৪. বিলাতের কথা

বিলাতের কথা

উনি আমাদের জ্ঞাতি শ্ৰীযুক্ত জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরকে আমার বিলেত যাবার কথা লিখেছিলেন। তাঁরা আমাদের নাবিয়ে নিতে জাহাজে লোক পাঠিয়েছিলেন। তিনি খ্ৰীস্টান হয়ে খ্রীস্টান কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে বিয়ে করেছিলেন বলে তার বাপ প্রসন্নকুমার ঠাকুর তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। সেই অবধি তিনি সপরিবারে বিলেতে বাস করছিলেন। তাঁর দুই মেয়ে ছিল—বলেন্দ্রবালা ও সত্যেন্দ্রবালা, তাঁদের ডাকনাম ছিল বালা ও সতু। জ্ঞানেন্দ্রমোহনের রং খুব সাফ ছিল। তিনি আদরের ছেলে ছিলেন বলে বাপ অল্প বয়সে যশোরের এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। সেই স্ত্রীর তিনি খুব অতুগত হয়ে পড়েছিলেন, এমন কি পাখার বাতাস দিয়ে ঘুম পাড়াতেন ও দিনরাত কাছে কাছে থাকতেন। সেই স্ত্রী মারা যেতে তিনি খুব অস্থির হয়ে পড়েন, সেই সময় কৃষ্ণ বন্দ্যোঃ নামে এক পাদ্রী তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে খ্ৰীস্টান করে ফেল্লেন। বাপের মৃত্যুর সময় নাকি তিনি একবার দেখা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল বলে ঢুকতে পারেন নি।

প্রসন্নকুমার ঠাকুর অত্যন্ত বেঁটে ছিলেন বলে’ তাঁর গুষ্টিসুদ্ধ তিন চার পুরুষ পর্যন্ত বেঁটে রয়ে গেছে। বালা ও সতু খুব বেঁটে ছিলেন, চেহারাও তেমন ভাল ছিল না, কেবল খুব চুল ও বড় বড় চোখ ছিল। তখনকার ধরণের ইংরিজী পোশাক পরতেন। তাদের ওখানে যে-সব ইংরাজ ভদ্রলোকের নিমন্ত্রণ হত—হয়ত বিয়ের সম্বন্ধ করবার উদ্দেশ্যে—তাঁদের মধ্যে একজন আমাকে চুপি চুপি বলেছিলেন যে, এদের বিয়ে করব কি, শরীরে যে কিছু নেই, শুধু কাঠি। বালা ও সতুর শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়নি। আর সকলে মারা গেলে অনেকদিন পর সতু বিষয়-কর্মের পরামর্শের জন্য মহারাজা যতীন্দ্রমোহনের কাছে কলকাতায় এসেছিল। যদিও জ্ঞানেন্দ্রমোহন বাপের বিষয় থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তবু কিছু বিষয় তাঁর ছিল, তার থেকে তাঁর চলত। শেষে তাঁর এক বন্ধু উকীল Ramsdenকে বলেছিলেন যে সে যদি Tagore নাম নেয় ত তাঁর বিষয়ের উত্তরাধিকারী হতে পারবে।

আমরা প্রথম বিলেতে গিয়ে তাঁর বাড়ীতে উঠেছিলুম আর আমার ছেলেদের দেখে খুশি হয়ে বলেছিলেন যে, বেশ ঠাকুরবাড়ীর উপযুক্ত হয়েছে। তাদের খেলনাও দিয়েছিলেন। পরে তিনি আমাদের অন্যত্র থাকবার ব্যবস্থা করে দেন। Miss Sharp ও Miss Donkins বলে দুই মেমের সঙ্গে আমার ভাব হয়েছিল। Miss Sharpএর বয়স হয়েছিল, কিন্তু কুমারীর মত বেশ সাজগোজ করে থাকতেন। তাঁর একজন দাসী ছিল, সে তাঁর পাকাচুল কুঁক্‌ড়ে দিয়ে সাজিয়ে রাখত। আমি মনে করতুম তিনি আমার বয়সী, পরে শুনলুম ৪০৷৫০ হয়ে গেছে। তাঁর সঙ্গে ব্রাইটন গিয়েছিলুম মনে আছে। সেখানে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যেতুম। তখন একটু একটু কাজ-চালানো ইংরিজী বলতে পারতুৎ। বিলেতে প্রথম বরফ-পড়া দেখে আমি এত মোহিত হয়েছিলুম যে, পাতলা রেশমী শাড়ি পরেই বাইরে ছুটে গেলুম, আর যেমন পড়ছে কুড়তে লাগলুম। সবাই বারণ করেছিল যে এখন বাইরে যেও না। তার দরুণ খুব অম্লখ করেছিল। উপর-হাতে ফুলো হয়ে ভিতরে ঘা হয়ে গেল। তখন Lord Lister আমাকে দেখেছিলেন—যিনি পরে antiseptic বের করেন। বহুদিন পরে যখন দেশে এলুম গুরুচরণ কবিরাজের তেলে সেই নালি ঘা সেরে গেল। বিলেতে অনেক দিন slingএ হাত বেঁধে বেঁধে শেষে এতটা উঁচুর বেশি হাত তুলতে পারতুম না।

বিলেতে আমার যে ছেলেটি অসময়ে হয়, তার মাথাটা ভাল করে হয়নি, শীঘ্রই মারা গেল। তাকে বলেছিলুম দ্বারকানাথ ঠাকুরের গোরের কাছে গোর দিতে। গত বৎসরও হেমলতা বউমারা গিয়ে সেটা দেখে এসেছেন। তার উপরের চোবি বলে’ ছোট ছেলেটিও বিলেতে মারা যায়। আমার মনে হয় রামা বলে চাকরটা তাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে বেশি জোরে জোরে হাঁটাত। আমার এখনো তার জন্য দুঃখ হয়। সে Lily of the Valley ফুলের নাম করতে বড় ভালবাসত মনে পড়ে।

ছেলেদের অসুখের সময় Miss Donkins বলে মেমটি আমাকে খুব সাহায্য করেছিল। সে গৃহস্থের মেয়ে, পরের উপকার করে বেড়াত। ছেলেদের যখন খুব খারাপ অবস্থা, তখন রাত্রি-বেশেই ছুটে বেরিয়ে পড়েছিল ডাক্তার ডাকতে।

বিলেতে প্রায় আড়াই বছর ভিন্ন ভিন্ন ভাড়া বাড়ীতে ছিলুম। উনি মাঝে বিলেতে এলেন, রবিকেও সঙ্গে এনেছিলেন। বালা পিয়ানো বাজাত, সেই সঙ্গে রবি গাইতেন, তাতে সে খুব খুশি হত। দুজনে খুব জমে গেল। রবির মাথা পরিষ্কার করে আমি চুল আঁচড়ে দিতুম। তারপর তিনি গান গাইতে শিখলে খুব সুখ্যাতি পেলেন। ছেলেরা শুনত ‘পাপা আসছে, পাপা আসছে’। কিন্তু সেখানে যত ছেলের পাপার রং সাদা দেখে, আর ওঁর রং কালো দেখে বিবি দরজার আড়ালে দরজার আড়ালে লুকিয়ে গিয়ে বল্ল “That’s not my Papa!” ওদের ‘পাপার’ সঙ্গে ভাব করতে অনেক সময় লাগল। কিছুদিন পরে আমরা একসঙ্গে ফ্রান্সে যাই। Mediterranean-এর নীল জল খুব সুন্দর। ফরাসীতে সমুদ্রের নাম “Mer” আর মায়ের নাম Mère-এর একই উচ্চারণ। এই দুইএর তারা তুলনা করত। আমরা Nice-এ একটা হোটেলে ছিলুম। সেখানে ছেলেমেয়েদের একটু একটু ফরাসী শেখাবার জন্ম হোটেলের চাকরদের কাছে নিজে গিয়ে দুধ জল প্রভৃতি চাইতে বলতুম।

আর একটি সুন্দর ছোট সাদা কুকুর সেখান থেকে এনেছিলুম বলে’ তার নাম রেখেছিলুম Nicois। দেশে এলে বাড়ীর দু’ একটি ছেলে তার ভেউ ভেউ ডাক শুনে ভয়ে খাটের উপর উঠে পড়ত মনে আছে। কিন্তু সে আসলে দুষ্টু ছিল না, কামড়াত না। ট্রেনে তাকে টুকরিতে লুকিয়ে বেঞ্চির তলায় রেখে দিলে সে স্টেশনে থামবার সময় গার্ডকে গাড়িতে আসতে দেখলে ভেউ ভেউ করে নিজের অস্তিত্ব জাহির করত, তাও মনে আছে। হোটেলে আমার মেয়ের চুল দেখে কোন মেম নাকি বলেছিল যে ঠিক যেন কালো রেশমের মত। তাই আবার বিবি এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলে সে কথা ঠিক কিনা। আর তাকে একটা ছোট পুতুল দিয়েছিলুম; তার সঙ্গে একবাক্স কাপড় ছিল, বদ্‌লে বদ্‌লে পরাবার জন্য। সেই পুতুলটাকে খাবার টেবিলে বিবি রেখে দিত, আর হোটেলের ওয়েটর তাকে ক্ষেপাবার জন্যে তুলে তুলে নিয়ে যেত।

ফরাসীদের জাতীয় সঙ্গীত Marseillaise আমার খুব ভাল লাগত। এখনো একটু একটু মনে পড়ে। ওখানে একটা বাড়ী ছেড়ে যখন আর একটা বাড়ীতে উঠে গেলুম তখন প্রথম বাড়িওয়ালী খুব রেগে গেল, বল্লে—এখানে যেরকম ভাল খাবার পাও সেখানে কী তা পাবে? –একটু একটু ফরাসী বলতে পারতুম। একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ফরাসী বলতে পারি কিনা; তাতে আমি বল্লুম—Je ne parle pas francais; তখন তিনি বল্লেন, এইত বল্লে। আর একটা কথা মনে আছে, রাস্তা কোথায় জানতে হলে বলতে হত Par où faut-il prendre pour aller অমুক জায়গায়। Ollendorf-এর একরকম বই পাওয়া যেত তাতে কথাবার্তা চালান একরকম শেখা যায়। ছোট ছেলেপিলে নিয়ে এই অল্প জ্ঞান নিয়ে বিদেশে যে কি করে কাটিয়েছিলুম, আর উনিই বা কি করে এই অবস্থায় আমাকে একলা পাঠালেন তাই এখন ভাবি। অবশ্য সেখানকার লোক আমাকে মায়া করত আর সবাই আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করত।

বিলেতে থাকতে Tunbridge Wells, Brighton ও Torquay তে গিয়েছিলুম। সমুদ্রের ধারের জায়গায় ছেলেরা বালি নিয়ে বালতি নিয়ে খেলা করত। দেশের লোকের মধ্যে Mabel Dutt (পরে ওঁর বন্ধু তারকনাথ পালিতের বউ হন) বেশ সুন্দরী ছিলেন। তার বাপ ক্ষেত্র দত্ত মেম বিয়ে করেছিলেন। মাঝে মাঝে আমাদের ওখানে আসতেন। একদিন মদ খেয়ে গেলাসে অল্প রেখেছিলেন, বিবি সেটুকু খেয়ে ফেলেছিল। সেজন্যে তাকে খুব বকলুম, কারণ তাঁর জিভে একটা অসুখ ছিল। মেবল আমার ছেলেদের চেয়ে বয়সে কিছু বড় ছিল ও তাদের শোবার সময় গল্প বলত। তাতে Beelzebub-এর কথা থাকত, তারা এখনো মনে করে। আর একজন ছিলেন অ্যানি চক্রবর্তী। তার বাপ গুডীব (সূর্যকুমার) চক্রবর্তী দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিলেত গিয়ে ডাক্তার হয়ে এসেছিলেন ও মালয় ফিরিঙ্গী মেম বিয়ে করেছিলেন। তার বড় মেয়ে সিসটার বেনেডিক্‌টা নামে নান্‌ হন আগেই বলেছি। এই অ্যানি ছিলেন তাঁর আর একটি মেয়ে ও তাঁর চেহারায় মাতৃকুলের কিছু ছাপ ছিল। তিনি এদেশে এসে প্যারী রায় নামক ব্যারিস্টারকে বিয়ে করে অনেকগুলি ছেলেমেয়ে নিয়ে বহু দিন সুখে সচ্ছন্দে সংসার করেন। তিনি সামাজিক মেলামেশায় খুব পটু ছিলেন। তাঁর সঙ্গে অনেক কাল ধরে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল। তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর সম্প্রতি পঙ্গু অবস্থায় বেঁচে আছেন শুনতে পাই, তবে আমার সঙ্গে আর দেখাশুনো হয় না।

আমারও এখন শরীর প্রাচীন ও অপটু। চোখে কানে ভাল দেখতে শুনতে পাইনে। সব কথা ভুলে যাই। সেইটেই আমার বেশী কষ্টকর মনে হয়। কাজেই পূর্বজীবনের কথা ধারাবাহিক ভাবে বলা আমার পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তবু আমার মেয়ে ছাড়েন না, তাই তাঁর প্রশ্নের যতটুকু পারি উত্তর দিয়ে যাই। তাতে খাপছাড়া ভাবে কিছু জানা যায় মাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *