বারান্দায় এসে হাশেমের মুখোমুখি পড়ে যায় আবু। দ্যাখে, দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাশেম। যেন আবুর জন্যেই অপেক্ষা করছে সে।
হাশেম ডাকল, আবু, শোন।
চোখ তুলে দেখল, থরথর করে কাঁপছে, দুপয়ে দাঁড়াতে পারছে না হাশেম। দুচোখ ফেটে যেন কিসের ব্যাকুলতা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আবু হাত বাড়িয়ে ধরলো তাকে, নইলে বোধ হয় মুখ থুবড়ে পড়েই যেত মানুষটা।
একটা কাজ করতে পারবি?
তার কথায় কান না দিয়ে আবু বলে, বিছানায় চলো। না কি একটা ইজিচেয়ার পেতে দেব? জ্বর একটু কমেছে বলেই উঠতে হয় নাকি?
ম্লান হাসিতে সূর্য হয়ে ওঠে হাশেমের মুখ। বলে, নারে না, আমার কিসসু হয়নি। শরীরটা কেবল মনের ওপর শোধ নিচ্ছে। অনেক দিনের রাগ কিনা! তোরা তাও হতে দিবিনে? আমার কিসসু দরকার নেই।
মুখে যতই বলুক, দুর্বলতার ঘোরে স্পষ্ট টলতে থাকে হাশেম। আবুকে শক্ত করে ধরে শুধোয়, বকুলের খবর জানিস, আবু? বকুল কোথায় আছে?
হাশেমের মুখে বকুলের নাম শুনে চমকে ওঠে আবু। একমুহূর্ত কোন জবাব দিতে পারে না। বকুল বকুলের সংবাদ সে জানবে কী করে? বকুলকে সে দেখেও নি কোনোদিন। বকুল তার কাছে কেবল একটা নাম ছাড়া আর কিছুই না। শুনেছিল, বছর খানেক আগে তার বিয়ে হয়ে গেছে।
আবু বলল, ঢাকাতেই আছে শুনেছিলাম। সেগুনবাগানে না কোথায়।
আমাকে আজ ঠিকানাটা এনে দিতে পারবি?
আবু অবাক হয়ে ভাবে, হাশেম ভাই কী জানেন বকুলের বিয়ে হয়ে গেছে? কথাটা জানাতে গিয়েও সাহস হয় না হাশেমের চোখে সাত রাজ্যের আকুলতা দেখে। সে আশ্বাস দিয়ে বলে, আচ্ছা দেখব।
হাশেম তখন স্বস্তি পেয়ে আবুকে ছেড়ে দিয়ে ঘরের দিকে এগোতে চায়, কিন্তু পারে না। মাটিতে পড়ে যাবার আগেই আবু তাকে বুক দিয়ে জড়িয়ে ধরে। বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয়। কী জানি কী হয়, বিছানায় শুয়ে ঘামে, অস্থিরতায়, জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। হাশেম যেন অনেক বড় একটা মাঠ পাড়ি দিয়ে এসেছে। বড় বড় চোখ মেলে আবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। আবু আবার বলে, আচ্ছা, দেখব আজ।
দুপুরে মাহবুব এলো হাশেমকে দেখতে। তার আগে সকালেই মাহবুবের বউ ফাতেমা এসেছিল। আজ ওরা দুজন এখানেই খাবে।
হাশেম মাহবুবকে দেখে বলল, কিরে, ভালো আছিস?
ঐ এক রকম।
মাহবুব মাথা নিচু করে উত্তর দেয়। ওর ওটা একটা স্বভাব। কথা বলতে গিয়ে, সে যে হোক না কেন, যে কথাই হোক না কেন, কেমন যেন লজ্জিত হয়ে পড়বে।
পুরনো স্বভাবটা এখনো যায় নি দেখে হাশেমের ভারী চেনা মনে হলো মাহবুবকে। ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা অমন। হাশেমের মনে হলো ছোটবেলার মাহবুবকে এক অলৌকিক বলে সে ফিরে পেয়েছে। যেন আর একটু পরেই মাহবুব বেরিয়ে গিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে ও পাড়ার ছেলেদের ব্যাডমিন্টন খেলা দেখতে লেগে যাবে। ফিরে এসে বায়না ধরবে আমাকেও র্যাকেট কিনে দাও, কর্ক কিনে দাও।
হাশেম বালিশটাকে পিঠের নিচে এনে মাথা উঁচু করে শুলো। মৃদু হেসে বলল, তোর বউ দেখলাম।
হাশেম চলে যাবার বছর তিনেক পরে বিয়ে করেছিল মাহবুব। কাজেই এই প্রথম দেখা।
—-ভারী লক্ষ্মী বউ পেয়েছিস।
মাহবুব মুখ নিচু করে আঙ্গুল দিয়ে চাঁদর খুঁটতে খুঁটতে শুধালো, তুমি এতদিন ছিলে কোথায়?
হাশেম হাসলো। হাসলো নাতো যেন অন্ধকারে একরাশ ফুলসৃস্টির ভ্রম হলো।
—-বাবা মা কাঁদতে কাঁদতে মরতে বসেছিলেন তোমার জন্যে।
মানুষ তো কাঁদতে জানে বলেই বেঁচে থাকে, মাহবুব। কান্নাটা হচ্ছে মানুষের একটা শক্তি। বুঝতে পারছিস?
মাহবুব নির্বাক হয়ে শোনে। হাশেম বলে, ব্যথা পেলেই কাঁদে। কান্না হচ্ছে ব্যথার রূপ। ব্যথাটাকে বুঝতে না পারলে কাঁদতে পারবি কেন? মানুষ তো এমনিতেই কাঁদে, কাঁদে না? হাত পা ছড়িয়ে আকুলি বিকুলি করে, বিচ্ছিরি সংস্কারের মতো। সংস্কারটাকে বাদ দিয়ে যে কান্না ওটাই শক্তি।
মনে মনে অস্বস্তি বোধ করে মাহবুব। সত্যি সত্যি হাশেম যে পাগল হয়ে গিয়েছে এইটে অবিশ্বাস করবার আর কোনো কারণ সে দেখতে পায় না।
ঠিক এই কথা যখন সে ভাবছিল, তখন তাকে চমকে দিয়ে একেবারে সুস্থ মানুষের মতো হাশেম ঘরোয়া প্রসঙ্গ ওঠায়। বলে, কী করছিস আজকাল? মা চাকরির কথা বলছিলেন।
হ্যাঁ।
আজ আপিস যাসনি?
ট্রেনিং-এ আছি।
মাহবুব রান্নাঘরে এসে মরিয়মকে জানাল, মা, ভাই দেখছি বদ্ধ পাগল।
চটে গেলেন মরিয়ম। বললেন, হ্যাঁবে, তোদের মুখে কি আর কোন কথা নেই? পাগলই তো! নইলে কী সব বকছে শুনে এসোগে।
মাহবুব আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল জোর দিয়ে, হঠাৎ চোখে পড়ল তার বউ ফাতেমা চোখ টিপে বারণ করছে।
আমার ছেলে পাগল আছে বেশ আছে।
বলতে বলতে মরিয়ম যেন আঁচল দিয়ে অশ্রুই মুছলেন।
বিলকিস সারা ইউনিভার্সিটিতে উৎসুক হয়ে খুঁজল আবুকে। কিন্তু কোথাও দেখা মিলল না তার। সে বাসায় না থাকাতে আবু চটে গেছে কাল। তার প্রমাণ ছোট্ট চিঠিটা। চিঠির সেই কথা—-আরেকটা তারিখ নাইবা নিলেন। চিঠি পেয়ে বিলকিস যেমন বিস্মিত হয়েছে, তেমনি মনে মনে নিজের কাছে ছোট হয়ে গেছে সে। মনে হচ্ছে কাল কথা দিয়ে অমন করে না বেরুলেও পারত। কিন্তু সে তো বুঝিয়ে লিখে রেখে গিয়েছিল। কিছুতেই যেন বুঝতে পারছিল না বিলকিস, হঠাৎ করে মানুষটার গিয়ে লাগল কোথায়? তবে সে কি যা আশঙ্কা করেছিল তা–ই সত্যি? আবু তার হৃদয়কে বাসনা করছে?
বিলকিস তখন নিজের নারীত্ব নিয়ে যেন বিষ বিব্রত বোধ করল। তারপর সারাদিনে ক্লাশের চাপে আর কিছুই মনে রইল না তার। সারাটা দিন ক্লাশ করে, লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করে বাইরে যখন বেরুল তখন মনে মনে বলল—- আরেকটা দিন পার হয়ে গেল। বিকেলের রাঙ্গা রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে নিজেকে মুগ্ধ হতে দিল বিলকিস। এই রৌদ্রটা শুধু এই সময়ের; আর কোন দিন তা ফিরে আসবে না। এক অপরূপ আনন্দ ও বেদনার আশ্রয়ে সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল আমগাছটার নিচে। আজ তার গাড়ি আসতে বড় দেরি হচ্ছে।
আরো কিছুক্ষণ দেখে বিলকিস রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরল। দ্যাখে, টেবিলের ওপর চিঠি। হাতের লেখা আর স্ট্যাম্প দেখে তক্ষুণি বুঝতে পারে ফ্লোরেন্স থেকে মন্টি চিঠি লিখেছে। ইস, এর আগেও মন্টি আরেকটা চিঠি দিয়েছিল। তার উত্তর দেয়া হয়নি। নিজের আলসেমিকে মনে মন নিন্দা করল বিলকিস। চিঠিটা তক্ষুণি খুলল না। তুলে নিয়ে রেখে দিল হাতব্যাগে।
বাথরুমে এসে মুখ মার্জনা করল। তারপর আয়নায় শাদা তোয়ালে জড়ানো মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল বিলকিস। যেন নিজের মৃতমুখ দেখছে, এমনি অপলক দৃষ্টি তার।
মন্টির মুখ অদ্ভুত রকমে রেখা ও কোণবহুল। আবছা আবছা মনে পড়ে বিলকিসের। আর রংটা গাঢ় তামাটে। দেখলে মনে হয়, একটা আবক্ষ মূর্তির দর্শন ঘটলো, বিশেষ করে মন্টি যখন চোখ বুজে থাকত। কথ বলতে বলতে অনেকক্ষণ চোখ বুজে থাকা, চোখ বুজেই কথা বলা মন্টির একটা স্বভাব। বিলকিসের মনে হতো তখন, মন্টি যেন চোখ বুজে দেখে নিচ্ছে যা বলছে। মন্টি বলত, পৃথিবীটার কোনো হারমনি নেই, বিলকিস। প্যাটার্ণ নেই, প্রাণ নেই। চান্স ইরেকটেড, চান্স ডাইরেকটেড। দেখে দেখে আমার গা জ্বালা করে। তাই তো ছবি আঁকি। চারটা ফ্রেমের মধ্যে যে পৃথিবী সৃষ্টি করলাম, তার ভেতরে বস্তুর প্রাণের হারমনি আছে, এইটে বড় কথা।
বিলকিসের অনেক দিন মনে হয়েছে, মন্টির চোখ বুজে থাকার অভ্যেসটা এখান থেকেই পাওয়া। এ যেন বাইরের পৃথিবী থেকে চট করে সুইচ অফ করে তার নিজের পৃথিবীতে চলে যাওয়া।
বেরিয়ে এসে বিলকিস বারান্দায় মোড়া পেতে বসল। শিশু সন্ধ্যের আভাস লেগেছে আকাশে। চারদিক ভারী শান্ত। মোড়ায় বসেই চা খেলো।
তারপর হাঁটল খানিক নিচেয় ঘাসের ওপর। ফিরে এসে ছোট বোন পারিজাতের সঙ্গে আদর খেলা করল। ছোট ভাগৃনে দুটো এসেছে কাল। টুকু আর টুলু। তারা তখন ভাঙ্গা চক দিয়ে মেঝেয় সোৎসাহে পাখি আঁকছে আর ছড়া কাটছে—-
দ গেলো শ্বশুর বাড়ি
বসতে দিল কাঠের পিড়ি।
তাদের কোল সাপটা করে নিয়ে সোফার ওপর বসল বিলকিস। গাল টিপে দিয়ে বলল, লক্ষ্মীছাড়া হয়েছিস দুটো।
তখন খিলখিল করে হাসতে হাসতে টুকু নেমে এলে বিলকিসের পায়ের ওপর। সেখানে বসে সে দোল খাবার চেষ্টা করতে লাগল। আর টুবলুও কিছু কম যায় না। সে বাহুর ফাঁক দিয়ে একেবারে কাঁধের ওপর উঠে বাতাসে সাঁতার দিতে লাগল।
টুকু আর টুবলুকে নিয়ে কাটানো গেল অনেকক্ষণ। তারপর নিজের ঘরে এসে মন্টির চিঠিখানা খুলে পড়তে বসলো। প্রথমেই লম্বা এক অভিযোগ!
আগের চিঠিটার জবাব দাওনি কেন? তোমার চিঠির জন্যে তাকিয়ে থেকে থেকে ঘাড় ব্যথা। করতে শুরু করে দিয়েছে। ডাকপিয়নটার কাছে পর্যন্ত লজ্জা পাচ্ছি। ওর সাইকেলটা মোড়ের মুখে দেখলেই এখন আমি পালাই।
বড্ড নিষ্ঠুর হয়েছ তুমি।
অথচ এদিকে তোমাকে নিয়ে কত কাণ্ড! আমার বন্ধু অগাস্টাস—- সেই যে ছেলেটা, যার কথা এর আগে তোমার কাছে লিখেছিলাম, একটা সোলো একজিবিশন করে ক্রিটিকদের কাছে। দারুণ বকা খেলো সেই অগাস্টাস এক কাণ্ডই করে বসেছে। আমার কাছ থেকে ফোটো নিয়ে তোমার ছবি এঁকেছে। নাম দিয়েছে দ বু ক্লাউড অ্যাণ্ড সেভেন্টি নাইন। অদ্ভুত এই নামটার একটা মজার ব্যাখ্যা আছে।
এবার হাতে টাকা এলেই অগাস্টাস তোমার কাছে ছবিটা পাঠাবে। ওর ছবি কেউ কিনতেই চায় না! যা বিক্রি হয় তাতে ওর কালো রুটি, মদ আর বাড়িউলিকে ভাড়া দেয়ার পয়সা হয় কোনো রকমে। তাই ভাবছি, ছবিটা শেষ অবধি তোমার কাছে পৌঁছুবে কিনা। ওকে বললাম, ছবির অন্তত একটা ফোটো তুলে পাঠাই।
তাতে চটে গিয়ে বলল, আড়াই বাই চার ইঞ্চি এক চিলতে কাগজে শাদা কালোয় আমার ছবির কংকালটাই পাবে।
লুসিয়েন কিন্তু অগাস্টাসকে ভোগাচ্ছে খুব। মেয়েটা যেন ওকে মানুষ বলেই গনতে চায় না। অগাস্টাসের এই হাল দেখে একেক সময় লুসিয়েনের ওপর এত চটে যাই যে তখন হাত নিসপিস করতে থাকে। মনে হয়, কী হয় পৃথিবীর, এই মেয়ে জাতটা না থাকলে?
তুমি ভাবছ, আমার মানসিক অধঃপতন দেখা দিয়েছে। না, না। অগাস্টাসকে দেখলে রাস্তার ষ্ট্যাচুটার পর্যন্ত দুঃখ হতো, আর আমি তো জ্যান্ত মানুষ! অথচ ছেলেটা এমন, বাইরে কিছু বলবে না, ভেতরে ভেতরে যে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সে ছাই সোনার পাত্র দিয়ে ঢেকে রাখবে। আমি বলি, লুসিয়েন একদিক থেকে ভালোই করছে অগাস্টাসের। নইলে ওর ছবি আঁকাই হতো না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেমন করে ছবি এঁকে চলে, দেখলে অবাক হতে হয়। শক্তি পায় কোত্থেকে? আমি বলি—-লুসিয়েন।
দ্যাখো কী কাণ্ড! একটু আগে লুসিয়েনের সূত্র ধরে তামাম মেয়ে জাতটাকে মন্দ বলছিলাম। এখন আবার তারই সুখ্যাতি করছি।
কলম তুলে ভাবলাম খানিক, কেন এমন হলো?
মনে হচ্ছে, একবার ব্যক্তি হিসেবে একবার শিল্পী হিসেবে দুরকম করে অগাস্টাসকে দেখছি বলেই এই গরমিল। কোনটাকে বড় করে দেখব? কী জানো বিলকিস, শেষ অবধি হয়ত মানুষটাকে বড় করে দেখা উচিত। মানুষটাই যদি কষ্ট পেল তাহলে এত হৈচৈ আয়োজন কার জন্যে? নামের মোহ যাদের আছে তাদের আলাদা কথা। তারা পেলেও যা, না পেলেও সেই একই। কিন্তু নামের মোহ যাদের নেই?
মানুষ বাঁচে বলেই তো পৃথিবীটা বাঁচে। যে মানুষ আজ মরে গেল, তার কাছে এ পৃথিবীর শিল্প সভ্যতা সুখ–দুঃখ সব কিছুই মরে গেল।
যতটুকু বেঁচে আছি, আনন্দ থাক। তাইতো বারবার তোমাকে বলি, আমাকে আর দূরে সরিয়ে রেখো না।
তোমার অন্তরটাকে আমার আপন করে নিতে দাও, যেন মৃত্যুর সময় আমাকে দুঃখ করতে না হয়।
কথায় কথায় কতদূর চলে এসেছি!
অগাস্টাস কাল ভোর রাতে আমাকে বেদম মার দিয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত ছুটছিল। কাল সন্ধ্যেয় লুসিয়েনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। ও এসেই বলল, আজ তোমার সঙ্গে আমার তারিখ।
আমি তোমার কথা মনে করে বললাম, আমার তারিখ তো হয়ে আছে, লুসিয়েন।
সে বলল, কুছ পরোয়া নেহী! তোমরা অমন একরোখা প্রেমিক কেন, মন্টি? আজ আমি তোমার মেয়েটার কাছ থেকে একটা দিন ছিনিয়ে নিতে এসেছি। ঠিকানা দিও, তাকে না হয় ফুল পাঠিয়ে ভাব করে নেবো পরে।
কী ভাবছ বিলকিস? ভাবছ, তোমার কথা দশখানা করে বলে বেড়িয়েছি সারা ফেলরেন্স? ভরসা আছে, তা যদি বলেই থাকি তুমি চটে যাবে না। আর এক্ষেত্রে বলিইনি। লুসিয়েনের আন্দাজ ভালো।
গলায় লুসিয়েনের হাত। তোমার কাছে স্বীকার করতে সংকোচ নেই, তখন আমার একটু ঘোর লেগেছিল যেন। নইলে পরক্ষণেই লুসিয়েনকে নিয়ে হৈচৈ করে বেড়িয়ে পড়লাম কেন?
দ্যাখো, অভিমান করতে যেও না যেন, লক্ষ্মী। আমি বলছি বলেই তো জানতে পারছ, নইলে জানতেও না। কথা দাও, আমাকে ভুল বুঝবে না। নইলে এই আমি কলম বন্ধ করলাম।
জানি, তোমার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। আমি তো জানিই, তোমার কাছে প্রশ্রয় আছে সব কিছুর।
তারপর রাতে ঘরে ফিরে লুসিয়েনের ছবি করতে বসেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, এই ছবিটা আঁকতে না পারলে লুসিয়েন থেকে যেন আমার নিস্তার নেই। রাত তখন অনেক। লুসিয়েনের পোরট্রেট করছি। শাড়ি পরা লুসিয়েন। দূরে টুলের ওপর পরিতৃপ্ত পোষমানা বেড়ালের মত এতক্ষণ বসে ছিল লুসিয়েন।
ক্যানভাসে শাড়ির রেখা দেখে ও শুধালো, ওকী! কেন?
আমি বললাম, মাথার ভেতরে অনেক কিছু ওভারল্যাপ করছে। তুমি কথা বলো না। পোরট্রেটটা তুমি নও, ওটা আমার এক্সপ্রেশন বা ইম্প্রেশন যা বলো।
এত দ্রুত শেষ করেছিলাম ছবিটা যে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিজেরই অবাক লাগলো। লুসিয়েন কাঁধ ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আর সব পেইন্টারদের তুলনায় তুমি অনেক বেশি সহৃদয়। মোটেই সময় নাওনি।
আমি দাঁড়িয়ে নিরিখ করছিলাম সদ্য আঁকা ছবিটাকে। ছবিটার ডোমিন্যান্ট রং ছিল গ্রীন। গ্রীনটার স্বরূপ তোমাকে লিখে বোঝাতে পারব না।
লুসিয়েন তার বুক আমার পিঠে ঠেকিয়ে আদুরে মেয়ের মত কাঁধে মাথা রেখে ছবিটা দেখছিল। ঠিক এই সময় ভূতের মতো অগাস্টাস এসে হাজির। ভেবে দ্যাখো বিলকিস, একেবারে অপেরা থেকে কেটে আনা একটা দৃশ্য! অগাস্টাস কিছু বলল না। এক মুহূর্ত একবার আমাকে দেখল, একবার লুসিয়েনকে। আমি তো মনে করলাম, অগাস্টাস আমার ছবিখানা ইজেল শুদ্ধ তেতলা থেকে ছুঁড়ে মারবে। বদলে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। অগাস্টাসের হাতে রং লেগে ছিল। ছবি আঁকছিল বোধ হয়, ফেলে রেখে উঠে এসেছে। এ রকম অনেক দিন এসেছে ও আমার ঘরে দুপুর রাতে আধ মাইল পথ হাঁটতে হাঁটতে। ওর জন্যে আমাকে মদ কিনে রাখতে হতো। আজ ওবও দুর্ভাগ্য। আমারও। পড়ে। পড়ে মার খেলাম পশুর মত। কিডনিতে একটা ঘুষি পড়েছিল বেকায়দায়, ব্যথাটা এখনো যায়নি। উলটে মারতে পারতাম, মারিনি। ভাবলাম, ও ওর পাত্র পান করুক প্রাণ ভরে।
অগাস্টাস চলে গেলে পর লুসিয়েন এসে আমার পাশে মেঝেয় হাঁটু গেড়ে বসল। আমার রক্ত দেখে অগাস্টাসের উদ্দেশে থুতু ছিটিয়ে বলল, ক্রাইস্ট। একটা পশু।
ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিতে এসেছিল লুসিয়েন। তাকে ফিরিয়ে দিলাম। সে রাগ করে চলে গেল। সকালের দিকে জ্বর এসেছিল। এখন নেই। বিছানাতেই আছি। হঠাৎ দুপুর বেলায় অগাস্টাস এসে একটা কথা না বলে আমার শুশ্রূষা করছে আনাড়ির মতো। বেচারা লজ্জা ঢাকবার জন্যে তখন থেকে গম্ভীর। দেখে হাসি পাচ্ছে।
দেখলে বিলকিস, অগাস্টাসের কাণ্ডটা?
এখন অনেকটা সুস্থ আছি।
আর কী লিখি? ভালো কথা, অগাস্টাস তোমার যে ছবি এঁকেছিল তার নাম দি বু ক্লাউড অ্যাণ্ড সেভেন্ডি নাইন কেন বলাই হলো না। ফেলরেন্সে এসে ও প্রথমে যে বাড়িটায় উঠেছিল। তার নম্বর ছিল উনআশি। কবে ছেড়ে দিয়েছে বাড়িটা, কিন্তু এখনো নাকি হোমসিক হলে তার গায়ের বাড়ির কথা মনে না হয়ে মনে পড়ে ফেলরেন্সের এই উনআশি নম্বর বাড়িটার কথা। অগাস্টাস বলে, এ হচ্ছে মনের এক অদ্ভুত খেলা। তা সেই থেকে প্রিয়তম যা কিছু। তারই প্রতীক ওর কাছে উনআশি। আব নীল মেঘ? তার ব্যাখ্যা ছবিতে, ছবি না দেখলে শুধু লিখে বোঝানো যাবে না।
অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে চিঠিটা, তাই না? তুমি এবারো যদি জবাব না দাও তাহলে সাংঘাতিক একটা কিছু করে বসবো। দাড়ি কামাতে গিয়ে গলায় ক্ষুর টেনে দিলে কেমন হয়?
আর নদিন পর আমার জন্মদিন। তোমার হয়ত মনেও পড়ত না আমি না লিখলে।
ভালো থেকো কিন্তু। নইলে ভীষণ রাগ করবো। আর তোমার পরীক্ষাটা কবে নাগাদ জানিও। তখন চিঠি লিখে জ্বালাতন করব না। কিন্তু ইতিমধ্যে চিঠি দিও।
তোমার চিঠি পাবার জন্যে নিজের ব্যাকুলতা দেখে হঠাৎ হাসি পাচ্ছে। গোটা মানুষটার জন্যেই যখন প্রতীক্ষা করছি, তখন একটা চিঠির জন্যেই এত! চিঠি না পাওয়াটাই এত অসহনীয়, তোমাকে না পেলে কী করব? এখান থেকে ভূমধ্যসাগর কিন্তু দূরে নয়। ডুবে মরা যাবে। অগাস্টাস তখন তোমার ছবির নাম বদলে হয়ত রাখবে দি বু সি অ্যান্ড সেভেন্টি নাইন।
ভালবাসা।
ইতি, তোমার মন্টি।
চিঠি শেষ করতেই আবুর কথা মনে পড়লো। চিঠি পড়তে পড়তে মন্টির মধ্যে তন্ময় হয়ে থাকার পর্দা ছিঁড়ে আবুর মুখ কেন ভেসে উঠল ভেবে পেল না বিলকিস। মনের মধ্যে মোচড় ওঠে, আবুর জন্যে কিছু করা দরকার। কিন্তু কতটুকুইবা তার ক্ষমতা?
কালকে চিরকুটে লেখা আবুর ওই কথাটা আরেকটা তারিখ নাইবা নিলেন—- একেবারে মর্মে এসে নাড়া দিয়েছে তাকে। এতকাল যা ছিল আড়ালে তার স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে এসে বিব্রত করে দিয়ে গেছে বিলকিসকে। তা হাত পা বাঁধা। আবুর জন্যে মমতা হয়, কিন্তু হাত ওঠাতে গেলে যে টান পড়ে; মন্টি তার সর্বস্ব নিয়ে এত ভরসা করে আছে। বিলকিসের মনের ভেতরটা খুব অসুখী হয়ে থাকে। জগৎ জোড়া একী নির্মম পরিহাস! লুসিয়েন অগাস্টাস এদের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, লুসিয়েন তার বিরাগ দিয়ে শক্তি জোগাচ্ছে অগাস্টাসের। বিলকিস ভাবে তার বিরাগেও কি শক্তিমান হয়ে উঠতে পারে না আবু
.
আবুকে অনেক কিছু করতে হবে। অনেক বড় হতে হবে। অমন সংবেদী ছেলেটা ইচ্ছে করলে অনেক বড় হতে পারে। বিলকিসের মনে হয়, তার যদি কোন অলৌকিক শক্তি থাকত তাহলে এই মুহূর্তে আবুকে পৃথিবীর সবসেরা মানুষ করে দিত।
রাতে চিঠির জবাব লিখতে বসলো বিলকিস। লিখবার আগে আরো দুবার পড়ল চিঠিটা; যেন যথেষ্ট করে অনুভব করে নিল মন্টিকে। বারোয়ারি কথায় ঠাসা জবাব। লুসিয়েনকে বকলো খানিক অগাস্টাসকে ভোগাবার জন্যে। অগাস্টাসের জন্যে দুঃখ করল তার ছবি বিক্রি হয় না বলে। লিখল, সেদিন ভোর রাতে অগাস্টাস মারপিট করে ভালই করেছে, নইলে। নিজেরই ওপরে প্রতিশোধ নিত। সেটা হতো আরো ভীষণ। মন্টি তার ঝড় আগলে সুবুদ্ধির পরিচয়ই দিয়েছে।
লিখল, এখানে আবু নামে তার এক বন্ধুর কথা। লিখল, এমন একেকটা লোক থাকে যারা অচেনাও থাকে না, আবার যাদের চেনাও যায় না। তারা সর্বমানুষের অনাত্মীয় হয়ে থাকার জন্যেই যেন এ পৃথিবীতে জেদ করে বেঁচে আছে। পরে লিখল দেশের খবর আর আবহাওয়ার কথা।
এতক্ষণ চিঠি থেকে সন্তর্পণে বাঁচিয়ে এসেছে নিজের কথা। চিঠির সবশেষে ছোট্ট করে বিলকিস লিখল
খুব যে ভয় দেখাচ্ছ আমাকে! তোমাকে এ রকম বিচলিত হতে দেখলে নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারিনে।
পারবে আমার মতো জেদি, স্পষ্ট, শাদা একটা মেয়েকে নিয়ে সারা জীবন কাটাতে?
তোমার জন্মদিন আমার মনে ছিল। ওই দিনটা আমার কাটবে ছুটি নিয়ে; তোমার কথা মনে করে।
.
বকুলের ঠিকানা চেয়েছে হাশেম। কিন্তু আবু কোথায় খুঁজবে বকুলকে? সেগুন বাগানের। প্রতিটি বাড়ি? রেস্তোরাঁয় দুপুরে অনেকক্ষণ ধরে একটা পথ আবিষ্কারের ভাবনা ভাবল। কিন্তু কোন ফল হলো না। আজ দুদিন হলো আবু শুধু ভাবছেই। এতদিন পরে বকুলকে কী দরকার? ভাবতে থাকে আবু। যাকে ভালবেসেছিল হাশেম, পাঁচ বছর আগেই তো তাকে কবর দিয়ে চলে গিয়েছিল। আজ ফিরে এসেছে কবর থেকে মৃতমুখ তুলে দেখবার জন্যে? হাশেম ভাইয়ের ব্যাকুল মুখের কথা মনে করে আবু ভীষণ অস্থিরতায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে থাকে মুঠি বন্ধ করে। একটা কিছু করা দরকার। খামোকা একটা শো–কেসের সামনে দাঁড়িয়ে জিনিস দেখতে থাকে আবু। দেখে না, চোখটাকে একটা কিছুতে স্থির রাখা চলে, মন বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। হঠাৎ রেস্তোরাঁয় ফিরে এসে টেলিফোন করে বিলকিসকে।
বিলকিস?
হ্যাঁ বলছি।
আমি আবু।
কী ব্যাপার?
বিলকিসের বুকের ভেতরটা স্তব্ধ হয়ে যায়। এই ভরদুপুরে আবু হঠাৎ টেলিফোন করল কেন? উদ্বেগ নিয়ে টেলিফোনের উপর ঝুঁকে পড়ে বিলকিস। কিন্তু অনেকক্ষণ কোন উত্তর আসে না। আবারো সে শুধোয়, হ্যালো, কী ব্যাপার?
তখন আর বলে, আমার একটা কাজ করে দিতে পারবেন?
কী কাজ?
প্রায় আর্তনাদের মত শোনায় বিলকিসের কণ্ঠ।
আবু বলে, কিছু না। একটা ঠিক না দরকার, খুঁজে দিতে হবে।
ঠিকানা?
হ্যাঁ, ঠিকানা। বকুল। প্রায় পাঁচ বছর আগে ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। বিয়ে হয়েছে। সেগুন বাগানে না কোথায় আছে শুনেছিলাম। বড় দরকার। পারবেন? আজ–কালের মধ্যেই দরকার।
আবুর কণ্ঠের ব্যাকুলতা টের পেয়ে বিলকিস যেন অবাক হয়, তেমনি তার জন্যে কিছু একটা করতে পারার সম্ভাবনায় আগ্রহে ভরে ওঠে। নিশ্বাস ফেলে বলে, হ্যালো, আমি নিশ্চয় দেখব।
কষ্ট দিলাম।
না, না। আপনি কাল একবার খোঁজ নেবেন। কেমন?
আমেনা আবছা অবাক হলেন আবুকে দেখে। বীথিকে নিয়ে হঠাৎ আবার কিছু হলো নাকি? বীথির বাবার চিঠিটা পাবার পর থেকে তিনি বড় চিন্তিত ও সন্ত্রস্ত আছেন। উদ্বিগ্ন গলায়। শুধোলেন, এই ভরদুপুরে? মুখটা যে একেবারে তেতে উঠেছে।
আবু ম্লান হেসে বলল, এইতো, এলাম।
বিলকিসের কাছে টেলিফোন করে ভাবছিল কোথায় যাওয়া যায়।
ইউনিভার্সিটি বন্ধ। বাসায় ফিরে যাবে, যেত, যদি বীথি ও রকম পাথরের মতো বসে না থাকত। বড় চাচিমার কাছে অনেকদিন আসা হয়নি, মনে মনে ভাবল আবু। ছেলেপুলে নেই। এলে কত খুশি হন। আমেনা শুধোলেন, হাশেম কেমন আছে?
ওই রকমই। তুমি আর দেখতে গেলে না যে?
যাবো কী, বাতের জ্বালায় অস্থির হয়ে আছি, বাবা। এক পা নড়বার যো নেই।
আমেনা নিরিখ করতে থাকেন আবুকে। ভাবেন বীথির বাবা যা লিখেছেন তা কী সত্যি? কথাটা কি তিনি জিজ্ঞেস করবেন আবুকে? কিন্তু মুখে বলেন, হাশেম কিছু বলে কোথায় ছিল?
বলে, মানুষ দেখতে বেরিয়েছিলাম।
ওমা, সে কিরে?
আবু হাসল। হাসতে হাসতে বলল, ও সব তুমি বুঝবে না। বাবা, মা, এমন কী বড় চাচা অবধি হাঁ হয়ে গেল হাশেম ভাইয়ের কথা শুনে।
আমেনা সংশয়ে দুলতে দুলতে বললেন, তাহলে জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে।
প্রলাপ! একেবারে ভাল মানুষের মতো, চাচিমা। চলো, নিজে শুনে আসবে। তখন দেখব। কার কথা ঠিক।
আবু একটা ছোট্ট ছেলের মতো করতে থাকে। বড় চাচিমা ভীষণ আদর করেন তাকে। যাহ, তুই বাড়িয়ে বলছিস, হিংসুটে। কই তোর চাচাতো কিছু বললেন না।
বেশ। বলে নি তো বলে নি। আমার বড্ড খিদে পেয়েছে।
ভাত খাবি?
কী মাছ?
ভালো মাছ নেইরে। একটা ডিম করে দি?
দাও।