৪. ছোট আঁকাবাঁকা গলি

গাড়িটা যেন শহর পেরিয়ে চলে আসে। রাস্তা ক্রমেই ছোট আঁকাবাঁকা গলি হয়ে ওঠে। হীরার নির্দেশেই এক জায়গায় গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা ঘিঞ্জি গলির মুখে, গাড়িটা দাঁড়ায়। হীরা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে, শুভাকে নিয়ে নামে। এদিকটা যেন নিশুতি। শীতও যেন এখানে বেশি।

গলির মধ্যে খানিকটা গিয়ে ডান দিকে বেঁকে কয়েক পা যেতেই, চোখের সামনে প্রকাণ্ড একটা দোতলা ভুতুড়ে বাড়ি দেখা যায়। অন্ধকার চারদিকে। আশেপাশে কিছু বস্তি, পোড় জমি, জঙ্গল ছড়ানো।

হীরা শুভকে নিয়ে সেই প্রকাণ্ড দোতলা ভুতুড়ে বাড়িটার দিকেই যায়। শুভার গাটা কী রকম ছমছম করে ওঠে। শুভা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। হীরা জিজ্ঞেস করে, কী হল?

কোথায় নিয়ে এলে এখানে?

এখানেই তো থাকি।

এটা তো একটা পোড়ো বাড়ি, কেউ নেই।

হীরা যেন একটু বিদ্রূপ করে জবাব দেয়, কলকাতায় আজকাল আবার পোড়ো বাড়ি বলে কিছু আছে নাকি? এ বাড়িতে ষোলো সতেরোটা ঘর আছে, প্রত্যেকটা ঘরে লোক থাকে।

কথা শেষ হতে না হতেই, শিশুর কান্না শোনা যায়। মায়ের কান্না থামানোর, সান্ত্বনা দেবার স্বর বেজে ওঠে। কোথায় যেন এক বৃদ্ধ কেশে ওঠে খক খক করে। হীরা শুভার হাত ধরে। বাড়িটার দরজাবিহীন সদর দিয়ে ঢোকে। সেকালের পুরনো বাড়ি। মাঝখানে উঠোন, চারপাশে ঘর। একটা ঘরে আলোর রেশ দেখা যায় জানালা দিয়ে।

হীরা বাঁ দিকের বারান্দায় উঠে, অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠে শুভাকে নিয়ে। পুরনো ইট আর শ্যাওলার গন্ধ লাগে শুভার নাকে। দোতলায় উঠে, একটা বাঁক নিয়ে, বারান্দার একদিকে এগিয়ে, একেবারে এক পাশে চলে যায়। আবার বাঁক নিয়ে, বাড়িটার বাইরের দিকের বারান্দার এক কোণে গিয়ে হীরা দাঁড়ায়। এদিকটায় একেবারে ভুতুড়ে নির্জনতা। একটা গাছের ঝুপসি ডাল এদিকেই হেলে পড়েছে।

হীরা পকেট থেকে ওর সেই যন্ত্রটা বের করে, তালা খোলে। ঘরে ঢুকে সুইচ টিপতে, একটা আলো জ্বলে। আলো এত কম যে, নরেশের আলোকিত ঘরের তুলনায় অন্ধকার বলে মনে হয়। লাল টিমটিমে আলো। ইলেকট্রিকের আলো যে এত কম হয়, শুভা জানত না। হীরার ডাকে শুভা ঘরে ঢোকে।

ঘরে আসবাব বলতে কিছুই নেই। একটা তক্তপোশ, তাতে একটা পাতলা ময়লা বিছানা, আর একটা পুরনো সেকালের কাঠের ভারী আলমারি। মনে হয়, বাড়িটার মতোই, এটাও পুরনো। হীরা দরজাটা বন্ধ করে, তক্তপোশের ওপর বসে পড়ে! বলে, নাও, রাত্তিরটা কোনওরকমে কাটিয়ে সকালবেলা দেশে চলে যেয়ো। সে সব আর আমি দেখতে যাব না। কিন্তু।

শুভা ফিরে তাকায়। হীরার সঙ্গে ওর চোখাচোখি হয়। হীরা বলে, খাবারগুলো তো তেজ করে ফেলে দিলে, এখন খাবে কী? দেখেই তো মনে হচ্ছে ধুকছু।

শুভা বললে, কোনও দরকার নেই।

 হীরার চোখ দুটো হঠাৎ বড় হয়ে ওঠে। দাঁড়িয়ে উঠে বলে, এ কী, তোমার কানের কাছে, ঘাড়ে রক্ত লেগে আছে।

শুভা আঁচল দিয়ে কান আর ঘাড়ের কাছে, আস্তে করে মুছে বলে, একটু লেগেছে।

হীরা জিজ্ঞেস করে, কামড়ে টামড়ে দেয়নি তো। যে রকম করছিল।

কথা শুনে লজ্জা করে ওঠে। ও চুপ করে তক্তপোশের ওপর গিয়ে এক পাশে বসে পড়ে। কিন্তু ও বিস্মিত উৎকর্ণ হয়ে, বারে বারেই কী যেন শুনতে থাকে। ওর মনে হয় কাছেই যেন কারা কথা বলছে। চুপিচুপি ফিসফিস করে কথা বলছে। ওর দৃষ্টি গিয়ে পড়ে, এ ঘরের আর একটা বন্ধ দরজার দিকে। হঠাৎ শুভার মনে পড়ে যায় একটা কথা। জিজ্ঞেস করে, তোমার যে ভাই-বোন আছে বলেছিলে?

বলেছি তো।

 কোথায় তারা?

হীরা উঠে দাঁড়ায়। বন্ধ দরজাটার গায়ে টোকা দিয়ে ডাকে, নমি–এই নমি।

দরজাটা দুই ডাকেই খুট করে খুলে যায়। ভিতরটা অন্ধকার, কিন্তু শুভা একটি মেয়ের মূর্তিকে দেখতে পায়। হীরা বলে, আলো জ্বাল তো। 

কথার সঙ্গে সঙ্গেই আলো জ্বলে ওঠে। এই ঘরের মতোই টিমটিমে রক্তিম আলো। সেই আলোয়, শুভা দেখতে পায়, দরজার কাছে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, বয়স কুড়িবাইশ হবে। অন্যদিকে দেওয়ালের কাছে, যেখানে সুইচ, সেখানে আর একটি মেয়ে, ষোলো সতেরো বছর বয়স হতে পারে। মেঝেয় পাতা ময়লা বিছানা। কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে আরও দুজন। মুখ দেখে মনে হয়, একটি ছেলের বয়স বারো-তেরো। আর একটি ছেলে আট-ন।

মেয়ে দুটি যে জেগেই ছিল, তাদের মুখ দেখেই বোঝা যায়। তাদের চোখে-মুখে বিস্মিত কৌতূহল, তীব্র অনুসন্ধিৎসা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। অথচ, যেন ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসিরও আভাস। দেখতে শুনতে মোটামুটি। হয়তো, ভালভাবে থাকতে পেলে, আরও ভাল লাগত। নিতান্ত সস্তা, বাড়িতে কাঁচা শাড়ি, জামাও সেই রকম। দুজনের কারুরই হাতে কাঁচের চুড়ি ছাড়া কিছুই নেই।

হীরা বলে, দেখে নাও, এরা আমার ভাই-বোন।

শুভা যেন এক নতুন জগতে চলে এসেছে। বহু দিনের ফেলে আসা একটা জগৎ, বা ওর পরিচিত, অথচ মনে করত, আর কোনও দিন এমন একটা জগৎ, ও আর দেখতে পাবে না। শুভা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। মেয়ে দুটির সঙ্গে ওর যতই দৃষ্টি বিনিময় হয়, ততই যেন ওদের মুখে চোখে হাসি ফুটতে থাকে। শুভার মুখ দিয়ে প্রথমেই বেরিয়ে আসে, তোমার মা নেই?

হীরা ঠোঁট উলটে বলে, নাঃ, সে পটল তুলেছে বছর পাঁচেক। সব আমার ঘাড়ে ফেলে, বুড়িটা সটকেছে।

দেওয়ালের দিকের ছোট মেয়েটি ফিক করে এক বার হেসে ওঠে, মুখে হাত চাপা দেয়। হীরা জিজ্ঞেস করে, হাঁরে নমি, কিছু আছে?

বড় মেয়েটি জবাবে বলে, খাবার?

হাঁ।

ছ-সাতটা রুটি আছে, আর কালকের সেই তরকারি একটুখানি।

 সে তো নষ্ট হয়ে গেছে।

না, শীতের দিন তো, রাত্রে গরম করেছিলাম।

তা হলে একে একটু দে, দ্যাখ খেতে পারে কি না।

শুভা বলে ওঠে, না, না, আমার দরকার নেই।

হীরা বলে, সে কথা তো অনেক বার শুনেছি। দেখ না, খেতে পার কি না। আর কানের কাছে রক্তটা ধুয়ে ফেলো গে! হ্যাঁরে সবি, ওদিকের বারান্দায় জল আছে তো?

ছোট মেয়েটি জবাব দেয়, আছে।

হীরা শুভকে বলে, নাও, ওদের সঙ্গে যাও, ওদের সঙ্গেই রাতটা কাটিয়ে দাও। আমার তো রাতটাই খারাপ হয়ে গেল!

নমির দিকে ফিরে বলে, যা, নমি নিয়ে যা একে। এর নাম শুভ।

নমি হঠাৎ বলে ওঠে, একে আবার কোথাকার লকার ভেঙে নিয়ে এলি দাদা!

কী?

হীরা খেঁকিয়ে উঠে বোনের দিকে তাকায়। নমি আর সবি, দুজনেই তখন হাসতে আরম্ভ করেছে। হীরা বলে ওঠে, না না ফাজলামি করিস না।

শুভার লজ্জা করে ওঠে। তবু, এ পরিবেশটা যেন অনেক সহজ আর বিশ্বাসযোগ্য লাগে ওর কাছে। ও যে একটা তালা ভাঙা চোরের বাড়িতে এসেছে, এ কথা মনেই থাকে না। হীরাকেও এখানে অন্যরকম লাগে। হীরা সত্যি একটা দাদা, বোন এবং ভাইদের দাদা।

সবি সবিতা যার নাম, সে খুব সহজভাবেই ডেকে ওঠে, এসো শুভাদি।

ডাক শুনে শুভার বুকের ভিতরটা চমকায় যত, বিস্ময়ে আর একটা বিচিত্র অনুভূতিতে যেন ততই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠতে চায়। মনে হয়, ও যেন চেনা আপন মানুষের কাছে এসে পড়েছে। এই দারিদ্র জীর্ণতা, তার মধ্যেই হাসি ঠাট্টা, এ সবই ওর চেনা গম্ভীর বিষয়। ওর নিজেরই পরিবেশের চেহারা। সবির ডাক শুনে, শুভাও সহজেই পাশের ঘরে যায়। নমি আবার বলে ওঠে, দেখিস দাদা, এ চোরাই মাল নিয়ে আবার বিপদে পড়তে না হয়।

নমির সঙ্গে শুভার চোখাচোখি হয়ে যায়। নমি হাসে। শুভার চোখে লজ্জা ফুটে উঠে। তবু সে হাসে। বলে, চোরাই মাল নই। বিপদে পড়ে এসেছি।

হীরা নিজের মনেই বলে, বিপদ! খুন হয়ে যেত আজ আর একটু হলে।

 নমি বলে, তাই নাকি!

হীরা জবাব দেয়, তবে? দ্যাখ না, এত জোরে মেরেছে, কানের নীচেটা বোধ হয় ফেটে গেছে।

কে মেরেছে?

কী জানি, নরেশ না কী নাম, এদের দেশের লোক। যাকগে, সে সব বলে কোনও লাভ নেই।

 নমি মাঝের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। সবি পাশের ঘরের আর একটা দরজা খুলে শুভকে নিয়ে যায়। সেখানে অন্ধকার। সবি বালতি থেকে মগে জল তুলে দেয়। শুভা ভাল করে কাঁধ ঘাড় ধুয়ে নেয়। বারান্দাতেই হাত পা ধোবার জায়গা। আর এক পাশে একটু রান্নার ব্যবস্থা।

ঘরে আসার পর নমি থালায় করে শুভকে রুটি তরকারি খেতে দেয়। ঘুমন্ত ভাইদের নাম ধরে বলে, ধীরু বিশু। কথায় কথায় কৌতূহল প্রকাশ করে শুভার সম্পর্কে। শুভা জানায়, তার সমস্ত কথাই এত লজ্জার যে মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছা করে না। কোনওদিন যদি সে সুযোগ আসে তো বলবে। তবে, নমি আর সবিকে ওর যে খুবই ভাল লাগছে, সে কথা জানায়।

ওরাও জানায় শুভকে ওদের খুব ভাল লাগছে। শুভা কেন রাত পোহালেই চলে যাবে? দু-একদিন বাদে গেলে ক্ষতি কী? যদিও কাউকে থাকতে বলতে ইচ্ছে করে না, তা হলেও শুভা থেকে গেলে ওরা খুব খুশি হবে।

এমনি সব নানান কথায় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। তারপরে ওরা ঘেঁষাঘেঁষি করে শুয়ে কোনওরকমে রাতটা কাটিয়ে দেয়। শুভা জানতে পারে, ওরা ওদের দাদার জন্যে, প্রতিটি রাত উদ্বেগে কাটায়। কখন কোনদিন কী দুঃসংবাদ আসবে, সেই ভয়ে ওরা কাঁটা হয়ে থাকে। কোনদিন যে ওদের কী বিপদ ঘনিয়ে আসবে, ওরা কিছুই জানে না। দাদা জেলে গেলেও ওরা না খেয়ে মরবে। জেলে না গিয়ে, শারীরিক ক্ষতি হলেও তাই হবে। দাদাকে বলে ওরা থামিয়ে রাখতে পারে না। অবিশ্যি দাদাকেও বলার কিছু নেই। সে সৎ থাকতেই চেয়েছিল, পারেনি। চোখের সামনে পিতৃহীন ভাই-বোন, বিধবা মাকে দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। আজ আর দাদাকে ফেরাতে পারে না ওরা।

পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে, শুভার বিস্ময় যেন ঘোচে না, সত্যি নিরাপদে নিরুপদ্রবে ওর রাত্রি কেটেছে। ধীরু আর বিশু অবাক হয়ে শুভকে দেখে।

হীরা মিথ্যা বলেনি। গোটা বাড়িটাতে মেলাই লোক। সকলেই গরিব। কারখানার দরিদ্র শ্রমিক, সামান্য ফেরিওয়ালা, এই রকম বিভিন্ন পেশার লোক বাস করে। হীরাদের অংশটা এক পাশে হওয়ায়, অনেকটা নিরিবিলি।

সকালবেলা, সাধারণ পরিবারের মতোই এখানে উনুন জ্বলে, চা হয়। দু-এক মুঠো মুড়ি চিবিয়ে সবাই চা খায়। শুভা লক্ষ করে, হীরা নিজের ঘর ছেড়ে প্রায় নড়েইনা। পাশের ঘরেও আসে না। তার দরজাটা প্রায় সবসময় বন্ধই থাকে। যেন এ অংশের সে কেউ নয়।

সকালবেলাই শুভার চলে যাবার কথা। নমি আর সবির কথাতেই যে শুভা থেকে যাওয়ার কথা ভাবে, তা নয়। নিজের মধ্যেও তার একটা দ্বিধা দেখা দেয়। বাড়ি যাবার আগে, আরও দু-একটা দিন, ওর ভাবতে ইচ্ছে করে। এভাবে বাড়ি যাবার কথা ভাবলেই ওর মনের মধ্যে প্রত্যাখ্যান ও অপমানের ভয় জেগে ওঠে। পায়ে যেন বেড়ি লাগে।

চা খাবার পরেই হীরা জিজ্ঞেস করে, কী, তোমাকে এখুনি হাওড়ায় পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে?

নমি জবাব দেয়, শুভাদি আজ যাবে না। তুই তাড়া দিচ্ছিস কেন দাদা।

 হীরা অবাক হয়ে বলে, আমি আবার তাড়া দিচ্ছি কোথায়। ও নিজেই বলেছিল চলে যাবে।

 হীরার সঙ্গে শুভার চোখাচোখি হয়। শুভা তাকিয়ে থাকতে পারে না। চোখ নামিয়ে নেয়।

হীরা বলে, থাকুক না। কাল রাত্রে তো আসতেই চাইছিল না। আমিই তো জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি। চোরের ভয়েই মরল যে!

নমি বলে, তা ভয় তো হবেই। কাল তো শুনলাম, কী ভাবে তুই গিয়ে লুকিয়েছিলি।

হীরা বলে, না না, মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করিস না।

তারপরেই ধুপুস করে শুয়ে পড়ে বলে, তা হলে বাবা আমি খানিকটা ঘুমিয়ে নিই। আমার এখনও চোখের ঘুম কাটেনি।

শুভা তবু দাঁড়িয়ে থাকে। নমি চলে যায় দরজাটা টেনে দিয়ে। হীরা চোখ বুজে থাকে। শুভা হীরার দিকে চেয়ে থাকে। এ লোকটার সঙ্গে, ওর মনের কল্পনাকে যেন মেলাতে পারে না।

হীরা হঠাৎ বলে ওঠে, কী হল?

শুভা একটু চমকে ওঠে। বলে, না কিছু না।

তারপরে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা একটা কথা।

কী?

শুনতে পাই, তালাগুনিন খুব সাংঘাতিক লোক, অনেক টাকা তার। তার ঘরের এ দুরবস্থা কেন?

 দূর, কোথায় টাকা। কোনওরকমে দিন চলে যায়। বড় দাঁও সেই কবে মেরেছি, সেই টাকা ভাঙিয়েই চলছে। আর মাঝে মধ্যে ছুটকো ছাটকা চলে, ওতে কিছু হয় না।

তার মানে ছিঁচকেমি।

হ্যাঁ, বড় কাজ অনেকদিন হয়নি। সেই ফেঁসে গেল বলেই তো তোমার ঘরে লুকিয়েছিলাম। এখন বেকার।

কিন্তু এভাবে কি সত্যি চালানো যায়?

কেন যাবে না? নরেশরা কী করছে। ওরা ব্যবসার নাম করে দাঁও মারছে, ওদের অনেক লোকজন, দল, অফিস সব আছে। আমার ও সব নেই। মেরে নিয়ে আসি, যদ্দিন চলে। চলে যায়, তারপর আবার বেরিয়ে পড়ি।

নরেশ এক রকমের চোর, তুমি আর এক রকমের চোর। তবু চোর তোত।

হীরা লাফ দিয়ে উঠে বসে। বলে, এই দ্যাখ, মা গোঁসাইয়ের মতো বক্তিমে আরম্ভ করো না বলে দিচ্ছি, ও সব আমার ভাল লাগে না।

শুভা চুপ করে চেয়ে থাকে, কিছু বলে না। সরে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়ায়। বাইরের দিকে চেয়ে থাকে। হীরা আবার শুয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ পর শুভা হঠাৎ বলে ওঠে, কত কাল বাইরে বেরুইনি।

হীরা তড়াক করে উঠে বলে, বেরুবে?

শুভা অবাক হয়ে বলে, কোথায়?

যেখানেই হোক, একটু ঘুরে আসব।

এখুনিই?

কী হয়েছে?

 হীরা নমিকে ডেকে বলে। নমি ওর একটা বোয়া কাপড় দেয়। তাই পরে হীরার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে শুভা। হীরা ট্যাক্সিতে তুলে, শুভাকে ময়দানে নিয়ে যায়। গঙ্গার ধারে ঘোরে। শীতের সকালবেলা, মিষ্টি রোদে বেড়াতে ভালই লাগে। তারকার সঙ্গেও শুভা বেড়িয়েছে, কিন্তু সেটা ছিল আলাদা। এটা অন্যরকম। মনের মধ্যে একটা দ্বিধা, ভবিষ্যতের নানান সংশয়ের আর, অথচ কোথায় যেন একটা মুক্তির স্বাদও অনুভূত হয়। তারকার সঙ্গে যখন বেড়িয়েছে, ঘুরেছে, তার মধ্যে ছিল একটা নতুন মদের মতো নেশা। অমৃতের বদলে যা গরল হয়ে উঠেছে, সেই গরলেরই খোয়ারি কাটছে এখন।

গঙ্গার ধারে বসে, হীরা বলে, এভাবে বেড়াতে ভুলেই গেছি, সত্যি।

এরকম বেড়িয়েছ কখনও?

হ্যাঁ, একটা মেয়ের সঙ্গেই বেড়াতাম মাঝে মাঝে। প্রেম করতাম।

 বলে হো হো করে হেসে ওঠে হীরা। শুভা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। হীরা বলে, তখন অবিশ্যি চোর হইনি। মেয়েটাও বলত, আমাকে নাকি ভালবাসে। কিন্তু একটা বেকার ছোঁড়ার সঙ্গে মেয়েরা কদিন প্রেম করতে পারে বলো। তাই কেটে পড়ল।

কোথায় গেল?

ভাল রাস্তায় যায়নি শুনেছি। তবে টাকা করেছে মেলাই।

ইঙ্গিতটা শুভা বুঝতে পারে। হীরার কথা আর হাসির মধ্যে তিক্ততার ঝাঁজটা পায় ও। তারপরে কথায় কথায় হীরা ওর প্রথম চুরির কাহিনী বলে। কী ভাবে এক ব্যবসায়ীর কাছে ও চাকরির জন্যে গিয়েছিল। লোকটা তার নিজের আলাদা ঘরে বসে হীরার সঙ্গে কথা বলছিল। লোকটা আসলে ছিল স্মাগলার। হীরাকে বলেছিল, নানান জায়গায় নানা ধরনের মাল চালাচালি করতে সে রাজি আছে কি না। তা হলে ভাল মাইনে আর কমিশন দুই-ই দেবে। অথচ হীরা গিয়েছিল, একটা সাধারণ চাকরির আশাতেই।

লোকটার সঙ্গে এই সব কথা যখন হচ্ছিল তখনই ফোন বেজে ওঠে। ফোনের কথা শুনেই লোকটা আঁতকে ওঠে। রিসিভার রেখে দিয়ে হীরাকে বলে, তুমি একটু বসো, আমার ড্রাইভার কাছেই কাকে। চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে। আমি আসছি।

লোকটা চলে যেতেই, বিদ্বেষে আর তিক্ততায় ওর মন ভরে ওঠে। হঠাৎ ওর লক্ষ পড়ে, নোকটার স্টিল আলমারির দিকে। তৎক্ষণাৎ ওর মনে হয়, আলমারিটা খুলতে পারলে কেমন হয়? সবই তো জোচ্চোরির টাকা। নিশ্চয় আলমারিতে কিছু আছে। তাড়াতাড়ি উঠে ও হাতল ঘোরায়। চাবি বন্ধ ছিল। সামনেই টেবিলের ওপর একটা কাগজকাটা চুরি পড়েছিল। সেটা চাবির ঘরে ঢুকিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। তাতে খোলেনি। তখন হন্যে হয়ে ও একটা পেরেক খুঁজেছিল। ওর মনে হয়েছিল, একটা তিন ইঞ্চি পেরেক ঢুকিয়ে, কোনওরকমে ডানদিকে মোচড়াতে পারলে, ওটা খুলে যাবে।

পেরেক ও খুঁজে পেয়েছিল দেওয়ালে গাঁথা অবস্থায়। সেটাকে খুলতে পেরেছিল। পেরেকটা চাবির গর্তে ঢুকিয়ে পিন গাঁথার যন্ত্র দিয়ে চেপে ধরে চাড় দিতেই, সত্যি সত্যি লকটা খুলে গিয়েছিল। আলমারি খুলেই, ও আর কিছু লক্ষ করেনি, শুধু দেখেছিল, বেশ কিছু নোট সাজানো রয়েছে। কোনও চিন্তা না করে, টাকাগুলো পকেটে পুরেছিল। তাও সব টাকা নিতে পারেনি। ওর হাত-পা কাঁপছিল, ঘাম ঝরছিল, গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। লকটা করতে পারেনি। এমনি হাতল ঘুরিয়ে বন্ধ করে, ঘরের বাইরে চলে এসেছিল। গদিতে যে দু-তিনজন কর্মচারী ছিল, তাদের বলে এসেছিল, দেরি হয়ে যাচ্ছে, পরে আবার একদিন আসবে।

সেই ওর প্রথম চুরি, যে চুরির জন্যে ও ধরা পড়েনি। ওকে কেউ দীক্ষা দেয়নি। ও নিজেই নিজেকে দীক্ষিত করেছিল এবং সেই থেকে এটাকেই ধ্যান-জ্ঞান করেছিল, আজ পর্যন্ত দুবার ধরা পড়েছে। একবার ছমাস, আর একবার দশ মাস জেল খেটেছে। কিন্তু চুরি ধরা পড়েনি কখনও। তবে ও যত বড় চোর নয়, নামটা তার চেয়ে বেশি। দলের সঙ্গে না থাকার জন্যে, ওর শত্রুও বেশি।

বলে, হীরা ধপাস করে গঙ্গাধারের দূর্বায় শুয়ে পড়ে। বলে, কেরানির ছেলে চোর হয়ে গেলাম।

কথাটা এমনভাবে বলে যেন ও মজা করছে। কিন্তু ওর মুখে তার কোনও চিহ্নই নেই। শুভা গঙ্গার বুকে দৃষ্টিপাত করে। তখনই সাইরেন বেজে ওঠে। ভাঁটার শেষ, জোয়ার আসছে।

শুভা কখন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ ওর খেয়াল হয়, হীরা কখন যেন ওর হাতটা ধরেছে। হীরা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। শুভা ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। হীরা জোরে হেসে ওঠে বলে, বেকার আর চোর সমান। কোনও মেয়েই তাকে চায় না। তবে দোহাই বাবা, আমি প্রেম করতে চাইনি। এমনি একটু হাতটা ধরেছিলাম। তোমাকে দেখে ভারী অবাক লাগে আমার। তোমার ভাগ্যটা অদ্ভুত।

তারপরেই লাফ দিয়ে উঠে বলে, চলো।

.

টালিগঞ্জে ফিরে শুভা যখন শোনে, ধীরু আর বিশু ইস্কুলে গিয়েছে, তখন ওর খুব অবাক লাগে। আবার নমির মুখে এ কথাও শোনে ইস্কুলে না ছাই, গিয়ে দেখ, কোথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ওদের আবার লেখাপড়া হবে?

কয়েক দিন এরকম কাটে। শুভা লক্ষ করে, ধীরু আর বিশু যে কেবল ইস্কুল পালিয়ে, উচ্ছঙ্খল দুর্বিনীত হয়ে উঠছে তাই নয়। নমি আর সবির সঙ্গেও, এই প্রকাণ্ড বাড়ি এবং পাড়াটার যে সব ছেলে আড্ডা মারতে আসে তারা কেউ ভাল নয়। দেখলেই বোঝা যায়, তারা অন্ধকারের জীব। তাদের ভাব, ভাষা, ভঙ্গি অত্যন্ত নিচু শ্রেণীর। সেই সঙ্গে নমি সবির আচরণও কদর্য লাগে। শুভা নেহাত নতুন বলে, ওদের সামনাসামনি চক্ষুলজ্জা হয়। অন্যথায় ওরা একেবারে বেহেড বেলাজ।

কোনওরকমে রান্নাটা করে দুজনে। তা ছাড়া যখন খুশি দুজনে বেরিয়ে যাচ্ছে, ফিরে আসছে। শুভাকে পেয়ে ওদের আরও সুবিধা। রান্না ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে দুজনে আড্ডায় মেতে যায়।

তথাপি, শুভাকে ওরা ভাল না বেসে পারে না। ওদের মনে কোথায় যেন একটা সমীহ বোধও আছে শুভার প্রতি। শুভার সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত ইয়ার্কি ঠাট্টা করতে গেলে, ওদের যেন কোথায় আটকে যায়। শুভাও গম্ভীর হয়ে ওঠে। ধীরু ও বিশু একটু ভক্ত হয়ে পড়ে শুভার। যদিও তাতে ওদের এত দিনের জীবনে কোনওই পরিবর্তন হয় না।

প্রায় পনেরো দিন হীরাও কোথাও বেরোয়নি। ও যেন অন্য মানুষ হয়ে উঠেছে। প্রায় একটা সংসারী চরিত্রের মানুষ যেন। শুভার সঙ্গে বক বক করে। একটু আধটু খিটিমিটিও লাগে। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই, একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ওদের মধ্যে কোথায় একটা কী ঘটছে, ওরা নিজেরাও জানে না। ওদের চোখের মুখের ভাবে ফুটে ওঠে। পরস্পরের সান্নিধ্যকে ওদেরও ভাল লাগে।

তারপরে একদিন বিকেল থেকেই হীরার চোখমুখ বদলাতে থাকে। ঘোর সন্ধ্যায় সে যখন বেরুবার উদ্যোগ করে, শুভা এসে সামনে দাঁড়ায়। হীরার চোখের দিকে তাকায়। হীরা ফিরেও চায় না। সে দরজার দিকে যায়। শুভা বলে, না বেরুলে হত না?

হীরা থমকে দাঁড়িয়ে বলে, দিলে তো অযাত্রা করে। খামকা একটা বাধা।

শুভা বলে, কী দরকার এ সব করার। একটা কাজকর্মের ফিকির দেখ না।

 হীরা রুখে ওঠে, এই দ্যাখ, ন্যাকামি কোরো না। তুমি আমাকে খাওয়াবে, না?

শুভা চুপ করে যায়। হীরা আবার বেরুবার উদ্যোগ করে। শুভা বলে, এভাবে চিরদিন কি চালিয়ে যেতে পারবে?

কেন, চালিয়ে আসিনি?

যে কোনওদিন তো তোমার জেল হতে পারে, একটা বিপদও হতে পারে।

হয় হবে।

তখন তোমার এ সব কে দেখবে, ভাই-বোনদের?

 যতক্ষণ নিজে আছি, ততক্ষণ ওরাও আছে। তারপরে আর জানি না।

সেই জন্যেই ওরাও এরকম হয়ে গেছে। কারুরই কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এও তোমারই জন্যে।

আমার জন্যে?

হ্যাঁ। কেবল খাইয়ে পরিয়ে রাখলেই হয়? একবার দেখছ না, ওদের কী অবস্থা হয়েছে?

হীরা এবারে অনুরাগে আর ক্ষোভে ফিরে তাকায়। চিৎকার করে ওঠে, দুত্তোরি তোর নিকুচি করেছে ভাল মন্দর। পেটে দুটো ভাত জুটছে, এই যথেষ্ট। বাকি ন্যাকামো রেখে দাও। ফের যদি আমাকে এ সব বলবে, মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাবে।

বলেই সে চলে যায় বাইরে। শুভা অন্ধকারে একলা দাঁড়িয়ে থাকে। ওর চোখের সামনে ভাসতে থাকে, হীরা নরেশের ঘরে গিয়ে স্টিল সেফ খুলছে। ওদিকে পাশের ঘরে তখন ধীরুর সঙ্গে সবির ঝপড়া মারামারি চলছে।

কিন্তু রাত্রি নটার মধ্যেই হীরা ফিরে আসে। তার মুখ থমথমে। এসেই শুয়ে পড়ে। শুভা ঘরে আসতেই খিঁচিয়ে ওঠে। ও বাধা দেওয়াতেই, হীরা যেতে পারেনি। এরকম বাধা পড়লে সে কোথাও যায় না।

আবার তর্কাতর্কি লাগে, ঝগড়া বেধে যায়। হীরা অত্যন্ত অপমানকর কথা বলে শুভকে। প্রায় মারতে ওঠে। শুভাও পেছিয়ে থাকে না। কিন্তু ও ভীষণ ক্লান্ত আর বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। একটা উদ্বেগ হয়তো গিয়েছে। এ পরিবেশ ওকে থাকতে দিচ্ছে না।

তারপরে আস্তে আস্তে, নমি সবির সঙ্গেও শুভার সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। ওদের আচরণের বিরুদ্ধে কথা বললেই, ওরা শুভাকে অপমান করে। তীব্র বিদ্রুপে জ্বালিয়ে দেয়। শুভা ওদের সঙ্গে সমানে ঝগড়া করে। ওরা ধীরু আর বিশুকে লেলিয়ে দেয়। ওদের পুরুষ বন্ধুদের সামনেই ঝগড়া করে।

পরে আবার শুভার সঙ্গে ওরা হেসে কথা বলবার চেষ্টা করে। শুভা একলা অবাক হয়ে বসে ভাবে, এরা তার কে? কেন সে এদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করে। নেহাত এক ঘরে আছে বলেই তো। ও নিজেই বা ওদের থেকে কত তফাত, কতটুকুই বা ভাল।

তবু শুভা যখন যেখানে আছে, সেখানে ছায়ার মতো কী একটা চিন্তা ওর পায়ে পায়ে ফেরে। মনের মধ্যে প্রতি পদে পদে বিরুদ্ধ ভাব জেগে ওঠে। হীরার চুরির জীবিকা, তার ভাইবোনদের আচার আচরণ সব মিলিয়ে, এই গোটা সংসারটার সঙ্গে ওর একটা সংগ্রাম চলতে থাকে।

অথচ শুভা একটা বাইরের মানুষ। একটা অবিশ্বাস্য অদ্ভুত অবস্থায় এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে।

আবার এই সংঘর্ষ সংগ্রামের মধ্যেই, কখনও কখনও, একটু হালকা হাওয়া ভেসে আসে। কিন্তু তা অহর্নিশ গুমোটের মধ্যে সামান্য পলকের বাতাস মাত্র। এভাবে থাকা যায় না। ওকে সেই খানেই ফিরতে হবে। দেশে, বাবা মায়ের কাছে, এবং সেই শেষ পরিণতির দিকে।

একদিন বিকালের আগেই, হীরার সঙ্গে শুভার ঝগড়া লেগে যায়। এখন শুভা নিজেকেই কোনও এক মাস্টারমহাশয়ের মেয়ে বলে চিনতে পারে না, এত কটু ইতর কথাবার্তা বলে ঝগড়া করে। আর হীরাও শুভকে বলে, শুভা যেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোজগার করে এনে খাওয়ায়, তা হলে সে আর চুরি করতে যাবে না।

শুভাও জবাব দেয়, সে ভাত খাবার আগে, হীরালাল চোর যেন গলায় দড়ি দিয়ে মরে।

হীরা রেগে গিয়ে শুভকে থাপ্পড় মেরে বসে। সেই শুভার শেষ। সেই মুহূর্তেই ওর সিদ্ধান্ত হয়ে যায়, এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একটি কথাও না বলে, হীরার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কেমন করে যে হাওড়ার বাসে ওঠে, কন্ডাক্টরকে করুণভাবে পয়সা না থাকার কথা বলে, নিজেরই চৈতন্য থাকে না। ট্রেনে উঠে, হাওড়া থেকে দেড় ঘণ্টার পথ পেরিয়ে, যখন ওদের স্টেশনে নামে, তখন বিকাল গড়িয়ে গিয়েছে।

স্টেশনের বাইরে এক বার থমকে দাঁড়ায়, তারপর আরও দ্রুত নতুন শহরের ভিতর দিয়ে ওদের বাড়ির দিকে যায়। চেনা পরিচিত কেউ ওকে দেখছে কি না দেখছে, সে চিন্তা ওর মাথায় এক বারও আসে না।

কিন্তু শহরটা যতই শেষ হয়ে আসে, ততই ওর গতি শ্লথ হয়ে আসে। বাড়ির কাছাকাছি এসে, ওর পা আর সরতে চায় না। একটা অর্ধেক তোলা বাড়ির সামনে, ঘোর সন্ধ্যার কোলে আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু দূরেই ওদের বাড়িটা, অন্ধকারে নিশ্ৰুপ দাঁড়িয়ে আছে। শুভার মনে পড়ে যায়, একদিন এ সময়েই প্রথম তাকে বাড়ির বারান্দায় দেখে তারকদা থমকে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তারকদার কথা আর তেমন মনে পড়ে না। বরং অনেক বেশি যন্ত্রণা কষ্ট অথচ যেন একটা গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে, একটা অন্য লোকের কথা বেশি মনে পড়ে। যে লোকটার চোখের দৃষ্টি বুঝতে ওর ভুল হয়নি। যে লোকটির জন্যে। ওর নিজের মনেও এক আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। যে লোকটির কাছে, একটা আত্মসমর্পণের আবেগে কখনও কখনও মনে মনে ব্যাকুল হয়েছে। যে আবেগ ব্যাকুলতা, জীবনে আর কখনও ও অনুভব করেনি।

কিন্তু দুয়ের মধ্যে একটা ব্যবধান কখনও ঘুচল না। তারই চিহ্ন গালে নিয়ে ফিরতে হয়েছে আজ। ওরা সবাই কেবল নিজেদের মতো করে চায়। অপরের মনটা দেখতে চায় না।

শুভা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। সামনের বারান্দা দিয়ে না গিয়ে, শুভাদের নিজেদের ভাগে পুরনো বাড়ির যে অংশ পড়েছে, ওর ঠাকুরদার আমলের সেই বাড়ির অংশের দিকে এগিয়ে যায়। সেই অংশের, অন্ধকার অলিন্দে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘরের মধ্যে টিম টিম করে আলো জ্বলছে।

শুভা অলিন্দে দাঁড়াতেই, ওর বাবার গলা শোনা যায়, কে, ওখানে কে?

বাতি হাতে শুভার মা বেরিয়ে আসে। জীর্ণ, রুগ্ন স্বাস্থ্য মায়ের? ভূত দেখার মতো চমকে, থমকে দাঁড়িয়ে যায়। বাবা ঘরের ভিতর থেকে আবার জিজ্ঞেস করে কে গো?

শুভা কথা বলতে ভুলে যায়। কাঁদবার কথাও ওর মনে আসে না। খক খক করে কাশতে কাশতে কুঁজো হয়ে ওর বাবা বেরিয়ে আসে। চোখ তীক্ষ্ণ করে দেখে। তারপরেই চমকে, যেন ভয় পেয়ে বলে, কে?

কারুর মুখে কোনও কথা নেই। দেখতে দেখতে ওর ভাই-বোনেরাও এসে পড়ে। ওরা যেন কেউ শুভাকে চেনে না, কোনওদিন দেখেনি। অথচ বিস্ময়ে একটা ভয় পাওয়া চোখে চেয়ে থাকে।

শুভার বাবা, হঠাৎ শক্ত গলায় বলে ওঠে, আর এদিকে না ওখান থেকেই বিদেয় হও। বিষের হাওয়া আর ঘরে ঢুকতে দেব না।

তবু শুভা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ও তো জানতই, কোথায় যাবে এবার। এই পরিণতি ওর জানাই ছিল। চোখের জল আসে আসুক। তবু ওর কী রকম কষ্ট হচ্ছে সবাইকে দেখে। অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এক বার যেন ওর গলা দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, যাচ্ছি।

.

শুভা অলিন্দ থেকেই নেমে আসে। অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়। পিছনে যেন মায়ের গলার ক্ষীণ একটা শব্দ শোনা যায়। কার যেন নিশ্বাস পড়ে। শুভা বাইরে বেরিয়ে আসে।

বেরিয়ে এসে, দরজার কাছেই একটা মূর্তি দেখে, থমকে যায়। অন্ধকারেও চিনতে পারে, হীরা। প্রথমেই বলে, পরের ট্রেন ধরেই ছুটে এসেছি…।

শুভা শোনে না, এগিয়ে যেতে থাকে।

হীরা বলতে থাকে, দ্বিধায় লজ্জায় ভয়ে ভয়ে, তুমি চলে এলে। মুখটা চেপে বসেছিলাম। হঠাৎ নমিটা ছুটে এল কাঁদতে কাঁদতে। পিছনে সবি, ভাই দুটোও।…

শুভা চলতেই থাকে। ওর গন্তব্য শহর পেরিয়ে রেল লাইন। হীরার গলাটা যেন রুক্ষ শোনায়। বলে, নমিটা বলে উঠল, তুই এখনও বসে আছিস দাদা? শুভাদি যে বেরিয়ে গেছে, শিগগির যা, দ্যাখ কোথায় গেল। শুভাদির হাতে যে একটা পয়সাও নেই।

আমি যেন বুঝতেই পারছিলাম না, কী করেছি। অথচ যে হাত তোমার গায়ে তুলেছি…।

হীরা আর কথা বলতে পারে না, স্বর বন্ধ হয়ে যায়। শুভা এগিয়ে যেতে থাকে। ওদের আশপাশ দিয়ে লোকজন যাতায়াত করে। ওদের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। ওরা অন্য জগতের মানুষ যেন।

হীরা আবার গলাটা পরিষ্কার করে বলে, তারপরে সবি আর ভাই দুটো কেঁদে উঠতেই খেয়াল হল, তাড়াতাড়ি ছুটলাম। জানতাম, তুমি কী করবে, কোথায় যাবে। কী ভাবে যে ট্রেনের পথটা চুপচাপ এসেছি। শুভাশুভা তুমি কোনদিকে যাচ্ছ। এদিকে স্টেশন নয়, শুভা।…

শুভা ক্রমে শহরের বাইরের অন্ধকারে, রেল লাইনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। হীরা শুভার হাতটা ধরতে চায়, পারে না। ওর মুখে উদ্বেগ ব্যাকুলতা। শুভার দৃষ্টি রেল লাইনের সিগন্যাল পোস্টের লাল আলোর দিকে।

হীরা আবার বলে, শুভা, আমি সব দেখেছি, ঘরের বাইরে থেকেই তুমি ফিরে চলে এলে। সেখানে তোমার বাবা মা ভাই বোন…

শুভা সহসা ঘাড় ঝাঁকিয়ে দ্রুত চলতে থাকে। এ সব কথা ও আর শুনতে চায় না। হীরা ব্যাকুল স্বরে বলে, শুভা, শুভা, এরা তোমাকে নেয়নি, আমার ভাইবোনদের কাছে চলো। ওরা তোমাকে সত্যি ভালবাসে।

শুভার অস্ফুট কান্না জড়ানো গলায় কেবল শোনা যায়, না না, আর এ সব শুনতে চাই না।…

শুভা প্রায় ছুটতে থাকে। হীরা ওর হাত চেপে ধরে। লাল আলো নীল হয়। হীরা বলে, ওরা তোমার কাছে থাকবে, তুমি যেমন বলবে…

.

গাড়ির শব্দ পাওয়া যায় দূরে। শুভার গলায় এক শব্দ, না না, আর না…

হীরা চিৎকার করে ওঠে, আমিও, আমিও তাই শুভা। আমি আর আগের রাস্তায় চলতে চাই না। আমি–তুমি যা বলেছ–আমি জানি, একটা মানুষ চিরদিন এ সব করতে পারে না। কিন্তু তুমি না থাকলে–

শুভা থমকে দাঁড়ায়। হীরার চোখের দিকে চায় তারপর সহসা মাঠের ওপর মুখ ঢেকে বসে পড়ে।

গাড়িটা তখনও অনেক দুরে। তার ক্ষীণ আলো এসে ওদের গায়ে পড়ে। হীরা আবার বলে, তুমি কাছে থাকলে সব পারব। ওরাও, আমার ভাই-বোনেরাও

কথা শেষ না করে, হীরাও শুভার কাছে নত হয়ে বসে। গাড়ির আলোটা আরও তীব্র হয়। একবার বাঁশি বেজে ওঠে।

৪. ছোট আঁকাবাঁকা গলি

৪. ছোট আঁকাবাঁকা গলি

গাড়িটা যেন শহর পেরিয়ে চলে আসে। রাস্তা ক্রমেই ছোট আঁকাবাঁকা গলি হয়ে ওঠে। হীরার নির্দেশেই এক জায়গায় গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা ঘিঞ্জি গলির মুখে, গাড়িটা দাঁড়ায়। হীরা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে, শুভাকে নিয়ে নামে। এদিকটা যেন নিশুতি। শীতও যেন এখানে বেশি।

গলির মধ্যে খানিকটা গিয়ে ডান দিকে বেঁকে কয়েক পা যেতেই, চোখের সামনে প্রকাণ্ড একটা দোতলা ভুতুড়ে বাড়ি দেখা যায়। অন্ধকার চারদিকে। আশেপাশে কিছু বস্তি, পোড় জমি, জঙ্গল ছড়ানো।

হীরা শুভকে নিয়ে সেই প্রকাণ্ড দোতলা ভুতুড়ে বাড়িটার দিকেই যায়। শুভার গাটা কী রকম ছমছম করে ওঠে। শুভা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। হীরা জিজ্ঞেস করে, কী হল?

কোথায় নিয়ে এলে এখানে?

এখানেই তো থাকি।

এটা তো একটা পোড়ো বাড়ি, কেউ নেই।

হীরা যেন একটু বিদ্রূপ করে জবাব দেয়, কলকাতায় আজকাল আবার পোড়ো বাড়ি বলে কিছু আছে নাকি? এ বাড়িতে ষোলো সতেরোটা ঘর আছে, প্রত্যেকটা ঘরে লোক থাকে।

কথা শেষ হতে না হতেই, শিশুর কান্না শোনা যায়। মায়ের কান্না থামানোর, সান্ত্বনা দেবার স্বর বেজে ওঠে। কোথায় যেন এক বৃদ্ধ কেশে ওঠে খক খক করে। হীরা শুভার হাত ধরে। বাড়িটার দরজাবিহীন সদর দিয়ে ঢোকে। সেকালের পুরনো বাড়ি। মাঝখানে উঠোন, চারপাশে ঘর। একটা ঘরে আলোর রেশ দেখা যায় জানালা দিয়ে।

হীরা বাঁ দিকের বারান্দায় উঠে, অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠে শুভাকে নিয়ে। পুরনো ইট আর শ্যাওলার গন্ধ লাগে শুভার নাকে। দোতলায় উঠে, একটা বাঁক নিয়ে, বারান্দার একদিকে এগিয়ে, একেবারে এক পাশে চলে যায়। আবার বাঁক নিয়ে, বাড়িটার বাইরের দিকের বারান্দার এক কোণে গিয়ে হীরা দাঁড়ায়। এদিকটায় একেবারে ভুতুড়ে নির্জনতা। একটা গাছের ঝুপসি ডাল এদিকেই হেলে পড়েছে।

হীরা পকেট থেকে ওর সেই যন্ত্রটা বের করে, তালা খোলে। ঘরে ঢুকে সুইচ টিপতে, একটা আলো জ্বলে। আলো এত কম যে, নরেশের আলোকিত ঘরের তুলনায় অন্ধকার বলে মনে হয়। লাল টিমটিমে আলো। ইলেকট্রিকের আলো যে এত কম হয়, শুভা জানত না। হীরার ডাকে শুভা ঘরে ঢোকে।

ঘরে আসবাব বলতে কিছুই নেই। একটা তক্তপোশ, তাতে একটা পাতলা ময়লা বিছানা, আর একটা পুরনো সেকালের কাঠের ভারী আলমারি। মনে হয়, বাড়িটার মতোই, এটাও পুরনো। হীরা দরজাটা বন্ধ করে, তক্তপোশের ওপর বসে পড়ে! বলে, নাও, রাত্তিরটা কোনওরকমে কাটিয়ে সকালবেলা দেশে চলে যেয়ো। সে সব আর আমি দেখতে যাব না। কিন্তু।

শুভা ফিরে তাকায়। হীরার সঙ্গে ওর চোখাচোখি হয়। হীরা বলে, খাবারগুলো তো তেজ করে ফেলে দিলে, এখন খাবে কী? দেখেই তো মনে হচ্ছে ধুকছু।

শুভা বললে, কোনও দরকার নেই।

 হীরার চোখ দুটো হঠাৎ বড় হয়ে ওঠে। দাঁড়িয়ে উঠে বলে, এ কী, তোমার কানের কাছে, ঘাড়ে রক্ত লেগে আছে।

শুভা আঁচল দিয়ে কান আর ঘাড়ের কাছে, আস্তে করে মুছে বলে, একটু লেগেছে।

হীরা জিজ্ঞেস করে, কামড়ে টামড়ে দেয়নি তো। যে রকম করছিল।

কথা শুনে লজ্জা করে ওঠে। ও চুপ করে তক্তপোশের ওপর গিয়ে এক পাশে বসে পড়ে। কিন্তু ও বিস্মিত উৎকর্ণ হয়ে, বারে বারেই কী যেন শুনতে থাকে। ওর মনে হয় কাছেই যেন কারা কথা বলছে। চুপিচুপি ফিসফিস করে কথা বলছে। ওর দৃষ্টি গিয়ে পড়ে, এ ঘরের আর একটা বন্ধ দরজার দিকে। হঠাৎ শুভার মনে পড়ে যায় একটা কথা। জিজ্ঞেস করে, তোমার যে ভাই-বোন আছে বলেছিলে?

বলেছি তো।

 কোথায় তারা?

হীরা উঠে দাঁড়ায়। বন্ধ দরজাটার গায়ে টোকা দিয়ে ডাকে, নমি–এই নমি।

দরজাটা দুই ডাকেই খুট করে খুলে যায়। ভিতরটা অন্ধকার, কিন্তু শুভা একটি মেয়ের মূর্তিকে দেখতে পায়। হীরা বলে, আলো জ্বাল তো। 

কথার সঙ্গে সঙ্গেই আলো জ্বলে ওঠে। এই ঘরের মতোই টিমটিমে রক্তিম আলো। সেই আলোয়, শুভা দেখতে পায়, দরজার কাছে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, বয়স কুড়িবাইশ হবে। অন্যদিকে দেওয়ালের কাছে, যেখানে সুইচ, সেখানে আর একটি মেয়ে, ষোলো সতেরো বছর বয়স হতে পারে। মেঝেয় পাতা ময়লা বিছানা। কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে আরও দুজন। মুখ দেখে মনে হয়, একটি ছেলের বয়স বারো-তেরো। আর একটি ছেলে আট-ন।

মেয়ে দুটি যে জেগেই ছিল, তাদের মুখ দেখেই বোঝা যায়। তাদের চোখে-মুখে বিস্মিত কৌতূহল, তীব্র অনুসন্ধিৎসা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। অথচ, যেন ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসিরও আভাস। দেখতে শুনতে মোটামুটি। হয়তো, ভালভাবে থাকতে পেলে, আরও ভাল লাগত। নিতান্ত সস্তা, বাড়িতে কাঁচা শাড়ি, জামাও সেই রকম। দুজনের কারুরই হাতে কাঁচের চুড়ি ছাড়া কিছুই নেই।

হীরা বলে, দেখে নাও, এরা আমার ভাই-বোন।

শুভা যেন এক নতুন জগতে চলে এসেছে। বহু দিনের ফেলে আসা একটা জগৎ, বা ওর পরিচিত, অথচ মনে করত, আর কোনও দিন এমন একটা জগৎ, ও আর দেখতে পাবে না। শুভা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। মেয়ে দুটির সঙ্গে ওর যতই দৃষ্টি বিনিময় হয়, ততই যেন ওদের মুখে চোখে হাসি ফুটতে থাকে। শুভার মুখ দিয়ে প্রথমেই বেরিয়ে আসে, তোমার মা নেই?

হীরা ঠোঁট উলটে বলে, নাঃ, সে পটল তুলেছে বছর পাঁচেক। সব আমার ঘাড়ে ফেলে, বুড়িটা সটকেছে।

দেওয়ালের দিকের ছোট মেয়েটি ফিক করে এক বার হেসে ওঠে, মুখে হাত চাপা দেয়। হীরা জিজ্ঞেস করে, হাঁরে নমি, কিছু আছে?

বড় মেয়েটি জবাবে বলে, খাবার?

হাঁ।

ছ-সাতটা রুটি আছে, আর কালকের সেই তরকারি একটুখানি।

 সে তো নষ্ট হয়ে গেছে।

না, শীতের দিন তো, রাত্রে গরম করেছিলাম।

তা হলে একে একটু দে, দ্যাখ খেতে পারে কি না।

শুভা বলে ওঠে, না, না, আমার দরকার নেই।

হীরা বলে, সে কথা তো অনেক বার শুনেছি। দেখ না, খেতে পার কি না। আর কানের কাছে রক্তটা ধুয়ে ফেলো গে! হ্যাঁরে সবি, ওদিকের বারান্দায় জল আছে তো?

ছোট মেয়েটি জবাব দেয়, আছে।

হীরা শুভকে বলে, নাও, ওদের সঙ্গে যাও, ওদের সঙ্গেই রাতটা কাটিয়ে দাও। আমার তো রাতটাই খারাপ হয়ে গেল!

নমির দিকে ফিরে বলে, যা, নমি নিয়ে যা একে। এর নাম শুভ।

নমি হঠাৎ বলে ওঠে, একে আবার কোথাকার লকার ভেঙে নিয়ে এলি দাদা!

কী?

হীরা খেঁকিয়ে উঠে বোনের দিকে তাকায়। নমি আর সবি, দুজনেই তখন হাসতে আরম্ভ করেছে। হীরা বলে ওঠে, না না ফাজলামি করিস না।

শুভার লজ্জা করে ওঠে। তবু, এ পরিবেশটা যেন অনেক সহজ আর বিশ্বাসযোগ্য লাগে ওর কাছে। ও যে একটা তালা ভাঙা চোরের বাড়িতে এসেছে, এ কথা মনেই থাকে না। হীরাকেও এখানে অন্যরকম লাগে। হীরা সত্যি একটা দাদা, বোন এবং ভাইদের দাদা।

সবি সবিতা যার নাম, সে খুব সহজভাবেই ডেকে ওঠে, এসো শুভাদি।

ডাক শুনে শুভার বুকের ভিতরটা চমকায় যত, বিস্ময়ে আর একটা বিচিত্র অনুভূতিতে যেন ততই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠতে চায়। মনে হয়, ও যেন চেনা আপন মানুষের কাছে এসে পড়েছে। এই দারিদ্র জীর্ণতা, তার মধ্যেই হাসি ঠাট্টা, এ সবই ওর চেনা গম্ভীর বিষয়। ওর নিজেরই পরিবেশের চেহারা। সবির ডাক শুনে, শুভাও সহজেই পাশের ঘরে যায়। নমি আবার বলে ওঠে, দেখিস দাদা, এ চোরাই মাল নিয়ে আবার বিপদে পড়তে না হয়।

নমির সঙ্গে শুভার চোখাচোখি হয়ে যায়। নমি হাসে। শুভার চোখে লজ্জা ফুটে উঠে। তবু সে হাসে। বলে, চোরাই মাল নই। বিপদে পড়ে এসেছি।

হীরা নিজের মনেই বলে, বিপদ! খুন হয়ে যেত আজ আর একটু হলে।

 নমি বলে, তাই নাকি!

হীরা জবাব দেয়, তবে? দ্যাখ না, এত জোরে মেরেছে, কানের নীচেটা বোধ হয় ফেটে গেছে।

কে মেরেছে?

কী জানি, নরেশ না কী নাম, এদের দেশের লোক। যাকগে, সে সব বলে কোনও লাভ নেই।

 নমি মাঝের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। সবি পাশের ঘরের আর একটা দরজা খুলে শুভকে নিয়ে যায়। সেখানে অন্ধকার। সবি বালতি থেকে মগে জল তুলে দেয়। শুভা ভাল করে কাঁধ ঘাড় ধুয়ে নেয়। বারান্দাতেই হাত পা ধোবার জায়গা। আর এক পাশে একটু রান্নার ব্যবস্থা।

ঘরে আসার পর নমি থালায় করে শুভকে রুটি তরকারি খেতে দেয়। ঘুমন্ত ভাইদের নাম ধরে বলে, ধীরু বিশু। কথায় কথায় কৌতূহল প্রকাশ করে শুভার সম্পর্কে। শুভা জানায়, তার সমস্ত কথাই এত লজ্জার যে মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছা করে না। কোনওদিন যদি সে সুযোগ আসে তো বলবে। তবে, নমি আর সবিকে ওর যে খুবই ভাল লাগছে, সে কথা জানায়।

ওরাও জানায় শুভকে ওদের খুব ভাল লাগছে। শুভা কেন রাত পোহালেই চলে যাবে? দু-একদিন বাদে গেলে ক্ষতি কী? যদিও কাউকে থাকতে বলতে ইচ্ছে করে না, তা হলেও শুভা থেকে গেলে ওরা খুব খুশি হবে।

এমনি সব নানান কথায় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। তারপরে ওরা ঘেঁষাঘেঁষি করে শুয়ে কোনওরকমে রাতটা কাটিয়ে দেয়। শুভা জানতে পারে, ওরা ওদের দাদার জন্যে, প্রতিটি রাত উদ্বেগে কাটায়। কখন কোনদিন কী দুঃসংবাদ আসবে, সেই ভয়ে ওরা কাঁটা হয়ে থাকে। কোনদিন যে ওদের কী বিপদ ঘনিয়ে আসবে, ওরা কিছুই জানে না। দাদা জেলে গেলেও ওরা না খেয়ে মরবে। জেলে না গিয়ে, শারীরিক ক্ষতি হলেও তাই হবে। দাদাকে বলে ওরা থামিয়ে রাখতে পারে না। অবিশ্যি দাদাকেও বলার কিছু নেই। সে সৎ থাকতেই চেয়েছিল, পারেনি। চোখের সামনে পিতৃহীন ভাই-বোন, বিধবা মাকে দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। আজ আর দাদাকে ফেরাতে পারে না ওরা।

পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে, শুভার বিস্ময় যেন ঘোচে না, সত্যি নিরাপদে নিরুপদ্রবে ওর রাত্রি কেটেছে। ধীরু আর বিশু অবাক হয়ে শুভকে দেখে।

হীরা মিথ্যা বলেনি। গোটা বাড়িটাতে মেলাই লোক। সকলেই গরিব। কারখানার দরিদ্র শ্রমিক, সামান্য ফেরিওয়ালা, এই রকম বিভিন্ন পেশার লোক বাস করে। হীরাদের অংশটা এক পাশে হওয়ায়, অনেকটা নিরিবিলি।

সকালবেলা, সাধারণ পরিবারের মতোই এখানে উনুন জ্বলে, চা হয়। দু-এক মুঠো মুড়ি চিবিয়ে সবাই চা খায়। শুভা লক্ষ করে, হীরা নিজের ঘর ছেড়ে প্রায় নড়েইনা। পাশের ঘরেও আসে না। তার দরজাটা প্রায় সবসময় বন্ধই থাকে। যেন এ অংশের সে কেউ নয়।

সকালবেলাই শুভার চলে যাবার কথা। নমি আর সবির কথাতেই যে শুভা থেকে যাওয়ার কথা ভাবে, তা নয়। নিজের মধ্যেও তার একটা দ্বিধা দেখা দেয়। বাড়ি যাবার আগে, আরও দু-একটা দিন, ওর ভাবতে ইচ্ছে করে। এভাবে বাড়ি যাবার কথা ভাবলেই ওর মনের মধ্যে প্রত্যাখ্যান ও অপমানের ভয় জেগে ওঠে। পায়ে যেন বেড়ি লাগে।

চা খাবার পরেই হীরা জিজ্ঞেস করে, কী, তোমাকে এখুনি হাওড়ায় পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে?

নমি জবাব দেয়, শুভাদি আজ যাবে না। তুই তাড়া দিচ্ছিস কেন দাদা।

 হীরা অবাক হয়ে বলে, আমি আবার তাড়া দিচ্ছি কোথায়। ও নিজেই বলেছিল চলে যাবে।

 হীরার সঙ্গে শুভার চোখাচোখি হয়। শুভা তাকিয়ে থাকতে পারে না। চোখ নামিয়ে নেয়।

হীরা বলে, থাকুক না। কাল রাত্রে তো আসতেই চাইছিল না। আমিই তো জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি। চোরের ভয়েই মরল যে!

নমি বলে, তা ভয় তো হবেই। কাল তো শুনলাম, কী ভাবে তুই গিয়ে লুকিয়েছিলি।

হীরা বলে, না না, মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করিস না।

তারপরেই ধুপুস করে শুয়ে পড়ে বলে, তা হলে বাবা আমি খানিকটা ঘুমিয়ে নিই। আমার এখনও চোখের ঘুম কাটেনি।

শুভা তবু দাঁড়িয়ে থাকে। নমি চলে যায় দরজাটা টেনে দিয়ে। হীরা চোখ বুজে থাকে। শুভা হীরার দিকে চেয়ে থাকে। এ লোকটার সঙ্গে, ওর মনের কল্পনাকে যেন মেলাতে পারে না।

হীরা হঠাৎ বলে ওঠে, কী হল?

শুভা একটু চমকে ওঠে। বলে, না কিছু না।

তারপরে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা একটা কথা।

কী?

শুনতে পাই, তালাগুনিন খুব সাংঘাতিক লোক, অনেক টাকা তার। তার ঘরের এ দুরবস্থা কেন?

 দূর, কোথায় টাকা। কোনওরকমে দিন চলে যায়। বড় দাঁও সেই কবে মেরেছি, সেই টাকা ভাঙিয়েই চলছে। আর মাঝে মধ্যে ছুটকো ছাটকা চলে, ওতে কিছু হয় না।

তার মানে ছিঁচকেমি।

হ্যাঁ, বড় কাজ অনেকদিন হয়নি। সেই ফেঁসে গেল বলেই তো তোমার ঘরে লুকিয়েছিলাম। এখন বেকার।

কিন্তু এভাবে কি সত্যি চালানো যায়?

কেন যাবে না? নরেশরা কী করছে। ওরা ব্যবসার নাম করে দাঁও মারছে, ওদের অনেক লোকজন, দল, অফিস সব আছে। আমার ও সব নেই। মেরে নিয়ে আসি, যদ্দিন চলে। চলে যায়, তারপর আবার বেরিয়ে পড়ি।

নরেশ এক রকমের চোর, তুমি আর এক রকমের চোর। তবু চোর তোত।

হীরা লাফ দিয়ে উঠে বসে। বলে, এই দ্যাখ, মা গোঁসাইয়ের মতো বক্তিমে আরম্ভ করো না বলে দিচ্ছি, ও সব আমার ভাল লাগে না।

শুভা চুপ করে চেয়ে থাকে, কিছু বলে না। সরে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়ায়। বাইরের দিকে চেয়ে থাকে। হীরা আবার শুয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ পর শুভা হঠাৎ বলে ওঠে, কত কাল বাইরে বেরুইনি।

হীরা তড়াক করে উঠে বলে, বেরুবে?

শুভা অবাক হয়ে বলে, কোথায়?

যেখানেই হোক, একটু ঘুরে আসব।

এখুনিই?

কী হয়েছে?

 হীরা নমিকে ডেকে বলে। নমি ওর একটা বোয়া কাপড় দেয়। তাই পরে হীরার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে শুভা। হীরা ট্যাক্সিতে তুলে, শুভাকে ময়দানে নিয়ে যায়। গঙ্গার ধারে ঘোরে। শীতের সকালবেলা, মিষ্টি রোদে বেড়াতে ভালই লাগে। তারকার সঙ্গেও শুভা বেড়িয়েছে, কিন্তু সেটা ছিল আলাদা। এটা অন্যরকম। মনের মধ্যে একটা দ্বিধা, ভবিষ্যতের নানান সংশয়ের আর, অথচ কোথায় যেন একটা মুক্তির স্বাদও অনুভূত হয়। তারকার সঙ্গে যখন বেড়িয়েছে, ঘুরেছে, তার মধ্যে ছিল একটা নতুন মদের মতো নেশা। অমৃতের বদলে যা গরল হয়ে উঠেছে, সেই গরলেরই খোয়ারি কাটছে এখন।

গঙ্গার ধারে বসে, হীরা বলে, এভাবে বেড়াতে ভুলেই গেছি, সত্যি।

এরকম বেড়িয়েছ কখনও?

হ্যাঁ, একটা মেয়ের সঙ্গেই বেড়াতাম মাঝে মাঝে। প্রেম করতাম।

 বলে হো হো করে হেসে ওঠে হীরা। শুভা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। হীরা বলে, তখন অবিশ্যি চোর হইনি। মেয়েটাও বলত, আমাকে নাকি ভালবাসে। কিন্তু একটা বেকার ছোঁড়ার সঙ্গে মেয়েরা কদিন প্রেম করতে পারে বলো। তাই কেটে পড়ল।

কোথায় গেল?

ভাল রাস্তায় যায়নি শুনেছি। তবে টাকা করেছে মেলাই।

ইঙ্গিতটা শুভা বুঝতে পারে। হীরার কথা আর হাসির মধ্যে তিক্ততার ঝাঁজটা পায় ও। তারপরে কথায় কথায় হীরা ওর প্রথম চুরির কাহিনী বলে। কী ভাবে এক ব্যবসায়ীর কাছে ও চাকরির জন্যে গিয়েছিল। লোকটা তার নিজের আলাদা ঘরে বসে হীরার সঙ্গে কথা বলছিল। লোকটা আসলে ছিল স্মাগলার। হীরাকে বলেছিল, নানান জায়গায় নানা ধরনের মাল চালাচালি করতে সে রাজি আছে কি না। তা হলে ভাল মাইনে আর কমিশন দুই-ই দেবে। অথচ হীরা গিয়েছিল, একটা সাধারণ চাকরির আশাতেই।

লোকটার সঙ্গে এই সব কথা যখন হচ্ছিল তখনই ফোন বেজে ওঠে। ফোনের কথা শুনেই লোকটা আঁতকে ওঠে। রিসিভার রেখে দিয়ে হীরাকে বলে, তুমি একটু বসো, আমার ড্রাইভার কাছেই কাকে। চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে। আমি আসছি।

লোকটা চলে যেতেই, বিদ্বেষে আর তিক্ততায় ওর মন ভরে ওঠে। হঠাৎ ওর লক্ষ পড়ে, নোকটার স্টিল আলমারির দিকে। তৎক্ষণাৎ ওর মনে হয়, আলমারিটা খুলতে পারলে কেমন হয়? সবই তো জোচ্চোরির টাকা। নিশ্চয় আলমারিতে কিছু আছে। তাড়াতাড়ি উঠে ও হাতল ঘোরায়। চাবি বন্ধ ছিল। সামনেই টেবিলের ওপর একটা কাগজকাটা চুরি পড়েছিল। সেটা চাবির ঘরে ঢুকিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। তাতে খোলেনি। তখন হন্যে হয়ে ও একটা পেরেক খুঁজেছিল। ওর মনে হয়েছিল, একটা তিন ইঞ্চি পেরেক ঢুকিয়ে, কোনওরকমে ডানদিকে মোচড়াতে পারলে, ওটা খুলে যাবে।

পেরেক ও খুঁজে পেয়েছিল দেওয়ালে গাঁথা অবস্থায়। সেটাকে খুলতে পেরেছিল। পেরেকটা চাবির গর্তে ঢুকিয়ে পিন গাঁথার যন্ত্র দিয়ে চেপে ধরে চাড় দিতেই, সত্যি সত্যি লকটা খুলে গিয়েছিল। আলমারি খুলেই, ও আর কিছু লক্ষ করেনি, শুধু দেখেছিল, বেশ কিছু নোট সাজানো রয়েছে। কোনও চিন্তা না করে, টাকাগুলো পকেটে পুরেছিল। তাও সব টাকা নিতে পারেনি। ওর হাত-পা কাঁপছিল, ঘাম ঝরছিল, গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। লকটা করতে পারেনি। এমনি হাতল ঘুরিয়ে বন্ধ করে, ঘরের বাইরে চলে এসেছিল। গদিতে যে দু-তিনজন কর্মচারী ছিল, তাদের বলে এসেছিল, দেরি হয়ে যাচ্ছে, পরে আবার একদিন আসবে।

সেই ওর প্রথম চুরি, যে চুরির জন্যে ও ধরা পড়েনি। ওকে কেউ দীক্ষা দেয়নি। ও নিজেই নিজেকে দীক্ষিত করেছিল এবং সেই থেকে এটাকেই ধ্যান-জ্ঞান করেছিল, আজ পর্যন্ত দুবার ধরা পড়েছে। একবার ছমাস, আর একবার দশ মাস জেল খেটেছে। কিন্তু চুরি ধরা পড়েনি কখনও। তবে ও যত বড় চোর নয়, নামটা তার চেয়ে বেশি। দলের সঙ্গে না থাকার জন্যে, ওর শত্রুও বেশি।

বলে, হীরা ধপাস করে গঙ্গাধারের দূর্বায় শুয়ে পড়ে। বলে, কেরানির ছেলে চোর হয়ে গেলাম।

কথাটা এমনভাবে বলে যেন ও মজা করছে। কিন্তু ওর মুখে তার কোনও চিহ্নই নেই। শুভা গঙ্গার বুকে দৃষ্টিপাত করে। তখনই সাইরেন বেজে ওঠে। ভাঁটার শেষ, জোয়ার আসছে।

শুভা কখন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ ওর খেয়াল হয়, হীরা কখন যেন ওর হাতটা ধরেছে। হীরা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। শুভা ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। হীরা জোরে হেসে ওঠে বলে, বেকার আর চোর সমান। কোনও মেয়েই তাকে চায় না। তবে দোহাই বাবা, আমি প্রেম করতে চাইনি। এমনি একটু হাতটা ধরেছিলাম। তোমাকে দেখে ভারী অবাক লাগে আমার। তোমার ভাগ্যটা অদ্ভুত।

তারপরেই লাফ দিয়ে উঠে বলে, চলো।

.

টালিগঞ্জে ফিরে শুভা যখন শোনে, ধীরু আর বিশু ইস্কুলে গিয়েছে, তখন ওর খুব অবাক লাগে। আবার নমির মুখে এ কথাও শোনে ইস্কুলে না ছাই, গিয়ে দেখ, কোথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ওদের আবার লেখাপড়া হবে?

কয়েক দিন এরকম কাটে। শুভা লক্ষ করে, ধীরু আর বিশু যে কেবল ইস্কুল পালিয়ে, উচ্ছঙ্খল দুর্বিনীত হয়ে উঠছে তাই নয়। নমি আর সবির সঙ্গেও, এই প্রকাণ্ড বাড়ি এবং পাড়াটার যে সব ছেলে আড্ডা মারতে আসে তারা কেউ ভাল নয়। দেখলেই বোঝা যায়, তারা অন্ধকারের জীব। তাদের ভাব, ভাষা, ভঙ্গি অত্যন্ত নিচু শ্রেণীর। সেই সঙ্গে নমি সবির আচরণও কদর্য লাগে। শুভা নেহাত নতুন বলে, ওদের সামনাসামনি চক্ষুলজ্জা হয়। অন্যথায় ওরা একেবারে বেহেড বেলাজ।

কোনওরকমে রান্নাটা করে দুজনে। তা ছাড়া যখন খুশি দুজনে বেরিয়ে যাচ্ছে, ফিরে আসছে। শুভাকে পেয়ে ওদের আরও সুবিধা। রান্না ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে দুজনে আড্ডায় মেতে যায়।

তথাপি, শুভাকে ওরা ভাল না বেসে পারে না। ওদের মনে কোথায় যেন একটা সমীহ বোধও আছে শুভার প্রতি। শুভার সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত ইয়ার্কি ঠাট্টা করতে গেলে, ওদের যেন কোথায় আটকে যায়। শুভাও গম্ভীর হয়ে ওঠে। ধীরু ও বিশু একটু ভক্ত হয়ে পড়ে শুভার। যদিও তাতে ওদের এত দিনের জীবনে কোনওই পরিবর্তন হয় না।

প্রায় পনেরো দিন হীরাও কোথাও বেরোয়নি। ও যেন অন্য মানুষ হয়ে উঠেছে। প্রায় একটা সংসারী চরিত্রের মানুষ যেন। শুভার সঙ্গে বক বক করে। একটু আধটু খিটিমিটিও লাগে। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই, একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ওদের মধ্যে কোথায় একটা কী ঘটছে, ওরা নিজেরাও জানে না। ওদের চোখের মুখের ভাবে ফুটে ওঠে। পরস্পরের সান্নিধ্যকে ওদেরও ভাল লাগে।

তারপরে একদিন বিকেল থেকেই হীরার চোখমুখ বদলাতে থাকে। ঘোর সন্ধ্যায় সে যখন বেরুবার উদ্যোগ করে, শুভা এসে সামনে দাঁড়ায়। হীরার চোখের দিকে তাকায়। হীরা ফিরেও চায় না। সে দরজার দিকে যায়। শুভা বলে, না বেরুলে হত না?

হীরা থমকে দাঁড়িয়ে বলে, দিলে তো অযাত্রা করে। খামকা একটা বাধা।

শুভা বলে, কী দরকার এ সব করার। একটা কাজকর্মের ফিকির দেখ না।

 হীরা রুখে ওঠে, এই দ্যাখ, ন্যাকামি কোরো না। তুমি আমাকে খাওয়াবে, না?

শুভা চুপ করে যায়। হীরা আবার বেরুবার উদ্যোগ করে। শুভা বলে, এভাবে চিরদিন কি চালিয়ে যেতে পারবে?

কেন, চালিয়ে আসিনি?

যে কোনওদিন তো তোমার জেল হতে পারে, একটা বিপদও হতে পারে।

হয় হবে।

তখন তোমার এ সব কে দেখবে, ভাই-বোনদের?

 যতক্ষণ নিজে আছি, ততক্ষণ ওরাও আছে। তারপরে আর জানি না।

সেই জন্যেই ওরাও এরকম হয়ে গেছে। কারুরই কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এও তোমারই জন্যে।

আমার জন্যে?

হ্যাঁ। কেবল খাইয়ে পরিয়ে রাখলেই হয়? একবার দেখছ না, ওদের কী অবস্থা হয়েছে?

হীরা এবারে অনুরাগে আর ক্ষোভে ফিরে তাকায়। চিৎকার করে ওঠে, দুত্তোরি তোর নিকুচি করেছে ভাল মন্দর। পেটে দুটো ভাত জুটছে, এই যথেষ্ট। বাকি ন্যাকামো রেখে দাও। ফের যদি আমাকে এ সব বলবে, মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাবে।

বলেই সে চলে যায় বাইরে। শুভা অন্ধকারে একলা দাঁড়িয়ে থাকে। ওর চোখের সামনে ভাসতে থাকে, হীরা নরেশের ঘরে গিয়ে স্টিল সেফ খুলছে। ওদিকে পাশের ঘরে তখন ধীরুর সঙ্গে সবির ঝপড়া মারামারি চলছে।

কিন্তু রাত্রি নটার মধ্যেই হীরা ফিরে আসে। তার মুখ থমথমে। এসেই শুয়ে পড়ে। শুভা ঘরে আসতেই খিঁচিয়ে ওঠে। ও বাধা দেওয়াতেই, হীরা যেতে পারেনি। এরকম বাধা পড়লে সে কোথাও যায় না।

আবার তর্কাতর্কি লাগে, ঝগড়া বেধে যায়। হীরা অত্যন্ত অপমানকর কথা বলে শুভকে। প্রায় মারতে ওঠে। শুভাও পেছিয়ে থাকে না। কিন্তু ও ভীষণ ক্লান্ত আর বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। একটা উদ্বেগ হয়তো গিয়েছে। এ পরিবেশ ওকে থাকতে দিচ্ছে না।

তারপরে আস্তে আস্তে, নমি সবির সঙ্গেও শুভার সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। ওদের আচরণের বিরুদ্ধে কথা বললেই, ওরা শুভাকে অপমান করে। তীব্র বিদ্রুপে জ্বালিয়ে দেয়। শুভা ওদের সঙ্গে সমানে ঝগড়া করে। ওরা ধীরু আর বিশুকে লেলিয়ে দেয়। ওদের পুরুষ বন্ধুদের সামনেই ঝগড়া করে।

পরে আবার শুভার সঙ্গে ওরা হেসে কথা বলবার চেষ্টা করে। শুভা একলা অবাক হয়ে বসে ভাবে, এরা তার কে? কেন সে এদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করে। নেহাত এক ঘরে আছে বলেই তো। ও নিজেই বা ওদের থেকে কত তফাত, কতটুকুই বা ভাল।

তবু শুভা যখন যেখানে আছে, সেখানে ছায়ার মতো কী একটা চিন্তা ওর পায়ে পায়ে ফেরে। মনের মধ্যে প্রতি পদে পদে বিরুদ্ধ ভাব জেগে ওঠে। হীরার চুরির জীবিকা, তার ভাইবোনদের আচার আচরণ সব মিলিয়ে, এই গোটা সংসারটার সঙ্গে ওর একটা সংগ্রাম চলতে থাকে।

অথচ শুভা একটা বাইরের মানুষ। একটা অবিশ্বাস্য অদ্ভুত অবস্থায় এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে।

আবার এই সংঘর্ষ সংগ্রামের মধ্যেই, কখনও কখনও, একটু হালকা হাওয়া ভেসে আসে। কিন্তু তা অহর্নিশ গুমোটের মধ্যে সামান্য পলকের বাতাস মাত্র। এভাবে থাকা যায় না। ওকে সেই খানেই ফিরতে হবে। দেশে, বাবা মায়ের কাছে, এবং সেই শেষ পরিণতির দিকে।

একদিন বিকালের আগেই, হীরার সঙ্গে শুভার ঝগড়া লেগে যায়। এখন শুভা নিজেকেই কোনও এক মাস্টারমহাশয়ের মেয়ে বলে চিনতে পারে না, এত কটু ইতর কথাবার্তা বলে ঝগড়া করে। আর হীরাও শুভকে বলে, শুভা যেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোজগার করে এনে খাওয়ায়, তা হলে সে আর চুরি করতে যাবে না।

শুভাও জবাব দেয়, সে ভাত খাবার আগে, হীরালাল চোর যেন গলায় দড়ি দিয়ে মরে।

হীরা রেগে গিয়ে শুভকে থাপ্পড় মেরে বসে। সেই শুভার শেষ। সেই মুহূর্তেই ওর সিদ্ধান্ত হয়ে যায়, এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একটি কথাও না বলে, হীরার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কেমন করে যে হাওড়ার বাসে ওঠে, কন্ডাক্টরকে করুণভাবে পয়সা না থাকার কথা বলে, নিজেরই চৈতন্য থাকে না। ট্রেনে উঠে, হাওড়া থেকে দেড় ঘণ্টার পথ পেরিয়ে, যখন ওদের স্টেশনে নামে, তখন বিকাল গড়িয়ে গিয়েছে।

স্টেশনের বাইরে এক বার থমকে দাঁড়ায়, তারপর আরও দ্রুত নতুন শহরের ভিতর দিয়ে ওদের বাড়ির দিকে যায়। চেনা পরিচিত কেউ ওকে দেখছে কি না দেখছে, সে চিন্তা ওর মাথায় এক বারও আসে না।

কিন্তু শহরটা যতই শেষ হয়ে আসে, ততই ওর গতি শ্লথ হয়ে আসে। বাড়ির কাছাকাছি এসে, ওর পা আর সরতে চায় না। একটা অর্ধেক তোলা বাড়ির সামনে, ঘোর সন্ধ্যার কোলে আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু দূরেই ওদের বাড়িটা, অন্ধকারে নিশ্ৰুপ দাঁড়িয়ে আছে। শুভার মনে পড়ে যায়, একদিন এ সময়েই প্রথম তাকে বাড়ির বারান্দায় দেখে তারকদা থমকে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু তারকদার কথা আর তেমন মনে পড়ে না। বরং অনেক বেশি যন্ত্রণা কষ্ট অথচ যেন একটা গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে, একটা অন্য লোকের কথা বেশি মনে পড়ে। যে লোকটার চোখের দৃষ্টি বুঝতে ওর ভুল হয়নি। যে লোকটির জন্যে। ওর নিজের মনেও এক আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। যে লোকটির কাছে, একটা আত্মসমর্পণের আবেগে কখনও কখনও মনে মনে ব্যাকুল হয়েছে। যে আবেগ ব্যাকুলতা, জীবনে আর কখনও ও অনুভব করেনি।

কিন্তু দুয়ের মধ্যে একটা ব্যবধান কখনও ঘুচল না। তারই চিহ্ন গালে নিয়ে ফিরতে হয়েছে আজ। ওরা সবাই কেবল নিজেদের মতো করে চায়। অপরের মনটা দেখতে চায় না।

শুভা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। সামনের বারান্দা দিয়ে না গিয়ে, শুভাদের নিজেদের ভাগে পুরনো বাড়ির যে অংশ পড়েছে, ওর ঠাকুরদার আমলের সেই বাড়ির অংশের দিকে এগিয়ে যায়। সেই অংশের, অন্ধকার অলিন্দে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘরের মধ্যে টিম টিম করে আলো জ্বলছে।

শুভা অলিন্দে দাঁড়াতেই, ওর বাবার গলা শোনা যায়, কে, ওখানে কে?

বাতি হাতে শুভার মা বেরিয়ে আসে। জীর্ণ, রুগ্ন স্বাস্থ্য মায়ের? ভূত দেখার মতো চমকে, থমকে দাঁড়িয়ে যায়। বাবা ঘরের ভিতর থেকে আবার জিজ্ঞেস করে কে গো?

শুভা কথা বলতে ভুলে যায়। কাঁদবার কথাও ওর মনে আসে না। খক খক করে কাশতে কাশতে কুঁজো হয়ে ওর বাবা বেরিয়ে আসে। চোখ তীক্ষ্ণ করে দেখে। তারপরেই চমকে, যেন ভয় পেয়ে বলে, কে?

কারুর মুখে কোনও কথা নেই। দেখতে দেখতে ওর ভাই-বোনেরাও এসে পড়ে। ওরা যেন কেউ শুভাকে চেনে না, কোনওদিন দেখেনি। অথচ বিস্ময়ে একটা ভয় পাওয়া চোখে চেয়ে থাকে।

শুভার বাবা, হঠাৎ শক্ত গলায় বলে ওঠে, আর এদিকে না ওখান থেকেই বিদেয় হও। বিষের হাওয়া আর ঘরে ঢুকতে দেব না।

তবু শুভা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ও তো জানতই, কোথায় যাবে এবার। এই পরিণতি ওর জানাই ছিল। চোখের জল আসে আসুক। তবু ওর কী রকম কষ্ট হচ্ছে সবাইকে দেখে। অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এক বার যেন ওর গলা দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, যাচ্ছি।

.

শুভা অলিন্দ থেকেই নেমে আসে। অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়। পিছনে যেন মায়ের গলার ক্ষীণ একটা শব্দ শোনা যায়। কার যেন নিশ্বাস পড়ে। শুভা বাইরে বেরিয়ে আসে।

বেরিয়ে এসে, দরজার কাছেই একটা মূর্তি দেখে, থমকে যায়। অন্ধকারেও চিনতে পারে, হীরা। প্রথমেই বলে, পরের ট্রেন ধরেই ছুটে এসেছি…।

শুভা শোনে না, এগিয়ে যেতে থাকে।

হীরা বলতে থাকে, দ্বিধায় লজ্জায় ভয়ে ভয়ে, তুমি চলে এলে। মুখটা চেপে বসেছিলাম। হঠাৎ নমিটা ছুটে এল কাঁদতে কাঁদতে। পিছনে সবি, ভাই দুটোও।…

শুভা চলতেই থাকে। ওর গন্তব্য শহর পেরিয়ে রেল লাইন। হীরার গলাটা যেন রুক্ষ শোনায়। বলে, নমিটা বলে উঠল, তুই এখনও বসে আছিস দাদা? শুভাদি যে বেরিয়ে গেছে, শিগগির যা, দ্যাখ কোথায় গেল। শুভাদির হাতে যে একটা পয়সাও নেই।

আমি যেন বুঝতেই পারছিলাম না, কী করেছি। অথচ যে হাত তোমার গায়ে তুলেছি…।

হীরা আর কথা বলতে পারে না, স্বর বন্ধ হয়ে যায়। শুভা এগিয়ে যেতে থাকে। ওদের আশপাশ দিয়ে লোকজন যাতায়াত করে। ওদের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। ওরা অন্য জগতের মানুষ যেন।

হীরা আবার গলাটা পরিষ্কার করে বলে, তারপরে সবি আর ভাই দুটো কেঁদে উঠতেই খেয়াল হল, তাড়াতাড়ি ছুটলাম। জানতাম, তুমি কী করবে, কোথায় যাবে। কী ভাবে যে ট্রেনের পথটা চুপচাপ এসেছি। শুভাশুভা তুমি কোনদিকে যাচ্ছ। এদিকে স্টেশন নয়, শুভা।…

শুভা ক্রমে শহরের বাইরের অন্ধকারে, রেল লাইনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। হীরা শুভার হাতটা ধরতে চায়, পারে না। ওর মুখে উদ্বেগ ব্যাকুলতা। শুভার দৃষ্টি রেল লাইনের সিগন্যাল পোস্টের লাল আলোর দিকে।

হীরা আবার বলে, শুভা, আমি সব দেখেছি, ঘরের বাইরে থেকেই তুমি ফিরে চলে এলে। সেখানে তোমার বাবা মা ভাই বোন…

শুভা সহসা ঘাড় ঝাঁকিয়ে দ্রুত চলতে থাকে। এ সব কথা ও আর শুনতে চায় না। হীরা ব্যাকুল স্বরে বলে, শুভা, শুভা, এরা তোমাকে নেয়নি, আমার ভাইবোনদের কাছে চলো। ওরা তোমাকে সত্যি ভালবাসে।

শুভার অস্ফুট কান্না জড়ানো গলায় কেবল শোনা যায়, না না, আর এ সব শুনতে চাই না।…

শুভা প্রায় ছুটতে থাকে। হীরা ওর হাত চেপে ধরে। লাল আলো নীল হয়। হীরা বলে, ওরা তোমার কাছে থাকবে, তুমি যেমন বলবে…

.

গাড়ির শব্দ পাওয়া যায় দূরে। শুভার গলায় এক শব্দ, না না, আর না…

হীরা চিৎকার করে ওঠে, আমিও, আমিও তাই শুভা। আমি আর আগের রাস্তায় চলতে চাই না। আমি–তুমি যা বলেছ–আমি জানি, একটা মানুষ চিরদিন এ সব করতে পারে না। কিন্তু তুমি না থাকলে–

শুভা থমকে দাঁড়ায়। হীরার চোখের দিকে চায় তারপর সহসা মাঠের ওপর মুখ ঢেকে বসে পড়ে।

গাড়িটা তখনও অনেক দুরে। তার ক্ষীণ আলো এসে ওদের গায়ে পড়ে। হীরা আবার বলে, তুমি কাছে থাকলে সব পারব। ওরাও, আমার ভাই-বোনেরাও

কথা শেষ না করে, হীরাও শুভার কাছে নত হয়ে বসে। গাড়ির আলোটা আরও তীব্র হয়। একবার বাঁশি বেজে ওঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *