বর্ধমান জেলা শেষ, অজয় নদের ব্রিজের ওপর দিয়ে গাড়ি যাবার সময়, গতি অনেক কমে গেল। উদিত দেখল, অজয়ের চেহারা ভয়াল। কে যেন বলে উঠল, উরে বাবা রে বাবা, অজয়ের মুত্তি দেখ্যা মনে লেয় কী, ই বারে আমাদের বীরভূমটা গোটা ভাইসবে।
অজয়ের চেহারা দেখে, কথাটা মিথ্যা মনে হয় না। মনে হচ্ছে যেন, লাল রক্তের ধারা হা হা করে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। গঙ্গা আর পদ্মার অবস্থা কী হয়ে উঠেছে কে জানে। উদিত ঠিক করেছিল বোলপুরে দুপুরের খাবারের অর্ডার দেবে। কিন্তু তার আগেই, রায় পরিবারের বিশাল, লুচি তরকারি আর মিষ্টির পাহাড় বেরোল, এবং এ ক্ষেত্রে যা হয়, উদিতকে সাগ্রহে তাদের সঙ্গে খেতে বলা হল। উদিত নানাভাবে আপত্তি জানাল। সে বোলপুর থেকে ক্যাটারিং-এর ভাত নেবে, কোনও অসুবিধা নেই।
তার অসুবিধা না থাকতে পারে, রায় পরিবারের সহৃদয়তা এবং আগ্রহের পক্ষে অসুবিধা। কৃষ্ণা মীনা খাবার বেড়ে দেবার ব্যবস্থা করল। মীনা প্রথমেই অতিথির হাতে কলাপাতায় খাবার তুলে দিয়ে বলল, আপনি বেশ স্বার্থপর লোক। আমরা খাব লুচি, আর আপনি খাবেন দুপুরে গরম গরম ভাত, আমাদের নজর লাগবে না?
মীনার কথায় সবাই হেসে উঠল। রায়মশাই বললেন, তুই বড় মুখফোড় মীনা।
উদিতকে বললেন, কিছু মনে করো না উদিত।
উদিত হেসে বলল, না না মনে করবার কী আছে। ওঁকে আমি আগেই চিনে নিয়েছি।
উদিতের কথায় সবাই আর একবার হেসে উঠল। কৃষ্ণার হাসি এবার জোরে বেজে উঠল। স্বয়ং রায়মশাইয়ের হাসিটিও বেশ চড়া। বললেন, চিনে নিয়েছ তো। তা হলেই হল। তোমাকে বলব কী, মীনা আপন পর সকলের পেছনে তো লাগেই। আমার পেছনে লাগতেও কসুর করে না।
মীনা ওর বাবার দিকে তাকিয়ে, চোখ বড় করে বলল, আমি আপনার পেছনেও লাগি, এ কথা বলতে পারলেন?
রায়মশাই হেসে বললেন, কেন বলতে পারব না বল। তুই তো কথায় কথায় আমার পেছনে লাগিস। এই আজকে বেরোবার জন্য তুই আমার পেছনে কম লেগেছিলি?
মীনার সঙ্গে আর একবার চোখাচোখি হতে, মীনার মুখে আবার রং লাগল। উদিত মনে মনে বলল, মেয়েটা পাজি আর ভাল, দুই-ই।…
বীরভূম অতিক্রম করার আগেই, দু-তিনবার গাড়ি দাঁড়াল। এক-এক জায়গা দিয়ে, গাড়ি অত্যন্ত মন্থরভাবে চলল। সে সব জায়গায় জল প্রায় রেললাইন ছুঁই ছুঁই করছে। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, বীরভূমের কোথাও কোথাও, ইতিমধ্যেই বন্যায় ভেসে গিয়েছে। অবস্থা মোটেই ভাল নয়। আকাশ মেঘলা। মাঝে মাঝে বৃষ্টি, মাঝে মাঝে বন্ধ। কিন্তু আবহাওয়া পুরোপুরি মেঘলা এবং বৃষ্টির।
বীরভূম ছাড়িয়ে যাবার পরে, প্রথম দুঃসংবাদ শোনা গেল, পাকুড় আর ধুলিয়ানের রাস্তা, অনেকখানি গতকালই নাকি ডুবে গিয়েছে, এবং যেটা একেবারেই আশা করা যায়নি, রাজমহলের পরে লাইন নাকি ডুবে গিয়েছে। সাধারণত এ কথা কখনও শোনা যায়নি, এই অঞ্চলে বন্যার বিস্তার এতটা হতে পারে। ধুলিয়ানের রাস্তা ডুবতে পারে, গঙ্গা খুব কাছেই, কিন্তু পাকুড়ের পরে রাস্তা রেললাইন ডুবে যাওয়াটা সাংঘাতিক ব্যাপার।
রায়মশাই বললেন, তাই যদি হয়, তবে আমি তো মনে করি, শরিগলি ঘাট অবধি যাওয়াই হবে না। আর যদিও যাওয়া হয়, সেখানে গঙ্গার পাড়ে আটকে যাওয়া, আরও ভয়ের। জল কখন কতটা বাড়বে, কে জানে।
কামরার মধ্যে অধিকাংশ মানুষের একই দুশ্চিন্তা। মীনার মতো মেয়েও, রীতিমতো উৎকণ্ঠিত। উদিত চিন্তিত। তবে একটাই ভরসা, গাড়িতে এত লোক। একলার জন্য চিন্তা করেই বা কী লাভ। কত দূর যাওয়া যায়, দেখা যাক।
পাকুড় থেকে নতুন যাত্রী প্রায় উঠলই না। বরং স্টেশনে কিছু বন্যার্তদের দেখা পাওয়া গেল, যারা এসে স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে।
হাড়োয়ায় কয়েকজন যাত্রী যারা উঠল, তাদের মুখে শোনা গেল, গঙ্গার ওপারে, পূর্ণিয়া ভাগলপুরের অনেক জায়গা ভেসে গিয়েছে। মহানন্দার অবস্থা খারাপ, কিষাণগঞ্জের অনেক আগেই রেললাইন নাকি ডুবে গিয়েছে। এমনকী, শোনা গেল, কাটিহার বারসই-এর মাঝখানে, কিছু রেললাইন নাকি জলমগ্ন। আর এবারের খবরও আগের মতোই, রাজমহলের কাছেই রেললাইনে জল উঠেছে। তার মানে একটাই, গাড়ি আর তার বেশি যেতে পারছে না।
উদিত একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইল, তিনপাহাড় থেকে মালদহে যাবার ফেরি লঞ্চ এখনও চালু আছে কি না। জানতে পারল, এখনও আছে। ওপারে মালদহ জেলার মানিকচক সড়ক যদি ডুবে যায়, তা হলে আপনা থেকেই ফেরি বন্ধ হয়ে যাবে। মানিকচক সড়কের অবস্থাও নাকি খুব ভাল না। যে কোনও মুহূর্তেই ডুবে যেতে পারে। কালিয়াচকের সড়ক ইতিমধ্যেই ডুবে গিয়েছে।
উদিত ভাবতে আরম্ভ করল। এদিকে যদি আটকে যেতেই হয়, তবে গঙ্গা পেরিয়ে মানিকচক হয়ে, মালদহ পশ্চিম দিনাজপুর, কিংবা পশ্চিম দিনাজপুর দিয়ে না গিয়ে যদি পূর্ণিয়ার সড়ক দিয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে। অবিশ্যিই, যদি সড়কগুলোর অবস্থা ভাল থাকে।
.
রাজমহলে এসে স্পষ্টই বোঝা গেল, গাড়ির পক্ষে এই মুহূর্তে আর বেশি দূর যাওয়া চলবে না। আকাশ মেঘলা বটে, বৃষ্টি নেই। একটা ঝোড়ো ভাবের বাতাস আছে। আকাশের চেহারা দেখে মনে হয়, হঠাৎ বৃষ্টি আসবে না। উদিত ওর প্রস্তাবটা রায়মশাইকে জানাল। এখানেই আটকা পড়ে থাকার চেয়ে, ফেরি পেরোবার ঝুঁকি নিয়ে যদি মালদহ হয়ে যাওয়া যায়।
রায়মশাই একটু চিন্তা করলেন। তাঁর উত্তর শোনবার জন্য, পরিবারের সকলেই উৎকণ্ঠিত উৎসুক চোখে চেয়ে রইল। উদিত আবার বলল, অবিশ্যি যদি মালদহের যাত্রীরা যায়, তা হলেই আমরা যাব, তা না হলে যাব না।
রায়মশাইয়ের চোখ একটু উজ্জ্বল হল। বললেন, তাই যদি যাই, তবে মালদহে ইংরেজবাজারে আমাদের আত্মীয় আছে, তাঁদের বাড়িতেই কয়েক দিন থেকে যাব।
উদিত গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। খবর নিয়ে জানল, একটা গাড়ি তিনপাহাড়ের দিকে এখনই যাবে। কিছু মালদহগামী লোকজনের সঙ্গে ও কথা বলল। যাত্রীর সংখ্যা খুব কম না। এদের মধ্যে অনেকেই অবিশ্যি গঙ্গা পার হতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু পথের মাঝখানে অনিশ্চিত অবস্থায় কেউ বসে থাকতেও চাইছে না।
রায়মশাই গোটা পরিবার নিয়ে গাড়ি বদলালেন। উদিতের সাহায্য ছাড়াও, কুলিরা যতটা পারল, টাকা আদায় করল। কোনও উপায়ও নেই। তিনপাহাড়ে এসে, গঙ্গার অবস্থা দেখে সত্যি ভয় লাগে। ফেরির লঞ্চ প্রস্তুতই ছিল। লঞ্চে ওঠবার সময়ে উদিত প্রথম লক্ষ করল, হাওড়া স্টেশনে দেখা সেই মেয়েটিকে, স্টল থেকে যে অনেক টাকার কাগজ কিনেছিল।
মেয়েটি তা হলে মালদহের যাত্রী। হাতে একটি বড় ব্যাগ, কাঁধে রংচঙে বর্ষাতি, আর এক হাতে সেই কাগজগুলো। এখন আর তাকে অতটা তাজা দেখাচ্ছে না। ইতিমধ্যেই, চুল রুক্ষু হয়ে উঠেছে, মুখে উদ্বেগের ছাপ পড়েছে। একটা ব্যাপার লক্ষ করা গেল, মেয়েটি ফাস্টক্লাসের যাত্রী হলেও, রায় পরিবারের কৃষ্ণা মীনার কাছ ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে চাইছে।
উদিত ভাবল, ও না হয় পুরুষমানুষ, বন্যা পরিস্থিতির কথা কিছু চিন্তা না করেই বেরিয়ে পড়েছে। রায়মশাইয়ের না হয় কন্যাদায়ের দুশ্চিন্তা, তাই এই ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে এখন পস্তাচ্ছেন। কিন্তু এরকম একলা একটি মেয়ে, এবং বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে বলেই মনে হয়, বয়সটাও মোটেই বেশি না, এমন দিনে বেরোল কী করে! উদিত ভেবেছিল, শান্তিনিকেতনে বা কাছাকাছি কোথাও যাবে। ফার্স্টক্লাসের টিকেট কেটে এ যাত্রিণী যে এত দূরের পথে পাড়ি দিচ্ছে, ও এক বারও বুঝতে পারেনি।
লঞ্চেই এক সময়ে উদিত দেখল, সেই মেয়েটি কৃষ্ণা মীনার সঙ্গে কথা বলছে। উদিত দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল, যদিও মীনা ওকে ঠিক চোখে রেখেছিল।
কিন্তু উদিতের দৃষ্টি নদীর দিকেই বেশি। রক্তাভ গঙ্গা যেন একটা রক্তাক্ত সমুদ্র হয়ে উঠেছে। কোথাও তার পারাপার দেখা যায় না। রেলিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে ভয় লাগে। লঞ্চের কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারল মানিকচকের রাস্তায় নাকি ইতিমধ্যেই জল উঠে পড়েছে। তবে, এখনও সেরকম খারাপ অবস্থা না। মোটর গাড়ি এখনও চলছে। তবে রাত্রের মধ্যে কী হবে, কিছুই বলা যায় না। এবং এও জানাল, আপাতত এটাই লঞ্চের শেষ ফেরি। অবস্থা ভাল না হলে, লঞ্চ আর যাতায়াত করবে না।
কিন্তু প্রায় সন্ধের মুখে, মানিকচকে পৌঁছে দেখা গেল, রাস্তায় জল আরও বেশি উঠে গিয়েছে। মোটর বাস নেই, কোনও গাড়িই কোথাও নেই। জল প্রায় হাঁটুর কাছে। রাস্তার আশেপাশের অধিবাসীরা দুপুর থেকেই, নিরাপদ জায়গার দিকে রওনা হয়ে গিয়েছে। মোটর বাসের না আসার কারণ হিসাবে শোনা গেল, আটগমের কাছে কালিন্দীর জল রাস্তায় এসে পড়েছে। মোটর বাস সেখান থেকেই ফিরে গিয়েছে।
কিন্তু মানিকচকে আটকে পড়াটা আরও বিপজ্জনক। যে কোনও মুহূর্তেই জীবননাশের সম্ভাবনা। অধিকাংশ লোকই, উত্তরে মথুরাপুর বা দক্ষিণে নুরপুরের দিকে হাঁটা ধরল। একসময়ে উদিতের মনে হল, রায় পরিবার, ও নিজে আর সেই মেয়েটি ছাড়া, অধিকাংশই চলতে আরম্ভ করেছে। রায়মশাইয়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কারোর মুখের দিকেই প্রায় তাকানো যাচ্ছে না। রায়মশাইয়ের ছোট ছেলে আর মেয়ে, দুজনে তো কান্নাকাটিই শুরু করে দিয়েছে। এখন উদিতের নিজেকেই কেমন যেন অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। ও রায়মশাইকে বলল, আমিই বোধ হয় আপনাদের আরও বিপদে ফেললাম।
রায়মশাই বললেন, তুমি আর কী বিপদে ফেলবে বাবা? যাঁর ফেলবার, তিনিই ফেলেছেন। তুমি নিজেও তো আর নিরাপদে নেই। এখন কী করা যায়, তাই ভালো। এভাবে তো দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।
সবাই একসঙ্গে, উদিতের মুখের দিকে তাকাল। যেন ও ঠিক এই বিপদে রক্ষা করতে পারবে। লজ্জিত আর বিব্রত হয়ে উঠল ও। এমনকী হাওড়া স্টেশনে দেখা সেই মেয়েটিও, উদিতের মুখের দিকে তাকাল। সমস্ত জায়গাটাকে একটা সাক্ষাৎ নরকের মতো মনে হচ্ছে। ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আশেপাশে, জল ঠেলেঠেলে, দু-একজন লোক যাতায়াত করছে। ভাগ্য একটু প্রসন্ন বলতে হবে, বৃষ্টি হচ্ছে না। তা হলে আর দেখতে হত না।
ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে জল নেই। কয়েক পা সামনেই জল। রাস্তার খানিকটা হেঁটে গেলে, সামনে আবার রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে, যেখানে জল নেই। সেখানে আরও দু-একজন লোক দেখা যাচ্ছে, অস্পষ্ট ছায়া ছায়া। উদিত বলল, চলুন, আমরা সবাই ওখানে যাই। আরও দু-একজন রয়েছে, বোধ হয় নৌকার ব্যবস্থা হচ্ছে।
নৌকার নামে, সকলেই যেন একটু আশার আলো দেখতে পেল। কিন্তু এত মালপত্র নিয়ে চলাফেরাই দুষ্কর। মালপত্র যা কিছু সবই রায় পরিবারের। রায়মশাই বললেন, আমি মালপত্র নিয়ে এখানে থাকি, তুমি এদের নিয়ে ওখানে গিয়ে দ্যাখ, ব্যাপারটা কী। মনে হচ্ছে ওখানে রাস্তার ধারে এখনও কিছু বাড়িঘর বেঁচে আছে। লোকজন পাওয়া যায় কি না দেখো।
উদিতের সেটা মন্দ মনে হল না। এই সময়ে, জলে পা দেবার আগেই, একটা গলা ভেসে এল, মিহির, মিহির এলি নাকি?
সকলেই তাকিয়ে দেখল, একজন রাস্তা দিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। উদিতের দিকে তাকিয়েই লোকটা মিহির মিহির বলে ডাকছে। উদিতের ভুরু কুঁচকে উঠল। গলাটা যেন কেমন চেনা চেনা লাগছে। শিলিগুড়ির নারায়ণের মতো লাগছে। কিন্তু সেটা তো বিশ্বাস করাই কঠিন, নারায়ণ আসবে মানিকচকে। মিহির নামটাও সে হিসাবে চেনা চেনা লাগছে। যদি লোকটা সত্যিই শিলিগুড়ির নারায়ণ হয়, তা হলে মিহিরও চেনা। যদিও মিহির বলে এ দলে কেউ নেই।
মীনা বলল, দাঁড়ালেন কেন, চলুন।
উদিত বলল, দাঁড়ান, লোকটিকে আমার চেনা চেনা লাগছে। আর একটু কাছে আসুক, দেখে নিই। লোকটি জল ভেঙে আর একটু কাছে আসতে, উদিতের আর কোনও সন্দেহ রইল না। সে বলে উঠল, নারাণ নাকি রে?
আগন্তুকও অবাক হয়ে বলল, একী উদিত, তুই এখানে?
উদিত বলল, আর বলিসনে, গঙ্গা ওদিকে মারমুখী, দেখছি এদিকেও মারমুখী। ভেবেছিলাম, এদিক দিয়ে বাইরোড যাবার চেষ্টা করব। কিন্তু তুই এখানে কী করছিস?
নারায়ণ ততক্ষণ কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বয়স উদিতের মতোই হবে। তবে ঘাড়ে গর্দানে মোটা বলে, তাকে একটু বেশি বয়স্ক লাগছে। নারায়ণ বুঝতে পারছে না, উদিতের সঙ্গে এরা কারা। তাকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, আর বলিস না মিহির আমাকে ডুবিয়েছে!
মিহির মানে, তোদের ড্রাইভার তো?
হ্যাঁ। এসেছিলাম ইংলিশবাজারে একটা কাজে। সঙ্গে একটা মাঝারি ট্রাক রয়েছে, কিছু মালপত্র নিয়ে এসেছিলাম। সে সব খালাস হয়ে গেছে। বন্যার কথা শুনে মিহির বলল, মানিকচক থেকে এক বার ওপারে যাবে, কোথায় কাদের বাড়ি আছে, ওদের আত্মীয়, ধুলিয়ানে না কোথায় থাকে। ফিরতি লঞ্চেই খবর নিয়ে চলে আসবে বলেছিল। সেই দুপুর থেকে অপেক্ষা করছি, মিহির এখনও এল না। এদিকে জল যেভাবে বাড়ছে, এর পরে ট্রাক ফেলে রেখে আমাকে চলে যেতে হবে।
উৎকণ্ঠায় আর উত্তেজনায়, নারায়ণ তাড়াতাড়ি অনেকগুলো কথা বলে ফেলল। আর উদিতের চোখে একটা ঝিলিক খেলে গেল। নারায়ণ আবার বলল, আমি যদি গাড়ি চালাতে পারতাম, তা হলে এতক্ষণে চলে যেতাম।
উদিত প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, সেজন্য ভাবতে হবে না। ইংলিশবাজার অবধি যাওয়ার মতো তেল মবিল আছে তো?
নারায়ণ প্রায় চিৎকার করে উঠল, ওহহ, উদিত, তুই তো চালাতে পারিস!
সকলের চোখেই যেন আলো দেখা দিল। বড় বড় চোখে উদিতের দিকে তাকাল। উদিত বলল, সেইজন্যই বলছি। তোর ট্রাক ঠিক আছে তো?
ঠিক আছে।
আটগমের কাছে রাস্তায় জল কী রকম হবে?
এই রকমই, এখানে যেরকম দেখছিস।
উদিত জলের দিকে তাকিয়ে বলল, তা হলে ঠিক আছে। ট্রাক কোথায়?
নারায়ণ সামনের দিকে দেখিয়ে বলল, কাছেই। লোকগুলো দাঁড়িয়ে আছে, ওর সামনেই বাঁকের মুখে।
উদিত বলল, চল গাড়িটা এখানে নিয়ে আসি, এদের সবাইকেই তুলতে হবে।
নারায়ণ বলল, কিন্তু গাড়ি ঘোরাতে পারবি না, ব্যাক করে নিয়ে আসতে হবে।
তা নিয়ে আসব, চল।
বলে ও রায়মশাইয়ের দিকে ফিরে তাকাল। রায়মশাই উত্তেজনায় বোধ হয় কাঁপছিলেন, বলে উঠলেন, জয় মা দুর্গতিনাশিনী। বাবা উদিত, তোমাকে আজ মা দুর্গাই মিলিয়ে দিয়েছিলেন। আর তোমার বন্ধুটিও সাক্ষাৎ নারায়ণ।
সকলের চোখেমুখেই আশা আর হাসি ঝিলিক দিচ্ছে। রায়মশাইয়ের প্রশস্তিতে, নারায়ণের ফরসা প্রকাণ্ড মুখটা লাল হয়ে উঠল। সেই মেয়েটির সঙ্গে উদিতের চোখাচোখি হল। মেয়েটি যেন কিছু বলতে চাইল। তার রং উঠে যাওয়া ঠোঁট এক বার নড়ে উঠল, কিন্তু কিছু বলতে পারল না। উদিত দেখল, মীনা ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই, মীনা ঠোঁটের কোণে হেসে, মেয়েটির দিকে চোখের কোণ দিয়ে তাকাল। উদিত বুঝতে পারল, মীনা একটু দুষ্টুমি করছে। ও নারায়ণের সঙ্গে চলে গেল।
যেতে যেতে নারায়ণের সঙ্গে উদিতের কথা হল, রায়মশাইদের সম্পর্কে। কিন্তু আর একটি মেয়ের পরিচয় ও জানে না। নারায়ণ বলল, বড়লোকের মেমসাহেব মেয়ে বলে মনে হচ্ছে।
উদিত বলল, তা তো বটেই। হাওড়া স্টেশনেই আমি দেখেছি!
হাতের বড় ব্যাগটা তো ফরেনের।
মেয়েটাও ফরেন মার্কা, পোশাক দেখেছিস।
দেখিনি আবার। কিন্তু মেয়েটাকে আমার চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
উদিত ধমক দিয়ে বলল, দ্যাখ নারাণ, গুল মারিস না। মেয়ে দেখলেই তোর চেনা চেনা লাগে। এ মেয়ে মালদহের, তুই চিনবি কী করে।
নারায়ণ বলল, তা ঠিক, কিন্তু মাইরি, মিথ্যা বলছি না, কেমন যেন চেনা চেনা মুখ লাগছে। বোধ হয় কখনও শিলিগুড়িতে গেছল তখন দেখেছি।
হ্যাঁ, এক বার দেখেই মনে রেখে দিয়েছিস। ও সব বাদ দে, তোকে যে এভাবে পেয়ে যাব, এক বারও ভাবিনি।
তোকেও যে পাব, ভাবিনি। আমি তো এই ফেরিটা দেখে, চলে যেতাম। আমি নিশ্চিন্ত মনে, ট্রাকে বসে আছি, ভাবছি মিহির নিশ্চয় এই ফেরিতে আসছে। তারপরে দেখছি, সবাই পালাচ্ছে, মিহির আর আসে না। তাই দেখতে এলাম এক বার, যদি এই দলের মধ্যে মিহির থেকে থাকে। কিন্তু মিহিরটা এল না-ই বা কেন?
শেষের দিকে ওর গলায়, চিন্তা ফুটে উঠল। উদিত বলল, আমার মনে হয়, কোনওরকমে আটকে গেছে। কিন্তু ভেবে দ্যাখ নারাণ, চলে যাবি, তারপরে যদি মিহির এসে খোঁজাখুঁজি করে?
নারায়ণ বলল, কোনও উপায় নেই, তা হলে আর ট্রাক ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। মিহির আসে তো, কোনও না কোনওভাবে চলে যাবেই। অবস্থা দেখেই বুঝতে পারবে, ট্রাক থাকলে পড়ে থাকত। আমার তো মনে হয়, আজ সারারাত্রি ট্রাক এখানে থাকলে কাল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
যোগাযোগটা সত্যি বিস্ময়কর। নারায়ণদের শিলিগুড়িতে বিরাট কনট্রাক্ট ফার্ম। সিভিল মিলিটারি দুই রকম কনট্রাক্ট বিজনেসই ওদের আছে। নারায়ণদের বাড়ি জলপাইগুড়ি, ব্যবসার ক্ষেত্র শিলিগুড়ি। শিলিগুড়িতেও তাদের বাড়ি আছে। তারা তিন ভাই শিলিগুড়িতেই থাকে। উত্তরবঙ্গ, আসাম, সমতলে এবং পাহাড়ে, সবখানেই ওদের কাজ হয়। আজ এমন দুর্দিনে যে, মানিকচকে ওদের গাড়ির দেখা পাওয়া যাবে, এটাকে দৈবঘটনা ছাড়া কিছু ভাবা যায় না।
উদিত বলল, আজ মনে হচ্ছে, তুই গাড়িটা না চালাতে শিখে ভালই করেছিস। তা হলে, এতক্ষণে তুই নিশ্চয় গাড়ি নিয়ে চলে যেতিস।
নারায়ণ বলল, না। চালাতে জানলেও, এই ফেরিটা দেখে যেতাম। মিহিরের জন্য শেষ অবধি দেখতাম।
সেটাও দেখা হয়েছে। অতএব মিহিরের আর কিছু বলবার নেই।