৪। পাতাল-জীবন
কিন্তু পরিবর্তন আসছিল ধীরে ধীরে নিজেদেরই অগোচরে। একটু একটু করে পালটে যাচ্ছিল দুজনে। যন্ত্র সভ্যতা গ্রাস করে নিচ্ছিল দুজনকে–সইয়ে সইয়ে। অসাড় হৃদয় দিয়ে কেউই তা টের পায়নি। ভেবেছে, এই তো স্বাভাবিক। এরই নাম জীবন।
ডেনটনকে পাঠানো হয়েছিল কারখানায়। সেখানে তাকে কাজ করতে হয়েছে এমন সব সঙ্গীর সঙ্গে, যারা স্বভাবে চোয়াড়ে, আকৃতিতে নরপিশাচ, কথাবার্তায় দুর্বোধ্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকেই নিচের তলার মানুষ আর ওপরের তলার মানুষের মধ্যে কথ্য ভাষায় যে পার্থক্য দেখা গিয়েছিল, তা প্রকটতম হয়েছে দ্বাবিংশ শতাব্দীতে। মেহনতি মানুষের ভাষা তাই নিতান্তই দুর্বোধ্য ওপরমহলের মার্জিত শিক্ষিত মানুষের কাছে। এতদিন বুদ্ধদেবের মতো বিরাট মেশিনের দাসত্ব করে এসেছে ডেনটন–একাই। কারও সঙ্গে কথা বলতে হয়নি–অসুবিধেটাও টের পায়নি। নতুন কারখানায় এসে অমার্জিত ছোটলোকি ভাষা শুনে ঘৃণায় অবজ্ঞায় সঙ্গীদের বয়কট করে একা একা থাকার মতলব করতেই লাগল বিরোধ। খানদানি সঙ্গী ডেনটনকে কোণঠাসা করে ফেলল চোয়াড়ে বৃষস্কন্ধ শ্রমিকরা। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়াও বাধিয়ে বসল। কদর্য রুটি গেলাবেই তাকে–ডেনটনের প্রবৃত্তি নেই। খাওয়ার। মুখে ঠুসে দিতে আসতেই রুখে দাঁড়িয়েছিল ডেনটন। প্রথমজনকে প্রহার করতেই প্রহৃত হল নিজেই। ঠোঁট কেটে গেল, চোখে কালশিটে পড়ে গেল এবং জ্ঞান হারিয়ে ছাইয়ের গাদায় লুটিয়ে রইল অনেকক্ষণ। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর আবার শুরু হয়ে যেত প্রহার-পর্ব এবং প্রাণটাও খতম হয়ে যেত তৎক্ষণাৎ, যদি না সদয়-হৃদয় এক শ্রমিক আড়াল করে দাঁড়াত তাকে। তারই কৃপায় একটু একটু করে শিখল হাতাহাতি লড়াইয়ের কৌশল। এ কৌশল সে জানে না বলেই তো বেধড়ক মার খেতে হয়েছে। পাতাল কারখানায়। মার্জিত রুচিবান ডেনটন সাগ্রহে শিখেছিল নিচুতলার মানুষদের টিকে থাকার প্রক্রিয়া। মনে হয়েছে, এই তো জীবন! আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে এসেছে ওপরতলার স্মৃতি। স্বরেস, বিনডন–সবাই ফিকে হয়ে গেছে স্মৃতিপট থেকে। তারপর একদিন। লড়াইয়ে পোক্ত হয়ে এসে একাই লড়ে গিয়েছিল কারখানার কুলিদের সঙ্গে। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহে রাত্রে শুয়ে এলিজাবেথিটার কাছে সোৎসাহে যখন বর্ণনা করছে তার নীচ জীবনের ইতর কাহিনি, তখন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল এলিজাবেথিটা। ইদানীং ওদের মধ্যে কথাবার্তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কথা বলার মতো উষ্ণতা ছিল না মনের মধ্যে। জড়, নিস্পৃহ যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল দুটি প্রাণচঞ্চল মানুষ–যন্ত্রের ক্রীতদাস দুটি যন্ত্র। কিন্তু ডেনটনের রূপান্তর দেখে এলিজাবেথিটা আর সামলাতে পারেনি নিজেকে। সে-ও তো পালটে যাচ্ছে। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে, অন্য মেয়ে-শ্রমিকদের মধ্যে নিজেকে আর দলছাড়া বলে মনে করতে পারছে না। এ জীবন তো সে চায়নি। এতদিন ডেনটন যা বলেছে, তা-ই বিশ্বাস করেছে–মেনে নিয়েছে। কিন্তু এখন এলিজাবেথিটা বুঝতে শিখেছে। হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে নরক তাদের জন্যে নয়–ওপরতলার জীবনটাই ফিরে পেতে চাইছে মনেপ্রাণে। আহ্বানও এসেছে ওপরতলা থেকে। ডেনটনকে ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ…
থ হয়ে বসে রইল ডেনটন!