৪. জোয়ানা মানিপেনি

অধ্যায় ৩১

জোয়ানা মানিপেনি
ফ্যাক্ট ফাইল

জন্ম : ৪ই অক্টোবর, ১৯৮১
বাবা : য়্যু দাজিং, সৎ বাবাঃ অ্যাশটন কুচার
মা : অলিভিয়া মানিপেনি
বৈবাহিক অবস্থা : অবিবাহিত। বয়ফ্রেন্ড নাই।
উচ্চতা : ৫’৮”
ওজন : ৫৯ কেজি
গায়ের রং : ফর্সা
জন্মদাগ : ডান গালে আঁচিল
শিক্ষাগত যোগ্যতা : ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনে মাস্টার্স, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়।
শখ : প্যারাগ্লাইডিং, পর্বতারোহণ
প্রিয় ছবি : রিয়ার উইন্ডো/আলফ্রেড হিচকক
স্বপ্ন : মাউন্ট এভারেস্টে চড়া।

মানিপেনির ফাইলটা গত কয়েকদিন ধরেই খুব বেশি নাড়াচাড়া করছেন। ডেভিড কর্নওয়েল। মানিপেনি’র সিআইএ’তে যোগদান অনেকটাই আকস্মিক, ঝোঁকের বশে করা। টিচার ছিল ও, একটা হাইস্কুলে পড়াতো। তারপর আচমকা ক্যারিয়ারের বাঁক বদল। মানিপেনি এর আগে সেন্ট্রাল এশিয়া ডেস্ক সামলাতো। গত ছয় মাস যাবত ও সাউথ-ইস্ট এশিয়া ডেস্কে। কাজেকর্মে মারাত্মক দক্ষ, আইকিউ লেভেল সাংঘাতিক। ট্রেনিংয়ে ওর ব্যাচ থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল। বাবার দিক থেকে চাইনিজ, মা’র দিক থেকে আমেরিকান। বাবা-মা’র ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে মার সাথে আমেরিকা চলে আসে ও। মা আমেরিকায় আরেকটা বিয়ে করেন। তারপর থেকে আমেরিকাতেই বসবাস।

ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরীর সাথে ওর একটা সম্পর্ক ছিল এককালে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং লেকচারার ছিলেন ডক্টর, তখন মানিপেনি ছিল তার টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট। তাদের মাঝে একটা সম্পর্কের মত ছিল, যদিও দুজনের কেউই এ সম্পর্কের কথা মুখে স্বীকার করে না।

মানিপেনির জন্য ডক্টরের সাথে পরিচিতি একটা প্লাস পয়েন্ট। এই অভিযানে ওকে অন্তর্ভুক্ত করার সবচেয়ে জোরালো যুক্তি ছিল এটাই। তাছাড়া মানিপেনি ভালোই পেশাদার। বলতে গেলে ওর চোখের সামনে ডক্টরের মাথায় কোপ বসানো হলো, ও কিন্তু বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সাধে কী আর লোকে ওকে চাইনিজ রোবট বলে ডাকে!

গত মাস থেকে সাউথইস্ট এশিয়া ডেস্কের সবার ওপর আলাদা মনিটরিং সিস্টেম চালু করা হয়। সিআইএ’র ছুঁচ ধরার জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, মনিটররা সরাসরি তাদের কাছে রিপোর্ট করতো। তাও সপ্তাহান্তে। সেই রিপোর্টের সামারি আবার চলে যায় ডেস্ক প্রধানের কাছে। জোয়ানা মানিপেনি’র মনিটরিং রিপোর্টটা ধোয়াশায় ঢাকা। তার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই। তবে কিছু উদ্ভট শখ আছে। প্যারাগ্লাইডিং আর পর্বতারোহণ। অফিস ছাড়া এগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকে ও। ওর ফোন কল ট্যাপ করে কিংবা ইমেইলে নজরদারি করে তেমন সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি। বেশ ক্লিন ওর রেকর্ড। স্রেফ একটা ঝামেলা।

নবুরু।

নবুরু প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত ছোট্ট একটা দ্বীপ। গত প্রায় এক মাস যাবত মানিপেনি পাবলিক পে-ফোন থেকে নিয়মিত কল করে যাচ্ছে ওই দ্বীপে। ওর নজরদাররা কল রেকর্ড চেক করে এটা নিশ্চিত করেছে। নবুরুর ব্যাপারে আরেকটা ছোট্ট তথ্য হলো সম্প্রতি এটা সোবাহান আকবর নামক এক বাংলাদেশি কিনে নিয়েছে।

সিআইএ’র ছুঁচের ব্যাপারে ডিপার্টমেন্ট জুড়ে একটা মিথ প্রচলিত। সেটা হচ্ছে সিআইএ’র ‘চ হলো রাশিয়ান এক এজেন্টের লাভার। তাও যেনতেন কেউ না। ওদের সুপারএজেন্ট বুলশিটের লাভার। যার কাছে এই তথ্যটা আছে সে-ই মনে করে ওর একলার কাছেই বুঝি তথ্যটা আছে, আর কারো কাছে নেই।

কথাটা ভুল।

আরো অনেকেই এ তথ্যটা জানে। এগুলো চাপা থাকে না, বেরিয়ে পড়ে। এখন প্রশ্ন হলো, জোয়ানা মানিপেনি কী বুলশিটের লাভার?

*

“আপনার উল্টাদিকের কেবিনে আপনারই মত বিদেশি এক রোগী ভর্তি হয়েছেন। আজ সকালেই অ্যাডমিটেড হয়েছেন ভদ্রলোক। শরীরের কয়েকটা জায়গায় গুলি। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানেন?”

“কী?” মোহাম্মদপুরে কুকুরের কামড়ের সাথে সাথে ইজ্জতটাও খুইয়ে এসেছে জোনাথন কিং। পৃথিবীর আর কোনকিছুতেই ও মজা খুঁজে পাচ্ছে না।

“ওর ডান পাছায় একটা ট্যাটু। বিষ্ঠার ট্যাটু। নিচে রাশিয়ান ভাষায় লেখা…”

“শিট।”

ডাক্তার অবাক হয়। “বাহ্, আপনি কীভাবে জানলেন?”

ঠোঁট উল্টায় কিং। “অনুমান করলাম…বাই দ্য ওয়ে, ও কোন কেবিনে?”

“আপনার উল্টাদিকের সারির মাথায়। ৩১২ নাম্বার কেবিন।”

ডাক্তার বেরিয়ে গেলে সুড়ৎ করে কিংও বেরিয়ে যায়। কিংয়ের নিতম্ব দেখার সৌভাগ্য হয়নি ডাক্তারের। দেখলে বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে থাকতেন। কারণ বিদেশি ওই রোগীর মত কিংয়ের পাছায়ও একটা ট্যাটু আঁকা। বাম পাছায়। গোবরের ট্যাটু। নিচে ইংরেজিতে লেখা…

“বুলশিট?” ৩১২ নাম্বার রুমের দরজা ফাঁক করে ভেতরে উঁকি মারে কিং।

খানিকক্ষণ পর কারো বিস্মিত গলা ভেসে আসে। “শিট?”

অন্ধকার বিছানায় কেউ শুয়ে বলে আছে মনে হচ্ছে। তার শুয়ে থাকার ভঙ্গি বেশ পরিচিত ঠেকে কিংয়ের কাছে।

তবে কী ও…?

“শিট?” দ্বিতীয়বার ঐ গলা শোনার পর মনের ভেতর আর কোন দ্বিধা কাজ করে না কিংয়ের। ছুটে যায় ও। ছুটে গিয়ে আলিঙ্গনে জড়ায় শুয়ে থাকা মানুষটিকে। রুমের ভেতরে কোন আলো জ্বলছে না। কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের তেরছা আলো এসে ঢুকছে ভিতরে। বিলবোর্ডের আলো। গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপন।

কাছে থাকুন।

সেই আবছা আলোয় পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে আমেরিকা ও রাশিয়ার দুই দুর্ধর্ষ স্পাইঃ শিট-বুলশিট।

“তুমি বুঝলে কীভাবে আমি এখানে?” বুলশিট ওরফে সারভব জিজ্ঞেস করে।

“ডাক্তার বললো তোমার পাছার ঐ ট্যাটুর কথা,” মুচকি হেসে জানায় শিট ওরফে জোনাথন কিং।

সারভবের মুখেও হাসি ফুটে। গত গ্রীষ্মে ট্যাটু করিয়েছে তারা। নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে বিখ্যাত ট্যাটু আঁকিয়ে মারাত সাফিনের কাছ থেকে। ট্যাটু প্রতি সাফিন ভালোই চার্জ নেয়। খ্যাতির একটা মূল্য আছে তো। কিং চাচ্ছিলো না এত খরচ করতে। কিন্তু সারভব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ট্যাটু সে করাবেই। শেষমেষ সারভবের জেদের কাছে নতি স্বীকার করে কিং। দুজন গিয়ে পাছা উদাম করে দাঁড়ায় মারাত সাফিনের সুঁচের নিচে। আর মসৃণ পাছা পেয়ে সাফিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে, তার উঁচ হয়ে যায় পিকাসোর তুলি। পাছাকে ক্যানভাস ভেবে এঁকে যায় ইচ্ছামত।

ট্যাটু করার স্মৃতি এখনো তরতাজা। দু’জন খানিকক্ষণ পুরনো স্মৃতি ঝালিয়ে নেয়। ঠোঁটের কোণে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠে। তবে দুজনার বর্তমান অবস্থা দেখে হাসিটা মুছতে সময় লাগে না।

প্রথমে সারভব ওর অভিজ্ঞতা শোনায়। কীভাবে পিছু নিয়েছিল মোটরবাইক চালকের, কীভাবে যুঝতে হলো চোখের পাতাহীন এক পাল নগ্ন মানুষের সাথে, কীভাবে এক ন্যাংটা বুড়োর নির্দেশে ওর ডানচোখের পাতা ঘ্যাচাং করে কেটে দেয়া হয়। শুনে শঙ্কার কালো মেঘে ছেয়ে যায় কিংয়ের মুখ। ছলছল চোখে সারভবের ডান চোখ দেখে ও। ডান চোখে। ব্যান্ডেজ বাঁধা। আপাতত বাম চোখ দিয়েই কাজ চালাচ্ছে সারভব।

তারপর কিংয়ের পালা অভিজ্ঞতা শোনানোর। কিং জানায় ডক্টরের ডেরায় কীভাবে পুলিশদের সামলালো, কীভাবে মোকাবিলা করলো জার্মান শেফার্ড, ব্লাডহাউন্ড আর ল্যাব্রাডরদের, কীভাবে ওরা ওর পাছা কামড়ে ধরে ঝুলে থাকলো, কীভাবে ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে দিলো এক দঙ্গল বজ্জাত কুকুরের দল।

শঙ্কার কালো মেঘে ছেয়ে যায় সারভবের মুখও। ছলছল চোখে ও কিংয়ের সদ্য উন্মুক্ত পাছা দেখে, চুমু এঁকে দেয় ক্ষতস্থানে।

“টমিকে খুঁজতে গেলে কেন হঠাৎ?” বুলশিট জিজ্ঞেস করে।

শিট তখন সবকিছু খুলে বলে। আকবর যে টমি, কাম হিয়ার লুপে আটকে গেছে তা জানায়। সেই লুপ ভাঙারই একটা চেষ্টা ছিল টমি নামধারী জ্বলজ্যান্ত সারমেয়টিকে হাজির করা। কিন্তু আরো কিছু সারমেয় মিলে পুরো পরিকল্পনাটিকে একদম লেজেগোবরে করে দিলো।

“মজার ব্যাপার কী জানো? আমাদের কাছে ডক্টরের ডায়েরি আছে। আকবরকে দিয়ে চুরি করিয়েছিলাম। ওখানে ডক্টর শেষের দিকে বেশ কিছু জায়গায় একটা কথা লিখে রেখে গেছেন।”

“কী কথা?”

“টমি মিয়া সব জানে।”

“টমি মিয়া?” চোখেমুখে বিভ্রান্তি নিয়ে তাকায় কিং। টমি মিয়া বলতে ওর ল্যাব্রাডরটাকেই তো এখানে বুঝাচ্ছেন ডক্টর ম্যাক, তাই না?”

বুলশিটকে অত নিশ্চিত দেখায় না। সেও যেন খানিকটা বিভ্রান্ত। “আমরা এক টমি মিয়াকে পাকড়াও করে এনেছিলাম। বাংলাদেশের এক বিখ্যাত কুক, ব্রিটিশ-বাংলাদেশি আসলে। ইংল্যান্ডে ওর রেস্টুরেন্ট আছে, রাজ রেস্টুরেন্ট। ঢাকায়ও ওর একটা রেস্টুরেন্ট আছে, টমি মিয়াস টি বার অ্যান্ড ক্যাফে রেস্টুরেন্ট। ওর আদি বাড়ি সিলেটে, আসল নাম মোহাম্মদ আজমান মিয়া।”

“হোয়াট?” কিংয়ের বিভ্রান্তি আরো বাড়ে। ““টমি, কাম হিয়ার এর টমি আসলে রক্তমাংসের মানুষ?” ওর চোখদুটো গোল আলুর মত গোল গোল দেখায়।

“আমরা তো সেটাই ভাবলাম। কিন্তু ওই টমি মিয়া তো কিছুই জানে, কিছু না। জিন্দেগীতে ও ডক্টরের নাম শুনেনি। ও সবকিছু জানলো কীভাবে? ও জানে খালি কারি বানাতে। আমরা মেহবুব আরেফিন চৌধুরীর কথা বলতে সে বললো, ইজ হি এ কুক?”

একচোট হেসে নেয় কিং। “তারপর?”

“আমরা আরো মনে করলাম শালা অ্যাকটিং করছে। ওর বৌকে ধরে নিয়ে আসলাম তখন। মেহবুব আরেফিনের কথা জিজ্ঞেস করাতে ওর বৌ বললো, আমরা ওর মেহবুব চাচার কথা জিজ্ঞেস করছি কিনা? পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল ওর মেহবুব চাচা লন্ডনের বিখ্যাত হোটেল ব্যবসায়ী। কয়েকটা বিশ্বমানের হোটেল আছে উনার, আছে রেস্টুরেন্টও। ইন্ডিয়ান কারি রেস্টুরেন্ট।”

“তারপর?”

“আমাদের তখন জেদ চেপে গেছে। একটা এসপার ওসপার করেই ছাড়বো। ধরলাম ঐ হোটেল ব্যবসায়ীকে। কিন্তু যেই লাউ, সেই কদু। এই ব্যাটাও কিছু জানে না। ইকোনমিস্টের আর্টিকেল টি অভ শ্যানং এর কথা জিজ্ঞেস করাতে খুব নিরীহ গলায় জানতে চাইলো-”এই চা খেলে কী স্পেশাল কিছু হয় কিনা?” আমরা বললাম, হয়। তখন বললো ওকে রেসিপি দিতে। ওর রাধুনীকে রেসিপি দিবে, রাঁধুনী গরম গরম চা বানিয়ে আমাদের খাওয়াবে! বুঝে ব্যাপারটা। এই টমি মিয়া আসলে কানা গলি ছাড়া আর কিছুই না।”

“আমার তো মনে হয় টমি মিয়া বলতে কুত্তাটার কথাই মিন করেছেন ডক্টর।”

“ধুর। মানুষই কিছু জানে না, আর কুত্তা!”

খানিকক্ষণ চুপ থাকে দু’জন। “তোমার এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা উচিত হবে না।” কিংকে মনে করিয়ে দেয় সারভব।

“হু, যাচ্ছি।” কিংয়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু ডক্টর চায়না থেকে যে জিনিস নিয়ে এসেছে, সেটা আসলে কী? অমরত্ব, অনন্ত যৌবনের আধার না মানববিধ্বংসী কোন অস্ত্র?”

“আমার তো মনে হয়, ডক্টর চায়না থেকে ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে আসছেন। উনার ডায়েরিতে ব্রহ্মাস্ত্রের প্রচুর রেফারেন্স দেয়া…”

কিং কথার মাঝখানেই নিজের হাত ঢুকিয়ে দেয়। আবার তিনিই দেশে ফিরে ইকোনমিস্টে চা-বিষয়ক দীর্ঘ আর্টিকেল লিখেছেন। যেখানে তিনি দাবি করেছেন, শ্যানংয়ের চা ছিল একটি ম্যাজিকাল পানীয়। ওই চা খেলে মৃতপ্রায় ব্যক্তি পুনরুজ্জীবিত হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা চায়ের সেই কোয়ালিটি হারিয়ে ফেলেছি। এখন চা মানুষের ঘুম তাড়ায়, কিন্তু ঘুম তো ইয়াবাও তাড়ায়…”

“ওখানে কিন্তু ব্রক্ষ্মাস্ত্রের কথাও মেনশন করা আছে, বাই দ্য ওয়ে।” সারভব মনে করিয়ে দেয়। “হু কিল্ড হিম, শিট?” এতক্ষণ ধরে প্রশ্নটা দুজনের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। অবশেষে ভাষা পায় তা।

“আমি জানি না, সারভব। আমি আসলেই জানি না।”

“কে তাকে মারতে পারে? সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে কী কেউ মারে?” স্বগতোক্তির মত নিজেকেই যেন প্রশ্নগুলো করে যায় বুলশিট। কিন্তু কোন উত্তর মিলে না।

“ডায়েরিতে কী কারো কথা লিখে গেছেন ডক্টর? বা, তিনি কী কাউকে সন্দেহ করতেন?”

দু’পাশে মাথা নাড়ায় বুলশিট। “কাউকে সন্দেহ করতেন কিনা জানি না। তবে শেষ দিকে এসে মারাত্মক সুইসাইডাল হয়ে গিয়েছিলেন ডক্টর। খুব ডিপ্রেসিং কথাবার্তা লিখে রেখেছেন। বারবার যিশুর রেফারেন্স টানতেন, আর বলতেন যিশুর সবচেয়ে বড় এচিভমেন্ট হলো তিনি ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মরার তিনদিন পর আবার আমাদের মাঝে ফিরে এসেছিলেন। অমর হওয়ার জন্য তাই মৃত্যুবরণ করাটা জরুরি, নাহলে অমর হওয়া সম্ভব না।”

করিডরে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। এভাবে দেখা করাটা আসলেই রিস্কি। কেউ দেখলে তুলকালাম কান্ড ঘটবে, একজন আমেরিকান এজেন্ট রাশিয়ান এজেন্টের শিয়রে দাঁড়িয়ে কী করছে!

“যাই। পরে কথা হবে।” চুমু বিনিময় শেষে টুপ করে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ে জোনাথন কিং।

*

অধ্যায় ৩২

সকালবেলা সেকেন্ড ইন কমান্ডের কাছ থেকে একটা সুখবর পান রফিকুল ইসলাম। তখন তিনি যোগব্যায়াম করছিলেন। খানিক আগে আদা চা দিয়ে গেছে রুম বয় একরাম। গলাটা খুসখুস করছে, আদা চা গলার জন্য উপকারী। তাই আদা চা বানাতে বলেছিলেন।

“স্যার, ব্যাংকারের কথা মনে আছে? মুজতবা মনোয়ার?”

“হ্যাঁ, মনে আছে।” ব্যাংকার মুজতবা মনোয়ার হলো দুধ চা কিলা

শিকার। অফিস থেকে ফেরার পথে ভদ্রলোক নিখোঁজ হন, তার লাশ পরদিন মিলে। হাতিরঝিলে। গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অদূরে পরিচিত দেয়াল চিত্র-দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেব।

লাশের পাশে অতি পরিচিত সাজ-সরঞ্জাম। একটা ট্রে। ট্রে’তে আধাকাপ লিকার চা, ছোট্ট একটা বাটিতে তিনটা বিস্কুট। যদিওবা দেয়ালচিত্রে দেয়া দুধ চা খেয়ে খুন করার কথা, কিন্তু খুনি লিকার চা খেয়েই কম্মো সেরেছে।

রসিক খুনি!

“মনোয়ারসাহেব সাধারণত বাসে করে বাসায় ফিরেন, কিন্তু সেদিন উনি সিএনজি’তে উঠছিলেন। আর উনার সাথে একজন ছিল…”।

“সিএনজি’র পেছনে বাবা কেন চাকর সিনেমার পোস্টার লাগানো?”

“আরে না, স্যার। ওইটা না। সিনেমার পোস্টার লাগানো কিনা এইটা উনার কলিগ বলতে পারলো না…”

“সেদিন কী উনার সাথে উনার কলিগ সিএনজিতে উঠেছিল?” অবাক হন রফিকুল ইসলাম।

সব কলিগদেরকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কেউ তো তখন কিছু জানায়নি। মুজতবা মনোয়ারের যাতায়াত অভ্যাসটা স্পষ্ট মনে আছে তার। বাসে চেপে অফিসে যান, বাসে চেপে অফিস থেকে ফিরেন। বড় মগবাজারে বাড়ি ভদ্রলোকের। মগবাজার রেল ক্রসিংয়ের খানিকটা সামনে। উনার অফিস গুলশানে, ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংকের হেড অফিসে। ওখানে ফিঙ্গার পাঞ্চ করে বের হতে হয়। সিস্টেম শো করছে ভদ্রলোক অফিস থেকে বের হয়েছেন ঠিক ৬৪০২ মিনিটে। তার পেছনের রেকর্ডও চেক করেছেন রফিকুল ইসলাম। উনি সাধারণত সোয়া ছয়টার ভেতরেই বাড়ির পথ ধরেন। কিন্তু বৌ জানাচ্ছেন, মুজতবা মনোয়ার গত মাসখানেক ধরে প্রতিনিয়ত বাসায় ফিরছেন দশটা-এগারোটার দিকে। মুজতবা মনোয়ার বৌকে জানিয়েছেন অফিসে সাংঘাতিক কাজের চাপ। তাই ফিরতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু রেকর্ড বলছিল ভিন্ন কথা। রেকর্ড বলছিল উনি সোয়া ছয়টার ভেতরই নিয়মিত অফিস থেকে বের হচ্ছেন। কিন্তু বাসায় ফিরছেন চার-পাঁচ ঘন্টা দেরিতে। ঢাকায় মারাত্মক জ্যাম থাকে সত্যি, কিন্তু তাই বলে প্রতিদিন রাস্তায় চার-পাঁচ ঘন্টা নষ্ট? গুলশান টু মগবাজার তো অত দূরের রাস্তাও না, ৬-৭ কিলোমিটার দূরত্ব।

তাহলে? পরকীয়া?

রফিকুল ইসলাম তার সেকেন্ড ইন কমান্ডকে এই জিনিসটাই চেক করার জন্য বলেছিলেন। মুজতবা মনোয়ারের ক্রেডিট কার্ড বিলও কিন্তু পরকীয়ার দিকেই আঙ্গুলি-নির্দেশ করছিল। গত এক মাসে বেশ কিছু মেয়েলি প্রোডাক্ট উনি ক্রেডিট কার্ডে কিনেছেন। ভাসাবি থেকে দুইটা শাড়ি। দুটা মিলে প্রায় পনেরো হাজার টাকা। তারপর আমিন জুয়েলার্স থেকে আংটি, গলার চেইন, নাকের মল। তিনটা মিলে প্রায় ত্রিশ হাজারের মত বিল। কোনটাই কিন্তু বৌয়ের জন্য না। বৌ জানাচ্ছেন গত এক-দেড় মাসে কোন বিয়ের দাওয়াতও ছিল না।

তাহলে এত এত খরচ কার মন ভজানোর জন্য?

“স্যার আছেন? হ্যালো, হ্যালো…”

“হ্যাঁ, শুনতেছি।”

“লাইনে ডিস্টার্ব করতেছে খুব…হ্যাঁ, এখন ক্লিয়ার। ওইদিন উনার সাথে উনার এক কলিগ সিএনজি’তে উঠছিল। কলিগ আরেক ডিভিশনে চাকরি করে। মুজতবা মনোয়ার ছিলেন ক্রেডিট ডিভিশনে, কলিগ চাকরি করতো হিউম্যান রিসোর্সে। মনোয়ার সেকেন্ড ফ্লোরে, কলিগ আদনান আলী সেভেন্থ ফ্লোরে। আমরা মনোয়ারের ডিভিশনের সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করছিলাম, হিউম্যান রিসোর্সে আর যাই নাই। আর কলিগটাও ভয়ে আগ বাড়ায়া আসে নাই। গতকালকে এসে বললো ও নাকি খুব গিল্টি ফিল করতেছে। পুলিশরা খুব হ্যারাস করে বলে এতদিন চুপ করে ছিল। ও বললো, ওইদিন রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে যায় মুজতবা ভাইয়ের সাথে। মুজতবা মনোয়ার যাবে কল্যাণপুর, আড়ংয়ের উল্টাদিকে। আর আদনান আলীর বাসা মিরপুর ১০-এ। মুজতবা মনোয়ার শেয়ারে যেতে রাজি হয়ে যায়। মুজতবাসাহেবের বাসা যে আসলে মগবাজার এইটা আবার আদনান আলী জানতো না। ওরা দুজন খুব ক্লোজ ছিল না। হাই-হ্যালো সম্পর্ক আরকি। সে মনে করলো মুজতবা ভাই বুঝি কল্যাণপুরেই থাকে। সে একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে কাছাকাছি এলাকায় থাকি, কিন্তু কখনো রাস্তায় দেখা হয় না। আজব! মুজতবাসাহেব কিন্তু কথাটা প্রটেস্ট করে নাই। ও চুপ মেরে ছিল। ও ভাব ধরে থাকে, ওর বাসা কল্যাণপুরেই। মগবাজারে না। যাত্রাপথে ওদের দুজনের মাঝে খুব বেশি কথা হয় নাই আর। টুকটাক। ভাবি কী করে, বাচ্চারা কেমন আছে, কোন স্কুলে পড়ে ইত্যাদি। মুজতবাসাহেবের দুই বছরের বাচ্চা আছে আপনি তো জানেনই স্যার, স্কুলে যায় না এখনো। আর ভাবি টিচার। লেকহেড গ্রামার স্কুলে পড়ায়। এইসব নর্মাল কথাবার্তা। তবে একটা জিনিস আলাদাভাবে বললো আদনান আলী, এইটা আপনার জানা দরকার। সিএনজিওয়ালা খুব বকবক করতেছিল। সিএনজিওয়ালা ওদেররে বললো যে শহরে নাকি এক নতুন খুনির আর্বিভাব ঘটছে। সিএনজিওয়ালার ভাষায়-দুধ চা খাইয়া খুনির শরীল গরম হইয়া যায়। মেশিন-মুশিন গরম হইয়া যায়। স্টেরেট মারডার করা ছাড়া তার আর কুনু উপায় থাকে না। ওরা খুব হাসে সিএনজিওয়ালার কথায়। ওরা জিজ্ঞেস করে, এগুলো সে জানে কীভাবে। ও জানায়, পেপার-পত্রিকায় পাইছে। এইভাবে জানে। সিএনজিওয়ালা আবার শিক্ষিত, মেট্রিক পাশ। নামটা বেশ উদ্ভট। গিল্টি মিয়া। ইংরেজিতে বানান করেও বলে সিএনজিওয়ালা : জি-ইউ-আই-এল-টি-আই…”

“হোয়াট?” মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে রফিকুল ইসলামের।

গিয়াস উদ্দিনকে ফোনে রেখেই কেস ফাইল ঘাঁটতে শুরু করেন তিনি। কেস ফাইলের এক কপি অফিসে, আরেক কপি উনার কাছে। দুধ চা কিলারের দ্বিতীয় ভিকটিম শান্তনু কায়সার। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ করছে, প্রথম বর্ষের ছাত্র। উত্তরায় বাসা। প্রতিদিন উত্তরা টু শাহবাগ বাসে যাতায়াত করে ও। ঘটনার দিন শান্তনু ওর বন্ধু সাকিবের সাথে ধানমন্ডিতে যায়। ওখানে একটা প্রোগ্রাম ছিল, গেঞ্জি ফেস্টিভ্যাল। ওটাতে যায় ওরা। গেঞ্জি-টেঞ্জি কিনে রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। ওদের সাথে আরো বন্ধু-বান্ধব এসে যোগ দেয়। ছবি-টবি তুলে। ফেসবুকে চেক-ইন দেয়। খেয়ে-দেয়ে ওরা যখন বের হয় তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে দশটা। সাকিবই প্রস্তাব দেয় সিএনজি নেয়ার। সাকিবের বাসা বনানী। ওকে বনানীতে ড্রপ করে সোজা উত্তরা চলে যাবে সিএনজি। টাকা-পয়সা বেশি লাগবে বলে শান্তনু রাজি হচ্ছিল না। একরামই তখন হাফ-হাফ শেয়ারের প্রস্তাব দেয়। একরাম হাফ দেবে, শান্তনু হাফ দেবে। অবশেষে শান্তনু রাজি হয়। সিএনজি দরদাম করে উঠে। ওই সিএনজিওয়ালাও খুব বাকপটু ছিল। বকবক করছিল অনর্গল।

সেইম স্টোরি বলে ও। শহরে এক ভয়ংকর খুনির আবির্ভাব ঘটেছে, দুধ চা খেয়ে কী জানি হয়ে যায় খুনির। হাত-পা নিশপিশ করে কাউকে কেঁসে দেয়ার জন্য। এক বৃদ্ধকে ইতিমধ্যে কেঁসে দেয়া হয়েছে, ওর পরবর্তী টার্গেট যে কেউ হতে পারে!

মামারা, চা-খুরদের থিকা সাবধান থাইকেন।

সিএনজিওয়ালা ওদেরকে সাবধান করে দেয়। ওরা হাসে খুব। তবে কী চা’তে ড্রাগ মেশানো থাকে? বাবা, ডাইল কিংবা হেরোইন?

হাইসেন না, মামারা। কেসডা সিরিয়াস।

কথায় কথায় সিএনজিওয়ালা মামার পরিচয় বের হয়। তিনি ম্যাট্রিক পাশ, নামটা খুবই অদ্ভুত। বাবা শখ করে রেখেছেন। মাসুদ রানার ফ্যান ছিলেন বাবা। নামটা মাসুদ রানারই এক চরিত্র। গিল্টি মিয়া। ইংরেজিতে বানান করে শুনিয়েও দেন। বানান ভুল অবশ্য। ঠিক মুজতবা মনোয়ারের সিএনজিওয়ালার মতো।

জি-ইউ-আই-এল-টি-আই…

*

মিরপুর ১০-এ মুজতবাসাহেবের কলিগ আদনান আলী নেমে যান। শেয়ারের অংশ মিটিয়ে দেন তিনি, মুজতবা মনোয়ারের কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নেন। হালকা রসিকতাও করেন-সাবধানে যাইয়েন, দেইখেন দুধ চা খেয়ে কার না আবার মেশিন গরম হয়। ব্যাংকার দুজন হাসে হো হো করে। মুজতবা মনোয়ার তখনো সুস্থ, সবল এবং ১০০% জীবিত। তখন ঘড়িতে বাজে সাতটা-সোয়া সাতটা। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী আর মাত্র ঘন্টা পাঁচেক জীবিত থাকেন তিনি। তারপর পাড়ি জমান পরপারে।

প্রায় একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় শান্তনু কায়সারের বেলায়ও। সাকিবকে বনানীতে নামিয়ে দেয় সিএনজি, তারপর ছুটে চলে উত্তরা পানে। এগারোটার দিকে রাজধানী তখন ফাঁকা। খুব দ্রুতই উত্তরা পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু শান্তনু কায়সার বাসায় ফেরেনি আর।

মুজতবা মনোয়ার কী তার ঈপ্সিত গন্তব্য কল্যাণপুরে এ নামতে পেরেছিলেন? নাকি তখনই সিএনজিওয়ালার মেহমান বনে যান? না, কল্যাণপুরে কাজ সেরে বাসায় ফিরতে গিয়ে মেহমান বনেন?

সেকেন্ড ইন কমান্ড গিয়াস উদ্দিনের কল্যাণে তথ্য মিলে। সে কল্যাণপুরে মুজতবা মনোয়ারের গন্তব্য খুঁজে বের করে ফেলে। দু’মাস আগে মুজতবা মনোয়ার তিনটা বইয়ের অর্ডার দেন রকমারিতে। রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি, সাম্ভালা, আকন। এটার বিলও ক্রেডিট কার্ডে মেটান তিনি। বইগুলোর ডেলিভারি ঠিকানা ছিল-মৌসুমী বিনতে আজিজ, গার্ডেন টাওয়ার, দ্বিতীয় তলা, বাসা নংঃ ১৮/এ, রোড নংঃ ২, কল্যাণপুর, ঢাকা।

মৌসুমী বিনতে আজিজ ডিভোর্সি। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়েছে বছর দুয়েক হলো। চাকরি করেন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। মেলা টাকা কামান। ফ্ল্যাটটা উনার নিজের, পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, মাস ছয়েক হলো মুজতবা মনোয়ারের সাথে এক মিউঁচুয়াল ফ্রেন্ডের বদৌলতে আলাপ হয়। এক দাওয়াতে। সেখান থেকে ফেসবুকে মুজতবা মনোয়ারের অ্যাড রিকোয়েস্ট পাঠানো। তাদের ভাব-ভালোবাসার ওইখানেই শুরু। তারপর ধীরে ধীরে ডেটিং, বাসায় আমন্ত্রণ।

মৌসুমী জানায় ঘটনার দিন মুজতবা মনোয়ার ওর বাসায় আসেননি। আসার কথা ছিল, কিন্তু আসেননি। সিএনজি’তে উঠার আগে একবার কথা হয়েছিল মুজতবা মনোয়ারের সাথে, তারপর আর হয়নি। পরে একসময় ফোন স্যুইচড অভ পান। ফোন আর সুইচড অন হয়নি।

ডিম ভাজি আর পরোটা দিয়ে নাস্তা সারেন রফিকুল ইসলাম। তারপর গরম গরম এক কাপ চা। ঘুম থেকে উঠেই এক প্রস্থ চা খাওয়া হয়ে গেছে। এখন আবার। রুম বয় একরাম ঢাকার এই পুলিশ অফিসারের ভাও বুঝে গেছে। অফিসারের জন্য চা তাই স্পেশালি বানানো হয়। গতকাল রাতে চা আনতে দেরি হয়ে গিয়েছিল এই জন্যই। যে সাধারণত চা বানায়, ও ছিল বাইরে। চাইলে বাইরের কোন দোকান থেকে চা নিয়ে আসতে পারতো একরাম। কিন্তু ও অপেক্ষা করে। প্রধান চা প্রস্তুতকারক ফিরে আসলে ও গরম গরম চা উপরে নিয়ে যায়।

রফিকুল ইসলাম নাস্তা খেয়েই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। জাকিয়া খান লিখে ইউটিউবে সার্চ দিয়েছিলেন। সেখানে একটা ভিডিও মিললো। প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় এই এক বদঅভ্যাস হয়েছে। নতুন কারো/কোনকিছুর নাম পেলেই গুগলে সার্চ দেয়া, কিংবা ইউটিউব দেখে নেয়া।

মিনিট দশের একটা ভিডিও, যেখানে “ট্রি অভ নলেজ” নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন জাকিয়া খান। ভিডিওটা একটা সেমিনারের সম্ভবত। পেছনে ব্যানার টাঙ্গানো-শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের জন্মবার্ষিকী। কেউ একজন ফোনে ভিডিও করেছে। হাত কাঁপছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে মানুষজনের কথা শোনা যাচ্ছে। মঞ্চে কারো চেহারা পরিস্কার বোঝা যায় না।

ডান দিকের কোণায় বসা ঐ লোকটা কী লালন বৈরাগী?

জাকিয়া খান সবুজ শাড়ি পরেছেন, সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ। চেহারায় একটা স্নিগ্ধ, শান্ত ভাব। চোখেমুখে আত্মপ্রত্যয়ের দৃঢ় ছাপ। তিনি বলেনঃ

“ট্রি অভ নলেজ বা বাংলায় জ্ঞানবৃক্ষ কথাটা আসলে কী? যে বৃক্ষের ফল খেলে বোধবুদ্ধি জাগ্রত হয়, চিন্তা-চেতনা বিকশিত হয়, জ্ঞানের নবস্পৃহা জাগে? নাকি অন্য কিছু? আমরা হোলি বাইবেল কিংবা পবিত্র কোরানের ঘটনাগুলো সবাই জানি। আদম (আঃ)-কে আল্লাহ নিষেধ করেছিলেন একটি গাছের ফল খেতে। শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে আদম (আঃ) সেই নির্দেশ মানতে পারেননি, খেয়ে ফেলেন নিষিদ্ধ ওই ফল। ফলাফল, স্বর্গ হইতে পতন। ধরায় আগমন। মানবজাতির অভ্যুদয়। ওই ফল না খেলে কিন্তু আমাদের জন্ম হতো না। আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া এখনো বেহেস্তেই সুখে-শান্তিতে দিনাতিপাত করতেন। তাহলে অবাধ্যতার ফল হলো এই দুনিয়াদারি, তাই না?”

মুখে কিঞ্চিৎ হাসির আভাস মিলে জাকিয়া খানের। হাসলে ভদ্রমহিলাকে অসম্ভব সুন্দর দেখায়। হাসি মুছে আবার শুরু করেন তিনি, “ইরাকে আল কুনা নামে একটা জায়গা আছে। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিসের সঙ্গমস্থল এই আল-কুনা শহর। শহরটার আলাদা একটা বিশেষত্ব আছে, বুঝতেই পারছেন। আল-কুর্নার আরো বিশেষত্ব আছে। স্থানীয়ভাবে অনেকে মনে করেন বাইবেলের গার্ডেন অভ এডেন হলো এই শহর। শহরে একটি অতি প্রাচীন বরই গাছ আছে। ট্যুরিস্টরা ঘুরতে আসলে এই বরই গাছটিকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় ট্রি অভ নলেজ হিসেবে…”

*

অধ্যায় ৩৩

চেলাচামুন্ডা সব হারিয়ে পাঁচ তারকা হোটেল সাবরিনা’য় আপাতত ঘাঁটি গেড়েছেন আলফনসো কুয়ারোন গ্যাং। গ্যাং বলতে মোটে তিনজন-তিনি নিজে, রাফসার রশিদ আর সদ্য নিয়োেগ প্রাপ্ত এক ছোকরা। ডাবল আর ওরফে রাফসার রশিদের মতে ছেলেটা বেশ কর্মঠ, মাথা পরিস্কার। ওর প্রাইভেট এজেন্সিতে ঢুকেছে বেশিদিন হয়নি। মাস ছয়েক হলো। কিন্তু এরই মধ্যে কাজ দিয়ে তুষ্ট করতে পেরেছে। নাম বিকাশ রঞ্জন বিশ্বাস।

কুয়ারোন অবশ্য ছেলেটার মধ্যে আলাদা কিছু পাননি, করল্লার জুস খাওয়া ছাড়া। ছেলেটা ঢকঢক করে এমনভাবে করল্লার জুস খায় যে মনে হয় পানি খাচ্ছে। করল্লার জুসও হয় আর মানুষ সেটা খায়ও, এটা কুয়াররানের চিন্তার বাইরে ছিল।

আইডিয়াটা এই করল্লার জুসখোর ছেলেটার মাথা থেকেই আসে। কসাই কাসেম ওদের কোমর ভেঙে দিয়ে গেছে, এখন হাত-পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ানোর জন্য নতুন পথ খুঁজে বের করা জরুরি। কিন্তু কী সেই পথ?

বিকাশ রঞ্জন ওদেরকে জানায়, পথের নাম শরীফুল হাসান। শরীফুল হাসান লেখালেখি করেন। ক’বছর আগে সাম্ভালা নামে একটা বই লিখে তোলপাড় ফেলে দিয়েছেন।

কুয়ারোন ভুরু কুঁচকান। “টি অভ শ্যানং এর সাথে শরীফুল হাসানের কী সম্পর্ক থাকতে পারে?”

মুচকি হাসে বিকাশ রঞ্জন। “সম্পর্ক অমরত্বে, এলিক্সির অভ লাইফে। সাম্ভালায় অমরত্বের ফর্মুলা দিয়েছেন লেখক, টি অভ শ্যানং’য়ে ঠিক যেরকমটা দাবি করেছেন অকালপ্রয়াত ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরী…”

তার মুখের কথা কেড়ে নেন কুয়ারোন। তার হঠাৎ মনে পড়ে যায় কিশোর বয়সে রুদ্ধশ্বাসে গেলা জেমস হিলটনের উপন্যাস লস্ট হরাইজনের কথা। “সাংগিলা নামক যে মিথিক্যাল শহরের কথা হিলটন উল্লেখ করেছেন যেখানকার বাসিন্দারা অমর, সাম্ভালায় কী ওরকম কিছুর কথা আছে?”

বিকাশের মুখের হাসি বিস্তৃত হয়। এই তো লাইনে এসেছেন। গত বইমেলায় শরীফুল হাসানের সাথে দেখা হয়েছিল। খুবই মাইডিয়ার টাইপ লোক, মিশুক, আন্তরিক। চা খেতে খেতে অনেক গল্প-গুজব হলো। সাম্ভালা লেখার পেছনের গল্প বললেন তিনি। বইটা লেখার জন্য উনি তিব্বতে গিয়েছেন, মাসদুয়েক তিব্বতের রাজধানী লাসায় থেকেছেন। মিশেছেন স্থানীয় লোকজনদের সাথে। আর্কাইভ ঘেঁটেছেন, পুরনো লাইব্রেরির নথিপত্র খুঁজে দেখেছেন। তিনি আমাকে বললেন, সাম্ভালায় অনেক কিছুই উনি উহ্য রেখে দিয়েছেন। ইচ্ছে করেই দেননি। দিলে অহেতুক কন্ট্রোভার্সি ক্রিয়েট হতো। উনি ওইদিন এক সন্তের গল্প বলেন। এক চাইনিজ সন্ত। অনেকে তাকে দেবতা মানে। ওই সন্ত প্লাস দেবতা আবার একজন কীর্তিমান চিকিৎসকও। যে কোন ধরণের রোগ সারাতে পারেন, শুধু পারেন না একটা রোগ সারাতে। মৃত্যু। ওই দেবতার নাম শ্যানং…”

তাকে আর কথা শেষ করতে দেন না আলফনসো কুয়ারোন। দুটো শব্দে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে ফেলেন। “ব্রিং হিম।”

*

কিন্তু আরো প্রায় ঘন্টাপাঁচেক পর যে লোকটাকে হোটেল সাবরিনার বিলাসবহুল কক্ষে হাজির করা হয় তাকে দেখে ইংরেজি একটা শব্দ বেরিয়ে আসে বিকাশ রঞ্জন বিশ্বাসের মুখ দিয়ে, আর সেটা হলোঃ “শিট!”

শরীফুল হাসানের আগমনে কুয়ারোনের মুখটা হাসি হাসি ছিল, নিমেষে হাসিটা উবে যায়। তার মুখ দিয়েও ইংরেজি গালিটা বের হয়, তবে তারটা প্রশ্নবোধক। “শিট?” পরে প্রশ্নটা আরো খানিকটা বিস্তৃত করেন তিনি। “কেন শিট?”

মনে মনে শিটের সাথে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী গালির তুবড়ি ফুটাচ্ছিল বিকাশ রঞ্জন বিশ্বাস। কারণ বিকাশ রঞ্জন বিশ্বাসের সাথে শরীফুল হাসানের কখনো দেখাই হয়নি। সে বই-টইও পড়ে খুব কম, সাম্ভালা পড়া তো দূরের কথা। ওর এক বন্ধু আছে, সালমান হক নামে। পড়ে, লেখালেখি করে। ওর কাছ থেকে এসব গল্প শুনেছে বিকাশ, তারপর সামান্য রংটং চড়িয়ে পেশ করেছে আলফনসো কুয়ারোনের কাছে। সালমানের সাথে কথা বলে শরীফুল হাসানের একটা ছবি ওই ফেসবুক মেসেঞ্জারে আনিয়েছে। এটুকু পর্যন্ত ঠিকই ছিল।

কিন্তু পরের ঘাপলাটা সালমান বাঁধায়। কথা ছিল শরীফুল হাসানের ছবি দেয়ার, কিন্তু সে ভুল করে আরেকজনের ছবি পাঠিয়ে দেয়। ওই লোকটাকেই ধরে এনেছে কুয়ারোনের চেলাচামুন্ডা। খানিক আগে সালমান সরি বলে পুনরায় ছবি পাঠিয়েছে। এবার আসল শরীফুল হাসানের।

কুয়ারোন ঐ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। কিছু একটা বলা দরকার, বুঝতে পারে বিকাশ রঞ্জন। ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে হবে।

বিকাশ গলার স্বর কয়েক ডিগ্রি উপরে তুলে বলেঃ “বললাম শরীফুল হাসানকে নিয়ে আসতে, তোমরা নিয়ে আসলা জাহিদুল হাসানকে।”

চেয়ারে বেঁধে রাখা লম্বা লোকটা নড়েচড়ে উঠে। ওর চোখদুটো ফোলা ফোলা, গালও ফোলা। যা ঘুষি খাওয়ার লক্ষণ। ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। এটাও সম্ভবত ঘুষি খাওয়ার লক্ষণ। ডান হাতের কড়ে আঙুল ও বুড়ো আঙুল বেঁকে গেছে, হাত পিছমোড়া করে বেঁধে রাখার কারণে যা বোঝা যাচ্ছে না। ওদের তাড়া খেয়ে লোকটা দৌড় দিয়েছিল, চোর ভেবে এলাকার অত্যুৎসাহী লোক হালকা পিটুনি দিয়ে দিয়েছে। যার জন্য ওর পরনের শার্ট অর্ধেক ভেঁড়া, ভেতরের স্যান্ডো গেঞ্জিও ছিঁড়ে গেছে। আরো মার পড়তো, প্যান্টও হয়তোবা ছিঁড়েখুঁড়ে রেখে দিতো মারধোরপ্রিয় লোজন কিন্তু কুয়ারোনের লোকগুলো ‘আইন নিজেদের হাতে তুলে নেবেন না‘ টাইপ ডায়লগ ঝেড়ে ওকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।

জাহিদুল হাসানের সাথে ওর কিছু বন্ধু-বান্ধবও আড্ডা দিচ্ছিল শাহবাগের ছবির হাটে, তারা গোলমাল শুরুর আগেই যে যেদিকে পারে সটকে পড়েছে। এই লোকেশনটা সালমানের দেয়া, ও বলেছিল আজ বাতিঘর প্রকাশনীর একটা আচ্ছা আছে। সেখানে শরীফুল হাসান আসবেন।

“আমার নাম জাহিদ হোসেন, জাহিদুল হাসান না,” লোকটা মিনমিনিয়ে বলে।

“চোপ, শালা! একদম চোপ।” গলার স্বর আরো কয়েক ডিগ্রি চড়িয়ে উত্তর দেয় বিকাশ।

চুপ মেরে যায় লোকটা।

কুয়ারোন রুষ্ট চোখে ডাবল আরের দিকে তাকান, তার চোখের দৃষ্টি পরিস্কার-এসব কী হচ্ছে?

রাফসার রশিদও রুষ্ট চোখে তার অধীনস্ত অফিসারের দিকে তাকায়। “ওরা তো ঠিক লোককেই ধরে নিয়ে আসছে, ভুলটা হলো কোথায়? এই লোকটাই তো শরীফুল হাসান, জাহিদুল হাসান হবে কেন ও?” ফোন উল্টে সালমানের পাঠানো প্রথম ছবিটা দেখায় সে। প্রথম পাঠানো ছবির সাথে চেয়ারে বেঁধে রাখা লোক মিলে যায়। অমিল বলতে ফোলা চোখ, ফোলা গাল, তুবড়ানো মুখমন্ডল। আর সব ঠিক আছে।

সালমানের পাঠানো ছবিটা আগ বাড়িয়ে বিকাশই সবার ফোনে ফরোয়ার্ড করে দিয়েছিল।

চেয়ারে বাঁধা লোকটা আবার নড়েচড়ে বসে। ওর মিনমিনে গলার স্বর শোনা যায়, “আমার নাম জাহিদ হোসেন, জাহিদুল হাসান না।”

“ওই ব্যাটা, এতো জাহিদ হোসেন জাহিদ হোসেন চুদাস ক্যান? জাহিদ হোসেন জাহিদ হোসেন চুদাস ক্যান?” পরিস্থিতি ক্রমশ আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে, মেজাজ তাই এমনিতেই চড়া বিকাশের। লোকটার কথা যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। ঠাস করে লোকটার গালে একটা চড়ই মেরে বসে বিকাশ।

টাল সামলাতে পারে না লোকটা, চেয়ারসুদ্ধ নিচে পড়ে যায়।

“তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নাই, বিকাশ,” রাফসার রশিদের গলা বরফশীতল। বিকাশ জানে এটা আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়ার পূর্বলক্ষণ। যে কোন সময় ডাবল অব রাগে ফেটে পড়তে পারে।

বিকাশ ইতস্তত করে, কী উত্তর দিবে এটা মনে মনে সাজায়। শরীফুল হাসানকে ও চিনে না, কখনো তার সাথে দেখাও হয়নি, ছবিটা সালমান হকের পাঠানো ছিল-এগুলো বললে প্রতিক্রিয়া কী রকম হবে তা ভেবে শিউরে উঠে ও।

কিন্তু চুপচাপ বসে নেই রাফসার রশিদ। ও ফ্লোরে পড়ে থাকা লোকটার পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ বের করে। মানিব্যাগ ছুঁড়ে বের হয় একটা আইডি কার্ড। একটা প্রতিষ্ঠানের এমপ্লয়ি আইডি কার্ড। কার্ডের ছবির সাথে লোকটার চেহারা মিলিয়ে দেখে ও, ফোন বের করে বিকাশের পাঠানো ছবিটাও দেখে।

“ও তো আসলেই শরীফুল হাসান না। তাহলে ভুল লোকের ছবি পাঠালে কেন বিকাশ?”

গুগলে সার্চ মেরে এতক্ষণে আসল শরীফুল হাসানের ছবিও বের করে ফেলেছেন আলফনসো কুয়ারোন। “এই যে ইনি হচ্ছেন শরীফুল হাসান।” ফোনের স্ক্রিন উল্টে সবাইকে ছবিটা দেখিয়ে দেন তিনি। “এই যে এটা হচ্ছে শরীফুল হাসানের ফেসবুক পেজ।” পেজ ঘেঁটে শরীফুল হাসানের আরো কিছু ছবি বের করেন কুয়ারোন। তারপর ফ্লোরে পড়ে থাকা লোকটাকে দেখান-”জাহিদুল হাসানের সাথে চেহারায় তো আকাশ-পাতাল তফাৎ শরীফুল হাসানের। তুমি কী ইচ্ছে করে ভুল লোকের ছবি পাঠালে, বিকাশ?”

বিকাশ তখন পিছু হটতে হটতে কাঁচে ঘেরা জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পুরো দেয়ালটাই কাঁচ। নিচে সুইমিং পুল দেখা যায়। অনেকে সাঁতার কাটছে, কেউ ডেক চেয়ারে আধশোয়া বসা। বিকাশের ইচ্ছা হয় লাফ মেরে পুলে নেমে যেতে, ডুব দিয়ে অতল জলরাশিতে হারাতে।

আচমকা উঠে দাঁড়ায় ফ্লোরে পড়ে থাকা লোকটা। তার হাতগুলো বাধা হয়েছিল, কিন্তু পা দুটো আর বাঁধা হয়নি। উঠে দাঁড়াতে তাই একটুও সমস্যা হয়নি তার।

চেয়ার উল্টে ডান কপাল ফেটে গেছে লোকটার। রক্ত চুঁইয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে তার ডান চোখ। ফোলা চোখটা এখন টকটকে লাল, রক্তাক্ত।

“আমার নাম জাহিদ হোসেন, জাহিদুল হাসান না।” বলেই দৌড় শুরু করে ও, লক্ষ্য বিকাশ রঞ্জন বিশ্বাস।

বিকাশ বুঝতেও পারে না ওর দিকে স্বয়ং যমদূত ছুটে আসছে। ঘটনার আকস্মিকতায় অপ্রস্তুত রুমে উপস্থিত অন্যরাও। বিকাশ সরে যেতে নেয়, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যমদূত ধরে ফেলেছে ওকে।

ভয়াবহ একটা আওয়াজ হয়। আওয়াজটা কাঁচ ভাঙার।

নিচের লোকজন অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকায়। তারা দেখে সাততলা থেকে দু’জন লোক পড়ছে, একজনের পেছনে আবার চেয়ার বাঁধা।

দ্রুত সরে পতিত দু’জনের জন্য জায়গা করে দেয় সবাই। মাধ্যকর্ষণের অমোঘ নিয়মে দুজনের নামতে বেশি সময় লাগে না। নিচে ল্যান্ড করতেই ফেটে চৌচির হয়ে যায় বিকাশ রঞ্জন বিশ্বাস এবং জাহিদুল হাসান অথবা জাহিদ হোসেনের মস্তক। বের হয়ে পড়ে ভেতরকার কলকজা, যন্ত্রাংশ, জিনিসপাতি।

কিন্তু তবুও জাহিদুল হাসান অথবা জাহিদ হোসেনের পাছার তল থেকে চেয়ারটা সরে না। একটা পায়া ভেঙে গেছে যদিও। তবু তিনটা পায়া নিয়েই ওটা লটকে থাকে লোকটার পিঠে।

*

অধ্যায় ৩৪

চট্টগ্রামে আসার পর সবকিছু খুব দ্রুত ঘটছে। লালন বৈরাগীর বাসা আবিষ্কার, তার অন্তর্ধান (মৃত্যু?), দৃশ্যপটে জাকিয়া খানের আবির্ভাব। এদিকে ঢাকাও উত্তপ্ত। ফিলোসফির প্রফেসর চায়না ঘুরে চা নিয়ে আর্টিকেল লিখলেন, সাথে সাথে ধুন্ধুমার কান্ড ঘটে গেল। সবার সামনে নৃশংস ভাবে খুন হলেন ভদ্রলোক। পেপারে এসেছে ওইদিন ঢাকায় বিদেশি লোকদের আনাগোনা ছিল অপ্রত্যাশিতভাবে বেশি। এদিকে এক চা ম্যানিয়াক সিরিয়াল কিলার মানুষ টপ টপ করে খুন করে যাচ্ছে। সর্বশেষ খুন আজ থেকে সপ্তাহ দুয়েক আগে। মাঝখানে বিরতি। এত দীর্ঘ বিরতি এর আগে দেয়নি খুনি।

তাহলে?

আর, চা নিয়ে এত তুলকালাম কান্ড কেন? সামান্য চায়ের কী এত মাহাত্ন?

জাকিয়া খান ফোনে আর দুই বার কথা বলেছে। একবার ভার্সিটির কারো সাথে। ভার্সিটি থেকেই কল করা হয়েছিল। একটা এক্সট্রা ক্লাস নিতে হবে এইজন্য। পরের কলটা জাকিয়া খান নিজেই করেছিল। পিঞ্জার অর্ডার।

গতকাল যে লোককে করা হয়েছিল ওই সিমটা রেজিস্টার্ড অসীম বড় য়ার নামে। খুব শীঘ্রই টেলিকম কোম্পানি থেকে লোকটার ছবি ও আইডি কার্ড পাঠিয়ে দেবে। সব সিম রেজিস্ট্রেশন করানোয় একটা লাভ হয়েছে। সহজেই অনেক তথ্য পাওয়া যায়।

সেইসাথে একটা খটকা। পুরা শরীরে ধনের ট্যাটু…

বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছেন মিনিট পাঁচেক হলো। আজ আর জহিরকে জানাননি তিনি। একলা একলাই ঘুরবেন মনস্থির করেছেন।

চারুকলার সামনে সুবিশাল মাঠ। ছাত্র-ছাত্রিরা গল্প-গুজবে মত্ত। দু’তিনজনের সাথে খোশগল্প করার চেষ্টা চালান রফিকুল ইসলাম। কিন্তু খুব একটা পাত্তা পান না।

রফিকুল ইসলাম ঘুরে বেড়ান। তার মনে খচখচ করতে থাকে একটা জিনিস। পুরা শরীরে ধনের ট্যাটু…

হঠাৎ তার নজর ঝাকড়া এক গাছের ওপর গিয়ে পড়ে। গাছের নিচে একজন চোখ মুদে পদ্মাসনে বসে আছে, নড়ছে টড়ছে না। যেনবা ধ্যানের দুনিয়ায় হারিয়ে গেছে। একটা সাদা বিড়াল ওর কোলে উবু হয়ে বসা। ঘাসের ওপর টিনের একটা বাটি। বাটিভর্তি দুধ। মুখ বাড়িয়ে বাটি থেকে চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে বিড়ালটা।

আগ্রহ বাড়ে রফিকুল ইসলামের। এগিয়ে যান।

তিনি কাছে গিয়ে বসে থাকেন খানিকক্ষণ। ছেলেটার গভীর শ্বাস টানার আওয়াজ আসছে। বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে, মুখ দিয়ে ছাড়ছে। আবার মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে, নাক দিয়ে ছাড়ছে। এভাবে মিনিট দশেক অতিক্রান্ত হয়। ছেলেটা হঠাৎ কথা বলে উঠে-”কী চান?”

“এটা কিন্তু শরীরের জন্য খুব উপকারী। এই যে বুকভরে শ্বাস নিচ্ছো, ফেলছো। ফুসফুসের জন্য খুব ভালো একটা ব্যায়াম।” খেজুরে আলাপ শুরু করার জন্য এর চেয়ে ভালো টপিক আর মাথায় আসছিল না রফিকুল ইসলামের।

ছেলেটা হাসে। হঠাৎ ওর গায়ের গেরুয়া বসন নজরে আসে গোয়েন্দাপ্রবরের। চাদরের মত কিছু একটা দুই কাঁধে জড়ানো, গা খালি। নিম্নাঙ্গে লুঙ্গি প্লাস ধুতি টাইপ কোন পরিধেয় বস্ত্র। ছেলেটা কী তবে…

“ওই যে দেখছেন আমার বন্ধুকে,” হাত উঁচিয়ে একজনকে দেখায় ছেলেটা। অদূরে ঝাঁকড়া চুলের এক তরুণকে বোর্ডের ওপর ঝুঁকে থাকতে দেখা যায়। হাতে ব্রাশ। ছবি আঁকছে। “আমি ওর মডেল। ছবির নাম ‘আধুনিক যুদ্ধা।”

জিভ কেঁটে উঠে যেতে উদ্যত হন রফিকুল ইসলাম। দূর থেকে বন্ধু তাকে মানা করে। “বসেন আংকেল। একটা ব্রেক নিচ্ছি, দোস্ত। লু ব্রেক।” কড়ে আঙুল উঁচিতে টয়লেটে যাওয়ার সার্বজনীন সংকেতটি দেখায় ঝাঁকড়াচুলল।

লু ব্রেকে চলে যায় ও। বিড়ালটি চুকচুক করে দুধ খায়। আড়মোড়া ভাঙে আধুনিক বুদ্ধা। উঠে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ স্ট্রেচ করে নেয়। হাত পায়ের খিল দূর করে।  

“অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে মনে হয়?”

“হ্যাঁ, প্রায় ঘন্টাখানেক। গতকাল তো আরো বেশিক্ষণ বসেছিলাম। এক নাগাড়ে প্রায় তিন ঘন্টা।”

“বাপরে!” চোখ কপালে উঠে গোয়েন্দাপ্রবরের।

তার বিস্মিত ভাব দেখে হাসে ছেলেটা। বিড়ালটা দুধ খাওয়ায় বিরতি দিয়ে মুখ তুলে তাকায়। বেশি বয়স হবে না ছেলেটার। বিশ-বাইশ। উদাম গায়ে আরো কম বয়স্ক লাগছে তাকে।

“এটা তাহলে সেই বিখ্যাত বোধিবৃক্ষ।” রেইনট্রি গাছের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন রফিকুল ইসলাম।

“হ্যাঁ।” বলে মুচকি হাসে ছেলেটা।

“আচ্ছা ছোট্ট একটা কুইজ। বলো দেখি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গাছ কী?”

ছেলেটা ধন্দে পড়ে যায়। বিড়ালটাও দুধ খাওয়া বন্ধ করে রফিকুল ইসলামের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। কে জানে হয়তোবা উত্তরের আশায়। আকাশ পাতাল ভেবে শেষমেষ হাল ছাড়ে ছেলেটা। “পারলাম না আংকেল। বলেন কোন গাছ?”

“জ্ঞানবৃক্ষ। ট্রি অভ নলেজ। যে বৃক্ষের ফল খেয়ে স্বর্গচ্যুত হন অ্যাডাম ও ঈ।”

তার জবাব শুনে আরো যেন চিন্তামগ্ন হয়ে যায় ছেলেটা। “আংকেল, মাস খানেক আগে চারুকলায় একটা সেমিনার ছিল। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে। ওখানে জাকিয়া সুলতানা তার একটা আর্ট সিরিজের কথা আমাদের জানান। আর্ট সিরিজটার নাম হচ্ছে-ট্রি অভ নলেজ। জ্ঞানবৃক্ষ। আপনার কথা শুনে হঠাৎ ওইটার কথা মনে পড়ে গেল।”

“হ্যাঁ, ইউটিউবে দেখেছি উনার ভিডিও। কালকে উনার সাথে কথাও বলে আসলাম। বেশ প্রতিভাবান শিল্পী।”

“দেখা করে এসেছেন?” একটু যেন অবাক হয় ছেলেটা।

রফিকুল ইসলাম পকেট হাতড়ে তার বন্ধুর একটা ভিজিটিং কার্ড বের করেন। বন্ধু শিল্প-সমঝদার, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কমের আর্টস সেকশনে লেখালেখি করে। নাম মঈনুল আহসান। ওর ভিজিটিং কার্ডটাই ঝেড়ে দেন এখানে। “আমি এসেছিলাম চট্টগ্রাম চারুকলা নিয়ে একটা মস্তবড় ফিচার লিখতে।”

ছেলেটা কার্ডটি দেখে আবার ফেরত দেয়। নিজের পরিচয় বলে। মোহাম্মদ আশফাকুজ্জমান।

লালন বৈরাগী নিয়ে আলাপ হয়। গতকাল বৈরাগীর সাথে রেষারেষির ব্যাপারে প্রশ্ন করায় কিন্তু একটুও প্রতিবাদ করেননি জাকিয়া খান। আসলেই কী রেষারেষি ছিল?

“কই এরকম কিছু তো খেয়াল করিনি। ইন ফ্যাক্ট লালন স্যার জাকিয়া ম্যাডামের ফ্যান ছিলেন। উনার খুব প্রশংসা করতেন। অনেকে তো এও বলে দু’জনের অ্যাফেয়ার ছিল…” কথাটা বলেই ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দেয় ছেলেটা।

মনে মনে অবাক হলেও ব্যাপারটা বুঝতে দেন না তিনি। ছেলেটা তখনো বলে যাচ্ছে, “জাকিয়া খানের ফ্যান কিন্তু কম না, প্রচুর…”

“পাগলা ফ্যানও আছে?”

“হ্যাঁ, আছে তো।”

“আর সুগার সোহানের মতো এডিক্ট ফ্যান?”

ছেলেটা তো অবাক। “আপনি সুগার সোহানকেও চিনেন?”

“হু, চিনি।”

আশফাকুজ্জামানদের এক ব্যাচ সিনিয়র সুগার সোহান। “সোহানের খুব ইচ্ছা জাকিয়া খানের একটা পোর্ট্রেট আঁকবে। ন্যুড পোর্ট্রেট। একবার বলেছিলও। শুনে ম্যাডাম নাকি ওকে চড় মেরেছিলেন। ছেলেটা নিজেকে শুধরে নেয় পরমুহূর্তে। “কনফার্ম খবর না অবশ্য। শোনা কথা। সত্যি নাও হতে পারে। তবে সত্যি হলেও আশ্চর্য হবে না। যে টাইপের ক্রেজি ও। ম্যাডামের একটা ট্যাটু করিয়ে নিয়েছে সোহান। বুকে। সুযোগ পেলেই শার্টের বোতাম খুলে দেখায়।”

“শুনলাম সোহান নাকি জাকিয়া খানকে ফলো করতো? ওর বাসার ওপরও নাকি নজর রাখতো। পাড়া-প্রতিবেশীরা বললো।” আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েন রফিকুল ইসলাম।

লেগে যায়।

“সোহান ফলো করে এটা জানি। তবে বাসার ওপর নজর রাখে কিনা

মুখ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেৰ

এটা জানি না। প্রায়ই তো মাল খেয়ে আউট হয়ে থাকে। পড়াশোনাও ছেড়ে দিয়েছে, অবশ্য এটা ছাড়া উপায়ও ছিল না। এখন শুনেছি নিজেই একটা

আর্ট পত্রিকার এডিটর বনে গিয়ে ছবি-টবি আঁকে…”

“ও না শুনলাম ডার্কের একজন সদস্য?”

“ছিল। তারপর লালন বৈরাগীর সাথে কাঁচাল বেঁধে গেল। প্রায় হাতাহাতি হওয়ার মতো অবস্থা। জাকিয়া সুলতানা তো এমনিতেই দেখতে পারেন না ওকে। শেষমেষ পত্রপাঠ বিদায়।”

“তাই নাকি?” এবার অবাক হবার পালা রফিকুল ইসলামের।

“হ্যাঁ। লালন বৈরাগীর সাথে রাস্তায়ও একবার লেগে গিয়েছিল ওর। কোন কারণে হয়তোবা লালন স্যার মিউনিসিপ্যালিটি মার্কেট এলাকায় গিয়েছিলেন। ওই জায়গা তো বুঝেনই, সুগার সোহানের রাজত্ব। কয়েকজন মিলে লালন স্যারকে ভালোই প্যাদানি দিয়ে নেয়। স্যারও শোধ তুলেছিলেন। ভার্সিটি থেকে সোহানকে এক্সপেল করিয়ে দিয়েছিলেন।”

“সোহান ওয়াজ এক্সপেলড?”

“ইয়েস। বাই লালন বৈরাগী।”

*

অধ্যায় ৩৫

কদমের পেটটা কেমন জানি করছে। গুড়গুড় গুড়গুড় গুড়গুড়। সকাল থেকে এ পর্যন্ত বার পাঁচেক টয়লেট ঘুরে এসেছে ও। কিন্তু আবারো প্রকৃতি ডাক দিয়েছে, সাড়া যে দিতেই হবে। নাহলে রুমেই কর্ম সাধন করতে হবে।

আর রুমটা যেনতেন কোন রুম নয়। যেন পাঁচ তারকা হোটেলের কোন সুইট। টয়লেটও ঝকঝকে তকতকে। চাইলে বিছানা পেতে শোয়া যাবে। আর ফোমের গদি এত নরম যে গা এলিয়ে দিলে মনে হয় যেন মাখনে বসেছে, গলে যাবে। ফ্রিজভর্তি খাবার। কেক, পেস্ট্রি, চকলেট। পানীয়ই কয়েক পদের। রেগুলার পেপসি, ডায়েট পেপসি, কমলার জুস, আপেলের জুস, আঙুলের জুস।

কদমের ভালো লাগার কথা। কিন্তু কদমের ভালো লাগে না। সে ময়লা ছেনে বড় হয়েছে। ময়লাকে সে আপন মনে করে, ভয়ানক দুর্গন্ধে সে বুক ভরে শ্বাস নেয়। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন কিছু দেখলে তার গা ঘিনঘিন করে, মনে হয় কৃত্রিম কিছু। আসল না, নকল। ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

অপারেশন ইন অ্যান্ড আউট সফল হয়েছে। গিল্টি মিয়া এসে ওর খুব তারিফ করলো ওইদিন। অ্যাম্বুলেসে চড়ে হাই-প্রোফাইল মানুষটিকে নিরাপদে নিয়ে আসা চাট্টিখানি কথা নয়। বারবার ওর পিঠ চাপড়ায় গিল্টি মিয়া।

“কদম ইজ এ স্মার্ট বয়। কদম হয় একটা স্মার্ট পোলা।”

অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে সেই যে এই ফ্ল্যাটে হাজির হয়েছে ও, আর বের হয়নি। বের হয়নি না বলে বের হতে দেয়া হয়নি বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। ফ্ল্যাটটা দু’জন ষন্ডামার্কা লোক পালা করে পাহারা দেয়, ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটা মাছিও বের হতে পারে না। হাই-প্রোফাইল লোকটা এখানে থাকেনি, তাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

মামা-মামির জন্য কদমের টেনশন হয় খুব। বুড়ো লোকদুটো কেমন আছে, একমাত্র আল্লাহই জানে। ফোন দিতো ও, টেনশন করতে মানা করে দিতো। কিন্তু ফ্ল্যাটে আসার পর থেকেই ফোন সিজড। গিল্টি মিয়াকে মামা মামির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিল কদম। গিল্টি মিয়া জানায় মামা-মামি ভালো আছে। অযথা চিন্তা না করতে।

মোবাইল সিজ করায় সাপের গেমটাও আর খেলতে পারে না কদম। হোমস্ক্রিনে উপত্যকার ছবিও আর দেখতে পারে না। সবুজ উপত্যকা, কুঁড়েঘর আর রংধনুর সাত রং। দেখলেই মনটা ঠান্ডা হয়ে যেত।

গিল্টি মিয়া আরো জানায়-”অপারেশন ইন অ্যান্ড আউট সফল হইছে। কিন্তু আসল অপারেশনটাই কিন্তু বাকি রইয়া গেছে…অপারেশন আউট।

ওইটা শেষ হইলে আমরা সাকসেস। নাইলে ঘোড়ার ডিম।”

“অপারেশন আউট?” চোখদুটো গোল গোল করে প্রশ্ন করে কদম।

গিল্টি মিয়ার মুখে অশ্লীল হাসি। হাত দিয়ে সে বীর্যস্খলনের ইঙ্গিত করে। “ইয়েস। অপারেশন মাল আউট।”

গিল্টি মিয়ার এখন বিজনেস এক্সিকিউটিভের অবতার। গায়ে দামি স্যুট, টাই। হাতে ব্রিফকেস। চুল ব্যাকব্রাশ করা। মুখে ফ্রেঞ্চকাট। গা’ থেকে ভুরভুর করে ভেসে আসছে দামি পারফিউমের গন্ধ। কিন্তু মুখ আগের মত। লাগামছাড়া।

সে ধীরে ধীরে কদমকে পরবর্তী প্ল্যান শোনায়। এটারও একটা গালভরা নাম দেয়া হয়েছে-অপারেশন শোডাউন। প্ল্যানটা আগের চেয়ে সহজ মনে হয় কদমের। এক রিপোর্টারকে কিছু তথ্য দিতে হবে, এই তো?

এ আর এমন কঠিন কী?

ওর মতামত শুনে মুচকি হাসে গিল্টি মিয়া। দৈনিক তাজা খবরের রিপোর্টার মাহফুজ আহমেদের নাম বলে ও। কীভাবে তাকে অ্যাপ্রোচ করতে হবে, তাও শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়।

মাহফুজ আহমেদ থাকে সেগুনবাগিচায়। সেবা প্রকাশনীর উল্টাদিকের গলির শেষ মাথায় একটা ক্রিম রংয়ের বাড়ি আছে। ওটার দোতলায়।

কদমকে মেইন রাস্তায় ষন্ডাদের একজন নামিয়ে দেয়। ষন্ডার গায়ের গন্ধ ভালো। গন্ধ শুঁকে কদম সহজেই বলে দিতে পারে কতদিন গোসল করেনি ও। মনে মনে হিসাব কষে কদম।

এক দিন, দুই দিন, তিন দিন…এক সপ্তাহ!

ষভা শুয়োরের মত ঘোঁত ঘোঁত করে কদমকে মনে করিয়ে দেয়-উনিশ-বিশ কিছু করলে চাকরিটা খোয়া যাবে, মামা-মামির তেরটা বাজবে, পা কেটে হাতে ধরিয়ে দেয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কদম অবশ্য ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কাটা পা নিয়ে সে করবেটা কী। কাটা পা কী হাতে নিয়ে ঘুরার জিনিস?

ডায়েরির ছেঁড়া পাতা ক’টা পকেটে আছে কিনা দেখে নেয় কদম। বুক পকেটে খসখস করছে কাগজ।

হ্যাঁ, আছে।

মাহফুজ আহমেদকে দেখে মনে হয় এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে। চুলগুলো পেছন দিক দিয়ে খাড়া, ঠোঁটের কোণায় লালা। পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর সুতির লুঙ্গি। লুঙ্গির গিট বাম হাতে ধরা, ডান হাতে দরজার হাতল। হাত ফসকালেই ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে।

ড্রইংরুমটাই শোবার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিছানায় সবুজ মশারি খাটানো। একপাশে সোফাসেট, টেবিল। তবে সব পাশে একটা জিনিস কমন-বই।

লোকটা ঢুলু ঢুলু চোখে ওর দিকে তাকায়। “কী চাই?”

কদম কী চায় তার হালকা আভাস দেয়। তাতেই কাজ হয়। ঘুম নিমেষে উবে যায় মাহফুজ আহমেদের ঢুলু ঢুলু চোখ থেকে, ডান হাতে ধরে রাখা দরজার হাতল পুরোপুরি ফাঁক হয়ে যায়। দুই হাত দিয়ে লুঙ্গিটা ভালো মতো গিঁট দিয়ে নেয় সাংবাদিক। তারপর, বই ফ্লোরে ফেলে কদমের জন্য সোফায় জায়গা করে দেয়া হয়। “বসেন ভাই, বসেন। চা চলবে, চা?”

কদম চা খাবে না। প্রথমে বসে সে ভেতরে ভেতরে খানিকটা গুছিয়ে নেয়। তারপর বলতে শুরু করে। শুরু থেকেই শুরু করে ও–

“মেহবুব স্যারের হার্টের সমস্যা আছে। ডায়বেটিক্সও আছে। চেকআপের জন্য আমাদের হসপিটালে প্রায়ই আসতেন। একবার হার্টের সমস্যায় মাথায় ঘুরান্টি খায়া পইড়া দুই দিন হসপিটালে ছিলেন। ওই সময় আমি ছিলাম রুম ক্লিনার কাম রুম বয়। ওইখান থিকা আমাদের পরিচয়। মেহবুব স্যার আমারে বেশ লাইক করতেন, সুখ-দুঃখের কথা কইতেন। কয় দিন ধরে সময়টা যে খুব খারাপ যাইতেছে ওইগুলা বলাবলি করতেন উনি। খুব টেনশনে থাকতেন, বলতেন উনারে কে জানি ফলো করতেছে। এর মধ্যে দেশ-বিদেশের অনেকেই আছে। উনি কাউরে বিশ্বাস করতে পারতেছেন না, উনার কাজের ছেলেরেও না। কিছুই ভালো লাগতো না স্যারের। একবার তো রাগে-দুঃখে কইয়াই দিলেন, এইভাবে বেশিদিন টিইক্যা থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। এরচেয়ে সুইসাইড ভালা। আর ওরাও ওরে বাঁচতে দিবো না। রাত-বিরাতে উড়াধুরা ফোন আসে। অমর হওয়ার ট্যাবলেট/বড়ি চায়, নইলে লাশ শেয়াল-কুত্তায় খাবে। এরচেয়ে সুইসাইড ভালা না, কন?”

মোবাইলের রেকর্ডার অন। মনোযোগী শ্রোতার মত গালে হাত দিয়ে বসে আছেন দৈনিক তাজা খবরের ডেপুটি স্টাফ রিপোর্টার। পর্দার ফাঁক দিয়ে কাউকে উঁকি-ঝুঁকি মারতে দেখা যায়। কদম গা করে না অতোটা। সে তার কথা চালিয়ে যায়। বুক পকেট থেকে কাগজ বের করে বাড়িয়ে ধরে।

“মেহবুব চৌধুরীর ডায়েরির পাতা। মরার দিন সকালে চেক আপে আসছিলেন উনি। খুব ইমোশনাল হইয়া বললেন, ‘কদম আমি মনে হয় বেশিদিন বাঁচবো না। তুমি এই পাতা কয়টা রাখো। এইগুলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেভ কইরা রাখবা, উপযুক্ত মানুষ পাইলে দিবা। বুঝছো? এইগুলা বলে ডায়েরির পাতা কয়টা আমার হাতে ধরায়া দিলেন। সুযোগ পাইলে আপনার খুব তারিফ করতেন উনি। বলতেন ‘মাহফুজ সাব খুব ভালা সাংবাদিক। উনারে তাজা খবরে মানায় না। উনার আরো ভালো পত্রিকায় চাকরি করা দরকার। এই জন্য এগুলা নিয়া আপনার কাছে আসলাম। আপনে এইগুলার একটা গতি করেন, স্যার।”

মিনতিভরা চোখে তাকিয়ে থাকে কদম। সাংবাদিক মাহফুজ আহমেদ তখন উড়ছেন, ড্যান্ডিখোর আকবরের পঙ্খিরাজ ঘোড়া যেন তিনি। মেঘ কেটে সুন্দর এগিয়ে যাচ্ছেন।

“আপনাকে প্রফেসর মেহবুব আরেফিন চৌধুরী আর কিছু বলেন নাই?” এক ফাঁকে কদমের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন সাংবাদিক।

কদম খানিকক্ষণ ভাবে। তারপর বলে, “স্যার খালি একটা কথাই কইতেন। বারবার কইতেন। কইতেন, টমি মিয়া সব জানে।“

“টমি মিয়া সব জানে?”

“হ। টমি মিয়া সব জানে।”

*

অধ্যায় ৩৬

ক্লান্ত-শ্রান্ত রফিকুল ইসলাম খাবার রুমে আনিয়ে নেন রাতে। আহামরি কোন মেন না। ভাত, ডাল আর মাছ দিয়ে শিমের তরকারি। ওগুলোই চেটেপুটে খান তিনি।

সারাদিন টো টোঁ করে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আজ সঙ্গি মিলেনি। জহির খুব ব্যস্ত, আজ দু’টা পরীক্ষা নিতে হবে। তাছাড়া খাতা দেখার চাপও আছে। তাই আর এদিকে আসা হয়নি ওর। যা করার আজ একলাই করেছেন রফিকুল ইসলাম। আধুনিক বুদ্ধা আশফাকুজ্জামানের সাথে কথা বলে রেজিস্টারেও ঢু মেরেছিলেন একবার। এতদিনে মেয়েটা চিনে গেছে তাকে। তাকে দেখে পরিচিতের হাসি দেয়।

রফিকুল ইসলাম কিছু তথ্য চান। জাকিয়া সুলতানার ব্যাপারে। তার ন্যাশনাল আইডি কার্ড, স্থায়ী ঠিকানা, তার কিছু হলে পিএফ ও গ্র্যাচুইটির টাকা কে পাবে-এ সংক্রান্ত তথ্য। মেয়েটা ওগুলো একে একে জোগাড় করে দেয়। পিএফ-গ্র্যাচুইটির ঘরে একটা পরিচিত নামের দেখা মিলে-অসীম বড়য়া। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়েন তিনি।

সুগার সোহানের গড়াগড়ির জায়গায় গিয়েছিলেন আবার। শুনলেন সোহান আজ গড়াগড়ি দিতে আসেনি। ওর ঠিকানা জোগাড় করে বাসায়ও একবার ফুঁ দেন রফিকুল ইসলাম। উদ্দেশ্য বাসায় গড়াগড়ি দিচ্ছে কিনা দেখা।

বাসায় কেউ নেই। মা শিক্ষিকা, একটি বেসরকারি কলেজে পড়ান। বিকালের দিকে বাসায় ফিরবেন। বাবা চাকরিজীবী, তিনি অবশ্য আর কখনোই ফিরবেন না। বছর সাতেক আগে পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। তাদের একমাত্র সন্তান সোহান।

তথ্যগুলো দেয় কাজের মেয়েটা। বাসায় ওই একমাত্র বাসিন্দা। আর কিছু সাদা বিড়ালকে দেখা যায় ওর পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে।

“সোহান কোথায়?”

গোয়েন্দার প্রশ্ন শুনে ঠোঁট উল্টায় মেয়েটা। “মামায় যে কই থাকে!”

“মামার রুমটা দেখতে পারি?”

মেয়েটা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে ভেতরে ঢুকতে দেয় রফিকুল ইসলামকে। সোহানের রুমের দরজা খুলে দাঁড়ায়। ভেতরে ভোঁতা একটা গন্ধ, সিগারেট খোরদের ঘর থেকে এরকম গন্ধই মিলে। ঘরটা মাঝারি আকৃতির। আসবাব বলতে টেবিল, চেয়ার, খাট ও ওয়াড্রোব। দেয়াল জুড়ে পোট্রট টাঙ্গানো। জাকিয়া সুলতানার পোট্রট। গালে হাত দিয়ে আছেন, চেয়ারে বসে আছেন। নানা স্টাইলের, নানা ভঙ্গিমার।

পকেট থেকে মোবাইল বের করে টপাটপ কয়েকটা ছবি তুলে ফেললেন রফিকুল ইসলাম। দেয়ালের ছবি, ঘরের ছবি। আরো কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে বেরিয়ে পড়েন তিনি।

তার মাথায় তখনো খচখচ করছে একটা জিনিস-পুরা শরীরে ধনের ট্যাটু…

কথাটা গতকাল সোহান হোটেল চুগতাইয়ে বসে বলেছিল। তখন মাথায় ধাক্কা লাগেনি, এখন যতবার ভাবছেন ততবার ধাক্কা লাগছে।

জাকিয়া খানের পুরো শরীরে পুরুষাঙ্গের ছবি আঁকা এটা সোহান কীভাবে জানলে? জাকিয়া খান কী তবে তার নগ্ন শরীর যাকে তাকে দেখিয়ে বেড়ায়? নাকি ব্যাপারটা ভিন্ন? হয়তোবা জাকিয়া খান শেষমেষ সোহানের অনুরোধে নুড চিত্রকর্মের মডেল হতে রাজি হয়েছে। বিচিত্র কিছুই না। অনুরোধে চেঁকি গেলার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আরো আছে।

কিন্তু জাকিয়া খানের কেসটা আসলে কী? দুধ চা কিলার কেসে তার ভূমিকা কোথায় এবং কতখানি? আশফাকুজ্জামান বলছিল অনেকে মনে করে লালন বৈরাগী ও জাকিয়া খানের মাঝে অ্যাফেয়ার ছিল। বৈরাগী নাকি জাকিয়া খানের ফ্যান ছিলেন? সত্যি নাকি?

রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম চারুকলায় আরো কয়েকজনের সাথে কথা বলে দেখেছেন। সবার মতামত দেখা গেল কাছাকাছি। গুজব আছে, ওদের মাঝে একটা সম্পর্ক ছিল। সেই গুজবের মাঝে সত্যতা কতটুকু? আর কতটুকু গুজব?

রফিকুল ইসলাম ভাবতে ভাবতেই একটা কিনারার খোঁজ পান। মিসেস লালন বৈরাগী। লালন বৈরাগীর প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে কখনোই কথা হয়নি রফিকুল ইসলামের। প্রায় আড়াই বছর আগে ওদের ছাড়াছাড়ি হয়েছে। তারপর আরেকটা বিয়ে করেছেন ভদ্রমহিলা। এখন ঢাকায় বসবাস।

প্রথম দিনেই ভার্সিটিতে লালন বৈরাগী ওরফে দুলাল হাসানের রেকর্ড ঘাঁটাঘাঁটি করা শেষ। বৈরাগী তার চাকরিজীবনের প্রাপ্ত পিএফ, গ্র্যাচুইটি ও সার্ভিস বেনিফিটসের নমিনি হিসেবে তার বৌকেই নির্বাচন করে রেখেছিলেন। চাকরি চলাকালীন সময়ে তার মৃত্যুতে বৌ দিলরুবা খানমই সার্ভিস বেনিফিটসের সমুদয় টাকা পেতেন। কিন্তু চাকরি চলাকালীন সময়ে তার কিছু হয়নি, তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও তার সাথে সমস্ত লেনদেন চুকিয়ে দিয়েছে।

প্রথম দিন লালন বৈরাগীর বাড়ি দেখে আসার পর রফিকুল ইসলাম একবার ফোন দিয়েছিলেন দিলরুবা খানমকে, উনি ফোন ধরেননি। আজ চারবার রিং শেষ হতেই ফোন রিসিভ হয়। ওপাশ থেকে একটা ভারি গলা ভেসে আসে।

“হ্যালো।”

“হ্যালো, মিসেস বৈরাগী বলছেন?”

“নট এনিমোর।” খানিকটা বিরক্ত শোনায় ভদ্রমহিলার গলা।

“সরি, দিলরুবা খানম। আমি রফিকুল ইসলাম বলছি। সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর অভ পুলিশ। ভালো আছেন আপনি? কথা বলা যাবে একটু?”

সাময়িক বিরতি। ওপাশের জন ভাবছে। হয়তোবা কথা বলা ও নীরব থাকার উপকারিত-অপকারিতা নিক্তিতে মাপছে। উপকারিতা জিতে যায়।

“বলেন।”

“আপনার এক্স-হাজবেন্ডের খবর নিশ্চয় শুনেছেন আপনি?”

“জি, শুনেছি। কিন্তু আপনারও তো শোনার কথা যে এক্স-হাজবেন্ডের সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হওয়ার প্রায় আড়াই বছর হলো।”

“জি, আমি জানি। আপনি তো ওকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাই না? লালন বৈরাগী মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন?”

“অ্যাভারেজ। গড়পড়তা মানুষ। প্রচুর পরিমাণে লোভ আছে, হিংসা আছে, রাগ আছে, ঘৃণা আছে। চরিত্রও খুব একটা সুবিধার না। যার তার সাথে শুয়ে পড়তে পারে এই লোক। ছাত্রি, ছাত্রির মা কেউ বাদ যায় না ওর লিস্ট থেকে। ওর মতো লোক হলো সমাজের ক্যান্সার। বিষফোঁড়া।”

এ ধরণের একটা জবাব তিনি আশা করছিলেন। পেয়ে তাই বিস্মিত হন না রফিকুল ইসলাম। “আর জাকিয়া সুলতানার সাথে উনার সম্পর্ক?”

“এই লোকটা শরীর ছাড়া কিছু বুঝে না। জাকিয়া সুলতানার সাথে ওর সম্পর্ক ছিল। সুলতানাকে ও ফ্যান্টাসাইজ করতো, দেবী মানতো রীতিমতো। ওই ছিনাল মাগীটাও খুব একটা সুবিধার ছিল না। কাউকে দেখলেই ঢলে পড়তো।” পরের কথাগুলো তিক্ততার বারুদে ঠাসা। “আর্টিস্ট লোকগুলা লুচ্চা শ্রেণীর হয়। পুরা দুনিয়াটাই ওদের জন্য এক বিরাট হোল, ঢুকানোর হোল। একদিন বাসায় এসে মেয়েটাকে হাতে নাতে পেয়ে গেলাম, ফস্টি নস্টি করতে আসছিল। আমাকে দেখে ফেরেশতা সাজে, এদিক দিয়া যাচ্ছিলাম, ভাবলাম ভাবিকে দেখে যাই। চুতমারানি, তুই কারে দেখতে আসছস আমি জানি না, না?”

ওপাশের আগুনের তাপে কানটা ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে রফিকুল ইসলামের। দমকল ডাকার সময় হলো কী?

উত্তাপ তখনো ছড়িয়ে যাচ্ছেন দিলরুবা খানম। “উইদিন ওয়ান উইক, ডিভোের্স দিয়ে আসি কুত্তার বাচ্চাটাকে। কর রংটং। আরো বেশি করে কর। আমার কী? ওই চ্যাটের বাল বাঁচলো না মরলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। মরলে বরং পৃথিবীর লাভ। রাখতেছি।”

লাইনটা ডেড হয়ে যায়। টুট টুট টুট।

*

অধ্যায় ৩৭

পরদিন চারটা প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকা বক্স নিউজ করলো একই শিরোনামে-টমি মিয়া সব জানে। বক্স নিউজের সাথে ছবি জুড়ে দেয়া। ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরীর ডায়েরির ছবি। সাংবাদিকরা ডায়েরি বিশ্লেষণ করে যা বুঝেছেন তা হলো, টমি নামে ডক্টরের একটা পোষা কুকুর আছে। জাতে ল্যাব্রাডর রিট্রিভার। চায়না থেকে ডক্টরের আহরিত জ্ঞান/সম্পদ ওই কুকুরটার হেফাজতে আছে বা ওই জ্ঞান/সম্পদ কোথায় পাওয়া যেতে পারে তার সন্ধান কুকুরটা দিতে পারবে।

মাহফুজ আহমেদ আবার এক কাঠি সরেস। সে ল্যাব্রাডর জাতের ঠিকুজি-কুলুজি, কোথায় পাওয়া যায়, ওদের বৈশিষ্ট্য-সব বের করে পত্রিকায় দিয়ে দেয়। অকুস্থলে গিয়ে একে তাকে জিজ্ঞেস করে জেনেও যায় ডক্টরের বাড়ির ল্যাব্রাডর এখন সৌখিন কুকুর পালক মোস্তফা জামানের জিম্মায়। মোস্তফা জামান পেশায় ব্যবসায়ী। তার একটা ইনডেন্টিং ফার্ম আছে। ব্যবসায়ের কাজে প্রায়ই হিল্লি-দিল্লী করা লাগে। দেশে ফেরার সময় প্রায়শই বিভিন্ন জাতের কুকুর সাথে নিয়ে ফেরেন তিনি। কানাডা থেকে এনেছিলেন চারটা ল্যাব্রাডরের জাত। এর একটা ডক্টরসাহেবকে গিফট দিয়েছিলেন মোস্তফা জামান। ডক্টরসাহেব এসেছিলেন ওর বাসায় নিমন্ত্রণ খেতে। এসে ফ্যাকাশে হলুদ ল্যাব্রাডর দেখে খুব ভালো লেগে যায় তার। মোস্তফা জামান দেখলেন ডক্টরকে উপহার দিলেও ওর কাছে তিনটা থেকে যায়। তাই হাসিমুখেই একটা ডক্টরের হাতে ধরিয়ে দেন তিনি।

মোস্তফা জামান একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য দেন। সেদিন কিছু দুষ্কৃতিকারীর খপ্পরে পড়েছিল ওর কুকুরের দল। দুষ্কৃতিকারীরা টার্গেট করেই এসেছিল। কে জানে, হয়তোবা ডক্টরের ফ্যাকাশে হলুদ ল্যাব্রাডরই ছিল ওদের কাঙ্ক্ষিত টার্গেট। যাই হোক, ল্যাব্রাডর হাতছাড়া হয়নি। তবে মাঝখান দিয়ে ক্রসফায়ারে পড়ে তিনটাকে পটল তুলতে হয়েছে :

কুকুর নাম্বার এক, জার্মান শেফার্ড

কুকুর নাম্বার দুই. রটওয়েলার

কুকুর নাম্বার তিন, ব্লাডহাউন্ড

কিন্তু এক হালি ল্যাব্রাডরের কোন ক্ষতি হয়নি। এখনো বহাল তবিয়তে আছে। চোর পালালে মানুষের বুদ্ধি বাড়ে। মোস্তফা জামানেরও বেড়েছে। এখন বাড়ির সিকিউরিটি টাইট। গার্ড এখন দু’জন। চারদিকে সিসিটিভি ক্যামেরা।

“আর কেনেলেও অলটাইম তালা লাগানো থাকে। দরজাটাও বেশ মজবুত…”

“কেনেল?”

চার দেয়ালের লম্বা শেডটা দেখিয়ে দেন মোস্তফা জামান। “এটাকেই ইংরেজিতে কেনেল বলে।”

গ্রীন সিগন্যাল না পেলে গেটের ভেতরে নতুন কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। মাহফুজ আহমেদকেও থামিয়ে দিয়েছিল গার্ড দু’জন। গেটে ছোটখাট ইন্টারভিউ পর্ব শেষে, আইডি কার্ড-টার্ড দেখিয়ে তবে অনুমতি মেলে।

ডক্টরের এই ল্যাব্রাডর কাহিনী লুফে নেয় প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলো। তারা ক্যামেরা নিয়ে হাজির হয় মোস্তফা জামানের বাসা থান্ডার ইন প্যারাডাইসে। গেট দেখায়, গেটের সামনে দন্ডায়মান দু’জন গার্ড দেখায়। চেহারায় সিরিয়াস ভাবভঙ্গি আর হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সাংবাদিককুল।

সবুজ পাতা টিভি মাসখানেক আগের একটা সাক্ষাৎকার বারবার প্রচার করতে থাকে। সাক্ষাৎকারটা প্রফেসরের বাসার ছাদে নেয়া। প্রফেসর সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, কুকুরটা ঘুর ঘুর করছে। সাক্ষাৎকারের ফাঁকে প্রিয় কুকুরের মুখে গুঁজে দিচ্ছেন বিস্কুট। দূরে চলে গেলে মাঝে মাঝে আদুরে গলায় ডাকছেন, “টমি, কাম হিয়ার। টমি, কাম হিয়ার।”

সোনার বাংলা টিভিতে দেখানো হয় টমির লাইফস্টাইল। টমি ভোরবেলা উঠে মনিবের সাথে হাঁটতে বের হতো। মোহাম্মদপুর মসজিদের উল্টাদিকে একটা ছোট্ট মাঠ আছে, টমির খুব প্রিয় জায়গা। ঘাসে গড়াগড়ি খেত সে, আর মনিব মেহবুব আরেফিন ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতেন। উঠতেন, বসতেন, দৌড়াতেন, স্ট্রেচ করতেন। দুই সাইডে দুটা গোলপোস্ট আছে। গোলপোস্ট ধরে ঝুলাঝুলি করতেন ডক্টর।

ঘন্টাখানেক ব্যায়াম শেষে ক্লান্ত সারমেয় ও মানুষ ঘরে ফিরে আসতো। ব্রেকফাস্টের সময় তখন। ডক্টরের জন্য ব্যালান্সড ব্রেকফাস্ট। দুধ, কলা, জেলি সহকারে দুইটা পাউরুটি, ডাবল ডিমের মামলেট ও এক গ্লাস কমলার জুস। মাঝে মাঝে টেস্ট বদলাবার জন্য আধা বাটি টক দই খান ডক্টর, কখনো সখনো পাউরুটির বদলে থাকে বাটিভর্তি কর্নফ্লেক্স। কর্নফ্লেক্স ভারি পছন্দ ছিল ডক্টরের, সুযোগ পেলেই গপাগপ কর্নফ্লেক্স গিলতেন।

আর টমি’র জন্য রেডি থাকতো বাটি ভর্তি সারমেয় খাদ্য। প্রায়শই ওর পাতে পরিমাপমতো মাংস থাকে, কখনো সখনো ফলমূল। গাজর টমির খুব পছন্দের খাবার। ডক্টর আবার গাজর পছন্দ করতেন না। শুধুমাত্র টমি’র জন্য ঘরে গাজর ঢুকতো। খেয়ে-দেয়ে টমি হালকা ঘুমিয়ে নিতো। আবার। উঠতো ঘন্টাদুয়েক পরে। ততক্ষণে ভার্সিটিতে চলে গেছেন ডক্টর। ঘরে। মানুষ বলতে স্রেফ দু’জন। আকবর আর রাঙ্গার মা।

দস্যিপনায় সময় কাটতো টমি’র। ওর খেলার প্রধান সাথি ছিল আকবর। আকবর বল ছুঁড়ে দিতো, টমি ছুটে গিয়ে বল নিয়ে আসতো। বলের চর্তুদিকে দাঁতের অসংখ্য দাগ। কামড় দিয়েছে যেখানে সেখানে রীতিমত দাঁতের পূর্ণাঙ্গ নকশা বসিয়ে দিয়েছে টমি।

কিছু বিশেষ দিন আছে যা ডক্টর খুব মান্য করতেন। যেমন পহেলা বৈশাখ। ওইদিন রাতে বারবিকিউ পার্টি হতো। ছাদের ফাঁকা জায়গায়। আগুনে ঝলসে মাংস বানাতেন ডক্টর। নিজে খেতেন, অন্যদের খাওয়াতেন। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে গানবাজনা চলতো। ডক্টর ভালো গিটার বাজাতে পারতেন, কখনো সখনো খালি গলায় গান ধরতেন। কুইনের জগদ্বিখ্যাত গান :

I want to break free
I want to break free
I want to break free from your lies
You’re so self satisfied I don’t need you
I’ve got to break free
God knows, God knows I want to break free

টমি লেজ দুলিয়ে নাচতে, নাচতো আকবরও। চাঁদের স্লান আলো ওদের হাসিমাখা মুখে মৃদু পরশ বুলিয়ে দিতো।

*

অধ্যায় ৩৮

টমি মিয়া সব জানে!

খবরের শিরোনাম দেখে ভ্রু কুঁচকাতেই হয় রফিকুল ইসলামকে। ঢাকার ঘটনা নিত্যনতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। ডায়েরির লেখা পড়ে সবাই ভাবছে ডক্টর হয়তোবা তার প্রিয় কুকুরের মাঝেই তার আবিষ্কৃত বস্তুটি রেখে গেছেন। কিন্তু সেই আবিষ্কৃত বস্তুটি কী?

দৈনিক তাজা খবর গোষ্ঠীর ধারণা আবিষ্কৃত বস্তুটি চার কোন লুপ্ত রেসিপি যা চাইনিজ সন্ত শ্যানংয়ের আমলের। আরেক সাংবাদিক শ্যাংকে নিয়ে মশলাদার আর্টিকেল লিখেছে। তার কলমের ছোঁয়ায় শ্যানং পরিণত হয়েছেন এক মিথিক্যাল গডে।

রফিকুল ইসলাম ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামের দিকে দৃষ্টি দেন। চট্টগ্রামে আজ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সাগরের অবস্থা ভালো না। নিম্নচাপ। বৃষ্টির সাথে সাথে হঠাৎ শীতও লাগতে শুরু করেছে। একটা ফুল হাতা শার্ট গায়ে চাপান তিনি।

আলস্য ভর করেছে আজ তার মাঝে। জোর করেই রুম ছাড়তে হয়। জানেন, রুমে থাকলে লেপের নিচ থেকে আর বের হওয়া হবে না।

মাথায় কিছু জিনিস জট পাকিয়ে গেছে, না দৌড়ালে খুলবে না। রফিকুল ইসলাম আগেও ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন। দৌড়ালে বা হাঁটলে তার মাথা খুলে ভালো। জটিল জিনিসও সহজে চিন্তা করতে পারেন। রুমে গিয়ে শার্ট বদলে টি-শার্ট গায়ে চড়ান। তারপর হোটেল থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেন। বৃষ্টির শীতল জলধারায় কেঁপে কেঁপে উঠে তার শরীর। প্রথম প্রথম মনে হয় শীতে বুঝি জমেই যাবেন। কিন্তু ধীরে ধীরে গা-সওয়া যায়। আর ঠান্ডা লাগে না।

কেসটা নিয়ে কিছু খটকা তাকে নিয়ত খোঁচাচ্ছে।

খটকা নাম্বার একঃ জহিরের নক দেওয়া। জহির বলছিল এ্যাফিতির ব্যাপারটা ও ধরতে পারেনি, ওর এক ফেসবুক ফ্রেন্ড ব্যাপারটা দেখিয়ে দিয়েছে। সেই ফেসবুক ফ্রেন্ডের নাম সোবাহান আকবর। জহিরের কাছ থেকে লিংক নিয়ে রফিকুল ইসলাম ওই আইডিতে একবার ঢুঁ মেরেছিলেন। প্রোফাইলে একটা ইয়টের ছবি। ইয়টের নাম-গার্ডেন অভ এডেন। প্রোফাইলে আর তেমন কিছুই নেই। ঠিকানা চট্টগ্রাম লেখা। তিনি একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলেন, রিপ্লাই দেয়নি।

খটকা নাম্বার দুইঃ দ্য টি অভ শ্যানং নামে যে একটা ছবি বৈরাগী আঁকছেন, এটা সোহান জানলো কীভাবে? ছবিটা সাম্প্রতিক, তার ওপর অসমাপ্ত। একমাত্র ওর বাসায় গেলে এটার সম্পর্ক জানতে পারার কথা। তাছাড়া বৈরাগী আর সোহানের মাঝে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। একজন যে আরেকজনকে বাসায় আমন্ত্রণ জানাবেন, এরকম পরিস্থিতি ছিল কী? জবাবটা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাহলে ছবিটার সম্পর্কে ও কীভাবে জানলো?

তিনপাক ঘুরে আবার হোটেলে ফিরে আসেন তিনি। নিচতলায় রেস্টুরেন্ট। ভুনা খিচুড়ির অর্ডার দেন তিনি। বৃষ্টি বাদলার দিনে খিচুড়ি জমবে ভালো, সাথে গরম গরম চা। দুধ চা। দুধ চা খেয়ে খুনিকে পাকড়াও করতে হবে…

তার ঠিক মুখোমুখি রেস্টুরেন্টের পেছনের দরজা। দরজাটা খোলা। বাইরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। কিছু বিশাল সাইজের মুরগি দেখা যায়। টার্কি মুরগি। খুঁটে খুঁটে খাবার খাচ্ছে। হাঁটছে, ঘুরছে আবার নিচু হয়ে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে।

ভুনা খিচুড়ির প্লেট রেখে যায় ওয়েটার। “চা এখন দেব, না খাবার পর?” ওয়েটার জিজ্ঞেস করে।

রফিকুল ইসলাম আনমনা, তার দৃষ্টি তখনো টার্কি মুরগিটার ওপর নিবদ্ধ। কী জানি মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না।

রেস্টুরেন্টটা জনবিরল। তার উল্টা দিকে এক দম্পতি বসেছে। তরুণ তরুণী। মেয়েটা মুগ্ধ নয়নে টার্কি মুরগিটার দিকে তাকিয়ে আছে। নিচু গলায় কী জানি বলে ও ছেলেটাকে।

ছেলেটা উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে গিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে। টার্কিগুলো নির্বিকার। এখনো ওগুলো খুঁটে খুঁটে খেয়েই যাচ্ছে।

ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে টেবিলে ফিরে আসে ছেলেটা। আর রফিকুল ইসলামের গেরোও খুলে যায়।

প্যাঁক প্যাঁক করে সাঁতার কাটে আর খায়!

*

অধ্যায় ৩৯

টমি নাটক নতুন দিকে মোড় নেয়।

টমি যে মানুষ না, সারমেয় এটা পুরো দেশবাসী জেনে গেছে। সে কী খায়, কতটুকু খায়, কীভাবে পয়লা বৈশাখে নাচানাচি করে তাও সবাই জেনে গেছে। সবাই এও জেনে গেছে মৃত্যুর আগে ডক্টর মহামূল্যবান কোন তথ্য এই বিশ্বস্ত কুকুরের কাছে সঁপে গেছেন। এরপর আর বসে থাকে না আমাদের গল্পের কুশীলববৃন্দ।

কাজে নেমে যায় সিআইএ সাউথইস্ট এশিয়া ডেস্কের চিফ অভ অপারেশন্স ডেভিড কর্নওয়েল ও তার দল। রাইলি’র খোঁজ এখনো মেলেনি, কিং আহত। তবে মোহাম্মদপুর অভিযানের কথা শুনে আর বসে থাকেনি কিং। এ জায়গায় এসে নিজের ইজ্জত খুইয়েছে ও, হৃত ইজ্জত পুনরুদ্ধারে দরকার হলে প্রাণ খুইয়ে আসবে। তবু হসপিটাল বেডে বসে আহত নিতম্ব ও কাঁধ ধরে আহাজারি করবে না।

রাশিয়ানরাও নিশ্চেষ্ট বসে নেই। পেটে গুলি খাওয়া সত্ত্বেও ইভান সারভব ওরফে বুলশিট কাজে নেমে পড়ে, সাথে সঙ্গি এজেন্ট মলোটভ। ক্রেমলিনকে বৃদ্ধাগুলি দেখিয়ে আলাদাভাবে লোক পাঠিয়েছেন এফআইএসের বাংলাদেশ প্রধান ফিওদর স্মোলভ। দরকার হলে নিজ দেশের সুপারএজেন্ট বুলশিটের খুলি গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিবেন, তবু ওই ল্যাব্রাডরে তার হাত পড়তে দিবেন না তিনি।

গুপ্তচোখ কাল্টের সদস্যরাও সক্রিয়। ন্যাংটা বুড়ো বুলশিটের সাথে লড়াইয়ে ডান হাত হারিয়েছে যদিও, কিন্তু নিষিদ্ধ ফল উদ্ধারের স্পৃহা হারায়নি একটুও। বরং বেড়েছে। সব ন্যাংটারা কাপড় পরে প্রস্তুতি নিয়ে নেয়। তাদের সদস্যরা কমে গেছে, কিন্তু টাকা ছড়িয়ে তোক ভিড়াতে সময় লাগে না বেশি।

ঘুঘুও প্রস্তুত। সকালবেলা টমির খবর চাউর হবার পর থেকে পুলিশের সাথে সাথে মোহাম্মদপুরে ডিউটি দিচ্ছে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। চাইলে টমিকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে যেতে পারে তারা। কিন্তু ডিপার্টমেন্ট হেড তানজীম ওয়ালিদ বাদ সাধেন। তিনি জানেন দেশ-বিদেশের অনেকেই টমিকে পাওয়ার জন্য মরিয়া। তাই ফাঁদ পেতে বসে থাকেন তিনি ও তার দলবল। এক ঢিলে কয়েকটা পাখি মারার স্বপ্নে বিভোর তিনি। সাদা পোশাকে সাধারণ মানুষদের ভিড়ে মিশে থাকে ঘুঘু বাহিনী।

আলমগীর আবারো ঘুঘু বিক্রেতার ছদ্মবেশে আছে। সকাল থেকে এ পর্যন্ত তিনটা ঘুঘু বিক্রিও করে ফেলেছে ও। মাঝে মাঝে মোড়ের টং দোকানে গিয়ে গলা ভিজিয়ে আসছে। টং দোকানে মারাত্মক ভিড়। দোকানির দম ফেলবার ফুসরত নাই। খালি চায়ের অর্ডার।

“মান্নান ভাই, দুইটা দুধ চা।”

“মান্নান ভাই, রং চা।”

“মান্নান ভাই, আদা চা।”

মান্নান মিয়া অর্ডার শুনে চা তৈরি করে যায়। দুধ চা, রং চা, আদা চা। ভিড় কিন্তু ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে। বেঞ্চিতে জায়গা হয় না। মানুষজন দাঁড়িয়েই চা গিলে।

আকাশের অবস্থা ভালো না। সকালে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তারপর থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি দিচ্ছে। আলমগীর শুনেছে বঙ্গোপসাগরে নাকি নিম্নচাপ। আজ আবহাওয়া এরকমই থাকবে।

আবহাওয়া নিয়ে কারো মাঝে কোন মাথাব্যথা নেই। আজ টক অভ দ্য টাউন টমি। ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরীর প্রিয় ল্যাব্রাডর। “লক্ষ কোটি টাকার রহস্য যার মাঝে লুকিয়ে আছে।

একজন বলে বসলো, “লোভে পইড়া মোস্তফা জামান নিশ্চয়ই কুত্তাটা ছিইড়া ফালাফালা কইর‍্যা ফালাইছে…”।

কথাটা মাটিতে পড়তে দেয় না কেউ। “হু, লোকটার ভাবগতিক এমনিতেই সুবিধার না। এতো এতো কুত্তা দিয়া কী করে ও?”

“লোকটা কুত্তার মাংস খায়, বুঝলেননি? কোরিয়ানরা যেমন কুত্তার মাংস খায়। মোস্তফা জামান আধা কোরিয়ান। ওর বাসায় চাকরি করতো একজন, সে বললো…”।

চা চলতে থাকে। দুধ চা, আদা চা, রং চা। আড্ডাও চলতে থাকে। আপনমনেই গুনগুন করছিল চা দোকানি মান্নান মিয়া।

“জীবনের সবচেয়ে বড় রহস্যটা কী, কন দেহি ভাইসাব?” হঠাৎ দরাজ গলায় প্রশ্ন করে বসে ও।

নড়েচড়ে বসে মান্নান মিয়ার নিয়মিত খদ্দেররা। মান্নান ভাই ফর্মে আছে। আজ নিশ্চয়ই জম্পেশ কোন গল্প হবে! আলমগীরও আগ্রহ বোধ করে।

বুড়োমতন একজন জবাব দেয় অথবা বলা ভালো জবাব দেয়ার চেষ্টা করে। তার মাথায় ক্যাপ, পরনে উলের সোয়েটার। “মৃত্যুই জীবনের সবচেয়ে বড় রহস্য। এরচেয়ে বড় আর কোন রহস্য নাই।”

আরো কয়েকজন চেষ্টা চালায়, কারো জবাবই মনঃপূত হয় না মান্নান মিয়ার। খানিকক্ষণ চুপ মেরে সে পুনর্বার প্রশ্ন করে, “কোন জিনিসটা মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয়? টমির কাছে কী থাকতে পারে যার লাইগ্যা সবাই এত পেরেশান?”

এবারও বুড়া লোকটা উত্তর দেয়। মানুষের কাছে নিজের জীবন সবচেয়ে প্রিয়। কিংবা নিজ নিজ ছেলেমেয়ের জীবন। এর চেয়ে প্রিয়তর আর কিছু নাই।”

“টমির কাছে অমরত্বের চাবি আছে, মান্নান ভাই। অমর হওয়ার মালমশলা ওর মধ্যে ডক্টর দিয়া গেছেন।” আরেকজন জবাব দেয়।

শুনে মুচকি হাসে মান্নান মিয়া। “তাইলে মেইন কথা হইলো গিয়া মানুষ যে কোন মূল্যে বাঁচতে চায়, অমর হইবার চায়। ঠিক কিনা?”

সবাই মাথা দোলায়। মৃত্যু কারোই পছন্দনীয় নয়। বুড়া লোকটা আবার মুখ খুলে। “মান্নান মিয়া, কেউ অমর না। সবাই মারা যায়। মানুষ যে বলতেছে ডক্টরের কাছে অমরত্বের চাবি আছে, এইগুলা আমার কাছে বাকওয়াজ মনে হয়। কারণ পাক কোরানে পরিস্কার বলা আছে, সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে…”

এক তরুণ মাঝখানে মাথা ঢুকিয়ে দেয়। “উনার ডায়েরিতে ব্রক্ষ্মাস্ত্রের কথাও লেখা আছে, চাচা। একদিকে মৃত্যু, আরেকদিকে জীবন।”

মান্নান মিয়া আর কিছু বলে না। চুপচাপ চা বানাতে থাকে। বৃষ্টির বেগ বাড়ে। ভিজে যায় গা মাথা সব। আর দাঁড়ানো যাচ্ছে না। আলমগীর সটকে পড়ে ওখান থেকে।

থান্ডার ইন প্যারাডাইসের সামনে ভিড় এখন কিছুটা হালকা। ওদের মাইক্রোবাস গলির শেষ মাথায় পার্ক করা। লতিফুর রহমানকে দেখা যায় মাইক্রোবাসের পেছনের সিটে বসে থাকতে। খানিক আগেও তিনি পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে ছিলেন। বৃষ্টি দেখে নেমে এসেছেন বোধহয়।

আলমগীর তার অবিক্রিত ঘুঘুগুলো মাইক্রোবাসে রেখেই চা খেতে গিয়েছিল। দূর থেকে লতিফুর রহমানের গনগনে রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে যে কারোরই মনে কু-ডাক ডাকবে। আলমগীরেরও ডাকছে। হয়তোবা আবারো বজ্জাত ঘুঘুগুলো হেগেমুতে ভরিয়ে দিয়েছে মাইক্রোবাস। পারতপক্ষে বসের সামনে পড়া যাবে না। কাঁচা চিবিয়ে খাবে।

হঠাৎ হুল্লোড় শোনা যায়। সবাই উপরে তাকিয়ে আছে। ব্যালকনিতে মোস্তফা জামান দাঁড়ানো, তার পাশে ল্যাব্রাডর।

মোস্তফা জামান স্মিত হেসে হাত নাড়ে। ফটোগ্রাফারের মুহুর্মুহু ফ্ল্যাশের শব্দে মুখরিত হয় চারপাশ।

কুত্তা পেলে সেলিব্রিটি বনে যাওয়া মানব ইতিহাসের একমাত্র লোক।

*

অধ্যায় ৪০

ডুবুরি নামানোর ত্রিশ মিনিটের মাথায় লাশটা উদ্ধার করা হয়। বস্তার একদিক ঘেঁড়া। মাছ ঠুকরে ঠুকরে বস্তার ফাঁক আরো বড় করে ফেলেছে। বস্তা খুললে লালন বৈরাগীর বিভৎস লাশ বের হয়ে আসে। ভোটকা দুর্গন্ধে নাকে হাত চাপে সবাই।

বৈরাগীর হাতের কয়েকটা আঙুল-কড়ে আঙুল, তর্জনী, মধ্যমা উধাও। ডান চোখের মণি উধাও। বাম চোখের অর্ধেক খাওয়া। বাকি অর্ধেক উধাও হওয়ার পথে। উধাও উরুর মাংসল অংশ, কণ্ঠার হাড়। হাড়হীন গলার অন্ধকারে একবার চোখ রাখলে মাথা ঝিমঝিম করে উঠে।

গত দিন পুকুরে কয়েকটা হাঁস ছিল। আপনমনে সাঁতার কাটছিল, আর খুঁটে খুঁটে কী জানি খাচ্ছিল। রফিকুল ইসলাম ভিভো ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলেছিলেন বেশ কয়েকটা। এর মাঝে হাঁসের ছবিও ছিল। খুঁটে খাওয়ার ছবিগুলো ভালোভাবে জুম করতেই ভয়ংকর চিত্রটা বেরিয়ে আসে।

হাঁসটা মানুষের আঙুল খাচ্ছে।

জাকিয়া খানকে পুলিশ ঘিরে রেখেছে। তার মুখ থমথমে। কোন কথা এখনো বলেননি তিনি। তার সাদা শার্ট কুঁচকানো, বেলবটম স্টাইলের ঘিয়ালি রংয়ের প্যান্ট বিবর্ণ।

গেটের বাইরে ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে সাংবাদিকদের দল ততক্ষণে হাজির। রফিকুল ইসলাম ইঙ্গিত দেন। সাথে সাথে পুলিশের তিন জন সদস্য উঠে দাঁড়ায় সাংবাদিকদের সামলাতে।

ভ্যানে উঠার ঠিক আগ মুহূর্তে কৌতূহলের কাছে হার মানেন রফিকুল ইসলাম। তিনি জাকিয়া খানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে বসেনঃ “হোয়াই?”

উত্তর মিলে না। জাকিয়া খান মিষ্টি করে হাসে শ্রেফ।

ভ্যানে বসার পর মেয়েটা মুখ বাড়ায়। “খ্যাতি আর অখ্যাতির মাঝে দূরত্ব স্রেফ চারটা খুন, বুঝলেন রফিকসাহেব।” মেয়েটা আপনমনে হাসে, তারপর আবার বলতে শুরু করে। “সেদিন আপনি ঠিকই বলেছিলেন। ক্রিয়েটিভ মানুষ মাত্রই অ্যাটেনশন সিকার। অ্যাটেনশন না পেলে ক্রিয়েটিভ লোকগুলো মারা যায়। এ মৃত্যু দেখা যায় না, অনুধাবন করে নিতে হয়। যে দুধ চার গ্রাফিতি অনাদরে-অবহেলায় এতদিন চিটাগাং ভার্সিটিতে পড়ে ছিল, তা আজ দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। কীভাবে? স্রেফ চারটা খুন।”

ভ্যানগাড়িটি চলে যায়। এখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। দূরে কোথাও বিদ্যুৎ চমকায়। বজ্রধ্বনিতে কেঁপে উঠে চারপাশ।

*

অধ্যায় ৪১

রাত তখন একটা বেজে পঁয়ত্রিশ।

ঘুঘু ডেকে উঠে কোথাও। ওটাই ছিল সিগন্যাল। বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠে মোহাম্মদপুর এলাকা। দুটা ভ্যান রাখা ছিল থান্ডার ইন প্যারাডাইসের সামনে। টিভি ভ্যান। বিস্ফোরণের ধাক্কায় দুটাই উপানে ধেয়ে যায়। ছিটকে পড়ে এর টায়ার, বনেট, জানালার কাঁচ, কলকজা, নাটবল্ট সব। তারপর আবার ও দুটো গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মত নেমে আসে নিচে। অ্যাশল্টের রাজপথ বিদীর্ণ হয়ে যায় ভয়াবহ সংঘর্ষে।

আলমগীর ঢুলছিল। লালা পড়ে ভিজে গেছে ওর শার্টের একাংশ। বিস্ফোরণের শব্দে উঠতে গিয়ে সিট থেকে পড়েই যায় বেচারা। জেগে উঠে কিচির মিচির শুরু করে দেয় ঘুঘুগুলো। বিশ্রি গন্ধে আবারো ভরে যায় মাইক্রোবাসের ভেতরটা।

ভয়ে মলত্যাগ করেছে ঘুঘুগুলো।

ভাগ্য ভালো লতিফুর রহমান নেই। বারোটার দিকে উনি অপারেশনের দায়িত্ব মামুন-অর-রশিদের ঘাড়ে সঁপে দিয়ে বাসার দিকে পা বাড়িয়েছেন। নাহলে এতক্ষণে চাবকে আলমগীরের পিঠের চামড়া তুলে ফেলতেন তিনি।

কিন্তু কাহিনী কী?

গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় আলমগীর, হাতে রিভলবার প্রস্তুত। প্যাসেঞ্জার সিট থেকে মামুনও নেমে পড়েছে। ওর হাতেও প্রস্তুত ফিভার। বোতামে লাগানো মাইক্রোচিপে কথা বলে উঠে মামুন–”হ্যালো, তৌহিদ। হ্যালো, হ্যালো, আর ইউ দেয়ার?”

তৌহিদ আর জায়েদের ডিউটি ছিল মোস্তফা জামানের বাসার ছাদে। কিন্তু কারো সাড়া পাওয়া যায় না। ছাদে গেলে ব্যাপারটা বুঝতে পারতো মামুন। দেখতে তৌহিদ ও জায়েদ দুজনই কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে ছাদে বসে আছে। মনে হবে গল্পে মগ্ন। কিন্তু আরেকটু কাছে গেলে আবিষ্কার হবে যে দুজনের ঘাড়ই অস্বাভাবিক ভাবে বেঁকে আছে। আর দুজনের কেউই শ্বাস নিচ্ছে না।

দুজনই বুলশিটের শিকার।

তালা ভেঙে সিঁড়িতে পা দিতে যাবে, তখনই আওয়াজটা কানে আসে বুলশিটের। কাঁচ ভাঙার আওয়াজ। থান্ডার ইন প্যারাডাইসের ঠিক উল্টাদিকে ছয়তলা একটা দালান আছে। ওই দালানের তিনতলা ব্যালকনি থেকে কেউ একজন দড়িতে ঝুলে ঝুলে এপাশের ব্যালকনিতে আসছিল। ঠিক শেষ মুহূর্তে ব্যালকনির গিট কেউ একজন কেটে দেয়।

তিনতলার ব্যালকনি মিস হয়ে যায়। দড়িসুদ্ধ মানুষটা দোতলার ব্যালকনির জানালায় গিয়ে আছড়ে পড়ে। কাঁচের জানালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে যায় জোনাথন কিং।

পড়বি তো পড় মালীর ঘাড়ে!

কিং অবশ্য মালীর গায়ে গিয়ে পড়ে না, মোস্তফা জামানদের বাগান নেই। মালী তো দূরের কথা। ও গিয়ে পড়ে একটা ব্লাডহাউন্ডের ওপর। ব্লাডহাউন্ড ঘুমাচ্ছিল। কেউ করে জেগে উঠে। সেদিন যে ব্লাডহাউন্ডটা মারা গিয়েছিল সেটা এই কুকুরের জোড়া। জোড়া হারিয়ে হাউন্ডটার খুব কষ্ট হচ্ছিল। মনিব তাই ওকে নিজের বেডরুমের মেঝেতেই শুতে দিতেন। মাঝরাতে কুঁ কুঁ করে কাঁদলে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দিতেন।

কিংকে মুহূর্তে চিনে ফেলে হাউন্ড। এই লোকটাই সেদিন ওর প্রিয়তমার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছিল।

আজ প্রতিশোধ নেবার পালা।

মুখ হাঁ করে এগিয়ে যায় ব্লাডহাউন্ড, উদ্দেশ্য কিংয়ের জননাঙ্গ। এক কামড়ে ছিঁড়ে…

থপ করে আওয়াজ হয়। নিমেষে হাউন্ডের থ্যাবড়া মুখখানা শতখন্ডে পরিণত হয়। গুলিটা নাক ধ্বসিয়ে দিয়ে ঘাড়ের পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। ওপাশের ব্যালকনির দিকে তাকায় কিং।

অ্যালিস্টার ম্যাকলিন। তাকে তাকাতে দেখে থাম্বস আপ দেখায় ম্যাকলিন।

যে লোকটা ওর দড়ি ছিঁড়ে দিয়েছিল সে এখন রাস্তায়। ম্যাকলিন কারাতের কোপ বসিয়েছিল ওর ডান কানের নিচে। আর টাল সামলানো সম্ভব হয়নি আলফনসো কুয়ারোনের পোপাষা গোয়েন্দা রাফসার রশিদের। কপালের বামপাশটায় চিড় ধরেছে মারাত্মক, অনেকটা যেভাবে দেয়ালে ফাটল ধরে ঠিক সেভাবে।

ফাটল থেকে গলগলিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। রক্ত ভিজিয়ে দেয় কালো কংক্রিট। কালো আর লালে মিলে তৈরি হয় এক ককটেল রং।

নিজেদের বেডরুমে ছয়ফুটী দানব কিংকে দেখে আর আত্মসংবরণ করতে পারেন না মিসেস মোস্তফা জামান, মরণচিৎকার দিয়ে উঠেন। চিৎকার দিয়ে উঠেন সৌখিন কুকুর পালক মোস্তফা জামানও।

তাদের সম্মিলিত চিৎকার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে।

চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়ায় মামুন ও আলমগীর। ওরা সবেমাত্র গেট পেরিয়ে সিঁড়িতে পা রেখেছেন। তবে কী রুমে ঢুকেই গেল কেউ?

দ্রুত সিঁড়ির ধাপ টপকায় ওরা দুজন। মামুন নিজের মাইক্রোচিপে নির্দেশ দেয়-”ইর্মাজেন্সি। উই নিড ব্যাক আপ। আই রিপিট, উই নিড ব্যাক আপ।”

ভয়ংকর শব্দে আবার কেঁপে উঠে থান্ডার ইন প্যারাডাইস। দুই গোয়েন্দা দুই তলায় ঝটপট উঠে দেখে কাঠের দরজা ভাঙা। কেউ একজন বিছানার পাশে নিথর পড়ে আছে। শ্বাস নিতে দেখে আশ্বস্ত হয় তারা।

কিন্তু আশ্বস্ত ভাব বেশিক্ষণ থাকে না। মাথায় কারাতের কোপ খেয়ে দুনিয়া ওলটপালট হয়ে যায় আলমগীরের। মামুনও ছিটকে মেঝেতে গিয়ে পড়ে। উঠতে যাবে তার আগেই অন্ডকোষ বরাবর মোম লাথি।

চোখে অন্ধকার দেখে মামুন। লাথি দিয়ে কিন্তু থেমে নেই ঘাতক। একটা ঘুষি ঠিক ডান কানের নিচে বসিয়ে দেয়, আরেকটা ঘাড়ের স্পর্শকাতর অংশে।

থপ!

মামুন কাতরধ্বনিও করে না। ঘুঘুর অপারেশন-ইন-চার্জ চিরতরে ঢলে পড়ে মেঝেয়।

আলমগীর দৌড়ে ভেতরের বড় রুমে গিয়ে ঢুকে। রুমটা মোস্তফা জামানের। চিৎকারের আওয়াজটা এখান থেকেই আসছিল। এখন আওয়াজ বন্ধ অবশ্য। চিরতরে বন্ধ। কিংয়ের গুলি মিসেস মোস্তফা জামানের বাম স্তন ফুটো করে বেরিয়ে গেছে পিঠ দিয়ে। ওটা এখন সাদা দেয়ালে বিদ্ধ। আর মোস্তফা জামানের মগজ বিছানায় ছিটকে পড়ে দুলছে হালকা। তার মাথা যেন খোসাহীন ফল, কিংবা আরো কাব্যিকভাবে বললে পাঁপড়িহীন গোলাপ।

আলমগীরকে ঢুকতে দেখে গুলি চালায় কিং। বিড়ালের প্রাণ আলমগীরের। শেষ মুহূর্তে লাফ মারায় জানে বাঁচে। জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে কপালে লাগতো, কিন্তু এখন আর লাগে না।

শুলিটা পাওয়ার জন্য বরং কপাল পেতে দেয় আরেকজন। লোকটা আলমগীরের পিছু পিছু রুমে ঢুকছিল। এইমাত্র ঘুঘু’র পুঁদে গোয়েন্দা মামুন অর-রশিদকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছে ও, আলমগীরকেও ঘুম পাড়াতে চাচ্ছিল। ভাবছিল এটা ওর ফরজ কাজ।

কিন্তু তার আগে নিজেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। তার মাথা পেছনের মসৃণ দেয়ালে রক্তাক্ত নকশার সৃষ্টি করে।

লোকটা সুপার এজেন্ট বুলশিটের সঙ্গি মলোটভ। গুলি খেয়ে পটল তোলার আগে একটা গুলি ছোঁড়ার সুযোগ মিলেছিল মলোটভের। ইচ্ছা ছিল মাথায় লাগাবে। কিংয়ের বাম কনুইয়ের সামান্য নিচে গিয়ে তা আঘাত হানে।

হঠাৎ ভয়ংকর একটা শব্দে কেঁপে উঠে তিনতলা দালান। ভারি কিছু একটা পতনের আওয়াজে কানা তালা লাগার জোগাড় হয়। কুকুরগুলোও একসাথে চিৎকার দিয়ে উঠে। কান খাড়া করে আলমগীর।

হ্যাঁ, কুকুরগুলো চেঁচামেচি করছে।

রুম থেকে আস্তে করে সটকে পড়ে ও। গন্তব্য নিচতলা।

নিচতলায় তখন এলাহি কান্ড। ভারি গেট ভেঙে ঢুকে পড়েছে একটা পাঁচটনী ট্রাক। ঘুঘু’র দুই চৌকস ব্যাকআপ, আলম ও বশির, দুজনই ট্রাকের চাপায় পিষ্ট। দুজনেরই হাত-পা-মাথা চিড়ে চ্যাপ্টা।

হয়তোবা গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ওরা। হয়তোবা ধাবমান ট্রাককে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল।

হ্যাঁ, ট্রাকের উইন্ডশিল্ড ভাঙা। ড্রাইভিং সিটে বসে আছে একজন। গলায় মস্ত ফুটো। রক্তে কোল-ড্রাইভিং সিট একাকার। মেঝেতে রক্তের নদী…

পুলিশ ক’জন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে, হাতে উদ্যত রিভলবার। তড়িঘড়ি করে বুক পকেট থেকে কার্ড বের করতে গিয়ে ফেলেই দেয় আলমগীর। গোলাগুলি ও বিস্ফোরণ আতঙ্কে নীল হয়ে যাওয়া এক পুলিশের তর্জনী ট্রিগারে চেপে বসে ভুলে।

গুলি ছুটে।

উবু হয়ে নিজের আইডি কার্ড তুলতে যাওয়া আলমগীরের বরাত আসলেই ভালো। গুলি আবারো ফসকায়। লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলি গিয়ে থামে বিধে।

“আমি ঘুঘু, আমি ঘুঘু।” আলমগীরের চিৎকার চাপা পড়ে আরেকটা বিকট বিস্ফোরণে।

এবারেরটা আসছে পুব দিক থেকে। পুব দিকে ঢালাই দেয়া কুকুরের শেড। ওখানে তখন নাটক জমে উঠেছে। সবে নিজের ব্রহ্মাস্ত্র ছুঁড়ে মেরেছে বুলশিট।

বুম!

বিস্ফোরণের ধাক্কায় উড়ে গেছে গুপ্তচোখের কয়েকজন সদস্য, উড়ে গেছে শেডের দরজার একাংশ। আরেক অংশ ঝুলতে থাকে। কজা নড়বড়ে, ফুঁ দিলেই হয়তোবা ধ্বসে পড়বে। ভেতর থেকে কুকুরের ঘেউঘেউ শোনা যায়।

গুপ্তচোখের অবশিষ্ট সদস্যরা ক্ষ্যাপাচোখে ওর দিকে তাকায়, হাতবিহীন ন্যাংটা বুড়োকে কমিক ক্যারেক্টারের মত লাগছে। যদিও ন্যাংটা বুড়ো এখন আর ন্যাংটা নেই, শরীরে আলখাল্লার মতো কাপড় জড়ানো। বাদবাকিদের পরনেও আলখাল্লা। হঠাৎ দেখলে বৌদ্ধ ভিক্ষুর মতো লাগে।

আবারো মুখোমুখি গুপ্তচোখ-বুলশিট। সেদিনের ঘটনা দু’পক্ষের কেউই ভুলেনি। গুলির ক্ষত এখনো শুকায়নি বুলশিটের। কাঁধে গুলি, উরুতে গুলি, পেটে গুলি। ব্যথা নিয়েই চলছে সে।

ব্যথা নিয়ে চলছে গুপ্তচোখ প্রধান ন্যাংটা বুড়োও। ওদিনের লড়াইয়ে অনেক পুরনো সঙ্গিসাথি হারিয়েছে ও। তাই আর অহেতুক কালক্ষেপণ করে না। একমাত্র হাত থেকে একটা শটগান ঝুলছে। ট্রিগার প্রেস করে ও।

দুম।

বুড়োর হাতের নড়াচড়া দেখেই বিপদ আঁচ করতে পেরেছিল বুলশিট, তৎক্ষণাৎ অ্যাক্রোবেটিক লাফ দিয়েছে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।

দুই আউন্স ওজনের বুলেট ওর বুকের ডান পাঁজরের মাংস খসিয়ে চলে যায়।

ব্যথায় চিৎকার দিয়ে উঠে বুলশিট।

তার কয়েকশো গজ দূরে মরণচিৎকার দিয়ে উঠে আলফনসো কুয়ারোনও। রগচটা গোয়েন্দা রাফসার রশিদকে হারিয়ে নিজেই মাঠে নেমে পড়েছিলেন তিনি। এদিকে গুপ্তচোখ আর বুলশিটের লড়াইও চরমে উঠেছে। শেডের দরজাও অর্ধেক ভাঙা। তাই মনে মনে আশা করছিলেন, ফাঁকেতালে যদি ল্যাব্রাডরটাকে খসানো যায়। মুখও খুলেছিলেন, ‘টমি’ বলে ডাক দিবেন বলে।

কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। ওঁৎ পেতে ছিল সিআইএ’র এক তৎপর সদস্য-ডেভিড ময়েস। ম্যাকলিনের জরুরি মেসেজ পেয়ে বাড়িতে ঢুকেছে ও। হাঙ্গামা এড়িয়ে শেডের কাছে আসতেই দেখে এগিয়ে আসছেন কুয়ারোন।

ময়েস অব্যর্থ শিকারী।

তার গুলি কুয়াররানের হৃৎপিন্ড ফুটো করে দিয়ে বেরিয়ে যায়। অমরত্বের আস্বাদ ধূলিসাৎ হয় মুন ফার্মাসিউটিক্যালসের কনিষ্ঠতম মালিকের।

ইমার্জেন্সি কল পেয়ে হাজির হওয়া র‍্যাবের কিছু চৌকস সদস্য ক্রল করে এগিয়ে যাচ্ছিল তিনতলা দালানের পুবদিকে। তাদের পিছু পিছু পুলিশও আছে, আছে আলমগীরও। তারা ইতিমধ্যে গ্রেফতার করেছে বাইরে ঘাপটি মেরে থাকা সন্দেহভাজন চারজনকে। পরবর্তী জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানাবে ওরা ফিওদর স্মেলভের লোক। স্মোলভ প্রাক্তন কেজিবি বর্তমান এফআইএস-এর বাংলাদেশ হেড।

পুনরায় কেঁপে উঠে থান্ডার ইন প্যারাডাইস, কেঁপে উঠে ক্রল করে এগোতে থাকা র‍্যাব-পুলিশ। মাটিতে শুয়ে থেকে আরেকটা ব্ৰহ্মাস্ত্র ছুঁড়ে মেরেছে বুলশিট।

এবারেরটা ঠিক বুড়োর জম্মার তলায় গিয়ে বিস্ফোরিত হয়। গুপ্তচোখ প্রধানের জঙ্গা সড়াৎ করে দু’ভাগ হয়ে যায়। দেহ ছিঁড়েখুঁড়ে ছিটকে পড়ে দিকবিদিক। হাত, পা, মাথা, হাড়। তার দেহের কলকজা ও যন্ত্রাংশ পরবর্তীতে অনেক খুঁজে উদ্ধার করা হয়। তবে তার চোখগুলো আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আলমগীর পরবর্তীতে কিরা কেটে বলেছে বুড়োর চোখদুটো গপাগপ গিলে ফেলেছে গুপ্তচোখের জীবিত ক’জন সদস্য। তবে আলমগীরের কথা কেউ গোনায় ধরেনি।

ঘেউ ঘেউ ঘেউ। ঘেউ ঘেউ ঘেউ।

ভাঙা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে আতঙ্কিত কুকুরের দল। মুহুর্মুহু গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের আওয়াজে ভয়ে কাঁপছে তারা। ভীত জার্মান শেফার্ডের সামনে পড়ে যায় ডেভিড ময়েস ও বেঘোরে প্রাণ হারায়। শেফার্ড টান মেরে ময়েসের কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলেছে। ময়েস ধাবমান শেফার্ডকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল। গায়ে লাগেনি যদিও। শেডের ভাঙা কজায় গিয়ে ওটা বিদ্ধ হয়।

গোলাগুলি-হাঙ্গামার মাঝে চুপটি করে কখন জোনাথন কিং দোতলার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে নিচে এসে দাঁড়িয়েছে তা কেউ খেয়ালও করেনি। কিং গেট ভেঙে ঢোকা ট্রাক দেখে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহ দেখে, ক্রল করে এগিয়ে যেতে থাকা পুলিশ-র্যাব দেখে। দেখে শেডের ওপাশে ধোঁয়া কুভুলি পাকিয়ে উঠছে। শেডের দরজা ভাঙা, পিলপিল করে কুকুরগুলো বেরিয়ে আসছে। নিথর পড়ে আছে আলখাল্লা পড়া কিছু দেহ, অথবা বলা ভালো, দেহের টুকরোটাকরা। শুয়ে বসে কাতরাচ্ছে আরো কয়েকটা।

তাদের ঠিক উল্টাদিকে বুলশিট। ব্যথায় মুখ বিকৃত। টলমলিয়ে উঠে দাঁড়ায় ও। চোখে ঝাপসা দেখে সবকিছু। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে, পুরনো ব্যথা ঝিলিক মারে। কাঁধে, উরুতে, পেটে। ঝাপসা চোখে ক্রল করে এগোতে থাকা পুলিশ-র্যাব দেখে। ঘাপটি মেরে থাকা শিট আর নজরে পড়ে না তার। একবার চেক করে নেয় ও লিটল বয় আছে কিনা।

হ্যাঁ, আছে।

লিটল বয় হিরোশিমায় ব্যবহৃত অ্যাটম বোমের কোডনেম। তার সাথে যেটা আছে, এটা অ্যাটম বোম না যদিও। ধ্বংসে অ্যাটম বোমার ধারে কাছেও যাবে না এটা। তবে ছোট্ট পরিসরে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।

বোমাটা আনলক করে সে। আনলক করার ষাট সেকেন্ডের মধ্যে ছুঁড়ে দিতে হয় বোমাটি, পুনরায় লক না করলে আপনা আপনি বিস্ফোরিত হবে।

১০, ১১, ১২…

ঘেউঘেউ করতে করতে ভীতসন্ত্রস্ত্ৰ কুকুরগুলো ধেয়ে আসছে। তখনই তীক্ষ্ণ আর্তনাদ।

“বুলশিট!” কিং ডুকরে কেঁদে উঠে।

হাঁচড়ে-পাঁচড়ে এক আলখাল্লাধারী বুলশিটের পেছনে এসে কখন দাঁড়িয়েছে তা ও বুঝতেই পারেনি। বুঝতে পারে যখন ছুরির তীক্ষ্ণ ফলা এঁফোড়-ওফোঁড় করে দেয় ওর পিঠ।

আলখাল্লাধারীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে কিং। কিন্তু বুদ্ধিমান আলখাল্লাধারী বুলশিটকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে।

গুলিটা হৃৎপিন্ডের ঠিক নিচে এসে বিধে। বুলশিট থরথরিয়ে কাঁপে। হাঁটু ভেঙে মেঝেতে পড়ে ও। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে শিটের দিকে একবার তাকায়। শিট তখন স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ, হাতের রিভলবারের দিকে বেকুব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

৪০, ৪১, ৪২…

সিআইএ সাউথইস্ট এশিয়া ডেস্কের চিফ অভ অপারেশন্স ডেভিড কনওয়েল রিভলবার তাক করেন জোনাথন কিংয়ের মাথা বরাবর। তিনি ঢুকেছেন মিনিট পাঁচেক হলো। ময়েসের কোন রিপ্লাই পাচ্ছিলেন না, তাই বাধ্য হয়ে নিজেই ছুটে এসেছেন। এসে দেখেন মঞ্চস্থ হচ্ছে শিট-বুলশিট পালা। “তুমিই তাহলে শিট!”

৫৮, ৫৯…৬০!

বুম!

ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে সমগ্র মোহাম্মদপুর এলাকা। পুবদিকের থামদুটো ধ্বসে যায়, দেয়ালে কয়েক খাবলা গর্তের সৃষ্টি হয়। ছাদের একাংশ ধ্বসে গিয়ে চাপা পড়ে র‍্যাব-পুলিশের ক’জন। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে উড়ে যায় আলখাল্লাধারী, দ্রুত ধাবমান জার্মান শেফার্ড, রট ওয়েলার, ইংলিশ মাস্টিফ ও একটি ল্যাব্রাডর।

ইভান সারভব ওরফে বুলশিটের কোন অস্তিত্বও পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধ্বংসস্তূপের মাঝখান থেকে অনেক খুঁজে পেতে পরবর্তীতে একটা পাছার একাংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়। পাছায় ট্যাটু আঁকা। বিষ্ঠার ট্যাটু। নিচে রাশিয়ান ভাষায় লেখা-শিট।

মারাত্মক আহত আলমগীরকে যখন চ্যাংদোলা করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে, তখন একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে ও। সে দেখে ব্যথায় কাতরাতে থাকা এক আলখাল্লাধারী একটি ফ্যাকাশে ল্যাব্রাডরের গলা ফাঁক করে দিয়ে চুক চুক করে রক্ত পান করছে!

“আই অ্যাম ইমমর্টাল! আই অ্যাম ইমমর্টাল! আই অ্যাম ইমমর্টাল!” আলখাল্লাধারীর চিৎকার থামে এক তরুণ পুলিশ সদস্যের বাঁটের আঘাতে।

আলমগীরের কথাটাকে ডিপার্টমেন্টের সবাই আবারও আষাঢ়ে গল্প হিসেবেই ধরে নেয়।

পুরো মোহাম্মদপুরবাসী তখন বাইরো গলিতে দাঁড়ানো। থান্ডার ইন প্যারাডাইস ঘিরে ধোঁয়ার কুণ্ডুলী ধায় আকাশ পানে।

*

অধ্যায় ৪২

জাকিয়া খান বললেন আননেসেসারি অ্যাটেনশন চান না, হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলেন দুধ চা এ্যাফিতি’র ক্রেডিট কে নিলো তাতে তার কিছু যায় আসে না। এমনকি লালন বৈরাগী যে তার ক্রেডিট কিডন্যাপ করে নিলো তাতেও বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই মনে।

পুরোটাই অভিনয়?

হয়তোবা মনে ক্ষোভ পুষে রেখেছিল, ঢাকায় গিয়ে র‍্যান্ডম কিছু মানুষ মেরে ক্ষোভের উদগীরণ ঘটালো। পপুলার করে তুললো নিজের সৃষ্ট আর্টকে। যে আর্ট এতদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। তারপর কতল করলো বৈরাগীকেও।

কিন্তু কেন? কেন এত পরে? অরিজিন্যাল দেয়ালচিত্রের বয়স দুবছরের বেশি। দু’বছর পর কেন এত হাঙ্গামা, ভাই? আর কেনইবা ঢাকা? জাকিয়া খান তো চট্টগ্রাম থাকেন, খুন চট্টগ্রামে করাটাই কী সহজ হতো না?

নাকি ঢাকায় ওর কোন সহকারি আছে? ওর হয়ে মানুষ কতল করে দিয়েছে। যে ভুল বানানে নিজের নাম বলে।

জি-ইউ-আই-এল-টি-আই… ।

সবাই তো বলছিল লালন বৈরাগী-জাকিয়া খানের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো, ‘অ্যাফেয়ার’ও আছে। বৈরাগীর প্রাক্তন বৌ-এর কথাও কী ওইদিকে ইঙ্গিত দেয় না?

তবে কী অ্যাফেয়ারে চিড় ধরেছে? বৈরাগী অন্য কোন মেয়েতে ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়েছেন? এই খুন কী তবে বৈরাগীর বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম?

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত তখন। জহির এসে ক্যাচুলেট জানালো। চা-টা খেল। আরো কিছুক্ষণ থাকতো কিন্তু ওর ছোট মেয়েটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাই আর সময় দিতে পারছে না। মাহদীর ফোন এলো। টিভিতে খবর দেখেছে। জাকিয়া খান দুধ চা খুনি এটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে ওর।

রফিকুল ইসলাম জানান, সোহানের সাহায্য ছাড়া এটা সম্ভব হতো না। ছেলেটা যদি জাকিয়া খানের ওপর নজর না রাখতো তাহলে…

মাহদী একটু ইতস্তত করে। তারপর জানায় সোহানকে গতকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর সিম অফ।

ব্যাপারটাকে অত গুরুত্ব দেন না রফিকুল ইসলাম। কোথাও নিশ্চয় নেশা-টেশা করে পড়ে আছে। ঠিকই ফিরে আসবে।

রফিকুল ইসলাম খেয়াল করেন তার জিমেইল অ্যাকাউন্টে কেউ একজন মেইল পাঠিয়েছে। ইনবক্সে ঢুকে দেখেন মেইলটা এসেছে গ্রামীণফোন কর্পোরেট অফিস থেকে। দুইটা অ্যাটাচমেন্ট সাথে দেয়া। উনি ঢাকার লোকটার আইডি চেয়েছিলেন। জিপি দুজনের আইডি-ই পাঠিয়ে দিয়েছে। এই আইডি কার্ড দিয়ে জাকিয়া খান সিম রেজিস্টার করেছিলেন। দশ বছর আগে জাকিয়া খানের চেহারায় চাকমাসুলভ ভাব আরো বেশি পরিমাণে বিদ্যমান ছিল। এখন চেহারায় একটা বাঙ্গালীয়ানা এসে মিশেছে, দুটা মিলে এক জগাখিচুড়ি।

এতক্ষণ চেহারার ওপর মনোযোগ বেশি ছিল বিধায় নামের দিকে নজর পড়েনি। কিন্তু নাম দেখতেই চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জোগাড় রফিকুল ইসলামের। নাম-নিশাত বড়ুয়া, পিতার নাম দিলীপ বড়ুয়া। জন্ম তারিখঃ ১৩ জুলাই, ১৯৮৪।

ভালো করে আবার কার্ডটা খুঁটিয়ে দেখেন তিনি। না ভুল হয়নি কোন। নিশাত বড়ুয়া-ই।

কিন্তু জাকিয়া খানের নাম নিশাত বড়ুয়া হয় কীভাবে?

প্লে-স্টোর থেকে ইলেকশন কমিশনের অ্যাপটা বহু আগেই ডাউনলোড করে রেখেছিলেন রফিকুল ইসলাম। মাঝে মাঝে ডাটাবেসে এনআইডি ভেরিফিকেশন চেক করে দেখা হয়। নিশাত বড়ুয়ার এনআইডির নাম্বার দিয়ে চেক করে দেখেন তিনি।

নাহ্, ঠিক আছে। বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানায় চট্টগ্রামের ঠিকানা দেয়া।

এবার ভার্সিটির রেজিস্টার অফিস থেকে প্রাপ্ত ডকুমেন্টগুলো বের করেন। এখানে জাকিয়া খানের পাসপোর্ট দেয়া। নাম-জাকিয়া খান, পিতার নাম সাদেক খান। জন্ম তারিখ অবশ্য একই। ১৩ জুলাই, ১৯৮৪।

ভ্রু কুঁচকে বিছানায় বসে থাকেন রফিকুল ইসলাম, তার মাথায় চিন্তার ঝড়।

দ্বিতীয় অ্যাটাচমেন্টে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তার জন্য। ওখানে একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি ও আইডি কার্ডের ছবি। পিডিএফ ফাইল। অসীম বড়ুয়া নামে একজনের আইডি কার্ড। নাম-অসীম বড়ুয়া, পিতার নাম : দিলীপ বড়ুয়া…।

এতটুকু পড়ে পুনরায় পড়া শুরু করেন রফিকুল ইসলাম। নাম-অসীম বড়ুয়া, পিতার নাম: দিলীপ বড়ুয়া।

ঝটপট নিশাত বড়ুয়ার এনআইডি বের করে নামটায় আবার চোখ বুলান তিনি। নাম-নিশাত বড়ুয়া, পিতার নাম দিলীপ বড়ুয়া…

হোয়াট দ্য ফাক…

অসীম বড়ুয়াই কী তবে গিল্টি মিয়া?

*

মান্নান মিয়া দুধ জ্বাল দেয়। চা পাতা মেশায়, চিনি মেশায়। গরম গরম চা কাপে ঢেলে পরিবেশন করে।

কালকে থেকে বৃষ্টি দিচ্ছে, এখনো অবিরত চলছে। বঙ্গোপসাগরে চাপ অব্যাহত। মান্নান মিয়াও খদ্দেরের চাপ অনুভব করেন। সাড়ে আটটাতেই আজ দোকান খুলে বসেছে ও। এই সকালেও মানুষের ভিড়।

কালকে মোহাম্মদপুরের পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল। রাতে বিস্ফোরণ আর গোলাগুলির শব্দে মনে হচ্ছিল কেয়ামত বুঝি সমাগত। চারদিকে গুজব। সবাই বলাবলি করছে কালকে গোলাগুলিতে প্রায় ৫০ জন মানুষ মারা গেছে। সবাই-ই নাকি বিদেশি গুপ্তচর।

আর কুকুরগুলোর একটাও বেঁচে নাই। একজন চুকচুক করে। “আহারে অবলা পশু।”

“আমার তো মনে হয় মোস্তফা জামান একলাই কুকুরগুলারে সাবাড় কইরা দিছে। পত্রিকায় লিখলো ল্যাওড়াধর একটারেও নাকি পায় নাই…”

“ল্যাওড়াধর না চাচা। ল্যাব্রাডর, ল্যাব্রাডর।” এক তরুণ শুধরে দেয় তাকে।

“অই হইলো।”

খানিকক্ষণ চুপচাপ চা খায় সবাই। গলিতে পুলিশ গিজগিজ করছে এখনো। লোকজনের ভিড়, কৌতূহলী সংবাদকর্মী, টিভি কু-সবকিছু মিলিয়ে রীতিমত গলদঘর্ম অবস্থা। মাঝে মাঝে পুলিশের অর্ডার আসে, এত কাপ চা পাঠায়া দাও। চা পাঠানো লাগে। একলা এত কিছু সামাল দিতে পারছে না মান্নান মিয়া। আজকের দিনের জন্য তাই দু’শো টাকা রোজ হিসাবে পিচ্চি এক টোকাইকে কাজে রেখেছে ও। চা-টা ওই এগিয়ে দেয়।

“অমরত্বের চাবি কী কেউ পেল?” একজন প্রশ্ন করে। কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো লোকটার, চেহারায় লম্বা ভ্রমণের অবসাদ।

“ধুর! সব বাকওয়াজ। কেউ অমর না, কেউ অমর হইতে পারে না।” ভিড় থেকে কেউ একজন জবাব দেয়।

কাজ করতে করতেই এক গাল হাসে মান্নান মিয়া। জ্বাল দেয়া দুধে চা পাতা মেশায়, চিনি মেশায়।

“হাসেন যে মান্নান ভাই?” ছেলেটা মান্নান মিয়ার নিয়মিত খদ্দের। বেস্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।

খুক খুক কেশে গলা পরিস্কার করে নেয় চা দোকানি। “আচ্ছা ভাইসাবেরা আপনেরা তো উচ্চ শিক্ষিত। আমারে কন তো এই যে পুরান পুরান সব বই-ধরেন, রামায়ণ, মহাভারত, শাহনামা এইগুলা মানুষ এখনো পড়ে ক্যান? এইগুলা তো হাজার বছরের পুরানা। তাইলে এতগুলা বছর এইগুলা টিকা আছে ক্যামনে?”

কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো লোকটা মুচকি হাসে। তার অবসাদগ্রস্ত মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। “মানে আপনি বলছেন মানুষ তার কর্মের মাধ্যমে অমর হয়, শারীরিকভাবে এটা সম্ভব না হলেও।”

আবারো মান্নান মিয়ার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। বহু বছর আগে একজনের কাছে আমি একটা গল্প শুনছিলাম। দেশ-বিদেশ ঘুরেন তিনি। একবার তিনি ইরাক গেছিলেন। তখনো সাদ্দাম ক্ষমতায়। ওইখানে একটা জায়গা আছে, নাম হইলো গিয়া…”।

“আল-কুর্না।” ব্যাগওয়ালা লোকটা বলে।

মান্নান মিয়া কৌতূহলী চোখে খদ্দেরের দিকে তাকায়। “জনাবের পরিচয়?”

রফিকুল ইসলাম পকেট থেকে আইডি কার্ড বের করে দেখান। গতকাল রাতের ট্রেন ধরে আজ সকালে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন তিনি। এসেই হালকা নাস্তা সেরে অসীম বড়ুয়ার খোঁজে ঢু মেরেছেন মোহাম্মদপুরে। অসীম বড়ুয়ার এনআইডি’তে মোহাম্মদপুরের ঠিকানাই দেয়া। বাড়িটা এই গলি থেকে মিনিট দশেকের রাস্তা। পানির ট্যাংকির পেছনে একটা কলোনি আছে, ওই কলোনিতে তার বাড়ি। একে তাকে জিজ্ঞেস করেন রফিকুল ইসলাম, অসীম বড়ুয়াকে চেনে কিনা?

সবাই না বোধক জবাব দেয়। এই নাম-ই ওরা জীবনে শোনেনি। চেনা তো দূরের কথা।

পরে এনআইডি কার্ডের কপি বের করলে সবাই চিনতে পারে। আরে, এ তো আমগো মান্নান ভাই।

তারপর অসীম বড়ুয়া ওরফে মান্নান মিয়ার খোঁজে এই গলিতে আগমন। জাকিয়া খানের দুই নামের জটিলতা মিটেছে। মেয়েটা এফিডেভিট করিয়ে জাকিয়া খান হয়েছে, নিশাত বড়ুয়া ছিল তার আসল নাম।

কার্ড দেখে জিভ কাটে চা দোকানি। “বেয়াদবি হইয়া গেছে, স্যার। মাফ কইরা দিয়েন।”

এবার রফিকুল ইসলামের হাসার পালা। “পরিচয় জানতে চাওয়া বেয়াদবি না, মান্নান মিয়া। নাকি অসীম বড়ুয়া বলে ডাকবো?”

আবারো হাসে মান্নান মিয়া। তবে কাজ থামায় না। চুপচাপ দুধ, চা পাতা মিশিয়ে গরম গরম চা পরিবেশন করে যায়।

“তোমার গল্প শেষ করো, মান্নান মিয়া।” আপনি থেকে সরাসরি তুমিতে নেমে আসলেন রফিকুল ইসলাম।

নতুন আসা খদ্দেরের হাতে চার কাপ ধরিয়ে মান্নান মিয়া আবার শুরু করে, “আল-কুনা শহরে একটা বরই গাছ আছে। মানুষজন ধারণা করে এই গাছটাই হইলো গিয়া কোরান-বাইবেলের গাছ। উনিও গাছ দেখতে গেছিলেন। গাছ থেকে বরই খাইয়া আসছেন।”

“এই গল্পের মাধ্যমে আসলে আপনি কী বুঝাতে চাইতেছেন, মান্নান ভাই?” তরুণটি প্রশ্ন করে।

রফিকুল ইসলামের চা খাওয়া শেষ। কাপটা উনি মান্নান মিয়ার হাতে ধরিয়ে দেন। মান্নান মিয়া কাপটা ছোট্ট বালতিতে ফেলে দেয়। পরিস্কার করে আবার এই কাপেই চা পরিবেশন করা হবে।

“হ্যাঁ। গল্পের মাজেজা বলো। আর এখন শুদ্ধ বাংলাতে বলল। তুমি একজন লেখক। আর তোমার ভাষা মোটেও এরকম না।” রফিকুল ইসলাম শুধু বাড়ি চিনেই আসেননি, বাড়ির ভিতরে ঢুও মেরে এসেছেন। দেখেছেন চা-দোকানি মান্নান মিয়ার দুই রুমের টিনশেড কীভাবে নানা ধরণের বইয়ে স্তূপাকার। এর মাঝে পাণ্ডুলিপিও আছে। গল্পের, উপন্যাসের, কবিতার।

চারপাশের লোকজন অবাক হয়ে মান্নান মিয়ার দিকে তাকায়। তবে মান্নান মিয়া ভ্রূক্ষেপ করে না। এবার সে প্রমিত বাংলায় গল্প বলা শুরু করে। “আমি একটা গল্প প্রায়ই বলি। একজন জ্ঞানী সন্তের গল্প। অনেক অনেক কাল আগে ছিলেন তিনি। জঙ্গলে বাস করতেন, ধ্যানে সময় কাটিয়ে দিতেন। খুব ভালো চিকিৎসক ছিলেন ওই সন্ত। একমাত্র মৃত্যু ব্যাতীত সকল রোগের দাওয়াই ছিলো তার কাছে। মানুষজনও চিকিৎসা নিতে আসতো। মুমূর্ষদের বাঁচিয়ে তিনি আনন্দ পেতেন, প্রতিদানে কিছু চাইতেন না। কিন্তু মৃত্যুর বিরুদ্ধে তিনি জয়ী হতে পারেননি। মানুষ মরবেই, এই যেন ছিল নিয়তি। তারপর একদিন তিনি একটা গাছ খুঁজে পান। যে গাছের ফল খেলে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায় মানুষ।

এই সন্তের নাম হলো শ্যানং, আর তার উদ্ভাবিত গাছের নাম হচ্ছে চা গাছ। যদিওবা কালের পরিক্রমায় গল্পটার বিকৃতি ঘটেছে। আসলে শ্যানং যে গাছ খুঁজে পেয়েছিলেন তা মৃত্যুকে শারীরিকভাবে পরাজিত করার গাছ।, এই গাছের ফল খেলে মৃত্যুকে স্পিরিচুয়ালি পরাজিত করা সম্ভব। কারণ এই গাছই হলো জ্ঞানবৃক্ষ, বাইবেলে বর্ণিত ট্রি অভ নলেজ। এই গাছের ফল যে একবার খেয়েছে তার মধ্যে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে। এই গাছকে ট্রি অভ চেঞ্জও বলা যায়।” মান্নান মিয়া একটু থামে। ইঙ্গিতে ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরীর বাড়ি দেখিয়ে বলে, “ডক্টর আমাকে বলেছিলেন, চায়নায় গিয়ে উনি সেই গাছের বীজ খুঁজে পেয়েছেন। শ্যানংয়ের সেই বিখ্যাত গাছ। আমি বললাম, আমরাও তো এর দাবিদার। শ্যানংয়ের বংশধর তো আমরাও…”

সবাই অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এসব কী আবোলতাবোল বকছে মান্নান মিয়া?

রফিকুল ইসলাম ইঙ্গিত দেন। সাদা পোশাকের ক’জন পুলিশ এসে মান্নান মিয়াকে দু’পাশ থেকে চেপে ধরে।

পুলিশগুলো তখন মান্নান মিয়াকে ধরে জিপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রফিকুল ইসলামের দৃঢ় বিশ্বাস, এই উন্মাদটাই দুধ চা খুনি। তার আপন বোন জাকিয়া খান/নিশাত বড়ুয়া। ভাইয়ের কুকর্ম ঢাকার জন্য জাকিয়া খান স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

“ডক্টরকে কী জন্য মারলি? অমরত্বের বখরা দেয়নি বলে?” রফিকুল ইসলাম এখন সোজা তুইয়ে নেমে গেছেন।

জিপে বসে হো হো করে হাসতে থাকে মান্নান মিয়া/অসীম বড়ুয়া। “হা হা হা। হো হো হো। আপনি মনে করেন ডক্টর মারা গেছে! হা হা হা। হো হো হো।” হাসতে হাসতে সিটে পড়েই যাবার উপক্রম হয় মান্নান মিয়ার।

রাইফেলের বাঁট দিয়ে ওর পেটে শক্ত করে তো দেয় একজন। “এই থাম। শালা দেখি পুরা মেন্টাল।”

জিপ ছেড়ে দেয়। মান্নান মিয়াকে মোহাম্মদপুর থানার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। মোবাইল ভাইব্রেট করছে দেখে পকেট থেকে মোবাইল বের করেন রফিকুল ইসলাম।

ছয়টা মিস কল! এই সবেমাত্র একটা মেসেজও এসে ঢুকলো। হয়তোবা ফোনে না পেয়ে মেসেজ পাঠিয়েছে। জহির।

মেসেজে ছোট্ট করে লেখা-সোহানের লাশ পাওয়া গেছে। দেখে মনে হচ্ছে, ড্রাগ ওভারডোজ।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকেন রফিকুল ইসলাম।

*

পরিশিষ্ট

ইয়টটির নাম বেশ গালভরা। গার্ডেন অভ এডেন। স্বর্গোদ্যান।

লম্বায়ও ইয়টটা দশাসই। প্রায় দেড়শো মিটার হবে। এটাকে ইয়ট না বলে অনায়াসে সুপারইয়ট বলা যায়।

এই মুহূর্তে ইয়টটা ঘিরে পাক খাচ্ছে একটা শ্বেতশুভ্র অ্যালবাট্রস। প্রায় আধাঘন্টা যাবত ইয়টটা অনুসরণ করে আসছে এ পাখি। কিন্তু পাখিটাকে সরে জায়গা করে দিতে হয়। কারণ তার জায়গায় এক মহাপতঙ্গ এসে আবির্ভূত হয়েছে। ওটা এখন ল্যান্ড করবে ইয়টে।

নিচে ক্রুরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ল্যান্ডিংয়ের জায়গা খালি করে ফেলে। মহাপতঙ্গ ধীরে ধীরে ল্যান্ড করে। দরজা খুলে যায়। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার একজন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করে। তার গায়ে দামি স্যুট, পায়ে দামি জুতো, মাথায় হাভানা হ্যাট। লোকটার বয়স দেখে বুঝা মুশকিল। চল্লিশও মনে হয়, পঞ্চাশ বললেও খুব বেশি বলা হয়েছে বলে মনে হয় না। তার হাঁটাচলার গতি বেশ স্বচ্ছন্দ, মসৃণ।

তার ওজন মাসখানেক আগেও ৭৯ কেজি ছিল, এই কদিনে ওজন খানিকটা কমেছে। এখন ওজন ৭৪ কেজি। স্যুট-শার্ট খুললে নাভির উপরে জোড়া জড়ুল দেখা যাবে।

তিনি ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরী।

তার পিছু পিছু সিঁড়ি বেয়ে গিল্টি মিয়াকে নামতে দেখা যায়। সেও স্যুটেড-বুটেড, হাতে ব্রিফকেস। তার পেছনে এক বিদেশি ললনা। জোয়ানা মানিপেনি। পরনে ঢোলা ফুলপ্যান্ট, উপরে সাদা ব্লাউজ। ব্লাউজের উপরে একটা শর্ট কোট।

ইয়টটার একদম উপরে হেলিপ্যাড। কপ্টার ওখানেই নেমেছে। ড. মেহবুব সিঁড়ি বেয়ে নিচের ফ্লোরে নামেন। ওখানে একটা ছোট্ট সৌখিন সুইমিং পুল। পুলে কেউ নামে না অবশ্য। কারণ পুল ভর্তি হাঙ্গর মাছ। ডক্টর হাঙ্গর মাছ খুব পছন্দ করেন, তার জন্য বিশেষভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে ওগুলো।

ডেক চেয়ারে গালে হাত দিয়ে পরিচিত একজনকে বসে থাকতে দেখা যায়। কদম।

“কদমের মুখ এত শুকনা ক্যান? কী হইছে? বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে?” গিল্টি মিয়া জিজ্ঞেস করে।

কদম চমকে উঠে। ফিরে তাকায় তিনজনের ছোট্ট দলটার দিকে। তার চোখ খানিকক্ষণের জন্য মানিপেনির ওপর গিয়ে পড়ে, কী জানি মনে করার চেষ্টা করে ও। তারপর ক্ষান্ত দিয়ে হাঙ্গর মাছগুলোর দিকে তাকায়। সে শুনেছে হাঙ্গর মাছগুলো সকাল থেকে না-খাওয়া। বসের নির্দেশ। উনি এসে নাকি খাবার দেবেন।

গিল্টি মিয়া ইঙ্গিতে হাঙ্গর মাছ দেখায়-”দেখতাছো ক্যামুন ভুখা! তোমার ওজনের কাউরে ফেলে দিলে তো দুই মিনিটের মামলা। মাত্র দুই মিনিট।” ডান হাতের দুই আঙুল দেখায় ও। তর্জনী ও মধ্যমা।

“আর তোমার ওজনের কাউকে ফেলে দিলে?” মেহবুব আরেফিন জিজ্ঞেস করেন।

“এই ধরেন পাঁচ মিনিট।” নিজের মেদবহুল শরীরের দিকে তাকিয়ে বলে ও।

এর আগেই গিল্টি মিয়ার ডানপাশের কপালে রিভলবার ঠেকিয়ে গুলি করে বসেন ডক্টর। গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে। গ্যালন গ্যালন রক্ত। গুলি করার পরপরই হালকা একটা ধাক্কা। টাল সামলাতে না পেরে সুইমিং পুলে পড়ে যায় গিল্টি মিয়া। ওখানে ওঁৎ পেতে আছে ক্ষুধার্ত হাঙ্গর মাছ।

“গিল্টি মিয়া, নো হার্ড ফিলিংস। ওকে?”

দুইটা হাঙ্গর মাছ এসে খুবলানো শুরু করে গিল্টি মিয়াকে। ধীরে ধীরে আরো কয়েকটা এসে হাজির হয়। একে একে সব কটা। গিল্টি মিয়া এখন সকল ধরণের হার্ড ফিলিংসের ঊর্ধ্বে।

গিল্টি মিয়াকে শেষ করতে করতে হাঙ্গরগুলো সময় নেয় মোটে তিন মিনিট আটচল্লিশ সেকেন্ড। পুলের নীল পানি তখন পরিণত হয়েছে টকটকে লালে।

স্টপওয়াচে হিসাব রাখছিলেন ডক্টর। স্বল্প সময় দেখে মুগ্ধ হন তিনি।

এরকম নৃশংস হত্যাকান্ডের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না কদম। সে পুরো হকচকিয়ে যায়। মানিপেনির মুখ অভিব্যক্তিহীন। তার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় নির্দেশ ছুঁড়ে দেন প্রফেসর-”যাও, পানিটা চেঞ্জ করতে বলো।” মানিপেনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়।

কদম তখনো খাবি খাচ্ছে।

“কুল ডাউন, কদম। কুল ডাউন। মানবজাতির ইতিহাস ভায়োলেন্সের ইতিহাস। এত সহজে ঘাবড়ালে চলবে? গিল্টি মিয়া ইজ ডেড, কারণ ও আমার সমস্ত প্ল্যান জানে। খুব রিস্কি। সরিয়ে দিতেই হলো, উপায় ছিল না। আচ্ছা গিল্টিকে ছাড়ো, আমাকে দেখো। এত সাংঘাতিক একটা প্ল্যান করলাম, নিজেই নিজের মৃত্যু রচনা করলাম, পাবলিককে ঢোল পিটিয়ে দেখিয়ে দিলাম যে ড. মেহবুব আরেফিন চৌধুরী ইজ ডেড। তাই না? এখন মৃত্যুবরণ না করলে তো পুর্নজন্ম নেওয়া সম্ভব না, কী বলল কদম? তাই আমার মৃত্যুবরণটা নেসেসারি ছিল। প্রয়োজনীয়। পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে ছিল আমেরিকা, রাশিয়া, বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো। ওদেরকে তো বুঝতে হবে যে ড. মেহবুব ইজ নো লংগার এলাইভ, তোমরা পিছু নেওয়া বন্ধ করো। তাই আমি আমার মতো দেখতে একজনকে পাঠালাম, আর আমি রয়ে গেলাম পিছে। টাকায় বাঘের চোখও পাওয়া যায়। আর এটা তো লুক এলাইক। আমার মতো চেহারা হতে হবে, উচ্চতা, চালচলন, পরিধেয় বস্ত্রাদি এগুলোও আমার মতে হতে হবে। তোমাকে হাত করলাম, কাসেমকেও হাত করলাম। তার হাতের তালুতে নতুন এক ধরণের ড্রাগ ইনজেক্ট করলাম, যখন নকল মেহবুব আরেফিন ওর সাথে হাত মেলালো কসাইখানায়। সো দ্যাট হি লুজেস হিজ মাইন্ড। এই ড্রাগটা মানুষের হিডেন ডিজায়ারগুলো প্রকট করে তোলে। তারপর তো দেখলে কাসেমের কাজ চপ চপ চপ চপ চপ।” হাত দিয়ে দা চালানোর ভঙ্গি করেন প্রফেসর। “নিয়মিত আকবরকেও ড্রাগ দেয়া হতো। এ ছাড়া উপায়ও ছিলো না, আকবরের যে স্পাই হওয়ার খায়েশ জেগেছে। ফলাফল তে দেখতেই পাচ্ছো: সফলতা।”

প্রফেসরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে কদম। তার চেহারায় যে অনুভূতি ফুটে উঠেছে তার নাম একটাই-ঘৃণা। দু’চোখে প্রবল ঘৃণা নিয়ে সে প্রফেসরের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে।

প্রশ্ন করতে চায় কদম-এতকিছু করে কী পেল ও? কিন্তু একদলা থুথু জমে আছে মুখে। ইয়টেই থুথু ফেলে দেয় ও।

মুচকি হাসেন মেহবুব আরেফিন। “আমার বায়োলজিক্যাল মাদার ছিলেন একজন পতিতা। আমার মা শামসাদ চৌধুরী ছিলেন গর্ভধারণে অক্ষম। ইনফার্টাইল, বন্ধ্যা। বাবা-মা দুজনেই সন্তান পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। সকল লাইনেই চেষ্টা করেছেন। ডাক্তারি, কবিরাজী। বাবার দেশ-বিদেশ ঘোরার চাকরি ছিল। যেখানেই গেছেন জড়িবুটি, তুকতাক সবকিছু ট্রাই করেছেন। তারপর বাবা গেলেন চায়নায়। ওখানেই দেখা হয় আমার বায়োলজিক্যাল মাদারের সাথে-মার্গারেট চো। চো’র ঔরসেই আমার জন্ম। চো’র ঔরসে আরো জন্ম মান্নান মিয়া/অসীম বড়ুয়া ও জাকিয়া খান/নিশাত বড়ুয়া’র। সেম ফাদার না যদিও, ভিন্ন ফাদার। মার্গারেট চো তো শেষ পর্যন্ত একজন পতিতা। তবে তিনি খুব ভালোবাসতেন বাবাকে। বাবার সাথেই উনি বাংলাদেশে চলে আসেন, চট্টগ্রামে ঘাঁটি গাড়েন। বাবাই উনার দেখভাল করতেন। আমার আসল মা শামসাদ চৌধুরী এগুলোর কিছুই জানতেন না। তিনি জানতেন আমাকে অ্যাডপ্ট করা হয়েছে। মার্গারেট চো’র ব্যাপারে তার কোন আইডিয়া ছিল না। বাবারও কী ছিল? তিনি কী জানতেন মার্গারেট চো শ্যানংয়ের বংশধর?”

মেহবুব আয়েফিন একটুক্ষণ থামেন। টেবিলে রাখা বোতল থেকে পানি খান। তারপর আবার শুরু করেন-”আমিও জানতাম না। চো মারা যায়, আব্বা মারা যান, আম্মাও মারা যান। চো’র কবর চিটাগাংয়ে। একবার উনার মৃত্যুবার্ষিকীতে মান্নান মিয়া ও জাকিয়া খানের সাথে পরিচয় হয়। মান্নান মিয়াই জানায় শ্যানংয়ের কথা। একদা এককালে এক সন্ত ছিল…” মান্নান মিয়া’র গলা নকল করে দেখান প্রফেসর।

“চায়না গেলাম। খুঁজে বের করলাম শ্যানংয়ের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কথা। খুঁজে বের করলাম আরেক গুপ্তজ্ঞান-ইমমরটালিটি।” আঙুল দিয়ে বাতাসে শব্দবন্ধনী আঁকেন প্রফেসর। “বেকুব মানুষ একবারও চিন্তা করলো না, শ্যানং নিজেই মরে ভূত হয়ে গেছে। সে যদি মৃত্যুকে জয় করতে পারতো, তবে সে বেঁচে থাকতো আজও। সে ওই অর্থে অমর ছিল না। কিন্তু যুগ যুগ ধরে মানুষ তাকে মনে রেখেছে। কারণ কী? তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা কিংবা গাছের গুণ। যে গাছ হাজার হাজার বছর পুরনো। যে গাছ মানবজাতির অভ্যুদয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জ্ঞানবৃক্ষ। ট্রি অভ নলেজ।” কোটের পকেট থেকে ছোট্ট একটা শিশি বের করেন প্রফেসর। চোখে লালসাময় দৃষ্টি। “ডেভিল প্ররোচনা দিয়েছিল : এ গাছের ফল খেলে তাদের চোখ খুলে TICS I God doth know that in the day ye eat thereof, then your eyes shall be opened…এ গাছের ফল খেলে আসলেই চোখ খুলে যায়। মানুষ দিব্যদৃষ্টি লাভ করে। নিজের চোখে দেখা। টিকিউএমের মালিক এটা খেয়েই তো আমাকে বিলিয়ন ডলার ধরিয়ে দিলেন। শ্যানং এটার কথাই বলছিলেন। মানুষজন তার কথার ভিন্ন ইন্টারপ্রেট করে। ওয়েল, আমিও ডিরেক্টলি কিছু বলিনি। ইনিয়েবিনিয়ে আগবাগডুম বলেছি। ডায়েরিতে আগবাগডুম লিখেছি। টমি মিয়া সব জানে। আর সবাই কুত্তার পেছনে ছুটলো। হা হা হা হা হা হা।” তার ঠা ঠা হাসির শব্দে অ্যালবাট্রস ছুটে পালায়। “শ্যানংয়ের দুই মহান পূজারী-মান্নান মিয়া ও জাকিয়া খানকে ট্র্যাপে ফেলে দিয়েছি। সুগার সোহানের বৈরাগীর সাথে ক্ল্যাশ ছিল। ওকে দিয়ে খুন করালাম বৈরাগীকে, তারপর সোহানকেও এমনভাবে মারলাম যাতে কেউ সন্দেহ না করে। ড্রাগ ওভারডোজ। জাকিয়া খান শেষ, তার সহযোগী হিসেবে মান্নান মিয়া শেষ, সুগার সোহানও শেষ। মৃত্যুর ভান করে চোখে ধূলো দিলাম সবাইকে। এখন আমার নাম সোবাহান আকবর, আমি এক সৌখিন ব্যবসায়ী। গাছের বীজ বিক্রি করে পেট চালাই।” মুচকি হেসে পকেট থেকে শিশিটা আবার বের করে দেখান তিনি।

তারপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে যায়।

মানিপেনি কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তা কেউ খেয়ালও করেনি। কদম আড়চোখে দেখে পুলের পানি এখনো টকটকে লাল, যদিও পানি বদলাবার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন ডক্টর। হয়তোবা কোন কারণে দেরি হচ্ছে, কু’রা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত। কিন্তু কদমের ভুল ভাঙ্গতে সময় নেয় না।

সেকেন্ডেরও কম সময়ে ডক্টরের শিশি ধরা হাতে কোপ বসিয়ে দেয় মানিপেনি। শিশিটা হাত থেকে মেঝেতে পড়ে যায়। তারপর গড়ায়। গড়িয়ে গড়িয়ে সোজা পুলের পানিতে।

“না!” শিশির পিছু পিছু ডক্টরও লাফ দেন রক্তমাখা পুলে।

ঝপাৎ!

খানিকক্ষন সবকিছু চুপচাপ। তারপর একে একে হাঙ্গরগুলো এসে হাজির হয়। তখন শুরু হয় মজা। এক অসম লড়াই। হুটোপুটি, তোলপাড়। চার মিনিট পনের সেকেন্ড পর সবকিছু একদম শান্ত।

“ডক্টর, নো হার্ড ফিলিংস। ওকে?” মানিপেনি পুলের রক্তাক্ত পানির দিকে তাকিয়ে বলে।

কদম সভয়ে নিচের দিকে তাকায়। “তারা তোমাকে মেরে ফেলবে। পালাও।”

মানিপেনি মাথা নাড়ে। “না, মারবে না।”

রেলিংয়ে ভর দিয়ে নিচটা দেখে নেয় কদম। ইয়টজুড়ে বিক্ষিপ্ত মৃতদেহ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।

“বিশ্বাস হয়, এই লোকটাকে একসময় আমি পাগলের মত ভালোবাসতাম। ও যখন ওর ভয়ংকর পরিকল্পনার কথা জানালো, বেঁকে বসলাম আমি। তখন ও বাবা-মাকে জিম্মি করে ফেলে। এতদিন বলছিল ওরা বেঁচে আছে, আটকে রেখেছে শুধু। তবে ভালো আছে, সুস্থ আছে। আজ জানলাম, আমার বাবা-মা বেঁচে নেই। তোমার মামা-মামিকেও ছাড়েনি, কদম।” স্মার্টফোন খুলে একটা নিউজ পোর্টাল বের করে মানিপেনি।

বৃদ্ধ দম্পতি জীবন্ত দগ্ধ।

গ্যাসের চুলা থেকে কীভাবে আগুন লেগেছে তার বিবরণ দেয়া নিচে। কদম হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকে। ইয়ট অটো’তে চলছে। তাদের বর্তমান গন্তব্য প্যাসিফিক মহাসাগরে অবস্থিত এক ছোট্ট দ্বীপ। দ্বীপটা সম্প্রতি সোবাহান আকবর নামক এক সৌখিন ব্যবসায়ী কিনে নিয়েছেন। দ্বীপের নাম নবুরু। নবুরু মানে নতুন জীবন।

মানিপেনি ইয়ট অটো থেকে ম্যানুয়ালে নিয়ে যায়। কদম রেলিংয়ে হেলান দিয়ে শান্ত সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকে। অ্যালবাট্রসটা আবার এসে হাজির হয়েছে, বাতাস কেটে উড়ছে। স্বচ্ছ পানির নিচ দিয়ে মাছ সাঁতার কেটে চলে।

বাংলাদেশে টমি উদ্ধার নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। আলমগীর কিরা কেটে বলে, ওদের সাথে তিনটা ল্যাব্রাডর ছিল। এর মধ্যে দুইটাকে কেটে পিস পিস করে খেয়ে ফেলেছে ওর সঙ্গিরা। একটা কোনক্রমে গাড়ি থেকে পালাতে সমর্থ হয়। লোকজন সেটাও পিটিয়ে মেরে ফেলে। তারপর ওরা যখন জানতে পারে এটাই সেই ল্যাব্রাডর (ওদের ভাষায় ল্যাওড়াধর), তখন এটাকেও পিসপিস করে কেটে ফেলা হয়। পরবর্তীতে কারওয়ান বাজারে টমির মাংস আড়াইশো গ্রাম করে বিক্রি হয়। দাম পাঁচ হাজার টাকা। আলমগীর আবারো কিরা কেটে বলে, ওর এক দুলাভাই টমির মাংস খেয়েছিলেন। দুলাভাই জানান-”বিশ্বাস করবা না, আলমগীর। শরীলে দুই হাতির তাকত পাইলাম মনে হইলো।”

কিন্তু আলমগীরের কথা কেউ গোনায় ধরে না, হেসেই উড়িয়ে দেয়।

2 Comments
Collapse Comments

Disgusting

Like the book and finished whole pages on 24 hours. Really great writing, so please carry on ..

PS: Dear Kakoli, what’s disgusting? If you mean the book then you are lying and don’t know the difference of good and bad …. So mind your language.

Thanks,
Munna

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *