পরিচ্ছেদ – চার : গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারী ও তাদের কার্য প্রণালী
গুণিনদের জীবনের বিভিন্ন দিকের যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে মোট ৪৬২ জন ব্যক্তিকে বিশেষভাবে পরীক্ষা করে। গুনিণদের বিশেষত্বকে (specialisation) ভিত্তি করে তাদের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। গুণিনদের অভিজ্ঞতা, সাধারণ মানুষের নানান রোগব্যাধি ও সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে তাদের পারদর্শীতা এবং তাদের আঞ্চলিক সুখ্যাতির কারণ অনুসন্ধান ও সেগুলির যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ করে গুণিনদের বিশেষত্বের যে সারণি প্রস্তুত করা হয়েছে তা নীচে দেখান হল।
সারণি সাত
গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারীদের বিশেষত্বের শ্রেণীবিভাগ
ক্রমিক সংখ্যা – প্রকৃতি – ব্যক্তির মোট সংখ্যা
১) ভবিষ্যত কথন ও অনুসন্ধান ……… ৫২
২) অশুভশক্তির অপসারণ ও প্রতিরোধ………… ৪১
৩) সৌভাগ্য অর্জন ……. ২০
৪) ভূত প্রেত ও দুরাত্মার বিতাড়ন ……… ৯৯
৫) সাপ, বিছে, পোকামাকড় ও জীবজন্তুর কামড়ের প্রতিকার …. ১৭৩
৬) রোগ নিরাময় ……… ৬
৭) দীর্ঘ মেয়াদী রোগ নিরাময় ……… ৭
৮) হাড় ভাঙা হাড়ে চোট নিরাময় ….. ১
৯) প্রসব বেদনার উপশম ও প্রসূতির বিপদমুক্তি ……… ২
১০) জন্মনিয়ন্ত্রণ ও গর্ভপাত…….. ২
১১) মায়েদের ও গৃহপালিত পশুর দুধের পরিমান বৃদ্ধি ….. ১৬
১২) পশুরোগ নিরাময় ও হারানো পশুর সন্ধান ………. ৯
১৩) শত্রু নিধন ………. ৮
১৪) অস্থিরতা সৃষ্টি করা ও পঙ্গু করে দেওয়া ……… ৬
১৫) নতি বা বশ্যতা স্বীকার করান….. ২০
মোট …….. ………………….. ৪৬২
সারণিতে উল্লিখিত কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে গুণিনদের গুপ্ত বিদ্যাচর্চার পেশাদারি দক্ষতার পরিচয় বিশেষভাবেই পাওয়া গেছে; কিন্তু এগুলি ছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রেই গুণিনরা যে নানান জটিল সমস্যার সমাধানে ও দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ে যথেষ্ট সক্ষম, তাও নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ্য করার অবকাশ মিলেছে। আবার এরকমও কিছু কিছু গুণিন আছে যারা শুধু কুখ্যাতি অর্জন করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুপ্ত ক্রিয়ার প্রয়োগে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গাঁয়ের সমস্ত লোকের কাছে উপহাসের পাত্র হয়েছে। এককোণে মুখ লুকিয়ে বাস করছে বছরের পর বছর। এও দেখা গেছে যে, একজন গুণিন এক বছরে ১০৫ জন বিভিন্ন রোগের রুগীকে সারিয়ে তুলে সর্বোচ্চ কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছে। তবে বছরে রুগী দেখার গড় হিসেব দেখতে গেলে বারো থেকে চোদ্দ জন মেয়ে পুরুষের চিকিৎসা এক এক জন গুণিন করে থাকে, এবং গুণিনের অধীন যারা শিক্ষাণবিশ তারা বছরে দু তিনটির বেশী রুগী দেখার সুযোগ পায় না। এ প্রসঙ্গে সুতাহাটা পুলিশ থানার অধীন কৃষ্ণনগরের নিশিকান্ত মাইতির কথা না বললেই নয়। এ অঞ্চলে তার নাম জানে না এমন লোক নেই বললেই চলে। নিশিকান্ত এখন ৬৬ বছরের জ্ঞানবৃদ্ধ এক গুণিন। দীর্ঘদিন ধরে গুণিনের পেশায় থেকে সে অসম্ভব রকমের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। তার কর্মক্ষেত্র বলতে বোঝায় গুপ্ত চিকিৎসা ক্ষেত্র; যা নাকি বছরের পর বছর সমানেই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে। তার চিকিৎসার ধারা দু’চারটি বিশেষ কর্মকাণ্ডের মধ্যেই যে সীমাবদ্ধ থেকেছে তা নয়; লোকায়ত বা প্রচলিত গুপ্তবিদ্যার প্রায় সমস্ত দিকেই নিশিকান্ত সমান পারদর্শী বলে খ্যাত। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যেতে পারে যে, ভবিষ্যদ্বাণী ও গণনার মাধ্যমে সে যে কোন দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয়, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধাচরণ ও বিতাড়ন, সাধারণ জ্বরজারি ও দীর্ঘমেয়াদী রোগ নিরাময়, প্রসব বেদনার উপশম, নিরুদ্বিগ্নে সন্তান প্রসব ও প্রসূতির জীবনের নিরাপত্তা, গর্ভপাত, জন্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ইত্যাদি জটিল বিষয়ের ক্ষেত্রে নিশিকান্তের মন্ত্রশক্তির প্রয়োগ ও সার্থকতার পরিচয় সত্যিই বিস্ময়কর। তবে তার দক্ষতা ও পারদর্শিতার সব থেকে বেশী পরিচয় মেলে ভেষজবিদ্যায়; এবং এদিক থেকে তাকে একজন ভেষজবিদ বলে অভিহিত করলে বোধহয় খুব একটা ভুল হয় না।
এসব অঞ্চলে জ্বর, চোখের অসুখ, পেটের গোলমাল ইত্যাদিতেই বাচ্চারা বেশী ভোগে। এই সমস্ত অসুখের মূলে কোন না কোন ভ্রাম্যমান বিদেহী আত্মাই যে সক্রিয়, লোকেদের মনে সে বিশ্বাসের অন্ত নেই। সেই জন্যে বাচ্চা বুড়ো বা যে কোন বয়সের মেয়ে পুরুষের মধ্যে এইসব অসুখের আঁচ পাওয়া মাত্র গুণিনের ডাক পড়ে। গুণিন বড় বড় চোখ করে রোগীকে একবার দেখে নিয়েই গণনা শুরু করে দেয় কিছু কিছু উপাদানের সাহায্যে ফলে রোগের কারণ জানতেও খুব বেশী দেরী হয় না। তবে গুণিন গণৎকার কী জানল না জানল সে প্রশ্ন রোগীর আত্মীয় পরিজন কেউই করে না, আর তা করতেও নেই! গুণিনের চিকিৎসা শাস্ত্রের বিধান অনুসারে। গুণিন কাউকে কিছু না বলে নুনপড়া কিম্বা জলপড়া তৈরী করে রোগীকে খাইয়ে দিয়ে যায়, যে কোন একটা খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশিয়ে। সূতাহাটায় আর একজন গুণিনের নামও প্রায় লোকের মুখে মুখে ফেরে সে হল চৈতন্যপুরের শ্রী হৃষিকেশ দাস। বিষাক্ত পোকামাকড় সাপ বিছে ইত্যাদির কামড় খাওয়া রোগীর দেহ থেকে বিষ ঝাড়ার রোজা। আবার যে কোন রকম দাঁতের ব্যথা সারানোর কাজে ঐ গুণিন বোধহয় বড় মাপের দন্ত চিকিৎসককেও হার মানাতে পারে।
এরকম আরো অনেক গুণিনই আছে যারা বছরে প্রায় জনা পঞ্চাশ রোগীর দৈহিক ও মানসিক রোগের চিকিৎসা করে সাফল্য অর্জন করার ক্ষমতা ধরে। সাঁওতালদের মধ্যে প্রফুল্লকুমার মাঝিও হল খুব নামজাদা এক ওঝা। অপদেবতায় ভর করা রোগীদের ভয়ানক ভয়ানক উপসর্গ উপশম ও নিরাময়ে ফুল্পের সমকক্ষ কেউ নেই। দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে ঝাড়ফুঁকের কাজে মাঝি মনপ্রাণ দিয়ে লেগে আছে এবং তার বয়স এখন ৬৫-র মত হবে। সামান্য এক টুকরো কাঁচ না হয় নিজের হাতের বুড়ো আঙুলের নখের ওপর নিথর দৃষ্টি রেখে ভূত প্রেত বা যে কোন রকম অশুভ শক্তির উপস্থিতি সে বুঝতে পারে। ডাইনী অনুসন্ধানকারীর মত অপদেবতার অবস্থান খুঁজে বার করতে পারে মন্ত্রের জোরে। ভূত তাড়াতেও সে এক নম্বর ওস্তাদ। ভগবানপুর থানার অধীন বাঁশকাজলপাই এর হরিচরণ মণ্ডল নামে এক তাঁতি মস্তুতন্ত্রের সাহায্যে পশু চিকিৎসায় যথেষ্ট নাম করেছে। যে সমস্ত দুষ্ট শক্তি ঘরের গাই গরুকে ভর করে দুধ টেনে নেয় এবং গরুকে শুকিয়ে মেরে ফেলে, সেই সমস্ত অশুভ শক্তিকে সরিয়ে দিতে হরিচরণ অদ্বিতীয়। কাজলপাই গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত হরিচরণকে ঘুরে বেড়াতে হয় পশু চিকিৎসার গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। গরু ছাগলের যে কোন রোগ সে সারিয়ে দেয় শেকড় বাকড় খাইয়ে। এক বছরে প্রায় গোটা কুড়ি গৃহপালিত জীবজন্তুকে কঠিন রোগ থেকে মুক্ত করেছে হরিচরণ। পিংলা পুলিশ থানার অন্তর্গত ধনেশ্বরপুরের এক নামকরা যাদুকর হল পূর্ণ সেনাপতি। মাঝি সম্প্রদায়ের এক অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন গুণিন বলেই সে খ্যাত। বিষ ঝাড়া ও অপদেবতায় পাওয়া রোগীর চিকিৎসাতেই সে নাম করেছে। এক টানা ৪৫ বছর ধরে সে যে কত রোগীর চিকিৎসা করেছে যাদুমন্ত্র প্রয়োগ করে তার ইয়ত্তা নেই। এখন সত্তরের কোঠায় পৌঁছলেও–সে সম্পূর্ণ সুস্থ ও সবল। আর দিনের পর দিন মাঝি সমাজের সেবা করে চলেছে নিরলসভাবে। এখনো তার ক্লান্তি বলে কিছু নেই।
সাঁওতাল গোষ্ঠীর আর এক নামজাদা গুণিন হল ৬৬ বছরের বৃদ্ধ কিসান মুরমু। সবং থানার অধীনে লুটুনিয়ায় তার ঘর। ডানে খাওয়া, ভূতে পাওয়া ও সাপে কাটা রোগীকে সুস্থ করায় কিসান সিদ্ধ হস্ত। তারই মত আর একজন হল প্রহ্লাদ মাহাতো। তার নিবাস ঝাড়গ্রাম থানার অন্তর্গত পিয়ারকাটা গ্রামে। বয়েস বছর ৪৫ হবে। বছর ২৭ থেকে সে আছে গুণিনের পেশায়। সাপ খোপ, পোকা মাকড় ইত্যাদির বিষ ঝাড়া বাদেও জন্তু জানোয়ারের কামড়ে যে কোন রকমের বিষাক্ত ক্ষত যারই হোক না কেন, প্রহ্লাদের চিকিৎসায় তা নির্মূল হতে বেশী দেরী লাগে না। আবার কোন মায়ের বুকের দুধ যদি কোন অশুভ দৃষ্টির ফলে শুকিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তা একদিনের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে প্রহ্লাদের মন্ত্রশক্তি অব্যর্থ বললেই চলে।
বিভিন্ন বর্ণ ও সম্প্রদায়ভুক্ত গুণিনদের বিশেষ বিশেষ দিকের ক্ষমতা, দক্ষতা নির্ণয় করার প্রয়াসেই আট নম্বর সারণি প্রস্তুত করা হয়েছে।
সারণি আট
বিভিন্ন বর্ণ ও সম্প্রদায়ভুক্ত গুণিনের কর্মদক্ষতা
যে সমস্ত গুণিনদের নিয়ে পরীক্ষার কাজ চালানো হয়েছে তারা কিন্তু সবাই পুরুষ। এ অঞ্চলে মেয়ে গুণিনের সংখ্যা খুবই কম, তবে যে সব মেয়েরা গুণিনের পেশায় আসে তারা সব ডাইন (dain) বলে পরিচিত হয়। অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, গুপ্তবিদ্যাচর্চায় ক্রিয়াকর্ম আচার বিচার ইত্যাদির প্রকৃতি বা ধরণ এতই কঠিন যে, মেয়েদের পক্ষে এই পেশা গ্রহণ করা সম্ভব হলেও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা প্রায় একেবারেই অসম্ভব। সাধারণভাবে তাই গুণিনের কাজে মেয়েদের প্রবেশ করার অনুমতি সমাজ দিতে চায় না। এখন বর্ণ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে গুণিনদের বয়সের হিসেব দেওয়া হল নীচের ৯ নম্বর সারণিতে।
সারনি নয়
গুণিনের বয়স
বর্ণ সম্প্রদায় | ২৪-৪০ বছর | ৪১-৬০ বছর | ৬১-৮০ বছর | ৮০-১০০ বছর | ১০১ বছর | মোট |
সকল বর্ণ ও সম্প্রদায় | ১২৮ | ২৩৮ | ৮৫ | ৯ | ২ | ৪৬২ |
.
শিক্ষা
উপযুক্ত গুরুর অধীনে থেকেই গুণিনের পেশা সংক্রান্ত যাবতীয় শিক্ষা নিতে হয়। সময় সময় একজন গুরুর অধীনে দুচার জন শিক্ষণবিশ একত্রে শিক্ষা গ্রহণ করে। যারা ভালোভাবে শিক্ষা নিতে চায় তারা যেকোন অঞ্চলের নামজাদা গুরুকে বেছে নিয়ে গুরুগৃহে উপস্থিত হয়, যে কোন শনি বা মঙ্গলবার সূর্যাস্তের পর। গুরুর চরণ দুহাতে স্পর্শ করে শিষ্যত্ব গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে। তারপর একটা নতুন লালপেড়ে কোরা ধুতি গুরুকে প্রণামী দিয়ে শিষত্ব লাভের অধিকার পায়। পরের দিন থেকেই গুণিন গৃহে শিক্ষণবিশের পাঠ শুরু হয়ে যায়। গুরু যতদিন পর্যন্ত শিষ্যের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে বলে মনে না করে ততদিন পর্যন্ত এক নাগাড়ে শিক্ষা চলতে থাকে দুচার বছর। শিক্ষা দেওয়া হয় সমস্ত রকম গোপনীয়তা অবলম্বন করে। গুপ্ত ক্রিয়াকর্মের নানান মন্ত্র গুরু উচ্চারণ করে যায় শিষ্যের চোখে চোখ রেখে। মন্ত্রগুলি গভীর মনোযোগ সহকারে শুনে নিয়ে যথাসাধ্য মুখস্ত বলে যেতে হয় শিষ্যকে গুরুর মুখপানে স্থির তাকিয়ে থেকে। তারপর কিছু কিছু গুপ্ত আচারের প্রয়োগ পদ্ধতি শিষ্যকে রপ্ত করতে হয় গুরুর নির্দেশনায়। এইভাবেই একজন শিক্ষানবিশ বছর কয়েক পর গুপ্তক্রিয়াকর্মে বিশেষজ্ঞ বা পারদর্শী বলে পরিচিত হয় এবং স্বাধীনভাবে গুণিনের পেশায় আত্মনিয়োগ করে।
কিন্তু গুরুগৃহে থাকার সময় কোন শিষ্যের পক্ষেই সমস্ত মস্তুতন্ত্র মনে রাখা সম্ভব হয় না, সেজন্যে জটিল মন্ত্রের অধিকাংশই খাতায় লিখে রাখতে হয় শিষ্যকে ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রেখে। তাছাড়া, গুপ্তক্রিয়াকর্মের বিচিত্র সব বিধি বিধানগুলোও হিসেব মত খাতায় সাজিয়ে রাখতে হয় গুরুর নির্দেশ মত। বিভিন্ন দেবদেবীর নাম, তাঁদের সন্তুষ্টি বিধানের ক্রিয়াকর্ম আচার বিচার উৎসর্গ, নৈবেদ্য ইত্যাদি বিষয়ের হিসেব অংকের মত নিখুঁতভাবে খাতায় কষে রাখার তালিমও শিষ্যকে নিতে হয়। অবশ্য, একজন সুদক্ষ গুণিন হয়ে উঠতে হলে প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ বছর গুপ্তবিদ্যাচর্চার শিক্ষা নেওয়া একান্তই প্রয়োজন, কখন কখন গুণিন তার শিষ্যকে নিজের সহযোগী করে নানারকমের রোগের রোগী দেখাতে নিয়ে যায় বিভিন্ন বাড়ীতে। তার ফলে গুপ্ত যাদুমন্ত্রের বাস্তব প্রয়োগ ও তার অভিপ্রেত ফলাফল বা গুণাগুণ সম্পর্কে শিষ্য যথেষ্ট পরিমাণে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ পায়, এবং ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে নামকরা গুণিন হওয়ার পথও যে তার প্রশস্ত হয় তা বলাই বাহুল্য।
গুণিনদের শিক্ষার মেয়াদ সম্পর্কেও বেশ কিছু তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। কিছু কিছু শিক্ষানবিশের সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। তারই মাধ্যমে জানা যায় যে, শিক্ষা চলাকালীন বিভিন্ন ধরণের রোগীকে পরীক্ষা করতে যেতে হয় শিক্ষার্থীদের নিয়মিতভাবে শিক্ষার আদর্শ বা নীতি হিসাবে। শিক্ষার্থীরা নিঃসংঙ্কোচে স্বীকার করে যে, গুপ্তবিদ্যায় যতদূর সম্ভব তারা পারদর্শী হতে চায়, এই পারদর্শিতা লাভের জন্যেই কম পক্ষে প্রায় বছর কুড়ি শিক্ষানবিশ হয়েই কাজ করতে হয়। গুণিনদের শিক্ষাগ্রহণের মেয়াদ দেখানোর জন্যে নীচে ছোট্ট একটি সারণি উপস্থিত করা হল, তবে শিক্ষানবিশদের মতে এর মধ্যে অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
সারণি দশ
শিক্ষার মেয়াদ
দুবছর | তিনবছর থেকে দশ বছর | এগার বছর থেকে কুড়ি বছর | একুশ বছর এবং তার বেশী | মোট |
সমস্ত গুণিন-৫৫ | ৩৬৭ | ৩৮ | ২ | ৪৬২ |
আগেই বলা হয়েছে যে, শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দ মত শিক্ষাগুরু বেছে নেয়; এবং সে গুরুগৃহ যতদূরেই হোক না কেন তাতে কিছু যায় আসে না। শিক্ষার্থী ঠিক সময়মত গিয়ে হাজির হয় গুরুগৃহে। পথের দূরত্ব তার কাছে কোন সমস্যাই নয়। বাছাই করা গুরুর কাছে গিয়ে গুপ্তবিদ্যার শিক্ষা নেওয়াটাই শিক্ষার্থীর কাছে সব থেকে বড় উদ্দেশ্য। লক্ষণীয় যে, গুরু শিষ্যের মধ্যে জাতপাতের কোন বাছবিচার নেই। যে কোন নিম্নবর্ণের গুরুর কাছে যে কোন উচ্চবর্ণের শিক্ষার্থী নিঃসঙ্কোচে গিয়ে উপস্থিত হতে পারে, শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং গুরু যেকোন জাতেরই হোক না কেন, তা নিয়ে ছাত্র মাথা ঘামায় না একটুও। তবে গুরুর প্রসিদ্ধি ও প্রতিষ্ঠা আছে কিনা ছাত্র শুধু সেই দিকটাই বিচার করে। আমরা তাই লক্ষ্য করেছি যে, ৪৬২ জন গুণিন হল ৩৪ রকমের জাত ও সম্প্রদায়ের মানুষ, এবং তাদের অধীনে শিক্ষানবিশি করতে এসেছে ৪৬টি বিভিন্ন জাতের উৎসাহী যুবক। আবার ব্রাহ্মণ গুণিনদের কাছে যেমন নিম্নবর্ণের মানুষ শিক্ষাগ্রহণ করে তেমনি নিম্নবর্ণের গুণিনের কাছেও ব্রাহ্মণ ছাত্র আসে গুপ্তবিদ্যার তালিম নিতে। তাই দেখা যাচ্ছে যে, গুপ্তবিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে জাতপাত সংক্রান্ত ভেদাভেদের কোন প্রশ্ন নেই। নীচের সারণিটি লক্ষ্য করলেই এ ব্যাপারে সব কিছু স্পষ্ট হয়ে যায়।
সারণি এগারো
বিভিন্ন বর্ণের শিক্ষাগুরু
শিষ্য সংখ্যা | ব্রাহ্মণ গুরু | মাহিষ্য গুরু | নমঃশূদ্র গুরু | হাড়ি গুরু | বৈষ্ণব গুরু | সাঁওতাল গুরু |
৩৪ | ২৪ | ৪ | ৩ | ১ | ১ | ১ |
এই সারণিটিতে দেখা যাচ্ছে যে, ৩৪ জনের মধ্যে ২৪ জন শিক্ষার্থী এসেছে ব্রাহ্মণ গুরুর কাছে। এছাড়া নিম্নবর্ণের মানুষ ও যে গুণিন বা গুরুগিরির পেশা নিয়ে থাকে তাও এখানে স্পষ্ট।
সমস্ত গুরুই কিন্তু একটা ব্যাপারে খুবই সতর্ক আর সেটা হল মন্ত্রগুপ্তির শপথ নেবার ব্যাপার। গুরুদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকে শিষ্যদের প্রতি; যাতে কোন ভাবে মন্ত্রগুপ্তির শপথ বাইরে বেরিয়ে না যায়। তাছাড়া, কঠিন নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে চলতে হয় শিক্ষার্থীদের। সময় সময় ছাত্রদের কৃচ্ছতা সাধনও করতে হয় যথেষ্ট পরিমাণে। গুরুর নির্দেশ অনুসারে বিভিন্ন দেবদেবীর পুজো পাঠের ব্যবস্থাও করতে হয় শিষ্যদের। দেবদেবীর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে নানারকমের ক্রিয়াকর্মের পালন করে যেতে হয় গুরুগৃহে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে। শিক্ষাথীমাত্রেই গুরুগৃহে পরিবারের একজন বলে গণ্য হয়ে থাকে এবং যাবতীয় গুপ্ত আচার অনুষ্ঠানে পরিবারের সকলেই সমানভাবে যোগদান করে শিক্ষার্থীদের প্রেরণা জুগিয়ে থাকে। গুরু তার শিষ্যদের সময় বুঝে একদিন জানিয়ে দেয় যে, বিভিন্ন দেবদেবী ও পৌরাণিক বীরদের (Veer) আশীর্বাদ ও করুণা লাভে সে সক্ষম হয়েছে, সেজন্যে এক বিশেষ অনুষ্ঠান শিষ্যকে নিজের হাতে সম্পন্ন করতে হবে। এই অনুষ্ঠান উত্তরণ (Urana) নামে এ অঞ্চলে পরিচিত। এই নামের অর্থ হল যে, গুপ্তকলাবিদ্যার উর্বস্তরে শিষ্যের উত্থান ঘটেছে সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। অনুষ্ঠানের দিনে গুরু শিষ্যকে পেট ভরে খাইয়ে দেয় হাতে করে। গুরুদক্ষিণা হিসেবে একটা নতুন ধুতি গেঞ্জি বা জামা আর সামান্য কটা টাকা দিয়ে গুরু চরণে প্রণাম করে। এরপর থেকে ঐ শিষ্য গুপ্তকলা বিদ্যায় একজন অভিজ্ঞ পেশাদারী গুণিন হিসেবে স্বাধীন ব্যবসা, শুরু করতে পারে যে কোন অঞ্চলে। তবে মাঝে মাঝে গুরুর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে হয়। জটিল ক্রিয়াকর্ম ও মন্ত্র তন্ত্র প্রয়োগের কূট কৌশল জানার জন্যেও মাঝে মাঝে গুরুর দ্বারস্থ হয়ে উপায় থাকে না। এইভাবে গুরু শিষ্য উভয়ে উভয়ের সম্পর্ক ও স্বার্থসিদ্ধির পথ প্রশস্ত রাখে।
.
বাধা নিষেধের গণ্ডী
গুপ্তবিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে প্রত্যেক গুণিনকেই নানারকমের বাধা নিষেধের (taboos and restrictions) গন্ডী বিশেষ ভাবে মেনে চলতে হয়। বলা যায় যে, গুপ্তকলাচর্চার প্রথানুযায়ী বাধা নিষেধের দিকটাই হল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক। কারো কোন দুর্ঘটনার সংবাদ কানে আসা মাত্র জামা জুতো পরে পথে বেরিয়ে পড়া গুণিনের ক্ষেত্রে একেবারেই নিষিদ্ধ। অপেক্ষা করতে হয় যাত্রার শুভ লগ্নের জন্যে বেশ কিছু সময়। যাত্রার মুখে কয়েকটা জিনিষ গুণিনের চোখে ভয়ঙ্কর অযাত্রা ও অমঙ্গল সূচক। প্রত্যেক গুণিনই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, নিষিদ্ধ জিনিসের কোন একটিও যদি শুভ কাজে যাবার আগে চোখে পড়ে যায় তাহলে তা অমঙ্গল ডেকে আনবে। গুণিনের গোনাগাঁথা ফলপ্রসূ হবে না। অশুভ জিনিসগুলো হল :
(১) যে কোন শূন্য পাত্র।
(২) হাঁচি ও টিকটিকির টকটক শব্দ।
(৩) রোগীর জন্মদিনে সেই রোগীকে দেখতে যাওয়া বারণ।
এগুলো বাদেও, কোন দেবদেবীকে আহ্বান করার সংকল্প স্থির করলে আগের দিন কোন কিছু আহার করা গুণিনের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ, অর্থাৎ, নিরঙ্কু উপবাস ও কঠোর সংযমের মধ্যে একদিন কাটাতে হয়। সংযমের সামান্যতম ত্রুটি হলে দেবতার আহ্বান নিষ্ফল হয় এবং কোন বিদেহী আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করাও সম্ভব হয় না। রহস্যচর্চার গুপ্তরীতি নীতি পালনের ক্ষেত্রে গুণিনের খেয়াল খুশীর কোন স্থান নেই; গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী যাবতীয় গুপ্ত প্রণালীর অনুশীলন ও প্রয়োগ কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেই করতে হয়। নিয়মের বাইরে কোন কিছু করা ভয়ঙ্কর ভাবে নিষিদ্ধ। গুপ্তক্রিয়াকর্মের প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রকাশ্যে আলোচনা যে কেবল নিষিদ্ধ তাই নয়, এ নিষেধাজ্ঞা কোনভাবে লঙ্ঘিত হলে গুণিনের পেশাগত জীবন হতাশায় পর্যবসিত হয়। হতাশা ছাড়া তার জীবনে আর কিছুই থাকে না। অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, গুপ্তবিদ্যা অনুশীলনকারী যখন গুপ্তক্রিয়া কৌশল সংক্রান্ত কোন সমস্যার সম্মুখিন হয় তখন সে একমাত্র তার শিক্ষাগুরুর কাছে গিয়েই শলাপরামর্শ করতে পারে, সে তার সমস্যা সমাধানের পথ বাতলে দেয়।
.
পারিশ্রমিক
সাধারণভাবে দেখা যায় যে, অধিকাংশ গুণিনই গুপ্তক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে দশের সেবা করার জন্যেই উদগ্রীব হয়ে থাকে। গুণিন তার সেবা কার্যের বিনিময়ে পারিশ্রমিক হিসেবে কোন অর্থ গ্রহণ করে না। প্রতিবেশীকে রোগব্যাধি দুঃখ দুর্দশা বিপদ আপদ থেকে মুক্ত করা এক পবিত্র কর্ম বলেই গুণিন মনে করে। গুণিন তাই শিষ্যকে দিয়ে শপথ করিয়ে নেয় যে, মানুষের উপকারার্থে মন্ত্রশক্তি প্রয়োগ করবে উপকারের বিনিময়ে সে কিছু প্রত্যাশা করবে না। এই রকম আদর্শ গুণিনের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করার জন্যেও কাউকে কোনরকম ভাবে অর্থ ব্যয় করতে হয় না। উপটৌকন দিতে হয় না। সামান্য দুএকটা পানপাতা ও গোটা কয়েক সুপুরি দিয়েই শিষ্যত্ব গ্রহণ করা যায়। কখন কখন হয়তো গুরুগৃহে গৃহদেবতার পুজায় যৎসামান্য অনুদান (token fee) হিসেবে দুকুড়ি এক পয়সা শিষ্যকে দিতে হয়। তবে কঠিন রোগ ভোগ, জ্বালা যন্ত্রণা ভূতে ভর করা, অপদেবতায় পাওয়া, ডানের চোখ লাগা, সাপে কাটা রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলার পারিশ্রমিক বাবদ গুণিনকে সামান্য কিছু অর্থ কিম্বা উপহার হিসেবে দুএকটা জিনিস দেবার প্রথা আছে বলে জানা যায়। সাপে কাটা মৃতপ্রায় রোগীকে বাঁচিয়ে তোলার জন্যে কোন কোন গুণিন বা রোজাকে প্রণামী হিসেবে পেতলের থালা বাটি ঘটি গাড় ইত্যাদি যে দান করা হয়েছে সে তথ্যও মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমরা পেয়ে থাকি।
মহিষাদলের রাজবংশী সম্প্রদায়ের গুণধর জানা একজন নামকরা গুণিন। পূর্বদক্ষিণ ময়না গ্রাম নিবাসী বিহারী মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি একদিন রাত্রি বেলা কারো এক পুকুরে চুরি করে মাছ মারতে গিয়ে বিষধর সাপের কামড় খায়। পুকুরের সংলগ্ন বাড়ীর দাওয়ায় এসে অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকে। তাকে ঐ অবস্থায় দেখতে পায় ঐ বাড়ীরই একজন। দেখেই সে ভয় পেয়ে যায়। চীৎকার করতে শুরু করে। আশে পাশের লোকজন বাতি হাতে ছুটে আসে। বিহারীর চোখমুখ একেবারেই নীল হয়ে যেতে শুরু করে। কাছে পিঠে যে কজন রোজা ছিল তারা যথাসাধ্য মন্ত্রশক্তির প্রয়োগ করতে থাকে। কিন্তু কারোর মন্ত্রে কোন কাজ হচ্ছে না দেখে ইন্দ্র নামে মস্ত এক গুণিনকে ডাকা হয়। সাপে কাটা রোগীর দেহ থেকে বিষ নামাতে ইন্দ্র নাকি গুণিনদের ইন্দ্র। কিন্তু ঘন্টা দুয়েক ধরে ঝেড়েও বিহারীর চোখ খোলাতে পারছে না। সে তখন ধরে নিল যে অন্য কোন রোজা এখানকার উপস্থিত লোকেদের মধ্যেই গা ঢাকা দিয়ে আছে আর সেইই তার অব্যর্থ মন্ত্রকে কেটে দিচ্ছে, ব্যর্থ করছে। ইন্দ্র তাই তাড়াতাড়ি তার গুরু মহিষাদলের গুণধর জানার কাছে একজনকে পাঠিয়ে দেয়, তাকে নিয়ে আসতে। শিষ্যের অসহায় অবস্থা শুনেই গুণধর তার বাগান থেকে ছোট্ট একটা গাছ উপড়ে নেয় এবং তার শেকড় সমান দুভাগ করে মুঠোয় নিয়েই তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করে বিহারীর বাড়ীর উদ্দেশ্যে। রোগীর বাড়ীর কাছাকাছি যখন সে এসে পৌঁছয়, তখন হঠাৎ এক পথচারীকে স্থির ভাবে একটু দাঁড়াতে বলে। তারপর ঐ পথচারীর দুকানে সেই শেকড় দুটো গুঁজে দিয়ে গুণধর তাকে জিজ্ঞেস করে যে, আকাশে সে কি দেখছে। পথচারী তার জবাবে বলে সূর্যের আলো নেই, অন্ধকার আকাশে রাশি রাশি তারা ফুটে আছে। গুণধর ভারী খুশী। একেবারে নিশ্চিন্ত। পথচারীর কান থেকে শেকড় খুলে নিয়ে ছুটতে ছুটতে গিয়ে হাজির হয় রোগীর কাছে। ঐ শেকড় শিল নোড়ায় বেটে জলে গুলে রোগীকে খাইয়ে দেয় এবং ইন্দ্রকে মন্ত্র পড়তে বলে। কিছুক্ষণের মধ্যে রোগী সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতেই সবাই অবাক। ধন্য ধন্য করতে থাকে গুণিন গুণধরকে। কিন্তু গুণধরের মুখে একটু হাসি দেখা গেল না বরং তার চোখের চাউনি হঠাৎ যেন কঠিন হয়ে ওঠে। তারপর সে সকলের পানে একবার তাকিয়ে নিয়ে একে একে সবাইকে একটু দূরে সরে যেতে বলে; গোবিন্দ নামে এক ব্যক্তি ছুটে পালাতে গিয়েও এক পাও নড়তে পারল না। কারণ গুণধরের গুণ তাকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে কাবু করে দিয়েছে। গুণধর আবার সবাইকে ডেকে এনে গোবিন্দকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখতে বলে বিচারাধীন আসামী করে। কারণ গোবিন্দই হল আসল দোষী। ওর উদ্দেশ্য ছিল বিহারী মন্ডলকে হত্যা করা। ওই অন্যান্য গুণিনদের মন্ত্র কাটতে থাকে বলে বিহারীকে কেউই সুস্থ করতে পারছিল না। ইন্দ্রের মত গুণিনের মন্ত্রকেও ফলপ্রসূ হতে দেয়নি গোবিন্দ। সুতরাং ঐ পাষন্ডকে
রেহাই দেবার প্রশ্নই ওঠে না। গ্রামবাসীদের বিচারে কঠোর নির্যাতন তাকে ভোগ করতেই হবে। দুষ্ট গুণিনের শাস্তি না হলে মন্ত্রশক্তির অবমাননা করা হয়, এই কথা বলেই গুণধর প্রস্থান করে। তবে পারিশ্রমিক হিসেবে মস্তবড় একটা পেতলের থালা গ্রহণ করতে হয়েছিল স্বনামধন্য গুণধর গুণিনকে।
কিন্তু উপজাতি গোষ্ঠীর গুণিনরা তাদের পারিশ্রমিক হিসেবে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অর্থ গ্রহণও করে থাকে। রোগীর নিকট আত্মীয় পরিজনের কাছ থেকে।
.
যাদুচর্চা
সাধারণ মানুষের ধারণা হল যে, যাদু বা গুপ্তবিদ্যাচর্চায় কিছু লোক আসক্ত হয় দুটো বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের জন্যে। প্রথম উদ্দেশ্য হল, অদৃশ্য ও অজ্ঞাতশক্তিকে সন্তুষ্ট করা, আর দ্বিতীয় হল, গুপ্ত যাদু সংক্রান্ত ক্রিয়া-প্রক্রিয়া অনুশীলনের মাধ্যমে ইষ্ট ও অনিষ্ট সাধন করার ক্ষমতা অর্জন করা। বহু প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের গ্রামে গঞ্জে নানারকমের মন্ত্রতন্ত্র স্তোত্র ইত্যাদি পুরোদস্তুর ভাবে চলে আসছে। কিন্তু এই সব মন্ত্রতন্ত্র সৃষ্টি কারীদের নামধাম আমাদের কাছে অজ্ঞাত বললেই হয়। মোটামুটি ভাবে এটাই লক্ষ্য করা যায় যে, যাদু সম্পৰ্কীয় ধর্ম বিশ্বাস বা পুজোপাঠের (magic cult) নানা আচার বিচারের সাহায্যে কোন কোন ব্যক্তি অতিমানবিক জগতের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে চায়, কিছু কিছু জটিল সমস্যা সমাধানের নির্দিষ্ট পথ অনুসন্ধানে প্রয়াসী হয়। এদিক থেকে দেখতে গেলে একজন যাজক বা পুরোহিত ও একজন যাদুকরের মধ্যে ক্ষেত্র বিশেষে কোন প্রভেদ থাকে না; উভয়কে একই পথের পথিক বলে গণ্য করা যায়। কিন্তু মনুষ্য জাতির ইতিহাসের দিকে তাকালে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, ধর্মতন্ত্র ও ডাকিনীতন্ত্রকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা হয়েছে সেই জন্যে যে পুরোহিত দেবদেবীর পুজো উপাসনা করে তার কাছে যাদুকরের কোন ঠাঁই নেই। গুপ্তবিদ্যাচর্চাকারী প্রেতপুরীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে বলেই তারা ধর্মপ্রাণ মানুষের দৃষ্টিতে অতীব নিকৃষ্ট, ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য।
তা সে যাই হোক না কেন, রহস্যচর্চাকারী মাত্রেই যে গুপ্তজ্ঞানের ভাণ্ডার তা অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করে। ভূত প্রেত ও নানারকমের অশুভ শক্তির বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে যে সমস্ত ধ্যান ধারণা বা বিশ্বাস চলে আসছে সেই সমস্ত বিশ্বাসকে মূলধন করেই রহস্যচর্চাকারীরা তাদের রহস্যজনক কার্যপ্রণালীর ধারাকে চমৎকার ভাবে টিকিয়ে রাখে; ডাকিনীতন্ত্রকে আধার করে। অবশ্য একথাও ঠিক যে, অদৃশ্য শক্তি সম্পর্কীয় যাবতীয় প্রচলিত বিশ্বাস ও ধর্ম জাতি বিজ্ঞানেরই অঙ্গীভূত বলে গণ্য হয়ে থাকে। আবার এও লক্ষণীয় যে, যাদুকরদের যাদুচর্চা আমাদের কাছে নানারকমভাবে নতুন নতুন তথ্য পরিবেশনেও যথেষ্ট সাহায্য করে। ইতিহাসের বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অতিপ্রাকৃত জগৎ সম্পৰ্কীয় বিচিত্র সব ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসের আদান প্রদান কিভাবে সম্ভব হয়েছে, এক যুগের মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে কি করে একাত্মতা লাভ করেছে, তা অবগত হওয়ার ক্ষেত্রেও যাদুবিদ্যার অবদান বড় কম নয়। এই সব বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে লক্ষ্য করা গেছে যে, গুণিনরা সমস্ত রকম স্তব স্তোত্র, মন্ত্র তন্ত্র আঞ্চলিক বাংলা ভাষাতেই রচনা করে, কিন্তু কথাগুলো মোটেই শুদ্ধ নয়; বরং ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথাগুলো বিকৃতভাবে উচ্চারিত হয়। অনেক মন্ত্র বাংলা ও উড়িয়া ভাষার সংমিশ্রণে রচনা করার রীতিও প্রচলিত; কোথাও কিছু কিছু উপজাতীয় শব্দের ব্যবহার করাই এক বিশেষ রচনা রীতি। আবার কিছু কিছু যাদুমন্ত্রের ভাষা সংস্কৃতের ধাঁচে করার জন্যে অনুস্বর ও বিসর্গ (Anuswara and visarga) ব্যবহারের প্রবণতাও যথেষ্ট লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন মন্ত্র রচয়িতা তথা গুণিনদের মধ্যে। এই প্রবণতার মূলে সংস্কৃত ভাষা ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রভাব যে কিছু না কিছু আছে তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়। এই প্রভাবে প্রভাবিত হয়েই গুণিনরা চেয়েছে সংস্কৃত মন্ত্রের মত তাদের যাদুমন্ত্রের কথাগুলোকে যতদূর সম্ভব গুরু গম্ভীর, আকর্ষণীয় ও ধ্বনিশীল করে তুলতে, এবং সেই সঙ্গে চেয়েছে যাদুমন্ত্রের ভাষাকে সাধারণ মানুষের কাছে অবোধ্য ও দুরূহ করে রাখতে। এরকম করার মূল উদ্দেশ্য হল, উচ্চনাদী ও দুর্বোধ্য ভাষার মন্ত্রতন্ত্র স্তব স্তোত্র সাধারণ মানুষের অন্তরে সব সময় যেন ভয় ও ভক্তি জাগিয়ে রাখতে সক্ষম হয়।
তবে মন্ত্র তন্ত্র মুখে শুধু আউড়ে গেলেই কাজ হয় না বরং সেগুলোর পদ্ধতির সার্থকতার ওপরই গুণিনের মন্ত্রশক্তির আসল পরিচয় নির্ভর করে। সেজন্যে কঠোর নিয়ম ও শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে গুণিনকে মন্ত্র প্রয়োগের বিভিন্ন পদ্ধতি বছরের পর বছর চর্চা করে যেতে হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে যেমন, বলা যেতে পারে যে, অনিষ্টকর বিদেহী শক্তিকে দূর করার জন্যে গুণিন শুধু যে মন্ত্র পড়ে যায় তা নয়, বিভিন্ন রকমের উপাদানও তাকে ব্যবহার করতে হয়। কোন ব্যক্তিকে রোগমুক্ত করার জন্যে কিম্বা দুষ্ট শক্তির আক্রমন থেকে তাকে রক্ষে করার জন্যে নানারকমের শেকড়বাকড় লতাপাতা দিয়ে মাদুলি কবচ ইত্যাদি তৈরী করতে হয় এবং দিনক্ষণ তিথি নক্ষত্র দেখে তাকে ধারণ করাতে হয়।
কিছু কিছু গুপ্তক্রিয়াকর্মে যাদুমন্ত্রের প্রয়োগ ও বিভিন্ন উপাদানের ব্যবহার গ্রন্থকার যেভাবে লক্ষ্য করেছেন সেইভাবে তার বিবরণ নীচে উপস্থিত করা হল :
(১) ভবিষ্যৎ কেমন: এটি হল গুপ্তবিদ্যাচর্চার এক বিশেষ দিক। যে কোন রকমের বিদেহী শক্তির রহস্য উদঘাটনের জন্যে প্রত্যেক গুণিনকেই দক্ষতা অর্জন করতে হয় ভবিষ্যত কথন পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতির জন্যে কতকগুলো উপাদান যেমন, জল, তেল, সর্ষে, নুন ও হলুদ গাছ একান্ত প্রয়োজন। জলপড়া, তেলপড়া সর্ষে পড়া ইত্যাদি বিষয়ক মন্ত্র প্রয়োগ করেই এক হাতের পাঁচ আঙ্গুলের নখদর্পণে (আয়না) পরিণত করা হয় এবং তারই সাহায্যে দুষ্টশক্তির অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। চোর জোচ্চর খুঁজে বার করার জন্যে মাটির খালি ভাড় বা পেয়ালা, ভাত খাবার থালা ও বেণু বাঁশের প্রয়োজন হয়। এই সব জিনিসের ওপর মন্ত্র পড়ে যে কোন চুরি যাওয়া জিনিসের সন্ধান মিলে যায় এবং সেই সঙ্গে চোরের নাম ধাম ও গুণিন জেনে ফেলে। আবার কার কখন বিপদ আপদ ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে সে সম্পর্কেও ভবিষ্যৎ বাণী সে করতে পারে।
পদ্ধতি: ভবিষ্যৎ কথন এর জন্যে নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন বা পদ্ধতি আছে। সূর্যাস্তের পর গুণিন বা ওঝা ভবিষ্যৎ কথনের দেবতাকে পুজো করে দুর্বোধ্যমন্ত্র পড়ে। তারপর বেণু বাঁশের সরু সরু দুটো কঞ্চি দুজনের হাতের মুঠোয় দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখতে বলে; উপস্থিত লোকজনকে কঞ্চির দিকে চোখ রাখার নির্দেশ দেয়। গুণিনের মন্ত্রগুণে কঞ্চির মাথা যে দিকে নুইয়ে পড়ে সেই দিকেই কল্পিধারক দুজনকে এগিয়ে যাবার আদেশ হয়। কিছু সময়ের মধ্যেই চোরের সন্ধান না পেলেও চুরি যাওয়া জিনিসের সন্ধান যে মিলে যায় সে রকম ঘটনার কথা আমরা আগেও বলেছি। গুণিন ছাড়াও ভূতের রোজা বলে যারা খ্যাত তারাও গভীরভাবে মায়া বিদ্যার চর্চা করে। ভূতের রোজা মাত্রেই প্রেতাত্মা বা বিদেহী শক্তির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখে চলে বলেই সাধারণের বিশ্বাস। ইংরিজীতে ভূতের রোজাকে স্পিরিট ডক্টর বলেই অভিহিত করা হয়। তবে শুধু মাত্র গুপ্ত যাদুচর্চার জোরেই এ ক্ষমতা পাওয়া যায় না, এরজন্যে ব্রাহ্মণ, মুসলমান ও হাড়ি এই তিন জাতের তিনটি তাজা যুবককে হত্যা করতে হয় গোপনে মারণ মন্ত্র প্রয়োগ করে। মৃত তিন যুবকের আত্মা ভূতের রোজার অনুগত (familiar Spirit) আত্ম হয়ে সদা সর্বদা তার হুকুমে হাজির থাকে বলেই এই অঞ্চলের মানুষের ধারণা। ভূতের রোজা তার অনুগত আত্মার মাধ্যমেই সব কিছু গণনা করে অব্যর্থ ভাবে। তাই তার ভবিষ্যৎ কথনের পেশা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। যে কোন রকমের দুষ্ট বা অশুভ শক্তি, ভূত, পেত্নী, ডান-ডাইনী ইত্যাদি অনুসন্ধানের কাজে সে খুব সহজেই সাফল্য অর্জন করে। ভূতের রোজার জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে যে অনুগত আত্মা অতন্দ্র প্রহরীর মত কাজ করে তাকে চ৩ (Chanda) নামে উল্লেখ করা হয়। অন্য যে কোন রকম অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করাই হল চন্ডের প্রধান দায়িত্ব।
তেল পড়া: জল পড়ার মতই সর্ষের তেলে ফুঁ দিয়ে গুণিনরা তেলপড়া করে বিভিন্ন রোগ ব্যাধি নিরাময় করার জন্যে। তিনটি কাঁচা শালপাতা কিম্বা কাঁঠাল পাতার ওপর তিন ফোঁটা সর্ষের তেল ফেলে সেগুলোকে কয়েকটি ভাঁজ করে কাঁটা দিয়ে আটকে দেওয়া হয়; যাতে খুলে না যায়। তারপর পাতার মোড়ক পর পর মাটিতে সাজিয়ে রেখে পূর্বদিকে মুখ করে গুণিন মনে মনে প্রাচীন বীর পুরুষদের আহ্বান করে, তাদের অনুগ্রহ লাভের আশায়। আবার বেশ কিছু সময় জোরে জোরে মন্ত্রপাঠ করার পর মোড় তিনটে নিরীক্ষণ করে খুব মনোযোগ সহকারে। তেল মাখান পাতার গায়ে গুণিন এমন কিছু লক্ষ্য করে যা দিয়ে সে বুঝে যায় তেলপড়া ঠিক হয়েছে কিনা। তেলপড়া ঠিক না হলে গুণিনের গণনাতেও গোলযোগ দেখা দেয়।
নখশুদ্ধিকরণ : গ্রামের যে কোন লোকের দামী কোন জিনিস যদি চুরি যায় তাহলে সে গুণিনের শরণাপন্ন হয়। কারণ, গুণিন ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই খোয়া যাওয়া জিনিস উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। গুণিনরা এই কাজের জন্যে গণনার এক বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বণ করে এবং সে পদ্ধতি হল নখশুদ্ধিকরণ (sanctification of nails) পদ্ধতি। যার জিনিস চুরি গেছে তার দুহাত একসঙ্গে জোড়া করে দুই বুড়ো আঙুলের নখ রাঙিয়ে দেওয়া হয় সর্ষের তেলের সঙ্গে লাল সিঁদুর মিশিয়ে। তারপর নখের দিকে তাকিয়ে গুণিন মন্ত্র পাঠ শুরু করে। মাঝে মাঝে নখের মাথায় ফুঁ দেয় ও শান পাথরের ওপর চাপড় মারে। এইভাবে কিছুক্ষণ করে যাবার পর গুণিন তার মক্কেলকে নখের ওপর খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখতে বলে। মক্কেল তখন এক নখের মাথায় চোরের মুখ ফুটে উঠতে দেখে এবং আর এক নখের মাথায় চুরি যাওয়া জিনিস। সুতরাং চোরকে খুঁজে বার করতে আর কোন অসুবিধাই হয় না বরং চোরের হাত দিয়েই যার জিনিস তার কাছেই আবার যথারীতি ফিরে আসে। এরকম আরো একটা অদ্ভুত পদ্ধতি প্রয়োগ করে চোরের খপ্পর থেকে গুণিন জিনিস উদ্ধার করে। কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটা আয়নার উল্টো পিঠে মন্ত্রপূত সর্ষের তেল লাগিয়ে গুণিন মন্ত্র পড়ে এবং বার কয়েক ফুঁ দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই চোরের মুখ ও চুরি যাওয়া জিনিষের ছায়া তার ওপর এসে পড়ে।
এই সব গোনাগুনি ব্যাপারে কেশিয়াড়ি থানার অন্তগত ফাপড়া গ্রামের অধিবাসী গোষ্ঠ দে নামে এক ব্যক্তির প্রচুর নামডাক আছে। হাতের রেখা বিচার করাতে সে ওস্তাদ। এদিক থেকে তাকে মস্ত বড় একজন হস্তরেখাবিদ বা পামিষ্ট বললেও ভুল হয় না। যে কোন লোকের জিনিষ চুরি গেলেই সে সোজা চলে আসে গোষ্ঠর কাছে। গোষ্ঠ তার ডান হাতের চেটোয় এক টুকরো হাড় রেখে বলে দেয় চুরি যাওয়া জিনিষ সে ফিরে পাবে কিনা। তাই গরু ছাগল ভেড়া যার গোয়াল বা খোঁয়াড় থেকে যখনই হারিয়ে যায় তাকে তখনই ছুটে আসতে হয় গোষ্ঠ গুণিনের ডেরায়। গোষ্ঠ কিন্তু তার পারিশ্রমিক হিসেবে কানা কড়িও কারো থেকে হাত পেতে নেয় না; এবং মক্কেলকে বলে দেয় যে, চুরির জিনিষ ফিরে পেলে সে যেন মা কালীর পূজো দেয়।
(২) দুষ্ট শক্তির আক্রমণ জনিত দুঃখ দুর্দশার দূরীকরণ : দুষ্ট শক্তির অদৃশ্য কালো হাতের আক্রমণে গ্রাম্য মেয়ে পুরুষের অনেকেই অনেক রকম আঘাত পায়, দুঃখ ভোগ করে। গুণিনের মন্ত্রশক্তির প্রয়োগ ছাড়া এ দুঃখের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব হয় না। প্রত্যেক গুণিনকে তাই নানারকমের মাদুলি, কবচ, তাবিজ ইত্যাদি সবসময় তৈরী রাখতে হয়। তাছাড়া, যে সমস্ত বিদেহী আত্মা গৃহস্থের বাড়ীতে রাত বিরেতে নানারকমভাবে উৎপাত করে সেই সমস্ত দুরাত্মাকে মন্ত্রবলে বেঁধে রাখার জন্যে পেরেক, লোহার রড ইত্যাদিও মজুদ রাখতে হয় গুণিনদের। গৃহস্থের বাড়ীর উঠোনে কিম্বা আশেপাশে বট বা অশ্বত্থ গাছের গায়ে পেরেক প্রায়ই পুঁততে হয় দুষ্টশক্তির নাম করে, মন্ত্র পড়ে। এসব ছাড়াও, দুষ্টশক্তির আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে বহুরকমের গুপ্তক্রিয়াকর্ম পালনের পদ্ধতির প্রচলণ আছে গুণিনের অলৌকিক যাদু জগতে।
(ক) প্রেতাত্মা বা বিদেহী আত্মা যাকে ভর করে গুণিন তার সর্বাঙ্গে ফুঁ দিয়ে মন্ত্রপাঠ করে। এইসব মন্ত্র রচনা ক্ষেত্রে গদ্য ও পদ্য উভয় রীতিরই প্রচলন আছে। তবে গদ্যের ভাষা বড়ই ফাঁক, অবিন্যস্ত বা অমার্জিত। মন্ত্রের মধ্যে দিয়ে প্রাচীন ভারতীয় বীর পুরুষদের অর্থাৎ সিংহের মত যাদের বিক্রম ছিল তাদেরই স্মরণ করা হয়, সেই সঙ্গে মা চণ্ডীকে বিভিন্নভাবে সম্বোধন করা হয়। চণ্ডীকে ধরা হয় হাড়ির কন্যা বলে। কোন কোন মন্ত্রে দেবাদিদেব মহাদেবকে সম্বোধন করে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও ভক্তি জ্ঞাপন করা হয়। যদিও মন্ত্রগুলি বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় রচিত তথাপি সমস্ত মন্ত্র প্রায় একই অর্থ বহন করে, সেই সঙ্গে আরো লক্ষ্য করা যায় যে, প্রতিটি অঞ্চলের অধিষ্ঠিত ও প্রাধান্য প্রাপ্ত দেবদেবীকে উদ্দেশ্য করে ও আহ্বান করে মন্ত্রগুলি রচিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ
“হাট বাজার, জনগণের মিলনস্থানকে শ্রদ্ধাকরি
পথঘাটকেও শ্রদ্ধা করি,
ইতর প্রাণী ও সর্পকূলের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাই,
মৃতদেহকেও সম্মান করি;
ভূতপ্রেত অপদেবতারাও সম্মানীয়
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদেহী আত্মারাও শ্রদ্ধেয়
তেত্রিশ কোটি দেবদেবীই হলেন পরম শ্রদ্ধেয়, পূজনীয়;
দেশের দুকোটি মানুষই শ্রদ্ধাভাজন
তোমাদের সবার কাছে অনুরোধ, আমার কাছে কেউ এসো না
আমি মহামুনি নরসিংহের শিষ্য।
আমার এই মহামুনির নামে তোমাদের নিষেধ করছি
আমার কাছে আসতে।”
আমি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর নাম স্মরণ করছি যাতে ভূত প্রেত অপদেবতারা আমার ওপর কোপদৃষ্টি দিয়ে আমার কোন অনিষ্ট করতে না পারে; আমার সারা বছরের কাজকর্মে কোনভাবে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। আমার এই অনুরোধ যদি বিফলে যায় তাহলে আমার আরাধ্য বীরপুরুষ এর বিহিত করতে এগিয়ে আসবেন।
(খ) এই মন্ত্র পাঠ করার পর গুণিন নিজের জন্যেও যেমন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার চেষ্টা করে তেমনি আবার গৃহস্থের বাড়ী ও তার আশেপাশের যেসব জায়গা ভূত প্রেত ঝাড়ার কাজের জন্যে নির্দিষ্ট সেইসব জায়গার অপদেবতাদের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে; নানা রকমের মন্ত্র পড়ে এবং উপস্থিত সকল লোক এক সঙ্গে হাতে তালি দেয়।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ
“ওহে বাবা ভূত! তুমি দেখতে কেমন বল
ঠিক যেন একটা বিশ্রী চেটালো তেলের পাত্রের নীচে ঝুলছে
ভাঙা কাস্তের আকারে একসারি দাঁত;
ওহে বাবা ভূত! তুমি হাজির হয়েছে বদ উদ্দেশ্য নিয়ে–
উদ্দেশ্য সফল করবে বলেই তোমার মুখে মুচকি হাসি।
নাও এখন এই ডিমগুলো গেলো তো–
তোমার জন্যেই আমি এগুলো এনেছি।
তোমার খাদ্য কি? তিনটে ডিম;
একটা হাসের ডিম, একটা মুরগীর আর একটা কচ্ছপের।
একটা কাসমিলা (জংলা উদ্ভিদ) এখানে দাঁড় করানো আছে–
কারো কোন অনিষ্ট না করে এখন যাও, ফিরে যাও বাবা।”
(গ) মন্ত্রবলে গুণিন যে কোন এক জায়গায় গণ্ডী দিয়ে ভূতকে গণ্ডীবদ্ধ করে রাখে যাতে গুপ্তক্রিয়া কর্ম সম্পন্ন করার সময় কোনরকম বিঘ্ন ঘটাতে না পারে; এবং গুপ্ত ক্রিয়া কুশলীদের অনিষ্ট সাধনে ও যাতে সক্ষম না হয়।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ–
“ওহে অপদেবতা! আমি এখন তোমায় এই ঘরে আটকে
লোহার পাত দেওয়া কপাট বন্ধ করছি।
তুমি এখন শ্মশানে মশানে পড়ে থেকে
শবদাহের চিতাগ্নির প্রচণ্ড উত্তাপ ও মশকের দংশন সহ্য কর।
ওখানেই তুমি এখন তোমার শয্যা প্রস্তুত কর–
আমি আরো শক্ত করে দরজা এঁটে দিচ্ছি।
দেবগুরুকে নিয়ে সারথী দ্রুত বেগে রথ ছুটিয়ে নেমে আসছে।
সেই সঙ্গে প্রভু গরুড় পক্ষীও তাঁর সুবিশাল পাখা মেলে
আকাশ পথে উড়ে আসছেন;
এবং গরুড়ের বাঁদিক ধরে মহাবীর মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেনও
তড়িৎ গতিতে ছুটে আসছেন;
এঁদের নিক্ষিপ্ত বাণও শোঁ শোঁ শব্দে ছুটে চলেছে
এ সমস্তই রাম লক্ষণ সীতা কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত,
অতএব আমার আজ্ঞা তুমি যদি অমান্য কর
তাহলে নরকেও তোমার নিস্তার নেই তুমি ধ্বংস হবে।
(ঘ) অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রক্ষা কবচের ব্যবহার। রক্ষা কবচ প্রস্তুত করার পদ্ধতি : দুষ্ট বা অশুভ শক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষে পাবার উদ্দেশ্যে গুণিনের দেওয়া রক্ষা কবচ যে গ্রামের অনেক লোককেই ধারণ করতে হয়, সে কথা অবশ্য আমরা অনেক আগেই জেনেছি। তবে এই কবচ প্রস্তুত করার নিয়ম কানুন বা পদ্ধতি খুব একটা সহজ নয়। বরং জটিলই বলা চলে। গুণিনের বিধান অনুযায়ী যে কোন রকমের রক্ষা কবচ তৈরী করা হোক না কেন, তা করতে হয় গুপ্তক্রিয়াকর্মের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রক্ষে কালীকে স্মরণ করে। তাই প্রথমেই যে কোন একটা মন্দিরের মা কালীর সিঁথির সিঁদুর প্রয়োজন হয়। তারপর অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানের মধ্যে হল, শোন কিম্বা গোরস্থানে গজিয়ে ওঠা তুলসী চারা, গুয়া বাবলার (Acacia Plant) শেকড়, মড়া পোড়ানোর নির্দিষ্ট জায়গা থেকে দুর্বা ঘাস ও চিতাবাঘের এক টুকরো চামড়া, সে যেমন করেই হোক জোগাড় করতেই হবে। সমস্ত জিনিষগুলো শুকিয়ে গুঁড়ো করতে হয় মিহি পাউডারের মত করে; এক চিমটি পাউডার মা কালী লেখা ছোট্ট একটু কাগজে মুড়ে তামা বা সোনার মাদুলীতে গালা বা মোম দিয়ে মাদুলি অর্থাৎ ঐ রক্ষা কবচের মুখ আটকে পুরুষদের ডান হাত ও মেয়েদের বাঁ হাতের কনুইএর ওপর লাল সুতোয় বেঁধে মায়ের নামে ধারণ করতে হয়। মঙ্গল ও শনি এই দুটো দিনই রক্ষা কবচ ধারণের জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে আছে, এবং ধারণের দিন আমিষ খাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ।
(ঙ) গাছ চালানো : অনিষ্টকর দুষ্ট শক্তি খুঁজে বার করার এক পদ্ধতি হল গাছ চালানো। এ এক বিচিত্র পদ্ধতি।
ভূত, প্রেত, দৈত্য, দানব ইত্যাদি অনুসন্ধান করার জন্যে যারা গুপ্ত ক্রিয়াকর্মে বিশেষ দক্ষ যারা স্পিরিট ডক্টর নামে সুখ্যাত তারাই শ্মশানে গিয়ে যোগাসনে বসে গভীর রাত্রে। যে অপদেবতা লোকের ক্ষতি করছে তার নাম জানতে ঐ সব ভূতের রোজা বা বিদেহী শক্তি বিশেষজ্ঞদের খুব বেশী বেগ পেতে হয় না। যে ব্যক্তি অপদেবতার উৎপীড়নে নানাভাবে উৎপীড়িত হয় সেই ব্যক্তির নাম করে ছোট্ট একটা পুতুল বা প্রতিকৃতি গড়া হয় শ্মশানের মাটি দিয়ে। পুতুলকে চিৎ করে শুইয়ে তার বুকের ওপর রাখা হয় শশ্মানের মাটির তৈরী একটা সাপের ফণা। তারপর নির্দিষ্ট ভূত বা অপদেবতার নামে মাটির ফণা বিদীর্ণ করা হয় লৌহ শলাকা দিয়ে। তার পর মুহূর্তেই শুরু হয়ে যায় গাছ চালানোর ক্রিয়াকর্ম। এ কাজে যে সমস্ত জিনিস লাগে তা হল বাইশ আঙুল লম্বা বাঁশের কঞ্চির তৈরী তীর ও ধনুক, এক ছড়া মর্তমান কলা গাছের তিনটি পাতা, আড়াইশ গ্রাম চাল, এক ভাঁড় গঙ্গাজল, এক থান মেটে সিঁদুর, ধূপ-ধূনো, আখের গুড় ও এক কুড়ি সাতেরটি চীনে গোলাপ।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ
হে বৃক্ষ!
তুমি এখন খুবই শক্তিশালী হয়েছ।
আমি তোমার কাছে এসেছি এবং
দেবী কালিকা যখন তোমার পরম সহায়
তখন আমি দেবীর নাম স্মরণ করে
তোমাকে আদেশ করছি–
ভূত বা অপদেবতাকে ধরার জন্যে।”
(চ) ভূত প্রেত ধরার পদ্ধতি: একটা বড় বোতল মন্ত্র পড়ে জল ভরা হয়। গুণিন বোতলের মুখে নাক ঠেকিয়ে খুব জোরে জোরে বার তিনেক জলন্যাস করে মন্ত্র পড়তে শুরু করে।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ
“হে মহাগুরু ক্ষেত্ৰপাদ! ভূতকে ধরে আন।
সারা জীবন ঐ ভূতকে এই বোতলে আবদ্ধ করে রাখ–
ভগবান অষ্টাঙ্গ যেমন আদেশ দিয়েছে তেমনি হোক।”
(ছ) ডাইনীদের নজর লাগা জ্বরের প্রতিষেধক মন্ত্র : ডাইনীদের বিষ নজর যার ওপর পড়ে তার দেহ বিভিন্ন রকমের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সময় সময় ডানের নজর লেগে বাচ্চারা ভীষণ ভাবে জ্বরে পড়ে অসুস্থ হয়। জীবনের আশঙ্কা পর্যন্ত দেখা দেয়। ডাক্তার কবিরাজ হাজার কিছু করেও সে জ্বর কমাতে পারে না। গুণিনের মন্ত্র তন্ত্র ছাড়া বাচ্চাকে সুস্থ করার অন্য কোন উপায় থাকে না। গুণিনকে তাই ডাক দিতেই হয়। গুণিন জলপড়ার জল খাইয়ে ও রোগীর সর্বাঙ্গে বার কয়েক ফুঁ দিয়ে রোগীকে একেবারে সুস্থ করে তোলে।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ
“ওরে শালী! কোথা থেকে তুই এসেছিস!
এবং তোর নিবাস কোথায়?
তুই কি জানিস — আমি পূবদিক থেকে এসেছি
এবং পশ্চিম দিকে বাস করি?
কেন রে তুই রক্তখাকি ডাইনী ভয়ানক এই বিপদের
জায়গায় এসে পড়েছিস?
তুই এই রোগীর সঙ্গে এখন বাঁধা পড়লি
এক তিলও নড়তে পারবি না।
এবার তোকে আমি ঝাঁটা পেটা করছি–
ওরে রাক্ষসী ডাইনী! যা যা, পালা পালা এক্ষনি।
ওরে কুলটা ডাইনী! তোর যে পঁয়ষট্টি জন অস্থায়ী স্বামী আছে
যা, তাদের সঙ্গে গিয়ে স্থায়ীভাবে ঘর করগে!
প্রাচীন বীর মহাপুরুষদের যে এটাই নির্দেশ।”
(জ) গ্রাম বাংলায় এটা প্রায় দেখা যায় যে পর অনেক শিশুই ঘন্টার পর ঘন্টা কাশতে থাকে। মা বাপ বা পরিবারের অন্য কেউই যে কান্না থামাতে পারে না। তখন বাড়ীর সকলেই ধরে নেয় যে, কোন অশুভ শক্তির হাওয়া বা ছোঁয়া লেগেছে বাচ্চার গায়ে। সুতরাং ডাইনী চিকিৎসকের (Witch doctor) শরণাপন্ন না হয়ে উপায় কি? চিকিৎসক এসে বার কয়েক ফুঁ দিয়ে ও বাচ্চার গায়ে পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়েই তার কান্না থামিয়ে দেয়।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ
“হে মা মঙ্গলচন্ডী! তুমি এখানে অধিষ্ঠান কর।
বাচ্চাকে তুমি চুপ করিয়ে দাও, মা।
ওরে দুরাত্মা! তুই এখানে এসেছিস কেন? দূর হয়ে যা বলছি
আমাদের ও ঘরে যেতে দে!
তুই কি জানিস–আমার সঙ্গে সিধকাঠি, ছোট মৃদঙ্গ
এবং বাঘের চামড়ায় মোড়া ছাই আছে?
কান্না থামাতে এগুলোই যথেষ্ট–
তাই তোকে বলছি। এখনই এ জায়গা থেকে বিদায় হ’।
আমি তোকে যেতে বলছি দেবী কটক চণ্ডীর নামে,
ঐ দেবীর শক্তি বড় ভয়ঙ্কর, তাঁর আদেশ অমান্য করলে
তুই ভয়ানক শাস্তি পাবি।”
আবার পেঁচো নামে এক ভয়ঙ্কর হিংস্র ও অনিষ্টকর ভূত আছে। তাকে তাড়ানোর জন্যে যে সমস্ত ক্রিয়াকর্ম করা হয় তা হল এই রকম:
সাধারণত উত্তর বা পশ্চিম মুখো হয়েই কর্মকাণ্ডের সূচনা করে গুণিন। যে বাড়ীতে পেঁচোর অবস্থান ঘটেছে বলে গুণিন মনে করে, সে বাড়ীর ঘর দালানে গোবর ছড়া দিয়ে ভালো করে মুছে ফেলতে হয়। তারপর বেশ খানিকটা ন্যাকড়ায় গোবর মাখিয়ে একটা পাত্র করে ঘরের এক কোণে রেখে দিতে হয়। সেই সঙ্গে উনুনের গনগনে আঁচে বেশ কিছুক্ষণ ধরে এক পাত্র জল ফুটিয়ে যেতে হয় মন্ত্র আওড়ে। তবে উনুনের পাশে আস্তাকুঁড় ঘেঁটে কিছু জঞ্জাল এনে আগে থেকেই জড়ো করে রাখতে হয় কেঁচোর উদ্দেশ্যে।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ—
“ওরে পাঁচু! আমি তোকে চিনি
তুই যা করে বেড়াস তাও আমি জানি।
তুই সাধারণত রাতের অন্ধকারেই ঘুরে বেড়াস–
আর গাঁয়ের মানুষের ঘরে গিয়ে অধিষ্ঠান করিস।
আমি ন্যায় বিচারের দেবতাকে আহ্বান করছি
তোকে দূর করে দেবার জন্যে।
তুই যদি এই মুহূর্তে দূর হয়ে না যাস তোকে তাহলে
এই ঝাটার বাড়ী দেব।”
যে কোন একটি গাছের চারপাশে গুণিন তার মন্ত্রপড়া বালির সঙ্গে সর্ষে মিশিয়ে প্রথমে ছিটিয়ে দেয়; তারপর সে নিজের হাতে একটা বড় লোহার পেরেক নিয়ে গাছের গায়ে পুঁতে দেয় কেঁচোর নাম করে। তার ফলে কেঁচো আর কোনদিনই কারো ঘরে গিয়ে অধিষ্ঠান করতে পারবে না। ঐ গাছেই সে বাঁধা পড়ে যায়, গাছ ছেড়ে যাবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে পেঁচো ভূত। গুণিনের পোঁতা পেরেকেই ভূত নাকি চির দিনের মত আটকে যায়।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ
“ওরে ভূত!
আমি স্বর্গ নরক উভয়কেই ডাক দিচ্ছি।
লঙ্কার রাবণ রাজার সিংহ দরজাকেও আমি ডাক দিচ্ছি
সারা দুনিয়ার নামজাদা যত বড় বড় শ্মশান ও গোরস্থান
আছে সেগুলোকেও আমি ডাক দিচ্ছি।
কামরূপের মহাদেবী কামাখ্যার নাম স্মরণ করে।
আর যে সমস্ত স্মরণীয় প্রাচীন বিদেহী আত্মা আছে,
এবং যারা কখনও মানুষের কোন অনিষ্ট করেনি–
আমি তাদেরও আসতে আহ্বান করছি।
তাছাড়া, সমস্ত গৃহস্থ বাড়ীর সর্বকালের ইষ্টকারী
মহান মহান কালপুরুষের পবিত্র আত্মা ও তাঁদের মত
অন্যান্য শক্তিশালী আত্মাকেও আহ্বান করছি।
এখন তুই এই বৃক্ষ ত্যাগ করে যদি,
অন্য কোথাও গিয়ে বাস করতে চাস–তাহলে তুই
চলে যা গয়াধামে;
সেখানে বিদেহী আত্মাদের তৃপ্তার্থে পিণ্ড দান করা হয়।
তুই সেখানে গিয়ে মহানন্দে বাস করগে যা।
আমি আমার জান গুরু গজেন মাইতির নামে
কামনা করি তুই যেন চিরদিনের মত এই গাছে বন্দী
হয়ে থাকিস।”
হলুদ পুড়িয়ে ভূত তাড়ানোর পদ্ধতি: গ্রামের অনেককেই যখন তখন ভূতে ভর করে। সুতরাং ভূত তাড়ানোর জন্যে-গুণিন বা ভূতের রোজার আগমন প্রায় সব বাড়ীতেই হয়। এক খন্ড গিঠে হলুদ পুড়িয়ে রোগীকে তার ধোঁয়া টানতে বলে গুণিন, এবং সেই সঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ চলতে থাকে। ধোঁয়া টানা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ভূতে ভর করা রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এই পদ্ধতির প্রচলন আজও যথেষ্ট আছে।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ
“ওরে ভূত! ওরে ভূত!
আমি এই হলুদ গাছের তীর হাতে নিলাম।
হলুদ গাছের পাহাড় তোর ওপর চেপে বসবে।
মহাপ্রভু হনুমান আসছেন, ভূত ও দুরাত্মাদের মুণ্ডচ্ছেদ করতে
দেবী চণ্ডী ও কামরূপের কামাখ্যা মা-ই আমাকে
এসব করার আদেশ দিয়েছেন;
তোকেও তারা এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন–
শিগ্গীর চলে যা,
ওকে ছেড়ে যা।
(৩) সুখ সম্পদ সৌভাগ্য অর্জন, অন্যের পুকুরে মাছ মারা, গুরুতর অপরাধে লঘুদণ্ড, মামলায় জয় লাভ, সিঁধ কেটে চুরি করার আগে বাড়ীর সকলকে ঘুমে অচৈতন্য করা ইত্যাদি ব্যাপারে নানা মন্ত্র তন্ত্র ক্রিয়াকর্ম ও সম্মোহিনী শক্তি প্রয়োগের নানাবিধ পদ্ধতির বহুল প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।
মামলা মোকদ্দমায় জয়লাভের পদ্ধতি : যে কোন তেল কলের মালিকের চোখ ফাঁকি দিয়ে সামান্য পরিমাণ সর্ষের তেল চুরি করে আনতে হয়। কারো বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দায়ের করার দিনে ঐ তেল সর্বাঙ্গে মেখে চান করাই গুণিনের বিধান। আবার কোন কোন গুণিনের বিধান অনুযায়ী চুরি করা তেলের সঙ্গে লজ্জাবতী লতার রস মিশিয়ে মেখে গেলে যেকোন মামলায় জয়লাভ অনিবার্য।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ
“ওহো! ঐ যে তেল! তোমাকে এনে মাটির পাত্রে রাখা হয়েছে।
তুমি আমাকে বলে নিশ্চিন্ত কর যে, বিচারকের রায়
আমার অনুকূলেই যাবে–
এবং আমি জিতে যাব।
হে মন্ত্রপূত তেল! এখন আমি তোমাকে গায়ে লাগাচ্ছি–
একটা মেম সাহেবের সঙ্গে একটা ভীতু খেঁকশেয়ালের
আর কোন ফারাক থাকবে না।
এই তেল সবার ওপর যাদুক্রিয়া করবে;
আদালতের জুরিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে;
এমন কি, ক্ষমতাধারী মন্ত্রীবর্গ ও পুলিশ কর্তাদের
প্রভাবিত করে আমার দিকে টেনে এনে
আমার কাম হাসিল করাবে।
মন্ত্র দেওয়া এই তেল মাখার পর আমার দেহের
প্রতিটি অঙ্গ পোষা-ছাগলের মত
আমার হুকুমে হাজির থাকবে
আমার খুশীমত কাজ করবে।
সর্বশক্তিমান ভগবান ও মহাকালীর নির্দেশে
আমার সংকল্প সিদ্ধ হতে বাধ্য।
হে আমার মন্ত্রপূত তেল!
তুমি তোমার অলৌকিক ক্রিয়া শুরু কর
আর দেরী নয়– এখন থেকেই শুরু কর।”
গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন করার পদ্ধতি : রাত দুপুরে কোন গৃহস্থের বাড়ীতে সিঁদ কাটার আগে ঐ বাড়ীর প্রত্যেকটি প্রাণীকে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন করে রাখার পদ্ধতি হল এই রকম:
শ্মশান, ভাগাড় ও গোরস্থান–এই তিন জায়গার মাটি ও লজ্জাবতী লতা সংগ্রহ করতে হয়। ঐ সব উপাদানগুলো এক সঙ্গে করে গুণিন তার ওপর মন্ত্র পড়ে চোরের হাত দিয়ে দেয়। চোর সেগুলো নিয়ে গিয়ে বাড়ীর চারপাশে ছড়িয়ে সিঁধ কাটতে লেগে যায় নির্ভয় চিত্তে। চোরের উদ্দেশ্য নির্বিঘ্নেই হাসিল হয়, বাড়ীর সকলেই ঘুমে অচৈতন্য হয়ে থাকে–চোর চুরি করে চলে যাবার পরেও। মন্ত্রপূত মৃত্তিকাচুর্ণের এমনই গুণ।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ—
“ও পবিত্র মন্ত্রপূত মৃত্তিকাচূর্ণ!
তুমি তো দেখতে পাচ্ছ–
আকাশের তারাগুলো কেমন নিষ্ক্রিয় হয়ে ঘুমিয়ে আছে।
হে নিদ্রা! তুমি খুব ধীরে সন্তপণে এসে
এই পরিবারের প্রত্যেকের চোখের পাতার ওপর ভর কর–
আমি যাতে নিশ্চিন্তে আমার প্রয়োজনীয় সামগ্রী
অপহরণ করতে পারি।
হে নিদ্রা! তুমি যত সম্ভব গম্ভীর হও, গম্ভীর হও।
এমন কি এই বাড়ীর আশেপাশের অন্যান্য মানুষজন ও
প্রহরীরা যারা এখনও নিদ্রা যায়নি–
তারাও যেন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
একমাত্র আমি ছাড়া আমার চারপাশের ঘরের
প্রতিটি প্রাণী যেন নিদ্রায় অচৈতন্য হয়ে থাকে।
অতিশয় ধর্মপ্রাণ হাড়ির দুই কন্যা–
মহাদেবী কালিকা ও চণ্ডিকার নামে শপথ নিয়ে
আমি এ কাজ করতে এসেছি।”
মন্ত্রের শেষে ‘ওম হিং’ ‘হং’ তিনটি শব্দ উচ্চারণ করতে হয়। এই শব্দ তিনটির ব্যবহার দেখে তন্ত্রাচারের কথাই আমাদের মনে আসে। এই সব মন্ত্র রচনার ক্ষেত্রে তন্ত্রশাস্ত্রের প্রভাব থেকে থাকতে পারে।
জানলা ভেঙে ঘরে ঢুকে চুরি করার পদ্ধতি : চোর তার নিজের বাঁ হাতের চেটোয় মন্ত্র তিনবার ফুঁ দেয়, রাতের অন্ধকারে গৃহস্থের বাড়ীর যে কোন একটা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে। তারপর মাথার ওপর তিনবার হাত ঘুরিয়েই জানলার পাল্লা করাত দিয়ে কাটতে শুরু করে। খট খট আওয়াজ হলেও তা কারোর কানে যাবে না। মন্ত্রের প্রভাবে বাড়ীর ঘুমন্ত প্রাণীদের কোন শব্দই কর্ণগোচর হয় না।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ–
হে মা কালিকে! ক্ষুদ্র কেশ বিশিষ্টা দেবী!
দয়া করে তুমি এখানে এসে উপস্থিত হও।
আমায় যেন ওরা বাঁধতে না পারে।
দেবী! লক্ষ্য রেখ তুমি গৃহস্বামী যেন আমায় ধরতে না পারে।
আমি এই জানলার মধ্যে দিয়ে যেন ভেতরে ঢুকে যেতে পারি।
কে আমায় এভাবে ঢোকার নির্দেশ দিয়েছে।
কালীঘাটের মা কালীই এই নির্দেশ দিয়েছেন।
যে কোন রকমের পোকা মাকড় জীবজন্তু সাপ বিছে ইত্যাদির কামড় সারানো যায় খুব সহজেই, যাদুমন্ত্র প্রয়োগ করে। এবং কি জাতের সাপে কামড়েছে তাও গুণিনরা বলে দিতে পারে দড়ির বাঁধন দিয়ে ও বিশেষ রকমের কিছু ওষধি ব্যবহার করে। সাপে কাটা রোগীকে বাঁচিয়ে তোলার জন্যে রোজারা বহু রকমের মন্ত্র প্রয়োগ করে। এখানে দৃষ্টান্ত হিসেবে একটি মন্ত্রের উল্লেখ করা হচ্ছে।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ—
সোমা ও চিতির মত আট রকমের বিষাক্ত সাপ।
ফণা ছাড়া বিরাট বিরাট সাপের মধ্যে
তের প্রকারের বিভিন্নতা।
এই সব সাপের কুল পরিচয় আজও আমি জানি না।
হে বিষ, তুমি রোগীর দেহ ত্যাগ কর
মহেশ্বরের গলায় গিয়ে ভর কর।
সাপের বিষে জর্জরিত মুমূর্ষ এই লোকটিকে
বিষমুক্ত করার জন্যে এগিয়ে আসবে চৌষট্টি মণ্ডল।
কে বলেছে তাদের এগিয়ে আসতে।
দেবী পার্বতীর স্বামী স্বয়ং শিব বলেছেন,
অতএব হে বিষ! তুমি অন্যত্র গমন কর।”
আবার কিছু কিছু মন্ত্র বিকৃত ওড়িয়া ভাষায় কবিতা করে রচিত হয়েছে। নাকি সুরে এই সব মন্ত্র পাঠ করা হয় সাপে কাটা রোগীর বিষ ঝাড়ার সময়। মন্ত্রের শেষে রোগীর ক্ষতস্থানে যতদূর সম্ভব গাল ফুলিয়ে রোজাকে ফুঁ পাড়তে দেখা যায়।
শেয়ালে কাটার ঘা শুকোনোর মন্ত্র : শেয়ালের কামড়ে গাঁয়ের অনেকেই ঘায়েল হয়ে থাকে। দগদগে ঘায়ের সৃষ্টি হয়। গুণিনের দেওয়া জড়ি বুটিতে সে ঘা খুব তাড়াতাড়ি সেরে যায়। অবশ্য মন্ত্রশক্তির প্রভাবও যথেষ্ট থাকে।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ–
হে কৃষ্ণ! তুমি এর অবস্থা দেখ।
কে তোমায় রাগিয়েছিল!
এই ব্যক্তিকে যে কামড়েছে সে নিজেই মরে যাবে।
বিষক্রিয়াকে ব্যর্থ হতে দাও।
বাড়ী এসো।
বিষ আর থাকতে পারে না, পারে না।
আমার গুরুই একথা বলেছে।”
কাঁকড়া বিছের বিষ ঝাড়া : হাতে পায়ে কিম্বা যে কোন জায়গায় কাঁকড়া বিছে হুল ফুটিয়ে থাকুক না কেন, সারা দেহ তীব্র বিষের জ্বালায় জ্বলতে থাকে। রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। কিন্তু গুণিনের হাতের যাদু ও মন্ত্রের জোরে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিষের জ্বালা একেবারে জুড়িয়ে যায়।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ–
“ওরে বিয়ের বিষ!
আমি যা বলি তা শোন।
আল্লা (ঈশ্বর) তোকে শাস্তি দেবেন।
ওরে বিছে তুই যদি বিষ টেনে নিস, তাহলে
আল্লা তোকে রক্ষে করবেন।”
নুনপড়ায় রোগ নিরাময় : এক চিমটি নুনের ওপর গুণিন তার ডান হাতের বুড়ো আঙুল ও মাঝের আঙুল ছুঁইয়ে নুন মন্ত্রপূত করে; সেই নুনের দু চার দানা মাটিতে ফেলে বাকি সবটুকু নুন পেটের রোগীকে গিলিয়ে দেওয়া যে কোন রকমের পেটের অসুখে নুনপড়া অব্যর্থ কাজ করে।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ—
নুন, নুন, নুন পেটের অসুখের অব্যর্থ ওষুধ।
একে পবিত্র মন্ত্রে কে মন্ত্রপূত করেছে!
ব্রাহ্মণের আধ-বামানি করেছে একে ফলপ্রসূ।”
কেউ যদি নজর দিয়ে কোন ব্যক্তির অনিষ্ট করতে চায় কিম্বা তাকে পেটের অসুখের রোগী করে ফেলে রাখতে চায়, কিন্তু নানা রকমভাবে তার দেহের উপসর্গ সৃষ্টি করে তাকে পঙ্গু করতে চায়, তাহলে সে নজর দোষ কাটানোর মন্ত্র হল:
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ–
“সে নিজেকে নিজে কষ্ট দেবে
কে বলেছে এই যাদুমন্ত্র প্রয়োগ করতে?
আমার পরম আরাধ্য জানগুরুর আজ্ঞাতেই
আমি এই মন্ত্র প্রয়োগ করছি।
জল মন্ত্রপূত করার পদ্ধতি: কাক ভোরে যে কোন পুকুর থেকে এক ভাঁড় জল এনে রাখতে হয় গুণিনের কাছে। গুণিন বহু রকমের মন্ত্র পড়ে বেশ কিছু সময় ধরে। তারপর সেই জলের মধ্যে এমন ভাবেই ছোট একটা ছুরি চালাতে থাকে যাতে মনে হয় জলকে কয়েক ভাগে ভাগ করা হল। এই সময় গুণিন যে মন্ত্র আওড়ে যায় তা হল এই রকম:
আমি রামচন্দ্রের ছুরি দিয়ে কেটে দিচ্ছি এই জলকে।
দুদিক দিয়েই কাটছি। এই ছুরি সমস্ত কিছু কেটে ফেলে।
এরপর আরো কিছু মন্ত্র পাঠ করে জলে বার কয়েক ফুটিয়ে সেই জল রোগীর সর্বাঙ্গে ছিটিয়ে দেয় গুণিন নিজের হাতে। সব শেষে রোগীকে এক ঢোক জল নিশ্বাস বন্ধ করে গিলে ফেলতে হয়। যে কোন অপদেবতা বা ডাইনীর নজর লাগা অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে এই জলপড়া হল মহৌষধ।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ—
জল, জল, জল, ওহহা গঙ্গার জল!
এই জল যে বড়ই ফলদায়ী।
রোগীর গলায় এই জল যাওয়া মাত্র
সমস্ত বিষ উবে যায়।
বাতব্যাধির নিরাময়ের যাদুমন্ত্র : বাতের ব্যথায় যে ব্যক্তি ভয়ানকভাবে আক্রান্ত, সে একেবারে সুস্থ হয়ে যাবে গুণিনের যাদু চিকিৎসায়। বাতের রোগীকে টান টান করে গুণিন মাটিতে শুইয়ে দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপুড় করেই শোয়ানো হয়। চিকিৎসার পদ্ধতি অবশ্য তেমন কিছু নয়। রোগীর মেরুদন্ডে মুখ ঠেকিয়ে গুণিন একের পর এক মন্ত্র বলে ফুঁ দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে রোগীর পিঠে গুণিনের হাতের দু একটা চাপড় পড়ে। মন্ত্র গুলো বাংলা ভাষায় হলেও তাতে ওড়িয়া ভাষার মিশেল থাকে।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ–
হে নারায়ণ! তুমি এই বাতব্যথার কথা শোন।
শিবঠাকুরের সহযোগী নন্দী, একদা কঠিন বাতের ব্যথায়
আক্রান্ত হয়েছিল।
শিব সেকথা জানতে পেরে নন্দীর গয়ে ত্রিশূল দিয়ে
আঘাত করেছিলেন।
শিব পার্বতী দুজন মিলেই আঘাত করেছিলেন
সেই আঘাতে চৌষট্টি রকমের বাত চোখের নিমেষে
সেরে গিয়েছিল।
বাতের রোগী নন্দীকে আর কোন যন্ত্রণাই তারপর থেকে
আর ভোগ করতে হয়নি।
তুমি কি জানতে চাও কে আমায় আঘাত করার
আদেশ দিয়েছে?
হর পার্বতীই আদেশ করেছেন।”
প্রসব বেদনা উপশমের মন্ত্র : প্রসূতির কোমরে গুণিন যাদুর দড়ি বেঁধে দেয় এবং তাতেই নির্বিঘ্নে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। কোন রকম কষ্ট ভোগ করতে হয় না। যাদুর দড়ি ছাড়াও আরো এক পদ্ধতির প্রচলন আছে। প্রসূতির পায়ের আঙুল থেকে মাথার চাঁদি পর্যন্ত মাপ করে সেই মাপের একটা কলমী লতাকে কয়েকটা টুকরো করে সে গুলোকে পুকুরের জলে দিয়ে আসে গুণিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রসব বেদনার উপশম হয়। কিন্তু প্রসব বেদনা যদি কারো কারো ক্ষেত্রে অসহ্য হয়ে ওঠে তাহলে অপমার্গ নামে এক বিশেষ ধরণের লতা গাছের শেকড় এনে প্রসূতির মাথার চুলে বেঁধে দেওয়া হয়। এতে বেদনার উপশমও যেমন অনিবার্য তেমনি সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রেও বিপদের কোনরকম আশঙ্কা থাকে না।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ—
দেবী বললেন, আমাদের এখন যাওয়া যাক পদ্ম পুকুরে–
পাঁক সরিয়ে বিষ সংগ্রহ করতে। তারা বলে
দেবী শেতলার চরণ হল পদ্ম ফুলের মতই।
পান চুন ও সুপারিতে নেশা হয়। সে যদি এই পান খেয়ে নেয়
তাহলে অশুভ শক্তির প্রভাবে থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
জন্মনিয়ন্ত্রণে : যেকোন মহিলা জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে গুণিনের শরণাপন্ন হতে পারে স্বামীর অনুমতিক্রমে। গুণিন এমন এক গাছের শেকড় নিয়ে আসে যে গাছ বজ্রাঘাতে পূর্ব মুখ হয়ে উপড়ে পড়েছে। শেকড়ের সঙ্গে মন্ত্রপূত দুটি গোলমরিচ বেটে মহিলাকে খেতে হয় স্নান করে উঠে, ভিজে কাপড়ে। এছাড়া আরো একটা পদ্ধতি হল, পান গাছের শেকড়ের সঙ্গে সাতটি গোলমরিচ ও সাবরা (Sabra) মিশিয়ে সেবন করা।
হারিয়ে যাওয়া জীবজন্তু সন্ধানের পদ্ধতি : যে লোকের গোয়াল বা খোঁয়াড় থেকে গরু মোষ ভেড়া বা ছাগল হারিয়েছে বা চুরি গেছে, গুণিন সেই গোয়ালের দরজায় দুছত্র মন্ত্র লিখে দিয়ে আসে খড়ি দিয়ে। তারপর দিক নির্ণয় করে গুণিন লোক পাঠিয়ে দেয় পশুটিকে খুঁজে আনতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পশুর সন্ধান মিলে যায় গুণিনের দিক গণনায়
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ–
“কোন এক কালে কাবীর্যাজুন নামে এক রাজা ছিল। রাজার ছিল এক হাজার হাতী। অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিল ঐ রাজা। গুণিনদের অনেকেই ঐ রাজার নাম করে হারিয়ে যাওয়া গবাদি পশু ফিরে পাবার মন্ত্র উচ্চারণ করে; এবং রাজার নামের মহিমায় গুণিনের কার্য সিদ্ধ হয়।”
অনেক দুষ্ট যাদুকর বা ব্লক ম্যাজিসিয়ান আছে যারা যাদু চালিয়ে গৃহস্থের গরুর বাচ্চার মুখ আটকে দেয়। বাচ্চা মায়ের দুধ খেতে পারে না। গরুও দুধ দুইতে দেয় না। এই অনিষ্ট যাদুমন্ত্র হল এইরকম :
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ—
গলা বন্ধ, গলা বন্ধ, গলা বন্ধ,
বাচ্চার খাদ্যনালির দ্বার হয় রুদ্ধ।
মাতৃ দুগ্ধ পানে বাচ্চা হয় বঞ্চিত।
খাদ্যনালির সমস্ত দিক বন্ধ।
এভাবে বন্ধ করার শক্তি আমায় কে দিয়েছে?
হিং, সিং গি, কেটকি (অর্থহীন বিচিত্র শব্দ মাত্র)
কূট বুড়ি চণ্ডী এবং মা বাশুলী–
আমায় একাজ করার আদেশ দিয়েছেন।
মা বাশুলী যেহেতু আমায় একাজে সাহায্য করেছেন
সেহেতু শ্রীরাম– যিনি মস্তবড় ত্যাগী মহাপুরুষ
সেই তিনিও এর প্রতিকারে অক্ষম।
বাণ লটকানো পদ্ধতি: বাণ চালিয়ে যে কোন সুস্থ লোককে শুকিয়ে শুকিয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেওয়া যায়। এই দুষ্ট ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্যে একান্ত প্রয়োজন চিতার দুটি আধপোড়া কাঠ বা বাঁশ। তাছাড়া, রোদে শুকনো সামান্য পরিমাণ চাল, গুটি কয়েক চিনে গোলাপ ফুল, এক টুকরো সাদা কাগজ, কেরোসিন তেলের বাতির ভূয়ষা দিয়ে তৈরী কালি ও একটি কলম। দুষ্ট যাদুকর যে ব্যক্তিকে মারতে চায় সে ব্যক্তির নাম ঐ কালি দিয়ে কাগজে লিখে মারণ মন্ত্র পাঠ করে এবং নাম লেখা কাগজটি কোন এক জায়গায় লুকিয়ে রাখে। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যায় যে, যাদুকরের উদিষ্ট ব্যক্তি ক্রমেই দেহের শক্তি হারাতে থাকে, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ শিথিল হয়ে আসতে থাকে তার। শেষ পর্যন্ত পঙ্গু অবস্থায় একদিন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। কোন গুণিনের যাদু চিকিৎসাতেও তার প্রাণ রক্ষে হয় না।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ
“হে মা চণ্ডিকে! হে মা কালিকে।
আমি কঠোর আত্ম সংযমী হয়ে–
তোমার চরণ পুজো করব।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই ত্রিমূর্তি সাক্ষী রইলেন,
তুমি ঐ ব্যক্তিকে হত্যা কর।
তোমার অব্যর্থ বাণ চালিয়ে।
হে দেবী! আমি তোমার নামে শপথ করছি–
আমি ঐ ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে
এক ভয়ংকর বাণ মারব।
আমি ফল, ফুল ও মিষ্টান্ন দিয়ে
তোমায় পুজো করছি।
হে আমার ভয়ঙ্কর মৃত্যুবাণ–
তুমি যাও, ঐ ব্যক্তির হৃদয় বিদীর্ণ কর।
শিকার যদি মাটিতে পড়ে যায়, তাহলে তার বুকে
কামড় দিয়ে তাকে রক্তাক্ত কর।
হে মা কালিকে! তোমার সিঁথিতে রয়েছে সিঁদুর–
সততা ও আন্তরিকতা বজায় রাখতে
আমি তোমায় অনুরোধ করি,
ঐ লোকটিকে তুমি নিধন কর –তা না করলে
তুমি রাম সীতা ও প্রাচীন বীরদের মাথা খাবে।
জানতে চাও, এ কাজ কে নির্ধারণ করে রেখেছে?
মা কালী ও মা চণ্ডীই বহু আগে থেকে
সব কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন।”
শত্রু নিধন পদ্ধতি: সংক্রামক যাদু প্রয়োগ করে শত্রু নিধন করতে পারে দুষ্ট যাদুকরেরা। সেই জন্যে বহুরকমের মারণ মন্ত্র ও পদ্ধতির প্রচলন আছে। এখানে গুটি কয়েক পদ্ধতির উল্লেখ করা যায়। সব থেকে সহজ পদ্ধতি হল, তে মাথার মোড়ে মাঝখানে কলাপাতায় মন্ত্রপূত সর্ষে রেখে আসা বিশেষ বিশেষ দিনে। রাতের অন্ধকারেই একাজ করা হয়। তবে সব থেকে কঠিন পদ্ধতি বোধহয় মারণ ক্রিয়ার সাহায্যে বিষধর সাপকে পোষ মানিয়ে ঐ সাপের কামড় খাওয়ান শত্রুকে। আবার যে কোন একটা ধারাল অস্ত্রের সাহায্যে এক কোপে একটা বাঁশের কঞ্চি কেটে সেটিকে মন্ত্রপূত করে খণ্ড খণ্ড করে ঐ অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেলা। টুকরোগুলোকে এমন বিজোড় সংখ্যা হতে হবে যাতে দিয়ে ভাগ করা না যায়। নীচে উল্লিখিত মারণ মন্ত্রটি যেমন বিচিত্র আকারেও তেমনি দীর্ঘ।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ—
“কঞ্চি কাটো টুকরো টুকরো করে।
ধীরে ধীরে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে।
কাটা টুকরো গুলো এখন মন্ত্রপূত হয়ে
এক একটি তীক্ষ্ণ বিষাক্ত বাণে পরিণত হয়েছে।
এগুলি দিয়ে আমি এখন লৌহ হৃদয় বিদীর্ণ করতে পারি
যাও বাণ, এই মুহূর্তে তুমি ছুটে যাও–
তোমার এই কাজে সাহায্য করতে, ডাকিনী, যোগিনী,
যক্ষ, দানব, দুষ্ট বাতাস, ব্রহ্মদৈত্য, পুরুষ, সুপুরুষ,
গৃহদেবতা, কুপুরুষ গৃহ-দুরাত্মা, জল-দৈত্য
প্রভৃতি সকলেই এগিয়ে আসবে।
হে পরম ব্রহ্ম! তুমি অনুগ্রহ করে উপস্থিত হও,
হে মহাপ্রভু বিষ্ণু! ভোলা মহেশ্বরকে সঙ্গে করে
তুমিও উপস্থিত হও।
হে ন্যায়পরায়ণ ভগবান! তোমাকেও আসতে মিনতি করি।
আমার এই সংকল্পের বিরোধিতা করতে কোন
লোক যদি আসেও
তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য।
বংশদণ্ডের আঘাতে তার অলক্ষ্যে তার মস্তিষ্ক চূর্ণ হবে।
শেষ পর্যন্ত যারা সেখানে আছে তারা সবাই
ভয়ে পালিয়ে যাবে;
এবং সেই অবসরে আমার সংকল্প সিদ্ধ হলে।”
সবল সুস্থ মানুষকে বিভ্রান্ত করে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটানো: কেমনভাবে সুস্থ মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়, তার বিচিত্র পদ্ধতি নীচে উল্লেখ করা হল : যে কোন একজন কুবিদ্যাচর্চাকারী বা দুষ্ট যাদুকর গঙ্গা থেকে একটি ইলিশ মাছ। ধরে মাটিতে পুঁতে দেয় শনিবারের বার বেলায়। একমাস পর মাটির নীচে থেকে মাছের গলা পচা আঁশ কাটা যা পায়, তা সযত্নে তুলে নিয়ে আসে ঐ যাদুকর–সেগুলোকে রোদে ভালো করে শুকিয়ে নিয়ে এক পাত্র জলের মধ্যে মন্ত্র পড়ে সেগুলো ছেড়ে দেয়। যে ব্যক্তির মস্তিষ্ক বিকৃত করার সংকল্প করে বাড়ীর আশে পাশে যে কোন জায়গায় মাছের পাত্র রেখে দিয়ে আসে রাত্তির বেলায়। আবার ঐ মাছের পাত্রে এমন এক সুগন্ধী ফুল ভিজিয়ে রাখে যার গন্ধ কেবল ওই ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ পাবে না দুষ্ট মন্ত্রের প্রভাবে। ফুলের গন্ধ পাবার পর থেকেই ঐ ব্যক্তির মাথায় নানা রকমের গোলমেলে চিন্তা শুরু হয়ে যায়। মাত্র দিন দশেকের মধ্যেই সে সবার কাছে বিকৃত মস্তিষ্ক বলে প্রতিপন্ন হয়। ঘর ছেড়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায় অনাহারে অনিদ্রায়।
বশীকরণ পদ্ধতি : যে কোন মেয়ে বা পুরুষকে বশ করার জন্যে দুষ্ট যাদুকরেরা যে প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি অবলম্বন করে তা এখানে উল্লেখ করা হল :
মাটির ভঁড়ে সপ্ত পুষ্করিণীর জল সংগ্রহ করতে হয় চন্দ্র গ্রহণের সময়। সেই রাত্রেই দুই রাস্তার মোড়ে বসে এক মুঠো চালের ভাত ফোঁটাতে হয় সামান্য একটু আগুন জ্বেলে। কিন্তু সে আগুণ বলতে পাতা নাতা বা কাঠের জ্বাল নয়। ঐ আগুন জ্বালানোর বিশেষ কটি উপাদানের প্রয়োজন। সেগুলি হল, কাকের বাসাভাঙা কাঠি, মৃত সধবার হাতের বালা চুড়ি (কঁচের হলেও হবে) বাজু ইত্যাদির টুকরো এবং শ্মশানের আধপোড়া কাঠের সামান্য অংশ। নিদারুণ সতর্কতার সঙ্গে কোন মতে চাল ফুটিয়ে নিয়েই তা মেখে ফেলতে হয় পশুর পচা চর্বি দিয়ে। সব থেকে ঐ ভাত বাবলা গাছের গোড়ায় ছিটিয়ে দিয়ে আসতে হয় উর্দিষ্ট নারী বা পুরুষের নাম করে। এই বশীকরণ ক্রিয়া সম্পন্ন হবার কিছুদিনের মধ্যেই উক্ত নারী বা পুরুষ গুণিনের হাতের মুঠোয় এসে যেতে বাধ্য হয় এবং গুণিনের যা কিছু চাহিদা তা তাকে মুখ বুজে পূরণ করে যেতে হয়।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ—
“এটি একটি যাদু, একটি অলৌকিক ঘটনা–
বশ করার যাদু, অধিকার করার এক বিস্ময়কর যাদু,
সমস্ত দিকেই এ যাদু কাজ করে
যে কোন স্ত্রী বা পুরুষের ওপর প্রভাব বিস্তারে
সদাই ছুটে যায় এ যাদু।
যে নারীকে আমি একান্তভাবে কামনা করি
এ যাদুমন্ত্র তাকে অনায়াসেই নিয়ে আসে।
শিবদুর্গার আশীর্বাদেই আমার গুপ্তযাদুক্রিয়া
সফল হয়, সার্থক হয়।
দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন করার পদ্ধতি: স্ত্রীকে ত্যাগ বা তালাক দেবার ইচ্ছে যে কোন পুরুষের মনে একবার উদয় হলেই হলো, চিন্তার কিছু থাকেনা। গুণিনই সে ইচ্ছে পূরণ করে দেয় খুব সহজেই। খরচ খর্চারও তেমন কোন ব্যাপার থাকে না। এই কাজে যে পদ্ধতির অনুসরণ করতে হয় তা মোটেও কঠিন নয়, খুবই সহজ। সামান্য একটা মাটির প্রদীপে গাওয়া ঘিয়ে সলতে ধরিয়ে গুণিনের গুপ্তক্রিয়ার সূচনা। সলতে হওয়া চাই সাদা কিম্বা একরঙা কাপড়ের। তে রাত্রের তিনটে প্রদীপের আধপোড়া সলতে একসঙ্গে রাখতে হয় নিজের কাছে, অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে ত্যাগ করতে যাচ্ছে। নিশুত রাতে গুণিন ঐ সলতেগুলোকে মন্ত্রপূত চাকু দিয়ে সমান ন টুকরো করার নির্দেশ দেয় এবং গুণিনের সঙ্গে ঐ ব্যক্তিকে সমানে মন্ত্রোচ্চারণ করে যেতে হয় বেশ কিছু সময় ধরে। সারা রাত জলস্পর্শ করবে না সে গুণিনের বিধানে।
প্রাসঙ্গিক মন্ত্রের সরল অনুবাদ— “ওম, বেং, নিং মিং (বিচিত্র শব্দ) আমায় সাহায্য কর।
তুমি দয়া করে ঐ ব্যক্তির বুকের ভেতর আগুন জ্বালাও
হে মহাভৈবর! তুমি একাজে আমায় সহায় হও।
ঐ নারীর বুক ভেঙে যাবে– মন বিক্ষিপ্ত হবে।
সে তার স্বামীর আশ্রয় হারাবে।
সমস্ত রকমের দাম্পত্য সম্পর্ক খুইয়ে ফেলবে
এইভাবে সে আমার কাছ থেকে
একেবারে বিচ্ছিন্ন হবে।
তাকে ত্যাগ করার নির্দেশ কে আমায় দিয়েছিলো?
পৌরাণিক যুগের রাজা ভোজ দিয়েছিল
আমাকে এই নির্দেশ।