ফাতনা কাঁপছে। মিরগেল ঠোকরাচ্ছে, দেখলেই বোঝা যায়। ঠুকরে যা ধূর্ত মিরগেল। মনে রাখিস, এটা নদী না, পুকুরের জল। জাল ফেলে তোকে তুলে নিয়ে আসতে পারি। তবে তার দরকার নেই। আমি শুধু নিরিবিলিতে জলের ধারে একটু বসতে এসেছি। ঘাটে এখন আর কেউ নেই। রোদ মাথার ওপরে। আমি যে ছায়ায় ছিলাম, রোদ সেখানেও একটা বর্শার মতো খোঁচা নিয়ে হানা দিয়েছে। আমার মুখের এক পাশ দিয়ে, চোখ ভুরু ঠোঁট ছুঁয়ে বুকে আর পেটে এসে পড়েছে। কী বলে গেলে তুমি নীলা বউদি? এমন নয় যে, তুমি কেবল ঠকতেই এসেছ।
নীলা বউদির একটি কথায়, পুরনো ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয় ওই ঘটনা কি ভবিষ্যতের কী বলে, একটা সাইন? সাইন টাইন না, মানে সংকেত? তা হলে সেটাকে ভবিতব্যই বলতে হবে। কিন্তু ভবিতব্যই যদি বলব তা হলে খুকুকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বসিরহাটের সেই দিনটির কথা ভাবব কেন? অগ্রহায়ণ মাসের সেই পড়ন্ত বেলার কথা নয় কেন? সেই নারকেল আর সুপুরি গাছের ফাঁক দিয়ে থিয়েটারের স্পট লাইটের মতো লাল রোদ এসে পড়েছিল খুকুর পিছন থেকে, তবু ওকেও-ওর মুখ, জামা, কাপড়ের বাইরে হাত গলা নাভির কাছে খোলা জায়গা সবই লাল দেখাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল ও যেন একটা তপ্ত রোদের পুতুল, যার তাপে আমি গলে যাচ্ছিলাম, হারিয়ে যাচ্ছিলাম এর মধ্যে, সেই তো শুরু। ভবিতব্য তো সেই দিনটাতেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু আমি তো সেরকম ভাবে কোনও কিছুই কখনও ভাবিনি। কোনও ভবিতব্যের কথা ভাববারই আমার দরকার হয়নি। জীবনে যখন যা এসেছে আমি তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি, আর দেখেছি যা কিছু ভেবেছি, চিন্তা করেছি, আশা করেছি, সবই যেন চাবুক খাওয়া পাগলা ঘোড়ার দলের মতো নানা দিকে ছুটে চলে গিয়েছে। এখন সব ঘটনাগুলোকে জোড়াতালি দিয়ে একটা একটা করে ভাবলে মনে হতে পারে, সবকিছুরই সংকেত আগেই পাওয়া যায়। কিন্তু আমি তা কখনও পাইনি। এখনও পাই না। তারপরেও তো আমি খুকুকে বিয়ে করেছিলাম। বরং মা যেন কেমন একটু আপত্তির ভাব দেখিয়েছিল, যা আগে কখনও দেখিনি। পানতু আপত্তি করেনি। কিন্তু বিনতিমুখটা বেঁকিয়েছিল। বাবার কথা তো আসেই না। যদিও তখন বাবা অন্য মূর্তি ধারণ করেছিল! যেন কত স্নেহময় কর্তব্যপরায়ণ পিতা, সংসারে পুত্রবধূকে বরণ করার জন্য কতই ব্যাকুলতা। বাড়ির শ্রী ফিরে যাবে, এমন কথাও মহাশয় বলেছিলেন। আমার অবিশ্যি কিছুই এসে যায়নি।
হ্যাঁ, বাবার ফিরে আসাটাও অদ্ভুত। লোকটি কি জড়ভরত, না উদাসীন, কিছুই আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। কিন্তু অসম্ভব। বাবাকে যে জড়ভরত বা উদাসীন বলবে, তার মতো ভুল আর কেউ করবে না। তবু, সে কী? কী চেয়েছে সারা জীবন ধরে? সে কি একটা পাহাড়ি ঈগল পাখি? বহু দুরের নীচে যে শ্যেন চক্ষে তাকিয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকার ধরে তুলে নিয়ে গিয়েছে পাহাড়ের ওপরে, ক্ষুধা মিটিয়েছে, আকাশে চক্কর দিয়ে বেড়িয়েছে, তারপরে আবার শিকারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু তারও তো ঈগল বউ থাকে, বউয়ের সঙ্গে ভালবাসাবাসি করে, বউ ডিম পাড়ে, ওম করে তা দেয়, সে-ই বাইরে সাবধানে পাহারা দেয় তারপরে বাচ্চা ফুটলে খাবার নিয়ে এসে মুখে তুলে দেয়। একটা গোটা চরিত্র, তার দায় আছে, দায়িত্ব আছে, কেবল শিকার করা তার জীবন না।
না, ত্রিলোচন চট্টোপাধ্যায় অন্য মানুষ। সংসার পরিবার সন্তানের দায় দায়িত্বের কথা সে কোনও দিন ভাবেনি। লোকটির ঔরসে আমার জন্ম, অথচ দুজনের মধ্যে অমিল কেবল না, কখনও বুঝতেও পারলাম না সারা জীবনটা ধরে সে কী চেয়েছে? অনেক সময় হাসিও পেয়ে যায়। ছেলেবেলায় এক একটা বন্ধু যেমন থাকে, যেমন করেই তুমি খেলাপাতি সাজাও, খেলার ঘর বানাও, আর দেখে দেখে খুশিতে মন ভরে উঠুক, একজন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু হাতে সব ভেঙেচুরে ওলটপালট করে দেয়। বাবাকে কোনও কোনও সময় সেই ভাঙচুর করা ছেলেটির মতো মনে হয়।
মনে আছে, বসিরহাট থেকে হারিয়ে যাওয়া বাবা সাত মাস বাদে এক বর্ষার কালো মেঘ ছাওয়া সন্ধ্যায় ফিরে এসেছিল। বৃষ্টি ছিল প্রায় সারা দিন। আমি খুকুদের বাড়ি থেকে সন্ধার একটু পরেই সাইকেল চালিয়ে কাকভেজা হয়ে ফিরেছিলাম। বাতাস ছিল না একটুও। আমাদের বিরাট বাড়ি আর সামনের বাগানটা যেন ভুতুড়ে পোড়ো বাড়ির মতো অন্ধকারে ভিজছিল। বড়দা মেজদা জ্যাঠাইমায়েরা তো গড়িয়ায় চলেই গিয়েছিল। ভাত কাপড় খাওয়া আর কিছু মাইনে দিয়ে ঝি রাখা সম্ভব ছিল না। একটা ছেলে আমাদের পাড়ার কাছেই থাকে, তেলি না তিলি, কী ওদের বলে–ছেলেটার নাম বিশে। বিশে সময়মতো এসে সামনের বাগানের টিউবওয়েল থেকে মাকে জল তুলে দিয়ে যেত। আমার জন্যও দোতলার বাথরুমে আর বারান্দায় জল তুলে দিত। সকালে এক বার যতটা সম্ভব, ওপরে নীচে ঝাট দিয়ে মুছে দিত। অথচ ঠাকুরদা জ্যাঠামশাই বেঁচে থাকতে
যাক গিয়ে, ও সব ভাবতে ভাল লাগে না। নেহাত বাগান পুকুরগুলো ছিল, কিছু ধান জমি ছিল, তার দৌলতে চালিয়ে যাচ্ছিলাম। বিশেকে রোজ হিসাবে বারো আনা পয়সা দিতাম। আমার আর মায়ের কাজ চলে যেত। কিন্তু সন্ধা রাত্রে মাকে কোনও দিনই একলা থাকতে হত না। আমাদের জ্ঞাতিদের কেউ, ঠাকমা, জ্যাঠাইমা, কাকিমা কেউ না কেউ বাড়িতে আসত। গল্পগুজবের সঙ্গে ট্রানজিস্টর বাজত। আমারও খেয়াল থাকত, বেশি রাত করলে মা একলা থাকবে। আমি যেখানেই যেতাম সন্ধ্যার পরেই বাড়ি ফিরতাম। অবিশ্যি আমার যেমন কোনও কোনও তাস খেলার বন্ধু ছিল, মায়েরও তেমনি কয়েকজন সঙ্গিনী ছিল, যাদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যেত।
কিন্তু দাদু মারা যাবার সাত মাস আর কয়েকদিন বাদে, সেই বর্ষার সন্ধ্যা রাত্রে আমি বাগানের দিকে বড় খোলা দেউড়ি দিয়ে মায়ের ঘরে আলো না জ্বলতে দেখে, অবাক হয়েছিলাম। দেউড়ির মাথায় একটা প্রায় জিরো পাওয়ারের টিমটিমে আলোটাই কেবল জ্বলছিল। আমি ডেকে উঠেছিলাম, মা, মা কোথায় গেলে?
কোনও সাড়া শব্দ তৎক্ষণাৎ পাইনি। ওই রকম হবার কথা ছিল না। মায়ের ঘরে আলো জ্বলা উচিত ছিল। কিছু না হোক, কেউ না আসুক ট্রানজিস্টরটা বাজা উচিত ছিল। আমি সাইকেলটা নিয়ে সামনের খোলা বারান্দায় উঠতেই থমকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। দেখেছিলাম, বাইরের ঘরের লাগোয়া ঘোট ঘরের জানালার ফাঁকে আলোর ইশারা। তার মানে ওঘরে? রাস্তা থেকেই দেখেছি বাইরের বৈঠকখানা ঘরের দরজা বন্ধ। সেটাই স্বাভাবিক। আমি একদিন ছাড়া ও-ঘরের দরজা খুলে ঢুকিনি। বসিরহাটের সেই ঘটনার পরে, এক দিন মাত্র বাড়ির ভিতর দিক থেকে, লাথি মেরে বাইরের হুড়কো ভেঙে ঢুকেছিলাম। এক বার দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল কী আছে সেই ঘরে।
কিছুই ছিল না, গুচ্ছের প্লাস্টিকের দড়ি আর ফিতা আর কিছু পুরো বা অর্ধেক তৈরি ঝুড়ি বা ব্যাগ, এক জানালায় কিছু কাচের চুড়ি, কপালের টিপ, তক্তপোশের বিছানার তলায় একজোড়া শাড়ি আর একটা ব্লাউজ, একটা কাঠের বাকসে কিছু হোমিওপ্যাথি ওষুধ! দেওয়ালের র্যাকে টাঙানো বাবার কয়েকটা জামা কাপড়। কিছু কাগজপত্রের গোছর মধ্যে হাতড়ে খুঁজেছিলাম, বিশেষ কোনও লোক বা ঠিকানা লেখা আছে কি না। সে রকম কিছুই ছিল না। সবই কলকাতার প্লাস্টিক কারখানা আর ঝুড়ি ব্যাগের পাইকারি দোকানের হিসাবপত্র। খুকুকে নিয়ে বসিরহাট থেকে ফেরার পরদিনই দাদু যে-চিঠিটা বাবাকে লিখেছিলেন সেটা দেখবার খুব ইচ্ছা ছিল। পাইনি।
আমি খোলা বারান্দা থেকে সাইকেল নিয়ে, থাম ঘেরা ছাদ আঁটা বারান্দায় উঠেছিলাম। প্রথমেই আমার চোখ পড়েছিল বাইরের ঘরের দিকে। দেখেছিলাম দরজাটা খোলা, একটা কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। তার মানে…। না, আমি আর কিছু না ভেবে মায়ের ঘরের সামনে দেওয়ালের গায়ে সাইকেলটা ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। আর সেই মুহূর্তেই মায়ের ঘরের দরজা খুলে গিয়েছিল। ঘরের ভিতরের আলো বারান্দায় এসে পড়েছিল। থামের খাঁজে পায়রার পাখা ঝাপটানোর শব্দ শোনা গিয়েছিল। আমি মায়ের ঘরের দিকে তাকিয়েছিলাম, দেখেছিলাম মা ঘরের দরজার সামনে এসে আমার দিকে তাকিয়েছিল, কিন্তু কথা বলতে পারছিল না। আমি মায়ের চোখের দিকে দেখেছিলাম। বসিরহাটে বাবাকে দানপত্র লিখে দেওয়ার খবর শুনে, মায়ের চোখ দুটো যেমন মরা মানুষের মতো দেখিয়েছিল, ঠিক যেন সেই রকম দেখাচ্ছিল। আমার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল, হাত পায়ের পেশি কঠিন হয়ে উঠেছিল। আমার বুকে দপ করে জ্বলে ওঠা আগুন নিশ্চয় আমার চোখেও দপদপিয়ে উঠেছিল। মাকে আমার আর কিছুই জিজ্ঞেস করার দরকার ছিল না। আমি বাইরের ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম।
কিন্তু বাইরের ঘরের দরজা পর্যন্ত আমাকে যেতে হয়নি। তার আগেই পাশের ঘরের খোলা দরজায় আমার চোখ পড়েছিল। আমি থমকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। জানি না, মানুষ এ সংসারে কত অবাক কাণ্ড দেখতে পারে! আমি দেখেছিলাম বাবা খালি গায়ে লুঙ্গি পরে একটা আলগা উনোন ধরাবার চেষ্টায় খুঁটে ভেঙে দিয়ে কেরোসিন তেল ঢেলে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়েছে। ঘরের ভিতর চল্লিশ বা ওই রকম কোনও পাওয়ারের আলো জ্বলছিল। বাবা আমাকে দেখতে পাচ্ছিল না, উনোন ধরাতেই ব্যস্ত ছিল। আমি দেখছিলাম বাবার বেশির ভাগ পাকা চুল মাথাটা উশকো খুশকো, যেন অনেক দিন কাটা হয়নি। ঘাড়ের কাছেও চুল বেয়ে পড়েছিল। খালি গা শরীরটা যেন কিছু রোগা দেখাচ্ছিল, যদিও তার বরাবরের সুপুরুষ চেহারাটি যথেষ্ট ভোগীর মতোই দেখায়।
আমি কোনও শব্দ না করে ঘরে ঢুকেছিলাম। আমার নিজেকেই তখন নিঃসাড়ে শিকার ধরা বাঘের মতো মনে হচ্ছিল। যেন ঝাঁপিয়ে পড়ব আর ছিঁড়েখুঁড়ে মানুষটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলব। কিন্তু বাদ সেধেছিল ঘরের আলোটা। সেটা দরজার ভিতর মাথার ওপরেই ছিল আর আমার ছায়া পড়েছিল। উনোনের ওপর। বাবা চমকে ফিরে তাকিয়েছিল। তার বড় বড় চোখের কোলগুলো যেন মাকড়সার ঝুল দিয়ে ঘেরা ছিল, আর চোখ দুটো স্বাভাবিকের থেকেও বড় দেখাচ্ছিল। খুঁটে তখন জ্বলতে আরম্ভ করেছিল। বাবা আমার চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়েছিল। স্পষ্ট দেখেছিলাম, বাবার চোখে ভয়, হাত পা পাথরের মতো হয়ে গেলেও গোরুর গায়ে মাছি বসলে যেমন তার চামড়া কেঁপে ওঠে, তেমনি তার মুখের আর গায়ের চামড়া যেন কেঁপে উঠছিল।
আমি এক পা এগিয়েছিলাম, বাবা এক পা পেছিয়েছিল। ঘরের একটাই দরজা। বাবার বেরোবার কোনও রাস্তা ছিল না। আমি তখন মনে মনে হিসাব কষছিলাম, দিদিমা আর তার শাশুড়ির পঞ্চাশ ভরির ওপরে সোনা, নগদ প্রায় তিরিশ হাজার টাকা, ইছামতীর ওপারে, ইস্ট পাকিস্তান বর্ডারের কাছাকাছি পঁচিশ বিঘা জমি বিক্রির টাকা। জলের দরে বিক্রি করলেও কম করে দশ হাজার টাকা। কেটেছিল তো মাত্র সাত মাস। তারপরে ওই চেহারা নিয়ে মানুষটা নিজের হাতে উনোন ধরাচ্ছিল। কিছু না হোক, যদি টোটাল অ্যামাউন্ট ষাট-পঁয়ষট্টি হাজার টাকাই ধরা যায়, সেই টাকা নিয়ে মাত্র সাত মাস পরে মানুষটা ওই চেহারা নিয়ে নিজের হাতে উনোন ধরাচ্ছিল?
দুদে! মা পিছন থেকে আমাকে ডেকে উঠেছিল।
বাবা দেওয়ালের কাছে সরে গিয়ে, প্রায় ভাঙা কিংবা গোঙানো স্বরে বলেছিল, আমাকে মারবি?
আমি প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করতে চেয়েছিলাম। হ্যাঁ, মারব। শুধু মারব না, তোমার ওই মুখ আমি জ্বলন্ত উনোনে গুঁজে ধরব আর দেখব তোমার সারা গায়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, তুমি জ্বলতে জ্বলতে পুড়ে মরছে৷’…কিন্তু সে সব কথা আমি বলিনি। আমি নিজেকে কতটুকুই বা চিনি? আমি কি ভেবেছিলাম, প্রথমেই যখন বাবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়িনি, আর আমি তার গায়ে কিছুতেই হাত তুলতে পারব না। গায়ে হাত তোলার ক্ষ্যাপামির ব্যাপারটা আমার জানা ছিল। এক বার থমকিয়ে গেলে আর পারা যায় না। আমি সেই যে মনে মনে হিসাব কষতে আরম্ভ করেছিলাম, ভাবতে আরম্ভ করেছিলাম, আর মনে মনে অবাক জিজ্ঞাসা জাগছিল, তখনই আমার ভিতর থেকে বাঘ হাওয়ায় উড়ে গিয়েছিল।
তবু আমি মায়ের দিকে ফিরে তাকাইনি, বাবার চোখ থেকে চোখ সরাইনি, অথচ কতগুলো জিজ্ঞাসা আমার ধারালো দাঁতের চাপে আটকিয়েছিল। কোথায় সেই টাকা? কী করেছ, সেই টাকা দিয়ে? কোথায় ছিলে সেই টাকা নিয়ে? কোন সাহসে তুমি এ বাড়িতে ফিরে এলে? ওই কথাগুলো আমার দাঁতের চাপে আটকিয়েছিল।
দুদে। মা আবার ডেকে উঠেছিল।
আমি মায়ের দিকে ফিরে প্রচণ্ড জোরে গর্জন করে উঠেছিলাম, চুপ করে চলে যাও এখান থেকে। আবার ফিরে তাকিয়েছিলাম বাবার দিকে। গোরুর গায়ে মাছি বসার মতো তার মুখ আর গায়ের চামড়া কেঁপে উঠছিল। কিন্তু আমি একটা কথাও বলতে পারিনি। আঘাত করা তত দূরের কথা। বরং চিৎকার করে উঠে বাবার দিকে একবার দেখেই পিছন ফিরে মাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। আমি কী করব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কোনও কথাও আমার মুখে আসছিল না। কেবল সারা শরীরে যেন একটা যন্ত্রণা পাক খাচ্ছিল। খুকুর কথা আমার মনে পড়েছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে। সাইকেলটা নিয়ে আমি আবার খোলা বারান্দা দিয়ে বাগানের দরজা দিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম। প্যাডেলে পা দিয়ে সাইকেলে ওঠবার আগেই আমার মুখের ওপর টর্চের জোরালো আলো পড়েছিল। আমি হাত তুলে চোখ ঢাকা দিয়ে হুংকার দিয়েছিলাম, কে?
আমি জটাই রে দুদে।টর্চটা নিবে গিয়েছিল, আবার শোনা গিয়েছিল, আমি নকুল আর বুলে, তোর কাছেই যাচ্ছিলাম। তুই এখন কোথায় বেরোচ্ছিস?
আমার তাস খেলার বন্ধুর দল। ওই সময়ে ওরা রোজই তাস খেলতে আসত। আমি চট করে কিছু জবাব দিতে পারছিলাম না। বোধ হয় জটাইয়ের হাতেই আবার টর্চ জ্বলে উঠেছিল, কিন্তু আলো আমার মুখে ফেলেনি। গায়ের ওপর ফেলেছিল। নকুলের গলা শোনা গিয়েছিল, দুদের মেজাজটা বিগড়ে আছে মনে হচ্ছে?
আমি স্থির করতে পারছিলাম না, ওদের চলে যেতে বলব কি না। বুলে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, দুদে, তুই কি এখন জোড়াদিঘি পাড়া চললি নাকি?
নকুল বোধ হয় খিক করে একটু হেসে উঠেছিল। আমার আর খুকুর কথা, ওদের কারোরই জানতে বাকি ছিল না। বুলের কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল, ওরা এসে না পড়লে সেই রাতে তখন আমি জোড়াদিঘি পাড়াতেই যেতাম। জটাই আবার জিজ্ঞেস করেছিল, কীরে দুদে, চুপ করে আছিস কেন? কোথাও কোনও দরকারে বেরোচ্ছিস নাকি?
জানি না, আমার মাথার ঠিক ছিল কি না, আমি বলেছিলাম, না, কোথাও যাব বলে বেরোইনি। তোদের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে বাড়িতে ভাল লাগছিল না।’
কী বলছিস দুদে? আমরা তো সময়মতোই এসেছি ।নকুল বলেছিল।
জটাই ওর টর্চের আলো দিয়ে কবজির ঘড়ি দেখে বলেছিল, সাতটা কুড়ি, দেরি কোথায়?
আমি কথা না বাড়িয়ে বলেছিলাম, কী জানি মনে হচ্ছিল তোরা আসতে দেরি করছিস। চল, ভেতরে যাওয়া যাক।
ওদের তিনজনের মাথায় দুটো ছাতা ছিল। জটাই বলেছিল, আমি টর্চ নিয়ে আগে ঢুকি।
আমি ওদের পিছনে পিছনে ঢুকেছিলাম। ওরা বারান্দায় ঢুকে, ছাতা বন্ধ করেছিল। নকুল এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ির আলোর সুইচটা টিপে দিয়েছিল। ওদের অন্য কোনও দিকে খেয়ালই ছিল না। কেবল জটাই সিঁড়ির দিকে যেতে গিয়ে মায়ের আলো জ্বালানো দরজা খোলা ঘরের দিকে এক বার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কাকিমা আজ একলা নাকি?
মায়ের জবাব এসেছিল ঘরের ভিতর থেকে, হ্যাঁ, আজ এখনও কেউ আসেনি।
আমি সিঁড়ির নীচে সাইকেলটা লক করে, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দেখেছিলাম, বাইরের ঘরের পাশের ঘরে আলো জ্বলছে, ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে ঘরের বাইরে। বুঝতেই পেরেছিলাম, কাকি জেঠি যারা মায়ের কাছে এসেছিল, মা তাদের সবাইকে কিছু বলে ফিরিয়ে দিয়েছে। তারাও হয়তো বাবার বাড়ি আসা টের পেয়েছিল আর একটা কিছু গোলমালের ভয়ে চলে গিয়েছিল। পরে আমার ধারণাটা মিলে গিয়েছিল যখন মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। বিতির কথা তখন আমার মাথায় ছিল না। আসলে ওই সময়টা ও পাশের খুড়তুতো বোনদের সঙ্গে পড়তে যেত। কিন্তু আমি নিজের কথা ভেবেও অবাক হয়েছিলাম, কারণ তাস খেলতে বসে আমি যেন মনে করতেই পারছিলাম না, কিছুক্ষণ আগেই কী ঘটে গিয়েছিল। বা কী ঘটতে পারত। বরং আমি অন্য দিনের তুলনায় ভালই খেলেছিলাম। যদিও আসলে আমি ভুলিনি কিছুই।
ভুলিনি কিছুই কিন্তু বাবাকে আমি, মাকে ঠকিয়ে দানপত্রে সই করিয়ে সোনা টাকা আর জমি বিক্রির টাকা আত্মসাতের কথা অনেক কাল জিজ্ঞেস করিনি। জিজ্ঞাসাও ঠিক বলা চলে না, চার বছর বাদে কথা কাটাকাটির মুখে, তার জোচ্চোরির কথা ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। অথচ জানতাম করার কিছুই ছিল না। মায়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, সাত মাস পরে সেই বর্ষার দিনে বাবা বিকাল নাগাদ বাড়ি ফিরে এসেছিল, হাতে ছিল কেবল একটি সুটকেস। প্রথমে রাস্তার দিক থেকে তালা খুলেই বাইরের ঘরে ঢুকেছিল। দেখেছিল বাড়ির ভিতরে ঢোকার দরজাটার হুড়কো নেই। বাড়ির ভিতর থেকে তালা বন্ধ। তখন দরজায় ঠকঠক শব্দ করে বিতির নাম ধরে ডেকেছিল। মায়ের কথানুযায়ী বাবার গলার স্বর শুনে মা আর বিনতিদুজনেই নাকি ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বিকালটাও ছিল মেঘে ঢাকা অন্ধকার আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। মা আর বিনতি দুজনেই ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে বারান্দার আলোটা জ্বেলে দিয়েছিল। বিনতিজিজ্ঞেস করেছিল, কে?
বাইরের ঘরের ভিতর থেকে বাবার গলা শোনা গিয়েছিল, আমি রে। এ ঘরটা আবার ওদিক থেকে বন্ধ করলে কে?
মা বা বিনতি হঠাৎ কোনও জবাব দেয়নি৷ মা ঘরের থেকে তালার চাবি এনে বিতির হাতে দিয়ে আবার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। বিনতি দরজা খুলে দেখেছিল, বাবা সুটকেস হাতে দাঁড়িয়ে। আলো জ্বলছিল, পাখা চলছিল, ঘর থেকে ভ্যাপসা গন্ধ বেরোচ্ছিল। বাবা বিনতিকে জিজ্ঞেস করেছিল, এ দরজার হুড়কোটা কোথায় গেল?’ বিনতি ভয়ে জবাব দিয়েছিল, আমি জানি নে।বাবা এ বিষয়ে আর কিছু না জিজ্ঞেস করে বলেছিল, আমাকে একটু চা করে দে তো।
বিনতি মাকে গিয়ে বলেছিল, আর বাবাকে চা করে দিয়েছিল। বাবা চা খেয়ে বাথরুমে গিয়েছিল। ফিরে এসে মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমাদের রাতের রান্না কি হয়ে গেছে?
মা নাকি প্রথমটা জবাব দিতে চায়নি, অন্তত আমাকে তা-ই বলেছিল। বিনতিজবাব দিয়েছিল, রান্না হয়ে গেছে। বাবা আবার বলেছিল, আমার জন্যও রান্না করতে হবে। মা তখন জবাব দিয়েছিল, দুদে না এলে আমি রান্নাটান্না কিছু করতে পারব না।
অ! বাবা বলেছিল, তবে থাক, আমার জন্যে রান্না করতে হবে না।
মা বোধ হয় তার জীবনে, ওই রকম কঠিন কথা বাবাকে আর কখনও বলেনি। আসলে আমার দোহাইটা কিছু না, এক বছর আগে থেকেই, বাবা আলাদা খেতে আরম্ভ করেছিল। কারণ হিসাবে বলেছিল, মায়ের হাতের রান্না নাকি বাবার ভাল লাগে না। মেয়েরা অনেক কিছু সহ্য করতে পারে, কতগুলো বিষয় একেবারে পারে না। খারাপ রান্নার অভিমানটা মায়ের মনে ছিল, তা-ই আমার নাম করে ওই রকম স্পষ্ট জবাব দিতে পেরেছিল। তারপরে বাবা নিজেই রাস্তার ধারের দোকান থেকে চাল। ডাল তেল নুন ইত্যাদি সব কিনে এনে রান্নার জোগাড়ে বসেছিল, যদিও শেষপর্যন্ত রান্না করে উঠতে পারেনি। জ্বলন্ত ঘঁটের ওপর কয়লা চাপাবার পরেই উনোন আর ধরেনি। তা ছাড়া সাত মাস বাদে, কোথায় সব হড়িকুড়ি ডেকচি ঢাকনা, খুঁজে পাওয়াও সম্ভব ছিল না। যে দরিদ্র সদগোপ বউটি বাবার রান্না করে দিত, বৃষ্টি বাদলায় তাকে খুঁজে আনাও সম্ভব ছিল না। বিনতিলুকিয়ে দেখেছিল, বাবা দোকান থেকে মিষ্টি আর দই কিনে এনে খেয়েছিল। দেখে ওর মনে কষ্ট হয়েছিল।
কিন্তু আমি জানতাম, মায়ের হাতের রান্না খেতে ভাল না লাগাটা বাবার একটা মিথ্যা বাহানা। অনেক কাল থেকেই বাবা মায়ের হাতে খেয়ে এসেছিল, তারপরে বাবার মনে সন্দেহ জেগেছিল মা হয়তো তাকে বিষ খাওয়াতে পারে। কথাটা আমি কারোকে–এমনকী, মাকেও কখনও বলিনি, তবে এটাই আমার সন্দেহ। কারণ আমি মনে করি বাবা জ্যাঠামশাইকে খুন করেছিল, বসিরহাটের দাদুকেও সম্ভবত কয়েকদিন পেটে বিষ ঢুকিয়েছিল। এ সব লোক অন্য কারোকে বিশ্বাস করতে পারে না। বিশেষ করে মাকে, যাকে সে সব দিক দিয়ে তিলে তিলে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। তা না হলে রাতারাতি এমন কিছু ঘটেনি মায়ের রান্না খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অথবা আর একটা কারণও হতে পারে, বাবা নিজেকে। আমাদের কাছ থেকে আলাদা করে নিয়েছিল। কিন্তু আলাদা তো ছিলই, কেবল মায়ের রান্না করা খাবারটা বাইরের ঘরে বসে খেত।
বাবা অবিশ্যি পরের দিনই সদগোপ বউটিকে ডেকে নিয়ে এসেছিল। বউটির নাম ছিল লক্ষ্মী, বাবা তাকে ওই নামেই ডাকত। তার বয়স ছিল চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের মধ্যে, কোলে চিরকালই একটা করে বাচ্চা মেয়ে দেখেছি। ছটি-সাতটি মেয়ের সে মা। স্বামীটি ছিল বাউণ্ডুলে, মাঠে-ঘাটে কিংবা ঘরামির কাজ করত, কারণ নিজেদের জমি ছিল না। তার ওপরে লোকটি নেশাভাও করত। কিন্তু লক্ষ্মী ছিল সব সময়ই হাসিখুশি, মাথায় ঘোমটা টানা, কপালে বড় সিঁদুরে টিপ। তাকে নিয়ে আমাদের কারোও কোনও মাথাব্যথা ছিল না। সে দু বেলা বাবার রান্না করে দিয়ে চলে যেত, আর নিজের খাবার বাড়ি নিয়ে যেত।
প্রায় সাত-আট দিন বাবাকে প্রায় বাইরের ঘরে বসে থাকতেই দেখেছিলাম, আমি লক্ষ রাখছিলাম, কারণ, আমার সত্যি কৌতূহল ছিল, ষাট-সত্তর হাজার টাকা সত্যি সাত মাসে ফুকে দিয়েছিল, নাকি টাকা নিয়ে অন্য কোনও মতলবে ছিল। কিন্তু সাত-আট দিন পরে বাবা যেদিন প্রথম বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, আমি পাড়ার মুদি দোকানের মালিক হারুকাকার কাছে জানতে পেরেছিলাম, বাবা চাল ডাল আটা তেল নুন থেকে সবই ধারে নিয়ে চালাচ্ছিল। আমি অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, বাবার সেটা কোনও স্টান্ট কি না। মাকেও বলেছিলাম। মা জবাব দিয়েছিল, বরাবরই তো ওই রকম করে এসেছে।
আমার মাথাটা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছিল। আমি জীবনে একসঙ্গে দু-চার হাজার টাকা হাতে করিনি, আর একটা লোক কম করে লাখ তিনেক বা তারও বেশি টাকা উড়িয়ে দিয়ে তারপরে পাড়ার মুদি দোকানে ধার করে চালাতে পারে কেমন করে? টাকা ওড়াবার ব্যাপার বুঝতে পারি, তারপরেই একেবারে ভিখিরির দশা, এমন লোকের মতিগতি আমি কিছুই বুঝতে পারি না।
মাসখানেকের মধ্যেই দেখেছিলাম বাবা কলকাতা থেকে আবার প্লাস্টিকের দড়ি ফিতে কাঁধে বয়ে আনতে আরম্ভ করেছিল। নিজের হাতে ঝুড়ি ব্যাগ বোনা ছাড়াও আস্তে আস্তে আবার মেয়েদের দল জুটতে আরম্ভ করেছিল। বাবা নিজের হাতে সবাইকে কেবল বোনা শেখাত না। রং তুলি দিয়ে বেশ নজর কাড়ানো রং-বেরঙের ঝুড়ি ব্যাগ আঁকত আর সেই রকম করেই সব বোনা হত। বাবা নিজেই ফিনিশ মালের বোঝা কাঁধে নিয়ে কলকাতায় পাইকারকে বিক্রি করে আসত। ছ মাসের মধ্যে কারখানা বেশ জমে উঠেছিল। একটা গোখরো সাপের দাঁতের বিষ নিংড়ে নেবার পরে সে যেমন কিছুকাল নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে, বাবা কিছুদিন সেই রকম ছিল। তারপরেই আবার দাঁতে বিষ জমতে আরম্ভ করার মতো বাবা আবার নিজ মূর্তি ধারণ করেছিল। লক্ষ্মীকে রান্নার কাজ থেকে বিদায় দেওয়া হয়েছিল। কারখানারই একটি বাইশ-চব্বিশ বছরের মেয়ে যার বেশ রং-ঢং আছে, চেহারাটিও বেশ ভাল, সে-ই কারখানার কাজের ফাঁকে বাবার রান্না করত। সাত মাস পরে ফিরে আসা বাবার সেই ভেঙে পড়া উঞ্ছ চেহারাটি আবার বেশ চেকনাই দিয়েছিল, সেই সঙ্গে বাইরের ঘরে নতুন আসরটিও বেশ ভাল জমে উঠেছিল।
আমি সব ব্যাপার দেখে, ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিলাম। কারখানার প্রত্যেকটা মেয়েই ছিল আমার চেনা, কারণ আমাদের এলাকারই আশেপাশের মেয়ে সব। আগে তাদের দু-একজনকে আমি ট্রেনে চাল পাচার করতে দেখেছি। কিন্তু আসলে তাদের জীবিকা ছিল আলাদা। প্রত্যেকটা মেয়ে বউয়েরই নানা রকম দুর্নাম ছিল। আমার বন্ধুরাও তাদের চিনত। বাইরে থেকে দেখলে, তাদের খেটে-খাওয়া গরিব মেয়ে বলেই মনে হত, কিন্তু তারা সকলেই আসলে আরও কিছু করত। অন্তত দুটি মেয়েকে আমি কয়েক বার বাজারের পিছনের পাড়ায় চলাফেরা করতে দেখেছি। সেখানে তাদের কোনও ঘর ছিল কি না, দেখিনি। একটি মেয়েকে দুপুরের দিকে প্রায়ই সেজেগুজে কলকাতায় যেতে দেখেছি, কী কারণে যেত তাও শুনেছি।
অবিশ্যি জানি, এখন আরও বাড়াবাড়ি হয়েছে। আমাদের এই অঞ্চল থেকে অনেক মেয়েই কলকাতায় সেজেগুজে সকালবেলাতেই কাজের নাম করে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে রাত্রি নটার মধ্যেই। লোকের কাছে বলে তারা চাকরি করতে যায়। হ্যাঁ, এক রকম তাই, তবে চাকরি না; তারা কলকাতায় বিশেষ বিশেষ জায়গায় বেশ্যাবৃত্তি করতে যায়।…আহ্, খুকুর চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। না না, আমি সেই সব মেয়েদের কারোকেই কিছু বলতে চাই না, কারণ আমি জানি, তারা দায়ে পড়েই ও রাস্তায় গিয়েছে।
কিন্তু আমাদের বাড়ির মধ্যে বাবার ব্যাপারগুলো আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। আমি নিজের চোখেই দেখেছি দুপুরে রাস্তার দিকের দরজা বন্ধ করে দিয়ে দু-তিনটে মেয়ে–মেয়ে? মাগি বলাই ভাল, বাবার ঘাড়ের ওপর পড়ে তার গা হাত পা টিপে দিচ্ছে। এমনকী বাড়ির ভিতর দিকের দরজাটা বন্ধ করার কথাও যেন মনে থাকত না। আর আমি বর্ষার দিনে সেই রান্নাঘরের কথা ভাবতাম। আমার সামনে, যে বাবার মুখের আর গায়ের চামড়া গোরুর গায়ে মাছি বসার মতো কেঁপে কেঁপে উঠেছিল, তার সাহস দেখে। বাবা অবিশ্যি ভাবটা দেখাত, সে বয়স্ক মানুষ, মেয়েগুলো সব ছেলেমানুষ, একটু গা হাত পা টিপে দিলে এমনকী ক্ষতি আছে।
কিন্তু আমি তো মহাশয়কে চিনতাম। আমার চৌদ্দ বছর বয়স থেকে চেনা। দুপুরে মাঝে মাঝে ভিতর দিকের দরজাও বন্ধ হয়ে যেত। সেই সময় যে কী ঘটত দেখতে না পেলে অনুমান ঠিকই করতে পারতাম। বিশেষ করে মেয়েদের হাসি যখন কানে আসত। শুনেছি একটা বাঁদরের ঝুঁকের মধ্যে একটাই পুরুষ বাঁদর থাকে, বাকিগুলো সবই বাঁদরি। বাবার ব্যাপারস্যাপার দেখে আমার সেই রকম মনে হত। লক্ষ করেছিলাম, মায়ের মুখও অন্ধকার হয়ে থাকত। বিনতিবলত, এ ঘরটার দিকে আমার তাকাতে ইচ্ছে করে না।’…
তারপরেও আমি ভাল করেই লক্ষ করে দেখেছি, সন্ধ্যার পরে কোনও কোনও রাত্রে দলের যে কোনও একটি মেয়ে বাইরের ঘরে থেকে যেত। বাবা মনে করত, কেউ কিছু টের পায় না। সবাই যে যার কাজ করে চলে গিয়েছে, বাবা একলা পড়ে আছে। পরের দিন কারও ঘুম ভাঙার আগেই দেখা যেত একটি মেয়ে সকলের আগে কাজে এসেছে। আসলে সারা রাত থাকার ভানটা ওই ভাবে করত। যে-মেয়েটা রান্না করত প্রায় দিনই তাকে দেখা যেত সে সকলের আগে কাজে এসেছে। অর্থাৎ রাত্রে। থাকতে হলে সে-ই বেশি থাকত।
অনেক দিন রাত্রেই আমার মনে হয়েছে, বিশেষ করে যেদিন সন্দেহ হত ঘরের মধ্যে কোনও মেয়ে রয়েছে, লাথি মেরে ঘরের দরজা ভেঙে ফেলি, আর সবাইকে ডেকে দেখাই। কিন্তু আশ্চর্য, দাতে দাঁত পিষেছি, হাত নিশপিশ করেছে, তবু কিছুতেই দরজায় লাথি মারতে পারিনি। কেন? আমার তো কোনও ভয় ছিল না। তবু কেন পারিনি? জানি না, সত্যি জানি না, যেমন আমি নিজেকেই জানি না। অথচ রাগে ফুসতাম, আবার কেমন যেন ক্যালাস মেরে যেতাম।
তারপরেই তো এসেছিল সেই দিনটি। প্রথম যুক্তফ্রন্টের সময় মিনিস্ট্রি ফর্ম করার পরে আমাদের বাড়িতে পিকনিকের সেই দিনটি। তার আগেই অবিশ্যি প্ল্যানটা আমার মাথায় এসেছিল। আমি সমস্ত বাথরুম পাইখানায় তালা লাগিয়ে দিয়েছিলাম। বাবা পুলিশ ডেকে এনে সুবিধা করতে পারেনি। প্রথমে আমার নামে রটাতে আরম্ভ করেছিল, আমাদের বাড়ির বাইরে আশেপাশের জঙ্গলে পুকুরধারের বাঁদাড়ে মেয়েগুলো বাথরুম সারতে যাবে, আর দোতলার পুবের খোলা ছাদ থেকে আমি তাদের ল্যাংটো মূর্তিগুলো দেখব বলেই ওই রকম একটা প্ল্যান করেছিলাম। সত্যি কথা বলতে কী, দোতলার খোলা ছাদের শেষ প্রান্তে বাথরুমে যেতে গিয়ে, কোনও সময়ে যে মেয়েগুলোকে কখনও বেআবরু অবস্থায় চোখে পড়েনি, তা না। কিন্তু সে সব আমি ইচ্ছা করে কোনও দিনই দেখিনি। আমাদের দোতলার পুবের খোলা ছাদে দাঁড়ালে পাশে কাকাদের বাড়ির অন্দর মহল থেকে শুরু করে আশেপাশের বন বাদাড় পুকুর অনেক কিছুই চোখে পড়ে। বড় রাস্তা, আর গাড়ি চলাচল, সবই দেখা যায়। পুবের লম্বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুব দিকের কয়েকটা বাড়ির ভিতরের অংশ চোখে পড়ে। কোনও দিন সে সব বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখবার দরকার হয় না। কারণ সকলেই চেনা।
তবে হ্যাঁ, মেয়েগুলো খুবই অসুবিধায় পড়েছিল কোনও সন্দেহ নেই, কারণ আমাদের বাড়ির বাইরে আশপাশ দিয়ে লোকজনেরা চলাফেরা করে। অনেকে রায়পুকুরে যাবার বা কাছাকাছি পাড়ার জন্য শর্টকাট হিসাবে আমাদের বাড়ির বাইরের বাগান বাঁদাড় পুকুর ধার দিয়েও যাতায়াত করে। সেই হিসাবে পাড়াগাঁয়ের নিরিবিলি বাবার কারখানার মেয়েগুলোকে, আচমকা বেআবরু অবস্থায় ত্রস্ত ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে হত। কেউ কেউ তো বেশ মজাই পেয়ে গিয়েছিল। আশেপাশের কিছু ঘুঘু, সময় বুঝেই আমাদের বাড়ির সীমানার বাইরে বাগানে বাঁদাড়ে ঢুকে পড়ত। অথচ এমন না যে, বিশেষ একটা সময়ে মেয়েরা বাইরে যেত। সকাল থেকে সন্ধ্যা, সারা দিনে তাদের কয়েক বারই যেতে হত, আর বুঝতে পারতাম, তারা বাবার কাছে গিয়ে নালিশ করত আর বাবা ক্রমশ আগুন হয়ে উঠছিল। আমি বুঝতে পারতাম খারাপ মেয়েরাও আড়ালে আবডালে বাথরুম সারতে গেলে লোকের চোখের সামনে উলঙ্গ হয়ে বসে থাকতে পারে না। তাদেরও লজ্জা শরম আছে। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না, কারণ বাবার সঙ্গে আপস করার কোনও প্রশ্ন ছিল না, মেয়েগুলোকে আমি সহ্য করতে পারতাম না।
সেই পিকনিকের সাত দিন বাদেই, নির্মলদের ফ্যাকটরিতে, ওর ডিপার্টমেন্টে আমি চাকরি পেয়ে গিয়েছিলাম। নতুন চাকরি আর ভবিষ্যতের আশা-অর্থাৎ খুকুকে বিয়ে করার চিন্তায় আমি মনে মনে বেশ মেতে গিয়েছিলাম। চাকরির দু সপ্তাহ পরের রবিবারের সকাল দশটা নাগাদ থানা থেকে সেই সাব ইনসপেক্টর এসেছিল সকাল নটায়। নীচে মা আর বিতির সঙ্গে চা খেয়ে গল্পগুজব করে ওপরে এসেছিল। চাকরি পাওয়ার পরে বিয়ের আগে পর্যন্ত প্রত্যেক রবিবারই ও সকালে আমাদের বাড়ি আসত। তারপরে আমি ওদের বাড়ি যেতাম। দুপুরে বাড়ি ফিরে খেয়ে আবার খুকুকে নিয়ে কলকাতায় যেতাম, সিনেমা থিয়েটার দেখতাম। সেই ভাবে প্রায় পাঁচ মাস কেটেছিল, তারপরে বিয়ে।
চাকরি পাওয়ার সেকেন্ড রবিবারে থানার এস আই যখন এসেছিল, তার আগে খুকুর সঙ্গে আমি কেবল কথা বলিনি। আসলে কথা আমাদের ফুরিয়ে গিয়েছিল। নিরালায় দেখা হলে আমি ওকে আগেই বুকের কাছে টেনে নিতাম। খুকু ব্যস্ত হয়ে ছটফট করত, কিন্তু নিজেকে পুরোপুরি ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা কখনওই করত না। ওর ছটফটিয়ে ওঠা আর ব্যস্ততা, অথচ আমার বুকের কাছে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখা আমাকে যেন আরও অস্থির করে তুলত। অস্থির? আসলে পাগল করে তুলত। তা ছাড়া ওর হাসি, আর তাকানোর মধ্যে এমন কিছু ছিল, সামনে এসে দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে এমন একটা কিছু ছিল, দুহাত যেন আপনা থেকেই ওকে জড়িয়ে ধরবার জন্য এগিয়ে যেত।
যাই হোক, চাকরির সেকেন্ড রবিবারে আমাদের সেই পালাটা চুকে গিয়েছিল। তারপরে আমি দাড়ি কামাতে শুরু করেছিলাম। খুকু গোটা দোতলার বারান্দায়, কখনও দক্ষিণের ঘরের কোলের বারান্দায়, অথবা পুবের খোলা ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ওই সময়টায়, খোলা ছাদের আলসেয় দাঁড়িয়ে নারকেল গাছের পাতা ধরে টানত। কাকাদের একটা পেয়ারা গাছের ডাল আমাদের ছাদে এসে পড়েছিল। খুকু পেয়ারা ছিঁড়ে নিত, অবিশ্যি যদি থাকত আর ছেলেমানুষের মতো ছুটে এসে আমাকে দেখাত, বলত, তোমাকে তা বলে দেব না।
আমি হাসতাম আর আমার বুকের মধ্যে রক্তে যেন ছলাৎ ছলাৎ করে বাজত। কিন্তু খুকু আমাকে, ওর কামড়ানো পেয়ারায় একটা কামড় বসাতে দিত। সেই সেকেন্ড রবিবারেও ও একটা পেয়ারা খুঁজে পেয়েছিল, আর বারান্দায় ছুটে এসে আমাকে দেখিয়েছিল, বেশ বড় আর পাকা পেয়ারা। আমি দোতলার বারান্দায়, থামের গায়ে পেরেকে ঝোলানো একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাচ্ছিলাম। খুকু আমার মুখের সামনে এনে পেয়ারাটা দেখিয়ে ছোট মেয়ের মতো খুশিতে বলে উঠেছিল, দেখেছ, কত বড় পাকা পেয়ারা।
কাকা কাকিমা বা বউদিরা দেখতে পেলে তোমাকে চোর বলবে। আমি সেফটি রেজারটা গাল থেকে তুলে নিয়ে বলেছিলাম।
খুকু ঘাড় বাঁকিয়ে বলেছিল, ইস, বললেই হল? আমাদের ছাদে গাছ কেন এসে পড়েছে?
আমাদের ছাদে কথাটা খুকুর মুখে শুনে আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠেছিল। ও তা হলে আমাদের বাড়িটাকে তখনই নিজের বাড়ি বলে ভাবতে আরম্ভ করেছিল। আমি বলেছিলাম, ও রকম পাকা গদগদে নরম পেয়ারা আমার ভাল লাগে না। বেশ ডাসা আর দাঁত বসিয়ে খাওয়া যায়, এমন পেয়ারা আমার ভাল লাগে।
অসভ্য! খুকু বলে উঠেছিল, আর ওর এমনিতেই লাল-ফরসা মুখটা আরও যেন লাল হয়ে উঠেছিল, আর ঘাড় কাত করে কালো চোখে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে, বুকের আঁচলটা অকারণ টেনে দিয়েছিল।
আমি প্রথমটা অবাক চোখে খুকুর দিকে তাকিয়েছিলাম, আর আমি কিছু বলবার আগেই ও ঘাড় আঁকিয়ে বলেছিল, খুব ভঁসা পেয়ারা খাবার লোভ, না?
আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলবার আগেই ও আবার বুকের আঁচলটা টেনেছিল, আর বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো কথাটা আমার মাথায় ঝলকিয়ে উঠেছিল। আমি হেসে উঠে বলেছিলাম, বিশ্বাস কর, আমি ও কথা ভেবে কিছু বলিনি।
খুকু শরীরে একটা ঢেউ দিয়ে, ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার আমার দিকে ফিরেছিল, যাক, আর সত্যি কথা বলতে হবে না।
কিন্তু আমি ওর বুকের দিকে তাকিয়েছিলাম। আর ওকে হাত বাড়িয়ে ধরবার জন্য মনটা ছটফট করে উঠেছিল। খুকু বুঝতে পেরেই যেন সরে গিয়েছিল, আর আমার ছটফটানির মধ্যেও মনে একটা জিজ্ঞাসা জেগে উঠেছিল, খুকু ভঁসা পেয়ারার কথায় ওই রকম ভাবতে শিখল কেমন করে? মেয়েদের বিষয়ে ডাসা বললে একটা কথাই বোঝায় সেই হিসাবে খুকুকেও হয়তো সেই সময়ে তা-ই বলা যেত, কিন্তু আমি ওকে কখনও সেই চোখে দেখিনি। আমার মনের অবস্থাটা অদ্ভুত হয়েছিল। এক দিকে খুশি অন্য দিকে কেমন একটা খচখচানি। তবু আমি হেসে উঠেছিলাম, আর তখনই নীচে থেকে বিতির কেমন এক রকম ভয় ভয় স্বরের ডাক ভেসে এসেছিল, সেজদা একবার নীচে আয়।
বিনতির কথা শেষ হতে না হতেই, সিঁড়িতে আমি জুতো খটখটিয়ে কারও উঠে আসার শব্দ পেয়েছিলাম। মুখে ক্রিমের ফেনা লাগানো, হাতে সেফটি রেজারটা নিয়ে আমি সিঁড়ির কাছে গিয়েছিলাম, আমার পিছনে ছিল খুকু। দেখেছিলাম, থানার এস আই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছে। কী ব্যাপার? শুধু অবাক না, আমার রাগও হয়েছিল এস আই-কে ওপরে উঠে আসতে দেখে। আমি রুক্ষ স্বরে বলে উঠেছিলাম, কী ব্যাপার, বলা নেই কওয়া নেই, আপনি যে একেবারে ওপরে উঠে আসছেন?
আমার কথা শুনে, আর আমার দিকে তাকিয়ে, এস আই সিঁড়ির মাঝপথেই থেমে গিয়েছিল, মুখে ফুটে উঠেছিল অপ্রস্তুত হাসি, বলেছিল, আপনার বাবা বললেন, আপনি ওপরে আছেন, তা-ই।’
তা-ই আপনি একেবারে ওপরে উঠে এলেন? আমি রীতিমতো রুখে উঠেই বলেছিলাম, বাড়ির একটা অন্দর-বার বলে কথা আছে, তা কি জানেন না?
এস আই আমার পিছনে খুকুকে দেখে আরও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল, আর খুকুকে দেখে সে কেবল অবাক হয়নি, যেন ভাবতেই পারেনি, আমার সঙ্গে খুকুর মতো একটি রূপসী মেয়ে থাকতে পারে। আমি আবার তাড়া দিয়ে বলেছিলাম, চলুন চলুন, নীচে চলুন। বলতে বলতে আমিও সিঁড়িতে পা বাড়িয়েছিলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে খুকুকে বলেছিলাম, তুমি ওপরেই থাকো, আমি আসছি।
এস আই লোকটি সত্যি হতচকিত হয়ে গিয়েছিল, তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমেছিল। আমি পিছনে পিছনেই নেমেছিলাম। দেখেছিলাম, মা আর বিনতিবারান্দার বাঁ দিকের ঘরের দরজার কাছে। দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের চোখে মুখেই ছিল ভয়ের ছায়া। স্বাভাবিক। পুলিশ দেখলে বাড়ির লোকেরা ভয় পাবেই, কারণ পুলিশ মানেই খারাপ কিছুকে বলে অশুভ কোনও ব্যাপার। আমি ব্যাপারটা তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, কিন্তু এস আই-কে নিয়ে বাইরের ঘরে বসার উপায় ছিল না। আমি বিতিকে বলেছিলাম, বিতি, মায়ের ঘর থেকে টুলটা এনে দে তো ছোটবাবুকে।
এস আই একটু বেশ ব্যস্ত হয়েই বলেছিল, না না, আমার জন্য টুল আনতে হবে না, আপনার সঙ্গে আমার সামান্য একটা কথা ছিল। বলে সে সিঁড়ির দিকে তাকিয়েছিল।
আমিও সিঁড়ির দিকে তাকিয়েছিলাম, দেখেছিলাম, খুকু সিঁড়ির মাঝখানের বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর হাতে যে বড় পাকা পেয়ারাটা ছিল বোধ হয় খেয়ালই ছিল না। ওর চোখেও মা আর বিতির মতো জিজ্ঞাসা আর ভয়ের একটা ভাব ছিল। আমি মুখ ফিরিয়ে এস আই-কে বলেছিলাম, বলুন, কী বলতে চান।
এস আই যেন একটু অস্বস্তিতেই মা বিতি, সিঁড়ির ওপর খুকুর দিকে দেখে বলেছিল, চলুন না একটু ওদিকে যাই। সে বাগানের দরজার দিকে তাকিয়েছিল।
চলুন। আমি বলেছিলাম, আর বাইরের খোলা দরজা দিয়ে দেখেছিলাম বাবা তক্তপোশের ওপর বসে সিগারেট টানছে। মেয়েদের কয়েকটা মুখ দরজার কাছে উঁকি দিয়ে আমাদের দিকেই দেখছিল। আমি তাকাতেই ওদের মুখগুলো আড়ালে চলে গিয়েছিল।
এস আই থামের পাশ দিয়ে নিচু বারান্দায় নেমে বাগানের দরজার দিকে গিয়েছিল। আমিও তার পিছনে পিছনে গিয়েছিলাম। এস আই দরজার চৌকাঠে পা রেখে দাঁড়িয়েছিল। আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে একটু কেশে নিয়ে বলেছিল, কমলবাবু, আসলে আমি আপনাকে বলতে এসেছিলাম, সময় করে এক বার থানায় আসবেন, বড়বাবু আপনার সঙ্গে একটা কথা বলতে চান।
আর সে কথা বলার জন্য আপনি একেবারে ওপরে ধাওয়া করেছিলেন? আমি হেসেই বলেছিলাম, কিন্তু ব্যাপারটা কী, কেন ডেকেছেন বড়বাবু, আপনি কিছু জানেন না?
এস আই বলেছিল, জানি, একটা খুব বিশ্রী ব্যাপার ঘটেছে। আপনার বিরুদ্ধে একদল মেয়ে থানায় একটা পিটিশন করেছে।
থানায় পিটিশন? একদল মেয়ে?’ আমি যেন আপন মনেই কথাগুলো বলেছিলাম।
এস আই বলেছিল, হ্যাঁ, ইয়ে, মানে আপনার বাবার কারখানার মেয়েরা আপনার এগেনস্টে একটা দরখাস্ত দিয়েছে, আপনি তাদের ইয়ে মানে শ্লীলতাহানি করেছেন।
কথাটা শুনেই আমার মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠেছিল। আমি এক বার পিছন ফিরে থামওয়ালা বারান্দার দিকে দেখেছিলাম। মা বিনতি আর খুকু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আমাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু আমি নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলেছিলাম, তার জন্যে আমাকে থানায় ডেকে পাঠাবার দরকার কী? আপনাদের যা করার আপনারা করুন, আমার যা করার আমি করব।
এস আই বলেছিল, দেখুন কমলবাবু, এ সব হল স্ক্যান্ডালাস ব্যাপার। অ্যাকশন নেবার আগে বড়বাবু আপনার সঙ্গে এক বার কথা বলতে চান।
এর কী অ্যাকশন আপনারা নিতে পারেন, আমি জানি না।আমি বলেছিলাম, এ তো সবই প্রমাণের ব্যাপার।
এস আই বলেছিল, তা ঠিক, তবে বুঝতেই পারছেন একদল মেয়ে যদি থানায় দরখাস্ত করে সাহায্য চায়, সেটা থানাকে তো দেখতেই হবে।
তবে আপনারা তা-ই দেখুন গে, আমার কিছু বলার নেই। আমি বাড়ির ভিতরে যাবার জন্য মুখ ফিরিয়ে পা বাড়িয়েছিলাম।
এস আই যেন বিশেষ অনুরোধ করার মতোই বলেছিল। কিন্তু কমলবাবু, আপনি এক বার থানায় গিয়ে বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করবেন, আই রিকোয়েস্ট ইউ।
আমি ফিরে রোখা ভাবেই বলেছিলাম, কেন, পিকনিকের দিন বাবা যখন আপনাকে তালা দেবার কথা শুনিয়েছিল, আপনিই তো তখন বলেছিলেন, ও সব আপনাদের ঘরোয়া ব্যাপার, আপনারা যা ভাল বুঝবেন, তাই করবেন!
হ্যাঁ বলেছিলাম। এস আই বলেছিল, কিন্তু এখন ব্যাপারটা একটু অন্য রকম হয়ে গেছে। বুঝতেই পারছেন, একদল মেয়ে যদি শ্লীলতাহানির জন্য কারোকে দায়ী করে থানার সাহায্য চায়, সেক্ষেত্রে থানা চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। এখন ব্যাপারটা নিয়ে কী করা যায়, বড়বাবু সেটাই আপনার সঙ্গে ডিসকাস করতে চান।
আমার ক্রিমের ফেনা লাগানো মুখ ক্রমেই শক্ত হয়ে উঠছিল। দরজার সামনে রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছিল, সকলেই এক বার আমাদের দেখে যাচ্ছিল, আর নিশ্চয় নানা কিছু ভাবছিল। আমি বলেছিলাম, ঠিক আছে, আপনি যান, আমি ভেবে দেখি।
এস আই রাস্তায় নেমে গিয়েছিল। আমি বাড়ির ভিতরে বারান্দায় ফিরে গিয়েছিলাম, তাকিয়েছিলাম বাইরের ঘরের খোলা দরজার দিকে। বাবা নিস্পৃহ ভাবে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে সিগারেট টানছিল। আমি আগেই জানতাম মানুষটি চুপ করে থাকবার পাত্র না, নিশ্চয়ই মনে মনে কোনও মতলব আঁটছে। মা ব্যস্ত ত্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কী রে দুদে, কী ব্যাপার?
ব্যাপার আবার কী, ওই যে বসে আছেন নাটের গুরু। আমি হাত দিয়ে বাইরের ঘরের দিকে দেখিয়েছিলাম, ব্যাপার হচ্ছে ওঁর। ওঁর ওই নোংরা ছুঁড়িগুলোকে দিয়ে থানায় দরখাস্ত করিয়েছে, আমি নাকি ওদের শ্লীলতাহানি করেছি। তবে জেনে রাখা ভাল শ্লীলতাহানি আমি করব না, সবগুলোকে পিটিয়ে এ বাড়ি থেকে বের করে দেব। বাড়িতে বসে উনি মেয়েমানুষ নিয়ে যা খুশি তাই করবেন, সব মেনে নিতে হবে! ঠিক আছে, দেখা যাক, কার দৌড় কদ্দূর।
বাবা তক্তপোশ থেকে লাফ দিয়ে নেমে, জোর শব্দে বাড়ির ভিতর দিকের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি আবার চিৎকার করে বলেছিলাম, দরজা বন্ধ করে পার পাওয়া যাবে না, ওই মেয়েমানুষদের নিয়ে কোর্টে গিয়ে দাঁড়াতে হবে।
মা আমার হাত ধরে টেনে নিয়েছিল, চেঁচাসনে দুদে, শোন, ব্যাপারটা কী ঘটেছে, একটু বুঝিয়ে বল।
বুঝিয়ে আর কী বলব বলো?’ আমি চিৎকার করেই বলেছিলাম। প্রচণ্ড রাগে আর ঘৃণায় আমার একটা অসুর হয়ে উঠতে ইচ্ছা করছিল, বলেছিলাম, বললামই তো, ওই মেয়েমানুষগুলোকে দিয়ে আমার নামে থানায় দরখাস্ত করা হয়েছে, আমি নাকি ওদের শ্লীলতাহানি করেছি, বুঝেছ? মানে, আমি জোর করে ওদের সঙ্গে বদমাইশি করেছি, গায়ে হাত দিয়েছি!..’ আমি খুকুর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলেছিলাম, তোমার ভাবী শ্বশুরের চরিত্রটি এখন চিনছ তো? আর ওই লোকটাকে তুমি আবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম কর।
খুকুর হাতে তখনও প্রায় লালচে হলুদ রঙের বড় পেয়ারা। আমার কথা শুনে ও মুখ নিচু করেছিল।
ওকে ওইভাবে বলার কারণ ছিল। আমি জানি না, ও কেন বাবার ঘরে যায় বা কথা বলে। গত সপ্তাহেই বাবা ওকে বলেছিল, দুদেকে বলে দিয়ো, ও যদি বাথরুম পাইখানায় তালা খুলে না দেয়, বিপদে পড়বে।
মা বলেছিল, শোন দুদে, কী দরকার এ সব ঝামেলার? তালাগুলো খুলে দিলেই পারিস বাপু।
চুপ করো। আমি মাকে ধমকিয়ে উঠেছিলাম, এর পরেও যদি ওই সব মেয়েমানুষগুলোকে ঢুকতে দিতে হয়, তা হলে আমিই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।বলেই আমি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গিয়েছিলাম। দাড়ি কামাবার মতো মেজাজ তখন আর ছিল না, কিন্তু না কামিয়েও উপায় ছিল না। বারান্দার রেলিঙের কাছেই জলের বাটি আর ব্রাশ ছিল। আমি ব্রাশ ভিজিয়ে আবার গালে বুলিয়েছিলাম। থামের গায়ে ঝোলানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেফটি রেজার চালাতে চালাতে চোখের কোণ দিয়ে দেখেছিলাম, খুকু সিঁড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি ওর দিকে না তাকিয়ে গালে রেজার ঘষেছিলাম। ও আস্তে আস্তে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। দোতলার লাল চকচকে বারান্দায় আয়নার মতোই ওর গোটা শরীরের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছিল। আমার মাথার মধ্যে দপদপ করে জ্বলছিল, অথচ খুকুকে বকে মনের মধ্যে খচখচ করছিল, তবু ওর দিকে আমি ফিরে তাকাতে পারছিলাম না। আমার হাত কাঁপছিল আর তার ফলে যা হয়, মুখের কয়েক জায়গায় অল্পস্বল্প কেটে গিয়েছিল। আসলে আমি খুব তাড়াতাড়ি গালে রেজার চালাচ্ছিলাম। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই কামানো শেষ করে পাইপ দেওয়া নালির মুখের কাছে রাখা জলের বালতি থেকে মগে জল তুলে মুখ ধুয়েছিলাম। খুকু তখনও আয়নার কাছাকাছি থামের গায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি মুখ মোছর জন্য আমার ঘরে ঢোকবার আগে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম, আর থমকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। দেখেছিলাম, ওর কাজল না-মাখা দুই চোখের কোণে বড় বড় ফোঁটায় জল জমে উঠেছে। ওর সঙ্গে পরিচয়ের পরে কখনও ওর চোখে জল দেখিনি। আমার মনেই শুধু কষ্ট হয়নি, রীতিমতো থিতিয়ে গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি ওর কাছে গিয়ে বলেছিলাম, তুমি কাঁদছ? আমি–আমি তো তোমাকে সেভাবে কিছু বলিনি।
আমার কথার পরেই খুকুর চোখের কোণ থেকে জলের ফোঁটা গালে গড়িয়ে পড়েছিল। আমি ওর হাত ধরে ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম, বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলাম, প্লিজ খুকু, আমার অন্যায় হয়ে থাকলে ক্ষমা কর, কিন্তু আমার মনের অবস্থাটা এক বার ভাবো৷
খুকু কান্না জড়ানো ফিসফিস ভেজা স্বরে বলেছিল, সেটা কি ভাবছি না? কিন্তু আমি কি ইচ্ছে করে তোমার বাবার কাছে যাই? ওঁর সঙ্গে চোখাচোখি হলেই উনি হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে আমাকে ডাকেন। তা ছাড়া, উনি তো সত্যি আমার গুরুজন। কিন্তু কী করে জানব উনি তোমাকে নিয়ে ওইসব বিচ্ছিরি কাণ্ড করবেন?
আমি জানি খুকু, আমি জানি, তোমার কোনও দোষ নেই। আমি খুকুর মুখটা আমার বুকে চেপে ধরেছিলাম, একটু ঘষেও দিয়েছিলাম, যেন ওর চোখের জল আমার গেঞ্জিতে মুছে যায়। ওর চোখের জল দেখে আমার মনে একটা কষ্ট আবেগ, দুই-ই এমন কাজ করছিল, যেন অস্থির হয়ে পড়েছিলাম, আমি জানি, বাবাকে তুমি গুরুজন হিসাবে দ্যাখ, ডাকলে কাছে না গিয়ে পার না। কিন্তু লোকটা কত দূর যেতে পারে এক বার ভেবে দ্যাখ।আমি ওর একটা হাত আমার ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলাম। ওর গালে গাল ঠেকিয়েছিলাম।
খুকু ওর মুখটা একটু সরিয়ে কিছু বলার জন্য আমার মুখের দিকে তাকিয়েই চমকিয়ে উঠেছিল, ভয় পেয়ে বলেছিল, এ কী, তোমার মুখে এত রক্ত কীসের?
কেটে গেছে, দাড়ি কামাতে।’ বলে আমি খুকুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম, ওর গালের জলের সঙ্গে আমার রক্ত লেগে গোটা গালটাই রক্তারক্তি দেখাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে ওর গাল মুছে দিয়ে হাত দেখিয়ে বলেছিলাম, দ্যাখ কী কাণ্ড, আমার রক্ত তোমার গালে লেগে গেছে।
খুকু আমার মুখের কয়েক জায়গা থেকে আঙুল দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে বলেছিল, লাগুক, আমি ধুয়ে ফেলব। আমার তো কাটেনি, তোমার কেটেছে। ডেটল নেই?
আছে, লাগাব। বলেছিলাম, কিন্তু মুখ নামিয়ে অমি খুকুর ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলাম।
খুকুর লাল ঠোঁট আরও লাল আর ভেজা দেখাচ্ছিল, বলেছিল, আহ কী হচ্ছে? এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, তোমার দেখছি তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই, সোহাগ করতে আরম্ভ করলে।
আমি জানতাম, খুকু আদর সোহাগ একটু বেশি মাত্রায় পছন্দ করত। কারণ, এখন তো বুঝি, নিজের সম্পর্কে ওর একটা নির্ঘাৎ ধারণা ছিল, পৃথিবীর যে কোনও পুরুষ, যে কোনও সময়েই ওকে আদর সোহাগের জন্য লালায়িত। অবিশ্যি সেটাই বোধ হয় স্বাভাবিক নিজেকে দিয়ে বিচার করলে, ওর সেই ধারণাটাকে স্বীকার করতেই হয়। সংসারে সব সুন্দরী আর রূপসী মেয়েদেরই মাথায় বোধ হয় ওই ধারণাটা বদ্ধমূল হয়ে যায়। গায়ে গতরে গুচ্ছের মাংস জমতে আরম্ভ করে অথচ দেখতে শ্যাওড়া গাছের পেতনি, তাদেরই এমন গ্যাদা দেখেছি, খুকুর মতো মেয়েদের তো কথাই নেই। যাই হোক, খুকুর বলার মধ্যেই এমন একটা ভাব ছিল, আমি আবার একটা চুমো খেয়েছিলাম, আর তার জবাবে ও আমার ঠোঁটে একটু জোরে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল। হ্যাঁ, সিক্সটি সেভেনে আমরা সেই পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম। বসিরহাটের দাদুর বাড়ি থেকে ফেরার পরে, বাবা যে সব ঘটনা ঘটিয়েছিল, তখন থেকেই আমাদের প্রেমের জোয়ারে শরীরে শরীর জড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার মানে এই না, বিয়ের আগেই আমরা শরীরের সব রহস্য ভেদ করেছিলাম। যদিও আমি কানাইয়ের মুখে শুনেছিলাম–থাক সে কথা, কারণ সেটা আর একটা পর্ব। তবে সেই দিনটা বসিরহাটে বাবার কীর্তির সব জ্বালা ভুলিয়ে দিয়েছিল সে যেদিন আমি খুকুকে প্রথম। থাক এ সব প্রসঙ্গ। এ সব ঘটনা আমাকে এমন বদ জায়গায় নিয়ে যায়, মনে হয় তখন আর আমি মানুষ থাকি না, আমার মাথায় একটা পাগলা ভূত চাপে।
আমার ঠোঁটে একটু জোরে দাঁত বসিয়ে দিয়েই, খুকু পালাবার ভঙ্গিতে দরজার কাছে সরে গিয়ে বলেছিল, সোহাগের সাধ মিটেছে তো?
আরও বেড়ে গেল। আমি হেসে বলেছিলাম, আর ওকে তাড়া না করে বলেছিলাম, থানার ছোট দারোগা আমাকে বলে গেল, আমি যেন এক বার থানায় গিয়ে বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করি, ব্যাপারটা ডিসকাস করার জন্য।
খুকুর বড় বড় কালো চোখে ভয় ফুটে উঠেছিল, তুমি থানায় যাবে?
কেন যাব না?
যদি তোমাকে আটকে রাখে?
এতই সহজ? আটকে রাখবে? আমি হেসে বলেছিলাম, যা খুশি তাই অপবাদ দেবে, তার জন্য শাস্তি হয়ে যাবে?
খুকু বলেছিল, তবু শোনো, তুমি একলা যেয়ো না। কারোকে সঙ্গে নিয়ে যেয়ো৷
হ্যাঁ, সেটা অবিশ্যি আমিও ভেবেছি। বলেছিলাম, আর ঘরের এক পাশে, দেওয়াল আলমারির পাল্লা খুলে, ডেটলের শিশি নিয়ে বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, কঁচা ডেটল কেটে যাওয়া কয়েকটা জায়গায় লাগিয়েছিলাম। যদিও তখন রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, জায়গায় জায়গায় ফোঁটা ফোঁটা জমাট বেঁধে শুকিয়ে গিয়েছিল। আমি আবার বলেছিলাম, তবে ভেবো না, আমি ভয়ে কারোকে সঙ্গে নিয়ে থানায় যেতে চাইছি। আসলে আমি বুঝতেই পারছি না। থানার ওসির সঙ্গে ডিসকাসটা কী করব? তাই ভাবছি, নির্মলকে পেলে, ওকে সঙ্গে নিয়ে যাব।’ বলতে বলতে আমি ঘরের বাইরে গিয়ে আবার জল দিয়ে মুখ ধুয়েছিলাম। রক্তের দাগ আর ছিল না।
তুমি কি এখনই থানায় যাবে? খুকু জিজ্ঞেস করেছিল।
আমি পাশের ঘরে যেতে যেতে বলেছিলাম, হ্যাঁ, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, আমি নির্মলের বাড়ি যাব, এ বেলাই থানার ব্যাপারটা সেরে ফেলব।
আমার ঘর বলতে তখন যেটা বোঝাত, সেটা এক সময়ে জ্যাঠামশাইয়ের ঘর ছিল। তার পাশেই উত্তর দক্ষিণ আর পশ্চিমে ভোলা ছাদ, সামনে পিছনে চওড়া বারান্দা আর মারবেল পাথরের মেঝেওয়ালা ঘরটা ছিল ঠাকুরদা ঠামার। জ্যাঠামশাইয়ের শোবার ঘরের পাশে একটি ছোট ঘর, জামাকাপড় ছাড়বার বা টাকাপয়সা দামি জিনিসপত্র রাখবার আলমারি ছিল। আলমারিটা অবিশ্যি জ্যাঠাইমা গড়িয়ার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমিও পাশের ঘরেই আলনায় আমার জামাকাপড় রাখতাম, আর সেখানেই তাড়াতাড়ি পায়জামা ছেড়ে ট্রাউজারের ওপর একটা হাওয়াই শার্ট চাপিয়ে, সামনের ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে এক বার চিরুনিটা বুলিয়ে নিয়েছিলাম। খুকু দরজার কাছ থেকে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, বলেছিল, তুমি নীচে গিয়ে, বাইরের ঘরের দিকে তাকিয়ে আর একটা কথাও চেঁচিয়ে বলবে না। যা করবার চুপচাপ করবে।
তা করব, কিন্তু খুকু, এই অপমান আমি সহজে হজম করব না। আমি চিরুনিটা রেখে খুকুর দিকে তাকিয়েছিলাম, একি, মুখটা এখনও ধোওনি? গালে যে রক্তের দাগ লেগেই রয়েছে।আমি ওর দিকে হাত বাড়িয়েছিলাম।
খুকু পিছলিয়ে যাবার মতো, ঘরের বাইরে চলে গিয়েছিল, বলেছিল, এত বেশি ভাল নয়।
অথচ ওর পিছলিয়ে যাওয়া শরীরের ভঙ্গি, চোখের কোণে তারার ঝিলিক, ঠোঁট কুঁচকে হাসি আর কথা, সবকিছুর মধ্যে, মনের ওই রকম একটা অবস্থাতেও, কেমন একটা দুর্দান্ত চুম্বকের মতো টান ছিল। ও যত বলত, বেশি ভাল নয়’ আমার ততই মনে হত, আরও বেশি ভাল, আরও বেশি ভাল।’.মন একটা অদ্ভুত বস্তু। এক দিকে যখন রাগ আর অপমানের জ্বালা, আর এক দিকে তখনই যেন, আকণ্ঠ তৃষ্ণায় খুকুকে চুমুক দিতে ইচ্ছা করছিল।
আমি ঘরের বাইরে এসেছিলাম। খুকু তখন বাইরে রাখা পাইপের খালি মুখের কাছে বালতির জলে মুখ ধুয়ে আঁচল দিয়ে মুছে নিয়েছিল। আমার দিকে তাকিয়ে প্রথমে জিভ দেখিয়ে ভেংচেছিল, তারপরে হেসে বলেছিল, চলো।
দুজনেই সিঁড়ি দিয়ে নেমেছিলাম। বিনতিতখনও নীচের বারান্দায় রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি মুখ ফিরিয়ে দেখেছিলাম, বাইরের ঘরের দরজাটা তখনও বন্ধ। মুহূর্তেই এস আই-এর কথাগুলো মনে পড়ে গিয়েছিল, আর আমার মুখটা শক্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু খুকুর কথা আমার মনে ছিল। বিতির চোখে মুখে তখনও দুশ্চিন্তা। খুকু ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। মা পশ্চিমের জানালার দিকে মুখ করে, কাকাদের বাগানের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি ডাকতেই মা মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছিল। মায়ের মুখ গম্ভীর, চোখে দুশ্চিন্তা। বলেছিলাম, আমি বেরোচ্ছি মা। ভাবছি নির্মল-টির্মল কারোকে নিয়ে এ বেলাই থানায় ঘুরে আসব।’
থানায়?’ মায়ের দুশ্চিন্তা ভরা চোখে ভয় ফুটেছিল, থানায় যাবি কেন?
মা সব কথা তখনও শোনেনি। আমি এস আই-এর কথা জানিয়েছিলাম, বলেছিলাম, দুশ্চিন্তা কোরো না, এক বার শুনে আসি, বড় দারোগা কী বলে। বেরিয়ে এসে, সিঁড়ির নীচে রাখা সাইকেলের লকের গায়ে লাগানো চাবি ঘুরিয়ে, সাইকেলটা বের করেছিলাম। খুকুর কথা শুনেই বুঝতে পারছিলাম, ও বিতিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমি বলেছিলাম, কিছু ভাবিসনে বিতি। এসো খুকু, আর দেরি নয়।
আমি খুকুকে নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে, সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে জোড়াদিঘি পাড়া গিয়েছিলাম। দৃশ্যটা নতুন কিছু না, তবু আশেপাশের রকের, চায়ের দোকানের, মুদিখানার আড্ডাধারীরা সকলেই তাকিয়ে দেখেছিল, আর নিশ্চয় কিছু বলাবলি করছিল। বলাবলির মধ্যে একটাই তো ওদের কথা, যা আমার বন্ধুরাও অনেক সময় ঠাট্টা করে বলত, তল্লাটের সেরা মেয়েকেই তুই শালা বাগিয়েছিস।’ রকের বা দোকানের আড্ডাবাজরা হয়তো মেয়ে’ শব্দের বদলে মাল’ উচ্চারণ করত। যদিও, খুকু এমন একটি মেয়ে, হেন ছেলে বা মেয়ে ছিল না, যার সঙ্গে ওর পরিচয় কথাবার্তা ছিল না। তবে হ্যাঁ, আমাদের শুনিয়ে কেউ কোনওদিন হিড়িক দেয়নি। কোনওকালেই দেয়নি, তা বলা যায় না। দিয়েছিল, অনেক পরে, সেভেনটিথ্রির সেই জঘন্য দিনগুলোতে।
আমি খুকুকে জোড়াদিঘি পাড়ায় ওদের বাড়ির দরজার সামনে ছেড়ে দিয়ে বলেছিলাম, বিকেলে এসে বলব, কী ঘটল না ঘটল।
প্লিজ, থানায় গিয়ে মাথা গরম কোরো না। খুকু বলেছিল, ওর কালো বড় চোখে মিনতি আর আবদার ছিল।
আমি সাইকেলে উঠতে উঠতে, হাত তুলে ওকে সান্ত্বনা দিয়ে, আগে গিয়েছিলাম ঝুলনতলায় নির্মলের বাড়িতে। শুনেছিলাম, ও ভোরবেলাতেই কলকাতায় চলে গিয়েছে। তারপরেই মনে পড়েছিল। নকুলের কথা। সেখানে গিয়ে ওর ছোট বোনের মুখে শুনেছিলাম, নকুল নাকি আমাদের বাড়ি যাবার নাম করেই বেরিয়েছে। নকুলের বাড়ির কাছে জটাইয়ের বাড়ি। একটা পুকুরের এপারে ওপারে। জটাইটা অবিশ্যি একটু শান্ত আর ঠাণ্ডা মেজাজের ছেলে। আসলে, আমাদের কয়েকজন বন্ধু গোষ্ঠীর মধ্যে, জটাই, যার ভাল নাম জটিলেশ্বর চক্রবর্তী, সবথেকে বেশি লেখাপড়া জানা পণ্ডিত ছেলে। ব্রিজ আর রামিতেও তুখোড়, ওকে সবাই পার্টনার হিসাবে পেতে চাইত। দেখেছিলাম, একতলার গ্রিলে ঘেরা, ছাদ আঁটা বারান্দায় চেয়ারে বসে ও একটা ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ছিল। চোখে মোটা লেন্সের চশমা। আমাকে খেয়াল করেনি। টিং টিং করে সাইকেলের বেল বাজিয়েছিলাম।
জটাই খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়েছিল, কী রে, রোববারের সকালে তুই? তোর তো এখন জোড়াদিঘি পাড়ায় থাকবার কথা।
হ্যাঁ। আমি সাইকেলটা স্ট্যান্ডের ওপর দাঁড় করিয়েছিলাম, জোড়াদিঘি পাড়া থেকেই আসছি, খুকুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এলাম। একটা ঘটনা ঘটেছে, তোকে বলতে এলাম। আমি গ্রিলের দরজার আলগা ছিটকিনি খুলে ভিতরে ঢুকেছিলাম।
জটাই খবরের কাগজটা পাশের নড়বড়ে টেবিলের ওপর রেখে, সামনের হাতছাড়া চেয়ার দেখিয়ে বলেছিল, বোস। কী আবার ঘটল?
আমি চেয়ারে বসে ওকে সব বলেছিলাম। জটাই মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনেছিল, ওর তো ভুরুজোড়া কুঁচকে উঠেছিল, ত্রিলোচন কাকা তো দেখছি ঝামেলা ছাড়া থাকতে পারে না?’ ও টেবিলের ওপর রাখা ওর সিগারেটের প্যাকেট থেকে আমাকে একটা দিয়েছিল, নিজে একটা নিয়েছিল। সিগারেট ধরিয়ে কয়েক টান দিয়ে, মিনিটখানেক ভেবে বলেছিল, শোন দুদে, থানায় যাবার আগে এক কাজ করা যাক। জগদীশকাকার সঙ্গে এক বার দেখা করে যাই। উনি কী বলেন, একটু শোনা যাক।
কথাটা আমার মনে লেগেছিল। ওইরকম চিন্তা ভাবনা জটাইয়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল। যাকে বলে, গোড়া বেঁধে কাজ করা। তা ছাড়া, জগদীশকাকা অর্থাৎ জগদীশ মৈত্র আমাদের এলাকার নামকরা উকিল নন শুধু, যুক্তফ্রন্টের একজন সমর্থক। আমি বলেছিলাম, খুব ভাল বলেছিস, তাই চল যাই।
জটাইয়ের পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি ছিল। তৈরি হবার দরকার ছিল না। ও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কেবল এক বার গলা চড়িয়ে বলেছিল, মা, আমি বেরোচ্ছি।
আমরা দুজনেই বরেন্দ্রপাড়ায় জগদীশ মৈত্রের বাড়ি গিয়েছিলাম। জটাই আমার সাইকেলের কেরিয়ারে বসেছিল। জগদীশ মৈত্রকে আমিও জগদীশকাকা বলে ডাকতাম। বাবার থেকে উনি দু-চার বছরের ছোট, কিন্তু বাবার নাম ধরেই ডাকেন। প্র্যাকটিস করতেন আলিপুর পুলিশ কোর্টে। তাঁর বৈঠকখানা ঘরে পাঁচ-ছ জন বিভিন্ন ধরনের লোক ছিল, তার মধ্যে দুজন মেয়েছেলে। আমাদের দেখে জগদীশকাকা চোখ থেকে চশমা খুলে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী ব্যাপার, তোমরা?
জটাই জবাব দিয়েছিল, জগদীশকাকা, এক মিনিটের একটা কথা ছিল।
জগদীশ মৈত্রদের পুরনো দোতলা বাড়ি। তিনি ঘরের সকলের দিকে এক বার দেখে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে বলেছিলেন, এসো, পাশের ঘরে গিয়ে তোমাদের কথা শুনে নিই।
আমি জানতাম, জটাই সঙ্গে না থাকলে জগদীশকাকা এত তাড়াতাড়ি আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন না। আমি আর জটাই ওঁর পিছনে পিছনে পাশের ঘরে গিয়েছিলাম। একটা তক্তপোশে মাদুর পাতা ছাড়া, আর কিছু ও ঘরে ছিল না। জগদীশকাকা নিজে তক্তপোশে বসে বলেছিলেন, বসো, শুনি কী কথা? মারামারি কিছু হয়েছে নাকি?
না না, ও সব কিছু না।’ জটাই জগদীশকাকার সামনে বসে, আমার দিকে এক বার দেখে, ঘটনা সব বলেছিল।
জগদীশকাকা শুনতে শুনতে, হাতের চশমাটা আবার চোখে লাগিয়ে আমার দিকে এক বার দেখেছিলেন, তারপরে বলেছিলেন, ক্ষেত্র বিশেষে, শান্তিরক্ষার জন্য থানায় পিটিশন করা যায় কিন্তু এটা তো সে রকম কোনও ব্যাপার নয়। এর জন্য বেসিক অভিযোগের ভিত্তিতে, থানায় ডায়রি করতে হবে। তা কি হয়েছে?
না জগদীশকাকা। আমি বলেছিলাম, আমাকে এস আই বলেছে, মেয়েরা আমার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির কথা জানিয়ে, ও সি-র কাছে দরখাস্ত করেছে।
জগদীশকাকা মাথা নেড়ে বলেছিলেন, না, এ রকম কিছু করা যায় না। কমপ্লেন ডায়রি করে, কেস খাড়া করতে হবে। এটা তো একটা জঘন্য অভিযোগ। আবেদনপত্রে থানায় লিখে পাঠালাম, তাতেই তো আর প্রমাণ হয়ে যায় না। এটা প্রমাণসাপেক্ষ ব্যাপার। তিনি একটু কেশে নিয়ে আবার বলেছিলেন, ত্রিলোচন নিশ্চয়ই থানায় কিছু গড়বড় করেছে, মানে পকেট থেকে কিছু খসিয়েছে, তা নইলে এ রকম হতে পারে না। তা ছাড়া বাসস্থানের মধ্যে কোনও কারখানা করা যায় না, করতে হলে তার বিশেষ ব্যবস্থা আছে। কুটিরশিল্প হলেও, সেটা একটা রেজিস্টার্ড ফার্ম হওয়া চাই। যদুর জানি, ত্রিলোচন সে সব কিছুই করেনি। আর, বাড়ির বাইরের লোককে, অন্দরের বাথরুম পাইখানা ব্যবহার করতে দেওয়াই বা হবে কেন? হলই বা তারা স্ত্রীলোক, কিন্তু বাড়িটা তো ধর্মশালা নয়।…জগদীশকাকা আমার দিকে তাকিয়েছিলেন, কিছুই হবে না। ওই করে তোমার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া যায় না। আসলে ত্রিলোচন তোমাকে একটু ভড়কে দিতে চেয়েছে। বাড়িটা তো ওর নামে নেই, বিক্রি করবার রাইটও ওর নেই।
মোটেই না। আমি প্রায় বুক ফুলিয়েই বলেছিলাম, কারণ জগদীশকাকার কথা শুনে, এমনিতেই আমার বুক ফুলে বারো হাত হয়েছিল, আপনি তো জানেন জগদীশকাকা, বাবা এক বার সেই ঠাকুরদার সই জাল করে।
জগদীশকাকা হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আরে জানি রে বাপু, ও সব কেচ্ছার কথা এখন থাক।
হ্যাঁ।’ জটাই বলেছিল, তা হলে জগদীশকাকা, আমরা এখন কী করব? ও সির সঙ্গে থানায় দেখা করব?’
জগদীশকাকা বলেছিলেন, আপত্তি কী? শুনেই এসো না, সে কী বলতে চায়। যদিও ভড়কি দেওয়া ছাড়া তার কিছুই বলার থাকতে পারে না। তবে যদি ওইসব বলে, মেয়েদের মুখ চেয়ে ওকে কিছু করতেই হবে, তবে সোজা জানিয়ে দেবে, ফৌজদারি মামলা দায়ের করে, যা খুশি করবার করো। বলেই তিনি তক্তপোশ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, ত্রিলোচনটা যে বুড়ো বয়সেও কী করছে। নিজের বউ মেয়েকে মাসে কিছু টাকা বাড়িয়ে দিলেই পারে।
আমি আর জটাই চোখাচোখি করে, জগদীশকাকার সঙ্গে বাইরের ঘরে গিয়েছিলাম। জটাই বলেছিল, তা হলে আমরা ঘুরে আসি জগদীশকাকা।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঘুরে এসো। জগদীশকাকা ওঁর চেয়ারে বসে বলেছিলেন, সম্ভব হলে, আমাকে এক বার ও বেলা জানিয়ে, কী কথা হল না হল।
জটাই বলেছিল, নিশ্চয়ই।
জটাইকে সাইকেলের কেরিয়ারে বসিয়ে, দুজনে সোজা থানায় গিয়েছিলাম। ও সি তার ঘরেই ছিল। দরজার বাইরে একজন রাইফেলধারী বাঙালি সেপাই দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ঘরে দুজন লোক আছে।
আপনি খবর দিন, কমলবাবু আর জটিলেশ্বরবাবু দেখা করতে এসেছেন। জটাই বলেছিল।
সেপাই পরদা সরিয়ে ও সি-র ঘরে ঢুকেছিল আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বেরিয়ে এসে বলেছিল, যান, ভেতরে যান।
আমরা ভিতরে ঢুকতে, ও সি কপালে দুহাত ঠেকিয়ে বলেছিল, আসুন, আসুন জটিলেশ্বরবাবু, কমলবাবু আসুন বসুন। টেবিলের সামনে খালি চেয়ার দেখিয়েছিলেন। আমরা দেখেছিলাম, চেয়ার ছেড়ে তখনই দুজনে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছিল। একজন বাজারের মাছের আড়তদার, চেনা মুখ, আর একজন অচেনা, ধোপদুরস্ত জামা ধুতির সঙ্গে চিনাবাজারের বুট পরা। দু জনেই বেরিয়ে গিয়েছিল, আমি আর জটাই চেয়ারে বসেছিলাম। ও সি অমায়িক হেসে বলেছিল, বলুন, আপনাদের জন্য কী করতে পারি।
আপনি তো আমাকে এস আই-কে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি বলেছিলাম, যা বলা বা করার, আপনিই বলবেন করবেন।
ও সি-র কপালের চামড়ায় ঢেউ লেগেছিল, ভুরু কুঁচকে উঠেছিল, তারপরে হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় প্রায় চমকিয়ে উঠে বলেছিল, ও হো হো, দেখুন, ভুলেই যাচ্ছিলাম। এততো সব ব্যাপার নিয়ে থাকতে হয়, মাথাটা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড়।বলতে বলতে সে টেবিলের ড্রয়ার খুলে কাগজপত্র হাটকাতে আরম্ভ করেছিল।
ও সি লোকটির বয়স বেশি না, চল্লিশের মধ্যে। ছোট চুল, সরু গোঁফ, চোখ মুখে সব সময়েই হাসি। মাস দুয়েক আগেও, এর জিপে গৌর সেনকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছিলাম। অবিশ্যি সত্যি বলতে কী, দু মাস পরে, ওই সময়ে যুক্তফ্রন্টের পার্টির দু-একজনকেও ও সির সঙ্গে মাখামাখি করতে দেখেছি। কে বা কারা যে রাতারাতি বদলিয়ে গিয়েছিল, বাইরে থেকে আমি কিছু বুঝতেই পারিনি।
এই যে পেয়েছি। ও সি ড্রয়ার থেকে রুলটানা একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজ আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, এটা পড়ুন, তা হলেই বুঝতে পারবেন।
জটাই কাগজটা ওর নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। আমিও ওর দিকে ঝুঁকে পড়েছিলাম। আমার প্রথমেই দৃষ্টি পড়েছিল কাগজের নীচের দিকে, যেখানে কাক বকের ঠ্যাঙের মতো, অসামান্য হাতের লেখায় আর ভুল বানানে, তিনটি মেয়ের নাম সই করা ছিল। বাদবাকি বুড়ো আঙুলের কালির ছাপ,
পাশে শিক্ষিত লোকের হাতে লেখা মেয়েদের নাম। জটাই হেসে উঠে বলেছিল, ওরে বাবা, এ তো দেখছি একেবারে সেকালের সংবাদপত্রের মতো লেখা চিঠি।
সেটা আবার কী? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।
জটাই বলেছিল, এ ধরনের চিঠি নাইনটিনথ সেঞ্চুরির বাংলা খবরের কাগজেই বেরোত। শোন, আমি পড়ে যাচ্ছি। হাতের লেখাটা দেখে মনে হচ্ছে, ত্রিলোচন কাকারই লেখা।
আমি বলেছিলাম, আমারও তাই মনে হচ্ছে।
জটাই পড়বার আগে বলেছিল, নীচের সই করা মেয়েরা থানার বড়বাবুকে লিখে জানাচ্ছে মাননীয় মহাশয়, আমরা স্থানীয় কতিপয় দরিদ্র অভাগা রমণী অত্যন্ত কাতরতার সহিত নিবেদন করিতেছি যে, আমরা গঙ্গাধর চ্যাটার্জি রোডস্থিত শ্ৰীযুক্ত ত্রিলোচন চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের গৃহস্থিত বহির্বাটি কক্ষে তাঁহার প্লাসটিকের কারখানায় নানাবিধ ঝুড়ি ও থলি প্রস্তুত করিয়া জীবিকা নির্বাহ করি। শ্রীযুক্ত ত্রিলোচন চট্টোপাধ্যায় মহাশয় আমাদিগকে কন্যা জ্ঞানে কাজের সুযোগ দিয়া সসম্মানে বাঁচিবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন। তিনি আমাদের পিতৃতুল্য। আপনি নিশ্চয়ই অনুমান করিতে পারেন, আমাদের মতন নিরক্ষর অরক্ষণীয়া নারীদের পক্ষে, বর্তমান যুগে এইরূপ সম্মানের সহিত জীবিকানির্বাহ করিয়া জীবনযাপন করা কত ভাগ্যের বিষয়। কিন্তু সম্প্রতি কিছুকাল যাবৎ আমরা অত্যন্ত অসম্মান ও অপমানের মধ্যে কাজ করিতেছি। ইহার কারণ, শ্রীযুক্ত ত্রিলোচন চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের একমাত্র পুত্র শ্রীস্বর্ণকমল চট্টোপাধ্যায়, আমাদিগকে গৃহমধ্যে প্রস্রাবাগার ও পাইখানা ব্যবহার করিতে না দিয়া, দরজায় তালা বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। আমরা দরিদ্র হইতে পারি, কিন্তু নারীর সম্মান সর্বত্র বিবেচ্য। কিন্তু সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজের সময়ে, বাধ্য হইয়াই আমাদিগকে লোকচক্ষুর সম্মুখে প্রাকৃতিক ক্রিয়াকলাপাদি করিতে হইতেছে। ইহা কত বড় লজ্জার ও অপমানকর বিষয়, আপনি অনুভব করিতে পারেন। শুধু ইহাই নহে, আমাদের উক্ত লজ্জাকর পরিস্থিতির সুযোগ লইয়া, শ্রীস্বর্ণকমল চট্টোপাধ্যায়, প্রায়শই আমাদের শ্লীলতাহানি করিতেছেন। বাধা দিতে গেলে, অকথ্য কটু ভাষায় গালিগালাজ ও বলপ্রয়োগ করিয়া থাকেন। আমাদিগকে রক্ষা করিবার কেহ নাই। এমতাবস্থায়, মহাশয়, আমরা দুঃখিনী রমণীরা আপনার দ্বারস্থ হইয়া প্রার্থনা করিতেছি, পূর্বের ন্যায় আমাদিগকে গৃহের অন্দরমহলস্থিত পাইখানা ও প্রস্রাবাগার ব্যবহার করিবার ব্যবস্থা করিয়া দিন। অন্যথায়, আমাদিগের পক্ষে সসম্মানে জীবিকানির্বাহ করা সম্ভব নহে। ইতি।
জটাই কাগজ থেকে চোখ তুলে এক বার আমার দিকে দেখেছিল, তারপরে ও সি-র দিকে। হেসে বলেছিল, যে স্বর্ণকমল চাটুয্যে বাড়ির বাইরেই মেয়েদের শ্লীলতাহানি করছে, বাড়ির মধ্যে পেলে তো তার আরও সুবিধে হবে।
সে রকম কিছু ঘটলে, তখন ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ও সি হাসি হাসি মুখে জটাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিল।
আমি হুমকে উঠে কী বলতে যাচ্ছিলাম, নিজেই জানি না। জটাই ও সির হাতে কাগজটা দিয়ে, গম্ভীর মুখে বলেছিল, তা হলে ব্যবস্থা যা নেবার নিন। যা ঘটেছে, তার কোনও নড়চড় হবে না।
মানে? ও সির মুখে হাসি, অথচ ভুরু কুঁচকে উঠেছিল, কী বলছেন, বুঝতে পারলাম না।
আমি বলে উঠেছিলাম, আপনার যা করার আপনি তা করুন, আমার যা করার তা তো আমি করেছিই।
ও সি আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে জটাইয়ের মুখে দেখেছিল, তারপর বেশ অমায়িক হেসে বলেছিল, ডেকে পাঠাতাম না কমলবাবু। ব্যাপারটা নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।’
জটাই জিজ্ঞেস করেছিল, কী আলোচনা করতে চান, বলুন। আপনার কথাই আগে শোনা যাক।
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, জটাই হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়েছিল। ও সি কাগজটা টেবিলের ওপর রেখে বেশ শান্ত আর ঠাণ্ডা ভাবে বলেছিল, দেখুন, একদল গরিব দুঃস্থ মেয়ে কমলবাবু সম্পর্কে গুরুতর অভিযোগ আমাকে লিখিতভাবে পাঠিয়েছে।
কীসের অভিযোগ? আমি প্রায় চিৎকার করেই উঠেছিলাম।
ও সি-র ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠেছিল। জটাই আবার আমার ঘাড়ে হাতের চাপ দিয়ে, ও সি-কে বলেছিল, লিখিত গুরুতর অভিযোগ হলেই কি তা সত্যি বলে ধরে নিতে হবে? সত্যি-মিথ্যে বিচারের কোনও ব্যাপার নেই?
ও সি-র কোঁচকানো ভুরু সোজা হয়েছিল, কপালে দু-একটি রেখা ফুটেছিল, অ্যাঁ? হ্যাঁ, সে তো বটেই, সত্যি-মিথ্যের বিচার তো নিশ্চয় করতে হবে।
কিন্তু আপনার কথা থেকে মনে হচ্ছে, আপনি ধরেই নিয়েছেন, আমি ওইসব ব্যাপার করেছি। আমি খ্যাক খ্যাক করে উঠেছিলাম।
জটাও ও সি-র মুখের দিকে তাকিয়েছিল। ও সি-র মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছিল, বলেছিল, দেখুন। কমলবাবু, আমাকে ধমকাবেন না। চিঠিটা পড়লেই বোঝা যায়, এর পেছনে আপনার বাবা রয়েছেন। আর এই চিঠিটা দশজনে পড়লে, আপনার সম্পর্কে কি লোকের ভাল ধারণা হবে?
জটাই বলেছিল, তার মানে আপনি বলতে চান, ত্রিলোচনকাকা আর ওই মেয়েগুলোই ঠিক বলেছে, দুদে মেয়েগুলোর শ্লীলতাহানি করেছে।
না জটিলেশ্বরবাবু, আমি সে রকম কিছুই বলতে চাই না। ও সি বলেছিল, ব্যাপারটা একটা পারিবারিক কেচ্ছা কেলেঙ্কারিতে দাঁড়াতে যাচ্ছে। সেই জন্যই আমি কমলবাবুকে ডেকে, একটা মিটমাটের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম। মেয়েগুলোর অবস্থার কথাও আপনাদের একটু ভাবতে হবে।
আমি একেবারে জ্বলে উঠে বলেছিলাম, আপনি তো কম দিন নেই এই থানায়, মেয়েগুলোকে কি আপনি চেনেন না? এত দরদ দেখিয়ে কথা বলছেন কেন?
ও সি হেসে উঠেছিল, আরে মশাই, মেয়েগুলো যাই হোক, লোকের সিমপ্যাথি সব সময়ে মেয়েদের দিকেই থাকে। এমনকী সে বেশ্যা হলেও। ডাঃ বিধান রায় পর্যন্ত সোনাগাছির মেয়েদের নিয়ে ভেবেছিলেন।
তারা তো মশাই সোনাগাছিতে থাকে, গেরস্থর বাড়িতে এসে ওঠেনি। জটাইও হেসে বলেছিল, দুটো ব্যাপারকে মিলিয়ে ফেলবেন না।
ও সি হেসেই খানিকটা অনুরোধের স্বরে বলেছিল, এ মেয়েগুলোকে না হয় আপনারা দয়াই করুন।
অসম্ভব। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিলাম, আমাদের বুকের ওপর বসে বাবা যা কেচ্ছা কেলেঙ্কারি করছে, এর পরে আমি কিছুতেই ওই মেয়েদের আর বাড়ির মধ্যে ঢুকতে অ্যালাও করব না। ডিসিশন ইজ ডিসিশন।
ও সি-র মুখ শক্ত হয়ে উঠেছিল, যদিও মুখের হাসিটা বজায় রাখবার চেষ্টা করেছিল, বলেছিল, আমাকে তা হলে ব্যবস্থা একটা নিতেই হবে, কারণ কিছু গরিব মেয়ে যেভাবে আবেদন রেখেছে, আমি তো তা উড়িয়ে দিতে পারি না।
জটাই বলেছিল, আপনাকে তো সে কথা আমি আগেই বলেছি, আপনি আপনার ব্যবস্থা নিন, আমরা আমাদের ব্যবস্থা নিচ্ছি। একজনের নামে যা-খুশি অপবাদ দিয়ে আপনাকে চিঠি দেওয়া হবে আর আপনি তাই নিয়ে যদি উঠে পড়ে লাগতে চান, লাগুন। আফটার অল, চিঠি তো ডায়রি নয়। ডেফিনিট কেস আপনাকে করতে হবে, শ্লীলতাহানির প্রমাণও করতে হবে।’ বলতে বলতে জটাই উঠে দাঁড়িয়েছিল।
আমিও উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। ও সি যেন একটু ব্যস্ত ভাবে বলেছিল, আরে উঠছেন কেন, বসুন, আর একটু আলোচনা করা যাক।
না, আর কোনও আলোচনা নয়। আমি বলেছিলাম, বাড়ির ভেতরে আমি বাইরের মেয়েদের ঢুকতে দেব না।
ও সি বলেছিল, বাড়িটা তো আপনার একলার নয়।
বাড়িটা আমার বাবারও একলার নয়। আমি কেঁজেই বলেছিলাম, বাড়ির ভেতরে কারখানা করতে দেওয়া হয়েছে, ওটাই যথেষ্ট, তা বলে কারখানার মেয়েদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে বাথরুম পাইখানা ব্যবহার করতে দেব না। আমি দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম।
ও সি আবার নরম হয়ে বলেছিল, কমলবাবু যে রকম রেগে আছেন, ওঁর সঙ্গে কথা বলাই মুশকিল। আপনি একটু কিছু ভেবে বলুন জটিলেশ্বরবাবু।
আমার মশাই বলার কিছু নেই।’ জটাই বলেছিল, ত্রিলোচনকাকা আমাদের বন্ধুদেরও অনেক বাজে কথা বলে গালাগাল দিয়েছেন। আমরা কেউ ওঁকে সাপোর্ট করব না।
ও সি হেসে বলেছিল, ত্রিলোচনবাবু দেখছি গোড়ায় গলদ করে বসে আছেন। আপনাদের সঙ্গেও ঝগড়া করেছেন?
ও সি যেন খুবই মুশকিলে পড়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিক। আমলটা যুক্তফ্রন্টের। তা না হলে কোনও রকম গোলমাল পাকাতেই কসুর করত না। হয়তো আমাকে ওই দিনই থানায় আটকিয়ে রাখত। কিন্তু পুলিশকেও রাতারাতি ভোল বদলাতে হয়েছিল। জটাই বলেছিল, আপনি ও সব ভাববেন না। আইনত যা ব্যবস্থা নেবার, তাই নিন।
ও সি-ও উঠে দাঁড়িয়েছিল, আর অমায়িকভাবেই বলেছিল, ব্যবস্থা আর কী নেব বলুন, একটা কেস হবে, এই আর কী। সেটাই আমি অ্যাভয়েড করতে চেয়েছিলাম।
আমি কোনও কথা না বলে বেরিয়ে এসেছিলাম। জটাই বেরিয়ে আসতে আসতে বলেছিল, ওই রকম অভিযোগকে অ্যাভয়েড করা যায় না।’
ও সি আমাদের সঙ্গে বাইরে এসেছিল, আর শেষ চেষ্টা করেছিল, জটিলেশ্বরবাবু, আলটিমেটলি বাপ ছেলেতে একটা কেস লড়ালড়ি হবে, আপনারা কি তা-ই চান?
হ্যাঁ, চাই। আমি জবাব দিয়েছিলাম।
ও সি আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। হুম, নজরটা একটু কড়াই ছিল। কিন্তু আমি ভয় পাইনি। আমি আর জটাই দুজনেই থানা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। বাড়ি ফিরে মা আর বিনতিকে সবই বলেছিলাম। বিকালে জোড়াদিঘি পাড়ায় গিয়ে খুকুকেও বলেছিলাম। বুঝেছিলাম, খুকু একটু ভয়ে ভয়ে ছিল। জটাই আমার সঙ্গে গিয়েছিল শুনে, আর বিশেষ করে জগদীশকাকার কথা শুনে খুকু খুবই আশ্বস্ত হয়েছিল। ওই দিন রাত্রেই, আমাদের বাড়ির দোতলায় নকুল পঞ্চানন বুলে সকলের সঙ্গেই কথা হয়েছিল। বুলে বলেছিল, নাহ্, এ বার দেখছি ত্রিলোচনকাকাকে একটু টাইট না দিলে নয়। কাল থেকে আমি আর পঞ্চা, আরও কারোকে পাওয়া গেলে, ত্রিলোচনকাকার রাস্তার দিকের রকে আড্ডা জমাব।
বুলের কথা শুনে সবাই হেসে ওর তারিফ করেছিল। পঞ্চানন বলেছিল, শালা, রেগুলার তাসের আচ্ছা বসিয়ে দেব, আর মাঝে মাঝে মুখ বাড়িয়ে বলব, ত্রিলোচনকাকা, আমাদের একটা চাকরি দিন।
আবার সবাই হেসে উঠেছিল। সত্যি কথা বলতে কী, আমার মনটা একটু খচখচ করছিল, কিন্তু ও সি-কে লেখা চিঠির কথাগুলো যত মনে পড়ছিল, ততই আমিও শক্ত হয়ে উঠেছিলাম। নকুল আমাকে এক বার জিজ্ঞেস করেছিল, কী রে দুদে, তোর আপত্তি নেই তো?
না, আমার আপত্তি থাকবে কেন? আমি বলেছিলাম, আমি একটা এসপার-ওসপার কিছু চাই। ভাবা যায়, মেয়েগুলোকে দিয়ে আমার নামে ওইরকম একটা জঘন্য চিঠি লেখাবে?
বুলে আর পঞ্চাননরা ওদের কথামতো কাজ আরম্ভ করে দিয়েছিল। আমি তো সারা দিন বাড়ি থাকতাম না। সকালবেলাই বেরিয়ে যেতাম। চাকরি থেকে ফিরে আগে এক বার জোড়াদিঘি পাড়ায় খুকুর কাছে যেতাম, তারপরে রাত্রে আমাদের দোতলার আড্ডায় সব শুনতাম। বাবাকে সত্যি রীতিমতো বেকায়দায় ফেলা হয়েছিল। ওই সময়ে, বাড়ির ভিতর দিকের দরজা বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকত। রাস্তার দিকের দরজাই খোলা থাকত। মেয়েগুলোকে ওই দরজা দিয়েই বেরিয়ে, বাড়ির বাইরে বাঁদাড়ে বাগানে জঙ্গলে পুকুরের ধারে যেতে হত। বুলে পঞ্চাননদের বাইরের বারান্দায় আঁকিয়ে বসায়, মেয়েগুলোরই কেবল অসুবিধা হয়নি। ঘটনাটায় বাবা আর ওরা এমন অবাক হয়ে গিয়েছিল, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাও একরকম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ, বাইরের বারান্দা থেকে সবই শোনা যায়।
বাবা প্রথম দু দিন চুপ করে ছিল। বোধ হয় ব্যাপারটা ভাববার বোঝবার চেষ্টা করছিল, কোনও মতলবও আঁটছিল। আমি তো মনে মনে ভেবেই রেখেছিলাম, মেয়েগুলো, না হয় পুলিশ আমার নামে কেস করবে। জগদীশকাকা কিছু ভাবতে বারণ করেছিলেন। তিন দিনের দিন, বাবা বারান্দায় বেরিয়ে বেশ রোখা গলাতেই জিজ্ঞেস করেছিল, তোমরা এখানে কী করছ?
কী আর করব, একটু তাস খেলছি, আর গল্প করছি। বুলে জবাব দিয়েছিল।
বাবা বলেছিল, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি, বৈঠকখানার বারান্দা, এখানে ও সব চলবে না।
পঞ্চানন বলেছিল, আমরা তো ভদ্রলোকের বাড়ির ছেলে। পাড়ার যে-কোনও বাড়ির রকেই তো আমরা বসে আড্ডা দিই, গল্প করি।
সে যেখানে কর, সেখানে কর। এখানে ও সব চলবে না। বাবা স্বর চড়িয়ে বলেছিল, তা ছাড়া এখানে মেয়েরা কাজ করে, ওদের চলাফেরার অসুবিধে হয়।’
বুলে বলেছিল, কেন, আমরা তো ওদের দিকে তাকিয়েও দেখিনে, অসুবিধের কী আছে?
ও সব জবাবদিহি আমি করতে পারব না। বাবা রুখে উঠে বলেছিল, আমার বাড়ির বারান্দায় এ সব আড্ডা চলবে না। আমি জানি এ সব ইতরামি ছোটলোকোমি ছাড়া আর কিছু নয়।
অন্যান্য যে সব ছেলেরা থাকত, তারা কেউ বাবার সঙ্গে কথা বলত না। যা বলার বুলে আর পঞ্চাননই বলত৷ পঞ্চানন বলেছিল, সব যখন জেনেই গেছেন, তখন তো আর কিছু বলার নেই। বুঝেছেন যখন আমরা ইতর আর ছোটলোক, তখন আর মিছে কথা বাড়াবেন না, ঘরে চলে যান।
কী বলতে চাও হে ছোকরা?’ বাবা প্রায় ক্ষেপে উঠেছিল, আমাকে হুকুম দেওয়া হচ্ছে?
বুলে বলেছিল, যা মনে করেন, তাই। তা নইলে আমরা কিন্তু সত্যি ঘোটলোক আর ইতর হয়ে যাব।
পঞ্চানন একটা বিকট আওয়াজ করে উঠেছিল। বাবা প্রায় ভয় পেয়েই দরজার কাছে সরে গিয়েছিল, কিন্তু বলেছিল, মনে করেছ, দেশটা এখন তোমাদের কবজায়, তাই যা খুশি তাই চালিয়ে যাবে? মনে রেখো, আমিও অজয় মুখুজ্জে সুশীল ধাড়ার কাছে যেতে পারি।
আর প্রফুল্ল সেনের কাছে যাবেন না?’ পঞ্চানন বিকট হেসে বলে উঠেছিল, বলেন তো খাদুদাদুকে আপনার এখানেই এনে দিই।
বাবা ঘরের মধ্যে ঢুকে জোর শব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি জানতাম, প্রফুল্ল সেনের ওপর তখন বুলে পঞ্চানন নির্মলরা ম্যাক্সিমাম রেগেছিল, ওঁর নাম দিয়েছিল, খাদুদাদু। আমি এও জানতাম, বুলে পঞ্চাননরা দল বেঁধে, রেল ইস্টিশনে, রাস্তায় লরি থামিয়ে গম খোঁজার নাম করে, লুটপাট ভালই চালিয়েছিল। এক দিকে খোলা বাজারে চালের দাম বাড়ছিল, অন্য দিকে রেশনে কেবলই চালের পরিমাণ কমে যাচ্ছিল। তখন জলধরদাকে বলতে শুনেছি, আশেপাশে সবখানে মজুতদাররা যত খাবার মজুত করেছে, সব খুঁজে বের করতে হবে, দরকার হলে লুট করে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে।
আমার ধারণা, ফলটা হয়েছিল মারাত্মক। গরিবদের মধ্যে বিলানো হতে দেখিনি, কিন্তু বুলে পঞ্চাননদের পকেট ভারী হতে দেখেছিলাম, জলধরদা কি জানতেন না? নির্মল জটাই কি জানত না? কিন্তু ও সব কথা আমি কোনও দিন তুলিনি। কারণ জানতাম, তা হলে ওরা আমার পিছনে লেগে যাবে। আমার বাবা তো অনেক দূরের কথা, ওই সময়ে সবাই ওদের ভয় পেত।
যাই হোক, বাবা বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বাবা তো এমনিতেই বাড়ির ভিতরে আসা বন্ধ করেছিল। মেয়েগুলো যাও বা রাস্তার দিকের দরজা দিয়ে চলাচল করছিল, তাও বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছিল। বেশির ভাগ সময় দুদিকের দরজা বন্ধ করে রাখতে হত। বাবা বেরোতে গেলেই বুলে পঞ্চাননদের আওয়াজ খেত। পঞ্চানন তো এক দিন বাবাকে শুনিয়েই বলেছিল, একদিন একটা দু কেজি ওজনের ঝাড়ব, পেটের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে যাবে।
প্রায় দু সপ্তাহের ওপর ওইভাবে কেটেছিল, আর আস্তে আস্তে একটা একটা করে মেয়ে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি খবর রাখছিলাম, আমার বিরুদ্ধে কোনও কেস করা হচ্ছে কি না। হয়নি। তার মানে বাবা বুঝতে পেরেছিল, আমার নামে শ্লীলতাহানির কেস প্রমাণ করতে পারবে না, কারখানাটা উঠে গিয়েছিল। তিন সপ্তাহের মাথায়, সব মেয়েরাই ভয়ে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। বাবা যে ভোরবেলা কখন বেরিয়ে যেত, টের পেতাম না। বাইরের দিকের দরজায় বড় বড় দুটো তালা ঝুলত। রাত্রে ফিরে আসা টের পেতাম, বাইরের ঘরের জানালা দরজার ফাঁকে আলো দেখে।
আমার একটা জ্বালা জুড়িয়েছিল। জীবনে সেই বোধ হয় আর এক বার আমার আশা ভাবনা চিন্তাগুলি শান্ত ঘোড়ার দলের মতো চুপচাপ ছিল। যদিও মা আর বিতির দরুন বাবার কাছ থেকে রোজ দু টাকা পাওনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখন আমার চাকরি হয়ে গিয়েছিল। বাবার ওপর নির্ভর করার দরকার ছিল না।
আমি জীবনের কোনও দিকটাই বোধ হয় ঠিক বুঝতে পারিনি, যেমন এখনও জানি না, জীবনটা ঠিক কেমন করে চলে। তার নিজেরই কি কোনও পথ করা আছে, যে-পথ দিয়ে সে আমাদের টেনে নিয়ে যায়? নাকি, আমরাই নিজেদের পথ করে চলি? তবে কেন, আগে পিছনে, কোনও দিকটাকেই কোনও দিন মেলাতে পারিনি? সেই দিনগুলো তবে কেন জীবনের চিরদিন হয়ে থাকল না, বাবাকে যখন সেই প্রথম হারিয়ে দিতে পেরেছিলাম, আর শ্রাবণ মাস এসেছিল, সে-শ্রাবণের এক মেঘ চাপা শুক্লপক্ষের রাত্রে খুকুকে বিয়ে করে এনে তুলেছিলাম এ বাড়িতে? বাবার সঙ্গে হারজিতের খেলাটাও তখন ভুলে গিয়েছিলাম। বাবাও ভুলে গিয়েছিল। কী বলে সেই সব কথাগুলোকে, মধুর? তার চেয়েও বেশি কিছু যেন, কারণ মধুর-টধুর আমি বুঝি না, বুঝেছিলাম, বেঁচে থাকায় কত সুখ!