৪. প্রায় সবকিছুর তত্ত্ব
একদা বস্তু ও শক্তির মধ্যে মহাজাগতিক সম্পর্ক উন্মোচন করেছিলেন সবার কাছে বড় ব্যক্তিত্ব আইনস্টাইন। আবার নক্ষত্রদের গোপন বিষয়ও আবিষ্কার করেন তিনি। কিন্তু যুদ্ধের পর নিজেকে নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আবিষ্কার করেন এই বিজ্ঞানী।
সে সময় পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক প্রায় সব অগ্রগতি হচ্ছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বে; ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরিতে নয়। যে কথাটা ভেবে আইনস্টাইন সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেতেন, তা হলো অন্য পদার্থবিজ্ঞানীরা তাঁকে হয়তো নিঃশেষ একজন মানুষ হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন। তাঁর ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যকে বেশির ভাগ পদার্থবিদই খুব কঠিন কাজ বলে মনে করতেন। বিশেষ করে নিউক্লিয়ার বল তখনো পুরোটা ছিল রহস্যের আবরণে মোড়া।
ঠিক সে সময় আইনস্টাইন মন্তব্য করেন, ‘মানুষ আমাকে সাধারণত বহুকাল আগে মাটিচাপা পড়া শিলাভূত বস্তু বলে মনে করে ইদানীং। মনে করে, বয়সের ভারে আমি অন্ধ ও বধির হয়ে গেছি। তবে এতে আমি খুব বেশি বিরক্ত হই না, কারণ আমার মেজাজের সঙ্গে ওদের এ ধারণা বেশ মানানসই। ‘
অতীতে একটা মৌলিক নীতি ছিল, যা আইনস্টাইনের কাজে পথ দেখিয়েছিল। তাঁর তত্ত্ব বিশেষ আপেক্ষিকতায় X, Y, Z, ও T জায়গা পরিবর্তন করলেও একই থাকে। সাধারণ আপেক্ষিকতায় ছিল সমতুল্যতার নীতি, যেখানে মহাকর্ষ ও ত্বরণ সমতুল্য হতে পারে। কিন্তু থিওরি অব এভরিথিং অনুসন্ধানে পথ দেখানোর মতো কোনো নীতির খোঁজ পেতে ব্যর্থ হন আইনস্টাইন। এখনো আমি আইনস্টাইনের নোটবুক আর গণনাগুলো উল্টেপাল্টে দেখি। দেখতে পাই, তাঁর নোটবুকে প্রচুর আইডিয়া আছে, কিন্তু পথ দেখানোর মতো কোনো নীতি নেই। একসময় তিনি বুঝতে পারেন, এটাই তাঁর চূড়ান্ত অনুসন্ধানকে ধ্বংস করে দেবে। একবার তিনি দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস, সত্যিকারের অগ্রগতি পেতে চাইলে অবশ্যই প্রকৃতি থেকে সাধারণ কিছু নীতি আবারও খুঁজে বের করতে হবে।’
কিন্তু তিনি কখনো সেটা খুঁজে পাননি। আইনস্টাইন সাহস করে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর সূক্ষ্ম, কিন্তু বিদ্বেষপরায়ণ নন।’ জীবনে এর পরের বছরগুলোতে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন এবং সিদ্ধান্তে আসেন, ‘আমার এখন সন্দেহ হয়, ঈশ্বর হয়তো আসলে বিদ্বেষপরায়ণ।
তাঁর ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি বা একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্বের অনুসন্ধান সেকালের অধিকাংশ পদার্থবিদ প্রায়ই অবহেলা করতেন। অবশ্য নিজের মতো করে ইউনিফায়েড থিওরি প্রণয়নের চেষ্টাও করেন অনেকে।
এমনকি এ রকম চেষ্টা করেছিলেন আরউইন শ্রোডিঙ্গারও। তিনি বেশ ভদ্রভাবে আইনস্টাইনকে লিখলেন, ‘আমি যখন খরগোশের কথা ভাবছি, আপনি তখন সিংহ শিকারে ব্যস্ত।’ তারপরও নিজের প্রণীত ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরির ঘোষণা দিতে ১৯৪৭ সালে এক সংবাদ সম্মেলন ডাকেন শ্রোডিঙ্গার। এমনকি সেই অনুষ্ঠানে আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইমন ডি ভ্যালেরাকেও উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছিল। শ্রোডিঙ্গার বললেন, ‘আমার বিশ্বাস, আমি নির্ভুল। যদি ভুল করি, তাহলে নিজের কাছেই নিজেকে ভীষণ বোকা লাগবে। পরে আইনস্টাইন শ্রোডিঙ্গারকে বলেছিলেন, তিনি নিজেও এককালে এই তত্ত্বটা ভেবেছিলেন, কিন্তু সেটা আসলে ভুল। আরও ব্যাপার হলো, তাঁর তত্ত্বটি ইলেকট্রন ও পরমাণুর প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে পারত না।
ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ও উলফগ্যাং পাউলিকেও এই পোকা ধরেছিল। একটা ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরির প্রস্তাব করেন এই দুই বিজ্ঞানী। পাউলি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় ছিদ্রান্বেষী এবং আইনস্টাইনের প্রজেক্টের সমালোচক। একটা মন্তব্যের জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর যেটাকে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করেছেন, তাকে জোড়া লাগানো মানুষের কম্ম নয়।’ অর্থাৎ ঈশ্বর যদি মহাবিশ্বের বলগুলো ছিন্নভিন্ন করেন, তাহলে সেগুলোকে আবারও একত্র করার আমরা কে?
১৯৫৮ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বক্তৃতা দেন পাউলি। সেখানে হাইজেনবার্গ-পাউলির ইউনিফায়েড থিওরি ব্যাখ্যা করেন তিনি। সেদিন দর্শকদের আসনে বসেছিলেন নীলস বোর। পাউলির কথা শেষে বোর সটান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমরা যারা পেছনে বসে আছি, তারা বুঝতে পারছি তোমার তত্ত্বটা বেশ উদ্ভট। কিন্তু সেটা যথেষ্ট উদ্ভট কি না, তা নিয়ে আমরা দ্বিধান্বিত।’
এর মাধ্যমে সেখানে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শুরু হয়। পাউলি দাবি করলেন, তাঁর তত্ত্বটা সত্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট উদ্ভট। কিন্তু অন্যরা বললেন, তাঁর তত্ত্বটা যথেষ্ট উদ্ভট নয়। পদার্থবিদ জেরেমি বার্নস্টাইন সেদিন দর্শক সারিতে ছিলেন। তিনি স্মৃতিচারণা করে বলেছেন, ‘সেটা ছিল আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দুই মহারথীর মধ্যে অস্বাভাবিক এক সম্মুখলড়াই। আমি ভাবতে লাগলাম, এখানে পদার্থবিজ্ঞানের বাইরের কেউ থাকলে যে কী ভাবতেন, কে জানে!
নীলস বোরই সঠিক ছিলেন। কারণ, পাউলির উপস্থাপিত তত্ত্বটা পরবর্তী সময়ে ভুল বলে প্রমাণিত হয়।
কিন্তু বোর আসলে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নাড়া দিয়েছিলেন। আইনস্টাইন এবং তাঁর সহযোগীরা ইতিমধ্যে সব কটি সরল ও সুস্পষ্ট তত্ত্ব নিয়ে কাজ করে দেখেছেন, সবই ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই সত্যিকার ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি অবশ্যই আগের সব পদ্ধতির চেয়ে মৌলিকভাবে আলাদা হবে। সেটা ‘যথেষ্ট উদ্ভট’ হবে, যাতে তা সত্যিকারের থিওরি অব এভরিথিং হিসেবে মেনে নেওয়া যায়।
কিউইডি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সত্যিকারের অগ্রগতি বলতে যা হয়েছিল, তা ছিল আলো ও ইলেকট্রনের জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ কোয়ান্টাম তত্ত্ব। একে বলা হয় কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকস বা কিউইডি। এর লক্ষ্য ছিল ডিরাকের ইলেকট্রন তত্ত্বের সঙ্গে ম্যাক্সওয়েলের আলোর তত্ত্বটা একীভূত করা। এভাবে আলো এবং ইলেকট্রনের জন্য এমন একটা তত্ত্ব তৈরি করা, যা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও বিশেষ আপেক্ষিকতা মেনে চলবে। (তবে ডিরাকের ইলেকট্রনের সঙ্গে সাধারণ আপেক্ষিকতা একীভূত করে কোনো তত্ত্ব প্রণয়ন করা খুবই কঠিন কাজ বলে মনে করা হয়।)
সেই ১৯৩০ সালে রবার্ট ওপেনহাইমার বুঝতে পারলেন, কিছু একটা গভীরভাবে বাধার সৃষ্টি করছে (পারমাণবিক বোমা বানানোর প্রজেক্টে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ওপেনহাইমার)। ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করা ফোটনকে কেউ বর্ণনার চেষ্টা করলে দেখা যায়, কোয়ান্টাম কারেকশন আসলে বিচ্যুত হয়ে অকেজো হয়ে যায় এবং অসীম ফলাফল দেয়। কোয়ান্টাম কারেকশন ছোট হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল, অর্থাৎ এটাই ছিল কয়েক দশক ধরে পথ দেখানোর নীতি। কাজেই ইলেকট্রনের ডিরাক সমীকরণ এবং ফোটনের ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ একীভূত করতে গেলে অনিবার্যভাবে একটা ত্রুটি দেখা দেয়। এটিই প্রায় দুই দশক তাড়িয়ে বেরিয়েছে পদার্থবিজ্ঞানীদের। অনেক পদার্থবিদ সমস্যাটি নিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু অগ্রগতি হয়েছে খুব সামান্যই।
অবশেষে ১৯৪৯ সালে স্বাধীনভাবে গবেষণা করে দীর্ঘমেয়াদি এই সমস্যাটার সমাধান করেন তিন তরুণ পদার্থবিদ। সেই তিন বিজ্ঞানী হলেন যুক্তরাষ্ট্রের রিচার্ড ফাইনম্যান ও জুলিয়ান শউইনগার এবং জাপানের শিনইচিরো তোমোনাগা।
তাঁদের সাফল্যটা ছিল বেশ লক্ষণীয়। তাঁরা ইলেকট্রনের চুম্বকীয় ধর্মের মতো বিষয়গুলো ব্যাপক নির্ভুলভাবে হিসাব করতে সক্ষম হন। কিন্তু কাজটা করতে এই তিন পদার্থবিদ যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন, সেটা বেশ বিতর্কিত ছিল। সেটা নিয়ে এখনো কিছুটা অস্বস্তি ও আতঙ্কিত বোধ করেন পদার্থবিদেরা।
এই বিজ্ঞানীরা কাজ শুরু করলেন ডিরাকের সমীকরণ এবং ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ ব্যবহার করে, যেখানে ইলেকট্রনের ভর ও চার্জ দেওয়া হয়েছিল নির্দিষ্ট প্রাথমিক মান (একে বলা হয় ‘স্বল্প ভর ও স্বল্প চার্জ’)। এরপর এই স্বল্প ভর ও চার্জের কোয়ান্টাম সংশোধনী নির্ণয় করা হলো। এই কোয়ান্টাম সংশোধনী ছিল অসীম। সমস্যাটা এর আগে দেখতে পেয়েছিলেন ওপেনহাইমারও।
কিন্তু এখানেই দেখা গেল আসল জাদুটা। আমরা যদি অনুমান করি যে আসল স্বল্প ভর ও চার্জ আসলে অসীম মান দিয়ে শুরু হয় এবং তারপর এই অসীম কোয়ান্টাম সংশোধনী হিসাব করি, তাহলে দেখা যায়, দুই অসীম সংখ্যা পরস্পরকে বাতিল করে দেয়। এভাবে পাওয়া যায় একটা সসীম মান! অন্য কথায়, অসীম বিয়োগ অসীম—সমান সমান শূন্য!
সেটা যে পাগলাটে ধারণা ছিল, তা বলা বাহুল্য, কিন্তু বেশ কাজের। ইলেকট্রনের চুম্বকীয় ক্ষেত্রের শক্তিমত্তাকে কিউইডি ব্যবহার করে অবিশ্বাস্য নির্ভুলভাবে হিসাব করা যায়। সেই নির্ভুলতার পরিমাণ এক শ বিলিয়নের এক ভাগ।
স্টিভেন ওয়াইনবার্গ উল্লেখ করেছেন, ‘এখানে তত্ত্ব ও পরীক্ষার মধ্যে সংখ্যাগত সমঝোতা সম্ভবত সব বিজ্ঞানের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর।’ এটা অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত দূরত্ব একটা চুলের ব্যাসের চেয়েও সূক্ষ্ম ও নির্ভুলভাবে গণনা করার মতো। শউইনগার এ নিয়ে এত গর্বিত ছিলেন যে এই ফলাফল প্রকাশ করে, এমন একটা সংকেত তিনি তাঁর সমাধিবেদিতে খোদাই করতে বলে গেছেন এবং তা ওখানে খোদিত আছে।
এই পদ্ধতিকে বলা হয় রিনরমালাইজেশন থিওরি বা পুনঃস্বাভাবিকীকরণ তত্ত্ব। তবে পদ্ধতিটি কষ্টকর, জটিল এবং মন ভোঁতা করে দেওয়ার মতো। আক্ষরিক অর্থেই হাজারটা পদকে নিখুঁতভাবে হিসাব করতে হয় এবং সেগুলোর সবই নিখুঁতভাবে বাতিল হয়ে যায়। সমীকরণভর্তি এই হিসাবে সামান্য একটা ত্রুটিও গোটা গণনাকে স্রেফ জলে ছুড়ে দিতে পারে। (একটা কথা বলা মোটেও অতিরঞ্জিত হবে না যে কয়েকজন পদার্থবিদ তাঁদের গোটা জীবন ব্যয় করেছেন রিনরমালাইজেশন থিওরি ব্যবহার করে কোয়ান্টাম সংশোধনীর দশমিকের পরের ঘর নির্ণয়ে।)
রিনরমালাইজেশন প্রক্রিয়া এত কঠিন হওয়ার কারণে ডিরাক ও এটি পছন্দ করতেন না। অথচ কিউইডি তৈরি করতে সহায়তা করেছিলেন তিনিই। ডিরাক মনে করতেন, এটা পুরোটাই কৃত্রিম, অনেকটা কম্বলের নিচের জিনিসগুলো ব্রাশ করার মতো। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘এটি কোনো বোধগম্য গণিত নয়। বোধগম্য গণিতের সঙ্গে একটা পরিমাণ বাদ দেওয়ার ব্যাপার জড়িত থাকে, যখন পরিমাণটা ছোট হতে দেখা যায়। কিন্তু পরিমাণটি অসীমভাবে বড় হওয়ার কারণে কখনো তা বাদ দেওয়া হয় না এবং আপনি এমন কিছু বাদ দিতে চাইবেনও না!’
রিনরমালাইজেশন থিওরি আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার সঙ্গে ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎ-চুম্বকত্বকে একীভূত করতে পারে। কিন্তু তত্ত্বটা আসলে চরমভাবে বিশ্রী। হাজারো পদ বাতিল করার জন্য এখানে অবশ্যই গাণিতিক কৌশলের একটা এনসাইক্লোপিডিয়ায় দক্ষ হতে হবে। কিন্তু ফলাফল নিয়ে আপনি কোনো তর্ক করতে পারবেন না।
কোয়ান্টাম বিপ্লবের প্রয়োগ
শেষ পর্যন্ত একগুচ্ছ উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের দিকে নিয়ে গিয়েছিল এটিই। এভাবে সংঘটিত হয় বিজ্ঞানের ইতিহাসে তৃতীয় বড় ধরনের বিপ্লব। সেটা ছিল উচ্চতর প্রযুক্তি বিপ্লব। এর মধ্যে রয়েছে ট্রান্সজিস্টর ও লেজার। আমাদের আধুনিক বিশ্ব গড়ে তুলতে এই বিপ্লবই সহায়তা করেছে।
ট্রান্সজিস্টরের কথা ভেবে দেখুন। গত এক শ বছরের মধ্যে সম্ভবত এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। ট্রান্সজিস্টর বিশাল টেলিযোগাযোগব্যবস্থা, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটসহ তথ্যপ্রযুক্তিতে বিপ্লব বয়ে এনেছে। ট্রান্সজিস্টর মূলত একটা দরজার মতো, যা ইলেকট্রনের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। একটা ভালভের কথা চিন্তা করুন। কোনো ভালভ সামান্য ঘুরিয়ে একটা পাইপের পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্ৰণ করা সম্ভব। একইভাবে ট্রান্সজিস্টর হলো অতিক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক ভালভ, যা সামান্য পরিমাণ বিদ্যুৎ যাওয়ার অনুমতি দেয়। এভাবে একটা তারের ভেতর দিয়ে অনেক বেশি ইলেকট্রনের প্রবাহ নিয়ন্ত্ৰণ করে ট্রান্সজিস্টর। কাজেই এভাবে অল্প সংকেতও বিবর্ধিত করা যায়।
একইভাবে লেজার হলো ইতিহাসের অন্যতম বহুমুখী অপটিক্যাল ডিভাইস। এটাও কোয়ান্টাম তত্ত্বের আরেকটি প্রায়োগিক ফল। কোনো গ্যাস লেজার তৈরি করতে হলে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম টিউব লাগে। এরপর এর মধ্যে শক্তি ঢোকাতে হয় (কোনো ইলেকট্রিক কারেন্ট প্রয়োগ করে)। শক্তির এই আকস্মিক প্রবেশের ফলে গ্যাসের ভেতরের কোটি কোটি ইলেকট্রন লাফ দিয়ে উচ্চতর শক্তি স্তরে চলে যেতে থাকে। শক্তিপ্রাপ্ত এই উত্তেজিত পরমাণুগুলো অস্থিতিশীল। কোনো একটা ইলেকট্রন যদি ক্ষয় হয়ে নিম্ন স্তরে চলে যায়, তাহলে তা আলোর ফোটন নিঃসরণ করে। ফোটনটা আঘাত করে পার্শ্ববর্তী উত্তেজিত পরমাণুকে। এ কারণে সেখানকার দ্বিতীয় পরমাণুও ক্ষয় হয়ে যায় এবং তা আরেকটি ফোটন নিঃসরণ করে। কোয়ান্টাম মেকানিকসের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, প্রথমটির সঙ্গে ঐকতানে কম্পিত হবে দ্বিতীয় ফোটনটি। ওই টিউবের দুই প্রান্তে আয়না লাগানো থাকে, যা ফোটনের এই বন্যাকে বিবর্ধিত করতে পারে। ক্রমান্বয়ে এই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ ফোটনের ঢল নামে। এর সব কটিই আয়নাগুলোর মধ্যবর্তী জায়গায় এপাশ-ওপাশ করে ঐকতানে দুলতে থাকে। আর তৈরি করে লেজার রশ্মি।
বর্তমানে লেজার দেখা যায় প্রায় সব জায়গাতেই। মুদিদোকানের ক্যাশ কাউন্টার, হাসপাতাল, কম্পিউটার, রক কনসার্ট, মহাকাশের স্যাটেলাইটসহ বিভিন্ন জায়গায় লেজারের দেখা মেলে। লেজার রশ্মিতে বিপুল পরিমাণ তথ্য বহন করা যায়। শুধু তা-ই নয়, এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ শক্তিও স্থানান্তর করা যায়, যা বেশির ভাগ পদার্থ পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। (স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে, লেজারের একমাত্র সীমাবদ্ধতা হলো লেজিং ম্যাটেরিয়াল এবং লেজারকে চালিত করা শক্তির স্থিতিশীলতা। কাজেই উপযুক্ত লেজিং পদার্থ এবং শক্তির উৎস ব্যবহার করে তাত্ত্বিকভাবে এমন লেজার রশ্মি তৈরি করা সম্ভব, যা সায়েন্স ফিকশন মুভিগুলোতে দেখা যায়।)
জীবন কী?
কোয়ান্টাম মেকানিকস প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তিত্ব আরউইন শ্রোডিঙ্গার। কিন্তু অন্য বৈজ্ঞানিক সমস্যা নিয়েও আগ্রহী ছিলেন এই বিজ্ঞানী। কয়েক শতাব্দী ধরে একটা সমস্যা বিজ্ঞানীদের আকর্ষণ করেছে। সেটি হলো, জীবন কী? কোয়ান্টাম মেকানিকস কি দিতে পারবে বহুযুগের এ রহস্যের সমাধান? শ্রোডিঙ্গার বিশ্বাস করতেন, কোয়ান্টাম বিপ্লবের একটি উপজাত জীবনের উৎপত্তি বোঝার চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে।
ইতিহাসব্যাপী দেখা যায়, বিজ্ঞানী ও দার্শনিকেরা বিশ্বাস স করেছেন, কোনো এক ধরনের জীবনীশক্তি আছে, যা জীবন্ত সত্তাকে প্রাণবন্ত করে তোলে। রহস্যময় একটা আত্মা যখন দেহের ভেতরে ঢোকে, তখন হঠাৎ তা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এবং মানুষের মতো আচরণ করে। আবার অনেকে এমন এক মতবাদে বিশ্বাস করেন, যাকে বলা হয় ডুয়েলিজম বা দ্বৈতবাদ। এ মতবাদ অনুযায়ী, বস্তুগত দেহ একটা আধ্যাত্মিক আত্মার সঙ্গে সহাবস্থান করে।
তবে বিজ্ঞানী শ্রোডিঙ্গার বিশ্বাস করতেন, জীবনের সংকেতলিপি কোনো নিয়ন্ত্রক অণুর মধ্যে লুকিয়ে থাকে, যা কোয়ান্টাম মেকানিকসের সূত্রগুলো মেনে চলে। আইনস্টাইন যেমন পদার্থবিজ্ঞান থেকে ইথারকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিলেন, তেমনিভাবে জীববিজ্ঞান থেকে জীবনীশক্তিকে বাতিল করার চেষ্টা চালান শ্রোডিঙ্গার। ১৯৪৪ সালে একটা পথিকৃৎমূলক বই লিখলেন তিনি, যার শিরোনাম হোয়াট ইজ লাইফ?। যুদ্ধপরবর্তী বিজ্ঞানীদের নতুন প্রজন্মের ওপর এই বইটার প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। বইয়ে জীবন সম্পর্কে প্রাচীনতম প্রশ্নটির উত্তরের জন্য কোয়ান্টাম মেকানিকস ব্যবহারের প্রস্তাব করলেন শ্রোডিঙ্গার। ওই বইয়ে তিনি দেখান, একটা জেনেটিক কোড কোনো একভাবে জীবিত সত্তার এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই কোড কোনো আত্মার মধ্যে নয়, বরং আমাদের কোষগুলোর অণুর সজ্জায় সংরক্ষিত থাকে। কোয়ান্টাম মেকানিকস ব্যবহার করে তিনি তাত্ত্বিকভাবে বললেন, এই রহস্যময় নিয়ন্ত্রক অণু কী হতে পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য ১৯৪০-এর দশকে আণবিক জীববিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের খুব বেশি কিছু জানা ছিল না।
শ্রোডিঙ্গারের এই বইটা পড়েছিলেন জেমস ডি ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক নামের দুজন বিজ্ঞানী। এরপর ওই নিয়ন্ত্রক অণুর খোঁজে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তাঁরা। ওয়াটসন এবং ক্রিক বুঝতে পারলেন, অণুগুলো এতই ছোট যে এদের দেখা বা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। এর কারণ হলো, একটা অণুর চেয়ে দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক বেশি। কিন্তু তাঁদের হাতে আরেকটা কোয়ান্টাম কৌশল ছিল। সেটা হলো এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি। এক্স-রের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আর অণুগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় কাছাকাছি। কাজেই কোনো জৈব পদার্থের ক্রিস্টালে এক্স-রে ছুড়ে দিলে এক্স-রে বিক্ষিপ্ত হবে বিভিন্ন দিকে। কিন্তু এই বিক্ষিপ্ত এক্স-রের বিন্যাসের মধ্যে ক্রিস্টালের পারমাণবিক কাঠামোর বিস্তারিত তথ্যও থাকবে। বিভিন্ন ধরনের অণু বিভিন্ন ধরনের এক্স-রে প্যাটার্ন তৈরি করে। কোনো দক্ষ কোয়ান্টাম পদার্থবিদ এই বিক্ষিপ্ত আলোর ফটোগ্রাফ দেখে বলতে পারেন আসল অণুর কাঠামোটা কেমন ছিল। কাজেই অণুকে সরাসরি দেখা না গেলেও এই প্রক্রিয়ায় তার কাঠামোর রহস্যভেদ করা সম্ভব।
কোয়ান্টাম মেকানিকস এতই শক্তিশালী যে বিভিন্ন পরমাণু যে কোণে পরস্পর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অণু গঠন করে, এ তত্ত্ব দিয়ে তা নির্ধারণ করা সম্ভব। শিশুদের টিংকারটয় বা লেগো ব্রিক খেলার মতো করে বিজ্ঞানীরা পরমাণুর পর পরমাণু সাজিয়ে, এসব পরমাণুর শিকলকে একত্রে বেঁধে জটিল কোনো অণুর প্রকৃত কাঠামো পুনরুৎপাদন করতে পারেন। ওয়াটসন ও ক্রিক বুঝতে পারলেন, ডিএনএ অণু হলো একটা কোষের নিউক্লিয়াসের অন্যতম প্রধান গাঠনিক উপাদান। তাই সেটাই তাঁদের সম্ভাব্য লক্ষ্য ছিল। সে সময় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এক্স-রে ছবি তুলেছিলেন রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন। সেগুলো বিশ্লেষণ করে ওয়াটসন ও ক্রিক সিদ্ধান্তে আসতে সক্ষম হন যে ডিএনএ অণুর কাঠামো আসলে ডাবল হেলিক্স।
একটা পেপারে ওয়াটসন ও ক্রিক কোয়ান্টাম মেকানিকস ব্যবহার করে ডিএনএ অণুর গোটা কাঠামো ডিকোড করতে সক্ষম হন। এই দুই বিজ্ঞানীর লেখা ওই পেপারটা বিশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা পেপার। এটা আসলে একটা মাস্টারপিস। বিজ্ঞানীদ্বয় উপসংহারে দেখান যে জীবসত্তার মৌলিক প্রক্রিয়া বা প্রজনন, আণবিক স্তরে নকল করা যেতে পারে। ডিএনএর সূত্রকগুলোতে জীবনের তথ্য এনকোড বা সংকেতাবদ্ধ থাকে। আর এই ডিএনএ পাওয়া যায় প্রতিটি কোষের ভেতরে।
যুগান্তকারী একটা আবিষ্কার ছিল সেটা, যা জীববিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বা মানব জিনোম প্রজেক্ট সম্ভব করে তোলে। এর মাধ্যমে আমরা যেকোনো ব্যক্তির ডিএনএর পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক বর্ণনা পেতে পারি।
এর আগের শতাব্দীতে চার্লস ডারউইন যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সেটাই এখন সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবীতে ফ্যামিলি ট্রি অব লাইফ বা জীবনবৃক্ষ তৈরি করা গেছে। এতে প্রতিটি জীবন্ত সত্তা বা ফসিল এই বৃক্ষের একটা শাখার একজন সদস্য। এসব কিছুই আসলে কোয়ান্টাম মেকানিকসের ফলাফল।
সুতরাং কোয়ান্টাম ফিজিকসের সূত্রগুলোর একত্রীকরণ শুধু মহাবিশ্বের গুপ্তরহস্যই নয়, বরং ট্রি অব লাইফকেও একত্র করেছে।
নিউক্লিয়ার বল
নিশ্চয়ই মনে আছে, আইনস্টাইন শেষ পর্যন্ত তাঁর ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি শেষ করতে পারেননি। এর আংশিক কারণ, ধাঁধাটির বিশাল একটা অংশের তখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেই নিখোঁজ অংশটা হলো নিউক্লিয়ার ফোর্স বা পারমাণবিক বল। ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে ফিরে গেলে দেখা যাবে, এ সম্পর্কে তখন একদম কিছুই জানা যায়নি।
কিন্তু যুদ্ধপরবর্তী যুগে কিউইডির বিস্ময়কর সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে পদার্থবিদেরা মনোযোগ দিলেন পরবর্তী জ্বলন্ত সমস্যাটার দিকে। অর্থাৎ নিউক্লিয়ার বলের ওপর কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ করলেন বিজ্ঞানীরা। কাজটা ছিল কঠিন আর শ্রমসাধ্য। কারণ, বলতে গেলে তাঁরা শুরু করেছিলেন ভাসা-ভাসা জ্ঞান থেকে। তাই এই অজানা- অচেনা এলাকায় নিজেদের পথ খুঁজে পেতে তাঁদের সম্পূর্ণ নতুন আর শক্তিশালী একটা হাতিয়ারের প্রয়োজন দেখা দিল।
দুই ধরনের নিউক্লিয়ার বল আছে। সেগুলো হলো সবল এবং দুর্বল নিউক্লিয়ার বল। প্রোটনের চার্জ ধনাত্মক। আর দুটি ধনাত্মক চার্জ পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। এসব কারণে পরমাণুর নিউক্লিয়াস সাধারণভাবে ভেঙে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই বৈদ্যুতিক চার্জজনিত বিকর্ষণকে কাটিয়ে উঠে নিউক্লিয়াসকে একত্রে ধরে রাখে যে বলটি, সেটিই হলো পারমাণবিক বল। এই বল ছাড়া আমাদের গোটা বিশ্ব একটা অতিপারমাণবিক কণাদের মেঘে বিলীন হয়ে যেত।
বিভিন্ন রাসায়নিক মৌলের নিউক্লিয়াসকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থিতিশীল রাখার জন্য সবল নিউক্লিয়ার বল যথেষ্ট। এর মধ্যে অনেকেই খোদ মহাবিশ্বের শুরু থেকেই স্থিতিশীল। বিশেষ করে প্রোটন আর নিউট্রনের সংখ্যার মধ্যে ভারসাম্য থাকলে তাদের স্থিতিশীল হতে দেখা যায়। তবে বেশ কিছু কারণে কিছু নিউক্লিয়াস অস্থিতিশীল। বিশেষ করে তাদের মধ্যে অনেক বেশি পরিমাণে প্রোটন বা নিউট্রন থাকলে এটি ঘটতে দেখা যায়। নিউক্লিয়াসে অনেক বেশিসংখ্যক প্রোটন থাকলে, বৈদ্যুতিক বিকর্ষণের কারণে নিউক্লিয়াস ভেঙে যায়। আবার নিউক্লিয়াসে বেশি পরিমাণে নিউট্রন থাকলে, তাদের অস্থিতিশীলতা ক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে দুর্বল নিউক্লিয়ার বল নিউট্রনগুলোকে দীর্ঘ মেয়াদে একত্রে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই ক্রমান্বয়ে তা ভেঙে যায়। যেমন একগুচ্ছ নিউট্রনের মধ্যে অর্ধেকই ক্ষয় হয়ে যায় মাত্র ১৪ মিনিটের মধ্যে। এরপর সেখানে বাকি থাকে তিনটি কণা। সেগুলো হলো প্রোটন, ইলেকট্রন এবং আরেকটি রহস্যময় নতুন কণা। নতুন এ কণার নাম অ্যান্টি- নিউট্রিনো। এ সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করব।
নিউক্লিয়ার বল নিয়ে গবেষণা করা খুবই কঠিন। কারণ, একটা পরমাণুর তুলনায় নিউক্লিয়াসের আকার প্রায় এক শ হাজার ভাগ ছোট। তাই একটা প্রোটনের ভেতরে অনুসন্ধান চালাতে পদার্থবিদদের নতুন একধরনের হাতিয়ারের প্রয়োজন হলো। একে বলা হয় পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর বা কণাত্বরক যন্ত্র। আমরা আগেই দেখেছি, অনেক বছর আগে নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করার জন্য একটা সিসা দিয়ে ঘেরা বাক্স থেকে রেডিয়াম নিঃসৃত রশ্মি ব্যবহার করেছিলেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। নিউক্লিয়াসের আরও গভীরে অনুসন্ধান চালাতে পদার্থবিদদের আরও শক্তিশালী বিকিরণ উৎসের প্রয়োজন হয়।
আর্নেস্ট লরেন্স ১৯২৯ সালে সাইক্লোট্রন উদ্ভাবন করেন। আজকের বিশালাকৃতির পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটরের অগ্রদূত ছিল এই সাইক্লোট্রন। সাইক্লোট্রনের মৌলিক নীতি খুব সরল। একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্র প্রোটনদের একটা বৃত্তাকার পথে চলতে বাধ্য করে। প্রতিটি চক্রে একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মাধ্যমে প্রোটনগুলোর শক্তি কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেকগুলো ঘূর্ণনের পর ক্রমান্বয়ে প্রোটনের রশ্মি কয়েক মিলিয়ন থেকে কয়েক বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টে পৌঁছাতে পারে। (পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটরের মৌলিক নীতি এতই সোজা যে স্কুলে পড়ার সময় আমি নিজেও একটা ইলেকট্রন পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর বানিয়ে ফেলেছিলাম। একে বলা হয় বেটাট্রন।)
এই রশ্মি শেষ পর্যন্ত একটা লক্ষ্যবস্তুর দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়, সেখানে এটি অন্য প্রোটনগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। এই সংঘর্ষ থেকে বেরিয়ে আসা বিপুল পরিমাণ ভগ্নাবশেষ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা নতুন ও আগে অনাবিষ্কৃত কণা খুঁজে পান। (কণাদের রশ্মি ছুড়ে দিয়ে প্রোটন চূর্ণ করার এই প্রক্রিয়া অমার্জিত ও অযথাযথ কাজ। একে জানালা দিয়ে পিয়ানো ছুড়ে ফেলার পর, সংঘর্ষের কারণে সৃষ্ট শব্দ বিশ্লেষণ করে পিয়ানোর ধর্ম নির্ধারণ করার চেষ্টার সঙ্গে তুলনা করা যায়। কিন্তু এটি যত অমার্জিত প্রক্রিয়াই হোক না কেন, প্রোটনের ভেতরে অনুসন্ধান চালানোর জন্য এটাই আমাদের জানা একমাত্র উপায়।)
পদার্থবিদেরা পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর ব্যবহার করে প্রথম প্রোটন চূর্ণ করেন ১৯৫০-এর দশকে। তখন তাঁরা হতবাক হয়ে একগুচ্ছ কণা দেখতে পান। সেগুলো পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।
ব্যাপারটা এককথায় অতিপ্রাচুর্য। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয়, যত গভীরে অনুসন্ধান করা যায়, প্রকৃতি ততই সরলতর হয়ে ওঠে, কোনোভাবেই জটিল হয় না। কিন্তু কোয়ান্টাম পদার্থবিদদের কাছে মনে হলো, প্রকৃতি হয়তো সত্যি সত্যিই বিরক্তিকর।
নতুন নতুন কণার বন্যা বয়ে যেতে লাগল। তাতে ভীষণ হতাশ ও বিরক্ত হয়ে রবার্ট ওপেনহাইমার ঘোষণা করলেন, ‘এই বছর যে পদার্থবিদ কোনো নতুন কণা আবিষ্কার করবেন না, তাঁকেই নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত।’ অন্যদিকে এনরিকো ফার্মি ঘোষণা করলেন, ‘আগে যদি জানতাম গ্রিক নামধারী এতগুলো কণা আছে, তাহলে পদার্থবিদ না হয়ে আমি উদ্ভিদবিদ হতাম।’
একপ্রকার বাধ্য হয়ে অতিপারমাণবিক কণাগুলোতে ডুব দিলেন গবেষকেরা। সে এক জগাখিচুড়ি অবস্থা। তা দেখে কিছু পদার্থবিদ দাবি করে বসলেন, মানুষের মন হয়তো এই অতিপারমাণবিক জগৎ বোঝার জন্য যথেষ্ট স্মার্ট নয়। এসব বিজ্ঞানীর যুক্তিটা ছিল, একটা কুকুরকে যেমন ক্যালকুলাস শেখানো অসম্ভব, তেমনি পরমাণুর গভীরে নিউক্লিয়াসে কী ঘটছে, তা বোঝার জন্য হয়তো মানবমন যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
কিছু বিভ্রান্তি কেটে গেল ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ক্যালটেক) মারে গেল-মান এবং তাঁর সহকর্মীদের গবেষণার কারণে। এই বিজ্ঞানীরা দাবি করলেন, প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে আরও ছোট ছোট তিনটি কণা থাকে। এই ছোট কণাদের নাম দেওয়া হলো কোয়ার্ক।
এই বিজ্ঞানীদের প্রস্তাবিত মডেলটা ছিল বেশ সরল। কিন্তু কণাগুলোকে বিভিন্ন দলে সাজাতে তা বিস্ময়করভাবে ভালো ফল দিল। মেন্ডেলিভের মতো গেল-মানও তাঁর তত্ত্বে কিছু ফাঁক দেখে নতুন শক্তিশালী মিথস্ক্রিয়া করা কণাদের ধর্ম কেমন হবে, তার পূর্বাভাস দিলেন। কোয়ার্ক মডেলের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করা হলো আরেকটি নতুন কণার। একে বলা হয় ওমেগা মাইনাস। ১৯৬৪ সালে সেটাও খুঁজে পাওয়া গেল। এর মাধ্যমে এই তত্ত্বের মৌলিক সঠিকতা যাচাই করা সম্ভব হয়। সে জন্য নোবেল পুরস্কার পান মারে গেল-মান।
কোয়ার্ক মডেল এত বেশি কণাদের একত্র করার কারণ হলো, এটি প্রতিসাম্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। মনে আছে নিশ্চয়ই, আইনস্টাইন চারমাত্রিক প্রতিসাম্য চালু করেছিলেন, যা স্থানকে সময় এবং সময়কে স্থানে পরিণত করতে পারে। গেল-মানও তিনটি কোয়ার্ক-সংবলিত এমন কিছু সমীকরণ প্রবর্তন করেন, সেগুলোকে একটা সমীকরণে বিনিময় করা হলেও সমীকরণটি একই থেকে যায়। এই নতুন প্রতিসাম্য তিনটি কোয়ার্কের পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে পারল।
দুই বিপরীত মেরু
ক্যালটেকের আরেক মহান পদার্থবিদ ছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান। তিনি কিউইডি রিনরমালাইজ করেছিলেন। অন্যদিকে কোয়ার্ক ধারণা চালু করলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মারে গেল-মান। কিন্তু ব্যক্তিত্ব আর মেজাজে দুজন ছিলেন দুই মেরুর মানুষ।
জনপ্রিয় গণমাধ্যমে পদার্থবিদদের সবর্জনীনভাবে হয় পাগল বৈজ্ঞানিক (ব্যাক টু দ্য ফিউচার মুভির ডক ব্রাউনের মতো) নয়তো দ্য বিগ ব্যাং থিওরি সিরিজের মতো হতাশাবাদী অদক্ষ নার্ড হিসেবে দেখানো হয়। তবে বাস্তবে পদার্থবিদেরা সব ধরনের আকার, আকৃতি এবং ব্যক্তিত্বের হতে পারেন।
ফাইনম্যান ছিলেন বর্ণিল ডাশমাছির মতো সদা চটকদার আর ক্লাউন স্বভাবের। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ সাংঘাতিক চমকবাজি ভঙ্গিতে অশ্লীল সব গল্প বলতেন। আর সেগুলো বলতেন শ্রমজীবী মানুষদের মতো কথ্য ভাষায়। (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লস অ্যালামসের ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির একটা গোপন সেফের তালা খুলে ফেলেন তিনি। তাতে পারমাণবিক বোমার গুপ্ত তথ্য ছিল। সেফের মধ্যে তিনি একটা সংকেত ব্যবহার করে একটা নোট রেখে দেন। পরের দিন ওই নোটটা খুঁজে পেয়ে সতর্কসংকেত বাজিয়ে দিয়েছিলেন সেখানকার কর্মকর্তারা। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের টপ সিক্রেট ল্যাবরেটরিতে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল।) ফাইনম্যানের জন্য কোনো কিছুই রীতিহীন বা আপত্তিজনক ছিল না। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে তিনি একবার নিজেকেই একটা হাইপারব্যারিক চেম্বারে আটকে রাখেন। এভাবে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, দেহের বাইরে কোনো অশরীরী অভিজ্ঞতা আদৌ আছে কি না।
তবে গেল-মান ছিলেন পুরো বিপরীত চরিত্রের। সদা ভদ্রলোক, কথা ও আচরণে নিখুঁত। পাখি দেখা, অ্যান্টিক সংগ্রহ করা, ভাষাতত্ত্ব আর ভূতত্ত্ব ছিল তাঁর অবসরের প্রিয় বিষয়বস্তু। কিন্তু তাঁদের চরিত্রগত পার্থক্য থাকলেও দুজনের চালিকা শক্তি এবং সংকল্প ছিল একই। সেটাই কোয়ান্টাম তত্ত্বের রহস্যগুলোর ভেতরে তাঁদের ঢুকতে সহায়তা করছিল।
দুর্বল বল এবং ভুতুড়ে কণা
এদিকে দুর্বল বল বোঝার জন্যও বেশ বড় ধরনের কার্যক্রম চলছিল। শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের চেয়ে এ বলটি প্রায় ১০ লাখ ভাগ দুর্বল। যেমন বিভিন্ন ধরনের পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ধরে রাখার জন্য দুর্বল বল যথেষ্ট নয়। তাই সেগুলো ভেঙে যায় এবং ক্ষয় হয়ে পরিণত হয় ক্ষুদ্রতর অতিপারমাণবিক কণায়। আমরা দেখেছি, তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের কারণে পৃথিবীর ভেতরটা এত বেশি উত্তপ্ত। বজ্রতুল্য আগ্নেয়গিরির প্রচণ্ড শক্তি এবং ভয়াবহ ভূমিকম্পের শক্তি আসে এই দুর্বল নিউক্লিয়ার বল থেকে। দুর্বল বল ব্যাখ্যার জন্য নতুন একধরনের কণা প্রবর্তন করার প্রয়োজন দেখা দিল। যেমন নিউট্রন অস্থিতিশীল এবং তা ক্রমান্বয়ে ক্ষয় হয়ে একটা প্রোটন ও একটা ইলেকট্রনে পরিণত হয়। একে বলা হয় বেটা ডিকে বা বেটা ক্ষয়। কিন্তু এই গণনাটা সম্পাদন করতে পদার্থবিদদের তৃতীয় একটা কণার প্রবর্তনের দরকার পড়ল। আবছা এই কণার নাম নিউট্রিনো।
নিউট্রিনোকে মাঝে মাঝে ভুতুড়ে কণাও বলা হয়। কারণ কোনো রকম শোষণ ছাড়াই কণাটা গোটা গ্রহ ও নক্ষত্রের ভেতর দিয়ে চলে যেতে পারে। ঠিক এই মুহূর্তে গভীর মহাকাশ থেকে আসা নিউট্রিনো কণার বন্যা আছড়ে পড়ছে আপনার দেহের ওপর। এর মধ্যে কিছু নিউট্রিনো গোটা পৃথিবীর ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছে। আসলে এসব নিউট্রিনোর মধ্যে এমন কিছু আছে, যা পৃথিবী থেকে আমাদের নিকটতম নক্ষত্র পর্যন্ত বিস্তৃত শক্ত একটা সিসার ব্লকের এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে আরেক প্রান্ত ভেদ করে বেরিয়ে যেতে পারে।
১৯৩০ সালে নিউট্রিনোর অস্তিত্বের কথা প্রথম অনুমান করেছিলেন পাউলি। তিনি একবার দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমিই এই চূড়ান্ত পাপ করেছি। এমন একটা কণার কথা বলেছি, যাকে কখনো পর্যবেক্ষণ করা যায় না।’ সত্যিই কণাটি দীর্ঘদিন পর্যন্ত অধরা রয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে একটা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে নিঃসৃত তীব্র বিকিরণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে কণাটি আবিষ্কৃত হয়। (বলতে গেলে, সাধারণ পদার্থের সঙ্গে নিউট্রিনো মিথস্ক্রিয়া করে না। পদার্থবিদেরা সেটা মেনে নিয়েই একটা পারমাণবিক চুল্লি থেকে নিঃসৃত বিপুলসংখ্যক নিউট্রিনোকে নিয়ে কাজে নেমেছিলেন, যাতে যেকোনোভাবেই হোক এর একটাকে অন্তত শনাক্ত করা যায়।)
দুর্বল নিউক্লিয়ার বল সম্পর্কে বুঝতে গিয়ে পদার্থবিদেরা আরেকবার প্রতিসাম্য প্রবর্তন করেন। ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো হলো দুর্বল মিথস্ক্রিয়া করা কণা জোড়া। তাই প্রস্তাব করা হলো যে তারা জোড় বাঁধতে পারে এবং প্রতিসাম্য দিতে পারে। এরপর এই নতুন প্রতিসাম্যকে সংযুক্ত করা যেতে পারে ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের পুরোনো প্রতিসাম্যের সঙ্গে। এর ফলাফল হিসেবে যে তত্ত্ব পাওয়া গেল, তাকে বলা হয় ইলেকট্রোউইক থিওরি বা তড়িৎ-দুর্বল তত্ত্ব। এ তত্ত্ব বিদ্যুৎ- চুম্বকত্বের সঙ্গে দুর্বল নিউক্লিয়ার বলকে একত্র করে।
এই ইলেকট্রোউইক থিওরির কারণে ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরস্কার পান বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়াইনবার্গ, শ্লেনডন গ্লাসো ও আবদুস সালাম।
আইনস্টাইন একসময় আশা করেছিলেন, আলোর সঙ্গে মহাকর্ষকে একত্র করবেন। কিন্তু দেখা গেল, মহাকর্ষ নয়, বরং আলো আসলে দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের সঙ্গে একত্র হতে বেশি পছন্দ করে।
তার মানে, শক্তিশালী বলের ভিত্তি গেল-মানের প্রতিসাম্য, যা তিনটি কোয়ার্ককে একত্রে বেঁধে প্রোটন ও নিউট্রন তৈরি করে। অন্যদিকে দুর্বল নিউক্লিয়ার বলের ভিত্তি একটা ক্ষুদ্রতর প্রতিসাম্য। অর্থাৎ ইলেকট্রনের সঙ্গে নিউট্রিনোর পুনর্বিন্যাস, যা এরপর বিদ্যুৎ- চুম্বকীয় বলের সঙ্গে একত্র হয়।
কিন্তু অতিপারমাণবিক কণাদের চিড়িয়াখানা ব্যাখ্যার জন্য কোয়ার্ক মডেল এবং ইলেকট্রোউইক তত্ত্ব শক্তিশালী হলেও এখানে এখনো বিশাল একটা ফাঁক রয়ে গেছে। জ্বলন্ত প্রশ্নটি হলো, এসব কণাকে একত্রে ধরে রেখেছে কী?
ইয়াং–মিলস থিওরি
বিদ্যুৎ-চুম্বকত্বে পাওয়া ধর্মগুলোর পূর্বাভাস দিতে ম্যাক্সওয়েলের ক্ষেত্র ছিল অত্যন্ত সফল। তাই ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের আরও শক্তিশালী ও নতুন সংস্করণের জন্য গবেষণা শুরু করলেন পদার্থবিদেরা। চেন নিং ইয়াং এবং রবার্ট এল মিলস এই থিওরির প্রস্তাব দেন ১৯৫৪ সালে। এখানে ১৮৬১ সালে ম্যাক্সওয়েলের প্রণয়ন করা একটা ক্ষেত্রের বদলে, অনেকগুলো ক্ষেত্রের একটা পরিবার থাকার প্রস্তাব দেন এই দুই বিজ্ঞানী। কোয়ার্কগুলো পুনর্বিন্যাস করতে গেল-মান যে প্রতিসাম্য ব্যবহার করেছিলেন, সেটাই এখন ইয়াং-মিলস ক্ষেত্রগুলোর নতুন গুচ্ছগুলোকে পরস্পরের মধ্যে পুনর্বিন্যাসের জন্য ব্যবহার করা হলো।
তাঁদের আইডিয়াটা বেশ সরল। পরমাণুকে ধরে আছে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র, যা ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। তাঁরা ভাবলেন, তাহলে কোয়ার্কগুলোকে একত্রে যেটি ধরে রেখেছে, সেটি হয়তো ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের সাধারণীকরণ। অর্থাৎ ইয়াং-মিলস ক্ষেত্রগুলো। কোয়ার্কগুলোর প্রতিসাম্য ব্যাখ্যায় যে প্রতিসাম্য ব্যবহৃত হয়, সেটিই এখন প্রয়োগ করা হয় ইয়াং-মিলস ক্ষেত্রে।
তবে বেশ কয়েক দশক এই সরল আইডিয়াটা নির্জীব হয়ে পড়ে ছিল। কারণ, ইয়াং-মিলস কণাদের ধর্ম যখন গণনা করা হলো, তখন আবারও ফলাফল পাওয়া গেল অসীম মানের। কিউইডিতে আমরা যেমন দেখেছি, সে রকম। দুর্ভাগ্যক্রমে ফাইনম্যান যেসব কৌশল চালু করেছিলেন, সেগুলোও ইয়াং-মিলস তত্ত্বকে রিনরমাল করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। বেশ কয়েক বছর নিউক্লিয়ার বলের জন্য একটা সসীম তত্ত্বের খোঁজে মরিয়া হয়ে ওঠেন পদার্থবিদেরা।
অবশেষে এসব অসীম পদের জঙ্গল সাফ হয়ে গেল উদ্যমী ডাচ গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী জেরার্ড ‘টি হুফটের সাহস আর খাঁটি মনের জোরে। এভাবে রিনরমালাইজ হলো ইয়াং-মিলস ক্ষেত্র। তত দিনে এসব অসীম বিশ্লেষণ করার জন্য কম্পিউটারগুলোও যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। তাঁর কম্পিউটার প্রোগ্রাম যখন এসব কোয়ান্টাম সংশোধনীর প্রতিনিধিত্ব করতে এক দল শূন্য উগরে দিচ্ছিল, তখনই হুফট বুঝতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই সঠিক।
এই যুগান্তকারী ঘটনার খবর অচিরেই পদার্থবিদদের নজর কাড়ল। পদার্থবিদ শেলডন গ্ল্যাশো উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘এই লোকটা হয় একেবারে গর্দভ, নয়তো গত কয়েক বছরে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় জিনিয়াস!’
সেটা এমন এক নৈপুণ্যের কাজ ছিল, যার জন্য ১৯৯৯ সালে নোবেল পুরস্কার পান ‘টি হুফট এবং তাঁর উপদেষ্টা মার্টিনাস ভেল্টম্যান। হুট করে এমন নতুন একটা ফিল্ড বা ক্ষেত্র পাওয়া গেল, যা জানা সব কণাকে নিউক্লিয়ার বলের মধ্যে আটকে ফেলল। সেই সঙ্গে ব্যাখ্যা করতে পারল দুর্বল বলকেও। কোয়ার্কের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা ইয়াং-মিলস ক্ষেত্রকে বলা হয় গ্লুয়ন। কারণ, এটা তখন কোয়ার্কগুলোকে একত্রে বাঁধতে গ্লু বা আঠার মতো কাজ করে। (কম্পিউটার সিমুলেশনে দেখা গেছে, ইয়াং-মিলস ক্ষেত্র ঘনীভূত হয়ে একটা টফি-জাতীয় পদার্থের আকার নেয়, যা এরপর কোয়ার্ককে আঠার মতো আটকে ফেলে।) সেটা করতে তিন ধরনের বা তিন কালারের কোয়ার্ক দরকার, যারা মেনে চলে গেল-মানের থ্রি-কোয়ার্ক সিমেট্রি। কাজেই সবল বলের নতুন একটা তত্ত্ব ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেল। এই নতুন তত্ত্বটির নামকরণ করা হলো কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিকস বা কিউসিডি। বর্তমানে এটিই আমাদের জানামতে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা।
হিগস বোসন—ঈশ্বর কণা
সুতরাং ধীরে ধীরে এসব বিশৃঙ্খলা থেকে একটা নতুন তত্ত্ব উঠে এল, যাকে বলা হয় স্ট্যান্ডার্ড মডেল বা প্রমিত মডেল। অতিপারমাণবিক কণার চিড়িয়াখানা বা জঙ্গল ঘিরে যে বিভ্রান্তি ছিল, একসময় তা কেটে গেল। প্রোটন ও নিউট্রনের ভেতরে ইয়াং-মিলস ফিল্ড (যাকে বলা হয় গ্লুয়ন) কোয়ার্কগুলোকে একত্রে বেঁধে রাখে। আর ইলেকট্রন ও নিউট্রিনোর মধ্যকার মিথস্ক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করে আরেকটি ইয়াং- মিলস ফিল্ড (যাকে বলা হয় ডব্লিউ ও জেড কণা)।
কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে চূড়ান্তভাবে মেনে নিতে যেটা বাধা দিচ্ছিল, সেটা হলো কণাদের জিগস পাজলের চূড়ান্ত টুকরাটার অভাব। যাকে বলা হয় হিগস বোসন। মাঝেমধ্যে যাকে গড পার্টিকেল বা ঈশ্বর কণা নামেও ডাকা হয়। প্রতিসাম্যও এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এই প্রতিসাম্য ভাঙার একটা উপায়ের দরকার, কারণ আমাদের চারপাশে যে মহাবিশ্বকে দেখা যায়, তা নিখুঁতভাবে প্রতিসম নয়।
আমরা এখন মহাবিশ্বের দিকে যখন তাকাই, তখন চারটি বলকে একটা আরেকটা থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেখি। মহাকর্ষ, আলো এবং নিউক্লিয়ার বলগুলোর মধ্যে প্রথম নজরে সাধারণ কোনো মিল আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু যতই সময়ের পেছনে যাওয়া যাবে, এই বলগুলো ততই একই কেন্দ্র অভিমুখী হতে থাকবে। হয়তো সৃষ্টির মুহূর্তে একটিমাত্র বল রূপে দেখা যাবে এদের।
কণা পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহার করে সৃষ্টিতত্ত্বের সবচেয়ে বড় রহস্য বা মহাবিশ্বের সৃষ্টি ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের সামনে বিকশিত হয় নতুন একটা চিত্র। হুট করে দুটি খুবই আলাদা ক্ষেত্র, কোয়ান্টাম মেকানিকস এবং সাধারণ আপেক্ষিকতা ধীরে ধীরে একটা আরেকটায় রূপান্তরিত হতে শুরু করে।
নতুন এই চিত্রে মহাবিস্ফোরণের তাৎক্ষণিক মুহূর্তে চারটি বলের সব কটিই একটা একক সুপারফোর্স বা অতিবলে একীভূত করা হয়। সেটি মেনে চলে প্রধান প্রতিসাম্য। এই প্রধান প্রতিসাম্য মহাবিশ্বের সব কটি কণার একটাকে আরেকটায় পরিণত করতে পারে। এই সুপারফোর্সকে যে সমীকরণ পরিচালনা করে, সেটিই হলো গড ইকুয়েশন বা ঈশ্বর সমীকরণ। আইনস্টাইন এবং অন্য পদার্থবিদদের হাত থেকে এতকাল যে প্রতিসাম্য ফসকে গেছে, এটাই সেই প্রতিসাম্য।
মহাবিস্ফোরণের পর মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে শুরু করলে তা ক্রমেই শীতল হতে থাকে। সঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে ভেঙে পড়তে থাকে বিভিন্ন বল এবং প্রতিসাম্য। এভাবে আজকের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের দুর্বল ও সবল বলের প্রতিসাম্য টুকরা টুকরা হয়ে ভেঙে পড়ে। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় সিমেট্রি ব্রেকিং বা প্রতিসাম্য ভাঙন। মানে, আমাদের এমন এক মেকানিজম দরকার, যা যথাযথভাবে এই আদি প্রতিসাম্য ভাঙতে পারবে এবং আমাদের কাছে স্ট্যান্ডার্ড মডেল রেখে যাবে। ঠিক এখানেই আসে হিগস বোসন।
এটি কল্পনা করার জন্য একটা নদীর বাঁধের কথা ভাবুন। জলাশয়ের মধ্যে পানির প্রতিসাম্য আছে। এই পানিকে ঘোরানো হলেও পানিগুলোকে একই রকম দেখাবে। অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সবাই জানি, পানি নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে। কারণ, নিউটনের মতে, পানি সব সময় নিম্ন শক্তির অবস্থায় যেতে চায়। বাঁধটি যদি ভেঙে যায়, তাহলে পানিগুলো হুট করে নিচের দিকে নিম্ন শক্তি অবস্থার দিকে যেতে থাকবে। কাজেই বাঁধের পেছনের পানিগুলো আছে উচ্চ শক্তির অবস্থায়। পদার্থবিদেরা বাঁধের পেছনের পানির এই অবস্থাকে বলেন ফলস ভ্যাকুয়াম বা মেকি শূন্যতা। কারণ, বাঁধটা হঠাৎ ভেঙে পানিগুলো সত্যিকার শূন্যতায় না যাওয়া পর্যন্ত অস্থিতিশীল। মানে, পানির নিম্নতম শক্তির অবস্থা হলো নিচের উপত্যকা। বাঁধটি ভেঙে গেলে আদি প্রতিসাম্য চলে যাবে এবং পানিগুলো তার সত্যিকার গ্রাউন্ড স্টেট বা ভূমি অবস্থায় পৌঁছাবে।
ফুটতে থাকা পানি বিশ্লেষণ করতে গেলেও এই প্রভাব দেখা যায়। ফোটার আগে পানি থাকে মেকি শূন্যতায়। এটি অস্থিতিশীল, কিন্তু প্রতিসম। অর্থাৎ এই পানিকে ঘোরানো যাবে এবং তা দেখতে একই রকম দেখাবে। কিন্তু পানি ফুটতে শুরু করার পর ধীরে ধীরে সৃষ্টি হবে ছোট ছোট বুদ্বুদ। এখানে প্রতিটি বুদ পার্শ্ববর্তী পানির তুলনায় একটা নিম্ন শক্তির অবস্থায় থাকে। প্রতিটি বুদ প্রসারিত হতে শুরু করে, যতক্ষণ না প্রতিটি বুদ্বুদ একত্র হয় এবং পানি ফুটে না ওঠে
এই দৃশ্যকল্প অনুসারে, মহাবিশ্বও একসময় আসলে একটা নিখুঁত প্রতিসম অবস্থায় ছিল। সব অতিপারমাণবিক কণাও একই প্রতিসাম্যের অংশ ছিল এবং সবার ভর ছিল শূন্য। তাদের শূন্য ভর হওয়ার কারণে তারা পুনর্বিন্যস্ত হতে পারবে, কিন্তু সমীকরণ একই থেকে যাবে। তবে অজানা কোনো কারণে সেটি ছিল অস্থিতিশীল। সেটি ছিল একটা মেকি শূন্যতার ভেতর। ক্ষেত্রটির সত্যিকার শূন্যতার (তবে ভাঙা) মধ্যে স্থানান্তরিত হওয়া জরুরি হয়ে পড়ে।
সেই সত্যিকার শূন্যতাটাই হিগস ক্ষেত্র। ফ্যারাডের বৈদ্যুতিক ক্ষেত্ৰ যেমন স্থানের সব কটি কোণে ছড়িয়ে থাকে, হিগস ক্ষেত্রও সে রকম স্থান-কালের সবটা জুড়ে ছড়িয়ে ছিল।
কিন্তু কিছু কারণে হিগস ফিল্ডের প্রতিসাম্য ভেঙে যেতে শুরু করে।
হিগস ক্ষেত্রের ভেতর কিছু ছোট ছোট বুদ্দ গঠিত হতে থাকে। এই বুদের বাইরের সব কণা ছিল ভরহীন ও প্রতিসম। কিন্তু বুদ্বুদের ভেতরে কিছু কণার ভর ছিল। মহাবিস্ফোরণ থেকে মহাবিশ্ব যতই সামনে এগিয়ে যেতে থাকে, এই বুদগুলো তত প্রসারিত হতে থাকে দ্রুতবেগে। তাতে কণাগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভর অর্জন করতে থাকে এবং আদি প্রতিসাম্য ভেঙে পড়ে। ক্রমান্বয়ে অতি বিশাল এক বুদের ভেতরে নতুন শূন্যতার অবস্থায় হাজির হয় গোটা মহাবিশ্ব।
কাজেই ১৯৭০-এর দশকে অসংখ্য পদার্থবিজ্ঞানীর কঠোর পরিশ্রমের ফল পাওয়া যেতে লাগল। কয়েক দশক ধু-ধু তেপান্তরে ঘোরাঘুরির পর, অবশেষে জিগস পাজলের সব কটি টুকরাকে একত্রে খাপে খাপে মেলাতে পারলেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বুঝতে পারলেন, (সবল, দুর্বল এবং বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের প্রতিনিধিত্ব করা) তিনটি তত্ত্বকে জোড়া দিয়ে তাঁরা এমন একগুচ্ছ সমীকরণ লিখতে পারছেন, যা গবেষণাগারে পর্যবেক্ষণ করা পরীক্ষার সঙ্গে খাপ খায়।
একটা প্রধান প্রতিসাম্য তৈরির চাবিকাঠি হলো তিনটি আলাদা আলাদা ছোট প্রতিসাম্যকে একত্রে বাঁধা। প্রথম প্রতিসাম্য ব্যাখ্যা করে সবল নিউক্লিয়ার বলকে, যা তিনটি কোয়ার্ককে পরস্পরের মধ্যে শাফল করতে পারে। দ্বিতীয় প্রতিসাম্য দুর্বল বলকে ব্যাখ্যা করে, যা ইলেকট্রন ও নিউট্রিনোকে শাফল করে। তৃতীয় প্রতিসাম্য ব্যাখ্যা করে ম্যাক্সওয়েলের আসল ক্ষেত্রকে। অবশ্য সব মিলে তৈরি চূড়ান্ত তত্ত্বটা ছিল বেমানান, বিশ্রী। কিন্তু তার সাফল্য ছিল তর্কাতীত।
প্রায় সবকিছুর তত্ত্ব
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, মহাবিস্ফোরণের এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় পরে পদার্থের ধর্মগুলো সম্পর্কে সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে স্ট্যান্ডার্ড মডেল।
অতিপারমাণবিক জগতের সবচেয়ে সেরা উপলব্ধির প্রতিনিধিত্ব করে স্ট্যান্ডার্ড মডেল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এতে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভট সব ছিদ্র রয়ে গেছে। প্রথমত, স্ট্যান্ডার্ড মডেলে মহাকর্ষকে উল্লেখ করা হয়নি। এটা অনেক বড় সমস্যা। কারণ, মহাবিশ্বের বৃহৎ পরিসরের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে মহাকর্ষ বল। আর স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সঙ্গে পদার্থবিদেরা যতবারই মহাকর্ষকে যুক্ত করতে চেষ্টা করেছেন, ততবারই তাঁরা সমীকরণগুলোর সমাধান করতে পারেননি। এর জন্য কোয়ান্টাম সংশোধনী ছোট না হয়ে অসীম হয়ে যায়, ঠিক কিউইডি এবং ইয়াং-মিলস কণাগুলোর মতো। কাজেই মহাবিশ্বের একগুঁয়ে কিছু রহস্য গোপন রয়ে গেছে, যার ওপর স্ট্যান্ডার্ড মডেল আলোকপাত করতে পারে না। যেমন মহাবিস্ফোরণের আগে কী ঘটেছিল এবং কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে কী আছে ইত্যাদি। (এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা আবারও ফিরে আসব। )
দ্বিতীয়ত, স্ট্যান্ডার্ড মডেল তৈরি করা হয়েছিল বিভিন্ন বলকে ব্যাখ্যাকারী তত্ত্বগুলো একত্র করে। ফলস্বরূপ যে তত্ত্বটি পাওয়া গেছে, তা আসলে জোড়াতালি মার্কা। (এক পদার্থবিদ একে তুলনা করেছেন একটা প্লাটিপাস, একটা আর্ডভার্ক ও একটা তিমিকে ঠুকে ঠুকে একত্র করে বানানো নতুন জন্তুর সঙ্গে। তারপরও একে বলা হচ্ছে প্রকৃতির সবচেয়ে অভিজাত জন্তু। এভাবে চূড়ান্ত যে জন্তুটি পাওয়া গেছে, বলা হয় একমাত্র তার মা-ই তাকে পছন্দ করতে পারবে।)
তৃতীয়ত, স্ট্যান্ডার্ড মডেলে বেশ কিছুসংখ্যক প্যারামিটার আছে, যা অনির্ধারিত (যেমন কোয়ার্কগুলোর ভর এবং তাদের মিথস্ক্রিয়ার শক্তিমত্তা)। আসলে এখানে প্রায় বিশটি ধ্রুবক আছে, যা একরকম বাধ্য হয়ে সমীকরণে ঢোকাতে হয়েছে। কিন্তু এসব ধ্রুবক কোথা থেকে এল এবং তাদের মানে কী, তার কিছুই বোঝা যায় না।
ছবি ৯ : স্ট্যান্ডার্ড মডেল হলো অতিপারমাণবিক কণাদের অদ্ভুত একটা সংগ্রহ, যা সঠিকভাবে আমাদের কোয়ান্টাম মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে পারে। এতে আছে ৩৬টি কোয়ার্ক ও অ্যান্টিকোয়ার্ক, ১২টি দুর্বল মিথস্ক্রিয়াকারী কণা এবং প্রতিকণা (যাকে বলে লেপটন) এবং ইয়াং-মিলস ফিল্ড ও হিগস বোসনের বড় ধরনের ভান্ডার। হিগস ক্ষেত্রকে উত্তেজিত করলে এই হিগস বোসন কণা তৈরি হয়।
চতুর্থত, এতে শুধু স্ট্যান্ডার্ড মডেলের কোয়ার্ক, গ্লুয়ন, ইলেকট্রন ও নিউট্রিনোর একটা নয়, বরং তিনটি হুবহু কপি বা জেনারেশন আছে। (কাজেই সবকিছু মিলিয়ে কোয়ার্কের সংখ্যা ৩৬টি, যার সঙ্গে তিনটি কালার, তিনটি জেনারেশন ছাড়াও আছে সংশ্লিষ্ট প্রতিকণা এবং ২০টি মুক্ত প্যারামিটার।) মহাবিশ্বের মৌলিক তত্ত্বটা এত জবরজং ও স্থুল হতে পারে, তা বিশ্বাস করা পদার্থবিদদের জন্য বেশ কঠিন।
এলএইচসি
সমস্যাটা যেহেতু অনেক গুরুত্বপূর্ণ, বিভিন্ন দেশ তাই পরের প্রজন্মের পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর বানাতে কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের জেনেভার বাইরে স্থাপিত লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার সংবাদ শিরোনামে নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছে। কারণ, বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত যতগুলো যন্ত্র বানিয়েছে, তার মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড়। এর পেছনে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি খরচ হয়েছে এবং এর বিস্তৃত পরিধির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭ মাইল।
এলএইচসি দেখতে বড় আকৃতির ডোনাটের মতো। সেটা দাঁড়িয়ে আছে সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্সের মাঝের সীমান্তজুড়ে। এই টিউবের ভেতরে প্রোটনকে চরম উচ্চ শক্তিতে না পৌঁছা পর্যন্ত ত্বারিত করা হয়। এরপর বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা আরেকটি উচ্চ শক্তির প্রোটনের বিমের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটানো হয়। এভাবে ১৪ বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তি বেরিয়ে আসে এবং বিপুল পরিমাণ অতিপারমাণবিক কণার ঝরনার সৃষ্টি করে। এরপর বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত কম্পিউটার ব্যবহার করে এসব কণার মেঘগুলো বোঝার চেষ্টা করা হয়।
এলএইচসির লক্ষ্য হলো মহাবিস্ফোরণের ঠিক পরের মুহূর্তটার অবস্থা নকল করা। আর এভাবে অস্থিতিশীল কণাগুলো তৈরি করা। অবশেষে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের শেষ টুকরা বা হিগস বোসনের দেখা মেলে ২০১২ সালে।
হাই এনার্জি ফিজিকসের জন্য সেটা ছিল অনেক বড় এক ঘটনা। কিন্তু তারপর পদার্থবিদেরা বুঝতে পেরেছেন, তাঁদের আরও লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। একদিকে স্ট্যান্ডার্ড মডেল পরমাণুর গভীরের প্রোটন থেকে শুরু করে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের একেবারে কিনারা পর্যন্ত সব কটি কণার মিথস্ক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা হলো, তত্ত্বটা বেঢপ বা অসুন্দর। এর আগে পদার্থবিদেরা যতবার পদার্থের মৌলিক প্রকৃতি অনুসন্ধান করেছেন, ততবারই নতুন ও অভিজাত প্রতিসাম্য আবির্ভূত হতে দেখা গেছে। তাই পদার্থবিদেরা একে সমস্যাযুক্ত বলে মনে করছেন। কারণ, একেবারে মৌলিক পর্যায়ে প্রকৃতি এত অগোছালো একটা তত্ত্ব পছন্দ করছে বলে মনে হচ্ছে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন
বেশ কিছু ব্যবহারিক সফলতা থাকা সত্ত্বেও সবার কাছেই স্পষ্ট যে স্ট্যান্ডার্ড মডেল চূড়ান্ত তত্ত্বের একটা মহড়ামাত্র। চূড়ান্ত তত্ত্ব এখনো আমাদের হাতে ধরা দেয়নি।
এদিকে অতিপারমাণবিক কণাগুলোর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে গিয়ে কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিস্ময়কর সাফল্য পাওয়া যায়। এতে উজ্জীবিত হয়ে সাধারণ আপেক্ষিকতাকে পুনরায় পরীক্ষা করতে শুরু করেছিলেন পদার্থবিদেরা। সেটি কয়েক দশক ধরে নিস্তেজ অবস্থায় পড়ে ছিল। পদার্থবিদেরা এখন আরও উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যে নজর দিয়ে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সঙ্গে মহাকর্ষকে একীভূত করার চেষ্টা করছেন।
তার মানে, আমাদের এখন মহাকর্ষের জন্য কোয়ান্টাম তত্ত্ব দরকার। সেটিই হতে পারে সত্যিকারের থিওরি অব এভরিথিং। এতে স্ট্যান্ডার্ড মডেল এবং সাধারণ আপেক্ষিকতা দুটোর জন্যই কোয়ান্টাম সংশোধনী গণনা করা যাবে।
এর আগে রিনরমালাইজেশন থিওরি ছিল হাতের চতুর এক কৌশল বা নৈপুণ্য, যা কিউইডি ও স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সব কোয়ান্টাম সংশোধনী বাতিল করতে পেরেছিল। তার মূল চাবিকাঠি ছিল, বিদ্যুৎ- চুম্বকীয় এবং নিউক্লিয়ার বলকে সেখানে দেখানো হয়েছিল কণা হিসেবে। সেগুলো হলো ফোটন ও ইয়াং-মিলস কণা। এরপর ম্যাজিকের মতো হাত সাফাই করে অসীমগুলো দূরে করা সম্ভব হয়েছিল। এভাবে অপ্রীতিকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত অসীমগুলোকে ঝেড়েমুছে ঢুকিয়ে রাখা গিয়েছিল কার্পেটের তলায়।
পদার্থবিদেরা সরলভাবে এই ঐতিহ্যকে মেনে চলছেন এবং আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব নিয়ে তাতে গ্র্যাভিটন নামে মহাকর্ষের নতুন বিন্দু কণার প্রস্তাব দিয়েছেন। কাজেই স্থান-কালের চাদরকে বোঝাতে আইনস্টাইন যে মসৃণ পৃষ্ঠতলের প্রবর্তন করেছিলেন, সেটা এখন কোটি কোটি অতিক্ষুদ্র গ্র্যাভিটন কণার মেঘে ঘেরা।
দুর্ভাগ্যক্রমে ৭০ বছর ধরে পদার্থবিদেরা অসীমগুলো দূর করার জন্য কষ্টকর যেসব কৌশল রপ্ত করেছেন, গ্র্যাভিটনের ক্ষেত্রে তার প্রতিটি ব্যর্থ হয়েছে। গ্র্যাভিটনের কারণে সৃষ্ট কোয়ান্টাম সংশোধনী অসীম এবং তা কোথাও দূর করা যায় না। এখানেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে পদার্থবিদদের। তাঁদের জয়ের ধারাবাহিকতা শেষ হয়ে গেছে হুট করে।
হতাশ হয়ে এরপর আরও শালীন লক্ষ্য নির্ধারণের চেষ্টা শুরু করেছেন পদার্থবিদেরা। মহাকর্ষের জন্য একটা পরিপূর্ণ কোয়ান্টাম তত্ত্ব তৈরি করতে না পেরে, বিজ্ঞানীরা গণনা করার চেষ্টা করছেন মহাকর্ষকে আলাদা রেখে সাধারণ পদার্থ কোয়ান্টাইজড হলে কী ঘটে। তার মানে, মহাকর্ষকে স্পর্শ না করে নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সির জন্য কোয়ান্টাম সংশোধনী গণনা করা। শুধু পরমাণুকে কোয়ান্টাইজড করা হলে, আশা করা হয় যে তা এক ধাপ সামনে এগিয়ে যাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রণয়নের বড় লক্ষ্যের দিকেও সম্ভব হবে অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করা।
এটা বেশ সংযত একটা লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এটা নতুন আর চমকপ্রদ সব ভৌত পরিঘটনার বিস্ময়কর এক প্লাবনের দরজা খুলে দেয়। যা মহাবিশ্বকে আমরা যেভাবে দেখি, তাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসে। হুট করে মহাবিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভট নানা পরিঘটনার মুখোমুখি হন কোয়ান্টাম পদার্থবিদেরা। সেগুলো হলো, কৃষ্ণগহ্বর, ওয়ার্মহোল, গুপ্তবস্তু ও গুপ্তশক্তি, টাইম ট্রাভেল এবং খোদ মহাবিশ্বের সৃষ্টি। কিন্তু এসব অদ্ভুত মহাজাগতিক পরিঘটনার আবিষ্কার থিওরি অব এভরিথিংয়ের জন্য একটা চ্যালেঞ্জও বটে। কারণ, এই তত্ত্বটাকে শুধু স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পরিচিত অতিপারমাণবিক কণাগুলো ব্যাখ্যা করলেই চলবে না, বরং মানুষের কল্পনা প্রসারিত করা এসব অদ্ভুত ঘটনাও অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে পারতে হবে।