৪.
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ। মোটেই গরম নেই, ঠাণ্ডা বাতাস সমুদ্রের দিক দিয়ে এসে আবহাওয়াটাকে সুন্দর করে তুলেছে।
নীল আকাশে চাঁদ উঠেছে কাগনা পাহাড়ের পিছনে। এই পাহাড় কর্সিকা দ্বীপকে দুই ভাগ করেছে। একই দ্বীপে তৈরি হয়েছে রাজ্য, তুচ্ছ কারণেও তারা পরস্পরকে আক্রমণ করে বসে। ঘৃণা করে একে অপরকে।
চড়াই উঠতে উঠতে চারদিক চেয়ে দেখছি। টাভরো নদী কোথায় দিয়ে বইছে তা দেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু তার কোনো চিহ্ন চোখে পড়ছে না। যদিও দূরে শান্ত ইস্পাতের আয়নার মতো দেখা যাচ্ছে ভূমধ্যসাগরের জলরাশিকে।
রাতের নিজস্ব কিছু শব্দ আছে। দিনে হয়তো এগুলো হাজার শব্দের ভিড়ে চাপা পড়ে থাকে, বা শুরুই হয় রাতের সাথে সাথে। লুসিয়েন এতে পুরো অভ্যস্ত। তাই তার উপর এর কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমি। নতুন বলেই সব শব্দকেই অদ্ভুত লাগছে, করে তুলছে আগ্রহী।
একটি তিন রাস্তার মোড়ে এসে লুসিয়েন থামল। একটা রাস্তা পাহাড় ঘুরে এগিয়ে গেছে। অন্যটা সোজা উঠে গিয়েছে উপরে। দ্বিতীয় রাস্তাটির চিহ্ন এত কম যে চোখে না পড়ার মতোই। লুসিয়েন জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠিকমতো উঠতে পারবেন তো।’
আমি উত্তর দিলাম, ‘উঠতে ঠিকই পারব। তবে মাথা ঘুরতে পারে।’
‘মাথা ঘুরবে কেন?’
‘গভীর খাদ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।’
‘তাহলে এ পথেই যাওয়া যাক, এ পথ দুর্গম হলেও কোনো খাদ নেই। আর এ পথে সময় অন্তত তিন কোয়ার্টার বাঁচবে।’
‘তাহলে এ পথেই চলুন।’
‘হোনি গাছের একটা ঝোলের ভেতর লুসিয়েন ঢুকল, আমিও তার পিছনেই চললাম। ডায়ামান্টি ঝোঁপঝাড় দেখতে দেখতে পঞ্চাশ ষাট গজ আগে চলছে।’
কিছুক্ষণ পরপর থেমে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
প্যারিসে দেখেছি উঁচু পদের কর্মচারীরা ঘোড়াকে দুই ভাবে ব্যবহার করে। সকালে গাড়িতে লাগিয়ে অফিসে যায়। আবার বিকেলে সেই ঘোড়ার পিঠে চেপে হাওয়া খেতে বের হয়। এই ডায়ামাল্টির কাজও সেই ধরনের। এ দু পা ওলা মানুষ দস্যু এবং চার পা ওলা জন্তু শিকারে সমানভাবেই অভ্যস্ত। এ ব্যাপারে লুসিয়েনকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার ধারণা ঠিক কি না?
‘না, আপনার ভুল হয়েছে, ডায়ামাল্টি মানুষ এবং জন্তু দুই-ই শিকারে অভ্যস্ত বটে, তবে যে মানুষের উপর তার আক্রোশ তারা মোটেই দস্যু শ্রেণির না, তারা হলো সৈনিক, ঘোড়সওয়ার পুলিশ আর স্বেচ্ছা সৈনিক, এই তিন সম্প্রদায়ের উপর তার রোখ।
‘তাহলে ডায়ামাল্টি কি ডাকাতের কুকুর?
‘হ্যাঁ, শুরু থেকেই মালিক ছিল এক অলার্তি। বহুদিন সে জঙ্গলে পালিয়েছিল। পালিয়ে থাকার সময় তার প্রয়োজনে আমি তাকে খাবার আর গুলি বারুদ এগুলো মাঝে মাঝে দিতাম। কলোনাদের হাতে লোকটি মারা গেল। ডায়ামাল্টি পরদিন আমার কাছে চলে এলে। আগেও জিনিসপত্র নিতে আমাদের বাড়ি আসত। কাজেই অসুবিধা হয়নি।
আমি জানালাম, কিন্তু আমার ঘর থেকে এ ছাড়াও আর একটা কুকুর চোখে পড়ল।
‘ব্রুক্কো, তার মালিক ছিল আবার বলো না। যে মারা যায় এক অলাৰ্ত্তির হাতে। জানেন এখন আমি কি করি? যখন কোনো কলোনাদের সাথে দেখা করি, সাথে থাকে ব্রুক্কো, আর যখন কোনো অৰ্ত্তির কাছে যাই, তখন সাথে নিই ডায়ামাল্টিক। কেউ যদি কোনোদিন ভুল করে কুকুর দুটো শিকল এক সাথে খুলে দেয়। তাহলে দুটোই নিজেরা মারামারি করে মারা যাবে।
থেমে, একটু দুখের হাসি দিল লুসিয়েন, মানুষ ঝগড়া করে। আবার ঝগড়া মিটেও যায়। ঝগড়া শেষে শান্তিতে থাকে। গির্জায় গিয়ে এক সাথে উপসনাও করে। কিন্তু কুকুররা একবার ঝগড়া করলে কখনও আর একপাত্র থেকে খাবার খাবে না।’
‘সত্যিকার কর্সিকার আবহাওয়ায় মানুষ আপনার কুকুর দুটো। হেসে বললাম আমি। কিন্তু ডায়ামাল্টির কথা বলার পর থেকেই তো তাকে দেখতে পাচ্ছি না। কোথাও গেল ও।
‘ব্যস্ত হবেন না। ও গেছে লী মাচিওতে।
ভাবছি জিজ্ঞেস করব, কোথায় লী মাচিও। তখনই কুকুরের ডাক শুনতে পেলাম। ডাক না বলে কান্না বলাই উচিত। এত করুণ এবং একটানা আমি ক্ষেপে উঠলাম অমঙ্গল আশা করে। লুসিয়েনের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও কী?’
‘ডায়ামাল্টি কাঁদছে।’
‘কাঁদছে, কার জন্য?
‘ওর মালিকের জন্য। ও মানুষ না, যে ওর মালিক মরে গেছে বলেই তাকে ভুলে যাবে।’
‘আর একবার আরও করুণ, একটানা সুরে ডায়ামাল্টি কেঁদে উঠল।’
‘বুঝেছি ওর মালিক এর কাছাকাছিই শত্রুর হাতে মারা গিয়েছিল।
‘হ্যাঁ। তাই আমাদের পিছনে ফেলে ডায়ামাল্টি লী মাচিতে চলে গেছে।’
‘তার কবর কি লী মাচিওতে?’
‘তা, কবর বলুন বা স্মৃতিস্তম্ভ বলুন। আমাদের দেশের নিয়ম হলো যখন কোনো লোক নিহত হবে, তার কবরের পাশ দিয়ে যে কেউ হেঁটে যাবে। সেই কবরের উপর রেখে যাবে একটা গাছের ডাল অথবা এক টুকরো পাথর। তার ফলে সাধারণ লোকের কবর এক সময় ধুলায় মিশে গেলেও যারা এই ভেলডেটায় শহীদ হন তাদের কবর দিনে দিনে বাড়তে থাকে। যেমন বেড়ে চলে তাদের জীবিত আত্মীয়দের প্রতিহিংসা।’
তৃতীয় বার শোনা গেল ডায়ামাল্টির কান্না। এবার এত কাছে যে সব জানার পরও আমি শিউরে উঠলাম। তারপরেই পথের মোড় ঘুরতেই আমাদের বিশ গজ সামনে দেখলাম ৪/৫ ফুট উঁচু সাদা একটা পাথরের ঢিবি। সমাধিস্তম্ভ। এরই নাম লী মাচিও।
এই অদ্ভুত স্মৃতিস্তম্ভের সামনে ডায়ামাল্টি সে আছে। লুসিয়েন একটা পাথর তুলে নিয়ে মাথার টুপি খুলে লী মাচিওর কাছে গেল।
লুসিয়েনের দেখাদেখি আমিও তার অনুসরণ করলাম।
স্তম্ভের কাছে দাঁড়িয়ে সে একটা ওক গাছের ডাল ভেঙে নিল। তারপর প্রথমে পাথর রাখল তারপর দিল ডাল। তারপর তাড়াতাড়ি বুড়ো আঙুল দিয়ে একটা ক্রস চিহ্ন আঁকল। স্বয়ং নেপোলিয়নকেও সংকটের সময় এই রকম চিহ্ন আঁকতে দেখা গিয়েছে।
লুসিয়েন যা করছে। আমিও তাই করছি।
তারপর আবার হাঁটতে শুরু করলাম–ডায়ামাল্টি পিছনে বসে রইল। প্রায় দশ মিনিট পরে তার শেষ হাহাকার শুনতে পেলাম আমরা। প্রায় সাথে সাথে সে মাথা এবং নেজ নিচু করে আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে এগিয়ে গেল। প্রায় একশো গজ এগিয়ে আবার ঝোঁপের ভেতর শত্রুর খোঁজ করতে লাগল।
.
পথ চলতেই বুঝলাম, লুসিয়েন ঠিকই বলেছিল। পথ বেশ কষ্টের চড়াই। বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলাম। কারণ এবার উপরে উঠতে দুই হাতই দরকার। আমার সামনের লোকের কথা আলাদা। সে এমন ভাবে পথ চলছে যেন সমতল দিয়েই সে হেঁটে যাচ্ছে। পাথর থেকে পাথরে লাফাতে লাফাতে কিছুক্ষণ পরেই আমরা একটা সমান জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। তার মাথার উপর চারিদিকে ভাঙা দেয়াল। এই ইস্ত্রিয়া দুর্গ, আমাদের গন্তব্য স্থান।
আরও পাঁচ মিনিট চড়াই উঠতে হলো, আরও খাড়া আরও দুর্গম। সবচেয়ে উঁচু ধাপে উঠে লুসিয়েন হাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে তুলল।
‘প্যারিসে বাড়ি হলে কি হবে? পাহাড়ে উঠতে আপনি আনাড়ি না।’
‘তা নই। এর আগেও আমি পাহাড়ে উঠেছি।’
লুসিয়েন হেসে বলল, ‘প্যারিসের মন্ট মার্টার পাহাড়ে বুঝি।’
‘তা তো ঠিক। কিন্তু মন্ট মার্টার পাহাড় ছাড়াও অনেক পাহাড়ে উঠেছি আমি রিগি, ফ্রাউন হল, জেসি, ভিসুভিয়াস, ঐখনি, এটনা।’
তাহলে এখন আপনার কাছে শিশু হয়ে গেলাম। আমি তো এক মন্ট রোগেন্ডে ছাড়া আর অন্য কোনো পাহাড়েই চড়িনি। যাক, আমরা এসে গেছি, চার শতাব্দী আগে এলে আপনাকে এখন আমার পূর্ব পুরুষেরা সিংহ দরজা খুলে দিয়ে ইস্ত্রিয়া দুর্গে স্বাগত জানাত। আজ তার বংশধর এই ভাঙা দেয়াল দেখিয়ে আপনাকে বলতে পারে। স্বাগত এই ধ্বংস স্তূপে।’
‘তাহলে কি এই দুর্গ ভিসেন্টনো দ্য ইস্ত্রিয়ার মৃত্যুর পর থেকে আপনাদের দখলে আছে।’
‘না, তা নেই লুসিয়েন তাড়াতাড়ি উত্তর দিল–কখনও এ দুর্গ আমাদের অধিকারে আসেনি। কিন্তু এর শেষ মালিক ছিলেন সেই বিখ্যাত স্যাভিলিয়া, লুসিয়েন দি ফ্রাঞ্চির বিধবা স্ত্রী। ওই লুসিয়েন যে আমাদের পূর্ব পুরুষ তা তো আপনাকে আগে জানিয়েছি।
এই মহিলার সম্পর্কে একটা ভয়াবহ গল্প প্রচলিত আছে না? একটু ইতস্তত ভাবেই জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘হ্যাঁ আছে, দিনে হলে থামলেই আর একটা ধ্বংসস্তূপ দেখতে পেতেন, সেটা ছিল সেনর দ্য গাইদিস এর বাড়ি। স্যাভিলিয়া যেমন ছিল সবার শ্রদ্ধার পাত্রী ওই গাইদিস ছিল সবার ঘৃণার পাত্র, স্যাভিলিয়া ছিলেন সুন্দরী, গাইদিস ছিল কুশ্রী। কিন্তু নিয়তি স্যাভিলিয়া বিধবা হবার পর গাইদিস তাকে বিয়ে করতে চাইল। স্যাভিলিয়া সে প্রস্তাব ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করার পর, গাইদিস শাসিয়ে খবর পাঠাল স্বেচ্ছায় বিয়ে না করলে, গায়ের জোরে সে স্যাভিলিয়াকে তুলে নিয়ে যাবে, তখন স্যাভিলিয়ার চাইতে গাইদিসের লোকজন ছিল বেশি, যুদ্ধ হলে স্যাভিলিয়ার জয়ের সম্ভবনা ছিল না। তাই তিনি আশ্রয় নিলেন কৌশলের। নিমরাজী ভাব দেখিয়ে তাকে দাওয়াত দিলেন এই দুর্গে খাবারের। ফাঁদে পা দিল মূর্খ গাইদিস। সে যে তাকে আগে ভয় দেখিয়েছিল, এ কথা ভুলে গিয়ে মাত্র একজন সঙ্গী নিয়ে ইস্ত্রিয়া দুর্গে এসে হাজির হলো। আসার সাথে সাথে তাকে বন্দি করলেন স্যাভিলিয়া।
গাইদিসের অনুচরেরা দুর্গ আক্রমণের সাহস পেল না, স্যাভিলিয়া ঘোষণা করে দিয়েছিল, সেরকম কোনো চেষ্টা হলে সঙ্গে সঙ্গে গাইদিস মারা যাবেন।
অনেক দিন স্যাভিলিয়ার কারাগারে ছিলেন গাইদিস। তাকে না মেরে বাঁচিয়ে রাখাটা যে কত বড় ভুল হয়েছে, তা টের পেলেন অনেক দেরিতে। এক চাকরাণীর সাহায্যে গাইদিস পালিয়ে গেল কারাগার থেকে এবং সঙ্গে সঙ্গে অনেক সৈন্য নিয়ে এসে আক্রমণ করল ইস্ত্রিয়া। যুদ্ধে পরাজিত এবং বন্দি হলো স্যাভিলিয়া। গাইদিস এক লোহার খাঁচায় বন্দি করে তাকে রাস্তার উপর রেখে দিলেন। সেইখানেই কয়েকদিন দুঃখ ভোগের পর মারা গেলেন স্যাভিলিয়ার।’
কথা বলতে বলতে ততক্ষণে আমরা ভাঙা দুর্গের ভেতরে এসে পড়েছি। দেয়ালের ফাঁক দিয়ে জ্যোা এসে প্লাবিত করে দিয়েছে সম্পূর্ণ দুৰ্গটা। কিন্তু দেয়ালের নিচেই জমাট অন্ধকার। সেদিকে তাকিয়েই লুসিয়েন ইতিহাস বলে চলল সেই দুর্গের।
স্যাভিলিয়ার মৃত্যুতে যে ভেনডেটা শুরু হলো, তা শেষ হলো চারশো বছর পর। আমার বাবার সময়। আমাদের বাড়ি পাশাপাশি দুটো বন্দুক ঝোলান দেখেছেন। তাতে একটাই তারিখ খোদাই কর আছে ১৮১৯ এর ২১ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টা। ঐ তারিখেই গাইদিস বংশের শেষ দুই বংশধর মারা যায়। একজন আবার বাবার গুলিতে, দ্বিতীয়জন আমার মায়ের গুলিতে।’
ওরা কি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়াই করছিলেন? আমি জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না।
‘মোটেই না। গাইদিস বংশে ১৮১৯ সালে দুই ভাইই বেঁচে ছিল। আমাদের বংশে আমার বাবা। বাবা ২১ সেপ্টেম্বর সার্টেন গিয়েছিলেন, তিনি ফিরে আসবেন অনসেভো রোড ধরে। গাইদিসদের একজন সেই জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল, আড়াল থেকে গুলি করার জন্য। অন্য ভাই লোজন নিয়ে এসে ২১ সেপ্টেম্বর সকাল বেলায় আক্রমণ করল আমাদের সুল্লাকারোর বাড়ি। বাবা বাড়িতে নেই। অরক্ষিত ঘর দখল করে ধ্বংস করার এই সুযোগ।
সুযোগ কিন্তু দুর্যোগে পরিণত হলো ওদের জন্য। বাবা ছিলেন সর্তক। অলমেডোর রাস্তায় গাইদিস যে কোথায় লুকিয়ে আছে। তা তিনি আগেই জেনে ফেলেছিলেন। ফলে গাইদিস গুলি করার আগেই বাবার গুলিতে গাইদিস ভাই মারা পড়ল জঙ্গলে। বাবা পকেট থেকে ঘড়ি বের করে দেখলেন তখন ঠিক বেলা এগারোটা।
ঠিক একই সময় সুল্লাকারোর বাড়িতে দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে মাও বন্দুক ছুড়ছেন। নিচে দ্বিতীয় গাইদিস ভাই দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে তার লোকজন নিয়ে। কিন্তু মায়ের বন্দুক থেকে ছোঁড়া গুলি কয়েক লোকের মধ্যে থেকে ঠিক দ্বিতীয় গাইদিস ভাইয়ের শরীরে ঢুকল। মাটিতে পড়ার সাথে সাথে মারা গেল সে। মা মুখ ফিরিয়ে দেয়ালের গায়ে ঘড়ি দেখলেন, দুপুর ঠিক এগারোটা।
চারশো বছর পরে স্যাভিলিয়ার মৃত্যুর প্রতিহিংসা শেষ হলো, এক সাথে গাইদিসের শেষ দুই বংশধর পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। এই ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যেই বন্দুক দুটিতে সন তারিখ লিখে টানানো। হয়েছে।
ওই তারিখের ঠিক সাত মাস পর আমাদের জন্ম। এমন মা বাবার ছেলে হয়ে কি করে যে লুই দার্শনিক হয়। তা আমার বোঝার বাইরে।
ঠিক এমন সময়।
চাঁদের আবছায়া আলো।
সেই আলো ছায়ায় এসে দাঁড়াল একজন মানুষ সাথে কুকুর। এসেই খুনি বা দস্যু অলাৰ্ত্তি সাথে কুকুর ডায়ামন্টি। সময় রাত নয়টা।
সময়ানুবর্তিতাই রাজাদের সৌজন্য–‘বলতেন ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই। এই অলাৰ্ত্তি ও তারই অনুসারী।
অলাৰ্ত্তি দেখে আমরা দুইজনেই উঠে দাঁড়ালাম।
অলাৰ্ত্তি বলল, ‘আপনার সঙ্গে ইনি কে, সেনর লুসিয়েন।
‘ওর জন্য চিন্তার কোনো কারণ নেই অলাৰ্ত্তি। ইনি আমার বন্ধু। আমার মুখ থেকে তোমার কথা শুনেই তোমার সাথে দেখা করার জন্য আগ্রহী হয়েছে। তাই তাকে সাথে নিয়ে এসেছি।
আমাকে সালাম জানিয়ে অলাৰ্ত্তি বলল, এদেশে মঁসিয়ে কে স্বাগত জানাচ্ছি।’
আমিও তাকে ফিরতি সালাম দিলাম।
অলাৰ্ত্তি বলল, ‘আপনারা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন?’
‘প্রায় বিশ মিনিট হবে।’
‘মাচিওতে ডায়ামাল্টি যখন কাঁদছিল তখন আমি শুনেছি। তারপর পনেরো মিনিট আগে সে আমার কাছে এল। ডায়ামাল্টি সত্যিই খুব বিশ্বস্ত কুকুর। মঁসিয়ে লুসিয়েন।
ডায়ামাল্টিকে আদর করতে করতে বলল, তোমার কথা ঠিক, অলার্তি ডায়ামাল্টি সত্যিই বিশ্বস্ত কুকুর।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যদি জানতেন লুসিয়েন এখানে কুড়ি মিনিট আগে এসেছেন, তাহলে এত দেরি করলেন কেন?
‘আসব কেন? অলাৰ্ত্তি বলল, আমাদের দেখা করার সময় ঠিক হয়েছে। রাত নয়টায়। ঠিক সময়ের পরে এলেও যেমন সময়ানুবর্তিতা ঠিক থাকে না তেমনি ঠিক থাকে না আগে এলেও।
‘তুমি কি আমাকে লক্ষ্য করে কথা বলছ?’ লুসিয়েন হেসে জিজ্ঞেস করল।
‘না–আপনার সাথে নতুন একজন বন্ধু রয়েছে, তার জন্যই আপনাকে আগে আসতে হয়েছে। তা আমি জানি। আমার জন্য অনেক কষ্ট আপনি করেছেন।’
তার জন্য আর ধন্যবাদ দিতে হবে না। অলাৰ্ত্তি, সে কষ্ট বোধ হয় শেষ হতে চলল এবার।
‘সে ব্যাপারে তো এখনও আলোচনা করার দরকার আছে, মঁসিয়ে লুসিয়েন।
আমার দিকে ফিরে লুসিয়েন বলল, আমরা যদি একটু আড়ালে যাই তা হলে আপনি নিশ্চয়ই কিছু মনে করবেন না।
আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলাম।
ভাঙা দেয়ালের যে পথ দিয়ে অলাৰ্ত্তি এসেছিল। সেই ফাঁক দিয়েই দুজনে বেরিয়ে গেল। জ্যোত্নার আলোয় এবার অলার্তিকে ভালোভাবে দেখতে পেলাম।
লোকটি বেশ লম্বা, মুখে দাড়ি, কাপড় ফ্রাঞ্চির মতোই। শুধু এটাই তফাৎ অলাৰ্ত্তির পোশাক ছেঁড়া এবং পুরানো। বিভিন্ন জায়গায় মাটি লেগে নোঙরা।
আমার থেকে তারা প্রায় বিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে কর্সিকার এক গ্রাম্য ভাষায় কথা বলছে, কাজেই তা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব না, কিন্তু কথা না বুঝলেও ভাবভঙ্গি বোঝা যায়।
অলাৰ্ত্তি উত্তেজিত। একটু পরপরই জোরে হাত পা নাড়ছে। লুসিয়েনের যুক্তি সে যেন ফেরাতে চাইছে। কিন্তু লুসিয়েন ঠাণ্ডা। তার কথায়ও উত্তেজনা নেই। সে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভাবে একটা মীমাংসার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
শেষে অলাৰ্ত্তির হাত পা নাড়া বন্ধ হলো, গলার স্বর ছোট হয়ে এলো।
তারপর সে একসময় হাত বাড়িয়ে দিলো লুসিয়েনের হাতের দিকে। আলোচনা শেষ করে তারা আমার দিকে এগিয়ে এল।
লুসিয়েন বলল, ‘প্রিয় সিয়ে, অলাৰ্ত্তি আপনার সাথে হাত মিলিয়ে ধন্যবাদ দিতে এসেছেন।
হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমি বললাম, ‘কিন্তু ধন্যবাদটা কিসের জন্য?
‘আপনি ওর পক্ষে জামিন হতে রাজি হয়েছেন বলে। আমি কথা দিয়েছি যে আপনি জামিন হবেন।
‘আপনি যখন কথা দিয়েছেন, তখন আমারই কথা দেয়া হয়েছে। যদিও ব্যাপারটা আমি কিছুই জানি না।’
আমার বাড়িয়ে দেয়া হাতে, অলাৰ্ত্তি আঙুল দিয়ে তা ছুঁয়ে দিল মাত্র।
লুসিয়েন বলল, এবার প্যারিসে ফিরে গিয়ে আপনি লুইকে বলতে পারবেন, সমস্ত গোলমাল তার ইচ্ছায় মীমাংসা হয়ে গিয়েছে এবং চুক্তি নামায় আপনি নিজে সই করেছেন।
‘চুক্তি? কিসের চুক্তি? বিয়ের?’
‘না এখনই না, তবে হতে কতক্ষণ।
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে অলাৰ্ত্তি গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আপনি শান্তির জন্য আগ্রহী। শান্তি স্থাপিত হোক, কিন্তু সম্পর্ক স্থাপনের কোনো কথা ওঠেনি। দলিলে ও ব্যাপারে কোনো লেখা হবে না।’
‘না, দলিলে ওসব লেখা হবে কেন? এটা হবে ভবিষ্যতের ব্যাপার। এখন অন্য কথা বল, আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করল, আমরা যখন ওদিকে কথা বলছিলাম, তখন একটা তিতির পাখির ডাক শুনেছিলেন?’
একবার যেন মনে হয়েছিল–একটা করর করর শব্দ শুনেছি, তারপরই ডাকটা থেমে গেল। মনে করেছিলাম ভুল শুনেছি।
‘না, ভুল আপনার হয়নি। পিছনের ওই বড় গাছটাতে একটা তিতির লুকিয়ে আছে। ওটাই কালকে আমাদের খাবার হবে।’
অলাৰ্ত্তি বলল, ‘অনেক আগেই ওটাকে গুলি করে নামাতাম। শুধুমাত্র গ্রামের লোকেরা কি মনে করে এটা ভেবে, সেটা করা হয়নি।
‘আমরা সে কাজ সম্পূর্ণ করে এসেছি,’ বলল লুসিয়েন। তার বন্দুকে গুলি ভরা শেষ হলে সেটা কাঁধে নিয়ে আমাকে প্রথম গুলি করতে বলল।
আমি বাধা দিয়ে জানালাম, আমি আপনার মতো বন্দুক বা পিস্তলে ওস্তাদ না, আমরা যাওয়ার সময় আমার সহযোগিতা পাবেন।
এরপর একটা দারুণ ব্যাপার হলো। অলাৰ্ত্তি করর, করর করে তিতিরের ডাক ডাকতে লাগল, গাছের তিতিরটা ভাবল সত্যি বুঝি তার কোনো সঙ্গী ডাকছে, সঙ্গীর জন্য সে বেচারী যেই গাছ থেকে আকাশের দিকে উড়ে যাওয়া শুরু করেছে, গুড়ম তিতিরটা ঝোঁপের মধ্যে পড়ে গেল, ডায়ামালি তাকে মুখে করে নিয়ে এলো, লুসিয়েনের গুলি পাখিটার ঠিক বুকেই লেগেছে।
‘তাহলে অলাৰ্ত্তি। কাল।’
‘হ্যাঁ মঁসিয়ে লুসিয়েন কাল।’
তোমার দেরি হবে না জানি। ঠিক সকাল দশটায়, তুমি, তোমার বন্ধুরা, আত্মীয়রা সবাই গ্রামের রাস্তার শেষ দিক দিয়ে ঢুকে গির্জায় আসবে। আমরা গির্জায় থাকব।
.
৫.
আবার জঙ্গলে ঢুকল অলাৰ্ত্তি, আমরা গ্রামের পথ ধরলাম। ডায়ামাল্টি প্রথমে ঠিক করতে পারছিল না কার সঙ্গে যাবে। তা শুধু এক মুহূর্তের জন্য তারপর আমাদের দিকেই ছুটে এল।
মনে পড়ল এবার, আসবার সময় কি কঠিন চড়াই না উঠতে হয়েছে। এখন আবার সে পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নামতে হবে। এ ভেবে অনেকটা দমে গেলাম। কারণ পাহাড়ে ওঠার চেয়ে নামা অনেক কঠিন।
কিন্তু লুসিয়েন মনে হয় মনের কথাটা বুঝতে পারেন, সে এবার অন্য পথ ধরল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
ঢালু রাস্তা, কাজেই নামতে নামতে কথা বলার অসুবিধা নেই। পঞ্চাশ গজের মতো এগিয়েই আমি আবার প্রশ্ন করতে শুরু করলাম।
‘তাহলে সত্যি সত্যি শান্তি স্থাপিত হলো।’
‘অনেক ঝামেলার পর, শেষ পর্যন্ত ওকে বোঝাতে পেরেছি যে যতটুকু ক্ষতি স্বীকার করবার, তা করেছে কলোনারা। দেখুন কলোনাদের মারা পড়েছে পাঁচজন, অলাৰ্ত্তিদের চার। কলোনারা শান্তি আনতে রাজি হয়েছে। গতকাল। অলাৰ্ত্তিরা রাজি হলো আজ। এ ছাড়াও কলোনারা সবার সামনে একটা জ্যান্ত মুরগি দেবে অলাৰ্ত্তিদের দশ বছর আগের সেই মুরগির জন্য। এতেই তো তারা স্বীকার করে নিল দোষটা তাদের। শুধু এই শর্তটার জন্যই। অলাৰ্ত্তিরা নরম হয়েছে।
‘তাহলে কালকে একটা মর্মস্পর্শি পূণর্মিলন হচ্ছে।’
‘সকাল দশটার সময়। আপনি ভেনডেটা দেখতে চেয়েছিলেন, একটা ভেনডেটার শেষ দেখতে পাচ্ছেন। আপনার ভাগ্য একবারে খারাপ বলতে পারি না। হ্যাঁ, চারশো বছর ধরে কর্সিকার লোকের মুখে ভেনডেটা ছাড়া অন্য কোনো কথা ছিল না। কিন্তু ভেনডেটার শুরু চাইতে দুর্লভ হলো এর অবসান দেখা, আমাদের দেশে।
আমি হেসে ফেললাম।
লুসিয়েন বলল, আপনার হাসি পাচ্ছে। তা আমাদের চরিত্র এবং রীতি হাসি পাবার মতোই।
না, সে কারণে হাসিনি আমি। হেসেছি এটা লক্ষ্য করে যে, আপনার এই মীমাংসার সাফল্যে আপনি খুশি না হয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন।
‘তাই? তাহলে শুনুন, এ মীমাংসার ব্যাপারে আমার যে কি আপ্রাণ চেষ্টা ছিল, তা আপনি ভাষা না বোঝার কারণে বুঝতে পারবেন না। তবে ভাষার ব্যাপারে কোনো চিন্তা নাই। আপনি দশ বছর পরে এলে দেখবেন, সবাই ফরাসি ভাষায় কথা বলছে।
‘আপনি চমৎকার উকিল হতে পারতেন।
‘মোটেই না। মীমাংসার ব্যাপারটা হয়তো কিছুটা পারি। সেটা হলো ঝগড়া মেটানোর কাজ, সবাই মিলে আমাকে ঈশ্বর আর শয়তানের মধ্যে সালিশ করে দিতে বলে তবে আমি নিশ্চয়ই সফল হব। আবার এটাও মানতে হবে আমার যুক্তি তর্ক মেনে নেয়া ঈশ্বরের পক্ষে চরম বোকামি হবে।
আর আলোচনা চালিয়ে গেলে লুসিয়েনের পক্ষে ধৈৰ্য্যচুত্যি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই আমি কথা বলা বন্ধ করলাম। লুসিয়েন ও চুপ রইল। ফলে বাকিটা পথ নীরবে চলতে চলতে এক সময় বাড়ি পৌঁছে গেলাম।
.
আমাদের জন্য গ্রিদো অপেক্ষায় ছিল।
লুসিয়েন কিছু বলার আগেই গ্রিদো তার জামার লম্বা পকেটে হাত ঢুকিয়ে তিতির পাখিটা বের করল। বন্দুকের আওয়াজেই সে পরিস্থিতি বুঝেছিল।
মাদাম ফ্রাঞ্চি তখন ঘুমাননি। তবে ঘরে চলে গিয়েছেন, গ্রিদোকে বলে গিয়েছেন, লুসিয়েন ফিরলে তার খবর পাঠিয়ে দিতে।
লুসিয়েন আমাকে জিজ্ঞেস করল, বিছানায় যাবার আগে কোনো কিছু আমার দরকার আছে কিনা। উত্তরে আমি জানালাম আর কিছু দরকার নেই।
সে তখন মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইল, আমি তাকে যেতে বলে নিজের ঘরে ঢুকলাম।
ঘরটাকে আবার ভালো করে দেখলাম, এই ঘরটাই লুইর চরিত্র সম্পর্কে আমাকে ধারণা দিয়েছিল। আমার সে অনুমান সত্য। লুই কেন লুসিয়েন। সম্পর্কেও আমার ধারণা সত্য। কিন্তু লুসিয়েনকে সামনে দেখেছি–লুইকে দেখিনি।
জামা কাপড় ছেড়ে বসলাম। এদের কাছে এসে কর্সিকার জনগণের হাবভাব সম্বন্ধে জানতে পেরে, সনাতা বেশ খুশি। ঘুম এলো না, লুই ওর আনসিরা থেকে ভিক্টর হুগো, ওরিয়েন্টালস’ বইটা বের করলাম। আগেও অনেকবার পড়েছি, তবু পড়তে ভালো লাগে। প্রথম পৃষ্ঠা পড়া শেষ হয়েছে, সেই সময় বারান্দায় পায়ের আওয়াজ পেলাম। দরজার কাছেই থেমে গেল সে শব্দ। বুঝলাম লুসিয়েন আমাকে শুভ রাত্রি জানাতে এসেছেন। কিন্তু আমি ঘুমিয়েছি ভেবে ডাকতে সাহস করছেন না।
বই টেবিলে রেখে ডাকলাম, ভেতরে আসুন।
সাথে সাথে দরজা খুলে লুসিয়েন ভেতরে এল।
এসেই বলল, ‘ফেরার পথে তেমন একটা কথা বলিনি বলে হয়তো আমাকে আপনি অভদ্র ভাবছেন, তাই আপনার কাছে ক্ষমা না চেয়ে শুতে যেতে পারছি না। ক্ষমা করুণ এবং আমার কাছে আরও যদি কিছু জানার থাকে, প্রশ্ন করুন।
আমি বললাম, ধন্যবাদ, আমার যা জানার ছিল তা জেনে গিয়েছি। তবে একটা ব্যাপারে আমি প্রশ্ন করব না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘কেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
‘ও নিয়ে আর কথার দরকার নেই। যদি জেদ ধরে বসেন, তবে প্রশ্নটা করলে আপনাকে বিব্রত হতে হবে।’
‘জেদ ধরলেই বলবেন, এ যদি হয় তাহলে আমি জেদই ধরলাম। বলে ফেলুন, কৌতূহলই সন্দেহের সৃষ্টি করে। সন্দেহই হয় অপ্রীতিকর। অপ্রিয় সন্দেহের চেয়ে অপ্রিয় সত্য ভালো।’
‘ও ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আপনার ব্যাপারে একটা মাত্র ধারণা আমার, সেটা হলো আপনি যাদুকর।
লুসিয়েন হেসে ফেলল, ‘বেশ ভেবেছেন, এখন আপনার চেয়ে আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। তা আমাকে আপনি যাদুকর ভাবলেন কি ভাবে?
দেখুন, আগে যা অস্পষ্ট ছিল আমার কাছে তা আপনি সবই পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তারপর দেখিয়েছেন ঐতিহ্যপূর্ণ অস্ত্রগুলি, যা আর একবার দেখার ইচ্ছা আমার আছে, একই নেয়ার দুই বন্দুকের ইতিহাসও আপনি জানিয়েছেন।
‘কিন্তু এগুলোতেই কেউ যাদুকর হয়ে যায় না।’
‘হ্যাঁ, আসল বিষয় হলো জন্মের সময় একটা দেহের বৈশিষ্ট্যের জন্য আপনি নয়শো মাইল দূরের আপনার ভাইয়ের সমস্ত অনুভূতি আপনি এখানে বসেই সমান ভাবে অনুভব করতে পারেন। আপনার ভাইও নিশ্চয়ই এই ভাবে আপনার সুখ-দুঃখের অনুভব করছে। তারপর মাদাম ফ্রাঞ্চি আপনার বিষণ্ণতার ব্যাপারে প্রশ্ন করায় আপনি জানালেন। আপনার ভাই নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েছেন, কিন্তু আপনার ভাই মারা গিয়েছেন কিনা এর উত্তরে–আপনি জানালেন–না, মরে গেলে আপনি তাকে দেখতে পেতেন।
লুসিয়েন এবার গম্ভীর হয়ে গেল, ‘হ্যাঁ সেটা ঠিকই বলেছিলাম।
‘যদি অপরাধ না হয়, তাহলে ওই কথাগুলোর অর্থ আমাকে খুলে বলুন। এটাই আমার শেষ কৌতূহল।
লুসিয়েনের মুখ গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হতে দেখে আমি বেশ দ্বিধার সাথেই শেষ কথাগুলো বললাম।
কথা শেষ হওয়ার পরে আমি চুপ করে যাওয়ার পরেও লুসিয়েন নীরব রইল।
কাজেই আমি আবার বললাম। সত্যিই আমার প্রশ্নটা যে বিব্রতকর তাতে এখন আমার সন্দেহ নাই। ও কথা আপনি ভুলে যান। মনে করুন ও প্রশ্ন আমি করিনি।
না ও ব্যাপারে শুধু এই বলতে পারি। আপনি একজন সাধারণ লোকের মতোই সন্দেহ পিপাসু। চার শতাব্দী থেকে আমাদের বংশে একটা প্রবাদ একটা অন্ধ বিশ্বাস চলে আসছে। সেটার সত্যতা সম্পর্কে আপনি সন্দেহ করলে আমাদের পক্ষে খুবই দুঃখের কারণ হবে।
আমি জানালাম–‘একটা কথা জেনে রাখুন। প্রবাদ বা উপকথা যাই বলুন না কেন–এ ব্যাপারে আমার চেয়ে বড় বিশ্বাসী আপনি আর কাউকে পাবেন না। এমন অনেক জিনিস আছে, যা অন্য কেউ অসম্ভব বললেও আমি সেটা সম্পূর্ণ সম্ভব বলে মনে করি।
‘তাহলে নিশ্চয়ই ধরে নিতে পারি, আপনি প্রেতাত্মায় বিশ্বাসী?’
‘এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতাটি আপনাকে বলব?’
‘বললে আমার পক্ষে সুবিধা হয় আমার ব্যাপার বলতে।’
‘আমার বাবা মারা যায় ১৮০৭ সালে, তখন আমার বয়স সাড়ে তিন বছর মাত্র। আমাকে এক বৃদ্ধা আত্মীয়ার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হলো, যখন। ডাক্তার বাবার সম্পর্কে শেষ উত্তর দিয়ে গেলেন। আত্মীয়ার কাছেই একটা ছোট বাড়িতে আলাদা বাস করতেন।
তিনি তার বিছানার সামনে আমার জন্য আলাদা বিছানা করে দিলেন। আমাকে ওখানে শুইয়ে দেয়ার পর এক সময় ঘুমিয়ে গেলাম। বাড়িতে তখন কি বিপদ চলছে তা জানতাম না, জানলেও বুঝতাম না।
ঘুমিয়ে আছি, হঠাৎ শুনলাম দরজায় পরপর তিনবার শব্দ। আমি তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দরজার দিকে ছুটলাম।
আত্মীয়া বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছ?’
দরজায় নক করার শব্দ তিনিও শুনেছেন। তা শুনেই ঘুম ভেঙেছে তাঁরও। তিনি ভয়ে কাঁপছেন। কারণ তিনি তো জানেন যে সদর দরজায় তালা বন্ধ করা আছে। কোনো দেহধারীর পক্ষেই উপরে উঠে এসে শোবার ঘরের দরজায় শব্দ করা সম্ভব না।
আত্মীয়ার প্রশ্নে আমি উত্তর দিলাম–‘শুনছ না, বাবা এসে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন? তিনি বিদায় নিতে এসেছেন আমার কাছে, আমি তাকে দরজা খুলে দিতে যাচ্ছি।’
কথা শুনেই তিনি বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। আর আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে ধরে রাখলেন। আমি কেঁদে বার বার চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম।
‘বাবা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছেন। আমি তাঁকে শেষ বারের মতো দেখব না?’
ছোটবেলার সেই দুঃখের অভিজ্ঞতার কথা স্বল্প পরিচিত এক যুবকের কাছে বলার সময় এতদিন পরেও কান্নায় আমার গলা বন্ধ হয়ে গেল। আমি চুপ করে রইলাম।
লুসিয়েন জিজ্ঞাসা করল, আপনার বাবার আত্মা পরে কখনো এসেছিল?’
‘না। যদিও আমি অনেক সময় ব্যাকুল হয়ে তাকে স্মরণ করেছি। অবশ্য এর কারণ হিসেবে আমি ধরে নিয়েছি, নিষ্পাপ শিশুর সাথে আত্মা সহজেই যোগাযোগ করতে পারে। কিন্তু বয়স্ক পাপীর ভাগ্যে সে রকম হয় না।’
লুসিয়েন মৃদু হেসে জানাল। আমাদের পরিবারের লোকেরা কিন্তু ওদিক থেকে ভাগ্যবান।
‘আপনারা তাহলে মৃত আত্মার দেখা পান?’
‘পাই যখনই কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটবে বা ঘটেছে।
‘আপনাদের এই সৌভাগ্য কিভাবে ঘটল সে ব্যাপারে আপনার কোনো ধারণা আছে?
আমার কোনো ধারণা নেই, এটা আগে থেকে ঘটে আসছে, আপনাকে যে স্যাভেলিয়ার কথা বলেছিলাম তার দুই ছেলে ছিল, মায়ের মারা যাবার সময়, আজাইচোতে এক চাচার কাছে থেকে লেখাপড়া করছিল। বড় হবার পরে তারা পরস্পর ভাইকে এমন ভালোবাসায় জড়িয়ে গেল, একদিন প্রতিজ্ঞা করল, মৃত্যুও দুজনে আলাদা করতে পারবে না। মুখে প্রতিজ্ঞা করেও তারা তৃপ্ত হতে পারল না। পাঁচমেন্টের উপরে রক্ত দিয়ে লিখে তাতে পরস্পর সই দিল। তাতে লিখল, দুজনের ভেতর একজন যদি আগে মারা যায়, তবে অন্য জনকে যে মারা যাওয়ার সাথে সাথে দেখা দেবে। আরও তার জীবনে প্রত্যেক সংকটময় সময় একবার করে দেখা দেবে।
এরপর মাত্র তিন মাস গিয়েছে।
এই ভাই দেশের বাইরে, অন্যজন বাড়িতে। প্রবাসী ভাই গুপ্তশত্রু দ্বারা। নিহত হন। ঠিক সেই সময় অন্য ভাই দেশের বাড়িতে বসে তাকে একটা চিঠি লিখছিল। চিঠি শেষ করে মোম দিয়ে মুখ আটকাতে যাবে, এমন সময় কে যেন ঠিক তার পিছনে নিঃশ্বাস ফেলল। চমকে গিয়ে সে পিছনে ফিরে দেখে তার ভাই দাঁড়িয়ে আছে। যার কাছে সে এতক্ষণ চিঠি লিখছিল।
তার কাঁধে হাত রেখে ভাই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু হাতের স্পর্শ তার কাঁধে অনুভব করতে পারছে না, কিন্তু ভাই তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সে তখন বুঝতে পারছিল কিনা জানি না। এ ভাই এইমাত্র লেখা চিঠিটা ও ভায়ের হাতে দেয়া মাত্র, চিঠিটা নিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ওই ভাইকে সে পরেও একবার দেখতে পেয়েছিল নিজের মৃত্যুর আগে। তাদের যে শপথ এবং চুক্তি শুধু তাদের দুজনকেই বাঁধেনি। তাদের ভাবী বংশধরদেরও যুগ যুগ ধরে বেঁধে রেখেছে। প্রতি পুরুষে এ বংশের লোক মারা যাওয়ার আগে আপনজনের আত্মাকে দেখতে পায়। তারা দেখা দেয় গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনার আগে।
‘আপনি নিজে কোনো আত্মার দেখা পেয়েছেন?
‘না তবে নিশ্চয়ই পাব। আমার বাবা তার মারা যাওয়ার আগে তার বাবাকে দেখেছিলেন। সেভাবে আমিও আমার বাবার আত্মার দেখা পাব। বলে আশা করি। এতদিন যে অনুগ্রহ আমাদের বংশে পেয়ে আসছে, তা আমাদের বেলায় বাতিল হয়ে যাবে। এমন কোনো অপরাধ আমরা করিনি।’
‘কিন্তু এই অনুগ্রহ কি শুধু মাত্র পুরুষদের বেলায়?’ প্রশ্ন করলাম আমি।’
‘হ্যাঁ।’
‘আশ্চর্য।’
‘আশ্চর্য হতে পারেন কিন্তু সত্য।
আমি তার দিকে ভালো করে দেখলাম। অন্য যে কোনো লোক এসব কথা বললে পাগল বলেই তাকে মনে হবে। কিন্তু লুসিয়েন শান্ত অবিচলিতভাবে এই অবাস্তব ব্যাপারকে সত্য বলে বলছে। ওর মনে হ্যামনেটের সেই মনোভাব রয়েছে–‘বন্ধু হোরেশিও। দর্শন বিজ্ঞান যা স্বপ্নেও ধারণা করতে পারেনি কোনোদিন, স্বর্গে এমন পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে।’
এই যুবকের সাথে যদি প্যারিসে বসে আমার সাথে দেখা হত, তবে তাকে আমি ধাপ্পাবাজ বলে ধরে নিতাম। কিন্তু এই কর্সিকার অজ গ্রামে বসে কি ভাবা যায়। নির্বোধ বলে, না বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী অপদেবতা বা অতিথি মানুষ বলে। অতি মানুষ যদি হয় তবে সাধারণ মানুষের চেয়ে যে অনেক বেশি সুখি।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর সে জিজ্ঞেস করল। ‘আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন তো।’
‘নিশ্চয়ই। আপনাকে ধন্যবাদ। বিশ্বাস করে আমাকে সব কথা বলার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি আপনার এ গোপন কথা কখনও ফাঁস করব না।’
আশ্চর্য হয়ে সে বলল, কিন্তু কোনোটাকে গোপন কথা বলছেন? এর মধ্যে তো কোনো কিছুই গোপনের নেই। এ গ্রামের যে কোনো লোকের কাছে জিজ্ঞাসা করলেই আপনি আমাদের সম্বন্ধে এসব কথা জানতে পারতেন। কর্সিকাতে এ কথা গোপন করার কোনো কারণও নেই। তবে আমার ভাই যদি প্যারিসে বসে সব কথা বলতে থাকে, তাহলে সমস্যা হবে–পুরুষেরা মুখ ঘুরিয়ে অবিশ্বাসের হাসি হাসবে আর মেয়েরা ভয়ে। চিৎকার করবে।
এরপর সে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
খুব বেশি ক্লান্ত থাকলেও ঘুম আসছিল না। শেষে ঘুম এলেও তা ছিল আজকে দেখা হওয়া সব লোককে নিয়ে আজগুবি স্বপ্নে বোঝাই, যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই। শেষ রাত্রে একটু গভীর ঘুম আসার ফলে, সকালে উঠতে অনেক বেলা হয়ে গেল।
লুই ফ্রাঞ্চির আরামের প্রমাণ পেলাম হাতের কাছেই ঘরে ঘণ্টা রয়েছে চাকরদের ডাকার জন্য। মনে হয় এই গ্রামে এটাই একমাত্র ঘণ্টা।
ঘণ্টা বাজাতেই গরম জল নিয়ে এলো গ্রিফো, লুই ফ্রাঞ্চি তার চাকরকে ভালো শিক্ষাই দিয়েছে।
লুসিয়েন এর মধ্যে দুবার আমার খোঁজ নিয়েছেন এবং সাড়ে নয়টার সময় আমার ঘরে আসার জন্য অনুমতি চেয়েছেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি নটা পঁচিশ বাজে। লুসিয়েন পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘরে এসে হাজির হলেন।
ফরাসি স্টাইলের পোশাক পরে একজন সৌখিন ফরাসি রূপে সে আমার ঘরে এসে ঢুকল। সাদা প্যান্টের উপর চটকদার জামা, তার উপরে কালো কোট। মার্চ শুরু হয়েছে কাজেই সাদা প্যান্টই তখন রেওয়াজ।
আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে, লুসিয়েন বলল, আমার পোশাক দেখে আপনি অবাক হয়েছেন? আমি যে সভ্য মানুষ তার প্রমাণ পেলেন?
‘পেলাম, আজাইচোতে এত ভালো দরজি আছে তা আমি ভাবতে পারিনি। এই ভেনভেটের কোট পরে আপনার পাশে দাঁড়ালে আমাকে প্যারিসের রাজপথের মজুরের মতো লাগবে।’
আজাইচোর কথা কি বলছেন, আমার এ পোশাক বানিয়ে আনা হয়েছে, প্যারিসের হুমালের ওখান থেকে। অর্থাৎ পোশাকটা প্রথমে আমারই জন্য বানানো হয়নি, হয়েছিল লুই এর জন্য। আমরা দুজনে লম্বায়-চওড়ায় একই মানের হওয়ায়–লুই নিজের গায়ের পোশাক আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে একটু আনন্দ করতে চেয়েছে। এই একটাই নয়, অনেকগুলো পাঠিয়েছে। বিশেষ কোনো উপলক্ষ থাকলে আমি সেগুলো পড়ি। যখন জেলা শাসক আসেন। আঞ্চলিক সৈন্যের সেনাপতি পরিদর্শনে বের হন। কিংবা আপনার মতো মাননীয় অতিথি যখন পায়ের ধুলো দেন, বিশেষ করে তার সাথে জড়িত থাকে আজকের এই অনুষ্ঠানের মতো মর্মস্পর্শী ব্যাপার। তখন সাদাসিধে পোশাক পরলে কি ফ্রাঞ্চি বংশের মর্যাদা বজায় থাকে।
লুসিয়েন ভদ্র ভাষায় তিক্ত ব্যঙ্গ করার ব্যাপারে সুদক্ষ। কিন্তু সে ব্যঙ্গ রুচিকে অতিক্রম করে না। আর অন্যকে আঘাত করার চাইতে নিজেকেই চাবুক মারার দিকে তার ঝোঁক বেশি। কাজেই কথার উত্তর না দিয়ে ঘাড় নেড়ে তাতে সায় দিলাম। সে তখন হাতে দস্তানা পরছে। বয়সিন বা রুসোর বাড়ির হলুদ দস্তানা–যা ঠিক মতো পরতে হলে এক কৌশল জানা প্রয়োজন।
এদিকে আমিও পোশাক পরে নিয়েছি। পৌনে দশটা বাজল।
লুসিয়েন বলল, এবার যাওয়া উচিত, অনুষ্ঠানটা দেখতে হলে নাশতার টেবিলে বসা চলে না। আপনি কি করবেন? না খেয়ে ওখানে যাওয়া নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
‘কেন হবে না? ফিরে এসে তো খেতে পারব। এগারটার আগে আমি সকালের নাস্তা করি না।’ এই বলে টুপিটা হাতে নিয়ে আমি ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম।
.
৬.
ফ্রাঞ্চিদের সদর দরজার আট ধাপ সিঁড়ির উপর দাঁড়ালেই গ্রামের গির্জাটার সামনের চত্বর চোখে পড়ে।
কালকেও চত্বরের পাশ দিয়েই এসেছি। কিন্তু তখন ছিল পুরো নির্জন। এখন ওখানে লোকের ভিড়, শুধুমাত্র নারী এবং শিশু। কোনো পুরুষ চোখে পড়ল না।
তিন রঙের চাদর বুকে আটকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়র ভদ্রলোক।
সামনে টেবিল চেয়ার নিয়ে উকিল ভদ্রলোক বসে আছেন। হাতে মীমাংসার দলিল লেখা কাগজ।
টেবিলের পাশে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম–ওখানে অর্লাত্তি অন্য জামিনদার দাঁড়িয়ে আছে। অন্য পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে–কলোনার জামিনদারেরা লুসিয়েন দাঁড়িয়েছে উকিলের পিছনে, উনি তো উভয় পক্ষের লোক।
ঘড়িতে দশটা বাজল।
জনতার মধ্যে সাথে সাথে যেন একটা শিহরণ বয়ে গেল। গ্রামের পথের দিকে সবাই একসাথে তাকাল। অবশ্য একে পথ বলা যায় কিনা সেটা গবেষণার বিষয়। পঞ্চাশটা বাড়ি ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তার পাশ দিয়ে একেবেকে চলে গেছে লম্বাটে একটা জমি, ওখান দিয়ে তোক চলাচল করে, কাজেই ওটাকেই পথ বলতে হবে।
আমাদের উৎসুক চোখের সামনে দুই পাশ দিয়ে দুটো মিছিল দেখা দিল। পাহাড়ের দিক থেকে অলাৰ্ত্তি, নদীর দিক থেকে কলোনাদের মিছিল। প্রত্যেকের হাতে জলপাইর ডাল (জলপাইর ডাল চিরদিনই ইউরোপের শান্তির প্রতীক) সাথে আত্মীয় বন্ধু। শুধু মুখগুলোর ভাবভঙ্গি যদি সহজ হত তাহলে একটা ধর্মীয় মিছিল বলে চালিয়ে দেয়া যেত।
দুই দলের দুই নেতা, চেহারা সম্পূর্ণ বিপরীত। অলাৰ্ত্তি হলো লম্বা ছিপছিপে, কালো চুল ভাবভঙ্গি চটপটে। কলোনা ঠিক এর উল্টো, বেঁটে, মোটা, শক্তিশালী। ওর চুল দাড়ি লালচে ছোট করে কাটা এবং কোকড়ানো।
মেয়রের নির্দেশেই দুজনের হাতে দুটো জলপাইর ডাল, মেয়রের ভেতর বিত্ব আছে।
কলোনার হাতে জলপাইর ডাল ছাড়া আর একটি জিনিস আছে। তার হাতে ঝুলছে একটা সাদা মুরগি। এটা দশ বছর আগের মুরগিটার
ক্ষতিপূরণ, যেটা নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়েছিল।
অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছিল এই ক্ষতিপূরণ নিয়ে। শেষ পর্যন্ত মীমাংসাই নষ্ট হতে গিয়েছিল এই সমস্যা নিয়ে। কলোনা ভেবেছিল মরা মুরগির ক্ষতিপূরণ বাবদ জ্যান্ত মুরগি দিলে তার অপমান হবে, অনেক কষ্টে অনেক বুঝানোর ফলে তাকে জীবিত মুরগি দিতে রাজী করিয়ে ছিল লুসিয়েন।
যেই সময় দুই দল দেখা গেল গির্জার দুই পাশে। সজোরে গির্জার ঘণ্টা বাজতে আরম্ভ করল আনন্দের ধ্বনি তুলে।
কিন্তু অলাৰ্ত্তি আর কলোনা? তাদের মুখে আনন্দের চিহ্ন নেই। তারা পরস্পরের দিকে চোখ পড়লেই হিংসায় রাগে ফেটে পড়ছে। যা হোক তারা কোনো ঝগড়া না করে চুপচাপ এগিয়ে এল।
গির্জার গেটের সামনে এসে তারা চার গজ ফাঁক রেখে পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়াল। মাত্র তিন দিন আগেও যদি কেউ কারো ১০০ গজের ভেতরেও চোখে পড়ত, তবে যে কোনো একজন মারা যেত।
পুরো মিনিট পাঁচেক চুপ। শুধু মিছিলে লোকই না, উপস্থিত সমস্ত জনতা। অনুষ্ঠানটি যদিও শান্তির জন্যই। তবুও নীরবতাকে শান্তির সপক্ষে ভাবার কোনো কারণ নেই।
অবশেষে মেয়র নিস্তব্ধতা ভাঙলেন। কলোনা প্রথমে তুমি বলবে, সেটা ভুলে গেছ?
কলোনা অতিকষ্টে নিজেকে সামলাল, তারপর নিচু স্বরে গ্রাম্য ভাষায় বিড়বিড় করে কিছু বলল।
আমি অতিকষ্টে তার বক্তৃতা থেকে এটুকুই শুধু বুঝলাম যে গত বছর ধরে তার মহৎ প্রতিবেশী অলাৰ্ত্তির সঙ্গে তার যে শোচনীয় ভেনডেটা চলছে, তার জন্য সে দুঃখিত এবং ক্ষতিপূরণ হিসাবে অলাৰ্ত্তিকে এই সাদা মুরগিটা দিচ্ছে।
কলোনার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অলাৰ্ত্তি চুপ করে ছিল। তারপর কর্সিকার ভাষায় সেও কিছু বলল, তার কথার অর্থ হলো অতীতের কথা সে ভুলে যাবে। মনে রাখবে শুধু আজকের ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠান এবং পুর্ণমিলনের কথা। স্বয়ং মেয়রের উপস্থিতিতে এবং মঁসিয়ে লুসিয়েন ফ্রাঞ্চির মাধ্যমে যে পুর্ণমিলন আজ ঘটল, মাননীয় উকিল যার দলিল নিজ হাতে লিখে এনেছেন।
তারপর আবার দুজনেই চুপ।
মেয়র আবার বলতে বাধ্য হলেন–এই যে ভদ্রলোকেরা–তোমরা হাত মিলাবে এরকম একটা কথা হয়েছিল না।’
নিজেদের অজান্তেই প্রতিদ্বন্দ্বীরা দুজনেই নিজে নিজের হাত পিছনে লুকিয়ে ফেলল।
বাধ্য হয়ে মেয়র সিঁড়ির মাথা থেকে নেমে এলেন। প্রথমে কলোনার হাত তার পিছন থেকে টেনে সামনের দিকে আনলেন, তারপর অলাৰ্ত্তির হাতও তেমনিভাবে সামনে নিয়ে এলেন, তাকে এই টানাটানিতে বেশ কষ্ট করতে হলো–কিন্তু মুখে দরাজ হাসি ফুটিয়ে নিজের বিব্রত অবস্থা ঢাকার চেষ্টা করলেন।
তারপর কোনো রকমে মেয়র দুই শত্রুর হাত এক করে শক্ত করে চেপে রাখলেন। উকিল এই শুভ সময়ের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি দলিল হাতে উঠে দাঁড়ালেন।
মেয়র দুই শত্রুর হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথমে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য চেষ্টা করছিল দুজনেই। কিন্তু না পেরে এখন ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে।
উকিল দলিল পড়তে শুরু করেছেন–মার্টেন প্রদেশের সরকারি উকিল। আমি গাইসেল আন্তোলিও সরোনা আমার উপস্থিতিগ্রামের গির্জার সামনে মাননীয় মেয়র। বিশেষ অতিথি এবং যাবতীয় গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে–
এক পক্ষে গাইতালো অর্সো-অলার্তি-সংক্ষেপে অলাৰ্ত্তি–এদের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বিচার করে এভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে–
আজ ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ৪ মার্চ তারিখে দশ বছর আগে উভয় পক্ষের মধ্যে যে ভেনডেটা ঘোষিত হয়েছিল আজ তার শেষ হলো।
আজ থেকে তারা সহৃদয় প্রতিবেশী এবং বন্ধুর মতো পাশাপাশি বাস করতে থাকবে–যেমন করত তারা–এই ঝগড়া শুরু হওয়ার আগে।
তার প্রমাণ স্বরূপ তারা আজ এই দলিলে সই দিয়েছে। এই গ্রামের গির্জার সামনে মেয়র পোলো আরজরি। সালিস লুসিয়েন দ্য ফ্রাঞ্চি। উভয় পক্ষের লোক এবং সরকারি উকিলের সামনে।
.
লুল্লাকারো, ৪ মার্চ, ১৮৪১।
লেখাটা শুনে মনে মনে উকিলের প্রশংসা করলাম, মুরগির কথাটা না লিখে খুব ভালো কাজ করেছেন। ওই মুরগির ব্যাপারেই কলোনার আপত্তি ছিল। ওটাই তার পরাজয়ের চিহ্ন।
দলিল শুনতে শুনতে যেমন কলোনার মুখ উজ্জ্বল হচ্ছে, তেমনি অলাৰ্ত্তির মুখ তত কালো হয়ে যাচ্ছিল, অলাৰ্ত্তি স্থির চোখে হাতের মুরগির দিকে তাকিয় আছে, যেন এক্ষুনি ওটা কলোনার মুখের উপর ছুঁড়ে মারবে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মনের ইচ্ছে কাজে পরিণত করার আগে মুখ তুলতেই লুসিয়েনের সাথে চোখাচোখি হলো, সেই ইচ্ছাটা শেষ হয়ে গেল।
মেয়র দেখলেন আর দেরি করলেই সব নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি পিছন হেঁটে সিঁড়ির মাথায় উঠতে লাগলেন, কলোনা আর অলাৰ্ত্তির হাত দুইটি তার হাতে ধরাই আছে। তার চোখও দুজনকেই পর্যবেক্ষণ করছে।
এবার দলিলে সই করার পালা, এখানেও সংকট আছে। যাকে আগে সই করতে বলা হবে সেই অপমানিত বোধ করবে। হয়তো কলম ছুঁড়ে ফেলে চত্বর থেকে বেরিয়েও যেতে পারে। মেয়র বুদ্ধি করে এ সংকটটা কাটিয়ে দিলেন, তিনি নিজেই সবার আগে সই করলেন। কাজেই আগে এখন সই করাটা অপমানের বিষয় না হয়ে সম্মানের হয়ে দাঁড়াল। অলাৰ্ত্তির হাতে কলম দিলেন মেয়র–অলাৰ্ত্তি সই করে কলম দিল লুসিয়েনকে। লুসিয়েনের পর কলোনা-কলোনা আবার সই জানে না। সে দিল একটা ক্ৰশ চিহ্ন।
এর মধ্যে গির্জার ভেতরে ঈশ্বরের মহিমা গান শুরু হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে বিরাট একটা যুদ্ধের জয় হয়েছে।
এদিকে স্বাক্ষরের পর স্বাক্ষর। যে কোনো স্তরের লোক গ্রামের বা বাইরের, নির্বিচারে এসে দলিলে সই করে যাচ্ছে।
তারপর এই নাটকের দুই নায়ক এক সথে গির্জায় ঢুকে বেদীর এক পাশে এক একজন প্রার্থনার জন্য বসল। এতক্ষণ পরে লুসিয়েন সহজভাবে নিঃশ্বাস ফেলছে। একটা দুশ্চিন্তার বোঝা তার মাথা থেকে নেমে গিয়েছে। আর চিন্তা নেই, প্রতিদ্বন্দ্বীরা মেনে নিয়েছে, শুধু মানুষের সামনে না, ঈশ্বরের সামনেও। প্রার্থনা শেষ হলো। অলাৰ্ত্তি আর কলোনা বের হবার সময় আর একবার মেয়রের অনুরোধে হাত মেলাতে বাধ্য হলো।
তারপর ওরা নিজের নিজের দলের সঙ্গে নিজেদের বাড়িতে গিয়ে ঢুকল। গত তিন বছরের মধ্যে ওরা কেউই এ ঘরে ঢুকতে পারেনি।
লুসিয়েন আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। তারপরই ডিনার সকালের নাস্তাটা আমাদের বাদ পড়েছে।
ডিনারে দেখলাম বিশেষ আয়োজন। যেন মস্ত একটা লোকের আপ্যায়ন হচ্ছে। বুঝলাম ব্যাপারটা। আমাকে দলিলে যখন নাম সই করতে হয়েছিল তখন নিশ্চয়ই নামটা লুসিয়েন দেখে নিয়েছে। নিশ্চয়ই এ নাম তার একেবারে অজানা না।
সকালেই আমি বলে ছিলাম যে, ডিনারের পরেই আমি রওনা হয়ে যাব। আমার একটা নাটকের রিহার্সাল প্যারিসে শুরু হতে যাচ্ছে। কাজেই ফিরে যাওয়াটা আমার পক্ষে একান্ত জরুরি। কাজেই লুসিয়েন এবং তার মায়ের বিশেষ অনুরোধ ফেলে আমাকে রওয়ানা দিতে হলো।
লুসিয়েন বলল, আপনি তো লুইকে একটা চিঠি পৌঁছে দেবার কথা বলেছিলেন, তাহলে সেই চিঠিটা লিখে দেই।’ মাদাম ফ্রাঞ্চির বাইরের কঠোরতা তো ছদ্মবেশ মাত্র। ভেতরে মাতৃ হে একেবারে কোমল। তিনি আমায় শপথ করিয়ে নিলেন, চিঠিটা আমি নিজ হাতে লুইকে দেব। সেটা অবশ্য আমার পক্ষে কষ্টের হবে না, কারণ রু দ্য হেলডার ৭নং সে থাকে। আমার বাসা থেকে কাছেই।
বিদায় নেবার আগে লুসিয়েনের ঘরে আর একবার গেলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম প্রত্যেকটা জিনিস, লুসিয়েন উদার হৃদয়ে আমায় অনুমতি দিল–
‘এখান থেকে যে কোনো একটা জিনিস উপহার হিসাবে আপনি নিলে আমি অত্যন্ত খুশি হব।’
এখন কিছু একটা না নিলে অভদ্রতা দেখায়। কাজেই আমি এক পাশ থেকে একটা ছোরা তুলে নিয়ে কোমরে রাখলাম। এখন আমি কি উপহার দেই? আমার বেল্টটি শিকারিদের কাজে লাগার কথা, কারণ ওটা শিকারিদের জন্যই তৈরি। আমি সেটা লুসিয়েনকে উপহার দিলাম। সেটা যে সহজ ভাবেই নিল, শুধু বন্ধুত্বের উপহার হিসাবে।
গ্রিদো এসে খবর দিল, আমার ঘোড়া তৈরি এবং গাইডও এসে পড়েছে। গ্রিদোকে আমি একটা শিকারের ভোজালি দিলাম তার ফলার দুই পাশে দুদিকে দুটো পিস্তল। উপহার পেয়ে গ্রিদো এমন আনন্দ প্রকাশ করল, যা আমি আর কাউকে দেখিনি।
নিচে এসে দেখলাম, মাদাম ফ্রাঞ্চি সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, বিদায় জানাবার জন্য ঠিক সেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন–যেখান থেকেই উনি স্বাগত জানিয়েছিলেন কালকে। তার হাতে চুমু খেয়ে বিদায় নিলাম। সাধারণ জীবনে এভাবে সম্মানীয়া মহিলা আমি কমই দেখেছি। তার প্রতি এখন আমার সম্ভম অটুট, অক্ষুণ্ণ।
লুসিয়েন আমার সঙ্গে দরজা পর্যন্ত এল।
‘অন্য কোনো সময় হলে আমি ঘোড়া নিয়ে পাহাড় পর্যন্ত আপনার সাথে যেতাম। কিন্তু আজকে অলাৰ্ত্তিরা কলোনাদের জন্য সে সাহস পাচ্ছি না, ওরা যে কোনো সময় আবার একটা অঘটন ঘটিয়ে বসতে পারে। শান্তির জীবনে অভ্যস্ত হতে ওদের সময় লাগবে।’
এই অল্প পরিচিত বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলাম, বললাম, আবার দেখা হবে?
‘নিশ্চয়ই হবে, যদি দয়া করে আবার কর্সিকায় আসেন।’
‘আপনিও তো প্যারিসে আসতে পারেন।’
‘না, ওখানে আমার যাওয়া হবে না।
‘আপনার ভাইয়ের ঘরে টেবিলের উপর আমার কার্ড রেখে এসেছি। ঠিকানাটা অন্তত ভুলবেন না।
‘না, তা ভুলব না। যদি কখনও ইউরোপে কোথাও যেতেই হয়, গিয়ে সবার আগে আপনার সাথে দেখা করব।’
‘তাহলে এই কথাই রইল।’ বলে আর একবার হাত মিলিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম। গ্রাম ছেড়ে নদী, নদীর পর পাহাড়। পাহাড়ে দেখা হলো অলাৰ্ত্তির সাথে।
সে আমাকে বিদায় জানাবার জন্য এখানে এসে অপেক্ষা করছে। গির্জার অনুষ্ঠানের সময় তার পরনে ছিল সভ্য পোশাক। কিন্তু এখন তার পরনে সেই পাহাড়ে চড়ার পুরানো ছেঁড়া পোশাক। বলল, ‘গ্রামে কি মানুষ থাকতে পারে? কেবলই মনে হয় ঘরের ছাদ এই বুঝি মাথায় ভেঙে পড়ল।
আমি বললাম, ‘কলোনার সঙ্গে মিলনটা যেন স্থায়ী হয়।
সে মুখ বাঁকাল। আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু কলোনা যে মুরগি দিয়েছিল, তার মাংসটা যেন ছিবড়ে।