অশোক সুমিতাদের বাড়ি এল। সুমিতা অশোকেরই বয়সি, দুজনে একসঙ্গে কলেজে পড়েছে। তুই তোকারি সম্পর্ক। অশোককে দেখে সুমিতাই আগে বলল, কী রে অশোক, কী ব্যাপার?
অশোক বলল, ব্যাপার গুরুতর। মাসিমা কোথায়?
রান্না করছেন। কিন্তু গুরুতর ব্যাপার মানে?
অশোক বলল, গুরুতর মানে, সত্যি গুরুতর। অমিতাদির ডেডবডিটা জনসন রোডের নর্দমায় আমিই প্রথম দেখে, থানায় ফোন করেছিলাম, তার থেকে দারোগার ধারণা হয়েছে, তা হলে আমি নিশ্চয় খুনের পেছনে আছি। তা না হলে, আমিই কেন প্রথম ওরকম একটা জায়গায় গেলাম, অমিতাদির ডেডবডি দেখতে পেলাম।
সুমিতা অবাক স্বরে বলল, ওমা, সত্যি তুই দিদির ডেডবডি সকলের আগে দেখেছিস?
হ্যাঁ। এখন বোধ হয় তোরও সন্দেহ হচ্ছে, আমিই অমিতাদিকে মেরেছি!
সুমিতা বলে উঠল, যাহ্, কী ফাজলামি করছিস? কিন্তু তুই জানলি কী করে, দিদির ডেডবডি ওখানে রয়েছে?
সেটা আমাকে ক্রেডিট দিতে পারিস। একটা ছিঁচকে চোর আর পকেটমারের কাছ থেকে আমি খবরটা জানতে পেরেছি। কিন্তু তার নাম আমি এখন বলব না, তা হলে ওর দশাও আমার মতো হবে, কিংবা আমার থেকেও খারাপ, হয়তো অ্যারেস্ট করেই বসবে। অথচ আমি ডেফিনিট যে, সে লোকটা অমিতাদিকে মারে নি। কিন্তু তুই কি আমাকে বসতে বলবি না, এক কাপ চাও খাওয়াবি না?
সুমিতা একটু লজ্জা পেয়ে গেল, বলল, বোস না, তোকে আবার খাতির করে বসাতে হবে নাকি? তোর কথা শুনে আমি তো থ হয়ে যাচ্ছি। বোস, আমি চায়ের কথা বলে আসছি।
সুমিতা ভিতরে চলে গেল, ফিরে এল মিনিট খানেকের মধ্যেই। বসে বলল, হ্যাঁ, তারপর? কী বলছিলি বল।
অশোক সিগারেট ধরিয়ে বলল, বলবার আর কী আছে। পুলিশ আমাকে যেভাবে চার্জ করেছে, এখন আমাকেই অমিতাদির মার্ডারের হদিস করতে হবে।
কী করে করবি?
তোরা সবাই যদি একটু সাহায্য করিস, তবেই কিছু করা যেতে পারে।
সুমিতা অনুসন্ধিৎসু ভাবে জিজ্ঞেস করল, কী রকম সাহায্য বল, নিশ্চয়ই করব।
অশোক সুমিতার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে, জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা সুমি, একটা কথা বল তো, প্রদ্যোৎদার সঙ্গে তোদের কি কোনওরকম ঝগড়া বিবাদ হয়েছে?
সুমিতা হঠাৎ কোনও জবাব দিল না। অশোকের চোখের দিকে একবার দেখে, মুখ নামিয়ে নিল। একটু চুপ করে থেকে, আবার মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, এ কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন বল তো?
অশোক ভণিতা না করে বলল, কাল একটা ব্যাপার দেখে, কথাটা আমার মনে হয়েছে। প্রদ্যোৎদা থানায় যখন তোদের ওঁর গাড়িতে উঠতে বলেছিলেন, তুই রিফিউজ করলি। তোদের ভাব ভঙ্গি দেখেও মনে হল, প্রদ্যোৎদার সঙ্গে যেন তোদের একটু মন কষাকষি চলছে। ব্যাপারটা চোখে ঠেকবার মতো তাই না?
সুমিতা তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না। একটু যেন ভেবে নিয়ে বলল, ধরেছিস ঠিকই একরকম। প্রদ্যোৎদাকে তোর কী রকম লোক বলে মনে হয়?
অশোক পাল্টা প্রশ্ন শুনে বলল, কিছু জানলে তো মনে হবে। বরাবর প্রদ্যোৎকে যেমন দেখে এসেছি, সেইরকমই জানি। পপুলার ডাক্তার, শহরের সকলেই প্রশংসা করে। তা ছাড়াও, শহরের অনেক কিছুর মধ্যে থাকেন। তোদের ইস্কুলের কমিটি সেক্রেটারিও প্রদ্যোৎদা-ই।
সুমিতা গম্ভীর গলায় বলে উঠল, সেটাই হয়েছে কাল।
কাল?
তা ছাড়া আর কী বলব। সে জন্যই তোকে জিজ্ঞেস করছিলাম, লোকটাকে তোর কী রকম মনে হয়।
বলতে বলতে সুমিতা যেন কেমন একটু উত্তেজিত হয়ে উঠল, এবং লোকটাশব্দ অশোকের কানে বিশেষ ভাবে ঠেকল। সুমিতার ভিতরের বিরূপতা আর বিতৃষ্ণা যেন স্পষ্ট হয়ে ফুটে বেরুল। অশোক বলল, সুমি, একটু ভেঙে বল। ইস্কুলের সেক্রেটারি হওয়াই কাল হয়েছে, এ কথার মানে কী?
সুমিতা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কেন, হেডমিস্ট্রেসের ব্যাপার তুই কিছু শুনিসনি?
অশোক শুনেছে, কিন্তু মুখে বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বলল, না তো? হেডমিস্ট্রেসের আবার কী ব্যাপার?
সুমিতার ঠোঁট বেঁকে উঠল, বলল, বাহ, তাদের পপুলার সমাজসেবী ডাক্তার প্রদ্যোৎদার সঙ্গে আমাদের হেডমিস্ট্রেসের এখন জোর প্রেমলীলা চলেছে, শুনিসনি?
অশোক আরও অবাক হবার ভান করে বলল, না তো? প্রদ্যোৎদার মতো লোক?
কথাটা ও শেষ করল না, জিজ্ঞাসু চোখে সুমিতার দিকে তাকিয়ে রইল। সুমিতার মুখ শক্ত হয়ে উঠল। বলল, শুধু হেডমিস্ট্রেস কেন, প্রদ্যোৎদার মতো লোক আরও অনেক লীলাই করতে পারে। জানিস তো, দেখতে নিরীহ গোরুও যখন একবার বিষ্ঠা খেতে আরম্ভ করে, সে আর তা ছাড়তে পারে না। তোদের প্রদ্যোৎ ডাক্তার হচ্ছে সেইরকম লোক। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু মেয়েদের সম্পর্কে লোকটার কোনও বাছবিচার নেই।
অশোক এতটা জানত না। এবার প্রকৃত অবাক হয়ে বলল, বলিস কী?
সুমিতা বলল, ঠিকই বলছি। বেশি বলার দরকার নেই, লোকটা তার নিজের বাড়ির ঝিকেও ছেড়ে দেয় না, আর তার কনসেপশন হয়ে গেলে, অনায়াসে অ্যাবরশন করিয়ে নেয়। আর কিছু শুনতে চাস?
অশোক এবার শুধু চমকে উঠল না, ঝটিতি একটা অন্য চিন্তা ওর মস্তিষ্কে এবার ঝলসে উঠল। ও সুমিতার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, এ সবের কোনও প্রমাণ বা ভিত্তি আছে?
সুমিতা জোর দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই।
মানে, তুই বলছিস, এখনকার ঝি, বৃন্দা?
হ্যাঁ। আর যাই হোক, দিদি বোকা ছিল না, সবই বুঝতে পারত। তবে হ্যাঁ, বুঝতে পারলেও কিছু যায় আসে না, কারণ প্রদ্যোৎ ডাক্তার দিদির কোনও পরোয়াই করত না। দিদির চোখের সামনেই সে যা খুশি করেছে। সে জানে, লোকে তার বিষয়ে খারাপ কোনও কিছুই বিশ্বাস করবে না।
অশোক বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। গভীর চিন্তায় ডুবে গেল, এবং একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন ওর মস্তিষ্কের মধ্যে আবর্তিত হতে লাগল। হেডমিস্ট্রেস, বিন্দুর গর্ভপাত, অমিতাদির সামনেই প্রদ্যোৎ ডাক্তার যা খুশি করতেন, নিরীহ গোরুও বিষ্ঠাখোর হয়…। রমিতা চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল। অশোকের চিন্তায় ছেদ পড়ল। রমিতা সুমিতার ছোট বোন, বয়স বছর পনেরো-ষোলো হবে। এখনও ফ্রক পরে। অশোক ওর হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে বলল, কেমন আছিস রমি?
রমিতা হেসে বলল, ভাল। তুমি তো আমাদের বাড়ি আসতে ভুলেই গেছ।
অশোক বলল, ভুলে গেলে আবার কেউ আসে নাকি?
রমিতা হাসল। সুমিতার থমথমে মুখের দিকে একবার দেখে বলল, যাচ্ছি, তোমরা কথা বলল।
রমিতা চলে গেল। অশোক চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, সুমি, তুই ভাই ভাবিয়ে তুললি। প্রদ্যোৎদার মতো লোক–অথচ এই প্রদ্যোৎদা অমিতাদি, দুজনে দুজনকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন। যে জন্য প্রবীরদাকেও অমিতাদি হতাশ করছিলেন।
সুমিতা খানিকটা বিরক্ত মুখে বলল, ও সব ভালবাসার কথা রাখ। পুরুষের আবার ভালবাসা।
অশোক হেসে বলল, এরকম করে বলিস না। দোষ দিতে হলে উভয়কেই দে, নয় তো কারোকেই না। সবই ব্যক্তি বিশেষের ব্যাপার। আচ্ছা সুমি, অমিতাদির মার্ডারের বিষয়ে তোর কী মনে হয়?
সুমিতা বলল, সেটা আমি ঠিক বলতে পারছি না। এতে প্রদ্যোৎ ডাক্তারের হাত আছে কি না, আমি বুঝতে পারছি না। লোকটা বদমাইশ, কিন্তু খুন করতে পারে কি না, আমি জানি না।
অশোক আবার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ভাবল। চায়ের কাপ শেষ করে উঠে দাঁড়াল। সিগারেট ধরিয়ে বলল, তা একরকম ঠিকই বলেছিস। স্ত্রীলোকের লোভ আর খুন করার সাহস, দুটো এক ব্যাপার না। আচ্ছা চলি, দেখি কী করা যায়। খুবই ঝাপসা লাগছে। কেন না, সবই প্রমাণের অপেক্ষা রাখে।
বলতে বলতে ও সুমিতাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। হাঁটতে হাঁটতে, অন্যমনস্কভাবেই ও এসে পড়ল, প্রদ্যোৎ ডাক্তারের পাড়ায়। পাড়ার মধ্যে, একটি ছোট মিষ্টির দোকান এবং একটা ছোটখাটো মুদি দোকান আছে। অশোকের চেনা দোকান, দোকানিরাও ওকে চেনে। না চেনার কোনও কারণ নেই। ছোট শহরের সবাই সবাইকে চেনে। অশোক প্রথমে মিষ্টির দোকানেই ঢুকল। দোকানদার হেসে জিজ্ঞেস করল, ঠাকুর কি পথ ভুলে নাকি?
অশোক বলল, পথ ভুলে না গোবিন্দদা, তোমার কাছে একটা কথা জানতে এলাম।
গোবিন্দ অবাক হয়ে বলল, কথা জানতে আমার কাছে? কী কথা ভাই ঠাকুর?
অশোক পরিষ্কার জিজ্ঞেস করল, বিহারি বাঙালি মারামারির দ্বিতীয় দিনে, বিকেলের দিকে তুমি কোথায় ছিলে?
গোবিন্দ বলল, কেন দোকানেই।
তখন কি তুমি প্রদ্যোৎ ডাক্তারের বউকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছিলে?
গোবিন্দ বলল, ও বাবা, তুমিও যে থানার দারোগার মতন জিজ্ঞেস করছ।
অশোক চকিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, থানার দারোগা এসেছিল নাকি?
হ্যাঁ, এই তো একটু আগে। তুমি যা জিজ্ঞেস করছ, বড়বাবুও সে কথা জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, ডাক্তারবাবুর বউকে আমি সারাদিনে বেরোতে দেখিনি।
হয়তো বেরিয়েছিল, তুমি খেয়াল করোনি।
তা হতে পারে। কাজে কর্মে থাকি। নাও খেয়াল করতে পারি।
বড়বাবু তোমাকে আর কী জিজ্ঞেস করলেন?
আর কিছু না। আমাকে মুখ ঝামটা দিয়ে বকে গেলেন, বললেন, খালি দোকানদারিই করো, আশেপাশে নজর রাখো না। বলোদিনি ঠাকুর, এ কেমন কথা?
অশোক হাসল, জিজ্ঞেস করল, ডাক্তারবাবু কখন বেরিয়েছিলেন, দেখেছ?
গোবিন্দ বলল, তা দেখেছি। উনি সন্ধে নাগাদ বেরিয়েছিলেন।
একলা?
না। ইস্কুলের দিদিমণিকে গাড়ির মধ্যে দেখেছিলাম।
অশোক রসগোল্লার পাত্রের দিকে তাকিয়ে, চুপ করে রইল। তারপর হঠাৎ ওর মস্তিষ্কের মধ্যে একটা নতুন চিন্তা যেন ওকে ধাক্কা দিয়ে সংকুচিত করে তুলল। তাড়াতাড়ি দোকান থেকে বেরিয়ে আসবার মুখে বলল, ভাল খবর দিলে গোবিন্দদা, চলি।
মনে মনে বলল, সময় আর নেই। সর্বনাশ হয়তো ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে।
কোনওদিকে না তাকিয়ে, বড় রাস্তায় এসেই, একটি খালি চলতি সাইকেল রিকশায় লাফ দিয়ে উঠে বলল, স্টেশন চলো, তাড়াতাড়ি।
মনে মনে আজ সকালের সংবাদের পূর্বাপর সমস্ত কথাগুলো আর একবার ভেবে নিল, এবং মনে মনে একটা অস্থির চঞ্চলতা বোধ করতে লাগল। স্টেশনে এসে, রিকশা ভাড়া মিটিয়ে, বারাকপুরের টিকেট কেটে, ট্রেনে চাপল। ট্রেন থেকে বারাকপুরে নেমে, উঠল বারাসতগামী বাসে। বারাসত পৌঁছুতেই লাগিয়ে দিল প্রায় ঘণ্টাখানেক। সেখান থেকে বসিরহাটগামী বাসে উঠে, টিকেট কাটল বেড়াচাঁপার। মনে মনে ভাবল, একটা গাড়ি যদি নিজের থাকত। বেড়াচাঁপার দূরত্বও কম না। বেড়াচাঁপায় নেমে, ও দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, গয়লাপাড়াটা কোথায়। জানা গেল, দক্ষিণে গিয়ে, পশ্চিমে বাঁক নিলে, গয়লাপাড়া পাওয়া যাবে।
বেড়াচাঁপা বেশ বড় জায়গা, সম্পন্ন গ্রাম, জনসংখ্যাও কম না। কিন্তু জিজ্ঞেস করে করে, গয়লাপাড়ার যত কাছে গেল, গ্রাম একটু নিরিবিলি মনে হল। কাঁচা মাটির রাস্তা, গোরুর গাড়ি চলতে পারে। একজন চাষিগোছের লোককে জিজ্ঞেস করল, বৃন্দাদের বাড়ি সে চেনে কি না। লোকটি সে বাড়িটা দেখিয়ে দিল।
নিরালা বাগান ঘেঁষে বাড়ি। বাগানটা অপরের। সামান্য দুটি বেড়ার ঘর। একটা চেঁকি ঘর। একটা লাউ মাচা। আশেপাশে ফাঁকা। কিছু ঝোঁপ ঝাড়। একটা পুকুর। বেশ নিরালা। উঠোনটা মোটামুটি পরিষ্কার। তা হলেও, কিছু ঘাস গজিয়েছে।
ঘর দুটোর, একটার দরজা বাইরে থেকে শিকল টানা। আর একটা আধ ভেজানো। কোথাও কোনও সাড়া শব্দ নেই। অশোক ডাকল, বৃন্দা।
কোনও সাড়া নেই। কয়েকবার ডাকল। কোনও সাড়া না পেয়ে, ভেজানো দরজাটা ঠেলে সে ভিতরে উঁকি দিল। অন্ধকার, বিশেষ কিছু চোখে পড়ে না। কেউ নেই। তা হলে বৃন্দা কি দেশে ফেরেনি? অন্য কোথাও গিয়েছে?
এই ভেবে ফিরতে গিয়ে, মনে হল, ঘরের মধ্যে বেড়ার এক কোণে কে যেন পা ছড়িয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে, অশোক ভিতরে ঢুকল। এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে দেখল, বৃন্দা। বৃন্দার চোখ খোেলা। জামাকাপড় ঘেঁড়া। সেও যুবতী। প্রায় উলঙ্গ। দেখলেই মনে হয়, সে ধর্ষিতা। কিন্তু মৃত। গলার কাছে ভাল করে লক্ষ করলেই বোঝা যায়, গলা টিপে মারা হয়েছে। ঠিক এ আশঙ্কাটাই অশোক করেছিল।
অশোক তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। কোনওদিকে না তাকিয়ে, একেবারে রাস্তার ওপরে এসে পড়ল। ভাবল কাল দুপুরে বৃন্দা চলে এসেছে। কখন তাকে মারা হল? কাল রাত্রে? সন্ধ্যায়? না আজই ভোর রাত্রে?
সেটা এক্সপার্ট ডাক্তার ছাড়া বলতে পারবে না। তাকেও সত্যি ধর্ষণ করা হয়েছিল কি না, সেটা ডাক্তার বলতে পারবে। কিন্তু একটা সন্দেহ ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠেছে। দুটো খুনের ধরনই একরকম, এবং নিঃসন্দেহে একই হাতের। অমিতাদিকে যেভাবে মারা হয়েছে, একেও প্রায় সে ভাবেই, কেন? সাক্ষী লোপাট?
বড় রাস্তায় এসে, বাসে উঠতে গিয়েও, অশোক চমকে উঠল। তাই তো! আর একবার দেখে আসতে হবে। সে বৃন্দাদের বাড়ির কাছাকাছি আর একবার এল। বাড়ির মধ্যে নয়। সামনের মাঠের মতো জায়গাটা, আর মাটির চওড়া রাস্তাটা দেখল। দেখে, হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল। গোরুর গাড়ির চাকার দাগ রয়েছে। মোটর বা সাইকেলের নয়। এ সব জায়গায় গাড়ির চাকার দাগ থাকা খুবই স্বাভাবিক।
অশোক একটা ফিরতি বাসে, বারাসতে বাস বদলে, বারাকপুরে এসে, দুটো টেলিফোন করল। একটা দেগঙ্গা থানায়।
দেগঙ্গা থানার মধ্যে বেড়াচাঁপা। আর একটা তার নিজের শহরের থানায়, শ্যামাচরণকে। দেগঙ্গা থানাকে, বেড়াচাঁপা গয়লাপাড়ার ঠিকানা দিয়ে বলল, বৃন্দা নামে একজন মেয়ে একটি ঘরে খুন হয়ে পড়ে আছে। আর শ্যামাচরণকে বলল, বৃন্দার খুন হবার কথা।
শ্যামাচরণের গলায় সন্দেহ তীব্র হয়ে উঠল, তুমি জানলে কী করে?
নিজের চোখেই দেখেছি।
তার মানে, বেড়াচাঁপায় গেছ তুমি?
এখন বারাকপুর থেকে বলছি, দেগঙ্গা থানাকেও ফোন করে বলে দিয়েছি।
তুমি কেন বেড়াচাঁপায় গেছলে?
বৃন্দাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে।
তোমাকে না আমি শহর ছেড়ে যেতে বারণ করেছিলাম?
এখুনি আবার শহরে ফিরে যাচ্ছি।
খুব সাবধান, তুমিই তোমার বিপদ ডেকে আনছ।
লোকটার সেই একই সন্দেহ। ও অন্য কথা বলল, আমার বিপদ পরে দেখা যাবে। আপনি একটা কাজ করবেন?
কী?
হেডমিস্ট্রেস সুধা হালদারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন, খুনের ঘটনার দিন, বিকালে তিনি কোথায় ছিলেন, এবং সেখানে তিনি কিছু ঘটতে দেখেছেন কি না।
তার মানে?
জিজ্ঞেস করে দেখুন না, কী বলে। আপনি তো বেশ ডাকসাইটে দারোগা, একটু কথা বের করুন ত। আমি এখুনি ফিরে যাচ্ছি, পালাব না।
ফোন ছেড়ে দিল সে।
.
রাত্রি আটটা অবধি অপেক্ষা করেও, শ্যামাচরণ যখন দেখল, অশোক এল না, সে তখন তার বাড়ি গেল। সেখানে গিয়ে শুনল, সেই যে সকালে বেরিয়েছে, আর বাড়ি ফেরেনি। এদিকে অশোককে সে মুখে যাই বলুক, তার কথামতো, সুধা হালদারকে, জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু বিশেষ কিছুই জানা যায়নি। খুবই শক্ত মহিলা। একটুও মচকায়নি। বরং পরিষ্কার বলেছে, ইস্কুলের একটা প্রয়োজনে সে বিকালে ডাক্তারের বাড়ি গিয়েছিল, এবং অমিতাকে তখন সেজেগুজে বেরোতে দেখেছে। সুধা হালদার এ শহরের মানুষদের ভাল চেনেই না। তবে, ইস্কুল কমিটির মেম্বার হিসাবে, প্রদ্যোৎ ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয়টা একটু বেশি হয়েছিল!
তবে, ডাক্তারের রিপোর্টে, অমিতা যে ধর্ষিতা হয়েছিল, তার প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু অশোক গেল কোথায়? শ্যামাচরণকে কি সে নাচাচ্ছে। তা হলে, অশোককে একেবারে শেষ করে ছাড়বে সে।
অশোকের বাড়ি থেকে আবার থানায় এল শ্যামাচরণ। এসে দেখল অশোক তার ঘরে বসে।
শ্যামাচরণ কিছু বলবার আগেই, অশোক বলল, সমস্ত ব্যাপারটাই প্রি-প্ল্যানড। যে মার্ডার করেছে, সে এমনকী ব্যাপারটাকে ধর্ষণ প্রমাণ করার জন্য, দৈহিক ভাবেই ধর্ষণের অভিনয় করেছে। শুধু তাই নয়, পুরুষ সংসর্গের চিহ্ন যাতে পাওয়া যায়, তাই অমিতাদির দেহে ঢেলে দিয়েছে। অলংকার অপহরণটাও মিথ্যে। ওটা সাজানো। এমনকী নিম্নাঙ্গে যে সব আঘাত, বা বুকের জামা ঘেঁড়া, ব্রেসিয়ার টেনে খুলে ফেলা, সমস্তটা দিয়েই প্রমাণ করার চেষ্টা, এটা ধর্ষণের অর্নামেন্ট ব্যাপার এবং চুরির।
শ্যামাচরণ এতক্ষণ ধৈর্য ধরে শুনছিল। এবার চিৎকার করে বলল, আগে প্রমাণ দাও, তারপর ফালতু বকবক করো।
অশোক একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, দিচ্ছি। অমিতাদি খুন হয়েছে বোধ হয় পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে। এর একমাত্র সাক্ষী ছিল বৃন্দা আর সুধা হালদার।
বৃন্দা? আর সুধা হালদার?
হ্যাঁ তাই বৃন্দাকে মরতে হয়েছে। সুধা হালদারকেও মরতে হত, কিন্তু খুনি তাকে বিশ্বাস করেছে, এবং বোধ হয় আশ্বাস দিয়েছে, বিয়ে করবে। আর বৃন্দার খুনটাও প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে, ধর্ষণ এবং হত্যা। খুনি এখানেও, একই ভাবে, পুরুষ সংসর্গ প্রমাণ করার জন্য, মৃতদেহের সঙ্গে সংসর্গ করেছে একই ভাবে।
কিন্তু বৃন্দা তো বলেছে, অমিতা পাঁচটার সময় বেরিয়েছিল।
সেটা মিথ্যা কথা।
কখন বেরিয়েছিল।
মোটেই বেরোয়নি।
বৃন্দা তা হলে কোথায় দেখেছে, অমিতাকে খুন হতে?
কোথায় দেখতে পারে?
সে যেখানে ছিল তখন।
নিশ্চয়ই ডাক্তারের বাড়িতেই ছিল।
তা হলে সেখানেই খুন হয়েছে।
হোয়াট!
শ্যামাচরণ লাফিয়ে উঠল। অশোক বলল, লাফালাফি করবেন না দারোগাবাবু, বসুন। অমিতাদি বাড়িতেই খুন হয়েছিলেন। সেখান থেকে, তার বডি, রাত্রে জনসন রোডে ফেলে দেওয়া হয়। বর্তমান দাঙ্গার সুযোগে, যাতে ব্যাপারটা কেউ ধরতে না পারে, তাই এ সময়টা কাজে লাগিয়েছে খুনি।
কে খুনি।
তার গাড়িতে অমিতাদির রক্ত এখনও লেগে আছে। গাড়িটা প্রদ্যোৎদার।
শ্যামাচরণ তীক্ষ্ণ অপলক সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল অশোকের দিকে। অশোক বলল, প্রদ্যোৎদা সত্যই গ্রেট লাভার। তবে তার ভালবাসার ঠোঁট দুটো ছিল ঠিক মানুষের মতো নয়, আরও তীব্র বাজপাখির সোনার মতো ধারালো ঠোঁট। এক কথায় স্বর্ণচঞ্চু একবার ধরলে ছিঁড়ে ফেলতে পারে। আর সুধা হালদারের চরিত্রের মধ্যে লেডি ম্যাকবেথের কিছু মিল আছে। কিংবা তার চেয়ে বেশি ইয়াগোর। তার প্ররোচনাতেই প্রদ্যোৎদা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু প্রদ্যোৎদা যে এমন নিষ্ঠুরভাবে মেরে, আবার মৃত স্ত্রীর সঙ্গে সংসর্গ করে, ধর্ষণ প্রমাণ করবে, এটা কল্পনাও করতে পারিনি।
শ্যামাচরণ জিজ্ঞেস করল, কী করে জানলে এ সব।
সারাদিন সব ব্যাপারটা প্রায় কল্পনার মধ্যেই ছিল। গাড়ির রক্তের কথাটাই ঘটনাকে বাস্তব করে তুলল। দেখবেন গাড়ির ডান দিকে, লাল প্ল্যাস্টিকের পা-পোষের ওপর রক্তের দাগ আছে। রক্তটা পরীক্ষা করালেই জানতে পারবেন, ওটা অমিতাদির রক্ত। তবে, একটুও দেরি না করে, গাড়িটা দখল করুন। বলা যায় না, হয় তো আর একবার গাড়িটা ধুয়ে ফেলতে পারে। আমি চলি।
কিন্তু তুমি শহর ছেড়ে যাবে না, মনে রেখো।
তার আর দরকার হবে না বোধ হয়।
সেই রাত্রেই গাড়িটা শ্যামাচরণ ডাক্তারের কাছ থেকে নিয়ে মহকুমার শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
.
তিনদিন পরে অশোক যখন নতুন বউদি কাঞ্চনের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল, তখন ফোন এল। শ্যামাচরণ বলল, ফরেনসিক পরীক্ষায় জানা গেছে, রক্তটা অমিতা রায়েরই। তা ছাড়া সুধা হালদার একটা স্বীকারোক্তি দিয়েছে, ঘটনাটা তার সামনেই ঘটেছিল, প্রদ্যোৎ রায়ের বাড়িতেই। বৃন্দার মা বলেছে, বৃন্দা তার মাকে সব কথাই বলেছিল।
গম্ভীর স্বরে অশোক জিজ্ঞেস করল, আপনার কোনও প্রমোশন হবে দারোগাবাবু?
ফের তুমি আমাকে দারোগাবাবু বলছ?
আচ্ছা শ্যামাচরণবাবু—
ফাজিল। আচ্ছা শোনো কাল একবার সকালে এসো।
যাব।
অশোক লাইন কেটে দিয়ে ঘরে এল। সব ঘটনা ব্যক্ত করল কাঞ্চনের কাছে। তারপর বলল, আর তুমি কিনা, জীবনদার মতো একটা লোককে মারতে পারছ না নতুন বউদি?
কাঞ্চন বলল, তুমি যে ধরে ফেলবে?
সে ভয়েই পার না, না?
হ্যাঁ, সব সময়ে যে তোমার ভয়ে ভয়েই থাকি।
বলে অশোকের দিকে তাকাতে গিয়ে, লজ্জায় মুখ নামাল। অশোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সত্যি, সংসারটা বড় অদ্ভুত নতুন বউদি। নীচে তখন ধ্রুপদের প্রলয় চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সেই সঙ্গেই, সপ্তমে বৃহস্পতি না পঞ্চমে, তাই নিয়ে প্রবল বাদানুবাদ। ঠাকুরবাড়ি বেশ জমে আছে।