৪. বিষ্ণুনারায়ণের মহলে

বীণাবালা বসে আছেন বিষ্ণুনারায়ণের মহলে।

তার সঙ্গে রয়েছেন বিভূতিনাথ সাহা ও ভুজঙ্গ দেব। এই আলোচনা রুদ্ধদ্বার। এখানে আর কারো প্রবেশ নিষেধ। এমনকি জমিদার অবনীন্দ্রনারায়ণেরও। বীণাবালা বললেন, তা ভুজঙ্গ বাবু, আপনি বলেছিলেন আপনার কিছু দাবি দাওয়া রয়েছে?

ভুজঙ্গ দেব কাঁচুমাচু মুখে বললেন, এ ঠিক দাবি দাওয়া নয় মা। আপনি আমার কন্যাসম। বলতে পারেন কন্যার নিকট পিতার আরজি।

বীণাবালা হাসলেন। বললেন, কন্যার নিকট কিন্তু পিতার আরজি হয় না ভুজঙ্গ বাবু। আদেশ হয়, অধিকার হয়।

ভুজঙ্গ দেব বিনয়ে গলে গিয়ে বললেন, হয়, হয়। কন্যা যখন কর্মে-গুণে পিতাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন হয়। তখন সে পিতার চেয়েও বড় হয়ে যায়।

বীণাবালা বললেন, সন্তান যত বড়ই হোক, সে পিতা মাতার সাথে আচার ব্যবহারে কখনো বড় হয় ভুজঙ্গ বাবু? হয় না। আর যদি হয়ই, তাহলে বুঝতে হবে সে সন্তান কুশিক্ষা পেয়েছে। সে অপরিণামদর্শী, অকৃতজ্ঞ। আমায় কি

অকৃতজ্ঞ সন্তান বলছেন?

ভুজঙ্গ দেব জিভ কেটে বললেন, কী যে বলছেন মা। তা কেন হবে? আপনার ন্যায় রূপে, গুনে-গুনান্বিতা সন্তান ক’জন হয়? আপনার ন্যায় বিনয়ী ভালো মানুষ…।

বীণাবালা হাত উঁচু করে ভুজঙ্গ দেবকে থামতে ইশারা করলেন। তারপর বললেন, আমি যে মানুষ ভালো নই, সে আমি জানি। আশা করি আপনারাও জানেন। না জানলে অতিসত্বর জানা দরকার। এবার কাজের কথা বলুন, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?

ভুজঙ্গ দেব খানিক আমতা আমতা করে বললেন, আপনি বোধ হয় জানেন, আপনাদের জমিদারির একখানা ছোটখাট মহাল রয়েছে বিনয়পুরের দিকে। ওই মহালখানা আমার খুব দরকার হয়ে পড়েছে মা। ওইদিকে আমার কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে। আমরা ব্যবসায়ী বংশের মানুষ। এই মগজে ব্যবসা বাদে আর কিছুই ঢোকে না। ওই করেই কোনোমতে বেঁচে-বর্তে রয়েছি। বিনয়পুরের দিকের ওই মহালখানা পেলে ওখানেই আমার ব্যবসাটা শুরু করতে পারতাম। তাছাড়া সমুদ্রের কাছাকাছি হওয়ায় সেখানে একখানা লবণ কারখানাও দিতে চাইছি। আপনার স্বর্গবাসী শ্বশুর জমিদার শ্রী বিষ্ণুনারায়ণকে অনেক অনুরোধও করেছিলাম। কিন্তু তিনি কখনো স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি। কখনো হা-ও বলেননি, আবার না-ও বলেননি। এখন আপনিই ভরসা মা জননী।

বীণাবালা খানিক চুপ করে থেকে বললেন, ওই মহালের কথা তো আমি জানতাম না ভুজঙ্গ বাবু! কে কিনেছিল ওই মহাল?

ভুজঙ্গ দেব বললেন, শ্রী যোগেন্দ্রনারায়ণ, উনি শেষ বয়সে এসে কী খেয়ালে ওই মহালখানা কিনেছিলেন। কিন্তু ওই কেনা অবধিই। আর কখনো ওখানে যাননি। প্রজাদের কাছ থেকে খাজনাও তোলেননি কখনো।

বীণাবালা বললেন, তো আপনি কি ইজারা চাচ্ছেন? নাকি কিনতে চাইছেন ও মহাল?

ভুজঙ্গ দেব বললেন, ইজারা না, আমি নিলে কিনেই নেব। তবে কিনা, ও অঞ্চলে ওই মহাল কিনে লাভ কী? নোনা মাটিতে ফসল নেই। কিছু কিছু ফসল হলেও, তাতে তেমন ফলনও হয় না। প্রজারা খাজনা দিতে পারে না। আমি ছাড়া তাই আর কেউ যোগ্য দামে ওই মহাল কিনতে চাইবে বলে তো মনে হয় না। আসলে কিনে করবেটা কী? প্রজা পুষবে? আমি কিনতে চাইছি, কারণ আমার তো আর মাটি দিয়ে কাজ না। আমার কাজ ওই লবণ নিয়েই। সাথে আর কিছু ব্যবসা-বাণিজ্যও যদি হয়।

বীণাবালা বললেন, তো আপনি ওখানে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করলে প্রজাদের কী হবে? তাদের কাউকে না কাউকে তো উচ্ছেদ করতে হবে। তাদের ফসলি জমিতে কল-কারখানা বসলে তারা খাবে কী? বসতবাড়ির জমিতে বসলে তারা তখন যাবে কই?

ভুজঙ্গ দেব বললেন, তাদের কারখানায় কাজের ব্যবস্থা করব। তাদের কোনো অসুবিধা হবে না।

বীণাবালা বললেন, হবে ভুজঙ্গ বাবু। অসুবিধা হবে। আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমায় আপনি আপনার কন্যাসম মনে করলেও আমি কিন্তু আপনার কন্যা নই। আমি দিঘাগড় জমিদার বাড়ির মেয়ে। দিঘাগড়ের জমিদার আমার পিতা। আমায় ভুলভাল বোঝানোর আগে সেটি মাথায় রাখা জরুরি ভুজঙ্গ বাবু।

ভুজঙ্গ দেব বীণাবালার এমন কথায় থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি খেয়াল করে দেখেছেন, আগের সেই বীণাবালা যেন আর নেই। দিন দিন চোখের সামনে বীণাবালা ক্রমশই অচেনা হয়ে যাচ্ছেন। একটা সময় বিষ্ণুপুরের জমিদারির পটপরিবর্তনের আকুতি নিয়ে বীণাবালা রোজ কতবারই না তার কাছে ছুটে যেত। কত বিনয় ছিল তার সেই সকল আকুতিজুড়ে। অথচ দিনে দিনে তিনি যেতেন সেইসব দিনের কথা দিব্যি ভুলে যাচ্ছেন! তিনি এখন বিষ্ণুপুর জমিদারির ক্ষমতা, বিত্ত, বৈভবের উৎস! সুতরাং পুরনো দিনের কথা আর মনে রাখার কী দরকার?

বীণাবালা বললেন, কী ভাবছেন ভুজঙ্গ বাবু? আমি অকৃতজ্ঞ? পুরনো কথা ভুলে গিয়েছি?

.

ভুজঙ্গ দেব এবার রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই মেয়েটিকে সে আজকাল ভয়ই পায়। তিনি বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, না না। কী যে বলেন! তা কেন? তা কেন?

বীণাবালা বললেন, আমি কিছুই ভুলিনি ভুজঙ্গ বাবু। আমার সকলই স্মরণে রয়েছে। তবে একখানা কথা কি জানেন, আমি যেমন ভালো মানুষ নই। আমি জানি আপনারাও ভালো মানুষ নন। এ সকলই স্বার্থের খেলা। এই জগতে স্বার্থের চেয়ে বড় কিছু নেই।

বীণাবালা এতক্ষণে বিভূতিনাথের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, কী বলেন বিভূতিবাবু? ভুল কিছু বললাম? এ জগতে স্বার্থের ঊর্ধ্বে কি কিছু রয়েছে? তা সে যুদ্ধ বলেন, ব্যবসা বলেন আর প্রেম ভালোবাসা বলেন।

বিভূতিনাথ সাহা মৃদু হাসলেন। বীণাবালাকে তিনি ছোটবেলা থেকেই চেনেন। বীণাবালাদের পরিবারের সাথে বিভূতিনাথ সাহার পরিবারের একটা যোগাযোগ ছিল বহু আগে থেকেই। সেই থেকেই তিনি বীণাবালাকে চেনেন। তাই ভুজঙ্গ দেব বীণাবালাকে আপনি সম্বোধন করলেও, বিভূতিনাথা সাহা বীণাবালাকে তুমি সম্বোধন করেন। যদিও ভুজঙ্গ দেবের চেয়ে বিভূতিনাথ সাহা বয়সে ঢের ছোট।

বিভূতিনাথ সাহা বললেন, বীণাবালা ঠিকই বলেছে ভুজঙ্গ বাবু। জগতে সকলই স্বার্থের খেলা। স্বার্থের অতীত কিছু নেই। আমরাও আমাদের নিজ নিজ স্বার্থের জন্যই এখানে এসেছি। স্বার্থ না থাকলে কেউ আসতাম না। আপনিও না, আমিও না। তবে হ্যাঁ, স্বার্থের রকম হয়তো আলাদা।

ভুজঙ্গ দেব কিছু বললেন না। তবে বীণাবালা বললেন, ওই যে বললাম, আমার মতোন আপনারাও ভালো মানুষ নন। তাই এটা আমার দায়িত্ব যে আপনাদের জানানো, আমায় কখনো ধোকা দেয়ার চেষ্টা করবেন না।

ক্রমশই নব নবরূপে আবিষ্কৃত হতে থাকা এই অন্য বীণাবালার দিকে তাকিয়ে রইলেন ভুজঙ্গ দেব। বীণাবালা বললেন, ওই মহাল সম্পর্কে আমি জানি না, এই কথা ঠিক না ভুজঙ্গ বাবু। আমি দেখলাম আপনি আসলে কতটুকু জানেন, আর কতটুকু আমায় বলেন।

ভুজঙ্গ দেব গলায় যথাসম্ভব বিনয় মাখিয়ে বললেন, আমি কি ভুল কিছু বলেছি?

বীণাবালা বললেন, ভুল আর মিছে এক জিনিস নয় ভুজঙ্গ বাবু। আপনারা আমার উপকার করছেন, বিপদে-আপদে আমার পাশে থাকছেন। আমারও দায়িত্ব আপনাদের প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া, আপনাদের স্বার্থ দেখা। এটা আমার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

ভুজঙ্গ দেব ঢোক গিলে বললেন, আপনি বুদ্ধিমতী। আপনার বিবেচনা তো আর ভুল হতে পারে না।

বীণাবালা বললেন, ওই মহালের খবর আমি সকলই জানি। আমার দাদাশ্বশুর জলের দরে কিনেছিলেন ওই মহাল। যখন কিনেছিলেন, তখন সকলেই ভেবেছিল পয়সাগুলো উনি গচ্চা দিলেন। কিন্তু আপনারা তো জানেনই, উনি অকারণে পয়সা নষ্ট করার মানুষ ছিলেন না। তার প্রমাণ মিলছে এতদিনে। রাইপুর আর বিনয়পুরজুড়ে হুহু করে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। বিদেশ-বিভুঁই থেকে লোকজন আসছে নানানরকম বাণিজ্য করতে। শুনেছি বিনয়পুরে জাহাজ কোম্পানিও আসবে। তখন ওই মহালের গুরুত্ব কেমন বেড়ে যাবে ভেবেছেন?

ভুজঙ্গ দেব মনে মনে দারুণ হোঁচট খেয়েছেন। বাইরের জগত থেকে এই বিরাট বিষ্ণুপুর জমিদারি বলতে গেলে একভাবে বিচ্ছিন্ন এক জায়গা। এর তিনধারজুড়েই বিশাল গঙ্গাবতী নদী। আবার এর উত্তর তল্লাটজুড়ে গহীন বারোহাটির জঙ্গল। ফলে এ অঞ্চলে সহসা যেমন বাইরের কোনো পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে না, তেমনি বাদবাকি জগতের খবরাখবরও তেমন আসে না। কিন্তু এখানে বসেও বিণাবালার মতোন এক রমণী এত খবর কী করে রাখে তা ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না ভুজঙ্গ দেব। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, এ সকল কথা সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, কিন্তু কই এখন অবধি তো কিছু হলো না। আর হবেও না। ওই বলা অবধিই সাড়!

বীণাবালা মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, এবার হবে। চলুন, অযথা কথা না বাড়িয়ে সরাসরি কাজের কথায় চলে যাই। ওই মহাল আপনার দরকার, সে কথা আমি জানি। ওই মহালখানি আপনি পেলে, আর বাকি সব যদি ঠিকঠাক থাকে, তাহলে বছর দশেকের মধ্যে আপনি হবেন বিনয়পুর, রাইপুরের সবচেয়ে। ধনাঢ্য ব্যক্তি। এ আমি নিশ্চিত। কারণ আপনি ব্যবসাটা বোঝেন। অথচ ওই মহাল আমাদের কোনো কাজেই লাগছে না। কারণ ওখানে যে ধরনের ব্যবসা করা দরকার, সেই রকম কিছু করার মতোন লোক আমাদের নেই। তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো, আপনার দরকার মহাল, আর আমাদের দরকার অভিজ্ঞ, দক্ষ মানুষ। সেই অভিজ্ঞ মানুষটি আপনি। এটি সমান সমানের কথা। কিন্তু এই যে এতদিন নানান বিপদে-আপদে আপনি আমার পাশে থেকেছেন, তার তো একটা বিনিময় আছে, আছে না? কিছু বলুন?

ভুজঙ্গ দেব কেবল মাথা নাড়লেন। কিন্তু মুখে কোনো জবাব দিলেন না। বীণাবালা নামের তার কন্যার বয়সী এই মেয়েটির কাছে তার নিজেকে এখন দুগ্ধপোষ্য শিশু মনে হচ্ছে। বীণাবালা আবার বললেন, সে জন্যই আপনার জন্য আমার একটি প্রস্তাব রয়েছে। প্রস্তাবটি হলো মহালখানি আমরা আপনার নিকট বিক্রি করছি না এবং বন্ধকও দিচ্ছি না। তবে আগামী পাঁচ বছর আপনি এই মহালখানি নিজের মতো করে ব্যবহার করবেন। আপনার যেমন খুশি তেমন। বিষ্ণুপুর থেকে এ বিষয়ে কেউ কখনো কিছু বলবে না। কোনো পয়সাও দাবি করবে না। তবে হ্যাঁ, প্রথম পাঁচ বছরের পর থেকে আপনার ব্যবসায় প্রতি মাসে যে লাভ হবে, তার একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রতি মাসে আমাদের দিতে হবে। সেটির পরিমান লাভের কতভাগ হবে তা আমরা পরে আলোচনা করে ঠিক করব।

ভুজঙ্গ দেবের খানিক সময় লাগল বিষয়টি বুঝতে। তিনি এখানে আসার আগে ভেবেছিলেন বীণাবালাকে ওই মহালের কথা বলার সাথে সাথে বীণাবালা হয়তো উপঢৌকন হিসেবেই তা ভূজঙ্গ দেবকে দিয়ে দিতে রাজি হয়ে যাবেন। অন্যথায় বিক্রি করতে রাজি হবেন। এটা-সেটা বুঝিয়ে অল্প কিছু দামে সেটি তিনি কিনে নিবেন। কিন্তু এখন তার মাথায় যেন কিছুই ঢুকছে না। তবে শেষ

অবধি তিনি এটিও বুঝতে পারলেন যে বীণাবালা তাকে যেই প্রস্তাবখানা। দিয়েছেন, সেই প্রস্তাব মেনে না নিয়ে আসলে তার উপায়ও নেই এবং এটিও সুস্পষ্ট যে বীণাবালা কোনোভাবেই ওই মহালের পরিপূর্ণ স্বত্ব ত্যাগ করতে রাজি নয়। ভেতরে ভেতরে ভুজঙ্গ দেব ভালোরকম অসন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু তার কিছুই তিনি প্রকাশ করলেন না।

ভুজঙ্গ দেব বীণাবালার প্রস্তাব গ্রহণ করে বের হতে যাবেন। এই মুহূর্তে বীণাবালা বললেন, ভুজঙ্গ বাবু, আমায় আর একখানা কাজ করে দিতে হবে যে?

ভুজঙ্গ দেব বললেন, কী কাজ?

বীণাবালা বললেন, আপনাকে ছোট ঠাকুরপো দীপেন্দ্র’র শ্বশুরালয়ে যেতে হবে। আমি শুনেছি ছোট ঠাকুরপো তার স্ত্রী আর সদ্যোজাত সন্তান নিয়ে শীঘ্রই বিষ্ণুপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবে। তার আসতে দীর্ঘসময় লাগবে আমি জানি। কিন্তু আমি চাই সে আরো কিছুদিন পরে বিষ্ণুপুরে আসুক। তার বিষ্ণুপুরযাত্রা বিলম্বিত করতে হবে। সে তার পিতার মৃত্যুর খবর পেয়েছে। কিন্তু বাদবাকি আর কোনো কিছু সম্পর্কেই সে জ্ঞাত নয়। আপনি যেকোনো উপায়ে তার শ্বশুরালয়ে উপস্থিত হয়ে তার যাত্রা বিলম্বিত করুন। তার গঙ্গামহল আগমনে আমি এখনো প্রস্তুত নই।

ভুজঙ্গ দেব কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও আর জিজ্ঞেস করলেন না। কেবল খানিক উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, তথাস্তু।

ভুজঙ্গ দেব চলে যেতেই বিভূতিনাথ সাহা বীণাবালার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। বীণাবালা বললেন, মেজো ঠাকুরপো খুব শীঘ্রই বারোহাটি থেকে গঙ্গামহলে ফিরবে। আমি চাই না, এই সময়ে ছোট ঠাকুরপোও তার শ্বশুরালয় থেকে গঙ্গামহলে ফিরে আসুক। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এই পরিস্থিতিতে দু’জনকে স্বভাবিক উপায়ে সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই আমি চাইছি ছোট ঠাকুরপো খানিক বিলম্বে আসুক।

বিভূতিনাথ সাহা গম্ভীর গলায় বললেন, হুম। এটি অবশ্য ঠিক। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণের বিষয়ে কী ভাবছ বীণাবালা?

বীণাবালা বললেন, আমি মেজো ঠাকুরপোকে কিছু ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলাম, আমার ধারণা ইঙ্গিতগুলো সে পেয়ে গেছে।

বিভূতিনাথ বললেন, কী ইঙ্গিত?

বীণাবালা বললেন, তাকে আমি স্পষ্ট একটি ধারণা দিতে চেয়েছিলাম যে বীণাবালা সহজ কোনো মানুষ নয়। যা হয়েছে, তা তাকে চুপচাপ মেনে নিতে হবে। তাছাড়া প্রকৃত অর্থেই বিষ্ণুপুর জমিদারির উত্তরাধিকারী তো তার জ্যেষ্ঠভ্রাতাই। সুতরাং তাকে এটা সহজ স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে হবে এবং এটিও তার বোঝা উচিত যে সে যদি সহজ স্বাভাবিক উপায়ে এটি মেনে না নেয়, তবে সেটির জন্যও বীণাবালা প্রস্তুত। এতদিনে বীণাবালার কর্মকাণ্ডে সে নিশ্চয়ই এটুকু বুঝতে পারছে যে সে কঠিন হলে বীণাবালার তরফে তার জবাবও হবে কঠিনতর। সে খামখেয়ালি, বদমেজাজী, এতদিনকার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার পুত্র হলেও নির্বোধ নয়। আশা করি এই এতদিনে ঘটা নানান ঘটনায় বীণাবালাকে সে স্পষ্টই অনুধাবন করতে পেরেছে।

বিভূতিনাথ গম্ভীর গলায় বললেন, হুম। কী মনে হয় তোমার? সে কবে আসবে?

বীণাবালা বললেন, বারোহাটি বাগান বাড়ির অবস্থা যার পর নাই সঙ্গিন। সেখানকার সাথে দীর্ঘদিন গঙ্গামহলের কোনো যোগাযোগ নেই। ফলে এখান থেকে আগে যে সব জিনিসপত্র, খাবার, খরচাপাতি নিয়মিত সেখানে যেত, সেসবও বন্ধ। শুনেছি তিন বেলা আহার জোটানোই দায় হয়ে পড়েছে সেখানে। আমার ধারণা ছিল গঙ্গামহলের সিংহদরজা খোলার খবর পেয়েই দেবেন্দ্রনারায়ণ তেড়েফুঁড়ে চলে আসবে। এসে হৈচৈ বাধাবে। সে তো এমনতিই উগ্র আর খামখেয়ালি স্বভাবের। কিন্তু ফটক খোলার এতদিন হয়ে গেলেও যে সে আসেনি, এই বিষয়টি নিয়ে আমি কিছুটা চিন্তিত।

বিভূতিনাথ বললেন, চিন্তার কিছু নেই বীণাবালা। সে আসবেই। তার স্ত্রী কন্যারা রয়েছে এখানে। আজ আসুক বা দু’দিন পরে আসুক। সে এখানে আসতে বাধ্য।

বীণাবালা বললেন, সে আসবে সেটি সুনিশ্চিত। কারণ তার স্ত্রী রেণুকা সন্তানসম্ভবা। চিন্তার বিষয় সেটি নয়। চিন্তার বিষয় সে আসতে দেরি করছে। কেন? তার সম্পর্কে আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে সে। সে যেমন মানুষ, তাতে এখানকার সকল খবর শুনে তার আর একমুহূর্তও দেরি করার কথা নয়।

বিভূতিনাথ এবার মাথা নাড়লেন। বললেন, হুম। বিষয়টি আসলেই চিন্তার। তবে আমার মনে হয় না, তার দিক থেকে আপাতত কোনো বিড়ম্বনা তৈরি হবে।

বীণাবালা সঙ্গে সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। সময় নিয়ে কী যেন ভাবলেন। তারপর মাথা তুলে বললেন, কিন্তু আমাদের নতুন জমিদার কর্তার কী হবে? তিনি তো এখনও ভাবছেন যে তার অতি আস্থাভাজন দিগ্বিজয়ী মেজো ভ্রাতা দেবেন্দ্রনারায়ণ ফিরলেই তিনি তার হাতে জমিদারির ভার তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে গান-বাজনা সাহিত্য রচনা করবেন!

বিভূতিনাথ শান্ত গলায় বললেন, এই অবনীন্দ্রনারায়ণকে নিয়ে তো দেখছি ভারি যন্ত্রণা। এ তো শিশুর চেয়েও অবুঝ। কী করবে একে নিয়ে?

বীণাবালা হাসলেন। বললেন, এত বছর যেহেতু সামলাতে পেরেছি, বাদবাকিও পারব। ওটা আমার উপরই থাকুক। আপনি বরং গুরুতর একখানা ঝামেলা সামাল দিন। এর চেয়েও গুরুতর বিড়ম্বনা কিন্তু এখনও রয়েই গেছে!

বিভূতিনাথ বিস্মিত গলায় বললেন, কী?

বীণাবালা শান্ত, শীতল গলায় বললেন, হেমাঙ্গিনী দেবী।

বিভূতিনাথ চমকে উঠলেন, তাই তো! হেমাঙ্গিনী দেবীর কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। বিভূতিনাথ বললেন, কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী কই? সে কি বেঁচে আছে? থাকলে কই সে? রাইপুরে তার বাড়িতে?

বীণাবালা বললেন, নাহ্, সে রাইপুরে নেই। আমি খোঁজ পাঠিয়েছিলাম।

বিভূতিনাথ বললেন, তাহলে?

বীণাবালা বললেন, তাহলে সে কোথায় আছে সেটি খুঁজে বের করতে হবে। যদি বেঁচে না থাকে সেটিও নিশ্চিত হতে হবে। আর বেঁচে থাকলে খুঁজে বের করে চিরতরে তার মুখ বন্ধ করে দিতে হবে এবং সেটি করতে হবে দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে তার আবার কোনোভাবে দেখা হবার আগেই। যত দ্রুতসম্ভব। আর তাকে খুঁজতে হলে সবার আগে উত্তর তল্লাটে বারোহাটির জঙ্গলের দিকে বা তার আশেপাশে খুঁজুন। জঙ্গলের ভেতরেও খুঁজে দেখতে পারেন। সেদিন বারোহাটির বাগান বাড়ি থেকে ওই অতরাতে পালিয়ে গিয়ে থাকলে জঙ্গলের ভেতর পথ হারিয়েও ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে মরে গিয়ে থাকলে তার একটা নিশ্চয়তাও চাই আমার। কোনো চিহ্ন নিশ্চয়ই থাকবে। তাই জঙ্গলে কিংবা ওদিককার প্রজাদের বাড়িতে বাড়িতে লোক পাঠান। আমি চাই, যেকোনো উপায়ে তার মুখ চিরতরে বন্ধ হোক।

বিভূতিনাথ বিস্মিত গলায় বললেন, খুন?

বীণাবালা নির্বিকার গলায় বললেন, এছাড়া যদি চিরতরে মুখ বন্ধ করবার আর কোনো উপায় জানা থাকে, তাহলে তা-ই করুন।

বীণাবালা আর কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বিভূতিনাথ ভীত চোখে বীণাবালার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না, তার চোখের সামনে এ তিনি কাকে দেখছেন! কোন বীণাবালাকে!

*

রতনকান্তি বসে আছে অবনীন্দ্রনারায়ণের অট্টালিকার ছাদে।

তার সামনে এতক্ষণ বসে ছিলেন অবনীন্দ্রনারায়ণ। তিনি খানিক আগে নিচে গেছেন। গতকাল রাতে কী একখানা গান মাথায় এসেছিলো, সেই গান তিনি খাতায় লিখে রেখেছিলেন। খাতাখানা তিনি খুব যত্নে লুকিয়ে রাখেন। কাউকে ধরতে অবধি দেন না। তাই নিচ থেকে খাতাখানা আনতে তিনি নিজেই। গিয়েছেন।

অবনীন্দ্রনারায়ণের সাথে রতনকান্তির ভারি ভাব হয়ে গেছে। রতনকান্তির সাথে কথা বলবার সময় অবনীন্দ্রনারায়ণ যেন ভুলেই যান যে তিনি বিষ্ণুপুরের জমিদার। অবশ্য এটি তিনি মনে রাখতেও চান না। আজ থেকে ঠিক এক সপ্তাহ আগে অবনীন্দ্রনারায়ণের সাথে গঙ্গামহলে ঢুকেই হইচইয়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল রতনকান্তি। আর কোনো এক ফাঁকে চট করে কেটেও পড়েছিল সে।

তারপর সোজা দেবেন্দ্রনারায়ণের অট্টালিকার নিচতলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বড় সুনসান চারদিক। সে বারকয়েক শব্দ করে কেশে গলা পরিষ্কার করল। কিন্তু কোথাও থেকে কারো কোনো সাড়াশব্দ এলো না। দীর্ঘসময়। দাঁড়িয়ে থেকে শেষে সকল দ্বিধা, শঙ্কা কাটিয়ে রতনকান্তি উঠে গিয়েছিল উপরতলার সিঁড়ি বেয়ে। কিন্তু লম্বা বারান্দাজুড়েও তখন সুনসান নিরবতা। কোথাও যেন কেউ নেই। ভৃত্য খগেনের সাথে দেখা হলো আরো খানিক বাদে। কোনো কাজ শেষে সে ছাদ থেকে নেমে আসছিল। খগেনই রেণুকার কাছে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। কিন্তু সেদিন রেণুকার সাথে খুব একটা কথা হয়নি রতনকান্তি র। রেণুকার চোখ-মুখজুড়ে রাজ্যের শঙ্কা আর দ্বিধা। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণ ভালো আছেন, সুস্থ আছেন জেনে সেই শঙ্কা যেন কিছু কাটল। কিন্তু রতনকান্তি কে নিয়ে রেণুকার দ্বিধারা যেন কাটছিল না। রেণুকা জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোনো চিঠিপত্র পাঠিয়েছেন তিনি?

রতনকান্তি বলেছিল, আজ্ঞে না। একবার ভেবেছিলেন যে পাঠাবেন কিন্তু পরে আবার ভাবলেন শেষ অবধি আমি যদি ঢুকতে না পারি? আর সেই চিঠি যদি ফটকেই কারো হাতে পড়ে যায়!

রতনকান্তির যুক্তি গ্রহণযোগ্য। একটা আশঙ্কা ছিলই। কিন্তু তারপরও রেণুকা যেন পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। তবে রতনকান্তিকে তিনি এইটুকু জানালেন যে রতনকান্তি আর আগের মতো সুদক্ষিণাকে পড়াতে আসতে পারবে না। বীণাবালা ঠিকই জেনে যাবেন। তখন নতুন সমস্যা তৈরি হবে। এমনিতেই এই মহল থেকে বহু দাসী, ভৃত্যকে ইতোমধ্যে সরিয়ে নিয়েছেন বীণাবালা।

এইটুকু শুনেই গঙ্গামহলের পরিস্থিতি রতনকান্তি খানিকটা আঁচ করতে পেরেছিল। তার কেবলি মনে হচ্ছিল এই গঙ্গামহলের দেয়ালের প্রতিটি ইটও যেন উৎকর্ণ হয়ে সদা সতর্ক প্রহরীর মতোন তাকিয়ে আছে। রতনকান্তি লক্ষ করল, রেণুকার মহলে ভৃত্য খগেন আর বয়স্কা দাসী অতসীবালা ছাড়া আর কোনো ভৃত্য বা দাসীই নেই। এর আগে সে যতবারই এই মহলে এসেছে, ততবারই দেখেছে গঙ্গামহলের সবচেয়ে আলো ঝলমলে মহল এটি। ভৃত্য, দাস-দাসীদের পদচারণায় সবসময় সরব, রমরমা হয়ে ছিল মহলটি। অথচ সেই মহলটিই যেন এখন সবচেয়ে নীরব, নির্জন। সেদিন সুদক্ষিণা বা সর্বজয়ার সাথে আর দেখা হলো না রতনকান্তির। কিন্তু রতনকান্তি বুঝতে পারছিল, গঙ্গামহলের অন্দরমহলের অবস্থা জানতে হলে তাকে যেকোনো উপায়ে এখানেই কিছুদিন থাকতেই হবে। কিন্তু উপায় কী? উপায় একটিই। একমাত্র অবনীন্দ্রনারায়ণের মাধ্যমেই সেটি সম্ভব।

রতনকান্তির ভাগ্য সুপ্রসন্ন। সে রেণুকার মহল থেকে বের হতেই দেখল অবনীন্দ্রনারায়ণ তার মহলের নিচে পায়চারি করছেন। তাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছিল। কিন্তু রতনকান্তি বুঝতে পারছিল না সে নিজ থেকে অবনীন্দ্রনারায়ণের কাছে যাবে কিনা! তাকে অবশ্য যেতে হলো না, অবনীন্দ্রনারায়ণই তাকে ডাকলেন। ডেকে বললেন, কি হে রতনকান্তি? একদম দুম করে হাওয়ায় মিশে গেলে?

রতনকান্তি কাঁচুমাচু মুখে তাকিয়ে রইল, জবাব দিলো না। অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, তা এখন গন্তব্য কোথায়?

রতনকান্তি বলল, আজ্ঞে বিরামপুর। আমি ওইখানেই থাকি, কর্তা।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, এখন এই আগুন রোদে অতটা পথ হেঁটে যাবে? আবার কাল আসবে?

রতনকান্তি ম্লান মুখে বলল, কাল থেকে আর আসতে হবে না, জমিদার কর্তা।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, কেন? সুলক্ষণা, সর্বজয়াদের গানের তালিম দেবে না?

রতনকান্তি মুখ নিচু করে বলল, কর্তা মা বললেন, ওরা আর গান শিখবে না।

অবনীন্দ্রনারায়ণ হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, তুমি বোধ হয় আমার মতোই, জমিদারদের নিয়ম-কানুন কিছুই বোঝে না, কিছুই জানো না। হা হা হা। জমিদার বাড়ির নিয়ম-শৃঙ্খলা আলাদা হে। এ বাড়ির মেয়েদের গান বাজনা শেখা নিষেধ। গান-বাজনার মতোন সস্তা বিষয় এদের মানায় না? বুঝেছ হে রতনকান্তি? আর রেণুকারও বোধ হয় ওসব পছন্দ নয়।

অবনীন্দ্রনারায়ণ খানিক থামলেন। তারপর হাসিহাসি মুখে খানিক গম্ভীরতা এনে বললেন, তবে দেবু ফিরলেই দেখবে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। সে নৃত্যগীতের ভীষণ ভক্ত। সে আসামাত্র দেখবে গঙ্গামহলের সবকিছুই পাল্টে যাবে। আর আমিও এইসব জমিদারি তার হাতে তুলে দিয়ে বিবাগী হবো। তখন দেখবে ওই মহলে থেকে আবার তোমার ডাক পড়বে।

অবনীন্দ্রনারায়ণের এই কথাটুকু রতনকান্তিকে ভারি অবাক করল! অবনীন্দ্রনারায়ণ তাহলে অন্দরমহলের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানেন না। তাকে হয়তো এই বলে বোঝানো হয়েছে যে দেবেন্দ্রনারায়ণ ফিরলেই তার মুক্তি! রতনকান্তি বলল, আজ্ঞে কর্তা।

রতনকান্তিকে আর কিছু বললেন না অবনীন্দ্রনারায়ণ। সে ফিরে যাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে পেছন থেকে আবার ডাকলেন অবনীন্দ্রনারায়ণ। তারপর বললেন, এক কাজ করলে কেমন হয় হে রতনকান্তি? এখন থেকে রোজ তুমি আমায় একটু-আধটু তালিম দিলে? কী বলে?

রতনকান্তি এটিরই অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু সে বিনয়ের সাথে বলল, আজ্ঞে কর্তা। আপনাকে তালিম দেয়ার মতোন যোগ্য আমি নই।

অবনীন্দ্রনারায়ণ শক্ত গলায় বললেন, আমি কোনো হাতি-ঘোড়া নই রতনকান্তি। তুমি এখন থেকে আমায় রোজ তালিম দেবে। আমি বীণাবালাকে বলে নেব…।

এই শেষের অংশটুকু বলেই অবনীন্দ্রনারায়ণ যেন খানিক লজ্জা পেলেন। তিনি বিব্রত গলায় বললেন, না মানে, তার আবার বাদ্যি-বাজনার শব্দে খুব মাথা ধরে কিনা, তাই। আর দেখি, তোমার একখানা থাকার ব্যবস্থাও করছি এইখানে। অতদূর থেকে রোজ রোজ আর কষ্ট করে আসতে হবে না।

সেই থেকে রতনকান্তি গঙ্গামহলেই। অবনীন্দ্রনারায়ণ বীণাবালার কাছে বলেছিলেন যে সেদিন গঙ্গাবতীর তীরে এক ছেলের সাথে তার দেখা। দরিদ্র ছেলেটি পথেপথে ঘুরে গান-বাজনা করে পেট চালায়। ছেলেটাকে তার ভারি পছন্দ হয়েছে। গান-বাজনায়ও ভীষণ ভালো। সে চায় ছেলেটি রোজ খানিকটা করে তাকে গান-বাজনা শেখাক। অবনীন্দ্রনারায়ণ রতনকান্তি সম্পর্কে এই সবকিছু বললেও সে যে সর্বজয়া সুদক্ষিণাদের গান শেখাত, সেটি কৌশলে এড়িয়ে গেল। কারণ তিনি জানেন দেবেন্দ্রনারায়ণ-সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে বীণাবালার প্রবল অসহিষ্ণুতা রয়েছে।

সব শুনে বীণাবালাও আপত্তি করেননি। তিনি ভেবেছিলেন তাহলে হয়তো অবনীন্দ্রনারায়ণকে খুশি মনেই কিছুদিন মহলে আটকে রাখা যাবে। আজকাল তিনি যেভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন, তাতে কবে না কবে আবার সকলের। অগোচরে গঙ্গামহল ছেড়ে বের হয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন! সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে হুটহাট পথে প্রান্তরে বেরিয়ে পড়ার এই ইচ্ছেটা হয়তো কিছুদিনের জন্য হলেও ভুলে থাকবেন অবনীন্দ্রনারায়ণ।

.

অবনীন্দ্রনারায়ণ নিচ থেকে খাতাখানা নিয়ে এলেন। আজকাল তিনি আর রতনকান্তির সামনে কিছু পড়তে বা গান গাইতে সঙ্কোচ বোধ করেন না। তিনি খাতাখানা খুলে নিচুস্বরে গাইতে লাগলেন–

মরিবার তরে বাঁচিয়া রয়েছি, বাঁচিবার তরে নহে,
জনম গিয়েছে ভোগে আর ভাগে, কিছুই পড়ে না রহে।
মোহ মায়াজালে জীবন কাটিছে, ভ্রম রয় আঁখিপাতে,
কাল অমানিশা দিবস কাড়িছে, আলো নেই নব প্রাতে:।
বেঁচে থাকা এই জীবনে মৃত্যু, অহর্নিশিতে দহে,
মরিবার তরে বাঁচিয়া রয়েছি, বাঁচিবার তরে নহে।

রতনকান্তি মুগ্ধ চোখে অবনীন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে রইল। কথাগুলো কী সহজ, গভীর আর সুন্দর, মরিবার তরে বাঁচিয়া রয়েছি, বাঁচিবার তরে নহে, জনম গিয়েছে ভোগে আর ভাগে, কিছুই পড়ে না রহে। এই মানুষটিকে সে যতই দেখছে ততই তার মুগ্ধতা সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আসলেই তো, এই যে একটা গোটা জীবন, তার পুরোটাই তো ভোগ আর ভাগের হিসেব করতে করতেই কেটে যায়। অথচ তার সকল কিছুই মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ। কিন্তু যে সকল কিছুতে মানুষ মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে পারে, সে সকল নিয়ে কজনই বা ভাবে? আহা, আসলেই তো, আমরা কেবল মরিবার তরেই বাঁচিয়া রয়েছি, বাঁচিবার তরে নহে। আমরা এই ভোগ আর ভাগের জগতে কেবল জৈবিকভাবেই বেঁচে থাকি, অথচ এই ভোগ আর ভাগজুড়ে কেবলই মৃত্যু। কেবলই বিনাশ। জৈবিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সকল কিছুর শেষ, সকল কিছুর সমাপ্তি।

.

রতনকান্তির বুকের ভেতরটা আর্দ্র হয়ে ওঠে। সেও অবনীন্দ্রনারায়ণের সাথে গুনগুন করে সুর তুলতে থাকে, বেঁচে থাকা এই জীবনে মৃত্যু, অহর্নিশিতে দহে, মরিবার তরে বাঁচিয়া রয়েছি, বাঁচিবার তরে নহে। রতনকান্তি তার জীর্ণ বেহালাখানায় বুকের সকল মমতা-আবেগ, অনুভূতির সুর তুলতে থাকে। সেই সুরে ডুবে যেতে যেতে সে দেখে অবনীন্দ্রনারায়ণ কাঁদছেন। অবনীন্দ্রনারায়ণের চোখ মুদ্রিত, তিনি সুগভীর প্রার্থনার ভঙ্গিতে যেন জগতের সকল নিমগ্নতা ঢেলে দিয়ে গান গাইছেন। তার নিজের লেখা গান। তার নিজের ভাবনার, অনুভূতির কথার গান। আর তার সেই কথারা, ভাবনারা যেন জলের স্রোত হয়ে তার চোখ বেয়ে নেমে আসছে।

.

পরদিন সন্ধ্যায় রতনকান্তির সাথে হঠাৎ সর্বজয়ার দেখা হয়ে গেল।

সর্বজয়া ব্যস্তভঙ্গিতে অবনীন্দ্রনারায়ণের মহলে ঢুকছিল। রতনকান্তিও সেসময় বের হচ্ছিল। একদম মুখোমুখি দেখা। কিন্তু সন্ধ্যার অল্প আলোর কারণে হোক কিংবা কোনো বিষয় নিয়ে সর্বজয়ার প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়ে থাকার কারণে হোক, সে রতকান্তিকে ঠিক চিনে উঠতে পারল না। রতনকান্তির পোশাক আশাকও তথৈবচ। সর্বজয়া কোনো বিষয় নিয়ে উত্তেজিত। সে রতনকান্তির দিকে ভালো করে তাকালও না। কঠিন গলায় হড়বড় করে বলল, এই কী নাম তোর? ডাক, তোদের রাণীমাতাকে ডাক। ডেকে বল যে সর্বজয়া কথা বলবে! কি? পেয়েছে টা কী সে?

রতনকান্তি কিছুই বুঝতে পারল না। সর্বজয়া তার সাথে এমন করছে কেন? সর্বজয়া আবার বলল, কি কানে যাচ্ছে না? দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? ডাক? রাণীমাতাকে ডাক। কিছু না বলতে বলতে, খুব বাড় বেড়েছে। কী করবে? কী করবে শুনি?

রতনকান্তি এবার বুঝল। সর্বজয়া কোনো কারণে বীণাবালার উপর ক্রুদ্ধ হয়ে ছুটে এসেছে। এমনিতেই সে বেপরোয়া, ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের। তার উপর দিনের পর দিন বীণাবালার নানান কর্মকাণ্ডে সে চূড়ান্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতে হিতে-বিপরীতও হতে পারে। রতনকান্তি বলল, একটু শুনবেন?

ততক্ষণে ভৃত্য ব্রজগোপাল আর মুকুন্দ বেরিয়ে এসেছে। অবাক সর্বজয়া এবার ঘাড় ঘুরিয়ে ভালো করে তাকাল রতনকান্তির দিকে। রতনকান্তিকে দেখে প্রথমে সে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। খানিক বিব্রত এবং লজ্জার আভাও দেখা গেল তার মুখে। কিন্তু সাথে সাথেই আবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করল সে, ও, এই তাহলে স্বভাব আপনার, হ্যাঁ? আমি আগেই জানতাম যে আপনি একটা সুযোগসন্ধানী। এখন এখানে সুযোগ পেয়েছেন, ঠিকঠিক এসে ঘাটি গেঁড়েছেন না? চমৎকার!

তারপর সে সঙ্গে সঙ্গেই মুখ ঘুড়িয়ে তাকালো ভৃত্যদের দিকে, গলার স্বর যতটা সম্ভব চড়িয়ে নিয়ে বলল, ডাক, তোদের রাণীমাতাকে ডাক। উনি মহারাণী হয়েছেন হ্যাঁ? কী ভেবেছেন? যা ইচ্ছে তাই করে চলবেন?

ব্রজগোপাল মিনমিনে স্বরে বলল, বড় মা মহলে নেই দিদি। তিনি বেরিয়েছেন। তুমি এমন করে কথা কইছ শুনলে বড় মা বড্ড কষ্ট পাবেন।

সর্বজয়ার আগুনে যেন ঘৃতাহুতি হলো। সে চেঁচিয়ে বলল, খুব কষ্ট পাবেন? তোদের রাণীমাতা খুব কষ্ট পাবেন? আহা! তার কষ্ট নিয়ে খুব মায়া হয়, না? একবার দেখতে গিয়েছিস ওখানে কী অবস্থা? সে তো এখন জমিদার। তার জমিদারি আমি দেখে নেব’খন। সে আমায় চেনে না।

মুকুন্দ এবার নিচু গলায় বলল, কী হয়েছে আমাদের বলো। বড় মা আসলে আমরা তাকে বলব।

সর্বজয়া তাতে দমল না। সে আরো উত্তপ্ত গলায় বলল, ও, এখন তার সাথে তোদের মারফত কথা বলতে হবে না? মহারাণীর সাথে সরাসরি কথা বলা যাবে না, তাই না?

সর্বজয়ার এই অগ্নিমূর্তি গঙ্গামহলের সকলেই চেনে। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে। সে এমনই বেপরোয়া, একরোখা। কাউকে হিসেব করে কথা বলে না। মান্যগণ্য করে না। যা একটু মানে তা তার বাবা দেবেন্দ্রনারায়ণকেই। কিন্তু তাও কেবল সামনাসামনি। অগোচরে, আড়ালে-আবডালে সে

দেবেন্দ্রনারায়ণকেও ধুয়ে দেয়। তার মা রেণুকা এই নিয়ে সবসময় ভীত থাকেন। নানান উপায়ে মেয়ের এই মেজাজ তিনি দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছ থেকে আড়াল করে রাখতেন।

ব্রজগোপাল আর মুকুন্দ, কেউ কোনো কথা বলল না। তবে বীণাবালার পুত্র দ্বিজেন্দ্র বেরিয়ে এলো। সে ঘুমিয়েছিল। সর্বজয়ার চেঁচামেচি শুনে তার নিদ্রা ভেঙেছে। সে দোতলার বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, কী হয়েছে রে সর্বজয়া?

সর্বজয়া যেন আরো ঝেঝে উঠল। সে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, কী হয়েছে রে সর্বজয়া! ন্যাকা সেজেছ না? যেন কিছুই জানো না। ঘরভর্তি লোকজন এনে রেখেছ। আর দেখেছ গিয়ে ওই মহলের অবস্থা? এক অতসীবালা ছাড়া আর কেউ আছে? মা যে অসুস্থ সে কথা তোমরা জানো না? এত কাজ কে করবে? আমার মা? নাকি আমরা দু’বোন?

দ্বিজেন্দ্র শান্ত গলায় বলল, এ নিয়ে এত হইচইয়ের কী আছে? ভালোভাবে বললেই তো হলো?

সর্বজয়া ক্ষ্যাপা গলায় বলল, ও, আচ্ছা। দাস-দাসীর জন্যও এই রাজপ্রাসাদে এসে মহারাণী আর রাণীপুত্রের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে, না? বাহ্, বেশ তো। আজ্ঞে রাজপুত্র, দয়া করে তপতী আর ভাণুমতিকে পাঠিয়ে দিবেন।

সর্বজয়ার চিৎকার চেঁচামেচিতে গঙ্গামহলের আর সকল মহল থেকেই লোকজন উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে তাকাচ্ছে। নায়েব গোপীনাথ সরকারের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না বেশ কিছুদিন ধরেই। দীর্ঘ বিরতির পর আজ ক’দিন হয় তিনি আবার গঙ্গামহলে আসছেন। গোপীনাথ সরকারও বিষ্ণুনারায়ণের মহলের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। দাস-দাসীরা লুকিয়ে-চুরিয়ে সর্বজয়ার অগ্নিমূর্তি দেখছে। দ্বিজেন্দ্রকে যে সে পাত্তাই দিলো না, এটিও তারা খুব উপভোগ করছে। উপরের বারান্দায় দাঁড়ানো দ্বিজেন্দ্র সকলের সামনে ভারি অপমানিত বোধ করল। সে জানে সর্বজয়ার সাথে সে কথায় পারবে না। বয়সে ছোট হলেও সর্বজয়া শরীরে লকলক করে বেড়ে উঠেছে। কথাবার্তায়ও বেপরোয়া। আর এই। বারো-তেরো বছর বয়সেই তাকে দেখতে মনে হয় কৈশোর পেরিয়ে প্রায় যুবতী হয়ে ওঠা এক মেয়ে। কিছুদিনের মধ্যেই পরিপূর্ণ যুবতী হয়ে ওঠার আভাস তার শরীরজুড়ে।

দ্বিজেন্দ্র কোনো কথা বলছে না দেখে সর্বজয়া আবার তোপ দাগল, কি রাণীপুত্র? কথা বলছেন না কেন? নাকি আপনার সাথে কথা বলতেও মহারাণীর মতোন দাস-দাসীর মাধ্যমে বলতে হবে?

দ্বিজেন্দ্র এবার খেপল, তোর অনেক বাড় বেড়েছে সর্বজয়া। এত বাড় ভালো নয়…।

দ্বিজেন্দ্র আরো কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু সর্বজয়া তাকে সে সুযোগ দিলো না। সে চেঁচিয়ে বলল, তা এখন কী করবে? পাইক-পেয়াদা লাগিয়ে মহল থেকে বের করে দেবে?

দ্বিজেন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর শীতল গলায় বলল, এখন। এখনই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ। তুই কিন্তু আমায় রাগিয়ে দিচ্ছিস।

সর্বজয়া গলা উঁচিয়ে বলল, ও, রাণীপুত্র রেগে গেলে জগতসংসার ভস্ম হয়ে যাবে, না? লঙ্কার হনুমান নাকি? কী করবে রাগিয়ে দিলে? আগুন জ্বালিয়ে দেবে? বলল কি করবে? খুন করবে? বাড়ি থেকে বের করে দেবে? কী পারবে সে বড় জানা আছে!

দ্বিজেন্দ্র আগের চেয়েও শীতল গলায় বলল, তোর কথা শুনে তো মনে হচ্ছে না, অত অল্পতে তোর হবে। তুই সকল সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিস। আমায় তুই চিনিস না। আমার মাকে চিনতেই তোদের পিণ্ডি উদ্ধার হয়ে গেছে। আমায় চিনতে গেলে থই পাবি না।

সর্বজয়া হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে হাততালি দিয়ে উঠল। তারপর বলল, বাহ্! এই তো রাণীপুত্রের মতোন কথা। মাতা কা পুত্র, হা?

দ্বিজেন্দ্র এবার সামান্য উত্তেজিত গলায় বলল, তোর বাবার মতো নয়। অন্যের জিনিসের প্রতি লালাভেজা দৃষ্টি। এতদিন বহু সহ্য করেছি। ওই গোঁয়ার গোবিন্দের কারণে ঢের অপমান সয়েছি। আমার মা-ও সয়েছে। সব হিসেব করা রয়েছে। যেন এ বাড়ির কর্তা উনি আর কত্রী তার স্ত্রী। সকল ক্ষমতা ওই মাঝমহলের আঁ? কে সে? কাকের গায়ে খুব ময়ূরপূচ্ছ!

সর্বজয়া আবারও চেঁচালো, খবরদার! খবরদার! আমার বাবাকে নিয়ে কথা বলবে না। তোমার মতোন ছুঁচো, তোমার মায়ের মতোন নোংরা গন্ধওয়ালা ইঁদুর আমার মা-বাবাকে নিয়ে কথা বলবে না। তোমরা আগে ইচ্ছে করে সব ভুল দেখতে আর এখন পুরো অন্ধ হয়ে গেছ। তা রাণীপুত্র, আমরা কি আজই ঘটিবাটি নিয়ে বের হবো? নাকি আরো কিছু সময় আছে? দয়া করে পাইক পেয়াদা পাঠানোর আগে গোছগাছ করার একটু সুযোগ দেবেন?

দ্বিজেন্দ্র কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সর্বজয়া আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকারে ধমকে উঠল, চুপ! একদম চুপ! অনেক দেখিয়েছ তোমরা, অনেক। আমার মরতে যাওয়া বাবাকে অবধি দেখতে যেতে দাওনি। কিন্তু ভুলে যেও না রাণীপুত্র, সময় সবসময় এক থাকে না। কথাটা ঠিক ঠিক মনে রেখো।

সর্বজয়া আর দাঁড়াল না। সে ঘুরে হাঁটা শুরু করল। রতনকান্তি সর্বজয়াকে অল্পবিস্তর জানে। তার কথাবার্তা শুনে তাকে খানিক বোঝারও চেষ্টা করেছে। কিন্তু আজ যেন সে সব কিছুই ভুল মনে হলো তার। এই সর্বজয়াকে সে চেনে না। এ যেন জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ। রতনকান্তি একবার ভাবল সে সর্বজয়ার পেছন পেছন যাবে। তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো চারপাশের এই এতগুলো মানুষ তাকিয়ে আছে। এখন এটি করা নির্ঘাত চূড়ান্ত বোকামি। সে চুপিচুপি তার ঘরের দিকে পা বাড়াল।

.

পরদিন খুব ভোরে রতনকান্তি আবার দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলে গেল। তখনও কেউ জেগে উঠেনি। সে গিয়ে খগেনকে ডেকে উঠাল। খগেন রতনকান্তিকে কিছু তথ্য দিলো। সে জানাল যে মহলে দাসী হিসেবে একমাত্র অতসীবালা রয়েছে। এদিকে রেণুকা সন্তানসম্ভবা। তার শরীর বেশ কদিন ধরেই খারাপ যাচ্ছিল। অতসীবালা হঠাৎ জ্বরে-আক্রান্ত হওয়ায় ওই শরীর নিয়েই ঘরের কাজ করতে হচ্ছিল রেণুকার। এই কাজ করতে গিয়েই পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল সে। খুব মারাত্মক কিছু না হলেও সর্বজয়া বিষয়টি আর নিতে পারেনি। তাই কাল অমন ক্রোধন্মত্ত হয়ে ছুটে গিয়েছিল।

রতনকান্তি এবার সত্যি সত্যি চিন্তিত হয়ে উঠল। দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে পথ থেকে তুলে এনেছেন বলেই কিনা কে জানে, এই পরিবারটির প্রতি সে এক ধরনের মমতা বোধ করে। সে নিজে এইটুকু জীবনজুড়ে নানান জায়গা ঘুরেছে। নানান মানুষের সাথে মিশেছে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক এইসব অভিজ্ঞতা। জগতে অভিজ্ঞতা এবং জানার কোনো শেষ নেই। পথে ঘুরতে ঘুরতেই এক বাউলগুরুর সাথে পরিচয়। সেই বাউলগুরু কাছ থেকেই তার গান বাজনা শেখা। বেশিদিন কোথাও ভালো লাগত না বলে চলে এসেছিল সে। হয়তো এই এখানেও বেশিদিন থাকবে না। এইটুকু জীবনে সংসারধর্মে বা অন্য কোথা আটকে স্থির হয়ে থাকার মানে খুঁজে পায় না রতনকান্তি। থাকেনি। আর তাই এই বয়সেই জীবনের বিচিত্রসব অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার কারণেই হোক, আর যে কারণেই হোক, এই পরিবারটির প্রতি যে অনুভূতি, সে অনুভূতি সে উপেক্ষা করতে পারে না।

রেণুকা’র জন্য খুব চিন্তা হতে লাগল রতনকান্তির। এই অবস্থায় সামান্য আঘাতও অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু কী করবে সে? এই বাড়িতে কোনো বদ্যি কবিরাজ ডেকে আনার ক্ষমতা তার নেই। ঝট করে একটা কথা তার মাথায় এলো। সর্বজয়া যদি বিষয়টি অবনীন্দ্রনারায়ণের কাছে খুলে বলে, তাহলে সে হয়তো একটা ব্যবস্থা করতে পারবে। তবে গতকাল সন্ধ্যায় সে যা করেছে তাতে বীণাবালা কতটা কী করবেন, সেটি নিয়ে রতনকান্তি সন্দিহান। রতনকান্তি খগেনকে বলল, সে সর্বজয়ার সাথে দেখা করতে চায়। খগেন ভেতরে চলে গেল। রতনকান্তি নিশ্চিত সর্বজয়া কখনোই তার সাথে দেখা করতে আসবে না। এলোও না। এলো সুদক্ষিণা। সে রতনকান্তির সাথে অনেকক্ষণ কথা বলল। সেই সকল কথাজুড়ে দু’টি মাত্র বিষয় ছিল। রতনকান্তি কেন আর তাকে গান শেখাতে আসে না? সে আগের শেখানো গানগুলো রোজ রোজ রেওয়াজ করে। রতনকান্তি আবার কবে থেকে গান শেখাতে আসবে?

আর দ্বিতীয়টি হলো তার বাবা আসছে না কেন? বাবা কবে আসবে?

রতনকান্তি যতটা পারল দুটি বিষয়েই সুদক্ষিণাকে আশ্বাস দিলো। সুদক্ষিণা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। এই মুহূর্তে রতনকান্তিকে চমকে দিয়ে সর্বজায়া এলো। রতনকান্তি উঠে দাঁড়ালো। সর্বজয়া কঠিন গলায় বলল, গুপ্তচর হয়েছেন? এখানে এমন কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে না যে গুপ্তচর হয়ে খবর সংগ্রহ করতে হবে। আপনার শরীরে তো দেখি রঙের ছড়াছড়ি। এত রঙের ভেতরে আসল রঙ কোনটি বলুন তো?

রতনকান্তি এই কথার মানে বুঝল না। সে অবাক গলায় বলল, বুঝতে পারছি না।

সর্বজয়া সেই একই কঠিন গলায় বলল, তা বুঝতে পারবেন কেন? না বুঝতে পারার ভান ধরে থাকা সবচেয়ে ভালো।

রতনকান্তি বলল, আমি আসলেই বুঝতে পারছি না।

সর্বজয়া বলল, আজ গান শেখান, কাল নাচ। তারপর দিন জুড়িগাড়ির কোচোয়ান হন। এখন আবার গুপ্তচর। ভালোই তো, অনেক গুন আপনার।

রতনকান্তির এবার খুব রাগ লাগছে। এই বাড়িতে আসার পর থেকে মেয়েটা তাকে একনাগাড়ে অপমান করে গেছে। কিন্তু সে কিছুই গায়ে লাগায়নি। বিষয়টি এমন নয় যে সে এখানে না থাকলে উপোষ করে মারা। যাবে। বা পেটের দায়েও সে এখানে আসেনি। বরং সে নতুন এক অভিজ্ঞতার অনুসন্ধানেই এখানে এসেছে। কিন্তু এই মেয়ে তাকে কী ভেবেছে?

রতনকান্তি রাগল না। সে নরম গলায় বলল, আপনার মাকে বদ্যি কবিরাজ দেখানো উচিত।

সর্বজয়া সেই একই স্বরে বলল, তা আপনি কি এখন বদ্যি কবিরাজও হবেন না কি? আর কী কী পারেন বলুন তো? আমার বাবার খবর এনে দিতে পারবেন? একটু চেষ্টা করে দেখুন, আমার ধারণা তা-ও পারবেন। আপনার জন্য কোনো কিছুই কোনো ব্যাপার না। চোখ বন্ধ করবেন, আর আমার বাবা আপনার চোখের ভেতর এসে কথা বলা শুরু করবে, তাই না?

রতনকান্তির একবার মনে হয়েছিল সে সর্বজয়াকে দেবেন্দ্রনারায়ণের কথা বলে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে ওই কথা বলার চেয়ে বড় বোকামি আর হয় না। নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো হবে ব্যাপারখানা। তাই বলতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে সে নিজেকে সামলালো। তবে শান্ত এবং মৃদু গলায় বলল, আপনি আমায় ভুল বুঝছেন। আমি একটা কথা বলতে এসেছিলাম।

সর্বজয়া জবাব দিলো না। তবে চূড়ান্ত তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে সে তাকালো। রতনকান্তি বলল, আপনার বড় জ্যাঠা জমিদার কর্তাকে যদি আপনি একবার বলেন, তাহলে আপনার মায়ের জন্য কোনো বদ্যি-কবিরাজের ব্যবস্থা হয়তো হয়ে যাবে। এই সময়টা খুব খারাপ। আপনি কি একবার উনাকে বলে দেখবেন?

সর্বজয়া আগুনের মতো তেতে উঠল। বলল, এই বুদ্ধি নিয়ে আপনাকে কে পাঠিয়েছে? দ্বিজেন্দ্র? ওকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। আপনাকে কাল রাতে তুই তুকারি করেছি তাতে হয়নি? ওই মেয়ে মানুষটাকে আমি চিনি না ভেবেছেন?

রতনকান্তি বুঝতে পারছিল যে কোনো কাজ হবে না। কিন্তু তারপরও সে শেষ চেষ্টা করল। মাথা নিচু করে রেখেই বলল, জমিদার কর্তা ওই মহলের আর সকলের মতো নন। উনি অন্যরকম। আপনি একটু উনাকে বলে দেখতে…।

সর্বজয়া রতনকান্তিকে কথা শেষ করতে দিলো না। সে ঝাঝালো গলায় বলল, সেই জন্যই তো বললাম, উনি একটা মেয়ে মানুষ। অন্যরকম না হলে পুরুষমানুষের বেশে কেউ মেয়েমানুষ হয় বলেন? আপনি আর একটি কথাও বলবেন না। একটি কথাও না। এই মুহূর্তে বের হয়ে যান। আপনাকে আর কখনো যেন আমার চোখের সামনে না দেখি। খগেন… খগেন…।

রতনকান্তি হতভম্ব হয়ে গেল। তবে সে আরও কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীরে, খুব ধীরে মহল থেকে বের হয়ে এলো।

.

বীণাবালা পরদিন সন্ধ্যায়ও গঙ্গামহলে ছিলেন না। সর্বজয়া বারান্দায় বসে তাকিয়ে ছিল গঙ্গামহলের মূল ফটকের দিকে। এই মুহূর্তে প্রাণতোষ বৈদ্য গঙ্গামহলে প্রবেশ করল। তার সাথে রতনকান্তি। সর্বজয়া কুঞ্চিত কপালে মানুষ

দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইল। সে দেখল প্রাণতোষ বৈদ্য এস্ত ভঙ্গিতে তাদের মহলের দিকেই এগিয়ে আসছে। আর রতনকান্তি ঢুকে গেল অবনীন্দ্রনারায়ণের মহলের বারান্দায়। সে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। প্রাণতোষ বৈদ্য এসে রেণুকাকে দেখে গেলেন। রেণুকা’র পা পিছলে পড়ে যাওয়ার আঘাতটি গুরুতর নয় বলে জানালেন। সামনের দিনগুলোর কিছু পরামর্শও দিলেন। চলে যাওয়ার সময় সর্বজয়া বলল, আপনাকে কে আসতে বলল? গঙ্গামহলে প্রবেশের বিষয়ে আজকাল তো বেশ কড়াকড়ি। ওই মহলের অনুমতি ছাড়া তো কিছুই হয় না! আপনি কিভাবে এলেন?

প্রাণতোষ বৈদ্য বলল, জমিদার কর্তা রতনকান্তি নামে এক ছেলের হাতে পত্র লিখে খবর পাঠিয়েছিলেন। জরুরি ভিত্তিতে আসতে বলা হয়েছিল।

সর্বজয়া কোনো কথা বলল না। সে প্রাণতোষ বৈদ্যকে বিদায় দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। সিংহ দরোজার আবছা আলোয় সে দেখলো রতনকান্তি অবনীন্দ্রনারায়ণের মহলের বারান্দা থেকে বেরিয়ে প্রাণতোষ বৈদ্যর হাতের বাক্সখানা নিয়ে তার পিছু পিছু গঙ্গামহল থেকে বেরিয়ে গেল। সর্বজয়া দীর্ঘসময় সেখানে অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে রইল। সন্ধ্যার অন্ধকারে সর্বজয়ার মুহূর্তের জন্য মনে হলো রতনকান্তির সাথে অতটা বাজে আচরণ সে না করলেও পারত।

*

সেদিন বিভুঁইকে দেখে আসার পর থেকে হরিহরণ খুব চুপচাপ হয়ে গেছে। তার ভাবনার জগতজুড়ে সারাটাক্ষণ কেবল বিভুঁই। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবীকে সে এখনো কিছু বলেনি। কারণ সেদিন বিভুঁইকে দেখার পর শেষ মুহূর্তে এসে তাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও, তারপর থেকে আবার বিপরীত ভাবনাগুলোও হরিহরণের মাথায় ভর করতে শুরু করেছে। যার প্রথম এবং প্রধান কারণটি হলো, দেবেন্দ্রনারায়ণ। দেবেন্দ্রনারায়ণ এমনিতেই নানা ঝড়-ঝাঁপটায় বিধ্বস্ত। এই মুহূর্তে তিনি যদি এসে দেখেন যে বিভুঁই ওখানে নেই, তাহলে তিনি কী করবেন? বিভুঁই যদি বেঁচে না থাকত, মরে যেত, তাহলেও তার মৃতদেহ সেখানে পাওয়া যেত। কিন্তু তিনি এসে যদি দেখেন, কিছুই নেই, তখন কী হবে?

এমন আরো অনেকগুলো চিন্তা হরিহরণকে চিন্তিত করে তুলল। সে কোনো সিদ্ধান্তেই পৌঁছাতে পারছিল না। বিভূঁইয়ের জন্য হেমাঙ্গিনী দেবীর ক্রমাগত বিলাপ সত্ত্বেও হরিহরণ তাই এ বিষয়ে তাকে কোনো কথাই বলল না। তবে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারলেও গত দু’দিনও হরিহরণ বিভূঁইকে দেখে এসেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রতিবারই বিভুঁই বুঝতে পেরেছে যে হরিহরণ সেখানে এসেছে। প্রথমদিন সে হরিহরণের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু হরিহরণ কোনো জবাব দেয়নি দেখে তারপর আর কথা বলেনি। পরদিনও না। শুধু বলেছিল, হরিহরণ যে সেখানে তার কাছাকাছিই রয়েছে, কিন্তু কথা বলছে না, তা সে জানে। তবে শেষের দিন বিভুঁইকে দেখে হরিহরণের আবার প্রচণ্ড মন খারাপ হলো। ছেলেটা মা হেমাঙ্গিনী দেবীর জন্য কী ব্যাকুল হয়েই না রয়েছে!

সেদিন সন্ধ্যায় বজরাডুবির চরে এসে হরিহরণ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে সে হেমাঙ্গিনী দেবীকে পুরো ঘটনা খুলে বলবে। ঘটনা শুনে হেমাঙ্গিনী দেবী যা। বলবে তাই হবে। রাতে হেমাঙ্গিনী দেবীকে বিভূঁইয়ের ঘটনা খুলে বলল হরিহরণ। হেমাঙ্গিনী দেবী উন্মাদিনীর মতোন দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে চিৎকার করতে লাগল। ভগবানকে অভিশাপ দিতে লাগল। যেন হিতাহিত জ্ঞান রহিত হয়ে গেছে তার। খানিক পরপরই সে বলছে, সে বিশ্বাস করে না যে বিভুঁই আর চোখে দেখতে পায় না। হয় হরিহরণ ভুল বুঝেছে, কিংবা হরিহরণকে বোকা বানানোর জন্য বিভুঁই ইচ্ছে করে দুষ্টুমি করেছে। আগে সে মাঝেমধ্যেই এমন নানান রকমের দুষ্টুমি সে করত। হরিহরণ অনেক বোঝালো কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী কিছুই শুনতে চাইছে না। সে ভগবানের নামে অবিরাম শাপশাপান্ত করতে লাগল। হরিহরণ শেষ অবধি রেগে গিয়ে বলল, তোর ছেলের তো বাঁচারই কথা ছিল না। ভগবানের এত দোষ, ভগবান কত বড় বড় বিপদ থেকে তাকে বাঁচিয়েছে তুই তা ভেবে দেখেছিস?

হেমাঙ্গিনী রুদ্রমূর্তিতে বলল, বাঁচালো যখন তখন এই অভিশাপ কেন দিলো? পাপ যা করার বিষ্ণুনারায়ণ করেছে। আমি করেছি। বিভুঁই কী করেছে? ভগবান এত সাধুসন্ত হলে বিষ্ণুনারায়ণকে শাস্তি দিত। তা না, শাস্তি দিল কিনা ওই ছোট্ট একটা ছেলেকে!

হরিহরণ কী বলবে! বিভূঁইয়ের জন্য তারও কি কষ্ট কম? হেমাঙ্গিনী সেই মুহূর্তেই বিভূঁইকে দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠল। কিন্তু হরিহরণ তাকে অনেক কষ্টে বোঝাল যে, এই এত রাতে কোনোভাবেই ওই জঙ্গলে হেমাঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং ভোরের আলো ফোঁটা অবধি অপেক্ষা করা যাক। শেষ অবধি হেমাঙ্গিনী দেবী বুঝল। তবে বাকি রাতে সে আর ঘুমাল না।

পুবাকাশে আলো ফোঁটার আগেই হরিহরণকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল হেমাঙ্গিনী দেবী। হরিহরণ উঠল। হেমাঙ্গিনী দেবীকে সে নিয়ে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু কেন যেন পুরোপুরি সংশয়মুক্ত হতে পারছে না। কোথায় যেন একটি বড় কাঁটা বিঁধে আছে। হরিহরণের মনের ভেতর খচখচ করতে লাগল। হেমাঙ্গিনী দেবী উতলা হয়ে উঠলেও হরিহরণ আলো ফোঁটার পরই নাও ভাসাল। নৌকায় অনেকটা পথ যাওয়ার পর বারোহাটির জঙ্গল। তারপর শুধুই পায়ে হাঁটা পথ। এই জঙ্গলের অনেক জায়গাই হরিহরণের নখদর্পণে। এখানে কীভাবে পথ চলতে হয়, পথ হারালে ফিরে আসতে হয়, ঘন বৃক্ষ, লতাপাতা, ঝোঁপ-ঝাড়, ভয়ঙ্কর প্রাণী এড়িয়ে হাঁটতে হয়, হরিহরণের তা সকলই জানা। ফলে তার একার জন্য এই জঙ্গলে যাতায়াত করা যতটা সহজ, হেমাঙ্গিনী দেবীকে সাথে নিয়ে যাতায়াত তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি কঠিন। হরিহরণ যতটা সম্ভব। গঙ্গাবতীর তীর কাছাকাছি রেখে যেতে লাগল। কারণ এই দিকটায় জঙ্গলের ঘনত্ব খানিক কম। তারা কতক্ষণ হেঁটেছে, হরিহরণ জানে না। খুব বেশি পথ নয়, তবে এরইমধ্যে হেমাঙ্গিনী দেবী হাঁপিয়ে উঠেছে। বার কয়েক হোঁচট খেয়ে পড়েও গেছে। হাত পায়ের চামড়া ছিলে রক্ত বেরুচ্ছে। এসব কারণেই খানিক পরপরই বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। এই বিশ্রাম নিতে গিয়েই ভয়ংকর জিনিসটি আবিষ্কার করল হরিহরণ।

একটা বড় বৃক্ষের গোড়াজুড়ে ঘন লতাগুল্মের ঝোঁপ। সেই ঝোঁপের আড়ালে বসে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছিল হরিহরণ আর হেমাঙ্গিনী দেবী। ঠিক এই মুহূর্তে শব্দটা শুনল হরিহরণ, কেউ কথা বলছে। এই জঙ্গলে এই সময়ে মানুষের গলার স্বর! হরিহরণ যারপরনাই বিস্মিত হলো। সে হেমাঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে নিঃশব্দে ঝোঁপের আরো ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর কান খাড়া করে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করল। দু’জন মানুষের কথোপকথন শোনা যাচ্ছিল। সেই কথোপকথন শুনে হরিহরণ যা বুঝল, তারা গত দিনকয়েক ধরেই এই অঞ্চলে কিছু খুঁজছে। কিন্তু যাকে খুঁজছে, তাকে এখনও পাওয়া যায়নি। তাদের কথাবার্তার শেষের দিকের কিছু অংশ শুনে হরিহরণের বুকের ভেতরটা ভয়ে জমাট বরফের মতোন হয়ে গেল। তাদের দুজনের একজন চিন্তিত গলায় বলল, এই জঙ্গলে মানুষ খুঁজে পাওয় কি সম্ভব?

তার সাথের লোকটি বলল, মানুষ খুঁজে না পেলেও হবে রে মধু। মানুষের লাশ পেলেও হবে। কেন, শুনিসনি? বিভূতিনাথ বাবু যে বললেন, হেমাঙ্গিনী দেবীকে জীবিত পেলে ভালো। আর তার মরা লাশ পেলে আরো ভালো।

মধু নামের লোকটি বলল,। মরা লাশ পেলে তো আর কষ্ট করে মরা বানাতে হবে নারে। মানুষ খুন করা বিষয় না, তবে মেয়ে মানুষ খুন করার আগে ফূর্তি করার বড় সাধ জাগে। হা হা হা।

প্রথম লোকটা বলল, এ তো রসালো কথা হে! খুনের আগে মৌজ করলে কেউ জানবেও না, হা হা হা। কিন্তু এভাবে আর কতদিন খুঁজব?

মধু নামের লোকটা বলল, যতদিন না পাই, ততদিনই খুঁজতে হবে রে।

হরিহরণ মধু নামের লোকটার হাসি শুনে শিউরে উঠল। কী ভয়ংকর মানুষ! সে হেমাঙ্গিনী দেবীর দিকে তাকাল। মানুষ দু’জনের কথোপকথন হেমাঙ্গিনী দেবীও শুনতে পেয়েছে। সে কতটা ভয় পেয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে না। হরিহরণ ঝোঁপঝাড়ের ফাঁকে চোখ রেখে অনেক কষ্টে লোক দু’জনকে দেখতে পেল। দুজনের হাতেই ধারলো বল্লম। তবে মধু নামের লোকটাকে দেখলেই মনে হয়। মস্ত হিংস্র এক জানোয়ার। তারা দুজনই বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। তারপর দুজনই হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তাদের বাদবাকি কথা শুনে হরিহরণ বুঝল, তারা এই দু’জন। শুধু নয়, তাদের সাথে আরো লোক রয়েছে। তারা দু’জন করে দলে ভাগ হয়ে অনুসন্ধানে রয়েছে। যেকোনো উপায়ে তারা হেমাঙ্গিনী দেবীর সন্ধান চায়। জীবিত বা মৃত।

হেমাঙ্গিনী দেবী যতই অবুঝের মতো আচরণ করুক, নিজের চোখের সামনে দেখা এই ঘটনায় হরিহরণ এবং হেমাঙ্গিনী দেবী দু’জনই বুঝতে পারল যে এই মুহূর্তে এই জঙ্গলে আর মুহূর্তকাল অধিক থাকা মানেই ভয়াবহ বিপদ। শুধু তাই-ই নয়। তারা যদি এখন বিভূঁইয়ের সেই মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে তাহলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। বরং এই মুহূর্তে সবচেয়ে নিরাপদ সিদ্ধান্ত হচ্ছে আবার বজরাডুবির চরে ফিরে যাওয়া। কারণ বিভুঁই যেখানে আছে, সেটি মোটামুটি নিরাপদ জায়গা। তার বিপদের আশঙ্কা আপাতত নেই। এইদিকে আর কয়েকটা দিন কেটে যাক। এই মানুষগুলো চলে গেলে পরিস্থিতি যখন শান্ত হবে, তখন আবার যাওয়া যাবে। প্রচণ্ড সতর্কতা এবং উৎকণ্ঠা নিয়ে হেমাঙ্গিনী দেবী আর হরিহরণ আবার বজরাডুবির চরে ফিরে এলো। তারপর দিন গুনতে লাগল।

মাঝে হরিহরণ একা একা একবার গিয়ে বিভুঁইকে দেখে এসেছে। হরিহরণ একা যাওয়াতে বিপদের আশঙ্কাও ছিল কম। কারণ ওরা আসলে খুঁজছে হেমাঙ্গিনী দেবীকে এবং হরিহরণকে তারা চেনেও না। সুতরাং হরিহরণ একা যদি কখনো তাদের সামনে পড়েও যায়, তারপরও বিপদের আশঙ্কা নেই বললেই চলে। ফলে হরিহরণ আর দু’দিন একা একা গিয়ে বিভূঁইকে দেখে আসল। মানুষগুলোর সাথে মুখোমুখি দেখা না হলেও হরিহরণ নানান নমুনা দেখে বুঝতে পেরেছে যে তারা তখনও অনুসন্ধানে ব্যস্ত। বড় বজরাযোগে তারা এসেছে। রাতে সেই বজরায় তারা রাত্রিযাপন করে আবার ভোর হলেই জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রায় দিন সাতেক পর পরিস্থিতি শান্ত হলো। তারপরও যতটা সম্ভব সতর্ক হয়েই হরিহরণ আর হেমাঙ্গিনী দেবী আবার যাত্রা শুরু করল। প্রতিটি মুহূর্তকেই যেন যুগযুগান্তর মনে হতে লাগল হেমাঙ্গিনী দেবীর কাছে। সে দম বন্ধ করা উৎকণ্ঠা নিয়ে পা ফেলতে লাগল।

তারা বিভূঁইয়ের মন্দিরে পৌঁছালো শেষ বিকেলে। হেমাঙ্গিনী দেবী আর হরিহরণ যখন সেই মন্দিরের সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছে তখন বিকেলে আলোও মরে আসছে প্রায়। সেই মরে আসা আবছা আলোয় হেমাঙ্গিনী দেবী আর হরিহরণ এসে বিভূঁইয়ের ঘরের সামনে দাঁড়াল। হেমাঙ্গিনী দেবী জগতের সকল অপেক্ষা, সকল রুদ্ধশ্বাস দিদৃক্ষা নিয়ে ঘরে ঢুকল। তার বুকের ভেতর জগতের সকল মমতার সমুদ্রেরা উন্মাতাল তরঙ্গের উচ্ছ্বাস নিয়ে দুকূল ছাপিয়ে উপচে উঠছে। সেই মমতার, অপেক্ষার, দিদৃক্ষার উন্মাতাল তরঙ্গ বুকের ভেতর আগলে রেখে হেমাঙ্গিনী দেবী তাকাল। তার বিভুঁইকে দেখবে বলে তাকাল। কিন্তু সেই ঘরের কোথাও তখন বিভুঁই নেই। কোথাও না!

ঘরের মেঝেতে খাবারের শূন্য পাত্রগুলো কেবল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এলোমেলো শূন্য থলেগুলো। দেয়ালের কোল ঘেঁষে পড়ে রয়েছে বিভূঁইয়ের শূন্য বিছানাখানিও। কেবল বিভুঁই নেই। কোথাও নেই।

.

বারোহাটির বাগানবাড়িতে দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে বসে আছে দাসী অপলা।

দেবেন্দ্রনারায়ণের ঘরের দরজা ভেজানো। অপলা বিমূঢ় তাকিয়ে আছে। দেবেন্দ্রনারায়ণের বিছানার দিকে। বিছানায় একটি ছেলে ঘুমাচ্ছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। কোনো কথা বললেন না। অপলাও না। কিন্তু এই নিরবতারও অমিত ভাষা রয়েছে। সেই ভাষাদের অপলা যেমন পড়তে পারছে, পারছেন দেবেন্দ্রনারায়ণও।

অনেকক্ষণবাদে দেবেন্দ্রনারায়ণই নিরবতা ভাঙলেন। বললেন, তুমি ঠিকই ধরেছ, এই ছেলেই হেমাঙ্গিনী দেবীর। সেই দিন নাওয়ে পাওয়া সেই গুটিবসন্তের ছেলে। তবে সে রাতে বারোহাটির জঙ্গলে আগুনে পুড়ে এ মারা যায়নি।

অপলা কোনো কথা বলল না। দেবেন্দ্রনারায়ণই বললেন, এই জীবনে তোমার কাছে লুকানোর মতো কিছু নেই আমার। একে আর লুকিয়ে কী হবে! একখানা চিরকুট ছিল সেই নাওয়ে। যাতে হেমাঙ্গিনী লিখেছিল, এই ছেলের প্রকৃত পিতা আমি। সে কেন এ কাজটি করল আমি জানি না। সে এই কথা সরাসরি আমায় বললেই পারত। কিন্তু নিজের ছেলেকে ওই অবস্থায় ওভাবে পাঠিয়ে ওই চিরকুট লিখে কেন করল? বিষ্ণুপুর জমিদারির প্রতি তার অনেক ক্ষোভ থাকতে পারে। আমার উপরও পারে। কিন্তু তার এই ক্ষোভ এই জিঘাংসার সকল কিছু কেন সে আমায় দগ্ধ করতে ব্যবহার করল? আমি জানি না সে কোথায়! কিন্তু তার সাথে একবার দেখা করতে চাই আমি, একবার।

দেবেন্দ্রনারায়ণ থামলেও অপলা কোনো কথা বলল না। দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিক চুপ থেকে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এই সকল কিছুর একটিমাত্র ব্যাখ্যা। ব্যাখ্যাটির নাম বীণাবালা। এই একাকী বন্দী দিনগুলোতে আমি অনেক ভেবেছি। অনেক না মেলা হিসেবই আমি মেলাতে পেরেছি। অনেক কিছুই মেলেনি। তবে সেই নাওয়ের ঘটনায় যা ঘটেছে তা কেবলই হেমাঙ্গিনী দেবীর কাজ নয়। আমি নিশ্চিত। বীণাবালা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গেছে। সে এখন ফণা তোলা বিষধর সাপ। যেকোনো অজুহাতে যে কাউকে বিষদাঁত বসাতে প্রস্তুত। আর আমি এখন প্রকৃতই অসহায়।

দেবেন্দ্রনারায়ণ উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালেন। বাইরে বিস্তৃত সবুজ। তিনি সেই সবুজের দিকে তাকিয়ে বিষাদমাখা গলায় বললেন, নিয়মমাফিক বিষ্ণুপুর জমিদারির উত্তাধিকারী আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা অবনীন্দ্রনারায়ণ- এ কথা সকলেই জানে। এ নিয়ে আমার কোনো লোভ-লালসা কখনোই ছিল না। কিন্তু অবনীন্দ্রনারায়ণের রকমটাই তো আলাদা। জমিদারি দেখবার মতোন মানুষ তিনি নন। এ আমার পিতা যেমন জানতেন, আমিও জানতাম। জানতাম বলেই আমরা চেয়েছিলাম, এসবের মধ্যে শুধু শুধু তাকে টেনে না আনতে। সে তার মতোই থাকুক। কিন্তু জমিদারি তো টিকিয়ে রাখতে হবে। তাই সকলেই চাইছিল আমিই হই জমিদারির উত্তরাধিকারী। কিন্তু এই নিয়ে যে বীণাবালার ক্রোধ জমে জমে এমন পর্বতসম হয়েছে তা কে জানত? সে যে ভেতরে ষড়যন্ত্রের এমন বীজ বুনে সেই বীজকে মহীরুহতে পরিণত করেছে, তা-ই বা কে জানত? তার উদ্দেশ্য অবশেষে সফল হয়েছে। অবনীন্দ্রনারায়ণের মনের ভাবনা আমি জানি না। তবে তাকে সেই এতটুকু বয়স অবধি যা দেখেছি, সে এসব নিয়ে ভাবার মানুষই নন। তাহলে? তাহলে তার আড়ালে রয়েছে বীণাবালা। বিষ্ণুপুরের জমিদার তাহলে এখন বীণাবালা? দীঘাগড়ের জমিদারবাড়ির কন্যা বীণাবালা হবে বিষ্ণুপুর জমিদারির দণ্ডমুণ্ডের কত্রী? কেন? এ আমি মেনে নিতে পারব না। বিষ্ণুপুর জমিদারির রক্ত কি মুছে গেছে?

অপলা এ বাড়ির দাসী। দাসীর সাথে এই সকল কথা বলা হয়তো দেবেন্দ্রনারায়ণের মানায় না। সেক্ষেত্রে দেবেন্দ্রনারায়ণের কথা শুনে অপলার। অবাক হবার কথা ছিল। কিন্তু সে অবাক হলো না। কারণ এই দেবেন্দ্রনারায়ণকে অপলা সেই এতটুকু বয়স থেকে দেখে এসেছে। সেই ছোট্ট দেবেন্দ্রনারায়ণ যতটা না তার মায়ের সাথে সময় কাটিয়েছে, খামখেয়ালি করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে এই দাসী অপলার কাছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ হয়তো প্রায়ই অপলা দাসীর কথা ভুলে যান, কিন্তু তার অবচেতন মন জানে, তার প্রয়োজনে অপলা দাসী নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও পাশে থাকবে। এ হয়তো ঠিক মাতা-পুত্রের সম্পর্ক নয়, কিন্তু তার চেয়ে অকিঞ্চিৎকর কিছুও নয়। অপলা আগেও বহুবার এই দেবেন্দ্রনারায়ণকে দেখেছে, যে তার কাছে ছুটে এসে এমন মনের আগল খুলে দিয়েছে। সুতরাং অপলা একটুও অবাক হয়নি। সে খুব নরম গলায় বলল, কিন্তু সকলই তো এখন উল্টো। বীণাবালা বহুদিনের জ্বালা পুষেছে বুকে। বহু হিসেব নিকেশ করেই নেমেছে…।

দেবেন্দ্রনারায়ণ হাত তুলে অপলাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি জানি। এও জানি এই মুহূর্তে আমার কিছুই করার নেই। কিন্তু এও তো মেনে নিতে পারছি না। জানি না কী হবে! তবে এই ছেলেটাকে তুমি দেখে রেখ। ওর সারা শরীরজুড়ে জ্বর। অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে। আমি হয়তো দু-চার দিনের মধ্যে গঙ্গামহলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। রতনকান্তি তো এখনও এলো না। ওর জন্য আর দুটো দিন অপেক্ষা করে রওয়ানা হয়ে যাব। কী হবে জানি না। কবে আবার ফিরব তা-ও না। ওকে ততদিন দেখে রাখার দায়িত্ব তোমার।

অপলা কোনো কথা বলল না। দেবেন্দ্রনারায়ণই আবার বললেন, একে এই ঘরের বাইরে কখনো নিও না। কাউকে দেখতেও দিও না।

.

অপলা জল এনে দিলো। নানান খাবার এনে রাখল ঘরে। বিভুঁইর শরীর মুছিয়ে দিল। বিকেলের দিকে চেতনা ফিরল বিভুঁইর। তখন ঘরে শুধু দেবেন্দ্রনারায়ণ আর বিভূঁই। বিভুঁই দীর্ঘসময় বুঝতে পারল না সে কোথায়! তবে সে যে এতদিনকার সেই মন্দিরে নেই, তা সে ঠিক বুঝতে পারল। সে শুয়ে আছে গদিআঁটা নরম বিছানায়। তবে জেগে উঠে প্রথমেই সে যেটি টের পেল, তা হলো গন্ধ। সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থেকেই বুক ভরে সেই গন্ধ টেনে নেয়ার চেষ্টা করল। এই গন্ধটা সে আগেও পেয়েছে। অনেক আগে। এই মানুষটা তাকে খাবার খাইয়ে দিয়ে যেত।

দৃষ্টিবিহীন অন্ধ বিভূঁইয়ের বাদবাকি ইন্দ্রিয়রা যেন তার এই নিঃসঙ্গ বসবাসের প্রতিটি দীর্ঘ মুহূর্তে শাণিত হয়েছে, সুতীক্ষ হয়েছে। সে ওই প্রতিটি মুহূর্তে তার চারপাশের দৃশ্য দেখতে চেয়েছে। শব্দ বা ঘ্রাণের উৎস জানতে চেয়েছে, বুঝতে চেয়েছে। যে প্রবল নিমগ্নতায়, গভীরতম আরাধনায়, অদম্য ইচ্ছায় সে প্রতিটি মুহূর্তে তার চারপাশের জগত, জগতের শব্দ, ঘ্রাণ আর তাদের উৎসদের বুঝতে চেষ্টা করেছে তা যেন বিভুঁইকে ক্রমশই পরিণত করে গড়ে তুলেছে অন্য এক দৃষ্টির মানুষ হিসেবে। যে মানুষ সেই শব্দের, ঘ্রাণের উৎসদের আলাদা করতে পারে, তার কল্পনার জগতে তাকে আকৃতি দিতে পারে, পরিচয় নির্মাণ করতে পারে।

সেই বিকেলে দেবেন্দ্রনারায়ণ আবিষ্কার করলেন বিভুঁই অন্ধ। গুটিবসন্ত তার দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিয়েছে। তবে বিভূঁইয়ের এই অন্ধত্ব দেবেন্দ্রনারায়ণকে যেন একটি সুস্পষ্ট বার্তা দিলো। বিভূঁইয়ের পিতৃপরিচয় নিয়ে এতদিন তার মনের কোণে যে সামান্য দ্বিধাটুকুও গেড়ে ছিল, সেটুকুকেও যেন কাটিয়ে দিলো। তার মনে পড়ল রাইপুরের সেই তান্ত্রিক গুরুজীর কথা। যিনি তাকে বলেছিলেন যে তার পরবর্তী সন্তান হবে অন্ধ! তাহলে কি ইঙ্গিতে তিনি বিভূঁইয়ের কথাই বলেছিলেন?

মানসিকভাবে বিপর্যস্ত দেবেন্দ্রনারায়ণের মনে হলো সেই তান্ত্রিক গুরুজী তাকে বিভূঁইয়ের কথাই বলেছিলেন। এমনিতেই এই সকল বিষয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণের এক ধরনের যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাস রয়েছে। এই ঘটনা যেন। তার সেই বিশ্বাসকে আরো শক্ত ভিত্তি দিলো।

.

আরো দু’টি দিন কেটে গেল। এর মধ্যে বিভূঁইয়ের সাথে দেবেন্দ্রনারায়ণের অনেক কথা হলো। বিভুঁই প্রায়ই মায়ের জন্য ছটফট করছিল। তবে সে কাঁদেনি। এই দুইদিনেই ছেলেটার প্রতি একধরনের মমতা অনুভব করছেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। বিভুঁই তার কাছে অনেক কিছুই জানতে চেয়েছে। তার অজস্র প্রশ্ন। সেইসকল প্রশ্নের কিছু কিছু উত্তর তিনি দিয়েছেন, কিছু কিছু দেননি, কিছু কিছু মিথ্যে বলেছেন।

যেমন বিভুঁই তার সম্পর্কে জানতে চাইলে দেবেন্দ্রনারয়ণ বলেছেন যে তিনি বিভূঁইকে অসুস্থ অবস্থায় নদীর পারে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। তারপর নিয়ে গিয়ে ওই জঙ্গলের ভেতর রেখে এসেছিল। কারণ এই গাঁয়ের মানুষ যদি জানে যে বিভূঁইয়ের এমন ভয়ানক ব্যাধি হয়েছে, তাহলে তারা তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলতে পারত। এজন্যই তিনি বিভূঁইকে অমন লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এরপর তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিভূঁইকে আর দেখতে যেতে পারেননি। বিভুঁই তখন আরো জানতে চেয়েছিল যে তাকে অন্য কেউ একজনও খাবার দিয়ে গিয়েছিল, কে সে?

এই প্রশ্নটি দেবেন্দ্রনারায়ণেরও। তার মনে হয়েছিল মানুষটি হেমাঙ্গিনী দেবী। দেবেন্দ্রনারায়ণ বিভূঁইকে বলেননি যে তিনি হেমাঙ্গিনী দেবীকে চেনেন। কিন্তু বিভুঁই যখন তার মায়ের জন্য অস্থির হয়ে যায়, যখন মায়ের গন্ধের কথা বলে, তখন দেবেন্দ্রনারায়ণ কৌশলে বার কয়েক বিভুঁইকে জিজ্ঞেস করেও দেখেছেন যে বিভূঁইকে যে খাবার দিয়ে গেছে সে তার মা কিনা? বিভুঁই স্পষ্ট করেই বলেছে যে না, সে তার মা না। বিভূঁইয়ের এই ঘ্রাণের বিষয়টি দেবেন্দ্রনারায়ণ এখন বিশ্বাস করেন। তিনি অপলা আর তার নিজেকে দিয়ে তা প্রমাণ করে দেখেছেন।

তাহলে বিভুঁইকে কে খাবার দিয়ে গেল? এমন আরও কত প্রশ্ন যে দেবেন্দ্রনারায়ণের মাথায় দিনমান ঘোরাফেরা করে, তা শুধু দেবেন্দ্রনারায়ণই জানেন। তিনি বিভূঁইয়ের কাছেও অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন। বিভুঁই কি করে ওই নদীর তীরে এলো। তার আগে সে কোথায় ছিল? কিন্তু বিভুঁই যে হেমাঙ্গিনী দেবী সম্পর্কে তাকে খুব বেশি কিছু বলতে পারল, বিষয়টি এমন নয়। সে কেবল বলেছে যে সে নদীর পারে ছিল কিনা তা তার মনে নেই। তার কেবল মনে আছে তার মা তাকে পড়তে দিয়ে এসেছিল বিনয়পুরে। সেখানেই তার অসুখ হয়। অসুখ দিন দিন বাড়তেই থাকে। এরপর কী হয়েছে বিভুঁই তা জানে না। তার আর কিছু মনেও নেই। সে কেবল গভীর অচেতন অবস্থা থেকে জেগে উঠে বুঝল সে চোখে দেখতে পায় না। সে পড়ে রয়েছে জনমানবহীন নির্জন কোনো জায়গায়।

*

বীণাবালা গম্ভীর মুখে বসে আছেন গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জের ঘরে।

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ। মাঝি নিতাই আর গুটিবসন্তে-আক্রান্ত বিভুঁইর ভাগ্য নির্ধারণে গঙ্গামহলে যে বৈঠক বসেছিল তাতে দুজন প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ উপস্থিত ছিলেন। তাদের একজন গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে। অন্যজনের দিবাকর চাটুজ্জে। ধর্মীয় বিষয়াদিতে এই দুজনের জ্ঞান, প্রজ্ঞা সর্বমহলে সুবিদিত। শুধু যে বিষ্ণুপুর জমিদারিতেই তাদের পরিচিতি বা প্রভাব সীমাবদ্ধ বিষয়টি তা নয়। আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চলেও ধর্মীয়-সামাজিক নানান বিষয়ে এদের প্রভাব লক্ষণীয়।

গত কদিন ধরেই গঙ্গামহলের বাইরে বিভূতিনাথ সাহা, গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে আর দিবাকর চাটুজ্জের সাথে আলাদা আলাদা বসেছেন বীণাবালা। কতগুলো বিষয় নিয়ে বীণাবালা গুরুতর কিছু সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন। বিষয়গুলো নিয়ে গঙ্গামহলে আলোচনা হোক, তা তিনি চাননি। তিনি জানেন না কেন, তবে গঙ্গামহলে গোপন ও গুরুতর কোনো আলোচনায় আজকাল তার খুব অস্বস্তি হয়। মনে হয় কেউ একজন যেন আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছে। তাছাড়া অবনীন্দ্রনারায়ণকে নিয়েও তিনি ভারি বিরক্ত। মানুষটা দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

আজ বীণাবালা বিভূতিনাথ সাহা, গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে এবং দিবাকর চাটুজ্জেকে একইসাথে নিয়ে বসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দিবাকর চাটুজ্জে একটি গুরুতর পারিবারিক কারণে আসতে পারেননি। বীণাবালা তাই বিভূতিনাথ আর গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জের সাথে বসেছেন। ভুজঙ্গ দেব এই মুহূর্তে বিষ্ণুপুরে নেই। তিনি দীপেন্দ্রনারায়ণের শ্বশুরালয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছেন।

খানিক আগে সন্ধ্যা নেমেছে। লণ্ঠনের আলোয়ে বীণাবালার গম্ভীর মুখোনি আরো গম্ভীর দেখাচ্ছে। তিনি গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জেকে বললেন, বাড়ুজ্জে মশাই, আমি একখানা কথা ভাবছি, জানি না আপনাদের কী মত?

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে বললেন, আজ্ঞে বলুন। আপনি গভীর চিন্তার মানুষ। এ বিষয়ে আমাদের করোরই কোনো দ্বিমত নেই।

বীণাবালা বললেন, বিষ্ণুপুরের সকল তল্লাটের প্রজারাই শান্ত। সে আমি জানি। তারা কখনোই গঙ্গামহলের কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেনি, সেও আমি জানি।

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে বললেন, একখানা কথা কি, এই সকল প্রজাদের বেশির ভাগেরই দিন যায় এক বেলা আধবেলা খেয়ে। তো তারা জানে তাদের আহার দেন জমিদার কর্তা। জমিদারের জমি চাষ করে তাদের আহার জোটে। উদরের চিন্তা জগতের সবচেয়ে বড় চিন্তা। তারা কোন ভরসায় সেই জমিদারদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবে? তারা জানে জমিদার যদি উচ্ছেদ করে, তবে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পথে নামতে হবে।

বীণাবালা বললেন, সে কথা আমি মানি। কিন্তু এর উল্টো ঘটনাও যে ঘটেনি তা কিন্তু নয়। প্রজারা মিলে জমিদার-তালুকদারের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে, এমন বহু দৃষ্টান্তও রয়েছে।

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে বললেন, সে ঠিক আছে। তবে কিনা উদরে আহার না থাকলেও ধর্মটা এদের ঠিক ঠিক মানা চাই। ধর্ম, সংস্কার এসকল তারা কিছুতেই ছাড়বে না। তাই যেখানে এ সকল বিষয় গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে এরা ঠিক ঠিক রুখে দাঁড়ায়। ভাবে, ধর্মনাশ ঠেকাতে পারলেই নিশ্চিত স্বর্গপ্রাপ্তি।

বীণাবালা খানিক টিপ্পনী কেটে বললেন, আপনি ধর্মাচারি মানুষ। প্রখ্যাত ব্রাহ্মণ, কিন্তু আপনার কথার ধরণ আর আচার দেখে মাঝে-মধ্যে আমারই সংশয় হয়। যা হিসেব আপনার! আপনি তো দেখি তাদের উল্টো, স্বর্গের চেয়ে দুনিয়ার কথা অধিক ভাবেন। আপনার লাভ-লোকসানের হিসেব বড় পাকা।

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে বললেন, ও কথা বলবেন না। ভগবান ন্যায় অন্যায় দেখেন। যার যেটুকু যোগ্যতা, সে ততটুকু পাবে। এও কিন্তু নীতি। যার বুদ্ধি যেমন সে তেমনই অর্জন করবে। এও তো ন্যায় বিচারই, ঠিক কি না বলুন? আমার ঘটে যদি খানিক বুদ্ধি থেকে থাকে, সে তো আমার ভালো থাকার জন্যই। তো ভালো থাকার উপায় আর কী আছে বলুন?

বীণাবালা হাসতে হাসতে বললেন, চিন্তিত হবেন না। আপনার প্রাপ্তি আমি ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেব। আপনার কাজের ন্যায্য মূল্যই আপনি পাবেন। এবার বলুন, প্রজারা যদি ধর্ম, সংস্কারের বিষয়ে এত সতর্ক হয়, তাহলে সেটিই তো আপনাদের মতো ব্রাহ্মণদের ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তাই না?

এতক্ষণে বিভূতিনাথ কথা বললেন, এ তো আর আজকালের কথা নয়। এ সেই মধ্যযুগ থেকেই চলে আসছে। ইওরোপে গীর্জা, পাদ্রী আর রাজা, এই তিনেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল। আর আমাদের রয়েছে মন্দির, ব্রাহ্মণ আর জমিদার।

বীণাবালা বললেন, বাড়ুজ্জে মশাই, এখন আপনি আমায় বলেন, আপনি তো প্রজাদের সাথে মেশেন। নানান সামাজিক-ধর্মীয় বিষয়াদিতে যুক্ত থাকেন। তা এই যে সকলে এতদিন যাবত ভেবে আসল দেবেন্দ্রনারায়ণই তাদের পরবর্তী জমিদার, তা সেই ভাবনা যখন পাল্টে গেল, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া কী? এখন কী বলছে তারা?

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে বললেন, বিষয়টিখানিক অদ্ভুত। এই ধরুন, জমিদার কেমন হবে? এটি প্রজাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারা জমিদারের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়, মনে মনে খুব অসন্তুষ্ট হয়। তারপর আক্ষেপ করে, জমিদার যদি ভালো হত, যদি এমন নিষ্ঠুর বদমেজাজি না হতো। কিন্তু বিনয়ী, কোমল জমিদার হলে সেটিও এরা মন থেকে মেনে নিতে পারে না। এরা আসলে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী, বদমেজাজী জমিদারই চায়। বিষয়টি অনেকটা এমন যে, মানুষ বাঘকে ভয় পায়, বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভাবে, ইস, বাঘটা যদি বাঘ না হয়ে বেড়াল হতো! কিন্তু বিপদ কাটতেই ভাবে, নাহ্, বাঘ হওয়া উচিত বাঘের মতোনই। ভয়ংকর গর্জন, গা হিম করা নখদন্ত ছাড়া আবার বাঘ হয় না কি! বাঘ হতে হবে হিংস্র। এ সকল ছাড়া বাঘকে আবার বাঘ বলে মানায় নাকি!

বিভূতিনাথ বললেন, বাহ্! চমৎকার বলেছেন তো বাড়ুজ্জে মশাই!

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে বীণাবালার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ অঞ্চলে আপনাদের জমিদারি কয়েক পুরুষের। দিনে দিনে তা বেড়েছে বৈ কমেনি। আগের সকল জমিদারই অমন হিংস্র ব্যাঘই ছিলেন। আপনার শ্বশুরকে বাইরে থেকে দেখলে যত সাদাসিধে মানুষই মনে হতো না কেন, তিনিও যে কিছু কম কিছু ছিলেন না তাও প্রজারা ঠিকই জানে। কথা হচ্ছে আর যাই হোক না কেন, দেবেন্দ্রনারায়ণও সে হিসেবে প্রজাদের কাছে পরবর্তী জমিদারই ছিলেন। তিনি অত্যাচারী, বদমেজাজি, খামখেয়ালি কিন্তু তারপরও প্রজাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস জমিদার তো এমনই হবে!

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে সামান্য থামলেন। তারপর বললেন, তবে কে জমিদার হবে এ নিয়ে প্রজাদের ভাবনা কম। তাছাড়া যখন আপনার শ্বশুর গত হলেন, আর বড় বাবু জমিদার হলেন, তখন গুটিবসন্তের মহামারি, প্রজারা সকলেই তাদের জীবন নিয়ে শঙ্কিত। তখন নতুন জমিদার কে হলো, তা নিয়ে ভাববার অবকাশ তাদের কই?

বীণাবালা বললেন, তার মানে এ নিয়ে তাদের আগ্রহ নেই? কিন্তু যদি এমন হয়, আমার স্বামী আর জমিদার হয়ে থাকতে চাইছেন না। তার পরিবর্তে আমিই জমিদারির দেখাশোনা করি? তখনও কি তারা চুপচাপই থাকবে?

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে সাথে সাথে জবাব দিলেন না। উত্তর গোছাতে খানিকটা সময় নিলেন যেন। এই ফাঁকে বীণাবালা বললেন, আবার ভাববেন না যেন যে আমি জমিদার হতে চাইছি। বিষয়টি তা-না, প্রজাদের ধাতটা জেনে রাখছি।

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে বললেন, মেনে যে নেবে না, তা বলছি না। আর কেউ বিকল্প হিসেবে না থাকলে কেউ হয়তো অত ভাবতই না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তারা সকলেই ধরে নিয়েছিল যে তাদের জমিদার হবেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। সুতরাং সেখানে আপনাকে মেনে নেওয়া খানিকটা কঠিনই। শুধু প্রজারাই কেন, আশেপাশের জমিদারির জমিদারেরাও বিষয়টি সহজভাবে নেবেন না। তাছাড়া বিষ্ণুপুর জমিদারির রক্ত তো আপনি নন। আপনি তো জানেনই, জমিদারিতে এই বংশ আর রক্ত খুব শক্ত জিনিস।

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে খানিক থেমে বললেন, তবে হা, দেবেন্দ্রনারায়ণ না থাকলে হয়তো বিষয়টা সহজ ছিল। তখন এ নিয়ে কেউ অত ভাবত না।

বীণাবালা রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলেন। বললেন, দেবেন্দ্রনারায়ণ না থাকলে?

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে বললেন, হু, না থাকলে। যদিও দীপেন্দ্রনারায়ণ রয়েছেন, কিন্তু তার কথা কেউ কখনো সেভাবে ভাবেনি।

বীণাবালা অদ্ভুত গলায় বললেন, কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ তো আছেন। দিব্যি বেঁচে আছেন। এমনকি গুটিবসন্তের মতোন কালব্যাধি জয় করে গঙ্গামহলে ফিরে আসছেন। তাহলে উপায়?

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে বললেন, কিসের উপায়?

বীণাবালা স্মিত হাসিতে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, দেবেন্দ্রনারায়ণের না থাকার উপায়।

প্রথমে অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বললেন না। না গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে, না বিভূতিনাথ সাহা। কারণ তারা কেউই তখনও বীণাবালার এই রহস্যময় উক্তির তাৎপর্য ধরতে পারেননি। বীণাবালা আর কথা বাড়ালেন না। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে অপসৃয়মান বীণাবালার ছায়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বিভূতিনাথ সাহা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, এ বেলা আসছি বাড়ুজ্জে মশাই। বুঝতেই পারছেন, গুরুতর বহু হিসেব এখনো বাকি রয়ে গেছে।

বিভূতিনাথ দ্রুত পায়ে এসে বীণাবালার পাশে হাঁটতে থাকলেন। বাইরে জুড়িগাড়ি অপেক্ষায় আছে। অতিদ্রুত গঙ্গামহলে ফিরতে হবে।

.

বীণাবালা গঙ্গামহলে ফিরলেন গভীর রাতে। তার সঙ্গে বিভূতিনাথ। কিন্তু মহলে ঢুকেই বীণাবালা থমকে গেলেন। তার ঘরের সামনে পায়চারি করছে। দ্বিজেন্দ্র। এতরাতে দ্বিজেন্দ্রকে এখানে পায়চারি করতে দেখে বীণাবালা খানিক উৎকণ্ঠিত বোধ করলেন। তিনি চিন্তিত গলায় বললেন, কী হয়েছে দ্বিজেন্দ্র? এত রাতে তুই এখানে?

দ্বিজেন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে কোনো কথা বলল না। সে মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকালো। তার চোখ রক্তজবার মতোন টকটকে লাল। বীণাবালার মনে অশনি ডেকে উঠল। তিনি দ্বিজেন্দ্রকে চেনেন। এমনিতেই সে খুব একটা কথাবার্তা বলে না। তিনি দ্বিজেন্দ্রর কাঁধে হাত রাখলেন, কী হয়েছে বাবা?

দ্বিজেন্দ্র খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, কিছু না।

বীণাবালা বুঝলেন মারাত্মক কিছু হয়েছে। তিনি দ্বিজেন্দ্রর কাঁধ শক্ত হাতে চেপে ধরে বললেন, কী হয়েছে আমায় বল?

দ্বিজেন্দ্র বলল, আমার সন্ধ্যা থেকে খুব মাথাব্যথা হচ্ছে, মনে হচ্ছিল তুমি আসলে কিছু একটা উপায় বলতে পারবে।

বীণাবালা ঠাণ্ডা চোখে দ্বিজেন্দ্রর দিকে তাকালেন। তিনি বুঝতে পারছেন কিছু একটা হয়েছে। খুব গুরুতর কিছু। কিন্তু দ্বিজেন্দ্র যেহেতু প্রথমেই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছে, তার মানে সে আর তা বীণাবালাকে বলবে না। কিন্তু কী এমন হয়েছে? বীণাবালা বললেন, তুই ঘরে যা, আমি আসছি।

বীণাবালা বিভূতিনাথকে বসার ঘরে বসিয়ে রেখে ব্রজগোপাল আর মুকুন্দকে ডাকলেন। মুকুন্দ সন্ধ্যার ঘটনা বীণাবালাকে বলল। সর্বজয়ার চিৎকার করে বলা নানান কথা, দ্বিজেন্দ্রর সাথে উত্তেজিত বাক্য বিনিময় অবধি সকলি সে সবিস্তারে বলল। বীণাবালা তারপরও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। কথা। শেষে তিনি দ্বিজেন্দ্রর ঘরে গেলেন। ঘরে গিয়ে দেখেন দ্বিজেন্দ্র চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। দ্বিজেন্দ্রকে ডাকতে গিয়েও বীণাবালা ডাকলেন না। ভাবলেন, বিভূতিনাথের সাথে আলাপ শেষ করেই ডাকবেন। কিন্তু চোখ ফেরাতে গিয়েও কেন যেন দ্বিজেন্দ্রর মুখ থেকে চোখ ফেরাতে পারলেন না বীণাবালা। কিছু একটা তাকে দীর্ঘসময় আটকে রাখল। তার কেন যেন মনে হতে থাকল, ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, অতি ভয়ংকর কিছু। কিন্তু সেই ভয়ংকর কিছুটি কি তা তিনি ধরতে পারছেন না।

বীণাবালা ঘুরে বসার ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। জরুরি বিষয়ে বিভূতিনাথের সাথে কথা আছে তার। বীণাবালা বিভূতিনাথের সামনে গিয়ে খানিক দাঁড়িয়ে রইলেন। বিভূতিনাথ বুঝতে পারছিলেন বীণাবালা কিছু নিয়ে চিন্তিত। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বীণাবালা শীতল গলায় বললেন, বারোহাটির জঙ্গলে যারা হেমাঙ্গিনীকে খুঁজতে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্ত পোক্ত, কঠিন চার জনের নাম বলুন।

বিভূতিনাথ খানিক ভেবে বললেন, লখাই, মধু…।

বীণাবালা বিভূতিনাথের কথা শেষ করতে দিলেন না। তার আগেই বললেন, কাল ভোর হবার আগেই এদের চারজনের সাথে আমি দেখা করতে চাই। তবে এখানে না। আপনার বাড়িতে।

বিভূতিনাথ কারণ জিজ্ঞেস করল না, কেবল মৃদু গলায় বললেন, আচ্ছা।

বীণাবালা বললেন, হেমাঙ্গিনী দেবীর কোনো খোঁজ মেলার সম্ভাবনা আছে?

বিভূতিনাথ কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু এবারও তার কথা আগেই থামিয়ে দিয়ে বীণাবালা বললেন, হেমাঙ্গিনীর কথা আবার পরে ভাবা যাবে। তার আগে দেবেন্দ্রনারায়ণের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। অন্ধকারে জুড়িগাড়িতে বারোহাটি থেকে গঙ্গামহলে পৌঁছাবার রাস্তা খুবই বিপজ্জনক। দেবেন্দ্রনারায়ণ যদি রাতের অন্ধকারে বারোহাটি থেকে গঙ্গামহলে যাত্রা করেন, তবে তার জুড়িগাড়ি উল্টে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সেই দুর্ঘটনায় সে মারাও যেতে পারে। পারে না?

বিভূতিনাথ অনেকটা সময় কোনো কথা বললেন না। তারপর শুধু বললেন, বীণাবালা!

বীণাবালা বললেন, যা বলছি তাই করুন। কাল ভোর হবার আগেই ওই চারজনকে আপনার বাড়িতে আনুন। আমি সময় মতো পৌঁছে যাব।

বীণাবালা আর কিছু বললেন না। ধীর পায়ে হেঁটে দোতলার সিঁড়ির দিকে এগোবেন। এই মুহূর্তে ভূত দেখার মতোন কিছু দেখে তিনি আচমকা দাঁড়িয়ে গেলেন। দেখলেন এই খানিক মাত্র আগে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা দ্বিজেন্দ্র দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি দ্বিজেন্দ্রকে কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই দ্বিজেন্দ্র বলল, মধু কাল তোমার সাথে যাবে না।

বীণাবালা অবাক গলায় বললেন, মধু কে?

দ্বিজেন্দ্র বলল, কাল যারা তোমার সাথে দেখা করবে, তাদের একজন।

বীণাবালা বললেন, ও যাবে না কেন?

দ্বিজেন্দ্র বলল, কোনো কারণ নেই। বিভূতিনাথ সাহাকে সে কথা জানিয়ে দিও।

বীণাবালা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই দ্বিজেন্দ্র খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘুরল। তারপর হাঁটতে শুরু করল।

বীণাবালা লণ্ঠনের আবছা আলোয় দ্বিজেন্দ্র’র দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার পাশে এসে দাঁড়ালেন বিভূতিনাথ। তাদের দু’জনের চোখেই বিস্মিত বিভ্রান্ত দৃষ্টি। সেই বিভ্রান্ত বিস্মিত দৃষ্টিতে তারা কিছুই বুঝতে পারলেন না। কী হয়েছে দ্বিজেন্দ্র’র? মধুর সাথে তার কি কাজ? আর সে মধুকে চেনেই বা কি করে! অনেক ভেবেও কোনো হিসেব মেলাতে পারলেন না বীণাবালা। অন্ধকারে হেঁটে যাওয়া দ্বিজেন্দ্র’র মুখের ভাষাও পড়তে পারলেন না।

পড়তে পারলেন না আরো একটি ভাষা। তাদের ঠিক গা ঘেঁষে হাতখানেক দূরত্বে দোতলায় যাবার যে সিঁড়ি, সেই সিঁড়ি তলায় ছোপছোপ গাঢ় অন্ধকার। সেই অন্ধকারের ভেতর তখন নিঃশ্বাস আটকে বসে রয়েছে রতনকান্তি দাস। বীণাবালা বা বিভূতিনাথ সেই অন্ধকারের ভাষাও পড়তে পারলেন না।

*

গঙ্গামহল থেকে বারোহাটির পথ পায়ে হাঁটা দূরত্বে কম নয়।

ঘোড়া বা দ্রুতগতির জুড়িগাড়িতে দূরত্ব কম হলেও পায়ে হাঁটা পথ প্রায় পুরো দিনের। রতনকান্তির হাঁটতে খারাপ লাগে না। বরং ভালোই লাগে। সে বাউণ্ডুলে মানুষ। পথ, পথের পাশের মাঠ, মাঠের ফসল, কর্মব্যস্ত মানুষ সকলই তার ভালো লাগে। রতনকান্তি জানে, দেবেন্দ্রনারায়ণ বারোহাটিতে তার অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু এখানে এসে যে পরিস্থিতিতে সে পড়েছে, তাতে হুট করে আবার চলে যাওয়াটা অনেকের মনেই সন্দেহের উদ্রেক করতে পারত। রতনকান্তি তা চায়নি। ফলে তাকে কিছুটা সময় বেশিই থাকতে হয়েছে গঙ্গামহলে। তবে গতকাল রাতের ঘটনার পর আর কোনোভাবেই দেরি করা যায় না। সামান্য বিলম্বে ভয়াবহ সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।

রতনকান্তি গঙ্গামহল থেকে বের হলো ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গেই। তার আগেই, প্রত্যুষে বীণাবালা বেরিয়ে গেছেন বিভূতিনাথ সাহার বাড়ির উদ্দেশ্যে। রতনকান্তি যদিও আঁচ করতে পারছিল যে সেখানে কী পরামর্শ হবে। কিন্তু তারপরও মনে হচ্ছিল নিজ কানে ঘটনা শুনতে পারলে ভালো হতো। তার ভেতরে গতরাতের ঘটনা নিয়ে দুশ্চিন্তা কাজ করলেও ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় এই মুহূর্তে ভারি ফুরফুরে লাগছে। সে গুনগুন করে গান ধরল

‘নয়ন মেলিয়া যা কিছু হেরিছি, তাহাতে পেয়েছি মিছে,
চিত্তে বিরাজে সত্য সুন্দর, খুঁজিছে কে তাহার পিছে?
অন্তঃকরণে বিরাজে যে জন, সে জনই হেরিল বাঁচা,
চিত্তবিহীন কায়াতে বাঁচিছে পক্ষীবিহীন খাঁচা।’

রতনকান্তির বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে। আসলেই তো, এই জনমে। সকলই কেবল চোখের দেখা, জিভের ভালো লাগা, শরীরের সুখ। কিন্তু এ সকলই কি মিছে নয়? আসল সত্য তো বুকের ভেতর। চিত্তে বিরাজে সত্য সুন্দর, কিন্তু সেই সত্যের পিছে কে খোঁজে? কে চিত্ত দিয়ে দেখতে চায়, অনুভব করতে চায়, কে প্রকৃতই সত্য ছুঁতে চায়? সকলই চোখের দেখায়, ভোগের আনন্দে মত্ত।

তার হঠাৎ মনে হয়, কেউ কেউ চিত্তেও দেখে। যেমন অবনীন্দ্রনারায়ণ। এই মানুষটি চিত্তেই দেখে। এই গানখানিও তার লেখা, এই গানের কথা তারই ভাবনা। এই মানুষটি আসলেই জগতের এই ভোগ, এই চিত্তবিহীন দেখা, এই হৃদয়বিহীন দেহের আনন্দে ডুবে থাকা মানুষ না। এই মানুষটি সত্যি-সত্যিই অন্তঃকরণে বিরাজ করেন। তাই তো লিখতে পেরেছেন অন্তঃকরণে বিরাজে যে জন, সে জনই হেরিল বাঁচা। আসলেই তো, অবনীন্দ্রনারায়ণ প্রকৃত অর্থেই সত্যিকারের বেঁচে থাকা এক মানুষ। যে নিজের অন্তরে শাশ্বত সত্যের অনুসন্ধান করে। অথচ চারপাশটা গিজগিজ করছে শুধুই হৃদয়বিহীন দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষেরা। যেন পক্ষীবিহীন খাঁচা। কী সুন্দর লিখেছেন, চিত্তবিহীন কায়াতে বাঁচিছে পক্ষীবিহীন খাঁচা।

রতনকান্তির মনে হলো, তার এই বাউণ্ডুলে জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা হলো অবনীন্দ্রনারায়ণের সাথে তার দেখা হওয়া। ওই সাদাসিধে মানুষটার বুকের ভেতর অসীম ভাবনার কী অপরূপ এক জগত! সেই জগতের খানিকটা দেখতে পাওয়াও ভাগ্যের।

সেদিন অবনীন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ রতনকান্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আচ্ছা রতনকান্তি, মানুষ বাঁচে কেন বল তো?

রতনকান্তি বলল, কখনো ভেবে দেখিনি তো!

অবনীন্দ্রনারায়ণ হাসলেন। তারপর বললেন, মানুষ আসলে বেঁচে থাকে মরে যাওয়ার জন্য।

রতনকান্তি বলল, সে তো এক দিক দিয়ে সত্যিই কিন্তু এটাও তো সত্য যে মানুষ জীবনজুড়েই বেঁচে থাকার চেষ্টা করে?

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, মানুষ আসলে জীবনজুড়েই জীবন ভোগ করার চেষ্টা করে। যাকে আমরা বেঁচে থাকার চেষ্টা বলি।

রতনকান্তি খানিক চুপ থেকে বলল, তা হয় কী করে?

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, হয়। এই যে ধরো গুটিবসন্তের মতোন কালব্যাধি মহামারি হয়ে এলো। সবাই কী করল? যে যেভাবে পারল, পালাল। সবাই বাঁচতে চাইল। বীণাবালা কী করল, সে গঙ্গামহলের ফটক অবধি বন্ধ করে দিল। যাতে আক্রান্ত কেউ গঙ্গামহলে আসতে না পারে। আমি দেবুর। রোগের কথা জানলাম অনেক পরে। এমনিতে আমি তর্ক করার মানুষ নই। কিন্তু এই নিয়ে বীণাবালার সাথে আমার খুব এক চোট হয়ে গেল। কেন কাউকে পাঠানো হলো না। দেবুকে কেন কেউ নিয়ে আসল না। আমায় জানানো হলো না এইসব নিয়ে। আমি যখন যেতে চাইলাম, বীণাবালা আমায় নানান উপায়ে আটকে দিলো। তুমি তো জানো, আমি শক্ত ধাঁচের মানুষ নই। ফলে যেতেও পারিনি। কিংবা হয়তো বীণাবালা, বা আর যারা সব পালাল, তাদের মতোই আমার ভেতরও ভয় ছিল, দেখতে গিয়ে যদি ছোঁয়াচে ও রোগ আমারও হয়ে যায়?

অবনীন্দ্রনারায়ণ খানিক থামতেই রতনকান্তি বলল, হ্যাঁ, ওই যে বললাম সকলেই বাঁচতে চায়। কিন্তু আপনি বললেন মানুষ মরে যাওয়ার জন্য বাঁচে।

অবনীন্দ্রনারায়ণ কথা বললেন না। একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, কিন্তু ধরো যদি এমন হতো, আমি বীণাবালাকে বলতে পারতাম যে গঙ্গামহলের সকল ফটক খুলে দাও। বিষ্ণুপুরের সকল গুটিবসন্তে আক্রান্ত মানুষের জন্য চিকিৎসার, সেবার ব্যবস্থা হোক। তারা না বাঁচুক, কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্তে তারা দেখে যাক তাদের জন্য কী অপার ভালোবাসা আমরা পুষে রেখেছি, মানুষ পুষে রেখেছে। না হয় আমরাও আক্রান্ত হতাম, মরে যেতাম, বা যেতাম না। কিন্তু এই যে ভালোবাসা, এই ভালোবাসারা কি অনন্তকাল বেঁচে থাকত না? বেঁচে থাকা মানুষের মুখে মুখে। হয়তো এই ঘটনা বুকে পুষে রাখত অসংখ্য বেঁচে থাকা মানুষেরা। হয়তো অন্য কোনো মানুষের এমন অন্য কোনো দুর্যোগে এই ভালোবাসার কথা, এই ঘটনার কথা মনে করে কেউ কেউ গিয়ে আক্রান্ত সেই মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াত। ভালোবাসা ছড়িয়ে দিত। হয়তো সেই মানুষগুলোর মাঝে কিংবা তাদের ভালোবাসাতে সওয়ার হয়েই আমি, বীণাবালা, আমি, বা অন্য কেউ বেঁচে থাকতাম অনন্তকাল। কিন্তু আমরা কী করলাম? বা আর যারা পালাল তারা কী করল? সকলেই বেঁচে থাকত চাইলাম। কিন্তু এই বেঁচে থাকা কতদিনের? মৃত্যু পর্যন্ত, তাই তো? অথচ দেখো, শরীরের মৃত্যু তো অবশ্যম্ভাবী। পার্থক্য শুধু এই যে, আজ বা কাল। কিন্তু এই মৃত্যুকে আমরা কিভাবে এড়াবো? অথচ আমরা কেবল ওই মৃত্যু পর্যন্তই বেঁচে থাকতে চাই। জীবনটাকে ভোগ করতে চাই। আমরা আসলে মরে যাওয়ার জন্য বেঁচে থাকতে চাই।

রতনকান্তি অবনীন্দ্রনারায়ণের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।

অবনীন্দ্রনারায়ণ বললেন, জগতে একমাত্র ভালোবাসা আর মমতারাই বেঁচে থাকে। এগুলো ছাড়া মানুষ একা একা কখনো বেঁচে থাকতে পারে না। তাকে বেঁচে থাকতে হলে ওই ভালোবাসা, মমতায় সওয়ার হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। অথচ জীবনজুড়ে মানুষ কেবল মরে যেতেই বেঁচে থাকে। কী অদ্ভুত না?

রতনকান্তি অনেকক্ষণ কোনো কথা বলেনি। সে বিমূঢ় চোখ মেলে তাকিয়েছিল অবনীন্দ্রনারায়ণের দিকে। অবনীন্দ্রনারায়ণ হেসে বলেছিলেন, হ্যাঁ, তুমি বলতে পারো, ঘৃণাতেও মানুষ সওয়ার হতে পারে। কিন্তু যে মানুষ তার ঘৃণ্য কাজের জন্য যুগ যুগ ধরে মানুষের ঘৃণাতে সওয়ার হয়ে বেঁচে থাকে, সেই বেঁচে থাকাকে বেঁচে থাকা বলে না। বরং সেই বেঁচে থাকা যে কোনো মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর।

পথ চলতে চলতে অবনীন্দ্রনারায়ণের সাথে তার এই সকল অমূল্য মুহূর্তের কথা ভাবছিল রতনকান্তি। অবনীন্দ্রনারায়ণের প্রতিটি কথা, প্রতিটি ভাবনা যেন রতনকান্তির ভাবনার জগতটাকে কাঁপিয়ে দেয়, নতুন করে ভাবিয়ে তোলে।

.

রতনকান্তি বারোহাটি বাগানবাড়িতে এসে পৌঁছালে শেষ বিকেলে। পথে কয়েকবার জিরিয়ে নিলেও এতটা পথ হেঁটে আসায় সে ভয়াবহ ক্লান্ত। কিন্তু অপলা তাকে বসতেই দিল না। সে বলল, মেজোকর্তা খুব রেগে আছেন। এই এতটা দিন তোমার জন্যই অপেক্ষায় আছেন। এখনই যাও, তার সাথে দেখা করো আগে। কী যে কাণ্ড ঘটাবে, ভগবান জানেন। এই ক’দিন দিব্যি কী ভালো মানুষটিই না ছিলেন, হাসি খুশি। আজ কী যে হলো! সকাল থেকেই রেগে আগুন। কাছে গিয়ে কথাটি অবধি বলা যাচ্ছে না।

রতনকান্তি এটিরই আশঙ্কা করেছিল। সে আর বসলো না। খানিক জল খেতে পারলে ভালো হতো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কিন্তু সে সে সবের কিছুই করল না। সোজা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল। কিন্তু টানা বারান্দা ধরে দেবেন্দ্রনারয়ণের ঘরের দিকে হেঁটে যাওয়ার মাঝপথেই তাকে থামতে হলো। সিঁড়িতে থপথপ শব্দ তুলে তাকে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে অপলা ছুটে আসছে। রতনকান্তি অবাক দৃষ্টিতে বলল, কী ব্যাপার?

অপলা বলল, এতটা পথ হেঁটে এসেছ, একটু জল-টল খাও। বসে একটু দম নাও। তারপর যাও।

রতনকান্তি কিছুই বুঝল না। এই খানিক আগেই না অপলা তাকে বসতে অবধি দিল না। আর এখনই আবার বলছে জিরিয়ে, জল খেয়ে নিয়ে তারপর যেতে! ভারি অবাক হলো সে। অপলা বলল, তুমি নিচে গিয়ে বসো, আমি মেজোকর্তাকে খবর পৌঁছে দিচ্ছি।

রতনকান্তি অবাক হলেও কিছু বলল না। সে ধীর পায়ে নিচে চলে গেল। অপলা দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। সে বিভূঁইয়ের কথা ভুলে গিয়েছিল। ভাগ্যিস শেষ মুহূর্তে তার মনে পড়েছে। না হলে কী ভয়াবহ কাণ্ডটাই

হতো! সে দেবেন্দ্রনারায়ণের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল। দেবেন্দ্রনারায়ণ দরজা খুললেন সময় নিয়ে। তার পরনে বাইরে বেরুবার পোশাক। অনেকদিন পর তিনি দাড়ি কামিয়েছেন। কিন্তু অনভ্যস্ততায় তার সুদৃশ্য গোঁফজোড়া সমান হয়নি। মুখের এখানে-সেখানে সামান্য কেটেও গেছে।

অপলা বলল, রতনকান্তি এসেছে। আমি ভুলে এ ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম প্রায়। এখন নিচে বসে আছে।

দেবেন্দ্রনারায়ণ গম্ভীর গলায় বললেন, হুম।

অপলা লক্ষ করল, দেবেন্দ্রনারায়ণের মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। আজ সকাল থেকেই দেবেন্দ্রনারায়ণ আবার সেই আগের গম্ভীর দাপুটে মানুষটিতে যেন ফিরে গেছেন। কারণটি অপলা জানে না। কিন্তু কারণ যাই হোক, দেবেন্দ্রনারায়ণকে এভাবে ছাড়া মানায় না। সে খুব মানে, দেবেন্দ্রনারায়ণ হলেন ব্যাঘ। আর ব্যাঘ্র যদি বেড়ালের মতো মিউমিউ ডাকে তাহলে তা মানাবে কেন? দেবেন্দ্রনারায়ণ বকুন, খামখেয়ালিপনা করুন, অত্যাচারি হোন, তাও তিনি তার স্বরূপেই বাঁচুন, এর বেশি কিছু অপলা চায় না।

.

দেবেন্দ্রনারায়ণ যখন নিচে নামলেন, তখন প্রায় সন্ধ্যা। রতনকান্তি বসেছিল হলঘরের সামনে শান-বাঁধানো বেদীতে। দেবেন্দ্রনারায়ণ আসতেই সে উঠে দাঁড়ালো। দেবেন্দ্রনারায়ণ ঠাণ্ডা গলায় বললেন, তোমার কেন বিলম্ব হয়েছে সে কথা বলার দরকার নেই। তোমায় যে জন্য পাঠিয়েছিলাম তার কিছু থাকলে বলল।

রতনকান্তি এই দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা আড়ষ্ট অনুভব করল। এতদিন সে দেবেন্দ্রনারায়ণেরই জ্যেষ্ঠভ্রাতা অবনীন্দ্রনারায়ণের সাথে বন্ধুর মতো সহজভাবে মিশেছে। কথাও বলেছে কাছের মানুষের মতোই। কিন্তু আজ আবার দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে দাঁড়িয়ে তার এমন কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণের সামনে সে যেন খানিক গুটিয়ে গেল। তাছাড়া সে আসলে গঙ্গামহলের ঘটনা সংক্ষেপে বলতে পারবে না। তাকে বলতে হবে বিশদভাবে। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি অস্থির হয়ে আছেন।

রতনকান্তি যতটা সম্ভব বিনয়ী গলায় বলল, আজ্ঞে কর্তা, আপনি যদি খানিক সময় দিতেন আমি তাহলে বিস্তারিত বলতে চাই। বিস্তারিত বলা অতি আবশ্যক।

দেবেন্দ্রনারায়ণ যুগপৎ বিরক্তি এবং অধৈর্য নিয়ে বললেন, যতটা সম্ভব সংক্ষেপে বলো।

রতনকান্তি তার গঙ্গামহলে প্রবেশের ঘটনা থেকে বলা শুরু করল। কিভাবে অবনীন্দ্রনারায়ণের সাথে তার দেখা হলো। তারপর গঙ্গামহল রেণুকার সাথে দেখা হওয়া, ফিরে আসতে গিয়ে আবার অবনীন্দ্রনারায়ণের সামনে পড়ে যাওয়া এবং শেষ অবধি অবনীন্দ্রনারায়ণকে গান শেখানোর অজুহাতে থেকে যাওয়া অবধি সে বলল। এ পর্যন্ত এসে দেবেন্দ্রনারায়ণ বিরক্ত হয়ে গেলেন। বললেন, এতসব পাঁচালি রাখো। আসল কথা বলো। আমাদের নতুন জমিদার অবনীন্দ্রনারায়ণের কথা বলো। বিষ্ণুপুরের জমিদার হয়ে তিনি কেমন আছেন?

রতনকান্তি বলল, আজ্ঞে কর্তা, আপনি তাকে ভুল বুঝবেন না। উনি এই হিসেব-নিকেশের মানুষ নন। আপনি তো তাকে চেনেন। আপনার পিতার মৃত্যুর পর সকলে মিলে তাকে বুঝিয়েছে যে আপনি নিখোঁজ। কোথাও আপনার কোনো খোঁজ-খবরও নেই। আপনার কনিষ্ঠ ভ্রাতাও তার শ্বশুরালয়ে। তিনিও ফিরবেন বিলম্বে। এদিকে বিষ্ণুপুরজুড়ে কালব্যাধি গুটিবসন্ত মহামারির রূপ ধারণ করেছে। ওই মুহূর্তে প্রজাদের মাথার উপর আশ্রয় আর ভরসা হিসেবে একজন জমিদার থাকা অতি জরুরি। যেহেতু ওই মুহূর্তে আর কোনো বিকল্প নেই, তাই এটি এখন তার দায়িত্ব। সব ঠিক হয়ে গেলে, আপনি যখন ফিরবেন, তখন না হয় তিনি আপনার হাতে সে দায়িত্ব অর্পণ করে মুক্ত হবেন।

দেবেন্দ্রনারায়ণ জানতেন অবনীন্দ্রনারায়ণ এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে নেই। তিনি সহজ-সরল ভাবনার জগতের মানুষ। তার ধাতই আলাদা। কিন্তু তারপরও রতনকান্তির কাছে এমন স্পষ্ট শুনে খুব ভালো লাগল দেবেন্দ্রনারায়ণের। তিনি বললেন, সে কি এখনও কিছুই জানে না?

রতনকান্তি বলল, অল্প কিছু। কিন্তু ভেতরের কথা কিছু জানেন না। আপনার অসুখের কথা তিনি জেনেছেন অনেক পরে। তিনি আপনাকে দেখতে আসতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী তাকে নানাভাবে বুঝিয়েছিলেন যে আপনার অসুস্থতা গুরুতর কিছু নয়। আপনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কিছুদিনের মধ্যেই গঙ্গামহলে ফিরবেন। আপনি তো জানেনই কর্তা, তিনি কেমন অন্য ধাতের মানুষ। এই সকল বিষয়-আশয়ের প্রতি তার মন নেই। তিনি থাকেন। তার ভাবনার জগতে।

অবনীন্দ্রনারায়ণ দেবেন্দ্রনারায়ণের অসুখের কথা শুনে উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন, এটি খুবই সহজ স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। তারা একই মাতৃজঠরের দুই ভাই। একজনের অসুস্থতা অন্যজনকে পীড়িত করবে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু এই অতি স্বাভাবিক ঘটনাটুকুও দেবেন্দ্রনারায়ণকে কেমন আর্দ্র করে তুলল। তার হঠাৎ মনে হলো, তিনি কত-কতদিন সেই চিরচেনা গঙ্গামহল, গঙ্গামহলের সামনের বিস্তৃত গঙ্গাবতী নদী, গঙ্গামহলের ভৃত্য, পাইক-পেয়াদা, সহিস, কেঁচোয়ান থেকে শুরু করে চেনা মুখগুলো দেখেন না। কত কতদিন!

রতনকান্তি বলল, তিনি আপনার অপেক্ষায় আছেন।

দেবেন্দ্রনারায়ণ ভেতরে ভেতরে আর্দ্র হয়ে উঠলেও গম্ভীর মুখে শুধু বললেন, হুম।

তবে সেই মুহূর্তে তিনি মনে মনে একটি অদ্ভুত বিষয় আবিষ্কার করলেন, বড় ভাই অবনীন্দ্রনারায়ণের সাথে তার শেষ কবে কথা হয়েছে তা তিনি মনে করতে পারছেন না। দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিক চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর বললেন, কিন্তু অবনীন্দ্রনারায়ণ চাইলেই তো আর তার দায়িত্ব আমায় হস্তান্তর করতে পারবেন না। বিষয়টি তো এখন আর অত সহজ নেই, তাই না?

রতনকান্তি মাথা নিচু করে বলল, আজ্ঞে কর্তা, তা সত্যি। ওখানকার পরিস্থিতি আসলেই খারাপ।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, বীণাবালা আমার অপেক্ষায় আছে, তাই তো?

রতনকান্তি সামান্য মাথা দুলিয়ে বলল, আজ্ঞে কর্তা, তিনি আপনার অপেক্ষায় আছেন, তার ধারণা ছিল আপনি আরো আগেই ফিরবেন। আপনি না ফেরাতে উনি খুবই অবাক হয়েছেন। হয়তো কোনো পরিকল্পনাও ভেস্তে গেছে। আর আপনি হয়তো জানেন যে বিভূতিনাথ এবং ভুজঙ্গ দেব নামে দু’জন অতিশয় গণ্যমান্য ব্যক্তিও এই সকল কিছুর সাথে যুক্ত।

দেবেন্দ্রনারায়ণ আবারও গম্ভীর গলায় বললেন, আগে বুঝিনি। প্রথম খানিকটা আঁচ করেছিলাম সেই রাতে গঙ্গামহলের সেই বৈঠকে। সকল কিছুই বুঝতে ঢের বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল।

দেবেন্দ্রনারায়ণ পায়ে পায়ে হেঁটে কিছুটা সামনে এগোলেন। সেখানে হাতের বা দিকে একখানি ছাউনি। ছাউনির নিচে দু’খানা জুড়ি গাড়ি। একখানা রতনকান্তি সেই রাতে চালিয়ে এসেছিল। আরেকখানা দেবেন্দ্রনারায়ণের নিজের জুড়িগাড়ি। তিনি আজ সকালেই রঘুকে বলে রেখেছিলেন, কেঁচোয়ান যেন গাড়িখানা ধুয়ে মুছে প্রস্তুত করে রাখে। কোচোয়ান গাড়ি পরিষ্কার করে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছে। তিনি গাড়ির কাছে গিয়ে গাড়ির অবস্থা দেখে সন্তুষ্ট হলেন। তারপর রতনকান্তির কাছে ফিরে এসে ভারী গলায় বললেন, কিন্তু অবনীন্দ্রনারায়ণ এবং বীণাবালা দু’জনই যদি আমার অপেক্ষায় থাকেন তাহলে বিষয়টি জটিল এক ধাঁধা হয়ে গেল না? তুমি বলতে চাইছ, দু’জনের দুটি ভিন্ন। উদ্দেশ্য, এবং সেই ভিন্ন দুটি উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দু’জনই চাইছে আমি এখন গঙ্গামহলে ফিরি? একদিকে অবনীন্দ্রনারায়ণ আমায় জমিদারি অর্পণ করবেন, সেই জন্যে অপেক্ষা করছেন। অন্যদিকে তাহলে বীণাবালা কী চাইছে? সে কিসের জন্য অপেক্ষা করছে? সে নিশ্চয় চাইছে না যে অবনীন্দ্রনারায়ণ আমায় ভালোয় ভালোয় জমিদারি অর্পণ করুক?

রতনকান্তি সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলো না। সে বুঝতে পারছে না, কাল রাতে শোনা ওই ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের কথা সে দেবেন্দ্রনারায়ণকে কিভাবে বলবে? শুনে দেবেন্দ্রনারায়ণের প্রতিক্রিয়া কী হবে? দেবেন্দ্রনারায়ণ যদি বিশ্বাস না করেন যে বীণাবালা তাকে হত্যা করবার ছক এঁটেছে! যত যাই হোক, রতনকান্তি পথ থেকে কুড়িয়ে আনা এক মানুষ। দেবেন্দ্রনারায়ণ যাকে ভালো করে চেনেন না, জানেন না অবধি। রতনকান্তির কিছু আচরণ দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছে তাকে। আস্থাভাজন করে তুলেছে। বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। কিন্তু তারপরও রতনকান্তি শেষ অবধি অজানা-অচেনা এক পথের মানুষ! জমিদার বংশের বা

জমিদার বাড়িরও কেউ নয় সে। তার কাছ থেকে খোদ জমিদার বাড়ির বড় বউ, বর্তমান জমিদারপত্নী বীণাবালা সম্পর্কে এমন ভয়াবহ কথা তিনি কিভাবে নিবেন? তাছাড়া, আজ দেবেন্দ্রনারায়ণের মেজাজ-মর্জিও তেমন ভালো নয়। সবকিছুতেই কেমন ফুঁসে উঠছেন! রতনকান্তির ভারী দ্বিধা হতে লাগল। কিন্তু কথাটি তাকে বলতেই হবে।

রতনকান্তি কিছুটা ভূমিকা টেনে বলল, উনার উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন। তবে আমি কিছুটা হলেও জেনেছি। কিন্তু আমার ধারণা এটি ছাড়াও উনার অন্য কোনো উদ্দেশ্যও রয়েছে। একটি বিফল হলে উনি অন্যটি কাজে লাগাবেন। আমি হয়তো আরও কিছু বিষয় জানতে পারতাম, কিন্তু আপনার স্ত্রী আমার সাথে কোনো কথাই বলেননি। তিনি আমাকে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না।

এতক্ষণে যেন রেণুকার কথা মনে পড়ল দেবেন্দ্রনারায়ণের। তার ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধ হতে লাগল। এই যে এতটা সময় গেল, তিনি কত কিছু নিয়ে কথা বললেন, এমনকি রেণুকার সাথে রতনকান্তির দেখা হয়েছে সে বিষয়েও সে বলল। কিন্তু তারপরও তিনি একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করেননি, রেণুকা কেমন আছে! ভারি অন্যায় হয়েছে। এই এতটা দিনেও যা হয়নি, এই মুহূর্তেও মধ্যেই তার সর্বজয়া এবং সুদক্ষিণার জন্যও কেমন অস্থির লাগতে লাগল। রেণুকা, সর্বজয়া, সুদক্ষিণা এই এতগুলো দিন তার জন্য কী অপেক্ষাটাই না করছে!

দেবেন্দ্রনারায়ণ যেন মুহূর্তেই এই সকল জটিলতা, এই সকল ষড়যন্ত্র, সকল কিছুই মুহূর্তেই ভুলে গেলেন। রতনকান্তির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, এখনই জুড়িগাড়ি সাজাও, আমি গঙ্গামহল যাবো। তুমি যাবে আমার সাথে, এক্ষুনি।

রতনকান্তি বলল, আজ্ঞে কর্তা। কিন্তু যদি অপরাধ মার্জনা হয়, দু’টি কথা বলতে চাইছি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ এবার চূড়ান্ত বিরক্ত হলেন, সেই থেকে তো বলেই যাচ্ছ। তোমার কথার শেষ হবার তো কোনো লক্ষণ দেখছি না! এক কথা বলতে গিয়ে স্ত্রীলোকের মতোন দশ কথা টেনে আনছ। তারপর আর আসল কথাই বলছ না! সমস্যা কী তোমার?

দেবেন্দ্রনারায়ণ রীতিমতো অস্থির এবং রাগান্বিত হয়ে উঠলেন। তবে কি ভেবে মুহূর্তেই আবার নিজেকে সামলেও নিলেন। বললেন, হ্যাঁ, কী বলবে, বলো।

রতনকান্তি বলল, প্রথম কথা হচ্ছে, আমি যদি এখন আপনার সাথে গঙ্গামহলে যাই, তাহলে সেটি কি ভালো হবে? এই যে আমার একা একা গঙ্গামহলে যাওয়া, এতদিনের এই এতসব কিছু, সকলই যে সাজানো ছিল তা কিন্তু আর সবার কাছে বড় বাজেভাবেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

রতনকান্তি একটু থামল, তারপর রাজ্যের দ্বিধা নিয়ে বলল, আর আমার মন বলছে, এই এখন এত অন্ধকারে অতটা পথ যাওয়া আপনার জন্য নিরাপদ নয়। কোনো বিপদও তো হতে পারে! হয়তো অন্ধকারে কোনো বিপদ ওঁৎ পেতে রয়েছে।

দেবেন্দ্রনারায়ণ রতনকান্তির শেষের কথাটি শুনে বড় অবাক হলেন। বিষ্ণুপুরে তার আবার আলো-অন্ধকার কী? বিষ্ণুপুরে কে তার ক্ষতি করবে? কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, রতনকান্তি কথাটি অযথা বলেনি। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। তিনি রতনকান্তির দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে বললেন, তুমি কি কিছু ইঙ্গিত করছ?

রতনকান্তি বলল, আমায় ক্ষমা করবেন কর্তা। আড়ালে-আবডাল থেকে হলেও আমি আপনার জ্যেষ্ঠভ্রাতা পত্নীকে দেখেছি। উনার কথা শুনেছি। উনাকে আমার ভয়ংকর এক মানুষ মনে হয়েছে। উনি উনার উদ্দেশ্য পূরণে হেন কোনো কাজ নেই যা করতে পারেন না। আপনি খানিক আগেই জিজ্ঞেস করছিলেন, গঙ্গামহলে আপনার ফেরা নিয়ে উনি কেন তেমন উদ্বিগ্ন নন। উনি আপনার অপেক্ষায় কেন আছেন? যদি এমন হয় যে…।

রতনকান্তি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। সে বুঝতে পারছে না কথাটি স্পষ্ট করে বলা ঠিক হচ্ছে কি না। দেবেন্দ্রনারায়ণ রতনকান্তির হঠাৎ থেমে যাওয়া দেখে বললেন, তুমি কি বলতে চাইছ যে বীণাবালা আমার যাত্রাপথে কোনো ক্ষতি করতে পারে? আমায় হত্যা করতে পারে?

কথাটি বললেও তিনি ভেতরে ভেতরে রতনকান্তির উপর রুষ্ট বোধ করছেন। ছেলেটির মধ্যে কেমন একটা সবজান্তা ভাব রয়েছে বলে তার মনে হচ্ছে।

রতনকান্তি মাথা নিচু করে মৃদু গলায় বলল, আজ্ঞে, আমায় ক্ষমা করবেন কর্তা। আপনার সাথে কোনো প্রহরী নেই। এই অন্ধকারে কেউ যদি পথরোধ করে আপনাকে হত্যা করে। তারপর জুড়িগাড়িসহ মৃতদেহ উঁচু রাস্তার পাশের কোনো গভীর খাদে বা নদীতে ফেলে রাখে? তখন সকলে ভাববে অন্ধকারে গাড়িখানা উল্টে দুর্ঘটনায় আপনার মৃত্যু হয়েছে।

দেবেন্দ্রনারায়ণ রতনকান্তির কথায় হকচকিয়ে গেলেন। খুবই সাধারণ একটি বিষয়। খুবই সহজ। কিন্তু এই সহজ কাজটিতেই বীণাবালার সকল সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে যেতে পারে। তিনি বিষয়টি এভাবে ভেবে দেখেননি। দেবেন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘসময় রতনকান্তির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তুমি আমায় স্পষ্ট করে বলো, এমন কিছুর ইঙ্গিত কি তুমি পেয়েছ? বীণাবালাকে এতটা নৃশংস, এতটা জঘন্য ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছে।

রতনকান্তি মৃদু গলায় বলল, আমায় ক্ষমা করবেন কর্তা। কিন্তু এমন কিছুই আমি নিজ কানে শুনেছি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর থমথমে গলায় বললেন, ধরে নাও তোমার কথা আমি বিশ্বাস করছি না। কিন্তু শুধুমাত্র সতর্কতার খাতিরে আজ রাতে আমি আমার যাত্রা স্থগিত করলাম। তবে কাল ভোরের আলো ফোঁটার পর আমি যাত্রা করব।

রতনকান্তি আনন্দিত গলায় বলল, আজ্ঞে কর্তা। তবে আপনি যাওয়ার পরে আমি যাব। একসাথে যাওয়াটা বোধ হয় ঠিক হবে না।

দেবেন্দ্রনারায়ণ সেই একইভাবে বললেন, সে তোমার ইচ্ছে। আমি কাল যাত্রা করছি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ ঘুরে দোতলার সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। রতনকান্তি ক্লান্ত পায়ে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে মূল ফটকের দিকে এলো। সেখানে ততক্ষণে অন্ধকার জেঁকে বসেছে। বাইরে একটানা ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। ফুরফুরে হিমলে হাওয়া বইছে। অদ্ভুত সুন্দর এক অন্ধকারের মুহূর্ত। কিন্তু সেই অদ্ভুত সুন্দর অন্ধকারের মুহূর্তে তার মধ্যে কেন যেন প্রচণ্ড অস্থিরতা শুরু হলো। মনে হতে লাগল, গঙ্গামহলে ঘটতে যাওয়া কোনো এক ভয়ংকর ঘটনা সে এড়িয়ে গেছে, ধরতে পারেনি। যেটি ধরতে পারা খুব জরুরি ছিল। এই ধরতে না পারায় কোনো বিপদ হয়ে যেতে পারে। মহাবিপদ।

কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও রতনকান্তি ধরতে পারল না ব্যাপারটি কী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *