০৪.
বাড়িটা যে কার ছিল, কিসের ছিল–কিছুই বোঝা যায় না। অনেকটা কুঠিবাড়ির মতন দেখতে। চারপাশে গাছপালার জঙ্গল। ভাঙাচোরা পাঁচিল। একসময় হয়ত কোনো সাহেব কোম্পানির ঘাঁটি ছিল, কিংবা কোনো সাহেবসুবো থাকত, ব্যবসা বাণিজ্য দেখাশোনা করত। এখন বাড়িটার কিছু কিছু কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে, বাকিটা ভেঙে পড়েছে।
তারাপদ ভাঙা ফটকের কাছেই কিকিরাদের পেয়ে গিয়েছিল। কিকিরাই নিচু গলায় ডেকে নিয়েছিলেন তারাপদকে।
ওরা তিনজনে গাছপালার আড়ালে এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল যে, এই বাড়িতে কারা আসছে সেটা নজর করা যায়। এখনো চাঁদ ওঠেনি। চাঁদ না উঠলেও অন্ধকার সামান্য ফিকে হয়েছে। আকাশের একপাশে চাঁদ উঠি-উঠি করছে।
কিকিরা ভেবেছিলেন, জায়গাটা একবার দেখেশুনে আজ চলে যাবেন। বেশি উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করবেন না। প্রথম দিনে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। কিছুই যে জানেন না। সাবধান হতে পারবেন না। প্রেসিদ্ধর চেলারা কখন কোন দিক থেকে দেখে ফেলবে কে জানে!
কিন্তু প্রেতসিদ্ধর আখড়ায় পৌঁছে দেরি হতে লাগল। ২০১২
এর মধ্যে দুটো ঘণ্টা পড়ে গিয়েছে। পেটা ঘড়িতে ঘণ্টা বাজানোর মতন করে ঢং করে ঘণ্টা বাজাচ্ছিল কেউ।
এখন আর ঘণ্টা বাজছে না।
চন্দন হাত বাড়িয়ে কিকিরাকে ঠেলা দিল। চাপা গলায় বলল, “সাহেব!”
কিকিরা তাকালেন। তারাপদও দেখল।
কোট-প্যান্ট পরা একটা লোক ভাঙা ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছিল। অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে সামনের দিকে পা বাড়াল। দাঁড়াল, আবার। বুঝতে পারছিল না কোন দিকে যাবে। কিকিরাদের বড় কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে লোকটি।
লোকটা জোরে-জোরে কাশল। তারপর গলা চড়িয়ে ডাকল, “কে আছে?”
বারকয়েক ডাকাডাকির পর সাহেব যখন বিরক্ত হয়ে পায়চারি করছে, বাড়ির দিক থেকে একজনকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।
সাহেব কিছু বলার আগেই লোকটা যেন কী বলল। শোনা গেল না।
পকেট হাতড়ে সাহেব এক টর্চ বার করেছিল বোধ হয়। আলো জ্বলল। ছোট টর্চ নিশ্চয়। সঙ্গে-সঙ্গে তার হাত থেকে টর্চ কেড়ে নিল লোকটা, প্রেতসিদ্ধর চেলা। টর্চ নিবিয়ে দিল।
সাহেব এবার খাপ্পা হয়ে উঠেছিল। চেঁচিয়ে বলল, “এটা কী?”
লোকটা বলল, “এখানে আলো নিয়ে আসা বারণ। লিখে দেওয়া হয়েছিল। চিঠি কই?”
সাহেব পকেট থেকে কী-একটা বার করল।
অন্ধকারেই লোকটা চিঠি দেখল, না, চিঠির চেহারা দেখেই বুঝে নিল সব কে জানে! বলল, “জোয়ারদার?”
“বিশ্বনাথ জোয়ারদার। পাতিপুকুর থেকে আসছি।…কী জায়গা তোমাদের! খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন জায়গায় মানুষ আসে?”।
“দরকার পড়লেই আসে। …কথা বলবেন না। আসুন।” বলে লোকটা ফিরতে লাগল। ফিরতে-ফিরতে বলল, “দেরি করে এলে ঘরে ঢুকতে দেবার নিয়ম নেই। গুরুজি আসনে বসে পড়েছেন। ঘর বন্ধ। দেখি কী বলেন।“
দু’জনের কথাবার্তা অস্পষ্টভাবেই শোনা যাচ্ছিল। শেষে আর কথা শোনা গেল না, ওরা এগিয়ে তফাতে চলে গেল।
তারাপদ বলল, “বাঙালিসাহেব।”
কিকিরা বললেন, “জোয়ারদার। বাবা বিশ্বনাথ।”
চন্দন বলল, “ক’জন হল কিকিরা?”
“সাহেবকে নিয়ে পাঁচজন। প্রথমে এসেছিল টাক, সেকেন্ড এল দাড়িঅলা বুড়ো, তিন নম্বর এল–রোগাসোগা চশমা চোখে, মাস্টার-মাস্টার চেহারার লোকটা, চার নম্বর হল তোমার সেই পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ছোকরা। আর লাস্ট এই জোয়ারদার।”
তারাপদ বলল, “আরও আসবে নাকি?”
“শনিবারের বাজারে পাঁচজন–মন্দ কী! এখানেই তো পঞ্চমুখী হয়ে গেল।”
ধীরে-ধীরে কথা বলছিল ওরা। গলার শব্দ উঠছিলই না। গায়ে-গায়ে তিনজনে দাঁড়িয়ে আকাশে চাঁদ উঠে এল।
চন্দন বলল, “দাঁড়িয়ে থেকে আর লাভ আছে?”
কিকিরা ভাবলেন সামান্য। তারপর বললেন, “না। আজকের মতন এখানেই ইতি। ভেতরে উঁকি মারার চেষ্টা করে লাভ নেই, ধরা পড়ে যাব। ওটা পরে হবে। জায়গাটা তো দেখা হয়ে গেল। আমি সকালের দিকেও খোঁজ নিতে পারব দু’-একদিনের মধ্যেই।”
“তা হলে ফেরা যাক।”
“চলো।”
সাবধানেই বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে এল তিনজনে। জ্যোৎস্না ফুটতে শুরু করেছে। হাওয়া আসছিল গঙ্গার দিক থেকে। কাছেই গঙ্গা। এই সরু গলিটা দিয়ে এগিয়ে গেলে কি গঙ্গা পাওয়া যাবে? কে জানে!
ফিরতি পথে তারাপদ বলল, “কিকিরা-স্যার, কী মনে হচ্ছে আপনার?”
কিকিরা বললেন, “মনে হচ্ছে, কল্পবৃক্ষটির গাছে রাই ফ্রুট ভালই ফলেছে।”
চন্দন জোরে হেসে উঠল।“রাইপ ফ্রুট!”
“গাছে ফল-ফুল ছাড়া আর কী ধরবে হে! এ-গাছ আবার ফুল ধরার গাছ নয়, ফলং বৃক্ষঃ। মানে ফল-ধরা গাছ।” কিকিরা রগুড়ে গলায় বললেন, পাকা লোক, প্রেতসিদ্ধ মহাপুরুষ উনি! পাকা ফল ফলাতে কতক্ষণ!”
তারাপদ বলল, “মহাপুরুষকে একবার যে দেখতে ইচ্ছে করছে, কিকিরা?”
“হবে। তর সও। এত তাড়াতাড়ি কি সব হয়! ধৈর্য ধরতে হবে, মাথা খাটাতে হবে। তবে না!”
হাঁটতে-হাঁটতে গলি দিয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়ল তারাপদরা।
সঙ্গে-সঙ্গে লোডশেডিং। কলকাতা বলে শহর। আলো না গেলে কি হয়!
ঝপ করে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় তিনজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। অচেনা জায়গা। কোন দিকে এগোবে যেন ঠাওর করতে পারছিল না। চোখ সইয়ে নিতে সময় লাগল সামান্য। ধীরে-ধীরে জ্যোৎস্নাও ফুটে উঠেছিল। এ-দিকটায় দোকানপত্র বেশি নেই। বসতবাড়িও কম। পর-পর বুঝি গুদোম-ঘর। কাঠগোলাও রয়েছে। লণ্ঠন, কুপি, মোমবাতি জ্বলে উঠতে লাগল একে-একে।
কিকিরা তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পা বাড়াতে যাচ্ছেন এমন সময় তারাপদ সেই ঢ্যাঙা লোকটিকে আবার দেখল। সঙ্গে তার নেড়ি কুকুরটাও। লোকটি বোধ হয় বাড়ি ফিরছে।
তারাপদর সঙ্গে লোকটির চোখাচুখি হয়ে গেল। চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল সে। হয়ত তারাপদদের তিনজনকে দেখছিল। তখন তারাপদ ছিল একলা মানুষ; এখন তিনজন হয়ে গেল কেমন করে?
তারাপদ কিছু বলার আগেই লোকটি নিজেই বলল, “দেখা হয়নি?”
মাথা নাড়ব কি নাড়ব না করে তারাপদ এমনভাবে মাথা নাড়ল যে হ্যাঁ-না কোনোটাই ঠিক করে বোঝা যায় না।
“তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?” লোকটি বলল। গলার স্বরে যেন খানিকটা উপহাস। ওর হাতে একটা পাতায় মোড়া খাবারের ঠোঙা।
তারাপদ বুদ্ধি করে বলল, “আজ লোক বেশি। চলে এলাম।”
“ও! শনি-মঙ্গল বুঝি!”
“শুদ্ধানন্দজি এখানে কত দিন আছেন, দাদা?”
“কত দিন! ওই তো…গত বছর…তা ধরেন দেড় বছরটাক। “
“তা হলে বেশিদিন নয়।”
“ওই হল।…আয় ল্যাংড়া…।” লোকটি আর দাঁড়াল না, তার লেজুড়টিকে ডেকে নিয়ে গলির মধ্যে চলে গেল। নেড়ি কুকুরটার নাম ল্যাংড়া, না কি সে এক পায়ে ল্যাংড়া তারাপদ বুঝতে পারল না।
কিকিরা বললেন, “কে হে লোকটা?”
“এই গলিতে থাকে। যাবার সময় দেখা হয়েছিল।”
“প্রেতসিদ্ধর এজেন্ট নয় বলেই মনে হল।”
“কী জানি!”
“নাও, চলো।”
চন্দন বলল, “কিকিরা, এতরকম ঝাট না করে এখানকার থানায় একটা খবর দিয়ে দিলেই তো হয়।”
তারাপদ বলল, “থানায় খবর!..চাঁদু, তুই থানা দেখাস না। যা না, গিয়ে খবর দে। কচু হবে।”
কিকিরা বললেন, “থানা-টানা পরে, আগে কল্পবৃক্ষটিকে দেখি। আলাপ-পরিচয় হল না মহারাজের সঙ্গে, আগে থেকেই থানা-পুলিশ কেন! নাও, চলো। হাঁটতে হবে খানিকটা।”
.
চন্দনের জরুরি কাজ ছিল, সে নেমে গিয়েছিল আগেই, কিকিরা আর তারাপদ বাড়ি ফিরলেন সাড়ে আটটার পরই। তারাপদর বোর্ডিংয়ে ফিরতে ফিরতে রাত হবে। কিকিরার বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া সেরে সে নিজের আস্তানায় ফিরবে। মাসের মধ্যে চার-পাঁচটা দিন তার এইভাবেই কাটে।
বাড়ি ফিরে বগলাকে চা করতে বললেন কিকিরা। তারপর আরাম করে বসলেন।
তারাপদও গা ছড়িয়ে বসে পড়ল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কিকিরা বললেন, “তারাপদ, তোমার অফিসের বন্ধু জগন্নাথের বাড়িতে এমন কেউ নেই যে হাঁড়ির খবর-টবর দিতে পারে?”
মাথা নাড়ল তারাপদ। বলল, “না। হাঁড়ির খবরে আপনি কী করবেন?”
কিকিরা বললেন, “জগন্নাথের বাবা সম্পর্কে খোঁজ-খবর করা দরকার।”
“কেন?”
“আসল রহস্যটা বোধ হয় ওখানে।”
“আপনি তখনও কথাটা বললেন, স্যার। আমি কিন্তু বুঝিনি। জগুদার বাবা কবে মারা গিয়েছেন, এখন তাঁকে টানাটানি কেন? মরা মানুষের সঙ্গে কিসের সম্পর্ক…”
“তুমি কিছু বুঝলে না.” তারাপদকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কিকিরা বললেন। “একটু মাথা খাটাও।”
“আপনিই বলুন।”
দু-চার মুহূর্ত কথা বললেন না কিকিরা, তারপর বললেন, “জগন্নাথের বাবা কী ছিলেন? না, জুয়েলার! তাঁর নিজের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তিনি তাঁর পেশা এবং নেশা কোনোটাই ছেড়ে দেননি। ভদ্রলোক একজন নামকরা স্টোন স্পেশ্যালিস্ট ছিলেন। বড় বড় কয়েকটা দোকানে আসা-যাওয়া করতেন, তাদের পাথর-টাথর পরখ করে দিতেন। ওঁর নিজের হাতে কোনো মক্কেল এলে উনি চেনা দোকান থেকে মালপত্র কিনিয়ে দিতেন। তাতে নিজের একটা কমিশন থাকত। তাই না? রাইট?”
“রাইট!” তারাপদ মাথা হেলাল।
বগলা চা এনেছিল। এগিয়ে দিল। দিয়ে চলে গেল।
চায়ে চুমুক দিয়ে কিকিরা আরামের শব্দ করলেন। পরে বললেন, “এই ভদ্রলোক, জগন্নাথের বাবা, একদিন বর্ষাকালে বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি ফিরছিলেন। তখন সন্ধে। এমন সময় এক মোটরবাইকঅলা এসে তাঁকে বাড়ির কাছাকাছি, পাড়ার মধ্যে আচমকা ধাক্কা মারে ভদ্রলোক রাস্তায় পড়ে যান। আশেপাশের রিকশাঅলারা চেঁচামেচি করে উঠতেই মোটরবাইকঅলা পালিয়ে যায়। রাইট?”
মাথা হেলিয়ে সায় দিল তারাপদ। চা খেতে লাগল।
কিকিরা বললেন, “জগন্নাথের বাবাকে ধরাধরি করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখান থেকে হাসপাতাল। দিন-তিনেক পরে তিনি মারা যান।”
“কোথায় যে চোট লেগেছিল জগুদা জানে না। বলতে পারে না, তারাপদ বলল।
“কোমরের কোনো বেকায়দা জায়গায় লাগতে পারে বা ধরো পড়ে যাবার পর মাথাতেও লাগতে পারে। হেড ইনজিউরি।”
“হতে পারে। অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট…”।
কিকিরা তারাপদকে দেখতে-দেখতে বললেন, “আমি যদি বলি ওটা অ্যাকসিডেন্ট নয়!”
“নয়?” তারাপদ অবাক হয়ে বলল।
“ধরো, জগন্নাথের বাবার কেউ পিছু নিয়েছিল। যে-লোকটা পিছু নিয়েছিল সে জেনেশুনে ইচ্ছে করে জগন্নাথের বাবাকে ধাক্কা মেরেছে।”
“জেনেশুনে? আপনি বলছেন কী, কিকিরা?জগুদার বাবাকে কি তবে জখম করার, খুন করার চেষ্টা হয়েছিল?”
“খুন না হোক, অন্তত জোর জখম।“
“কেন?”
“কেন!…কেন তা ভেবে দেখে আমার মনে হয়েছে, জগন্নাথের বাবার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান কিছু ছিল। কী থাকতে পারে? সোনাদানা, না, পাথর? সোনাদানা থাকার চেয়েও যেটা সম্ভব সেটা হল পাথর। দু-চার টুকরো দামি হীরে, চুনি, ক্যাটস আই..”
“কী বলছেন আপনি, কিকিরা? হীরে, চুনি নিয়ে একটা লোক বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি ফিরবে? তা ছাড়া জগুদার বাবা ওসব পাবেনই বা কেমন করে?”
“কেন? ওঁর পক্ষেই তো পাওয়া সম্ভব।” কিকিরা হাত বাড়িয়ে চুরুটের খাপ টেনে চুরুট বার করতে লাগলেন। বললেন, “কোনো জুয়েলারের দোকান থেকে আনছিলেন। কিংবা কোনো জুয়েলারের দোকানে বেচতে নিয়ে গিয়েছিলেন।”
“বেচতে? জগুদার বাবা! আপনি ভুলে যাচ্ছেন–জগুদার বাবার যা অবস্থা ছিল…”
“জানি হে জানি। অবস্থা ভাল ছিল, না ওঁর। কিন্তু এই কলকাতা শহর বলে নয়, সর্বত্র স্মাগল্ড বা চোরাই সোনা, পাথর বেচাকেনা হয়। ধরো, কোনো চোরাইঅলা জগন্নাথের বাবার মারফত কিছু পাথর বিক্রি করতে চেয়েছিল। বলবে, তা কি সম্ভব? আমি বলব, সম্ভব। সম্ভব ওই জন্যে যে, সব কারবারের মতন এ-সব কারবারেরও একটা সার্কেল আছে। রিং। ওরা। পরস্পরকে চেনে। কারবার করে। বিশ্বাসও করে।”
তারাপদ চুপ। সে যেন ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিল না। আবার এত কথা শোনার পর সরাসরি অবিশ্বাস করতেও বাধছিল।
চুরুট ধরিয়ে কিকিরা বললেন, “দুটো জিনিস হতে পারে। হয় কোনো চোরাইঅলার কিছু মাল জগন্নাথের বাবার কাছে ছিল; না হয়, কোনো দোকান থেকেই জগন্নাথের বাবা কিছু সোনাদানা, পাথর চুরি করে আনছিলেন। জিনিসগুলো ওঁর ফতুয়ার ভেতরের পকেটে, না হয় কোমরে কষির মধ্যে ছিল। হাতে ছিল না, পকেটেও নয়। মোটরসাইকেলঅলা যদি সহজে সেগুলো পেত, ছেড়ে পালাত না, কেড়েকুড়ে নিয়ে চলে যেত। ও জগন্নাথের বাবাকে ফলো করে এসেছিল জিনিসগুলো হাতাতে, পারেনি। তারপর তাড়া খেয়ে পালিয়ে যায়।”
তারাপদর চোখের পলক পড়ছিল না। কিকিরা কি ঠিক বলছেন? পাথর-টাথরের কথা যদি সত্যি হয়, জগুদার বাবা যে কোনো জুয়েলারের দোকান থেকে দু-দশটা দামি পাথর চুরি করে আনছিলেন, একথা সে বিশ্বাস করে না। ছি ছি। জগুদার বাবা চোর? কিকিরার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এক মৃত ভদ্রলোকের নামে তিনি চোর অপবাদ দিচ্ছেন। তারাপদ মনে-মনে অসন্তুষ্ট, বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। ক্ষুব্ধ হয়েই বলল, “আপনি জগুদার বাবাকে চোর ভাবছেন?”
কিকিরা বললেন, “না, চোর ভাবিনি। আমি বলছিলাম, হয় এটা না হয় ওটা! যুক্তিতে তাই বলে। অঙ্কের নিয়ম আর কি! তা ছাড়া তুমি কেমন করে বুঝছ, একটা মানুষ, খুব একটা খারাপ অবস্থায় পড়ে হঠাৎ একদিন লোভের বশে এমন কাজ করবে না! করতেও তো পারে। তবু চোর কথাটা বাদ দিচ্ছি। চোরাই মাল তো বটেই..।”
“আপনি কি বলতে চাইছেন, এই চোরাই জিনিসগুলো জগুদার বাবা জগুদার মাকে লুকিয়ে রাখতে বলে মারা যান?”
“আমার তাই মনে হয়।”
“আপনি ভুল করছেন কিকিরা-স্যার।”
“হতেই পারে ভুল। চাণক্য শ্লোকে নাকি বলেছে, বুদ্ধিমানে আধাআধি ভুল করে, বোকারা পুরোটাই ভুল করে।”
তারাপদ জবাব দিল না কথার।
কিকিরা চুরুট টানতে টানতে চোখ বুজে থাকলেন সামান্যক্ষণ। তারপর চোখ চেয়ে তারাপদকে দেখলেন। “এতক্ষণ যা শুনলে সেটা হল স্টেজের পেছনের ব্যাপার। যবনিকার অন্তরালে। তোমার-আমার চোখে পড়ছে না। পরের ব্যাপারটা বাপু অন্ দি স্টেজ। শুদ্ধানন্দ প্রেসিদ্ধ।…যাক্ সিনেমার এখানে ইন্টারভ্যাল, পরের ব্যাপারটা কাল-পরশু হবে। তুমি শুধু জগন্নাথদের বাড়ির ব্যাপারটা খোঁজখবর করো। ওর বাবা, ওর জ্ঞাতিগুষ্টি…যা যা পারো জেনে নেবার চেষ্টা কোরো।”
তারাপদ শুনল। মনে হল, কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে।