৪. পাঁচকড়ি ঢুকে পড়ে বাবুর খয়রাতি ফর্দে

পাঁচকড়ি ঢুকে পড়ে বাবুর খয়রাতি ফর্দে

একদিন নাজিরের হুকুম হল, যারা খাজনা বাকি রেখেছে সেই সব মুজরিমদের গ্রেফতার করো, না হলে হাজির করো তাদের কারিন্দাকে। খাজনা বাকির ফর্দে ছিল এক নবাবজাদা তার কোনও কর্মচারীর হেনস্তা মানে তাকেই বেইজ্জত করা। কালেক্টর সাহেব বাহাদুর হুকুম পাঠিয়েছিলেন নাজিরকে আর আমার ফরজ ছিল সেই হুকুম তামিল করার। আমি তো তুরন্ত দু’জন চাপরাশিকে নিয়ে হাজির হলাম নবাব সাহেবের হাবেলিতে। গ্রেফতারি পরওয়ানা দাখিল করে জানালাম যেতে হবে নাজিরের দপ্তরে। নবাব তো এই হুকুম থোড়াই কেয়ার করেন। আমাদের মুখের উপর ছুঁড়ে দেওয়া হল সেই পরওয়ানা, চারধার থেকে শুধু আওয়াজ উঠল মার! মার! আমরাও ল্যাজ তুলে হাওয়া। পরদিন হুজুরের কাছে পেশ করা হল এক আচ্ছা-খাসা কৈফিয়ত। শুনেছিলাম ওই নবাবের কারিন্দা নাকি রোজ কাছারিতে আসে সেরেস্তাদারের সঙ্গে সলা-পরামর্শ করতে। আমিও তক্কে তক্কে ছিলাম। মওকা মিলতেই খবর দিলাম হুজুরকে। তিনি হুকুম দিলেম গ্রেফতার কর ব্যাটাকে। তিনদিন কয়েদ থাকার পর নবাব তার সব বকেয়া মিটিয়ে কারিন্দাকে খালাস করল। নবাবজাদার বড় শিক্ষা হয়েছিল। বুঝতে পেরেছিল তকমাধারীদের সঙ্গে ফইজতের মাশুল কী। পরে তাকে সেলাম করতে গেলে শুধু যে বখশিশ জুটেছিল তাই নয়, বলা হয়েছিল এরপর থেকে দরকার পড়লেই মিলবে ইনাম।

আমদানির আর একটা জায়গা হল আবকারি। আফিম যারা চাষ করে তাদের মঞ্জুরি থাকে অন্যদের মুচড়ে টাকা করার। আফিম চাষের মঞ্জুরি হাতে পেলেই শুরু হয়ে যায় নানা বজ্জাতি। একদিন হুকুম হল তল্লাশি চালাতে হবে চোরাই আফিমের খোঁজে। খবরটা শুনেই হাজির হল ঠিকেদার। একথা সেকথার পর গুঁজে দিল পাঁচটা টাকা। বুঝলাম এওজে আমাকেও কিছু করতে হবে। ঠিকেদারের লোকেরাও চলল আমার সঙ্গে তল্লাশিতে। যে মকানের তল্লাশি নেওয়া হবে, সেখানে পৌঁছে রোয়াবের সঙ্গে হাঁক পাড়লাম মকান মালিকের নাম ধরে। মকান মালিক ছিল একজন রেস্তদার বানিয়া। সে জানত কোনও বেচাল করেনি। তাই বলতেই দোর খুলে দিল। হঠাৎ আমার নজরে পড়ল, সঙ্গে আসা ঠিকেদারের একজন আদমি চুপিচুপি একটা পুলিন্দা হাবিজাবির গাদায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তল্লাশি চালানোর সময় সেটাই সে আবার বের করে আনল। তারপর শুরু হল তার নৌটঙ্কি। এই হল সেই চোরাই আফিম যার জন্য আমাদের এত দিকদারি। বেচারা বানিয়া! সে তখন ভয়ে কাঁপছে। রহম চাইছে বার বার। কিন্তু আমিও নাচার। একবার রিশবত কবুল করেছি এখন আর ওকে বাঁচাই কেমন ভাবে। সাক্ষীদের সামনে রেখে জব্দ করা হল সেই চোরাই আফিম। মনসুবা, তারা যা দেখেছে তা যেন ঠিকঠাক হুজুরের সামনে বয়ান করে। নাউমেদ বানিয়া তখন কবুল করে বসল পঞ্চাশ টাকা। আমি তাকে জবরদস্ত গালিগালাজ করে সাক্ষীদের বলতে বসলাম, ব্যাটার এত হিম্মত আমায় রিশবত দিতে চায়! সাহেব বাহাদুর তাকে ১০০ টাকা জরিমানা করলেন। এর চার ভাগের এক ভাগ গেল সরকারি তোশাখানায়, অর্ধেকটা পেল ঠিকেদারের লোকেরা আর বাকিটা আমি।

এইরকম আমদানি মনে হয় না খুব খারাপ, তবে ঠিকেদারের তরফে না গিয়ে উলটো তরফে গেলে বোধ হয় আমদানি আরও বেশি হত। অবশ্য আমাকে খুব বেশিদিন ইন্তেজার করতে হল না। ডিপটি সাহেবের হুকুম হল এক মসহুর তওয়ায়েফের কোঠিতে তল্লাশি চালাতে হবে। ঠিকেদার এলে আমি মোলাকাত করলাম না। কিন্তু রাতের বেলা হাজির হলাম গস্তানি দিলফরবের কোঠিতে। কমতি হল না খাতিরদারির। তবে আমি সাফ জানিয়ে দিলাম চাইলে আমি রগড়াতে পারি আবার রেহাও করতে পারি। খাতিরদারির জন্য শুধু বেহেতরিন সামানই নয় সেই সঙ্গে মিলল দিলফরবের দেওয়ানা করা মুসকানও। জানালাম, তার কোঠিতে অনেক আফিম মজুদ, যা দিয়ে তার নোকর-চাকরেরা মোদক বানায় আর এই মোদকই লোকেরা ছিলিমে করে টানে। আমার কথায় সে সব হাপিস করা হল। পরদিন আমি ঠিকেদারের লোকলস্কর নিয়ে দাখিল হলাম কোঠিতে তল্লাশি চালাব বলে। পুলিশ বরকন্দাজদের সামনে যাতে কোঠিতে ঢোকার আগে এই লোকলস্করদের তল্লাশি নেওয়া হয় তার উপর আমি জোর দিলাম। এদের ভিতর একজনের কাছে মিলল একটা বড় কুফার (Kuffa) বান্ডিল। পুলিশ সেটা রেখে দিল নিজের হেপাজতে। শুরু হল তল্লাশি। মিলল না কিছুই। রিপোর্ট দাখিল করলাম হুজুরকে। জরিমানা হল ঠিকেদারের লোকদের। দিলফরেব শুধু যে আমায় বখশিশ দিল তাই না তার কাছে আমার ইজ্জতও কায়েম হল।

শুধু যে মাল বেচে আবকারি কিষানরা মুনাফা করে তাই নয়, তল্লাশি চালানোর হুমকি দিয়ে হয়রান করে মারে ছাপোষা লোকেদের। এ ছাড়াও আছে বেআইনি সামান জব্দ করা, চোরাইমালের মজুতদারদের কাছ থেকে টাকা তোলা। যারা বেআইনি কারবার করে তারাও চায় না ঝুট ঝামেলায় যেতে। তাই কিষানরা যা চাইছে তা ঠেকিয়ে পার পেয়ে যায়। এদের গ্রেফতার করার হাজারও বখেরা। আইন-আদালত সাক্ষী, প্রমাণ কর গুনহগার কে। সরকার খোদ যদি চোরাইমাল বাজেয়াপ্ত করে তখন আর কিষানের ধামাচাপা দেওয়ার উপায় থাকে না। জরুর সাজা হয় চোরাই কারবারিদের। কারবারি যদি এত গরিব হয় যে আমদানির কোনও আশা নেই তখন কিষানরাই তাদের আইনের হাতে ছেড়ে দেয় মাড়াই হতে।

১. এওজ: বদল, বিনিময়

২. রহম: মার্জনা, ক্ষমা

৩. না উমেদ: হতাশ, হতদ্যম

৪. গস্তানি: যে নারী প্রণয়ীর সন্ধানে ঘোরে, অভিসারিকা

১. বেহেতরিন: অমূল্য

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *