৪. ধ্বনিপরিবর্তন ও শব্দবিকৃতি

চতুর্থ অধ্যায় – ধ্বনিপরিবর্তন ও শব্দবিকৃতি

১. ধ্বনিপরিবর্তনের প্রকৃতি

কথা বলিবার সময় ধ্বনিগুলি পৃথক্‌ভাবে পর পর উচ্চারিত হইলেও মনের মধ্যে সেগুলি অবিচ্ছিন্নভাবেই আসে, সুতরাং উচ্চারণকালে পূর্ববর্তী ধ্বনি পরবর্তী ধ্বনিকে অথবা পরবর্তী ধ্বনি পূর্ববর্তী ধ্বনিকে প্রভাবিত করিতে পারে। উচ্চারণের দ্রুততার অথবা উচ্চারণপ্রযত্ন শিথিল করিবার চেষ্টার ফলে পর পর উচ্চারিত দুই ধ্বনির মধ্যে একটি অথবা উভয় ধ্বনি বিকৃত হইতে পারে। শ্বাসাঘাতের তীব্রতার জন্যও ধ্বনির বিকৃতি অথবা লোপ হয়। এইরূপে শব্দ ও পদমধ্যস্থিত ধ্বনি-পরিবর্তন (Sound Change) নানারকমের হয়।

বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান অনুসারে ধ্বনিপরিবর্তন প্রধানত দুই রকমের। একরকম হইল সাধারণ ধ্বনি-পরিবর্তন (Phonemic change), যাহাতে বাগ্‌ব্যবহারে কোন বৈলক্ষণ্য আনে না। দ্বিতীয়রকম হইল, অর্থগত বা ব্যাকরণগত ধ্বনি-পরিবর্তন (Morphophonemic change)। যেমন সংস্কৃতে ‘যা-অস্তি’ > ‘যাস্তি’ এখানে সন্ধির জন্য যে স্বরধ্বনি পরিবর্তন হইল তাহা সাধারণ ধ্বনি-পরিবর্তন, কিন্তু ‘করোতি’: ‘কারয়তি’—এখানে ক-কারে যে পরিবর্তন দেখা যাইতেছে তাহা ব্যাকরণগত ধ্বনিপরিবর্তন॥

২. শ্রুতি-ধ্বনি

মুখের ভাষায় পদমধ্যস্থিত ধ্বনিগুলি বিচ্ছিন্নভাবে উচ্চারিত হয় না। জিহ্বা বিশ্রাম না লইয়া অবিচ্ছিন্নভাবে এক ধ্বনির উচ্চারণস্থান হইতে পরবর্তী ধ্বনির উচ্চারণস্থানে যায়। সুতরাং অনেক সময় দ্রুত উচ্চারণে এক ধ্বনির স্থান হইতে অন্য ধ্বনির স্থানে যাইবার কালে জিহ্বা অসতর্কভাবে মধ্যবর্তী স্থানে অনপেক্ষিত ধ্বনি উচ্চারিত করিয়া ফেলে। এইরূপ মধ্যব্যঞ্জনাগমকে বলে শ্রুতি-ধ্বনি (Glide)। শব্দের সিদ্ধ-বানান, (Orthography)-এ সাধারণত শ্রুতিধ্বনি দেখা যায় না। কিন্তু কখনো কখনো শ্রুতিধ্বনি, উচ্চারণে প্রাধান্য লাভ করিয়া, বানানেও ঢুকিয়া পড়ে। অনেক ভাষায় দেখা গিয়াছে যে, ন-কার র-কারের মধ্যে শ্রুতিধ্বনি দ-কার উদ্ভূত হইয়াছে, এবং অনেক সময় এই ধ্বনি প্রাধান্য লাভ করিয়া পদের সিদ্ধ বানানেও ঢুকিয়া পড়িয়াছে। বৈদিক [সূনর=স্ঊন্‌অর] “সমৃদ্ধ” হইতে সংস্কৃত [সুন্দর=স্ঊন্‌দ্‌অর]। সংস্কৃত [বানর] হইতে প্রাচীন বাঙ্গালায় হইয়াছিল [বান্দর], তাহা হইতে পশ্চিমবঙ্গের উপভাষায় [বাঁদর]। তুলনীয়, হিন্দীতে [বন্দর, পন্দ্ৰহ (প্রাকৃত ‘পন্নরহ’ হইতে)]; গ্রীক aner: andros।

দুই স্বর-মধ্যবর্তী স্পৃষ্ট একক ব্যঞ্জন প্রাকৃতে লুপ্ত হইয়াছে। যেমন, সকল > সঅল। কিন্তু উচ্চারণের সময় [স-] এবং [-অল] এই দুই অক্ষরের মধ্যে শ্রুতিধ্বনির য়-কার আসিয়া যাইত [সয়ল]। অধিকাংশ প্রাকৃত শব্দের বানানে এই শ্রুতিধ্বনি পাওয়া যায় না। কিন্তু অর্ধমাগধী প্রাকৃতে পাওয়া যায়। এই ধ্বনিকে প্রাকৃত বৈয়াকরণেরা য়-শ্রুতি বলিয়াছেন। বাঙ্গালাতেও এইরূপ য়-শ্রুতি শোনা যায়। [কে এলো?] এই বাক্য দ্রুত বলিতে গেলে দাঁড়ায় [কেয়েলো?]। এখানে [কে] এবং [এলো] এই দুই পদের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য উচ্চারণে য়-শ্রুতি আসিয়াছে। যা ধাতুতে-আ প্রত্যয় করিলে হয় (যাআ) এখানে [যা] এবং [আ] এই দুই অক্ষরের মধ্যে ব-শ্রুতি [‘ব’=w] এই শ্রুতি-ধ্বনি আসিয়াছে। বাঙ্গালায় ও-কার দ্বারা সাধারণত ব-শ্রুতি নির্দেশ করা হয়। ফলে [যাআ] না বলিয়া আমরা বলি এবং লিখি [যাওয়া]॥

৩. সাম্য ও বৈষম্য

পদের উচ্চারণকালে অনেক সময় সন্নিকট দুইটি বিভিন্ন ধ্বনি পরম্পর অথবা একে অপরের প্রভাবে পড়িয়া অল্পবিস্তর সাম্য লাভ করে। এই ব্যাপারকে ধ্বনিবিজ্ঞানে বলা হয় সমীভবন (Assimilation)। সমীভবন তিন রকমের হইতে পারে। (১) পূর্ববর্তী ধ্বনি পরবর্তী ধ্বনিকে বদলাইয়া দিতে পারে, (২) পরবর্তী ধ্বনি পূর্ববর্তী ধ্বনিকে রূপান্তরিত করিতে পারে, অথবা (৩) পরস্পরের প্রভাবে দুইটি ধ্বনিই পরিবর্তিত হইতে পারে। এই তিনপ্রকার সমীভবনকে যথাক্রমে বলা হয় প্রগত (Progressive), পরাগত (Regressive), এবং পারস্পরিক বা অন্যোন্য (Mutual)। সংস্কৃত হইতে প্রাকৃতে উদাহরণ,— (১) প্রগত চক্র > চক্ক, পক্ক > পক, পদ্ম > পদ্দ, লগ্ন > লগ্‌গ, *শস > সংস্কৃত শশ ইত্যাদি। বাঙ্গালায়— গলদা > গল্লা (চিংড়ি)।

(২) পরাগত সমীভবনের উদাহরণ সংস্কৃতে ব্যঞ্জন-সন্ধিতে যথেষ্ট মিলে। তৎ + জন্য > তজ্জন্য; উৎ + মুখ > উন্মুখ। বৈদিক কুর্কুর > সং কুক্কুর; সং মুক্তা > প্রা মুত্তা; প্রজ্ঞা > পঞ্‌ঞা; কর্ম > কম্ম। বাঙ্গালায়—রাঁধনা > রান্না।

(৩) অন্যোন্য সমীভবনের উদাহরণ— সংস্কৃত সন্ধিতে— উৎ + শ্বাস >উচ্ছ্বাস। সং সত্য >প্রা সচ্‌চ; ঊর্ধ্ব > উব্‌ভ; বিদ্যা > বিজ্জা; মধ্য > মজ্‌ঝ।

সমীভবনের বিপরীত ব্যাপার হইল বিষমীভবন (Dissimilation)। ইহাতে পদমধ্যস্থিত দুইটি সমধ্বনির মধ্যে একটি বদলাইয়া যায়। লক্ষ্য করিতে হইবে যে, সমীভবনের মতো বিষমীভবনে ধ্বনিগুলি পরস্পর ঘনিষ্ঠ সংলগ্ন নহে, অল্পবিস্তর অন্তরিত। এইরূপ ধ্বনিপরিবর্তন অত্যন্ত বিরল। সং মন্মথ > প্রা বম্মহ; সং পিপীলিকা > পালি কিপিল্লিকা; লাটিন মার্মোর (marmor) > ইংরেজী মাৰ্বল (marble), বাঙ্গালার গ্রাম্য উচ্চারণে ‘লাল’ স্থানে ‘নাল’; পোর্তুগীস আর্মারিও (armario) > বাঙ্গালা আল্‌মারি; সংস্কৃত মর্ত্য > প্রাকৃত মচ্চ (সমীভবন) > উড়িয়া মঞ্চ (বিষমীভবন)।

মধ্যপদস্থিত দুইটি ধ্বনির স্থানপরিবর্তনকে বলে বিপর্যার্স বা বিপর্যয় (Metathesis)। বৈদিক বম্রী > সং বল্মী-ক; সং করেণু > সং, প্রা কণেরু; সং জোৎস্না > প্রা* জোহ্‌ণা > জোণ্‌হা; সং হ্রদ > *দ্ৰহ >পালি রহদ, আরবী কুফ্‌ল > বাঙ্গালা কুলুপ; ইংরেজী বক্‌স্ (box) > বাঙ্গালা বাসক্‌॥

৪. যোগ, বিয়োগ ও বিকার

উচ্চারণপ্রযত্ন লাঘবের জন্য অথবা অনভ্যস্ত ধ্বনিগুচ্ছ অভ্যাস অনুসারে সরল করিতে গিয়া কিংবা ছন্দের প্রয়োজনে অনেক সময় দুইটি সংযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির মধ্যে একটি স্বরধ্বনি আসিয়া ব্যঞ্জনধ্বনি দুইটিকে বিশ্লিষ্ট করিয়া দেয়। এমন স্বরাগমকে বলে বিপ্রকর্ষ, স্বরভক্তি অথবা মধ্যস্বরাগম (Anaptyxis)। বৈদিকে (ছন্দের বা সুরের প্রয়োজনে) ‘ইন্দ্র’ স্থলে ‘ইন্দর’; বৈদিক দহ্র > সং, প্ৰা দহর; মনোহর্থ > মনোরথ; *ইন্দ্রা > ইন্দিরা; সং স্নেহ > প্রা সিণেহ; দর্শন > দরিসণ। বিপ্রকর্ষের উদাহরণ প্রাকৃতে প্রচুর আছে। বাঙ্গালায় কাব্যের ভাষায় এবং গ্রাম্য উচ্চারণেও ইহার যথেষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায়। ভক্তি > ভকতি, মুক্তি > মুকতি, ক্লেশ > কিলেশ (প্রাকৃত), প্রীতি > পিরীতি, শুক্ল > সুকুল (ব্রাহ্মণের পদবী), পদ্ম > পদুম (প্রাকৃত), ম্লেচ্ছ > মেলেচ্ছ; ইংরেজী গ্লাস (glass) > গেলাস, স্টেশন > পাঞ্জাবী সটেশন।

উচ্চারণ-সুবিধার অথবা অন্য কারণে পদের আদিতে যুক্ত অথবা একক ব্যঞ্জনের পূর্বে স্বরধ্বনির আগম হইলে আদিস্বরাগম (Prothesis) বলে। —সং স্ত্রী > পা, প্রা ইত্থী; সং ক্ষমা > মধ্য-বা অক্ষেমা; স্পর্ধা > আস্পর্ধা। আধুনিক বাঙ্গালায় বহু ইংরেজী শব্দের রূপান্তরে আদিস্বরাগম লক্ষিত হয়। আস্তাবল, ইস্টিশান (এস্টেশান) ইত্যাদি। বাঙ্গালার উপভাষাবিশেষে আদি ব্যঞ্জনাগমও দেখা যায়। উজু > রুজু, ওঝা > রোজা।

কখনো কখনো শব্দের শেষে স্বরধ্বনি যুক্ত হয়। এ ব্যাপারকে বলা হয় অন্ত্যস্বরাগম (Apothesis)। সং নৌ > নাবা (=নৌ+আ), সং পরিষদ্‌ > পালি পরিসদা; সং দিশ্‌ > দিশা, নক্‌ত্‌ > নক্ত; ইং বেঞ্চ > বা বেঞ্চি, এক্‌টিং > একটিনি, ইত্যাদি। অন্ত্যব্যঞ্জনাগমও হইতে পারে। সং সর্ব+জি > সর্বজিৎ, ভূ+ভৃ > ভূতৃৎ।

যুগ্ম ব্যঞ্জনধ্বনির পূর্বে ই-কারের আগম হইলে বলে অপিনিহিতি (Epenthesis)। পূর্ববঙ্গের উপভাষায়, সং বাক্য > বাক্ক > বাইক্ক, যক্ষ > জক্‌খ > জইক্‌খ, সত্য > সত্ত > সইত্ত, ব্রাহ্ম > ব্রাহ্ম > ব্রাইহ্ম; লাটিন factum > প্রত্ন-ফরাসী * fattu > ফরাসী fait ইত্যাদি। (মতান্তরে পরবর্তী ই-কার উ-কারের পূর্ববর্তী রূপেও উচ্চারিত হওয়াই অপিনিহিতি। পরিষ্কার উদাহরণ পাওয়া যায় শুধু-ই-কারের এবং তাহাও দুইটি মাত্র। কাঁচি > কাঁইচি, গাঁতি > গাঁইতি।)

বাঙ্গালায় অপিনিহিতির যে সব উদাহরণ দেওয়া হয় তাহার অধিকাংশেই ব্যাপারটি স্বর-ব্যঞ্জনের বিপর্যাস ছাড়া কিছু নয়। যেমন, চারি > চাইর, মারি > মাইর, ষাটি > ষাইট; ওড়িয়ায় পউস < সংস্কৃত পাংশু।

অপিনিহিত (Ephenthetic) অথবা বিপর্যস্ত (Metathetic) স্বরধ্বনি পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির সহিত মিলিত হইলে এবং তদনুসারে পরবর্তী স্বরধ্বনির বিকৃতি ঘটিলে অভিশ্রুতি (Umlaut) বলে। [করিয়া] হইতে অপিনিহিতির ফলে [*কইরিআ] অথবা মতান্তরে বিপর্যাসের ফলে [কইরা] > ক’রে; শুনিয়া > শুইনা > শুনে; বলিয়া > বইলা > ব’লে; হাটুয়া > *হাউটা > হেটো।

দুই তিন শত বৎসর পূর্বে বাঙ্গালা ভাষায় [ই, উ] অপিনিহিতি (আসলে বিপর্যাস) ব্যাপকভাবে দেখা দিয়াছিল। বিপর্যস্ত উ-কার পরে ই-কার হইয়া যায়। —সাধু > সাউধ > *সাইধ; সং দদ্রূ > বা দাদু > দাউদ > দাইদ > দাদ; করিয়া > *কইরা; হারিয়া > হাইরা, ইত্যাদি।

অপিনিহিতি বিপৰ্যাস অথবা সন্ধি ব্যতিরেকে অভিশ্রুতির মতো ধ্বনিপরিবর্তন হইলে বলে স্বরসঙ্গতি (Vowel Harmony)। এখানে এক স্বরধ্বনির প্রভাবে অপর স্বরধ্বনি বদলাইয়া যায়, উচ্চাবস্থিত স্বরধ্বনি নিম্নবস্থিত স্বরধ্বনিকে উচ্চে টানিয়া লয়। এ (নিম্নাবস্থিত)+ই (উচ্চাবস্থিত) > ই+ই; উ (উচ্চাবস্থিত)+আ (নিন্মাবস্থিত) > উ+ও। যথা, দেশি > দিশি; বিলাতি > বিলিতি; নিরামিষ্য > নিরামিষি; মূলা > মূলো।

স্বরসঙ্গতি চার রকমের হইতে পারে। (১) প্রগত (অন্ত্যস্বর আদ্যস্বর অনুযায়ী পরিবর্তিত হইলে): মূলা > মূলো; শিকা > শিকে। (২) পরাগত (আদ্যস্বর অন্ত্যস্বর অনুযায়ী): গোটা > গটা (উপভাষা); আখো(< *আখুয়া) > এখো (=ইক্ষুজাত); *যদো (< *যদুয়া) > যোদো (নাম); *সিধো (< *সিধুয়া) > সেধো (নাম); দেশি > দিশি; না-কি > নিকি (কথ্য)। (৩) মধ্যগত (আদ্য ও অন্ত্য অথবা অদ্য কিংবা অন্ত্য স্বর অনুযায়ী মধ্যস্বর পরিবর্তিত হইলে): বিলাতি > বিলিতি; নিরাবিলে > নিরিবিলি (কথ্য); বারেন্দা > বারান্দা (কথ্য)। (৪) অন্যোন্য (আদ্য ও অন্ত্য দুই স্বরই পরস্পর প্রভাবিত হইলে): মোজা > মুজো (উপভাষা); ধোঁকা > ধুঁকো (ঐ)। স্বরধ্বনির পরিবর্তন হয় জিহ্বার উঁচু-নীচু অবস্থানে।

পদের কোন অক্ষরে প্রবল শ্বাসাঘাত থাকিলে অনেক সময় শ্বাসাঘাতহীন অক্ষরে স্বরধ্বনি ক্ষীণ হইয়া আসিয়া লোপ পায়। এইরূপ ধ্বনির—সাধারণত স্বরধ্বনির—পরিবর্তনকে স্বরধ্বনির অবস্থান অনুসারে যথাক্রমে (১) আদিধ্বনি লোপ (Aphesis) (২) মধ্যধ্বনিলোপ (Syncope) এবং (৩) অন্ত্যধ্বনিলোপ (Apocope) বলে। (১) সংস্কৃতে অপিহিত > পিহিত; উদক > পা দক; অলাবু > বা লাউ, অভ্যন্তর > ভিতর; এরণ্ড > রেড়ী; উপানৎ > পানই; উদ্ধার > ধার। বাঙ্গালায় —রুই (<রোহিত) > উই, রুজু (< ঋজু) > উজু। (২) সংস্কৃতে—অভিজানু > অভিজ্ঞু; অগুরু > অগ্রু; সুবর্ণ > স্বর্ণ; বাঙ্গালায়— রাঁধনা > রাঁধ্‌না > রান্না; গৃহিণী > *গিরিনী > *গির্‌ণী > গিন্নী। (৩) সংস্কৃত [আকাশ, জল] হইতে বাঙ্গালা [আকাশ্‌, জল্‌]; অগ্নি > আগুন্; সন্ধ্যা > প্রা সঞ্‌ঝা বা সাঁঝ > সাঁঝ্‌। ফারসী মুহ্‌রির > বাঙ্গালা মুহুরী; সংস্কৃত ফেরু > বাঙ্গালা *ফেউর > ফেউ।

কখনো কখনো কোন শব্দে পাশাপাশি দুই সমধ্বনির অথবা সমধ্বন্যাত্মক অক্ষরের মধ্যে একটি লুপ্ত হয়। ইহাকে বলে সমাক্ষরলোপ (Haplology বা Syllabic Syncope। *যাদৃশম্মিন্ > যাদৃশ্মিন (ঋগ্‌বেদ); *নক্‌ক্ষত্র “রাত্রির অধিপতি” > নক্ষত্র; *মধুধুঘ > মধুঘ; মম+মৎ > মমৎ (ঋগ্‌বেদ); প্রপা-পালিকা > *প্রপালিকা > পবালিআ (প্রাকৃত); ইং চক্ (chalk) + বা খড়ি > চাখড়ি; পাদোদক > পাদোক।

নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি লুপ্ত হইয়া যদি পূর্ববর্তী স্বরধ্বনিকে অনুনাসিক করিয়া দেয় (অর্থাৎ সন্নিকটস্থ নাসিক্য ধ্বনির প্রভাবে যদি স্বরধ্বনি নাসারন্ধ্রে অনুরণিত হইয়া নির্গত হয়), তাহা হইলে নাসিক্যীভবন (Nasalization) বলে। যেমন, সন্ধ্যা > সঞ্‌ঝা >সাঁঝ; চন্দ্র > চন্দ > চাঁদ; মাংস > মাঁস। নাসিক্য ব্যঞ্জনের সংস্রব ছাড়াও স্বরধ্বনি অনুনাসিক হইতে পারে। তখন বলে স্বতোনাসিক্যীভবন (Spontaneous Nasalization)। পুথি > পুঁথি; টেকসই > টেকসই; উপভাষায় হাসি > হাঁসি; খোকা > খোঁকা; চা > চাঁ।

[ঋ, র্‌, ষ্‌] প্রভৃতি “মূর্ধা-উচ্চারিত” (অর্থাৎ উর্ধ্বতালু-সন্নিহিত) ব্যঞ্জনধ্বনির সংস্পর্শে দন্ত্য ব্যঞ্জন মূর্ধন্য উচ্চারিত হইলে মূর্ধন্যীভবন (Cerebralization) বলে। সংস্কৃত কৃত > প্রা কট; সং বর্ধ > প্ৰা বডঢ > বা বাড়; সং প্রথতে > সং পঠতে; সং অস্থি > আঁঠি। [ঋ, র্‌, ষ্‌] প্রভৃতি ধ্বনির সংস্পর্শ ব্যতিরেকে দন্ত্য ব্যঞ্জন মূর্ধন্য উচ্চারিত হইলে স্বতোমূর্ধন্যীভবন (Spontaneous Cerebralization) বলে। উৎ-দীন > উড্‌ডীন; বৈদিক অততি > সং অটতি; বৈদিক চততি > প্রা চডই > চড়ে; সং পততি প্ৰা পডই > বা পড়ে।

স্পৃষ্ট ধ্বনি উম্ম উচ্চারিত হইলে (অর্থাৎ শ্বাসনিৰ্গম এক চোটে না হইয়া কিছুক্ষণ ধরিয়া হইলে) উষ্মীভবন (Spirantization) বলে। যেমন, কাগ·জ· < কাগজ (পুরানো-কাগজওয়ালার চীৎকার); ফু·ল < ফুল (আধুনিক কোন কোন গায়কের উচ্চারণে)। উষ্মীভবনের জন্য [কালী পূজা] পূর্ববঙ্গের এক উপভাষায় [খ.লী ফু.জা] হইয়াছে। এইরূপ উষ্মধ্বনি যদি [স, শ] অথবা [জ] হয়, তবে সকারীভবন (Assibilation) বলে। যেমন, মেজ্‌দা > মেজ·দা; আসে > আসে (পূর্ববঙ্গ); গাছতলা > গাস্‌তলা (দ্রুত উচ্চারণে); পাছতলা (অথবা পাদ+তলা) > পাস্‌তলা।

[স] যদি ঘোষবৎ [জ] হইয়া শেষে [র] হয় তবে তাহাকে বলে রকারীভবন (Rhotacism)। প্রাচীন লাটিন ausosa > *auzoza > প্রাচীন ইংরেজী hasa > *haza > hare; ইন্দো-ইউরোপীয় *dusmenes > ইন্দো-ইরানীয় দুজমনস্‌ > সংস্কৃত দুর্মনস্-। [দ] মূর্ধন্যীভূত [ড] এবং তাহা হইতে [ড়] হইয়া কখনো কখনো [র] অথবা [ল] হয়। সং পঞ্চদশ > প্রা পন্নডহ > বা পনর; সং ষট+দশ > ষোড়শ > বা যোল; সং কটুকৃত্য > বা কড়চা, করচা।

কোন ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণ করার সময়ে যদি কণ্ঠনালীর আকুঞ্চন হয় অর্থাৎ যদি ব্যঞ্জনধ্বনি ও হ-কার একসঙ্গে উচ্চারিত হয় অর্থাৎ ধ্বনি দুইটির মধ্যে যে বিরাম তাহা ক্ষীণ হইয়া আসিয়া, অবশেষে যদি বিলুপ্ত হয় তবে সে ধ্বনিকে মহাপ্রাণিত (Aspirated) বলে। যেমন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে এভোঁ > *এব্‌হোঁ > এবে হোঁ; কাত্ হও > কাথও (দ্রুত উচ্চারণে); পাঁচ হালা > পাঁছালা (দ্রুত উচ্চারণে); তা হলে > থালে (অপভাষা)।

কোন মহাপ্রাণ ধ্বনি উচ্চারণ সময়ে যদি কণ্ঠনালীর আকুঞ্চন না হয় তবে সে ধ্বনিকে অল্পপ্রাণিত (Deaspirated) বলে। সংস্কৃতে ভূ ধাতুর লিটে *ভভার > বভার; উপভাষায় কাঁধ (< স্কন্ধ) > কাঁদ, ধাঁধা > ধাঁদা, অবধি > অব্‌দি।

ম-বা বহিনী, হিন্দি বহিন এবং হিন্দি ভৈঁস, বা ভয়সা—এই দুই শব্দে মহাপ্রাণতার বিপৰ্যাস ঘটিয়াছে, অর্থাৎ একটি ব্যঞ্জনধ্বনি মহাপ্রাণহীন, অপরটি মহাপ্রাণিত হইয়াছে অর্থাৎ মহাপ্রাণ রহিয়া গিয়াছে। ভগিনী (=বহগিনী) > *বঘিনী· (> বগহিনী) > বহিন; মহিষ > *ব্হইঁস > ভৈঁস; মেঢক > ভেড়া।

জিহ্বাগ্র-দ্বারা উচ্চার্য (apical বা frontal) কোন ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণকালে যদি জিহ্বার পশ্চাদ্‌ভাগ তালুও স্পর্শ করে তবে তালব্যীভবন (Palatalization) বলে। যেমন, ইংরেজিতে, এজ্যুকেশন (education) ইন্‌স্টীচ্যুশন (institution) এখানে [d] ও [t] উচ্চারণে তালব্যীভূত।

অঘোষ ধ্বনি সঘোষ হইলে ঘোষীভবন (Vocalization বা Voicing) বলে। মকর > মগর, কাক > কাগ, কতদূর > (দ্রুত উচ্চারণে) কদ্‌দূর, যাবৎ+এব >যাবদেব (সন্ধি), অপ্‌+দ > অব্‌দ (ঐ), শকট > ম-বা সগড়।

সঘোষ ধ্বনি অঘোষ হইলে অঘোষীভবন (Devocalization বা Devoicing) বলে। অবসর > অপসর (কথ্য), ম্‌+দত > মত্ত (সন্ধি), শিঙ্‌নি > শিগ্‌নি > শিক্‌নি (কথ্য)।

কোন ধ্বনি উচ্চারণের শেষে কণ্ঠনালীর আকুঞ্চন হইলে অর্থাৎ একটু ঢোক গেলার মতো প্রযত্ন হইলে কণ্ঠনালীয়ভবন (Glottalization) বলে। পূর্ববঙ্গের অনেক স্থানে [ঘ, ধ, ভ] ধ্বনির যে উচ্চারণ শোনা যায় গc, ধc, বc তাহা এইরকম। সিন্ধী ও পাঞ্জাবী ভাষাতেও এই উচ্চারণ শোনা যায়। এরকম ধ্বনিকে বলে অবরুদ্ধ (Implosive বা Recursive)।

ধ্বনিপরিবর্তনের ফলে যদি পাশাপাশি অবস্থিত অক্ষরসংখ্যা কমিয়া যায় তবে সঙ্কুচন (Contraction) বলে। সং অন্ধকার > প্রা-বা অন্ধার; সং পরিষদ্‌ > পর্ষদ; সং কদলক > বা কলা। মধ্যস্বরলোপ হেতু সঙ্কোচন সং সুবর্ণ > স্বর্ণ; উপব্দ < উপপদ (বৈদিক); দারুপদ > দ্রুপদ, ইত্যাদি।

স্বরভক্তির ফলে অথবা অন্য উপায়ে এক অক্ষর একাধিক অক্ষরে পরিণত হইলে বিস্ফুরণ (Expansion) বলে। সংস্কৃত পর্যঙ্ক > ব্রজবুলি পরিষঙ্ক; সং প্রত্যাশা >ম-বা প্রতিআশ (অর্ধতৎসম)। মধ্য বাঙ্গালায় সৈন্য > সহিন্য। উপভাষায় শান (বাঁধানো ঘাট) > শাহান। তুলনীয় ওড়িয়া স্নাহান < স্নান, মাঙুস < মাংস, নুরুপ <নৃপ॥

৫. শব্দপ্রভাবিত ও অর্থানুগত

কথা বলিবার সময়ে ধ্বনিগুলি ছাড়া-ছাড়া ভাবে এক একটি করিয়া উচ্চারিত হয় না, ধ্বনিগুচ্ছরূপে অর্থাৎ পৃথক্‌ পৃথক্ পদসত্তায় প্রবাহিত হয়। বাক্যের সমগ্র অর্থের প্রতি মনোযোগ রাখিয়াই পদ অর্থাৎ অর্থবান্‌ ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারিত হয়। বক্তার ও শ্রোতার মনে বাক্যবদ্ধ পদগুলির পৃথক্‌ সত্তাবোধ আছে বটে, কিন্তু সেগুলি মনের ভাণ্ডারে এলোমেলো ছড়ানো থাকে না, যেন থাকে থাকে বা খোপে খোপে গোছানো থাকে। বাঙ্ময় মানুষের মনের অত্যন্ত স্বাভাবিক ধর্ম হইতেছে পদভাণ্ডারকে অর্থের দিক দিয়া যেন থাকে থাকে বা খোপে-খোপে গুছাইয়া রাখা। সুতরাং কোন খোপের সব পদ এক-একটি করিয়া মনে রাখিতে হয় না, প্রত্যেক খোপের বা থাকের দুই চারিটি পদ মনে রাখিলেই হয়। আবশ্যকমত সেই পদগুলির সাদৃশ্যে অর্থাৎ ছাঁচে বা ছাপে অপর পদ ইচ্ছামত গড়িয়া নেওয়া যায়। যেমন, ‘নাপতিনী’, ‘ধোপানী’ প্রভৃতি ব্যবসায়গত স্ত্রীত্ববোধক কয়েকটি শব্দ মনে রহিলে প্রয়োজনমত সেগুলির সাদৃশ্যে ‘মজুরানী’, ‘মাস্টারনী’ প্রভৃতি পদের যোগান সহজসাধ্য হয়। সংস্কৃতে ‘দেবতা’ ‘বন্ধুতা’, ইত্যাদি [-তা] প্রত্যয়ান্ত শব্দ “ভাব” অর্থজ্ঞাপন করে। এইসব শব্দের সাদৃশ্যে “মম (=আমার) ভাব” অর্থাৎ “আত্মপরতা” অর্থে ‘মমতা’ শব্দ নিষ্পন্ন হইয়াছে। সংস্কৃতে ‘বধূটি’ হইতে বাঙ্গালা ‘বউড়ী’ আসিয়াছে। পরে ইহার সাদৃশ্যে ‘শাশুড়ী’ এবং ‘ঝিউড়ী’ শব্দ উৎপন্ন হইয়াছে।

এইরূপে অর্থসম্বন্ধযুক্ত শব্দ বা পদ-সমষ্টির সহিত সামঞ্জস্য করিবার জন্য কোন শব্দের ও পদের ধ্বনি অথবা অর্থ-পরিবর্তন ঘটিলে তাহাকে সাদৃশ্য (Analogy) বলে। সাদৃশ্যের কার্য প্রধানত তিন প্রকার। নূতন শব্দ ও পদ গঠন, পুরাতন শব্দের ও পদের আকার পরিবর্তন, এবং পুরাতন শব্দের ও পদের অর্থ পরিবর্তন। পূর্বের অনুচ্ছেদে সাদৃশ্যের সাহায্যে নূতন শব্দ উৎপাদনের উল্লেখ আছে। এখন সাদৃশ্যের প্রভাবে শব্দের ও পদের আকার পরিবর্তনের আরও উদাহরণ দিতেছি। সংস্কৃতে স্বরান্ত শব্দের ষষ্ঠীর একবচনে শব্দের শেষ স্বরধ্বনি [অ ই উ ঋ ঔ] অনুসারে বিভিন্ন রকমের পদ নিষ্পন্ন হয়। যেমন, নরস্য, মুনোঃ, সাধোঃ, পিতৃঃ, নাবঃ ইত্যাদি। কিন্তু প্রাকৃতে অ-কারান্ত শব্দের সাদৃশ্যে সর্বত্র একই রূপ পাওয়া যাইতেছে। যেমন, ণরস্‌স, মুণিস্‌স, সাহুস্‌স, পিউস্‌স, ণাবস্‌স। পুরানো বাঙ্গালায় ষষ্ঠীর বহুবচনে ‘আহ্মার’, ‘তোহ্মার’ পদ দুইটির সাদৃশ্যে ‘সবার’ হইয়াছে ‘সহ্মার’ (বিকল্পে)।

নূতন শব্দের সৃষ্টিতে যেমন, পুরাতন শব্দের অর্থপরিবর্তনেও তেমনি, সাদৃশ্য বিশেষ কার্যকর। “অন্তরিক্ষ”-বাচক বৈদিক ‘রোদসী’ শব্দের সাদৃশ্যে রবীন্দ্রনাথ ‘ক্রন্দসী’ শব্দের প্রয়োগ করিয়াছেন। উদাহরণ কোন ভাষাতেই অসুলভ নয়।

ভাষার বিবর্তনে ও বিকাশে সাদৃশ্যের প্রভাব আদিকাল হইতে সমানভাবে চলিয়া আসিয়াছে। আদিম অবস্থায় ভাষায় ব্যাকরণসুলভ সামঞ্জস্য বেশি ছিল না বলিয়া অনুমান হয়। সাদৃশ্যের প্রভাবেই মানুষের মন বিশৃঙ্খল ও পরম্পর-অসম্বন্ধ পদগুলিকে গুছাইয়া ব্যাকরণের গুচ্ছে বাঁধিয়াছে এবং ক্রমে ক্রমে পদের রূপবাহুল্য কমাইয়া আনিয়া ব্যাকরণভার লঘু করিয়াছে। বাগ্‌যন্ত্রের ও শ্রবণ-শক্তির বৈষম্য ইত্যাদি স্বাভাবিক কারণবশে নিয়তই ভাষাপরিবর্তনের যে অজস্র অবকাশ ঘটিতেছে তাহা যদি সাদৃশ্যের দ্বারা প্রতিহত না হইত তবে কোন ভাষা বেশিদিন অবিকৃত থাকিতে পারিত না। প্রধানত সাদৃশ্যই (অর্থাৎ মানবমনের নিগূঢ় সামঞ্জস্যবোধ) উৎকেন্দ্রিকতা হইতে রক্ষা করিয়া ভাষাকে ব্যবহারযোগ্য শক্তি ও স্থায়িত্ব দান করিতেছে।

সাদৃশ্যবোধ ভাষাজ্ঞানে শিশুর চৈত্ত্য গুরু। সাদৃশ্যের সাহায্যে নূতন শব্দের যথেচ্ছ সৃষ্টিতে শিশুর অবাধ অধিকার। কিন্তু অনাবশ্যক বলিয়া শিশু-সৃষ্ট শব্দ ব্যবহারে আসে না। শিশুর মতো অশিক্ষিতের অর্থাৎ যাহাদের ভাষায় অল্প প্রবেশ হইয়াছে এমন লোকের মুখেও সাদৃশ্যসৃষ্ট শব্দ বেশি শোনা যায়। সাহিত্যে হাস্যরস যোগানো ছাড়া এইরূপ অশিক্ষিতসৃষ্ট শব্দের কোন স্থান নাই। দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’তে ইহার একটি সুন্দর উদাহরণ মিলিতেছে। ইংরেজী পড়িতে গিয়া পূর্ববঙ্গ-নিবাসী রামমাণিক্য বড়ই গোলমালে পড়িয়াছিল। তাহার বিষম সমস্যা ছিল এই—“মর্দাগোর পের্‌লাউনে ‘হি, হিজ্‌, হিম্‌’ অইচে; মাইয়াগোর নামে ‘শি, হার্‌, হার্‌’ কইচে; যদি মর্দাগোর পের্‌লাউনে ‘হি, হিজ, হিম’ অইল, তবে মাইয়াগোর “শি, শিজ্‌, শিম্‌’, অইব না ক্যান্‌?”

বহুশব্দের সাদৃশ্যে না হইয়া যদি একটিমাত্র শব্দের প্রভাবে অপর কোন শব্দের রূপপরিবর্তন হয়, তবে তাহাকে বিমিশ্রণ (Contamination) বলে। যেমন, পোর্তুগীস ‘আনানস্‌ (annanas) ‘রস’ প্রভাবে বাঙ্গালায় ‘আনারস’। (অবশ্য এখানে বিষমীভবনের প্রভাবও থাকিতে পারে)। অপর উদাহরণ—‘ঝটিৎ’ (রবীন্দ্রনাথ) ‘তড়িৎ’ শব্দের প্রভাবে; ‘তিয়াষ’ (ঐ) ‘তৃষ্ণা’র প্রভাবে। অনেক সময় মিশ্রণের ফলে ভুল বানানোর সৃষ্টি হয়। ‘কালিদাস’-এর নজিরে শিক্ষিত লোকের লেখনীতেও অনেক সময় ‘কালিপ্রসন্ন’, ‘চণ্ডিদাস’ বাহির হয়।

দুইটি শব্দ কাটাজোড়া করিয়া একটি নতুন শব্দ নির্মিত হইলে বলে জোড়কলম এবং এইরূপে উৎপন্ন শব্দকে বলে জোড়কলম শব্দ (Portmanteau Word)। আসলে বিমিশ্রণ ও জোড়কলম মোটামুটি একই ব্যাপার। বিমিশ্রণে উপাদান অংশ দুইটি তুল্যমূল্য নয়, জোড়কলমে তাহা তুল্যমূল্য। জোড়কলম যেমন—শ্যাম+শ্বেত>শ্যেত (বৈদিক); জহার+বভার>জভার (ঐ); সম্যক্‌+সোম্য>সন্ম (পালি); আরবী মিন্নৎ+সংস্কৃত বিজ্ঞপ্তি (>প্রাকৃত বিন্নত্তি) >বাঙ্গালায় মিনতি; অরি+বৈরী > মধ্য-বা ঐরি; পয়োধর+ভার > পয়োভার (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন); নিশ্চল+চুপ >নিশ্চুপ (রবীন্দ্রনাথ); জেদী+তেজালো (জোরালো) > জেদালো (রবীন্দ্রনাথ); মৈত্রী+মিতালি > মৈতালি; পৃথু+স্থূল >পৃথুল; উন্মুখ+মুখর > উন্মুখর; ইং slip+glide>slide ইত্যাদি।

বিভিন্ন ভাষা অথবা একই ভাষার বিভিন্ন শব্দও ও শব্দাংশ (প্রত্যয়, উপসর্গ ইত্যাদি) মিলাইয়া নূতন শব্দ গঠিত হইলে তাহাকে সঙ্কর শব্দ (Hybrid Word) বলে। যেমন, ‘কহতব্য’, (বাঙ্গালা ‘কহ্‌’ ধাতুতে সংস্কৃত-‘তব্য’ প্রত্যয়); ‘নিখরচা’ (বাঙ্গালা উপসর্গে ফারসী শব্দ যোগ); ‘মাষ্টারী’ (ইংরেজী শব্দে বাঙ্গালা প্রত্যয়), ‘অকাট্য’ (বাঙ্গালা ধাতুতে সংস্কৃত প্রত্যয় ও উপসর্গ যোগ); ওড়িয়া ‘নিজোর’ ( =দুর্বল, দেশি উপসর্গ+ফারসী শব্দ।)

অনেক সময় দেখা যায় যে, দুরুচ্চার্য ও অপরিচিত শব্দ অল্পবিস্তর ধ্বনিসাম্যের সুযোগ পাইয়া পরিচিত শব্দের সাদৃশ্য লাভ করিয়াছে। এইরূপ শব্দ বিকৃতিকে বলে লোকনিরুক্তি (Folk-etymology)। যেমন, প্রাচীন বৈদিকে মাকড়সার নাম ছিল ‘ঊর্ণবাভ’ অর্থাৎ “যে কীট ঊর্ণা বয়ন করে”; পরে বয়নার্থক [বভ্‌] ধাতু (ইংরেজী weave) অপ্রচলিত হইয়া পড়ায় এবং মাকড়সা লুতাতন্তুর মাঝখানে, নাভিতে থাকে বলিয়া সহজেই শব্দটি ঊর্ণনাভ-এ রূপান্তরিত হইয়াছিল। ইংরেজী আর্ম্‌চেয়ার (armchair) বাঙ্গালায় ‘আরাম চেয়ার’ বা ‘আরাম কেদারা’ হইয়াছে, কেননা এই চেয়ারে বসা আরামের। ইংরেজী হসপিটাল (hospital) নিছক ধ্বনি-সাম্যের ফলেই বাঙ্গালায় ‘হাঁসপাতাল’ হইয়াছে। ‘বিষ’-এর প্রভাবে সংস্কৃত ‘বিস্ফোটক’ বাঙ্গালায় ‘বিষফোড়া’য় দাঁড়াইয়াছে। ‘হাতে-নাতে ধরা পড়া’ এই বাক্যাংশে ‘নাতে’ আসলে ছিল ‘নোতে’ (সং=লোপ্‌ত্র অর্থ, “চোরাই মাল”), ‘হাতে’ শব্দের সাদৃশ্যে ‘নাতে’ হইয়াছে। লোকনিরুক্তির প্রভাবে শব্দের চেহারা যে কতটা বদলাইয়া যায় তাহার একটি ভালো উদাহরণ আধুনিক ‘রূপটান’। শব্দটির মূলে আছে সংস্কৃত ‘উর্দ্বত্তন’ (অর্থ “মর্দিত অঙ্গরাগ লেপ”), প্রাকৃতে ‘ঊব্বট্টণ’, মধ্য-বাঙ্গালায় ‘উবটন’। বাঙ্গালায় দৈবাৎ শব্দের আদি স্বরধ্বনির পূর্বে র-কারের আগম হয়। এখানেও তাহাই হইয়া শব্দটি হইল *’রুবটন’। তাহার পর ‘রূপ’ এবং টান’ এই দুই শব্দের প্রভাবে ইহা ‘রূপটান’-এ পরিণত হইয়াছে। ‘টাকার কুমীর’ এর ‘কুমীর’ আসিয়াছে ‘কুবের>কুবির’ হইতে। এখানে দেব ধনাধিপতির নামে ধ্বনি-পরিবর্তন আনিয়াছে। এইরূপ, ন-পাৰ্যমাণে >নাপার জীবনে। ইংরেজী violin বাঙ্গালায় একদা ‘বাহুলীন’ হইয়াছিল। প্রাচীন একটি অক্ষর ভুল পড়ার ফলে পুরানো ইংরেজীতে ye (আধুনিক the) শব্দটি উৎপন্ন হইয়াছিল। সংস্কৃত ‘পক্ষর’ (=ডানার মতো পক্ষযুক্ত, অর্থাৎ বর্মপরিহিত) যুদ্ধের ঘোড়ার (এবং সৈনিকের) বিশেষণ ছিল। মধ্য-বাঙ্গালায় ইহা দাঁড়াইয়াছিল ‘পাখর’। পরে ‘পাখর’ শব্দটির অর্থ এবং বর্মযুক্ত ঘোড়ার স্মৃতি বিলুপ্ত হওয়ায় রূপকথায় ‘পাখর (ঘোড়া)’ অলৌকিক দ্রুতগামী অশ্ব বুঝাইতে লাগিল। পাখি বিনা বাধায় যেখানে খুশি উড়িয়া যাইতে পারে, তাই ‘পাখর (ঘোড়া)’ হইল ‘পক্ষরাজ (ঘোড়া)’। শব্দটি এখন হইয়াছে “পক্ষীরাজ”।

লোকব্যুৎপত্তিতে শব্দকে ছাঁটকাটও করা যাইতে পারে। যেমন, অপূর্ব কথা>অপূরুব কথা>অপরূপ কথা>(‘অপ’ বাদ দিয়া) রূপকথা। ‘রূপকথা’ আবার ‘র’-বাদ দিয়া ‘উপকথা’।

শব্দের ব্যুৎপত্তিকল্পনা বুদ্ধিমান্‌ মানুষের মনের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তির বশে কোনো বহুপ্রচলিত নামের অংশ অপ্রচলিত হইয়া পড়িলে তাহা পরিচিত শব্দের রূপ গ্রহণ করিতে পারে। যেমন, স্থান-নাম ‘উল্‌টাডিঙ্গি’ (যেখানে একদা একটা ডিঙ্গি উল্‌টাইয়াছিল)। কলকাতার এই অঞ্চল এখন বসতিভূমি, এখানে ডিঙ্গির সম্বন্ধ এখন অকল্পনীয়। তাই এখন নামটি হইয়াছে ‘উলটাডাঙ্গা’।

শিক্ষিত ব্যক্তির মুখে সাদৃশ্যের প্রভাবে বাক্যাংশের অথবা শব্দের বিশ্লেষণ-বিকৃতির ফলে কখনো কখনো শব্দের রূপও পরিবর্তিত হয়, অথবা নূতন প্রত্যয়ের কিংবা নূতন শব্দের উদ্ভব হয়। এইরূপ শব্দবিকারের নাম বিষমচ্ছেদ বা নিষ্কালন (Metanalysis)। সংস্কৃত ‘নবরঙ্গ’ ফারসী ‘নারাঙ্গ’; তাহা হইতে আরবী ‘নারাঞ্জ’ তাহা হইতে আধুনিক ইংরেজীতে an orange (“একটি কমলালেবু”)। এইভাবে norange শব্দ দাঁড়াইল orange-এ। ‘অসুর’ শব্দ মৌলিক। ইহার প্রথম অক্ষরকে নঞর্থ উপসর্গ মনে করিয়া বিষমচ্ছেদের ফলে ‘সুর’ (=দেবতা) শব্দ উৎপন্ন। ‘বিধবা’ শব্দও মৌলিক। পরবর্তী কালে ‘বি-ধবা’ এইরূপ বিষমচ্ছেদ হইতে “পতি” অর্থবাচক ‘ধব’ শব্দের উৎপত্তি। এইরূপে নি+ধুবন>নিধু+বন। সম্বন্ধবিভক্তি ভ্রমে শেষে র-কার ত্যাগ করিয়া ফারসী ‘মুহরির’, ‘বর্গির’ বাঙ্গালয় হইয়াছে ‘মুহুরি’, ‘বর্গি’। লার্টিন ‘পিসুম’ > ইংরেজী pcase, তাহা হইতে pea—বহুবচন বিভক্তি ভ্রমে অন্ত্য স-কার বাদ দিয়া। ‘সদৃশ’ হইতে উৎপন্ন ‘সরেশ’ বিষমচ্ছিন্ন হইয়া বিপরীতার্থক ‘নিরেশ’ উৎপন্ন করিয়েছে। (তবে ইহাতে ‘নীরস’ শব্দের প্রভাবও আছে।) বিষমচ্ছিন্ন শব্দের একটি চমৎকার উদাহরণ উড়িয়া ‘মেবচ্চ’ (উচ্চতম সংখ্যা), এটি আসিয়াছে একটি সংখ্যাবাচক শব্দমালা-শ্লোকের শেষাংশ হইতে (“—কোটিরর্বুদমেবচ”)।

‘অট্টহাস’, ‘অট্টহাস্য’ হইতে নিষ্কালন করিয়া রবীন্দ্রনাথ ‘অট্ট’ শব্দটি স্বাধীনভাবে ব্যবহার করিয়াছেন। যেমন, ‘অট্ট গরজে’, ‘অট্ট হাসিয়া’, ‘অট্টবিদ্রূপ’ ইত্যাদি।

বাঙ্গালা [মন] (স্বাধীন শব্দ এবং প্রত্যয় দুই রূপেই প্রচলিত), এবং [মত] ও [হেন] বিষমচ্ছেদ হইতে উৎপন্ন। সংস্কৃত [ঈয়ন্ত্‌, তাবন্ত্‌, যাবন্ত্‌] হইতে উৎপন্ন বাঙ্গালা [এমন, তেমন, যেমন] ভাঙ্গিয়া [-মন], [-মত], উৎপন্ন হইয়াছে। যেমন, কোনো-মনে (ম-বা); হেন-মত, সেই-মত, কোনোমতে, ইত্যাদি। সংস্কৃত [*যাদৃশ্ন, *এদৃশ্ন, *কীদৃশ্ন] ইত্যাদি হইতে উৎপন্ন বাঙ্গালা [যেহেন, এহেন, কেহেন] ভাঙ্গিয়া বাঙ্গালা [-হেন] উদ্ভূত। যেমন, “পাগল হেন” [রবীন্দ্রনাথ]।

সংস্কৃত উ-কারান্ত শব্দে যৎপ্রত্যয় হইলে বিশেষ সন্ধির নিয়মে উ-কার এবং য-কার মিলিয়া [-ব্য] হইয়া যায়। যেমন, পশু ( +য)—পশব্য, তালু (+য)—তালব্য। এমন শব্দগুলি হইতে [ব্য] অংশ নিষ্কালিত করিয়া নূতন প্রত্যয়রূপে ব্যবহার করিয়া নূতন শব্দ তৈয়ারি হইল—পিতৃব্য, ভ্রাতৃব্য, মৃগব্য। এইরূপে ‘পথ্‌+য >পথ্য, রথ্‌+য >রথ্য’ হইতে [‘থ্য’] বাহির করিয়া নূতন প্রত্যয়রূপে ‘অজথ্য’ (> অজ+থ্য, “অজায় হিতম্‌”), ‘অবিথ্য’ (> অবি+থ্য, “অবয়ে হিতম্‌”) এই দুই শব্দে ব্যবহৃত হইয়াছে।

উচ্চারণের, বানানের অথবা অর্থের সাদৃশ্যে এবং ভ্রান্তিবশে কখনো কখনো বিদেশি শব্দ নিজস্ব বলিয়া মনে হয় এবং সেইমত রূপান্তর গ্রহণ করে। যেমন এখন ইংরেজীতে (শুধু এদেশে চলিত) bearer শব্দ। এর মূলে আছে বাঙ্গালা শব্দ ‘বেহারা’, সংস্কৃত “ব্যবহারক” (অর্থাৎ কর্মচারী ভৃত্য)।

লোকনিরুক্তির বশে অথবা অন্য কারণে এমন নূতন শব্দ সৃষ্টি হইতে পারে যাহার বাস্তবিক কোন-ই মূল নাই। এমন শব্দকে বলা হয় ভূয়া শব্দ (Ghost Word)। যেমন সাধুভাষায় ‘প্রোথিত’। সংস্কৃতে কোনো ‘প্রোথ’ ধাতু নাই। শব্দটি বাঙ্গালা ‘পোতা (পোঁতা)’ শব্দের পূর্বরূপ প্রাকৃত শব্দের আধারে কল্পিত। তেমনি সংস্কৃত আহ্বান >প্রাকৃত *আহবান > সাধু-ভাষায় ‘আবাহন’। সংস্কৃত নীরাজন (—প্রাচীন কালে আশ্বিন অথবা কার্তিক মাসে যুদ্ধযাত্রার প্রারম্ভে রাজারা অস্ত্রশস্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে ধুইয়া মাজিয়া লইতেন এবং হাতিঘোড়াকে জলাভিষিক্ত করিতেন। সেই অনুষ্ঠান, নীরমজ্জন >প্রাকৃত *নীরঁজ্জন>সাধুভাষায় ‘নিরঞ্জন’।

বিদেশি অথবা অবিদেশি কোনো প্রাপ্ত শব্দকে প্রাচীনতর রূপ দিয়া আত্মসাৎ করিয়া ভদ্র রূপ দিবার ফলে যে শব্দ উৎপন্ন হয় তাহাকে বলিতে পারি পুনর্গঠন (Back-formation)। যেমন, বিদেশি শব্দ প্রাকৃত ‘তুরুক্ক’ হইতে ‘তুরষ্ক’; গ্রীক kamelos হইতে সংস্কৃত ‘ক্রমেলক’ (প্রাকৃত ‘কমেলঅ’ মধ্য দিয়া); প্রাচীন সংস্কৃত ‘বিভীতক’ হইতে জাত প্রাকৃত ‘বহেডঅ’ হইতে অর্বাচীন সংস্কৃত ‘বহেদক’, ‘বহেটক’, ইত্যাদি।

সমমুখ ধ্বনি-পরিবর্তনের (Convergent Phonemic Change) ফলে বিভিন্ন শব্দ একই রূপ লইতে পারে। এমন একরূপ শব্দকে বলা হয় সমরূপ (Homonym)। যেমন, (১) সং পীতল (> পিত্তল) ও (২) প্লীহ্‌ন হইতে বা পীলা (“পীলা রঙ”, “পেটে পীলে”); সং (১) বয়ন ও (২) বপন হইতে বা বোনা (“কাপড় বোনা”, “ধান বোনা”); সং (১) বাতুল ও (২) ব্যাকুল হইতে বা বাউল (“আমি এক বাউল তুমি দ্বিতীয় বাউল”, “বাউল হইলাম আমি ধৈর্য-নাহি মনে”); আটা (=“গোধূম-চূর্ণ” এবং “কাগজ জুড়িবার লেই”); ডাল (=“ভোজ্যবিশেষ” এবং “বৃক্ষের শাখা”); জান (=“জানীহি” এবং “বিজ্ঞ”); বই (=“পুস্তক”, “ব্যতীত” এবং “বহন করি”); সই (“সখী” “সহ্য করি” এবং দস্তখত” ) ইত্যাদি।

ধ্বনিতে একরকম হইলেও যদি বানানে পার্থক্য থাকে তবে সে সব শব্দকে সমধ্বনি (Homophone) বলে। যেমন, সং সুবর্ণ >বা সোনা; শ্রবণ > শোনা; পঠন, পতন >ম-বা পঢ়ন, পড়ন (আ-বা সমরূপ ‘পড়ন’); বা যায় (=গমন করে), জায় (=যোগফল) <সং যাতি, < ফা জায়; বা শান, সান < সং শাণ, সংজ্ঞা; ইত্যাদি।

বিমুখ ধ্বনি-পরিবর্তনের (Divergent Phonemic Change) ফলে এক শব্দ কালক্রমে একাধিক রূপ ধারণ করিতে পারে অথবা বিভিন্ন শব্দ একই রূপ লইতে পারে। এমন শব্দ দুইটি হইলে যমক (Doublet), তিনটি হইলে ত্রিক (Triplet), তাহার বেশি হইলে গুচ্ছক (Multiplet)।

যমকের উদাহরণ: সং‘মেঢ্রক’>বা মেড়া, ভেড়া; সং ক্ষার >বা খার, ছার; সং ব্রাহ্মণ > বা বামুন, ভোজপুরী বাভন; সং গ্রন্থ (গ্রন্থি) >বা গাঁথ, গাঁঠ; সং ঘটিকা >বা ঘড়ি, ঘটী; সং ঊর্ধ্ব >প্রা উব্‌ভ, উদ্‌ধ; সং ভণ্ড > বা ভাঁড়, ভান; ইত্যাদি।

ত্রিক ও গুচ্ছকের উদাহরণ: বাঙ্গালা বল (অনুজ্ঞা), বল (বল =শক্তি), বল (ball); বাড়ি ( =ঘর), বাড়ি ( =লাঠি), বাড়ি ( =শস্য ধার দেওয়া); বাড়ি (ক্রিয়াপদ); মধ্য-বাঙ্গালা দে (=দেব), দে (=দেহ), দে (অনুজ্ঞা); যা (অনুজ্ঞা), যা ( =দেবরপত্নী), যা (=যাবৎ); কড়া ( =কঠিন), কড়া ( =লৌহপাত্র), কড়া ( =লোহার বালা), কড়া (কড়ি, সংখ্যা)॥

৬. শব্দদ্বৈত

বাঙ্গালার মতো কোনো কোনো ভাষায় শব্দদ্বৈত একটি বিশেষ লক্ষণ বলা যায়। শব্দদ্বৈত মানে একক শব্দের স্থানে জোড়া শব্দের ব্যবহার। জোড়া শব্দের শেষ অংশ অনুসারে দ্বৈতশব্দের তিন শ্রেণী—অনুকার, অনুগামী ও সমার্থক-অনুগামী।

সমাসের মতো দেখিতে কোনো কোনো শব্দের দ্বিতীয়াংশ প্রথম অংশেরই ঈষৎ পরিবর্তিত রূপ, এবং প্রতিধ্বনির মতো। অর্থ—‘ইত্যাদি’। এমন প্রতিধ্বনিযুক্ত শব্দকে বলে অনুকার শব্দ (Echo Word)। অনুকার শব্দের ব্যবহার আধুনিক বাঙ্গালা ভাষার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। যেমন, ভাতটাত, চাকরবাকর, বইফই, বুড়িশুড়ি; ইত্যাদি। অবজ্ঞা অথবা বিরক্তি বুঝাইতেই ফ-কারযুক্ত অনুকার ব্যবহার হয়। যেমন ‘গানটান আমার আসে না’, কিন্তু ‘তোমাদের ওসব গানফান এখন রেখে দাও’।

অনুকার শব্দের মতো কোনো কোনো শব্দ দ্বন্দ্ব-সমাসের দ্বিতীয়াংশ রূপে ব্যবহৃত হয়। এমন শব্দকে বলা হয় অনুগামী শব্দ (Dependent বা Tag Word)। যেমন, গাছগাছড়া, রাজারাজড়া, পাখিপখালি, ছেলেপিলে, নাতিনাতকুড়।

যদি দ্বিতীয় পদটির স্বাধীন ব্যবহারও থাকে তবে তেমন শব্দকে বলা যায় সমার্থক অনুগামী শব্দ (Tautologous Compound)। যেমন, কুলিকামিন, মাপজোখ, গাছপালা, দাবিদাওয়া, লেখাজোখা, ভাইভায়াদ, ধারেকাছে ইত্যাদি॥

৭. ধ্বন্যাত্মক শব্দ

শব্দের উচ্চারণে অর্থের সঙ্গে সঙ্গে কোন বাহ্যবস্তুর ধ্বনিও ঝঙ্কৃত হইলে তাহাকে ধ্বন্যাত্মক শব্দ (Onomatopoeic Word) বলে।

বাঙ্গালায় ধ্বন্যাত্মক শব্দ ভাব বা ক্রিয়া বুঝাইলে আম্রেড়িত হয়। ‘কট্‌’ শব্দটি ধ্বনিমাত্র বুঝায়, কিন্তু ‘কট্‌কট্‌’ বলিলে হঠাৎ-বেদনার স্পন্দন অথবা ক্রিয়া বোঝায়। এইরকম আম্রেড়িত ধ্বন্যাত্মক শব্দে বিশেষ বিশেষ ব্যঞ্জন ও স্বর ধ্বনিতে কিছু প্রতীকপ্রবণতা (Symbolism) লক্ষ্য করা যায়। যেমন (১) ট ( =বিচ্ছিন্ন ধ্বনি): ড় (=টানা ধ্বনি)। গট্‌গট্‌: গড়্‌গড়্‌; পট্‌পট্: পড়্‌পড়্‌; হুট্‌হুট্‌: হুড়্‌হুড়্‌; চট্‌চট্‌: চড়্‌চাড়্‌; খট্‌খট্‌: খড়্‌খড়্‌ ইত্যাদি। [ট-ড়]-এর এই বৈপরীত্য অনুকার পর্যায়ের ধ্বন্যাত্মক শব্দেও লক্ষিত হয়। যেমন, সে দাঁত কট্‌মট্‌ করিল: সে কড়্‌মড়্‌ করিয়া হাড় চিবাইল।

ধ্বন্যাত্মক শব্দ

কোন কোন ধ্বন্যাত্মক শব্দ পুরাপুরি ধ্বন্যাত্মক নয়, কোন সাধারণ শব্দগর্ভ। যেমন, মিশ্‌মিশে (কালো); এখানে ‘মিশি’ শব্দ লুকানো আছে। ধবধবে (সাদা), এখানে ধোয়া (বা ধোবা) শব্দ ভিতরে আছে। গনগনে (আগুন), এখানে আগুন শব্দের রেশ আছে॥

৮. ধ্বনির ভাবদ্যোতকতা (Sound Symbolism)

উপরে শব্দদ্বৈতের আলোচনা হইতে উপলব্ধ হইবে যে অর্থের মাত্রা (বা ভাব) অনেক সময় নির্ভর করিতেছে বিশিষ্ট ধ্বনির উপর। ধ্বনিবিশেষের এমনি ভাবনির্ভরতা শব্দদ্বৈত ছাড়াও অন্যত্র দেখা যায় আধুনিক বাঙ্গালা ভাষায়। যেমন, একজনের নাম শিব, তাহাকে আদর করিয়া সম্ভাষণ করিতে গেলে সে ‘শিবু’, আর ঘনিষ্ঠ অথবা তাচ্ছিল্য করিয়া ডাকিলে সে ‘শিবে’ (পুরানো বাঙ্গালা ‘শিবা’ হইতে)। তেমনি, বট (বটকৃষ্ণ) >বটু: বটা; নর (নরেন্দ্র, নরহরি) >নরু: নরা; বীর (বীরেন্দ্র) >বীরু: বীরে ইত্যাদি।

উ-কার ধ্বনির এই আদর-ভাবপ্রকাশ ক্ষুদ্র শিশুদের প্রতি ব্যবহৃত শব্দে ও বাক্যেও দেখা যায়। যেমন, খুকী >খুকু; দুধ > দুধু; নাক > নাকু (“নাকুর বদলে নরুন”) ইত্যাদি।

ধ্বন্যাত্মক শব্দ-তালিকা হইতে বোঝা যায় যে আদি অক্ষরে ই-কার ক্রিয়ার ক্ষীণতা, উ-কার স্বল্পতা এবং এ-কার (অ-কার জাত) অননুমোদিত প্রাচুর্য বোঝায়। যেমন, ঝরঝর > ঝিরঝির: ঝুরঝুর: ঝ্যারঝ্যার; পটপট (ক’রে চেয়ে থাকা) > পিটপিট: পুটপুট: প্যাটপ্যাট; ইত্যদি॥

৯. নিরঙ্কুশ শব্দসৃষ্টি

সম্পূর্ণ নূতন সৃষ্ট শব্দ সব ভাষাতেই অত্যন্ত দুর্লভ, নাই বলিলেই হয়। উদাহরণের মধ্যে ইংরেজী [gas] সর্বজনপরিচিত।

বাক্যাংশের আদিধ্বনিসমাহারে সৃষ্ট হইলে বলে মুণ্ডমাল শব্দ (Acrostic Word, যেমন, ইংরেজী Radar (=Radio Detection And Ranging), Unesco ( =United Nations Educational Scientific and Cultural Organigation); okay (O.K.=All Correct) ইত্যাদি। ‘বি এ’ (B. A.), ‘এম্ এ’ (M. A.) ইত্যাদি ছাড়া বাঙ্গালায় উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হইল ‘পিপুফুশু’ ও ‘সসেমিরা’। প্রথম শব্দটি দুই কুঁড়ের সংলাপের, দ্বিতীয়টি একটি পুরানো গল্পের চারটি শ্লোকের, প্রথম অক্ষরের সমবায়ে উৎপন্ন। পুরানো দলিলের ভাষায়—‘তদ’ (তদ্‌ দক্ষিণ), ‘তদু’ ( =তদ্‌ ‘উত্তর), ‘তপ’ ( =তৎ পশ্চিম), ‘তপু’ (তৎ পূর্ব)।

এই প্রসঙ্গে বর্ণমালার অক্ষরসমবায়ে সৃষ্ট একটি শব্দের উদাহরণ দেওয়া যায়—‘হযবরল’ ( =অত্যন্ত বিপর্যস্ত)। এইভাবে চর্যাগীতিতে সুপরিচিত ‘আলি’, ‘কালি’ আদি স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণ লইয়া গঠিত॥

১০. বাক্যশব্দ

কখনো কখনো সমগ্র বাক্য অথবা বাক্যাংশ অর্থপরিবর্তন করিয়া একটিমাত্র শব্দে পরিণত হয়। যেমন, লাটিন non par “অ-সমান>অতিরিক্ত” ইংরেজীতে হইয়াছে umpire “জয় পরাজয়ে নির্লিপ্ত ব্যক্তি”>ক্রীড়ায় বা বিবাদে মধ্যস্থ” ফারসী ‘ন অস্ত্‌ ন বুদ্‌’ অর্থাৎ “না আছে না ছিল”>বাঙ্গালা ‘নাস্তানাবুদ্‌’; ‘ইতি হ আস’ “এইরকমই ছিল” >‘ইতিহাস’; ‘কিং বদন্তি’ “কি বলে (লোকে)”>‘কিংবদন্তী’; ‘যা ইচ্ছা তাই’>‘যাচ্ছেতাই’; ‘কে ও কে-টা’>‘কেওকেটা’; ‘যৎ পরঃ ন অস্তি’>‘যৎপরোনাস্তি’; ‘তৎ ন তৎ ন’>তন্নতন্ন’; ‘অদ্য ভক্ষ্যো ধনুর্গুণ’, (হিতোপদেশের গল্পের শ্লোকের শেষাংশ)>‘অদ্যভক্ষধনুর্গুণ’ (অর্থ, “নিঃস্ব ব্যক্তি”); কথ্যভাষায়—‘গয়ং-গচ্ছ’ (“যাচ্ছি-যাব-ভাব দীর্ঘসূত্রিতা”)<গতং গচ্ছ; ‘ত্রাহিরাম’ (“ত্রাণ কর রাম”) (ব্যক্তিনাম); ‘অথবা’ (<অথ বা), ‘কিন্তু’ (<কিং তু); ‘কদাচ’ ( <কেদা চ); ‘কিঞ্চিৎ’ (কিং চিৎ); বা ‘কিছু’, ম-বা ‘কিছ’ (<কিং চ); ‘যদিচ’ (<যেদি চ); ‘যদ্যপি’ (<যেদি অপি); ‘নস্যাৎ’ ( <ন স্যাৎ)। সং নাস্তিক শব্দটি ন অস্তি (<নাস্তি) এই বাক্য হইতে উদ্ভূত। মানে হইল ‘ঈশ্বর নাই এই যাহার বিশ্বাস’। সংস্কৃত ‘অস্তিক্ষীরা’ ( <অস্তি ক্ষীরম্‌ (“যে নারীর স্তনদুগ্ধ আছে”)॥

সিদ্ধ-বানান ও শুদ্ধ-বানান সর্বদা এক না হইতে পারে। সংস্কৃতে শুদ্ধ-বানানই সিদ্ধ-বানান, কিন্তু বাঙ্গালায় তৎসম শব্দ ছাড়া অন্যত্র সিদ্ধ-বানান শব্দবিদ্যা অনুসারে শুদ্ধ-বানান অনেক সময় নয়। যেমন, ‘যায়’ (=জায়), ‘সহর’ (শহর), ইত্যাদি।

সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দের মুসলমান লেখকেরা সকল সংসার বুঝাইতে ‘সয়াল সংসার’ লিখিয়াছেন। এইখানে য়-শ্রুতি সিদ্ধ বানানে ঢুকিয়াছে।

মার্কিন ভাষাতাত্ত্বিকেরা ‘প্রগত’ ও ‘পরাগত’ পরস্পর বিপরীত অর্থে ব্যবহার করেন।

অপিনিহিতি, অভিশ্রুতি ও অপশ্রুতি এই নাম তিনটি শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের সৃষ্টি।

৩৬ পৃষ্ঠার স্বরধ্বনি-চিত্র দ্রষ্টব্য।

সাদৃশ্যের প্রসঙ্গ পূর্বে।(পৃ ২৮) দ্রষ্টব্য।

‘ক্রন্দসী’ শব্দ বেদে আছে বটে, কিন্তু সেখানে অর্থ “চীৎকারী বিপক্ষ সেনাদ্বয়” (“যং ক্রন্দসী সংযতী বিহ্বয়েতে পরোহবর উভয়া অমিত্রা” ঋক্‌সংহিতা ২-১২-৮)।

শ্ৰীমতী সুনন্দা দত্ত প্রণীত ‘রবীন্দ্রকাব্যভাষা’ (১৯৬১) পৃ ২৩৫।

ঐ পৃ ২৭৩।

ঐ পৃ ২৫৬।

ঐ পৃ ২২০।

রবীন্দ্র-কাব্যভাষা পৃ ২০৮।

যেমন বাঙ্গালায় ‘বিদায়’, ‘বেশ’, ‘কম’, ‘আস্তে’ ইত্যাদি।

ধ্বনি-পরিবর্তনের সহযোগে শব্দার্থ পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন শব্দের উৎপত্তির একটি কৌতুকাবহ উদাহরণ পাই সংস্কৃত ‘শৃঙ্গবের’ শব্দের বিদেশি রূপান্তরে। গ্রীকে শব্দটি হইয়াছে ‘জিঙ্গিবেরিস’। তাহা হইতে ল্যাটিন ‘জিঙ্গিবের’ এবং তাহা হইতে (১) জাঞ্জিবার দ্বীপের নাম, (২) ইংরেজী ginger, (৩) স্পেনীয় denger (ন্যাকামী, ছিনালী”), বাঙ্গালায় ডেঙ্গু (রোগ)।

‘পিঠ পুড়ে।” “ফিরে শুই।”

“সদ্ভাবপ্রতিপন্নানাং বঞ্চনে কা বিদগ্ধতা। অঙ্কে কুমারমারোপ্য হত্বা কিং নাম পৌরুষম্‌॥

সেতুবন্ধে সমুদ্রে চ গঙ্গাসাগরসঙ্গমে। ব্রহ্মহা মুচ্যতে পাপৈর্মিত্রদোহী ন মুচ্যতে॥

মিত্রদ্রোহী কৃতঘ্নশ্চ যে চ বিশ্বাসঘাতকাঃ। তে সর্বে নরকং যান্তি যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ॥

রাজাসি রাজপুত্রোহসি যদি কল্যাণমিচ্ছসি। দেহি দানং দ্বিজাতিভ্যো দেবতারাধনং কুরু॥”

তদ্ভব রূপে ‘যারপর নাই’। সংস্কৃত সমাসবদ্ধ পদটি বাঙ্গালার অনুবাদ হওয়াই সম্ভব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *