৪. গির্জার ঘড়ি

বুধবার, ডিসেম্বর ৮, ১৯৯৩

আস্তে আস্তে গির্জার ঘড়ি মাঝরাতের সময় মনে করিয়ে দিল। আমাদের চারপাশের দলটা আরো ভারি হয়ে উঠল।

আমরা এর মধ্যেই একশর মত লোক জড়ো হয়ে গেছি। এর মধ্যে অনেকেই আছেন পুরোহিত, তারা সবাই বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে মূর্তির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

 ‘আমাদের মহান মাতাকে অভিনন্দন। আমার পাশ থেকে কেউ একজন বলল।

 ‘অভিনন্দন। সকলেই বলল।

একজন রক্ষী সাথে সাথে সামনে এসে বলল আমরা যেন চুপ থাকি। কারণ আমরা অন্যান্য তীর্থযাত্রীদেরকে বিরক্ত করছি।

‘আমরা অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছি। আমাদের দলের একজন বললেন।

তারাও অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। রক্ষি একটু দূরে বৃষ্টির মধ্যে প্রার্থনারত অন্য দল তীর্থ যাত্রীদেরকে ইশারা করে বলল। দেখুন তারা নিরবে প্রার্থনা করছে।

আমি চাচ্ছিলাম আমার বন্ধুটির সাথে একদম একা একা থাকতে। এই জায়গা থেকে অনেক দূরে তার হাত ধরে একা থাকব আর আমি কীরকম অনুভব করছিলাম সেটা তাকে বলব।

সেই ঘরটা নিয়ে, আমাদের পরিকল্পনা নিয়ে, আমাদের ভালোবাসা নিয়ে আরো অনেক কথা বলার প্রয়োজন।

আমি তাকে নিশ্চিত করতে চাইছিলাম যে তাকে নিয়ে আমার অনুভব কত শক্তিশালি, তাকে জানাতে চাচ্ছিলাম যে তার স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে। কেননা আমি তার পাশেই আছি, তাকে সাহায্য করব।

রক্ষী আবারো সেরকম করলে তখন সেখানকার পাদ্রীরা নিচু স্বরে প্রার্থনা করা শুরু করল।

 আমরা আরো সামনে এগুনোর পর দেখতে পেলাম অসংখ্য লোক মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করছে।

‘এই লোকগুলো কে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 “এরা হলো ক্যারেশমাটিক লোক, আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পন্ন অনুসারী। সে উত্তরে বলল।

 আমি এদের কথা আগে শুনেছিলাম। কিন্তু তাদের এই নাম দিয়ে আসলে কি বুঝায় সেটা আমি জানি না। সে বুঝতে পারল যে আমি কিছুই বুঝি নি।

 ‘এই মানুষগুলো পবিত্র সেই আগুনকে গ্রহন করেছে। যেই আগুন যীশু রেখে গিয়েছিল আর খুব অল্প সংখ্যক লোকই সেই আগুন দিয়ে তাদের প্রদীপ জ্বালাতে পেরেছে। অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী সত্য লোকদের কাছাকাছি এই লোকেরা। আমার বন্ধু বলল। তারা সূর্যের পোশাক পরা এক নারীর মাধ্যমে পথ প্রদর্শিত হচ্ছে। সেই নারী হলো মেরিমাতা। চোখের ইশারায় সে মূর্তির দিকে ইংগিত করে বলল।

‘তুমি শীতে কাঁপছ। এখানে তোমার থাকার দরকার নেই। সে বলল।

 ‘তুমি কি এখানে থাকবে?

হ্যাঁ। এটাই আমার জীবন।

‘তাহলে আমিও এতে অংশগ্রহণ করব। আমি বললাম যদিও এর থেকে দূরে থাকতেই আমার ইচ্ছে করছিল। এটা যদি তোমার পৃথিবী হয়ে থাকে তাহলে কীভাবে এর অংশ হওয়া যায় সেটা আমি শিখব।

দলের লোকজন গান গাইতে থাকল। আমি চোখ বন্ধ করে তাদেরকে অনুসরণ করতে থাকলাম। তাদের শব্দগুলো অনুসরণ করার চেষ্টা করলাম। যদিও ফরাসি ভাষার একটা শব্দও আমি বুঝতে পারছিলাম না।

এটা নিশ্চই খুব শিগগির শেষ হয়ে যাবে। তারপর আমরা দুজন আবার সেন্ট সেভনে আমাদের ডেরায় ফিরে যাব। কেবলমাত্র আমরা দুজন।

আমি আস্তে আস্তে গানের সুরের সাথে তাল মেলাতে লাগলাম। ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম সংগীতটা আমাকে স্পর্শ করছে। যেন এই সংগীতের নিজস্ব একটা জীবন আছে। এটা আমাকে মুগ্ধ করে ফেলছে। বাইরের শীত আমার কাছে কমে আসছিল। সংগীতের সুর আমার কাছে আরো ভালো লাগছিল। এটা আমাকে অতীতের সময়গুলোতে নিয়ে যাচ্ছিল যখন ঈশ্বর আমার অনেক কাছে ছিলেন আর আমাকে সাহায্য করেছেন।

আমি যখন এই সংগীতের কাছে নিজেকে পুরোপুরি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলাম তখনই সংগীতের সুর বন্ধ হয়ে গেল।

আমি চোখ মেলে তাকালাম।

আমার পাশে প্রহরী ছিল না। বরং সেখানে একজন পাদ্রী ছিলেন। সে আমাদের দলের অন্যান্য পাদ্রীদের কাছে কয়েক মুহূর্ত ফিসফিস করে কিছু বলল।

আমাদের পাদ্রী আমাদের দিকে ফিরে বলল, আমাদের প্রার্থনা আমরা নদীর ওপারে গিয়ে করব।

*

আমরা খুব নিরবে হেঁটে হেঁটে সাঁকো পার হয়ে কৃত্রিম গুহার সামনে দিয়েই নদীর ওপার চলে গেলাম। নদীর ওপারটা সত্যিই খুব সুন্দর। গাছগাছালিতে ছাওয়া বিস্তীর্ণ প্রান্তর। নদীটা এখন আমাদেরকে সেই গুহা থেকে পৃথক করে রেখেছে।

এখান থেকেই আমরা উজ্জ্বল আলোকময় ছবিটা দেখতে পাচ্ছি। এখন আমরা অন্য প্রার্থনাকারীদেরকে কোনো রকম বিরক্ত না করেই উঁচু স্বরে গান গাইতে পারব।

আমাদের চারপাশের লোকজন তাদের মুখ আকাশের দিকে ফোঁটা মুখে মেখে চিৎকার করে গান গাইতে থাকল।

কেউ কেউ তাদের হাত দুটোকে উঁচুতে তুলে ধরল। একটু পরে দেখাদেখি সবাই তাদের সাথে যোগ দিল, গানের তালে তালে ছন্দে ছন্দে তারা হাত নাচাতে লাগল।

আমি এই রকম একটা মুহূর্ত থেকে দূরে থাকতে চাইছিলাম আবার একই সাথে খুব মনোযোগ দিয়ে ওদের কার্যকলাপ দেখে তাদের সাথে অংশগ্রহণ করতেও খুব ইচ্ছে করছিল।

 আমার পাশে একজন যাজক স্পেনিশ ভাষায় গান করছিল। আমি তার সাথে সাথে শব্দগুলো পুনরায় বলার চেষ্টা করছি। তারা মেরিমাতার কাছে বর্তমান নিয়ে প্রার্থনা করছিল আর বলছিল যে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তাদের মাথার উপর আশীর্বাদ হয়ে ঝরে পড়ছে।

‘তোমার আশীর্বাদ আমাদের ওপর ঝরে পড়ক। আরেক পুরোহিত স্পেনিশ, ইটালিয়ান, ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় শব্দগুলো বলল।

 এর পরের ঘটনাটা একদম অভাবনীয়।

উপস্থিত সব মানুষ এমন ভাষায় কথা বলা শুরু করল যে ভাষাটা আমি জীবনেও শুনি নি।

 তারা যত না কথা বলছিল তার চেয়ে বেশি শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তাদের কথাগুলো আত্নার ভেতর থেকে ভেসে ভেসে আসছে।

আমার বন্ধুর সাথে গির্জার ভেতর যে কথা বার্তাগুলো হয়েছিল আমি সেগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম। আমি যখন তাকে প্রত্যাদেশের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম সে বলেছিল সকল বিজ্ঞতা হলো তোমার আত্মা কি বলছে সেটা মন দিয়ে শোনার ফল।

উপস্থিত সকলেই নদীর ওপারে কুমারী মাতার মূর্তির দিকে স্থির হয়ে তাকিয়েছিল। মনে হচ্ছিল সবাই ঘোরের ভেতর চলে গেছে। চারপাশে আমার বন্ধুকে খুঁজলাম। সে আমার থেকে একটু দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত দুটো আকাশের দিকে ওঠানো। সে খুব দ্রুত কিছু একটা বলছিল। মনে হচ্ছিল সে যেন মেরিমাতার সাথে কথা বলছে।

সে হাসছিল, মাথা নাড়ছিল তাকে দেখে সত্যিই অবাক লাগছিল।

এটাই হলো তার জগৎ। আমি ভাবলাম।

পুরো দৃশ্যটাই আমাকে ভয় পাইয়ে দিল।

 আমার পাশে যে লোকটাকে আমি সারা জীবনের জন্য চেয়েছিলাম সেই মানুষটা আমাকে বলেছিল ঈশ্বর নিজেও একজন নারী। সে খুবই দুর্ভেদ্য ভাষায় কথা বলছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে আছে গভীর ঘোরের ভেতর।

 পাহাড়ের উপর ঘরগুলো ক্রমশই মিথ্যে মনে হচ্ছে। আশপাশের এই দৃশ্য যদি পৃথিবীর অংশ হয়েই থাকে তাহলে আমার বন্ধুটি এর মধ্যেই এটা ত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে গেছে।

 মাদ্রিদে আমাদের সম্মেলন থেকে শুরু করে একসাথে আমাদের সকল দিন মনে হচ্ছিল একটা স্বপ্ন, আমার জীবন আর বাস্তব জগতের মাঝে একধরনের অভিযান। একই সময়ে সেই স্বপ্নের মধ্যে এই জগতের সুঘ্রাণ, প্রেমের স্পর্শ, নতুন অভিযানের স্বাদ লেগেছিল।

আমি চারপাশে আবারো তাকালাম।

আমার কাছে এটা পরিষ্কার হলো স্কুলে আমরা যে ক্যাথলিজম শিখেছিলাম এটা সেই ক্যাথলিজম না।

এভাবে আমার জীবনে আমি এই মানুষটাকে কল্পনা করি নি।

একজন মানুষ আমার জীবনে! নিজের ভাবনায় আমি নিজেই অবাক হয়ে বললাম।

নদীর তীর ধরে ওপারের গুহাটার দিকে তাকিয়ে আমার একই সাথে ভয় আর ঈর্ষা হচ্ছিল। ভয় হচ্ছিল কারণ এসব কিছুই আমার কাছে একদম নতুন ছিল। আর নতুন যে কোনো বিষয়ই আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়।

আমি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ছিলাম এই জন্য যে এই মানুষটার ভালোবাসা আমি যতটুকু ভেবেছিলাম আস্তে আস্তে তার চেয়েও অনেক মনে হচ্ছিল আমার কাছে।

 আমার মা আমাকে নিচু মন আর স্বার্থপরতার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দাও।

 আমাদের বাসা ছেরে তার এই সত্য পথ ধারণ করার জন্য কি পরিমাণ পরিশ্রম তাকে করতে হয়েছিল। কিংবা সে যদি আর সেমিনারিতে ফিরে না আসে তাহলে সেই পথ থেকে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য আমাকে কি পরিমাণ মূল্য দিতে হবে? কে জানে?

এখানে যারা ছিল তারা সবাই নিজের কাজের উপর গভীর মনোযোগ দিয়ে রেখেছিল।

শুধু মাত্র আমি তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম আর সে ফেরেস্তাদের ভাষায় কথা বলে যাচ্ছিল।

 হঠাৎ করেই আমার ভেতর থেকে ভয় আর ঈর্ষা দূর হয়ে সেখানে প্রশান্তি আর কৃতজ্ঞতা এসে ভর করল। ফেরেস্তারা কারো সাথে কথা বলছে, শুধু মাত্র আমি একা।

 আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে কে আমাকে এই অদ্ভুত ভাষায় কথা বলার জন্য প্রণোদিত করছিল। হতে পারে আমার বন্ধুর সাথে কথা বলার তাকে আমার এই মুহূর্তের অনুভূতিগুলো জানানোর প্রচণ্ড ইচ্ছে হচ্ছিল।

কিংবা হতে পারে আমার আত্মার সাথেই খুব কথা বলার প্রয়োজন আমার। কারণ আমার মনের ভেতর অনেক প্রশ্ন রয়েছে যেগুলোর উত্তর আমাকে পেতেই হবে।

আমি বুঝতে পারলাম না আমার কি করা উচিত। খুব হাস্যকর লাগছিল আমার কাছে সব কিছু।

আমার চারপাশে কত পুরুষ, নারী, ছাত্র, কমবয়সী তরুণ তরুণি, গির্জার পুরোহিত। পবিত্র শক্তিকে আমার ভেতরের ভয় তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই লোকগুলোই আমাকে উৎসাহিত করছিল।

তুমি চেষ্টা করো। আমি নিজেকে বললাম। তোমাকে যা করতে হবে প্রথমে মুখটা খোলো তারপর যে কথাটা তুমি বোঝে না সেটাই বলার চেষ্টা করো। আমি এভাবেই সে রাতে প্রার্থনা করলাম, সেই রাতটা পরদিন সকাল হয়ে দিন পার হয়ে গেল।

আমি বুঝতেই পারলাম না কীভাবে এটা শুরু হলো।

আমার জন্য এক নতুন জগতের আরম্ভ হলো।

ঈশ্বর নিশ্চই আমার কথা শুনেছেন। কথাগুলো আমার কাছে আস্তে আস্তে আরো সহজ হয়ে উঠল। আমার ভেতর থেকে সমস্ত বিব্রতভাব দূর হয়ে গেল, আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল আর প্রার্থনার কথাগুলো আরো দ্রুত আমার মুখ থেকে বের হতে লাগল। যদিও আমি একটা কথাও বুঝতে পারছিলাম না কিন্তু ঠিক আমার আত্ম দিয়ে সব কিছুই উপলব্ধি করতে পারছিলাম।

আমি কি করছিলাম এখন তার কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল না। এ স্বাধীনতা আমাকে স্বর্গের দিকে নিয়ে গেল যেখানে রয়েছে এমন একজনের ভালোবাসা যা সব কিছুকে ক্ষমা করে দেয়।

মনে হচ্ছিল আমার বিশ্বাস ফিরে আসছে।

 আমি ভালোবাসার অলৌকিকতায় অভিভূত হয়ে পড়লাম। মনে হচ্ছিল মেরি-মাতা আমাকে তার কোলে তুলে নিয়েছেন।

কোনো কিছু না বুঝেই আমি কাঁদতে শুরু করলাম।

এক রকম আনন্দ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। যেই আনন্দ আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে যে ভয় এতদিন নিয়ন্ত্রণ করত তাকে ভাসিয়ে দিল।

আমি চোখ মেলে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে স্বর্গের দিকে তাকালাম। বুঝতে পারলাম আমার চোখের পানি বৃষ্টির পানিতে ধুইয়ে যাচ্ছে।

পৃথিবী জেগে আছে। উপর থেকে স্বর্গের অলৌকিকতার ফোঁটাগুলো ঝরে পড়ছে।

আমরা সকলেই সেই একই অলৌকিকতার অংশ।

ঈশ্বর যদি একজন নারী হতেন তাহলে কতই না ভালো হতো। আমি নিজেকেই বললাম।

আমার চারপাশের সবাই বিড়বিড় করে বলল এটা যদি সত্যিই হয় তাহলে নিশ্চয় ঈশ্বরের নারী রূপ আমাদেরকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে।

.

‘চলো আমরা অষ্টম তাঁবুর প্রার্থনা শুরু করি। একজন পুরোহিত স্পেনিশ, ইটালিয়ান ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথাটা বলল।

আমি আবারো সংশয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। কি ঘটতে যাচ্ছে এখানে?

একজন কেউ এসে আমার কাঁধে তার হাত রাখল। অন্য আরেকজন এসে ঠিক একইভাবে আমার কাঁধে হাত রাখল। এভাবে আমরা আটজন একে অপরের কাঁধে হাত রেখে ঠিক আটের মত করে একটা বৃত্ত তৈরি করলাম। তারপর আমরা সামনে ঝুঁকে একজন আরেকজনের মাথা স্পর্শ করলাম।

আমাদেরকে দেখে তখন মানব তাঁবুর মতো মনে হচ্ছিল। বৃষ্টি পড়ার শব্দ বেড়ে গেছে কিন্তু কেউ সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছে না।

আমাদের মধ্য থেকে একজন প্রার্থনা শুরু করল আর বাকিরা আমিন বলতে থাকল।

আমি নিজেকে দেখে আবারো অবকা হলাম। আমি একেবারে শিশুর মতো প্রার্থনা করছিলাম। আমি বিশ্বাস করছিলাম যে আমাদের প্রার্থনা নিশ্চই কবুল হবে।

আমরা এক সাথে প্রার্থনা করতে থাকলাম। আমি আবারো মুক্ত স্বাধীন হওয়ার অনুভূতি টের পেলাম।

অনেক বছর ধরে আমি নিজের অন্তরের সাথে যুদ্ধ করছি। কেননা আমি দুঃখ, কষ্ট, অবহেলাকে খুব ভয় পেতাম।

আমি এখন জানি সত্যিকারের ভালোবাসা সব কিছুর উপরে। আমি জানি তুমি যদি ভালো না বাসতে পারো তাহলে তোমার মরে যাওয়াটাই ভালো।

আমি কেবল ভাবতাম শুধু অন্য মানুষগুলোরই ভালোবাসার জন্য একধরনের উদগ্রীব আর পাগলামো আছে। কিন্তু আমি এখন আবিষ্কার করেছি আমিও ভালোবাসার যোগ্য। প্রতিটি পেনি হিসেব করলে ভালোবাসার মূল্য অনেক।

আমাকে এসব চিন্তা বন্ধ করতে হবে। যে অনুষ্ঠান চলছে সেদিকে আমার মনোযোগ দিতে হবে।

.

আমাদের দলটাকে যে পুরোহিত নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি বললেন আমরা যেন আট আকৃতির তাবুটা ভেঙে এখন অসুস্থদের জন্য প্রার্থনা শুরু করি। প্রত্যেকেই বৃষ্টির মধ্যে নেচে গেয়ে ঈশ্বরের প্রশংসা করে আকাশের দিকে হাত তুলে প্রার্থনা শুরু করল। লোকজন এখন অদ্ভুত সব ভাষায় কথা বলা শুরু করল।

একজন মহিলা চিৎকার করে বলতে থাকল যে এখানে কারো মেয়ে অসুস্থ আছে সে যেন জানে যে তার মেয়েটা অবশ্যই সুস্থ হয়ে যাবে।

প্রার্থনাকারিরা উৎসাহের সাথে তাদের প্রার্থনা করছিল। মাঝে মাঝে সেই মহিলার কথা শোনা যাচ্ছে।

 ‘এখানে কেউ একজন আছে যার মা কিছু দিন আগে মারা গেছে। তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে তার মা এখন মহান আনন্দময় স্বর্গে আছে।

 খুব গোপনে আমাকে যে অলৌকিকতার কথা বলা হয়েছিল সেই অলৌকিকতায় আমিও বিশ্বাস করা শুরু করলাম।

 আমি আশা করছিলাম সেই গলার স্বরটা যেন বলে ভালোবাসা হলো ফেরেস্তা, সাধুদের আর মহান ঈশ্বরের আশীর্বাদ।

*

আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে এই অনুষ্ঠান কতক্ষণ চলবে।

আমার চারপাশের লোকজন অবিরত কথা বলে যাচ্ছে, প্রার্থনা করছে, নাচছে, উপরের দিকে হাত তুলে প্রার্থনা করছে, তাদের চারপাশে যেসব লোকজন আছে তাদের জন্য, যারা সেখান অনুপস্থিত তাদের জন্য এবং প্রার্থনা করছিল অলৌকিক ক্ষমতার জন্য।

অবশেষে যে যাজক অনুষ্ঠানটিকে পরিচালনা করছিলেন তিনি বললেন যে আসুন আজকে এখানে প্রথমবারের জন্য যারা এসেছেন তাদের জন্য প্রার্থনা করি।

বোঝা গেল আমিই তাহলে এখানে নতুন নই আরো অনেকে আছে। এটা আমাকে বেশ স্বস্তি দিল।

সকলেই প্রার্থনা শুরু করল। এখন আমার শুধু শোনা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

আমি কেবল তাদের প্রার্থনার উত্তর দিচ্ছিলাম।

আমার প্রয়োজন ছিল অনেক।

‘চলো আমরা আশীর্বাদগুলো গ্রহণ করি। যাজক বললেন।

 জনতার ভিড় নদীর ওপারে অস্পষ্ট যে গুহামন্দির ছিল সেদিকে ঘুরে গেল। পুরোহিত নানা ধরনের প্রার্থনা করলেন। তারপর সকলে চুমু খেল, একে অপরের জন্য শুভ কামনা করল, তারপর নিজ নিজ রাস্তায় হাঁটা দিল।

আমার বন্ধু কাছে আসল। তাকে স্বাভাবিকভাবেই খুব সুখি দেখাচ্ছিল।

‘তুমি ভিজে গেছ।’ সে বলল।

‘তুমিও তো। আমি হেসে বললাম।

আমরা হেঁটে গাড়িতে উঠলাম। সেইন্ট সেভিনের দিকে রওনা দিলাম।

আমি সেইন্টসেভিনে যাওয়ার জন্য খুব উদগ্রিব থাকলেও এই মুহূর্তে আমি কী বলব সেটা বুঝতে পারছিলাম না।

আমি এমনকি সেই পাহাড়ের ভেতর ঘরের বিষয়ে কিংবা অনুষ্ঠানের বিষয়ে অথবা অদ্ভুত সেই ভাষা কিংবা তাঁবুপ্রার্থনার বিষয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলেও কিছু বলতে পারছিলাম না।

সে দুইটা জগতে বাস করে। কখনো এটাতে থাকে আবার কখনো ওটাতে। আমাকে বের করতে হবে সে কোথায় কখন থাকে।

আমরা যখন ঘরে ফিরে আসলাম তখন সে বলল, “আমার কেবল একটাই সোয়েটার আছে। তুমি এটা নাও। আমি কালকে আমার জন্য আরেকটা কিনে নেব।’

 ‘আমাদের কাপড়গুলো হিটারের উপর রাখলে আশা করি আগামীকালের মধ্যে শুকিয়ে যাবে। গতকাল আমি একটা জামা ধুয়ে রেখেছিলাম এখন সেটা পরব।’

কয়েক মিনিট আমরা আর কিছুই বললাম না।

অবশেষে সে ব্যাগ থেকে একটা শার্ট বের করে আমাকে দিয়ে বলল, “তুমি এটা পরে ঘুমাতে পারো।

 ‘বাহ খুব ভালো। আমি উত্তরে বললাম।

বাতি থেকে সরে গিয়ে অন্ধকারে আমার ভেজা কাপড়গুলো খুলে হিটারের উপর রাখলাম।

 জানালা দিয়ে বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সে নিশ্চই আমাকে আবছা নগ্ন দেখতে পেয়েছিল।

যাই হোক আমি শার্টটা পরে চাদরের নিচে চলে গেলাম ঘুমানোর জন্য।

 ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি শুনতে পেলাম সে বলল।

‘আমি শিখছি কীভাবে তোমাকে ভালোবাসতে হয়ে।

আমার বন্ধু একটা সিগারেট ধরাল।

‘তুমি কি মনে করো সঠিক সময়টা এসে গেছে? সে বলল।

আমি জানতাম সে কী বোঝাতে চাইছে। আমি উঠে তার বিছানার পাশে গিয়ে বসলাম।

তার সিগারেটের আলোয় আমাদের মুখ দুটো অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে আমার হাত ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকল। আমি তার মাথার চুলের ভেতর আমার হাতের আঙুলগুলো চালালাম।

 ‘এই বিষয়ে তোমার জিজ্ঞেস করা উচিত হয় নি। আমি বললাম। ‘ভালোবাসার কোনো প্রশ্নের দরকার পড়ে না। ভালোবাসাটা বর্ণনা করা সত্যিই কঠিন। তুমি যদি চিন্তা করা বন্ধ করো তাহলে ভীতগ্রস্ত হয়ে পড়বে। তাই যেভাবে তুমি জিজ্ঞেস করছ সেভাবে বলা ঠিক না। যেভাবে তুমি ইতিপূর্বে ঝুঁকি নেওয়ার কথা বলেছ।

 ‘আমি জানি আগে আমি কখনোই জিজ্ঞেস করি নি।

 ‘তুমি ইতোমধ্যেই আমার হৃদয়কে দখল করে ফেলেছ। আমি তাকে বললাম। আগমীকাল তুমি চলে যাবে। কিন্তু এই কয়েকদিনের অলৌকিকতাকে আমরা সারা জীবন মনে রাখব। আমি মনে করি ঈশ্বর তার বিজ্ঞতা দিয়ে স্বর্গে সব কিছু রেখে দিয়েছেন। ফলে আমরা সব সময় সচেতন থাকব যাতে করে দুঃখকে না ভুলি যেভাবে ভালোবাসার আনন্দকে মনে রেখেছি।

আমার মুখটা সে তার হাত দিয়ে ধরে বলল, তুমি সব কিছু খুব দ্রুত শিখে ফেল।

আমি নিজে খুব অবাক হলাম। তবে মাঝে মধ্যে তুমি যদি মনে করো যে তুমি কিছু জানো তাহলে তুমি সেটা আর বোঝার চেষ্টা করবে না।

 ‘আমি আশা করি তুমি আবার এটা ভাববে না যে আমি খুব জটিল প্রকৃতির। আমি বললাম। অনেক পুরুষ মানুষের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, অনেকের সাথেই আমার প্রেম হয়েছে।

“ঠিক আজকের মতো। সে বলল।

তার কথাটা খুব স্বাভাবিক মনে হলেও তার গলার স্বর থেকে আমি বুঝতে পারছিলাম সে এই বিষয়ে কিছু শুনতে চায় না।

কিন্তু আজকের এ সকাল থেকে আমি আবিষ্কার করলাম যে সত্যিকারের ভালোবাসা আমি এতদিন পর আবিষ্কার করেছি। এটা বোঝার চেষ্টা করো না। কারণ একমাত্র মেয়েরাই আমি কি বলতে চাইছি সেটা বুঝতে পারবে।’

আমার বন্ধু আমার মুখটাকে আগলে ধরল। আমি তার ঠোঁটে খুব মৃদু ভাবে চুমু খেলাম। তারপর বিছানায় চলে গেলাম ঘুমানোর জন্য।

আমি নিশ্চিত ছিলাম না কেন আমি এটা করলাম।

আমি কি তাকে আমার আরো কাছে বন্দি করতে চাইছি নাকি তাকে মুক্ত করতে চাইছি।

 এটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে আমি এখন ক্লান্ত।

আমার জন্য রাতটা ছিল সত্যিকারের শান্তির একটা রাত। আমি যদিও ঘুমিয়েছিলাম তারপরেও আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন জেগে আছি। একজন পুণ্যবতী মহিলা আমাকে তার কোলে নিয়ে ঘুম পারাচ্ছে।

আমি নিজেকে ভালোবাসায় সুরক্ষিত মনে করছিলাম।

.

প্রচণ্ড গরমে সাতটার সময়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল।

কাপড়গুলো শুকানোর জন্য আমি হিটারটারের মিটার বেশি দিয়ে রেখেছিলাম। বাইরে এখনো অন্ধকার। তাই আমি খুব আস্তে আস্তে কোন শব্দ না করে আমার বন্ধুর ঘুম না ভাঙিয়ে ওঠার চেষ্টা করলাম।

 কিন্তু আমি যখন উঠে দাঁড়ালাম দেখলাম আমার বন্ধু সেখানে নেই।

আমি অস্থির হয়ে পড়লাম। আমার ভেতর থেকে তখন দ্বিতীয়জন উঠে এসে বলল, “দেখলে তুমি যেই রাজি হলে অমনি সে চলে গেল যেভাবে সব পুরুষ মানুষেরা যায়।

আমার অস্থিরতা মুহূর্তেই আরো বেড়ে গেল। কিন্তু আমি নিয়ন্ত্রণ হারাতে চাচ্ছিলাম না।

আমার ভেতরের দ্বিতীয়জন বলল, আমি এখনো আছি। তুমি যদি বাতাসকে পথ ঘুরিয়ে দিতে বলো, দরজাটা খুলে দাও তাহলে ভালোবাসা তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা যদি কাজগুলো দ্রুত করি তাহলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ খুব দ্রুত আমরা নিতে পারব।

আমি বাস্তবতার সাথে চিন্তা করার চেষ্টা করলাম।

 আমার ভেতরের দ্বিতীয়জন বলল, সে চলে গেছে। এখন তোমাকে এখান থেকেই উঠে দাঁড়াতে হবে। তোমার জীবন পড়ে আছে জারাগোজায়, সেখানে তোমার সব। তোমার সব কিছু হারানোর আগে তুমি এখনই সেখানে চলে যাও।

নিশ্চই তার কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল। আমি ভাবলাম।

‘সব পুরুষ মানুষেরই কোনো না কোনো কারণ থাকে। আমার ভেতরের দ্বিতীয়জন বলল। তবে বাস্তবতা হলো তারা সবাই পালিয়ে যেতে পছন্দ করে।

 ঠিক আছে ঘটনা যদি এই রকমই হয়ে থাকে তাহলে আমাকে আগে ঠিক করতে হবে কীভাবে আমি স্পেন যাব।

“ঠিক আছে এবার আসো বাস্তবতা নিয়ে কথা বলি। এখন আসল সমস্যা হলো টাকা। আমার ভেতরের দ্বিতীয়জন বলল।

আমার কাছে একটা সেন্টও ছিল না।

 আমাকে এখন নিচের সিঁড়িতে গিয়ে আমার বাবা মার সাথে যোগাযোগ করে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য টিকেটের টাকার ব্যবস্থা করতে হবে।

কিন্তু এটাতো ছুটির দিন। আগামীকাল ছাড়া টাকা পাওয়ার কোন সুযোগ নেই।

আমি এখন কী খাব? আমার বাড়ির মালিককে কীভাবে বোঝাব যে তাদের পাওনা শোধ করার জন্য কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে।

‘ভালো হয় কাউকেই কিছু না বলা। আমার ভেতরের দ্বিতীয়জন বলল।

 ঠিক আমার ভেতরের যে দ্বিতীয় মেয়েটা আছে সে অনেক অভিজ্ঞ। অনেক কিছুর মুখোমুখি সে হয়েছে। সে ঠিকই বলেছে।

 আমাকে এখন স্বাভাবিকভাবে আমার বন্ধুর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তারপর যখন দেশ থেকে আমার টাকা আসবে তখন আমি এখানকার ভাড়া বাড়ির বিল শোধ করে দেব। তার আগে কিছুই বলা ঠিক হবে না।

আমার ভেতরের দ্বিতীয়জন বলল, খুব ভালো। তুমি ঠিক আগের শক্ত বাস্তববাদি মেয়েটার মতোই কাজ করছ। দুঃখ করো না। সামনের দিনগুলোতে তুমি আরো কাউকে পাবে। যাদেরকে কোনো ঝুঁকি ছাড়াই তুমি ভালোবাসতে পারবে।

 হিটারের উপর থেকে আমার কাপড়গুলো আমি নামিয়ে আনলাম। কাপড়গুলো শুকিয়ে গেছে। আমাকে এখন গ্রামের আশপাশে কোনো ব্যাংক আছে কিনা খুঁজে বের করতে হবে। তারপর একটা ফোন করতে হবে। এসব কিছু আমি স্বাভাবিক ভাবে যখন চিন্তা করতেই পারছি তখন শুধু শুধু দুঃখ পেয়ে কান্নাকাটি করে লাভ কী।

.

আমি সব কিছু যখন গুছিয়ে নিলাম তখনই আমার বন্ধুর নোটটা দেখতে পেলাম।

.

আমাকে সেমিনারিতে যেতে হয়েছে। তোমার সব কিছু গুছিয়ে নাও। আজকে রাতেই আমরা স্পেন যাব। দুপুরের পর আমি ফিরে আসছি। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

.

কাগজটা আমার বুকের ভেতর রেখে একই সাথে কান্না আর প্রশান্তি পেল। আমি তাকে ভালোবাসি। প্রতিটি মিনিটেই আমার ভালোবাসা বড় হচ্ছে আর আমাকে পাল্টে দিচ্ছে। ভবিষ্যতের ওপর আমার আবারো বিশ্বাস বেড়ে গেল। আস্তে আস্তে ঈশ্বরের প্রতি আমার বিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করল। এসব কিছুই হচ্ছে ভালোবাসার জন্য।

.

আমার ভেতরের দ্বিতীয়জনের দরজাটা বন্ধ করে বললাম, আমার নিজের অন্ধকার নিয়ে আমি আর কখনো কথা বলব না। চতুর্থ তলা থেকে নিচে পড়ে গেলে যে ব্যথা হবে একশ তলা থেকে পড়লেও সেই ব্যথা হবে।’

আমি যদি পড়েই যাই তাহলে এটা অনেক উঁচু থেকে পরব।

*

বাইরে যেও না ক্ষুধার্ত। বাড়ির মহিলাটা বলল।

‘আমি বুঝতে পারছি না তুমি কীভাবে স্পেনিশ বলছ। আমি অবাক হয়ে বললাম।

 ‘সীমান্ত এখান থেকে খুব দূরে না। স্পেনিশ না জানলে আমি ঘর ভাড়া দিতে পারব না।’

মহিলাটা আমার জন্য কয়েকটা টোস্ট আর কফি বানিয়ে আনল। আমি দিনটার জন্য নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করে ফেলেছিলাম। দিনের এক একটা ঘণ্টা আমার কাছে এক একবছরের মতো মনে হয়েছিল।

‘তোমরা দুজন বিয়ে করেছ কতদিন হবে?’ মহিলাটা বলল।

‘আমি এই ছেলেটাকেই জীবনে প্রথম ভালোবেসেছি।’ এর চেয়ে বেশি কিছু আমার বলতে ইচ্ছে করছিল না।

‘তুমি কি পাহাড়ের ঐ চূড়াটা দেখতে পাচ্ছ?’ মহিলাটা বলতে থাকল।

ঐ পাহাড়েই আমার প্রথম ভালোবাসার মৃত্যু হয়েছিল।

‘তুমি কিন্তু আবার অন্য কাউকে খুঁজে পেয়েছ। আমি বললাম।

“হ্যাঁ আমি পেয়েছি। আমি আবারো সুখ খুঁজে পেয়েছি। ভাগ্য একটা অত্যন্ত আজব জিনিস। আমি এমন কাউকে পাই নি যে তার প্রথম ভালোবাসাকে বিয়ে করতে পেরেছে। আর যারা সেটা করেছে তাদের সবাই আমাকে বলে যে তারা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটার অভাব অনুভব করছে।

হঠাৎ করেই মহিলাটা কথা বলা বন্ধ করল।

 ‘আমি দুঃখিত। আমি তোমাকে হতাশ করতে বা দুঃখ দিতে চাই নি। মহিলাটা বলল।

‘আমি মনে কষ্ট পাই নি।

‘আমি ঐ বাড়িটার কুয়োটাকে সব সময় দেখি। ভাবি আগে কেউ জানতই না যে পানি কোথায় আছে। তখন সেইন্ট সেভিন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি একটা কুয়ো খুড়বেন। তারপর তিনি এই কুয়োটা খুড়লেন। সেইন্ট সেভিন যদি ঐ কুয়োটা না খুড়তেন তাহলে গ্রামটা ঐ দূরে নদীর পাশেই থাকত।

‘কিন্তু ভালোবাসার সাথে এটার কী সম্পর্ক? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘এই কুয়োটার কারণেই লোকজন এখানে আসে। তাদের ভালোবাসা, স্বপ্ন আশা হতাশা নিয়ে কথা বলে। কেউ কেউ পানির দিকে তাকায়। কেউ কেউ কুয়োর পানির প্রবাহ যেখান থেকে হচ্ছে সেখানে একত্রিত হয়। আমি মনে করি যখন আমরা ভালোবাসার জন্য এটার দিকে তাকাই তখন ভালোবাসাও সেদিকে তাকায়। আমরা যখন একা হয়ে পড়ি তখন জীবন সত্যিই খুব অদ্ভুত হয়ে উঠে।

 তুমি কি কখনো আই চিঙ নামের কোনো বইয়ের কথা শুনেছ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 না আমি শুনি নি।

‘এই বইটাতে বলা আছে, একটা শহর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরে যেতে পারে কিন্তু একটা কুয়ো কিছুতেই পারে না। এই ঝর্ণটার পাশে লোকজন তাদের ভালোবাসার কথা বলে, তাদের মনের তৃষ্ণা মেটায়, নিজেদের ঘরবাড়ি বানায়, সন্তানরা বড় হয়। এখান থেকে যখন তাদের কেউ চলে যেতে চায় তারা চলে যেতে পারে কিন্তু এই কুয়োটা কিছুতেই তাদের সাথে যেতে পারে না। ভালোবাসা সেখানেই পরিত্যাক্ত থেকে যায়। এমনকি আরো পরিষ্কার পানি দিয়ে কুয়োটা পূর্ণ হলেও।

লক্ষ্মী মেয়ে তুমি একেবারে অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ কোনো নারীর মতো কথা বলছ। মহিলাটা বলল।

“না আমি সব সমই খুব ভীত ছিলাম। আমি কখনোই কোন কুয়ো খনন করি নি। কিন্তু আমি সেটা এখন করার চেষ্টা করছি। আর এখানে কি ঝুঁকিটা আছে আমি সেটাকেও ভুলতে চাই না।’

কথা বলতে বলতে আমার পকেটে কিছু একটা আমি টের পেলাম। যখন আমি অনুভব করলাম এটা কি আমার বুক ভয়ে জমে গেল। আমি দ্রুত কফি শেষ করলাম।

চাবি। আমার কাছে চাবি।

‘এই শহরে একজন মহিলা ছিলেন যিনি মারা যাওয়ার পর তার সব কিছুই সেমিনারিদেরকে দিয়ে গিয়েছেন। আপনি কি তার বাড়িটা চেনেন? আমি মহিলাটাকে জিজ্ঞেস করলাম।

মহিলাটা দরজা খুলে আমাকে বাড়িটা দেখাল। এই খোলা প্রাঙ্গনে সেই মহিলাটার বাড়িই সবচেয়ে পুরাতন। বাড়িটার পেছন থেকে অনেক দূরে পাহাড়গুলো দেখা যায়।

‘মাস দুয়েক আগে দুজন পুরোহিত এই বাড়িটাতে এসেছিল। মহিলাটা বলল। এবং….’ মহিলাটা থেমে আমার দিকে সন্দেহপূর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকল। তাদের মধ্যে একজনকে একেবারে হুবহু তোমার স্বামীর মতো দেখাচ্ছিল।

 ‘হা তিনিই ছিলেন। আমি উত্তরে বললাম।

 আমার কথা শুনে মহিলাটা একদম অবাক হয়ে গেল। কি করবে বুঝতে পারছিল না।

আমি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ঘরের চারপাশটার ভেতরে কুয়াশার ঝুল। আমার মনে হচ্ছিল বাদামি রঙের কোনো অদ্ভুত একটা জন্তু বের হয়ে এসে আমাকে আরো অচিন কোনো জায়গায় নিয়ে যাবে।

আমি বোকার মতো হাতের চাবিটা দিয়ে খেলা করছিলাম।

ঘরের ভেতরের ময়লার ঝুলগুলো এত পরিমাণ মোটা ছিল যে সেখান থেকে জানালা দিয়ে দূরে পাহাড় দেখা অসম্ভব ছিল।

 ঘরটা হয়ত অন্ধকার ছিল। দরজার চৌকাঠ ভেদ করে ঘরের ভেতর সূর্যের আলো ঘরে ঢোকা ছিল অসম্ভব।

আমার বন্ধুকে ছাড়া ঘরটাকে দেখে খুব দুঃখি দুঃখি লাগছিল।

 ঘড়ির দিকে তাকালাম। সকাল নয়টা।

 অপেক্ষার এই প্রহর অতিক্রম করার জন্য আমাকে কিছু একটা করতে হবে।

অপেক্ষা করো। এটা ছিল আমার জন্য ভালোবাসার প্রথম শিক্ষা।

তোমার ভালোবাসা ফিরে আসার আগে তুমি সম্ভাবনাময় সকল ধরনের কথা বার্তা, পরিকল্পনা, তোমার উদ্বেগ সব কিছু নিয়েই তুমি চিন্তা করতে পারো। অপেক্ষার প্রহর পাল্টে যাবে দুঃশ্চিন্তায়, আর দুঃশ্চিন্তা তোমাকে ভীত করে তুলবে, ভয় তোমাকে ভালোবাসা উপস্থাপনের জন্য বিব্রত করবে।

আমি জানতাম না আমার কোথায় যাওয়া উচিত। ফেলে আসা দিনগুলোয় আমাদের যে কথাবার্তা হয়েছিল সেগুলো আমার মনে পড়ছে। এ ঘরটা ছিল স্বপ্নের প্রতীক।

কিন্তু সারাদিনতো আমি এখানে দাঁড়িয়ে কাটাতে পারব না। আমি সাহস জুগিয়ে দরজার দিকে হাঁটা দিলাম।

*

পিলার।

ফরাসি উচ্চারণে কুয়াশার ভেতর থেকে কারো একজনের স্বর ভেসে আসল।

ভয় পাওয়ার চেয়ে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম যেখানে আমরা ঘর ভাড়া করেছিলাম গলার স্বরটা হয়ত সেই বাড়ির মালিকের। আমি অবশ্য বাড়ির মালিককে আমার নাম বলি নি।

‘পিলার।

আমি আবারো খুব কাছেই শুনতে পেলাম।

আমি ঘুড়ে তাকিয়ে খোলা চত্তরের দিকে তাকালাম। একটা আকৃতি খুব দ্রুত আমার দিকে ছুটে আসছে। হতে পারে কুয়াশার ভেতর আমি যে ভূতের কথা চিন্তা করেছিলাম সেটা বাস্তব হয়ে আমার দিকে ফিরে আসছে।

 ‘একটু দাঁড়াও। সেই লোকটা বলল। আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই।

লোকটা যখন আমার কাছে আসল আমি দেখতে পেলাম তিনি একজন পুরোহিত।

 ‘হোলা। তার হাত দুটো ভাজ করে হাসতে হাসতে বলল।

আমি একটু অবাক হয়ে তাকে উত্তর দিলাম।

‘প্রচুর কুয়াশার চারপাশটা ঢেকে রেখেছে। পুরোহিত ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল। “সেইন্ট সেভিন যখন থেকে পাহাড়ে বাস করা শুরু করেছেন এই ঘর থেকে চারপাশের দৃশ্যটা অত্যন্ত সুন্দর ছিল। তুমি নিচের উপত্যকাটা আর বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া দেখতে পাবে।

‘আপনি এখানে কী করছেন? কীভাবে আপনি আমার নাম জানলেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 “তুমি কি ভেতরে যেতে চাও?’ পুরোহিত কথার বিষয় পাল্টানোর চেষ্টা করে বলল।

‘না! আমি চাই আপনি আমার কথার উত্তর দেন।’

পুরোহিত তার হাত দুটোকে গরম করার জন্য কিছুক্ষণ ঘসল। তারপর বসল। আমিও তার পাশে বসলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কুয়াশা আরো ঘন হয়ে পড়তে শুরু করল।

আমাদের চোখের সামনে এর মধ্যেই গির্জাটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি কেবল কুয়োটা দেখতে পাচ্ছিলাম। মাদ্রিদের সেই মহিলাটা আমাকে কী বলেছিল আমি সেটা মনে করার চেষ্টা করলাম।

 “তিনি এখন উপস্থিত।’ আমি বললাম।

 ‘কে?

 ‘স্বয়ং দেবী। এই কুয়াশাগুলো তিনি। আমি উত্তরে বললাম।

 ‘তাহলে তিনি নিশ্চয় এই বিষয় নিয়ে তোমার সাথে কথা বলবে। পুরোহিত হাসতে থাকল।

 ‘আপনি এখানে কি করছেন? কীভাবে আপনি আমার নাম জানলেন? আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমি এখানে তোমাদের দুজনকে দেখতে এসেছি। গতকাল একটা দল আমাকে বলেছে তোমরা দুজন সেইন্ট সেভিনে আছ জায়গাটা খুব ছোট।

‘আমর বন্ধু সেমিনারিতে গিয়েছে।

পাদ্রির মুখ থেকে হাসিটা মিলিয়ে গেল। সে তার মাথাটা নেড়ে যেন নিজের সাথেই কথা বলছে এভাবে বলল, “খুব খারাপ।

 ‘আপনি বলতে চাইছেন সে সেমিনারিতে গিয়ে খুব খারাপ করেছে?

না সেটা নয়। কারণ সে সেখানে নেই। আমি এই মাত্র সেমিনারি থেকে এসেছি।

কয়েক মুহূর্ত আমি কিছুই বলতে পারলাম না।

সকালে ঘুম থেকে উঠার পর যে ভাবনাগুলো আমার মাথায় এসেছিল আবারো সেগুলো চলে আসল। টাকা, সব কিছু গুছিয়ে নেওয়া, মা-বাবাকে ফোন করা, টিকিটের ব্যবস্থা করা। কিন্তু আমি এসবের কিছুই করি নি।

পাদ্রী আমার পাশে বসল। একজন শিশুর মতো আমি পুরোহিতের কাছে সব কিছু খুলে বললাম।

‘সপ্তাহ খানেক আগে আমি জানতে পারলাম আমি কে, জীবনে আমি কী চাই? এখন আমার মনে হচ্ছে একটা ঝড়ে আমি আটকা পড়ে গেছি দেখে মনে হচ্ছে এখান থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তা নেই। নিরবতা ভেঙে আমি বললাম।

 ‘তোমার সন্দেহকে ঠেকাও। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পাদ্রী বলল।

তার উপদেশ আমাকে অবাক করল।

 ‘ভয় পেয়ো না। সে আবারো বলল যেন মনে হচ্ছে সে আমার অনুভূতিগুলো জানে। আমি জানি চার্চের জন্য নতুন পাদ্রী লাগবে। তোমার বন্ধু সে জন্য চমৎকার একজন। কিন্তু এই জন্য তাকে অনেক চড়া মূল্য দিতে হবে।

 ‘এখন সে কোথায় আছে? সে কি স্পেনে যাওয়ার জন্য আমাকে এখানে রেখে গেছে?

‘স্পেন? স্পেনে তার করার কিছুই নেই। পাদ্রী বলল। তার একমাত্র ঘর হচ্ছে এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা আশ্রম। যদিও সে সেখানে নেই। তবে আমি জানি তাকে কোথায় পাব।’

পাদ্রীর কথা শুনে আমার উৎসাহ আর সাহস ফিরে আসল। যাক আমার বন্ধু তাহলে আমাকে ছেড়ে যায় নি।

কিন্তু পাদ্রী তখনো হাসছিল না। তোমার এতে খুশি হওয়ার কিছু হয় নি।

 পাদ্রী যেন আবারো আমার মনের কথা বুঝতে পারল।

 ‘এটা তার জন্য ভালো হতো সে যদি স্পেন চলে যেত। পাদ্রী বলল।

পাদ্রী দাঁড়িয়ে আমাকে তার সাথে যেতে বলল।

 দুই রাত আগে আমার বন্ধুর সাথে যে রাস্তাগুলো আমরা পার হয়েছিলাম পাদ্রীর সাথে এখন সেইন্টসেভিনের সেই রাস্তাগুলো দিয়েই হাঁটছি।

 ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 ‘আমরা তাকে খুঁজে বের করতে যাচ্ছি। সে উত্তরে বলল।

 ‘পাদ্রী আপনি আমাকে সংশয়ের মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। আমি হাঁটতে হাঁটতে বললাম। আপনি যখন বললেন সে সেমিনারিতে নেই তখন আপনাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল।

‘আমার সন্তান তুমি আমাকে বলল ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে তোমার কতটুকু ধারণা আছে।

‘খুব কম।

পাদ্রী হেসে বলল, ক্যাথলিক ধর্ম বিষয়ে তুমি বেশ ভালোই জানে। কিন্তু আমি তোমাকে ক্যাথেলিজমের বিষয়ে জিজ্ঞেস করছি না। আমি তোমাকে আধ্যাত্মিক জীবনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছি।

কয়েক মুহূর্ত আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমি ঠিক নিশ্চিত না। কিছু লোক আছে যারা সব কিছু ছেড়ে ঈশ্বরের সন্ধানে বের হয়ে যায়।

 ‘তারা কি ঈশ্বরকে খুঁজে পায়?

‘পাদ্রী আপনিই এই বিষয়ে ভালো জানেন। আমার কোন ধারণা নেই।

এই বিষয়ে তোমার ভুল ধারণা আছে। যে লোক ঈশ্বরের সন্ধানে বের হয় সে কেবল তার সময়টাকেই নষ্ট করে। সে হাজার হাজার মাইল পথ হেঁটে বেড়াবে, অসংখ্য ধর্মের লোকের সাথে মিশবে, নানা মতবাদের সাথে সম্পর্ক হবে কিন্তু সে ঈশ্বরকে খুঁজে পাবে না। ঈশ্বর আছেন এখানে। আমাদের চারপাশে। আমরা তাকে আমাদের চারপাশের কুয়াশায় দেখতে পাচ্ছি। আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি তখন তাঁর ফেরেস্তারা আমাদেরকে লক্ষ্য রাখে। আমাদের কাজে সহায়তা করে। ঈশ্বরকে খোঁজার জন্য তোমাকে চারপাশে তাকাতে হবে।

কিন্তু তার সাথে সাক্ষাৎ করা খুব সহজ কাজ নয়। কারণ ঈশ্বর যত আমাদেরকে তার রহস্যের মুখোমুখি হতে বলবেন আমরা তত পথ ভোলা হয়ে পড়ব। তিনি আমাদেরকে সব সময় বলছেন আমরা যেন আমাদের স্বপ্ন আর হৃদয়ের অনুসরণ করি। আমরা যদি একেক সময় একেক পথে ঘুড়ে বেড়াই তাহলে সেটা আমাদের জন্য খুব কঠিন হবে।

 অবশেষে আমরা আবিষ্কার করব যে ঈশ্বর চান আমরা সুখী হই। কারণ তিনি আমাদের পিতা।

.

‘এবং তিনি আমাদের মাতা।’ আমি পাদ্রীর কথার সাথে যোগ করলাম।

কুয়াশা হাল্কা হয়ে আসছিল। আমি ছোট্ট একটা খামার বাড়ি দেখলাম যেখানে একজন মহিলা খড় কুড়োচ্ছে।

‘হা ঈশ্বর হলেন মা। পাত্রী বললেন। আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করার জন্য তোমাকে সেমিনারিতে ঢুকতে হবে,কতগুলো চর্চার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। এই সব কিছুই তোমাকে বিশ্বাস ও খোদাকে গ্রহণ করার জন্য করতে হবে। তারপর থেকেই আমরা সবাই ঈশ্বরের পথের অনুসারি হয়ে যাব। তার অলৌকিকতার একটা যানবাহন হয়ে যাব আমরা।’

‘আমার বন্ধু এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই আমাকে সব বলেছে। আমি পাদ্রীর কথায় বাধা দিয়ে বললাম। সে আমাকে এই ধারণাটাও শিক্ষা দিয়েছে।

 ‘আমি আশা করি তুমি ঈশ্বরের উপহার গ্রহণ করেছ। তুমি কি জানো কেন যীশুকে ক্রুসিফাইড করা হয়েছিল?

আমি এর উত্তরে কিছু বললাম না।

পাদ্রী বললেন, কারণ ঈশ্বর পৃথিবীতে এসেছিলেন তার ক্ষমতাকে আমাদের মধ্যে প্রদর্শন করার জন্য। আমরা তার স্বপ্নেরই অংশ। তিনি চেয়েছিলেন তার স্বপ্নটা সুখি হোক। এভাবে আমরা যদি স্বীকার করতাম যে ঈশ্বর আমাদেরকে সুখী করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন তাহলে আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে যা কিছু আমাদের দুঃখ বয়ে আনছে সে সব কিছুই আমাদের কর্মের ফল। এ কারণে আমরা সব সময় ঈশ্বরকে হত্যা করে আসছি। কখনো তাকে ক্রুসিফাইড করছি, আবার কখনো তাকে আগুনে পুরাচ্ছি, কখনো তাকে বন্দি করছি, অথবা খুব স্বাভাবিক ভাবে আমাদের অন্তর থেকে তাকে মুছে দিচ্ছি। কিন্তু যারা তাকে বুঝতে পেরেছে…’

তারাই অনেক বড় আত্মত্যাগের মাধ্যমে এই পৃথিবীটাকে পাল্টে দিয়েছে।

কথা বলতে বলতে আমরা যখন সেই খামার বাড়ির কাছাকাছি চলে আসলাম তখন যেই মহিলাটা খড় কুড়োচ্ছিল সেই মহিলা দ্রুত আমাদের কাছে ছুটে আসল।

‘পাদ্রী আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’ পাদ্রীর হাতে চুমু খেয়ে মহিলা বলল।

 ‘সেই তরুণ ছেলেটি আমার স্বামীকে সুস্থ করে তুলেছে।

 ‘কুমারী মাতা তোমার স্বামীকে সুস্থ করেছে। পাদ্রী বলল। ছেলেটা ছিল কেবল একটা মাধ্যম।

গতরাতের একটা স্মৃতির কথা আমার মনে পড়ল। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোক আমার বন্ধুকে ইংগিত করে আমাকে বলেছিল যে আমি এমন একজন লোকের সাথে দাঁড়িয়ে আছি যে অলৌকিক কিছু করতে পারে।

.

‘আমাদেরকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। পাদ্রী বলল।

না না আমরা পারব না। আমি ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে বললাম। আমি ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি, আমাকে একটু কফি খেতে হবে।’

মহিলাটা আমার হাত ধরল, আমরা তার বাড়িতে ঢুকলাম।

বাড়িটা খুব সাধারণ ছিল কিন্তু খুব আরামদায়ক ছিল। পাথরের দেয়াল, কাঠের মেঝে। আগুনের সামনে ষাট বছরের একজন লোক বসেছিল। লোকটা পাদ্রীকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেল। তার হাতে চুমু খেল।

দয়া করে দাঁড়াবেন না। আপনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন নি। পাদ্রী বলল।

 ‘আমি এর মধ্যেই পঁচিশ পাউন্ড ওজন বাড়িয়ে ফেলেছি। তবে আমার স্ত্রীকে এখনো ভালোভাবে সাহায্য করতে পারছি না। লোকটি বলল।

ভয়ের কোন কারণ নেই। আপনি আস্তে আস্তে আরো ভালো হয়ে যাবেন।

‘ঐ তরুণ ছেলেটা কোথায়? বাড়ির পুরুষ লোকটা জিজ্ঞেস করল।

 ‘আমি ছেলেটাকে প্রতিদিন সে যেখানে যায় সেখানেই যেতে দেখতাম, তবে আজকে দেখলাম সে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। মহিলাটা বলল।

পাদ্রী আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করল কিন্তু কিছু বলল না।

‘আমাদেরকে আশীর্বাদ করুন পিতা, তার ক্ষমতা..’ মহিলাটা বলল।

 ‘মহান কুমারী মাতার ক্ষমতা। পাদ্রী সংশোধন করে বলল।

 ‘কুমারী মাতার ক্ষমতা আপনারও ক্ষমতা। আপনিই তাকে এখানে এনেছেন। মহিলা বলল।

 কথা শেষ করে মহিলা আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল, আমার স্বামীর জন্য প্রার্থনা করবেন।’

পাদ্রী লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে পুরুষ লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার সামনে দাঁড়াও।’

বুড়ো লোকটাকে যেভাবে বলা হলো সে তাই করল।

পাদ্রী চোখ বন্ধ করে অনেক কিছু প্রার্থনা করল। বিড়বিড় করে অনেক কিছু বলল। বুড়ো লোকটার শরীরে কাঁধে তার হাত বুলিয়ে দিল। দূরে ফায়ারপ্লেসে আগুন পট পট শব্দ করে জলছিল। পাদ্রীর সে দিকে কোন লক্ষ্য নেই। তিনি তার কাজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলেন।

তারপর বললেন, “ঈশ্বর সব সময় এই ঘরে থাকবেন।

 আমার দিকে ফিরে আবার উঠে দাঁড়ানোর ইশারা করলেন।

‘আপনারা তো কফি খাননি। আমাদের চলে যাওয়া দেখে মহিলাটা বললেন।

‘আমি যদি এখন কফি খাই তাহলে আমি রাতে ঘুমাতে পারব না।’ পাদ্রী বলল।

 মহিলাটা হেসে বিড়বিড় করে বলল, কিন্তু এখনতো মাত্র সকাল।

ততক্ষণে আমরা রাস্তায় নেমে এসেছি।

.

‘পাদ্রী সেই মহিলাটা একজন তরুণের কথা বলছিল যে তার স্বামীকে সুস্থ করে তুলেছে। সেই তরুণটি কি আমার বন্ধু?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“হ্যাঁ সেই। পাদ্রী বলল।

আমি আবারো অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলাম। একদিন আগে বিলাবোতে আমাদের স্মৃতি, তারপর মাদ্রিদের সম্মেলন, এরপর অলৌকিকতা নিয়ে মানুষের কথাবার্তা আর এখন নিজেই সেটার মুখোমুখি হওয়া। সব কিছুই আমাকে ঠিক স্বস্তি দিচ্ছিল না।

আমি এমন এক মানুষের প্রেমে পড়েছি যে অলৌকিকভাবে মানুষের অসুস্থতাকে সাড়িয়ে তুলতে পারে। যে লোকটা মানুষকে তার দুঃখ থেকে প্রশান্তি দিতে পারে। অসুস্থ আর রুগ্ন মানুষকে সুস্থ আর স্বাস্থ্যবান করে তুলতে পারে।

আমার মনের স্বাভাবিক চিত্রের সাথে তার এই ক্ষমতা মিশে না বলে কি আমি আমার বন্ধুকে সরিয়ে দিব?

‘শোনো বাছা নিজেকে দোষ দিও না। পাদ্রী বলল।

আপনি আমার মন পড়তে পারছেন।

 ‘হ্যাঁ আমি পারি। পাদ্রী বলল। এটা আমার জন্য উপহার। কুমারী মাতা আমাকে এটা শিখিয়েছেন যাতে অস্থির মানবের আবেগকে যতটুকু সম্ভব আমি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারি।

‘আপনিও তাহলে অলৌকিক কিছু করতে পারেন?

‘আমি কাউকে সুস্থ করে তুলতে পারি না। কিন্তু পবিত্র ক্ষমতার আমিও কিছু পেয়েছি।’

‘পাদ্রী তাহলে আপনি আমার হৃদয়কে পড়তে পারছেন। আপনি জানেন আমি তাকে ভালোবাসি। আমরা এক সাথেই এ পৃথিবীটাকে আবিষ্কার করেছি। আমরা এক সাথেই থাকতে চাই। আমার জীবনের প্রতিটি ক্ষণে সে আছে আমি তাকে এখানে চাই অথবা না চাই তাতে কিছুই যায় আসে না।

আমার পাশে যে পাদ্রীটা হাঁটছে তাকে আমি এর চেয়ে বেশি কি বলতে পারি।

এই লোকটা কখনোই বুঝতে পারবে না যে আমার আরো পুরুষের সাথে প্রেম ছিল, আমি যদি বিয়ে করতাম তাহলে এতদিনে আরো সুখী হতাম। আমি যখন ছোট ছিলাম তখনো প্রেমে পড়েছিলাম আর সোরিয়ার প্রাঙ্গনে আমার প্রেমকে হারিয়ে এসেছি।

কিন্তু অবস্থা যা দেখা যাচ্ছে তাতে করে আমার প্রথম প্রেমকে ভুলে থাকা সম্ভব নয়।

আমি মনে মনে বললাম,’ পাদ্রী সুখি হওয়ার অধিকার আমার আছে। আমি যা হারিয়েছিলাম তা আবার আবিষ্কার করেছি। আমি দ্বিতীয়বার তা হারাতে চাই না। আমার সুখের জন্য যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত আমি। যদি আমি যুদ্ধে হেরে যাই তাহলে আমার অলৌকিক ক্ষমতাকে কাজে লাগাবো। আপনি যেভাবে বলেছেন সেভাবে একজন নারী হিসেবে আমার ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ঈশ্বরকে এক পাশে সরিয়ে রাখব।’

আমি বুঝতে পেরেছি এ ছোট মানুষটা এখানে কী করতে এসেছে। সে এসেছে আমাকে বোঝাতে আমি যেন আমার বন্ধুকে ছেড়ে চলে যাই। কারণ আমার বন্ধুর আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।

 আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে পাদ্রী আমার আমার পাশে থেকে আশা করবে যে আমি আর আমার বন্ধু যেন বিয়ে করে অন্যান্যদের মতো সেইন্ট সেভিনে থাকি।

পাদ্রী আমার সাথে ছোট্ট একটা চালাকি করতে এসেছে।

একটা শব্দও উচ্চারণ না করে পাদ্রী আমার চিন্তাগুলোকে পড়ছিল। অথবা সম্ভবত সে আমাকে বোকা বানাচ্ছে।

হয়ত সে জানেও না যে অন্যেরা কী চিন্তা করে।

খুব দ্রুত কুয়াশা কেটে যাচ্ছিল। আমি এখন রাস্তা-ঘাট, পাহাড়ের উঁচু চূড়া, মাঠ, বরফে আচ্ছাদিত গাছ সব কিছুই দেখতে পাচ্ছি। আমার আবেগ পরিষ্কার হয়ে আসছে।

.

ধুরু! এটা যদি সত্যিই হয় যে পাদ্রী কারো মনের কথা বুঝতে পারে তাহলে আমার মনের মধ্যে কি আছে এটা তাকে পড়তে দেওয়া উচিত। তাকে বুঝতে দেওয়া উচিত গতকাল আমার বন্ধু আমার সাথে প্রেম করতে চেয়েছিল, আমাকে প্রেম নিবেদন করেছিল কিন্তু আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। আর আজকে আমার সেটার জন্য কষ্ট হচ্ছে।

.

গতকাল আমি ভেবেছিলাম সে যদি চলেই যায় তাহলেও আমার শৈশবের স্মৃতিগুলো মনের মধ্যে থেকে যাবে। কিন্তু সেটা ছিল কেবলই বোকামি।

‘পাদ্রী আমি তাকে ভালোবাসি। আমি আবারো বললাম।

 ‘আমিও তাকে ভালোঝাসি। আর ভালোবাসা সব সময় নির্বোধের মতো কিছু করায়। আমার জায়গা থেকে আমি তাকে তার ভাগ্য থেকে দূরে রাখতে চাই।’

‘পাদ্রী এটা সহজ হবে না। বিশেষ করে আমার দিক থেকে এটা মোটেও সহজ হবে না। গতকাল সেই গুহার কাছে প্রার্থনার সময় আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আপনি যে উপহারের কথা বলছেন সেই উপহারের অলৌকিক ক্ষমতা আমারো আছে। আমার বন্ধুকে সাথে রাখার জন্য এখন আমি সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগাব।

‘তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক। আমি আশা করি তুমি পারবে। পাদ্রী মুচকি হেসে বলল।

পাদ্রী একটু দাঁড়াল তারপর পকেট থেকে একটা জপমালা বের করে শক্ত করে সেটা ধরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “যীশু আমাদেরকে কসম কাটতে নিষেধ করেছেন। আমি সেটা করছি না। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি আমি কখনোই তোমার বন্ধুর জন্য প্রথাগত কোন ধার্মিক জীবন আশা করি নি। একজন সাধারণ পুরোহিতের মতো তাকে দেখতে চাই নি। সে অন্য কোনো উপায়ে ঈশ্বরের সেবা করতে পারে। তোমার পাশে থেকে।

 পাদ্রী যা বলছে সেটা আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল।

কিন্তু সে সত্য কথাটাই বলছে।

.

‘সে উপরে আছে। পাদ্রী বলল।

আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। একটু দূরে একটা গাড়ি দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে। আমরা যে গাড়িটা দিয়ে ভ্রমণ করেছিলাম এটা দেখতে প্রায় সেরকম।

 ‘সে সব সময় পায়ে হেঁটে চলে। কিন্তু এখন সে আমাদেরকে বোঝাতে চাচ্ছে যে সে দীর্ঘপথ ভ্রমণ করেছে। পাদ্রী হেসে বলল।

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *