চতুর্থ দৃশ্য
[খোলা মাঠ। শো শো করে শীতের হাওয়া বইছে। তিনটি শিশু গায়ে চট জড়িয়ে বসে বসে শীতে কাঁপছে। বাচ্চাগুলির সঙ্গে বেশ কিছু গ্রামবাসী আছে। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছ। এদের মধ্যে আছে ওসমান নামের অতি বৃদ্ধ এক ব্যক্তি। কাঁদের নামের এক তরুণ। লতিফা নাম্নী এক তরুণী। মঞ্চের এক কোণায় মাটির মালসায় আগুন। অতি বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আগুন তাপাচ্ছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ দূরাগত ধ্বনি শোনা যাবে। আনন্দের বাজনা বাজছে ও তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। গ্রামবাসীরা উৎকীর্ণ হয়ে প্রতীক্ষা করবে। দেখা যাবে লাঠিতে ভর দিয়ে মজনু আসছে। সে একবারও না থেমে একই গতিতে মঞ্চ অতিক্রম করবে। কথাবার্তা যা হবে চলার মধ্যেই হবে।]
বৃদ্ধ : বড় কষ্ট! বড় কষ্ট! শীত জবর পড়ছে। বুড়া-মরণের শীত পড়ছে।
এই শীতে সব বুড়া শেষ হবে রে। বুড়ার দল সব শেষ।
তরুণ : শেষ হইলেই ভাল। বুড়া দিয়া কি হয়? কিছু না।
তরুণী : এইটা কেমন কথা? ও বুড়ো চাচা, আপনে আগুনের কাছে গিয়া বসেন। হাত দুইটা মেলেন আগুনের উপরে।
বৃদ্ধ : দুই দিকে আগুন জ্বলে রে বেটি। পেটের মইধ্যেও আগুন। খিদার আগুন। সেই আগুনের কষ্ট আরো বেশি।
তরুণ : এক কাজ করেন চাচা মিয়া, হা কইরা এট্টু আগুন খাইয়া ফেলেন। আগুনে আগুনে শান্তি। পেট ঠাণ্ডা হইব। হা হা-হা।
তরুণী : চুপ কর। লজ্জা নাই? কেমন কথা কও?
তরুণ : মজাক করি রে মজাক করি। রাইতটা তো কাটান দেওন লাগব। হাসি-মজাক কইরা রাইত পার করি। ও চাচা মিয়া, গোসা হইছেন?
বৃদ্ধ : [কথা বলবে না]
তরুণ : গোসা কইরেন না চাচা মিয়া। শীতের মইধ্যে মাথার ঠিক থাকে না। একটা কিচ্ছা কন দেখি।
বৃদ্ধ: [চুপ করে থাকে]
অন্য একজন : কন গো, একটা কিচ্ছা কন। কিচ্ছা হুনতে হুনতে রাইতটা পার করি।
বৃদ্ধ : [চুপ]।
সবাই : কনগো কন, একটা কিচ্ছা কন।
বৃদ্ধ : এক দেশে আছিল এক রাজা।
তরুণ : রাজার গল্প বাদ দেন। একটা গরীব মাইনষের গল্প কন দেহি।
বৃদ্ধ : গরীব মাইনষের কোন গস্প হয় না। খামাখা কথা কইও না। গল্পটা হুন মন দিয়া। শুনতে মনে না চায় দূরে গিয়ে বইসা থাক। এক দেশে আছিল এক রাজা। তরুণ উঠে দূরে চলে যায়। সেই রাজার বড় শান শওকত। বেশুমার খানা-খাদ্য।
অন্য একজন : কি খানা-খাদ্য এট্টু কন শুনি।
বৃদ্ধ : কি কমু কও? রাজবাড়ির খানা-খাইদ্যের হিসাব-নিকাশ নাই। সেই রাজার হাতিশালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া। লোক-লস্কর, পাইক বরকন্দাজ। কিন্তু রাজার মনে সুখ নাই।
তরুণী : তবু সুখ নাই? কন কি? ক্যান? সুখ নাই ক্যান?
বৃদ্ধ : রাজা হইল আটকুড়া, তার পুত্রসন্তান নাই।
তরুণী : আহা রে!
বৃদ্ধ : পুত্রসন্তানের কারণে রাজা শুধু বিয়া করে। যেখানে যত সুন্দর কন্যা পায় বিয়া করে। কিন্তু পুত্রসন্তান হয় না। [তরুণ শব্দ করে হেসে উঠবে।]
হাস ক্যান?
তরুণ : আটকুড়া রাজা হইতে মনে চায়।
[সবাই হেসে উঠবে। এবং হাসি থেমে যাবে।]
তরুণী : এর পরে কি হইল কন? পুত্রসন্তান হইল?
বৃদ্ধ : কিচ্ছা আইজ থাউক। মন ভাল লাগছে না। বড় কষ্ট রে, বড় কষ্ট! শীতের কষ্ট। ক্ষিদার কষ্ট।
তরুণী : একটা ক্ষিদার কিচ্ছা কন্ তো চাচা মিয়া? জানা আছে?
অন্য একজন : চুপ, চুপ, চুপ। পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। রাজার লোক আসতাছে। [সবাই চুপ]
তরুণ। : পায়ের শব্দ না গো, বাতাসের শব্দ। ঠাণ্ডা বাতাস। বড় ঠাণ্ডা বাতাস।
বৃদ্ধ : সমস্ত দিন গেল। সইন্ধ্যা গেল। চাইরদিক অন্ধকার। ঠাণ্ডা শীতের বাতাস। রাজার খবর নিয়া তো এখনো কেউ আইল না।
সকলেঃ আসে না। কেউ আসে না।
তরুণী : পায়ের শব্দ শোনা যায়। ভাল কইরা চাইয়া দেখেন। কাউরে দেখা যায়?
সকলে : না। কেউ না।
বৃদ্ধ : শীতের বাতাস বয়, শরীর দুর্বল হইছে, বড় কষ্ট হয়।
তরুণী : পায়ের শব্দ শোনা যায় চারদিকে চউখ ফেলেন
রাজা সাবের লোকজন কাউরে দেখা যায়?
সকলে : না, কেউ নাই।
বৃদ্ধ : শীতের বাতাস বয়
শরীর দুর্বল হইছে, বড় কষ্ট হয়।
অন্য একজন : চুপ করেন, চুপ করেন,
কোন কথা নাই।
কে যেন আসতে ধরছে লাঠির শব্দ নাই।
ওসমান : তুমি কেডা?
মজনু : আমি মজনু।
ওসমান : বাদ্য-বাজনা শোনা যায়। আসে কেডা?
মজনু : রাজার পয়গাম আসতেছে। বড় সুসংবাদ।
[ দ্বিতীয় প্রজা নিয়ামত পিঠ বাঁকা করে ঢুকবে। সেও প্রথমজনের মত মঞ্চ অতিক্রম করবে।]
তরুণ : আপনে কেডা?
বশির : আমার নাম বশির।
তরুণ : বেঁকা হইয়া হাঁটেন ক্যান?
বশির : রাজার পয়গাম আসতাছে। বড় সুসংবাদ।
[তৃতীয় জনের প্রবেশ। প্রথম দু’জনের মতো মঞ্চ অতিক্রম করবে।]
তরুণী : আপনি কেডা গো?
নিয়ামত : আমি নিয়ামত।
তরুণী : জোয়ান বয়সে অমুন বেঁকা হইয়া হাঁটেন ক্যান?
[নিয়ামত দাঁড়াবে] কমরটা ভাঙলেন ক্যামনে? ঘটনাটা কন।
বৃদ্ধ : নিয়ামত, শীত লাগলে আগুনের কাছে আইসা এট্টু খাড়াও।
নিয়ামত : [হাঁটতে শুরু করবে] বাদ্য-বাজনা শুনা যায় রাজার পয়গাম আয়।
বড় সুসংবাদ।
[দেখতে দেখতে রাজার সংবাদ বহনকারী দল এসে পড়বে। ঢোল আছে, রামসিংগা আছে। একজন ঘোষক আছে।]
ঘোষক : গ্রামবাসী, মন দিয়া শুনেন। রাজা সাবের হুকুমে এই বৎসর বসন্তের উৎসব আগে আগে হইবার কথা। এ বিষয়ে আপনাদের মতামত বলেন।
গ্রামবাসী : [মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবেন। গুন গুন কথা হবে।]
ঘোষক : হ্যাঁ, কিংবা না। স্পষ্ট করে বলেন।
ওসমান : পেটে ভাত নাই। রাজা সাবরে ভাত দিতে কন। শীতের মইধ্যে আবার বসন্ত উৎসব কি?
ঘোষক : এত কথা না রে ভাই, হ্যাঁ কিংবা না স্পষ্ট করে বলেন।
ওসমান : না।
ঘোষক : একজন শুধু না বললেন আর সব হ্যাঁ।
[বলতে বলতে বাজনা শুরু হবে।]
গ্রামবাসী : [মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবে।]
ঘোষক : ভাই আপনের নাম?
ওসমান : ওসমান।
ঘোষক : আসেন আমাদের সাথে।
ওসমান : কই?
ঘোষক : এত কথা বলবার সময় নাই। আসতে বলছি আসেন।
চলেন এইবার যাই। [ওসমান উঠে দাঁড়াবে।]
গ্রামবাসী : কই যান?
[ঘোষক তার দলবল নিয়ে চলে যায় শো শো করে বইবে শীতের বাতাস। শুকনো পাতা পড়ছে। তিন পিঠ-বাঁকাকে আবার মঞ্চ অতিক্রম করতে দেখা যাবে। এবার একজনের পিছনে একজন। গ্রামবাসী তাকিয়ে দেখবে, কিছু বলবে না। দূরাগত ধ্বনি। গ্রামবাসী সচকিত। ঘোষকের প্রবেশ।[
ঘোষক : সুসংবাদ ভাই, সুসংবাদ! রাজ্যের সব লোক বসন্তের উৎসব চায় তাই উৎসবের সময়টা আপনাদের জানাই মাঘ মাসের নয় তারিখে খুব শুভক্ষণ-এই দিনে উৎসব হবে শুনেন দিয়া মন।
[এ পর্যন্ত বলতেই তরুণটি থু করে থুথু ফেলবে।]
গ্রামবাসী : [থু করে থুথু ফেলবে]
ঘোষক : মাঘ মাসের নয় তারিখে শুভ দিনক্ষণ।
তরুণ : ভাই আপনে রাজা সাবরে ভাত দিতে কন।
ঘোষক : গ্রামাবসী বৃদ্ধ-যুবা শুনেন দিয়া মন।
তরুণ : ভাই আপনে রাজা সাবরে কাপড় দিতে কন।
গ্রামবাসী : ভাত দিতে কন। কাপড় দিতে কন। ভাত দিতে কন। কাপড় দিতে কন। [ঘোষকের লোকজন তরুণটিকে ধরবে এবং নিয়ে যেতে শুরু করবে।]
তরুণী : একটা কথা শুনেন— আপনে কথার জবাব দেন।
আপনে আমার ঘরের মানুষ কোন্ জাগাতে নেন?
ঘোষক : চুপ।
তরুণ : তুই চুপ।
ঘোষক: মনে নাই ডর ভয় বড় বেশি কথা কয়।
তরুণী : [ গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে] ঘরের মানুষ লইয়া যায়,
চাইয়া থাকেন ক্যান। আমার মানুষ আমার কাছে কাইড়া আইন্যা দেন। [ গ্রামবাসী সব একত্রে দাঁড়িয়ে যাবে।]
ঘোষক : খবরদার, চুপ।
[সবাই যে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় ফ্রীজ হয়ে যাবে।]