৪. নদীটা এখানে বেশ সরু

নদীটা এখানে বেশ সরু হয়ে যাওয়ায় জল শুধু গভীর হয়নি, স্রোতও যথেষ্ট বেড়ে গেছে। সেই তীব্র স্রোত বিশাল হুইল ঘুরিয়ে যে-বিদ্যুৎ তৈরি করে, তাতে কারখানার মেশিন ঘোরে, বিদ্যুতের আলো পাওয়া যায় চা-কারখানায়। নদীর ওপর লোহার সাঁকো, সাঁকোর ওপর দিয়ে পিচের যে-রাস্তা করা হয়েছে, তাতে দিব্যি গাড়ি চলাচল করতে পারে। ডাক্তারবাবু সাঁকো পেরিয়ে বড়সাহেবের অফিসে পৌঁছে দেখলেন, বড়সাহেবের বেয়ারা ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছে। ডাক্তারবাবুকে দেখে সেলাম করে দরজা খুলে দিল।

ভেতরে পা দিতেই বড় মেজ ছোটসাহেবকে চেয়ারে আর ভারতীয় বড়বাবুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন ডাক্তারবাবু। তিনি বললেন, “গুড ইভনিং স্যার, আপনি আমাকে ডেকেছেন?”

“গুড ইভনিং ডক্টর। প্লিজ় সিট ডাউন,” বড়সাহেব বললেন।

একটু স্বস্তি পেলেন ডাক্তারবাবু। আক্রমণ করার থাকলে প্রথমে এত মিষ্টি করে কথা বলেন না বড়সাহেব। তিনি উলটোদিকের চেয়ারে বসলেন। বড়সাহেব বললেন, “প্রথমে আমি ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু ক্রমশ ওদের কাজকর্ম দেখে উদ্বিগ্ন না-হয়ে উপায় নেই। তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ, আজ একজন উগ্রপন্থী পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে মারা গিয়েছে। আর ঘটনাটা ঘটেছে চা-বাগানের পাশের বাজার এলাকায়। এত কাছে যে, উদ্বিগ্ন না-হয়ে উপায় নেই। তুমি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হচ্ছ?”

“হ্যাঁ, ব্যাপারটা সত্যি দুশ্চিন্তা করার মতো?” ডাক্তারবাবু বললেন।

দ্বিতীয় ম্যানেজার বললেন, “পুলিশের গুলিতে কোনও কোনও বিদ্রোহী উন্ডেড হয়েছে বলে খবর পাচ্ছি, তারা কি চিকিৎসার জন্যে আপনার হাসপাতালে এসেছে?”

মাথা নাড়লেন ডাক্তারবাবু, “আমার জানা নেই।”

তৃতীয় ম্যানেজার বললেন, “দায়িত্ব এড়িয়ে যাবেন না। চা-বাগান এলাকায় যারা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে, তাদের কোনওরকম প্রশ্রয় আমরা দেব না। ওদের মেরে ফেললেও, আমাদের বিরুদ্ধে গভর্নমেন্ট কোনও ব্যবস্থা নেবে না। তাই কোনওরকম মার্সি দেখাবেন না।”

বড় ম্যানেজার হাত তুললেন, “শান্ত হও চার্লস। ডক্টর কয়েক বছর আমাদের কোম্পানিতে আছেন। কোম্পানি ওঁর ওপর খুব নির্ভর করে। ওয়েল ডক্টর, ব্রিটিশ সরকার ইচ্ছে করলে বিদ্রোহীদের দেখামাত্র গুলি করে মেরে ফেলে এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু আমি ওই পথে যেতে চাইছি না। আমার মাথায় একটা অন্য রকম পরিকল্পনা এসেছে। সেই ব্যাপারেই আলোচনা করব,” সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন বড়সাহেব। একটু ভেবে বললেন, “ডুয়ার্স এবং অসমের চা-বাগানের কাজের জন্যে এদেশে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছিল না একথা আপনারা তো জানেন।”

দ্বিতীয় ম্যানেজার বললেন, “হ্যাঁ’ লোকাল আদিবাসীরা চা-গাছের চাষ করতে চায়নি, তা জানি।”

তৃতীয় ম্যানেজার অবাক হলেন, “কেন? ওরা তো মাইনে পেত!”

বড় ম্যানেজার বললেন, “চার্লস, কোনও কোনও মানুষ পেটের চেয়ে ধর্মকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়। লোকাল আদিবাসীরা মনে করেছিল, যে-গাছের ফল-ফুল-পাতা বা শেকড় খাওয়া যায় না, সেই গাছের চাষ করলে ওদের ভগবান রেগে যাবে। ওদের কিছুতেই চা গাছের বাগানে কাজ করানো যায়নি। কোনও অনিচ্ছুক ঘোড়ার পিঠে বসে তুমি রেস জিততে পারো না।”

তৃতীয় ম্যানেজার বললেন, “মাই গড। কী বোকা ওই লোকগুলো?”

বড়সাহেব বললেন, “ওয়েল, তখন এজেন্টরা এসে প্রমিস করল তারা চা-বাগানে কাজ করার জন্যে শ্রমিক এনে দেবে পাশের প্রভিন্স বিহার থেকে। মাথাপিছু টাকা নিয়ে জল আর খাবারের সঙ্গে ঘরের লোভ দেখিয়ে ওরা আমাদের চা-বাগানগুলোতে কাজের জন্যে শ্রমিক এনে দিত।”

“থ্যাঙ্ক গড,” তৃতীয় ম্যানেজার বললেন।

দ্বিতীয় ম্যানেজার হাসলেন, “এটা আমি শুনেছি। ওই লোকদের এখানে এনে চার্চের ফাদারকে অনুরোধ করা হয়েছিল ব্যাপটাইজ করে দিতে। তাই করা হলে লোকগুলো রাতারাতি খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিল এবং একটা খ্রিস্টান নামও ফাদারের কাছ থেকে পেয়েছিল। তাই তো?”

“কারেক্ট,” বড়সাহেব মাথা নাড়লেন, “এই লোকগুলোর পূর্বপুরুষ যদি তাদের বিহারের গ্রামে থেকে যেত, তা হলে এরা বোধহয় জন্মাত না।”

তৃতীয় ম্যানেজার অবাক হল, “কেন?”

“খাবার না-পেয়ে এদের পুর্বপুরুষ কতদিন বেঁচে থাকত? জল নেই, খাবার নেই, বন্যপ্রাণী শেষ করে ফেলেছে ধরে খেয়ে, ভয়ংকর অবস্থা থেকে চলে এসেছিল এরা। খুব কম সংখ্যায় লোক থেকে গিয়েছিল। কীভাবে ছিল, আদৌ তারা আছে কি না, তা আমি জানি না। এখানে আসার পর কেউ ফিরে গিয়েছে বলে আমি শুনিনি।”

দ্বিতীয় ম্যানেজার জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কী চাইছেন?”

আবার কিছুক্ষণ ধোঁয়া ছাড়লেন বড়সাহেব চোখ বন্ধ করে। তারপর চোখ খুলে বললেন, “আমি নিশ্চিত, যদি ওখানে ওদের কেউ বেঁচে থাকে, তা হলে খুব দুর্দশার মধ্যে আছে। আপনি কী বলেন ডাক্তার?”

হঠাৎ নিজের নাম শুনে ডাক্তারবাবু হকচকিয়ে গেলেন। বললেন, “আমার কাছে কোনও খবর নেই। এখানে তো খবরের কাগজ নিয়মিত পাই না। রেডিয়োর ওপর নির্ভর করতে হয়। মুশকিল হল, রেডিয়োতে সব খবর বলে না। তাই জানবার কোনও উপায় নেই।”

“ঠিক কথা,” বড়সাহেব মাথা নাড়লেন, “যদি চা-বাগানের কাজে ওদের ডুয়ার্স এবং অসমে না-নিয়ে আসা হত, তা হলে নিজের দেশে কীরকম থাকত, আপনারা কোনও ধারণা করতে পারেন?”

ছোট ম্যানেজার হাসলেন, “বেশির ভাগ মানুষ না খেয়ে হয়তো মরেই গেছে।”

মেজ ম্যানেজার বললেন, “তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কী করে?”

বড় ম্যানেজার বললেন, “ঠিক কথা। প্রথমে যাদের চা-বাগানের কাজের জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল, তাদের কেউই বোধহয় আর জীবিত নেই। আর ওখানে কী ঘটছে, যারা থেকে গিয়েছিল, তাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ এদের হয়নি। তার প্রধান কারণ, যারা থেকে গিয়েছিল, তারা তো বটেই, যারা এসেছিল, তাদের কারও অক্ষরজ্ঞান না-থাকায় চিঠি লিখে খোঁজখবর নিতে পারেনি।”

ডাক্তারবাবু কথা বললেন। বিষয়টা তাঁকে বেশ অবাক করছিল। বললেন, “আমি বুঝতে পারছি না, আপনি ওদের নিয়ে ঠিক কী ভাবছেন!”

“খুব সহজ ব্যাপার। আমি আমাদের শ্রমিকদের বোঝাতে চাই, যদি তাদের এখানে নিয়ে আসা না হত, তা হলে তারা এখন কী দুর্দশার মধ্যে ওখানে থাকত। আমরা এখানে এনেছি বলে ওদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত,” বড়সাহেব গম্ভীর গলায় কথাগুলো বললেন।

মেজসাহেব আঁতকে উঠলেন, “মাই গড। আমাদের চা-বাগানের সমস্ত শ্রমিকদের অত দূরে নিয়ে যাওয়া কি সম্ভব?”

বড়সাহেব হাসলেন, “মাথার ব্যবহার করতে তুমি দেখছি ভুলে গেছ। এত লোক কেন নিয়ে যাওয়া হবে, চার-পাঁচজনের একটা দল, যাদের লিডার ছাড়া সবাই ওই অঞ্চলের মানুষের বংশধর, শুধু তাদেরই পাঠানো হবে। এই শ্রমিকরা সব দেখেশুনে ফিরে আসার সময় দু’জন পুরুষ এবং নারীকে সঙ্গে নিয়ে আসবে, যারা এখনও ওখানে বেঁচে আছে। এই লোকগুলোর মুখে আমাদের শ্রমিকরা শুনবে, কী ভয়ংকর কষ্টের মধ্যে ওরা বেঁচে আছে। যদি আমরা ওদের না-নিয়ে আসতাম, তা হলে একই দুর্দশায় পড়ত ওরা।”

ছোটসাহেব বললেন, “বাঃ, ভাল হবে। কিন্তু যাদের নিয়ে আসা হবে, তাদের কি আবার ফেরত পাঠাবেন?”

বড়সাহেব বললেন, “আমার বিশ্বাস ওদের কেউ ফিরে যেতে চাইবে না এখানকার আরাম ছেড়ে।”

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা করার পেছনে আপনার উদ্দেশ্য হল, শ্রমিকদের বোঝানো দেশে থাকলে তারা কী দুর্দশায় থাকত। তাই তো?”

“ঠিক,” বড়সাহেব মাথা নাড়লেন।

মেজসাহেব বললেন, “ওদের দেখিয়ে কোম্পানি কী লাভ করবে?”

বড়সাহেব সিগারেট নেভালেন, “ঘোষণা করে দেওয়া হবে যারা বিদ্রোহী লোকগুলোকে সাহায্য করবে, তাদের ধরে পূর্বপুরুষদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। বাকি জীবনটা ওদের ভয়ংকর কষ্টের মধ্যে কাটাতে হবে। যারা সাহায্য করবে না, তাদের শিশুদের পড়াশোনা শেখানো হবে। হয়তো ভবিষ্যতে তাদের বাবুর চাকরিতে নেওয়া হবে,” বড় ম্যানেজার সাহেব বললেন, “মানুষ প্রথমে পেটের কথা ভাবে। তারপর নিরাপত্তা চায়। দেশভক্তি খিদের চাপে উড়ে যেতে বাধ্য।”

ছোটসাহেব বললেন, “বাঃ, চমৎকার আইডিয়া।”

মেজসাহেব বললেন, “কিন্তু এটা বেশি দেরিতে করা চলবে না, না-হলে যারা বিপ্লব করতে চাইছে, তাদের দল আরও ভারী হয়ে যাবে।”

বড়সাহেব বললেন, “একদম ঠিক কথা। আমি আপনাদের এখানে ডেকেছি একটা টিম তৈরি করার জন্যে, যারা ওদের ফেলে আসা গ্রামগুলোতে যাবে।”

ছোটসাহেব হাসলেন, “ব্যাপারটার মধ্যে অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ আছে। আপনি যদি বলেন, তা হলে আমার যেতে আপত্তি নেই। আমি লিড করতে পারি।”

“বাঃ! অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের এই দলে না-যাওয়াই ভাল। গায়ের চামড়া বলবে আমরা বিদেশি। মনে রাখবেন স্বাধীনতা আন্দোলন খুব ছোঁয়াচে রোগের মতো। ওখানেও যে ওই আন্দোলনের আঁচ পৌঁছয়নি, তা আমি বলতে পারি না। তাই কোনও ঝুঁকি না-নিয়েই এই দলে সাদা চামড়ার কাউকে না-রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বড়সাহেব ডাক্তারবাবুর দিকে তাকালেন, “আমার মনে হয় এই দলের নেতা হিসেবে ডক্টরের যাওয়া উচিত।”

ডাক্তারবাবু চমকে উঠলেন, “আমি!”

“হ্যাঁ। আপনি ওদের আস্থাভাজন মানুষ, ওদের ভাষা ভাল বলতে পারেন। আপনার কাছে ওরা মনের কথা সহজে বলতে পারবে। আপনি ছাড়া দু’জন পুরুষ এবং দু’জন মহিলা শ্রমিককে দলে রাখতে চাই, যাদের চেহারা দেখলেই মনে হবে ভালভাবে খেয়েদেয়ে আছে। এদের আপনি বেছে নিন। আপনার হাসপাতালের নার্সদের কাউকে ইচ্ছে হলে নিতে পারেন।”

এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল যে, আপত্তি করার সুযোগ পেলেন না ডাক্তারবাবু। তিনি যখন ইতস্তত করছেন, তখন বড়সাহেব বললেন, “এবার আপনি বলুন বড়বাবু, আমাদের এই টিম কীভাবে ওখানে যাবে?”

বড়বাবুর বয়স হয়েছে। অবসর নেবেন এক বছর পরে। প্রতিটি বাক্যে দু’বার স্যার বলেন। তিনি মুখ খোলার আগেই ছোটসাহেব বললেন, “আপনি যখন ইংরেজি লেখেন, তখন একটাও ভুল পাওয়া যায় না। কিন্তু মুখ খুলেই তো-তো করে ভুল ইংরেজি বলেন! আপনি ধীরে ধীরে কথা বলুন।”

বড়বাবু পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে চোখে চশমা এঁটে পড়তে লাগলেন, “স্যার, এই চা-বাগান থেকে গাড়ি করে ওদের শিলিগুড়ি স্টেশনে যেতে হবে। সেখান থেকে ট্রেনে করে বারসই হয়ে বিহারের ট্রেন ধরে মহুয়ামিলন স্টেশনে নামতে হবে। মহুয়ামিলনে ছোট-বড় হোটেল আছে। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে একশো মাইলের মধ্যে আদিবাসীদের বিভিন্ন গ্রামে পৌঁছে যাওয়া যাবে।”

“গুড। আপনি ডক্টরের সঙ্গে বসে এই ট্যুরের জন্যে কত খরচ হবে, তার হিসেব করে তার টেন পার্সেন্ট বাড়িয়ে দেবেন। ডক্টর, আমি চাইছি আপনি কালকের মধ্যে টিম তৈরি করে নিয়ে পরশু রওনা হয়ে যান,” বড়ম্যানেজার কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালেন। যেন আর কিছু বলার বা শোনার নেই।

রাতে কোয়ার্টার্সে ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন ডাক্তারবাবু। বেশ কিছুদিন ধরে ডাক্তারবাবুর স্ত্রী বলছিলেন, চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করতে। জলপাইগুড়িতে ডাক্তারবাবুর পৈতৃক বাড়ি আছে। পড়াশোনাও সেখানেই করেছেন। ফলে পরিচিতি যে একদম নেই, তা নয়। অতএব জলপাইগুড়ি শহরে থেকে ডাক্তারি করে বেঁচে থাকা খুব সমস্যার হবে না।

ডাক্তারবাবুকে তাঁর স্ত্রী আবার ওই কথা মনে করিয়ে দিলে তিনি বললেন, “এটা তো আমি সহজেই পারি। কিন্তু চা-বাগানের এই কর্মীরা এবং তাদের পরিবারের লোকজন কী অসহায়, তা তো তুমি দেখছ। এদের ছেড়ে চলে যাব?”

“থেকেই-বা তুমি কী করতে পারছ? বলো!”

“প্রকাশ্যে কিছুই পারছি না কিন্তু…”

“তুমি গোপনে ওদের সাহায্য করছ, একথা প্রকাশ পেলে কী হবে তা ভাবতে পারছ?”

“জানি। কিন্তু আমার একটা ব্যাপারে এখন কৌতূহল হচ্ছে। এই যে ম্যানেজার আমাদের যে-উদ্দেশ্যে পাঠাতে চাইছেন, তার পাশাপাশি আমি এইসব মানুষের আত্মীয়রা, যারা ওখানে থেকে গিয়েছে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। না-গেলে আমি সেই সুযোগ পাব না।”

“তুমি ম্যানেজারের অর্ডার মেনে নেবে?”

“এই অর্ডার মেনে নিলে যদি আমার অনকেদিনের কৌতূহলের নিরসন হয়, তা হলে তা মেনে নিতে আমার আপত্তি নেই,” ডাক্তারবাবু হাসলেন।

চা-বাগানের বড়বাবু হাসপাতালে এলেন পরের দিন সকালে। বললেন “গুড মর্নিং ডাক্তারবাবু! আসতে পারি?”

“নিশ্চয়ই। বসুন।”

উলটোদিকের চেয়ারে বসে একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন বড়বাবু, “এই নিন। এই কাগজে সমস্ত ইনফরমেশন ডিটেলস লিখে দিয়েছি। কিন্তু আমি চেষ্টা করেও মহুয়ামিলনের কোনও হোটেলের নাম পাইনি। আপনাদের যেতে এবং আসতে প্রায় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচদিন সময় লাগবে। বড়সাহেব চাইছেন ওখানে অন্তত পাঁচদিন থেকে সব তথ্য সংগ্রহ করে আনুন।”

“এই যে প্রায় এগারোদিন ধরে পাঁচজন মানুষ যাবে, থাকবে, ঘুরবে এবং ফেরার সময় আরও দু’জন সংখ্যায় বাড়বে, তাদের যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়ার খরচ কত পড়বে, তার হিসেব করেছেন?” ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

“ডাক্তারবাবু, গতকাল সন্ধ্যায় অর্ডার পেয়েছি। এত অল্প সময়ের মধ্যে সবটা করে উঠতে পারিনি। আপনাকে বিকেলের আগেই দিয়ে দেব,” বড়বাবু মাথা নাড়লেন, “আপনি যাদের সঙ্গে নিয়ে যাবেন তাদের ঠিক করেছেন?”

ডাক্তারবাবু বললেন, “আপনি ঠিক করে দিন না!”

“তা দিতে পারি। কিন্তু ছেলেগুলো কি কমবয়সি হলে ভাল হবে! ওরা তো দেশের কথা শুনেছে বলে মনে হয় না!”

“কমবয়সি নয়। একজন প্রৌঢ়, একটু শক্তসমর্থ বৃদ্ধ হলে ভাল হয়। বাকিরা বিভিন্ন বয়সের। আর হ্যাঁ, সবাই ছেলে না-হয়ে একজন মেয়ে দলে থাকলে সুবিধে হবে। ওখানকার মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারবে,” বলতে বলতে মাথা নাড়লেন ডাক্তারবাবু।

“কিন্তু একজন মেয়ে দূরদেশে ছেলেদের সঙ্গে যেতে কি রাজি হবে? অল্পবয়সি হলে তার বাবা বা স্বামী ছাড়বে না। বেশি বয়সিদের নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না, সমস্যা হবে। দু’জন মেয়ে হলে তবু…”

“তা হলে দু’জনেই যাক। দু’জন ছেলে আর দু’জন মেয়ে। এক কাজ করুন, আমাদের হাসপাতালে এতোয়ারি নামে যে-মেয়েটি কাজ করে, তার স্বামী সঙ্গে থাকে না। ওকে নিতে পারেন। আর ওর সঙ্গে আর-একজনকে বেছে নিন। দেরি না-করে এখনই ঠিক করবেন, সঙ্গে ছেলেদুটোকেও,” ডাক্তারবাবু কথা শেষ করলেন।

কিন্তু যাও বললেই যাওয়া যায় না। পাশের চা-বাগানের এক বাঙালিবাবুর কলেজে পড়া ছেলেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে এসেছিল। ছেলেটি নাকি দেশদ্রোহী। সে পুলিশের কাছে ধরা দিতে চায়নি। পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে সে মারা গিয়েছে।

ছেলেটিকে এলাকায় সবাই পছন্দ করত। তার মৃত্যুর খবর পাওয়ামাত্র হাটের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। বাগানের মালিক সাহেব কোম্পানি বলে কর্মচারীরা কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু মানুষ অসন্তুষ্ট হয়েছে। অসম থেকে যে-ট্রেন আসে এবং অসমে যায় তা অর্ধেকদিন বন্ধ রাখতে হয়েছিল। আর এই কারণে বড়সাহেব তার প্রতিনিধিদের যাত্রা কয়েকদিন পিছিয়ে দিলেন।

এতে লাভ হল ডাক্তারবাবুর। চা-বাগানে বইপত্র পছন্দসই পাওয়া যায় না। কিছু বই সংগ্রহ করলেন, কিন্তু তাতেও খুব একটা কাজ হল না। চা-বাগানের কাজে খাবারের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসা শ্রমিকদের ইতিহাস সেসব বইয়ে তেমনভাবে নেই। দু’জন বৃদ্ধ যারা একসময় বালক বয়সে এসে চা-বাগানের কাজে সারা জীবন কাটিয়েছে, তাদের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। তারা স্মৃতি হাতড়ে যেটুকু বলতে পেরেছিল, তা জড়ো করে ডাক্তারবাবু বুঝলেন, ওরা বাবা-মায়ের সঙ্গে দলে দলে গ্রাম ছেড়ে বহু পথ হেঁটে একটা জায়গায় পৌঁছেছিল, যেখানে পেটকাটা গাড়ি রেল ইঞ্জিনের পেছনে সার দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই ওয়াগনে বাবা মায়ের নাম লিখে সবাইকে তোলা হয়েছিল। জায়গাটার নাম তারা জানে না। হয়তো বাবা-মা জানত। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, গ্রাম থেকে ওই জায়গায় পৌঁছতে তাদের কতটা সময় লেগেছিল। দু’জন দু’রকম উত্তর দিয়েছিল। কেউ বলেছিল দু’দিন, কেউ বলেছিল একদিন। তবে দু’জনে একটা বিষয়ে একই কথা বলেছে। যারা বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসেছিল, তাদের সবাইকে ইংরেজদের আড়কাঠিরা নিয়ে আসেনি। বিশেষ করে বৃদ্ধবৃদ্ধা এবং অভিভাবকহীন শিশুদের বাধ্য করা হয়েছিল থেকে যেতে। ওরা চোখের জল ফেললেও কাজ হয়নি।

ডাক্তারবাবু খুশি হলেন। সেই বৃদ্ধরা এতদিন পরে বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু বালক-বালিকা, শিশু, হয়তো কিশোর-কিশোরীদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। তাদের খুঁজে বের করে কথা বলতে হবে। ডাক্তারবাবু ভাবলেন, যখন ওদের পূর্বপুরুষদের চা-বাগানের কাজে নিয়ে আসা হয়েছিল, তখন যাতায়াতের ব্যবস্থা খুব খারাপ ছিল। কিন্তু তার পরে তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ওইসব গণ্ড পাড়াগাঁ থেকে আসা-যাওয়ার পথের চেহারা কি বদলায়নি?

বিকেলবেলায় বড়বাবু হাসপাতালে এলেন। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বললেন, “খুব ভাল হল যাত্রার দিন পিছিয়ে যাওয়ায়।”

ডাক্তারবাবু তাকালেন। বড়বাবু বললেন, “ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল,” এখন একটু ধীরেসুস্থে কাজ করা যাবে। বড়সাহেব জিজ্ঞাসা করছিলেন, কত টাকা দিলে আপনাদের ওখান থেকে ঘুরে আসতে অসুবিধে হবে না? আমি হিসেব করে একটু বেশি বলেছি। ট্রেনভাড়া বাদ দিয়ে তিনশো টাকা। ঠিক আছে?”

“ব্যাপারটা আমার চেয়ে আপনি ভাল বুঝবেন,” ডাক্তারবাবু বললেন।

“ম্যানেজার সাহেব বলেছেন, আপনার জন্যে সব ব্যবস্থা আলাদা করতে।”

“আপনি এখান থেকে ওসব আলাদা করবেন কী করে? আমার ওপর ছেড়ে দিন।”

“ঠিক কথা। আচ্ছা, আপনার সঙ্গে যারা যাবে তাদের একজনের নাম আপনি বলেছিলেন। বাকিদের কথা চিন্তা করেছেন?” বড়বাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

“না। তা ছাড়া ওই মেয়েটি তো যেতে রাজি না-ও হতে পারে। আপনি বরং ওর সঙ্গে কথা বলে দেখুন,” ডাক্তারবাবু খবর পাঠালেন, এতোয়ারি যেন এখনই এসে দেখা করে।

বড়বাবু বললেন, “দুটি লোককে আমি ভেবেছি। আপনি কথা বলে দেখুন, একজন ফ্যাক্টরিতে কাজ করে, অন্যজন বড়সাহেবের বেয়ারা। দু’জনেই বেশ চটপটে। বেয়ারা এক-আধটা ইংরেজি শব্দ জানে। আচ্ছা, যদি এই মেয়েটি রাজি হয়ে যায় তা হলে ওকেই দায়িত্ব দিন না, যে ওর সঙ্গে যাবে সেই মেয়েকে বেছে নিতে।”

এতোয়ারি দরজায় এসে দাঁড়াল। মুখে কৌতূহল।

ডাক্তারবাবু বললেন, “ভেতরে এসো। শোনো, আমাদের বড়সাহেবের ইচ্ছে, তোমরা যারা চা-বাগানে কাজ করো, তাদের পূর্বপুরুষরা যেখান থেকে এসেছে, সেই জায়গাটা তোমরা কয়েকজন দেখে এসে কীরকম লাগল তা সবাইকে বলো। দু’জন ছেলের সঙ্গে দু’জন মেয়ে এই দলে থাকবে। মেয়েদের একজন হিসেবে তোমাকে ভাবা হয়েছে।”

বড়বাবু বললেন, “তোমরা চারজন এখান থেকে শিলিগুড়ি গিয়ে ট্রেনে চেপে তোমাদের পূর্বপুরুষের দেশে যাবে। আমাদের ডাক্তারবাবু তোমাদের নিয়ে যাবেন। উনি যা বলবেন তাই তোমাদের করতে হবে, ওঁর কথামতো চলতে হবে। এখন বলো, তুমি যেতে রাজি আছ তো?”

একটু সময় নিল এতোয়ারি। দুটো মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। যাদের সঙ্গে অন্য সময় সে কথা বলতে সাহসই পেত না।

ডাক্তারবাবু বিরক্ত হলেন, “কী হল? অসুবিধে থাকলে বলো।”

এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল, “ওখানে গিয়ে কী করতে হবে?”

“ওখানে তোমার পূর্বপুরুষের আত্মীয়রা আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলবে। কী কথা বলবে তা আমি পরে বলে দেব,” ডাক্তারবাবু বললেন।

“আর কোনও মেয়ে সঙ্গে থাকবে তো?”

“হ্যাঁ থাকবে।”

মাথা নিচু করল এতোয়ারি, “আপনি হুকুম করছেন, আমি যাব।”

“তা হলে আর-একটা কাজ করো। তোমার পছন্দমতো আর-একজন মেয়েকে সঙ্গে নাও। তাকে কাল সকালে নিয়ে আসবে,” বড়বাবু বললেন।

এবার মাথা নাড়ল এতোয়ারি, “আমি যাদের চিনি তাদের স্বামী বা বাবা একা যেতে দেবে না,” তারপর একটু নিচু স্বরে বলল, “আমার মতো কেউ নেই।”

বড়বাবু বললেন, “ঠিক কথা। কী করা যায়! এই মেয়েটিকে একা পাঠালে ওকে নিয়ে নানা কথা রটবে,” বলতে বলতেই মনে পড়ে গেল বড়বাবুর। এতোয়ারির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, “একটি মেয়ে আছে, যেতে রাজি হলে বাবা-মা-স্বামী কোনও সমস্যা করবে না। কারণ, তারা কেউ নেই। তবে মেয়েটা চা-বাগানে কাজ করে না, এটাই মুশকিল।”

“কে? ওর পূর্বপুরুষ কি ওদেশ থেকে এসেছিল?”

“হ্যাঁ ডাক্তারবাবু। জ্বরজারি হলে আপনার কাছে নিশ্চয়ই ওষুধ নিতে এসেছে। মেয়েটার নাম পুষি। আমাদের চা-বাগানের বাউন্ডারির বাইরে যে-কয়েকটা ঝুপড়ি আছে, তার একটায় থাকে। তিরিশ-বত্রিশের বেশি বয়স না।”

ডাক্তারবাবু বললেন, “হ্যাঁ, অল্প বয়সে পুষি চা-বাগানে কাজ করত। কিন্তু ওই মেয়েটার তো বেশ দুর্নাম আছে বলে শুনেছি।”

“থাক না। বড়সাহেব যে জন্যে পাঠাচ্ছেন, সেই কাজটা ঠিকঠাক করে এলে আমাদের অসুবিধে কোথায়! ওর সঙ্গে আজই কথা বলা দরকার।”

“হ্যাঁ, বলুন। এমন তো হতে পারে, পুষি যেতে রাজি হবে না। আপনি তো ওকে জোর করে পাঠাতে পারবেন না,” ডাক্তারবাবু এতোয়ারির দিকে তাকালেন, “পুষিকে নিশ্চয়ই চেনো। ও যদি সঙ্গে যায় তা হলে তোমার কি অসুবিধে হবে?”

একটু ভাবল এতোয়ারি। তারপরে মাথা নেড়ে না বলল।

বিকেলে চেম্বারে এসে বসতেই ছোট নার্স সামনে এসে বলল, “পুষিকে কি আপনি দেখা করতে বলেছেন স্যার?”

“পুষি? ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার কাছে নয়, বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করতে বলো।”

“পুষি বলছে বড়বাবু নাকি ওকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।”

“ও। ডাকো ওকে।”

ছোট নার্স যাকে ঘরে নিয়ে এল, তার শুধু চেহারা নয়, হাঁটাচলাতেও চটক আছে। ছোট নার্স বলল “এর নাম পুষি।”

“এটাই কি তোমার ভাল নাম?”

“তাই তো ছেলেবেলা থেকে শুনেছি। চার্চের জন্য অবশ্য আর-একটা নাম ছিল, সে নাম বললে কেউ চিনতে পারবে না,” পুষি হাসল।

মেয়েটাকে ভাল করে দেখলেন ডাক্তারবাবু। বয়স আন্দাজ করা খুব কঠিন, তবে অন্য সব শ্রমিক পরিবারের মেয়েদের মতো শরীরটাকে অবহেলায় ফেলে রাখে না। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন তোমাকে আজ ডাকা হয়েছে তা নিশ্চয়ই বড়বাবু বলেছেন?”

পুষি হাসল, “হ্যাঁ। বলেছেন অনেক দূরে রেলগাড়িতে চড়ে যে-দল যাবে, আমাকে সেই দলে থাকতে হবে। আর-একটা মেয়েও নাকি দলে থাকবে।”

“হ্যাঁ। আমরা দশ দিনের মধ্যে ফিরে আসব,” ডাক্তারবাবু বললেন।

“আপনি যাবেন তো?”

“হ্যাঁ, যাব।”

“আমার যেতে খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু…” থেমে গেল পুষি।

ডাক্তারবাবু তাকালেন, কপালে ভাঁজ পড়ল।

“বলতে লজ্জা করছে…”

ডাক্তারবাবু তাকিয়ে থাকলেন, কথা বললেন না।

“এতদিন থাকব না,” চোখের কোণে তাকাল পুষি, “খরচ আছে। আপনারা কি সবাইকে শুধু শুধু বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছেন, না টাকাও দেবেন?”

“তোমার কথা তো আমি ম্যানেজার সাহেবকে বলব। আর কেউ তো টাকা চায়নি। অবশ্য এটাও সত্যি, সবাই বিনা পারিশ্রমিকে যাবে কেন! হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে এতোয়ারির পরিচয় আছে?”

“এতোয়ারি?”

“যে-মেয়েটি এখন এই হাসপাতালে কাজ করে।”

“ও। যে-মেয়েটার চোখের ওপরে বিরাট আব ছিল? হ্যাঁ, তাকে দেখেছি। কারও সঙ্গে মেশে না বলে শুনেছি। কেন?”

“এতোয়ারি দলের সঙ্গে যাচ্ছে। তুমি যদি যাও, তা হলে তোমরা দু’জন মেয়ে একসঙ্গে থাকবে!” ডাক্তারবাবু বললেন, “ও এখনও টাকার কথা বলেনি। তোমাকে যদি বড়সাহেব টাকা দেন, তা হলে ওকেও দেওয়া হবে।”

“কী করব বলুন? ওদের তো বাবা-দাদা-স্বামী আছে। আমার তো কেউ নেই। যত খরচ সব আমাকেই মেটাতে হয়,” পুষি হাসল।

“ঠিক আছে। তুমি কাল সকালে এসে খবর নিয়ে যেয়ো বড়সাহেব টাকা দিতে রাজি আছেন কি না । আর হ্যাঁ, একটু দাঁড়াও,” ডাক্তারবাবু এতোয়ারিকে ডেকে পাঠালেন। এতোয়ারি এল। মুখ নিচু করে দাঁড়াল।

ডাক্তারবাবু বললেন, “এতোয়ারি, এই হল পুষি। তুমি নিশ্চয়ই ওকে চেনো। আমাদের সঙ্গে ওর যাওয়ার কথা আছে।”

এতোয়ারি মাথা নাড়ল। পুষি বললে, “ও মা, তোমার কপালে একটা আব ছিল না? সেটা কোথায় গেল?”

এতোয়ারি মুখ তুলল, “ছিল, এখন নেই।”

“বাঃ, আব চলে যাওয়ার পর তোমার মুখ খুব সুন্দর হয়ে গেছে।”

শান্ত গলায় এতোয়ারি বলল, “ডাক্তারবাবু ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।”

“কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে বুঝি! অল্পবয়সে করলে ভাল জায়গায় বিয়ে হতে পারত। যার সঙ্গে বাপ-মা বিয়ে দিয়েছিল সে আছে না গেছে!”

“আমার জানা নেই।”

ডাক্তারবাবু দেখলেন পুষি ঠোঁট উলটে কাঁধ নাচাল। তার একটাই মানে, এতোয়ারিকে পুষির এখন পছন্দ হচ্ছে না। ডাক্তারবাবু বললেন, “পুষি, তুমি এখন যেতে পারো।”

বড়বাবু চারজনের জন্যে পঞ্চাশ টাকা বরাদ্দ করতে বড়সাহেবকে রাজি করালেন। ডাক্তারবাবুকে বললেন, “বড়সাহেবকে এই খাতে টাকা দিতে রাজি করাতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমি বলি কী, টাকাটার পাঁচ ভাগ করে এক ভাগ আপনিও নিন।”

মাথা নাড়লেন ডাক্তারবাবু, “ওসব কথা থাক।”

“আর-একটা ভাল খবর আছে। পুষিকে বলেছি দশ দিনের জন্যে দশ টাকা দেওয়া হবে। তার বেশি বড়সাহেব পারবেন না। সে গুঁইগাই করেও শেষপর্যন্ত রাজি হল। তা হলে তৈরি হয়ে নিন। এই খামটা রাখুন। এতে সমস্ত টাকা রয়েছে। আপনারা কাল সকালেই রওনা হয়ে যান,” বড়বাবু বললেন।

সকাল হতেই ফ্যাক্টরির সামনে ভিড় জমতে লাগল। কুলিলাইনগুলো থেকে দলে দলে মানুষ এসেছে। যারা তাদের পূর্বপুরুষদের ভিটে দেখতে যাচ্ছে, তাদের বিদায় জানাতে। তারা নিজেদের মধ্যে যেসব কথা বলছিল, তা সেইসব গ্রাম নিয়ে, যা তাদের পূর্বপুরুষদের ছিল। তারা কেন, তাদের বাবা-কাকারাও সেই গ্রাম চোখে দেখেনি। শোনা কথার সঙ্গে কল্পনা মিশে গিয়ে গল্প ক্রমশ লম্বা হচ্ছিল।

স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারবাবু এলেন। সঙ্গে কাজের লোকের মাথায় একটা বেডিং আর সুটকেস। এতোয়ারি এবং তার মা একপাশে দাঁড়িয়ে। ফ্যাক্টরির লোকটির নাম কালু, সাহেবের বেয়ারার নাম সোমরা। দু’জনেই বেশ সেজেগুজে এসেছে। তাদের বউ-ছেলেমেয়েরা ঘিরে রেখেছে তাদের।

একটু পরে বড়সাহেব মেজ এবং ছোটসাহেবকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। বড়সাহেব ডাক্তারবাবুর সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, “গুড লাক। ওখানকার যত খারাপ সব এদের দেখাবে!”

গাড়ি এল। বাগানের গাড়ি। এই গাড়িতে সবাই দু’ঘণ্টা দূরে তিস্তা নদীর গায়ে গিয়ে নামবে। সেখান থেকে নৌকোয় ওপারে গিয়ে বাসে চেপে শিলিগুড়িতে পৌঁছে ট্রেন ধরবে।

বড়সাহেব বললেন, “ওরা চারজন কেন? আর-একজন মহিলার আসার কথা ছিল, সে কোথায়?”

ঠিক তখনই পুষিকে দেখা গেল দুলতে দুলতে আসছে। তার হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ। বড়সাহেবকে বড়বাবু ফিসফিস করে কিছু বললে তিনি পুষিকে দেখলেন।

চোখাচোখি হওয়া মাত্র অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল পুষি। দেখা গেল বিদায় জানাতে প্রত্যেকের আত্মীয়বন্ধুরা এলেও পুষির জন্যে কেউ আসেনি। ড্রাইভারের পাশের আসনে উঠে বসলেন ডাক্তারবাবু। বাকিরা পেছনের দু’সারি আসনে। বড়সাহেব বললেন, “ডক্টর, কোনও বড় সমস্যা হলেই লোকাল থানাকে জানালে, ওরা এখানকার থানাকে ওয়্যার করে জানালে, আমি খবর পেয়ে যাব। ও হো, আপনি এটা রাখুন।”

বড়সাহেবের নির্দেশে একটা থলি এগিয়ে দিল তাঁর বেয়ারা। বড়সাহেব বললেন, “এর মধ্যে ক্যামেরা আছে। সঙ্গে অনেক ছবি তোলার জন্যে ফিল্ম। ওখানকার মানুষের দারিদ্র্যের ছবি যতটা পারেন তুলে আনবেন।”

থলিটা নিয়ে মাথা নাড়লেন ডাক্তারবাবু। বড়সাহেব বললেন, “ওয়েল, ভালভাবে সব কাজ শেষ করে ফিরে আসুন। মনে রাখবেন, ওখানকার দু’জন মানুষ, অবশ্যই স্বামী-স্ত্রীকে যেমন করে হোক এখানে নিয়ে আসবেন। ওদের মুখে না-শুনলে এখানকার মানুষ বিশ্বাস করবে না। ব্যাপারটা ভুলে যাবেন না যেন।”

গাড়ির চাকা গড়াতে আরম্ভ করলেই অনেকগুলো নারীকণ্ঠ চিৎকার করে কেঁদে উঠল। একটু পরে পুরুষকণ্ঠ সঙ্গে যোগ দিল। কান্না যে সংক্রামক, তা আর-একবার প্রমাণিত হল। গাড়ির পেছন পেছন শ্রমিকেরা প্রথমে হাঁটতে, পরে দৌড়োতে লাগল সবাই গাড়ির পেছন পেছন। একসময় গাড়ির গতি বেড়ে যেতে তারা পেছনে পড়ে রইল।

জলপাইগুড়ি আর বার্নিশের মধ্যে যে-বিশাল তিস্তা নদী, তার ওপর নৌকো যাতায়াত করছে। চা-বাগান থেকে সেখানে পৌঁছতে প্রায় দু’ঘণ্টা সময় লাগল। ডাক্তারবাবু লক্ষ করছিলেন, এই পথটুকু পেছনে বসা চারজন মানুষ কোনও শব্দ করেনি। সবাই অদ্ভুত চোখে দু’পাশের গাছপালা, গ্রামের ঘরবাড়ি দেখে গিয়েছে।

ডাক্তারবাবু গাড়ি থেকে নেমে ওদের ডাকলেন। কালু বলল, “আমি যাব না ডাকদারসাব। আমার খুব ভয় করছে।”

“ভয় করছে? কেন? আমরা তো দশদিন পরে ফিরে আসব।”

ঠিক তখনই গাড়ি থেকে নেমে হাসল পুষি, “আমার তো ভয় দূরের কথা, খুব মজা লাগছে। জীবনে কখনও ট্রেনে করে কোথাও যাইনি, আজ যেতে পারব,” হাত তুলে কালুকে বলল, “তুমি কী! বাচ্চা ছেলে নাকি? নেমে এসো।”

নৌকায় চেপে নদী পেরিয়ে আসার পর সোমরা বলল, “এতবড় নদী আমি কখনও দেখিনি। নৌকোতেও আজ প্রথম চড়লাম।”

অন্যরা কথা না-বললেও মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তারাও একইরকম ভাবছে। নদীর এ পাশে তিনটে ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল। প্রথম ড্রাইভার সাগ্রহে রাজি হল শিলিগুড়ি স্টেশনে ওদের পৌঁছে দিতে। ভাড়া নিয়ে একটুও দরাদরি করল না। অনেকদিন পরে জলপাইগুড়ি শহরের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে ডাক্তারবাবুর মনে হল, স্ত্রী সঙ্গে না-থাকলে চা-বাগানে থাকা সম্ভব হত না। হঠাৎ পেছন থেকে পুষির চিৎকার ভেসে এল, “রোককে, রোককে, জারা রোককে।”

ড্রাইভার ঝটপট গাড়ি থামালে পুষি জানলা দিয়ে মুখ বের করে কিছু দেখে বলল, “কী সুন্দর, কী সুন্দর!”

এতোয়ারি পুষির মাথার পাশ দিয়ে দেখতে পেল রাস্তার ধারে একটা খুব সুন্দরী মেয়ের ছবি টাঙানো রয়েছে। এত সুন্দরীকে সামনাসামনি দূরের কথা, ছবিতেও কখনও দেখেনি সে।

ডাক্তারবাবু গম্ভীর গলায় ড্রাইভারকে বললেন, “চলো।”

গাড়ি চলতে শুরু করলে আবার বসে পড়ে পুষি জিজ্ঞাসা করল, “বাব্বা! এত সুন্দরী মেয়ে সত্যি সত্যি হয়?”

“ছবিটা আমি দেখিনি, বলতে পারব না,” ডাক্তারবাবু বললেন।

শিলিগুড়ির টাউন স্টেশনটি বেশ ছোট। অবশ্য সারা দিনে হাতে গোনা কয়েকটি ট্রেন এই স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। ভাড়ার গাড়ি ছেড়ে দিয়ে সবাইকে নিয়ে একটা অপেক্ষাগৃহে ঢুকে ডাক্তারবাবু বললেন, “তোমরা এখানেই অপেক্ষা করো। ওপাশে বাথরুম আছে। ছেলেরা আমার সঙ্গে এসো।”

এখন দুপুর প্রায় শেষ। সামনের দোকান থেকে চারজনের জন্যে খাবার কিনে ওদের পাঠিয়ে দিয়ে, ডাক্তারবাবু স্টেশন মাস্টারের ঘরে ঢুকে দেখলেন, ভদ্রলোক বাঙালি। আলাপ হল।

সব শুনে ভদ্রলোক বললেন, “আমি এতদিন এখানে আছি, কাউকে আপনার মতো উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা করতে দেখিনি। আপনি কি ওদের সঙ্গে যাবেন, না আলাদা কোচে যেতে চান?”

“ওদের আলাদা ছাড়া উচিত হবে না। ওই ক্লাসে আমার তেমন অসুবিধে হবে না। অন্য কোচে গেলে চিন্তায় থাকব,” ডাক্তারবাবু বললেন। স্টেশন মাস্টার টাকা নিয়ে তাঁর কর্মচারীকে দিয়ে টিকিট করিয়ে আনলেন। বললেন, “ও হ্যাঁ, দু’মিনিট বাঁ দিকে গেলে ভাল খাবারের দোকান পাবেন। বললে ওরা পথের জন্যে প্যাক করে দেবে।”

টিকিট নিয়ে ওয়েটিং রুমে এসে ডাক্তারবাবু দেখলেন, একদিকের মেঝের ওপর বসে আছে এতোয়ারি। উলটোদিকে কালু ও সোমরা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। পুষিকে না-দেখতে পেয়ে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “পুষি কোথায়?”

ছেলেরা তাকাল। কালু হাত তুলে দরজা দেখিয়ে বলল, “বাইরে চলে গেল।”

ডাক্তারবাবু আবার ঘরের বাইরে এসে দু’পাশে তাকিয়েও মেয়েটাকে দেখতে পেলেন না। যেরকমই জীবনযাপন করুক, পুষি যদি হারিয়ে যায় তা হলে তাঁকেই জবাব দিতে হবে।

খানিকটা এপাশ-ওপাশ ঘোরার পর ডাক্তারবাবু পুষিকে দেখতে পেলেন। একটা সিগারেটের দোকানের সামনে দুটো ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে হেসে কথা বলছে। তিনি গম্ভীর গলায় ডাকলেন, “পুষি!”

ঘাড় ঘুরিয়ে পুষি তাঁকে দেখে একটা হাত নাড়ল। তখনই ডাক্তারবাবু দেখলেন, ওর অন্য হাতে সিগারেট জ্বলছে। শ্রমিক মেয়েরা বিশেষ করে যাদের একটু বয়স হয়েছে, তাদের বিড়ি খাওয়ার অভ্যেস আছে। হাট থেকে তামাক পাতা আর তামাক কিনে বাড়িতে বিড়ি বানিয়ে নিলে খুব কম খরচ হয়। কিন্তু পুষির হাতে সিগারেটটা খুব চোখে লাগল।

ছেলেদের কিছু বলে পুষি বেশ কায়দা করে সিগারেট নিভিয়ে হেলতে দুলতে কাছে এল, “একটু দেখতে না-পেয়ে মাথাখারাপ হয়ে গেল নাকি! বলুন কী বলছেন।”

“তোমরা চারজন একসঙ্গে থাকবে, একা কোথাও যাবে না। এটা তো চা-বাগান নয়। বদমাশ লোকজন চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে!”

“ও মা! তাই?” হাসল পুষি।

“যাও, ওদের কাছে যাও।”

“আচ্ছা আপনি বদমাশ লোকদের চেনেন?” তাকাল পুষি।

“তাদের দেখে বোঝা যায় না, ব্যবহারে প্রকাশ পায়।”

“ও! কিন্তু ওই যাদের এনেছেন, তাদের সঙ্গে থাকতে আমার একটুও ভাল লাগছে না। বিচ্ছিরি,” ঠোঁট বেঁকাল পুষি।

“মানে?” অবাক হলেন ডাক্তারবাবু।

“সেই চা-বাগান ছাড়ার পর কেউ কথা না-বলে মুখ ভেড়ার মতো করে বসে আছে। কথা বললেও উত্তর দেয়নি।”

“তুমি এতোয়ারির সঙ্গে কথা বলতে পারো!”

“এতোয়ারি? সে তো সতী-সাবিত্রী! আমার সঙ্গে কথা বললে যদি তার চরিত্র খারাপ হয়ে যায় এই ভয়ে কুঁকড়ে আছে,” খিলখিলিয়ে হেসে উঠল পুষি।

“তুমি তো খুব বাচাল! যাও, ওদের সঙ্গে বসে থাকো। খবরদার একা একা কোথাও যাবে না। এটা শহর, চা-বাগান নয়। এখানকার মানুষেরা সবাই সরল নয়। যাও!” শেষ শব্দটা বেশ জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন ডাক্তারবাবু।

অবাক হয়ে একবার ডাক্তারবাবুকে দেখে স্টেশনের ঘরের দিকে চলে গেল পুষি। ডাক্তারবাবু লোকগুলোর মুখ দেখে বুঝলেন বেশ হতাশ হয়েছে।

কাঠের বেঞ্চ, যাত্রী কম থাকায় তাতেই কেউ কেউ শুয়ে পড়েছে। যতই সংকুচিত হয়ে থাকুক, মানুষ দেখেই শেখে। ট্রেন ছাড়ার পর খাওয়া সেরে সোমরা এবং কালু সাহসী হল। ওরা ওপাশের একটা খালি বেঞ্চে দু’পাশে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। জানলার ধারে বসে ছিল পুষি। তার পাশে এতোয়ারি। ট্রেন চলছে সাধারণ গতিতে। ডাক্তারবাবু ওদের উলটোদিকে বসে আদিবাসীদের ইতিহাস সংক্রান্ত একটা বই পড়ছিলেন।

হঠাৎ পুষি চিৎকার করে এক হাতে চোখ চেপে এপাশে মুখ ফেরাল।

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে?”

বাঁ হাতে একটা চোখ ঢেকে অন্য খোলা চোখে তাকাল পুষি। বলল, “উঃ, কী একটা ঢুকল চোখে। খুব জ্বলছে ওঃ মাগো?”

“ধোঁয়ার সঙ্গে ইঞ্জিনের কয়লার কুচি উড়ে আসে। তারই গুঁড়ো হয়তো ঢুকেছে। এতোয়ারি ওর চোখ থেকে গুঁড়োটা এই রুমালের একটা কোণ দিয়ে তুলে বাইরে বের করে দাও। অস্বস্তি চলে যাবে,” ডাক্তারবাবু বললেন।

একটু ইতস্তত করল এতোয়ারি। তারপর ডাক্তারবাবুর এগিয়ে দেওয়া রুমাল নিয়ে পুষির পাশে বসে নিচু গলায় বলল, “চোখ খুলে তাকাও।”

পুষি চোখ বড় করল। করে আঃ, আঃ বলতে লাগল।

রুমালের কোনা সুচলো করে চোখের কোণ থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কয়লার কুচি বের করে এনে এতোয়ারি বলল, “বেরিয়ে গেছে।”

পুষি তিন-চারবার চোখের পাতা ফেলে বন্ধ করে চিৎকার করল, “ওঃ, এখনও কচকচ করছে। বের হয়নি।”

এতোয়ারি বলল, “দেখি!” সে আবার ভাল করে চোখ দেখে নিয়ে বলল, “আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।”

“কিন্তু আমার চোখে ব্যথা করছে!” কাঁদো কাঁদো হল পুষি।

ডাক্তারবাবু দেখলেন, এতোয়ারি তার আগের জায়গায় ফিরে গিয়ে রুমালটা এগিয়ে দিল। সেটা নিয়ে বাধ্য হয়ে ডাক্তারবাবু পুষির সামনে গিয়ে বললেন, “দেখি চোখটা, মুখ ওপরে তোলো।”

আদুরে আদুরে ভঙ্গিতে পুষি মুখ তুলে দু’চোখই বন্ধ করে রাখল। চিবুকে আঙুল দিয়ে মুখটা তুলে ডাক্তারবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, “চোখ খোলো।”

সঙ্গে সঙ্গে দুটো চোখই খুলল পুষি। ডাক্তারবাবু যখন পরীক্ষা করছিলেন, তখন লক্ষ করলেন পুষি যে-চোখে ময়লা পড়েনি, সেই চোখ বারবার খুলছে আর বন্ধ করছে। দেখা হয়ে গেলে ডাক্তারবাবু বললেন, “ওপাশের ছোট্ট দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে ভাল করে চোখ ধুয়ে এসো। ময়লা যা ছিল বেরিয়ে গেছে। যাও।”

যে-চোখে ময়লা পড়েছিল সেই চোখের পাতা কয়েকবার খোলা বন্ধ করে একগাল হাসল পুষি, “নাঃ, চলে গেছে। আর ধুতে হবে না। আপনি হাত দিলেই সব অসুখ সেরে যায়।”

দু’-দু’বার ট্রেন পালটে ওরা যখন মহুয়ামিলন স্টেশনে পৌঁছল, তখন দুটো দিন কেটে গিয়ে তৃতীয় দিনের ভোর এসেছে। ওরা পাঁচজন ছাড়া খুব অল্প যাত্রী ট্রেন থেকে নামল, উঠল। টিকিট দেখিয়ে বাইরে আসার সময় ইউনিফর্ম পরা একটি লোককে দেখে ডাক্তারবাবু বুঝতে পারলেন ইনি স্টেশন মাস্টার। এগিয়ে গিয়ে বললেন, “গুড মর্নিং। আমি ডক্টর মুখার্জি। নর্থ বেঙ্গল থেকে আসছি। আপনি…”

“স্টেশন মাস্টার অফ দিস স্টেশন,” বলতে বলতে ভদ্রলোক গর্বের হাসি হাসলেন।

“আপনার কাছে একটু সাহায্য চাইছি।”

“ইয়েস!” ভদ্রলোক বোধহয় বাংলা বলতে চাইছিলেন না।

“কাছাকাছি থাকা-খাওয়ার হোটেল কোথায় আছে?”

“নো হোটেল।”

“সর্বনাশ!”

“হোয়্যার টু গো?”

“আমরা এখানকার গ্রামগুলো ঘুরে দেখতে চাই।”

“ও! দেন ইউ আর গভর্নমেন্ট অফিসার। ইউ ইন মাই স্টেশন। দেয়ার ইজ় আ গেস্টরুম। দে আর উইথ ইউ? দেন দে ক্যান স্টে ইন দ্য প্লাটফর্ম। ফুড ইজ় নো প্রবলেম। মাই নেম ইজ় মিস্টার এস কে দে,” ভদ্রলোক হেলতে-দুলতে চলে গেলেন।

খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে একটা বুড়ো লোক হাফপ্যান্ট আর চাদর মুড়ি দিয়ে কথা শুনছিল। স্টেশন মাস্টার চলে গেলে এগিয়ে এল সে। কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, “আপনারা যদি থাকা-খাওয়ার জায়গা চান, তা হলে দু’মাইল দূরে মরা সাহেবের বাংলোতে চলে যান।”

“মরা সাহেবের বাংলো মানে?”

“ওখানে একজন বুড়ো সাহেব থাকতেন। অনেকদিন হল মরে গিয়েছেন। এখন যে-বুড়িটা থাকে, তাকে সবাই ওই মরা সাহেবের বউ বলে। সঙ্গে মেয়েছেলে আছে দেখলে বুড়ি হয়তো জায়গা দিতে পারে। মুশকিল হল সাহেবের সঙ্গে থাকতে থাকতে বুড়ি আর মদেশিয়া ভাষায় কথা বলে না। বাইরের লোকের সঙ্গে শুধু ইংরেজিতে কথা বলে। আপনারা ওখানে যেতে পারেন।”

কথাগুলো মনে ধরল ডাক্তারবাবুর! লোকটির কাছে ঠিকঠাক হদিশ জেনে নিয়ে চারজনকে বললেন, তাঁকে অনুসরণ করতে।

স্টেশন ছাড়াতেই যেসব গাছ নজরে এল, তাদের উত্তরবাংলার চা-বাগান অঞ্চলে দেখা যায় না। সুরকির রাস্তা। তার ওপর গাড়ির চাকার দাগ রয়েছে। কিন্তু দু’পাশে কোনও বাড়িঘর নেই।

স্টেশনের রাস্তাটা একটা বড় রাস্তায় মিশে যেতে ডান দিকে ঘুরলেন ডাক্তারবাবু। লোকটা এই দিক দিয়েই যেতে বলেছিল। এখন পরিচিত গাছ দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগই আমগাছ। দূরে দূরে কয়েকটা খড়ের বাড়ি, কিন্তু লোকজন নজরে পড়ছে না। রাস্তাটা বাঁক নিতেই যে-বাড়িটা চোখে পড়ল, সেটা যে মরা সাহেবের বাংলো তাতে ডাক্তারবাবুর আর সন্দেহ থাকল না।

দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে বাড়িটাকে বেশ যত্ন করে তৈরি করা হয়েছিল।

মানুষসমান পাঁচিলে চারপাশ ঘেরা দোতলা বাড়িটার কাছাকাছি অন্য কোনও বাড়ি নেই। ডাক্তারবাবু তাঁর দল নিয়ে বাড়ির বন্ধ লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভেতরে খানিকটা ঘাসের জমি, তারপর বারান্দা পেরিয়ে ঘরগুলো। কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ, বারান্দায় কেউ নেই।

ডাক্তারবাবু ইংরেজিতে চিৎকার করে জানতে চাইলেন ভেতরে কেউ আছে কি না! দ্বিতীয়বারে নীচের দরজা খুলে কুঁজো চেহারার প্রৌঢ় বেরিয়ে ওঁদের দেখে বেশ অবাক হয়ে তাকাল। ডাক্তারবাবু বললেন, “ভেতরে আসতে পারি?”

“আপনি কে?” হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল লোকটা।

“আমি একজন ডক্টর।”

“ডক্টর? আপনি চিকিৎসা করেন?” লোকটি গলা তুলল।

“হ্যাঁ।”

সঙ্গে সঙ্গে নীচে নেমে গেটের তালা খুলে লোকটা বলল, “ম্যাডামের শরীর খুব খারাপ, দয়া করে দেখে বলবেন, কী করতে হবে!”

“চলুন।”

“এরা?” বাকিদের দিকে তাকাল লোকটা।

“ওরা আমার সঙ্গে এসেছে। চলুন।”

ডাক্তারবাবু সঙ্গীদের বললেন, “তোমরা বারান্দায় অপেক্ষা করো,” নিজের সুটকেস থেকে একটা ব্যাগ বের করে এতোয়ারির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি আমার সঙ্গে এসো। ঝোলাটাকে ওখানেই রেখে দাও। তোমরা অপেক্ষা করো।”

পুষি ঠোঁট ওলটাল। বুঝিয়ে দিল এতোয়ারিকে গুরুত্ব দেওয়া তার পছন্দ হয়নি। প্রৌঢ় ওদের দোতলায় নিয়ে গিয়ে একটু অপেক্ষা করতে বলে একটা ঘরে ঢুকে গেল। মিনিট তিনেক পরে প্রৌঢ়র সঙ্গে একজন প্রৌঢ়া বেরিয়ে এলে, প্রৌঢ় বলল, “ইনি ডাগতারবাবু, ভেতরে নিয়ে যা।”

প্রৌঢ়া ইশারা করে ভেতরে ঢুকলে ওঁরা পা বাড়ালেন। ডাক্তারবাবু দেখলেন, সুন্দর গদিওয়ালা খাটে একটি মহিলা শুয়ে আছেন। তাঁর মাথার চুল ধবধবে সাদা। পরনে পা ঢাকা স্কার্ট। বুকের ওপর চাদর চাপা দেওয়া।

মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। বললেন, “গুড মর্নিং, আর ইউ ডক্টর?”

“ইয়েস!” কাছে গিয়ে মহিলাকে ভাল করে দেখে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “কী অসুবিধে হচ্ছে?”

“সারা শরীরে ব্যথা, মাঝে মাঝে জ্বর আসছে। আমার বয়স এখন বাহাত্তর, কিন্তু আরও আট বছর আমি বাঁচতে চাই,” মহিলা বললেন।

হাত বাড়িয়ে মহিলার কবজি ধরে নাড়ি পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু বুঝলেন, গতি সামান্য বেশি। হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “আশি কেন? তার বেশি?”

ডাক্তারবাবুকে থামিয়ে দিয়ে মহিলা বললেন, “আমার স্বামী আশিতে মারা গিয়েছেন। ওয়েল, এখানে একজন হোমিওপ্যাথ ছাড়া কোনও ডাক্তার নেই। আমার স্বামী ওর ওষুধ পছন্দ করতেন না। মুশকিল হল এখানে কোনও অ্যালোপ্যাথি ওষুধের দোকান নেই। তুমি আমার চিকিৎসা কীভাবে করবে?”

ডাক্তারবাবু বুঝলেন মহিলা কথা বলতে ভালবাসেন। তাই উত্তর না-দিয়ে যা যা পরীক্ষা করার, তা করে কিছু প্রশ্ন করলেন। উত্তর পেয়ে বললেন, “আমার সঙ্গে সামান্য কিছু ওষুধ আছে, যা ইমার্জেন্সিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি রাঁচি থেকে ওষুধ আনানো যায়, তা হলে খুব ভাল হয়।”

ব্যাগ খুলে একটা শিশি আর ট্যাবলেট বের করে তিনি এতোয়ারিকে বললেন, “দু’চামচ জলের সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়ে দাও। দশ মিনিট পরে ট্যাবলেটটা দেবে। ম্যাডাম, যদি এই ওষুধে কাজ হয় তা হলে খুব ভাল, তা না হলে ওষুধ আনাতে হবে।”

ডাক্তারবাবু দেখলেন, মহিলা শুয়ে শুয়ে হাতজোড় করে চোখ বুজে বিড়বিড় করে, সম্ভবত প্রার্থনা করলেন।

প্রৌঢ়া মহিলার সহযোগিতায় গ্লাসের জলের সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে এতোয়ারি সযত্নে খাইয়ে দেওয়ার পর বৃদ্ধা বললেন, “তোমরা নীচে গিয়ে অপেক্ষা করো। এই মেয়েটি আমার কাছে থাক।”

নীচে তিনটে ঘর খুলে দিল প্রৌঢ়া নেমে এসে। বলল, “আজকের দিনটা আপনি, আপনারা এখানে থাকতে পারেন। চার ক্রোশ দূরে একটা বাজার আছে। সেখানকার ধর্মশালায় অনেকে থাকেন। কাল সেখানে চলে যেতে পারেন।”

“অনেক ধন্যবাদ,” ডাক্তারবাবু বললেন।

“ওই মেয়েটি বলল, আপনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন। সেখানে নাকি চা গাছের বাগান আছে। এখানে নাকি মেয়েটার পূর্বপুরুষ থাকত। তারা কোথায় থাকত তাই দেখতে এসেছেন। কথাটা কি সত্যি?” প্রৌঢ়া জিজ্ঞাসা করল।

“হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন,” ডাক্তারবাবু বললেন।

“আপনার সঙ্গের লোকদুটো কি মেয়েদের স্বামী?”

“না না। ওরা একই চা-বাগানে থাকে।”

“ওদেরও পুর্বপুরুষ এই দেশে থাকত?”

“হ্যাঁ।”

প্রৌঢ়া চলে গেলে ডাক্তারবাবু পুরুষদের এবং মেয়েদের ঘর আলাদা করে দিলেন। একটু পরে যে-লোকটি প্রথম দরজা খুলেছিল, সে দুটো প্লেট নিয়ে নীচে এল। একটা প্লেটে অনেকগুলো মোটা রুটি আর অন্য প্লেটে গুড় রয়েছে। লোকটা বলল, “ঘরেই ছোট প্লেট আছে, তাতে খাবার ভাগ করে নিন। আর হ্যাঁ, ওপরে যে-মেয়েটা আছে, সে ওপরেই খেয়ে নেবে।”

প্রৌঢ়া চলে গেলে ডাক্তারবাবু পুষিকে ডেকে বললেন, অর্ধেক রুটি আর অর্ধেক গুড় একটা প্লেটে ঢেলে পাশের ঘরে ছেলেদের দিয়ে আসতে। এইসময় প্রৌঢ়া আবার ফিরে এল। বলল, “বাড়ির পেছনে কুয়ো আছে। তার জলে স্নান করা, খাওয়া, কাপড় কাচা করা যাবে।’ তারপর পুষিকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি রাঁধতে পারো?”

পুষি সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে না বলে জানাল, “এতোয়ারি, মানে যে-মেয়েটি ওপরে আছে, সে খুব ভাল রাঁধতে পারে।”

“তা হলে ঠিক আছে,” প্রৌঢ়া চলে গেল।

অবাক হয়ে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “এতোয়ারির রান্না তুমি কোথায় খেয়েছ? তোমার সঙ্গে পরিচয়ই ছিল না!”

“না থাক, দেখে তো বোঝা যায়,” হাসল পুষি, “আমার আবার রান্নাবান্না একদম ভাল লাগে না। আচ্ছা, আমরা বাইরে যাব না?”

“এতটা পথ ট্রেনে চেপে এসেছ, স্নান-খাওয়া সেরে বিশ্রাম করে নাও। তারপর বাইরে যাবে,” ডাক্তারবাবু বললেন, “ওদের ওই প্লেট দিয়ে বলে এসো বাড়ির পেছনের পুকুরের জল ব্যবহার করতে পারে।”

মুখ ভ্যাটকালেও প্লেট তুলে বেরিয়ে গেল পুষি।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার আগে প্রৌঢ়া এসে ডাক্তারবাবুকে ডেকে বৃদ্ধার কাছে নিয়ে গেল। বৃদ্ধাকে দেখার আগেই এতোয়ারির ওপর চোখ গেল। বেশ অবাক হলেন তিনি। এরই মধ্যে স্নান সেরে নেওয়ায় অনেক ঝকঝকে দেখাচ্ছে ওকে। কিন্তু সবচেয়ে চোখে পড়ছে ওর পরনের পোশাক। আসার সময় যা পরে এসেছিল, তা এখন ওর অঙ্গে নেই। যদিও পুরনো কিন্তু বেশ ধবধবে সাদা পায়ের পাতার কাছাকাছি ঢাকা স্কার্ট পরে আছে এতোয়ারি। চোখাচোখি হতে যেন লজ্জা পেল সে।

ডাক্তারবাবুকে দেখে উঠে বসলেন বৃদ্ধা, “থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর। তিনদিন ধরে খুব কষ্টের মধ্যে ছিলাম। এখন আপনার দেওয়া ওষুধ খেয়ে খানিকটা আরাম পাচ্ছি। আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব জানি না।”

“আপনি আপনার হাতটা একবার দিন তো!” পাশে বসে ডাক্তারবাবু বৃদ্ধার নাড়ি পরীক্ষা করলেন। তারপর বললেন, “আপনার হয়তো একটু আরাম লাগছে, কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ হতে আরও একটু সময় লাগবে।”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ়া জিজ্ঞাসা করল, “কী খেতে দেব?”

“হালকা খাবার, যা সহজে হজম করতে পারবেন। এতোয়ারি হাসপাতালে কাজ করে, ওকে জিজ্ঞাসা করলে ঠিক বলে দেবে। এতোয়ারি, দুপুরের খাওয়ার পর ওঁকে সকালের ওষুধটা আবার দিয়ে দিয়ো,” ডাক্তারবাবুর এবার প্রৌঢ়াকে বললেন, “ওঁর মাথা ভাল করে ধুয়ে দিন। এমন করে মুছিয়ে দেবেন যেন চুলে জল না-থাকে। ভেজা গামছা দিয়ে শরীর মুছিয়ে দেবেন।”

প্রৌঢ়া মাথা নাড়লে ডাক্তারবাবু বললেন, “আপনারা এখানে একটু দূরে যাতায়াত করেন কীভাবে?”

“গোরুর গাড়িতে, ঘোড়াও ভাড়া পাওয়া যায়,” বৃদ্ধা বললেন, “আপনি কোথায় যেতে চান তা ওদের বলুন, ব্যবস্থা করে দেবে।”

“আমরা বাজারে যাব। ওখানকার ধর্মশালায় যদি জায়গা পাওয়া যায় তার চেষ্টা করব,” ডাক্তারবাবু বললেন।

“সেটা কাল করলেও তো হবে। আজ এখন খাওয়াদাওয়া করুন,” বৃদ্ধা চোখ বন্ধ করলেন।

পুরুষ দু’জনকে তাদের ঘরে খাবার দেওয়া হল। রুটি, সবজি আর ডালের সঙ্গে ডিমসেদ্ধ। পুষি খাবার নিয়ে সামনে বসে বলল, “আমি তো রান্না জানি না। কিন্তু ওই মেয়েটার চেয়ে ভাল রাঁধতে পারতাম।”

ডাক্তারবাবুর খিদে পেয়েছিল, চুপচাপ খেয়ে নিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *