৪. জগতের ধারণা এবং সৃষ্টির কাহিনী

চতুর্থ অধ্যায় —জগতের ধারণা এবং সৃষ্টির কাহিনী

সৃষ্টির আদিকথা

সৃষ্টির আদিতে কিছুই ছিল না। না ছিল পৃথিবী, না ছিল স্বৰ্গ, না ছিল আকাশ, না ছিল নক্ষত্ররাজি। নিঃসীম শূন্যতার মাঝে বরফের কুয়াশা আর আগুনের অস্তিত্ব ছিল শুধু।

উত্তরে ছিল নিফেলহাইম— এই জগত বরফের চেয়েও শীতল, হিমের চেয়েও হিম। সর্বক্ষণ এক গহন কালো কাদামাখা কুয়াশা নিফেলহাইমকে ঢেকে থাকে। সেই কুয়াশায় আকাশ মাটি কিছু দেখা যায় না— এক ঘন অন্ধকারের রাজত্ব। এই জগতে একটি বিশাল কূপ আছে, তার নাম ভারগেল্মির। সেই কূপ থেকে এগারোটি বিষাক্ত বরফের নদী বেরিয়েছে। তারপর সেগুলি নিফেলহাইমের শেষ অবধি গিয়ে অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছে।

দক্ষিণে ছিল মুসপেলহাইম— সেখানে আগুনের রাজত্ব। সমস্ত কিছুই সেখানে উজ্জ্বল, সবকিছুই জ্বলছে। নিফেলহাইমের একদম বিপরীত এই জগত। যেখানে নিফেলহাইমে অন্ধকারের রাজত্ব—এখানে আলো। নিফেলহাইমে শীতলতার রাজত্ব আর মুসপেলে আগুনের রাজত্ব। কামারশালায় যেমন গনগনে আগুন জ্বলে, মুসপেলহাইমেও সেইরকম আগুন জ্বলে সর্বদা। কোথাও কোন কঠিন ভুমির লেশ নেই, সবটাই গলছে। প্রচন্ড উত্তাপে ক্রমাগত পাথর গলছে আর আগুন ছিটকাচ্ছে। মুসপেলহাইমে যেন এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির অভ্যন্তর।

এই মুসপেলের একদম শেষপ্রান্তে থাকেন আগুন দানব সুর্তর। তিনি দেবতাদেরও আগে থেকে সেখানে রয়েছেন এবং র‍্যাগনারকের পরেও থাকবেন। তাঁর হাতে রয়েছে এক জ্বলন্ত তরবারি। নর্স ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী যখন বিশ্বের অন্ত হবে র‍্যাগনারক নামক অন্তিম যুদ্ধে— তখন তিনি বেরিয়ে আসবেন তাঁর জগত মুসপেলহাইম থেকে। জ্বলন্ত তরবারির আঘাতে সবকিছু তছনছ করে দেবেন তিনি; সমস্ত জগত সংসার আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেবেন।

মুসপেলহাইম আর নিফেলহাইমের মাঝে রয়েছে এক বিরাট ফাঁকা জায়গা, এক বিরাট শূন্য— কোনো আকৃতি নেই সেই অসীম শূন্যতার। নিফেলহাইমের নদীগুলি এই ফাঁকা জায়গায় বিলীন হয়েছে। এই ফাঁকা বিরাট শূন্যের নাম হল গিনুনগাগ্যাপ। নর্সভাষার এই শব্দের মানে হল, হাই তোলার মত শূন্যতা। এসব তখনকার কথা, যখন সময়ের কোনো হিসাব ছিল না। প্রাচীন সেই সময়ে এই ফাঁকা জায়গায় উত্তর থেকে হিমেল হাওয়া আর কুয়াশা এবং দক্ষিণ থেকে উষ্ণতার হাওয়া এসে একটা অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক জায়গার সৃষ্টি করেছিল। কতদিন ধরে এমন চলেছিল জানা নেই, তবে এভাবে যখন বরফকে আগুন গলিয়ে দিল তখন প্রচুর জলের সৃষ্টি হল, আর সেই জল থেকে সৃষ্টি হল প্রথম জীবনের। এক বিরাট দানব, তাঁর নাম য়িমির, তিনি জন্ম নিলেন সেই জল থেকে। য়িমির পুরুষ ছিলেন না, নারীও নন, বরং দুইই।

এই জীবই ছিলেন সকল দানবদের পূর্বপুরুষ।

রিমিরই যে একমাত্র জীব তা কিন্তু নয়। একটা দৈত্যাকায় শিংবিহীন গরুও সেই গলন্ত বরফ থেকে জন্মেছিল। সে নুনেভরা বরফের ঢিপি চাটত আর তার দুধ খেয়েই য়িমির প্রাণধারণ করেছিলেন। সেই দুধ খেয়ে তিনি দিনে দিনে আরো দ্রুত বিশাল হচ্ছিলেন। সেই গরুর নাম অদুমরা।

একদিন সেই গরু নোনা বরফের ঢিপি চাটছে, পেলো কিছু সোনালি চুল। পরের দিন একজন পুরুষের মাথা, তার পরের দিন একজন আস্ত মানুষ বেরিয়ে এলেন সেই ঢিপি থেকে। তাঁর নাম বুরি, তিনি দেবতাদের পুর্বপুরুষ। (একটি মতে, বরফের ঢিপিকে চেটেচেটে বুরির রূপ দিয়েছিল অদুমরা)।

য়িমির যখন ঘুমোচ্ছিলেন তখন তাঁর দুই হাত থেকে দুইজন দানবের সৃষ্টি হয়, একজন নারী এবং অন্যজন পুরুষ। এবং তাঁর দুই পা থেকে একজন ছয় মাথাওয়ালা দানবের জন্ম হয়। এরাই

য়িমিরের ছেলেমেয়ে। এরা দ্রুত বংশবিস্তার করে এবং কিছুদিনের মধ্যেই সংখ্যায় অনেক বেড়ে যায়। এদের মধ্যে থেকেই একজনকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেন বুরি। (অন্য একটি মতানুযায়ী বুরিও য়িমিরের মত স্বয়ং সন্তান উৎপাদন করেছিলেন)। তাঁর একটি সন্তান হয়, তাঁর নাম বোর। এই বোর একজন দানবকন্যা বেসলাকে বিবাহ করেন। বোর এবং বেসলার তিন পুত্র সন্তানের নাম, ওডিন, ভিলি এবং ভে। এছাড়াও বোর এবং বেসলা জগতবৃক্ষ ইগড্রাসিলকে রোপণ করেন। এই বৃক্ষের কথা বিস্তারিতভাবে পরের অনুচ্ছেদে আছে।

ওডিন, ভিলি এবং ভে— এই তিনজন বড় হয়ে উঠলেন। তাঁরা দেখলেন উত্তরে বরফের রাজত্ব আর দক্ষিণে আগুনের— দুইদিকের কোনো একদিকে গেলেই সাক্ষাৎ মৃত্যু। আর মাঝে দৈত্যদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এমন চলতে থাকলে কিছুদিন পরে কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না। এই গিনুনগাগ্যাপে সমুদ্র, বালি, ঘাস, পাথর, মাটি, গাছ, আকাশ, তারা কিছুই নেই। কোনো জগত নেই, পৃথিবী বা স্বৰ্গ কিছু নেই। শুধুমাত্র একটা ফাঁকা জায়গা আছে। তখন তাঁদের মনে হল এই ফাঁকা জায়গায় বিশ্ব সৃষ্টি করা যাক। তারা পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করলেন, কীভাবে তারা সৃষ্টি করবেন সকল বিশ্বসংসার, বর্তমান এবং ভবিষ্যত।

ওডিন, ভিলি এবং ভে য়িমিরকে হত্যা করলেন। করতেই হত কারণ বিশ্বসৃষ্টির অন্য কোনো উপায় তাঁরা ভেবে পাননি। আশ্চর্যের বিষয়, সৃষ্টির শুরু হল মৃত্যু দিয়ে।

তাঁরা য়িমিরকে ছুরিকাঘাত করলেন। সমুদ্রের মত নোনা, গাঢ় ছাই রঙের রক্ত বেরিয়ে এলো বন্যার মত। সব দৈত্যরা সেই রক্তের বন্যায় ভেসে গেলেন, ডুবে গেলেন। শুধু বারগেলমির নামের একজন দানব ছিলেন। তিনি আর তাঁর বৌ দুইজনে বুদ্ধি করে একটা কাঠের বাক্সে লুকিয়েছিলেন— তাঁরা বেঁচে গেলেন। দানবদের পরবর্তী প্রজাতি এদের থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।

ওডিন এবং তাঁর ভাইরা য়িমিরের মাংস দিয়ে মাটি বানালেন। হাড়গুলি পাহাড়পর্বত হল। দাঁত দিয়ে বড়বড় পাথর তৈরি হল। যে সব হাড় ভেঙে গেছিল সেগুলিও পাথর হল। য়িমিরের মাথার খুলি দিয়ে তৈরি হল আকাশ। মুসপেলহাইমের আগুনের ফুলকি দিয়ে তৈরি হল অসংখ্য তারা। আর য়িমিরের ঘিলু দিয়ে তৈরি হল মেঘ।

পৃথিবী তৈরি হল একটা চাকতির মত, ইগড্রাসিলের একদম মাঝে। তার চারদিকে ঘিরে থাকল সমুদ্র। দানবরা যাতে আসতে না পারে তাই ওডিন, ভিলি আর ভে য়িমিরের চোখের পাতাগুলি দিয়ে একটা বিরাট পাঁচিল তৈরি করে দিলেন চারপাশে। এই ঘিরে দেওয়া যায়গার নাম হল মিডগার্ড— যাকে আমরা পৃথিবী বলি।

কিন্তু মিডগার্ড এক্কেবারে ফাঁকা। এত কষ্ট করে সবকিছু বানানো হল কিন্তু সেখানে কেউ থাকে না। কেউ মাঠে ঘুরে বেড়ায় না, কেউ মাছ ধরে না, কেউ পাহাড়ে ওঠে না। কেউ শিকার করে না, প্রকৃতির রূপ দেখে মুগ্ধ হয় না বা জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে ভেসে বেড়ায় না। ওডিন, ভিলি আর ভে জানতেন যতক্ষণ না এখানে কেউ বসবাস করবে, ততক্ষণ এটা সাৰ্থক পৃথিবী হয়ে উঠবে না। তাঁরা চারদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন কিন্তু কোনো উপযুক্ত প্রাণীর দেখা পেলেন না।

একদিন তাঁরা সমুদ্রের চারদিকে ঘুরছেন, এমন সময় দেখলেন— দুটো কাঠের টুকরো সমুদ্রে ভেসে তীরে এসে পড়েছে। প্রথমটা অ্যাশ গাছের টুকরো। অ্যাশ গাছের সহ্য ক্ষমতা বেশি, আর সুন্দর সুঠাম দেখতে, তার শিকড় অনেক গভীর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। এই গাছের কাঠ দিয়ে সুন্দর ভাবে আসবাব বানানো যায়, কোনোভাবেই এটা ভেঙে যায় না। অ্যাশ গাছ দিয়ে কোনো অস্ত্রের হাতল বা বর্শার লম্বা লাঠিও বানানো যায় সহজেই।

দ্বিতীয় যে টুকরোটি তাঁরা খুঁজে পেলেন, সেটা এল্ম গাছের। এল্ম গাছ সুন্দরী আর সঙ্গে শক্তপোক্ত। একটা ঘর বা হলঘর অনায়াসে বানানো যায় এল্ম গাছ দিয়ে।

দেবতারা কাঠের টুকরো দুটো তুলে নিয়ে বালিতে অর্ধেক পুঁতে দিলেন। ওডিন তারপর তাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করলেন। ভিলি তাঁদের ইচ্ছাশক্তি দিলেন, দিলেন বুদ্ধিমত্বা আর কাজ করার ইচ্ছা। তাঁরা এখন নড়তে পারেন, চাইতে পারেন। ভে তারপর দিলেন তাঁদের আকার। কান বানালেন, তারা শুনতে পারলো তখন। চোখ দিলেন, তারা দেখতে পারলো। ঠোঁট দিলেন, যাতে তারা কথা বলতে পারে। এছাড়াও ভে অ্যাশ গাছের টুকরোটিকে দিলেন পুরুষের আদল আর এল্ম গাছটিকে নারীর আদল।

এরপর তিন দেবতা দিলেন তাদের বস্ত্র, তারপর দিলেন নাম। অ্যাশ গাছ থেকে হয়েছে বলে পুরুষটির নাম হল আস্ক আর এল্ম গাছ থেকে আসা নারীটির নাম এমরা।

এমব্লা আর আস্ক থেকেই সমগ্র মানবজাতির সৃষ্টি হল; আর ওডিন তাঁদের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন বলেই তাঁকে অল—ফাদার বা সর্ব-পিতা বলা হয়।

ইগড্রাসিল বা বিশ্ব-বৃক্ষ

ইগড্রাসিল বা বিশ্ব-বৃক্ষ

ইগড্রাসিল

বোর আর বেসলা যে বিশ্ববৃক্ষ রোপন করেছিলেন সেটা হল একটা অ্যাশ গাছ, সবথেকে সুন্দর দেখতে এবং সবার থেকে বিশাল — এরই নাম ইগড্রাসিল। এটা নয়টি জগতের মাঝে গড়ে উঠেছে এবং তাদের ধরে রেখেছে। এই নয়টি জগতের মধ্যেকার যোগাযোগের মাধ্যমও এই গাছ।

ইগড্রাসিলের সর্বোচ্চ শাখায় একটা বিরাট ঈগল থাকে। সেই ঈগল এতই বিরাট যে তার দুই চোখের মাঝের জায়গায় বাসা করেছে এক বাজপাখি। এই ঈগল সর্বোচ্চ জায়গা থেকে সবকিছু দেখতে পায়— বিশ্বের অনেক রহস্যই তার জানা।

ইগড্রাসিলের ডালে এক ইঁদুর থাকে— তার নাম রাটাটোস্ক। সে এই মহা ঈগল আর সেই ড্রাগন নিডহগের মধ্যে সংবাদ নিয়ে যাওয়া আসা করে। সে কিন্তু সব সংবাদের মধ্যেই খানিকটা করে নিন্দা আর পরচর্চা মিশিয়ে দেয়। সংবাদকে বিকৃত করে মুখরোচক করাতেই তার আনন্দ।

ইগড্রাসিলের সবথেকে উঁচু ডালপালায় চারটি হরিণ চরে বেড়ায়, তাদের নাম ডাইন, ভ্যালিন, ডুনেয়ার আর ডুরাথ্রর। এরা ইগড্রাসিলের পাতা খায়। এছাড়াও গাছের মূলের কাছে অগণিত সাপ রয়েছে, যারা সারাক্ষণ শিকড়ে কামড় বসিয়ে চলেছে গাছটির ক্ষতি করার জন্য।

এই গাছ থেকেই ওডিন নয় দিন নয় রাত ঝুলে ছিলেন, নিজের কাছে নিজেকেই বলি দিয়েছিলেন। এই জন্য এই গাছকে ফাঁসিকাঠ বলেও অভিহিত করা হয়। তাই ওডিন আবার ফাঁসিকাঠেরও দেবতা।

ইগড্রাসিল গাছে চড়া যায়, তবে দেবতারা চড়েন না। তাঁরা বাইফ্রস্ট নামে একটা রামধনুর সেতু বানিয়ে নিয়েছেন০০ সেখান দিয়েই চলাফেরা করেন বিভিন্ন জগতের মাঝে (বিশেষত অ্যাসগার্ড থেকে মিডগার্ডে)। সেই সেতুতে দেবতা ছাড়া আর কেউ চড়তে পারে না। ট্রল বা দৈত্যরা চড়ার চেষ্টা করলেই তাদের পা পুড়ে যায়। অবশ্য দেবতাদের অনুমতিসাপেক্ষে অন্য জাতির কেউ এই সেতুতে চলাফেরা করতে পারে।

ইগড্রাসিলের মধ্যে যে নয়টি জগত আছে সেগুলি হল

অ্যাসগার্ড— যেখানে অ্যাসির গোত্রের দেবতারা বাস করেন। এখানেই সর্বোচ্চ এক রাজাসনে দেবতাদের সম্রাট ওডিন বসে থাকেন।

এল্ফহাইম— এখানে লাইট এল্ফরা বাস করেন। তাঁরা অত্যন্ত ফরসা এবং সুন্দর দেখতে।

স্প্যাতেলহাইম— এখানে ডোয়ার্ফ বা ডার্ক এদের বসবাস। তাঁরা পাহাড়ের নিচে বাস করেন এবং তাঁদের বৈশিষ্ট্য হল এঁদের অসামান্য কারিগরি বিদ্যা।

মিডগার্ড— আমরা পৃথিবীর মানুষরা যেখানে বাস করি সেটা মিডগার্ড। নর্স মিথ অনুযায়ী মিডগার্ড একটা চ্যাপ্টা জায়গা, যার চারপাশ সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত; সমুদ্রের পরে রিমিরের অক্ষিপল্লব দিয়ে বেড়া দেওয়া আছে।

য়োটুনহাইম—বরফ এবং পর্বতদানবদের বাসস্থান। এছাড়াও অন্যান্য প্রকার দানবদের অনেকেই এখানে বাস করেন।

ভ্যানাহাইম— যেখানে ভানির গোত্রের দেবতারা বাস করেন। ভানির এবং অ্যাসির গোত্রের দেবতারা পরস্পরের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ। এমনকি কিছু ভানির দেবতা এমনও আছেন যারা অ্যাসগার্ডে থাকেন।

নিফেলহাইম— এর কথা আগেই বলা হয়েছে। বরফ দিয়ে ঘেরা, অন্ধকার কুয়াশার জগত।

মুসপেলহাইম— আগুনের রাজত্ব এখানে। এখানকার রাজা হলেন সুতর।

হেলহাইম— এই জগতের রানী হলেন হেল, যার কথা আমরা পরে আরো বিস্তারিত জানব। যে সকল মানুষের মৃত্যু যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মত হয়নি; সাধারণ ভাবে, রোগে বা দুর্ঘটনায় পড়ে মারা গেছেন যাঁরা— তাঁরা সকলেই মৃত্যুর পর হেলহাইমে যান।

.

তিনটি কূপ থেকে এই বৃক্ষ জীবনধারণের জন্য জল পায়।

ইগড্রাসিলের প্রথম শিকড় চলে গেছে নিফেলহাইমের সেই বরফঢাকা নদীগুলির উৎসে, যার নাম ভারগেল্মির। সেই কূপে বাস করে এক ড্রাগন যার নাম নিডহগ, সে সর্বক্ষণ ইগড্রাসিলের সেই শিকড়কে খুঁড়ে চলে। দ্বিতীয় শিকড় চলে গেছে য়োটুনহাইমের এক কূপে। য়োটুনহাইম সকল দানবদের বাসস্থান। এই কূপের মালিক হলেন জ্ঞানী দৈত্য মিমির

তৃতীয় শিকড় চলে গেছে উর্ড নামক এক কূপের গভীরে। এই উর্ডের কাছে এক হলঘর আছে। সেই হলঘরে তিন নন বোন থাকেন। তাঁদের নাম—উর্দু, ভারলন্ডী আর স্কাল্ড। এই তিন বোন ওডিনের থেকেও বেশি জানেন। সবথেকে বড় বোন উর্ড— সে অতীতের সব কথা দেখতে পান, জানতে পারেন। ভারল্যান্ডি জানতে পারেন বর্তমানে কোথায় কী হচ্ছে— ন’টা জগতের সবকিছুর বর্তমান খবর রয়েছে তাঁর কাছে। আর স্কাল্ড সবথেকে ছোট বোন হয়েও সবথেকে বেশি জ্ঞানী কারণ তাঁর ক্ষমতা আছে ভবিষ্যৎ দেখার এবং জানার। এই ক্ষমতা স্বয়ং ওডিনেরও নেই।

নর্নরা ভাগ্য বুনে চলেন। যখন কোনো শিশুর জন্ম হয়, তখন নর্নরা তার কাছে আসেন আর বিভিন্ন উপহার দেন। কখনও সেই উপহার ভালো হয়, কখনও বা খারাপ। এর উপরে তার ভবিষ্যৎ জীবন নির্ভর করে। এই নর্নরা ইগড্রাসিলের রক্ষণাবেক্ষণও করেন। তাঁরা গাছটিতে নিয়মিত জল দেন, গাছটির শিকড়ে যাতে যথেষ্ট মাটি থাকে তার ব্যবস্থা করেন।

দানব নেকড়ে স্কল ও হাটি যথাক্রমে সূর্য ও চন্দ্রকে গিলে ফেলার জন্য ধাওয়া করেছে।

দানব নেকড়ে স্কল ও হাটি যথাক্রমে সূর্য ও চন্দ্রকে গিলে ফেলার জন্য ধাওয়া করেছে।

দিবা-নিশি সূর্য-চন্দ্ৰ

মানুষ সৃষ্টির পরে দেবতারা ভেবে দেখলেন, এই অন্ধকার মিডগার্ডে তাদের বাস করা বেশ কঠিন। তাই তখন তাঁরা সূর্য এবং চন্দ্র বানাবার খোঁজ শুরু করলেন সঙ্গে দিবস এবং রাত্রি সৃষ্টির কথাও ভাবলেন।

এই কাজ করার জন্য দেবতারা কিন্তু বেছে নিলেন দানবদেরই। প্রথমেই রাত্রি এলেন। তাঁর নাম নট, তিনি খুব সুন্দরী একজন দানবী। তাঁর মাথায় একরাশ ঘন কালো চকচকে চুল। নট তিনবার বিবাহ করেছেন— প্রথমবারে অড নামে এক দানবের সঙ্গে। অড শব্দের মানে অন্ধকার। এই দানবের ঔরসে তাঁর এক পুত্রসন্তান হয়— যার নাম স্পেস বা মহাকাশ। তারপর তিনি বিবাহ করেন অ্যানার নামক একজনের সঙ্গে। তিনি যে আদতে কী, সেই সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না। একটি মত অনুযায়ী অ্যানার শব্দের অর্থ আদার বা অন্য। এই স্বামীর ঔরসে তাঁর একটি কন্যা হয় — যার নাম আর্থ বা মৃত্তিকা। (এই আর্থ মানে পৃথিবী নয়, কারণ পৃথিবী হল মিডগার্ড)। কিছুদিন পরেই হঠাৎ করে অ্যানার অদৃশ্য হয়ে যান। তখন নট তৃতীয়বার বিবাহ করেন— এই স্বামীর নাম ড্যালার। ড্যালার শব্দের অর্থ ডন বা ভোর। ইনি সোনালী চুলওয়ালা একজন দানব ছিলেন। তৃতীয় স্বামীর ঔরসে নটের একটি পুত্রসন্তান হয়— তিনি অত্যন্ত ফর্সা এবং তাঁর চুল সাদা। শুধু তাই নয়, তিনি খুব উজ্জ্বল, তাই তাঁর নাম হয় ড্যাগর বা ডে অর্থাৎ দিবস। তখন দেবতারা ভাবলেন যে মানুষের দিনের চব্বিশ ঘন্টা সময়কে সমান দুইভাগে ভাগ করে নট এবং ড্যাগরকে দিয়ে দেওয়া হবে। দুইজনকেই দুটো রথ দেওয়া হল। একটি সাদা, একটি কালো। এবং চারটি করে ঘোড়াও দেওয়া হল। সেই ঘোড়াগুলি এত তাড়াতাড়ি ছুটতে পারে যে রথ আকাশে উড়ে চলে।

রাত্রি এবং দিবস যাতে একা একা সারাক্ষণ আকাশে চলতে চলতে বিরক্ত না হয়ে যান, তাই তাঁদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য দেবতারা চাঁদ এবং সূর্যকে সৃষ্টি করলেন। প্রথমে চন্দ্র সূর্য দুইজনেই আকাশে একসঙ্গে থাকতেন। তাঁদের একসঙ্গেই দেখা যেত। তাঁরা নড়তেন না। কিন্তু কিছুদিন পরে মুন্ডেলফেরি নামক এক দানবের দুই সন্তান হল— একটি পুত্র এবং একটি কন্যা। মুন্ডেলফেরি তাঁর সন্তানদের দেখে এতই খুশি হলেন যে ছেলেটির নাম রাখলেন মানি বা চন্দ্র, এবং মেয়ের নাম রাখলেন সল বা সুর্য। তিনি খুবই অহংকার করে বললেন তাঁর সন্তানদের মত উজ্জ্বল আর কেউ নেই। দেবতারা ক্ষুণ্ণ হলেন মুন্ডেলফেরির এই আত্মপ্রচার দেখে। তাঁকে শাস্তি দিতে, তাঁর কাছ থেকে তাঁর সন্তানদের কেড়ে নিলেন দেবতারা। তারপর সেই সন্তানদের এমন কার্য দিলেন, যার থেকে তাঁদের ছুটি নেই। সলকে দিলেন সুর্যের রথ টানার কাজ। আর মানি পেলেন চন্দ্রের রথ টানার ভার। দুইজনেই কিন্তু ভারী খুশি হলেন এই কাজ পেয়ে

এদের দেখে অন্য দানবদের খুব হিংসে হল, যে সল এবং মানি এত সম্মানজনক কাজ পেয়েছেন। তাই দুই দানব নেকড়েবাঘ, তাঁদের নাম স্কল (নামের অর্থ মকারি বা ঠাট্টা) এবং হাটি (নামের অর্থ হেট বা ঘৃণা); তাঁরা যথাক্রমে সল এবং মানিকে তাড়া করতে থাকলেন। স্কল এবং হাটি তাঁদের ধরে ফেললেই খেয়ে ফেলবেন তাই সল এবং মানি কখনোই এক জায়গায় থাকেন না— সবসময়ই চলতে থাকেন।

ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, র‍্যাগনারকের সময়ে অবশেষে সলকে গলাধঃকরণ করবে স্কল এবং মানিকে গিলে ফেলবে হাটি। একটি মত অনুযায়ী ফেনরির নেকড়ে (পরে এঁর সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে) গলাধঃকরণ করবে চন্দ্র-সূর্য। অন্য একটি মত অনুযায়ী স্কল এবং হাটি ফেরির নেকড়েরই বংশধর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *