ঝুমু ও সন্ন্যাসিনী ও অলীক উড়ান
কাশী থেকে আগত গুরুমায়ের কাছে ঝুমু এই প্রথম নয়। গুরুভক্তি তাকে অধিকার করেনি। এখানে সমাগত জনগণের মধ্যে যে ঐকান্তিক সমর্পণ, চোখেমুখে তদ্গতচিত্ততার যে ছবি আঁকা, ঝুমু তা দেখেছে ভারী দূর থেকে সিনেমার মতো। ‘মাতাজির আশীর্বাদে সব হয়।’ বড়পিসি তাকে বলেছেন, ‘এমন সাধিকা একালের দিনে আর হয় না।’
ঝুমু এই সব কথা, সব দেখা, টোপরকে বলেছে।
‘বুঝলি রে টোপর, বড়পিসি বলে, যখন প্রণাম করবি, মায়ের কাছে বলবি, মা আমাকে আদর্শবান স্বামী দাও। সুখের সংসার দাও। আমি না কিছুই বলতে পারি না।’
‘প্রণাম করো?’
‘তা করব না কেন?’
‘তখন কী বলো মনে মনে?’
‘কী জানি! আমার মন তখন কোথায় থাকে! হয়তো ভাবছি তোরই কথা, তবু প্রণাম করলাম। চাওয়া-টাওয়া আসে না।’
‘কেন বলো তো? তুমি কি বিবেকানন্দবাদী? জ্ঞান দাও মা, শুদ্ধা ভক্তি দাও?’
‘না রে টোপর, চাইলে ভগবানের কাছে চাইব। উনি সন্ন্যাসিনী হতে পারেন, ভগবান নন।’
‘সব মানুষের মধ্যেই ভগবান আছেন— জানো না? খুনি, ধর্ষক, প্রতারক, মিথ্যাচারী— সব্বাই ঐশিক বিভবে ঐশ্বর্যবান। তবু তুমি বলছ গুরুমায়ের মধ্যে ভগবান পাও না?’
‘তাঁর মধ্যে ভগবান, আর তিনিই ভগবান— এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য নেই? টোপর? সে বিচারে ভগবান আমার মধ্যেও আছেন। মাতাজি কি আমার কাছে তাঁর প্রার্থনা জানাবেন?’
‘মাঝে মাঝে তোমার মধ্যে থেকে একটা তীব্র আলো বিচ্ছুরিত হয় ঝুমুদি। তখন তুমি মহামানবী হয়ে ওঠো।’
‘মহামানবী-টানবী নয়। আমি কেন হঠাৎ বর দাও, ঘর দাও বলে গড় করতে যাব! ওসব এমনিই হবে। আর হওয়ারই বা কী আছে। ঘর তো আমার আছেই। বর হলেও চলে, না হলেও! তাতে মাতাজির কী ভূমিকা? মাতাজি অমন দাতাজির ভূমিকা নিলেনই বা কেন? তিনি নিজেও জানেন, জগতে কোথায় কখন কী ঘটবে, তার ওপর হাতে আছে মাত্র দু’জনের।’
‘দু’জনের? একজন তো ভগবান। আরেকজন?’
‘কেন? সন্ত্রাসবাদী! মৌলবাদীও বলা যায়।’
‘ইনশাল্লা ঝুমু। সাধু সাধু!’
‘ঠিক বলিনি? কে জন্মাবে, কে নয়, কে মরবে, কে শিক্ষিত হবে, কে মুখ দেখাবে না, কে ট্রেনে চেপে ঘরে ফিরতে ফিরতে, আপিসে কাজ করতে করতে, কিংবা নিজের ঘরে, নিজের পরিবারের সঙ্গে ঘুমোতে ঘুমোতে খুন হবে— সব তো ওরাই ঠিক করে। প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর মারেন বন্যার জলে চুবিয়ে, পাহাড়ে ধস এনে, ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি ধ্বংস করে— ওরা মারে বোমাবন্দুকে। মারণ ক্ষমতায় মানুষ ঈশ্বরের চেয়েও শক্তিশালী। এবং নিষ্ঠুর।’
‘মৌলবাদী এবং সন্ত্রাসবাদী এক নয়। মৌলবাদ হল কোনও তত্ত্ব সম্পর্কে বা দর্শন সম্পর্কে গোঁড়ামি। আর সন্ত্রাসবাদ হল ক্ষমতায়ণ। ভয় দেখিয়ে ক্ষমতা দখল করা। মৌলবাদী গোষ্ঠী সন্ত্রাস সৃষ্টি করে একই উদ্দেশ্যে। সেই ক্ষমতা কুক্ষীগত করা।’
‘কোনও দর্শনের মূলতত্ত্বে বিশ্বাস রাখার মধ্যে যদি গোঁড়ামি ঢুকে পড়ে, তাকে যদি নিন্দনীয় বলা হয়, এই গুরুর দল নিন্দনীয় নয় কেন? এখানে তত্ত্ব প্রধান নয়। গুরু আত্মিক শক্তি দ্বারা সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ করতে পারেন, এই বিশ্বাসটিও গোঁড়া এবং অন্ধ। এর মধ্যে একটি প্রলোভন আছে। সুখ, সম্পদ কেবল বাড়িয়ে তোলার লোভ। কেউ কি বলে, পাড়ার ওই অন্ধ ভিখিরির দৃষ্টি এনে দাও! ভিক্ষাচক্রের অবসান করো। রাজনীতি ও পুলিশের মধ্যে সততা দাও মা! বলে না। কেবল আত্মতোষ! গুরুর কাজ হবে অনুগতজনের দৃষ্টি উন্মোচন। তার পরিবর্তে তিনি অলীক বিশ্বাসের ছলনায় ক্ষমতা সৃষ্টি করছেন। গুরুর পায়ে পড়ছে গিয়ে সব। ফিসফিস করে কথা বলছে যাতে গুরুর ধ্যানে ব্যাঘাত না ঘটে। ব্যাঘাত হলে কী হবে? গুরু রুষ্ট হবেন। গুরু রুষ্ট হলে কী হবে? অকল্যাণ। আবার এক ভয় এসে গেল। লোকে শোকে তাপে হতাশায় জর্জরিত হয়ে গুরুমুখী হয়, কিংবা ভক্তিমার্গের টানে, পরলোকে পুণ্যের জমা বাড়াবার টানে, সেখানেও ভয় দেখাতে হবে? গুরু যদি শান্তি না দিয়ে ত্রাসেরই সঞ্চার করলেন, তবে তাঁর কাছে গিয়ে লাভ কী হল!’
‘তোমার গণধোলাই খাবার সময় হয়েছে ঝুমুদি।’
‘যা মনে হয়, বলি। সবার ভাল না-ও লাগতে পারে।’
‘প্রণাম তো করো।’
‘বড়পিসি বলে, তাই। গুরুজনের কথা অমান্য করব?’
‘গুরু অস্বীকার করো, আর গুরুজনের আদেশ বিনা প্রশ্নে মেনে নাও?’
‘তুই ভেবে দ্যাখ টোপর, মাতাজি মৌনী। শুধু হাসি দিয়ে যোগাযোগ করেন।’
‘কথার দায় এড়াতে চান।’
‘তুই প্রার্থনা করলি, মাতাজি মাথা নাড়লেন, তুই তো আশা অনুযায়ী তার ব্যাখ্যা করবিই। উনি নাকি মনে মনে বার্তা পাঠিয়ে দেন। সমাধিস্থ হয়ে সারা রাত ঘরের মধ্যে শূন্যে ভেসে বেড়ান। সেইসময় একজন মাত্র ওঁর কাছে থাকতে পায়। ওঁর প্রধান শিষ্যা অমৃতহৃদয়া। ওই ভেসে বেড়ানোর সময় মাতাজিকে স্পর্শ করলে বৈদ্যুতিক স্পর্শাঘাত লাগে।’
‘উরিব্বাস! আমাকে নিয়ে চলো ঝুমুদি। আমি ভেসে বেড়ানো শিখব। কী মজা বলো তো। গড়গড়ি বিদায়! যেখানে খুশি উড়ে যাব।’
‘সেখানেই আমার প্রশ্ন। উনি ভেসে বেড়ালে সমাজের কী লাভ!’
ঝুমু ও সন্দীপন ও অকারণ
আবার বড়পিসির সঙ্গে সেই মাতাজির স্থানে এল ঝুমু। মাতাজিই বিবাহে অনিচ্ছুক সন্দীপনকে বলে-কয়ে রাজি করিয়েছেন। ঝুমুরও বিয়ের গেঁরো খুলেছে। কী করে বলে-কয়ে ব্যাপারখানা ঘটল! মৌনী গুরুমাতা কি বলা-কওয়ার সংকেতও পাঠান মনে মনে? না। কথোপকথন প্রলম্বিত হলে তাঁর সহায়িকা অমৃতহৃদয়া। তিনি মাতাজির চোখের পলক থেকেও ভাষা বুঝে নেন।
মাতাজি গেরুয়া আসনে, রেশমের গেরুয়া বসন পরে বসে আছেন। যার দিকেই চাইছেন, হাসছেন মধুর। তিনি বৃদ্ধা, কিন্তু রূপবতী। অদূরে অমৃতহৃদয়া। তাঁর পাশে শান্তহৃদয়া। অমৃতহৃদয়া কীর্তন গাইছেন। শান্তহৃদয়ার হাতে কর্ত্তাল। যে মেয়েটি চোখ বন্ধ করে শ্রীখোল বাজিয়ে চলেছে, তাকে আগে দেখেনি ঝুমু। সে গেরুয়া পরেনি। সাদা সালোয়ার কুর্তায় লক্ষ্মৌ চিকনের কাজ। লম্বা বিনুনী। কানে মুক্তোর দুল। মুখখানা পানপাতার মতো নয়, বরং ডিম্বাকৃতি, রোগা, ফর্সা মেয়েটিকে দেখে ঝুমুর মনে হল ভারী দুঃখী এ। হয়তো আদৌ তা নয়। কোনও কোনও মুখে বিষাদের চিরস্থায়ী রং লেগে থাকে। এই মেয়ের মধ্যে রিক্ততা।
মেয়েটির খুব কাছে একজন বসে গানে বিভোর তাল দিচ্ছে। ঝুমু-র তাকে চেনা লাগল। জয়ী তাকে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে বসলেন। কানে কানে বললেন, ‘ওই যে বসে আছে, ও সন্দীপন। কী ভক্তি ছিলেটার!’
এই ছেলেটির সঙ্গে ঝুমুর বিয়ে হবে? তারপর? যা যা হয়! উত্তেজনাকর! মালাবদল! হাতে-হাত রেখে যজ্ঞানুষ্ঠান! এটা ওটা! অবশেষে সেই! ফুলশয্যা! ভাবতেই ঝুমুর শরীর অস্থির হয়ে উঠল অজানা আতঙ্কে! সে তো দিব্যি ছিল। কেন এই বিয়ের আয়োজন? সে তার ভবিষ্যৎ জীবনের চিরসঙ্গী বিষয়ে এতটুকু আকর্ষণ বোধ করল না! যেন, যাই ঘটুক, এই অচেনার দূরত্বই আসলে স্থায়ী হবে। এই ভক্তিমান, বিরলকেশ, কুকুরপ্রেমী যুবক, কয়েকটি মন্তর পড়ে কী করে তার সর্বস্ব হতে পারে? এমনকী যার এই কৌতূহলও নেই যে তার ভাবী স্ত্রী কেমন! যে কেউ, যেমন-তেমন, কেবল এক স্ত্রীলিঙ্গময়ী হলেই তার চলে যাবে! হয়তো চলে যায়! ভিড়ের মধ্যে বসে, ভক্তি সঙ্গীতের সুর ও ছন্দের মনমাতানো আবেশে, ফুল-ধূপ-চন্দনের সুবাস ও শুদ্ধাচারের নানাবিধ নিয়মনিষ্ঠায় তার উপলব্ধি হতে লাগল, বিয়ের প্রাথমিক উদ্দেশ্য যৌনতার চাহিদা মেটানো, দ্বিতীয় উদ্দেশ্য বংশরক্ষা। সম্পর্ক সবচেয়ে গৌণ ও অর্থহীন। গড়ে উঠলে ভাল, না হলেও সমস্যা নেই। সে টোপরের অনেক কথা উপলব্ধি করতে লাগল নিঃশব্দে আর তার চোখ ভিজে উঠল! টোপরের জীবন আর সবার মতো নয়, টোপরের শরীর স্বাভাবিক নয়, টোপরের মেধা ও উপলব্ধি বৃহত্তর, গাঢ়তর, শক্তিমান! এই মুহূর্তে টোপরের কাছে যাবার তীব্র ইচ্ছা হল তার। সে সন্দীপনের থেকে চোখ ফিরিয়ে সুগ্রন্থিত মালাগুলি দেখতে লাগল। এর মধ্যেকার ফুলসজ্জা কী অপরূপ এক শিল্প! ভক্তির সঞ্চার হোক বা না হোক, এখানকার পরিবেশটি মনোরম। এখানে থাকলে মনে পড়ে না, বেরিয়েই মলময়, আবর্জনাময় পথে পা রাখতে হবে। তার মনে হল, বিয়ের আসরও ঠিক এইরকম। আয়োজনের ঔজ্জ্বল্য পরিণামের কারুণ্য ভুলিয়ে রাখে।
ঝুমু ও টোপর ও হৃদয় তোর
বাড়ি ফিরতে ঝুমু-র কাছে খবর এল, টোপরের জ্বর এসেছে। সে ব্যাকুল হয়ে উঠল। বিয়ে স্থির হয়ে যাবার পর সে আগেকার মতো ওবাড়ি যায় না আর। প্রবীর বা টোপর ডাকাডাকি করে না। কবে যেন সুর ছুটে গেছে, তালও টুটেছে। শুধু নিঃশব্দে বেজে চলেছে বিদায়ের নীরব বাঁশিটি।
টোপরের প্রস্তাবের পরও ঝুমু স্বাভাবিক থাকতে চেয়েছিল। সব কিছুই আগের মতো আছে, চাইলেই মনের যাবতীয় চঞ্চলতা, বেদনার আভাস মুছে ফেলা যাবে সে ভেবেছিল। টোপরকে না দেখে তারও কষ্ট। জানালা দিয়ে যে দেখা, ঝুলবারান্দা দিয়ে যে দেখা, তা কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। তবু, সে দৃঢ়চিত্ত হওয়ার সংগ্রামে রত। চলে তো যাবেই। যেতেই হবে। সকলেরই অভ্যাস হোক।
এ প্রয়াস নিত না সে। বিদায়ের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সে পুরনো জীবন পেতে চেয়েছিল। হল না। অবুঝ টোপর। একদিন ফের বলে বসল, ‘ঝুমু, সত্যি স্বীকার করবে?’
‘তোকে মিথ্যে বলেছি কোনও দিন?’
‘তুমি সত্যি আমাকে চাও না?’
‘টোপর, লক্ষ্মীসোনা, পাগলামি করিস না আর। তোকে আমি কত ভালবাসি। সব ভালবাসা কি একরকম হতেই হবে?’
‘আমার পা দুটি অশক্ত, আমি চলতে-ফিরতে অক্ষম বলেই কি আমায় চাও না?’
‘না টোপর! আমি তোকে এক মুহূর্তের জন্যও অক্ষম ভাবি না সোনা!’
‘কারণ তোমার দায়িত্বে বাধ্যবাধকতা নেই।’
‘থাকলে কী হত? টোপর, তোকে কোনও দিন দূর ছাই করেছি আমি? একবারের জন্যও বিরক্ত হয়েছি? এতদিনে আমাকে এই বুঝলি?’
‘মা যাকে ফেলে যায়, তাকে কি জগতের কেউ আর কোলে নিতে চায় গো?’
‘টোপর, জগতে রুপুকাকিমারা যেমন আছেন, মা টেরিজাও আছেন। প্রবীরকাকা কি তোকে আগলে রাখেননি? আমার কথা যদি বলিস, তোর সঙ্গে আমার অনেক আলোচনা হয়েছে, আমরা দু’জনেই মেনেছি, বাধ্যতা নয়, শুধু ভালবাসার টানে যে বাঁধন সম্পর্কের তার চেয়ে বড় সত্য আর কিছু হয় না।’
‘তা হলে কেন ঝুমু? কেন আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যাবে?’
‘কেন আমাকে কষ্ট দিস টোপর? কেন এমন অবুঝপনা করিস? কেন মিথ্যে ভাবনা আঁকড়ে আছিস? আমাদের আনন্দের দিনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে না?’
‘না ঝুমু। আনন্দে থাকব বলেই তো তোমাকে ডাকছি। একসঙ্গে থাকা ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই। আমি যে তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। তুমিও আমাকে ছেড়ে পাগল হয়ে যাবে এই সহজ কথাটা কেন বুঝছ না?’
‘আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে রে টোপর। তোকে কি ভূতে ধরল? সম্পূর্ণ অচেনা লাগছে আমার তোকে। বাবা, প্রবীরকাকা একটুও জানতে পারলে কী হবে জানিস না? সব ভেঙেচুরে যাবে।’
‘আমাদের হৃদয়ভাঙার চেয়েও কি বেশি সেই ভাঙন? বাবা জানে। আমি বাবাকে বলেছি।’
‘টোপর! এসব কী করছিস তুই! ভগবান! ইশশ্ কী ভাবছেন আমাকে প্রবীরকাকা! ভাবছেন আমি তোর মাথাটি খেয়েছি!’
‘বাবা আমাদের সঙ্গে আছে ঝুমুদি!’
‘প্রবীরকাকা তোর এই পাগলামো মেনে নিলেন?’
‘বাবা আমাকে বুঝেছে ঝুমু। শুধু তুমি বুঝছ না।’
‘তোকে আমি বুঝি। শুধু এখন…ইদানীং…’
‘নিজেকে বোঝো তুমি, নিজেকে বোঝার চেষ্টা করো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
টোপর ও ঝুমু ও সেই মুকুর
এ লজ্জা সে কোথায় রাখে? কেমন করে লুকোয় মুখ? রাতে ঘুম নেই। দিনে স্বস্তি নেই। কেমন রাগ হচ্ছে টোপরের ওপর! অসম্ভব খেলায় মেতেছে! যাবতীয় অসংবদ্ধতা আকাশে বাতাসে কেন ছড়িয়ে দিচ্ছে সে? ঝুমু বিরক্ত, ক্রুদ্ধ, উদ্বিগ্ন, দুঃখী! সে এখান থেকে যেতে পারলে বাঁচে। এই নিরাপদ পারিবারিকতা সে হারাতে চায় না। কোনও উথালপাথাল সে পেতে চায় না। সকল নিষেধ মান্য করে সে ভারী নিশ্চিন্ত আছে, সকল চাওয়া পূর্ণ করে সে তৃপ্ত, কিন্তু এ কোন চাওয়ার কাছে টোপর তাকে এনে ফেলল যা তাকে নিষ্ঠুর হতে বাধ্য করছে!
কিন্তু টোপরের জ্বর হলে সে কী করে নিষ্ঠুর হয়? সে ওবাড়ি ছুটে যেতে লাগল। সোনালি সুতোর কারুকাজ করা লাল ঢাকাই শাড়িটি পরে, নতুন মার্জনা করা প্রাক্তনী অলঙ্কার পরে, যেতে লাগল সে। তার চলার দোলায় দুলতে লাগল বিনুনী। তার সুগোল, সুপুষ্ট পশ্চাৎ-শরীরে নিরন্তর পাক খাচ্ছে নির্বিষ কালকেউটে যাতে প্রেমছোবলে নীল না হয়ে যায় ঝুমুর মেয়েটি।
বাড়ির ভেতরে আসতেই প্রবীর বললেন, ‘এলি? টোপর খুঁজেছে।’
‘অনেক জ্বর?’
‘একশো তিন ডিগ্রি উঠেছিল।’
‘কী বললেন ডাক্তার?’
‘তমাল আসবে রাতে একবার। আপাতত জ্বর নামার জন্য ওষুধ দিলাম।’
‘ডা. তমাল দত্তভৌমিক? অশ্বিনী দত্ত রোডে তোমার বন্ধু?’
‘কেন রে? হ্যাঁ, ওকেই ডাকলাম।’
‘না না। এমনি জানতে চাইছি।’
‘টোপরের তো অসুখ-বিসুখ তেমন করে না। চিন্তা হচ্ছে।’
‘ও কি ঘুমোচ্ছে?’
‘তুই কি এখন একটু থাকবি ঝুমু? সকাল থেকে বেরোইনি। ঝিরি এসেছে দু’বার। নমি-পলাশ ওরাও ছিল। কিন্তু তোকে দেখতে না পেলে টোপর মন খারাপ করে।’
‘তুমি কোথায় যাবে? যাও না! আমার এখন আর কাজ নেই।’
‘ঝুমু মা, এই শাড়িতে তোকে খুব মানিয়েছে। এমন শাড়ি রুপুর খুব পছন্দ ছিল।’
‘জানি প্রবীরকাকা।’
ঝুমু টোপরের কাছে গেল। মাথা অবধি চাদরে ঢেকে টোপর শুয়ে আছে মৃতদেহের মতো। ঝুমুর গলার কাছে কান্না পাকিয়ে উঠল। ক’দিন এমনই হচ্ছে। সে এখান থেকে চলে যেতে চায়। আবার চলে যেতে হবে মনে হলে খুব কান্না পায়। এ এক আশ্চর্য উপলব্ধি। এমন চাওয়া এ জীবনের কাছে যা বেদনাবিধুর। কেন মেয়েরাই সব ছেড়ে যায়?
ঝুমু আলতো করে টোপরের মুখের থেকে চাদরের ঢাকনা টেনে দিল। টোপর চোখ না খুলেই বলল, ‘বসো।’
‘তোকে কতদিন বলেছি, মুখ ঢেকে শুবি না।’
‘একটা ছবি তুলবে? নিজের মৃতদেহ কেমন হবে দেখে নেব।’
‘মারব এক চড়।’
‘আহা, মরব তো একদিন সবাই।’
‘আর মুখ ঢেকে শুবি না। জ্বর বাধালি কী করে?’
‘দুঃখে জর্জরিত হলে জ্বর তো আসবেই।’
ঝুমু টোপরের কপালে গলায় হাত দিল। টোপর চোখ খুলল। তার গায়ে জ্বরস্বেদ।
‘কতদিন পর তোমার স্পর্শ।’
‘তুই-ই তো আমায় ছুঁস না।’
‘ছোঁয়ার সে অধিকার দেবে কি আমায়।’
‘কথা বলিস না। চুপ করে থাক। কত জ্বর উঠেছিল! ঝিরি, নমি সব্বাই জানে, শুধু আমি জানি না।’
‘তোমাকে বলা হয়নি। আজ তোমার শুভানুষ্ঠানের সূচনা। তার মধ্যে জড়তা ঢুকিয়ে লাভ কী! লাল শাড়িতে তোমাকে কত মানিয়েছে ঝুমুদি!’
‘সব্বাই শাড়িটার প্রশংসা করল।’
‘শাড়িটা যে পরেছে, প্রশংসা তারই প্রাপ্য।’
‘ধুস! আমার আবার প্রশংসা!’
‘শাড়িটা তুমি সঙ্গে নেবে তো?’
‘নেব।’
‘শাড়ির প্রতিটি বুননে আমি থাকব তোমার সঙ্গে ঝুমুদি!’
‘যাক, ভাল লাগল।’
‘কী?’
‘তুই আমায় দিদি ডাকলি।’
‘দিদিমাও ডাকতে পারি। কী এসে যায়? এতকাল দিদি ডেকেছি, জিহ্বাস্খলন হতে পারে না? এইসব দিদি-দাদা ডাকাই অর্থহীন। গুরুদর্শন হল?’
‘আরও অনেক দর্শন হল।’
‘সন্দীপন?’
‘বুঝলি কী করে?’
‘অনুমান। গুরুমা এলেন। ভক্তিমানের উপস্থিতি অসম্ভব নয়। তোমার সঙ্গে কথা বললেন?’
‘হাতজোড় করে দায়সারা নমস্কার। একটি মেয়ে শ্রীখোল বাজাচ্ছিল। তার নাম মালিনী।’
‘তো?’
‘মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় হল না, আমার একটু আগ্রহ হচ্ছিল, মেয়ে শ্রীখোল বাজায়, আলাপ করতাম। আমি সামনে যেতেই সে মুখ ফিরিয়ে কোথায় চলে গেল!’
‘কাল যার সঙ্গে তোমার জীবন বাঁধা পড়বে, সে একটি কথাও কইল না! আর তুমি ভাবছ মালিনীর কথা?’
‘কী আর বলবে! এরপর তো বলতেই হবে।’
‘খুব আনন্দে আছ ঝুমু?’
‘না। কীসের আনন্দ?’
‘বিয়ে চেয়েছিলে, হতে যাচ্ছে।’
‘আমার মতো সাধারণ মেয়ের আর কীই বা চাওয়ার আছে? বিয়ে, সংসারধর্ম, সন্তান প্রতিপালন, হঠাৎ একদিন দেখব বুড়ো হয়ে গেছি। বড়পিসির মতো।’
‘ভাবতেই পারছি না পাশের বাড়িটায় তুমি নেই। এখন কত কম আসো তুমি। শাস্তি দিচ্ছ, বুঝতে পারছি। তুমি আমায় যা দেবে, তাই নেব। আমার অন্য উপায় নেই। সমস্ত দুঃখরাত দেবে যদি দাও, পাহাড়ের খাঁজ থেকে বজ্রপাখি বাঁকা ঠোঁটে তুলে নিল আমার নিশান, আমার আর কোনও চিহ্ন নেই, আমাকে নতুন করে এঁকো, যদি চাও। তোমার প্রাণের থেকে প্রাণ দিয়ো তাতে। আমার মুখের থেকে চাদরের আবরণ তুলে ফেলে দিয়ো মৃত্যুর ঝাঁপি খুলে। তোমাকে কোথায় পাব বলে যাও। এঘরে ওঘরে তোমাকে ডেকে ডেকে ক্লান্ত আমার তরল মৃতস্বর বাবুইপাখির ঠোঁটে গুঁজে দেবে মৌন জোনাকি।’
‘চুপ কর টোপর। ভাল লাগছে না।’
‘কেঁদো না। যা চেয়েছ, পেয়েছ। কাঁদো কেন? দূরে যাচ্ছ। ছেড়ে তো যাচ্ছ না।’
‘আমার ভাল লাগছে না।’
‘যাও ঝুমু, আমার ডেস্কের দেরাজ খোলো। একটা সাদা প্যাকেট পাবে। নিয়ে এসো।’
‘নে।’
‘এটা তোমার।’
‘কী?’
‘তোমার সেলফোন। আমার নামে সিম পুরেছি। সিমের মাঝে অসীম আছে। যতখুশি কথা বোলো। বিলের তোয়াক্কা কোরো না। নিষ্পদ শতরূপ তার ভার বইতে পারবে।’
‘এ নিয়ে আমি কী করব?’
‘এই অর্ধমৃত আপদকে ফোন করতে ইচ্ছে করবে তোমার। তোমাকে যে জানি আমি ঝুমু।’
ঝুমুর ঝুমুর
বাড়িটি দোতলা। বেশ বড়। তারই উত্তর-পশ্চিমের ঘরে ঝুমুর প্রথম রাতের শয়ন। সে-রাত হল কালরজনী। স্বামী-স্ত্রী একত্র শয়ন করবে না। এমনকী বধূ ঘরে পদার্পণ করার পর তাকে শ্বশুরগৃহে বরণ করে নিলে, বর সে রাতে বধূর মুখদর্শন করবে না। যদি করে তো বেহুলার মতো দুঃখী হবে সে।
বেহুলা। স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে যে ভেসে গেল কলার ভেলায়। সদ্য কিশোরী হওয়া একটি মেয়ে ভেসে চলল একা। বাকিরা সেই দৃশ্য দেখল চুপচাপ। কেউ কেউ চোখের জল ফেলল বটে, কিন্তু বেহুলার জীবনের অধিকার বিষয়ে একটি কথাও কইল না।
সেই থেকে মেয়েরা কলার ভেলায় চেপে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
আজ ঝুমু-র বেহুলার কথা বড় মনে পড়ছে। আজ তার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। ছেড়ে আসা কী ভীষণ কঠিন! আজন্ম অধিকার, আশৈশব ভালবাসা, অভ্যাস, ছোট ছোট প্রিয় বস্তুগুলি, সে বিছানার নরম পরিচিত কোল, ঘরের গন্ধ, স্নানঘরের ভিজে ভিজে একান্ত দেওয়ালে কাল্পনিক আঁকিবুকি! সব কাজ। সব অধিকার। সবার সকল প্রিয়কর্ম সমাধা করার অপূর্ব তৃপ্তি ও পুলক!
আর মানুষেরা। সেইসব মানুষেরা! যারা প্রিয়! আপনার। যাদের শ্বাসের সঙ্গে শ্বাস মিলে গেছে এতকাল। যাদের সমস্ত দুর্বলতা জানা হয়ে আছে। যাদের কাছে বদহজম, চোঁয়া ঢেকুর বা আলসেমি— কোনও কিছুর জন্যই লজ্জিত হতে হয় না!
সব কিছু ছেড়ে আসা। সব লোক, সব বস্তু। এবং, নতুন, অচেনা কিছু লোককে আপনার করে নেওয়ার নির্দয় পাথুরে রাস্তা!
ঝিরি তাকে ধরে কাঁদল। ঝিরির মতো মেয়ে। খরতর। বেপরোয়া। স্বাধীন মেয়ের সমস্ত বৈশিষ্ট্যে অটল বিশ্বাসী।
আর সে? টোপর?
একবারও আসেনি বিয়ের আসরে। একবার দাঁড়ায়নি বারান্দায়। টোপর নিজেকে ঢেকে রেখেছিল। কী হবে ওর? কে দেখবে? জ্বর সারেনি ভাল করে। রক্তের নানাবিধ পরীক্ষা। আজ তার ফল জানা যাবে। সে ঝিরিকে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘টোপরকে দেখিস।’
‘আমার তোর মতো করে দেখাশুনো করার ক্ষমতা নেই দিদি। টোপর, প্রবীরকা, বাবা, আমি— আমরা কেউই শিখিনি কী করে আগলাতে হয়, দেখাশোনা করতে হয়, আমরা শুধু পেতে শিখেছি। এরপর যার যার তার তার।’
ঝুমু-র কান্না পাচ্ছে। সে রোধ করতে পারছে না। প্রবীর বললেন, ‘মা, তুই যে আমাদের সকলের মা ছিলি!’
‘তোকে ছাড়া শূন্য লাগবে ঘর।’ জ্যোতির্ময় বললেন।
মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় কাঁদবে, এ নিয়ে বিস্ময়ের কিছু নেই। না কাঁদলেই অবাক ব্যাপার! দেখো, কাঁদল না, কী মেয়ে! একদম তৈরি! তৈরি কীসের জন্য? ন্যাকা! জানো না! বিয়ে করে কী জন্য? মেয়ে শোয়ার জন্য ব্যাকুল! একটি মেয়ে কামিনী। তার কাঁদায় কাম, হাসায় কাম, বসায় ভালবাসায় কাম, চক্ষে কাম, নখরে কাম, সাজায় কামযামিনী।
‘কাঁদছ কেন? এই যে! ঝুমুর! এত কাঁদার কী আছে? এই তো গড়িয়া আর লেক গার্ডেন্স! মেট্রোয় উঠলেই বাপের বাড়ি চলে যাবে!’
‘তেমন কচিও তো নয়। দিব্যি মানিয়ে নেবে।’
‘তোমার অনেক গুণগাথা শুনেছি। সংসারে সব কাজই পারো। এমন মেয়েই এ বাড়িতে দরকার। আজকাল তো মেয়েরা কুটোটি নাড়তে পারে না। আমার ছেলের বউ, বুঝলে, মন্টি, বলে, মা— কালোজিরে কোনটা? হাহা হো হো হেহে হিহি!’
‘মন্টি যেন কী চাকরি করে?’
‘চাকরি ভাল করে। এম বি এ করেছে তো। তাই বলে কালোজিরে…আমরাও তো এম এ বিএ করেছি। মা তাই বলে ঠুঁটো জগন্নাথ করেননি আমাকে। সব পারতাম। কল্যাণী তো লাকি। কাজ জানা বউ পেয়েছে।’
‘শান্তও তো। মুখখানা মিষ্টি। কী চুল দেখো মাথায়! হ্যাঁ গো বউ, মাথায় কী তেল দাও!’
‘তুই থাম! কলপ করে তো চুলের বারোটা সাত বাজিয়েছিস। ও কি আর গজাবে!’
‘আমি বাপু সাদা চুল নিয়ে ঘুরতে পারব না। সে তোরা যাই বল।’
‘এখানে কে আছে বল যে কলপ করে না? ভাল জায়গায় করালে কোনও ক্ষতি নেই।’
‘আজকাল অল্পবয়সিদেরও চুল পাকে।’
‘আমাদেরও এমন কী বয়স হয়েছে?’
‘তাই নাকি? ওই জন্যই তোর বরের মুখে সারাক্ষণ হাসি।’
‘চুপ কর, নতুন বউয়ের সামনে…’
‘নতুন বউ তো কী! ও তো এখন আমাদেরই।’
‘না। ও কল্যাণীদির। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখবে। ছেলেটাকে দরকচা বানিয়েছে। আমরা নিমন্ত্রিত অতিথি। বিয়ের কোনও কাজে আমাদের হাত লাগাতে দিল? সব করল গুরুভগিনীরা। ওরাই আত্মীয়। এই বউ আমাদের কেউ নয়। অলকদা তো অর্ধপাগল। এবার বউটার পালা।’
‘চুপ কর, বউ শুনবে, কল্যাণী শুনলে ধুইয়ে দেবে তোকে।’
‘যা তো! ও কী ধোয়াবে? ওর সব জানি! আমি ছেড়ে দেব? বউ শুনবে না! ও অন্য জগতে আছে। কল্যাণী কী বলে জানিস? ছেলের বিয়ে দিয়েছি, কারণ নাতি চাই। আমি মহিলা সমিতি করা মানুষ, বললাম— আগে তো ছেলেবউয়ের প্রেম জমুক— তারপর নাতি! বলে-দাম্পত্যে প্রেম হয় নাকি?’
‘তো কী হয়?’
‘যা যা হওয়া সম্ভব। শুধু প্রেম বাদ। কল্যাণী নাতি চায়। বলে, এই বাড়ি, এই সম্পত্তি, কার জন্য রেখে যাব। বললাম— নাতিই চাই? নাতনি হলে হবে না? বলে, মেয়েরা জন্মায় পর হওয়ার জন্য। আর মেয়ে মানেই ঝামেলা। ও নাকি এক শাশ্বতীকে নিয়েই জ্বলেপুড়ে মরছে।’
‘শাশ্বতীর ব্যাপারটা কি সত্যি?’
‘পুরোপুরি। আমার মেয়ে হলে আমি ফিরিয়ে আনতাম। এরা যেন পাষাণ।’
‘কী বলছ গো তোমরা আমার নামে?’
‘তোর কপালের কথা বলছি। আবার কী!’
‘ও নিয়ে আর ভেবে কী হবে তনুমাসি? আমি মরলে মাঝে মাঝে অ্যালবাম খুলে ছবি দেখো।’
‘চুপ কর। হ্যাঁ রে, কাল্টু কি একটুও পালটায়নি?’
‘পালটাতে দেবে না ওরা মাসি। অসুখকে অসুখ বলে স্বীকার না করলে রোগ সারে বলো?’
‘সত্যি রে, তোর কথা ভাবলে ভেতরটা কেমন করে। আমার পুপু বলে, লালদির জীবনটা খারাপ করে দিল কালুমাসি। ওকে ফিরিয়ে আনা উচিত ছিল।’
‘যা কপালে আছে হবে মাসি। এই যে মেয়েটাকে আনল বিয়ে দিয়ে, ওর কী হবে?’
‘চুপ কর। শুনবে।’
‘জানবে তো সবই একদিন।’
‘কে জানে, আমাদের দীপের মন বদলে যেতেও পারে।’
‘দাদাকে তোমরা চেনো না মাসি।’
ঝুমু ও টোপর ও জীবনের জ্বর
টুকরো টুকরো কথা ঝুমু-র কানে আসছে। কোনও কথাতেই তার মন নেই। প্রতিটি পরিবারেই কিছু না কিছু বিক্ষোভ বেদনার ইতিহাস থাকে। তার প্রতি ঝুমু-র আগ্রহ নেই। মন পড়ে আছে টোপরের রক্ত পরীক্ষার ফলাফলে। কী এল? খারাপ কিছু এল না তো?
মহিলারা একে একে বিদায় নিলেন। শাশ্বতী প্রত্যেকের খোঁজ করতে লাগল। কোন মাসি খেলেন না, কোন পিসি গাড়ি আনতে পারেননি, কোন মাইমা রাতের ওষুধ ভুলেছেন।
ঝুমু তার নতুন শাড়ির ভারমুক্ত হতে চাইছিল। শাশ্বতী এসে বলল, ‘চলো, খেয়ে আসি।’
‘আমি কিছু খাব না আর।’
‘কেন গো?’
‘অনেক মিষ্টি খেয়েছি। খিদে নেই।’
‘আমি খেয়ে আসি তবে। তোমার সঙ্গে শোবো। ততক্ষণ আরও কিছু কেঁদে নাও। ওই কাঠের আলমারিতে তোমার জিনিসপত্র আছে। চাইলে স্নান করতে পারো। ম্যাক্সিও আছে। পরে নাও। আমিই শুধু থাকব।’
শাশ্বতী চলে যেতেই ঝুমু ব্যাগ থেকে ছোট্ট মুঠোভাষখানি বার করে বিদ্যুতের সংযোগ পথ খুঁজে লাগল। যন্ত্রটি শক্তি বাহী করে তুলতে হবে। ঝুমু তাকে গালে ছোঁয়াল। টোপরের দেওয়া, যেন এ মুহূর্তে টোপর স্বয়ং। এবার বলতে হয়নি আর, টোপর ঝিরিকেও এ যন্ত্র উপহার দিয়েছে।
আজই এই গৃহে সে প্রথম এল। সম্ভবত এই ঘরেই সে থাকবে। অথচ তার মনে হচ্ছে সে কতকাল নিজের বাড়ির লোকের দেখা পায়নি। সে টোপরকে ফোন করল।
‘বলো ঝুমু।’
‘কেমন আছিস টোপর? জ্বর বেড়েছে?’
‘বেড়েছিল। এখন ঘাম।’
‘রক্তের কী রিপোর্ট?’
‘সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। চারিদিকে ডেঙ্গি হচ্ছে, তমালকাকা বললেন সাবধানে থাকতে। আমি তো জানি, রক্তে কিছু পাওয়া যাবে না।’
‘ডেঙ্গি হলে ধরা পড়ত।’
‘প্রথমবার ধরা না-ও পড়তে পারে।’
‘আমার ভাল লাগছে না।’
‘কেন?’
‘তোর জ্বর।’
‘তুমি চলে যাবে বলেই আমার জ্বর এসেছে গো ঝুমু।’
‘সেরে ওঠ সোনা।’
‘আমার কিছু হয়নি। ও আপনি সেরে যাবে। তুমি কেমন আছ বলো।’
‘জানি না রে টোপর। খুব কান্না পাচ্ছে।’
‘কান্না পেলে কেঁদে নিয়ো। মন হালকা হবে।’
‘ওষুধপত্র ঠিকমতো খাবি। রান্নাঘরে নিজে কিছু করতে যাস না। কেমন তো টোপর?’
‘যাব না ঝুমু। তুমিও কিন্তু দোপাট্টা বা আঁচল দিয়ে জ্বলন্ত উনুন থেকে কিছু নামাতে যাবে না। দোপাট্টা নেবেই না রান্নাঘরে। চাদরও নয়।’
‘আর শোন, ব্যায়াম নিয়মিত করবি। আমি বলি কী, তুই সারাক্ষণের জন্য কাউকে রেখে নে। সবাই যে-যার কাজে চলে যাবে। তুই যে একেবারে একা হয়ে যাবি। আমার ভাবনা হচ্ছে।’
‘আমার পায়ে জোর না থাকতে পারে, মনের জোর আছে। তুমি জানো।’
‘তোর কাছে সর্বক্ষণ কেউ আছে জানলে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি।’
ঘরে প্রবেশ করলেন কল্যাণী।
‘এত আহ্লাদের কথা কার সঙ্গে হচ্ছে?’
‘আসুন…’
‘আসুন আবার কী। আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমাকেই আসতে বলছ!’
‘এক মিনিট, হ্যাঁ?… টোপর, আমি রাখি রে। যা বললাম ভেবে দেখিস। কাল আবার ফোন করব। কাল আবার ব্লাড নেবে? প্লেটলেট কাউন্ট? ঠিক আছে। ভাল করে খাবি কিন্তু। হ্যাঁ। খাবি। রাত জাগিস না, হ্যাঁ?’
‘লাল বলছিল, তুমি নাকি রাতে খাবে না। তাই দেখতে এলাম। তা, তোমার আরও যদি কথা থাকে, সেরে নাও।’
‘না না। আপনি বসুন। টোপরটা অসুস্থ, তাই।’
‘তোমার সেই পাড়াতুতো ভাই?’
‘আমরা ওকে নিজের ভাই বলেই মনে করি।’
‘কী হয়েছে?’
‘খুব জ্বর। ডেঙ্গি হতে পারে। ডাক্তার বলেছেন।’
‘অ। তা তুমি খাবে না কেন?’
‘খিদে নেই।’
‘দেখো বাপু। পরে যেন বাইরে বোলো না শ্বশুরবাড়িতে খেতে দেয়নি।’
‘এ মা ছিছি!’
কল্যাণী চলে গেলেন। ঝুমু ঝিরিকে ফোন করল। কালই সাবার সঙ্গে দেখা হবে। তবু ঝুমুর মনে হতে লাগল ছুটে চলে যায় নিজের ঘরটিতে। সে স্নানঘরে দোর দিয়ে খানিক কেঁদে নিল আবার। জল গরম করে স্নান করল ভালরকম। আয়নায় দেখল নিজেকে। কপালে সিঁথিতে সিঁদুরের লালে সে কেমন বদলে গিয়েছে। তার গা শিরশির করে উঠল। কাল ফুলশয্যা। এমন একজনের সঙ্গে কাল রাতে তাকে থাকতে হবে, যে চোখ তুলে তাকে দেখেনি পর্যন্ত। মাল্য বিনিময়ের সময়, শুভদৃষ্টির সময় সে তবু সলাজ দৃষ্টি দিয়েছিল মানুষটির দিকে, কিন্তু বিনিময় হল না। গোপন ইঙ্গিতে ঝুমু বুঝে যাচ্ছে, সে আকাঙ্ক্ষিত নয়। কাম্য নয়। কেমন করে একজন পুরুষের কাছে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলতে হয় ঝুমু জানে না। সে অকস্মাৎ শিরদাঁড়া টান করে দাঁড়াল দর্পণের প্রতিবিম্ব সমেত। সন্দীপন নামে মানুষটির অনুগ্রহ পেতে সে কি খুব ব্যগ্র হবে? জীবন হঠাৎ এমন জটিল কোনও প্রশ্নের মুখোমুখি ঠেলে দেয়, যার উত্তর হতে পারে ভারসাম্যহীন। আজকের হ্যাঁ বলা কাল না হতে পারে।
ঝুমু কি তা জানে?
কাল সে যা না করে এসেছে, আগামী সকাল তাকে সেদিকেই টেনে নেবে কিনা, জানে কি সে? কেউ জানে? মহাযজ্ঞ নিরন্তর স্ফুলিঙ্গ ওড়ায়। সেইসব, কোথায় কখন ধরাবে আগুন, কে জানে! মাথার সিঁদুরে কারও নাম লিখিত থাকে না। মূর্খ পুরুষ, তুমি ভাবো, দু’আঙুলে নারী কিনে নেবে? তুমি ভাবো, সিঁদুরের দাগ মাথার খুলির তলা দিয়ে চলে যায় মস্তিষ্কে হৃদয়ে? জেনে রেখো, প্রেমে ও প্রজ্ঞানে কোনও মেয়ে সতীত্বশৃঙ্খলে বাঁধা নয়। তুমি যদি না চাও আমিও চাব না। না যদি দাও ভালবাসা, আমি পাশাপাশি শোয়াব খেয়াল। আমি সাধারণ মেয়ে। ধুলোবালি মেখে স্নান, রাতের অন্ধকার আমার কাজল। কালো মেঘ দিয়ে গড়া চুল। ঠোঁটে লেগে থাকে কষ, হাসি, মাদক ওষুধ। দুই বুক দুধে ভরা। যোনি অপূর্ব মৃত্তিকা দিয়ে গড়া। বুকের চাতালে আমি ইচ্ছাকে স্বদুগ্ধ খাওয়াই।
ঝুমু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। অচেনা মানুষ বিয়ে করা মানে অচেনার ইচ্ছায় আত্মসমর্পণ নয়। এই কালে মেয়েরা কি অরক্ষণীয়া হয়? শব্দটি হয়েছে বিস্মৃতপ্রায়। কিন্তু তার ভাব? ব্যঞ্জনা? সংসারে ভারসাম্য বিপন্ন হয়, ব্যাহত হয় স্থিতি, যদি ছাব্বিশোর্ধ্ব কন্যে থাকে ঘরে। অবিবাহিত। যতই সে পণ্ডিতানী হোক, যতই সুফলা ও শস্যশালিনী, এমন গভীর সংস্কার, মেয়ের গলায় বরমাল্য না যদি দোলে, বাপের আত্মগ্লানি খলখল করে ওঠে, মায়ের গভীর বিষাদ রোগ ধরে, ভাইয়েরা আপনার বিবাহের পথে তাকে মনে করে কাঁটা— যে কাঁটা বছর বছর বোন মহাপ্রেমে দিয়ে আসে যমের দুয়ারে ভ্রাতৃগণে আয়ু রবে বলে। বোনের পরেও যদি থাকে কোনও ছোটবোন, তার দশা নিরাপত্তাহীন। অতএব বিবাহযোগ্যা তুমি যাও, চলে যাও, ঘর বর পাও, এ সংসারে ঠাঁই নাই তব। তোমার চাহিদা গৌণ। মুখ্য হল পরিপার্শ্ব কী কী চায়। একা তুমি কে হে?
তা হলে দাঁড়ায় কী? এত দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে মেয়েদের বিকাশের কাল ছাব্বিশ বছর। গৌরীদান থেকে পথ হেঁটে হেঁটে এই বরাদ্দ বেড়েছে।
অতএব ঝুমুরের প্রয়োজন ছিল একখানা হস্তান্তরযজ্ঞ থেকে ফেরা। পেয়ে গেল। আর কিবা চাই!
ছাতে গর্জন করছে দাপাদাপি করছে বাঁটুল। ঝুমু এখনও দেখেনি তাকে। আটক থাকায় সে ক্ষিপ্ত হয়ে আছে।
নীচ থেকে চড়া স্বরে তর্ক ভেসে আসছে। নারী-পুরুষ উভয়েরই কণ্ঠ আছে। ঝুমু তার দীর্ঘ ঘন চুল আঁচড়ালো। পুরো ভেজায়নি, পাছে ঠাণ্ডা লেগে যায়। বসন্ত ফুলের রেণুর নীচে ঢেকে রাখে রোগজর্জরতা। বীজাণুর ভরা ঝাঁপি!
ঝুমু ও বাঁটুল ও ফুলশয্যা
বিছানাটি ফুলে ফুলে সাজানো। গোলাপ ও রজনীগন্ধার জালে নতুন শয্যা ছত্রী সগৌরবে ঋজু। গোলাপি বেনারসি পরে জড়োসড়ো বসে আছে ঝুমু। কে আসছে, কে যাচ্ছে, সবই স্বপ্নের মতো। আজ শাশ্বতী নজরকাড়া রূপসী হয়ে আছে। তার বর আসেনি? শ্বশুরবাড়ির কেউ? সম্পর্ক নেই। শুধু লাল জেদ করে আসে।
লাল! অদ্ভুত নাম!
সব্বাই চলে গেলে ঝুমু গা ধুলো। একটি নতুন তাঁতের শাড়ি। কীসব মিষ্টি খাওয়া-দাওয়া নিয়ম। চুল দিয়ে স্বামীর পা মুছিয়ে দাও। আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দাও মুখ। পতি দেবতা। স্বামী প্রভু। রীতি মান্য করতে হয় ঝমর ঝমর শাঁখা নোয়া পলা পরে। নইলে অকল্যাণ! কার অকল্যাণ? কে তার রক্ষাকারী?
দোর টেনে চলে গেল লাল। ফুলশয্যা ঘিরে যেমন হইচই দেখেছে ঝুমু, হল না সেরকম। সন্দীপন গম্ভীর পুরুষ। হাসে কম। কথা বলে আরও কম। কেশবিরলতায় তার গাম্ভীর্য মানায়। সে ঘরের একধারে রাখা সোফায় বসল। আর প্রথম প্রাণীটিকে দেখতে পেল ঝুমু। বাঁটুল। চারপায়ের নখরে ঝমঝম শব্দ তুলে টগবগ করতে করতে সে প্রবেশ করল ঘরে। নাক দিয়ে ঠেলে সে অনায়াসে দরজা খোলে। ব্রিটানিয়া মারি বিস্কিটের মতো রং। ঘাড়ে ও লেজে ঝাঁকড়া চুল। কান অল্প ঝুলে আছে। ঝুমুর মনে হল, ঘরে একটা ঘোড়া ঢুকে পড়েছে। গম্ভীর স্বরে বাঁটুল ডাকল ঘ্রাউ! চোখ ঝুমুর দিকে! বন্য! তীব্র! কয়েক পা এগিয়ে এল। নাকের ডগা কাঁপিয়ে গন্ধ শুঁকল। ঝুমু সিঁটিয়ে বসে আছে। ঘ্রাউ ঘ্রাউ। বাঁটুল আবার ডাকল।
‘বাঁটুল! ডোন্ট বিহেভ লাইক এ বিচ।’
‘ঘ্রাউ!’
‘বাঁটুল, উনি এখন থেকে এবাড়িতেই থাকবেন। বুঝেছ? এসো। এদিকে এসো।’
ঝুমু স্পষ্ট দেখল বাঁটুলের মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেল। চোখ থেকে বন্যতা সরে গিয়ে নরম সলাজ চাহনি। হালকা নাচের ছন্দে সে সন্দীপনের বুকের কাছে মুখ নিয়ে দাঁড়াল। লেজটা অল্প অল্প দোলাচ্ছে। সে দোলা কখনও পথের নেড়ি কুকুরের মতো নয়। তাতে আপ্লুতির উত্তাল নড়ন নেই। আছে গভীর আনন্দমগ্ন দোল। পাতলা লাল জিভ বার করে সে সন্দীপনের ঠোঁট চাটল, গাল চাটল, দু’পায়ের মধ্যখানে, যেখানে পুরুষত্ব ধারণ করা হয় বলে মনে করে পুরুষেরা -সেখানে নাক ঘষতে লাগল।
সন্দীপন বাঁটুলকে সাপটে নিচ্ছে। মুখে চুমু খাচ্ছে। সেই চুম্বনদৃশ্য জীবপ্রেম ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে আরও বহু দূর!
‘কী হয়েছে, উঁ? কী চাই? মাই সুইটহার্ট! মাই ডার্লিং!’
‘কুঁঃ কুঁঃ কুঁঃ! আঁউ!’
‘আমি তো তোমারই বাঁটুলিয়া, বুঁটুসোনা! তোমাকে আমি চোম্পু করে দেব তো! তোমাকে দিলখোশ করে দেব। আমার নূরজাহান বাঁটুলেশ্বরী!’
‘উঁ! উঁ! উঁ! উঁ! আ!’
বাঁটুল সবল দুটি পা তুলে দিয়েছে ঝুমুর সদ্যপ্রাপ্ত বরের কাঁধে। অস্থির লেহন করছে মুখ, বুক, গলা, ঘাড়। শব্দ করছে উঁ উঁ উঁ! আদরের শব্দ! যেন কুকুরের লোমশ চামড়ায় গড়া ওভারকোট পরে সন্দীপনের সতৃষ্ণ প্রেমিকা!
ঝুমুর গা শিউরে উঠছে। সে আড়চোখে দেখছে আর আঁচল প্যাঁচাচ্ছে আঙুলে। তার ইচ্ছে করছে, এখুনি ফোন করে টোপরকে, ঝিরিকে, ঝাড়ু নমিতাকে বলে এই দৃশ্যের কথা! সে অজ্ঞ বা অপরিণত নয়। ফুলশয্যার রাত কতখানি অর্থবহ সে জানে। এই রাতে দাম্পত্যের সূচনা। এই রাতে প্রেম অথবা অপ্রেমের সূত্রপাত। ওই লোক যদি ঝুমুকে চুমু খেতে চায়! ওই মুখে! অসম্ভব! ঝুমু দেবে না! তার মনে হচ্ছে, বাঁটুলের চুম্বন তার ঠোঁটে মিশে যাবে! সে কখনও পশুপালন করেনি। এই তন্ময় আদর মানুষে-পশুতে, সে অভ্যস্ত নয়। সে কি এক অসরল মেয়ে? মন্দমনা?
সময় যাচ্ছে। ঘ্রাউ, ভুক্, উঁইই, ওঁ ওঁ নানান শব্দ করছে বাঁটুল। তার সারা শরীরে সন্দীপনের আঙুল খেলছে। ঝুমু, কিছুক্ষণ দেখার পর, একটু বেশিই শব্দ করে হাই তুলে ফেলল।
সন্দীপনের মনে পড়ল ঝুমুরের কথা। সে বাঁটুলের গলায় আদর করতে করতে বলল— ঘুম পাচ্ছে! পাবেই তো।
‘না না, ঠিক আছে।’
‘আমার তোমাকে বিশেষ কিছু বলার নেই। মশারিটা টাঙিয়ে নেওয়া ভাল। মশা আছে।’
‘আমার ঘুম আসবে না। মশারির অভ্যাস নেই।’
‘মশার তেল জ্বেলে দিই তবে।’
‘ঠিক আছে।’
‘শুয়ে পড়ো।’
‘আপনি?’
‘এত ফুলের মধ্যে শুতে আমার গা ঘিনঘিন করে।’
‘কেন?’
‘অত প্রশ্ন কোরো না। ফুলে পোকা থাকে। কৃত্রিম সুগন্ধ! আমি কৃত্রিমতা ভালবাসি না।’
‘অকৃত্রিম খুব কম জিনিসই আছে এ জগতে। বাজারি ফুল বিশুদ্ধ থাকে না ঠিকই, তবে ঈশ্বরকে এই ফুলই দেওয়া হয়।’
‘ঈশ্বরের কাছে পৌঁছয় কেবল ভক্তি।’
‘প্রশ্ন করতে বারণ করছেন। জিজ্ঞাসা জাগলে কী করব?’
‘বেশি প্রশ্ন করতে বারণ করেছি। নিজের মতো থাকো। আমাকেও বেশি বিরক্ত কোরো না।’
‘বিরক্ত কেন করব?’
‘বলে রাখলাম। তোমার খরচের ভার ধর্মতঃ আমার। ওই আলমারিতে টাকা আছে। চাবি গোপন রেখো। যখন যা লাগে নিয়ে নেবে। কৈফিয়ত দরকার নেই।’
ঝুমু ফুলগুলি পরিষ্কার করল, রাখল একটি সেলোফেন প্যাকে। শুয়ে পড়ে তার মনে হল, এই ফুল সরিয়ে শয্যা সন্দীপনের উপযুক্ত করে তোলা কি আহ্বান হল? সে কেবল স্বভাবসিদ্ধভাবে সন্দীপনের অসুবিধা দূর করতে চেয়েছিল। কে জানে সে এর কোন ব্যাখ্যা করবে। তবু একপক্ষে স্বস্তি, লোকটা গোড়া থেকে গায়ে হামলে পড়ছে না। সে চোখ বুঁজে রইল। খানিক পর বড় আলোটি নিবে গেল। কেউ শুয়ে পড়ল পাশে, দূরত্ব রেখে। গদিখানা নড়ে উঠল। এবার আরও জোরে। শুঁক শুঁক। ঘ্যাস ঘ্যাস ঘ্যাস। বাঁটুলের শ্বাসের শব্দ। ঝুমু কুকুরের গন্ধ পেল। চোখ মেলে দেখল, বাঁটুল তার সারা গা শুঁকছে। সে আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল-আঁঃ আঁঃ আঁঃ!
‘ভয় নেই। কিছু করবে না।’
‘ওকে সরান।’
‘ওকে গন্ধ নিতে দাও। না হলে রাতে বিপদে পড়তে পারো।’
‘ওমাঃ!’
শোঁকাশুঁকি শেষে সে থেবড়ে বসে পড়ল দু’জনের মাঝে।
ঝুমুর গলা শুকনো। সে বলল, ‘জল খাব।’
‘টেবিলে জল আছে।’
ঝুমু উঠতে পারছে না। নড়লে যদি ঘ্যাক করে কামড়ে দেয়!
‘কিছু বলবে না আর।’
‘ও কি এখানেই থাকবে সারা রাত!’
‘আমার সঙ্গে ঘুমোন ওর অভ্যাস।’
‘আমার অভ্যাস নেই।’
‘অভ্যাস করতে হবে। তোমার জন্য আলাদা ঘর বরাদ্দ করা যাবে না।’
সন্দীপনের কণ্ঠ নির্মম, শীতল। বড় অবহেলা সেই স্বরে। যেন ঝুমুকে বিবাহ করে, একখানি ঘর দিয়ে সে বড় ঋণদাতা, অনুগ্রহকারী। আলাদা ঘর বরাদ্দ করা যাবে না। যেন অমোঘ আদেশ। যেন ঝুমু এক ঘরভিখারিণী। সিঁদুরকাঙাল। কোনওখানে তার ঠাঁই নেই। অরক্ষণীয়া মেয়ে, বাপ তার নিরাপদ সামাজিক প্রতিষ্ঠা খরিদ করে দূরের মানুষ।
সে কী করতে পারে? কুকুরের সঙ্গে সহবাস অনভ্যাসে সে কি উৎপীড়িত বোধ করে চ্যাঁচাবে উদ্দাম?
তুলকালাম করে ফেলবে এই বলে যে সে এমন শয়ন নিকৃষ্ট ও অসহনীয় মনে করে। দু’জন মানুষের সম্পর্ক কেনাবেচার মধ্যে একটি কুকুর তৌল হওয়া সমীচীন নয়। গৃহপালিত প্রাণী থাকতেই পারে। কিন্তু এইভাবে, যে সে সম্পর্কের সশস্ত্র কোটাল। এই নিয়ে মুখর প্রতিবাদ করবে কি ঝুমু?
অসম্ভব। ঝুমু তা পারে না। তবে ঝুমু কী পারে? চুল ঝাড়ে। ফুল পাড়ে। সে সংকুচিত হয়ে ওঠে। আতঙ্কিতও। অকস্মাৎ মনে হয়, টোপরের অকপট নিবেদন ঠেলে দিয়ে সে এক মস্ত ভুল করে বসে আছে! পালাতে চেয়ে অন্ধনিশানায় ছুটে গেছে। তার চেয়ে ঝিরি অনেক অনেক বেশি চৌখস। অনেক বেশি স্পষ্ট ও বুদ্ধিধারিণী। তার চেয়ে এমনকী সামান্য শিক্ষিত ঝাড়ুদারনি নমিতাও স্থিতধী। সমঝদার।
এমনকী ঝিরি ও নমিতা দু’জনেই সমাজের সম্পূর্ণ পৃথক সামাজিক অবস্থানে থেকেও নিজস্ব অধিকার ও সম্মানবোধের ক্ষেত্রে সচেতন। দৃঢ়চিত্ত। বয়সের পাঁচ বৎসর ব্যবধান আঙ্কিক দূরত্ব ছাপিয়ে ঝিরি ও নমিকে ঝুমুর চেয়ে বস্তুত বছর পঞ্চাশ এগিয়ে দিয়েছে।
ঝুমুর সংকুচিত আত্মার ভিতর থেকে কথা উঠে এল। তার প্রথম সরব প্রতিবাদ। মৃদু। তবু অর্থবহ।
‘আপনি আশ্চর্য কথা বলছেন। একটা অচেনা কুকুরের পাশে শুয়ে কেউ ঘুমোতে পারে?’
‘ওকে কুকুর বলবে না। আজ প্রথমদিন। মাপ করে দিলাম।’
ঝুমু উঠল। জল খেল। বালিশ নিল। দেরাজ খুলে চাদর নিল। খাট ও তার পেছনে কাঠের আলমারি। মাঝে একফালি জায়গা। সে চাদর পাতল। নিল তার বাপের বাড়ি থেকে তত্ত্বে দেওয়া নতুন কম্বল। তত্ত্বে আরও কত কী! কানাই সামন্ত সরু গলির মহিলারা নমিতার নেতৃত্বে সাজিয়েছে চমৎকার! ধুতির নৌকা। বেনারসি পরা কনে পুতুল। প্রণামী শাড়ির বাহারি আঁচলে কুচি করে পাখি, মাছ, প্রজাপতি! মিষ্টিও কতরকম! আয়োজনের ত্রুটি নেই। এই ভূমিশয্যা তার কাম্য ছিল না। তার প্রাপ্যও নয়। সে নিঃশব্দে হু হু কাঁদতে লাগল। সরল মেয়েটা বুঝতেও পারল না শয্যা প্রত্যাখ্যান করে স্বৈরাচারী উদ্ধত পুরুষতন্ত্রের দিকে সে কতখানি থুতু ঢেলে দিল!
ঝুমু ও শাশ্বতী ও সময়ের বিবর্ণ গতি
‘জয়ীপিসি কি জানতেন না সন্দীপন কুকুর নিয়ে শোয়?’ টোপর বলল।
ঝিরি বলল, ‘জানত। ভেবেছিল বিয়ের পর কুকুরের জায়গায় বউকে ঠিকই শোয়াবে।’
টোপরের মুখ রাগে লাল। সে বলল, ‘তুমি কি ও বাড়ির বড়দের জানিয়েছ?’
‘এখনও কিছু বলিনি। আর বলবই বা কী! সবাই জানেন, আমাদের দু’জনের মাঝে বাঁটুলের কোলবালিশ!’
‘দিদি বলবে? দিদিকে তুই চিনিস না টোপর?’ ঝিরি রাগতভাবে বলল।
‘এভাবে কেউ একঘরে থাকতে পারে?’
‘স্বামী-স্ত্রীর একটা স্বাভাবিক জীবনও তো আছে। তার মধ্যে একটা ধামসা কুকুর ঢুকে পড়লে চলবে কী করে!’
‘জ্যোতিকাকা কী বলছেন?’
‘মানিয়ে নিতে বলছেন। বিয়ের পর মেয়েদের অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়। সেই চেষ্টাই করতে বলছেন।’
‘চমৎকার! ঝিরি, এ বিষয়ে বাইরে থেকে আমাদের কিছুই করার নেই। যতক্ষণ না তোর দিদি নিজে কোনও উদ্যোগ নেবে, আমরা কী করব?’
‘আমার বাবাকে জানাবার কথা, বড়পিসিকে জানাবার কথা, জানালাম। আর কী করব?’
‘তা জয়ীপিসির কী পরামর্শ?’
‘একই। মানিয়ে নাও। এত ভাল ছেলে! ভক্তি বান! ভাল চাকরি! অত বড় বাড়ি, প্রচুর বিষয়সম্পত্তি। ঠিক আছে। লাজুক ছেলে। চরিত্রবান। কখনও মেয়েদের সঙ্গে মেশেনি। লজ্জায় এমন করছে। ক’দিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। বাবা বলল, ‘অত খরচ করে বিয়ে দিয়েছি। একটা কুকুরের জন্য তো বিবাদ করতে পারব না। বাড়ির পোষা জানোয়ারের প্রতি ওরকম টান অনেকের থাকে। মানিয়ে নাও।’ তা এই ন’দিন মানিয়ে আমি নিয়েছি। বাবার খরচ বিফলে যেতে দেব কেন? বাঁটুল এখন আমায় চেনে। সত্যি বলব? আমার কুকুর ভয় লাগে! কখনও তো পুষিনি। হাঁ করলে ওই তীক্ষ্ণ দাঁত। মনে হয়, হঠাৎ যদি টুঁটি চেপে ধরে! মরে যাব! তবে সবই অভ্যাস! আমার সয়ে যাবে। কিন্তু ও ওর জায়গা ছাড়বে না। তাই আমিই জায়গা ছেড়ে বসে আছি।’
‘আমি জানি না ঝিরি, তোর দিদি কোন দিকে যাচ্ছে।’ টোপর বলল।
‘আমিও জানি না।’ ঝিরির বিষণ্ণ জবাব।
কেউই কি জানে? ঝুমু নিজেও জানে না। সন্দীপনের সঙ্গে এখনও তার ভাববিনিময় হয়নি। সে বিস্মিত। শরীরের চাহিদাও তো থাকে মানুষের। সন্দীপন কি শরীরে অক্ষম? শীতল? ঝিরির উদ্যোগে কিছু প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হয়েছিল সন্দীপন ও ঝুমু-র। শিক্ষিত সমাজের আধুনিক মনস্করা সম্বন্ধের বিয়ের জন্য এই আধুনিক ব্যবস্থার পক্ষে! চিকিত্সকের শংসাপত্র অনুযায়ী সন্দীপনের কোনও ত্রুটি নেই। তা হলে?
ঝুমু তল পাবার চেষ্টা করছে শুধু। মাস গেল। এর মধ্যে ঝুমু আর বাপের বাড়ি যায়নি। কোথায় গিয়েছে? কোথাও না। তার জীবনে এখনও কামরাঙার কুঁড়ি আসেনি। মধুচন্দ্রিমার চাঁদ ওঠেনি। সে রুটি রাঁধে, চুল বাঁধে, কচু কাটে, শাড়ি আঁটে। প্রকাশ্যে ম্যাক্সি পরা নিষেধ। সালোয়ার কামিজ মানা। কী যায় আসে। শাড়িতে শাড়িতে ভরা আলমারি। প্রায়ই নতুন শাড়ি পরে। কেউ চেয়েও দেখে না। সে আপনি পরে সানন্দে আয়নার কাছে দাঁড়ায়। টোপরকে ফোন করে। প্রতিদিন। বারবার। কী করছিস টোপর? আজ একটা শাড়ি পরলাম। ধূপছায়া রং। গোলাপি পাড়। নিজের ছবি নিজেই তুলতে একটুও ইচ্ছা নেই। তাই লেখে। কফি খেলি? ক’বার? রান্না ভাল করেছিল প্রতিমা? কী কী রাঁধল রে? তোর কাজ কেমন হচ্ছে? পারছিস তো? প্রবীরকাকা নিয়মিত হাইপ্রেশারের ওষুধ খাচ্ছেন তো?
রান্নাঘরে টোপরকে মনে পড়ে তার। সে আঁচলখানি কোমরে পেঁচিয়ে নেয়। পাছে আগুন লেগে মরে-এই ভয় টোপরের। মরবে না সে। টোপরের শুধু ঝুমু আর বাবা-ঝুমু কি তা জানে না? তার সবটুকু ভাল থাকা টোপরের জন্যই তো।
ঝুমু আলুপরোটা, ঝুমু কুকুরের জন্য মাংস সেদ্ধ, ঝুমু শ্বশুরের হরলিকস, ঝুমু শাশুড়ির আধকপালে রোগে উপশম, ঝুমু পটলের পেট থেকে শাঁস খুঁচিয়ে তুলে পুর রেঁধে পটলের পেটে পুরে তেলে ঝালে কষা কষা দোলমা, ঝুমু, কপালে সিঁদুরের টিপ পরে টোপরকে ফোন, ঝুমু, মেঝেতে শুয়ে থাকা ঝুমু অভ্যস্ত ভূমিশয্যা আশ্রিত নিদ্রায়, ঝুমু গ্রীষ্মের বিকেলে গেলাসে গেলাসে তরমুজ শরবৎ! আমপোড়া!
‘টোপর ও টোপর! তোকে, দেখি না কতদিন!’
‘দেখতে চাও? চলে এসো।’
‘চলে যেতে চাই। পারি না। দেয় না যেতে। বলে নতুন বউ ঘন ঘন বাপের বাড়ি গেলে লোকে নিন্দে করবে। আজ দুপুরে কী হয়েছে শোন। এ বাড়িতে ঘর বয়ে মাছ-সবজি পৌঁছে দিয়ে যায়। বাবুর সময় নেই বাজারে যাবার। পুঁটি, মৌরলা দিয়ে গেছে এই গাদা। আমায় কাটতে বললেন। আমি কি পারি? কোনও দিন কি কুটেছি? এসব গোপালীমাসিই করত না?’
‘তোমার বিয়ের আগে ও বাড়িতে কী ব্যবস্থা ছিল?’
‘বাড়তি তিরিশ টাকা দিলে কেটে দিত ঝি।’
‘তারপর?’
‘কুটতে তো বসলাম। মাছ পিছলে পিছলে যায়। দেড় ঘণ্টা ধরে কুটেই চলেছি। পিঠ টনটন করছে। হঠাৎ এঁদের এক আত্মীয় এলেন। বিয়েতে আসেননি তাঁরা। উনি, দীপের মা, আমায় বলছেন-যাও, বেনারসি পরো শিগগির। ভরদুপুর, হাতে মাছের গন্ধ, স্নান হয়নি, কিন্তু বেনারসি পরতেই হবে।’
‘পরলে?’
‘কী করব? পরলাম। ওই ঘরের ব্লাউজের ওপরেই। উনি অতিথিদের সামনে বলতে লাগলেন-‘ঝুমুরকে বলেছি, সারাক্ষণ সাজোগোজো, খুশি থাকো। এ বাড়িতে আর কাজ কী।’ ভেব দ্যাখ ধাপ্পাটা।’
‘স্বাভাবিক নয় বলছ?’
‘আরও আছে। যেই ওঁরা চলে গেলেন, উনি বলছেন ‘বেনারসি পরেই মাছ কুটতে বোসো না। সংসারে সঙ সাজতে হয়। শাড়িটা ভাল করে গুছিয়ে রেখে এসো! এই ক’টা মাছ কুটতে যে দিন পার করে দিলে। জয়ীদি বলেছিলেন মেয়ে সব পারে, সংসারে হেন কাজ নেই যে করে না! এখন বুঝি, বাড়িয়ে বলা স্বভাব! এ যেন বাংলার যাত্রাপালা! কিংবা আমি যেন একটা রোবট পুতুল! এই মাছ কুটতে বোসো! এই আমাকে এক গ্লাস জল দাও! গ্লাসে যেন মেছো গন্ধ না থাকে। এই বেনারসি পরো। এই হাসো। এই হেসো না। এই আটপৌরে বনে যাও। কী অদ্ভুত!’
‘খেলা বেশ জমে উঠেছে ঝুমু। তুমি যে এত কথা আমায় বলছ, যদি কেউ শুনে ফেলে।’
‘ওপরে আমি একা। শুনবে না। শুধু বাঁটুল আছে।’
‘সাবধান হও ঝুমু।’
‘চুপি চুপি কথা বলছি।’
‘শুধু শুধু ঝুঁকি নিয়ো না সোনা। আমাদের যে এই কথাটুকুই সম্বল। তুমি তো আসছও না।’
‘যেতে দেয় না। মিশতে দেয় না কারও সঙ্গে। পাড়ার কেউ এলে উনি পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এঁদের অনেক রহস্য টোপর। অনেক কিছু ঢাকাচাপা দেওয়া।’
‘সাবধানে থেকো ঝুমু। আমি চিন্তিত তোমাকে নিয়ে।’
‘আমারও তোকে নিয়ে ভারী ভাবনা হয় সোনা।’
‘পলাশকে নিয়ে নিলাম ঝুমু।’
‘নিলি মানে?’
‘তুমি বলেছিলে সারাক্ষণের একজন। ও রইল। আমার কাজের জন্যও সহায়ক দরকার। ওর বাড়ি তো এখানেই। সাড়ে আটটায় আসবে, থাকবে সারাদিন। বারো ঘণ্টা। বাবা ফিরে এলে ওর ছুটি। ওকে আমি শুরুতে দেব সাত হাজার টাকা।’
‘ও রাজি?’
‘খুব খুশি। ভেবে দেখো। ওর কোনও বাড়তি খরচ নেই। কাজও শিখতে পারবে।’
‘খুব ভাল করেছিস টোপর। একটা বড় চিন্তা গেল। সাবধানে থাকবি, হ্যাঁ?’
একদিন কল্যাণী ধরলেন।
‘কার সঙ্গে রোজ রোজ এতক্ষণ কথা বলো?’
‘বাড়িতে ফোন করি। ঝিরির সঙ্গে কথা হয়। টোপরের সঙ্গে।’
‘রোজই ফোন করো তোমার ভাইকে?’
‘হ্যাঁ।’
‘দিনে ক’বার?’
‘যখন মনে হয়। একা থাকে তো সারাদিন, চিন্তা হয়। এখন থেকে ওর জন্য একজন আসবে।’
‘তোমার ছোট?’
‘কে?’
‘ওই টোপর নামের প্রতিবন্ধী ছেলেটা?’
‘অনেক। চার বছরের।’
‘ঝিরির বয়সি? তা ভাল! মা-টা শুনলাম পালিয়ে গিয়েছে? বাবাঃ! অমন ছেলে জন্ম দেবার চেয়ে না দেওয়া ভাল ছিল। মায়ের কষ্ট একজন মা-ই বোঝে!’
‘ও কিন্তু নিজে সব পারে! কত জ্ঞান! কত মেধা! এই বয়সেই কত বড় চাকরি করে। আমরা তো এই তিনজন গায়ে গায়ে বড় হয়েছি। টোপর আমাদের বড়ই আপন। ওর জন্য আমাদের সব সময় চিন্তা!’
‘বিয়ে হয়ে গেলে এমন পিছু টানতে নেই। নতুন সংসারকে আপন করে নিতে হয়। এখন এ বাড়ির মানুষই তোমার সব। তোমার আত্মীয় বন্ধু। ওদেরটা ওদের বুঝে নিতে দাও।’
‘বাপের বাড়ির জন্য টান থাকবে না?’
‘থাকবে না কেন? তবে পাড়াতুতো ভাইয়ের প্রতি পিরিতটা বাড়াবাড়ি রকমের না?’
অপমানে ঝুমু-র চোখে জল এল। সৌজন্য, ভদ্রতা বড়ই ক্ষণস্থায়ী। কথা যেন বঁড়শি! ছুড়ে গলায় গেঁথে দাও। যেমন ‘পিরিত’ শব্দটা! উঠতে-বসতে-শুতে-খেতে মনে পড়ে। অস্তিত্ব জানান দেয়। সে খুব পাড়াবেড়ানি কখনও ছিল না। তবু এই বাড়িতে দমবন্ধ লাগে। এই দ্বিতল বাড়িতে দিন কাটে। কোথাও যায় না। কেউ দুটি গল্পও করে না। একদিন পাড়ার অপরাজিতা এলেন আলাপ করতে। ঝুমু তাঁর দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। পলক পড়ে না প্রায়। কী সুন্দরী! কল্যাণী ভ্রূ কুঁচকে টিভি দেখছেন। অসুস্থ শ্বশুর সারাক্ষণ থুম্ব হয়ে বসে আছেন। চোখে দৃষ্টি বেভুল। সারাক্ষণ কী যে চিবোন! একপাশ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ে। চিবুক থেকে ঝুলঝুল করে ফোঁটা। বুকের জামা ভিজে যায়। কেউ চেয়েও দেখে না। ঝুমু মুছে দেয় মাঝে মাঝে। শ্বশুর ঘোলা চোখে তাকান। ভাষাহীন!
অপরাজিতার আগমন কেউই গ্রাহ্য করলেন না। অপরাজিতাই সপ্রতিভ শুরু করলেন, ‘দীপের বিয়ের সময় ছিলাম না বউদি। তাই আসা হল না।’
‘বোসো। কোথায় গিয়েছিলে?’
‘দিল্লি। আমাদের মেয়েরা একটা নাটক করল।’
‘বেশ। ঝুমুর, এ পাড়ায় ওই কোণের তিনতলাটা এঁদের।’
‘বউদির যেমন কথা। বাড়ি চেনালে হবে? মানুষটাকে চেনাতে হবে না? শোনো মেয়ে, আমি অপরাজিতা, আমার একটি সংগঠন আছে। মেয়েদের জন্য। মেয়েরাই চালায়। অসহায় মেয়েদের আমরা নানাভাবে সাহায্য করি। এ পাড়ার অনেক মেয়ে, অনেক বউ আমার সঙ্গী। যে যা পারে, যেভাবে পারে, সংগঠনের পাশে দাঁড়ায়। তোমাকেও আমাদের দলে পেতে চাই। বউদিকে বলতে বলতে হার মেনে গিয়েছি। তোমাকে ছাড়ব না।’
ঝুমু-র ভাল লাগছিল। সে তো কিছু করতেই চায়। সাধারণ থেকে অসাধারণে উপনীত হওয়া কঠিন, কিন্তু সাধারণের ক্ষমতা, ক্ষয় না করে প্রয়োগ করা ভাল। সে অপরাজিতার কাজের বিবিধ বর্ণনা শুনে বলল, ‘আমার আগ্রহ হচ্ছে।’
‘হচ্ছে? তা হলে এ মাসের শেষে যে সভা হবে তাতে এসো। একটা ধারণা হবে। কাদের জন্য কাজ, কী কাজ। কারা আছে আমার সঙ্গে। আমি আবার আসব তোমার কাছে ঝুমুর।’
অপরাজিতা চলে যেতেই কল্যাণী বললেন, ‘একটা কথা কাউকে বলার আগে আমার অনুমতি নেওয়াটা ভদ্রতা। কিছুই শেখোনি দেখছি। শিখবেই বা কোত্থেকে। মা নেই।’
‘আমি কি ভুল কিছু বলেছি?’
‘ফট করে বলে বসলে আগ্রহ আছে। চেনো আগে, জানো, আমাকে জিজ্ঞেস করো।’
‘আমার আপনাকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল।’
‘ও এক ঢলানি মেয়ে। ষোলো বছর বয়সে ফিল্ম করতে নেমেছিল। দুটো-তিনটে ছবি করেছে। তারপর পাত্তা না পেয়ে থিয়েটারে নেমেছিল। ওখানেও সুবিধা করে উঠতে পারেনি। মুরুব্বি ধরে এনজিও করেছে। ওর সঙ্গে একদম যাবে না।’
ঝুমু তর্ক করল না। ভাবল, সে দাঁড়ের পাখি? শিকলি দিয়ে বেঁধে রাখবে? অবোধ কি সে? সারাক্ষণ তার আচরণীয় বিষয় প্রশ্নের মুখোমুখি হবে! নিজের বাড়িতে ঝুমুর আচরণে কোনও দখল ছিল না। দুটি সংসার সে চালিয়েছে। পদে পদে এত নিষেধ তার মন ক্ষুব্ধ করছিল। এ গৃহে তার ভূমিকা আসলে কী। যার হাত ধরে আসা, সে আজও কেমন দূরের। যদি এমনই হবে, বিয়ে করল কেন? তাদের প্রথম রাতের চিত্র পুনঃপুন রচিত হচ্ছে। সন্দীপন একদিনও বলেনি, নীচে শুয়ো না। আমি বরং বাঁটুলকেই নীচে শোয়াচ্ছি। এর অর্থ হল, সে যেমন চাইবে তেমনই হবে। ঝুমুরের কোনও স্থান নেই কোথাও। কে কার স্থান নির্ণয় করে? কী তার রীতি-নীতি? যে অপরাজিতা বিপন্ন মেয়েদের আশ্রয় দিতে চান, সমাজ কী চোখে তাঁকে দেখে? ষোলো বছর বয়সে একজন স্বপ্নের হাতছানি অনুসরণ করে পথে নেমেছিল। স্বপ্ন ছুঁতেও পারেনি, তাই আজও সে নিন্দনীয়। যদি আজ সে মহাতারকা হত, তার পদার্পণে ধন্য হত না কি এই গৃহ? মানুষের মর্যাদা কিছু লঘু শর্তাধীন।
এ প্রসঙ্গে সে আর কাউকে কিছু বলেনি। টোপর বা ঝিরিও জিজ্ঞেস করেনি। সে বোঝে, জানানো বা জানতে চাওয়ার নিরিখে বিষয়টি অতি ব্যক্তিগত। এ বাড়িতেও কেউ বলেনি-দীপ, তুই কেন কুকুর নিয়ে বউয়ের সঙ্গে ঘুমোতে যাস?
কিন্তু প্রশ্ন উঠল যখন শাশ্বতী এল আবার। সে এল এক বায়সবিলাসী ভোরে। যখন এমনকী ঘরের বউও জাগেনি। তবু দরজাঘণ্টা শুনে প্রথম জাগল বাঁটুল। সেও এমনকী বুঝে গেছে তার সংসারকৃত্যের প্রথম দাবি ঝুমু-র কাছে প্রকাশ করা উচিত। সে ঝুমু-র মুখের কাছে এসে বলল, ঘ্রাউ! ঝুমু চোখ মেলল। ঘণ্টি বাজল আবার। বাঁটুল বলল, উঁক উঁক!
ঝুমু উঠল। ম্যাক্সির ওপরেই শাড়ি জড়িয়ে নেমে এল নীচে। এই আধফোটা ভোরে নীচের তলা অন্ধকার। হঠাৎ তার মনে হতে লাগল, সে একা হয়ে গেছে, বাকি জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, কোনও সম্পর্ক ব্যতিরেকে সে একটি পৃথিবীতে পৃথিবীর কেউ নয়, তার মূল্য হারিয়েছে, তার আঙুলে জড়ানো নেই তার কোনও প্রীত্যর্থী আঙুল, এ অপূর্ব আঁধারে নিজেকে নিয়ে বিড়ম্বিত সে অদ্ভূত আবিষ্কার করল টোপরকে না দেখে সে আর এক মুহূর্ত পারছে না! টোপরের প্রতি এই অনিবার টান তার মধ্যে এক নতুনতর সত্তার জাগরণ ঘটিয়ে তুলল। সে যেন এক তৃষিত ক্যাকটাস। মরুচরাচরে শিকড় চাড়িয়ে দিচ্ছে বালুতলে জলের সন্ধানী। তার অস্তিত্ব কণ্টকময়, তবুও অতুলনীয় ফুলে ফুলে ভরে উঠতে সে-ও চায়। কার জন্য? কাকে দেবে ফুল, কাকে কাঁটা? তাকেই, তাকেই, সে তার ফুলের অধিকারী, সে-ই তার কাঁটার সম্রাট! আগেও কতবার, কতবার সে টোপরের টানে ওবাড়ি ছুটে গেছে, কিন্তু আজ এই মিশকালো ভোরের অন্তরতম আলো তার হৃদয় ভাসিয়ে দিতে লাগল শরতের দু’কূলপ্লাবী প্রেমবতী স্রোতস্বতী নদীটির মতো! এ তার অপার বিস্ময়! এ যেন তার ভেতরে অন্য এক ঝুমুর! অন্ধের মতো দরজার দিকে যেতে লাগল সে। যেন দরজা খুললেই সে টোপর দেখবে!
সে দরজা খুলল অল্প ফাঁক করে। আধো আলো আধো অন্ধকারে, ভোরের বেলায় পথবাতির পার্থিব অভিমানী আলোর তলায় শাশ্বতী। শাল মুড়ে চেয়ে আছে। ঝুমু তার চোখ দেখল। এই মুহূর্তে বড় আর্তি পেল সে। বড় কাতরতা।
‘লাল! এসো!’
‘তোমাকে বিরক্ত করলাম ঝুমু। জানতাম তুমিই আসবে।’
‘এসো লাল।’
‘আমি একটু ঘুমোতে চাই। কাল সারা রাত্রি ঘুমোইনি।’
‘এসো। তোমার ঘরে চলো। কালই গুছিয়েছি লাল। খাবে কিছু? খিদে পেয়েছে?’
‘পেয়েছে।’
‘তোমার ঘরে যাও। আমি আসছি।’
মুখেচোখে জল দিল ঝুমু। দাঁত মাজার সময় নেই। লাল নামের মেয়েটা ক্লিষ্ট। বিপন্ন। ক্ষুধাকাতর। দয়াবন্তী ঝুমু, বোকা-বোকা সরল-সরল সাধারণ-সাধারণ ঝুমু, পাকশালে গিয়ে চা বসাল। এই ভোরে কী খেতে ভাল লাগবে লালের? কেক গড়েছিল দু’দিন আগে। নিল দু’টুকরো। কলা সাজাল থালিতে। পেয়ালায় সোনালি চা। খুব গুছোন এদের সংসার। প্রাচুর্য আছে। কৃপণতাও নেই। বাড়ির আসবাবপত্র রুচিসম্পন্ন, দামি। আধুনিক যন্ত্রপাতির সবরকম সুবিধা আছে। সম্পর্ক যদি বলতে হয়, ঝুমুর সঙ্গে গড়ে উঠেছে এই আসবাবপত্রগুলির, এই যন্ত্রগুলির। সে এদের ঝাড়ে পোছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে, এরা প্রকম্পনে, মসৃণতায়, আবেশে ধরা দেয়। বলে, ভালবাসো। ঝুমু ভালবাসে। বিন্দু বিন্দু ময়লা তুলে ফেলে ফটোফ্রেম থেকে। টিপে টিপে মুছে নেয় পাকশালের ময়লা। তকমা জুটেছে তার, বউ কাজের, বউ শান্ত, বউ কথা কম বলে। তবে বড্ড ফোন করে বাপের বাড়িতে, আর বুদ্ধি কম। বোকা। সহজে বিশ্বাস করে ফেলে। কখন কী করতে হবে বোঝে না।
বোকা কেন? সেই যে সে অপরাজিতাকে বিশ্বাস করেছিল? কেন বোকা? নির্বিবাদী সেবিকাকে বোকা ছাড়া আর কিছু কি ভাবে মানুষ? যারা সেবা পায়, সেবা করিয়ে নেয়, হাতে পায়ে গেঁথে দেয় অদৃশ্য শেকল, তাদের প্রভুত্বপরায়ণতা তৃপ্ত হয়! কিন্তু যে পীড়নের সামগ্রী, তাকে বোকা ভেবে তারা বিস্মিতও হয় বুঝি!
ঝুমু খাবার নিয়ে এল।
শাশ্বতী নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। চোখ খোলা। হাতে পোড়া ছোপ। কালশিটে।
‘খেয়ে নাও লাল। হাত পুড়ল কী করে?’
‘আমার তো সবই পুড়েছে ঝুমু? জানো না?’
‘তুমি খাও লাল। আমি শাড়ি-টাড়ি ঠিকমতো পরে আসি। দাঁত মাজি। তারপর আসব।’
ঝুমু সকালের কর্তব্য সারছে। বাঁটুল ঘুরছে পিছু পিছু। শুঁকছে। আজকাল ঝুমু বাঁটুলের প্রতি একটু মায়া বোধ করে। জানোয়ারের গায়ে যে বুনো বোঁটকা গন্ধ, প্রথমদিন তার গা গুলিয়েছিল। দ্বিতীয়দিন,তৃতীয়দিন। কবে অভ্যস্ত হয়ে গেল সে। গন্ধে, ভূমিতলে, নিষ্কাম দাম্পত্য ব্যবস্থায়। সে এক সাধারণ মেয়ে, সে যে বেশিকিছু পারে না। সইতে পারে আদিগন্ত বেদনার ভার, আর মেনে নিতে পারে।
বাঁটুলের প্রতি তার মায়া আছে। ভালবাসা নেই। সে গা ঘাঁটতে পারে না। লোম বেছে রক্তশোষী পোকা তুলে আনতে পারে না। স্নান করাতে পারে না। বাঁটুলের দেহসেবার লোক আছে। করে যায়। সন্দীপন নিয়মিত তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে নিয়ে যায়। অন্য সমজাতীয় সারমেয় দ্বারা এই সারমেয়ীর যৌনতৃপ্তির ব্যবস্থাও আছে নির্দিষ্ট ঋতুকালে। এ বাড়িতে বাঁটুলের পরমাদর। প্রথমদিনই বলেছিল শাশ্বতী। অনাদর সে-ই বোঝে ভালরকম।
সে রান্নাঘরে গেল। চা বানাবে। নিজের। প্রতিবার বানাবে একেকজন উঠলেই। এ বাড়িতে কফির গন্ধ নেই। ভাগ্যিস নেই। টোপরকে ছাড়া ঝুমু কফি খেতে কোনও দিন পারবে না।
চা নিয়ে সে ফিরে এল। কলা ও কেক নিঃশেষিত। চা আধপেয়ালা পান করেছে। ঘুমিয়ে আছে লাল। চোখের কোণ থেকে জল পড়ছে। ঘুমের মধ্যেই। মুখখানা ম্লান। ঝুমুর বুক মুচড়ে উঠল। শাশ্বতী বলেছিল, ‘তোমার-আমার একই বছরে জন্ম। বউদি-টউদি বলব না।’
প্রায়ই ফোন করে শাশ্বতী। কল্যাণীর সঙ্গে কথা বিনিময় হয়। কখনও কখনও ঝুমুর সঙ্গে। বলে, ‘কেমন আছ ঝুমুর?’
‘ভাল আছি লাল। তুমি কেমন আছ?’
‘আমি ভাল থাকতে চাইছি। তুমি সত্যি ভাল আছ তো?’
‘ভাল থাকার চেষ্টা করছি। পেরেও যাচ্ছি। ভাল থাকা খুব কঠিন না।’
‘খুব কঠিন, ঝুমুর।’
‘কবে আসবে?’
‘যাব। ওবাড়িতে কেউ আমাকে চায় না।’
‘সে আবার কী! এ তো তোমারও বাড়ি।’
‘ক’দিন থাকো। তুমিও চাইবে না। আমি ফোন করলে ভ্রূ কুঁচকে যাবে তোমার। আমি গেলে মুখ অন্ধকার হয়ে যাবে। বেশিদিন থাকলেই বিরক্তি।’
‘ননদ-বউদির সম্পর্ক পৌরাণিক যুগ থেকে বৈরীতার। আমরা কী করে অন্যরকম হব?’
‘কী সুন্দর বললে ঝুমুর।’
‘এমন করে টোপর কথা বলে। ওর কথার ধরন আমাকে মাঝে মাঝে পেয়ে বসে। আমি বুঝি, ওর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছি।’
‘টোপরকে খুব ভালবাসো?’
‘তুমিও ভালবাসবে, যদি ওকে দেখো ক’দিন। ওর অসহায়তা, ওর সক্ষমতা। ওর যুদ্ধ, ওর জয়।’
‘আমাকে দেখাবে?’
‘নিশ্চয়ই।’
শাশ্বতী সুখে নেই। তার শ্বশুরবাড়িতে সমস্যা। কী সমস্যা? ঝুমু জানে না। এখন, এই মেয়েটির জন্য তার কষ্ট হচ্ছে। সে টোপরের সঙ্গে কথা বলতে চাইল। ভয় পেল। শাশুড়ির প্রশ্নাঘাত তাকে অন্তরে সংকুচিত করেছে। সে কি তবে লুকিয়ে কথা বলবে? না। সে কথা কম বলবে। কত কম? কেনই বা সে কল্যাণীকে ভয় পাবে? সে তো অন্যায় করছে না। সম্পর্কবিহীনতা কেন তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে? কল্যাণী কে তার? কিছু মন্ত্র, অগ্নিসাক্ষ্য, মাল্যবিনিময় মানেই কি সম্পর্ক? প্রাণে প্রাণ লাগল! তোমার মা আমার মা হয়ে গেল! তোমার যাবতীয় প্রিয়— কুঞ্জবন থেকে কুক্কুরী আমার প্রিয় হল। কিন্তু আমার টোপরকে আমি ফোন করতে পারব না। বধূ হিসেবে যাবতীয় কর্তব্য সে অস্বীকার তো করেনি। বিবাহের প্রস্তাব, দেনাপাওনা, মন্ত্র ও জনসাক্ষ্যে আত্মীয়তা বন্ধনের চুক্তিপত্রে কি স্বাক্ষর দু’তরফেই হয়নি? ওই মহিলা কি জানে, ঝুমুর অদ্যাবধি আসঙ্গবিবর্জিত কন্যকাকুমারী।
সে ফোন নিল। তার ছোট্ট মুঠোভাষ। ছাতে চলে গেল। কী এক ব্যাকুল হাওয়া আনাচে কানাচে। গ্রীষ্মের ছাঁট লাগা ধূসর আকাশ থেকে উড়ে উড়ে আসে এক উথালিপাথালি। তার শিরশির করে বুক তলপেট। তার ঠোঁট জিভ কার গোপন শলায় শোষণোন্মুখ। তার পাগলিনী হতে ইচ্ছা যায়। সে খুলে ফেলে চুল। মনে হয়-এই আকাশের নীচে, সব ভুলে, সে খুলে ফেলবে শাড়ি। ও হাওয়া, ও পাগল হাওয়া ও রোদ্দুর নরম-পরম প্রেমের স্পর্শে ঝুমুর কাহাকে জড়াবে, কোন দিকে হবে ধাবমান, কোন সে মানুষ-ঝুমু কার হাতে জন্মমৃত্যু চায়!
‘টোপর।’
‘বলো।’
‘মন ভাল নেই।’
‘না থাকারই কথা।’
‘কেন?’
‘সাতসকালে মনে পড়েছে আমাকে।’
‘মনে হচ্ছে ছুটে চলে যাই।’
‘এসো।’
‘পারি না কেন?’
‘একদিন পারবে।’
‘ও টোপর, তোকে দেখি না কতদিন।’
‘অন্তরে তাকাও। দেখো, আমি আছি। আমি তোমার অন্তরের হাতছানি। সেই আহ্বান অস্বীকার করে তুমি কতদূর যাবে?’
‘আমার ক্ষণে ক্ষণে কান্না পায় কেন? বাইরে ভাব দেখাই, যেন আমার কোনও কষ্ট নেই। কিন্তু আমার কোনও সুখ নেই টোপর। আমার কেন এত বিষাদ? কেন দুঃখ? কেন সারাক্ষণ তোকে ছাড়া আর কিছু ভাবতেও পারি না? তোকে ছেড়ে থাকা এত কঠিন হবে বুঝতেও পারিনি। টোপর, ও টোপর, তোকে গভীর করে ভাবলেই কান্না পায় কেন?’
‘কারণ আমি নিরন্তর কাঁদি। কেন তুমি চলে গেলে ঝুমু? আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখিনি।’
‘ও টোপর! এভাবে বলিস না। লাল এসেছে। ওকে দেখে কী যে কষ্ট!’
‘তোমার ভালবাসা দিয়ে ওকে ভরে দাও ঝুমু।’
‘ভোরবেলা এল। কীসে এল। কেন এল। ঘুমোচ্ছে এখন।’
ঝুমুর! কল্যাণী ডাকছেন। ঝুমুর! ছাতে কী করছ? এটা কি ছাতে যাবার সময়?
‘টোপর, রাখি এখন?’
‘রাখো।’
‘সাবধানে থাকবি।’
‘তুমি সাবধান হও। ঝুমু, ঝড় আসছে। তুমি কি ঘন কালো ধূলিময় মেঘ দেখতে পাচ্ছ?’
‘না না। আকাশ রোজকার মতো। ঝোড়ো হাওয়াই বা কই।’
‘ওগো বালিকা, যদি ঝড় ওঠে, আমি রইলাম। আর কোনও দিকে যেয়ো না তুমি। তোমার জন্য আমি মহীরূহ হয়ে যেতে পারি। তোমার জন্য আমি হয়ে যাব পর্বত-পাহাড়। আমার আত্মার থেকে বের করে সর্বকর্মা দৈত্যজিন-তোমার প্রাসাদ বানাব। কেউ তাকে ছুঁতেও পারবে না। তুমি নিরাপদে থেকো। আনন্দে আনন্দে আনন্দে থেকো সেই আশ্চর্য অট্টালিকায়। আমার বুকের মধ্যে ঝুমু।’
‘যাই রে টোপর। আমি যাই। উনি ডাকছেন।’
ছিক্ ছিক্ ছিক্! ওঁয়াও! নখের শব্দ তুলে বাঁটুল পৌঁছল। ঝুমুর গায়ে গায়ে। কল্যাণীও। শুনো হে বড়াঞি। শাশুড়ি আমাকে বড় চোখে চোখে রাখে। ছায়ায় ছায়ায় ফেরে অতিকায় নিরর্থ নিষেধ।
‘এই সকালে ছাতে কী করছ? ফোন?’
‘কথা বলছিলাম। আপনারা কেউ ওঠেননি। ভাবলাম ছাতে যাই। লাল এসেছে ভোরবেলায়।’
‘জানি। এই এক মেয়ে। আমার হাড় জ্বালিয়ে খেল।’
আজ কী বার? রবি। আজ প্রাতঃরাশ করে সন্দীপন চলে যাবে। কোথায়? সারাদিন কোন দেশে? ঝুমুর জানে না। তার জীবনে শনিবার-রবিবার নেই। সে লুচি ভাজে। আলুর তরকারি। ঝি বলে-বউদিমণি, দুপুরের কী মশলা? কোন মাছ? কী মাংস? ঝুমু অতীতের খাবার টেবিলগুলি থালায় ভরে দেয়।… ঝিরি লুচি, বাবা লুচি। টোপর, ও টোপর কী খাবি লুচি দিয়ে? আবার সাদা আলুর ছেঁচকি। খাব না। আমায় বেগুন ভেজে দাও। গোল গোল। ডিপ ফ্রাই। ও লো রাই, তোর পাগল কানাই বাঁশিতে বাঁশিতে ডাকে রাধা রাধা রাধা। তোর ও হৃদয়মন অর্ধ আছে এঘরে সংসারে, অর্ধ আছে কুঞ্জবনে বাঁধা।
‘লাল, তোমাকে লুচি দিই?’
‘চারটে খেলাম ঝুমু।’
কল্যাণী বলেন, ‘এভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি তোর লাল।’
সন্দীপন বলে ‘তোকে তোর সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
‘আমরা আর কতদিন দেখব?’
‘তখন তোকে বারণ করেছিলাম। আমাদের কথা শুনে চললে আজ এমন হত না।’
‘পাড়ার লোকে পর্যন্ত বলাবলি শুরু করেছে।’
শাশ্বতী বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে চোখ মুছল। ভারী গলায় বলল, ‘আমার দম আটকে আসে। তাই তোমাদের কাছে আসি। এই দেখো আমার হাত। কাল সারারাত বেঁধে রেখেছিল। খেতে দেয়নি। যখন আর থাকতে না পেরে বললাম, আনব, তখন ছাড়ল। আমার ছেলেটাকেও খারাপ করে দিচ্ছে মা। আমার সব শেষ হয়ে গেল।’
‘পঞ্চাশ হাজার! অসম্ভব! লাল, এভাবে চলতে পারে না।’
‘ছেলে নিয়ে তুই এখানে চলে আসবি, সেটাও হয় না। লোকে কী বলবে। ওদের বোঝাবার চেষ্টা কর।’
‘জানি না মা, কী বোঝাব, কীভাবে বোঝাব।’
এই প্রথম ঝুমুর সামনে আলোচনা। সে আন্দাজ করছে।
লাল নিজের পছন্দে অযোগ্য বিয়ে করেছিল। এখন তাকে নিষ্ঠুর পীড়ন করা হয়। চেনা কেচ্ছা। নিত্যকার কিসসা শ্বশুরাল কা! বাপের বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসো।
না।
মার।
টাকা নিয়ে এসো।
অনেক এনেছি। আর না।
পিটুনি।
নিয়ে এসো।
না।
খাওয়া বন্ধ। অত্যাচার।
টাকা নিয়ে এসো।
না।না।না।
পোড়াও, পোড়াও ওকে সস্তা কেরোসিনে। গলা টিপে মেরে ফেলো। বিষ আনো কিনে। পরিস্থিতি কি এতখানি ভয়ংকর? নাকি আরও বেশি! কানাই সামন্ত সরু গলির জীবন তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে!
দুপুরে খাওয়া সারা হলে ঝুমু-র কীই বা করার থাকে? টোপরের সঙ্গে অনন্ত কথোপকথনের দুপুর মনে পড়ে। হায়! মুখোমুখি কথার পরিবর্তে মুঠোভাষে মন যে তৃপ্ত নয়। সে যখন-তখনই যেত। সবসময়। কথা হত তাও নয়। একটু দেখে আসত। পড়ায় মগ্ন টোপর। ব্যায়ামরত টোপর। কম্পিউটার বিজড়িত টোপর। টোপরের থেকে প্রবীরকাকা। আহা প্রবীরকাকা! একমনে এডিনিয়ামের পাপড়ি থেকে মুছে দেন ধুলো। ফুলগুলি আঙুলে ছোঁয়ান যেন রুপুকাকিমার ঠোঁট ফুলগুলি। ওবাড়িতে এডিনিয়ামের প্রথম চারাটি তিনিই আনয়ন করেছিলেন। সেই বৃক্ষবীজ, সন্তানসন্ততি, আরও সব নানা রঙা আত্মীয়-স্বজনে ভরা ছাত। অতশত বোঝেনি তখন ঝুমু। এখানে এসে সে নতুনতর দৃষ্টিতে দেখে ফেলে আসা দিনগুলি।
ঝিরি! ঝিরি ঝিরি ঝাউপাতার মতো ঝিরি। তার প্রিয় বোন। হেঁটে হেঁটে পড়া করে। দুমদাম কথা বলে। স্বাধীনতা পাখি হয়ে উড়ে যেতে চায়। ফোন করে না বেশি। এস এম এস করে।
‘এভাবে কতদিন?’
‘জানি না।’
‘পুরাণের সতীসাবিত্রী হবি নাকি? পঞ্চসতীর পর ষষ্ঠসতী ঝুমুসতী।’
‘দেখি না কী হয়।’
‘বোকামো করিস না।’
‘কী করব?’
‘চেপে ধর। বল, এ সবের অর্থ কী? বিয়ে করে দূরে দূরে। করল কেন বিয়ে?’
‘আমি বলব, আপনি কেন দূরে? আমি যে আর পারি না! তার মানে বুঝিস?’
‘আমি বলব।’
‘তারপর? সে রোমান্টিক হয়ে যাবে? উতলা হোস না। সময় দেওয়া ভাল। তাড়া কী!’
‘বন্ধু হল?’
‘না। কথাই তো হয় না। তবে বাঁটুল আমার বশ হচ্ছে।’
‘তুই কি তবে বাকি জীবন কুকুর কুকুর খেলবি?’
কুকুর কুকুর খেলা! বেশ কথা! সে তো কুকুর কুকুরই খেলছে। ঝুমু এসো। এল। ঝুমু যাও। গেল। ঝুমু দাও। দিল। তার কি অপমান লাগে না, বিছানায় বাঁটুল, সে মেঝেতেই আঁটুল, সন্দীপন শামলা সাঁটুল একবারও অনুরোধ নাটুল!
ঝুমু কি চেয়েছে তাকে সাধাসাধি করুক ওই লোক কেননা সে কাজললতায় মাথা সিঁদুরে রাঙিয়ে এনেছে!
ধুত্তোর! ঝুমু সাধারণ মেয়ে, পতিধনের প্রেমপ্রার্থিনী বটে, ভিখারিণী হতে সে পারবে না।
তা হলে প্রেমকাঙালী কি বলা যায় তাকে? সম্পূর্ণ নিঃস্ব নিরহঙ্কার ভিক্ষাব্রতী না হলে কি প্রেম চাওয়া হয়? সে কি সন্দীপনের কাছে তেমনই আঁচলপাতা?
না। ঝুমু প্রস্তুত নয়। সে গতানুগতিক ধাপ পেরিয়েছে। নিজেকে প্রদর্শন করেছে প্রায় গণিকার মতো। পটল বা পাজামার মতো। বিবাহ করেছে উপবাস করে। নস্যাৎ করেছে এক পাগল অবুঝ প্রেম। সমস্ত সংস্কার মেনে সে শুদ্ধতার গৌরবে নারীত্বের অগৌরব অবমাননা ঢেকে এগৃহে এসেছে কেন? যৌনতার তৃপ্তিকারী সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার ছাড়পত্র আছে, তৃপ্তি নেই হায়! নয় নয় নয় তৃপ্তি, ঝুমুও প্রস্তুত নয়। কিন্তু মুখের আলাপটুকু শুরু হতে কি পারত না? কেউ কি বিশ্বাস করবে, বরকে সে আপনি সম্বোধন করে? লোকসমক্ষে এড়িয়ে যায় সম্বোধন, ঠিক যেমন টোপর এড়িয়ে যায় তাকে সরাসরি ঝুমু ডাকা! ওঃ টোপর! টোপর! আয়! ঝুমুরের চোখের ভিতর একবার তাকা। ঝুমুর দশদিশি এক মহাকাশ বিসারী টোপর দিয়ে ঢাকা!
ঝুমু পায়ে পায়ে এল শাশ্বতীর ঘরে। সে বসে আছে জানালার কাছে।
‘এসো, ঝুমুর।’
‘হাতে ছ্যাঁকা কেন লাল?’
‘ওরা দেয়। ও।’
‘ও বাবা! কেন দেয় লাল?’
‘দেখো, ওই যে ছোট্ট জমিটা দেখছ, ওটা আগে আরও বড় মাঠ ছিল। আমরা খেলতাম। আর ওই যে বড় উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি, ওখানে আমবাগান ছিল।
পুকুরও ছিল একটা। মাত্র পনেরো বছর আগেও পাড়াটা অন্যরকম ছিল ঝুমুর। পাড়া গাঁ মতো। আমরা ওই মুখুজ্জেবাড়িতে পাত পেড়ে সত্যনারায়ণের সিন্নি খেতে যেতাম। এখন কেউ কারও বাড়ি যায় না। আর ওই অপুদি, অপরাজিতা, ও ছিল আগুনের মতো।’
‘তোমার হাতটায় ওষুধ লাগানো দরকার।’
‘কী লাভ?’
‘এসো। লাগিয়ে দিই।’
‘তুমি বড় ভাল মেয়ে ঝুমুর। যত্ন কোরো না। আর যেতে চাইব না ওবাড়ি।’
‘ইচ্ছে না করলে যাবে না।’
‘এরা ঠেলে পাঠায়। আমি যে নিজে বিয়ে করেছি। তুমি আমার পদবি দেখোনি? প্রতিলোম বিবাহ আমার তরফে। বাড়িতে আপত্তি করেছিল। কত ভাল স্কুলে পড়তাম! কত আদর ছিল বাড়িতে! স্কুলের বাস নিতে আসত, আমাকে ব্যাগটুকুও বইতে দিত না বাবা। লোক ছিল। নিয়ে যেত। সেই আমি চোদ্দো বছর বয়সে পালিয়ে গেলাম। চোদ্দো! ভাবতে পারো?’
‘ও। তারপর?’
‘বয়ঃসন্ধি আমাকে অন্ধ করে টেনে নিল। লোকটা অনেক বড় ছিল বয়সে। আমাদের স্কুলগাড়ির ডোর হেল্পার। আমাকে দীঘা নিয়ে গিয়েছিল। বাবা ফিরিয়ে আনল। স্কুল আমাকে বহিষ্কার করল। লোকটারও চাকরি গেল। আমার ওই অল্প বয়সেই শরীরে বড় খিদে ছিল! সারাক্ষণ মাথায় ওইসব ঘুরত! বাড়ি ফিরে দু’দিনেই ওকে ভুলে গেলাম! কিন্তু শরীরের বোধগুলো জেগে রইল। লেখাপড়ায় মন নেই তবু খুব সাধারণ ওই স্থানীয় স্কুলটায় ভর্তি করল বাবা। আমি তখন উন্মাদ। ভূতগ্রস্ত। বছরখানেকের মধ্যেই কাল্টুর সঙ্গে প্রেম জমে উঠল আমার। লুকোতেও ভুলে গেলাম। কী বেপরোয়া! ওই মোড়ে দাঁড়িয়েই কথা বলতাম। মা মেরেছে পর্যন্ত। আমি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়েছিলাম ঝুমুর। অনেক করেও যখন আমাকে শোধরানো গেল না-দাদা আমাকে ঘরে আটকে রাখতে শুরু করল। তখন আমাদের দুটো গোল্ডেন রিট্রিভার কুকুর ছিল। ডোরা আর কুট্টুস। বাঁটুল হল ওদেরই ছানা। আচ্ছা, দাদা এখনও বাঁটুল নিয়ে শোয়?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার ভয় করে না?’
‘করেছিল। আমি জায়গা ছেড়ে দিয়েছি।’
‘মানে?’
‘বাঁটুল তার জায়গায় ঘুমোয়। আমি নীচে।’
‘কী যা তা বলছ?’
‘তোমার কথা বলো।’
‘এ আবার কী! মা জানে? ঝুমুর, সত্যি বলো তো, তোমার সঙ্গে দাদার ভাব হয়েছে?’
‘হবে, তাড়া কী। একই বাড়িতে, একই ঘরে আছি।’
‘এই ভয় আমি পেয়েছিলাম। মাকে বলেছিলাম। হে ভগবান!’
‘তুমি ঝিরির মতো বিচলিত হয়ে উঠলে লাল। শান্ত হও।’
‘এটা মেনে নেওয়া যায় না।’
‘তুমি যে এত বছর ধরে মার হজম করছ!’
‘সে আমার নিজের দোষে।’
‘দোষ নয়, বয়সের ভুল। সে ভুল শোধরানো যায় এখনও।’
‘আর যায় না গো। আমার ছেলে। ভুটকান। তাকে দেখোনি তুমি। আসতে দেয় না। সে আমাকে একটুও ভালবাসে না। কিন্তু আমি মা। তাকে ছাড়ি কী করে? ঘর কামড়ে পড়ে থাকি। ভুটকান না থাকলে হয়তো চলে যেতাম যেদিকে দু’চোখ যায়।’
‘টোপরের মা ওকে ফেলে চলে গিয়েছিল।’
‘পারল কী করে? ওরকম ছেলে! ভাবতেও পারি না।’
‘রুপু কাকিমা পেরেছে। সবাই কি একরকম হয়?’
‘সেজন্য তুমি টোপরকে এত ভালবাসো?’
‘ও আমাকে আঁকড়ে বড় হয়েছে। ছোট তো অনেক। আমাদের ঝিরির মতোই তো। ঝিরি তো ছটফটে। পাড়া দাপিয়ে বেড়াত। টোপর খেলতে পারত না বলে আমি ওর সঙ্গে থাকতাম।’
‘কী সুন্দর তোমাদের সম্পর্ক!’
‘টোপর আশ্চর্য ছেলে জানো। ওর কথা উঠলে আমি থামতে পারি না। এই বয়সেই ওর কী গভীর মন, কী বিস্তৃত ভাবনা!’
‘আমাকে টোপরের কাছে নিয়ে যাবে না?’
‘যাব। অনেকদিন ও বাড়ি যাইনি।’
‘মা বাপের বাড়ি যাওয়া পছন্দ করে না। আমি এলে রাগ করে। বিরক্ত হয়। তোমার সঙ্গে তো করবেই। আমি সব বুঝি। এবাড়িতে আমি বালাই মাত্র। ও বাড়িতে গোরুছাগলের মতো। তবু যখন আর পারি না, চলে আসি।’
‘তুমি এখানেই থাকো।’
‘থাকতে দেবে না। কাল্টু এসে হুজ্জোত করবে। পাড়ার লোকর কাছে মায়ের মান যাবে। কতবার এমন হয়েছে। কাল্টু জানে, ছেলে আমার দুর্বলতা।’
‘মারে কেন?’
‘অনেক কারণে। ওর সঙ্গেও আমি পালিয়েছিলাম। স্কুল থেকে পিকনিকে গিয়েছিলাম, আলাপ হল। কোলাঘাটে। অনেকটা সঞ্জয় দত্তর মতো দেখতে। ওরকম চুল। ওরকম হাসি। বাগবাজারে ওর বাবার মিষ্টির দোকান। ও নাকি বৈদ্যুতিক জিনিসপত্রর ব্যবসা করে। ভেবেছিলাম বিয়ে তো করি, বাড়িতে মেনে নেবে। এবারে কিন্তু বাবা আমাকে ফিরিয়ে নিতে এল না। মুখ নিচু করে আমিই এসেছি। কয়েক মাস কাল্টু ভালই ছিল। খুব সাধারণ বাড়িঘর। বাগবাজারে মিষ্টির দোকান শুনে যেমন মনে হয়, তা নয়। কাশী মিত্র ঘাটের কাছে একটা ছোট চায়ের দোকান। নিম্নবিত্ত। অসুবিধা হত। এই প্রাসাদের মতো বাড়ি থেকে আধবস্তির মলিন অন্ধকার ঘরে গিয়ে পড়লাম। তবু মানিয়ে নিয়েছিলাম। মাত্র ষোলো বছর বয়সে আমি গর্ভধারণ করলাম। ঠিক সে সময় প্রথম চাপ দেওয়া শুরু করল কাল্টু। বাপের বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসো। ব্যবসা করব। তোমার বিয়েতে তো খরচ হয়নি। সেই টাকা আমার প্রাপ্য। আপত্তি করলাম। শুরু হল মার। প্রথমে কাল্টু। তারপর মা ও কাল্টু। এখন মা, কাল্টু আর ভুটকুন।’
‘ভুটকুন তো ছোট।’
‘ওর শৈশব চলে গেছে। পাড়াটা তেমন ভাল নয়। তার ওপর বাড়ির প্রশ্রয়। কাল কী করল জানো? এই যাত্রায় পঞ্চাশ হাজার দাবি ওদের। রাজি হচ্ছিলাম না। লড়ে যাই যতক্ষণ পারি। ওরা মারে। খুন্তির ছ্যাঁকা দেয়। সহ্য করি। কাল আমাকে চেপে ধরল কাল্টু। ওর মা হাত বাঁধল খাটের পায়ার সঙ্গে। আমার বাবার টাকা নিয়ে নিয়ে কত কী করেছে! ভাঙা বাড়ি পাকা করেছে। কাল্টু বাইক কিনেছে। তবু লোভ যায় না। কাল্টু চড়-থাপ্পড় মারছে। আমিও চিৎকার করছি। আগে চুপচাপ সহ্য করতাম যাতে লোকে জানতে না পারে। লোক কিন্তু জেনেই গেল। তাই এখন আমি চ্যাঁচাই। তাতে লাভ হয়েছে গো। বেশিক্ষণ চালাতে পারে না। কাল আমায় মারছে মারছে মারছে। আমি চ্যাঁচাচ্ছি— পারব না, আনব না, শুনব না। মিছিলের লোকের মতো। মানছি না। মানব না। ভুটকুনকে ডাকল কাল্টু। বলল— পেচ্ছাপ কর। মা’র গায়ে পেচ্ছাপ কর।’
‘ঈশ্বর!’
‘করল ভুটকুন। আমারই সন্তান, আমাকেই তার পুরুষাঙ্গ তাক করে প্রস্রাব করল সারা গায়ে। ফুর্তিতে।’
‘কী করে সহ্য করো তুমি!’
‘আমি আমরণ সহ্য করব। আমার অপরাধ, পাপ নিঃশেষ করে যাব। পরের জন্মের জন্য একটুও রাখব না। সেই জন্মে আমি আবার নতুন করে লাল হব। ঝুমুর, কথা হল, তবু আমি রাজি হচ্ছিলাম না। আমার ছেলে, কতই তো হিসি করেছে গায়ে। তাতে কী! সারা রাত ওইরকম বেঁধে রাখল। জল দিল না। খেতে দিল না। তলপেট টাটিয়ে উঠল বেগে, বাথরুমে যেতে দিল না। আমি হার মানলাম। বললাম, ছেড়ে দাও। টাকা আনব। বাড়িটা আর সহ্য হচ্ছিল না। চলে এলাম।’
‘ওঃ! ঠাকুর!’
‘বাবা অনেক দিয়েছে। যতদিন ভাল ছিল। আর কত দেবে? কেন দেবে? আমি জানি আমি চেয়ে অন্যায় করছি। কিন্তু কী করব?’
‘তুমি চলে এসো। ওই টাকা দিয়ে মামলা করো। মুক্ত হও।’
‘কী লাভ? কী পাব? আর কি ফিরে পাব নতুন জীবন?’
‘নতুন জীবন নিশ্চয়ই পাবে।’
‘কেউ কি ভালবাসবে আমাকে? বিয়ে করবে? হয় না ঝুমুর। দশ বছরের বাচ্চার মা আমি। এগারো বছরের বিবাহিত জীবনে আমি বুড়িয়ে গিয়েছি। আর দম নেই।’
‘নতুন জীবন মানে কি বিয়েই শুধু? স্বামী? সংসার? ওই যে অপরাজিতাদি— যেসব মেয়ে উদ্ধার করে জীবনের দিশা ফেরাবার চেষ্টা করছেন-তাদের কী ভবিষ্যৎ? দশ-এগারো-বারো বয়স। এরই মধ্যে যৌননির্যাতনের শিকার। তবু তাদের জন্য পথ খোঁজা চলছে।’
‘অপুদির খুব বদনাম জানো তো।’
‘হতে পারে। কিন্তু ওঁর কাজটা বড়। তুমি সেই কাজে যুক্ত হয়ে যাও। এ বাড়িতে অর্থাভাব তো নেই। তুমি থাকবে, তাতে কী!’
‘আমি ঠিক এ বাড়ির নেই আর। নীচে নেমে গেছি। ওরা যখন মারে আমাকে, আমি চ্যাঁচাই, কীরকম অচেনা লাগে। আমি কি সেই লাল? সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়তাম। কাজের লোক আমার ব্যাগ বয়ে দিত। নিউ মার্কেট, বরদান মার্কেট, শ্রীরাম আর্কেড থেকে যার জন্য উপহার আনত বাবা! যার জন্মদিনে পঁচিশজন বন্ধু পেত বেশ দামি প্রত্যুপহার। আদরের লাডলা থেকে এখন আমি ভিখিরি হয়ে গিয়েছি। হাতিবাগানের ফুটপাথ থেকে খুঁটে খুঁটে বাজার করি। সেলাই করে ব্রা পরি। আমি ফোন করলেই আমার মা ভয়ে ভয়ে থাকে, এই বুঝি টাকা চাইব। আমি মরে গেছি ঝুমুর। আমার আর ফেরা হবে না। কতদিন পর আজ তোমার কাছে প্রাণ খুলে কথা বললাম। আজকাল এবাড়িতে আমার কথা শুনতেও কেউ প্রস্তুত নয়। বাবা অর্ধচেতন। মা চিরকালই খুব শক্ত। এখন আমার ব্যাপারে মা প্রায় নির্মম। কী করবে। আমার কথা ছাড়ো। আমার এখন ভাবনা বাড়ল তোমায় নিয়ে। তোমার কী হবে?’
রাতে খাবার টেবিলে ভাতে আঙুলের নড়াচড়া করে যাচ্ছে লাল।
‘দাদা, কিছু দিতে পারবি? না নিয়ে গেলে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।’
‘আমি কোথা থেকে দেব। পঞ্চাশ হাজার কি দশ টাকার মতো?’
ঝুমু বলে বসল, ‘কী অমানুষিক অত্যাচার করে! ওদের নামে থানায় ডায়েরি করা উচিত। লালকে লালের ছেলে সমেত এ বাড়িতে নিয়ে আসুন। তারপর পুলিশে যান।’
‘তোমাকে এখনও এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার দেওয়া হয়নি। ঝুমুর। নিজের সীমা লঙ্ঘন কোরো না।’
ঝুমু কেঁদে ফেলল। এবং, এই কান্না পাওয়া তাকে নিজের সম্পর্কে বিস্ময়াহত করে দিল। তা হলে কি সে মেনে নিচ্ছে সে এবাড়ির কেউ? ভালবাসাহীন সম্পর্ক সে নিজেই সম্পর্ক বলে মানে না। সে সামাজিক সম্মান রক্ষা করছে মাত্র। সময়ের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছে জীবনের রূপরেখা লাভের আশায়। তা হলে সে এমন বলল কেন? লালের প্রতি কি কোনও টান জন্মাচ্ছে তার? যা ন্যায্য সে তাই বলেছে। এরা কি মানুষ? টাকা দিচ্ছে। তাই রাগ। আবার মেয়েকে ওই নরকে পাঠাচ্ছে। হতে পারে শাশ্বতী ভুল করেছিল, ফিরে এলে লোক দু’চার কথা বলবে। কী এসে যায়!
কল্যাণীর স্বর কঠোর ও নিষ্প্রাণ। বললেন, ‘ঘটে বুদ্ধি থাকলে বুঝতে পুলিশ ডাকলে লোক হাসানোই হবে। মেয়ে আমাদের মুখে চুনকালি কম দেয়নি। আর মাখতে পারবে না কেউ। যেমন কর্ম তেমনি ফল। বাদুড়ে ফল খেয়ে গেলে সেই ফল নষ্ট ধরা হয়। ওর জন্য কে অত হ্যাপা পোয়াবে! ঘরে হাজার পনেরো টাকা আছে, দিয়ে দিচ্ছি, আপাতত এই নিয়ে যা। আমাদের কি টাকার গাছ আছে?’
‘আর দশ হাজার দাও মা। অন্তত অর্ধেক না নিলে আবার মারবে।’
‘লাল, মা তোকে পনেরো দিচ্ছে, চুপচাপ নিয়ে চলে যা। কাল্টুকে বলবি, আর চাপ দিয়ে টাকা নিতে পারবে না। যা হয় হোক, এস্পার ওস্পার। এবার একটা বোঝাপড়ায় আয়।’
‘দাদা, বিশ্বাস কর, মানে না।’
‘এখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাস ব্যাপার না। সব কিছুর একটা শেষ আছে।’
‘আমার কি ভাল লাগে এই ভিখিরিপনা? তোদের না বললে আর কাকে বলব।’
‘এসব অভিযোগ আমার ভাল লাগে না। কাল্টু যখন মারে, হাতটা ধরে ভেঙে দিতে পারিস না? রান্না তো করিস। গরম খুন্তির পাল্টা ছ্যাঁকা দিতে পারিস না শাশুড়িকে? অতই ন্যাকাবোকা তুই? তোর লোভ কিছু কম নয়। তোর সায় না থাকলে কাল্টুর এত সাহস হয় কী করে?’
মাথা ঝুঁকে প্রায় ভাতলগ্ন লালের। পিঠ কাঁপছে। চোখের জলের স্রোতে ডিঙি বেয়ে যায় বিষাক্ত কঠিন পিঁপড়েরা। ঘরে ঘরে বিষ পিঁপড়ের ঘন ডেরা।
গভীর রাত্তিরে, যখন জগতের শয্যা প্রস্তুত, এমনকী ঝুমুরেরও ভূমিশয্যা, ছাতের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। বাঁটুল চেঁচিয়ে উঠল। ঘ্রাউ, ঘ্রোক। সে বিশেষ ডাকে না। অল্প ডাকলে বর্ষার নবোদিত মেঘডাকের মতো শোনায়। তার কন্ঠের মেঘশ্রী সুউচ্চ প্রপাতের গরজন মনে হয় যদি ক্ষেপে ওঠে। দুঃখে বা আহ্লাদে কাতর উঁ উঁ রব। তখন সে কুক্কুরী থেকে উন্নততর এক মানবী প্রাণীতে পরিণত হয়।
সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে ছাতে যাচ্ছে শাশ্বতী। ঝুমু-র ইচ্ছে হল সে-ও যায়। বার বার যেতে চায় আকাশের তলে। কে জানে বারতা কী আনে ঝিরি বায়ু। নিজেরেই খুঁজিতে খুঁজিতে ছাতে সে কাহারে পায়। আকাশ মিশিয়া যায় ছাতের শরীরে। তারা জ্বলে তারা নেভে, কে জানে কখন মন ধায় কোন এক গহন সন্ধানে। কে আছে, কে আছে, কে আছে সেখানে!
‘লাল।’
‘বলো ঝুমুর।’
‘ছাতে একলা কী করছ?’
‘কিছু না। ভাবছি ভুটকুনটা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ল কিনা।’
‘আমি আজ ঘুমোতে পারব না লাল।’
‘কেন?’
‘তোমার জীবন আমাকে উদ্বিগ্ন করেছে। আতঙ্কে আছি আমি। যদি আবার তোমাকে মারে!’
‘মার খেলে আমার আর কিছু হয় না ঝুমুর। সয়ে গেছে। কষ্ট হয়, নিজেরই মায়ের কাছে, নিজেরই অধিকার খুইয়ে এই গ্লানির জীবন। আমার তো চাহিদা কিছু নেই গো ঝুমুর। একটা ভুলের জীবন টেনে টেনে পারি না যে আর। একটু শান্তি চাই। বড় ক্লান্ত আমি।’
‘জোর আনো লাল। থেকে যাও। এ বাড়িতে তোমার অধিকার কিছু কম নয়।’
‘আর দশ হাজার টাকাও যদি পেতাম, ওরা কিছুদিন ভাল থাকত।’
‘কতদিন?’
‘জানি না। ছ’মাস। আট মাস।’
‘তখন সব কিছু স্বাভাবিক?’
‘আমার স্বাভাবিকতার অর্থ মারধোর গালিগালাজ সব নিয়ে।’
‘কাল্টু কী করেন?’
‘আমার শ্বশুরের টিমটিমে মিষ্টির দোকান ছিল। চায়ের দোকানই আসলে। তুলে দিয়ে এস টি ডি বুথে, জেরক্স, ফ্যাক্স। সঙ্গে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। আসলে বিদ্যুৎ মিস্ত্রি। কাজ জানে। লোকে ডাকে। ও যায়। বাইক চেপে। ওর রূপ আমাকে শেষ করেছে, ওকেও। অমন নায়কোচিত রূপ নিয়ে ও কিছুতেই নিচুতলার জীবনে ও জীবিকায় অভ্যস্ত হতে পারল না। একটা টিউব লাইট লাগিয়ে, পাখা সারিয়ে, ও বড় জোর ত্রিশ টাকা পায়। ওর এক দিনের তেল। এ বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে নিয়ে এখন ছোটখাটো আলোকসজ্জার কাজ ধরে। যদি ও চায়, ভালভাবে বাঁচতে পারি। সামান্য সম্বল করে ভালবেসে ভালভাবে বাঁচা যায়। দেখি তো, বিত্তের লোভ, বৈভবের মিথ্যা প্রদর্শনের আত্মবঞ্চনা ওকে মানুষ রাখেনি।’
‘দশ হাজার টাকা আরও পেলে তুমি ছ’ মাসের ভাল থাকা কিনে ফেলতে পারো? তারপর?’
‘জানি না ঝুমুর। আমার কোনও তারপর নেই।’
‘আমি আসছি।’
ঝুমু নিয়ে এল মুঠোভাষ।
‘টোপর।’
‘বলো ঝুমু।’
‘তোর টাকা আছে?’
‘আছে।’
‘আমার দশ হাজার টাকা লাগবে।’
‘নিয়ে যাও।’
‘কেন লাগবে, বলি?’
‘বলা জরুরি নয়। তবে তোমার যদি ইচ্ছে করে বলবে নিশ্চয়ই।’
‘তোর সব ঠিক আছে তো বাবু?’
‘না।’
‘কেন রে সোনা?’
‘সন্ধ্যাবেলা চোখ বন্ধ করে বসে ছিলাম। মনে হল, তুমি কাঁদছ। তুমি ভাল নেই।’
‘এমন করে না সোনা। আমি ভাল আছি।’
‘না ঝুমু। আমি টের পাই। কী করে পাই, জানি না। বোধহয় কোনও মহাজাগতিক সংকেত কাজ করে। তোমাকে বাদ দিয়ে তো আমি নিজেকে ভাবিনি। তুমি আমার জীবনের অংশ হয়ে গেছ। জানো কি, আমার উপার্জনের প্রথম অপরূপ টাকাকড়ি আমি ছুঁইনি এখনও। তোমার আঁচলে দেব। কথা ছিল।’
‘না টোপর, পাগলামি করে না। মন ভাল রাখ। আমার সোনা না তুই?’
‘সন্ধ্যা থেকে একবারও ফোন করোনি কেন?’
‘হল না। বুঝিস না? কত কাজ। লাল আছে। আসে না তো বেশি।’
‘হুঁ। টাকা ওর জন্যই তোমার প্রয়োজন ঝুমু।’
‘হ্যাঁ টোপর।’
‘জানি তো আমি তোমায়। তোমার মধ্যে যে এক বনদেবী বসে আছে। ফুলের গয়না পরা। তার কোনও বৈষয়িক চাহিদা নেই। সে শুধু ভালবাসে। প্রাণ দিয়ে মন দিয়ে ভালবাস। ভালবাসা পেল কিনা তাও ভাবে না।’
‘ও পাগল…! এবার রাখি?’
‘ঝুমু, তোমার ফোন না এলে মনে হয় আমি পাতালের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি। স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল। পিচ্ছিল পথে আমি দ্রুত নেমে যাচ্ছি কোন অতল জগতে।’
‘এ রকম করে না। আমার সংসার আছে না?’
‘সেটা তো আমারও সংসার গো ঝুমু। তুমি কি জানো, যখন রান্না করো, আমি তোমার করতলে খুন্তি চেপে ধরি, আমি তোমার ফুসফুস ঢেকে দিই আমার দু’হাতে যাতে তেল, কালি, ধুলো না ঢুকতে পায়, তোমার গোপন বিজন অশ্রু, তোমার প্রকাশিত লজ্জিত আঁখিবারিধারা আমি হোমিওপ্যাথির শিশিতে লুকিয়ে রাখছি এক সুবিশাল দারুমঞ্জুষায়। তোমার বর কি তোমাকে চুম্বন করেছে? আমি জানি, করেনি, এখনও করেনি। তুমি জেনো, আমি তার দুই ঠোঁটে বিছিয়ে থাকব স্বয়ং চুম্বন।’
অন্ধকার কোণে ঝুমুরের হাত চেপে ধরল শাশ্বতী ননদিনী।
‘এ তুমি কী করলে?’
‘অন্তত ছ’মাস ভাল থাকো।’
‘তারপর? কতবার ঝুমুর? কেন? টোপর তো আমার কেউ নয়।’
‘আমি কি তোমার কেউ?’
‘আমার বান্ধব হও ঝুমুর। বড় একা আমি। কেউ নেই যাকে আঁকড়ে হৃদয় ভোলাব। আজ তুমি কত ভালবেসে নরম পাপড়ি দিয়ে ঢেকে দিলে ক্ষত, দাদা কি জানবে? বুঝবে তোমাকে কোনও দিন? ঝুমুর, তোমার ঋণ আমি কীভাবে শুধব?’
‘রইল ঋণ। সুদে বাড়ুক না। বুঝে নেব একদিন।’
‘কিন্তু এর মধ্যে টোপর যে এসে পড়ল। না না। ঝুমুর। যা হয় হবে। ও টাকা দিয়ো না আমায়। চেয়ে চেয়ে আমি নষ্ট হয়ে গেছি। লোভ বাড়িয়ে দিয়ো না। আমি যখন অসহায় বোধ করি, আমার কাণ্ডজ্ঞান চলে যায়। না হলে পোকামাকড়ের মতো আসি এভাবে? বাঁটুলের আত্মমর্যাদাবোধ আমার চেয়ে বেশি।’
‘আমি তোমাকে এভাবে থাকতে দেব না। কিছু একটা করব। টোপরকে বলব। ওর খুব বুদ্ধি। ও ঠিক পথ বলে দেবে। তোমার আপত্তি নেই তো? আমি একটু সময় শুধু চাই।’
‘আমার পথ বন্ধ। কেন মিছে মৃতকে জীবিত ভেবে বিছানা সাজাবে? কেন এক লোভী, বোকা, পালছেঁড়া, হালভাঙা মেয়ে তোমার করুণা পাবে বৃথা পরিশ্রমে!’
‘তুমি আজ কতদিন পর হৃদয় খুলেছে বলো। তার দাম নেই?’
‘দশ হাজার টাকা! টোপর চাইলেই দিয়ে দেয়!’
‘আগে তো চাইনি। এই প্রথম।’
‘ও তোমার কী ঝুমুর?’
‘আমার বড় প্রিয় ও। ওকে বড় ভালবাসি।’
‘আর ও?’
‘ও? ভালবাসে।’
‘খুব ভালবাসে। তুমি বোঝো না। মানুষ বিনা প্রশ্নে অনায়াসে টাকা দিয়ে দেয় দু’ কারণে।’
‘কী কী?’
‘বদ মতলবে, যাকে খাবে বলে জিভ চাটে আর বিপরীতে যাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে।’
‘কাল কি যেতেই হবে?’
‘না। থেকে যাব। আরও একটু ভিক্ষা ভিক্ষা খেলা হবে। যদি দিয়ে দেয় দশ হাজার! কেন?’
‘একবার ওবাড়ি যেতাম। তুমি সঙ্গে গেলে উনি, মানে তোমার মা রাজি হলেও হতে পারেন।’
‘যাব। দেখব টোপর। এক আশ্চর্য ছেলে।’
ঝুমু ভারী স্ফুর্তিতে টইটম্বুর হঠাৎ। অনেক অনেকদিন পর। সে যাবে। কাল যাবে। তার বুকের ভিতর থরো থরো আনন্দলহর। বাবা নয়, কাকা নয়, ঝিরি, নমি, গোপালীমাসি নয়, তার মন জুড়ে শতরূপ, আনাচে কানাচে শতরূপ ভূমিতে আচ্ছাদে শতরূপ শতরূপ টোপর টোপর! সে ঘরে ফিরে এল।
খ্যাস্ খ্যাস্ সুঁক্ সুঁক্ ওঁয়াও মু উ উ উ! দেহলোমে বহুক্ষণ বিলি পেয়ে বাঁটুল তৃপ্তিতে উতরোল।
‘ইয়ে…খক্ খক্, খুক্…হুখুর হুঁখর…’
কাশি, গলা ঝাড়া, দ্বিধাবিজড়িত। সন্দীপন বলে উঠল, ‘আমি তো মেঝেতে শুতে বলিনি। ওটা তোমার সিদ্ধান্ত।’
‘লালের বিছানায় শুতে পারি। ঘর তো ফাঁকাই থাকে। লালের অনুমতি নিয়ে নেব।’
‘লালের সঙ্গে বেশি মেশামিশি না করাই ভাল। মাতাজি বলেছেন, ওর মধ্যে অশুভ শক্তির আধিক্য। ও এলে এবাড়িতে নেগেটিভ এনার্জি বেড়ে যায়। ওর জন্য বাবার এই দশা।’
‘ও খুব করুণ অবস্থায় আছে। আমি আর কী বলব, আপনারা অনেক বেশি জানেন। আমাদের কানাই সামন্ত সরু গলিতে কোনও মেয়ের ওপর মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার হলে বাকিরা কোমর বেঁধে তার প্রতিকারে লেগে পড়ে। সকালে গলা খুলে ঝগড়া, বিকেলে প্রয়োজন পড়লে একে অপরের সহায়। আমি ওদেরই কাছে শিখেছি।’
‘লাল নিকৃষ্ট জীবন বেছে নিয়েছে। আমরা ওর জন্য যথেষ্ট করেছি। ও তোমার সঙ্গে বন্ধু পাতাচ্ছে, এবার তোমার গহনায় টান দেবে।’
‘ছি ছি! না! এভাবে বলবেন না! আপনার বোন!’
‘বড় মাসির ছেলের বিয়েতে বেশ কিছু গয়না চুরি গিয়েছে। সবাই জানে এটা লালের কাজ।’
‘ধরা পড়েছিল?’
‘না। তবে ওই ঘর ছেড়ে যেন নড়ছিলই না। তুমি এখন এ বাড়ির। তোমাকে বলা দরকার। মা বলছিল, তোমার গয়না সব মায়ের লকারে রাখার জন্য। তুমি চাইলে আমি আলাদা লকার করে দেব।’
‘কীভাবে প্রমাণ হল ওটা লালেরই কাজ?’
‘লাল সেসময় টাকা চাইছিল। আমরা দিইনি। ও তখন সুনন্দ মামার কাছে চায়।’
‘তিনি কি দিয়েছিলেন?’
‘না। দেবে কেন? কেউ দেয়? আমরা নিরুপায় হয়ে দিই। মাতাজির আদেশ, বাংলা নববর্ষ এলে ভাল তিথি দেখে কাশীতে আমাদের নামে যজ্ঞ চড়াবেন। তারপর আর ওকে টাকা দেওয়া যাবে না।’
‘ওকে এ বাড়িতে নিয়ে আসাও যাবে না?’
‘ওর সংশ্রব ত্যাগ করতে হবে।’
‘লাল কি তা জানে?’
‘যজ্ঞের পবিত্র ভস্ম না আনা পর্যন্ত নয়।’
ঝুমু বালিশ নিচ্ছে, চাদর, আজকাল কম্বল লাগছে না।
‘ইয়ে, মা খুব রাগারাগি করেছে। তুমি নীচে শোও। আজ থেকে বাঁটুলই নীচে শোবে। বিছানাটা পাতো। এপাশে পাতো। আমার এদিকে। যাতে হাত বাড়ালেই ওকে পাই। তোমার ওই বিছানাতেই ও শুয়ে পড়ুক।’
‘আমি কিন্তু ভালই শুচ্ছিলাম।’
‘মা জানল কেন তবে?’
‘কথায় কথায় লাল জেনেছে। ও বলে থাকবে।’
‘সে যাই হোক। বাঁটুলকে বুঝিয়ে বলেছি। ও তোমার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি।’
ঝুমু নিজের শয্যাখানি বাঁটুলের জন্য পাতছে পরিপাটি। তফাতই বা কী! সন্দীপনের চোখে অন্তত পার্থক্য কিছু নেই।
সে বিছানার এক পাশে শুয়ে পড়ল। বিবাহের পরবর্তী মাসাধিককালে এই প্রথম প্রলম্বিত সংলাপ। ঝুমু-র ক্লান্ত লাগছিল। সে চোখ বন্ধ করল। ভাবছে। সে যদি এই শাশ্বতীর দশায় পড়ে, কী করবে ঝিরি? কিংবা ঝিরি পড়ল এমন অবস্থায়। সে কি ঝিরিকে দেখে গয়না লুকোবে? আলমারির চাবি সামলাবে? গণনা করাবে কোনও ভাসমান সন্ন্যাসিনীর বিদু্ৎক্ষমতা দ্বারা? মহাযজ্ঞ কাশীতে, হরদ্বারে? জগৎ কি এমনই নির্মম? তার বাবাও কি বলেনি কুকুরের সঙ্গে শয়ন মানিয়ে নেওয়া চাই। খরচা করে মেয়ের বিয়ে দিলে মেয়েরা সমস্ত দাবি ও অধিকার যজ্ঞের আগুনে খইয়ের উৎসর্গের মতো পুড়িয়ে দিয়ে আসে। এ যেন নির্মম অগস্ত্যযাত্রা! নগদ অর্থ ও অর্থহীন সম্মানবোধের নিগড়ে পড়ে এক লটারির জীবন। যে মেয়ে নিজে বর বাছে, তার সকলই বরবাদ। তার স্বেচ্ছাসিদ্ধান্ত ঘৃণা করা হয়।
চকাস চুকুম পুশ ফুচ উঁ অ্যাঁও চুমু চলছে বাঁটুলে-সন্দীপনে। ঘরে সারাক্ষণই বাঁটুলি গন্ধ। যখন তখন যেখানে সেখানে বাঁটুলের লোম। সাধারণ মেয়ে ঝুমু, অতি সাধারণ, শ্বশুরঘরে শয্যা পেলে, মানিয়ে নাও, নাও। তোমার একটি বিয়ে, তোমার পরম লোভন। মানিয়ে নিতে না পারলে জাহান্নামে যাও।
সে মানিয়ে নেবে বলে পাশ ফিরল। ঝিরিটা কী করছে? আজ এস এম এস একটাই। ‘দাবাখেলা যথারীতি চলছে। গোপালীমাসি পরোটা ভেজেছিল। শক্ত। তোর একটা ছবি ল্যামিনেট করা। টোপরের ঘরে। বেশ ভাল ছবি। হি লাভস ইউ সো মাচ্। মি টুউ। মিস ইউ দি।’
হি লাভস ইউ। লাভস ইউ। লাভস ইউ। ইউ। ইউ। ইউ?
ইউ?
বুকের তলে শিরশির করে। কী এক কষ্টের মতো সুখ। কী এক অপার্থিব আনন্দ। টোপরকে ছেড়ে এসে ঝুমু বশ্যতা স্বীকার করা লাজুক মেয়েটি। টোপর পাগল। ছবি রাখল কেন? পাগল! পাগল একেবারে! ঝুমু বড়। ঝুমু অনেক অনেক বড় বয়সে।
গভীর আবেশ নিয়ে নিদ্রা গেল ঝুমু। আলো নিভে গেছে। রাস্তার অ-বাঁটুল কুকুরেরা জেগে আছে। আর আকাশের তারা। ছাতের ওপর টুপটাপ ঝরে পড়ে তারাদের ধুলো। কার ক্ষতমুখে কে যেন চেপে ধরে প্রেমময় তুলো। কোন দেশে কোন এক আকুল প্রেয়সী মদ্যপ প্রেমিককে লেখে চিঠি। শোণিতে অশ্রুতে লেখে— মদ নয়। আমাকেই পান করো চুমুকে চুমুকে। আমি সুরাময়ী হব। আমি তোমার অতল হাতে ধীরে অতি ধীরে নিঃশেষে হয়ে যাব সুরা থেকে সুর। এসো, পান করো বিভব আমার।
কিন্তু কবিতা ও সুরা ছাড়া আরও কত হাত। ঘন ও কঠিন। চ্যাটচেটে। কাঁপা কাঁপা! স্বেদসিক্ত।
হাতখানি ঘোরে ফেরে। পাছায়। কোমরে। বুকে পেটে।
কে?
ঝুমু ছুড়ে ফেলে দিল। কী করছেন?
সন্দীপন ঘন ঊরু দিয়ে চেপে ধরল ঊরু। তার গরম নিশ্বাসে পুড়ছে ঝুমুরের মুখ। কামড়ে ধরছে গাল, কান, গলা। এক হাত বুকে। অন্য হাত গভীর অসুখে টানাটানি করছে পোশাক। এক জানু যোনিতে আঘাত করছে নির্মমতায়।
ছাড়ুন! ছাড়ুন! কী করছেন।
হাঁপাচ্ছে। পুরুষটা হাঁপাচ্ছে। গায়ে কী জোর। ঝুমু পারছে না। পেরে উঠছে না।
দেখুন। আমি তৈরি নই। আমাকে সময় দিতে হবে। আঃ! লাগছে! উঃ! বাবা গো! না! প্লিজ না। আজ না। আমাদের কথাই হয়নি ভাল করে। না। না।
চোপ! এসব আমার অধিকারের জিনিস। চোপ! আরে!
ঘ্রাউ! ঘ্রাউ! ভুক! গ র র র! রাগী গলা বাঁটুলের।
বাঁটুল, একটাও শব্দ নয়। চুপ।
ঘ্রাউ! ঘ্রাউ! ঘ্রাউ! ঘ্রাউ!
এভাবে না। প্লিজ। ছাড়ুন। বাঁটুলের সামনে না।
ঘ্রাউ! ঘ্রাউ! গরররর! ওঁও ওঁও! ঘ্রাউ!
বাঁটুল! যাও! যাও! যাও!
ঘ্রাও ঘ্রাও ঘ্রাও!
তবে রে!
লাফিয়ে উঠল সন্দীপন। দ্রুত হাতে পাজামায় দড়ি আঁটল। এক লম্ফে শেকল পরালো বাঁটুলকে। বেঁধে দিল খাটের পায়ায়। দেরাজ টেনে বার করল চাবুক। শপাং শপাং সাঁই সাঁই সাঁই। শপাং শপাং….
বাঁটুল কাঁদছে উঁ উঁ মু মু উঁক উ উ উ উ উ উ…
ঝুমু-র হৃৎকম্প হচ্ছে। সারা দেহে কাঁপন ছড়িয়ে গেল। এইভাবে মারে কেউ! দেখো, গুটিয়ে যাচ্ছে প্রাণীটা। লুকোতে চাইছে। পিঠ বেঁকে গেল। বাবা গো! আদরের কাউকে এভাবে মারা যায়!
কী করছেন! বন্ধ করুন! মারবেন না মারবেন না মারবেন না!
কল্যাণী উঠে এসেছেন। শাশ্বতীও। কী হচ্ছে! ঘরে কী হচ্ছে!
ঝুমু বেশবাস ঠিক করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। সন্দীপন দরজা খুলল। টেনে হচড়ে নিয়ে যাচ্ছে বাঁটুলকে। ছাতে যাচ্ছে। বাঁটুল যাবে না। প্রতিরোধ করছে। কাঁদছে। উঁ উঁ মুম্ মুম্। তার গলায় ফাঁসের মতো চেপে বসেছে গলাবাঁধুনি!
কল্যাণী বলছেন, ‘কী হল দীপ! মারছিস কেন বাঁটুলকে?’
‘কী রে দাদা!’
‘যাও! যাও যে যার ঘরে! আদর পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠেছে। ওর পায়তারা বার করছি আমি।’
‘কী হল ঝুমুর? দীপ এমন রেগে উঠল কেন?’
ঝুমুর নীরব। তার আর শব্দ নেই। ছাতে আবার পিটাই চলছে। কল্যাণী জ্বলন্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন, ‘তুই বাড়ি এলেই একটা নয় একটা অঘটন! মনে হয় দূর করে দিই।’
সেই রাতে ঝুমু বর পেল। পরাক্রমের কাছে কৌমার্য হারাল।
ঝুমু ও টোপর ও প্রেমিক শহর
ভোরবেলা তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা, গায়ে ব্যথা, কামড়ের দাগ, আঁচড়ের রক্ত ফুটে ওঠা। এর নাম বিয়ে! এর নাম দাম্পত্য। এর নাম আইনত যৌন সহবাস। ঠোঁটে রক্ত মাখা ফল তুলে উড়ে যায় বিয়ে। কেউ সুখ ভেবে আনন্দে বিভোর, কেউ নিরানন্দ, ভাবে, এরই নাম চাবুক ও অপূর্ব নিহিত সন্ত্রাস।
ঝুমুরের চোখ থেকে জল পড়ল টুপ টুপ টুপ। সে ফোন নিয়ে ছাতে গেল। ধীরে, অতি ধীরে! যেন তার গায়ে জোর নেই, দীর্ঘ অসুখে সে ক্ষীণজীবী এক। তলপেটে লাগছে প্রতি পদক্ষেপে। যেন তার মনই শুধু নয়, শরীরের সমস্ত পেশি বিদ্রোহ করে বসে আছে। তারা অসহায় ক্রোধে জমাট-কঠিন! সে নিঃশব্দে ডাকল টোপর… টোপর!
যাবতীয় যন্ত্রণা ও অশ্রু সমেত তার কাছে টোপর ও শান্তি একাকার হয়ে গেল। ছাতের এক কোণে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে বাঁটুল। চোখ তুলে চাইল। মুখ তুলল না। ডাকলও না। স্বামী কি ধর্ষণ করে? স্বামীর ভোগের থালা সাধারণ মেয়ে। সে কি বাড়ি ফিরে বলবে, বাবা, ওই সন্দীপন অপমান করেছে আমাকে। ধর্ষণ করেছে। যাব না যাব না যাব না ও ঘরে। বাবা বুঝিবে কি? বিবাহের অধিকারে স্বামীরা চড়াও হয় নির্মমে স্ত্রীদেহে। বাবা বুঝিবে কি? হাঁ করে থাকবে। মানিয়ে নে। ভাল ছেলে দীপ। যোগ্য ছেলে, ভাল রোজগার। ভাল পরিবার।
বাঁটুল কি বুঝেছিল ধর্ষণ? নাকি তার ঈর্ষা হচ্ছিল? বাঁটুল কি ঝুমুর প্রতি ন্যায়িক সমর্থন দেয়, নাকি সে-ই এক প্রতিপক্ষ?
ঝুমু থেবড়ে বসে পড়ল ছাতে। বাঁটুলের কাছে। গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আহা! অনুগত প্রভুভক্ত! অনুগতজনে এ কি হে এ বিরাট শাস্তি! রাত থেকে রক্তপাত তার। নরম গলিত স্রোতের স্পর্শ টের পাচ্ছে সে। যন্ত্রণার লোহিত কণিকা।
‘টোপর!’
‘বলো ঝুমু।’
‘কষ্ট হচ্ছে রে। খুব। আমার লেগেছে।’
‘আহা! ঝুমু! কাঁদে না! সোনা তো তুমি! আমার কত আদরের! কাঁদে না এভাবে!’
‘আমাকে …জোর করে… টোপর কী নিষ্ঠুর!’
‘আহা! ঝুমু! এসো! সব ধুয়ে দিই। মুছে দিই। এসো। চলে এসো সোনা।’
‘এভাবে বলছিস কেন? আমি কত বড়! বড্ড কষ্ট হচ্ছে। তাই তোকে ফোন করলাম। ঝিরিকে কি বলা যায়? আর কাউকে কি বলা যায়?’
‘ঝুমু। ফোনই যে সম্বল। কী দিয়ে সারাব তোমাকে বলো! কথা দিয়ে! শব্দ দিয়ে! আদরের শব্দ কিছু! সেরে ওঠো। সেরে ওঠো তুমি।’
বাঁটুল ঝুমুর হাত চাটছে। অল্প। জিভের এই এতটুকু বার করে। চাটছে তুপ তুপ তুপ। মানুষী ও কুকুরীতে বোঝাপড়া ভালবাসা হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। মাঝখানে দর্পিত পুরুষ। নির্বিচারে মারে প্রিয়জনে। লুঠ করে অবলীলাক্রমে। টনটনে নির্বোধ কাম দিয়ে ফুঁড়ে দেয় যাবতীয় তলপেট মহীতলে।
স্নান সেরে শুয়ে ছিল ঝুমু। কল্যাণী চা পাঠিয়ে দিলেন। তিনি কি জানেন, ছেলে বধূসম্পত্তির দখল নিয়েছে জোর করে?
শাশ্বতী কোথায়? লাল? লাল কই? সে যে বলেছিল, ঝুমুকে ওইবাড়ি নিয়ে যাবে!
ঝুমু এসএমএস পড়তে লাগল। ‘চলে গেলাম। কাল কষ্টে ছিলে তুমি। আমি মেয়ে, বুঝি। অনেক ভেবেছি রাতে। তোমার টাকা নিতে পারব না গো। বড্ড ছোট লাগবে নিজেকে। আমি পতিত। অপয়া। অশুভ। আমি জানি। তুমি বড় ভাল মেয়ে ঝুমু। ভগবান তোমাকে সুখশান্তি দিন। ফোন কোরো। আমার এ ফোনে ব্যালেন্স থাকে না।’
ঝুমুর ঝুমুর
ধর্ষণ কাকে বলে?
নারীর মতের বিরুদ্ধে এবং বলপূর্বক যৌনসম্ভোগ চলছে। দিনের পর দিন।
বিবাহ মানে কি? দুইটি জীবনকে যুক্ত করা হল। তারা একে অপরকে আজীবন বিশেষভাবে বইবে। যৌনতায়। দুঃখে। সুখে। দারিদ্রে। সাফল্যে। ব্যর্থতায়। রোগে ও শোকে।
সন্দীপন ও ঝুমু-র বিবাহ যৌনতার দ্বারে এসে উচ্ছৃঙ্খল ব্যভিচারী। ভালবাসা প্রেম বহুদূর, সন্দীপন ঝুমু-র সঙ্গে সুভদ্র বোঝাপড়া করে নেবার আগেই ঝুমু মনোমন্দিরহীন শরীরের স্তূপ।
তা হলে সন্দীপন একমাস দূরে ছিল কেন? কেন আগ্রহ দেখায়নি? আজও যদি সে শরীরে আগ্রাসী হয়, মনে হয় না কেন? ঝুমু, এক সাধারণ মেয়ে, মন ও শরীর নিয়ে বড় চিন্তিত এখন। সে কী করে? এই সংকটে সে কী করে? সে আর প্রতিরোধ প্রতিরক্ষা রচনা করে না। চাইলেই সুড়ঙ্গ খুলে দেয়। চাইলেই, বরফবিমণ্ডিত ধ্যানী পর্বত তার, গা বেয়ে উঠে যাওয়া আঙুল প্রতিম প্রাণী সে সহ্য করে অপার স্থিরতায়। কিন্তু সে জানে, সে চায়নি। এইভাবে চায়নি। এর মধ্যে যদি থাকত একটু প্রেমের মশলা, একটু এলাচ-দারুচিনি-তেজপাতা-লবঙ্গ মিশ্রিত ভালবাসা সুগন্ধ! নেই! ভালবাসা নেই। প্রেম নেই! সে অপমানিত। সে ক্লেদ ও গ্লানি মেখে অহোরাত্র খরতর দাহে পুড়ছে।
অন্তরে অস্থির সে। বাইরে গম্ভীর। শান্ত বাঁটুল তার মুখপানে চেয়ে থাকে। গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। সে বসে যদি, তার পায়ে মাথা রেখে পড়ে থাকে। ঝুমুর শোবার ঘরে বাঁটুল আর প্রবেশ করে না।
এক রাত্রে সে অপ্রিয় রমণ সয়ে শান্ত স্বরে বলল, ‘কথা আছে।’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘আপনি এ আচরণ কেন করলেন একজন শিক্ষিত পরিশীলিত লোক হয়ে?’
‘আমাকে আপনি বলার দরকার নেই।’
‘আপনি মাতাজিকে গুরু মেনেছেন। নারীজাতির প্রতি আপনার সম্মান সমীহ থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল না কি?’
‘আমি কাউকে অসম্মান করিনি।’
‘আমাকে করেছেন। আমার আপত্তি সত্ত্বেও আপনি জোর করেছেন।’
‘তুমি আমার বিবাহিত স্ত্রী। এখানে জোরের প্রশ্ন কী করে আসে?’
‘আসে। শুধু আপনি তা বোঝেন না।’
‘অপুদি আসে তোমার কাছে মা বলছিল। ওর কাজই হল পাড়ার মেয়ে-বউয়ের মাথা খাওয়া। শি ইজ এ বিচ। অসহায় মেয়েদের শেল্টার দেবার নামে ব্রথেল চালায় আর মুখে নারীবাদী বুকনি ঝাড়ে। ওর ফাঁদে পা দেওয়া আমি বা মা বরদাস্ত করব না।’
‘কিন্তু তাঁকে আপনারা বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।’
‘সেটা ভদ্রতা। এক পাড়ায় বাড়ি। করতে হয়।’
‘দেখুন, আমি অপুদির হয়ে ওকালতি করছি না। তিনি কেমন সেটা তাঁর ব্যাপার। সমস্ত সম্পর্কের মধ্যে শ্রদ্ধা ও সম্মানের একটি জায়গা থাকে, আপনি তার পরোয়া করেননি। সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়।’
‘দেখো, তোমার প্রেমে তো পড়িনি আমি। দাম্পত্যে দেহ আসবে। তোমার ভাল না লাগলেও আমার অধিকার আমি ছাড়ব কেন? মাতাজির আদেশে আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। আরও অনেক যোগাযোগ ছিল। কিন্তু জয়ীমাসি আমার মায়ের কাছে কেঁদে পড়েছিলেন, তোমার বর জুটছিল না। তো তোমাকে আমি ঘর বর সংসার দিয়েছি। মাথায় সিঁদুর দিয়ে বিয়ে করেছি। আর কী চাও? কোলে করে বসে থাকব? সত্যি বলতে কী, আমার তোমার প্রতি কোনও আগ্রহ নেই এটা বলে দেওয়া ভাল। তুমি জানো মাতাজি আমাদের কতখানি। তিনি বলেছেন ছেলে পাবার জন্য এটা অমৃতযোগ। মা নাতি চায়। তোমারও নিশ্চয়ই ছেলে পাবার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।’
‘আপনি আমায় জিজ্ঞেস করেছেন আমি এখুনি ছেলে চাই কিনা? আদৌ চাই কিনা।’
‘তাজ্জব! মেয়েমানুষ ছেলে তো চাইবেই। চায় না কারা। অপুদির মতো। পুরুষ শিকার করা কাজ। তুমি তো একটা ভাল মেয়ে!’
‘অপুদির মেয়ে আছে যতদূর জানি।’
‘বাবা কে জিজ্ঞেস কোরো।’
‘দেখুন, আমার প্রতি যখন আপনার কোনও আগ্রহ নেই, আমাদের সন্তান আনারও কোনও প্রয়োজন নেই। জগতে আর একটা বোঝা বাড়িয়ে কোনও লাভ আছে?’
‘আমার আপত্তি নেই। কিন্তু মা নাতি চায়। তা ছাড়া স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম করবে, এটা ন্যায়সঙ্গত অধিকার।’
‘স্বামী স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে পারে না কিন্তু!’
‘ন্যাকামো কোরো না। আরও হাজার পুরুষ যা করে, আমি তাই করেছি।’
হে ক্রোধ, হে কষ্ট, হে অপমানজর্জরতা, এই সাধারণী তবে কী করে? বড় গ্লানি হে ঈশ্বর। সাধারণ মেয়েদের বড় অসহায় গ্লানি! এই ক্লেদ সে কী প্রকারে ধোয়! তার মনের মূল্য নেই? ইচ্ছার মূল্য নেই? ভালবাসা পেতে পারে না সে?
সে ব্যাগ নিল। সামান্য কয়েকটি টাকা। কাজ পড়ে আছে। রান্না পড়ে আছে। বাঁটুলের সেদ্ধ মাংস। শ্বশুরের স্ট্যু। সারা বাড়ি থেকে ক্রমাগত ধুলো ঝাড়া। সে সোজা গেল কল্যাণীর কাছে।
‘আমি বেরোচ্ছি।’
‘বেরোচ্ছ! কোথায়?’
‘বাড়ি যাচ্ছি।’
‘বাড়ি যাচ্ছ? বলা নেই কওয়া নেই ওমনি বাড়ি যাবে কি?’
‘আমি যাব।’
‘ও মা! এ কী কথা! সব কাজ পড়ে রইল, উনি চললেন ড্যাঙডেঙিয়ে।’
‘আমাকে যেতেই হবে।’
‘কী আশ্চর্য! ভিজে বেড়ালটি হয়ে থাকো, মনে হয় না তো দেখে! মা গো, আমাকে অমান্য করছ! একেবারে ব্যাগ কাঁধে করে তৈরি! পাগলা নাকি? মাথা খারাপ লুকিয়ে বিয়ে দিল শেষে? জয়ীকে ফোন করছি আমি।’
ঝুমু বেরিয়ে পড়ল। চলতে লাগল পথ। হাঁটছে। দিকশূন্য। চিন্তাহীন। কাউকে ফোনও করছে না। তার চোখে জল আসছে। সে বেপরোয়া কাঁদতে কাঁদতে চলেছে একাকী। এ গলি ও গলি, অচেনা কানাগলি, অচেনা মানুষ, ঘরবাড়ি, পুকুরের ধারে ধারে সুবিশাল পাতাওলা মানকচু গাছ, ছাইগাদা, গাদা গাদা ছাই— যেখানে মেয়েদের শিশুজন্ম গতি পায়, গাদা গাদা পাঁক— যেখানে মেয়েদের নামিয়ে আনা হয়, গাদা গাদা ব্যবহৃত বস্তুর স্তূপ, আবর্জনা, ছেঁড়া চটি, কুকুরের দাঁতে কাটা রক্ত মাখা রজঃস্রাবশোষী তুলো ছড়ানো ছেটানো-সব মেয়ে, সব মেয়ে, সব নারী, পৃথিবীর সমস্ত অদরকারি, ফেলনা, দুর্গন্ধ আবর্জনা বৃহৎ নিটোল অর্থহীন ডিম্ব প্রসব করা স্ত্রীলিঙ্গ বিশেষ!
অবশেষে সে এসে দাঁড়াল ব্রিজি মেট্রো ইস্টিশানের দোরগোড়ায়, সড়ি ভাঙতে লাগল ক্লান্ত দুই পায়ে। এই ইস্টিশানের দ্বিতীয় নাম শহিদ ক্ষুদিরাম। কিংবা ক্ষুদিরামই নামের প্রকৃত পরিচয়। ব্রিজি মৌখিক নির্মাণ!
তার শ্বশুরঘর থেকে সবচেয়ে কাছে হয় গড়িয়া বাজারস্থিত কবি নজরুল ইস্টিশান। সেদিকে যায়ইনি সে। ঘোরের ভিতর সে ট্রেনে চাপল। নামল। হাঁটছে আলুথালু। চলছে এলোমেলো। মন চলো। মন চলো। কোথায় নিয়ে যেতে চাও হে!
তার ফোন বাজছে।
কে?
বড়পিসি।
সে ধরল না। ধরবে না!
একসময় পৌঁছে গেল তার পুরোন এলাকায়।
‘কেমন আছ ঝুমুদি?’
‘কেমন আছিস তুই নমি?’
‘ভাল আছি। কতদিন পরে এলে! শ্বশুরবাড়িতে গিয়েই বুঝি ভুলে গেছ! আমাদের মনে পড়ে না?’
‘খুব মনে পড়ে রে নমি। এখানে কী ভাল ছিলাম! মুন্নার মা’র সঙ্গে ঝগড়া করিস এখনও?’
‘না ঝুমুদি। সেই সুখ আর নেই। মাসির গলায় ক্যান্সার হয়েছে।’
‘ও মা! সে কি!’
‘অত দোক্তা খেত সবসময়! এই তো ধরা পড়ল। ক’দিন ধরেই অসুস্থ অসুস্থ। গলা ব্যথা। খেতে পারে না। শুধু বলে, জ্বলে যাচ্ছে। খাবার নামলেই জ্বলে যাচ্ছে। ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক দিল। সারল না, তখন ভাঙড়ে গেল।
‘আহা রে।’
‘সবাই বলছে বম্বে যাও। টাকা লাগে না, বলো? আমাদের আবার বম্বে-ট্রম্বে। চিত্তরঞ্জনেই যা করার করছে।’
‘সত্যি খুব খারাপ লাগছে রে।’
‘শিবুর বউয়ের কথা জানো?’
‘না।’
‘ওঃ! সে যা কেচ্ছা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে হবে না। রসিয়ে বলতে হবে। আজ থাকবে তো? রাতে যাব তা হলে।’
‘থাকতেও পারি। জেনে নিস।’
‘পলাশ আমাকে একটা ফোন কিনে দিয়েছে। সেকেন্ড হ্যান্ড অবশ্য। তোমার নম্বরটা দাও তো, একটা মিসড কল মারি।’
‘লিখে নে।’
‘টোপর চাকরি দিয়েছে তো পলাশকে, জানো তো?’
‘জানি। টোপরের সঙ্গে কথা হয়। মুন্নার মা, শিবুর বউয়ের খবর কিছু বলেনি। তাড়া থাকে তো।’
‘খুব বড় চাকরি করে টোপর। পলাশ বলছিল। একজন প্রতিবন্ধী যে কত বাধা অগ্রাহ্য করে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে যায়, টোপর তার উদাহরণ। কিন্তু বড্ড বেশি গম্ভীর হয়ে গেছে। ভয় লাগে। তুমি কিন্তু রোগা হয়ে গিয়েছ ঝুমুদি। জামাইবাবু ঘুমোতে দেয় না? সারা রাত জাগিয়ে রাখে? হি হি হি! প্রথম প্রথম খুব হয়, ঝুমুদি?’
‘অ্যাই, চুপ কর, ফাজিল কোথাকার। আমি বাড়ি যাই এখন। দেখি, গোপালীমাসির কাছ থেকে চাবি নিই।’
তাকে দেখে সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে গেল গোপালীর। ঘর্মাক্ত কর্মক্লান্ত মুখখানা আলোয় আলো। দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছেন, যেন ঝুমু-র গর্ভধারিণী, বলছেন, ‘ওমা! ঝুমু! হঠাৎ এখন! কতদিন আসোনি মা! জামাই কই? পরে আসবে?’
ঝুমুকে জড়িয়ে ধরছেন। ঝুমু গোপালীমাসির গায়ে চিরপরিচিত গন্ধ পাচ্ছে। তেল, পেঁয়াজ, রসুন, মাছ, ময়লা, ঘাম মিশ্রিত এক অসামান্য মাতৃত্বময়ী গন্ধ! সে বলল, ‘বড় মন কেমন করছিল মাসি! শাশুড়ির আপত্তি ছিল, তবু চলে এলাম!’
‘সে আবার কী? এটা কি ভাল হল ঝুমু?’
‘কেন নয়? আমার ইচ্ছে বলে কিছু থাকতে নেই মাসি?’
‘যাক, যাক! এসে যখন পড়েছ, আর কথা বাড়ানোর দরকার নেই। যাও, ঘরে যাও। আমি যাব’খন পরে।’
চাবি নিয়ে চলে এল ঝুমু! এই কানাই সামন্ত সরু গলি, এখানকার রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ তাকে মোহিত করে দিতে লাগল। যেন সে শাপগ্রস্ত প্রস্তরমূর্তি থেকে সদ্য মানুষতাপ্রাপ্ত! কতদিন…কতদিন পর!
সেই বাড়ি! আঃ! কতদিন পর! দরজা বন্ধ করল ঝুমু। বড় করে শ্বাস নিল। তারপর কাঁদতে লাগল হু হু করে। কোথায় যে ব্যথা বাজে, সম্পূর্ণ বুঝতেও পারছে না। সে যেন পরাজিত। নিঃস্ব। সাধারণ মেয়ে হিসেবে এই তার জীবন। কোনও ব্যতিক্রম নয়। তবু তার মনে হচ্ছে সে নিঃশেষিত। চতুর্দিকে পড়ে আছে তারই দেহমন পুড়ে যাওয়া ছাইভস্ম!
সে আধো আলো ঠান্ডা একতলার ঘরে মায়ের হলদেটে ছবির সম্মুখে দাঁড়াল। এই ছবি তারা ময়লা হতে দেয়নি। বছরে দু’দিন, জন্ম ও মৃত্যুর দিনে জ্যোতির্ময় মালা দিতে কখনও ভোলেননি। সে নিজেরই ভেতরকার গড়ে উঠতে থাকা মায়া ও মাতৃত্বচেতনার দ্বারা মাকে বুঝে উঠতে চায় আজ।
বড়পিসি বলেছিল, ‘তোর মা নেই, মা পাবি এইবারে। কল্যাণীদি বড় ভালমানুষ।’
শাশুড়ি কি মা হয়? সমস্ত জন্মদাত্রী মা হয়? সমস্ত প্রতিপালিকা গর্ভধারিণী কি মা হয়? ওমা ওমা ওমা আমি কী করব? আমাকে যে মরতে হবে মা। আমি যে টোপর ছাড়া থাকতে পারছি না। মা…! ও টোপর…!