রণেশের সঙ্গে তার বউয়ের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। তার মস্ত কারণ একটা মেয়ে। আর্ট কলেজের এই ছাত্রীটি রণেশের সঙ্গে খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে একটা বিশেষ কারণে। মেয়েটির বাবা প্রভাবশালী লোক। তাঁর সহায়তায় রণেশ প্যারিসে একটা এক বছরের বৃত্তি পায় এবং বিদেশে প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা হয়। রণেশ যখন বিদেশে যায় তখন মেয়েটাও আগেভাগে গিয়ে প্যারিসে বসে আছে। শোনা যায়, সেখানেই তাদের মেলামেশা মাত্রা ছাড়াতে শুরু করে। রণেশ প্যারিসে থাকে এক বছর। এক বছরে মেয়েটি অন্তত তিনবার প্যারিসে যায়।
এসব খবর চাপা থাকে না। পল্লবিত হয়ে এদেশেও এসে পৌঁছোয়। রণেশের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি এবং তৎসহ পয়সা বেড়েছে। পোশাক বদলেছে। সবচেয়ে বেশি বদলেছে মেজাজ। রণেশ চল্লিশোর্ধ্ব। এ বয়সে কাঁচা মেয়ের সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা যেমন রোমাঞ্চক তেমনি বিপজ্জনক।
রণেশ যখন প্যারিসে তখন পিপুল রণেশের স্টুডিয়ো দেখেশুনে রাখত। রণেশের রং তুলি নিয়ে ক্যানভাসে ইচ্ছেমতো ছবিও আঁকত। রণেশ তাকে সে অধিকার দিয়েই গেছে।
এক রবিবার রণেশের স্টুডিয়োতে বসে সকালের আলোয় ছবি আঁকছিল পিপুল, এমন সময় দরজার কড়া নড়ল। দরজা খুলে পিপুল দেখে, রণেশের পুরুষালি কুচ্ছিত বউ ধারাশ্রী দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রমহিলা একটু কঞ্জুস এবং খিটখিটে। কণ্ঠস্বরে মিষ্টতা নেই। সম্ভবত বউয়ের জন্যই রণেশ আলাদা থাকত। পিপুলও ধারাশ্রীকে তেমন পছন্দ করে উঠতে পারেনি কখনো।
কিন্তু এই সকালে ধারাশ্রীর মুখচোখের ভাব অন্যরকম। ভীষণ অসহায়, বিবর্ণ, কাঁদো কাঁদো।
পিপুল একটু অবাক হয়েই বলল, আসুন কাকিমা।
ধারাশ্রী ভিতরে এল। চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে গা এলিয়ে হাঁফ ছাড়ল কিছুক্ষণ। ধারাশ্রী কদাচিৎ এখানে আসে। আসবার দরকারই হয় না। কলকাতায় তাদের নিজস্ব চমৎকার একখানা বাড়ি আছে। ছেলে-মেয়েরা ভালো ইস্কুলে পড়ে। গাড়ি কেনা হয়েছে সম্প্রতি।
ধারাশ্রী হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তুমি রণিতা বলে কোনো মেয়েকে চেনো?
পিপুল অবাক হয়ে বলে, রণিতা চৌধুরি? হ্যাঁ, পরিচয় হয়েছিল।
এখানে আসত?
দু-বার এসেছিল।
দু-বার? এসে কি রাত কাটিয়েছে?
পিপুল তটস্থ হয়ে বলে, না। রণেশকাকার সঙ্গে ছবি নিয়ে কীসব কথাবার্তা হচ্ছিল। দু বারই বিকেলের ট্রেনে ফিরে গেছে।
ঠিক জান? নাকি লুকোচ্ছ?
না, আমি জানি। রণিতাদিকে আমি নিজেই ট্রেনে তুলে দিয়ে এসেছি।
ধারাশ্রী হঠাৎ বলল, ওদের সম্পর্কটা কীরকম তা কি তুমি জান?
না তো! কী জানব?
ন্যাকা সেজো না। এখন বড়ো হয়েছ, সবই তোমার বুঝবার কথা।
আমি কিছু জানি না।
রণেশ যে রণিতাকে বিয়ে করবে ঠিক করেছে তা জান?
হতভম্ব পিপুল বলে, না তো!
তুমি খুব সেয়ানা ছেলে, তাই না? সব জেনেও বোকাটি সেজে আছ। রণিতা আর রণেশের বৃন্দাবন ছিল এইখানে। তুমি রণেশের শাগরেদ, তোমার না জানার কথা নয়।
পিপুল বিপদে পড়ে বলল, আমি কিছুই জানি না।
জানলেও বলবে না। তুমিই ওই রায়বাড়ির ভাগ্নে! তোমার বাবা তো শুনেছি মাতাল আর লম্পট। তুমি তো চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা হবেই।
পিপুল এখন কলেজে পড়ে, দাড়ি কামায় এবং একটা ছোটোখাটো দলের সর্দারি করে। এ তল্লাটে তার একটা নামডাক আছে। ছেলেবেলায় যা হয়েছে হয়ে গেছে। কিন্তু এখন কেউ তাকে এত সরাসরি অপমান করতে সাহস পায় না। তার আত্মমর্যাদাজ্ঞান খুব টনটনে। রণেশের বউ বলে সে এতক্ষণ কিছু বলতে দ্বিধা করছিল, কিন্তু এবার আর সামলাতে পারল না। বলল, আপনি এত অভদ্র কেন?
এ কথায় ধারাশ্রীর ফেটে পড়ার কথা রাগে। কিন্তু ফল হল উলটো। হঠাৎ ধারাশ্রী হাউমাউ করে কেঁদে মুখ ঢাকল শাড়ির আঁচলে। তারপর অনেকক্ষণ শুধু কাঁদল। পিপুল ভ্যাবাচ্যাকা।
কান্নার পর যে ধারাশ্রী মুখ তুলল সে অন্যরকম–দুঃখী, নরম, অনুতপ্ত। পিপুলের দিকে চেয়ে বলল, তুমি কি কিছুই জান না পিপুল?
পিপুলও অনুতপ্ত। বিনয়ী গলায় বলল, এটা মফস্সল। এখনও এখানে কেউ কিছু শোনেনি।
রণেশ তোমাকেও বলেনি কখনো?
না। বিশ্বাস করুন।
করছি। কাউকে বিশ্বাস করা আমার এখন বড্ড দরকার। রণেশ ব্যাংকের আমার অ্যাকাউন্টে প্রায় চার লাখ টাকা ট্রান্সফার করেছে। কলকাতার বাড়ি আমার নামেই ছিল, এখনও আছে। রণেশ দাবি তুলবে না। তার বদলে সে মুক্তি চাইছে–রণিতাকে বিয়ে করবে।
পিপুল চুপ করে রইল। তার মনে পড়ল, রণেশ তাকে মাঝে মাঝে বলত, পুরুষমানুষদের, বিশেষ করে শিল্পীদের একজন মাত্র মহিলা নিয়ে থাকা অসম্ভব। প্রকৃতির নিয়ম এরকম নয়।
ধারাশ্রী বলল, রণিতা ওর হাঁটুর বয়সি। এমন কিছু সুন্দরী কী তুমিই বলো!
পিপুল দেখেছে, রণিতা খুব সুন্দরী না হলেও মুখশ্রী ভারি মিষ্টি। কালোর ওপর ছিপছিপে ছোটোখাটো চেহারা। চোখে সমসময়ে একটু অবাক দৃষ্টি।
পিপুল মাথা নেড়ে বলে, না, তেমন সুন্দরী নয়।
তাহলে? তাহলে ও এরকম করল কেন?
আপনি অস্থির হবেন না কাকিমা।
ধারাশ্রী অবাক হয়ে বলে, হব না! কী বলছ? আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, তবু অস্থির হব না?
পিপুল নম্র গলায় বলে, রণেশ কাকা কিন্তু এখানে কখনো কোনো বাড়াবাড়ি করেননি। আপনমনে ছবি আঁকতেন। কখনো কখনো আমার সঙ্গে বসে ছবি নিয়ে কথা কইতেন।
তুমি হয়তো সব জান না। ওদের মাখামাখি এখানেও হত। অবশ্য সেটা জেনেই-বা আর আমার লাভ কী? আমার যা সর্বনাশ হওয়ার তো হয়েই গেছে।
কিন্তু রণেশকাকা তো এখন প্যারিসে!
সেখান থেকেই খবর আসছে। কয়েকদিন আগে রণেশ একটা চিঠি লিখেছে আমাকে। তাতে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করেছে। যদি না ভাঙি, তাহলে ও রণিতাকে নিয়ে আলাদা থাকবে।
আপনি রণেশকাকাকে কী লিখলেন?
কিছু লিখিনি। উকিলের সঙ্গে কথা বলেছি। উকিল বলেছে, বিয়ে যদি আমি ভাঙতে না চাই, তাহলে ও কিছু করতে পারবে না। কিন্তু তাতে কী লাভ বল! তুমি এখনও তেমন বড়ো হওনি, তোমার কাছে বলতে লজ্জা করে। তবু বলি, আমার রূপ নেই, ছবি আঁকতে পারি না, ছবি বুঝিও না, বয়সও হচ্ছে–কী দিয়ে রণেশকে বেঁধে রাখব বলো তো? বিয়ে না ভাঙলেই কী আর ও বশ মানবে?
পিপুল খুব সংকোচের সঙ্গে বলে, রণেশকাকা তো এমনিতে বেশ ভালো লোক।
সে তোমাদের কাছে। আমি ওর স্ত্রী, আমার চেয়ে ভালো আর ওকে কে জানে!
এখানে কেউ রণেশকাকার চরিত্র নিয়ে কখনো কিছু বলেনি?
এখানকার লোক ওকে জানে না। অনেকদিন ধরেই ও আর আমাকে পছন্দ করছে না, টের পাচ্ছি। এখানে পড়ে থাকে, কলকাতায় যেতে চায় না। গেলেও কেমন আলগোছ হয়ে থাকে। আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না, তুমি কি জান?
পিপুল না বলতে পারল না। কথার ফাঁকে ফাঁকে রণেশ তাকে ইঙ্গিত দিয়েছে যে, স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নয়। ধারাশ্রী বড্ড অহংকারী আর আত্মসর্বস্ব। রণেশের টাকার দিকেই তার নজর। পিপুল অবশ্য সেসব বলল না। মুখে সমবেদনা মেখে বসে রইল সামনে।
ধারাশ্রী অনেক কথা বলল। বিয়ের পর প্রথম চূড়ান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে শুধু পরস্পরের ওপর নির্ভর করে কেমন করে তারা বেঁচে ছিল। কত ভালোবাসা আর বিশ্বাস ছিল দু-জনের প্রতি দু-জনের। বহুবার কাঁদল ধারাশ্রী।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছিল, পিপুল জোর করে ধারাশ্রীকে নিয়ে গেল দিদিমার কাছে। ভাত খাওয়াল। তারপর বলল, বিকেলের গাড়িতে আমি গিয়ে কলকাতায় পৌঁছে দেব আপনাকে। আপনি একটু ঘুমোন।
খুবই ক্লান্ত ছিল ধারাশ্রী। বোধহয় রাতের পর রাত ঘুমোয় না। বলতেই বিছানায় শুল এবং ঘুমিয়ে পড়ল।
সন্ধ্যের সময় উঠে বলল, পিপুল, তুমি আজ আমার সঙ্গে কলকাতায় যাবে, কিন্তু তোমাকে ফিরতে দেব না–কাল ফিরো।
টালিগঞ্জের বাড়িতে একবার আগেও এসেছিল পিপুল। সুন্দর ছোটো একখানা দোতলা বাড়ি। একতলায় সবটা জুড়ে স্টুডিয়ো। ছবি বিশেষ নেই। কারণ রণেশের ছবি আজকাল আঁকা মাত্র বিক্রি হয়ে যায়।
রণেশের দুই মেয়ে, এক ছেলে। ছেলে বড়ো, মেয়েরা কিশোরী। ফুটফুটে সুন্দর চেহারা তাদের। মা-বাবার ডিভোর্সের আশঙ্কায় প্রত্যেকেই কেমন যেন ভীতু, লাজুক আর সংকুচিত। কথা বলছে না কেউ।
এরকম মুহ্যমান বাড়িতে থাকা খুব কষ্টকর। পিপুলের অস্বস্তি হচ্ছিল।
এত দুঃখের মধ্যেও ধারাশ্রী তার কোনো অযত্ন করল না। নিজের হাতে রান্না করে তাকে খাওয়ালো রাতে। বলল, তোমাকে আমার অনেক কথা বলার আছে। আমার জীবনটা যে ছারখার হয়ে গেল সে-কথা তো সবাইকে বলা যায় না।
পিপুল বুঝতে পারছিল না, তাকেই বা ধারাশ্রী এত দুঃখের কথা বলতে চায় কেন? সে তো ধারাশ্রীর কাছে প্রায় অচেনা একটি ছেলে। তাকে আজ ধরেই বা রয়েছে কেন ধারাশ্রী?
নীচের স্টুডিয়োতে একটা ক্যাম্প-খাটে বিছানা পাতাই থাকে। রণেশ এখানে বিশ্রাম নেয়। সেই বিছানায় শুয়ে সবে চোখ বুজেছে পিপুল, এমন সময় ধারাশ্রী এল। একটা চেয়ার টেনে তার মুখোমুখি বসে বলল, আমি এখন অনেক কথা বলব তোমাকে। শুধু শুনে যেও, জবাব দেওয়ার দরকার নেই। কথাগুলো বলতে না পারলে আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাব।
পিপুল উঠে বসে বলল, আপনি বলুন।
সারারাত কথা বলল ধারাশ্রী। তাদের প্রেমের কথা, বিয়ের কথা, ছেলে-মেয়ে জন্মানোর কথা, দারিদ্র্যের কথা, তারপর প্রেমছুট হওয়ার কথা, তার সঙ্গে ধারাশ্রীর নিজের জীবনের নানা ঘটনার কথা বলতে বলতে কথার খেই হারিয়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। অসংলগ্ন হয়ে পড়ছিল। পিপুল খুব মন দিয়ে অনুধাবন করছিল ধারাশ্রীকে। কিন্তু বুঝতে পারছিল ধারাশ্রী স্বাভাবিক নেই। খানিকটা পাগলামি দেখা দিয়েছে বোধহয়।
সকালে ধারাশ্রী এত ক্লান্ত হয়ে পড়ল যে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল ঘাড় কাত করে। সকালে রণেশের ফুটফুটে বড়ো মেয়েটি নেমে এল দোতলা থেকে। মাকে চেয়ারে বসে ঘুমোতে দেখে একটু অবাক হয়ে পিপুলের দিকে চেয়ে বলল, ইজ শি সিক?
পিপুল কী বলবে ভেবে পেল না। মাথা নেড়ে বলে, বুঝতে পারছি না। সারারাত কথা বলেছেন।
আজকাল মা বড্ড বেশি কথা বলছে। একা-একাও বলে। ওকে কি ডাক্তার দেখানো উচিত?
আমার তো সেটাই ভালো মনে হয়।
আপনি কি আজকের দিনটা থাকতে পারবেন?
কেন বল তো?
মেয়েটা লাজুক মুখে বলল, আসলে আমাদের মন ভালো নেই কারো, মা যদি সিক হয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের কিছু হেল্প দরকার।
পিপুল বলে, যদি কিছু করার থাকে করব। ওটা নিয়ে ভেবো না।
ডাক্তার এল, দেখল। সঙ্গেসঙ্গে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল ধারাশ্রীকে। তারপর বলল, এ বাড়িতে বড়ো কেউ নেই?
পিপুল বলল, আমি আছি।
ওঃ! বলে ডাক্তার তার বড়ত্বে একটু সন্দেহ প্রকাশ করে বলল, এক্সট্রিম মেন্টাল প্রেসার। হাইপারটেনশনটাও বিপজ্জনক। প্রেসক্রিপশন দিয়ে যাচ্ছি, ওষুধগুলো ঠিকমতো যেন দেওয়া হয়।
একদিনের জায়গায় পিপুলকে থাকতে হল তিন দিন। তিন দিন কাটল দারুণ উদ্বেগে, অনিশ্চয়তায়। ঘুম ভাঙলেই ধারাশ্রী নানা অসংলগ্ন কথা বলে, হাসে, কাঁদে। বিছানা ছেড়ে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল একবার। বিছানার কাছাকাছি পিপুল চেয়ারে বসে থাকে দিন-রাত। প্রয়োজন হলে ডাক্তার ডাকে ফোনে, ওষুধ এনে দেয়। তিন দিন ধরে সে বুঝতে পারল, রণেশের তিন ছেলে-মেয়েই অপদার্থ বাস্তববুদ্ধিবর্জিত। অতি আদরে এরা কেউ কাজের মানুষ হয়নি। এমন কী রান্না-খাওয়া অবধি বন্ধ হতে বসেছিল। পিপুল বেগতিক দেখে বাজার করে আনল, নিজেই রান্না করল এবং পরিবেশন করে খাওয়াল সবাইকে। মায়ের অসুখে ভেঙেপড়া তিনটে ছেলে-মেয়েকে প্রবোধ দেওয়ার কাজটাও তাকে করতে হল সঙ্গেসঙ্গে।
বড়ো মেয়েটির নাম অদিতি। ফর্সা। দারুণ সুন্দর বছর সতেরোর মেয়েটিকে মেমসাহেব বলে ভুল হয়। অন্য দুটিও প্রায় সমান সুন্দর, কিন্তু অদিতি দারুণ। কিন্তু সুন্দর বলেই কী একটু বেশি সরল? মাঝে মাঝেই সে পিপুলকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা পিপুলদা, মা যদি মরে যায়, তাহলে আমাদের কী হবে? বাবা তো আর আমাদের বাবা নেই!
কে বলল নেই?
বাবা যদি রণিতাকে বিয়ে করে, তাহলে কি আর বাবা আমাদের বাবা থাকবে?
বাবা সব সময়েই বাবা। কিন্তু অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? কাকিমা ঠিক ভালো হয়ে উঠবেন। ওঁর অসুখটা সিরিয়াস নয়। মেন্টাল শক থেকে ওরকম হয়।
অদিতির চোখ ছলছল করে, মা ছাড়া আমাদের যে কী হবে?
রণেশের বড়ো সন্তানটি ছেলে, তার নাম অতিথি। ছোটোটি মেয়ে–তার নাম মোনালিজা। তারা চমৎকার দুটি ছেলে-মেয়ে, কিন্তু তাদেরও বাস স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে। এই বাস্তব পৃথিবীর কিছুই প্রায় তারা জানে না। সারাদিন তারা পিপুলের মুখের দিকে চেয়ে থাকে, পিপুল যা করার করবে, তাদের যেন কিছু করার নেই। তবে তারা পিপুল যা বলে তাই নীরবে এবং বিনা প্রতিবাদে করে। এমনকী পিপুলের সঙ্গে রাতেও জেগে থাকার চেষ্টা করতে করতে ধারাশ্রীর বিছানার চারপাশে নানা ভঙ্গিতে শুয়ে বা বসে ঘুমিয়ে পড়ে।
জেগে থাকে পিপুল। চুপচাপ বসে বই পড়ে, কিংবা ভাবে। তার ঢুলুনিও আসে না। কঠিন বাস্তবের সঙ্গে পাঞ্জা কষে সে বড়ো হচ্ছে। সে তো এদের মতো পরীর রাজ্যের মানুষ নয়।
দ্বিতীয়ত রাতে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠে অদিতি বলল, আচ্ছা পিপুলদা, তোমাকে কি আমি এক কাপ কফি করে দেব?
হঠাৎ একথা কেন?
আমার বাবা যখন রাত জাগে তখন কফি খেতে দেখেছি।
পিপুল হাসল, আমি চা বা কফি বিশেষ খাই না। আমার কোনো নেশা নেই।
আমার বাবা হুইস্কি খায়, তুমি খাও?
অদিতি আপনি থেকে প্রথম দিনেই তুমিতে নেমে গেছে। তিন ভাই-বোনই তাকে বোধহয় একটু আপনজন বলে ধরে নিয়েছে, তাই দাদা আর তুমি বলছে। পিপুলের ভালোই লাগছে এদের।
সে বলল, আমি মদ খাই না। কোনোদিন খাবও না।
কেন খাবে না? খাওয়াটা খারাপ, তাই না?
খুব খারাপ। মদ খেত বলেই তো আমার বাবার আজ কত দুর্দশা। তাকে দেখেই আমার চোখ খুলে গেছে।
মার কাছে শুনেছি তোমার খুব দুঃখ। সত্যি?
কাকিমা তোমাকে বলেছে বুঝি?
তোমাকে যখন নিয়ে এল তখন আমাদের আড়ালে বলেছে। তুমি কি খুব গরিব?
খুব। দিদিমার কাছে আশ্রয় না পেলে কী হত কে জানে।
আমার বাবাও খুব গরিব ছিল, জান?
জানি। রণেশকাকা আমাকে সব বলেছে।
গরিব কি ভালো হয়?
তার কী কিছু ঠিক আছে? ভালোও হয়, মন্দও হয়।
তুমি কিন্তু খুব ভালো। ভীষণ।
পিপুল হাসল। এই সরলা বালিকার মধ্যে এখনও পাপ ঢোকেনি। এদের ভগবান কী চিরকাল এরকম নিষ্পাপ রাখবেন?
তিন দিন বাদে চতুর্থ দিন সকালে ধারাশ্রী তার বিপদ কাটিয়ে উঠে বসল। শরীর দুর্বল, কিন্তু রক্তচাপ কমছে। কথাবার্তার অসংলগ্নতাও আর নেই। ছেলে-মেয়েদের কাছে ডেকে অনেকক্ষণ তৃষিত চোখে চেয়ে দেখল তাদের। তারপর বলল, এ ক-দিন কি করলি তোরা? কে তোদের দেখল?
কেন, পিপুলদা! সবাই সমস্বরে বলে উঠল।
ধারাশ্রী পিপুলের দিকে চেয়ে বলল, তোমাকে অনেক কষ্ট দিলাম, তাই না?
আপনার কষ্টের তুলনায় আমারটা কিছুই না। আপনি ওসব ভাববেন না।
তোমার কলেজের ক্ষতি হল তো?
পুষিয়ে নেবো। আজকাল কলেজে তেমন পড়াশুনো হয় না।
দিদিমা ভাবছে না?
দিদিমা একটু ভাববে। তাই আজ একবার বাড়ি যাব।
এসো গিয়ে। কিন্তু মাঝে মাঝে চলে এসো। তোমার রণেশকাকা আমাদের ত্যাগ করেছে, তাই বলে তুমি কোরো না কিন্তু।
এতকাল দিদিমা ছাড়া আর কারো মায়া ছিল না তার। এই প্রথম রণেশের পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে তার কষ্ট হচ্ছিল। তিন দিনে মায়ায় জড়িয়ে পড়ল নাকি সে!
ফিরে আসার পর রণেশের স্টুডিয়োতে বসে ছবি আঁকতে আঁকতে প্রায়ই তিন দিনের নানা স্মৃতি এসে হাজির হয়। অদিতির মুখখানা খুব মনে পড়ে তার। আঁকতে চেষ্টা করে, পারে না অন্যরকম হয়ে যায়।
তিন মাস আর কোনো খোঁজখবর নেয়নি পিপুল। মন থেকে ধীরে ধীরে মুছেই যাচ্ছিল ওরা। পিপুলের নিজেরও অনেক কাজ। পড়াশুনো, ব্যায়াম, ছবি আঁকা, পরোপকার করে বেড়ানো। মাসতিনেক বাদে হঠাৎ একদিন রণেশ এসে হাজির। চেহারাটা অনেক ভালো হয়েছে, গায়ের রং ফর্সা হয়েছে, মুখটা একটু বেশি গম্ভীর।
পিপুলের সঙ্গে দেখা হতে বলল, কেমন আছিস?
ভালো। আপনি কেমন?
আমিও ভালো। তুই তো দেখছি অ্যাডাল্ট হয়ে গেছিস!
পিপুল অস্বস্তির সঙ্গে হাসল।
রণেশ তার ঘরে আরামচেয়ারে বসে মাথার পাতলা চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলল, আমার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছিস, না?
হ্যাঁ। কাকিমা খুব আপসেট।
হওয়ারই কথা। কুড়ি বছরের ম্যারেড লাইফ। একটা অভ্যাসও তো হয়ে যায়।
আপনি কাকিমার কাছেই আছেন তো?
দেখা করেছি, কিন্তু থাকব না। এত পাগলামি করছে যে সহ্য করা মুশকিল।
আপনি কি রণিতাদিকে বিয়ে করবেন?
বিয়ের প্রশ্ন ওঠে না। ধারা তো ডিভোর্স দেয়নি। তবে দিলে ভালো করত। এখন ও পাগলামি করছে বটে, কিন্তু মরা-সম্পর্ককে কী বাঁচানো যায়?
পিপুল মরা বা জ্যান্ত কোনো সম্পর্কের কথাই জানে না। তবে নিজের বাবার কথা মনে পড়লে সে একটা মৃত সম্পর্কের জের টের পায়। জন্মদাতা বাপ, তবু কতই না পর!
রণেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ধীরস্বরে বলল, কখনো আমাকে মানুষ বলেই ধারা গ্রাহ্য করল না। আমার ভালো-মন্দ দেখল না। এখন যেই সম্পর্ক ভাঙতে চলেছে তখন ক্ষেপে উঠেছে। এসব পাগলামিকে ভালোবাসা বা সেন্টিমেন্ট বলে ভাবিস না যেন–এ হল আহত অহং। ও রণিতার কাছে হার মানতে চাইছে না।
আপনি তাহলে কী করবেন?
রণেশ হাসল। বলল, আমার তো এসকেপ রুট আছেই। ছবি আঁকব, ছবিতে ডুবে যাব।
আর কাকিমা?
তবে তার কর্মফল ভোগ করতে হবে। তবে আমি তো নিষ্ঠুর নই। মেয়েরা যত নিষ্ঠুর হতে পারে, ছেলেরা তত পারে না।
রণিতাদির কী হবে?
রণিতা আধুনিক মেয়ে। সে হিসেব না কষে কাজ করে না।
তার মানে কি কাকা?
রণিতা আর আমি প্ল্যান করেছি, ধারা ডিভোর্স না দিলে আমরা অন্য কোনো রিলিজিয়নে কনভার্ট করব। তখন অসুবিধে হবে না। কিন্তু এসব তোকে বলছি কেন রে পাগলা! এসব হচ্ছে জীবনের কুৎসিত দিক। এগুলোর দিকে নজর দিস না। তুই আমাকে খারাপ ভাবিস নাকি?
না। যার হাতে অত সুন্দর ছবি বেরোয়, সে কী খারাপ হতে পারে?
ঠিক বলেছিস। দুঃখের বিষয়, আমি ছবিতে ডুব দিতে পারি কিন্তু ধারা ডুব দেবে কীসে? ওর তো একটা এসকেপ রুট দরকার, তাই না?
আমি জানি না।
ওর জন্য একটু ভাবিস তো। আগে গান গাইত–চর্চাটা রাখেনি। চর্চা থাকলে ওই গানই ওকে বাঁচিয়ে দিত। যাদের কোনও শিল্প নেই, শখ নেই তাদের বড়ো কষ্ট–তাই না?
বোধহয়।
আয়, আজ দু-জনে ছবি আঁকি।
দু-জনে পাশাপাশি বসে গেল ছবি আঁকতে। আঁকতে আঁকতে রণেশ প্যারিসের গল্প করছিল মাঝে মাঝে। মহান সব ছবির গল্প, শিল্পীদের গল্প, বিদেশের নানা অভিজ্ঞতার গল্প। বলতে বলতে হঠাৎ বলল, ওঃ হ্যাঁ, ভালো কথা! তোর কথা আমার ছেলে-মেয়েরা খুব বলছে আজকাল!
তাই নাকি?
ওরে সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। ওদের তুই মেসমেরাইজ করে এসেছিস–তোর কাকিমাকেও।
পিপুল লজ্জার সঙ্গে হাসল।
রণেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুই না থাকলে ধারার কী হত কে জানে! আমার ছেলেমেয়েরা তুলোর বাক্সে মানুষ হয়েছে, দুনিয়ার আঁচ টেরই পায়নি কখনো। তুই সেসময়ে না থাকলে ওরা দিশেহারা হয়ে যেত। কী যে করত কে জানে!
কাকিমা এখন ভালো আছেন?
শরীর খারাপ নয়, তবে মনে হয় প্রেসারটা ক্রনিক হয়ে গেল। একটু হার্টেরও প্রবলেম। তবে সিরিয়াস কিছু নয়।
কাকিমা কিন্তু সে-দিন পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন।
শুনেছি। তোকে সারারাত জাগিয়ে রেখেছিল। তবে সে ভাবটা এখনও আছে। বেশি কথা বলছে, বেশি কাঁদছে, বেশি চেঁচামেচি করছে। আয়, ওসব কথা ভুলে যা। ছবি আঁক, ছবি তোকে সব ভুলিয়ে দেবে। দুনিয়া নিয়ে বেশি ভাববি না কখনো। ওটা আমাদের কনট্রোলে তো নেই।
দু-জনে অনেকক্ষণ নীরবে ছবি আঁকল। অখন্ড মনোযোগে।
রণেশ বলল, তোর স্ট্রোক অনেক পাওয়ারফুল হয়েছে তো! খুব খেটেছিস মনে হচ্ছে! কালারসেন্সটা এখনও গ্রো করেনি–আয় তোর ছবিটা একটু রিটাচ করে দিই। দেব?
সে তো আমার ভাগ্য।
পোর্ট্রেট করতে ভালোবাসিস বুঝি? এটা কার মুখ?
মন থেকে আঁকা।
রণেশ পাকা আর্টিষ্ট, প্রতিভাবানও। দু-একটা শেড পালটে দিল, দু-চারটে নতুন টান মারল। তারপরই হঠাৎ ঝকঝকে করে হেসে উঠল একটা চেনা মেয়ের মুখ।
রণেশ কিছুক্ষণ হাঁ করে ছবিটার দিকে চেয়ে থেকে বলল, তাই তো ভাবছি মুখটা এত চেনা-চেনা ঠেকছিল কেন! এ তো অদিতি!
এই বলে হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে রণেশ। পিপুল লজ্জার মরে গেল।