ভণ্ডামি করতো সেই রক্ষণশীলদের। পাশ্চাত্যয়ানার নামে তারা পশ্চিমের যে-হাস্যকর অনুকরণ করছিলো, তিনি তা দেখিয়ে দিয়ে ইংরেজি-শিক্ষিত নব্যদের ব্যঙ্গ করলেন। অপর পক্ষে, প্রাচীনদের তিনি বিদ্রুপ করলেন তাদের ভণ্ডামির স্বরূপ উন্মোচন করে। এই উভয় সমাজকে তিনি যে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছিলেন, প্রহসন থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর অনেক সমালোচক ধারণা দিয়েছেন যে, তিনি নিজের সমাজ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই প্রহসন দুটি পড়লে বোঝা যায়, খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলেও অথবা আপাতদৃষ্টিতে জীবনযাত্রায় হিন্দু সমাজ থেকে দূরে সরে গেলেও, এই সমাজকে একেবারে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা এবং ক্ষমতা – উভয়ই তাঁর ছিলো।
কিন্তু এই প্রহসন দুটির বিষয়বস্তুর চেয়েও যা উল্লেখযোগ্য তা হলো: এ দুটি রচনা করার সময়ে তিনি সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রকে শিকেয় তুলে রাখতে পারলেন এবং পাশ্চাত্য নাট্যরুচি দিয়ে এই প্রহসনের আঙ্গিক, কাহিনী, চরিত্র এবং সংলাপ রচনা করার সুযোগ পেলেন। আর তাতে সাফল্য লাভ করলেন কল্পনাতীত। শর্মিষ্ঠা রচনা করতে গিয়ে তিনি দেশীয় সাহিত্যের শেকল কাটতে পারেননি। পদ্মাবতীতে সে বাঁধন তিনি কেবল আলগা করেছিলেন। প্রহসনে এসে সে শেকল ছিন্ন করার সুযোগ পেলেন। এবং সংলাপ রচনা, চরিত্রচিত্ৰণ আর মঞ্চ পরিকল্পনা থেকে মনে হয় সেই স্বাধীনতা তিনি বেশ উপভোগও করেছেন। বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ থেকে একটা দৃষ্টান্ত দিলে দেখা যাবে এর আগেকার নাটক পদ্মাবতী থেকে এর সংলাপ কতো আলাদা:
ভক্ত। (স্বগত) আহ! বেলাটা কি আজ আর ফুরবে না? (হাই তুলিয়া) দীনবন্ধো! তোমারই ইচ্ছা! পুটি বলে যে পঞ্চী ছুঁড়ীটাকে পাওয়া দুষ্কর, কি দুঃখের বিষয়! এমন কনক রত্নটি তুলতে পাল্লেম না হে! সসাগরা পৃথিবীকে জয় করে, পার্থ কি অবশেষে প্রমীলার হস্তে পরাভূত হলে্ন? যা হোক, এখন যে হানফের মাগ্টাতে পাওয়া গেছে এও একটা আহ্লাদের বিষয় বটে। ছূঁড়ী দেখতে মন্দ নয়, বয়স অল্প, আর নবযৌবনমদে একেবারে যেন ঢলে ঢলে পড়ে। শাস্ত্রে বলেছে যে যৌবনে কুক্কুরীও ধন্য। (চতুর্দিকৎ অবলোকন করিয়া)। ইঃ! এখনও না হবে তো প্রায় দুই দণ্ড বেলা আছে। কি উৎপাত!
এখানে প্রমীলার হাতে পার্থের পরাজিত হবার যে-উপমা আছে, তা এই প্রহসনের জন্যে খুব উপযোগী, এমনটা বলা যায় না। বরংএর মধ্য দিয়ে তাঁর ধ্রুপদী উপমা-প্রীতিই প্রকাশ পেয়েছে। তবে এ উপমা সত্ত্বেও, এই সংলাপ সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে প্রহসনের বেশ উপযোগী হয়েছে। ইচ্ছে করলে তিনি যে রীতিমতো চলিত ভাষায় লিখতে পারতেন, এ প্রহসন দুটি তার নির্ভুল প্রমাণ।
অবশ্য সফলতা একদিকে যদি বা এলো, অন্য দিকে এলো না। শর্মিষ্ঠার অব্যবহিত পরে প্রহসন অভিনয় করা হবে – এই প্রলোভন দিয়ে রাজারা তাঁর কাছ থেকে তড়িঘড়ি করে দুটি প্রহসন লিখিয়ে নিলেও তার কোনোটাই অভিনীত হলো না। একেই কি বলে সভ্যতা?-র মহড়া শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে সে খবর পৌঁছে গেলো প্রভাবশালী নব্যশিক্ষিতদের কাছে। অভিনেতা কেশব গাঙ্গুলির স্মৃতিচারণ থেকে জানা যাচ্ছে, নব্যশিক্ষিতরা এটাকে ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের প্রতি একটা বিদ্রূপ বলে বিবেচনা করলেন। অমনি তাঁরা এই প্রহসনের অভিনয় বন্ধ করার দাবি জানিয়ে তাঁদের একজন নেতাকে পাঠালেন রাজাদের কাছে। এই নেতার যথেষ্ট প্রভাব ছিলো রাজাদের ওপর। সুতরাং শর্মিষ্ঠা সাড়ম্বরে অভিনীত হলেও, রাজারা নব্যশিক্ষিতদের পরামর্শ শুনে একেই কি বলে সভ্যতা?-র অভিনয় করাতে সাহস পেলেন না।৬৪ কেবল তাই নয়, তাঁরা এতে এতো বিরক্ত হয়েছিলেন যে, অন্য প্রহসনটি নিযেও পাছে আপত্তি ওঠে এই আশঙ্কায় তারও অভিনয় বন্ধ রাখলেন।
বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ(দ্বিতীয় সং)
শর্মিষ্ঠার অভিনয় দেখে মাইকেল যতোটা খুশি হয়েছিলেন, প্রহসন দুটির অভিনয় হলো না দেখে, তার চেয়েও বেশি দুঃখিত হলেন। তাই বছর খানেক পরে দুঃখ করে কেশব গাঙ্গুলিকে লিখেছিলেন: ‘মনে রাখবেন, আপনারা প্রহসন দুটির ব্যাপারে আমার ডানা ভেঙে দিয়েছিলেন।’৬৫ প্রহসন দুটির অভিনয় বন্ধ করে রাজারা সত্যি সত্যি বাংলা নাটক এবংমাইকেল — উভয়েরই ক্ষতি করেছিলেন। প্রহসনে তিনি ভাষার যে-সাবলীলতা খুঁজে পেয়েছিলেন, আরও-একটু চর্চা করতে পারলে তা দিয়ে তিনি তাঁর নাটকের ভাষাকেও সাবলীল করতে পারতেন বলে মনে হয়। এবং তেমন অবস্থায়, পরিণতি লাভ করতে বাংলা নাটকের অতো দেরি করতে হতো না।
রাজারা অবশ্য জানতেন যে, তাঁরা অনুরোধ করে এই প্রহসন দুটি রচনা করিয়েছিলেন। সে জন্যে, অভিনয় করাতে না-পারলেও, প্রতাপচন্দ্র সিংহ এই প্রহসন দুটি ছাপানোর খরচ বহন করলেন। ১৮৬০ সালের গোড়ার দিকে — সম্ভবত জানুআরি-ফেব্রুআরি মাসে — প্রহসন দুটি প্রকাশিত হয়। সমকালীন নাটক এবং প্রহসনে যেসব সমাজ-সংস্কারমূলক বিষয়বস্তু নেওয়া হয়েছিলো, তার বেশির ভাগই সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশকে লক্ষ্য করে রচিত হয়েছিলো বলে বৃহত্তর সমাজ এসব নাট্যরচনাকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেনি। বরং এসব রচনায় সমাজের একাংশের বিকার দেখে সমাজের বাকি অংশ কৌতুক বোধ করেছে। কিন্তু মাইকেল যাদের আক্রমণ করলেন, তারা ধর্মীয় দিক দিয়ে সমাজের কোনো একটা নির্দিষ্ট অংশের মানুষ নয়, অথবা তাঁর দেখানো সমস্যাটাও সরাসরি ধর্মের সঙ্গেও যুক্ত নয়। যাদের তিনি হুল ফোটালেন, গোটা হিন্দু সমাজে তাদের প্রতিনিধিরা ছড়িয়ে ছিলো। সমাজে তাদের প্রভাবও ছিলো ব্যাপক। সে জন্যে, কবির নিন্দা হলো সমাজের বিভিন্ন তরফ থেকে। নব্যশিক্ষিতরা একেই কি বলে সভ্যতা? প্রহসনে তাঁদের ক্যারিকেচার দেখে এবং রক্ষণশীলরা বুড় সালিকে তাঁদের ভণ্ডামির প্রতিবিম্ব দেখে ভেদাভেদের কথা ভুলে গিয়ে একযোগে নিন্দার কোরাস গাইলেন।৬৬ ওদিকে, অভিনয় না-হবার জন্যে কবি প্রথমে বিষণ্ণ হলেও, পরে নিন্দার জোর উপলব্ধি করতে পারলেন। তখন নিজেই ভাবলেন: এ প্রহসন প্রকাশ না-করাই ভালো ছিলো। তাঁর মনে হলো: ‘এখনো বাংলাভাষায় নাট্যামোদীদের রুচি নিয়ন্ত্রণের উপযোগী ভালোনাটক লেখা হয়নি অথবা সেসব নাটক অভিনয় করার মতো মঞ্চও তৈরি হয়নি, ‘এমন অবস্থায় প্রহসন লিখে জনমতকে চটিয়ে দেওয়া বিচক্ষণতার কাজ নয়।’৬৭
চারদিকের জনমত দেখে কবি তাঁর প্রহসন সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত যে-সিদ্ধান্তেই পৌছে থাকুন না কেন, আসলে প্রহসনে তিনি দেশীয় নাট্যরীতি থেকে সত্যিকার মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলেন। তবে এই দুই প্রহসনে তিনি যেভাবে তাঁর পাঠক/দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছেন এবং সংলাপ রচনায় যে-স্বতঃস্ফূর্ততা দেখিয়েছেন, পরে তা অংশমাত্র তাঁর কাজে লেগেছিলো। কারণ এরপর তিনি মাত্র একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখেছিলেন। তা ছাড়া, এই প্রহসনের সার্থক অভিনয় হলে তিনি আত্মবিশ্বাস লাভ করতে পারতেন এবং পরবর্তী রচনায় তাঁর সদ্য-অর্জিত নৈপুণ্য খাটাতে পারতেন। সত্যি বলতে কি, তাঁর নাট্যপ্রতিভার পূর্ণ বিকাশের জন্যে সময়টা ছিলো প্রতিকূল। পরে কেশব গাঙ্গুলিকে লেখা একটি তির্যক উক্তিতে তিনি যথার্থই লিখেছিলেন: সময়ের তুলনায় তিনি ছিলেন প্রাগ্রসর।৬৮
প্রহসন লিখতে গিয়ে পদ্মাবতীর রচনা তিনি মুলতুবি রেখেছিলেন। লেখাশেষ করে তিনি আবার পদ্মাবতী লেখার কাজে হাত দেন। ১৮৫৯ সালের মাঝামাঝি তিনি এ নাটক শেষ করেছিলেন — এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়; যদিও ঠিক কখন আরো সুনির্দিষ্ট করে তা বলার জো নেই। তিনি যে-বিপুল উৎসাহ নিয়ে পদ্মাবতী লেখা আরম্ভ করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত সে উৎসাহ তিনি বজায় রাখতে পারেননি। কোনো কোনো সমালোচক সে জন্যে লক্ষ্য করেছেন যে, পদ্মাবতীর প্রথম চার অঙ্কে যে-স্বতঃস্ফূর্ততা এবং সাবলীলতা আছে, শেষ অঙ্কে তা অনেকাংশে অনুপস্থিত। যে-নাটকের প্লটকে কবি অত্যন্ত নাটকীয় বলে বিবেচনা করেছিলেন, সেই নাটকের শেষ পর্যায়ে তার প্রতি কেন আকর্ষণ হারিয়ে ফেললেন, তিনি নিজে সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। আমার ধারণা, তাঁর আগ্রহ অন্যদিকে চলে গিয়েছিলো। অতীতেও তাঁকে হঠাৎ পুরোনো বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে দেখা গেছে। এমন কি, পরবর্তী সময়েও আমরা তাঁকে এমন আচরণ করতে দেখবো।
পদ্মাবতীতে যে-অসাধারণ নাট্যসম্ভাবনা ছিলো, তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে না-পারলেও, এই . রচনা তাঁকে অন্য পথের নির্দেশ দিয়েছিলো। এই নাটক লেখার সময়ে তিনি সংলাপে ইংরেজির মতো অমিত্রাক্ষর ব্যবহার করা যায় কিনা, তা নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন – আগেই তা লক্ষ্য করেছি। তাঁর এই পরীক্ষায় সফলতা লাভ করে তিনি এতোটা আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিলেন যে, এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন: ‘আমাদের নাটক গদ্যে না-লিখে, অমিত্রাক্ষরে লেখা উচিত।’৬৯ তিনি অনেক কিছুই লিখেছিলেন জেদ করে। কিন্তু এসবের মধ্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। একেবারে আক্ষরিক অর্থে বাজি ধরে তিনি এই ছন্দ রচনা করেছিলেন। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ১৮৫৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন শর্মিষ্ঠা অভিনয়ের জন্যে মহড়া চলছিলো, সে সময়ে একদিন রাজভ্রাতৃদ্বয়, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এবং মাইকেলের মধ্যে বাংলা নাটক নিয়ে কথাবার্তা চলছিলো। এক পর্যায়ে কবি বললেন যে, যতো দিন না বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রচলিত হচ্ছে, ততোদিন বাংলা নাটকের উন্নতি আশা করা যায় না। তার উত্তরে যতীন্দ্রমোহন বলেন যে, বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ বোধ হয় রচনা করা সম্ভব নয়। (ভারতীয় কোনো কোনো ভাষায় ১৩০ বছর পরে এখনো তা হয়নি।) সে কথার উত্তরে কবি বলেন যে, তেমন চেষ্টা করলে বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর লেখা সম্ভব হতেও পারে। কিন্তু যতীন্দ্রমোহন তা মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ঈশ্বর গুপ্ত এক সময়ে অমিত্রাক্ষরের প্যারোডি করে যা লিখেছিলেন, তিনি তার উল্লেখ করে কবিকে একটু ঠাট্টা করেন। ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন:
কবিতা কমলা কলা পাকা যেন কাঁদি
ইচ্ছা হয় যত পাই পেট ভরে খাই।
বলা বাহুল্য, ঈশ্বর গুপ্তের এই প্যারোডিও অযোগ্য প্যারোডি। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের ঠাট্টা শুনে মাইকেল অমনি চটে গেলেন। বললেন: ‘বুড়ো ঈশ্বর গুপ্ত পারেননি বলে, আর কেউ বাংলায় অমিত্রাক্ষর লিখতে পারবে না, এটা আমি বিশ্বাস করিনে।’ তর্কের শেষে তিনি বললেন: ‘আমি শিগগিরই আপনার ভুল ভাঙিয়ে দেবো। আর যদি প্রমাণ করতে পারি, অমিত্রাক্ষর লেখার জন্যে বাংলা ভাষা যথেষ্ট উপযোগী, তা হলে কী হবে? যতীন্দ্রমোহন বললেন: ‘তা হলে অমিত্রাক্ষর ছন্দে আপনি কোনো কাব্য রচনা করলে, আমি তা আমার ব্যয়ে ছাপিয়ে দেবো।’ হাত তালি দিয়ে কবি বললেন: ‘দুতিনদিনের মধ্যেই আপনি কয়েকটি স্তবক দেখতে পাবেন।’৭০
যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর
কয়েকটি স্তবক নয়, তিন-চার দিনের মধ্যে তিনি যতীন্দ্রমোহনকে দেখতে পাঠালেন তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যের গোটা প্রথম সর্গ। তিনি যেমন গৌরদাসের খোঁচা খেয়ে শর্মিষ্ঠা রচনা করেছিলেন, তেমনি যতীন্দ্রমোহনের খোঁচায এখন অমিত্রাক্ষর ছন্দে তাঁর প্রথম বাংলা কাব্য রচনার সূত্রপাত করলেন। আসলে তিনি ছিলেন অসাধারণ শক্তির অধিকারী। তবে অনেক সময়ে নিজের থেকে সেই শক্তিকে কাজে খাটানোর উৎসাহ অথবা উদ্যম পেতেন না। কিন্তু জেদের মুখে তাঁর সুপ্ত ক্ষমতা বন্যাধারার মতো সব বাধ ভেঙে বেরিয়ে পড়তো। পরেও এর দৃষ্টান্ত দুর্লক্ষ্য হবে না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, অমিত্রাক্ষরের কোনো ঐতিহ্য না-থাকা সত্ত্বেও তিনি কী করে বাংলায় অতো দ্রুত অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা রচনা করতে সক্ষম হলেন? আসলে এটাকে যতোটা আকস্মিক বলে মনে হয়, কবির জন্যে অতোটা আকস্মিক ছিলো না। আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি, অমিত্রাক্ষর ছন্দ তাঁর কাছে কিছু নতুন ছিলো না। হিন্দু কলেজে পড়ার সময়ে ১৭/১৮ বছর বয়সে তিনি একবার একটি চতুর্দশপদী লিখতে চেষ্টা করেছিলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দে। কৈশোরক উচ্ছাসবশত সেটিকে সনেট বলেই দাবি করেছিলেন!) তবে সে ছিলো নিতান্ত ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়াস। তা ছাড়া, তার সাফল্যও ছিলো খুব সীমিত। তারপর রীতিমতো অনুশীলনের সুযোগ পান Visions of the Past রচনা করার সময়ে। তৃতীয় বার পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগ পান কাব্যনাট্য Rizia-য় এসে। সুতরাং ভাষা ভিন্ন হলেও অমিত্রাক্ষরের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি ভালো করে অবহিত ছিলেন। এ ছন্দ নিয়ে তিনি কেবল ভাবেননি, এ নিয়ে রীতিমতো পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। বাংলাতেও দু-চার পঙ্ক্তি রচনা করার চেষ্টা করেছিলেন কিনা, কে জানে? পয়ার এবং ত্রিপদীর কঠোর শিকলে বাংলা ছন্দের হাত-পা যে বাঁধা এ তিনি হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছিলেন। যতি এবং অন্ত্যমিলের এই কঠোর নিয়মের মধ্যে থেকে ছন্দ এবং ভাষা যে তার কোমল সৌন্দর্য এবং স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হয় – এ-ও তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন। একটি চিঠিতে তিনি এ সম্পর্কে লিখেছিলেন যে,চীনা মেয়েদের যেমন লোহার জুতো পরিয়ে তাঁদের পায়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে আটকে রাখা হয়, বাংলা ছন্দের নিয়মও তেমনি ভাষার স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করে।৭১ ছন্দ সম্পর্কে তাঁর এই বিশ্বাস এতো আন্তরিক এবং প্রবল ছিলো যে, কয়েক বছর পরে তিনি এ নিয়ে আবেগপূর্ণ একটি সনেটও লিখেছিলেন:
বড়ই নিষ্ঠুব আমি ভাবি তারে মনে,
লো ডাষা, পীড়িতে তোমা গড়িল যে আগে
মিত্রাক্ষর-রূপ বেড়ি! কত ব্যথা লাগে
পর যবে এ নিগড় কোমল চবণে ॥
স্মরিলে হৃদয় মোর জ্বলি উঠে বাগে!
ছিল না কি ভাব-ধন, কহ, লো ললনে,
মনের ভাণ্ডারে তার, যে মিথ্যা সোহাগে
ভুলাতে তোমারে দিল এ কুচ্ছ ভূষণে?
একবার অমিত্রাক্ষর রচনার আপাত অসাধ্য সাধন করার পর তিনি যে-উৎসাহ লাভ করেন, তা তাঁকে শত অসুবিধের মধ্যেও দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে দেয়। অফিসে কাজের চাপ, হেনরিয়েটার সাত- আট মাসের গর্ভ, প্রহসন রচনা এবং পদ্মাবতী শেষ করার কাজ-ইত্যাদির মধ্যেও তিনি তিলোত্তমার দ্বিতীয় সর্গ লিখে ফেললেন। তিলোত্তমার ধারণাটি এতো অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কী করে সম্পূর্ণ অনায়ত্ত একটি ছন্দে লিখে ফেললেন, তা-ও নিঃসন্দেহে বিস্ময়ের ব্যাপার। তিলোত্তমার কাহিনী তিনি প্রধানত ভিত্তি করেছিলেন হিন্দু পুরাণের ওপর। তবে কেবল দৃষ্টিভঙ্গিতেই নয়, কাহিনীতেও তাঁর মৌলিকত্ব কম ছিলো না। এ ক্ষেত্রেও তিনি যে রাতারাতি সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তা নয়। The Captive Ladie-তেও এর আগে দেশীয় কাহিনীর সঙ্গে মৌলিক চিন্তাধারা মিশিয়ে কাহিনী সৃষ্টির কৌশল তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। হিন্দু পুরাণের সঙ্গে গ্রীক পুরাণের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন পদ্মাবতী নাটকেও। সে কারণে, তিলোত্তমাকে যতোটা অভিনব এবং আকস্মিক মনে হয়, আসলে তা নয়। এ ব্যাপারে তাঁর প্রস্তুতি শুস্ক হয়েছিলো অনেক আগে। তিলোত্তমা রচনার কয়েক মাস পরে তিনি রাজনারায়ণ বসুকে লিখেছিলেন একজন খৃস্টান যুবক হিশেবে হিন্দু ধর্মকে তিনি থোড়াই পরোয়া করেন। কিন্তু হিন্দু পুরাণ এতো সুন্দর! যার সামান্য কল্পনাশক্তি আছে, সে-ই একে মোচড় দিয়ে অনেক রস বের করতে পারবে।৭২ সেই হিন্দু পুরাণ থেকে তিনি তিলোত্তমার জন্যে উদারভাবে উপকরণ ধার করেছিলেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও পদ্মাবতীর মতো — ভিনদেশী ধারণাকে তিনি প্রকাশ করেছিলেন দেশী দেবদেবীর ছদ্মবেশে। তবে দেশী-বিদেশী ভাবধারা এবং বিষয়বস্তুর অনুপাত যেমনই হোক না কেন, একদিকে দেবদেবী এবং অন্যদিকে অসুরদের রেখে তিনি যে-কাহিনীকাব্য রচনা করেন, তা আঙ্গিক এবং রসের বিচারে বাংলা কাব্যে একেবারে অভূতপূর্ব। তিনি নিজেও এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। গর্বের সঙ্গে তাই একাধিক জায়গায় বলেছেন: ‘এ কাব্য হলো বাংলা ভাষার প্রথম কাব্য।’৭৩ এই কাব্য রচনা করার সময়ে প্রথম দিকে তিনি এতো উদ্দীপ্ত বোধ করেছেন, বিশেষ করে অমিত্রাক্ষর ছন্দ নিযে যে, তিলোত্তমার পাশাপাশি রিজিয়া এবং সুভদ্রার খানিকটাও এই নতুন ছন্দে রচনা করে ফেলেছিলেন।
এ ধরনের কাব্যের সঙ্গে তখনকার কলকাতার সাহিত্যরসিকদের তেমন কোনো পরিচয় না-থাকলেও, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য যে বাংলা সাহিত্যের দরবারে এক অসাধারণ আগন্তুক, তা বুঝতে অনেকের কষ্ট হয়নি। যতীন্দ্রমোহন এবং রাজারা তো এর প্রশংসা করেছিলেন, অন্য যাঁরা এই কাব্য পড়েছিলেন, তাঁরাও এর মধ্যে মৌলিকত্ব আছে, এটা বুঝতে ভুল করেননি। হিন্দু কলেজের প্রাক্তন ছাত্র রাজেন্দ্রলাল মিত্র ছাত্রজীবন থেকে মাইকেলের চেনা। তিনি ১৮৫৯ সালে বিবিধার্থ সংগ্রহ পত্রিকা সম্পাদনা করছিলেন। তিলোত্তমার প্রথম সর্গের পাণ্ডুলিপি দেখে অমনি তিনি তা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন। মাইকেল এ সর্গ রচনা করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এটি বিবিধার্থ সংগ্রহে ছাপা হয় শ্রাবণ (১৮৫৯) সংখ্যায়। তার পরের মাসে ছাপা হয় দ্বিতীয় সর্গ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কবির নাম তাতে ছাপা হয়নি। বরং রাজেন্দ্রলাল এই প্রকাশিত অংশের সঙ্গে একটা কৈফিয়ত জুড়ে দিয়েছেন। তিনি লেখেন:
কোন সুচতুব কবির সাহায্যে আমরা নিম্নস্থ কাব্য প্রকটিত করিতে সক্ষম হইলাম। ইহার রচনপ্রণালী অপর সকল বাঙ্গালী কাব্য হইতে স্বতন্ত্র। ইহাতে ছন্দ ও ভাবের অনুশীলন, ও অন্ত্যযমকের পরিত্যাগ করা হইয়াছে। ঐ উপায়ে কি পৰ্য্যন্ত কাব্যের ওজোগুণ বর্ধিত হয তাহা সংস্কৃত ও ইংরাজী কাব্য পাঠকেরা জ্ঞাত আছেন। বাঙ্গালীতে সেই ওজোগুণের উপলব্ধি করা অতীব বাঞ্ছনীয়: বর্তমান প্রবাসে সে অভিপ্রায় কি পৰ্য্যন্ত সিদ্ধ হইয়াছে তাহা সহৃদয় পাঠকবৃন্দ নিরুপিত করিবেন।৭৪
পত্রিকার সম্পাদক কাব্যের অংশবিশেষ প্রকাশ করতে সাহস পেলেন; সেই অংশের কাব্যগুণ এবং ছন্দের অভিনবত্বের উচ্চ প্রশংসা করলেন – অথচ কবির নাম প্রকাশ করলেন না কেন, বলা মুশকিল। সম্পাদকের মন্তব্য থেকে মনে হয় না, সে নাম প্রকাশে তাঁর তেমন কোনো আপত্তি ছিলো। কারণ আপত্তি থাকলে অথবা এই কাব্যকে যথেষ্ট উঁচু মানের বলে মনে না-করলে, তিনি এই কাব্য প্রকাশই করতেন না। আমার ধারণা, আপত্তি ছিলো স্বয়ং কবির। তিনি অমিত্রাক্ষর লিখে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলেন, কিন্তু পাঠকরা এই অভিনব ছন্দের কাব্যকে কেমনভাবে গ্রহণ করবেন, বিশেষ করে ‘মাইকেল’ নামের এক ম্লেচ্ছ কবির রচনাকে, সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। সে জন্যে, পত্রিকায় নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। এক সময়ে কলকাতায় The Captive Ladie কাঙ্ক্ষিত সমাদর লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছিলো, সেই অভিমান এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবই হয়তো তাঁকে নিজের নাম গোপন রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিলো – প্রথমে দেখতে চেয়েছিলেন পাঠক এবং সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়।
পত্রিকায় প্রকাশের অব্যবহিত পরে এই কাব্যের কোনো প্রতিকূল সমালোচনা শুনে তিনি নিরুৎসাহ্ হয়েছিলেন কিনা জানা যায় না। কিন্তু, পদ্মাবতীর মতো এই কাব্য রচনার কাজও হঠাৎ মাঝ পথে বন্ধ রেখেছিলেন। তারপর প্রায় পাঁচ-ছ মাস পরে তিনি এটা শেষ করেন। তা-ও এক বারে শেষ করেছিলেন কিনা সন্দেহ করি। কারণ, তিনি লিখেছেন: তৃতীয় সর্গের শেষে তিনি কাব্যটি সমাপ্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যতীন্দ্রমোেহনের অনুরোধে কাহিনীটি চতুর্থ সর্গ পর্যন্ত টেনে নেন। সুন্দ- উপসুন্দকে তিনি যে যথেষ্ট প্রাধান্য দিয়ে পাঠকদের সামনে হাজির করেননি, সে সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। গোড়াতে তিনি মোট পাঁচটি সৰ্গ লিখতে চেয়েছিলেন। রাজনারায়ণ বসুকে তিনি লিখেছিলেন: ‘পঞ্চম সর্গটি লিখিনি ছাপার জন্যে বেচারা যতীন্দ্রমোহনের খরচ বেড়ে যাবে বলে।’৭৫ এ কোনো যুক্তিপূর্ণ কৈফিযৎ নয়। আমার ধারণা, তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি যেভাবে সুন্দ- উপসুন্দের পরস্পরকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে তাড়াহুড়ো করে কাব্যটি শেষ করেন, তার সঙ্গে বিস্তারিত প্রস্তুতি পর্বের সামঞ্জস্য নেই।
সে যাই হোক, খুব সম্ভব ১৮৬০ সালের জানুআরি মাসে ছাপার জন্যে তিনি এ কাব্যের পাণ্ডুলিপি শেষ করেন। ১৪ ফেব্রুআরি যতীন্দ্রমোহন ঠাকুবতীকে লেখেন: ‘চতুর্থ সর্গ পড়ার কাজ শেষ করেছি। আমার ভয় হচ্ছিলো, আমার জন্যে পাছে ছাপার কাজে দেরি হয়ে যায়। তাই আমি খানিকটা অবসরের সময় বেছে নিযে বইটা শেষ করে ফেলেছি। পড়তে গিয়ে আমার এতো ভালো লেগেছিলো যে, নিজের অজ্ঞাতেই এই বই-এর শেষে পৌঁছে তিলোত্তমাসম্ভব। গিয়েছিলাম। আমার ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক ফলে গেছে – কাব্যদেবী অকাতরে আপনার জন্যে গৌরব কাব্য। নিয়ে এসেছেন। তৃতীয় সর্গের চেয়েও এই সর্গটা ভালো হয়েছে। ‘৭৬ পাছে ছাপার কাজে দেরি হয়ে যার, যতীন্দ্রমোহন সে জন্যে দ্রুত পাণ্ডুলিপি পড়ে ফেললেও, ছাপার কাজে শেষ পর্যন্ত কিছু দেরি হয়েছিলো। ২৪ এপ্রিল কবি রাজনারায়ণ বসুকে যে-চিঠি লেখেন, তা থেকে জানা যাচ্ছে, তখনো সে বইটি প্রকাশিত হয়নি। তবে তিন সপ্তাহ পরে যখন আবার চিঠি লেখেন, তখন জানান যে, বইটি সবেমাত্র প্রকাশিত হয়েছে।৭৭
তিলোত্তমার নামপএ
গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবার পর বাংলাপত্রপত্রিকায় এ কাব্যের মোটামুটি অনুকূল সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিলো। মাস দুয়েকের মধ্যেই সোমপ্রকাশ পত্রিকায় দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের সমালোচনা ছাপা হয়। দ্বারকানাথ সংস্কৃত পণ্ডিত হলেও প্রাচীনপন্থী ছিলেন না। তিনি কবিব অভিনবত্ব দেখে তার নিন্দা করেননি। বরং তাঁর পাণ্ডিত্য এবং কবিত্বের প্রশংসা করেছিলেন এবং তাঁর ভাষার সৌন্দর্য এবংনতুন ছন্দের অশেষ সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। সমালোচনা করেছিলেন তাঁর বিষয়বস্তুর এবং ভাষার কাঠিন্যের।৭৮ বিবিধার্থ সশ্রহে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সমালোচনা বের হয় বছরের শেষ দিকে। তাতে তিনি কবির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। কবির শব্দ ব্যবহারের সমালোচনা করলেও, ‘বর্তমান কাব্য বঙ্গভাষার প্রধান কাব্যমধ্যে গণ্য হইবে, সন্দেহ নাই’ বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।৭৯
তিলোত্তমা যখন প্রথম লিখেছিলেন, তখন কবি এই কাব্যের মান সম্পর্কে ঠিক আত্মবিশ্বাস লাভ করতে পারেননি। তা ছাড়া, নিজের চার দিকে এমনকাউকে পাননি, যিনি এ কাব্যের যথার্থ সমালোচনা অথবা মূল্যায়ন করতে পারতেন। এ কাব্যে তিনি দেশীবিদেশী উপাদানের যে-সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন এবং যে-নতুন ছন্দ প্রবর্তন করেছিলেন, তা তাঁর পাঠকদের জন্যে এ কাব্যকে আরো কঠিন করে তুলেছিলো। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো সাহিত্যিক এবং পণ্ডিতও প্রথমে অমিত্রাক্ষর ছন্দের সৌন্দর্য বুঝতে পারেননি। কবির চিঠি থেকে জানা যায় যে, অমিত্রাক্ষর ছন্দের সৌন্দর্য বুঝতে এবং তা ঠিকমতো পড়তে বিদ্যাসাগবে বেশ কয়েক মাস সময় লেগেছিলো।৮০ বস্তুত যতোটা প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য ছিলো, তিনি যে জীবদ্দশায় তা পাননি, তার কারণ সেকালের বাঙালি পাঠকদের যে-কাব্যরুচি ছিলো, সে তুলনায় তিনি অনেক প্রাগ্রসর রচনা লিখেছিলেন। কেবল তাই নয়, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেও নতুন ধারণা লাভ করার অথবা নিজের সাহিত্যচিন্তাকে পরিষ্কার করার সুযোগ পাননি। অথচ তিনি যে-ইংরেজ রোম্যান্টিক কবিদের ভক্ত ছিলেন, তাঁরা পরস্পর কেবল পরিচিত ছিলেননা, একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত এবং উপকৃত হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে বায়বন, কীটস, শেলী, স্কট, মূর, সাউদি এবংহান্টের মধ্যে যে-ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটেছিলো, তার কথা মনে করা যেতে পারে। তাঁরা তাঁদের জ্যেষ্ঠ সমসাময়িক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থএবংকলরিজেরওকাছাকাছি এসেছিলেন।
রাজেন্দ্রলাল মিএ
অপর পক্ষে, মাইকেলের সাহিত্যসঙ্গী কারা ছিলেন? রোম্যান্টিক কবিদের তুলনায় বলতে গেলে কেউ নন। কারণ, যতীন্দ্রমোহন এবং দুই রাজা-ভ্রাতা তাঁর পৃষ্ঠপোষক থাকলেও, কবির চিন্তাকে প্ররোচিত করার ক্ষমতা তাঁদের ছিলো না। গৌরদাস তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন, কিন্তু তিনি সাহিত্যের সমজদার ছিলেন না। রাজেন্দ্রলাল মিত্র, কিশোরীচাঁদ মিত্র এবং প্যারীচাঁদ মিত্রের সঙ্গে তিনি মিশতেন। কিন্তু এঁরা কেউ কবি-নাট্যকার ছিলেন না। বিদেশী সাহিত্যে এঁদের জ্ঞান যে অগাধ ছিলো, তা-ও নয়। ছোটোবেলা থেকে কবিরআর-এক বন্ধু ছিলেন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। কবির চেয়ে বয়সে প্রায় তিন বছরের ছোটো হলেও, পারিবারিক ভিত্তিতেই তাঁরা ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কবি মাদ্রাস থেকে কলকাতায় ফিরে আসার পর, তাঁর সঙ্গে আবার রঙ্গলালের যোগাযোগ হয়। এ সময়ে রঙ্গলাল এডুকেশন গেজেট পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। তবে কবি যখন রাজনারায়ণ বসুর কাছে রঙ্গলালের কথা উল্লেখ করে চিঠি লেখেন (১৮৬০ সালের মাঝামাঝি) তখন তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে সাময়িকভাবে অধ্যাপনা করছিলেন। রেঙ্গলালের সঙ্গে নিজের তুলনা করে তিনি কি নিজের অদৃষ্টকে দোষারোপ করেননি!) এই রঙ্গলাল ছিলেনকবিএকমাত্র কবিবন্ধু। কিন্তু তিনি নিজেই তাঁকে পদ্যলেখক বলে উল্লেখ করেছেন। রঙ্গলাল বিদেশী সাহিত্য জানতেন না, তা বলেননি। কিন্তু রঙ্গলালের দৌড় বড়ো জোর বায়রন, মূর আর স্কট পর্যন্ত, তার বেশি নয় – এই সীমাবদ্ধতার কথাই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন।৮১ তিনি যে-ধ্রুপদী কবিদের দিয়ে পরিণত জীবনে প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাঁদের রচনার সঙ্গে রঙ্গলালের পরিচয় ছিলো সামান্যই। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য তিনি তাঁর বন্ধুকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। শুনে তাঁর বন্ধু প্রশংসাও করেছেন। এমন কি, তিনি লিখেছেন, তাঁর রচনা দিয়ে রঙ্গলাল প্রভাবিত হয়েছেন।৮২ কিন্তু প্রভাবিত হলেও মাইকেলকে তিনি ভাবাতে পারেননি।
কয়েক মাস পরে বিদ্যাসাগরকেও মাইকেল গুণগ্রাহী হিশেবে পেয়েছিলেন। তবে বিদ্যাসাগর সৃজনশীল সাহিত্যিক ছিলেন না। কবি এক চিঠিতে লিখেছিলেন: ‘V… (তিলোত্তমা) পড়ে নিন্দা করেছেন।’৮৩ এই V প্রায় নিঃসন্দেহে বিদ্যাসাগর। অবশ্য অচিরেই বিদ্যাসাগর তাঁর একজন পৃষ্ঠ-পোষকে পরিণত হন। আর বিধবাবিবাহ আন্দোলনে তাঁর অবদানের জন্যে কবিও তাঁর মূর্তি নির্মাণের জন্যে এক মাসের অর্ধেক বেতন চাঁদা হিশেবে দিতে চেয়েছেন।৮৪ বছর দুয়েকের মধ্যে বিদ্যাসাগরের নামে তিনি একটি বইও উৎসর্গ করেন। বস্তূত, গোটা বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর যে অতি অসাধারণ একজন মানুষ তিনি সেটা বিশেষ করেই জানতেন। সে জন্যে, বিদ্যাসাগর যখন তাঁর কাব্যের প্রশংসা করেন, তখন একাধিক চিঠিতে তা উল্লেখ করেছিলেন।৮৫’
রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়
এমতাবস্থায়, তিলোত্তমার মূল্যায়নের জন্যে কবি একমাত্র যাঁর দিকে তাকালেন, তিনি রাজনারায়ণ বসু। দুঃখের বিষয়, সাহিত্য-পাঠক, সমাজ-সংস্কারক এবং ভাবুক হলেও, রাজনারায়ণও কোনো সৃজনশীল সাহিত্যিক ছিলেন না। তবু তিনি তাঁকেই অনুরোধ জানান, তিলোত্তমা সম্পর্কে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় একটা সমালোচনা লেখার জন্যে। কলেজ-জীবনে রাজনারায়ণের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠত ছিলো না, আগেই আমরা তা লক্ষ্য করেছি। কিন্তু বিবিধার্থ সংগ্রহ পত্রিকায় তিলোত্তমা পড়ে তিনি প্রশংসা করে চিঠি লিখেছিলেন।৮৬ হিন্দু কলেজ ত্যাগ করার প্রায় দুদশক পরে এই চিঠির মাধ্যমেই দুজনের মধ্যে নতুন করে পরিচয় এবং বন্ধুতা গড়ে ওঠে। রাজনারায়ণের মন্তব্যে তিনি খুব উৎসাহিত হয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিলো, তিনি এতো দিনে তাঁর কাব্যের একজন সত্যিকার সমজদার পেয়েছেন। সে জন্যে তিনি নিজের থেকে চিঠি লিখে রাজনারায়ণকে এমন কথাও বলেছেন যে, কলকাতায় থাকলে, তিনি তাঁকে এ কাব্য নিয়ে বক্তৃতা করার জন্যেও অনুরোধ করতেন। তিনি আরো লেখেন: রাজনারায়ণ কি কোনো স্কুল- পরিদর্শককে চেনেন না, যিনি তিলোত্তমাকে স্কুলের উঁচু শ্রেণীর পাঠ্য বই হিশেবে সুপারিশ করতে পারেন?৮৭ পাঠ্যবই হলে অনেক কপি বই বিক্রি হবে – সেটা কবির প্রধান লক্ষ্য ছিলো না। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর কাব্য দেশের লোকেদের কাছে পৌছে যাক। তিনি আরো লিখেছিলেন: কাব্যতো শিগগিরই বের হচ্ছে, কিন্তু প্রশ্ন হলো, কজন পড়বে! তিনি আশা করতে পারেননি, তাঁর কাব্যের সৌন্দর্য পাঠকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে না-দিলে, তাঁরা সত্যি সত্যি তা বুঝতে পারবেন। সে জন্যে, তিনি এ কাব্যের সমালোচনা লেখার জন্যে রাজনারায়ণকে অতো অনুরোধ করেছিলেন। ওদিকে, অনেক প্রশংসা করলেও, রাজনারায়ণ শেষ পর্যন্ত এ কাব্যের সমালোচনা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় লেখেননি। তবে তা সত্ত্বেও, আধুনিক কাব্য অথবা অমিত্রাক্ষর ছন্দ সম্পর্কে প্রায় অজ্ঞ পাঠকরাও কবিকে বিস্মিত করে এ বই কিনেছিলেন এবং এক বছরের মধ্যে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের প্রয়োজন হয়েছিলো।
রাজনারায়ণ তখন তিলোত্তমার সমালোচনা না-লিখলেও, অথবা প্রাচীনপন্থীরা তাঁর কাব্যের ছন্দ এবং বিষয়বস্তুর সামলোচনা করলেও, ইংরেজি শিক্ষিত নবীনদের কাছ থেকে কবি অনুকূল সমালোচনা যথেষ্ট পরিমাণে শুনেছিলেন। সে জন্যে, প্রথমে অনিশ্চিত থাকলেও, এক সময়ে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লিখেছেন: ‘কাব্যটা রু করেছিলাম ঠাট্টার মধ্য দিয়ে, কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, আমি আসলে এমন একটা কাজ করে ফেলেছি, যা আমাদের কাব্যকে বেশ এগিয়ে দেবে। অন্তত, ভবিষ্যতে যাঁরা বাংলায় কবিতা লিখবেন, তাঁরা এ থেকে এটুকু শিখতে পারবেন যে, কৃষ্ণনগরের সেই লোকটা, যাঁকে বলা হয় বাংলা কাব্যের জনক, তাঁর থেকে ভিন্ন ভঙ্গিতে কবিতা লিখতে হবে। লোকটা নিজে প্রতিভাবান হলেও কী জঘন্য তাঁর কবিতা!’৮৮ তিলোত্তমা থেকে তিনি যে-আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিলেন, বস্তুত, তাই তাঁকে মেঘনাদবধ এবং বীরাঙ্গনার মতো আরো উন্নত কাব্য রচনার প্রেরণা দিয়েছিলো।
মাইকেল তিলোত্তমার প্রথম দু সৰ্গ লিখেছিলেন মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। যে-ছন্দে তিনি লিখেছিলেন, তার ওপর তখন তাঁর কোনো দখলও ছিলো না। তা ছাড়া, বাংলা শব্দভাণ্ডারও সে পর্যায়ে তাঁর ভালো আয়ত্তে ছিলো বলে মনে হয় না। এক বছর আগে শর্মিষ্ঠা লেখার সময়ে হিন্দু পুরাণও তাঁর কাছে অনায়ত্ত ছিলো। তা হলে তিনি এই অসাধ্য সাধন করলেন কী করে? এর সহজ উত্তর হলো: অমিত্রাক্ষর ছন্দ রচনার পেছনে যেমন বাংলায়না-হোক, ইংরেজিতে তাঁর পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিলো, তেমনি কাব্য রচনায়ও তাঁর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিলো। তদুপরি, সন্দেহ করি, The Captive Ladie লেখার পর তিনি যে অনামী কাব্য লিখতে আবম্ভ করেন এবং তার জন্যে তিনি যে-উপাদান সগ্রহ করেন, তার অনেকটা তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য লেখার সময়ে কাজে লাগিয়েছিলেন। সেদিক দিয়ে মাদ্রাসে তাঁর অনামী কাব্যটি সূর্যালোক না-দেখলেও, তিলোত্তমা গৌড়জনের মন ভোলাতে পেরেছিলো।
তিলোত্তমার দু সর্গ পর্যন্ত লেখার পর কবি যে কয়েক মাস এ কাব্য ফেলে রেখেছিলেন, তার কারণ সম্ভবত যতীন্দ্রমোহনের সঙ্গে বাজিতে জিতে এ কাব্য রচনায় তখনকার মতো তাঁর আগ্রহ হ্রাস পায়। কিন্তু এর পেছনে আরও দুটো কারণ ছিলো বলে মনে হয়। অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে তিনি রীতিমতে ব্যস্ত এবং উদ্বিগ্ন ছিলেন। এর কারণ, প্রথমত তেসরা সেপ্টেম্বর তারিখে খুব ঘটা করে বেলগাছিয়া থিয়েটারে শর্মিষ্ঠা নাটক অভিনীত হয়। সেকালে একটা নাটকের অভিনয় খুব সহজ কাজ ছিলো না। এই অভিনয় উপলক্ষে তাঁর পক্ষে মহড়ায় নিয়মিত হাজির থাকা ছাড়া আরো কিছু বাড়তি দায়িত্ব পালন করাও সম্ভব। তবে তার চেয়েও গুরুতর কারণটা ছিলো পারিবারিক।
হেনরিয়েটার প্রথম সন্তানের জন্ম হয় ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে।৮৯ এই উপলক্ষে সম্পূর্ণ অনাত্মীয় পরিবেশে নিঃসঙ্গ এবং সন্তান লালনে অভিজ্ঞতাহীন হেনবিয়েটাকে তিনি যথেষ্ট সাহায্য দিয়েছিলেন বলে মনে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, হেনরিয়েটা তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন এর সাড়ে ন বছর আগে এবং তাঁর ছোটো ভাই-এর জন্ম হয়েছিলো বিশ বছরেরও আগে। সুতরাং কোনো শিশুকে কিভাবে মানুষ করতে হয়, তিনি কাছ থেকে তা দেখার সুযোগ পাননি। অপর পক্ষে, মাইকেল ছিলেন আগে থেকেই চারটি সন্তানের জনক। এদের মানুষ করেছেন কিনা জানিনে, কিন্তু নিঃসন্দেহে এদের মানুষ হতে দেখেছেন। এই পরিবেশে তিনি যে হেনরিয়েটাকে যথেষ্ট পরিমাণে সাহায্য করেছিলেন, তা প্রায় ধরে নেওয়া যায়। তিনি এবং তাঁর জীবনসঙ্গিনী এই সন্তানের নাম রাখেন হেনরিয়েটা অ্যালাইজা শর্মিষ্ঠা। হেনরিয়েটা নামটা, দেখাই যাচ্ছে, মায়ের দ্বিতীয় নাম থেকে নেওয়া। অ্যালাইজা হলো হেনরিয়েটার মায়ের নাম। আর, মেয়ের জন্মের মাত্র বারো দিন আগে শর্মিষ্ঠা নাটকের সফল অভিনয় দেখে কবি এতোই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, নাটকের নামটাও লাগিয়ে দিলেন মেয়ের নামের সঙ্গে। তৃতীয় নাম হলেও পরবর্তীকালে তিনি অনেক সময়ে তাঁর এই কন্যাকে শর্মিষ্ঠা নামেই শনাক্ত করতেন। এ থেকেও তাঁর প্রথম নাটকের প্রতি দরদের মাত্রা বোঝা যায়।
হেনরিয়েটা কলকাতায় আসার পর পরিচিত অথবা পড়শিদের কাছে তিনি তাঁকে নিশ্চয় স্ত্রী বলেই তাঁর পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের যে কোনো চার্চে গিয়ে বিয়ে হয়নি অথবা রেবেকার সঙ্গে তাঁর যে বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি – এসব তিনি কারো কাছে প্রকাশ করেননি। অসম্ভব নয় যে, শর্মিষ্ঠার ব্যাপটিজমের সময়ে এটা একটা ছোটোখাটো সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। তাঁদের কখন এবং কোথায় বিয়ে হয়েছিলো, ব্যাপটিজমের সময়ে পাছে বিব্রত হবার মতো সেই প্রশ্নটা ধর্মযাজকের মুখ থেকে শুনতে হয়, সম্ভবত সে জন্যে মেয়ের ব্যাপটিজম পিছিয়ে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়েতাঁরা এই আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন মেয়ের জন্মের প্রায় পাঁচ মাস পরে – ১৮৬০ সালের দোসরা ফেব্রুআরি তারিখে তিলোত্তমা ছাপানোর যখন উদ্যোগ চলছিলো এবং প্রহসন দুটি যখন হয় সবেমাত্র প্রকাশিত হয়েছে অথবা দু-এক সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশিত হবার কথা। মাদ্রাসে বসে যখন তিনি প্রথম পিতা হতে যাচ্ছিলেন, তখন উচ্ছাস প্রকাশ করে লিখেছিলেন: হেই, আমার তারকারা উজ্জ্বল হচ্ছে।৯০ কিন্তু আগের অধ্যায়ে লক্ষ্য করেছি, সত্যি সত্যি মাদ্রাসে তাঁর প্রথম কন্যার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গ্রহ-নক্ষত্র হঠাৎ এমন কিছু ভালো ফল দিতে আরম্ভ করেনি। কিন্তু শর্মিষ্ঠার জন্মের সময়ে এবং তার পরবর্তী আড়াই বছর আর্থিক অবস্থার তেমন উন্নতি না-হলেও, সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর খ্যাতি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিলো। শর্মিষ্ঠার জন্মের ঠিক আগে এবং পরে কী বলে তিনি উচ্ছাস প্রকাশ করেছিলেন কে জানে!
কন্যা শর্মিষ্ঠার ব্যাপটিজমের দলিল
ঠিক ন বছর এগারো মাস আগে — ১৮৪৯ সালের আগস্ট মাসে প্রথম সন্তানের পিতা হবার পর যে- আনন্দ পেয়েছিলেন এবং যে-সন্তানদের সঙ্গ থেকে প্রায় চার বছর বঞ্চিত ছিলেন, শর্মিষ্ঠা জন্মের পর তিনি সেই আনন্দই নিশ্চয় পেয়েছিলেন! কিন্তু সেই সঙ্গে ফেলে-আসা সন্তানদের জন্যে দুঃখ কি ঘনীভূত হয়ে দেখা দেয়নি? শর্মিষ্ঠার আধো-আধো কথা এবং হাসি-কান্না কি ব্যর্থ, ফিবি, জর্জ আর মাইকেলের স্মৃতিই তাঁর মনে জাগিয়ে তোলেনি? ছোটো ছেলে মাইকেল মারা গিয়েছিলো কবি মাদ্রাস ত্যাগের অঙ্গ দিন পরে। কিন্তু জীবিত তিনটি সন্তানও কার্যত তাঁর কাছে ছিলো মৃত। এই দাহ কি তাঁকে ভেতরে ভেতরে তুষানলের মতো দগ্ধ করেনি? তিনি যদি সাধারণ মানুষ হতেন, তাঁর হৃদয়ের তন্ত্রীগুলো যদি মোটা হতো, তা হলে এসব তাঁকে কম ব্যথিত করতো। কিন্তু স্পর্শকাতর হৃদয়ের অধিকারী কবির মনের গভীরে সূক্ষ্ম তারগুলো যে নিরন্তর পিলু-বারোঁয়ার ধুন বাজিয়েছে, কোথাও তিনি লিখিতভাবে না-বললেও, সেটা বোধ হয় অস্বীকার করার জো নেই।
কিন্তু রেবেকা এবং ফেলে আসা সন্তানদের জন্যে কাতর হলেও সেই দুঃখকে কারো সঙ্গে তিনি ভাগ করে নিতে পারেননি। হেনরিযেটার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না; এমন কি, গৌরদাসের মতো ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছেও মনের কথা প্রকাশ করে হাল্কা হতে পারেননি। গৌরদাস এবং রাজনারায়ণ বসুর মতো ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা অবশ্য মাইকেলের আগের বিয়ে এবং পবিবারের কী হলো, তা নিয়ে কখনো কখনো জল্পনা-কল্পনা করতেন। কবি মারা যাবার পরে যেমন গৌরদাস বসাককে লেখা একটি চিঠিতে রাজনারায়ণ বসু এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লিখেছিলেন: “তুমি আমাকে লেখোনি, কিন্তু আমি আগেই সন্দেহ করতাম যে, মধু (হেনরিয়েটাকে নিযে) পালিয়ে এসেছিলো।’৯১ বন্ধুরা মাইকেলকে ভালো করেই চিনতেন। তাঁরা জানতেন, পারিবারিক গোপন কথা তিনি কারো কাছে বলবেন না। সে জন্যে তাঁরা হয়তো তাঁকে এ ব্যাপারে একাধিক বার প্রশ্ন করেননি। আর তিনিও এ ব্যাপারে এড়িয়ে যাবার মতো কোনো উত্তর দেওয়া ছাড়া সঠিক উত্তর দেননি।
রেবেকাকে নিয়ে ঘর করলেও মাদ্রাসে থাকার সময়ে অন্তত দু বছর তিনি হেনরিয়েটার সঙ্গে প্রেম করেছিলেন বলে মনে হয়। দ্বৈতজীবন যাপনতাঁর তখন থেকেই আরম্ভ হয়েছিলো। হেনরিয়েটা আসার পর, কলকাতায়ও সেই দ্বৈতজীবনের মহড়া চলতে থাকে — তবে এবারে লুকোনোর প্রয়াস হেনরিয়েটার কাছ থেকে। বস্তুত, কি মাদ্রাস, কি কলকাতা — কোথাও তিনি নিজেকে কারো কাছে ঠিক খুলে ধরতে পারেননি। তাঁর কাব্যেও – বীরাঙ্গনায় — দ্বিতীয় এক ব্যক্তির জন্যে প্রেম নিবেদনের কথা বেশ জোরালোভাবে প্রকাশ করেছিলেন। সে-ও কি আত্মজৈবনিক বিষাদের স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি। কিন্তু দুঃখ তাঁকে কুরে কুরে খেলেও, রোম্যান্টিক কবি আশা করতে, স্বপ্নের জাল বুনতে ভালোবাসতেন। ভাঙা সংসার, লেগে-থাকা দুর্বহ দারিদ্র্য, কর্মস্থানে অসন্তোষ, নিঃসঙ্গতা – সবকিছুর মধ্যেও আরো খ্যাতির খোয়াব দেখেছেন, আইন পড়ে অনেক অর্থ উপার্জন কবার আশা করেছেন, হেনরিয়েটা এবং নতুন সন্তানকে ভালোবেসেছেন, বন্ধুদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করেছেন।৯২ কবিত্বের মতো রসিকতাও ছিলো তাঁর সহজাত। এখানেও তাঁর ব্যক্তিত্বের দুটি কোঠা দেখতে পাই।
সে যাই হোক, কন্যার জন্মের কিছু আগে থেকে আরম্ভ করে চার-পাঁচ মাস অর্থাৎ ডিসেম্বর মাস (১৮৫৯) পর্যন্ত তিনি অন্য কোনো রচনায় হাত দেননি। এ সময়ে তিলোত্তমার পাণ্ডুলিপি মাজা-ঘষা করেছিলেন হতো, জানুআরি মাসের দিকে লেখাও শেষ করেছিলেন। এমন কি, ব্রজাঙ্গনা কাব্যের কিছু কবিতাও সম্ভবত এ সময়ে লিখেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটা ছিলো তুলনামূলকভাবে কম সৃষ্টিশীল। পরবর্তী আলোচনা থেকে দেখা যাবে, এর পরের আড়াই বছর তিনি অনেক বেশি লিখেছিলেন। বলতে গেলে, সেটাই ছিলো তাঁর জীবনের সবচেয়ে উর্বর সময়।
ডিসেম্বর-জানুআরি মাসে প্রকাশের জন্যে তিলোত্তমার চূড়ান্ত রূপ দিতে গিয়ে তিনি অমিত্রাক্ষরের ওপর তাঁর দখল আরো জোরদার করেন। তার চেয়েও বড় কথা, অমিত্রাক্ষরের ভেতর যে-অসীম সম্ভাবনা ছিলো, তা আরো ভালোকরে উপলব্ধি করেন। তা ছাড়া, হিন্দু পুরাণকে ব্যবহার করে আধুনিক কালের উপযোগী মানবিক আগ্রহবিশিষ্ট সাহিত্য সৃষ্টির যে-অনন্ত সম্ভাবনার কথা আগে এক সময়ে লিখেছিলেন, এখন নিজে সেটা আরও পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলেন। আমার বিশ্বাস, এই পরিবেশেই তাঁর মাথায় আসে মেঘনাদবধ কাব্যের ধারণা। সুন্দ-উপসুন্দের যে-কাহিনী তিনি তিলোত্তমার জন্যে নির্বাচন করেছিলেন, তার চেয়ে রামায়ণের কাহিনী যে অনেক বেশি নাটকীয় এবং জনপ্রিয়, এ-ও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু মেঘনাদবধ কাব্য (এবং ব্রজাঙ্গনা) তিনি লিখতে শুরু করেন কোনো রকমের ঢাক-ফোল না-পিটিয়ে। এই দুটি বিষয়ের সঙ্গেই হিন্দু ধর্মীয় অনুষঙ্গ অত্যন্ত জোরালো। বাল্যকাল থেকে তিনি নিজেও রামায়ণ এবং রাধাকৃষ্ণের কাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয়েছিলেন।
তাঁর রচনা থেকে সহজেই বোঝা যায়, তিনি পদাবলী পড়েছিলেন ভালো করে। তিনি নিশ্চয় অনেক বার কীর্তনও শুনেছেন। সত্যি বলতে কি, তাঁর পৈতৃক পরিবারের ধর্মবিশ্বাস যেমনই হোক না কেন, কীর্তনের প্রতি তাঁর টান ছিলো আন্তরিক। খৃস্টান তো আগেই হয়েছিলেন, এমন কি তিনি যখন বিলেত থেকে পুরোপুরি সাহেব হয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন, তখনো নস্টালজিয়ার টানে হঠাৎ একদিন তিনি এক আগন্তুকের কাছ থেকে কীর্তন শুনেছেন, এমন ঘটনার কথাও জানা যাচ্ছে।৯৩ তবে পরিণত জীবনে তিনি রাধাকৃষ্ণের কাহিনীর মধ্যে ধর্মীয় নয়, মানবিক প্রেমের সৌন্দর্য এবং আবেদনই দেখতে পেয়েছিলেন; এবং আবেদনের কারণেই খৃস্টান হয়েও তিনি ব্রজাঙ্গনা লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যা লিখছিলেন, তা নিয়ে প্রায় কারো সঙ্গে আলাপ করেননি। এর কারণ, তিনি রাধাকৃষ্ণের কাহিনীর মধ্যে যা দেখতে পেয়েছিলেন এবং চার দিকের লোকেরা এর মধ্যে যা দেখতে পেতেন, তা সম্পূর্ণ আলাদা। রাধা তাঁর চোখে জীবাত্মাব প্রতীক নন, তিনি ‘মিসেস রাধা’ মাত্র। সেই মিসেস রাধার প্রেমের আন্তরিকতা এবং সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। প্রকৃত পক্ষে, তিনি বোধ হয় আশা করেননি, ব্রজাঙ্গনার বিষয়বস্তু নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলা যায়, অথবা সেটা কেউ ঠিকমতো বুঝতে পারবেন। কিন্তু তবু, একটি-দুটি করে তিনি মোট আঠারোটি আধুনিক পদাবলী লিখে ফেলেন। এবং মার্চ-এপ্রিল মাসের মধ্যেই লেখার কাজ শেষ করে ছাপাতে দিয়েছিলেন।
ব্রজাঙ্গনার নামপত্র
কাব্যবিচারে ব্রজাঙ্গনা কতোটা সার্থক হয়েছে, সে সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশেষ করে এর আন্তরিকতা সম্পর্কে। রাধাকৃষ্ণের কাহিনীকে যাঁরা ধর্মীয় অনুষঙ্গে দেখতে পান, তাঁরা এই পদাবলীতে আন্তরিক ভক্তিভাবের অভাব দেখে এর প্রতি কম আকষর্ণ অনুভব করতে পারেন। কিন্তু কবি যে এ কাব্য আন্তরিকতার সঙ্গেই লিখেছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রথম যৌবন থেকে তাঁর মধ্যে গীতলতাব যে-ধারা বহমান ছিলো এবং যাকে তিনি অন্তহীন অধ্যয়নের মাধ্যমে অর্জিত এক ধরনের মননশীলতার আবরণ দিয়ে এপিকী চেহারা দিতে চেষ্টা করেছিলেন, মেঘনাদবধ লেখার ফাঁকে ফাঁকেও সেই গীতলতা ব্রজাঙ্গনার পঙক্তিতে পঙক্তিতে প্রকাশিত হয়েছে। তা ছাড়া, ভাষা এবং ছন্দ নিয়ে তিনি নিরন্তর যে-পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন, ব্রজাঙ্গনায় তা নতুন দিগন্ত স্পর্শ করেছে। স্তবকবিন্যাস এবং অন্ত্যমিলে এ কাব্যে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বল্প-আলোচিত একটি দিকের পরিচয় দিয়েছেন
কেনে এত ফুল তুলিলি, স্বজনি –
ভরিয়া ডালা?
মেঘাবৃত হলে, পরে কি রজনী
তারার মালা?
আর কি যতনে, কুসুমে বতনে
ব্ৰজেব বালা?
আর কি পবিবে কভু ফুলহার
ব্রজকামিনী?
কেনে লো হরিলি ভূষণ লতার
বনশোভিনী?
অলি বঁধু তার; কে আছে রাধার
হতভাগিনী?
এই পঙ্ক্তিগুলোকে বাংলা সাহিত্যের পরবর্তী খ্যাতনামা লিরিক কবিদের লেখা বলেই মনে হয় – অন্তত, মাইকেলের রচনা বলে চেনা যায় না।৯৪
মেঘনাদবধ তিনি মোটামুটি নীরবে রচনা করতে শুরু করেছিলেন – তিলোত্তমার পাণ্ডুলিপি শেষ করার ঠিক পরে, সম্ভবত ১৮৬০ সালের ফেব্রুআরি মাসে। তিনি একদিকে রাম-লক্ষ্মণ আর অন্যদিকে তাঁদের প্রতিপক্ষ হিশেবে রাবণ এবং রাক্ষসদের যেভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন, তখনকার পাশ্চাত্য শিক্ষিত আধুনিক ব্যক্তিদের পক্ষেও এ কাহিনীর তেমন ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব ছিলো না। হতে পারে, সে জন্যেই মেঘনাদবধ কাব্য লেখার গোড়ার দিকে তিনি এ কাব্য সম্পর্কে তাঁর বন্ধুদের তেমন কিছু বলেননি। কাজ একটু এগিয়ে গেলে, তখন দেখাবার কথা ভেবে থাকবেন। তা ছাড়া, তখনো অমিত্রাক্ষর ছন্দ এবং কাব্য রচনায় তাঁর হাত কতোটা এসেছে, সে সম্পর্কে তিনি ষোলো আনা আত্মবিশ্বাস লাভ করতে পারেননি। ২৪শে এপ্রিল তিনি রাজনারায়ণ বসুকে যে-চিঠি লেখেন,তা থেকে আভাস পাওয়া যায়, মেঘনাদবধ কাব্যের বেশ খানিকটা ততোদিনে লেখা হয়ে গেছে। তা না-হলে তিনি এ চিঠিতে লিখতেন না: ‘আমি আমার প্রিয় ইন্দ্রজিতের মৃত্যু উদ্যাপন করতে যাচ্ছি।’ কিন্তু এতোটা রচনা করার পরও তিনি লিখেছেন: ‘আমার মনে হয় না, এখনো আমি কাব্য রচনার কৌশল ঠিকমতো আয়ত্ত করতে পেরেছি। সে জন্যে তোমাদের আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। ইতিমধ্যে কয়েকটা ছোটোখাটো মহাকাব্য লিখে হাত পাকিয়ে নিই! ৯৫ এই চিঠির সঙ্গে রাজনারায়ণের কাছে কবি মেঘনাদবধ কাব্যের প্রারম্ভিক অংশটা পাঠিয়েছিলেন। তাঁর জবানি থেকে জানা যাচ্ছে, এর আগেও তিনি এক বন্ধুকে এই সূচনা অংশটি দেখিয়েছিলেন এবং সেই বন্ধু বলেছিলেন: ‘চমৎকার!’৯৬
এ সময়ে বাল্যবন্ধু রঙ্গলাল প্রায়ই আসতেন মধুর সঙ্গে আলাপ করতে। যে-বন্ধু মেঘনাদের শুরুটা দেখে বলেছিলেন ‘চমৎকার’, তিনি রঙ্গলালও হতে পারেন। তিলোত্তমা পড়ে তিনি যে বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন, তা কবি উল্লেখ করেছিলেন। তবে সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর বিচারবুদ্ধির ওপর তিনি ঠিক ভরসা করতে পারছিলেন না। সে জন্যে বাজনারায়ণের মতামত চেয়ে পাঠান। ছাত্রজীবনে রাজনারায়ণ প্রচুর সাহিত্য পড়তেন। বিবিধার্থ সংগ্রহ পত্রিকায় তিলোত্তমা পড়ে তিনি যে-সমালোচনামূলক চিঠি লিখেছিলেন, তা দেখে কবি বিশেষ আনন্দিত হয়েছিলেন। কারণ তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, রাজনারায়ণের সাহিত্যবোধ রয়েছে। তাঁর মতামত চাওয়ার আর-একটা কারণ বোধ হয় এই যে, সেই পর্যায়ে, ঐতিহ্যিক হিন্দু মূল্যবোধের প্রতি তাঁর আনুগত্যের আপেক্ষিক অভাব ছিলো। কবি ভালো করে জানতেন, রাজনারায়ণ ব্রাহ্ম। বস্তুত, রাজনারায়ণ তাঁকে তাঁর ব্রাহ্ম ধর্ম বিষয়ক উপদেশমালারকপি পাঠিয়েছিলেন৯৭ এবং তিলোত্তমার ইন্দ্ৰচরিত্রেরও প্রতিকূল সমালোচনা করেছিলেন। এই সমালোচনার কারণ, সে পর্বে পৌত্তলিকতা-বর্জিত ব্রাহ্ম ধর্মে তাঁর গভীর আস্থা – মাইকেল এমন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।৯৮
মে মাসের গোড়ায় পদ্মাবতী প্রকাশিত হয়। রাজনারায়ণের কাছে মেঘনাদবধ কাব্যের সূচনা অংশ সম্পর্কে মতামত জানতে চেয়ে তিনি যে-চিঠি লিখেছিলেন, তার জবাবও পানএসময়ে। কিন্তু ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটছিলো। নিজেই লিখেছেন: ‘অফিসের কাজ করি; চার-পাঁচ ঘণ্টা আইন পড়ি,ল্যাটিন, গ্রীক আর সংস্কৃত শিখি – তারপর কবিতাও লিখি। একজন অলস লোককে ব্যস্ত রাখার জন্যে এসব কি যথেষ্ট নয়?’৯৯ রাজনারায়ণ মেঘনাদ সম্পর্কে কী লিখেছিলেন, জানা যাচ্ছে না। কিন্তু অনুমান করি, অনুকূল সমালোচনাই করেছিলেন। তা ছাড়া, সৃষ্টির আনন্দে কবিতখন মশগুল। রাজনারায়ণের চিঠির উত্তর দিতে কদিন দেরি হয়ে গেলো। অবশ্য, তাঁর আত্মবিশ্বাস ততোদিনে যে বেশ মজবুত হযেছে, চিঠির ভাষা থেকে সেটা একেবারে পরিষ্কার। তাই লিখেছেন: ‘বিশ্বনাথের সাহিত্যদর্পণকে আমি কদলী দেখাবো। কোনো আদর্শ নিতে হলে আমি তা নেবো য়োরোপের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের কাছে থেকে – সংস্কৃত সাহিত্য থেকে নয়।’১০০ অবশ্য সেই সঙ্গে এ-ও বলেছিলেন যে, পরিবর্তন আনতে হবে ধীরে ধীরে। কারণ, তিনি জানতেন, একটা জাতির সাহিত্যরুচি এক দিনে গড়ে ওঠে অথবা বদলে দেওয়া যায় না। সে জন্যে, কি নাটক লেখার সময়ে, কি কাব্য লেখার সময়ে সংস্কৃত আলঙ্কারিকদের মতামত তিনি অনেকটাই মেনে নিয়েছিলেন। শর্মিষ্ঠা অথবা তিলোত্তমা লেখার সময়ে তাঁর এই মানসিকতা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু মেঘনাদবধকাব্য লেখার আগে তিনি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস লাভ করেছিলেন। বর্ধিত আত্ম-বিশ্বাসের কারণে সাহিত্যদর্পণকে জলে ফেলে দেবার সাহসী উক্তি করলেও, শেষ পর্যন্ত মহাকাব্য সম্পর্কে সংস্কৃত আলঙ্কারিকদের বিধান তিনি উড়িয়ে দেননি বা দিতে পারেননি। তার সঙ্গে আপোশ করেছিলেন।
একদিকে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবার জন্যে এবং অন্যদিকে খানিকটা লেখার পর সৃষ্টির নেশায় চুর হবার দরুন মেঘনাদবধ রচনায় এ সময়ে বেশ অগ্রগতি হয়। রাজনারায়ণকে লিখেছেন: ‘মেঘনাদ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।’ আশা করেছেন, বছরের শেষাশেষি রচনার কাজ সমাপ্ত হবে। রাজনারায়ণ যে এই কাব্যের সূচনা অংশটি পছন্দ করেছিলেন, তা জানতে পেরে লিখেছেন: শুরুটা তোমার ভালো লেগেছে জেনে আমি খুশি হয়েছি।১০১ তবে তিনি যে-চালে কথাটা লিখেছেন, তাতে মনেহতে পারে, রাজনারায়ণ পছন্দ করেছেন, ভালো কথা, পছন্দ না-করলেও কিছু যেতে-আসতো না। কিন্তু না, রাজনারায়ণের মতামতকে তিনি মূল্য দিতেন। সেকারণে, তিলোত্তমার প্রশংসা অনেকের কাছে শোনা সত্ত্বেও, মে মাসের শেষে অথবা জুন মাসের প্রথম দিকে তিলোত্তমা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে রাজনারায়ণকে সত্যিকার মতামত দেবার জন্যে বারবার অনুরোধ করেছেন। আশ্বাস দিয়ে বলেছেন: ‘সমালোচনা আমি সহ্য করতে পারবো। তুমি যদি এ কাব্যের সমালোচনা করো, তা হলে, দোহাই তোমার, বন্ধু বলে আমাকে খাতির করো না। আমার যতোটা প্রাপ্য আমাকে ততোটাই আচ্ছামতো আঘাত কোরো। যারা সাহিত্যের লেজ নেড়েছিলো, আমি হচ্ছি তাদের মধ্যে অন্যতম ভেজা বেড়াল!’ মে মাসের গোড়ার দিকে পদ্মাবতী প্রকাশিত হবার পর, সে নাটক সম্পর্কেও তিনি রাজনারায়ণের মতামত চেয়ে আন্তবিক অনুরোধ জানিয়েছিলেন।১০২ বস্তুত, তিনি মনে তেন, বড়ো সমালোচক হবার মতো ক্ষমতা তাঁর ছিলো। তাঁকে সে কথা তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন যে, বঙ্গদেশে সাহিত্য খানিকটা রচিত হলেও, সাহিত্য সমালোচনা কী বস্তু, সে সম্পর্কে পাঠকদের কোনো ধারণা ছিলো না। সে জন্যে, রাজনারায়ণকে অনুবোধ জানিযেছেন, দেশবাসীর কাছে সঙ্গত এবং আলোকিত সমালোচনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে।
রাজনারায়ণ এই কাব্যের কিছু দোষত্রুটির দিকে কবির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এর মধ্যে বিশেষ করে ছিলো, করি উপমা সম্পর্কে তাঁর আপত্তি। তাঁর মনে হয়েছিলো যে, মাইকেল চিরাচরিত উপমা ব্যবহার করেন, বিশেষত আদিবাত্মক উপমা।১০৩ রাধাকৃষ্ণের প্রেমের কাহিনী কবি রীতিমতো ভালোবাসতেন – ব্রজাঙ্গনা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তা আমরা লক্ষ্য করেছি। তা ছাড়া, স্থির বিদ্যুতের মতো বহু-ব্যবহৃত উপমাও কবি তিলোত্তমা লাগিয়েছিলেন। রাজনারায়ণ এসবের সমালোচনা করেছিলেন একটি চিঠিতে। কবি এই সমালোচনা প্রসন্নতার সঙ্গে মেনে নেন। উত্তরে লেখেন: ‘মনে কোরো না, তোমার সমালোচনা বন্ধ্যা জমিতে পড়েছে। মেঘনাদে দেখবে কোনো আদিরসাত্মক উপমা নেই, চাঁদের সঙ্গে পদ্মের ভালোবাসার কথা নেই, স্থির বিদ্যুতের উল্লেখ নেই, এমন কি, রাধার বিখ্যাত প্রেমের কথা একবারও নেই।’ আদিরসাত্মক উপমা তিনি তিলোত্তম কেন ব্যবহার করেছিলেন, তার একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বলেছেন: ‘এ হলো কালিদাসের প্রতি আমার পক্ষপাতিত্বের জন্যে।’১০৪ তিনি যে প্রথমে বিশপস কলেজে এবং পরে মাদ্রাসে বেশ ভালো সংস্কৃত শিখেছিলেন – অন্তত কালিদাস পড়ার মতো – সে কথাও তিনি রাজনারায়ণকে মনে করিয়ে দিয়েছেন।
অন্য পাঁচজন শিল্পীর মতোই, মাইকেল কেবল সমালোচকদের মুখ চেয়ে লিখতেন না। মনের আনন্দেই লিখতেন। অবশ্য তিনি যে ভালো লিখছেন, এ আশ্বাস তিনি প্রতি নিয়ত চাইতেন। (সে কি আত্মবিশ্বাসের অভাবে? নাকি, মাদ্রাসে প্রথম কাব্য লিখেকাতি খ্যাতি লাভে ব্যর্থ হওয়ার দরুন?) মেঘনাদবধকাব্যে তিনি বড়ো রকমের একটা পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। তিনি ভালো-মন্দ সম্পর্কে জনপ্রিয় বিশ্বাসের আঁতে ঘা দিয়েছিলেন। তা ছাড়া, রাম-বাবণ সম্পর্কে তাঁর গতানুগতিকতা-বিরোধী মনোভাবের মতো, পযাবের ওপরস্টীম রোলার চালিয়ে তিনি যে-ছন্দ রচনা করেন, তা-ও ছিলো সমান অ-গতানুগতিক। এমন কি, যে-ভাষায় তিনি লিখেছিলেন, সেও অনেকাংশে তাঁর নিজের গড়া। এমতাবস্থায়, সমালোচকদের কাছ থেকে তাঁর আশ্বাসের দরকার ছিলো বৈকি! কিন্তু সমালোচকরা যেমনই দেখতে পান না কেন, মেঘনাদবধকাব্যের বেশ খানিকটা লিখে তিনি নিজে এই কাহিনীর সৌন্দর্য সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারছিলেন। তাই রাজনারায়ণকে লিখেছেন: ‘একজন উৎসাহী খৃস্টান তরুণ হিশেবে হিন্দু ধর্মকে আমি এক চুলও পরোয়া করিনে। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের চমৎকার পৌরাণিক কাহিনী আমি ভালোবাসি। কী কাব্যিক! যার কল্পনা করার মতো ক্ষমতা আছে, তেমন কেউ একে ব্যবহার করে সুন্দরতম বস্তু তৈরি করতে পারবে।’১০৫ নিজের ধর্মবিশ্বাস এবং হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে তাঁর মনোভাব এখানে তিনি অতো খুলে বলতে পেরেছেন সম্ভবত রাজনারায়ণকে লিখেছিলেন বলে। তিনি জানতেন, সে পর্যাযে রাজনারায়ণ নিজেকে ঐতিহ্যিক হিন্দু ধর্ম থেকে দূরে ব্রাহ্ম বলে শনাক্ত করতেন।
মাইকেল চিঠিপত্রে অনেক বিষয়ে মন খুলতে পারতেন। বিশেষ করে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে উচ্ছসিত হতে পারতেন। তবে তাতে নিজের ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক খবর সামান্যই দিতেন। কিন্তু এই মাত্র যে-চিঠির উল্লেখ করলাম, সেই চিঠিতে তিনি হেনরিয়েটা সম্পর্কে দুটি তথ্য উল্লেখ করেন। একটি সম্ভবত তাঁর পিতার মৃত্যু সম্পর্কে। তিনি লিখেছেন: ‘মাস পাঁচেক আগে ইংল্যান্ডে আমার স্ত্রীর এক আত্মীয় মারা গেছেন, তাঁর জন্যে আমি এখন শোক করছি।’১০৬ পাঁচ মাস আগে ইংল্যান্ডে হেনরিয়েটার কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মারা যাওয়া অসম্ভব নয়। তবে, আমার ধারণা, ইনি আসলে হেনবিয়েটার আত্মীয়দের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ –তাঁর পিতা এবং কবির প্রাক্তন সহকর্মী জর্জ জাইলস হোয়াইট। মৃত্যুকালে এঁর বয়স হয়েছিলো ৫৪ বছর। ইনি অবশ্য ইংল্যান্ডে মারা যাননি, ইনি মারা যান মাদ্রাসে, ৭ জানুআরি।১০৭ কবি যে গোপনীয়তা অবলম্বন করেন, তার মধ্যে হেনরিয়েটার সত্যিকার পরিচয় গোপন করার প্রয়াস থাকতে পারে। মনে রাখা দরকার, এ চিঠিতে তিনি হেনরিয়েটাকে সরাসরি স্ত্রী বলে পরিচয় দিলেও, তাঁর সঙ্গে কোনো দিনই বিয়ে হয়নি। এই দুর্বলতার কারণে, তিনি আগাগোড়া তাঁর সম্পর্কে খানিকটা গোপনীয়তা পালন করেছেন। মৃত্যুর অল্প আগে তিনি সন্তানদেরও তাঁদের জননীর পরিচয় দিয়ে যাননি। অবশ্য যাঁর সঙ্গে তিনি পনেরো বছর স্বামী-স্ত্রীর মতো একত্রে বাস করেছেন, কিন্তু প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ করতে পারেননি বলে, বিয়ে করতে পারেননি – তাঁকে তিনি নিজের অন্তরে স্ত্রী ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেন বলে মনে করা যায় না।
আলোচ্য চিঠিতে হেনরিয়েটা সম্পর্কে কবি দ্বিতীয় যে-তথ্যটি উল্লেখ করেন, সেটি হলো, রাজনারায়ণের স্ত্রী তিলোত্তমার প্রথম পাঠিকা নন; তাঁর আগে হেনরিয়েটা এ কাব্য পড়েছেন। এ বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। হেনরিয়েটা বাংলা শিখে এ কাব্য পড়ে তার সৌন্দর্য বুঝতে পেরেছিলেন, তা মনে হয় না। কিন্তু, এটা থেকে তাঁর চরিত্রের আভাস পাওয়া যায়। তিনি কবির সত্যিকারের সঙ্গিনী হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি যে বাংলা শিখেছিলেন বছর চারেক পরে লেখা কবির আর-একটি চিঠি থেকেও তা জানা যায়। The Captive Ladie, Upsori, Rizia অথবা তাঁর অনামা কাব্যটি পড়ে রেবেকা কতোটা প্রশংসা করেছিলেন অথবা কবিকে কতোটা উৎসাহ দিয়েছিলেন, তা জানার উপায় নেই। কিন্তু এটা জানা যাচ্ছে, হেনরিয়েটা উপলব্ধি করেছিলেন যে, তাঁর জীবনসঙ্গী অর্ধেক বাস্তব বিশ্বে বাস করেন, অর্ধেক স্বপ্নের জগতে। সুতরাং গোটা মানুষটাকে পেতে হলে, তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে বোঝা দরকার, আর দরকার তাঁকে রচনায় সম্যক উৎসাহ দেওয়া।
নিজের কথা বলতে গিয়ে কবি রাজনারায়ণকে এক জায়গায় লিখেছেন: “আসলে আমি দারুণ অলস। কিন্তু এক-একটা সময়ে আমার মধ্যে লেখার নেশা জেগে ওঠে। তখন আমি পাহাড়ী নদীর মতো তরতর করে এগিয়ে যাই।’ তিনি অলস ছিলেন না মোটেই। তিনি রুটি-রোজগারের কাজ ছাড়াও কখনো কখনো রোজ বারো ঘণ্টা লেখাপড়া করতেন, আমরা আগে তা দেখেছি। খুব বন্ধুবৎসল হলেও, অলস গল্প করে তিনি সময় কাটাতে পছন্দ করতেন না। নিজের জীবনযাত্রার পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন: কলকাতার খবরের কাগজ আমি একদম পড়িনে। বাড়ি থেকে বের হই কালেভদ্রে।’১০৮ হেনরিয়েটা কলকাতায় আসার পর থেকে তাঁর সামাজিকতা করার সুযোগ আরো কমে যায়। নিঃসঙ্গ সঙ্গিনীকে বাড়িতে একা ফেলে রেখে বাইরে গিয়ে তিনি সময় কাটাতেন না। তদুপরি, আগের সেপ্টেম্বরে কন্যার জন্মের পর এই সুযোগ আরো কমে যাওয়াই স্বাভাবিক।
তা ছাড়া, তিনি বাইরে যাবেন কোথায়? কার সঙ্গে আড্ডা দেবেন, অথবা কথা বলবেন? তিনি যে-ধ্রুপদী সাহিত্যের পৌরাণিক জগতে বাস ব্রতেন, অনেক ইংরেজি-শিক্ষিত লোক থাকলেও, সে জগতে তাঁর সঙ্গে বিচরণ করার মতো অন্য কোনো দোসর তাঁর চারদিকে ছিলো না। এক জায়গায় চিঠিতে তিনি লিখেছেন, তিনি বাস করেন মৃতদের মধ্যে।১০৯ আরো একটা কথা মনে রাখা যেতে পারে, মাদ্রাসে তাঁর ইংরেজ / অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বন্ধু ছিলো, কিন্তু কলকাতায় তেমন ঘনিষ্ঠ কোনো ইংরেজ অথবা ফিরিঙ্গি বন্ধু ছিলো না। কারণ, কলকাতায় দেশীয় আর ইংরেজদের মধ্যে একটা দুর্লঙ্খনীয় কাঁটাতারের বেড়া ছিলো। ফ্যাগানের মতো লোককে তিনি পছন্দ করতেন; কিন্তু সামাজিক মেলামেশার জন্যে পুলিশ কোর্টের একজন দোভাষী অথবা লিগ্যাল ক্লার্কের সঙ্গে জজের দূরত্ব ছিলো যোজন যোজন। বরং, কলকাতায় এলে, গৌরদাস তাঁর কাছে আসতেন গল্প করতে। ১৮৬০ সালে রঙ্গলালও তাঁর কাছে আসতেন বেশ ঘন ঘন। এরকমের বাল্যবন্ধুদের সঙ্গেই তিনি যা আড্ডা দিতেন। নয়তো বাড়িতেই থাকতেন হেনরিয়েটার সঙ্গে।
গরমের সময়ে গেলাশের পর গেলাশ বীয়ার খেতেন বরফ দিয়ে। কখনো শেরি। কখনো আরো কড়া পানীয়। তবে লেখার নেশায় যখন কুঁদ হতেন, তখন সেটাই যথেষ্ট হতো। তখন আর শরাবের দরকার হতো না। সত্যি বলতে কি, তখন তিনি ইচ্ছে করেই মদ্যপান করতেন না। কারণ মদ্যপান করলে তিনি সীমা রাখতে পারতেন না। আর অপরিমিত পান করার পর কিছুতেই ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে উঠতে পারতেন না। রাজনারায়ণের কাছে হলপ করে লিখেছেন: তিলোত্তমার একটি লাইনও তিনি নেশার ঘোরে লেখেননি। উল্টো, মদের নেশা হলে তিনি লিখতেই পারেন না।১১০ হেনরিয়েটা মাদ্রাসে থাকতে মদ্যপান করতেন কিনা, জানার উপায় নেই। ধারণা করি, করতেন না। তিনি ছিলেন বাড়ির অল্পবয়সী অবিবাহিত বেকাব কন্যা; পিতা এবং বিমাতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিলো মন কষাকষিব; তদুপরি মাদক জাতীয় পানীয়ের দামও যথেষ্ট। এমতাবস্থায়, নিয়মিত মদ্যপান না করাবই সম্ভাবনা। কিন্তু কলকাতায় এসে তিনি অচিরেই মদ্যপায়ী মাইকেলেব পানীয়-সঙ্গিনী হয়েছিলেন।
কবির চরিত্রে দ্বৈত ব্যক্তিত্ব দেখা যায় – এ সম্পর্কে আগেই ইঙ্গিত করেছি। স্রষ্টা মাইকেল আর পার্থিব ভোগের প্রতি লোভী, নিজেকে জাহির করতে সদাব্যস্ত, অহঙ্কারী, গাপ্লিক, আর-পাঁচজন-সাধারণ-মানুষের-মতো একজন রক্তমাংসের মানুষ মাইকেলের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান ছিলো। তিনি নিশ্চয় অনেক সময়ে রেবেকা অথবা হেনরিযেটার স্তরে নেমে আসতে পাবতেন, কিন্তু কখনো কখনো তিনি যে তীদের থেকে অনেক দূরে সরে যেতেন, তা বলাই বাহুল্য। অনুমান কবি, হেনরিয়েটাও অচিরে বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর সঙ্গে গল্প করার চেয়ে লেখাপড়া করতেই তাঁর সঙ্গী বেশি পছন্দ করেন। এবং এই উপলব্ধি থেকে হেনরিয়েটা যদি বেশি করে নিঃসঙ্গ বোধ করে থাকেন, তা হলে অবাক হবার কিছু নেই।
নিজেকে বারবার অলস আখ্যা দিয়ে কবিযা বলতে চেয়েছেন, তা হলো: লেখার ব্যাপারে তাঁর একটা আলস্য আছে। কেবল চিঠি লেখার ব্যাপারে নয়, কাব্য, নাটক ইত্যাদি লেখার ব্যাপারেও তিনি এই আলস্য অনুভব করতেন। তবে একবার লিখতে শুরু করলে লেখার তোড়ে কোথায় ভেসে যেতেন, নিজেই তা টের পেতেন না। এ যে কেবল তাঁর রচনার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করি, তা নয়। একবার আলসেমি কাটিয়ে উঠে বন্ধুদের যখন লিখতেন, তখনো কথার ঘোরে, ভাবনার উচ্ছাসে অনেক সমযে ভেসে যেতেন। হাতের লেখায় তাঁর এক-একটা চিঠির দৈর্ঘ্য বিবেচনা করলে বোঝা যায়, তিনি কাগজ- কলম নিয়ে বসলে লিখতে কতো ভালোবাসতেন।
জ্যোতিষীরা বলেন, আগুনের ঘরে যাদের জন্ম, তাদের উৎসাহ নাকি আগুনের মতো মুহূর্তের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, আবার সেই উৎসাহকে অল্প সময়ের মধ্যে পুড়িয়ে ফেলে সে আগুন নিভেও যায় অচিরে। পঁচিশে জানুআরি জন্ম হয়ে থাকলে,১১১ পাশ্চাত্য জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী কবির জন্ম আগুনের নয়, তাঁর জন্ম বায়ুর ঘরে। কিন্তু বারবার তাঁর মধ্যে দ্রুত উৎসাহ জন্ম নিতে এবং দ্রুত আবার সে উৎসাহ নিভে যেতে দেখি। একনাগাড়ে তিনি দীর্ঘ দিন কিছু করতে পারেননি, লিখতে তো নয়ই। মাদ্রাসে The Captive Ladie শেষ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অনামা কাব্যটি অথবা Rizia শেষ করতে পারেননি। কলকাতায়ও পদ্মাবতী লেখার আগে খুব উৎসাহ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু লিখতে লিখতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। এ ছাড়া, তিলোত্তমা তিন সর্গেই শেষ করতে চেয়েছিলেন। বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে লেখা আরম্ভ করেছিলেন; শেষ করেননি। প্রহসন লিখে খুব সফল হলেও, পরে মন্তব্য করেছিলেন, প্রহসন লেখার সময় হয়নি। কিন্তু ১৮৬০ সালের শুরু থেকে আরম্ভ করে পরের বছর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তাঁর মধ্যে একটা আশ্চর্য ব্যতিক্রম লক্ষ্য করি। এমন বিবতিহীন সৃষ্টির উৎসাহ তার মধ্যে এর আগে অথবা পরে কখনো দেখা যায়নি।
পদ্মাবতী আগেই শেষ করেছিলেন – বছরের (১৮৬০) গোড়ার দিকে। তারপর বসেন তিলোত্তমা। শেষ করতে। তিলোত্তমা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে লিখতে আরম্ভ করেন মেঘনাদবধ কাব্য। এ কাব্য লেখার জন্যে তিনি সময় নিয়েছিলেন কমবেশি এক বছর। অন্য কোনো রচনার জন্যে তিনি এতো সময় নেননি অথবা এতোটা সময় তিনি কোনো রচনায় অব্যাহত মনোযোগও রাখতে পারেননি। বস্তুত, রামায়ণ থেকে কাহিনীর কাঠামো নিলেও মেঘনাদবধে তিনি এতো মৌলিকত্ব দেখিয়েছিলেন – অন্য ভাষায়, এতো নতুনত্ব সৃষ্টি করেছিলেন যে, একেবারে শেষ পর্যন্ত তিনি একটা চ্যালেঞ্জ এবং সৃষ্টির আনন্দ অনুভব করেছেন। তাই গোড়াতে তিনি এ কাহিনী যতো বড়ো হবে বলে মনে করেছিলেন, খানিকটা লেখার পর বললেন, না, আরো বড়ো হবে। প্রথমে বলেছিলেন, মোট পাঁচটি সর্গ থাকবে। তারপরে বললেন, সর্গ থাকবে নটি। তারপর আবার বলেন, দশটি। আসলে, তাঁর প্রকৃতির কথা চিন্তা করলে মেঘনাদবধকাব্যকে একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা বলে মনে হয়। তবে মেঘনাদবধ রচনা করার সময়েও তিনি যে অন্য দিকে মনোযোগ দেননি, তা নয়। অগস্ট মাসের গোড়াতে যেমন, তিনি হঠাৎ নতুন একটি নাটক লিখতে আরম্ভ করলেন – কৃষ্ণকুমারী।
মশগুল হয়ে কাব্য রচনা করতে কবতে হঠাৎ তিনি নাটক লিখতে আরম্ভ করলেন কেন, বলা মুশকিল। অভিনেতা কেশব গাঙ্গুলি তাঁকে রাজপুতদেব কাহিনী নিয়ে একটি নাটক লেখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু অনুবোধ জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর সাধের মেঘনাদবধকাব্য লেখার কাজ বন্ধ রেখে নাটক লিখতে আরম্ভ করবেন, এটাকে যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না। আমার ধারণা, হঠাৎ যেমন কথাব ঝোঁকে রত্নাবলীর অনুবাদ করেছিলেন, অথবা শর্মিষ্ঠা লিখতে আরম্ভ করেছিলেন, তেমনি কোনো একটা ব্যাপার ঘটেছিলো। রাজাদের কাছ থেকে অনুরোধ আসাও সম্ভব। যদিও, দুটি প্রহসনের এবং পদ্মাবতী নাটকের অভিনয় না-করিয়ে রাজারা তাঁর বিশ্বাস খানিকটা ধসিয়ে দিয়েছিলেন। কৃষ্ণকুমারী লিখতে আরম্ভ কবার কদিন পরে কেশব গাঙ্গুলিকে তিনি যে চিঠি লেখেন, তা থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, তিনি নিশ্চিতভাবে আশা করেছিলেন, এ নাটক বেলগাছিয়ায় অভিনীত হবে। ‘একটা ঐতিহাসিক নাটক হওয়া সত্ত্বেও এতে আছে মাত্র পাঁচটি কি ছটি পুরুষ চরিত্র আর চারটিনারী চরিত্র। আমি এমন কোনো ছিদ্র রাখিনি যাতে কোনো কৈফিয়ত দিয়ে আমাদের (থিয়েটারের) ম্যানেজার ফসকে যেতে পারেন। ছোটো রাজা (ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ) যদি চারটি নারী চরিত্র নিয়ে আপত্তি করেন, তা হলে তাঁকে বলবেন, চারটির মধ্যে তিনটি চরিত্র অভিনয় করার লোক আমি জুটিয়ে দেবো।’১১২
কারণ যাই হোক, তেসরা অগষ্ট মেঘনাদবধ কাব্যের দ্বিতীয় সর্গের কাজ শেষ করেই তিনি বসে যান নাটকের জন্যে রাজপুতদের একটা জুৎসই কাহিনী খুঁজতে। তেসরা অগস্ট ছিলো বুধবার। বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্ত জেগে তিনি টডের The Annals and Antiquities of Rajasthan পড়তে থাকেন। শুক্রবার ভোর রাতে অর্থাৎ ইংরেজি মতে শনিবার ভোব একটার সময়ে কাব্যদেবী তাঁর ওপর প্রসন্ন হলেন। তিনি একটা দারুণ প্লট পেয়ে গেলেন। তার পরের দিন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুব আর রাজাদের আসরে গিয়ে দিয়ে আসেন নাটকের সারাংশ আর সেই সঙ্গে কী কী চরিত্র থাকবে, তার তালিকা। এর তিন-চার দিন পরে কেশব গাঙ্গুলিকে চিঠি লেখেন। তাতে তাঁর চিরাচরিত স্বভাবের পরিচয় দিয়ে এই নতুন নাটকটি সম্পর্কে প্রচুর উচ্ছাস প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন: ‘একজন সত্যিকার নাট্যরসিক হিশেবে আপনি কৃষ্ণকুমারীর প্রেমে না-পড়ে পারবেন না, আমি যেমনটা পড়েছি। হে বিধাতঃ! কী যে একটা রোম্যান্টিক ট্র্যাজেডি হবে!’ তারপর অভিনয়ের প্রসঙ্গে লিখেছেন: “আপনি কিন্তু রাজাদের একটু চাঙ্গা করে তুলবেন! বেলগাছিয়ার মতো এতো সুন্দর থিয়েটার এখন কিনা বাদুড় অথবা বাদুড়ের মতো লোকদের আড্ডায় পরিণত হযেছে!’১১৩ রাজারা কিন্তু অভিনয়ের ব্যাপারে তেমন কোনো উৎসাহ দেখাননি। তবে যতীন্দ্রমোহন উৎসাহী ছিলেন। বই ছাপানোর প্রস্তাব দিয়ে তিনি মাইকেলকে অনুপ্রাণিত করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কবির বিশেষ আগ্রহ ছিলো অভিনয়ে, বই প্রকাশে নয়। ততোদিনে তাঁর কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু শর্মিষ্ঠার অভিনয় শেষে তিনি যে-আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলেন সে স্বাদ একবারই পেয়েছিলেন। এই চিঠিতে তিনি কেশব গাঙ্গুলিকে লিখেছেন যে, কৃষ্ণকুমারী ছাপানোর ব্যাপারে তাঁর তেমন আগ্রহ নেই। তিনি চান এর অভিনয় হোক। এমন কি, তার জন্যে, তিনি একত্রে অভিনয়ের উদ্দেশে দরকার হলে একটি প্রহসনও লিখে দিতে রাজি ছিলেন। এর দু-এক দিন পরে লেখা আর-একটি চিঠি থেকেও বোঝা যায়, অভিনয়ের ব্যাপারে সুস্পষ্ট আভাসনা-পেয়ে তিনিনাটক লেখা আরম্ভ করতে চাননি। কারণ তখন তিনি বরং মেঘনাদবধকাব্য লেখার কাজ চালিয়ে যাবার আগ্রহ দেখিয়েছেন।১১৪
নাটকের প্লট মনের মধ্যে বেশ স্পষ্ট রূপ নিলেও, তিনি সঙ্গে সঙ্গে নাটক লেখা শুরু করেননি। তখনও কেশব গাঙ্গুলির সঙ্গে নাটকে কি কি চরিত্র থাকবে – তা নিয়ে আলাপ চলেছে।১১৫ সম্ভবত ১৫ অগস্ট তারিখে কেশব গাঙ্গুলির কাছ থেকে অভিনয় সম্পর্কে আশ্বাস লাভের পর তিনি লেখার কাজ আরম্ভ করেন। কিন্তু একবার লেখার কাজ শুরু করার পর পাহাড়ী নদীর বেগে তাঁর কাজ চলতে থাকে। চতুর্থ অঙ্ক শেষ করেন মাস শেষ হবার কদিন আগে। লেখা শেষ করে কেশব গাঙ্গুলির কাছে চতুর্থ অঙ্কের পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে নাটকটি সম্পর্কে প্রচুর উচ্ছাস এবং গর্ব প্রকাশ করেন। হেনরিয়েটা কয়েক মাস আগে বাংলায় তিলোত্তমা পড়েছিলেন বলে কবি উল্লেখ করেছিলেন। অনুমান করি, কৃষ্ণকুমারী লেখার সময়ে তাঁকেও পড়ে শুনিয়েছেন এবং তিনি যে কতো সুন্দর একটি নাটক লিখছেন, তা বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। সে যাই হোক, কেশব গাঙ্গুলিকে বিরল বিনয় প্রকাশ করে তিনি লেখেন: ‘বেলগাছিয়া থিয়েটারের একজন নগণ্য সদস্য হিশেবে এই থিয়েটারের গৌরব বাড়ানোর জন্যে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অন্য সদস্যরা যদি এর পরও ঝিমুতে থাকেন, তা হলে সেটা আমার অপরাধ নয়। ঈশ্বরের নামে বলতে পারি, এ নাটকটার আর কিছু না-থাকলেও এতে অভিনয়ের সীমাহীন সম্ভাবনা রযেছে।’১১৬
চতুর্থ অঙ্ক পড়ে কেশব গাঙ্গুলি কৃষ্ণকুমারীর চুল-চেরা সমালোচনা করেছিলেন — বিশেষ করে তিনি শেকসপীয়রের নাটকের সঙ্গে এ নাটকের তুলনা করেছিলেন। কবি তাতে খুশি হয়েছিলেন কিনা বলা শক্ত। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি এ নাটকটি উৎসর্গ করেছিলেন কেশব গাঙ্গুলির নামে। তা থেকে মনে হয়, অভিনেতা হিশেবে তাঁকে তিনি যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন। তাঁকে তিনি কেবল গ্যারিক বলতেন না, আন্তরিকভাবে তাঁকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বলে বিবেচনা করতেন। অভিনেতার দৃষ্টিকোণ থেকে কেশব গাঙ্গুলি এ নাটকের যে-সমালোচনা করেছিলেন, কবি মেনে নিয়েছিলেন। দু-তিন দিন পরে — পয়লা সেপ্টেম্বর – কেশবের সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কৈফিয়ত দিয়ে বলেছেন: ‘এ নাটকটা বিচার করার সময়ে আপনি যদি শেকসপীয়রের কথা অতোটা না-ভাবতেন, তা হলে ভালো হতো। আপনি যেসব ত্রুটির কথা লিখেছেন, সেগুলো ক্রটি ঠিকই, কিন্তু তার প্রতিটির উর্ধ্বে ওঠা স্বয়ং শেকসপীয়রের পক্ষেও সম্ভব নয়। … আপনি যেভাবে সূক্ষ্ম সমালোচনা করেছেন, তাতে বিশ্বের সকল নাট্যকারই ডুবে যাবেন, একমাত্র শেকসপীয়র ছাড়া। এমন কি, তিনিও বোধ হয় যথেষ্ট কাহিল হবেন।’১১৭ কেশব গাঙ্গুলি সংলাপের ভাষার প্রশংসা করেছিলেন। মাইকেল তাতে খুব খুশি হন। তা ছাড়া, কেশব গাঙ্গুলি নাটকটার সামগ্রিকভাবে যে প্রশংসা করেছিলেন, তাতেও।
তিনি প্রাণপণ আশা করতে থাকেন যে, ছোটো রাজা নিশ্চয় অতঃপর এ নাটকের অভিনয় করাতে রাজি হবেন। কিন্তু তিনি যদি এর প্রশংসা করতে ব্যর্থ হন, তা হলে বুঝতে হবে আমরা বড়ো আগে জন্মেছি।’১১৮ নাটকটি লেখা শেষ করার দুদিন পরে কেশব গাঙ্গুলিকে তিনি যে-চিঠি লেখেন, তাতে আবার অভিনযের প্রসঙ্গ তোলেন। যতীন্দ্র ঠাকুর আর দীনু মিয়া’-কে নিয়ে ছোটো রাজার কাছে দরবার করলে তিনি রাজি হতে পারেন ইত্যাদি অনেক পরামর্শই দিয়েছেন কেশব গাঙ্গুলিকে। এমন কি, তিনি এ-ও লিখেছিলেন যে, ছোটো রাজাকে প্রধান চরিত্র জগৎসিংহের ভূমিকায় অভিনয় করতে অনুরোধ করলে তিনি এ নাটকের অভিনযে উৎসাহ দেখাবেন। সব শেষে আশঙ্কা আর অভিমান করে বলেছেন: ‘প্রহসন দুটির অভিনয়কে কেন্দ্র করে আপনারা আমার ডানা ভেঙে দিয়েছিলেন। এবারে এই নাটক নিয়ে আপনারা যদি আবার তেমন চাল দেন, তা হলে আমি বাংলায় লেখা ছেড়ে দিয়ে হিব্রু অথবা চীনা ভাষায় লিখবো।’ ছোটো রাজার কাছে নিজে কথা পাড়ার ব্যাপারে ঠিক ভরসা পাননি। তাই লিখেছেন: ‘রাজা নিমরাজি হলে, পরশু রোববার বেলগাছিয়ায় আমরা এ নিয়ে আলোচনা করতে পারি।’১১৯
টডের বই থেকে কৃষ্ণকুমারীর কাহিনীর মূল কাঠামো পেলেও, গল্পটা মাইকেলের নিজেরই রচনা। যে-কাহিনী ছিলো রাজাদের ক্ষমতা এবং লোভের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে, তাকেই তিনি প্রেম এবং স্নেহের সঙ্গে কর্তব্যের দ্বন্দ্বে পরিণত করেন। রাজনীতির পটভূমিতে তিনি এই সূক্ষ্ম মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েনকে অসীম সহানুভূতির সঙ্গে অঙ্কন করেছেন। তা ছাড়া, ইতিহাস থেকে ভীমসিংহ, জগৎসিংহ, মানসিংহ এবং কৃষ্ণকুমারীর নাম নিলেও এগুলো এবং অন্য চরিত্রগুলো তাঁর নিজেরই কল্পনা করে নিতে হয়েছে। এ নাটকের কাঠামোয় শেকসপীয়রের প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। সজ্ঞানেই তিনি শেকসপীয়রকে অনুকরণ করেছিলেন। কিন্তু সেখানেও তিনি তখনকার সমাজ এবং বাংলা ভাষা ও নাটকের পরিপ্রেক্ষিতে সচেতনভাবে নানা রকমের রদবদল করে নিয়েছেন। যেখানে যেখানে শেকসপীয়রের কোনো কোনো চরিত্রের সঙ্গে সাদৃশ্য ছিলো, তাও সরাসরি তিনি উল্লেখ করেছেন। যেমন, ধনদাসের চরিত্রের সঙ্গে ইয়াগোর, বলেসিংহের সঙ্গে বার্ডের। তা ছাড়া, নিরপরাধ কৃষ্ণকুমারীকে প্রাণ দিতে হয় – নিতান্ত নিয়তির কারণে — তার এই আত্মত্যাগের ঘটনা চকিতে গ্রীক নাটক ইফিজিনিয়াকেও মনে করিয়ে দেয়।১২০
নারী চরিত্রগুলো কল্পনায় মাইকেল বিশেষ মৌলিকত্ব দেখিয়েছিলেন। যোরোপীয় নারীদের সঙ্গে ভারতবর্ষীয় নারীদের যে আসমান-জমিন ফারাক, সেটা ভালো করে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন: তিনি যদি একটি বিদুষী চরিত্র অঙ্কন করে তাকে পুরুষদের সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে দেখান, তা হলে সেটা হবে অবিশ্বাস্য। ‘আমার চারদিকে একটা গণ্ডী রয়েছে, তার বাইরে পা বাড়ানোর কোনো জো নেই। ফল হয়েছে এই যে, আমাকে বেশ কয়েকটি নারী চরিত্র আমদানি করতে হয়েছে, যাতে করে প্লটের মধ্যে নারীদের ব্যাপারে যে-ঘাটতি রয়েছে, সেখানটাতে একটা পরিপূর্ণতার ভাব দেখানো যায়।’১২১
অভিনয় হবে কিনা, তা নিয়ে নিঃসন্দেহ হতে না-পারায় প্রথম দিকে এ নাটক লেখায় তাঁর কতোটা উৎসাহ ছিলো, বলা মুশকিল। কিন্তু একবার খানিকটা লিখে ফেলার পর তিনি খুব অনুপ্রাণিত এবং উদ্দীপ্ত হয়ে এ নাটক শেষ করেছিলেন। তিনি জানতেন, আঙ্গিক, চরিত্র চিত্রণ, ঘটনার নাটকীয়তা এবং সংলাপ রচনার দিক দিয়ে শর্মিষ্ঠা এবং পদ্মাবতীকে এ নাটক ছাড়িয়ে যাবে। সে কথা মনে রেখে লিখেছেন: ‘আশা করি আমি একটি প্রগতিশীল জীব।’১২২ রাজনারায়ণকে আর-এক চিঠিতে বিনয় করে লিখেছেন: ‘তুমি যখন কৃষ্ণকুমারী পড়বে তখন হয়তো ভাববে যে, অনুশীলন করলে সাহিত্যের এ বিভাগেও এই লেখক মোটামুটি ভালোই করতে পারবে।’১২৩ ভালো করতে পারবেন কেন, তিনি যে তখনকার বাংলা ভাষার যে-কোনো নাটকের চেয়ে ভালো নাটক রচনা করেছিলেন, তা তিনি ভালো করে জানতেন। বিশ্বসাহিত্যে তাঁর যে-জ্ঞান ছিলো, তার পরিপ্রেক্ষিতে অথবা বিনয়বশত তিনি এ মন্তব্য করে থাকবেন। তাঁর সীমাবদ্ধতা — অনাযত্ত ভাষা, বাংলা ভাষায় নাট্য-ঐতিহ্যের অভাব এবং মঞ্চ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা তাঁর তুলনামূলকভাবে কম ছিলো — এ বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তবে তা সত্ত্বেও, এ নাটক তিনি যে খুব দরদ দিয়ে লিখেছিলেন, এ নাটক পড়লে। তা বোঝা যায়। তা ছাড়া, তিনি নিজেও এবিষয়ে সরাসরি মন্তব্য করেছেন। ‘আমি যে এমন পাষণ্ড, তা আমিও এই নাটকের প্রুফ দেখার সময়ে কযেকটা দৃশ্য পড়ে চোখের জল ফেলেছি।’১২৪
কৃষ্ণকুমারীর প্রচ্ছদপট
টডের বই-এ কৃষ্ণকুমারীর যে-কাহিনী দেওয়া ছিলো, তা নিতান্তই সংক্ষিপ্ত। মাইকেল লিখেছেন যে, তিনি এ কাহিনী। পেয়েছেন টডের বই-এর প্রথম খণ্ডেব ৪৬১ পৃষ্ঠায়।১২৫ আসলে এ কাহিনীটি আছে ৪৬১ থেকে ৪৬৫ পৃষ্ঠায় — বিক্ষিপ্তভাবে। টড যে-কাহিনী বলেছেন, তা হলো:
কৃষ্ণকুমারী ছিলো খুব সুন্দরী একটি কন্যার নাম, যাকে পাওয়ার জন্যে জয়পুরের জগৎসিংহ আর মারোয়াবের (মাইকেলের ভাষায়, মরুদেশের) রাজা মান সিংহ তাঁদের সমস্ত বীরত্ব এবং ভারতবর্ষীয় লুণ্ঠন ক্ষমতা নিয়ে প্রস্তুত হয়েছিলেন। প্রাচীন কালের হেলেনের মতো সে নিজের এবং তার বিরোধীদের গৃহধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। জয়পুরের রাজা সিন্ধিয়ার (মহারাষ্ট্রপতি মাধবজী) অর্থের দাবি প্রত্যাখ্যান করায়, তিনি কেবল যে জগৎসিংহের বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন, তাই নয়; তিনি সমর্থন করলেন মানসিংহের প্রস্তাব। তিনি রানার কাছে দাবি করলেন জয়পুরের দৌত্য বাতিল করে দিতে। কিন্তু রানা সেটা করতে অস্বীকার করলে সিন্ধিয়া তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে এগিয়ে আসেন। তাঁকে বাধা দেবার চেষ্টা করা হয় এবং তাতে জয়পুরের সৈন্যরাও যোগ দেয় — যদিও তা ব্যর্থ হয়। সিন্ধিয়া গিরিপথ ধরে অগ্রসর হন এবং উপত্যকায় আট হাজার সৈন্যের লাশ ছড়িয়ে দিয়ে মেবারের রাজধানীর উপকণ্ঠে — কামানের পাল্লার মধ্যে — এসে ঘাঁটি স্থাপন করেন। আমীর খানও মানসিংহেব দলে যোগ দান করেন। বিয়ের আয়োজন বাতিল করা এবং দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া ভীমসিংহেব আর কোনো উপায় ছিলো না। সিন্ধিয়া উপত্যকায় এক মাস ছিলেন এবং তার মধ্যে একলিঙ্গের মন্দিরে রানার সঙ্গে তাঁর একদিন সাক্ষাৎ হয়।
ওদিকে, আহত অহঙ্কার নিয়ে জগৎ সিংহ এর প্রতিশোধ নেবার জন্যে তৈরি হন। তিনি এমন একটি বিশাল বাহিনী সমবেত করলেন, সাম্রাজ্যের অতীত গৌরব শেষ হবার সময় থেকে যেমনটা আর দেখা যায়নি। রাজা মানসিংহও তাঁর এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করার জন্যে তৈরি হলেন। কিন্তু মারওয়ারে সিংহাসনের দাবি নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছিলো। তাই মান সিংহের পক্ষে তাঁর গোষ্ঠীর আনুগত্য ছিলো বিভক্ত। সেখানে সিংহাসনের একজন দাবিদার দেখা দিলেন (ধনকুল সিংহ) এবং তাঁর সঙ্গে মানসিংহের লড়াই রু হলো। নানা ষড়যন্ত্র এবং সংঘাতের মধ্য দিয়ে মানসিংহ শেষ পর্যন্ত জয়ী হন।
*
ষড়যন্ত্র শেষ হলেও সমস্ত ব্যাপারটার ওপর যবনিকা পড়ার শর্ত হিশেবে আর-একটি দাবি করা হয়। কোনো পক্ষই এই যুদ্ধের মূল কারণ — কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ে করার দাবি ত্যাগ করবে না।
কৃষ্ণকুমারীর বয়স ছিলো মাত্র ষোলো। ইফিজিনিয়াকে যখন বিসর্জনের বেদীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, তখন তাঁর দেশ রক্ষা পেয়েছিলো — এই ছিলো এক মহৎ সান্ত্বনা। (অ্যামোনাইটদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে) জেফথা যেমন তাঁর প্রতিজ্ঞা অনুয়ায়ী তাঁর কন্যাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন এবং কন্যার আত্মত্যাগের ফলে যেমন পিতার খ্যাতি রক্ষা পেয়েছিলো, তার নীরব আত্মত্যাগের সঙ্গে কৃষ্ণকুমারীর বিসর্জনের সর্বোত্তম তুলনা মেলে। .. তবে তাকে তরবারি দিয়ে হত্যা করা হয়নি। তার জন্যে তৈরি করা হয়েছিলো এক পাত্র পানীয়। পিতার নাম করে সেটা যখন তাকে দেওয়া হয়, কৃষ্ণা তখন সেই পাত্রের পানীয় নিঃশেষে পান করে। দাঁড়িয়ে সে প্রার্থনা জানায় তার পিতার দীর্ঘজীবন এবং উন্নতির জন্য। মাতাকে সে সান্ত্বনা দেয়: ‘মা, তুমি কেন কষ্ট পাচ্ছো? — এর ফলে আমার জীবনের দুঃখই তো হ্রাস পাচ্ছে। আমি মরতে ভয় পাইনে। আমি তোমার মেয়ে নই? আমি মৃত্যুকে ভয় পাবো কেন?’ …কৃষ্ণকুমারী ঘুমিয়ে পড়লো — যে-ঘুম থেকে সে আর কখনো জেগে উঠলো না।
এই কাহিনী-কণিকাকে মাইকেল কতোটা পরিবর্ধন এবং নিজের মতো করে পরিকল্পনা করে নিয়েছিলেন, কৃষ্ণকুমারী পড়লে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। বিশেষ করে ধনদাস, বিলাসবতী, মদনিকার উপ-কাহিনী এর মধ্যে যে-জটিলতা নিয়ে এসেছে, তা কাহিনীর মধ্যে বৈচিত্র্য এবং মানবিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। কাহিনীর শেষে কৃষ্ণাকে বিষ পান না-করিয়ে নাটকীয়তা দেবার জন্যে প্রথমে রাজভ্রাতা বলেন্দ্রকুমারকে দিয়ে হত্যা করানোর চেষ্টা দেখানো হয়। কিন্তু স্নেহের কাছে পরাজিত বলেন্দ্র কৃষ্ণাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়। তারপর কৃষ্ণা যথেষ্ট নাটকীয়তা সৃষ্টি করে নিজের খড়ূগ দিয়ে আত্মহত্যা করে। কৃষ্ণকুমারী নাটকের সঙ্গে ইফিজিনিয়া অ্যাট আউলিসের মিল আছে বলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখকরা অনুমান করেছেন। ১২৬ কিন্তু অনুমানের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, টডের রাজস্থান-কাহিনীতেই হেলেন এবং ইফিজিনিয়ার উল্লেখ ছিলো। সুতরাং নাট্যকার সজ্ঞানে এই সামঞ্জস্য কাজে লাগিয়েছিলেন।
কৃষ্ণকুমারী শেষ করে মাইকেল আবার মেঘনাদবধ রচনা আরম্ভ করেন। এবারে তৃতীয় সর্গ। মাঝখানে মাসখানেক কাব্য রচনার কাজ বন্ধ থাকলেও, আবার লিখতে শুরু করার পরেই লেখার উদ্দীপনা ফিরে এলো। কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি রাজনারায়ণকে লিখেছিলেন যে, আপাতত তিনি কেবল ছোটোখাটো মহাকাব্য রচনা করছেন।১২৭ এভাবে হাত পাকানোর পরে লেখা হবে সত্যিকার মহাকাব্য। আপাতদৃষ্টিতে এই উক্তিকে আত্মবিশ্বাসের অভাব বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আসল ঘটনা এর উল্টো। এ সময়ে তিনি এতো উৎসাহিত বোধ করেন এবং নিজের রচনাকে এতো উন্নত মানের বলে বিবেচনা করেন যে, তার অর্থ দাঁড়ায়: আর হাত পাকানোর দরকার নেই। মেঘনাদবধ কাব্যকে যাতে রীতিমতো মহাকাব্যের চেহারা দেওয়া যায় এবং দেশীয় সমালোচকরা যাতে সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র মতেও এর কোনো খুঁত ধরতে না-পারেন, তার জন্যে মেঘনাদবধ লেখার আগে তিনি ভালো করে সাহিত্যদর্পণ পড়ে নিয়েছিলেন। এবং মেঘনাদের মতো আঁটঘাট বেঁধেই সমরে নামতে চেয়েছিলেন। সস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র অনুযায়ী মহাকাব্যের দশটি সর্গ থাকা প্রয়োজন তিনি জানতেন। কিন্তু মেঘনাদবধের দশটি সর্গ হবে কিনা, তিনি সে সম্পর্কে গোড়ার দিকে ঠিক নিশ্চিত ছিলেন না। এখন তৃতীয় সর্গ রচনা করার সময়ে ভাবনার পালে এমন হাওয়া লাগলো যে, তাঁর মনে হলো: কাহিনীটাকে তিনি পারবেন দশম সর্গ পর্যন্ত টেনে নিতে। রাজনারায়ণকে লিখলেন: ‘কাব্যটাকে আমি দশটি সর্গ অবধি লম্বা করতে চাই, যাতে করে এ কাব্য মহাকাব্য হিশেবে যদ্দুর সম্ভব পরিপূর্ণতা লাভ করে। আর তেমন না-হবার কোনো কারণও নেই; বিষয়টা সত্যি সত্যি বীরত্বপূর্ণ, কেবল বাঁদরগুলোই রসভঙ্গ করে, এই যা। তবে তার আর কী করা যায়, সেদিকেও আমি নজর রাখবো।’১২৮ এ সময়ে নিজের কাব্য নিয়ে তিনি যে এতো উচ্ছসিত হয়েছিলেন, তার একটা কারণ এই যে, তিলোত্তমার ভক্ত-সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। যে-বিদ্যাসাগর এক সময়ে অমিত্রাক্ষরের মাহাত্ম্য ধরতে পারেননি, তিনিও এ সময়ে তিলোত্তমার মধ্যে যথেষ্ট গুণ দেখতে পান। ওদিকে, সোমপ্রকাশ পত্রিকা এর অনুকূল সমালোচনা করে। ১২৯ এমন কি, পাদ্রি জেমস লঙ পর্যন্ত কবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। কদিন আগে তিনি গৌরদাসকে বলেছিলেন: ‘বেঁচে থাকলে দত্ত দেখো তোমাদের দেশের ভাষায় বিপ্লব ঘটাবে।’১৩০ এর আগে কবি নিজেও আশা প্রকাশ করে লিখেছিলেন: ‘সব ব্ল্যাঙ্ক ভার্স হো জাগা।’১৩১ এখন এতো অনুকূল সমালোচনা দেখে তিনি স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। এবং মেঘনাদবধকে দশ সর্গ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করেন।
রচনার এই বর্ধিত পরিকল্পনা ছাড়া, সেপ্টেম্বর মাসে (১৮৬০) কবি ঠিক করে ফেলেন যে, পুরো কাব্য শেষ করা অবধি তিনি অপেক্ষা করে থাকবেন না, প্রথম পাঁচ সৰ্গ শেষ হলে সেগুলো দিয়ে প্রথম খণ্ড প্রকাশ করবেন। প্রকাশ করার ব্যাপারে আর্থিক অসুবিধে থাকতে পারতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা-ও নেই। কারণ দিগম্বর মিত্র এ কাব্য ছাপার জন্য টাকা দিতে রাজি হয়েছেন। ‘এ ব্যাপারে আমি কিন্তু সত্যি খুব ভাগ্যবান। আমার এসব অলস কাজকর্মের জন্যে সহজেই পৃষ্ঠপোষক আর খদ্দের পেয়ে যাই।’১৩২ কিন্তু এক শতাব্দী পরে এখন মনে হচ্ছে, এ ব্যাপারে কবির চেয়ে অনেক ভাগ্যবান ছিলেন তাঁর পৃষ্ঠপোষকরা। সামান্য অর্থ বিনিয়োগ করে তাঁরা মাইকেল-সাহিত্যের সঙ্গে আজও বেঁচে আছেন সাহিত্যের ইতিহাসে।
সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মেঘনাদ রচনা নিয়ে কবি খুব ব্যস্ত থাকেন। আগের কয়েক মাস রাজনারায়ণ বসুকে প্রতি মাসে দু-তিনখানা করে চিঠি লিখেছেন। কিন্তু সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তিনি তাঁকে যে-চিঠিটি লেখেন, তার প্রায় চার মাসের মধ্যে আর-কোনো চিঠি পাওয়া যায় না। অক্টোবরের মাঝামাঝি হেনরিয়েটা দ্বিতীয় বারের মতো গর্ভবতী হন। হয়তো তা-ও কবিকে ব্যতিব্যস্ত এবং উদ্বিগ্ন করে থাকবে। তবে তা সত্ত্বেও, চার মাসের মধ্যে তিনি মেঘনাদবধ কাব্যের তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম সর্গ শেষ করেন। তিনি লিখতেন ঝড়ের গতিতে। তারপর সব সময়ে মাজাঘষা করে রচনাকে উন্নত করতে চেষ্টা করতেন। তাঁর যেসব রচনার খসড়া এবং সংশোধিত সংস্করণ পাওয়া গেছে, সেগুলোর তুলনা করলে বোঝা যায়, তিনি ছিলেন, ইংরেজিতে যাকে বলে পার্ফেকশনিস্ট। সেপ্টেম্বর মাসের ১০/১২তারিখ থেকে ডিসেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে তিনি কেবল তিনটি সর্গ রচনাই করেননি, বরং তাদের যথেষ্ট পরিমার্জনাও করেছেন। ঠিক কখন থেকে এ কাব্য ছাপার কাজ শুরু হয়, তা জানা যাচ্ছে না; তবে বই আকারে মেঘনাদবধকাব্যের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় (১৮৬১) সালের চৌঠা জানুআরি, শুক্রবার।
এ কাব্য ছাপাখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আগে, রাজনারায়ণ বসু মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় বেড়াতে আসেন। তাঁর আসার কারণ অংশত ৭ পৌষ (২০ ডিসেম্বর ১৮৬০) উপলক্ষে ব্রাহ্ম সমাজে বক্তৃতা দান, অংশত কবির অনুরোধ। আসলে, তিনি আসার কথা লিখেছিলেন অক্টোবর মাসের শেষ দিকে – দুর্গা পুজোর ছুটিতে। (সেবার দুর্গা পুজোর সরকারী ছুটি ছিলো ১৯ থেকে ২৬ অক্টোবর। ১৯ শুক্রবার ছিলো সপ্তমী পুজো।) তিনি একাধিক চিঠিতে লিখেছিলেন যে, রাজনারায়ণের সঙ্গে দেখা হবে এই আশায় তিনি পুজোর ছুটির জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন। কিন্তু পুজোর ছুটিতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কেশব সেনের সঙ্গে রাজনারায়ণ নৌকোয় করে রাজমহল ভ্রমণ করতে যান। সঙ্গে অন্যান্যের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথও ছিলেন।১৩৩ কবির সঙ্গে এই সাক্ষাৎ এবং এই সাক্ষাতের সময়ে কবি যে-আন্তরিকতা এবং উচ্ছাস প্রকাশ করেন, সে কথা প্রায় তিরিশ বছর পরে রাজনারায়ণ বসু লিখেছিলেন যোগীন্দ্রনাথ বসুর কাছে।১৩৪ তা ছাড়া, আত্মচরিতে এ সম্পর্কে উল্লেখ করেছিলেন।১৩৫ এ যাত্রায় কবির লোয়ার চিৎপুর রোডের বাড়িতে রাজনারায়ণ একাধিক বার গিয়েছিলেন। প্রথম বার যখন যান তখন কবি মেঘনাদবধের প্রফ দেখছিলেন। কদিন পরে আবার যান খাবার নিমন্ত্রণে। এখানে তিনি কবির মাদ্রাসের এক বন্ধুকে দেখতে পান এবং এবারেই প্রচুর মদ্যপানে উচ্ছসিত কবি রাজনারায়ণের গালে অজস্র চুমু খান।১৩৬ তাঁকে কবি মেঘনাদবধের একটি কপিও দেন, দ্রুত তা পড়ে তাঁর মতামত জানানোর জন্যে।
আগেও দেখা গেছে, কোনো লেখা শেষ করার পর অথবা কোনো রচনা প্রকাশিত হবার পর, তিনি সে সম্পর্কে বন্ধুরা কী ভাবছেন, তা জানার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। রাজনারায়ণের মতামত জানার জন্যে তিনি উদ্গ্রীব ছিলেন আরও বেশি। যে-দেশে সত্যিকার উন্নত এবং আধুনিক সাহিত্য গড়ে ওঠেনি অথবা সে সাহিত্যের কোনো সমজদার সমাজ তৈরি হয়নি, সে দেশে কবি ‘মেদিনীপুরের কোনো একজন শিক্ষকের চেয়ে কারো মতামতকেই বেশি মূল্য দিতেন না।’ সত্যি বলতে কি, তাঁকে তিনি এক অসাধারণ ব্যক্তি বলে বিবেচনা করতেন। নিজেই লিখেছেন: ‘তোমার মতামত আমার চারদিকের দশ লাখ লোকের ‘বাহবা বাহবা’ আওয়াজের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।’১৩৭ রাজনারায়ণ মেদিনীপুরে ফিরে যাবার কদিন পরে কবি তাঁকে তাগিদ দিয়ে চিঠি লিখলেন: ‘মেঘনাদবধ সম্পর্কে তোমার রায় শোনার জন্যে আমি রুদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করে আছি।’১৩৮ তবে রাজনারায়ণ কী বলেন, সেটা শোনার জন্যে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করে থাকতে পারলেন না। তাই ঐ চিঠির শেষ দিকে উল্লেখ করেছেন যে, কাব্যটা দ্রুত প্রচারিত হচ্ছে।১৩৯
কবি অতো আশা করলেও রাজনারায়ণ মেঘনাদবধ সম্পর্কে তাঁর মতামত দ্রুত জানাতে পারেননি। এমন কি, তাঁকে কোনো চিঠিও লেখেননি। সে জন্যে ফেব্রুয়ারি মাসে অগত্যা তিনি নিজের থেকে আবার রাজনারায়ণকে লেখেন। ‘কী ব্যাপার বন্ধু? আমার মেঘনাদ কি তোমার মনে এতোই অভক্তি জন্মিয়েছে, যাতে করে তুমি তার হতভাগা কবির সঙ্গেই যোগাযোগ ছিন্ন করতে চাও?’১৪০ রাজনারায়ণের নীরবতায় হতাশ হলেও, কবি এ সময়ে বেশ খোশ মেজাজে ছিলেন। কদিন আগে — ১২ ফেব্রুআরি মঙ্গলবার সন্ধ্যেবেলায় — কালীপ্রসন্ন সিংহের বিদ্যোৎসাহিনী সভা তাঁকে একটা সংবর্ধনা দিয়েছিলো। এই সংবর্ধনায় যোগ দিয়েছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, কিশোরীচাঁদমিত্র, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, রমাপ্রসাদ রায় প্রমুখ অনেকে। ১৪১ তাঁকে এই অনুষ্ঠানে একটি রুপোর পানপাত্র উপহার দেওয়া হয়। ইংরেজি রীতি অনুযায়ীই এই উপহার নির্বাচিত হয়। এই সংবর্ধনাকে সেযুগের পরিপ্রেক্ষিতে কতোটা আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান বলা যায় অথবা এর মাধ্যমে কবি তাঁর অবদানের কতোটা স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, বলা শক্ত। তবে কবিযশঃপ্রার্থী মাইকেল এমন সংবর্ধনা অথবা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এর আগে অথবা পরে কখনো পাননি। চিঠির ভাষা থেকে মনে হয়, তিনি খুশি হয়েছিলেন। বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করতে পারাটা যে মেঘনাদবধকাব্যের রচয়িতার পক্ষে একটা অসাধারণ ঘটনা, তিনি সেটাও উল্লেখ করেছেন। ১৪২ বাংলায় সাহিত্য রচনা করলেও তিনি যে আর পাঁচজন বাঙালির মতো নন, তিনি যে আসলে আধা-ইংরেজ — এটা বোধ হয় আন্তরিকভাবে তিনি বিশ্বাস করতেন।
খোশ মেজাজে থাকার আর-একটা কারণ, মেঘনাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি। অপ্রত্যাশিত নানা জনের কাছ থেকে তিনি মেঘনাদবধ সম্পর্কে, বিশেষ করে, কবি হিশেবে তাঁর নিজের সম্পর্কে প্রশংসার কথা শুনতে পাচ্ছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি উল্লেখ করেছেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। ‘সারদাপ্রসাদ সেদিন আমাকে বলেছিলেন যে, দে(বেন্দ্রনাথ ঠাকুবের) মতে, খুব কম হিন্দু [অর্থাৎ বাঙালি] লেখকই আছেন, যিনি ঐ লোকটার কাছে — মানে ৬ নম্বর লোয়ার চিৎপুর রোডের মোটা লোকটার — তোমার বন্ধুর কাছে দাঁড়াতে পারেন।’১৪৩ দেবেন্দ্রনাথকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন না। চিনতেন তাঁর জামাতা সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়কে। আদালতে তাঁর সঙ্গে অনেক সময় তাঁর দেখা হতো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, এ সময়ে তিনি নাকি প্রায়ই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে যেতেন।
মেঘনাদবধ কাব্য রচনার সময় | |
১৮৬০, জুলাই – | “প্রথম সর্গ পাঠালাম” (রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠি) |
“দ্বিতীয় সর্গের খানিকটা পাঠিয়েছিলাম ; প্রায় দুশো লাইন হয়ে গেছে” (ঐ) | |
১৮৬০, ৩ অগস্ট | “দ্বিতীয় সর্গ পড়ে মুগ্ধ হবে” (ঐ) |
১৮৬০, ১? সেপ্টেম্বর – | “সব ব্ল্যাঙ্ক ভার্স হো জাগা” (ঐ) |
১৮৬০, সেপ্টেম্বরের শেষ | “কয়েক সপ্তাহ আগে তোমাকে দ্বিতীয় সর্গ পাঠিয়েছি; তৃতীয় সর্গ লিখছি, মোট দশটি সর্গ করতে চাই” (ঐ) |
১৮৬১, ৪ জানুআরি – | প্রথম খণ্ড (প্রথম পাঁচটি সর্গ) প্রকাশিত হয়। |
১৮৬১, জানুআরি – | “ষষ্ঠ সর্গ শেষ করেছি। প্রায় ৭৫০ পঙ্ক্তি হয়েছে” (রাজনারায়ণ বসুকে লেখ চিঠি)। |
১৮৬১, ২০ ফেব্রুআরি – | “ষষ্ঠ এবং সপ্তম সর্গ শেষ করেছি। অষ্টম সর্গ লিখছি” (ঐ) |
১৮৬১, মে- | “দ্বিতীয় খণ্ড ছাপা হচ্ছে” (ঐ) |
১৮৬১, মে-র শেষ দিক – | “এখনো নবম সর্গের কয়েক শো পঙ্ক্তি লেখা বাকি আছে” (ঐ) |
১৮৬১, জুলাই – | “এক মাসের মধ্যে প্রকাশিত হবে” ((ঐ) |
১৮৬১, ২৩ জুলাই- | “এর পর নবম সর্গ ছাপা হচ্ছে” (ঐ) |
১৮৬১, অগস্ট – | “তোমাকে নতুন মেঘনাদের কপি পাঠানো হয়েছে” (ঐ) |
১৮৬১, ২৯ অগস্ট – | “তোমার সমালোচনার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছি” (ঐ) |
এবং একবার নাকি মেঘনাদবধকাব্যের পাণ্ডুলিপি থেকে তাঁর ভাঙ্গা-ভাঙ্গা গলায় খানিকটা সারদাপ্রসাদকে পড়েও শুনিয়েছিলেন।১৪৪ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যখনকার কথা লেখেন, তখন তাঁর বয়স এগারো বছর। (পরে রবীন্দ্রনাথও এই কথার সূত্র ধরে লিখেছিলেন যে, মাইকেল এক সময়ে তাঁদের বাড়িতে আসতেন।১৪৫) তাঁর এই সাক্ষ্য কতোটা নির্ভরযোগ্য, জানা নেই। মাইকেলের স্বরভঙ্গ দেখা দেয় ১৮৬৭ সালের পর, তিনি যখন ব্যারিস্টার হিশেবে হাইকোর্টে কাজ করতে আরম্ভ করেন। ১৮৬১/৬২ সালে তাঁর গলা ভাঙা-ভাঙা ছিলো বলে কোনো মন্তব্য কোথাও পড়িনি। তা ছাড়া, কবির জবানি থেকেও তাঁর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যাবার প্রত্যক্ষ কোনো সমর্থন পাওয়া যায় না। তবে, হতে পারে, তিনি সারদাপ্রসাদের সঙ্গে দু-একবার গেছেন। সেটা যে কোনো নিয়মিত ব্যাপার ছিলো না — বলাই বাহুল্য।
রাজনারায়ণকে কবি আরও লিখেছিলেন যে, এ সময়ে বড়োবাজারের এক বেনিয়ানের কেরানি মেঘনাদবধ পড়ে খুব উচ্ছসিত হয়েছিলেন। পথচারী-মাইকেলকে দেখে এই কেরানি নাকি তাঁর উচ্ছাস চাপতে পারেননি এবং কবির পরিচয় না-জেনেই তাঁর কাছে এ কাব্যের খুব প্রশংসা করেছিলেন।১৪৬ এই বর্ণনা এবং মূল ঘটনার মধ্যে কতোটা মিল ছিলো, বলা যাচ্ছে না। কিন্তু মেঘনাদবধ শিক্ষিত এবং বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্তের বসার ঘর ছেড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে পথ করে নিচ্ছে, এ কথা তিনি একাধিক বার বলেছেন। রাজনারায়ণকে এ কাব্যের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে লিখেছেন: ‘কাব্যটা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শুনতে পাই, অনেক হিন্দু মহিলাও এ কাব্য পড়ে কাঁদছেন।’১৪৭ এ তথ্য কবিকে নিঃসন্দেহে আত্মতৃপ্তি দিয়ে থাকবে। তবে সেকালে এ কাব্য পড়ার মতো অথবা পড়ে বোঝার মতো কজন হিন্দু মহিলা কলকাতা তথা বঙ্গদেশে ছিলেন, সেটা এ প্রসঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। কবি যা শুনে সত্যি সত্যি আত্মতৃপ্তি পেয়েছিলেন, তা হলো: বড়ো কবিদের সঙ্গে তাঁর তুলনা। ‘অনেকে বলেন, এ কাব্য মিল্টনের চেয়েও ভালো হয়েছে। তবে সেটা নিতান্ত বাজে কথা, কারণ কোনো কিছুই মিন্টনের চেয়ে ভালো হতে পারে না। অনেকে বলছেন, আমার এ কাব্য কালিদাসের সমকক্ষ হয়েছে। সে কথায় আমার অবশ্য কোনো আপত্তি নেই। আমার মনে হয় না ভার্জিল, কালিদাস এবং ত্যাসোর মতো লিখতে পারা অসম্ভব। কারণ এঁরা মহান কবি হলেও, অমর নন; কিন্তু মিল্টন দেবতাদের মতে, অমর।’১৪৮ মেঘনাদবধ সম্পর্কে কোনো মতামত না-জানানো সত্ত্বেও, রাজনারায়ণের প্রতি কবি এ চিঠিতে যে-প্রসন্নতা প্রকাশ করেন, তার আর-একটি কারণ, ফেব্রুয়ারি মাসে Indian Field পত্রিকায় রাজনারায়ণের লেখা তিলোত্তমাসম্ভবকাব্যের সমালোচনা প্রকাশিত হয়।১৪৯
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
এর কিছুকাল পবের এক চিঠি থেকে জানা যায়, রাজনারায়ণ মেঘনাদবধকাব্যের মূল্যায়ন করে কবিকে লিখেছিলেন। রাজনারায়ণের সে চিঠির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। কিন্তু কবির ভাষা থেকে মনে হয়, কিছু সমালোচনা থাকলেও, সে চিঠির মধ্যে প্রশংসাই বেশি ছিলো। এই পত্রের ওপর ভিত্তি করে লেখা রাজনারায়ণের সমালোচনাটি বাংলায় প্রকাশিত হয়েছিলো প্রায় কুড়ি বছর পরে। এতে রাজনারায়ণ বলেছিলেন, মেঘনাদবধ হলো নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষার সর্বোৎকৃষ্ট কাব্য। এই কাব্যে এখানে-সেখানে কিছু দোষ থাকলেও, তাঁর বিবেচনায় সেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।
অধিকন্তু দোষ ধরিলে প্যারাডাইস লস্ট্ কাব্যেও তাহা অল্প নাই। … পাঁচ বৎসর পূর্বে বাঙ্গালা কবিতা যেরূপ অসংস্কৃত অবস্থায় ছিল, তাহা দেখিয়া সে সময়ে কে বলিতে পারিত যে এত অল্প কালের মধ্যে স্থল বিশেষে ভাবের উচ্চতা প্রায় হোমরের ইলিয়াড ও মিল্টনের প্যারাডাইস লষ্টের ন্যায় এবং স্থল বিশেষে করুণ রসে বাল্মীকিব সমকক্ষ একখানি অমিত্রাক্ষর কাব্য বাংলা কাব্যে প্রচারিত হইবে?… তাঁহাকে বাঙ্গালা সাহিত্যের গেটে আখ্যা দেওয়া যাইতে পারে। আমরা যখনই ইহা পাঠ করি তখনই ইহা নূতন বোধ হয়। অসাধারণ কবির রচনাব প্রকৃত লক্ষণ এই যে, তাহা কখনই পুরাতন বা অরুচিকর হয় না। বহু শতাব্দী পরে যখন গ্রন্থকার এবং তাঁহার সমালোচক উভযই অন্তর্হিত হইবেন, তখনও মনুষ্যগণ অক্লান্ত অনুরাগের সহিত মেঘনাদ পাঠ করিবে।১৫০
কিন্তু কবি মারা যাবার পর রাজনারায়ণ বসু যখন বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক বক্তৃতা করেন (গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৮৭৮), তখন প্রশংসার চেয়ে তাতে সমালোচনা বেশি ছিলো। আসলে ততোদিনে জাতীয়তাবাদী ভাবনার দ্বারা রাজনারায়ণ অনেকটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন। কেবল হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বে এই মনোভাব লক্ষ্য করা যায় না, ১৮৬০-এর দশকে জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা এবং ১৮৭০-এর দশকে সঞ্জীবনী ও হিন্দু জাতীয় মহাসভর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থেকেও তাঁর জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনা প্রতিফলিত হয়। এসব সভা কলকাতার অতি ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর বাইরে আদৌ পরিচিত হয়েছিলো কিনা, সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। যা বিশেষ প্রাসঙ্গিক, তা হলো: এসবের মধ্য দিয়ে রাজনারায়ণের জাতীয়তাবাদী মনোভাব অভ্রান্তভাবে প্রকাশ পায়। সেই মনোভাব বঙ্গদেশে কোনো বিপ্লব নিয়ে না-এলেও, তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে চরিত্রগত পরিবর্তন এনেছিলো। একদিন রাজনারায়ণ তিলোত্তমাসম্ভবের ইন্দ্রকে অথবা ব্রজাঙ্গনাকে প্রশংসা করতে পাবেননি — তাদের হিন্দু চরিত্রের জন্যে। বন্ধুকে তখন কবি বরং উপদেশ দিয়ে লিখেছেন: ‘সাহিত্য বিচারের সময়ে কি ধর্মের কথা মনে রাখা যায়?’১৫১ কিন্তু ১৮৭০-এর দশকের শেষ দিকে এসে রাজনারায়ণ বিশেষভাবে সমালোচনা করেন মাইকেলের ‘বিজাতীয়’ মনোভাবকে।
আৰ্য্যকুলসূৰ্য্য রামচন্দ্রের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ না করিয়া রাক্ষসদিগের প্রতি অনুরাগ ও পক্ষপাত প্রকাশ করা, নিকুম্ভিলা-যজ্ঞাগারে হিন্দু জাতির শ্রদ্ধাস্পদ বীর লক্ষ্মণকে কাপুরুষের ন্যায় আচরণ করানো, খর ও দূষণের মৃত্যু ভবতারণ রামচন্দ্রের হাতে হইলেও তাহাদিগকে প্রেতপুরে স্থাপন, বিজাতীয় ভাবের দৃষ্টান্তের মধ্যে এই তিনটি এখানে উল্লিখিত হইতেছে। বাঙ্গালা কবিদিগের মধ্যে কবিকঙ্কণ যেমন জাতীয় ভাবসম্পন্ন, তেমন অন্য কোন কবি নহেন।১৫২
রাজনারায়ণের এই সমালোচনাকে যথার্থ সাহিত্য সমালোচনা বলা যায় না। আসলে, এখানে তিনি সাহিত্য এবং জাতীয়তা তথা ধর্মীয় ভাবকে গুলিয়ে ফেলেছেন। তবে স্বীকার করতে হবে যে, তাঁর জাতীয়তাবাদী চিন্তাও তুলনামূলকভাবে অল্প সময়ের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে বিবর্তিত হয়েছিলো। ১৮৬০ সালের ডিসেম্বরে তিনি কবিকে বলেছিলেন: ‘আমার এই সংস্কার জন্মিয়াছে যে তোমার পরিচ্ছদ ও আহার ইংরাজের মতন হইলেও তোমার হৃদয়টা সম্পূর্ণরূপে হিন্দু।’১৫৩ কিন্তু ১৮৭৭ সালে বক্তৃতায় বলেন: ‘তিনি (মাইকেল) তাঁহার কবিতাকে হিন্দু পরিচ্ছদ দিয়াছেন বটে, কিন্তু সেই হিন্দু পরিচ্ছদের নিম্ন হইতে কোট-পালতুন দেখা যায়।১৫৪
রাজনারায়ণ তাঁর সমালোচনায় সাহিত্য বিশ্লেষণ মোটেই করেননি, তা বলা যায় না। মাইকেল যেসব ধ্রুপদী কবিকে অনুসরণ করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে তুলনা করে তিনি কিছু ঢালাও মন্তব্য করেছিলেন।
মাইকেল মধুসূদনের রচনাতে প্রাঞ্জলতার অত্যন্ত অভাব। কবির রচনাতে প্রাঞ্জলতা না থাকিলে তাহা মধুর ও মনোহর মনে হয় না। সকল শ্রেষ্ঠতম কবির রচনা অতিশয় প্রাঞ্জল, যথা, — হোমর ও বাল্মীকি। শ্রেষ্ঠতম কবিদিগের মধ্যে মিল্টনের রচনা তত প্রাঞ্জল নহে, কিন্তু তাঁহার অন্যান্য গুণ যেরূপ আছে, তাহাতে মাইকেল কথনই তাঁহার সমতুল্য হইতে পারেন না। মিল্টনে যেরূপ ভাবের গভীরতা, শব্দবিন্যাসের রাজ-গাম্ভীর্য ও রচনার জম্জমাট্ দৃষ্ট হয়, মাইকেলের কবিতাতে ততটা দৃষ্ট হয় না। কিন্তু মিল্টনের প্রাঞ্জলতার অভাব মাইকেলে বিলক্ষণই দৃষ্ট হয়।১৫৫
রাজনারায়ণের এই বক্তৃতায় মাইকেলের সাহিত্যানুরাগীরা বিরক্ত হয়েছিলেন। সে কথার উল্লেখ করে রাজনারায়ণ লিখেছেন: ‘এই বক্তৃতা করিবার পর আমি অবগত হইলাম যে, আমি উপরে যাহা বলিয়াছি, তজ্জন্য মাইকেল মধুসূদনের পক্ষ এবং বিপক্ষ উভয় পক্ষীয় লোকেরা আমার প্রতি বিরক্ত হইয়াছেন। ইহাতে কেবল এই মাত্র প্রমাণিত হইতেছে যে, আমি যাহা বলিয়াছি, তাহা ঠিক বুলিয়াছি।১৫৬ প্রায় সওয়া শো বছর পরে এখন অবশ্য রাজনারায়ণ যতোটা স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, মাইকেলকে তার চেয়ে অনেক বড়ো কবি বলে বিবেচনা করা হয়। এবং তাঁর উক্তিকে রীতিমতো স্ববিরোধিতা বলেই বিবেচনা করা যায়।
মেঘনাদবধের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হবার সময়ে তিনি ষষ্ঠ সর্গ লিখতে আরম্ভ করেন। সম্ভবত রাজনারাযণকে তার খানিকটা শুনিয়েছিলে্ন। কিন্তু জানুআরি মাসের (১৮৬১) প্রথম দিকে রাজনারাযণ কলকাতা থেকে যাবার কয়েক ঘণ্টা পরেই কবি হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছ/সাত দিন অসুস্থ ছিলেন। রসিকতা করে রাজনারায়ণকে লিখেছেন: ‘মেঘনাদ আমাকে খতম করবে, না আমি তাকে খতম করবো, বস্তুত, তা নিয়ে একটা দড়ি টানাটানি চলছিলো। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। শেষ পর্যন্ত আমিই জয়ী হয়েছি, তার মানে তাকে আমি খতম করেছি; আর সেই সঙ্গে শেষ করেছি মেঘনাদের ষষ্ঠ সর্গ — প্রায় সাড়ে সাতশো পঙ্ক্তি।১৫৭ ফেব্রুআরি মাসের শেষ দিকে লেখা তাঁর চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে, ততো দিনে তিনি সপ্তম সর্গ লেখার কাজ শেষ করে অষ্টম সর্গ লিখতে আরম্ভ করেন। তারপর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অষ্টম সর্গ শেষ করে তিনি দ্বিতীয় খণ্ড ছাপাখানায় পাঠান। তবে মে মাসের দ্বিতীয় ভাগে তিনি রাজনারায়ণকে যে-চিঠি লেখেন, তা থেকে দেখা যাচ্ছে, তখনো মেঘনাদ প্রকাশিত হয়নি। তার কারণ, তিনি এর রচনার কাজ শেষ করতে পারেননি। কয়েক শো পঙ্ক্তি লেখা তখনো বাকি। এর আগের আলোচনা থেকে লক্ষ্য করেছি, পদ্মাবতী এবং তিলোত্তমাসহ তাঁর অন্য একাধিক রচনার একেবারে সমাপ্তি পর্যায়ে পৌঁছে তিনি সেগুলো শেষ করার ব্যাপারে আলসেমি করেছেন। আমার ধারণা, নাটক অথবা কাব্য যা-ই রচনা করুন না কেন, শেষ দিকে পৌঁছে, লেখার নেশা ফিকে হয়ে যাবার জন্যে তিনি এমন গড়িমসি করতেন। তা ছাড়া, যেমনটা আগেই ইঙ্গিত করেছি, কোনো বিষয় নিয়ে তিনি দীর্ঘ সময় লেগে থাকতে পারতেন না। এ ক্ষেত্রে মেঘনাদবধকাব্যই একটা ব্যতিক্রম।
এ কাব্য রচনার কাজ তিনি আরম্ভ করেছিলেন ১৮৬০ সালের প্রথম দিকে। এপ্রিল মাসের চিঠি থেকে দেখা যাচ্ছে, ততো দিনে খানিকটা লেখা হয়ে গেছে।১৫৮ আর সে কাব্য শেষ করলেন ১৮৬১ সালের সম্ভবত মে-জুন মাসে। এতো দীর্ঘদিন তিনি কোনো রচনার দিকে তাঁর মনোযোগ এবং আগ্রহ অক্ষুন্ন রাখতে পারেননি। কিন্তু মেঘনাদবধ তিনি লিখতে আরম্ভ করেন কারো সঙ্গে বাজি রেখে নয়, নিজের অন্তরের তাগিদে। এর কাহিনী, নাটকীয়তা, অন্তর্নিহিত স্পিরিট, এতে মৌলিকত্ব দেখানোর সুযোগ এবং সর্বোপরি, তিনি একে যেভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন এবং যেভাবে এ কাহিনী তিনি পুনর্নির্মাণ করছিলেন, তার ফলে তিনি তাঁর উৎসাহ বাঁচিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। বস্তুত, কেবল উৎসাহ বাঁচিয়ে রাখা নয়, তিনি প্রথম সর্গের সাফল্য দেখে দ্বিতীয় সর্গ রচনা করেন আরো বেশি যত্নের সঙ্গে। রাজনারায়ণকে লেখা তাঁর চিঠি থেকে এ কাব্য লেখার পেছনে তাঁর যে সজ্ঞান প্রযত্ন এবং প্রত্যাশা ছিলো, সে সম্পর্কে বেশ জানা যায়। রাজনারায়ণের প্রথম খণ্ড ভালো লেগেছিলো, তারই সূত্র ধরে তিনি লেখেন:
আশা করি দ্বিতীয় খণ্ড তোমার আরও ভালো লাগবে। অন্তত আমি এটা শেষ করেছি অনেক বেশি যত্ন নিয়ে। তোমার কাছে গোপন করবো না — আমার স্বীকার করতে হবে, এর কোনো কোনো অংশ আমার হৃদয়কে অবিমিশ্র আত্মপ্রসাদে ভরে দেয়। তোমাকে বলতে পারি, বন্ধু, আমার কোনো ধারণাই ছিলো না যে, আমাদের মাতৃভাষা আমাকে এতো অফুরন্ত উপকরণ জোগাবে এবং তুমি জানো, আমি কোনো বড়ো পণ্ডিত নই। আমি অবশ্যই স্বীকার করবো যে, এটা আমার কাছে একটা রহস্য — কিভাবে ভাবনা এবং রূপকল্পগুলো তাদের সঙ্গে শব্দ নিয়ে এসেছে — এমন সব শব্দ যা জানতাম বলে আমি নিজেই মনে করিনি। তা ছাড়া, এ কাব্য। আমি অলঙ্কার শাস্ত্র এতোটা মেনে রচনা করেছি যে, একজন দ্বাসি সমালোচকও এর মধ্যে কোন খুঁত খুঁজে পাবেন না। তুলনামূলকভাবে বলতে পারি, এ কাব্যটা দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে এবং খুব বিক্রি হচ্ছে। এ কাব্য বের হবার পর অমিত্রাক্ষরের সমালোচকদের মুখ বন্ধ হযেছে। কী বলো দোস্ত্, বড়ো রকমের একটা বিজয় না? আমাকে এরই মধ্যে লোকেরা মিল্টন এবং কালিদাসের সঙ্গে তুলনা করতে আবন্ত করেছেন। আমি এই উপাধির কতোটা যোগ্য, তা নিজে বলতে পারছিনে, কিন্তু এটা শুনে সত্যি খুব আত্মতৃপ্তি অনুভব করি। আরও কয়েক বছর যদি বেঁচে থাকি, তা হলে আমি আরও ভালো লিখতে পারবো,এটা তোমাকে বলতে পারি, কারণ আমার আরও অনুশীলন দরকার।১৫৯
তাঁর এই অনুশীলন করার প্রসঙ্গে একটা মন্তব্য করা যেতে পারে তিনি একটু বেশি আত্মসচেতন ছিলেন। ইতিপূর্বে মন্তব্য করেছি, অহঙ্কার তাঁর চরিত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সাহিত্যের মান উন্নয়ন করার ব্যাপারে তাঁর কোনো গাফিলতি ছিলো না। নিরন্তর অধ্যয়ন এবং নিরলস অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিতভাবে সামনে এগিয়ে যাবার সাধনা করেছেন। সে কারণে মেঘনাদবধের প্রথম খণ্ড রচনার সময়ে ছন্দসহ তিলোত্তমা কাব্যে অনেক ক্রটি দেখতে পেয়েছেন। আবার মেঘনাদের দ্বিতীয় সর্গ রচনার সময়ে প্রথম সর্গের ছন্দে অনেক ভুল চোখে পড়েছে। তিলোত্তমাসম্ভব তিনি নতুন করে লিখতে আরম্ভ করেছিলেন। মেঘনাদবধ সংশোধন করার সংকল্পও প্রকাশ করেছিলেন।১৬০
মেঘনাদবধের শেষাংশ লেখা, প্রুফ দেখা ইত্যাদি কবি যথাসময়ে করতে পারেননি। ফেব্রুআরি মাসে তিনি মেঘনাদের অষ্টম সর্গ রচনা করিছিলেন। কিন্তু এপ্রিলেও এই সর্গ ছাপা শেষ হয়নি। তখন লিখতে আরম্ভ করেছিলেন নবম সর্গ। শেষ পর্যন্ত এই বই ছাপার কাজ শেষ হয় জুলাই মাসের শেষে।১৬১ ডিসেম্বর মাস থেকে তিনি যে-গতিতে লিখছিলেন, তাতে ততোদিনে লেখা শেষ হয়ে যাবার কথা। সে জন্যে এখানে প্রশ্ন ওঠে; এ সময়ে তিনি কি অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন? গৌরদাস বসাক আর রাজনারায়ণ বসুকে লেখা তাঁর চিঠি থেকে এই প্রশ্নের উত্তর মেলে।
এ সময়ে খিদিরপুরের বাড়ি, মায়ের অলংকার এবং জমি-জমা নিয়ে জ্ঞাতিদের সঙ্গে তাঁর যে-মামলা-মকদ্দমা চলছিলো, তার মধ্যে অন্তত দুটি চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছে গিয়েছিলো। ফেব্রুআরির শেষে একটি মামলায় তিনি জয়ী হন।১৬২ আর একটি মামলা আটকে ছিলো কলকাতায়। এ নিয়ে তিনি ব্যতিব্যস্ত ছিলেন বলে মনে হয়। তা ছাড়া, এ সময়ে তাঁর পৃষ্ঠপোষক ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ মৃত্যুশয্যায়। তিনি মারা যান ২৯শে মার্চ তারিখে। তার কদিন আগে গৌরদাস কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন কটকের বালেশ্বর থেকে। পৈতৃক সম্পত্তি – কলকাতার বাড়ি — উদ্ধারের জন্যে কবির মামলার একজন প্রধান সাক্ষী ছিলেন গৌরদাস। তাঁর জ্ঞাতিদের পরস্পরবিরোধী নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত করেছিলেন। সেই সূত্র ধরেই তিনি সাক্ষী দেন। তদন্ত করা ছাড়াও,এ বাড়ি এবং এ বাড়ির পরিবার সম্পর্কে তিনি বহু বছর ধরে অনেক কথা জানতেন, সে সূত্র ধরেও তাঁর পক্ষে সাক্ষী দেওয়া সম্ভব। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট গৌরদাস তাঁর কাজের জায়গা — বালেশ্বরে-থাকায় মামলা আটকে ছিলো। এখন তিনি কলকাতায় আসায় প্রিন্সিপাল সদর আমীন চাইলেন অবিলম্বে তাঁর সাক্ষ্য নিতে। কিন্তু গৌরদাস কোনো কারণে যথাসময়ে সাক্ষ্য দেবার জন্যে সদর আমীনের দপ্তরে যেতে পারেননি। তাতে কবি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ঈশ্বরচন্দ্র মারা যাবার পরের দিন তিনি তাই লিখেছেন: ‘তুমি যদি অবিলম্বে আদালতে না-যাও, তা হলে আমার বেচারী মায়ের অলংকারগুলো হারাতে হবে। দোহাই তোমার, তুমি কী করছো, আমাকে দেরি না-করে জানিয়ো। আগামী মাসের তেসরা রায় দেবার তারিখ ঠিক হয়েছে।’১৬৩ গৌরদাস যথাসময়ে সাক্ষী দিতে পেরেছিলেন কিনা অথবা ঠিক সময়ে মামলার রায় প্রকাশিত হয়েছিলো কিনা, জানা যায় না। তবে অল্পকালের মধ্যেই কবি জয় লাভ করেন, তা রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠি থেকে জানা যায়।১৬৪
আলোচ্য সময়ে আর-একটা কারণেও তাঁর পক্ষে ব্যস্ত থাকা সম্ভব। সে হলো: নীলদর্পণের অনুবাদ। এ নাটকের অনুবাদ তিনি করেছিলেন কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু করে থাকলে, তা করেছিলেন এ সময়ে। নীলদর্পণ প্রকাশিত হবার পরে জেমস লঙের বিরুদ্ধে যখন মামলা ওঠে, তখন সেই মামলার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন এই বই-এর মুদ্ৰক – মি ম্যানুয়েল। তিনি তাঁর সাক্ষীতে বলেছিলেন যে, এই বই-এর ছাপার কাজ শুরু হয় এপ্রিল মাসে। ছাপা শেষ হয় মে মাসে। তিনি বলেন যে, পুরো পাণ্ডুলিপি তিনি একবারে পাননি। জেমস লঙ কয়েক পৃষ্ঠা করে নিয়ে আসতেন।১৬৫ (মাইকেল এক রাতে নীলদর্পণের অনুবাদ শেষ করেছিলেন বলে যে-উপাখ্যান প্রচলিত আছে, আদৌ অনুবাদ করে থাকলে, তা যে ঠিক নয়, ম্যানুয়েলের সাক্ষ্য থেকে তা অন্তত বোঝা যায়।)
নীলদর্পণের অনুবাদ তিনি করেছিলেন কিনা, সে সম্পর্কে জেমস লঙের কোনো সাক্ষ্য পেলে চূড়ান্তভাবে বলা যেতো। জেফ্রি এ, ওডি প্রোটেস্টেন্ট মিশনারিদের সম্পর্কিত তাঁর বই-এ লিখেছেন যে, জেমস লঙের তত্ত্বাবধানে মাইকেল নীলদর্পণ অনুবাদ করেছিলেন। প্রমাণস্বরূপ তিনি জেমস লঙের দুটি চিঠির উল্লেখ করেছেন — একটি ২৪ অগস্ট (১৮৬১) তারিখে কলকাতার বিশপকে লেখা আর অন্যটি ১৫ তারিখে লন্ডনে তাঁর প্যারেন্ট কমিটিকে লেখা।১৬৬ ব্যর্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত জেমস লঙের চিঠিপত্রের যে-সংগ্রহের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে ২৪ অগস্ট লেখা বলে কথিত চিঠিটির কোনো অস্তিত্ব নেই। আর ১৫ তারিখের চিঠিতে আদৌ মাইকেলেরনাম নেই। এতে তিনি কেবল লিখেছিলেন:
বিচারের সমযে যা সম্মান এবং সত্যবাদিতার কারণে প্রকাশ করতে পাবিনি, এখন তা বলতে পাবি — আমি এ বই সম্পাদনার এবং এটা অনুবাদ করার জন্যে একজন অনুবাদক নিযোগের কাজ কবেছিলাম সরকারের সচিবের পক্ষ থেকে।১৬৭
এমন কি, পরের বছর মার্চ মাসের পাঁচ তারিখে তিনি যখন মাদ্রাস থেকে ১৮৬১ সালের ঘটনাবলীর সমীক্ষা করেছেন, তখনো তিনি নীলদর্পণ সম্পর্কে অনেক কথাই লিখেছেন, কিন্তু কে অনুবাদ করেছেন, তা এড়িয়ে গেছেন।
গত বছরটা ছিলো আমার জন্যে ঘটনাবহুল — এর প্রথম ছ মাসে আমার কাজ ছিলো চিরাচরিত রুটিনমাফিক — অর্থাৎ দেশীয় পড়ূয়া এবং ক্যাটেকিস্টদের সঙ্গে শীতের সময়কার কার্যকলাপ — আমি পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো-সহ বারাসত সফরে গিয়েছিলাম এবং সেখানে তাঁবুতে থাকার সময়েই ঐ এলাকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে লেখক আমার কাছে নীলদর্পণ পাঠান।…
কিন্তু আমার এই আবামের এবং ভালো-লাগা ঘটনাবলীতে হঠাৎ ছেদ পড়লো এবং কালো মেঘ দেখা দিলো। … আমি মি সিটন কারকে রবিনসন ক্রুসো এবং নীলদর্পণ-সহ কিছু বই দিয়েছিলাম। মি সিটন কার ছিলেন আমাদের ভার্নাকুলার লিটাররি সোসাইটির একজন পুরোনো সদস্য। তিনি সম্প্রতি কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন এবং দেশীয় পত্রপত্রিকায় কী হচ্ছে তা জানার জন্যে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। এব ফল হলো, আমি অনুরুদ্ধ হলাম একজন দেশীয়কে দিয়ে নীলদর্পণের একটি অনুবাদ করানোর জন্যে, যার জনো পারিশ্রমিক দেওয়া হবে।১৬৮
এ পর্যন্ত নীলদর্পণ কোথায় কেমন করে পেলেন, কার আদেশে অনুবাদ করালেন — সবই বলা সত্ত্বেও, এর পরে লঙ আর কিছুতেই কিভাবে অথবা কাকে দিয়ে অনুবাদ করালেন, তার উল্লেখ করেননি। সুতরাং নীলদর্পণের অনুবাদ মাইকেল করেছিলেন কিনা, সে সম্পর্কে এখনো আমরা চূড়ান্তভাবে কিছুই বলতে পারিনে। তবে তিনি এ অনুবাদ করে থাকলে, তা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে গোপন করার কোনো প্রয়োজন হতো না। কারণ এই অনুবাদ করানো, তার খরচ জোগানো এবং সরকারী খামে করে তা বিভিন্ন জনের কাছে পাঠানো সবই হয়েছিলো সরকারের জ্ঞাতসারে, সম্মতিতে এবং খরচে।১৬৯ সুতরাং এই অনুবাদ করায় মাইকেলকে তাঁর ওপরওয়ালারা ডেকে র্ভৎসনা করেছিলেন বলে যে-গল্প চালু আছে,১৭০ তা নিতান্তই কিংবদন্তী — সত্য নয়। সিটন কার এবং স্যর বার্টল ফ্রায়ারকে বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই বিচারের শেষ পর্যন্ত লঙ কিছুতেই নাম বলেননি। যে-দুটি পত্রিকা এবং যে-নীলকরদের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছিলো, তাদেরও জানা ছিলো, কারা এই অনুবাদ করিয়েছেন। এমন কি, বিচারের অব্যবহিত পরে সিটন কার নিজেও তাঁর দায় স্বীকার করেন।১৭১ কিন্তু তা সত্ত্বেও লঙ কেন কোনোদিন অনুবাদকের নাম প্রকাশ করেননি, তা বলা শক্ত। আমার ধারণা, মাইকেলকে দিয়ে অনুবাদ করিয়ে থাকলে লঙ এ পর্যায়ে তা প্রকাশ করতেন। মাইকেল চমৎকার ইংরেজি-জানা বিখ্যাত কবি, এ তথ্য লঙ ভালো করেই জানতেন এবং তাঁর নাম উল্লেখ করলে অনুবাদের প্রামাণিকতা বাড়বে — এটা মনে করাই তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও তিনি নাম বলেননি। এ থেকে মনে হয়, তিনি কোনো নাম-করা লোক দিয়ে অনুবাদ করাননি। জেফ্রি ওডি জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করেই বলেছেন যে, মাইকেল এই অনুবাদ করেছিলেন, তা না-হলে তাঁর কোনো তথ্য ছিলো না।
মাইকেল নীলদর্পণ অনুবাদ কবেছিলেন কিনা, সে সম্পর্কে আমার সন্দেহের আর-একটা কারণ এর ভাষা। রত্নাবলীর অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন যে, তিনি অনুবাদ করেছেন নাটকের সর্বোত্তম অ্যাংলো-স্যাক্সন ভাষায়। নীলদর্পণের ভাষা দেখে সেই অ্যাংলো-স্যাক্সন ভাষার পরিচয় পাওয়া যায় না। বস্তুত এ ভাষা থেকে মনে করা কঠিন যে, তিনি এই বই-এর অনুবাদক।
নীলদর্পণ সম্পর্কে সন্দেহ থাকলেও, মেঘনাদবধ রচনায় পারিবারিক দায়িত্ব থেকে বড়ো রকমের বাধা এসেছিলো, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথমত, লোয়ার চিৎপুর রোডের যে-বাড়িতে তিনি বাস করতেন, মে মাসে সেখান থেকে সরে যেতে হয়। কারণ, এ বাড়িটার তখন মেরামত হচ্ছিলো। বাড়ি বদল করে তাঁকে যেতে হয় বাল্য, কৈশোর এবং প্রথম যৌবনে যে-খিদিরপুরে ছিলেন, সেই এলাকায় (যদিও নিজেদের বাড়িতে নয়)। তারপর কয়েক সপ্তাহ পরে সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করার সিদ্ধান্ত নেন। দ্বিতীয়ত, হেনরিয়েটা দ্বিতীয় সন্তান প্রসব করেন ২৩ জুলাই।১৭২ এই সন্তান — দ্বিতীয় পক্ষের প্রথম পুত্ৰের — নাম রাখা হয় ফ্রেডারিক মাইকেল মিল্টন ডাট। শর্মিষ্ঠার অভিনয়ের কদিন পরেই কন্যার জন্ম হয়েছিলো। তখন তার অন্যতম নাম দিয়েছিলেন শর্মিষ্ঠা। এবারে মেঘনাদবধ লেখার অব্যবহিত পরে পুত্রের নাম রাখলেন মিল্টন। এ থেকেও আভাস পাওয়া যায়, মেঘনাদ রচনার সময়ে তিনি মিল্টনের কথা কতোটা ভেবেছিলেন। তা ছাড়া, মেঘনাদবধ সম্পর্কে তাঁর মনোভাবের খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায় আর-একটা বিষয় থেকে — পরবর্তী সময়ে কবি তাঁর এই পুত্রকে অনেক সময়ে মেঘনাদ নামে ডাকতেন। পুত্রের জন্মে তিনি খুশি হয়েছিলেন নিঃসন্দেহে। আগেই যেমনটা উল্লেখ করেছি, তিনি ক্বচিৎ তাঁর সংসারের খবর দিতেন চিঠিপত্রে। কিন্তু পুত্রের জন্মের পরে রাজনারাযণকে তিনি যে-চিঠি লেখেন, খুব সম্ভব অগস্টের প্রথম দিকে, তাতে এই ছেলের জন্মের খবর দিয়েছেন।১৭৩
ফ্রেডারিক মাইকেল মিল্টনের ব্যাপটিজমের দলিল
মেঘনাদবধ রচনার শেষ পর্যায়ে তাঁর পরিচিত দুজন উল্লেখযোগ্য লোক মারা যান — ২৯ মার্চ মারা যান তাঁর অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ, আর ১৪ জুন মারা যান Hindoo Patriot পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখার্জি। ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ তাঁকে নাট্যরচনায় খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন। তা ছাড়া, আর্থিক সংকট থেকে তাঁকে একাধিক বার উদ্ধার করেছিলেন, আমরা তা ইতিপূর্বে লক্ষ্য করেছি।১৭৪ হরিশ মুখার্জিকেও তিনি বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। হরিশ মুখার্জি প্রতিভাবান এবং সাহসী ছিলেন। সিপাহি বিপ্লব এবং নীল বিদ্রোহের সময়ে তিনি Hindoo Patriot-এর সম্পাদক হিশেবে নির্ভীক ভূমিকা পালন করেন। সিপাহী বিপ্লবের সময়ে তাঁর ভূমিকা ছিলো আরও সাহসী। নীলকরেরা তখন চাষীদের ওপর যে-তীব্র নির্যাতন চালাচ্ছিলো, তিনি তার কঠোর সমালোচনা করেন এবং নীল কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দেন। তা ছাড়া, নীলচাষীদের পক্ষে মামলা-মকদ্দমায় সহায়তা দিয়ে তাঁদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। মোট কথা, দেশে সৎ এবং সাহসী সম্পাদক এবং বুদ্ধিজীবী হিশেবে তিনি সুনাম এবং শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। কলকাতার পত্রিকায় থাকে বস্তা পচা আবর্জনা ১৭৫ — এ কথা বলে সমালোচনা করলেও, হরিশ মুখার্জির প্রতি কবি কখনো অশ্রদ্ধার কোনো উক্তি করেননি। উন্টো, হরিশচন্দ্রের মৃত্যুর পরে যখন তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানোর জন্যে একটা ছাত্র বৃত্তি প্রবর্তনের প্রশ্ন ওঠে, তিনি তখন টাকা দিতে রাজি হয়েছিলেন। কেবল তাই নয়, তাঁর বন্ধুদের সমালোচনা করে বলেছিলেন, তাঁর জন্যে স্ট্যাচু তৈরি হবে না কেন?১৭৬ অন্যদের উৎসাহের অভাবে শেষ পর্যন্ত তাঁর নিজের উৎসাহও কমে যায়। তিনি হরিশ স্মৃতি রক্ষা তহবিলে দশ টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন।১৭৭ হরিশচন্দ্রের স্মৃতিসভা অনুষ্ঠিত হয় জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে। সে যাই হোক, ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ অথবা হরিশ মুখার্জির মৃত্যুর জন্যে মেঘনাদ রচনার কাজ হয়তো তেমনভাবে পিছিয়ে যায়নি, কিন্তু কবির মনের ওপর বড়ো রকমের প্রভাব পড়েছিলো, এমনটা অনুমান করা সম্ভব। বিশেষ করে এব পর তিনি যে আর কোনো নাটক লেখার পরিকল্পনা করেননি, তার অন্যতম কারণ ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের অকাল মৃত্যু। পরে লক্ষ্য করবো, Hindoo Patrior-এর সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতর যোগাযোগ ঘটেছিলো।
মেঘনাদবধ মাইকেলের সাহিত্যিক-জীবনের বস্তুত ক্লাইমেক্স। The Captive Ladie লেখার মধ্য দিয়ে, এমন কি, বলা যায়, তারও আগে একেবারে কৈশোর থেকে তিনি কবি হিশেবে খ্যাতি লাভের জন্যে যে-সাধনা শুরু করেছিলেন, মেঘনাদে এসে তাতে সিদ্ধি লাভ করেন। যদিও তখনো একে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা বলে বিবেচনা করেননি। ছোটোখাটো মহাকাব্য লিখে তিনি হাত পাকানোর যে-সংকল্প প্রকাশ করেছিলেন,১৭৮ তাঁর মতে, এ কাব্য ছিলো তারই একটি। মেঘনাদবধ লেখার সময়েও একজন সত্যিকার উঁচুদরের কবি হিশেবে তাঁর মনে হয়েছে যে, উৎকৃষ্ট কাব্য লেখার জন্যে যে-ক্ষমতা দরকার, তা তখনো তার অনায়ত্ত। অথচ তা সত্ত্বেও, মেঘনাদবধ প্রকাশের অল্প দিন পবে তাঁর মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তি লক্ষ্য করি। তাঁর মনে হলো: যথেষ্ট হয়েছে, আর কেন! সবাইতো কালিদাস এবং মিল্টনের সঙ্গে তাঁর তুলনা করছে! আসলে তাঁর চরিত্রে ভোগ এবং বৈরাগ্যের আশ্চর্য এক সমন্বয় ঘটেছিলো। পাওয়ার আকর্ষণ ছিলো তাঁর, কিন্তু পাওয়ার পর আঁকড়ে ধরে রাখার বাসনা তীব্র ছিলো না। ব্যারিস্টারি পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিলেত যাত্রা কবার কদিন আগে রাজনারায়ণ বসুকে লেখা এক চিঠিতে তিনি যা বলেছিলেন, তা থেকে তাঁর এই আসক্তিহীনতার পরিচয় মেলে।১৭৯ তিনি লিখেছিলেন, যেভাবে তিনি চলে যাচ্ছেন, তাতে লোকেরা তাকে মাতৃভাষা এবং সাহিত্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করতে পারে। কিন্তু তিনি তো সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর পরীক্ষায় সফলতা লাভ করেছেন, তাঁর মাতৃভাষাকে এগিয়ে দিয়েছেন, এখন যেতে আর বাধা কি? সাফল্য যদি আসতে দেরি করতো, তা হলে তিনি আরও পরে যেতেন; এমন কি, হয়তো আদৌ যেতেন না।১৮০ কিন্তু সকাল-সকাল সাফল্য এবং সার্বজনিক স্বীকৃতি লাভের পর বসে বসে অলস কবিতা লেখার কোনো অর্থ হয় না। যে-কবিযশকে তিনি একদিন গণ্য করতেন সবচেয়ে দুর্লভ বস্তু হিশেবে, সেই কবিযশ লাভের পর তাকে নিয়ে তিনি তৃপ্ত থাকতে পারলেন না। অথবা তাকে আরও বাড়ানোর সাধনাকে শ্রেয় বলে ভাবলেন না। তখন সরস্বতীর সাধনা না-করে তিনি নজর দিলেন লক্ষ্মীর দিকে।
একজন সৃজনশীল লেখকের রচনা এবং জীবনের মধ্যে কতোটুকু যোগ আছে, সে নিয়ে অনেক সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে বলেছেন, লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে তাঁর সৃষ্টির কোনো যোগাযোগ না-ও থাকতে পারে। এবং সে জন্যে, কারো সাহিত্য বোঝার অথবা সে সাহিত্যের রস আস্বাদনের জন্যে তাঁর জীবনী জানার কোনো আবশ্যক নেই।১৮১ অপর পক্ষে, হেনরি জেমস বলেছেন, ‘লেখক তাঁর বই থেকে নিজেকে সযত্নে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও, তাঁর প্রতিটি বই-এর প্রতিটি পাতায় তিনি হাজির থাকেন।’১৮২ একজন ঔপন্যাসিক অথবা একজন নাট্যকার যেসব চরিত্র অঙ্কন করেন, তার প্রত্যেকটির সঙ্গে তাঁর নিজের মিল না-থাকতে পারে, তার অনেকগুলো হয়তো তাঁর চরিত্র থেকে একেবারে আলাদা। কিন্তু তাঁর উপন্যাস অথবা নাটকে বারবার যে-বলার কথাটা ফিরে ফিরে আসে, তা তাঁর নিজের। তার মধ্যে যে-অনুভূতির প্রকাশ ঘটে, সে তাঁর আন্তরিক অনুভূতি।
মাইকেল বারবার পৌরাণিক কাহিনী বেছে নিয়েছেন। এ থেকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পাবে যে, তিনি পৌরাণিক জগতে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেটা মোটেই ঠিক নয়। এমন কি, নতুন ভাষা ও ছন্দ এবং ভিন্নতর ভঙ্গিতে পৌরাণিক কাহিনী নতুন করে বলার লোভেও নয়। সত্যি বলতে কি, তাঁর মনোভাব ছিলো প্রাচীন জগৎ থেকে একেবারে আলাদা। কিন্তু তিনি ধ্রুপদী সাহিত্যের অত্যুৎসাহী পাঠক হিশেবে পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে একটা আশ্চর্য সৌন্দর্য দেখতে পেতেন। সেই সৌন্দর্য তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে পুরাণকে পরিবেশন করতে। তিনি পৌরাণিক কাহিনী বেছে নিয়েছিলেন, তার মধ্য দিয়ে তাঁর আধুনিক মানবিক মূল্যবোধকে প্রকাশ করার জন্যে। চতুর্দশ শতাব্দীর রেনেসান্সের পণ্ডিতরাও পুরোনো গ্রীক আর ল্যাটিন সাহিত্য চর্চা করেছিলেন। কিন্তু সেটা প্রাচীন কালে ফিরে যাবার জন্যে নয়, বরং সেই সাহিত্যের প্রচার এবং নতুন ব্যাখ্যার মাধ্যমে আধুনিক মানবিক মূল্যবোধকে প্রকাশ এবং প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে। তাঁদের হিউম্যানিস্ট বিশেষণের কারণ সেটাই। উনিশ শতকে যে-বঙ্গীয় রেনেসান্স হয়েছিলো বলে দাবি করা হয়, তার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রকাশ যাঁদের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য করা যায়, তাঁদের একজন নিঃসন্দেহে মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর আগে রামমোহন রায় হিন্দু শাস্ত্র অনুবাদ এবং প্রচার করেছিলেন, সেই শাস্ত্র দিয়ে প্রাচীন ভারতে ফিরে যাবার জন্যে নয়, বরং তার মাধ্যমে সমকালীন সমাজকে সংস্কার করার জন্যে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও একই উদ্দেশ্যে প্রাচীন শাস্ত্র অনুবাদ করেছিলেন এবং তার নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি অবশ্য কেবল শাস্ত্রে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। প্রাচীন সাহিত্য অনুবাদ এবং প্রচার করেও তিনি সমকালীন সাহিত্য রুচিকে উন্নত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। রামোহন এবং বিদ্যাসাগর — উভয়ই রেনেসান্সের হিউম্যানিস্ট পণ্ডিত বলে আখ্যায়িত হতে পারেন। তাঁদের পর যিনি এই বিশেষণের সবচেয়ে প্রধান দাবিদার, তিনি মাইকেল। পার্থক্য এই যে, তিনি আদৌ শাস্ত্র অনুবাদ করেননি, সাহিত্যেরও অনুবাদ করেছিলেন সামান্যই। তিনি পৌরাণিক কাহিনীর নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এবং ধ্রুপদী সাহিত্যের ওপর ভিত্তি করে নতুন সাহিত্যের প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি ভারতীয় পুরাণের মধ্যে নতুন এবং অসাধারণ সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছিলেন। শর্মিষ্ঠা, পদ্মবতী, তিলোত্তমা এবং মেঘনাদবধে একে-একে তিনি তাঁর এই একান্ত পুরাণ-প্রীতির পরিচয় দিয়েছেন। নয়তো প্রাচীন ভারতবর্ষে ফিরে যাবার মনোভাব তাঁর মোটেই ছিলো না। মধ্য এবং প্রাচীন যুগের ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর মনোভাব কেমন ছিলো, তার খানিকটা প্রকাশ আমরা ইতিপূর্বের্তীর The Anglo-Saxon and the Hindu-র মধ্যে দেখতে পেয়েছি।
মেঘনাদবধের বিষয়বস্তু এবং মাইকেল-মানস নিয়ে এ পর্যন্ত অনেক আলোচনা হয়েছে। সবচেয়ে বিতর্কিত আলোচনা হয়েছে হিন্দু দেবতা রামের প্রতি তাঁর প্রতিকূল এবং রাক্ষসরাজ রাবণের প্রতি তাঁর অনুকূল মনোভাব নিয়ে। তাঁর সমকালেও এই সমালোচনা সবচেয়ে প্রবল ছিলো। রাজনারায়ণকে লেখা একটি চিঠিতে কবি স্বীকার করেছেন যে, তাঁর সহানুভূতি ছিলো বিশেষ করে রাক্ষসদের জন্যে এবং তিনি রাম আর তাঁর তুচ্ছ অনুসারীদের অপছন্দ করেন। অন্য আর-এক চিঠিতে লিখেছেন: ‘এই কাহিনী থেকে আমি মহৎ একটা কাব্য লিখতে পারতাম, কিন্তু বাঁদরগুলো রসভঙ্গ করে।১৮৩ কিন্তু তাঁর সমালোচকরা তাঁর এই বক্তব্যটাই সবচেয়ে সত্য মনে করে একে হিন্দুদের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবের একেবারে মোক্ষম প্রমাণ হিশেবে হাজির করেছেন। কিন্তু এখানে কবি আসলে একটা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বীর রাক্ষসদের প্রতিপক্ষ হিশেবে বানরদের দেখাতে সংকোচ বোধ করেছেন। কারণ তার ফলে রাক্ষসদের বীরত্ব ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু কোনো কোনো সমালোচক এই দৃষ্টিকোণ থেকে মেঘনাদবধের বিচার করেননি। তবে কবি যে বহিরাগত এবং আগ্রাসী রামের চেয়ে রাক্ষসদেরই জ্ঞাতে এবং অজ্ঞাতে সমর্থন করেছেন, তাঁরা তাঁকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখেছেন।
আসলে তাঁর সমস্ত অধ্যয়ন, অভিজ্ঞতা এবং জীবনদৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যে-নব্যরামায়ণ লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন, সেই রামায়ণে রামের বদলে রাবণ দেখা দিলেন নায়ক হিশেবে। এটা সেকালের কোনো হিন্দু কবির পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি এই অভূতপূর্ব ধারণা কোথায় পেলেন? প্রথম যৌবন থেকে পাশ্চাত্যের উদার ভাবনা এবং সাহিত্য দিয়ে তাঁর মন লালিত হয়েছে। ঐতিহ্যিক চিন্তাধারাকে বাদ দিয়ে তিনি গোড়া থেকেই স্বাধীনভাবে ভাবতে শিখেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, রাম এবং রাবণকে এমন ঐতিহ্য-বিরোধী ভাবমূর্তিতে তিনি কল্পনা করতে পারতেন কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। এ ক্ষেত্রে যা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়, তা হলো তাঁর ধর্মান্তর। সন্দেহের কারণ নেই যে, খৃস্টান হবার দরুন এবং সেই সঙ্গে পাশ্চাত্যের মূল্যবোধ স্বীকরণের ফলে এই অসাধ্য সাধন করা তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছিলো।
সমালোচক হিশেবে যাঁরা আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে উৎসাহী, তেমন অনেকে আবার এমনও বলেছেন যে, সিপাহী বিপ্লবের পর যে-নতুন জাতীয়তাবাদী চেতনা জন্ম নিচ্ছিলো, রাম-রাবণের সংঘর্ষ দিয়ে কবি সেটাকেই প্রতিফলিত করতে চেয়েছিলেন এবং এ ক্ষেত্রে তাঁর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি স্বভাবতই রামের বদলে রাবণের পক্ষ নিয়েছে।১৮৪
মধুসূদনের একান্ত নিজস্ব এই দৃষ্টিভঙ্গির এমন সরলীকৃত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাঙালিরা পরাধীনতার জ্বালায় একেবারে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিলেন, ইতিহাস এমন সাক্ষ্য দেয় না। তা হলে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ সিপাহী বিপ্লবকে সাজানো সংসারে বর্গীর হামলার মতো একটা উপদ্রব বলে বিবেচনা করতেন না। মাইকেলের সহপাঠী এবং বন্ধু রাজনারায়ণ বসু সিপাহী বিপ্লবকে কোন দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, আগেই আমরা তা লক্ষ্য করেছি। বস্তুত, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ইংরেজ রাজত্ব থেকে যে-সমৃদ্ধি এবং নিশ্চিত নিরাপত্তা লাভ করেছিলেন, কোনো মধ্যযুগীয় শক্তিকে স্বাগত জানিয়ে তাকে বিনষ্ট করতে তাঁরা তৈরি ছিলেন না।
এ বিষয়ে কবির মনোভাব তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি জটিল ছিলো বলে মনে হয়। কারণ, তাঁর নিজের স্বরূপ বা আত্মপরিচয় সম্পর্কে তাঁর ধারণা রাজনারায়ণদের মতো অতোটা সিধে ছিলো না। রাজনীতির তিনি ধার ধারতেন না। তখন পর্যন্ত দেশের পরাধীনতা সম্পর্কে কোনো প্রবল, মনোভাব তাঁর রচনায় প্রতিফলিত হয়নি। দেশের পরাধীনতায় তিনি যে-খুব অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, তার কোনো প্রকাশ তাঁর রচনায় প্রকটভাবে দেখা দেয়নি। এমনকি, চলতি ঘটনাবলীর প্রতিও মাদ্রাসে পত্রিকা সম্পাদনা করার সংক্ষিপ্ত সময় ছাড়া জীবনের অন্য পর্যায়ে তিনি নিতান্ত অনীহা দেখিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও নিজের পরিবার, সমাজ, এবং ধর্ম ত্যাগ করে তিনি যোজন যোজন দূরে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী রেবেকা এবং জীবনসঙ্গিনী হেনরিয়েটা ছিলেন আধা-ইংরেজ। তাঁদের সঙ্গে সংসার করার ফলে আত্মপরিচয় সম্পর্কে তাঁর ধারণা যদি আরও ধোঁয়াটে হয়ে থাকে, তা হলেও বিস্মিত হবার কারণ নেই। সর্বোপরি, ইংরেজিসভ্যতার প্রতি তাঁর কী গভীর ভালোবাসা ছিলো, তা-ও আগেই আমরা দেখেছি। ধর্মে বিশেষ আগ্রহনা-থাকলেও, তিনি নিজেকে বেশ জোর গলায় খৃস্টান বলে পরিচয় দিতেন। নিজেকে তিনি ইংরেজ মনে করতে পারতেন না ঠিকই — বিশেষ করে চামড়ার রঙের দরুন — কিন্তু তাই বলে তিনি কি নিজেকে অসঙ্কোচে বাঙালি বলে সনাক্ত করতেন? অথবা ভারতীয় বলে? বলা শক্ত। বরং চার্চের মতো কোনো একটা জায়গায় গিয়ে রাতারাতি ধর্মের মতো চামড়ার রং এবং জন্মের পরিচয় বদল করতে পারলে, অসম্ভব নয় যে, তিনি তাও চেষ্টা করতেন। ইংরেজদের প্রতি তাঁর যেটুকু বিরূপতা এসেছিলো, তা এসেছিলো তিনি ইংরেজদের যে-বর্ণবাদী, বৈষম্যমূলক এবং প্রভূচিত আচরণ লক্ষ্য করেছিলেন, তা থেকে। ‘ছোটো’ ইংরেজের অনেক সংকীর্ণ ব্যবহারের তিনি শিকার হয়েছিলেন। মোট কথা, সবকিছু মিলে তিনি যৌবন থেকে এক ধরনের স্বরূপের সংকটে ভুগতেন বলে মনে হয়। তবে জীবনের সব পর্যায়ে তাঁর স্বরূপ-ভাবনা যে একই রকম ছিলো, তা ভাববার কারণ নেই। এহেন জটিল মানসিকতার অধিকারী মাইকেল সিপাহী বিপ্লবকে এক কথায় ভালো অথবা মন্দ বলে বিবেচনা করতেন বলে মনে হয় না। য়োরোপে গিয়ে তাঁর এই আত্মপরিচয়ের সংকট কিভাবে ঘনীভূত হয় এবং নতুন মোড় নেয়, যথাসময়ে আমরা তা দেখতে পাবো। তবে এখানেই উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সেই সংকটের সময়ে একাধিক সনেটে তিনি মাতৃভূমিকে নতুন চোখে দেখেছিলেন। তাঁর সেই মনোভাব মেঘনাদবধ আলোচনা প্রসঙ্গেও বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
কয়েক বছরের মধ্যে দেশ সম্পর্কে তাঁর ভালোবাসা ধীরে ধীরে কেলাসিত রূপ নেয়। ভারত-ভূমি সনেটটি তিনি শুরু করেছেন একটি ইটালীয় কবিতার দুটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে:
কুক্ষণে তোরে লো, হায়, ইতালি! ইতালি!
এ দুখজনক রূপ দিয়াছেন বিধি।
উদ্ধৃত এই দুই পঙ্ক্তি থেকেই বোঝা যায়, একবিতায় তিনি ভারতবর্ষের দুঃখের কথা বলবেন। তবে তিনি কেবল দুঃখের কথাই বলেননি, সেই সঙ্গে স্বদেশকে তিনি আনুগত্যহীন, নিজের সতীত্ব রক্ষা করতে অসমর্থ এবং দুর্বল বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
নহিস্ লো বিষময়ী যেমতি সাপিনী;
রক্ষিতে অক্ষম মান প্রকৃত যে পতি;
পুড়ি কামানলে, তোরে করে লো অধিনী
(হা ধিক!) যবে যে ইচ্ছে, যে কামী দুর্মতি!
যখন যে-বিজয়ী এসেছে, ভারতবর্ষ তারই কাছে নিজেকে অনাবৃত করে দিয়েছে। এখানে তিনি কেবল মুসলিম বিজয়ীদের কথা বলেছেন বলে মনে হয় না। বরং সমকালীন ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির সামনে ভারতের পরাজয়ের ইঙ্গিতও দুর্লক্ষ নয়। আমরা কবিতায়ও তাঁর এই ক্ষোভ দেখতে পাই।
আমরা, — দুর্বল, ক্ষীণ, কুখ্যাত জগতে,
পরাধীন, হা বিধাতঃ , আবদ্ধ শৃঙ্খলে? —
কি হেতু নিবিল জ্যোতিঃ মণি, মরকতে,
ফুটিল ধুতুরা ফুল মানসের জলে
নির্গন্ধে কে কবে মোরে? জানিব কি মতে?
বামন দানবকুলে, সিংহের ঔরসে
শৃগাল কি পাপে মোরা কে কবে আমারে
কেবল নিজেদের ধিক্কার দেননি, সেই সঙ্গে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন:
রে কাল, পূরিবি কি রে পুনঃ নব রসে
রস-শূন্য দেহ তুই? অমৃত-আসারে
চেতাইবি মৃত-কল্পে? পুনঃ কি হরষে,
শুক্লকে ভারত-শশী ভাতিবে সংসারে?
বঙ্গদেশে যে-জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ১৮৬০-এর দশক থেকে ধীরে ধীরে উন্মেষ লাভ করতে আরম্ভ করে, সেই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে দীক্ষা না-নিলেও, এ কবিতা দুটিতে দেশপ্রেম এবং পবাধীনতা সম্পর্কে তাঁর যে-মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে তা তাঁর অন্তরের অন্তস্তল থেকে উৎসারিত। বস্তূত, এ চেতনা তাঁর হৃদয়ের গহীনে স্ফটিকের মতো ধীরে ধীরে দানা বেঁধেছিলো। এবং এমন মনে করার কারণ নেই যে, এ চেতনা তিনি কেবল প্রবাসে দৈবের বশেই স্বীকরণ করেন।
মেঘনাদবধে তাঁর এই চেতনা অতো প্রকট না-হলেও ক্রিয়াশীল ছিলো নিঃসন্দেহে। কিন্তু তিনি যদি পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক না-হয়ে, হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হতেন, তা হলে মনে মনে তিনি রাবণের — রাক্ষসদের পক্ষ নিতে পারতেন না। তিনি কোনো কোনো জায়গায় রাম এবং লক্ষ্মণকে বীর এবং মহান বলে দেখাতে চেয়েছেন ঠিকই; তবে তা-ও সেই বিখ্যাত বীরদের প্রতিপক্ষ হিশেবে রাবণ কতো বড়ো, তা দেখানোর উদ্দেশ্যে। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার, মাইকেল কেবল স্বধর্ম এবং স্বসমাজ ত্যাগ করেননি; তিনি খৃস্টান সমাজেও গৃহীত হননি। সে জন্যে, তিনি কোনো সমাজকে পুরোপুরি আপন বলে মেনে নিতে পারেননি। ফলে, তিনি হিন্দু থাকেননি; খৃষ্টানও হতে পারেননি। তিনি যা হয়েছিলেন, তা একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। তদুপরি বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে নিত্য সহবাসে তিনি যে-ঔদার্যের অধিকারী হন, তা-ও তাঁকে রাবণ, মেঘনাদ এবং বীরবাহু থেকে আরম্ভ করে বাম,লক্ষ্মণ এবং সীতা পর্যন্ত সবগুলো চরিত্রকে মানুষ হিশেবে দেখতে সাহায্য করেছিলো। আর বানরদেরও তিনি নিতান্ত বানর হিশেবেই দেখেছিলেন, কোনো দেবতা হিশেবে নয়। তাঁর এই নির্ভেজাল মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে তাঁর পক্ষে রামায়ণের কাহিনীর এই নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়েছিলো।
রাম এবং রাবণ সম্পর্কে মাইকেল কাব্যে যা লিখেছেন, মনে হয় না, তা থেকে তাঁর পক্ষপাত সবার কাছে অতোটা স্পষ্ট হতো। বরং অনেক জায়গাতেই বিভিন্ন উপমার মাধ্যমে তিনি রামকে রাবণের চেয়ে বড়ো করেই দেখিয়েছেন। কিন্তু রাম এবং তাঁর বানর সৈন্যদের সম্পর্কে রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠিতে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, তা থেকে বাঙালি সমালোচকদের এ সম্পর্কে আর-কোনো সন্দেহ ছিলো না। নয়তো তাঁর রচনা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে রামের প্রতি তাঁর যে অনেকটাই দরদ ছিলো, তা বোঝা যেতো। সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি এবং ভিন্ন সময়ে লালিত একজন সমালোচক, ক্লিন্ট সীলি একটি চমৎকার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, রাবণকে বড়ো বললেও কবি অনেক সময়ে তাঁর বর্ণনা দেবার জন্যে যেসব উপমা ব্যবহার করেছেন, তা রাবণকে বড়ো না-করে, ববং ছোটোই করে। অপর পক্ষে, রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেক সময়ে তিনি তাঁর প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি দেখিয়েছেন।১৮৫ আমার মনে হয়, সীলির এই মন্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে।
The Captive Ladie, Rizia এবং তিলোত্তমাসম্ভবের মধ্য দিয়ে তিনি যে-বীররস, ঐশ্বর্য এবং জাঁকজমক পরিবেশনের প্রযত্ন করছিলেন, তাও চূড়ান্ত রূপ নেয় মেঘনাদবধকাব্যে। এর পরে তাই বীররস পরিবেশনের আগ্রহ তিনি অনেকাংশে হারিয়ে ফেলেন। এমন কি, মেঘনাদবধের একেবারে গোড়াতে তিনি বীররস পরিবেশনের উদাত্ত ঘোষণা দিলেও, আসলে এ কাব্যের নাম থেকে আরম্ভ করে প্রধান ঘটনা পর্যন্ত সবকিছুই গভীর বিষাদে ঢাকা। একটি সমৃদ্ধিশালী এবং পরিপূর্ণ সুখের পুরী কিভাবে ভাগ্যদোষ আর বহিরাগতের হামলা, গৃহশত্রুর ষড়যন্ত্র এবং অন্যায় সমরে রাতারাতি শোকপুরীতে পরিণত হতে পারে, একাব্যের বহিরঙ্গে করি সেটাই দেখাতে চেয়েছেন। বিশেষ করে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, রাবণের মতো একজন দায়িত্বপূর্ণ ও প্রজাবৎসল রাজা এবং একজন আদর্শ স্বামী ও পিতা কিভাবে, আপাতদৃষ্টিতে, ভাগ্যদোষে প্রচণ্ড ঝড়ের আঘাতে উন্মূলিত বটের মতো সকল গৌরব হারিয়েছেন।
এ কাব্য লিখতে শুরু করার অল্প দিন পরে — তখনো তিনি প্রথম সর্গ শেষ করেননি — তখনই রাজনারায়ণকে ভাবী ট্র্যাজেডির প্রতি দুঃখ প্রকাশ করে চিঠি লিখেছিলেন।১৮৬ সুতরাং, গোড়াতে তিনি বীররসের একটি কাব্য লিখতে চাইলেও সৃজনশীলতার টানে তিনি রচনা করেছিলেন একটি ট্র্যাজিক কাব্য, এমনটা মনে করার কারণ নেই। বস্তুত, তিনি প্রথম থেকেই জানতেন এ কাব্যে তিনি কী লিখবেন। এ কাব্যের অনেকটা জুড়ে তাঁকে বর্ণনা করতে হবে লঙ্কার ঐশ্বর্য, সমৃদ্ধি, আড়ম্বরের চিত্র, আর থাকবে বীরবাহু, মেঘনাদ, রাম এবং লক্ষ্মণের অসাধারণ বীরত্ব এবং প্রচণ্ড সংঘাতের কথা — এমনটা তিনি প্রথমেই পরিকল্পনা করেছিলেন। এসব বর্ণনা করার জন্যে তাঁকে বীররসের আশ্রয় নিতে হবে, তা-ও তাঁর অজানা ছিলো না। কিন্তু কাব্যের কেন্দ্রে থাকবে মেঘনাদের হত্যা আর নিঃস্ব রিক্ত রাবণেব মর্মস্পর্শী ট্রাজেডি, কাব্য পরিকল্পনা করার গোড়া থেকে এ-ও তাঁর কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট ছিলো। সুতরাং বীররস পরিবেশন করার যে-প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, সে ছিলো নিতান্ত আংশিক ভাষণ।
মাইকেলের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কোদণ্ডটঙ্কারের কথা তিনি যতোবারই অথবা যতো জোরেই বলুন না কেন, অন্তরের অন্তস্তলে তিনি ছিলেন নির্ভেজাল রোম্যান্টিক এবং লিরিক কবি। তিনি নিজেও এ সম্পর্কে ষোলো আনা সজাগ ছিলেন। সত্যি বলতে কি, মেঘনাদবধে বীররসের আড়ালে কবি-চরিত্র আদৌ ঢাকা থাকেনি। সেখানে যুদ্ধবিগ্রহের তলা দিয়ে ফল্গূধারার মতো গীতলতা বহমান। মেঘনাদবধের চতুর্থ সর্গের সঙ্গে মূল কাহিনীর যোগাযোগ নেই এবং সে কারণে এই সৰ্গটা না-থাকলেই ভালো হতো — এ কথা কবি নিজে লিখেছেন।১৮৭ কিন্তু, তা সত্ত্বেও, বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তিনি স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ আর সহমর্মিতা নিয়ে এই সর্গটি রচনা করেছিলেন। কারণ, রণভেরী বাজানোর চেয়ে গীতলতায় ভেসে যাওয়াই ছিলো তাঁর স্বভাবসিদ্ধ। সে জন্যে, রচয়িতার দ্বিধা সত্ত্বেও, এই সর্গটি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিলো। এবং অনেকে এই সর্গটিকেই এ কাব্যের শ্রেষ্ঠ সৰ্গ বলে বিবেচনা করতেন। কবি অবশ্য সে সম্পর্কে নিজেও সচেতন ছিলেন। বস্তুত, এ কাব্যের যেখানেই রোম্যান্টিক হবার সুযোগ ছিলো, মাইকেল সেখানেই স্বাচ্ছন্দ্য দেখিয়েছেন। তারপর কাব্যটি শেষ করতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। শেষ দিকে বীররস পরিবেশন করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এ কাব্য রচনার সময়ে তিনি তাই একাধিক বার রাজনারায়ণকে লিখেছেন; ‘আর বীররস নয়। রোম্যান্টিক এবং লিরিক কাব্যের বিরাট সম্ভাবনা আছে আমাদের সাহিত্যে। অতঃপর সেদিকে পা বাড়াবো।১৮৮ কবিতার সংকল্প থেকে সরে যাননি। মেঘনাদবধের পর তিনি আর কোনো দিন পুষ্পক রথে চড়ে যুদ্ধযাত্রা করেননি। এমন কি, একটু পরে দেখতে পাবো, বীরাঙ্গনাকাব্যে বীর নারীদের কথা লিখলেও সে কাব্যের মূল সুর নিতান্তই রোম্যান্টিক এবং তা বিষাদে আচ্ছন্ন।
মেঘনাদবধকাব্য লিখতে অতো সময় লাগায় কবি মাঝেমধ্যে অন্য দিকে তাকিয়েছেন। যেমন, পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে লিখেছিলেন কৃষ্ণকুমারী নাটক। তা ছাড়া, ব্রজাঙ্গনার বেশির ভাগ পদও তিনি এ সময়ে রচনা করেছিলেন। আর রচনা করেছিলেন, বাংলা ভাষায় তাঁর প্রথম সনেট। ছাত্রজীবনেই তিনি ইংরেজিতে বেশ কতোগুলো সনেট লিখেছিলেন। মেঘনাদবধ লেখার সময়ে তাঁর মনে হয়েছিলো, বাংলা ভাষায়ও সনেট প্রবর্তন করা সম্ভব। তারপর প্রথম সনেটটি লিখে তাঁর মনে হলো যে, বাংলা ভাষায় কেবল সনেট লেখা সম্ভব নয়, বরং তাঁর মতো প্রতিভাবান লোকেরা সনেটের চর্চা করলে বাংলা সনেট ইটালিয়ান সনেটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে।১৮৯
তিনি যে-বিষয়ে তাঁর প্রথম সনেট লিখেছিলেন, সে তাঁর একান্ত অন্তরের কথা। এক সময়ে তিনি সত্যি সত্যি মনে করতেন, বাংলা ভাষা শেখার অযোগ্য। সে সময়ে তিনি সজ্ঞানে বাংলা ভাষা ভুলে যাবার জন্যেও তিনি কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর কাঙিক্ষত স্বপ্ন খানিকটা সফল করার সুযোগ পেয়েছিলেন তাঁর অবহেলিত বাংলা ভাষার মাধ্যমে। শর্মিষ্ঠা প্রকাশের সময় থেকে যে-জয়যাত্রায় তিনি বেরিয়েছিলেন, মেঘনাদবধে এসে তাঁর মনে হলো, তিনি সে পথের শেষে পৌছে গেছেন। অন্তত তিনি এ সময়ে যথেষ্ট আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। সেই আত্মপ্রসাদের কেলাসিত প্রকাশই আলোচ্য সনেটটিতে — কবি-মাতৃভাষায়:
নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য রতন।
অগণ্য; তা সবে আমি অবহেলা করি,
অর্থলোভে দেশে দেশে করিনূ ভ্রমণ,
বন্দরে বন্দরে যথা বাণিজ্যের তরী।
কাটাইনু কত কাল সুখ পরিহরি,
এই ব্রতে, যথা তপোবনে তপোধন,
অশন, শয়ন ত্যজে, ইষ্টদেবে স্মরি,
তাঁহার সেবায় সদা সপি কায় মন।
বঙ্গকুল-লক্ষ্মী মোরে নিশার স্বপনে
কহিলা হে বৎস, দেখি তোমার ভকতি,
সুপ্রসন্ন তব প্রতি দেবী সরস্বতী।
নিজ গৃহে ধন তব, তবে কি কারণে
ভিখারী তুমি হে আজি, কহ ধন-পতি?
কেন নিরানন্দ তুমি আনন্দ-সদনে?
এ কবিতায় কবি তাঁর দুটি ভ্রান্তির কথা বলেছেন — অর্থলোভ আর তার জন্যে দেশে দেশে ভ্রমণ। মাদ্রাস-যাত্রা কি তা হলে অর্থলোভে? কিন্তু মনে হয়, এটা নিতান্তই কথার কথা। আসলে তিনি তাঁর ভ্রান্তি এবং মরীচিকার পেছনে জীবনের মূল্যবান সময় অপচয় করার জন্যে নিজের প্রতি ধিক্কারই দিতে চেয়েছেন। তিনি যে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা না-করে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করার ব্যর্থ চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন, সেই ভ্রান্তিকে তিনি বড়ো করে দেখেছিলেন। বছর চারেক পরে তিনি যখন কবিতাটি আবার নতুন করে লেখেন, তখন তাঁর উপলব্ধি আরও গভীর হয়েছে। অর্থলোভেব চেয়ে তখন ভাষার প্রশ্নটা তাঁর মনে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তখন সে জন্যে লিখেছিলেন,
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন; –
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ।
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
এখানে সরাসরি অর্থলোভের কথা বলেননি। বরং পর-ধন-লোভ বলে একই সঙ্গে সাহিত্য এবং অর্থের অনুষঙ্গ দিতে পেরেছেন। কবিতার শেষেও।
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।
— বলে অর্থলোভের বদলে সাহিত্য-যশের দিকেই বিশেষ করে ইঙ্গিত দিয়েছেন। ভার্সাইতে লেখা সংশোধিত সনেটটি ছন্দের সাবলীলতা, ভাষার মাধুর্য এবং সর্বোপরি, আন্তরিকতায় বেশি সুন্দর হয়েছে। কিন্তু তাই বলে প্রথম সনেটটিকে কোনোক্রমে কম সফল বলে মনে হয় না। বস্তুত, ১৮৬০ সালে মেঘনাদবধ রচনার সময়েই তিনি সনেট লেখা পরিকল্পনা করেন এবং তাতে সাফল্য লাভ করেন, যদিও তখনই আরও সনেট লেখেননি, বা লিখতে পারেননি।
মেঘনাদবধ শেষ করে কবি আত্মতৃপ্তির একটা নিশ্বাস ফেলেছিলেন। মনে হয়, তিনি নিজেকে নিয়ে খুশি হয়েছিলেন। ‘একখানা ট্র্যাজেডি, একটি পদাবলী সংকলন আর একটি সত্যিকার মহাকাব্যের অর্ধেক — কি বলো বন্ধু, এক বছরের মধ্যে — এবং সে বছরেরও মাত্র অর্ধেক হয়েছে — কি যথেষ্ট নয়? আমি যদি অন্য কিছুর জন্যে কোনো কৃতিত্ব দাবি করতে না-পারি, অন্তত একটা পরিশ্রমী কুকুর হিশেবে প্রশংসা পেতে পারি, তাই না?’ — রাজনারায়ণকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন।১৯০ মেঘনাদবধ শেষ করে তিনি একদিকে যেমন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন, তেমনি অন্য দিকে একটা সংকটে পড়েন। সংকট — অতঃপর তিনি কী করবেন, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্তহীনতার। রাজনারায়ণকে তিনি এ সময়ে একাধিকবার এ বিষয়ে পরামর্শ দেবার জন্যে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এইমাত্র যে-চিঠিটি উল্লেখ করলাম, সেটি তিনি লিখেছিলেন মেঘনাদবধ শেষ করে; মহররমের ঠিক পরে। ‘আমি সবেমাত্র মহরমের হৈচৈ থেকে কাটিয়ে উঠেছি।’ সে বছর মহররম হয়েছিলো ১৯ জুলাই। লেখার সুনির্দিষ্ট কোনো কিছু নেই, সে জন্যে তিনি ভাবছিলেন, কী নিয়ে লেখা যেতে পারে। ঠিক সেই সময়ে মহররম দেখে তাঁর মনে হলো: ‘মুসলমানদের মধ্যে যদি কোনো বড়ড়া কবির জন্ম হয়, তা হলে তিনি হোসেন এবং তার ভাই-এর মৃত্যু নিয়ে চমৎকার একটা মহাকাব্য রচনা করতে সক্ষম হবেন। আর সেই বিষয়ের প্রতি তিনি সমগ্র মুসলমান সম্প্রদায়ের আগ্রহও জাগিয়ে তুলতে পারবেন। আমাদের (অর্থাৎ হিন্দুদের) এ রকমের কোনো বিষয় নেই।১৯১ (কয়েক বছর পরে মীর মশাররফ হোসেন গদ্যে এ কাহিনী লিখে যে-জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, তা কবির দূরদৃষ্টি এবং বিচারবোবে প্রমাণ দেয়।)
মহররম নিয়ে তিনি নিজে কাব্য লেখার কথা অবশ্য ভাবেননি। কারণ, তিনি মুসলিম সংস্কৃতি সম্পর্কে অতো ভালো জানতেন না। বা মুসলিম সংস্কৃতি থেকে নেওয়া একটা বিষয় তাঁর মধ্যে অতোটা আন্তরিক আবেগও জাগাতে পারতো কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু মুসলমানদের বিষয় নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করা দরকার, এটা তিনি বেশ জোর দিয়ে একাধিকবার বলেছিলেন। মাদ্রাসে তিনি যখন Rizia রচনা করছিলেন, তখনকার কথা আলোচনা করার সময়েও আমরা এটা লক্ষ্য করেছি। মুসলমান নামের বিরুদ্ধে হিন্দু সাহিত্যিক এবং পাঠক মহলে যে-বিরূপ মনোভাব ছিলো, তা দূর করা প্রয়োজন, তিনি সে কথাও বলেছেন। তাঁর চিন্তাধারা কতোটা সঠিক সে প্রশ্নে না-গিয়েও বলতে পারি যে, তাঁর বিবেচনায়, জাতি হিশেবে মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় অনেক বেশি তেজী এবং তাঁদের মহিলারাও অনেক বেশি কৌতূহলোদ্দীপক। সুতরাং তাঁদের নিয়ে নাটকীয় সংঘাতপূর্ণ সাহিত্য রচনা সম্ভব।১৯২ কবির এতো আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও, তিনি অবশ্য মুসলমানী বিষয় নিয়ে কিছু রচনা করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে কারণটা আপাতদৃষ্টিতে তাঁর নিজস্ব নয়। আসলে, তিনি কিছুতেই তাঁর বন্ধুদের এ বিষয়ে রাজি করাতে পারেননি। তবে তাঁদের বিরোধিতা সত্ত্বেও, তিনি মেঘনাদবধ রচনার সমকালে রিজিয়াকে নিয়ে একটি কাব্যনাট্য লিখতে আরম্ভ করেছিলেন। বিলেত থেকে ফিরেও নাকি তিনি তৃতীয় বারের মতো Rizia লেখার কথা ভেবেছিলেন।
মেঘনাদবধ রচনার কাজ যখন শেষ হবার পথে, তখন তিনি লিরিক লেখার কথা চিন্তা করেছিলেন এবং সে সম্পর্কে রাজনারায়ণ বসুকে চিঠি লিখেছিলেন – আমরা আগেই তা উল্লেখ করেছি। এখন জুন মাসের (১৮৬১) শেষ দিকে মেঘনাদবধের নবম সর্গ ছাপাখানায় পাঠিয়ে দিয়ে, তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার জন্যে একটি কবিতা রচনা করেন। বলা হয়, এ কবিতা লেখার অনুরোধ এসেছিলো সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে।১৯৩ তখন সত্যেন্দ্রনাথের বয়স ঠিক উনিশ বছর। সারদাপ্রসাদের মাধ্যমে কবির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হওয়া অসম্ভব নয়। সে যাই হোক, সত্যেন্দ্রনাথ নাকি কবির কাছে চেয়েছিলেন একটি ব্রহ্মসঙ্গীত। কিন্তু খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করার অব্যবহিত পরে কিছু কাল ছাড়া, কোনো দিনই ধর্মে মাইকেলের উৎসাহ প্রবল ছিলো না। ফরমাইশি রচনা — বিশেষ করে ব্রহ্মসঙ্গীতের মতো ফরমাইশি রচনা লিখতে তিনি তৈরিও ছিলেন না। তিনি লিখলেন, তাঁর হৃদয়-মোচড়ানো ঘনীভূত আবেগের একটি লিরিক — আত্মবিলাপ। এই কবিতা লেখার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই তিনি রাবণের বিলাপ লিখেছিলেন। সেই বিলাপ তাঁকে আত্মবিলাপ লেখার ধারণা দিয়েছিলো, নাকি মনে মনে তিনি নিরন্তর যে-আত্মবিলাপ করছিলেন, যে-পাপবোধ তাঁকে অনুক্ষণ তুষানলে দগ্ধ করছিলো, তা-ই রাবণের বিলাপ লেখায় তাঁকে প্রেরণা দিয়েছিলো, বলা মুশকিল। আমার ধারণা, উভয়ই উভয়কে প্রভাবিত করেছিলো। রাবণের বিলাপে যে-অসাধারণ আন্তরিকতা এবং আবেগ লক্ষ্য করি, নিজের হৃদয়ে তুলনীয় অনুভূতি না-থাকলে, তা লেখা কঠিন হতো। রাবণের যে-শোক দেখতে পাই, এবং শেষ পর্যন্ত তাকে যে পতনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়, তার পেছনে তাঁর কোনো পাপ রয়েছে, এটা তাঁর জানা ছিলো, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কোন পাপ – সে সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিলো না। সীতাহরণ করে তিনি যে অন্যায় করেছেন, এটা তিনি মনে করতে পারেননি। তাঁর মূল্যবোধ দিয়ে সূর্পণখার অপমানের প্রতিকার করার জন্যে তিনি যা করেছেন, তাকে তিনি পাপ বলে গণ্য করতে পারেননি। অপর পক্ষে, আত্মবিলাপ লেখার সময়ে ভালো করে জানতেন তিনি কী ‘পাপের শাস্তি পাচ্ছেন।
আত্মবিলাপ রচনার সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিলো মাত্র ৩৭ বছর। বয়স হয়ে যাচ্ছে, অমূল্য আয়ু অকারণে নষ্ট হচ্ছে – এসব কথা ভাববার সময় তখনো তাঁর আসেনি। বরং ততোদিনে তিলোত্তমাসম্ভব এবং মেঘনাদবধ কাব্য প্রকাশের মাধ্যমে ছোটোবেলা থেকে বড় কবি হওয়ার এবং কবি হিশেবে যশ লাভের যে-স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা অনেকাংশে চরিতার্থ হয়েছে। নিজে বলেছেন, বাংলা ভাষার প্রথম সত্যিকার কাব্য তিনিই লিখেছেন। তদুপরি, বাড়তি খ্যাতিও পেয়েছেন অলীক কুনাট্যবঙ্গের বদলে শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী এবং কৃষ্ণকুমারী নাটক আর দুটি প্রহসন রচনা করে। এসব নাট্যরচনা যে তাঁকে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকে পরিণত করেছিলো, উচ্ছসিতভাবে তাও বন্ধুকে লিখেছিলেন। সত্যি বলতে কি, তখনকার কলকাতার বাঙালি সমাজে তাঁর চেয়ে বহু গুণ আয় করতেন অনেকে, বড়ো বড়ো পদে অধিষ্ঠিতদের সংখ্যাও কম ছিলো না; কিন্তু এখন এক শতাব্দী পরের মূল্যমানেই নয়, সমকালীন বিচারেও তাঁরা কেউ মাইকেলের ধারে-কাছে যেতে পারতেন না। তিনি বাঙালি সমাজে একটি বিশিষ্ট আসন দখল করে নিয়েছিলেন।
কেবল তাই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও, কৈশোর থেকে নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করার যে-স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাতেও সাফল্য লাভ করেছিলেন। হিন্দু কলেজের, এমন কি, বিশপস কলেজের আমলেও তিনি খাঁটি ইংরেজ ললনা অথবা শ্বেতাঙ্গিনী বিয়ে করার স্বপ্ন দেখেছিলেন কিনা, সন্দেহ করি। কারণ, তখনো অবধি কোনো বাঙালি পুরুষ কোনো ইংরেজ মহিলার পাণিগ্রহণ করেননি। কিন্তু ১৮৬১ সালে আত্মবিলাপ লেখার অনেক আগেই তিনি একটি শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সে বিয়ে ভেঙে যাবার পর ঘর করছিলেন আর-একজন শ্বেতাঙ্গিনীর সঙ্গে। মোট কথা, পছন্দ করে বিয়ে করার যে-স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তা সফল হয়েছিলো।
তাঁর আর এক স্বপ্ন ছিলো অনেক টাকাপয়সার, অর্থস্বাচ্ছন্দ্যের। মাদ্রাসে তাঁর যথেষ্ট টানাটানির পর ১৮৬১ নাগাদ তাও অংশত সফল হয়েছিলো। পুলিশ কোর্টের লিগ্যাল ক্লার্ক হিশেবে মাসিক বেতন ১২৫ টাকা ছাড়াও বইপত্র থেকে তাঁর বাড়তি আয় ছিলো। কিন্তু, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, আত্মবিলাপ লেখার আগে সম্পত্তি নিয়ে যে-চারটি মামলা চলছিলো, তার তিনটির ফয়সালা হয়। একটিতে জয়ের ফলে তাঁর বাৎসরিক আয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বেড়ে যাবে, খুশি হয়ে তিনি তা বন্ধুকে লিখেছিলেন।১৯৪ তা ছাড়া, খিদিরপুরের বাড়িও তিনি ফিরে পেয়েছিলেন। এমন কি, মায়ের অলঙ্কার বাবদে পেয়েছিলেন ১৩০০ টাকা।১৯৫ সঙ্গে সঙ্গে তিনি আর্থিকভাবে তেমন লাভবান হননি, কিন্তু তুলনামূলক অর্থস্বাচ্ছন্দ্যের সম্ভাবনা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন। মোট কথা, তাঁর সারাজীবনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে তাঁর জন্যে ১৮৬১ সাল ছিলো বেশ সুখের সময়। প্রেম, অর্থস্বাচ্ছন্দ্য এবং যশ লাভ, এই তিনটি ক্ষেত্রেই তিনি তখন কমবেশি সাফল্য অর্জন করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সেই আপাত সুখের সময়ে তিনি আত্মবিলাপ লিখেছিলেন। এবং এতে তিনি তিনটি বিষয়ের জন্যে হাহাকার করেছেন, প্রেম, অর্থ আর যশোলাভ। বলেছেন, এই তিন মুক্তার লোভে তিনি শতমুক্তাধিক আয়ু ক্ষয় করেছেন। এ কবিতার মধ্যে এমন একটা আন্তরিকতার সুর আছে যে, একে অকারণ দুঃখবিলাস বলে মনে করা শক্ত। তা হলে প্রশ্ন হচ্ছে, ঐ সময়ে এই অকাল হাহাকারের কারণ কী? এক কথায় এর উত্তর হলো, ব্যক্তিজীবনে, আরও পরিষ্কার করে বললে, পারিবারিক জীবনে তাঁর অন্তহীন অনুতাপ আর হতাশা থেকেই তিনি এ কবিতা রচনা করেছিলেন।
মাদ্রাস পর্বের আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য না-থাকলেও, তাঁর পারিবারিক জীবন বেশ সুখের এবং পবিতৃপ্তির ছিলো। রেবেকার প্রতি তাঁর ভালোবাসার গভীরতা কতোটা ছিলো, তার আভাস পেয়েছি The Captive Ladie-র আলোচনা প্রসঙ্গে। সন্তানের জন্মে তাঁর উচ্ছাস এবং চিঠিপত্র ও কবিতায় পরিবার সম্পর্কে তাঁর প্রশান্ত তৃপ্তির কথা থেকেও তাঁর সুখী জীবনের খবর মেলে। রেবেকাও কবিকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন বলে ধারণা করি। সবার বিরোধিতার মুখে তিনি মাইকেলের মতো একজন চালচুলোহীন, আত্মীয়সহায়হীন কৃষ্ণাঙ্গকে বিয়ে করেছিলেন। এবং বিয়ে করে রীতিমতো নজির স্থাপন করেছিলেন। বিয়ের পরে তিনি দারিদ্র্য, রুগ্নতা, পরপর সন্তানধারণ, স্বামীর বোহীমিয়ান জীবনযাত্রা, সবকিছুই সহ্য করেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রেবেকাও মানুষ হয়েছিলেন তুলনামূলকভাবে স্নেহহীন পরিবেশে। সুতরাং কবির ভালোবাসা পেয়ে তিনি আর সবকিছু তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলেন। স্ত্রীকে নিয়ে কবি মাদ্ৰাসে কপোত-কপোতীর মতো প্রেমঘন নীড় গড়ে তুলেছিলেন।
তারপর মাদ্রাস ত্যাগের পর থেকে সেই পরিবারের সঙ্গে চিরদিনের মতো তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়। স্বামীর বিশ্বাসঘাতকতায় একজন স্ত্রী যতোটা আহত হয়, রেবেকা তার চেয়ে স্বভাবতই বেশি আহত হয়েছিলেন। তা ছাড়া, হেনরিয়েটার সঙ্গে গোপন প্রণয়ের খবর প্রকাশিত হওযায়, কবি কেবল রেবেকার কাছে বিব্রত হননি, অতি-ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের চোখেও ছোটো হয়ে যান। মনে রাখা দরকার, এই বন্ধুরাই তাঁকে বিয়ে করতে সাহায্য করেছেন, চাকরি পেতে সাহায্য করেছেন, কৃষ্ণাঙ্গ হয়েও শ্বেতাঙ্গ সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভে সাহায্য করেছেন। নেইলরঢ় নর্টন, কেনেট (জুনিয়র), সেলফেন্ট, এমনি কয়েকজন বন্ধুর নাম। এখন নিজের স্ত্রীর প্রতি তাঁর প্রবঞ্চনার খবর প্রকাশিত হওযায়, তাঁর আর মুখ দেখানোর, অন্তত মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর উপায় ছিলো না। সে জন্যে তিনি কোনোদিন, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও, আর মাদ্রাসে ফিরে যেতে পারেননি — যদিও কলকাতায় আসার পরে রেবেকার সঙ্গে একটা আপোশ করার চেষ্টা হযেছিলো বলে মনে হয়। আমার ধারণা, রেবেকা এবং সন্তানদের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগ না-থাকলেও দুই পক্ষ একে অন্যের খবর রাখতো। পরের আলোচনায় দেখা যাবে, কবির মৃত্যুর পরেও মাদ্রাসের সন্তানরা কেমন করে তাঁর ব্যারিস্টার-পরিচয় নিয়ে গর্ব করেছে।১৯৬ রেবেকার সঙ্গে আপোশ হতে পারে — এ জন্যে কবি অন্তত দুবছর অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু ১৮৫৮ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যখন রেবেকার সঙ্গে তাঁর কোনো সমঝোতা হলো না, তখন তিনি কলকাতায় আসার আহ্বান জানান হেনরিয়েটাকে।
প্রথম দিকে হেনরিয়েটার সঙ্গে নতুন সংসার পেতে তিনি রঙিন নেশায় বুঁদ হয়ে সময় কাটিয়েছিলেন — এমনটা অনুমান করা অসঙ্গত হবে না। কিন্তু হেনরিযেটার সঙ্গে মিলনে প্রমত্ত হলেও, রেবেকার প্রতি তাঁর ভালোবাসা চলে গিয়েছিলো, এমনটা মনে করার কারণ নেই। তা ছাড়া, সন্তানবৎসল কবি, কী করে একটি-দুটি নয়, চারটি সন্তানের কথা ভুলে যাবেন? তার ওপর, ১৮৫৮ সাল থেকে আড়াই বছর নিরবচ্ছিন্ন নৈকট্যের পরে, তাঁর নেশা হয়তো ফিকে হয়েছিলো। সেই পর্যায়ে তিনি বিলাপকরতে আরম্ভ করেন। হেনরিয়েটার গর্ভে তাঁর প্রথম যে-সন্তান জন্মেছিলো, আত্মবিলাপ লেখার আগে সেই শর্মিষ্ঠার বয়স হয়েছিলো প্রায় পৌনে দু বছর। আর দ্বিতীয় সন্তান ততো দিনে হয় জন্মেছে, নয়তো কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার জন্ম নেবার কথা। কিন্তু তারই মধ্যে অতীতের স্মৃতি তাঁকে একেবারে মন্থন করেছে। বিশেষ করে অপরাধবোধে তিনি একেবারে কাতর এবং বিহ্বল হয়েছেন।
তিনি যখন মাদ্রাস ত্যাগ করেন, তখন তাঁর আর্থিক অবস্থা সচ্ছল ছিলো না। সহাযহীন স্ত্রী এবং চারটি শিশুকে বলতে গেলে অকূলে ভাসিয়ে তিনি কলকাতা যাত্রা করে যে-অপরাধ এবং চরম নিষ্ঠুরতা করেছিলেন, সে সম্পর্কে একজন স্পর্শকাতর মানুষ হিশেবে তিনি নিজেও ষোলো আনা সচেতন ছিলেন। তাঁর সারা জীবনের ঘটনাবলী, এমন কি, তাঁর রচনাবলী সাক্ষ্য দেয়, তিনি হৃদয়হীন ছিলেন নিশ্চয় অপরাধবোধ এবং অনুশোচনার তুষানলে তিনি দগ্ধ হচ্ছিলেন। তদুপরি, তিনি যেহেতু তাঁর এই কীর্তির কথা কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেননি, সে জন্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে তিনি আরো বেশি করে বিধ্বস্ত হয়েছেন। এ সময়ে যদি তিনি কারণবারি পানের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন, তা হলে আশ্চর্য হবার কারণ নেই।
বলা বাহুল্য, আত্মবিলাপ লেখার প্রেরণা কবি পেয়েছিলেন একেবারে অন্তরের অন্তস্তল থেকে। এ কবিতায় তাঁর ঐকান্তিক হতাশা এবং অপরাধবোধ, এমন কি, পাপবোধ নির্ভুলভাবে চোখে পড়ে। আত্মবিলাপ লেখার সময় পর্যন্ত অর্থলোভে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছিলেন — এমন কথা বলার কারণ ছিলো না। বরং ইংল্যান্ড যাত্রা করার পরে এ কথা বললে তা প্রাসঙ্গিক হতো। যশোলোভে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছিলেন, সে কথাও এ পর্যায়ে আদৌ প্রযোজ্য নয়। কিন্তু।
প্রেমের নিগড় গড়ি পরিলি চরণে সাদে
কি ফল লভিলি?
জ্বলন্ত-পাবক-শিখা- লোভে তুই কাল-ফাঁদে
উড়িয়া পড়িলি!
পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়, ধাইলি অবোধ, হায়!
না দেখিলি, না শুনিলি, এবে রে পরাণ কাঁদে!
এ কথা তিনি সে পর্যায়ে আন্তরিকভাবেই অনুভব করেছিলেন। খৃষ্টান হয়ে তিনি সে ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা পালন করতেন, তা নয়। ধর্মে তাঁর বিশ্বাসও অটল ছিলো না। কিন্তু খৃষ্টানদের সনাতন পাপবোধ তাঁকে বেশ গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলো বলে মনে হয়। আত্মবিলাপ লেখার সমকালে কেবল রাবণের মুখে নয়, মেঘনাদবধ এবং বীরাঙ্গনা কাব্যের বহু চরিত্রের মুখেই পাপের ফল ভোগ করার কথা শুনতে পাই। আত্মবিলাপেও ঘটেছে অংশত সেই পাপবোধের প্রতিফলন।
নিজের স্ত্রী এবং সন্তানদের প্রসঙ্গ ছাড়া, প্রথম যৌবনে তিনি যে অংশত কবি হবার আশায়, অংশত আয়োজিত বিয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে এবং অংশত বিলেত যাবার পথ প্রশস্ত হবে মনে করে [সাধিতে মনের সাদা] খৃস্টান হয়ে বাবা-মাসহ সমস্ত আপনজনকে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছিলেন তার জন্যেও তাঁর মনে কি কোনো অপরাধবোধ এবং অনুশোচনা ছিলো না? শুধু বাবা-মাসহ নিজের পরিবারকে হারানো নয়, সত্যি বলতে কি এই এক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি নিজের শেকড়ও ছিন্ন করেছিলেন আজন্মের একান্ত আপন প্রতিবেশ থেকে। তার জন্যেও কি তিনি অপরাধ বোধ করেননি? প্রকৃত পক্ষে, অসামান্য হতাশা এবং নিঃসঙ্গতা থেকেই তিনি আত্মবিলাপ লেখেননি, বরং তিনি যে পাবকশিখার মতো হেনরিয়েটার মোহে তাঁর সব আপনজনদের থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গিয়েছিলেন — এই নিদারুণ দুঃখ, পাপ- এবং অপরাধ-বোধ থেকেই এক অসাধারণ আবেগের মুহূর্তে অমন মর্মভেদী বিলাপ করেছিলেন। পাছে এই আর্তনাদে কোনো রকম কৃত্রিমতা দেখা দেয় সেজন্যেই কি তিনি সদ্য-উদ্ভাবিত বিদগ্ধ অমিত্রাক্ষর বর্জন করে সনাতন সরল ত্রিপদীর ছন্দে এ বিলাপ প্রকাশ করেছিলেন? অসম্ভব নয়। সত্যি সত্যি, আত্মবিলাপ তাঁর এক অতি অসাধারণ আন্তরিকতাপূর্ণ আত্মজৈবনিক রচনা। কয়েক বছর পরে ভার্সাইতেও নিজেরমনের কথা বলার একটা ঝোঁক এসেছিলো তাঁর জীবনে, কিন্তু তখনকার নস্টালজিয়াপূর্ণ সনেট আর কলকাতায় বসে লেখা এই বিলাপে আসমান- জমিন ফারাক। শুধু বক্তব্য এবং রসের পার্থক্য নয়, আত্মবিলাপ আর সনেটের ভঙ্গিও আলাদা।
মেঘনাদবধের পর আত্মবিলাপের মতো একটি উল্লেখযোগ্য খণ্ড কবিতা লিখলেও, কবি তখন মনঃস্থির করে উঠতে পারেননি, অতঃপর তিনি কী লিখবেন। রাজনারায়ণ সিংহলবিজয়ের যে-কাহিনী সরবরাহ করেছিলেন, তাকে বেশ ভালো মনে হলেও, শেষ পর্যন্ত এই কাহিনী তাঁর মনে কোনো আবেগের সৃষ্টি করেনি। যে-কাহিনী সাধারণ মানুষের কাছে অজানা, সে কাহিনী নিয়ে লেখা মহাকাব্য কতোটা জনপ্রিয় হবে, সে বিষয়ে তাঁর মনে সংশয় ছিলো। সে জন্যে সিংহলবিজয়ের পরিকল্পনা করলেও অথবা তার প্রথম ২৪ পঙক্তি লিখে ফেললেও, তা নিয়ে তিনি সিংহলের দূর পথে যাত্রা করতে পারেননি। লিরিক কবিতা লেখার কথাও ভেবেছিলেন একাধিক বার। কিন্তু মেঘনাদবধ লেখা শেষ করার কয়েক সপ্তাহ পরে রাজনারায়ণকে এক চিঠিতে নিজেই আবার বলেছেন, মাঝেমধ্যে তিনি কেবল একটা-আধটা লিরিক কবিতা আর সনেট লিখবেন – এটা তিনি ভাবতে পারছেন না।১৯৭ এ সময়ে গদ্যে লেখার কথাও তাঁর মাথায় এসেছিলো। মোট কথা, বিষয়বস্তু নির্বাচন নিয়ে তিনি অন্তত মাস তিনেক একটা সংকট এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন।
তদুপরি, দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দেবার পরে হেনরিয়েটার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। তিনি তা নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন এবং বিপদগ্রস্ত হন। বোঝা যায়, ওষুধপত্ৰ খাওয়ানো থেকে আরম্ভ করে চিকিৎসকদের কথামতো তিনি কোনো কিছু করতেই বাকি রাখেননি। পরের বছর ফেব্রুআরি মাসে রাজনারায়ণ বসুকে যে-চিঠি লেখেন, তা থেকে দেখা যাচ্ছে, হাওয়া বদলের জন্যে তিনি হেনরিয়েটাকে নিয়ে নৌকোয় ছিলেন কিছুদিন। সম্ভবত এই সময়ে তিনি যশোরে যান। তারপর যান বর্ধমানে। বর্ধমানে যান স্থলপথে। হেনরিয়েটার স্বাস্থ্য খানিকটা ভালো হবার পর, নিশ্চিন্ত কবি আবার সাহিত্যসেবার জন্যে মনে মনে তৈরি হলেন। ‘বন্ধু, এবারে আমি আবার তোমাদের সেবায় নিজেকে দেবার জন্যে প্রস্তুত।’১৯৮
বিষয়বস্তু নিয়ে কিছুকাল ঠিক মনঃস্থির করতে না-পারলেও, একটা বিষয় সম্পর্কে তাঁর মনে কোনো সংশয় ছিলো না — সে হলো: আর বীররসের কবিতা তিনি লিখবেন না। যদিও এ পথে সাফল্য এসেছিলো প্রত্যাশারও বেশি। ‘তিলোত্তমা আর মেঘনাদই যথেষ্ট।’ তা ছাড়া, করুণ রস সৃষ্টিতে তিনি যে স্বাভাবিক সাফল্য দেখাতে পারছিলেন, সেটাও তিনি বিবেচনা করেন। ‘নিজেই জানতাম আমি এতো করুণ রসের অধিকারী।’ ‘মেঘনাদ, কৃষ্ণকুমারী, লক্ষ্মণেরজন্যে রামের বিলাপ,স্বামীর জন্যে প্রমীলার বিলাপ ইত্যাদির জন্যে অনেককে চোখের জল ফেলতে হবে।’১৯৯ এমন কি, তাঁর নিজের বিলাপও কিছু কম আন্তরিক ছিলো না।
কি নিয়ে লেখা যায়, তা ভাবতে ভাবতে এক সময়ে কোনো রকমের ঢাক-ঢোল না-পিটিয়ে তিনি লিখতে আরম্ভ করেন একটি নতুন কাব্য। সিংহলবিজয়নয়, তার বদলে লিখে ফেলেন বীরাঙ্গনা। তিনি নীরবে এই কাব্য লেখার কারণ বিশ্লেষণ করার আগে এর বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিকের দিকে নজর দেওয়া যাক। আপাতদৃষ্টিতে তিনি বীরাঙ্গনার পত্রাবলী রচনা করেন রোমান কবি ওভিদের (পুরো নাম Publius Ovidius Naso) Epistulae Heroidum কাব্যের অনুকরণে। খৃষ্টের জন্মের অব্যবহিত পরে রচিত এই কাব্যে ওভিদ পত্রাকারে কয়েকজন নাযিকার প্রেমের কথা প্রকাশ করেছিলেন। আঙ্গিকের দিক দিয়ে চিঠি হলেও, আসলে এগুলো অনেকটা নাটকীয় স্বগতোক্তির মতো। মাইকেল ওভিদ থেকে নিয়েছিলেন দুটি জিনিশ — কাব্যের মূল বিষয়বস্তু প্রেম আর পত্রের আঙ্গিক। কিন্তু তিনি এর মালমশলা জোগাড় করেছিলেন ভারতীয় পুরাণ থেকে। তিনি বেছে নেন পুরাণ থেকে কয়েকটি বিখ্যাত নারী চরিত্র। এই পত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এসব চিঠিতে আছে এই নারীদের অভিমান আর অনুযোগের কথা। কাব্যের নাম বীরাঙ্গনা হলেও এই নারীরা কেউই বীররসে উদ্দীপ্ত হয়ে এইসব পত্র লেখেননি। আর কবিও বীররসে ভেসে মহাগীত পরিবেশন করার জন্যে এ কাব্য রচনা করেননি। আসলে এ কাব্যে তাঁর নিজের পুরোনো প্রেম এবং গভীর অপরাধ-বোধের নির্ভুল প্রমাণ মেলে। তিনি কয়েক মাস আগে যে-আত্মবিলাপ লিখেছিলেন রেবেকা এবং সন্তানদের প্রতি তাঁর অপরাধবোধ থেকে, এ কাব্যের উৎস নিহিত আসলে সেখানেই। আত্মবিলাপে তিনি নিজের দিকটা লিখেছিলেন, কিন্তু বীরাঙ্গনায় তিনি লেখেন রেবেকা যা বলতে পারতেন, সে কথা। এই থীম একান্তভাবে তাঁর নিজের। সে জন্যেই তিনি এ কাব্য লেখার আগে এ নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলেননি। এ আত্মবিলাপেরই সম্প্রসারণ।
বীরাঙ্গনার নামপত্র
যেহেতু নিজের অন্তর থেকে এ কাব্য লেখার ধারণা এবং উৎসাহ পেয়েছিলেন, সে জন্যে একবার লিখতে আরম্ভ করার পরেই পাল-তোলা নৌকোর মতো সে লেখা এগিয়ে চললো তরতর কবে। সংসারের ঝামেলা শেষে সাহিত্যচর্চার জন্যে তিনি এখন তৈরি — রাজনারায়ণকে এ কথা লেখার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে তিনি এ কাব্য লিখতে আরম্ভ করেছিলেন। আলোচ্য চিঠি থেকে দেখা যাচ্ছে, ততোদিনে তাঁর পরিকল্পিত মোট একুশটি পত্রের মধ্যে এগারোটি লেখার কাজ শেষ করে তিনি তা ছাপাখানায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঠিক এই সময়ে সংশোধিত তিলোত্তমাও পুনর্মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়।
বীরাঙ্গনার প্রথম এগারোটিতে তিনি যেসব পত্র রচনা করেছেন সেগুলো হলো দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা, সোমের প্রতি তারা, দ্বারকানাথের প্রতি রুরিুণী, দশরথের প্রতি কেকয়ী, লক্ষ্মণের প্রতি সূর্পণখা, অর্জ্জুনের প্রতি দ্রৌপদী, দুর্যোধনের প্রতি ভানুমতী, জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা, শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী, পুরুরবার প্রতি উৰ্বশী আর নীধ্বজের প্রতি জনা। সবগুলো চিঠিই মহিলাদের, তাঁদের স্বামী অথবা প্রেমিকের কাছে লেখা — এ ছাড়া, আপাতদৃষ্টিতে এসব পত্রের মধ্যে কোনো মিল নেই। এক-একজন মহিলা এক-একটি সমস্যাকে কেন্দ্র করে এসব পত্র লিখেছেন। সমস্যা আলাদা, পাত্র-পাত্রী আলাদা। কিন্তু চিঠিগুলো পড়লে সহজেই মহিলাদের বক্তব্যে পুরোপুরি না-হলেও তাঁদের ভাবাবেগে একটা অখণ্ড সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
এই মহিলারা তাঁদের পুরোনো প্রেমের এবং ক্ষেত্রবিশেষে সৌন্দর্যের কথা মনে করিয়ে দিয়ে নিজেদের অভিমান এবং অনুযোগর কথা বলেছেন। তাঁদের প্রধান অনুযোগ স্বামী/ প্রেমিক তাঁদের কথা ভুলে গেছেন এবং/অথবা তাঁদের প্রতি অঙ্গীকার পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। শকুন্তলা যেমন বলেছেন:
এ নব যৌবনে এবে ত্যজিলা কি তুমি,
প্রাণপতি? কোন্ দোষে, কহ, কান্ত, শুনি,
দাসী শকুন্তলা দোষী ও চরণ-যুগে?
এ মনে যে সুখ-পাখী ছিল বাসা বাঁধি,
কোন্ ব্যাধকেশে আসি বধিলে তাহারে,
দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলার এ উক্তি অবশ্যই যথার্থ। কিন্তু রেবেকা যদি কবিকে এ কথা বলতেন, তা হলে তা কি সমান প্রযোজ্য হতো না?
নিলে অনুসূয়া যবে মন্দ কথা কযে,
অপবাদে প্রিয়ম্বদা তোমায়, – কি বল্যে
বুঝাবে এ দৌঁহে দাসী, কহ তা দাসীরে?
অনুসূয়া এবং প্রিয়ম্বদা নাম দুটি পাল্টে দিয়ে নেইলর, সেলফেন্ট অথবা কেনেটের নাম ব্যবহার করলে এই পত্র রেবেকাও কি মাইকেলকে লিখতে পারতেন না? জীবনীর সঙ্গে রচনার যোগাযোগ বোঝাতে গিয়ে লিয়ন ইডেল বলেছেন যে, একজন ঔপন্যাসিক অথবা একজন নাট্যকার নানা ধরনের বহু চরিত্র অঙ্কন করেন। আপাতদৃষ্টিতে তাদের মধ্যে কোনো মিল থাকে না। কিন্তু ঐসব উপন্যাস এবং নাটকে বারবার যে-বক্তব্য এবং মূল বিষয়টি ফিরে ফিরে আসে, তার মধ্য দিয়ে লেখককে অভ্রান্তভাবে চোখে পড়ে।২০০ বীরাঙ্গনার পত্রগুলো বিশ্লেষণ করলেও তেমনি নির্ভুলভাবে ধরা পড়ে মাইকেলের হৃদয়। এবং সেটা কেবল শকুন্তলার বক্তব্য থেকে নয়, কমবেশি এগারোটি চিঠি থেকেই। এমনকি, অসমাপ্ত চিঠিগুলোও কোনো ব্যতিক্রম নয়।
তারা সোমকে লিখেছিলেন:
যেদিন, — কুদিন তাবা বলিবে কেমনে
সে দিনে, হে গুণমণি, যেদিন হেরিল
আঁখি তার চন্দ্রমুখ, – অতুল জগতে! –
যেদিন প্রথমে তুমি এ শান্ত আশ্রমে
প্রবেশিলা, নিশাকান্ত, সহসা ফুটিল
নবকুমুদিনীসম এ পরাণ মম
উল্লাসে, — ভাসিল যেন আনন্দ সলিলে!
রেবেকাও প্রথম পরিচয়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে মাইকেলকে একথা লিখতে পারতেন। অথবা ‘হা ধিক, কি পাপে,/ হায়রে কি পাপে, বিধি, এ তাপ লিখিলি/ এভালে?’ বলে আক্ষেপ করতে পারতেন। রুরিুণী অনুতাপ
স্বেচ্ছায় দিয়াছে দাসী, হায়, একজনে
কায় মনঃ ;… — রুম গুণনিধি! –
উড়ে প্রাণ, পোড়া কথা পড়ে যবে মনে!
কি পাপে লিখিলা বিধি এ যাতনা ভালে?
ভাগ্যদোষের কথা জনাও বলেছেন:
তুমি পতি, ভাগ্যদোষে বাম মম প্রতি
তুমি! কোন সাধে প্রাণ ধরি ধরাধামে?
এ পোড়া ললাটে
লিখিলা বিধাতা যাহা, ফলিল তা কালে!
রেবেকাও একই ভাষায় তাঁর ভাগ্যদোষের কথা বলতে পারতেন। হয়তো বলেছেন। তিনিও মাইকেলের সঙ্গে পরিচয়ের পর গভীরভাবে তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন এবং সব রকমের বাধাকে অগ্রাহ্য করে তাঁকে বিয়ে করেছিলেন। এমন কি, স্বামী মাদ্রাস ত্যাগ করার এক মাস আগেও তাঁর সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। সে কারণে এখন তাঁকে ত্যাগ করার জন্যে তিনি নিজেকে অন্তত দোষারোপ করতে পারছিলেন না। বরং বারবার নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করেছেন। রেবেকা কি কলকাতায় স্বামীর কাছে কোনো চিঠিপত্র লিখেছিলেন? তা জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু লিখলে শকুন্তলা, তারা, রুক্ষিণী অথবা জনার মতো একই ভাষায় একই ভঙ্গিতে তিনি লিখতে পারতেন। রেবেকার চিঠি পেয়ে তা থেকে কবি কি সত্যি সত্যি অভিমানিনী এবং প্রবঞ্চিতা নারীর মনোভাব অনুভব করেছিলেন, নাকি তিনি কেবল কল্পনাই করতেন রেবেকা কী লিখতে পারতেন? — এ তথ্য আমাদের জানা নেই। কিন্তু একটা কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়: রেবেকা ‘বীরাঙ্গনা’দের ভাষায় লিখলে তা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক হতো না।
রেবেকা এবং কবির বিচ্ছেদের পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক মনে হয় দশরথের প্রতি কেকয়ী এবং অর্জ্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর চিঠি দুটি। বিয়ের সময় রেবেকার বয়স ছিলো — আগেই লক্ষ্য করেছি — মাত্র ১৭। তারপর কবি মাদ্রাস ত্যাগ করার আগেই অল্প বিরতিতে তাঁর চার-চারটি সন্তান হয় এবং ততোদিনে তাঁর সৌন্দর্য অনেকাংশে হ্রাস পাওয়ারই কথা। কবি মাদ্রাস ত্যাগের সময় রেবেকার বয়স হয়েছিলো প্রায় ২৫। তারপর ১৮৬২ সালের শুরুতে তাঁর বয়স আরও ছ বছর বৃদ্ধি পেয়েছিলো। কবি তখন পুরোনো প্রেমিকার চেহারাটা কেবল কল্পনা করে নিতে পারতেন। সেই কল্পনার রেবেকা লিখতে পারতেন:
না পড়ি ঢলিয়া আর নিতম্বের ভরে!
নহে গুরু উরুদ্বয়, বণ্ডুল কদলী-
সদৃশ! সে কটি, হায়, কর-পদ্মে ধরি
যাহায়, নিন্দিতে তুমি সিংহে প্রেমাদরে,
আর নহে সরু, দেব! নম্রশিরঃ এবে
উচ্চ কুচ! সুধাহীন অধর! লইল
লুটিয়া কুটিল কাল, যৌবন-ভাণ্ডারে
আছিল রতন যত; ***
কিন্তু পূৰ্ব্বকথা এবে স্মব, নরমণি! –
সেবিনু চরণ যবে তরুশ যৌবনে,
কি সত্য করিলা, প্রভু, ধর্মে সাক্ষী করি,
মোর কাছে! ***
কামীর কুরীতি এই শুনেছি জগতে,
অবলার মনঃ চুরি করে সে সতত
কৌশলে; নির্ভয়ে ধর্ম্মে দিয়া জলাঞ্জলি; –
প্রবঞ্চনা-রূপ ভগ মাখে মধুরসে!
*
কি দোষে কেকয়ী দাসী দোষী তব পদে?
এ পর্যন্ত নিজের কথা। তারপরের কথাটা আরও প্রাসঙ্গিক, আরও গুরুত্বপূর্ণ:
কোন অপরাধে পুত্র, কহ, অপরাধী?
*
কি কুহকে, কহ শুনি, কৌশল্যা মহিষী
ভুলাইলা মনঃ তব?
একমাত্র কৌশল্যা নামটা বদলে হেনরিয়েটা করে দিলে এ চিঠির নিচে রেবেকার স্বাক্ষর থাকা মোটেই অসঙ্গত হতো না। রেবেকা অবশ্য দ্রৌপদীর জবানিতেও লিখতে পারতেন।
যদি তুলে থাক তুমি, ভুলিতে কি পারে
দ্রৌপদী?
*
কবীশ্বর তুমি
গাঁথি মধুমাখা গাথা পাঠাও দাসীরে।
*
স্মরিয়া তোমারে,
আকুল এ পোড়া প্রাণ, হায়, দিবানিশি!
পাই যদি অবসর, কুটীর তেয়াগি
স্মৃতিদূতী সহ, নাথ, ভ্রমি একাকিনী
পূর্বেবর কাহিনী যত শুনি তাঁর মুখে!
*
এ ছলনা, কহ, কি কারণে?
এস ফিরি, নররত্ন! কে ফেরে বিদেশে
যুবতী পত্নীরে ঘরে রাখি একাকিনী?
*
কি কাজ উত্তরে?
পত্রবহ সহ ফিরি আইস এ বনে!
যযাতির প্রতি শর্মিষ্ঠা অথবা নলের প্রতি দময়ন্তীর পত্রেও প্রাসঙ্গিকতার অভাব নেই। কবি মাদ্রাস ত্যাগের তিন মাসের মধ্যে রেবেকা শিশুপুত্র এবং দু কন্যাকে নিয়ে (অন্য পূত্রটি ততো দিনে মারা গিয়েছিলো) যে অসহায় আশ্রয়হীন অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন, শর্মিষ্ঠার জবানির সঙ্গে তার বোধ হয় তেমন কোনো পার্থক্য ছিলো না।
দাবানলে দগ্ধ হেরি বন-গৃহ, যথা
কুবলী শাবক সব সঙ্গে লয়ে চলে,
না জানে আবার কোথা আশ্রয় পাইবে!
হে রাজন্, শিশুএয় লয়ে নিজে সাথে
চলিল শর্মিষ্ঠা-দাসী কোথায় কে জানে
আশ্রয় পাইবে তারা? মনে রেখ তুমি।
নয়নের বারি পড়ি ভিজিতে লাগিল
আঁচল, বুঝিয়া তবু দেখ প্রাণপতি
কে তুমি, কে আমি নাথ, কি হেতু আইনু
দাসীরূপে তব গৃহে রাজবালা আমি?
রেবেকা রাজবালা ছিলেন না সত্য, কিন্তু শ্বেতাঙ্গিনী এবং সে কালের পরিপ্রেক্ষিতে মাইকেলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব কম ছিলো না। তিনি যে কবিকে বিয়ে করেছিলেন, তার মধ্যে সাহসিকতা যেমন ছিলো, তেমনি ত্যাগও একেবারে কম ছিলো না। তিনি সঙ্গতভাবেই তাঁকে নিশ্চয় বলতে পারতেন –
ত্যজিলে তুমি হে যারে, না জানি কি দোষে,
নমে সে বৈদভী আজি তোমার চরণে।
এই পত্ৰকাব্যের ধারণা ওভিদের কাছ থেকে পেলেও, ওভিদ আর মাইকেলের নায়িকাদের বক্তব্য এবং মনোবেদনা অভিন্ন নয়। তা ছাড়া, মাইকেল যাঁদের বেছে নিয়েছিলেন, আপাতদৃষ্টিতে সেই নায়িকাদের মধ্যেও কোনো ঐক্য নেই। কিন্তু কবি অভিমান এবং অনুযোগের যোগসূত্র দিয়ে বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন অবস্থানের কয়েকজন ক্ষুব্ধ এবং বিরহিণী নারীকে সফলভাবে একটি কাব্যের অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এবং আগের আলোচনা থেকে দেখা গেছে যে, এ কাব্য রচনার একটা প্রধান প্রেরণাই ছিলো আত্মজৈবনিক। মাদ্রাসে ফেলে-আসা তাঁর প্রথম প্রেমিকার সম্ভাব্য বিরহ, প্রবঞ্চনাজনিত ক্ষোভ এবং মর্মস্পর্শী বেদনা এ কাব্যের প্রায় প্রতিটি পত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। রেবেকার সীমাহীন ক্ষোভ এবং সন্তানদের প্রতি নিজের অবিচারের কথা কল্পনা করে কবি অপরাধ-বোধে জর্জরিত হতেন এবং নিজেকে নিজে আঘাত করতেন। রেবেকা এবং হেনরিয়েটা — এই দুই নারীর মাঝখানে পড়ে তিনি ছিন্নভিন্ন এবং বিপন্ন হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তিনি এই সমস্যার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।
অমিত্রাক্ষরের যাত্রা শুরু হয়েছিলো তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য দিয়ে। সমকালীন সমালোচকরা এ কাব্যের ছন্দকে সফল বলে মেনে নিয়েছিলেন। এক শতাব্দীর দূরত্ব থেকে এখন এই ছন্দের, বিশেষ করে কবির কিছু কিছু শব্দ প্রয়োগের মুদ্রাদোষ অথবা অন্য ধরনের খুঁত চোখে পড়ে। কিন্তু এই ছন্দকে অসাধারণ এবং প্রশংসনীয় বলে স্বীকার না-করে উপায় নেই। বস্তুত, যে-ভাষায় সেকালে চালু ছিলো দুটি মাত্র প্রামাণ্য ছন্দ — পয়ার আর ত্রিপদী, সে ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দকে একেবারে বিপ্লবাত্মক বিবেচনা না-করে পারা যায় না। মেঘনাদবধে এসে কবি এই ছন্দ এবং তাঁর শব্দ প্রয়োগকে আরও উন্নত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কবির ছন্দবোধ এবং শব্দ-নির্বাচন এতো দ্রুত উন্নত হচ্ছিলো যে, মেঘনাদবধের দ্বিতীয় খণ্ড লেখার সময়ে তিনি প্রথম খণ্ডের ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখতে পাচ্ছিলেন। আগেই বলেছি, এ সময়ে তিনি প্রথম খণ্ড পুরোপুরি সংশোধন করতে চেয়েছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি তা করার সুযোগ পাননি। এই ছন্দকে তিনি পরিমার্জনার মাধ্যমে নিখুঁত এবং পরিপূর্ণ করে তুলতে পেরেছিলেন বীরাঙ্গনায়। শব্দ ব্যবহারেও তাঁর একান্ত নৈপুণ্য লক্ষ্য করি এই কাব্যে। বিশেষ করে আভিধানিক শব্দের বদলে প্রতিদিনের জীবন থেকে তিনি বহু শব্দ সফলভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। বস্তুত, ভাষা এবং ছন্দ সম্পর্কে তিনি এতো সচেতন শিল্পী ছিলেন যে, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে শর্মিষ্ঠা থেকে বীরাঙ্গনার উৎকর্ষে পৌঁছেছিলেন। এক সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে এমন সমালোচনাও হয়েছিলো যে, তিনি অন্ত্যমিল দিয়ে কবিতা লিখতে পারেন না বলে অমিত্রাক্ষরে কবিতা লেখেন।২০১ এই নিন্দুকদের জবাব দেবার জন্যেই যেন তিনি ব্রজাঙ্গনা লিখেছিলেন অন্ত্যমিল রেখে। এবং তাতে আধুনিক বাংলা কাব্যের সেই শৈশব অবস্থায় তিনি দেখিয়েছিলেন পঙক্তি এবং স্তবক বিন্যাসে কতো বৈচিত্র্য আনা সম্ভব। বীরাঙ্গনায় আমরা সকল পরীক্ষানিরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক সফল কবিকে দেখতে পাই। অতঃপর পাক্কা ফিস্ট নিয়ে তিনি যখন আঙ্গিক, ভঙ্গি এবং উপস্থাপনার দিক দিয়ে নবতর কাব্য উপহার দেবার জন্যে একেবারে প্রস্তুত, সেই মুহূর্তে হঠাৎ বিদায়ের বাঁশি বেজে উঠলো। তিনি যেমন হঠাৎ উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো বাংলা সাহিত্যের আসরে দেখা দিয়েছিলেন, তেমনি আকস্মিকভাবে সেই আসর ত্যাগ করার সংকল্প ঘোষণা করলেন। বীরাঙ্গনা প্রকাশিত হবার মাত্র চার মাসের মধ্যে তিনি বাংলা সাহিত্যর কক্ষ থেকে ছিটকে পড়লেন অনেক দূরে। এর মাস আটেক আগেই তিনি রাজনারায়ণকে লেখা তাঁর সেই বিখ্যাত চিঠিতে বলেছিলেন, তিনি বাংলা সাহিত্যের আসরে এক বিশাল ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হবেন। ২০২ ধূমকেতু বলার কারণ, সে বাঁধা পথে চলে না, উৎকেন্দ্রিকতা এবং আকস্মিকতা তার বৈশিষ্ট্য। এবং সেই আকস্মিকতায় সবাইকে চমকে দেওয়া এবং বিস্মিত করা তাঁর লক্ষ্য। তারপর আবার আকস্মিকভাবে তাঁর অন্তর্ধান হবে ঠিকই, কিন্তু ইতিহাসে তাঁর ব্যতিক্রমী আবির্ভাবের কথা লেখা থাকবে চিরদিন।
প্রাক্তনের গতি কার সাধ্য রোধে? — এ কেবল রাবণের কথা নয়; রাবণের সষ্টা মাইকেল সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। যখন শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রচনার জন্যে সব আয়োজন একেবারে সম্পন্ন, সে সময়ে ভাগ্য তাঁকে ঠেলে দিলো সর্বনাশের দিকে। আশার ছলনে তিনি পা বাড়ালেন চোরাবালির পথে। তবে এ জন্যে তিনি নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে দায়ী করতে পারেন না। তিনি সত্যি সত্যিই স্বকৃতভঙ্গ। তাঁর জীবনের মস্তো বড়ো একটা ট্র্যাজেডি এই যে, তিনি আত্মবিলাপ লেখার পর, তার মানে একবার নিজের ভুল বুঝতে পারার পর সংশোধনের পথে না-গিয়ে সত্যিকার আত্মহননের পথে পা বাড়ালেন। আগের আলোচনা থেকে দেখেছি, তখনো পর্যন্ত অন্তত অর্থলোভে তিনি নিজের সর্বনাশ ডেকে আনেননি। কিন্তু যখন সাফল্য দেখা দিতে শুরু করেছে, সাহিত্যক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত যশের ভাগীদার হতে আরম্ভ করেছেন, এমন কি, মামলা-মকদ্দমা শেষে আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, ঠিক সেই সময়ে তিনি মায়াময় স্বর্ণমৃগ দেখতে পেলেন। যোগ-বিয়োগ করে দেখলেন হিশেব মিলে যাচ্ছে। কাঙিক্ষত কবিযশ পেয়ে গেছেন, সচ্ছলতাও এক পা দূরে মাত্র। সত্যিকার ধনী হবার এতো বড়ো সহজ সুযোগ তিনি ছেড়ে দেবার কথা ভাবতে পারলেন না।
কম বেতনের চাকরি করতে গিয়ে কবি বারবার তাঁর ভাগ্যকে দোষারোপ করেছেন। একাধিক চিঠিতে তিনি এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। রাজনারায়ণ বসু একটি চিঠিতে লিখেছিলেন: আইন আর কবিত্ব — এ দুটি একত্রে একেবারে অসাধারণ! এর উত্তরে তিনি লিখেছেন: ‘অন্যরা আয় করবে আর আমি কেন বসে বসে অলস কবিতা লিখবো?’২০৩ আর যে-কথাটা সরাসরি লেখেননি, কিন্তু খুব ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করেছিলেন, তা হলো: বহু অযোগ্য এবং অর্ধশিক্ষিত লোক তাঁর তুলনায় অনেক বেশি টাকাপয়সা আয় করছিলেন এবং সাধারণ লোকেরা তাঁকে নয় বরং তাঁদেরই বেশি খাতির করে। আগেই দেখেছি, এই ক্ষোভ থেকে তিনি ১৮৫৯ সালের জানুআরি মাসে আইন পরীক্ষা দেওয়ার সংকল্প নিয়েছিলেন। কিন্তু সে বছর এবং তার পরবর্তী দু বছর আইন পরীক্ষা বাতিল হয়ে যায়। ফলে তাঁর উকিল হয়ে গাদা গাদা টাকা কামাই করার স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়নি। এখন পেছনের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, ওকালতি পরীক্ষায় পাশ করলে তাঁর জন্যে সেটা মন্দের ভালো হতো। কারণ, তা হলে ব্যারিস্টার হতে গিয়ে এবং ব্যারিস্টার হয়ে তাঁর যে-চরম সর্বনাশ হয়েছিলো, তা বোধহয় হতো না। সাহিত্য সৃষ্টিতে বিঘ্ন হতে পারতো, কিন্তু শেষ জীবনে দারিদ্র্য এবং রোগ ভোগের যে-অসাধারণ অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিলো, তা হতো বলে মনে হয় না।
এক সময়ে তিনি রোজ পাঁচ-ছ ঘণ্টা করে আইন অধ্যয়ন করছিলেন পরীক্ষা দেবেন বলে। এ থেকে বোঝা যায়, আইন পরীক্ষাকে তিনি কতোটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। সেই পরীক্ষা দেবার সুযোগ যখন এলো, ততোদিনে চার-চারটি মামলায় জয়ী হয়ে তিনি বেশ কিছু সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। হিশেব করে দেখলেন, এই সম্পত্তি বন্ধক রেখে তিনি বিলেত গিয়ে উকিল নয়, একেবারে ব্যারিস্টার হয়ে আসতে পারবেন। তখন কলকাতায় প্রায় ৩০ জন ব্যারিস্টার এবং ৮৪ জন অ্যাটর্নি ছিলেন। কিন্তু তাঁরা ছিলেন সবাই ইংরেজ অথবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান।২০৪ কবি দেখলেন, তিনি যদি ব্যারিস্টার হয়ে আসতে পারেন, তা হলে উকিলের চেয়ে অনেক বেশি আয় করতে পারবেন। তা ছাড়া, প্রথম বাঙালি ব্যারিস্টার হিশেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন এবং খ্যাতি লাভ করাও তাঁর পক্ষে অনেক সহজ হবে। তিনি পরিকল্পনা করলেন, একা যাবেন ইংল্যান্ডে। এতে হেনরিয়েটার তরফ থেকে আপত্তি আসতে পারতো। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, হেনরিয়েটা এতে প্রবল আপত্তি করেননি।
ব্যারিস্টার হবার ব্যাপারে কবি বাড়তি উৎসাহ পেয়েছিলেন বন্ধুদের কাছ থেকে। তাঁদের একজন — গৌরদাস বসাক – নিজেই এক সময়ে ব্যারিস্টার হবার কথা ভেবেছিলেন। তবে সবচেয়ে বেশি বাস্তব সাহায্য এবং উৎসাহ যিনি দিয়েছিলেন, তিনি হলো, যাঁকে তিনি তাঁর শেষ কাব্য বীরাঙ্গনা উৎসর্গ করেছিলেন — ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নিজে সৃজনশীল সাহিত্যিক হলেও, বিদ্যাসাগর কেবল আকাশ- কুসুম রচনা করেননি; সাফল্য তাঁর কাছে ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈষযিক দিক দিয়ে সেকালের শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে সফল হযেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। বৈষয়িকতার সেই মানদণ্ড এবং মানসিকতা দিয়ে তিনি বন্ধুদের দেখতে অংশত অভ্যস্ত ছিলেন। তা ছাড়া, ইংরেজদের সঙ্গে পাল্লা দেবার এক ধরনের জেদও তাঁর মধ্যে ছিলো। বাঙালিদের মধ্যে কোনো ব্যারিস্টার নেই এবং ব্যারিস্টারি পড়ার মতো বিদ্যা ও অর্থ শিক্ষিতদের মধ্যে বলতে গেলে কারো নেই — এটাও নিশ্চয় তাঁকে পীড়া দিতে। সে জন্যে, তাঁরা নিজেরা যা হতে পারেননি — প্রধানত বিত্তের অভাবে – মধুকে দিয়ে সেটাই এখন বাস্তবায়িত করতে চেষ্টা করেছিলেন। সমাজের শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন যে, নতুন যুগের পরিপ্রেক্ষিতে অফিস-আদালত, ব্যবসা বাণিজ্য, রাষ্ট্রীয় কাঠামো সর্বত্র দেশীয়দের উন্নতির পথ অত্যন্ত সীমিত। অথচ স্বজাতিকে নিয়ে গর্ব করার নতুন চেতনাও শিক্ষিত সমাজেদানা বাঁধছিলো দ্রুত গতিতে, বিশেষ করে সিপাহী বিপ্লবের পর। আইসিএস হবার জন্যে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মনোমোহন ঘোষের বিলেত গমন২০৫ অথবা দেশীয়দের ব্যারিস্টারি পড়ার হুজুগ – এই নবলব্ধ স্বাজাত্যবোধের অংশবিশেষ। বিদ্যাসাগর যে কবিকে সম্পত্তি বন্ধক রাখার ব্যবস্থাসহ যাবার ব্যাপারে নানা রকমের সহযোগিতা দিয়েছিলেন –এটা তার প্রধান কারণ।
ভাগ্য অবশ্য কবির প্রতি প্রসন্ন ছিলো না। সেজন্যে তাঁর বেলায় হিতে বিপরীত ঘটলো। বিদ্যাসাগর এবং তাঁর অন্য বন্ধুদের এই সহযোগিতা এবং সাহায্য তাঁকে আপাতদৃষ্টিতে উন্নতির পথে এগিয়ে দিলেও, আসলে ঠেলে দিলো সর্বনাশী এক অন্ধকার গহ্বরের দিকে — যেখান থেকে তিনি আর কোনো কালে বেরিয়ে আসতে পারেননি। গ্রীক নাটকের নিয়তিবাদে তিনি ব্যক্তিগত জীবনে কতোটা বিশ্বাস করতেন জানিনে, কিন্তু তাঁর সাহিত্যে নিয়তি বারবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আত্মবিলাপেও তিনি ভাগ্যের প্রতি দোষারোপ করেছেন। সেই অন্ধ নিয়তি এবার বিলেতের নাম করে তাঁকে অনিবার্য পতনের পথে ডেকে নিলো।
তিনি বিলেত চলে যেতে পারেন এবং তাঁর সাহিত্যজীবন হয়তো ফুরিয়ে এসেছে – এ সম্ভাবনার কথা জানিয়ে তিনি রাজনারায়ণকে চিঠি লিখেছিলেন ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে (মার্চের গোড়ার দিকেও হতে পারে, কারণ চিঠিতে তিনি লিখেছেন — বীরাঙ্গনা সবেমাত্র প্রকাশিত হয়েছে — এ কাব্য প্রকাশের তারিখ ২৬ ফেব্রুআরি, ১৮৬২)। তাতে তিনি লিখেছেন: ‘আমি বিলেত যাবার জন্যে জোগাড়যন্তর করছি। সেখানে আইন অধ্যয়ন করবো। কাব্যদেবীকে তাই বাধ্য হয়ে বিদায় জানাতে হবে।’২০৬ এ চিঠিরভাষা থেকে বোঝা যায় যে, তাঁর বিলেত যাবার কথা বেশকিছুদিন থেকে আলোচিত হচ্ছিলো। এ ব্যাপারে পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়াও হয়েছিলো। বিলেত যাবার এবং সেখানে লেখাপড়া করার খরচ জোগানোর ব্যবস্থা করতে বিদ্যাসাগর সাহায্য করেন — এ কথা কবি রাজনারায়ণকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেছেন।২০৭ তিনি হিশেব করে দেখেছিলেন যে, গোটা ব্যাপারটার জন্যে তাঁর ব্যয় হবে প্রায় হাজার বিশেক টাকা। এবংআগের বছর মামলায় জিতে পৈতৃক সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের পর ধার করে এই টাকা ব্যয় করার মতো সামর্থ্যও তাঁর হয়েছিলো।
কল্পনার বিলেত যাবার জন্যে তিনি নানা ধরনের ব্যবস্থা পাকাপাকি করেছিলেন নানা জনের সঙ্গে। পরিবার আর নিজের টাকাপয়সার ব্যবস্থাটাই ছিলো তার মধ্যে সবচেয়ে জরুরী। পৈতৃক আমলের কর্মচারী মহাদেব চট্টোপাধ্যায় এক সময়ে তাঁর সম্পত্তি থেকে তাঁকে বেদখল করার চেষ্টায় তাঁর জ্ঞাতিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করা সত্ত্বেও, তাঁকে নিজের তালুক চক মুনকিয়া এবং গদারডাঙ্গা পত্তনি দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এক সময়ে মতিভ্রম হয়ে তাঁর স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করলেও, এখন তাঁর প্রতি মহাদেব অনুগত থাকবেন। তা ছাড়া, পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধারের জন্যে গৌরদাস বসাক এবং কিশোরীচাঁদ মিত্র সহায়তা করলেও শেষ দিকে মহাদেব চট্টোপাধ্যায় মামলা পরিচালনার খরচ বহন করেছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি নগদ প্রায় পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় করেছিলেন। অংশত সেই টাকা শোধ দেবার জন্যে এবং অংশত কিছু বাঁধা আয়ের অধিকারী হবার জন্যে তিনি মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রীকে পত্তনিদার নিযুক্ত করেন। চুক্তি অনুযায়ী ১২৬৮ সন থেকে ১২৭৪ সন পর্যন্ত সাত বছরের জন্যে তাঁর আয় প্রতি বছরের জন্যে ২৯৯৭ টাকা ৮ আনা নির্ধারিত হয়। ঠিক হয় যে, এই টাকা মহাদেব চট্টোপাধ্যায় প্রতি বছর মোট চার কিস্তিতে শোধ দেবেন। — পৌষ মাসে ৩৭৪ টাকা ৮ আনা, মাঘ মাসে ৭৪৯ টাকা ৮ আনা, ফারুনে ১১২৪ টাকা ৩ আনা আর চৈত্র মাসে ৭৪১ টাকা ৫ আনা।২০৮
মহাদেব যাতে নিয়মিতভাবে টাকা দেন, সে ব্যাপারে জামিন থাকতে রাজি হন রাজা দিগম্বর মিত্র — কবি যাঁকে কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে মেঘনাদবধ কাব্য উৎসর্গ করেছিলেন। তাতেও কবি নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। কারণ দিগম্বর মিত্র বিখ্যাত এবংব্যস্ত মানুষ, পত্তনিদারের সঙ্গে সবসময়ে যোগাযোগ করার মতো সুযোগ তার না-ও হতে পারে। সে কারণে, দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন আরও একজন — পিসতুতো ভাই বৈদ্যনাথ মিত্রের ওপর। খানিকটা এ কাজের বিনিময়ে, খানিকটা পিতার নির্দেশে তিনি বৈদ্যনাথ এবং তাঁর ভাই দ্বারকানাথকে বছরে তিন শো টাকা করে দেবার ব্যবস্থাও করে গিয়েছিলেন।২০৯ তদুপরি এঁদের সম্পত্তিও দান করেছিলেন অনেক টাকার। বিলেত যাবার আগে মাইকেল যেসব দলিল করেছিলেন, তার একটি থেকে দেখা যায় এঁরা দুজনই ছিলেন তাঁর পিতার ‘প্রতিপালিত’।২১০ চক মুনকিয়া এবং গদারডাঙ্গার বাৎসরিক খাজনা ছিলো ১৫০০ টাকা।২১১ মহাদেব চট্টোপাধ্যায়কে তিনি যে-পত্তনি দেন, তার তারিখ (১ অক্টোবর ১৮৬১) থেকে বোঝা যায় যে, ব্যারিস্টারি পড়তে যাবেন, এ নিয়ে রাজনারায়ণ বসুকে চিঠি লেখার অন্তত মাস ছয়েক আগে থেকে এ সম্পর্কে তিনি চিন্তা-ভাবনা করছিলেন এবং কথাবার্তা বলছিলেন। তবে বিষয়টা পাকাপাকিভাবে ঠিক হয় ফেব্রুআরি মাসের শুরুতে এবং তখন তিনি বন্ধুকে উচ্ছাস প্রকাশ করে চিঠি লেখেন।
বিলেত যাবার খরচ তিনি জোগাড় করেছিলেন নানা সূত্র থেকে। তার মধ্যে একটা হলো পৈতৃক বাড়ি বিক্রি। বাসগৃহ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণা ছিলো। মাথা গোঁজার একটা জায়গা হলেই তিনি সন্তুষ্ট হতেন না। মাদ্রাসে আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি একাধিক বার বাড়ি বদল করেছিলেন। পরবর্তী আলোচনায়ও দেখতে পাবো, আয় অনুযায়ী তিনি কতো বার বাড়ি বদল করেছেন। খিদিরপুরে তাঁদের যে-বাড়ি ছিলো, তাকে তিনি তাঁর অথবা তাঁর পরিবারের বাসোপযোগী বলে বিবেচনা করেননি। তার কারণ কি বাড়ির অবস্থা, নাকি বাড়ির অবস্থান, তা জানা যায় না। মামলায় এই বাড়ির অধিকার পাওয়ার পরে তিনি খিদিরপুরে বাস করলেও, এই বাড়িতে বাস করেননি। অথচ বাল্য এবং যৌবনের বাসগৃহ সম্পর্কে তাঁর মনে একটা নস্টালজিয়া থাকাই তো স্বাভাবিক। অন্তত এটা জানা যায় যে, একবার এ বাড়িতে গিয়ে এর নতুন মালিকের কাছে তিনি তাঁর মা এবংএ বাড়ির জন্যে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।২১২ কিন্তু মাঝে-মধ্যে এ রকমের হঠাৎ-জেগে-ওঠা দুঃখ দেখা দিলেও, বিলেত থেকে ফিরে এসে তিনি বাড়িতে থাকার কথা চিন্তা করেননি। করলে, অতো শস্তায় এ বাড়ি তিনি বিক্রি করতেন না। কিন্তু বিলেত যাবার উজ্জ্বল স্বপ্নে তিনি এ সময়ে এতোই মশগুল ছিলেন যে, পৈতৃক বাড়ি অকাতরে উড়িয়ে দিতে তাঁর তেমন আটকায়নি। আলিপুর আদালতের একটি দলিল থেকে দেখা যায়, সাত হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি এ বাড়ি বিক্রি করেছিলেন বাল্যবন্ধু রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটোভাই হরিমোহনের কাছে।২১৩ হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তখন সব টাকা তখন শোধও দেননি।
পৈতৃক সম্পত্তি সংলগ্ন জমিও তিনি বিক্রি করেন। তবে হরিমোহনের কাছে ন্য। এ জমি কেনেন জেমস ফ্রেডারিক নামে একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। ইনি ছিলেন অরিয়েন্টাল ব্যাংকের কর্মচারী। বস্তা তৈরির একটা কারখানাও ছিলো এঁর। এঁর কাছে এই জমি বিক্রি করে তিনি পেয়েছিলেন ১৬০০ টাকা।২১৪ এ সমযে মহাদেব চট্টোপাধ্যায় তাঁকে ১০ এপ্রিল তারিখে এক হাজার এবং ১ জুন তারিখে ১৫৮৬ টাকা ৯ আনা আট পাই দিয়েছিলেন।২১৫ ১ জুন তারিখে দেওযা টাকার মধ্যে এক হাজার টাকা ছিলো ধার এবং বাকি টাকা ছিলো সম্পত্তি বাবদ। পরে মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে টাকা নিয়ে যে- তিক্ততা দেখা দেয়, তার অনেকটাই দেখা দিয়েছিলো এই টাকা ধার করার শর্ত থেকে। মাইকেল এই টাকা গ্রহণের শর্ত হিশেবে স্বীকার করেন যে, তিনি বিদেশ থাকার সময়ে মহাদেব তাঁকে প্রতি বছর তিন হাজার টাকার বদলে দেবেন দুহাজার টাকা। কিন্তু কবি ফিরে আসার পর সম্পত্তির পুনর্জরিপ করাবেন। যদি এই জরিপ থেকে দেখা যায় যে, সম্পত্তির আযদু হাজার টাকার বেশি, তা হলে মহাদেব তাঁকে বাড়তি টাকা শোধ করবেন। আর যদি দেখা যায় যে, জমি থেকে আয় দু হাজার টাকার কম, তা হলে মাইকেল ধার-করা এক হাজার টাকা শতকরা ১০ টাকা সুদ-সহ মহাদেবকে ফিরিয়ে দেবেন।২১৬
বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে বিলেত যাবার সব খরচ তিনি জোগাড় করতে পারেননি। তা ছাড়া, তিনি যাবার সময়ে হেনরিয়েটা এবং দুই সন্তানের জন্যে কিছু টাকা ব্যাংকে রেখে যেতে চেয়েছিলেন। সে জন্যে তিনি এ সময়ে পরিচিতদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেন। মথুরামোহন কুণ্ডু, সাগর দত্ত এবং মধুসূদন মজুমদার নামে তিন ভদ্রলোকের কাছ থেকে তিনি ধার করেছিলেন যথাক্রমে ১৭০০, ৮০০ এবং ৫০০ টাকা।২১৭ বিদ্যাসাগরের কাছ থেকেও কবি এক হাজার টাকা ঋণ করেছিলেন। এসব টাকা দিয়ে বিলেত যাবার জাহাজের ভাড়া এবং এই ঘাটতি পূরণের কথা ভেবে থাকবেন। কিন্তু পরের আলোচনা থেকে লক্ষ্য করবো, কবির আয়-ব্যয়ের হিশেব নির্ভুল ছিলো না।
যে-কোনো উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখলে মধু চিরকাল তা নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতে পছন্দ করতেন। এবারেও তার ব্যতিক্রম হলো না। বন্ধুকে — রাজনারায়ণ বসুকে — লিখলেন: ‘বোধ হয় সামনের মাসেই বিলেত যাচ্ছি। আর কবি মধু নয়, দোস্ত্, এবারে মাইকেল এম এস ডাট এস্কোয়ার, ইনার টেম্পলের ব্যারিস্টার! হা! হা! হা! দারুণ ব্যাপার, তাই না?’২১৮ কিন্তু এমন রঙিন স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত বাস্তবে পরিণত হবে তো? বড়োকরে আশা করতে ভয় পান তিনি। এর আগেও বিলেত যাবার গোলাপী স্বপ্ন দেখেছিলেন। মাস খানেকের মধ্যে যাত্রা করবেন — সে বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত ছিলেন; কিন্তু শেষ তক যাওয়া হয়নি। মাদ্রাসে বড় একটা চাকরি পাবেন, সে আশাও ব্যর্থ হয়েছিলো। The Captive Ladie লিখে ভেবেছিলেন, বিলেত না-গিয়েই ইংরেজি সাহিত্যে বড়ো রকমের ছাপ রাখতে পারবেন — সে স্বপ্নও অচিরে বাস্তবতার রূঢ় আঘাতে খানখান হয়ে গিয়েছিলো। বারবার এ রকমের স্বপ্নভঙ্গের জন্যে বড়ো রকমের আশা করতেও তিনি ভরসা পাচ্ছিলেন না। সে জন্যে ‘হা! হা! হা!’ বলে অট্টহাস্য করলেও, পরক্ষণে লিখেছেন: ‘আশা করি আমি হতাশ হবে না।’ কিন্তু তিনি শুনতে না-পেলেও, প্রিতবনির মতো প্রায় একই সময়ে ভাগ্যদেবীও হা! হা! করে অট্টহাস্য করছিলেন। ভাগ্যদেবী যেন অশ্রুত দৈববাণীতে বলেছিলেন: ‘তোমার বিলেত যাওয়ার সাধ পূরণ হবে, কিন্তু তাতে আশা তোমার পূরণ হবে না। ব্যারিস্টারও হবে কিন্তু সে বিদ্যা পুরোপুরি প্রয়োগ করতে পারবে না।’
যখন বিলেত যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছেন, সেই ব্যস্ততার মধ্যে বন্ধুরা তাঁর ওপর একটা গুরু দায়িত্ব চাপলেন — Hindoo Patriot পত্রিকা সম্পাদনার কাজ। আগের বছর ১৪ জুন এই পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখার্জি মারা যান — ইতিপূর্বে আমরা তা দেখতে পেয়েছি। তিনি মারা যাবার পর থেকে এ পত্রিকা পরিচালনায় অব্যবস্থা দেখা দিয়েছিলো। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ছাপাখানা-সহ এ পত্রিকা কিনে নিয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ এবং এর সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় আর গিরিশচন্দ্র ঘোষ। কুঞ্জলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিছুদিন সম্পাদনার কাজ করেছিলেন। কিন্তু পত্রিকার হাল তাঁরা কেউই শক্ত হাতে ধরতে পারেননি। সে জন্যে কবির বন্ধুরা ভেবেছিলেন মাদ্রাসে পত্রিকা সম্পাদনার যে-অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছিলেন, তা দিয়ে তিনি এই ডুবন্ত পত্রিকাকে ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হবেন। অংশত হরিশচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির কারণে এবং অংশত বিদ্যাসাগর ও যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের মতো দুজন প্রভাবশালী বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষকের অনুরোধে তিনি এই কাজ হাতে নেন। যেভাবে বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে মাদ্রাসে তিনটি পত্রিকার কাজ করেছিলেন, তাতে তিনি নিজেও আশা করেছিলেন যে, এই পত্রিকার মান উন্নত করতে পারবেন। কলকাতার পত্রিকা সম্পর্কে তাঁর ধাবণা যে উচু ছিলো না, তা আগেই বলেছি। তাঁর বিশ্বাস ছিলো, তিনি হাত দিলে সে পত্রিকার চেহারায় তার ছাপ পড়তে বাধ্য। তাই রাজনারায়ণকে লিখেছেন: ‘আগামী সোমবারের সংখ্যাটাকে আমার সম্পাদিত সংখ্যা বলে চিনতে তোমার বেগ পেতে হবে না।’২১৯
এই চিঠির পরবর্তী অংশ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, পত্রিকার কথা ভাবতে গিয়ে উদ্দীপ্ত বোধ করলেও, তিনি সত্যি সত্যি উত্তেজিত বোধ করছেন বিলেত যাবার প্রসঙ্গে। সে জন্যে কিছুতেই বিলেত যাবার প্রসঙ্গটা ভুলতে পারেননি। অচিরে যাওয়া হবে সেই বিলেতে, যেখানে যাবার স্বপ্ন দেখেছেন প্রথম যৌবন থেকে। অবশ্য তখন ভেবেছিলেন, বিলেত যাবেন কবি হতে। এখন ভাবছেন, বিলেত যাবেন ব্যারিস্টার হতে। এ কথা ভেবে কি তিনি নিজের অজ্ঞাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন? আমার মনে হয়, ফেলেননি। কারণ, ইতিমধ্যে আশাতীত কবিখ্যাতি লাভ করে-ছিলেন –হোক না বাংলায়! এই কথা মনে রেখে তিনি বাজনারায়ণকে যে-চিঠি লিখেছিলেন – তার কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। বস্তুত, সাহিত্যিক হিশেবে বিতর্কাতীত প্রতিষ্ঠা লাভের পর তিনি ভেবেছিলেন: কবি হবার জন্যে কে আর বিলেত যায়! সরস্বতীর নয়, এবারে তিনি গলায় পরবেন লক্ষ্মীর বরমাল্য।
Hindoo Patriot-এর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কয়েক সপ্তাহের বেশি ছিলো বলে মনে হয় না। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের চিঠি থেকে মনে হয় যে, এই পত্রিকা থেকে কোনো টাকাপয়সা না-পাওয়ায় কবি এর দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চাইছিলেন।২২০ আরও জানা যাচ্ছে, তিনি যখন পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তাঁর সঙ্গে মোটামুটি কথা হয়েছিলো যে, তিনি সপ্তাহে দু-তিনটে করে লেখা দেবেন আর সম্পাদনার কাজ তদারকি করবেন। তিনি তাঁর এই দায়িত্ব গুরুত্বের সঙ্গে পালন করছিলেন। কিন্তু টাকাপয়সা না-পাওয়ায় যতীন্দ্রমোহনের কাছে অভিযোগ করেন। পত্রিকার কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে যতীন্দ্রমোহন তাঁকে অন্তত আর-এক মাস ধৈর্য ধরতে অনুরোধ করেন। ‘তারপরও যদি পত্রিকার পরিচালকরা আপনাকে নিয়মিত টাকাপয়সা না-দেন, তাহলে আমি আর আপনাকে এব্যাপারে বিরক্ত করবো না।’২২১ যতীন্দ্রমোহনের এ অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি বেশি দিন এ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
বস্তুত, এ সময়ে বিলেত যাবার ব্যাপারে সব রকমের আয়োজন করতে তিনি বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এসব আয়োজনের মধ্যে একটা ছিলো হেনরিয়েটা এবং দুই সন্তানের নিরাপত্তার পাকা ব্যবস্থা করা। ছোটো ছোটো সন্তানের একটি সংসারকে কোথাও কেবল এক অসহায় মহিলার দায়িত্বে ফেলে গেলে তাদের কী গুরুতর বিপদ হতে পারে, রেবেকার পরিবার দেখলে তিনি তা চাক্ষুষ উপলব্ধি করতে পারতেন। তা তিনি করেননি। কিন্তু কল্পনায় নিশ্চয় রেবেকাদের দুরবস্থার কথা গভীবভাবে অনুভব করে থাকবেন। এবারে আবার কলকাতায় দুটি সন্তান এবং তাদের জননীকে যাতে তেমন বিপদে পড়তে না-হয়, তিনি অবশ্যই সেটা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু সে পথে একাধিক বাধা ছিলো। আত্মীয়দের সঙ্গে মামলা-মকদ্দমা তখনো একেবারে মিটে যাযনি। মামলায় হেরেও তাঁরা আপীল করেছেন। আপীলে হেরে নতুন করে মামলা করেছেন, ইত্যাদি। সে কারণে, রাজনারায়ণকে আগের চিঠিটি লেখার কিছুদিন পরে-মার্চ মাসে–আবার লেখেন: ‘যতোটা তাড়াতাড়ি বিলেত যেতে পারবো বলে ভেবেছিলাম, ততোটা তাড়াতাড়ি যাওয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। আমার আত্মীয়দের সঙ্গে আমার যে-মামলা এখনো চলছে তার আগুন না-নিভিয়ে আমি দেশ ছাড়তে চাইনে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে – তারা বদমাশের চূড়ান্ত, নয়তো এই পৃথিবীতে তাদের মতো বোকা আর নেই। মামলায় প্রায় ফতুর হয়ে গেছে, তবুকথাবার্তা শোনার পাত্র তারা নয়!’২২২ এই চিঠি লেখার মোটামুটি তিন মাস পরে তিনি সত্যি সত্যি একদিন বিলেত যাত্রা করলেন।
কলকাতা থেকে মাদ্রাসে পালিয়ে যাবার আগে পরিচিত পরিবেশ এবং স্বজনদের ফেলে যাবার কথা ভেবে, তাঁর মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো, আমরা তার কোনো হদিস পাইনি। তবে পরিবারের প্রতি তাঁর মনে যে-তিক্ততা তৈরি হয়েছিলো, তারকথা নিজেই লিখেছিলেন। সেই তিক্ততা দিয়ে বিচ্ছেদের বেদনাকে তিনি খানিকটা লঘু করার প্রয়াস পেয়ে থাকবেন। কিন্তু মাদ্রাসে যাবার পরেও তিনি যে বঙ্গদেশকে ভুলতে পারেননি, আমরা তাঁর কবিতা এবং চিঠিপত্র থেকে দেখতে পেয়েছি। এবারে বিলেত যাবার আগে তাঁর মনের অবস্থা কেমন হয়েছিলো, রাজনারায়ণকে লেখা দুটি চিঠি থেকে তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম চিঠিতে লিখেছেন: ‘যদি বেঁচে থেকে ফিরে আসতে পারি, তা হলে দেখা হবে। তা না-হলে এক শো বছর পরে আমার দেশের লোকেরা হয়তো ক্ষীণতম বেদনার সঙ্গে বলবে।
Far away – Far Away,
From the land he love’d so well
Sleeps beneath the colder ray.২২৩
বিলেত যাত্রার আগে দেশ, পরিচিত পরিবেশ এবং আপনজনদের জন্যে তাঁর মন যে বিষন্ন এবং বিরহবিধুর হযেছিলো, তা বোঝাই যাচ্ছে। তা ছাড়া, জীবিত ফিরে আসতে পারবেন কিনা, সে সম্পর্কেও উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এই দুশ্চিন্তা অস্বাভাবিক নয়।
জাহাজে ওঠার পাঁচ দিন আগে বন্ধুকে যে-চিঠি লিখেছিলেন, তা থেকে তাঁর একটা অপরাধ- বোধও প্রকাশ পেয়েছে। তিনি যে সাহিত্যচর্চা না-করে কেবল অর্থলোভে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছিলেন — সেই অপরাধবোধ। সে জন্যে কৈফিয়তের সুরে বলেছেন: ‘বন্ধু, আমি আমার স্বদেশের সাহিত্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, আশা করি তুমি নিশ্চয় তা মনে করবে না। নতুন কাব্যটি যে-অসাধারণ সাফল্য লাভ করেছে, তা যদি না-হতো, তা হলে আমি অবশ্যই আমার যাত্রা পিছিয়ে দিতাম। অথবা হয়তো যেতামই না। আমার দায়িত্ব আমি তা হলে পৌরুষের সঙ্গে পালন করতাম। কিন্তু আমরা সকাল-সকাল বিজয় লাভ করেছি। এমতাবস্থায় এ দায়িত্ব আমি এখন তরুণদের হাতে সমর্পণ করতে পারি। তা ছাড়া, দূর থেকেও আমি তাঁদের গতিবিধি পরিচালনায় ক্ষান্ত হবোনা।’২২৪ মেঘনাদবধের সাফল্য সম্পর্কে কবির মনে কোনো রকমের সন্দেহ ছিলো না। কারণ বারো মাসের মধ্যে এ কাব্যের প্রথম খণ্ডের এক হাজার কপি বিক্রি হয়ে গিয়েছিলো এবং দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ আরম্ভ হয়েছিলো। এই সটীক সংস্করণ সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, কবির ভাষায়২২৫, একজন সত্যিকার বিএ — হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তিনিও রাজনারায়ণ বসুর প্রতিধ্বনি করে মেঘনাদবধ কাব্যকে বাংলা ভাষার প্রথম সত্যিকার কাব্য বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।২২৬ মেঘনাদবধ লেখার সময়ে তিনি মনে করেছিলেন, এই কাব্য লিখে তিনি হাত পাকাচ্ছেন, কিন্তু সেই কাব্যই যখন সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করলো, তখন সেই সাফল্য দেখে ভাবলেন, কবি হিশেবে তিনি যে-যশ লাভ করতে পারতেন, তা পুরোপুরিই লাভ করেছেন; এবারে অর্থস্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে বেঁচে থাকার সাধনা করতে পারেন।
মানুষ হিশেবে তাঁর অনেক কিছুর প্রতি দুর্বলতা ছিলো। কিন্তু অর্থ এবং যশের মধ্যে কোনটার প্রতি তাঁর দুর্বলতা বেশি ছিলো, বলা শক্ত। তবে অর্থ সঞ্চযের প্রতি তাঁর লোভ ছিলো না। তিনি জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছিলেন; ‘বড়োলোকর’ মতো জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে চেয়েছিলেন। তার
জন্যে টাকাপয়সার দরকার। নয়তো টাকাপয়সা হিশেবে টাকাপয়সার প্রতি তাঁর তেমন কোনো আকর্ষণ ছিলো না। আয়ের চেয়ে টাকা ব্যয় করতেই তাঁর উৎসাহ ছিলো সমধিক। অর্থ ছাড়া তাঁর আন্তরিক দুর্বলতা ছিলো প্রশংসা এবং যশের প্রতি। একজন সত্যিকার বিএ তাঁর কাব্য সম্পাদনা করছেন — এটাকে তিনি একটা স্বীকৃতি বলে বিবেচনা করেছেন। তদুপরি রাজনারায়ণকেও তিনি তাঁর খ্যাতি এবং যশ রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়ে যেতে চাইলেন। (যদিও তখনো রাজনারায়ণ মেঘনাদবধের কোনো সমালোচনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেননি। কবি আশা করেছিলেন যে, তিনি যাবার পরেও রাজনারায়ণ মেঘনাদ এবং বীরাঙ্গনার সমালোচনা লিখবেন। কবি অবশ্য ভুল প্রত্যাশা করেছিলেন। পরবর্তী কুড়ি বছরের মধ্যেও রাজনারায়ণের মেঘনাদ-সম্পর্কিত সমালোচনা প্রকাশিত হয়নি।) ‘প্রিয় রাজ, তোমার বন্ধুকে কিন্তু ভুলে যেয়ো না। তা ছাড়া, তোমার বন্ধুর খ্যাতি যাতে টিকে থাকে, সে দিকেও যত্ন নিয়ো।’২২৭
এই চিঠির সঙ্গে তিনি একটি ছোট্টো কবিতা পাঠান — বঙ্গভূমির প্রতি। কবিতাটি সম্পর্কে তাঁর নিজের মূল্যায়ন হলো – ‘আশা করি কবিতাটি ভালো না-হলেও, অন্তত সম্মানজনক হয়েছে।’ এ কবিতা তিনি শুরু করেন তাঁর প্রথম যৌবনের নায়ক বায়রনের একটি পঙ্ক্তি দিয়ে — My Native Land! Good-Night!২২৮ আন্তরিকতায় এ কবিতাটি অসাধারণ। সাধারণভাবে, তাঁর কবিতায় প্রচুর জাঁকজমক আছে — এ সম্পর্কে একমত হলেও, আন্তরিকতা কতোটুকু আছে সে সম্পর্কে সমালোচকরা একমত নন। কিন্তু আত্মবিলাপের মতো এই ছোটো কবিতায়ও অসাধারণ আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে
সাধিতে মনের সাদ ঘটে যদি পরমাদ
মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে!
প্রবাসে, দৈবের বশে, জীব-তারা যদি খসে
এ দেহ-আকাশ হতে, — নাহি খেদ তাহে।
জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর, হায়বে, জীবন-নদে?
কিন্তু যদি রাখ মনে, নাহি, মা, ভরি শমনে;
মক্ষিকাও গলে না গো, পড়িলে অমৃত-হ্রদে।
সাহিত্য সাধনা ছেড়ে দিয়ে বিদেশ যাত্রা করার জন্যে তাঁর মনে যে-অপরাধ বোধ দেখা দিয়েছিলো, এ কবিতায়ও তা অনুপস্থিত নয়। সে জন্যে, কবিতায় শুরুতে বলেছেন: মনের সাধ পূরণ করতে গিয়ে যদি ভুল করি, তবু তোমার মনের লালপদ্মকে মধুহীন কোরো না। মনের এই সাধ কেবল বিলেত যাওয়া হলে, তিনি এই কৈফিয়ত দিতেন না। কিন্তু নিজে ভালো করেই জানতেন যে, তিনি সাহিত্যের আসর ত্যাগ করে অনেক ঝুঁকি নিযে সুদূরে যাত্রা করছিলেন কবি হবার জন্যে নয় — ব্যারিস্টার হবার জন্যে। তিনি আশা করেছেন, জন্মভূমি তাঁর এই অপরাধ ক্ষমা করবেন। এ কৈফিয়ত দেবার পর, এ কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি যেন তাঁর শেষ ইচ্ছাই ব্যক্ত করেছেন — স্বদেশের প্রতি, বন্ধুদের প্রতি, সাহিত্যানুরাগীদের প্রতি। তাঁর মূল কথাটি হলো: ‘মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে।’ চেতনায় এবং অবচেতনে কবির মনে মৃত্যুচিন্তা ছিলো প্রবল। চিঠিপত্রে বহুবার সে কারণে তিনি নানা ভাষায় বলেছেন: অতো দিন যদি বেঁচে থাকি; বিধাতা যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন ইত্যাদি। এ কবিতায়ও সেই চিন্তা স্পষ্ট করে প্রকাশ পেয়েছে — এবং দূরদেশে যাত্রার আগে সেটা স্বাভাবিকও। কিন্তু যে-অসাধারণ চিত্রকল্প দিয়ে সেটি প্রকাশ করেছেন, সেটা তাঁর জন্যেও খুব সাধারণ নয় — প্রবাসে এ দেহ-আকাশ থেকে জীবতারা যদি দৈবের বশে খসে যায়, তা হলে খেদ নেই কোনো! বরং তিনি কবিতার শেষে আবার প্রার্থনা করেছেন, কি বসন্ত, কি শবতে তিনি যেন বঙ্গভূমির স্মৃতিজলে পদ্মের মতো সর্বদা ফুটে থাকেন।
যাবার আগে রাজনারায়ণকে তিনি যেমন আন্তরিকতা ঢেলে চিঠি লিখেছিলেন, অন্য কাউকে তেমন লিখেছিলেন কিনা, তা জানা নেই। প্রিয়তম বন্ধু গৌরদাসের সঙ্গে যাবার ঠিক আগে দেখা হয়েছিলো কিনা, তাও জানা যায় না।২২৯
উল্লেখপঞ্জী ও টীকাটিপ্পনী – মধুচক্র — গৌড়জনে যাহে
পৃ ১৪৯
১ ২৪ মে তারিখের অ্যাথেনিয়াম পত্রিকায় দেখতে পাই যে, ১৮ মে তারিখে নাবিয়া জাহাজে করে রেভারেন্ড ও মিসেস কেনেট কলকাতা থেকে মাদ্রাসে ফিরে এসেছেন। এই রেভারেন্ড কেনেট বিশপস কলেজে মাইকেলের সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু চার্লস এগব্যর্ট কেনেট। মাদ্রাসে আশ্রয় এবং চাকরি পেতে তিনি মাইকেলকে সাহায্য করেছিলেন। তিনি সস্ত্রীককেন কলকাতায় গিয়েছিলেন, তা সঠিক জানা না-গেলেও বেবেকার সঙ্গে কবির বিয়ে ততোদিনে ভেঙে গিয়ে থাকলে তাঁদের পক্ষে আপোশের কথা বলাই স্বাভাবিক।
২ গৌরদাসের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪৪৯।
পৃ ১৫০
৩ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪৬ (১৭ ফেব্রুআবি ১৮৫৬), HRP।
৪ ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ, মধু-স্মৃতি, পৃ. ৪৬৮।
৫ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, পৃ. ১৩।
পৃ ১৫১
৬ ১৮৫৭ থেকে ১৮৬৩ সালের মধ্যে কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রত্যেকটি ইংরেজি পঞ্জিকাতেই এই বেতনের অঙ্ক দেওয়া হয়েছে। এ ক’ বছরে কবির বেতন মোটেই বৃদ্ধি পায়নি।
৭ ভোলানাথ চন্দ্রের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪৮২।
৮ Calcutta Directory for 1857 (Calcutta, 1857), Junior Magistrate’s Office. Judicial Clerk, M. M. Dutt, Rs 125.
৯ কৈলাসবাসিনী দেবী, আত্মকথা (কলকাতা: হীরক রায়, ১৯৮২), পৃ. ২৭।
১০ মধু-স্মৃতি, পৃ. ৫৭; মাইকেল মধুসূদন দত্ত: জীবন ও সাহিত্য, পৃ. ১২৭।
১১ Bengal Directory for 1857, Street Finder.
পৃ ১৫২
১২ মধু-স্মৃতি, পৃ. পৃ. ৫৬।
১৩ মাইকেলকে লেখা গৌরদাস বসাকের চিঠি, ৫ জানুআরি ১৮৫৬, মধু-স্মৃতি, পৃ. ৫১।
১৪ সম্বাদ ভাস্কর, ২২ নভেম্বর ১৮৫৬, বিনয় ঘোষ সম্পাদিত সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, তৃতীয় খণ্ড (কলকাতা: বীক্ষণ, ১৯৬৪) গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৩৩৫-৩৬।
১৫ আত্মচরিত, পৃ. ৬৪-৬৫।
১৬ মন্মথনাথ ঘোষের কর্মবীর কিশোরীচাঁদ মিত্র (কলকাতা:) গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১০৮।
১৭ সম্বাদ প্রভাকর পত্রিকায় এ সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়। বিনয় ঘোষের বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজগ্রন্থে উদ্ধত, পৃ. ২৬৬। আরও দ্রষ্টব্য আমার লেখা সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও বাংলা নাটক (ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৮৪), পৃ. ৩৯।
১৮ আত্মচরিত, পৃ. ৬৫।
১৯ ঐ, ৬৬।
২০ রাজনারায়ণ এই বক্তৃতা করেন ১৮৭৩ সালে। — যোগেশচন্দ্র বাগল, রাজনারায়ণ বসু (২য় সং; কলিকাতা: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৯৫৫), পৃ. ৬৯।
পৃ ১৫৪
২১ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৯৯; মধু-স্মৃতি, পৃ. ৩১।
২২ Athenaeum, 28 June.
২৩ Athenaeum, 1 July 1851.
২৪ Ibid.
পৃ ১৫৫
২৫ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৬, HRP।
২৬ কুলীনকুলসর্ব্বস্ব নাটক অভিনীত হয় ১৮৫৭ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে। তার আগে শকুন্তলার অভিনয় হয় ঐ বছরের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে। — ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় নাট্য-শালার ইতিহাস (৪র্থ সং; কলিকাতা: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৬৮), পৃ. ৩৪, ৩৯।
পৃ ১৫৬
২৭ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪৭ ও ৪৮, HRP।
২৮ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪৭, HRP।
২৯ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ১৫৯।
৩০ শর্মিষ্ঠা নাটকের প্রস্তাবনা-সঙ্গীত।
৩১ গৌরদাস বসাকের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৪৫৬; মধু-স্মৃতি, পৃ. ৬২।
পৃ ১৫৭
৩২ মধু-স্মৃতি, পৃ. ৬২।
৩৩ ঐ।
পৃ ১৫৮
৩৪ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৪৯, HRP।
৩৫ ঐ।
পৃ ১৫৯
৩৬ ঐ।
৩৭ MMD to Keshab Gangooly, পত্রসংখ্যা ৬২, HRP।
৩৮ মধু-স্মৃতি, পৃ. ৬৩।
পৃ ১৬০
৩৯ আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি, পিতার তরুণী এবং দ্বিতীয় বিবাহকে কেন্দ্র করে হেনরিয়েটার সঙ্গে পিতার সম্পর্ক বিষিয়ে গিয়েছিলো। কলকাতার আসার বছর দুযেক পরে পিতার মৃত্যুর পরেও হেনরিয়েটা আর মাদ্রাসে যাননি। এমন কি, মাইকেলের চিঠিতেও এর কোনো সরাসবি উল্লেখ নেই।
পৃ ১৬১
৪০ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৫০, HRP।
৪১ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৫১, HRP।
পৃ ১৬৩
৪২ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৫০, HRP।
৪৩ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৫১, HRP।
৪৪ Ibid,
পৃ ১৬৪
৪৫ ইংরেজিতে অনূদিত রত্নাবলীর ভূমিকা দ্রষ্টব্য।
পৃ ১৬৫
৪৬ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৫১, HRP।
পৃ ১৬৬
৪৭ ঈশ্বর গুপ্তেব প্রশস্তিতে কবি এ কবিতা লেখেন ১৮৬৬ সালে। এ কবিতায় তিনি দুঃখ করে লিখেছেন: ‘সবে কি ভুলিল তোমার স্মরণ-নিকষে, / মন্দ-স্বর্ণ-রেখা-সম এবে তব নামে / নাহি কিহে জ্যোতি ভাল স্বর্ণের পরশে?’ — ঈশ্বর গুপ্ত, চতুর্দশপদী কবিতাবলি।
৪৮ I.O.R., Recommendations by the Committtee for Sudder Examination to the Bengal Government, Jaanuary 1859,
৪৯ Ibid.
৫০ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৫১, HRP।
৫১ Ibid. অনুবাদের কাজ কবি শুরু করেছিলেন জানুয়ারি মাসে। অনুবাদের প্রথমাংশ পড়ে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ১০ ফেব্রুয়ারি কবির কাছে একটি চিঠি লেখেন। মধু-স্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৬৫।
পৃ ১৬৭
৫২ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৫২, HRP।
৫৩ মধু-স্মৃতি পৃ. ৬৫।
৫৪ Indian Field, 25 June 1859. এই পত্রিকার কিছু সংখ্যা ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে আছে। কিন্তু রাজনারায়ণ বসুর লেখা তিলোত্তমার সমালোচনা যে-সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিলো, সেটি নেই।
৫৫ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৫১, HRP।
৫৬ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৫২, HRP।
পৃ ১৬৮
৫৭ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৫১, HRP।
৫৮ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৫২, HRP।
৫৯ মাইকেল মধুসূদনকে লেখা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের চিঠি, মধু-স্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৬৮।
৬০ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৫২, HRP।
৬১ মাইকেল মধুসূদনকে লেখা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের চিঠি, মধু-স্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৬৮।
৬২ MMD to Gourdas Bysack, পত্রসংখ্যা ৫২, HRP।
পৃ ১৭১
৬৩ বিস্তারিত বিবরণের জন্যে দ্রষ্টব্য আমার লেখা সমাজ-সংস্কার আন্দোলন ও বাংলা নাটকগ্রন্থ, পৃ. ৪০৯-১৮ ও অন্যত্র।
পৃ ১৭২
৬৪ কেশবচন্দ্র গাঙ্গুলির স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৪৯০-৯১।
৬৫ MMD to Keshab Gangooly, পত্রসংখ্যা ৬৯, HRP।
পৃ ১৭৩
৬৬ কেশবচন্দ্র গাঙ্গুলির স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৪৯০-৯১।
৬৭ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৫, HRP।
৬৮ MMD to Keshab Gangooly, পত্রসংখ্যা ৭০, HRP।
৬৯ MMD to Keshab Gangooly, পত্রসংখ্যা ৫৪, HRP।
পৃ ১৭৪
৭০ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত গ্রন্থে উদ্ধৃত ৪৭৩; মধু-স্মৃতি, পৃ. ৭১।
পৃ ১৭৫
৭১ MMD to Keshab Gangooly. পত্রসংখ্যা ৫৪, HRP।
৭২ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৬, HRP।
পৃ ১৭৬
৭৩ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৫ ও ৫৬, HRP।
৭৪ বিবিধার্থ সংগ্রহ, ১৭৮১ শকাব্দ, মধুসূদন রচনাবলীতে উদ্ধৃত, পৃ. ঊনত্রিশ।
৭৫ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৭, HRP।
পৃ ১৭৭
৭৬ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের স্মৃতিচারণ, মধু-স্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৭৩।
৭৭ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৬, HRP।
৭৮ ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য প্রসঙ্গে’, সোমপ্রকাশ পত্রিকা, ২৩ শ্ৰবণ ১২৬৭।
৭৯ ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’, বিবিধার্থ সংগ্রহ, অগ্রহায়ণ ১৭৮২ শকাব্দ, মধু-স্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৮০-৮৩। কবি নিজে এই সমালোচনা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হতে না-পারলেও, রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠিতে এর উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘kind’। MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৬১, HRP।
পৃ ১৭৮
৮০ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৭ এবং ৭২, HRP।
৮১ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৭২, HRP। বাল্যবন্ধু রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে এ মন্তব্য করার কারণ হয়তো এই যে, এডুকেশন গেজেট পত্রিকায় তিলোত্তমাসম্ভবের যে-সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিলো, তাতে রঙ্গলাল মাইকেলের যথেষ্ট প্রশংসা করতে পারেননি।
পৃ ১৭৯
৮২ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৬, HRP।
৮৩ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৭, HRP।
৮৪ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৬১, HRP।
৮৫ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৭, HRP।
৮৬ গ্রন্থাকারে তিলোত্তমাসম্ভব প্রকাশের ঠিক আগে মাইকেলের কবিত্ব এবং তাঁর কাব্যের সৌন্দর্যের প্রশংসা করে রাজনারায়ণ বসু ১ মে এবং ১৯ জুন (১৮৬০) তারিখে দুটি চিঠি লেখেন। – MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৫, HRP।
৮৭ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৬, HRP।
পৃ ১৮০
৮৮ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৫, HRP।
৮৯ IOR, N/1/97/231.
পৃ ১৮১
৯০ MMD to Bysack, পত্রসংখ্যা ৪১, HRP।
পৃ ১৮২
৯১ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, পৃ. ২৯।
৯২ বীরাঙ্গনা কাব্যের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিজীবনের সাদৃশ্যের জন্যে পরবর্তী আলোচনা দ্রষ্টব্য – পৃ. ২১৬-২০।
পৃ ১৮৩
৯৩ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ২০।
পৃ ১৮৪
৯৪ এই কবিতা পরবর্তী বিহারীলাল চক্রবর্তী, এমন কি, রবীন্দ্রনাথকে মনে করিয়ে দিতে পারে। এ কাব্যে ছন্দ নিয়েও তিনি বেশ সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এ কবিতায় ছ মাত্রার যে-ছন্দ ব্যবহার করেছেন, তা সে যুগের পক্ষে অকল্পনীয়।
৯৫ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৫, HRP।
৯৬ Ibid.
পৃ ১৮৫
৯৭ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৯, HRP।
৯৮ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৭, HRP।
৯৯ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৬, HRP।
১০০ Ibid.
১০১ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৬১, HRP।
পৃ ১৮৬
১০২ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৫, HRP।
১০৩ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৬০, HRP।
১০৪ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৭, HRP।
১০৫ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৬, HRP।
পৃ ১৮৭
১০৬ Ibid.
১০৭ IOR/N/2/41/42.
১০৮ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৬, HRP।
১০৯ ঐ।
১১০ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৯, HRP।
১১১ আগেই উল্লেখ করেছি, মাইকেলের জন্ম-সন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেলেও, জন্ম-তারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। ১৩ই জানুয়ারি তারিখে লেখা একটি চিঠিতে বিশপস কলেজের অধ্যক্ষ লিখেছিলেন যে, সেদিন ছিলো মাইকেলের জন্মদিন। তিনি নিজে কোনো চিঠিপত্রে তাঁর জন্মদিনের উল্লেখ করেননি।
পৃ ১৮৯
১১২ MMD to Gangooly, পত্রসংখ্যা ৬২, HRP।
পৃ ১৯০
১১৩ Ibid.
১১৪ MMD to Gangooly, পত্রসংখ্যা ৬৩, HRP।
১১৫ MMD to Gangooly, পত্রসংখ্যা ৬৪, HRP।
১১৬ MMD to Gangooly, পত্রসংখ্যা ৬৭, HRP।
পৃ ১৯১
১১৭ MMD to Gangooly, পত্রসংখ্যা ৭০, HRP।
১১৮ Ibid.
১১৯ MMD to Gangooly, পত্রসংখ্যা ৬৯, HRP।
১২০ এই নাটকের কাহিনীর সঙ্গে বিশেষ করে কৃষ্ণকুমারীর আত্মহত্যার সঙ্গে ইফিজিনিয়ার কাহিনীর মিল আছে, এ কথা জেমস টড তাঁর রাজস্থান কাহিনীতেই উল্লেখ করেন। মাইকেল সেই কাহিনীকেই আরও নাটকীয়তা দান করেন। J. Tod, The Annals and Antiquities of Rajasthan, PP. 461-65.
১২১ MMD to Gangooly, পত্রসংখ্যা ৬৪, HRP।
পৃ ১৯২
১২২ MMD to Gangooly, পত্রসংখ্যা ৭০, HRP।
১২৩ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮২, HRP।
১২৪ Ibid.
১২৫ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৬৮, HRP।
পৃ ১৯৩
১২৬ সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ৩য় খণ্ড (সপ্তম সং, কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯১৪), পৃ. ১১৭।
১২৭ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৫, HRP।
পৃ ১৯৪
১২৮ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৭২, HRP।
১২৯ Ibid.
১৩০ Ibid.
১৩১ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৬৮, HRP।
১৩২ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৭২, HRP।
পৃ ১৯৫
১৩৩ রাজনারায়ণ বসু, আত্মচরিত (ওরিয়েন্ট, ১৯৮৫ সংস্করণ), পৃ. ৬৮।
১৩৪ ঐ, পৃ. ৭০।
১৩৫ রাজনারায়ণ বসুর স্মৃতিচারণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচবিত গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ৪৭১।
১৩৬ রাজনারায়ণ বসু, আত্মচরিত, পৃ. ৭০।
১৩৭ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৫, HRP।
১৩৮ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৭৪, HRP।
১৩৯ Ibid.
১৪০ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৭৭, HRP।
১৪১ Ibid.
১৪২ Ibid.
পৃ ১৯৬
১৪৩ Ibid.
১৪৪ বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি (কলিকাতা: শিশিব পাবলিশিং, ১৯২০), পৃ. ৬৪-৬৫। মাইকেল প্রায়ই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যেতেন বলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে-দাবি করেছেন, তার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ আছে। কারণ তিনি যখনকার কথা উল্লেখ করেন (মেঘনাদবর্ধ কাব্য প্রকাশের আগে), তখন তাঁর বয়স এগারো। তার চেয়েও বড়ো কথা মাইকেল নিজে তখনকার একটি চিঠিতে লিখেছেন যে, তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুবকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না এবং শুনেছেন যে, তাঁর এক পুত্র কবি। আর, যে-সারদাপ্রসাদের সূত্র ধরে মাইকেল জোড়াসাঁকোতে ‘প্রায়ই আসিতেন’ বলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দাবি করেছেন, তাঁর পুরো নামও মাইকেল ভালো করে জানতেন বলেও মনে হয় না। তিনি সারদাপ্রসাদের উল্লেখ করে লিখেছেন ‘কী একজন গাঙ্গুলি — তোমার বন্ধু দেবেন্দ্রনাথের জামাতা।’
১৪৬ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৪, HRP।
পৃ ১৯৮
১৪৭ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৭৪, HRP।
১৪৮ Ibid.
১৪৯ Indian Field পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা ব্রটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে আছে। কিন্তু এই সমালোচনা যে-সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, সেটি নেই। এটি প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। শেষ সপ্তাহে লেখা একটি চিঠিতে কবি এ জন্যে রাজনারায়ণকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। কিন্তু কোনো উচ্ছ্বসিত মন্তব্য করেননি। (MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৭৭, HRP।
১৫০ রাজনারায়ণ বসু, ‘মেঘনাদবধ সমালোচনা’, বিবিধ প্রবন্ধ, প্রথম খণ্ড (১৮৮২), দ্বিজেন্দ্রলাল নাথ সম্পাদিত মধুসূদন: সাহিত্য প্রতিভা ও শিল্পী-ব্যক্তিত্ব (কলকাতা: পুথিপত্র, ১৯৮৬) গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১৫-১৬।
১৫১ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৬, HRP। Also see পত্রসংখ্যা ৫৭, HRP।
পৃ ১৯৯
১৫২ রাজনারায়ণ বসু, বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা (কলিকাতা: নূতন বাঙ্গালা যন্ত্র, সংবৎ ১৯৩৫ [১৮৭৮], পৃ. ৩৪-৩৫।
১৫৩ রাজনারায়ণ বসু, আত্মচরিত, পৃ. ৬৯।
১৫৪ রাজনারায়ণ বসু, বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা, পৃ. ৩৪-৩৬।
১৫৫ ঐ।
১৫৬ ঐ, পাদটীকা,।
১৫৭ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৭৪, HRP।
১৫৮ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৫, HRP।
১৫৯ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮২, HRP।
১৬০ Ibid.
পৃ ২০১
১৬১ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৭৪, ৮১, ৮২, ৮৩ ও ৮৪, HRP।
১৬২ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮১, HRP।
১৬৩ MMD to Bysack, পত্রসংখ্যা ৭৯, HRP।
১৬৪ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮১, HRP। ৮২ সংখ্যক পত্রেও মামলায় অগ্রগতি হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন।
১৬৫ বিচারে ৬ জুন তারিখে ম্যানুয়েলের জরিমানা হয়েছিলো। এই মামলার রায় দেওয়া হয় ৯ জুন (১৮৬১) তারিখে। জেমস লঙ তাঁর বিবৃতি দেন ২৭ জুন তারিখে। তাঁর বিচার ১৮ই জুলাই তারিখে আরম্ভ হয়ে ২৪শে জুলাই তারিখে শেষ হয়। দ্রষ্টব্য: Trial of Rev. James Long for the Publication of the ‘Nil Darpan’ (London: James Ridgway, 1861).
১৬৬ G. A. Oddie, Social Protest in India (Delhi: Manohar, 1979), p. 174.
পৃ ২০২
১৬৭ James Long to Parent Committee, 15 Aug. 1861, Birmingham University, James Long Papers, CMS, CI 1/0/185/1-154.
১৬৮ James Long to Parent Committee, 5 Mar. 1862, CI 1/0/185/1-154.
১৬৯ James Long to Parent Committee, 15 Aug. 1861 and Seton Kerr’s letter to J. Long, CI 1/0/185/1-154,
১৭০ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এ মন্তব্য করেন তাঁর ‘রায় বাহাদুর দীনবন্ধু মিত্র বাহাদুরের জীবনী’ প্রবন্ধে। সুপ্রিম কোর্টে মাইকেল কখনো চাকরি করেননি। সুতরাং তাঁর চাকরি চলে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠেনা। তা ছাড়া, তিনি নীলদর্পণ অনুবাদ করে থাকলেও, তা করেছেন সরকারী আশীর্বাদ নিয়ে। মনে হয়, বঙ্কিমচন্দ্ৰ জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করেই এ মন্তব্য করেছিলেন।
১৭১ Sir Bartle Frere’s letter to J. Long, 18.7.61, CI 1/0/185/1-154.
পৃ ২০৩
১৭২ IOR, N/1//101/38.
১৭৩ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৫, HRP।
১৭৪ পাইকপাড়ার রাজারা অন্তত তিনবার তাঁকে অর্থ সাহায্য করেন। প্রথমবার বেশ দরাজ হাতে টাকা দেন রত্নাবতী অনুবাদ করার জন্যে, দ্বিতীয়বার বাংলা এবং ইংরেজি শর্মিষ্ঠার জন্যে এবং তৃতীয়বার মাইকেলকে দেনামুক্ত করার জন্যে। প্রহসন ছাপানোর খরচও দেন তাঁরা। গৌরদাস বসাককে লেখা ৩ মে ১৮৫৯ তারিখের চিঠিতে এ রকম অর্থ সাহায্য দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (পত্রসংখ্যা ৫২, HRP)।
পৃ ২০৪
১৭৫ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৬, HRP।
১৭৬ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৩, HRP।
১৭৭ Indian Field, 3 Aug., 1861.
১৭৮ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৫, HRP।
১৭৯ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৯, HRP।
১৮০ Ibid.
পৃ ২০৫
১৮১ যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত পঙক্তি হলো: কবিরে পাবে না তাঁহাব জীবনচরিতে।
১৮২ Henry James quoted in L. Idel, Writing Lives: Principia Biographica (London: W. W. Norton & Co., 1987), p. 140.
১৮৩ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৭২, HRP।
পৃ ২০৬
১৮৪ W. Radice, “Xenophilia and xenophobia: Michael Madhusudan Datta’s Meghnad-badh Kabya” in R. Snell and I. M. P. Raeside (eds.), Classics of Modern South Asian Literature. Harrassowitz Velag: Wiesbaden, 1998.
পৃ ২০৮
১৮৫ C. Seely, “Homeric Similes, Occidental and Oriental: Tasso, Milton and Bengal’s Micheal Madhusudan Dutt”, Comparative Literature Studies, Vol. 25, No. 1 (1988), pp. 35-54.
পৃ ২০৯
১৮৬ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৫৫, HRP।
১৮৭ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮২, HRP।
১৮৮ Ibid.
১৮৯ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৭২, HRP।
পৃ ২১১
১৯০ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৩, HRP।
১৯১ Ibid.
১৯২ MMD to Gangooly, পত্রসংখ্যা ৭০, HRP।
১৯৩ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনচরিত, পৃ. ৩৪২। ‘আত্মবিলাপ’ প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালের (শকাব্দ ১৭৮৩) আশ্বিন সংখ্যা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়। এতে রচয়িতার নাম ছিলো না।
পৃ ২১২
১৯৪ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮১, HRP।
১৯৫ Ibid.
পৃ ২১৩
১৯৬ এই বই-এর সংযোজন এবং সংযোজনের ১৮ সংখ্যক পাদটীকা দ্রষ্টব্য।
পৃ ২১৫
১৯৭ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৬, HRP।
১৯৮ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৭, HRP।
১৯৯ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮১, HRP।
পৃ ২১৭
২০০ L. Idel, Writing Lives: Principia Biographica, p. 136.
পৃ ২২০
২০১ তাঁর সমালোচকদের উত্তরে তিনি কেবল অন্ত্যমিল দিয়েই ব্রজাঙ্গনার কবিতা লিখলেন না, তিনি এতে ছন্দের এতো সফল এবং গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষানিরীক্ষা করলেন যে, তাকে অমিত্রাক্ষরের চেয়ে কম কৃতিত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না। — সুকুমার সেন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৪। তা ছাড়া কয়েক বছর পরে চতুর্দশপদী কবিতাবলিতেও অত্যন্ত সফলভাবে অন্ত্যমিল ব্যবহার করেন।
২০২ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৩, HRP।
পৃ ২২১
২০৩ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৩, HRP। আরও দ্রষ্টব্য: পত্রসংখ্যা ৫৬, ৮১ ও ৮৭।
২০৪ New Calcutta Directory. 1859-62 (Calcutta, 1859-62) আইন অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
পৃ ২২২
২০৫ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মনোমোহন ঘোষ বিলেত যাত্রা করেন ১৮৬২ সালের ২৩শে মার্চ। তাঁদের যাত্রা উপলক্ষে Hindoo Patriot পত্রিকা মন্তব্য করে, ‘We trust many more will follow their example.’- Hindoo Patriot, 24 March 1862.’। মনে হয় তাঁদের যাত্রার বেশ আগে থেকেই এ বিষয় নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিলো। জেমসলঙ মাদ্রাস থেকে এর আগেই লন্ডনে প্যারেন্টস কমিটিতে লেখা চিঠিতে জানিয়েছিলেন। তবে তাতে মনোমোহন ঘোষের নাম ছিলো না। J. Long to Parent Committee, 28. 2. 1862, CI 1/0/185, 1-154.
২০৬ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৭, HRP।
২০৭ Ibid.
পৃ ২২৩
২০৮ Vender 289, Book CH, Vol. 7, pp. 402-03 (1861). এই দলিলের পুরো পাঠের জন্যে দ্রষ্টব্য: গিরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায, ‘মাইকেল ও বিদ্যাসাগর’, প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৮, পৃ. ৯৭২-৭৩।
২০৯ ঐ, পৃ. ৯৭৩-৭৪।
২১০ দলিলে বলা হয়েছে: ‘আমার পিসতুত ভ্রাতা এবং বাল্যকাল অবধি আমার পিতার প্রতিপালনাধীন ছিলেন।’ — ঐ পৃ. ৯৭৪।
২১১ ভার্সাই থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে কবি যেসব চিঠিপত্র লিখেছিলেন, তার মধ্যে বেশ কয়েকটিতেই তিনি উল্লেখ করেছেন যে, এই সম্পত্তির বাৎসরিক খাজনা ছিলো ১৫০০ টাকা।
২১২ তখন এ বাড়ির মালিক বাল্যবন্ধু হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বাড়িতেই হরিমোহন এবং তাঁর দুই ভাই – গণেশচন্দ্র ও রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছেলেবেলায় কবির বন্ধুত্ব হয়েছিলো। সুতরাং বাল্য ও প্রথম যৌবনের স্মৃতি-বিজড়িত সেই বাড়িতে গিয়ে নস্টালজিক মনোভাব জেগে ওঠা স্বাভাবিক।
পৃ ২২৪
২১৩ গিরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ‘মাইকেল ও বিদ্যাসাগর’, প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৮, পৃ. ৯৬৯-৭০। এই দলিলে তিনি লিখে দিয়েছিলেন যে, এই বাড়ি থেকে হরিমোহন বেদখল হলে, তিনি তাঁকে সাড়ে হাজার টাকা প্রদান করবেন।
২১৪ দলিল সংখ্যা ২ ও ৩, ঐ, পৃ. ৯৬৯।
২১৫ বিদ্যাসাগকে লেখা কবির চিঠি থেকে (২ জুন ১৮৬৪), পত্রসংখ্যা ১০২, HRP।
২১৬ ঐ।
২১৭ বিদ্যাসাগকে লেখা কবির চিঠি থেকে (২ জুন ১৮৬৪), পত্রসংখ্যা ৯৪, HRP।
২১৮ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৭, HRP। সাগর দত্ত ও মধুসূদন মজুমদারের কাছ থেকে ধারের কথা জানা যায় বিদ্যাসাগকে লেখা কবির চিঠি থেকে (২ জুন ১৮৬৪), পত্রসংখ্যা ৯৪, HRP। গিরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ‘মাইকেল ও বিদ্যাসাগর’, প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৮, পৃ. ৯৬৯-৭০। দলিলের তারিখ ২ জুন ১৮৬২।
২১৯ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৭, HRP।
২২০ কবিকে লেখা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুবের পত্র, মধু-স্মৃতি গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১৫৪।
২২১ ঐ।
পৃ ২২৬
২২২ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৮, HRP।
২২৩ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৭, HRP।
২২৪ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৯, HRP।
২২৫ ঐ।
পৃ ২২৭
২২৬ হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত ‘মেঘনাদবধ কাব্যের ভূমিকা’, দ্বিজেন্দ্রলাল নাথ সম্পাদিত মধুসূদন: সাহিত্যপ্রতিভা ও শিল্পী-ব্যক্তিত্ব গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ২৬-৩১।
২২৭ MMD to Rajnarayan Basu, পত্রসংখ্যা ৮৯।
২২৮ Lord Byron, ‘Child Harold’s Pilgrimage’, Canto the First, IV, Child Harold’s Good Night.
পৃ ২২৮
২২৯ গৌরদাস বসাক তখন বহমপুর এবং মুরশিদাবাদে ষষ্ঠ শ্রেণীর ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হিশেবে কাজ করছিলেন। বন্ধুর বিদায়ের আগে আসতে পেরেছিলেন কিনা, তার কোনো খবর পাওয়া যায় না।