৪. তারা স্টেশনে পা দেওয়ামাত্র

তারা স্টেশনে পা দেওয়ামাত্র চিটাগাং মেল ছাড়ার ঘন্টা পড়ল। মরিয়ম বলল, চল, চিটাগাং যাই গিয়া। অন্তুকেও বেশ আগ্রহী মনে হচ্ছে। সে পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, চিটাগাং যাইবা?

কবে ফিরবে?

চিটাগাং গেলে দুই-তিন দিনের আগে ফিরা মুশকিল।

তাহলে যাব না। আজ না ফিরলে মা বকবে।

তারা পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে চলে এল। ঢাকা ময়মনসিং লোকাল লাইনে। দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীতে বোঝাই। এর ভেতর ঢোকা মুশকিল। মরিয়ম বলল,চল, ছাদে উঠি।

অন্তু রাজি হল না। তার গায়ে শার্ট নেই। ছাদের বাতাসে ঠাণ্ডা লেগে অসুখ-বিসুখ হলে বড় কষ্ট হবে। জ্বর হলেই গায়ে কাঁথা দিতে ইচ্ছে করে। তারা কাঁথা পাবে কোথা?

ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বহু কষ্টে তারা একটা কামরায় উঠে পড়ল। ট্রেন দুলছে, দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। পুতুল তার পাশে দাঁড়ান লোকটির হাত ধরে টাল সামলানর চেষ্টা করতেই লোকটি এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, গায়ে হাত দিস না, খবর্দার এক চড় দেব।

লোকটা সত্যি সত্যি চড় দেবার জন্যে হাত ওঠাল। পুতুলের একবার ইচ্ছে হল বলে–বাচ্চাদের সঙ্গে কেউ এ রকম করে?

সে অবশ্যি কিছু বলল না। লোকটার কেমন রাগী রাগী চেহারা, হয়তো সত্যি চড় কষিয়ে দেবে। মরিয়ম পুতুলের পেটে একটা খোঁচা দিয়ে বলল, দেখ, দেখ ম্যাজিক দেহায় ওমা কেমুন সুন্দর!

সত্যি সত্যি এই প্রচণ্ড ভিড়েও একটা লোক ম্যাজিক দেখাচ্ছে। তার হাতে চারটা তাস। সবাইকে তাস দেখাতে দেখাতে অদ্ভুত মেয়েলি গলায় বলছে—

চলন্ত পথের ভাই ব্রাদার, আসোলামু আলাইকুম। আমার হাতে আপনারা কি দেখতেছেন? নজর দিয়া দেখবেন। এর নাম হাতসাফাই। চোখের ধান্ধা। এক রাজার তিন রানী। ভাল কইরা লক্ষ করবেন। পরে বলবেন না যে রানী ছিল চাইরটা। পরে বললে, কাম হবে না। কেউ হাতে নিয়া দেখতে চাইলে আওয়াজ দিবেন। হাতে নিয়ে দেখতে দিব। আছেন কোনো ভাই-হাতে নিতে চান? আছেন কেউ? লজ্জা করবেন না। লজ্জা নারীর ভূষণ পুরুষের শত্রু। আছেন কোনো ভাই? থাকলে আওয়াজ দেন। টাইম কিন্তুক শেষ–এক দুই তিন। কী দেখতাছেন? এক রাজার এক রানী। দুই রানী গায়েব। এর নাম ম্যাজিক হাতসাফাই। চাইর শ বিশের খেলা।

পুতুল মুগ্ধ। চারটা তাস ছিল, এখন আছে মাত্র দু’টি। বাকি দুটি গেল কোথায়? সত্যি সত্যি হাওয়া হয়ে গেছে। কী আশ্চর্য কাণ্ড! মরিয়ম ফিস ফিস করে বলল, এখন হে দাঁতের পাউডার বেচব। নিম পাউডার। সত্যিই তাই। লোকটি তার কাঁধের ঝোলা থেকে চার-পাঁচটা কৌটা বের করেছে। ঠিক আগের মতো মেয়েলি গলায় বলছে–

চলন্ত পথের ভাই ও ব্রাদার। এইবার আপনাদের জন্যে আছে, অত্যাশ্চর্য নিম টুথ পাউডার। আবদুল জলিলের বাঘ মার্কা ৫১১ নং নিম টুথ পাউডার মুখের দুর্গন্ধ দূর, দাঁতের পোকা দূর। এক ঘষায় দাঁত সাফ। দোষ-ত্রুটি সব সাফ…

মরিয়ম ফিস ফিস করে বলল, এর পাউডার বিক্রি হয় না!

তাই নাকি?

হ। বেহুদা চিল্লায়। কেউ কিনে না।

কেনে না কেন?

বেচাকিনা হইল গিয়া ভাইগ্যের ব্যাপার। ভাইগ্যে না থাকলে, হয় না।

সত্যি সত্যি লোকটির নিম টুথ পাউডার একটিও বিক্রি হল না। পুতুল লক্ষ করছে লোকটির মুখ কত দ্রুত বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে। তবু সে হাল ছাড়ছে না। ক্রমাগত বলছে, দোকানে কিনতে গেলে দুই টাকা, কিন্তু পাবলিসিটির জন্য সুবর্ণ সুযোগ–এক টাকা, এক টাকা, এক টাকা।

মরিয়ম বলল, অখন এই লোক গান গাইব।

পুতুল অবাক হয়ে বলল, এ গানও জানে?

জানে। গান জানে, পাখির ডাক জানে। দুই বিড়ালের ঝগড়া জানে। জানলে কি হইব জিনিস বিক্রি হয় না।

বড় মায়া লাগছে পুতুলের। তার কাছে টাকা থাকলে সে সব কটা কৌটা কিনে ফেলত। লোকটি এখন গান ধরেছে–

মনে বড় আশা ছিল যাব মদীনায়
ও ও ও
যাব মদী-না—য়।

সুন্দর গান। গাড়ির অনেকেই তাল দিচ্ছে। লোকটি বিষণ্ণ মুখে গাইছে। মনে হচ্ছে সে সত্যি সত্যি মদীনায় যেতে চায়। পুতুলের ইচ্ছে করছে লোকটির সঙ্গে মদীনায় যেতে। মদীনা দেশটা কেমন? লোকটা এত সুন্দর করে গাইছে। মনে হচ্ছে ভারি সুন্দর দেশ মদীনা।

গান শেষ করতেই বেশ কয়েক জন বলল, আরেকটা হউক। দেহতত্ত্বের গান ধরেন। লোকটি হাসি মুখে শুরু করল–

হলুদিয়া পাখি সোনার বরণ
পাখিটি ছাড়িল কে?

লোকটির অসীম ধৈর্য। গান করে সে আবার তার ঝুলি থেকে ছোট ছোট কৌটা বের করছে। মরিয়ম পুতুলের কানে কানে বলল–

এখন বেচব কানপাকা অষুধ। এই গুলাও বিক্রি হয় না।

হয় না কেন?

বিক্রিবাটা হইল ভাগ্যের ব্যাপার।

তাই নাকি?

হুঁ।

কে বলেছে তোমাকে?

আমি জানি।

পুতুল একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এরা কত কিছু জানে। সেই তুলনায় সে প্রায় কিছুই জানে না। লোকটি কানপাকা ওষুধের ওপর বক্তৃতা শুরু করেছে। সবাই আগ্রহ করে শুনছে–

চলন্ত পথের যাত্রিগণ। এইবার দেখুন অত্যাশ্চর্য কানপাকার মলম কর্ণ-সুন্দর! এই মলমের ফর্মুলা রূপনগরের এক কামেল ফকির স্বপ্নে পান। এই সম্পর্কে বলার কিছুই নাই। রূপনগরের কর্ণ-সুন্দর বললেই লোকে চিনে। কোনো ভাইয়ের দরকার আছে? দরকার থাকলে আওয়াজ দিবেন। প্রতি কৌটা দু’টাকা, দু’টাকা, দু’টাকা। তবে। পাবলিসিটির জন্য মুল্য হ্রাস–এক টাকা, এক টাকা, এক টাকা। আছেন কোনো ভাই? থাকলে আওযাজ দেন।

কেউ কোনো আওয়াজ দিল না। লোকটির জন্যে পুতুলের বড় মায়া লাগছে। তার কাছে টাকা থাকলে সে দুটো কর্ণ–সুন্দর’ কিনত।

মরিয়ম বলল, এই লোক যদি গান গাইয়া ভিক্ষা করত, তাইলে মেলা পয়সা কামাইত।

ভিক্ষা করে না কেন?

একেক জন থাকে একেক কিসিমের।

পুতুল ফিস ফিস করে বলল, লোকটার জন্যে খুব মায়া হচ্ছে। এই কথায় মরিয়ম খিলখিল করে হেসে ফেলল যেন পুতুল খুব অদ্ভুত কথা বলছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *