৪. বণিকদের কথা

চতুর্থ পর্ব – বণিকদের কথা

বণিকদল–…এবং ফাউণ্ডেশনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পুরোভাগ ছিল বণিকেরা। পেরিফেরির দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছিল তাদের প্রভাব-বলয়। কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছর লেগে যেত তাদের টার্মিনাসে ফিরে আসতে। তাদের শিপগুলো অবশ্যি আহামরি কিছু ছিল না, এখানে সেখানে দেখা যেত অদক্ষ মেরামতির ছাপ, তাৎক্ষণিক জোড়াতালির চিহ্ন। তাদের সততাও যে একেবারে বিতর্কের উর্ধ্বে ছিল তা নয়। আর তাদের সাহস…

এসবের সাহায্যেই তারা চার রাজ্যের ঐ ছদ্ম-ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলল।…

বণিকদের সম্পর্কে যে কত গল্প-কাহিনী প্রচলিত আছে তার কোনো লেখাজোখা নেই। কিছুটা সচেতনভাবে এবং কিছুটা উপহাসভরে তারা স্যালভর হার্ডিনের একটি সারগর্ভ উক্তিকে তাদের মটো হিসেবে গ্রহণ করেছিল: তোমার নীতিবোধ যেন কখনো ন্যায্য এবং সঙ্গত কাজ করা থেকে তোমাকে বিরত রাখতে না পারে! এসব গল্পের কোনটি সত্য আর কোনটি মনগড়া তা এখন বলা কষ্টসাধ্য। তবে সম্ভবত প্রতিটিতেই কিছু না। কিছু অতিরঞ্জন রয়েছে।…

–ইনসাইক্লোপীডিয়া গ্যালাকটিকা

.

লিমার পনিয়েটসের রিসিভারে যখন কল-টা পৌঁছল, সে তখন আকণ্ঠ সাবান ফেনায় ডুবে আছে। গ্যালাকটিক পেরিফেরির অন্ধকার, নিঃসীম মহাশূন্যেও টেলিমেসেজ আর বাথটাবের অস্তিস্কের যেসব পুরনো গল্প শোনা যায়, সেগুলো যে মিথ্যা নয় এ-ঘটনাটাই তার প্রমাণ।

ফ্রী-ল্যান্স শিপটির যে অংশে বিভিন্ন ধরনের মালপত্র ঠাসাঠাসি করে রাখা নেই সৌভাগ্যক্রমে সেটি যথেষ্ট আধুনিক এবং উন্নত। এতটাই যে, ঠাণ্ডা এবং গরম পানির শাওয়ারটি কন্ট্রোল প্যানেল থেকে মাত্র দশ ফুট দূরে দুই-বাই-চার ফুট মাপের একটি ছোট্ট, চমৎকার স্থানে অবস্থিত। রিসিভারের ঝনকার পরিষ্কারভাবে কানে এল পনিয়েটসের।

সাবানের ফেনা আর খিস্তি ছড়াতে ছড়াতে বেরিয়ে এল সে। এডজাস্ট করল ভোকাল। ঠিক তার তিন ঘণ্টা পর দ্বিতীয় একটা ট্রেড শিপ চলে এল প্রথমটার পাশে। দুই শিপের মধ্যবর্তী এয়ার টিউব গলে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি নিয়ে এক যুবক ঢুকল ভেতরে।

সবচেয়ে ভাল চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে নিজে পাইলট-সুইভেল-এ গিয়ে বসল পনিয়েটস।

তুমি করছিলেটা কী, বলতো, গোর্ম? গম্ভীর মুখে শুধোল সে। ফাউণ্ডেশন থেকে আমাকে তাড়া করে এসেছ নাকি এ পর্যন্ত?

লেস গোর্ম একটা সিগারেট ধরিয়ে দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল। আমি? মোটেই না। মেইল-এর পরদিনই ঘটনাক্রমে গ্রিপটাল ফোর-এ ল্যাণ্ড করে এ অধম। ওরা আমাকে এটাসহ তোমার কাছে পাঠিয়ে দিল।

ছোট্ট, চকচকে একটা গোলাকার বস্তু পনিয়েটসের হাতে তুলে দিল সে। বলল, জিনিসটা গোপনীয়। সুপার-সিক্রেট। সাব-ইথার বা ঐ জাতীয় ব্যাপারের ওপর ভরসা করা যায়নি। অন্তত আমার তাই ধারণা। পার্সোনাল ক্যাপসুল বলা যেতে পারে এটাকে। তুমি ছাড়া আর কারো হাতে খুলবে না ওটা।

একরাশ বিরক্তি নিয়ে ক্যাপসুলটার দিকে তাকাল পনিয়েটস। সেটা বুঝতে পারছি। এও জানি, হতচ্ছাড়া এই জিনিসগুলোতে কখনো কোনো সুখবর থাকে না।

তার হাতের ওপর খুলে গেল ক্যাপসুলটা। বেরিয়ে এল পাতলা, স্বচ্ছ একটা টেপ। ত্বরিত চোখ বুলিয়ে মেসেজটা পড়ে নিল পনিয়েটস। দ্রুত পড়ার কারণ হচ্ছে টেপের শেষাংশটা বের হতে হতে প্রথম অংশটা ধূসর হয়ে কুঁচকে গেছে। দেড় মিনিটের মাথায় সেটা কালো রঙ ধারণ করল। তারপর গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ল।

হাহাকার বেরিয়ে এল পনিয়েটসের কণ্ঠ থেকে, ওহ গ্যালাক্সি!

লেস গোর্ম শান্তভাবে জিগ্যেস করল, আমি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি? নাকি ব্যাপারটা তার চেয়েও গোপনীয়?

তুমি যেহেতু বণিক সংঘে আছ, তাই তোমাকে বলা যেতে পারে। অ্যাসকোনে যেতে হবে আমাকে।

অ্যাসকোনে কেন?

ওরা একজন ট্রেডারকে আটক করেছে। কথাটা বোলো না কাউকে।

আটক করেছে? রাগে ফেটে পড়ল গোর্ম। এটা তো কনভেনশন বিরোধী কাজ!

লোকাল পলিটিক্স নাক গলানোটাও।

ও! তাই করেছিল বুঝি লোকটা? গোর্ম একটু মিইয়ে গেল। তা ট্রেডার লোকটা কে? আমি চিনি এমন কেউ?

না, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে পনিয়েটস বলল।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর কোনো প্রশ্ন করল না গোর্ম।

উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে পনিয়েটস। ফাঁকা চোখে চেয়ে আছে ভিসিপ্লেটটার দিকে। লেন্সের মতো দেখতে গ্যালাক্সির অংশটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলল সে আপনমনে। তারপর গলা চড়িয়ে বলে উঠল, যাচ্ছেতাই ব্যাপার! এমনিতেই আমি কোটার পেছনে পড়ে আছি!

গোর্ম-এর মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। দোস্ত, অ্যাসকোন তো নিষিদ্ধ এলাকা।

তা ঠিক। একটা পেননাইফও বিক্রি করা যাবে না অ্যাসকোনে। কোনো ধরনের অ্যাটমিক গ্যাজেটও কিনবে না ওরা। আমার কোটার এই অবস্থায় ওখানে যাওয়ার অর্থ মারা পড়া।

কোনোভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় না ব্যাপারটা?

আনমনে মাথা নাড়ল পনিয়েটস। লোকটা আমার পরিচিত। বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। কী আর হবে? গ্যালাকটিক স্পিরিট ভরসা। স্পিরিট যেদিকে যেতে বলবে, খুশিমনে সেদিকে পা বাড়াব।

চোখ বড় বড় করে গোর্ম বলল, কী বললে?

গোর্মের দিকে তাকিয়ে হাসল একটু পনিয়েটস। বুক অভ দ্য স্পিরিট বইটা যে তোমার পড়া নেই, সেকথা খেয়াল ছিল না।

নামই শুনিনি কখনো, সংক্ষেপে উত্তর দিল গোর্ম।

শুনতে, যদি তোমার ধর্ম বিষয়ক ট্রেনিং থাকত।

ধর্ম বিষয়ক ট্রেনিং? যাজক হওয়ার জন্যে? ভীষণ আহত হয়েছে গোর্ম বোঝা গেল।

এই ভয়ই করছিলাম। আমার জীবনে এটা একটা গোপন কলংক। তবে ফাদারদের আমি কম জ্বালাইনি। ওঁরা আমাকে তাড়িয়ে দেন এবং যে-কারণে তাড়ান ঠিক সেই কারণেই পরে ফাউণ্ডেশনের তত্ত্বাবধানে সেকুলার শিক্ষালাভের সুযোগ পাই আমি। যাকগে ওসব কথা। এ-বছর তোমার কোটার অবস্থা কেমন?

সিগারেটের শেষাংশটা পিষে ফেলে টুপিটা ঠিক করল গোর্ম। আমার শেষ কার্গোটা যাচ্ছে এখন। আই উইল মেক ইট।

ভাগ্যবান লোক তুমি! হতাশ কণ্ঠ পনিয়েটসের।

গোর্ম বিদায় নেবার পরেও অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল সে।

এসকেল গোরভ তাহলে অ্যাসকোনে! তা-ও আবার জেলে!

দুঃসংবাদ! সত্যি বলতে কী, খবরটা যতটা খারাপ শোনানোর কথা, তার চেয়েও বেশি খারাপ! কৌতূহলী এক ছোকরাকে ঘটনাটার একটা লঘু সংস্করণ জানিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়া এক কথা, আর সত্যটার মুখোমুখি হওয়া আরেক কথা।

তার কারণ, মাস্টার ট্রেডার এসকেল গোরভ আদৌ কোনো ট্রেডার নয়। খুব অল্প কয়েকজন লোক জানে ব্যাপারটা। লিমার পনিয়েটস তাদের একজন। গোরভ ট্রেডার তো নয়ই, বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন লাইনের লোক; এসকেল গোরভ ফাউণ্ডেশনের একজন এজেন্ট!

.

দুই

দু হপ্তা হয়ে গেছে! নষ্ট হয়ে গেছে মূল্যবান চৌদ্দটি দিন।

এক হপ্তা চলে গেছে অ্যাসকোনে পৌঁছুতেই। সবচেযে দূরবর্তী সীমান্তের কাছে আসতেই টহলরত ওয়ারশিপগুলো এসে জড়ো হলো। ওদের ডিটেকশন সিস্টেম যাই হোক, সেটা যে কাজ করে এবং ভালভাবেই কাজ করে, তাতে সন্দেহ নেই।

কোনোরকম সিগনাল না দিয়ে শীতল, নিস্পৃহ একটা দূরত্ব বজায় রেখে এক পাশে সরিয়ে আনল ওকে শিপগুলো, রূঢ়ভাবে বাধ্য করল অ্যাসকোনের সেন্ট্রাল সান-এর দিকে এগোতে।

ইচ্ছে করলে পনিয়েটস ঠিকই ওদের এক হাত দেখিয়ে পারত। ওদের শিপগুলো মৃত এবং অবলুপ্ত গ্যালাকটিক এম্পায়ার-এর উচ্ছিষ্ট হলেও যাকে বলে ঠিক ওয়ারশিপ নয়- স্পোর্ট ক্রুজার। আর যেহেতু ওগুলোতে অ্যাটমিক পাওয়ার নেই, সেহেতু নেহাতই খেলনা বলে গণ্য করা যায় শিপগুলোকে। কিন্তু পনিয়েটসকে একথা মনে রাখতে হয়েছে যে, এসকেল গোরভ ওদের হাতে বন্দি। এবং হাতছাড়া করার মত পণবন্দী গোরভ নয়। কথাটা অ্যাসকোনও ভাল করে জানে।

তো, এরপর চলে গেছে আরেক হপ্তা। গ্র্যাণ্ড মাস্টার এবং আউটার ওয়ার্ল্ডের মাঝখানে মেঘের অগুনতি স্তরের মতো অসংখ্য যেসব নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছে, তাদের অতিক্রম করতেই বেরিয়ে গেছে দ্বিতীয় সপ্তাহটা। মিষ্টি কথায় আর তোষামোদে প্রতিটি খুদে উপ-সচিবকে তুষ্ট করতে হয়েছে। একজনের কাছ থেকে দস্তখত নিয়ে তার পরবর্তী ওপরওয়ালার কাছে পৌঁছুবার জন্যে যে পরিমাণ সযত্ন এবং সতর্ক চাটুকারিতা দরকার হয়েছে, তাতে রীতিমত বমি এসে গিয়েছিল ওর।

এই প্রথমবারের মতো পনিয়েটস আবিষ্কার করল, তার ট্রেডারের পরিচয় কোনো কাজে আসছে না।

তবে শেষ পর্যন্ত যা হোক, জায়গামত প্রায় পৌঁছে গেল সে। প্রহরাধীন, গিলটি করা দরজার ওপাশেই রয়েছেন গ্র্যাণ্ড মাস্টার- কিন্তু মাঝখান থেকে চলে গেছে দু দুটো সপ্তাহ।

গোরভ এখনও বন্দি আর পনিয়েটসের কার্গো তার শিপের হোন্ডের ভেতর পচছে।

গ্র্যাণ্ড মাস্টার ভদ্রলোক বেঁটেখাটো। প্রায় মাথা জোড়া টাক। বলিরেখা আকর্ণ মুখ। ঘাড়ের ওপর জেঁকে বসা পুরু, চকচকে পশমের কলারের ভারে তাঁর শরীরটা যেন নড়তে চড়তে পারছে না।

গ্র্যাণ্ড মাস্টার ইঙ্গিত করতেই সশস্ত্র লোকগুলো সরে গিয়ে প্যাসেজের মতো জায়গা করে দিল। সেই প্যাসেজ ধরে চেয়ার অভ স্টেটের পায়ের কাছে এগিয়ে গেল পনিয়েটস।

কোনো কথা নয়, চাবুকের মতো তিনটে শব্দ ছুটে এল গ্র্যান্ড মাস্টারের কণ্ঠ থেকে। ঝটিতি বন্ধ হয়ে গেল পনিয়েটসের ফাঁক হওয়া ঠোঁট জোড়া।

হ্যাঁ, ঠিক আছে- অ্যাসকোনের প্রবল প্রতাপান্বিত শাসক দৃশ্যত একটু নরম হলেন- অর্থহীন বকবকানি আমার একদম সহ্য হয় না। তুমি আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না। আর তোষামোদ জিনিসটাও দুচোখে দেখতে পারি না আমি। তাছাড়া, এক্ষেত্রে অভিযোগ-অনুযোগের কোনো দরকার নেই। তোমাদের ঐ শয়তানিভরা যন্ত্রগুলো অ্যাসকোনের কারো কোনো দরকার নেই। একথাটা জানিয়ে তোমাদের যে কতবার সতর্ক করে দেয়া হয়েছে তারও কোনো ইয়ত্তা নেই।

স্যার, শান্তভাবে বলল পনিয়েটস, আমি অভিযুক্ত ট্রেডারকে সমর্থন করছি না। যেখানে তারা অবাঞ্ছিত সেখানে নাক গলানো ট্রেডারদের নীতি নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, গ্যালাকটিকা বিশাল। অনিচ্ছাকৃতভাবে সীমা লঙ্ঘনের ব্যাপার এর আগেও বেশ কয়েকবার ঘটেছে। এটা একটা দুঃখজনক ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়।

দুঃখজনক, অবশ্যই, চিচি করে উঠলেন গ্র্যাণ্ড মাস্টার। কিন্তু ভুল? ধর্মদ্রোহী শয়তানটাকে পাকড়াও করার দু ঘণ্টা পর থেকেই গ্লিপটাল ফোর-এ তোমাদের লোকজন নিগোসিয়েশন শুরু করার অনুরোধ করতে করতে আমাকে একেবারে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তুমি যে এখানে আসছ, সে-কথাটাও হাজারবার জানানো হয়েছে আমাকে। দেখেশুনে তো মনে হচ্ছে, এটা একটা সুসংগঠিত উদ্ধার অভিযান। অনেক কিছুই তো মনে হচ্ছে আগে থেকেই ভেবে রাখা হয়েছিল দুঃখজনক বা অন্য যেকোনো ভুলের জন্যে এটাকে একটু বেশি-ই মনে হচ্ছে।

গ্র্যাণ্ড মাস্টারের কালো চোখে স্পষ্ট ভর্ৎসনা। তিনি বলে চললেন, আর এই যে তোমরা, ট্রেডাররা, এক বিশ্ব থেকে আরেক বিশ্বে যারা ছোট প্রজাপতির মতো পাগলপারা হয়ে ঘুরে বেড়াও, তোমরা কি তোমাদের অধিকার নিয়ে এতটাই আত্মহারা যে, অ্যাসকোনের সবচেয়ে বড় বিশ্বে সিস্টেমের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে- পা দেয়াটাকে তুচ্ছ একটা সীমালঙ্ঘন সংক্রান্ত ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই মনে কর না? কী, নিশ্চয়ই তা নয়?

মনে মনে ভেংচি কাটল পনিয়েটস। নাছোড়বান্দার মতো সে বলে উঠল, ইওর ভেনারেশন, ব্যবসা করার প্রচেষ্টাটা যদি ইচ্ছাকৃত হয়, সেক্ষেত্রে তা আমাদের বণিক সংঘের কঠোরতম বিধি-নিষেধের পরিপন্থী এবং সম্পূর্ণ অবৈধ।

অবৈধ, তা ঠিক, কর্কশ কণ্ঠে বললেন গ্র্যাণ্ড মাস্টার। এতোটাই অবৈধ যে তোমাদের বন্ধুকে সম্ভবত তার মাশুল দিতে গিয়ে প্রাণটা খোয়াতে হবে।

পনিয়েটসের পাকস্থলীতে মোচড় পড়ল। মৃত্যু, ইওর ভেনারেশন, এমনই চরম এবং অপ্রত্যাহারযোগ্য একটা ব্যাপার যে, এর কোনো বিকল্প না থেকে পারে না।

সতর্ক উত্তরটা আসার আগে সামান্য বিরতি পড়ল। আমি শুনেছি, ফাউণ্ডেশন বেশ সম্পদশালী।

সম্পদশালী? তা তো বটেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কি জানেন, আমাদের যে ধরনের সম্পদ আছে আপনারা তা নিতে অনিচ্ছুক। আমাদের অ্যাটমিক গুডসের মূল্য-

তোমাদের অ্যাটমিক গুডস মূল্যহীন, তার কারণ, ওগুলোর ওপর পূর্বপুরুষদের আশীর্বাদ নেই। ওগুলো পাপপূর্ণ আর অভিশপ্ত, তার কারণ পূর্বপুরুষদের নিষেধাজ্ঞা আছে ওগুলোর ওপর। কথাগুলো গত্বাঁধা আবৃত্তির মতো শোনাল; যেন একটা সূত্রের মতো আওড়ান হলো।

গ্র্যাণ্ড মাস্টারের চোখের পাপড়ি ঝুঁকে পড়ল, তিনি অর্থপূর্ণ কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন, অন্য কোনো দামি জিনিস নেই তোমাদের?

কিন্তু পনিয়েটস নিরীহ মুখে বলল, বুঝলাম না। আপনি ঠিক কী চান?

গ্র্যাণ্ড মাস্টারের দুহাত দুদিকে প্রসারিত হল। আমার এখানে ব্যবসা করতে চাইছ, অথচ জান না আমি কী চাই, চমৎকার! ধরে রাখো, পবিত্রস্থান অপবিত্র করার দায়ে, আই মিন, স্যাক্রিলিজের অভিযোগে অ্যাসকোনীয় আইন অনুযায়ী তোমার সহকর্মী শাস্তি পেতে যাচ্ছে। ডেথ বাই গ্যাস। আমরা নীতিবান জাতি। সবচেয়ে গরিব কৃষকটিও এই অপরাধে এর চেয়ে বেশি শাস্তি পাবে না, বা আমি নিজে হলেও এর কম পেতাম না।

পনিয়েটস খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো বিড়বিড় করে শুধালো, ইওর ভেনারেশন, আমাকে কি বন্দির সঙ্গে একটু কথা বলার অনুমতি দেয়া যাবে?

গ্র্যাণ্ড মাস্টার শীতল কণ্ঠে জবাব দিলেন, অ্যাসকোনীয় আইনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ করার বিধান নেই।

পনিয়েটসের কণ্ঠে অনুনয় ঝরে পড়ল। ইওর ভেনারেশন, একজন মানুষের দেহটাই যখন বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে, তখন তার আত্মার প্রতি করুণা দেখানোর জন্য অনুরোধ করছি আমি আপনাকে। তার প্রাণসংশয় দেখা দেবার পর থেকে সবরকমের আত্মিক সান্ত্বনা থেকে বঞ্চিত রয়েছে সে। এমনকি এই অন্তিম মুহূর্তেও আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে, তাকে হয়ত অপ্রস্তুত, অশুদ্ধ অবস্থায় সর্বশক্তিমান স্পিরিটের কাছে চলে যেতে হবে।

টেনে টেনে, সন্দেহভরা কণ্ঠে গ্র্যান্ড মাস্টার জিগ্যেস করলেন, তুমি কি আত্মার সেবক?

পনিয়েটসের মাথা বিনীত ভঙ্গিতে নিচু হয়ে গেল, আমাকে সেভাবেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ইহজাগতিক উদ্দেশ্যের কাছে সমর্পিত জীবনের আধ্যাত্মিক দিকটির পরিচর্যা করার জন্য মহাকাশের বিস্তৃত অঙ্গনে আমার মতো লোকের দরকার পড়ে ট্রেডারদের।

গ্র্যাণ্ড মাস্টার তাঁর নিচের ঠোঁটটি চেপে ধরলেন দাঁত দিয়ে। পূর্বপুরুষদের আত্মার কাছে যাবার আগে প্রত্যেকেরই উচিত তার আত্মাকে প্রস্তুত করা। কিন্তু তোমরা, অর্থাৎ ট্রেডাররা যে আস্তিক, সেটা আমি ঘৃণাক্ষরেও ভাবিনি।

.

তিন

লিমার পনিয়েটসকে অতি সুরক্ষিত দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে দেখে এসকেল গোরভ এক চোখ মেলে কাউচের ওপর নড়েচড়ে উঠল। প্রচণ্ড শব্দে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা। বিড়বিড় করে কী যেন বলে মেঝেতে নেমে দাঁড়াল গোরভ।

পনিয়েটস! তোমাকে পাঠিয়েছে ওরা?

স্রেফ ভাগ্য, তিক্ত কণ্ঠে জবাব দিল পনিয়েটস, কিংবা দুর্ভাগ্যও বলতে পার। প্রথমত, অ্যাসকোনে এসে ফ্যাসাদে পড়ে গেলে তুমি। দ্বিতীয়ত, তুমি যে-মুহূর্তে ঝামেলায় জড়ালে, আমি তখন আমার সেলস রুট ধরে অ্যানকোনের পঞ্চাশ পার্সেকের মধ্যে চলে এসেছি। তৃতীয়ত, তুমি আর আমি এর আগে এক সঙ্গে কাজ করেছি এবং বোর্ড সেকথা জানে। চমৎকারভাবে সব মিলে গেছে, তাই না? এরপর আমাকেই যে আসতে হবে, সেটা তো সোজা হিসেব।

সাবধান! উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলে উঠল গোর। কেউ আড়িপেতে থাকতে পারে। তুমি কি ফিল্ড ডিস্টর্টার পরে আছ?

কব্জি পেঁচিয়ে থাকা অলংকৃত ব্রেসলেটটা দেখাল পনিয়েটস। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল গোরভ।

চারদিকে তাকাল পনিয়েটস। সেলটা ফাঁকা, কিন্তু বিরাট। আলো পর্যাপ্ত, কোনো দুর্গন্ধ নেই। খারাপ না। ওরা দেখছি তোমাকে বেশ জামাই আদরেই রেখেছে! দেখেশুনে বলল সে।

মন্তব্যটাতে কান দিল না গোরভ। বলল, তুমি এখানে এলে কী করে বলতো? দুহপ্তা ধরে আমাকে যাকে বলে একেবারে নির্জনবাসে রাখা হয়েছে।

কীভাবে এলাম জিগ্যেস করছ? যে বুড়ো বকটা এদের বস, তার কিছু দুর্বলতা আছে। ধর্ম বিষয়ক কথাবার্তায় বেশ নরম হতে দেখলাম তাকে। টের পেয়ে সুযোগটা কাজে লাগালাম। আমি এখানে এসেছি তোমার আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা হিসেবে। লোকটার মধ্যে সামান্য হলেও ধার্মিকসুলভ কিছু গুণ আছে। দরকার পড়লে সে তোমার গলায় ছুরি চালাবে ঠিকই, কিন্তু তোমার অশরীরী, অসহায় আত্মার মঙ্গলের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না। তেমন কিছু না, সামান্য একটু ব্যবহারিক মনস্তত্ত্ব প্রয়োগ করলাম আর কী। বোঝেই তো, একজন ট্রেডারকে সব কিছুই অল্প বিস্তর জানতে হয়।

ব্যাঙ্গের হাসি ফুটল গোরভের ঠোঁটে। আর তুমি তো থিওলজিকাল স্কুলে লেখাপড়াই করেছ। যাকগে, ওরা তোমাকে পাঠিয়েছে বলে খুব খুশি হয়েছি আমি। কিন্তু গ্র্যাণ্ড মাস্টার যে শুধু আমার আত্মার কল্যাণ নিয়েই ব্যস্ত তা তো আর নয়; মুক্তিপণের কথা সে কিছু বলেছে?

পনিরেটসের চোখ জোড়া কুঁচকে এল। হালকা একটা আভাস দিয়েছে। অবশ্যি সেই সঙ্গে গ্যাস প্রয়গ করে মারার ভয়ও দেখিয়েছে। আমি ইনিয়ে বিনিয়ে এড়িয়ে গেছি। ব্যাপারটা একটা ফাঁদ হতে পারত। তা, লোকটা তাহলে চাপে ফেলে কিছু আদায় করার মতলবে আছে? তা, কী চায় সে?

সোনা।

সোনা! পনিয়েটস ভ্রুকুটি করল। ধাতু হিসেবেই? কীসের জন্যে?

সোনা ওদের বিনিময় মাধ্যম।

বুঝলাম, কিন্তু আমি সোনা পাব কোত্থেকে?

যেখান থেকে পার যোগাড় করবে! শোন, ব্যাপারটা খুব জরুরি। যতক্ষণ পর্যন্ত গ্র্যাণ্ড মাস্টার সোনার গন্ধ পাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার কিছুই হবে না। বলে দাও, সোনা দিচ্ছ তুমি তাকে। যত চায় পাবে সে। তারপর সোনা আনতে যদি তোমাকে ফাউণ্ডেশনে ফিরে যেতে হয় তাহলে তাই যাও। আমাকে ছেড়ে দেবার পর পথ দেখিয়ে আমাদেরকে সিস্টেমের বাইরে দিয়ে আসবে ওরা। তারপর আমরা দুজন দু দিকে চলে যাব।

পনিয়েটস অসন্তোষভরা কণ্ঠে বলল, তারপর ফিরে এসে তুমি আবার চেষ্টা করবে, তাই না?

অ্যাসকোনে অ্যাটমিক জিনিসপত্র বিক্রি করাটাই আমার অ্যাসাইনমেন্ট।

এক পার্সেক যাওয়ার আগেই ওরা ধরে ফেলবে তোমাকে। এটা জান নিশ্চয়ই?

না, জানি না, একগুঁয়ের মতো বলে উঠল গোরভ। আর জানলেও আমার সিদ্ধান্তের কোনো হেরফের হতো না।

পরের বার ওরা তোমাকে খুন করবে।

শ্রাগ করল গোরভ। যেন তাতে কিছুই এসে যায় না।

পনিয়েটস শান্ত কণ্ঠে বলল, গ্র্যাণ্ড মাস্টারের সঙ্গে আবার কথা বলতে হলে আগে আমাকে পুরো গল্পটা শুনতে হবে। এতদিন আমি প্রায় অন্ধের মতো এগিয়েছি বলতে পার।

কাহিনীটা খুব সরল, গোরভ বলল। এই পেরিফেরিতে ফাউণ্ডেশনের নিরাপত্তা জোরদার করতে চাইলে এখানে একটা ধর্মনিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী আমরা হইনি এখনো। চার রাজ্য-কে ঠেকাতে হলে এছাড়া কোনো উপায় নেই আমাদের।

পনিয়েটস মাথা ঝাঁকাল। সেটা আমি বুঝি। যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো সিস্টেম আমাদের অ্যাটমিক যন্ত্রপাতি গ্রহণ করছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে আমাদের ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না–

আর ফলশ্রুতিতে তারা হয়ে উঠতে পারে স্বাধীনতাকামী এবং শত্রুভাবাপন্ন।

বেশ, পনিয়েটস সুবোধ বালকের মতো মাথা ঝাঁকাল। কিন্তু এটা তো গেল তত্ত্বগত দিক। এখন বলো, ঠিক কী কারণে অ্যাটমিক যন্ত্রপাতি বিক্রি করা যাচ্ছে না। ধর্ম? গ্র্যাণ্ড মাস্টার সেরকমই আভাস দিয়েছেন।

এটা এক ধরনের পূজা- পূর্বপুরুষ পূজা। অতীতে একবার চরম দুঃসময় নেমে এসেছিল ওদের জীবনে। তখন বিগত প্রজন্মের কয়েকজন বীর সেই বিপদ থেকে তাদের রক্ষা করেন। জ্ঞানী-গুণী আর সহজ-সরল মানুষ ছিলেন তারা। প্রায় একশো বছর আগের কথা এটা। এম্পেরিয়াল ট্রপকে তাড়িয়ে দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম সরকার গঠিত হয়। সেই থেকে প্রাগ্রসর বিজ্ঞান আর বিশেষ করে অ্যাটমিক পাওয়ার ওদের কাছে ইম্পেরিয়াল শাসনামলের আতঙ্কসূচক প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

তাই নাকি? দুই পার্সেক দূর থেকেই তো ওদের ছোট ছোট চমকার শিপগুলো ঠিকই শনাক্ত করে ফেলল আমাকে। ব্যাপারটাতে কেমন যেন অ্যাটমিকের গন্ধ পাচ্ছি আমি?

কাঁধ ঝাঁকাল গোরভ। সন্দেহ নেই, ওগুলো ওরা রেখে দিয়েছে, ব্যবহার করছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, নতুন করে ওরা কিছুই গ্রহণ করবে না, আর ওদের অভ্যন্ত রীণ অর্থনীতি পুরোপুরি নন-অ্যাটমিক। ঠিক এই অবস্থাটাকেই বদলাতে হবে আমাদের।

কীভাবে সেটা করতে যাচ্ছি আমরা?

বিশেষ কোনো একটা স্থানে প্রতিরোধ নষ্ট করে দিয়ে। ব্যাপারটা এ রকম–ধরো, ফোর্স-ফিল্ড ব্লেড সহ একটা পেননাইফ কোনো এক অভিজাত লোকের কাছে বিক্রি করতে পারলাম আমি। তো, তখন সেই ভদ্রলোক নিজের গরজেই আইনের ওপর চাপ প্রয়োগ করবেন যাতে তিনি জিনিসটা ব্যবহার করতে পারেন। এমনিতে কথাটা খেলো শোনাতে পারে, কিন্তু সাইকোলজিক্যালি এতে কোনো খুঁত নেই। তো, এভাবে ঝোঁপ বুঝে কোপ মারতে পারলে আদালতে অ্যাটমিকের সপক্ষে একটা বিচ্ছিন্ন দল গড়ে উঠবে। তারা অ্যাটমিক যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহারের জোর দাবি তুলবে।

ওরা তোমাকে এই কাজে পাঠিয়েছে, আর এদিকে আমি এসেছি মুক্তিপণ দিয়ে তোমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্যে, যাতে তুমি আবারো চেষ্টা চালাতে পার। কাজটা একটু হঠকারী হয়ে গেল না?

কীভাবে? সতর্ক গলায় জিগ্যেস করলে গোরভ।

শোন, হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল পনিয়েটস, তুমি একজন কূটনীতিক, ট্রেডার নও, বা বললেও তা হয়ে যাবে না। এটা একজন ট্রেডারের কাজ আর আমার গোটা কার্গো শিপে পচছে। দেখে মনে হচ্ছে, আমার কোটা পূরণ হবে না এবার।

হালকাভাবে হেসে উঠল গোরভ। বলল, তার মানে তুমি এমন একটা কাজের জন্যে জীবনের ঝুঁকি নিতে চাইছে যে-কাজটা আসলে তোমার নয়?

পনিয়েটস পাল্টা প্রশ্ন করল, তুমি বলতে চাইছ, কাজটা একজন দেশপ্রেমিকের এবং ট্রেডাররা দেশপ্রেমিক নয়?

অবশ্যই না। পাইওনিয়াররা কখনোই দেশপ্রেমিক হয় না।

ঠিক আছে, মেনে নিলাম। ফাউণ্ডেশনকে রক্ষা করা বা এ-ধরনের কোনো কাজে আমি ছুটে বেড়াই না, মেনে নিলাম। কিন্তু আমি পয়সা কামাতে বেরিয়েছি আর এটা তার একটা সুবর্ণ সুযোগ। সেই সঙ্গে যদি এতে ফাউণ্ডেশনের কোনো উপকার হয় তাহলে সোনায় সোহাগা।

উঠে দাঁড়াল পনিয়েটস। গোরভও উঠে দাঁড়াল তার সঙ্গে। কী করতে যাচ্ছ তুমি?

হাসল পনিয়েটস। জানি না, গোরভ, এখনো জানি না। তবে ঘটনাটার মূলে যদি বিক্রির ব্যাপারটাই মুখ্য হয়ে থাকে তাহলে বলতেই হচ্ছে, আমি তোমার লোক। বড়াই করা আমার স্বভাব নয়, তবুও বলছি, আমি কখনো আমার কোটা পূরণ করতে ব্যর্থ হইনি!

টোকা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল সেলের দরজা। দুজন গার্ড ওর দুপাশে এসে দাঁড়াল।

.

চার

প্রদর্শনী? গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করলেন গ্র্যাণ্ড মাস্টার। তার পশমি ধড়াচুড়ো নিয়ে আয়েশ করে বসলেন আরো। কৃশ হাতে লোহার দণ্ডটা আঁকড়ে ধরলেন। বেত হিসেবে ব্যবহার করেন তিনি এটাকে।

আর সোনা, ইওর ভেনারেশন, পনিয়েটস বলল।

আর সোনা, গাছাড়াভাবে সায় দিলেন গ্র্যাণ্ড মাস্টার।

পনিয়েটস তার হাতের বাক্সটা নামিয়ে রাখল। চেহারায় একটা প্রবল আত্মবিশ্বাসের ছাপ নিয়ে সেটার ডালা খুলল। চারপাশের চরম বৈরী পরিবেশের মধ্যে নিজেকে তার বড় নিঃসঙ্গ মনে হলো। অর্ধবৃত্তাকারে বসা শুশ্রুমণ্ডিত কাউন্সিলররা সবাই বিরূপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। এদের মধ্যে গ্র্যাণ্ড মাস্টারের পাশেই বসে আছেন সরুমুখো এক উচ্চপদস্থ সভাসদ, ফার্ল। নির্জলা

বেরীভাব তাঁর দৃষ্টিতে। পনিয়েটসের সঙ্গে আগে পরিচয় হয়েছে তার। এবং প্রথম দর্শনেই পনিয়েটস তাকে তার প্রধান শত্রু হিসেবে ধরে নিয়েছে; অতএব সঙ্গত কারণেই, তার প্রধান শিকার হিসেবেও।

হলঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সেনাবাহিনীর একটি ছোট দল, কী ঘটে এখানে, তা দেখার জন্যে। পনিয়েটসকে তার শিপ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখা হয়েছে। কোনো অস্ত্র নেই তার সঙ্গে। অবশ্যি এই মুহূর্তে সে যে ঘুষ দিতে যাচ্ছে সেটাকে যদি একটা অস্ত্র বলে গণ্য করা যায় তাহলে ভিন্ন কথা। গোরভ এখনো ছাড়া পায়নি

ঝাড়া এক হপ্তা মাথা খাঁটিয়ে জবরজঙ্গ যে যন্ত্রটা বানিয়েছে, সেটায় কিছু ফাইনাল অ্যাডজাস্টমেন্ট করে নিল পনিয়েটস। মনে মনে আরেকবার প্রার্থনা করল, লিড-লাইনড কোয়ার্টজটা যেন চাপটা সহ্য করতে পারে।

কী এটা? জিগ্যেস করলেন এ্যাণ্ড মাস্টার।

এটা আমার তৈরি একটা ছোট্ট যন্ত্র, এক পা পিছিয়ে এসে জবাব দিল পনিয়েটস।

সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু আমি সেকথা জানতে চাইছি না। এটা কি তোমাদের টার্মিনাসের ঐ জঘন্য ম্যাজিক জাতীয় কোনো ব্যাপার?

গম্ভীর মুখে পনিয়েটস স্বীকার করল জিনিসটা অ্যাটমিক। বলল, তবে আপনাদের কাউকে এটা স্পর্শ করতে হবে না, বা এটা নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি একাই সামলাব এটা। আর যন্ত্রটায় যদি ঘৃণ্য কোনো কিছু থেকে থাকে তাহলে তার দায়-দায়িত্ব আমার একার।

যেন ভয় দেখাচ্ছেন তিনি যন্ত্রটাকে, এমনিভাবে লোহার ছড়িটা উঁচু করলেন গ্র্যাণ্ড মাস্টার। দ্রুত কিন্তু নিঃশব্দে ঠোঁট জোড়া নড়তে লাগল তাঁর। যেন বিশুদ্ধিকরণ মন্ত্র পড়ছেন তিনি। ডানে বসা সরুমুখো কাউন্সিলর ঝুঁকে পড়লেন গ্র্যাণ্ড মাস্টারের দিকে। ফার্লের অবিন্যস্ত গোঁফ জোড়া এগিয়ে এল অ্যাসকোনের শাসকের কানের দিকে। বিরক্তির সঙ্গে কাঁধ ঝাঁকিয়ে মাথা সরিয়ে নিলেন বৃদ্ধ।

পনিয়েটসকে জিগ্যেস করলেন, এই অভিশপ্ত যন্ত্র আর তোমার স্বদেশীর মুক্তিপণের মধ্যে সম্পর্কটা কোথায়? অর্থাৎ আমি জানতে চাইছি, সোনার সঙ্গে যন্ত্রটার সম্পর্ক কোথায়?

যে-ধাতুকে আপনি ঘৃণা করেন সেই লোহাকে খাঁটি সোনায় পরিণত করতে পারি আমি এই যন্ত্রের সাহায্যে। পনিয়েটসের একটা হাত যন্ত্রটার সেন্ট্রাল চেম্বারে নেমে এসে সেটার শক্ত, গোলাকার ফ্ল্যাংকগুলো আলতো করে আঁকড়ে ধরল। মানুষের হাতে এই একটা মাত্র যন্ত্র আছে যেটা দিয়ে লোহাকে- কুৎসিত লোহাকে উজ্জ্বল, ভারি, হলুদ সোনায় পরিণত করা সম্ভব, ইওর ভেনারেশন।

পনিয়েটসের মনে হলো, সে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। সচরাচর সে খুব চমৎকার, সাবলীল এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে খদ্দের পটিয়ে ফেলে। কিন্তু এ-মুহূর্তে সে যেন একটা ভাঙাচোরা স্টেশন ওয়াগনের মতো ধুকে ধুকে এগোচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, ওর বক্তব্যের ধরন নয়, বিষয়বস্তুটাকেই গুরুত্ব দিলেন গ্র্যাণ্ড মাস্টার।

অর্থাৎ ট্র্যান্সমিউটেশন? এর আগে অনেক নির্বোধই কাজটা করতে পারে বলে দাবি করেছে। এই অন্যায় ধৃষ্টতার উচিত পুরস্কারও তারা পেয়েছে।

তারা কি শেষ পর্যন্ত সোনা বানাতে পেরেছিল?

মনে হলো ভেতরে ভেতরে বেশ মজা পাচ্ছেন গ্র্যাণ্ড মাস্টার। সোনা তৈরির সাফল্য এমন একটা অপরাধ যে, সেটা আসলে কোনো অপরাধ নয়। আসলে সোনা তৈরি করতে চাওয়া এবং ব্যর্থ হওয়াটাই মারাত্মক অপরাধ। এই যে, আমার এই লাঠিটাকে সোনা বানাতে পারবে তুমি? লোহার ছড়িটা মেঝেতে ঠুকলেন তিনি।

ইওর ভেনারেশন, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার যন্ত্রটা একটা ছোট্ট মডেল মাত্র। আমারই তৈরি করা। সেই তুলনায় আপনার ছড়িটা খুব বেশি লম্বা।

গ্র্যাণ্ড মাস্টারের চকচকে চোখ দুটো সভাসদদের ওপর ঘুরে একজনের ওপর স্থির হলো।

র‍্যাণ্ডেল, তোমার বাগুলো দাও তো। আহা, ভয় পাচ্ছ কেন? দরকার পড়লে ওগুলোর দ্বিগুণ মূল্যের জিনিস দেয়া হবে তোমাকে।

সভাসদদের হাত ঘুরে এ্যাণ্ড মাস্টারের হাতে চলে এল ওগুলো। গম্ভীর মুখে তিনি বাক্সগুলোর ওজন অনুমান করার চেষ্টা করলেন। তারপর নাও বলে ছুঁড়ে দিলেন মেঝেতে।

পনিয়েটস তুলে নিল ওগুলো।

সিলিণ্ডারটা খোলার আগে শক্ত হাতে বা জোড়া টেনে ধরে সাবধানে অ্যানোড স্ক্রিনের মাঝখানে বসাল পনিয়েটস। বার কয়েক চোখের পাতা উঠল-নামল তার। তীর্যক হয়ে এল দৃষ্টি। পরেরবার আর তত কষ্ট হবে না, কিন্তু প্রথমবার কোনোমতেই ব্যর্থ হওয়া চলবে না।

ঘরে তৈরি ট্রান্সমিউটারটা টানা দশ মিনিট কর্কশ শব্দ করে গেল। আবছাভাবে টের পাওয়া গেল ওজোন-এর গন্ধ। সভাসদরা সবাই বিড় বিড় করতে করতে যার যার জায়গা ছেড়ে পিছিয়ে গেলেন। জরুরি ভঙ্গিতে ফার্ল আবার কী যেন বললেন গ্র্যাণ্ড মাস্টারের কানে। বৃদ্ধের মুখে কোনো অভিব্যক্তির ছাপ পড়ল না। এক চুলও নড়লেন না তিনি।

হঠাৎ দেখা গেল, সোনা হয়ে গেছে বা জোড়া।

বিড়বিড়িয়ে ইওর ভেনারেশন শব্দ দুটো উচ্চারণ করে গ্র্যান্ড মাস্টারের দিকে ওগুলো বাড়িয়ে ধরল পনিয়েটস। ইতস্তত করতে লাগলেন বৃদ্ধ। তারপর দু হাত নাড়িয়ে সরিয়ে নিতে বললেন বাল জোড়া। অনেকক্ষণ ধরে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ট্র্যান্সমিউটারটির দিকে।

পনিয়েটস দ্রুত বলে উঠল, জেন্টেলমেন, নিখাদ সোনা এটা। প্রমাণ চাইলে যে কোনো ফিজিক্যাল বা কেমিক্যাল টেস্ট করে দেখতে পারেন। সাধারণ সোনার সঙ্গে এর কোনো তফাৎ খুঁজে পাবেন না। যেকোনো ধরনের লোহাকেই এই অবস্থায় নিয়ে আসা সম্ভব। মরিচা থাকলেও অসুবিধা নেই। অথবা যদি লোহার সঙ্গে বেশ খানিকটা সংকর ধাতুও থাকে, তাতেও অসুবিধে নেই।

খামোকাই বকবক করে যাচ্ছে পনিয়েটস। ওর দু হাতে যে বা দুটো শোভা পাচ্ছে সেগুলোই ওর হয়ে নিঃশব্দে কথা বলে যাচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত গ্র্যাণ্ড মাস্টার আস্তে আস্তে একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। সরুমুখো ফার্ল আর চুপ থাকতে পারলেন না। ইওর ভেনারেশন, এ সোনার উৎস দূষিত, বলে উঠলেন তিনি।

গোবরেও কিন্তু পদ্মফুল ফুটতে পারে, ইওর ভেনারেশন, পনিয়েটস যুক্তি দেখাল। আপনার প্রতিবেশীদের সঙ্গে লেনদেনের সময় আপনাকে তো কত বিচিত্র ধরনের জিনিসই কিনতে হয়। কই, তখন তো আপনি জিগ্যেস করেন না, সেগুলো তারা কোথায় পেল- আপনার সদাশয় পূর্বপুরুষদের আশীষধন্য অর্থডক্স মেশিন থেকে, না স্পেস লুট করে? আমি তো আর মেশিনটা নিতে বলছি না, বলছি সোনা নিতে।

ইওর ভেনারেশন, আবারও বলে উঠল ফার্ল, যারা আপনার হুকুম নিয়ে বা আপনাকে জানিয়ে কোনো কাজ করে না, সেই বিদেশীদের কোনো পাপের জন্যে আপনি দায়ী নন। কিন্তু আপনার চোখের সামনে, আপনার সম্মতিক্রমে এই যে লোহা থেকে পাপপূর্ণ পথে ভুয়া সোনা তৈরি করা হলো তা গ্রহণ করাটা আমাদের পুণ্যবান পূর্ব পুরুষদের স্বর্গীয় আত্মার চরম অবমাননা ছাড়া আর কিছুই নয়।

কিন্তু তারপরেও সোনা সোনা-ই, খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন গ্র্যাণ্ড মাস্টার। তাছাড়া এটা তো একটা ম্লেচ্ছ, অভিযুক্ত, দুবৃত্তের বদলে নেয়া মুক্তিপণ। ফার্ল, তুমি বড় খুঁতখুঁতে স্বভাবের লোক। বললেন বটে, কিন্তু হাতটা সরিয়ে নিলেন তিনি।

ইওর ভেনারেশন, পনিয়েটস বলে উঠল, আপনি নিজেই জ্ঞানের প্রতিমূর্তি। ভেবে দেখুন, একজন ম্লেচ্ছকে ছেড়ে দিলে আপনাদের পূর্বপুরুষদের কোনো ক্ষতি হবে না, অথচ এর বদলে আপনি যে সোনা পাচ্ছেন তা দিয়ে আপনি তাঁদের পবিত্র আত্মার বেদী অলংকৃত করতে পারবেন। আর সোনা যদি অপবিত্রই হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এমন পবিত্র কাজে ব্যবহার করলে নিশ্চয়ই সেই অপবিত্রতা ধুয়ে মুছে যাবে।

তীক্ষ্ণস্বরে হেসে উঠলেন গ্র্যাণ্ড মাস্টার ফাল, লোকটার কথা শুনে কী মনে হচ্ছে তোমার? ও ঠিকই বলেছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো ওর কথাও খাঁটি।

ফার্ল গোমড়ামুখে বললেন, তাই তো মনে হচ্ছে। তবে ব্যাপারটা যাতে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিকর স্পিরিটের শয়তানিতে পরিণত না হয় সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া দরকার।

বেশ তো, এক কাজ করুন না কেন, পনিয়েটস বলে উঠল, তাতে আরো সহজ হয়ে যাবে ব্যাপারটা। এই সোনা আপনাদের পূর্বপুরুষদের বেদীতে নৈবেদ্য দিয়ে আমাকে তিরিশ দিনের জন্যে আটকে রাখুন। তিরিশ দিন পর যদি তাদের অসন্তোষের কোনো চিহ্ন পাওয়া না যায়, বা কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, তবে নিশ্চয়ই এটা প্রমাণিত হবে যে নৈবেদ্য গৃহীত হয়েছে? এর চেয়ে বেশি আর কী করতে পারি আমি?

এবং এ্যাণ্ড মাস্টার যখন উঠে দাঁড়িয়ে তার সভাসদদের মতামত চাইলেন, কেউই সম্মতিসূচক ইঙ্গিত দিতে ভুললেন না। এমনকি ফালও গোঁফের বাড়তি অংশ চিবুতে চিবুতে আবছাভাবে ঘাড় নাড়লেন।

মৃদু হেসে ধর্মীয় শিক্ষার উপকারিতার কথা ভাবতে লাগল পনিয়েটস।

.

পাঁচ

ফার্লের সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে করতে কেটে গেল আরো সাতদিন। ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত বোধ করছিল পনিয়েটস। তবে এ-ধরনের শারীরিক অসহায়ত্ব সয়ে এসেছে তার এ কদিনে। সব জায়গাতেই চোখে চোখে রাখা হয়েছে তাকে।

সতর্ক প্রহরায় ফার্লের শহরতলীর ভিলায় নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। মুখ বুজে ব্যাপারটা মেনে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তার।

বয়স্কদের গণ্ডীর বাইরে ফার্লকে আরো লম্বা এবং আরও কম বয়েসী মনে হয়। সাধারণ পোশাকে তাকে একেবারেই বয়স্ক মনে হলো না।

তুমি একটা অদ্ভুত লোক, হঠাৎ বলে উঠলেন তিনি। চোখ দুটো নেচে উঠল তার। আমার সোনা দরকার, এই ব্যাপারটা বারে বারে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়া ছাড়া গত সপ্তাহে তুমি কিছুই করনি; বিশেষ করে গত দুঘণ্টায় এই ইঙ্গিতটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। নেহাতই পশুশ্রম, তার কারণ, সোনা আবার কার না দরকার? আরেক পা এগোেচ্ছ না কেন?

নেহাতই সোনা নয় এটা, বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল পনিয়েটস। নেহাত সোনা নয়। স্রেফ দুচারটে পয়সার ব্যাপার নয়। বরং সোনার পেছনে যে ব্যাপার আছে সেটাও এর সঙ্গে জড়িত।

সোনার পেছনে আবার কী থাকবে? বাঁকা হাসি হাসলেন ফার্ল। উদ্ভট আরেকটা ডেমনস্ট্রেশনের পাঁয়তারা করছে না তো?

উদ্ভট? পনিয়েটস বুরু কোঁচকাল।

তাছাড়া আর কী! হাতদুটো ভাঁজ করে বুকের ওপর রাখলেন ফার্ল। চিবুক দিয়ে আলতো করে ঘষলেন। আমি তোমার সমালোচনা করছি না, তবে আমি নিশ্চিত, উদ্ভট ব্যাপারটা পুরোপুরি ইচ্ছাকৃত। উদ্দেশ্যটা আগে ভাগে জানতে পারলে হিজ ভেনারেশনকে সতর্ক করে দিতে পারতাম আমি। তোমার জায়গায় আমি হলে, সোনাটা আমি আমার নিজের শিপে তৈরি করে সবার চোখের আড়ালেই দিতাম। তাতে করে ঐ প্রদর্শনীর ব্যাপারটা আর এতে করে যে বিরূপ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে সে দুটোই এড়ানো যেত।

ঠিক, স্বীকার করল পনিয়েটস, কিন্তু আমি যেহেতু আমিই, তাই কাজটা আমি আমার নিজের মতো করেই করেছি, আর বিরূপতাটুকু সহ্য করেছি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে।

তাই? শুধুই কি তাই? মজা পেলেও তিনি যে খানিকটা বিরক্তও হয়েছেন সেটা লুকোবার কোনো চেষ্টা করলেন না ফার্ল। আর আমার ধারণা, তুমি ঐ তিরিশ দিনের শুদ্ধি-সময় চেয়ে নিয়েছ যাতে এই দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যাপারটাকে আরো কিছুটা অর্থবহুল করে তোলা যায়। সোনাটা যদি ইমপিওর প্রমাণিত হয়, তাহলে?

সাহস করে একটু ঝুঁকিপূর্ণ বসবোধের পরিচয় দিল পনিয়েটস। যেখানে ঐ সোনার অবিশুদ্ধতা বিচারের ভার তাঁদের ওপর যাঁরা ওটাকে বিশুদ্ধ বলে রায় দেবার জন্যে নিজেরাই সবচেয়ে বেশি উৎসুক?

চোখ কুঁচকে পনিয়েটসের দিকে তাকালেন ফার্ল।

ঠিক কথা। এবার বলো, বিশেষ করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলে কেন তুমি?

বলছি। এই অল্প সময়েই, মানে যে কদিন ধরে এখানে আছি আমি, আপনার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা জিনিস খেয়াল করলাম এবং আকৃষ্ট হলাম। যেমন ধরুন, আপনি বয়সে তরুণ- কাউন্সিলের একজন খুবই তরুণ সদস্য আপনি। এমনকি আপনার বংশও খুব একটা প্রাচীন নয়।

তুমি আমার বংশের সমালোচনা করছ?

মোটেই না। আপনার পূর্বপুরুষেরা সবাই অত্যন্ত মহান এবং পূতপবিত্র চরিত্রের লোক, সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে। কিন্তু কিছু দুর্মুখ আছে যারা বলে বেড়ায়, আপনি ফাইভ ট্রাইবস-এর অন্তর্ভুক্ত নন।

চেয়ারের পিঠে হেলান দিলেন ফার্ল। ট্রাইবের সবার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান দেখিয়ে বলছি, তিনি তাঁর বিদ্বেষ লুকোনোর চেষ্টা করলেন না, ফাঁই ট্রাইব দুর্বল হয়ে গেছে। তাদের আভিজাত্যও কমে এসেছে। ট্রাইবের পঞ্চাশজন সদস্যও জীবিত নেই এখন।

কিন্তু এরপরেও কিছু লোক বলে বেড়ায়, ট্রাইবের বাইরের কাউকে গ্র্যাণ্ড মাস্টার হিসেবে দেখতে চায় না জাতি। তাছাড়া এ-ও বলা হয়ে থাকে যে, গ্র্যাণ্ড মাস্টারের এমন তরুণ এবং নব্য-আধুনিক একজন প্রিয়পাত্র রাজ্যের ক্ষমতাবান লোকদের মধ্যে কারো না কারো সঙ্গে সঙ্গে ঘোরতর শত্রুতায় জড়িয়ে পড়তে বাধ্য। হিজ ভেনারেশনের বয়স হচ্ছে। তার স্পিরিটের বাণী ব্যাখ্যা করার ভার যদি কোনো শক্রর হাতে পড়ে, তাহলে কি মনে করেন মৃত্যুর পর হিজ ভেনারেশনের আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে?

ভ্রুকুটি করলেন ফার্ল। একজন বিদেশী হিসেবে তুমি অনেক কিছু শুনে ফেলেছ। যে-কান এতো বেশি শোনে সে-কান সাধারণত কেটে ফেলা হয়।

সেটা পরে ঠিক করা যাবে।

আমাকে বলতে দাও, চেয়ারের ভেতর নড়ে উঠলেন ফার্ল। তোমার শিপের ঐ অশুভ খুদে মেশিনের সাহায্যে তুমি আমাকে সম্পদ আর ক্ষমতার লোভ দেখাতে চাইছ। ঠিক কি না?

ধরে নিন তাই। আপনার আপত্তিটা কোথায়? স্রেফ আপনার শুভ-অশুভ বিচারবোধ?

ফার্ল মাথা নাড়লেন। মোটেই না। দেখ, বিদেশী, আমাদের সম্পর্কে তোমাদের বর্বরোচিত ধারণা একান্তই তোমাদের। তবে আমি কিন্তু মোটেই আমাদের পৌরাণিক জগতের বাসিন্দা নই। যদিও বাইরে থেকে আমাকে দেখে সেকথা মনে হবার উপায় নেই। আমি বাপু শিক্ষিত লোক। আর আমার ধ্যান-ধারণা আলোকপ্রাপ্তও বটে। আমাদের ধর্মীয় অনুশাসনের যাবতীয় খুঁটিনাটি সব ঐ জনসাধারণের জন্যে; নীতিগত দিক দিয়ে নয়, আচার-অনুষ্ঠানগত দিক দিয়ে।

তাহলে আপনার আপত্তি কোথায়? পনিয়েটস নাছোড়বান্দা।

স্রেফ ঐ জনগণ। তোমার সঙ্গে আমার একটা বোঝাঁপড়া হলেও হতে পারে, কিন্তু তার আগে আমাকে নিশ্চিত হতে হবে, তোমার ঐ খুদে যন্ত্রগুলো আসলেই কাজের জিনিস। তুমি যেসব জিনিস বিক্রি কর- যেমন ধর, একটা রেজর- সেটা যদি আমাকে রীতিমত নিচ্ছিদ্র গোপনীয়তার সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় তাহলে আর ধনী হব কীভাবে আমি। তাছাড়া, জিনিসটা ব্যবহার করতে গিয়ে আমি যদি ধরা পড়ে যাই, সেক্ষেত্রে গ্যাস চেম্বার বা জনতার রুদ্ররোষের হাত থেকেই বা বাঁচব কী করে?

ব্যাপারটা ঠিকই ধরেছেন আপনি, শ্রাগ করল পনিয়েটস। তবে এক্ষেত্রে দুটো জিনিস বাঁচাতে পারে আপনাকে। এক হলো, আপনার বিপুল অঙ্কের মুনাফা। আর দুই হচ্ছে, জনগণকে তাদের নিজেদের স্বার্থেই অ্যাটমিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা। স্বীকার করছি, কাজটা খুব শক্ত। কিন্তু লাভ সে তুলনায় অনেক বেশি। তবে এ-মুহূর্তে সেটা আপনার মাথা ব্যথা, আমার নয় আদৌ। কারণ, আমি রেজর, ছুরি বা যান্ত্রিক গারবেজ ডিসপোজার বিক্রি করছি না।

তাহলে কী বিক্রি করছ?

খোদ সোনা। সরাসরি। গেল হপ্তায় আমি যে যন্ত্রটা দেখিয়েছিলাম, আপনি সেটা পেতে পারেন।

এবার একেবারে স্থির হয়ে গেলেন ফার্ল। তাঁর কপালের চামড়ায় ঢেউ খেলে গেল। ঐ ট্রান্সমিউটারটা?

ঠিক তাই। লোহা আর সোনা, দুটোর সাপ্লাই সমান সমান থাকবে আপনার। এতে আশা করি আপনার সব প্রয়োজন মিটবে। তারুণ্যের অভিযোগ আর শত্রুদের উপস্থিতি সত্ত্বেও গ্র্যান্ড মাস্টারশিপের ব্যাপারে কোনো অসুবিধে হবে না। অ্যাণ্ড ইট ইজ সেইফ।

কীরকম?

একটু আগে অ্যাটমিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করার ব্যাপারটাকেই একমাত্র নিরাপত্তা বলে বর্ণনা করেছেন আপনি। এখানেও ঐ একই ব্যাপার। যন্ত্রটা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে আপনাকে। সবচেয়ে দূরের এস্টেটের দুর্ভেদ্যতম দুর্গের গোপনতম কুঠরিতে লুকিয়ে রাখবেন আপনি ট্রান্সমিউটারটা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তারপরেও তাৎক্ষণিভাবে সেটা আপনাকে ধনসম্পদ উপহার দেবে। আসলে আপনি সোনা কিনছেন, মেশিনটা নয়। আর সে সোনা কোত্থেকে এল তার কোনো চিহ্ন থাকবে না। কারণ, স্বাভাবিক সোনার সঙ্গে এ-সোনার কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না।

যন্ত্রটা চালাবে কে?

কেন, আপনি নিজে! দেখিয়ে দিলে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই শিখে নিতে পারবেন। যেখানে বলবেন সেখানে ফিট করে দেব আমি ট্রান্সমিউটারটা।

বিনিময়ে?

দেখুন, সতর্ক কণ্ঠে বলল পনিয়েটস, আমি একটা দাম চাইব, বেশ চড়া দামই চাইব। এটাই আমার জীবিকা। যন্ত্রটা খুব দামি, তাই এক ঘনফুট সোনার যা মূল্য সেই মূল্যের পেটা লোহা দেবেন আপনি আমাকে।

হেসে উঠলেন ফার্ল। পনিয়েটসের চেহারা কালো হয়ে উঠল। আপনি কিন্তু, স্যার, দুঘণ্টার মধ্যেই দামটা উঠিয়ে নিতে পারবেন, শীতল কণ্ঠে বলল সে।

হ্যাঁ, আর তুমি চলে যাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই দেখা দেল যন্ত্রটা অচল হয়ে পড়েছে। আমি গ্যারান্টি চাই।

এক্ষেত্রে আমার কথাই গ্যারান্টি।

আর সেটা বেশ দামিও বটে, ব্যঙ্গচ্ছলে ছোট্ট একটা কুর্ণিশ করলেন ফার্ল। কিন্তু তোমার উপস্থিতি তার চেয়ে আরো ভাল গ্যারান্টি হবে বলে আমার বিশ্বাস। তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যন্ত্রটা ডেলিভারির এক সপ্তাহ পর আমি তোমার মূল্য পরিশোধ করব। অসম্ভব!

অসম্ভব?

যেখানে আমাকে কিছু বিক্রি করতে চেয়েই স্বচ্ছন্দে একটা মৃত্যুদণ্ড পাওনা হয়ে গেছে তোমার? শোন, একটাই বিকল্প আছে তোমার সামনে আগামীকাল গ্যাস চেম্বারে মৃত্যু।

পনিয়েটসের মুখে কোনো অভিব্যক্তির ছায়া নেই। তবে তার চোখ দুটো সামান্য ঝিলিক দিয়ে উঠল বলে মনে হলো। সে বলল, আপনি একটা অন্যায় সুযোগ নিচ্ছেন। অন্তত লিখিত একটা প্রতিশ্রুতি তো দেবেন?

হ্যাঁ, সেটা দিয়ে নিজের মত্যুদণ্ডের ব্যাপারটা আরো পাকাঁপোক্ত করি আর কী! না জনাব, পরম স্বস্তির একটা হাসি হাসলেন ফার্ল, আমাদের দুজনের মধ্যে বোকা মাত্র একজনই।

মৃদু কণ্ঠে পনিয়েটস বলল, ঠিক আছে, তাহলে সেই কথাই রইল।

.

ছয়

তিরিশতম দিনে পাঁচশো পাউণ্ড উজ্জ্বল, হলুদ সোনার বদলে মুক্তি পেল গোরভ। সেই সঙ্গে মুক্তি পেল তার ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য শিপটিও।

অ্যাসকোনীয় সিস্টেমে প্রবেশ করার সময় যেমন, বেরোবার সময়ও তেমনি সিলিন্ডার আকৃতির ছোট ছোট শিপগুলো এগিয়ে দিয়ে এল ওদের। গোরভের শিপটার দিকে তাকিয়ে ছিল পনিয়েটস। মৃদু সূর্যালোকে সাদা একট ফুটকির মতো দেখাচ্ছে ওটাকে। হঠাৎ করে অভেদ্য, বিকৃতি-নিরোধক ইথার-বীমে পরিষ্কার তার গলা শুনতে পেল পনিয়েটস।

যা চেয়েছিলাম তা কিন্তু হলো না, পনিয়েটস। একটা ট্রান্সমিউটারে কাজ হবে। সে যাই হোক, জিনিসটা তুমি পেলে কোথায় বলো তো?

পাইনি, পনিয়েটসের কণ্ঠ স্থির। একটা ফুড ইরেডিয়েশন চেম্বারে বসে বানিয়েছি। তেমন একটা কাজের না। ব্যাপক হারে শক্তিক্ষয় আইনত নিষিদ্ধ, নইলে সারা গ্যালাক্সি জুড়ে হেভি মেটাল না খুঁজে ট্রান্সমিউটেশনই ব্যবহার করত ফাউণ্ডেশন। ওটা একটা খুবই মামুলি ট্রিক। সব ট্রেডারই ব্যবহার করে। তফাৎটা হলো, এর আগে লোহা থেকে সোনা বানানো কোনো যন্ত্র চোখে দেখিনি আমি। তবে জিনিসটা খুবই ইম্প্রেসিভ। কাজও করে- তবে খুবই সাময়িকভাবে।

বুঝলাম। কিন্তু ট্রিকটা কোনো কাজের না।

কিন্তু ওটাই তোমাকে ঐ নরক থেকে বের করে এনেছে।

কথা সেটা না; বিশেষ করে, ওরা এসকর্ট করে চলে গেলেই যখন আমাকে ফিরতে হবে।

কেন?

সেটা তুমি নিজেই ব্যাখ্যা করেছ তোমার এই রাজনীতিক ভদ্রলোককে। গোরভের গলা গম্ভীর। তোমার কথার মূল বক্তব্য ছিল যে ট্রান্সমিউটারটা একটা উদ্দেশ্য সাধনের উপায় মাত্র, সেটার নিজের কোনো মূল্য নেই। অর্থাৎ লোকটা সোনা কিনছে, মেশিন নয়। সাইকোলজি হিসেবে ওটা ভালই ছিল, কারণ ব্যাপারটা কাজে দিয়েছিল, কিন্তু

কিন্তু? পনিয়েটস নিতান্ত গোবেচারার মতো শুধাল।

রিসিভারের কণ্ঠটা তীক্ষ্ণতর হল। কিন্তু আমরা ওদের কাছে এমন একটা যন্ত্র বিক্রি করতে চাইছি। যেটার নিজস্ব মূল্য আছে। এমন একটা যন্ত্র, যেটা তারা খোলাখুলি ব্যবহার করতে চাইবে। এমন কিছু যা তাদেরকে তাদের নিজেদের গরজেই অ্যাটমিক টেকনিকের পক্ষে কথা বলতে বাধ্য করবে। সোজা কথায়, এমন যন্ত্র, যা ওদেরকে অ্যাটমিক টেকনিকের ভক্ত বানিয়ে ফেলবে।

সবই বুঝলাম, শান্ত কণ্ঠে বলল পনিয়েটস। আগেও একবার বলেছ আমাকে। কিন্তু একবার ভেবে দেখেছ, আমার ঐ বিক্রিতে কত লাভ হয়েছে? ট্রান্সমিউটারটা যদ্দিন টিকবে, আই মীন, কাজ করবে, ততদিন দুহাতে সোনা বানিয়ে যাবে ফার্ল। আর পরবর্তী নির্বাচনটা কিনে নেবার মতো সামর্থ ফার্লের না হওয়া পর্যন্ত ওটা টসকাবে না। অথচ বর্তমান গ্র্যাণ্ড মাস্টার কিন্তু খুব বেশিদিন টিকছে না।

তুমি কি ফার্লের কৃতজ্ঞতার ওপর ভরসা করছ? গোরভ বরফ শীতল কণ্ঠে শুধাল।

না, ভরসা করছি লোকটার বোধশক্তি আর তার নিজের গরজের ওপর। ট্রান্সমিউটারটা তাকে একটা নির্বাচন বাগিয়ে দিচ্ছে, অন্যান্য মেকানিজম-

না, না, তোমার যুক্তিটা ঠিক হলো না। কৃতিত্বটা সে সোনাকে দেবে, ট্রান্সমিউটারটাকে না। এই কথাটাই আমি বোঝাতে চাইছি তোমাকে এতক্ষণ ধরে।

দাঁত বের করে হাসল পনিয়েটস। নড়েচড়ে আরেকটু আরাম করে বসল। ঢের হয়েছে, অনেকক্ষণ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বেচারাকে।

পনিয়েটস বলল, ধীরে, গোরভ, ধীরে। কথা আমি শেষ করিনি এখনো। অন্যান্য যন্ত্রপাতিও এর সঙ্গে জড়িত।

সামান্য বিরতি। তারপর গোরভের সতর্ক কণ্ঠ ভেসে এল। অন্যান্য যন্ত্রপাতি বলতে?

নিজের অজান্তেই অপ্রয়োজনীয় একটা ভঙ্গি করে পনিয়েটস বলল, এসকর্টটা দেখতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি, অসহিষ্ণ কণ্ঠে গোরভের। তুমি ঐ যন্ত্রপাতিগুলোর কথা বলো।

সে কথাই তো বলছি- শুনে যাও। ফার্ল-এর প্রাইভেট নেভি এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। গ্র্যাণ্ড মাস্টারের তরফ থেকে এটা তাকে দেয়া একটা সম্মানসূচক উপহার বলতে পার। লোকটা সেই নেভিকে ব্যবহার করছে আমাদের এসকর্ট করার কাজে।

তো?

তা, লোকটা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয় তোমার? অ্যাসকোনের সীমান্তে, তার খনি অঞ্চলে, বুঝলে? শোন! হঠাৎ করে জ্বলে উঠল পনিয়েটস। তোমাকে আমি আগেই বলেছি, দুনিয়া উদ্ধার করতে আসিনি আমি, এসেছি পয়সা কামাতে। কিন্তু ট্রান্সমিউটারটা বিনে পয়সাতেই বিক্রি করে দিয়েছি আমি। গ্যাস চেম্বারের ঝুঁকি অবশ্য ছিল, কিন্তু তাতে আমার কোটা পূরণ হয়নি।

খনির কথায় এস পনিয়েটস। এসবের সঙ্গে ওগুলোর সম্পর্ক কীসের?

লাভের। আমরা টিনের পাহাড় গড়তে যাচ্ছি, গোরভ। এই বুড়ো শিপে যত টিন ধরে তত তো বটেই, তারপর তোমার শিপেও নিতে হবে অনেক। আমি ফার্লের সঙ্গে টিন আনতে নিচে নামব, তুমি ওপর থেকে তোমার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র তাক করে আমাকে কাভার দেবে। বলা যায় না, ফার্ল গণ্ডগোল পাকালেও পাকাতে পারে। ঐ টিনই আমার লাভ।

ট্রান্সমিউটারের বদলে?

আমার সমস্ত অ্যাটমিক যন্ত্রপাতির বদলে। দ্বিগুণ দামে, একটা বোনাস সহ। প্রায় ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল সে। স্বীকার করছি, এটা আমি একরকম জোর করেই আদায় করেছি লোকটার কাছ থেকে। কিন্তু আমাকে তো আমার কোটা পূরণ করতে হবে, না কি?

রীতিমত অথৈ জলে হাবাডুবু খাচ্ছে গোর। ক্ষীণ কণ্ঠে সে বলল, ব্যাপারটা একটু খুলে বলা যায় না?

খুলে বলার কী আছে? ব্যাপারটা তো পানির মতো সোজা। বুঝলে গোরভ, ঘোড়েল কুকুরটা মনে করেছিল, পুরোপুরি ওর ফাঁদে আটকা পড়ে গেছি আমি। তার কারণ, স্বভাবতই এ্যাণ্ড মাস্টারের কাছে আমার কথার চেয়ে তার কথার মূল্য বেশি। ট্র্যান্সমিউটারটা সে নিয়েছিল ঠিকই, আর অ্যাসকোনে সেটা একটা ক্যাপিটাল ক্রাইম, এটাও ঠিক। কিন্তু ধরা পড়লেই সে এ কথা বলে পার পেয়ে যেত যে, নির্ভেজাল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে আমাকে এই নিষিদ্ধ জিনিস বিক্রি করার ফাঁদে পা দিতে প্রলুব্ধ করেছে।

তা তো বটেই।

কিন্তু ব্যাপারটা এত সরল নয় মোটেই। তুমি ভাল করেই জান, জীবনে মাইক্রোফিল্ম-রেকর্ডারের নাম শোনেনি-ফার্ল। এ-রকম জিনিস যে আদৌ থাকতে পারে, সেকথাও ঘুণাক্ষরে ঠাই পায়নি তার মাথায়।

হেসে উঠল গোরভ।

একটা কথা ঠিক, পনিয়েটস মাথা নেড়ে বলল। হি হ্যাড দ্য আপার হ্যাঁণ্ড কর্তটা ওর হাতে ছিল। আমাকে বেশ কোণঠাসা করে ফেলেছিল লোকটা। কিন্তু : আমি তক্কে তক্কে ছিলাম। ট্রান্সমিউটারটা ফার্লকে তার পছন্দমত জায়গায় ফিট করে দেবার সময় চট করে যন্ত্রটার ভেতর রেকর্ডারটা ঢুকিয়ে দিলাম আমি। পরের দিন যন্ত্রটা পরীক্ষা করে দেখার ছলে বের করে নিলাম আবার। সবকিছু রেকর্ড হয়ে গেছে ততক্ষণে মাইক্রোফিল্ম-রেকর্ডারটায়- গোপন আস্তানায় বসে ফার্ল বেচারা সমস্ত আর্গ প্রয়োগ করে ট্রান্সমিউটার চালাচ্ছে, আর প্রথমবার সোনা তৈরি করার পর খুশিতে এমন উদ্বাহু নৃত্য করছে যেন ওটা সদ্য পাড়া তার নিজের ডিম- এগুলো সব ধরে রেখেছে রেকর্ডারটা।

ওকে সেটা দেখিয়েছিল?

দুদিন পর। গোবরগণেশটা থ্রি-ডাইমেনশনাল কালার সাউণ্ড ইমেজ জিন্দেগীতে দেখিনি। মুখে বলে, সে নাকি কুসংস্কারাচ্ছন্ন নয়। অথচ সেই সময় ওর চোখ মুখের অবস্থা যদি দেখতে ভয় আর শ্রদ্ধায় গদগদ অমন দৃষ্টি আর কারো চোখে দেখিনি আমি, হলপ করে বলতে পারি। যখন বললাম, সিটি স্কোয়ারে আমি একটা রেকর্ডার রেখে এসেছি, আর ঠিক দুপুর বেলা সেটা লক্ষ লক্ষ ধর্মোন্মাদ অ্যাসকোবাসীর চোখের সামনে চালু হয়ে যাবে, আর তারপরে মুহূর্তের মধ্যে ওরা তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে- অমনি, মাত্র আধ সেকেন্ডের মধ্যে, আমার পা জড়িয়ে ধরে প্রলাপ বকতে শুরু করল ফার্ল। আমার কথামত যে কোনো চুক্তিতে আসার জন্য এক পায়ে খাড়া তখন লোকটা।

সত্যি তাই? চাপা হাসি হাসল গোরভ। আই মীন, তুমি কি সত্যি সত্যি সিটি স্কোয়ারে রেকর্ডার রেখে দিয়েছিল?

না, রাখিনি। কিন্তু তাতে কী? হি মেড দ্য ডিল। যত পারি টিন বোঝাই করে নিয়ে যাব, এই শর্তে আমার আর তোমার প্রত্যেকটা গ্যাজেট কিনে নিল সে। সে সময় ওর চোখে আমি রীতিমত সর্বশক্তিমান, যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা রাখি। চুক্তিটা কাগজে-কলমেই হয়েছে। ওর সঙ্গে নিচে নেমে যাবার আগে তোমাকে সেটার একটা কপি দিয়ে যাব- সাবধানের মার নেই, কি বল?

কিন্তু তুমি ওর অহম চূর্ণ করে দিয়েছ, বলল গোরভ। যন্ত্রপাতিগুলো কি আর ব্যবহার করবে ও?

কেন করবে না? ক্ষতি পুষিয়ে নেবার এটাই একমাত্র উপায় তার। যদি সে ওগুলো বিক্রি করে পয়সা কামাতে পারে তাহলেই হারানো অহংবোধ ফিরে পাবে সে। আর পরবর্তী গ্র্যাণ্ড মাস্টার ফাঁই হচ্ছে। আর আমাদের কাজে লাগাবার জন্যে সে-ই সবচেয়ে উপযুক্ত লোক।

বুঝলাম, গোরভ বলল, ভালই বিক্রি হলো তোমার। কিন্তু তারপরেও বলতে হচ্ছে, তোমার এই সেলস টেকনিকটা বেশ অসুবিধেজনক। সেমিনারি থেকে ওরা কি আর খামোকা তাড়িয়ে দিয়েছিল তোমাকে? তোমার কোনো নীতিবোধ নেই নাকি?

এতে খারাপটা কী দেখলে তুমি? পনিয়েটস নির্লিপ্ত স্বরে জিগ্যেস করল। আর তাছাড়া, নীতিবোধ সম্পর্কে স্যালভর হার্ডিন কী বলে গেছেন তা তো তুমি জানোই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *