৪. গির্জার বাইরে দাঁড়িয়ে

৩১.

ব্রাইডা সিঁড়ির ওপরে উঠে গির্জার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। এই ছোট্ট গোলাকার ভবনটা মহাকালের গর্ব। আয়ারল্যান্ডের খ্রিস্টিয়ান ধর্মীয় স্থাপনার প্রথমদিককার অন্যতম ভবনের একটি। প্রতিবছর জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত আর টুরিস্টরা এটার পরিদর্শনে আসে। পঞ্চাশ শতকের মূল কাঠামোর তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কয়েকটা মেঝে ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন রেখে গেছে। যাই হোক, কিছুটা অংশ এখনো আগের মতোই আছে। যে কারণে দর্শনার্থীরা ইতিহাসের বৈচিত্র্যপূর্ণ স্থাপত্যের সাথে পরিচিত হতে পারে।

ভেতরে অর্গান বাজছিল। ব্রাইডা বাইরে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে মিউজিক শুনতে লাগল। এই গির্জায় সব কিছু এমন সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছিল, যেন পৃথিবীর একটা সংস্করণের মতো। যে কেউ দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে তার কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত হওয়ার দরকার হতো না। এখানে কোনো রহস্যময় শক্তির আধিপত্য ছিল না। কোনো অন্ধকার রাত্রির ব্যাপার ছিল না। এখানে অগ্নিদগ্ধ মানুষের ব্যাপারে কোনো কথা নেই। জগতের ধর্মগুলো এখানে এসে একত্রে থাকতে পারে, যদি তারা সহমত হয়। ঈশ্বরের সাথে মানুষের বন্ধন দৃঢ় করতে পারে। তাদের দ্বীপটি এখনো শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের জন্য ব্যতিক্রমী জায়গা হিসেবে প্রসিদ্ধ। উত্তরের দিকে, লোকজন এখনো ধর্মের নামে একে অন্যকে হত্যা করে। কিন্তু সম্ভবত তা শেষ হতে চলেছে। ঈশ্বরকে প্রায় সব ভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি আমাদের পবিত্র পিতা। আমরা সবাই রক্ষা পেয়েছি।

 আমি একজন ডাইনি। ব্রাইডা নিজেকে বলল। গির্জার ভেতরে প্রবেশের জন্য নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে লাগল। এখানে ভিন্ন ধরনের রীতি বিরাজ করছে। এমনকি যদি একই ঈশ্বরের বাহুতলে হয়, যদি সে এই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকে, এই জায়গাটাকে অশুচি করে ফেলতে পারে। অথবা পরিবর্তে অশুচি হতে পারে।

ব্রাইডা সিগারেট জ্বালাল। দিগন্তের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এসব ব্যাপারে না ভাবতে চেষ্টা করল। তার বদলে মায়ের কথা ভাবছিল। ইচ্ছা হচ্ছিল দৌড়ে বাড়িতে চলে যায়। গিয়ে মাকে বলে আর দুই দিনের মধ্যে সে মহৎ রহস্যের ডাইনিবিদ্যায় দীক্ষিত হতে যাচ্ছে। সে সময়ের সাথে ভ্রমণ করছে। সে যৌনতার শক্তির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। শুধু চাঁদের রীতির কৌশল প্রয়োগ করে দোকানের জানালা দিয়ে ভেতরে কী হচ্ছে এখানে বসে দেখতে পারে। তার ভালোবাসা এবং বোঝাঁপড়ার দরকার। কারণ সেও এ রকম গল্প জানে, যা কাউকে কখনো বলেনি।

অর্গান বাজানো বন্ধ হয়ে গেল। ব্রাইডা আরো একবার গ্রামের কথা শুনতে পেল। পাখিরা গাইছে। গাছের পাতায় বাতাসের ঝিরঝির শব্দ। বসন্তের আগমনী বার্তা ধ্বনিত হচ্ছে। গির্জার পেছন দিক দিয়ে একটা দরজা খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেল। কেউ একজন বেরিয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য, শৈশবের এক রবিবারের দৃশ্য দেখতে পেল। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। বেশ বিরক্ত হচ্ছিল, কারণ লাইনটা অনেক লম্বা। রবিবারই একমাত্র দিন, যেদিন মাঠ জুড়ে মুক্ত প্রাণীর মতো ঘুরতে পারে সে।

আমার অবশ্যই ভেতরে যাওয়া উচিত। সম্ভবত মা-ই বুঝতে পারবেন তার অনুভূতি এখন কেমন। কিন্তু এই মুহূর্তে, তিনি অনেক দূরে। তার সামনে ফাঁকা চার্চ। সে কখনো উইক্কাকে প্রশ্ন করেনি, কিছু ঘটে তার ক্ষেত্রে খ্রিস্টিয়ানিটিনির ভূমিকা কী? তার মনে হতে থাকে, যদি সে দরজার ভেতর দিয়ে হেঁটে যায় তাহলে তার পূর্বসূরি ডাইনি বোনেরা অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের সাথে প্রতারণা করা হবে।

কিন্তু তাহলে আমিও অগ্নিদগ্ধ হব। ব্রাইডা নিজেকে বলল। তার মনে পড়ে গেল একদিন উইক্কা ডাইনি শহীদদের নিয়ে প্রার্থনা করছিল। সেই প্রার্থনায়, উইক্কা যিশুখ্রিস্ট ও কুমারী মেরির নাম উল্লেখ করেছিল। ভালোবাসা সব কিছুর ওপরে। ভালোবাসার ক্ষেত্রে মৃণার কোনো সুযোগ নেই। শুধু মাঝে মাঝে কিছু ভুলভ্রান্তি ছাড়া। এক পর্যায়ে, মানুষেরা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে সিদ্ধান্ত নেয়। ফলাফলে ভুল করতে থাকে। কিন্তু ঈশ্বরের এ ক্ষেত্রে কিছুই করার নেই।

শেষ পর্যন্ত ব্রাইডা ভেতরে ঢুকল। ভেতরে কেউ ছিল না। কয়েকটা জ্বলন্ত মোমবাতি দেখে বোঝা যাচ্ছিল কেউ একজন ঝামেলার মধ্যে পড়েছে। আর এইভাবে তারা দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান জগতের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে। গির্জার মধ্যে প্রবেশের ক্ষেত্রে তার আগের চিন্তাভাবনার জন্য দুঃখ করল। এখানে কোনো কিছুর ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা দেয়া নেই। লোকজনের অন্তত একবার অন্ধকার রাত্রির বিশ্বাসের ব্যাপারে সুযোগ নেয়া উচিত। দুই হাত প্রসারিত করার আগে ঈরের কাছে আত্মসমর্পণ করল সে।

ঈশ্বর তাকে সাহায্য করতে পারবে না। সে একই তার সিদ্ধান্তে আছে। কেউ তাকে সাহায্য করতে পারবে না। ঝুঁকি নেয়ার মাঝে শেখার ব্যাপার আছে। তার সামনে যে ক্রুশবিদ্ধ মানুষটা তার মতো একই সুযোগ তার নেই। তিনি জানতেন তার মিশন কী। কারণ তিনি ঈশ্বরের পুত্র। তিনি কখনো কোনো ভুল করেন না। তিনি কখনো সাধারণ মানুষের ভালোবাসার ধরন জানেননি। শুধু ঈশ্বরের ওপর ভালোবাসা বজায় রেখেছিলেন। তিনি মানুষের সম্মুখে প্রজ্ঞাকে উন্মুক্ত করেছেন। মানুষকে স্বর্গের সত্য পথ দেখিয়েছেন।

কিন্তু এটাই কি সব এক রবিবারের ক্যাটেসিজম ক্লাসের কথা মনে পড়ে যায়। সেদিন যাজক অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি প্রভাবিত ছিলেন। তারা বিসাসের ওপর একটা অধ্যায় পড়ছিল। রক্তাক্ত শরীরের ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছেন। ঈরের কাছে প্রার্থনা করছে তাকে যে পাত্র থেকে পান করার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে, তা সরিয়ে নিয়ে যেতে।

কিন্তু কেন, যদি তিনি এরই মধ্যে জেনে থাকেন তিনি ঈশ্বরের পুত্র? যাজক জিজ্ঞাসা করলেন। কারণ তিনিই একমাত্র হৃদয় দিয়ে তা জানতেন। তিনি যদি পুরোপুরি নিশ্চিত হতেন, তার মিশন অর্থহীন হয়ে পড়ত। কারণ তিনি পুরোপুরি মানুষ ছিলেন না। মানুষ হলে তার ভেতরে সন্দেহ থাকত। আর এখনো তোমার পথেই থাকত।

 ব্রাইডা আবার যিশুর প্রতিমূর্তির দিকে তাকালো। তার গোটা জীবনের মধ্যে এই প্রথমবার, খুব কাছাকাছি এলো। সেখানে সম্ভবত একজন মানুষ ছিল। ভীত একাকী। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসা করছিলেন, পরমপিতা, পরমপিতা, তারপরও তুমি আমাকে কেন ক্ষমা করলে তিনি যদি তা বলে থাকেন, তার কারণ হতে পারে, এমনকি তিনিও নিশ্চিত ছিলেন তাকে কোথায় যেতে হবে। তিনি একটা সুযোগ নিয়ে সব মানুষের মতো অন্ধকার রাত্রিতে জেনেছেন, শুধু এই ভ্রমণের শেষেই তিনি তা জানতে পারবেন। তিনিও সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন। বাবা মাকে আর ছোট্ট গ্রাম ছেড়ে মানুষের গোপন রহস্য এবং আইনের রহস্যময়তা খুঁজতে বেরিয়েছিলেন।

যদি তিনি এসবের মধ্য দিয়ে যেতেন তিনি অবশ্যই ভালোবাসার সমন্ধে জানতেন। এমনকি যদিও গসপেল কখনো তা উল্লেখ করেনি– মানুষের মাকে অলোবাসা বুঝতে পারাটা এরিক শক্তির অলোবাসা বোঝার চেয়ে অনেক কঠিন। কিন্তু এখন তার মনে পড়ে যাচ্ছে, তাকে আবার যখন পুনরুহিত করা হবে, প্রথমে যে মানুষটি যাবে সে একজন মহিলা, যে তাকে একেবারে শেষ পর্যন্ত সঙ্গ দিয়েছিল।

নিঃশব্দ প্রতিমূর্তি যেন তার ভাবনায় সম্মত হলো। তিনি লোকজনের সম্বন্ধে, ওয়াইন, খাবার, পার্টি আর জগতের সব সৌন্দর্যের ব্যাপারে জানতেন। এটা অসম্ভব যে তিনি একজন মহিলার ভালোবাসার কথা : জানবেন না। সে কারণেই তিনি তার শরীর থেকে মাউন্ড অব অলিভের ওপর রক্ত ঝরিয়েছেন। কারণ কারো ভালোবাসা জানার পরে, জগৎ ছেড়ে যাওয়া খুবই কঠিন। সমস্ত মানুষের প্রতি ভালোবাসায় তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

তিনি জগতের সব কিছুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তিনি ভ্রমণরত থেকে জানতেন অন্ধকার রাত্রি এক সময় ক্রমে শেষ হবে।

ঈশ্বর, এই জগতের আমরা সবাই অন্ধকার রাত্রির ঝুঁকির মধ্যে আছি। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই কিন্তু তার চেয়ে বেশি ভয় পাই নিজের জীবন নষ্ট করে যেনার জন্য। আমি ভালোবাসার ব্যাপারে ভয় পাই, কারণ এ এমন জিনিসের সাথে জড়িত যা আমাদের বোধের ঊর্ধ্বে। ভালোবাসার আলো অনেক উজ্জ্বল কিন্তু তার চারদিকের ছায়া আমাকে ভীত করে।

ব্রাইডা হঠাৎ করে বুঝতে পারল সে প্রার্থনা করছে। ঈশ্বর নীরবে তাকে দেখছেন। তার কথা বুঝতে পারছেন। কথাগুলোকে আন্তরিকতায় গ্রহণ করেছেন।

এক মুহূর্তের জন্য, তার কাছ থেকে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল। কিন্তু কোনো শব্দ শুনতে পেল না। কোনো চিহ্ন দেখতে পেল না। ক্রশবিদ্ধ মানুষটার সামনেই যেন সেই উত্তর ছিল। তিনি তার অংশটুকু করেছেন। জগৎকে তা দেখিয়েছেন। যদি প্রত্যেকেই তার কাজটুকু করে, তাহলে কেউ কোনো কষ্ট ভোগ করবে না। কারণ তিনি সকলের কষ্ট নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

ব্রাইডা বুঝতে পারল সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। যদিও কেন তা সে জানে না।

.

৩৪.

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কিন্তু বৃষ্টি হয়নি। লরেন্স এই শহরে অনেক বছর ধরে আছে। মেঘের গতি প্রকৃতি জানে। সে উঠে পড়ল। কফি বানানোর জন্য কিচেনে গেল। ব্রাইডাও তার সাথে যোগ দিল। পানি ফোঁটাতে লাগল।

গত রাতে তুমি খুব দেরিতে বিছানায় গেছ। লরেন্স বলল।

 কোনো উত্তর দিল না ব্রাইডা।

আজ সেই দিন। লরেন্স বলল, আর আমি জানি দিনটা তোমার জন্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। ওখানে তোমার সাথে যেতে পারলে ভালো হতো।

এটা একটা পার্টি। ব্রাইডা বলল।

তার মানে কী?

এটা একটা পার্টি। আর যত দিন ধরে আমরা একে অন্যকে জানি, আমরা সব সময় পার্টিতে একসাথে গিয়েছি। তোমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

.

৩৫.

ম্যাগাস বাইরে বেরিয়ে এলেন। গত দিনের বৃষ্টি তার বাগানের ফলনের কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না দেখতে হবে। সব কিছু ঠিকঠাক আছে। ম্যাগাস হাসলেন। দেখে মনে হচ্ছে প্রকৃতির শক্তি মাঝে মাঝে সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করে।

তিনি উইক্কার কথা ভাবছিলেন। উইক্কা আলোকবিন্দু দেখতে পাবে না। কারণ তারা শুধু দৃশ্যমান জগতের আত্মার সঙ্গী। কিন্তু উইক্কা নিশ্চয় ম্যাগাস আর তার ছাত্রীর মধ্যে যে শক্তির প্রবাহ সঞ্চারিত হয় তা লক্ষ করবে। ডাইনিরা সাধারণ মহিলাদের অনেক ওপরে।

চাঁদের রীতিনীতিতে এ ব্যাপারটাকে ভালোবাসার দর্শন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও মাঝে মাঝে এ রকম দুজন মানুষের ভেতরে এই ব্যাপারটা ঘটে, যারা একে-অপরের আত্মার সাথী নয়, কিন্তু তারা প্রেমে পড়ে। তিনি কল্পনা করলেন ব্যাপারটা হতে পারে। মেয়েলি রাগের কারণে এমনটি হয়। যে রকম স্নো হোয়াইটের সত্য, যে আর কোনো মহিলাকে নিজের চেয়ে সুন্দর মানতে নারাজ।

উইক্কা একজন শিক্ষক। খুব শিগগিরই সে তার রাগের অনুভূতির ব্যাপারটার অসারতা বুঝতে পারবে। কিন্তু তার মধ্যে উইক্কার জ্যোতি রং বদলে ফেলবে।

তিনি সেই সময় উইক্কার কাছে যেতে পারেন। তার চিবুকে চুমু খেয়ে বলতে পারেন, উইক্কার ঈর্ষার ব্যাপারটা তিনি দেখতে পেয়েছেন। সে অস্বীকার করবে। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, সে রেগে আছে কেন?

উইক্কা তাকে বলতে পারে সে একজন নারী। আর নারীর অনুভূতি ব্যাখ্যা করার দরকার হয় না। তিনি উইক্কার গণ্ডদেশে আরেকবার চুমু দেবেন। কারণ সে যা বলেছে তা সত্য। তিনি উইক্কাকে বলবেন, তারা আলাদা হয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি কেমনভাবে তাকে মিস করেছেন। আর তিনি এখনো জগতের যেকোনো মহিলার চেয়ে, উইক্কার অনুরাগী হিসেবেই আছেন। শুধু ব্রাইডার ব্যাপারটা আলাদা। কারণ ব্রাইডা তার আত্মার সঙ্গী।

উইক্কার মতো জ্ঞানী মহিলা তখন সুখী হতে শুরু করবে।

আমি অবশ্যই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। ম্যাগাস ভাবলেন। আমি কল্পনায় কথোপকথন শুরু করেছি। তারপর তিনি বুনতে পারলেন বয়সের কারণে এমনটি হচ্ছে না। মানুষ প্রেমে পড়লেই সব সময় এ রকম আচরণ করে।

.

৩৬.

বৃষ্টি বন্ধ হওয়ায় উইক্কা বেশ সন্তুষ্ট। রাতের আগেই আকাশের মেঘ পরিষ্কার হয়ে যাবে। মানুষের কাজের ধরন অনুসারে প্রকৃতির আচরণ করা উচিত।

উইক্কা সব রকম প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সবাই নিজ নিজ কাজ ঠিকঠাক ভাবে করেছে। সব কিছুই জায়গামতো আছে।

উইক্কা বেদির কাছে গিয়ে তার শিক্ষককে স্মরণ করল। সে শিক্ষককে ওই রাতে উপস্থিত থাকতে বলল। তিনজন নতুন ডাইনি মহৎ রহস্যময়তায় নিজেদের দীক্ষিত করবে। এই কাজের পুরো দায়দায়িত্ব তার ওপর।

 উইক্কা কফি বানানোর জন্য কিচেনে গেল। কিছুটা অরেঞ্জ জুস নিল। টোস্ট আর কয়েক টুকরো পাউরুটি খেল। নিজের শরীরের ব্যাপারে এখনো যে যত্নবান। কতটা সুন্দরী তা সে জানে। নিজের সৌন্দর্যকে অবহেলা করে বুদ্ধিমত্তা প্রমাণ করার কোনো দরকার নেই।

কফি নাড়তে নাড়তে অনেক বছর আগের এ রকম একটি দিনের কথা মনে পড়ে গেল উইক্কার। সেদিন শিক্ষক তার ভাগ্যকে মহ রহস্যের সাথে জুড়ে দিয়েছিলেন। এক মুহূর্তের জন্য, সে কল্পনা করতে চেষ্টা করে, সেই সময়ে সে কেমন মানুষ ছিল। তখন তার স্বপ্ন কী ছিল। জীবনের কাছে সে কী চেয়েছিল।

 আমি অবশ্যই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। উইক্কা জোরে জোরে বলল, এখানে বসে অতীতের কথা চিন্তা করছি। সে কফি পান করে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। এখনো অনেক কিছু করার আছে। জানে, সে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে না। তার জগতে, সময়ের কোনো অস্তিত্ব নেই।

.

৩৬.

রাস্তার পাশে পার্ক করা গাড়ির সংখ্যা দেখে ব্রাইডা বিস্মিত হলো। সেই সকালে পরিষ্কার আকাশে ঘনঘোর মেঘের ঘটা। সূর্যের শেষ আলোকরশিও চাপা পড়ে গেছে। বাতাসে হাড়কাঁপানো শীতের প্রকোপ থাকলেও, আজ বসন্তের প্রথম দিন।

 ব্রাইডা জঙ্গলের আত্মাদের থেকে সাহায্য প্রার্থনা করেছে। তারপর লরেন্সের দিকে তাকালো। লরেন্সও ভয়ে ভয়ে একই রকম শব্দমালা পুনরাবৃত্তি করছে। এখানে ওকে বেশ সুখীই লাগছে। দুজন একসাথে থাকলে, সময়ের সাথে সাথে তারা একে অন্যের বাস্তবতায় প্রবেশ করে। তাদের মধ্যেও, দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান জগতের একটা সেতুবন্ধন কাজ করছে। তাদের প্রতিটি কাজেই ম্যাজিকের অস্তিত্ব বিরাজমান।

 তারা বেশ দ্রুতই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগল। শিগগিরই তৃণভূমির কাছে পৌঁছে গেল। এখানে কী দেখবে তার প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল ব্রাইডার। সব বয়সী পুরুষ-মহিলা, সন্দেহ নেই এরা বিন্নি পেশার, দলে দলে ভাগ হয়ে আছে। এ রকমভাবে কথা বলছে, যাতে মনে হয় গোটা উৎসবটাই জগতের সবচেয়ে প্রাকৃতিক বিষয়। বাস্তবতা হলো, তারাও ব্রাইডা আর লরেন্সের মতো কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় আছে।

এ সমস্ত লোকজন উৎসবের অতিখি? লরেন্স জিজ্ঞাসা করল। এত ভিড় হবে তা আশা করেনি সে।

ব্রাইডা ব্যাখ্যা করল, ওর মধ্যে কয়েকজন তার মতো অতিথি হিসেবে আছে। সে নিজেই ঠিকভাবে জানে না ওর মধ্যে কারা দীক্ষায় অংশ নেবে। কিন্তু কাঙিক্ষত সময়ে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।

একটা কোণ দেখে তাদের জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে রাখল। লরেন্স যে ব্যাগটা নিয়ে এসেছিল সেটাও রাখল। তার মধ্যে ব্রাইডার পোশাক আর তিন বোতল ওয়াইন আছে। উইক্কা জানিয়েছিল, প্রত্যেকেই, তাই সে অংশগ্রহণকারী হোক আর অতিথি হোক, এক বোতল করে ওয়াইন নিয়ে আসতে হবে। তারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার আগে লরেন্স জিজ্ঞাসা করেছিল, অন্য অতিথি কারা। ব্রাইডা লরেন্সকে জানিয়েছিল, ম্যাগাস আসবে। পাহাড়ে ম্যাগাসের সাথেই সে দেখা করতে যেত। লরেন্স আর কোনো কিছু বলেনি।

কল্পনা করতে পারো, লরেন্স শুনতে পেল তার পাশে দাঁড়ানো একজন মহিলা মন্তব্য করছে। কল্পনা করতে পারো, আমার বন্ধুরা কি বলবে যদি তারা জানত আমি একজন সত্যিকারের ডাইনি সাব্বাহ।

একজন ডাইনি সাব্বাহ!

এই উৎসব রক্তপ্রবাহ, অগ্নিকাণ্ড, বয়স আর নিয়ম-কানুনের। লরেন্স নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল, যাই হোক, তার মতো আরো অনেক মানুষ এখানে আছে। যাই হোক, তৃণভূমির মাঝখানে কাঠের স্তূপ দেখে তার মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল।

উইক্কা অন্য মানুষের সাথে কথা বলছিল। কিন্তু যেই না ব্রাইডাকে দেখতে পেল, দেখা করতে চলে এলো। হাই, হ্যালো করে জিজ্ঞাসা করল সে ঠিক আছে কি না। ব্রাইডা মহানুভবতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে লরেন্সকে পরিচয়। করিয়ে দিল।

আর আমি আরো একজনকে আমন্ত্রণ করেছি। ব্রাইডা বলল।

উইক্কা বিস্ময়ের সাথে ব্রাইডার দিকে তাকালো। চওড়া করে হাসল। ব্রাইডা নিশ্চিত, উইক্কা জানে সে কী বোঝাতে চেয়েছে।

আমি খুশি। উইক্কা বলল, সর্বোপরি, এটা একটা উৎসবও। আমি যখন বুড়ো জাদুকরকে দেখেছিলাম এর বয়স সে রকম। হতে পারে সেও এখান থেকে একটা দুটো জিনিস শিখতে পারে।

আরো লোকজন আসতে লাগল। ব্রাইডা বলতে পারে না এদের মধ্যে অতিথি কারা, আর অংশগ্রহণকারী কারা। আধা ঘণ্টা পরে, প্রায় শখানেক লোক তৃণভূমির কাছে একত্রিত হয়ে চুপিচুপি কথা বলতে লাগল। উইক্কা চুপ থাকার জন্য অনুরোধ করল।

এটা একটা অনুষ্ঠান। উইক্কা বলল, কিন্তু এটা একটা উৎসবও। আর কোনো উৎসবই সবাই গ্লাস পরিপুর্ণ করে না নিলে শুরু হতে পারে না।

উইক্কা ওয়াইনের বোতল খুলে পাশেরজনের গ্লাস পরিপূর্ণ করে দিল। খুব শিগগিরই ওয়াইনের নহর বয়ে যেতে লাগল। কণ্ঠস্বর চড়া হতে লাগল। ব্রাইডা পান করতে চাইছিল না। এখনো তার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে গমের ক্ষেতের মধ্যে একজন মানুষ তাকে গোপন মন্দিরে চাঁদের রীতি দেখিয়েছিল। পাশাপাশি, যে অতিথির আশা করেছিল তিনি এখনো পৌঁছাননি।

অন্যদিকে লরেন্সকে বেশ স্বাচ্ছন্দ দেখা গেল। পাশের লোকজনের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে।

এটা সত্যিই একটা পার্টি! সে হাসতে হাসতে বলল ব্রাইডাকে। সে অসাধারণ কিছু আশা করে এখানে এসেছিল। কিন্তু এটা এখন শুধু একটা পার্টির রূপ নিয়েছে। আর তার বিজ্ঞানী বন্ধুদের চেয়ে এখানে মজা আরো অনেক বেশি।

একটু দূরে একজন সাদা দাড়িওয়ালা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। লরেন্স ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হিসেবে তাকে চিনতে পারল। লরেন্স ভালো করে তার সম্বন্ধে জানে না। কিছুক্ষণ পর, প্রফেসরও তাকে চিনতে পারলেন। আনন্দসূচক স্বরে গ্লাস তুলে ধরলেন।

লরেন্স স্বস্তিবোধ করতে লাগল। এখন আর ডাইনি শিকার করা হয় না, তাদের সহমর্মীদেরও না।

এটা একটা পিকনিকের মতো। ব্রাইডা শুনতে পেল কেউ একজন বলছে। হ্যাঁ, এটা পিকনিকের মতো। আর তাতেই বিরক্ত হয়ে উঠল ব্রাইডা। সে আরো বেশি উপাসনাভিত্তিক কিছু আশা করেছিল। সাব্বাথের মতো কিছু। যেখানে গোয়া, সেইন্ট-সেইন আর পিকাসোর মতো অনুপ্রেরণা থাকবে। ব্রাইডা পাশের বোতল তুলে নিয়ে পান করতে শুরু করল।

একটা পার্টি। একটা পার্টির মাধ্যমে দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান জগতের সেতুবন্ধ পার করা যায়। ব্রাইডা বুঝতে পারল না এ রকম সেকুলার এটম্পফিয়ারের মধ্যে কীভাবে পবিত্র জিনিস পালন করা সম্ভব।

রাত নেমে আসে। লোকজন পান করতে থাকে। গাঢ় অন্ধকারে সব কিছু ডুবে যেতে থাকে। ওখানকার উপস্থিত কয়েকজন পুরুষ কোনো রকম নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান ছাড়াই-আগুন জ্বালে-আলোকিত করার জন্য। অতীতেও এমনটি হয়েছে। ডাইনিবিদ্যার মধ্যে আগুন শক্তিশালী উপাদান বিবেচিত হওয়ার আগে, আগুন আলোরই উৎস ছিল। আলোর চারদিকে মহিলারা তাদের পুরুষের সাথে একত্রিত হয়ে কথা বলে, তাদের জাদুকরী অভিজ্ঞতা, মধ্যযুগের যৌনতাময় দানবের ভীতির কথা। অতীতেও এ রকমটিই হয়েছে– একটা পার্টি, জনপ্রিয় উৎসব। বসন্তের জন্য আনন্দময় উৎসব এবং প্রত্যাশারও। সুখী হওয়াটা আইনের চোখে চ্যালেঞ্জের মতো, কারণ এই জগতে কেউ নিজেদের সেভাবে উপভোগ করতে পারে না। ভূমির ঈশ্বর তাদের অন্ধকার দুর্গ বন্ধ করে দিয়েছেন। জঙ্গলের আগুন যেন ডাকাতি হয়ে গেছে। যারা সুখী হওয়ার জন্য আগ্রহী ছিল তারা কেউ সুখের অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি। কৃষকরা হয়তো সারা বছর সুখী হওয়ার আশা করত। কিন্তু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বেড়াজালে হুমকির মুখে পড়েছে।

চার পাঁচজন মানুষ কিছুটা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, ওরা আগুনের চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে শুরু করল। সম্ভবত ডাইনি সাব্বাথের অনুকরণ করছে। ওসব নৃত্যরতাদের মধ্যে ব্রাইডা একজন দীক্ষাকারীকে দেখতে পেল, উইক্কা একবার যাকে শহীদের বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ব্রাইডা বেশ শক পেল। সে ধারণা করেছে চাঁদের রীতিতে অনেক বেশি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পবিত্র জায়গাটাকে রক্ষা করা হবে। ম্যাগাসের সাথে কাটানো রাতের কথা মনে পড়ে যায়। তাদের মহাজাগতিক পরিভ্রমণের সময় পান করাটা কেমন সুন্দরভাবে সংযোগ স্থাপন করেছিল।

আমার বন্ধুরা ঈর্ষায় নীল হয়ে যাবে। ব্রাইডা শুনতে পেল কেউ একজন বলছে, তারা কখনো বিশ্বাস করবে না আমি এখানে এসেছিলাম।

 বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। ব্রাইডার একটু দূরত্ব বজায় রাখা দরকার। কী ঘটছে তা ঠিকভাবে বুঝতে হবে। এখন থেকে বাড়িতে চলে যাওয়ার আগে তাকে ঘটনাটা জানতে হবে। কারণ গত এক বছর ধরে সে যা বিশ্বাস করেছে এখন তার মোহমুক্তি ঘটতে যাচ্ছে। উইক্কাকে খুঁজছিল ব্রাইডা। দেখতে পেল উইক্কা কয়েকজন অতিথির সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। সময়ের সাথে আগুনের চারধারের নৃত্যরত মানুষের সংখ্যা বাড়ছিল। কয়েকজন হাততালি দিয়ে গান গাচ্ছিল। অন্যরা বোতল খালি করায় ব্যস্ত ছিল।

আমার একটু হাঁটতে যাওয়া দরকার। লরেন্সকে বলল ব্রাইডা।

লরেন্সের চারপাশে একদল লোক জড়ো হয়েছে। তারা জড়ো হয়ে প্রাচীন তারকারাজি আর আধুনিক পদার্থবিদ্যার অলৌকিকত্ব মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। যাই হোক, সে তাড়াতাড়ি লেকচার দেয়া বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি চাও আমি তোমার সাথে আসি?

না। আমি একাই ঘুরে আসতে চাই।

ব্রাইডা দল ত্যাগ করে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ওদের কণ্ঠস্বর আরো জোররালো হয়ে উঠেছে। সব কিছু ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে। মাতলামো, মন্তব্য, লোকজনের ডাইনিসুলভ খেলা, আগুনের চারধারের নৃত্য– সব কিছু তার মাথায় গুলিয়ে যেতে লাগল। এই রাতের জন্য এত দিন অপেক্ষা করেছে সে। কিন্তু এটা ঠিক আরেকটা পাটির রূপ নিয়েছে। যেন কোনো দাঁতব্য পার্টি, যেখানে লোকজন গিয়ে খায়-দায়, মাতাল হয়, জোকস বলে তারপর জানায় তাদের ভারতীয় দক্ষিণাংশের জন্য অথবা উত্তর মেরুর সিল মাছের জন্য সাহায্য দরকার।

 ব্রাইডা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগল। দূর থেকে আগুনের জায়গাটা চোখে চোখে রাখল। সে এ রকম একটা পথ দিয়ে হাঁটতে লাগল, যাতে মধ্যের সেই পাথরটা চোখে পড়ে। যাই হোক, ওপর থেকে দেখে আরো বেশ হতাশ লাগছিল। উইক্কা বিভিন্ন দলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি না জিজ্ঞাসা করছে। লোকজন আগুনের পাশে নাচছে। কয়েকজন দম্পতি এর মধ্যে তাদের মাতাল চুম্বন সমাপ্ত করেছে। লরেন্স হাত নেড়ে নেড়ে দুজন মানুষের সাথে কথা বলছে। সম্ভবত এ রকম কোনো কিছু, যা এখনকার উপযুক্ত। কিন্তু এই উৎসবের কথা নয়। একজন মানুষ ওখানে দেরিতে এসে প্রবেশ করল। ওখানকার গুঞ্জনের অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। কিছুটা মজাও পাচ্ছে সবাই।

হাঁটার ধরন দেখে মানুষটাকে চিনতে পারল ব্রাইডা।

 জাদুকর ম্যাগাস!

চমকে উঠে ব্রাইডা আবার দৌড়ে ফিরে আসতে লাগল। জাদুকর ম্যাগাস পার্টিতে ঢোকার আগে ওখানে পৌঁছাতে চায় সে। তাকে সাহায্য করার জন্য ম্যাগাসকে দরকার, আগেও যেমনটি করেছিল। এখানে কী ঘটছে তার অর্থটা ম্যাগাসের কাছ থেকে জেনে নেয়া দরকার।

.

৩৮.

উইক্কা সম্ভবত জানে কীভাবে একটা সাব্বাথের অর্গানাইজ করতে হয়। জাদুকর ম্যাগাস পার্টিতে এসে ভাবলেন। তিনি উপস্থিত লোকজনের মধ্যে শক্তির মুক্ত প্রবাহ অনুভব করতে পারছেন। উপাসনার এই পর্যায়ে সাব্বাথকে যেকোনো পার্টির মতোই মনে হবে। অতিথিরাও একই ওয়েভলেংথে আছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। তার প্রথম সাব্বাথে, এসব দেখে তিনি প্রথমে খুব ধাক্কা খেয়েছিলেন। তার মনে পড়ে তিনি শিক্ষককে ডেকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, এসব কী হচ্ছে।

তুমি কি এর আগে কখনো কোনো পার্টিতে যাওনি? তার শিক্ষক জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ম্যাগাস এ রকম বাধা দেয়ায় কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন।

অবশ্যই সে গিয়েছে, ম্যাগাস বলেছিল।

তাহলে একটা ভালো পার্টি কিসে বোঝা যায়?

প্রত্যেকেই নিজেদের উপভোগ করে।

গুহার মধ্যে বাস করার সময় থেকেই পুরুষেরা পার্টির ব্যাপারটা ধারণ করে রেখেছে। তার শিক্ষক বললেন। আমরা জানি সেটাই প্রথম দলগত উপাসনা। সূর্যের রীতিতে এই উপাসনা বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। একটা ভালো পার্টি মানে সেখানে সবাই অংশ নেয়। কিন্তু তা ঘটানো বেশ কঠিন। মাত্র কয়েকজন মানুষের জন্য গোটা পার্টি নষ্ট হয়ে যায়। ওই সব মানুষ ভাবে তারা অন্যদের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাদের খুশি করা কঠিন। তারা ভাবে তাদের সময় নষ্ট হচ্ছে, কারণ তারা কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। আর তারা সাধারণত দোষীদের রহস্যময় কাব্যময়তার হাতে ছেড়ে দেয়। এসব মানুষ অন্যদের সাথে বন্ধন কোনোমতে রক্ষা করতে পারে। মনে রেখো, ঈশ্বরের প্রথম রাস্তা প্রার্থনা। দ্বিতীয় রাস্তা আনন্দ।

 শিক্ষকের সাথে সেই কথোপকথনের পরে অনেক বছর কেটে গেছে। তারপর থেকে ম্যাগাস অনেক সাব্বাথে অংশগ্রহণ করেছে। আর তিনি জানেন এই পার্টি খুব দক্ষভাবে সাজানো হয়েছে। সমগ্র মানুষের প্রাণশক্তির লেভেল সব সময় বেড়ে চলেছে।

তিনি ব্রাইডাকে খুঁজছিলেন। পার্টিতে অনেক লোকজন আছে। তিনি লোকজনের ভিড়ে অভ্যস্ত নন। তিনি জানতেন সম্মিলিত শক্তির প্রয়োজন রয়েছে। তিনি সে ব্যাপারে প্রস্তুত হয়ে এসেছেন। কিন্তু প্রথমে নিজেকে গুছিয়ে নেয়া দরকার। ব্রাইডা তাকে সাহায্য করতে পারবে না। ব্রাইডাকে পেলে তিনি অনেক বেশি সহজ বোধ করবেন।

তিনি একজন প্রজ্ঞাবান পুরুষ। তিনি আলোকবিন্দু সমন্ধে জানেন। তার শুধু নিজের সচেতনতা বদলে নেয়া দরকার। আলোকবিন্দু এই সমস্ত মানুষের মাঝে দেখা যেতে পারে। বছরের পর বছর তিনি এই আলো খুঁজে ফিরেছেন। আর এখন সেই আলোকবিন্দু তার থেকে কয়েক গজ দূরে আছে।

ম্যাগাস সচেতনতা বদলে নিলেন। তিনি আবার সম্মিলিত লোকদের দেখতে লাগলেন। এইবারে তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে নিলেন। তিনি বিভিন্ন রকমের রঙের জ্যোতি দেখতে পাবেন। রাতের অন্ধকারে রঙের ধরনগুলো খুব কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে।

উইক্কা সত্যিই একজন অসামান্য শিক্ষক। তিনি আবার ভাবলেন, সে খুব দ্রুত কাজ করে। শিগগিরই এসব জ্যোতির মধ্যে যে শক্তির কম্পন মানুষের শরীরের মধ্যে বিরাজ করছে, একবার না একবার কম্পিত হবে। তারপর আচার-অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু করা হবে।

তিনি ডানে-বামে খুঁজতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত আলোকবিন্দুর অবস্থান বের করতে পারলেন। তিনি ব্রাইডাকে বিস্মিত করার জন্য চুপি চুপি নিঃশব্দে এগিয়ে গেলেন।

ব্রাইডা। তিনি বললেন।

 আত্মার সঙ্গী ঘুরে দাঁড়াল।

 ব্রাইডা একটু হাঁটতে গেছে। একজন তরুণ যুবক বিনীত স্বরে বলল।

মুহূর্তটা যেন স্থবির হয়ে গেছে। ম্যাগাস তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকালেন।

 আপনি অবশ্যই সেই জাদুকর হবেন, ব্রাইডা যার সমন্ধে আমাকে অনেক কিছু বলেছে। লরেন্স বলল, আমাদের সাথে যোগ দিন। ও খুব বেশি সময় নেবে না।

 কিন্তু ব্রাইডা ততক্ষণে সেখানে চলে এসেছে। সে কথোপকথনরত মানুষ দুজনের বিপরীতে দাঁড়াল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।

আগুনের অন্য দিক থেকে কেউ একজন তাকে দেখছে, ম্যাগাস বুঝতে পারলেন। তিনি ওই দৃষ্টি চেনেন। ব্রাইডা আলোকবিন্দু দেখতে পাবে না। কারণ শুধু আত্মার সঙ্গীরাই একে অন্যকে চিনতে পারে। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি অনেক গভীর আর প্রাচীন। যে চাঁদের রীতির নারী-পুরুষের হৃদয়ের কথা জানে।

ম্যাগাস ঘুরে দাঁড়িয়ে উইক্কার মুখোমুখি হলেন। তিনি আগুনের অন্য পাশ থেকে উইক্কারর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মুহূর্তের মধ্যে উইক্কা সব কিছু বুঝতে পারল।

ব্রাইডাও ম্যাগাসের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারা বেশ আনন্দে আছে। ম্যাগাস এসেছে।

আমি আপনাকে লরেন্সের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। ব্রাইডা বলল। পার্টিটা হঠাৎ করে তার কাছে বেশ মজার মনে হলো। আর কোনো ব্যাখ্যার দরকার নেই।

ম্যাগাস এখনো আগের অবস্থায় আছে। তিনি ব্রাইডার জ্যোতি বেশ তাড়াতাড়ি বদলাতে দেখলেন। উইক্কা পছন্দের রঙের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

জাদুকর ম্যাগাস আসায় ব্রাইডা বেশ খুশি। ম্যাগাস যা কিছু বলবে বা করবে তাতে তার এই দিক্ষা নেয়ার রাতটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ম্যাগাসকে অবশ্যই যেকোনো মূল্যে নিজের আবেগকে সামলে রাখতে হবে।

আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। ম্যাগাস লরেন্সকে বললেন, আমাকে এক গ্লাস ওয়াইন ঢেলে দিলে কেমন হয়?

লরেন্স হেসে বোতল বাড়িয়ে দিলেন।

আমাদের দলে স্বাগতম। লরেন্স বলল, আমি নিশ্চিত আপনিও পার্টি উপভোগ করবেন।

অন্যদিকে তাকালো উইক্কা। তার চেহারায় স্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠল। ব্রাইডা কোনো কিছুই লক্ষ্য করছে না। ব্রাইডা খুব ভালো ছাত্রী। উইক্কা আজ রাতের দীক্ষা নেয়ার অনুষ্ঠান থেকে তাকে বাদ দিতে পারে, কারণ সে সবচেয়ে সহজ পদক্ষেপও নিতে ব্যর্থ হবে।

আর ম্যাগাস নিজের দেখভাল নিজে করতে পারে। ম্যাগাসের বছরের পর বছর কাজ আর নিয়মানুবর্তিার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি নিজের আবেগকে সামলে রাখতে পারবেন। অন্যের প্রতি আবেগ দেখানোর যথেষ্ট সময় আছে। ব্রাইডা তার কঠোর পরিশ্রমকে সম্মান করে। তার জেদী স্বভাব আর অফুরন্ত শক্তির ব্যাপারে কিছুটা ভয় পায়।

উইক্কা আরো কয়েকজন অতিথির সাথে কথা বলতে লাগল। কিন্তু সে যা দেখেছে তার বিস্ময় গেল না। মাগাস কেন ব্রাইডার প্রতি এতটা মনোযোগ দিচ্ছে? ব্রাইডা আর যাই হোক একজন ডাইনির চেয়ে বেশি কিছু নয়। ব্রাইডা চাঁদের রীতি শেখার জন্য কয়েকটা কর্তব্য পালন করেছে মাত্র।

ব্রাইডা তার আত্মার সঙ্গী।

আমার নারীসুলভ ইনটুইশন খুব ভালো কাজ করছে না। উইক্কা সব কিছু কল্পনা করতে পারে। শুধু এসব ক্ষেত্রে পারে না। সে নিজেকে এই বলে সান্তনা দিল অন্ততপক্ষে সব কিছুর ব্যাপারে তার কৌতূহল একটা ভালো দিকে রূপ নিচ্ছে। ঈশ্বরের পছন্দ করা পথে তার ছাত্রী এগিয়ে চলেছে।

.

৪০.

ম্যাগাস ভিড়ের মধ্যে এমন একজনকে দেখতে পেলেন, যাকে তিনি চেনেন। মুহূর্তের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তার সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে গেলেন। ব্রাইডা বেশ আনন্দে আছে। তার পাশে ম্যাগাসের উপস্থিতি উপভোগ করছে। কিন্তু তার মনে হলো ওকে যেতে দেয়াই সবচেয়ে ভালো হবে। তার নারীসুলভ ইনটুইশন তাকে বলছে, সবচেয়ে ভালো হয় যদি সে আর লরেন্স একসাথে খুব বেশি সময় না কাটায়। তারা বন্ধু হতে পারে। যখন দুজন। পুরুষ একসাথে একজন নারীর প্রেমে পড়ে, তারা বন্ধু হওয়ার চেয়ে একে অন্যকে ঘৃণা করে। এ রকমটি হলে শেষ পর্যন্ত তাকে দুজনকেই হারাতে হতে পারে।

ব্রাইডা আগুনের পাশে দাঁড়ানো লোকজনের দিকে তাকালো। হঠাৎ করে তার নিজেরও নাচতে ইচ্ছা হলো। লরেন্সকে তার সাথে যোগ দিতে বলল। লরেন্স এক মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করল। কিন্তু তারপর সাহস দেখিয়ে সম্মত হলো। লোকজন তখনো চারদিকে ঘুরে ঘুরে হাততালি দিচ্ছিল। ওয়াইন পান করে খালি বোতলে স্টিক আর চাবি দিয়ে নির্দিষ্ট ছন্দে বাজাতে লাগল। ব্রাইডা নাচতে নাচতে ম্যাগাসের পাশ দিয়ে গেলে ম্যাগাস তার দিকে তাকিয়ে গ্লাস উঁচিয়ে হাসলেন। আজ রাত ব্রাইডার জীবনের শ্রেষ্ঠতম রাত।

উইক্কা নৃত্যরত বৃত্তের সাথে যোগ দিল। ওখানে সবাইকে বেশ সুখী লাগছে। অতিথিরা হয়তো এই পার্টিতে কী ঘটতে পারে এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিল। এখন সব কিছু দেখে, পুরোপুরি রাতের শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বসন্ত কাল এসে গেছে। তাদের এখন উৎসব পালনের দরকার। আত্মাকে ভবিষ্যতের সূর্যভরা দিনগুলোর জন্য পরিপূর্ণ করে নিতে হবে। বিগত দিনের বিষণ্ণ সন্ধ্যা আর নিঃসঙ্গ রাত কাটানোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভুলে যেতে হবে।

হাততালির আওয়াজ জোরালো হচ্ছে। এখন উইক্কা ছন্দ তুলে দিয়েছে। নিয়মিত ছন্দে তালি পড়ছে। সবার চোখ আগুনের ওপর নিবদ্ধ। ঠাণ্ডার কোনো অনুভূতি নেই, যেন এরই মধ্যে গ্রীষ্মকাল পড়েছে। আগুনের চারপাশের বৃত্তাকার মানুষগুলো গা থেকে সোয়েটার খুলে ফেলতে শুরু করেছে।

 চলো গাই উইক্কা বলল। সে কয়েকবার দুই লাইনের গান গাইল। শিগগিরই সবাই তার সাথে গাইতে শুরু করল। কয়েকজন মাত্র বুঝতে পারল গানটা আসলে ডাইনিদের মন্ত্র। এখানে গানের শব্দগুলোর সুরই ব্যাপার, গানের অর্থ নয়। এটা ঈশ্বর প্রেরিত ঐশ্বরিক শক্তির শব্দ, যা শেষ হয়েছে জাদুকরী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যেমন ম্যাগাস আর তার শিক্ষক উপস্থিত আছেন– বিভিন্ন মানুষের একত্র হওয়ার জ্যোতি দেখছেন।

লরেন্স ধীরে ধীরে একই ধরনের নাচে বিরক্ত হয়ে উঠল। মিউজিশিয়ানদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য গেল। অন্যরা আগুনের কাছ থেকে সরে গেল, কেউ কেউ ক্লান্ত হওয়ার কারণে। আর অন্যরা গেল কারণ, উইক্কা তাদের বলেছে ছান্দিক ভাবটা ঠিক রাখতে। শুধু দীক্ষা নেয়ার জন্য যারা এসেছে তারা খেয়াল করল কী ঘটছে। পার্টিটা শুরু হয়েছে পবিত্র জগতে প্রবেশ করার জন্য। খুব তাড়াতাড়ি, শুধু চাঁদের রীতির মহিলারাই আগুনের পাশে নাচতে থাকে। আজ রাতে যেসব ডাইনি দীক্ষা নেবে, তারাই নাচছে।

এমনকি উইক্কার পুরুষ ছাত্ররাও নাচ থামিয়ে দিয়েছে। পুরুষের জন্য দীক্ষার উপাসনা অন্য রকম। তা অন্য তারিখে অনুষ্ঠিত হবে। ধীরে ধীরে আগুনের চারপাশে নারী শক্তিতে পরির্পণু হয়ে গেল। রূপান্তরের শক্তি। এ কারণেই সময় যেন অন্য রকম মনে হয়।

ব্রাইডার গরম লাগতে শুরু করেছে। ওয়াইনের কারণে নয়, কারণ সে খুব কমই পান করেছে। সম্ভবত অগ্নিশিখার কারণে গরম লাগছে। তার খুব ইচ্ছা করছে ব্লাউজ খুলে ফেলতে। কিন্তু সে লজ্জিত বোধ করছে। বিব্রত হওয়ার কারণে সে ধীরে ধীরে হাততালি আর গানের সাথে তাল মিলিয়ে আগুনের পাশে নাচতে থাকে। তার চোখ অগ্নিশিখার ওপর নিবদ্ধ। জগৎটাকে ধীরে ধীরে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে থাকে। প্রথমবার ট্যারট কার্ডের কার্যকারিতা তার সামনে উন্মোচিত হলে যেমনটি লেগেছিল তেমন লাগতে শুরু করে।

আমি মোহাবেশের মধ্যে চলে যাচ্ছি। ব্রাইডা ভাবল। কিন্তু তাতে কী? এই পার্টিটা মজার!

কী অদ্ভুত মিউজিক! লরেন্স বোতল বাজাতে বাজাতে ভাবছে সময় ঠিক রাখতে পারবে। নিজ শরীরের সাথে তাল রেখে লক্ষ করল হাততালির ছন্দ আর মিউজিকের শব্দ তার ঠিক বুকের মাঝখানে কম্পিত করছে। ক্লাসিক্যাল মিউজিকের কনসার্টে বেইস ড্রামের বিটে বুকের ভেতর এ রকম হয়। অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, ছন্দটা তার হৃদয়ের বিটকে নির্দেশ করছে।

উইক্কা ছন্দের তাল দ্রুত লয়ে করে দিল। লরেন্সের হৃৎপিণ্ডের বিটও দ্রুতগামী হয়ে গেল। একই ব্যাপার অবশ্যই সবার মধ্যে ঘটছে।

আমার মস্তিষ্কে আরো বেশি রক্ত সঞ্চালিত হচ্ছে। লরেন্সের বিজ্ঞানমনস্ক মন বলল। কিন্তু সেও এখন ডাইনিবিদ্যার অনুষ্ঠানের একটা অংশ। বিজ্ঞানসম্মত জিনিস ভাবার কোনো সময় নেই। এ ব্যাপারে ব্রাইডার সাথে পরে কথা বলতে হবে।

আমি পার্টিতে আছি। মজা করতে এসেছি। লরেন্স জোরে শব্দ করে বলল। তার পাশে কেউ একজন কেঁদে উঠল, শোনন! শোনো! উইক্কার হাততালির শব্দ আরো দ্রুত লয়ে চলতে লাগল।

 আমি মুক্ত। আমার শরীর নিয়ে আমি গর্বিত, কারণ দৃশ্যমান জগতের ঈশ্বরের প্রতিভূ হয়ে আছে তা। আগুনের তাপ সহ্য করা যাচ্ছিল না। বাস্তব জগৎ বহুদূরের মনে হতে থাকে। সাধারণ জিনিসের ব্যাপারে কেউ গ্রাহ্য করছে না। সে বেঁচে আছে। রক্ত নালিকার ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। সে তার শরীর ও মন সব পুরোপুরি দিয়ে দিয়েছে। আগুনের চারপাশে নৃত্য করে ফেরা তার কাছে নতুন কিছু নয়। ছন্দটা জাগিয়ে তোলা দরকার, যাতে স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকে যে এক সময় সে প্রজ্ঞার শিক্ষক ছিল। সে একা ছিল না, কারণ পার্টিটা নিজেকে ফিরে পাওয়ার পার্টি। অনেক জীবনের মাধ্যমে এই রীতি বহন করে চলেছে। নিজের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত।

উইক্কা আবার নিজের শরীরের দিকে তাকালো। সুন্দর শরীর। সহস্র বছর ধরে এই হিংসাত্মক দুনিয়ায় লড়াই করে আসতে হয়েছে। এই শরীর সাগরে বাস করেছে, দুনিয়ার বুকে হামাগুড়ি দিয়েছে, গাছে উঠেছে, চারদিকে হেঁটেছে। আর এখন গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে দুই পায়ে ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। শরীরটা অনেক লড়াই করে এই পর্যায়ে এসেছে। এই পৃথিবীতে কোনো সুন্দর বা কুতসিৎ শরীর নেই। কারণ সবাই একই পূর্বপুরুষের অবদান হিসেবে এসেছে। সবাই আত্মাকে ধারণ করার দৃশ্যমান অংশমাত্র।

উইক্কা নিজের শরীর নিয়ে সত্যিই গর্ববোধ করে।

উইক্কা নিজের ব্লাউজ খুলে ফেলল।

উইক্কা ভেতরে কোনো ব্রা পরেনি। কিন্তু তাতে কিছু যায়-আসে না। হ্যাঁ, সে তার শরীর নিয়ে গর্বিত। কেউ এ জন্য তাকে বিদ্রূপ করতে পারে না। এমনকি সে যদি সত্তর বছরের বৃদ্ধাও হয়, তখনো সে তার শরীর নিয়ে গর্বিত থাকবে। কারণ এই শরীরের মধ্যে দিয়ে আত্মা তার কাজ চালিয়ে যেতে পারে।

আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন মহিলাও ব্লাউজ খুলে ফেলল। সেটাও কোনো ব্যাপার নয়।

ব্রাইডা ট্রাউজারের বেল্ট খুলল। শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। গোটা জীবনের যেকোনো সময়ের চেয়ে নিজেকে মুক্ত মনে হলো। সে যা কিছু করছে তার পেছনে কোনো কারণ নেই। সে খুব সাধারণভাবে নগ্ন হয়েছে। কারণ নগ্নতাই একমাত্র উপায়, যার মাধ্যমে আত্মাকে মুক্ত করে দেয়া যায়। অন্য লোকেরা ওখানে রয়েছে বলে তাতে কিছু যায়-আসে না। তারা কাপড় পরিহিত অবস্থায় তাকে দেখছে। তার ইচ্ছা এখানে যারা আছে সবাই তাদের শরীর নিয়ে একই রকম অনুভব করুক। সে খুব সহজেই মুক্তভাবে নাচতে পারছে। কোনো কিছুই তার সঞ্চালনায় বাধা দিচ্ছে না। তার শরীরের প্রতিটি কণিকা বাতাস স্পর্শ করছে। বাতাসে পোশাকের সুগন্ধ ভেসে আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *