আমার চশমার কাঁচ আচ্ছন্ন হয়ে গেল গরম কফির ধোঁয়ায়–ঠিক যে মুহূর্তে চুমুক দেবার জন্য মুখ নামিয়েছি, তখন।
এই জিনিসটা আমার খুব ভালো লাগত; এই বাষ্প লেগে দৃষ্টি শাদা হয়ে যাওয়া, বিন্দু বিন্দু জলকণার মধ্যে অণুর মতো রামধনুর রং দেখতে পাওয়া। আর সুগন্ধ, কালোকফির সাড়া জাগানো সুবাস। অন্যান্য দিন, এই রকম একা বসতাম আমি, কোনো রেস্তোরাঁয়, কালো কফির পেয়ালা নিয়ে, বিকেলে, ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে এয়ার কণ্ডিশনার থেকে, লোকেরা চলত মৃদু পায়ে, সুন্দরী মেয়েদের দেখা পাওয়া যেত। ভুলে যাওয়া এক উপন্যাসে পড়া নায়কের মতো আমি কালোকফি চুমুকে চুমুকে নিঃশেষ করতাম, যেন এমনি করেই সে নায়ক কাছে। পাচ্ছে তার মেয়েটিকে যে মেয়েটি ভালোবাসত কালোকফি। আমার অনেকদিন ইচ্ছে হয়েছে, নিশাতকে ঐ উপন্যাসের মেয়েটির মতো কালোকফির জন্যে পাগল হতে দেখি। কিন্তু আমার স্কুটারে চড়ার আনন্দও যেমন অর্থহীন কিংবা দুর্বোধ্য নিশাতের কাছে, তেমনি কালোকফির স্বাদটা। নিশাত কালোকফি একেবারেই খেতে পারে না। সরু করে ফেলে ঠোঁট বলে, হেমলক। বিষ।
আমি তখন হো হো করে হেসে বলি, আর আমি সক্রেটিস?
আহা। তার পায়ের কড়ে আঙুল। বলতে বলতে নিশাত ঢেলে নেয় দুধ। কালোকফির স্বচ্ছ মেহগনি রংটা ঘুরতে ঘুরতে বাদামি হয়ে যায়। আমার মনে হয়, আমার একটা আনন্দ ঐ পেয়ালার মধ্যে চামচের আবর্তনে বিষাদের চেহারা নিল।
ঢাকায় ফিরেছি সকালবেলা। স্টেশন থেকেই টেলিফোন করে দিয়েছি নিশাতের কলেজে। সন্ধ্যে সাতটায় দেখা হবে, মোহাম্মদপুর স্কুলের বোর্ডিং গেটে দাঁড়িয়ে থাকব আমি। এবং আজকেই ঠিক করে ফেলব বিয়ের প্রস্তাব করে কীভাবে পাঠানো যায়।
সিনেমার ব্যানারে বড় বড় মুখ। আমি অবাক হয়ে দেখছি। হাত ঘড়িতে স’পাঁচটা বাজে। হাসি পেল। বড় অধৈর্য হয়ে উঠেছি আমি: নিশাতের সঙ্গে অনেক কটা দিন এবং অনেকগুলো মাইল ভ্রমণের পর আজ আবার দেখা হবে, তাই আমার ভেতরটা লাগছে নতুন প্রেমে পড়া ছোঁকরার মতো–মাতাল, উদ্বেগে অস্থির; গলার কাছে নামহীন বাষ্পের পিণ্ড আর রক্তিম কর্ণমূল আমার।
বসলাম সেই রেস্তোরাঁটায় যেখানে নিশাতের সঙ্গে সে রাতে বসেছিলাম। নিশাত বলছিল, বাড়িতে মেহমান আসবে; আর আমি বলছিলাম, খানিকটা অভিমান করেই, বেশ তুমি খাবে তো খাবে না, আমি খাই, বসে বসে দেখো। নিশাত অবশেষে খেতে রাজি হয়েছিল। একজন বেয়ারা প্যাড পেন্সিল হাতে করে লিখে নিচ্ছিল আমাদের পছন্দ। গরম সুপের স্পর্শে নিশাত তার ঠোঁট কুঁচকে ফেলেছিল।
কফির জন্যে বললাম আমি। কফি এলো। চুমুক দিতে যাবে, তখন তার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল আমার চশমার কাঁচ। আর সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরটায় কী হয়ে গেল কিছু ঠাহর করতে পারলাম না, বিশ্ব–সংসারের চেহারাই যেন পালটে গেল এক নিমেষে। লুপ্ত হয়ে গেল চারদিকের ছবি, দেয়াল, মানুষ, কাউন্টার, আমার কফির পেয়ালা। চোখ তুলে দেখি, ভালো করে কিছুই দেখতে পারছি না আমি। ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে আমার কাঁচ, না, পৃথিবী আমার সমুখ থেকে বিদায় নিচ্ছে? হঠাৎ প্রচণ্ড কান্না হতে লাগল ভেতরে। নিজেকে নিঃসঙ্গ, বধির, পরিত্যক্ত মনে হলো। ভুলে গেলাম চশমার কাঁচ পরিষ্কার করলেই সব আবার দেখতে পাবো আমি। যেন পৃথিবী আমাকে চরমভাবে বঞ্চিত করে চারদিক থেকে হা–হা করে হাসছে আর আমি ডুবে যাচ্ছি।
কোথায় আমার আনন্দ? আমার কালোকফির প্রিয় স্বাদ? বাষ্পের মধুর স্পর্শ? আমি হত্যাকারী। বাবাকে আমি হত্যা করেছি। চোখের সামনে খাটো কালো কোট পরা বেয়ারাকে মনে হচ্ছে ব্যারিস্টার, আমার দিকে তর্জনী তুলে, দূরে কাউন্টারে, যেন বিচারকের উচ্চাসনে আসীন বিচারপতি ঐ নির্বিকার–মুখ ম্যানেজার, তাকে বলছে, এর চেয়ে ঘৃণ্যতম অপরাধ আর কী হতে পারে। পুত্র হত্যা করেছে পিতাকে। পিতা, যে পিতা মুখের অন্ন আর বুকের রক্ত দিয়ে মানুষ করেছে সন্তানকে।
এই পৃথিবীটাকে আমার মনে হয় এক অর্থহীন অদ্ভুত চক্রান্ত, যার ভেতর থেকে আমরা আমাদের নিজস্ব অর্থ বার করে নিই–এবং যার একাংশও বোধগম্য নয় আরেকজনের কাছে। কাল রাতে বাজ পড়ল, আজ আমার ছেলেটা মারা গেল–অতএব বাজ পড়াটা ছিল মৃত্যুর অগ্রদূত, এমনি করেই তো দুই বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যে ঐক্য খুঁজেছি, অর্থের সঞ্চার করেছি আমরা। সঞ্চার বলাও ভুল, বলতে পারি –জন্ম, জন্ম দিয়েছি অর্থের। মানুষ বোধহয় অর্থহীন, সম্পর্কহীন কোনকিছুকেই ধারণা করতে পারে না। সম্ভবত তার রক্তের মধ্যে রয়েছে এক অসীম–শূন্যতার আতঙ্ক, যার হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে মানুষ প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টি করছে স্বপ্ন আর বিভ্রম।
আমি কি ব্যতিক্রম?
কী জানি। কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আমার সমুখে কালোকফি, তার ধোঁয়ায় চশমার কাঁচ হঠাৎ কুয়াশা হয়ে যাওয়া, এর সঙ্গে আমার বাবার মৃত্যুর ইতিহাস মনে পড়ে যাবার কোনো সম্পর্ক নেই। তবু মনে পড়েছে। এবং এত কঠিনভাবে মনে পড়েছে যে আমার পুরনো পৃথিবী ধ্বসে ধ্বসে পড়ছে তার নির্মম আঘাতে, ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছে। আমি তাকিয়ে আছি পেয়ালায় রাখা কালোকফির দিকে। আস্তে আস্তে বাতাসে কেটে যাচ্ছে কাঁচ থেকে বাষ্পের কণাগুলো। স্বচ্ছ হয়ে আসছে। আবার আমি দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি মৃদু রেখায় তখনো ধোঁয়া উঠছে পেয়ালা থেকে।
এ সবই কয়েকটি সেকেণ্ডের মধ্যে ঘটে গেছে। কিন্তু আমি সেই পুরনো আমি আর নেই। আজ যখন পেছনের দিকে তাকিয়ে এই ঘটনাটা মনে করবার চেষ্টা করছি, আবার যখন মুহূর্তগুলোকে তাদের সম্পূর্ণ বিবরণের জন্যে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি, তখন এক হতাশায় ভরে আসছে আমার মন, ক্লান্ত হচ্ছে আমার কলম। কারণ, কিছুই সঠিক অনুক্রমে মনে পড়ছে না, অনেক জরুরি জিনিশ, মনে হচ্ছে, ভুলে গেছি এবং দেখছি অনেক তুচ্ছাতিতুচ্ছ স্মৃতির আলোয় জ্বলজ্বল করছে। ঠিক কোন্ জিনিস কোন্ ভাবনা কিংবা কার মুখ অথবা কোন মুহূর্ত, আমাকে মনে করিয়ে দিল বাবার মৃত্যুর ইতিহাস সেদিন সেই রেস্তোরাঁয় তা আজ আর কিছুতেই বলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, যদিও বা কোনো কারণ বের করতে পারি, তা হবে কাল্পনিক, আমার নিজের সৃষ্টি করা। আমি কেবল এইটুকু বলতে পারি, কালোকফির ধোঁয়ায় যখন আচ্ছন্ন হয়ে গেল আমার চশমার কাঁচ তখন সেই চরম বিপ্লব ঘটে গেল আমার চিন্তার ভেতরে।
অথচ সেদিন রাতে গ্রামের সেই রুদ্ধশ্বাস অন্ধকার ঘরে, মা যখন আমার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিষের মতো কথাগুলো উচ্চারণ করলেন তখন এতটা লাগেনি। তখন কেবল একটা যন্ত্রণা হয়েছিল, যার পরিণতি হয় না। আমি যখন চলে এলাম–পরদিন সকালে আসতে পারিনি, ফিরোজা আমাকে আরো একদিন জোর করে রেখে দিয়েছিল–তখনো এত সহস্র হয়ে বাজেনি ঐ মৃত্যুর ইতিহাস। বরং আমার মনটা বেশ ভালোই ছিল পরদিন। ফিরোজা এসে বলল, চা পাইতে দেরি হইব। আমরা কেউ চা খাই না। বাজারে মানুষ পাঠাইছি।
আমার তখন মনে হলো, অকারণে, কিন্তু একটা বেদনার মতো, ফিরোজার স্বামী বোধহয় চা খেতেন রোজ সকালে। বললাম, রিয়াজ কই?
কে জানে?
পাঠিয়ে দিন না? বেশ হয়েছে দেখতে। পড়তে দেননি?
অর আবার পড়া। ফিরোজা ম্লান হেসে বলল, পইড়া যা করবো আমার জানা আছে। হালের। মুঠি না ধরলে ভাত জুটবো না। ঐ বই নিয়া মনে কইলে যায় ইস্কুলে।
অবাক হলাম ফিরোজার কথা শুনে। লেখাপড়ার দিকে এত বিতৃষ্ণা, আমি, হতে পারে জানতাম না। ছেলে হবে, এবং বয়স হলে স্কুলে যাবে, পাশ করবে, এইটেই আমার কাছে। স্বাভাবিক। হাল না ধরলে ভাত জুটবে না–এর মতো অসম্ভব যেন আমি আর কিছু শুনিনি। ব্যাকুল হয়ে বললাম, ছি ছি, এটা কী হলো? লেখাপড়া না শিখলে কেউ বড় হয়? টাউনে কেউ নেই?–মানে ওর বাবার মানে, শহরে থাকলে ওর লেখাপড়ার মন হতো। ভালো হতো।
ফিরোজা বলল, অর চাচারা নিতে চাইছিল। আমি দেই নাই। কী খাইবো, কী পরবো, চাচিরা নিজের থুইয়া পরের ছাওয়াল আপনা করবো কেন? পর আপনা হয় না, ভাই। একবারে এতিম হইয়া যাইতো রিয়াজ, নিয়া আসছি, আল্লা দিলে এমনি চলবো।
চোখে পানি এসে গিয়েছিল আমার। গতরাতে ভাবছিলাম, বললে রিয়াজকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। সে কথাটাও বলতে পারলাম না। বললাম, ভারী সুন্দর হয়েছে ছেলেটা। ফিরোজা তখন চলে গেল।
বেলা বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে চনমন করে খিদেটা উঠল আমার। খেলাম প্রচুর। রিয়াজ আমার কোলের কাছে বসে পা ছড়িয়ে ভাত–তরকারি ঢেলে বাঘা বাঘা হাতে খেল। মা এসেছিলেন পরবেশন করতে। খোরশেদ সাহেব একটা মামলার তদবিরে ফজরের আগেই চলে গেছেন শহরে, ফিরবেন রাত্তিরে। তার সঙ্গে আমার সকালে দেখা হয়নি। যাবার কথা বলতেই মা মৃদুস্বরে আপত্তি করলেন এবং কারণ দেখালেন, ফিরোজার বাপ বাড়ি নাই। তুমি যাইবা, সে কী কইবো?
গত রাতের কিছুই যে আমার মনে নেই, এবং মনে থাকলেও তা দুঃস্বপ্ন বলেই ধরে নিয়েছি। এ বিষয়ে আমি এখন নিশ্চিত। কারণ, ঐ কথাগুলো মনে থাকলে আমি তখন হাসতে পারতাম না।
হাসছিলাম। মা আমাকে চোখ তুলে কৌতূহল ভরে একবার দেখলেন, দেখে চোখ নামিয়ে নিলেন আমার চোখ পড়াতে। দুজনেই বুঝতে পারলাম, অথচ কেউই বললাম না, তিনি আমাকে যেতে দিতে চান না, খোরশেদ সাহেব থাকলেও আজ সকালে আমার যাওয়া হতো
। আমি যে বুঝতে পেরেছি এটা টের পেয়ে মার মুখ রাঙা হয়ে উঠল। এবং আমার তখন সেই মুহূর্তে সেই এক দুপুরের রৌদ্র ঝরা বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে তুলতে চিরদিনের চেনা মনে হলো মা-কে।
সেই রাঙা হাসিটা মনে আছে আমার যে কোনো এইমাত্র দেখা ছবির মতো। আরো বিশেষ করে মনে আছে এই কারণে যে, অমৃতের মতো মধুর মনে হয়েছিল যে মুখ, সেই মুখ কল্পনার চোখে যদিও, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আজ কিন্তু অনুভূতির লেশমাত্র আর নেই। কী করে এই বিচ্যুতি ঘটলো, স্মৃতির ছবি থেকে কখন অপসারিত হলো অর্থের ইন্দ্রজাল, তা বিশ্লেষণ করলে দুটো পাঁচটা রাত কেটে যাবে, কোনো তথ্য দিতে পারব না।
আমার সেদিন আর যাওয়া হলো না। তার পরদিনও না। পরদিন দুপুরবেলায় মা আমাকে তার প্রথম বিয়ের লাল চেলিটা ভাঁজ করে বুকের কাছে লুকিয়ে এনে দিলেন। আমি খুব অবাক হলাম। সকালে মাকে বলেছিলাম, নিশাতের কথা। বলছিলাম, আমার বিয়েতে তার আসা চাই। তিনি মুখে কিছু বললেন না, নামিয়ে নিলেন মুখ, তার কোলের পরে ঘুমিয়ে পড়ল সব ছোট মেয়েটা আমি বুঝতে পারলাম, আসলে আমার মা–কে ডাকাই উচিত হয়নি। আমার বয়স হয়েছে, এবং আমার বোঝা উচিত ছিল, মার পক্ষে কিছুতেই এখন আর সম্ভব নয় এই বাড়ির বাইরে এসে তার প্রথম পক্ষের ছেলে, আমি, আমার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করা। অত্যন্ত লজ্জিত হলাম। মার জন্যে আমার প্রবল কষ্ট হলো। সেটাকে কবর দেবার জন্যে জোর করে হেসে বললাম, বিয়ের পরে নিয়ে আসব নিশাতকে।
আমার দিকে বোবা চোখে তাকালেন তিনি। তখন সে চাহনিটার কোনো অর্থ স্পষ্ট হয়নি আমার কাছে, কিংবা অবান্তর একটি অভিব্যক্তি বলে মনে হয়েছে ওটা, যা আমরা অহরহ প্রশ্রয় দিয়ে থাকি যে কোনো দুজন বা তারো বেশি একসঙ্গে বসলে। আমার ফিরতি ট্রেনটা যখন আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল ঢাকার দিকে, তখন বিচ্ছিন্ন অনেকগুলো ছবির ভেতরে মার এই বোবা চাহনিটা মনে পড়েছিল। কিন্তু তখনো বুঝতে পারিনি কী তিনি বলতে চেয়েছিলেন সে দৃষ্টি তুলে। আজো তার সন্ধান পাইনি। অথচ, আমার স্মৃতি যখন এত উজ্জ্বল করে ধরে রেখেছে সেই চাহনিটা, তখন নিশ্চয়ই তার কোনো মানে আছে, আমার মনে এত গভীর দাগ কেটে গেল যে মুহূর্ত, তার অর্থ আমি না জানলেও কোথাও না কোথাও লেখা আছে।
লাল চেলিটা হাতে নেবার পরও ভালো করে বুঝতে পারিনি আমি একটা বিয়ের শাড়ি হাতে করে আছি, এবং এই শাড়ি পরে আমার বাবাকে প্রথম দেখেছিলেন মা আজ থেকে তিরিশ বছর আগের এক রাতে। শিরশির করে উঠলো আমার গা। নিঃশ্বাস ভারী করে তুললো দীর্ঘদিন ট্রাঙ্কে বন্দি হয়ে থাকার মোহনীয় ঘ্রাণ। বোকার মতো জিগ্যেস করলাম, কার? কার আবার? আমার বিয়া হইছিল এই শাড়ি পইরা।
বলে না দিলেও বুঝতে পারলাম বিয়ে মানে আমার বাবার সঙ্গে বিয়ে। বুঝতে পারলাম দীর্ঘ বৎসরগুলো মা এই শাড়ির সঙ্গে তার প্রথম পুরুষ, ভালোবাসা, ভয়, মৃত্যু ও অশ্রুকে একত্রিত করে সমস্ত আলো ও বাস্তব থেকে দূরে তোরঙ্গের তলায় নিরন্ধ্র গহ্বরে চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। জানতে পারেনি বিশ্ব, হয়ত তিনি নিজেও ভুলে গেছেন একদিন আস্তে আস্তে; আমি সেই মৃতকে জীবন্ত করে তুললাম।
বললাম, কী করব?
বউরে দিও।
আমার এখনো মনে আছে সেই শাড়িটা নিয়ে আমি অনেকক্ষণ বসেছিলাম অবাক হয়ে। বৃষ্টির মতো নরোম গুঞ্জনে, কিসের কে জানে, আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল আমার মন। মার দিকে দেখছিলাম। এবং আমার কিছুতেই যেন খুশির কুলান হচ্ছিল না হৃদয়ে। রিয়াজ এসে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল, টানাটানি করতে লাগল শাড়িটা নিয়ে। মা তাকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললেন, সর, সর, ডাকাইত।
এক সময় ফিরোজা বলল, বউ নিয়া আসবেন কইলাম।
আচ্ছা, আসব।
এখন আমার ভালো করে মনেও নেই সেদিন কোন ঘটনা কোনটার পরে ঘটেছিল। মার শাড়ি দেয়া, ফিরোজার অনুবোধ, রিয়াজের এসে দাঁড়ানো–এসব কোন অনুক্রমে ঘটেছিল? কেবল এটুকু মনে আছে আমার মনটা খুব ভালো ছিল, আমি বেশ সহজ হয়ে উঠেছিলাম, পরদিন আসবার সময় খুব খারাপ লেগেছিল আমার, ফিরোজা আর মা বাড়ির শেষ সীমানা পর্যন্ত এসে পুকুরের ওপারে সুপুরি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে যতদূর দেখা যায় তাকিয়েছিলেন। আমি ধরা গলায় বলেছিলাম, আবার আসব, বউ নিয়ে।
আগাগোড়া ঘটনাগুলোর মধ্যে কোথায় যেন একটা ফাঁকি ছিল যেটা আমি তখন বুঝতে পরিনি। আমি সহজইে ভুলে যেতে পেরেছিলাম প্রথম রাতে দুঃস্বপ্নের মতো মার আবির্ভাব আর বিয়ের মতো মৃত্যুময় কিন্তু সত্য, আমার বাবার সেই মৃত্যুর ইতিহাস এবং সহজেই পেরেছিলাম এই সংসাব, যে সংসার আমার নয়, যে সংসারে আমি চিরদিনের অবাঞ্ছিত, সেই সংসারকে আপন করে দেখতে; এমন কি ফিরোজাকে আমার ভাল লাগতে চেয়েছিল, রিয়াজকে আমি শহরে নিয়ে যাবার কথাও চিন্তা করেছি।
ফাঁকি ছিল নিশ্চয়ই, আমি আমার অজান্তে অভিনয় করেছিলাম। এছাড়া আর কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে অমন ব্যবহারে। বাবার মুত্যু ইতিহাস শোনবার পর নিজের দুঃসহ গ্লানি ঢাকবার হয়ত ব্যর্থ চেষ্টা ছিল ওগুলো। নইলে ওখানে দুদিন, তারপর সারাদিন সারারাত ট্রেনে ঢাকায় ফেরা, ঢাকায় ফিরে এই বিকেল অবধি কম করে হলেও মোট নব্বই ঘণ্টাব মধ্যে একবারও কেন মনে পড়ল না রাতে মায়ের মুখে শোনা কথাগুলো? আমার হাতে বাবার মৃত্যু হয়েছে, এই অপ্রত্যাশিত খবরটা নিয়ে কোনো আলোড়নের স্মৃতিই আমার মনে নেই।
কফির ধোঁয়ায় চশমার কাঁচ যখন কুয়াশা হয়ে গেল, তখন কোন ইন্দ্রজালে অবচেতনের রুদ্ধ দুয়ার খুলে গেল। ছড়িয়ে ছিটকে পড়ল আমার গ্লানি, আমার পাপ, আমার ক্ষমাহীন অস্তিত্ব। আমার কাছে লুপ্ত হলো আশা বাস্তব এবং বর্তমান; দুলে উঠল অতীতের ভারী পর্দা যা ঢেকে রেখেছিল আমার স্মৃতিকে।
পেয়ালার দিকে তাকিয়ে একে একে মনে পড়তে লাগল পেছনের দিনগুলো। আমাকে কোন আয়াসই স্বীকার করতে হচ্ছে না, তারা আপনা থেকেই আসছে এবং দেখিয়ে যাচ্ছে নিজেদের গঠনগুলো। ছাব্বিশ বছর যে স্মৃতির কোনো চিহ্নমাত্র ছিল না, ঈশ্বর তা বিস্মৃতির ধূলি থেকে আবার নবদেহে হাজির করতে লাগলেন। দেখলাম, আমি শিশু হয়ে গেছি। দেখলাম, বাবার হাত ধরে আমি দাঁড়িয়ে আছি বাড়ির সামনে ঘাসের ওপর, বেলা পড়ে যাচ্ছে। আবার দেখলাম, ও পাড়ার এক গরিব বউ এসে মার কাছে চাল চাইছে–আমাকে দেখে হাসছে আর বলছে, গ্যাদা কত বড় হইছে গো। শুনলাম, এই আমার দাই মা। দাই মা আবার কেমন মা? স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি সারাদিন একা একা হাঁটছি আর এ কথাটা ভাবছি।
কোথায় ছিল স্মৃতিগুলো এই ছাব্বিশটি বছর? মার একটা কথার শেষ যেন উড়িয়ে দিয়েছে শোয়ার দরোজা, পতন হয়েছে বিস্মৃতির নগরের, ঐ দেখা অচ্ছে। দেখলাম, নদীতে প্রবল স্রোত নেমেছে, ঘোলা পানি খল খল করে তালি বাজাতে বাজাতে ঘুরতে ঘুরতে বয়ে চলেছে; তার মুখে গাছপালা বাড়িঘর কিছু আটকাচ্ছে না, পাড় থেকে বড় বড় চাঙ্গড় ধ্বসে পড়ছে। দিনরাত। ভোর রাতে আমাকে ঘুম থেকে তুলে বাবা বললেন, গ্যাদা চলো, নদী দেইখা আসি। ভাঙতেছে।
আমি ভোরের অস্পষ্ট আলোর ভেতরে চলছি চোখ ডলতে ডলতে। ক্রমে রাঙা হয়ে উঠছে। সূর্য, আস্তে আস্তে বাড়িঘর গাছপালার ছবি স্পষ্ট হয়ে আসছে, দূর থেকে বেতালা ঢাকের মতো আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি আর নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে ভোরের ফুরফুরে হাওয়া।
বাবা বললেন, শুনছাও? নদী ভাঙ্গে তার আওয়াজ। য্যান ঢাক বাজে না?
তখন আমার খুব ফুর্তি হলো। বাবা হাত ছেড়ে দিয়ে লাফাতে লাফাতে তার আগে আগেই চললাম। তিনি পেছনে থেকে মুখে যদিও বললেন, দেইখ্যা, পইড়া যাইবা, কিন্তু বাধা দিলেন না আমাকে।
একেবারে সেদিনকার কথার মতো আমার মনে পড়ছে এই লাফিয়ে চলার দৃশ্যটা। মনে করতে করতে চোখে পানি এসে গেছে আমার, খেয়াল করিনি। কফিতে একটা চুমুক দিয়ে নড়ে-চড়ে বসলাম তখন। সিগারেট ধরালাম। ধরিয়ে দেখি, স্মৃতির সূত্রটা ছিঁড়ে গেছে। ধারাবাহিকভাবে কিছুতেই আর মনে পড়ছে না কিছু। যেন ঐ লাফিয়ে চলাটা অনন্তকাল পর্যন্ত চলেছিল।
তারপর যে ছবিটা মনে পড়ল—-দেখতে পাচ্ছি, বাবা নদীর উঁচু পাড়ের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে কী দেখছেন। আমি তার পেছনটা দেখতে পাচ্ছি অনেক দূর থেকে। খুব মজা লাগছে আমার বাবাকে অমন ঝুঁকে পড়ে থাকতে দেখে। দৌড়ে এসে হাসতে হাসতে তাঁর পিঠে দিলাম ধাক্কা; এখনি তিনি যেন সচকিত হয়ে উঠবেন এবং দেখে হেসে ফেলে তাড়া করবেন ধরবার জন্যে, যেমন আমার খেলার বন্ধুরা করে থাকে। কিন্তু বাবা সে সব কিছুই করলেন না। বিরাট একটা গাছের গুঁড়ির মতো গড়িয়ে পড়লেন নদীর ভেতরে। ছলাৎ করে একটা শব্দ উঠল। আমার চোখের সামনে হাত খানেক মাটিতে সরু কালো সূতোর মতো চিড় ধরলো। চিৎকার করে পেছনে ছুটে আসতেই দেখলাম একটা বড় চাঁদের আকারে খানিকটা পাড় ধ্বসে পড়ল নদীতে যেখানে একমুহূর্ত আগে ছিলাম আমি এবং আমার একমুহূর্ত আগে বাবা।
আর মনে নেই। তারপর যে স্মৃতিটা একেবারে পিঠেপিঠে মনে পড়ে তা হচ্ছে আমার চাচি ডিমের মতো গোল দলা পাকিয়ে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন আমাকে আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। এই একটা ছবি বাবার গড়িয়ে পড়া, আমার লাফিয়ে পেছনে হটে আসা, বারবার ফিরে ফিরে মনে পড়তে লাগল রেস্তোরাঁয় বসে। যেন এমনি করে দেখে দেখে আমি আরো কিছু নতুন তথ্য আবিষ্কার করতে পারবো। আমি তো হত্যাকারী, বাবাকে হত্যা করেছি, নতুন কোনো তথ্য যেন সে সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে আরো; আমাকে নিঃসন্দেহে প্রতিপন্ন করবে। জগতের ঘৃণ্যতম অপরাধী হিসেবে।
পেয়ালার কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আরো এক পট আনতে বললাম বেয়ারাকে। একটু আগে যাকে আমার মনে হয়েছিল আদালতের ব্যারিস্টার, অভিযুক্ত করছে আমাকে, চরম শাস্তি প্রার্থনা করছে আমার জন্যে, সে আরেক পট কফি এনে রাখলো।
আজ আমি আর ওকালতি করি না, কাজি সাহেবের জুনিয়রি ছেড়ে দিয়েছি যেন কত যুগ আগে, তাই আজো আমার স্পষ্ট করে মনে পড়ে ওয়েটারের কালো কোটকে ব্যারিস্টারের কালো কোট বলে ভুল করার করুণ সম্ভব মুহূর্তটি।
আমার তখন ঝোঁক চেপে গিয়েছিল নিজেকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেয়ার। যে কয়েক হাজার টাকা ব্যাঙ্কে ছিল, তা আমার শেষ নির্ভর, আমার অনেক স্বপ্নের ভিত্তি। প্রথমেই সে টাকাগুলো উড়িয়ে ছত্রখান করে দেবার তীব্র বাসনা হলো। একদিন পাঁচশ টাকা তুললাম। কিন্তু কী করা যায় পাঁচশ টাকা দিয়ে এই ঢাকা শহরে? একটা দোকানে উঠে সেন্ট কিনলাম এক গাদা, শাড়ি কিনলাম, মেয়েদের চপ্পল পছন্দ হলো দুজোড়া–তাও নিলাম। আর নিজের জন্যে, যা কোনদিন পারব কল্পনা করিনি, কিনলাম দামি টোব্যাকো, পাইপ, ড্রেসিং গাউন আর একটা সোনার ক্যাপ কলম। এক সন্ধ্যায় ফতুর পাঁচশ টাকা। আজ সে সব কথা মনে পড়ে হাসি পায়। সিনেমা দেখার অভ্যেসটা ছিল আমার মোলআনা; মনে হয়, বাংলা কোনো ছবিতে কাউকে দেখে থাকব গাউন পরে পাইপ খেতে, কথা বলতে অত্যন্ত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে –তাই নিজের জন্যে ওগুলো কিনেছিলাম। আসলে নিজেকে শক্ত সবল করে দাঁড় করানোর হাস্যকর প্রয়াস হিসেবেই এই কেনার অভিযান, যা তখন বুঝতে পারিনি। এখনো হয়ত সুটকেশের তলায় পড়ে আছে গাউনটা, প্রথম কয়েকদিন ব্যবহারের পর সেই যে ফেলে রেখেছি আর ফিরে তাকানোও হয়নি।
ফিরে তাকাবো কী, আমার মনে তখন শূন্য মাঠে তপ্ত বাতাসের ঘূর্ণি হচ্ছে। আমার তখন একটাই কথা, আমি যখন আমার বাবাকেই এই দুহাতে ধাক্কা দিয়ে হত্যা করতে পেরেছি, তখন পৃথিবীতে আমার কিসের ভয়, কিসের তোয়াক্কা। আমি যেন যা খুশি তা করতে পারি। যে ছেলে পরীক্ষায় ফেল করেছে তার অঙ্কে দশ পেলেই কী আর আশি পেলেই বা কী? আমার যেন সমস্ত নীতি, শৃঙ্খলাবোধ, সব তছনছ হয়ে গেছে; উচ্চাশা হাস্যকর, সংসার অসম্ভবের আহ্বান, কর্ম এবং অর্থ অর্থহীন। যে শাস্তি আইন আমাকে দিতে পারেনি, তার চেয়ে বড় শাস্তি সৃষ্টির সাধনা তখন আমি করছিলাম সমস্ত স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়ে, সাধ উপেক্ষা করে, আত্মনিপীড়ন আর বঞ্চনার ভেতর দিয়ে।
সেন্ট, শাড়ি, চপ্পল কিনেছিলাম কার কথা মনে করে এখন আর মনে নেই। নিশাতের কথা ভেবে থাকব? কিন্তু নিশাত তখন আমার চেনাজগৎ থেকে এত দূরে যে তাকে মনে হতো মৃত একটি মানুষ, যার নাম আমার মনে আছে, মুখ; কিন্তু যার কাছে আর যাওয়া যায় না। রুমি? সম্ভবত তাও নয়। কারণ, রুমি হলে আমি বেছে বেছে গাঢ় রংয়ের শাড়িগুলো কিনতাম না। রুমি ছিল কালো; আমার বেশ মনে আছে, রুমি একেকদিন সবুজ বা ঐ রকম গাঢ় রংয়ের শাড়ি পরতো বলে আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠতো। আমি যা কিনেছিলাম তা একজন ফর্সা রক্তিম মেয়েকেই মানাতো বেশ। ফিরোজার জন্যেও কিনিনি। কারণ, সেদিন রেস্তোরাঁয় কালোকফির ধোঁয়ায় চশমার কাঁচ ঢেকে আসবার মুহূর্তেই আমার সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে মোরশেদ সাহেবের পরিবারের সঙ্গে।
আজ আমার মনে হয়, নিশাতকে ভুলেও আমি ভুলতে পারিনি সেদিন–যেমন আজো পারিনি, এই লেখার মুহূর্ত পর্যন্ত পারছি না। নিশাতের কথা ভেবেই হয়ত কিনেছিলাম ওগুলো। যে দেয়াল আমি নিজেই তুলেছি, তা ভেঙ্গে আবার নিশাতের কাছে ফিরে যেতে পারবো না; কারণ, আমার আত্মাভিমান বড় প্রবল তখন। যা কিছু ছিল আমি যে আমিই, এবং আমার সব সঠিক– এই অহঙ্কারটা ছিল ষোলআনা। কিন্তু মনের একেবারে শেষ কোণায় বোধহয় আকাক্ষাটা মরেও মরেনি; এই আশেপাশেটা যায়নি, যে ইচ্ছে করলেই নিশাতকে আমি বউ করতে পারতাম। তাই ওই সেন্ট, শাড়ি, চপ্পল কেনার ভেতর দিয়ে হয়ত অসম্ভব আশা করেছি, নিশাতকে আমি নিজেই সৃষ্টি করে নিতে পারবো। জিনিসগুলোর মধ্যে তার রক্তিম উষ্ণ শরীরটা যেন স্পন্দনমান হয়ে উঠবে। এটাকে আমার এখন মনে হয় মস্তিষ্ক বিকৃতির এক ধরনের লক্ষণ। কিন্তু তখন সেটা বুঝতে পারিনি কারণ, তখন আমি যা করছিলাম তা–ই মনে হচ্ছিল এবং যে কোনো যুক্তি ও সত্যের বিরোধিতা করবার জেদ ছিল প্রচুর।
বাড়ি বয়ে নিয়ে এসে, মনে আছে, প্রথমেই হাঁক পেড়ে ডাকলাম জালালের স্ত্রীকে। তিনি ছেলেটাকে পড়াচ্ছিলেন মেঝেয় শুয়ে শুয়ে। আমার আওয়াজ শুনে ধরমর করে উঠে এলেন। গায়ে গতরে শাড়ি টানতে টানতে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি বলি, কে না কে? এগুলো কী?
দেখুন না কী? বলতে বলতে তার হাতে তুলে দিলাম সেন্ট, শাড়ি, চপ্পলের ব্রাউন কাগজ মোড়া প্যাকেটগুলো। জালাল আমার দিকে চকচকে চোখে তাকাল, যেন মহা দুর্বোধ্য কিছু তার চোখের সামনে ম্যাজিকের মতো ঘটে যাচ্ছে।
আমার এখন হাসি পায়, আমি ওকালতি করতাম, মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আমাকে কারবার করতে হতো, অথচ সেদিন যা করলাম তা নেহাৎ মূখের কী নির্বোধের মতো একটা কাণ্ড; পূর্বাপর ভাবলাম না একটুও, জালালের স্ত্রীকে সেই শাড়ি চপ্পল দিয়ে বসলাম। তার সঙ্গে আমার ঠাট্টা চলত, জালাল আমার ভালো বন্ধু। তারো চেয়ে সত্য, মানুষের মন এক জটিল যন্ত্র যার কোন্ কাটার আবর্তনে কোন্ কাঁটা ঘুরবে তা অঙ্ক-ফলের মতো বলা যায় না।
জিনিসগুলো খুলতে খুলতে জালালের স্ত্রীর মুখে গভীরতর হতে লাগল আনন্দ–উল্লাসের রেখাগুলো, ছোট্ট একটা মেয়ের মতো খুশি দেখাতে থাকল সে। আমি সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম।
নিশাতের সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে না, একথাটা ওদের জানানো হয়েছিল কিনা মনে নেই। খুব সম্ভব বলেছিলাম। এবং এটা আরো সম্ভব, মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে নিশাতের সঙ্গে আমার সম্পর্কের এত বিরাট পরিবর্তন কী করে ঘটল তা জানবার জন্যে ওরা স্বামী স্ত্রীতে ভীষণ পীড়াপীড়ি করেছিল আমাকে। সম্ভবত এইজন্যে বলছি, আমার উপহার তাহলে জালালের মুখ কালো করে দিত না। জালাল ভেবেছিল, আসলে আমি একা উড়নচণ্ডি লক্কা পায়রা– এইমাত্র একটি মেয়েকে কথা দিয়ে আর বিয়ে করলাম না এবং পরদিন বিনি মাশুলে গাড়ি চড়ার আনন্দ খুঁজতে বেরুলাম কৌশলে বন্ধু–স্ত্রীর প্রতি নিজের অনুরাগ জানিয়ে। আমি জালালকে দোষ দিই না। নিশাতের মতো সাফ মাথা, অনুভূতি–সম্পন্ন মেয়েই যদি ভুল বুঝতে পারে তো জালাল কোন ছার। জালাল আমার বন্ধু কেবল, আর নিশাতের সঙ্গে ছিল আমার হৃদয়ের সম্পর্ক।
এ সবই ভুল। একটা মানুষ কিছুতেই বুঝতে পারে না আরকটা মানুষকে। যত নিকট হোক দুটি মন, এমনকি তারা বিনিময় করুক তাদের রক্ত, তবু তারা বুঝতে পারবে না একজন আরেকজনকে সম্পূর্ণভাবে। যে সেতু আমরা কল্পনা করে থাকি তা সেতুর বিভ্রম মাত্র। নইলে মুখে না বললে, ভাষায় না ভাবনাকে ব্যক্ত করলে কেন অচল হয়ে যায় জগৎ? নিশাতকে যেহেতু আমি কিছুই বলিনি আমার চেতনার বৈপ্লবিক পবির্তনগুলো সম্পর্কে, সে হয়ত মনে করে বসে আছে, আমি সেই আমিই আছি এবং আসলে আমি এক হৃদয়হীন পশু।
আশ্চর্য, মানুষের মনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মুখের রেখা বদলায় না, তা যদি বদলাতো তাহলে এই পৃথিবীতে বাস করা সহজ হতো অনেক।
সেদিন রেস্তোরাঁয় আমি বসেছিলাম স’পাঁচটায়। সাতটায় দেখা করবার সময় ছিল নিশাতের সঙ্গে। কিন্তু তার আগে ঘটলো অঘটন, আমার চশমার কাঁচ আচ্ছন্ন হয়ে গেল কালোকফির ধোঁয়ায় এবং আমি বিকৃত হতে লাগলাম হত্যাকারী হিসেবে। আমার মনে হলো, আগেই বলেছি, এখন আমার পক্ষে পৃথিবীর যে–কোন পাপ করা সম্ভব এবং তা হচ্ছে লঘুকীর্তি। মনে হলো, এই বেঁচে থাকাটা অর্থহীন এবং আরো মনে হলো, ততোধিক অর্থহীন মৃত্যু।
সেই মুহূর্ত থেকেই আমার অধঃপাতের শুরু। কিংবা একে নবজন্ম বলব? জীবনের নতুন মুখ? এই কয়েক বৎসর আমি বয়সে যা না বেড়েছি তার চেয়ে মনটা বুড়ো হয়েছে। পুরনো আর প্রচলিত কথাগুলো এখন আমিও সোচ্চারে বলতে শুরু করেছি। যেমন, অধঃপাতের কথা লিখতে লিখতে আমি ভাবছি, আসলে আমরা কি জানতে পারি কোনটা আমাদের জন্যে ভালো আর কোনটা খারাপ? যা হয় মঙ্গলের জন্যেই হয়। এবং বুড়োদের মতো এখন আমিও বলতে দ্বিধা করি না. আমাদের সমস্ত ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে আছে কোথাও না কোথাও; অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিভিন্ন মানুষেরই কীর্তি।
ভাগ্যবাদীতার শুরুও সেদিন সেই বিকেলেই হয়েছিল, আমি অনুমান করছি। কারণ, নিজের বিধ্বস্ত স্বপ্ন থেকে চোখ তুলে যখন সময় দেখলাম, তখন সাড়ে সাতটা বাজে। নিশাতের সঙ্গে দেখা করবার নির্ধারিত সময় আধঘণ্টা হলো পেরিয়ে গেছে। এতক্ষণ বসে বসে কফির পেয়ালায় আমি বারবার সেই ছবিটাই দেখছিলাম আমার দৌড়ে আসা, দৌড়ে এসে ধাক্কা দিলাম বাবাকে, তিনি গড়িয়ে পড়লেন, একটা ধ্বস খসে পড়বার আগেই চিৎকার করে পিছিয়ে এলাম আমি।
অভিভূতের মতো উঠে এলাম রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এসে দেখি সিনেমা হলের মাথায় নতুন ছবির ব্যানার লাগাচ্ছে। নৃত্যভঙ্গিমায় দাঁড়ানো মেয়েটির কাটা ছবিতে দড়ি পরিয়ে আস্তে আস্তে কুলিরা টেনে তুলছে পোর্টিকোর মাথায়। একটা অতিকায় স্বপ্নের মতো সে উঠে যাচ্ছে। আমি হা করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।
আমার যাওয়া হলো না। নিশাত এতক্ষণে আমার জন্যে ইস্কুলের বোর্ডিং গেটে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ফিরে গেছে। কাঁঠালতলা দিয়ে পুকুরের পাড় ভেঙ্গে বাসায়। বাসায় গিয়ে খোকনকে কোলে নিয়ে হয়ত ভাবছে কেন আমি এলাম না? আমিতো কোনদিন কথা দিয়ে এরকম করিনি। হয়ত কাঁঠালগাছের নিচেও দাঁড়িয়েছে কিছুক্ষণ যদি আমি শেষ মুহূর্তে আসি, যদি শোনা যায় কোনো স্কুটারের শব্দ।
নিশাত কি জানবে কী আমার হয়ে গেছে। নিশাতকে আমি কোনদিন বলতে পারব না। ঠিক তখন ইন্টারভ্যাল হলো। আচমকা ভরে উঠল সিনেমা হলের সামনের জায়গাটুকু। আর দাঁড়িয়ে থাকা গেল না। লোকের ধাক্কায় আমি ক্রমাগত নাজেহাল হচ্ছি।
তখন হাঁটতে শুরু করলাম। সিঙ্গারের সামনে দিয়ে চলতে লাগলাম স্টেডিয়ামের দিকে। সে চলায় না আছে কোনো উদ্দেশ্য, না কোনো চেতনা আমবে মনে হচ্ছে, আমাকে এরকম। হাঁটতে হবে এবং থামলে চলবে না। যেন আজ সারারাত্রির মধ্যে আমি হাঁটতে পারলো এবং পৌঁছে যেতে পারবো পৃথিবীর অপর প্রান্তে।
আজ আমার মনে হয়, সত্য থেকে পলায়নের স্পৃহা সে মুহূর্তে প্রবল হয়ে উঠেছিল আমার ভেতরে।
স্টেডিয়ামের মোড়ে দাঁড়িয়ে ওষুধ বেচা হকারদের খেলা দেখলাম খানিক; আবার হাঁটতে শুরু করলাম। সেকেণ্ড গেটের পাশে একসিডেন্ট হয়েছে, উল্টে পড়ে আছে নতুন ঝকমকে একটা গাড়ি, পাশে দাঁড়ানো একটা ট্রাক, ড্রাইভার পালিয়েছে। লোকেরা উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলছে, দৌড়ুচ্ছে, ভিড় করছে, আহতকে আরেকটা গাড়ি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সেখান। থেকে এগিয়ে বড় চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবলাম কোনদিকে যাবো। একটা সিগারেট ধরালাম। তেতো লাগল। কাশি উঠল। হাঁটতে লাগলাম পার্কের দিকে, পার্ক পেরিয়ে রেসকোর্স বা হাতে ফেলে অন্ধকার গা ছমছমে রাস্তা দিয়ে শাহবাগের দিকে। শাহবাগের সামনে সার সার। ট্যাকসি দাঁড়িয়ে আছে। যেন বিরাট বিরাট হলুদ কালো ফুলের মালা গেঁথে রাতের রাস্তায় ফেলে রেখে গেছে কেউ।
কাল নিশাতকে টেলিফোন করব। কালকের কথা কাল ভাবা যাবে। আবার আমি হাঁটছি। আর্টস্কুলের বিরাট খোলা সিঁড়িতে দুধের মতো আলো বয়ে যাচ্ছে। গাছের গায়ে কারা যেন। কোন্ আন্দোলনের পোস্টার সেঁটে গেছে। দেখা যাচ্ছে পাবলিক লাইব্রেরীর দেয়ালে আঁকা ছবির একটা অংশ। আমি থমকে দাঁড়ালাম।
একটা লোক আমার কাছে সিগারেট ধরাবার জন্যে আগুন চাইল। ধরিয়ে নিয়ে গেল সে। আমি এগুলাম। নীলক্ষেত ফায়ার স্টেশনে লাল গাড়িগুলো জ্বলজ্বল করছে। বারান্দায় তাস পিটছে কারা? সামনে সুন্দর করে ছাঁটা ফুলের কেয়ারি, ঘন ঘাসের ঝোপ।
নদী ভাঙছিল। আমরা দেখতে গিয়েছিলাম। আমি দৌড়ে এসে ধাক্কা দিয়েছিলাম বাবাকে। একটা বড় ধ্বস ভেঙে পড়ল তারপর। তিনি আর উঠে আসতে পারেননি। এই ছাব্বিশ বছর কোথায় ছিল এই ছবিটা?
রাস্তার লোকগুলোকে একেবারে অন্যগ্রহের মনে হচ্ছে। তারা আসছে যাচ্ছে, গাড়ি বাস ছুটে চলেছে, রিকশাওলা বেল বাজাচ্ছে–কোনো কিছুর সঙ্গেই যেন আমার আর কোনো বন্ধন নেই।
আজিমপুরে আমার এক ক্লাশের একদা বন্ধু থাকতো। কখনো সখনো যেতাম তার ফ্ল্যাটে। তার দরোজায় গিয়ে ধাক্কা দিলাম। সে দরোজা খুলে অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিগ্যেস করল, কী হয়েছে তোমার? অসুখ?
বড় ক্লান্ত লাগছিল তখন। আলাপকে সংক্ষিপ্ত করবার জন্যেই মিথ্যে করে বললাম, হ্যাঁ, অসুখ।
সে রাতে ওর ওখানে থেকে গেলাম।
পরদিন টেলিফোন করতে গিয়ে আমার হাত কাঁপল। যখন রিসিভারটা তুলে ডায়াল করতে গিয়েও রেখে দিলাম, কাজি সাহেব অবাক হয়ে আমাকে দেখলেন। নিঃশব্দে একটা প্রশ্ন আঁকলেন ভ্রূ তুলে।
আমি যে চমৎকার মিথ্যে বলতে পারব, আমার ধারণা ছিল না। বললাম, সময় জানতে চেয়েছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হলো আজ সকালেই ঘড়ি মিলিয়েছি, তাই রেখে দিলাম।
ও।
আরেকবার আড়চোখে দেখলাম কাজি সাহেবকে। কী জানি, তিনি যদি বুঝতে পেরে থাকেন, আমি মিথ্যে বলেছি। কিন্তু তিনি ততক্ষণে তার নথিপত্রে আবার ডুবে গেছেন। আমি বাঁচলাম।
নিশাতকে আর টেলিফোন করা হলো না।