০৪.
বুধবার জয় গেল দিল্লি। স্বভাবতই একা বাড়িতে ধৃতি আর পরমার থাকা সম্ভব নয়। ধৃতির যাওয়ার জায়গা নেই তেমন। পরমার আছে। তাই পরমা গেল বাপের বাড়ি। সেই সঙ্গে ছুঁড়ি ঝিটাকেও নিয়ে গেল। গোটা ফ্ল্যাটে ধৃতি একা।
অবশ্য ধৃতি আর কতটুকুই বা ফ্ল্যাটে থাকে! তার আছে অফিস, আড্ডা, ফিচার লেখার জন্য তথ্য সংগ্রহ করে ঘুরে বেড়ানো। রাতে নাইট ডিউটি নেই বলে শুধু সেই সময়টুকু সে ফ্ল্যাটে থাকে।
রাত নটা নাগাদ ধৃতি অফিসে একটা বড় পলিটিক্যাল কপি লেখা শেষ করল। খুব পরিশ্রম গেছে। এইবার ছুটি। চলে যাওয়ার আগে সে এর ওর তার সঙ্গে কিছু খুনসুটি করে রোজই। আজ বুড়ো ডেপুটি নিউজ এডিটার মদনবাবুর সঙ্গে ইয়ার্কি করছিল।
ঠিক এইসময়ে চিফ সাব-এডিটার ডেকে বললেন, তোমার ফোন হে!
ধৃতি হ্যালো শুনেই কেঁপে ওঠে একটু। টুপুর মা।
বলুন। ধৃতি বলে।
চিঠি তো পেয়েছেন!
পেয়েছি।
ছবিটা দেখলেন?
হু।
কেমন?
টুপু খুবই সুন্দরী।
আপনাকে তো বলেইছিলাম যে টুপুকে সবাই মিস এলাহাবাদ বলত। আমার টুপু ছিল সাংঘাতিক সুন্দরী।
হু।
খবরটা কবে ছাপা হবে?
ধৃতি একটু ইতস্তত করে বলে, দেখুন এসব খবর ছাপার এক্তিয়ার তো আমাদের নেই।
আপনি ইচ্ছে করলেই পারেন।
পারি না। দোহাই! প্লিজ! আমার টুপুআপনাদের কাছে কিছুই না জানি। কিন্তু ওর খবরটা ছাপা হলে আমি বড় শান্তি পাব। মায়ের ব্যথা তো বোঝেন না আপনারা!
শুনুন। প্রথম কথা, টুপু যদি নামকরা কেউ হত তবে খবরটা ছাপা সহজ হয়ে যেত। যদি খুনের কেস আদালতে উঠত তাও অসুবিধে হত না। কিন্তু শুধু আসাম্পশনের ওপর তো আমরা কিছু করতে পারি না।
দুচার লাইনও নয়?
না। তবে আপনি ইচ্ছে করলে বিজ্ঞাপন দিয়ে খবরটা ছাপতে পারেন। কিন্তু তাতে খুনের উল্লেখ থাকলে চলবে না।
কিন্তু আমি যে সবাইকে টুপর খুনের খবরটাই জানাতে চাই।
তাহলে আপনি পুলিশের গ্রুতে প্রসিড করুন। যদি মামলা হয় তাহলে আমি খবরটা ছেপে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। আর নইলে খুনের যথেষ্ট এভিডেনস চাই। এলাহাবাদের লোকাল কাগজে কি খবরটা বেরিয়েছিল?
না।
তবে আমাদের কিছু করার নেই। আপনি পুলিশকে কিছু জানাননি?
জানিয়েছি, কিন্তু তারা কোনও গা করছে না।
কেন?
তারা এটাকে খুন বলে মনে করছে না যে তারা লাশ চায়।
লাশ! কেন, লাশ পাওয়া যায়নি?
না। কী করে যাবে? টুপুকে যে একটা পাহাড়ি নদীতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
কোথায়?
টুপুর মা একটু চুপ করে থামে। তারপর দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলেন, কোথায় তা আমি ঠিক জানি না।
তাহলে খুন বলে ধরে নিচ্ছেন কেন? সাক্ষী আছে?
না।
তবে কী করে জানলেন?
ওরা কলকাতায় বেড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে যায় আরও অনেক জায়গায়। সবশেষে ঘটনাটা ঘটে মাইথনে।
মাইথনে?
খুব নির্জন জায়গা। ওরা ফরেস্ট বাংলোতে থাকত।
কারা? টুপু আর কে?
ওঃ, সে ঠিক জানি না।
না জানলে কী করে হবে? টুপু কার সঙ্গে গিয়েছিল তা আপনার খোঁজ নেওয়া উচিত।
কী করে নেব? আমি অনাথা বিধবা। টুপুর তো বাবা নেই, ভাইবোন নেই। টুপু একটিমাত্র। তবে আমাদের টাকা আছে। অনেক টাকা। খবরটা ছাপানোর জন্য যদি টাকা খরচ করতে হয় তো আমি পিছুপা হব না। বুঝলেন? টুপুই যখন নেই তখন এত টাকা আমার কোন কাজে লাগবে? আমি আপনাকে খবরটা ছাপানোর জন্য হাজার টাকা দিতে পারি। রাজি?
না। ধৃতি গম্ভীর হয়ে বলে, টাকা থাকলে আপনি বরং তা সৎ কাজেই ব্যয় করুন, খবরটা ছাপা গেলে আমি এমনিতেই ছাপতাম।
কিছুতেই ছাপা যাবে না?
ধৃতি হঠাৎ প্রশ্ন করে, আপনি কোথা থেকে কথা বলছেন?
টুপুর মা খানিক নিস্তব্ধ থেকে বললেন, কেন বলুন তো?
এলাহাবাদ থেকে কি?
আবার খানিক চুপচাপ থাকার পর টুপুর মা বলেন, না।
তবে কি কলকাতা থেকে?
হ্যাঁ। আমি কাল কলকাতায় এসেছি।
ধৃতি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আপনার চিঠিটাও কিন্তু কলকাতা থেকে ডাকে দেওয়া হয়েছিল। যদিও চিঠিতে ডেটলাইন ছিল এলাহাবাদের।
টুপুর মা লজ্জার স্বরে বলেন, সে একটা কাণ্ড। আমার একজন চেনা লোককে চিঠিটা ডাকে দিতে দিই। সে সেইদিনই কলকাতা যাচ্ছিল। তাই একেবারে কলকাতায় গিয়ে তাকে দিয়েছে। কিছু মনে করেছিলেন বোধহয়।
না, মনে কী করব? এরকম হতেই পারে।
আপনি হয়তো কিছু সন্দেহ করেছিলেন?
বিব্রত ধৃতি বলে, না না।
আমি কলকাতায় এসেছিলাম টুপুর ব্যাপারেই। টুপুকলকাতায় কোথায় ছিল তা আমি জানি না। কিন্তু সম্ভব-অসম্ভব স্ব জায়গায় খোঁজ নিচ্ছি। কেউ কিছু বলতে পারছে না।
টুপু কি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল?
কেন, বলিনি আপমাকে সে কথা?
না।
টুপুর মা একটু হেসে বললেন, ওমা। আমারই ভুল তবে। যা হোক, আজকাল আমার মেমরিটা একদম গেছে। হা, টুপু তো পালিয়েই এসেছিল। টুপু যত সুন্দরী ছিল ততটা শান্ত বা বাধ্য ছিল না। খুব অ্যাডভেঞ্চারাস টাইপ।
ও। তা পালাল কেন?
আমি যা বারণ করতাম তাই করব এই ছিল স্বভাব টুপুর। ও খানিকটা ছেলের মতো মানুষ হয়েছিল তো। সাইকেল, সাঁতার, গাড়ি চালানো, বন্দুক হেড়া সব জানত।
খুব চৌখস মেয়ে তো!
খুব। একস্ট্রা-অর্ডিনারি যাকে বলা যায়।
পালাল কেন তা তো বললেন না।
টুপুর যে বিয়ের ঠিক হয়েছিল!
টুপু বিয়েতে রাজি ছিল না বুঝি?
না। ও বলত আর একটু বয়স হলে সে মাদার টেরেসার আশ্রমে বা সৎসঙ্গ কিংবা রামকৃষ্ণ মিশনে চলে যাবে। সারা জীবন সন্ন্যাসিনী হয়ে থাকবে।
কেন?
ও পুরুষদের পছন্দ করত না। না, কথাটা ভুল বলা হল। আসলে ও কখনও তেমন পুরুষ দেখেনি যাকে সত্যিকারের বন করা যায়। সব পুরুষমানুষকেই ও খুব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। বলত, এদের কাউকে বিয়ে করা যায় না।
কিন্তু পালানোর ব্যাপারটা তো বললেন না?
বলছি। আমরা ওর বিয়ে ঠিক করি একজন ব্রিলিয়ান্ট অ্যামেরিকা ফেরত মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। দারুণ ছেলে। টুপুর আপত্তি আমরা শুনিনি।
কেন?
শুনিনি তার কারণ চট করে এরকম ভাল পাত্র কি পাওয়া যায়, বলুন? যেমন চেহারা তেমনি স্বভাব, দেদার টাকা রোজগার করে, হাই পোজিশনে চাকরি করছে।
তারপর?
আশীর্বাদের আগের দিন টুপু একটা চিঠি লিখে রেখে চলে গেল। কাউকে, এমনকী আমাকে পর্যন্ত জানিয়ে যায়নি।
সঙ্গে কেউ যায়নি?
কী করে বলব?
কলকাতায় গিয়েছিল কী করে জানলেন?
সেখান থেকে আর একটা চিঠি দেয়। তাতে লেখে, আমি খুব ফুর্তিতে আছি। এবার বেড়াতে যাব দার্জিলিং, নেতারহাট, মাইথন, আরও কয়েকটা জায়গার নাম লেখে। সব মনে নেই।
কিন্তু মারা যাওয়ার ব্যাপারটা?
ওঃ হ্যাঁ। মাইথন থেকে ওর শেষ চিঠি। তাতে ও খুব মন খারাপের কথা লিখেছিল। জানিয়েছিল যে কে বা কারা ওর পিছু নিয়েছে। তারা ওর ভাল করতে চায় না, ক্ষতি করতে চায়।
তারপর?
তারপর আর কোনও খবর নেই। তবে আমি এক রাতে স্বপ্ন দেখি যে টুপু উঁচু থেকে জলের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। আপনি কখনও মাইথনে গেছেন?
গেছি।
আমি যাইনি। জায়গাটা কেমন?
সুন্দর।
সেখানে পাহাড় আছে?
আছে। তবে ছোট পাহাড়।
টুপুও তাই লিখেছিল। সেখানে কী একটা বিখ্যাত মন্দির আছে না?
আছে। কল্যাণেশ্বরীর মন্দির।
সেখানে সেই মন্দিরে ঢোকার গলিতে নাকি কারা টুপুর পাশ দিয়ে যেতে যেতে শাসিয়েছিল যে মেরে ফেলবে।
কিন্তু কেন?
সে তো জানি না। টুপুর মতো মেয়ের কি শত্রু থাকতে পারে? তবু ছিল, জানেন। আর টুপু যে খুব অ্যাডভেঞ্চারাস টাইপের ছিল।
বুঝলাম। কিন্তু টুপুর সঙ্গে কেউ ছিল না?
হয়তো ছিল। তাদের কথা টুপু লিখত না।
কলকাতায় আপনাদের আত্মীয়স্বজন নেই?
আমার শ্বশুরবাড়ি এখানে। তবে আমার দিককার কোনও আত্মীয় এদিকে থাকে না। আমার বাপের বাড়ি গোরক্ষপুরে, তিন পুরুষের বাস।
টুপু কি তার বাপের বাড়িতে উঠেছিল?
টুপুর মা হেসে বললেন, টুপুর বাপের বাড়ি বলতে অবশ্য এলাহাবাদের বাড়িই বোঝায়। তবে এখানে আমার স্বামীর খুড়তুতো ভাই-টাই আছেন। বাড়ির একটা অংশ অবশ্য আমাদের। সে অংশ তালা দেওয়া থাকে, আমরা কলকাতায় এলে সেখানেই উঠি। কিন্তু টুপু এ বাড়িতে আসেনি।
ধৃতি এতক্ষণ পরে টের পেল যে, সে খামোখা এত কথা বলছে বা শুনছে। শুনে তার কোনও লাভ নেই। টুপুর ব্যাপারে তার করারও কিছু নেই।
ধৃতি বলল, সবই বুঝলাম। কিন্তু সিমপ্যাথি জানানো ছাড়া আর কী করতে পারি বলুন?
শুনুন। দয়া করে আপনার বাসার ঠিকানাটা দেকেন?
কেন?
বিরক্ত হবেন না। ঠিকানাটা থাকলে আমি যদি দরকারে পড়ি তাহলে কন্ট্যাক্ট করতে পারব। আমি কলকাতার কিছুই চিনি না। আমার দেওররাও খুব সিমশাথেটিক নয়। আমি আপনার মতো একজন বুদ্ধিমান লোকের সাহায্য পেলে খুব উপকৃত হব। অবশ্য যদি কখনও দরকার হয়। নইলে এমনিতে বিরক্ত করব না।
একটু দ্বিধা করেও ধৃতি ঠিকানা বলল।
আপনার বাসায় ফোন নেই?
না।
আচ্ছা, ছাড়ছি।
ভদ্রমহিলা ফোন রাখলেন। ধৃতি হাফ হাড়ল।