ধম্ম
কিন্তু বুদ্ধের শিক্ষাদানের প্রথম প্রয়াস সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। গয়া যাবার পথে উপকা নামের পূর্ব পরিচিত এক জৈনের দেখা পান তিনি। বন্ধুর পরিবর্তন নিমেষে লক্ষ করেছিল সে। ‘তোমাকে দারুণ প্রশান্ত লাগছে! কত সজাগ!’ চেঁচিয়ে বলেছে সে। ‘কী শান্ত তুমি। তোমার চেহারা পরিষ্কার। চোখজোড়া উজ্জ্বল। তোমার গুরু কে? আজকাল কার ধম্ম অনুসরণ করছ?’ নিখুঁত ছিল সুচনাটা। বুদ্ধ জানালেন, তাঁর কোনও গুরু নেই। কোনও সংঘেরও সদস্য নন তিনি। এখন পর্যন্ত জগতে তাঁর মতো আর কেউ নেই, কারণ তিনি আরাহান্ত, ‘সফল জনে’ পরিণত হয়েছেন, যিনি পরম আলোকন লাভ করেছেন। ‘কী?’ অবিশ্বাসের সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল উপকা। “নিশ্চয়ই নিজেকে বুদ্ধ, জিনা, আধ্যাত্মিক বিজয়ী, পবিত্রজন দাবি করছ না, আমরা যাঁর অপেক্ষা করছি?’ ‘হ্যাঁ,’ জবাব দিলেন বুদ্ধ। তিনি সকল আকাঙ্ক্ষা জয় করেছেন। প্রকৃতই তাঁকে জিনা ডাকা যেতে পারে। সংশয়ের চোখে তাঁকে দেখল উপকা। মাথা নাড়ল: ‘বন্ধু, স্বপ্ন দেখে যাও,’ বলল সে। ‘আমি চললাম এই দিকে।’ হঠাৎ মূল রাস্তা ছেড়ে একটা পার্শ্ববর্তী পথ বেছে নিল সে, নিব্বানার প্রত্যক্ষ পথ অস্বীকার করল।[১]
বিচ্যুত না হয়ে ব্রাহ্মণদের শিক্ষার পাদপীঠ ও গুরুত্বপূর্ণ শহর বারানসির উদ্দেশে যাত্রা অব্যাহত রাখলেন বুদ্ধ। অবশ্য শহরে বেশি দিন থাকলেন না তিনি। সরাসরি ইসিপাতানার উপকণ্ঠের হরিণ-বাগিচার দিকে চললেন। যেখানে সাবেক পাঁচ সঙ্গী থাকার কথা জানা ছিল তাঁর। তাঁকে এগিয়ে আসতে দেখে সতর্ক হয়ে উঠলেন ওই ভিক্ষুরা। তাঁরা যতদূর জানতেন, তাঁদের পুরোনো মন্ত্রণাদাতা গৌতম পবিত্রজীবন ত্যাগ করে বিলাসিতা ও আত্ম-তুষ্টির জীবন বেছে নিয়েছেন। তাঁকে আর আগের মতো স্বাগত জানাতে পারলেন ন তাঁরা, একজন মহান সাধুঁকে যেভাবে সম্মান জাননো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অহিংসার প্রতি নিবেদিত ভালো মানুষ ছিলেন তাঁরা। তাঁকে কষ্ট দিতে চাইলেন না। তাঁরা স্থির করলেন, দীর্ঘ যাত্রার শেষে বিশ্রাম নিতে চাইলে গৌতম খানিকটা সময় তাঁদের সঙ্গে বসতে পারেন। কিন্তু বুদ্ধ কাছে আসার পর পুরোপুরি নিরস্ত্র হয়ে পড়লেন তাঁরা। সম্ভবত তাঁরাও তাঁর নতুন প্রশান্তি ও আত্মবিশ্বাস দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন, কারণ ভিক্ষুদের একজন নিজের পোশাক ও বাটি নিয়ে তাঁকে স্বাগত জানাতে ছুটে এসেছিলেন। অন্যরা আসন প্রস্তুত, পানি যোগাড়, পিড়ি আর তোয়ালে আনতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, যেন তাঁদের পুরোনো নেতা পা ধুতে পারেন। তাঁকে ‘বন্ধু’[২] বলে আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাগত জানালেন তাঁরা। প্রায়ই ঘটবে এমন। বুদ্ধের আচরণের দয়া ও সহানুভূতি প্রায়শঃ একইভাবে মানুষ, দেবতা ও প্রাণীকূলের মাঝে বৈরিতা দূর করবে।
সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এলেন বুদ্ধ। এখন আর তাঁকে বন্ধু ডাকা উচিত হবে না তাদের, ব্যাখ্যা করলেন তিনি, কারণ তাঁর আগের সত্তা অদৃশ্য হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ ভিন্ন মর্যাদা পেয়েছেন তিনি। এখন একজন তথাগত তিনি, এক অদ্ভুত পদবী, যার আক্ষরিক অর্থ, ‘এভাবে গত।’ তাঁর অহমবাদ নিৰ্বাপিত হয়েছে। তিনি পবিত্রজীবন পরিত্যাগ করেছেন, এমন যেন তাঁরা না ভাবেন; বরং সম্পূর্ণ উল্টোটাই সত্যি। তাঁর বক্তব্যে আকর্ষণীয় দৃঢ়তা ও তাগিদ ছিল যা সঙ্গীরা আগে কখনও শোনেননি। ‘শোন!’ বললেন তিনি, ‘আমি নিব্বানা মৃত্যুহীন অবস্থা অর্জন করেছি। আমি তোমাদের নির্দেশনা দেব! ধম্ম শিক্ষা দেব!’[৩] তাঁরা তাঁর শিক্ষা শুনলে, অনুশীলন করলে, তাঁরাও আরাহান্তে পরিণত হতে পারবেন, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরম সত্যে প্রবেশ করে নিজেদের জীবনে একে বাস্তবে পরিণত করতে পারবেন। কেবল মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনতে হবে তাঁদের।
এরপর প্রথম হিতপোদেশ দিলেন বুদ্ধ। টেক্সটে তা ধম্মাকাপ্পাবাত্তানা-সুত্তা অর্থাৎ ধম্মের চাকা ঘোরানোর বয়ান নামে রক্ষিত আছে, কারণ তা শিক্ষাকে জগতে প্রকাশ করে মানবজাতির জন্যে এক নতুন যুগ সূচনা করেছে। যারা এখন জীবন যাপনের শুদ্ধ উপায় জানে। নিগূঢ় অধিবিদ্যিক তথ্য প্রদান নয়, বরং পাঁচ ভিক্ষুকে আলোকনের পথ দেখানোই এর উদ্দেশ্য। তাঁরাও তাঁর মতো অরাহান্ত হতে পারবেন, কিন্তু কখনও গুরুর সমকক্ষ হতে পারবেন না, কারণ বুদ্ধ নিজ প্রচেষ্টায় একা এবং কারও সাহায্য ছাড়া নিব্বানা লাভ করেছেন। মানুষ জাতিকে শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সাম্মা সামবুদ্ধ হয়ে পরম আলোকনের গুরু-আরও উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছেন তিনি। পরবর্তীকালের বৌদ্ধ শিক্ষা উল্লেখ করবে যে, প্রতি ৩২,০০০ বছরে একবার, যখন ধম্মের জ্ঞান পৃথিবী হতে সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে, সাম্মা সামবুদ্ধ পৃথিবীতে আগমন করবেন। গৌতম আমাদের কালের বুদ্ধে পরিণত হয়েছিলেন। ইসিপাতানার হরিণ বাগিচায় শুরু করেছিলেন তাঁর ধর্মীয় জীবন।
কিন্তু কী শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তিনি? মতবাদ বা বিশ্বাসের কোনও অবকাশ ছিল না বুদ্ধের: কোনও ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দেওয়ার ছিল না তাঁর, দুঃখের মূল কারণ সম্পর্কে কোনও তত্ত্ব নয়, আদি পাপের কোনও গল্পও নয়; নয় পরম বাস্তবতার কোনও সংজ্ঞা। এই ধরনের আঁচ-অনুমানে কোনও যুক্তি খুঁজে পাননি তিনি। বিশেষ অনুপ্রাণিত ধর্মীয় মতামতকে যারা ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে বুদ্ধ মতবাদ তাদের কাছে অস্বস্তিকর। ব্যক্তির ধর্মতত্ত্ব বুদ্ধের কাছে সম্পূর্ণ উপেক্ষার বিষয়! অন্য কারও কথায় কোনও মতবাদ গ্রহণ করা তাঁর চোখে একটা ‘অদক্ষ’ অবস্থা যা আলোকনের দিকে চালিত করতে পারে না, কারণ তা ব্যক্তিগত দায়িত্বের বরখেলাপ। কোনও প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসে আত্মসমর্পণে কোনও কৃতিত্ব দেখেননি তিনি। নিব্বানার অস্থিত্বে আস্থা এবং নিজে তার প্রমাণ করার প্রতিজ্ঞাই ‘বিশ্বাস’। বুদ্ধ সব সময় জোর দিয়ে বলেছেন, শিষ্যরা যেন তাঁর শিক্ষা নিজস্ব অভিজ্ঞতায় যাচাই করে নেয়, কিছুই যেন শোনা কথায় মেনে না নেয়। ধর্মীয় ধারণা অনায়াসে আঁকড়ে থাকার আরেকটা বস্তু মানসিক প্রতিজ্ঞায় পরিণত হতে পারে, অথচ ধম্মের উদ্দেশ্যে মানুষকে বিসর্জনে সহায়তা যোগানো।
‘বিসর্জন দেওয়া’ ছিল বুদ্ধের শিক্ষার অন্যতম মূল সুর। আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তি সবচেয়ে কর্তৃত্বপূর্ণ নির্দেশনাও আঁকড়ে থাকে না বা অবলম্বন করে না। সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী। কিছুই টিকে থাকে না। শিষ্যরা তাদের সত্তার প্রতি তন্ত্রীতে এই বিষয়টি শনাক্ত করতে না পারা পর্যন্ত নিব্বানা অর্জন করতে পারবে না। নিজেদের কম্ম সম্পাদনের পর এমনকি খোদ তাঁর শিক্ষাও ত্যাগ করতে হবে। একবার তিনি তাদের ভেলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুবিশাল জলরশির মুখোমুখি হয়ে সেটা পেরুনোর জন্যে মরিয়া এক পর্যটকের গল্প বলেছেন। কোনও সেতু, ফেরি ছিল না সেখানে, নিজেই ভেলা বানিয়ে নদ। পার হয় সে। কিন্তু তারপর, বুদ্ধ শ্রোতাদের জিজ্ঞেস করলেন, ভেলা দিয়ে পর্যটকের কী করা উচিৎ? ওটা উপকারে এসেছে বলে পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ হবে তার? যেখানে যাবে সাথে করে নিয়ে যাবে? নাকি স্রেফ বেঁধে রেখে যাত্রা অব্যাহত রাখবে? উত্তরটা পরিষ্কার। ‘ঠিক একইভাবে, ভিক্ষুগণ, আমার শিক্ষা নদী পেরুনোর কাজে লাগানোর জন্যে একটা ভেলার মতো, আঁকড়ে থাকার জন্যে নয়,’ উপসংহার টেনেছেন বুদ্ধ। ‘তোমরা সঠিকভাবে ভেলাসুলভ প্রকৃতি বুঝতে পারলে, এমনকি সুশিক্ষা ও (ধম্ম) ত্যাগ করবে, অশুভগুলোর কথা তো না বললেই চলে।’[৪] তাঁর ধৰ্ম্ম পুরোপুরি প্রায়োগিক ছিল। অনিচনীয় সংজ্ঞা প্রদান বা কোনও শিষ্যের অধিবিদ্যিক প্রশ্নের বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল মেটানো এর কাজ ছিল না। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বেদনার নদী পেরিয়ে ‘দূরের পাড়ে’ পৌঁছাতে মানুষকে সক্ষম করে তোলা। তাঁর কাজ ছিল দুঃখ-কষ্ট দূর ও শিষ্যদের নিব্বানা অর্জনে সাহায্য করা। এই লক্ষ্য পূরণ করেনি এমন যেকোনও কিছুই যেকোনও রকম গুরুত্বহীন।
সেকারণেই এখানে মহাবিশ্বের সৃষ্টি বা পরম সত্তার অস্তিত্ব সংক্রান্ত কোনও দুর্বোধ্য তত্ত্ব নেই। এসব বিষয় আগ্রহোদ্দীপক হতে পারে, কিন্তু সেগুলো শিষ্যকে আলোকন এনে দেবে না বা দুঃখ হতে মুক্তি দেবে না। কোসাম্বির সিমসাপা বনে বাস করার সময় বুদ্ধ একদিন কিছু পাতা ছিঁড়ে শিষ্যদের দেখালেন, গাছে আরও পাতা বেড়ে উঠছে। তিনিও তেমনি তাদের সামান্য কিছু শিক্ষা দিয়ে আরও অনেক শিক্ষা তুলে রেখেছেন। কেন? ‘কারণ, শিষ্যগণ, সেগুলো তোমাদের কাজে আসবে না, পবিত্রতার সন্ধানে সেগুলো উপযোগি নয়; ওসব শান্তি ও নিব্বানার প্রত্যক্ষ জ্ঞানে পৌঁছে দেবে না।’[৫] দর্শন নিয়ে বারবার প্রশ্ন করে চলা সন্ন্যাসীদের একজনকে তিনি বলেছেন, সে একজন আহত মানুষের মতো যে কিনা তাকে আঘাতকারী ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা না জানা পর্যন্ত চিকিৎসা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। অর্থহীন এসব তথ্য পাবার আগেই সে মারা যাবে। ঠিক একইভাবে যার জগৎ বিশ্বজগতের সৃষ্টি বা পরম সম্পর্কিত তথ্য পাওয়ার আগে বুদ্ধের শিক্ষা অনুসরণে অস্বীকৃতি জানায় তারা এইসব দুর্ভেয় তথ্য জানবার আগেই কষ্ট ভোগ করে মারা যাবে। বিশ্বজগৎ সৃষ্ট বা চিরন্তন হয়ে থাকলে কী এসে যাবে? শোক, দুঃখ-কষ্ট ও দুর্দশা তারপরও থাকবে। কেবল বেদনা বিনাশের সঙ্গেই বুদ্ধের সম্পর্ক। ‘আমি বর্তমানে অসুখী অবস্থার প্রতিকারের উপদেশ দিতে এসেছি।’ দার্শনিকভাবে আগ্রহী ভিক্ষুকে বলেছিলেন বুদ্ধ, ‘সুতরাং আমি তোমাদের কাছে কোন কোন বিষয় ব্যাখ্যা করিনি এবং তার কারণ সব সময় মনে রাখবে।’[৬]
কিন্তু হরিণ বাগিচায় পাঁচ সাবেক সঙ্গীর সাথে সাক্ষাতের পর একটা কিছু দিয়ে শুরু করতে হয়েছিল বুদ্ধকে। কীভাবে ওদের সন্দেহ দূর করবেন তিনি? চারটি মহান সত্য সম্পর্কে কোনও ধরনের যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে হয়েছিল তাঁকে। আমরা জানি না, সেদিন পাঁচ ভিক্ষুকে আসলে কী বলেছিলেন তিনি। পালি টেক্সটে প্রথম হিতোপদেশ নামের বয়ানটি সেদিনের ধর্মোপদেশের হুবহু বিবরণ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ধর্মগ্রন্থসমূহ সংকলিত হওয়ার সময় সম্পাদকগণ সম্ভবত সুবিধাজনকভাবে অত্যাবশ্যকীয় বিষয়সমূহ চালুকারী এই সুত্তার দেখা পেয়ে এই পর্যায়ে বর্ণনায় সংযোজন করেছেন।’[৭] কিন্তু যেভাবেই হোক, প্রথম হিতোপদেশ যথার্থ ছিল। বুদ্ধ সবসময়ই তাঁর শিক্ষাকে যে জনসাধারণকে তিনি শিক্ষা দিচ্ছেন তাদের উপযোগি করে তোলার বিষয়ে যত্নবান ছিলেন। পাঁচ ভিক্ষু গৌতমের কৃচ্ছ্রতা ত্যাগের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন। সুতরাং বর্তমান সুত্তায় তাঁর মধ্যপন্থার মূল তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে তাঁদের আশ্বস্ত করার মাধ্যমে শুরু করেছিলেন। যেসব মানুষ ‘অগ্রযাত্রা’য় নেমে পবিত্র জীবনে গিয়েছে, বলেছেন তিনি, তাদের উচিৎ একদিকে ইন্দ্রিয় সুখের দুটি চরম রূপ এবং অন্যদিকে চরম কৃচ্ছ্রতা সাধন এড়িয়ে যাওয়া। কোনওটাই উপকারী নয়, কারণ এগুলো নিব্বানার দিকে চালিত করে না। তার বদলে তিনি এই দুই বিকল্পের মাঝে এক সুখকর মধ্যপন্থা, অষ্টশীল পথ আবিষ্কার করেছেন, এবং নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারেন সন্ন্যাসীদের তা সরাসরি আলোকনের দিকে নিয়ে যাবে।
এরপর বুদ্ধ চারটি মহান সত্যের রূপরেখা দিলেন: দুঃখ-কষ্টের সত্য, দুঃখ-কষ্টের কারণের সত্য, দুঃখ-কষ্ট অবসান বা নিব্বানার সত্য এবং এই মুক্তি অভিমুখী পথের সত্যি। অবশ্য এই সত্যগুলোকে অধিবিদ্যিক তত্ত্ব নয় বরং প্রায়োগিক কর্মসূচি হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ধম্ম শব্দটি কেবল কী নয়, বরং কী হওয়া উচিৎ তাও বোঝায়। বুদ্ধ’র ধম্ম ছিল জীবনের সমস্যা- সংকটের রোগ নির্ণয় ও প্রতিষেধকের ব্যবস্থাপত্রও, যা হুবহু অনুসরণ করতে হবে। তাঁর হিতোপদেশে প্রতিটি সত্যের তিনটি উপাদান ছিল। প্রথমে তিনি ভিক্ষুদের সত্য প্রত্যক্ষ করিয়েছেন। এরপর এ ব্যাপারে কী করতে হবে সেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন: দুঃখ-কষ্টকে ‘সম্পূর্ণভাবে’ জানতে হবে,’ দুঃখ-কষ্টের কারণ ‘আকাঙ্ক্ষা’ ‘বিসর্জন দিতে হবে’: দুঃখ-কষ্টের অবসান, নিব্বানাকে আরাহান্তের হৃদয়ে একটি ‘বাস্তবতায়’ পরিণত হতে হবে। এবং অষ্টশীল পথ ‘অবশ্যই’ অনুসরণ করতে হবে। সবশেষে, তিনি স্বয়ং কী অর্জন করেছেন তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বুদ্ধ: তিনি ‘প্রত্যক্ষভাবে দুঃখকে উপলব্ধি করেছেন: আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করেছেন: নিব্বানার অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন: শেষ পর্যন্ত তিনি এর পথ অনুসরণ করেছেন। এটা, ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি, যখন নিজের কাছে ধম্মের কার্যকারিতা প্রমাণ করেছেন ও বাস্তব অর্থে কর্মসূচি সম্পাদন করেছে, তখনই আলোকন সম্পূর্ণ হয়েছে: ‘চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন করেছি আমি।’ বিজয়ীর সুরে চিৎকার করেছে তিনি।[৮] সত্যিই সামসারা হতে মুক্ত হয়েছিলেন তিনি। জানতেন মধ্যপন্থাই সত্যি পথ। নিজ জীবন ও ব্যক্তিত্ব সেটা প্রমাণ করেছে।
পালি টেক্সট আমাদের বলছে, বুদ্ধের হিতোপদেশ শোনার সময় পাঁচ ভিক্ষুর অন্যতম কোন্দান্না ‘প্রত্যক্ষভাবে’ তাঁর শিক্ষা অনুভব করতে শুরু করেছিলেন। যেন সত্তার গভীরতা থেকে তাঁর মাঝে ‘জেগে উঠেছিল’ এটা। যেন চিনতে পেরেছিলেন তিনি-বরাবরই জানা ছিল।[১০] এভাবেই সবসময় ধর্মগ্রন্থগুলো কোনও নতুন শিষ্যের ধম্মে শিক্ষা গ্রহণের বর্ণনা দিয়েছে। এটা বিশ্বাসের প্রতি কোনও ধারণাগত সম্মতি ছিল না। আসলে হরিণ বাগিচায় দীক্ষানুষ্ঠান সম্পাদন করেছিলেন বুদ্ধ। ধাত্রীর মতো একজন আলোকপ্রাপ্ত মানুষের জন্মে সহায়তা দান করছিলেন, বা তাঁর নিজস্ব উপমা ব্যবহার করে বলা যায়, খাপ হতে তরবারি বা খোলস হতে সাপ বের করে আনছিলেন তিনি। প্রথম হিতোপদেশ শোনার জন্যে হরিণ বাগিচায় সমবেত দেবতাগণ কোন্দান্নার পরিবর্তন লক্ষ করে আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন: ‘প্রভু বারানসির হরিণ বনে ধম্মের চাকা চালু করেছেন!’ দেবতাদের চিৎকার একের পর এক আকাশে অন্য দেবতাদের কাছে পৌঁছে গেল। শেষে খোদ ব্রহ্মার কানেও গেল। ধরণী কেঁপে উঠল, দেবতার চেয়েও উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল ‘কোন্দান্না জানে! কোন্দান্না জানে!’ খুশিতে চেঁচালেন বুদ্ধ। বৌদ্ধ ট্র্যাডেশন অনুযায়ী ‘স্রোতে প্রবেশকারীতে’ (সোতাপান্না)[১১] পরিণত হয়েছিলেন কোন্দান্না। পুরোপুরি আলোকপ্রাপ্ত হননি বটে, কিন্তু তাঁর সন্দেহ কেটে গিয়েছিল। তিনি আর অন্য কোনও ধম্মে আগ্রহী ছিলেন না। বুদ্ধের পদ্ধতিতে অবগাহন করতে প্রস্তুত ছিলেন তিনি; জানতেন এটাই তাঁকে নিব্বানার দিকে নিয়ে যাবে। বুদ্ধের সংঘে যোগদানের আবেদন জানালেন তিনি। ‘এসো, ভিক্ষু,’ জবাব দিলেন বুদ্ধ। ‘ধম্ম চমৎকারভাবেই প্রচার করা হয়েছে। পবিত্র জীবন যাপন করো, যা তোমার দুঃখ কষ্টকে চিরকালের জন্যে দূর করে দেবে।[১২]
কিন্তু পালি টেক্সট হরিণ বনের এই প্রথম শিক্ষার আরেকটি ভাষ্য অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটা আরও দীর্ঘ এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রক্রিয়ার বর্ণনা দেয়। জোড়ায় জোড়ায় ভিক্ষুদের নির্দেশনা দিয়েছেন বুদ্ধ, অন্যদিকে বাকি তিনজন ওদের ছয়জনের জন্যে পর্যাপ্ত খাদ্য যোগাড় করতে বারানসিতে চলে গেছেন। এখানে বোঝানো হয়েছে, অধিকতর নিবিড় এই শিক্ষায় ভিক্ষুদের তাঁর বিশেষ যোগ শিক্ষা দিচ্ছিলেন বুদ্ধ, ‘অভিনিবেশ’ ও ‘অপরিমেয়’র সাথে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।[১৩] ধ্যান অবশ্যই আলোকনের জন্যে অপরিহার্য। শিক্ষাব্রতীরা বুদ্ধের যোগীয় অনুবীক্ষণের নিচে দেহ-মন স্থাপন করতে না শিখলে ও নিজেদের গভীরে ডুব না দিলে ধম্ম ‘প্রত্যক্ষভাবে’ উপলব্ধি করা যাবে না বা বাস্তবতায় পরিণত হবে না। কেবল হিতোপদেশ শুনে আর লোকমুখে শোনা সত্যসমূহ গ্রহণ করে কোন্দান্না ‘স্রোতে প্রবেশকারী’ হয়ে তাঁর ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞান’ অর্জন করতে পারবেন না। ভিক্ষুরা আপন অভিজ্ঞতার পরতে পরতে দুঃখ-কষ্ট ও আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে সজাগ না হওয়া পর্যন্ত সঠিকভাবে তাঁর সত্য অনুধাবন করা যাবে না। তাঁর শিক্ষার অষ্টশীল পথে ধ্যানের অনুশীলনও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পাঁচ ভিক্ষুকে দেওয়া নির্দেশনা প্রায় নিশ্চিতভাবেই একটি মাত্র সকালের চেয়ে বেশি সময় নিয়েছিল। আগে হতেই তাঁরা সফল যোগি ও অহিংসা নীতিতে দক্ষ হয়ে থাকলেও ধম্মের কার্যকর হতে সময় প্রয়োজন ছিল। যাই হোক, পালি টেক্সট আমাদের বলছে, কোন্দান্নার মাঝে ধম্ম ‘জেগে ওঠার’ অল্প পরেই বাপ্পা, বাদ্যিয়, মহানামা ও আশাজিও ‘স্রোতে প্রবেশকারী’তে পরিণত হন।[১৪]
ধম্মের যৌক্তিক গঠন ধ্যানের অনুশীলনের পরিপূরক ছিল যা শিক্ষার্থীকে তা ‘উপলব্ধি’ করতে সক্ষম করে তুলত। যোগের মাধ্যমে ভিক্ষুগণ মতবাদ কোন্ সত্যি ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছে তা শনাক্ত করতে পারতেন। বৌদ্ধদের ধ্যানের অন্যতম প্রধান বিষয় হচ্ছে নির্ভরশীল ঘটনার ধারা (পাতিক্কাসমুপদ), যা বুদ্ধ সম্ভবত পরবর্তী কোনও পর্যায়ে দুঃখ-কষ্টের সত্যের সম্পূরক হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। যদিও পালি টেক্সটগুলো আলোকপ্রাপ্তির অব্যবহিত আগে-পরেই এই ধারা বিবেচনা করেছেন বরে উল্লেখ করেছে।[১৫] এই ধারা বারটি শর্তাধীন ও নিয়ন্ত্রণের সম্পর্কের মাধ্যমে আমাদের জীবনের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতি তুলে ধরে চেতনাশীল কোনও সত্তার জীবন চক্রের সন্ধান করে এবং দেখায় কীভাবে প্রতিটি মানুষ চিরন্তনভাবে ভিন্ন কিছুতে পরিণত হচ্ছে।
[১] অজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে [২] কম্ম: কম্মের উপর নির্ভর করে [৩] চেতনাঃ চেতনার উপর নির্ভর করে [৪] নাম ও ধরণ: নাম ও ধরনের উপর নির্ভর করে [৫] ইন্দ্রিয় অঙ্গ: ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করে [৬] সংযোগ: সংযোগের উপর নির্ভর করে [৭] অনুভূতি: অনুভূতির উপর নির্ভর করে [৮] আকাঙ্ক্ষা: আকাঙ্ক্ষার উপর নির্ভর করে [৯] সম্পর্ক: সম্পর্কের উপর নির্ভর করে [১০] অস্তিত্ব: অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে [১১] জন্ম: জন্মের উপর নির্ভর করে [১২] দুঃখ: বয়স ও মৃত্যু, দুঃখ, বিলাপ, দুর্দশা, শোক ও হতাশা।[১৬]
এই ধারাক্রম বৌদ্ধ শিক্ষার কেন্দ্রিয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এটা উপলব্ধি করা সহজ নয়। এটা যাঁদের কাছে নিরুৎসাহব্যঞ্জক ঠেকে, তাঁরা এই ভেবে আশ্বস্ত হতে পারেন যে, বুদ্ধ একবার এক ভিক্ষুকে এটা সহজ মনে করায় ভর্ৎসনা করেছিলেন। একে উপমা হিসাব দেখতে হবে, এক জীবন হতে অন্য জীবনে টিকে থাকার মতো কোনও সত্তা না থাকা সত্ত্বেও–যেমনটা বুদ্ধ উপলব্ধি করছিলেন–মানুষ কেমন করে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে এটা যখন সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করে। কী সেই জিনিস যা আবার জন্ম নেয়? এমন কোনও আইন আছে যা পুনর্জন্মকে দুঃখের সঙ্গে সম্পর্কিত করে?
ধারায় ব্যবহৃত পরিভাষাগুলো কিঞ্চিৎ দুর্বোধ্য। যেমন ধরা যাক ‘নাম ও ধরণ’ স্রেফ পালি বাকধারায় ‘ব্যক্তি’; ‘চেতনা’ (বিন্নানা) কোনও ব্যক্তির চিন্তা ও অনুভূতির সামগ্রিকতা নয়, বরং এক ধরনের উচ্চমার্গীয় বস্তু, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের শেষ ভাবনা বা আবেগ যা তার জীবনের সকল কম্ম দিয়ে গঠিত হয়েছে। এই ‘চেতনা’ মায়ের জঠরে এক নতুন ‘নাম ও ধরনের’ বীজানুতে পরিণত হয়। ভ্রুণের ব্যক্তিত্ব পূর্বসুরির মৃত্যুপথযাত্রী ‘চেতনা’র শর্তাধীন। এই ‘চেতনা’র সঙ্গে যখন ভ্রূণ সম্পর্কিত হয়, তখনই নতুন এক জীবনচক্র সূচিত হতে পারে। ভ্রূণ ইন্দ্রিয় অঙ্গগুলোর বিকাশ ঘটায়। জন্মের পর এগুলো বাহ্যিক জগতের সঙ্গে ‘যোগাযোগ’ করে। এই ইন্দ্রিয়জ সম্পর্ক ‘শিহরণ’ বা অনুভূতির জন্ম দেয় যা দুঃখের সবচেয়ে শক্তিশালী কারণ ‘আকাঙ্ক্ষা’র দিকে চালিত করে। আকাঙ্ক্ষা চালিত করে ‘সম্পর্কের’ দিকে যা আমাদের মুক্তি ও আলোকন প্রতিহত করে। আমাদের যা নতুন ‘অস্তিত্বে’ নতুন জন্ম ও আরও দুঃখ, অসুস্থতা, শোক আর মৃত্যুতে ঠেলে দেয়।[১৭]
অজ্ঞতা দিয়ে সূচিত হয় এই ধারা যা দুঃখকষ্টের সবচেয়ে শক্তিশালী না হলেও প্রধান কারণে পরিণত হয়। গাঙ্গেয় অঞ্চলের অধিকাংশ সন্ন্যাসী আকাঙ্ক্ষাই দুঃখের প্রথম কারণ বলে বিশ্বাস করতেন। এদিকে উপনিষদ ও সমক্ষ্যের ধারণা ছিল যে বাস্তবতার প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতাই মুক্তির পথে প্রধান অন্তরায়। বুদ্ধ এ দুটো কারণকে সম্পর্কিত করতে পেরেছিলেন।[১৮] তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি মানুষ বেঁচে আছে, কেননা চারটি কারণ সম্পর্কে অজ্ঞ সত্তার মাধ্যমে সে সাবেক অস্তিত্বে বিরাজ করেছে। ফলে নিজেদের তারা আকাঙ্ক্ষা ও ভোগান্তির কবল হতে মুক্ত করতে পারে না। সঠিকভাবে ওয়াকিবহাল নয় এমন মানুষ মারাত্মক বাস্তব ভুল করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, একজন যোগি ভাবতে পারে যে ঘোরের কোনও একটি উচ্চতর পর্যায়ই নিব্বানা। ফলে সম্পূর্ণ মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সে আর বাড়তি প্রয়াস পাবে না। পালি টেক্সটে দেওয়া ধারাক্রমের অধিকাংশ ভাষ্যে দ্বিতীয় ধারাটি কম্ম নয় নয়, বরং আরও কঠিন বিষয় সাংখারা (গঠন)। কিন্তু দুটো শব্দই একই ক্রিয়াপদ মূল হতে নেওয়া: ক্র (করা)। সাংখারা শব্দটিকে কিছুটা দুর্বোধ্যভাবে অনুবাদ করা হয়েছে: ‘অবস্থা বা বস্তু যা গঠন বা প্রস্তুত হচ্ছে।’[১৯] এভাবে আমাদের কর্মকাণ্ড (কম্ম) আগামী অস্থিত্বের ‘চেতনা’ গঠন করছে: তাকে আকার নিচ্ছে ও শর্তাধীন করছে। বুদ্ধ যেহেতু আমাদের ইচ্ছাগুলোকে মানসিক কৰ্ম্ম হিসাবে দেখেছেন, ধারাক্রম দেখাচ্ছে যে, আমাদের বাহ্যিক কর্মকাণ্ডকে প্ররোচিতকারী আবেগসমূহের ভবিষ্যৎ পরিণাম থাকবে: লোভী, বিভ্রান্ত পছন্দের একটি জীবন আমাদের শেষ, মৃত্যুপযাত্রী চিন্তার (বিন্নানা) মানকে প্রভাবিত করবে। এটা আবার পরবর্তীকালে আমরা কোন জীবন পাব তাকে প্রভাবিত করবে। নতুন ‘নাম ও ধরনে’ বাহিত এই শেষ, মৃত্যুপথযাত্রী ‘চেতনা’ কী চিরন্তন, স্থির অস্তি ত্ব? একজন ব্যক্তি কী বারবার জীবন যাপন করবে? হ্যাঁ এবং না। চেতনাকে যোগিদের মতো স্থায়ী, চিরন্তন সত্তা বলে বিশ্বাস করতেন না বুদ্ধ। একে বরং এক সলতে থেকে আরেক সলতেয় যাওয়া শিখার মতো অন্তিম টিমটিমে শক্তি হিসাবে দেখেছেন।[২০] অগ্নিশিখা কখনওই ধ্রুব নয়। সন্ধ্যারাতে জ্বালানো আগুনই ভোরবেলার জ্বলন্ত আগুন, আবার ঠিক তা নয়।
ধারাক্রমে কোনও স্থির সত্তা নেই। প্রতিটি কাড়া অন্যটির ওপর নির্ভরশীল ও সরাসরি ভিন্ন কিছুর দিকে চালিত করে। এটা মানুষের জীবনের অনিবার্য সত্য হিসাবে বুদ্ধের দেখা ‘হয়ে ওঠার’ এক নিখুঁত প্রকাশ। আমরা সব সময়ই ভিন্ন কিছু হতে চাই। এক নতুন ধরনের সত্তার জন্যে যুদ্ধ করছি। সত্যিকার অর্থেই দীর্ঘদিন একই অবস্থায় থাকতে পারি না। প্রতিটি সাংখারা পরবর্তীটিকে জায়গা ছেড়ে দেয়: প্রতিটি অবস্থা স্রেফ অন্যটির ভূমিকা। সুতরাং, জীবনের কোনও কিছুকেই স্থিতিশীল হিসাবে দেখা যাবে না। ব্যক্তিকে একটি প্রক্রিয়া হিসাবে দেখাতে হবে, অপরিবর্তনীয় কোনও সত্তা নয়। একজন ভিক্ষু ধারাক্রম নিয়ে ধ্যান করার সময় যোগির দৃষ্টিতে একে দেখতে পান, প্রতিটি শিহরণের উত্থান-পতনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে মনোযোগি হয়ে ওঠেন, তখন কোনও কিছুর উপর ভরসা করা যাবে না, সমস্ত কিছুই অস্থায়ী (অনিক্ক), এই সত্যের ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞান’ অর্জন করেন তিনি। তিনি তখন কার্য ও কারণের এই অন্তহীন ধারাক্রম হতে নিজেকে মুক্ত করার জন্যে দ্বিগুণ প্রয়াস চালাবেন।[২১]
অবিরাম আত্মমূল্যায়ন ও দৈনন্দিন জীবনের উত্থান-পতনের দিকে মনোযোগ এক ধরনের শীতল নিয়ন্ত্রণ এনে দেয়। ধ্যানে অভিনিবেশের দৈনিক অনুশীলন অব্যাহত থাকলে তা ভিক্ষুকে আরও গভীরে প্রোথিত ব্যক্তিত্ব ও যৌক্তিক বিশ্লেষণে উপস্থাপযোগ্য ব্যক্তিত্বের প্রকৃতি সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি এনে দেয়। ব্রাহ্মণদের কৃচ্ছতার ঘোরের জন্যে অবকাশ ছিল না বুদ্ধের। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, তাঁর ভিক্ষুদের সংযমের সঙ্গে চলতে হবে এবং আবেগ প্রকাশ হতে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু অভিনিবেশ ভিক্ষুকে তাঁর আচরণের নৈতিকতা সম্পর্কে আরও সজাগ করে তোলে। তিনি তখন তার ‘অদক্ষ’ কর্মকাণ্ড কেমন করে অন্যদের ক্ষতি সাধন করতে পারে এবং তাঁর অনুপ্রেরণাও কেমন করে ক্ষতিকারক হতে পারে সেটা লক্ষ করেন। তো, বুদ্ধ উপসংহার টেনেছেন, আমাদের ইচ্ছা কম্ম এবং তার পরিণাম রয়েছে।[২২] অচেতন বা সচেতন ইচ্ছা, যা আমাদের কর্মকাণ্ডকে উৎসাহ যোগায় সেগুলো মানসিক কাজ যা যে কোনও বাহ্যিক কাজকর্মের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। চেতনা হিসাবে (ইচ্ছা : পছন্দ) কম্মের পুনঃসংজ্ঞা ছিল বিপ্লবাত্মক। নৈতিকতার সামগ্রিক প্রশ্নকে তা গভীর করে তুলেছে। যা কিনা এখন মনে আর হৃদয়ে স্থাপিত, বাহ্যিক আচরণের কোনও ব্যাপার হতে পারবে না।
কিন্তু অভিনিবেশ (সাতি) বুদ্ধকে আরও ভিন্নতর উপসংহারে চালিত করেছে। পাঁচ জন ভিক্ষুর ‘স্রোতে প্রবেশকারী’ হবার তিনদিন পর হরিণ বনে দ্বিতীয় হিতোপদেশ দেন বুদ্ধ। এখানে তিনি তাঁর অনাত্মা (সত্তাহীনতা) সম্পর্কিত অনন্য মতবাদের ব্যাখ্যা দেন তিনি।[২৩] মানবীয় ব্যক্তিত্বকে তিনি পাঁচটি ‘স্তূপ’ বা ‘উপাদানে’ (খণ্ড): ভাগ করেন তিনিঃ দেহ, অনুভব, ধারণা, আচরণ (স্বোচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত) ও সচেতনতা। ভিক্ষুদের প্রতিটি খণ্ডের বিষয় ভিন্নভাবে বিবেচনা করার পরামর্শ দেন। যেমন ধরা যাক আমাদের দেহ বা অনুভূতি প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে। এতে করে আমাদের বেদনা যোগাচ্ছে। আমাদের তা হতাশ করে তুলছে। আমাদের আচরণ ও ধারণা সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। প্রতিটি খণ্ড দুঃখের শিকার বলে ত্রুটিপূর্ণ ও ক্ষণস্থায়ী। এর পক্ষে অসংখ্য ভাববাদী ও যোগীদের কাঙ্ক্ষিত সেই সত্তার অনুসন্ধান বা ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে না। এটা কি সত্যি নয়, শিষ্যদের জিজ্ঞেস করলেন বুদ্ধ, প্রতিটি খণ্ড পরখ করার পর একজন সৎ ব্যক্তি নিজেকে এর সাথে পুরোপুরি একাত্ম করতে পারছে না বলে আবিষ্কার করবে, কারণ এটা বড় বেশি অসন্তে াষজনক? সে বলতে বাধ্য হবে: ‘এটা আমার নয়, আমি আসলে যা এটা তা নয়: এটা আমার সত্তা নয়।[২৪] কিন্তু বুদ্ধ স্রেফ চিরন্তন, পরম অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করেননি। এবার তিনি ঘোষণা করলেন, সিথিশীল নিম্নস্তরের সত্তা বলেও কিছু নেই। ধারা যেমন দেখায়, প্রতিটি সচেতন সত্তা এক অবিরাম পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে: পুরুষ বা নারী স্রেফ ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তনশীল অস্তিত্বের ধারাক্রমমাত্র।
বুদ্ধ তাঁর গোটা জীবন এই বার্তাই প্রচার করে গেছেন। সপ্তদশ শতকের ফরাসি দার্শনিক দেকার্তে যেখানে ঘোষণা দেবেন, ‘আমি ভাবি তাই আমি অস্তিত্বশীল’, সেখানে বুদ্ধ সম্পূর্ণ বিপরীত উপসংহারে পৌঁছেছিলেন। নিজের আবিষ্কৃত অভিনিবেশের যোগী পদ্ধতিতে তিনি যত ভেবেছেন ততই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আমরা যাকে ‘সত্তা’ বলি তা আসলে একটা বিভ্রম। তাঁর দৃষ্টিতে, আমরা যত ঘনিষ্ঠভাবে আমাদের যাচাই করব ততই স্থায়ী সত্তা হিসাবে কোনও কিছুকে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে উঠবে। মানুষের ব্যক্তিত্ব এমন স্থবির অস্তিত্ব নয় যেখানে ঘটনা সংঘটিত হয়। যোগীর অনুবীক্ষণসুলভ বিশ্লেষণের অধীনে স্থাপন করা হলে প্রতিটি ব্যক্তিই একটি প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে। ব্যক্তিত্বের বর্ণনা দেওয়ার বেলায় জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড বা খরস্রোতা ঝর্নার উপমা দিতে পছন্দ করতেন বুদ্ধ। এর এক ধরনের পরিচয় থাকলেও কোও দুটি বিশেষ মুহূর্তে এক নয়। প্রতিটি সেকেন্ডে আগুন ভিন্ন কিছু, নিভে গিয়ে আবার নিজেকে সৃষ্টি করেছে–ঠিক মানুষের মতো। দরাজ হেসে মানুষের মনকে বনেবাদারে ছুটে বেড়ানো বানরের সঙ্গে তুলনা করেছেন বুদ্ধ: ‘একটা ডাল আঁকড়ে ধরে, পরক্ষণে ওটা ছেড়ে আরেকটা ধরে।’[২৫] আমরা যাকে ‘সত্তা হিসাবে অনুভব করি তা আসলে স্রেফ সুবিধাজনক পরিভাষা, কারণ আমরা অবিরত বদলে যাচ্ছি। একইভাবে দুধ পর্যায়ক্রমে দই, মাখন, ঘি এবং ঘিয়ের সূক্ষ্ম নির্যাসে পরিণত হতে পারে। এইসব পরিবর্তনের কোনওটাকে ‘দুধ’ বলার কোনও যুক্তি নেই, যদিও সেটা বললে ঠিক হওয়ার একটা ভাব থাকে। [২৬]
অষ্টাদশ শতকের স্কটিশ অভিজ্ঞতাবাদী ডেভিড হিউম গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যসহ একই ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন: তিনি চাননি তাঁর দর্শন পাঠকদের নৈতিক আচরণকে প্রভাবিত করুক। কিন্তু অ্যাক্সিয়াল যুগের ভারতে রূপান্তরকারী না হলে জ্ঞানের কোনও তাৎপর্য ছিল না। ধম্ম ছিল কাজের আদেশব্যঞ্জক এবং অনাত্মার মতবাদ কোনও বিমূর্ত দার্শনিক প্রস্তাবনা ছিল না, বরং বৌদ্ধদের এমন আচরণ দাবি করত যেন অহমের কোনও অস্তিত্ব নেই। এর নৈতিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী, ‘সত্তা’র ধারণাই কেবল ‘আমি ও আমার’ সম্পর্কিত অদক্ষ চিন্তাভাবনা সৃষ্টি ও স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে না; অহমবাদকে তর্কসাপেক্ষে সকল অশুভের উৎস হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে; সত্তার সাথে অতিরিক্ত সংযোগ ঈর্ষা বা শত্রুর প্রতি ঘৃণা, প্রতারণা, হামবড়া ভাব, অহঙ্কার, নিষ্ঠুরতা এবং সত্তা আক্রান্ত বোধ করলে, সহিংসতা ও অন্যদের বিনাশ ডেকে আনতে পারে। পশ্চিমাবাসীরা প্রায়শঃই বুদ্ধের অনাত্মার মতবাদকে নাস্তিবাদী ও হতাশাব্যাঞ্জক মনে করে, কিন্তু সর্বোত্তম অবস্থায় অ্যাক্সিয়াল যুগে সৃষ্ট সবগুলো মহান বিশ্বধর্ম দরুণ ক্ষতিকারক সর্বগ্রাসী ভীতকারী আহমকে দমন করতে চেয়েছে। বুদ্ধ অবশ্য আরও বেশি অগ্রসর ছিলেন। তাঁর অনাত্মার মতবাদ সত্তাকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়নি। তিনি স্রেফ সত্তার অস্তিত্ব অস্বীকার গেছেন। একে স্থায়ী বাস্তবতা হিসাবে কল্পনা করা ভুল ছিল। এ জাতীয় যেকোনও ভ্রান্ত ধারণা আমাদের দুঃখ-কষ্টের চক্রের সঙ্গে আটকে রাখা সেই অজ্ঞতারই লক্ষণ।
যেকোনও বৌদ্ধ শিক্ষার মতোই অনাত্মা কোনও দার্শনিক মতবাদ ছিল না, মূলত তা ছিল বাস্তব ভিত্তিক। যোগ ও অভিনিবেশের মাধ্যমে একজন শিষ্য অনাত্মার ‘প্রত্যক্ষ’ জ্ঞান অর্জন করতে পারলে অহমবাদের বেদনা ও বিপদ হতে নিষ্কৃতি পাবে সে, তখন তা যৌক্তিক অসম্ভাব্যতায় পরিণত হবে। অ্যাক্সিয়াল দেশগুলোয় আমরা দেখেছি, স্বর্গ হতে নির্বাসিত এবং জীবনকে অর্থ ও মূল্য প্রদানকারী পবিত্র মাত্রা হতে বঞ্চিত মানুষ সহসা নিঃসঙ্গ, দিশাহারা বোধ করেছে। এক নতুন বাজার অর্থনীতিতে চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জগতে নিরাপত্তাহীনতা হতেই তাদের অধিকাংশ বেদনার সৃষ্টি হয়েছিল। বুদ্ধ তাঁর ভিক্ষুদের বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, অন্যদের ক্ষতি সাধন করে দাপানো, তোষামোদ করা, ও ফাঁপিয়ে তুলে বাঁচানোর মতো তাদের কোনও ‘সত্তা’ নেই। সন্ন্যাসী অভিনিবেশের অনুশীলনে অভ্যস্থ হয়ে গেলে বুঝতে পারবে, আমরা যাকে ‘সত্তা’ বলি সেটা কত ক্ষণস্থায়ী। তখন আর এইসব চলমান মানসিক অবস্থায় নিজের অহমকে মেলাবে না সে, সেগুলোর সঙ্গে একাত্ম হবে না। নিজের আকাঙ্ক্ষা, ভয় ও কামনাগুলোকে তার সঙ্গে সম্পর্কহীন দূরবর্তী ঘটনা হিসাবে দেখতে শিখবে। একবার এই পক্ষপাতহীনতা ও প্রশান্তি অর্জন করার পর, দ্বিতীয় হিতোপদেশ শেষে পঞ্চভিক্ষুর কাছে ব্যাখ্যা দিলেন বুদ্ধ, নিজেকে আলোকনের উপযোগি হয়ে উঠতে দেখবে সে। ‘তার লোভ মিলিয়ে যাচ্ছে, বাসনা অদৃশ্য হয়ে যাবার পর হৃদয়ের মুক্তি অনুভব করে সে।’ লক্ষ্য অর্জন করেছে সে, আলোকপ্রাপ্ত হওয়ার পর বুদ্ধ যেমন করেছিলেন তেমনি বিজয় উল্লাস প্রকাশ করতে পারে সে। ‘অবশেষে পবিত্র জীবন যাপন করা হয়েছে। যা করার ছিল, সম্পাদন করা হয়েছে; আর কিছুই করণীয় নেই।’[২৭]
এবং প্রকৃতপক্ষে পঞ্চ ভিক্ষু বুদ্ধের অনাত্মার ব্যাখ্যা শোনার পর পাঁচজনই পরিপূর্ণ আলোকপ্রাপ্ত হয়ে আরাহান্তে পরিণত হলেন। টেক্সট আমাদের বলছে, তাঁর শিক্ষা তাঁদের হৃদয়কে আনন্দে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে।[২৮] অদ্ভুত মনে হতে পারে: আমরা যে সত্তার স্বপ্ন দেখি সেটা অস্তিত্বহীন জেনে কেন এত খুশি হবেন তাঁরা? বুদ্ধ জানতেন অনাত্মা ভীতিকর হতে পারে। বহিরাগত কেউ প্রথমবারের মতো এই মতবাদ শুনে ‘আমি নিশ্চিহ্ন, ধ্বংস হয়ে যাব, আমার আর অস্তিত্ব থাকবে না,’[২৯] ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু পালি টেক্সট দেখায়, লোকে পাঁচ ভিক্ষুর মতো ব্যাপক স্বস্তি ও আনন্দের সাথে অনাত্মাকে গ্রহণ করেছে। এতে ‘প্রমাণ’ হয়েছে, এটা সত্যি। মানুষ যখন অহমের অস্তিত্ব নেই ভেবে জীবন যাপন করে, তখন তারা আবিষ্কার করে, তারা আগের চেয়ে খুশি। আমাদের একান্ত মহাবিশ্ব হতে সত্তাকে আসনচ্যুত করে সেখানে অন্যান্য সত্তাকে স্থাপন করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ‘অপরিমেয়’র অনুশীলনের অনুরূপ সত্তার বিস্তৃতি অনুভব করেছে তারা। অহমবাদ সংকীর্ণকারী। আমরা স্বার্থপর দৃষ্টি কোণে দেখার সময় আমাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ থাকে। আমাদের মর্যাদা ও বেঁচে থাকার তীব্র উদ্বেগ হতে সৃষ্ট লোভ, ঘৃণা ও নাগালের বাইরের যাপিত জীবন কাঠামো মুক্তি নির্দেশক। বিমূর্ত ধারণা হিসাবে উত্থাপিত হলে অনাত্মাকে অনুজ্জ্বল মনে হতে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতায় নেওয়া হলে মানুষের জীবন পাল্টে দেয়। যেন অহমের অস্তিত্ব নেই, এমনিভাবে জীবন যাপন করে মানুষ অহমবাদকে জয় করেছে বলে আবিষ্কার করেছে এবং অনেক ভালো বোধ করেছে। একজন যোগির ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞান’ দিয়ে অনাত্মাকে উপলব্ধি করে তারা এক সমৃদ্ধ, পূর্ণ অস্তি ত্বে পৌঁছেছে। সুতরাং অনাত্মা নিশ্চয়ই আমাদের মানবীয় অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানায়। যদিও সত্তার অস্তিত্ব না থাকার বিষয়টি আমরা হাতে কলমে প্রমাণ করতে পারব না।
বুদ্ধ বিশ্বাস করতেন, স্বার্থহীন জীবন নারী ও পুরুষকে নিব্বানার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। একেশ্বরবাদীরা বলবে, এটা তাদের ঈশ্বরের সত্তায় পৌঁছে দেবে। কিন্তু একজন ব্যক্তিরূপ উপাস্যের ধারণাকে খুবই সীমাবদ্ধ মনে করেছেন বুদ্ধ, কারণ এটা বোঝায়, পরম সত্তা স্রেফ আরেকটা সত্তা মাত্র। নিব্বানা কোনও ব্যক্তি বা স্বর্গের মতো কোনও জায়গা নয়। বুদ্ধ সব সময় কোনও পরম নিয়ম বা মহা সত্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন, কেননা সেটা আঁকড়ে থাকার আরেকটা বস্তু, আরেকটা শৃঙ্খল, আলোকনের পথে আরেকটা বিঘ্ন হয়ে উঠতে পারে। সত্তার মতবাদের মতো ঈশ্বরের ধারণাও অহমকে উস্কে দেওয়া ও ফাঁপিয়ে তোলার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। ইহুদি, ক্রিশ্চান ও ইসলামের সবচেয়ে স্পর্শকাতর একেশ্বরবাদীগণ এই বিপদ সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠবে ও ঈশ্বর প্রসঙ্গে এমনভাবে কথা বলবে যা নিব্বানা সম্পর্কে বুদ্ধের সংযমের স্মারক। তারা জোর দিয়ে একথাও বলব যে, ঈশ্বর স্রেফ আরেকটা সত্তা মাত্র নন; ‘সত্তা’ সম্পর্কে আমাদের ধারণা এত সীমিত যে ঈশ্বর অস্তি ত্বহীন, অর্থাৎ ‘তিনি’ আসলে কিছু না বলাটাই অনেক সঠিক। কিন্তু অধিকতর জনপ্রিয় স্তরে এটা নিশ্চিতভাবে সত্যি যে, ‘ঈশ্বর’কে প্রায়শঃই ‘তাঁর’ উপাসকদের কল্পনা ও পছন্দ মাফিক প্রতিমায় পরিণত করা হয়। ঈশ্বরকে আমরা আমাদেরই মতো পছন্দ-অপছন্দ সম্পন্ন করলে ‘তাঁকে’ দিয়ে আমাদের সবচেয়ে সংকীর্ণ, স্বার্থপর ও এমনকি ভীষণ আশা, শঙ্কা আর কুসংস্কারকে মেনে নিতে বাধ্য করা খুবই সহজ হয়ে যায়। এই সীমাবদ্ধ ঈশ্বরের এভাবে ইতিহাসের বেশ কিছু জঘন্য ধর্মীয় নিপীড়নে অবদান রেখেছেন। বুদ্ধ আমাদের নিজস্ব সত্তায় পবিত্র অনুমোদনের সীলমোহর দানকারী উপাস্যে বিশ্বাসকে ‘অদক্ষ’ বর্ণনা করতেন; এটা কেবল বিশ্বাসীকে ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক অহমবাদেই বন্দি করে রাখবে, যেটা তার ছাড়িয়ে যাবার কথা। আলোকন দাবি করে, আমরা তেমন কোনও মেকি জাঁক প্রত্যাখ্যান করব। মনে হয় ‘অনাত্মার’ প্রত্যক্ষ যোগ উপলব্ধি অন্যতম প্রধান উপায় যার মাধ্যমে আদি বৌদ্ধরা নিব্বানা প্রত্যক্ষ করেছিল। এবং সত্যি সত্যিই অ্যাক্সিয়াল যুগের ধর্মবিশ্বাসগুলো কোনও না কোনওভাবে জোর দিয়েছে যে, কেবল সম্পূর্ণ আত্মপরিত্যাগ অনুশীলন করেই আমরা নিজেদের সম্পূর্ণ করে তুলতে পারব। পরকালে আয়েসী অবকাশ লাভের মতো কোনও কিছুর ‘সন্ধানে’ ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ স্রেফ আসল উদ্দেশ্য ছাড়িয়ে যাওয়া। হরিণ বাগিচায় আলোকনপ্রাপ্ত পাঁচ ভিক্ষু গভীরতর স্তরে এবিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন।
এবার অন্যদের কাছে ধম্ম পৌঁছে দিতে হবে তাঁদের। স্বয়ং বুদ্ধ যেমন উপলব্ধি করেছিলেন, দুঃখের প্রথম মহান সত্যি উপলব্ধির মানে অন্যের দুঃখ- কষ্টে সহানুভূতিশীল হওয়া; অনাত্মার মতবাদ বোঝায়, একজন আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিজের জন্যে নয় বরং অন্যদের জন্যে বেঁচে থাকবে। এখন আরাহান্তের সংখ্যা ছয় জন, কিন্তু বেদনায় আবৃত বিশ্বে আলোক পৌঁছে দেওয়ার জন্যে সংখ্যাটা খুবই কম। তারপর যেন জাদুমন্ত্র বলে বুদ্ধের ছোট সংঘে নতুন সদস্যের জোয়ার দেখা দিল। প্রথমজন ছিলেন বারানসির এক ধনী বণিকের ছেলে ইয়াসা। তরুণ গৌতমের মতো বিলাসিতায় জীবন কাটাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু একরাতে ঘুম থেকে জেগে দেখেন খাটের চারপাশে ঘুমাচ্ছে তাঁর ভৃত্যরা, ওদের এমন কুৎসিত, বিশ্রী ভঙ্গি দেখে বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠেন তিনি। নাদান কথার মতো অন্যান্য টেক্সট কোনও রকম দুঃখ প্রকাশ ছাড়াই তরুণ গৌতম সম্পর্কে একই কাহিনী বলার ব্যাপারটি কাহিনীর আদি আদর্শ প্রকৃতি তুলে ধরে। গাঙ্গেয় অঞ্চলে অসংখ্য মানুষের অনুভূত বিচ্ছিন্নতাকেই বর্ণনা করেছেন ইয়াসা। পালি টেক্সট আমাদের বলছে, অন্তর থেকে বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠা ইয়াসা যন্ত্রণায় চিৎকার করে বললেন, ‘এ যে ভয়ঙ্কর! মারাত্মক।’ সহসা জগৎ অশ্লীল, অর্থহীন মনে হলো, অসহনীয়ও বটে। অবিলম্বে ভালো কিছুর সন্ধানে ‘সামনে বাড়ার’ সিদ্ধান্ত নিলেন ইয়াসা। একজোড়া সোনার চপ্পল পায়ে গলিয়ে পা টিপেটিপে বাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিড়বিড় করে ‘ভয়ঙ্কর! মারাত্মক! বলতে বলতে হরিণ বাগিচার উদ্দেশে রওনা হলেন। বুদ্ধের সামনে পড়ে গেলেন তারপর। ভোরে ঘুম থেকে উঠে শীতল আলোয় হাঁটছিলেন তিনি আলোকপ্রাপ্ত মানুষের বর্ধিত মানসিক শক্তিতে ইয়াসাকে চিনতে পারলেন বুদ্ধ। ইশারায় তাঁকে বসতে বলে হাসি মুখে বললেন: ‘এটা ভয়ঙ্কর নয়। মারাত্মক নয়। এসো, বসো, ইয়াসা। তোমাকে ধম্ম শিক্ষা দেব আমি।’[৩০]
বুদ্ধের প্রশান্তি ও কোমলতা মুহূর্তে স্বস্তি যোগাল ইয়াসার। সেই অসুস্থকর আতঙ্ক রইল না তাঁর, নিজেকে বরং সুখী ও আশাবাদী বোধ করতে লাগলেন। মন আনন্দময় ও শান্ত থাকায় আলোকনের জন্যে সবচেয়ে উপযোগি অবস্থায় ছিলেন তিনি। চপ্পল খুলে বুদ্ধের পাশে বসে পড়লেন তিনি। তাঁকে মধ্যপন্থার শিক্ষা দিলেন বুদ্ধ। ধাপে ধাপে তানহা ও ইন্দ্রিয়জ সুখ এড়ানোর মৌল শিক্ষার মাধ্যমে শুরু করলেন, পবিত্র জীবনের সুবিধার বর্ণনা দিলেন। যখন দেখলেন ইয়াসা মনোযোগি ও প্রস্তুত, তাঁকে চারটি মহান সত্যি শিক্ষা দিতে শুরু করলেন তিনি। শোনার সময় ‘ধম্মের খাঁটি দৃশ্য জেগে উঠল’ ইয়াসার মাঝে, এমনভাবে তাঁর আত্মায় তলিয়ে গেল যেমন করে, আমাদের যেভাবে বলা হয়েছে, রঙ কাপড়ে ভেতরে প্রবেশ করে তাকে রাঙিয়ে তোলে।[৩১] ইয়াসার মন ধম্মে ‘রঞ্জিত’ হবার পর দুটোকে আর আলাদা করার উপায় ছিল না। এটাই ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞান,’ কারণ ইয়াসা এমন গভীর স্তরে ধম্ম অনুভব করেছেন যে তিনি এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন। এটা তাঁর সম্পূর্ণ সত্তাকে ‘রঞ্জিত’ করেছে। লোকে প্রথম ধম্মের কথা শোনার সময়, বিশেষ করে খোদ বুদ্ধ দীক্ষা দেওয়ার সময় এটাও সাধারণ অভিজ্ঞতায় পরিণত হবে। ধম্ম তাঁদের প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পূর্ণ খাপ খেয়ে যাচ্ছে ভেবেছে তারা, এটা তাদের পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও অনুকূল; এক অর্থে আগাগোড়াই জানা ছিল তাদের। পালি টেক্সটে আমরা দামাস্কাসের পথে সেইন্ট পলের যন্ত্রণাকর বা নাটকীয় ধর্মান্তরের মতো কোনও ঘটনার উল্লেখ দেখি না। এ ধরনের যেকোনও হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতাকে বুদ্ধ ‘অদক্ষ’ বিবেচনা করতেন। মানুষকে অবশ্যই তার স্বভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে, যেমনটি গোলাপজাম গাছের নিচে ছিলেন তিনি।
ইয়াসা ‘স্রোতে প্রবেশকারী’ হওয়ার পরই বুদ্ধ লক্ষ করলেন আরেক প্রবীন বণিক এগিয়ে আসছেন ওঁদের দিকে। তিনি বুঝে গেলেন, নিশ্চয়ই ইয়াসার বাবা হবেন। তখন অধিকতর দক্ষতায় প্রাপ্ত বিবেচিত ইদ্ধি বা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বলে ইয়াসাকে অদৃশ্য করে দিলেন তিনি। দারুণ বিচলিত ছিলেন ইয়াসার বাবা। তাঁর গোটা বাড়ি ইয়াসার খোঁজে ব্যস্ত, কিন্তু তিনি সোনার চপ্পলের ছাপ অনুসরণ করেছেন, যা তাঁকে সরাসরি বুদ্ধের কাছে নিয়ে এসেছে। আবার বণিককে বসালেন বুদ্ধ। আভাসে জানালেন অচিরেই ইয়াসাকে দেখতে পাবেন তিনি। ছেলের মতো একইভাবে নির্দেশনা দিলেন বাবাকে। নিমেষে মুগ্ধ হয়ে গেলেন বণিক: ‘প্রভু, এ অনন্য! সত্যি অনন্য!’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ‘ধৰ্ম্ম এমন স্পষ্ট করা হয়েছে যেন আপনি অন্ধকারে লণ্ঠন ধরে রেখে ভুল হয়ে যাওয়া একটা কিছু শুদ্ধ করে দিচ্ছেন।’ এরপর প্রথমবারের মতো তিনি বুদ্ধ, ধম্ম ও ভিক্ষুদের সংঘের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা প্রকাশকারী ঘোষণা ত্রি-আশ্রয় নামে নামে পরিচিত হয়ে ওঠা আচার পালন করলেন।[৩২] প্রথম সাধারণ অনুসারীদের প্রথম ব্যক্তিতে পরিণত হলেন তিনি, যিনি সংসারী থেকেও বৌদ্ধদের পদ্ধতির এক পরিবর্তিত ধরণ অনুসরণ করেছেন।
বাবার চোখের আড়ালে বুদ্ধে কথা শোনার সময় সম্পূর্ণ আলোকপ্রাপ্ত হলেন ইয়াসা, প্রবেশ করলেন নিব্বানায়। এই পর্যায়ে বুদ্ধ তাঁকে তাঁর বাবার সামনে প্রকাশ করলেন। ইয়াসাকে কেবল তাঁর মায়ের জন্যে হলেও বাড়ি ফিরে যেতে অনুনয় করলেন বণিক। অবশ্য বুদ্ধ ধীরে ধীরে তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন, ইয়াসা একজন আরাহাস্তে পরিণত হয়েছেন। তাঁর পক্ষে এখন গৃহস্থের জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এখন আর গৃহস্থের প্রজনন ও অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তোলার মতো বাসনা ও আকাঙ্ক্ষায় আক্রান্ত নন তিনি। ধ্যানের জন্যে এখন তাঁর দীর্ঘ নীরবতা ও নিরিবিলি পরিবেশ প্রয়োজন হবে, সংসারী জীবনে যা সম্ভব হবে না। ফিরে যেতে পারবেন না তিনি। বুঝতে পারলেন ইয়াসার বাবা। কিন্তু বুদ্ধকে সেদিন তাঁর বাড়িতে আহার গ্রহণের আবেদন জানালেন। ইয়াসা হবেন তাঁর পরিচারক সন্ন্যাসী। খাবারের সময় ইয়াসার মা ও প্রাক্তন স্ত্রীকে দীক্ষা দিলেন বুদ্ধ। তারাও বুদ্ধের প্রথম মহিলা সাধারণ অনুসারীতে পরিণত হয়।
কিন্তু এ খবর পরিবারের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল। বারানসির নেতৃস্থানীয় চার বণিক পরিবারের সদস্য ইয়াসার পার বন্ধু তাঁর গেরুয়া বসন পরার খবরে এতটাই বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলেন যে দীক্ষা নিতে বুদ্ধের কাছে হাজির হলেন তারা। আশপাশের পল্লী এলাকা হতে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পরিবারের ইয়াসার পঞ্চাশ জন বন্ধুও তাই করলেন। অভিজাত ও বনেদী গোত্রের এইসব তরুণ অচিরেই আলোকপ্রাপ্ত হলেন। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই, টেক্সটসমূহ আমাদের বলছে, খোদ বুদ্ধসহ পৃথিবীতে আরাহান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল একষট্টি জনে।
উল্লেখযোগ্য গোত্রে পরিণত হচ্ছিল সংঘ। কিন্তু নতুন আরাহান্তদের সদ্যপ্রাপ্ত মুক্তি নিয়ে বিলাসিতা করতে দেওয়া চলবে না। তাদের বৃত্তি জগৎ হতে স্বার্থপর পশ্চাদপসরণ নয়, অন্যদের বেদনা হতে মুক্তি অর্জনে সাহায্য করার জন্যে বাজার এলাকায় প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল তাঁদের। এখন ধম্মের নির্দেশ মোতাবেক অন্যদের জন্যে বাঁচাবেন তারা। ‘এবার যাও,’ ষাটজন ভিক্ষুকে বললেন বুদ্ধ।
জগতের জন্যে সহানুভূতি দেখিয়ে দেবতা আর মানুষের সুবিধা, কল্যাণ ও সুখের জন্যে ভ্রমণ করো। দুজন একই পথে যেয়ো না। ধম্ম শিক্ষা দাও, ভিক্ষুগণ, পবিত্র জীবন নিয়ে ধ্যান কর। অন্তরে সামান্য আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ধৰ্ম্ম না শোনায় কষ্ট ভোগ করছে কিছু সত্তা। তারা এটা বুঝতে পারবে।[৩৩]
বুদ্ধ মতবাদ সুবিধাপ্রাপ্ত অভিজাত গোষ্ঠীর মতবাদ ছিল না। ‘সাধারণ মানুষের ‘অনেকের’ (বহুজনা) ধর্ম ছিল। বাস্তব ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে আবেদন রাখলেও তাত্ত্বিকভাবে সবার জন্যে খোলা ছিল এটা এবং ধর্ম-বর্ণ যাই হোক না কেন কারও জন্যে এর দরজা রুদ্ধ ছিল না। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কেউ একজন এমন এক ধর্মীয় কর্মসূচির স্বপ্ন দেখেছেন যা একক কোনও দলের মাঝে সীমিত ছিল না, বরং সমগ্র মানব জাতির জন্যেই চিন্তা করা হয়েছে। উপনিষদের সাধুদের প্রচারিত মতবাদের মতো এটা কোনও নিগূঢ় পথ ছিল না, বাজার এলাকায়, নব প্রতিষ্ঠিত শহরে, বাণিজ্য পথ বরাবর সবার জন্যে উন্মুক্ত ছিল। মানুষ যখনই ধৰ্ম্মের কথা শুনেছে, গাঙ্গেয় অঞ্চলে বিবেচনা করার মতো একটি শক্তিতে পরিণত হওয়া সংঘে এসে ভিড় করেছে তারা। নতুন ব্যবস্থায় সদস্যরা ‘শাক্য গুরুর নির্দেশপ্রাপ্ত অনুসারী’ নামে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু নিজেদের তারা স্রেফ ভিক্ষুদের সংঘ (ভিক্ষু-সংঘ) হিসাবে আখ্যায়িত করতেন।[৩৪] যোগদানকারী লোকেরা এতদিন সুপ্ত থাকা মানবতার সমগ্র এলাকায় ‘জাগ্রত’ হয়েছে বলে আবিষ্কার করেছে। এক নতুন সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতা অস্তিত্ব লাভ করেছিল।
তথ্যসূত্র
১. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ৬।
২. প্রাগুক্ত।
৩. প্রাগুক্ত।
৪. মাজহিমা নিকয়া, ২২।
৫. সামুত্তা নিকয়া ৫৩: ৩১।
৬. মাজহিমা নিকয়া, ৬: ৩।
৭. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ৬; সাম্যত্তা নিকয়া, ৫৬: ১১।
৮. প্রাগুক্ত।
৯. পরবর্তী কালের বৌদ্ধ ধারাভাষ্য অনুযায়ী শিশু গৌতমকে পরখ করতে আগত ব্রাহ্মণ ছিলেন কোন্দান্না। গৌতম বুদ্ধ হবেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন তিনি। দীক্ষার অভিজ্ঞতা থাকায় তিনি সবসময় অন্নাতা কোন্দান্না: সবজান্তা কোন্দান্না নামে পরিচিত ছিলেন।
১০. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ৬।
১১. প্রাগুক্ত।
১২. প্রাগুক্ত। আমাদের জানানো হয়েছে যে, আদি এই বৌদ্ধরা ‘স্রোতে প্রবেশকারী’ হতে মাত্র সাতটি আগামীজীবন নিয়ে পরিপূর্ণ আলোকিত মানুষ আরাহান্তে উন্নীত হয়ে সামসারা হতে সম্পূর্ণ মুক্তি অর্জন করেছেন। পরবর্তী কাহিনী শিক্ষা দিয়েছে যে, অধিকাংশ মানুষের জন্যে দুটো মধ্য পার্যায়ের পথ রয়েছে: [১] ‘প্রত্যাবর্তনীয়’ (সাকাদাগামী), যার কেবল একটি প্রত্যবর্তন অবশিষ্ট রয়েছে; [২] ‘অপ্রত্যাবর্তনীয়’ (অনাগামী), যিনি কেবল স্বর্গে দেবতা হিসাবে জন্ম নেবেন।
১৩. মাজহিমা নিকয়া, ২৬, টিলমেন ভেতার, দ্য আইডিয়াজ অ্যান্ড মেডিটেটিভ প্র্যাকটিসেস অভ আর্লি বুদ্ধজম, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, কোপেনহাগেন ও কোলন, ১৯৮৬, xxix।
১৪. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ৬।
১৫. সাম্যত্তা নিকয়া, ১২: ৬৫; দিঘা নিকয়া, ১৪; বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ১; উদনা, ১: ১-৩।
১৬. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ১।
১৭. মাইকেল কারিথার্স, দ্য বুদ্ধা, অক্সফোর্ড ও নিউ ইয়র্ক, ১৯৮৩, ৬৮- ৭০; হারমান অলদেনবার্গ, দ্য বুদ্ধা, হিজ লাইফ, হিজ ডকট্রিন, হিজ অর্ডার (অনু. উইলিয়াম হোয়ে), লন্ডন, ১৮৮২, ২২৪-৫২; কার্ল জেস্পারস, দ্য গ্রেট ফিলোসফার্স: দ্য ফাউন্ডেশনস (অনু. রালফ্ মেইনহেইম), লন্ডন, ১৯৬২, ৩৯- ৪০; ভেতার, আইডিয়াজ অ্যান্ড মেডিটেটিভ প্র্যাকটিসেস, ২৪০-৪২।
১৮. রিচার্ড এফ. গমব্রিচ, থেরাভেদা বুদ্ধজম: আ সোশ্যাল হিস্ট্রি ফ্রম অ্যানশেন্ট বেনারেস টু মডার্ন কলোম্বো, লন্ডন ও নিউ ইয়র্ক, ১৯৮৮, ৬২-৬৩; অলদেনবার্গ, দ্য বুদ্ধা, ২৪০-৪২; কারিথার্স, দ্য বুদ্ধা, ৬৬।
১৯. ভেতার, আইডিয়াজ অ্যান্ড মেডিটেটিভ প্র্যাকটিসেস, ৫০-৫২; অলদেনবার্গ, দ্য বুদ্ধা, ২৪৩-৪৭।
২০. ভেতার, আইডিয়াজ অ্যান্ড মেডিটেটিভ প্র্যাকটিসেস, ৪৯-৫০।
২১. অলদেনবার্গ, দ্য বুদ্ধা, ২৪৮-৫১; কারিথার্স, দ্য বুদ্ধা, ৫৭-৫৮।
২২. আঙুত্তারা নিকয়া ৬: ৬৩।
২৩. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ৬; সাম্যত্তা নিকয়া, ২২: ৫৯।
২৪. প্রাগুক্ত।
২৫. সাম্যত্তা নিকয়া, ২২: ৬১।
২৬. দিঘা নিকয়া, ৯।
২৭. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ৬।
২৮. প্রাগুক্ত।
২৯. মাজহিমা নিকয়া ১।
৩০. বিনয়া: মহাভাগ্য ১: ৭।
৩১. প্রাগুক্ত।
৩২. প্রাগুক্ত, ১: ৮, আসলে পণ্ডিতগণ বিশ্বাস করেন, বুদ্ধের জীবদ্দশায় ভিক্ষুগণ কেবল বুদ্ধের কাছেই ‘একক শরণ’ নিয়েছেন। বুদ্ধের মৃত্যুর আগে ‘ত্রি-শরণ’ বাধ্যতামূলক হয়নি।
৩৩. বিনয়া: মহাভাগ্য ১: ১১।
৩৪. সুকুমার দত্ত, বুড্ডিস্ট মক্কস অ্যান্ড মনাস্টারিজ অভ ইন্ডিয়া, লন্ডন, ১৯৬২, ৩৩।