৪. বিজয়ী ইসলাম

8. বিজয়ী ইসলাম

রাজকীয় ইসলাম (১৫০০-১৭০০)

গানপাউডারের আবিষ্কার এবং এর ব্যবহার সামরিক প্রযুক্তির বিকাশ ঘটায় যার ফলে শাসকরা আগের চেয়ে বেশী প্রজাদের ওপর শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন I আরও বৃহত্তর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন তাঁরা, যদি দক্ষ পরীক্ষিত প্রশাসনের ব্যবস্থা করতে পারতেন। আব্বাসীয় ক্ষমতার অবনতির সময় থেকে ইসলামী রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ানো সামরিক রাষ্ট্র এবার অস্তিত্ব পেল। ইউরোপেও রাজারা বিশাল কেন্দ্রীকৃত রাজ্য এবং পরম রাজতন্ত্র গড়ে তুলতে শুরু করছিলেন, যেখানে আরও সুসমন্বিত সরকারী প্রশাসন যন্ত্র ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ এবং ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিনটি প্রধান ইসলামী সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে: ইরানে সাফাভীয় সাম্রাজ্য, ভারতে মোঘুল সাম্রাজ্য এবং আনাতোলিয়া, সিরিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও আরবে অটোমান সাম্রাজ্য। অপরাপর আকর্ষণীয় রাজনীতি ও আবির্ভূত হয়েছিল। সির-ওক্সাস বেসিনের উযবেকিস্তানে এক বিরাট মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আর মরোক্কোয় গঠিত হয়েছিল শিয়া প্রাধান্য বিশিষ্ট আরেকটি রাজ্য। যদিও এই সময়ে মুসলিমরা মালয়ী আর্কিপলেগোর বাণিজ্য-নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ক্ষেত্রে চীনা, জাপানি, হিন্দু ও বুদ্ধ ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছিল, কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে মুসলিমরাই আধিপত্য বিস্তার করে।

সুতরাং বিজয়ের একটা পর্ব ছিল এটা। তিনটি প্রধান সাম্রাজ্যই যেন ইসলামের সাম্যবাদী ঐতিহ্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বলে মনে হয়েছে এবং তারা পরম রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেছে। জনসাধারণের জীবনের প্রতিটি দিক পরিচালিত হত আমলাতান্ত্রিক নির্ভুলতার সঙ্গে আর সাম্রাজ্যগুলো গড়ে তুলেছিল এক অসাধারণ প্রশাসন যন্ত্র। তারা সবাই মঙ্গোলদের সমর রাষ্ট্রের ধারণায় প্রভাবিত ছিল, তবে সাধারণ মানুষকেও তাদের রাজকীয় নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, যাতে রাজবংশ তৃণ-মূল পর্যায়ে সমর্থন লাভ করতে পারে। কিন্তু একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক দিয়ে এই সাম্রাজ্যগুলো পুরনো আব্বাসীয় রাষ্ট্রের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। আব্বাসীয় খলিফাগণ এবং তাদের রাজদরবার কখনওই প্রকৃত অর্থে ইসলামী প্রতিষ্ঠান ছিল না। শরীয়াহ্ আইনের আওতাভুক্ত ছিলেন না তাঁরা, নিজস্ব আলাদা জাগতিক নীতিমালা নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু নতুন সাম্রাজ্যগুলোর শক্ত ইসলামী মুখীনতা ছিল, খোদ শাসকগণই যাকে উৎসাহিত করেছেন। সাফাভীয় ইরানে শিয়া মতবাদ রাষ্ট্র-ধর্মে পরিণত হয়; মোঘুল নীতিমালায় ফালসাফাহ্ ও সুফিবাদের প্রবল প্রভাব ছিল; অন্যদিকে অটোমান সাম্রাজ্য পরিচালিত হয়েছে সম্পূর্ণও শরিয়াহ্ অনুযায়ী।

কিন্তু পুরনো সমস্যা রয়েই যায়। চরম অধিপতিকে যত ধার্মিক বলেই মনে হোক না কেন, এই ধরনের একনায়কতন্ত্র মৌলিকভাবে কুরানের চেতনা বিরোধী। অধিকাংশ লোক তখনও চরম দারিদ্র্যের মাঝে বসবাস করত এবং কৃষিভিত্তিক সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অনাচার-অবিচারের শিকার ছিল তারা। নতুন নতুন সমস্যাও দেখা দিয়েছিল। মোঘুল ভারত এবং অটোমান সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্ৰ আনাতোলিয়া, এ দুই জায়গাতেই মুসলিমরা আপেক্ষিকভাবে নবাগত ছিল। উভয়েরই তাদের অমুসলিম প্রজাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি শেখার প্রয়োজন ছিল, যারা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। শিয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা সুন্নী ও শিয়াদের মাঝে এক নতুন ও অনতিক্রম্য ভাঙন সৃষ্টি করে, জন্ম দেয় অসহিষ্ণুতা আর আক্রমণাত্মক সাম্প্রদায়িকতাবাদের যা ইসলামী জগতে ছিল নজীরবিহীন– একই সময়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্টদের তিক্ত বিরোধের অনুরূপ। খোদ ইউরোপের চ্যালেঞ্জও ছিল, এতদিন পর্যন্ত মুসলিমদের চোখে যা ছিল পশ্চাদপদ এলাকা, আগ্রহ জাগানোর অনুপযুক্ত। ইউরোপ অবশ্য কৃষিভিত্তিক সমাজের সকল সমস্যা হতে মুক্ত সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক সমাজ গঠন করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল মাত্র, যা শেষপর্যন্ত পাশ্চাত্যকে কেবল ইসলামী বিশ্বকে অতিক্রমই নয় বরং বশীভূত করায় সক্ষম করে তুলেছিল। নতুন ইউরোপ পেশীশক্তি পরখ করছিল কেবল, তবে ষোড়শ শতাব্দীতে তখনও প্রকৃত হুমকি হয়ে ওঠেনি। রাশানরা যখন মুসলিম কাযান ও অস্ত্রাখানে আক্রমণ চালিয়ে (১৫৫২-৫৬) সেখানে খ্রিষ্টধর্ম চাপিয়ে দেয়, উত্তর ইউরোপে নতুন বাণিজ্য পথ খোলার মাধ্যমে লাভবান হয়েছিল মুসলিমরা। ১৪৯২-তে যে ইবারীয় (Iberian) পর্যটকরা আমেরিকা আবিষ্কার করেছিল, পৃথিবীর চারপাশে খুলে দিয়েছিল নতুন নতুন নৌপথ, পর্তুগিজ বণিকদের চলিষ্ণুতা বাড়িয়ে দেয় তারা। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে লোহিত সাগরীয় এলাকায় নিও-ক্রুসেড পরিচালনার মাধ্যম তারা দক্ষিণ সাগরে মুসলিম বাণিজ্য ধ্বংস করার প্রয়াস পায়। পর্তুগিজদের এসব হামলা পাশ্চাত্যের কাছে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ইসলামী জগতে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। ইরানে শিয়া সাম্রাজ্য গড়ে তোলার ব্যাপারেই মুসলিমরা বেশী আগ্রহী ছিল, প্রাথমিক সাফাভীয়দের অসাধারণ সাফল্য সুন্নী প্রত্যাশার ওপর এক বিরাট আঘাত ছিল। কয়েক শতাব্দী সময়কালের মধ্যে প্রথমবারের মত ইসলামী রাজ্যের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে এক স্থিতিশীল, শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী শিয়া রাষ্ট্রের পত্তন ঘটেছিল।

সাফাভীয় সাম্রাজ্য

দ্বাদশবাদী শিয়া মতবাদ গ্রহণকারী আযেরবাইজানের সাফাভীয় সুফি ধারার অনুসারীরা কিছুদিন ধরেই জর্জিয়া ও ককেসাসের ক্রিশ্চান অধিবাসীদের বিরুদ্ধে ঘায়ু ( Ghazu) হামলা চালিয়ে আসছিল, কিন্তু তারা মেসোপটেমিয়া ও পশ্চিম ইরানের আমিরদের ক্রোধেরও শিকার হয়েছিল। ১৫০০তে ষোল বছর বয়স্ক ইসমায়েল এই ব্যবস্থার পির পদে অধিষ্ঠিত হয়ে আমিরদের হাতে নিহত পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের প্রয়াস পান। ১৫০১-এ অভিযানের এক পর্যায়ে তাব্রিয অধিকার করেন ইসমায়েল এবং পরবর্তী এক দশক সময়কালে ইরানের বাকি অংশ অধিকার করে চলেন। তিনি দ্বাদশবাদী শিয়াবাদ তাঁর নতুন সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হবে বলে ঘোষণা দেন।

বিস্ময়কর পরিবর্তন ছিল এটা। এর আগ পর্যন্ত অধিকাংশ শিয়াই ছিল আরব। ইরানের রাঈ, কাশান, খুরাসান ও পুরনো গ্যারিসন শহর কুম-এ শিয়া কেন্দ্র ছিল বটে, কিন্তু সিংহভাগ ইরানিই ছিল সুন্নী। তো ইরান থেকে সুন্নী মতবাদ নিশ্চিহ্ন করার কাজে নামেন ইসমায়েল: সুফি তরিকাহ্ সমূহকে দমন করা হয়; উলেমাদের হত্যা করা হয় নয়ত পাঠানো হয় নির্বাসনে। প্রশাসনের সদস্যদের জন্যে প্রথম তিন রাশিদুনকে অভিশম্পাত দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে–যাঁরা বৈধভাবে আলীকে প্রদত্ত ক্ষমতা “জোর করে ছিনিয়ে” নিয়েছিলেন। অতীতে কখনও কোন শিয়া শাসক এমন ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে নির্যাতনের এক নতুন ক্ষমতার যোগান দিচ্ছিল। পূর্ববর্তী দুশো বছর ধরে শিয়া ও সুন্নীদের মাঝে একটা আঁতাত ছিল। কয়েক শতাব্দী ধরে শিয়াবাদ ছিল গোপন অতীন্দ্রিয়বাদী গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় যারা গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে কোনও সরকার বৈধ হতে পারে না বিশ্বাস করে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। কীভাবে একটা “রাষ্ট্রীয় শিয়াবাদে”র অস্তিত্ব থাকতে পারে? কিন্তু শাহ্ ইসমায়েল এই যুক্তিতে টলেননি। সম্ভবত: দ্বাদশবাদী অর্থোডক্সি সম্পর্কে বেশী কিছু জানতেন না তিনি, কেননা তিনি তরিকাসমূহের চরমপন্থী ঘুলুউ শিয়াবাদের লোক-গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন, যারা বিশ্বাস করত মেসিয়ানিক কল্পরাজ্য সমাসন্ন। অনুসারীদের কাছে নিজেকে হয়ত গোপন ইমাম হিসাবেই তুলে ধরেছিলেন তিনি, শেষ জমানার যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্যে ফিরে এসেছেন। সুন্নী ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত তাঁর জিহাদ ইরানেই শেষ হয়নি। ১৫১০-এ তিনি সুন্নী উযবেকদের খুরাসান থেকে বিতাড়ন করেন এবং তাদের ওক্সাসের উত্তরে ঠেলে দেন; সুন্নী অটোমানদেরও আক্রমণ করেন তিনি, কিন্তু ১৫১৪-তে চ্যান্ডিরানের যুদ্ধে সুলতান প্রথম সেলিমের কাছে পরাস্ত হন। আপন রাজ্যের বাইরে সুন্নীদের ধ্বংস করার তাঁর প্রয়াস ব্যর্থ হয়, কিন্তু ইরানের অভ্যন্তরে তাঁর আক্রমণ সফল হয়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অধিকাংশ ইরানি প্রবলভাবে শিয়া হয়ে যায় এবং আজ পর্যন্তও তাই আছে।

শাহ্ ইসমায়েল এক সামরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের ওপর দারুণ আস্থা ছিল তাঁর, যারা প্রশাসন পরিচালনা করত। অতীতের স্যাসানীয় ও আব্বাসীয় সম্রাটদের মত শাহকে “পৃথিবীতে ঈশ্বরের ছায়া” হিসাবে অভিহিত করা হত; কিন্তু সাফাভীয় বৈধতার ভিত্তি ছিল ইসমায়েলের নিজেকে ইমামদের বংশধর হিসাবে দাবী। অবশ্য সাফাভীয়দের এটা উপলব্ধি করতে সময় লাগেনি যে প্রতিপক্ষদের মাঝে বিপ্লবী উদ্দীপনা জাগিয়ে দেয়া তাদের চরমপন্থী আদর্শ সরকারের আসীন হবার পর আর তেমন একটা কাজে আসবে না। শাহ্ প্রথম আব্বাস (১৫৮৮-১৬২৯) ঘুলুউ আদর্শে অনুপ্রাণিত আমলাদের বাদ দিয়ে জনগণকে দ্বাদশবাদী শিয়া মতবাদের অধিকতর অর্থোডক্স রূপ শিক্ষা দেয়ার জন্যে বিদেশ থেকে আরব শিয়া উলেমাদের আমদানি করেন, তাদের জন্যে মাদ্রাসা নির্মাণ করেন, মুক্ত হাতে আর্থিক সমর্থন দেন তাদের। আব্বাসের অধীনে সাম্রাজ্য এর তুঙ্গ অবস্থায় পৌঁছে যায়। অটোমানদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত বিজয় অর্জন করেন তিনি এবং তাঁর রাজধানী ইসফাহান এক সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ প্রত্যক্ষ করে, যা সম্প্রতি ইউরোপে সংঘটিত ইটালীয় রেনেসাঁর মত ওই অঞ্চলের পৌত্তলিক অতীত হতে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল; ইরানের বেলায় এর মানে ছিল প্রাক-ইসলাম যুগের পারসিয়ান সংস্কৃতি। এটা ছিল সেইসব মহান সাফাভীয় চিত্রশিল্পী বিহাদ (Bihzad মৃত্যু: ১৫৩৫) এবং রিয়া-ই-আব্বারি (Riza-i-Abbari, মৃত্যু : ১৬৩৫)-দের সময়, যাঁদের হাতে সৃষ্টি হয়েছিল আলোকোজ্জ্বল ও স্বপ্নীল নানা মিনারাত। ইসফাহান পরিণত হয়েছিল আকর্ষণীয় মসজিদ আর মাদ্রাসাসহ পার্ক, প্রাসাদ আর বিশাল সব খোলা ময়দানের এক অনন্য সাধারণ নগরীতে।

অবশ্য অভিবাসী নতুন উলেমাগণ পড়েছিলেন এক অদ্ভুত অবস্থায়। প্রাইভেট গ্রুপ হিসাবে তাঁরা কখনও নিজস্ব শিয়া মাদ্রাসা পাননি, বরং গবেষণা ও আলোচনার জন্যে পরস্পরের বাড়িতে মিলিত হতেন। নীতিগতভাবে তাঁরা সবসময় সরকারের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছেন; কিন্তু এবার তাঁদের ইরানের শিক্ষা ও বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থার দায়িত্ব গ্রহণ করার প্রয়োজন দেখা দিল, কাঁধে চাপল সরকারের অন্যান্য ধর্মীয় কার্যক্রমও। শাহ্ তাদের উদার হাতে উপহার আর মঞ্জুরী দান করেন যার কল্যাণে আর্থিক দিক দিয়ে শেষমেষ স্বাধীন হয়ে যান তাঁরা। ধর্ম বিশ্বাসকে তুলে ধরার এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না বলে ভাবলেন তাঁরা, কিন্তু তখনও রাষ্ট্র সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করেছেন, সরকারী পদপদবী প্রত্যাখ্যানকরেছেন, প্রজা হিসাবে পরিগণিত হতে চাননি। তাদের অবস্থান ছিল সম্ভাবনাময়ভাবে শক্তিশালী। দ্বাদশবাদী অর্থোডক্সি অনুযায়ী শাহগণ নন, বরং উলেমাগণই গোপন ইমামের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাফাভীয়রা উলেমাদের সামাল দিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, সমগ্র ইরানবাসী শিয়া মতবাদে দীক্ষিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁরা পুরোপুরিভাবে নিজেদের অবস্থানের ফায়দা ওঠাতে পারেননি। কিন্তু তাঁদের নতুন ক্ষমতার মানে ছিল দ্বাদশবাদী শিয়া মতবাদের আকর্ষণীয় কিছু বৈশিষ্ট্য চাপা পড়ে যাওয়া। নিজেদের গভীর অতীন্দ্রিয়বাদী ব্যাখ্যা অনুসরণ করার পরিবর্তে তাঁদের কেউ কেউ বরং অক্ষরমুখী হয়ে উঠেছিলেন। মুহাম্মদ বাকির মজলিসি (মৃত্যু: ১৭০০) সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উলেমায় পরিণত হয়েছেন, কিন্তু এক নতুন শিয়া গোঁড়ামি প্রদর্শন করে গেছেন তিনি। উলেমাদের কেবল ফিক্হ’র ওপরই জোর দিতে হবে। মজলিসি ইরানি শিয়াবাদের অতীন্দ্রিয়বাদ ও দর্শনের প্রতি এমন এক অনাস্থা যোগ করেন, যা আজও টিকে আছে।

সমবেত জিকর এবং সুফি সাধকদের কাল্ট-এর মত পুরোনো সুফি ভক্তিবাদের স্থান দখল করার জন্যে মজলিসি জনগণকে শিয়া মূল্যবোধ ও ধার্মিকতা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে কারবালায় শাহাদাত্বরণকারী হুসেইনের সম্মানে পালিত আচার অনুষ্ঠানের ওপর জোর দেন। সুবিশাল মিছিল আর আবেগময় শোকসঙ্গীত গাওয়া হত, মানুষ বিলাপ আর কান্নায় মত্ত হত তখন। এসব আচার ইরানের প্রধান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কারবালার করুণ ঘটনা তুলে ধরা আবেগময় নাটক ‘তাজিয়াহ্’র প্রচলন ঘটে যেখানে জনগণ আর নিষ্ক্রিয় দর্শক মাত্র নয়, বরং আবেগময় সাড়া প্রদান করে তারা বুক চাপড়ে কাঁদে, ইমাম হুসেইনের দুর্ভোগের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে তোলে। এইসব আচার এক গুরুত্বপূর্ণ রক্ষা কবচের কাজ করেছে। যখন তারা কাঁদে, কপাল চাপড়ায়, বেসামাল হয়ে কাঁদে, নিজেদের মাঝে শিয়া ধর্মানুরাগের মূল আকাঙ্ক্ষা ন্যায়-বিচারের প্রসঙ্গ জাগিয়ে তোলে দর্শকরা, নিজেদের প্রশ্ন করে কেন সব সময়ই ভালো মানুষেরাই দুর্ভোগের শিকার বলে মনে হয় আর খারাপ বা অশুভ কেন টিকে থাকে। কিন্তু মজলিসি এবং শাগণ এই আচার অনুষ্ঠানের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে যত্নের সঙ্গে চাপা দিয়েছেন। আপন গৃহে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হওয়ার বদলে জনগণকে সুন্নী ইসলামের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর শিক্ষা দেয়া হয়েছে। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামে হুসেইনকে অনুসরণ করার শপথ গ্রহণের পরিবর্তে মানুষকে বলা হয়েছে তাঁকে একজন পৃষ্ঠপোষক হিসাবে দেখার জন্যে যিনি তাদের স্বর্গলাভ নিশ্চিত করতে পারবেন। আনুষ্ঠানিকতাকে এভাবে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার উপায় বানানো হয়েছিল। জনগণকে তাগিদ দেয়া হয়েছে ক্ষমতাবানদের তোষামোদ আর কেবল নিজেদের স্বার্থের কথা ভাববার। ইরানি বিপ্লব (১৯৭৮-৭৯) অনুষ্ঠিত হবার আগে আর কাল্ট দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরুদ্ধে নির্যাতিত জনগণের ক্ষোভ প্রকাশের উপায় হতে পারেনি

কিন্তু উলেমাদের কেউ কেউ পুরনো শিয়া ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত রয়ে গিয়েছিলেন; তাদের ধ্যান-ধারণা বর্তমান কালেও, কেবল ইরানে নয়, বরং গোটা বিশ্বের সংস্কারক ও বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা জোগায়। মির দিমাদ (মৃত্যু: ১৬৩১) এবং তাঁর শিষ্য মোল্লা সদরা (মৃত্যু: ১৬৪০) ইসফাহানে অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনের এক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, মজলিসি এর দমনে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছেন। দর্শন ও আধ্যাত্মিকতাকে একত্রিত করার সুহরাওয়ার্দির ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন তাঁরা; অনুসারীদের অতীন্দ্রিয়বাদী অনুশীলন শিক্ষা দিয়েছেন যাতে করে তারা আলম আল- মিথাল এবং আধ্যাত্মিক জগতের অনুভূতি লাভে সফল হয়ে উঠতে পারে। দু’জনই জোর দিয়ে বলেছেন যে, একজন দার্শনিককে অবশ্য অবশ্য অ্যারিস্টটলের মত যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার অনুসারী হতে হবে, কিন্তু তাকে আবার সত্য আবিষ্কারে কল্পনানির্ভর, সজ্ঞামূলক দৃষ্টিভঙ্গিও গড়ে তুলতে হবে। উলেমাদের সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার ব্যাপারে দু’জনই দারুণ বিরূপ ছিলেন, একে তাঁরা ধর্মের বিকৃতি হিসাবে দেখেছেন। শক্তির দ্বারা সত্য আরোপ করা যায় না এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সমরূপতাবাদ (Intellectual Conformism) প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে বেমানান। মোল্লা সদরা রাজনৈতিক সংস্কারকে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হিসাবেই দেখেছেন। তাঁর প্রধান রচনা আল-আফসান আল-আরবাহ্ (দ্য ফোরফোল্ড জার্নি- The fourfold Journey)-তে তিনি জাগতিক পৃথিবীকে পরিবর্তনের প্রয়াস নেয়ার আগে একজন নেতার যেসব অতীন্দ্রিয়বাদী প্রশিক্ষণ নেয়া আবশ্যক সেসবের বর্ণনা দিয়েছেন। সবার আগে তাঁকে অবশ্যই অহমবোধ ঝেড়ে ফেলতে হবে, স্বর্গীয় আলোক গ্রহণ করতে হবে আর অর্জন করতে হবে ঈশ্বরর অতীন্দ্রিয় বোধ। এই পথে তাঁরা শিয়া ইমামদের মত, যদিও একই মাত্রার নয়, একই রকম আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে পারবে। আয়াতোল্লাহ্ খোমিনি (১৯০২-৮৯) মোল্লা সদরার শিক্ষায় গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন এবং পরলোকগমনের আগে জাতির উদ্দেশে দেয়া শেষ ভাষণে তিনি জনগণকে ইরফানের গবেষণা ও অনুশীলন অব্যাহত রাখার আবেদন জানিয়েছেন, কেননা আধ্যাত্মিক সংস্কার ছাড়া প্রকৃত অর্থে কোনও ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে না।

ইরানের উলেমাদের মাঝে ক্রমশ বিস্তার লাভ করতে থাকা একেবারে নতুন এক ধারণার কারণে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন মোল্লা সদরা, আমাদের বর্তমান কালেও যার চরম রাজনৈতিক পরিণাম রয়ে গেছে। নিজেদের উসুলি বলে দাবীকারী একটা দল বিশ্বাস করত যে সাধারণ মুসলিমরা নিজেরা ধর্মবিশ্বাসের মৌল নীতিমালা (উসুল) ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং তাদের উচিত জ্ঞানী শিক্ষিত উলেমার সন্ধান করা এবং তাঁর আইনি বিধান অনুসরণ করা, যেহেতু একমাত্র তারাই গোপন ইমামের কর্তৃত্ব ধারণ করেন। শিয়া উলেমাগণ কখনওই সুন্নীদের মত “ইজতিহাদের দ্বার” রুদ্ধ করতে রাজি হননি। প্রকৃতপক্ষে, নেতৃস্থানীয় জুরিস্টকে তারা মুজতাহিদ বলে অভিহিত করতেন। মুজতাহিদ- যিনি ইসলামী আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে “স্বাধীন বিচার বুদ্ধি” প্রয়োগের অধিকার লাভ করেছেন। উসুলিদের শিক্ষা ছিল, এমনকি শাহকেও মুজতাহিদ প্রদত্ত ফাতওয়াহ্ মানতে হবে, যাঁকে তিনি মন্ত্রণাদাতা হিসাবে মনোনীত করেছেন, কেননা তাঁর আইনি পরামর্শ শাহ্-র প্রয়োজন। সপ্তদশ শতাব্দীতে উসুলিরা ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করতে পারেনি, কিন্তু শতাব্দীর শেষ নাগাদ, যখন পরিষ্কার হয়ে গেল যে সাফাভীয় সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়েছে, তাদের অবস্থান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের দুর্বলতার পরিপূরক হিসাবে একটা শক্তিশালী আইনি কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়েছিল।

সাম্রাজ্য ইতিমধ্যে যে কোনও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ভাগ্যই বরণ করে নিয়েছিল, নিজের দায়িত্ব পালন করে উঠতে পারছিল না। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতি ঘটেছিল, বিরাজ করছিল অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা আর শেষ দিকের শাহ্রা ছিলেন অনুপযুক্ত। ১৭২২-এ যখন আফগান গোত্রগুলো ইসফাহানে হামলা চালায়, অপমানজনকভাবে আত্মসমর্পণ করে নগরী। এক সাফাভীয় যুবরাজ হত্যাযজ্ঞ এড়িয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং মেধাবী অথচ নিষ্ঠুর কমান্ডার নাদির খানের সহায়তায় হানাদারদের বিতাড়িত করেন। বিশ বছরেরও বেশী সময় ধরে নাদির খান, যিনি সাফাভীয় সহকর্মীকে বাদ দিয়ে নিজেকে শাহ্ ঘোষণা করেছিলেন, ইরানকে আবার একত্রিত করেন এবং উল্লেখ্যযোগ্য সামরিক বিজয় অর্জন করেন। কিন্তু নির্দয় নিষ্ঠুর মানুষ ছিলেন তিনি এবং ১৭৪৮-এ আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান। এই সময়কালে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ইরানের উলেমাদের এমন এক নজীরবিহীন ক্ষমতার অধিকারী করে তোলে মুসলিম বিশ্বে যা আর কখনও দেখা যায়নি। প্রথমত: নাদির খান যখন অসফলভাবে ইরানে সুন্নী ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পেয়েছিলেন, নেতৃস্থানীয় উলেমাগণ তখন সাম্রাজ্য ত্যাগ করে নাজাফ ও কারবালা এ দুই পবিত্র শিয়া নগরীতে গিয়ে ওঠেন (যথাক্রমে আলী ও হুসেইনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত)। গোড়াতে একে এক বিপর্যয় বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু অটোমান ইরাকের অন্তর্গত নাজাফ ও কারবালায় একটা ভিত্তি পেয়েছিলেন তাঁরা। যেখান থেকে তাঁরা ইরানের জাগতিক শাসকের নাগালের বাইরে থেকে জনগণকে নির্দেশনা দিতে পারতেন। দ্বিতীয়ত, নাদির খানের মৃত্যুর পরবর্তী অন্তর্বর্তী সময়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে, ইরানে যখন কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব বলে কিছুই নেই, উলেমাগণ ক্ষমতার শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসেন- ১৭৭৯-এ টুরকোমান কাজার গোত্রের আকা মুহাম্মদ নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে কাজার বংশ প্রতিষ্ঠা করার পর আবার সেখানে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উসুলিদের অবস্থান অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দেখায়, যে উলেমাগণ যেকোনও শাহ্-র চেয়ে কার্যকরভাবে ইরানি জনগণের ভক্তি আর আনুগত্য আদায় করতে পেরেছিলেন।

মোঘল সাম্রাজ্য

সুন্নী ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত শাহ্ ইসমায়েলের শিয়া জিহাদের ফলে সৃষ্ট অস্থিরতা ভারতে নতুন মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে অংশতঃ দায়ী ছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা বাবুর (মৃত্যু: ১৫৩০) ইসমায়েলের মিত্র ছিলেন। সাফাভীয় এবং উযবেকদের মাঝে সংঘটিত যুদ্ধের সময় তিনি শরণার্থী হিসাবে আফগান পার্বত্য অঞ্চলের কাবুলে পালিয়ে যান, সেখানে টিমুর লেঙ্ক প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের অবশিষ্টাংশের নিয়ন্ত্রণভার নিজ হাতে তুলে নেন। এরপর উত্তর ভারতে ক্ষমতার একটা ভিত্তি স্থাপনে সক্ষম হন তিনি, টিমুরের পছন্দ মঙ্গোল কৌশলে অঞ্চলটি পরিচালনার প্রয়াস পান। তাঁর রাজ্যটি টেকেনি এবং ১৫৫৫ অবধি আফগান আমিরদের মাঝে উপদলীয় সংঘাত বজায় থাকে, তখন বাবুরের সবচেয়ে সক্ষম বংশধর হুমায়ুন সিংহাসন দখল করে নেন এবং যদিও এর পরপরই মৃত্যু ঘটেছিল তাঁর, একজন নির্ভরযোগ্য রিজেন্ট ১৫৬০-এ হুমায়ুনের পুত্র আকবর (১৫৪২-১৬০৫) সাবলকত্ব লাভের আগ পর্যন্ত “মঙ্গোল” (বা “মোঘুল”) ক্ষমতা অটুট রাখেন। উত্তর ভারতে একটি সংহত রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন আকবর, এখানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন তিনি। সরাসরি সুলতানের অধীনে এক সেনাবাহিনীর আদলে মঙ্গোলদের অনুসরণে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা কৌশল ধরে রেখেছিলেন তিনি। দক্ষ আমলাতন্ত্র গড়ে তোলেন তিনি এবং আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে অন্য মুসলিম শাসকদের সর্বনাশ করে তাঁর মোঘল সাম্রাজ্য বিস্তার ঘটাতে শুরু করেন, যতক্ষণ না হিন্দুস্তান, পাঞ্জাব, মালভা এবং দক্ষিণাত্য তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন হয়।

অবশ্য ইসমায়েলের বিপরীতে আকবর প্রজাদের দমন বা তাদের ওপর নির্যাতন চালাননি, কিংবা তাদের আপন ধর্ম বিশ্বাসে দীক্ষা দেয়ার প্রয়াসও পাননি। যদি তা করতেন, তাঁর সাম্রাজ্য টিকে থাকতে পারত না। মুসলিমরা এমন এক দেশে সংখ্যালঘু শাসক ছিল সেখানে কখনও ধর্মীয় একরূপতা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলেনি। প্রত্যেক হিন্দুবর্গের নিজস্ব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ছিল এবং বুদ্ধ, জ্যাকবাইট, ইহুদি, জৈন, ক্রিশ্চান, যরোস্ট্রিয়, সুন্নী মুসলিম এবং ইসমায়েলিরা কোনও রকম বাধা-বিপত্তি ছাড়াই উপাসনা করার অনুমতি পেয়ে আসছিল। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে সকল বর্গের হিন্দু, এবং এমনকি কিছু সংখ্যক মুসলিমও একেশ্বরবাদের এক আধ্যাত্মবাদী ধ্যানধর্মী ধরন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একত্রিত হয়েছিল, যেখানে সবরকম সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতাকে ত্যাগ করা হয়। গুরু নানক (মৃত্যু: ১৪৬৯) প্রতিষ্ঠিত শিখ ধর্ম এইসব গোষ্ঠী হতে গড়ে উঠেছিল, এখানে হিন্দু ধর্ম ও ইসলামের ঐক্য ও সংহতির ওপর জোর দেয়া হয়েছে। অবশ্য আক্রমণাত্মক বিরোধিতার একটা সম্ভাবনা সবসময়ই ছিল। ভারতে বিশ্বজনীনতা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং কোনও অসহিষ্ণু নীতি ভারতীয় সংস্কৃতির মূলসুর বিরোধী হয়ে দাঁড়াত। মুসলিম শাসকগণ এটা আগে থেকেই জানতেন, সেজন্য তাঁরা সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনে হিন্দুদের নিয়োগ দিয়েছেন। আকবর এই ঐতিহ্যকে আরও জোরদার করে তোলেন। তিনি জিম্মিদের ক্ষেত্রে শরিয়াহ্ কর্তৃক জারি করা জিযিয়াহ্ কর বাতিল করে দেন, হিন্দু অনুভূতিকে আঘাত না করার জন্যে নিরামিষ-ভোজীতে পরিণত হন এবং শিকারে ইস্তফা দেন (এ ক্রীড়াটি দারুণ উপভোগ্য ছিল তাঁর)। আকবর সকল ধর্মকে শ্রদ্ধা করতেন। হিন্দুদের জন্যে মন্দির নির্মাণ করেছেন তিনি। ১৫৭৫-এ তিনি এক “উপাসনা গৃহ” স্থাপন করেছিলেন যেখানে সকল ধর্মের পণ্ডিত ব্যক্তিগণ আলোচনার উদ্দেশ্যে মিলিত হতে পারতেন। “স্বর্গীয় একেশ্বরবাদের (devine monotheism তাওহীদ-ই ইলাহী) প্রতি নিবেদিত নিজস্ব সুফি মতবাদও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি, যা কুরানের একজন মাত্র ঈশ্বর সঠিকভাবে পরিচালিত যেকোনও ধর্মে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন, এই বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

যদিও নিঃসন্দেহে এটা কুরানের চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত ছিল, কিন্তু আকবরের বহুত্ববাদ (Pluralism) কোনও কোনও শরিয়াহ্ গোষ্ঠীর মাঝে গড়ে ওঠা কট্টর সাম্প্রদায়িক মনোভাবের একেবারে বিপরীত ছিল এবং সাম্প্রতিক শিয়া/সুন্নী বিরোধের গোঁড়ামির তুলনায় কয়েক আলোকবর্ষ দূরবর্তী। কিন্তু অন্য যেকোনও নীতি ভারতে রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়াত। রাজত্বের গোড়ার দিকে উলেমাদের প্রশ্রয় দিয়েছেন আকবর, কিন্তু তিনি কখনওই শরিয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর নিজস্ব ঝোঁক ছিল সুফিবাদ ও ফালসাফার দিকে, এ দুটোই ঝুঁকে ছিল এক বিশ্বজনীন দর্শনের প্রতি। ফায়লাসুদের বর্ণিত আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন আকবর। তাঁর জীবনীকার সুফি ঐতিহাসিক আবদুলফযল আল্লামি (১৫৫১-১৬০২) আকবরকে একজন আদর্শ দার্শনিক-রাজা হিসাবে দেখেছেন। তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে তিনি (আকবর) ছিলেন আদর্শ মানুষ ( Perfect Man), সুফিদের ধারণানুযায়ী উম্মাহকে ঐশী নির্দেশনা দেয়ার জন্য যিনি প্রতি প্রজন্মের মাঝে অবস্থান করেন। আকবর এমন এক সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যা, যুক্তি দেখিয়েছেন আল্লামি, মানুষকে এমন এক উদার চেতনাবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করত যার ফলে বিবাদ-বিসম্বাদ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। এই নীতি সুফি আদর্শ সুহল-ই কুল (“বিশ্বজনীন শান্তি”) প্রকাশ করে, এটা মাহব্বাত-ই কুল, “বিশ্বজনীন ভালোবাসার” সূচনা মাত্র, মানবজাতির জাগতিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণের সন্ধান করবে যা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে গোঁড়ামি অর্থহীন; আকবরের মত আদর্শ ফায়লাসুফ রাজা সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার ঘৃণ্য কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে।

মুসলিমদের কেউ কেউ অবশ্য আকবরের ধর্মীয় বহুত্ববাদে আক্রান্ত বোধ করেছে। আমাদ সিরহিন্দি (মৃত্যু: ১৬২৫), যিনি নিজেও সুফি ছিলেন, মনে করেছেন বিশ্বজনীনতা (যার জন্যে ইবন আল-আরাবিকে দায়ী করেন তিনি) বিপজ্জনক। সিরহিন্দি ঘোষণা করেন যে, আকবর নন, বরং তিনিই যুগের আদর্শ মানব (Perfect Man)। একমাত্র তখনই ঈশ্বরের নৈকট্য পাওয়া যাবে মানুষ যখন নিবেদিতভাবে শরিয়া আইন মেনে চলবে, এই পর্যায়ে যাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আরও সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছিল। অবশ্য সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমাংশে ভারতের স্বল্প সংখ্যকে মুসলিমই সিরহিন্দির দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সমর্থন জুগিয়েছিল। আকবরের পৌত্র শাহ্ জিহান, যিনি ১৬২৭ থেকে ১৬৫৮ পর্যন্ত শাসন পরিচালনা করেছেন, আকবরের নীতি বজায় রাখেন। তাঁর তাজমহল হিন্দুদের স্থাপত্য কৌশলের সঙ্গে মুসলিমদের স্থাপত্য কলার মিশ্রণের পিতামহের ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছে। রাজদরবারে তিনি হিন্দু কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন আর মুসলিম বৈজ্ঞানিক রচনাবলী সংস্কৃত ভাষায় অনূদিত হয়। কিন্তু সুফিবাদের প্রতি বৈরী ছিলেন শাহ্ জিহান, তাঁর ধর্মানুরাগ আকবরের তুলনায় অনেক বেশী শরিয়াহ ভিত্তিক ছিল।

তিনি এক ক্রান্তিকালীন চরিত্র হিসাবে প্রমাণিত হয়েছেন। শতাব্দীর শেষ দিকে এসে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে মোঘল সাম্রাজ্যের পতন সূচিত হয়েছে। সেনাবাহিনী এবং দরবার দুটোই অতিমাত্রায় ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছিল; সম্রাটগণ তখনও সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছিলেন, কিন্তু কৃষির প্রতি প্রয়োজনীয় নজর দেননি, যার ওপর তাঁদের সম্পদ নির্ভরশীল ছিল। আউরেঙজিবের শাসনামলে (১৬৫৮-১৭০৭) অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করে। তাঁর বিশ্বাস ছিল মুসলিম সমাজের বৃহত্তর শৃঙ্খলার মাঝে সমাধান নিহিত। মুসলিম “ভিন্ন মতাবলম্বী”দের পাশাপাশি অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতিও ভয়ঙ্কর ঘৃণাবোধের মাঝে তাঁর নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে। সিরহিন্দির মত মুসলিম, যাঁরা পুরনো ধর্মীয় বহুত্ববাদে অসন্তুষ্ট ছিলেন তাঁদের কাছ থেকে সাম্প্রদায়িক নীতির পক্ষে সমর্থন পান তিনি। ভারতে হুসেইনের সম্মানে শিয়াদের উৎসব উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, আইন করে সুরাপান নিষিদ্ধ করা হয় (যা হিন্দুদের সঙ্গে মেলামেশা কঠিন করে তোলে) এবং হিন্দু অনুষ্ঠানাদিতে সম্রাটের অংশগ্রহণের হার মারাত্মকভাবে হ্রাস করা হয়। জিযিয়াহ্ পুনর্বহাল করা হয় এবং হিন্দু বণিকদের ওপর দ্বিগুণ হয়ে যায় করের হার। সবচেয়ে মারাত্মক, সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করা হয়। প্রতিক্রিয়া দেখায় যে পূর্ববর্তী সহিষ্ণুতা কত প্রাজ্ঞ ছিল হিন্দুগোত্রপ্রধান আর শিখদের নেতৃত্বে মারাত্মক বিদ্রোহ পরিচালিত হয়, শিখরা পাঞ্জাবে নিজস্ব স্বদেশের জন্যে আন্দোলন শুরু করে।

করে। আউরেঙজিবের পরলোকগমনের পর টালমাতাল অবস্থায় পড়ে সাম্রাজ্য এবং আর কখনও সামলে উঠতে পারেনি। উত্তরাধিকারীগণ তাঁর সাম্প্রদায়িক নীতি পরিহার করেন, কিন্তু ক্ষতি যা হবার আগেই হয়ে গিয়েছিল। এমনকি মুসলিমরা পর্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছিল, শরিয়াহ্র প্রতি আউরেঙজিবের উৎসাহে প্রকৃতপক্ষে ইসলামী কিছু ছিল না; শরিয়াহ্ সবার জন্যে ন্যায়বিচারের কথা বলে-জিম্মিরা সহ। সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল এবং স্থানীয় মুসলিম কর্মকর্তারা স্বায়ত্তশাসিত একক হিসাবে যার যার এলাকা নিয়ন্ত্রণ শুরু করে।

অবশ্য ১৭৩৯ পর্যন্ত মোঘলরা ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজদরবারে হিন্দু ও মুসলিমদের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, পরস্পরের ভাষায় কথা বলতে শেখে তারা এবং ইউরোপ থেকে আসা বইপত্র একসঙ্গে পাঠ ও অনুবাদ করে। কিন্তু শিখ ও পার্বত্য অঞ্চলের হিন্দু গোত্রপতিরা শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে এবং উত্তর-পশ্চিমে ইরানের সাফাভীয় সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনা আফগান গোত্রগুলো ভারতে একটা মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ প্রয়াস পায়। ভারতীয় মুসলিমরা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করে: তাদের সমস্যাদি আধুনিক কালের মুসলিমদের সামনে এসে দাঁড়ানো বহু অসুবিধা ও বিতর্কের পূর্বাভাস হিসাবে কাজ করেছে। তারা অনুভব করতে শুরু করে যে এমন এক দেশের বিচ্ছিন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠী তারা যেটি অটোমান সাম্রাজ্যের আনাতোলিয় কেন্দ্রভূমির সীমান্তবর্তী এলাকা নয়; বরং সভ্য জগতের অন্যতম প্রধান সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি। কেবল হিন্দু এবং শিখদের মোকাবিলা করছে না তারা, ব্রিটিশরাও শক্তিশালী বাণিজ্যিক অস্তিত্ব গড়ে তুলছে, যা উপমহাদেশে ক্রমবর্ধমানহারে রাজনৈতিক রূপ নিচ্ছিল। প্রথমবারের মত মুসলিমরা শয়তান কর্তৃক শাসিত হবার আশঙ্কার মুখোমুখি হল। ইসলামী ধার্মিকতার ক্ষেত্রে উম্মাহর গুরুত্বের বিচারে এটা ছিল গভীর উদ্বেগজনক। কেবল রাজনৈতিক ব্যাপার ছিল না এটা, বরং তাদের অস্তি ত্বের গভীরতম প্রদেশ স্পর্শ করেছিল। ভারতে মুসলিমদের জীবনে এক নয়া নিরাপত্তাহীনতার বোধ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। ইসলাম কী তবে স্রেফ আরেকটি হিন্দু বর্গ হয়ে দাঁড়াবে? মুসলিমরা কী তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলবে এবং ইসলামের জন্মভূমি মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে আলাদা ভিনদেশী সংস্কৃতির তোড়ে ভেসে যাবে? তবে কী শেকড়ের সঙ্গে সংযোগ চ্যুত হয়েছে তারা?

সুফি চিন্তাবিদ শাহ্ ওয়ালি-উল্লাহ্ (১৭০৩-৬২) বিশ্বাস করতেন, সমাধান নিহিত রয়েছে সিরহিন্দির প্রস্তাবনায় এবং তাঁর মতামত ভারতের মুসলিমদের ওপর একেবারে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছিল। নতুন সংগ্রামী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন তিনি। এদিকে মুসলিমরা যখন তাদের ক্ষমতা বিশ্বের অন্য অংশে চলে যাচ্ছে ভেবে ইসলামের টিকে থাকার প্রশ্নে একই রকম শঙ্কা অনুভব করছিল, দার্শনিক ও সংস্কারকগণও সমরূপ উপসংহার পৌঁছেছেন। প্রথমত: মুসলিমদের অবশ্যই গোত্রীয় ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রণাঙ্গনে দাঁড়াতে হবে। উপমহাদেশের বিশেষ পরিস্থিতির দাবী মেটাতে শরিয়াহকে অবশ্যই পরিমার্জনা করতে হবে এবং হিন্দুকরণ প্রতিরোধের উপায়ে পরিণত হতে হবে একে। সামরিক ও রাজনৈতিক প্রাধান্য বজায় রাখা মুসলিমদের জন্যে অত্যাবশ্যক। শাহ্ ওয়ালি উল্লাহ্ এত বেশী উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, তিনি এমনকি মুসলিম শক্তির পুনর্জাগরণের স্বার্থে ধ্বংসাত্মক আফগান প্রয়াসেও সমর্থন দিয়েছিলেন। মুসলিমদের চিন্তা জগতে একটা আত্মরক্ষামূলক চাপ যোগ হয়েছিল এবং তা আধুনিক যুগের মুসলিমদের ধার্মিকতার একটা বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে।

অটোমান সাম্রাজ্য

১৪৫৩তে অটোমানরা যখন কনস্ট্যান্টিনোপল অধিকার করে নেয় (যা এখন ইসতাম্বুল নামে পরিচিত), একটা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মত অবস্থানে পৌঁছে যায় তারা; আস্তে আস্তে সাম্রাজ্যটি গড়ে উঠতে পেরেছিল বলে অন্যান্য সাম্রাজ্যের তুলনায় এর ভিত্তি ছিল অনেক দৃঢ়, ফলে তা সর্বাধিক সাফল্যমণ্ডিত এবং স্থায়ী হয়ে ওঠে। প্রাথমিক পর্যায়ের অটোমান গোত্রপতিরা আর পাঁচজন গাজী শাসকদের মতই ছিলেন, কিন্তু ইস্তাম্বুলে সুলতানগণ বাইযানটাইনদের আদলে রাজদরবারের ব্যাপক আনুষ্ঠানিকতা বিশিষ্ট এক চরম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য রাষ্ট্রের কাঠামোর ভিত্তি ছিল প্রধানত পুরনো মঙ্গোল আদর্শ, সুলতানের ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণাধীন বিশাল সেনাবাহিনীকে কেন্দ্রীয়ক্ষমতা হিসাবে বিবেচনা করা হত। মেহমেদ, দ্য কনকোয়েরার-এর ক্ষমতার ভিত্তি ছিল বলকান অভিজাত গোষ্ঠীর সমর্থন– যাদের অনেকেই তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল; আর পদাতিক বাহিনী–”নয়া সেনাদল” (ইয়েনি চেরি-yeni cheri) — গানপাউডার আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে যা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। বহিরাগত হিসাবে ধর্মান্তরিত ক্রীতদাস জোনিসারিদের জমিজমার প্রতি কোনও আগ্রহ ছিল না, ফলে তারা সুলতানদের নিরেট প্রতিরক্ষা বুহ্য হিসাবে এক স্বাধীন বাহিনীতে পরিণত হয়। অটোমানরা তাদের পুরনো আদর্শের বৈশিষ্ট্যও বজায় রেখেছিল: নিজেদের তারা ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদে নিবেদিত এক সীমান্ত রাজ্যের কর্মী দল হিসাবে দেখেছে। পশ্চিমে তাদের সামনে ছিল ক্রিশ্চান জগৎ আর পুবে শিয়া সাফাভীয়রা। অটোমানরাও সাফাভীয়দের মত তীব্র সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে, অটোমান সাম্রাজ্যে বসবাসরত শিয়াদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ঘটনা ঘটে।

জিহাদ ছিল বিস্ময়করভাবে সফল। সাফাভীয়দের বিরুদ্ধে প্রথম সেলিমের (১৪৬৭-১৫২০) অভিযান যা ইরানি অগ্রযাত্রাকে থমকে দিয়েছিল –এক বিজয়মণ্ডিত যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয় যার ফলে সমগ্র সিরিয়া এবং মিশর অটোমান শাসনের আওতায় চলে আসে। আরব এবং উত্তর আফ্রিকা সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল। পশ্চিমে, অটোমান সেনাবাহিনী ইউরোপ অধিকার অব্যাহত রাখে এবং ১৫৩০-এ পৌঁছে যায় ভিয়েনার দোরগোড়ায়। সুলতানগণ অসাধারণ আমলাতান্ত্রিক দক্ষতার সঙ্গে এমন এক সুবিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছেন, এ সময়ের আর কোনও রাষ্ট্র এর ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারেনি। সুলতান তাঁর প্রজাদের ওপর একরূপতা চাপিয়ে দেননি বা সাম্রাজ্যের অসদৃশ উপাদানসমূহকে একটা বিরাট দলে টানতে চাননি। সরকার কেবল এমন একটা কাঠামোর ব্যবস্থা করেছে যা বিভিন্ন গ্রুপকে–ক্রিশ্চান, ইহুদি, আরব, তুর্কী, বারবার বণিক, উলেমা, তরিকাহ্ আর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী– শান্তিময় পরিবেশে বসবাস সক্ষম করে তুলেছিল, প্রত্যেকে যার যার অবদান রেখেছে, নিজ নিজ বিশ্বাস আর রীতি পালন করেছে। এভাবে সাম্রাজ্যে ছিল বিছিন্ন গোষ্ঠীর এক মিশেল, যার প্রতিটি এর সদস্যদের প্রত্যক্ষ বিশ্বস্ততা দাবী করত। একজন গভর্নর (পাশা) কর্তৃক শাসিত, দুটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল সাম্রাজ্য, যিনি সরাসরি ইস্তাম্বুলের কাছে জবাবদিহি করতেন।

সুলেইমান আল-কানুনির (“দ্য ল-গিভার”) (১৫২০-৬৬) শাসনামলে সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে। পাশ্চাত্যে ইনি সুলেইমান দ্য ম্যাগনিফিশেন্ট নামে খ্যাত। তাঁর শাসনাধীনে সাম্রাজ্য এর সম্প্রসারণের সর্বশেষ সীমায় পৌঁছে যায়। ইস্তাম্বুল এক সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ প্রত্যক্ষ করেছিল, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অনন্যসাধারণ স্থাপত্য কর্ম, বিশেষ করে দরবারী স্থাপতি সিনান পাশার (মৃত্যু: ১৫৭৮) স্থাপত্য কর্ম। গোটা সাম্রাজ্য জুড়ে নির্মিত অটোমান মসজিদগুলোর সুস্পষ্ট ভিন্ন স্টাইল ছিল: ওগুলো ছিল খোলামেলা, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ছিল সেখানে, নিচু গম্বুজ আর সুউচ্চ মিনার ছিল ওগুলোর। চিত্রকলা, ইতিহাস আর চিকিৎসাবিজ্ঞানকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বেশ উঁচু পর্যায়ে পৌঁছে দেয় দরবার; ১৫৭৯-তে একটা মানমন্দির নির্মিত হয়; আর নৌপথ ও ভৌগলিক ক্ষেত্রে নতুন ইউরোপীয় আবিষ্কারে আলোড়িত হয়েছে। সম্প্রসারণের এই বছরগুলোয় পাশ্চাত্যের সঙ্গে তথ্যের আন্তরিক আদান- প্রদান ঘটে, তখন ইউরোপের বিভিন্ন সাফল্য সত্ত্বেও অটোমান সাম্রাজ্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি ছিল।

অন্য দু’টি সাম্রাজ্যের মত অটোমানরাও তাদের রাজ্যকে একটা বিশেষ ইসলামী পরিচয় দিয়েছিল। সুলেইমানের অধীনে অতীতের যেকোনও মুসলিম রাষ্ট্রের তুলনায় শরিয়াহ্ অনেক বেশী মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। সকল মুসলিমের জন্যে সরকারি আইনে পরিণত হয় তা। অটোমানরাই প্রথম শরিয়াহ্ আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞগণ– কাজিগণ, যারা আদালতে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতেন; তাদের পরামর্শক (মুফতি), যারা আইনের ব্যাখ্যা দিতেন; এবং মাদ্রাসার শিক্ষকগণ –সরকারি বাহিনীতে পরিণত হন। সুলতানের সঙ্গে প্রজা সাধারণের নৈতিক ও ধর্মীয় যোগসূত্র গড়ে তোলেন এঁরা। আরব প্রদেশগুলোয় এটা সবিশেষ মূল্যবান ছিল, যেখানে রাষ্ট্র ও উলেমাদের মধ্যকার অংশীদারি জনগণকে তুর্কি শাসন মেনে নিতে সাহায্য করেছিল। উলেমাদের কেবল পবিত্র আইনের সমর্থনই ছিল না–যা শাসকদের বৈধতা দিয়েছিল বরং প্রায়শ এমনটি ঘটতে দেখা গেছে যে, নির্দিষ্ট প্রদেশের স্থানীয় অধিবাসী উলেমাগণ, স্বদেশী জনতা এবং তুর্কি গভর্নরের মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছেন।

অটোমানদের প্রজাসাধারণ প্রধানত শরিয়াভিত্তিক রাজ্যের সদস্য হিসাবে গর্বিত ছিল। কুরান শিক্ষা দিয়েছে যে ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী বসবাসকারী উম্মাহ্ সমৃদ্ধি লাভ করবে, কেননা তা অস্তিত্বের মৌলনীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রাথমিক অটোমানদের বিস্ময়কর সাফল্য, যাদের বৈধতা ব্যাপকভাবে ঈশ্বর প্রত্যাদিষ্ট আইনের প্রতি আনুগত্যের ওপর দাঁড়িয়েছিল, এই বিশ্বাসের পক্ষেই সাক্ষ্য দেয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে। উলেমাগণও এটাও অনুভব করেছিলেন যে এই সাম্রাজ্য তাঁদেরই রাজ্য আর অটোমানগণ রাষ্ট্রীয় নীতি এবং মুসলিম বিবেকের এক বিরল সমন্বয় অর্জন করেছে। কিন্তু এই অংশীদারির আবার- ফলপ্রসূ ছিল বটে– নেতিবাচক দিকও ছিল, কেননা এটা উলেমাদের ক্ষমতায়নের পরিবর্তে শেষ অবধি তাদের কণ্ঠরোধ, এমনকি অপমানিত করেছে। শরিয়ার সূচনা হয়েছিল প্রতিবাদ আন্দোলন হিসাবে এবং এর গতিশীলতার অধিকাংশের মূলে ছিল বিরোধী অবস্থান। অটোমান ব্যবস্থার অধীনে অনিবার্যভাবে তা হারিয়ে গিয়েছিল। উলেমাগণ রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সরকারী কর্মকর্তা হিসাবে, সুলতান এবং তাঁর পাশাগণ ভর্তুকি প্রত্যাহারের হুমকি দিয়ে- করেছেনও- তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। আবু আল-সুন্দ খোলা চেলেবি (১৪৯০-১৫৭৪), যিনি অটোমান-উলেমা মৈত্রীর নীতিমালা প্রণয়ন করেছিলেন, স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে কাজিগণ শরিয়া অভিভাবক সুলতানের তরফ থেকে কর্তৃত্ব লাভ করে থাকেন সুতরাং তাঁরা তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী আইন প্রয়োগে বাধ্য। এভাবে শরিয়াহ্কে চরম রাজতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয় (যা আগের চেয়ে ঢের বেশী শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল) –মূলত যার বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যেই সূচনা ঘটেছিল এর।

ইরানের শিয়া উলেমাগণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। জনগণের সমর্থন লাভ করেন তাঁরা। ইরানি উলেমাদের অনেকেই পরবর্তীকালে নিবেদিত প্রাণ সংস্কারকে পরিণত হন এবং অত্যাচারী শাহ্রদের বিরুদ্ধে জনগণকে কার্যকর নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উলেমা আধুনিককালের গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক ধ্যান-ধারণা গ্রহণে প্রস্তুত হয়ে ওঠেন। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যে উলেমাগণ হীনবল হয়ে পড়েছিলেন, রাজনৈতিক সুবিধা বঞ্চিত হওয়ায় রক্ষণশীল হয়ে পড়েন তাঁরা এবং ফলে যেকোনও পরিবর্তনের বিরোধিতা করেন। সুলেইমানের শাসনকাল শেষ হবার পর মাদ্রাসাসমূহের পাঠ্যক্রম আরও সংকীর্ণ রূপ নেয়। ফালসাফার পাঠ বাদ দেয়া হয়, জোর দেয়া হয় ফিক্হর প্রতি অধিকতর মনোযোগের ওপর। অটোমান সাম্রাজ্যের ইসলামী অবস্থান, এক বিশাল গাজী রাজ্য, ছিল সাম্প্রদায়িক ও গোত্রবাদী। মুসলিমরা মনে করেছে তারা চারদিক থেকে চেপে আসা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে অর্থোডক্সির পতাকাবাহী। উলেমাগণ, এমনকি সুফিগণও এই মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন; তারপর যখন সাম্রাজ্যের দুর্বলতার লক্ষণগুলো প্রথমবারের মত ফুটে ওঠে, এই প্রবণতা আরও প্রবল চেহারা নেয়। যদিও রাজদরবার তখনও ইউরোপ থেকে আগত নতুন নতুন ধ্যান-ধারণাকে স্বাগত জানাচ্ছে, কিন্তু মাদ্রাসাগুলো হয়ে দাঁড়াল ইউরোপীয় অবিশ্বাসীদের কাছ থেকে নেয়া যেকোনও পরীক্ষা নিরীক্ষার বিরোধিতার প্রধান কেন্দ্র। যেমন, উদাহরণ স্বরূপ, উলেমাগণ ইসলামী বই পুস্তকের মুদ্রণের বিরোধিতা করেছেন। সাম্রাজ্যের ক্রিশ্চান জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন তাঁরা, যাদের অনেকেই অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গেই নতুন পশ্চিমের দিকে তাকিয়েছিল। জনগণের ওপর উলেমাদের প্রভাব অটোমান সমাজের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে প্রবল হয়ে ওঠে এবং মানুষ এমন এক সময়ে পরিবর্তনের ধারণার প্রতি বৈরী হয়ে পড়ে যখন পরিবর্তন ছিল অবশ্যম্ভাবী। উলেমাগণ পুরনো ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে ধরে থাকায় মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্যের আধুনিকতা হানা দেয়ার পর তাদের পক্ষে জনগণের সাহায্যে এগিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। ফলে পথনির্দেশের জন্যে অন্যত্র চোখ ফেরাতে হয়েছে তাদের।

এমনকি মহাপরাক্রমশালী অটোমান সাম্রাজ্যও কৃষিভিত্তিক সমাজের সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে যথাযথ ছিল না, সম্প্রসারণের গতির সঙ্গে যা তাল মেলাতে পারেনি। সামরিক শৃঙ্খলা দুর্বল হয়ে পড়ায় সুলতানগণ আবিষ্কার করলেন, তাঁরা আর চরম ক্ষমতা ভোগ করতে পারছেন না। অর্থনীতির দুরবস্থা দুর্নীতি আর কর ফাঁকির প্রবণতা সৃষ্টি করে। উচ্চবিত্তের লোকেরা বিলাসী জীবনযাপন করতে থাকে, হ্রাস পেয়ে চলে রাজস্ব আয়; অধিকতর কার্যকর ইউরোপীয় প্রতিযোগিতার কারণে বাণিজ্যে অবনতি ঘটে, আর স্থানীয় সরকারগুলো নিজের তহবিল সামলাতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েনি, বরং পুরো সপ্তদশ শতাব্দী জুড়ে এক প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক জীবন ধরে রেখেছিল। অবশ্য অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ পতন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে–বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্থানীয় সংস্কারকগণ ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পান।

আরবীয় পেনিনসূলায় মুহাম্মদ ইবন আবদ আল-ওয়াহহাব (১৭০৩-৯২) ইস্তাম্বুল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে সক্ষম হন এবং মধ্য আরব ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে এক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ইবন তাঈমিয়াহ্র ঐতিহ্য অনুযায়ী টিপিক্যাল সংস্কারক ছিলেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস ছিল কুরান এবং সুন্নাহ্ মৌলবাদী প্রত্যাবর্তন এবং পরবর্তী কালের সকল সংযোজনের জঙ্গী প্রত্যাখ্যান- যেখানে মধ্যযুগীয় ফিকহ্, অতীন্দ্রিয়বাদ, ফালসাফাহ্ অন্তর্ভুক্ত এবং অধিকাংশ মুসলিম এগুলোকে স্বাভাবিকই মনে করত- দ্বারা চলমান সঙ্কট সর্বোত্তম উপায়ে মোকাবিলা করা সম্ভব। অটোমান সুলতানগণ যেহেতু প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য মেনে নেননি, আব্দ আল- ওয়াহহাব তাদের ধর্মত্যাগী বলে ঘোষণা দেন, মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য বলে দাবী করেন। পরিবর্তে তিনি সপ্তম শতাব্দীর প্রথম উম্মাহ্ আদর্শের ওপর ভিত্তি করে নিখাদ বিশ্বাসের এক ছিটমহল সৃষ্টির প্রয়াস পান। তাঁর আগ্রাসী কৌশল সমূহের কিছু কিছু বিংশ শতাব্দীতেও– আরও ব্যাপক পরিবর্তন ও অস্থিরতারকাল- কিছু মৌলবাদীদের দ্বারা ব্যবহৃত হবে। ওয়াহহাবিবাদ ইসলামের একটি রূপ যা আজও সৌদি আরবে অনুসৃত হচ্ছে। ঐশী গ্রন্থের কঠোর আক্ষরিক ব্যাখ্যা এবং গোড়ার দিকের ইসলামী ট্র্যাডিশনভিত্তিক এক পিউরিটান ধর্ম।

মরোক্কোয় সুফি সংস্কারক আহমাদ ইবন ইদরিস (১৭৮০-১৮৩৬) ভিন্নভাবে সমস্যার মোকাবিলা করেছিলেন। তাঁর সমাধান ছিল জনগণকে শিক্ষিত করার মাধ্যমে আরও ভালো মুসলিমে পরিণত করা। উত্তর আফ্রিকা ও ইয়েমেনে ব্যাপক সফর করেছেন তিনি, সাধারণ মানুষকে তাদের নিজস্ব ভাষায় নির্দেশনা দিয়েছেন, আর সালাতের মত মৌল প্রার্থনার আচার কীভাবে সঠিকভাবে সারা যায় সে শিক্ষা দান করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে উলেমাগণ তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, মাদ্রাসাসমূহে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন নিজেদের, কেবল ফিকহ’র সূক্ষ্ম বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, আর জনগণকে আপন বোধ-বুদ্ধি অনুযায়ী চলার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। অন্য নব্য সুফিগণ, এই সংস্কারকদের এনামেই অভিহিত করা হয়, আলজিরিয়া ও মদীনায় একই ধরনের দায়িত্ব পালন করেন। মুহাম্মদ ইবন আলী আল-সানুসি (মৃত্যু: ১৮৩২) সানুসিয়াইয়াহ্ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন যা আজও লিবিয়ায় ইসলামের প্রভাবশালী রূপ হিসাবে টিকে আছে। নব্য-সুফিগণের নতুন পশ্চিম সম্পর্কে কোনও আগ্রহ বা জ্ঞান ছিল না, কিন্তু তারা তাঁদের নিজস্ব অতীন্দ্রিয়বাদী ঐতিহ্যের মাধ্যমেই ইউরোপীয় আলোকনপর্বে ( Enlightenment) আবিষ্কৃত ধারণার অনুরূপ ধারণা গড়ে তুলেছিল। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে উলেমাদের উপর নির্ভর করার পরিবর্তে মানুষকে তাদের নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টির ওপর নির্ভর করতে হবে। ইবন ইদরিস এমনকি পয়গম্বর বাদে আর সমস্ত মুসলিম চিন্তাবিদের কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যানের কথাও বলেছেন। এভাবে তিনি মুসলিমদের বিভেদের অভ্যাস ঝেড়ে ফেলে, অতীত ঐতিহ্য আঁকড়ে থাকার বদলে নতুনকে মূল্য দিতে অনুপ্রাণিত করেছেন। তার অতীন্দ্রিয়বাদের ভিত্তি হচ্ছেন ব্যক্তি পয়গম্বর, মানুষকে তিনি দূরবর্তী ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষায় না থেকে নিজেদের আদর্শ মানব সন্তান হিসাবে পড়ে তোলার শিক্ষা দিয়েছেন, অনেকটা ভক্তিমূলক মানবতাবাদের আদলে।

সুতরাং, নতুন ইউরোপের বৈশিষ্ট্য প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে মুসলিমদের পক্ষে নিরেট কোনও যুক্তি ছিল না। বহু শতাব্দী ধরে এমন কিছু মূল্যবোধের বিকাশ ঘটিয়েছে তারা যেগুলো আধুনিক পশ্চিমের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিভাত হবে: সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তীব্র আবেগ, এক সাম্যবাদী রাজনীতি, বাক স্বাধীনতা এবং তাওহীদের আদর্শ সত্ত্বেও, প্রকৃতপ্রস্তাবে যা (শিয়াবাদের ক্ষেত্রে) ধর্ম ও রাজনীতির নীতিগত বিচ্ছিন্নতা। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অধিকাংশ সচেতন মুসলিম মানতে বাধ্য হয় যে ইউরোপ তাদের ছাড়িয়ে গেছে। গোড়ার দিকে অটোমানরা ইউরোপীয় শক্তিগুলোকে নাস্তানাবুদ করেছিল বটে, কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে তারা আর তাদের সামনে দাঁড়াতেই পারছিল না, সমানে সমানে লড়তেও পারছিল না তারা। ষোড়শ শতাব্দীতে সুলেইমান ইউরোপীয় বণিকদের কূটনৈতিক নিরাপত্তা (Immunity) দান করেন। এই চুক্তিগুলো ক্যাপিটুলেশনস (কারণ এগুলো প্রণীত হয়েছিল capita : শিরোনামের নিচে) নামে পরিচিত ছিল যার সারকথা ছিল এই যে অটোমান এলাকায় বাসকারী ইউরোপীয় বণিকদের দেশীয় আইন মেনে চলার আবশ্যকতা নেই; তাদের নিজস্ব আইন অনুযায়ী নিজেদের আদালতে তাদের অপরাধের বিচার হত, যেখানে সভাপতিত্ব করতেন তাদের নিজস্ব কনসাল। সুলেইমান সমপর্যায়ে থেকে ইউরোপের বিভিন্ন জাতির সঙ্গে এইসব চুক্তিতে উপনীত হয়েছিলেন। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে ক্যাপিটুলেশনগুলো অটোমানদের সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করে দিচ্ছে, বিশেষ করে ১৭৪০-এ যখন সাম্রাজ্যের ক্রিশ্চান মিল্লেটদের (millets) জন্যে পরিবর্তিত হল, ইউরোপীয় বিদেশীদের মতই “নিরাপত্তার অধিকারী” (Protected) হয়ে উঠল তারা, সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন রইল না আর।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ অংশে এসে অটোমান সাম্রাজ্যের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে দাঁড়ায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের আরও অবনতি ঘটে; অরবীয় প্রদেশগুলোর বেদুঈন গোত্রগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়; আর স্থানীয় পাশাগণ আর ইস্তাম্বুলের যাথাযথ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকলেন না, প্রায়শ দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা, জনগণকে শোষণ করতে থাকেন। এদিকে পাশ্চাত্য অবশ্য একের পর এক জয় লাভ করে যাচ্ছিল। কিন্তু অটোমানগণ অযথা উদ্বিগ্ন বোধ করেনি। সুলতান তৃতীয় সেলিম ইউরোপকে অনুসরণ করার প্রয়াস পান, তিনি ভেবেছিলেন পশ্চিমা কায়দায় সেনাবাহিনীর সংস্কার করা গেলে শক্তির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যাবে। ১৭৮৯তে তিনি ফরাসি ইন্সট্রাকটরদের নিয়ে সামরিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন, যেখানে ছাত্ররা ইউরোপীয় ভাষা শিক্ষা আর আধুনিক মার্শাল আর্টের পাশাপাশি নতুন পাশ্চাত্য বিজ্ঞান অধ্যায়ন করে। কিন্তু পশ্চিমের হুমকি মোকাবিলার জন্যে এসব যথেষ্ট ছিল না ৷ মুসলিমরা বুঝে উঠতে পারেনি যে অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই ইউরোপ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক সমাজের বিকাশ ঘটিয়েছে, এবং এখন অপ্রতিরোধ্যভাবে ইসলামী বিশ্বকে অতিক্রম করে গেছে- অচিরেই বিশ্ব ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠবে তারা।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ তিনটি বিশাল সাম্রাজ্যই পতনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। এর কারণ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অযোগ্যতা বা অদৃষ্টবাদ নয়, যেমনটি ইউরোপীয়রা প্রায়ই উদ্ধতভাবে মনে করে থাকে। যেকোনও কৃষিনির্ভর রাজনীতির আয়ুষ্কাল সীমাবদ্ধ এবং এই মুসলিম রাজ্যগুলো, যা কৃষিভিত্তিক আদর্শের চূড়ান্ত বিকাশের প্রতিভূ ছিল, স্রেফ স্বাভাবিক এবং অনিবার্য সমাপ্তির মুখোমুখি হয়েছে। প্রাক-আধুনিক যুগে পশ্চিমা ও ক্রিশ্চান সাম্রাজ্যও উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করেছে। ইসলামী রজ্যেও ইতিপূর্বে পতন ঘটেছে; প্রতিবারই মুসলিমরা ভস্মস্তূপ থেকে ফিনিক্সের মত পুনরুজ্জীবিত হতে পেরেছে এবং এগিয়ে গেছে উত্তরোত্তর ব্যাপক সাফল্যের দিকে। কিন্তু এবারের ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে মুসলিমদের দুর্বলতা আর পাশ্চাত্যের একেবারে ভিন্ন ধরনের সভ্যতা সমসাময়িক হয়ে দাঁড়ায় এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা অনেক বেশী দুরূহ বলে আবিষ্কার করবে মুসলিম বিশ্ব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *