বাড়িতে ফিরে, আভাকে শুনিয়ে দাদা বলেছিল, স্যার জে. সি-র ছেলেটা শুনেছি লম্পট। রোজই একগাদা মেয়ে নিয়ে, পার্ক স্ট্রিট চৌরঙ্গি পাড়ায় হোটেলে বারে ঘুরে বেড়ায়।
রঞ্জনদা বলেছিল, লম্পট কাকে বলে! মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ালেই লম্পট হয় না। তবে শুনেছি জলি কোনও কর্মের নয়। আর সে কর্ম দিয়ে করবেই বা কী? কলকাতায় যে কটি ব্লু ব্লাড ফ্যামিলি আছে, স্যার জে. সি-র ফ্যামিলি তার মধ্যে সবথেকে নাম করা। ইংরেজ আমলের স্যার, বাপ পেয়েছিল, নাইটহুড। আর রাজা তো অনেক কালের। সারা ইস্ট ইন্ডিয়ায় ছড়ানো ছিল জমিদারি। প্রথাটা উঠে গেলেও, আইনের মারপ্যাঁচে, আর ক্ষমতার জোরে, সরষের মধ্যে ভূত তো ভারতবর্ষের মূল ঘাঁটি। এখনও একেবারে সব ঘুচে যায়নি। কলকাতার সম্পত্তিই তো কোটি টাকার ওপরে। স্যার জে. সি. মগজওয়ালা তোক। অনেক নাম করা কোম্পানির মোটা শেয়ার হোল্ডার। ডিভিডেন্ডের হিসাব কষতে গেলে থই পাওয়া যাবে না। শুনেছি, তিনি বাইরে বিশেষ দেখা দেন না, কিন্তু শাহেনশা লোক।’ রঞ্জনদা চোখ টিপে একটা খারাপ রকমের ইঙ্গিত করেছিল, তার একমাত্র বংশধর জলি। লম্পটও যদি হয়, ওর পক্ষে স্যার জে. সির সম্পত্তির সামান্যও খরচ করতে পারবে না। শুনেছি, স্যার জে. সি. ছেলেকে কিছু একটা তৈরি করবার অনেক চেষ্টা করেছেন। বিলেতে রেখেছিলেন অনেক দিন। অক্সফোর্ডে নামেই ছাত্র ছিল, নাচ-গান নিয়েই মেতে থাকত। এখনও তাই থাকে। বেশ আছে। আভার কপালটা ভালই বলতে হবে।
হ্যাঁ, জলির আর একটা যূপকাষ্ঠের বলি। দাদা ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসেছিল।
এমনি অনেক কথাই হয়েছিল। আভা কোনও কথাই বলেনি। কারণ, তখন ওর বলবার মতো কিছু ছিল না। ছিল কেবল দেখবার এবং শোনবার। জলির চেহারাটা মনে পড়েছিল। লম্বা, রোগা, হাড়পুষ্ট চেহারা। দেখতে খুবই সাধারণ। কথাবার্তা আচরণে, মুগ্ধতা এত বেশি ছিল, পুরুষকে তার দ্বারা সঠিক চেনা যায় না। আভিজাত্যও তেমন চোখে পড়েনি। তেমন কোনও স্বাতন্ত্রও না। ভদ্র, খুশ-মেজাজি। নাচটা জানে ভাল, গান ও বাজনাতেও পারদর্শী মনে হয়েছিল। কিন্তু জয়াকে এত ভয় কেন? ওটাকে তো ভয়ই বলে।
তারপর থেকেই ঘন ঘন নিমন্ত্রণ। চারদিকেই গুঞ্জন চলছিল, জলি এখন আভা ছাড়া আর কারোকে চেনে না। নিমন্ত্রণের তালিকায় অরুণ, বউদি, দিদি, রঞ্জনদা, সবসময় থাকত। জয়ার আচরণ ক্রমেই শক্ত আর আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু হোটেলে রেস্তোরাঁয় জলির ভাল লাগছিল না। ওদের বিশাল বাড়ির, নিজের সীমানায়, আড্ডা জমিয়েছিল। সেখানেও অসুবিধা কিছু ছিল না। পিয়ানো থেকে শুরু করে, যাবতীয় বাজনাই ছিল। নাচের জন্য ছিল বিরাট ফ্লোর। বিশাল ডাইনিং টেবিল, অপর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা। রীতিমতো বার–সেলারে ভরতি উৎকৃষ্ট মদের বোতল। খিদমদগারের ছড়াছড়ি।
আভাকে আগে যারা ঘিরেছিল, তারা সকলেই প্রায় সরে গিয়েছিল। জলির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। যারা দু-চারজন থেকে গিয়েছিল, তারা জলিরই মোসাহেব আর অনুচরে পরিণত হয়েছিল। জয়াকে আর দেখা যাচ্ছিল না। জলি আভাকে নিজের আরও ঘন সান্নিধ্যে টেনে নিচ্ছিল। অলংকার আর পোশাক, দামি উপহারের হার বেড়েই চলেছিল। দিদি বউদিও বাদ যেত না। এমনকী জলি নিজে আভাকে সাজাতে নিয়ে যেত। চুল বাঁধা থেকে, নানা রকমের পোশাকে, সমঝদার শিল্পীকে দিয়ে সাজানো। তারপরেই এক দিন জলি আভাকে নিয়ে স্যার জে. সির কাছে হাজির হয়েছিল। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আভাকে।
আভা যেন কেমন একটা ভয়ের শিহরন অনুভব করেছিল। স্যার জে. সির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেনি। জলির থেকেও যেন অনেক বেশি শক্ত আর সুপুরুষ। মাথায় ধূসর চুল, সাদা ট্রাউজার আর ফুল স্লিভ শার্ট পরা লোকটির চোখ দুটো যেন ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ আর উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। জলির থেকে মাথায় উঁচু না হলেও মনে হয়েছিল যেন অনেক উঁচু। উন্নত নাসা, চওড়া কপাল, মোটা ঠোঁট, চিবুকের মাঝখানে ভাঁজ। জলির থেকে চওড়া। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে, আভার মনে হয়েছিল, ও যেন নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর গোটা শরীরটা কুঁকড়ে গিয়েছিল। এবং শিরদাঁড়ায় একটা কম্পন অনুভব হয়েছিল। আধুনিকতা আর স্বেচ্ছাবিহার সমাজের যে স্তরেই ও উঠে থাকুক, ভিতরে তো ছিল। একটি হিন্দু মধ্যবিত্ত মেয়ে। অতএব, যেটা ওর কাছে স্বাভাবিক আর অনিবার্য মনে হয়েছিল, তাই করেছিল। নত হয়ে ভেঙে পড়েছিল স্যার জে. সি-র পায়ের কাছে। প্রণাম যাকে বলে।
স্যার জে. সি. আভাকে ডানা ধরে তুলেছিলেন। পিছনে কোমরের নীচে হাত দিয়ে, সামনে টেনে নিয়েছিলেন। আভার যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তিনি ঈষৎ হেসে জলির দিকে এক বার দেখে আভাকে সরিয়ে দিয়ে আবার দেখেছিলেন। চাপা গম্ভীর স্বরে ইংরেজিতে বলেছিলেন, কচি মুরগির গলা আর বুকের হাড়ের মতোই মনোরম। শুনেছি ভাল নাচে। দেখব এক দিন। তুমি একে তোমার সারা জীবনের বালিকা বন্ধু করে রাখতে পারো, আর ওর সারা জীবনের জন্য ভাল কিছু করতে পারো, যাতে ওকে জীবনধারণের জন্য কিছু ভাবতে না হয়।
সে সব কথার কী অর্থ, আভা বুঝতে পারেনি। জলিকে কেমন অস্বস্তিতে হাসতে দেখেছিল। কুণ্ঠা আর দ্বিধার সঙ্গে বলেছিল, আমি আর একটু বেশি দূর পর্যন্ত ভেবেছি।’
তুমি ভাবতে পারো, সেটাই তো আশ্চর্যের কথা। স্যার জে. সি. সুরহীন স্বরে বলেছিলেন, বরং না ভাববার চেষ্টা করো। ভাববার দায়িত্বটা এত কাল যাদের ছিল, তাদেরই থাক। তুমি তোমার মতো থাকো। যাও, জীবনকে উপভোগ করো।’
.
জলি আভার হাত ধরে বেরিয়ে আসবার সময়, স্যার জে. সি. বলেছিলেন, আমার এখানে ওর নাচ একদিন দেখব।’
আভার মনে কেমন একটা দুর্বোধ্য ভয় জেগেছিল। ও তাড়াতাড়ি জলির সঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। আবার প্রণাম করার কথা ওর মনে আসেনি। মাথা নিচু করে, স্খলিত স্বরে উচ্চারণ করতে পেরেছিল, যাচ্ছি।’
স্যার জে. সি.-র পাথরের মতো মুখে ঈষৎ হাসি লেগে ছিল। কিছুই বলেননি। কিন্তু বেরিয়ে আসবার সময়, ভিতর দিকের একটা দরজা খুলে, সেই ঘরে জয়া ঢুকেছিল। আভা দেখতে পেয়ে অবাক হয়েছিল। ও জলিকে জিজ্ঞেস করেও স্যার জে. সি-র কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারেনি। কোনও মেয়ের সৌন্দর্যের সম্পর্কে, ওইরকম ভাষা আগে কখনও শোনেনি। ব্যক্তিটির সম্পর্কে ওর মনে একটা ভয় ও বিতৃষ্ণা চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। জয়ার সম্পর্কেও জলির কাছ থেকে স্পষ্ট কিছু জানতে পারেনি। জয়া ডিভোর্সি, শুধু এইটুকু জেনেছিল। কিন্তু সে কেন আর জলির কাছে আসত না, কখন কোথায় তার অবস্থান, সবই কেমন অস্পষ্ট রহস্যময় মনে হয়েছিল।
তারপরেই একদিন সেই ঘটনা, ধর্ষণ। জলির সেই বিকৃত উন্মত্ত চেহারা। অন্য ঘর থেকে তখন বাজনার মৃদু শব্দ ভেসে আসছিল। আভার শরীরে সেই প্রথম এক অনাস্বাদিত ব্যথা ও যন্ত্রণা। মনে তীব্র ভয়। হৃতসর্বস্ব নিঃস্ব আর অসহায় বোধের গভীরতা ওকে যেন অবশ করে দিয়েছিল। ও শব্দ করে কাঁদতে পারেনি। বালিশে মুখ গুঁজে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। আর জলি ঘোষণা করেছিল, আমি তোমাকে চিরকালের বান্ধবী করে রাখব না, যার মানে রক্ষিতা। বাবা তা-ই চান। আমি তোমাকে বিয়ে করব।’ মেহগিনি কাঠের অদ্ভুত আর বিচিত্র দর্শন আলমারি খুলে, সে একটা হিরের আংটি পরিয়ে দিয়েছিল আভার আঙুলে। নগ্ন ধর্ষিতাকে তুলে দাঁড় করিয়েছিল সামনে। নিজের হাতে পোশাক পরিয়ে
সেই রাত্রে বাড়ি ফেরার সময়, দিদি বউদি ওর দিকে বারে বারে, সন্দিগ্ধ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছিল। দাদা আর রঞ্জনদাও। বাড়ি ফিরে দাদা বলেছিল, বলিদান হয়ে গেছে, এ বার ছিঁড়ে খাবার পালা। বউদি আংটি দেখে চমকে উঠেছিল। কিন্তু কী ঘটেছিল, আভা তা বলতে পারেনি। দু সপ্তাহ পরেই, জলি সেই অসামান্য ঘটনা ঘটিয়েছিল। আভাকে রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে করেছিল। বিশেষ বিশেষ মহলে, সে খবর যেন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। বিয়ে করে জলি কলকাতার এক বড় হোটেলের সুইটে উঠেছিল। কোনও পার্টি দেয়নি। খুব কম বন্ধু বান্ধবী আর আভার দাদা বউদি দিদি রঞ্জনদাকে নিমন্ত্রণ করেছিল। তবু, অনেক অনিমন্ত্রিত ব্যক্তি এসেছিল। উপযাচক হয়ে, জলিকে আর আভাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গিয়েছিল। আসলে, তারা যেন অবাক কৌতূহল আর অবিশ্বাস নিয়ে ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করতে এসেছিল। রঞ্জনদা বলেছিল, নীলরক্তের ধারকেরা খুবই মুষড়ে পড়েছে। তবে কলকাতার বুকে এটা একটা ইতিহাস। এখন ইতিহাসের ধারাটা কোন দিকে যায়, সেটাই দেখার।
জলি রাত্রে আভাকে নিয়ে, ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছিল। মা খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু কেঁদেছিলেন। মায়ের কান্না দেখে, আভাও কেঁদেছিল। জলির সঙ্গে ফিরে গিয়েছিল হোটেলে। আভা তখনও স্বামীসহবাসের জন্য দেহে মনে প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেনি। তাতে যায় আসেনি কিছুই। জলির ভিতর থেকে, সেই মূর্তি আবার বেরিয়ে এসেছিল। বিকৃত উন্মাদ এক ধর্ষক।
কয়েক দিন হোটেল বাসের সময়ে অনেকে এসেছে গিয়েছে। বন্ধুবান্ধবীরা ছাড়া। কী কথাবার্তা হয়েছিল, আভা জানে না। জলি আভাকে নিয়ে বাড়ি গিয়েছিল। ওর কল্পনায় যে বিবাহিত জীবন ও সংসারের চিত্র ছিল, আদৌ সেই পটভূমি ছিল না। জীবন আগের মতোই চলছিল। আভা গর্ভবতী হয়েছিল। জানত ও গর্ভধারণ করেছিল সেই প্রথম দিনই। জোজো পেটে এসেছিল। স্যার জে. সির বিশাল বাড়িতে, একমাত্র ছেলের বিলাসবহুল উইঙে আভার করণীয় কিছুই ছিল না। এমনকী, জলিরও ভূমিকা স্বগৃহের কর্তা না। বা আভা গৃহিণী না। সবই এক অদৃশ্য নির্দেশে চালিত হত। টাকার অভাব ছিল না। বাড়িতে পার্টি, নাচ গান পান ভোজন, বাইরে বার রেস্তোরাঁয় যাওয়া, আগের মতোই চলছিল।
আভা আশা করত, স্যার জে. সি. ওকে দেখতে চাইবেন। ডেকে পাঠাবেন। তা ঘটেনি। জলির বিকৃত যৌন রুচির আরও নতুন পরিচয় পেয়েছিল। ধীরে, পরে, আস্তে আস্তে। পরিণামে, আভার পক্ষে মর্ষকামী হয়ে ওঠা যেন অনিবার্য ছিল। কিন্তু বিপরীত, ও শীতল হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের দশ মাস পূর্ণ হবার আগেই জোজোর জন্ম হয়েছিল। অবিশ্যিই কলকাতার বিখ্যাত নার্সিংহোমে জোজো জন্মেছিল। জলির জীবনে কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। সে তার নিজের মতো জীবনযাপন করছিল। চোখের সামনে কিছু না দেখলেও, আভা বুঝতে পারত, অনেক মেয়ে ছিল জলির প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে। যদিও আভাকে বাধ্য করা হয়নি, জোজোকে নিয়ে গৃহের বিলাস আর আরামের মধ্যে একলা পড়ে থাকতে হবে। আয়া, দাসী, ভৃত্যের অভাব ছিল না। জোজোকে দেখাশোনার জন্য একান্তভাবে ওর ওপর কোনও দায়িত্ব ছিল না। তবু ও বাড়ির পার্টি ছাড়া, বাইরে বিশেষ যেত না। মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেত। কখনও কখনও জোজোকে নিয়ে যেত। মা জিজ্ঞেস করতেন, জোজোর অন্নপ্রাশন এবং নাম রাখার কী ব্যবস্থা হচ্ছে? আভা জবাব দিতে পারত না। বরং, ওর এমন ভয়ও হত, বাইরে বেরিয়ে, ফিরে গিয়ে হয়তো দেখবে, স্যার জে. সি-র বাড়ির দরজা ওর সামনে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এমন সম্ভাবনার কথা ওকে কেউ বলেনি। ভয়টা ওর মনে কেমন করে যেন জন্ম নিয়েছিল।
মা শারীরিক কষ্ট ভুলে, সাত মাসের জোজোকে নিয়ে কালীঘাটে গিয়েছিলেন। প্রসাদ খাইয়েছিলেন, এবং তরুণকে দিয়ে যথাবিহিত সামান্য অনুষ্ঠানও করেছিলেন। তরুণ যেহেতু জোজোর মামা, তার হাতেই অন্ন গ্রহণ বিধিসিদ্ধ ছিল। পুরোহিত নামকরণের জন্য একটি আদ্যক্ষর বলেছিলেন, ব’। মা বলেছিলেন, বিবেকরঞ্জন মজুমদার। আভা সব কথাই জলিকে বলেছিল। জলি অবাক হেসে বলেছিল, আমাকে বলোনি কেন? জোজোর অন্নপ্রাশন আমাকে বাদ দিয়ে?’ সে বাড়িতে পার্টি দিয়েছিল। আভা দাসদাসীর কাছে, স্যার জে. সির সীমানার খবর কিছু কিছু পেত। সেখানেও পার্টি হত। নাচ গানও বাদ যেত না। সেখানে সব হোমরা চোমরা ব্যক্তিদের আগমন ঘটে। মিনিস্টার, এম. পি. থেকে হাইকোর্টের জজ, ব্যারিস্টার, পুলিশের বড় বড় কর্তা, কলকাতার নামকরা বিখ্যাত সব ব্যক্তি। কিন্তু জয়া কেন সেখানে, এ রহস্য বুঝতে পারত না। শুনেছিল, জয়াদের বাড়ি আছে আলিপুরে। সেখানে না থেকে, স্যার জে. সি-র কাছে কেন। আগে জানত, জলির সীমানায় জলি আভাকে বিয়ে করার আগে থেকেই, জয়া স্যার জে সি-র সীমানায় চলে গিয়েছিল। স্যার জে সি-র পরিবারের দু-চারজন আত্মীয়স্বজনকে আভা দেখেছিল। তারা কালেভদ্রে আসত। সে বাড়িতে জয়ার ভূমিকাটা কী?
কিছুকাল পরেই সেই অভূতপূর্ব কদর্য নগ্ন ঘটনাটি ঘটেছিল। জয়া এসেছিল জলির উইঙে। জলিও ছিল। জয়া আভাকে ডেকে নিয়ে একসঙ্গে বসেছিল। জয়া আভার সঙ্গে হেসে কথা বলেছিল। আভা মনে মনে অবাক হলেও, খুশিই হয়েছিল। জয়া নিজের থেকেই আভাকে বলেছিল, হুইস্কি বের করো, আজ আমরা তিনজন ফ্যামিলি পার্টি করব।’
আভা নিজেই হুইস্কি পরিবেশন করেছিল। তিনজনেই পান করছিল। কিন্তু আভার যেটায় অরুচি, জলি ফিলম আর প্রোজেক্টর বের করে, সেই ব্লু ফিলম চালিয়েছিল। জয়া আভাকে আদর করেছিল। তারপরেই সেই বিবস্ত্র নগ্নতার খেলা। রেহাই পায়নি আভাও। সেনগ্নতার কোনও তুলনা নেই। আভা জলিকে ও জয়াকে দেখে, ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। যেতে দেওয়া হয়নি। সেই কুৎসিত অনুষ্ঠানে আভাকে জোর করেই অংশগ্রহণ করানো হয়েছিল। জয়ার ভূমিকার একটা দিক বীভৎস রূপে উন্মোচিত হয়েছিল। কিন্তু আসলে পিতাপুত্রের দুই সীমায়, জয়ার প্রকৃত ভূমিকাটা কী? জেনেছিল, জয়া স্যার জে. সি-র শ্যালক কন্যা। জলির মামাতো বোন। বিয়ে হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের এক ক্ষয়িষ্ণু রাজ পরিবারের ছেলের সঙ্গে। বিয়ের তিন বছরের মধ্যেই বিচ্ছেদ ঘটেছিল। বিয়ে ও বিচ্ছেদের কথাটা জলির মুখেই শুনেছিল–অনেকটা ঠাট্টা আর বিদ্রুপের সঙ্গে। সে বিবৃতিও এক কলঙ্কিত কাহিনীর। জয়া নাকি ওর শ্বশুরের ভোগেই লাগত। স্বামীর পক্ষে সম্ভব ছিল না বাবার সঙ্গে লড়ে ওঠা। সম্পত্তির বিষয়টিই ছিল সবকিছুর মূলে। জয়ার এবং ওর স্বামীর। শ্বশুর সর্বেসর্বা, যাকে যা খুশি দেবার মালিক। জয়া কিছু হাতড়াতে পেরেছিল। শ্বশুরের প্রতিদান হিসাবে। আর তা নিয়েই, শেষপর্যন্ত ওকে সরে আসতে হয়েছিল। বিচ্ছেদের মামলায় বিবাদী পক্ষের কোনও বিরোধিতা না থাকায়, আদালত জয়ার পক্ষেই ডিক্রি দিয়েছিল। এবং আরও কিছু নগদ এবং অলংকার পেয়েছিল।
কিন্তু শ্বশুরের বিছানা থেকে ভাইয়ের বিছানায় কেমন করে আসা যায়? আর ওই রকম বীভৎস বিকৃত যৌন প্রমোদ চরিতার্থতার জন্য? ব্যভিচারের কি কোনও সীমা নেই? জয়া আবার জলির উইঙে ফিরে আসতে আরম্ভ করেছিল, আর সেই বীভৎস অনুষ্ঠানের পুনরাবৃত্তিও ঘটতে আরম্ভ করেছিল। সেটা কি জয়ার এক রকমের প্রতিহিংসা পরায়ণতা–আভার প্রতি? আভাকে সরে যাবারই ইন্ধন জোগানোর একটা বেপরোয়া চেষ্টা নাকি? কেমন করে সরবে আভা? সরতে পারেনি। কারোকে বলতে পারেনি সেইসব ঘটনা। বলেছিল, অনেক পরে, জোজোর কেস নিয়ে, কোর্টের পিটিশনে লিখিতভাবে। সে সব পরের কথা। স্যার জে. সি-র সঙ্গেই বা জয়ার সম্পর্ক কী? জবাবের রূপটা আভার গায়ে কাঁটা দিয়ে, তীব্র বিবমিষার উদ্রেক করেছিল। তাও কি সম্ভব? শ্বশুরের দ্বারা বলাৎকারের পরিণাম কী? গম্যসম্যতার কোনও নির্দেশই রাখে না?
স্যার জে. সির প্রাসাদে সর্বত্রগামী দুজন বয়স্কা দাসী আভার প্রতি কিছুটা করুণা করত। তাদের মুখেই শুনেছিল, জয়ার মা জয়ার থেকেও সুন্দরী ছিলেন। তিনি এক সময়ে স্যার জে. সি-র সীমানায় প্রায়ই আসতেন। রাত্রিবাসও করতেন। জলির মা মারা গিয়েছিলেন অনেক আগেই। দাসীরা কখনই কিছু ব্যাখ্যা করে বলত না। ভাষার মধ্যে ইঙ্গিতই ছিল যথেষ্ট। জয়ার মায়ের সঙ্গে স্যার জে. সি. প্রেম করতেই পারেন। বিপত্নীক মানুষ, শ্যালক পত্নীর সঙ্গে সম্পর্কটাও মধুরই হবার কথা। তিনি ছাড়াও, অনেক মহিলারই আগমন ঘটত স্যার-এর দুর্গের মতো সীমানায়। জয়ার মা আত্মহত্যা করেছিলেন। তার কারণ অবিশ্যি দাসী বলতে পারেনি। এবং তারপরে, তারই কন্যা, জয়ার কী ভূমিকা স্যার জে সি-র উইঙে? জলির ক্ষেত্রে তো সবই যেন ইচ্ছাকৃতভাবে জানানো হয়েছিল। কিন্তু জয়া সম্পর্কে সমস্ত দাস দাসী, এমনকী স্যার জে. সি-র অফিস কর্মচারীদের বা এত ভয় কীসের? সীমাহীন তার প্রতাপ প্রতিপত্তি। জলিও যেন জয়ার করুণাপ্রার্থী। এবং, জলি আভার ক্ষেত্রে ধর্ষকের ভূমিকা নিয়েছিল। অথচ জয়ার ক্ষেত্রে তাকে মর্ষকামীর ভূমিকায় দেখা যেত। কী এ সবের রহস্য? বিয়ের বছর না কাটতেই, আভার এ অভিজ্ঞতাও হয়েছিল, জলি পুরুষ হিসাবে সমর্থ শক্ত না। বিবিধ বিকৃত আচরণেই তার সুখ।
আভার সন্তান ছিল, স্বামীও ছিল। কিন্তু কোনও সংসার ছিল না। সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, ওর ভিতরে বিদ্রোহ ধূমায়িত হত। দেহে মনে ও ছিল উপবাসী। অথচ ওর আয়ত্তে ছিল সবই। ও নিজেও গা ভাসাতে আরম্ভ করেছিল। মনের সেই হিন্দু মধ্যবিত্ত সংস্কারগুলো কবেই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। জলির সঙ্গে বাইরে ঘুরে বেড়ালেও, ওর পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পেয়েছিল। এবং নতুন বন্ধুও জুটেছিল। ওর রূপ তত কমেনি, আরও দীপ্ত, আগুনের মতো লেলিহান হয়েছিল। সেই সঙ্গে পরিচয় জলির স্ত্রী। স্যার জে. সি-র পুত্রবধূ। স্তাবকের সংখ্যা কমেনি, বেড়েছিল। প্রেমের নামে, উচ্ছলতার চোরা পথে ভেসেছিল।
কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই, যে বিরোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে আভার বাইরের জীবনের কোনও সম্পর্ক ছিল না। জলির অবহেলা বাড়তে আরম্ভ করেছিল। অবহেলা ঘৃণায় পরিণত হয়েছিল। এবং উন্মত্ত ক্রোধে, আভার ওপর শারীরিক পীড়নও শুরু হয়েছিল। জয়া স্পষ্টই বলতে আরম্ভ করেছিল, এটাই তো অনিবার্য ছিল। তুমি কেন এ বাড়ির পুত্রবধূ, এ প্রশ্নের কোনও জবাবই মেলেনি। স্যার জে. সি. বিশ্বাসই করেন না, জলি বিয়ে করেছে। একজন সামান্য দুস্থ মাতাল উকিলের মেয়ে স্যার জে. সি-র পুত্রবধূ? বলতে গেলে, হোটেলে বারে নেচে গেয়ে ছেনালি করা ছাড়া যার আর কোনও পরিচয়ই নেই? …’
জোজোর তখন পাঁচ বছর। এক বছরের মধ্যে দ্রুত পট পরিবর্তন হয়েছিল। কোন অদৃশ্যলোক থেকে সেই পটপরিবর্তনের অতি সূক্ষ্ম অথচ অমোঘ খেলা চলছিল, আভা অনুমান করতে পারত। সেই অদৃশ্যলোকের ক্রীড়াবিদটিকে জীবনে ও এক বারই দেখেছে। তখন পর্যন্ত এক বার। যার সম্পর্কে ওর মনে একটা অলৌকিক ভয় স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। প্রথম দিকে আভাকে অতিষ্ঠ হয়ে মায়ের কাছে চলে যেতে হত। কখনও জোজোকে নিয়ে। কখনও একলা। অত্যাচার পীড়নের মাত্রা বাড়ছিল। আভাও রুখে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছিল। বিশাল শক্তির কাছে, তা ছিল, অতি দুর্বলের চেষ্টা। তবু তার মধ্যেই বব পেটে এসেছিল। যখন জানাজানি হয়েছিল, তখন গর্ভপাত আভার পক্ষে বিপজ্জনক ছিল। তবু গর্ভপাতের জন্য নানাভাবে ওর চারদিকে কঠিন ব্যুহ তৈরি করা হয়েছিল। যে বুহ্য ভেদ করে, ও পালিয়েছিল। শেষ বারের মতো, সেই বিশাল প্রাসাদ থেকে ওর প্রস্থান।
কিন্তু জোজোকে ওরা ছাড়েনি। জোজোকে দেখতে গিয়েও, বন্ধ দরজা থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। বব জন্মেছিল হাসপাতালের ভিড়ভারাক্রান্ত প্রসূতিদের মাঝখানে। তখনও তরুণ আর জবার ওপরেই নির্ভরশীল। ওর যাবতীয় অলংকার শাড়ি সবই সেই বাড়িতে পড়েছিল। কেবল একটি হিরার আংটি আর দুই কানে দুটো মুক্তোর অলংকার ছিল। চেক বইটা এসেছিল সঙ্গে। জোজোকে দেখবার জন্য অস্থির আর আর্ত হয়ে উঠেছিল। অনেক বার বাইরে থেকে টেলিফোন করে কাতর অনুরোধ জানিয়েছে, এক বার ওকে, দেখতে দাও। যেখানে তোমাদের ইচ্ছে সেখানেই।’.নির্মমভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। তার পরই সেই ভয়ংকর ঘটনা। আভার চোখের সামনে ভেসে উঠল, ছ’বছরের জোজোর সেই ক্ষতবিক্ষত মূর্তি। আভার সারা শরীর যেন এক দুঃসহ ব্যথায় মুচড়ে বেঁকে উঠল। দু হাত মুখ ঢাকল।…
.
ববের কান্নায় আভায় ঘুম ভাঙল। ঘুম আসবে, ও ভাবতে পারেনি। কিন্তু ভয়, উৎকণ্ঠা, অশুভ আর দুঃসহ অতীত রোমন্থন, সবকিছু জারিত হয়ে ঘুম ওর ভিতর থেকেই ওকে গ্রাস করেছিল। ঘুম ভাঙতেই, মুহূর্তেও ওর ভুল হল না, কোথায় আছে। চকিতে উঠে বসল। বব ওর মাথার কাছে বসে খুঁতখুঁত করে কাঁদছে। প্রথমেই চোখে পড়ল, ঘরে দিনের আলোর আবছায়া। কিন্তু দক্ষিণের জানালার পরদাটা মাঝে মাঝে উড়তেই, বাঁকা রোদের একটা ঝিলিক পশ্চিমের দেওয়ালে পড়ছিল। আর সবই বন্ধ থাকার দরুন, বেলা কতটা হয়েছে বুঝে উঠতে পারল না। পাশে হাত পড়তেই টের পেল, বব প্রস্রাব করে বিছানা ভিজিয়েছে। সংকোচ বোধ করল, পরের বিছানা এ রকম নোংরা হওয়ায়। রবার। ক্লথ ছিল না, অতএব এটা প্রায় অনিবার্যই ছিল। তবু ও তাড়াতাড়ি ববকে কোলে নিয়ে বাথরুমে গেল। ধরে বসাল কমোডের ওপর। খোলা জানালা দিয়ে তাকাল বাইরের দিকে। গাছের পাতায় রোদের ঝলক। গাছপালার আড়ালে, দক্ষিণের বাড়িটার গায়ে রোদ পড়েছে।
বব কমোড থেকে উঠে পড়বার চেষ্টা করল। কিন্তু এক বার প্রস্রাব করল। আভা ববকে কোলে তুলে নিয়ে, সিসটার্ন টেনে দিল। জল পড়ার শব্দের মধ্যেই, আভা হঠাৎ চমকে নাসারন্ধ্র স্ফীত করল। হালকা সিগারেটের গন্ধ ভেসে আসছে! কোথা থেকে? নীচের ঘরে কেউ সিগারেট খাচ্ছে? তারই গন্ধ? ও ববকে কোলে করে সরে এসে, বেসিনের ট্যাপ খুলে ঠাণ্ডা জলে চোখ মুখ ধুয়ে নিল। ববের মুখেও জল হাত বুলিয়ে দিল। প্রথমেই দরকার, ববকে খাওয়ানো। ও ঘরের মধ্যে এল। আবার সিগারেটের মৃদু গন্ধ নাকে এল। এ বার আরও যেন টাটকা। ফ্ল্যাটের মধ্যে কেউ ঢুকেছে?
আভা দুটো দরজার দিকেই তাকাল। দুটোই ভিতর থেকে বন্ধ। গন্ধটা তা হলে নিশ্চয়ই দক্ষিণের জানালা দিয়ে আসছে। পাশের ঘরে কেউ? আভার নিশ্বাস বুকের কাছে এসে যেন আটকে রইল। উৎকর্ণ হয়ে শুনল, কোনও শব্দ হচ্ছে কি না। কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না। ঘরের মাঝের দরজায় কোনও চাবির ছিদ্র নেই। বাইরের ঘরে যাবার দরজায় আছে। ও সেই দরজার সামনে গিয়ে, নিচু হয়ে ছিদ্রে চোখ রাখল। গোটা ঘরটা রোদে ভেসে যাচ্ছে। মিঃ কাপুর পুব দিকের জানালা দুটো গতকাল রাত্রে খুলে দিয়েছিল। তারপর আর বন্ধ করা হয়নি। বন্ধ করা উচিত ছিল। জানালাগুলো গরাদহীন। সামান্য ছিদ্র দিয়ে ঘরের চারদিক দেখা যায় না। কারোকে চোখেও পড়ছে না। তবু ও চাবির ছিদ্রে নাক রাখল, আর বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। বিদেশি সিগারেটের চেনা গন্ধ আরও টাটকা আর স্পষ্ট লাগল। তার মানে বাইরের ঘরে কেউ সিগারেট টানছে? নিশ্চয় মিঃ কাপুর না। সে ধূমপান করে না।
বব দরজার ওপরে দু হাত দিয়ে ধাক্কা দিল। ওর ছোট হাতের শব্দই যেন আভার কানে বিরাট হয়ে বাজল। বব পা ছুড়ল, আর অধৈর্য হয়ে, কেঁদে উঠল। ও এ ঘরের বাইরে যেতে চায়। খিদেও পেয়েছে। আভা হাতল ঘুরিয়ে আস্তে আস্তে দরজাটা খুলল। বব কোল থেকে পিছলে নেমে যাবার চেষ্টা করল। আর তখনই আভার চোখে পড়ল, বাইরের ঘরের একটা সিলিং ফ্যান ঘুরছে। ও ঝটিতি পিছিয়ে আসতে গেল। পরিষ্কার মনে আছে, বাইরের ঘরের আলো আর পাখার সুইচ ও অফ করে দিয়েছিল। কেউ নিশ্চয়ই ফ্ল্যাটে ঢুকেছে। অথচ বাইরের ঘরে তাকে দেখা যাচ্ছে না।
বব অস্থির হয়ে, কোল থেকে নেমে পড়ল। হামা দিয়ে বাইরের ঘরের দিকে যেতে লাগল। শঙ্কায় আর উত্তেজনায়, আভার হাত পা অবশ হবার উপক্রম করলেও, ববকে ছাড়তে পারল না। ও বাইরের ঘরে ঢুকল। ডান দিকে তাকিয়ে দেখল, ডাইনিং টেবিলে ডিসের ওপর একটা কাপ! ও নিচু হয়ে ববকে তুলে নিল। কোনও সন্দেহ নেই, ফ্ল্যাটে কেউ ঢুকেছে। দেখল, ডান দিকে দরজাটা খোলা। পরদাটা নিশ্চল, ভিতরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
সেই মুহূর্তেই পাশের বাথরুমের দরজাটা একটা শব্দ করে খুলে গেল। একজন বেরিয়ে এল। আভা দাঁতে দাঁত চেপে ববকে বুকের কাছে শক্ত করে চেপে ধরল। দু চোখে আতঙ্ক। মুখের শেষ রক্তবিন্দু যেন কেউ শুষে নিল।
সুপ্রভাত। ইংরেজিতে লোকটি বলল। ঠোঁটে কিং সাইজ সিগারেট। হাতে তার শেভিং ব্রাশ। গালে দু-তিন জায়গায় শেভিং ক্রিম লাগানো। গায়ে বুক খোলা একটা পাঞ্জাবির নীচে সিল্কের লুঙ্গি। তারপরেই পরিষ্কার বাংলায় বলল, বম্বে থেকে কাল বিকেলের ফ্লাইট রাত্রি এগারোটায় উড়েছে। প্রায় তিনটে নাগাদ পৌঁছেছি। আমার নাম সুবীর। কাপুরের চিঠিটা আমি পড়েছি।
কিন্তু আপনি–আভার আতঙ্কিত চোখ দুটি জিজ্ঞাসায় আরও বড় হয়ে উঠল, আপনাকে–।
চেনা চেনা লাগছে?’ সুবীর নামে লোকটি হাসল, হ্যাঁ, দেখেছেন আগে, জলির বাড়ির পার্টিতে। অন্তত বার তিনেক।
আভার স্বর স্খলিত, আপনি আমার সঙ্গে–।
নেচেছি। সুবীর মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল, কিন্তু আপনি আমাকে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছেন মনে হচ্ছে। আমি অবিশ্যি কাপুরের চিঠি পড়ে, ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারিনি। শুধু জেনেছি, আপনি বিশেষ বিপদে পড়েছেন, তাই সে আপনাকে বাধ্য হয়ে এখানে এনেছে। বিপদের ব্যাপারটা হয়তো আমি একটু অনুমান করতে পারছি। সে সব কথা পরে হবে। আপনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন।
বব নতুন লোক দেখে একটু থমকে গিয়েছিল। তারপরেই আবার খুঁতখুঁত কান্না জুড়ল। এবং কোল থেকে নেমে যেতে চাইল। সত্যিই কি আভা নিশ্চিন্ত হতে পারে? না কি ঘুরে ফিরে শেষপর্যন্ত ওর আর ববের আততায়ীর ফাঁদেই এসে পড়েছে? সুবীরের নাম যথার্থই সুবীর কিনা, ও মনে করতে পারছে না। কিন্তু ওকে দেখা মাত্রই, চিনতে পেরেছিল। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল জলির উইঙে হলঘরের মতোই সেই বিরাট আর মহার্ঘ আসবাবে সাজানো বসবার ঘর। যেখানে আলাদা নাচের ফ্লোরও ছিল। এবং সেই নাচের ফ্লোরে এই লোকটির সঙ্গে ওর নাচের দৃশ্য।
সুবীর বাথরুমে ফিরে যেতে গিয়ে, আবার আভার দিকে তাকাল। হেসে বলল, জলির ওখানে আমাকে দেখেছেন বলে, আপনি বোধ হয় নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। সত্যি কথা বলতে কী, জলির সঙ্গে আমার পরিচয় সামান্যই। একটা সময়ে ওর সঙ্গে কিছু দিন মেলামেশা করেছিলাম। আসলে ও তখন আমাদের অল ইন্ডিয়া বিজনেস সংস্থায় কিছু টাকা লগ্নি করার কথা ভেবেছিল। তা সম্ভব হয়নি, কারণ স্যার জে. সি. টাকা দিতে চাননি। জলির নিজের কিছুই করার উপায় ছিল না, আপনিও তা ভালই জানেন। সেই সুবাদেই কয়েক বার সে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিল। তার সঙ্গে দীর্ঘকাল আমার কোনও যোগাযোগ নেই। হয়তো সে আমাকে ভুলেই গেছে। অবিশ্যি আপনাদের ঘটনা–আপনার ছেলে জোজোকে নিয়ে মামলার সংবাদ সবই কাগজে পড়েছি। অথচ। সুবীর থেমে গিয়ে, আভার কোল থেকে পিছলে নেমে যাওয়া, কার্পেটের ওপর ববকে দেখল। আবার আভার দিকে বিশেষ চোখে তাকিয়ে বলল, আপনার সঙ্গে জলির বিয়েটাকে আমি নীল রঙের সঙ্গে লাল রক্তের মিলন বলেই ধরে নিয়েছিলাম। স্যার জে. সি-র পরবর্তী বংশধরেরা লাল রক্তের ধারক হয়ে নতুন যুগের সঙ্গে পা মেলাবে, এ রকম মনে করতাম। তার যে এমন সাংঘাতিক পরিণতি হতে পারে—অবিশ্যি জলিদের মতো ব্লু ব্লাড ফিউডাল পরিবারের পক্ষে এটাই হয়তো স্বাভাবিক কাজ হয়েছে। এনি হাউ, আপনার ভবিষ্যৎ কী, বলতে পারি না। আপাতত আপনি সেই পরিবেশে নেই, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
আপনার কথা শুনে আমি ভরসা পাচ্ছি।আভার রুদ্ধ নিশ্বাস যেন ধীরে মুক্তি পেল, আমি আমার ছেলের খাবার তৈরি করব ভাবছি।
সুবীর বাথরুমে ঢোকবার আগে বলল, নিশ্চয়ই করবেন।
আভা তবু মিনিট খানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আকস্মিক চমকিত আতঙ্কের কাঁপুনিটা যেন এখনও থামছে না। কিন্তু ও সুবীরের কথায় অনেকটা নিশ্চিত বোধ করছে। বব সেই তামার ছাইদানিটা নিয়ে খেলা শুরু করেছে। ও তাড়াতাড়ি কিচেবে ঢুকল। গ্যাস জ্বালিয়ে, দ্রুত হাতে জল গরম করতে বসিয়ে দিল। ভয় মিশ্রিত কৌতূহল সহজে যেতে চায় না। ও কিচেনের দরজার আড়ালে থেকে, সাবধানে উঁকি দিল। সুবীরের বাথরুমের খোলা দরজা দিয়ে তাকে দেখা যাচ্ছে। সে বেসিনের ওপরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, গালে ব্রাশ ঘষছে। চোখ-মুখ উজ্জ্বল, গায়ের রং প্রায় কালো, দীর্ঘ শক্ত শরীর সুবীরের ওলটানো চুলের জুলফি এবং কপালের সামনের দিকে চুল বেশ সাদা হয়ে উঠছে। বয়স কত হতে পারে? সে যখন সাদা ঝকঝকে দাঁতে হাসছিল, তখন তাকে সহৃদয় আর অমায়িক দেখাচ্ছিল। সম্ভবত মধ্য চল্লিশ হবে। কিছু বেশি হওয়াটাও আশ্চর্যের না।
কেটলিতে জল ফুটে ওঠার ফোঁস ফোঁস শব্দে ও সরে এল। গ্যাস নিভিয়ে, দ্রুত হাতে, টেবিলের ওপর থেকে বেঁটে মোটা খাবারের বোতলটা টেনে নিল। গেলাস আর চামচ বের করল, কাচের পাল্লা সরিয়ে। জলটা একটু বেশি গরম হয়ে গিয়েছে। বোতল থেকে চামচেয় করে শুকনো গুঁড়ো খাবার তুলে গেলাসে ঢালল। কেটলির মুখটা খুলে দিল।
আমি জানি না, পটের চা এখনও যথেষ্ট গরম আছে কি না। সুবীর গালে ক্রিমের ফেনা মাখা মুখ নিয়ে, বাথরুমের দরজার কাছে এগিয়ে এল। হাতে সেফটি রেজর, যদি খাবার মতো গরম থাকে, খেতে পারেন। আবার বাথরুমের মধ্যে ঢুকে গেল।
আভা চোখ ফিরিয়ে দেখল, কাশ্মীরি উলের ক্যাপে ঢাকা চায়ের পট টেবিলের ওপর ট্রে-তে রয়েছে। সুবীর রাত্রি তিনটেয় পৌঁছে আর কতটুকু সময় ঘুমিয়েছে? কখন উঠে নিজের হাতে চা করেছে? অবিশ্যি এখন কটা বেজেছে ও কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘরের রোদ দেখে মনে হচ্ছে, আটটা। সাড়ে আটটার বেশি না। ও দ্রুত গেলাসে গরম জল ঢেলে ববের খাবার তৈরি করল। তারপরেই পটের ঢাকনা খুলে গায়ে হাত দিয়ে অনুভব করল উষ্ণতা। যথেষ্ট গরম রয়েছে বলেই মনে হল। কাপ ডিস। বের করে পট থেকে চা ঢালল। ধোঁয়া উঠছে। কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতেই গরমটা যেন আরামদায়ক মনে হল। কিচেনে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতেই ও ববের খাবারের গেলাসে চামচ নাড়তে লাগল। চব্বিশ ঘণ্টা ঝড়ের পর, এখন প্রকৃতই যেন একটা নিশ্চিন্ত বোধ করছে। রক্তশূন্য মুখের রং স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। চা খেয়ে, ববের গেলাস নিয়ে বেরিয়ে এল। নিজের দিকে তাকাবার অবকাশ নেই। গায়ের শাড়ি চটকানো, খোলা চুল উশকোখুশকো। গালে কপালে ছড়িয়ে পড়েছে। রাত্রে ব্রা-র ফাঁসটা খুলতে ভুলে গিয়েছিল। গেলাসটা সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে, ববকে টেনে নিয়ে সোফায় বসল। পাখার বাতাসে, খাবার একটু ঠাণ্ডা হয়েছে। শক্ত করে গেলাস ধরে ববের মুখের কাছে, চুমুক দেবার মতো করে ধরল। বব ঠেটি ডুবিয়ে, দুটি দাঁত দেখিয়ে হাসল।
সুবীর বাথরুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল। জল পড়ার শব্দে বোঝা গেল, সে স্নান করছে। ববের খাওয়া শেষ হবার আগেই, সুবীর ঘরের পরদা সরিয়ে বেরিয়ে এল। এখন অন্য একটা ধোয়া পাঞ্জাবি, এবং নতুন একটা লুঙ্গি পরেছে সে। বোতাম খোলা পাঞ্জাবির ফাঁকে, পাউডার ছড়ানো। চুল উলটে আঁচড়ানো। চোখ দুটো একটু লাল। পাঞ্জাবির গোটানো হাতায় বাঁ কবজিতে ঘড়ি দেখা যাচ্ছে। না বসে বলল, ড্রাইভারকে আমি সকালবেলার খাবার আনতে বলে দিয়েছি। ও এ বার এসে পড়বে।
আভার চোখে ভয় ফুটে উঠল, ড্রাইভার?
হ্যাঁ, আপনি তার সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। সুবীরের মুখে বরাভয়ের হাসি, মাঝবয়সি বিহারি লোকটি আপনাকে চিনতে পারবে না। তা ছাড়া তার কোনও অকারণ কৌতূহল নেই, বিশ্বস্তও বটে। কাপুর নিশ্চয়ই গতকাল আমার ড্রাইভার আর গাড়ির দেখা পায়নি। পেলে জানতে পারত, আমি রাত্রেই ফিরে আসছি। অবিশ্যি তাতে কোনও ক্ষতি হয়নি।
আভার চোখে কৌতূহলিত জিজ্ঞাসা, মিঃ কাপুর আপনার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
হ্যাঁ, ওর সঙ্গে আমার অনেক দিনের পরিচয়। কুড়ি বছর আগে দিল্লিতে। সুবীর পকেট থেকে বিলিতি কিং সাইজ সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করল, ওদের পরিবার, বাবা মা আত্মীয়স্বজন সকলের সঙ্গেই আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা। ওর সঙ্গে যখন পরিচয় তখন ওর বড় মেয়ে এক বছরের ছিল। সে সময়ে আমি অটোমোবিল ডিলারের কাজ করতাম, পরে অবিশ্যি সে কাজ ছেড়ে দিয়েছি। কাপুর সেই বিজনেস নিয়েই আছে। কলকাতায় ব্যবসার ব্যাপারে, ওকে আমি সাহায্য করেছিলাম। কিন্তু আপনার সঙ্গে ওর পরিচয় কী করে হল, সেটা আমি জানি না।’
আভা ববের মুখের কাছ থেকে গেলাস সরিয়ে নিল। ব্যস্ত হয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই, সুবীর হাত তুলে ওকে নিরস্ত করল, এক্ষুনিই বলতে হবে না। ছেলেকে খাইয়ে নিন। তারপরে আপনি নিশ্চয়ই চানটান সেরে নেবেন?
মিঃ কাপুর আসার পরে আমি চান করব।আভা নিজের দোমড়ানো কোঁচকানো শাড়ির দিকে চোখ নামিয়ে দেখল, আমার শাড়ি জামা কিছু নেই। মিঃ কাপুর কিছু নিয়ে আসতে পারেন৷
সুবীর চিন্তিত মুখে মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল, হ্যাঁ, তা বটে। আমার এখানে মেয়েদের পোশাক নেই। ব্যাচেলরের কী অর্থ জানি না, আমি আনম্যারেড। সে লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাল। চোখে কৌতুকের হাসি, এনি হাউ, আপনি ছেলেকে খাইয়ে নিন।
এ সময়েই টেলিফোনটা বেজে উঠল। আভা চমকে সে দিকে তাকাল। সুবীর এগিয়ে রিসিভার তুলে নিল। আভার চোখে শঙ্কিত জিজ্ঞাসা। সুবীর ইংরেজিতে বলল, হ্যালো…হ্যাঁ, আজ ভোর তিনটেয় ফিরেছি।…না, না, আমার এখানে আসতে হবে না। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে যাচ্ছি। লাঞ্চের আগে অফিসে দেখা হবে। হ্যাঁ, ঠিক আছে। সে রিসিভার নামিয়ে রাখল, একমাত্র অসুবিধা এটাই, এখানে অনেকেই দেখা করতে আসে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে। তবে আমি সেটা আপাতত বন্ধ রাখব। অবিশ্যি, কলিং বেল বাজিয়ে সাড়া না পেলে, সবাই ভাববে, আমি নেই। যে-ই আসুক, ফিরে যাবে।
আভার মনে ক্ষণে ক্ষণেই দুশ্চিন্তা আর সংশয় জেগে উঠছিল। জিজ্ঞেস করল, আপনি কি সত্যিই এখুনি বেরিয়ে যাবেন?
না। মিথ্যা কথা বললাম। সুবীর হেসে অনায়াসেই বলল, এখন এখানে কারোকে আসতে দিতে চাই না। কাপুর না আসা পর্যন্ত আমি থাকব। ও বোধ হয় এগারোটা নাগাদ এসে যাবে। এখন ন’টা বেজে গেছে। সাইরেন কেন বাজল না, জানি না।’
কলিং বেল বেজে উঠল, ক্রিং ঙ ঙ…। আভা ঝিটিতি ববকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। আতঙ্কিত চোখে দরজার দিকে দেখে, সুবীরের মুখের দিকে তাকাল। সুবীর নিচু স্বরে বলল, মনে হচ্ছে ড্রাইভার এসেছে। তবু আপনি ঘরের মধ্যে যান। আমি দরজা খুলছি।
আভা ববকে ও গেলাস নিয়ে, ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজাটা নিঃশব্দে চেপে বন্ধ করে দিল। ববের খাওয়া শেষ। ও শূন্য গেলাসটা হাতে টেনে নিতে চাইছে। আভা দরজায় কান পাতল। সুবীরের স্বর শুনতে পেল। সে বাংলায় বলছে, ওই টেবিলে রাখো। তোমার কাছে টাকা আছে তো? ঠিক আছে, তুমি নাস্তা করে, স্নান করে নাও। গাড়ি গ্যারেজের মধ্যে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে। আমার বেরোতে দেরি হবে।
অন্য কোনও গলার স্বর শোনা গেল না। দরজা বন্ধ করার শব্দ হল। তারপরে ওর দরজায় ঠুকঠুক। আওয়াজ, সুবীরের স্বর, আসুন।
আভা দরজা খুলে বেরিয়ে এল। সুবীর বলল, ড্রাইভার। খাবার দিয়ে গেল। চলুন, খেয়ে নেওয়া যাক। তার আগে আমি একটু জল গরম করতে দিই। কফি না চা খাবেন?
জল গরম করতে আমিই যাচ্ছি। আভা ববকে কার্পেটের ওপর নামিয়ে দিয়ে, কিচেনের দিকে গেল। তার আগেই ওর চোখে পড়েছে, টেবিলের ওপর পার্ক স্ট্রিটের বিখ্যাত স্ন্যাকস ফুডের বড় প্যাকেট। বলল, আপনি যা প্রেফার করবেন, তাই হবে।
সুবীর বলল, তা হলে কফি।
আমি একেবারে তৈরি করেই নিয়ে আসছি।আভা কিচেনের ভিতরে চলে গেল।
সুবীরের মুখে চিন্তার ছায়া। সে এক বার ববের দিকে দেখল। বব তার দিকে তাকিয়ে, দুটো দাঁত দেখিয়ে হাসছে। গলা দিয়ে দুর্বোধ্য শব্দ বের করছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আভা স্টিলের পটে কফি আর কাপ-ডিস ট্রে-তে নিয়ে এল। রাখল খাবার টেবিলের ওপর। সুবীর এগিয়ে এসে প্যাকেট খুলল। প্রচুর খাবার। বেশ কিছু টোস্ট, মাখনের ছোট প্যাকেট, চিকেন প্যাটিস, পাতলা কাগজে মোড়া ওমলেট। বব যেন খাবারের গন্ধেই হামা দিয়ে খাবার টেবিলের কাছে এগিয়ে এল। আভা ওকে কোলে তুলে নিল। সুবীর জিজ্ঞেস করল, ও কি এ খাবার কিছু খেতে পারবে?
ওমলেটে লঙ্কা না থাকলে, একটু দেওয়া যেতে পারে।আভা বলল, সে জন্য ভাববেন না, বসুন। খেতে আরম্ভ করুন।
সুবীর বসল, বলল, আপনি বসুন। এ বার আপনার কথা কিছু শোনা যাক।
আসছি। আভা দ্রুত ছুটে গিয়ে কিচেন থেকে দুটো প্লেট আর ছুরি চামচ নিয়ে এল। সুবীর সব খাবার দুটো প্লেটে রাখল। আভা ওমলেট খুলে দেখল, কাঁচা লঙ্কা দেওয়া নেই। একটু ভেঙে ববের মুখে দিল। সুবীর তুলে নিল টোস্ট, ছুরি দিয়ে মাখন মাখিয়ে আভার দিকে এগিয়ে দিল। কৃতজ্ঞতা বোধে, আভার বুকের মধ্যে যেন টনটন করে উঠল। ঠোঁট নেড়ে কিছু বলল, যা বোঝা গেল না। আসলে ধন্যবাদ জানাতে চেষ্টা করল। আর চোখ শুকনো রাখার চেষ্টা করল। সুবীরের খাওয়া শুরু হতে, ও সমস্ত ঘটনা বলতে লাগল। গতকাল কাপুরের সঙ্গে পরিচয় থেকে তারও আগের ঘটনা, এবং এই ফ্ল্যাটে পৌঁছানো, কোনও কথাই বাদ দিল না। কথা বলতে বলতে ওর খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সুবীরের মুখ গম্ভীর, চিন্তিত। বলল, হুম, বুঝেছি। প্রায় এ রকমই অনুমান করেছিলাম। আপনি খান, খেয়ে নিন।
আভা খেতে আরম্ভ করল। ববকেও একটু আধটু দিতেই হচ্ছে। সুবীর নিজের কাপে কফি ঢেলে নিয়ে সিগারেট ধরাল। বলল, জোজোর ডেথ কেসের পর।
ডেথ কেস?’ আভা অবাক রুদ্ধ স্বরে বলে উঠল।
সুবীর বলল, বিচারকের রায় তাই অ্যাকসিডেন্টাল ডেথ বলা হয়েছে। এ ছাড়া বাইরে আপনি কিছুই বলতে পারবেন না, তাই না? তা হলে কনটেম্পট অফ কোর্ট-এর দায়ে পড়ে যাবেন। এনি হাউ, তারপরে মনে হচ্ছে, এটাই সহজ হিসাব, আপনি আর বব কেন বেঁচে থাকবেন।
আভা মল্লিক মেসোমশাইয়ের কথা বলল। সুবীর ঘাড় কঁকিয়ে বলল, উনি বোধ হয় ঠিক কথাই বলেছেন। কিন্তু এ ভাবে আপনি কত দিন পালিয়ে বেড়াতে পারবেন? খুব বেশি দিন সম্ভব না। আপনাকে আর ববকে যে ভাবে সরানোর পন্থা নেওয়া হয়েছে, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই, এটা একটা খুব চালু ব্যাপার। কলকাতায় তো কথাই নেই। পলেটিকাল মার্ডার থেকে, অনেক রকম খুনের ঘটনা লেগেই আছে। আপনার শত্রু নিশ্চয়ই দারুণ শক্তিশালী, আর যারা পেছন নিয়েছে, তারা হয়তো পেশাদার, কিন্তু পেছনের খুঁটির জোর খুব জবরদস্ত।
নিশ্চয়ই। আভা বলল, জোজোর কেসেই সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে।’
সুবীর সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। মাথা ঝাঁকাল, আপনি নিজে পুলিশের কাছেও যেতে পারছেন না।
আমি খোলাখুলি রাস্তায় বেরোতেই সাহস পাচ্ছি না। আভার চোখে আতঙ্কের ছায়া ফুটল, আপনার কি মনে হয়, পুলিশের কাছে গিয়ে আমরা বাঁচব?’
সুবীর আভার দিকে তাকিয়ে বলল, খুব অস্বস্তিকর প্রশ্ন। জবাব দেওয়া আরও কঠিন। তবে, সাধারণ ভাবে, এ রকম ঘটনায় আগে পুলিশের সাহায্যের কথাই মনে আসে৷ আপনি লোকাল থানায় যেতেও ভরসা পাচ্ছেন না। কিংবা টেলিফোনে জানাতেও সাহস পাচ্ছেন না। তাই তো?
হ্যাঁ। আভা ঘাড় ঝাঁকাল।
সুবীর চেয়ার ছেড়ে উঠে, সেন্টার টেবিল থেকে ছাইদানিটা তুলে নিয়ে এল। আবার বসল খাবার টেবিলের চেয়ারে। সিগারেটের ছাই ঝেড়ে বলল, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের যে কর্তা জোজোর কেসের তদন্ত করেছিলেন, তাঁর কাছে এক বার যেতে পারেন।
মিঃ দীপনারায়ণের কাছে? আভার চোখে শঙ্কিত বিস্ময়। ওর গলার কাছে যেন কাটা ফুটে গেল।
সুবীর বলল, লোকাল থানা সম্পর্কে আপনার মনে যে-ভয়টা রয়েছে, সেটা কতখানি খাঁটি, অথবা অমূলক, মিঃ দীপনারায়ণের সঙ্গে কথা বললে, আপনি সেটাও যাচাই করতে পারবেন। খোদ লোকের কাছে যাওয়াই ভাল। একটা রেকর্ড ওর থাকবে। অবিশ্যি ফলাফলের ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত হতে পারবেন না হয়তো। তিনি আপনার কাছে একটা লিখিত অভিযোগ চাইতে পারেন বা চাইবেন। সেটা আপনি লিখেই নিয়ে যাবেন। একটা কপি নিজের কাছেও রেখে দেবেন। কিন্তু কারা আপনাকে আর ববকে খুন করতে চাইছে সেটা আপনি জানেন না। কারোকে সন্দেহ করেন কি? না, এমন কারোর নামই আপনি করতে পারেন না।
আভা যেন ত্রস্ত বিস্ময়ে কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেল। সুবীরের চোখে চোখ রাখল। সুবীরের দৃষ্টি স্থির, চোখের পাতা নিবিড়। ঠোঁটে ঈষৎ হাসি ফুটল, আপনি কারোর নামই করতে পারেন না– করবেন না। সেটাও আপনার কাছে তা হলে লিখিত চাওয়া হবে। প্রমাণহীন কোনও কিছুই আপনি লিখে দিতে পারেন না। আর আপনি এটাও বোঝেন, তাতে কোনও লাভই হবে না। মিঃ দীপনারায়ণের কাছে যাওয়া মানে, বাঁচবার একটা চেষ্টা। যদিও আপনার মল্লিক মেসোমশায়ের কথা আমি ভুলতে পারছি না, তবু যেতে বলছি।
আভার চোখে অন্যমনস্কতা। কোনও কথা বলতে পারছেনা। চুপ করে বসে রইল। সুবীর ওর কাপে পট থেকে কফি ঢেলে দিল, নিন, কফি খান।
আভা সুবীরের চোখের দিকে তাকাল। ওর মনে নানা সংশয় সন্দেহের তোলপাড় চলছে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে। চোখে আর্ত অসহায়তা। চোখ নামিয়ে কম্পিত হাতে কফির কাপ তুলে ঠোঁটে হেঁয়াল।
বুঝতে পারছি, আপনি বেরোতেই ভয় পাচ্ছেন। সুবীর সিগারেটে টান দিল, আপনাকে বলছি না, আগে থেকে টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যাবেন। আপনি আমার গাড়িতে একেবারে আচমকা লালবাজারে গিয়ে মিঃ দীপনারায়ণের সঙ্গে দেখা করতে চাইবেন। আপনি আগে গেছেন ওঁর কাছে?
আভা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, গেছি।
তা হলে ওঁর ঘর আপনি চেনেন। সুবীর বলল, দরজায় সেন্ট্রি থাকবে, তবু আপনি ববকে কোলে নিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে যাবার চেষ্টা করবেন। বাধা পেলে, আপনি কাতর অনুরোধ করবেন। অন্তত মিঃ দীপনারায়ণের চোখে পড়বার চেষ্টা করবেন। মনে হয়, উনি আপনাকে ফেরাবেন না। সেন্ট্রি যদি আপনাকে চিনতেও পারে, ক্ষতি নেই। আমার ধারণা, আপনার প্রতি সাধারণ মানুষের যথেষ্ট সমবেদনা রয়েছে। সেন্ট্রি আপনাকে সাহায্যই করতে পারে। এ বার কথা শেষ করে, লালবাজার থেকে বেরিয়ে আসা–ভেরি কুশিয়াল মোমেন্ট। আমি ধরে নিচ্ছি, যদি আপনার আততায়ীরা জেনে যায়, আপনি লালবাজারে গেছেন, তা হলে সেখান থেকে ওরা আপনার পেছু নেবে। তবে এত তাড়াতাড়ি নাও জানতে পারে।’
ওরা ছাড়া, লালবাজার থেকে অন্য কেউ আমার ওপর লক্ষ রাখতে পারে।আভা বলল।
সুবীর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আপনার এ ভয়ও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবু এই রিস্কটা নিতেই হবে। আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়িতে এসে উঠে পড়বেন। গাড়ি আপনাকে ব্যাবোর্ন রোডে নিয়ে যাবে। তারপরের ব্যবস্থা আমার।
কিন্তু আপনার এ আশ্ৰয়টা আমাকে হারাতে হতে পারে। আভার স্বরে গভীর উৎকণ্ঠা। আপনার গাড়িতে আমাকে দেখা মানেই, আপনার সঙ্গে আমাকে লোকেট করবেই।
সুবীর ভুরু কুঁচকে মিনিট খানেক ভাবল, হুম, কথাটা একেবারে ভুল বলেননি। আমি একটু বেশি স্মার্টলি সব ভেবে ফেলেছি, আসলে ভুলই করেছি। এ ক্ষেত্রে আমি আমার ড্রাইভারকে বলে, ওর চেনা। আর বিশ্বাসী একজন ট্যাক্সিওয়ালাকে কাজে লাগাতে পারি। তাকে আমার ড্রাইভার বুঝিয়ে বলে দেবে। আমার গাড়িতে যে ভাবে যাবার কথা বলছিলাম, ট্যাক্সিতেও আপনি ঠিক সে ভাবেই যাবেন, চলে আসবেন। কাপুর এলে, ওর সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা হবে, ওর মতামত শোনা যাবে। যদি ঠিক হয়, তবে আজই এ সুযোগ নিয়ে নিন।
আজ?’ আভা যেন সাপ দেখার মতো চমকে উঠল।
সুবীর বলল, আমি তো তাই মনে করি। মিঃ দীপনারায়ণের সঙ্গে কথা বলা হয়ে গেলে, আপনিও নিজের অবস্থা আরও পরিষ্কার বুঝতে পারবেন।
কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন, আমি এখন কোথায় আছি?’আভা সুবীরের চোখে উৎকণ্ঠিত চোখ রাখল।
সুবীর যেন লজ্জা পেয়ে হেসে ফেলল, আশ্চর্য, বিপদে পড়লে জানি মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। দেখছি, আমিই দিশেহারা হয়ে গেছি। কথাটা মনেই আসেনি। এটা একটা ভাইটাল কোয়শ্চেন। জবাবটা আপনাকে আগেই ভেবে রাখতে হবে। উনি নিশ্চয়ই তা চাইবেন।
আভা তৎক্ষণাৎ কোনও কথা বলল না। সুবীরের চোখে চোখ রেখে, কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ভাবল, সুবীরকে ও কতটুকু চেনে? জলির বাড়িতে নিতান্তই একজন বন্ধু অতিথি হিসাবে দেখেছে। আভার সঙ্গে নাচতে চেয়েছে। আভা সৌজন্য দেখিয়ে নেচেছে। এবং অবিশ্যিই মানুষটিকে ওর অভদ্র মনে হয়নি। নাচতে গিয়ে অনেক সময়েই যেমন অনেককে দেখা যায়। কিন্তু সহসা গোয়েন্দা বিভাগের সেই কর্তাব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে বলছে কেন? সমস্ত ব্যাপারটা কি সে বুঝতে পারছে না? জোজোর কেসে মিঃ দীপনারায়ণের তদন্তের ব্যাপারটি নিখুঁত। সন্দেহ নেই। তারপরে তার ভূমিকা কেমন যেন অস্পষ্ট আর ঝাপসা লেগেছিল। তার প্রথম দিকের উদ্দীপনা কি পরে নিতান্তই রুটিন মাফিক কাজের মতো নিস্তেজ উৎসাহহীন হয়ে যায়নি? বিশেষ করে, ময়না তদন্ত আর ফরেনসিক রিপোর্ট পাবার পরে ও যখন গিয়েছিল তখন তিনি অত্যন্ত ঠাণ্ডা আর নির্বিকার ব্যবহার করেছিলেন। বলেছিলেন, কেস এখন কোর্টে গেছে, যা হবার সেখানেই হবে। আপনাকে আর আমার কাছে আসতে হবে না। আমার করণীয় আমি ঠিকই করব।’..বলতে গেলে একরকম নীরস গম্ভীর মুখে বিদায় করে দিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম রিপোর্টের সঙ্গে, পরবর্তী রিপোর্টের মধ্যে এমন কিছু অমিল ছিল, যা আভার কাছে বিস্ময় ও বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছিল। এর পরেও তার কাছে যাবার কোনও উৎসাহ ও বোধ করছে না। বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতিতে, গুরুতর বিপদের ঝুঁকি নিয়ে। সুবীর ওকে কোন দিকে ঠেলে দিতে চাইছে?
মিসেস মজুমদার, আপনি ভয় পেলে আলাদা কথা। সুবীর সিগারেটের শেষাংশ ছাইদানিতে গুঁজে দিল, কিন্তু লালবাজারে যেতে আপনাকে আমি বাধ্য করছি না, সে প্রশ্নও নেই।
আভা চকিতে চোখ তুলে সুবীরের মুখের দিকে তাকাল। তার ঠোঁটে হাসি থাকলেও, মুখে গাম্ভীর্য নেমে এসেছে। ও ব্যস্ত কুণ্ঠায় বলল, না, না, আপনি আমাকে যেতে বাধ্য করবেন এ কথা আমি ভাবব কেন?
আপনার যা মনের অবস্থা, ভাবলেও দোষ দেওয়া যায় না। সুবীর হেসে বলল, আমি ভগবানে বিশ্বাসী নই। কিন্তু মানুষের শুভ আর অশুভ শক্তিকে সবসময়েই দেখতে পাচ্ছি। একটা অশুভ শক্তি আপনার পেছনে কাজ করছে। অথচ কোনও শুভ শক্তিকে আপনার পেছনে দেখতে পাচ্ছি না। নিজের কথা ভেবেও, এই সত্যি কথাটা আমাকে বলতেই হচ্ছে। আপনাকে ঘিরে যে প্লট তৈরি হয়ে গেছে, তার মধ্যে জড়িয়ে পড়ার পরিণাম আমি বুঝতে পারছি। আমিও হেলপলেস স্বীকার করছি। তবু যে বিপদের ঝুঁকি নিয়েও আপনাকে মিঃ দীপনারায়ণের কাছে যেতে বলছি, তার একটাই মাত্র কারণ। আপনি আপনার অবস্থাটা আরও পরিষ্কার বুঝতে পারবেন।’
সুবীরের কথাগুলো এবং তার স্বরে এমন কিছু ছিল, যা ওর মনকে অনেকখানি সংশয়হীন করে তুলল। বুদ্ধির থেকে, ওর তীব্র প্রবৃত্তিই যেন সুবীরকে বিশ্বাস করল। ও বলল, আমি যাব।’
তবু একটু ভাবুন। সুবীর আবার একটা সিগারেট ধরাল।
আভা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি আমাকে একটু কাগজ দিন। কলম আমার কাছে আছে। মিঃ দীপনারায়ণ লিখিতভাবে আমার কাছে যা চাইবেন, চাইতে পারেন, সেটা আমি লিখে ফেলছি। তার আগে, আমি ববকে এক বার বাথরুম ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।
মিঃ কাপুর এল সাড়ে এগারোটা নাগাদ। আভার জন্য দুটো শাড়ি, দুটো জামা, একটা শায়া নিয়ে এসেছে। জামা আর শায়ার ব্যাপারে সে তার মেয়ে বীণার কাছ থেকে একটা মাপের আন্দাজ নিয়েছিল। তা ছাড়া, পাঁউরুটি, দু ডজন ডিম, কিছু চাল, তেলের ছোট টিন, অল্পবিস্তর তরিতরকারি, গুঁড়ো মশলার প্যাকেট, টিন ফিশ, ববের জন্য বড় এক কৌটো ফুড ইত্যাদি। সুবীরকে দেখে সে তেমন একটা অবাক হয়নি। কারণ সুবীরের আসা যাওয়ার কোনও ঠিক বাঁধাধরা দিনক্ষণ থাকে না। বরং খুশিই হল সুবীরকে দেখে।
সুবীর সব দেখেশুনে হেসে বলেছে, তুমি দেখছি আমার ডেরায় একটা নতুন সংসার পাতবার ফিকিরে আছ।’…তারপরে, তার আসার আগে সুবীরের সঙ্গে আভার আলোচনার বিষয় সব শুনল। শুনে প্রথমে তার একটু ইতস্তত ভাব দেখা গেল। এবং পরে সুবীরের সঙ্গে একমত হল। আভার লেখা চিঠিটা দেখল। সুবীর আগেই চিঠিটা দেখেছিল। চিঠিটা বেশ গুছিয়েই লেখা হয়েছে। মিঃ কাপুর এ কথাও বলল, তার বা বিজিতের বাড়ির দিকে কেউ নজর রাখছে বলে মনে হচ্ছে না। ওরা বুঝতে পেরেছে, আভা সেখানে নেই। পিসিমা আলিকে কাজের অছিলায় রাস্তায় পাঠিয়ে খোঁজও নিয়েছেন।
কথাবার্তা বলে এটাই স্থির হল, আভা এখনই যাবে। ব্যাপারটা মিটতে দেড়-দু’ ঘণ্টা লাগতে পারে। দুপুরের খাবার এ বেলার মতো বাইরে থেকে আনিয়ে নেওয়া যাবে। কেবল আভা স্নান করে জামাকাপড় বদলে নেবে।
আভা তাই করল। ওর স্নান করা আর শাড়ি জামা বদলানোর ফাঁকেই, সুবীর ড্রাইভারকে ডেকে, তার চেনাশোনা একজন ট্যাক্সিওয়ালাকে ডেকে আনতে বলল। কোথায় কোথায় যেতে হবে, সবই বুঝিয়ে দিল। আভা তৈরি হতেই, ড্রাইভার এসে জানাল, ট্যাক্সি এসে গিয়েছে। সুবীরও তার পোশাক বদলে সাফারি পরে নিয়েছিল। কেবল ববেরই জামা বদলানো হল না। মিঃ কাপুর ববের জামার কথা ভাবেনি। বেরোবার আগে আভার কেবল মল্লিক মেসোমশায়ের কথাগুলো মনে পড়ল। নীচে নেমে ট্যাক্সিতে ওঠার আগে মিঃ কাপুর আভার হাতে ফ্ল্যাটের চাবিটা দিল। আভা সেটা হাতব্যাগে পুরে নিল।
ট্যাক্সি লালবাজারে পৌঁছুতে সময় নিল প্রায় কুড়ি মিনিট। ভিতরে ঢোকবার সময়, ট্যাক্সি ড্রাইভার একটি জায়গা দেখিয়ে জানিয়ে দিল, সেখানে সে ট্যাক্সি নিয়ে অপেক্ষা করবে। আভার মনে হল, ওর চারদিকে গভীর জঙ্গল আর অন্ধকার। সামনে সার্চ লাইটের আলো। সেই আলোয় ও মিঃ দীপনারায়ণের অফিসের দিকে এগিয়ে চলেছে। ওর চারপাশের আর কোথায় কী আছে, কিছুই ও দেখছে না, জানতে পারছে না। কেবল দাতে দাঁত চেপে বসছে। বুকের কাছে নিশ্বাস আটকানো। ও সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় কয়েক ধাপ উঠতেই, পিছনে ভারী পায়ের জুতোর শব্দ শোনা গেল। ও ফিরে তাকাল না। শব্দ খুব দ্রুত এগিয়ে এল, আর ওকে পাশ কাটিয়ে দু ধাপ উঠেই থেমে গেল। আভা চোখ তুলে তাকাল। মিঃ দীপনারায়ণ। তিনি কুটি অবাক চোখে তাকালেন, আপনি?
সিঁড়িতেই মিঃ দীপনারায়ণের দেখা পেয়ে আভা অবাক হল, স্বস্তিও বোধ করল। ওর গলার স্বর রুদ্ধ, স্খলিত, ‘আমি আপনার সঙ্গেই একটু দেখা করতে এসেছি।‘
আমার সঙ্গে? মিঃ দীপনারায়ণের ভ্রুকুটি চোখে চিন্তিত বিস্ময়, আসুন। সিঁড়ি উঠতে উঠতে বললেন, খবর না দিয়ে এসেছেন। হয়তো আমার দেখা নাও পেতে পারতেন। আমি তো বেরিয়ে গেছলাম। কাজ শেষ না হলে, এখন ফিরতাম না। আভা তাকে অনুসরণ করতে করতে বলল, আমি ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে বেরিয়ে এসেছি।
সেন্ট্রি এক বার ববকে কোলে আভার দিকে দেখল। আভা মিঃ দীপনারায়ণের ঘরে ঢুকল। টাই বাঁধা শার্টের হাতা খানিকটা গোটানো, কোমরে লেদার বেল্টের বন্ধনী, মিঃ দীপনারায়ণের শ্যামবর্ণ বলিষ্ঠ চেহারায় তাকে বেশ স্মার্ট দেখায়। লম্বা খুব বেশি নন, কিন্তু হঠাৎ দেখলে লম্বা মনে হয়। কালো চুল, সিঁথে কাটা বাঁ দিকে। পাতলা ভুরুর নীচে চোখ জোড়া তীক্ষ্ণ ও গভীর। ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক চওড়া মুখ। পরিষ্কার গোঁফ দাড়ি কামানো। নিজের জায়গায় বসে, সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, বসুন। কী। ব্যাপার, বলুন।
আভা বসল। বব টেবিলের ওপর ওর ছোট ছোট থাবা দিয়ে চাপড়াতে লাগল। মিঃ দীপনারায়ণ আবার বললেন, ছেলেকেও নিয়ে এসেছেন?
হ্যাঁ, ওকে কোথাও রেখে আসার উপায় ছিল না। আভা একটু থেমে প্রথম দিনের ঘটনা থেকে সবই বলল। কেবল কোথায় কোথায় ছিল, সেসব জায়গায় নাম বলল না।
মিঃ দীপনারায়ণ সিগারেট টানতে টানতে সব শুনলেন। শুনতে শুনতে অবাক হলেন। তেমন চিন্তিত মনে হল না। সুবীরের সঙ্গে কথামতো, বাঁধাধরা প্রশ্নগুলোই তিনি করলেন। জানতে চাইলেন, লোকাল থানায় রিপোর্ট করা হয়েছে কি না। আভা মিথ্যা কথাই বলল, যে হয়েছে। কারণ বিজিত আর মিঃ কাপুর থানায় একরকম ভাবে খবর দিয়েছিল। সেটাও রিপোর্ট বলে ধরে নেওয়া যায়। মিঃ দীপনারায়ণ বললেন, আমি তো ব্যাপারটার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনিও কারোকে সন্দেহ করতে পারছেন না। অথচ আপনি নিঃসন্দেহ, কেউ বা কারা আপনাকে আর ছেলেকে খুন করতে চাইছে। এটা তো একটা গুরুতর ব্যাপার। কিন্তু দেশটা তো মগের মুল্লুক নয়?
আভার জীবনটা এতই ছোট, (যা আগে ও কখনও অনুভব করেনি।) মগের মুল্লুক কোথায়, এবং সেখানে কী ঘটে, ওর কোনও ধারণা নেই। কথাটা অবিশ্যি ও আগেও শুনেছে। ইস্কুলের বইয়ে পড়ে থাকলে, আজ আর তা মনে নেই। অতএব মিঃ দীপনারায়ণের কথার জবাবে ও কিছু বলতে পারল না। গভীর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে তাকাল ওঁর মুখের দিকে। উনিও ওঁর সেই তীক্ষ্ণ চোখে আভার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, হুম। লোকাল থানা এ নিয়ে কোনও তদন্ত করেছে?
আমি জানি না। আভা বলল, আমি তারপর থেকে নানান জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছি। যেখানেই যাই, সেখানেই আমার খোঁজ করা হচ্ছে। কেউ শেলটার দিতেও ভয় পাচ্ছে।’
মিঃ দীপনারায়ণ হাসলেন, রীতিমতো মিষ্ট্রি অ্যান্ড মার্ডার স্টোরির মতো শোনাচ্ছে অবিশ্যি আমি সে রকম সিরিয়াসলি ব্যাপারটা ভাবতে পারছি না। থানার সঙ্গে যোগাযোগ করব। তা আপনি কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন?
অ্যাঁ?’ আভার ভিতরটা ভয়ে সিঁটিয়ে উঠল। ঢোক গিলে বলল, নানান বন্ধুদের বাড়িতে।
মিঃ দীপনারায়ণ জিজ্ঞেস করলেন, এখন কোথায় আছেন–মানে কোথা থেকে এলেন?
সুকুমার দাশ।’ এই নামটাই আভা ভেবে রেখেছিল। কেন তা জানে না। বলল, কয়েলস করপোরেশনের ডিরেক্টর ।
মিঃ দীপনারায়ণ মাথা ঝাঁকালেন, হুম! বুঝেছি! স্যার জে. সি-র ওখানে মোটা শেয়ার আছে। তিনি ববের দিকে তাকালেন, তাঁর শেষ উত্তরাধিকার। তা শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে কি আপনার কোনও যোগাযোগ নেই এখন?
অনেক দিন থেকেই নেই, আপনি তো জানেন। আভা মনে মনে অবাক হল। মিঃ দীপনারায়ণ সব জেনেও এমন একটা প্রশ্ন করছেন?
মিঃ দীপনারায়ণ সিগারেটে আয়েসের টান দিলেন, জানি। ভাবলাম এর মধ্যে যদি কোনও রকম। যোগাযোগ হয়ে থাকে। আপনার এ অবস্থায় ওদেরই তো আপনাকে দেখা উচিত। জোজের ডেথের। কেসের ব্যাপার নিয়ে যা ঘটে গেছে, সেটা তো একটা ভুল বোঝাবুঝি। এখন মিটিয়ে নেওয়াটাই। উচিত। তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন, সে যাই হোক।’
টেলিফোন বেজে উঠল। মিঃ দীপনারায়ণ রিসিভার তুলে নিলেন, হ্যালো–স্পিকিং। হু-হুঁ…(আভার চোখ মিঃ দীপনারায়ণের দিকে। আতঙ্ক চেপে রাখা কঠিন হয়ে উঠছে। কার টেলিফোন?)..জানি..হুম…সে ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে?…এখানেই হ্যাঁ। হাসলেন। (এখানেই? কে এখানেই? আভা? কার টেলিফোন? ও ববকে টেবিলের সামনে থেকে টেনে নিল।) গুডলাক। রিসিভার নামিয়ে দিলেন। তাকালেন আভার দিকে, আপনি যখন বলছেন, তখন আমি নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর করব। একটা লিখিত অভিযোগ মানে সব ঘটনা লিখে আমাকে দেবেন।’
আমি লিখেই নিয়ে এসেছি। আভার হাত কাঁপছে। ও হাতব্যাগ খুলে, কাগজটা বের করে বাড়িয়ে দিল। ওর শিরদাঁড়ায় শিহরন। তাড়াতাড়ি উঠতে চাইছে।
মিঃ দীপনারায়ণ কাগজটা নিয়ে হাসলেন, একেবারে তৈরি হয়েই এসেছেন দেখছি।’
কাগজে দ্রুত চোখ বোলালেন। এখনও তার চশমার দরকার হয় না। ঠিক আছে। আপনি কি চান, আমার লোক আপনাকে সবসময় শ্যাডো করবে?
সেটা কী করা উচিত আপনিই ভাল বুঝবেন। আভা কথাটা ভেবেই বলল, আমাকে আর ববকে আপনি বাঁচান।’
মিঃ দীপনারায়ণ উঠে দাঁড়ালেন। আভাও দাঁড়াল। তিনি টেবিলের পাশ দিয়ে কয়েক পা এগোলেন, এতটা ভয় পাবেন না। আমার যা করবার আমি করব।
আভা দরজার দিকে এগুলো। তিনি দরজা পর্যন্ত আভাকে পৌঁছে দেবার মতো সৌজন্য রক্ষা করলেন। এখানেই হ্যাঁ’…কথাটা ওর কানে বাজছে। বাইরে কি ওরা কোথাও ওত পেতে আছে? আভা সিঁড়ির দিকে পা বাড়াবার আগে, ওঁর দিকে তাকিয়ে বলল, যাচ্ছি।
গুড লাক।’ টেলিফোনের সেই শুভেচ্ছাসূচক শব্দটিই তিনি আভাকে শোনালেন।
আভা লক্ষ করল, মিঃ দীপনারায়ণের তীক্ষ্ণ চোখের গভীরে কৌতূহল। ও দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামল। ওর স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়েও বুঝতে পারে, লালবাজার থানা কম্পাউন্ডের মধ্যে কোনও ঘটনাই ঘটবে না। যদি ঘটে, যদি ওরা এখানে ওর পাত্তা করে থাকতে পারে, তা হলে বাইরেই কোথাও…। ও পদক্ষেপ স্থির রাখার চেষ্টা করল। নির্দিষ্ট জায়গায় হেঁটে গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল। ট্যাক্সিটি তৎক্ষণাৎ স্টার্ট করল। থানার ডান দিকে বেরিয়ে লালদিঘি চক্কর দিয়ে, ক্লাইভ স্ট্রিটের দিকে এবং সেখান থেকে ব্র্যাবোর্ন রোড। চারদিকে গাড়ির ভিড়, ডাইনে বাঁয়ে এবং লোকজন। আভা ববকে বুকে চেপে, গাড়ির কাঁচ তুলে, এক কোণে লেপটে বসে আছে। কাছে পাশাপাশি কোনও গাড়ি এসে পড়লেই সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে উঠছিল। ট্যাক্সি একটা জায়গায় দাঁড়াল। আভা ড্রাইভারের দিকে তাকাল। ড্রাইভার বা দিকে একটি অফিস বিল্ডিঙ্গে ঢোকার পথ হাত দিয়ে দেখিয়ে হিন্দিতে বলল, আপনি ওই অফিসের মধ্যে চলে যান। আপনার জন্য ওখানে লোক আছে।
আভা বাইরে তাকিয়ে দেখল। পেভমেন্টের ওপর নানা লোকের ভিড়। খুব কাছেই সানগ্লাস চোখে দুটো লোক কি ওকেই দেখছে? আভা সঁতে দাঁত চেপে, দরজা খুলে নেমে পড়ল। নির্দিষ্ট অফিস বিল্ডিংয়ের চওড়া পথে ঢুকে পড়ল। ভিতরে আলো জ্বলছে। বাইরে দু ধারে অনেক বোর্ড। ও ঠিক কোন দিকে যাবে জানে না। তবু এগিয়ে গেল। হঠাৎ ওর সামনে এসে দাঁড়াল সুবীরের ড্রাইভার। বলল, আসুন সঙ্গে আসুন।
আভা তাকে অনুসরণ করল। পিছনে তাকাল না। একতলারই একটা বিরাট অফিস ঘরের ভিতর দিয়ে, ও ড্রাইভারের পিছনে পিছনে গেল। কেউ কেউ ওর দিকে চোখ ফেরাল। ও বুঝতে পারছে। কিন্তু ওর সামনে ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ নেই। অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে, একটা ছোট গলি। পাশে দেওয়াল। সেই গলিটার শেষে একটা ছোট দরজা খোলা। ড্রাইভার সেই দরজা দিয়ে বেরোল। অন্য। একটা রাস্তা, ছোট, গাড়ি পার্ক করে আরও অপ্রশস্ত করে রেখেছে। এবং অসম্ভব ভিড়। ড্রাইভার খানিকটা হেঁটে, একটা গাড়ির দরজা চাবি দিয়ে খুলল। পেছনের দরজা খুলে দিয়ে, আভাকে বলল, বসুন।
আভা উঠে বসল। গাড়ি স্টার্ট করল। ভিড়ের মধ্যে গাড়ি পিঁপড়ের থেকেও আস্তে চলছে। ডান দিকে গিয়ে, গাড়িটা আবার ব্র্যাবোর্ন রোডেই এসে পড়ল। এবং শেষপর্যন্ত সুবীরের ফ্ল্যাট বাড়িটার কম্পাউন্ডে ঢুকল। আভার কোনও সময়ের হিসাব ছিল না। ও পিছনের উইন্ডো স্ক্রিন দিয়ে পিছনে দেখল। কোনও গাড়ি পিছনে নেই। কারোকে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা যাচ্ছে না। ও ববকে কোলে নিয়ে নেমে ভিতরের দিকে এগিয়ে গেল। এলিভেটর নীচেই ছিল। দ্রুত খাঁচায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে তিন নম্বর টিপল। এলিভেটর উঠতে লাগল। ও ব্যাগ থেকে চাবি বের করল। চারতলায় এসে, এলিভেটর থামতেই, দরজা খুলে বেরিয়ে, বন্ধ করতে গেল। ফ্ল্যাটের চাবি খুলে, ভিতরে ঢুকে পড়ল। মিঃ কাপুর সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল।
আভা প্রায় চমকে উঠেছিল, আপনি ভেতরে?
হ্যাঁ, সুবীরের সঙ্গে পরামর্শ করে, এ ব্যবস্থাই ঠিক ছিল। সে টেলিফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, আপনি মোটামুটি নিশ্চিত, কোনও গাড়ি আপনার পিছু নেয়নি?
আভা হাঁপাচ্ছিল। বলল, অনেক গাড়ির মধ্যে সেটা বুঝে ওঠা খুবই কঠিন ব্যাপার। নিশ্চিত কী করে বলব?’
মিঃ কাপুর রিসিভার তুলে ডায়াল করল। কয়েক সেকেন্ড পরে বলল, আমি কাপুর বলছি। উনি এসে গেছেন।…সেটা ঠিক বোঝা যায়নি। তবে মনে হয়, ঠিকই আছে। আমি যেটুকু বুঝেছি, পিছু নিলে, মাঝ পথেই দুর্ঘটনা ঘটে যেত।…হ্যাঁ, ঠিক আছে…হ্যাঁ, ছাড়ছি।’ সে রিসিভার নামিয়ে রাখল। আভার। দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার জন্য খাবার আনানো আছে, কিচেনে রয়েছে। আমি এখন যাচ্ছি। সুবীর সাতটা থেকে সাড়ে সাতটায় ফিরবে, তিন বার কলিং বেল পুশ করবে। আমিও সেই সময়েই আসব।’ সে বেরোবার আগে, কিচেনে গিয়ে জানালা দিয়ে এক বার নীচের দিকে দেখল। ফিরে এসে আভার। দিকে আর এক বার হাত তুলে বিদায় জানিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে গেল।
আভার কোল থেকে বব নেমে গিয়েছে। ও ভাবল, এমন নিঃস্বার্থ উপকার, এই আশ্রয়, কতদিন পাওয়া যাবে?…
রাত্রি সাড়ে ন’টা। বব ঘরের মধ্যে ঘুমোচ্ছে। সেন্টার টেবিলের সামনে, সোফায় সুবীর আর মিঃ কাপুর। অন্যটায় আভা। টেবিলের ওপর একটা স্কচের বোতল, কয়েকটা সোডার। এবং একটি বিয়ারের বোতল। ওরা হুইস্কি নিয়েছে। বিশেষ অনুরোধে, প্রায় দু মাস পরে, আভা একটু বিয়ার নিয়ে বসেছে। ওদের তিন পেগ হয়ে গিয়েছে, চার চলছে। সুবীর কবজির ঘড়ি দেখে, আভাকে বলল, সাড়ে ন’ টা। এ বার দেখুন।
আভা উঠে টেলিফোনের কাছে গেল। দীর্ঘ সোফার এক ধারে বসে, টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল। উত্তেজনায় যেন থরথর করছে। ওপারে রিং হচ্ছে। টেলিফোন ঠিক আছে তো? অবিশ্যি আরও একটা লাইন আছে। ওপার থেকে রিসিভার উঠল, মেয়ের কণ্ঠস্বর। স্বরে কেমন একটা উৎকণ্ঠিত দ্বিধা, হ্যালো।
মঞ্জুর স্বর! আভা বলল, মঞ্জু? ওপার থেকে তৎক্ষণাৎ যেন উৎকণ্ঠিত বিস্ময় ফেটে পড়ল, আভা? তুই? তুই কোথায়। আভা, কোনও এক জায়গায়। আমাকে কি কেউ।’ মঞ্জুর স্বরে অস্থিরতা, ভয়, উত্তেজনা, খুঁজতে এসেছিল কি না? নিশ্চয়ই। তুই বেঁচে আছিস তা হলে।’…আভার স্বর যেন আটকে যেতে চাইল। কোনও রকমে উচ্চারণ করল, এখনও আছি।…মঞ্জু বলল, তা বটে, নইলে তোর গলা শুনছি কেমন করে। শোন, তিন দিন আগে সাড়ে তিনটে নাগাদ দুটো নোক এসেছিল। বাহাদুর গোন্ডকে (অ্যালসেসিয়ান কুকুর) নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাবার পরেই। ইন ফ্যাক্ট ওরা গান পয়েন্টে মানে রিভলবার দেখিয়েই একজন বাইরে, আর একজন ভিতরে ঢুকে এসেছিল। তোর আর ববের কথা জিজ্ঞেস করল। তারপরে আমাদের গোটা বাড়িটাই তন্ন তন্ন করে খুঁজল। খুঁজে দুঃখ প্রকাশ করে বেরিয়ে গেল। আমি ভয়ে কাঠ! সন্ধেবেলা সুকুমার ফেরবার পরেই ওকে সব কথা বললাম। ও ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল। প্রথমে জলিকে টেলিফোন করল। জলি বলল, এ সব ব্যাপারে সে কিছুই জানে না, কারণও বুঝতে পারছে না। তারপরেই ও থানাকে ফোন করল, সব কথাই বলেছে। থানা বলেছে, আমাদের অ্যালার্ট থাকতে। ওরা নিজেরাও লক্ষ রাখবে। শোন, এখনও শেষ হয়নি। আজ সন্ধেয়, দুজন লোক এসেছিল, সেই ওরা না। সুকুমার তখন ছিল। ওরা বলল, মিঃ দীপনারায়ণ ওদের পাঠিয়েছেন, তোর সঙ্গে দেখা করতে। সুকুমার বলল, সে তো এখানে নেই। ওরা বলল, মিসেস মজুমদার মিঃ দীপনারায়ণের কাছে গেছলেন। বলেছেন উনি এখানেই আছেন। আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, ওঁকে শ্যাডো করার। উনি নাকি বিশেষ বিপদে আছেন। তুই কি সত্যি লালবাজারে গেছলি?’…মঞ্জু একসঙ্গে অনেক কথা বলে থামল। আভা বলল, গেছলাম, বাধ্য হয়েই তোদের বাড়ির কথা বলেছি। তুই বা সুকুমার রাগ করিসনি তো?…মঞ্জু যেন উৎকণ্ঠায় ধমকে উঠল, আরে ধ্যেত, রাগের কথা ছাড়। তারপরের ঘটনা শোন। ওরা চলে গেল। আর এই মাত্র আধ ঘণ্টা আগে, সেই লোক দুটো আবার এসেছিল–সেই আর্মড লোক দুটো। সুকুমারও তখন ছিল। কথাবার্তায় ওরা খুব ভদ্র। প্রথমেই বলল, মিঃ দাশ আপনার কুকুরটিকে চেইন দিয়ে বাঁধুন, অকারণ ওর প্রাণ আমরা নিতে চাই না। আমরা আপনার বাড়ির ভিতরটা একটু দেখব। সুকুমার প্রথমটা রেগে উঠেছিল, বলেছিল, এ সব কী ব্যাপার? আমরা কি অরাজক দেশে বাস করছি? লোকটি একেবারে বিনয়ের অবতার, আসলে মারাত্মক। বলল, মিঃ দাশ। আপনাকে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, আমাকে বাধা দেবেন না। আমি আপনার কোনও ক্ষতিই করব না, আপনার বাড়ির একটি আলপিনেও হাত দেব না। অপরাধের মধ্যে আমি আপনার বাড়িতে ঢুকে একটু দেখব। আমরা যাকে খুঁজছি, খবর আছে, সে আপনার বাড়িতে আছে। বলে তোর নাম করল। ওদের জেদের কাছে আমাদের সাবমিট করতেই হল। নইলে গোন্ডকে ওরা গুলি করে মেরেই ঢুকত। গোন্ডকে বাঁধার পরে, ওরা আমাকে বাইরের ঘরে রেখে, সুকুমারকে সঙ্গে নিয়ে গোটা বাড়ি তন্ন তন্ন করে তোর খোঁজ করেছে। যাবার সময় সেই আবার দুঃখ প্রকাশ…এই যে শোন আভা, সুকুমার এসেছে, তোর সঙ্গে কথা বলবে।
আভা তারপরই সুকুমারের গম্ভীর স্বর শুনতে পেল, আভা, কোথায় আছ, জানতে চাই না। কীসের জন্য কী ঘটছে, সবই বুঝতে পারছি। আমরা কোন জগতে বাস করছি বুঝতে পারছি না। আমরা কথায় কথায় জঙ্গলের তুলনা দিই, কিন্তু কলকাতা অনেক ভয়াবহ, হিংস্র। মনে হচ্ছে হন্যে বাঘেরা তাদের শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে–শাসন আইনকে তারা থোড়াই কেয়ার করে। তোমাকে কী বলব ভেবে পাচ্ছি না, তবু আমি কিছু করার চেষ্টা করব। সে চেষ্টা কাজে লাগবে কি না জানি না। তোমার শত্রুরা ডিটারমাইন্ড। অপ্রাসঙ্গিক কি না, জানি না, তবু বলছি, জোজোর কেসে জলি আর জয়া যখন হাজতে ছিল, সেই তিন দিনের মধ্যে স্যার জে. সি. বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে বহু লক্ষ টাকা তুলেছেন। পনেরো লক্ষরও বেশি খরচের হিসাবটা উনি কী দেখাবেন, তা উনি নিশ্চয়ই ভেবেছেন। এটা পুরনো কথা। তুমি জানতে! আভা বলল, ‘না। তার মনে হয় সেই টাকা দিয়ে–!’…সুকুমার বাধা দিল, ও সব ভেবে লাভ নেই। অনুমান করতেই পারছ, সে টাকা কোথায় গেছে। আপাতত বলতে বাধ্য হচ্ছি, তোমাকে আর ববকে ভগবান রক্ষা করুন। সম্ভব হলে টেলিফোনে যোগাযোগ রেখো।’…আভা দ্রুত জিজ্ঞেস করল, ‘সুকুমার, আমি কখনও তোমার কাছে গেলে, থাকতে দেবে তো?’ সুকুমারের গলা যেন কেঁপে গেল, ‘আভা, তুমি যখন খুশি আসতে পারো কিন্তু আমাদের দায়িত্বের তোয়াক্কা কেউ করে না। হয়তো অসহায়ভাবে চোখের সামনে ভয়ংকর কিছু দেখতে হবে। ছাড়ছি, আমি এখুনি এক বার থানায় যাব, সেখান থেকে জলির কাছে। বেঁচে থাকার চেষ্টা করো, ববকে আমার চুমো দিচ্ছি।’…লাইন কেটে গেল।
আভা আস্তে আস্তে রিসিভার নামিয়ে রাখল। গলাটা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গিয়েছে। চোখে শূন্যতা। তাকাল সুবীর আর মিঃ কাপুরের দিকে। ওরা দুজনেই আভার দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। আভা উঠে এসে ওদের সামনে বসল। মিঃ কাপুর বিয়ারের গেলাসটা তুলে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল। আভা চমকে উঠে শব্দ করল, ‘অ্যাঁ? ওহ, হ্যাঁ ধন্যবাদ।’ ও ঢক ঢক করে গেলাস শূন্য করে দিল। আর টেলিফোনের সব বয়ান ওদের বলল।
আভার কথার শেষে, খানিকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। মিঃ কাপুর আর সুবীর কয়েক বার। তাদের হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিল। সুবীর একটা সিগারেট ধরিয়ে কেশে বলল, ব্যাপারটা বোঝা গেল। গোয়েন্দা অফিসাররা ঘুরে যাবার পরেই ওরা আবার এসেছিল ব্যাপারটা যেন কাকতালীয় নয়। এর পরে কোনও উচ্চপর্যায়ে আবেদন করলেও, প্রশ্ন দাঁড়াবে দুটি। এক: বিষয়টি প্রমাণ বহির্ভূত বলা হবে, অতএব ভিত্তিহীন। প্রমাণ করাও খুব কঠিন। দুই: উচ্চপর্যায়ের কেউ সিমপ্যাথেটিক হয়ে এগিয়ে আসবেন কি না। তবু আমি বলব, এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত মিনিস্টারকে এক বার জানানো দরকার। জোজোর কেসে যদিও সরকার পক্ষই বাদি ছিল, তবু এখন ঘটনাটা আলাদা। তিনি যদি মার্সি দেখান সরাসরি প্রাণ ভিক্ষা চাওয়া।
তার মানে তুমি মিসেস মজুমদারকে রাইটারসে যেতে বলছ?’ মিঃ কাপুর জিজ্ঞেস করল।
সুবীরের মুখ চিন্তিত। বলল, সেটা এখনই বলতে পারছি না। কীভাবে তাঁকে জানানো যায়, ভেবে দেখতে হবে।
স্বরাষ্ট্র সচিবকে জানালে কেমন হয়? মিঃ কাপুর জিজ্ঞেস করল।
সুবীর অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, তিনি তো গোয়েন্দা বিভাগের ওপরই দায়িত্ব দেবেন। সেটা তো হয়েই গেছে। অবিশ্যি মিসেস মজুমদারের সামনেই বলছি, লক্ষ্য যেখানে হত্যা, সেখানে আজ সারা দেশে, কে কাকে বাঁচাতে পারছে? পলিটিকাল অর ননপলিটিকাল-হত্যা চলেছেই। তবু মানুষ বাঁচতে চায়, চেষ্টা করে। এটাও একটা চেষ্টা, ফলাফল যাই হোক।
মিঃ কাপুর ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়াল, দশটা বেজে গেছে, আমি উঠি। ব্যাপারটা ভেবে দেখা যাক, বিশেষ করে কী ভাবে মিনিস্টারকে জানানো যাবে। আভার দিকে তাকিয়ে, ডান হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, আমিও যখন আসব, তিন বার পুশ করব। দু জনকেই শুভরাত্রি। সে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। এবং দরজা বন্ধও হয়ে গেল।
তিন বার পুশ মানে কলিং বেলের সংকেত। আভা শুনল। অথচ যেন কিছুই শুনছে না। মনে হচ্ছে, ওকে ঘিরে একটা ভয়ংকর বেষ্টনী ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। ছায়ার মতো কারা এগিয়ে আসছে।
মিসেস মজুমদার। সুবীর ডাকল।
আভা চকিত হয়ে তাকাল। ব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, এ বার আপনাকে খেতে দিই। তার জন্যে ব্যস্ত হতে হবে না। সুবীর বলল, একজন মহিলার হাতের রান্না অনেক দিন বাদে আমার কপালে জুটবে। এখন কথা হচ্ছে, লালবাজারে গিয়ে আপনি মোটামুটি আপনার অবস্থা অনেকটা বুঝতে পেরেছেন। আস্থা আর ভরসা হয়তো কিছুই পাননি, তবু মিনিস্টারকে জানালে, অবস্থাটা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। শোনা যাক না, তিনি কী বলেন। এ বিষয়ে আগামীকাল আপনাকে আমি জানাব, কী ভাবে প্রসিড করা যায়। আপনাকে আমি রাইটারসে যেতে বলব না, অন্য কোনও ব্যবস্থা করা যায় কি না, সেটাই দেখব। উপদেশ দেওয়া অর্থহীন, কিন্তু আপনি জানেন, মাংস এক জায়গায় পচতে আরম্ভ করলে, বাকিটাও পচতে থাকে। ভয়টা সেই রকম। আপনি সেটা রোখবার চেষ্টা করুন, আর যা করণীয় তাই করে যান।
আভা ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল, বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি তো ওদের সম্পত্তি হেরিটেড করতে চাই না। সেটা আমি লিখিত ভাবেও দিতে রাজি আছি। কিন্তু বব?’ সুবীর বলল, ধরে নিলাম, আপনি না হয় কারোকে বিয়েই করলেন, অন্তত প্রমাণ করার জন্য, উত্তরাধিকার সূত্র ত্যাগ করলেন। কিন্তু গোকুলে যে কৃষ্ণ থেকেই যাচ্ছে। তার কী উপায়? বিধিব্যবস্থা হয়তো অনেক বাতলানো যায়, ওরা কি তা মানবে? জোজোকে দিয়ে যার শুরু। সে কথাটা শেষ করল না। উঠে দাঁড়াল, যাক এখন এ সব কথা। আসুন খেয়ে নিই।