৪. দেশে ফেরার পর

৪. দেশে ফেরার পর

১৯৪০ সালের প্রথম দিন। ঠিক চার বছর দু’মাস ইংল্যাণ্ডে কাটানোর পর বসু দেশের মাটিতে পা রাখলেন। গিয়েছিলেন ব্যারিস্টার হবার উচ্চাশা নিয়ে, ফিরলেন দু’চোখে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে। মনটা খুব অস্থির। অনেকদিন পর দেশে ফেরার আনন্দ ছাপিয়ে উঠছে উদ্বেগ আর উত্তেজনা। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, আর এক পা পেছোতেও তিনি রাজী নন। তবে তাঁর সিদ্ধান্তই যে ঠিক এ কথা বাবাকে বোঝাবেন কেমন করে?

বম্বে বন্দরের কাস্টম্স বিভাগ বসুর জিনিসপত্র তন্নতন্ন করে তল্লাসি করল। কঠিন মুখের এক অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান অফিসার বসুর জামাকাপড় হাতড়ে বার করল এঙ্গেল্স-এর লেখা ‘অ্যান্টি-ড্যুরিং’। বসুও দমবার পাত্র নন। দাবী করলেন রসিদ দিতে হবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও অফিসার রসিদ দিতে বাধ্য হয়, বসু দ্রুতপায়ে বেরিয়ে আসেন। বাইরে অপেক্ষা করছিলেন জাহাজে আলাপ হওয়া এক ইংরেজ মহিলা। আগে থেকেই বসু তাঁর কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বই ‘দ্য হিষ্ট্রি অব্ দ্য কমিউনিস্ট পার্টি অব্ সোভিয়েত ইউনিয়ন (বলশেভিক)’। বইটি নিয়ে বসু বেরোতেই দেখেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন বম্বাইএর কম্যুউনিস্ট পার্টির সদস্য। বম্বেতে তিনি দিন তিনেক রইলেন। দেখা হল অনেক পার্টি কমরেডের সঙ্গে, কয়েকটা সভা-সমিতিতে গেলেন। বম্বেতে যে অভিজ্ঞতাটা বসুর এখনও মনে আছে তা হল অমলনের নামে জায়গায় এক ছাত্রসভায় বক্তৃতা দেওয়া। দেশের মাটিতে বসুর সেই প্রথম বক্তৃতা। বসু ইংরেজিতে বলেছিলেন, পেয়েছিলেন উষ্ণ অভিনন্দন, ফিরেছিলেন প্রচুর ফুলের তোড়া নিয়ে।

কলকাতায় ফেরার ট্রেনে উঠতেই আবার একরাশ চিন্তাভাবনা তাঁকে ঘিরে ধরে। এত বছর ইংল্যাণ্ডে থাকার সময় বাবার সঙ্গে চিঠিতে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। প্রথম কয়েকটা মাস প্রতি সপ্তাহে বসু চিঠি লিখতেন। পরে রাজনৈতিক কাজকর্মে ব্যস্ত থাকায় চিঠির সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে, চিঠির দৈর্ঘ্যও কমতে থাকে। যাই হোক, মাসে অন্তত একটা চিঠি বাবাকে লিখতেই হত। কিন্তু কোনও চিঠিতেই তিনি তাঁর নতুন মতাদর্শে দীক্ষা নেওয়ার কথা বা পুরোপুরি রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত ঘুণাক্ষরেও বাবাকে জানান নি।

ডাঃ নিশিকান্ত বসু এতদিন পর ছোটছেলেকে দেখে যারপরনাই খুশী হলেন। “হাওড়া স্টেশনে আমাকে আনতে গিয়েছিলেন বাবা ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু। আমার গায়ে ছিল সাহেবী পোশাক—ঐ কোট-প্যান্ট আর কী। বাবা দেখেই বললেন, ‘অনেক রোগা হয়ে গেছিস গনা।’ আমি এদিকে ভাবছি কথাটা পাড়ব কিভাবে।” দেখা হওয়ার উচ্ছ্বাসের প্রথম উত্তাপে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেওয়ার ইচ্ছা বসুর ছিল না। গাড়িতে বসে বাবার সঙ্গে অনর্গল কথা বলতে বলতে বাড়ি পৌঁছলেন। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বাবাকে চমকটা দিলেন। সারা ঘরে তখন একটা স্তব্ধতা। ডাঃ নিশিকান্ত বসু ঘরে বজ্রপাত হলেও বোধহয় এতখানি আঘাত পেতেন না। মা হেমলতা দেবীও যারপরনাই দুঃখিত হলেন। আদরের গনা তাঁদের এতদিনের স্বপ্ন ভেঙে দিল! সম্ভ্রান্ত, সম্পন্নবংশের ছেলে ‘কমিউনিস্ট’ হবে? কিন্তু ছেলে তার সিদ্ধান্তে অটল। বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর বাবা বোঝাতে শুরু করেন, “দেখো, রাজনীতি করো ঠিক আছে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশও রাজনীতি করেছেন আবার একই সঙ্গে ব্যারিস্টারিও করেছেন। তুমিও নাহয় তাই করো”—কিন্তু গনা কিছুতেই দু’নৌকোয় পা দিতে রাজী নয়, সে রাজনীতিকেই জীবনের ব্রত করবে একেবারে মনস্থির করে ফেলেছে। ‘কমিউনিস্ট’ হওয়া মানে তো ভয়ংকর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে বরণ করা, বাবা মা সহজে এই কঠিন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের মেনে নিতেই হয়। ছেলে তার সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়তে রাজি নয়।

বাড়ির উত্তেজনা থিতিয়ে যেতে না যেতেই বসু পার্টির কাজকর্ম শুরু করে দেন। ইতিমধ্যে ব্যারিস্টারি পরীক্ষার রেজাল্ট এসে যায়, পাস করেছেন শুনে অবশ্য ছেলের সিদ্ধান্ত পালটে যায় না। ইংরেজি পোশাক ছেড়ে বাঙালী পোশাক ধুতি পাঞ্জাবী পরা শুরু করেন, কলকাতার বাইরে বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতের সেই শুরু। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির অধিকাংশ নেতাই হয় আণ্ডারগ্রাউণ্ডে নয় জেলে। এঁদের মধ্যে ছিলেন বঙ্কিম মুখার্জি, সতীশ পাকড়াশি, আবদুল হালিম, সুধাংশু দাশগুপ্ত (পরে যিনি ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন) এবং আরও অনেকে। পার্টির নির্দেশ অনুযায়ী বসু আণ্ডারগ্রাউণ্ডে গেলেন না, তবে তাঁর প্রধান কাজ হল আণ্ডারগ্রাউণ্ড সংগঠনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা। অনেক সময় পরিস্থিতি অনুযায়ী আণ্ডারগ্রাউণ্ডে থাকা নেতাদের গোপন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, গোপনসভার জায়গা ঠিক করা—এই সব কাজও করতে হত। সংগঠক হিসাবে লণ্ডনেই তিনি বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, দেশে এসে এই ক্ষমতা রীতিমত কাজে লাগালেন।

নিজের বাড়িতেও তিনি অনেক সময় আত্মগোপনকারী নেতাদের আশ্রয় দিয়েছেন। বাবা মা সবই জানতেন, তবে আপত্তি করতেন না, একবার মুজফ্ফর আহমেদ (কাকাবাবু বলে যিনি পার্টিমহলে পরিচিত ছিলেন), সরোজ মুখোপাধ্যায় এবং পাঁচুগোপাল ভাদুড়ি হিন্দুস্তান পার্কে এক সভায় এসে বললেন যে তাঁদের গোপন ডেরায় ‘ওয়াচার’ বসেছে, বসু তখনি সেই ডোভার লেনে তাঁদের গোপাল কুমারমঙ্গলমের (মোহন কুমারমঙ্গলমের ভাই) বাড়ি নিয়ে গেলেন। তিনি তখন নেশা করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, বসু তাঁকে ঠেলে তুলে বললেন, “তোমার বাড়িতে কয়েকজন অতিথি এসেছেন, থাকার ব্যবস্থা করে দাও।” থাকার ব্যবস্থা হল। কয়েকদিন সেখানে থাকার পর আবার তাঁরা বাসা পাল্টালেন। অনিশ্চয়তার চূড়ান্ত আর সেটাই যেন বসুকে টানত।

সাধারণ জনগণই নেতা তৈরি করে। গ্রামাঞ্চল আর মফস্বলের সাধারণ মানুষের সঙ্গে বসুর প্রত্যক্ষ যোগাযোগের শুরু হয় পার্টির নির্দেশে। পার্টি নেতৃত্ব তাঁকে বিভিন্ন জেলায়, মফস্বলে পাঠায় পার্টি-ক্লাস নেবার জন্য। সে সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্বন্ধে জনগণকে সচেতন করা। এরই মধ্যে বসু বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতির খবরাখবর রাখতেন। তখন সারা বিশ্বে যুদ্ধের দামামা বাজছে। ব্লিৎসক্রীগ-এর যুগ, হিটলারের ইহুদী-বিদ্বেষ চরমে উঠেছে। বসু রোজই যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতির খবর পড়তেন কাগজে, রেডিও শুনতেন, বিদেশের বন্ধুবান্ধবের চিঠিতেও যুদ্ধের জীবন্ত বর্ণনা থাকত। প্যারিসে পঞ্চমবাহিনীর অনুপ্রবেশ, সাধারণ পণ্যদ্রব্যের টানাটানি, গেষ্টাপোর অকথ্য অত্যাচার, স্বস্তিকা চিহ্নের নিপীড়নের রাজ, জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণ—ঘটনার পর ঘটনা যুদ্ধের চরিত্র যেন পালটে দিল। কমিউনিস্টরা যুদ্ধ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতি পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করল। তখন কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার সময়, কিন্তু বেশির ভাগ নেতাই তখন জেলে। পরিস্থিতি অনুযায়ী তাঁরা নীতি সম্বন্ধে তাঁদের অভিমত পাঠাতে লাগলেন। যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন যুদ্ধকে তাঁরা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ হিসাবেই নিন্দা করেছেন। কিন্তু যখন নাৎসীরা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করল তখন এই যুদ্ধকে বলা হল ‘জনগণের যুদ্ধ’। পিপলস্ ওয়ার’। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ পরিণত হল জনযুদ্ধে। সোভিয়েত ইউনিয়নের লড়াইকে স্তালিন ‘গ্রেট পেট্রিয়টিক ওয়ার’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে বসু নিজে লিখেছেন : “তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ফ্যাসিবাদকেই প্রধান বিপদ বলে চিহ্নিত করেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি বলেছিল ফ্যাসিবাদ পরাস্ত হলে ভারতের স্বাধীনতা কেউ আটকাতে পারবে না। জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে নেহরু ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দাবি করেন, ব্রিটেনের কাছে পরাধীন থেকে আমরা ব্রিটেনকে যুদ্ধে সাহায্য করব না, ব্রিটেন আমাদের স্বাধীনতার দাবি মেনে নিক, আমরাও তাহলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হব।”

মূলত ফ্যাসিবাদবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিবিড়ভাবে নিজেকে জড়ালেন বসু। প্রতিষ্ঠিত হল ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’, ফ্রেণ্ডস্ অব্ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন। জ্যোতি বসু হলেন তাঁর সম্পাদক আর স্নেহাংশু আচার্য হলেন কোষাধ্যক্ষ। এ প্রসঙ্গে শ্রী স্নেহাংশু আচার্য লিখেছেন :

“জুন ২২, ১৯৪১-এ অধ্যাপক হীরেন মুখার্জির কাছ থেকে টেলিফোনে সংবাদ পাই যে নাৎসিবাহিনী তার সমস্ত মিলিটারি শক্তি নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেছে। সম্ভবত বেলা ১টা নাগাদ টেলিফোন পেয়েছিলাম। আমি তৎক্ষণাৎ হীরেন মুখার্জির কাছে গিয়েছিলাম এবং সেখানে রাধারমণ মিত্রকে দেখতে পেলাম। আমরা প্রত্যেকেই ভয়ংকরভাবে উত্তেজিত হয়েছিলাম এই কারণে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন কেবলমাত্র ঔপনিবেশিক জনসাধারণের মুক্তির জন্যই নয়, বিশ্বে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ আনার জন্য দাঁড়িয়েছে।…ঐদিনই সন্ধ্যায় অর্থাৎ ২২শে জুন, ১৯৪১-এ একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং ডঃ ভূপেন দত্তকে সভাপতি এবং অধ্যাপক হীরেন মুখার্জি ও আমাকে যুগ্ম সম্পাদক করে একটি কমিটি ঐ সভাতেই গঠিত হয়েছিল। উক্ত সভায় অন্যান্যদের মধ্যে কমরেড জ্যোতি বসু, ভূপেশ গুপ্ত, চিন্মোহন সেহানবীশ, গোপাল হালদার, মোহিত ব্যানার্জি, আবদুল্লাহ রসুল, সত্যব্রত চ্যাটার্জি উপস্থিত ছিলেন। আমার মনে আছে ঐ সময় কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী ছিল এবং অতি অল্প সময়ে অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা ছিল খুবই কষ্টকর। কিন্তু যাই হোক কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ এবং অন্যান্যদের কাছে আমাদের সংগঠন সম্বন্ধে সংবাদ পাঠানো হয়েছিল। পরবর্তীকালে সংগঠনের একটি নতুন কাঠামো তৈরি হয় এবং কমরেড জ্যোতি বসু সম্পাদকের দায়িত্ব নেন আর আমি কোষাধ্যক্ষ। ১৯৪১-এর জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ৪৬, ধর্মতলা স্ট্রীটে একটি তিনতলা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম এবং ঐ ফ্ল্যাটটিই ভারত সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির কার্যালয়ের ঠিকানা হয়েছিল।”

বসু তখন উদীয়মান কমিউনিস্ট নেতার ভূমিকা পালন করছেন। পরনে সাদাসিধে ধুতি পাঞ্জাবী, কাঁধে একটা সূতির ঝোলা, আজ মেদিনীপুর, কাল বর্ধমান, পরশু আসানসোল, ভিড় ট্রেনে যাতায়াত করছেন। থেমে থেমে বাংলায় বক্তৃতা দিচ্ছেন, ইংরেজি শব্দ এসে বাংলা বাক্যে ঢুকে যাচ্ছে। বুঝলেন, বাংলা ভাষাটা ভাল করে রপ্ত করতে হবে। বাংলা পড়েন নি তা নয়, তবে ইংরেজি বই পড়ার অভ্যাসই বেশি ছিল। বাংলা পড়তে শুরু করলেন—যতদূর সম্ভব ইংরেজি শব্দ বর্জন করে বাংলা বলার চেষ্টা চালালেন। কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলা ভাষণে বেশ পটু হয়ে গেলেন। ছোট ছোট কাটা কাটা বাংলা বাক্যে দিব্যি ভাষণ দিতে শুরু করলেন। ভাষণের মধ্যে কোনও আতিশয্য, অলংকারের আড়ম্বর নেই, নেই কোনওরকম নাটকীয়তা—সহজ, সরল ভাষায় শ্রোতার হৃদয় জয় করে নিলেন। আবেগ উত্তাপহীন, মেদহীন বাক্যই সরাসরি শ্রোতাদের মনে গিয়ে প্রবেশ করত।

এদিকে বাবা মা ভাবতে থাকেন ছেলের বিয়ে দিলে বোধহয় সে এই অনিশ্চিত ‘কমিউনিজম’ ছেড়ে ব্যারিস্টারির দিকে ঝুঁকবে, সংসারী হবে। ব্যারিস্টার হিসাবে বসু কলকাতা হাইকোর্টে নাম লিখিয়েছিলেন, কিন্তু সারাদিন পার্টির কাজেই কেটে যেত। বিবাহ প্রসঙ্গে ডাঃ নিশিকান্ত বসু তাঁর ডায়রিতে লিখেছেন : “ঈশানচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের নাতনী, অনুকূল ঘোষ মহাশয়ের কন্যার সহিত বিবাহের সম্বন্ধ একপ্রকার ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলাম। সেও মেয়েটিকে জানিত, যদিও কখনও আলাপ পরিচয় ছিল না।”

বিলেত যাওয়ার আগে বিয়ে হল না। বিলেত থেকে ফেরার কিছুদিন পর বাবা মা বিয়ের প্রস্তাব দিলেন, কিন্তু বসু কিছুতেই রাজি হলেন না। এখনও তেমন কাজকর্ম শুরু করেন নি, কোনও রোজগার নেই, রাজনীতি করছেন, আর সারাজীবন এই রাজনীতিই করবেন——বিয়ে কি করে করবেন? বাবা মা ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে চিন্তায় অস্থির হলেন, আবার উপরোধ অনুরোধ করতে লাগলেন। বসু আর তাঁদের কষ্ট বাড়াতে চাইলেন না, রাজি হয়ে গেলেন। ডাঃ নিশিকান্ত বসু ডায়রিতে লিখছেন : “সে রাজী হইল। ১২ জানুয়ারি রাত্রি ৯টার সময়। তখনই আমি যাইয়া কন্যাপক্ষকে খবর দিলাম। তাঁহারা অধীর হইয়া তৎক্ষণাৎ তাহাদের বৌবাজারের বাড়ি ও কন্যার মামাবাড়ি গেলেন। সাত দিনের মধ্যে সব ঠিক করিয়া ২০শে জানুয়ারি বিবাহ দিলেন। সকলেই খুব সুখী হইল।…সেদিন রাত্রি ২টার সময় বিলাত হইতে পাশের খবর আসিল। যাহাতে তাহাদের ও তাহাদের ভবিষ্যৎ বংশের ভরণপোষণ চলে তাঁহার দয়ায় তাহার ব্যবস্থা হইয়া গেল। পুত্র বলিল দেশের কাজ করিবে। হাইকোর্ট যাইবে না।”

বাসন্তী (ছবি) ঘোষ ছিলেন বসুর প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের ভাইঝি। সম্পন্ন, শিক্ষিত উচ্চবংশীয় পরিবারের কন্যা। সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং সুশীলা। অতি সহজেই তিনি স্বামীর সাধাসিধে জীবনের আদর্শে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন বসুর জীবনে প্রথম নারী যাঁকে তিনি গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন। দুঃখের কথা তাঁদের বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডাঃ নিশিকান্ত বসু কলকাতায় ছিলেন না। ছবির অ্যাপেনডিসাইটিস হয়েছে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই অপারেশন হবে এই খবর তিনি ছেলের চিঠিতে পেয়েই কলকাতা চলে আসেন। তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করাতে অস্ত্রোপচার রদ হয়, ছবি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং মায়ের কাছে বৈদ্যনাথ ধামে চলে যান। কয়েক মাস পরে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁর টাইফয়েড হয়। বসু ডাঃ বিধান রায়কে দেখান, অন্যান্য চিকিৎসকেরও পরামর্শ নেন কিন্তু ভীষণ টাইফয়েডে মাত্র পাঁচদিন ভুগে তিনি মারা যান।

এই দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করার একমাত্র উপায় ছিল একটানা নিরলস কাজ করে যাওয়া। বসু নিজেকে কাজকর্মে এমন ডুবিয়ে রাখলেন যে ভাববারও সময় যেন না থাকে। বসুর বাবা বেশিরভাগ সময়ই কাটাতে লাগলেন বারদিতে। মা মারা গেলেন ১৯৪১ সালে। সেই সময়ই বসু হাইকোর্ট বার লাইব্রেরীতে বসে আছেন। বাবা টেলিফোনে তাঁকে এই দুঃসংবাদ জানালেন। পারলৌকিক কাজকর্ম দাদা করলেন। “বাবা বললেন তোমাকে নিরামিষ খেতে হবে না, আমি অবশ্য ওসব কিছুই করতাম না, বাবা এটা বলাতে জোর পেয়ে গেলাম”–বসু মন্তব্য করেন।

ভারতীয় রাজনীতি তখন আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। জাতীয়তাবাদী নেতারা বুঝলেন ফ্যাসিবাদ কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। আবার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে পরাধীন জাতি হিসাবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামও করতে পারছেন না। ব্রিটিশকে ভারত ছাড়ার জন্য বিশেষভাবে বলা হচ্ছে অথচ ব্রিটিশ ভারতের মাটি ছাড়তে রাজী নয়। তারা কিছুতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। কমিউনিস্ট পার্টি বার বার বলছে স্বাধীন ভারতই ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করতে পারে। সারাদেশে তখন রাজনৈতিক সংকটের পাশাপাশি চলছে নিদারুণ অর্থনৈতিক সংকট। ১৯৪২ সালের ৯ই আগষ্ট গান্ধী, নেহরু, মৌলানা আজাদ এবং জাতীয় কংগ্রেসের আরও কয়েকজন নেতাকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তার করল। এইভাবে শুরু হয়ে গেল বিখ্যাত ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন। দেশ জুড়ে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে শুরু করল। কমিউনিস্ট পার্টি সেই মুহূর্তে এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল কারণ তারা মনে করেছিল আন্দোলন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে দুর্বল করবে। ফলে পার্টির নেতাদের ওপর চলল অকথ্য অত্যাচার। পার্টি অফিস আক্রান্ত হল। পার্টি নেহরু, গান্ধী প্রমুখ নেতাদের মুক্তির দাবী করল, রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলল।

বসুর বয়স তখন মাত্র আটাশ। দক্ষ পার্টিকর্মী। বুদ্ধিমান আর সমঝদার। কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতাও কম নয়। আবার নমনীয়তা আর দৃঢ়তার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বে। তখন তাঁর দৈনন্দিন রুটিনটা ছিল এইরকম : খুব সকালে তিনি উঠতেন না, সকাল সাতটা নাগাদ উঠে তৈরি হয়ে আটটার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া—সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির অফিস, পার্টির চাঁদা তোলা, সভাসমিতিতে বক্তৃতা দেওয়া—এই সব করতে করতে কোন্ ফাঁকে সারাটা দিন কেটে যেত। প্রায়ই চলে যেতেন হাওড়া স্টেশনে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে মফস্বলে, আবার অনেক সময় জেলায় জেলায় ঘুরতে হত। পার্টিক্লাস নিতে হত নিয়মিত। ফিরতে রীতিমত রাত হয়ে যেত। আবার দিনের পর দিন হয়ত কলকাতার বাইরেই থেকে যেতেন। এই প্রসঙ্গে ডাঃ নিশিকান্ত বসু তাঁর ডায়রিতে লিখেছেন : “ছোট ছেলে জ্যোতি একা কলিকাতার বাড়ীতে থাকে। তাহার কাছে কিছুদিন থাকিবার ইচ্ছা। তাহার স্ত্রীর মৃত্যুর পরে এই প্রথম আমি কলিকাতায় আসিলাম। ছেলেকে দেখাশোনা করিবার কেহ নাই। একটি চাকর আছে, সে যখন যাহা রান্না করিয়া দেয় তাহা অম্লান বদনে খাইয়া ওঠে। দেখিলাম তাহার অসুবিধা অনেক হয় কিন্তু কিছুই গ্রাহ্য করে না। অথচ অনেক খরচ হয়। ১৪ দিন কলিকাতার বাসায় রহিলাম। যতদিন সেখানে রহিলাম প্রতিদিন বাজার করিতাম। ছেলের যাহাতে ভাল খাওয়া হয় তাহার ব্যবস্থা করিতে লাগিলাম। দেখিতাম সে খুব দেশের কাজে ব্যস্ত। অনেক লোক তাহার কাছে আসিত এবং সেও কোথায় কোথায় যাইত। প্রায়ই ঠিক সময় আহার হইত না। সময়মত আহারাদি না হওয়ায় তাহার শরীরও খুব খারাপ দেখিলাম। কিন্তু দেশের জন্য গা ঢালিয়া দিয়াছে, শরীরের প্রতি ভ্রুক্ষেপ নাই। তাহাকে কিছুদিন রাজসাহী আসিয়া বিশ্রাম করিতে বলিলাম। সে বলিল অনেক কাজ এখন পারিবে না। যে কয়দিন ছিলাম একটু দেখাশোনা করিলাম।”

বসু তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, খাওয়াদাওয়া সুখ অসুখের দিকে কোনও দৃষ্টি নেই। পার্টির কাজে কেটে যায় সারাদিন। রাতে পড়েন প্রিয় বই ‘দ্য হিস্ট্রি অব্ দ্য কমিউনিস্ট পার্টি অব্ সোভিয়েত ইউনিয়ন (বলশেভিক)’। সেই সময় এই বইটি ছিল তাঁর অনুপ্রেরণার মূল উৎস।

১৯৪২ সালের ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলনে যোগ দিতে বসু ঢাকায় গিয়েছিলেন। বঙ্কিম মুখার্জি আগেই সেখানে গেছেন। সম্মেলনের দিন বসু এবং স্নেহাংশু আচার্য হাঁটতে হাঁটতে মঞ্চের দিকে এগোচ্ছেন এমন সময় দেখলেন ভীতসন্ত্রস্ত জনতা দৌড়চ্ছে, বন্ধু স্নেহাংশুর হাতে চোট লাগল, শুনলেন ঢাকার কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য, উদীয়মান বিপ্লবী লেখক সোমেন চন্দকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই মর্মান্তিক ঘটনায় সেখানকার আবহাওয়া থমথমে হয়ে উঠল। বসুও অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। তবে সম্মেলন বন্ধ হল না, বক্তৃতাও দিতে হল। এর পর বসু আর স্নেহাংশু আচার্য গেলেন মুন্সীগঞ্জের এক জনসভায়। তারপর ময়মনসিং-এ স্নেহাংশু আচার্যের বাড়ি কয়েকদিন থেকে কলকাতায় ফিরলেন। বাবা নিশিকান্ত বসু তাঁর ডায়রিতে লিখছেন : “১৪ই জুলাই আমার ছোট পুত্র জ্যোতি ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণায় কৃষক সম্প্রদায়ের নিকট বক্তৃতা দিয়া বারদি আসিল। তাহাকে নিকটে পাইয়া তাহার দিদিমার খুব আনন্দ হইল।”

“সেই সময় একবার আমি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করেছিলাম”- বললেন বসু। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক সুরেন গোস্বামী। কবি তখন অসুস্থ। “ওঁর সচিব এ. কে. চন্দ আমাদের বললেন এখন দেখা হওয়া সম্ভব নয়, যুদ্ধের খবরে উনি খুবই বিচলিত। ডাক্তারের বারণ আছে। তবে কবি বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাস্ত করা যাবে না।” এ প্রসঙ্গে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ লিখেছেন : “জার্মানি যখন রাশিয়া আক্রমণ করল, সেই অসুখের মধ্যেও বারে বারে খোঁজ নিয়েছেন, বারে বারে বলেছেন সব চেয়ে খুশি হই রাশিয়া যদি জেতে। সকালবেলায় অপেক্ষা করে থাকতেন যুদ্ধের খবরের জন্য। যেদিন রাশিয়ার খবর একটু খারাপ, মুখ ম্লান হয়ে যেত, খবরের কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। যেদিন অপারেশন হয় সেদিন সকালবেলা অপারেশনের আধঘণ্টা আগে আমার সঙ্গে তাঁর এই শেষ কথা : ‘রাশিয়ার খবর বলো’। বললুম, ‘একটু ভাল মনে হচ্ছে, হয়ত একটু ঠেকিয়েছে।’ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল : ‘হবে না? ওদেরই তো হবে! পারবে, ওরাই পারবে।

১৯৪৩ সালে দেখা দিল ভয়াবহ মন্বন্তর। বলা যেতে পারে শতাব্দীর ভয়ংকর মন্বন্তর। এই মন্বন্তরের জন্য যতটা না দায়ী ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ—খরা, নিষ্ফলা, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী ছিল মানুষ। মানুষের তৈরী সরকারের ব্যর্থ খাদ্যনীতিই এই মন্বন্তর ডেকে এনেছিল। সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাড়ে চার লক্ষের বেশি লোক অনাহারের শিকার হয়। আগষ্ট মাসে কলকাতা শহরে অভুক্ত, অর্ধভুক্ত মানুষের মিছিল আছড়ে পড়ে। কর্তৃপক্ষ প্রাণপণ চেষ্টা চালান তাদের শহরের সীমানার বাইরে ঠেলে সরিয়ে দিতে। খাদ্যবণ্টনের চরম অসাম্যই এই মন্বন্তরের কারণ ছিল। বেঙ্গল ফেমিন ইনকোয়ারী (উড়হেড) কমিশনের রিপোর্টে সরকারকেই মূলত দায়ী করা হয়। বলা হয় সরকার ইচ্ছা করলে এই বিপর্যয় অবশ্যই এড়াতে পারত।

এই মন্বন্তরের সময় কমিউনিস্ট পার্টি এগিয়ে এসেছিল দুর্গত মানুষের ত্রাণে। তখন বসু কমিউনিস্ট পার্টির সারাক্ষণের বিশ্বস্ত কর্মী। প্রথমে ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা, তারপর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের বিরোধিতা, তারপর এই মন্বন্তরের মোকাবিলা করা, দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবা করা—ধীরে ধীরে বসু যেন জনগণের নিতান্ত এক কাছের মানুষ, নির্ভরযোগ্য মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। খুব কাছ থেকে বসু এই দুর্ভিক্ষের করাল রূপ দেখেছেন। কয়েকটি নির্মম ছবি এখনও তাঁর স্মৃতিকে পীড়া দেয়। বললেন : “তখন পথেঘাটে কঙ্কালের মত মানুষের ভিড়, আকাশে বাতাসে ‘একটু ফেন দাও’, ‘একটু ফেন দাও’ —আর্ত চিৎকার।” ডাঃ বিধান রায়ের নেতৃত্বে গড়া হল মেডিকাল রিলিফ কো অর্ডিনেশন কমিটি। দিনেরবেলায় সেখানে যেতে হয়, রাতে প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভা বা সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির বৈঠক। একবার শোনা গেল অভুক্ত মানুষের মিছিল আসছে শহরের মধ্যে, তারা শুনেছে সরকার তাদের খাদ্য আর আশ্রয় দেবে। রাজভবনের দিকে ভিড় আছড়ে পড়ল। পার্টিকর্মীরা তখন রাস্তার বড় মোড়গুলিতে দাঁড়িয়ে পড়ল যাতে সেই মিছিলের গতি রোধ করা যায়, কেননা ব্রিটিশ সরকার হাঙ্গামা দেখলেই ভিড়ের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে দেবে। কিন্তু ক্ষুধার যন্ত্রণা বড় যন্ত্রণা। স্রোতের মত মানুষ বাঁধ ভেঙে এগিয়ে গেল, এই দৃশ্য বসু নিজে চোখে দেখেছিলেন। একটা ঘটনা তাঁর এখনও মনে আছে “এক শীর্ণ মহিলা কোলে একটি শিশু নিয়ে কোনও রকমে পা টেনে টেনে এগোচ্ছিলেন, হঠাৎ তিনি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। সব শেষ কিন্তু কি আশ্চর্য শিশুটি তখনও বেঁচে, মাকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে।” রিলিফের কাজ করতে করতে প্রায়ই এই ছবিটা বসুর মনে পড়ত

বম্বেতে ১৯৪৩ সালের ২৩শে মে থেকে ১লা জুন কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সর্বভারতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হল। তার আগেই ১৮ই থেকে ২১শে মার্চ কলকাতায় ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন হলে অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির তৃতীয় সম্মেলন। এটি ছিল পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির প্রথম প্রকাশ্য সম্মেলন কারণ তার আগে পার্টি ছিল বে-আইনী। এই তৃতীয় প্রকাশ্য প্রাদেশিক সম্মেলনে, সাতজনকে নিয়ে একটি ছোট প্রাদেশিক কমিটি গঠিত হয়েছিল। ভবানী সেন সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। এর কয়েক মাস পরে পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক নেতৃত্ব বসুকে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতে পাঠালেন। প্রথমদিকে তিনি বন্দর ও ডক শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য ডক ও বন্দর এলাকায় যেতে শুরু করেন। তারপর পার্টি তাঁকে পাঠাল রেল শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতে। শ্রমিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বসুর এই প্রথম। বসুর কাজ ছিল বেঙ্গল অ্যাণ্ড আসাম রেলওয়ে শ্রমিকদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার কাজে সাহায্য করা। কাজটা একেবারেই সহজ ছিল না। কারণ তখন বেঙ্গল অ্যাণ্ড আসাম রেলওয়ে এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন আগে থেকেই ছিল। পরে হুমায়ুন কবীর এর সভাপতি হন। বসুর সঙ্গে ছিলেন মহম্মদ ইসমাইল, নিখিল মৈত্র যাঁদের আগেই এই কাজের অভিজ্ঞতা ছিল। তাছাড়া তাঁকে বহু প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন সরোজ মুখোপাধ্যায়। যিনি পরে সি পি আই (এম)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক হয়েছিলেন। বসুকে এই সময় যাঁরা সাহায্য করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন নিত্যনন্দ চৌধুরি, অমূল্য উকিল, পূর্ণেন্দু দত্তরায়, সত্যেন গাঙ্গুলি এবং সত্য গুপ্ত। বসু সেই সময় শ্রমিকদের মিটিং করতে বঙ্কিম মুখার্জি এবং সরোজ মুখার্জির সঙ্গে ঢাকায় গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন পার্বতীপুর-সোদপুরে। বসুর সব সময়ের কাজ ছিল শিয়ালদহ-বিভাগ, হাওড়া-বিভাগ, কাঁচরাপাড়া, পূর্ববঙ্গ ও আসামে ঘুরে রেলশ্রমিকদের মধ্যে সংগঠন করা। বসু এই কাজে সফল হলেন। গঠিত হল “বি. এ রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন”। ১৯৪৪ সালে গঠিত এই ইউনিয়নের সভাপতি হলেন বঙ্কিম মুখার্জি। বসু হলেন প্রথম সাধারণ সম্পাদক। পরে বেঙ্গল অ্যাণ্ড আসাম রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন এবং বি. ডি. রেল. রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সংযুক্তির ভিত্তিতে গঠিত হয় রেলওয়ে শ্রমিকদের নতুন এক সংগঠন, বেঙ্গল অ্যাণ্ড আসাম রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। বসু এই সংগঠনেরও প্রথম সাধারণ সম্পাদক হলেন। রেলশ্রমিকদের দাবী আদায়ের জন্য তিনি এই সময় বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন রীতিমত প্রভাবশালী এক নেতা। তারপর স্থান করে নিয়েছেন সর্বভারতীয় স্তরে। অল ইণ্ডিয়া রেলওয়ে মেনস ফেডারেশনের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৪৫ সালে পার্টির পলিটব্যুরোর নির্দেশ অনুযায়ী ভারতের সব প্রদেশে কয়েকজন কমিটির সংগঠক বা পি.সি.ও. (প্রভিন্সিয়াল কমিটি অরগানাইজার) মনোনীত করা হয়। বাংলায় অন্যতম পি.সি.ও. মনোনীত হলেন জ্যোতি বসু। দলীয় সাংগঠনিক এই পদে মনোনীত হবার পর বসুকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি।

নতুন রেল ইউনিয়ন সংগঠিত হবার পর রেলপথের ইংরেজ জেনারেল ম্যানেজারের কাছে বসুদের দাবী হল ‘ বি. এ. রেল রোড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’কে স্বীকৃরি দিতে হবে। জেনারেল ম্যানেজার অনেক টালবাহানার পর রাজি হলেন। স্বীকৃত ইউনিয়নের সম্পাদক হিসাবে বসুকে দেওয়া হল রেলপথে যাতায়াতের জন্য প্রথমশ্রেণীর পাস।

এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয়। ফ্যাসিবাদী শক্তির নির্মম অত্যাচার থেকে বিশ্ব মুক্তি পায়। ১৯৪৫ সালের পয়লা মে সোভিয়েত লালফৌজ এবং মিত্রবাহিনীর কাছে হিটলারের ফ্যাসিস্ত বাহিনী–সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জার্মানির সর্বাধিনায়ক আত্মসমর্পণ করেন। বার্লিন রাইখষ্ট্যাগের চূড়ায় লালফৌজের কয়েকজন সৈন্য কাস্তে হাতুড়ি-খচিত লালপতাকা উত্তোলন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতির চেহারাও আবার পালটে গেল। ফ্যাসিবাদ পরাস্ত হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন আবার ব্রিটিশ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দৃষ্টিতে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হল। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় “সি.পি.আই. তার ‘জনযুদ্ধ’ যুগের সাধারণভাবে ‘জনযুদ্ধ’-র লাইন বলে পরিচিত ‘ধর্মঘট-বিমুখতা’ ও ‘সংগ্রামবিমুখতা’র লাইন পরিবর্তন করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শেষ ও চূড়ান্ত সংগ্রামের লাইন গ্রহণ করল। এই যুগের বিভিন্ন শ্রমিক-কৃষক সংগ্রাম সংগঠিত করার ও এই শ্রমিক-কৃষক সংগ্রামগুলিতে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্বও গ্রহণ করেছিল সি.পি.আই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণআন্দোলনগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্টরা ক্রমশ চলে এসেছিলেন যুদ্ধ-পরবর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণসংগ্রামের পিছনের সারি থেকে সামনের সারিতে।”“

এই সময় প্রতিটি গণ-আন্দোলনে বসুর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। প্রায় প্রত্যহই তাঁকে বিভিন্ন সভা সমিতিতে বক্তৃতা দিতে হত, মিছিলে বেরোতে হত এবং বি.পি.টি. ইউ.সি-র বহুবাজার স্ট্রীটের অফিসেও যেতে হত। বসু অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারতেন, উৎসাহ আর সাহসের অভাব তাঁর ছিল না। এই সময় ২৭ ও ২৮শে অক্টোবর পালন করা হয় ইন্দোনেশিয়া-দিবস। ইন্দোনেশিয়ার জনগণের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন এবং এই সংগ্রাম দমনের উদ্দ্যেশে ভারতীয় সৈন্যদের ব্যবহারের প্রতিবাদে এই দিনটি পালিত হয়েছিল। সেই সময়কার আর একটি উল্লেখযোগ্য আন্দোলন হল সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দীদের মুক্তির আন্দোলন। এই আন্দোলন দুটি পর্যায়ে ব্যাপকভাবে করা হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের ৫ই নভেম্বর এই আন্দোলনের শুরু। বিভিন্ন গণ-আন্দোলনের জোয়ারের মধ্যে শেষ হল ১৯৪৫ সাল। বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনে বসু তখন তন্নিষ্ঠভাবে এক সুদক্ষ সংগঠকের সক্রিয় এবং বহুমুখী ভূমিকা পালন করছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *