৪. দশশালা বন্দোবস্তে বাংলাদেশের যে বেজায় ক্ষতি

দশশালা বন্দোবস্তে বাংলাদেশের যে বেজায় ক্ষতি হয়েছে তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না, আমার এক শালার ব্যবহারেই তা বোঝা যায়। শালা যে কী চীজ আমি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। একজনের ধাক্কায় আমার একলার যা দুর্দশা করেছে তার পরিমাণকে দশগুণ বাড়িয়ে দশজনার পরিণাম খতিয়ে বার করা খুব কঠিন নয়। এমন কিছু শক্ত আঁক না।

তাহলে, গোড়া থেকেই শুরু করা যাক—

 

এই যে, সুচিত্র যে! এমন হঠাৎ?— আমার উচ্চস্বরে অভ্যর্থনা অথবা অভিযোগ, কী প্রকাশ পায় বলতে পারিনেঃ আপিসের ছুটি-টুটি না কি?

এই সকালে আর এমন অকালে বিনা নোটিশে সুচিত্রব আবির্ভাব আমার বিচিত্র বলেই মনে হয়।

ওর আসা-যাওয়া, প্রায় ধূমকেতুর মতই, এতই কখনো কদাচ যে, কল্পনাকেও একটু ভাবিত না করে পারে না।

বাড়ির খবর সব ভালো তো দাদা? জিজ্ঞেস করে ও।

বাড়ি? বাড়ির খবর? যদুর ভাল হতে হয়। সুচিত্রব একমুখ উত্তর : সত্যি বলতে, বাড়ির কোনো খবর নেই। বহুদিন ধরে পাইনি। তার মানে অবশ্যই যে, খবর ভালোই; খারাপ কিছু হলেই খবর আসত, কিন্তু সেকথা না—

বলতে বলতে সুচিত্র, আমাদের মাঝখানে, আমাদের প্রাপ্তরাশেব মধ্যস্থলে নিজেকে স্থাপিত করে। রাশীকৃত হয়।

আমার সময় বেশি নেই। তোমরা যদি খাওয়া দাওয়ার জন্যে খুব বেশি পীড়াপীড়ি লাগাও তাহলে এক্ষুনি আমায় উঠে পড়তে হবে। ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়েছি। সাড়ে আটটার ট্রেন ধরতে হবে আমায় বলতে বলতে ও জাঁকিয়ে বসে।

ওর কথা, সো পেয়ে, কিঞ্চিৎ আশ্বস্তিতে, দুখানা টোসটের অন্দরে একখানা পোচকে সুবিন্যস্ত করে প্রায় মুখে তুলবার মত পরিপাটি করে তুলেচি, সুচিত্ৰ চকিতের মধ্যে হাত বাড়িয়ে সেই টোস্ট আর পোচের হরিহরাত্মাকে আয়ত্তে এনে নিজের অম্লানবদনে পুরে দ্যায়—

বাঃ, তোমার টেষ্ট আছে হে, চকরবতি! বাঃ! রোমন্থনের সাথে সাথে সে জানায়ঃ বাস্তবিক, চক্কোত্তিদের যে রান্নাঘবের সম্রাট বলে সে কি সাধে? চক্কোত্তিরা মুসলমান হলে খাসা বাবুর্চি হতে পারে। এবং এই বলে সে অপরাপর টোস্ট-পোচদের ওপর পরের পর আক্রমণ চালায়। আর বলে যায় : একটা চক্কোত্তি কাটলে দুটো বাবুর্চি বেরয়, কথাটা মিথ্যে নয়।

তোমার সাড়ে আটটার ট্রেন ধরা চাই—বল্লে না—? সুচিত্র এবং দেয়ালঘড়ির দিকে যুগপৎ দৃষ্টি রেখে আমি মনে করিয়ে দিই। স্মরণ না করিয়ে পারিনে।

তার বদলে সাড়ে দশটার ধরলেও ক্ষতি নেই। সুচিত্র বলে।

তবে—আর কি! আমার হতাশ কণ্ঠস্বরে যদুব সাধ্য আনন্দের অভিব্যক্তিদানের প্রয়াস থাকে।

হ্যাঁ, যেজন্যে এসেছি আসল কথাই বলা হয়নি এখনো। সুরু করে সুচিতয় : আপিসের ছুটির কথা জিজ্ঞেস করছিলে না? সেই ছুটির সম্পর্কেই আমার আসা।

তবে যে বল্লে ছুটি পাওনি? পৃষ্ঠদেশের শেষ তৃণ-খণ্ডের জন্য অকাতরে অপেক্ষমান উটের মত আমি ওর উত্তরের প্রতীক্ষা করি। উটপুখের মতন।

এখনো পাইনি বটে, তবে পাবো শীগগিরই। হপ্তাখানেকের ছুটি নেব ভাবছি—এই সামনের হপ্তায়। সুচিত্র অচিরাৎ সব বিশদ করে দেয়। আর সেই কারণেই তোমার কাছে এলাম।

আমার কাছে? আমার কাছে এসে ভুল করেছ ভায়া। আমি ডাক্তার কি কবরেজ নই যে তোমাকে রেডিমেড-সাটিফিকেট দিতে পারব। মেডিকেল সার্টিফিকেট-বিতরণকারী কোনো ডাক্তার কবরেজের সাথে আলাপও নেই আমার। আমার কাছ এসে লাভ?

বিতৃষ্ণ নেত্রে আমার প্রতি দৃকপাত করে ও বলে-কল্পনাকেই বলে : এটা দিনকের দিন এমন হাঁদা হয়ে যাচ্ছে কেন রে? এটাকে তুই এতদিনেও মানুষ করতে পারিসনি দেখছি! একে কাটলে দুটো বোকা হয়। এমন কি, তেমন কায়দা করে কাটতে পারলে তিনখানাও বার করা যায়।

কল্পনা হাসতে থাকে, আমি ঘোঁৎ ঘোঁৎ করি।

অবিশ্যি, ঘোঁৎকারের চেয়েও, কঠোরতর ভাষায় আমি প্রতিবাদ করতে পারতাম, সুচিত্রর সঙ্গে আমার তথাকথিত মধুর সম্বন্ধ কটু-তিক্ত-কষায়ের যে-কোনোটায় রূপান্তরিত করতেও বিশেষ কোনো বাধা ছিল না, উক্ত রসান্তরণে যৎসামান্যই আমার যেত আসত কিন্তু কল্পনার যসিতে আমাকে কাহিল করে দেয়। অগ্রপশ্চাৎ উভয় প্রদেশ থেকে

অতর্কিতভাবে পরের দ্বারা আক্রান্ত হলে খুব পরাক্রান্ত লোকও বেসামাল হয়ে পড়ে।

ছুটি আমার মঞ্জুর হয়েই আছে, সেজন্য কাউকে মাথা ঘামাতে হবে না। বিবস কষ্ঠে ও জানায় সেজন্যে আমি ভাবছিনে। আমি ভাবছি যে ছুটিটা কাটানো যায় কোথায়। সবাই মিলে এই কটা দিন ফুর্তি করে এক সাথে কাটালে কেমন হয় রে খুকি?

খুব ভালো হয় দাদা! কল্পনা উল্লসিত হয়ে ওঠে: উঃ কী আমোদ যে হয় তাহলে!

কি বলগো, মজা হয় না খুব? কল্পনা আমার দিকে তাকায়।

তা–তা একটু হয় বৈকি। আমি চেষ্টা কবে বলি : সুচিত্র যে মজাতে অদ্বিতীয়—কে না জানে?

কিন্তু তোমাদের এখানে এসে কাটাতে আমি চাচ্ছি নে তো।

এখানে না? এতক্ষণে মজ্জমান আমার একটু আমেজ লাগে,—পিঠের তৃণদণ্ড অগাধ জলের তৃণখণ্ড হয়ে দেখা দেয়। অথই জলে ডুবে যাবার মুখে সেই তৃণটি ধরে আমি বলি : দুঃখের কথা! খুবই দুঃখের কথা! তোমার সঙ্গলাত আমাদের পক্ষে যে কতটা গ্রীতিকর তা তুমি জাননা, কিন্তু তাহলেও অন্যায় আসলিন্স ভালো না। ছুটির এই কটা দিন জোর করে আব সবার আলিঙ্গন থেকে ছিনিয়ে তোমাকে আমরা উপভোগ করতে চাইনে। না, কল্পনা, না, ও যখন আমাদের এখানে এসে ছুটিটা কাটাতে রাজি নয়, তখন ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে উপরোধ কোরো না। স্বার্থপরের মত সেটা সত্যিই জবরদস্তি করা হবে।

আমাকে আধখানা কথাও কি কইতে দেবে আগে? বিৰূপ চক্ষের বিষাক্ত চাহনিতে সৃচিত্র আমাকে বিদ্ধ করে : আমি কী মৎলব এঁটেছি তোমাদের বলি তাহলে। আমি বলছিলাম কি, আমরা সবাই মিলে ভবেশদের রিশড়ের ওইখেনে গিয়ে ছুটিটা কাটালে কেমন হয়?

হ্যাঁ, এটা মন্দ আইডিয়া না। কল্পনা সায় দেয়।

ভবেশ আমাদের প্রতিবেশী এবং পরিচিত। রিশড়ের বাড়িটাও আমাদের অচেনা নয়। জানাশোনার মধ্যে বেশ লোক বেছে বেছে ভবেশরা বাগান-বাড়িটা ভাড়া দিয়ে থাকে—অবশ্যি এক আধ হপ্তার কড়ারেই। আমবাও কয়েকবার সেখানে গিয়ে ফুর্তি করে কাটিয়ে এসেছি।

হুম। আমিও মাথা নাড়ি—ভবেশকে বলে দেখব। কী বলে শুনি। আমার ধারণা, আগামী সপ্তাহে ওরা নিজেরাই সেখানে বেড়াতে যাচ্ছে।

যাচ্ছে না। এখানে আসবার পথে ওদের বাড়ি হয়েই এলাম তো। ওকে বাজিয়ে এসেছি।

সুচিত্রর কার্যপ্রণালী এই বকমই। সম্পূর্ণ নিখুঁৎ। ওস্তাদী হাতের সূচী-শিল্পের মতই সুচাক-সব কিছুই এফোঁড় ওফোড় করে চলে যায়—তার সূচীভেদ্যতার ভেতর কোথাও ফাঁক রাখে না।

প্রথম হিম পড়ছে, ঋতু পবিবর্তনের মুখে এই সময়ে কলকাতার বাইরে পা বাড়ানো কি ঠিক হবে? আমি ইতস্তত কবি? তার ওপরে আমার আবার সদির ধাত।

বেশ, এই শনিবারই আমাকে রিশড়েয় যাওয়া ঠিক হলো দাদা। কল্পনা বলে। হাকিম যেমন হুকুম দিতে বসে আসামীর মুখাপেক্ষা করে না তেমনি অনায়াসে আমার মুখের দিকে না তাকিয়ে অম্লানবদনে বলে দ্যায়।

বাঃ, লক্ষী মেয়ে, খাসা মেয়ে! চমৎকার মেয়ে তো একেই বলে বাঃ! সুচিত্রর কলকলধ্বনি শুনিঃ বেশ ভালোই হলো। ঐ সাথে তোমরা যদি তরফদারকেও সঙ্গে নাও, আরো ভালো হয় তাহলে। গোবিন্দ আমার প্রাণের বন্ধু, জানে তো? তরফদারকে। নিমন্ত্রণ করতে কি তোমাদের কোনো আপত্তি আছে?

না, না, আপত্তি কিসের? তোমার বন্ধু আসবেন–সে তো সুখের কথাই। কল্পনাই জবাব দেয়।

কিন্তু তার তো আর ছুটি হয়নি—তার কি নিজের কাজকর্ম নেই? আমিই মৃদু আপত্তি জানাই, অবিশ্যি তরফদারের তরফ থেকেই।

গোবিন্দ? সে ক্যাজুয়াল লীভ নিয়ে বাড়িতে বসে আছে। টেলিফোন করে খবর নিয়েছি আমি। এখানে আসবার মুখে একটু আগেই ওকে বাজিয়ে এসেছি।

আহা, যখন এত লোককেই গায়ে পড়ে বাজিয়ে এসেছ, বাদ দাওনি কারুক্ষেই, তখন একটু কষ্ট করে ঐ সাথে আমার ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকেও কেন বাজিয়ে এলে না? দয়া করে আগামী সপ্তাহে যদি কিছু ওভারড্রাফট দিতো আমায়? এতক্ষণে আমারো একটু ঝাঁঝ দেখা দেয়।

তোমার মেজাজটা আজকাল এমন তিরিক্ষে মেরে যাচ্ছে কেন হে? মনে হচ্ছে হাওয়া বদলানোর দরকার। রিশড়েয় কটা দিন কাটিয়ে এলে তোমার উপকার হবে। বলতে বলতে সুচিত্র উঠে পড়ে: আমি চললুম এখন। সেই রিশড়েতেই মিশব তোমাদের সঙ্গে। কেমন?

ঘূর্ণি হাওয়া চলে যাবার পর, ধ্বংসস্তুপে বিমূঢ় হয়ে পড়লেও মানুষ যেমন একটা অবর্ণনীয় স্বস্তি পায়, চারিধারের নষ্টাবশেষের থেকে অবশিষ্ট নিজেকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে, আমি সেই মানসিক প্রয়াসে লিপ্ত, কল্পনা আমার তন্ময়তায় বাধা দিয়ে বলে

আচ্ছা, হ্যাঁগা, দাদা তটিনীর কোন কথা তুলল না যে? এটা যেমন একটু কেমন-কেমন না?

হয়তো অন্য তটিনীতে পাড়ি জমাচ্ছে আজকাল। আর কোথাও খেয়া বাইছে! দিলেই হলো, খেয়ালী তো!

উহু, তটিনী বলতে দাদা অজ্ঞান। এ হতেই পারে না। তটিনীকেও তাহলে নেমন্তন্ন করা যাক, কী বলো? তাক লাগিয়ে দেয়া যাবে দাদার, কেমন না?

সে কথা মন্দ নয়। আমি বলি। নিস্পৃহ কণ্ঠেই বলি।

ওর বেশি জোরালো সায় দিতে সাহস হয় না আমার, তবু এতক্ষণে, বলতে কি, সত্যিই আমার মন্দ লাগে না। উষর মরুভুমির মাঝখান দিয়ে তটিনী প্রবাহিত হওয়াটা মন্দ কী? অবগাহনের তেমন আশা না থাকলেও—পাড়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতেই—এমন কী খারাপ? মিশকালো মেঘের রূপালী পাড়রা দেখা দিতে থাকে একে একে—এতক্ষণে।

 

অবশেষে আগামী সপ্তাহ এল। আমরা এলাম রিশড়েয়। ভবেশের বাগান বাড়িতে। হিমেল হাওয়া এল, হিম আসতে লাগল, ভয়ানক ঠাণ্ডা এসে পড়ল—কিন্তু সুচিত্ৰর আর দেখা নেই।

হিমেল হাওয়ার হাত ধরে সর্দি এল, কাশি এল, আমার পুরাতন হাঁচিরা এসে পড়ল, আধিব্যাধিদের যারা যারা আসবার এই সুযোগে একে একে এসে গেল, কেবল সুচিত্র এল না। অবশেষে আগামী সপ্তাহ কাবার হয়ে আরেক শনিবার ঘুরে এল।

সুচিত্রর একি লীলা? বুঝতে পারছিনে তো। কল্পনাকে আমি প্রশ্ন করি। আমার পায়ের কাছে তিন তিনটে গরম জলের বোতল, গলাগলি করে আমার পায়ের তলায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। গলায় উলের কক্ষটার, আর গায়ে জড়াজড়ি যত রাজ্যের লেপ। লেপের ওপরে লেপের প্রলেপ।

ছুটি পায়নি বোধ হয়। কল্পনা সাফাই দিতে চেষ্টা করে।

তাহলেও তার করে জানানো উচিত ছিল তার। জলপাইগুড়িতে জলপাই আছে কি জানিনে, তবে টেলিগ্রাফ অফিস আছে, যদুব আমার জানা।

এখনো তো রয়েছে একটা দিন। কাল হয়ত আসতে পারে। দেখা যাক না।

কিন্তু না, কালও সে এল না। আবার আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। সর্দি কাশি হচিরা সাথে সাথে এল, সেই সাথে আরো ঢের খাঁটি জিনিস আমদানির সম্ভাবনা দেখা গেল। আজ্ঞে হ্যাঁ, নিউমোনিয়া পর্যন্ত প্রায় এসে পৌঁছল, কিন্তু আমাদের ওল্ড ম্যানিয়া—সেই আমার শ্যালকরত্ন এল না।

আদা-গোলমরিচ-তেজপাতা-মিশ্রির গরম কাথ পান করছি, সন্ধ্যে হব-হব—এমন সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল।

গেলাসটা নামিয়ে, স্বল জড়িয়ে, দুই বাড়ে দুই বালিশ সম্বল করে খলিত পদে টেলিফোনের জবাব দিতে গেলাম।

কি হে, বোকর! সুচির গলা বলি, আছে কেমন?

কে? সুচিত্র নাকি? কিরকম তোমার ব্যাভার বলো তো? সাত দিন ধরে আমরা সেখানে—আর তোমার দেখা নেই?

আমার দেখা? তার মানে? আমি যে দেখা দেব সে কথা কখন বললুম? সুচিত্রও বিস্মিত গলা বাড়ায়: ওখানে যে আমি যাব কক্ষনো তা তো আমি বলিনি। ঘুণাক্ষরেও না। আমার মতলবটা নিশ্চয়ই তোমরা—তুমি অন্ততঃ—আঁচ করতে পেরেছিলে?

জবাবের হলে কী যেন বলতে যাচ্ছিলাম, বলতে গিয়ে হেঁচে দিলাম। হচিরা পরম্পরায় এসে আমার বাক্যব্যয়ে বাধা দিল—কিন্তু ওর পক্ষে সবই সমান। আমার বক্তব্য বুঝতে তাতে ওর কিছু অসুবিধা হলো না।

ও বললে: বুঝেছি। আর বলতে হবে না। গোবিন্দটা গিয়েছিল?

তরফদার? নিশ্চয়! সে তো অবাক হয়ে গেছে। তুমিই তাকে আহ্বান করে এনে এভাবে বিসর্জন দেবে সে ভাবতে পারেনি। মতলবটা কী ছিল তোমার শুনি।

একদম তুমি আঁচতে পারেনি? বলো কী? বিন্দুবিসর্গও না? আচ্ছা আহম্ম তো! তোমরা কি ভেবেছিলে যে জলপাইগুড়ির জোয়াল থেকে এক হপ্তার এই মুক্তি রিশড়ের মাঠে মারবার জন্যেই আমি ক্ষেপে রয়েছি? যেকালে কি না নিষ্প্রদীপের স্বল্প আলোকে কলিকাতা মহানগরী আরো ঢের রহস্যময়ী হয়ে বাহু বাড়িয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন? তুমি দেখছি একটি নির্জলা বোক্চৈতন!

তাহলে এত কাণ্ড করে এই সব বাগানপাটির মানে? এসব ঠিকঠাক করার উদ্দেশ্য?

উদ্দেশ্য আছে বইকি বন্ধু! গোবিন্দকে আমার পথ থেকে রানো। যাতে আমি অবাধে তটিনীকে নিয়ে বয়ে যেতে পারি। একটু বোকা যদিও, গোবিন্দটা লোক মন্দ না। কিন্তু একটা ওর মহন্দোষ, তটিনীর ওপরে ঝোঁক। ওরও ঝোঁক। এইটেতেই ওকে মাটি করছে। এইহপ্তাখানেকের ছুটির সুযোগে ওর আড়ালে তটিনীর সঙ্গে একটা পাকাপাকি করে ফেলার আমার মতলব ছিল। ভেবেছিলাম, গোবিন্দটা যখন তোমাদের সঙ্গে রিশড়ের মাটি চষবে, সেই ফাঁকে আমি তটিনীকে নিয়ে, চাই কি, গোধূলি লগ্নে একেবারে স্থ হয়েও যেতে পারি। এই সব কারণেই, গোবিন্দকে সরানোর দরকার ছিল আমার। তোমরা যে আমার এত বড় একটা উপকার করে তার জন্য আমি চরিতার্থ—চিরকৃতজ্ঞ। গোবিন্দকে হটাবার জন্যে তোমাদের অজএ-অজ

টেলিফোনের পরপার থেকে ওর ধন্যবাদমুখরতা উদ্বেল হয়ে ভেসে আসে। সমস্তটা আমি নীরবে হজম করি, জীর্ণ করতে বেশ একটু লাগে বৈ কি! তারপরে ভেঁকুর তুলে বলি:

তাহলে এই কটা দিন বেশ ফুর্তিতেই কেটেছে, কী বলে? মতলবও হাসিল নিশ্চয়? তটিনী, তুমি আর গোধূলি—তিনজনে মিলে হলে ত্রিবেণীসম বাধিয়ে ফেলে, আশা করি?

নাঃ, দুঃখের কথা বলব কী তাই? দুঃখের সঙ্গে সুচিত্র জানায়: ট্রেন থেকে শেয়ালদায় নেমেই, ফোন করে খবর পেলাম, তটিনী কোথায় নাকি কয়েকদিনের জন্যে উধাও হয়েছে–এর কোন মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গেছে নাকি কোথায়! ওর বাড়ি থেকেই বললে। কিন্তু কোথায় যে গেছে বাড়ির কারু জানা নেই। মেয়েটার নামও কেউ বলতে পারল না। কী করি, কোথায় কোথায় আর কার কার সঙ্গে যে ও যেতে পারে তার তালিকা নিয়ে খোঁজাখুঁজি করে ওকে খুঁজে বার করতেই গোটা হপ্তাটা আমার ছাওয়া হয়ে গেল।

বার করতে পেরেছে তো? আমি বলি: গোধূলিকেও শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাতে পেরেই নিশ্চয়?

উঁহুঃ! বিদীর্ণ কণ্ঠস্বর সুচিত্রর।–গোধূলির যথাটা বার বার বোলো না, প্রাণে ব্যথা পাচ্ছি। অনেক মাইল লম্বা ওর দীর্ঘনিঃশ্বাস আমার কানে লাগে।

আহা, আমাদের রিশড়ের বাগানবাড়িতে মেও আসতে যদি একবার—আমিও সখেদে বলি : —এসে পড়তে যদি।

য়্যাঁ? তার মানে?

অবিশ্যি, তুমি না আসায় গোবিন্দ আর তটিনীর যে বিশেষ অসুবিধা হয়েছে একথা আমি বলতে পারব না—

বলছ কী তুমি? সুচিত্র বাধা দিয়ে বলে। ওর সূচীভেদ্য স্বর যেন বিঁধতে থাকে আমায়।

তটিনীর প্রতি তোমার টানের কথা তো কল্পনা জানে। ওকে নেমন্তন্ন করাব কথা বলতে তুমি হয়ত ভুলে গেছ এই ভেবে সে নিজের থেকেই তটিনীকে ডাকিয়ে এনেছিল। এবং তারপরে এই দিন সাতেক—এতগুলি দিনের একান্ত আওতায়—তটিনী কোন খাতে যে বয়ে গেছেন, যাক গে,—যেতে দাও, পরচর্চায় লাভ কী? ওসব পরে কথায় পরীর কথায় আমাদের কাজ কি ভায়া–

রিসিভার নামিয়ে রেখে, বালিস ঘাড়ে, কম্বল গায়ে, নড়বড় করতে করতে, আমাব ইজিচেয়ারে, গরম জলের বোতলদের পাশে, গেলাসের সেই ক্বাথের কাছে আবার এসে কাত হই।

ভেবে দেখলে, প্রেমের ফাঁদ তো চারধারেই পাতা–ভূমণ্ডলের কোথায় নেই? যথাস্থানে আর উপস্থিত মুহূর্তে, বোকার মত, ধরা দিলেই হয়। তা না করে বিধাতার ওপরে টেক্কা মেরে নিজের চেষ্টায় বিশেষ করে সেই ফাঁদ পাততে গেলে যা হয় তা কোন কাজের হয় না। মাঝখান থেকে পাতানো ফাঁদে অবাঞ্ছনীয় লোকেরা অযাচিতভাবে জড়িত হয়ে, সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া এবং মানসী ইত্যাদির অভাবিত মিলনে জর্জরিত হয়ে পড়ে। ইজিচেয়ারে তেরছা হয়ে শুয়ে কঠোপনিষদের এই সব কঠিন তত্ত্ব মানসচক্ষে দর্শন করি।

তবু, তাহলেও, এতক্ষণে অনেকটা ভালো লাগে। ঢের সুস্থ বোধ করি। ঠাণ্ডা যেন বহুৎ কমে গেছে—নিউমোনিয়ার উপসর্গগুলোও যেন এর মধ্যেই উপে যাচ্ছে মনে হয়। আরাম পাই, ক্রমশই চাঙ্গা হতে থাকি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *