দেড়মাস পার হল বাবা ফিরলেন না। এর আগে কখনো এতদিন বাইরে থাকেন নি। পনেরো দিন আগে মনি অর্ডারে তের শ টাকা পাঠিয়েছেন। কুপনে গুড়ি গুড়ি অক্ষরে লেখা–
পর সমাচার, আমি ভাল আছি। দেশের সামগ্রিক অবস্থা খারাপ। কাজেই ব্যবসা বাণিজ্যও খারাপ। কি কৰিব বুঝিতে পারিতেছিনা। জ্বর জ্ঞারিতে কিঞ্চিৎ কাবু হইয়াছি। তবে বর্তমানে সুস্থ। খাওয়া দাওয়া নিয়মিত করিতেছি। শিগগীরই আসিতেছি।
কুপনের লেখা দেখে আমরা খুব চিন্তিত বোধ করলাম। কারণ কুপনের লেখাটা বাবার হাতের না। অন্য কেউ লিখে দিয়েছে। এরকম কখনো হয় না। মা বললেন, কে লিখে দিল রে।
ভাহয়া বলল–অশনি সংকেত।
মা বললেন, অশনি সংকেত কি?
মেয়ে ছেলের হাতের লেখা বলে মনে হচ্ছে।
ভাইয়ার এই রসিকতা মাঠে মারা গেল। মা খানিকক্ষণ কঠিন চোখে তাকিয়ে থেকে–দ্রুত চলে গেলেন।
ভাইয়া হো হো করে খানিকক্ষণ হাসল। আমরা কেউ ভাইয়ার হাসিতে যোগ দিতে পারলাম না। আপা বিরক্ত হয়ে ধমক দিল–চুপ কর তো ভাইয়া।
রাতে মার সঙ্গে ঘুমুচ্ছি। মা বললেন, মানি অর্ডারের লেখাটা কি মেয়ের হাতের?
আমি বললাম, মেয়ের হাতের লেখা আবার কি? মেয়েদের কি কোন আলাদা লেখা হয়? ছেলেরা যেমন লেখে মেয়েরাও তেমনই লেখে। মা শুকনো ভাবে বললেন, ও।
তুমি তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ভাব না-কি মা?
না ভাবি না।
বাবা কয়েক দিনের মধ্যেই চলে আসবেন। তোমার মন থেকে তখন সব দুঃশ্চিন্তা দূর হবে। বাবাকে আটকে রেখ। তাকে আর বাইরে বেরুতে দিও না।
ও বেশীদিন ঘরে থাকতে পারে না।
এইবার কঠিন শাসনে বেঁধে রাখবে। দরকার হলে তালা বন্ধ করে রাখবে। পরিবে না?
মা চুপ করে রইলেন।
আমি মার গায়ে হাত রেখে বললাম, আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর বাবা ফিরে আসবে মা। আটচল্লিশ ঘণ্টা।
মা শুকনো গলায় বললেন, ফিরে এলে তো ভালই।
বাবা ফিরে এলেন না। আরো পনেরো দিন কেটে গেল। মার দিকে তাকিয়ে আমরা এমন ভাব করতে লাগলাম যেন এটা কিছুই না। বাবার দীর্ঘদিন না ফেরাটা যেন খুব স্বাভাবিক।
লেখকরা না-কি অনেক কিছু বুঝতে পারেন?
আপনি কি পারেন? আপনি কি আমাকে দেখে বলতে পারবেন আমি সুখে আছি না কষ্টে আছি? আমার কিন্তু মনে হয় না। এখন যদি আমি আপনাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাই আপনি ভাববেন–বাহ সুখী পরিবার তো! হাসাহাসি গল্পগুজব হচ্ছে। কে বলবে আমাদের কোন সমস্যা আছে? ভাইয়া এক জাপানী শেখার স্কুলে ভর্তি হয়েছে। নিয়মিত ক্লাস করছে। জাপানী ভাষা যা শিখে আসছে–আমাদেরও শেখাচ্ছে। যেমন অজি গরম : কিয়োও ওয়া আৎসূই দেসু। গতকালও গরম ছিল : কিনেও মো আৎসুকওয়া দেসু। অনেক দিন পর আপনাকে দেখতে পাচ্ছি : ইয়াআ শিবারা।
ভাইয়া যা শিখে আসছে আমিও সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে সব শিখে নিচ্ছি। খাবার টেবিলে দুজন গম্ভীর ভদিতে জাপানীতে কথা বলি। অথচ আড়াই মাস হয়ে গেল–বাবার খোঁজ নেই, তিনি কোথায় আছেন কিছুই জানি না। দুপুরবেলা আমরা সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি–কারণ ঠিক দুপুরে পিয়ন আসে। পিওন আসে এবং চলে যায়। চিঠি আসে না। আমাদের উৎকণ্ঠা কাটে না। হয়ত টেলিগ্রাম আসবে। টেলিগ্রাম পিয়ন তো যে কোন সময় আসতে পারে।
আমরা সবাই যে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা এবং অনিশ্চতায় বাস করছি তা একজন অজনকে বুঝতে দেই না। সংসার একেবারে অচল অবস্থায় এসে ঠেকেছে। ঠিক ঝি নেই। ঘরের যাবতীয় কাজকর্ম মা এবং আপা করছেন। আপাই বেশী করছে। মার শরীর ভেঙ্গে পড়েছে। তিনি তেমন কিছু করতে পারেন না। বেশীরভাগ সময় বারান্দায় বসে থাকেন।
সংসার এখনো কি করে চলছে আমি জানি না। দুবেলা রান্না হচ্ছে তা দেখছি। দুঃসময়ের জন্যে মার নানা রকম গোপন সঞ্চয় আছে। একে একে সেইসব সঞ্চয় ব্যবহৃত হচ্ছে। তাও নিশ্চয়ই শেষের দিকে। গত সপ্তাহে প্রথমবারের মত কলেজে যাবার আগে আগে বললেন, বাদ দে, কলেজে যেতে হবে না।
আমি বললাম, কেন যেতে হবে না মা?
মা চুপ করে রইলেন।
রিকশা ভাড়া দিতে পারবে না–তাই না?
হুঁ।
হেঁটে যাব। তোমাকে রিকশা ভাড়া দিতে হবে না।
বাসা থেকে বই খাতা নিয়ে আমি বের হই–বেশীরভাগ দিনই কলেজে যাই। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটি। কেন হুঁটি বলুন তো? হ্যা, ঠিক ধরেছেন আমি বাবাকে খুঁজি। প্রতিদিনই মনে হয় আজ হয়ত পাব। হঠাৎ দেখব রাস্তার মোড়ে কোন চায়ের দোকানে বসে বাবা চা খাচ্ছেন–হাতে খবরের কাগজ। বাবাকে দেখে প্রচণ্ড চিৎকার দিতে গিয়েও আমি দিলাম না। নিজেকে সামলে নিয়ে চুপিচুপি তাঁর পেছনে দাঁড়ালাম। কানের কাছে মুখ নিয়ে নীচু গলায় গানের মত সুরে বললাম, বাবা!
তিনি চমকে তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন, আরে খুকি, তুই এখানে কোত্থেকে?
আমি বললাম, আগে বল তুমি এখানে কি করছ?
চা খাচ্ছি।
আমরা চিন্তায় মরে যাচ্ছি, আর তুমি আরাম করে চা খাচ্ছ?
চিন্তায় মরে যাচ্ছিস কেন?
আনাতা মো ইশশোনি ইকিমাসেন কা!
ইকড়ি মিকিড়ি করছিস কেন?
ইকড়ি মিকিড়ি না এটা হচ্ছে জাপানী ভাষা।
জাপানী বলছিস কেন?
বাসার সিষ্টেম বদলে গেছে বাবা। বাসায় কথাবার্তা সব হয় জাপানীতে।
বলিস কি?
তোমাকেও জাপানী শিখতে হবে নয়ত কথাবার্তা বলতে পারবে না।
এতো আরেক যন্ত্রণা হল দেখি।
বাবার সঙ্গে দেখা হলে প্রথম কথা কি বলব তা ভেবে ভেবে পথ হাঁটতে ভাল লাগে। বাসায় ফিরি ক্লান্ত হয়ে কিন্তু এক ধরনের উত্তেজনা নিয়ে। মনে হয় বাসায় পা দিয়েই দেখব–বাবা এসেছেন। চুলে কলপ দিয়ে যুবক সাজার হাস্যকর প্রচেষ্টা যথারীতি করেছেন। দাঁতও ওয়াশ করা হয়েছে। মার জন্যে অতি বদরঙা শাড়িও আনা হয়েছে। বারান্দার মোড়ায় বসে পা দোলাতে দোলাতে চা খাচ্ছেন। কাছেই বাজারের ব্যাগ। চা শেষ করে চলে যাবেন মাছের মাথা কিনতে। সবচে পচা মাথাটা কিনে হাসি মুখে ফিরবেন। রান্নার সময় মার পাশে বসে ডিরেকশন দেবেন–দুটা কাঁচা মরিচ ছেড়ে দাওতো। আর এক চিমটি পাঁচ ফোড়ন।
তিনমাস পার হবার পর আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম। ছবিসহ বিজ্ঞাপন। ভাইয়া থানায় গিয়ে জিডি এন্ট্রি করাল। ওসি সাহেব বললেন, উনার কি কোন শত্রু আছে?
ভাইয়া দুঃখিত গলায় বলল, শত্রু থাকবে কেন?
ওসি সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, মহাপুরুষদেরও তো শত্রু থাকে ভাই। গান্ধিজীকেও আততায়ীর হাতে মরতে হয়েছিল।
মৃত্যুর কথা বলছেন কেন?
কথার কথা বলছি। তবু পসিবিলিটি কিছু থাকেই। আপনি বলছেন ব্যবসায়ের কারণে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়–ধরুন কোন হোটেলে হার্ট এ্যাটাক হল। কেউ জানে না এই লোক কে? তখন একদিন অপেক্ষা করে সাধারণত মাটি দিয়ে দেয়।
বলেন কি?
আমাদের দেশের বেশীর ভাগ মানুষ কখনো পকেটে ঠিকানা নিয়ে ঘুরে না। আপনি দিন সাতেক পরে আসুন। এ জাতীয় কেইস থানায় রিপোর্টেড হয়। খবর বের করে রাখব। ঘাবড়াবেন না।
ঘাবড়াচ্ছি না।
শুধু ভাইয়া না, আমরা কেউ ঘাবড়াচ্ছি না। অন্তত আমাদের দেখে কেউ বলবে না আমরা ভেঙ্গে পড়েছি। শুধু একটু বেশী হাসাহাসি করছি। আগের চেয়ে শব্দ করে কথা বলছি। রাত একটা দুটা পর্যন্ত জেগে বসে থাকছি। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলে এক সঙ্গে দু তিন জন ছুটে যাচ্ছি।
আমার ধারণা ছিল, পত্রিকায় ছবি বের হবার পর অনেকেই আমাদের বাসায় আসবে। বাবার বন্ধুরা যারা তাঁর সঙ্গে ব্যবসা করেন। যাদের সঙ্গে কর্মসূত্রে তাঁর ঘনিষ্ঠত হয়েছে। আশ্চর্য! কেউ এল না। তাহলে ব্যাপার কি এই দাঁড়াচ্ছে যে তাঁর কোন বন্ধু বান্ধব ছিল না? মিত্রহীন একজন মানুষ এই শহরে দীর্ঘদিন ঘুরে বেড়িয়েছে?
সুলায়মান চাচা একদিন বললেন, রেনু তোর বাবার একটা ছবি আমাকে দিস তো?
ছবি দিয়ে কি হবে চাচা?।
চকবাজারে যাব। ছোট ব্যবসায়ীরা সবাই কোন না কোনভাবে চকবাজারের সঙ্গে যুক্ত। ওদের ছবি দেখালে চিনতে পারে।
আমাকে সঙ্গে নেবেন চাচা?
আচ্ছা নেব। শরীরটা একটু ঠিক হোক তারপরই …।
সুলায়মান চাচার শরীর খুবই খারাপ করেছে। বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যাওয়াও নিষিদ্ধ। সেবার জন্যে তাঁর তিন মেয়েই এসেছিল। তাদের তিনি হাঁকিয়ে দিয়েছেন। ভাইয়াকে বলেছেন, এরা স্বামীর পরামর্শে আমাকে খুন করবে। মুখে বালিশ চেপে ধরবে। তিনজন এক সঙ্গে বালিশ চেপে ধরলে আর দেখতে হবে না।
ভাইয়া বলল, চাচা আপনার নিজের মেয়ে। এসব কি বলছেন?
সুলায়মান চাচা বললেন, এরা এখন আর মেয়ে না–এরা স্বামীর হাতের রোবট। স্বামীরা বোতাম টিপে এদের কন্ট্রোল করছে। হাসতে বললে হাসে, কাঁদতে বললে কাঁদে। এখন ওরা হা করে বসে আছে–কখন মরব। রোজ খোজ নিতে আসে অবস্থা কি? আর কত দেরী।
ভাইয়া বলল, উনারা ভাল মনেই আসেন।
মোটেই ভাল মনে আসে না। আমি মুখ দেখেই বুঝতে পারি। ওরা যখন দেখে আমার শরীর একটু ভাল তখন মুখ লম্বা করে ফেলে। সে একটা দেখার মত দৃশ্য। তবে ওস্তাদের মার শেষ রাত্রে–এমন পাঁচ দেব–বুঝবে ঠ্যালা।
কি ঠ্যালা?
মেজো মেয়েকে সব জমিজমা দানপত্র করে যাব। ঐ মেয়েটাই সবচে বদ। তখন খেলা জমে যাবে। বাকি দুইজন তাকে ছিড়ে ফেলবে। সম্পত্তি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হবে। তিন জামাই যে থ্রী কমরেডস হয়েছে কমরেডশীপ বের হয়ে যাবে। শুরু হবে সাপে নেউলে–হা হা হা।
প্ল্যান খারাপ না চাচা।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে প্ল্যান বের করা। প্ল্যান খারাপ হবে কেন? তোর বাবার সন্ধান বের করার জন্যেও প্ল্যান করছি। সারাদিন তো বাসায় শুয়েই থাকি। শুয়ে শুয়ে ভাবি।
পেয়েছেন কিছু?
এখনো কংক্রিট কিছু পাই নি। তবে সব রকম চেষ্টা চালাতে হবে। ভৌতিক, আধিভৌতিক। দরকার হলে জ্বীনের সাহায্য নিতে হবে। ছোটবেলায় দেখেছি কেউ হারিয়ে গেলে জ্বীন নামানো হত।
আমি হেসে ফেললাম। সুলায়মান চাচা বিরক্ত গলায় বললেন, এই মেয়ে হাসে কেন? জগতে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার হয়। বুঝলি মেয়ে–সবকিছু হেসে উড়িয়ে দিতে নাই। জ্বীন, পরী সবই আছে।…
আমি বললাম, একবার জ্বীন নিয়ে আসুন চাচা। আমার জ্বীন দেখার খুব শখ।
দেখি পাওয়া যায় কি-না। এই লাইনে ওস্তাদ লোকজন পাওয়াই মুশকিল। চর্চা নাই। দু একজনকে বলেছি–ওরা চেষ্টা চরিত্র করছে।
আমরা উঠে আসার আগে সুলায়মান চাচা নীচু গলায় বললেন, রঞ্জু, শোন, টাকা পয়সা লাগবে?
ভাইয়া বলল, না।
চালাচ্ছ কিভাবে?
চালাচ্ছি না। চাকা আপনা আপনি ঘুরছে।
করছ কিছু?
বাংলা বাজারে বইয়ের প্রুফ দেখছি। নতুন একটা পত্রিকা বের হয়েছে তার সঙ্গেও আছি। দু হাজার করে দিবে বলছে–দেখি।
চাকরি বাকরির চেষ্টা কিছু করছ না?
না।
না–কেন?
কোন লাভ নেই খামাখা পরিশ্রম।
ব্যারিস্টার সাহেবকে বলে দেখলে হয় না? উনার সঙ্গে তো তোমার খুব খাতির। খাতির আছে না এখনো?
আছে।
তাহলে বল উনাকে।
বলব, আগে মন্ত্রী হোক। শোনা যাচ্ছে মন্ত্রী হতে বেশী দেরী নেই। মন্ত্রী হলে ধরব। উনার মন্ত্রী হবার জন্য আমি দিনরাত দোয়া করছি। ভাবছি একটা খতম পড়াব। খতমে ইউনুস।
এক সন্ধ্যায় সুলায়মান চাচা খবর পাঠিয়ে আমাকে এবং ভাইয়াকে নিয়ে গেলেন। তাঁর ঘরে রোগী লম্বা এক লোক বসে আছে। ছোট ছেটি চোখ, গায়ে কটকটা হলুদ রঙের পাঞ্জাবী। সুলায়মান চাচা গলা খাকড়ি দিয়ে বললেন, উনাকে খবর দিয়ে এনেছি। উনি হচ্ছেন একজন গণক। নিখোজ লোকের সন্ধান দিতে পারেন। খুব নাম ডাক আছে।
ডুবন্ত মানুষ খড়কুটা আঁকড়ে ধরে। হলুদ পাঞ্জাবী গাঁয়ে এই লোককে খড়কুটারও অধম লাগছে। একে আকড়ে ধরার কোন মানে হয় না।
ভাইয়া বলল, জনাব আপনার নাম?
এমন ভঙ্গিতে জনাব বলল যেন সে নাটোরের মহারাজাকে সম্বোধন করছে। ঐ লোকও খানিকটা ঘাবড়ে গেল। নীচু গলায় বলল, আমার নাম আবদুর রহমান।
আবদুর রহমান সাহেব, নিখোঁজ লোক খুঁজে বের করাই কি আপনার একমাত্র পেশা না অন্য কিছুও করেন?
সাইড ব্যবসা আছে।
মূল ব্যবসা লোক খোজা? কিভাবে খুঁজেন–মন্ত্র আছে?
মন্ত্র না। আল্লাহ পাকের পাক কালাম।
কত টাকা নেন এর জন্যে?
কনট্রাক্টে কাজ করি। কাজ সমাধ্য হইলে টেকা নেই। লোক বুঝে নেই। পঞ্চাশ টাকাও নেই আবার ধরেন, দশ হাজারও নেই।
দশ হাজার কেউ দিয়েছে?
জ্বি দিয়েছে। এক ব্যবসায়ীর ক্লাস টুতে পড়ে ছেলে হারায়ে গিয়েছিল–গণে বের করলাম।
বলেন কি?
কথা বিশ্বাস না করলে সাটিফিকেট দেখেন।
মারহাবা আপনার সার্টিফিকেটও আছে?
সুলায়মান চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, খামাখা এত কথা বলছ কেন রঞ্জু? ও বলছে কনট্রাক্টে কাজ করবে তাই করুক। যদি সন্ধান দিতে পারে আমরা তাকে পাঁচশ টাকা দেব।
ভাইয়া উদাস গলায় বলল, ঠিক আছে দেব।
ভদ্রলোককে বাবার নাম, দাদার নাম দেয়া হল। বাবার ব্যবহারী একটা সার্ট দেয়া হল। সেই সার্ট মাথায় জড়িয়ে সে চোখ বন্ধ অবস্থায় গুন গুন করে খানিকক্ষণ কি যেন পড়ল। চোখ খুলে খুবই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, উনি রওনা হয়ে গেছেন। এখন আছেন মোটরে। চলন্ত অবস্থায় তাঁকে দেখলাম। শরীর ভাল আছে। তবে একটু কফ হয়েছে।
ঢাকায় পৌঁছবেন কবে?
এক সপ্তাহ লাগবে?
মোটরে আসতে এক সপ্তাহ লাগবে? বলেন কি? উনি আছেন কোথায়, দিল্লীতে?
তা বলতে পারতেছি না–তবে ঠিক এক সপ্তাহ লাগবে আসতে।
উনার গায়ে কি কাপড় দেখলেন?
পাঞ্জাবী।
শাদা রঙের না খদ্দর?
শাদা।
আচ্ছা ভাই আরেকজনের সন্ধান দিতে পারেন কি-না দেখেন। এর নাম আভা। এ ঢাকা শহরেই আছে। কোথায় আছে জানি না।
আবদুর রহমান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, একদিনে দুইজনের কাজ করতে পারি না। এখন যাতায়াত খরচ দেন, চলে যাই। সাতদিন পরে এসে পাঁচশ টাকা নিয়ে যাব।
ভদ্রলোককে কুড়ি টাকা যাতায়াত ভাড়া দেয়া হল। সুলায়মান চাচাই দিলেন।
ভাইয়া বলল, এই মক্কেল কোত্থেকে জোগাড় করেছেন চাচা?
তোমার বিশ্বাস হয় নি, না?
আপনার হয়েছে?
একেবারে যে অবিশ্বাস হচ্ছে তা না। জাতে অনেক অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটে। দেখা যাক না সাতদিন অপেক্ষা করে। ক্ষতি তো কিছু নেই।
লোকটা পুরোপুরি বোগাস চাচা–বাবা কখনো পাঞ্জাবী পরেন না। ব্যাটা তাঁকে দেখেছে পাঞ্জাবী পরে বসে আছেন।
হয়ত শখ করে পরেছেন। দেখা যাক না। সাতটা দিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
সাতদিন কাটল। অষ্টম দিনে আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে রইলাম। আমরা কেউ ব্যাপারটা বিশ্বাস করছি না তবু মনে মনে অপেক্ষা করছি। আমাদের মধ্যে সবচে যে অবিশ্বাসী–ভাইয়া–সে ভোরবেলা বাজার থেকে মাছের মাথা কিনে আনল। দুপুরে আমরা মাথা খেলাম না–অপেক্ষা করে রইলাম রাতের জন্যে। বাবা যদি রাতে আসেন। রাতেও এলেন না। আমরা যথারীতি খাওয়াদাওয়া করলাম। ভাইয়া আধুনিক ঈশপের গল্প বলে সবাইকে হাসাল। মাও হাসলেন।
রাত এগারোটা থেকে বৃষ্টি নামল। মুষলধারে বৃষ্টি। মা আমাকে ডেকে বললেন–রেনু, রঞ্জুকে বল না এক পোয়া চিনি নিয়ে আসতে।
এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে?
মা মৃদু গলায় বললেন, লোকটা যদি ভিজতে ভিজতে আসে। এসেই চা খেতে চাইবে। ঘরে একদানা চিনি নেই।
ভাইয়াকে বলতেই সে বৃষ্টি মাথায় করে চিনি আনতে গেল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুলু আপাদের বাড়ির কাজের ছেলেটি এসে আমাকে একটা চিরকুট দিয়ে গেল। সেখানে লেখা,
রেনু, খুব বৃষ্টি হচ্ছে। ছাদে ভিজতে ইচ্ছা করছে। তুমি আসবে? প্লীজ।
চলে এসো। আমার মনটা ভাল না।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। মন খারাপের কত তুচ্ছ কারণ থাকে মানুষের। মুষল ধারে বৃষ্টি পড়ছে এই দেখে একজনের মন খারাপ হয়ে গেছে। সে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মন ভাল করার চেষ্টা করবে।
আমি দুলু আপার বাড়িতে গেলাম না। অনেক রাতে ঘুমুতে গিয়ে দেখি মা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পরেছেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নীচু গলায় কয়েকবার ডাকলাম–মা সাড়া দিলেন না। যদিও জানি তিনি জেগে আছেন। চলে এলাম ভাইয়ার ঘরে। সেও শোবার জোগাড় করছে।
তোমার ঘরে শোব ভাইয়া।
ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে বলল, অনুমতি দেয়া হল। কণ্ডিশান আছে।
কি কণ্ডিশান?
ভোর পাঁচটায় ডেকে দিতে হবে, পারবি?
এত ভোরে উঠার তোমার দরকার কি?
এক ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে কথা হয়েছে। সে আমাকে বরিশাল নিয়ে যাবে। ট্রাক ছাড়বে ভোর ছটায়।
বরিশাল যাবে কেন?
একটা কাজ আছে।
বাবার কোন খোঁজ পেয়েছ?
হুঁ।
সদরঘাটের এক লোক বলল–দিন দশেক আগে সে বাবাকে দেখেছে। বরিশাল যাবার লঞ্চে উঠছেন।
দিন দশেক আগে সে বাবাকে ঢাকায় দেখেছে?
তাই তো বলল।
বাবাকে সে চেনে?
ছবি দেখে চিনেছে। নাম জানে না। চেহারায় চেনে।
আমাদের তুমি বলনি কেন?
লোকটার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি, তাই বলি নি।
বিশ্বাস হয় নি কেন?
লোকটার চেহারা প্রফেশনাল মিথ্যাবাদীর মত।
চেহারা মিথ্যাবাদীদের মত আবার কি?
মিথ্যাবাদী লোকদের চেহারায় মিথ্যার ছাপ পড়ে।
ও শুধু শুধু মিথ্যা বলবেই বা কেন?
প্রাফেশনাল মিথ্যাবাদীরা কারণ ছাড়াই মিথ্যা বলে–তাদের একজনকে তুই যদি জিজ্ঞেস করিস, ভাই বাসাবো যাব কোন রাস্তায়? সে ভাল মানুষের মত মুখ করে বলবে–বাসে করে চলে যান। সহজ হবে।
কোন বাসে উঠব?
প্রফেশনাল মিথ্যাবাদী তখন কি করবে জানিস? ভুল একটা বাসে উঠিয়ে দেবে। এতেই এদের আনন্দ। ভাল কথা, বরিশাল যাবার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলিস না। বাবাকে পাওয়া গেলে মজার একটা সারপ্রাইজ হবে। সারপ্রাইজ নষ্ট করে লাভ নেই।
ভাইয়া বরিশাল থেকে কোন খবর ছাড়াই ফিরে এল। অন্তত আমার তাই ধারণা কারণ কাউকে সে কিছু বলল না। আমিও কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না। সে যদি নিজ থেকে কিছু বলতে চায় বলবে।
আমি আবার ভাইয়ার ঘরে থাকতে শুরু করেছি। কারণ মা এখন আমাকে ঠিক সহ্য করতে পারছেন না। অল্পতেই খিটমিট করেন–একি গায়ে পা তুলে দিচ্ছিস কেন? ভালমত ঘুমা। অকারণে এত নড়াচড়া করিস না তো। বিশ্রী লাগে।
শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, আমি কি ভাইয়ার ঘরে ঘুমুব?
মা বিরক্ত হয়ে বললেন, যা ইচ্ছা ক বিরক্ত করিস না।
ভাইয়ার স্বভাব কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আগের হাসি খুশী ভাব খানিকটা কমে গেছে। রাতে দুটা টিউশানী করে খুব ক্লান্ত হয়ে ফিরে। ভাত খেয়েই বুকের নীচে বালিশ দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। পত্রিকার লেখা লিখতে হয়। লেখার সময় মেজাজ খুব খারাপ থাকে। কর্কশ গলায় বলে, চা দে তো রেনু।
আমি যদি বলি, চিনি ছাড়া দেব ভাইয়া? চিনি শেষ হয়ে গেছে।
ভাইয়া বিশ্রী ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠবে, চিনি নেই সেটা রাত-দুপুরে বলছিস কেন? দিনে মনে ছিল না? যেখান থেকে পারিস চিনি দিয়ে চা বানিয়ে আন।
আমি প্রায় মাঝরাতে চিনি আনতে দুলু আপাদের বাসায় গেলাম। তিনি ফ্লাস্ক ভর্তি চা বানিয়ে দিলেন। শুধু চা না, সঙ্গে এক প্লেট নোনতা বিসকিট। স্লাইস করে কাটা পনির।
ভাইয়া চা খায়, পনির মুখে দেয়। একবারও বলে না–কোখেকে জোগাড় হল। তার লেখালেখির সময়টা আমি বারান্দায় বসে থাকি। যে সব রাতে দুলু আপা গান বাজায়–আমার সময়টা ভাল কাটে। তবে বেশীরভাগ সময় বসে থাকতে হয় চুপচাপ। দুলু আপার স্বভাবেরও বোধ হয় পরিবর্তন হয়েছে। আগের মত একই গান লক্ষবার বাজান না।
শুনতে পাচ্ছি তাঁর বিয়ের কথা হচ্ছে। যার সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্ছে তাকে একবার দুলু আপাদের বাড়িতে দেখেছি। আমার পছন্দ হয় নি। মানুষটা হয়তবা খুবই ভাল। প্রথম দর্শনে কোন পুরুষকেই আমার পছন্দ হয় না। পুরুষদের বোধ হয় উল্টোটা হয়–প্রথম দর্শনে সব মেয়েকেই ভাল লাগে।