৪. ঘুম ভাঙে বেশ দেরিতে

সেই ঘটনার পরের দিন আলি কেনানের ঘুম ভাঙে বেশ দেরিতে। অনুভব করে সর্বশরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। নড়াচড়া করার শক্তি নেই। তবু সে অনুভব করে একটা প্রশান্তি তাকে আচ্ছন্ন করে আছে। তার আপন অস্তিত্ব পাথর খণ্ডের মতো ভারি মনে হয়।

এদিকে সকালের রাঙা আলো ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করেছে। নতুন সূর্যালোক জাগ্রত ধরিত্রীর রূপরস গন্ধ তাকে ক্রমাগত চঞ্চল এবং উতলা করে তুলেছে। আলি কেনান অনুভব করে এই পৃথিবী সুন্দর। সুন্দর তার প্রসন্ন সূর্যোদয় সুন্দর সূর্যাস্ত। ঘাসপাতা, গাছপালা পাখপাখালি সবকিছু সুন্দর। আল্লাহ মেয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছে বলেই তো এই দুনিয়া এতো রূপরসে ভরা। মেয়ে মানুষ না থাকলে পৃথিবী একটি মরুভূমিতে পরিণত হতো। আলি কেনান শুয়ে শুয়ে অনুভব করে।

এই আকাশ পৃথিবীর কোথায় রসের একটা গোপন উৎসধারা খুলে গেছে। এই ধারা স্রোতে সে যেনো ভেসে যাচ্ছে। সর্ব অস্তিত্বে নিজেকে নবজাত শিশুর মতো পেলব এবং সুকুমার মনে করতে থাকে।

আলি কেনান চোখ বুঝে আছে, তবু টের পায় ছমিরন হুজরাখানায় ঢুকেছে। মেয়ে মানুষের শরীরের আলাদা একটা ঘ্রাণ আছে। সহসা ছমিরনকে দেখার একটা তীব্র গভীর তৃষ্ণা মনের মধ্যে অনুভব করে। গা ধুয়েছে ছমিরন। তার মাথায় আধভেজা চুলের বোঝা পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। দুয়েক ফোঁটা পানি ঘাড়ের কাছটিতে চকচক করছে। মুখে গুটিবসন্তের দাগগুলো স্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে। চোখে চোখ পড়তেই ছমিরন ঠোঁট ফাঁক করে হাসলো। বাহু দুটো অকারণে নাড়া দিলো। আলি কেনানের মনে হলো,

এই বাহু দুটোর ভাষা আছে। যেনো তারা বলছে, তুমি বাঁধা পড়ে গিয়েছে গো। আর যাবে কোথায়?

আস্তানায় লোকজন আসতে শুরু করেছে। অগত্যা আলি কেনানকে শয্যাত্যাগ করে উঠতে হয়। সে প্রাতঃকৃত্য শেষ করলো। ছমিরন এবারও গরম পানিতে গামছা ভিজিয়ে তার সারাগা মুছে দিলো। দু জনের মধ্যে একটি কথাও বিনিময় হয়নি। আলি কেনান ছমিরনের দিকে তাকাতে পারছিলো না। কোত্থেকে একটা লজ্জা এসে তাকে আড়ষ্ট করে দিচ্ছিলো। সে বেমালুম ভুলে গেলো, গতকাল তার ওপর একটা বিরাট ঝড় বয়ে গেছে।

আলি কেনান বাইরে এসে দেখে হোগলার চাটাইয়ের ওপর লোকজন বসে রয়েছে। আর ইমাম সাহেব একটি জলচৌকির ওপর কাগজ রেখে কোরানের আয়াত লিখছেন। আলি কেনান ভীষণ বিরক্ত হলো। রোজ রোজ একই দৃশ্য ঘুম থেকে উঠে তাকে দেখতে হয়। ইমাম সাহেবকে ডেকে বলে,

ইমাম সাহেব হগলডিরে কইয়া দ্যান, কারো লগে আমি কতা কইবার পারুম না।

ইমাম সাহেব মিন মিন করে বললেন, অনেকে অনেক দূর থেইক্যা আইছে। চইল্যা যাইতে বলা কি ঠিক অইব? কথা না বাড়িয়ে আলি কেনান বলে,

তা অইলে আপনে দেইখ্যা শুইন্যা তাবিজ আর পানি পড়া দিয়া দেন। তার কথা শুনে ইমাম সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন!

আমি দিলে লোকের উপকার অইব?

আলি কেনান বললো,

আপনে নিজেরে এত আদনা ভাবেন কেরে। কলন্দর বাবা স্বপ্নে কইছে, আপনে দিলেও কাম অইব। খুশিতে ইমাম সাহেবের চোখ দুটো নেচে উঠলো। আপনে হাঁছা কইতাছেন?

হ হাঁছা

সে বাইরে এসে রোজকার মতো মনু মনু বলে কুকুর ছানাটিকে ডাকলো।

পরিচিত চিৎকার করে, ঘন্টি বাজিয়ে কুকুর ছুটে এলো না।

কি কারণ? তখনই আলি কেনানের নিমবাগান মাজারের ঘটনাটি মনে পড়ে গেলো। শরীরের ব্যথা বোধকরি নতুন করে তেতে উঠলো। পাশের ঘরে দু-এক জন শিষ্য অসহ্য যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। আলি কেনান হঠাৎ করে ভিন্ন মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। স্থির করে ফেললো খানকীর বাচ্চাটাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে।

আলি কেনান বাস্তববাদী মানুষ। সবকিছু গুছিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা তার আছে। মাথাটাও ভীষণ পরিষ্কার। সবচেয়ে কম ঝুঁকি গ্রহণ করে প্রতিপক্ষের মারাত্মক ক্ষতি কিভাবে করা যায় সে শিক্ষা যৌবনে চর দখলের সময় সে পেয়েছে। শরীরের স্নায়ুর সমস্ত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ঐ বিষয়টি ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে। তখন বিষয়ান্তরে মননানিবেশ করা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাটায়। তার মাথায় একটা নতুন পরিকল্পনা বিজলীর শিখার মতো ঝিলিক দিয়ে জেগে উঠলো।

গায়ের জড়তা, ক্লান্তি যথাসম্ভব দূর করে সে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। কিছু কিছু সাপ নাকি আছে, ক্ষেপে গেলে লেজের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছোবল মারে। আলি কেনানেরও অনেকটা সেই অবস্থা। সে শিষ্যদের হাঁক দিলো :

এই কালাম, এই বশির, এই ফজলা তোরা হগলে আইয়া হুইন্যা যা। যে দুজন বাড়িতে থাকে, তাদেরও ডেকে আনা হলো। ফজলা খুব কঁকাচ্ছিলো। আলি কেনান তার পরিকল্পনাটা প্রকাশ করতে পারছিলো না। তার একান্ত ইচ্ছে শিষ্যেরা মন প্রাণ দিয়ে তার কথাগুলো শুনুক। সে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য বাঘের মত একটা হালুম করলো। সকলে তার দিকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকায়। আলি কোন বয়ান করতে আরম্ভ করে :

তোরা বেবাকডিতে হুন, গত রাইতে কলন্দরি বাবার কাছে অনেকক্ষণ ধইর‍্যা জারজার অইয়া কানলাম। কানতে কানতে ঘুমাইয়া পড়ছি কহন টেরও পাই নাই। এক সময়ে দেহি হুজরাখানা রোশনাইয়ে ভইরা গেছে। আর চাইরদিকে বেহেশতের বাস। আমি চউক মেইল্যা চাইয়া দেহি একডা বুইড়া মানুষ। মুহে সাদা দাড়ি। হাতে লাঠি আর গায়ে আমাগো মতোন শিকল। মুহের দাড়ি থেইক্যা, হাতের লাঠি থেইক্যা রোশনি বাইর অইবার লাগছে। এমুন ছবি আমি আর জিন্দেগিতে দেহি নাই। বুইড়া মানুষডি আমারে কইলো,

আলি কেনান তুই উইঠ্যা খাড়া। আমি কইলাম,

নিমবাগান মাজারে আমারে ধইর‍্যা কিলাইছে। উঠবার শক্তি নাই। তহন তিনি আমার গায়ে হাতের লাঠি তুইল্যা একটা বাড়ি দিলেন। লগে লগে আমার দরদ ব্যথা সব চইল্যা গেল। আমি বুইড়া মানুষডির পায়ের উপর আছরাইয়া পইরা কইলাম,

বাজান আপনে কেডা? তখন তিনি আমারে সোহাগ কইরা হাত বুলাইয়া কইলেন,

আমার নাম বু আলি কলন্দর। আলি কেনান বলতে থাকে, শিষ্যেরা অবাক হয়ে শুনে। তারপর আমার দুই চউক দিয়া হু হু কইর‍্যা পানি পড়তে লাগলো। বাবাজান তাঁর পাক হাতে আমার চউকের পানি মোছাইয়া কইলেন,

বেটা আলি কেনান, তর দিলে খুব মহব্বত। আর কান্দনে কাম নাই। আমি কষ্ট পাইতাছি তোগো লাইগ্যা।

আলি কেনান নির্বিকার বলে যাচ্ছিলো। শিষ্যেরা সম্মোহিত হয়ে শুনছিলো। দেখা গেলো ইমাম সাহেবও আয়াত লেখা বন্ধ করে মুগ্ধ বিস্ময়ে আলি কেনানের স্বপ্ন পুরানের কথা শুনছেন। আলি কেনান বলে যায়,

তারপর বাবা আমারে কইলেন, খোরাসানি আমার মুরিদ আছিল। এই ব্যাপারে তার লগে আমার ফাইন্যাল কথা অইয়া গেছে।

ঐ খাদেম বেটা নাপাক বজ্জাত আর হারামি। তুই অরে খেদাইয়া মাজারের দহল লইয়া ল। তিনখান কতা মনে রাখিস। কুত্তা লইয়া যাবি না। অহন আসহাবে কাফের জমানা নয়। অহন কুত্তা নাপাক। জন্তু জানোয়ারে যদি হাউস থাহে, ভেড়া লইয়া যাবি। ভেড়া পাক জন্তু। আমাগো দ্বীনের নবী ভেড়ার গোশত খাইতে পছন্দ করতেন। আর হুন এশার নামাজের আগে গান বাজনা করবিনা। আমার ঘুম ভাইঙ্গ্যা গেল। দেহি শরীরে আর দওর ব্যথা নাই। বেবাক ঘরে ম ম খোশবু। আমি কানতে কানতে কইলাম,

বাজান আরেকবার দর্শন দ্যান। আমার চউকে আর নিদ্রা আইলনা। তরা হুইঙ্গা দেখ অহনও আমার গতরে খোশবু লাইগ্যা আছে। ইমাম সাহেব নাকটা আলি কেনানের আলখেল্লার কাছে নিয়ে গেলেন, হাঁছাইত দেহি, চম্পা ফুলের মত বাস পাওয়া যায়। বু আলি কলন্দর যে স্বপ্নে দর্শন দিয়েছেন, সে ব্যাপারে আর কারো সন্দেহ রইলো না।

এত কিছুর পরও আলি কেনানের মনের দ্বিধার ভাবটা কাটলো না। জেলফেরত আসামী কালামের মুখে একটুও ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলোনা। শুরু থেকেই আলি কেনানের মনে বেজেছে এই কালাম হারামজাদা তার কথায় বিশ্বাস করে না। এমনকি মনে মনে তাকে একটা দাগাবাজ ভাবলেও সে বিস্মিত হবে না। মানুষের মনের ভাষা পাঠ করার ক্ষমতা না থাকলে সে এই অল্প দিনে এতো দূর প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারতো না। কালাম এখানে থাকলে খেতে পায় বলেই আছে। তার মনে নিশ্চয়ই অন্য কোনো মতলব আছে। তথাপি আলি কেনান তাকে তাড়িয়ে দিতে পারেনি। তাহলে দলটি কানা হয়ে যায়। আরো একটি বিষয় চিন্তা করার আছে। কালামের গানের গলাটি ভারী মিষ্টি।

আলি কেনান হুঙ্কার দিয়ে বললো,

এ্যাই শালা কালাম্যা। এত কি ভাবতে আছস? শুনলি বাবা বু আলি কলন্দর কি কইয়া গেছেন। অহন তোরা কি করবি, হেইড্যা ক?

কালাম কোনো রকম দ্বিধা না করেই বললো,

তা অইলেতো মারামারি করতে অয়। আর মারামারি কইর‍্যা আমরা পারুম কেনে। অরা অনেক। একবার খাদেমের মাইনসে আমাগো খেদাইয়া দিছে। আপনে কি করবার চান, আপনে জানেন, আমি কিছু কইবার পারুমনা। তাকে কথা বাড়াতে না দিয়ে আলি কেনান বলে বসলো,

হ হাঁছা কতাই কইছস। আমি বাবা বু আলি কন্দরের হাতের বাঁশি। তিনি যেভাবে বাজান, আমি সেভাবে বাজি। আর তরা আমার হাতের যন্ত্র। যা করবার কমু, করবি? কেউ তখন আলি কেনানের প্রতিবাদ করলো না। সুতরাং সে নিশ্চিত হয়ে তার পরিকল্পনাটা প্রকাশ করে। আমরা হগলে যাইয়া আগামী শুক্রবারে মাজারের দখল লইয়া লমু। আমাগো উপর বাজানের দোয়া আছে। কুনু বাপের ব্যাটা ঠ্যাহাইতে পারতো না। বাজান যা যা কইছেন আমরা হগলডি মাইন্যা চলুম। ঐ মাজারে আমরা তামুক টামুক খামু না। এশার নামাজের আগে গান বাজনা করুম না। আর ভেড়া লইয়া যামু। বাজান কইছেন, ভেড়া পাক জন্তু। তরা জখম টখম সারাইয়া ল।

কালাম বলেই বসলো,

অরা অনেক, আমরা মাত্র সাতজন।

আলি কেনান ধমক দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দিলো।

শালা চোরা, তর দিলে ইমানের তেজ নাই। বাবা মঈনুদ্দিন একলা আইসা তামাম হিন্দুস্তানে ইসলাম জারী করছে। ইমানের বলে অসাধ্য সাধন করা যায়। তারপরে আর কারো কিছু বলার থাকে না।

ফজল আর মুন্নাফ গাবতলির হাটে গিয়ে দুধের মতো সাদা ধবধবে একজোড়া ভেড়ার বাচ্চা কিনে আনে। আলি কেনান নিজে দাঁড়িয়ে তাদের গোসল করানো দেখলো। তারপর রোদে বেঁধে রেখে গা শুকিয়ে নেয়া হলো। লোমগুলো একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেলে দুটি গামলাতে রং গুলে একটাকে সামনের দিকে সবুজ এবং পেছনে লাল রং লাগানো হলো। আর অন্যটাকে পেছনের দিকে নীল এবং সামনের দিকে হলদু রং মাখিয়ে দেয়া হলো। গলায় চামড়ার বেল্ট পরিয়ে ঘণ্টি লাগানো হলো। চার পাঁচদিন ধরে শিষ্যরা শিকল ধরে শহরের রাস্তায় ভেড়ার বাচ্চাদের হাঁটা চলার টেনিং দিলো।

শুক্রবার দিন ঠিক জুমার নামাজের পূর্ব মুহূর্তটিতে আলি কেনানেরা সদলবলে নিমবাগানের খোরাসানি বাবার মাজারে এসে হাজির হলো। কোনোরকম বিলম্ব না করেই সকলে নামাজের কাতারে দাঁড়িয়ে যায়। কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে তাদের দিকে তাকায়। দুয়েকজনের অনুতাপও হয়। তারা গত শুক্রবারে এই ফকিরদের গায়েই হামলা করেছে। কার দিলের ভেতর কি আছে সেতো আল্লাহ জানেন। পারতপক্ষে কেউ বিকেকের কাছে দায়ী হতে চায় না। সুতরাং নামাজ শেষে যে যার মতো ঘরে চলে গেলো।

আলি কেনানেরা মসজিদে প্রবেশ করার সময় ভেড়ার বাচ্চা দুটোকে মাজারের সামনে শ্বেত করবী গাছের সঙ্গে বেঁধে গিয়েছিলো। গত শুক্রবারেও তারা কুকুরটিকে এই নিমবাগানের মাজারেই রেখে গিয়েছিলো। বেচারী আহত কুকুর সেই থেকে এখানেই পড়ে আছে। কুকুরসুলভ ঘ্রাণশক্তি দিয়ে বোধ করি বুঝতে পেরেছিলো, আলি কেনানের অন্ন আর তার ভাগ্যে নাই। ভেড়ার বাচ্চা দুটো দেখে কুকুরের প্রতিশোধ স্পৃহা জাগ্রত হওয়া একটুও অস্বাভাবিক নয়। তাই হা করে ভেড়ার বাচ্চা দুটোকে কামরাতে ছুটে আসে। রং করা ভেড়ার বাচ্চা দুটো প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চীৎকার করতে থাকে। ভাগ্যিস তখন নামাজ শেষ হয়ে গিয়েছিলো। নইলে আজকে একটা অঘটন ঘটে যেতে পারতো।

খাদেম মাজারেই ছিলেন। আসলে তিনি আলি কেনানের কাজ কর্মের ওপর নজর রাখছিলেন। তিনি অসম্ভব রকম ক্ষেপে গিয়ে আলি কেনানকে বললেন, অ মিয়া তোমার মনে কি আছে কওতো দেহি? একবার আস কুত্তা লইয়া, একবার আস ভেড়া লইয়া। মাইর খাইয়াও তোমার শিক্ষা অইলো না? মাজারটারে নাপাক না কইর‍্যা ছারবানা দেখছি। তোমার মতি গতি ত সুবিধার নয়।

আলি কেনান এটাই চেয়েছিলো। সে খাদেমকে বলে,

তোর কথা শেষ অইছে?

খাদেম বললেন,

এইখান থেইক্যা কাইট্যা পড়। আর কুনু দিনই এইমুখি আইবানা। আইলে পিডের ছাল থাকতনা। আলি কেনান তার আপন স্বরূপ প্রকাশ করলো।

খানকির পোলা, তর বড় বাড় অইছে। আর বাড়তে দিমুনা। বাবা বু আলি কলন্দর আমারে খোয়বে আইস্যা কইয়া গেছেন খোরাসানি বাবা বু আলি কলন্দরের মুরিদ আছিলো। বাবায় কইছেন, তুই মাজার নাপাক কইর‍্যা ফেলবার লাগছস। তরে মাজার থেইক্যা তাড়াইয়া দিবার হুকুম দিছেন। কুত্তা আছিল নাপাক জন্তু, হের লাইগ্যা কুত্তারে তর কাছে রাইখ্যা গেছি। তুইও নাপাক, কুত্তাও নাপাক। এইবার ভেড়া লইয়া আইছি। ভেড়া পাক জন্তু আমাগো দ্বীনের নবী ভেড়ার গোশত খাইতেন।

খাদেমের মনে তখনও যথেষ্ট সাহস ছিলো। গত জুমার দিন তিনি নিজের চোখেইতো দেখেছেন আলি কেনানরা কেমন মারটা খেয়েছে। আশা করেছিলেন আজকেও তেমন একটা কিছু ঘটে যাবে। আর শরীরের উত্তেজনাও এসে গিয়েছিলো। তিনি বলেই বসলেন,

বেশী তেড়িমড়ি করলে জান খাইয়া লমু মিয়া, কাইট্যা পড়।

শুয়রের বাচ্চা, খানকির পোলা, গত শুক্কুরবারে কি করছস মনে আছে। অহনও গতরের দরদ ব্যথা যায় নাই। একক্ষণে এ্যাই মাজার থাইক্যা যদি বাইর অইয়া না যাস, খুন কইর‍্যা পুঁইত্যা রাখুম। সাত সাতজন মানুষ খাদেম সাহেবের দিকে তেড়ে এলো। খাদেম ডানে বামে সামনে পিছনে তাকিয়ে দেখেন, তিনি একেবারে একা। সাহায্য করার মতো কেউ নেই। তবু কণ্ঠের শেষ জোরটুকু প্রয়োগ করে বললেন,

অ মিয়া আগে ভাগে কইয়া রাখলাম, ভালা অইব না কিন্তু।

শাউরের পুত। তরে ভালা অহন দেহাইতাছি।

আলি কেনান খাদেমের কপালে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো। শিষ্যেরাও ছুটে আসে। খাদেম সাহেব কমজোর মানুষ। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাকে ধরাশায়ী করে ফেলতে তাদের কোনো অসুবিধে হলো না। নিমবাগানের কিছু কিছু কৌতূহলী মানুষ চারপাশে জড়ো হয়ে মজা দেখে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জিগগেস করে,

কি হয়েছে, অমন করে মানুষটাকে মারছো কেনো?

আলি কেনান তার কণ্ঠস্বর এক কাঠি চড়িয়ে বলে,

না মাইর‍্যা পেয়ার করুম নাকি? আপনেরা এই হারামীরে চেনেন? হারামজাদা খুনি বজ্জাত। ব্যাটা ডাকাইত, মাজারটারে পচাইয়া ফেলাইল। জানেন অর নামে থানায় দশটা মামলা আছে? তার শিষ্যদের নির্দেশ দিলো,

এই নাপাক জন্তুটারে ব্যাবাকডিতে বাইরে থুইয়া আয়। শাউরের পুত মনে থাকে য্যান, মাজারে আবার যদি দেখি জান খাইয়া ফেলামু। যথেষ্ট মানুষ জমা হয়েছিলো। ইচ্ছে করলে খাদেম আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারতেন। আলি কেনানরা তাকে মেরেছে, খুনি বলেছে, ডাকাত বলেছে, বলেছে থানায় মামলা আছে। তিনি কেনো চুপ করে থাকলেন, তিনিই বলতে পারেন। তাঁকে নিরুত্তর দেখে লোকজনও এগিয়ে এলো না। কেউ কেউ মনে করলো, হয়তো লোকটার অতীত খুবই খারাপ। গর্হিত কোনো কাজ করে মাজারে ছদ্মবেশে আশ্রয় নিয়েছে। খাদেমকে তাড়ানোর পর আলি কেনানের দলবল মাজারে প্রবেশ করে আল্লাহ আল্লাহ শব্দে জিকির করতে থাকে। নিম বাগানের কিছু কিছু মানুষ মনে করলো, তাদের মহল্লার মাজারটির নিশ্চয়ই কিছু আছে। নইলে পাগল দরবেশের দল কি আর শুধোশুধি জিকির করতে আসে। আলি কেনানেরা চীকার করে জিকির করতে করতে মুখে ফেনা তোলে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর লাইলাহাইল্লাল্লাহ শব্দে দ্বিতীয় দফা জিকির আরম্ভ করে। জিকির শেষ করে আলি কেনান শিষ্যদের সামনে সিনা টান করে দাঁড়িয়ে বললো,

তগোরে কইছিলাম না, বাবায় কখনো মিছা খোয়াব দেহায় না। অহন ত তরা চউকের সামনে পরমান পাইয়া গেলি। এই জানোয়াররে আমরা বাইর কইরা দিছি। অহন মাজার আমাগো।

আলি কেনানের অট্টহাসি আসতে চায়। আল্লাহ যা করে ভালার লাইগ্যা করে। হেইদিন হেই কাণ্ড না ঘটলে, আইজকার ঘটনা ঘটত না। মাজার আলি কেনানদের দখলে চলে এলো।

আলি কেনান চরের মানুষ। কোনো জিনিস দখল করলে কি করে রক্ষা করতে হয় তা সে ভালোভাবেই জানে। সে শিষ্যদের মধ্যে তিনজনকে সার্বক্ষণিকভাবে নিমবাগানের মাজারে মোতায়েন রাখলো। সেও প্রায় প্রতিদিন বেলা দশটার সময় রিকশায় চেপে ফুলতলি থেকে এখানে এসে হাজির হয়। প্রথম চার পাঁচদিন তারা আশেপাশের লোকজনকে জানিয়ে দিলো :

আগে যে মানুষটি এই মাজারে থাকতো সে একটা খুনি ডাকাত। থানায় তার নামে দশ বারোটা খুনের মামলা আছে। জনমত তো সবসময় হাওয়ার অনুকূলে চলে। তারা ধরে নিলো ব্যাপারটা সত্য হতেও পারে। কেউ কেউ অবাক হয়ে চিন্তা করলো, এতদিন এই খাদেম লোকটা তাদের বোকা বানিয়ে গেছে। আল্লাহর দুনিয়াতে কতো রকমের যে ভেল্কিবাজ আছে।

আলি কেনান বসে থাকার মানুষ নয়। ইতিমধ্যে সে নিমবাগানের ওয়ার্ড কমিশনারের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে ফেলেছে। এলাকার আরো কিছু প্রভাবশালী মানুষের সঙ্গে তার জানপাহচান হয়ে গেছে। কিছু বখাঠে এবং বেকার যুবক কিশোরও তার সঙ্গে জুটে গেলো। আলি কেনান ছোঁড়াদের কানে মন্ত্র দিয়েছে। আগামী পাঁচই রজ্জব মাঘ মাসের তেইশ তারিখে খোরাসানি বাবার মাজারে ওরশ করতে হবে। ছোঁকড়ারা গিয়ে কমিশনারকে ধরেছে। আমরা মাঘ মাসের তেইশ তারিখ খোরাসানি বাবার মাজারে ওরশ পালন করবো। আপনাকে আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে।

কমিশনার সাহেবের ছোঁকড়াদের সঙ্গে থাকতে কোনো আপত্তি ছিলো না। কিন্তু ভয় পাচ্ছিলেন ছোঁড়ারা তাঁর কাছে একটা গরু কিংবা খাসীর দাম দাবী করে বসবে। এই আশঙ্কায় তিনি উশখুশ করছিলেন। তিনি আপত্তি করে বললেন,

হঠাৎ করে ওরশ কি ব্যাপার? ছোঁকড়াদের একজন বলে বসলো,

কোনোদিন ওরশ হয়নি বলে এবার ওরশ হবে না, তার কোনো অর্থ থাকতে পারে না। আপনি এটা কি কথা কইলেন, আপনি কোনো দিনতো কমিশনার হননি। এইবার হয়েছেনে। সত্য কিনা কন? বলে রাখলাম, আমরা এবার ওরশ করবো, আপনাকে পেছনে থাকতে হবে।

কমিশনার বুঝে গেলেন, তিনি রাজী না হলেও ওরা ওরশ করে ফেলবে। তাই কথা ফিরিয়ে নিয়ে বললেন,

না না আমি সে কথা বলিনি। তবে এখন টাকা পয়সার খুব টানাটানি চলছে কিনা, তোমরা যদি টাকা পয়সা দাবী করে বসো আমার দেবার ক্ষমতা নেই। ছোঁড়ারা বললো,

আপনাকে টাকা পয়সা দিতে হবে না। আপনি শুধু পেছনে থাকবেন। আমরা রাস্তায় গাড়ি আটকে টাকা উঠাবো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল তুলবো। বাজারের মহাজনদের কাছে যাবো। এরকম একটি সুন্দর প্রস্তাবে কমিশনারের আপত্তি থাকার কোনো কারণ রইলো না।

আলি কেনানের শিষ্য এবং নিমবাগানের ছোঁকড়ারা বাহুতে মাথায় লাল সালুর ফেট্টি বেঁধে রাস্তায় নেমে পড়লো। প্রতিটি বাস, প্রাইভেট কার থামিয়ে দাবি করতে থাকলো,

খোরাসানি বাবার ওরশ, চাঁদা দিন। কতো টাকা কতো জায়গায় খরচ করেন, দিন আল্লাহর নামে দশ বিশ টাকা দিয়ে যান। গাড়িওয়ালাদের মধ্যেও ঘাউরা লোক কম ছিলো না। তারা অনুরোধ কানে তুললো না। অনেকে দশ পনের টাকার বদলে গাড়িটা অক্ষত ফেরত নিয়ে যেতে পারছে ভেবে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলো। আরেক দল বস্তা কাঁধে নিমবাগানের বাড়ি বাড়িতে ধরনা দিতে থাকলো। আগামী তেইশে মাঘ খোরাসানি বাবার মাজারে ওরশ। সুতরাং চাল দেন, টাকা দেন, যে যা পারেন দেন। একেবারে না করবেন না। আল্লাহ বেজার হবে। টাকা পয়সা চাল এসব মন্দ উঠলো না। কিন্তু তার একাংশ দেশী মদ এবং ব্লু ফিল্ম-এর পেছনে হাওয়া হয়ে গেলো। তারপরেও দু-দুটো গরু তারা কিনতে পারলো। বাজারের মহাজনদের কাছে গিয়ে তেল, মশলা, ডাল এবং অন্যান্য জিনিসপত্তর খুব অনায়াসে জোগাড় করে ফেললো। ব্যবসায়ীরাতে ধর্মকাজে টাকা পয়সা দিতে কৃপণতা করে না।

দেখতে দেখতে আঠারোই মাঘ এসে গেলো। সেদিন সকাল থেকে কাজের অন্ত নেই। নতুন লালসালু দিয়ে মাজার সাজানো হচ্ছে, শামিয়ানা টানানো হচ্ছে। প্রাঙ্গণের ঝোঁপ জঙ্গল পরিষ্কার করা হচ্ছে। এতে কাজ করার মানুষ কোত্থেকে এলো কেউ বলতে পারে না। কোরান খতম হচ্ছে, দরুদ পাঠের শব্দ ভেসে আসছে। জোহরের নামাজের পর গরু দুটো জবাই করা হলো। ভিখিরি এবং নগর কাকের চীকারে কান পাতা দায় হয়ে পড়লো। আছরের নামাজের অন্তে খোশবাগ শাহী মসজিদ এবং বায়তুল তুমাম মসজিদের ইমাম সাহেব দুজন এসে মিলাদ পড়ালেন। তারা আল্লাহর মহিমা, নবীর তারিফ বয়ান করার পর কবরে শায়িত মহাপুরুষের রুহের শান্তি কামনা করে মোনাজাত করলেন। মহাপুরুষের দয়ার অছিলায় দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান নর নারীর গুনাহ মাফের আরজ করলেন।

নিমবাগানের চিন্তাশীল মানুষেরা ভেবে দেখলেন ওই মাজারটির নিশ্চয়ই কোনো অলৌকিক মহিমা আছে। নইলে জামানার বুজুর্গ এই সমস্ত বিশিষ্ট আলেম এখানে ফাতেহা পাঠ করতে আসবেন কেনো? অনেকের মন থেকে সন্দেহের শেষ বাম্পটুকুও দূর হয়ে গেলো। মাগরিবের নামাজের পর খাওয়াদাওয়া শুরু। মাত্র দুটো গরু জবাই হয়েছে। অন্যান্য বড়ো বড়ো ওরশের তুলনায় এটা কোনো ব্যাপারই নয়। দীন আয়োজনই বলতে হবে। তবে বড়ো কাজের সূচনা দীনভাবে হওয়াই ভালো। এ বছর দুটো গরু জবাই হয়েছে। তার পরের বছর বিশটা। এমনি ভাবে বাড়তেই থাকবে। ওরশ যতো জমকালো হবে, বাবার মহিমাও ততো ছড়িয়ে পড়বে।

এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি সবাই এসেছিলেন। ভিখিরি যারা এসেছিলো ভর পেট খেতে পেরেছে। তারপরেও বেশ কিছু ভাত এবং মাংস ডেকচির তলায় ছিলো। সেগুলো মাটির সানকিতে করে স্থানীয় সম্ভান্ত লোকদের বাড়িতে বিলি বণ্টন করা হলো। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকলে এশার নামাজের পর শুরু হলো গান। আলি কেনানের দলটি তো ছিলোই। তাছাড়াও বাইরের একটি কাওয়ালির দল আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলো। রাত ভর গান বাজনা চললো। ছোট্টো একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া তেমন খারাপ কিছু ঘটেনি। সেটা হলো : নিমতলির দুদল ছোকরার মধ্যে চাঁদার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে প্রথমে তর্কাতর্কি তারপর হাতাহাতি। বয়স্করা এগিয়ে এসে মিটমাট করে না দিলে খুনোখুনি পর্যন্ত গড়াতে পারতো। নিমবাগান এলাকায় আলি কেনানের খুব সুনাম ছড়িয়ে পড়লো। বলতে গেলে আলি কেনানের চেষ্টার পরই খোরাসানি বাবার নাম প্রচার হয়েছে। পুরোনো খাদেমটির কথা ভুলে যেতেও মানুষের সময়ের প্রয়োজন হলো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *