৪. প্রতি মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু দুর্ঘটনা

প্রতি মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু দুর্ঘটনা ঘটে। আমার জীবনেও ঘটেছে। কিন্তু এর কোন কারণ নেই, কোন যুক্তি নেই। যা হলো, তা না হলেও চলতো এবং যা ঘটল না অথচ ঘটলে ভাল হতো–এমনি অনেক কিছু দিয়েই তো মানুষের জীবন। এই সব যুক্তি-তর্ক আমি জানি, আমি বুঝি কিন্তু তবু আজও অলস মধ্যাহ্নে বা গোধূলির রাঙা আলোয় মথুরা রোড দিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি ফেরার পথে মনটা উদাস হয়ে যায়। ডান পাটা অ্যাকসিলারেটরের পর চাপ দিলেও যেন গাড়ী ছুটতে চায় না, স্টিয়ারিংটা জোর করে চেপে ধরলেও যেন মনে হয় তাতে জোর নেই। পিছনের সমস্ত গাড়ী আমাকে ওভারটেক করে আগে যায়, আমি পিছিয়ে পড়ি।

কিন্তু আমার মন? সে ইমপালা, মার্সিডিসকে হারিয়ে দেয়। ছশো-সাতশো মাইল স্পীডের বোয়িং সেভেন-জিরো সেভেনকেও হারিয়ে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে আমার মন ছুটে চলে যায় কায়রোর নাইল নদীর পাড়ে, নাইল হিলটন হোটেলের চারতলার ঐ কোণার ঘরে।

আজও মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গলে ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠি, মনে হয় বুঝি ডাক্তারের ঘরেই শুয়ে আছি। আজও বিদেশে গেলে হোটেলের লাউঞ্জে, এয়ারপোর্টের ট্রানজিট লাউঞ্জে বা এয়ার লাইন্সের কাউন্টারে একটা বিরাট খোপাওয়ালা একটু ময়লা, একটু বেঁটে মেয়ে দেখলে আজও চমকে উঠি।

কিন্তু কেন এমন হয়? আমি তো ডাক্তারের প্রেমে পড়িনি, সেও তো আমাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের কোন স্বপ্ন দেখেছিল বলে আমি বুঝতে পারিনি। তবে? এর জবাব আমি খুঁজে পাইনি। মনে মনে শুধু এই কথা ভেবে সান্ত্বনা পেয়েছি যে, মানুষের মন তো অপারেশন থিয়েটারের পেসেন্ট নয় যে ছুরি-কাঁচি দিয়ে কাটাকুটি করলেই ব্যথা লাগে আর সেলাই করে কটা ইনজেকশন দিয়ে বড়ি গিলিয়ে দিলেই সে ব্যথা সেরে যাবে।

তাই তো আজও অনেক স্মৃতির ভীড়ের মধ্যেও ডাক্তারের স্মৃতিকে মুছে ফেলতে পারিনি। ভুলতে পারিনি সেই দুটি দিনের মিষ্টি ইতিহাস। আমি স্থির জানি আজও যদি কায়রো, রোম, প্যারিস বা লণ্ডনে অপ্রত্যাশিতভাবে ডাক্তারের সঙ্গে আমার দেখা হয়, আনন্দে -আত্মতৃপ্তিতে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, উত্তেজনায় জড়িয়ে ধরবে। হয়তো শাড়ির আঁচলটা বুকের পর থেকে খসে পড়বে, চোখের কোণে একটু দুষ্টু হাসির রেখা ফুটিয়ে বলবে, বাচ্চু! তুমি আজও আমাকে ভুলতে পারনি?

 আমি শুধু বলব, ডাক্তার, তুমি যে আমাকে এমন করে ভুলে যাবে তা আমি কোন দিন ভাবতে পারিনি।

আমার কাছ থেকে একটু সরে শাড়ির আঁচলটা টেনে উঠিয়ে আবার ভাল করে জড়িয়ে নিতে নিতে ডাক্তার বলবে, তুমি যেন কোথাকার কোন্ রাজপুত্তর, পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে একদিন আমার পর্ণকুটিরে উদয় হয়ে আমাকে ধন্য করেছিলে যে তোমাকে মনে করে রাখতে হবে।

ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় জানি না, নাইল হিলটন হোটেলের ঐ দুটি দিনের স্মৃতিকে কেন্দ্র করে ডাক্তারের জন্য আহত আমার মনটা পীড়িত হয়। জীবন সংগ্রামের কোন ব্যর্থতার বেদনায় কখনও মনটা বিষণ্ন হলে ডাক্তারের কথা মনে পড়ে, ঐ দুটি দিনের ইতিহাস রোমন্থন করে এখনও অনেক আনন্দ, অনেক তৃপ্তি পাই।

……মাস চারেক আগে বিদেশ যাত্রার প্রাক্কালে পালামে অনেকেই এসেছিলেন আমাকে বিদায় জানাতে। লগেজ ও টিকিট চেক করে কাস্টমস এনক্লোজারে না ঢুকে ফিরে এসেছিলাম লাউঞ্জের এক কোণায় বন্ধু বান্ধবীদের মাঝে।

কোকাকোলার বোতল নামিয়ে রেখে বেলা গুণ গুণ করে গা শুনিয়েছিল, মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে, সেদিন ভরা সাঁঝে’ গৌরী-বৌদি কানে কানে ফিস ফিস করে বলেছিলেন, দেখবেন ঠাকুরপো, বেশী দুষ্টুমি করবেন না কিন্তু! আদো আদো গলায় ছল ছল চোখে বনুয়া মেমসাহেব জিজ্ঞাসা করেছিল, আমাকে মনে থাকবে? আমি ওর মাথাটায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিলাম, যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম, সুতরাং তোমাকে ভুলব কি ভাবে বলতে পার?

প্রতিমা আমাকে একটা চিমটি কেটে বলল, কমিনিট বাদে এয়ার হোস্টেস দেখলেই তো সব গুলিয়ে যাবে আবার…

আমি বললাম, বলেন কি? এয়ার হোস্টেস তো এমনিতে উড়ে বেড়ায়; তাঁকে নিয়ে আমি আর কি উড়ব? উড়তে হলে গ্রাউণ্ড হোস্টেস নিয়েই উড়ব।

উকিলদার চিৎকার, ব্রহ্মচারীর মুচকি হাসি ও আরো অনেক কিছু উপভোগের পর দামাল দত্তের কমিক গান শুনিয়ে আমার বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান শেষ হলো! আমি পাশপোর্ট, হেলথ সার্টিফিকেট চেক করিয়ে কাস্টমস এনক্লোজারে ঢুকলাম। তারপর আবার বেরিয়ে এসে বাইরে রেলিং-এর এপারে দাঁড়িয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আস্তে আস্তে প্লেনের দিকে এগিয়ে গেলাম। অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েও বার বার পিছন ফিরে দেখেছি, হাত নাড়ার উত্তর দিয়েছি। প্লেনের মধ্যে ঢোকবার আগে আর একবার রুমাল নেড়ে ওদের সবার প্রতি শেষবারের মতো শুভেচ্ছা জানালাম।

ব্যস! তারপর আর প্রাণ খুলে বাংলা কথা বলিনি, প্রাণ খুলে আড্ডাও দিইনি। লণ্ডনে একদিন সন্ধ্যায় এক বাঙালী ডাক্তারের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, কিন্তু তা নিতান্তই ক্ষণেকের জন্যে। দীর্ঘ চারমাস বিদেশ ভ্রমণকালে আরো দুচারজন বাঙালীর দেখা পেয়েছি, কিন্তু তার বেশী কিছু নয়।

কর্মব্যপদেশে চার চারটি মাস থেকে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ালাম। সকাল, বিকেল, সন্ধ্যা বা মাঝরাতে টাইপরাইটারে প্রেস ম্যাসেজ টাইপ করে কেবল পাঠিয়েছি প্রায় প্রতিদিন। কাজকর্ম ও ককটেল ডিনারের অবসরে মস্কোয় রেড স্কোয়ারে ঘুরে বেড়িয়েছি, লেনিনের স্মৃতি সৌধে লেনিনের মৃতদেহ দেখেছি, জারদের স্মৃতি বিজড়িত পঞ্চদশ শতাব্দীর ক্রেমলিন প্রাসাদ দেখেছি, লেনিনগ্রাদে অক্টোবর বিপ্লবের স্মৃতি চিহ্ন দেখেছি, প্যারিসে ক্রেজী হর্স সেলুনে উন্মত্ত যৌবনের প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে সারারাত স্যাম্পেন খেয়েছি, বার্লিনে দুটি বিবদমান মহাশক্তিকে মুখোমুখি দেখেছি, দেখেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার জীবন্ত ইঙ্গিত।

আরো অনেক কিছু দেখেছি ও করেছি। লণ্ডনে বণ্ড স্ট্রীট, অক্সফোর্ড স্ট্রীট, রিজেন্ট স্ট্রীটে ঘুরে বেড়িয়েছি। রাতের লণ্ডনে ইংরেজ যুবক যুবতীদের অসহ্য উচ্ছলতা দেখেছি, প্রত্যক্ষ করেছি কালা আদমীদের দুর্গতি। তারপর রোমে সুন্দরী ইতালিয়ান যুবতীর উষ্ণ সান্নিধ্য উপভোগ করেছি, সেন্ট পিটারের চারপাশে ঘুরে বেড়িয়েছি। আর একবার মহাকবি কীটস-এর সমাধির সামনে দাঁড়িয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। এরপর ক্রেডল অফ সিভিলাইজেশন আথেন্স দেখে এলাম বেইরুট। বাইবেলের ভাষায় লেবানন দুধ ও মধুর দেশ হলেও আজ কাল বোধহয় ওদেশের শিশুরাও হুইস্কী খেয়ে নাইট ক্লাবে মানুষ হয়।

এলাম কায়রো। সাতদিন থাকার প্রোগ্রাম ছিল, কিন্তু সাত হাজার বছরের ইতিহাসের ‘পর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিতে সাত দিনও সময় নিলাম না, পাঁচ দিনেই মোটামুটি সব কিছু দেখে নিলাম। স্যার যদুনাথ সরকার বা টয়েনবি হলে যে কাজ সত্তর বছরেও করতে পারতেন কিনা সন্দেহ, আজকের দিনে বুদ্ধিমান টুরিস্ট সে কাজ প্রয়োজনবোধে একদিনেও শেষ করতে পারেন। তাইতো পাঁচদিন ঘোরাঘুরির পর আমি আর প্রয়োজনবোধ করলাম না।

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরও অনেকক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করে কাটালাম। তবুও উঠলাম না, মাথার বালিশ দুটোকে বুকের তলায় চেপে ধরে বিছানার ’পর পড়ে রইলাম আরো কিছুক্ষণ। হঠাৎ মনটা উদাস হয়ে গেল, মনে পড়ে গেল দিল্লীর স্মৃতি। ঘরে ফেরার টান অনুভব করলাম অনেক দিন পর। আপন জনের বিরহ বেদনায় মনটা একটু নরম হয়ে গেল। মনে হলো ছুটে চলে যাই দিল্লী, কিন্তু মন তো অনেক কিছুই চায়!

অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠতেই হলো। হেলে দুলে বাথরুমে গেলাম। সেভ করে, স্নান সেরে বেরিয়ে এসে দেখি সাড়ে নটা বেজে গেছে। রুম সার্ভিসকে টেলিফোন করে ঘরে ব্রেকফার্স্ট দিতে বললাম। ব্রেকফার্স্ট সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলের ওপর দিয়ে আরেকবার ব্রাশটা টেনে নিলাম, নাকের পাশ, চোখের কোণা থেকে ল্যাকটো ক্যালামাইনের গোলাপী দাগগুলো মুছে ফেললাম। তারপর টাই-নটটা একটু ঠিক করে নিয়ে কোটের পকেটে পাশপোর্ট আর ট্রাভেলার্স চেকগুলো পুরে নিলাম। নীচে ব্যাঙ্ক থেকে চেকগুলো ভাঙ্গিয়ে নিয়ে মাস্কি রোড বা খান খালিল বাজারে গিয়ে কিছু কেনা কাটার উদ্দেশ্যে গজেন্দ্র গমনে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

লিফট থেকে বেরিয়ে ডান দিকের কোণায় ব্যাঙ্কের কাউন্টারে গিয়ে বিশেষ ভীড় দেখলাম না। দুচারজন বিদেশী টুরিস্টদের পাশে একজন শাড়ি পরিহিতা যুবতীকে এক ঝলক দেখেছিলাম। মনে হয়েছিল দক্ষিণ ভারতীয়। যাই হোক সে ঐ ঝলকই, তার বেশী কিছু নয়। ব্যাঙ্কের কাউন্টারে পাশপোর্টের মধ্যে চেকগুলো গুঁজে এগিয়ে দিয়ে একটু পাশে সরে গিয়ে সিগারেট ধরালাম। সিগারেট টানতে টানতে হয়তো কোন আধেক-আবৃত কোন বিদেশিনীকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে গিয়ে আনমনা হয়ে পড়েছিলাম, এমন সময় আমার নাম ধরে কে যেন ডাকতেই সম্বিত ফিরে এলো। বুঝলাম ব্যাঙ্ক কাউন্টার থেকে তলব এসেছে। চেকগুলোতে আর একবার সই করে ইজিপসিয়ান পাউণ্ডের নোটগুলো তুলে নিয়ে একটু এগুতেই হঠাৎ এক নারী কণ্ঠে কে যেন প্রশ্ন করলেন–আপনি বাঙালী?

সেদিন নাইল হিলটন হোটেলের লাউঞ্জে দিনে দুপুরে ভূত দেখলেও নিশ্চয়ই অতটা আশ্চর্য হতাম না, যা আশ্চর্য হয়েছিলাম অকস্মাৎ এক নারী কন্ঠে বাংলা কথা শুনে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে শুধু বললাম, হ্যাঁ।

একটু থেমে আবার প্রশ্ন করলাম, আপনিও বাঙ্গালী নাকি?

একটু হেসে তিনি বললেন, কেন? কথা শুনে কি মনে হচ্ছে জাপানী?

নিজের বোকামির জন্য নিজেই ভীষণ লজ্জিত বোধ করলাম! শুধু বললাম, অনেকদিন পর বাংলা কথা শুনে ব্রেনটা ঠিক রিএ্যাক্ট করতে পারেনি। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে কায়রোয় নাইল হিলটন হোটেলের লাউঞ্জে যে বাংলা কথা শুনব তা কল্পনাও করতে পারিনি…

এই ভাবেই ডাক্তারের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। তারপর ঐ লাউঞ্জের একপাশে দাঁড়িয়েও ডাক্তারকে জানিয়েছিলাম, দুনিয়ার কোন চুলোয় ঠাঁই না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত জার্নালিজম করছি এবং বাধ্য হয়ে বাংলাদেশের গুণী-জ্ঞানী শিক্ষিত লোকদের আমার লেখা পড়তে হচ্ছে।

কেন এ কথা বলছেন? জার্নালিজম তো চমৎকার প্রফেশন, আর নিশ্চয়ই ভাল লেখেন…

থাক, থাক, আর এগুবেন না।

ডাক্তারও তার নিজের কথা শুনিয়েছিল। শুনিয়েছিল, সে দেশ থেকে এম. বি. বি এস. পাস করে হাসপাতালে চাকরি করতে করতে বৃত্তি লাভ করে শিশু-যক্ষ্মারোগীদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবার জন্য পশ্চিম জার্মানীর স্টুটগার্টে ছিল দু বছর। এখন ডিপ্লোমা নিয়ে দেশে ফিরছে। জার্মানীতে থাকার সময় ছুটিতে কন্টিনেন্ট ঘুরেছে, কিন্তু মিডল ইস্ট দেখেনি। তাইতো এবার বেইরুট দেখে কায়রো এসেছে।

কপাল থেকে উড়ন্ত চুলগুলো সরিয়ে, পড়ন্ত সিল্কের শাড়ির আঁচলটা টেনে নিতে নিতে ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, আপনি কি কোন জরুরী কাজে বেরুচ্ছেন?

বালাই ষাট এখানেও জরুরী কাজ! ভাবছিলাম খান খালিল বাজারে একটু ঘোরাঘুরি করব।

ডাক্তার লিফট-এর দিকে পা বাড়িয়ে বললো, বাজারে পরে যাওয়া যাবে। এখন চলুন ঘরে গিয়ে একটু আড্ডা দেওয়া যাক।

ডাক্তারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমি লিফটে চড়লাম, চার তলায় লিফট থেকে বেরিয়ে এলাম এবং তারপর ডানদিকে ঘুরে কোণার ঘরে গেলাম। ঘরে না বসে আমি এগিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আর এক নজর ঐতিহাসিক নাইলকে দেখলাম। আমি বললাম, আমার ঘরের ব্যালকনির চাইতে আপনার এই ব্যালকনি থেকে নাইলকে আরো অনেক ভালভাবে দেখা যায়।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ।

কয়েক মিনিট পরে ডাক্তারের আহ্বানে আমি ঘরের ভিতর এসে কোটটা খুলে ফেললাম বিছানার ’পর। বসে পড়লাম সোফায়। ডাক্তার আমার কোটটাকে হ্যাঙ্গারে চড়িয়ে ওয়াড্রবে রাখতে গিয়ে বললো, কোটটাকে তুলে রাখছি, বুঝলেন?

আমি একটু দুষ্টুমির হাসি হেসে বললাম, এমনি করে একে একে আমার আরো দায়িত্বগুলো স্বেচ্ছায় তুলে নেবেন নাকি?

ওয়াড্রবে কোটটা ঝোলাতে ঝোলাতে বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললো, বিদেশ বিভূঁইতে একটা বাঙ্গালী মেয়েকে একলা পেয়ে ভয় দেখাচ্ছেন কেন বলুন তো?

আমি বললাম, তাই বুঝি?

ওয়াড্রব বন্ধ করে ডাক্তার আমার সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলো, এবার বলুন কি খাবেন?

আমি নির্বিকার হয়ে উত্তর দিলাম, তেলে ভাজা আর মুড়ি।

ডাক্তার না হেসে পারল না। বললো, আপনি তো আচ্ছা লোক।

কেন বলুন তো? ন্যাকামি করে আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম।

কেন আবার? এখানে মুড়ি তেলে ভাজা পাব কোথায়?

বাঙ্গালী বলে স্বেচ্ছায় আলাপ করলেন, আদর করে নিজের ঘরে ডেকে আনলেন, তাই ভাবছিলাম হয়তো বাঙ্গালীর খাবারই খাওয়াবেন।

ডাক্তার আর কথা না বাড়িয়ে চাপা হাসি হাসতে হাসতে টেলিফোনে কফির অর্ডার দিল। কফি এলো। ডাক্তার আমার সামনের সোফায় বসে কফি তৈরি করে আমাকে দিল।

সেদিন ঐ কফির পেয়ালা সামনে নিয়ে আমাদের যে আলোচনা হয়েছিল, তার সুর আজও আমার কানে বাজে। কফির কাপে প্রথম চুমুক দিয়েই ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি বাংলাদেশে মানুষ হয়েছেন।

না।

তবে তো আপনি খাঁটি বাঙ্গালীই নন।

তাই বুঝি?

ঘাড় বেঁকিয়ে ডাক্তার বললো, আজ্ঞে হ্যাঁ।

মিনিট দুই চুপচাপ থেকে শেষ চুমুক কফি খেয়ে ডাক্তার বললো, যে বাঙ্গালী কর্ণফুলি-বুড়িগঙ্গা দেখেনি, যে মেঘনায় নৌকো চড়েনি, যে গোয়ালন্দ ঘাটে ইলিশ মাছ খায়নি, যে নবদ্বীপ আর শান্তিনিকেতন দেখেনি, সে আর যাই হোক খাঁটি বাঙ্গালী নয়।

ঢোখটা উপরে উঠিয়ে ঘাড়টা আবার বাঁকা করে ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, বুঝলেন জার্নালিস্ট।

মাদ্রাজীদের মতো এমনভাবে আমি ঘাড় নাড়ালাম যে হ্যাঁ না– দুই-ই হতে পারে।

আলোচনা আরো একটু এগিয়ে চললো। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলো, দিল্লীতে আপনারা কে কে থাকেন?

আমি জানালাম, আমি থাকি, রামচন্দ্র নামে একটা চোর চাকর থাকে; আর আছে দুটো বেড়াল, একটা কুকুর।

কেন আপনি বিয়ে করেন নি?

ছোটবেলা থেকেই তো একটা ফুটফুটে সুন্দর বৌ ঘরে আনার স্বপ্ন দেখে আসছি, কিন্তু আজ পর্যন্ত তো জুটলো না।

ডাক্তার উড়িয়েই দিলো আমার কথাটা। বললো, তাহলে নিশ্চয়ই কাউকে পছন্দ করে রেখেছেন।

পছন্দ তো অনেককেই হয়েছে, কিন্তু তাদের পাচ্ছি কোথায় বলুন?

ডাক্তার নাছোড়বান্দা। আমার রোগটা ধরবার নেশায় মশগুল হয়ে উঠলো। জিজ্ঞাসা করলো, বলুন না কাকে পছন্দ করে পাচ্ছেন না?

পছন্দ তো এলিজাবেথ টেলর–আঁদ্রে হেপবার্নকেও করেছি। কিন্তু পাচ্ছি কোথায় বলুন?

ডাক্তার বললো, কেন দুষ্টুমি করছেন? সোজা কথায় বলুন না প্রেমে পড়েছি, পরে বিয়ে করবো।

আমি বললাম, ডাক্তার ফর গডস সেক হোন্ড ইওর টাংগ। এমন ভাবে জেরা করলে নার্ভাস হয়ে আমি সব কিছু বলে ফেলব।

ডাক্তার শুধু মুচকি হেসে বললো, আপনাকে দেখেই বোঝা যায় যে আপনি বেশ দুষ্ট লোক, বুঝলেন?

আমাদের নাইল হিলটন হোটেলের পাশ দিয়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগের নাইল নদী যেমন ধীরে ধীরে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছিল, আমাদের আলোচনাও তেমনি ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য বন্ধনের দিকে টেনে নিয়েছিল।

ডাক্তার একবার জানলা দিয়ে বাইরের বিরাট আকাশের দিকে চাইল, একবার আমার মুখের দিকে চেয়ে আবার দৃষ্টিটা সরিয়ে নিলো। একটু চুপ করে রইল। তারপর নরম গলায় বললো, একটা কথা বলবো?

নিশ্চয়ই। একটা কেন একশোটা বলুন।

দুঃখ পাবেন না?

না, না, দুঃখ পাব কেন? আপনার যা ইচ্ছা বলুন।

ডাক্তার একটু চুপ করে গেল। তারপর প্রায় এক নিঃশ্বাসে হঠাৎ বলে ফেলল, আমি মুসলমান, আমি ইস্ট পাকিস্তানের লোক।

কেন জানি না, এক মুহূর্তের জন্য আমার বুকের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ চমকে গেল কিন্তু তবুও নিজেকে সামলে নিলাম। সহজ হয়েই বললাম, তাতে কি হয়েছে? বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে এই কায়রোতে বসে আজ আমার কাছে আপনার একমাত্র পরিচয় আপনি বাঙ্গালী। সুতরাং আপনি হিন্দু কি মুসলমান, আপনার বাড়ি বাঁকুড়ায় কি বগুড়ায়–তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

ডাক্তারের চোখ মুখ দেখে মনে হলো সে যেন আমার কথায় অনেকটা স্বস্তি ও শান্তি পেয়েছে।

কথায় কথায় বলা হয়েছিল। আমি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, এবার চলি। আপনি লাঞ্চ খেয়ে একটু বিশ্রাম করুন।

কেন একসঙ্গে লাঞ্চ খেলে জাত যাবে?

ছি, ছি, আপনি কি বলছেন?

ডাক্তারের ঘরে বসেই সেদিন দুজনে একসঙ্গে লাঞ্চ খেয়েছিলাম। পরমাত্মীয়ার মতো যত্ন করে আমাকে সে খাইয়েছিল। ওজর আপত্তি অগ্রাহ্য করে সে প্রায় সব মাংসটাই আমার প্লেটে ঢেলে দিয়েছিল।

নাইল নদীর জল আরো গড়িয়েছিল। সোফা ছেড়ে ডাক্তারের বিছানায় বালিশটা পিঠে দিয়ে একটু কাৎ হয়ে বসেছিলাম। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করল, তুমি একটু শোবে?

না, না, শোব না।

কেন লজ্জা করছে? নাকি দুর্নামের ভয়?

ডাক্তার আমার মুখের দিকে চেয়েছিল, কিন্তু উত্তর সে নিজেই দিয়েছিল।

ভয় নেই বাচ্চু, এটা বাংলা দেশ নয় যে দুর্নাম রটবে। তুমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে শুতে পারো।

ডাঃ মৈমুনা সুলতানার আরো অনেক স্মৃতি আজও আমার মনের মধ্যে রজনীগন্ধার মতো মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়। আবার একটু পরেই ঝরা বকুলের মত বেদনা বোধ করি মনে মনে। খবরের কাগজের রিপোর্টার হয়েও ঐ দুটি দিনের রিপোর্ট লেখার ক্ষমতা আমার নেই। মানুষের মুখের কথার আমি রিপোর্ট লিখি, কিন্তু মনের কথা লেখবার বিদ্যা তো আমার জানা নেই। তবে মনে পড়ে…

ডাক্তার হঠাৎ কেমন উদাস হয়ে গেল। দৃষ্টিটা নাইল হোটেলের জানলা থেকে নাইল নদী পেরিয়ে অনেক দূর চলে গেল, চলে গেল পদ্মা-মেঘনা-বুড়ীগঙ্গা-কর্ণফুলির দেশে।

জানো বাচ্চু, কে আমাকে প্রথম এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন?

আমি চুপ করেই রইলাম।

জগন্নাথ কাকা। শুনেছি মার পেটে থেকে বেরুবার পর আমি কোন কান্নাকাটি না করায় বাড়ির সবাই ভাবলেন আমি বেঁচে নেই। জগন্নাথ কাকা কোন কথা না বলে এক কড়া গরম জল চেয়ে নিলেন। তারপর আমার পা দুটো ধরে গরম জলের মধ্যে ডুবিয়ে তুলে এনে পিঠে পটাপট চড় মারতে লাগলেন। আধ ঘণ্টা কি পঁয়তাল্লিশ মিনিট এই রকম জলের তাপ আর জগন্নাথ কাকার চড় খেয়ে আমি হঠাৎ কেঁদে উঠলাম। বাবা ছুটে এসে জগন্নাথ কাকাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, জগন্নাথ! গত জন্মে তুই নিশ্চয়ই আমার ভাই ছিলি, নয়তো মেয়েটা তোরই মেয়ে ছিল। জগন্নাথ কাকা কোনদিন আমাদের বাড়িতে এসে ভিজিট নিতেন না; তাইতো বাবা নিজের হাতের সোনার ঘড়িটা খুলে তার হাতে পরিয়েছিলেন।

জগন্নাথ ডাক্তার নিজের মেয়ের চাইতে মৈমুনাকে কম ভাল বাসতেন না। হাটের দিন ডিসপেন্সারী থেকে ফেরার পথে মৈমুনার জন্যও এক প্যাকেট মিষ্টি আসত। একটু বড় হলে দুরন্তপনা বা দুষ্টুমি করার জন্য মা মারধর করতে এলেই মৈমুনা ছুটে পালাত জগন্নাথ কাকার বাড়িতে। পূজার সময় মৈমুনাও নতুন জামা পেত তার জগন্নাথ কাকার কাছ থেকে।

নাইলের পাড়ে বসে ডাক্তারের মনে অতীত স্মৃতি যেন ভীড় করে এসেছিল। তার মনে পড়ল মালতী নগরের বড় বাড়ির দুর্গাপূজার কথা, কালীদাদুর সুর করে মন্ত্ৰপড়ার কথা। মনে পড়েছিল, পূজার কদিন আগেই হারানে তার দলবল নিয়ে আসত ঢাক বাজাতে। হারানের ঢাকের আওয়াজ শুনলেই ওরা সবাই ছুটে আসত বড় বাড়িতে। হারানে বড় বাড়িতে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই এক চোট নেচে বাজিয়ে দেখাত। তারপর হারানে দিদার দেওয়া জলপানি খেতে বসলে ঢাক তুলে নিতো কনকদা। আহা সে কি বাজনা! আরতির সময় হারানে আর কনকদার ঢাক বাজানো শুনতে ডাক্তার পূজার প্রতি সন্ধ্যায় ছুটে এসেছে বড় বাড়িতে। অমন বাজনা নাকি ডাক্তার আর কোথাও শোনেনি।

আর কি মনে পড়ে?

মনে পড়ে বুড়ো শিবতলার মেলার কথা, মনে পড়ে রথের কথা। সেদিন কে হিন্দু, কে মুসলমান সে খবর কেউ রাখত না বা রাখার প্রয়োজন বোধ করত না। গ্রামের সবাই মেতে উঠত একই আনন্দে। কেন মহরমের দিন? জগন্নাথ কাকা, যতীন পাকড়াশী, গদাই চক্রবর্তী, হালদার মাষ্টার সবাই আসত ডাক্তারদের বাড়ি। ধর্মের গোঁড়ামি ছিল, সংস্কার ছিল, কিন্তু মানুষকে ভালবাসায় কোন দ্বিধা ছিল না।

এইত প্রথম দাঙ্গা বাধলে জগন্নাথ ডাক্তার উড়ো চিঠি পেল। মৈমুনার বাবা ছুটে গিয়েছিলেন মুন্সীপাড়ার দলবল নিয়ে। বলে ছিলেন, জগন্নাথ, ভয় করিস না। জেনে রাখিস আমি না শেষ হলে তোর এক ফোঁটা রক্ত পড়বে না তোর এই বাপ-ঠাকুরদার ভিটেয়। ঠিক তাই-ই হয়েছিল। গজখালির মুসলমানরা জগন্নাথ ডাক্তারের বাড়ি আক্রমণ করলে রক্তপাত হয়েছিল মৈমুনার বাবার, জগন্নাথ ডাক্তারের নয়।

ডাক্তার আমার হাতটা চেপে ধরে বললো, জানো বাচ্চু, সেই জগন্নাথ কাকাও একদিন গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন, মালতি নগরের বড় বাড়ির পূজা বন্ধ হলো, কনকদার আর হারানের হাতে আর ঢাকের আওয়াজ শোনা যায় না, বুড়ো শিবতলা জঙ্গলে ভরে গেল, রথের মেলাও বন্ধ হলো।

অনেক চেষ্টা করেও ডাক্তার চোখের জল আটকাতে পারল না। উত্তেজনায় ঠোঁটটা কেঁপে উঠল। বললো, বলতে পার বাচ্চু, জগন্নাথ কাকাকে হারিয়ে আমি সুখী, না তোমার শিয়ালদ’ প্ল্যাটফর্মে ভিখারীর মতো পড়ে থেকে সুখী? তুমি তো জার্নালিস্ট, বলতে পার বাংলা দেশটা কেন এমন ছারখার হয়ে গেল?

ডাক্তারের কোন প্রশ্নের জবাব আমি দিইনি, দেবার ক্ষমতাও আমার ছিল না। শুধু ডাক্তারকে কাছে টেনে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিয়েছিলাম।

আজ সেই দুটি অবিস্মরণীয় দিনের কথা রোমন্থন করতে গিয়ে টুকরো টুকরো আরো অনেক কিছু মনে পড়ছে। ঘোরাঘুরি করে আমি ভীষণ পরিশ্রান্ত হয়েছিলাম। ফিরে এসেই ঝপাং করে ডাক্তারের বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ডাক্তার চেঞ্জ করতে বাথরুম থেকে বেরুবার আগেই আমি ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ডাক্তার আলতো করে আমার জুতা-মোজা-টাই খুলেছিল, আমাকে পাশ ফিরিয়ে ভাল করে শুইয়ে দিয়েছিল। দুএক ঘণ্টা পরে আমাকে জোর করে তুলে ডিনার খাইয়েছিল। আমি বারণ করেছিলাম, কিন্তু কিছুতেই শোনেনি। বলেছিল, এত ঘোরাঘুরির পর রাত্রে না খেলে শরীর ভীষণ দুর্বল হবে।

পরের দিন আমাকে নিজে পছন্দ করে টাই পরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দেখ কি চমৎকার দেখাচ্ছে। একটু দুষ্টুমি করে আমার মুখটা ধরে বলেছিল, নাউ রিয়েলি ইউ ল্যুক লাইক এ হ্যাণ্ডসাম ইয়ংম্যান।

তাই বুঝি?

দুপুর গড়িয়ে বিকেল এলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। পিরামিডের চূড়া রাঙ্গিয়ে সূর্য অস্ত গেল। ডাক্তার আবার উদাস হলো।

ব্যালকনিতে দুটো পিপিং চেয়ারে দুজনে বসেছিলাম। ডাক্তার আমার হাতটা নিয়ে খেলা করছিল। খেলা থেমে গেল, হঠাৎ কোথায় তলিয়ে গেল। একটু পরে দেশের কথা আবার শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে আমার হাতটাকে টান দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ–শরৎচন্দ্র কি শুধু হিন্দুদের, নজরুল বা জসীমউদ্দীন কি শুধু আমাদের? বাংলার পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, কবি গান কি শুধু হিন্দুদের, না মুসলমানদের? আমরা লড়াই করেছি, ঝগড়া করেছি, মারামারি করেছি, কিন্তু তাই বলে কি বাংলার হিন্দু-মুসলমানদের দেহে একই রক্ত বইছে না? বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের জন্য পলাশীর মাঠে হিন্দু-মুসলমানের কি মিলিত রক্তপাত হয়নি?

ডাক্তার আমাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, বাচ্চু, তুমি তো জার্নালিস্ট। বল না, কেন এমন হলো? কেন আজ বাঙ্গালী বাংলা দেশে চোখের জল ফেলছে?

আমরা দুজনে একই ফ্লাইটে কায়রো থেকে করাচী এলাম। দুজনের মনটাই ভারী হয়েছিল, বিশেষ কেউই কথাবার্তা বলিনি। শুধু একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি করাচীতে কোথায় থাকবে?

হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে।

শেষ রাতের দিকে পায়ের পর থেকে কম্বলটাকে দুজনেরই গলা পর্যন্ত টেনে দিয়েছিল। আর? আর একটু নিবিড় হয়ে আমার বুকের পর মাথা রেখেছিল।

ভোর বেলায় প্লেন করাচী পৌঁছল। পাকিস্তানের মাটিতে পা দিতে দিতেই ডাক্তার এমন করে আমাকে আঘাত দেবে, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। যতবার কাছে গেছি, ততবার সরে গেছে। যতবার কথা বলেছি, ততবার ভ্রূ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। কাস্টমস এনক্লোজারের বাইরে বেরুবার আগে ডাক্তার আমাকে এমন তাচ্ছিল্যভাবে অগ্রাহ্য করল যে আমি মর্মাহত না হয়ে পারলাম না। কোন প্লেন থাকলে হয়তো সিটিতে না ঢুকে দিল্লীই ফিরে আসতাম।

যাই হোক শেষ পর্যন্ত কতকগুলো খবরের কাগজ কিনে একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেল রওনা হলাম। খবরের কাগজগুলো খুলে চমকে উঠলাম। বুঝলাম ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহাকাশে ঘোর ঘনঘটা দেখা দিয়েছে, ভারতকে শায়েস্তা করার নেশায় পাকিস্তান উন্মাদ হয়ে উঠেছে।

পরের দিন রাত আড়াইটের সময় আবার প্লেন। তাই কাজ কর্ম সন্ধ্যার মধ্যেই সেরে হোটেলে ফিরে এলাম। উদ্দেশ্য ছিল তাড়াতাড়ি ডিনার খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেব। হোটেলে ফিরে এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ডাইনিং রুমে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছি ঠিক এমনি সময় কে যেন দরজায় নক করল। দরজা খুলতেই ডাক্তারকে দেখে আমি বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হাসিমুখে ডাক্তারকে অভ্যর্থনা করতে পারলাম না, গম্ভীর হয়েই বললাম, এসো।

ডাক্তার হাতের প্যাকেটগুলো টেবিলের উপর রেখে সামনে এসে অসহায়ার মতো আমার দিকে চাইল। দুহাত দিয়ে আমার মুখটা ধরে বললো, তুমি খুব রাগ করেছ, তাই না বাচ্চু?

আমি কোন উত্তর দিলাম না।

ডাক্তার দৃষ্টিটা সরিয়ে নিয়ে বললো, কি করব বলল। এয়ারপোর্টে বেশী কথাবার্তা বললে হয়তো তুমি কিছু মুস্কিলে পড়তে, নয়ত আমার কোন ঝঞ্ঝাট বাধত। তাইতো…

এতক্ষণে হুঁস হলো ডাক্তারকে বসতেও বলিনি। বললাম, বোসো।

ডাক্তার সোফায় না বসে বিছানায় বসল। আমার হাত ধরে পাশে বসাল। আমার দিকে একবার চাইল। দুচার মিনিট দুজনেই চুপচাপ বসে রইলাম। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল ডাক্তার।

বলো না, তুমি আমার পর রাগ করনি, তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ।

আমি শুধু বললাম, কোন্ অধিকারে তোমার পর রাগ করব বলো? বাঙ্গালী বলে বিদেশ বিভূঁইতে তুমি আমাকে যে ভালবাসা, যে মর্যাদা দিয়েছ, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এর চাইতে বেশী কিছু প্রত্যাশা করা তো আমার অন্যায়।

এবার ডাক্তারের দিকে ফিরে বললাম, আর ক্ষমা? তুমি হাসালে ডাক্তার। আমার কাছে তুমি ক্ষমা চাইবে কেন?

ডাক্তারের চোখের জলের কাছে শেষ পর্যন্ত আমাকে হার মানতে হলো। বললাম, হ্যাঁ, রাগ করেছিলাম, দুঃখ হয়েছিল কিন্তু এখন আর কিছু নেই।

আমার ডান হাতটা টেনে নিজের বুকের পর রেখে ডাক্তার বললো, আমাকে ছুঁয়ে বলো তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ।

আমি আর কথা বলিনি। দুহাত দিয়ে ডাক্তারকে টেনে নিয়েছিলাম নিজের বুকের মধ্যে।

একটু পরে আমার গলা থেকে টাইটা খুলে একটা নতুন টাই বেঁধে দিল। টাই-এর নটটা ঠিক করতে করতে বললো, তুমি তো জার্নালিস্ট। কত অসংখ্য মানুষের সঙ্গে তোমার নিত্য ওঠা বসা। তোমার পক্ষে আমার মতন একটা সাধারণ বাঙ্গালী মেয়েকে নিশ্চয়ই মনে রাখা সম্ভব নয়।

নটটা বাঁধা হয়ে গেলে টাইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ডাক্তার বললো, আমি কিন্তু তোমাকে কোনদিন ভুলব না।

ডাক্তার আমার বিদায় বেলার একটি মুহূর্তও নষ্ট করেনি। বলেছিল, বাচ্চু, তুমি এবার একটা বিয়ে কর। আর দেরী কোরো না। তাছাড়া তোমাকে যেন একলা ভাল লাগে না। তোমাকে একলা ভাবতেও ভাল লাগে না।

হাসপাতালে ডাক্তারের ডিউটি ছিল। অনেক দেরী হয়েছিল, আর দেরী করল না। টেবিলের পর থেকে প্রেজেনটেশনের প্যাকেটগুলো এনে আমার হাতে দিল, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না। দুজনে মুখোমুখি নীরবে চোখের জল ফেলেছিলাম বেশ কিছুক্ষণ।

তারপর ধীর পদক্ষেপে ডাক্তার চলে গেল আর আমি পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেললাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *