৪. নীতুর ঘুম ভেঙে গেল

৪.

গভীর রাতে নীতুর ঘুম ভেঙে গেল, তার মনে হলো ঘরের মাঝে কেউ যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নীতুর প্রথমে মনে হলো এটা নিশ্চয়ই মনের ভুল। সে পাশ ফিরে শুয়ে আবার ঘুমিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু তখন সে আবার স্পষ্ট কান্নার শব্দ শুনতে পেল ।

নীতু এবারে বিছানায় উঠে বসে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। তখন সে আবার কান্নার শব্দ শুনতে পেল, মনে হলো শব্দটা আসছে আলমারির ভেতর থেকে। নীতুর কেমন জানি ভয় ভয় করতে থাকে, কী করবে বুঝতে পারল না, মনে হলো চিৎকার করে তার আব্বুকে ডাকে, কিন্তু এত বড় হয়েছে এমন ভয় পেয়ে আব্বু কিংবা আম্মুকে ডাকলে সেটা কেমন দেখায়? নীতু তাই কাউকে ডাকল না, কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর সাবধানে বিছানা থেকে নামল, পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে সুইচ টিপে আলোটা জ্বালিয়ে দিল, প্রথমে নীতুর চোখ ধাধিয়ে যায়, কিছুক্ষণের মাঝে ধীরে ধীরে আলোটা চোখে সয়ে এলো, তখন সে পিট পিট করে চারিদিকে তাকাল। ঘরে ঝকঝকে আলো থাকার কারণে হঠাৎ করে নীতুর ভয়টা কেটে গেছে। সে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে, কোথাও কোনো শব্দ নেই। নীতু কিছুক্ষণের মাঝে আবার কান্নার শব্দ শুনতে পেল, এবারে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কান্নার শব্দটা আসছে আলমারির ভেতরে তাক থেকে।

নিশ্চয়ই বিড়াল বাচ্চা দিয়েছে, নীতুর ভেতর থেকে ভয়টা এবারে পুরোপুরি কেটে গেল। বিড়ালের বাচ্চার কান্না অনেক সময় ঠিক মানুষের কান্নার মতো শোনায়! বিড়ালেরা বাচ্চা দেয়ার পর বিচিত্র জায়গায় তাদের বাচ্চাদের রেখে যায়, এবারে নিশ্চয়ই তার ঘরের ভেতর আলমারিতে রেখে গেছে। বিড়ালের ছোট ছোট বাচ্চা দেখতে খুব ভালো লাগে, যখন গুটিগুটি হাঁটে তখন খুব মায়া হয়। নীতু বিড়ালের বাচ্চাগুলো দেখার জন্যে আলমারির দরজাটা খুলল, নিচু হয়ে নিচের তাকে তাকালো, দেখল বিড়াল নয় একটা ছোট শিশু সেখানে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। নীতু যখন তাকাল তখন শিশুটিও তার দিকে তাকাল। বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে, সেই চোখে এক ধরনের ব্যাকুলতা, এক ধরনের আতঙ্ক। চোখ দুটোতে পানি টল টল করছে।

নীতু চিৎকার করে লাফ দিয়ে পেছনে সরে যেতে যেতে অনেক কষ্টে চিৎকারটি থামাল, সে এখনো কিছু জানে না, বাচ্চাটি কে, কোথা থেকে এসেছে, কিন্তু বাচ্চাটি যে ভয় পাচ্ছে সেটি বুঝতে কোনো সমস্যা হলো না। সে যদি চিৎকার করে তাহলে বাচ্চাটি যে আরো ভয় পেয়ে যাবে সেটাও সে অনুমান করতে পারল। হাত দিয়ে নিজের মুখটা চেপে রেখে সে কয়েক হাত পেছনে সরে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে রইল। বাচ্চাটিও ঠিক একইভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

এভাবে কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল, তখন নীতু কাঁপা গলায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

বাচ্চাটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, এবারে কান্না থামিয়ে নীতুকে পাল্টা জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

নীতুর ঘরে নীতুর আলমারির ভেতর বসে নীতুকে এই প্রশ্নটা করা যায় কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় কিন্তু নীতু তার ভেতরে গেল না, যতটুকু সম্ভব পরিষ্কার করে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করল, বলল, আমার নাম নীতু। আমি এই ঘরটায় থাকি। তুমি কে? এখানে কোথা থেকে এসেছ?

বাচ্চাটা কেমন যেন রেগে উঠল, বলল, কোথা থেকে এসেছি মানে? তোমরাই না আমাকে ডেকে আনলে?”

নীতু চোখ কপালে তুলে বলল, আমরা?

হ্যাঁ তোমরা। তোমরা ডেকেছ বলেই তো এসেছি। আম্মু বলল যাস নে, আমি বললাম একটু দেখে আসি।

নীতু বিস্ফারিত চোখে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা ডেকেছি বলে এসেছ? তার মানে তুমি ভূত? ভূতের বাচ্চা?

বাচ্চাটা মাথা নেড়ে তার চোখ মুছল। নীতু কী বলবে বুঝতে পারল না, ঢোক গিলে কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তুমি কাঁদছ কেন?

বাচ্চাটা বলল, কাঁদব না তো কী করব? ডেকে ডেকে আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছ? এখন আমি আটকা পড়েছি, যেতে পারছি না। আমার আম্মুকেও দেখতে পাচ্ছি না।

আম্মুকে দেখতে পাচ্ছ না?

না। বলে বাচ্চাটা আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল।

নীতু গলার স্বর নরম করে বলল, শোনো, শোনেনা, তুমি কেঁদো না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

কচু ঠিক হবে। কী বিশ্রী জায়গা। গরম আর ধুলা। আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

এই চিপার মাঝে বসে থাকলে দম তো বন্ধ হয়ে যাবেই। বের হয়ে আস।

বাচ্চাটা সন্দেহের চোখে নীতুর দিকে তাকাল, বলল, তুমি ভয় দেখাবে না তো?

না, না, ভয় কেন দেখাব?

খোদার কসম?”

খোদার কসম।

বাচ্চাটা তখন আলমারির নিচের তাক থেকে বের হয়ে এলো। এদিক-সেদিক তাকাল।

নীতু বাচ্চাটাকে ছুঁয়ে দেখবে কিনা একটু চিন্তা করল, তারপর সাবধানে একটু স্পর্শ করল। বাচ্চাটার শরীর একটুখানি ঠাণ্ডা এছাড়া মানুষের বাচ্চার সঙ্গে অন্য কোনো পার্থক্য নেই। নীতু তখন সাবধানে বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর তার হাত ধরে তাকে ঘরের মাঝখানে এনে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। চেয়ারের সামনে বসে সে বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকাল, কী মায়াকাড়া চেহারা, টলটলে চোখ, মাথায় এলোমেলো কুচকুচে কালো চুল। সে বাচ্চাটার হাত ধরে রেখে কোমল গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?

সোলায়মান।

নীতু সোলায়মানের হাত ধরে অন্য হাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, সোলায়মান, তোমার কোনো ভয় নেই। আমি তোমাকে তোমার আম্মুর কাছে পৌঁছে দেব।”

সত্যি?

সত্যি।

খোদার কসম?

খোদার কসম না বলা পর্যন্ত বাচ্চাটি কিছু বিশ্বাস করে না, তাই নীতু বলল, খোদার কসম।

এই প্রথমবার বাচ্চাটির মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে ফিক করে হেসে দিল, বাচ্চাটির হাসিটি কী সুন্দর!

.

ঠিক তখন পাশের ঘরে আম্মু বিছানা থেকে উঠেছেন। তার ঘুম খুব পাতলা অল্পতেই ঘুম ভেঙে যায়, তার মনে হলো পাশের ঘরে নীতুর গলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। এত রাতে নীতু একা একা কেন কথা বলছে দেখার জন্যে আম্মু উঠে এলেন। নীতুর ঘরে আলো জ্বলছে, আম্মু দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন।

দরজার শব্দ শুনে নীতু পিছন ফিরে তাকাল, আম্মুকে দেখে সে চমকে উঠল। আম্মু বিস্ফারিত চোখে একটা মুহূর্তে তাকালেন, হঠাৎ করে তার মুখের চেহারা পাল্টে গেল, একটা চাপা শব্দ করে পা থেকে স্যান্ডেল খুলে হিংস্র মুখে ভেতরে ছুটে এলেন, নীতু বুঝতে পারল না ভূতের বাচ্চা সোলায়মানকে দেখে আম্মুর মতো এত শান্ত একজন মানুষ এমনভাবে ক্ষেপে উঠলেন কেন। আম্মুর হাত থেকে সোলায়মানকে বাঁচানোর জন্যে নীতু তার ওপর রীতিমতো উপুড় হয়ে পড়ল।

আম্মু অবশ্য নীতু আর সোলায়মানকে পাশ কাটিয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেলেন তারপর হাতের স্যান্ডেল দিয়ে মেঝেতে আঘাত করলেন, নীতু অবাক হয়ে দেখল হলদে রংয়ের একটা পোকা আম্মুর স্যান্ডেলের আঘাতে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। আম্মু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের স্যান্ডেলটা নিচে ফেলে পায়ে পরলেন তারপর নীতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখেছিস? কত বড় বোলতা দেখেছিস? কামড় দিলে খবর হয়ে যেত।

নীতু অবাক হয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইল, আম্মু এত ছোট একটা বোলতাকে দেখে ফেলেছেন কিন্তু ভূতের বাচ্চা সোলায়মানকে দেখছেন না। আসলেই কী দেখছেন না? আম্মু চ্যাপ্টা হয়ে থাকা বোলতাটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘরের ভেতর ঢুকলো কেমন করে?

নীতু বলল, আম্মু তুমি বোলতাটাকে দেখে এত জোরে চিৎকার দিলে, আমি ভাবলাম বুঝি ভূত-টুত কিছু একটা দেখেছ?

ওইটাই বাকি আছে। রাত-বিরেতে ভূত দেখাতে হবে।

নীতু খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলল, আম্মু তুমি কী এই ঘরে আর কিছু দেখছ?

আর কী দেখব?

এই মনে করো অন্য কিছু।

অন্য কিছু কী?

ভূতের বাচ্চা হঠাৎ করে বলল, আমি তো ভূত আমাকে কেউ দেখতে পাবে না।

নীতু ভূতের বাচ্চার কথা শুনে চমকে উঠল কিন্তু অবাক হয়ে দেখল আম্মু তার কথা শুনতে পেলেন না। ভূতের বাচ্চা হাসি হাসি মুখে নীতুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কথাও শুনতে পাবে না।

নীতু দেখল সত্যি সত্যি আম্মু ভূতের বাচ্চা সোলায়মানকে দেখতেও পান না, তার কথাও শুনতে পান না। কী আশ্চর্য!

আম্মু হঠাৎ করে নীতুর দিকে ভালো করে তাকালেন তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু তুই এত রাতে জেগে এই চেয়ারের সামনে বসে আছিস কেন?

নীতু বলল, না, মানে ইয়ে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। তখন মানে ইয়ে মানে ভাবলাম উঠে একটু চেয়ারের সামনে বসি।

শুনলাম তুই নিজে নিজে কথা বলছিস? তোর হয়েছেটা কী?

কিছু হয়নি আম্মু।

তাহলে নিজে নিজে কথা বলছিস কেন?

নীতু হাত নেড়ে উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বলল, ও কিছু না আম্মু। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে একা একা লাগে, তখন জোরে জোরে নিজের সঙ্গে কথা বললে আর একা লাগে না!

আম্মু হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বললেন, এই রকম কথা আমি জন্মেও শুনিনি! নিজের সঙ্গে আবার কথা বলে কী রকম? এখন ঢং বন্ধ করে ঘুমা। রাত একটার সময় উঠে বসে নিজের সঙ্গে কথা বলতে হবে না।

নীতু বলল, ঘুমাচ্ছি আম্মু। ঘুমাচ্ছি।

আম্মু ঘর থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নীতু তার বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা বের করে দিয়ে ভূতের বাচ্চা সোলায়মানকে ফিসফিস করে বলল, আম্মু তোমাকে দেখতে পায়। নাই। তোমার কথাও শুনে নাই।

তোমাকে বলেছি না আমি ভূত, কেউ আমাকে দেখতে পাবে না। আমার কথাও শুনতে পাবে না।

নীতু ফিসফিস করে বলল, কিন্তু আমি তাহলে কেমন করে দেখছি?”

তোমরা আমাকে মন্ত্র পড়ে ডেকে এনেছ, সেইজন্যে তুমি দেখছ।

অন্যেরা দেখবে না।

নীতু বলল, কী আশ্চর্য!

ভূতের বাচ্চা সোলায়মান একটা হাই তুলে বলল, আমার ঘুম পেয়েছে।

নীতু বলল, এসো, ঘুমাবে। এসো।

কোথায় ঘুমাব?

আমার বিছানায়।

আর তুমি কোথায় ঘুমাবে?

আমি কোনো এক জায়গায় ঘুমিয়ে যাব।

নীতু বিছানাটা ঝেড়ে ভূতের বাচ্চা সোলায়মানকে শুইয়ে দিল। বাচ্চাটি উপুড় হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করল। কিছুক্ষণের মাঝেই বাচ্চাটি ঘুমিয়ে পড়ে।

নীতু ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে ভূতের বাচ্চা সোলায়মানের পাশে বসে থাকে। কী আশ্চর্য একটা ঘটনা, তার এখনো বিশ্বাস হয় না সত্যি সত্যি একটা ভূতের বাচ্চা তার বিছানায় শুয়ে আছে। বাচ্চাটি তার মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে এখানে আটকা পড়েছে, সে তাকে কথা দিয়েছে তাকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেবে। কেমন করে দেবে সে এখনো জানে না। কিন্তু একটা উপায় নিশ্চয়ই বের হয়ে যাবে। ভূতের বাচ্চাটির পাশে বসে থাকতে থাকতে এক সময় তার চোখে ঘুম নেমে আসে, সে তার পায়ের কাছে ছোট জায়গাটিতে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *