৪. বিলাস ট্যাকসি নিয়ে এল

বিলাস ট্যাকসি নিয়ে এল ডেকে। সবাই তৈরি হয়েছে বেরুবার জন্যে। বিলাসের রান্না করাই সার হয়েছে। খাবার টেবিলে কোনওরকমে সবাই বসেছিল এক বার। কিন্তু খাওয়া কারুরই ঠিক হয়নি। যার কোনওদিকে না তাকিয়ে খাবার কথা ছিল মন দিয়ে, সেই সুমিতাও পারেনি খেতে।

ওর মন জুড়ে যে এত উৎকণ্ঠা, এত অস্বস্তি ছিল, রবিদাকে পেয়ে কয়েক মুহূর্তের কান্নার আবেগে সেই বন্ধ হৃদয়ের দরজাটি গেল খুলে। যা উপচে পড়েছে, তাকে লুকিয়ে রাখার কোনও প্রশ্ন নেই। লুকিয়ে রাখতেও পারেনি।

কিন্তু ওর স্নান করতে যাওয়ার ফাঁকে যেন কী একটা ঘটে গেছে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই মেজদির চাউনি ও কথা শুনেই বিস্মিত লজ্জায় হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে পালাতে হয়েছিল। কিন্তু পালাবার উপায় ছিল না। সকলেই ওর দিকে ফিরে ফিরে দেখেছে কয়েকবার। বড়দি, মেজদি, বাবাও। কী যে ছিল সেই দেখার মধ্যে। তখন মনে হচ্ছিল, রবিদার পিঠে গু করে একটি কিল মেরে, ওঁরই বুকে মুখ লুকিয়ে বলে, কী বলেছেন আপনি ওদের। যেন সেই অলক্ষিত লতাটির সন্ধান পেয়ে গেছে ওরা, তাতে সবাই খুশি হয়েছে কি না বোঝা গেল না। অবাক যে হয়েছে, সেটুকু চাপা থাকেনি।

সুমিতা যেটুকু জানে না, সেটুকু হল, ওর অনুপস্থিতিতে রবি বলেছিস সুগতাকে, তোমরা সবাই চলে গেলে, সুমিতা একলা এ বাড়িতে থাকতে পারবে না।

রবিদার কথার মধ্যে কী ছিল, সহসা আর প্রতিবাদ করতে পারেনি কেউ। মহীতোষ বলে উঠেছিলেন, ঠিকই বলেছ রবি, ঝুমনো তো মাঝপথে নেমে যাবে। ওদের কী জরুরি সভা আছে উনিভার্সিটিতে। রুমনোটা ওর বড়দির সঙ্গে থাকতে পারবে।

ট্যাকসিতে ওঠার সময়ে রবিদা দাঁড়িয়ে রইলেন। সুমিতা ততক্ষণে বড়দি মেজদির মাঝখানে গিয়ে বসেছে জড়সড় হয়ে। মহীতোষ উঠতে গিয়েও দাঁড়ালেন থমকে। বললেন, কই রবি, তুমি সামনের দিকে ওঠো।

সুমিতা লক্ষ করে দেখেছে, রবিদা অনেকক্ষণ থেকেই কেমন বিমর্ষ হয়ে উঠেছেন। বাবার কথা শুনে চকিতে এক বার দেখে নিলেন বড়দিকে। কুণ্ঠিত হেসে বললেন, আমার যাওয়ার কি দরকার আছে কাকাবাবু? রবিদার কথা শুনে বাবাও এক বার বড়দির মুখের দিকে দেখলেন। বললেন, তোমার নিজের দিক থেকে যদি কোনও বাধা থাকে, তা হলে কিছু বলার নেই। কিন্তু আমি ভেবেছিলুম, তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে।

কিন্তু এই কথার মাঝখানে বড়দি একটি কথাও বললে না। ও তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, স্থির চোখে। বাবার সঙ্গে কথা বলার পর, সে-ই যে নীরব হয়েছে, তারপর থেকে মুখ খোলেনি এক বারও। অন্যান্যদিন রবিদার সঙ্গে এতক্ষণে কত কথা হয়ে যায়। কত কথা যে ওরা বলে। চিরদিন ভেবে ভেবে অবাক হয়েছে সুমিতা, ওদের দুজনকে কথা বলতে দেখে। যেন দুজনের কথা বলা কোনওদিন শেষ হবে না।

কিন্তু, এ পরিবারের অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো আজও রবিদা খাবার ঘরেই বসেছিলেন সকলের সঙ্গে। বাবা আর মেজদির সঙ্গে কয়েকটি কথা হয়েছে। সেই কথার ফাঁকে ফাঁকে সবাইকে লুকিয়ে অনেক বার রবিদা বড়দির দিকে তাকিয়েছেন। সুমিতার মনে হয়েছে, বড়দির আনত চোখও যেন লক্ষ করছিল সেটুকু। এমনকী, রবিদার ভাব-ভঙ্গি দেখে দু-একবার ওকে তাকাতেও হয়েছে। তবু বড়দির গলা থেকে একটি কথাও বেরোয়নি। যেন সে নিজেকে ক্রমেই শক্ত করেছে।

মেজদি বলে উঠল, তুমি চলো রবিদা। বলছিলে, সাড়ে বারোটায় তোমার ক্লাস আছে। ওখান থেকে চলে যেয়ো কলেজে।

মেজদির দিকে তাকাতে গিয়ে আর এক বার চোখ পড়ল সুজাতার দিকে। তার দিকে তখন সকলেরই চোখ পড়ছে গিয়ে। বোঝা গেল, বড়দিরও অস্বস্তি হচ্ছে। স্থির চোখের পাতা নড়েচড়ে উঠল কয়েক বার। বাঁ হাত থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটি ডান হাতে নিয়ে, রবিদার দিকে তাকিয়ে কোনও রকমে বলল খুব নিচু গলায়, চলো না।

লোহার গেট ধরে দাঁড়িয়েছিল বিলাস। আরও দূরে লক্ষ করলে দেখা যেত, বাইরের ঘরের জানালার পরদার আড়ালে ঝি অচলার মুখখানি। বিকৃত মুখে তার একটি অশ্রদ্ধার ভাব। বিলাসের কাছে শুনেছে যে, বড় মেয়ে তার স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির জন্যে কোর্ট কাছারি করছে। ভাবছিল, হবে না। এত বাইরের ছেলে-ছোকরার ভিড় যে বাড়িতে, সে বাড়ির মেয়েরা ছাড়াছাড়ি না করবে কেন?

ওপাশে, ডেপুটি বাড়ির দোতালায় বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল প্রৌঢ়া গিন্নি আর ছোট মেয়ে। মেয়েটি সুমিতারই সহপাঠিনী। বয়সে দু-এক বছরের বড়। নাম তাপসী। তাকিয়ে যেন মজা দেখছে।

রবিদা উঠে গিয়ে বসলেন ড্রাইভারের পাশে। সুমিতা জানত, বড়দির ওই বলাটুকুর জন্যই দাঁড়িয়েছিলেন রবিদা। ওদের দুজনের মধ্যে ওটা ভদ্রতা কিংবা সামাজিকতার ব্যাপার নয়, সম্পর্কের সংকোচ ও আড়ষ্টতা। বাইরে মস্ত বড় মানুষ রবিদা। অধ্যাপনা আর রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেক সম্মান ওঁর। যখন বড়দির সামনে এসে দাঁড়ান, তখন আর বাইরের সেই মানুষটিকে চেনা যায় না। মনে হয়, বড়দির একটি অঙ্গুলি সংকেতের জন্য সর্বক্ষণ অপেক্ষা করে আছেন উনি। এর মধ্যে সুখ ও আনন্দ আছে কতখানি তা জানে না সুমিতা। কিন্তু, দুজনের মাঝখানে, কোথায় কোন অদৃশ্য একটি ব্যথার ছোট কাঁটা যেন আছে লুকিয়ে। তাকে চোখে দেখা যায় না। তাকে অনুভব করা যায় না বড়দির দিকে তাকিয়ে। রবিদার সান্নিধ্যে এলে খচখচানিটুকু টের পাওয়া যায়।

গাড়ি এসে পড়েছে ট্রাম রাস্তার উপরে। রোদে স্নান করে উঠেছে সারা শহরটি। ট্রামের ঘর্ঘর, বাসের চিৎকার, প্রাইভেট গাড়ির হর্ন, রিকশার ঠুনঠুন, মানুষের কলরবে কেমন এক সচকিত উল্লাসে উদ্দাম হয়ে উঠেছে রাস্তাঘাট। যুদ্ধের পর দাঙ্গার অবরোেধ সবে কাটিয়ে উঠেছে শহর। তার ছাপ লেগে আছে। এখনও এখানে সেখানে। দেয়ালে দেয়ালে, দাঙ্গা আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পোস্টারে গেছে ছেয়ে। কোনওটিতে গান্ধীজির শান্তির বাণী, কোনওটিতে সাম্প্রদায়িক রণহুংকার ক্রিস মিশনের বিরুদ্ধে জেহাদ কোনওটিতে। এ-আর-পি ওয়ার্ডেন পোস্টগুলির সামনে সেই নীল কুর্তা মানুষগুলির জটলা নেই আর। শুধু সরিয়ে নেওয়ার অবসর পাওয়া যায়নি এখনও সাইনবোর্ডগুলি। এখানে সেখানে এখনও জরুরি শেলটারের প্রাচীরগুলি রয়েছে দাঁড়িয়ে।

গাড়িতে সবাই চুপচাপ। সবাই বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আড়চোখে দেখল এক বার বড়দিকে। বড়দি স্নান করেনি। আঁচড়ে নিয়েছে সামনের চুলগুলি। সাবান ধোয়া মুখে একটু হিমানীর প্রলেপ মাত্র। সাদা রং-এর কাশ্মীরি সার্জের ব্লাউজের সঙ্গে পরে এসেছে আঁশপাড় সাদা তাঁতের শাড়ি।

বিয়ের এক বছর আগে এমনি সাদা জামাকাপড় খুব এত বড়দি। সে সব খদ্দরের জামাকাপড়। তখন সুমিতা সবদিক থেকেই অনেক ছোট। ওর স্কুলের বইয়ের আশেপাশে আর যে সমস্ত ভগবতী আর দেশনেত্রীদের বহু বিচিত্র চমকপ্রদ কাহিনীগুলি থাকত, সেইসব নায়িকাদের সঙ্গে হুবহু মিশিয়ে ফেলত বড়দিকে। বড়দি মেজদি আর রবিদার মুখে নানান কথা শুনে শুনে, ওর বুকের মধ্যে এক অস্পষ্ট আগুনের আঁচ লেগেছিল। কেমন একটি অস্পষ্ট ঘৃণা ও বিদ্বেষে ফুলত মনে মনে। কে যে শত্রু, কার বিরুদ্ধে এত রাগ, তা-ই ভাল করে জানত না সুমিতা। এই উত্তাপের পিছনে বড়দির সেই মূর্তিখানি আসল। বড়দি তখন ধ্যানের নায়িকা।

তখন রবিদার সঙ্গে রোজ বাইরে যেত বড়দি। রবিদার সঙ্গেই সারাক্ষণ। সেই স্রোতে মেজদিও ভেসে গিয়েছিল। কত ছেলে আসত বাড়িতে। সকলের মধ্যে বড়দিকে দেখাত রানির মতন। সেদিনের রবিদা আর বড়দি, আর আজকের এই দুই বন্ধুতে কত তফাত।

সবচেয়ে চরম হয়েছিল, বড়দির জেলে যাওয়া। সারা কলকাতাটাই যেন বড়দির জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। বাড়িতে পুলিশ তছনছ করছে। মেজদি গেছে পালিয়ে। কী ভাগ্যি, বাবা তখন অবসর নিয়েছেন চাকরি থেকে। জেল হয়েছিল রবিদারও।

পনেরো দিন পরেই জেল থেকে বেরিয়ে এল বড়দি। ছ মাস পরে রবিদা। গিরীনদার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বড়দির, জেলে যাওয়ার আগেই। রবিদা এসে দেখলেন, গিরীনদা এ বাড়ির প্রত্যহ আসরের একজন। রবিদা আসার পরেই তো পাকাপাকি হল বিয়ের কথা।

তখনও সুমিতা রবিদার হাসির দিগন্তে বিষণ্ণতার অস্তাভা দেখেছে। যেটুকু ও আজও জানে না, সেটুকু সেদিনও জানত না যে, রবিদার দীপ্ত চোখের কোণ থেকে কোন শিখাঁটি নিভে গেছে একেবারে। সে শিখাঁটি নিভে গেলে বাইরেটাকে তো অন্ধকার করে না। যেখানটাতে ঘনীভূত হয় অন্ধকার, সে জায়গাটি থাকে সকলের অগোচরে। যেখানে বেদনা যত, তত জমে নিজের ধিক্কার। রবিদার মতো মানুষেরা সেইখানটি ঢেকে রেখে হেসে বেড়ান দশজনের সামনে।

সুমিতা জানত না, বিয়ের আগে যেদিন বড়দি রবিদাকে বলেছিল, রবি, আমি তোমার ওপর অন্যায় করছি না তো?

তীব্রবেগে রক্ত প্রবাহ ছুটে এসেছিল রবির মুখে। কী তীব্র হাসি ফুটেছিল তার ঠোঁটে। যেন আগুন জ্বলছিল দপ দপ করে। বলেছিল, আমার ওপর? না, না, তেমন দুরাশা তো আমি কোনওদিন করিনি উমনো। তা হলে তো স্পষ্ট করে তোমাকে বলতে পারতুম কোনওদিন।

ঠিক সেই মুহূর্তেই ওরা দুজনেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল দুজনের কাছ থেকে। সেই দুরাশা থাকলে স্পষ্ট করে বলতে পারত রবি? এত বড় মিথ্যে কথাটা কেউ বোধ হয় চোখে চোখে তাকিয়ে বলতে পারেনি, শুনতেও পারেনি।

এর বেশি বলতে পারেনি কেউ কিছু। রবি বাইরে বেরিয়ে এসে দেখেছিল, রাত্রের নির্জন রাস্তায়, একটি বাড়ির ছায়ায় যেন ঘাপটি মেরে পড়ে আছে গিরীনের মস্ত বড় গাড়িটি।

বড় রাস্তায় এসে আর এক বার হেসেছিল রবিদা। ভুল, সবটাই একেবারে ভুল। চোখে আগুন, ঠোঁটে আগুন যে রুদ্রাণীর হাতের পতাকা নিয়ে সবার আগে রবিদা মৃত্যু-উল্লাসে যাবেন ছুটে, সেই রুদ্রাণী ধরেছে রানির বেশ। সত্যি, একটুও বিদ্বেষ হয়নি রবির। ভেবেছিল, এ ছাড়া কী উপায় আছে সুজাতার। ও যেভাবে মানুষ হয়েছে, যে মন নিয়ে বেড়েছে, ঠিক সেই পথই নিয়েছে বেছে। ওইদিকেই সুজাতার সীমান্ত। তার ওপারে রবির আগুনের শিখায় কাঁপা অস্পষ্ট দিগন্তে কী আছে, কে জানে। বুকের মধ্যে কেঁপে উঠেছিল রবির। কী এক সর্বনাশের হাত থেকেই না সুজাতা বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে, বেঁচেছে নিজে। হয়তো, পরে না পেত ওর রুদ্রাণীকে, না পারত রানির মতো সমাদর করতে। তখন ধুলো মাখামাখি করে দাঁড়াতে হত দুজনকে দশজনের সামনে। কী অপমান!

আজ তো সুজাতা ধুলো মেখে দাঁড়ায়নি। দাঁড়িয়েছে রানির মতোই। রবিকে সে ধরেওনি, ছাড়েওনি। নিজের মনকে চোখ টিপে ছলনার মধ্য দিয়ে ও স্বীকার করেনি গিরীনকে। ও যেন চিরকাল ধরেই প্রতীক্ষা করছিল গিরীনের। যেদিন এসে গিরীন চাইল, দু হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।

রানি বলেই, রানির মতো বেরিয়ে এসেছে আজ।

এলোমেলো হয়ে উঠেছিল সুমিতার অস্পষ্ট মন। কোন বেশটি যে বড়দির সত্যি, সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। ওই জেলে যাওয়ার বেশ, না গিরীনদার সামনের বেশ। যদিও কোনওটাই ওকে ক্ষুণ্ণ করেনি।  মনে হয়েছিল বড়দি যেন একটি স্বাধীন সুন্দর পুতুল। কখনও এই বেশে, কখনও ওই বেশে বেড়ায় সেজে।

কিন্তু কোথা থেকে কী ঘটে গেল। সুমিতার মনে পড়ল সেই বিশ্রী সংবাদটির কথা। গিরীনদার চেহারার সঙ্গে কোনওদিন ঘটনাটির মিল খুঁজে পায়নি। স্পষ্ট মনে পড়ছে, বড়দিকে লেখা, সুমিতার লুকিয়ে দেখা গিরীনদার সেই পত্রটি।–তোমাকে প্রতারণা আমি কোনওদিন করতে চাইনি। যার বিষয় নিয়ে তুমি এতটা ক্ষিপ্ত হয়েছ, সে আমার বিবাহিতা স্ত্রী নয়। তখন আর সামনাসামনি নয়, দূর থেকে ওরা পত্রে পত্রে আয়ুধ নিক্ষেপ করছে পরস্পরের প্রতি।

আর একটি গিরীনদার পত্র–তার সঙ্গে তো আমি কোনও সম্পর্কই রাখিনি। তোমার হিতৈষী সংবাদদাতারা আমার নামে মিথ্যে কথা বলছেন তোমাকে।

স্ত্রীর অধিকারে যে সব গালাগাল আমাকে দিয়েছ, আমার অতি বড় শত্রুও কোনওদিন তা দেয়নি। সেই জন্যই বলছি, ছোট মুখে বড় কথায় আমার বড় ঘৃণা।

পড়তে পড়তে মনে হত, সুমিতার বুকের তন্ত্রী ছিঁড়ে পড়বে। একে তো লুকিয়ে দেখার কাঁপুনি, তার ওপরে সেই ভয়ংকর কথাগুলি। এলোমেলোভাবে মনে পড়ছে সেই সব পত্রের কথা-হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্কেরই শৈথিল্য ছিল না। সে কথা এখনও বলছি। তাতে তোমার যত ঘৃণা এবং রাগই হোক, এ সত্য স্বীকার না করে পারছিনে। কিন্তু সে সুন্দরী এবং বিদুষী কি না অনর্থক এ প্রশ্ন করে আমাকে খোঁচা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না। হ্যাঁ, সে আমার রক্ষিতা ছিল। তুমি লিখেছ, আমার মতো নীচ সবই করতে পারে। তা ঠিক, সুতরাং তার রূপ ও বিদ্যার কথা থাক। তোমাকে যে পেয়েছিলুম, সেটা তো অস্বীকার করতে পারবে না। একটি কথা, পত্র লেখালেখি পরস্পরের প্রতি ঘৃণাটাই বাড়ালে। সুতরাং আর থাক। তবে আমার বিশ্বাস, তোমার অধিকারে আমি কোনওরকমেই হস্তক্ষেপ করিনি। তোমার ফিরে আসার পথ পরিষ্কার। আর তা না চাইলে সেটাকেও অপরিষ্কার করে রাখতে রাজি নই আমি।

আবার

তার কাছে আর যাব কি না যাব, কিংবা, আমি আমার পুরনো জীবন ত্যাগ করব কি না, তোমার ওই ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ প্রশ্নের মুখে আমি তার কোনও জবাবদিহি করতে পারব না। হ্যাঁ, যত দিন প্রয়োজন বুঝব, তত দিন তাকে আর্থিক সাহায্য না করে পারব না। তবে এত দিনে তোমার সঙ্গে আমার ব্যাপারটা পারিবারিক অপমানের শেষ সীমায় এসে পড়েছে। তুমি ফিরে না এলে আমাদের বংশে একটি নতুন অধ্যায় রচনা করতে হবে আমাকে। আমি কোনও কিছুকেই আর ঝুলিয়ে রাখতে পারব না।

কত কথা সেই পত্রাবলীর। তারই পরিণতির সর্পিল পথ বেয়ে এখনও চলতে হচ্ছে।

হঠাৎ গাড়িটি দাঁড়াল। চমকে তাকাল সুমিতা। মেজদি নেমে যাচ্ছে। ব্যস্ত ছুটন্ত চৌরঙ্গি। ইংরেজি ছবিঘরের ভিড়। ভিড় চারদিকে সাদা, কালো মেয়ে পুরুষের। মাথার উপরে গম্বুজের কপালে ঘুরছে। সময়ের কাঁটা। কাঁচের গায়ে গায়ে ঝুলছে রকমারি জামা ও প্রসাধন সামগ্রী।

গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল মেজদি। বেশে ওর বৈরাগ্য, ভঙ্গিতে রাজেন্দ্রাণী। নেমে দাঁড়াতেই দেখা গেল, হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটি ফেলে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে আসছে মৃণাল। মেজদির বন্ধু, একসঙ্গে পড়েছে। গত বছর পাশ করেছে মৃণাল। মেজদি পরীক্ষা দিতে পারেনি।

সে এসে আগে রবিদার দিকে চেয়ে হাসল একটু। তারপরে হঠাৎ মুখখানি করুণ করে তাকাল বড়দির দিকে। যেন শবযাত্রার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বড়দিও হাসল একটু। মেজদি বলল বড়দিকে, দিদি, আমি তা হলে যাচ্ছি।

বড়দিকে কেমন অন্যমনস্ক লাগছিল। ঘাড় কাত করে বলল, আচ্ছা। মহীতোষ ফিরে তাকিয়ে বললেন, আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস ঝুমনো।

মৃণালের পাশ ঘেঁষে ফিরতে গিয়ে মেজদি বলল, চেষ্টা করব বাবা।

বাবা ওদের দুজনকেই দেখছিলেন। মৃণাল আর মেজদিকে।

গাড়ি বেরিয়ে গেল। হঠাৎ সমস্তটাই যেন সুমিতার স্বপ্নের ঘোরে ঘটে গেল। বাবা, বড়দি, মেজদি, রবিদা, সবাইকেই ভালবেসেছিল সুমিতা। তার জন্যে ওর জীবনে নিরঙ্কুশ সুখ ছিল না। কীভাবে, কোনদিক দিয়ে কতগুলি বিচিত্র সুখ-দুঃখ গড়ে উঠেছিল ওর মনে। সেই মন, মানুষের এমন বৈচিত্র্য দেখে সভয়ে কেঁদে উঠেছে, কেঁপে উঠেছে। আজ মৃণালকে মেজদির পাশে দেখে, অন্যদিনের মতো খুশিতে ও উপচে উঠতে পারল না। এখনও বিত্ত ও অবস্থা দিয়ে সুখ-দুঃখ রচনা করার পথে পা বাড়াতে পারেনি সুমিতা। খালি ভয় আজ, মানুষ তার নিজের হাসি নিজেই দেয় ধুয়ে শেষ করে। মানুষের জীবনধারণের মধ্যে কোথায় কতগুলি মহাসর্বনাশ আছে লুকিয়ে। আর মানুষ তাকে কেমন করে যেন নিজেই ডেকে নিয়ে আসে। কী করে বলবে ও, মৃণালকে দেখলে মেজদির গম্ভীর পাতলা ধারালো ঠোঁটের কোণে একটি বিচিত্র হাসির রেখা দেখতে পায় কেন? একদিন পেয়েছিল গিরীনদার সামনে বড়দিরও। তারপর ওই পত্রগুলি। যার প্রতিটি লাইনের ফাঁকে ফাঁকে অদৃশ্য রয়ে গেছে আসল কথাগুলি। ফুটে উঠেছে শুধু ক্ষিপ্ত, অবুঝ, অপমানকর কতগুলি মিথ্যা কথার সারি।

রাস্তাঘাট, গাড়ির গতি, ভেতরে বাবা, বড়দি,রবিদা, সব মিলিয়ে ঘোর কাটল না ওর স্বপ্নের। কেবল একটি মর্মভেদী কান্না ঠেলে উঠতে লাগল বুক থেকে।

সুমিতার গল্প-সাহিত্য, হাসি-খেলা-গানের সহজ পথ দলে দুমড়ে ভাঙছে চোখের সামনে। সবটাই এত বড় মিথ্যে এই সংসারে?

এই ঘোরের মধ্য দিয়েই গাড়ি কোর্টে এল। কখন উঠে গেল বার লাইব্রেরিতে। উকিল অনিলবাবু বক বক করে গেলেন। কালো গাউন পরা শকুনের মতো উড়ে উড়ে যেন চলেছে কতগুলি মানুষ। আশেপাশে ডাইনে বাঁয়ে, সর্বত্র তাদের ছায়া। জোড়া জোড়া চোখ এসে গিলছে বড়দিকে, সুমিতাকে, সবাইকে। আলমারিতে, বইয়ে, আলোছায়াতে সর্বত্রই যুদ্ধমান তীক্ষ্ণদৃষ্টি। চারদিকের এক মহাসমারোহ এখানে যেন ঘিরে আসছে এক বিশালকায় খঙ্গ নিয়ে। বড়দি আর গিরীনদার মাঝখানের সমস্ত তন্ত্রীকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে।

ভয় নিয়ে, কান্না চেপে, কখন রবির সঙ্গে এসে দাঁড়াল সুমিতা নীচের গাড়ি ভিড় করা লনের একপাশে, সে খেয়ালটুকুও নেই। তারপর হঠাৎ ও চমকে দেখল, একটি গাড়ির দরজা খুলে নামছেন গিরীনদা। ও অস্ফুট গলায় বলে উঠল, গিরীনদা।

রবি বলল, কই?

তারপর দুজনেই নিঃশব্দে চেয়ে দেখল, গিরীনদা নেমেছেন গাড়ি থেকে। সেই গিরীনদা! দেখে কাঁপছে সুমিতার বুকের মধ্যে। হয়তো ডাক দিয়ে বসবে। ঠিক তেমনি, টাই আঁটা, কোট পরা, ফিটফাট গিরীনদা। তবু যেন সব মিলিয়ে কিছু অবিন্যস্ত। চোখ থেকে গগলস নামিয়ে ড্রাইভারকে কী বলে চলে গেলেন ওপরে। দেখতেও পেলেন না ওঁর রুমনো সাহেবাকে, বন্ধু রবিকে।

হঠাৎ রবির গলার স্বরটি কেমন গাঢ় হয়ে উঠল। সুমিতার ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল, আমরা এখানেই। দাঁড়াই রুমনি কেমন।

-হ্যাঁ।

আবার বলল, কী ভাবছ রুমনি?

কী ভাবছে সুমিতা? বড় ভয় পেল, চোখ ফেটে জল আসবে এখুনি। তবুও হাসল। হেসে রুদ্ধ গলায় বলল, বলব রবিদা?

অবাক হয়ে বলল রবি, বলো না।

সুমিতা সেই অসহজ পথের নির্মমতার যন্ত্রণা নিয়ে, সহজ পথের কথাটাই বলে ফেলল নির্ভয়ে। ঢোঁক গিলে, হেসে বলল, আচ্ছা রবিদা, যদি গিরীনদা এখুনি বড়দির কাছে গিয়ে দাঁড়ান হেসে?

রবি চমকে উঠে বলল, অ্যাঁ? কিন্তু সুমিতা তখন ফিসফিস করে যেন স্বপ্নের ঘোরে বলেই চলেছে, যদি গিরীনদা গিয়ে বড়দির হাত ধরে টেনে নিয়ে যান। যদি বড়দিটা কেঁদে ফেলে সত্যি সত্যি গিরীনদার সঙ্গে চলে যায়। ওরা সব ঝগড়া ভুলে যদি সেই আগের মতো হয়ে যায়। সেই আগের মতো হাসতে হাসতে, ঠিক আগেরই মতো ওই গাড়িতে চলে যায়।..

সমস্ত গলাটি ভরে উঠল সুমিতার হাসি কান্নার সুধায়। রবি কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারল না। খানিকক্ষণ নীরবতার পর সুমিতাকে কাছে টেনে, মাথায় হাত বুলিয়ে, চাপা স্বরে বলল, ঠিক বলেছ রুমনি, ঠিক। এর চেয়ে ভাল আর কিছু হয় না।

রবিদা আর সুমিতা দুজনেই আচ্ছন্ন হয়ে রইল ওদের ঘোরে। কতক্ষণ এমনি আচ্ছন্ন হয়েছিল কে জানে। সময়ের মনে সময় পার হয়ে গেল। এই দুজনে নিঃশব্দ অথচ দ্রুত নিজের নিজের মনে অদৃশ্য ধারায় চলে গেল কোন সুদুরে। চমক যখন ভাঙল, দেখল গিরীনদা চলে যাচ্ছেন গাড়ি নিয়ে। তবে? তবে কী হল? একটু পরেই নেমে এল বড়দি বাবার সঙ্গে। পাশে পাশে উকিল অনিলবাবু। দেখল, বড়দির রংহীন সাদা শাড়িটাতে আগুন লেগেছে যেন। ওর সারা চোখেমুখে একটি অস্বাভাবিক দীপ্তি। একটি অদ্ভুত চাপা তীব্র হাসির ধারে চমকাচ্ছে ওর চোখমুখ। এমনকী, ওর চলবার ভঙ্গিটি পর্যন্ত আরও দৃপ্ত খরো হয়ে উঠেছে।

.

অনিলবাবু বিদায় নিলেন হাসতে হাসতে। কিন্তু বাবাকে তেমনি অসহায় করুণ দেখাচ্ছে।

কাউকে কিছুই বলতে হল না। বোঝা গেল, সেই অমোঘ পরিণতি ঘটে গেছে। সুমিতার সব স্বপ্ন ভেঙে, একটি ছিন্ন পত্রের মতো নেমে এল বড়দি। গিরীনদা গেছেন তার আগেই। রাজশক্তি দিয়ে ওদের বিচ্ছেদ আজ সম্পূর্ণ হয়েছে। বড়দি বলল, তোমরা বাড়ি যাও বাবা, আমি এক জায়গায় ঘুরে যাব।

বাবা যেন ভয় পেয়ে চমকে উঠে বললেন, কোথায়?

বড়দি: অনেক দিন অমলাদের বাড়ি যাইনি। আজ একটু ঘুরে যাব।

 বাবা ছেলেমানুষের মতো করুণ গলায় বললেন, আজ থাক উমনো, অন্যদিন যাস।

বড়দি ওর সেই দীপ্ত হাসিমুখেই বলল, না বাবা, আমার বাড়ি যেতে এখুনি ইচ্ছে করছে না। তোমরা যাও আমি সন্ধ্যার আগেই ফিরব।

তারপর রবিদার দিকে ফিরে, নিজের হাতঘড়ি দেখল। বলল, এ কী, তুমি কলেজ কামাই করে ফেললে? সাড়ে বারোটায় তোমার ক্লাস ছিল যে?

রবিদা অপ্রস্তুত গলায় বললেন, হ্যাঁ, আজ আর যাওয়া হল না।

বড়দি এক মুহূর্ত দুরের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, বাবা, তুমি চলে যাও, আমি পরে যাচ্ছি।

 বলে ও চলে গেল। দৃপ্ত পদক্ষেপে, ওর সাদা শাড়িতে আগুন ছড়িয়ে যেন গেল চলে। একটু পরে, এরা তিনজনেও অগ্রসর হল। খানিকটা এগিয়ে রবিদা বললেন, আমি আজ চলি কাকাবাবু। কাল পরশু বাড়িতে যাব। তারপর সুমিতা বাবার পাশাপাশি হেঁটে চলল।

তখনও অফিস আদালতের ছুটি হতে কিছু বাকি। মাঘের রোদে কাঁপছে অনাগত চৈত্রের দীপ্তি। রাস্তায় ভিড় কম। ট্রামবাসগুলি ফাঁকা ফাঁকা।

বাবা বললেন, রুমনো, চ, বাগবাজারে তোর জ্যাঠাইমার কাছে যাই আজ একটু।

রুমনির কথা বলতে ভয় হল। অন্য কিছু নয়, ওর সমস্ত রুদ্ধ কান্না ভেঙে পড়বে বলে। সম্মতি জানাল ঘাড় কাত করে।