৪. জাগরেব, ক্রোশিয়া, ৬:৩০ এ এম

জাগরেব, ক্রোশিয়া, ৬:৩০ এ এম

মেরি আর আমি একটা বরফ জমা ঝরনার ধারে বসে আছি। ভাব দেখে মনে হচ্ছে এ বছর আর বসন্তকাল আসবে না। মনে হয় শীত থেকে সরাসরি গ্রীষ্মে গিয়ে পড়বে। ঝরনার মাঝামাঝি একটা কলামের ওপর স্ট্যাচু দাঁড়িয়ে আছে। সারাটা বিকাল আমি সাক্ষাৎকার দিয়ে কাটালাম। নতুন বই সমন্ধে আর একটা কথাও বলতে পারছি না। সাংবাদিকরা সাধারণ প্রশ্নগুলোই করে গেলঃ

আপনার স্ত্রী কি বইটা পড়েছে (আমি জানি না)? আপনার কি মনে হয় সমালোচকরা আপনার সাথে অসদাচরণ করেছে (কি)? এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড টাইম টু সিউ কি আপনার পাঠককে হতভম্ব করেছে? লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের উম্মোচন কি পাঠককে মুগ্ধ করেছে (একজন লেখক কেবল তার। ব্যক্তিজীবন নিয়ে লিখতে পারেন?) এ বই থেকে কি সিনেমা বানানো হবে (আমি আবার বলছি, বইয়ের ঘটনা পাঠকের মনে সিনেমার চেয়ে নয়বার বেশি সিনেমার মতো হয়, যে কারণে আমি সিনেমার জন্য বই বেচতে চাই না)? ভালোবাসার ব্যাপারে আপনি কি ভাবেন? আপনি কেন ভালোবাসা নিয়ে লিখতে পছন্দ করেন? কীভাবে একজন মানুষ ভালোবাসায় সুখী হতে পারে, ভালোবাসা, ভালোবাসা, ভালোবাসা, ভালোবাসা?…

 সাক্ষাৎকার শেষ হলে প্রকাশকদের সাথে রাতের খাবার রীতিনীতির একটা অংশ। টেবিল লোকজনে ভর্তি, যারা চায় আমি মুখে কাঁটাচামচ দিয়ে বসে থাকি। তারাও সাধারণত একই প্রশ্ন করে, আপনি কোথা থেকে প্রভাবিত হন? আমি খাওয়ার চেষ্টা করি; কিন্তু আমাকে সেই সাথে অবশ্যই ভদ্র হতে হয়, কথা বলতে হয়, সেলিব্রেটি হিসেবে ভূমিকা পালন করতে হয়, কতকগুলো মজাদার গল্প বলতে হয়, খুব ভালো প্রভাব দেখাতে হয়। আমি জানি প্রকাশকই সত্যিকারের হিরো, কারণ তিনি কখনো বলেন না কোথায় বই বিক্রি হয় অথবা হয় না। তিনি তার বদলে কলা অথবা সাবান বিক্রি করতে পারতেন, ব্যাপারটা আরো সহজ হতো, তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় না, তারা কোনো রকম অভিযোগ করেন না।

 সাপারের পরে সাধারণ রুটিন হলো তারা তাদের শহরের মনুমেন্ট, ঐতিহাসিক স্থান, অভিজাত বার দেখাতে নিয়ে যান। সব সময় একজন গাইড থাকে, যে সব কিছুই জানে এবং আমার মাথাটা তথ্যে ভরে দেয়। আমাকে এ রকম ভাব দেখাতে হয়, যেন সত্যিই আমি শুনছি এবং মাঝে মাঝে আগ্রহ বোঝানোর জন্য কিছু প্রথাগত প্রশ্ন করতে হয়। আমি প্রায় সবগুলো মনুমেন্ট চিনে ফেলি, মিউজিয়ামে যাই, ঐতিহাসিক স্থানগুলো দর্শন করি। আমি সেগুলোর কোনোটার কথা মনে রাখতে পারি না। আমি শুধু অদ্ভুত জিনিসগুলো মনে রাখতে পারি, পাঠকের সাথে সাক্ষাৎ, বার, সম্ভবত হেঁটে চলা কোনো পথের কথা।

একদিন একটা ট্রাভেল গাইড বানাতে চাইলাম, যাতে শুধু ম্যাপ আর হোটেলের ঠিকানাগুলো থাকবে, বাকি পাতাগুলো শূন্য পড়ে রইল। এভাবেই লোকজন তাদের নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ রেস্টুরেন্ট, মুনমেন্ট এবং শহরের দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখে; কিন্তু যা কখনো উল্লেখ করা হয় না, কারণ আমরা যে ইতিহাস শিখি সেগুলো আমরা যা অবশ্যই দেখি তার মধ্যে সংযুক্ত থাকে না।

 আমি এর আগে জাগরেবে এসেছি। এই ঝরনা আমার কাছে যেকোনো লোকাল টুরিস্ট গাইডের কাছে যেমন তার চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না। কিন্তু এটা তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমি এখানে যা কিছু দেখেছি। অপূর্ব কারণ, আমি আবিষ্কার করেছি আমার জীবনের গল্পের সাথে এর সংযোগ রয়েছে। অনেক বছর আগে, অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে সারা দুনিয়া তরুণ হিসেবে ঘুরে বেড়িয়েছি, আমি একজন ক্রোশিয়ান চিত্রকরের পাশে এখানে বসেছিলাম। আমি তুরস্কের দিকে গিয়েছিলাম। আমরা এখানে বিদায় জানিয়েছিলাম। দুই বোতল ওয়াইন পান করেছিলাম। সব কিছু নিয়েই আলাপ করছিলাম, ধর্ম, নারী, সংগীত, হোটেল ভাড়া, ড্রাগ। আমরা ভালোবাসা বাদে আর সব কিছু নিয়েই আলাপ করেছিলাম। কারণ যেসব মানুষকে আমরা ভালোবাসতাম, তাদের নিয়ে আলাপ করার কিছু ছিল না।

 চিত্রকর বাড়িতে চলে গেলে, একজন তরুণীর সাথে আলাপ হলো। আমরা একসাথে তিনটি দিন কাটিয়েছিলাম। একে অন্যকে ভালোবেসেছিলাম, কারণ আমরা দুজনই জানতাম ব্যাপারটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। ও আমাকে লোকজনের আত্মার ব্যাপারে বুঝতে সাহায্য করেছিল। আমি কখনো ওকে ভুলিনি।

যেভাবে আমি কখনো ঝরনার কথা ভুলিনি। সে কারণে সাক্ষাৎকারের পরে, অটোগ্রাফ, সাপার, মনুমেন্ট আর ঐতিহাসিক স্থানগুলো দর্শনের পরে আমি জোর দিয়ে প্রকাশককে ওই ঝরনার কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বললাম। তারা জিজ্ঞেস করল, ঝরনাটা কোথায়? আমার কোনো ধারণা নেই। যেভাবে আমার কোনো ধারণা ছিল না জাগরেবে এত বেশি ঝরনা আছে। ঘণ্টাখানেক খোঁজার পর, আমরা শেষ পর্যন্ত ঝরনাটা খুঁজে বের করতে পারলাম। আমি এক বোতল ওয়াইনের আবেদন জানালাম। আমরা সবাইকে বিদায় জানালাম। মেরির সাথে একসাথে নীরবে বসে রইলাম। একে অন্যকে ধরে রইলাম। ওয়াইন পান করলাম। সূর্য অস্ত যাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম

তোমাকে দিন দিন বেশ সুখী মনে হচ্ছে। মেরি আমার কাঁধে মাথা রেখে বলল।

 তার কারণ আমি কে তা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি। অথবা অন্যথায়, আমার এই কাঁধে গোটা জীবনের ইতিহাস আর বয়ে বেড়াতে পারছি না।

আমি ওকে যাযাবরের সাথে মিখাইলের কথোপকথনের কথা বললাম।

 অনেকটা ওই অভিনেতার সাথে কথা বলার মতো। ও বলল, প্রতিবারের নতুন ভূমিকার সময়, কে ওই চরিত্রে হতে পারে সে ব্যাপারে আমরা থমকে যাই। আমরা বিভ্রান্ত হই। তোমার ব্যক্তিগত ইতিহাসকে লোকজনের সামনে বলে দেয়াটাকে তুমি ভালো মনে করো?

তুমি কি বলোনি আমাকে আগের চেয়ে ভালো দেখাচ্ছে?

 কিছুটা কম ইগোস্টিক। যদিও এই ঝরনা পাওয়ার আগ পর্যন্ত তুমি আমাদের একটুও বিশ্রাম দাওনি; কিন্তু তুমি যা বলেছ, ব্যাপারটা তার বিরুদ্ধে যায়, যখন থেকে এই ঝরনাটা তোমার অতীতের ব্যাপার।

আমার জন্য, ব্যাপারটা প্রতিকের মতো। কিন্তু এই ঝরনাটাকে আমি আমার চারদিকে বয়ে নিয়ে যেতে পারছি না, আমি সব সময়ের কথা মনে করি না, আমার বন্ধুদের দেখানোর জন্য এর ছবি তুলি না। চিত্রশিল্পী বা প্রেমে পড়া তরুণীর মতো এর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকি না। এখানে আবার ফিরে আসাটা সত্যি ভালো; কিন্তু আমি যদি এখানে ফিরে না আসতাম, তাহলে আগের অভিজ্ঞতার ব্যাপারে কোনো রকম পার্থক্য দেখা দিত না।

তুমি কী বলতে চাইছ, আমি বুঝতে পেরেছি।

 আমি খুশি।

 আর আমি দুঃখিত। কারণ এ জন্য মনে হচ্ছে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারো। আমাদের যখন প্রথম দেখা হয়েছিল তখনই থেকেই তোমাকে জানি; কিন্তু এর পরও ব্যাপারটা বেশ কঠিন, কারণ আমি তোমার সাথে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

সেটাই সমস্যা। আমরা যেকোনো ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি।

 এটাও মানুষের স্বভাব।

 এ কারণেই যে মহিলাটিকে আমি বিয়ে করেছি সে জাহির হয়ে গেছে। আমার দুর্ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত, আমি নিজেকে এই প্রবোধ দিয়ে রেখেছিলাম আমি শুধু ওর সাথেই সুখী হতে পারি, ওকে আমি যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসি এই জন্য নয়, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম একমাত্র ওই আমাকে বুঝতে পারবে। ও আমার পছন্দ-অপছন্দ জানে, আমার বহিঃমুখিতা, যেভাবে আমি জগৎটাকে দেখি। ও আমার জন্য কী করেছে, সে ব্যাপারে আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ। আমি ভেবেছিলাম আমি ওর জন্য যা করেছি তার জন্য সেও আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। আমি ওর চোখে জগৎ দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার কি সেই গল্পটা মনে আছে, দুজন অগ্নিনির্বাপককর্মী আগুনের ভেতরে ঢুকেছিল আর বেরিয়ে আসার পর একজনের মুখে কালিতে কালো হয়ে ছিল?

মেরি উঠে দাঁড়াল। আমি দেখতে পেলাম ওর চোখ জলে ভরে গেছে।

বেশ, আমার কাছে জগৎটা এ রকম। আমি বলে চললাম। এসথারের সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি। সেটাই কি ভালোবাসা? অথবা এটাই কি নির্ভরশীলতা? আমি জানি না। আমার মনে হয় ভালোবাসা আর নির্ভরশীলতা একে অন্যের হাত ধরে চলে।

 সম্ভবত। কিন্তু ধরো এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ লেখার বদলে, যে বইটা সত্যিই একজন বহুদূরে চলে যাওয়া মহিলার প্রতি চিঠি লেখার মতো, আমি অন্য প্লট বেছে নিতে পারতাম। উদাহরণস্বরূপ মনে করো, স্বামী আর স্ত্রী দশ বছর ধরে একসাথে থাকে। তারা প্রতিদিনের ভালোবাসায় অভ্যস্ত, প্রতিদিনই যৌনসংসর্গ করে, এখন সপ্তাহে একমাত্র এক দিন তারা সহবাস করে, কিন্তু সেটা সত্যিই কোনো ব্যাপার নয়, কারণ তাদের বন্ধন, পারস্পরিক বোঝাঁপড়া, সঙ্গ দেয়া। স্বামী দুখঃবোধ করে যখন তাকে রাতের খাবার একা খেতে হয়, কারণ স্ত্রীর কাজ থেকে ফিরতে দেরি হয়। স্ত্রী স্বামীর বাইরে যাওয়াটাকে ঘৃণা করে; কিন্তু এগুলো চাকরির অংশ হিসেবেই মেনে নেয়। তারা বুঝতে পারে, কিছু একটা হারিয়ে গেছে; কিন্তু তারা দুজনই প্রাপ্তবয়স্ক, তারা জানে তাদের সম্পর্কটা স্থিতি রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি শুধু বাচ্চাদের খাতিরে হলেও। তারা আরো বেশি করে কাজ এবং বাচ্চাদের প্রতি জড়িয়ে পড়ে। তারা নিজেদের বিয়ে নিয়ে খুব কমই ভাবে। সব কিছুই বেশ ভালোভাবে চলছে মনে হয়। দেখে মনে হয় তাদের জীবনে আর কোনো নারী পুরুষ নেই।

যত দিন পর্যন্ত না তারা বুঝতে পারে কিছু একটা ভুল হচ্ছে। তারা সমস্যাটাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখে না। যতই সময় গড়াতে থাকে, তারা ততই একে অন্যের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তারা আরো বেশি বয়স্ক হয়ে পড়ে, নতুন জীবন শুরু করার মতো কোনো সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। তারা নিজেদের পড়াশোনা অথবা এমব্রয়ডারিতে ব্যস্ত রাখে, টেলিভিশন দেখে, বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা করতে যায়; কিন্তু রাতের খাবারের আগে বা পরে তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। স্বামী খুব সহজেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে, স্ত্রী আগের চেয়ে আরো বেশি নীরব হয়ে যায়। তারা দেখতে পায় তারা আরো বেশি দূরে সরে যাচ্ছে; কিন্তু কেন তা বুঝতে পারে না। তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, বিয়ে জিনিসটাই এ রকম, কিন্তু এ নিয়ে বন্ধুদের সাথে কোনো কথা বলে না। তারা সুখী দম্পতির প্রতিরূপ হিসেবে মর্যাদা পায়। স্ত্রীর প্রেমিক থাকে, তেমনি থাকে স্বামীরও। কিন্তু কখনো তা সিরিয়াস কিছু নয়। তাদের মধ্যে কোনো কিছুই ঘটে না, কারণ পরিবর্তনের জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে।

আমি এই গল্প জানি, যদিও আমার নিজের জীবনে সে অভিজ্ঞতা হয়নি। আর আমার মনে আমরা নিজেদের জীবনে এই জাতীয় জিনিসে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। আমি কোট খুলে ফেললাম। ঝরনার চুড়ার দিকে উঠতে শুরু করলাম। মেরি জিজ্ঞেস করল আমি কী করছি।

আমি ঝরনার মাঝখানের কলামের দিক থেকে একটু হেঁটে আসছি।

তুমি কি পাগল! এখন বসন্তকাল! বরফ সত্যিই খুব পাতলা হয়ে থাকবে।

কলামের ওদিকটা থেকে আমার হেঁটে আসা দরকার।

আমি এক পা তুলে বরফের ওপর রাখলাম, পাতলা বরফটা নড়ছিল, কিন্তু চৌচির হয়ে গেল না। সূর্যের দিকে এক চোখে তাকিয়ে, আমি একপ্রকার সূর্যপ্রার্থনা করতে লাগলাম। আমি যদি কলামের দিকটাতে কোনোমতে পৌঁছাতে পারি, বরফ ভেঙে পড়া ছাড়াই আবার ফিরে আসতে পারব। আমি ঠিক পথে আছি কিনা সেটা একটা চিহ্ন হতে পারে। আমার কোথায় যেতে হবে, তা ঈশ্বর দেখিয়ে দেবে।

 তুমি পানিতে পড়ে যাবে।

 তো? সবচেয়ে খারাপ যে জিনিসটা ঘটতে পারে পানি খুবই ঠাণ্ডা, কিন্তু হোটেলটা এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আমাকে খুব বেশিক্ষণ ভুগতে হবে না।

 আরেক পা বরফের ওপর দিলাম। আমি এখন পুরোপুরি ঝরনার ওপরে। কিনারার দিক থেকে বরফ ভেঙে পড়ছে। কিছুটা পানি বরফের ওপর উঠে এসেছে। কিন্তু বরফ এখনো ভাঙেনি। আমি কলামের দিকে এগোতে থাকলাম। মাত্র চার মিটার সামনে-পেছনের ব্যাপার। আর আমি শুধু ঠাণ্ডা শীতল পানিতে স্নানের ঝুঁকি নিতে যাচ্ছি। যাই হোক, কী ঘটতে পারে সে ব্যাপারে আমার অবশ্যই চিন্তা করা উচিত নয়। প্রথম পদক্ষেপ যখন নিয়েছি তখন শেষ পর্যন্ত যাওয়া উচিত।

আমি কলামের কাছে পৌঁছে গেলাম। হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম। আমার চারপাশের সব কিছু ভেঙে পড়ছে। কিন্তু আমি এখনো বরফের ওপরে। আমার এখনো দৌড়ে ফিরে যাওয়া দরকার। কিন্তু কিছু একটা যেন আমাকে বলছিল, আমি যদি অমনটি করি, আমার পদক্ষেপ ভারী হয়ে যাবে আর আমি পানিতে পড়ে যাব। আমাকে অবশ্যই খুব ধীরে ধীরে ফিরে আসতে হবে, যেভাবে গিয়েছি সেই তালেই ফিরতে হবে।

মাথার ওপরে সূর্য। আমার কিছুটা চোখ ধাধিয়ে আছে। আমি শুধু সেলুয়েটে মেরির ছবি দেখতে পাচ্ছি। ভবন আর গাছের আকৃতি বুঝতে পারছি। বরফের পাতগুলো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরে যাচ্ছে। বরফের ওপর পানি উঠে যাচ্ছে। কিন্তু জানি, আমি কিনারায় পৌঁছে যেতে পারব। জমাট বরফের সীমাবদ্ধতা জানি। কীভাবে এ নিয়ে কাজ করতে হয় তাও জানি। কীভাবে এর সাহায্য চাইতে হয়। কীভাবে পতন এড়াতে হয়। আমি একধরনের মোহাবেশের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। আমি যেন আবার শিশু হয়ে গেছি। এ রকম কিছু করছি, যা ভুল, নিষিদ্ধ, কিন্তু যা আমাকে অদ্ভুত আনন্দ দিয়েছে। অপূর্ব! ঈশ্বরের মহান করুণা। আমি যদি তা করতে চেষ্টা করি, ব্যাপারটা ঘটবে।

 মিখাইলের সাথে দেখা হওয়ার জন্য কৃতজ্ঞ। মৃগী রোগী মিখাইল ভাবে সে। কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। আমি স্ত্রীর খোঁজে ওর সাথে দেখা করতে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। আবিষ্কার করলাম আমার জীবনের প্রতিফলন ফিরে আসছে। এসথার কি এখনো আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ? আমি তাই মনে করি। ওর ভালোবাসাই আমার জীবন বদলে গিয়েছিল। এখনো আমাকে বদলে দিচ্ছে। আমার ইতিহাস পুরনো হয়ে যাচ্ছে, বহন করার জন্য ভারী হয়ে গেছে। এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছি যে, বরফের ওপর দিয়ে হাঁটাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম একদা আমি সান্তিয়াগোর পথে হেঁটেছি।

আরেকবার ভাঙনের শব্দ শুনতে পেলাম। উপরিভাগে একটা ফল্ট লাইন দেখা গেল। কিন্তু জানি আমি তা করতে পারব। কারণ আমি আলোকিত, এত বেশি আলোকিত, যেন মেঘের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারি। আমার সাথে খ্যাতির বোঝা নেই, যে গল্প বলেছি তাই অনুসরণ করতে হবে। আমি এত স্বচ্ছ, যেন সূর্যের রশ্মি আমার শরীর ভেদ করে আত্মাকে আলোকিত করতে পারে। দেখতে পাচ্ছি আমার ভেতরে অনেক অন্ধকার দিক আছে। কিন্তু ধৈর্য আর সাহসের সাথে সেগুলো ধুয়েমুছে যাবে।

আরেকটা পদক্ষেপ, আরো বেশি ভাঙনের শব্দ কিন্তু নিরাপদ। ঝরনার কিনারা কাছাকাছি চলে এসেছে।

.

আমি এনভেলাপ খুলব এবং এসথারকে খুঁজে নিয়ে আসব। কারণ মিখাইল, আর্মেনিয়ানের রেস্তোরাঁর সেই গুরু, বলেছে- গল্পটার শেষ পর্যায়ে পৌঁছানো দরকার। যখন সব কিছুই এতবার করে বলা হয়ে গেছে, যেসব জায়গা আমি দেখে এসেছি, যে জিনিসের অভিজ্ঞতা আমার হয়ে গেছে, যে পদক্ষেপ আমি এসথারের কারণে নিয়েছি, সব কিছুই দূর স্মৃতির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিখাদ ভালোবাসা ছাড়া কোনো কিছুই রবে না। আমার মনে হচ্ছে কোনো কিছুর ঋণ নেই। আমার মনে হচ্ছে না ওকে দরকার, কারণ শুধু ওই আমাকে বুঝতে পারে, কারণ আমি ওর প্রতি অভ্যস্ত। কারণ ও আমার গুণাগুণ জানে, জানে বিছানায় যাওয়ার আগে আমি এক টুকরো টোস্ট খাই আর জেগে উঠে আন্তর্জাতিক খবরাখবর দেখি। প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হই। ও আমার বইয়ের সংগ্রহের ব্যাপারে জানে। কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে কতটুকু সময় ব্যয় করি জানে। পরিচারিকা ডাকতে শুরু করলে কতটা বিরক্ত হই জানে।

সব কিছুই অদৃশ্য হয়ে যাবে। শুধু ভালোবাসাই থেকে যাবে, যা স্বর্গে, তারকারাজ্যে, মানুষ, ফুল, পতঙ্গ, সব কিছুর মধ্যেই ছড়িয়ে আছে। বরফের বিপদ সত্ত্বেও আমার ভয় আনন্দে রূপ নিয়েছে।

আমি ঝরনার কিনারা স্পর্শ করলাম। একটা হাত আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসছে। আমি ওটাকে আঁকড়ে ধরলাম। মেরি আমাকে নিচে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করল।

 তোমার জন্য আমার গর্ব হয়। আমি কখনো এ রকম কিছু করতে পারতাম না।

খুব আগের কথা নয়। ব্যাপারটা সে রকম কিছু নয়, দেখে খুব শিশুসুলভ, দায়িত্বজ্ঞানহীন, অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার মনে হয়। কিন্তু আমি যেন আবার পুনর্জীবন লাভ করেছি এবং আমার নতুনভাবে রিস্ক নেয়া দরকার।

 সকালের আলোটা অবশ্যই তোমার জন্য ভালো। তুমি জ্ঞানী মানুষের মতো কথা বলছ।

আমি এইমাত্র যা করলাম, কোনো জ্ঞানী লোক কখনো তা করবে না।

*

আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল লিখতে হবে, ফেভার ব্যাংকের যেসব প্রধান ম্যাগাজিন আছে তাতে দিতে হবে। আমার মাথার মধ্যে শত শত হাজার হাজার আইডিয়া ঘোরাঘুরি করে, কিন্তু আমি জানি না কোনটা আমার মনোযোগ, শক্তি আর রক্তের সাথে মিশে আছে।

 প্রথমবার এ রকমটি হয়েছে তা নয়। যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তা সবই আমার বলা হয়ে গেছে এমনটি মনে হয়। আমার মনে হয় স্মৃতি হারাচ্ছি, আমি কে তাও ভুলে যাচ্ছি।

 জানালার কাছে গিয়ে বাইরের রাস্তার দিকে তাকালাম। নিজেকে প্রবোধ দিতে লাগলাম আমি পুরোপুরি পেশাগত দায়িত্বের একজন মানুষ। এর বেশি কিছু আর প্রমাণ করার দরকার নেই। আমি পাহাড়ের গায়ে বাড়ি বানিয়ে বাকি জীবন পড়াশোনা, হাঁটাহাঁটি আর খাবার ও আবহাওয়ার কথা বলে কাটিয়ে দিতে পারি। আমি নিজেকে বারবার বোঝালাম একজন লেখকের যেটুকু অর্জন করার কথা তার সব কিছুই আমি অর্জন করেছি। আমার বই পৃথিবীর প্রায় সবগুলো লিখিত ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাহলে কেন একটা ম্যাগাজিনের আর্টিকেল নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি, তা সে ম্যাগাজিন যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন? ফেভার ব্যাংকের কারণে। তো আমার সত্যিই কিছু লেখা দরকার, কিন্তু লোকজনের আমার আর কী বলার আছে? আমি কি তাদের বলব, তারা যেসব গল্প শুনেছে তার সব কিছু ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে ঝুঁকি নিতে?

তারা সবাই বলবে, আমি একজন স্বাধীন মানুষ। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার যা খুশি আমি তাই করব।

আমি কি তাদের বলব, ভালোবাসার শক্তি প্রবাহ আরো বেশি করে উন্মুক্তভাবে ব্যবহার করার জন্য?

তারা বলবে, আমি এরই মধ্যে ভালোবাসা অনুভব করতে পারি। প্রকৃতপক্ষে, আমি অনেক বেশি ভালোবাসা বুঝতে পারি। ভালোবাসা পরিমাপ করা যায় যেমনভাবে আমরা দুটো রেলওয়ে ট্র্যাকের মধ্যে পার্থক্য মাপতে পারি, ভবনের উচ্চতা অথবা পাউরুটির জন্য কতটুকু ইস্ট দরকার তা যেমনটি বুঝতে পারি। আমি ডেস্কে ফিরে এলাম। মিখাইল আমার জন্য যে খাম রেখে গেছে তা খুললাম। এখন আমি জানি এসথার কোথায় আছে। আমার শুধু জানা দরকার সেখানে কীভাবে যেতে হবে। আমি ওকে ফোন করলাম। বরফের ওপর দিয়ে আমার হাঁটার ব্যাপারে বললাম। মিখাইল বেশ প্রভাবিত হলো। আজ রাতে ও কী করছে জানতে চাইলাম। মিখাইল জানাল, ওর বান্ধবী লুক্রেসিয়ার সাথে বাইরে যাবে। আমি ওকে বললাম, দুজনকেই সাপারে আসতে। না, আজ রাতে নয়, কিন্তু আমি যদি চাই, ওর আর ওর বান্ধবীর সাথে সামনের সপ্তাহে বাইরে যেতে পারি।

ওকে বললাম, আগামী সপ্তাহে আমি আমেরিকায় বক্তব্য দিতে যাচ্ছি। কোনো ব্যস্ততা নেই। ও জানাল, আমরা সপ্তাহ দুই অপেক্ষা করতে পারব।

আপনি অবশ্যই বরফের ওপরে কোনো কণ্ঠস্বর শুনে থাকবেন। মিখাইল বলল।

না, আমি কোনো কণ্ঠস্বর শুনিনি।

তো, আপনি এমনটি কেন করলেন?

কারণ আমার মনে হয়েছিল এমনটি করা দরকার।

 ওটাই অন্য আরেকভাবে কণ্ঠস্বর শোনার পদ্ধতি।

আমি বাজি ধরতে পারি, আমি যদি বরফের ওপর দিয়ে যেতে পারি, তার মানে আমি তৈরি। আর আমার মনে হয় এখন সময় এসেছে।

তাহলে কণ্ঠস্বরটা আপনাকে প্রয়োজনীয় সংকেত পাঠিয়েছে।

কণ্ঠস্বরটা কি আপনাকে এ ব্যাপারে কোনো কিছু বলেছে?

 না, আমাকে কিছু বলেনি। আমরা যখন সেইন নদীর তীরে ছিলাম, আমি বলেছিলাম কণ্ঠস্বরটা কখন সময় আসবে তা বলে দেবে। আমি জানতাম তা আপনার কাছে বলা হবে।

যেমনটি আগেও বললাম, আমি কোনো কণ্ঠস্বর শুনতে পাইনি।

আপনি অমনটি ভাবছেন। সবাই ও রকমটিই ভাবে। আর এখন, বর্তমান কী বলছে তাই দিয়ে বিচার করা হয়। প্রত্যেকেই সব সময় কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। আমরা যখন কোনো সংকেতের মুখোমুখি হয় তখন আমাদের কাছে সাহায্যটা চলে আসে।

 তর্ক না করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার শুধু কিছু বাস্তবধর্মী বর্ণনা দরকার। কোথা থেকে একটা গাড়ি ভাড়া নিতে হবে, কতটা সময় ধরে যেতে হতে পারে, কীভাবে বাড়ি খুঁজে বের করতে হবে, কারণ তা ছাড়া, ম্যাপের হিসাব ধরলে ওখানে কতগুলো দাগচোক ছাড়া আর কিছু নয়- লেকশোর অনুসরণ করে, একটা কম্পানির সাইনবোর্ড, ডানে মোড় ইত্যাদি। সম্ভবত মিখাইল জানে কে আমাকে সাহায্য করতে পারে।

আমরা পরবর্তী মিটিংয়ের আয়োজন করলাম। মিখাইল আমাকে সরাসরি কিছু কথা জিজ্ঞেস করল- ওই গোত্রের লোকজন প্যারিসে আছে।

আমি ওকে গোত্রের লোকজন কারা জিজ্ঞেস করলাম।

যেসব লোকজন আমার সাথে রেস্টুরেন্টে কাজ করে তারা। মিখাইল উত্তর দিল। কোনো রকম বিস্তারিত কিছু বলল না। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম আমেরিকা থেকে ওর জন্য কোনো কিছু আনতে হবে কিনা। ও আমাকে বুকে ব্যথার জন্য নির্দিষ্ট একটা ওষুধ আনতে বলল। আমি ভেবেছিলাম আরো মজাদার কিছু আনতে হবে, কিন্তু ওর অনুরোধ একটা কাগজে লিখে রাখলাম।

 আর আর্টিকেলটা?

.

আমি আবার ডেস্কে ফিরে গেলাম। কোনো বিষয়ে লিখতে পারি তা ভাবতে লাগলাম। খোলা খামের দিকে আবার তাকালাম। ভেতরে কী পেয়েছি সে ব্যাপারে আমি বিস্মিত হইনি। মিখাইলের সাথে কয়েকবার সাক্ষাতের পরে, আমি যা আশা করেছিলাম ঠিক তাই পেয়েছি।

এসথার মধ্য এশিয়ার একটা ছোট্ট গ্রামে বাস করে। আরো সংক্ষেপে বলতে গেলে কাজাখস্তানের এক গ্রামে।

 আমার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। আমার নিজের গল্প রিভিউ করতে শুরু করলাম। অবসেশনের ব্যাপারে মেরিকে বিস্তারিত বলেছি। মেরিও একই রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। মেরির বলা কিছু কথায় আমি বিস্মিত হয়েছি। কি প্রক্রিয়াটা কাজ করতে শুরু করেছে। মেরি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, কম উদ্বিগ্ন।

আমি জানি না কেন আমি এসথারকে খুঁজে পেতে চাই। ওর প্রতি আমার ভালোবাসা জীবনকে আলোকিত করেছে। আমাকে নতুন নতুন জিনিস শিখিয়েছে। ব্যাপারটা সত্যিই যথেষ্ট। কিন্তু মিখাইল যা বলেছিল তা মনে পড়ে যায়, গল্পের নিজেরই এর শেষ সীমায় আসা দরকার। আর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম চালিয়ে যাব। আমাদের বিয়ের বরফ যখন ভেঙে গেছে সেই মুহূর্তে আমি কী আবিষ্কার করব তা জানি আর আর কীভাবে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা পানির মধ্যে যাওয়ার পরও কিছু হবে না। ওই গ্রামে পৌঁছানোর আগে আমি কী আবিষ্কার করব, তা জানি।

আর্টিকেলটা! এসথার কি আবারও জাহির হিসেবে প্রতিপন্ন হবে, অন্য কোনো কিছুতে আমার মনোযোগ দেয়া থেকে বিরত রাখতে পারবে?

না, আমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু করার দরকার হলে, সৃষ্টিশীল শক্তির দরকার হয়, আর আমার কাজের ধরনটা ও রকমই; আমি প্রায় হিস্টোরিয়ার কাছাকাছি চলে যাই, ওই সমন্ধে প্রচুর পড়াশোনা করি এবং তারপর আর্টিকেলটা লেখা হয়ে ওঠে। আমি এবার ভিন্নভাবে করার চেষ্টা করলাম। সব কিছু খুব সাবধানে প্রস্তুত করলাম, কিন্তু আমার কল্পনা শুধু অকল্পনীয় চাপের মধ্যেই কাজ করতে থাকে। আমার অবশ্যই ফেভার ব্যাংকের সম্মান করা উচিত। আমার অবশ্যই লেখা উচিত। অনুমান করা যায় কি নিয়ে! নারী-পুরুষের সম্পর্কের সমস্যাগুলো নিয়ে। কিন্তু সম্পাদক বিশ্বাস করে, যে মানুষ এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ লিখতে পারে সে অবশ্যই মানুষের আত্মা সমন্ধে খুব ভালোভাবেই জানে।

আমি ইন্টারনেটে লগ অন করলাম। কিন্তু তা কাজ করছে না। কানেকশন ধ্বংস করে দেয়ার পরে এ রকমটি দেখিনি। আমি কয়েকজন টেকনিশিয়ানকে ডাকলাম। কিন্তু তারা কম্পিউটার ওপেন করে আমার কম্পিউটারে কোনো সমস্যা দেখতে পেল না। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি সমস্যাটা কোথায় বোধ করছি। আধাঘণ্টা ধরে নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, কনফিগারেশন বদলে দিয়ে তারা নিশ্চিত হলো সমস্যাটা আমার নয়, সমস্যাটা সার্ভারের। আমি নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিলাম যে, সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল, সাহায্যের জন্য ওদের ডাকাটাই হাস্যকর ব্যাপার হয়েছে। দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরে, কম্পিউটার আর কানেকশন দুটোই ক্রাশ করল। এখন, কয়েক মাস যাবত শারীরিক ও মানসিক দ্বন্দ্বের পরে, আমি খুব সাধারণভাবেই মেনে নিলাম টেকনলজি আমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও পাওয়ারফুল। এটা ওর ইচ্ছামাফিক কাজ করে। সবচেয়ে ভালো হয় বসে বসে পেপার পড়া অথবা হাঁটতে যাওয়া। কেবল আর টেলিফোন সংযোগ ভালো অবস্থায় আসা এবং কম্পিউটার আবার কাজ করবে এই সিদ্ধান্তে আসার জন্য অপেক্ষা করাই ভালো। আমি আবিষ্কার করলাম, কম্পিউটারের নিজস্ব জীবন আছে।

আমি আরো কয়েকবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আগের অভিজ্ঞতায় জানি, হাল ছেড়ে দেয়াই সবচেয়ে ভালো। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি ইন্টারনেট, এই মুহূর্তে আমার জন্য তার দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে। উৎসাহ পাওয়ার জন্য নতুন একটা ম্যাগাজিন পড়লে কেমন হয়? পোস্টে আসা একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে একজন মহিলার সাক্ষাৎকার পড়লাম, যার সম্প্রতি একটি বই বেরিয়েছে। ধারণা করতে পারেন কী নিয়ে? ভালোবাসা। বিষয়টা যেন আমাকে সর্বত্রই খুঁজে বেড়াচ্ছে।

সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছে, যদি শুধু মানুষের জন্য একটা উপায় থাকে সুখী হওয়ার জন্য, তা তার সঙ্গীর ভালোবাসাই। মহিলা উত্তর দিয়েছে, না।

ভালোবাসা সুখের আকর, এ ধারণা অধুনা উদ্ভাবন। সতেরো শতকের শেষ ভাগে এ ধারণা গড়ে ওঠে। তারপর থেকে, লোকজন বিশ্বাস করতে শিখেছে ভালোবাসা চিরদিনের জন্য থাকা উচিত আর ভালোবাসার সর্বোত্তম জায়গা হচ্ছে বিয়ে। অতীতে, আবেগের দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়ে অনেক কম আশাবাদী ছিল। রোমিও আর জুলিয়েট কোনো সুখী গল্প নয়, এটা একটা ট্র্যাজেডি। শেষ কয়েক দশকে, বিবাহের মাধ্যমে ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপূর্ণতা বেড়ে ওঠে, বেড়ে যায় হতাশা এবং অসন্তোষ।

.

কথাটা এভাবে বলা অনেক সাহসী ব্যাপার; কিন্তু আমার আর্টিকেলের জন্য ভালো কিছু নয়। কারণ আমি ভদ্রমহিলার সাথে আদৌ একমত নই। নারী পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারে আমার বুকশেলফে বই খুঁজতে লাগলাম। ম্যাজিক্যাল প্রাকটিসেস ইন নর্থ মেক্সিকো। যেহেতু অবসেশন আমার আর্টিকেল লিখতে কোনো সাহায্য করছে না, আমার নিজের মনকে রিলাক্স করানো দরকার।

আমি বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলাম। হঠাৎ করে একটা লেখা আমাকে বিস্মিত করল : একোমোডর বা ছেড়ে আসা পয়েন্ট : আমাদের জীবনে এ রকম একটা ইভেন্ট আছে, যা আমাদের পতনের জন্য দায়ী, একটা ক্ষত, নির্দিষ্ট একটা তিক্ত পরাজয়, ভালোবাসার ক্ষেত্রে হতাশা, এমনকি এমন কোনো বিজয়, যা আমরা বুঝতে পারি না। আমাদের কাপুরুষ করে তোলে, সম্মুখপানে অগ্রসর হতে বাধা দেয়। আর এই প্রক্রিয়ায় আমাদের ভেতরের লুকানো শক্তি বাড়তে থাকে, সে ক্ষেত্রে আমাদের সারা জীবনে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে বুঝতে হয় তা কোথায় ঘটেছে।

দ্য একোমোডাডর। আর্চারি বা তীরন্দাজ শেখার অভিজ্ঞতা- একমাত্র এই খেলাটা আমি উপভোগ করি। আর্চারির শিক্ষক বলেন, কোনো শট কখনো পুনরাবৃত্তি হয় না। খারাপ বা ভালো শট শেখার কোনো পয়েন্ট নেই। শত বা হাজারবার পুনরাবৃত্তি করলে, আমরা টার্গেটকে হিট করা থেকে নিজদের মুক্ত করতে পারি না। আমাদের কাছে তীর, ধনুক আর লক্ষ্যবিন্দু থাকে। সেই মুহূর্তে, শক্তিটা একটা নির্দিষ্ট জিনিসের দিকে থাকে, আমরা যখন তীরটা ধনুক থেকে মুক্ত করতে থাকি, তখন জিনিসটা জানে মুহূর্ত এসে গেছে।

দ্য একোমোডাডর। ব্যক্তিগত ইতিহাসের আরেকটা অংশ ভেসে উঠছে। শুধু যদি মেরি এখানে থাকত! আমার নিজের সাথে কথা বলা দরকার, নিজের শৈশব, ওকে বলা দরকার কীভাবে আমি যখন ছোট ছিলাম, আমি সব সময় অন্য ছেলেদের সাথে মারামারি করতাম, মার খেতাম, মার দিতাম। কারণ ক্লাসে আমিই সবচেয়ে বড় ছিলাম। একদিন, আমার কাজিন আমাকে কায়দামতো পেটাল। আমি বুঝতে পারলাম, তারপর থেকে আমি কখনো আর কোনো লড়াইয়ে জিততে পারব না। তারপর থেকে আমি সব রকম শারীরিক লড়াই এড়িয়ে চলতাম, যদিও অধিকাংশ সময় আমাকে কাপুরুষের মতো আচরণ করতে হতো এবং গার্লফ্রেন্ড ও অন্য বন্ধুদের সামনে অপদস্থ হতে হতো।

দ্য একোমোডাডর। দুই বছর ধরে, কীভাবে গিটার বাজাতে হয় তা শেখার চেষ্টা করছি। শুরুতে, আমি খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি করতে লাগলাম, কিন্তু তারপর এ রকম একটা স্কেলে এসে আমি আর এগোতে পারলাম না। কারণ আমি আবিষ্কার করলাম, অন্যরা আমার চেয়ে অনেক দ্রুত শিখে ফেলছে। নিজেকে মধ্যমমানের মনে হতে লাগল। লজ্জা পেলাম। গিটার শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। একই ব্যাপার সুকার, ফুটবল, বাইসাইকেল রেসের ক্ষেত্রে ঘটতে লাগল। আমি সব কিছুই খুব ভালোভাবে শিখতে থাকি; কিন্তু একটা ক্ষেত্রে এসে সব সময় আটকে যাই।

কেন?

 কারণ গল্প অনুযায়ী, সব সময় আমাদের জীবনে এমন একটা মুহূর্ত আসে যখন শেষ সীমায় পৌঁছে যাই। আমি সব সময় আমার লড়াইটা লেখক হওয়ার জন্য অস্বীকার করে গেছি। যে কারণে এসথার সব সময় একোমোডাডরকে অনুমোদনের ক্ষেত্রে অস্বীকার করেছে। একটু আগে যে প্যারাগ্রাফটা পড়লাম তা আমার নিজের জীবনের সাথে মিলে গেছে।

দ্য একোমোডাডর : সব সময় আমাদের জীবনে এ রকম কোনো ঘটনা ঘটে, যা আমাদের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

বিবাহের ব্যাপারে সাধারণত তাই ঘটে। এসথারের সাথে আমার সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে।

এখন আমি ম্যাগাজিনের জন্য আর্টিকেল লিখতে পারি। কম্পিউটারের কাছে এগিয়ে গেলাম। আধাঘণ্টার মধ্যে অর্ধেকটা ড্রাফট লিখে ফেললাম। ফলাফল দেখে বেশ খুশি হলাম। আমি ডায়ালগের আকারে একটা গল্প লিখে ফেলেছি, গল্পটা যেন ফিকশন; কিন্তু এটা একটা ঘটনা, কথোপকথন আমস্টারডামের একটা হোটেলে বসে হচ্ছে।

আমার আর্টিকেলে, চরিত্রের নাম এবং পরিস্থিতি নেই। বাস্তব জীবনে, এসথার নাইটড্রেস পরে জানালা দিয়ে কানালের দিকে তাকিয়ে থাকত। তখন ও একজন যুদ্ধের সংবাদদাতা হয়ে ওঠেনি। ওর চোখ তখনো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠত, নিজের কাজকে ভালোবাসত, যেখানে ইচ্ছা আমার সাথে ভ্রমণে যেত এবং তখন জীবনে অনেক অ্যাডভেঞ্চার ছিল। আমি নীরবে বিছানার ওপর শুয়ে পড়লাম। মন বহুদূরে চলে গেছে। আগামীদিনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে চিন্তিত।

.

গত সপ্তাহে, আমি একজন মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, যে পুলিশ ইন্টারোগেশনের ব্যাপারে এক্সপার্ট। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তারা বেশির ভাগ তথ্যই পান তাদের একটা টেকনিক ব্যবহার করে। টেকনিকটাকে বলা হয় ঠাণ্ডা-গরম টেকনিক। তারা সব সময় খুব রাগী একজন পুলিশকে দিয়ে শুরু করেন, যে এসেই বলে আইনকানুন ভাঙা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই, সে চিৎকার করে এবং টেবিলে সজোরে চাপড় দেয়। সাক্ষী ছাড়াই বন্দিকে ভয়ে আধমরা করার উপক্রম করলে, একজন ভালো পুলিশ এসে তার কলিগকে থামতে বলে, বন্দিকে সিগারেট অফার করে, তার বন্ধু হওয়ার ভান করে এবং যে তথ্য দরকার তা পেয়ে যায়।

হ্যাঁ, আমি অমনটি শুনেছি।

তাহলে তিনি আমাকে এমন কিছু বলেছিলেন, যা আমাকে সত্যিই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। ১৯৭১ সালে, কালিফোর্নিয়ার স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা একটা বন্দিশালা তৈরি করবেন, যাতে ইন্টারোগেশনের সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারগুলো স্টাডি করতে পারেন। তারা চব্বিশজন ছাত্রছাত্রীকে ভলেন্টিয়ার হিসেবে বাছাই করেন। তাদের গার্ড আর ক্রিমিনাল এই দুই দলে ভাগ করে দেন।

মাত্র এক সপ্তাহ পরে, তাদের পরীক্ষণটা বন্ধ করে দিতে হয়। গার্ড ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক সৌজন্যতাবোধ ছিল, তারা ভালো পরিবেশ পরিবার থেকে এসেছে, তারা সত্যিকারের মনস্টারে পরিণত হলো। টর্চারের ব্যাপারটা রুটিনে পরিণত হলো এবং বন্দিদের যৌন হয়রানি করাটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়াল। যেসব ছাত্রছাত্রী এই প্রজেক্টে অংশ নিয়েছিল, গার্ড আর ক্রিমিনাল, তারা বড় ধরনের ট্রমায় ভুগতে লাগল। তাদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার দরকার হলো। এই পরীক্ষণটা আর কখনোই পুনরায় করা হয়নি।

 ইন্টারেস্টিং।

 ইন্টারেস্টিং বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছ? আমি সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপারে কথা বলছি। সুযোগ পেলেই মানুষের খারাপ দিকটা বের হয়ে পড়ে। আমি আমার কাজ নিয়ে কথা বলছি, যা শিখেছি তাই বলছি।

সে ব্যাপারটাই আমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। তুমি কেন এত রেগে যাচ্ছ?

রাগ? আমি যা বলছি তাতে যে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দিচ্ছে না তার ব্যাপারে আমি কীভাবে রেগে যাব? যে আমার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দিচ্ছে না, শুয়ে শুয়ে শূন্যতার দিকে তাকিয়ে আছে, তার ওপর আমি কীভাবে রেগে যাব?

আজ রাতে তুমি কতটা পান করেছ?

 এমনকি তুমি উত্তরটাও জানো না, তাই না? আমি সারাটা সন্ধ্যে তোমার সাথে ছিলাম। তোমার কোনো ধারণাই নেই আমরা কোথায় পান করেছিলাম অথবা করেছিলাম কিনা! কোনো কিছু নিশ্চিত করার জন্যই শুধু তুমি আমার সাথে কথা বলোবা তোমার সমন্ধে যখন কোনো তেলানো কথা বলা হয়!

দেখ, সারা দিন কাজ করে আমি ক্লান্ত। তুমি কেন আমার সাথে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ছ না? আমরা সকালে কথা বলতে পারি!

কারণ আমি সারাটা সপ্তাহ মাস জুড়ে এমনটি করেছি। প্রকৃতপক্ষে গত দুই বছর যাবত এভাবেই কাটাচ্ছি! আমি কোনো কথোপকথন শুরু করতে চাই; কিন্তু তুমি সব সময় ক্লান্ত থাকো, তো আমরা বলি, ঠিক আছে, আমরা শুয়ে পড়ব এবং আগামীকাল কথা বলব। কিন্তু আগামীকালে অন্য কাজ করার থাকে, আরেক দিনের কাজ। প্রকাশকদের সাথে নৈশ ভোজ, তো আমরা বলতে পারি, ঠিক আছে, আমরা শুয়ে পড়ি আর আগামীকাল কথা বলি। এভাবেই আমি আমার জীবন কাটাচ্ছি। সেই দিনের অপেক্ষা করছি যখন আমি আবার তোমাকে আমার পাশে পাব, তত দিন পর্যন্ত আমার নিজের কিছু করার আছে, আমি সেটাই বলতে চেয়েছিলাম। একটা জগৎ তৈরি করার, যেখানে আমি সব সময় যা ইচ্ছা তাই রিফিউজ করতে পারি; আমি নিজের জন্য কোনো স্বাধীন জীবন চাই না। আর আমি তোমার জগৎটাকেও আক্রমণ করতে চাই না।

তুমি আমাকে কী করতে বলো? কাজ বন্ধ করে দেব? আমরা এত সংগ্রাম করে যা অর্জন করতে চাইছি, তা বাদ দিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপে রিভার ক্রুজে যাব? তুমি কি বুঝতে পারো না আমি যা করছি তা বেশ উপভোগ করি? আমার জীবনটাকে বদলে দেয়ার ব্যাপারে তোমার কি একটুও মাথাব্যথা নেই?

তোমার বইয়ে, তুমি ভালোবাসার গুরুত্বের ব্যাপারে কথা বলো, অ্যাডভেঞ্চারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলো, স্বপ্নের সংগ্রামের আনন্দের কথা। বলো। আর আমার সামনে এখন কে আছে? এ রকম কেউ, সে যা লেখে তা পড়ে দেখে না। যে ভালোবাসার ব্যাপারে দ্বিধান্তিত থাকে, অ্যাডভেঞ্চারের ব্যাপারে কথা বলাটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে, আনন্দের ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যে মানুষটাকে আমি বিয়ে করেছিলাম সে কোথায়, আমি যা বলছি তা কে কানে নিচ্ছে?

যে মেয়েটিকে আমি বিয়ে করেছিলাম সে কোথায়?

তুমি বোঝাতে চাচ্ছ সেই মানুষটি যে তোমাকে সব সময় সাপোর্ট দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে ভালোবেসেছে? তার শরীর এখানে, আমস্টারডামের সিনগেল ক্যানালের দিকে তাকিয়ে দেখ, সে থাকবে, আমি বিশ্বাস করি, তার বাকি জীবন তোমার সাথে থাকবে। কিন্তু সেই মহিলার আত্মা চলে যাওয়ার জন্য দুয়ারে প্রস্তুত।

কিন্তু কেন?

কারণ তিনটি জঘন্য শব্দ : আমরা আগামীকাল কথা বলব। তাই কি যথেষ্ট নয়? যদি তাই না হয়, তাহলে এটুকু বিবেচনা করো, যে মেয়েটিকে তুমি বিয়ে করেছিলে সে জীবন নিয়ে এক্সসাইটেড, আনন্দ আর আইডিয়ায় পরিপূর্ণ। আর এখন একজন গৃহিণীতে পরিণত হয়েছে।

কথাটা হাস্যকর।

অবশ্যই হাস্যকর! ফালতু কথা! তুচ্ছ, বিশেষত আমরা যেভাবে সব কিছু চেয়েছি। আমরা খুব সৌভাগ্যবান, আমাদের অর্থসম্পদ আছে। আমাদের কোনো ছোটখাটো জিনিস নিয়ে কখনো আলোচনা করার দরকার হয় না। অন্যদিকে, গোটা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ শিশু ক্ষুধা-তৃঞ্চায় মারা যাচ্ছে, যুদ্ধ, রোগ, হ্যারিকেন, ট্র্যাজেডি প্রতি সেকেন্ডেই ঘটছে। তো এ অবস্থায় আমি এসব ব্যাপারে কীভাবে অভিযোগ করতে পারি?

তুমি কি মনে করো আমাদের একটা বাচ্চা নেয়া দরকার?

সেভাবেই সমস্ত দম্পতি তাদের সমস্যার সমাধান করে একটা বাচ্চা নিয়ে নেয়! তুমিই একমাত্র মানুষ, যে নিজের স্বাধীনতার বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে বাচ্চার ব্যাপারটাকে দীর্ঘায়িত করছ। তুমি কি সত্যিই তোমার মন বদলেছ? আমার মনে হয় এখনই সঠিক সময়।

বেশ, আমার মতে, তুমি খুব একটা ভুল বলোনি! আমি তোমার বাচ্চা নিতে চাই না। আমি সেই মানুষটার বাচ্চা নিতে চাই, যে মানুষটাকে আমি চিনি, যার স্বপ্ন আছে, যে সব সময় আমার পাশে থাকবে! আমি যদি কখনো গর্ভবতী হই তাহলে এমন কারো দ্বারা হব, যে আমাকে বুঝতে পারবে, আমাকে সঙ্গ দেবে, আমার কথা শুনবে, যে আমাকে সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষা করবে!

 তুমি মাতাল হয়ে পড়েছ। দেখ, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমরা আগামীকাল কথা বলব, কিন্তু দয়া করে, এখন বিছানায় এসো। আমি ক্লান্ত।

“ঠিক আছে, আমরা আগামীকাল কথা বলব। আর আমার আত্মা, যা এখন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, যদি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, আমার সন্দেহ আছে। তাতে আমাদের জীবনযাপনের ওপর প্রভাব পড়বে।

 ‘তোমার আত্মা চলে যেতে পারে না।’

‘তুমি আমার আত্মাকে খুব ভালোভাবেই চেনো। কিন্তু তুমি তার সাথে বছরের পর বছর কথা বলোনি, তুমি জানো তা কত বদলে গেছে, কত বেপরোয়া তোমাকে তার কথা শোনাতে চেয়েছে। এমনকি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতার মতো নগণ্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে চেয়েছে।

 ‘যদি তোমার আত্মা এত বেশি বদলে গিয়ে থাকে, তাহলে তুমি এখনো কীভাবে একই রকম আছো?

কাপুরুষতার জন্য। কারণ আমি সত্যিই ভেবেছিলাম আগামীকাল আমরা কথা বলব। কারণ আমরা দুজনে মিলে যা গড়ে তুলেছি তা ধ্বংস হয়ে যেতে দিতে চাইনি। অথবা সব কারণের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ যেটা, আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি।

 ‘তুমি তাহলে সেই ব্যাপারেই আমাকে দোষী করছ।

 ‘তোমার কথাই ঠিক। আমি তোমাকে দেখি, ভাবি আমি তোমাকেই দেখছি, কিন্তু সত্যটা হলো আমি নিজেকেই দেখি। আজ রাতে আমি আমার শক্তি, আমার বিশ্বাস নিয়ে ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করব যেন আমার বাকি দিনগুলো এমন না যায়।

.

আমি হাততালির শব্দ শুনতে পেলাম। থিয়েটার কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আমি এ রকম কিছু করতে পারি, যাতে ঘুমহীন রাত কাটানো যায়। আমি একটা বক্তৃতা দিতে যাচ্ছি।

অনুষ্ঠানটা এমনভাবে শুরু হচ্ছে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোনো দরকার নেই। ও ওখানে দাঁড়িয়ে সাধারণভাবেই এমন কিছু বলছে, যাতে শ্রোতারা বুঝতে পারে, যার মধ্যে ওর অনেক বন্ধুবান্ধব আছে। ও কী বলেছে তা সত্ত্বেও, যাই হোক, ও বেশ কিছু আত্মজৈবনিক বর্ণনা দিয়ে শেষ করল এবং লেখক হিসেবে আমার মোগ্যতা, আমি যেসব পুরস্কার জিতেছি এবং আমার লক্ষ লক্ষ বই বিক্রির কথা বলল। ও স্পন্সরকে ধন্যবাদ জানাল। আমার দিকে ঘুরে আহ্বান জানাল।

আমিও ওকে ধন্যবাদ দিলাম। আমি দর্শক-শ্রোতাদের বললাম, সবচেয়ে গুরুতুপূর্ণ যা বলব তা আমার বই সম্পর্কে, কিন্তু আমার মনে হয় এসব ব্যাপারে কিছুটা ব্যাখ্যা দেয়া দরকার। ব্যাখ্যা করলাম আমাদের মানবীয় অবস্থা এ রকম প্রবণতা তৈরি করেছে, যাতে সবচেয়ে ভালোটা হয়, কারণ আমরা সব সময় ভালোবাসা এবং অনুমোদনের খোঁজ করি। আমার বই শুধু পর্বতের ওপর মেঘের সীমানায় অথবা সাগরের দ্বীপে দৃশ্যমান।

এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ লেখা আমার জন্য কতটা কঠিন ছিল তা বর্ণনা করলাম। এ বইয়ের অনেক অংশ আমি এখন বুঝতে শুরু করেছি। যতবার বইটা পড়ি মনে হয় সৃষ্টিকর্তার চেয়ে সৃষ্টিই সব সময় মহোত্তর।

 সাক্ষাৎকার পড়া অথবা লেখকের লেখা নিয়ে লেকচার দেয়ার মতো বিরক্তিকর কাজ আর কিছু নেই। যদি কোনো বইয়ের ভেতর সেই লেখার ব্যখ্যা না থাকে, তাহলে সে বই পড়ার যোগ্য নয়। একজন লেখক লোক সম্মুখে এলে, তার নিজের জগত্তাকে দেখাতে হয়, বইয়ের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা নয় আর এই কথা বলে আমি আমার ব্যক্তিগত কথায় চলে গেলাম।

 “কিছুদিন আগে, পর পর কয়েকটা সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য জেনেভায় গিয়েছিলাম। সারা দিনের কাজের শেষে, আর একজন মেয়ে বন্ধুর কারণে শেষ মুহূর্তে রাতের খাবারের দাওয়াত বাতিল করে দিলাম। শহরটা ঘুরে দেখতে চাইলাম। খুব অপূর্ব একটা রাত ছিল। রাস্তাগুলো জনশূন্য, বার আর রেস্তোরাঁ জীবনের পরিপূর্ণ ছবি ঝলমল করছে। সব কিছুই বেশ শান্ত, সুন্দর, নিয়মমাফিক চলছিল…হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারলাম, আমি পুরোপুরি একা।

 বলার অপেক্ষা রাখে না, এক বছর ধরে আমি বিশেষ একটি কারণে পুরাপুরি একা। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমার গার্লফ্রেন্ড প্লেনে মাত্র দুই ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থান করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, একটা ব্যস্ত দিন কাটানোর পর, একটা সরু রাস্তা দিয়ে উভ্রান্তের মতো ঘোরার সময়, কারো সাথে কোনো কথা বলে, একাকী সৌন্দর্য উপভোগ করা।

সেলফোন বের করলাম। যাই হোক, এই শহরে বন্ধুদের নাম্বার আমার কাছে আছে; কিন্তু কাউকে ফোন করার জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিলাম, একটা বারে গিয়ে ড্রিংকস অর্ডার করব, কেউ না কেউ আমাকে চিনতে পারবে এবং তাদের সাথে যোগ দিতে বলবে। কিন্তু আমি কোনোমতে লোভ সামলালাম।

আমি কল্পনা করতে শুরু করলাম, কত শত শত লোক সেই মুহূর্তে নিজেকে হতভাগ্য বেকার ভাবছে, তাই সে ধনী, সুন্দরী, অভিজাত যে কেউ হতে পারে। কারণ এই রাতে তারা একাকী। যেমনটি গতকালও ছিল। হয়তো আগামীকালও থাকতে পারে। ছাত্ররা কারো সাথে বের হয়নি, বয়স্ক লোকেরা টেলিভিশনের সামনে বসে আছে, ব্যবসায়ীরা তাদের হোটেল রুমে, যেসব মহিলারা সারাটা বিকাল মেকআপ করে কাটিয়েছে তাদের ভাবখানা তারা কোনো সঙ্গীর অপেক্ষায় নেই। তারা শুধু সুন্দরী আর্কষণীয়া এটাই নিশ্চিত হতে চায়। পুরুষরা তাদের তোষামোদ করে তাদের সাথে কথা বলতে চায়, কিন্তু মহিলারা তাদের সব সময় বাতিল করে দেয়, কারণ তাদের মনের মধ্যে সব সময় একটা ভয় থাকে যে পুরুষেরা হয়তো তারা যে সিঙ্গেল মম অথবা নিচু শ্রেণীর কেরানি। তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে, খবরের কাগজ পড়ার মতো সময়ও তাদের হাতে থাকে না। যেসব লোক নিজেদের আয়নার সামনে দেখে এবং নিজেদের কুৎসিত ভাবে, বিশ্বাস করে সুন্দর হওয়া সত্যিই একটা ব্যাপার, নিজেদের সময় সুন্দরী, ধনী, বিখ্যাতদের ম্যাগাজিন পড়ে কাটায়। স্বামী-স্ত্রী আশা করে রাতের খাবারের পরে কথা বলবে; কিন্তু সব সময় কথোপকথনটা আগামীকালের জন্য ভোলা থাকে, আর সেই আগামীকাল আর কখনোই ফিরে আসে না।

“সেই দিন, আমি এ রকম একজন বন্ধুর সাথে লাঞ্চ করলাম, যে এইমাত্র ডিভোর্স দিয়ে এসেছে। মেয়েটি আমাকে বলল, এখন আমি স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারছি, সব সময় যে রকম স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু ব্যাপারটা মিথ্যা। কেউ ওই জাতীয় স্বাধীনতা চায় না, আমরা সবাই চাই কেউ আমাদের পাশে থেকে জেনেভার সৌন্দর্য দেখুক, বই নিয়ে আলোচনা করুক, সাক্ষাৎকার, সিনেমা, এমনকি স্যান্ডউইচ ভাগ করে নিক। কারণ একেকজনের জন্য এক একটা কেনার মতো অর্থ তাদের কাছে নেই। পুরো একটা খাওয়ার চেয়ে অর্ধেকটা খাওয়া ভালো। সেই মানুষটার সাথে বাধাগ্রস্ত হোক যে সরাসরি বাসায় চলে যায়, কারণ আজ রাতে টিভিতে গুরুত্বপূর্ণ খেলা আছে।

একাকী থাকার চেয়ে ক্ষুধার্ত থাকা ভালো। কারণ যখন আপনি একাকী- আমি এখানে আমাদের বেছে নেয়া নিঃসঙ্গতার কথা বলছি না- কথাটা এ রকম যেন আমরা মানব প্রজাতির অংশ নই।

নদীর অন্য পাশে সুন্দর একটা হোটেল আমার জন্য অপেক্ষা করছে। হোটেলের লাক্সারিয়াস রুম, সদাপ্রস্তুত কর্মকারী, ফাইভ স্টার সার্ভিস। ব্যাপারটা ভেবে আমার আরো খারাপ লাগছে, কারণ আমি এত দিন যা অর্জন করেছি, সব ব্যাপারে আমার সুখী হওয়া উচিত।

 ফেরার পথে, আমি একই পরিস্থিতিতে থাকা লোকদের পাশ কাটিয়ে এলাম। লক্ষ করলাম, ওরা দুই ক্যাটাগরিতে ভাগ হয়ে আছে কেউ কেউ উদ্ধত, কারণ তারা নিজেরাই এই নিঃসঙ্গতা বেছে নিয়েছে এ রকম ভান করতে চায়। অন্যদের বেশ দুঃখিত দেখায়।

আমি আপনাদের এসব বলছি, কারণ আরেক দিন আমি আমস্টারডামের একটা হোটেলে একজন মহিলার সাথে ছিলাম, যে তার জীবন সম্বন্ধে বলেছিল। আমি আপনাদের এসব বলছি, কারণ যদিও বলা হয়েছে এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ, মাঝে মাঝে টাইম টু রেন্ড গভীর ক্ষত রেখে যায়।”

তালি দেয়ার আগে বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেল।

.

প্যারিসের নিরানন্দ এলাকায় পৌঁছালাম। যে এলাকাটাকে কখনো গোটা শহরের সবচেয়ে জীবন্ত সাংস্কৃতিক জীবন বলা হয় না। সেইসব লোককে চিনতে পারলাম, যারা বৃহস্পতিবার সাদা পোশাকে আর্মেনিয়ান রেস্তোরাঁয় হাজির হয়।

আপনারা সবাই কেন এ রকম ফেন্সি ড্রেস পরেন? এটা কি একটা সিনেমার ব্যাপারে কোনো ধরনের উৎসর্গ?

 ‘এটা কোনো ফেন্সি ড্রেস নয়। মিখাইল উত্তর দিল, “আপনি কি কোনো গালা নাইটে আপনার পোশাকআশাক বদলে যান না? আপনি কি গলফ খেলতে জ্যাকেট আর টাই পরে যান?

“ঠিক আছে, তাহলে আমাকে প্রশ্নটা অন্যভাবে করতে দিন। আপনারা কেন। তরুণ গৃহহারা লোকদের মতো পোশাক পরার সিদ্ধান্ত নিলেন?

 কারণ, এই মুহূর্তে, আমরা তরুণ গৃহহারা মানুষ, অথবা এভাবে বলা যায়, চারজন তরুণ গৃহহারা মানুষ আর দুজন প্রাপ্তবয়স্ক গৃহহারা মানুষ।

এবারে প্রশ্নটা অন্যভাবে করতে দিন, তাহলে আপনারা এ রকম পোশাক পরেছেন কেন?

‘রেস্তোরাঁয় আমরা শরীরকে খাদ্য জোগাই। লোকজন যে শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সেই সমন্ধে কথা বলি। ভিখারিদের মধ্যে, আমরা আত্মাকে খোরাক জোগাই, যাদের হারানোর কিছু নেই তাদের সাথে কথা বলি। এখন, আমরা আমাদের কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশে এসেছি।

মিখাইল এ রকম কিছু ব্যাপারে কথা বলছিল, যা আমি এরই মধ্যে লক্ষ করেছি। ব্যাপারটা মনে হচ্ছে দিন দিন বেড়েই চলেছে; তরুণরা এভাবেই পোশাক পরে, এলোমেলো কিন্তু খুবই কল্পনাপ্রবণ পোশাক, যেন কতকটা মিলিটারি ইউনিফর্ম অথবা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর চরিত্রের পোশাক। তারা প্রায় সবাই শরীরে ছিদ্রও করেছে আর অদ্ভুত সব চুলের ছাট। প্রায়ই, এই দলগুলো রাগী ভয়ংকর চেহারার কুকুর নিয়ে চলাফেরা করে। একবার এক বন্ধুকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওরা কেন সব সময় ওদের সাথে কুকুর রাখে। বন্ধুটি জানিয়েছিল, যদিও আমি জানি না ব্যাপারটা সত্য কিনা। পুলিশ এদের অ্যারেস্ট করতে পারে না, কারণ ওদের সাথে কুকুর থাকে।

এক বোতল ভদকা হাত ঘুরে আমার হাতে এল। আমরা ভিখারিদের সাথে থাকলে ভদকা পান করি। আমার বিস্ময় লাগে মিখাইলের জন্মসূত্রেই এই ব্যাপারটা আছে। আমি এক চুমুক পান করলাম, লোকজন ওখানে আমাকে দেখলে কী বলতে পারে তা কল্পনা করতে লাগলাম।

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, তারা বলতে পারে, লেখক সম্ভবত তার পরবর্তী বইয়ের ব্যাপারে রিসার্চ করছেন। তাতেই তারা বেশি স্বস্তিবোধ করবে।

 ‘আমি এখন এসথারকে খোঁজার জন্য তৈরি। কিন্তু আমার আরো কিছু তথ্য দরকার, কারণ আপনার দেশ সমন্ধে আমি বলতে গেলে কিছুই জানি না।’

‘আমি আপনার সাথে যাব।’

কী?

আমার পরিকল্পনায় আদৌ এমনটি ছিল না। আমি নিজে যা হারিয়েছি তা পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে ভ্ৰমণ আমার কাছে সব কিছু। আর তা মধ্য এশিয়ার কোনো প্রদেশে গিয়ে শেষ হতে পারে। ব্যাপারটা খুব অন্তরঙ্গ এবং ব্যক্তিগত, এ রকম কিছু যার কোনো সাক্ষীর দরকার নেই।

‘অবশ্য যতক্ষণ আপনি আমার টিকিটের দাম দিচ্ছেন। আমার কাজাখস্তানে ফিরে যাওয়া দরকার। দেশকে খুব মিস করছি।’

‘আমি ভেবেছিলাম আপনি এখানে কাজ করছেন। রেস্তোরাঁয় বৃহস্পতিবারের পারফর্ম্যান্সে কি আপনার দরকার নেই।

 ‘আপনি ব্যাপারটাকে আবার পারফর্ম্যান্সে বলছেন। আমি আপনাকে আগেও বলেছি, এটা একটা সাক্ষাৎকার, আপনি যা হারিয়েছেন তা পুনরুদ্ধার করার একটা পথ, কথোপকথনের ঐতিহ্য। কিন্তু চিন্তা করবেন না। আনাস্টাসিয়া এখানে আছে। আর মিখাইল নাকে নোলক পরা একটা মেয়ের দিকে দেখিয়ে দিল। ও এরই মধ্যে ওর গিফট উন্নত করেছে। আমি চলে গেলে ও সব কিছুর দেখাশোনা করতে পারবে।’

 তিনি ঈর্ষান্তিত। আলমা বলল। যন্ত্রসংগীত বাজাচ্ছিল সে। প্রতিটি মিটিংয়ের শেষে সে গল্প বলে।

 ‘সত্যিই বুঝতে পারার ব্যাপার।’ আরেকটা ছেলে বলল। ছেলেটি চামড়ার আউটফিট পরেছে, যাতে মেটাল মোলক, সেফটি পিন এবং রেজর ব্লেডের মতো ধাতব জিনিস জড়ানো আছে। মিখাইল তরুণ, সুদর্শন এবং প্রাণশক্তিতে ভরপুর।

“তিনি অবশ্য কম খ্যাতিমান, কম ধনী এবং কম প্রাণশক্তির স্পর্শে আছে। আনাস্টাসিয়া বলল, মেয়েদের দৃষ্টিকোণ থেকে, সব কিছুই বেশ ভারসাম্যপূর্ণ মনে হচ্ছে, তারা দুজনই তারা যা পেতে যাচ্ছে তা পেয়েছে।

সবাই হেসে উঠল। ভদকার বোতল আরেক রাউন্ড হাত ঘুরে এল। আমিই একমাত্র হাসির কিছু দেখতে পেলাম না। আমি নিজেই বিস্মিত হয়ে গেলাম। অনেক বছর পরে আমি প্যারিসের ফুটপাতে বসে আছি, নিজেই সন্তষ্ট।

আপনি যেমনটি ভাবছেন গোত্রটি তার চেয়ে অনেক বড়। তারা সবাই আছে, আইফেল টাইওয়ারের নিচ থেকে শুরু করে টারবেস শহরে যেখানে আমি সম্প্রতি বাস করেছি। কিন্তু আমি সতোর সাথে বলতে পারছি না আমি সব কিছু বুঝতে পেরেছি।’

 ‘তারা তারেবের থেকে দূরে দক্ষিণের দিকে পেতে পারে। সান্তিয়াগোর পথে প্রতিটি রুট তারা অনুসরণ করে। তারা ফ্রান্সের কোথাও অথবা ইউরোপের কোথায় থামে, তারা সমাজের অংশ হিসেবেই সমাজের বাইরে বাস করে। তারা বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে ভয় পায়। একটা চাকরি খুঁজে নিয়ে বিয়ে করতে ভয় পায়। তারা এগুলোর বিরুদ্ধে যথাসম্ভব লড়াই করার চেষ্টা করে। তাদের মধ্যে ধনী-গরিব সবই আছে। কিন্তু তারা টাকা-পয়সার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। তাদের সম্পূর্ণ অন্য রকম দেখায়। লোকজন তাদের পাশ দিয়ে গেল তারা এ রকম ভাব করে, যেন তাদের দেখতে পাইনি। কারণ তারা ভীত থাকে।

 ‘তাদের এ রকম আক্রমণাত্মক দেখায়?

হ্যাঁ, কারণ ধ্বংসাত্মক আবেগ হলো সৃষ্টিশীল আবেগ। যদি তারা আক্রমণাত্মক না হয়, বুটিক হাউসগুলো খুব তাড়াতাড়ি এ রকম কাপড়চোপড় বানাতে শুরু করবে, প্রকাশকরা শিগগিরই এদের নতুন মুভমেন্টের ওপর ম্যাগাজিনে স্টোরি করে ফেলবে। টিভি প্রোগ্রামে এই উপগ্রোত্র নিয়ে দেখানো হবে, সমাজবিজ্ঞানীরা আর্টিকেল লিখে ফেলবে, সাইকিয়াট্রিস্টরা উপগোত্রের সদস্যদের পরিবারে গিয়ে আলাপ করবে, তাহলে তাদের সমস্ত ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। তো তারা আমাদের সমন্ধে যত কম জানবে ততই আমাদের জন্য ভালো, আমাদের আক্রমণ সত্যিকার অর্থে আমাদের প্রতিরক্ষা।

 ‘প্রকৃতপক্ষে, আমি আজ রাতে এখানে এসেছি আপনার কাছ থেকে কিছু তথ্য জানার জন্য। কিন্তু কে জানে, আপনার সাথে আজ রাতটা এখানে কাটানোর অর্থ হয়তো আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে নতুন পালক সংযোজন করা। কাজাখস্তানের জার্নির জন্য, নিজের সাথে কাউকে নেয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমি আপনার কাছ থেকে কোনো সাহায্য না পেলে, ফেভার ব্যাংক আমাকে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ জোগাবে। আমি দুই দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। আগামীকাল রাতে আমার একজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি আসবে। কিন্তু তারপর থেকে আমি দুই সপ্তাহের জন্য ফ্রি আছি।’

মিখাইল ইতস্তত করতে লাগল।

ব্যাপারটা আপনার ওপরে। আপনি মানচিত্রটা পেয়েছেন, গ্রামের নাম জেনেছেন, এসথার কোথায় আছে সেই বাড়িটা খুঁজে পাওয়া আপনার জন্য খুব একটা কঠিন কিছু হবে না। আমি নিশ্চিত ফেভার ব্যাংক আপনাকে আলমাটি যেতে সাহায্য করবে, কিন্তু আমার সন্দেহ আছে তার চেয়ে বেশি দূর যেতে পারবেন কিনা, কারণ স্টেপের নিয়মকানুন ভিন্ন। পাশাপাশি, আমিও আপনার ফেভার ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে কিছু ডিপোজিট জমা করেছি। সেগুলো দাবি করার সময় এসেছে, আমি আমার মাকে মিস করছি।’

মিখাইলের কথা ঠিক। ‘আমাদের কাজ শুরু করতে হবে।

আলমার স্বামী বলল। মিখাইল, আপনি আমার সাথে যেতে চান কেন? শুধু আপনার মাকে মিস করছেন বলে?

মিখাইল কোনো উত্তর দিল না। পুরুষটি ড্রাম বাজাতে শুরু করল। আলমা সিম্বল বাজাতে লাগল। অন্য ভিখারিরা পথিকের কাছে টাকা-পয়সা ভিক্ষা চাইতে লাগল। মিখাইল আমার সাথে কেন যেতে চায়? আর আমি কীভাবে স্টেপে ফেভার ব্যাংকের সাহায্য নিতে পারি যেখানে আমি কাউকেই প্রকৃতপক্ষে চিনি না? আমি কাজাখস্তানের এম্বাসি থেকে ভিসা পেতে পারি, একটা গাড়ি ভাড়া নিতে পারি, ফ্রেন্স কনসুলেট থেকে আলমাটির একজন গাইডকে সাথে নিতে পারি। তাহলে আমার আর অতিরিক্ত কি দরকার?

 আমি ওখানে দাঁড়িয়ে গোটা দলটাকে দেখতে লাগলাম। কী করতে চাই তা জানি না। ট্রিপের ব্যাপারে এখনই আলোচনা করার উপযুক্ত সময় নয়। আমার আরো কিছু কাজ করতে হবে। আমার বান্ধবী বাসায় আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমি কেন এখনই এখান থেকে চলে যাচ্ছি না?

 আমি চলে যাচ্ছি না, কারণ নিজেকে বেশ মুক্ত মনে হচ্ছে। অনেক বছর ধরে এই জাতীয় কোনো কাজ করিনি। নতুন অভিজ্ঞতায় আমার মনকে উন্মুক্ত করে দিইনি। আমার জীবনের একোমোডেডরকে চালিয়ে নিয়ে যাইনি। এ রকম বিষয়ে অভিজ্ঞতা হয়নি, যা হয়তো আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং নয়, কিন্তু অন্ততপক্ষে অন্য রকম।

ভদকা শেষ হয়ে গেল, তার বদলে রাম এল। আমি রাম অপছন্দ করি। কিন্তু এই যখন এখানে আছে তখন রামের সাথে মানিয়ে নেয়াই ভালো। দুজন সংগীতঙ্গ বাজিয়েই চলেছে। তখন একটা মেয়ে এসে ওর হাত ধরে কিছু একটা যন্ত্রাংশ বদলানোর কথা বলল। লোকটা খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে, কিন্তু সব সময় ধন্যবাদ, চমৎকার সন্ধ্যা’ শুনতে পায়। একজন লোককে মনে হলো ধন্যবাদ দেয়াটা অপচয় করার মতো ফিরে এসে কিছু টাকা দিল।

দশ মিনিট ধরে এই দৃশ্য দেখার পরে, দলের কেউ আমার দিকে লক্ষ করে একটা শব্দও বলল না। আমি বারের দিকে এগিয়ে গেলাম, দুই বোতল ভদকা কিনে ফিরে এলাম। রামটুকু নদৰ্মায় ঢেলে দিলাম। আনাস্টাসিয়া আমার আচরণে খুশি হয়েছে বোঝা গেল। আমি আবার কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।

আপনি কি ব্যাখ্যা করতে পারেন কেন আপনার শরীর ছিদ্র করেন?

 ‘কেন অন্য লোকের স্বর্নাংলকার গয়না বা হাই হিল বা লো-কাট ড্রেস এমনকি শীতকালেও পরে?’

‘এটা কোনো উত্তর হলো না।’

‘আমরা শরীরটাকে ছিদ্র করি কারণ আমরা রোমের নতুন বর্বরদের দল। আমরা কোনো ইউনিফর্ম পরি না সে কারণে আমাদের গোত্রটাকে আলাদা করে চেনার জন্য আমাদের অন্য রকম কিছু করা দরকার।

 সে এ রকমভাবে বলল, যেন তারা কোনো ঐতিহাসিক মুভমেন্টের অংশবিশেষ। কিন্তু ঘরে ফেরা লোকজনের কাছে তারা শুধু বেকার তরুণদের অংশ, যাদের শোয়ার কোনো জায়গা নেই, প্যারিসের রাস্তার ভবঘুরে, টুরিস্টদের বিরক্ত করে, লোকাল ইকোনমিতে অবদান রাখে না, বাবা-মা থেকে দূরে থাকে, পিতা-মাতারও তাদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

আমি এক সময় এসব পছন্দ করতাম- তখন হিপ্পি মুভমেন্ট সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল। বিশাল রক কনসার্ট, ছিন্নভিন্ন জামাকাপড়, ভাইকিং জলদুস্যুদের চিহ্ন, শান্তির সাইন। যেমনটি মিখাইল বলছিল, গোটা হিপ্পি ব্যাপারটা হঠাৎ করে বিক্রয়যোগ্য দ্রব্য হিসেবে বিবেচিত হয়, তারপর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

একজন মানুষ রাস্তা দিয়ে এল। লেদার জ্যাকেট আর সেফটি পিন পরা ছেলেটা লোকটার কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। ছেলেটা লোকটার কাছে টাকা চাইল। যাই হোক, কোনো তাড়াহুড়ো না দেখিয়ে অথবা আমার কাছে ভাংতি নেই’ এই জাতীয় কিছু না বলে লোকটা দাঁড়িয়ে গেল, আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলল :

 ‘আমি প্রতিদিন সকালে অন্ততপক্ষে এক লক্ষ ইউরো ঋণ নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠি, উঠি আমার বাড়ির কারণে, ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে। আমার স্ত্রীর ব্যয়বহুল আচরণের কারণে। আমার অবস্থা আপনাদের চেয়েও খারাপ। আমার মনের অবস্থাও শোচনীয়। কেমন হয় আপনারা যদি আমাকে অল্প কিছু দিয়ে সাহায্য করেন যাতে আমার ঋণ কিছুটা কম হয়?

লুসেরিয়া-মিখাইল যাকে তার গার্লফ্রেন্ড বলে দাবি করে- পঞ্চাশ ইউরো নোট বের করে লোকটার হাতে দিল।

 ‘আপনি নিজের জন্য কিছু ক্যাভিয়ার কিনে নিন। আপনার এই দুর্ভাগ্যজনক জীবনের জন্য একটু হলেও আনন্দ দরকার।

 মানুষটি ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল, যেন এ রকমভাবে একজন ভিখারির কাছ থেকে পঞ্চাশ ইউরো নেয়া খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। এই ইটালিয়ান মেয়েটির ব্যাগে ওই পঞ্চাশ ডলারের নোটটিই ছিল- রাস্তায় ভিক্ষা করে পেয়েছিল!

 ‘চলো, আমরা অন্য কোথাও যাই।’ লেদার জ্যাকেট পরা ছেলেটা বলল।

 ‘কোথায়? মিখাইল জিজ্ঞেস করল।

 ‘খুঁজে দেখি অন্য কোথাও যাওয়া যায় কিনা। উত্তরে অথবা দক্ষিণে?

আনাস্টাসিয়া পশ্চিমের দিকটা পছন্দ করল। সর্বোপরি, মিখাইলের ভাষ্য অনুযায়ী মেয়েটি তার গিফটকে উন্নত করছে।

.

শতাব্দী আগে সেইন্ট-জ্যাকুয়াস যেখান দিয়ে ভ্রমণ করেছিলেন আমরা সেদিকটা অতিক্রম করলাম। সান্তিয়াগো ডি কমপোস্টেলার দিকে গেলাম। সাধারণত তীর্থযাত্রীরা এই অভিমুখে আসে। আমরা নটরডেমের পাশ দিয়ে গেলাম, ওখানে কয়েকজন নতুন ধরনের বর্বর প্রকৃতির লোক ঘোরাফেরা করছে। ভদকা শেষ হয়ে গেছে। তো আমরা আরো দুই বোতল ভদকা কিনলাম। যদিও আমি জানি না এই দলের সবাই আঠারো বছরের ওপরে কিনা। কেউ আমাকে ধন্যবাদ দিল না। তাদের ভাব দেখে মনে হলো আমার ভদকা কেনাটা স্বাভাবিক।

আমার নিজের মধ্যে মাতাল ভাব বুঝতে পারছি। আমাদের দলে নতুন এসে যোগ দেয়া মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছি। সবাই বেশ জোরে জোরে উচ্চ স্বরে কথা বলছে। খালি কৌটায় সজোরে লাথি কষাচ্ছে- ধাতবের সাথে প্লাস্টিকের অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে কেউ কোনো কিছু নিয়ে তেমন কিছু বলছে না। আমরা সেইনের ধার দিয়ে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। কমলা আর সাদা ফিতে দিয়ে বেশ খানিকটা জায়গা সংস্কারের কাজ চলছে বলে ঘেরাও করে রাখা। পেভমেন্টে ওঠা থেকে লোকজনের দূরে সরিয়ে রাখা কারণ। পাঁচ মিটার পরে গিয়ে আবার পেভমেন্টে ওঠা যাবে। ‘জিনিসটা এখনো এখানে। নতুনদের মধ্যে একজন বলল।

কী এখানে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘ও কে?

 ‘আমাদের একজন বন্ধু।’ লুসেরিয়া জবাব দিল। প্রকৃতপক্ষে, সম্ভবত তুমি ওর লেখা কোনো একটা বই পড়েছ।

নতুন আগন্তুক আমাকে চিনতে পারল। কিন্তু অন্যদের মতো কোনো বিস্ময় দেখাল না। উল্টো দিকে, জিজ্ঞেস করল আমি ওকে কিছু অর্থ দিতে পারি কিনা, সাথে সাথেই আমি অনুরোধটা রিফিউজ করলাম।

‘আপনি যদি জানতে চান ফিতাটা এখানে কেন, আমাকে এক ইউরো দিতে হবে। জীবনের সব কিছুরই মূল্য আছে, যা আপনি আমার চেয়ে ভালো করেই জানেন। আর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান প্রোডাক্টের মধ্যে তথ্য একটি।

 দলের কেউ আমার সাহায্যে এগিয়ে এল না। তো আমি উত্তরের জন্য ওকে এই ইউরো দাম শোধ করলাম।

 ‘ফিতাটা এখানে কারণ আমরা এখানে রেখেছিলাম। আপনি যেমনটি দেখতে পাচ্ছেন, এখানে কোনো সংস্কারের কাজ চলছে না। কমলা সাদা ফিতাটি পেভমেন্টকে ব্লক করে রেখেছে। কিন্তু এখানে কী হচ্ছে কেউ কিছুই জিজ্ঞেস করছে না। তারা পেভমেন্ট থেকে নেমে সারা হয়ে রাস্তা দিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। যাই হোক, আমি কোথায় যেন পড়েছিলাম আপনার একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল, ব্যাপারটা কি সত্যি?

হ্যাঁ, ঘটেছিল। আর তার কারণ আমি পেভমেন্ট থেকে নেমে গিয়েছিলাম।’

চিন্তা করবেন না। এখানে যখন লোকজন পেভমেন্ট থেকে নেমে হাঁটে, তারা অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে থাকে। আর এখানে ফিতা রাখার এটাও একটা কারণ, চারদিকে কী ঘটে চলেছে সে সমন্ধে লোকজনকে আরো বেশি সচেতন করা।

না, তা নয়। যে মেয়েটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল সে বলল, এটা শুধু একটা মজার ব্যাপার। যাতে লোকজনের কাণ্ডকারখানা দেখে আমরা হাসতে পারি। কোনো রকম ভাবনাচিন্তা না করেই লোকজন নিয়ম মেনে চলছে। আর কোনো কারণ নেই, ব্যাপারটার কোনো গুরুত্ব নেই, কেউ এটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিচ্ছে না।’

দলে আরো লোকজন যোগ দিল। এখন আমরা সংখ্যায় এগারোজন। সাথে দুটো এলসেশিয়ান কুকুর আমরা আর ভিক্ষা করছি না, কারণ আমাদের বুনো দলটার কাছাকাছি আসার সাহস কেউ করছে না। আবারও মদের বোতল খালি হয়ে গেল। ওরা সবাই আমার দিকে তাকাতে লাগল। আমাকে আরেক বোতল কেনার জন্য অনুরোধ করল, যেন ওদের মাতাল করার দায়িত্ব আমার ওপরে পড়েছে। আমি বুঝতে পারলাম আমার তীর্থযাত্রার এটাই পাসপোর্ট। তো আমি আরেকটা মদের দোকান খুঁজতে লাগলাম।

যে মেয়েটির প্রতি আমি আগ্রহী হয়ে উঠেছি- যার বয়স আমার মেয়ের বয়সী হওয়ার মতো দেখে মনে হলো আমি ওর দিকে লক্ষ করছি তা লক্ষ্য করেছে। আমার সাথে কথা বলতে শুরু করল। আমি জানি আমাকে উদ্দীপ্ত করার খুব সহজ রাস্তা এটি। কিন্তু আমি তাতে যোগ দিলাম না। মেয়েটি ওর ব্যক্তিগত জীবনের কোনো কিছু আমাকে বলল না, ও আমাকে শুধু জিজ্ঞেস করল একটা দশ ডলারের নোটে কতগুলো বিড়াল আর ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে।

 ‘বিড়াল আর ল্যাম্পপোস্টঃ

 ‘আপনি জানেন না, তাই না? আপনি টাকা-পয়সার কোনো রকম গুরুত্ব দেন না। বেশ, আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, ওখানে চারটা বিড়াল আর এগারোটা ল্যাম্পপোস্ট রয়েছে।’

 ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ড্রাগ নেয়?

‘কেউ কেউ, কিন্তু মূলত সবাই শুধু এলকোহল পান করে। খুব বেশিও পান করে না, কারণ এটা আমাদের স্টাইল নয়। ড্রাগ আপনাদের জেনারেশনের লোকজনই বেশি ব্যবহার করে, তাই না? উদাহরণস্বরূপ, আমার মা, পরিবারের জন্য রান্নাবান্না করা, বাড়িটাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, আমার খোঁজখবর করা ড্রাগের মতো কাজ করে। আমার বাবার ব্যবসার কোনো সমস্যা হলে মা কষ্ট পায়, আপনি কি তা বিশ্বাস করেন? মা আমার জন্য কষ্ট পায়, আমার বাবা, ভাইবোন সবার জন্য, সব কিছুর জন্য। সারাটা সময় খুশি থাকার ভান করে আমরা অনেক শক্তি নষ্ট করে ফেলেছি, সে কারণেই ভেবেছি বাড়ি থেকে পালিয়ে আসাই সর্বোত্তম।

 আরেকটা ব্যক্তিগত ইতিহাস।

 ‘আপনার স্ত্রীর দিকে দেখুন। সাদা চুলের, তে রিং লাগানো তরুণ বলল, ‘সেও ঘর ছেড়ে গিয়েছে, তাই নয় কি? তার কারণ কি সে সব সময় সুখী থাকার ভান করে গেছে?

তো সে কারণে এসথার এখানেও এসেছে। ও কি এই তরুণদের কারো হাতে সেই রক্তমাখা শার্টের টুকরো দিয়ে গেছে?

আপনার স্ত্রীও কষ্ট পেয়েছে। লুসেরেসিয়া হেসে উঠল। কিন্তু আমরা যতটুকু জানি, সে এখন আর কোনো কষ্ট পাচ্ছে না। এটাকে আমি সাহসিকতা বলি! ‘আমার স্ত্রী এখানে এসে কী করত?

‘সে ওই মঙ্গোলিয়ান ছেলেটার সাথে এখানে এসেছিল। মঙ্গোলিয়ান ছেলেটার ভালোবাসার ব্যাপারে অদ্ভুত ধারণা ছিল। ছেলেটার ভালোবাসার কথা আমরা কেবল বুঝতে শুরু করেছিলাম। সে প্রশ্ন করে করে আমাদের তার গল্প বলত। একদিন, সে দুটোই করা বন্ধ করে দিল। সে বলল অভিযোগ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমরা সাজেশন দিলাম সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে এখানে আমাদের সাথে চলে আসতে। কারণ আমরা উত্তর আমেরিকা ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছি। সে আমাদের ধন্যবাদ জানাল কিন্তু বলল তার অন্য পরিকল্পনা আছে এবং পুরোপুরি আমাদের বিপরীত দিকেই যাত্রা করবে।

 ‘তুমি কি উনার শেষ বইটা পড়োনি?’ আনাস্টাসিয়া জিজ্ঞেস করল।

 ‘না, আমি আগ্রহ দেখাইনি। লোকজন বলছিল বইটা অনেক রোমান্টিক। এখন আমরা আরো বেশি বুঝতে পারব?

.

লোকজন আমাদের জন্য এভাবে পথ করে দিচ্ছিল যেন আমরা সামুরাই, গ্রামে যাচ্ছি, দস্যুরা সামনের শহরে পৌঁছে গেছে, বর্বররা রোমে প্রবেশ করেছে। এই গোত্র কোনো আক্রমণাত্মক আচরণ করছে না, আক্রমণ ভাব তাদের পোশাকআশাকে, শরীর ছিদ্র করায়, উচ্চ স্বরে কথাবার্তা বলায়। শেষ পর্যন্ত আমরা একটা মিনিমাৰ্ট পেয়ে গেলাম। আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে ওরা সবাই দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তাকের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করল।

 মিখাইলকে ছাড়া ওদের কাউকে আমি চিনি না। এমনকি এও জানি না ও আমাকে যা বলেছে তা সত্যি কিনা। ওরা যদি কিছু চুরি করে তাহলে কী হবে? যদি ওদের কারো কাছে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র থাকে? দলের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য হিসেবে, ওদের এই কর্মকাণ্ডের জন্য কি আমি দায়ী থাকব না?

 ক্যাশ রেজিস্টারে বসা মানুষটি সিকিউরিটি আয়নায় ওদের দেখতে লাগল। দলের লোকজন জানে আমি চিন্তিত হয়ে পড়েছি, ওরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, একে অন্যের মধ্যে ভাব বিনিময় করল। টেনশন বাড়তে লাগল। ব্যাপারটা সংক্ষেপ করার জন্য, আমি তিন বোতল ভদকা তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি ক্যাশ রেজিস্টারের কাছে চলে এলাম।

সিগারেট কিনতে আসা একজন মহিলা বলল, আগের দিনগুলোতে, প্যারিস বোহেমিয়ান এবং শিল্পীদের দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল, উদ্বাস্তু মানুষের দল ছিল না। সে ক্যাশিয়ারকে পুলিশ ডাকার উপদেশ দিল।

“আমার মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে এখানে খুব খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। মহিলাটি বিড়বিড় করে বলল।

 ক্যাশিয়ারের ছোট্ট জগতে ভয়ের ছোঁয়া লেগেছে। এত বছরের পরিশ্রমের ফল আর অনেক ধার-দেনায় গড়ে তোলা দোকান, এখানে সম্ভবত ছেলে সকালে কাজ করে, স্ত্রী বিকালে আর সে রাতে। ক্যাশিয়ার মহিলাটির দিকে তাকিয়ে মাথা নোয়াল আর আমি বুঝতে পারলাম এরই মধ্যে পুলিশকে কল করা হয়ে গেছে।

 যে কাজে আমি সম্পৃক্ত নই, তাতে জড়িয়ে পড়াটা আমি ঘৃণা করি। কিন্তু সেই সাথে কাপুরুষতাকেও ঘৃণা করি। যতবারই এমন কিছু ঘটে, আমি সপ্তাহখানেকের জন্য নিজের প্রতি নিজের শ্রদ্ধা হারাই।

 “চিন্তা করবেন না…’ আমি বলতে শুরু করলাম।

কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

 দুজন পুলিশ ভেতরে ঢুকল। মালিক মাথা নুইয়ে ইশারা করল। কিন্তু তরুণরা পুলিশের দিকে কোনো রকম ভ্রূক্ষেপ করল না। ওদের ভাব দেখে মনে হলো এসব ব্যাপারে ওদের মাথাব্যথা নেই। এর আগে ওদের সাথে অনেকবার এমনটি হয়ে থাকতে পারে। ওরা জানে ওরা কোনো অপরাধ করেনি (যদি ফ্যাশনের ব্যাপারে অপরাধের কথা ধরা হয় কিন্তু তা পরের সিজনে আবার বদলে যেতে পারে)। ওদের অবশ্যই ভীত হওয়া উচিত; কিন্তু ওদের মধ্যে বিন্দুমাত্র ভয়ের ছাপ নেই। ওরা জোরে জোর কথা চালিয়ে যেতে লাগল।

 ‘আমি একদিন একজন কমেডিয়ানকে দেখেছিলাম। সে বলেছিল গাধা লোকজনদের তাদের আইডেন্টিটি কার্ডে গাধা লিখে রাখা উচিত।’ আনাস্টেসিয়া কাউকে সম্বোধন না করেই বলল। তাহলে আমরা বুঝতে পারতাম কাদের সাথে কথা বলছি।

হ্যাঁ, স্টুপিড লোকজন সমাজের জন্য সত্যিই বিপজ্জনক। পরীর মতো দেখতে মেয়েটি বলল। মেয়েটার পরনের পোশাক ভ্যাম্পায়ার টাইপের, একটু আগে আমার সাথে বিড়াল আর ল্যাম্পপোস্টের সংখ্যার কথা বলছিল। তাদের বছরে একবার পরীক্ষা নেয়া উচিত, তারপর রাস্তায় হাঁটার লাইসেন্স দিতে হবে যেমনটি ড্রাইভারদের গাড়ি চালানোর জন্য দেয়া হয়।

পুলিশটি দেখে মনে হয় ওদের চেয়ে বয়সে খুব একটা বেশি হবে না, কিছুই বলল না।

 ‘তুমি কি জানো আমি কী করতে পছন্দ করি?’ মিখাইলের গলা, কিন্তু আমি ওকে দেখতে পাচ্ছি না, কারণ ও একটা তাকের পেছনে রয়েছে, এই দোকানের সব কিছুর লেবেল বদলে দিতে পছন্দ করি। লোকজন পুরোপুরি বিভ্রান্ত হবে। তারা বুঝতে পারবে না জিনিসগুলো ঠাণ্ডা নাকি গরম খেতে হবে, সিদ্ধ করে নাকি ভাজি করে খেতে হবে। যদি তারা ইন্সট্রাকশন পড়তে না পারে, তারা জানবে না কীভাবে খাবার তৈরি করতে হবে। তারা সবাই রান্নাবান্না ভুলে যাবে।’

ওখানে যারা কথা বলছিল সবাই এতক্ষণ খাঁটি পারিসিয়ান ফরাসিতে কথা বলছিল। শুধু মিখাইল বিদেশি উচ্চারণে কথা বলল।

‘আমি কি আপনার পাসপোর্ট দেখতে পারি।’ একজন পুলিশ বলল।

 ‘ও আমার সাথে।

কথাটা আমি স্বাভাবিকভাবেই বললাম, যদিও আমি জানি এর অর্থ কী হতে পারেআরেকটা স্ক্যান্ডাল।

 পুলিশটি আমার দিকে তাকাল।

 ‘আমি আপনার সাথে কথা বলছি না, কিন্তু আপনি যখন আগ বাড়িয়ে বলতে চাইছেন, আমি আশা করছি আপনার সাথে এ রকম কোনো ডকুমেন্ট আছে, যা দিয়ে আপনি কে তা প্রমাণ করতে পারবে। আর আপনার অর্ধবয়সী ছেলেমেয়ে

পরিবেষ্টিত হয়ে ভদকা কিনে দেয়ার কারণ দর্শাতে পারবেন।’ আমি কাগজপত্র দেখাতে অস্বীকার করলাম। আমি আইনগতভাবে তাদের দেখাতে বাধ্য নই। কিন্তু আমি মিখাইলের কথা ভাবছিলাম। একজন পুলিশ এখন মিখাইলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সে থাকার মতো সত্যিই কি ওর কোনো পারমিশন আছে? ওর দিব্যদৃষ্টি আর এপেলেপসির গল্প ছাড়া ওর সমন্ধে আর কী আমি জানি? যদি এখনকার এই টেনশনে ওর এপেলেপসির আক্রমণ শুরু হয়ে যায়?

 আমি পকেটে হাত দিয়ে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করে আনলাম।

 ‘তো আপনি…’

 ‘আমি।’

‘আমিও বুঝতে পারছি আপনিই। আমি আপনার একটা বই পড়েছি। কিন্তু তার মানে আপনি আইনের উর্ধ্বে উঠে গেছেন তা নয়।’

ঘটনা হলো পুলিশ আমার একটা বই পড়ার পরও আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করল।

আমি ভদ্রভাবে বললাম :

না, আমি আইনের উর্ধ্বে নই। প্রকৃতপক্ষে, এখানকার কেউ কোনো আইন ভাঙেনি। ক্যাশ রেজিস্টারে থাকা ভদ্রলোক অথবা সিগারেট কিনতে আসা ভদ্রমহিলা কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগ না করা পর্যন্ত কেউ অপরাধী নয়।’

আমি ঘুরে দাঁড়ালে, যে ভদ্রমহিলা আর্টিস্ট আর বোহেমিয়ানদের কথা উল্লেখ করছিল সে ততক্ষণে চলে গেছে। সন্দেহ নেই ভদ্রমহিলা পরের দিন তার প্রতিবেশীদের বলবে, তাকে ধন্যবাদ, কারণ ডাকাতির হাত থেকে বাঁচিয়েছে।

‘আমার কোনো অভিযোগ নেই।’ রেজিস্টারের পেছনে বসা লোকটা বলল, ‘আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম কারণ তারা খুব উচ্চ স্বরে কথা বলছিল; কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে তারা প্রকৃতপক্ষে কোনো ক্ষতি করেনি।

‘এই ভদকা কি আপনার জন্য স্যার?

আমি মাথা নোয়ালাম। তারা জানে এখানে সবাই মাতাল কিন্তু তারা বড় ধরনের কোনো পরিস্থিতিতে যেতে চায় না।

স্টুপিড লোকজন ছাড়া একটা জগৎ পুরোপুরি ক্যাওস হবে!’ লেদার জ্যাকেট আর মেটাল পিন পরা ছেলেটা বলল, “আমরা এখানে যেসব বেকার লোকজন আছি তাদের বদলে, সেখানে বেশি কাজ থাকবে এবং কেউ কাজ করার থাকবে না!

 ‘চুপ করো!

 আমার কণ্ঠস্বর কর্তৃত্বপরায়ণ।

 ‘তোমরা সবাই কথা বলা বন্ধ করো!

আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে সবাই চুপ করে গেল। আমার হৃৎপিণ্ড জোরে জোরে শব্দ করছিল; কিন্তু আমি পুলিশের সাথে এমনভাবে কথা বলতে লাগলাম, যেন এই জগতের আমিই সবচেয়ে ঠাণ্ডা মানুষ।

 ‘ওরা যদি সত্যিই বিপজ্জনক হতো, তাহলে এভাবে কথা বলত না।

পুলিশ ক্যাশিয়ারের দিকে ঘুরে গেলঃ

 ‘আপনার যদি আমাদের দরকায় হয়, আমরা আশপাশেই থাকব।

 বাইরের বেরিয়ে যাওয়ার আগে পুলিশ তার কলিগকে জোরে জোরেই বলল, ‘আমি স্টুপিড লোকজন ভালোবাসি। যদি ওরা না হতো তাহলে হয়তো আমাদের কিছু সত্যিকারের ক্রিমিনালের মোকাবিলা করতে হতো।

 ‘তুমি ঠিক বলেছ।’ অন্য পুলিশ বলল, স্টুপিড লোকজনের নিজস্ব নিরাপদে রাখার সুন্দর ক্ষমতা রয়েছে।’

 তারা তাদের স্বভাবসুলভ স্যালুট দিয়ে বেরিয়ে গেল।

দোকান থেকে বেরিয়ে আমি যে জিনিসটা করলাম, ভদকার বোতল ভেঙে শুড়িয়ে দিলাম। তার মধ্যে একটা বেঁচে গিয়েছিল। ওটা খুব তাড়াতাড়ি মুখ থেকে মুখে ফিরতে লাগল। যখন ওরা পান করছিল, আমি দেখতে পেলাম ওরা ভয় পেয়েছে, যেমন ভয় আমি পেয়েছিলাম। শুধু পার্থক্যটা হলো ওরা হুমকির সম্মুখীন হলে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।

 ‘আমার ভালো লাগছে না। মিখাইল একজনকে বলল, “চলো যাই।

আমি জানি না মিখাইল ‘চলো যাই বলে কী বোঝাতে চেয়েছে। সবাই সবার জায়গায় চলে যাবে বা শহরে অথবা ব্রিজে? কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করল না আমি ওদের সাথে যেতে চাই কিনা। তো আমি ওদের অনুসরণ করলাম। মিখাইলের মন্তব্য ‘আমার ভালো লাগছে না আমাকে সিদ্ধান্তহীনতায় রাখল। তার মানে আজ রাতে আর মধ্য এশিয়ায় যাত্রার ব্যাপারে কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। আমি কি এখন চলে যাব? অথবা আমি ওদের সাথে আঠার মতো লেগে থেকে চলো যাইয়ের মানে কী দেখব? আমি আবিষ্কার করলাম, ওদের সঙ্গ বেশ উপভোগ করছি এবং ভ্যাম্পায়ারের পোশাক পরা মেয়েটিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছি।

সম্মুখীন হওয়া ছাড়া আমি সব সময় বিপদের চিহ্ন দেখলেই পালিয়ে চলে যেতাম।

.

আমরা চলতে থাকলাম- কোথায়, আমি জানি না আমি গোটা অভিজ্ঞতার ব্যাপারে ভাবছিলাম। একটা গোত্র। একটা সিম্বলিক প্রত্যাবর্তন যখন মানুষ নিজের গোত্রকে রক্ষা করে খুব কমই টিকে ছিল। একটা গোত্র, যা আরেকটা শত্রুপূর্ণ গোত্রের মাঝে টিকে আছে, যাকে আমরা সোসাইটি বলি। একদল মানুষ যারা একত্র হয়েছে একটা আদর্শ সমাজ গড়ার জন্য, যাদের সমন্ধে আমি কিছুই জানি না, শরীর ছিদ্র করা আর অদ্ভুত পোশাক পরা ছাড়া। ওদের আদর্শগত মূল্য কী? ওরা জীবন সমন্ধে কী ভাবে? ওরা কীভাবে অর্থ উপার্জন করে? ওদের কি কোনো স্বপ্ন আছে অথবা শুধু জগতের বিস্ময় দেখাই যথেষ্ট? পরবর্তী সন্ধ্যেয় আমি যে সাপারে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছি তার চেয়ে এরা অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং, আমি জানি ওখানে ঠিক কী হয়। আমি বুঝতে পারলাম ভদকার প্রভাবেই আমার এমনটি হচ্ছে। কিন্তু নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে, আমার ব্যক্তিগত ইতিহাস অনেক দূরে সরে যাচ্ছে, শুধু বর্তমান মুহূর্তের উপস্থিতি, জাহির অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

দ্য জাহির?

 হ্যাঁ, জাহির অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি জাহির একজন মানুষের বস্তুর প্রতি অবসেসড হওয়ার চেয়ে বেশি কিছু।….

খুব শক্তিশালী জাহির মনে হয় প্রতিটি মানবশিশু জন্মানোর সাথে সাথে জন্ম নেয় এবং শৈশবেই পূর্ণ শক্তিপ্রাপ্ত হয়, এ রকম কিছু নিয়মকানুন আরোপ করে, যাকে সব সময় সম্মান জানাতে হয়ঃ

ভিন্ন ধরনের লোকজন বিপজ্জনক; তারা অন্য জাতির অন্তর্ভুক্ত। ওরা আমাদের জমি চায়, চায় আমাদের মেয়েদের।

আমাদের অবশ্যই বিয়ে করতে হবে, বাচ্চা পয়দা করতে হবে, প্রজাতির জন্ম দিতে হবে।

 ভালোবাসা খুবই ছোট ব্যাপার, একজন মানুষের জন্য যথেষ্ট এবং আমরা বিয়ে করলে, আরেকজন মানুষের শরীর এবং আত্মার অধিকারী হয়ে উঠি।

যে কাজ পছন্দ করি না তাই করি, কারণ আমরা সংগঠিত সমাজের অংশ। প্রত্যেকেই যা করতে চায় তাই করলে, জগৎটা দণ্ডায়মান হয়ে যাবে।

আমাদের অবশ্যই জুয়েলারি কিনতে হবে আমাদের জাতটাকে চিনিয়ে দেবে, যে রকমটি শরীর ছিদ্র করাটা ভিন্ন গোত্র বুঝিয়ে দেয়।

আমাদের সব সময় আনন্দিত থাকতে হবে এবং যারা নিজেদের সত্যিকারের অনুভূতি প্রকাশ করবে তাদের অবজ্ঞা করতে হবে; নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করা একটা গোত্রের জন্য বিপজ্জনক।

আমাদের যেকোনো মূল্যে না বলা এড়িয়ে যেতে হবে, কারণ যারা সব সময় হ্যাঁ বলে, লোকজন তাদের পছন্দ করে। আর এটাই আমাদের শত্রুপূর্ণ রাজ্যে টিকে থাকতে সাহায্য করে।

আমরা নিজেরা কী অনুভব করি তার চেয়ে অন্যরা কী ভাবল তাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

কখনো গোলমাল করো না, তাহলে এটা হয়তো শত্রু গোত্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।

তুমি যদি অন্য রকম আচরণ করো তাহলে তুমি সমাজ থেকে বহিস্কৃত হবে, কারণ তুমি অন্যদের সংক্রমিত করতে পারো এবং এ রকম কিছু ধ্বংস করে দিতে পারো, যা প্রথম পদক্ষেপেই সংগঠিত করা কঠিন।

আমাদের সব সময় নতুন বাসস্থানের ব্যাপারটা বিবেচনা করতে হবে। আমাদের নিজেদের সমন্ধে যদি সঠিক ধারণা না থাকে তাহলে অবশ্যই একজন ডেকোরেটরকে ডাকতে হবে, যাতে সে অন্যদের আমাদের ভালো রুচি দেখাতে পারে।

আমাদের অবশ্যই দৈনিক তিনবার আহার করতে হবে। এমনকি যদি আমরা ক্ষুধার্ত নাও থাকি এবং যখন সৌন্দর্যের ব্যাপার এসে পড়ে তখন অবশ্যই উপোস থাকতে হবে, তাই যদি আমরা ক্ষুধার্তও থাকি।

 প্রচলিত ফ্যাশন অনুযায়ী আমাদের পোশাক পরতে হবে। ভালোবাসতে ইচ্ছা হোক আর না থোক যৌন সংসর্গ করতে হবে, দেশের নামে হত্যা করতে হবে, তাড়াতাড়ি সময় চলে যাওয়ার আশা করতে হবে, যাতে রিটায়ারমেন্ট তাড়াতাড়ি চলে আসে, রাজনীতিবিদদের নির্বাচিত করতে হবে, জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে অভিযোগ, চুলের স্টাইল পরিবর্তন, অন্য রকম কাউকে সমালোচনা, শনিবার, রবিবার অথবা শুক্রবারে, কে কোন ধর্মে তার ওপর নির্ভর করে, ধর্মীয় সার্ভিসে যেতে হবে, পাপের জন্য করুণা ভিক্ষা চাইতে হবে। নিজেদের নিয়ে গর্ব বোধ করতে হবে, কারণ আমরা সত্যিটা জানি এবং অন্যান্য গোত্রের উপহাস করতে হবে- যারা ভুয়া প্রভুতে বিশ্বাস করে।

আমাদের শিশুরা অবশ্যই আমাদের পদানুসরণ করবে। সর্বোপরি আমরা বয়স্ক হয়ে গেছি এবং জগৎ সমন্ধে জানি।

আমাদের অবশ্যই একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি থাকতে হবে, এমনকি যদিও আমাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো চাকরি পাইনি, এর পরও জোর করে পড়াশোনা করি।

 আমরা এমন বিষয়ে পড়াশোনা করি, যা কখনো ব্যবহার করি না কিন্তু কেউ আমাদের যা বলেছে তা জানা জরুরি; এলজেব্রা, ত্রিকোণমিতি, কোড অব হাম্মুরাবি।

আমাদের কখনো পিতা-মাতাকে দুঃখ দেয়া উচিত নয়। এমনকি যা কিছু আমাদের সুখী করে তা যদি ছেড়েও দিতে হয়।

আমাদের চুপি চুপি সংগীত চর্চা করতে হবে, গোপনে কাঁদতে হবে। কারণ আমিই সব শক্তিশালী জাহির, যে নিয়মকানুনের আড়ালে থাকে এবং রেলওয়ে ট্রাকের মধ্যে ব্যবধান বজায় রাখে, সাফল্যের অর্থ, ভালোবাসার সর্বোত্তম উপায়, পুরস্কারের গুরুত্ব বোঝে।

.

আমরা অভিজাত এলাকার একটা ভবনের পাশে গিয়ে থামলাম। দলের একজন গিয়ে সামনের দরজায় একটা সাংকেতিক শব্দে আঘাত করতে লাগল। সবাই আমরা তৃতীয় তলায় গেলাম। ভেবেছিলাম এ রকম কোনো পরিবারের দেখা পাব, যাদের সন্তানরা গৃহত্যাগ করেছে এবং কোনো বন্ধুকে দায়িত্ব দিয়েছে ওর কাছাকাছি থেকে ওর ওপর নজর রাখতে। কিন্তু যখন লুসেরেসিয়া দরজা খুলল, সব কিছুই অন্ধকারময়। রাস্তা থেকে চুঁইয়ে আসা আলোয় ভেতরের অন্ধকার চোখ সয়ে গেলে দেখতে পেলাম বিশাল ফাঁকা একটা লিভিং রুম। শুধু একটা ফায়ারপ্লেস চোখে পড়ে, যা হয়তো বছর ধরে কখনো ব্যবহার করা হয়নি।

সাদা চুলের এক তরুণ, প্রায় ছয় ফুট লম্বা, রেইনকোট আর মোহক পরা কিচেনের দিকে গেল। কয়েকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ফিরে এল। আমরা সবাই মেঝেতে গোল হয়ে বসলাম। সেই রাতে প্রথমবার আমি ভয় পেলাম। হরর মুভির শয়তানের উপাসনা শুরুর দৃশ্যের মতো যেখানে ভিকটিম সব সময় একজন আগন্তুক।

 মিখাইলকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। তার চোখের দৃষ্টি কেমন যেন এলোমেলো, কোনো কিছুর ওপর স্থির নিবদ্ধ নয়। তাতে আমার অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল। যেকোনো মুহূর্তে ওর ইপিলেপটিক মূৰ্ছা হতে পারে। এখানকার লোকজন কি ওই পরিস্থিতির সাথে পরিচিত? এর চেয়ে এখন এখান থেকে চলে গিয়ে অন্য কোথায় জড়িয়ে পড়া ভালো ছিল না?

আমি লক্ষ করলাম মিখাইল তার এপিলেপটিক আক্রমণটা কোনোমতে সামাল দিল। সে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে পড়ছে। আর্মেনিয়ান রেস্তোরাঁয় মঞ্চের উপস্থিতির মতো তার চোখের দৃষ্টি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে।

‘আমরা এখন আমাদের স্বাভাবিক প্রার্থনা শুরু করব।’ মিখাইল বলল।

সেই সব তরুণ, এতক্ষণ যারা আক্রমণাত্মক, মাতাল ছিল তারা সবাই চোখ বন্ধ করে হস্ত প্রসারিত করল। এমনকি দুই এলসেশিয়ান কুকুরও শান্ত হয়ে রুমের এক কোণে বসে রইল।

‘হে দেবী, যখন আমি গাড়ির দিকে তাকাই, জানালা দিয়ে দোকান দেখি, লোকজনের দিকে দেখি, যখন আমি ভবনের আর মনুমেন্টের দিকে তাকাই, আমি সেখানে তোমার অনুপস্থিতি দেখি। তোমাকে ফিরে আনার সামর্থ্য আমাদের দাও।’

গোটা দল একসাথে বলতে লাগল, ‘হে দেবী, আমরা অভিজ্ঞতায় দেখেছি কঠিন সময়ে তোমার উপস্থিতি বুঝতে পারি। আমাদের সাহায্য করো, ছেড়ে যেও না। শান্তভাবে দৃঢ় মনোযোগের সাথে তোমাকে চিন্তা করার সাহায্য করো, এমনকি যদিও ব্যাপারটা গ্রহণ করা কঠিন যে আমরা তোমাকে ভালোবাসি।

আমি লক্ষ করলাম, এখানকার সবার জামাকাপড়ের কোথাও না কোথাও একই ধরনের প্রতীক রয়েছে। কারো একেবারে বুকের কাছে, কারো মেটাল ব্যাজে, কারোর এমব্রয়ডারি করে দেয়া, এমনকি কারো কারো ফেব্রিকের কাপড়ের ওপর কলম দিয়ে আঁকা।

***

‘আজ রাতটা এই মানুষটাকে উৎসর্গ করতে চাই, যে আমার পাশে বসে আছে। তিনি আমার পাশে বসে আছেন, কারণ তিনি আমাকে রক্ষা করতে চান।

ও কীভাবে তা জানল?

 “তিনি একজন ভালো মানুষ। তিনি জানেন ভালোবাসা রূপান্তরিত হয় এবং তিনি ভালোবাসার দ্বারা নিজেকে রূপান্তরিত করতে চান। তিনি তার আত্মায় অনেক বেশি ব্যক্তিগত ইতিহাস বহন করে চলেছেন। কিন্তু তা থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যে কারণে তিনি আজ রাতে আমাদের সাথে। তিনি সেই মহিলার স্বামী, যাকে আমরা সবাই চিনি, সেই মহিলা যে আমার কাছে প্রমাণ হিসেবে স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেছে তার বন্ধুর নিদর্শন এবং বার্তাবাহক হিসেবে।

মিখাইল রক্তমাখা কাপড়টা বের করে তার সামনে রাখল।

‘এইটা অজানা সৈনিকের জামার অংশ। সৈনিক মারা যাওয়ার আগে, মহিলাটিকে বলে গিয়েছিল, আমার কাপড়চোপড় কেটে সেই টুকরোগুলোকে তাদের মধ্যে ভাগ করে দাও, যারা মৃত্যুতে বিশ্বাস করে এবং যারা এ রকমভাবে জীবন যাপন করে, যেন আজই জীবনের শেষ দিন। লোকজনকে বলে দাও যে, আমি এইমাত্র ঈশ্বরের মুখ দর্শন করেছি, মানুষকে ভীত হতে নিষেধ করো; কিন্তু আত্মপ্রসাদ লাভ করো না। একমাত্র সত্যের খোঁজে থাকো, যার নাম ভালোবাসা। এর আইন অনুসারেই জীবনযাপন করো।

ওরা সবাই কাপড়ের টুকরোটির দিকে তাকিয়ে রইল।

আমরা বিদ্রোহের সময় জন্মগ্রহণ করেছি। আমাদের সমস্ত প্রাণশক্তি এতেই ঢেলে দিয়েছি। আমাদের জীবনের প্রতি ঝুঁকি নিয়েছি। আমাদের তারুণ্য সব কিছুর প্রতি। হঠাৎ করে ভীত হয়ে পড়েছি আমরা। আমাদের প্রাথমিক আনন্দ প্রকৃত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। দুশ্চিন্তা, একঘেয়েমি, নিজের সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ। লক্ষ করেছি, আমাদের কোনো কোনো বন্ধু এরই মধ্যে হাল ছেড়ে দিয়েছে। আমরা এই একাকীত্বের মধ্যে অন্তর্হিত, কেউ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। আমরা এই প্রশ্নেই জীবন শেষ করেছি- এসবের অর্থ কী।

 মিখাইল বিরতি দিল।

 ‘এটাই। আমরা বয়ে চলেছি। জানি যে আমাদের আত্মা, যদিও তা স্বর্গীয়, সময়ের জালে ধরা পড়েছে, এর সমস্ত সৌভাগ্য এবং সীমাবদ্ধতা। আমরা যত দূর সম্ভব, এই জাল থেকে নিজেদের মুক্ত করি। যখন ব্যাপারটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আমরা যে গল্প বলেছিলাম তার কাছে ফিরে আসি। আমাদের লড়াইটাকে কখনো স্মরণ করি না। পরিস্থিতি ঠিক হওয়ার জন্য আমরা লড়াইটাকে বন্ধ করে দিই। আমিন।

 ‘আমিন। সবাই প্রতিধ্বনিত করল।

 ‘আমার দেবীর সাথে কথা বলা দরকার।’ মোহাক পরা সাদা চুলের তরুণ বলল।

‘আজ রাতে নয়। আমি ক্লান্ত।

 সবাই হতাশায় বিড়বিড় করে উঠল। আর্মেনিয়ান রেস্টুরেন্টের লোকজনের মতো এরাও মিখাইলের গল্প জানত এবং ওর পাশের সেই উপস্থিতি সমন্ধে অবগত ছিল। মিখাইল উঠে দাঁড়াল। এক গ্লাস পানি আনার জন্য রান্নাঘরে গেল। আমিও ওর সাথে গেলাম।

ওরা এই অ্যাপার্টমেন্টে কীভাবে এসেছে জিজ্ঞেস করলাম। ও ব্যাখ্যা করল ফ্রান্সের আইন অনুসারে কোনো ভবন মালিকের দ্বারা ব্যবহৃত না হলে যে কেউ তা আইনগতভাবে দখল করে নিতে পারে। সংক্ষেপে ব্যাপারটা তাই।

মেরি আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে, আমি আবার সমস্যায় পড়ব। মিখাইল আমার হাত ধরল।

‘আজ বলেছেন আপনি স্টেপসে যাচ্ছেন। আমি আরো একবার বলব : দয়া করে আমাকে আপনার সাথে নিয়ে যান। আমার দেশে ফিরে যাওয়া দরকার, যদিও তা খুব অল্প সময়ের জন্যও হয়ে থাকে কিন্তু আমার কোনো অর্থকড়ি নেই। আমার দেশের লোকজনকে মিস করছি। আমার মা, বন্ধুবান্ধব সবাইকে মিস করি। বলতে পারি, কণ্ঠস্বর আমাকে বলেছে আপনার আমাকে দরকার পড়বে। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি নয়, আপনি খুব সহজেই এসথারকে খুঁজে পাবেন। আমার কোনো সাহায্যের দরকার পড়বে না। কিন্তু দেশে ফেরার জন্য আমার কিছু করার দরকার।

 ‘আমি আপনাকে রিটার্ন টিকিটের টাকা দিতে পারি।’

 “জানি আপনি তা পারেন। কিন্তু আপনার সাথে ওখানে থাকতে পারলে আমার ভালো লাগবে। এসথার যেখানে বাস করে ওখানে আপনার সাথে যেতে চাই। ওখানকার বাতাস অনুভব করতে চাই, যাকে আপনি ভালোবাসেন তার রাস্তায় পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে চাই। এসথার এখনো আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমি ওর কাছ থেকে শিখতে চাই। আপনার কি মনে পড়ে একবার আপনি বাধাগ্রস্ত গল্প’ সমন্ধে বলেছিলেন। ওর বাড়িতে না পৌঁছানো পর্যন্ত আপনার সাথে থাকতে চাই। ওভাবেই আমি আপনার এবং আমার জীবনের শেষ অধ্যায়ে পৌঁছে যাব। ওর বাড়িতে পৌঁছে গেলে আপনাকে একা ছেড়ে চলে যাব।”

 জানি না কী বলব। অন্য কিছু নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম। লিভিং রুমের লোকজনের কথা জিজ্ঞেস করলাম।

‘ওই লোজনেরা আপনার প্রজন্মের মতো শেষ করতে ভয় পায়, ওই প্রজন্ম জগজুড়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বাস্তবতায় এসে সব শেষ হয়। আমরা শক্তিশালী হওয়ার ভান করি, কারণ আমরা দুর্বল। ওখানে শুধু আমাদের কয়েকজন, কিন্তু আমি মনে করি লোকজন নিজেদের আজীবন প্রতারণা করতে পারে না। এখন আমার প্রশ্নের উত্তর কী?’

মিখাইল, আপনি জানেন আমার ব্যক্তিগত ইতিহাস নিয়ে কতটা মুক্ত থাকতে চাই। আপনি যদি আরো কিছুক্ষণ আগে জিজ্ঞেস করতেন, তাহলে অনেক সহজে বলতে পারতাম, আপনার সাথে ভ্রমণটা আনন্দদায়ক, যেহেতু দেশটাকে আপনি ভালোভাবে চেনেন, ওখানকার রীতিনীতি, সম্ভাব্য বিপদ জানেন। এখন, মনে হয় ব্যাপারটা আমার নিজেরই করা উচিত। আমার জীবন বদলে গেছে, মনে হচ্ছে যেন আমার দশ, এমনকি বিশ বছর বয়স কমে গেছে, নিজেই এ রকম অ্যাডভেঞ্চারে যেতে চাই।’

‘আপনি কখন যাবেন?

‘যত তাড়াতাড়ি ভিসা পেয়ে যাব। দুই-তিন দিনের ভেতরে।

 ‘দেবী আপনার সাথে থাকতে পারে। কণ্ঠস্বর বলেছে এটাই ঠিক সময়। আপনি মত বদলালে আমাকে জানাবেন।

মেঝেতে শুয়ে থাকা লোকজনের পাশ কাটিয়ে চলে এলাম। ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরে ফেরার সময় বুঝতে পারলাম জীবনকে আমি যে রকমটি ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দদায়ক। সব সময় তরুণ সময়ে ফিরে গিয়ে আনন্দ করা সম্ভব। এই মুহূর্তের প্রতি এতই মনোযোগী ছিলাম যে, আমার পাশ দিয়ে যাওয়া লোকজনের দিকে ভালোভাবে লক্ষ করিনি। কেউ আমাকে লক্ষ করেনি; কিন্তু ব্যাপারটা আমার পছন্দ হলো। রাজা চতুর্থ হেনরি যেমনটি বলেছিলেন, শহরটা যেন আবার সেই রূপে ফিরে এসেছে, যখন তিনি একজন ক্যাথেলিককে বিয়ে করার জন্য প্রটেস্ট্যান্টদের দ্বারা বিতাড়িত হয়েছিলেন, ‘প্যারিস খুব ভালো জগাখিচুড়ি জায়গা।

ব্যাপারটা তার চেয়ে বেশি। আমি আবার ধর্মীয় উন্মাদনা দেখতে পাই। রক্তস্নাত লড়াই, রাজা, রানি, জাদুঘর, দুর্গ, শাস্তি পাওয়া শিল্পী, মাতাল লেখক, দার্শনিক, যোদ্ধা, বিশ্বাসঘাতক সবার কথাই যেন মনে পড়ে গেল।

.

জীবনে এই প্রথমবার বাসায় ফিরে সাথে সাথে কম্পিউটারে গিয়ে কেউ ইমেইল পাঠিয়েছে কিনা তা দেখলাম না। কোনো গুরুত্বপূর্ণ চিঠি বা নিমন্ত্রণ এসেছে কিনা তা চেক করলাম না। কোনো কিছুই আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। মেরি ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা তা দেখতে বেডরুমে গেলাম না। কারণ জানি ও ঘুমের ভান করে থাকবে।

শেষ রাতের খবর দেখার জন্য টিভি চালু করিনি, কারণ ছোটবেলা থেকে যে খবর শুনে আসছি এখনো সেই খবরই শুনব, এক দেশ আরেক দেশকে হুমকি দিয়ে আসছে, একজন আরেকজনকে ধোকা দিচ্ছে, অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে, খুব বড় ধরনের প্যাশন তৈরি হয়েছে, ইসরাইল আর ফিলিস্তিনি সংকট সমাধানে ব্যর্থ, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পরে, ওরা একটা চুক্তিতে এসেছে, আরেকটা বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে, হ্যারিকেন ঝড়ে হাজার হাজার লোক গৃহহারা হয়েছে।

 আমার মনে পড়ে গেল আজ সকালের সবচেয়ে বড় খবর কী ছিল, কোনো রকম আক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি, হাইতিতে বিদ্রোহের ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেছে। হাইতির ব্যাপারে আমি কী করতে পারি? তাতে আমার অথবা আমার স্ত্রীর জীবনে কী পার্থক্য বয়ে আনতে পারে অথবা মিখাইলের গোত্রের? কীভাবে আমি আমার জীবনের মূল্যবান সময় থেকে পাঁচ পাঁচটা মিনিট কোনো বিদ্রোহ অথবা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে কাটাতে পারি? গোটা ব্যাপারটা হজম করতে হবে। আমাকে শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে!

জানালা খুলে দিলাম। বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস ভেতরে ঢুকে আমাকে শীতল করে দিল। কাপড়চোপড় খুলে ফেললাম। নিজেকে বললাম, এই ঠাণ্ডার ভেতরে দাঁড়াতে পারি। দাঁড়িয়ে থাকলাম। কোনো কিছুই ভাবছিলাম না। শুধু পা মেঝেতে আছে এটুকুই সচেতন ছিলাম। চোখের দৃষ্টি আইফেল টাওয়ারের ওপর নিবদ্ধ। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনতে পাচ্ছি। পুলিশের সাইরেন আর কথোপকথন যা বুঝতে পারছিলাম না।

আমি কিছুই না। ব্যাপারটা আমাকে অন্য রকম আনন্দ দিল।

*

‘তোমাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।’

 ‘অদ্ভুত বলতে কী বোঝাচ্ছ?”

 ‘তোমাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

 ‘আমি বিষণ্ণ নই। আমি খুশি।’

 ‘তুমি দেখছ? এমনকি তোমার গলার স্বরেও মিথ্যা ঝরে পড়ছে। তুমি আমার ব্যাপারে দুঃখী। কিন্তু কোনো কিছু বলার মতো সাহস তোমার নেই।

 ‘আমি দুঃখী হতে যাব কেন?’

কারণ আমি গত রাতে মাতাল অবস্থায় ঘরে ফিরেছিলাম। তুমি এমনকি জিজ্ঞেস পর্যন্ত করোনি আমি কোথায় গিয়েছিলাম।’

 ‘আমি আগ্রহী নই।’

তুমি কেন আগ্রহী নও? তোমাকে বলেছিলাম আমি মিখাইলের সাথে বাইরে গিয়েছিলাম, আমি কি তা বলিনি?

 ‘তাহলে কি তুমি ওর সাথে বাইরে যাওনি?

 ‘হা, গিয়েছিলাম।’

 ‘তো, তাহলে জিজ্ঞেস করার কী আছে?

 ‘তোমার কি মনে হয় না তোমার বয়ফ্রে, যাকে তুমি ভালোবাসো বলে দাবি করো, দেরিতে ঘরে ফেরে, অন্তত তোমার এটা বের করা উচিত কী ঘটেছে?

“ঠিক আছে, কী ঘটেছিল?

‘কিছুই না। আমি মিখাইল আর অন্য বন্ধুদের সাথে বাইরে গিয়েছিলাম।’

 ‘বেশ।’

 ‘তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করেছ?

 ‘অবশ্যই আমি বিশ্বাস করি।

 ‘আমি মনে করি না তুমি আর আমাকে মোটেই ভালোবাসো। তুমি ঈর্ষান্বিত নও। তুমি কোনো কিছুর পরোয়া করো না। আমি কি সাধারণভাবে রাত দুটোয় বাসায় ফিরি?

 ‘তুমি কি বলোনি তুমি একজন মুক্ত মানুষ।

 ‘আর আমি।’

‘এ ক্ষেত্রে, তুমি রাত দুটোয় ফিরে এসে তোমার যা খুশি তাই করতে পারো। আমি যদি তোমার মা হতাম, আমি চিন্তিত হতাম, কিন্তু তুমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, তাই নয় কি? তোমাদের পুরুষের এই আচরণটা বন্ধ করা উচিত যে, তোমাদের সব সময় বাচ্চাদের মতো দেখতে হবে।

‘আমি ওই জাতীয় চিন্তার কথা বলিনি। আমি ঈর্ষাপরায়ণতার কথা বলেছি।’

 ‘আমি যদি এই মুহূর্তে কোনো নাটক করি তাহলে কেমন হবে, নাশতার পরে?

না, ও রকমটি করো না, প্রতিবেশীরা শুনতে পাবে।’

 ‘প্রতিবেশীদের ব্যাপারে আমি পরোয়া করি না। আমি কোনো নাটকীয়তা করতে চাইছি না, কারণ আমার অমনটি মনে হচ্ছে না। আমার জন্য ব্যাপারটা বেশ কঠিন, কিন্তু জাগরেবের ব্যাপারে তুমি যা বলেছ তা শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করেছি। আমি সেই ধারণার ব্যাপারে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। এই ফাঁকে, ব্যাপারটা যদি আমাকে সুখী করে, আমি সব সময় ঈর্ষান্বিত, রাগান্বিত, উম্মত্ত বা যাই হোক না কেন তার ভান করতে পারি।’

 ‘আমি যেমনটি বলেছি, তোমাকে অদ্ভুত মনে হচ্ছে। ভাবতে শুরু করেছি। তোমার জীবনে আমার আর কোনো গুরুত্ব নেই।

ভাবতে শুরু করেছি সিটিং রুমে একজন সাংবাদিক তোমার জন্য অপেক্ষা করছে তা তুমি ভুলে গেছ, সে যেই হোক, সম্ভবত আমাদের কথোপকথন শুনে ফেলেছে।’

*

আহ, সেই সাংবাদিক। আমি অটোমেটিক পাইলটে গেলাম। কারণ জানতাম সাংবাদিক কোন জাতীয় প্রশ্ন করবে। আমি জানি কীভাবে সাক্ষাৎকার শুরু হবে। (আপনার নতুন উপন্যাস সমন্ধে কথা বলা যাক। মূল মেসেজটা কী?’) আর আমি কীভাবে উত্তর দেব তাও জানি (যদি শুধু একটা মেসেজ দিতে চাইতাম, আমি শুধু একটা বাক্যই লিখতাম, বই নয়।)

আমি জানি সমালোচকের ব্যাপারে আমার অনুভূতি কী জানতে চাইবে। বিশেষত যারা আমার বইয়ের কঠোর সমালোচনা করে। আমি জানি সে কী বলে কথা শেষ করবে, আপনি কি এরই মধ্যে একটা নতুন বই লিখতে শুরু করে দিয়েছেন? আপনি এখন কোনো বিষয়ের ওপর কাজ করছেন?’ আর তার উত্তরে আমি জানাব, ব্যাপারটা গোপনীয়।

আমি যেমনটি আশা করেছিলাম সাক্ষাৎকার সেভাবেই শুরু হলো :

 ‘আপনার নতুন বই সমন্ধে কথা বলা যাক। মূল মেসেজটা কী?

 ‘আমি যদি শুধু একটা মেসেজ দিতে চাইতাম, শুধু একটা বাক্যই লিখতাম, বই নয়।’

 ‘আপনি লেখেন কেন?

কারণ ওভাবেই আমি আমার অনুভূতি অন্যের সাথে শেয়ার করতে পারি।

বাক্যটা আমার অটোমেটিক পাইলট স্ক্রিপ্টের একটা অংশ। কিন্তু আমি থেমে গিয়ে নিজেকে সংশোধন করে নিলাম :

যদিও সেই নির্দিষ্ট গল্পটা অন্যভাবেও বলা যায়।

 ‘অন্যভাবে? তার মানে কি আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ নিয়ে আপনি খুশি নন?

না, অন্যভাবে বললে, আমি আমার এ বই নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট। কিন্তু আমার উত্তরে সন্তুষ্ট নই। আমি কেন লিখি? সত্যিকারের উত্তর হলো : আমি লিখি, কারণ লিখতে ভালোবাসি।

 সাংবাদিকের চোখে সন্দেহপ্রবণতা দেখা গেল : এটা কোন ধরনের কনফেশন? ‘আমি লিখি কারণ যখন কিশোর ছিলাম, ফুটবল খেলতে পারতাম না, আমার কোনো গাড়ি নেই অথবা খুব বেশি অ্যালাউন্স নেই আর আমি উইডের ব্যাপারে কিছুটা…’

আমি কথোকথনের ব্যাপারে খুব মনোযোগ দিলাম। মেরির সাথে কথোপকথন মনে করিয়ে দিল অতীতে আমি এ রকম কিছু বলেছি, যার কোনো অর্থ নেই। নিজের ব্যক্তিগত ইতিহাস নিয়ে কথা বলা দরকার। তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমি বলে চললাম :

‘আমি কখনো প্রচলিত পোশাক পরতাম না। আমার ক্লাসের মেয়েরা সে ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিল। তো সে কারণে ওরা আমাকে অবজ্ঞা করত। রাতে, আমার বন্ধুরা যখন গার্লফ্রেন্ডের সাথে বেরিয়ে যেত, অফুরন্ত সময়ে নিজের একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছিলাম, যা আমাকে সুখী করবে; লেখক এবং তাদের বইই আমার সাথী ছিল। একদিন, আমাদের এলাকার একটা মেয়েকে উদ্দেশ্য করে একটা কবিতা লিখলাম। এক বন্ধু আমার রুমে কবিতাটা পেয়ে চুরি করে নিয়ে গেল। আমরা একসাথে থাকাকালে সে গোটা ক্লাসে আমার কবিতাটা দেখাল। সবাই হাসতে লাগল। তারা ভেবেছিল ব্যাপারটা হাস্যকার আমি প্রেমে পড়েছি!

একমাত্র যে মেয়েটি হাসল না সে ওই মেয়েটি যাকে উদ্দেশ্য করে কবিতাটা লেখা। পরের দিন সন্ধ্যায়, আমরা থিয়েটারে গেলে, মেয়েটা কোনোভাবে আমার পাশের সিটটা জোগাড় করে ফেলল। ও আমার হাত ধরল। আমরা হাত ধরাধরি করে থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এলাম। একটা মেয়ের সাথে একাকী ঘোরার কারণে আমার ক্লাসের ছেলেরা মুগ্ধ হয়ে গেল।

আমি থামলাম। আমার মনে হতে লাগল আমি অতীতে চলে গেছি, ওর হাত ধরেছি, আমার জীবন বদলে গেছে।

‘আর তা শুধু একটা কবিতার কারণে,’ আমি বলে চললাম, একটা কবিতা দেখিয়ে দিল লেখার মাধ্যমে আমার ভেতরের অদৃশ্য জগৎটাকে উন্মোচিত করে, আমি দৃশ্যমান জগতের ক্লাসমেটদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারি। শারীরিক শক্তি, ফ্যাশনেবল পরিচ্ছদ, গাড়ি, খেলাধুলায় পারদর্শিতার মতোই। সাংবাদিক কিছুটা বিস্মিত। আমি তার চেয়ে বেশি বিস্মিত। সাংবাদিক নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করল :

সমালোচকরা আপনার কাজের প্রতি এত কঠোর কেন, এ ব্যাপারে আপনি কী ভাবেন?’

আমার অটোমেটিক পাইলট সাধারণত এভাবে উত্তর দেবে : ‘আপনি অতীতের যেকোনো ক্লাসিক লেখকের আত্মজীবনী পড়ে দেখতে পারেন তাদের সাথে নিজেকে তুলনা দিচ্ছি না, বুঝতে পেরেছেন- দেখতে তাদের সমালোচকরাও তখন কেমন কঠোর ছিল। কারণটা খুবই সিম্পল; সমালোচকরা অতিরিক্ত ইনসিকিউর, তারা সত্যিই জানে না কী ঘটছে, রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা গণতন্ত্রমনা কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট। তারা বিশ্বাস করে, লোকজন উপযুক্তভাবেই যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের বেছে নেবে। কিন্তু সিনেমা, বই, সংগীতের ক্ষেত্রে তাদের কোনো ধারণাই নেই।

আমি আবার আমার অটোমেটিক পাইলটকে উন্মুক্ত করলাম। পুরোপুরি জানি সাংবাদিক আমার উত্তর প্রকাশ করে দেবে।

 ‘আপনি কি কখনো জান্তের আইন শুনেছেন?

না, আমি শুনিনি। সাংবাদিক বললেন।

 ‘বেশ, সভ্যতার শুরু থেকেই এর অস্তিত্ব। কিন্তু অফিশিয়ালি ব্যাপারটা ১৯৩৩ একজন ড্যানিশ লেখকের দ্বারা প্রচলিত হয়। জান্তের ছোট্ট শহরে, টেন কমট্যান্ডের শক্তির মতো লোকজনদের বলা হয় তারা কীভাবে ব্যবহার করবে, দেখে মনে হয় শুধু জান্তেতে নয়, সর্বত্রই এর প্রচলন রয়েছে। আমি যদি ব্যাপারটা সংক্ষেপে একটামাত্র বাক্যে বলি, তাহলে বলতে পারি : মধ্যমপন্থী এবং অপরিচিতিই হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। আপনি যদি তাদের সাথে সমঝোতা করেন, জীবনে আপনি কখনো বড় ধরনের সমস্যায় পড়বেন না। কিন্তু আপনি যদি ভিন্ন হওয়ার চেষ্টা করেন…’

‘জান্তের কমনড্যান্টগুলো কী জানতে পারলে ভালো হতো। সাংবাদিক সত্যিকারের আগ্রহের সাথে বললেন।

 ‘ওগুলো আমার এখানে নেই, কিন্তু আপনি চাইলে সংক্ষেপে বলতে পারি।’

 আমার কম্পিউটার থেকে সংক্ষিপ্ত এবং সংকলিত অংশের প্রিন্ট বের করলাম।

 ‘আপনি কেউ নন। কখনো এটা ভাবার সাহস করবেন না, আমরা যা করি আপনি তার চেয়ে বেশি কিছু জানেন। আপনার কোনো গুরুত্ব নেই, আপনি ঠিক কিছু করতে পারেন না, আপনার কাজের কোনো গুরুত্ব নেই, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি আমাদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন, আপনি সুখী জীবন যাপন করতে পারবেন। সব সময় এটা মনে রাখবেন, আমরা যা বলি সিরিয়াসলি বলি এবং কখনো আমাদের মতামতের ওপর হাসবেন না।’

সাংবাদিক কাগজের টুকরোটা ভাজ করে পকেটে রেখে দিলেন।

‘আপনার কথাই ঠিক। যদি আপনি কেউ না হয়ে থাকেন, যদি আপনার কাজের কোনো গুরুত্ব না থাকে, তাহলে তা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। যদি কোনোভাবে, আপনি মধ্যম শ্রেণীর ওপরে উঠে সাফল্য পেয়ে যান, তাহলে আইনকে অবজ্ঞা করছেন, আপনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন।’

আমি খুব খুশি যে সাংবাদিক এত সহজে নিজের মতো করে উপসংহারে পৌঁছে গেছেন।

‘আর শুধু সমালোচকরাই এই কথা বলে না। আমি যোগ করলাম, “অনেক মানুষ, আপনি যা ভাবছেন তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ, একই কথা বলে।

*

সেদিন সন্ধ্যায়, আমি মিখাইলের সেলফোন নাম্বারে ফোন করলাম।

 ‘চলুন একসাথে কাজাখস্তানে যাওয়া যাক।

মনে হলো না ও খুব বিস্মিত হয়েছে। আমাকে একটা শুকনো ধন্যবাদ জানিয়ে জানতে চাইল কী কারণে আমি মনোভাব বদলেছি।

দুই বছর ধরে, আমার জীবন জাহির ছাড়া আর কিছুই পরিবৃত্ত নয়। আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে, আমি ভুলে যাওয়া দীর্ঘ পথ অনুসরণ করতে থাকি, সেই রেলওয়ে ট্রাকে যেখানে রেলের দুই পাটির মাঝখানে ঘাস গজিয়েছে কিন্তু এখনো তা ট্রেন দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে। আমি এখনো শেষ স্টেশনে পৌঁছাইনি। তো এই পথের মাঝখানে থেকে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।’

 মিখাইল বলল, আমি কোনোমতে একটা ভিসা জোগাড় করে দিতে পারি কিনা। আমি ব্যাখ্যা করলাম ফেভার ব্যাংক আবার আমার সাহায্যে কাজে আসতে পারে। একজন রাশিয়ান বন্ধু তার গার্লফ্রেন্ডকে ফোন করে দিল, মেয়েটি কাজাখস্তানের একটা বড় নিউজপেপার কম্পানির ডিরেক্টর। ডিরেক্টর প্যারিসের অ্যাম্বাসাডরে ফোন দিল। সেই সন্ধ্যায় ভিসা রেডি হয়ে যাবে।

‘আমরা কখন যাব?

‘আগামীকাল। টিকিট কেনার জন্য আপনার প্রকৃত নামটা জানা দরকার। অন্য লাইনে ট্রাভেল লাইনের এজেন্ট ফোন ধরে আছে।’

লাইন ছেড়ে দেয়ার আগে, আমি একটা কথা বলতে চাই; আমি সত্যিই আপনার বলা ওই রেলওয়ে ট্র্যাকের দূরত্বের ব্যাপারটা পছন্দ করি আর এইমাত্র আপনি রেলওয়ে লাইন সমন্ধে বললেন, কিন্তু আমি মনে করি না সে জন্য আপনি আপনার সাথে আমাকে যেতে বলছেন। আমি মনে করি আপনি একসময় যা লিখেছিলেন এবং আমি মনেপ্রাণে যা বিশ্বাস করি সেই কারণে। আপনার স্ত্রী সব সময় এ লাইনগুলো কোট করত। তারা যা বলেছে তা ফেভার ব্যাংকের বিজনেসের চেয়ে অনেক বেশি রোমান্টিক :

 আলোর যোদ্ধারা জানে সে কতটা কৃতজ্ঞ।

দেবদেবীর দ্বারা তিনি বিপদের সময় সাহায্যপ্রাপ্ত হন। দৈবপ্রাপ্ত শক্তি সব কিছুই জায়গামতো রাখে, তাকে সর্বোত্তমটা দেয়। সে কারণেই, সূর্যাস্তের সময় তিনি হাঁটু গেড়ে প্রার্থণায় বসেন।

তার সঙ্গীরা বলে, তিনি খুব ভাগ্যবান! কিন্তু তিনি জানেন ‘ভাগ্য’ তার এবং তার বন্ধুদের চারদিকে ঘুরছে কারণ দেবদেবীরা তাদের কথা শুনছে।

 ‘আমি যা লিখি তা সব সময় মনে রাখতে পারি না। কিন্তু আপনাকে ধন্যবাদ। এখন এই মুহূর্তে আপনার নামটা ট্রাভেল এজেন্সীকে দেয়া দরকার।

.

ফোনের উত্তর দেয়ার জন্য ট্যাক্সি কম্পানির কাছ থেকে বিশ মিনিট সময় চেয়ে নিলাম। আমার মনে হচ্ছে আমাকে হয়তো আরো আধাঘণ্টা সময় বেশি অপেক্ষা করতে হবে। মেরিকে কালো পোশাকে বেশ যৌন আবেদনময়ী লাগছিল। আমি আর্মেনিয়ান রেস্তোরাঁর ব্যাপারে ভাবছি। সেই মানুষটার কথা ভাবছি যে বলেছিল তার স্ত্রী অন্য পুরুষের কামনার বস্তু হয়ে ওঠে। আমি জানি এসব গালা সাপারে যেসব ভদ্রমহিলা আসেন তারা এ রকম আউটফিট পরেন, যাতে তাদের সুডৌল স্তন এবং শরীরের ভঙ্গিমা সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, যাতে তাদের স্বামী অথবা ছেলেবন্ধুরা জানতে পারে তাদের স্ত্রী বা গার্লফেরা অন্য পুরুষের কামনার বস্তু। তারা ভাবে, “ঠিক আছে, ওর দিকে ভালোভাবে তাকাও কিন্তু দূরত্ব বজায় রেখো, কারণ ও আমার সাথে, ও আমার। আমি তোমার চেয়ে উপযুক্ত কারণ আমার কাছে এমন কিছু আছে, যা তোমরা সবাই পছন্দ করো।’

আমি আর কোনো ব্যবসায় জড়াতে চাই না। আমি কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর করছি না অথবা কোনো সাক্ষাৎকার দিচ্ছি না। আমি খুব কমই কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করি, ফেভার ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে নিজের ডিপোজিট করতে। আমি সাপারে এ রকম কারোর পাশে বসব যে একঘেয়ে, যে আমাকে প্রশ্ন করব বই লেখার অনুপ্রেরণা আমি কোথা থেকে পাই। অন্যদিকে আমার পাশে কয়েক জোড়া স্তন দেখানোর জন্য উন্মুখ থাকবে সম্ভবত কোনো বন্ধুর স্ত্রী আর আমাকে সেদিকে তাকানো বন্ধ করতে হবে কারণ আমি যদি অমনটি করি, সেকেন্ডের জন্যও, মেয়েটি তার স্বামীকে বলবে আমি ওর প্রতি ঝুঁকে আছি। আমরা যখন ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, আমি সাম্ভাব্য কথোপকথনের সম্ভাব্য টপিকসের তালিকা তৈরি করছিলাম।

(ক) পোশাক-পরিচ্ছদ ভাবভঙ্গি দেখে লোকজনের মন্তব্য আপনাকে খুব অভিজাত দেখাচ্ছে’, ‘কি সুন্দর পোশাক’, ‘আপনার ত্বক অনেক সুন্দর। বাড়িতে ফিরে গিয়ে তারা বলবে আমি কত খারাপ পোশাক পরি, আমাকে কতটা খারাপ দেখায়।

(খ) সম্প্রতি হলিডেতে, আপনার অবশ্যই আরুবাতে যাওয়া উচিত, খুব ফ্যান্টাস্টিক জায়গা। গ্রীষ্মে কানকুনে সামার নাইটের ওপর কিছু নেই। প্রকৃতপক্ষে, তারা কেউ নিজেরা ছুটির দিনগুলো তেমন উপভোগ করে না, তারা মাত্র কয়েক দিনের জন্য মুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং তারা বাধ্য হয়ে উপভোগ করে কারণ যথেষ্ট টাকা-পয়সা খরচ হয়েছে।

 (গ) আরো ছুটির দিন, এবার তারা কিছু জায়গার সমালোচনা করে, আমি সম্প্রতি রিওডি জেনেরোতে গিয়েছিলাম- জঘন্য শহর। কলকাতার রাস্তার দারিদ্র্য সত্যিই দুঃখজনক। তারা শুধু সেই সব জায়গায় যায় যেখানে নিজেদের অনেক ক্ষমতাবান মনে হয়।

 (ঘ) নতুন থেরাপি, শুধু এক সপ্তাহ সাদা ঘাসের রস সত্যিই চুলের গড়ন অন্য রকম করে দেয়। আমি দুই দিন বিয়াট্রিজের স্পাতে কাটিয়েছি, ওখানকার পানি ছিদ্রগুলোকে উন্মুক্ত করে শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়। পরের সপ্তাহে তারা আবিষ্কার করে সাদা ঘাসে কোনো বিশেষ পদার্থ নেই আর গরম পানি ছিদ্রগুলোকে উন্মুক্ত করে বিষ বের করে দিতে পারে।

(ঙ) অন্য লোকেরা, আমি জীবনেও এ রকম দেখিনি। ব্যাপারটা কী?’ আমি বুঝতে পারছি ওর কীসের সমস্যা, যাতে অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে দিতে হবে।’ তারা সেই সব লোকের নিয়ে কথা বলা যাদের পার্টিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, তারা ইচ্ছামতো সমালোচনা করতে পারে, যতক্ষণ ইচ্ছা ততক্ষণ।

(চ) জীবনের ব্যাপারে কিছুটা অভিযোগ, ‘আমার আশা জীবনে নতুন কিছু ঘটুক। বাচ্চাদের নিয়ে খুবই চিন্তিত, ওরা কখনো ঠিক সংগীত শোনে না ভালো সাহিত্য পড়ে না। তারা একই রকম সমস্যা নিয়ে ভোগা অন্য লোকদের মন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করে।

(ছ) আঁতেলদের আলোচনায়, যেকোনো সন্ধ্যায়, আমরা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘর্ষ নিয়ে কথা বলতে পারি। বলতে পারি ইসলাম ধর্ম, সম্প্রতি এক্সিবিশন, লেটেস্ট দার্শনিক গুরু, চমৎকার বই- যে বইয়ের কথা কেউ শোনেনি, সংগীতের ব্যাপারস্যাপার। আমরা নিজেদের পাণ্ডিত্য ফলাই, স্পর্শকাতর মতামত দিই- কারণ আমরা সবাই জানি ওই এক্সিবিশনকে আমরা কতটা ঘৃণা করি, ওই বই পড়তে কতটা অপছন্দ করি অথবা ওই সিনেমা দেখতে। শুধু ওই রাতে কিছু বলতে হবে বলেই আমরা এসব কথার সূচনা করি।

.

ট্যাক্সি চলে এসেছে। আমার ভেনুর দিকে এগোচ্ছি। আমার লিস্টে আরেকটা ব্যক্তিগত আইটেম যোগ করলাম; মেরির কাছে অভিযোগ করছিলাম এই সাপারটা আমার জন্য কতটা পীড়াদায়ক। ও আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল ব্যাপারটা সত্যি আমি সব সময় তা উপভোগ করি শেষ পর্যন্ত এবং সত্যিই খুব ভালো সময় কাটে।

আমরা প্যারিসের সবচেয়ে অভিজাত রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। আজকের ইভেন্টের জন্য সংরক্ষিত রুমের দিকে গেলাম। লিটারেরি প্রাইজের প্রেজেন্টেশন অনুষ্ঠান- যার আমি একজন বিচারক। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। কেউ কেউ আমাকে দেখে হাই-হ্যালো করল। অন্যরা আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে মন্তব্য করতে লাগল, অনুষ্ঠানের কর্মকর্তারা আমার কাছে এসে লোকজনের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। সব সময়ের মতোই কিছু বিরক্তিকর শব্দ ব্যবহার করল, আপনার জানেন এই ভদ্রলোক কে, অবশ্যই’ কেউ কেউ আমার দিকে তাকিয়ে পরিচিতের ভঙ্গিতে হাসল, অন্যরা আমাকে দেখে মোটেই চিনতে পারল না; কিন্তু ভান করল আমাকে চেনে অন্যথায় তারা যে অস্তিত্বহীন জগতে বাস করে, সেখানে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। তারা এসব ব্যাপার খুব ভালো করেই বোঝে।

গত রাতের ওদের কথা আমার মনে পড়ল। ভাব; স্টুপিড লোকদের সবাইকে একটা জাহাজে করে গভীর সমুদ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তাদের দিনের পর দিন পার্টিতে যোগ দিতে হচ্ছে, কয়েক মাস ধরে তারা একের পর এক লোকজনের সাথে পরিচিত হচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা শেষ পর্যন্ত মনে রাখতে পারছে কে কি?

 কোন ধরনের লোকেরা এই জাতীয় অনুষ্ঠানে আসে তার একটা ক্যাটালগ তৈরির চেষ্টা করলাম। দশ ভাগ হলো সদস্যরা, ডিসিশন মেকাররা, যারা আজ রাতে আসবে, কারণ তাদের ফেভার ব্যাংকের কাছে কিছু ঋণ রয়ে গেছে। কিন্তু তারা সব সময় যেকোনো জিনিসের জন্য চোখ-কান খোলা রাখে, যাতে তাদের কাজের সুযোগটা পায়- কীভাবে অর্থ আয় করতে হয়, কোথায় ইনভেস্ট করতে হয়। তারা খুব তাড়াতাড়িই বলতে পারে কোথায় অথবা কোনো অনুষ্ঠান লাভজনক অথবা নয়, তারা সব সময় পার্টি থেকে আগে বেরিয়ে যায়, কখনো সময়ের অপচয় করে না।

দুই শতাংশ প্রতিভাবান, যাদের সত্যিকার অর্থেই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে। তারা এরই মধ্যে কয়েকটা নদীতে অবগাহন করেছে, তারা কেবল ফেভার ব্যাংকের অস্তিত্বের ব্যাপারটাতে সচেতন, সবাই খুব প্রাণশক্তিতে ভরপুর কাস্টমার, তাদের গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিস দেয়ার রয়েছে, কিন্তু তারা এখনো সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো কোনো পজিশনে আসেনি। তারা সবার সাথেই খুব ভালো ব্যবহার করে কারণ জানে না কার সাথে তারা কথা বলছে। তারা সদস্যদের চেয়ে অনেক বেশি ভোলা মনের কারণ তাদের জন্য যেকোনো রাস্তাই কোনো না কোনো দিকে নিয়ে যাবে।

 তিন শতাংশকে আমি বলি টুপামারাস- আগের উরুগুয়ের গরিলা দল। তারা এই দলকে সংগঠিত করে যেকোনো ধরনের যোগাযোগের জন্য পাগল। তারা নিশ্চিত নয় কোথায় থাকতে হবে অথবা অন্য পার্টিতে যাবে কিনা, তারা উদ্বিগ্ন, তারা নিজেরা কতটা প্রতিভাবান তা দেখাতে উদগ্রীব কিন্তু তারা আমন্ত্রিত হয় না।

আর বাকি পঁচাশি শতাংশ ট্রে। আমি ওদের ও রকমই বলি, কারণ কোনো দলই নির্দিষ্ট তৈজসপত্র ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। তো কোনো অনুষ্ঠানই অতিথি ছাড়া হতে পারে না। ট্রেরা জানে না সত্যিই কী ঘটে চলেছে; কিন্তু তারা গুরুত্বটা বোঝে। তারা এক দল থেকে আরেক দলে যায়, এক সাপার থেকে আরেক সাপারে তারা কি অসুস্থ হয়ে পড়ে না- আমি বিস্ময় নিয়ে ভাবি?

এই ব্যাপারগুলো মেরির কাছে বলতেই ও বলল, কোনো কোনো লোক যেমন কাজের ব্যাপারে আসক্ত তেমনি অন্যরা মজাতে আসক্ত। দুই দলই সমানভাবে অসুখী। তারা কোনো কিছু হারাচ্ছে; কিন্তু নিজেদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়াতে অসমর্থ।

একজন স্বর্ণকেশী তরুণী আমাদের কথোপকথনের সময় আমার দিকে এগিয়ে এল। আমাকে জানাল এ টাইম টু রেন্ড অ্যান্ড এ টাইম টু সিউ বইটা সে কতটা উপভোগ করেছে। সে বাল্টিকের একটা দেশ থেকে এসেছে। সে সিনেমা নিয়ে কাজ করে। তাকে খুব তাড়াতাড়ি টুপামাররা দলের বলে চিহ্নিত করতে পারলাম, কারণ সে যখন আমার ব্যাপারে আগ্রহী, সেই সাথে অন্য জিনিসেও আগ্রহী।

আমি টেবিলের প্রধান। সে কারণেই আমি ট্রেটা নিরাপদ দূরত্বে রাখতে পারছি। অবশ্য সেই সাথে অন্য কোনো কিছু বিরক্ত করার সুযোগ দিচ্ছি না। আমি গাড়ি মেনুফ্যাকচারিং কম্পানির পরিচালক আর একজন শিল্প বোদ্ধা, যিনি এ ক্ষেত্রে অর্থলগ্নি করবেন তাদের দুজনের মাঝে বসে আছি। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে, তাদের কেউ প্রচলিত আনুষ্ঠানিক পোশাক পরেনি। আমাদের টেবিলের আরেকজন পারফিউমারির পরিচালক, একজন আরব প্রিন্স, একজন ইসরায়েল ব্যাংকার- যে ফোরটিনথ শতাব্দীর পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে, আজকে রাতের প্রধান অর্গানইজার।

আমি হাতের গ্লাস টেবিলে রাখলাম। অন্য পাশের লোকদের নাম পড়লাম। মেরি প্রটোকল অনুযায়ী অন্য টেবিলে বসেছে।

 যেমনটি আমি সম্ভাব্য কথোপকথনের টপিকের তালিকা করেছিলাম, আমরা সাংস্কৃতিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে একটু-আধটু কথা বলতে লাগলাম- এটা কি খুব মার্ভেলাস এক্সিবিশন ছিল না, ওটা কি খুব বুদ্ধিদীপ্ত রিভিউ ছিল না… আমি নিজের খাবারের দিকে মনোযোগী ছিলাম- স্যামন এবং ডিম দিয়ে ক্যাভিয়ার- কিন্তু আমি বারবারই সেই একই প্রশ্নে বাধা পাচ্ছিলাম, আমার নতুন বইয়ের কাজ কেমন চলছে, আমি কোথা থেকে অনুপ্রেরণা পাই, আমি এখন কোনো নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি কিনা। সবাইকে দেখে মনে হলো খুব সংস্কৃতিমনা, সবাই সব কিছু ম্যানেজ করে নিয়েছে। কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি, যারা নিজেদের অন্তরঙ্গ বন্ধু মনে করে। সবাই বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে কথা বলতে পারে অথবা কালচারকে কোনো ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

‘আমরা কেন অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি না?”

 প্রশ্নটা আমার মুখ থেকে হঠাৎ করে বেরিয়ে গেল। টেবিলের সবাই চুপ করে গেল। যাই হোক, এ রকমভাবে লোকজনের কথার মধ্যে বাধা দেয়া সত্যিই খুব রূঢ় ব্যাপার। বিশেষ করে এভাবে নিজের দিকে মনোযোগ টেনে নেয়া। দেখে মনে হয়, যেভাবেই হোক, ভিখারিদের সাথে গত রাতের প্যারিসের রাস্তায় ভ্রমণটাই আমার এ রকম মতিভ্রমের কারণ, যার মানে এই জাতীয় কথোপকথনে মনোযোগ দিতে পারছি না আমি।

 ‘আমরা একোমোডাডরের ব্যাপারে কথা বলতে পারি। যে মুহূর্ত থেকে আমাদের জীবনে যখন আমরা সিদ্ধান্ত নেই আমাদের আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে এবং তার পরিবর্তে আমরা কি তাই।

 কাউকে খুব বেশি আগ্রহী মনে হলো না। আমি বিষয় বদলানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।

 ‘আমরা যে গল্প ভুলে গেছি তার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলতে পারি। আমরা পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের গল্পের মধ্যে বাস করার চেষ্টা করতে পারি। প্রতিদিন ভিন্নতর কিছু করার চেষ্টা করতে পারি- রেস্তোরাঁয় আপনার পাশে বসা লোকটার সাথে কথা বলতে পারি, হাসপাতালে ঘুরে আসতে পারি, প্যাডেলে পা রাখতে পারি, অন্য লোক কী বলতে চাইছে তা শুনতে পারি, ভালোবাসার শক্তিকে মুক্ত করে দিতে পারি, তার বদলে আমরা এক কোনায় দাঁড়িয়ে সব কিছু একটা জগের মধ্যে ভরে ফেলতে চাইছি।

‘আপনি কি এডান্ডিটিরি নিয়ে বলছেন?’ পারফিউমারির ডিরেক্টর জিজ্ঞেস করলেন।

না। আমি বোঝাতে চাইছি নিজেকে ভালোবাসার একটা উপাদান হিসেবে দেখাতে, ভালোবাসার প্রভু নয়। এ রকম কারো সাথে থাকতে, যাকে আপনি সত্যিই চান, সমাজ আপনাকে বাধ্য করেছে বলে নয়।

আমাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে ফ্রেন্স কনুসুল জানাল, আমাদের টেবিলের চারপাশে যারা আছে তারা সব সময় ঠিক স্বাধীনতাই ভোগ করে। সবাই একমত হলো, যদিও দেখে মনে হলো না কেউ তা বিশ্বাস করছে।

‘সেক্স! স্বর্ণকেশী মহিলা চেঁচিয়ে বলল। আজ অপরাহে তার ভূমিকা কেউ বুঝতে পারছিল না। আমরা কেন সেক্স নিয়ে কথা বলছি না? সেক্স ব্যাপারটা অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং এবং এর জটিলতাও অনেক কম।

অন্ততপক্ষে ওর মন্তব্যটা স্বতঃস্ফূর্ত। আমার পাশে বসা এক ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়ে বিব্রতকর হাসি দিল। কিন্তু আমি হাততালি দিলাম।

 ‘যৌনতা অবশ্যই অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং, কিন্তু আমি নিশ্চিত নই এটা ভিন্নতর কোনো টপিক কিনা। পাশাপাশি, যৌনতার ব্যাপারে কথা বলায় কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।’

 ‘এটার অবশ্য খুব খারাপ স্বাদও রয়েছে। আমার একজন প্রতিবেশী বলল।

 ‘আমরা কি জানতে পারি নিষিদ্ধ কী?’ অর্গানাইজার জিজ্ঞেস করলেন। তাকে দেখে মনে হলো বেশ অস্বস্তিতে আছেন।

 ‘বেশ, উদাহরণ হিসেবে টাকার কথা বলা যায়। এই টেবিল ঘিরে যারা আছে সবার টাকা আছে অথবা আছে এ রকম ভান করছে। আমরা এখানে একত্রে আমন্ত্রিত হয়েছি কারণ আমরা ধনী, বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী। কিন্তু আমাদের মধ্যে কেউ কি ভেবেছে এ ধরনের কোনো ইভেন্ট, লোকজন প্রকৃতপক্ষে কত আয় করে তার ওপর করা যায় কিনা? আমরা সবাই যখন আমাদের নিজেদের সমন্ধে এতটাই নিশ্চিত, এতটাই গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে আমরা কেন আমাদের জগৎটাকে দেখে দেখছি না এবং কেমন হতে পারে কল্পনা করছি না?

 ‘আপনি কী বোঝাতে চান? কার-মেনুফ্যাকচারিং ফার্মের পরিচালক জিজ্ঞেস করলেন।

 ‘সে এক বিশাল গল্প। আমি টোকিওর বারে বসে হ্যাঁন্স আর ফ্রিজের গল্প দিয়ে শুরু করতে পারতাম এবং মঙ্গোলিয়ান যাযাবরের উল্লেখ করতে পারি, যিনি বলেছিলেন আমাদের নিজেরা কী তা ভুলে যাওয়া দরকার এবং আমরা প্রকৃতপক্ষে কী হতে চাই তা জানা দরকার।

 ‘আপনি আমাকে গুলিয়ে দিচ্ছেন।

‘সেটা আমার ব্যর্থতা। আমি সত্যিই ব্যাখ্যা করতে পারছি না। কিন্তু ব্যাপারটাকে একটু অন্যভাবেই করা যাক। আমি জানতে চাই এখানে যারা আছে তারা কে কত আয় করে। তার মানে হলো, টাকা-পয়সার দিক থেকে, টেবিলের প্রধান যিনি বসে আছেন তার থেকেই শুরু হোক।

সবাই চুপ। নীরবতা। আমার জুয়া কাজ করছে না। টেবিলের চারপাশে যারা আছে তারা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে; কারো অর্থনৈতিক অবস্থা জিজ্ঞেস করা যৌনতার চেয়ে অনেক বড় নিষিদ্ধ ব্যাপার। এমনকি বিশ্বাসঘাতকতা, দুর্নীতি অথবা সংসদীয় অচলাবস্থায়র চেয়েও বেশি কিছু।

যাই হোক, আরব প্রিন্স সম্ভবত এসব ব্যাপারস্যাপারে বিরক্ত হতে হতে এবং ফাঁকা কথাবার্তায় বিরক্ত হয়ে, সম্ভবত প্রতিদিন হয়তো তার ডাক্তার বলে থাকেন আপনি মারা যাচ্ছেন অথবা সম্ভবত অন্য কোনো কারণে আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন :

 ‘আমি মাসে অন্তত বিশ হাজার ইউরো আয় করে থাকি, ব্যাপারটা নির্ভর করে আমার দেশের পার্লামেন্টের অনুমতির ওপরে। যদিও তা আমি কত খরচ করি তার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, কারণ আমার অকল্পনীয় তথাকথিত বিনোদন এলাউন্স আছে। অন্যভাবে বলা যায়, আমি এখানে এসেছি এম্বাসির গাড়িতে। যে কাপড়চোপড় আমি পরেছি তাও সরকারের। আগামীকাল ব্যক্তিগত জেট প্লেনে করে আমি আরেকটা দেশ ভ্রমণে যাব, সেখানে পাইলটের খরচ,, জ্বালানি, এয়ারপোর্ট ট্যাক্স সব আমার এলাউন্স থেকে কর্তন করা হবে।’

তারপর তিনি উপসংহার টানলেন।

‘দেখে মনে হয় বাস্তবতা কোনো প্রকৃত বিজ্ঞান নয়।

যদি আরব প্রিন্স এতটা ভোলামেলাভাবে কথা বলতে পারেন, তার অর্থনৈতিক অবস্থার বর্ণনা দিতে পারেন, যিনি টেবিলের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ ব্যক্তি, অন্যদের চুপ করে বসে থেকে প্রিন্সকে বিব্রত করাটা শোভনীয় নয়। তারাও এই খেলায় অংশ নিতে যাচ্ছেন। প্রশ্ন এবং বিব্রতকর অবস্থা।

‘আমি জানি না ঠিক কত আমি আয় করি।’ অর্গানাইজার বললেন। ফেভার ব্যাংকের একজন প্রতিনিধি। মাসে দশ হাজার ইউরোর আশপাশেই তা ঘোরাঘুরি করে, কিন্তু আমিও বিভিন্ন অর্গানাইজেশনের প্রধান হিসেবে এন্টারটেনমেন্ট এলাউন্স পেয়ে থাকি। সব কিছুতেই আমার জন্য ছাড় থাকে সাপার, লাঞ্চ, হোটেল, এয়ার টিকিট, মাঝে মাঝে কাপড়চোপড়ও যদিও আমার কোনো ব্যক্তিগত জেট প্লেন নেই।’

ওয়াইন শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি ওয়েটারকে আমাদের গ্লাস পরিপূর্ণ করে দেয়ার সংকেত দিলেন।

 এখন কার-মেনুফ্যাকচারিং ফার্মের ডিরেক্টরের পালা, যাকে দেখে মনে হচ্ছে টাকা-পয়সার ব্যাপারে কথা বলাটা ঘৃণা করেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তিনি ব্যাপারটাকে বেশ উপভোগ করছেন।

 ‘আমিও বলতে পারি একই রকম আয় করি এবং আমারও একই রকম আনলিমিটেড এন্টারটেইনমেন্ট এলাউন্স আছে।’

একের পর এক, প্রত্যেকেই কে কত আয় করে তা স্বীকার করল। এদের সবার মধ্যে ব্যাংকারই সবচেয়ে ধনী, বছরে দশ মিলিয়ন ইউরো, পাশাপাশি ব্যাংকে তার শেয়ার যা দিন দিন বাড়তে থাকে।

স্বর্ণকেশী তরুণী যে এখন আমাদের সাথে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেয়নি, উত্তর দিতে অস্বীকার করল।

 ‘এটা আমার গোপন বাগানের একটা অংশ। এটা আমার ছাড়া অন্য কারো ব্যবসা নয়।

‘অবশ্যই তা নয়। কিন্তু আমরা একটা খেলা খেলছি মাত্র।’ অর্গানাইজার বললেন।

স্বর্ণকেশী তরুণী আমাদের সাথে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানাল। তা না করে সে নিজেকে এখানকার সবার চেয়ে অন্য রকম উচ্চতায় নিয়ে গেল। এই দলের মধ্যে একমাত্র তারই গোপনীয়তা আছে। যাই হোক, নিজেকে উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে মেয়েটি শুধু…

অবশ্যম্ভাবীভাবে এবার প্রশ্নটা আমার দিকেই এল।

 ‘এটা নির্ভর করে বছরে যখন আমার নতুন বই প্রকাশিত হয়, আমি পাঁচ মিলিয়ন ইউরো আয় করতে পারি। কিন্তু যদি আমার কোনো বই প্রকাশিত না হয়, তাহলে অন্যান্য বই থেকে রয়ালিটি নিয়ে তা দুই মিলিয়নের মতো হয়।

 ‘আপনি এই প্রশ্নটা শুধু এ জন্য করেছেন, যাতে আপনি কত আয় করেন তা জানাতে পারেন?’ স্বর্ণকেশী তরুণী বলল। কেউ ইমপ্রেসড হয়নি।

মেয়েটি বুঝতে পেরেছে সে আগে ভুলভাবে চলেছে এবং এখন সে পরিস্থিতিটাকে শুধরানোর চেষ্টা করছে।

ব্যাপারটা উল্টো প্রিন্স বললেন, আপনার মতো একজন বিখ্যাত লেখককে আমি আরো বেশি ধনী ভেবেছিলাম।’

স্বর্ণকেশী তরুণী সেই রাতে আর মুখ খোলেনি।

 টাকা-পয়সার ব্যাপারে কথাবার্তা কয়েকটা নিষিদ্ধ ব্যাপার ভেঙে দিল। বোঝা গেল লোকজন কত আয় করে সেটাই তাদের কাছে বড় ব্যাপার। ওয়েটারকে আগের চেয়ে বেশি বেশি আসতে হলো। ওয়াইনের বোতল খুব তাড়াতড়ি শেষ হয়ে যেতে লাগল। অর্গানাইজারের লোকেরা স্টেজে উঠে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করল। পুরস্কার বিতরণ করল এবং তাড়াতাড়ি আমাদের কথোপকথনের কাছে ফিরে এসে যোগ দিল। রাজনীতিবিদরা চায় কথা বলার সময় অন্যরা চুপ করে থাকুক। আমরা টাকা-পয়সা দিয়ে কী করি সে ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা শুরু করলাম।

আমি ভাবলাম প্রসঙ্গ বদলে ওদের জিজ্ঞেস করব, কোন ধরনের শেষকৃত্য তারা পছন্দ করতে পারে- টাকা-পয়সার মতো মৃত্যুও অনেক বড় নিষিদ্ধ বিষয় কিন্তু পরিবেশটা এতটাই হালকা হয়ে গেছে এবং প্রত্যেকেই আগের ব্যাপারটা নিয়ে এত বেশি কথা বলছে যে, আমি কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিলাম।

 ‘আপনারা সবাই টাকা-পয়সার ব্যাপারে কথা বলছেন, কিন্তু আপনারা জানেন না অর্থ কী।’ ব্যাংকার বললেন। “কেন লোকজন ভাবে একটা রঙিন কাগজ, একটা প্লাস্টিক কার্ড অথবা ধাতব একটা জিনিসের এতটা মূল্য কেন? তার চেয়ে খারাপ, আপনি কি জানেন আপনার টাকাকড়ি, আমার মিলিয়ন ডলার এসব ইলেকট্রনিক স্পন্দন ছাড়া আর কিছু নয়?

অবশ্যই আমরা তা জানি।

‘একদা, অর্থসম্পদ ছিল মহিলারা যা পরত। ব্যাংকার চলে চললেন, ‘অমূল্য ধাতব দিয়ে তৈরি গহনা খুব সহজে স্থানান্তর করা যেত, গণনা করা যেত এবং ভাগ করে নেয়া যেত। মুক্তা, স্বর্ণ, অমূল্য পাথর। আমরা সবাই আমাদের সম্পদ দৃশ্যমান জায়গায় বয়ে নিয়ে যাই। এসব জিনিসের বিনিময়ে গরু-ছাগল বা শস্যদানা পাওয়া যেত কারণ কেউ রাস্তার নিচে নেমে গরু-ছাগল নিয়ে আসা বা শস্যের বস্তা বয়ে আনত না। মজার ব্যাপার হলো, আমরা এখনো সেই আদিম যুগের কিছু গোত্রের মতো আচরণ করি। আমরা গহনা পরে নিজেরা কতটা ধনী তা অন্যদের দেখাই, এমনকি যদিও টাকা-পয়সার চেয়ে আমাদের অনেক বেশি গহনা থাকে।

 ‘এটা উপজাতীয় আইন। আমি বললাম, “আমাদের দিনগুলোতে, তরুণরা চুল লম্বা রাখত, আর এখনকার সময়ে সবাই শরীর ছিদ্র করে। এর মাধ্যমে তারা যে একই মনমানসিকতার মানুষ তা চিহ্নিত করে, যদিও তা দিয়ে কিছু ক্রয় করা যায় না।

 ‘আমাদের ইলেকট্রনিক স্পন্দন দিয়ে জীবনের একটা ঘণ্টার অতিরিক্ত স্পন্দন ক্রয় করতে পারে?, সেগুলো কি আমাদের যেসব ভালোবাসার মানুষ চলে গেছে তাদের ফিরে আনতে পারে?, অর্থ কি ভালোবাসা কিনতে পারে?

 ‘অর্থ দিয়ে শর্তসাপেক্ষে ভালোবাসা কেনা যায়। কার-মেনুফ্যাকচারিং ফার্মের ডিরেক্টর আনন্দিত স্বরে বললেন।

ভদ্রমহিলার চোখ বিষাদগ্রস্ত। আমি এসথারের কথা ভাবলাম। আজ সকালে সাক্ষাৎকারে সাংবাদিকের কাছে দেয়া কথা মনে পড়ল। আমরা ধনী, প্রভাবশালী, বুদ্ধিমান, লোকজন তা ভালো করেই জানে। আমরা সকল প্রকারের গহনা ও ক্রেডিট কার্ড শুধু ভালোবাসা এবং স্নেহ পাওয়ার জন্য অর্জন করেছি।

 ‘সব সময় নয়। পারফিউমারির পরিচালক আমার দিকে ঘুরে বললেন।

না, আপনি ঠিক বলেছেন, সব সময় নয়। যাই হোক, আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি একজন ধনী মানুষ। কিন্তু সব সময় নই। যাই হোক, এই টেবিলের কেউ কি বলতে পারবেন দশ ডলারের নোটে কতগুলো বিড়াল আর ল্যাম্পপোস্ট থাকে?

কেউ জানে না। কেউ আগ্রহী নয়। ভালোবাসার মন্তব্যের আবহাওয়া পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল। আমরা আবার সাহিত্য পুরস্কার, প্রদর্শনী, সর্বশেষ সিনেমা এবং নাটক নিয়ে আলাপ করতে লাগলাম।

.

‘টেবিলে তোমার সময় কেমন কাটল?’

 ‘সব সময়ের মতো।

‘বেশ, আমি অর্থকড়ির ব্যাপারে বেশ মজাদার চমকদার আলোচনা শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু হায়, ব্যাপারটা ট্র্যাজেডিতে শেষ হয়।

তুমি কখন যাচ্ছ?

সকাল সাড়ে সাতটায় এখান থেকে বেরিয়ে পড়ব। তুমি যেহেতু বার্লিনের বিমানে যাবে, আমরা একই ট্যাক্সিতে যেতে পারি।

 ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?”

 ‘তুমি জানো আমি কোথায় যাচ্ছি। তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করোনি কিন্তু তুমি জানো।’

‘হ্যাঁ, আমি জানি।

 ‘যেমনটি তুমি জানো আমরা এই মুহূর্তে বিদায় জানিয়ে রাখি।

 ‘আমরা সেই সময়ে ফিরে যেতে পারি, আমাদের প্রথম দেখার সময়; একজন আবেগী পুরুষ, যার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে এবং একজন মহিলা যে তার প্রতিবেশীর সাথে প্রেমে মত্ত। তোমাকে আগে যে কথাটি বলেছিলাম : আমি তিক্ত অভিজ্ঞতার সাথে লড়তে যাচ্ছি। বেশ, আমি লড়াই করে হেরে গেছি। এখন আমি শুধু আমার ক্ষতস্থান চেপে ধরে চলে যাচ্ছি।’

‘আমিও লড়াই করে হেরে গেছি। আমি সেই ক্ষত সেলাই করার চেষ্টা করছি না। তোমার মতো, আমিও তিক্ত অংশে লড়াই করেছি।’

 ‘আমি প্রতিদিন কষ্টভোগ করি, তুমি কি তা জানো? আমি মাসজুড়ে কষ্ট করছি, তোমাকে দেখানোর চেষ্টা করেছি আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, আমার পাশে থাকো তখন জিনিসগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন, আমি কষ্ট পাই কি না পাই, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যথেষ্ট হয়েছে। সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। আমি ক্লান্ত। জাগরেবের সেই রাতের পরে, আমি নিজেকে মুক্ত করে বলেছি, যদি ঝড়ঝঞ্ঝা আসে, আসুক। আমি পাতার মতো তাতে গা ভাসিয়ে দেব। আমাকে তুষারের মধ্যে উড়িয়ে নিয়ে যাক কিন্তু একদিন আমি সেরে উঠব।’

‘তুমি অন্য কাউকে খুঁজে পাবে।’

“অবশ্যই আমি খুঁজে পাব। আমি তরুণী, সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, আবেদনময়ী, কিন্তু তোমার সাথে আমার যেসব জিনিসের অভিজ্ঞতা হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা কি অর্জন করতে পারব?’

 ‘তুমি অন্য ধরনের আবেগের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, তুমি জানো, যদিও তুমি তা বিশ্বাস করো না। একসাথে থাকার সময় আমি তোমাকে ভালোবাসি।

 ‘আমি নিশ্চিত তুমি আমাকে ভালোবাসো, কিন্তু তাতে আমার যন্ত্রণা একটুও কমবে না। আমরা আগামীকাল আলাদা টাক্সিতে যাব। আমি বিদায় জানাতে ঘৃণা করি। বিশেষত এয়ারপোর্ট অথবা রেলস্টেশনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *