ঝন্টু ও সুমনের নাটকের পালা শেষ হওয়ার পর অন্ধকার জঙ্গলের ঝিঁঝি ডাকা নিরবতায় সবাই আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। কাছে, দূরে হাজার হাজার ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া কোথাও কোনও শব্দ নেই। রবি বললো, কাউকে যদি সারারাত একা এ পথ দিয়ে হাঁটতে হয় সে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে।
ঝন্টু বললো, আমাদের বাংলার ইদ্রিস স্যার শরশ্চন্দ্রের আঁধারের রূপ পড়াতে গিয়ে এটাই ব্যাখ্যা করতে বলেছিলেন।
এটা কোনটা? জানতে চাইলো সুমন।
শ্রীকান্ত পড়েছিস?
না পড়িনি।
তাহলে আর আঁধারের রূপ বুঝবি কিভাবে! স্কুলে থাকতে শ্রীকান্ত বাজি ধরে এক রাত শ্মশানে ছিলো। অন্ধকার রাতের এক অসাধারণ বর্ণনা আছে ওতে। এক জায়গায় আছে ঝিঁঝি পোকার শব্দ রাতের নিরবতাকে আরও বাড়াইয়া দিয়াছিল। এটাই ব্যাখ্যা করতে বলে, শব্দ কিভাবে নিরবতাকে বাড়িয়ে দেয়।
এখন বুঝেছি। জবাব দিলো সুমন।
শোয়েব বললো, তোমরা না স্কাউটিং কর?
হা করিই তো। জোর দিয়ে বললো ঝন্টু।
তাহলে কোরাসে গান ধরতে অসুবিধে কোথায়?
অসুবিধের কথা কেউ কি বলেছি?
সবাই মিলে তাহলে গান ধরো!
কোনটা গাইবো, গ্লোরি হালালুজা?
একটার পর একটা গাইতে থাকো না? যতক্ষণ স্টক আছে ততক্ষণ তো গাওয়া যায়। এই বলে শোয়েব ওর ভরাট গলায় গান ধরলো, এ্যাম উই গো মার্চিং অল।
ঝন্টু আর সুমনের সঙ্গে রবিও গলা মেলালো। স্কাউটিং না করলেও ওদের স্কুলের এসব গান শুনতে শুনতে ওরও মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো। কোরাসে গান গাইতে গিয়ে ঝন্টু টের পেলো শোয়েবের গলায় চমৎকার সুর আছে। গ্লোরি হালালুজার পর মাই ডার্লিং ক্লেমেন্টাইন গাওয়া শেষ করে ঝন্টু বললো, শোয়েব ভাই, তুমি লুকোতে পারবে না। তুমি নিশ্চয় গান গাও।
গান গাই, এটা লুকোচ্ছি কোথায়? হেসে জবাব দিলো শোয়েব, স্কুলে থাকতে টেলিভিশনের নতুন কুঁড়িতে একবার রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে ফার্স্ট হয়েছিলাম।
তাহলে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাও।
সারাদিনের উদ্বেগ আর বিপদের সম্ভাবনা ভুলে থাকার জন্য ঝন্টুদের গান গাইবার জন্য বলেছিলো শোয়েব। তবে একা গান গাইবার মুড ওর ছিলো না। বললো, আমার সঙ্গে তোমাদেরও গাইতে হবে।
জানা গান হলে গাইবো। ঝন্টু বললো, তুমি কোনটা গাইতে চাও?
সবাই মিলে এমন পরিস্থিতিতে গাওয়ার জন্য আগুন জ্বালো মন্দ হবে না।
দারুণ হবে। বলে ঝন্টু এক লাইন বাদ দিয়ে শুরু করলো, একলা রাতের অন্ধকারে, আমি চাই পথের আলো।
সবাই এক সঙ্গে কোরাস ধরলো–আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো/ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে।
এরপর ওরা গাইলো আমি ভয় করবো না আর বাঁধ ভেঙ্গে দাও।
রাজা আলী হাঁটছিলো সবার আগে। ওর হাতে টর্চ। বাংলা গানগুলো ওর কাছে অচেনা মনে না হলেও সুমনদের সঙ্গে কোরাস গাইবার মতো সাহস ওর ছিলো না। ও হিসেব করছিলো এক ঘন্টায় ওরা তিন মাইলের ওপর হেঁটেছে। ঘন জঙ্গল পেরিয়ে ওরা কিছুটা ফাঁকা জায়গায় এসেছে, তখনই রাজা আলী বললো, সামনে গ্যারাম দেখা যাইতেছে।
সম্ভবত দূর থেকে ওদের গান শুনে কুকুর ডাকছিলো। মানুষের চেয়ে কুকুরের শোনার ক্ষমতা অনেক বেশি। কুকুরের ডাক কানে আসতেই ওরা দেখলো দূরে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটা আলো দেখা যাচ্ছে। ওদের সবার মুখে হাসি ফুটলো।
হাইওয়ে থেকে সামান্য বায়ে নামতেই সামনে যে টিনের বাড়ি দেখা গেলো ওরা সেখানেই গিয়ে দাঁড়ালো। শোয়েব বললো, তোমরা নিশ্চয় চিটাগংয়ের আঞ্চলিক ভাষা জানো না। ওদের ভাষায় কথা বললে বেশি খাতির পাওয়া যাবে। এই বলে ও গলা তুলে ডাকলো, বাড়িতে কেউ আছেন?
দু বার ডাকতেই হারিকেন হাতে মাঝ বয়সী মুখে কালো দাড়িওয়ালা একজন বেরিয়ে এলো। দেখে মনে হয় গ্রামের অবস্থাপন্ন কৃষক জোতদারও হতে পারেন। হারিকেনের আলো ওদের মুখের কাছে ধরে বললো, তোমরা কারা?
দাড়ি দেখে প্রথমে শোয়েব লম্বা এক সালাম দিয়ে বললো, আমরা মুসাফির। শোয়েবের মুখে চট্টগ্রামের কথা শুনে কেউ বুঝতে পারবে না ওর বাড়ি যে এখানে নয়। ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেও ওর স্থানীয় বন্ধুরা বুদ্ধি দিয়েছিলো রাস্তা ঘাটে রিকশা স্কুটারে কিংবা দোকানপাটে গিয়ে যদি ঠকতে না চায় তাহলে যেন চট্টগ্রামের ভাষা শিখে নেয়।
আমরা কক্সবাজার যাচ্ছিলাম। শোয়েব কাতর গলায় বললো, পথে গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। রাতে থাকার জন্য আপনাদের গ্রামে কি কোথাও জায়গা পাওয়া যাবে? বাড়িতে না হলে মসজিদেও থাকতে পারি।
আমার এত বড় বাড়ি। আমি থাকতে তোমরা অন্য কোথাও কেন থাকবে? এই বলে গৃহকর্তা গলা তুলে ডাকলেন, মকবুইল্লা, ওরে মকবুইল্লা!
বিশালদেহী কামলা গোছের এক লোক অন্ধকার কুঁড়ে সামনে এসে জ্বী হুজুর, বলে হাত কচলাতে লাগলো।
গৃহকর্তা বললেন, শিগগির কাঁচারি ঘর খুলে দে। এরা ঢাকার মেহমান। মোরগ জবাই দে। এদের মুখ হাত ধোয়ার সাবান পানি দে।
শোয়েব বিব্রত হয়ে বললো, অসময়ে রান্না বান্নার ঝামেলা কেন করবেন? আমাদের একটু গুড় মুড়ি পেলেই চলবে।
তা কি করে হয়? অপ্রসন্ন গলায় গৃহকর্তা বললেন, আপনারা এক রাতের মেহমান। আপনাদের উপযুক্ত মেহমানদারি করতে পারবো না। তারপরও আল্লার রহমতে আমার বাড়িতে দুই বেলা পাঁচ সাত জন বাড়তি মানুষের জন্য রান্না হয়। আপনারা মুড়ি খেয়ে রাত কাটালে গ্রামে আমি মুখ দেখাবো কি করে?
চট্টগ্রামের গ্রাম এলাকার মানুষের অতিথিপরায়ণতার কথা শোয়েবের অজানা নয়। এ নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে ও বললো, আমাদের একজনের আজ কক্সবাজার যাওয়া দরকার। ওখান থেকে মেকানিক আনতে হবে। আমাদের গাড়ি রাস্তার ধারে অচল হয়ে পড়ে আছে।
কোনও চিন্তা করবেন না। আপনারা মুখ হাত ধুয়ে খাওয়া দাওয়া করুন। অতিথিব সল গৃহকর্তা বললেন, আমার বড় ছেলের হোণ্ডা আছে। ও আপনাদের একজনকে কক্সবাজার নিয়ে যাবে। বেশি হলে মিনিট পনেরো লাগবে যেতে।
গৃহকর্তার কথা শেষ হলে নিচু গলায় মকবুল বললো, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।
গৃহকর্তা নিজের হাতের হারিকেন মকবুলকে দিয়ে ভেতরে গেলেন। শোয়েবরা মকবুলকে অনুসরণ করে সামনের কাঁচারি ঘরে এলো। দরজায় তালা লাগানো ছিলো। কোমরে বাঁধা চাবির গোছা থেকে চাবি বের করে ও দরজা খুললো।
ঘরের অর্ধেক জুড়ে পাশাপাশি দুটো বড় তক্তপোষ পাতা। ওপরে পাটি বিছানো একপাশে হাতলওয়ালা দুটো চেয়ার আর কাঠের আলমারি। মকবুল দরজার পাশে হারিকেন রেখে বললো, আপনারা বসেন। আমি আপনাদের বিছানা এনে দিচ্ছি।
তক্তপোষের ওপর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো সুমন, ঝন্টু আর রবি। ঝন্টু বললো, তুমি যে এক অসম্ভব কাজ করে ফেললে শোয়েব ভাই। কোথায় রাস্তায় নয় গাড়িতে বসে খালি পেটে রাত কাটাতে হতো। আর এখানে একেবারে জমিদারী কায়দায় অতিথি আপ্যায়ন।
শোয়েব বললো, এমনিতে আমাদের দেশের গ্রামের মানুষ খুব অতিথিপরায়ণ হয়। তার ওপর গৃহকর্তা বেশ অবস্থাপন্ন মনে হচ্ছে। ছেলেকে হোণ্ডা কিনে দিয়েছে, কম কথা নয়।
সুমন বললো, তোমার নিজের বাহাদুরি স্বীকার করছে না শোয়েব ভাই। চিটাগং-এর ভাষায় কথা না বললে এত খাতির পেতে না।
শোয়েব কোনও কথা না বলে মৃদু হাসলো। দুজন লোকের মাথায় তোশোক বালিশ চাদর আর কম্বল চাপিয়ে মকবুল ঘরে ঢুকলো। ওর পেছনে একজন বাইরে উঠোনে বালতি ভরা পানি আর সাবান তোয়ালে এনে রেখে দাঁড়িয়ে রইলো।
সারাদিনে ধকল শোয়েবের ওপর দিয়েই বেশি গেছে। ভোর না হতে ও হাঁটা শুরু করেছিলো। গত রাতে ও রুমে ফেরেনি। লণ্ডুিতে এক জোড়া প্যান্ট শার্ট ছিলো। রকিবের উদ্ধার করা কাগজগুলো আগেই সরিয়ে রেখেছিলো ইকবাল স্যারের কোয়ার্টারে। ওর রুমে হামলা হওয়ার পর থেকে ও রোজ রাতেই এক রুম থেকে। আরেক রুমে, এক হল থেকে অন্য হলে রাত কাটাচ্ছিলো। কাল রাতেই ওরা খবর পেয়েছে শিবিরের গুণ্ডারা একটা বড় ধরনের হামলা করবে। শুধু ওর সংগঠনের নয়, ছাত্র ফ্রন্ট আর ছাত্রলীগের বন্ধুরাও ওকে সতর্ক করে দিয়েছিলো, এবারের হামলায় প্রধান টার্গেট হচ্ছে শোয়েব। ক্যাম্পাসে যদিও পর্যাপ্ত পুলিশ বসানো হয়েছে, ইকবাল স্যারও ওকে বলেছিলেন, দরকার মনে করলে ওঁদের কোয়ার্টারে গিয়ে থাকতে। শোয়েবের বন্ধুরা কোনওটাই নিরাপদ মনে করেনি। সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শোয়েব শেষ রাতে গ্রামের ভেতর দিয়ে হেঁটে হাইওয়েতে উঠেছে। বাসে ওঠার মতো টাকা ওর সঙ্গে থাকলেও বাস নিরাপদ মনে হয়নি। লোকাল বাসে জামাত শিবিরের লোকেরা চলাফেরা করে। কেউ চিনে ফেলতে পারে। সেজন্য ও গাড়িতে লিফট নেয়ার প্ল্যান করেছিলো। সুমনদের গাড়ির আগে ও কম করে হলেও দেড় ডজন গাড়িতে লিফট চেয়েছিলো। ওর বেশভূষা দেখে কেউ পছন্দ করেনি।
ওরা সবাই মুখ হাত ধুয়ে বিছানায় শুয়ে বসে আলোচনা করছিলো। মেকানিক পাওয়া গেলেও রাতে নিশ্চয় ওদের যেতে দেয়া হবে না। সকালে রাজা আলী ওদের কক্সবাজার সার্কিট হাউসে নামিয়ে চট্টগ্রাম ফিরে যাবে, যদি গাড়িটা রাতে সারানো যায়।
রাত নটা না বাজতেই মকবুল এসে ঘরের মাটির মেঝেতে মাদুর পেতে নকশি কাঁথার দস্তরখানা বিছিয়ে দিলো। একজন ওটার ওপর বড় বড় ফুল আঁকা চিনেমাটির প্লেট রেখে গ্লাসে পানি ঢেলে সামনে রাখলো। দুজন লোক বড় ট্রেতে ভাত, ডাল, আলু ভাজি, ডিমের ঝোল আর মুরগির রেজালা আনলো। ওদের পেছন পেছন গৃহকর্তা আর তার ছেলে ঘরে ঢুকলো। সুমনদের চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে, প্যান্ট শার্ট পরে তৈরি হয়ে এসেছে। ফর্শা গায়ের রঙ, এখনও শেভ করা শুরু করেনি, গালে পাতলা দাড়ির আস্তরণ, আরেকটু বড় হলে চে গুয়েভারার মতো লাগতো।
গৃহকর্তা বললেন, কই বাবারা, আপনারা আরম্ভ করেন। এ হচ্ছে আমার ছেলে সৈয়দ ফজলুল করিম, কক্সবাজার কলেজে পড়ে। এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে। খাওয়া সেরে উঠুন। ওর সঙ্গে আপনারা একজন কক্সবাজার যেতে পারেন।
ওদের সবারই ক্ষিদে পেয়েছিলো। বিশেষ করে শোয়েবের সারা দিনে দুটো কলা আর কমলা ছাড়া খাওয়ার মতো কিছু জোটেনি। ওরা মাদুরে বসতেই মকবুল ওদের প্লেটে ভাত তুলে দিলো। সুমন বললো, আমাদের তুলে দিতে হবে না। আমরা নিজেরা নিয়ে খাবো।
গৃহকর্তা তার ছেলেকে নিয়ে চেয়ারে বসে ওদের খাওয়া দেখছিলেন। হেসে বললেন, শহরের ছেলেরা তুলে খাওয়ানো পছন্দ করে না। ঠিক আছে বাবারা, আপনারা নিজেরা তুলে খান। পেট ভরে খাবেন, কোনও লজ্জা করবেন না।
সুমন বললো, আমাদের আপনি করে বলছেন, এতে কিন্তু আমরা লজ্জা পাচ্ছি। আমরা আপনার ছেলের বয়সী, আমাদের তুমি বলবেন।
হা হা করে গলা খুলে হাসলেন গৃহকর্তা–কথা শুনে মনে হচ্ছে শরিফ খানদানের ছেলে। তোমরা কিন্তু নিজেদের নাম বলোনি।
সুমনই সবার নাম বললো। এরপর গৃহকর্তা কে কী, কার বাবা কী করেন, এসব জানতে চাইলেন। রাজা আলীর বাবা নেই। সুমন, ঝন্টু আর রবি বললো ওদের বাবারা কী করেন। শোয়েব জানালো ওর বাবা ব্যবসা করেন। আর পড়ার কথা গোপন করে বললো, ঢাকার এক ওষুধ কোম্পানির জুনিয়র এক্সিকিউটিভ।
কথার ফাঁকে ফাঁকে গৃহকর্তা মকবুলকে বলছিলেন, ওরা কিন্তু কিছুই খাচ্ছে না। মুরগির রানটা শোয়েবের পাতে তুলে দে। রাজার প্লেটে ভাত দে। সুমন ডিমের তরকারি নেয়নি।
গৃহকর্তা নিজের কথাও বললেন। কক্সবাজারে দুটো চিংড়ির ঘের আছে। ধানি জমি আছে সত্তর কানি। এতেই আল্লার রহমতে তাঁর দিন কোনও মতে চলে যায়। দিন যে কিভাবে যায় সুমনরা তাঁর অতিথি আপ্যায়নের ঘটা দেখেই বুঝতে পারছিলো। অচেনা লোকজনদের যে খাতির করছেন চেনাদের ভাগ্যে নিশ্চয় এর চেয়ে বেশি জোটে!
তখনও ওদের খাওয়া হয়নি,এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে এক লোক এসে গৃহকর্তাকে বললো, সওদাগর বাড়ির মেজ মিয়া এসেছেন। আপনাকে ভেতরে যেতে বলেছেন।
লোকটার কথা শুনে গৃহকর্তা ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বাবারা, তোমরা আরাম করে খাও, বলে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার ছেলে ফজলুল করিম তাঁঁকে অনুসরণ করলো।
সওদাগর বাড়ির মেজ মিয়া কি এ বাড়ির কুটুম্ব হয়? মকবুলকে প্রশ্ন করলো শোয়েব।
দূর সম্পর্কের কুটুম্বিতা একটা আছে। তবে মেজ মিয়া আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।
এত রাতে চেয়ারম্যান সাহেব কী করতে এলেন?
সামনে তো চেয়ারম্যান ইলেকশন। ওই বিষয়ে হয়তো কথা বলতে এসেছেন।
খাওয়া শেষ করে মস্ত এক ঢেকুর তুলে শোয়েব বললো, তোমাদের বাড়িতে কি কেউ জাদু জানে মকবুল মিয়া?
কামলা মকবুলকে মিয়া বলাতে ও খুব খুশি হলো। জাদুর কথা শুনে অবাকও হলো–জাদুর কী দেখলেন?
এক ঘণ্টার ভেতর এত সব ভালো ভালো রান্না কে করলো?
আমাদের হুজুরের তিন বিবি। চাকর চাকরাণি আছে ছয় সাত জন। এইটুকু রান্না করতে আর কী লাগে?
মুরগি রান্না ভারি চমৎকার হয়েছে।
মুরগির সালুন বেঁধেছেন করিম মিয়ার মা, হুজুরের বড় বিবি সাহেব। তিনি খুব উঁচু খানদানের মেয়ে।
তোমাদের চেয়ারম্যান সাহেব কোন পার্টি করেন?
মকবুলের জবাব দেয়ার আগেই গৃহকর্তা এসে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর ছেলে করিম মাথায় হেলমেট পরে তৈরি হয়ে এসেছে। তিনি শোয়েবকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের খাওয়া ঠিক মতো হয়েছে তো? আমাদের কুটুম্ব এসেছিলেন বলে উঠে যেতে হলো।
শোয়েব উচ্ছ্বসিত গলায় বললো, অসময়ে কোথাও এত ভালো খাবার আর থাকার জায়গা পাবো আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি চাচা।
গরিবের ঘরে যা ছিলো তাই দিয়ে মেহমানদারি করতে হলো, দিনে যদি আসতে পুকুর থেকে মাছ ধরতাম। ঢাকার মেহমানদের খাতির করার সুযোগ কি আর সব সময় পাওয়া যায়!
করিম দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলো। কক্সবাজার যাওয়ার জন্য ও অনেকক্ষণ ধরে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে। বললো, আব্বা, আমাদের এখন যাওয়া দরকার।
গৃহকর্তা ব্যস্ত হয়ে বললেন, হ্যাঁ বাবা শোয়েব, ফজলুল করিমের সঙ্গে তোমরা কে যাবে?
রাজা আলী এগিয়ে এসে বললো, আমি যাবো।
চলুন যাই। এই বলে রাজা আলীকে নিয়ে করিম বেরিয়ে গেলো।
ওর স্কুটারের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পর গৃহকর্তা বললেন, তোমাদের ওপর অনেক ধকল গেছে। শুয়ে পড়ো। এই রাতে রাজা আলী যদি মিস্ত্রি জোগাড় করতে পারেও ওর ফিরতে ফিরতে রাত হবে।
শোয়েব হাই তুলে বললো, হ্যাঁ শোয়া দরকার।
আমি যাই তাহলে? দরজা ভেজিয়ে রাখলেই হবে, বন্ধ করার দরকার নেই। বাইরের বারান্দায় আমাদের দুজন কামলা শশাবে। ভয়ের কিছু নেই। আমাদের এলাকায় চুরি ডাকাতি হয় না বললেই চলে।
গৃহকর্তা বেরিয়ে যাওয়ার পর শোয়েব দরজাটা ভেজিয়ে দিলো। সুমন, ঝন্টু আর রবি বাইরে গেলো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য। শোয়েব চিন্তিত ছিলো গাড়ির নিরাপত্তা নিয়ে। গৃহকর্তাকে জিজ্ঞেস করা হলো না তিনি লোক পাঠিয়েছেন কিনা। পাঠালেও লাভ নেই। ওরা রাতে এলে দল, বেঁধে আসবে। বাড়ির লোকেরা ওদের ঠেকাতে পারবে না।
বাইরে আকাশে তখন কৃষ্ণপক্ষের আধখানা চাঁদ ঝুলছে। মরা জ্যোৎস্নায় ঘরবাড়ি গাছপালা সব কালো অন্ধকারের চাদর গায়ে জড়িয়ে আছে। ঝন্টু বললো, কী অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ। ঢাকায় কখনও এমন জোসনা দেখা যাবে না।
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য রবি সামান্য আড়াল খুঁজছিলো। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে অন্ধকার কুঁড়ে একটা লোক বেরিয়ে এলো। কাছে আসার পর ওরা মকবুলকে চিনতে পারলো। সুমন আর ঝন্টুকে বাইরে ঘুরতে দেখে মকবুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনারা বাইরে কী করছেন?
ঝন্টু বললো, পেশাব করতে বেরিয়েছিলাম। ভারি সুন্দর পরিবেশ। ভাবলাম একটু ঘুরি।
মকবুল গম্ভীর হয়ে বললো, গোরস্তানের পাশে পেশাব করা ঠিক না। হুজুরের দাদাজী ছিলেন জিন্দা পীর। এই গোরস্থানে ওঁর কবর আছে। নাপাক কাজ তিনি পছন্দ করেন না।
সামনে বেতের ঝোপে ঘেরা জায়গাটা যে গোরস্থান ওরা বুঝতে পারেনি। রবি ওদিকেই গেছে পেশাব করতে? মকবুল টের পেলে যদি হইচই–করে সুমন উল্টোদিকে হাঁটতে হাঁটতে ওকে জিজ্ঞেস করলো মকবুল ভাই, আপনাদের বাড়িতে যে চেয়ারম্যান সাহেব এসেছিলেন তিনি চলে গেছেন?
গৃহকর্তা মকবুলকে বলে দিয়েছিলেন, মেহমানরা যেন রাতে বাইরে না বেরোয়। সেজন্য মিন্নাতালি আর মকবুলকে বলেছেন কাঁচারি ঘরের বারান্দায় শুতে। ঢাকা শহর থেকে আসা সাহেবদের সুন্দর ফুটফুটে চেহারার ছেলেটা ওকে আপনি বলে ভাই ডেকেছে–এতেই মকবুল গলে গেলো। গৃহকর্তা ওকে কী বলেছিলেন কিছুক্ষণের জন্য ও ভুলে গেলো। বিগলিত হেসে সুমনকে বললো, এই তো কিছুক্ষণ আগে চেয়ারম্যান সাহেব চলে গেছেন।
শোয়েব যে কথাটা মকবুলের কাছ থেকে জানতে চেয়ে উত্তর পায়নি সুমন সেটা ওর কাছে আবার জানতে চাইলো আপনাদের চেয়ারম্যান সাহেব কি কোনও পার্টি করেন মকবুল ভাই?
মাথা নেড়ে সায় জানালো মকবুল চেয়ারম্যান, মেম্বার হতে গেলে একটা না একটা পার্টি তো করতেই হয়।
কোন পার্টি করেন তিনি?
জামাতে ইসলামী।
মকবুলের ছোট্ট উত্তর শুনে সুমন আর ঝন্টুর বুকের ভেতরটা গুড় গুড় করে উঠলো। ঝন্টু খুব সাবধানে জিজ্ঞেস করলো, ফজলুল করিম ভাইর আব্বাও কি জামাতে ইসলামী করেন?
এ বাড়ির সবাই জামাতে ইসলামী করেন।
আপনিও করেন?
আমরা হলাম চাকর নফর। দল করা কি আমাদের মানায়?
ততক্ষণে রবি এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ঝন্টু বললো, এখানে পেশাব কোথায় করা যায় মকবুল ভাই?
পাশের পুকুরের দিকে আঙুল তুলে মকবুল বললো, ওই দিকে গিয়ে করে আসেন।
ঝন্টু আর সুমন পুকুরের দিকে গেলো জলবিয়োগ করতে। ওদের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে মকবুলের মনে হলো গৃহকর্তা ওকে কী বলেছিলেন। সুমন আর ঝন্টু জলবিয়োগ সেরে ফিরতেই মকবুল বললো, আপনারা ঘরে না ঢুকলে আমরা তো শুতে পারবো না।
ততক্ষণে রবিও এসে গেছে। ওরা তিনজন কথা না বাড়িয়ে সোজা কাঁচারি ঘরে গিয়ে প্রথমে দরজা বন্ধ করলো। শীত লাগবে বলে ঘরের জানালা আগে থেকেই বন্ধ ছিলো। ওদের চেহারায় চাপা উত্তেজনা আর সতর্ক চলাফেরা দেখে শোয়েব অবাক হয়ে প্রশ্ন করতে যাবে–আঙুলের ইশারায় সুমন ওকে কথা বলতে বারণ করলো।
পা টিপে ওরা সবাই বিছানায় উঠে গোল হয়ে বসলো। ঝন্টু ফিশ ফিশ করে শোয়েবকে বললো, মকবুলের কাছে শুনলাম এটা জামাতীদের বাড়ি। বাড়ির সবাই নাকি জামাত করে। ওদের হাত থেকে বাঁচার জন্য শোয়েব ভাই তুমি ওদেরই গুহায় আশ্রয় নিয়েছে।
শোয়েব ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। বারান্দার দিকে ইশারা করে তাকিয়ে বললো, আজ রাতেই পালাতে হবে।
দরজার সামনে ওরা দুজন শুয়ে থাকবে। বললো সুমন।
দরকার হলে সিঁদ কেটে পালাবো।
রাজা আলীকে পাবো কোথায়?
আগে কক্সবাজারে যাবো। রাজা আলীকে না পেলে তুমি তো ডিসিকে বলবে। সুমনকে আশ্বস্ত করলো শোয়েব।