৪. গুপ্তচরবৃত্তির কলাকৌশল

অধ্যায় : ৪ – গুপ্তচরবৃত্তির কলাকৌশল

The Spy Strategy

সাধারণ জনগণের ধারণানুযায়ী গোয়েন্দা বৃত্তিতে নিয়োজিত একজন ‘অপারেটর’ সবক্ষেত্রেই একজন ‘গুপ্তচর’। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা তা নয়। তবে তিনি (অপারেটর) গোয়েন্দা কার্যক্রমের কলাকৌশল ও গুপ্তচরবৃত্তির ধরণ সম্পর্কে ধারণা রাখেন। ‘র’ স্থাপনার একজন প্রশিক্ষকের মতে, “পূর্বে এমন একটা সময় ছিল যখন, আই বি-র (Intelligence Bureau) ট্রেনিং সেন্টারে অফিসারদের গুপ্তচরবৃত্তির ব্যাপক কলাকৌশল সম্পর্কে বিশদ প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। পরবর্তীতে অন্য গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ করে রাশিয়ার গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ স্কুলের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এ ধরনের প্রশিক্ষণে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয় বেশি।” সুতরাং অল্প কিছুদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, বিভিন্ন পেশার অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের শুধু তাদের বিশেষ সুনির্দিষ্ট কাজ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

ক। সংগঠন (The Organization)

দেশের বিশেষ চাহিদা বা প্রয়োজনের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে এমন একটি সংস্থা হিসেবে ‘র’-কে সংগঠিত করা হয়েছিল। এর আসল উদ্দেশ্য ছিল তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেশের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা। শুধু দেশের বাইরে ‘র’-এর কার্যক্রম বিস্তৃত এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে-এর কোনো ‘ভূমিকা’ প্রযোজ্য নয়। এর উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ‘জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করার পর তার পরিচালক নির্বাচিত হন ভারতীয় সরকারের একজন ‘সচিব’ পদমর্যাদার কর্মকর্তা। ‘র’ প্রধান ও জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স কমিটির পরিচালক উভয়েই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীন বলে বিবেচিত হন। ‘র’- পরিচালকের অধীনে ভারত সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব ‘অফিস অব স্পেশাল অপারেশনস’ (OSO) এবং বিভিন্ন দেশ হতে গোয়েন্দা তথ্যাদি সংগ্রহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। এ ছাড়াও তিনি ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা”, “ইলেক্ট্রনিক টেকনিক্যাল সেকশন’ ও ‘সাধারণ প্রশাসন’ বিভাগের তদারকি করেন। অতিরিক্ত সচিবের মতো মহাপরিচালক নিরাপত্তাও (DG Security) ‘র’ প্রধানের আওতাধীনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন। এগুলো হচ্ছে ‘এভিয়েশন রিসার্চ সেন্টার’ (ARC) ও ‘স্পেশাল সার্ভিস ব্যুরো’ (SSB)।

অতিরিক্ত সচিবের (Addl Director RAW) অধীনে পাঁচজন যুগ্ম সচিব’ (Jt. Directors) কর্মরত থাকেন। যাদের চারজন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ও পঞ্চম জন ‘ইলেক্ট্রনিক’, ‘প্রশাসনিক’ ও ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা’ বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন। ‘কাউন্টার এসপায়োনজ’ যা প্রাথমিক পর্যায়ে ‘র’-এর দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল তা আই বি-র (IB) আওতায়ই থেকে যায়।

চারজন যুগ্ম পরিচালক (Jt. Director) পৃথিবীর নির্দিষ্ট অংশের জন্য সুনির্দিষ্ট চারটি ভিন্ন ‘ডেস্ক’ নিয়ন্ত্রণ করেন। এর মধ্যে প্রথম এলাকা হচ্ছে পাকিস্তান, দ্বিতীয় এলাকা চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, তৃতীয় এলাকা মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা এবং চতুর্থ এলাকা পৃথিবীর অন্যান্য স্থান/দেশ (চার্ট দ্রষ্টব্য)। এ সব ডেস্কের সাথে ক’জন ‘ডেস্ক অফিসার’ সংযুক্ত থাকেন, যিনি ‘সদর দপ্তর’ ও ‘বিদেশী স্থাপনা’ (Overseas stations) এবং ‘স্থাপনা প্রধানদের’ (Station Cheif) মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেন। ‘ডেস্ক অফিসার’ হচ্ছেন ‘স্থাপনা প্রধানের’ সাথে মূল সংযোগকারী, যেখানে ‘স্থাপনা প্রধান’ ‘কেস অফিসার’ (Case officer) ও অন্যদের তদারক করেন এবং তিনি (Station Cheif) সাধারণত দূতাবাসে কোনো ‘লোক দেখানো’ আবরণের আড়ালে (Under cover) ( যেমন- কালচারাল অ্যাটাশে বা ফার্স্ট সেক্রেটারি) কর্মরত থাকেন। ‘ডেস্ক অফিসার’ আবার তাঁর প্রতি বরাদ্দকৃত বিভিন্ন রেকর্ডপত্র সংরক্ষণের গুরু দায়িত্বও বহন করেন। এ ক্ষেত্রে ‘কেস অফিসার’ তাঁকে আদিষ্ট ‘অপারেশনের’ জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি প্রেরণ করে থাকেন। সাধারণত একটি ‘অপারেশন’ বা ‘প্রজেক্টের’ জন্য একজন ‘কেস অফিসার’ নির্দিষ্ট থাকেন। তবে মাঝে মাঝে ক্ষেত্র বিশেষে তাঁকে অন্য আরো দু’একটি ‘প্রজেক্ট’ তদারকি করতে হতে পারে। ‘কেস অফিসার’ বিভিন্ন সময় ‘প্রধান এজেন্ট’-এর (Principal Agent) সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন, যিনি (প্রধান এজেন্ট) আবার অন্যান্য ‘এজেন্ট’ ও ‘কেস অফিসারের’ মধ্যে প্রধান যোগাযোগকারী এবং সাধারণত তিনি ‘এজেন্টদের’ স্বদেশীয়-স্বজাতি বা স্বগোত্রীয় হয়ে থাকেন।

একজন ‘এজেন্ট’ যিনি তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেন, তিনি যে দেশে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালানো হয় সেদেশীয় নাগরিক হিসেবে পরিচিত। আসলে একজন ‘এজেন্টই’ হচ্ছে একজন প্রকৃত ‘গুপ্তচর’। একটি গোয়েন্দা অপারেশনে প্রধান অবলম্বন হলো একজন ‘রাজ প্রতিনিধি’ (Resident) (যিনি দূতাবাসে কূটনীতিক হিসেবে সাধারণত Resident Agent হিসেবে গোয়েন্দা জগতে পরিচিত) যিনি বিভিন্ন চলমান অপারেশন বা গোয়েন্দা কর্মকাজের গতিবিধির সাথে সমান তাল রক্ষা করে অপারেশনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। একজন ‘Resident Agent’ কখনই প্রকাশ্যে বা সরাসরি কোনো গোয়েন্দা কার্যক্রমের সাথে নিজেকে ঘুণাক্ষরেও জড়িয়ে ফেলেন না। তিনি সাধারণত অপারেশনের পরপর সবকিছু ঠিকঠাক করতে বা প্রমাণ নষ্ট করতে চেষ্টা করেন ও যদি অপারেশন ব্যর্থ হয় তবে বিভিন্ন দিক সামাল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মাত্র। কখনো কখনো অবশ্য তিনি ‘কেস অফিসার’, ‘স্থাপনা প্রধান’ ও ‘অপারেশনের’ সমন্বয় সাধনও করে থাকেন।

জনমনে সাধারণত ইন্টেলিজেন্স (Intelligence) ও এসপায়োন’ (Espionage) শব্দ দুটি নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয় এবং স্বভাবতই এ দুটিকেই ‘গুপ্তচরবৃত্তির’ সমার্থক বলে ধারণা করা হয়। আসলে ‘ইন্টেলিজেন্স’ বলতে যখন কোনো দেশ তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের যে চেষ্টা চালায় তাকে বোঝানো হয়; সেখানে তথ্য সংগ্রহকারী সংস্থা বিভিন্ন দেশের সশস্ত্র বাহিনী, সরকার, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প এমনকি গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। এ ব্যাপারে মাইলস্ কপল্যান্ডের (Miles Copeland) ভাষায়, “যে কোনো সরকারি কর্মকর্তা, তিনি যে কোনো পর্যায়েই কর্মরত থাকেন না কেন, যখন তিনি সরাসরি গোয়েন্দাবৃত্তির জন্য তথ্য সংগ্রহ করেন তখন তাকে একজন ইন্টেলিজেন্স’ কর্মকর্তা বলা যায়। এ সমস্ত কর্মকর্তা হতে পারেন- রাষ্ট্রদূত, অ্যাটাশে (সামরিক, নৌ, বিমান), সিভিল এভিয়েশন, বাণিজ্যিক, পেট্রোলিয়াম অথবা কৃষি সংক্রান্ত অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রের কর্মকর্তা, এমনকি প্রশাসনিক ও উপদেষ্টার কাজে নিয়োজিত ছাড়া সকল দূতাবাস কর্মকর্তা/কর্মচারীই ইন্টেলিজেন্স’-এর সাথে জড়িত থাকতে পারেন।”

কিন্তু ‘এসপায়োনজ’ একটি ভিন্ন ধরণের গোয়েন্দাবৃত্তি যা সাধারণত, যে সব তথ্য স্বাভাবিকভাবে সংগ্রহ করা যায় না, তা সংগ্রহের ওপর জোর দেয়। ইন্টেলিজেন্সের মতো ‘নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের’ একই উদ্দেশ্যে এক্ষেত্রে ‘বিশেষ অপারেশনের’ মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। বর্তমানকালে, একটি বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থাকে’ বিভিন্ন রকম কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। সে ক্ষেত্রে কখনো মুক্ত স্বাধীনভাবে প্রাপ্ত তথ্য সংগ্রহ ও এর বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে জটিল বিশেষ অপারেশন পর্যন্ত-এর আওতার মধ্যে পড়ে এবং এগুলো পরিচালনার জন্য সাধারণভাবে পরিচিত একটি ‘স্পাইস্কুলের’ প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি।

খ। গোদাদিয়া হোস্টেল (The Godadia Hostel)

‘র’-এর জন্য প্রথম প্রশিক্ষণ স্কুল স্থাপন করা হয় ‘গোদাদিয়া হোস্টেলে’। এ স্থানটি ছিল নয়াদিল্লির একপ্রান্তে একটি একমুখী রাস্তার ওপর ‘আনন্দ পর্বত’ পাহাড়ের চূড়ায়। এ ভগ্নপ্রায়, জীর্ণশীর্ণ আদিম প্রশিক্ষণ শিবিরটি দীর্ঘদিন থেকেই প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হয়তো বৃটিশদের কাছ থেকে এ পরিবেশে প্রশিক্ষণ পাওয়ার জন্য আই বি (IB) কর্মকর্তারা এ ধরণের একটি স্থান প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন করেছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বৃটিশরা ‘জেলখানায়’ তাদের গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতো এবং এ ধরণের একটি ‘গোপনতার বাতিক’ থেকেই সম্ভবত আই বি কর্মকর্তারা আনন্দ পাহাড়ে, গোদাদিয়া হোস্টেলকে বেছে নিয়েছিলেন। এ স্কুলভবনটি ‘র’ প্রতিষ্ঠার পর কিছুদিন তাদের নতুন রিক্রুটদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।

গ। বসন্ত বিহার ভবন (The Vasant Vihar House)

‘র’-এর সংগঠন বৃদ্ধির সাথে সাথে সমানুপাতিক হারে এর চাহিদারও বৃদ্ধি ঘটে। তাই দক্ষিণ দিল্লির আবাসিক এলাকার একটি সিনেমা হলের পিছনে একটি নতুন বাড়ির দখল নেয়া হয়। পরে স্থান পরিবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত এ বাড়িতেই কাজ চালানো হতে থাকে। তখন রাজধানীতে প্রয়োজনীয় স্থানের দুষ্প্রাপ্যতা এ ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে। ১৯৭০ সালের শুরুতে অনেক ব্যাপক পরিসরের একটি জায়গা চিহ্নিত করা হয়। সেটি ছিল ‘বসন্ত বিহার’ আবাসিক এলাকায় একজন প্রাক্তন বিমান বাহিনী প্রধানের বাড়ি।

‘বসন্ত বিহারে’ ‘র’ স্কুল স্থানান্তরের সাথে সাথে দু’পাশে দুটি চারতলা সহযোগী বিল্ডিংসহ ‘র’-এর নিজস্ব এগারতলা বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনাকারীরা সব অপারেশনাল শাখাসহ পুরো সংস্থাটিকে ‘একই ছাদের নিচে আনার’ ধারণা কার্যকর করেন। এ সিদ্ধান্ত শুধু নিরাপত্তার খাতিরেই নয় বরং সংস্থাকে সাবলীল ও স্বল্পখরচে পরিচালনার জন্যও প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ‘র’ অফিসসমূহ প্রথম দিকে কাছাকাছি বা একত্রে অবস্থিত ছিল না যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে। কারণ এগুলো রাজধানীর বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। সে সময় ‘র’ প্রধান বিজয় চকের কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের দক্ষিণ ব্লকে বিভিন্ন পর্যায়ে সমন্বয়ের জন্য অল্পকিছু কর্মচারী দিয়ে তাঁর কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন। অন্যদিকে অন্যান্য বিভিন্ন বিভাগগুলো ছিল অফিসপাড়ার পূর্ব ব্লকের দু’টো তলায়, কিছু ‘কনট প্লেসের’ দোকান ও ব্যবসা-বাণিজ্য এলাকার উঁচু বাড়িগুলোয়, কিছু এফ আই সি সি আই বিল্ডিং- এ (যা বর্তমানে Natural History Museum) এবং স্পেশাল অপারেশন শাখার অফিস ছিল রামকৃষ্ণ পুরমে। এগুলো সবই ছিল ভাড়া করা বাড়ি। এ প্রেক্ষিতে ‘র’-এর জন্য নতুন কমপ্লেক্স তৈরির প্রকল্প অনুমোদন করা হয় এবং ১৯৭৬ সালে ‘নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের’ জন্য ‘মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস’ (MES) কে ওই কমপ্লেক্স তৈরির জন্য নিযুক্ত করা হয়।

কিন্তু হঠাৎ কংগ্রেস সরকারের পতনে ও কিছুটা আমলাতান্ত্রিক লালফিতার দৌরাত্ম্যে ‘র’ অফিসসমূহ একত্রীকরণের স্বপ্ন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। যদিও বাড়ি তৈরি অব্যাহত থাকে তবে দিল্লিওয়ালারা’ ‘স্পাই হাউস’ (Spy House) নামে এর নামকরণ করেন। ‘র’-এর নিজস্ব সুবৃহৎ বাড়ি (Mansion) তৈরির প্রচেষ্টাকে অভিহিত করা হয় পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ বলে। জনতা সরকার ক্ষমতায় আসার পরপর অতিউৎসাহী কিছু ব্যক্তি, ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে ‘র’-এর বিভিন্ন রক্তাক্ত খুনাখুনি ও দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্ত ক্ষেপের বিষয়ে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দেন। বিভিন্ন জনের অপপ্রচারেও ‘র’-এর এধরণের ভাবমূর্তির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন আদেশ দেয়া হয়, যেখানে ‘র’-কে নতুন তৈরি কমপ্লেক্স অন্যান্য সংস্থার সাথে ভাগাভাগি করে অফিস স্থাপনের জন্য বলা হয়। সুতরাং একই বাড়িতে ও একই ছাদের নিচে সকল স্থাপনার (one roof conceptt) চিন্তা বিনা আপত্তিতে ত্যাগ করে ‘র’ চুপচাপ অন্য পন্থা গ্রহণ করে। এ পরিণামদর্শী গোপন ব্যবস্থায় ‘র’-এর ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা কিছু কম পরিচিত স্থাপনা ও শাখাকে ওই বাড়িতে স্থানান্ত র করেন যা পরে অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে বিবেচিত হয়েছিল। ‘র’-বিরোধী চক্র এ ধরণের কোনো ব্যাপার সন্দেহ করার পূর্বেই ঘটনার আবর্তনে কংগ্রেস (আই) সরকার আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে এবং এর সাথে সাথে ‘র কমপ্লেক্স’ নিয়ে সকল জল্পনা-কল্পনা, হৈ হুল্লোড় ধীরে ধীরে থিতিয়ে যায়।

ঘ। প্রশিক্ষণ স্কুল (Training School)

প্রশিক্ষণ স্কুল যা ‘হাউস’ নামে চিহ্নিত তা পরিচালক প্রশিক্ষণসহ পাঁচজন প্রশিক্ষক দ্বারা পরিচালিত হয়, যার সকলেই স্থায়ীভাবে নিয়োগকৃত। ১৯৭০ সালে বৈদেশিক ইন্টেলিজেন্সের সাথে সম্পর্কিত স্কুলের প্রশিক্ষণ এ স্কুলের আওতায় আনা হয়। ‘ডিরেক্টরেট জেনারেল অব সিকিউরিটির’ অধীন সকল এজেন্সিও এর সীমারেখায় পড়ে। তবে টেকনিক্যাল ও বিশেষ কোর্সের অপারেশনাল ট্রেনিংয়ের জন্য অন্যান্য সংস্থার প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণের সাহায্য চাওয়া হয়। মোটামুটি এভাবে সকল প্রশিক্ষণ একই জায়গায় দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে।

শুরুতে ইন্টেলিজেন্স জগতে নতুন যোগদানকারী প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে ‘র’ প্রশিক্ষকরা দারুণ সমস্যায় পড়ে যান। সে সময় ১৯৬৮ সালের দিকে বিভিন্ন সংস্থা থেকে ‘র’ কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হয়, যারা অনেকেই ছিলেন পুলিশ, আই বি ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য। ইতোমধ্যেই এরা তাদের পূর্বের সংস্থায় একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর হঠাৎ করে “ইন্টেলিজেন্স’ ও ‘এসপায়োনজ’ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণে বেশ অসুবিধার মধ্যে পড়ে যান। একজন প্রশিক্ষক পরে মন্তব্য করেন “এ সমস্ত নতুন প্রশিক্ষণার্থীদের প্রায়ই বৃটিশ, রাশিয়ান ও আমেরিকান গুপ্তচরদের বিভিন্ন উদাহরণ দেয়া হতো এবং তারা প্রতিনিয়তই একইরূপ ভারতীয় গুপ্তচরের কোনো ঘটনা শোনার আগ্রহ দেখাতো, কিন্তু ‘র’-এ ধরণের খেলায় (গুপ্তচরবৃত্তিতে) নতুন হওয়ায় ওইরূপ উদাহরণ দেয়া বেশ কঠিন ছিল।” গুপ্তচরবৃত্তির উদাহরণ টানা একজন প্রশিক্ষকের কাছে খুবই প্রিয়, কারণ এটা শুধু শুনতে ভলো লাগে তাই নয় বরং এ ধরণের বিভিন্ন কাহিনী পার্থিব ‘এসপায়োনজ’ বিষয়াবলীর মধ্যে আনন্দদানেও সক্ষম।

ঙ। মনভোলানো কথার মায়াজাল (Pep talk)

‘র’ প্রশিক্ষণ স্কুলে আলোচিত (Pep talk) ‘মনভোলানো কথামালা’ অন্যান্য প্রশিক্ষণ স্কুলে আলোচিত কথামালার (Pep talk) অনুরূপ। এ সব শুরু করা হয় নতুন রিক্রুটদের কল্পজগতের গুপ্তচরবৃত্তির কল্পকাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাস্তব ইন্টেলিজেন্স’ ও ‘এসপায়োনজ’ জগত সম্পর্কে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য। একইভাবে এ সব বর্ণনা এক সপ্তাহ থেকে দশদিন পর্যন্ত চলে। একজন প্রশিক্ষক এ ব্যাপারে উল্লেখ করেন, “একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় উদাহরণ যা কোর্সের শুরুতে প্রায়ই উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এটি হচ্ছে, সুইজারল্যান্ডে বসবাসকালীন একজন তরুণ গোয়েন্দা এজেন্ট মধ্যস্থতাকারী এক ব্যক্তির মাধ্যমে একজন বিদঘুটে সাংবাদিকের সাথে কিছুক্ষণ ‘গালগল্প’ বা আড্ডা মারার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন; সেই চরম রাজনৈতিক মতাবলম্বী’ সাংবাদিকের বিশেষভাবে উল্লেখ্য করার মতো ‘কোদাল সদৃশ’ দাড়ি ও ‘তীক্ষ্ণভেদী’ একজোড়া চোখ ছিল। কোনো কারণে এজেন্ট ভদ্রলোক সময় করে উঠতে পারেননি এবং অবশেষে সেই সাংবাদিক রাশিয়ায় সংঘটিত বিপ্লবে অংশ নিতে সুইজারল্যান্ড ত্যাগ করেন। তাঁর নাম ছিল ‘নিকোলাই লেনিন’ ও এজেন্ট ভদ্রলোক ছিলেন ‘এলেন ডুলেস’।” এই এলেন ডুলেস পরবর্তীতে আমেরিকার সি আইএ’র গঠনে স্থপতির ভূমিকা পালন করেন, যিনি প্রায়ই বলতেন যে, “তুমি কখনই জানো না কখন বা কোথায় বজ্রপাত আঘাত হানবে।” (যদিও এলেন ডুলেস প্রকৃতার্থে একজন এজেন্ট ছিলেন না তবে তিনি ছিলেন একজন “ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভ’)। উল্লেখ করা যায় যে সব গুপ্তচর ধরা পড়েছেন, তাদের উদাহরণ বা ঘটনা ব্যর্থতার সমার্থক/পরিচায়ক বলে প্রশিক্ষণ স্কুলে ‘ভালো উদাহরণ’ রূপে গণ্য করা হয় না।

একটি দেশের সার্থক গোয়েন্দা ‘কেস স্টাডি’ থেকে কতটুকু শেখা যায় তা বিতর্কের ব্যাপার। কারণ প্রত্যেকটি অপারেশন ভিন্ন প্রকৃতির এবং কার্যক্ষেত্রে ও রাজনৈতিক বিবেচনায় উভয় পর্যায়েই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা এবং পরিস্থিতিতে অপারেশন পরিচালিত হয়ে থাকে।

দুটো ঘটনা ও অপারেশন কখনো একরকম নয়। কারণ প্রত্যেকটি ভিন্ন জনগোষ্ঠী ও ভিন্ন সংস্কৃতির আলোকে অপারেটরদের নিজস্ব রুচি ও প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে পরিচালনা করতে হয়। বড়জোড় এ সব ক্ষেত্রে ‘এসপায়োনজ’ কার্যক্রমের ‘অনুভূতি’ প্রয়োগ করা যায়, কিন্তু ভিন্ন স্থানে একইরূপ পরিস্থিতির জন্য কোনো নির্দিষ্ট ‘কার্য সাধন প্রণালী’ নির্দেশ করা সম্ভব নয় এবং সেখানে অন্যরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে। অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা যেমন সি আইএ, কেজিবি, চাইনিজ সিক্রেট সার্ভিস, এমনকি পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিও সাধারণত অনুরূপ ভিন্ন পটভূমি ও শিক্ষায় গড়ে উঠেছে। তাদের ‘লক্ষ্য’ ও ‘উদ্দেশ্য’ ভিন্ন এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থার মধ্যে তারা তাদের কাজ চালিয়ে যায়। তাদের কর্মক্ষেত্রে একমাত্র মৌলিক সাদৃশ্য হচ্ছে যে, তারা সকলেই ‘ইন্টেলিজেন্স’-এর জন্য তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত।

চ। প্রশিক্ষণের প্রবহমানতা (The Training Continues)

বৃটিশ ইন্টেলিজেন্স থেকে ধার করা আপ্তবাক্যসমূহ ‘র’-এর প্রশিক্ষণে অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যবহৃত হয়। কারণ এর কিছু অংশ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, আর বাকিটা ‘ভালো উদ্ধৃতিরূপেই’ উল্লিখিত হয়, যেমন- “একটি উৎকৃষ্ট এসপায়োনজ অপারেশন একটি উৎকৃষ্ট বিয়ের মতো,”। “এটা কোনো ঘটনাই নয়, এখানে কোনো ভালো গল্প হতে পারে না।”

এরমধ্যে নতুন প্রশিক্ষণার্থী মাত্র দশদিনের সীমিত সময় পার করার পর আসল গোয়েন্দাবৃত্তির যৎসামান্য প্রক্রিয়া রপ্ত করতে পারে, যা দ্বারা সে দেশের ‘বন্ধু’ ও শত্রু’র মধ্যে পার্থক্য করার কৌশল সম্পর্কে অবগত হয়। সে আরো বুঝতে পারে যে, একটি গোয়েন্দা সংস্থা মূলত: শত্রু থেকে বন্ধুর পার্থক্য নির্ণয় করে না, বরং দেশের পররাষ্ট্রনীতি সে কাজটি সঠিকভাবে সমাধা করে থাকে।

পরবর্তী কোর্সে তাকে বিভিন্ন নিত্য কর্তব্যকর্মে নিয়োজিত করা হয়, যেখানে সে বিভিন্ন দাপ্তরিক ফর্ম (Forms), তথ্য শ্রেণীবিন্যাস এবং বিভিন্ন দপ্তর ও আন্তঃদপ্তর লিপি, ‘অপভাষা’ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এ সমস্ত একঘেঁয়ে ব্যস্ততা থেকে আপাত কোনো মুক্তি নেই। কিন্তু এ পর্যায়েই সে ক্ষণস্থায়ী কোনো ঘটনা বা দ্রুত শোনা কোনো কথা থেকে ‘কি ঘটতে যাচ্ছে’ তা অনুভব করতে পারে যা পরবর্তী ‘বিশেষ প্রশিক্ষণের’ সাথে সম্পর্কযুক্ত। এভাবে পর্যায়ক্রমে সে প্রথমবারের মতো দাপ্তরিক কার্যাবলী সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে ‘লাল ফিতার’ বাধা অতিক্রম করার কৌশল তার করায়ত্ত হয়।

দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রশিক্ষণে, প্রশিক্ষণার্থীকে সুদূর সীমান্ত এলাকায় পাঠানো হয়, যেখানে একজন ‘সেল অফিসারের’ সাথে এফ আই বি’তে (Field Intelligence Bureau) তাঁকে সংযুক্ত করা হয়। এফ আই বি’তে তাকে ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত সংযুক্ত থাকতে হতে পারে। এখানেই সে প্রথমবারের মতো অফিস অব স্পেশাল অপারেশনস’ (OSO)-এর অধীনে পরিচালিত বিপদসংকুল স্থানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কোনো গোপন (Clandestine) অপারেশনের গুরুত্ব বুঝতে শিখে। ‘রাত্রিকালীন মহড়ায়’ তাঁরা সীমান্ত প্রহরা এড়িয়ে কাঁটাতারের বেড়ার নিচ দিয়ে সীমান্ত পার হওয়ার মহড়া দেয়। সীমান্ত প্রহরীর দায়িত্ব পালনকারী ‘স্পেশাল সার্ভিস ব্যুরো’ (SSB) নামের আরেকটি গোপন গোয়েন্দা শাখার সদস্যদের সাথে পুরোপুরি বাস্তব অবস্থার আলোকেই এ সব মহড়া পরিচালনা করা হয়। যদিও মহড়াকালীন তাদের ‘সীমান্ত প্রহরীদের’ হাতে ধরা না পড়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয় কিন্তু অনভিজ্ঞ বলে প্রতিনিয়তই তারা ধরা পড়ে ও ব্যাপক ‘নকল’ (Simulated)।

জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হয়। (প্রকৃতপক্ষে Simulated Interrogation-এর আসল জিজ্ঞাসাবাদের সব মজাই পাওয়া যায়)। এ ‘নকল জিজ্ঞাসাবাদ’ প্রশিক্ষণের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাধারণত ছোট শহর ও গ্রামের পাশে এ সব গুপ্তচর মহড়ার (Spy game) আয়োজন করা হয়।

প্রশিক্ষণের পরবর্তী পর্যায়ে ‘নকল শত্রু এলাকায়’ প্রতিকূল পরিবেশে প্রশিক্ষণার্থীকে ‘কন্টাক্ট’- এর সাথে যোগাযোগ করতে হয় (Contact বলতে গোয়েন্দাবৃত্তিতে নির্দিষ্ট কোনো লোক/ এজেন্ট বোঝায় যার মাধ্যমে শত্রু এলাকায় যোগাযোগ করা হয় তথ্য আদায় বা পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানার জন্য)। এ ক্ষেত্রে তাঁরা (প্রশিক্ষণার্থীরা) ‘নকল শত্রু এলাকা’ পরিদর্শন/পরীক্ষা করে, একটি ‘সেফ হাউস’ (গোপনে দেখা করা বা তথ্য আদান-প্রদানের জন্য কোনো একটি বাড়ি/স্থাপন বা জায়গা ঠিক করতে হয়, এ জায়গাকেই Safe House বলে) খুঁজে বের করে এবং তাঁদের মিলিত হবার নির্দিষ্ট স্থান (Rendezvous = R.V) চিহ্নিত করে। এ ধরণের মহড়ায় অনেক সময় সন্দেহজনক ঘোরাফেরার কারণে স্থানীয় জনগণ কর্তৃক প্রশিক্ষণার্থীদের ধরে পুলিশে সোপর্দ করার ঘটনা ঘটে, যেখানে পুলিশ তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সম্পর্কে কিছুই জানে না। একবার নতুন রিক্রুটের এভাবে ধরা পড়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একজন প্রশিক্ষক উল্লেখ্য করেন, “ওই সব এলকার জেলখানাগুলো না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, ওগুলো কী ধরণের জঘন্য, আর একরাত ওখানে কাটানো দুঃস্বপ্ন বৈ কিছুই নয়। খুব কম লোকই জামিনে ছাড়া পাওয়ার আগে এ কষ্ট সহ্য করতে পারে।”

‘নকল পরিস্থিতি’র প্রশিক্ষণ একজন রিক্রুটকে শত্রু এলাকায় কিভাবে কাজ করতে হয়, সে বিষয়ে অভিজ্ঞ করে তোলে। সীমান্ত এলাকার প্রশিক্ষণ গোয়েন্দা কার্যক্রম সংক্রান্ত ‘আসল অনুভূতির’ প্রকাশ ঘটায়। ভারতের পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব সীমান্ত এ ধরণের বিশেষ অপারেশনে কোনো কৃত্রিমতা ছাড়াই প্রশিক্ষণের উপযুক্ত স্থান বলে চিহ্নিত। শহরে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পর্বতসঙ্কুল এলাকায় কাজ করার জন্য অতি উচ্চতায় ও হিমালয়ের নিম্নাঞ্চলে এবং পূর্বাঞ্চলের বৃষ্টিস্নাত জঙ্গলেও প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। শেষ পর্যায়ের প্রশিক্ষণ সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়; শুধুমাত্র OSO-এর (Office of Special Ops) বিশেষ শাখায় যারা পরবর্তীতে কাজ করবে তাদের জন্য নির্দিষ্ট। বিজন এলাকা ও শহরে ঘনিষ্ঠ তদারকিতে পরিচালিত প্রশিক্ষণের পর প্রশিক্ষণার্থীদের তৈরি করা হয় ‘শেষ পর্যায়ের ঘষামাজার’ (Final Polishing) জন্য। এ পর্যায় সাধারণত ‘প্রভাবিতকরণ পর্যায়’ নামেই অভিহিত, যাকে সোজা কথায় ‘মগজ ধোলাইয়ের’ সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এভাবে একজন রিক্রুটের প্রশিক্ষণ পর্যায় শেষ হয় বটে তবে একজন ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভ’ হিসেবে তাঁর নবযাত্রা এখান থেকেই শুরু।

‘নবজীবনের’ শুরুতে তাঁকে অবশ্য বিদেশে থাকাকালীন ‘এজেন্ট’ বা ‘স্পাই’ (গুপ্তচর) রিক্রুট করার কলা-কৌশলগুলো ভালোভাবে রপ্ত করতে হয়। একটি সুবিন্যস্ত, সুসংগঠিত গোয়েন্দা চক্রে একজন ইন্টেলিজেন্স এজেন্টের কাজ কারবার এতোই গতানুগতিক যে, সে সাধারণ জ্ঞান ও সহজ কর্মকুশলতা প্রয়োগে ওই ধরণের কার্যক্রম সহজেই চালিয়ে যেতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়োগকৃত এজেন্টকে কিছু মৌলিক কার্যপ্রণালী সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যেখানে তাকে (এজেন্টকে ) নিরাপত্তাকর্মীদের পাতা ফাঁদ শনাক্তকরণ কৌশল, অনুসরণ এড়িয়ে নির্ধারিত ‘Meeting place’-এ যাবার পদ্ধতি, ‘Meeting Place’ নির্বাচন ও শনাক্তকরণ করা এবং সে এলাকা নিরীক্ষণ মুক্ত কিনা তা পরীক্ষা করা বা জরুরি অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যদি কোনো জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যেখানে পেশাদারি অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, সেখানে কোনোভাবেই খামখেয়ালির সুযোগ নেই। আবার বিভিন্ন যুক্তিযুক্ত কারণে একজন ‘এজেন্টের’ মাঝে অতিমাত্রায় পেশাদারি মনোভাব থাকা উচিত নয়। কারণ এ ধরণের ‘অতি পেশাদারি’ মনোভাব তার চালচলনে নির্দিষ্ট ‘ছকের’ প্রবর্তন ঘটায় যা সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। তাই একজন গুপ্তচর তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা পর্যন্ত তাকে ‘ঢেকে’ রাখাই শ্রেয়।

এসব কিছুর মধ্য দিয়ে এর মাঝে প্রশিক্ষণ ও প্রভাবিতকরণের (Indoctrination-বিশেষ মতোবাদে শিক্ষা দেয়া) কাজ সম্পন্ন করা হয়। অঙ্গীকারের প্রতি নিবেদনশীলতা ও খুঁটিনাটি ক্ষেত্রেও প্রশিক্ষণার্থীদের আশাব্যঞ্জক সাফল্য অর্জিত হতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে একজন ‘র’ প্রশিক্ষকের ভাষা হচ্ছে, “মাঠ পর্যায়ের প্রশিক্ষণ শেষে একজন প্রশিক্ষণার্থী নিজেকে অত্যন্ত ‘দৃঢ়চেতা’ বলে ভাবতে শেখে, আপনার সম্মুখে যখন তারা উপস্থিত হবে, তখন তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও উদ্দেশ্য বিচারের জন্য তাদের চোখের দিকে চেয়ে দেখার কিছুই নেই, বরং অনিয়মিত চলনে রুক্ষ পদযুগলই আপনার আকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তরের জন্য যথেষ্ট।”

ছ। নতুন ধারণা (New Concepts )

১৯৭০ সালের পর ‘র’-এর নীতিমালা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়। যদিও ‘মৌলিক নীতিমালা’ অপরিবর্তনীয় থাকে। ‘নতুন দর্শনের’ প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়েছিল সত্তর- এর দশকের প্রথম দিকে কোনো এক সময়। প্রাথমিক পর্যায়ে রিক্রুট করা বিভিন্ন পেশাজীবীর (বিশেষ করে পুলিশ ও আই বি-র কর্মকর্তা/কর্মচারী) পাশাপাশি পরবর্তীতে বিপুল পরিমাণে উচ্চপদস্থ আই সি এস কর্মকর্তা, প্রশাসক ও ‘বিশেষ টেকনিক্যাল পেশায়’ (বিশেষ করে ‘এভিয়েশন’ ও ‘ইলেক্ট্রনিক্স’) দক্ষ ব্যক্তিদের ‘র’-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

পেশাদার ব্যক্তিরা তাঁদের নিজস্ব পেশায় অভিজ্ঞ ছিলেন, তবুও তাদের পেশা সম্পর্কে খুঁটিনাটি পুনরায় মনে করিয়ে দেয়া ও গোয়েন্দাবৃত্তিতে সজাগ করে তোলার জন্য স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ জন্য প্রশিক্ষণ কোর্সে তাঁদের গোয়েন্দা বৃত্তিতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। বিশেষ করে ‘Need to know’ (যার যতোটুকু জানা দরকার) নীতি এক্ষেত্রে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন। নতুন কর্মকর্তাদের সাথে তাদের পূর্বেকার কর্মস্থলের কর্মকর্তাদের সম্পর্কে ছিল কিছুটা ‘সোজাসুজি’ ও কিছুটা ‘মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী সমান্তরাল’ ধরণের। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার নির্যাস/উপাদান হচ্ছে ‘সরাসরি’ ধাঁচের সম্পর্ক। নতুন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণের ফলে সাংগঠনিক গঠন, পরিচালনা দক্ষতা ও নতুন নতুন ধারণার উদ্ভাবনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়, যা এতদিন অবহেলিত হয়ে আসছিল। এ ক্ষেত্রে তথ্য বিশ্লেষণ শুধু সদর দপ্তরের সরাসরি আওতায় রাখা হয়। এ ছাড়া অন্যান্য কার্যক্রম মোটামুটি একই রকম থাকে।

এরপরও একজন বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গোয়েন্দা কাজে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠার জন্য আরো কিছু প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়ে ও এভাবে প্রশিক্ষণ কোর্স একটি অতি উঁচুমানের “বৈজ্ঞানিক কর্মসূচি’ ও ‘লক্ষ্যাভিমুখী’ কর্মসূচিতে উন্নীত হয়। অতঃপর একজন বৈদেশিক ‘ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভ’ একজন ‘ডেস্ক অফিসারের’ সহকারীরূপে প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত একটি ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’ ডেস্কে যোগদান করেন। ভারতের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক ও আচরণ বিভিন্ন ডেস্কের ‘গুরুত্ব’ নির্ধারণ করে। অন্য অপারেটিভরা মাঠপর্যায়ে ‘সহকারী কেস অফিসার’ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। উভয়ক্ষেত্রেই নতুন অপারেটররা দু’বছর পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যান।

জ। এসপারোনজ (Espionage )

সরাসরি মাঠপর্যায়ে নামার পর ‘স্টেশন চিফের’ নিয়ন্ত্রণাধীনে একজন ‘অপারেটিভ’ গোয়েন্দা জগতে ‘নাক গলানো’ শুরু করে। সে সাধারণত কোনো দাপ্তরিক ছদ্মাবরণে বিশেষ করে দূতাবাসের আওতায় কোনো ‘আড়াল’ (Cover) নেয়ার চেষ্টা করে; আবার কখনো কখনো বিভিন্ন গোপন/গুপ্ত (Covert) পরিচয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। এ পর্যায়ে অবশ্য ‘নিজস্ব লোকদের’ পক্ষ থেকে তাঁকে তীব্র প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় এবং অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এ ‘নিজস্ব লোকগুলো’ হলো বৈদেশিক বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এরা প্রায়শই এক ‘আজগুবী’ কৌতুকের উল্লেখ্য করে থাকে, “একজন ‘র’-এজেন্ট একজন বৈদেশিক দপ্তরের কর্মকর্তার সাথে করমর্দন করার পর, উভয়েই দ্রুত নিজ নিজ আঙ্গুল গুণে দেখেন যে, কোনটি খোয়া গেছে কিনা।” যদিও এ পর্যন্ত এ ধরণের কোনো খোয়া যাবার ঘটনা রেকর্ড করা হয়নি।

একজন অপারেটিভের মূল কাজ হলো বিভিন্ন সূত্র থেকে কাঁচা (Raw) তথ্য সংগ্রহ (পত্র- পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, কূটনীতিকদের বিভিন্ন আড্ডা ও বিভিন্ন প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে তথ্য সংগ্রহ) এবং বন্ধু দেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা। অবশ্য নিয়োজিত ‘ইনফর্মার’-এর মাধ্যমেও তথ্য সংগৃহীত হতে পারে। এভাবেই বিভিন্ন প্রত্যক্ষ কাজের মাধ্যমে সে প্রথমবারের মতো ‘একটি’ নির্দিষ্ট গোয়েন্দা ‘অপারেশন’ সংগঠিত করতে শেখে।

ঝ। কর্মধারা (The Functions )

অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার মত ‘র’- অপারেটিভদের কর্মধারাও মোটামুটি একই রকম। পূর্বোল্লিখিত ‘রেসিডেন্ট’ (Resident) প্রথাগত ঐতিহ্যে ইন্টেলিজেন্স কার্যক্রমের ‘প্রধানতম খুঁটি’ বিশেষ। যেখানে কোনো অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে তিনি সাধারণত তার পার্শ্ববর্তী কোনো দেশ থেকে তা নিয়ন্ত্রণ করেন। যেমন মিসরে কোনো অপারেশনের তত্ত্বাবধানের জন্য বৈরুত বা বাগদাদে তিনি অবস্থান করবেন। যে দেশে তিনি থাকেন, সেখানে তিনি বৈধ বাসিন্দা হিসেবেই থাকেন ও সে দেশের কোনো স্থানীয় আইন-কানুন ভঙ্গ করেন না। তিনি অবশ্যই অর্থনৈতিভাবে সচ্ছল, সমাজে সর্বজনস্বীকৃত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব এবং অতি অবশ্যই একজন ‘ভারতীয়’। কোনো প্রকারেই তিনি ‘গুপ্ত’ (Covert) বা ‘প্রকাশ্য’ (Overt) অপারেশনের সাথে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত হন না, কিন্তু মাঠপর্যায়ের সকল ‘অপারেটর’ ও ‘এজেন্টদের’ সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং ‘কেস অফিসার’ ও ‘স্টেশন চিফ’ বা স্থাপনা প্রধানের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ থাকে।

‘কেস অফিসার’, যিনি কোনো ‘প্রজেক্টে’ জড়িত তিনি সে ক্ষেত্রের সকল ‘অপারেশনাল রেকর্ডপত্র’ সংরক্ষণ ও সাথে সাথে শুধু ‘সুনির্দিষ্ট’ কোন অপারেশনের জন্য রিক্রুটমেন্টের ঝামেলা ও তৎসংক্রান্ত সাক্ষাৎ আলোচনার ব্যবস্থা করে চলমান অপারেশনের অগ্রগতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি মাঠপর্যায়ের ‘অপারেটিভদের’ সাথে সময় সময় সরাসরি বা ‘প্রধান এজেন্টের’ মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখেন (প্রধান এজেন্ট, যে দেশে অপারেশন চালানো হয়, সে দেশের নাগরিক ও রিক্রুট করা এজেন্টের সাথে তাঁর বৈধ যোগাযোগ রক্ষার উপর থাকে)। মাঠ পর্যায়ের এজেন্টদের দায়িত্ব হচ্ছে ‘কেস অফিসারের’ জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা, যার মাধ্যমে তিনি অপারেশন সম্পর্কিত সর্বশেষ খবরাখবর পেতে পারেন। এ ধরণের প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের জন্যই ‘কেস অফিসার’ ‘প্রধান এজেন্টের’ (Principal Agent) মাধ্যমে ‘এজেন্ট’ নিয়োগ করে থাকেন। একজন ‘গুপ্তচর’ এভাবেই বড়শিতে ধরা পড়ে। বাস্তবে, এ সকল এজেন্টই অপারেশনের সদস্য যাদের প্রকৃত ‘গুপ্তচর’ বলা যেতে পারে। এজেন্টরা যে দেশে অপারেশন পরিচালিত হয়, সে দেশেরই নাগরিক ও দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে তাঁরা গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োজিত হয়। দেশের প্রতি ‘বিশ্বাসঘাতকতাই’ (তা যে কোনো কারণেই হোক না কেন) এদের ‘এজেন্ট’ হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির পূর্বশর্ত। একজন এজেন্টকে কখনো নিয়োগের সাথে সাথেই কাজে লাগানো হয়, আবার কখনো কখনো তাকে ভবিষ্যতের জন্য ‘হিমাগারে’ রেখে দেয়া হয়। এ সমস্ত ক্ষেত্রে নির্দেশ দেন সাধারণত ‘স্থাপনা প্রধান’ (স্টেশন চিফ) বা সরাসরি ‘র’-এর দিল্লিস্থ সদর দপ্তর। এ ধরণের এজেন্টদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে (‘কভার’ সরে যাওয়ায়) অস্বীকার করা হয় বা ত্যাগ করা হয়; তবে যারা কূটনৈতিক আবরণে আবৃত থাকেন তারা সাধারণত ‘অনাস্থাভাজন’ বা ‘অবাঞ্চিত’ ব্যক্তি হিসেবে ঘোষিত হন।

একজন ‘রেসিডেন্ট’, এজেন্ট ও কেস অফিসারের মধ্যে যোগাযোগের ফাঁকে তাঁর কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং কখনই এজেন্টের সাথে সরাসরি যোগাযোগে আসেন না। সকল প্রকার সন্দেহের ঊর্ধ্বে তিনি নিরাপদে কলকাঠি নাড়েন এবং যদি কখনো অবস্থা বেগতিক বলে বিন্দুমাত্র আভাষ পাওয়া যায়, তবে তৎক্ষণাৎ তাঁর সকল ‘সম্পৃক্ততা’ মুছে ফেলার (Cleaning up or Mop up) ব্যবস্থা থাকে। বিশেষ করে, অপারেশনসমূহের ‘ধরণ-ধারণ’ ও অগ্রাধিকার বিবেচনা করে ‘রেসিডেন্ট’ সাধারণত একটির বেশি অপারেশন তত্ত্বাবধান করেন না। কারণ যদি অপারেশন ভুল হয়ে যায় বা বাতিল করতে হয়, তবে যেন শুধু একটি বাতিল করে অন্যগুলোর গোপনীয়তা রক্ষা করা যায়।

‘পুরাতন পদ্ধতিতে’ স্পাই নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা বর্তমান বাস্তবতায় অপ্রয়োজনীয় ও ‘অতীত দিনের স্মৃতি’ (যদিও এখন পর্যন্ত কোনো কোনো এজেন্সি নাছোড়বান্দার মতো এ ধরণের নেটওয়ার্ক পদ্ধতিতে কাজ করে)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাধারণত এ ধরণের ‘নেটওয়ার্ক’ পদ্ধতিতে বৃটিশ ও জার্মান এজেন্টরা পৃথিবী জুড়ে বিস্তৃত ছিল। পর্যায়ক্রমে এ পদ্ধতি উভয় দেশের প্রচুর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে একজন এজেন্ট ধরা পড়লে পর্যায়ক্রমে অন্য এজেন্টরাও ধরা পড়ে। একজন গুপ্তচর ধরা পড়ার পর যখন তাকে কথা বলতে বাধ্য করা হয় তখন জনবল ও সম্পদ উভয় দিকেই অপূরণীয় ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দেয়। বর্তমানে বিজ্ঞানের ক্রম উন্নতিতে ‘তৃতীয় মাত্রা পদ্ধতি’ (কথা আদায়ের জন্য এক ধরণের নির্যাতন পদ্ধতি) ইতিহাসের বিষয়, বরং তার স্থলে ট্রুথ সিরাম’ ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে একজন এজেন্টের কাছ থেকে অতি সহজে বহু ‘কথা’ আদায় করা সম্ভব, যতোটা না অসম্ভব ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ‘বলপ্রয়োগে’ ও ‘নির্যাতনের’ মাধ্যমে একজন এজেন্টের কাছ থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা। পদ্ধতির যদিও পরিবর্তন হয়েছে তবুও একজন এজেন্ট এখনও ‘বন্দুকের নলের’ সামনেই তার কাজ চালিয়ে যায়। সে যতো কম জানবে (Need to Know) অর্থাৎ যা জানার দরকার শুধু তা জানবে, তাতে তারও যেমন লাভ, তেমনি যে দেশ তাকে নিয়োগ করেছে সে দেশেরও তেমনি লাভ।

ঞ। কিংবদন্তি (Myths)

একজন গোয়েন্দা বা এজেন্ট জনগণের নিকট প্রায় ক্ষেত্রেই বিশেষ করে ‘গোয়েন্দা কল্পকাহিনী’ ও ‘গোয়েন্দা পেশার’ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বিকৃতরূপে চিহ্নিত হন। কারণ জনসমক্ষে তাঁকে গোয়েন্দা বা এজেন্ট বলে চিহ্নিত করা সম্ভব নয় এবং তাঁর অপারেশনগুলোর রেকর্ড থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে। সে কল্পকাহিনীর একজন ‘সুপার এজেন্ট’ (James Bond) নয়, যে অনুমতিহীন, রোমাঞ্চপ্রিয়, অন্ধকারের নাম গোত্রহীন বাসিন্দা বলে প্রতিবিম্বিত। আসলে একজন ভালো এজেন্টের গুণাবলী মোটামুটি এর বিপরীত। তাঁর প্রধানতম গুণ হতে হবে তাঁর জন্য নির্ধারিত অপারেশন টার্গেটে অলক্ষ্যে, চিহ্নিত না হয়ে পৌঁছানোর ক্ষমতা, যা একজন এজেন্টের জন্য সাধারণত অত্যন্ত কঠিন ও জটিল কাজ। যতোক্ষণ পর্যন্ত না সে নির্ধারিত অপারেশন টার্গেট সীমানায় পৌঁছতে সক্ষম ততোক্ষণ পর্যন্ত সে ‘কোনো কাজের লোক’ বলেই বিবেচিত হবে না।

এখানে প্রচলিত আরেকটি ধারণার উল্লেখ করতে হয়। আমরা অনেকেই মনে করে থাকি যে, একজন এজেন্ট যে দেশের জন্য কাজ করছে তাঁকে অবশ্যই সে দেশীয় নাগরিক হতে হবে, আসলে এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা বৃত্তিতে বেশি বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, এজেন্ট কোনো দেশের হোক না কেন তা কোন ব্যাপার নয়, যে বা যার প্রয়োজনীয় অপারেশনাল এরিয়ায় পৌঁছানোর ক্ষমতা আছে তাকেই মূলত: প্রাধান্য দেয়া হয়। (এখানে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন ভারতীয় এসপায়োনজ অপরেটিভের পক্ষে কখনই পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনায় ঢুকে তথ্য সংগ্রহ সম্ভব নয়, কাজেই পারমাণবিক বোমার তথ্য সংগ্রহের জন্য ওই স্থাপনায় কর্মরত কোনো পাকিস্তানী বা অন্যদেশীয় ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা হবে না।)

এই রূঢ় বাস্তবতা আবার অনেকের মনে ‘ডাবল এজেন্ট’ ভীতির জন্ম দেয়, (যে একত্রে দু’টি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির পক্ষে কাজ করে থাকে) যেখানে, সে একঢিলে দু’পাখি মারার তালে থাকে। এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত এ রকম হতে পারে, তবে বেশিরভাগ সময় সে অন্যপক্ষের কোনো কাজে লাগে না, কারণ যখনই একটি ‘ইন্টেলিজেন্স’ এজেন্সি একজন ‘ডাবল এজেন্ট’ নিয়োগ করে তখন থেকে তাঁকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো তথ্য প্রদান থেকে বিরত থাকে বা এমনভাবে বিকৃত তথ্য সরবরাহ করে যা আসলের মতো মনে হলেও শত্রুপক্ষের কোনো কাজে লাগার উপযুক্ত নয়।

‘এজেন্ট’ ছাড়াও কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন ‘ফ্রিল্যান্স’ও গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োজিত হন। সদর দপ্তরের একজন ‘কেস অফিসার’ এ ক্ষেত্রে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তিনি বিভিন্ন ‘স্টেশন চিফ’দের আওতাধীন এলাকায় কাজ চালিয়ে যান, যেখানে স্টেশন চিফরা তাঁর উপস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেন না, তবে কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁর উপস্থিতি ‘স্টেশন চিফদের’ জানানো হয়। তাঁর কার্যকলাপ অত্যন্ত বিস্তীর্ণ পরিধির এবং সাধারণত তিনি কোনো এজেন্ট নিয়োগ করেন না। অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে তিনি তাও করে থাকেন তবে সে ক্ষেত্রে তাঁর এজেন্টদের সাথে ‘কাট আউট’ (মধ্যস্থ ব্যক্তি) ব্যতীত সরাসরি যোগাযোগ থাকে। ‘কেস অফিসার’ তাঁর দেশ ত্যাগের পূর্বে তাঁকে খুঁটিনাটি সর্ববিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞানদান করেন। যদিও তাঁর কার্যকলাপ গোপনীয় ও অবৈধ কিন্তু তাঁর পরিচয় বা আবরণ বৈধ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এখানে তিনি এমনভাবে বিদেশ পাড়ি দেন যেন তাঁর প্রয়োজনই তাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। বৈধ পরিচয়দানকারী যে কোনো একজন ব্যক্তিত্বের মধ্যে তিনি অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, যেমন- একজন ছাত্র, পর্যটক, সাংবাদিক, বিমানের কর্মকর্তা/কর্মচারী, ব্যবসায়ী অথবা একজন শিল্পীও ‘ফ্রিল্যান্স’ হিসেবে গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োজিত থাকেন। তাঁর কার্যকলাপ রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাধারণ বিশ্লেষণ, তথ্য নিরূপণ থেকে আরম্ভ করে ‘বিশেষ লক্ষ্যে’ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে যেখানে তাঁর পেশাভিত্তিক পরিচয়ই তাঁকে ‘বিশেষ লক্ষ্যে’ পৌঁছুতে ও তথ্য আদায়ে সহায়তা দান করে। তাঁর কার্যক্রম তাঁর পর্যায়ক্রমিক ভ্রমণের উপর ভিত্তি করে আবর্তিত হয়। সকল পর্যায়েই তিনি একজন ‘অনুচর’ হিসেবে পর্যাপ্ত সম্মানী পেয়ে থাকেন যাতে করে সংস্থার সাথে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ থাকে এবং কেস অফিসারের নিকট তিনি আসল নামে পরিচিত হন। তবে রেকর্ড পত্রে তিনি সাংকেতিক নামে নথিভূক্ত থাকেন।

এসপায়োনজের ক্ষেত্রে সাফল্য পুরোপুরি নির্ভর করে ‘উদ্বুদ্ধকরণের’ সার্থকতার ওপর। এখানে উদ্দেশ্যের তারতম্য থাকতে পারে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় যে, কেন একজন লোক গুপ্তচর হতে আগ্রহ প্রকাশ করে? এর উত্তরে বলা যায়, কেউ অতিমাত্রায় দেশপ্রেম বোধের কারণে, কেউ রোমাঞ্চের আশায়, আবার কেউ শুধু টাকার আশায় এ জগতে পা বাড়ায়; অবশ্য এ তিন শ্রেণী ছাড়াও আর একদল যারা এসপায়োনজকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে ইচ্ছুক তারাও গুপ্তচরবৃত্তির খাতায় তাদের নাম লিপিবদ্ধ করেন। তবে সব ক্ষেত্রেই ‘উদ্বুদ্ধকরণের’ ব্যাপারটি সম্পর্কিত থাকে। একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক তাঁর সাধারণ মানের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই একজন গুপ্তচর হিসেবে সার্থকতা লাভ করতে পারেন। যদিও তাঁর কার্যকলাপ একজন নিয়োজিত ও প্রশিক্ষিত গুপ্তচরের চেয়ে সীমিত পর্যায়ে আবর্তিত হবে। একজন ‘নিয়মিত’ এজেন্টই কেবল গুপ্তচরবৃত্তির কলাকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন, এ ধরণের গুপ্তচরদের কখনও কোনো ক্ষেত্রে দেশের সার্বিক ইন্টেলিজেন্স সম্পর্কে জানানো হয় না। কারণ এ জগতে সব কার্যকলাপ পরিচালিত হয় ‘যার যতোটুকু জানা প্রয়োজন’ (Need to know basis) শুধু ততোটুকু ব্যাপারে মাথা ঘামানোর ওপর কঠোর নীতিমালার মাধ্যমে। পৃথক পৃথকভাবে কঠোর নিয়মনীতিতে বিভক্ত বিভিন্ন বিভাগ শুধু তাদের যতোটুকু জানা প্রয়োজন, ততোটুকুই আলাদাভাবে জানতে পারে। অন্য বিভাগে কি তথ্য এলো না এলো তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন অধিকারই তাদের নেই। এই যার যতোটুকু জানা প্রয়োজন’ কেবল মাঠপর্যায়ের অপারেটরদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয় বরং ‘র’-এর সমগ্র সংগঠনের, এমনকি প্রধানতম ব্যক্তির জন্যও একান্ত পালনীয় কর্তব্য।

একজন নিয়মিত অপারেটিভ যিনি সাধারণত পরবর্তীতে একজন ‘কেস অফিসার’ পদে উন্নীত হন, তাঁকে সবসময়ই কোনো ‘কাল্পনিক মতোবাদে’ উদ্বুদ্ধ এজেন্টের সংস্পর্শ হতে দূরে থাকার উপদেশ দেয়া হয়। পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, এসব এজেন্ট কোন অপারেশনের মাঝ পর্যায়ে হঠাৎ ‘বিবেকের’ (!) দংশনে ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে অঘটন ঘটিয়ে বসেন ও এ ধরণের অপারেশনকে ‘চরম অনৈতিক’ বলে ভাবতে শুরু করেন। সাধারণত কোনো আবেগাশ্রিত মতোবাদে বিশ্বাসী নয় এমন ব্যক্তিই মূলত: একজন আদর্শ এজেন্ট হিসেবে বিবেচিত হন। এজেন্ট রিক্রুটমেন্টের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে- এজেন্টের প্রদেয় তথ্য নয় বরং এজেন্টকে স্বয়ং কিনে ফেলা বা বশ করা এবং যতো কম পারিশ্রমিকই হোক না কেন তা নিয়মিত তাঁকে প্রদান করা। এ ক্ষেত্রে তার পারিশ্রমিক নিয়মিত দেয়া তাঁকে একবারে বেশি টাকা দেয়া অপেক্ষা জরুরি, কারণ এ পদ্ধতি তাকে অপারেটিভের ওপর ক্রমঃনির্ভরশীল হতে বাধ্য করে।

কোনো কোনো সময় অপারেশনের বিশেষ পর্যায়ে কোনো বিশেষ বা নির্দিষ্ট তথ্য প্রদানের জন্য এজেন্ট বেশি টাকা বা বোনাস দাবি করার প্রলোভনে পড়ে যায়। এ সব ক্ষেত্রে প্রশিক্ষকদের মতে অতিরিক্ত কোন দাবি না মানাই শ্রেয়। কারণ একবার দাবি মানলে তা ক্রমাগত ভুল তথ্য সরবরাহ করে এজেন্টকে অতিরিক্ত লোভী করে তুলতে উৎসাহিত করে। যদি দাবি আদায় না হওয়ায় এজেন্ট পিছিয়ে যেতে চায় তবে সে ক্ষেত্রে প্রশিক্ষকরা অপারেটিভদের তাদের শিখানো মৌলিক নীতি অনুসরণের উপদেশ দিয়ে থাকেন। যেখানে উল্লেখ আছে, “এজেন্ট তোমার মাধ্যমে নিয়োগ লাভ করেছে, তার আর অন্য কোনো কন্টাক্ট নেই এবং তোমার কাছে তথ্য নিয়ে আসা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথও নেই। সে কিছুক্ষণ বা কিছুদিন মনে মনে রাগ করে থাকতে পারে কিন্তু অবশেষে সে অবশ্যই তোমার সাথে একমত হতে বা পথে আসতে বাধ্য।”

তথ্যের উপযুক্ত মূল্য প্রদানের ব্যাপারটি সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ ‘মূল্য প্রদান’ কয়েকটি মৌলিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট করা হয়। যাকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করা হবে তার পূর্বতন সব তথ্য অবশ্যই তার আসল নিয়োগকর্তার (যেখানে সে কর্মরত থাকে) নিকট মজুদ আছে। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাকে এমনভাবে একটি যুক্তিযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়া হয় যাতে কেউ মনে না করতে পারে, সে তার আসল উপার্জনের বাইরে কোনো ‘গোপন উপার্জন’ করছে যা তাঁকে তার প্রতিষ্ঠানে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করবে। তাকে নিয়োগ করার মূল কারণ হলো তার গুরুত্বপূর্ণ কর্মস্থল যার তথ্য অপারেটিভের প্রয়োজন। যতো বেশিদিন নিরাপদে বিশ্বস্ততার সাথে সে ওই প্রতিষ্ঠানে থাকতে পারে ততই তথ্য আদায় করা সুবিধাজনক। তাই গুপ্তচরবৃত্তির জন্য তাকে দেয় পারিশ্রমিক তাকে তার মূল উপার্জনের ‘অতিরিক্ত কিছু দেয়ার’ মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা বাঞ্ছনীয়। অন্যভাবে ব্ল্যাকমেইলিং ও ভীতিপ্রদর্শনের মাধ্যমে তথ্য আদায় বর্তমানে প্রচলিত নয় (অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষ প্রয়োজনে তা মাঝে মাঝে করতে হয়)। খুব কম এজেন্সিই এ নীতি অবলম্বন করে থাকে। আবশ্য এটা ভাবা উচিত নয় যে, তারা (এজেন্সি) হঠাৎ করে নীতি বা নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছে; বরং এ পদ্ধতি অপারেশনের পরবর্তী পর্যায়ে কোনো কাজে আসে না। এজেন্ট বা তথ্যসূত্রকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করলে হয়ত ভয়ে বা বিদ্বেষ বশে এজেন্ট তার কর্মস্থল ত্যাগ করে চলে যাবে- যা শেষ পর্যন্ত একটি মূল্যবান সূত্র বা উপায় হারানো ছাড়া আর কোনো উপকারে আসবে না। অবশ্য এমন উদাহরণও আছে যেখানে ভীতি প্রদর্শনে ভালো কাজ হয়েছে। অনেক ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বিভিন্ন সময়ে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকে। সি আই এ, কে জি বি ও এস আই এস (বৃটিশি গুপ্তচর সংস্থা) পতিতালয় পরিচালনায় বিনিয়োগ করে থাকে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এ সব প্রতিষ্ঠান প্রতিপালনের উদ্দেশ্য কিন্তু একজন ভাবী এজেন্টের নিকট হতে কোনো পতিতা বা সমকামী ব্যক্তির সাহচর্যে থাকা অবস্থায় কোনো তথ্য আদায়ের জন্য নয়। সকলে সহজেই বুঝতে পারেন, ওইরূপ চরম মুহূর্তে কারো কোনো রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য প্রকাশ করে দেয়ার মতো অবস্থা থাকে না। কিন্তু এ সব ‘কীর্তিকলাপ’ তাদের বেশি করে সহযোগিতা করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। কারণ তাদের এ সব ‘বিশেষ’ অবস্থার দৃশ্যাবলী বাইরে জনসমক্ষে প্রকাশ করার ভয় দেখানো হয়। এ সব ক্ষেত্রে একজন ‘টোপ’ সাধারণত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, একজন এমপিও কোনো কোনো সময় একজন মন্ত্রীও হতে পারেন যাঁরা গোপনীয়তা ফাঁস হবার ভয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে বাধ্য হন।

‘র’-এর অবশ্য এ ধরণের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই (যদিও অনেকেই এ ধরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আগ্রহান্বিত ছিলেন)। তারা একবার পতিতালয় পরিচালনার দোষে অভিযুক্তও হয়েছিলেন। আমি (লেখক) বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানতে পেরেছি যে, এ ধরণের কোনো প্রতিষ্ঠান ‘র’-এর নেই, কারণ পতিতালয় প্রতিষ্ঠা করলে শেষে কোনো এক সময় তা প্রকাশিত হয়ে পড়বে এবং বাইরে বিশেষ করে সংসদে এ নিয়ে বিরূপ আলোচনার ঝড় বয়ে যাবে।

যে সব দেশে ‘সেক্স পারলার’ বৈধ বলে স্বীকৃত সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ভ্রমণকারী সরকারি কর্মকর্তাদের তাঁদের ভ্রমণ বিধিমালায় ওই সব পারলার এড়িয়ে চলার নির্দেশ দেয়া হয়। তাই কোনো হদ্দ বোকা ছাড়া এ ধরণের প্রলোভনে কেউ নিজেকে জড়ায় না। কিন্তু তারপরও দুয়েকজন ‘বোকা’ (!) সব ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়।

‘গুপ্তচর’ বা ‘এজেন্ট’ যে নামেই তাদের ডাকা হোক না কেন, এসপায়োনজ জগতে তারা শুধু অর্ধেক ভূমিকা পালন করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে অন্য একজন ‘কন্টাক্ট’ থাকেন যিনি বাকি অর্ধেক ভূমিকা সুচারুরূপে পালন করেন। এই বাকি অর্ধেক ভূমিকায় অভিনয়কারী হলেন একজন ‘উঁচু স্তরের কন্টাক্ট’ (Contact)। এ সব ক্ষেত্রে স্থাপনা প্রধান (Station Chief) একটি অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বাধ্য হন। ‘কন্টাক্ট’ হয়তো কোনো বিশেষ ব্যাপারে আলোচনা করতে বা তথ্য দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন কিন্তু এ সব কিছুর সমন্বয় কার্যত নির্ভর করে মিশন প্রধানের সদিচ্ছার ওপর। অনেক দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাজক বা পুরোহিত শ্রেণীও ইন্টেলিজেন্সে বিশেষভাবে অংশগ্রহণ করেন। ‘র’ প্রথমদিকে সার্বিক ক্ষেত্রে অনেক অপারেশনে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিল। ভারতীয় পররাষ্ট্র ক্যাডারের বিভিন্ন কর্মকর্তা/কর্মচারী যাদের ‘র’ অপারেটিভদের সাথে ইন্টেলিজেন্সের ব্যাপারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার কথা, সেখানে ‘র’ অপাটিভরা সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতির শিকার হন। এখন পর্যন্ত (১৯৮১ সাল পর্যন্ত) ‘র’-এর কর্মকর্তাদের সাথে পররাষ্ট্র সার্ভিসের কর্মকর্তারা বিভিন্ন বিবাদে ও মতদ্বৈততায় জড়িয়ে আছেন। অবশ্য প্রথমদিকে এমনও দেখা যেত যে, রাষ্ট্রদূতগণের সাথে ‘র’-এর স্থাপনা প্রধানদের বেশ ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কিন্তু সেটা আজ ‘ইতিহাসের’ কথা। এ ধরণের সমন্বয়হীনতার অভাব অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র সার্ভিসের এবং আরো নির্দিষ্ট করে বললে বিশেষভাবে কূটনীতিবিদরা সরাসরি জড়িত না হয়েও এসপায়োনজ-এর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। কারণ কেবল দূতাবাসের মাধ্যমেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব, যদিও ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিও এ ব্যাপারে আলাদাভাবে তৎপর থাকে। এটা কোনো নতুন মতোবাদ বা তত্ত্ব নয়, বিভিন্ন সংস্থাই (গুপ্তচর প্রতিষ্ঠান দূতাবাসের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন কন্টাক্টের সাথে নিরাপদ যোগাযোগ বজায় রাখে। দূতাবাস সহজেই যে প্রতিষ্ঠান বা তথ্যসূত্রের নিষিদ্ধ দরজায় করাঘাত করতে পারে তা অন্যভাবে অন্য কারো পক্ষে অত্যন্ত কঠিন একটি ব্যাপার বৈকি।

ট। তথ্য পাচার (Passing Information)

একজন এজেন্ট নিয়োগের পর প্রধান এজেন্ট ও তার মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদানের জন্য একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। বেশিরভাগ ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি এ সব ব্যাপারে একজন সংবাদ বাহক যাকে সাধারণত ‘কাট আউট’ (Cut Out) বলা হয় তার সাহায্যে রেসিডেন্ট এজেন্ট বা কেস অফিসার ও এজেন্টের মধ্যে তথ্য/সংবাদ আদান-প্রদান করে থাকে। কোনো কোনো সময় তারা প্রয়োজনে ‘ডেড লেটার বক্স’ (Dead Letter Box ) ব্যবহার করে (পূর্ব চিহ্নিত কোন নিরাপদ জায়গা যেখানে নিরাপদে কোন নথিপত্র রেখে আসা হয় ও পরবর্তীতে তা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে)। ডেড লেটার বক্স-এর জন্য নিরাপদ উপযুক্ত এলাকা নির্ধারণ নির্ভর করে বিরাজমান পরিস্থিতির ওপর। কার্যত সে এলাকাকেই নিরাপদ বলে ধরা হয় যেখানে ‘কাট আউট’ জানতে পারে না যে, সে কি নথিপত্র বা তথ্য গ্রহণ করছে এবং এজেন্টকে চিহ্নিত করার তার কোনো উপায় থাকে না। ‘ডেড লেটার বক্স’ হিসেবে যে কোনো ধরণের স্থান যেমন— ট্রেনের নির্দিষ্ট কোনো বগি বা স্থান, বিমানের টয়লেট, হোটেল, রেস্তোরাঁ, বিপণন কেন্দ্র, ট্রাভেল এজেন্সি ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।

যা হোক না কেন, বেশিরভাগ প্রশিক্ষক প্রতিনিয়ত একজন ভালো উন্নতমান সম্পন্ন এজেন্ট প্রাপ্তির ও এজেন্ট তৈরির উন্নত কলা-কৌশল উদ্ভাবনের চিন্তা-ভাবনা করেন, যদিও অনেক ক্ষেত্রে এ সব কিছুই ঠিকমত কাজ করে না। মূল নীতিমালা সব সময় সবক্ষেত্রে একই থাকে অর্থাৎ প্রতিটি এজেন্ট ও প্রতিটি টার্গেট থাকে ভিন্ন ভিন্ন। একজন প্রশিক্ষকের ভাষায়, “এসপায়োনজের সাথে অতিঘনিষ্ঠ একজনও এ ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে পারেন যে, পৃথিবীজুড়ে প্রায় সকল এসপায়োনজ সংগঠনে প্রায় একইরূপ পন্থা অনুসরণ করা হয়, যদিও কে জি বি ও জাপানের সংগঠনে এখনো সেই পুরানো পদ্ধতি অর্থাৎ নেটওয়ার্ক পদ্ধতির ওপর নির্ভরতা বিদ্যমান।” পাকিস্তানী ইন্টেলিজেন্সের ভারতে পরিচালিত বিভিন্ন অপারেশনে প্রায়ই দেখা গেছে যে, তারা খুব বেশি মাত্রায় মাঝে মাঝেই পুরনো নেটওয়ার্ক পন্থার অনুসরণ করেছে। “কিন্তু এ সকল প্রচেষ্টার প্রায় সবই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তাই নির্দিষ্ট করে কোনো উপসংহারে আসা সহজ কাজ নয়” বলে ‘র’ প্রশিক্ষকদের ধারণা।

‘টার্গেট’ বলে ইন্টেলিজেন্সে যা চিহ্নিত করা হয়, তা ছোট কিংবা বড় মাত্রার যে কোনো অপারেশনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিবেচ্য হিসেবে স্বীকৃত। অপারেশনের ক্ষেত্রে এটা নিৰ্দিষ্ট দেশে নির্দিষ্ট তথ্যের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, সে ক্ষেত্রে সরাসরি টার্গেট এ ব্যাপারে জড়িত নাও থাকতে পারে (পাকিস্তান কিভাবে পারমাণবিক বোমার প্ল্যান হস্তগত করলো তা জানার জন্য যে ইউরোপীয় ফার্ম/প্রতিষ্ঠান থেকে তা সংগ্রহ করা হয়েছে তৎসম্পর্কীয় তথ্য জানাই যথেষ্ট, সেখানে পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রকল্পে যাবার প্রয়োজন নাও পড়তে পারে)। আবার টার্গেট, একটি গোটা দেশও হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ অপারেশনের কথা বলাই যথেষ্ট। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাপক/ বিস্তৃত ভৌগোলিক অঞ্চল, যেমন বর্তমানে (১৯৮১ সাল) অতি পরিচিত ইরান-ইরাক যুদ্ধ এলাকাও এর অন্তর্গত হতে পারে। আবার একটি ফাইল কেবিনেট, ব্যবহৃত/পরিত্যক্ত টাইপ রাইটার রিবন, কার্বন পেপার অর্থাৎ যেখানে বা যা দ্বারা গোপন কিছু সংরক্ষণ করা হয় বা লেখা হয় এমন সাধারণ বস্তুও টার্গেট’ বলে চিহ্নিত হতে পারে। (তাই এ সব উপকরণ বিশেষ করে কার্বন পেপার ও টাইপ রাইটার রিবন বেশিরভাগ ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিতে ব্যবহারের পরপর নষ্ট করে ফেলা হয়)। জনশ্রুতি বা প্রচলিত বিশ্বাসের আলোকে একটি মানবহৃদয় কখনই টার্গেট হতে পারে না, কারণ টার্গেট’ হৃদয়ভিত্তিক হওয়ার চেয়ে শারীরিক হওয়াই বাস্তবসম্মত।

একবার টার্গেট চিহ্নিত করার পর, একজন অপারেটিভের ব্যাপক দায়িত্ব হচ্ছে সে সম্পর্কে সকল ‘অপারেশনাল ডাটা’ সংগ্রহ করা। এই ‘ডাটা’ সংগ্রহ একজনের বিস্তৃত ‘অপারেশনাল পরিকল্পনা’ প্রণয়নের জন্য প্রথম প্রয়োজনীয় শর্ত

অপারেশনাল উপাত্ত সংগ্রহের শুরুতেই হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন তৈরি তথ্য, যেমন কোনো টার্গেট এরিয়ায় কর্মরত কর্মকর্তাদের তালিকা সংগ্রহ করা হয়। এ কাজটি বেশিরভাগ দেশের প্রচলিত সাধারণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাঝে সংগ্রহ করা তুলনামূলক সহজ কাজ। এ ধরণের নামের তালিকা সাধারণত বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ‘সীমিত শ্রেণীভিত্তিক টেলিফোন নির্দেশিকায় পাওয়া যেতে পারে (বেসরকারি শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাতেও অনুরূপ পাওয়া যেতে পারে)। এ সব টেলিফোন নির্দেশিকায় শুধু নাম নয় বরং পদবি, আবাসিক ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর, সংস্থার ব্যবহৃত কোড বা সাংকেতিক শব্দ, অফিসে নির্দিষ্ট কর্মকর্তার নির্ধারিত রুম নম্বরও পাওয়া যায়। এই জাতীয় সংগৃহীত উপাত্তসমূহ ‘টার্গেট সাবজেক্ট’ (Target Subject) -এর কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। টার্গেট সাবজেক্ট’ বলতে সাধারণত কোনো একক ব্যক্তি বা একদল নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে বোঝানো হয়ে থাকে, যার বা যাদের টার্গেট এলাকায় প্রবেশাধিকার এবং ঈন্সিত তথ্য সংগ্রহের সম্ভাবনা আছে। প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার পর সাবজেক্ট’ নিয়মিত বিভিন্ন ক্লাব, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ধর্মীয় সমাবেশ, এমনকি বেশ্যালয়েও কখনো কখনো যাতায়াত আরম্ভ করেন। কিছু কিছু ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কাছে সদ্য নবায়িত পতিতালয়, মেসেজ পারলার, হেলথ ক্লাবের তালিকা তৈরি থাকে যেখানে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, সরকারি পদস্থ ব্যক্তিত্ব ও এমপিরা নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন। এ ধরণের তালিকার ব্যাপারটি ব্যাপকার্থে বেশিরভাগ পশ্চিমা ও কিছু কিছু পূর্বাঞ্চলের দেশের জন্য প্রযোজ্য। এভাবে বিভিন্ন স্থানে সাবজেক্টের যাতায়াতের উদ্দেশ্য হলো টার্গেট এলাকার তথ্যে যাদের আইনসম্মত হস্তক্ষেপের অধিকার আছে তাদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা। ভারতে সি আই এ ও কে জি বি উভয় এজেন্সির অপারেটিভদের প্রতিশ্রুতিশীল সরকারি ও ব্যবসায়ী ‘সাবজেক্টের’ সাথে প্রায়ই ‘আড্ডা’ দিতে লক্ষ্য করা যায়, যার ফলশ্রুতিতে তারা কোনো প্রাথমিক বা চলতি ঘটমান ঘটনার সূত্র পেতে পারে।

যদিও প্রতিটি এজেন্সিরই আলাদা নিজস্ব পদ্ধতি আছে এবং এ ক্ষেত্রে সি আই এ ও কে জি বি’র উল্লেখ্য করা মানে এই নয় যে, ভারতে অন্যান্য ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলোও তাদের মতো একইরূপ কোনো পন্থা অবলম্বন করে না। এখানে ওই দুটি বিশেষ এজেন্সির উল্লেখ্য করার অর্থ হচ্ছে যে, ওই দুটো এজেন্সির ‘কার্যকলাপ’ এ এলাকায় তাদের বৃহত্তর স্বার্থে নিবেদিত। সি আই এ ভারতে জানামতে কয়েকবার চেষ্টা করেছে (অনেকবার সফলও হয়েছে) প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা বা ব্যক্তিত্বের সাথে সখ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে। এ ধরণের প্রথম শ্রেণীর ‘টোপের’ মধ্যে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, ব্যক্তিগত গোপনীয় সেক্রেটারি, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ব্যক্তিত্ব; অর্থাৎ যারা প্রায়ই মন্ত্রী বা সেক্রেটারিগণের সাথে বিভিন্ন কার্যোপলক্ষে মিলিত হয়ে থাকেন তাদের বোঝানো হয়।

অন্যদিকে কে জি বি দ্বিতীয় শ্রেণীর ‘টোপের’ ওপর নির্ভর করে এসেছে। যাদের মধ্যে ক্লার্ক, টাইপিস্ট, সংবাদবাহক শ্রেণীর লোকজন অন্তর্ভুক্ত (যারা সাধারণত গোপনীয় ও সাধারণ সব ধরণের তথ্যই বহন করে ও অফিস সময়ের পর কারো সন্দেহের উদ্রেক না করে অফিসে থাকতে পারে বা প্রবেশ করতে পারে)।

তৃতীয় ধারার ‘টোপের’ মধ্যে ইলেকট্রিশিয়ান, টেলিফোন অপারেটর, রাজমিস্ত্রি, পানি লাইন তদারককারী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় যারা শুধু কোনো অকস্মাৎ পাওয়া সুযোগে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। (উপরোল্লেখিত বিশ্লেষণ, বিভিন্ন সময় সি আই এ; কে জি বি ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর নিয়োজিত বিভিন্ন ধৃত গুপ্তচরদের স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে প্রদত্ত। এ রকম অনেক ক্ষেত্রে দূত গুপ্তচরেরা এমনকি জানতো না যে, তারা কার পক্ষে কাজ করছে)। এ সব বিভিন্ন ‘টোপ’ ছাড়াও অন্য আরেক ধরণের আকর্ষণীয় তথ্যসূত্রের উল্লেখ্য করা যায়, যারা বৈদেশিক নিযুক্তি লাভ করেন ও প্রায়ই এখান থেকে ওখানে বদলি হয়ে যান। এ শ্রেণীর মধ্যে কূটনীতিবিদ হতে শুরু করে বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত কূটনীতিবিদ নন এমন কর্মকর্তাও থাকেন, যারা তাদের স্ব-স্ব মন্ত্রণালয়ের হয়ে সমন্বয় সাধনের কাজে নিয়োজিত থাকেন। এঁরা প্রায়শই অত্যন্ত আকর্ষণীয় তথ্যসূত্র হিসেবে গণ্য হন, কারণ তাঁরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় সরকারি দলিল দস্তাবেজ নাড়াচাড়া করেন, যা যে কোনো ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির নিকট অত্যন্ত কার্যকর ‘তথ্যসূত্র’ রূপে তাঁদের চিহ্নিত করে।

মহিলাগণ যারা একসময় ‘রীতিগত কারণে নিষিদ্ধ’ বলে বিবেচিত হতেন, তাঁরা, এমনকি ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভদের স্ত্রীগণ অনেকদিন থেকে এসপায়োনজ জগতের বাইরে অবস্থান করে আসছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে, যখন দেখা যায় যে, ‘স্বামীরা’ বিভিন্ন ‘কভারে’ ভিন্ন ভিন্ন ছদ্মনামে গোয়েন্দা বৃত্তিতে নিয়োজিত আছেন, তখন ‘স্ত্রীদেরও’ এসপায়োনজের অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তা করা হয়। তাই বর্তমানে বেশিরভাগ ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিতে ‘স্বামী-স্ত্রী দল’ হিসেবে একটি দলীয় পদক্ষেপ বেশ কার্যকর বলে স্বীকৃত।

সঠিক ‘তথ্যসূত্রের’ সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা আসলে তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়, যদি ‘টার্গেটের’ সামাজিক পরিমন্ডলের মধ্যে সঠিকভাবে জড়িয়ে পড়া যায়। এই সামাজিক পরিমন্ডলে যুক্ত হওয়ার জন্য অপারেটিভকে ক্লাব, ধর্মীয় সংগঠন ও ক্রীড়া ক্লাবে নিয়মিত যাতায়াত করতে হয়। এ ক্ষেত্রে অপারেটিভের গৃহীত কৌশল হলো কারো মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক না করে ওইসব সংগঠনের সাথে পুরোপুরি ‘মিশে যাওয়া’। সুতরাং এখানে দেখা যাচ্ছে যে, একজন ‘তথ্যসূত্র’ চিহ্নিত করার পূর্বে অনেক ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন। এই জটিল পরিস্থিতিতেই অপারেশনের সবচেয়ে কঠিন অংশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হয়।

বেশিরভাগ দেশে অবশ্য এ ধরণের কাজ তেমন কঠিন কোনো ব্যাপার নয়, কারণ ওই সব দেশের রাজধানীতে ও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শহরে সামাজিক পরিমন্ডলের ব্যাপ্তি অনেক বিস্তৃত। তার উপর কূটনীতিবিদগণ ও সরকারি কর্মকর্তারা খুব বেশিমাত্রায় বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে থাকেন, যা এ ক্ষেত্রে কাজের জটিলতাকে অনেক সহজ করে আনে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে এ ব্যাপারটি আসলেই বেশ কঠিন। কারণ, তাদের সামাজিক বিন্যাসই এ রকম যে, নিরাপত্তা এজেন্সিগুলো সব সময় সম্ভাব্য ‘তথ্যসূত্রের’ ওপর কড়া নজর রাখে। কিন্তু একজন প্রশিক্ষকের মতে “এসপায়োনেজ জগতে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়”। যে সব দেশ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল, সে দেশের বিভিন্ন সাংবাদিক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল ওইসব দেশে প্রায়ই শুভেচ্ছা সফরে যাতায়াত করে, যার দরুণ একজন ‘কন্টাক্ট’ খুঁজে পেতে বিশেষ কষ্ট হয় না। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নটি হচ্ছে, কেবল একজন সঠিক ‘কন্টাক্ট’ খুঁজে বের করা।

একজন প্রতিশ্রুতিশীল এজেন্ট খুঁজে পেয়েও তার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার পর ‘তার’ সম্পর্কে ‘জ্ঞাত হওয়ার’ Feel, যে অভিধায় ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিতে এই জ্ঞাত হওয়া’-কে বোঝানো হয়) সমস্যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। প্রাথমিক তদন্তের সময় এ ‘জ্ঞাত হওয়ার’ ব্যাপারটি ভিন্ন ভিন্নভাবে পরীক্ষা করা হয়, কারণ ওই প্রতিশ্রুতিশীল এজেন্টটি একজন সঠিক নির্বাচিত ব্যক্তি নাও হতে পারেন। তবে একবার যখন নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এজেন্টটি একজন খাঁটি ব্যক্তি তখন তদন্তের পরিবর্তে তাকে কোনো নির্দিষ্ট ‘অফার’ দেয়া হয়। এরপরও কোনো ভুল অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কোনো ভুল ‘অফার’ একটি অত্যন্ত বড় বিপর্যয় ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট। প্রায় প্রত্যেক প্রতিশ্রুতিশীল এজেন্ট কোনো ‘অফারের’ পরে তার বৈশিষ্ট্যানুযায়ী প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে এবং তথ্য প্রদান ও সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে তার নিজস্ব বলয়ের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো এজেন্ট তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রস্তাবে রাজি হন না, যতোক্ষণ পর্যন্ত না তার জন্য কোন ‘ছল’ বা ‘excuse’-এর নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। কারণ তিনি মানসিকভাবে কাজ করতে প্রস্তুত হলেও যে কোনো ‘ছল’ বা ‘excuse’-এর আশ্রয় তাকে নিতে হয় এবং তা তাকে তার বিবেকের কাছে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে।

একবার প্রস্তাব গ্রহণের পর নব্য প্রতিশ্রুতিশীল এজেন্টকে স্বল্প গুরুত্বের তথ্য সংগ্রহের জন্য টোপে গাঁথা হয় (অবশ্য এজেন্ট পরম নিশ্চিন্তে এ ‘টোপ’ সম্পর্কে অনবহিত থাকেন)। একবার সাফল্যের সাথে তথ্য সংগ্রহের পর ‘নব্য এজেন্ট’ তার নতুন কাজের প্রতি আস্থা লাভ করেন এবং বিবেকের সাথে তার যুদ্ধের ইতি ঘটে। তিনি ক্রমান্বয়ে বুঝতে শেখেন যে, তাঁকে যা করতে বলা হচ্ছে তা অত্যন্ত সহজ কাজ বৈ কিছু নয়।

‘অগোপনীয়’ তথ্য সংগ্রহের পর ধীরে ধীরে নতুন এজেন্টকে ক্রমান্বয়ে ‘মোটামুটি গোপনীয়’ ও ‘অতিগোপনীয়’ শ্রেণীর তথ্যসংগ্রহের জন্য উৎসাহিত করা হয়। প্রতিক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য পর্যাপ্ত স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা থাকে।

(আমি এ ক্ষেত্রে কয়েক বছর পূর্বে ‘র’ প্রধান মিঃ কাও-এর সাথে আমার সাক্ষাতের ঘটনা স্মরণ করতে পারি, যেখানে আমি তাঁকে ‘র’-এর বিপুল অংকের বাজেট ও এর যথেচ্ছ খরচ করবার অনুমতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। যদিও মিঃ কাও ‘র’-এর বাজেট সম্পর্কে কোনো কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি উল্লেখ্য করেন যে, “আপনি যদি সর্বোৎকৃষ্ট যন্ত্রপাতি কিনতে চান, তবে আপনাকে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হবে, তথ্যের ব্যাপারেও সে কথাই প্রযোজ্য”)।

ইতোমধ্যে নব প্রতিশ্রুতিশীল এজেন্ট একজন পূর্ণাঙ্গ গুপ্তচরে পরিণত হন। এ পর্যায়ে এজেন্টের সাথে নতুন সম্পর্কের সূচনা হয়, যেখানে পূর্বে তাঁকে তাঁর চিন্তা-চেতনার ওপর শ্রদ্ধাশীল থেকে কাজ করতে দেয়া হতো সেখানে এই প্রথমবারের মতো তাঁকে নির্দিষ্ট ‘শ্ৰেণীভূক্ত’, ‘অতিগোপনীয়’ তথ্য সংগ্রহের জন্য বলা হয়। অবশ্য পাশাপাশি প্রথমবারের মতো তাঁকে ‘ফাঁকি’ দিয়ে লুকিয়ে কাজ সমাধা করার বিভিন্ন কলা-কৌশল শিখিয়ে দেয়া হয়, যেখানে এতোদিন পর্যন্ত তিনি তার নিজ বুদ্ধিমত্তার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলেন। এ সব কলা-কৌশল শিখানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, যে ব্যক্তি ‘অতিগোপনীয়’ তথ্যসমূহ দেখার ও জানার অধিকার আছে তিনি অতি অবশ্যই তাঁর নিজ দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সার্বক্ষণিক নজরদারিতে আবদ্ধ থাকেন। অনেক দেশেই, যে সব ব্যক্তির ‘গোপনীয়’ ফাইলপত্র ঘাঁটার সুযোগ আছে, যা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, সেখানে নিজস্ব লোকদেরও চোখে চোখে রাখতে হয়। এ সব ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এজেন্সি একটি বিশেষ ‘ছক’ অনুযায়ী নজর রাখার ব্যবস্থা করে যাতে ওই ধরণের ব্যক্তিদের দৈনন্দিন ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক রুটিন নিয়মিত চেক করা হয়। (ভারতীয় ব্যবস্থাদিও অনেকটা অনুরূপ। সি আই ডি, স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো যৌথভাবে ওই দায়িত্ব পালন করে থাকে।)

পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে পদ্ধতিগত ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তবে এ সব ক্ষেত্রে আদর্শ পরিস্থিতি হচ্ছে ডকুমেন্ট বা দলিলপত্রাদির নকল করা। এ ক্ষেত্রে অবশ্য নকলকারী প্রাপ্ত দলিলপত্রাদি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু কোনো এজেন্টের পক্ষে ক্যামেরাসহ দলিলপত্রাদির সংরক্ষণাগারে প্রবেশ করে তার ফটো তুলে আনা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এভাবে ছবি তোলা হয়তো কোনো ব্যতিক্রমী পরিবেশ পরিস্থিতিতে একবার সম্ভব হতে পারে, কিন্তু এভাবে ছবি তোলার পুনরায় কোনো প্রচেষ্টা এজেন্টের চিহ্নিতকরণ ও তার ধরা পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

এরপরও, বর্তমানে যুগে ‘দ্রুতগতির ফিল্ম’ ও উন্নত প্রযুক্তির ‘ছোট ক্যামেরা’ যা সাধারণ বাণিজ্যিক বিপনিগুলোতেও সব সময় পাওয়া যায়, সেগুলোর মাধ্যমে দলিলপত্রাদির ছবি তোলা অনেক সহজ কাজে পরিণত হয়েছে। দলিলপত্রাদির নকল কপি তৈরিতে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত (ফটোকপি করা হতে শুরু করে মাইক্রোফিল্মে রূপান্তর পর্যন্ত) এবং এ ক্ষেত্রে দলিলপত্র সংশ্লিষ্ট স্থাপনা হতে সরিয়ে ফেলতে হয়। তবে এজেন্টের যদি ওইসব দলিলপত্রের ব্যাপারে অধিকার থাকে ও সে ওগুলো সাথে করে বাড়ি নিয়ে যেতে পারে কেবল তখনই সে নকল প্রস্তুতে হাত দেয়ার অধিকার রাখে, অন্যথায় নকল কপি তৈরি বাস্তবসম্মত নয় আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থাপনার টাইপিষ্ট অতিরিক্ত কার্বনকপি সাথে নিয়ে যেতে পারে। তবে বর্তমানে প্রায় সকল নিরাপত্তা সংস্থাই এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক হওয়ায় এভাবে কোনো দলিল পাচার কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এ পদ্ধতিতে একজন মুদ্রাক্ষরিককে একটি কন্টাক্ট বা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করায় এজেন্টের জন্য যে কোনো সময় ‘নিরাপত্তা বিপর্যয়’ ডেকে আনতে পারে। তাই এ পদ্ধতিতে অতি প্রয়োজনীয় না হলে তথ্য সংগ্রহ করা হয় না।

একজন এজেন্ট ‘নিরীক্ষণে’ থাকবেন, এ কথা ধরে নিয়েও বলা যায় যে, (যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে) কোনো সরকারের পক্ষেই শ্রেণীভুক্ত দলিলপত্র পর্যবেক্ষণকারী সকল কর্মচারী, নিদেনপক্ষে সন্দেহভাজন ব্যক্তিবর্গের প্রতি সার্বক্ষণিক নিরীক্ষণ চালানো অসম্ভব ব্যাপার। (কারণ তা করতে হলে একজন লোককে তার অগোচরে ২৪ ঘণ্টা নিরীক্ষণে রাখার জন্য কমপক্ষে ৫ জন পর্যবেক্ষক/নিরীক্ষক প্রয়োজন এবং এতগুলো নিরীক্ষক পোষা এক কথায় অসম্ভব)। এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সরকার এ ধরণের দলিলপত্রে প্রবেশাধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ‘অনস্পষ্ট’ নিরীক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সে ধরণের কোনো ব্যক্তির দৈনন্দিন রুটিন ও জীবনযাপন পদ্ধতিতে কোনো হেরফের সন্দেহের উদ্রেক করে। একটি নির্দিষ্ট পরিমন্ডলে জীবন-যাপনকারী বা অভ্যস্ত ব্যক্তির রুটিনে সামান্যতম পরিবর্তন যা তার সামাজিক অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তা অতি সহজেই খুঁজে বের করা সম্ভব। সুতরাং প্রতিটি এজেন্টকে তাঁর স্বাভাবিক জীবন-যাপন পদ্ধতি অনুসরণের জন্য আদেশ দেয়া অত্যন্ত জরুরি।

এজেন্টের স্বাভাবিক জীবনযাপনের পরিমন্ডলেও প্রয়োজনীয় কারো সাথে কন্টাক্ট প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। একজন পর্যবেক্ষণাধীন এজেন্টের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করার উপায় বিভিন্ন রকম হতে পারে, যেখানে পূর্বনির্ধারিত ‘সেফ হাউস’ বা ‘সেফ জোনের’ মাধ্যমে যোগাযোগ করা যায়; তবে এ সবকিছুই হতে হবে ‘পূর্বনির্ধারিত’। যদি কখনো খুব কম সময়ের মধ্যে এজেন্টর সাথে দেখা করা জরুরি হয়ে পড়ে তবে পূর্বনির্ধারিত ছদ্মনামের আড়ালে একটি জায়গায় ‘স্বল্পকালীন সাক্ষাতের’ ব্যবস্থা করা হয়। এ ধরণের ‘স্বল্পকালীন সাক্ষাৎ’ সাধারণত কোনো মেসেজ, বিশেষ করে কোনো ‘নোট’ যখন জনবহুল কোনো স্থান যেমনঃ সিনেমা হল, বাণিজ্য কেন্দ্র, হোটেলের টয়লেট বা থিয়েটারে অতিদ্রুত আদান-প্রদানের প্রয়োজন হয় তখন আয়োজিত হয়। অবশ্য এ সব পদ্ধতি হাজারো রকমের হতে পারে তবে সব কিছুই থাকে পূর্বনির্ধারিত। যদিও এভাবে যোগাযোগ করা একটি নিরাপদ ব্যাপার তবুও নিরীক্ষণাধীন কোনো এজেন্ট এ ধরণের যোগাযোগ স্থাপনের সময় ধরা পড়তে পারেন। আবার কোনো কোনো সময় অনির্ধারিত যোগাযোগের ব্যবস্থাও করতে হয়। এমনকি তিনি যদি সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকেন তবুও এজেন্টকে নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে যোগাযোগ করার নির্দেশ থাকে। অল্পসময়ের নোটিশে যোগাযোগের প্রয়োজন হলে কোন ‘সেফ হাউস’ যা সাধারণত কোনো আবাসিক এলাকায়, যেখানে এজেন্ট গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োজিত হওয়ার আগেও নিয়মিত যাতায়াত করতেন সেখানে সাক্ষাতের আয়োজন করা হয়। অথবা এমন কোনো স্থান বেছে নেয়া হয় যেখানে এজেন্ট শহরের বাইরে কোনো পর্যটন প্রমোদ কেন্দ্রে কাজের অবসরে ক্ষণিক ‘আরাম’ উপভোগের জন্য যেতে পারেন। ‘সেফ হাউস’ পদ্ধতিতে সাধারণত অন্যান্য সকল উপায়ে চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর্যায়ে শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে যোগাযোগ করা হয়। ইন্টেলিজেন্স জগতে ‘সেফ হাউস’ মূলত হঠাৎ দেখা সাক্ষাৎ করার জন্য অথবা যদি পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ে বা কাভার উন্মোচিত হয়ে যায় তখন যাতে কিছু সময়ের জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক জেরার হাত থেকে বেঁচে লুকিয়ে থাকা যায় বা জেরার মুখে পড়লেও যাতে ওই এলাকাতে এজেন্টের উপস্থিতির কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখানো সহজ হয় সেজন্য নির্বাচিত হয়। একজন এজেন্ট কেবল ‘প্রতি নিরীক্ষণ’ বা ‘কাউন্টার সার্ভেইলেন্সে’ উপযুক্ত প্রশিক্ষণ লাভের পর ‘সেফ হাউস’ পদ্ধতি ব্যবহারের অনুমতি লাভ করে। অবশ্য এ প্রশিক্ষণও তাকে সার্বক্ষণিক এক মস্তবড় ঝুঁকির সম্মুখীন করে তোলে কারণ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি নির্দিষ্ট এলাকায় তার উপস্থিতির সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হতে পারেন। এতোসব প্রশিক্ষণের পরও একজন ভালো উপযুক্ত ‘নিরীক্ষণকারী’ যে কোনো এজেন্টকে বিশেষ করে সন্দেহভাজন কোনো এজেন্টের আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে ও ‘প্রমাণ উপাত্তের লেজের’ সূত্র ধরে সহজেই শনাক্ত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে এজেন্ট নিজে তো বটেই বরং তার সহগামীসহ গ্রেপ্তার হবার ঝুঁকি থেকে যায়।

একবার যখন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় তখন সদর দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ যোগাযোগ স্থাপন প্রক্রিয়া দুটি মৌলিক পদ্ধতিতে সাধিত হতে পারে। প্রথম পদ্ধতিতে এজেন্টের কাছ থেকে দলিলপত্রাদি সংগ্রহ করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেয়া হয়। যেখানে এগুলো পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছার জন্য রাখা হয় তাকে ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভরা ‘ডেড লেটার ড্রপ’ বলে থাকে। সাধারণত একজন ‘বাহক’- এর মাধ্যমে এ সমস্ত দলিলপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বহন করানো হয়। ‘বাহক’ কদাচিৎ কখনো কোনো অপারেশনের বিষয়বস্তু, ধরণ বা কোনো এজেন্ট ও অপারেটিভের পরিচয় জানতে পারে; তবে যে অপারেটিভ তাকে নিয়োগ করেছে তার সাথে তার পরিচয় থাকে এবং সে অপারেটিভ মাত্র দু’একবার বাহকের সাথে রুটিন ঠিক করার জন্য মিলিত হন ও যখন তখন ইচ্ছানুযায়ী তার (বাহক) সাথে যোগাযোগ স্থাপনের নিশ্চয়তা বিধান করেন। এভাবে বাহকের অপ্রয়োজনীয় সকলের সাথে যোগাযোগের সকল রাস্তা বন্ধ রাখা হয়।

‘বাহক’- একজন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিমান কর্মচারী বা এমন কোনো ব্যক্তি হতে পারেন যিনি সচরাচর স্বাভাবিক প্রয়োজনে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ান যেখানে ওই সব ডকুমেন্টসমূহ পৌঁছানো প্রয়োজন। একজন ‘বাহক’ নিছক গোপন মিশনে ব্যাপৃত হওয়া থেকে আরম্ভ করে শুধু টাকা উপার্জনের জন্যও এ ধরণের কাজে নিয়োজিত থাকেন।

বাহকের মাধ্যমে পরিবহনের পাশাপাশি পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষ ডাক বিভাগের সাহায্যেও সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। যদিও অনেক সরকার চিঠিপত্র ‘সেন্সর’ করে থাকে তবুও প্রতিটি চিঠি খোলা ও পড়া এক কথায় অসাধ্য ব্যাপার। এমনকি যদি আপাতত নির্দোষ সহজ সরল শব্দমালার সাথে সাংকেতিক শব্দও মিশ্রিত থাকে তথাপি একজন বিশেষজ্ঞ ব্যতীত তার অর্থ উদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে একটি সাধারণ টেপরেকর্ডারে রেকর্ডকৃত মেসেজ যা একটি সংযুক্ত ‘গ্যাজেট’ (একপ্রকার সাইফার বা সাংকেতিক হিজিবিজি শব্দ বা পরিবর্তিত বেতার তরঙ্গকে স্বাভাবিক পরিবর্তন করতে পারে এবং স্বাভাবিককে উল্টোটা করতে পারে)-এর মাধ্যমে পরিবর্তিত আকারে প্রেরণ ও গ্রহণ করা হয়। এই ‘গ্যাজেটের’ ব্যবহারের ফলে মেসেজটি অত্যন্ত উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে টেপ করা যায় যা ভুল গতিতে চলমান কোনো রেকর্ড প্লেয়ারের মতো শব্দ তৈরি করে বা কর্কশ শব্দের উৎপত্তি ঘটায় এবং অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে প্রেরিত হয়ে থাকে। রেকর্ডকৃত মেসেজটি একটি অ-ক্ষতিকর ‘হামিং সাউন্ডের’ (রেডিও ট্রান্সমিশনে ব্যবহৃত) সাথে প্রেরণ করা হয়, যা অপর প্রান্তে একটি অনুরূপ গ্যাজেট-এর মাধ্যমে বেতার যন্ত্রে গৃহীত হয়। এভাবে রেকর্ডকৃত দশ মিনিটের কোনো মেসেজ আর ‘কর্কশ শব্দ’ ধাপ অতিক্রমে মাত্র দু’সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে থাকে। এমনকি যদি মাঝপথে কোথাও এ মেসেজটি মনিটর করা হয়, তবে তা নিতান্তই কোনো আবহাওয়া জগত সংক্রান্ত কর্কশ শব্দ বলেই মনে হবে। এ ধরণের বার্তা প্রেরণের জন্য দূতাবাসগুলোকে ব্যবহার করা হয়। কারণ তাদের সাধারণ দৈনন্দিন কাজের জন্য বৈধ বেতার যন্ত্রপাতি কূটনৈতিক আবরণে ব্যবহার করা যায়। অন্য আরেক পদ্ধতিতে চোরাকারবারিদের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান বা পাচার করা হয়। চোরাচালানি তার স্বাভাবিক চোরাচালানের পাশাপাশি এসপায়োনজের সাথেও যুক্ত থাকেন। এ পদ্ধতিকে সাধারণত উপেক্ষা করা হয়। কারণ একজন চোরাচালানি যে কোনো সময় ধরা পড়তে পারে এবং বাঁচার জন্য এসপায়োনজের সাথে তার সম্পৃক্ততা প্রকাশ করে দিতে পারে যা যে কোনো সরকারের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর একটি ব্যাপার। এ পদ্ধতি, যে সব জায়গায় অন্যসব পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে কেবল সেখানেই ব্যবহার করা হয়।

ঠ। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স (Counter Intelligence)

এসপায়োনজ আইন-কানুন অনেকটা ‘ক্রিমিনাল অ্যাক্টের’ সমগোত্রীয় (যদিও যে দেশে গুপ্তচর পাঠানো হয় সে দেশে আইন-কানুন ভঙ্গ করেই তা করা হয়)। এসপায়োনজ জগতে কোনো কাজ তার ন্যূনতম চিহ্নও যাতে প্রকাশ না হয়ে পড়ে সেভাবে সম্পাদন করা হয়, এমনকি যে দেশে এটা পরিচালনা করা হয় সে দেশের সরকার পর্যন্ত কোনো গোপন দলিল/ তথ্য চুরি যাওয়ার পরও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করে। অবশ্য মাঝে মাঝে যখন কোন এজেন্ট ধরা পড়ে তখন এর ব্যতিক্রম হয়। যখন একজন এজেন্ট ধরা পড়ে তখন এর পশ্চাতে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের অপারেটররা সক্রিয় বলে ধরে নেয়া যায়। ভারতের ক্ষেত্রে এ কাজটি করে থাকে আই বি বা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো। বেশিরভাগ ইন্টেলিজেন্স সংস্থায় বৈদেশিক ইন্টেলিজেন্স, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ও এসপায়োনজ ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার আওতাভুক্ত। যদিও ভারতে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স আই বি-র একটি অংশ তবুও ‘র’-এর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও গোপন তথ্য পাচার বন্ধ রাখার জন্য ‘র’-এ আলাদা একটি ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’ শাখা রয়েছে। অবশ্য একজন ‘র’ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভের ভাষ্য মতে, ‘র’-এর ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কোনো ক্ষমতা নেই’, যা দ্বারা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, আই বি-র মতো ‘র’-কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সন্দেহজনক কাউকে গ্রেপ্তার ও অন্তরীন করার কোনো ক্ষমতা নেই। এ পর্যন্ত ‘র’-এর অভ্যন্তরে উল্লেখযোগ্য কোনো অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি। ‘র’-কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স সেল সময়ে সময়ে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অনুসন্ধান তল্লাশি ও সংস্থার সাধারণ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সন্তুষ্ট হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়।

যাহোক না কেন, এরপরও বিদেশী সংবাদ সংস্থার মতে রবি নাথ সোনি নামে একজন ‘র’ কর্মকর্তা ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালে দলত্যাগ করেছেন বলে সন্দেহ করা হয়। ‘র’- এর সূত্র মতে, রবি নাথ সোনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন মেজর, যিনি পর্যায়ক্রমে ‘র’র সংস্পর্শে আসেন এবং ১৯৭০ সালে পাকিস্তান ডেস্কের অতিরিক্ত পরিচালকরূপে যোগ দেন। খবরে সোনিকে একজন সি আই এ’র অনুস্থাপনকারী বলে উল্লেখ করা হয়, যদিও ‘র’ এ খবরের সত্যতা অস্বীকার করে। এ সম্পর্কে যতোটুকু জানা যায়, তাতে দেখা যায় যে, সোনি কিডনি অপারেশনের জন্য কানাডায় বদলি হবার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর এ বদলি কখনো বাস্তবে পরিণত হয়নি। সে সময় তাঁকে কিছুসংখ্যক বিদেশী মহিলার সাথে আড্ডা মারতে ও ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। কিন্তু ডেস্ক প্রধানের প্রশ্নের জবাবে সে কোনো বিদেশীর সাথে দেখা হবার কথা অস্বীকার করে (আই বি-র কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভরা এ ব্যাপারটি ডেস্ক প্রধানকে অবহিত করেন)। সরকারি আইনানুযায়ী কোনো ইন্টেলিজেন্স অপারেটিভ বিদেশীদের সাথে দেখা করলে তার বিশদ বর্ণনা লিখিতভাবে দিতে বাধ্য এবং বিশেষ করে কি কারণে তিনি বিদেশীদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতে উৎসাহিত হয়েছেন তার উল্লেখ করতে হয়। যখন সোনিকে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেখানো হয় তখন সে ওইসব বিদেশিনীকে তাঁর শুধু বান্ধবী বলে উল্লেখ করেন। এর কিছুদিন পর সে কানাডায় ছুটিতে যাবার জন্য আবেদন করে, যা মঞ্জুর করা হয়। সোনি ছুটি পাবার সাথে সাথে কানাডায় চলে যান (যদিও তাঁর স্ত্রী ও সন্তান তাঁর আগেই কানাডায় চলে গিয়েছিলেন)। তাঁর ছুটি শেষ হয়ে যাবার পরও তিনি যখন অনুপস্থিত থাকেন তখন ‘র’ তাঁকে ফিরে এসে কাজে যোগদানের পরামর্শ প্রদান করে এবং এও উল্লেখ করে যে, তিনি যদি সময়মতো ফিরে না আসেন তবে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হবে। ধারণা করা হয়, কানাডীয় ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের সহানুভূতি আদায়ের উদ্দেশ্যে সোনি স্থানীয় টরেন্টো স্টার’ পত্রিকায় যোগাযোগ করে ও তাদের ওই চিঠিটি দেখিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, ওই পত্রে ‘র’ তাঁকে মেরে ফেলার ইঙ্গিত দিয়েছে। ‘র’-এর সূত্র মতে কানাডীয় নাগরিকত্ব লাভের আশায় সোনি ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেন এবং তজ্জন্য উক্ত ‘নাটকের’ অবতারণা ঘটান (এখনও সোনি কানাডায় আছেন বলে বিশ্বাস করা হয়)। ‘র’ তাঁর সম্পর্কে ওই বারই শেষ খবর নিয়েছিলে।

আই বি’র কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স কার্যক্রম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা খুব ভালোভাবেই ভারতে সক্রিয় রয়েছে, যেমন অন্যান্য দেশেও তারা সমানভাবে সক্রিয়। কোনো কোনো সময় তাদের লক্ষ্য হচ্ছে ভারত, আবার অনেক ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ। পাকিস্তানের বর্তমান গোয়েন্দা কার্যক্রম বিশেষ করে ভারতের সামরিক অগ্রগতি ও স্থাপনা বলয়ে আবর্তিত। টিকা রামা কাসিয়াপের গ্রেপ্তার হওয়া, যিনি সামরিক কমান্ডারদের মিটিং-এর সারসংক্ষেপ পাকিস্তান দূতাবাসের আনোয়ার আহমেদ নামক একজন কর্মচারীর কাছে ৯ নভেম্বর ১৯৭৯ সালে পাচার করেন তা অতিসাম্প্রতিক একটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। আই বি এ সব গুপ্তচরদের ‘গুপ্ত স্থান থেকে তাড়িয়ে বের করে’ থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের পদ্ধতি অন্যান্য সংস্থার মতো একই রকম এবং অত্যন্ত সরল সাধারণ পদ্ধতিতে একজন গুপ্তচরকে ফাঁদে ফেলা হয়। এ ফাঁদ পাতার ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু দলিলপত্র সংগ্রহের জন্য ফেলে রাখা হয়, যা একজন গুপ্তচরের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি ব্যাপার। এ সব দলিলপত্র সংগ্রহের পরপরই উক্ত গুপ্তচরকে শুধু নিরীক্ষণে রাখা হয় এবং শেষে কাসিয়াপের মতো গ্রেপ্তারের মাধ্যমে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। কাসিয়াপকে বেশ কিছুদিন ধরে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল। কারণ তার অতিরিক্ত ব্যয় আই বি’র নজরে আসে। এরপর শুধু ধৈর্য ধরার ব্যাপার, যতোক্ষণ পর্যন্ত না সে তার কেস অফিসারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। অন্য আরেকটি ঘটনায় ইউ এন আই নামের এক সংবাদ সংস্থার সূত্রমতে পাকিস্তানী এসপায়োেনজ কার্যক্রমে ৫২ জন ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা কর্মচারীর জড়িত থাকার ঘটনা প্রকাশ পায়, যার মধ্যে ২৮ জন ছিলেন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার। এ ঘটনার ফলশ্রুতিতে তিনজন পাকিস্তানী এজেন্ট ধরা পড়ে, যারা ভারতে গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োজিত ছিলেন। যেহেতু এ কেসটি সাম্প্রতিক একটি ঘটনা তাই এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা সম্ভব হয়নি। (অবশ্য এখন Samba Spying Case নামে আলাদা একটি বই বেরিয়েছে, যাতে ওই ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়-অনুবাদক)। এখানে যে ব্যাপারটি লক্ষণীয়, তা হলো, পাকিস্তানী ইন্টেলিজেন্স ধারণাতীতভাবে ভারতে সক্রিয়। এ ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে ‘সাম্বা স্পাইং কেস’ নামে সমধিক পরিচিত যা নিকট অতীতে আই বি’র মাধ্যমে উন্মোচিত সবচেয়ে বড় মাপের একটি পাকিস্তানী গুপ্তচর কার্যক্রম বলে ধরা যায়। কে জি বি ও সি আই এ-এর ব্যাপারেও অনুরূপ গুপ্তচরবৃত্তির প্রমাণ আছে এবং তাদের কিছু এজেন্ট পূর্ববর্তী কয়েক বছরে ভারতে ধরাও পড়েছে।

ড। ভুল তথ্য উপস্থাপন (Disinformation )

‘র’-এর গৃহিত কৌশল অথবা ব্যাপকার্থে ইন্টেলিজেন্স কৌশলের শেষ ধাপে এসে আমরা ‘ফাঁকি দেয়া’ বা ‘ভুল তথ্য উপস্থাপন’-এ ধরণের ভিন্ন ভিন্ন অভিধায় ভূষিত বিভিন্ন সংস্থার প্রদত্ত বিশেষণ নিয়ে আলোচনা করতে পারি। তবে যে বিশেষণেই ভূষিত করি না কেন সবার উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন, আর তা হলো ‘ভুল পথে পরিচালিত করা’, ‘জনমতকে হতবুদ্ধি-বিশৃঙ্খল বা প্রজ্বলিত করা’।

যুদ্ধাবস্থায় এ সবের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের উপকারার্থে সামরিক উদ্দেশ্য হাসিল করা আর শান্তিকালীন সময়েও এগুলো দেশের স্বার্থের সাথে জড়িত। সোজা কথায় এর অর্থ হচ্ছে প্রবঞ্চনা বা চাতুরীর আশ্রয়ে কার্যসিদ্ধি করা। এ ক্ষেত্রে শত্রুদেশে ভুল তথ্যের অনুপ্রবেশ করানো হয়, যার ফলশ্রুতিতে সে দেশের স্বার্থহানি ঘটে থাকে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে শত্রুদেশের জনগণকে নিজ দেশের ইচ্ছানুযায়ী কোনো বিশেষ কিছুতে বিশ্বাস করানো। এ সংক্রান্ত উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ভুল গোয়েন্দা রিপোর্ট সংবাদ মাধ্যম, কূটনৈতিক চ্যানেল অথবা রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও অন্য পেশাজীবীদের মাধ্যমে অনুপ্রবিষ্ট করানো হয়, যাদের মতামত ভুলতথ্য পরিবেশনের সূত্র ধরে নিজ দেশের ইচ্ছানুযায়ী পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করার মতো প্রভাব বিস্তারকারী।

ভুল তথ্য প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ অপারেশনের’ সময় অত্যন্ত কার্যকরি ফল পাওয়া গিয়েছিল। পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিসমূহ ধারণা করে, ভারতের দ্রুত ও পর্যাপ্ত সৈন্য সমাবেশের ক্ষমতা নেই। পশ্চিমাদের এ বিশ্লেষণ কায়দা করে পাকিস্তানী ইন্টেলিজেন্সে প্রবিষ্ট করানো হয়। আসলে ভারতীয় সৈন্য উত্তর-পূর্বে সমাবেশ করেছিল। প্রস্তুতিপর্বে পশ্চাৎ অবস্থান থেকে আদিষ্ট জায়গায় সেনা চলাচলের অবস্থা বিরাজিত ছিল। এ কারণে সেনাবাহিনী দূরে বিস্তৃত এলাকা যেমন ঝাঁসি, রাবিনা, হায়দরাবাদ ও ব্যাঙ্গালোরে অবস্থান নেয়। সে সব স্থানে সঙ্কুচিত চলাচল অব্যাহত রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই নিরাপত্তার কথা চিন্তা করা হয়, কারণ একটি মাত্র শব্দের প্রকাশ পাওয়া অত্যন্ত ক্ষতির কারণ হতে পারত। পরিকল্পনাকারীরা ভারতের মতো একটি উন্মুক্ত দেশে কোনো গোপন তথ্যের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না, বিশেষ করে ব্যাপক সৈন্য চলাচলের মতো উন্মুক্ত চলাচলে তা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে তাঁরা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বনের চেষ্টা করেন। ভারতীয় প্রতিরক্ষা অবস্থানসমূহ বিশেষ করে শেষ প্রান্তের রিজার্ভ সৈন্য সমাবেশ গোপন রাখার উদ্দেশ্যে সৈন্যবাহিনীকে মহড়া স্থলে ‘ভান’ করার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে একদম শেষ পর্যায়ে যুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে তাদের অপারেশনাল অবস্থানে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এই প্রস্তাবনায় ভারতীয় সেনাধ্যক্ষ জেনারেল মানেকশ রাজি হননি বরং তিনি উল্লেখ্য করেন, “আমি এ কল্পনাপ্রবণ খেয়ালি পরিকল্পনা মোটেই পছন্দ করছি না। আপনাদের এটা অবশ্যই বোঝা উচিত যে, আমার সেনা সংগঠন কোনো জার্মান প্যানথার ডিভিশন নয়। তাদের চলাচলে নিজেদের চাহিদামতো সময়ের প্রয়োজন আছে।”

অতএব তদনুযায়ী সেনাবাহিনীকে প্রকাশ্য দিবালোকে পুরোপুরি গোপনীয়তা ভঙ্গের ঝুঁকি নিয়েও শুধু সুষ্ঠু চলাচলের স্বার্থে ‘কনসেনট্রেশন এলাকায়’ পাঠিয়ে দেয়ার কাজ শুরু হয়। (কনসেনট্রেশন এলাকা বলতে যেখানে সেনাবাহিনী পুরোপুরি প্রতিরক্ষা অবস্থানে যাবার পূর্বে একত্রিত হয় তাকে বুঝায়)। অবশ্য তাদের প্রকৃত অবস্থানের কথা গোপন রাখার জন্য অন্য অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, যার মধ্যে ছিল- যাত্রাপথে বিভিন্ন স্থানে উদ্দেশ্যমূলক থামা, গুপ্ত পর্যবেক্ষকদের ফাঁকি দেয়ার জন্য অন্য ধরণের ভুল ‘ফরমেশন সাইন’ (কোনো ব্রিগেড বা ডিভিশনের সৈন্যরা আলাদাভাবে ব্রিগেড বা ডিভিশন অনুযায়ী ইউনিফর্মের হাতায় যে প্রতীক সংযুক্ত রাখে) এবং সম্পূর্ণ নতুন যুদ্ধ কৌশল সংক্রান্ত প্রতীক চিহ্নসমূহের ব্যবহার (India’s war since Independence: The Liberation of Bangladesh, Vol II, Vikas, 1980)।

এ সব উদ্যোগ বেশ কিছুদিনের জন্য পর্যবেক্ষকদের বোকা বানাতে সক্ষম হয়েছিল। এদিকে ‘র’ সূত্র থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভিন্ন ভুল তথ্য উপস্থাপনের ফলে পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা সত্য বিবর্জিত সিদ্ধান্তে উপনীত হন। পাকিস্তানী ইন্টেলিজেন্স এজেন্টরা বেশকিছু সময়ের জন্য সৈন্য চলাচলের আসল খবর সংগ্রহে ব্যর্থ হয় যদিও শেষ দিকে এসে তারা সফলতা লাভ করে, কিন্তু ততোদিনে ভারতীয় উদ্দেশ্য সফলতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।

অন্যদিকে ভুল তথ্য পরিবেশনার ধারা অনুসরণ করে চীন পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের এ ধারণা দেয় যে, তারা সম্প্রতি প্রশান্ত মহাসাগরে সংঘটিত মিসাইল পরীক্ষায় সম্পূর্ণ সফলতা লাভ করেছে, অবশ্য ‘র’-এর উল্টোই অনুমান করে।

এগুলোই মূলত কমবেশি ক্ষেত্রে প্রচলিত এসপায়োনজ ধারণা দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

ঢ। বিশেষ অপারেশনসমূহ (Special Operations)

এতোকিছুর পরেও ‘র’-এর মধ্যে বিশেষ এসপায়োনজ সংগঠন সক্রিয়, যারা এসপায়োনজ ছাড়াও ‘রাখঢাক ছদ্মাবরণে’ যা সাধারণত প্রকাশ পায় না এমন প্রচুর নোংরা কাজে ব্যস্ত থাকে। এরা ‘অফিস অব স্পেশাল অপারেশন’ (ও এস ও) -এর আওতাধীনে এদের কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। ও এস ও মূলতঃ এর নামের মতোই বিশেষ অপারেশন পরিচালনা করে। এ সংগঠনে যারা কাজ করেন তারা একেকজন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, যারা অপারেশনের ধরণের ওপর ভিত্তি করে বিশেষ প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। কোনো ইন্টেলিজেন্স তা সে বিশেষ বা অন্য যে কোনো ধরণেরই হোক না কেন তা মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক প্রস্তুতি ছাড়া শুরু হতে পারে না। ও এস ও স্টাফরা প্রচলিত এসপায়োনজরই বিভিন্ন কলাকৌশল রপ্ত করেন। কিন্তু প্রচলিত এসপায়োনজ থেকে তাদের পরিচিতি প্রকাশ পাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং ঝুঁকিও অনেক ব্যাপক। ব্যর্থতা এক্ষেত্রে প্রচণ্ড হেনস্থার কারণ হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে যদি অপারেশনের কথা জনগণের কাছে প্রকাশ পেয়ে যায়। কিন্তু তবুও এ ঝুঁকি ও এস ও কে নিতেই হয়। তবে ‘র’ এ ক্ষেত্রে বেশ ভাগ্যবান, কারণ এর গৃহীত বাংলাদেশ ও সিকিম অপারেশন দুটো জনগণের কাছে কিছু কিছু প্রকাশ পেলেও এতে কোনো অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। এর মৌলিক কার্যক্রম আবর্তিত হয় সংস্থার বিভিন্ন সূত্র হতে যেমন- ছাত্র, ধর্মীয় গোষ্ঠী, শ্রমিক ও প্রবাসীদের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যের বিশ্লেষণের ওপর, যা কিনা জনসচেতনতার প্রতিকূলে নয়। পরিকল্পনা, সংগঠন ও অপারেশনের যাত্রা বিশেষভাবে নির্দিষ্ট সময়ে শুরু করার মাধ্যমে ও এস ও-এর কার্যক্রম চলতে থাকে। কোনো কোনো সময় দলত্যাগী কাউকে সমর্থন ও সাহায্য দান এবং সমন্বয় সাধন করার প্রয়োজনও দেখা দিতে পারে।

এ সব উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য ও এস ও অপারেটররা বিভিন্ন কাভার নিয়ে, গোপন ছদ্ম উপায়ে নানা ধরণের সংস্থা গঠনে অথবা বিভিন্ন সংস্থাকে সাহায্য করে, যাদের শত্রু এলাকায় বৈধভাবে কাজ চালিয়ে যেতে কোনো অসুবিধা নেই। এ সব কাভার গ্রহণের জন্য সাধারণত ট্রাভেল এজেন্সি, ছোটখাট রফতানি প্রতিষ্ঠান, এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গড়ে তোলা হয়। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বেছে নেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, অপারেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই কাভারে কাজ চালিয়ে যাওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশনের পরও যদি কাভার সন্দেহের ঊর্ধ্বে ও পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে তবে অপারেটিভরা ওখানে থেকে যায়। আবার যখন কোন দেশের সাথে রাজনৈতিক কোন আলোচনা ব্যর্থ হয় তখনও ও এস ও কে বিশেষ কাজে স্মরণ করা হয়। অবশ্য যখন যুদ্ধের ডামাঢোল বাজতে থাকে তখন ও এস ও কে ডাকা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। ও এস ও এমনিই একটি সংগঠন, যার কার্যাবলীকে বলা যায় ‘গোপন বিশেষ অপারেশন, যা অন্যকিছু থেকে কম শয়তানীপূর্ণ। তবে অবশ্যই যুদ্ধ থেকে ভাল প্রকৃতির।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *