৪. ট্যাক্সি এসে থামল

ট্যাক্সি এসে থামল পার্ক সার্কাসের খুব বড়ো একটা বাড়ির সামনে। দেখলেই মনে হয় পাঁচমিশেলি লোক থাকে। আবার এখানে কোনো নতুন লোকের সঙ্গে পরিচয় হবে, এই ভেবেই অভিজিতের মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। না, নতুন লোকের সঙ্গে আলাপ করতে আর ভালো লাগে না।

কোথায় যাচ্ছিস রে বাদল?

চল-না।

আমার ভালো লাগছে না, চল, অন্য কোথাও যাই!

এই অভিজিৎ এরমধ্যে তোর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কেন? সোজাভাবে হাঁট।

লিফট দিয়ে উঠে পাঁচ তলায় লম্বা বারান্দায় এক কোণের দরজার সামনে গিয়ে ওরা দাঁড়াল। বাদল কিন্তু কলিং বেল টিপল না, পকেট থেকে চাবি বার করে দরজা খুলল। তাতে অভিজিতের মনে হল, ফ্ল্যাটটা নিশ্চয়ই খালি।

কিন্তু ভেতরে ঢুকে, প্রথম ঘরটা পেরিয়ে দ্বিতীয় ঘরে এসে অভিজিৎ চমকে উঠল। খাটের ওপর শুয়ে আছে একটি মেয়ে। মেয়েটি ঘুমোচ্ছে। তার লম্বা চুলগুলো পড়েছে খাটের পাশে। একটা হাত বিছানার ওপর এমনভাবে পাতা, ঠিক যেন মনে হয়, সে চাইছে।

অভিজিতের একবার মনে হল, মেয়েটি যেন রূপকথার রাজকন্যা। দৈত্যপুরীতে বন্দি। সে আর বাদল দু-জনে মিলে এসেছে তাকে উদ্ধার করতে।

বাদল ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ইশারায় অভিজিৎকে বলল, চুপ করে থাকতে। তারপর খাটের কাছে গিয়ে মুখ ঝুঁকিয়ে টপ করে মেয়েটাকে একটা চুমু খেল। অভিজিৎ আশা করেছিল, মেয়েটি চমকে চেঁচিয়ে উঠবে বা একটা নাটকীয় ধরনের কিছু করবে। সেরকম কিছুই হল না। মেয়েটি আস্তে আস্তে চোখ মেলল, বাদলকে দেখে খুব সাধারণভাবে জিজ্ঞেস করল, কখন এসেছ?

বাদল বলল, আমার এক বন্ধুকে নিয়ে এসেছি।

মেয়েটি এবার ধড়মড় করে উঠে বসল। গায়ের আঁচল ঠিক করে বাদলকে ভর্ৎসনা করে বলল, ও মা, কী অসভ্য তুমি! সে-কথা আগে বলতে হয়।

বাদল বলল, আয় অভিজিৎ, আমরা বসবার ঘরে যাই। কেতকী তোমার চাকরটা কোথায় গেল?

ও একটু বাইরে গেছে। আসতে দেরি হবে।

এই রে, তাহলে আমাদের জিনিসপত্তর কে আনবে?

 তোমার সঙ্গে আনেনি কিছু?

 না।

কেতকী আঁচল-টাচল সামলে একটা চিরুনি হাতে নিয়ে এঘরে এল। বলল, এখন তো সবে বিকেল, যদি চা-টা খাও তো আমি করে দিতে পারি।

বাদল মুখ ভেংচে বলল, ধুস। এখন চা কে খাবে? আমার এই বন্ধুটি খুব ভালো, এর নাম অভিজিৎ।

কেতকী হাতজোড় করে নমস্কার করল! শুয়ে থাকা অবস্থায় অভিজিৎ এক রাজকন্যা ভেবেছিল, আসলে সেরকম দেখতেই নয়। একটু বেঁটে, গোলগাল, মুখখানা ঢলঢলে। মেয়েটির রূপ তেমন নেই, আছে স্বাস্থ্য, এটাই ওর প্রধান সম্পদ বোঝা যায়।

বাদল বলল, তুই বোস অভিজিৎ, আমি একটা বোতল কিনে আনি। আর বিয়ার খেতে ভালো লাগছে না। জিন খাবি?

অভিজিতেরও জিভটা শুকনো শুকনো লাগছে। একবার একটু খাওয়া শুরু করলে তারপর আর এমনি চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগে না! একটু জিন বা হুইস্কি হলেই ভালো হয় এখন।

সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল, আমিও তোর সঙ্গে যাচ্ছি।

না, তোর যাবার দরকার নেই। তুই বোস-না, কাছেই দোকান।

অভিজিৎ তবুও যেতে চাইছিল, বাদল তাকে জোর করে বসিয়ে রাখল।

কেতকীও বলল, আপনি বসুন না। শুধু শুধু দু-জনের যাওয়ার দরকার কী?

বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাদল কেতকীকে বলল, আমার বন্ধুকে যত্ন কোরো কিন্তু।

দরজা বন্ধ হওয়ার পর কেতকী অভিজিতের কাছে এসে দাঁড়াল। চিরুনিটা চুলে ডুবিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে কীভাবে যত্ন করতে পারি বলুন?

অভিজিৎ বলল, এক গেলাস জল—

কেতকী রান্নাঘর থেকে ফ্রিজের ঠাণ্ডা জল এনে দিল, তারপর বলল, আর কিছু?

অভিজিতের অস্বস্তি লাগছে। নারীসঙ্গ সে ভালোবাসে। একসময় পাড়ায় পাড়ায় ঘুরেছে এইরকম মেয়েদের সন্ধানে। কিন্তু সুমিত্রাকে বিয়ে করার পর তার সে নেশা কেটে গেছে। সুমিত্রাকে কথা দিয়েছিল, এবার থেকে ভালো হবে।

কেতকীকে দেখতে ভালো নয়। আলাদাভাবে বিচার করলে তার শরীরের কোনো অংশটাই সুন্দর বলা যায় না। তবু, সব মিলিয়ে তার বেশ একটা আকর্ষণ আছে। তার শরীর থেকে যা বিচ্ছুরিত হচ্ছে, তার নাম মোহ। এই মেয়েটি এখানে একলা কেন থাকে? বাদলের পকেটে চাবি। সে যখন-তখন এখানে আসতে পারে। ঘুমন্ত মেয়েটিকে চুমু খেতে পারে!

এইকথা ভেবেই, অভিজিতের মনে ঠিক হিংসে নয়, হঠাৎ অসম্ভব রাগ হয়। পৃথিবীর কোনো মেয়েকেই অন্য কেউ ভোগ করছে এটা সে সহ্য করতে পারে না। সমস্ত মেয়েই শুধু তার জন্য কেন অপেক্ষা করে থাকবে না। কেন তার কথা শুনবে না?

অভিজিৎ মেয়েটির দিকে তীব্রভাবে তাকিয়ে রইল। ফাঁকা ঘর, শুধু তার সামনে একটি মেয়ে–এ-রকম অবস্থায় পড়লে গা ছমছম করে।

বাদল তার সামনেই মেয়েটিকে চুমু খেল। কোনোরকম লজ্জা বা লুকোচুরি নেই। আবার ইচ্ছে করেই যেন মেয়েটির কাছে তাকে একা রেখে গেল। এর মানে কী?

তুমি আমার পাশে এসে একটু বসবে! নিজের গলার স্বর শুনে অভিজিৎ নিজেই চমকে গেল। কীরকম যেন, রুক্ষ আর গোঁয়ারের মতন।

কেতকী কিন্তু চমকাল না। হাত তুলে সে চুল আঁচড়াচ্ছিল। তার উদ্ধত বুকে আঁচলটা এমনভাবে লেগে আছে যেন যেকোনো মুহূর্তেই খসে পড়বে, অথচ পড়ছে না। তার পেটের কাছে অনেকটা অংশ নগ্ন। রীতিমতন চর্বিজমা পেট, বেঁটে মেয়েদের এ-রকমই হয়, অথচ দেখতে খারাপ লাগছে না।

কেতকী অভিজিতের পাশে এসে বসে পড়ে বলল, এই তো বসলাম।

তুমি কে?

আমার নাম কেতকী।

তা তো বুঝলাম। তুমি এখানে একলা থাক?

আর কে থাকবে?

তোমার আর কেউ নেই?

হ্যাঁ। অনেকে আছে, কত বন্ধু, কত চেনা, কত তোমার মতন হঠাৎ চেনা, এমনকী আমার একটি স্বামীও আছে। সে-ও আসে মাঝে মাঝে।

 মাঝে মাঝে? অন্য সময় তুমি একলা থাক?

অন্য কেউ কেউ সঙ্গেও থাকে।

হঠাৎ যদি তোমার স্বামী এসে পড়ে?

কেন, সে হঠাৎ আসবে কেন? আর এলেই-বা কী?

বাদল তোমার কে হয়?

ধরে নাও বন্ধু।

অভিজিৎ কেতকীর কাঁধে হাত রেখে বলল, এ-রকম দুপুর বা বিকেলে এসে তোমাকে যদি কেউ মেরে রেখে যায়? আদর করতে করতে ঘাড় মুচড়ে দেয়?

কেতকী তবুও চমকাল না। হাসতে হাসতেই বলল, ওসব কী অলক্ষুণে কথা! আমায় মারবে কেন? আমি কি কারুর কোনো ক্ষতি করেছি?

অভিজিৎ বেশ শক্ত করে দু-হাতে কেতকীর মাথাটা ধরে কাছে টেনে এনে খুব গভীরভাবে চুমু খেল।

কেতকী একটুও আপত্তি করল না, চিরুনিটা খসে গেল হাত থেকে। এক হাতে সে গলা জড়িয়ে ধরল অভিজিতের।

কেতকীর ঠোঁট অসম্ভব গরম। অভিজিৎ রীতিমতন চমকে উঠেছিল। এতটা সে আশাই করেনি। জোর করে কোনো মেয়েকে চুমু খেলে সে ঠোঁটকে মনে হয় ভিজে রবার। অভিজিৎ কেতকীকে একটু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়াল।

কেতকী বলল, তুমি গোড়া থেকেই এত রেগে আছ কেন গো? আমি তোমার নাম দিচ্ছি রাগিবাবু।

এক্ষুনি বাদল আসবে।

আসুক না!

তুমি বাদলের নিজস্ব মেয়ে, তুমি আমার কেউ নয়।

 আমি কারুর কেনা বাঁদি নই গো রাগিবাবু!

অভিজিৎ হাতের উলটো পিঠ দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছল। একটু আগে বাদল যাকে চুমু খেয়েছে, সেই এঁটো ঠোঁটে সে মুখ দিয়েছে। এক সময় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিশে এ-রকম সে অনেক করেছে। তখন সে ভাবত, অমৃত কখনো উচ্ছিষ্ট হয় না। এখন সে-কথা মনে হচ্ছে না।

উঠলে কেন, বোসো।

আমি অন্য জায়গায় বসছি।

 কেতকী এবার হাসতে হাসতে ঢলে পড়ল। তারপর বলল, তুমি দেখছি সত্যি সত্যি অদ্ভুত! তোমার বন্ধু বলে গেল তোমাকে খাতির করতে আর তুমি এ-রকম পরপর ব্যবহার করছ কেন?

আমি খুব খারাপ লোক।

তুমি কীরকম লোক আমি এক পলকেই বুঝেছি। আমরা লোক চিনি।

সোফার তলায় উঁকি মেরে কেতকী চিরুনিটা খুঁজল। তারপর অভিজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, চিরুনিটা তোমার পায়ের দিকে, তুলে দাও তো—

অভিজিৎ চিরুনিটা তুলে ওর দিকে ছুঁড়ে দিল। এবার কেতকী উঠে দাঁড়িয়ে আবার চুল বাঁধতে বাঁধতে বলল, যেতে-আসতে তোমার বন্ধুর অন্তত পনেরো মিনিট লাগবে। তা ছাড়া ও বোধহয় ইচ্ছে করেই দেরি করে আসবে।

কেন?

তোমার জন্যে, বুঝলে বোকারাম!

না।

বেশ তো! তাহলে চুপচাপ বসে থাকো। শুধু শুধু দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছ কেন?

অভিজিৎ আবার কেতকীর কাঁধে হাত রাখল। বাদল কি তাকে সত্যিই এইজন্যে এখানে নিয়ে এসেছে? এতে বাদলের লাভ কী?

এবার অভিজিৎ চুমু খাবার বদলে কেতকীর ঠোঁটটা কামড়ে দিল। একই সঙ্গে তার লোভ এবং রাগ দুটোই হচ্ছে। কেন এত সহজে একটি মেয়েকে পাওয়া যায়? চেনা নেই শোনা নেই মাত্র দশ মিনিটের পরিচয়। তাতেই সে মেয়েটিকে চুমু খেতে গেল, আর মেয়েটি একটুও আপত্তি করল না। এর মানে কী। টাকাপয়সাতেই সব কিছু এত সহজ হয়ে যায়?

আমার ইচ্ছে তোমার ঘাড়টা ধরে মুচড়ে দিই। দেব?

কেন বার বার ও কথা বলছ? আমি কী দোষ করিচি?

বাদল কেন তোমাকে আগে চুমু খেল?

 আ মরণ! সাধে কী তোমার নাম দিয়েছি রাগিবাবু?

 অভিজিৎ আবার কেতকীকে ছেড়ে দিয়ে দূরের সোফাটায় বসে রইল। ঘাড় গোঁজ করে, অনেকটা অভিমানী শিশুর মতন। কেতকীর সঙ্গে আর একটাও কথা বলল না।

বাদল ফিরল বেশ খানিকটা পরে। একটা বড়ো বোতল, আর সঙ্গে কিছু খাবার।

কৈফিয়তের সুরে সে বলল, কাটলেটগুলো ভাজিয়ে আনতে দেরি হয়ে গেল।

তারপর এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে বলল, কেতকী কোথায়?

ঘরে তখন অভিজিৎ একলা, কেতকী পাশের ঘরে সম্ভবত শাড়ি বদলাচ্ছে।

বাদল বিরক্তভাবে বলল, দেখেছ? মেয়েটা বুঝি তোকে একলা বসিয়ে রেখে গেছে? কেতকী?

বন্ধ দরজার ওপার থেকে যেন বহুদূর থেকে শোনা গেল, আসছি, তোমরা বোসো।

কেতকীর জন্যে ওরা আর অপেক্ষা করল না। বাদল নিজেই রান্নাঘর থেকে গেলাস আর জলের বোতল নিয়ে এল। গেলাসে ঢালার সঙ্গে সঙ্গে অভিজিৎ চুমুক দিয়ে অনেকখানি খেয়ে ফেলল। ঠিক বুভূক্ষুর মতন। অনেকক্ষণ ধরে তার শরীর ঠিক এটাই চাইছিল। যখনই তার চিন্তাধারায় গোলমাল হয়ে যায়, তখনই অভিজিতের মদের খুব বেশি দরকার হয়।

দুপুরে অফিসে গিয়েই সে একটা সমস্যার মধ্যে পড়েছিল। সাহসের সঙ্গেই সে সেই সমস্যাটার মুখোমুখি হতে চায়। তার চেষ্টায় যদি অসীম আর তিন জনের চাকরি বাঁচে, তাহলে সে চেষ্টা সে করবেই। কিন্তু কেন রতনলাল চাড্ডার সঙ্গে রাত দশটার আগে দেখা করা যাবে না। সেই রাত দশটা পর্যন্ত তাকে বাদলের সঙ্গে কাটাতে হবে।

সুমিত্রাকে কথা দিয়ে এসেছে যে আজ ঠিক সময় ফিরবে। সে আজ নিজে বাজার করেছে। আর সুমিত্রা রান্না করেছে। আজ কথা রাখতেই হবে। আজ বেশি নেশা করাও চলবে না। তার কি নেশা হয়েছে? না, না, তেমন কিছু না।

এক কাজ করলে হত না? এক্ষুনি যদি সে বাড়ি ফিরে যায়? স্নান-টান করে, পোশাক পালটে, খাওয়া-দাওয়া সেরে সে যদি আবার এসে বাদলের সঙ্গে দেখা করে? তাহলে সুমিত্রার কাছে কথা রাখাও হবে, আর অফিসের কাজটাও করা যাবে। সেটাই বেশ ভদ্রলোকের মতন ব্যাপার হয়। সেটাই অভিজিৎ করবে। একটা কোনো অজুহাত দেখিয়ে বাদলের কাছ থেকে কেটে পড়বে। তবে এক্ষুনি নয়, আর খানিকটা পরে গেলেও চলবে।

এখন মাত্র সাড়ে পাঁচটা বাজে। বোতলটা যখন ধরেছেই, আর একটু খেয়ে নিলে ক্ষতি কী?

কেতকী সত্যিই শাড়ি বদলাতে গিয়েছিল। একটা ঝলমলে লাল রঙের শাড়িতে তার চেহারাটা অনেকটা বদলে গেছে। যেমন চুল বেঁধেছে, মুখে ক্রিম ঘষেছে, এখন আর তাকে ঠিক আগের মতন দেখাচ্ছে না।

বাদল তাকে বলল, নাও, তোমার জন্যে কাটলেট এনেছি।

কাটলেটের এক টুকরো ভেঙে মুখে পুরে কেতকী বলল, কোথাও বেড়াতে যাবে?

 বাদল বলল, বেড়াতে? কোথায়?

 চলো না, বাইরে যেকোনো জায়গা থেকে একটু ঘুরে আসি

ধুর

তাহলে এই সন্ধ্যে বেলা বসে বসে শুধু মদ গিলবে নাকি?

তা ছাড়া আবার কী করব?

তাহলে তোমরা থাকো, আমি ঘুরে আসি, একাই যাই বাবা! আমি সারাদিন ঘরের মধ্যে থাকি, আমার বুঝি ভালো লাগে?

তা সকালে বেড়াতে গেলেই পারতে? সকালে তো আমরা আসি না।

শোন কথা! সকালে আবার কোথায় বেড়াতে যাব?

বাদল কেতকীর কোমর ধরে কাছে টেনে বলল, এই, তুমি আমার বন্ধুকে খাতির যত্ন করোনি কেন? জান, ও একটা অফিসের ম্যানেজার, ফেলনা নয়?

কেতকী বলল, তোমার বন্ধু যা রাগি, আমাকে গ্রাহ্যই করছে না। এতক্ষণ ধরে তো একটা কথাও বলেনি আমার সঙ্গে।

অভিজিৎ রাগি? হা-হা-হা! ও আবার রাগি হল কবে থেকে? ও আসলে একটু লাজুক।

অভিজিৎ অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। কেতকীর কোমরে বাদলের হাত, সে সহ্য করতে পারছে না। যেন বাদলের কোনো অধিকার নেই। অভিজিৎ আবার গেলাসে বড়ো চুমুক দিল।

হঠাৎ সে বলল, এক কাজ কর-না বাদল, তোরা দুজনে একটু বেড়িয়ে আয়। আমিও একটু অন্য জায়গা থেকে ঘুরে আসি। আমার একটা কাজও আছে। বলেই সে বুঝল যে ভুল করেছে। এরকমভাবে যাওয়া যায় না। এখন ওরা ভাববে, ওদের আলাদা থাকার সুযোগ দেওয়ার জন্যেই যেন অভিজিৎ চলে যেতে চাইছে। ওরা ছাড়বে কেন?

বাদল বলল, কাজ? তখন যে তুই বললি, রাত দশটা পর্যন্ত তোর কোনো কাজ নেই!

হঠাৎ মনে পড়ে গেল। একবার টালিগঞ্জে যেতে হবে–

গুলি মার! মাল-ফাল খেয়ে এখন আবার কাজ? কাজ তো হবে সেই দশটার সময়। কেন, কেতকীকে তোর ভালো লাগছে না? কেতকীকে তোর পছন্দ হয়নি? কেতকী কিন্তু খুব ভালো মেয়ে। ওর শরীরে রাগ বলে কোনো বস্তু নেই।

আগে তো এর কথা শুনিনি!

এই তো বছর খানেক হল বন্ধুত্ব হয়েছে।

অভিজিৎ চুপ করে গেল। বাদল যেন ঠিক তার মনের কথাটাই বুঝে ফেলে বলল, তুই বুঝি ভাবছিস, আমি অনেক টাকাপয়সা দিয়ে ওকে রেখেছি? মোটেই তা নয়। কেতকীর যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে, নিজের রোজগারও আছে। কেতকী আমাকে ভালোবাসে।

অভিজিৎ আরও রেগে গেল। কেন বাদল এমন অনায়াসে ভালোবাসার কথা বলবে? কেতকীকে ভালোবাসার ও কে?

অভিজিৎ বলল, আমার সত্যি একটা কাজ আছে। ঘুরে আসব আবার।

 কেতকী বলল, কেন, আমাকে বুঝি আপনার পছন্দ হচ্ছে না? আমি দেখতে ভালো নই?

না, না, কী আশ্চর্য সে-কথা নয়!

তবে আপনি চলে যেতে চাইছেন কেন?

সত্যি আমার একটা কাজ আছে।

এতক্ষণ মনে পড়েনি, এখন মনে পড়ল? জানি, অনেক সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে। আমি অতি সাধারণ, সামান্য একটা মেয়ে, আমার সামনে বসে থাকতেও আপনার ভালো লাগছে না।

আরে কী আশ্চর্য! এ-রকম কথা তো আমি ভাবিইনি একদম।

তা হলে আপনি এসে আমার পাশে বসুন।

অভিজিৎ উঠে দাঁড়িয়েছিল, আবার তাড়াতাড়ি এসে কেতকীর কাছে বসল। বাদল অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে হাসছে।

অভিজিৎ এই হাসির মর্মও বুঝতে পারল না। বাদল তার অনেক দিনের বন্ধু–কিন্তু এখন যেন কীরকম অচেনা হয়ে গেছে। সে চাবি দিয়ে একটা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে তার ভেতরের একটি ঘুমন্ত মেয়েকে চুমু খায়।

বাদল বলল, দে অভিজিৎ, তোর গেলাসটা দে। খালি হয়ে গেছে দেখছি। কেতকী, তুমি একটু মাল খাবে না?

অভিজিৎ বুঝল, এক্ষুনি তার ওঠা হবে না! যাক খুব একটা তাড়া তো নেই। আরও আধঘণ্টা পর আর একবার চেষ্টা করব। তখন বাদলের খানিকটা নেশা হয়ে যাবে। আর বাধা দেবে না। অথচ তখন যে অভিজিতের নিজেরও বেশি নেশা হয়ে যাবে। সেটা তার খেয়াল রইল না।

বাদল বলল, এই ফ্ল্যাটটা কার জানিস? বাবুভাইয়ের।

অভিজিৎ বলল, বাবুভাই? সে তো মুম্বাই-এর লোক?

তা মুম্বাই-এর লোকের কি কলকাতায় ফ্ল্যাট থাকতে নেই? যারা বড়ো ব্যবসা করে তাদের সারাদেশেও সব বড়ো বড়ো শহরেই একটা করে ফ্ল্যাট থাকে। হোটেলের বদলে ফ্ল্যাটেই সুবিধে।

অভিজিতের মনে পড়ল, মিস্টার রক্ষিত আজই বলেছেন, বাবুভাই একজন ভারতবিখ্যাত চোর। তার টাকাতেই বিয়ার ফ্যাক্টরি হবে। তার টাকারই একটা অংশ অভিজিৎকে বাগাবার ব্যবস্থা করতে হবে, তাহলে চারটি ছেলের চাকরি বাঁচানো যাবে। কিন্তু এখানেও বাবুভাই? এই ফ্ল্যাটে? তাহলে এখানে কেতকী কী করে? কেতকী কি আসলে বাবুভাইয়ের রক্ষিতা?

অভিজিৎ বলল, বাবুভাই এখানে কখন আসেন? ওনার সঙ্গে একটু আলাপ করা যায় না।

 বাদল অবাক হয়ে বলল, বাবুভাই তো এখানে আসে না কখনো। কলকাতাতেই আসে দু তিন বছরে একবার!

তাহলে এই ফ্ল্যাট রেখেছে কেন?

রেখেছে কাজের জন্য!

অভিজিৎ ভাবল এর মানে কী? কে এই রহস্যময় বাবুভাই! বাদল নিখিল কেতকী রতনলাল চাড্ডা যেন তাকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে। অভিজিৎকেও সেই বৃত্তে যোগ দিতে হবে। হঠাৎ অভিজিতের গা ছমছম করে। সে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে।

বাদল বলল, আমার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাইরে থেকে এলে আমি তো এখানেই থাকার ব্যবস্থা করে দিই। আমার চাবিটা দিয়ে দিই। তারা কেউ কেউ–কথাটা শেষ না করে বাদল কেতকীর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল।

অভিজিৎ বলল, কেতকী বুঝি তোর কোনো ব্যাপারেই আপত্তি করে না?

না! ও তো খুব ভালো মেয়ে। তা ছাড়া কী জানিস, হিংসে বলে কোনো কিছু ওর মধ্যে নেই, আমারও নেই। ঈর্ষা-ফির্সার ব্যাপারগুলো আমরা মন থেকে একেবারে মুছে ফেলেছি!

এটা খুব একটা নতুন কথা শুনছি।

বড়ো কোনো কাজ করতে গেলে মেয়েমানুষ নিয়ে হিংসে করলে চলে না!

এখানে কোন বড়ো কাজটা হচ্ছে শুনি?

টের পাবি, আস্তে আস্তে টের পাবি।

আমি তোমার ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না!

নে, গেলাস শেষ কর।

বাদল, তুই কবে থেকে এত মদ খেতে শিখলি রে? আগে তো এত খেতে দেখিনি কখনো!

বাদল বলল, তুই-ই তো আমাদের শিখিয়েছিস অভি! তুই ছিলি এ লাইনে আমাদের গুরু!

অভিজিৎ কিছু না বলে হাসল।

বাদল বলল, বোস, আমি আসছি বাথরুম থেকে।

 কেতকী সেই যে বেড়াতে যাবে বলে শাড়ি বদলে এসে দাঁড়িয়েছিল এখনও সেইরকমই দাঁড়িয়ে আছে, বসেনি।

বাদল বাথরুমে যাওয়ার পর অভিজিৎ তাকে বলল, দাঁড়িয়ে কেন, বোস।

কেতকী তার পাশের চেয়ারে এসে বসল।

অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল, বাবুভাইয়ের ফ্ল্যাট, অথচ সে কখনো আসে না। তুমি..তুমি তাহলে এখানে থাকো কেন? তুমি বাবুভাইয়ের কে?

.

আমি আবার কে? এটা বাবুভাইয়ের অফিস, আমি সেই অফিসে কাজ করি।

এটা অফিস?

হ্যাঁ! মাঝে মাঝে মাল আসে, সেটা আমার কাছে রাখি, আবার লোক এলে তার হাতে দিয়ে দিই।

অফিসের কোনো সাইনবোর্ড নেই কেন? যারা মাল কিনতে আসবে, তারা চিনবে কী করে?

এখানে যারা মাল নিতে আসে, তারা সবাই চেনা লোক।

কী মাল?

তুমি বাপু অত কথা জানতে চেয়ো না। তুমি নতুন লোক তোমার এসব কথার দরকার কী? ফুর্তি করতে এসেছ ফুর্তি করো–

অভিজিৎ রক্তাক্ত চোখে তাকাল কেতকীর দিকে। তার নেশা চড়ে গেছে, মুখে তেলতেলে ভাব ফুটে উঠেছে। এখন নিজেকে মহাশক্তিমান মনে হয়!

সে আদর করার জন্যে হাত বাড়িয়ে কেতকীর গায়ে তার সব কটা নখ চেপে ধরল। কেতকী বলল, উঃ লাগছে। তারপর অভিজিৎকে প্রলুব্ধ করার জন্য কেতকী বুকের আঁচল ইচ্ছে করে ফেলে দিল।

অভিজিৎ বলল, তোমাকে আমি খুন করব।

তা খুন করতে হয় তো করো না। তখন থেকে বার বার এককথা বলছ কেন?

সত্যি তোমার ঘাড়টা মুচড়ে দেব?

কেন রে বাপু? আমি কী দোষ করেছি?

অভিজিৎ একথার ঠিক উত্তর দিতে পারল না। হাতের গেলাসটা কেতকীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, খাও!

খাচ্ছি তো! এই তো আমার গেলাস আছে।

না। এর থেকে খাও, খেতেই হবে!

অভিজিৎ এত জোরে চিৎকার করল যে, ঘরের ভেতরটা গমগম করে উঠল। সে যেন পাগল হয়ে গেছে। নিজের গেলাসটা জোর করে কেতকীর মুখের ওপর চেপে ধরে আবার হুংকার দিয়ে বলল, খাও! ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে কেতকী শান্তভাবে বলল, এই তো খেলাম।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বাদল বলল, কী হয়েছে?

কেতকী বলল, কিছু হয়নি তো।

তাহলে অভিজিৎ এত রাগারাগি করছিল কেন?

অভিজিৎ হাসবার চেষ্টা করে বলল, কই রাগিনি তো? কেতকীকে একটু আদর করছিলুম –তুই যে বললি তোর কোনো হিংসে নেই?

তারপর বাদলকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে সে লাফিয়ে উঠে বলল, আমিও একটু বাথরুমে যাব।

কয়েক পা গিয়ে সে আবার ফিরে এসে নিজের গেলাসটা শেষ করে দিল এক চুমুকে। তারপর বাথরুমের দরজা বন্ধ করে সশব্দে জলের কলটা খুলে দিল। তারপর বাথরুমের দরজাটা অল্প একটু ফাঁক করে চোরের মতো লুকিয়ে দেখতে লাগল, বাদল আর কেতকী এখন কী করে!

ওরা জড়াজড়ি করবে কিনা সে-সম্পর্কে অভিজিতের আগ্রহ নেই, সে জানতে চায়, বাদলের কাছে কেতকী তার নামে কিছু লাগায় কিনা–কেতকীর ঘাড়ে সে নখ বসিয়ে দিয়েছে।

ওরা জড়াজড়িও করল না, কোনো ব্যাপারে উত্তেজিত হতেও দেখা গেল না।

দু-জনে মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসে আস্তে আস্তে কী যেন, বলাবলি করতে লাগল। অভিজিতের নামে নিশ্চয়ই নয়, তাহলে নিশ্চয়ই এদিকে একবার তাকাত। ওদের এমন সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গি যে, ঠিক যেন মনে হয় স্বামী-স্ত্রী। অভিজিৎ বেশ খানিকটা নিরাশা বোধ করল।

আবার সে যখন বেরিয়ে এল, তখনও তাকে দেখে কেতকী বা বাদল হঠাৎ কথা থামিয়ে দিল না। ওরা কোন এক ইলেকট্রিক মিস্তিরি সম্পর্কে কথা বলছিল।

কী করে যে সময় কেটে যায়, বোঝা যায় না। অভিজিৎ ঘড়িতে দেখল সাড়ে সাতটা বাজে। এখনও বাড়ি চলে যাওয়া যায়। তাহলে দশটার মধ্যে ঠিক ঘুরে আসতে পারবে। বোতলটায় আর বেশি নেই, শেষ করতে আর মিনিট পনেরো-কুড়ি লাগবে। ওটুকু ফেলে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। অভিজিৎ আবার গেলাসটা বাড়িয়ে দিল।

বোতল শেষ হওয়ার আগেই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল।

বাদল বলল, কে এসেছে আবার?

কেতকী বলল, আমি দেখছি।

ঝুটঝামেলার পার্টি এলে এখন হঠাও! এখন যেন এখানে কেউ না আসে।

চাকরটা ছুটি নিয়েছিল বোধ হয় সে-ই ফিরে এসেছে। না, চাকর নয়, অন্য কেউ নয়, নিখিল। এয়ারপোর্ট থেকে মালপত্র নিয়ে সোজা এখানে চলে এসেছে।

বাদল বলল, তুই এরমধ্যেই ফিরলি!

নিখিল বলল, প্ল্যান স্যাংশন হয়ে গেছে। খুব সহজেই কাজ হয়ে গেল। এবার রতনলালের সঙ্গে বসে

অভিজিৎকে দেখে নিখিল বলল, তুই এসেছিস? বা:! খুব ভালো হয়েছে। সেদিন তোর সঙ্গে ভালো করে কথাই হল না।

অভিজিৎ খানিকটা ঘোলাটে চোখ মেলে তাকিয়ে রইল নিখিলের দিকে। এই তার বন্ধু নিখিল, একসময় কত ঘনিষ্ঠতা ছিল। এখন তার কত ব্যস্ত, দায়িত্বপূর্ণ গম্ভীর ভাব। ভালো করে অভিজিতের দিকে চেয়েই দেখল না!

অভিজিৎ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, এই নিখিল! শালা—

নিখিল চমকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, কী!

অভিজিৎ বলল, তুই এত পোজ মারছিস কেন?

 তাই নাকি? কই? তুই আমার পোজ কী দেখলি?

অভিজিৎ আবার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। হাত নেড়ে বলল, না, না, কিছু না, এমনিই

কেতকী নিখিলের হাত থেকে কোটটা নিয়ে শোয়ার ঘরে ঝুলিয়ে দিতে গেল। ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, তুমি চা-টা কিছু খাবে? দুপুরে কখন খেয়েছ?

নিখিল বলল, ওসব লাগবে না। এয়ারপোর্ট থেকে সবে খেয়ে-টেয়ে এসেছি।

বাদল বলল, মালও তো ফুরিয়ে গেছে। দাঁড়া, একটা বোতল নিয়ে আসি!

 নিখিল তাকে বাধা দিয়ে বলল, যেতে হবে না। আমি শিলং-এর ক্যান্টিন থেকে দু-বোতল ভালো হুইস্কি এনেছি, খুব সস্তায়।

হাতের ঝোলাটা বাদলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে খোল, আমি চট করে একটু চান করে নিই আগে। বোস অভিজিৎ, তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে।

অভিজিতের আর বাড়ি ফেরা হল না। নতুন বোতলটা খোলার পর তার আর বাড়ি ফেরার কথা মনে পড়ল না। এখন অভিজিতের কথা রীতিমতো জড়িয়ে এসেছে। কেতকীর দিকে যতবার চোখ পড়ছে, সে কটমট করে তাকাচ্ছে। বাদলের অসাক্ষাতে সে আরও একবার কেতকীকে বলল, তোমাকে আমি খুন করব।

কেতকীর ওপর কেন যেন, ক্রমশ রাগ বেড়ে যাচ্ছে, সে নিজেই বুঝতে পারছে না।

নিখিল স্নান করে সেজেগুজে এসে যখন বসল, তখন অভিজিৎ সোফার একপাশে কাত হয়ে পড়েছে। নিখিল তাকে একটা খোঁটা মেরে বলল, এই, ওঠ! এরমধ্যেই শুয়ে পড়লি কেন?

অভিজিৎ কষ্ট করে উঠে বসল। নিখিল বলল, শোন, সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। আমাদের প্রোজেক্টটার কাজ শিগগির শুরু হবে!

অভিজিৎ জিজ্ঞেস করল, কীসের প্রোজেক্ট?

বাঃ, তোর মনে নেই? সেদিন যে বললাম? বিয়ার ফ্যাক্টরি..শিলং-এ

বিয়ার ফ্যাক্টরি? বিয়ার ব্রুয়ারি! হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ

 হাসছিস কেন? এতে হাসির কী আছে?

 বিয়ার ফ্যাক্টরি? না, বিয়া-র ব্রুয়ারি।

সে যাইহোক, এটা পাবলিসিটির ব্যাপার

অভিজিৎ নিখিলের কথা কিছুই শুনছে না। জড়ানো গলায় বলতে লাগল, বি-য়ারি ব্রু য়ারি! হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ

এর পাবলিসিটি ক্যাম্পেনের জন্যে তোকে বলেছিলাম

অভিজিৎ মুখের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে বলল, পাবলিসিটি? কি-স্যু লা-গ-বে-না। লোকে এমনি খেয়ে নেবে। কেন পা-ব-লি-সি-টির জন্যে পয়সা খরচ করবি? আমিই তো সব খেয়ে নেব! হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ।

নিখিল সামান্য ধমক দিয়ে বলল, কী হচ্ছে অভিজিৎ, কথাটা শোন মন দিয়ে।

অভিজিৎ প্রবলভাবে হাসতে হাসতে বলল, শুনেছি তো? বিয়ারের আবার পাবলিসিটি! মদের কখনো…মদের কখনো পাবলিসিটি লাগে? সবাই তো এমনি এমনি…সবাই তো খেয়ে নেয়! কে মদ খায় না, বল? গলি গলি মে গোরস ফিরে, মদিরা বৈঠে বিকায়। জানিস না? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।

বাদল বলল, এঃ অভিজিৎটা একদম আউট হয়ে গেছে।

 অভিজিৎ অমনি খাড়া হয়ে বসে বলল, আউট? আমি আউট? কোন শালা বলে আউট?

 বাদল আর নিখিল ওকে আর পাত্তা দিল না। নিজেদের গেলাসে মনঃসংযোগ করল। অভিজিৎও আর থামতে পারল না। হ্যাংলার মতন বার বার গেলাসটা এগিয়ে দিচ্ছে। নিখিল একবার মৃদুভাবে বলল, অভি, তুই আর খাসনি!

বেশ করব খাব! কেন খাব না?

 নিখিল আবার তাকে অগ্রাহ্য করে বাদলের দিকে তাকিয়ে বলল, কাল সকালে বাবুভাইকে একটা টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে। তোর চেনা কোনো উকিল আছে?

কেতকী হঠাৎ বলে উঠল, উঃ, দেখো তো, আমায় তখন থেকে কীরকম জ্বালাচ্ছে? আমার বুঝি ব্যথা লাগে না? ছাড়ো!

অভিজিৎ কেতকীর একটা হাত পেছন দিয়ে মুচড়ে ধরে আছে। চাপা গলায় বলল, খুন করব তোমাকে! একদম শেষ করে দেব।

নিখিল বিরক্তভাবে বলল, এই অভি, কী-কী করছিস? ছেড়ে দে ওকে। ও তোর কী ক্ষতি করেছে?

বাদল বলল, আজ অভিজিৎটার মেজাজ ভালো নেই। দুপুর থেকে দেখছি।

 খুব ভালো মেজাজ! কে বলল, মেজাজ ভালো নেই?

তাহলে ওকে ছেড়ে দে।

না ছাড়ব না।

 বাদল একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে অভিজিৎকে সরিয়ে দিল কেতকীর কাছ থেকে।

অভিজিৎ বলল, কী রে। তখন যে বললি তোর ঈর্ষা নেই? তাহলে এখন চটে যাচ্ছিস কেন?

নিখিল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সাড়ে নটা বাজল, চল, রতনলালের কাছে যেতে হবে। অনেক কথা আছে।

অভিজিৎ ওঠার চেষ্টা করে বলল, আমিও যাব।

বাদল বলল, থাক, তোকে আজ আর যেতে হবে না।

 অভিজিতের মুখখানা হঠাৎ খুব ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অভিমানের সঙ্গে বলল, আমি যাব না? সারাসন্ধ্যে এইজন্যে বসে রইলাম?

নিখিল বলল, তোকে এই অবস্থায় আমরা নিয়ে যেতে পারি না। বাদল বলল, এখন ও গেলে কী উলটোপালটা বলে ফেলবে সব কেঁচিয়ে যাবে।

অভিজিৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। নিখিলের হাত জড়িয়ে বলল, নিখিল, তুই আমাকে নিয়ে যাবি না? আমি তোর কত দিনের পুরেনো বন্ধু, তুই আমাকে নিয়ে যাবি না? পাবলিসিটির কাজটা আমার ভীষণ দরকার! ওই কাজটার জন্য চার জনের… চার জনের..বুঝলি চার জনের…অভিজিৎ কাঁপতে লাগল।

নিখিল বলল, সেই পাবলিসিটির কথাটাই তো তোকে বলতে চাইছিলাম। তুই তো শুনলিই না।

হাতের উলটোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে অভিজিৎ বলল, চল, রতনলালের কাছে গিয়ে কথাটা পাকা করে আসি।

আজ আর হবে না।

হবে না! কেন হবে না? বাদল সেইজন্যে আমাকে এতক্ষণ বসিয়ে রাখল। ও নিয়ে যাবে বলেছিল।

বাদল বিরক্তভাবে বলল, নিয়ে যাব তো বলেছিলাম। কিন্তু তুই শালা এরকম মাতাল হয়ে গেলি কেন? রতনলাল একদম মাতলামি পছন্দ করে না।

কে মাতলামি করছে? আমি? একবার বাইরে গেলেই ফিট হয়ে যাব। অভিজিৎ সেনগুপ্ত কোনোদিন আউট হয় না।

থাক ঠিক আছে, আর একদিন যাস নাহয়।

না, না, আর একদিন নয়…আজ-ই…আমার ভীষণ দরকার–মাইরি বলছি, এই কাজটা –চল, এক্ষুনি চল–

এক পা এগোতে গিয়ে অভিজিৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

নিখিল বলল, আজ আর তুই কিছু পারবি না, তুই এখানেই শুয়ে থাক। কেতকী তোর দেখাশুনো করবে।

হাঁটু গেড়ে উঠে বসতে বসতে চিৎকার করে বলল, না।

বাদল তার হাত ধরে টেনে সোফায় বসিয়ে দিল। টেবিল থেকে একটা গেলাস তুলে নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নে আর একটু খা ঠিক হয়ে যাবে।

তারপর বাদল নিখিলের দিকে চোখের ইশারা করে বলল, দেরি হয়ে যাচ্ছে—

 পা টিপে বেরিয়ে গেল ওরা দুজন।

 ঝন ঝন করে কাঁচ ভাঙার শব্দে অভিজিতের ঘোর ভাঙল। এরমধ্যেই তার একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল, গেলাসটা হাত থেকে পড়ে গেছে।

দরজার কাছ থেকে ফিরে এসে কেতকী বলল, ভাঙলে তো গেলাসটা?

বেশ করেছি!

আচ্ছা, বেশ করেছ, ভালো করেছ। এখন শুয়ে থাকো তো!

অভিজিৎ কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করলে, ওরা কোথায় গেল?

চলে গেছে।

আমাকে নিয়ে গেল না শালারা! ঠিক আছে, আমি নিজেই যাব।

তুমি আজ আর কোথাও যেতে পারবে না! এখানেই থেকে যাও। চাকরটা এল না, কাকে দিয়ে যে, খাবার আনাই। খিচুড়ি রাঁধতে পারি, তুমি খাবে?

চোপ।

পাঊরুটি আর জ্যাম দিয়ে স্যাণ্ডউইচ বানিয়ে দেব?

অভিজিৎ মুখে একটা ঘৃণার ভঙ্গি করে বলল, এ, স্যাণ্ডউইচ, খিচুড়ি? দুর দুর দুর! ওসব ভদ্দরলোক খায়! আমি খাব কাঁকড়ার ঝোল আর গরম ভাত…

সে আমি কোথায় পাব?

তোমায় কে পেতে বলেছে? আমার…আমার বাড়িতে।

 আজ তুমি এই অবস্থায় বাড়ি যেতে পারবে?

 চোপ বলছি না! খুন করে ফেলব একদম। আমি তোমাকে খুন করে ফেলতে পারি জেনেও ওরা তোমার কাছে আমায় একা রেখে গেল যে? যদি সত্যিই খুন করি?

কেতকী কাছে এগিয়ে এসে বলল, তখন থেকে অত খুন খুন করছ কেন? আমি তোমার কী করেছি?

সে-কথার কোনো জবাব না দিয়ে অভিজিৎ টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি বাড়ি যাব। তারপর একপাটি জুতো খুলে গিয়েছিল, সেটা আবার পরে নিল। পকেট চাপড়ে দেখল মানিব্যাগটা ঠিক আছে কিনা। তারপর অন্ধের মতন দরজার দিকে এগোল।

কেতকী তার সামনে দাঁড়িয়ে বাধা দিয়ে বলল, লক্ষ্মীটি, যেয়ো না। এই অবস্থায় তুমি কী করে যাবে? একটা অ্যাক্সিডেন্ট করবে শেষকালে? রাত্তিরটা থেকে যাও, সকালে যেয়ো।

চোপ! আমাকে কি খারাপ লোক পেয়েছ যে, তোমার মতন একটা মেয়েছেলের ঘরে রাত কাটাব?

কেতকী তবু ওকে জড়িয়ে ধরে অনুনয় করে বলল, আমি তোমায় একটুও জ্বালাতন করব না। তুমি ঘুমিয়ে থাকবে–বিছানা পেতে দিচ্ছি–

অভিজিৎ তাকে ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল, খবরদার, ছোঁবে না আমাকে খুন করে ফেলব তা হলে।

কেতকী ওকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গিয়ে আস্তে আস্তে বলল, সে ক্ষমতাও তোমার নেই।

দরজা খুলে বেরিয়ে গেল অভিজিৎ। কোনোরকমে দেওয়াল ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামল। রাস্তা এখন ফাঁকা, ট্যাক্সি পেতে অসুবিধে হল না।

সেই ট্যাক্সি নিয়ে অভিজিৎ খুঁজতে গেল রতনলালের বাড়ি। রাস্তার নাম, বাড়ির নম্বর কিছুই এখন তার মনে নেই। ড্রাইভারকে বলল ডাইনে।

তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। একটু বাদে ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, আভি কীধার?

অভিজিৎ বলল, বাঁয়া! বাঁয়া চলিয়ে।

আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

ড্রাইভার আবার জিজ্ঞেস করতেই অভিজিৎ একবার বলতে লাগল ডাইনা একবার বাঁয়া। গাড়ি চরকির মতো ঘুরতে লাগল।

প্রায় ঘণ্টা খানেক এরকমভাবে ঘোরার পর এক সময় অভিজিতের মনে পড়ল বাড়ি যাওয়ার কথা। বাড়ির রাস্তা চিনতে ভুল হল না।

বাড়ির সামনে এসে ঠিক গুনে গুনে ট্যাক্সি ভাড়া দিল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে এমন ভাবে উঠতে লাগল যেন, তার আর একটুও নেশা নেই। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিল চাকর। অভিজিৎ তাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, বউদি কোথায়?

চাকর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল খাবার ঘরে। অভিজিৎ সেখানে উঁকি মেরে দেখল। খাবার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে সুমিত্রা।

অভিজিৎ তার পাশে গিয়ে মাথায় হাত রাখল।

চমকে মাথা তুলল সুমিত্রা। একদৃষ্টে স্বামীর দিকে চেয়ে রইল।

অভিজিৎ তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মুখে একটা ভয়ের ভাব ফুটিয়ে বলল, আজ অফিসে সাংঘাতিক ব্যাপার হয়ে গেল। তোমাকে পরে বলব!

সুমিত্রা ঠাণ্ডাভাবে বলল, ঠিক আছে, শোবে চলো।

 কেন, খাব না?

না, আজ আর খেতে হবে না।

সে কী? কাঁকড়া? কাঁকড়া খাব বলে ছুটতে ছুটতে এলাম।

এখন খেতে পারবে?

আলবাত পারব! তোমার রান্না কাঁকড়া খাব, বলে আজ বিকেল থেকে কিছু খাইনি। সত্যি বিশ্বাস করো

সুমিত্রা খাবার সাজিয়ে দিল। অভিজিৎ হাত-টাত না ধুয়েই, ঝোল দিয়ে ভাত মাখতে লাগল। মাখছে তো মাখছেই। চোখে আবার ঘোর এসে যাচ্ছে। এক গরাস ভাত হাত ধরে আছে, মুখে আর তুলতে পারছে না।

সুমিত্রা সেদিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখে রাগ বা কষ্টর কোনো ছায়া নেই। যেন বরফের তৈরি মুখ। চোখেও পলক পর্যন্ত ফেলছে না। একসময় সে আবার শান্তভাবে বলল, বললাম তো, আজ আর খেতে পারবে না? উঠে পড়ো, হাত ধুয়ে নাও!

কেন খাব না। নিশ্চয়ই খাব।

টপাটপ দু-গেরাস ভাত পুরে দিল মুখে। তারপর অভিজিৎ বাটি থেকে সবেমাত্র একটা কাঁকড়ার দাঁড়া হাতে তুলে নিয়েছে, সেই সময় বমি করল। পিচকিরির মতন তার মুখ দিয়ে বমি ছুটে গিয়ে পড়ল সুমিত্রার গায়ে, সুমিত্রার ভাতের থালায়। অভিজিৎ হাত দিয়ে বমি আটকাতে পারল না, মুখ থুবড়ে পড়ল থালার ওপর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *