৩১. ফাঁদ!
পরিকল্পনামাফিক চোরের মত গ্যালারিতে সটকে পড়ল এলিস। রুমের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ডিসপ্লের পেছনে যার যার পজিশন নিয়ে নিল। লম্বা লম্বা ডিসপ্লেগুলোতে রাজ-রাজড়াদের বর্ম পরিহিত ম্যানিকুইন এখন অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
করিডোরের লাইট অন হবার সাথে সাথে গুণে দেখল কজন এসেছে। প্ল্যান হল একেবারে শেষ জন ঢোকার পর আরো বিশ সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হবে যেন আরো কেউ থাকলে বোঝা যায়। আর তারপর দশ সেকেন্ডের ব্যবধানে একের পর এক তারাও বের হয়ে যাবে।
কয়েক মুহূর্ত পর বেরিয়ে এলো কলিন। তারপর সেখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল ডা. শুক্লার জন্য। সবার শেষে আসবে বিজয়। একটু আগেই সিরিয়াস ভঙ্গিতে এর কারণও জানিয়েছে, কারণ আমার কাছেই তো সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।” সময় তেমন না থাকায় কেউ আর কোনো তর্ক করেনি।
কিন্তু এতক্ষণ পার হয়ে গেলেও ডা. শুক্লার দেখা নেই। চিন্তিত ভঙ্গিতে এলিসের দিকে তাকাল কলিন। ডা. শুক্লা কিংবা বিজয় কাউকেই রেখে যাবার কোনো ইচ্ছেই তাদের নেই। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ভেতরে ঢোকাটাও ঠিক হবে না। গানম্যানেরা যখন পিছু নেয়নি তখন নিশ্চয়ই ভেতরে ওঁৎ পেতে থাকবে।
হঠাৎ মাথায় এলো কথাটা: যদি ডা. শুক্লাকে ইতোমধ্যে বন্দী করে ফেলে?
কিন্তু অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগেই সেকেন্ড ফ্লোরের ল্যান্ডিংয়ে রক্তাক্ত সাহুকে নিয়ে উদয় হল রাইলি। “গ্যালারির লাইট জ্বালাও”, অন্ধকারেও এলিস আর কলিনকে ঠিকই দেখেছে। গা জ্বলানো হাসি দিয়ে সাহুকে আদেশ করতেই পালন করলেন কিউরেটর।
নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে বরফের মত জমে গেল এলিস আর কলিন। এই লোকটা কে তা না জানলেও সাহুর ডান হাতের রক্ত আর রাইলির হাতের বোয়ি ছুরি দেখে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না যে অবস্থা সুবিধের না। তারা ফাঁদে পড়ে গেছে।
.
কিউরেটরের দুর্ভাগ্য
আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে আছে বিজয়। রক্তে ভেজা সাহুর সাথে এলিস আর কলিনকেও বাইরে নিয়ে গেল সোনালি চুলের লম্বা আর পেশিবহুল এক তরুণ। হাতে আবার বিশাল বোয়ি ছোরা। গ্যালারির বাইরে যে অ্যামবুশ পাতা ছিল সেটা টেরই পায়নি এলিস আর কলিন। কিন্তু সাহুর সাথে এ কী করেছে? এবার বোঝা গেল সাহু কেন আর্তচিৎকার করছিলেন। কিউরেটরের অবসন্ন চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ব্যথার চোটে বোধ-বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে।
রুমের ওপাশে কালো স্কি-মাস্ক পরিহিত গানম্যানেরা তিন বন্দীকে ধরে দাঁড়াল।
ফোনে সব শুনে নিল রাইলি, “এলিস টার্নার। চেক। কলিন বেকার।” কলিনের দিকে তাকাল, “তুমিই সেই। রুমে তো আর কোনো শ্বেতাঙ্গ দেখছি না। তারপর চারপাশে তাকিয়ে বলল, “দুর্গে তো তোমরা তিনজন ছিলে। সব কাজে নাক গলানো বাকি দুজনকে ধরা হয়েছে। তার মানে আরো একজন আছে।” গলা তুলে ডাকল, “বিজয় সিং! আমি ভালোভাবেই জানি যে তুমি এখানে। আর লুকাতে পারবে না। যদি চাও যে ওদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করি তাহলে এখনি বেরিয়ে এসো।”
সাথে সাথে বুঝে গেল বিজয়। প্রথমত, কোনো না কোনোভাবে এরা দুর্গে নজরদারি করেছে। কিভাবে সেটা ধরতে পারলেও ওদের নাম-ধাম এমনকি কজন আছে সেটাও তারা জানে। আর আরেকটা ব্যাপার হল ইমরান আর রাধাকেও ধরে ফেলেছে। তবে এই লোকটার ইনফরমেশন কারেক্ট না। ডা. শুক্লার কথা জানে না। প্রাজ্ঞ নোকটা কেন লুকিয়ে আছেন বুঝতে না পারলেও এটুকু আশা যে উনি সবকিছু দেখছেন।
দাটাকে টানতে টানতে কেসের পেছন থেকে বেরিয়ে এলো বিজয়; সহজ স্বরে জানালো, “এই যে আমি।”
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাইলির চেহারা। যাক সব তার ইচ্ছে মতই এগোচ্ছে। এরপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ করে সাহুর দিকে ফিরে এক পোচ দিয়েই গলাটা কেটে ফেলল। ধপ করে মেঝের উপর আছড়ে পড়ল কিউরেটরের দেহ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। “ওকে আসলে আর কোনো দরকার নেই।” ব্যাখ্যা দিল রাইলি।
ভীতি বিহ্বল অন্যদের সামনে এবারে এলিসকে ধরে রক্তমাখা ছুরির ফলা চেপে ধরল মেয়েটার গলায়, “এবার বলো মেটাল প্লেটটা কোথায়?” ফিসফিস করে উঠল রাইলি।
পিস্তল তাক করে বিজয় আর কলিনের দিকে এগোল দুজন গানম্যান। একটু নড়াচড়া করলেই পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে হাত কিংবা পায়ের দিকে উড়ে যাবে বুলেট।
চামড়ার উপর গেঁথে বসায় গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা রক্ত। কথা বলতে চেষ্টা করল এলিস; কিন্তু গলায় কোনো স্বর ফুটল না।
মিটিমিটি হাসছে রাইলি, “দেখা যাক কতক্ষণ সহ্য করতে পারো।”
“ওয়েট” নিজেকে সামলাতে না পেরে এক পা আগে বাড়ল বিজয়। চোখের সামনে দেখছে এলিসের আতঙ্কিত চেহারা, “ওর কাছে মেটাল প্লেটটা নেই। ওটা ওই দরজার পেছনের আরেকটা রুমে রাখা হয়েছে। কয়েক মিনিট আগে তালা মারা রুমটাকে ইশারায় দেখিয়ে বলল, “চাবি আমার কাছে।” উদ্যত অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা গানম্যানের দিকে তাকাতেই লোকটাও মাথা নাড়ল।
“খুব সাবধান” বিজয়কে সতর্ক করে দিল গানম্যান। স্কি মাস্কের আড়ালে খসখস করে উঠল গলা, “এই রেঞ্জ থেকে কোনো চালাকি করেই কিন্তু বাঁচতে পারবে না।”
আস্তে আস্তে চাবির রিং তুলে রাইলির দিকে ছুঁড়ে মারল বিজয়। খানিকটা ঝুঁকে এলিসকে টানতে টানতে দরজার কাছে নিয়ে তালা খুলে ফেলল রাইলি। কিন্তু ভেতরের সারি সারি ট্যাবলেট আর সিলমোহর দেখেই অসহিষ্ণু হয়ে জানতে চাইল, “এর মাঝে কোনটা?”
ধাতব পাতটা দেখিয়ে দিন এলিস। মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে তৃতীয় গানম্যানের কাছে সরিয়ে ছুরিটাকে খাপে ভরে নিল রাইলি। তারপর সিলটাকে হাতে নিয়ে দেখল।
আর ঠিক তখনি এমন এক ঘটনা ঘটল যে বিস্মিত হয়ে গেল বিজয় আর কলিন।
.
৩২. ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
মেসিডোনিয়া
প্রাসাদের কক্ষে বসে আছেন আলেকজান্ডার। ভাবনায় বিভোর হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন জানালার দিকে। এমন সময় কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই ভেতরে এলেন রানি মাতা।
“পুত্র” বলে উঠলেন অলিম্পিয়াস, “দেখো তোমার জন্য আমি কোন উপহার এনেছি।”
ভ্রু-কুঁচকে এদিকে ফিরলেন আলেকজান্ডার। শৈশব থেকেই মায়ের এমন আচরণ দেখলেও এখনো কেন যেন অভ্যস্ত হতে পারেননি। যখন তখন গান গাওয়া, ইচ্ছে হলেই নাচ, সাপের প্রতি দুর্বোধ্য এক ভালোবাসা আর না
জানিয়ে রুমে ডোকা মাঝে মাঝে সত্যিই খুব বিরক্ত লাগে। কিন্তু মাকে এত ভালোবাসেন যে এসব বলার কোনো মানেই হয় না।
গাঢ় আর গভীর চোখ জোড়া দিয়ে নিজের গিফট খুঁজলেন আলেকজান্ডার কিন্তু মায়ের হাত দু’খানা তো খালি।
“উফ, মা” অভিযোগ করলেন তরুণ রাজা, “এরকম করোনা তো। বলল কী এনেছ। জানো আমি উপহার কত পছন্দ করি।”
“তার আগে আমার কাছে একটা প্রমিজ করো” ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন অলিম্পিয়াস। একমাত্র পুত্রের সাথেই তিনি কোনো ছলা-কলা করেন
কিংবা কোনো সুবিধাও আদায় করতে চান না। কেবল এটুকুই অভিপ্রায় যে একদিন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে পুত্রের মহিমা। আর এর জন্য যা যা দরকার তিনি তাই করবেন।
কপালে ভাঁজ ফেলে আলেকজান্ডার জানালেন, “নির্ভর করছে এটা কী তার উপর।”
“ওহ্, আমার মনে হয় এই প্রমিজটাকে পূর্ণ করতে পারলে তুমি খুশিই হবে” ছেলের কৌতূহল বাড়িয়ে তুললেন অলিম্পিয়াস, “আর সেটা পারস্যের বিরুদ্ধে তোমার অভিযান নিয়ে।”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালেন আলেকজান্ডার, “মা, তুমি জানো এ ব্যাপারে আমি কতটা আগ্রহী। পারসীয়রা আমাদেরকে যে অবমাননা করেছে, আমাদেরই ভূমিতে আমাদেরকেই যতটা নিগ্রহ করেছে, সেটার প্রতিশোধ নেয়াই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য। পারস্য সাম্রাজ্যকে মেসিডোনিয়ান শাসনাধীনে না আনা পর্যন্ত আমার শান্তি হবে না।”
“আমি জানি” পুত্রের দিকে তাকিয়ে শেহের হাসি হাসলেন অলিম্পিয়াস। “কিন্তু এতটুকুতেই থামবে কেন? পারস্যের ওপারে পূর্বে আরো বিস্তৃত ভূমি পড়ে আছে।” এবার প্রায় ফিসফিস করে জানালেন, “পূর্বদেশীয় দেবতাদের ভূমি, যেখানে ইন্দাসসহ আরো বিশাল সব নদী বয়ে যায়।”
“পৃথিবীর শেষ মাথা! সমৃদ্ধিশালী সেসব স্থান সম্পর্কে অবশ্য আমিও শুনেছি।” গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন আলেকজান্ডার। ইন্দাস উপত্যকার সোনা আর মূল্যবান সব পাথরসহ স্থানীয়রা পারসীয়দেরকে স্বর্ণধূলির আকারে যে কর দেয় তার বহু গল্পও শুনেছেন। কিন্তু তার মানে তো নিজ দেশ থেকে বহু বছর বাইরে কাটাতে হবে। সেটার যথাযথ মূল্য পাবো তো? তাহলে তো পারস্য সাম্রাজ্য আমাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হবে।”
“সেসব ভূমিতে তুমি যা পাবে তা কোনো পার্থিব সম্পদ নয়।” চিকচিক করে জ্বলে উঠল অলিম্পিয়াসের চোখ। “দেবতা হিসেবে তোমার জন্ম। তুমি জিউসের পুত্র। তোমাকে আগেও বলেছি একথা। কিন্তু এখনো তুমি মরণশীল।” খানিক থেমে পুত্রের চোখের দিকে তাকালেন, “ইন্দাসের স্থানে স্থানে প্রচলিত আছে এ গাঁথা। মহান এক রহস্য সম্পর্কে প্রাচীন সেই পৌরাণিক সত্য তোমাকে দেবতায় রূপান্তরিত করবে। আর আমি চাই তুমি এই রহস্যেরই অন্বেষণ করো।”
পূর্বদেশ থেকে আসা দার্শনিকের সাথে আলোচনার কথা জানালেন অলিম্পিয়াস। পার্চমেন্ট আর ধাতব পাতটা আলেকজান্ডারকে দিয়ে খোদাইকৃত শব্দগুলোও ব্যাখ্যা করলেন। ঠিক যেমনটা জানিয়েছেন সেই পণ্ডিত।
“তবে এটা হবে একটা সিক্রেট মিশন। অনুসন্ধানের কথা তোমার সেনাবাহিনি জানতে পারলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেবে। আর বিশ্বাস না করায় তারা হয়ত তোমার সাথে যেতেও অস্বীকার করবে।”
অলিম্পিয়াসের কথা শেষ হবার পর পার্চমেন্টটা পরীক্ষা করে দেখলেন আলেকজান্ডার। অবশেষে জানালেন, “এটাই আমার নিয়তি; আমিই হয়ে উঠব দেবতা।”
.
৩৩. বর্তমান সময়
তৃতীয় দিন
জরুরি তলব
ডোরবেল শুনে তাড়াহুড়া করে দরজা খুলতে গেল রাধা। বিজয় এসেছে নাকি?
কিন্তু দোরগোড়াতে শোকার্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে সাফারি স্যুট পরিহিত এক লোক, নির্ঘাৎ কোনো দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে। ঘাবড়ে গেল রাধা।
“মিস রাধা শুক্লা?” জানতে চাইল লোকটা।
মাথা নাড়ল রাধা। ধুকপুক করছে বুক।
“আমি হোশিয়ার সিং। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো থেকে এসেছি।” আইডি কার্ড বের করেও দেখাল। কিন্তু রাধার শূন্য চোখে কিছুই ধরা পড়ল না। কেবল জানতে চাইছে যে এত রাতে লোকটা এখানে কী করতে এসেছে।
“মিঃ ইমরান কিরবাঈকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।” জানাল হোশিয়ার সিং। “কেউ একজন আজ সন্ধ্যায় তার অ্যাপার্টমেন্টে রকেট প্রপেলড বোমা ছুঁড়ে খুন করতে চেয়েছিল। অবস্থা বেশ সংকটজনক। আমাকে বলা হয়েছে। আপনাকে জানানোর জন্য, যদি হাসপাতালে আসতে চান তো।”
হতভম্ব হয়ে গেল রাধা। ইমরান হাসপাতালে? বোমা? যা শুনছে কেন যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। খানিকক্ষণ আগেই তো ইমরানের সাথে কথা হয়েছে।
“আমাকে একটু সময় দিন” ভেতর থেকে ফোন আনতে ছুটল রাধা। দ্রুত হাতে ইমরানের অবস্থা জানিয়ে বিজয়কে মেসেজ পাঠিয়ে হাসপাতালে দেখা করার কথা জানাল। “চলুন।” দরজায় তালা লাগিয়ে এস্তপায়ে বাগান ধরে অপেক্ষারত গাড়ির কাছে চলে এলো রাধা।
.
এক অদ্ভুত ত্রাণকর্তা
মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দেহবর্মের ডিসপ্লের পেছনে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সবকিছু দেখেছেন ডা. শুক্লা। এলিসকে টানতে টানতে ট্যাবলেটের রুমে নিয়ে গেল রাইলি। বিজয়ের মত তিনিও বুঝতে পারলেন যে সন্ত্রাসীরা তার অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই জানে না। জানেন না ঠিক হবে কিনা, তবে সিদ্ধান্ত নিলেন যে লুকিয়েই থাকবেন। অন্য কোনো কাজে না লাগলেও বাকিদেরকে বন্দী করার পর তিনি অন্তত ইমরানকে ফোন করে সাহায্য চাইতে পারবেন। এই ফাঁকে মনে মনে নিজেকে গালও দিলেন। জীবনে প্রথমবারের মত সাথে মোবাইল ফোন না রাখার জন্য অনুশোচনা করলেন। এত বছর ধরে রাধা অনেকবার চেষ্টা করলেও তিনি একথা কানেই তোলেন নি। “যখন মোবাইল ফোন ছিল না তখনো তো আমি দিব্যি ঘুরে ফিরে চলেছি”। মেয়েকে শান্ত করেছেন, “যদি কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করতে চায় তাহলে ঠিকই খুঁজে পাবে।”
আজ উপলব্ধি করেছেন যে এরকম পরিস্থিতিতে একটা মোবাইল ফোন কতটা দরকার। একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েও সাহায্য চাওয়া যেত।
এরই ফাঁকে এলিসকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে দিল রাইলি। টলতে টলতে আরেকটু হলেই পড়েই যাচ্ছিল মেয়েটা। তৃতীয় গানম্যান এগিয়ে এসে ধরে ফেলল। লোকটা ঠিক ডা. শুক্লার ফুট খানেক দূরে।
লোকটা এলিসকে ধরলেও নিজের ভারসাম্য বাঁচাতেই হাবুডুবু খাচ্ছে।
হঠাৎ করেই ডা. শুক্লার মাথায় এলো একটা আইডিয়া।
লোকটা যেই না নিজেকে ধাতস্থ করতে যাবে সেই মুহূর্তে কুড়ালের মাথা দিয়ে গানম্যানের মাথায় ডা. শুক্লা দিলেন একটা বাড়ি একই সাথে এলিসকেও ধরে ফেললেন। বর্মের আড়াল থেকে বেরিয়ে মুহূর্তের মাঝে ঘটিয়ে ফেললেন সব কাণ্ড।
কুড়ালের আঘাতে মেঝেতে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে গেল গানম্যান। চুরমাড় হয়ে গেল ডিসপ্লের কাঁচ আর সাথে সাথে যেন চারপাশে নরক ভেঙে পড়ল।
ডা. শুক্লাকে কুড়াল ঘোরাতে দেখেছে বিজয় আর কলিন। প্রথমে অবাক হয়ে গেলেও সাথে সাথে যার যার পাশের গানম্যানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
বন্দীদের দিকে নজর থাকায় সহকর্মীর পতন দেখে বিস্মিত হয়ে গেল বাকি দুই গানম্যান। ফলে মুহূর্তের জন্য তারাও দিশেহারা হয়ে পড়ল।
সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল বিজয় আর কলিন। নিচু হয়ে বসে এক হাঁটুর উপর ভর দিয়ে ঘুরে আরেক পা দিয়ে এক গানম্যানকে আঘাত করল কলিন। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল লোকটা। হাত থেকে পড়ে গেল পিস্তল। ডাইভ দিয়ে অস্ত্রটা হাতে নিয়েই হাতল দিয়ে লোকটার মাথায় বাড়ি দিতেই জ্ঞান হারাল গানম্যান।
এলিসকে তুলে দরজার দিকে দৌড় দিলেন ডা. শুক্লা। অন্যদিকে মেঝেতে গড়িয়ে গিয়েই হাতের গদা ঘুরিয়ে পেছনের গানম্যানকে মারল বিজয়। যদি আবার নিজের গায়েই লাগে তাই গড়িয়ে সরে এলো একপাশে। গোলাকার রডের মাথায় লাগানো আটটা ফলা বিজয়কে নিরাশ করল না। গানম্যানের উরুতে লেগে কেটে দিল পেশি; অথর্ব হয়ে পড়ে গেল গানম্যান।
মাত্র সেকেন্ড খানেকের মধ্যেই এত কিছু ঘটে গেল যে রাইলি নড়াচড়ারও সুযোগ পেল না। খাপ থেকে ছুরি বের করার আগেই বাইরে বেরিয়ে গিয়ে ঠাস করে দরজা আটকে দিল চার বন্দী।
প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে উঠতেই লাফ দিয়ে পিছু নিল রাইলি। কিন্তু হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে গেছে পুরো গ্যালারি। নিশ্চয় চারজনের কেউ একজন মাথা খাঁটিয়ে যাবার আগে করিডোরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে গেছে।
এটা সেটার সাথে ধাক্কা খেতে খেতে অতি সন্তর্পণে দরজার কাছে এলো রাইলি। কিন্তু খোলার পর দেখা গেল করিডোরেও নিকষ কালো আঁধার। উন্মুক্ত জানালা দিয়ে কানে এল মিউজিয়ামের বাইরে গাড়ি স্টার্ট দেবার আওয়াজ।
রাগে জ্বলে উঠল সর্বাঙ্গ। খেপে গিয়ে সিঁড়ির কাঠের হাতলের গায়ে ছুরির কোপ মারলেও শান্তি হচ্ছে না। কুপারকে সবকিছু জানাতে হবে। কিন্তু কুপারের প্রতিক্রিয়া চিন্তা করে যে রাগ হচ্ছে তা না; আজ রাতের এ ঘটনা তার রেকর্ডে দাগ ফেলে দিল। নিজের লোকেরাই হল এ ভরাডুবির কারণ।
তবে ভবিষ্যতে আর কখনোই এমনটা হবে না।
.
৩৪. নিউ দিল্লি
তাড়াহুড়ো করে মিউজিয়াম থেকে বেরিয়েই সেন্ট্রাল দিল্লির রাস্তা ধরে গাড়ি ছোটাল বিজয়। ব্যস্ত ট্রাফিকের মাঝেও এঁকেবেঁকে ছুটতে ছুটতে মিউজিয়াম আর তাদের মাঝে যতটা সম্ভব দূরত্ব কমাতে চাইছে। সবার চোখের সামনেই ভাসছে ঠাণ্ডা মাথায় কিউরেটরকে হত্যার দৃশ্য।
একটু পরে অবশ্য খানিকটা টেনশন কমলেও হুইলে ধরা হাত একটুও নরম হল না। “লোকটা কী কুপার নাকি?” এলিসকে জিজ্ঞেস করল বিজয়।
কোনোমতে মাথা নাড়ল এলিস। এখনো নিজেকে সামলাতে পারছে না। সোনালি চুলের তরুণটাকে না চিনলেও এটা বেশ বুঝতে পারছে, তাকে এত সহজে ছাড়বে না ওরা। সেই গ্রিস থেকে এতদূর পিছু ধাওয়া করে দিল্লি পর্যন্ত চলে এসেছে। এমনকি বিজয়ের দুর্গের কথাও জানে!
“ইমরানকে জানাতে হবে। কুপার হোক বা না হোক আজ রাতের ঘটনাটা এমনি এমনিই ঘটেনি। কেউ একজন সারাক্ষণ তোমার উপর চোখ রাখছে এলিস।” ঠিক যেন মেয়েটার মনের কথাই টের পেয়েছে বিজয়। কলিনকে নিজের ফোন দিয়ে জানাল, “ইমরানকে ফোন করো। স্পিড ডায়ালে নাম্বার আছে।”
মাথা নেড়ে স্মার্টফোনের স্ক্রিনসেভার সরাতে বিজয়ের পাসওয়ার্ড টাইপ করল কলিন, “আরে, রাধা তোমাকে একটা মেসেজ পাঠিয়েছে।”
“পড়ো তো!” অবাক হয়ে গেল বিজয়।
পড়ার সাথে সাথে কলিনের চোয়াল ঝুলে পড়ার দশা।
“কী হয়েছে?” ভেতরের সীট থেকে জানতে চাইলেন ডা. শুক্লা। পাশেই এলিস।
“ইমরান” কেঁপে উঠল কলিনের গলা। যা পড়েছে তা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। “আজ সন্ধ্যায় উনার অ্যাপার্টমেন্টে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। এখন হাসপাতালে আছেন? কে একজন আইবি’র লোকের সাথে রাধাও ওখানে গেছে। বলল আমরাও যেন যাই।” হাসপাতালের ঠিকানা জানাতেই তৎক্ষণাৎ গাড়ি ঘোরাল বিজয়। আর হয়ত পনের মিনিটের মাঝেই পৌঁছে যাবে।
.
আইবি? নাকি না?
গাড়িতে বসে একদৃষ্টে চারপাশের দৃশ্য দেখছে বিষণ্ণ রাধা। মাথায় যদিও একগাদা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ইমরানকে কেন টার্গেট করল? উনাকে কেন কেউ খুন করতে চাইবে? এর সাথে কী আগের দিন টাইটানে ভিজিটের কোনো সম্পর্ক আছে? যদি তাই হয় তাহলে তো ওর নিজের জীবনও সংশয়ের মধ্যে পড়ে গেছে।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে চিন্তাটা দূর করে দিল রাধা। ভেবে ভাল লাগছে যে সে অন্তত তিনজন ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তার সাথে এই গাড়িতে নিরাপদেই আছে।
“ডাক্তারেরা ইমরানের সম্পর্কে কী বলেছেন?” পাশেই বসে থাকা এজেন্টের দিকে তাকাল রাধা। গোঁফঅলা লোকটার চেহারা বেশ রুক্ষ।
কিন্তু উত্তর না দিয়ে লোকটা কেবল কাধ ঝাঁকাল। সামনের প্যাসেঞ্জার সিট থেকে এদিকে ঘুরে উত্তর দিল হোশিয়ার সিং, “আমরা শুধু জানি যে উনার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। বাকিটা পৌঁছানোর পর জানা যাবে।”
বহুকষ্টে চোখের জল আটকাল রাধা। গত বছর থেকেই ইমরানের সাথে তার একটা বিশেষ সম্পর্ক হয়ে গেছে। কিডন্যাপড হবার পরে আরেকটু হলে মারাই যাচ্ছিল। ইমরান এসে বাঁচিয়েছে; এখন পর্যন্ত নিশ্বাস নিতে পারছে।
গোলচত্বরের কাছে এসে বামদিকে ঘুরে গেল গাড়ি। এখনো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আত্মমগ্ন থাকলেও খানিকটা চমকে উঠল রাধা। কোন পথ ধরে এগোচ্ছে এতক্ষণ কেন যেন খেয়াল করেনি। সাউথ দিল্লি থেকে হাসপাতালের দিকেই এসেছিল। কিন্তু ইমরানকে হারাবার চিন্তায় অস্থির থাকায় বুঝতেই পারেনি কখন দূরে সরে এসেছে। এইমাত্র উপলব্ধি করল যে চানক্যপুরীর মধ্য দিয়ে ধোলা কুয়ানের দিকে ছুটছে গাড়ি; আর এই রাস্তায় ওদেরকে গুড়গাঁও নিয়ে যাবে।
ঝট করে একবার পাশের কর্কশ চেহারার এজেন্টের দিকে তাকিয়ে সামনের দুজনেকেও দেখে নিল রাধা। কেউই বুঝতে পারছে না যে তারা ভুল রাস্তায় যাচ্ছে বা বুঝতে পারলেও কোনো প্রক্ষেপ নেই। গাড়ির রেডিও অন করা আর লেটেস্ট বলিউড গানের সাথে গুনগুন করছে হোশিয়ার সিং।
কোথায় কোনো একটা গন্ডগোল হচ্ছে। অস্বস্তি বোধ হল। এরা সত্যিই আইবি এজেন্ট তো? নাকি এসব কিছুই আচমকা টাইটানে উদয় হবার পরিণতি? এজেন্টের আইডি কার্ড স্মরণ করার চেষ্টা করলেও বুঝতে পারল একটুও মনে নেই। হয়ত ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখেছে। এতটা অসাবধান হবার জন্য মনে মনে নিজেকে গালও দিল।
কিন্তু যদি এরা আইবি এজেন্টের ভান ধরে এসে থাকে তাহলে এতক্ষণও ওকে খুন করেনি কেন? কোনো প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় বাড়িতেই তো কাজটা সারতে পারত। কেন তাহলে ইমরানকে দেখানোর বাহানা করে হাসপাতালে নেবার কথা বলেছে? তার মানে ইমরানের কথাটা আসলে অজুহাত। এ চিন্তা মাথায় আসতেই খানিকটা আশাও জাগল। হয়ত ইমরান সুস্থই আছেন; উনার কিছুই হয়নি। কিন্তু নিজের কথা মনে হতেই আবার খুশি উবে গেল।
নিজের সিটে প্রায় ডুবে গেল রাধা। হতে পারে ও একটু বেশিই ভয় পাচ্ছে। কিন্তু ওর ধারণাটা যদি সত্যি হয় তাহলেও সন্দেহের কথাটা এদেরকে বুঝতে দেয়া যাবে না। দুপাশের দরজার উপর চোখ বোলাল সেন্ট্রাল লকিং মেকানিজম দিয়ে তালা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই না যে খোলা যাবে না। তবে চলন্ত গাড়ি থেকে ঝাঁপ দেবার কোনো মানে নেই। আহত হলে আবার ওকে বয়ে নিয়ে যাবে লোকগুলো।
বুঝতে পারল পালানোর জন্য হয়ত কেবল একটাই সুযোগ পাবে। তাতে যদি ব্যর্থ হয় তাহলে লোকগুলোও সতর্ক হয়ে যাবে আর দ্বিতীয় কোনো সুযোগ পাওয়া যাবে না।
চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল রাধা। এত সহজে হাল ছাড়া যাবে না। ধৈর্য ধরে কোনো একটা ট্রাফিক ইন্টারসেকশনে গাড়ি না থামা
পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সেটাই হবে একমাত্র সুযোগ।
একদৃষ্টে রাস্তার দিকে তাকিয়ে অজানা গন্তব্যের কথা ভাবল রাধা; কী ঘটতে যাচ্ছে ওর সাথে?
.
৩৫. হাসপাতাল
হাসপাতালের পার্কিং লটে ঢুকেই ঘঁাচ করে ব্রেক কষল বিজয়। চারজন আরোহীর সবাই একসাথে বেরিয়েই ছুটল ইমারজেন্সি রুমের দিকে। বিজয় আর কলিন রিসেপশনে হুমড়ি খেতেই পিছনে চলে এলো এলিস। তরুণদের মত এত জোরে না পারলেও আস্তে আস্তে এলেন ডা. শুক্লা।
“ইমরান কিরবা?” রুদ্ধশ্বাসে জানতে চাইল বিজয়, “আমরা উনার বন্ধু।”
“জাস্ট আ মোমেন্ট প্লিজ” মাপা কণ্ঠে জবাব দিল রিসেপশনিস্ট। কিছু কাগজপত্র চেক করে কি-বোর্ডে কী যেন টাইপ করল। তারপর কম্পিউটার মনিটর দেখে অবশেষে মাথা নেড়ে জানাল, “নাহ, এই নামে এখানে কেউ নেই।”
পরস্পরের দিকে তাকাল দুই বন্ধু, “আপনি নিশ্চিত?” বিশ্বাসই করতে পারছে না বিজয়। “আমরা তো শুনেছি যে উনি নাকি কিছুক্ষণ আগেই এখানে ভর্তি হয়েছেন। বোমা বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে কাজ করেন।”
দৃঢ় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রিসেপশনিস্ট, “আমি সমস্ত রেকর্ড চেক করে দেখেছি। কোনো বোমা বিস্ফোরণে আহত রুগী নেই। আর ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো থেকে তো নয়ই। আয়্যাম সরি। হয়ত আপনারা ভুল হাসপাতালে এসেছেন।”
এতক্ষণে সবার কাছে পৌঁছে সবকিছু শুনলেন ডা. শুক্লা। সাথে সাথে উদ্বেগে ভরে গেল চেহারা। কাউকে বলতে হল না। বাকিরাও বুঝতে পারছে। সবার মাথায় ঘুরছে একই চিন্তা। যদি ইমরান হাসপাতালে না থাকে তো রাধার সাথে কাদের দেখা হয়েছে আর ওকে কোথায়ই বা নিয়ে গেছে?
.
উদয় হল সুযোগ
ধোলা কুয়ানে পৌঁছে গেল গাড়ি। এইমাত্র ফ্লাইওভার পার হয়েছে। পাশেই এয়ারপোর্ট এক্সপ্রেস মেট্রো লাইন। এবার সোজা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের দিকে ছুটছে।
মেট্রো স্টেশনের পরের সিগন্যালেই প্রচুর গাড়ি দেখা যাচ্ছে। রিং রোডের চারপাশ থেকে আসছে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। কার, বাস, টু-হুঁইলার মিলে যত্রতত্র মোড় ঘোরার কারণে সৃষ্টি হয়েছে প্রচন্ড ট্রাফিক জ্যাম।
বুঝতে পেরেই শক্ত হয়ে গেল রাধা। এই-ই সুযোগ। এই সিগন্যালটা পার হলেই দিল্লি থেকে গুড়গাঁওগামী এক্সপ্রেসওয়ে। তারপর গাড়ি এত জোরে ছুটবে যে আর কোনো সুযোগ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
চট করে একবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রাধা। পাশের গাড়িটা এতটাই কাছে যে দুটোর মধ্যে খুব বেশি হলে ফুট খানেকের ব্যবধান। তাই দরজা খুলে বের হওয়াটা বোকামি হবে।
ধীরে ধীরে এগোচ্ছে গাড়ি। শত চেষ্টা করেও এলোমেলো ট্রাফিকের মধ্য দিয়ে চালাতে পারছে না ড্রাইভার। দুটো গাড়ির মাঝখানের গ্যাপ খানিকটা বাড়লেও টেনশনে আছে রাধা! সবুজ বাতি জ্বলে উঠল। দ্রুত কেটে যাচ্ছে জ্যাম।
এখন নয়ত কখনোই নয় ভাবতে ভাবতে অবচেতনেই ডোরনবে হাত দিল রাধা।
আর ঠিক সেসময়েই বেজে উঠল ফোন। গাড়ির বাকি তিনজনই সাথে সাথে ওর দিকে তাকাল। অথচ শেষ ভরসা এটাই।
.
কোনটা সত্যি?
“ও তত ফোন ধরছে না” চিন্তিত স্বরে জানাল বিজয়। ডা. শুক্লাও বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। নিঃশব্দে পরস্পরের যাতনা আর অনুভূতি ভাগ করে নিলেন একজন পিতা আর এক ফিয়ান্সে।
“ইমরানকে দেখো তো” বলে উঠল কলিন, “উনাকে তো এমনিতেও পিটার সম্পর্কে জানাতে হবে। হয়ত রাধা কোথায় আছে উনি জানেন।” এ বিষয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ থাকলেও মানসিক স্পৃহাকে হারাতে চায় না। তাহলে বিজয় আর ডা. শুক্লা আরো ভেঙে পড়বে।
মাথা নেড়ে ইমরানের নাম্বার ডায়াল করল বিজয়। অদ্ভুত আর অপরিচিত একটা স্বর বলে উঠল, “ইয়েস?”
“আ…আমি আসলে ইমরান কিরবাঈয়ের সাথে কথা বলতে চাই” খানিকটা দ্বিধা নিয়ে উত্তর দিল বিজয়।
“তুমি কে?” বেশ কর্তৃত্বের স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করল আগন্তুক।
এক মুহূর্তের জন্য শক্ত হয়ে গেল বিজয়। মনে হচ্ছে লোকটা ইমরানকে চেনে। তারপরেও এটা নিশ্চিত যে ইমরান নন। তাহলে কে?
“আমি…ওমম…উনার বন্ধু” অবশেষে বলল বিজয়, “বিজয় সিং।”
“হোল্ড অন।” আদেশ দিয়েই কয়েক মুহূর্তের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেল অজানা কণ্ঠস্বরের মালিক। খানিক বাদেই অবশ্য জানাল, “ওকে, ইউ চেক আউট। ইউএস-ইন্ডিয়া টাস্ক ফোর্সে তুমিও আছো। সরি, বিজয়। নিশ্চিত হওয়া দরকার ছিল যে সত্যিই তুমি ফোন করেছ কিনা। এরকম পরিস্থিতিতে আমরা কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না।”
ক্রমেই বাড়ছে বিজয়ের বিস্ময়। আবার খানিকটা উদ্বেগও আছে। এরকম পরিস্থিতি মানে কী? ইমরান কোথায়?
তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল লোকটা।
“তোমাকে জানানো হয়নি?” মনে হল উনিও অবাক হয়েছেন। “আজ তো ইমরানকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। একেবারে ক্লোজ রেঞ্জে ওর অ্যাপার্টমেন্টে ছোঁড়া হয়েছে একটা রকেট প্রপেলড বোমা। ধুলায় মিশে গেছে পুরো অ্যাপার্টমেন্ট। ইমরানের অবস্থাও বেশ সংকটপূর্ণ। সার্জারি চলছে। জানি
কতটুকু কী হবে।” বিজয়ের মনে হল মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তার মানে ইমরানের উপর অ্যাটাকের খবরটা সত্য! খুব দ্রুত সবকটা ইনফরমেশনকে একসুতোয় জোড়া লাগাল। এখন ইমরানের সার্জারি চলছে আর তারাও ভুল হাসপাতালে এসেছে যার মানে রাধাকে অপহরণ করা হয়েছে। আর যারা ওকে গায়েব করেছে তারা আইবি এজেন্টের বেশ ধরে এসেছে মানে পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিল। লোকগুলো মেয়েটার জন্য অত্যন্ত ভয়ংকর। বাজি ধরে বলতে পারে যে এই নকল আইবি এজেন্টেরাই ইমরানকেও মারতে চেয়েছিল।
“বিজয়” জানতে চাইল ওপাশের কণ্ঠ, “তুমি এখনো লাইনে আছো?”
কী বলবে কিছুই মাথায় আসছে না। কোনোমতে জানতে চাইল, “আপনি কে?”
কঠোর স্বরে জানাল সে কণ্ঠ, “আমি অর্জুন বৈদ্য, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর, আগেও দেখা হয়েছে তোমার সাথে।”
নিজের উপরই ক্ষেপে গেল বিজয়। সে তো বৈদ্যকে চেনে। ইমরানের বস। গত বছর পুরো অ্যাডভেঞ্চার শেষ হবার পর দেখাও হয়েছে। কিন্তু উনিই যে ফোন ধরবেন সেটাই বা বিজয় কিভাবে জানবে।
“আয়্যাম সরি, মিঃ বৈদ্য, তোতলাতে লাগল বিজয়, “আসলে আপনার কণ্ঠস্বর চিনতে পারিনি। কিন্তু এটাও আশা করিনি যে…”
“দ্যাটস ফাইন”, জানালেন বৈদ্য, “তুমি এখন কোথায়? রাধাও কি তোমার সাথে আছে? আজ যে ওরা টাইটান ফার্মাতে গিয়ে ছিল সেটার সাথে এই ঘটনার যোগসাজস থাকার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।”
ভয়ে বিজয়ের হাত-পা হিম হয়ে গেল। আগেও বহুবার সে আর রাধা এসবের মাঝে দিয়ে গিয়েছে। প্রথম যখন ইমরান ট্রাস্ক ফোর্সে জয়েনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন, তখন বিজয় মানা করেছিল। গত বছরের স্মৃতি এখনো মন থেকে মুছেনি, তাছাড়া একটা সিক্রেট রক্ষার গুরুভারও আছে কাঁধে। শেষমেশ রাধার পীড়াপীড়িতে রাজি হতে হল।
“তোমার চেয়ে টাস্ক ফোর্সের জন্য বেশি উপযুক্ত আর কে আছে”, বলেছিল মেয়েটা; বিজয়ের সিক্রেট সম্পর্কে কলিন আর রাধাও জানে। নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুজন ব্যক্তির কাছে একথা লুকাতে মন সায় দেয়নি। আর তাই রাধা বুঝিয়েছিল, “তোমার দেশ শুধু নয় বরঞ্চ গোটা পৃথিবীর জন্য কাজ করার সুযোগ পাবে। এ ধরনের সুযোগ জীবনে কেবল একবারই আসে।”
অগত্যা মানতেই হল। এরপর রাধা জয়েন করার সময়েও আপত্তি করেছিল; কিন্তু মেয়েটা ওর কথা কানেই তোলেনি।
“ব্যাপারটা কিন্তু বেশ বিপজ্জনক” অনেক বোঝাতে চেয়েছে বিজয়। “ওহ, আমার জন্য বিপজ্জনক আর তোমার জন্য নয়, তাই না?” স্বভাবসুলভ জ্বলজ্বলে চোখে উত্তর দিয়েছিল কঠোর রাধা, কারণ তুমি পুরুষ আর আমি নারী বলে?”
“না, সেটা না” আমতা আমতা করে উত্তর দিয়েছিল বিজয়। মনে মনে অবশ্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। রাধাই তো ওকে রাজি করিয়েছে আর ও কিনা ওর সাথে! কিন্তু নিজের কথা খুলে বলার সাধ্য ছিল না।
এখন আবার নাড়া দিল সে স্মৃতি। বিজয়ের ভয়ই অবশেষে সত্যে পরিণত হল। জীবনে প্রথমবারের মত, তাও ইমরানের অসন্তুষ্টি নিয়েই ফিল্ড মিশনে গিয়েছিল রাধা। আর এখন এমনকি বৈদ্য পর্যন্ত জানে না যে ও কোথায়।
যা যা ঘটেছে সব খুলে বলল বিজয়। ইমরানের অ্যাপার্টমেন্টে যারা বোমা ফাটিয়েছে তারা যে নকল আইবি এজেন্টদের সাথেও জড়িত সে ব্যাপারে অর্জুন বৈদ্যও একমত হলেন।
“ডোন্ট ওরি” বিজয়কে আশ্বস্ত করে বললেন, “আমি এক্ষুনি রাধার ফোন ট্রেস করার ব্যবস্থা করছি। যদি জিপিএস অন থাকে তাহলে তাড়াতাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে। আর ইমরানের সম্পর্কে তোমাকে জানাব। ঈশ্বর জানেন যে আমরা সকলেই ওর দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। এখন যেখানে আছে সেখানেই থাকো। আমি কয়েকজন এজেন্টকে পাঠাচ্ছি। মনে হচ্ছে তোমরা কেউই নিরাপদ নও।”
“থ্যাংকস” ফোন কেটে দিয়ে অন্যদেরকে সবকিছু জানাল বিজয়। তবে কথা বলার সময় কেন যেন আরেকটা চিন্তা খেলে গেল মাথায়। বৈদ্যর একটা মন্তব্যে কেন যেন খটকা লেগেছে। হঠাৎ করেই বুঝতে পারল যে সোনালি চুলের তরুণ কিভাবে দুর্গে তাদের একত্রে থাকার কথা জানতে পেরেছে। ডা.
শুক্লার কথা কেন টের পায়নি সেটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে।
.
৩৬. ৩২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, সেপ্টেম্বর
সমরকন্দ, বর্তমান সময়ের উজবেকিস্তান
ল্যাম্প আর মশালের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে পুরো সগডিয়ান রাজপ্রাসাদ, কর্মব্যস্ত চারপাশে সকলেই আনন্দ-উল্লাসে মত্ত। ভোজনের আয়োজন করেছেন সম্রাট স্বয়ং। অপ্রত্যাশিত এক পরাজয়ের পর বাল্ক পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করে নতুন করে শৃঙ্খলিত করেছেন তার সেনাবাহিনি। এরপর চারটা মোবাইল ইউনিটকে নদী উপত্যকা পেরিয়ে বর্তমানকালের তাজিকিস্তান আর আরেকটা ইউনিট উজবেকিস্তানে পাঠিয়েছেন সমরকন্দে একত্রিত হবার জন্য। পরিবার পরিজনসহ বিদ্রোহী গোত্র প্রধানেরা পিছিয়ে চলে এসেছে আলেকজান্ডারের পরবর্তী স্টপেজ সগডিয়ান রক পর্যন্ত। এর পেছনে অবশ্য অনেক কারণও আছে।
তবে এতে বর্তমানের আনন্দে কোনো ভাটা পড়েনি। আলেকজান্ডার এখন পারস্য সম্রাট। আগামীতে রকও জয় করে নেবেন। কোনো কিছুই তার পথে বাধা হতে পারে না।
প্রাসাদের ভেতরে উপচে পড়ছে ভোজনশালা। পানির মত বইছে ওয়াইন, আর টেবিলগুলোও উপাদেয় সব সগডিয়ান খাবারে পূর্ণ।
বিশাল কক্ষে একসাথে মিশে গেছে সাধারণ সৈন্য আর জেনারেল, মেসিডোনীয় আর অ-মেসিডোনীয় সকলেই। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেছে সমস্ত শক্রতা আর রাজনীতি। যুদ্ধের কথা বিস্মৃত হয়ে সবাই বেশ আন্তরিক আচরণ করছে।
তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না এ পরিবেশ।
হলের একপাশে হেফাসন আর নিজের অন্তরঙ্গ কজন পুরুষকে নিয়ে আসর জমিয়েছেন আলেকজান্ডার। চিৎকার-চেঁচামেচি আর হাসির হল্লায় বোঝ গেল সুরার মাত্রা।
কিন্তু ওয়াইনে মত্ত হবার আগেই এগিয়ে এলেন হেফাসন।
“এবার চুপ হও সবাই!” গুটিকয়েক সৈন্য আর জেনারেল এদিকে মনোযোগ দিলেও বেশিরভাগই কোনো পাত্তা দিল না। কেউ একজন আবার এমন এক মন্তব্য করল যে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন আলেকজান্ডার।
এবার নিজের কর্তৃত্ব জাহির করার সিদ্ধান্ত নিলেন হেফাসন। খাবার ভর্তি একটা টেবিলের উপর লাফ দিয়ে উঠে ব্রোঞ্জের দুটি সার্ভিং ডিশের সমস্ত কিছু ফেলে বেশ কয়েকবার জোরে জোরে করাঘাত করলেন।
অবশেষে নিশ্চুপ হল পুরো কক্ষ। কিছু একটা ঘটছে আঁচ করে সবাই এদিকে মনোযোগ দিল। আলেকজান্ডারের প্রিয়ভাজন যখন এভাবে টেবিলের উপর উঠে বাসন বাজাচ্ছে আর সম্রাট নিজেও শান্ত হয়ে আছেন তখন ব্যাপার নিশ্চয় গুরুতর।
সন্তুষ্ট হেফাসন এবার আলেকজান্ডারের পাশে বসা একজনকে ইশারা দিলেন।
“আমাদের স্থানীয় কবি প্রাণিকাসের লেখা কবিতা শোন”, মিটিমিটি হেসে লাফ দিয়ে টেবিল থেকে নেমে এলেন হেফাসন।
সবাই হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিল। টেবিলের উপর উঠে আবৃত্তি শুরু করলেন প্রাণিকাস।
সাথে সাথে পাল্টে গেল সমস্ত চিত্র। প্রাণিকাসের আবৃত্তির সাথে সাথে হলের বেশির ভাগ লোক হেসে কুটি কুটি হল। আবার বিভিন্ন ধরনের মন্তব্যে ভারী হয়ে উঠল বাতাস। অন্যদিকে কবিতা শুনে কয়েকজনের চেহারা হয়ে উঠল কালো আর কঠোর।
এরা সকলেই বেশ প্রাচীন পন্থী। আলেকজান্ডারের পিতা ফিলিপের আমলের রাজনীতিবিদ। তবে তরুণ রাজাকেও কম সহায়তা করেন নি। একসাথে লড়েছেন বিভিন্ন লড়াই। বিশেষ করে বলা যায় মেসিডোনিয়ানদের ভাগ্যের পাল্লা ভারী করা গগাঁমেলার যুদ্ধ। তাই যা শুনছেন তা কিছুতেই মনঃপুত হচ্ছে না।
সমরকন্দে আলেকজান্ডারের জেনারেলদের পরাজয়ের উপর রচিত এ কবিতায় বলা হয়েছে গত শীতে বাধ্য হয়ে বাল্কে পিছিয়ে আসার কথা। ব্যাকট্রিয়ান গোত্রের হাতে এরকম অবমাননার জন্য উপহাসের পাত্র হয়েছেন। জেনারেলগণ।
এ কথা কানে আসতেই নিজেদের মাঝে মৃদু গুঞ্জন শুরু করলেন প্রাচীনপন্থী রাজনীতিকেরা। এদের মাঝে সবচেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন মাত্র কিছুদিন আগেই ব্যাকট্রিয়া ও সগডিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত প্রাদেশিক শাসনকর্তা ক্লিটাস।
“বর্বর আর শত্রুদের সামনে মেসিডোনিয়াদেরকে অপমান করা হচ্ছে।” দাঁতে দাঁত ঘষে বুঝিয়ে দিলেন রাগের মাত্রা। “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি এসব সহ্য করব নাকি? আমাদের মাঝে কী কোনো সত্যিকারের পুরুষ নেই? আমাদেরকে ব্যঙ্গ করছে তাই কী দেখতে হবে?”
“সফলতা এলে আলেকজান্ডার হয় এর দাবিদার আর যখন পরাজিত হই তখন জেনারেলরা হয় দায়ী।” অসন্তোষে অভিযোগ করলেন আরেকজন। “ফিলিপের সময়তো এমনটা কখনো হত না।”
ওনার দিকে তাকালেন ক্লিটাস, “তাহলে কিছু বলছেন না কেন? বন্ধ করুন এসব বাজে কথা! ফিলিপ আর এমনকি আলেকজান্ডারের সামনেও আমাদের কথা বলার যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে। আমাদের যুক্তি নিশ্চয় আগ্রাহ্য করবে না।
“লোকগুলো সব মাতাল হয়ে গেছে।” ভর্ৎসনা করে উঠলেন আরেকজন প্রাজ্ঞ। “মাত্রাতিরিক্ত ওয়াইনের প্রভাবে ওদের মাথা কাজ করছে না। তাই এ সময়ে কিছু বলাটা ঠিক হবে না। পারসেপোলিসে কী হয়েছে মনে নেই?” পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী পারসেপোলিসে প্রবেশ করে এরকমই এক ভোজনের আয়োজন করেছিলেন আলেকজান্ডার। আর সেই অনুষ্ঠানেই মদ্যপ আলেকজান্ডার সিদ্ধান্ত নেন পুরো পারসেপোলিসে আগুন ধরিয়ে দেবেন। ফলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে অনিন্দ্য সুন্দর সে শহর।
“আর মাতাল হয়ে ফিলিপ যে আলেকজান্ডারকেও খুন করতে চেয়েছিল সে কথাও মনে রেখো।” অভিজাত বংশ থেকে আসা এক রমণী, ক্লিওপেট্রা আর ফিলিপের বিবাহ অনুষ্ঠানের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন আরেক প্রৌঢ়। আলেকজান্ডারকে অবৈধ ইশারা করে ক্লিওপেট্রার চাচা অ্যাটালাস মন্তব্য করেছিলেন যে এবার ফিলিপ এক বৈধ উত্তরাধিকারী জন্ম দিতে পারবে। অলিম্পিয়াস নিজে ফিলিপ নয় বরঞ্চ জিউসকেই আলেকজান্ডারের পিতা দাবি করলেও ক্ষেপে উঠেন আলেকজান্ডার। অ্যাটালাসের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে মারেন নিজের কাপ আর মাঝখানে ফিলিপ পড়ে যাওয়ায় সাথে সাথে তরবারি বের করে আলেকজান্ডারকে খুন করতে উদ্যত হন মৃত সম্রাট। কিন্তু নেশাগ্রস্ত থাকায় মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়াটাই সার হয়।
তবে এতে স্পষ্ট হয়ে উঠে যায় সুরামত্ত রাতে ঘটনা কতদূর এগোতে পারে। আজ রাতটাও ঠিক তেমন। তাই তুচ্ছ কিছু নিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠাকে সায় দিলেন না প্রাচীন রাজনীতিকেরা।
কিন্তু ক্লিটাস দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। “এসব থামাতেই হবে। আর যদি আপনাদের কারো সাহস না হয় আমিই করব। গ্রাণিকাসে আমিই বাঁচিয়েছি আলেকজান্ডারকে। আর ভুলে যাবেন না যে পিলোটাসকে হত্যা করার পর সেনাবাহিনির অর্ধেক আমাকে আর বাকি অর্ধেক হেফাসনকে সমর্পণ করেছে। তাই আমার কথা না মেনে পারবে না।”
ধাক্কা দিয়ে ভিড়ের মাঝে পথ করে একেবারে প্রাণিকাসের টেবিলে পৌঁছে গেলেন ক্লিটাস।
“যথেষ্ট হয়েছে!” প্রাণিকাসকে আদেশ দিয়ে বললেন, “আর না!” আবৃত্তির মাঝপথে থেমে গিয়ে হেফাসন আর আলেকজান্ডারের দিকে তাকাল প্রাণিকাস।
টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন অ্যালকোহলের নেশায় আচ্ছন্ন তরুণ রাজা।
“কেন থামবে?” ক্লিটাসকে জিজ্ঞেস করলেন আলেকজান্ডার, “সে তো সত্যি কথাই বলছে।”
পুরো হল রুমে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। ব্যাপারটা এখন আর প্রাণিকাস আর ক্লিটাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আলেকজান্ডারও জড়িয়ে পড়েছেন।
আস্তে করে টেবিল থেকে নেমে পিছু হটল প্রাণিকাস। পরস্পরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ক্লিটাস আর আলেকজান্ডার।
“তোমার পিতার আমল থেকেই এ ঐহিত্য চলে আসছে যে বিজয়ের দাবিদার আর পরাজয়ের জন্য দায়ী,..” ক্লিটাস শুরু করলেও শেষ করতে পারলেন না, মাঝপথে বাধা দিলেন আলেকজান্ডার।
“আমার পিতা!” থু করে থুথু ফেলে বললেন, “এমনভাবে বলছেন যেন তার মত নীতিবান আর কেউ নেই। তার বিজয়ে আমিও যে কত ভূমিকা পালন করেছি তার জন্য আমাকে কখনো প্রশংসা করেছেন? পিতার ঐতিহ্যের কথা বলছেন? আমি তো শুধু জানি আমার প্রতি তার অন্যায় অভিপ্রায়ের কথা। আমার প্রতি উনার প্রতিহিংসার কথা। সেসব কি তাহলে? সেগুলো কি একজন ন্যায়বানের চিহ্ন?” ক্লিটাসের দিকে তাকিয়ে ওয়াইনের কাপে চুমুক দিলেন আলেকজান্ডার। ‘
“তুমি তোমার পিতার স্মৃতিকে অবজ্ঞা করছ। পারস্যের উপর আক্রমণ তিনিই শুরু করেছিলেন আর আজ তুমি যা করেছ তা বহু বছর আগে উনিই করতেন যদি না এক আততায়ীর ছোরা তার জীবন কেড়ে নিত।” থেমে গেলেন ক্লিটাস। আবেগের তোড়ে হারিয়ে যাচ্ছে যুক্তিবোধ। “ভুলে যাচ্ছো যে আজ তুমি যা তা কেবল পিতার কল্যাণেই পেয়েছ। আজ তোমার যা কিছু অর্জন তিনিই সবকিছুর ভিত্তি করে গেছেন। তোমার চেয়েও তার অর্জন কয়েক গুণ বেশি। আর আজ তুমি পিতা ফিলিপকে অমান্য করে আমনের সন্তান হিসেবে ভান করে নিজেকে অনেক বড় কিছু ভাবছ?”
শেষ শব্দটার সাথে সাথে সবাই যেন নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেল।
“বদমায়েশ!” ক্ষিপ্ত স্বরে উত্তর দিলেন ওয়াইনের নেশামত্ত আলেকজান্ডার। “আমাকে তিরস্কার করে মেসিডোনিয়ানদের মাঝে অসন্তুষ্টি জাগানোর ইচ্ছে তাই না?”
কিন্তু নিজের জায়গায় অনড় রইলেন ক্লিটাস, “যদি তুমি কারো যুক্তি শুনতে চাও তাহলে কেন তাদেরকে নিমন্ত্রণ করেছ? দাস আর দুবৃত্তদেরকে সঙ্গে রাখলেই পারতে। তারা নতমুখে তোমার চাটুকারিতা করত!”
ক্রোধে ফেটে পড়লেন আলেকজান্ডার। ক্লিটাসের দিকে ছুঁড়ে মারলেন হাতের কাপ। দুজনের গায়েই ছিটিয়ে পড়ল ওয়াইন। হন্তদন্ত হয়ে সকলেই ছোটাছুটি করছে। এরই মাঝে পরিবেশন টেবিল থেকে একের পর এক ফল তুলে ক্লিটাসের দিকে ছুঁড়তে লাগলেন তরুণ রাজা। আশেপাশে অস্ত্রের খোঁজে হাত বাড়ালেও একটাও পাওয়া গেল না।
“প্রহরীদেরকে ডাকো!” চিৎকার করে উঠলেন আলেকজান্ডার, “আমার’ গার্ডেরা কোথায়? ডাকো ওদেরকে!”
এদিকে ক্লিটাসের কয়েক জন বন্ধু এসে টানতে টানতে জেনারেলকে প্রাসাদের বাইরে নিয়ে গেল। একেবারে পরিখার ওপারে; যেন আলেকজান্ডারের রোষানল থেকে তিনি নিরাপদে থাকতে পারেন। তারপর আলেকজান্ডারের ক্রোধ প্রশমিত হলে তিনি আবার এসে নৈশ দাওয়াতে যোগ দিতে পারবেন। যদি তা ততক্ষণ পর্যন্ত টিকে তো।
পৌঁছে গেল আলেকজান্ডারের দেহরক্ষী দল। গোল করে দাঁড়িয়ে তরুণ রাজাকে ঘিরে ফেলল।
একটু পরেই ক্লিটাসের বন্ধুরা ফিরে এসে আনন্দ উৎসব পুনরায় শুরু করার ইশারা দিল। আগামীকাল হ্যাংওভার কেটে গেলেই সবাই আবার সবকিছু ভুলে যাবে।
কিন্তু অদৃষ্ট আজ রাতের ভাগ্যে লিখে রেখেছে এক ভিন্ন পরিণতি।
হঠাৎ করেই দরজার কাছে শোনা গেল হৈ চৈ। তারপরই ভেতরে এলেন ক্লিটাস। যুদ্ধ ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়াটা তার স্বভাব নয়। সবসময় এ নীতিতেই অটল থেকেছেন। তাই আজও তার ব্যতিক্রম হবে না।
“আহ, আমি! গ্রিসে রাজত্ব করছে এক দুষ্ট প্রবৃত্তি!” পুরো হলরুম জুড়ে গমগম করে উঠল ক্লিটাসের কণ্ঠ। তরুণ রাজার দিকে এগোতে গিয়ে আবৃত্তি করলেন ইউরিপিডেসের লেখা আন্দ্রোমাচের এক পংক্তি। গলার স্বরে স্পষ্ট ঔদ্ধত্য।
বন্ধুদের কাছে ফিরে আসতে গিয়েও ঘুরে তাকালেন আলেকজান্ডার। ক্লিটাসকে দেখার সাথে সাথেই মাথায় চড়ে উঠল রাগ। তাই প্রতিক্রিয়াও হল একেবারে তৎক্ষণাৎ। এক গার্ডের কাছ থেকে বর্শা নিয়েই সোজা জেনারেলের দিকে দৌড় দিলেন।
“বিসাসের চেয়ে তো ভিন্ন কিছু নও!” বর্শা বিদ্ধ ক্লিটাস মাটিতে পড়ে যেতেই ফিনকি দিয়ে ছুটল রক্ত। হলের মাখখানে তৈরি হল রক্তের খাড়ি। সবাই সভয়ে এমনভাবে পিছিয়ে গেল যেন এ রক্ত অভিশপ্ত। এর আগে আলেকজান্ডারের এ রূপ আর দেখা যায়নি। যেন তার উপর অন্য কেউ ভর করেছে।
রক্তের সাথে বেরিয়ে গেল ক্লিটাসের প্রাণশক্তি। হাটু ভেঙে বসে পড়লেন আলেকজান্ডার। মাতাল হলেও ঠিকই বুঝতে পেরেছেন যে কী করেছেন। ক্লিটাসের প্রাণহীন দেহের উপর নুইয়ে পড়ে তাই কান্না আটকাতে পারলেন না। জেনারেলের রক্তে ভেসে গেল তার পোশাক আর জুতা; কিন্তু এবার কোনো ভ্রূক্ষেপ করলেন না।
জীবনে প্রথমবারের মত ভিন্নমত পোষণকারী কাউকে হত্যা করলেন আলেকজান্ডার। আর একই সাথে ভঙ্গ হল দুটো মেসিডোনীয় প্রথা। প্রথমটা হল, সেনাবাহিনির উপস্থিতিতে বিচার ছাড়াই কাউকে হত্যা করা। আর দ্বিতীয়টি হল জিউসের আতিথ্য নীতি, নিমন্ত্রিত অতিথিকে হত্যা করা। যে
অতিথি কিনা সারাজীবন বিশ্বস্ততার সঙ্গে রাজপরিবারের সেবা করে গেছে।
অশ্রুজলে পূর্ণ হয়ে উঠল সে রাত। প্রথমবারের মত নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষার রাশ টানতে ব্যর্থ হলেন আলেকজান্ডার।
তবে এটাই কিন্তু শেষ নয়।
.
৩৭. বর্তমান সময়
তৃতীয় দিন
পলায়ন...
খেয়ালের বশেই কাজটা করে ফেলল রাধা। গাড়ির বাকি তিন আরোহী ওর দিকে তাকাবার সাথে সাথেই মোবাইলের রিং আগ্রহ করে ভোর নবে হাত দিয়ে খুলে ফেলল গাড়ির দরজা। পাশের গাড়ির ফেন্ডারে ঠাস করে লাগায় কতটা ক্ষতি হয়েছে দেখতে নেমে এল ড্রাইভার।
উত্তেজিত ড্রাইভার, পেছনের একগাদা গাড়ির হর্ন সবকিছুকে উপেক্ষা করে ট্রাফিক জ্যামের মধ্য দিয়ে ছুটল রাধা। উদ্দেশ্য যত দ্রুত সম্ভব কয়েক মিটার দূরের মেট্রো স্টেশনে পৌঁছানো।
গ্লকের (পিস্তল) মাজল ঝলসে উঠায় তাড়াহুড়া করে আবার নিজের জায়গায় চলে গেল ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির ড্রাইভার। প্রচন্ড ভয় আর আত্মরক্ষার চিন্তায় ভুলে গেছে অন্য সবকিছু।
এদিকে গাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনজনই রাধার পিছু নিল। ফুটপাত ধরে এগিয়ে ত্রস্তপায়ে লাফ দিয়ে মেট্রো স্টেশনের এসকেলেটর লিফটে চড়ে বসল রাধা। ড্রাইভারদের দল সামনে এতক্ষণ হর্ন বাজালেও নকল আইবি এজেন্টদের
উদ্যত পিস্তল দেখে সবাই আবার চুপ করে গেল।
“ট্রেন আসছে!” স্টেশনের গায়ে হলুদ আলো পড়তেই চিৎকার করে উঠল তিনজনের একজন। নিজেদের হাঁটার গতি বাড়িয়ে আশপাশের গাড়িগুলোকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে রাধার পিছু পিছু এসকেলেটর লিফটে উঠে গেল।
চট করে দেখবার জন্য পিছনে তাকানোর ঝুঁকি নিল রাধা। দেখল এত ট্রাফিক সত্ত্বেও থামল না পিছু ধাওয়াকারীরা। হাতের পিস্তল স্পষ্ট দেখা গেলেও কেন যেন এখনো গুলি করেনি। খানিকটা অবাকই লাগল ঘটনাটা।
কিন্তু এত শত ভাবার মত সময় নেই হাতে। প্লটফর্মে পৌঁছেই ঘঁাৎ করে থেমে গেল ট্রেন। একই সময়ে এসকেলেটর থেকে নামল রাধা। সৎ নাগরিকের মত টিকিটের জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়াবার সময় নেই। অন্যদের চিৎকার অগ্রাহ্য করে সবাইকে টপকে সামনে চলে এল রাধা। তারপর প্লাটফর্মের একেবারে শেষ মাথা পর্যন্ত দৌড়ে উঠে পড়ল একেবারে শেষ কোচে। মনে মনে শুধু আশা করছে যেন নকল তিন এজেন্ট প্লাটফর্মে আসার আগেই ট্রেনটা ছেড়ে দেয়।
ট্রেনের দরজা বন্ধ হতেই ভয়ার্ত চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রাধা। লোকগুলো এখনো প্রাটফর্মেই আছে। হঠাৎ করেই একজন ওর দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকালেও গতি বাড়িয়ে স্টেশন থেকে বের হয়ে গেলো ট্রেন।
হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল জোর হট্টগোল। তিনজনের যে লোকটা একটু আগে ওকে দেখে ফেলেছিল সে এবারে তার সাথীদেরকে নিয়ে লাফাতে লাফাতে এক্সিটের দিকে চলে গেল। ট্রেনের গতি বাড়লেও কী ঘটেছে বুঝতে পারল রাধা। এসকেলেটর থেকে গেটের কাছে ছুটে এলো সাধারণ পোশাকধারী পাঁচজন আগন্তুক। সবার হাতেই হ্যান্ডগান। এই পাঁচজন এবার নকল তিন আইবি এজেন্টের পিছু নিল। এরা কারা না জানলেও লোকগুলোর পিছু নেয়াতে বোঝ গেল সাধারণ পোশক হলেও তারা আইনের লোক।
ধপ করে খালি একটা সিটে বসে কপাল মুছল রাধা। এতক্ষণ মনে পড়ল মোবাইল ফোনের কথা। রিং বাজছিল, উত্তর দেয়া হয়নি। ফোনটা বের করেই চেক করে দেখল বিজয়ের নাম্বার। দেখো একেবারে সময় মত এসেছিল ফোনটা! তাড়াতাড়ি করে নাম্বার ডায়াল করল রাধা।
“আয়্যাম ফাইন”, ঘটে যাওয়া সবকিছু জানিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে উদয় হওয়া পাঁচজন সশস্ত্র লোকের কথাও খুলে বলল।
কিডন্যাপারদের অবস্থা শুনে মিটিমিটি হাসল বিজয়, “ওরা আসলে বৈদ্যের পাঠানো আইবি এজেন্ট। তোমার জিপিএস ট্রেস করে সাহায্য করার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। মনে হচ্ছে উনার পরিকল্পনা কাজ করেছে।”
রাধাও হেসে ফেলল; কিন্তু আবার একটা কথা মনে হতেই মুছে গেল হাসি। “তার মানে ইমরানের হাসপাতালে ভর্তি হবার ঘটনাটা মিথ্যাকাহিনি।”
“না, তা না।” এবারে বিজয়ের খবর পরিবেশনের পালা। “আর খুব বেশি হলে দশ মিনিটের মধ্যেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাবে। আমি এক্ষুনি রওনা দিচ্ছি। তুমি শুধু চুপচাপ ভালো একটা জায়গা দেখে অপেক্ষা করো।”
বিজয়ের আমেরিকান সুলভ হাবভাব দেখে অট্টহাসি দিল রাধা। মনে পড়ে গেল লুইস লামারের উপন্যাসের কথা। ওর সাথে এত কিছু ঘটে যাবার পরেও হাসি আসছে দেখে ভালোই লাগল আর একই সাথে বিজয় যে ওকে এয়ারপোর্টে আনতে যাচ্ছে তাতেও স্বস্তি পেল।
জিন্সের পকেটে ফোনটাকে রেখে দিয়েই চোখ বন্ধ করে ফেলল। সন্ধ্যার টেনশন নাকি জোনগড় থেকে গুড়গাঁও আবার দিল্লি আসার ধকল বুঝতে পারছে না।
বহুক্ষণ পর মনে হল ট্রেনটা থেমে গেল। ঝাঁকুনি খেয়ে জেগে উঠল রাধা। কিন্তু পুরোপুরি ধাতস্ত হবার আগেই দেখল চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একগাদা লোক।
আস্তে আস্তে ঝাপসা দৃষ্টি স্পষ্ট হতেই বুঝতে পারল পেছনে ছয় জন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ককেশীয় পুরুষ। সবাই সশস্ত্র। আর শ্বেতাঙ্গ লোকটা ঠিক ধর উপর ধরে আছে একটা হ্যান্ডগান। পুরো কোচ খালি। একটাও। প্যাসেঞ্জার নেই। পালিয়ে গেছে নাকি!
লোকটার সেঁতো হাসি দেখেই সব বুঝে গেল রাধা। “আমরা এয়ারপোর্টে চলে এসেছি মাই ডিয়ার।” ব্যঙ্গের স্বরে বলে উঠল লোক। “ওয়েলকাম টু ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।” একেবারে নিখুঁতভাবে নকল করল ঘোষণাটা। আর লোকটার গলার স্বরও হুবহু মিলে গেল ইংরেজি সেই ঘোষণার সাথে। “সিটবেল্ট বেঁধে নাও সোনামণি। তোমাকে এখন দীর্ঘ একটা ভ্রমণে যেতে হবে।”
.
আইজিআই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, মেট্রো স্টেশন
হতভম্ব হয়ে স্টেশনের দিকে তাকিয়ে আছে বিজয়। দশ মিনিট আগে পৌঁছে দেখে যে আবার সেন্ট্রাল দিল্লির উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে ট্রেন। এদিকে প্লাটফর্মে রাধার কোনো চিহ্নও নেই। চারপাশে শুধু পরবর্তী ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত প্যাসেঞ্জার যারা এই মাত্র ফ্লাইট থেকে নেমেছে। গেল কোথায় মেয়েটা!!
স্টেশনের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত আরো একবার চক্কর দিয়ে এলো বিজয়; যদি রাধাকে মিস করে থাকে এই আশায়। এর সম্ভাবনা যথেষ্ট কম হলেও ঝুঁকি নিতে চায়নি।
বৈদ্যের এজেন্টের আশায় বাকিদেরকে রেখে এয়ারপোর্টে ছুটে এসেছিল বিজয়। ট্রাফিক জ্যাম বিরক্তিকর হলেও জানে ও কথা দেয়াতে রাধা ঠিক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু এখন কী করবে কিছুই মাথায় আসছে না। ফোনে কল করেও লাভ হচ্ছে না। সুইচড অফ। এ ব্যাপারটাও বেশ ভাবাচ্ছে। ফোন কেন বন্ধ রেখেছে?
কোথাও একটা গড়বড় হয়েছে মনে হচ্ছে। যদি এমন হয় যে কথা বলার সময়েও আসলে রাধা বন্দিই ছিল! হয়ত জোর করেই বলিয়েছে যে কিডন্যাপাররা চলে গেছে। ধারণাটা অস্বস্তিকর হলেও ইমরানের সাথে যা ঘটে গেছে তারপর আর স্বাভাবিকভাবে কিছুই ভাবতে পারছে না।
কলিনকে ফোন করে এখানকার পরিস্থিতি জানিয়ে দিল বিজয়। সাথে সাথে এলিস, ডা. শুক্লা আর তিনজন আইবি এজেন্টকে নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল কলিন। বিজয় আসার একটু পরেই চলে এসেছে এজেন্টের দল আর তাদের আইডেন্টিটি বৈদ্য নিজে ভেরিফাই করেছেন।
আইবি এজেন্টরা ওদেরকে জোনগড়ে পৌঁছে দেবার কথা। কোথায় ফিরবে সেটা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে আর কোনো স্থানকে সুরক্ষিত মনে হয়নি। তাই সবাই মেনে নিয়েছে বিজয়ের যুক্তি; তা হল এলিস যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যদের সাথে দুর্গে ছিল লোকগুলো ততক্ষণ পর্যন্ত শত্রুপক্ষ হাত গুটিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিল।
“আমার মনে হয় কেল্লাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে নিরাপদ।” সবাই বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিল বিজয়ের রায়।
রাধাকে আর কিভাবে খুঁজবে বুঝতে না পেরে ইমরানের নাম্বার ডায়াল করল বিজয়। বৈদ্য নিজের নাম্বার বিজয়কে না দিয়ে বলেছেন কিছু সময়ের জন্য এই নাম্বারেই যোগাযোগ রাখতে।
“সবকিছু ঠিক আছে তো? ফোন কানে দিয়েই জানতে চাইলেন বৈদ্য।
“না, নেই।” সবকিছু খুলে বলল বিজয়। সাথে আরো জানাল, “আমার আরেকটা অনুরোধ আছে, রাধার ফোনের জিপিএস ধরে আরো একবার ট্রেস করার চেষ্টা করা যায় না?”
“আমি এক্ষুনি কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি” উত্তরে জানালেন বৈদ্য, “কিন্তু ফোন খোলা না থাকলে কোনো লাভ নেই। যেমনটা তুমি বললে সেরকমই যদি সুইচ অফ থাকে তাহলে বেশি কিছু করা যাবে না।
মুষড়ে পড়ল বিজয়। ভয় পাচ্ছে যদি রাধাকে আবারো অপহরণ করা হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয় আততায়ীরা ওর ফোন ভোলা রাখবে না। আর যদি খোলেও তাহলেও জিপিএস নিষ্ক্রিয় করে রাখবে যেন ওর কোনো হদিসই না পাওয়া যায়।
বেশ বুঝতে পারছে যে তাদেরকে মিউজিয়ামে যে দলটা আক্রমণ করেছে তাদের কাছে বিজয়দের সবার স্মার্টফোনের জিপিএস ট্র্যাক করার আধুনিক টেকনোলজি আছে। সবার পরিচয় আর অবস্থান জানতে পাবার এটাই হল রহস্য। কিন্তু ডা. শুক্লার কাছে কোনো ফোন না থাকায় আক্রমণকারীরা উনার কথা জানত না। ব্যাপারটা উপলব্ধি করার সাথে সাথেই সবাই যার যার জিপিএস বন্ধ করে দিয়েছে।
তবে এখন বেশ ভয় হচ্ছে। এই লোকগুলো মোটেই আনাড়ি নয়। আর আইবি যে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারাও যদি সে ধরনেরই হয় তাহলে তো বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে তারা কতটা শক্তিশালী। তার মানে বিজয়ের দুঃস্বপ্নই সত্য হল। এবার হয়ত রাধাকে হারাতেই হবে।
.
৩৮. বন্দী…
তিরতির করে কেঁপে উঠে খুলে গেল চোখের পাতা। চারপাশে তাকিয়েই গুঙ্গিয়ে উঠল রাধা। সবার আগে চোখে পড়ল আশেপাশের রঙ।
সাদা। একেবারে শ্বেতশুভ্রই বলা চলে। একটা সাদা সিলিং। সাদা দেয়াল আর সম্ভবত সাদা মেঝে। বুঝতে পারল ওকে একটা বিছানার সাথে বাধা হয়েছে। কব্জি আর গোড়ালি এমনভাবে আটকানো যে একটুও নড়াচড়ার সাধ্য নেই। বাম হাতে আবার স্যালাইন চলছে।
খানিকক্ষণ মুক্তি পাবার জন্য বহু কসরত করেও অবশেষে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। কোনো লাভ নেই।
মাথাটা অসম্ভব ভারী হয়ে আছে। দেহও যেন সীসা। কোথায় শুয়ে আছে ও? এখানে এসেছেই বা কিভাবে? অস্পষ্টভাবে শুধু মনে পড়ছে যে ট্রেনের কোচে ওর দিকে পিস্তল ধরেছিল একটা লোক। তারপর ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে নামার পর আর কিছু মনে নেই।
জোর করে একটা কেমিকেলের গন্ধ নিঃশ্বাসের সাথে ভেতরে নিতে বাধ্য করেছিল লোকগুলো। সেই কটু ধোয়ার গন্ধে এখনো জ্বালা করছে না। বজ্রমুষ্টি একটা হাত রাধার ঘাড়ের নিচে ধরে জোর করে ভেজা এক টুকরো কাপড়ে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছিল। ঘাড়ের কাছে সে জায়গাটায়ও ব্যথা হচ্ছে।
এতক্ষণে বুঝতে পারল যে গায়ে একটা হসপিটাল গাউন জড়িয়ে শুয়ে আছে। তাহলে তার নিজের জিন্স আর টপ কোথায় গেল? কে তার পোশাক বদলে দিয়েছে? অজানা একজন এরকমটা করেছে ভাবতেই অপমানবোধের পাশাপাশি হঠাৎ এক ক্রোধে দিশেহারা বোধ করল রাধা।
আস্তে আস্তে রাগ বাড়তেই ভেসে গেল সমস্ত যুক্তিবোধ। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করতে করতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়াই শুরু করল এ বন্দীদশা
থেকে মুক্তি লাভের জন্য।
.
… নাকি গিনিপিগ?
সেন্টারের কন্ট্রোল রুমের একটা ব্যাঙ্কে বসে কৌতূহল নিয়ে একদৃষ্টে ক্যামেরার ভিডিও মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছেন ডা, বরুন সাক্সেনা। এরপর সঙ্গীর দিকে ঘুরে মাথা নেড়ে জানালেন, “তুমি ঠিকই বলেছ গ্যারি। আমি জানতামই না যে এই ড্রাগের এতটা শক্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে।”
দাত বের করে হেসে ফেলল গ্যারি ফ্রিম্যান। “হেই, আপনাকে বলেছিলাম বলতে ভাল লাগছে না; কিন্তু সত্যিই তা বলেছিলাম। হঠাৎ করে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠা রাধাকে যে ভিডিও মনিটরে দেখা যাচ্ছে তার উপর বুড়ো আঙুল নাচিয়ে জানাল, “আমার মনে হয় এখনই ওকে অ্যান্টিভোট দেয়া উচিত। যদি ওকে সম্পূর্ণ অক্ষত রাখতে চান। নয়ত আগামী দু’ঘণ্টায়ও কাটবে না এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আর ততক্ষণে মেয়েটা একটা কিংবা দুটো হাতই হারিয়ে ফেলবে।”
অন্যদিকে পর্দায় দেখা যাচ্ছে এখনো বাধন নিয়ে লড়াই করছে রাধা। হাতের ইনজেকশন সূচের কথা যেন ভুলেই গেছে। অসম্ভব জোরে ঝাঁকি খাচ্ছে টিউবে লাগানো স্যালাইনের প্যাকেট।
শেষ বারের মত ভিডিও মনিটরের দিকে তাকিয়ে ইন্টারকমে কয়েকটা নির্দেশ দিলেন সাক্সেনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুমে ঢুকে স্যালাইনের মধ্যে কিছু একটা মিশিয়ে দিল নার্স। অ্যান্টিডোট দ্রুত কাজ করায় প্রায় সাথে সাথে শান্ত হয়ে গেল রাধা।
“রেগুলার নমুনার ক্ষেত্রে এ ধরনের দৃশ্য হয়ত দেখার সুযোগ পাবেন না।” মিটিমিটি হাসছে ফ্রিম্যান। “ওদের শরীরে আমরা এতকিছু ইনজেকশনের মাধ্যমে ভরেছি যে ড্রাগের সাথে মিশে কোনটা যে কোন প্রতিক্রিয়া করে তা বলা মুশকিল। তবে এটাকে সময় মত পাওয়াতে ভালই হয়েছে। একেবারে সঠিক সময়ে।”
“ওকে পাইনি” রুম থেকে বেরোবার সময় জানালেন সাক্সেনা, “এখানে কুপার নিয়ে এসেছে। আজ নয়ত কাল ওকে ঝেরে ফেলতেই হবে। তার আগে জানতে হবে যে মেয়েটা অপারেশন মহাভারত সম্পর্কে কী কী জানে।”
“সত্যি?” উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল ফ্রিম্যানের চেহারা। “দেখুন আপনারা আমাকে এখানে বন্দী করে রেখেছেন আর তাই বাইরের দুনিয়ায় যে কী ঘটেছে আমি কিছু জানি না।”
“আর কিছু তো করারও নেই।” পাল্টা জবাব দিলেন সাক্সেনা, “আমরা এখানে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে এসেছি। এমনকি আমিও তো খুব একটা বাইরে যেতে পারি না। এই ফ্যাসিলিটিকে কোনোভাবেই টাইটানের সাথে জুড়তে দেয়া যাবে না। আর তোমরা এখানে যে বিষয়ে পড়াশোনা করো তা যেকোনো মূল্যেই গোপন রাখতে হবে। এ কথা তুমিও জানেনা। যদি একটা শব্দও বাইরে যায় ধুন্ধুমার লেগে যাবে। বিশেষ করে যদি প্রকাশ পায় যে টাইটানের জেনেটেকিস হেড এই গবেষণা চালাচ্ছে।”
“ইয়াহ, আমি জানি, জানি। কিন্তু তার মানে তো এই না যে এতে খুশি হতে হবে।” ঘোৎ ঘোঁৎ করে উঠল ফ্রিম্যান, “কোনো ঝুঁকি কি দেখা দিয়েছে?”
কাঁধ ঝাঁকালেন সাক্সেনা, “জানি না। এই কারণেই তো মেয়েটাকে ধরে এনেছি। খুঁজে বের করা প্রয়োজন। আমার কাছে তো সাংবাদিক সেজে এসেছিল। সে সময়ে জানতাম না। টের পেলাম যখন কুপার এসে মেয়েটা আর স্বরূপের কাছে আসা আইবি এজেন্টের মধ্যেকার যোগাযোগের কথা জানাল। তখন শুনলাম যে মেয়েটা আন্ডারকাভার হিসেবে কাজ করছে।”
শিস দিয়ে উঠল ফ্রিম্যান। তার মানে সেও আইবি লোকটার সাথে কাজ করছে? ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনিতে?”
“এখনো জানি না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আইবির লোকটা মারা গেছে…কিংবা যাচ্ছে। কুপার সেটা সামলেছে। আর মেয়েটা কী জানে, জানার পর তারও একই পরিণতি হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত কুপার ওকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। তার মানে যতক্ষণ এখানে আছে, আমাদেরও ব্যবহার করতে দ্বিধা নেই। এতটা ভালো আর একেবারে তাজা নমুনা পাওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়।” কদর্যভাবে হেসে ফেললেন সাক্সেনা; ফ্রিম্যানও মিটিমিটি হাসছে।
.
৩৯. পাওয়া গেল সম্পর্ক
কেল্লার স্টাডিতে একসাথে বসে আছে বিজয়, কলিন, এলিস আর ডা. শুক্লা। কিছুক্ষণ আগে সবাইকে এসকর্ট দিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেছে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর এজেন্টরা। তারপর আবার ফিরে গেছে। যদি আরো কেউ তাদের পিছু নিয়ে থাকে কিংবা নজরদারি করে সেজন্য খুব সাবধান থাকতে হয়েছে।
দুর্গে ফেরার পর থেকেই বেশ স্বস্তি আর নিরাপদ বোধ করছে বিজয়। এখানে অন্তত কোনো ভয় নেই। কিন্তু জোনগড়ে ফেরা আর তারপরেও এখন পর্যন্ত রাধার কোনো সংবাদ না পাওয়ায় সবাই বেশ উদ্বিগ্নও বটে। মনে হচ্ছে যেন একেবারে বাতাসে মিলিয়ে গেছে মেয়েটা।
কন্যার শোকে মনমরা হয়ে বসে আছেন ডা. শুক্লা, “বৈদ্য টাইটানে গিয়ে তদন্ত করছেন না কেন? নির্দিষ্ট কাউকে না হলেও এতক্ষণে প্রায় দশবারের উপর করে ফেলেছেন এ প্রশ্ন। যদিও বিজয় এই বলে আশ্বস্ত করেছে যে বৈদ্য নিজে টাইটান ফার্মাসিউটিক্যালসের সিইও স্বরূপ ভার্মার সাথে কথা বলেছেন। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর খোদ ডিরেক্টরকে নিজ অফিসে দেখে লোকটা রীতিমত ঘাবড়ে গেলেও ইমরান আর রাধার ব্যাপারে অকৃত্রিম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এমনকি তদন্ত কাজ আর রাধাকে খোঁজার ব্যাপারেও পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। পাশাপাশি ভারতে টাইটানের প্রতিটি অফিস আর আউটসোর্সড ফ্যাসিলিটিতে আইবি এজেন্টদের পরিদর্শনের প্রস্তাবও দিয়েছেন।
“সমস্ত সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখছে আইবি”, ধৈর্য বজায় রেখেই জানাল বিজয়। ডা. শুক্লার খাতিরে চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে। “আমাদেরকে আসলে ওদের উপর ভরসা রাখতে হবে। আশা করি শীঘ্রিই কোনো না কোনো খবর পাওয়া যাবে।”
এবার কথা বলল এলিস, “যাদুঘরে সোনালি চুলের লোকটা একটা কথা বলেছিল।” বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “মনে আছে যখন আমাদেরকে শুনেছিল? তখন ইমরান আর রাধা সম্পর্কে কী যেন একটা বলেছিল।”
“বলেছিল যে ওদের ব্যবস্থা করা হয়েছে।” গোমড়ামুখে উত্তর দিল বিজয়। রাধা আর ইমরান দুজনেই যে টার্গেট হবে সেটা যে কেন ওর মাথায় এল না। তবে জানে যে এর জন্য কাউকে দায়ী করা যায় না। তখন তো সুতোর উপর ঝুলছিল তাদের নিজেদের ভাগ্য! কপালের জোর বলতে হবে বেঁচে ফিরতে পেরেছে। লোকগুলো তো পেশাদার খুনিই ছিল।
“হ্যাঁ, কিন্তু মনে নেই এটাও তো বলেছিল যে ওরা দুজন চারপাশে নাক গলাচ্ছিল।” সতর্ক চোখে তাকাল এলিস। জানে এসময় এটা বলাটা হয়ত ঠিক হবে না। কিন্তু একই সাথে এর মাধ্যমে নতুন একটা দিকও পাওয়া যাবে।
“ইয়াহ্, মনে আছে।” কলিন ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই বিজয় আর ডা. শুক্লাও মাথা নাড়লেন। তবে এবারে উরুতে চাপড় মেরে উঠল কলিন। বুঝতে পারল না এলিস কী বলতে চাইছে, “ও ঈশ্বর! দুটো ঘটনা আসলে একসাথে জড়িত।”
এখনো দ্বিধায় ভুগছে বিজয় আর ভা, শুক্লা। এলিস বুঝতে পারল দুজনেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ায় চিন্তাশক্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তাই ব্যাখ্যা করে বলল, “এতদিন ধরে আমরা ভেবে এসেছি যে গ্রিসের খনন কাজ আর আমার সাথে যা ঘটেছে তার সাথে পিটারের জড়িত থাকা আর এখানে, ভারতে ইমরানের বায়ো-টেররিজমের সম্ভাব্য উদয় খুঁজে পাবার মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এটা কি হতে পারে যে এই দুই ঘটনা আসলে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত?”
বিজয়ের দিকে তাকালেন ডা. শুক্লা। বুঝতে পারছেন না খবরটা ভালো না মন্দ। কিন্তু সাথে সাথে কোনো উত্তর দিল না বিজয়। এতক্ষণ সে নিজেও জাদুঘরে ঘটে যাওয়া সমস্ত আলাপচারিতা আর ঘটনা নিয়ে মনে মনে বিশ্লেষণ করছিল আর এলিস ঠিক তার চিন্তার সূত্রগুলোকেই শব্দ হিসেবে উচ্চারণ করেছে। দুজনের সম্পর্কের শুরু থেকেই মেয়েটা বিজয়কে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারত। বিজয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করার চমৎকার দক্ষতা আছে, একই সাথে নিজের সহজাত বোধের উপরও নির্ভর করে, কিলার কম্বিনেশন বলা যায়। এলিস বুঝতে পারল যে বিজয় মনে মনে তার দক্ষতা আর বোধশক্তি ব্যবহার করে ওর কথার সত্যতা যাচাই করছে।
“তোমার কথাই হয়ত ঠিক” অবশেষে জানাল বিজয়, “ওরা আমাদের সবার সম্পর্কেই জানে কেবল ডা. শুক্লা ছাড়া। তাদের কাছে এমন প্রযুক্তি আছে যাতে আমাদের সমস্ত গতিবিধি ধরা পড়ে। সেভাবেই দুর্গে এলিসের উপস্থিতির কথা জেনে জাদুঘর পর্যন্ত আমাদেরকে অনুসরণ করেছে। রাধা আর ইমরানকে অনুসরণ করেছিল। তাই জানত যে ওরা টাইটান ফার্মাতে যাবে। জাদুঘরের সোনালি চুলের লোকটার কথা থেকে এটুকু স্পষ্ট বোঝা গেছে। আর তারপর থেকে ইমরান আর রাধাকে টার্গেট করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে: গ্রিসের খনন কাজ আর বায়োটেররিজমের মধ্যে সম্পর্কটা কোথায়? জানি যে তারা কিউবটার পেছনে লেগেছে। এখন জানি যে আলেকজান্ডারও কিছু একটার খোঁজে ভারতে এসেছিলেন। এমন কিছু যাকে ইউমেনিস ‘দেবতাদের সিক্রেট নামে অভিহিত করে গেছেন।” সমস্বরে নিজের চিন্তা সকলের কাছে খুলে বলল বিজয়।
অন্যেরা চুপ করে বসে শুনছে। বিজয়কে এলিস আর কলিন ভালভাবেই চেনে; তাই মাঝখানে কোনো কথা বলে ওকে বাধা দিল না। রাধার জন্য দুশ্চিন্তায় অস্থির ডা. শুক্লা ঠিকভাবে শুনতেই পেল না যে বিজয় কী বলছে।
“তো” আবারো বলে উঠল বিজয়, “উপসংহারে বলা যায় আলেকজান্ডার যেটা খুঁজছিল সেটাই আসলে বায়োটেররিজমের সম্ভাব্য উৎস। আমার মাথায় শুধু একটাই ধারণা আছে আর তা হল এটা এমন এক ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়া যা মানুষকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এমন কিছু যা সন্ত্রাসীরা নিজেদের কাজে লাগাবে। আর কিই বা হতে পারে? এর মাধ্যমে টাইটানের ক্লিনিক্লাল ট্রায়ালে যেসব ঘোট ঘোট সেলগুলো ছিল সেগুলোর উপস্থিতির কারণও স্পষ্ট হয়ে গেছে। টেস্ট রিপোর্টেও অজানা এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাসের কথা পাওয়া গেছে। কিন্তু তাতে তো আরো বহু প্রশ্নর উদয় হয়েছে। একটা ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাসকে কেন “দেবতাদের রহস্য” বলা হবে? আলেকজান্ডারই বা কেন এই রহস্য খুঁজছিলেন? যদি পেতেন তাহলে কী করতেন? নাকি অন্য কিছু যা আমাদের চোখে পড়ছে না?”
পুরো ব্যাপারটা হজম করতে গিয়ে বাকিরা একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল। বিজয়ের উপসংহার পুরোপুরি যৌক্তিক মনে হচ্ছে। ও যে প্রশ্নগুলো তুলেছে সেগুলোও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু পরিষ্কার কোনো উত্তর নেই। বিশেষ করে আলেকজান্ডারের অভিযানে যদি কোনো ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাসই মুখ্য উদ্দেশ্য হয় তাহলে বায়োটেররিজমের সাথে এর সম্পর্ক কী?
উঠে দাঁড়ালেন ডা. শুক্লা, “রাত হয়ে গেছে। আমি আসি।” বিষণ্ণ ভঙ্গিতে অন্যদেরকে জানালেন, আসলে এ মুহূর্তে একটু একা থাকতে চাইছেন। তাই আলেকজান্ডার আর বায়োটেররিজমের মাঝে সম্পর্ক নিয়ে কোনো আগ্রহই পাচ্ছে না। তার অপহৃত কন্যা সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। এমনকি গোয়েন্দা সংস্থাও না। আর যদি এতে সন্ত্রাসীরা জড়িত থাকে তার মানে মেয়েটা কতটা বিপদের মধ্যে আছে। একজন সিনিয়র আইবি অফিসারের অ্যাপার্টমেন্টে যদি বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে তাহলে তাদের হাতে বন্দী রাধার সাথে কী কী ঘটতে পারে?
বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল বিজয়। ও নিজেও বেশ দুশ্চিন্তায় আছে; কিন্তু একটু আগেই যা আবিষ্কার করল, তাতে মনে হচ্ছে লড়াই করার মত অন্তত হাতে কিছু আছে। কী কিংবা কিভাবে করবে। কতটুকু লাভ হবে না জানলেও নিজের অনুভব শক্তির উপর তার পূর্ণ আস্থা আছে। “আচ্ছা তোমরাও গিয়ে একটু রেস্ট নাও না?” কলিন আর এলিসকে জানাল বিজয়। “আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে আরেকটু ভাবতে চাই। দেখা যাক নতুন কোনো আইডিয়া পাই কিনা।”
বন্ধুকে ভালোই চেনে কলিন। তাই কোনো দ্বিমত না করে এলিসের কাঁধে টোকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল, “ঠিকই বলেছ। এখন তাহলে উঠি; সকালে দেখা হবে।”
অন্যেরা স্টাডি থেকে বেরিয়ে যেতেই বিশালাকৃতির জানালার কাছে। দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকাল বিজয়।
দুর্গের চারপাশের অন্ধকারের মতই আঁধারে চেয়ে আছে ওর অন্তর। কিন্তু গভীর গহীন থেকে আস্তে আস্তে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এক বিদ্রোহী মনোভাব। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তাকে সাহায্য করেছে এ প্রবৃত্তি। হার না মানা এ জেদই তাকে টিকে থাকতে শিখিয়েছে। তবে হ্যাঁ, কখনো কখনো দুঃখ বয়ে আনলেও বেশিরভাগ সময়েই লক্ষ্য অর্জনে অটুট থাকতে পেরেছে।
আশা করছে এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। রাধাই এখন ওর একমাত্র সম্পদ। বলতে দ্বিধা নেই যে কলিনের মত মহৎ হৃদয় বন্ধুও আছে; যে কিনা প্রায় ভাই বলা যায়। কিন্তু বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর থেকে যা পায়নি, রাধা তাকে সে ভালোবাসা দিয়েছে। এমনকি এখন বুঝতে পারে যে এলিসের কাছ থেকেও তা পায়নি। রাধার কাছ থেকে নিঃস্বার্থ আর শর্তহীন ভালোবাসা পেয়েছে বিজয়। সম্ভব বলে যা কখনো ভাবতেই পারেনি।
অথচ এখন তাকে হারাতে বসেছে।
.
৪০. বিনিময়ের প্রস্তাব
বসে বসে পুরো পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে দেখল কুপার। পরিকল্পনা মত সবকিছু এগোলেও জাদুঘরে কেবল খানিকটা গড়বড় হয়ে গেছে। একটু আগেই সবকিছু জানিয়েছে রাইলি। শিকার হারিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে আছে স্বর্ণকেশি ছেলেটা।
“এটা নিয়ে এত ভেবো না”, প্রবোধ দিয়েছে কুপার। “এসব টুকটাক ঝামেলা তো হয়ই। যাই হোক, মেয়েটা এখনো আমাদের হাতে আছে। ওরা বাধ্য হবে ধরা দিতে। সাথে আরেকটা বোনাসও আছে। মেটাল প্লেটটা তত আমাদের কাছে। এটা ছাড়া কিউবটা কোনো কাজেই দেবে না।” ফোন তুলে। নিল কুপার। সময় হয়েছে আগে বাড়ার। একটা ফোন করতে হবে।
বিজয়ের নাম্বারে ডায়াল করল। আর প্রায় সাথে সাথেই উত্তর এলো।
“ইয়েস। কে বলছেন?”
“আমার নাম পিটার কুপার। বোধ হয় তোমার বন্ধু এলিসের কাছে আমার কথা শুনেছ।”
নীরবতা নেমে এলো অপর প্রান্তে। কল্পনার চোখে কুপার স্পষ্ট দেখছে যে এত রাতে ওর ফোন পেয়ে বিজয় কতটা চমকে উঠেছে। এটাও বুঝতে পারছে যে রাধার সংবাদের আশায় জেগে উঠেছে বিজয়ের সাহস। কুপারও ঠিক এটাই চায়। পরিকল্পনার সফলতা নির্ভর করছে তার দাবি মেনে নেয়ার জন্য বিজয় কতটা মরিয়া হয়ে আছে সেটার উপর।
তাই চুপচাপ অপেক্ষা করছে কুপার। ভারী হয়ে উঠেছে ওপাশের নীরবতা।
“রাধা কোথায়?” নিজেকে আর সামলাতে না পেরে অবশেষে জানতে চাইল বিজয়, “যদি ওর এতটুকু ক্ষতি করে থাকো…” যুৎসই কোনো শব্দ খুঁজে
পেয়ে বাক্যটাকে অসমাপ্তই রেখে দিল। অজানা অচেনা এক শত্রুর বিরুদ্ধে কী করতে পারবে যখন তারা কোথায় লুকিয়ে আছে সে সেটাও জানে না?
“এমন কোনো বোকামি করো না যার জন্যে তোমাকে পস্তাতে হবে।” উপদেশ দিল কুপার। “তোমার বাগদত্তা আমাদের কাছে। নিরাপদেই আছে। তবে আপাতত। তুমি আমাদের সাথে কতটা সহযোগিতা করবে তার উপর নির্ভর করছে ওর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা।”
আবার নীরব হয়ে গেল বিজয়। এবারে আর অপেক্ষা করল না কুপার। বরঞ্চ জোর দিয়ে বলল, “আমার একটা প্রস্তাব শোন, এক ধরনের বিনিময় বলতে পারো, তোমার কাছে এমন একটা জিনিস আছে যা আমরা চাই। আর আমাদের কাছে আছে তোমার জিনিস তাহলে কেন পরস্পরের সাথে বদলে নেই না? সবাই খুশি হবে আর শেষ ভালো তো সব ভালো।”
“কিউবটা চাও?”
“ইয়েস। আর এলিস টার্নার। আমাকে দুটোই দিতে হবে; তাহলে তুমি তোমার বাগদত্তাকে ফিরে পাবে।”
আবার নিশ্চুপ ওপ্রান্ত। কুপার বেশ বুঝতে পারছে যে বিজয় কতটা কষ্টে নিজের আবেগ সংযত করছে। এটা সত্যিই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত। বাগদত্তার বিনিময়ে প্রাক্তন বান্ধবী। দুজনের ভাগ্যই এখন বিজয়ের হাতে।
“আমি একেবারে নির্বোধ নই।” বলে চলল কুপার, “তোমাকে আগামী কাল দুপুর বারোটা পর্যন্ত সময় দিচ্ছি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবার জন্য। তারপর আমাকে জানিয়ে দিও। ততক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চয়তা দিচ্ছি তোমার বাগদত্তার মাথার একটা চুলও কেউ স্পর্শ করবে না। কিন্তু এর মাঝে একটা সিদ্ধান্তও আশা করছি।”
ফোন কেটে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙল কুপার। সময় হয়েছে বিছানাতে গড়িয়ে পড়ার। দিনটা বেশ দীর্ঘ ছিল। তাছাড়া বয়সও হচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন মাঠপর্যায়ের কাজই বেশি উপভোগ করত। টার্গেটের পিছু ধাওয়া
করা, কখনো কখনো হারিয়ে ফেলা আবার নাগালে পাওয়া এক শক্তিশালী নেশার মত লাগত। কিন্তু এখন শারীরিক পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তবে হাতের কাজটা তো করতেই হবে। আর তার অভ্যাসই হল খুঁটিনাটি ব্যাপারে নজর দেয়া। কাল আবার বিজয় সিংকে কল করবে। তখনই নির্ধারিত হয়ে যাবে দুই নারীর ভাগ্য।