জয়দের বাড়িতে পৌঁছতে ঠিক পঞ্চাশ মিনিট লাগল।
তেমন খুঁজতেও হয়নি বাড়ি। একবারেই পাওয়া গেল।
স্কুটার থেকে নেমে জয়কে দেখতে পেল মিলা। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ফেডেড জিনসের লুজ ধরনের জিনস পরা, আকাশি রংয়ের টিশার্ট। বাঁহাতে সুন্দর বেল্টের ঘড়ি। পায়ে সুন্দর স্যান্ডেলসু। সকালবেলা গোসল, সেভ এসব সেরে বেরুবার ফলে বেশ ফ্রেস লাগছে তাকে।
জয়কে দেখে খুব ভাল লাগল মিলার। মনে হলো এই মানুষের ওপর সর্বান্তকরণে নির্ভর করা যায়। এই মানুষ কারও কোনও ক্ষতি করতে পারে না।
মনটা আশ্চর্য এক ভাল লাগায় ভরে গেল তার।
মিলাকে দেখেই স্কুটারের সামনে এগিয়ে এসেছে জয়। সঙ্গে সঙ্গে তার গা থেকে চমৎকার একটা পারফিউমের গন্ধ এলো। এই গন্ধে মুহূর্তের জন্য কী রকম যেন দিশেহারা হলো মিলা। অপলক চোখে জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।
মিলাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসল জয়। কী হলো? নামবে না?
মিলা থতমত খেল। তারপর লাজুক হাসল। নামব না কেন?
কোলের ওপর কলেজের ব্যাগ। ব্যাগ নিয়ে নামল সে।
জয় বলল, আমি একটা কাজ করতে চাই। তুমি কি রাগ করবে?
জয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে মিলা বলল, হ্যাঁ খুবই রাগ করব।
কথাটা না শুনেই বলছ?
বুঝে গেছি কী করতে চাইছেন আপনি।
বলো তো?
স্কুটার ভাড়াটা দিয়ে দিতে চাইছেন।
জয় হাসল। হ্যাঁ।
কেন আপনি দেবেন?
বলেই ব্যাগের ভেতর থেকে ছোট্ট পার্স বের করল মিলা। একটা পঞ্চাশ টাকা আর একটা দশ টাকার নোট স্কুটারঅলাকে দিল। তারপর জয়ের দিকে। তাকাল। চলুন।
মিলাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে এল জয়।
বাড়ির ভেতরে নানা রকমের জিনিসপত্র ছড়ানো। লেবার ওস্তাগাররা আসছে, যাচ্ছে। ঠুকুর ঠাকুর শব্দ হচ্ছে। বাইরে থেকে বেশ একটা হযবরল অবস্থা। কিন্তু জয়ের রুমে বলতে গেলে তেমন কোনও শব্দই আসছে না। বেশ ছিমছাম সুন্দর রুম। সিঙ্গেল খাট পাতা। নরম ফোমের ওপর আড়ংয়ের বেডকাভার। বিছানার একপাশে বেডসাইট টেবিল। তাতে জয়ের মোবাইল সেটটা পড়ে আছে। দুতিনটি পত্রিকা, সুন্দর একটা টেবিল ল্যাম্প। এক পাশে দেয়ালের সঙ্গে দুটো বেতের সোফা, ছোট্ট টিপয়। আরেক পাশে ওয়ার্ডরোব। তার ওপর চৌদ্দইঞ্চি সনি টেলিভিশন। একটা ক্রিস্টালের ফ্লাওয়ারভাস, ছোট্ট একটা টেপ রেকর্ডার, কয়েকটা অডিও ক্যাসেট, দুতিনটি পারফিউম, রুম স্প্রে। সবমিলে অত্যন্ত রুচিকর একটা পরিবেশ।
জয়কে গেটের সামনে দেখে যেমন ভাল লেগেছিল মিলার, এখন এই রুমে ঢুকেও তেমন ভাল লাগল। রুম ভরে আছে এয়ার ফ্রেসনারের গন্ধে।
মিলা মুগ্ধ গলায় বলল, খুব সুন্দর রুম।
জয় হাসল। আমার মতোই।
মানে?
তুমি একদিন বলেছ আমিও সুন্দর।
না তা বলিনি। বলেছি, ব্যক্তিত্ববান।
ব্যক্তিত্বই তো মানুষকে সুন্দর করে।
তা ঠিক। সেই অর্থে আপনি সুন্দর।
ব্যাগটা এক সোফায় রেখে পাশের সোফায় বসল মিলা। এবার বলুন তো স্কুটার ভাড়াটা আপনি কেন দিতে চাইছিলেন?
তেমন কোনও কারণ নেই। ভদ্রতা।
কিসের ভদ্রতা?
আমাদের ফ্যামিলির কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে। আমাদের বাড়িতে কেউ এলে, যদি রিকশা কিংবা স্কুটারে আসে, আমরা চেষ্টা করি তাদের আসা যাওয়ার ভাড়াটা দিয়ে দিতে। যদিও বেশির ভাগ সময়ই কেউ নিতে চায় না।
চাইবে কেন? কেউ যদি কারও কাছে আসে, যার কাছে আসবে তার কাছে থেকে পথখরচা নেবে নাকি!
তা ঠিক। তবু আমরা অফার করি।
আমার ক্ষেত্রে আর কখনও করবেন না।
তা করব না। তবে কথাটা শুনে খুব খুশি হলাম।
এতে খুশি হওয়ার কী হলো?
খুশি হচ্ছি এই কারণে যে আজকের পরও তুমি আমার কাছে আসবে।
চোখ তুলে জয়ের মুখের দিকে তাকাল মিলা। তার মানে কী? আপনি কি আজ এমন কোনও ব্যবহার করবেন যার ফলে আমি আর কখনও এখানে আসব না?
জয় হাসল। ধুঁৎ। তুমি সব সময় এসব ভাব কেন? তোমার কথা শুনে আমার ভাল লেগেছে যে তুমি আমার কাছে, এখানে, আমি ডাকলেই আসবে।
আপনি না ডাকলেও আসতে পারি।
কথাটা আমি এসব ভেবেই বলেছি।
মিলা যে সোফাটায় ব্যাগ রেখেছে, সেই সোফার সামনে এসে দাঁড়াল জয়। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগটা সোফার পাশে নামিয়ে রাখল মিলা। বসুন।
জয় বসল। তোমার কোনও অসুবিধা হয়নি তো?
কিসের অসুবিধা?
এখানে আসতে?
না।
মানে স্কুটার পাওয়া, বাড়ি খুঁজে পাওয়া।
কোথাও কোনও অসুবিধা হয়নি।
গুড।
বলেই উঠে দাঁড়াল জয়।
মিলা অবাক হলো। কী হলো, উঠলেন কেন?
পাশাপাশি বসতে ভাল লাগছে না।
কেন?
তোমার মুখটা দেখতে পাচ্ছি না। প্রিয় মানুষ সামনে থাকলে তার মুখ না দেখতে পেলে আমার খুব অস্থির লাগে।
জয় বিছানায় বসল। মিলার মুখোমুখি। এবার তোমাকে খুব ভাল দেখতে পাচ্ছি।
মিলা হাসল। কেমন লাগছে আমাকে?
পেইল লাগছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তোমার বোধহয় রাতে ভাল ঘুম হয়নি।
ঠিকই বলেছেন। ঘুমটা খুব ভাল হয়নি।
কেন?
জানি না।
আমার কথা ভেবেছ?
ইস, আপনার কথা ভাববার কী এমন ঠেকা পড়েছে আমার?
সত্যি ভাবনি?
না।
তাহলে আজ এলে কেন?
মুন্নিকে না পেয়ে ভেবেছি।
তার মানে একজনকে না পেয়ে আরেকজনের কথা ভেবেছ?
মুন্নি কিন্তু মেয়ে।
তা আমি জানি। কারণ আজ পর্যন্ত মুন্নি নামে কোনও ছেলে আমি দেখিনি। ছেলেদের নাম হয় মুন্না।
মুন্না কিন্তু মেয়েদেরও নাম হয়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, মুন্না নামের একটি মেয়েকে আমি চিনি।
কোথায় থাকে?
আমেরিকায়। আগে আমাদের এলাকায় থাকত।
বিয়ে হয়ে গেছে? হাজব্যান্ডের সঙ্গে থাকে আমেরিকায়?
না পড়তে গেছে।
বাহ্, ভাল তো।
তারপর জয় বলল, তুমি কি বাথরুমে যাবে?
মিলা হাসল। কেন আমি হঠাৎ বাথরুমে যাব? আর আপনি এত বাথরুম বাথরুম করেন কেন?
জয়ও হাসল। আসলে তোমাকে খুব পেইল লাগছে। এমনিতেই রাতে ঘুমোওনি তার ওপর স্কুটার জার্নি। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হও, ভাল লাগবে।
বাথরুমে যাওয়ার দরকারও ছিল মিলার। জয়ের কথা শুনে উঠল সে। ফ্রেস হয়ে এল।
জয় মুগ্ধ গলায় বলল, এবার সত্যি তোমাকে সুন্দর লাগছে।
মিলা কপট রাগ দেখাল। হয়েছে, আর পটাতে হবে না।
নতুন করে পটাবার কিছু নেই।
তারমানে পটিয়ে ফেলেছেন?
অবশ্যই। নয়তো তুমি এখানে আসতে?
মিলা কথা বলল না। আগের জায়গায় বসল। আপনি এত বাথরুম বাথরুম কেন করছিলেন আমি বুঝতে পেরেছি।
কেন বল তো?
বাথরুমটা আমাকে দেখাতে চেয়েছেন। চেয়েছেন আমি যেন আপনার বাথরুমের প্রশংসা করি। প্রশংসা আমি করছি। বাথরুমটা সত্যি সুন্দর।
ধন্যবাদ। কিন্তু এই উদ্দেশ্য নিয়ে আমি বলিনি।
সঙ্গে সঙ্গে গা এলিয়ে বসল মিলা। আমি আজ কেন এসেছি জানেন?
জানি।
কেন বলুন তো?
আমার সঙ্গে প্রেম করতে।
জ্বী না, আপনার সঙ্গে প্রেম আমি করব না।
কেন?
আগে একটি প্রেম আপনি করেছেন। এবং আমারই বান্ধবীর সঙ্গে। সেকেন্ডহ্যান্ড প্রেমিকের সঙ্গে প্রেম আমি করব না।
তাহলে তো আমার খুব লস হয়ে গেল।
কী রকম?
তোমার বান্ধবীকেও হারালাম, তোমাকেও হারালাম।
কিন্তু আমার বান্ধবীর সঙ্গে এমন আপনি করলেন কেন? সুমি তো খুব ভাল মেয়ে।
তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ওদের ফ্যামিলিও খুব স্ট্যান্ডোর্ড।
আমি সব জানি। প্রেম ভালবাসার সঙ্গে এসবের কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক যাকে তুমি ভালবাসবে শুধু তার সঙ্গে। সে কেমন, তার চরিত্র কেমন, ব্যক্তিত্ব এবং রুচি কেমন। মানুষ হিসেবে সে কোন স্তরের, এইসব।
প্রেমিকা হিসাবে সুমি কেমন ছিল?
তা তোমাকে আমি বলতে চাই না।
কেন?
থাক।
কিন্তু আমার জানা দরকার।
কেন?
আমার মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে আমার প্রেম হবে।
জয় হাসল। এখনও হয়নি?
বলব না। এখন যা জানতে চাইছি শুধু তাই বলুন।
তোমাকে খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে।
আমি সত্যি খুব সিরিয়াস টাইপের মেয়ে।
মুখের সুন্দর একটা ভঙ্গি করে জয় বলল, আচ্ছা শুনুন সিরিয়াস মেয়ে, কোন কোন ব্যাপারে আপনি খুব সিরিয়াস?
মিলা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, সব ব্যাপারেই।
খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে?
মিলা হাসল। এই একটা ব্যাপারে আমি একেবারেই সিরিয়াস না।
অর্থাৎ না খেয়ে থাকেন?
আরে না।
তাহলে?
খাই। খিদে পেলে হাতের কাছে যা পাই তাই খেয়ে ফেলি। আমার তেমন কোনও চয়েজ থাকে না।
এখন কি আপনার খিদে পেয়েছে?
না। কখন পাবে?
জানি না।
দুপুরে খিদে আপনার পায় তো, নাকি?
তা পায়।
তখন কী খাবেন?
ভাত।
কিন্তু এখানে যে ভাতের ব্যবস্থা নেই।
মিলা বুঝে গেল এতক্ষণ ধরে খাওয়া দাওয়া নিয়ে কেন কথা বলছে জয়। বলল, এখানে ভাতের কোনও দরকার নেই। আমি বাসায় গিয়ে খাব।
তুমি যাবে কটায়?
এখান থেকে দুটো কিংবা সোয়া দুটোয় স্টার্ট করব। অর্থাৎ তিনটার মধ্যে বাসায় পৌঁছাতে হবে। সেভাবেই বলে বেরিয়েছি।
সোয়া দুটো পর্যন্ত না খেয়ে থাকবে তুমি?
আমার কোনও অসুবিধা হবে না।
কিন্তু আমাকে তো কিছু না কিছু খেতে হবে। খিদে কিন্তু আমি একদম সহ্য করতে পারি না। খিদে পেলে মাথা খারাপ হয়ে যায় আমার।
আপনি খান। আপনাকে খেতে মানা করেছে কে?
তবে ভাত আমি খেতেই চাই না। খাদ্যের মধ্যে আমার সবচে’ অপছন্দ ভাত।
আর পছন্দ?
চুমু।
মিলা হাসল। ধুৎ। সব সময় ফাজলামো করবেন না।
এবার জয়ও হাসল। নির্মল মুখ করে হাসল। তোমার সঙ্গে খুব ফান করি আমি।
কেন করেন?
ভাল লাগে। খুব ভাল লাগে। ফান কিন্তু সবার সঙ্গে করা যায় না, জানো? কোনও কোনও মানুষের সঙ্গে করা যায়।
আমার সঙ্গে কেন করা যায় বলুন তো?
ফানটা তুমি বোঝ এবং এনজয় করো। তোমার সঙ্গে যেদিন প্রথম দেখা হলো, কথা হলো, সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম তুমি ঠাট্টাপ্রিয় মানুষ। যারা ঠাট্টা পছন্দ করে তারা মনের দিক দিয়ে খুব ভাল হয়। এজন্যই তো তোমাকে আমি প্রপোজ করলাম।
এখন তো মনে হচ্ছে সেটাও ঠাট্টা।
জয় সঙ্গে সঙ্গে অমিতাভ বচ্চন হয়ে গেল। কৌন বনেগা ক্রোড়পতি স্টাইলে বলল, এই প্রশ্নের জবাব, ব্রেক কা বাদ।
মিলা খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর বলল, কিসের ব্রেক?
আগের প্রসঙ্গ। বল কী খাবে?
বললাম তো কিছু খাব না।
তুমি এমনিতেই অত্যন্ত স্লিম, এট্রাকটিভ ফিগারের, তোমার ডায়েট করবার কোনও দরকার নেই।
আরে ধুৎ ওসব ডায়েট ফায়েট আমি করি না।
তাহলে বল, কী খাবে? ভাত ছাড়া।
আপনি কি সারাদিন এখানে থাকবেন?
তীক্ষ্ণচোখে মিলার মুখের দিকে তাকাল জয়। কেন বল তো?
এমনি।
আমার মনে হয় কারণ আছে।
কী কারণ?
তুমি কি চাইছো আমি তোমার সঙ্গে বেরুই। তারপর কোথাও কিছু খেয়ে, মানে কোথাও ফাস্টফুডের দোকান থেকে কিংবা কোনও চায়নিজ রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ করে তোমাদের বাড়ির কাছাকাছি কোথাও তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি!
না আমি এরকম ভাবিনি।
তাহলে ঠিক আছে।
তারপর নিজেই খাবারের ডিসিশানটা নিল জয়। এখন আর ফান নয়, আমি সিরিয়াসলি বলছি।
মিলা সঙ্গে সঙ্গে বলল, বলুন। আমিও সিরিয়াসলি শুনছি।
তুমি যদি সত্যি সত্যি ভাত খেতে চাও, আমি আনাতে পারি। উত্তরায় এখন সব ব্যবস্থা আছে। সুন্দর সুন্দর ভাতের হোটেল আছে। ভাত মাছ মাংস সবজি ডাল, চাইলে সবই তোমাকে আমি আনিয়ে দিতে পারি। আমার রুমে প্লেট গ্লাস ফ্রেসপানি চামচ সবই আছে। অর্থাৎ ভাল ব্যবস্থা।
কিন্তু ভাত এখানে আমি খাব না।
শুনে খুশি হলাম।
কেন?
তুমি ভাত খেলে, তোমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য ভদ্রতা করে আমাকেও খেতে হতো। এখন তাহলে একটা কাজ করি, চিকেন বার্গার আর ভার্জিনকোলা আনাই, বেশ স্মার্ট খাবার…।
জয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই মিলা বলল, কিন্তু আমার একদম খিদে পাচ্ছে না। আপনি শুধু আপনার জন্য আনান।
জয় গম্ভীর হলো। বাজে কথা বলো না। দুপুর হয়ে গেছে, খিদে পাবে না কেন তোমার?
মিলা বুঝল খেতে তাকে হবেই। বলল, কিন্তু আনবে কে?
লোক আছে। কোনও অসুবিধা নেই। তুমি স্রেফ দুটো মিনিট বসবে, আমি লোক পাঠিয়ে আসছি।
সত্যি সত্যি দেড় দুমিনিটে ফিরে এল জয়। মুখে সুন্দর হাসি।
মিলা বলল, ব্রেক কা বাদ কিন্তু শেষ। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
জয় কী রকম উদাস এবং আনমনা হলো। সামান্য সময় কিছু ভাবল। তারপর বলল, তোমার সব কথার উত্তরই আজ পেয়ে যাবে। মানে যা যা জানতে চাইবে তুমি। তোমার মনে যা যা আছে।
একটা একটা করে প্রশ্ন করব?
সিওর।
প্রথমে তাহলে ওই প্রশ্নটার উত্তর দিন।
আমি তোমাকে প্রপোজ করেছিলাম ওটা ফান কী না?
হ্যাঁ।
এই প্রশ্নটার উত্তর দেব সবার শেষে।
কেন?
এমনি।
উত্তরটা কিন্তু আমি জানি।
আমিও জানি।
মিলা অবাক হলো, ওমা, আপনি তো জানবেনই।
জয় শব্দ করে হাসল। তোমার এই অবাক হওয়াটা দেখার জন্য এভাবে বললাম।
ইস আপনি সারাক্ষণ কীভাবে যে এত মজা করেন!
এবার প্রশ্নগুলো করতে থাকো।
মিলা আচমকা বলল, সুমির সঙ্গে আপনার কী হয়েছিল?
প্রেম, প্রেম হয়েছিল।
আমি তো তাই জানতাম। এনিওয়ে, কীভাবে হয়েছিল বলবেন আমাকে?
সুমি তোমাকে বলেনি?
কিছুটা বলেছে।
কিছুটা কেন বলবে? তুমি হচ্ছো সুমির এক নাম্বার বন্ধু। তোমাকে তার সবই বলার কথা। এবং আমাকে সে বলেছে, আমাদের কথা তুমি সব জানো। অর্থাৎ তোমাকে সে সব বলেছে।
কী কী বলেছে শুনবেন?
বল।
আপনাদের পরিচয় হয়েছিল টেলিফোনে।
হ্যাঁ। ওর এক মামাতো ভাইয়ের কাছ থেকে নাম্বারটা আমি পেয়েছিলাম।
কিন্তু মামাতো ভাইটাকে আপনি চেনেন না।
রাইট। সে আমার চেনা পরিচিত কেউ নয়। আসলে সুমিকে ফোন করার ব্যাপারটাও ছিল একটা ফান। আমার যা স্বভাব আর কি? ধানমন্ডিতে একটা ফোন ফ্যাক্সের দোকান করেছে আমার বন্ধু বাবু। বাবুর দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছি, একটা ছেলে এল ফোন করতে। আমাদের বয়সীই হবে। নাম্বারটা সে বলল। বাবুর সামনে একটা সাদা খাতা। খাতায় চট করে নাম্বারটা সে লিখল। লিখে ফোন ডায়াল করল। করে ছেলেটাকে ধরিয়ে দিল। ছেলেটা বলল, কে? সুমি? আমি বাদশা। কোন বাদশা মানে? তোর মামাতো ভাই।
তার মানে সুমি প্রথমে তার মামাতো ভাইকে চিনতেই পারেনি। সুমির অবশ্য এরকম একটা স্বভাব আছে। চট করে অনেক চেনা মানুষকেও চিনতে পারে না সে।
এই স্বভাবটার কথা আমি অবশ্য জানি না। যাহোক, শোন। আমি তারপর ভাবলাম, অকারণেই ভাবলাম, সুমি তো তার মামাতো ভাইকেই চিনতে পারেনি, দেখি তত অন্য কেউ মামাতো ভাই সেজে ফোন করলে সে কী করে? কিন্তু আমার বন্ধু বাবু খুবই কঠিন টাইপের জিনিস। চাইলে খাতায় লিখে রাখা সুমির নাম্বার আমাকে কিছুতেই দেবে না।
কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না, নাম্বারটা সে খাতায় লিখে রাখল কেন?
জয় হাসল। কোনও কারণ নেই। কেউ এই ধরনের দোকানে এসে যদি বলে ভাই আমি একটা ফোন করব, সাধারণত দোকানের লোকরা বলে, নাম্বারটা বলুন ডায়াল করে দিচ্ছি।
ও এই কারণ?
না আর একটা কারণও আছে।
কী?
এইভাবে নাম্বারটা লিখে রাখলে সারাদিনে কতগুলি ফোন করা হলো তার একটা হিসেব থাকে। বিজনেসের হিসাব মেলাতে সুবিধে হয়।
মুখের মজাদার একটা ভঙ্গি করল মিলা। বুঝেছি। কিন্তু ওই খাতা থেকে কোনও নাম্বার চাইলে আপনার বন্ধু আপনাকে দেবে না কেন?
নীতিগতভাবেই তো দেয়া উচিত না। কারণ ওটা বাবুর বিজনেস। তার ওখান থেকে নাম্বার নিয়ে কেউ যদি কাউকে ডিস্টার্ব করে!
তা ঠিক।
কিন্তু সুমির নাম্বারটা আমি পেয়ে গেলাম বেশ সহজ একটা কায়দায়। ওর মামাতো ভাই যখন ফোন করে প্রথমদিককার দুতিনটে নাম্বার আমি মনে রেখেছিলাম। হঠাৎ করে বাবুকে বললাম, দেখি তোর খাতাটা, আজ কতগুলো ফোন হলো? বিজেনেস কেমন হলো? বাবু খুবই উৎসাহ নিয়ে খাতাটা আমাকে দিল। সুমির নাম্বারটা আমি মুখস্ত করে ফেললাম। বাবু কিছু বুঝতেই পারল না। সেদিনই বিকেলবেলা সুমিকে ফোন করলাম। ভাগ্য কী রকম ভাল দেখ, সুমিই ফোন ধরল। বললাম, হ্যালো, সুমি আছে? সুমি বলল, বলছি। আপনি কে? সুমির গলার স্বর এবং কথা বলার ধরন আমার এত ভাল লাগল, আমি কিন্তু আর কোনও চালাকি করলাম না। পরিষ্কার বললাম, কীভাবে ওর নাম্বার পেয়েছি এবং ফোনটা ওর মামাতো ভাই সেজে ফান করার জন্য করেছিলাম, কিন্তু সুমির গলা এবং কথা বলার ধরন এত ভাল লাগল যে তার সঙ্গে ফান করতে ইচ্ছে করছে না। আমার কথা শুনে সুমি একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। কী বলছেন আপনি? এইভাবে অচেনা কারও সঙ্গে কেউ ফান করে? আপনি তো অদ্ভুত মানুষ!
জয় একটু থামল। এইভাবে শুরু হয়েছিল আমাদের।
মিলা কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজায় কে নক করল। উঠে দরজা খুলল জয়। শপিংব্যাগে বার্গার এবং ভার্জিনকোলা দিয়ে গেল অল্প বয়েসি একটা ছেলে। সে এই বাড়ির কাজের একজন লেবার।
খাবারের প্যাকেট মিলার সামনে ছোট্ট টিপয়ের ওপর নামিয়ে রাখল জয়। বলল, চল আগে খেয়ে নিই। আমার খুব খিদে পেয়েছে।
মিলা সঙ্গে সঙ্গে একটা বার্গার এবং ভার্জিনকোলা বের করে জয়ের হাতে দিল। আপনি খান।
আমি একা খাব কেন? তুমিও খাও।
খাচ্ছি।
বলে মিলাও তার প্যাকেট খুলল।
খেতে খেতে জয় বলল, তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের কথা হয়। কখনও আমি ফোন করি, কখনও সুমি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হয়। কারণ আমাদের দুজনার কারও তেমন কোনও কাজ নেই। আমি মাস্টার্স করে বসে আছি। চাকরি বাকরি করতে চাইলাম। বাবা বললেন দরকার নেই। আগে বাড়িটা তৈরি কর তারপর বিজনেসে লাগিয়ে দেব। সুমি বিএ পাস করেছে, মাস্টার্সে ভর্তি হবে। দুজনের হাতেই অনেক সময়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার কী জানো, কথা বলতে বলতে নিজেদের অজান্তে কখন যে আমরা পরস্পরকে তুমি করে বলতে শুরু করেছি, পরস্পরকে ভালবেসে ফেলেছি, পরস্পরের প্রতিটি খুটিনাটি বিষয় শেয়ার করতে শুরু করেছি, টেরই পাইনি।
তখনও আপনারা কেউ কাউকে দেখেননি।
হ্যাঁ।
এটাই সবচে আশ্চর্যের ঘটনা।
সত্যি। খুবই আশ্চর্যের ঘটনা।
বার্গার শেষ করে ভার্জিনকোলা খুলল জয়। চুমুক দিল। কিন্তু ততদিনে ভালবাসার কথা সবই আমাদের হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে যখন দুজন দুজনকে দেখার জন্য অস্থির তখন সুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে এল তোমাকে নিয়ে।
ওই তো গুলশানের সেই রেস্টুরেন্টে। কিন্তু সুমিকে দেখে আপনার ভাল লাগল না।
চোখ তুলে মিলার দিকে তাকাল জয়। কে বলেছে তোমাকে?
আমি জানি। আমার মনে হয়েছিল সুমির চে’ আপনি আমাকে বেশি লাইক করেছেন। এজন্য সুমির সামনেই আমার ফোন নাম্বার চাইলেন। তারপর ফোন করে আমাকে প্রপোজ করলেন।
প্রপোজ করলাম মানে কী? তোমাকে বললাম, তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। তুমি সুমির চে’ বেশি সুন্দর এবং স্মার্ট। তুমি চাইলে সুমিকে বাদ দিয়ে আমি তোমার সঙ্গে প্রেম করব।
এটা প্রপোজ করা না?
এক অর্থে তো অবশ্যই।
কিন্তু আপনার কি মনে হয়নি কথাটা আমি সুমিকে বলে দেব?
না মনে হয়নি।
কেন?
আমার দিকে তোমার তাকানো ইত্যাদি দেখে আমার মনে হয়েছিল আমাকেও বোধহয় তোমার ভাল লেগেছে।
তা কিন্তু ঠিক। আপনাকে আমার ভাল লেগেছে।
এজন্যই মনে হয়েছে সুমিকে তুমি বলবে না।
আমি কিন্তু সুমিকে বলে দিয়েছিলাম।
আমি জানি। যেদিন তুমি বলেছ সেদিনই সুমি আমাকে সব জানিয়েছে। এবং আমার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করেছে। আমাকে আর ফোন করে না, আমি ফোন করলে রিসিভ করে না। কখনও যদি ফোন ধরে, আমার গলা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রেখে দেয়।
এটাই তো উচিত। সুমির জায়গায় আপনি হলেও তো তাই করতেন।
হয়তো করতাম। কিন্তু আজ তোমাকে আমি আসল কথাটা বলি, তোমাকে ফোন করে প্রপোজ ইত্যাদি করা বা তোমার সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা, পুরোটাই কিন্তু ফান ছিল।
মিলা একেবারে থতমত খেয়ে গেল। ফান ছিল মানে?
আমি এক ধরনের মজা করার জন্য ওভাবে বলেছিলাম তোমাকে। দেখতে চেয়েছিলাম ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়। তুমি সত্যি সত্যি আমার প্রতি দুর্বল হও কী না। নিজেকে দিয়ে দেখতে চাইলাম, মানুষের মত বদলায় কী না। ভালবাসার ক্ষেত্র বদলায় কি না।
কী দেখলেন?
বদলায়।
হ্যাঁ। আমিও তাই মনে করি।
বদলায় বলেই সুমি যখন আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল আমি তোমাকে ফোন করতে শুরু করলাম। তোমার সঙ্গে আলাদা করে দেখা টেখাও হলো।
আর আমার কী হলো জানেন? সুমির ওপর খুব রাগ হলো যখন সে আমাকে ব্লেম দিল।
কী ব্লেম?
বলল নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রশ্রয় দিয়েছি। নয়তো আপনি নাকি প্রপোজ করার সাহস পেতেন না। শুনে এত মেজাজ খারাপ হলো আমার। ডিসাইড করলাম সুমির সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখব না এবং আপনার সঙ্গে সম্পর্ক করব।
এবং তাই করতে লাগলে?
হ্যাঁ।
কোন ফাঁকে দুজনেরই খাওয়া শেষ। বাগারের খালি প্যাকেট এবং ভার্জিনকোলার শূন্য টিন ঘরের কোণে একটা বাক্সেটে ফেলে দিল জয়। দেখে মিলা বলল, আপনি খুব গুছালো ধরনের।
কিন্তু জীবনের আসল জায়গাটাই অগোছালো করে ফেলেছি।
কীভাবে?
ছেলেমানুষি করে।
আপনার কথা আমি বুঝতে পারিনি।
এই যে সুমিকে নিয়ে, তোমাকে নিয়ে যা করলাম।
হ্যাঁ এটা আসলে ছেলেমানুষিই।
তুমিও তো আমার সঙ্গে তাল দিয়ে গেলে! তোমার তো উচিত ছিল আমাদের দুজনার সমস্যাটা মিটিয়ে দেয়া।
কীভাবে?
প্রেমিক প্রেমিকার ভুল বোঝাবুঝি হলে মাঝখানে যে বন্ধু থাকে সে তা মিটিয়ে দেয় না?
কিন্তু সমস্যা তো সেই বন্ধুটাকে নিয়েই!
তা ঠিক। জয়ের চোখের দিকে তাকাল মিলা। আপনাকে একটা প্রশ্ন করব?
সিওর।
আজ কিন্তু কোনও ফান করবেন না। পরিষ্কার জবাব দেবেন।
ঠিক আছে।
আপনি কি সত্যি সুমিকে ভালবাসতেন?
জয়ও মিলার চোখের দিকে তাকাল। বাসতাম না, এখনও বাসি।
কিন্তু আপনি যে বলেছেন আমি সুমির চে’ বেশি সুন্দর, বেশি স্মার্ট?
সেটাও সত্যি। সত্যি তুমি সুমির চে’ অনেক বেশি সুন্দর এবং স্মার্ট। কিন্তু সৌন্দর্য এবং স্মার্টনেসের সঙ্গে প্রেমের কোনও সম্পর্ক নেই। পৃথিবীতে অনেক সুন্দরী এবং স্মার্ট মেয়ে আছে কিন্তু তারা আমার প্রেমিকা নয়। তাদেরকে আমি ভালবাসি না। আমি ভালবাসি সুমিকে।
মিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কথাটা আরও আগে বললে পারতেন।
কী হতো তাহলে?
এই জটিলতাগুলো তৈরি হতো না।
সুমিকে আমি বলতে চেয়েছি। নানারকমভাবে চেষ্টা করেছি কিন্তু সে আমার সঙ্গে কথাই বলে না। আমার ফোন রিসিভই করে না।
মিলা আবার জয়ের চোখের দিকে তাকাল। বুঝলাম। আর আমার ব্যাপারটা?
জয় হাসল। তোমার আবার কোন ব্যাপার?
এই যে যখন তখন আমাকে ফোন করা, আজ নিয়ে চারবার দেখা হলো। এত রোমান্টিক কথাবার্তা বললেন। এরকম নিভৃত ঘরে বসে আছি আমরা। দুজন।
আসলে তোমাকে আমি আমার বন্ধু ভেবেছি। সুমির এত ভাল বন্ধু তুমি, ভেবেছি আমারও বন্ধু হবে তুমি।
আমিও তাই হতে চেয়েছিলাম। কিন্ত…।
কী?
কোথায় যেন অন্যরকম কী একটা হতে চলেছে।
ওসব কিছু না। মন থেকে সব ঝেড়ে ফেল। ভাব আমরা দুজন বন্ধু, স্রেফ বন্ধু। ভাল বন্ধু।
আমার মনে হয় সেটা ভাবাই ভাল।
তারপর মিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
জয় বলল, কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না সুমিকে আমি কেমন করে ফিরে পাব?
মিলা উঠল। চেষ্টা করুন। নিশ্চয় পেয়ে যাবেন।
মিলাকে উঠতে দেখে জয়ও উঠল। তোমাকে কি একটা স্কুটার ডেকে দেব?
ভাল হয়।
যে ছেলেটা খাবার এনেছিল তাকেই স্কুটার ডাকতে পাঠালো জয়।
স্কুটার আসার পর, স্কুটারে চড়ার আগে মিলা বলল, আপনি সত্যি খুব ভাল।
জয় হাসল। কেন এটা বলছ?
টেলিফোনে কত রকমের কথা আপনার সঙ্গে হয়েছে। প্রেম, ভালবাসা, চুমু, কত রকমের কথা বলেছেন। অথচ আজ এতটা নিভৃতে পেয়ে আপনি আমার হাতটাও ধরেননি। কোনও না কোনওভাবে আমার ওপর কোনও চান্স নেননি। ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেননি।
তা আমি কেন করব, বলো। আমার সব স্পর্শ আমি সুমির জন্য তুলে রেখেছি।