৪. গিথিয়ন বন্দর

শেষ পর্যন্ত আমরা যখন গিথিয়ন বন্দরের দেখা পেলাম, দেখলাম যে বন্দর থেকে বেরিয়ে আসা একটা মাছ ধরার নৌকা আমাদের ডাক দিচ্ছে। জাহাজ থামিয়ে নৌকাটা আমাদের কাছাকাছি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমরা। কাছে আসলে দেখা গেল যে মানুষটা আমাদের ডাক দিয়েছে সে আসলে অ্যাডমিরাল হুইয়ের অবশিষ্ট তিন ছেলের একজন। হাসিখুশি ধরনের একটা ছেলে, নাম হুইসন।

টাটা চাচা! কাছে আসার সাথে সাথে চিৎকার করে ডাক দিল সে। সেরেনার খবর পাওয়া গেছে। ভালো আছে ও। নৌকা আরো কাছাকাছি আসার সঙ্গে তার চিৎকারের মাত্রাও বাড়তে লাগল। এক সিরীয় ব্যবসায়ী ব্যবসার কাজে মিশরে গিয়েছিল। লুক্সরে উটেরিকের দরবার থেকে আমাদের রাজা হুরোতাসের কাছে একটা চিঠি নিয়ে এসেছে সে। উটেরিক গর্ব করে বলেছে যে তার লোকেরা আমাদের বোন সেরেনাকে তুলে নিয়ে গেছে, এখন সে বন্দি হয়ে আছে লুক্সরে। উপযুক্ত প্রতিদানের বিনিময়ে সেরেনাকে মুক্তি দিতে রাজি আছে উটেরিক; কিন্তু তার নিজের শর্ত অনুযায়ী।

কথাগুলো শোনার সাথে সাথে স্বস্তির শীতল পরশ বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে; তার পরেই প্রচণ্ড হতাশা ঘিরে ধরল। স্বস্তি পেলাম এটা শুনে যে সেরেনা এখনো বেঁচে আছে। আর হতাশা বোধ করলাম কারণ, এখন দর কষাকষির জন্য উটেরিকের পাল্লাই বেশি ভারী।

মেমননে উঠে এলো হুইসন। গিথিয়ন বন্দরে প্রবেশ করলাম আমরা, একই সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেলাম এ পর্যন্ত যা কিছু জানা গেছে তার গুরুত্ব এবং উপযযাগিতা নিয়ে। জাহাজ নোঙর করার পরেই রামেসিস আর হুইসনকে জাহাজে অপেক্ষা করতে বলে আমি তীরে নামলাম। উদ্দেশ্য আমার পায়রাগুলোর দায়িত্বে যে লোক নিয়োজিত আছে তার কাছ থেকে এ পর্যন্ত আসা খবরগুলো সংগ্রহ করব। আমাকে দেখেই হাতে বেশ কিছু প্যাপিরাস নিয়ে দৌড়ে এলো সে। সবগুলোই এসেছে লুক্সরে অবস্থানরত ওয়েনেগের কাছ থেকে। কিন্তু চিঠির কথাগুলো পড়তে পড়তে জলে ভিজে এলো আমার চোখ।

ওয়েনেগ জানিয়েছে, আঠারো দিন আগে পানমাসি এবং তার বন্দিনী রাজকুমারী সেরেনা লুক্সরে পৌঁছেছে। অর্থাৎ মেমননকে নিয়ে আমরা নীলনদের মুখে পৌঁছানোর তিন দিন আগেই নিজের ডেরায় পৌঁছে গেছে ধুরন্ধর শয়তানটা।

ফারাও উটেরিক বুবাস্টিসের নির্দেশে বন্দরে জড়ো হয়েছিল কয়েক শ নারী পুরুষ। তাদের মাঝে ওয়েনেগও ছিল। তাদের সবার সামনে সেরেনাকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় তীরে নামানো হয়। পায়ে কোনো জুতো ছিল না তার, অদ্ভুত সুন্দর চুলের রাশি লম্বা হয়ে ঝুলছিল কোমর পর্যন্ত; কিন্তু তাই বলে এত লম্বা নয় যে তার নিতম্ব ঢাকতে পারবে।

ওয়েনেগ লিখেছে, সেরেনার সৌন্দর্যে এবং তার প্রতি নিষ্ঠুরতার মাত্রা দেখে উপস্থিত সবার মাঝে কেমন অটুট নীরবতা নেমে এসেছিল। যদিও দর্শকদের মাঝে কেউই জানত না যে কে এই তরুণী।

বন্দরে নামানোর পর প্রহরীদের একজন সেরেনাকে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করে। রাজপরিচারকদের একজন এসে এরপর সেরেনার লম্বা চুলের গোছা কেটে ফেলে। এই সময় দর্শকদের মাঝে মৃদু প্রতিবাদের গুঞ্জন ওঠে।

জ্বলন্ত চোখে তাদের দিকে তাকায় উটেরিক, বোঝার চেষ্টা করে যে কে তার মতামতের বিরোধিতা করছে। তার দৃষ্টির সামনে চুপ হয়ে যায় সবাই। এবার অন্যদিকে ফিরে প্রধান অত্যাচারকারী এবং জল্লাদ কুখ্যাত ডুগকে সামনে ডেকে পাঠায় ফারাও। প্রায় নাচতে নাচতে তার সামনে এসে দাঁড়ায় লোকটা। সাথে সাথে আসে তার কিছু মুখোশপরা সাঙ্গোপাঙ্গ, যাদের সাথে ছিল একটা ষাঁড়ে টানা আবর্জনা ফেলার গাড়ি। সেরেনাকে ওই গাড়িতে তুলে নেয় তারা। গাড়ির ভেতর একটা খাড়া খুঁটির সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলা হয় সেরেনাকে, যাতে নিজের নগ্নতা সে ঢাকতে না পারে। এবার মিছিল করে লুক্সরের পথে পথে ঘোরানো হয় তাকে। মিছিলের শুরুতে ছিল এক ঢাকবাদক। পথের দুপাশে অনেক লোক জড়ো হয়েছিল। ডুগের লোকদের ইশারায় সেরেনার ওপর নানা রকম অভিশাপ আর অপমান ছুঁড়ে দিতে থাকে তারা। শেষে পাহাড়ের ওপরে দুঃখ-দুর্দশার ফটক নামের সেই ভয়ংকর কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। কারাগারের দরজার ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যায় সেরেনা আর তার পেছনে বন্ধ হয়ে যায় দরজা। এরপর থেকে তাকে আর দেখেনি ওয়েনেগ।

ওয়েনেগের জবানিতে সেরেনার দুর্দশার বিবরণ পড়ার পরেই গিথিয়ন বন্দর থেকে বের হয়ে এলাম আমি, চলে গেলাম ট্যাগেটাস পর্বতমালার সর্বোচ্চ শিখরে। পাহাড়ে ওঠার পথে প্রায় পুরো রাস্তা দৌড়ে এলাম আমি, মনে মনে চাইছি যেন শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে মনের কষ্টকে কিছুটা হলেও দাবিয়ে রাখা যায়। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে অলিম্পাস পর্বতে বসবাসকারী দেবতাদের উদ্দেশ্যে তীব্র অভিশাপ বর্ষণ করলাম আমি, সাবধান করে দিলাম যে তারা যদি তাদের সন্তানকে রক্ষা না করে তাহলে তাদের দায়িত্ব এখন থেকে আমাকেই পালন করতে হবে।

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়ে উঠেছি বলেই কি না কে জানে, কিন্তু পাহাড় থেকে নেমে এসে যখন দেখলাম যে রামেসিস আর হুইসন আমার জন্য ঘোড়ায় জিন পরিয়ে অপেক্ষা করছে, ততক্ষণে হারানো আত্মবিশ্বাস অনেকটাই ফিরে পেয়েছি আমি। প্রায় সাথে সাথেই দুর্গের দিকে রওনা দিলাম আমরা। দুর্গে পৌঁছেই চলে এলাম মন্ত্রণাকক্ষে। দেখলাম রাজা হুরোতাস এবং অ্যাডমিরাল হুই সেখানে অন্য রাজাদের সাথে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। আমি কক্ষের ভেতরে ঢুকতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল হুরোতাস দ্রুত এগিয়ে এলো আমার দিকে।

খবর শুনেছ? গর্জে উঠল সে। এক ব্যবসায়ীর মারফত সরাসরি উটেরিকের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি আমরা। তুমি ঠিকই বলেছিলে, টাইটা! উটেরিকের চ্যালা পানমাসিই চুরি করে নিয়ে গেছে আমার সেরেনাকে। সেই কথা আবার বড় মুখ করে চিঠিতে লিখেছে শয়তানটা। সেরেনা না থাকলে আজ পানমাসি জীবিতই থাকত না, অথচ হারামজাদা সেই প্রতিদান দিল কি না এইভাবে! কিন্তু এখন আমরা নিশ্চিত যে কী ঘটেছে এবং এটাও জানি যে ওকে কোথায় বন্দি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটা সেটা হলো ওর গায়ে হাত দেয়নি কেউ। কিন্তু তীব্র অপমানের শিকার হতে হয়েছে ওকে।

হ্যাঁ। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য হুরোতাসকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। হুইসন এই কথাগুলো আগেই বলেছে আমাকে। এটাও বলেছে যে সেরেনার বিনিময়ে অন্য কিছু চায় উটেরিক।

উটেরিককে আমি বিশ্বাস করি না। সে একটা বিষাক্ত সাপ। যত যা-ই বলুক না কেন, আমি প্রায় নিশ্চিত যে শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে আমাদের যুদ্ধে নামতেই হবে, জবাব দিল হুরোতাস। তবে তার আগে আমরা দেখব যে সে আসলে কী চায়। তবে সহজ কিছু চাইবে না এটা আগে থেকেই ধরে রাখা যায়। কিন্তু আমি তাকে জবাব দেব রক্ত আর অস্ত্রের মাধ্যমে, গম্ভীর মুখে শপথ করল সে। তারপর পেছনে বসে থাকা রাজাদের মাঝে তিনজনের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এরা হচ্ছে গোত্রপ্রধান ফাস, পারভিজ এবং পো।

হ্যাঁ এদের সবাইকেই আমি চিনি, বলে তিনজনের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা জানালাম আমি।

তাই তো আমিই ভুলে গিয়েছিলাম, একটু লজ্জিত দেখাল হুরোতাসকে।

ক্ষমা চাইছি, টাইটা। সেরেনাকে নিয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় আছি আমি।

ভালো খবরটা কি তেহুতিকে জানিয়েছ এখনো? প্রশ্ন করলাম আমি।

এখনো না, স্বীকার করল হুরোতাস। আমি নিজেই শুনেছি মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে। তা ছাড়া ঘোড়া নিয়ে বের হয়ে গেছে তেহুতি এবং আমি জানি না যে কোথায় গেছে ও। চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল হুরোতাস। কোনো কথা না বললেও বুঝতে পারলাম আমার কাছে আসলে কী চাইছে সে।

ও কোথায় গেছে আমি বোধ হয় জানি। যদি তোমার আপত্তি না থাকে তাহলে ওর সঙ্গে দেখা করতে যেতে চাই, বললাম আমি।

অবশ্যই! এখনই যাও, টাইটা। অত্যন্ত কষ্টে আছে ও। আমাদের মাঝে কেবল তুমিই জানো কীভাবে ওর মন ভালো করতে হবে।

*

হুরোতাস নদীর তীরে সেই রাজকীয় কুটিরে এসে পৌঁছলাম আমি। বাড়ির সামনে তৈরি করা আস্তাবলে ঘোড়াটা বেঁধে রাখলাম, তারপর শূন্য কামরাগুলোর মাঝে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম। ডাকছি তেহুতির নাম ধরে। কিন্তু কোনো ৮ কামরাতেই কাউকে পাওয়া গেল না, সবগুলো শূন্য। তাই এবার বাড়িটা থেকে বের হয়ে নদীর তীরে চলে এলাম আমি।

নদীর ধারে যেই জায়গাটায় মা আর মেয়ে একসাথে অনেক সময় কাটিয়েছে। সেখানে উপস্থিত হওয়ার আগেই পানির শব্দ শুনতে পেলাম। বাকের কাছ এসে দেখলাম ঢেউয়ের মাঝে ভেসে রয়েছে তেহুতির মাথাটা, ঘন সাদা চুল লেপটে আছে তাতে। আমাকে দেখতে পায়নি ও। তাই এবার পানির কিনারে একটা পাথরের ওপর বসে পড়লাম আমি, তারপর ওকে দেখতে লাগলাম। জানি, অন্তরের ব্যথাকে শারীরিক কষ্ট দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে ও। ট্যাগেটাস পর্বতমালায় চড়ার সময় আমিও এ কাজটা করেছিলাম।

নদীর এপার থেকে ওপারে বারবার সাঁতরে পার হতে লাগল ও, যতক্ষণ না ওকে দেখতে দেখতে আমার নিজেরই পেশিতে ব্যথা শুরু হলো। তারপর একসময় নদীর যে কিনারে আমি বসে আছি সেখানে চলে এলো ও, অল্প পানিতে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াল। সম্পূর্ণ নগ্ন; কিন্তু ত্রিশ বছর আগে যেমনটা ছিল এখনো ঠিক তেমনই সুগঠিত পাকানো শরীর। নদীর কিনারে উঠে এলো এবার, এখনো পাথরের ওপর বসে থাকা আমাকে দেখতে পায়নি।

তারপর আমি উঠে দাঁড়ালাম। এবার আমাকে চোখে পড়ল ওর। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, সাথে সাথে চোখের পাতায় খেলা করছে ভয়। তারপর আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সাথে সাথে সুন্দর মুখটা আনন্দে ভরে উঠল। নদীর পানিতে ঝড় তুলে এক দৌড়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো ও।

ধন্যবাদ! ধন্যবাদ টাইটা! হাসছে ও, আবার একই সাথে স্বস্তির অশ্রু নেমেছে চোখে।

আমিও হাসলাম ওর দিকে তাকিয়ে। কীভাবে বুঝলে ভালো খবর এনেছি আমি?

তোমার মুখ দেখে! তোমার হাসিভরা মুখটা দেখেই বুঝে নিয়েছি আমি! কাছাকাছি এসেই ঠাণ্ডা হয়ে আসা শরীরটা নিয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরল ও। পরস্পকে আলিঙ্গন করলাম আমরা। এবার তেহুতি জানতে চাইল কোথায় ও?

উটেরিকের কারাগারে বন্দি হয়ে আছে ও, জবাব দিলাম আমি। দুঃখ-দুর্দশার ফটক নামটা তেহুতির সাথে উচ্চারণ করতে কিছুতেই মন চাইল না আমার।

হাসিটা মুছে গেল ওর মুখ থেকে। প্রশ্ন করল লুক্সরে?

ভালো আছে ও, কোনো ক্ষতি হয়নি, তেহুতিকে আশ্বস্ত করলাম আমি। নির্দিষ্ট কিছু শর্তের বদলে ওর মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে উটেরিক।

ওহ, আমি যদি যেতে পারতাম আমার মেয়ের কাছে! ফিসফিসিয়ে বলে উঠল তেহুতি। কথাটা শুনে মাথা নাড়লাম আমি।

না! ওখানে একবার গেলে তুমি আর ফিরে আসতে পারবে না। কিন্তু সেরেনা ঠিকই ফিরে আসবে। হয়তো একটু সময় লাগবে; কিন্তু আমি শপথ করে বলছি যে, ওকে ফিরিয়ে আনব তোমার কাছে, বললাম আমি। সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেলেই এখান থেকে রওনা দেব আমি। যেখানে ওকে বন্দি করে রাখা হয়েছে সে পর্যন্ত হয়তো পৌঁছতে পারব না; কিন্তু ওকে অন্তত এটুকু জানাতে পারব যে আমি কাছেই আছি। আর তাতে ওর সাহস বেড়ে যাবে অনেক এবং কষ্টের মাত্রা কিছুটা হলেও কমে আসবে।

আমরা সবাই তোমার কাছে অনেক ঋণে ঋণী, টাইটা। কীভাবে তোমার প্রতিদান দেব বলো তো?

বেশি কিছু নয়, শুধু তোমার মুখের হাসি আর একটা ছোট্ট চুমু হলেই চলবে তেহুতি। এখন তোমার বোনের কাছে যেতে হবে আমাকে। ওর-ও আমাকে দরকার।

আমিও যাব তোমার সাথে। আগামীকাল হচ্ছে সেই দিন, যেদিন ও আর ওর স্বামী মিলে ওদের ছোট ছেলে পালমিসকে সমাধিস্থ করবে। কুচক্রী উটেরিকের আরো এক শিকারে পরিণত হয়েছে ওদের ছেলে।

*

পালমিস ছিল এমন একটা ছেলে, যাকে সবাই ভালোবাসতো। কমপক্ষে কয়েক শ শোকার্ত মানুষ যোগ দিল আমাদের শোকযাত্রায়। ট্যাগেটাস পর্বতমালার এক নির্দিষ্ট জায়গায় কিছু গুহার উদ্দেশ্যে চলেছি আমরা, যেখানে রাজা হুরোতাস এবং অ্যাডমিরাল হুইয়ের সকল ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এবং আত্মীয়স্বজনদের কবর দেওয়া হয়েছে। পালমিসের মৃতদেহকে মমি করে রাখা হয়েছে একটা শবাধারে। দশটা কালো ষাঁড়ের সাহায্যে টানা একটা কাঠের গাড়িতে রয়েছে সেই শবাধার।

তার পেছন পেছন আসছে বেকাথা। এক হাত ধরে আছে তার স্বামী হুই, গম্ভীর হয়ে আছে তার চেহারা। আরেক পাশে হাঁটছে তেহুতি। পাগলের মতো কাঁদছে বেকাথা, কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না তাকে। তার বাকি তিন ছেলে রয়েছে ঠিক তার পেছনেই, আর তাদের পেছনে রয়েছে তাদের নিজ নিজ বাহিনীর সৈনিকরা। সবার পরনে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সাজ, কণ্ঠে নিজ নিজ বাহিনীর বীরত্বসূচক গান, যুদ্ধের সময় যা গায় তারা। একজন দক্ষ সাহসী তরুণ যোদ্ধা, যার জীবন নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে, তার জন্য এর চাইতে সঠিক শেষকৃত্য আর কিছুতেই হতে পারে না।

এমনকি আমি নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া থেকে নিজেকে সামলাতে পারছি না, যদিও আমার চোখের সামনে বহু যুবককে মারা যেতে দেখেছি, দেখেছি তাদের মৃতদেহকে কবরে শুইয়ে দিতে বা আগুনে পুড়িয়ে দিতে। প্রতিশোধের জন্য জ্বলছে আমার বুকের ভেতরটা। অ্যারেসের উপত্যকায় প্রবেশ করল আমাদের দলটা। জিউসের পুত্র অ্যারেস, যিনি যুদ্ধ এবং নির্মমতার দেবতা। উপত্যকার দুই পাশে খাড়া উঠে গেছে পাহাড়ের সারি, ফলে সার্বক্ষণিক ছায়া ঘিরে রয়েছে জায়গাটাকে। কবরের প্রবেশপথের সামনে এসে দাঁড়াল শবাধার টানা গাড়িটা। পাহাড়ের গায়ে একটা গভীর এবড়োখেবড়ো ফাটল বলা যায় প্রবেশপথটাকে। এরপর আর গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই গাড়ির চালকদের শহরে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। যে পথে এসেছিল সে পথেই আবার ফিরে গেল তারা। এবার পালমিসের সহযোদ্ধারা এগিয়ে এলো সামনে। শবাধারটিকে অনন্ত বিশ্রামে শায়িত করল তারা। আবারও তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বেকাথা, কাঁদছে অঝোরে। শেষ পর্যন্ত তেহুতি আর হুই এগিয়ে গিয়ে প্রায় টেনে সরিয়ে আনল তাকে। তারপর যে পথে এসেছিলাম সেই পথেই আবার দুর্গে ফিরে এলাম আমরা।

*

যুদ্ধের জন্য অধীর হয়ে আছে আমার হৃদয়, তাই মনে হতে লাগল যেন ইচ্ছে করেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে দেরি করছে সবাই। গোত্রপ্রধান আর অন্য রাজারা সবাই একে একে তাদের সেনাবাহিনী নিয়ে পৌঁছতে লাগল, গিথিয়ন উপসাগরে নোঙর করল তাদের যুদ্ধজাহাজ। সাদা পালে ছেয়ে গেল উপসাগরের ঘন নীল পানি। তীরের কাছাকাছি বিভিন্ন জায়গায় নোঙর করল তারা। গিথিয়ন বন্দরে এখন এত বেশি জাহাজ যে ইচ্ছে করলে শুধু এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজের ডেকে পা রেখেই বন্দরের এ মাথা থেকে ও মাথায় চলে যাওয়া যায়। হুরোতাস নদীর তীরে খোলা মাঠগুলো ধীরে ধীরে ভরে উঠতে লাগল অসংখ্য সশস্ত্র যোদ্ধার জন্য আশ্রয় হিসেবে গড়ে তোলা তাবু আর ছাউনিতে। উপত্যকার বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল ঢাল আর শিরস্ত্রাণের সাথে তলোয়ারের সংঘর্ষের ঝনঝন আওয়াজ। প্রশিক্ষকরা চিৎকার করে নির্দেশ দিতে লাগল যোদ্ধাদের, প্রত্যেকেই চাইছে তার বাহিনীকে সর্বোচ্চ দক্ষ করে তুলতে।

প্রতিদিন পাহাড়ের মাথায় চড়ে বসি আমি, সাগরের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য রাখি যে একটা বিশেষ পালের দেখা পাওয়া যায় কি না। সেই সিরীয় ব্যবসায়ীর যেকোনো দিন মিশর থেকে ফিরে আসার কথা। ফারাও উটেরিকের শর্তগুলো আমাদের শোনানোর জন্য বয়ে আনবে সে। অবশেষে একদিন তার জাহাজের হালকা নীল পালের দেখা পাওয়া গেল। এই রং করা হয়েছে এক বিশেষ প্রজাতির সাগর-শামুকের রস থেকে। ধারণা করা হয় বিপজ্জনক সমুদ্র এবং জলদস্যুদের হাত থেকে জাহাজকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে এই রং। আমার বিশ্বাস করতে মন চাইল যে, এই রং হয়তো সৌভাগ্য বয়ে আনবে আমাদের জন্য। কিন্তু জাহাজটা কাছে আসার পর বুঝতে পারলাম সেই সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

বন্দরে জাহাজের এত বেশি ভিড়, সেখানে ব্যবসায়ীর জাহাজ ভেড়ানোর কোনো জায়গায় পাওয়া গেল না। ফলে একটা ছোট মাছ ধরার নৌকা নিয়ে তার সাথে দেখা করতে গেলাম আমি। ব্যবসায়ীর নাম বেন জাকেন। আমাকে সে জানাল, ফারাও উটেরিক বুবাস্টিস-সুমহান এবং সুউচ্চ-এর পক্ষ থেকে সে একটা চিঠি এনেছে ঠিকই। সন্দেহ নেই নিজের নামের সাথে আরো একটা বিশেষণ যোগ করেছে উটেরিক। কিন্তু চিঠিটা আমার হাতে দিতে রাজি হলো না ব্যবসায়ী। বলল, চিঠিটা রাজা হুরোতাসের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তাকে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে এবং নিজের দায়িত্বে সে কোনো অবহেলা করতে রাজি নয়। ধারণা করলাম, চিঠির বদলে হুরোতাসের কাছ থেকে বড় অঙ্কের পুরস্কার আশা করছে সে, এবং সেটা সংগ্রহেও কোনো রকম অবহেলা করার ইচ্ছে নেই তার। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, চিঠিটা অন্তত একবার আমাকে দেখতে দেওয়া উচিত, যাতে কোনো খারাপ খবর থাকলে সেটা অপেক্ষাকৃত নরম ভাষায় রাজা হুরোতাস এবং রানি তেহুতিকে জানানো যায়। কিন্তু কোনোভাবেই রাজি করানো গেল না ব্যাটাকে।

অগত্যা বেন জাকেনকে নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে এলাম আমি, তারপর দুর্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেখানে পৌঁছে দেখলাম অধীর আগ্রহে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সেরেনার বাবা-মা। পুরস্কারের পরিমাণ নিয়ে একটু ঝগড়া করার চেষ্টা করল বেন জাকেন, কিছুটা সময় নষ্ট হয়ে গেল তাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধৈর্য হয়ে উঠল হুরোতাস এবং তার রাগ দেখে আর কিছু বলার সাহস পেল না ব্যবসায়ী। তবে চলে যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে অভিযোগ জানাতে শুনলাম তাকে।

মন্ত্রণাকক্ষে এখন আমি হুরোতাস আর তেহুতি ছাড়া আর কেউ নেই। এবার উটেরিকের পাঠানো শ্বেতপাথরের পাত্রটার মুখে লাগানো সিল ভাঙল হুরোতাস। ভেতরে রয়েছে গোল করে পাকানো একটা প্যাপিরাসের চিঠি আর সিল করা একটা অর্ধস্বচ্ছ সবুজ কাঁচের পাত্র। আমার জানা মতে এ ধরনের পাত্রে জ্ঞানী চিকিৎসকরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ বা নমুনা সংরক্ষণ করে থাকে।

আপাতদৃষ্টিতে একেবারেই সাধারণ এই জিনিসগুলো টেবিলের ওপর রাখল হুরোতাস। নীরবে ওগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম আমরা। তারপর তেহুতি মৃদু স্বরে বলে উঠল, আমার ভয় লাগছে। ওর ভেতর কী আছে আমি জানি না, জানতেও চাই না। কিন্তু এটা ঠিকই বুঝতে পারছি যে ভালো কিছু হতে পারে না।

হুরোতাস বা আমি কেউই ওর কথার জবাবে কিছু বললাম না। কিন্তু আমি জানি আমাদের তিনজনই এই মুহূর্তে একই রকম বোধ করছে। শেষ পর্যন্ত হুরোতাসই নড়ে উঠল প্রথম। নিজেকে একটা ঝাঁকি দিল সে, যেন এইমাত্র জেগে উঠেছে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে। হাতের তালু দিয়ে মুখ মুছল, চোখ পিটপিট করল কয়েকবার। তারপর হাত বাড়িয়ে প্যাপিরাসটা তুলে নিয়ে তাতে লাগানো মোমের সিলমোহরটা পরীক্ষা করল। তারপর কোমরের খাপে ঝোলানো ছুরিটা বের করে সেটার মাথা ঢুকিয়ে দিল সিলের ভেতর। চাড় দিতেই প্যাপিরাস থেকে আলগা হয়ে উঠে এলো সেটা। এবার কাগজটা খুলে আলোর দিকে ধরল সে। মৃদু মচমচ শব্দ করে উঠল সেটা। হায়ারোগ্লিফে লেখা কথাগুলো বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করল হুরোতাস।

না! তীক্ষ্ণ স্মরে বলে উঠল তেহুতি। জোরে জোরে পড়ো। ওতে কী লেখা আছে আমিও জানতে চাই।

থমকে গেল হুরোতাস। আমি চাই না কোনো কারণে কষ্ট পাও তুমি।

জোরে জোরে পড়ো! আবার বলে উঠল তেহুতি। ভ্রূ কুঁচকে উঠল হুরোতাসের। কিন্তু তার পরেই হার মেনে নিল সে, জোরে জোরে পড়তে শুরু করল।

জারাস এবং হুই,

মিশরের রাজকীয় সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে যাওয়া দুই কাপুরুষ দলত্যাগীর প্রতি।

সেরেনা নামের বেশ্যাটা এখন আমার কবজায়। আমার কারাগারের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছে তাকে, যেখানে ওকে তোমরা জীবনেও খুঁজে পাবে না। তবে নিম্নোক্ত শর্তগুলো যদি তোমরা মানতে রাজি থাকো তাহলে ওকে মুক্তি দিতে পারি আমি।

শর্ত এক। তোমরা আমাকে তিন কোটি রৌপ্যখও পরিশোধ করবে। আমার বাবা ফারাও টামোসের সময়ে তোমরা যখন এই মিশরের সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিক ছিলে তখন তোমরা দল ত্যাগ করে পালিয়ে যাও। তার পর থেকে এ পর্যন্ত তোমাদের কারণে আমার এই পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে তোমাদের।

শর্ত দুই। তোমরা যাকে ভুলবশত যুবরাজ রামেসিস বলে সম্বোধন করো তাকে সশরীরে আমার হাতে তুলে দিতে হবে। এই অপরাধী আসলে এক নীচু বংশজাত ক্রীতদাস, যে কি না দাবি করে যে তার শরীরে মিশরের রাজরক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। মিশর সেনাবাহিনীতে নিজের অবস্থান ত্যাগ করে পালিয়ে গেছে সে। তাকে যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যায় সে জন্য তাকে অবশ্যই আমার কাছে হস্তান্তর করতে হবে। শর্ত তিন। তোমরা যাকে ভুলবশত প্রভু টাইটা বলে সম্বোধন করো তাকেও সশরীরে আমার হাতে তুলে দিতে হবে।

এই ঘৃণিত ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে একজন শবসাধক এবং ডাকিনিবিদ্যার মতো ভয়াবহ এবং নিকৃষ্ট জাদুর উপাসনাকারী। একই সাথে সে একজন নীচ ক্রীতদাস, যে তার মনিবের কাছ থেকে পালিয়ে গেছে। তাকে যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যায় সে জন্য তাকে অবশ্যই আমার। কাছে হস্তান্তর করতে হবে।

আমার এই দাবিগুলো পুরোপুরি পূরণ করার জন্য তোমাদের এক মাস সময় দেওয়া হলো। আমার দাবি মানা না হলে প্রত্যেক মাসে তোমাদের কাছে এমন একটা জিনিস পাঠাব আমি, যেটা দেখে তোমাদের শিক্ষা হওয়া উচিত। সেই জিনিসগুলোর প্রথমটা এই চিঠির সঙ্গে পাঠানো হচ্ছে। সবুজ কাঁচের পাত্রে রয়েছে তা।

মিশরের ফারাও উটেরিক বুবাস্টিস (যার আরেক পরিচয় অপরাজেয়)

*

তিনজনই এবার একসাথে দৃষ্টি ফেরালাম নিরীহ চেহারার সবুজ রঙের কাঁচের বোতলটার দিকে। সবাই যেন কোনো রহস্যময় জাদুতে পাথর হয়ে গেছি। শেষ পর্যন্ত তেহুতিই নীরবতা ভঙ্গ করল।

আর সহ্য করতে পারছি না আমি। এই উটেরিককে আমি চিনি। আমার ভাই ফারাও টামোসের প্রথম সন্তান সে, সম্পর্কে আমার ভাইপো। ছোটবেলা থেকেই দুর্বল আর চুপচাপ প্রকৃতির ছিল, তাই ভেবেছিলাম হয়তো ওকে দিয়ে কারো কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ওকে চিনতে ভুল হয়েছিল আমার। ওর মাঝে আসলে সব রকমের শয়তানির প্রকাশ ঘটেছে, ফিসফিস করে বলল সে। কথার মাঝখানে কান্নায় ভেঙে এলো ওর কণ্ঠস্বর, ফলে কথাগুলো প্রায় বোঝাই গেল না। কিন্তু যতটা সময় কথা বলল ও তার মাঝে একবারও দৃষ্টি সরাল না কাঁচের পাত্রটার ওপর থেকে। আমাদের কাছে সেই উটেরিক কী পাঠাতে পারে ভাবতে গেলেই শিউরে উঠছি আমি। তুমি কি পাত্রটার মুখ খুলবে টাইটা?

কাউকে না কাউকে তো খুলতেই হবে, বললাম আমি। তারপর পাত্রটা তুলে নিয়ে মুখের ছিপিটা পরীক্ষা করলাম। দেখলাম নরম কাঠ কেটে তৈরি করা হয়েছে সেটা, তারপর মুখের সাথে মোম দিয়ে শক্ত করে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাবধানে ধরে মোচড় দিতেই সিলটা ভেঙে গেল। মৃদু হিসসস শব্দের সাথে নিজে থেকেই বেরিয়ে এলো ছিপিটা, যেন ভেতরের বাতাস চাপ দিয়ে ওটাকে বের করে দিয়েছে। ভেতরের যা ছিল সব টেবিলের ওপর উপুড় করে ঢেলে দিলাম আমি। তিন জোড়া চোখ রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে রইল টেবিলের ওপর এসে পড়া জিনিসটার দিকে।

জিনিসটা আর কিছুই নয়, একটা মানুষের তর্জনী। একেবারে গোড়া থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। সরু সুগঠিত একটা আঙুল। ত্বকের ওপর কোনো দাগ নেই, সম্পূর্ণ মসৃণ। এমন একজন নারীর আঙুল, যাকে জীবনে কখনো অবহেলা বা শারীরিক পরিশ্রমের মুখোমুখি হতে হয়নি।

তীব্র ক্ষোভ আর হতাশামিশ্রিত একটা আর্তনাদ বের হয়ে এলো তেহুতির মুখ দিয়ে। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ও, ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে আছে টেবিলের ওপর পড়ে থাকা বীভৎস জিনিসটার দিকে।

আমার মেয়ে সেরেনাকে পঙ্গু করে দিতে শুরু করেছে উটেরিক। এই কাজ করতে একবারও ওর হাত কাঁপল না? ঘুরে দাঁড়িয়েই কামরা থেকে দৌড়ে বের হয়ে গেল তেহুতি। হুরোতাস আর আমি বিস্ময় আর বিষণ্ণতা চোখে নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।

শেষ পর্যন্ত আমিই নীরবতা ভঙ্গ করলাম। ওর কাছে যাও, বললাম হুরোতাসকে। হয়তো ও নিজেও বুঝতে পারছে না; কিন্তু এই মুহূর্তে তোমাকেই ওর সবচেয়ে বেশি দরকার। যাও ওর কাছে। সান্ত্বনা দাও ওকে। আমি এখানেই অপেক্ষা করব তোমার জন্য। মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল হুরোতাস, তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। পেছনে খোলাই রইল দরজাটা।

ধীরে ধীরে আতঙ্কের প্রাথমিক রেশটা কাটিয়ে উঠলাম আমি, তারপর এগিয়ে গেলাম টেবিলের দিকে। এবার আগের চাইতে তীক্ষ্ণ চোখে সম্পূর্ণ চিকিৎসকের দৃষ্টিতে পরীক্ষা করলাম বিচ্ছিন্ন আঙুলটা। বুঝতে পারলাম এটা দেখতে যা মনে হচ্ছে আসলেও তাই। নকল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সত্যিই একজন তরুণীর আঙুল এবং খুব সম্ভব অভিজাত বংশের কেউ। সেরেনার হাতটা কখনো ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখিনি আমি; কিন্তু আঙুলটা দেখে মনে হচ্ছে ওরই। শুধু… কী একটা ব্যাপার যেন মিলছে না। ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম আমি। তারপর মনে পড়ল কাঁচের বোতলের ছিপি খুলে ফেলার সাথে সাথে হিসসস শব্দে কিছুটা বাতাস বের হয়ে এসেছিল। এবার বিচ্ছিন্ন আঙুলটার আরো কাছে ঝুঁকে এলাম আমি, ভালো করে শুঁকে দেখলাম। ওপরে লবণের মিহি আস্তরণ রয়েছে, পচনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য লাগানো হয়েছে নিশ্চয়ই। তার পরও পচন ধরার খুব মৃদু একটা গন্ধ ইতোমধ্যে বের হতে শুরু করেছে আঙুলটার থেকে।

পুরো ব্যাপারটার রহস্য উদ্ঘাটন করতে আমি এতই চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছিলাম যে, হুরোতাস কখন দরজা দিয়ে আবার ভেতরে এসে ঢুকেছে খেয়ালই করিনি। যতক্ষণ না মৃদু স্বরে কথা বলে উঠল ততক্ষণ পর্যন্ত ওর উপস্থিতি টেরই পেলাম না আমি।

দেবত্বের অধিকারী ব্যক্তির শরীরে কখনো পচন ধরে না, বলল ও।

চরকির মতো ঘুরে দাঁড়ালাম আমি, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম হুরোতাসের দিকে। প্রশ্ন করলাম কী বললে?

আমার ধারণা, আমার কথা ঠিকই শুনেছ তুমি, বন্ধু। আস্তে করে মাথা। দোলাল হুরোতাস।

হ্যাঁ, তা শুনেছি, কিছুটা বিভ্রান্তি নিয়ে সম্মতি জানালাম আমি। কিন্তু তুমি যা বললে… তা দিয়ে আসলে কী বোঝাতে চেয়েছ?

দেবত্বের অধীকারী কারো শরীরে কখনো পচন ধরে না, আবার বলল ও। তারপর আরেকটা কথা বলল, এই আঙুলটা সেরেনার হতে পারে না। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা জিনিসটার দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল হুরোতাস।

কারণ সেরেনার মাঝে ওই দেবত্বের চিহ্ন আছে।

তুমি জানতে! অবাক হয়ে বলে উঠলাম আমি। আরো একবার মাথা ঝাঁকাল হুরোতাস। কীভাবে জানলে? জানতে চাইলাম ওর কাছে।

আমিও একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম, ব্যাখ্যা করল হুরোতাস। দেবী আর্টেমিস আমার স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন। সেরেনার কীভাবে জন্ম হয়েছে সেটা তিনিই বলেছেন আমাকে। থেমে গেল হুরোতাস। হঠাৎ করে কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠল ওর চেহারা, আগে কখনো এমন দেখিনি আমি। আর্টেমিস আমাকে বলেছিলেন: তোমার স্ত্রীর গর্ভে যে সন্তান বড় হচ্ছে সে তোমার হৃদয়জাত বটে; কিন্তু তোমার ঔরসজাত নয়।

এই কথা কি কখনো তেহুতিকে বলেছ তুমি? প্রশ্ন করলাম আমি। মাথা নাড়ল হুরোতাস।

না। কখনো বলবও না। তাতে হয়তো আমাদের দুজনের মাঝের বিশ্বাস আর সুখ নষ্ট হয়ে যাবে। সে জন্যই এখন তোমার কাছে ফিরে এসেছি আমি। আমি চাই তুমিই তেহুতিকে বুঝিয়ে বলো যে এটা উটেরিকের আরো একটা নোংরা চাল ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি চাই আমার এবং তেহুতির মাঝে যে। বিশ্বাস বিরাজমান তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নাও তুমি। আমার হাতটা ধরে আস্তে করে ঝাঁকি দিল সে। আমার জন্য আমাদের জন্য এটুকু তুমি করবে না?

অবশ্যই! ওকে আশ্বস্ত করলাম আমি। তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে প্রবেশ করলাম সূর্যের আলোয় আলোকিত বাগানে, যেখানে তেহুতিকে পাব বলে জানি। মাছে ভরা পুকুরটার পাশে নিজের প্রিয় জায়গায় বসে ছিল ও। কাছে গিয়ে দাঁড়াতে মুখ তুলে চাইল। সব হারানোর অভিব্যক্তি খেলা করছে ওর চেহারায়।

এখন আমি কী করব টাইটা? তোমাকে আর আমার ভাইপো রামেসিসকে ওই দানবটার হাতে কিছুতেই তুলে দিতে পারব না আমি। অথচ আমার একমাত্র মেয়ের অঙ্গগুলো সে এক এক করে ছিঁড়ে আনবে, এই চিন্তাও আমি সহ্য করতে পারছি না।

এই দুটো কাজের কোনোটাই তোমাকে করতে হবে না। ওর পাশে এসে বসলাম আমি, তারপর কাঁধের ওপর হাত রেখে জড়িয়ে ধরলাম। তেহুতি, তুমি নিশ্চয়ই জানো যে দেবত্বের অধিকারী শরীর পচনের অভিশাপ থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত?

মাথা নাড়ল তেহুতি। কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।

যে আঙুলটা আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে, লবণ মাখানো অবস্থাতেও পচন ধরেছে তাতে। বোঝা যাচ্ছে যে স্বর্গীয় কোনো চিহ্ন নেই ওতে, অর্থাৎ ওটা সেরেনার আঙুল নয়। অন্য কোনো দুর্ভাগা মেয়ের হাত থেকে আঙুলটা কেটে নিয়েছে উটেরিক।

আমার দিকে তাকিয়ে রইল তেহুতি। ধীরে ধীরে আবার সোজা হয়ে উঠল ওর ঝুলে পড়া কাঁধ দুটো। নতুন করে শক্তি ফিরে পেয়েছে সে। ঠিকই বলেছ তুমি, টাইটা। বোতলটা খোলার সাথে সাথেই পচনের গন্ধ পেয়েছিলাম আমি। কিন্তু তখন এটা নিয়ে তেমন চিন্তা করিনি। কিন্তু এখন তোমার মুখ থেকে শোনার পরে মনে হচ্ছে তোমার কথাই ঠিক।

হ্যাঁ। কিন্তু উটেরিককে এটা কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আমাদের বোকা বানাতে ব্যর্থ হয়েছে সে।

মোটেই না! সম্মতি জানাল তেহুতি। কিন্তু আমার স্বামীর ব্যাপারে কী করবে? কথা দাও টাইটা হুরোতাসকে কখনো বলবে না যে সেরেনার আসল বাবা কে।

তোমার স্বামী খুব ভালো একজন মানুষ, একজন দক্ষ রাজাও বটে। কিন্তু দেবতা আর ছাগলের মাঝে তফাত ধরার মতো বুদ্ধি তার মাথায় আছে বলে মনে হয় না। তুমি যে স্বপ্নের মাঝেই গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলে এটা কখনো ওর মাথায় আসবে না। তা ছাড়া তোমার প্রতি ওর বিশ্বাসের কোনো সীমা নেই, তেহুতিকে আশ্বস্ত করলাম আমি। প্রয়োজন পড়লে দারুণ দক্ষ একজন মিথ্যাবাদীতে পরিণত হওয়ার ক্ষমতা আছে আমার।

*

ঠিক করলাম প্রথমে গোপনে মিশরে ঢুকব আমি, চেষ্টা করে দেখব যে সেরেনার সাথে দেখা করার। কারাগার থেকে যদি ওকে মুক্ত করতে নাও পারি, একটু সাহস এবং সান্ত্বনা জোগানোর চেষ্টা তো করতে পারব। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের কথা রামেসিসকে জানাব কি না বুঝতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত দুর্গের মাঝে ওর নির্দিষ্ট কামরায় গিয়ে হাজির হলাম। সবগুলো জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলাম, আমরা ছাড়া আর কেউ আছে কি না। নিশ্চিত হওয়ার পর রামেসিসকে খুলে বললাম আমার সিদ্ধান্ত। এবং সব শেষে বললাম যে আমার এই পরিকল্পনার কথা আর কাউকে না জানাতে।

নীরবে আমার সব কথা শুনল রামেসিস। কথা বলা শেষ হতে আস্তে করে মাথা ঝাঁকাল ও।

 আমিও ঠিক এই একই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু এমনকি তোমাকেও বলার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার, স্বীকারোক্তি জানাল ও।

তার মানে কি আমি ধরে নিতে পারি যে আমার সাথে আসছ তুমি? অবাক হওয়ার ভান করলাম আমি, যদিও এটাই শুরু থেকে আমার ইচ্ছে ছিল।

প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার কোনো দরকার ছিল বলে মনে হয় না টাটা। আমাকে জড়িয়ে ধরল রামেসিস এবং প্রায় সাথে সাথেই আবার ছেড়ে দিল। কখন রওনা দিচ্ছি আমরা?

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব! জবাব দিলাম আমি।

এবার লুক্সরে অভিমুখে আমাদের যাত্রার কথা জানিয়ে সেখানে মদের দোকানে আস্তানা গেড়ে বসা ওয়েনেগের উদ্দেশ্যে তিনটি পায়রা ছেড়ে দিলাম। তারপর রামেসিসকে নিয়ে গেলাম রাজা হুরোতাস আর রানি তেহুতির কাছ থেকে বিদায় নিতে। আমরা সেরেনাকে উদ্ধার করতে যাচ্ছি শুনে দুজনেই দারুণ খুশি হলো। সেরেনার সাথে যখন আমাদের দেখা হবে তখন ওকে দেওয়ার জন্য একটা অসাধারণ উপহার আমার কাছে দিল তেহুতি। আমি ওকে প্রতিশ্রুতি দিলাম, জীবন দিয়ে হলেও এই উপহারকে রক্ষা করব আমি এবং প্রথম সুযোগেই তুলে দেব সেরেনার হাতে।

সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই মেমননের পাল তুললাম আমি আর রামেসিস। দক্ষিণমুখী এই যাত্রার সময় নিজেদের কাজ ঠিক করে নিলাম আমরা, সেগুলো অনুশীলনও করে নিলাম কয়েকবার। বোকাসোকা এক পাগলাটে ভড়ের ছদ্মবেশ নিলাম আমি, আর রামেসিস হলো আমার ছন্নছাড়া মনিব। রাখালরা যে বাঁকানো লাঠির সাহায্যে পশু চরায় তাই দিয়ে আমাকে এদিক-ওদিক নিয়ে বেড়াল সে। জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলি আমি, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটি। গিথিয়ন বন্দরের প্রধান দরজায় বসে থাকা দুই ভিক্ষুকের কাছ থেকে কিনে আনা পোশাক পরে নিলাম আমরা দুজন। আমাদের হয়ে আমার এক চাকর পোশাকগুলো কিনেছে তাদের কাছ থেকে, ফলে কেউ আমাদের চিনে ফেলবে সে ভয় নেই। তবে পোশাকগুলো সত্যিই দারুণ ভেঁড়া, ময়লা আর দুর্গন্ধময়। সৌভাগ্যক্রমে মিশরীয় উপকূল দৃষ্টিসীমার মাঝে আসার আগ পর্যন্ত ওই পোশাকের মাঝে ঢুকতে হলো না আমাদের।

রাত নামার আগ পর্যন্ত মেমননেই অপেক্ষা করলাম আমরা। তারপর অন্ধকার নেমে এলে আবারও দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করলাম, যতক্ষণ না ডাঙার আবছা রেখা বোঝা যায়। মাটি দেখা গেলে মেমননের ডেকের ওপর নিয়ে আসা ছোট্ট ডিঙি নৌকাটা নামিয়ে নিলাম। তারপর জাহাজের নাবিকদের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছেঁড়া কাপড়গুলো পরে উঠে পড়লাম ডিঙিতে। নাবিকরা আবার ল্যাসিডিমনের পথে রওনা দিল, আর আমরা চললাম নীলনদের নয়টা মুখের মধ্যে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ পথ ওয়াদি তুমিলাত লক্ষ্য করে।

ভোরের আলো ফুটলে দেখা গেল ইতোমধ্যে নদী ধরে চার-পাঁচ লিগ পথ এগিয়ে এসেছি আমরা। মিশরীয় নদীপথ ধরে ভেসে চলা আরো অনেকগুলো ছোট ছোট জলযানের মাঝে মিশে গেছে আমাদের নৌকা। তবে নদীর স্রোত এখন আমাদের গতিপথের বিপরীতে, ফলে সোনালি শহর লুক্সরে পৌঁছতে গিয়ে বেশ কয়েক দিন সময় লেগে গেল। এই সময়ের মাঝে আমাদের অগোছালো নোংরা চেহারা আরো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠল, দেখে মনে হতে লাগল যে আমাদের অবস্থা জন্ম থেকেই এ রকম। তাই রামেসিস যখন লাঠির মাথায় আমাকে ঠেলতে ঠেলতে ওয়েনেগের মদের দোকানে নিয়ে ঢোকাল তখন আমার এলোমেলো দৃষ্টি আর পদক্ষেপ দেখে প্রথমে ওয়েনেগ আমাদের দুজনকে চিনতেই পারল না। দোকানে ঢোকার সাথে সাথেই আমাদের বের করে দিতে চাইল সে। শেষ পর্যন্ত যখন আমাদের সত্যিকারের পরিচয় ওকে বোঝাতে সক্ষম হলাম তখন প্রথমে একেবারে অবাক হয়ে গেল সে এবং তার পরেই দারুণ খুশি হয়ে উঠল। প্রথম রাতের বেশির ভাগ সময় জেগেই কাটালাম আমরা। রাজকুমারী সেরেনাকে কোথায় আটকে রাখা হতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা করলাম, সেইসাথে ওয়েনেগের দোকানের প্রধান পণ্য অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের মদ চেখে দেখলাম। সৌভাগ্যক্রমে সবগুলোই উৎকৃষ্ট স্বাদের। বোঝা গেল ওয়েনেগের রুচি বেশ অভিজাত। একই সাথে আরো। একটা কাজ করলাম আমি। রানি তেহুতি তার মেয়ে সেরেনাকে দেওয়ার জন্য যে উপহারটা দিয়েছিলেন সেটা মদের দোকানের নিচে অবস্থিত ভাড়ার ঘরে বেশ কিছু মদের বোতলের তূপের পেছনে লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করলাম। অন্যান্য সকল সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করার পর আমরা একমত হলাম যে, সেরেনাকে সম্ভবত কুখ্যাত জল্লাদ ডুগের কাছেই বন্দি করে রাখা হয়েছে। শেষবার ওকে এই লুক্সরের রাস্তায় ডুগের হাতে বন্দি অবস্থাতেই দেখা গেছে। অবশ্য এমনও হতে পারে যে, উটেরিক আর তার দোসররা আমাদের এটাই বিশ্বাস করাতে চায়। হয়তো সেরেনাকে অন্য কোনো কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। উটেরিক সিংহাসনে বসার পর এমন শত শত কারাগার গজিয়ে উঠেছে পুরো দেশে। তবে এটাও ঠিক যে, প্রধান প্রধান বন্দিদের আটকে রাখার জন্য উটেরিকের প্রথম পছন্দ হচ্ছে দুঃখ-দুর্দশার ফটক। হয়তো কারাগারের নামটাই এর কারণ। এবং আমাদের মাঝে একমাত্র আমিই ওই কারাগারের ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেয়েছি। ফলে আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে কারাগারের অভ্যন্তরীণ অংশের একটা মানচিত্র তৈরি করার।

আমার দৃষ্টিশক্তিও অত্যন্ত শক্তিশালী। আলো যদি ভালো থাকে তাহলে এক লিগ দূরত্বের কোনো বস্তুর গঠনও আমি খুব সহজেই চিনতে পারি। এক ঘণ্টায় একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ হেঁটে হেঁটে যত দূরে যেতে পারে তাকে বলা হয় এক লিগ। ফলে আরো একটা কাজ পড়ল আমার ভাগে। সেটা হচ্ছে দিনের বেলায় কারাগারের চারপাশে ঘিরে থাকা পাহাড়গুলোর ওপরে বসে বসে কারাগারের ওপর নজর রাখা। সত্যি কথা বলতে আমি নিজেই কাজটা বেছে নিলাম আমার জন্য। অর্ধ দেবী-অর্ধ মানবী সেই নারীকে এক নজর দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি আমি, তা সে যত দূর থেকেই হোক না কেন। ওকে একবার দেখতে পেলে আমার সাহস আর প্রতিজ্ঞা আরো দৃঢ় হবে, উটেরিক এবং ডুগের হাত থেকে ওকে ছিনিয়ে আনার জন্য আরো সাহসের সাথে লড়াই করতে পারব আমি।

নিজের কিছু বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় আমার জন্য দশ-বারোটা কালো রঙের ভেড়ার ব্যবস্থা করল ওয়েনেগ। এখন প্রতিদিন সকালে সেই রাখালের লাঠিটা ব্যবহার করে প্রাণীগুলোকে পাহাড়ে চরাতে নিয়ে যাই আমি, অবস্থান নিই লুক্সর এবং কারাগারের মাঝখানে অবস্থিত রাস্তাটার আশপাশে। এখানে বসে দিনের বেশির ভাগ সময় আমার কাটে ভেড়াগুলোর ওপর লক্ষ্য রেখে এবং রাস্তা দিয়ে যারা যাতায়াত করে তাদের ওপর আড়চোখে খেয়াল রেখে। খুব তাড়াতাড়িই আমি বুঝতে পারলাম কারাগারে যেসব বন্দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের মাঝে খুব কমই আবার এ পথে ফেরত আসে। সোজা কথায় কারাগার থেকে তারা আর বের হতে পারে না। ব্যাপারটা খেয়াল করে নিজের সৌভাগ্যে খুশি না হয়ে পারলাম না আমি।

স্বাভাবিকভাবেই রামেসিসও আমার সঙ্গী হতে চেয়েছিল। কিন্তু স্রেফ দুটো প্রশ্ন করেই ওকে নিরুৎসাহিত করেছি আমি। প্রথম প্রশ্নটা হচ্ছে, কখনো দেখেছ যে দুজন রাখাল মিলে মাত্র বারোটা ভেড়াকে পাহারা দিচ্ছে? আর দ্বিতীয় প্রশ্নটা হচ্ছে,যদি এমনটা তোমার চোখে পড়ে তাহলে কি মনের ভেতর সন্দেহ জাগবে না?

হতাশার চোটে হাত দুটো মাথার ওপরে ছুড়ল রামেসিস। আচ্ছা, তোমার যে কখনো ভুল হয় না, এটা তোমার কেমন লাগে, টাইটা?

প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি লাগত। কিন্তু আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গেছে, ওকে আশ্বস্ত করলাম আমি।

*

এভাবে পাহারা দিতে দিতে বিশতম দিনে ভাগ্য আমার সহায় হলো। সেদিনও শহরের দক্ষিণ দিকের দরজা খুলে যাওয়ার সাথে সাথে ভেড়াগুলোকে নিয়ে বের হয়ে এলাম আমি। তখন সবে সূর্য উঠছে। ইতোমধ্যে আমাকে মোটামুটি চিনে ফেলেছে সবাই, ফলে আমি যখন বের হয়ে এলাম তখন কেউ খেয়ালই করল না। পালের মধ্যে বুড়ো ভেড়াটা পাহাড়ের দিকে যাওয়ার রাস্তা চিনে ফেলেছে। শহরতলির মাঝ দিয়ে বাকি ভেড়াগুলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল সে। এই রাস্তাটা সাধারণত লুক্সরের সাধারণ নাগরিকরা এড়িয়ে চলে, কারণ তারা জানে এই রাস্তা কোথায় গেছে। এটাকে দুর্ভাগ্যের প্রতীক বলে গণ্য করে তারা। ভেড়ার পালের সাথে সাথে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চললাম আমি। তবে প্রথম তীক্ষ্ণ মোড়টা যেখানে ঘন জঙ্গল জন্মেছে সেখানে এসেই থমকে দাঁড়াতে হলো। কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না, প্রথমে শুধু ঘঘাড়ার খুরের শব্দ আর ব্রোঞ্জ-বাঁধাই করা চাকার ভারী আওয়াজ পাওয়া গেল। তার পরেই মোড় ঘুরে আমাদের সামনে এসে পড়ল চারটি রথ। আমাদের ঠিক উল্টো দিকে যাচ্ছে তারা, লুক্সর শহরের দিকে। সবার সামনের রথটা হুড়মুড় করে এসে পড়ল আমার মদ্দা ভেড়াটার ওপর। ঘাড় ভেঙে সাথে সাথে মারা পড়ল প্রাণীটা। আরো একটা ভেড়ির সামনের পা গুঁড়ো হয়ে গেল চাকার আঘাতে। করুণ সুরে ভ্যা ভ্যা করে ডাকতে লাগল প্রাণীটা। ইতোমধ্যে এই ছোট্ট ভেড়ার দলটার প্রতি বেশ মায়া জন্মে গেছে আমার। তাড়াতাড়ি সামনে গিয়ে প্রতিবাদ জানাতে চাইলাম আমি।

তবে সামনের রথের চালক ইতোমধ্যে আমাকে এবং আমার নোংরা জানোয়ারগুলোকে গালাগালি করতে শুরু করেছে, সেইসাথে সমানে চালাচ্ছে। হাতে ধরা চাবুকটা। আমি সামনে এগিয়ে যেতেই মাথার কাপড়ের আবরণটা সরিয়ে ফেলল সে। সাথে সাথে উন্মোচিত হলো ডুগের সেই ভয়ানক চেহারা। ময়লা কাপড়চোপড় এবং খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর লম্বা এলোমেলো চুলে ঢেকে থাকায় আমার চেহারা চিনতে পারেনি সে। তবু সাবধানের মার নেই ভেবে তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলাম আমি, তারপর মরা ভেড়াটাকে টানতে টানতে রাস্তার পাশে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। তারপর একটা পাথর তুলে নিয়ে আহত ভেড়িটারও যন্ত্রণা চিরতরে বন্ধ করার ব্যবস্থা করলাম। রাস্তা পরিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে রথ নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল ডুগ, তবে যাওয়ার আগে আমার অর্ধনগ্ন পিঠের ওপর শেষ একটা চাবুকের বাড়ি মেরে যেতে ভুল করল না। কাতর স্বরে গুঙিয়ে উঠলাম আমি। দ্বিতীয় রথটাও চলে গেল আমার পাশ দিয়ে। কিন্তু তৃতীয় রথটা আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রথের যাত্রীর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম আমি।

মাথা কামিয়ে ফেলা হয়েছে ওর, মারের চোটে ফুলে গেছে চোখ-মুখ। এক চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। পরনে একটা খাটো টিউনিক। জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে সেটা, এবং শুকনো রক্ত আর নানা রকম ময়লা লেগে আছে সবখানে। কিন্তু তার পরও এখনো আমার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী বলে মনে হলো ওকে।

পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার দিকে এক নজর তাকাল সেরেনা। সেই মুহূর্তে আমাদের মাঝে দূরত্ব ছিল খুব বেশি হলে দুই কি তিন হাত। এক মুহূর্তের জন্য আমার ছদ্মবেশের কারণে আমাকে চিনতে পারল না ও, কিন্তু তার পরেই বদলে গেল ওর অভিব্যক্তি। আনন্দ এবং বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ জোড়া, এমনকি ফুলে ওঠা চোখেও সেই আনন্দ ফুটে উঠল পরিষ্কার। আমার নাম উচ্চারণের ভঙ্গিতে নড়ে উঠল ঠোঁট জোড়া, তবে কোনো শব্দ বের হলো না। –কুঁচকে ওকে নীরবে সাবধান করলাম আমি। সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিল সেরেনা, অন্যদিকে সরিয়ে নিল চোখ। তার পরেই আমাকে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল ওর রথ। আর একবারও আমার দিকে তাকাল না সেরেনা, আমাকে চিনতে পেরেছে এমন কোনো লক্ষণও দেখা গেল না ওর মধ্যে। কিন্তু আমি খেয়াল করলাম, এখন আর হতাশায় বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে না ওকে। কাঁধগুলো সোজা হয়ে উঠেছে আবার, কামানো মাথাটা এখন আগের চাইতে উঁচু হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন নতুন করে একটা আশার চাদর ঘিরে রেখেছে ওকে এবং সেটা এত দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার।

আমার নিজের মনেও নতুন আশা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, কারণ আরো একটা জিনিস আমার চোখে পড়েছে। সেটা হচ্ছে ওর হাত বাঁধা হয়নি এবং সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, প্রতিটা আঙুলই অক্ষত আছে। ফাঁস হয়ে গেছে উটেরিকের ধোঁকাবাজি। এ ছাড়া এটাও আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে, ওর চেহারায় যে আঘাতের চিহ্ন ফুটে উঠেছে সেগুলো খুব শীঘ্রই মিলিয়ে যাবে, কারণ ওর শরীর স্বর্গীয়।

ডুগের রথ বাহিনী মোড় ঘুরে ওপাশে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত চেহারায় নিরীহ এবং অসহায় ভাব ফুটিয়ে রেখে অপেক্ষা করলাম আমি। তার পরেই একটা উল্লসিত চিৎকার ছেড়ে হাতের লাঠিটা একদিকে ছুঁড়ে ফেলে এদিক-ওদিক দৌড়ে বেড়াতে শুরু করলাম পাগলের মতো। নিজেকে শান্ত করতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল আমার। তারপর লাঠিটা যেখানে ফেলেছিলাম সেখান থেকে কুড়িয়ে নিয়ে শহরের দিকে দৌড়াতে শুরু করলাম। পালের ভেড়াগুলো হঠাৎ করে আমাকে এভাবে পালাতে দেখে ভয় পেয়ে গেল, ব্যা ব্যা করে ডাকতে ডাকতে পিছু নিল আমার। তবে দৌড় প্রতিযোগিতায় ওদের হারিয়ে দিলাম আমি। ওয়েনেগের মদের দোকানে যখন পৌঁছলাম তখনো বেশ অনেকটা পেছনে পড়ে রয়েছে ভেড়ার দল।

মদের দোকানের নিচে গোপন আস্তানায় খুঁজে পাওয়া গেল ওয়েনেগ আর রামেসিসকে। লুক্সরে নিজের আগমনের মূল উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্ক আছে এমন সব জিনিস এখানেই রাখে ওয়েনেগ, একেবারে উটেরিকের নাকের নিচে। এগুলোর মাঝে রয়েছে ল্যাসিডিমন এবং লুক্সরের মাঝে সংবাদ আদান প্রদানের জন্য ব্যবহৃত কবুতরের বেশ কয়েকটা খাঁচা এবং প্রচুর পরিমাণে তীর-ধনুক এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র।

ওকে পেয়ে গেছি আমি! ভেতরে ঢুকেই দুজনকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।

অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল দুজন, তারপর একই সাথে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল কাকে?

সেরেনাকে, আবার কাকে! উত্তেজিত গলায় জবাব দিলাম আমি।

বলো, দ্রুত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো রামেসিস। কোথায় ও? আমার কাঁধ চেপে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল সে। ও ঠিক আছে তো? ওর ওপর কোনো অত্যাচার করেনি তো শয়তানগুলো? যত দ্রুত সম্ভব…

রামেসিসের উত্তেজনা কমে আসার জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করতে হলো আমাকে। তারপর বললাম, ডুগ আটকে রেখেছে ওকে সেই দুঃখ-দুর্দশার ফটকে। আজ সকালে রথে করে সেরেনাকে নিয়ে এদিকেই আসছিল সে… এই বলে দ্রুত কয়েক কথায় রামেসিসকে বুঝিয়ে বললাম যে, ডুগ সম্ভবত সেরেনাকে নিয়ে লুক্সরে উটেরিকের প্রাসাদে গেছে। হয়তো আরো এক দফা জিজ্ঞাসাবাদ চালানো হবে সেরেনার ওপর। এটাও বললাম যে, সেরেনার কপালে এর পরে কী ঘটতে পারে বলে আমার ধারণা।

ওকে মারধর করা হয়েছে। মুখ আর হাত-পায়ে মারের দাগ লেগে আছে এখনো, তবে চিরস্থায়ী কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না। এবং উটেরিক যেমন হুমকি দিয়েছিল সেই অনুযায়ী ওর কোনো আঙুল বা শরীরে অন্য কোনো অংশ কেটে ফেলা হয়েছে বলেও আমার মনে হয়নি। আমি যতটা দেখলাম ওর দৃষ্টি অথবা মানসিক অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। নিজের অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ এবং সতর্ক ছিল ও। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক, কারণ বন্দি হিসেবে ওর গুরুত্ব উটেরিকের কাছে অনেক বেশি। কিছুতেই ওর বড় কোনো ক্ষতি হতে দিতে পারে না সে। এই কথাগুলো বলার পর কিছুটা শান্ত হয়ে এলো রামেসিস আর ওয়েনেগ। এবার আমার ঠাণ্ডা মাথায় সাজানো পরিকল্পনার কথা খুলে বললাম ওদের কাছে।

সেরেনাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার জন্য এর চাইতে ভালো সুযোগ আর আমাদের সামনে আসবে বলে আমার মনে হয় না। কারাগার থেকে নিরাপদ কোনো জায়গায় সরিয়ে আনতে হবে ওকে। ডুগ যদি একবার ওকে নিয়ে আবার কারাগারের দরজার ওপাশে ঢুকে পড়তে পারে তাহলে সেরেনাকে উদ্ধার করার কোনো উপায়ই থাকবে না। এবং আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না, কারণ কারাগারের ভেতরে আমি ঢুকেছি এবং জানি যে কাজটা কত কঠিন! কেউই আমার সাথে তর্ক করার কোনো চেষ্টা করল না। কিন্তু রামেসিসের চেহারায় একই সাথে আশা আর নিরাশা খেলা করতে শুরু করল।

তাহলে বলো কী করতে হবে আমাদের, অনুনয়ের সুরে বলল সে।

আমার পরিকল্পনাটা এ রকম, ওদের বললাম আমি। আমরা জানি যে এই মুহূর্তে সেরেনা কারাগারের বাইরে রয়েছে। উটেরিক তার পোষা জল্লাদ ডুগকে নির্দেশ দিয়েছে সেরেনাকে তার প্রাসাদে নিয়ে আসতে। তার উন্মাদ মস্তিষ্ক কেন এই কাজ করতে চাইল তা আন্দাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, হয়তো সেরেনার ওপর আরো অত্যাচার চালাতে চায় সে; অথবা অপমান করতে চায়, কে জানে। তবে এটা ঠিক যে, আজ সন্ধ্যার আগেই সেরেনাকে নিয়ে কারাগারে ফিরে আসার চেষ্টা করবে ডুগ। তাই আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি আজ দুপুর থেকে সূর্যাস্তের মাঝে কোনো একসময়ে ওই একই রাস্তা ধরে ফিরে যাবে ডুগ, যেখানে সকালে তার সাথে দেখা হয়েছে আমার। এই পর্যন্ত বলে ওয়েনেগের দিকে ফিরলাম আমি। প্রশ্ন করলাম, আজ দুপুরের আগে কতজন দক্ষ এবং বিশ্বাসী লোক জোগাড় করতে পারবে তুমি?

মাত্র কয়েক মুহূর্ত নীরবে চিন্তা করল ওয়েনেগ, আঙুলে কর গুনল কয়েকবার। তার পরই জবাবটা প্রস্তুত হয়ে গেল তার মুখে। বারোজনের কথা নিশ্চিত বলতে পারি, বলল সে। ভাগ্য যদি ভালো থাকে তো পনেরোজন। তবে এরা সবাই উটেরিকের চরম শত্রু এবং জাত যোদ্ধা। তবে এটা জানা নেই যে, ওদের সবার কাছে নিজস্ব ঘোড়া আছে কি না।

মাথা ঝাঁকালাম আমি। অস্ত্র থাকলেই চলবে। ভালো ঘোড়া কোথায় পাওয়া যাবে সেটা আমি জানি। তার মানে আন্দাজ করা যাচ্ছে যে ভুগের দলবলের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি সমান সমানই থাকবে। উপরন্তু ওদেরকে চমকে দেওয়ার মাধ্যমে বাড়তি সুবিধা থাকবে আমাদের হাতে।

আমি যেটা নিশ্চিত বলতে পারি সেটা হচ্ছে, এখানে বসে এক দল বুড়ি মহিলার মতো বকবক করে কোনো কাজই হাসিল করতে পারব না আমরা। অস্থির হয়ে উঠেছে রামেসিস, কামরার ভেতরে পায়চারি করছে অনবরত। সেরেনার বিপদের কথা শুনে যেমন কষ্ট পাচ্ছে তেমনি ওকে উদ্ধার করার একটা সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে উত্তেজিতও হয়ে উঠেছে। তবে রওনা দেওয়ার আগে আরেকটু দেরি করলাম আমি, মদের বোতলের তূপের ওপাশ থেকে তেহুতির দেওয়া সেই উপহারটা বের করলাম, যেটা ওর মেয়েকে দেওয়ার জন্য ল্যাসিডিমনে থাকতে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল সে। জিনিসটা আমার ছেঁড়া ময়লা পোশাকের ভেতরে পিঠের সাথে বেঁধে নিলাম আমি। তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করা না হলে এখন কেউ ওটা খুঁজে পাবে না।

এবার ওয়েনেগকে কিছু জিনিসপত্রের একটা তালিকা দিলাম, যেগুলো ওর লোকদের অবশ্যই সাথে করে নিয়ে আসতে হবে। ডুগের সাথে যেখানে আমার দেখা হয়েছিল তার চাইতেও আধ লিগ দূরে একটা ঝরনা বয়ে গেছে পথের মাঝ দিয়ে। একটা পাথরের সেতু দিয়ে পথ করা হয়েছে সেখানে। ঠিক হলো ওখানেই দেখা হবে আমাদের। ওয়েনেগকে পই পই করে বলে দিলাম যে আমাদের দলের প্রত্যেক সদস্য যেন দুপুরের অন্তত এক ঘণ্টা আগেই সেখানে উপস্থিত থাকে। জানি যে এত অল্প সময়ের মাঝে প্রস্তুত হওয়া প্রত্যেকের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ইচ্ছে করেই একটু অল্প সময় বেঁধে দিলাম ওদের, যেন পথে কেউ দেরি করে না বসে।

*

ওদিকে আমার ন্যাওটা ভেড়াগুলো তখন মদের দোকানের পেছনে উঠানে এসে অপেক্ষা করছে। আরো একবার শহরের দক্ষিণ ফটক দিয়ে বের হয়ে এলাম আমরা, অলস পায়ে পথ চলছি। স্বাভাবিকভাবেই ঝরনার ওপর সেই সেতুর গোঁড়ায় যেখানে আমাদের মিলিত হওয়ার কথা সেখানে সবার আগে আমিই পৌঁছে গেলাম। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়েনেগের যোদ্ধারা এক এক করে পৌঁছতে শুরু করল। ওয়েনেগকে আগেই বলে দিয়েছিলাম লোকজনের সন্দেহের চোখ এড়ানোর জন্য একসাথে দুজনের বেশি যেন কেউ না আসে। তাই করেছে ওরা, একজন দুজন করে এসে পৌঁছাচ্ছে। প্রত্যেকের কাছেই রয়েছে পর্যাপ্ত অস্ত্র। এই উত্তাল বিপদসংকুল সময়ে একা একা চলাফেরা করছে। এমন যে কারো জন্য অবশ্য এটাই স্বাভাবিক।

যেমনটা ভেবেছিলাম, নির্ধারিত সময়ের মাঝে পৌঁছতে পারল না সবাই। নির্দিষ্ট জায়গায় যখন শেষ ব্যক্তিটি এসে পৌঁছল তখন বিকেলের মাঝামাঝি। তবে শেষ পর্যন্ত তেরোজন দক্ষ এবং সশস্ত্র যোদ্ধাকে পেয়ে গেলাম আমি। সেতুর আগে পথের দুই পাশে জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে থাকতে বললাম তাদের সবাইকে।

এই তেরোজনের মাঝে সবাই হিকসসদের বিরুদ্ধে অন্তত একটা যুদ্ধে লড়াই করেছে আমার পাশে দাঁড়িয়ে। ফলে আমাকে সহজেই চিনতে পারল সবাই এবং আবার দেখতে পেয়ে দারুণ খুশি হয়ে উঠল। আসন্ন লড়াইয়ে কার ভূমিকা কী হবে সেটা কাউকে একবারের বেশি দুবার বুঝিয়ে দেওয়া লাগল না। এ ধরনের আগের লড়াইয়ে আগেও অংশ নিয়েছে ওরা এবং কেউই কখনো ব্যর্থ হয়নি।

নিজের জন্য এমন একটা জায়গা বেছে নিয়েছি আমি, যেখান থেকে লুক্সর থেকে আসা পথটার অনেকখানি অংশ স্পষ্ট দেখা যায়। অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে উঠেছি, এই সময় দেখলাম দূরে ধুলো উড়ছে। শহর থেকে বেরিয়ে এসেছে রথের একটা সারি, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এখন উঠে আসছে আমাদের দিকেই। ভুগের সাথে আজ সকালে যেখানে আমার সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছিল সেই জায়গাটা পেরিয়ে এলো ওরা দেখতে দেখতে। কাছে আসতে দেখলাম দ্রুত গতিতে রথ ছুটিয়েছে ওরা, তবে বেশ ঢিলেঢালা মেজাজে আছে সবাই। বুঝলাম আজ সকালে আমার সাথে দেখা হওয়ার ঘটনা থেকে ঠিকই কিছু একটা সন্দেহ করেছিল ডুগ। তবে এখন আর সেই সন্দেহ নেই তার মনে, কারণ ফেরার পথে কোনো বিপদের গন্ধ পাচ্ছে না সে। এবং পরিকল্পনা সাজানোর সময় ঠিক এই ব্যাপারটার ওপরেই নির্ভর করেছিলাম আমি। সত্যিকারের প্রতিভার অন্যতম প্রধান লক্ষণ হচ্ছে সঠিক দূরদৃষ্টি।

এবার আমার ফাঁদের আওতায় চলে এলো ওরা, কেউ এখনো কিছু বুঝতে পারেনি। চিৎকার করে একে অপরের সাথে ঠাট্টা করছে চালকরা, ঘোড়াগুলোকে তাড়া লাগাচ্ছে। দেখলাম এবারও তৃতীয় রথের ওপরই রয়েছে। সেরেনা। এটাও আমার পরিকল্পনা সাজানোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইচ্ছে করেই অন্য যযাদ্ধাদের সামনে রেখেছি আমি, যাতে সবার আগে সেরেনার কাছে পৌঁছতে পারি।

সরাসরি সামনে তাকিয়ে আমাদের অবস্থান পার হয়ে গেল প্রথম রথের চালক। পথের দুই পাশে ঘন জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে থাকায় আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে এক চুলও সন্দেহ করেনি সে। তাকে অনুসরণ করে দ্বিতীয় রথও সেতুর ওপর উঠে পড়ল। এই রথে বসে আছে কালো আলখাল্লা পরা ডুগ। তার পরেই তৃতীয় রথ অর্থাৎ সেরেনার রথ চলে এলো আমার সামনে। আমার অবস্থান জানা না থাকায় কিছুই বুঝতে পারল না ও, যদিও এত কাছ থেকে ওকে দেখতে পেয়ে দ্রুত হয়ে উঠল আমার হৃদস্পন্দন। তার পরেই চতুর্থ ও শেষ রথটা উঠে পড়ল সেতুর ওপরে।

এবার আর ওদের ফেরার কোনো পথ নেই। সরু সেতুর ওপর এতটা জায়গা হবে না যে, কোনো একটা রথ সম্পূর্ণ উল্টো দিকে ঘুরে ছুটতে শুরু করবে। যে ফাঁদ পেতেছি আমি তা থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই কারো।

দুই আঙুল মুখের ভেতর পুরে তীক্ষ্ণ স্বরে শিস দিলাম আমি। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে এই শব্দের সাথে সাথে আক্রমণ করা হবে। অনেক অনুশীলন করে এই শিস দেওয়া আয়ত্ত করেছি আমি। কাছ থেকে শুনলে কানে তালা লেগে যায়, এত তীক্ষ্ণ শব্দ। কিন্তু এমনকি যুদ্ধের হট্টগোলের ভেতরেও অনেক দূর থেকে শোনা যায় এই শিস। এই শব্দেরই অপেক্ষা করছিল আমার লোকেরা। সাথে সাথে কাজ শুরু করে দিল তারা।

সেতুর অন্য প্রান্তে হাতুড়ি নিয়ে দুজনকে মোতায়েন রেখেছিলাম আমি। সেতুর দুই পাশে নিচু জায়গায় হামাগুড়ি দিয়ে বসে ছিল তারা। আমার শিসের শব্দ শুনেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলো লুকানোর জায়গা ছেড়ে, সামনে এগিয়ে এলো। দুজনের হাতেই রয়েছে ভারী পাথরের তৈরি বিশাল হাতুড়ি। প্রথম রথের দুই চাকার সবগুলো শিক চূর্ণ হয়ে গেল তাদের হাতুড়ির আঘাতে। ভেঙে পড়ল চাকাগুলো। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এমন আকস্মিক আক্রমণের মুখে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল চালক আর তার সঙ্গী। গাড়ি থেকে উড়ে দূরে গিয়ে পড়ল তারা। তাদের গাড়ির ভাঙা অংশে সম্পূর্ণ রুদ্ধ হয়ে গেল সেতু ছেড়ে নামার পথ, ফলে পেছনের বাকি রথগুলো একটার সাথে আরেকটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল সাথে সাথে।

এবার সেতুর ওপর পুরোদমে আক্রমণ চালালাম আমি। আমাদের যুদ্ধ হুংকারে আরো চমকে গেল রথের চালক আর তাদের ঘোড়াগুলো। এদিক-ওদিক পালানোর চেষ্টা করল তারা, ফলে আরো জট বেঁধে গেল রথের দড়িদড়ায়। একটা ঘোড়া পা ফসকে সেতুর ওপর থেকে পড়ে গেল নিচে। কিন্তু সম্পূর্ণ পড়তে পারল না, দড়িতে পঁাচ খেয়ে ঝুলে রইল মাঝপথে। ভয়ে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে আর সেইসাথে অন্য ঘোড়াগুলোকেও নিজের ওজনের কারণে টেনে নিচ্ছে নিচের দিকে। রথচালকরা সবাই পরস্পরের উদ্দেশ্যে চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। তাদের মাঝে সবচেয়ে জোরে চেঁচাচ্ছে ডুগ। সবাই প্রচণ্ড পরিমাণে বিভ্রান্ত, কেউ বুঝতে পারছে না কী করবে।

ওদিকে ইতোমধ্যে রানি তেহুতির দেওয়া উপহারটা বের করে ডান হাতে নিয়ে নিয়েছি আমি। খাপ থেকে বের করার সাথে সাথে সূর্যের আলোতে ঝলক দিয়ে উঠেছে তলোয়ারটার নীলচে ফলা। পৃথিবীতে আর কোনো ধাতুর তৈরি তলোয়ারের সাধ্য নেই তীক্ষ্ণতার দিক দিয়ে একে হারায়। এই তলোয়ার যেন প্রলয়ের আরেক নাম।

সেরেনা! হট্টগোল ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠলাম আমি। চরকির মতো ঘুরে তাকাল সেরেনা এবং দেখতে পেল আমাকে।

টাটা! চিৎকার করে উঠল ও। আমি জানতাম তুমি আসবে। মনে হলো যেন এই মুহূর্তে আরো বেড়ে গেল ওর সৌন্দর্য এবং বাড়িয়ে দিল আমার উৎসাহ। ধরো! বলেই তলোয়ারটা মাথার ওপর এক পাক ঘোরালাম আমি এবং ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে। ডান হাত সম্পূর্ণ বাড়িয়ে দিল সেরেনা, তারপর তলোয়ারটা মাথার ওপর আসতে শূন্যেই খপ করে ধরে ফেলল। এবার অন্য হাতটা রথের কিনারে রেখে এক লাফে বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। মনে হলো যেন ফুলের ওপর হালকা পায়ে এসে নামল কোনো ছোট্ট পাখি। নেমেই তীরবেগে ছুটতে শুরু করল ও।

ডুগ! ছুটতে ছুটতেই ডেকে উঠল সেরেনা। ওই কুৎসিত নামটাও যেন অদ্ভুত সুন্দরভাবে বেজে উঠল ওর কণ্ঠস্বরে। স্বাভাবিকভাবেই ওর দিকে ফিরে তাকাল ডুগ। হালকা পায়ে ছুটে তার কাছে পৌঁছে গেল সেরেনা, পাগুলো যেন মাটিকে স্পর্শই করছে না। ওর হাতে ধরা উজ্জ্বল ধাতব ঝিলিকটা দেখতে পেল ডুগ এবং বুঝতে পারল যে অনেক দেরি হয়ে গেছে, এখন আর ওর নিজের তলোয়ার বের করার সময় নেই। বুঝে নিল সাক্ষাৎ মৃত্যু ছুটে আসছে ওর দিকে। সাথে সাথে রথের ভেতর ঝুঁকে বসে আত্মরক্ষার চেষ্টা করল সে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও কাপুরুষতার পরিচয় দিয়ে গেল ব্যাটা। বাতাসে লাফিয়ে উঠল সেরেনা, তারপর শূন্যে থাকতেই তলোয়ারের ফলা নামিয়ে আনল রথের ভেতরের অংশে। দেখলাম নীলচে ফলাটা প্রায় অর্ধেক ঢুকে গেল ভুগের কালো আলখাল্লা ভেদ করে। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল ডুগ, মাথাটা ঝটকা দিয়ে উঠে গেল ওপরে। যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে আছে মুখ, ফলে এর আগে যা দেখেছিলাম তার চাইতেও কুৎসিত লাগছে তাকে দেখতে।

সাবলীল ভঙ্গিতে তার পিঠ থেকে তলোয়ারটা বের করে আনল সেরেনা। ফলার অর্ধেক অংশ লাল হয়ে গেছে ভুগের রক্তে। এবার তলোয়ারটা উল্টো দিকে আঘাত করার ভঙ্গিতে নিখুঁতভাবে ঘুরিয়ে ধরল ও। লাফিয়ে উঠে একটা চক্কর দিল সেরেনা, মনে হলো ওর হাতের তলোয়ারটা যেন পরিণত হয়েছে এক ফালি সূর্যের আলোতে।

লাফ দিয়ে ডুগের দেহের বন্ধন থেকে ছিন্ন হলো তার মাথা, গড়িয়ে পড়ল রথের ভেতরে। দীর্ঘ একটা মুহূর্তের জন্য মাথাহীন ধড়টা হাঁটু গেড়ে বসে রইল, তার পরেই ফিনকি দিয়ে উজ্জ্বল রক্ত বেরিয়ে এলো তার কাটা গলা থেকে। ধপ করে রথের ভেতর পড়ে গেল ডুগের মৃতদেহ।

এসো ছেলেরা! এবার আমার বাকি যোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে ডাক দিলাম আমি। সেরেনার শ্বাসরুদ্ধকর তলোয়ারবাজি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে সবাই। বাকি কুকুরগুলোর ব্যবস্থা করা যাক! অন্যান্য রথের আরোহীর দিকে ইঙ্গিত করে নির্দেশ দিলাম এবার।

না, টাইটা! প্রায় সাথে সাথেই চিৎকার করে আমাকে বাধা দিল সেরেনা। ছেড়ে দাও ওদের। ওরা সবাই ভালো লোক। ওদের কারণেই আমার ওপর নির্যাতন চালাতে গিয়েও পারেনি ডুগ।

রথের আরোহীদের মুখে এবার স্বস্তির ছায়া পড়তে দেখলাম আমি। ওরা জানে যে মৃত্যু ওদের কতটা কাছাকাছি চলে এসেছিল।

যত দিন বেঁচে থাকবে তার প্রতিটা দিন মহামান্যা রাজকুমারীকে ধন্যবাদ জানানো উচিত তোমাদের, ওদের উদ্দেশ্য করে ধমকে উঠলাম আমি। তবে ইচ্ছে করেই কথাটা বলার সময় মৃদু হাসি ফোঁটালাম ঠোঁটের কোনায়। তারপর হঠাৎ করেই আমাদের পেছন দিক থেকে একটা উচ্চকিত গলার চিৎকার ভেসে এলো।

সেরেনা! তুমি ছাড়া আর কেউ হতে পারো না! তোমার গলা শুনেই চিনতে পেরেছি আমি। যেখানেই থাকি না কেন তোমার কণ্ঠস্বর চিনতে কখনো ভুল হবে না আমার। মুহূর্তের মধ্যে নিজের অবস্থান ছেড়ে দৌড়ে সামনে এগিয়ে এলো যুবরাজ রামেসিস।

দুর্ধর্ষ তলোয়ারবাজ সেরেনা, একটু আগেই যে নিজের তলোয়ারের আঘাতে কুখ্যাত ডুগের মাথা ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে সেই এবার এমনভাবে চিৎকার করে উঠল যেন তাকে হঠাৎ গরম কয়লার ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কেউ। রামেসিস! রামেসিস! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি এখনো ল্যাসিডিমনেই আছো। ওহ, হাহোর আর হোরাসকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে তুমি আমাকে উদ্ধার করতে এত দূর ছুটে এসেছ!

দৌড়ে এসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল প্রেমিক-প্রেমিকা, এবং এমন অদম্য উৎসাহের সাথে তারা কাজটা করল যে ঝনাৎ করে বাড়ি খেল তাদের তলোয়ারের ফলা। খুব সম্ভব তাদের দাঁতও একইভাবে বাড়ি খেয়েছিল, যদিও সেটা বোঝা যায়নি। সেরেনাকে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে অবাক হলাম না আমি, তবে বেশ মেজাজ খারাপ হলো। রামেসিসের অবস্থাও খুব একটা ভালো মনে হলো না। ওদের দিক থেকে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি, তারপর দুজনকে নিজেদের সামলে ওঠার সময় দিয়ে আক্রমণের পরবর্তী পর্যায় শুরু করার জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করলাম বাকিদের।

*

ডুগের মৃতদেহটা স্রেফ সেতুর ওপর থেকে টেনে নিচের নালায় ফেলে দিয়ে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হলো। তবে তার মাথাটা রেখে দিলাম আমি, একটা ঘোড়ার খাবারের থলেতে ভরে রাখলাম। পরে দেখা যাবে কী করা যায় ওটা নিয়ে। তার পরনের কালো আলখাল্লা অবশ্য এখনই আমার কাজে লাগবে। কাপড়গুলো অবশ্য আমার হালকা-পাতলা শরীরের জন্য খুব বেশি ঢোলা হয়ে গেল। তবে কী আর করা, তাই ডুগেরই আরো কিছু বাড়তি কাপড় পরে কোনোমতে মানিয়ে নিলাম নিজেকে। কাপড়গুলোতে এখনো সেরেনার আঘাতের ফলে বের হওয়া রক্ত লেগে আছে। যে রথটার চাকা ভেঙেছে সেটাকে রেখে যাওয়া লাগল। বাকি তিনটি রথে গাদাগাদি করে উঠলাম আমরা সবাই, তারপর রওনা দিলাম দুঃখ-দুর্দশার ফটক নামের সেই কারাগারের দিকে। আগের আরোহীদের সাথে এখন যোগ হয়েছি আমি, রামেসিস এবং ওয়েনেগের তেরো যোদ্ধা। সৌভাগ্যক্রমে এখান থেকে আমাদের গন্তব্য খুব বেশি দূরে নয়। তা ছাড়া পথ কোথাও বেশি খারাপ হয়ে এলে অনেকেই নেমে রথ ঠেলতে হাত লাগাল।

সূর্য যখন পশ্চিম দিগন্ত স্পর্শ করেছে সেই সময় কারাগারের সামনে এসে পৌঁছলাম আমরা। সবচেয়ে সামনের রথটার ওপর বুকের ওপর দুই হাত ভাঁজ করে মহা আরামে বসে আছি আমি, মাথার ওপর টেনে দিয়েছি কালো কাপড়। আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে সেরেনা। পরনে সেই বন্দির পোশাক, হাতগুলো ইচ্ছে করেই সবাইকে দেখিয়ে সামনে বেঁধে রাখা। অভিনেত্রী হিসেবে ওর জুড়ি মেলা ভার। এই মুহূর্তে ওকে দেখে মনে হচ্ছে নিতান্ত অসহায়, হতাশ একটা মানুষ। তবে ইচ্ছে করলে ঝকঝকে সাদা দাঁত দিয়ে একটা টান মেরেই হাতের ফস্কা গেরো খুলে ফেলতে পারবে ও। তার ওপর ওর পায়ের কাছে কিছু খড় দিয়ে ঢেকে রাখা রয়েছে নীলচে সেই তলোয়ারটা। রামেসিস আমাদের দুজনের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তলোয়ার খাপে পুরে রেখেছে সে, চেহারা ঢেকে রেখেছে একটু আগে সেরেনার বদৌলতে বেঁচে যাওয়া প্রহরীদের একজনের শিরস্ত্রাণের সাহায্যে। ফারাও টামোসের অন্যতম প্রিয় পুত্র হিসেবে তার চেহারা মিশরের প্রায় সবাই খুব ভালোভাবেই চেনে। এই মুহূর্তে তাই সবার সামনে মুখ দেখানো উচিত হবে না ওর।

সূর্যাস্তের সময়টাকে কারাগারের ফটকে পৌঁছানোর উপযুক্ত সময় হিসেবে নির্বাচন করেছি আমি, কারণ ওই সময়েই দৃষ্টিসীমা সবচেয়ে কম থাকে। তবে আমরা পৌঁছনোর সাথে সাথেই অবশ্য খুলল না দরজা। ভেতরে যেসব প্রহরীরা রয়েছে তারা বেশির ভাগই সদ্য মৃত ডুগের ভাই, ছেলে অথবা আত্মীয়স্বজন। সকালে যারা বেরিয়ে গিয়েছিল তাদের রথ এবং লোকসংখ্যার সাথে, এখন যারা ফিরে এসেছে তাদের সংখ্যায় মিল নেই দেখে নানা রকম প্রশ্ন ছুড়ল তারা। আমাদের দলের কয়েকজন তাদের বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল যে, ফেরার পথে খাদে পড়ে একটা রথ হারিয়েছে তারা এবং কয়েকজন মারা পড়েছে তাতে। এ ছাড়া সম্প্রতি যে কয়েদিকে এই কারাগারে আনা হয়েছে তার কারণে কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো বাড়াতে চেয়েছেন ফারাও উটেরিক, এবং সে কারণেই বাড়তি লোক পাঠিয়েছেন তিনি।

ইচ্ছে করেই অবশ্য এই হইচই আর বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি আমি। কারণ আমি চাই যত বেশি সম্ভব প্রহরী এবং কারাগার কর্মচারী এসে জড়ো হোক প্রবেশমুখে। তাতে করে একবারেই ওদের সবার ব্যবস্থা করে ফেলতে পারব আমরা, কারাগারের ভেতরে ঢুকে এক এক করে খুঁজে খুঁজে মারতে হবে না। অজস্র অলিগলি, উঠান আর কামরা রয়েছে এই কারাগারের ভেতরে।

যখন মনে হলো যে আমার এই বুদ্ধিতে কাজ হয়েছে, কমপক্ষে ত্রিশজনের মতো প্রহরী এসে জড়ো হয়েছে আমাদের সামনে উঠিয়ে রাখা টানা সেতুর ওপরে তখন রথের ওপর উঠে দাঁড়ালাম আমি। তারপর ভুগের নিখুঁত অনুকরণে ফেটে পড়লাম তীব্র রাগে। কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকায় আমার মুখ দেখতে পেল না কেউ; কিন্তু দেয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে অকথ্য ভাষায় কুৎসিত সব গালিগালাজ ঝাড়তে লাগলাম আমি। অনেকের নামও আমার জানা আছে, ফলে আরো বেশি বিশ্বাসযোগ্য হলো আমার অভিনয়। হবে না-ই বা কেন, স্বয়ং ভুগের কাছ থেকেই এগুলো শিখেছি আমি। মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় যে ইচ্ছে করলে দারুণ অভিনেতাও হওয়া সম্ভব ছিল আমার পক্ষে। এবং এবারও সেই ধারণা সত্যি প্রমাণিত হলো। ডুগের আত্মীয়দের মাঝে কেউ একটুও সন্দেহ করল না যে তাদের সাথে যেই লোকটা কথা বলছে সে ডুগ ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে।

শেষ পর্যন্ত তাদের মাঝে একজন সেই গৎ বাঁধা কথাগুলো উচ্চারণ করল: তাহলে নিজ দায়িত্বে প্রবেশ করো। কিন্তু জেনে রেখো ফারাও এবং মিশরের সকল শত্ৰু এই দেয়ালের ভেতরে প্রবেশ করার পর চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায়। বাকিরা এবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো, তাদের প্রিয় আত্মীয়কে স্বাগত জানানোর জন্য ভিড় জমাল প্রাঙ্গণের ওপরে।

এদের মাঝে অস্ত্র রয়েছে কেবল অর্ধেকের কাছে। বাকিরা অস্ত্র নিয়ে আসার প্রয়োজন বোধ করেনি, কারণ তাতে দেরি হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বন্দিদের নিয়ে মজা করার সুযোগ হারাতে হতো তাদের। উটেরিক টুরোর শাসনে পুরো দেশে যে অনিয়মের চূড়ান্ত চলছে, তার ছোট্ট একটা উদাহরণ এই কারাগারের বিশৃঙ্খলা।

ভুগের বড় ভাই গ্যাষিওকে চিনতে পারলাম আমি। আমাকে দেখেই স্বাগত জানানোর জন্য দ্রুত সামনে এগিয়ে এলো সে। বাকিদের তুলনায় অবশ্য এ অনেকটা আলাদা। দারুণ ধূর্ত আর চালাক একজন যোদ্ধা, সেইসাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে অত্যন্ত বিপজ্জনক। এমনকি নিজের ভাইয়ের চাইতেও ভয়ানক সে। বুঝতে পারছি যে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে এই লোক যদি সামান্যতম ধারণাও পেয়ে যায় তাহলে মুহূর্তের মধ্যে মরণপণ লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তে হবে আমাদের। রথ থেকে নেমে পড়লাম আমি, তারপর তার ভাইয়ের অনুকরণে হেলেদুলে সামনে এগিয়ে গেলাম। আমার তলোয়ার এখনো খাপেই পোরা রয়েছে; কিন্তু ছোরাটা বের করে বাম হাতে রেখেছি। আলখাল্লার ভাঁজে ঢাকা রয়েছে সেটা। কাছাকাছি আসতেই গ্যাম্বিওর সামনে বাড়িয়ে দেওয়া ডান হাতটা শক্ত মুঠোয় ধরে ফেললাম আমি, এক ঝাঁকি দিয়ে ওর ভারসাম্য নড়িয়ে দিলাম। এবার আমাকে চিনতে পারল সে, চোখের তারায় ফুটে উঠল ভয়। বুঝতে পারল, সব শেষ। পাঁজরের নিচ দিয়ে ছুরির মাথাটা ঢুকিয়ে দিলাম আমি, ফুটো করে ফেললাম হৃৎপিণ্ড। ছুরিটা জায়গামতো ঢুকিয়ে রেখেই বাম হাতে তাকে জড়িয়ে ধরলাম, যাতে নড়াচড়া করতে না পারে। চারপাশের হইচইয়ে ঢাকা পড়ে গেল তার মরণ-আর্তনাদ। লোকটার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে তার আত্মাকে সেই সব নিরপরাধ মানুষের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম মনে মনে, যারা এই দেয়ালের মাঝে এদের হাতে নির্মম নির্যাতন ভোগ করে মৃত্যুবরণ করেছে।

কী হচ্ছে সেটা বুঝতে বুঝতে কারাগারের অন্য প্রহরীদের অনেক বেশি সময় লেগে গেল। প্রথম রথের চারপাশে ভিড় জমিয়েছে তারা, সেরেনাকে নিয়ে বিদ্রূপ করছে নানা রকম। কেউ কেউ চাইছে ওকে টেনে রথের ওপর থেকে নামিয়ে আনতে। সুন্দরী নারী কয়েদি পেয়ে তার ওপরই স্থির হয়ে আছে সবার মনোযোগ। বুঝতে পারলাম আরো একবার সেরেনাকে নগ্ন করে ফেলার জন্য তর সইছে না কারো। এবার পরের দুই রথে করে যারা এসেছে তারা লাফ দিয়ে মাটিতে নামল, তারপর সামনে এগিয়ে এলো। একই সঙ্গে নিজেদের তলোয়ার বের করে এনেছে তারা। যুদ্ধ হুংকারের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে সতর্ক হওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়ে নীরবে কাজে নেমে পড়ল সবাই। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কারাগারের প্রহরীদের মাঝে অর্ধেকেরও বেশি মারা পড়ল। শেষ পর্যন্ত যারা বাকি রইল তারা অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগল। কিন্তু এর মাধ্যমে অনেক বড় একটা ভুল করল তারা। কারণ তাদেরকে পা ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো অগ্নিকুণ্ডের মাঝে। সারা রাত ধরে জ্বলল সেই আগুন।

*

কারাগারের দখল নিজেদের হাতে নিয়ে আসার পর আমাদের প্রথম কাজ হলো মাটির নিচের বন্দিশালায় যে সমস্ত বন্দি রয়েছে তাদের মুক্ত করে ওপরে নিয়ে আসা। তাদের সংখ্যা হবে এক শ বিশেরও বেশি, যাদের মাঝে প্রায় ত্রিশজনের মতো নারী কয়েদিও রয়েছে। তবে সঠিক সংখ্যাটা গুনে নিতে পারলাম না আমি আর সেরেনা, কারণ ওপরে নিয়ে আসার প্রায় সাথে সাথেই মারা যেতে লাগল অনেকেই। বেশির ভাগই মারা গেল প্রলম্বিত ক্ষুধা এবং তৃষ্ণার কারণে। কিন্তু এর সাথে অন্যান্য কারণ হিসেবে যে ব্যাপারগুলো কাজ করল সেগুলো হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে চাবুকপেটা করা, এক বা উভয় চোখই উপড়ে নেওয়া, নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে ফেলা, জ্যান্ত চামড়া ছিলে নেওয়া, পায়ুপথে গরম ধাতব দণ্ড ঢুকিয়ে দেওয়া এবং সেইসাথে ডুগ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গ কর্তৃক উদ্ভাবিত আরো অন্যান্য অত্যাচারের পদ্ধতি। রামেসিস এবং আমি মিশরে ফিরে এসেছিলাম শুধু একটা কারণে। সেটা হচ্ছে

উটেরিক সেরেনাকে কোথায় আটকে রেখেছে তার হদিস বের করা, সেইসাথে যদি সম্ভব হয় তাহলে সেরেনার মনে কিছু শক্তি এবং আশার সঞ্চার করা, যাতে এই ভয়াবহ বিপদেও মনোবল ধরে রাখতে পারে ও। কিন্তু কখনো আশা করিনি যে স্রেফ আমাদের দুজনের চেষ্টাতেই উটেরিকের কবল থেকে ওকে উদ্ধার করা যাবে। কিন্তু এখন যেহেতু সেই অসম্ভব ঘটনাটা ঘটেই গেছে সুতরাং এই মুহূর্তে আমার প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল সেরেনাকে আফ্রিকা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া এবং ল্যাসিডিমনে ওর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। আমি নিশ্চিত যে রামেসিসকে যদি এই ব্যাপারে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে সেও আমার সাথে সম্পূর্ণ একমত হবে। কিন্তু রাজকুমারী সেরেনার মতামত বা ইচ্ছা জানার কোনো চেষ্টাই করিনি আমরা।

আমাদের দুজনকে কয়েক ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ দিল সেরেনা, যাতে একটু বিশ্রাম নিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারি আমরা। তার পরেই আমাদের ঘুম থেকে তুলে ডেকে পাঠাল এক যুদ্ধকালীন মন্ত্রণা সভায়। প্রথমে আমার ধারণা হলো ও নিশ্চয়ই বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে দ্রুত সহজ এবং নিরাপদ রাস্তাটা খুঁজে বের করার জন্যই এই সভার আয়োজন করেছে।

ভোরবেলা আমরা চারজন কারাগারের প্রাচীরের ওপর জড়ো হলাম। চারজন বলছি কারণ, সেরেনা আমাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য ওয়েনেগকেও ডেকে এনেছে।

আমরা আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জন করেছি, প্রথমে সেরেনাই কথা শুরু করল। যেটা হচ্ছে একটি নিরাপদ ঘাঁটি তৈরি করা, যেখান থেকে সব কাজ পরিচালনা করা যায়। এবং এর জন্য তোমাদের তিনজনকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে চাই আমি। অবাক হয়ে রামেসিস এবং ওয়েনেগের দিকে তাকালাম আমি। দেখলাম ওরাও আমার মতো একই রকম বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। এখন আমাদের দ্বিতীয় দায়িত্ব হচ্ছে স্পার্টায় অবস্থানরত আমার বাবার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা, বলে চলল সেরেনা।

আমার মনে হয় তুমি আসলে বলতে চাইছ যে আমাদের দ্বিতীয় দায়িত্ব হচ্ছে তোমাকে মিশর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া, তারপর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ল্যাসিডিমনে তোমার বাবার কাছে তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়া, ওকে বাধা দিয়ে বলে উঠলাম আমি। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সেরেনা।

দুঃখিত প্রিয় টাটা। কিন্তু তুমি কীসের কথা বলছ আমি বুঝতে পারছি না। আজ আমরা সত্যিই এক অসাধারণ বিজয় অর্জন করেছি। শুধু অসাধারণ বললে কম হয়ে যায়। বলা যায় অলৌকিক এক বিজয় ধরা দিয়েছে তোমাদের হাতে। শত্রু-অধ্যুষিত এলাকার ঠিক মাঝখানে একটা ঘাঁটি তৈরি করে নিতে পেরেছ তোমরা। এখানে আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ।

নিরাপদ ঠিক অন্তত যতক্ষণ না আমাদের এই অবস্থানের খবর লুক্সরে উটেরিক টুয়োর কানে পৌঁছাচ্ছে। দূরে দিগন্তের গায়ে ভেসে থাকা সোনালি প্রাসাদের ছায়াটার দিকে ইঙ্গিত করলাম আমি। এখান থেকে খুব বেশি পাঁচ কি ছয়… বড়জোর দশ লিগ দূরে হবে প্রাসাদটা।

বড় বড় চোখে নিষ্পাপ দৃষ্টি এনে আমার দিকে তাকাল সেরেনা। জানতে চাইল, কে এই খবর নিয়ে যাবে তার কাছে?

কারাগারের প্রহরীদের কেউ না কেউ– বলতে শুরু করেও থেমে গেলাম আমি। গতকাল বিকেলেই সকল প্রহরীকে হয় হত্যা করা হয়েছে না হয় আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। অগত্যা নিজেকে শুধরে নিলাম আমি। বললাম, মানে উটেরিকের কোনো অনুচর যখন এখানে রসদ বা লুক্সর থেকে কয়েদি নিয়ে আসবে তাদের কথা বলছি।

দুঃখ-দুর্দশার ফটকের দরজার ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না, আমাকে মনে করিয়ে দিল সেরেনা। সকল রসদ এবং নতুন কয়েদিদের সামনের উঠানে নামিয়ে দিয়ে যাওয়া হয়। এখন থেকে ডুগের ছদ্মবেশে তুমিই ওদের স্বাগত জানানোর দায়িত্ব পালন করবে। আমরা সবাই দেখেছি এই ভূমিকায় তুমি অদ্বিতীয়। তার পরই কণ্ঠস্বর বদল করে বলে উঠল, জেনে রেখো, ফারাও এবং মিশরের সকল শত্ৰু এই দেয়ালের ভেতর প্রবেশ করার সাথে সাথ চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায়!

যদিও সেরেনা দারুণভাবে নকল করল কথাটা, তবু ওর কথায় রাজি না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। এবার পরবর্তী প্রশ্নটা ছুড়লাম ওর দিকে। উটেরিক যদি এর পরে আবারও তোমাকে লুক্সরে ডেকে পাঠায়? তখনো কি আমাকে ভুগের ভূমিকায় অভিনয় করতে বলো তুমি? তাকে কী বলব আমি?

উটেরিক আমার কাছে শপথ করেছে যে আর কখনো আমাকে চোখের সামনে দেখতে চায় না সে। সত্যি কথা বলতে, বুদ্ধির ছিটেফোঁটাও নেই তার মাথায়, খুব সহজেই তাকে বোকা বানানো যায়। প্রতিবার যখন তাকে নিয়ে আমি কোনো ঠাট্টা করছিলাম, তার পোষা ভাড়গুলো হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। একবার তো রেগেমেগে ওখানেই আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে, মরে গেলে আমার কোনো মূল্য থাকবে না তার কাছে। শেষ পর্যন্ত রাগে-দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড় হয়েছিল তার, দেখে এমনকি আমিও দুঃখ বোধ করতে শুরু করেছিলাম। সব দেবতাকে সাক্ষী রেখে শপথ করেছে সে, বলেছে জীবনে আর কোনো দিন আমাকে দেখতে চায় না। তারপর দুপদাপ করে বেরিয়ে গেছে দরবার থেকে।

খুশি সামলে রাখা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে, হো হো করে হেসে উঠলাম সেরেনার বর্ণনা শুনে। তবে এর পরও শেষ একটা চেষ্টা করে দেখলাম। স্থানীয় কৃষকদের ব্যাপারে কী করবে? যেসব রাখাল এখানে ভেড়া চরাতে আসে তারা? জানি যে এই প্রশ্নে কোনো কাজ হবে না, তবু একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী?

পা দিয়ে মেঝেতে বাড়ি মারল সেরেনা। এই কারাগারের দেয়ালগুলো অনেক উঁচু, মনে করিয়ে দিল ও। কোনো রাখালের পক্ষেই এর ভেতরে কী চলছে তা দেখা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত এই ভয়ানক জায়গার আশপাশে কেবল একজন রাখালই পা রাখার দুঃসাহস দেখিয়েছে। আর তার নাম হচ্ছে। টাইটা। এমনকি অপরাজেয় ফারাও উটেরিক টুরোও এখানে আসার সাহস পাবে না। সে জন্যই আমাকে নিয়ে যেতে নিজের চ্যালাদের পাঠিয়েছিল সে। তোমার বাবা-মা? তোমাকে ফিরে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে রয়েছে তারা। সেরেনাকে ল্যাসিডিমনে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার হলে সব কিছু করতে রাজি আছি আমি।

আমার বাবা-মা আমাকে তখনই দেখতে পাবে যখন তারা মিশরে আসবে, শক্ত গলায় জবাব দিল সেরেনা।

কেন? আরো একবার সেরেনার জবাব শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি।

কারণ মিশরই এখন আমার বাড়ি। আমার ভবিষ্যৎ স্বামী এই মিশরের ফারাও হতে যাচ্ছে এবং আমি হতে যাচ্ছি তার রানি। এমনকি আমার উপাধিও ঠিক করে রেখেছি আমি। রানি ক্লিওপেট্রা বলে আমাকে জানবে মানুষ। আর এই নামের অর্থ নিশ্চয়ই তুমি জানো টাইটা? পিতার গর্ব। আশা করি এই খবর জানার পর সন্তুষ্ট হবে আমার বাবা।

আমিও! হেসে বলল রামেসিস।

ফাঁদে পড়ার পর তা থেকে বের হওয়ার কোনো পথ যখন না থাকে তখন তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারি আমি। তাই এবার এক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়লাম সেরেনার সামনে। বললাম, রানি ক্লিওপেট্রার জয় হোক!

তাহলে এবার একটু কাজের কথায় আসা যাক? অনেক কাজ পড়ে আছে। আমাদের, মিষ্টি গলায় বলল সেরেনা। তারপর ওয়েনেগের দিকে ফিরল। তোমার মদের দোকানে কতগুলো পায়রা আছে? আর ওগুলো উটেরিকের নাকের নিচ থেকে সরিয়ে এখানে এই দুঃখ-দুর্দশার কারাগারে আনতে…হঠাৎ করে থেমে গেল সেরেনা, কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল। বোঝা গেল এই জায়গার জন্য উটেরিক যে নাম ঠিক করেছে সেটা তার পছন্দ হচ্ছে না। …আনন্দের বাগান! হ্যাঁ এখন থেকে এটাই হবে এ জায়গার নাম! বলে উঠল ও। আজ থেকে আমাদের এই ঘাটির নাম হবে আনন্দের বাগান। আর সবার আগে আমি যে কাজটা করতে চাই সেটা হচ্ছে প্রবেশপথের ওখানে যে খুলিগুলো আছে সেগুলো সব সরিয়ে ফেলতে। ওগুলোকে যথাযথ উপায়ে সম্মানের সাথে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করব আমরা।

তবে একটা খুলি আমি প্রবেশমুখের দরজায় রেখে দিতে চাই মহামান্যা রানি, প্রতিবাদ জানালাম আমি। বাকি খুলিগুলোকে তুমি কবর দিতে পারো, আমার কোনো আপত্তি নেই।

কোন খুলির কথা বলছ তুমি? সন্দেহভরা গলায় প্রশ্ন করল সেরেনা।

কুখ্যাত ডুগের খুলি, বললাম আমি। হাসিতে ফেটে পড়ল ও।

এমন বুদ্ধি শুধু তোমার মাথাতেই আসা সম্ভব টাইটা। তবে সত্যিই দারুণ একটা প্রস্তাব দিয়েছ তুমি।

*

আরো একবার শুঁড়িখানার মালিকের ভূমিকায় ফিরে গেল ওয়েনেগ। সেদিন সন্ধ্যাতেই লুক্সরের প্রধান দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল সে। এমনিতে ডুগ তার নিয়মিত খদ্দের ছিল, তাই পরদিন সকালে যখন সে পাঁচটা গাধার পিঠে মদের বোতলের বস্তা চাপিয়ে প্রধান দরজা দিয়ে বের হলো তখন কেউ সেটা আমলে নিল না। তবে প্রতিটি বস্তার নিচেই রইল একটা করে ঝুড়ি, আর তাতে বারো-চৌদ্দটা করে পায়রা। প্রতিটি পায়রার চোখে ঠুলি পরানো হয়েছে, যাতে শহরের দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় কেউ বাক-বাকুম করে ডেকে না বসে। তাহলে প্রহরীদের চোখে ধরা পড়ে যাবে সব।

ওয়েনেগ যখন এই কাজে ব্যস্ত তখন আমি আর সেরেনা মিলে রাজা হুরোতাসের কাছে পাঠানোর জন্য একটা চিঠি লিখে ফেললাম। তবে একটু বেশিই বড় হয়ে গেল চিঠিটা, যা একটি পাখির পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তাই ওয়েনেগ ফিরে আসার পর চিঠিটাকে ভাগ ভাগ করে পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম আমরা। একটা চিঠি সম্পূর্ণ বহন করতে পাঁচটা পাখির প্রয়োজন হলো।

চিঠিতে লেখা হলো রামেসিস এবং আমার মাধ্যমে উটেরিক এবং ডুগের হাত থেকে সেরেনার উদ্ধার পাওয়ার খবর। স্বাভাবিকভাবেই হুরোতাসের কাছ থেকে কোনো জবাব পেলাম না আমরা, কারণ লুক্সর বা আনন্দের বাগানে জন্ম নিয়েছে এমন কোনো পায়রা নেই তার কাছে। ফলে সেরেনার উদ্ধার পাওয়ার খবরে হুরোতাসের দুর্গে কেমন আনন্দের ফোয়ারা বইছে তা কেবল কল্পনার চোখে দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো আমাদের।

কয়েক দিন পর পরই পায়রা পাঠাতে লাগলাম আমরা। পরের দিকে অবশ্য আমাদের চিঠিগুলো আরো বেশি সংক্ষিপ্ত হলো এবং উটেরিকের সেনাবাহিনীর বর্তমান অবস্থা আর তাদের যুদ্ধজাহাজ রথ ও সেনাবাহিনীর সংখ্যা এবং অন্যান্য খবরই বেশি থাকল তাতে।

ল্যাসিডিমনের দুর্গ এবং আনন্দের বাগানের মাঝে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার জন্য ওয়েনেগের কাছে আরো সুবিধাজনক একটা ব্যবস্থার প্রস্তাব করলাম আমি। আমার প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতিবার মদের দোকান থেকে এখানে আসার সময় কিছু কিছু করে পুরুষ এবং মেয়ে পায়রা নিয়ে আসতে লাগল সে, যেগুলো বাচ্চা ফোঁটানোর মতো যথেষ্ট বয়সে পৌঁছে গেছে। রাজকুমারী সেরেনাকে জানালাম যে আমরা আনন্দের বাগানে পায়রা উৎপাদন করতে চাই। তারপর সেগুলো স্থল এবং জলপথে পাঠিয়ে দেওয়া হবে ল্যাসিডিমনে, যাতে সেখান থেকে ছেড়ে দেওয়া হলে পাখিগুলো সরাসরি তাদের যেখানে জন্ম হয়েছিল সেখানে ফিরে আসতে পারে। তখন সেরেনার বাবা রাজা হুরোতাসের কাছ থেকে চিঠিও বয়ে আনতে পারবে তারা।

পায়রা হচ্ছে সত্যিকারের আশ্চর্য এক পাখি, সেরেনাকে বুঝিয়ে বলল ওয়েনেগ। ওদের অনেকগুলো গুণের মাঝে একটা হচ্ছে ওরা দারুণ একনিষ্ঠ।

একটু বিভ্রান্ত দেখাল সেরেনাকে, বুঝতে পারেনি কথাটা। এবার ওকে বুঝিয়ে বললাম আমি। সারা জীবন ধরে পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে ওরা, এবং পুরুষ পাখি কখনো নিজের সঙ্গিনী ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে পাখির দিকে তাকায় না পর্যন্ত।

তাই নাকি? ইস, কী সুন্দর… বলে রামেসিসের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ও। সত্যিই, কী সুন্দর! সবুজ চোখে দুষ্টুমির হাসি নিয়ে সেরেনার দিকে তাকিয়ে সজোরে ঘাড় নাড়ল রামেসিস।

এবার ওয়েনেগ আর আমি মিলে প্রথম পুরুষ পায়রাটাকে ছেড়ে দিলাম পায়রার খোপের ভেতর। ইতোমধ্যে সেখানে ছয়টা মেয়ে পায়রা রাখা হয়েছে। পুরুষ পাখিটাকে দেখেই বাকিদের মাঝে দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি হলো, ভয় পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াতে লাগল সবাই। সঙ্গিনী বেছে নিতে কিছুটা সময় নিল পুরুষ পায়রাটা। তবে যখন দেখলাম যে তার পছন্দ করা শেষ তখন ওয়েনেগের সহায়তায় বাকি পাঁচটা মেয়ে পায়রাকে বের করে নিলাম খোপ থেকে। পুরুষ পায়রাটাকে ছেড়ে দিলাম তার সঙ্গিনীর মন ভজাতে।

এবার পুরুষ পাখিটার দিকে খেয়াল করে দেখো- বলে চলল ওয়েনেগ।

এক মিনিট দাঁড়াও ওয়েনেগ, তাকে থামিয়ে দিল সেরেনা। এভাবে পুরুষ পাখি পুরুষ পাখি বলে ডাকতে পারো না তুমি। ও তো নিছক কোনো পাখি নয়, তাই না? একটা নাম থাকা উচিত ওর।

অবশ্যই অবশ্যই। ঠিকই বলেছেন আপনি মহামান্যা রানি। আগেই কথাটা চিন্তা করা উচিত ছিল আমার। তা ওকে কী নামে ডাকব আমরা? প্রশ্ন করল ওয়েনেগ। ডানাওয়ালা প্রভু বলে ডাকলে কেমন হয়?

ধ্যাত! বলে এক মুহূর্ত চিন্তা করল সেরেনা। ওর হাবভাব দেখেছ? দেখে মনে হয় না নিজেকে দারুণ এক প্রেমিক বলে ভাবে ও? তা ছাড়া আমরা সবাই চাই যে ও অনেকগুলো বাচ্চার জন্ম দিক, তাই না? এদিক দিয়ে চিন্তা করলে ওর জন্য একটা নামই সঠিক হয়। হুই চাচা! ওকে হুই চাচা বলে ডাকব আমরা!

হাসিতে ফেটে পড়লাম আমরা। নিজেদের সামলে নিতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেল আমাদের। শেষে ওয়েনেগই আবার কাজের কথায় ফিরে এলো। দেখেছ কীভাবে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও? সঙ্গিনীকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। মেয়ে পাখিটা যে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। পালাচ্ছে ঠিকই; কিন্তু বেশি দূরে যাচ্ছে না বা বেশি জোরেও দৌড়াচ্ছে না, মনে করিয়ে দিলাম আমি।

তা তো অবশ্যই, বলল সেরেনা। ও একজন মেয়ে এবং ভালোই বুদ্ধি রাখে মাথায়।

এবার হুই চাচা তার লেজের পালকগুলো ছড়িয়ে দিয়ে প্রেমিকার পেছনে লেগেছে। মেয়ে পাখিটা ঠিক ওর সামনে সামনেই থাকছে, বেশি দূরে সরছে না কিন্তু।

ঠিক বলেছ! দারুণ চালাক একটা পাখি ও! হাততালি দিয়ে উঠল সেরেনা।

এত সহজে ধরা দিতে চায় না প্রেমিকের কাছে।

শেষ পর্যন্ত প্রেমিকের দিকে ফিরে তাকাল ও। এবার প্রেমিকার জন্য মুখ হাঁ করে দিচ্ছে হুই চাচা, বর্ণনা দেওয়া চালিয়ে গেলাম আমি।

এই কাজ কেন করছে সে? জানতে চাইল সেরেনা।

একে বলা হয় চিরন্তন চুম্বন। মেয়ে পাখিটাকে নিজের জীবনসঙ্গিনী হওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সে। এবার ওয়েনেগের কাছ থেকে পায়রার আচরণ ব্যাখ্যার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলাম আমি, কারণ ওদের সম্পর্কে আমি ওয়েনেগের চাইতে অনেক বেশি জানি।

দেখিস এত সহজে বোকা বনিস না, মেয়ে পাখিটাকে সাবধান করে দিতে বলে উঠল সেরেনা। মা কী বলেছে মনে রাখিস। কোনো পুরুষকে কখনো বিশ্বাস করতে নেই। কিন্তু মেয়ে পাখিটা ওর কথায় কোনো কর্ণপাত না করে নিজের পুরো মাথাটা পুরুষ পাখির গলা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। কয়েক মুহূর্ত পর মাথাটা বের করে আনল সে, তারপর পেট মাটিতে রেখে বসে পড়ল।

কপালে তোর খারাবি আছে রে! মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলল সেরেনা। পুরুষ পাখিটা এবার মেয়ে পাখির পিঠের ওপর চড়ে বসল, তারপর কয়েকবার ডানা ঝাঁপটে লেজের পালকগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ঢেকে নিল নিজেদের পেছনের অংশ। অবশ্য নাও থাকতে পারে, বলল সেরেনা, তারপর আস্তে করে হাত বাড়িয়ে দিল রামেসিসের হাতের দিকে।

ওদের ভালোবাসার এই বহিঃপ্রকাশ দেখেও না দেখার ভান করলাম আমি, ব্যাখ্যা দেওয়া চালিয়ে গেলাম তার বদলে: আশা করা যায় যে দশ দিন পরেই মেয়ে পাখিটা দুই কি তিনটে ডিম পাড়বে। সেগুলো ফুটে বাচ্চা বের হতে লাগবে আরো আঠারো দিন। আর দেড় মাসের মাঝেই বড় হয়ে উঠবে বাচ্চাগুলো। তারপর যেখানেই ওদের পাঠানো হোক না কেন ঠিকই পথ চিনে এই আনন্দের বাগানে ফিরে আসতে পারবে।

সে তো অনেক দিনের ব্যাপার, আনমনে বলে উঠল সেরেনা। তোমার কোনো ধারণাই নেই টাইটা, বাবা-মায়ের কাছ থেকে কিছু খবর পাওয়ার জন্য কত ব্যাকুল হয়ে আছি আমি। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ও। তবে তার পরেই সামলে নিল নিজেকে। তবে এখন আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে পূর্ণবয়স্ক পাখিগুলোকে ল্যাসিডিমনে পাঠানোর একটা উপায় বের করা, যাতে আমার প্রিয় মানুষগুলোর কাছ থেকে চিঠি নিয়ে ফিরে আসতে পারে ওরা…

ওর কথার জবাবে আমি কিছু বলার আগেই হঠাৎ কারাগারের প্রাচীরের ওপর থেকে ট্রাম্পেটের জোরালো আওয়াজ ভেসে এলো। প্রহরীরা সাবধান করে দিচ্ছে সবাইকে। আলোচনার ইতি টানলাম আমি। ওই শব্দের অর্থ হচ্ছে লুক্সর থেকে কেউ আসছে এদিকে। যদি কোনো ঝামেলা হয়, তোমরা সবাই জানো যে কার ওপর কী দায়িত্ব আছে। এবার আমাকে ভুগের ছদ্মবেশ নিতে হয়, বলে দ্রুত পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি।

*

বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে আছি আমি। উটেরিকের সাথে সেরেনার শেষবার দেখা হওয়ার পর এই প্রথম কোনো আগন্তুককে কারাগারের আশপাশে দেখা গেল। উটেরিক হয়তো তার সিদ্ধান্ত বদলেছে, এখন আবারও সেরেনার ওপর নির্যাতন চালানোর জন্য তাকে প্রাসাদে নিয়ে যেতে লোক পাঠিয়েছে–এই চিন্তাটা জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে রাখলাম। কোথাও না থেমে এক দৌড়ে সামনের উঠানে চলে এলাম আমি, তারপর দম নেওয়ার জন্য না থেমেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম প্রাচীরের ওপর নজরদারির জন্য তৈরি করা স্তম্ভে। সাথে সাথেই দূরে রথের চাকায় ওড়া ধুলোর মেঘ চোখে পড়ল আমার। লুক্সর থেকে বেরিয়ে আসা পথটা ধরে এদিকেই আসছে ওরা।

কতগুলো রথ ওখানে? প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলাম আমি। কাঁধ ঝাঁকাল সে।

বেশ কয়েকটা আছে, কমপক্ষে দশ-বারোটা তো হবেই। অনেক দ্রুত আসছে ওরা।

অনুভব করলাম, স্বস্তির একটা স্রোত বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে। স্রেফ সেরেনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যেতে চাইলে এতগুলো রথ পাঠাত না উটেরিক। ওদের কাউকে চিনতে পেরেছ? প্রশ্ন করলাম প্রহরীর উদ্দেশ্যে।

না, এখনো অনেক দূরে রয়েছে ওরা। তবে খুব সম্ভব নতুন কয়েদি এবং তাদের প্রহরীরাই আসছে। আমার মতামতের সাথে মিলে গেল তার মন্তব্য।

বরাবর যেটা হয়ে এসেছে, প্রবেশপথের মুখে আটকে দেবে ওদের। আমি গিয়ে পোশাক বদলে আসছি।

সব কাজ শেষ করে আমি যখন ফিরে এসে টানা সেতুর মাথায় চড়লাম, দেখলাম প্রধান দরজার সামনে ধুলো মাখা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এগারোটা যুদ্ধের রথ। প্রতিটি রথেই বেশ কয়েকজন যাত্রী রয়েছে, যাদের বেশির ভাগকেই বেঁধে রাখা হয়েছে শিকল দিয়ে।

কারা তোমরা? কে পাঠিয়েছে তোমাদের? কী চাও এখানে? ভুগের কণ্ঠস্বর নকল করে দেয়ালের ওপর থেকে তাদের উদ্দেশ্যে জানতে চাইলাম আমি।

অপরাজিত ফারাও উটেরিকের রাজকীয় রথচালক আমরা! এখানে এসেছি ফারাওয়ের নির্দেশে। একত্রিশজন কয়েদির সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য তোমার হাতে তুলে দিতে চান ফারাও। আমরা তাদের নিয়ে এসেছি।

আমার নির্দেশে বন্দিদের রথ থেকে নামানো হলো, তারপর গোড়ালিতে শিকল দিয়ে একসাথে বাঁধা অবস্থায় সবাইকে দরজা দিয়ে ঢোকানো হলো ভেতরের প্রাঙ্গণে। অনেক ওপরে প্রধান ফটকের মাথায় ঝুলন্ত অবস্থায় ভুগের মাথার খুলির শূন্য কোটরগুলো চেয়ে রইল তাদের দিকে। ডুগের হায়ারোগ্লিফ প্রতীক ব্যবহার করে বন্দিদের রসিদে স্বাক্ষর করলাম আমি। তারপর তাদের নিয়ে আসা রথচালকরা আবার বের হয়ে গেল প্রধান দরজা দিয়ে। খালি রথ নিয়ে লুক্সরের পথে রওনা হয়ে গেল তারা। এবার বন্দিদের দীর্ঘ সারিটিকে পথ দেখিয়ে ভেতরের উঠানে নিয়ে এলাম আমরা, যেখানে রাজকুমারী সেরেনার নিজের হাতে লাগানো বাগান শোভাবর্ধন করেছে। বন্দিরা ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে তাদের স্বাগত জানিয়ে বেজে উঠল নানা রকম উচ্ছ্বসিত বাজনা।

ক্লান্তি আর হতাশা কাটিয়ে উঠে অবাক চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে শুরু করল বন্দিরা। যদিও এখনো বাগানের খুব কম গাছেই ফুল ফুটেছে; কিন্তু বন্দিরা যে অত্যাচারের যন্ত্রপাতি এবং ফাঁসিকাঠ দেখবে বলে আশা করেছিল তার কিছুই নেই ভেতরে। তার বদলে তাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনজন কামার। সবার সামনে হাঁপর, সেইসাথে হাতে রয়েছে বাটালি এবং হাতুড়ি। প্রত্যেক বন্দি সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার গোড়ালি থেকে বাটালির সাহায্যে শিকল কেটে ফেলল তারা। বন্দিরা আরো অবাক হয়ে গেল যখন দেখল তাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে মাটির পাত্রভর্তি ফেনা ওঠা বিয়ার, একটা রুটির টুকরো আর বড় একটা শুকনো সসেজ ধরিয়ে দেওয়া হলো। এবার তাদের হতাশা কেটে যেতে শুরু করল। এই খাবারগুলো যারা সবার মাঝে ভাগ করে দিল তাদের মধ্যে একজনকে সবাই খুব দ্রুত চিনে ফেলল- যুবরাজ রামেসিস, যাকে সবাই অনেক আগেই মৃত বলে ধরে নিয়েছিল। উল্লসিত চিৎকারে তাকে অভিবাদন জানাল সবাই। সবাই গোগ্রাসে খেয়ে নেওয়ার পর তারা যুবরাজের চারপাশে এসে জড়ো হলো এবং মৃত অবস্থা থেকে জীবিত হয়ে ফিরে আসতে দেখে তাকে নানা রকম প্রশংসা আর আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি জানাতে লাগল। অবশ্য আমাকেও ওরা খুব ভালোভাবেই চেনে, বলা যায় রামেসিসের চাইতেও আমি ওদের কাছে বেশি পরিচিত। আমিও আমার যোগ্য প্রশংসা এবং ধন্যবাদের অংশ পেলাম।

এবার আমার লোকেরা বন্দিদের কয়েক ভাগে ভাগ করে ফেলল। তবে এবার দেখা গেল এক একজনের গা থেকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। কয়েক মাস আগে উটেরিকের বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর থেকে এরা সবাই সেই একই কাপড় পরে আছে। এবার আমার নির্দেশে ওদের সবাইকে রান্নাঘরের নিচে, কূপের পাড়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নিজেদের শরীর এবং কাপড়চোপড় ক্ষার দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে নিল। দারুণ উৎসাহের সাথেই কাজটা করল তারা। যে অত্যাচারের কথা সবাই আশা করছিল তার বদলে এমন অপ্রত্যাশিত ভালো আচরণ পেয়ে দারুণ খুশি হয়ে উঠেছে সবাই।

সবার গোসল এবং কাপড় পরা শেষ হওয়ার পর তাদের মাঝ থেকে বারোজনকে চিনতে পারলাম আমি আর রামেসিস। এরা সবাই মিশরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী পরিবারের প্রধান। ফারাও টামোসের মৃত্যুর আগে তার সাথে এদের সবার সুসম্পর্ক ছিল এবং প্রচুর ধনসম্পদের মালিক ছিল সবাই। এবার ওদের প্রশ্ন করে জানতে পারলাম সবার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আনা হয়েছে, আর তা হচ্ছে দেশদ্রোহিতা। এবং সেই অভিযোগেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সবাইকে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের সবার সব সম্পদ গিয়ে ঢুকেছে ফারাওয়ের রাজকীয় কোষাগারে। নিজের পকেট ভারী করতে কখনো খুব একটা দ্বিধা করতে দেখা যায়নি উটেরিককে।

মিশরীয় সমাজের সম্পদশালী ব্যক্তিরা ছাড়াও বন্দিদের মাঝে আরো কিছু জনপ্রিয় এবং সফল রাজকর্মকর্তা এবং সেনা কর্মকর্তাকে পাওয়া গেল। সবার পরিচয় নিশ্চিত করার পর তাদের উদ্দেশ্যে একটি স্বাগত বক্তব্য রাখলাম আমি। সেই বক্তৃতায় তাদের নিশ্চিত করলাম যে রামেসিস এবং আমি যে ধরনের মানুষকে আমাদের সঙ্গে রাখতে চাই তাদের ভেতর সেই সব মানুষের সব গুণাবলিই আছে। নকল ফারাওয়ের হাতে তারা যে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলাম আমি, সেইসাথে এটাও বললাম যে, আমি এবং রামেসিসও তাদের মতোই একই অত্যাচারের শিকার হয়েছি। সব শেষে তাদের আহ্বান জানালাম আমাদের দলে যোগ দিতে, যারা রামেসিসকেই মিশরের একমাত্র যোগ্য ফারাও হিসেবে অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। বললাম, তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট বলে ধরা হয়েছে। এখন তারা সবাই এই মহান দেশের মুক্ত ও স্বাধীন নাগরিক। এ ছাড়াও এ ব্যাপারে তাদের মতামত শোনার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী আমি এবং রামেসিস।

মনে হলো যেন প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা মতামত আছে এবং তা প্রকাশ করার ব্যাপারে প্রত্যেকেই দারুণ আগ্রহী। কারণ আমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দারুণ হট্টগোল শুরু হয়ে গেল সবার মাঝে। সেই মুহূর্তে যদি রাজকুমারী সেরেনা সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ না করত তাহলে হয়তো হট্টগোল সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ত। সত্যি কথা বলতে এই মুহূর্তে সেরেনার উপস্থিতির ব্যাপারটা আমিই সাজিয়ে রেখেছিলাম।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সবার চিৎকার-চেঁচামেচি নিচুপ হয়ে গেল, প্রথমবারের মতো সেরেনাকে দেখতে পেল মিশরের অভিজাত সম্প্রদায়ের সদস্যরা। এটাও মনে রাখতে হবে যে, উটেরিকের হাতে বন্দি হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের মাঝে কোনো নারীর ওপর চোখ রাখেনি এরা, ফলে তাদের বিস্ময়টা হলো আরো বেশি।

এই মুহূর্তে তাদের সামনে প্রায় অলৌকিক পর্যায়ের একটা ঘটনা ঘটছে। রক্ত মাংসের মানুষকে দেখছে ঠিকই; কিন্তু তাকে স্বর্গীয় কেউ বলে ধরে নিয়েছে সবাই। সেরেনার মাঝে যে দেবত্ব বিদ্যমান তার কারণে ওর মাথার চুল আগের চাইতেও যেন উজ্জ্বল আর দীর্ঘ হয়ে গজিয়েছে। এখন সত্যিই তাকে দারুণ লাগছে দেখতে।

ওর হাত ধরল রামেসিস, তারপর সবার সামনে এগিয়ে নিয়ে এলো। এই নারীই আমার স্ত্রী হতে যাচ্ছে। এ হলো স্পার্টান ল্যাসিডিমনের রাজকুমারী সেরেনা, সবাইকে জানাল সে। সাথে সাথে মৃদু গুঞ্জন বয়ে গেল সবার মাঝে। গুঞ্জনের কিছুটা তৈরি করল আফসোসের দীর্ঘশ্বাস আর বাকিটা তৈরি হলো প্রশংসাসূচক বাক্যে।

সঠিক সুযোগ চিনতে কখনো ভুল হয় না আমার। এই মুহূর্তে দুই হাত ওপরে তুলে নীরবে সবাইকে জয়ধ্বনি দেওয়ার ইশারা করলাম আমি। প্রায় সাথে সাথে সবার মিলিত কণ্ঠস্বরের হর্ষধ্বনিতে প্রায় উড়ে যাওয়ার অবস্থা হলো আমার।

রামেসিস আর সেরেনার জয় হোক! মিশরের ফারাও এবং রানির জয় হোক!

*

মনে হলো যেন একেবারেই অশিক্ষিত আর মূর্ণ হওয়ার পরেও উটেরিক কোনো রহস্যময় উপায়ে সবচেয়ে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ বত্রিশজন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে পাঠিয়েছে আমাদের কাছে। এই বত্রিশজন মানুষকে দিয়েই একটি সরকারের মন্ত্রিসভা গঠন করা যেতে পারে। আমরাও তাই করলাম। মিশরের রাষ্ট্রীয় পরিচালনার কাজে রামেসিসকে সহায়তা করার কাজে নিয়োগ দিলাম তাদের প্রায় সবাইকে।

বন্দিদের মাঝে ছিল কৃষি, খাদ্য, পশুপালন, শিক্ষা, মৎস্যপালন, বন বিভাগ, খনিবিদ্যা, নির্মাণ, অর্থ ও করবিদ্যা, পানি সরবরাহ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা- সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী এবং যুদ্ধবিদ্যায় দক্ষ সব ব্যক্তির সমারোহ। ফারাওয়ের কাছ থেকে প্রস্তাবিত সকল পদে খুব আনন্দের সাথেই যোগদান করল তারা। তবে তাতে অবশ্য আমার খুব একটা উপকার হলো না, কারণ যতই অভিজ্ঞ বা দক্ষ হোক না কেন, নতুন কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোথাও আটকে গেলে সবাই আমার কাছেই সাহায্য বা পরামর্শ চাইতে এলো।

কয়েক দিন পর পরই আনন্দের বাগানে এসে পৌঁছতে লাগল কয়েদিদের দল। সবাইকেই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে অপরাজেয় উটেরিক। অল্প সময়ের মাঝেই আমাদের লোকবল প্রায় কয়েক শতে পৌঁছে গেল। তাদের মাঝ থেকে ওয়েনেগ আর আমি মিলে কাঠমিস্ত্রি ও নির্মাণশ্রমিক আলাদা করে নিলাম। এবার তাদেরকে কাজে লাগানো হলো আমার নকশা অনুযায়ী চারটি দ্রুতগামী ছোট জাহাজ এবং দুটো বড় নৌকা তৈরির জন্য। ল্যাসিডিমনে অবস্থানরত রাজা হুরোতাস এবং আমাদের অন্যান্য মিত্রের সাথে যোগাযোগের কাজে ব্যবহার করা হবে এগুলো। প্রথম জাহাজটা প্রায় সমুদ্রে নামানোর উপযোগী হয়ে গেছে, এই সময় একদিন দারুণ উত্তেজিত অবস্থায় সেরেনা দেখা করতে এলো আমার সাথে। জানাল হুই চাচা আর তার প্রেমিকা পায়রাটা যে তিনটি ডিম পেড়েছিল সেগুলো ফুটে এখন বাচ্চা বেরিয়েছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বড় হয়ে যাবে বাচ্চাগুলো এবং উড়তেও শিখে যাবে। তখন ল্যাসিডিমনে সেরেনার বাবা-মায়ের কাছে পাঠানো যাবে ওগুলোকে, এবং, আমাদের দুই পক্ষের মাঝে সংবাদ আদান-প্রদান অনেক সহজ হয়ে আসবে।

এমনিতেও প্রতি রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে সেরেনা। কোডিস বেভাস নামে নতুন একটা লেখনী পদ্ধতি তৈরি করছে ও, যেটা আমাদের সমসাময়িক হায়ারোগ্লিফিকসের চাইতে প্রায় বারো গুণ ছোট এবং অনেক বেশি নিরাপদ। আমাদের মিশরীয় ভাষার প্রধান প্রধান দুই শ শব্দের জন্য কেবল একটিই প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে এই ভাষায়, যেটা বেশির ভাগ দরকারি কথাবার্তা লেখার জন্য যথেষ্ট। লেখার সাধারণ নিয়মগুলো ওর কাছ থেকে বিস্তারিত শোনার পর প্রায় সঙ্গেই সঙ্গেই এর স্বাভাবিক সৌন্দর্যে অবাক হয়ে গেলাম আমি। এই ভাষা আমি নিজে কেন আবিষ্কার করিনি এই ভেবে আফসোসও হলো। আমার সাহায্য নিয়ে বাবা মায়ের কাছে পাঠানোর জন্য এই ভাষায় একটা চিঠিও লিখে ফেলল সেরেনা। পঞ্চাশটি মস্তিষ্ক আলাদা আলাদা কাজ করার চাইতে দুটি দক্ষ মস্তিষ্ক একসাথে কাজ করলে তাতে অনেক বেশি ফল পাওয়া যায়।

এক শুভদিন দেখে মাঝরাতের কিছু পরে আমাদের প্রথম জাহাজটা নদীতে ভাসালাম আমরা। জাহাজের নাম রাখা হয়েছে আর্টেমিসের শপথ। চাঁদ তখন দিগন্তের ওপাশে সরে গেছে, শুধু কিছু তারার আলোয় আলোকিত হয়ে আছে নদীর বুক। আমাদের মাঝ থেকে সবচেয়ে দক্ষ ছয়জন নাবিককে রাখা হয়েছে জাহাজ পরিচালনার দায়িত্বে। বহুবার মিশর থেকে ল্যাসিডিমনের মাঝে যাতায়াত করেছে তারা। পেন্টু নামে এক দক্ষ নাবিককে দেওয়া হয়েছে জাহাজের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব। মানুষ এবং নাবিক- দুই হিসেবেই তার ওপর ভরসা আছে আমার। জাহাজে করে ছত্রিশটি পায়রা নিয়ে যাচ্ছে তারা। এ পর্যন্ত আনন্দের বাগানে এই পায়রাগুলোই জন্মাতে সক্ষম হয়েছি আমরা। খোলা সমুদ্রের ওপর দিয়ে লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ার মতো শক্তি অর্জন করেছে সবগুলোই। এ ছাড়া মাছশিকারি ঈগল এবং অন্য শিকারি পাখিদের দৃষ্টি এড়ানোর মতো যথেষ্ট বুদ্ধিও রাখে মাথায়।

এই পাখিগুলোর পাশাপাশি আরো থাকছে প্রায় এক শ প্যাপিরাস পুঁথি, যাতে রয়েছে রাজকুমারী সেরেনার মনোমুগ্ধকর হায়ারোগ্লিফে লেখা একটি চিঠি। রাজা হুরোতাস এবং রানি তেহুতিকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে চিঠিটা।

পরদিন সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ আমার দরজায় আস্তে করে টোকা দিল কে যেন। খুব সাবধানে দরজা খুলে উঁকি দিলাম আমি। দেখলাম রামেসিস আর সেরেনা দাঁড়িয়ে আছে ওপাশে, শীতে কাঁপছে দুজনই।

আমরা তোমাকে বিরক্ত করছি না তো, হে জ্ঞানী? ভেতরে আসতে পারি? কেবল আমার কাছ থেকে প্রায় অসম্ভব কিছু আদায় করার দরকার হলেই এই সম্বোধনে আমাকে ডাকে রামেসিস। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দরজাটা আরেকটু খুললাম আমি।

হাথোরের শপথ! তোমার প্রশ্নের জবাব হচ্ছে মোটেই না এবং অবশ্যই। অথবা উল্টোটাও ধরতে পারো। ইচ্ছে করেই একটু ধোঁয়াশা ধরনের জবাব দিলাম আমি, যাতে আমাকে পেয়ে না বসে ওরা। তবে একই সাথে সরে দাঁড়িয়ে ওদের ভেতরে ঢোকারও সুযোগ করে দিলাম।

ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ বিব্রত চেহারায় পাশাপাশি বসে রইল ওরা। শেষ পর্যন্ত রামেসিস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমাদের মনে হয়েছিল তুমি হয়তো আমাদের সাথে প্রার্থনা করতে রাজি হবে।

কী অদ্ভুত! চেহারায় বিস্মিত ভাব ফুটিয়ে তুললাম আমি। দেবতারা মাঝে মাঝে আমাদের সাথে কথা না বলেই নানা রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। সত্যি কথা বলতে তারা প্রায়ই এমন সব কাজ করেন, যেটা আমাদের ইচ্ছের ঠিক উল্টো। হয়তো স্রেফ নিজেদের প্রাধান্য বোঝাতেই কাজটা করেন তারা।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রামেসিস। তারপর সেরেনার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাল, যার অর্থ হচ্ছে আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম। সেরেনার চোখগুলো হঠাৎ বড় বড় হয়ে উঠল, তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে ভরে উঠল অশ্রুতে। আমি জানি যে ও কত দক্ষ অভিনেত্রী। কিন্তু এই মুহূর্তে আপাতত আত্মসমর্পণ করা ছাড়া পথ নেই আমার।

ঠিক আছে ঠিক আছে, হার মানলাম আমি। সাথে সাথে হাসি ফুটল রামেসিসের ঠোঁটে। এবং একই সাথে সম্পূর্ণ অলৌকিকভাবে শুকিয়ে গেল সেরেনার চোখের পানি। কিন্তু আমাদের প্রার্থনার বিষয়বস্তু কী হবে? দেবতাদের কাছে কীসের অনুরোধ জানাব আমরা? যদিও আমার মনে হচ্ছে। সেটা আমি আগেই জানি।

আমরা চাই আর্টেমিসের শপথের ওপর সদয় দৃষ্টি রাখুন দয়ালু দেব-দেবীগণ এবং তাকে নিরাপদে গিথিয়ন বন্দরে নোঙর করার অনুমতি দিন, ব্যাকুল কণ্ঠে জানাল সেরেনা। তারপর আমরা এটাও বলতে চাই যে, তারা যেন আমাদের পায়রাগুলোর ওপরে খেয়াল রাখেন, তাদেরকে নিরাপদে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনেন। সেইসাথে আমার বাবা-মায়ের পাঠানো খবর যেন অক্ষত অবস্থায় আমাদের হাতে পৌঁছায়।

এটুকুই? বাহ, বললাম আমি। তা বেশ তো। তাহলে গোল হয়ে হাতে হাত ধরে দাঁড়াই আমরা, কি বলো? সেরেনার হাতগুলো অত্যন্ত কোমল, এবং স্বাভাবিকভাবেই ওগুলো ধরতে আমার খুবই ভালো লাগে।

*

আর্টেমিসের শপথকে প্রথমে নীলনদ হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ল্যাসিডিমনের গিথিয়ন বন্দরে পৌঁছাতে হবে। সেখানে হুরোতাস আর তেহুতি আমাদের চিঠি পড়বে এবং সেরেনার আবিষ্কৃত কোডিস ব্রেভাসে তার জবাব লিখবে। তারপর সেই চিঠিকে পায়রাগুলোর পায়ে বেঁধে আবার ফেরত পাঠাবে আনন্দের বাগান অভিমুখে। তাদের আবার বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে এখানে পৌঁছতে হবে। এর জন্য সব মিলিয়ে কত সময় লাগবে সে ব্যাপারে আমরা তিনজনই আলাদা আলাদাভাবে একটা হিসাব করলাম। সেরেনা ধারণা করল পনেরো দিন। রামেসিস আরেকটু বাস্তববাদী হয়ে বলল বিশ দিন। আমি বললাম তেইশ দিন, অবশ্য যদি দেবতারা আমাদের সহায় হতে চান তাহলেই কেবল এটা সম্ভব।

খোঁড়া কচ্ছপের গতিতে কাটতে লাগল দিনগুলো। প্রথমে সেরেনার হিসাব করা পনেরো দিন পার হয়ে গেল। তারপর রামেসিসের বিশ দিন, তবু মাথার ওপর দেখা পাওয়া গেল না কোনো পায়রার। এমনকি আমি নিজেও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে লাগলাম। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখলাম শিকারির হাতে নিহত পায়রার রক্তমাখা পালক ভাসছে বাতাসে। কিন্তু ঠিক তেইশ দিনের দিন সকালে আমাদের মাথার ওপরের আকাশে নীল আর বেগুনি রঙের ছোপ দেখা গেল অনেকগুলো। বোঝা গেল ফিরে আসছে পায়রারা। এক এক করে নিজেদের খোপে এসে ঢুকতে লাগল তারা আর জোরে জোরে গুনতে লাগলাম আমরা।

আমাদের ধারণা ছিল হুরোতাস আর তেহুতি হয়তো একটা একটা করে ছাড়বে পায়রাগুলোকে। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানানোর থাকলে হয়তো বড় জোর দুটো কি তিনটে ছাড়তে পারে। কিন্তু আমরা সবাই প্রচণ্ড অবাক হয়ে দেখলাম একের পর এক পাখি শুধু এসেই যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ছত্রিশ পর্যন্তই গোনা হয়ে গেল আমাদের। হতবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমরা।

আমাদের এত বেশি অবাক হওয়ার পেছনে কাজ করেছে মূলত দুটো জিনিস। প্রথমটা হচ্ছে হুরোতাস এবং তেহুতি একই সাথে ছত্রিশটা পাখিকেই আমাদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। আর দ্বিতীয়টা হলো এই দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার পরেও একটা পাখিও ঘরে ফিরে আসতে ব্যর্থ হয়নি।

আমার অনুরোধ অগ্রাহ্য করে এমন সবিস্তারে চিঠি লেখা কেবল আমার মায়ের পক্ষেই সম্ভব, বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল সেরেনা। স্বাভাবিকভাবেই যে মেয়েটাকে এত ভালোবাসি তার পক্ষে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলাম আমি।

আহা সেরেনা। যে নারী তোমাকে জন্ম দিয়েছে তার ব্যাপারে এমনভাবে কথা বলতে পারো না তুমি, বললাম আমি।

আমার মায়ের পাঠানো চিঠি আর বাবার পাঠানো চিঠির মধ্যে একটু তুলনা করে দেখো, তাহলেই বুঝতে পারবে যে এমন কথা কেন বলেছি আমি, জবাব দিল সেরেনা। সুতরাং তাই করলাম আমি।

তেহুতির দারুণ সুন্দর নানা রঙের হায়ারোগ্লিফের লেখায় ভরে গেছে বত্রিশটা প্যাপিরাস। তার মেয়ে সংক্ষেপে চিঠি লেখার যে পরামর্শ দিয়েছিল সেটাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে সে। চিঠির অনেক অংশে, এমনকি কবিতার মতো করেও লিখেছে তেহুতি এবং আমি নিজেও স্বীকার করতে বাধ্য হলাম যে লেখাগুলো আসলেই বেশ সুন্দর। পানমাসির হাতে অপহৃত হওয়া এবং উটেরিকের আস্তানায় বন্দি হয়ে থাকার পরেও যে তার মেয়ে সফলভাবে পালাতে সক্ষম হয়েছে এটা নিয়ে তেহুতির আনন্দের কোনো সীমা নেই। সেরেনার সাহস এবং বুদ্ধির দারুণ প্রশংসা করেছে সে এবং লিখেছে যে খুব শীঘ্রই তাদের দেখা হবে। সেইসাথে জানতে চেয়েছে যে দুষ্টু বুড়ো টাইটা সেই নীল তলোয়ারটা সেরেনাকে দিয়েছে কি না। মেয়েকে সে পরামর্শ দিয়েছে তলোয়ারটাকে ধারালো করে রাখতে এবং সেটা কীভাবে করতে হবে সে ব্যাপারে কিছু বুদ্ধিও দিয়েছে। তারপর সেরেনাকে নিশ্চিত করেছে যে রামেসিসের সাথে তার বিয়ের পোশাকটা তৈরির কাজ অবশেষে শেষ হয়েছে। এবং সত্যিই নাকি দেখার মতো একটা পোশাক হয়েছে সেটা। মেয়েকে ওটা পরা অবস্থায় দেখার জন্য নাকি আর তর সইছে না তার। এ ছাড়া মধুতে মাখানো ঝলসানো পাখি আর ঈল মাছের কিছু রন্ধনপ্রণালিও উল্লেখ করেছে সে, জানতে চেয়েছে সেরেনার বিয়েতে অতিথিদের এই খাবারগুলো পরিবেশন করলে সেরেনার কোনো আপত্তি আছে কি না। সব শেষে এই বলে শেষ করেছে যে, ছোট্ট প্যাপিরাসগুলোতে মোটেই জায়গা নেই, এটা নিয়ে তার দারুণ আফসোস হচ্ছে। তারপর আবারও মেয়ের নিরাপত্তা এবং সুস্বাস্থ্য কামনা করেছে এবং সব শেষে দাবি জানিয়েছে যে, সেরেনা যেন আরো অনেকগুলো পায়রা পাঠায় ল্যাসিডিমনে। এখনো নাকি অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর জানানো বাকি এবং তাদের মাঝে একটা খবরের উদাহরণ হচ্ছে; হুইসনের বউয়ের একটা ছেলে হয়েছে।

অন্যদিকে হুরোতাসের পাঠানো চারটি প্যাপিরাসকে বলা যায় সংক্ষিপ্ততা এবং পরিষ্কার ভাষার এক অনন্য উদাহরণ, একজন অভিজ্ঞ এবং দক্ষ যোদ্ধার মানানসই কাজ। সেরেনার তৈরি করা এবং আমার সম্পাদিত ভাষা কোডিস ব্রেভাসে নিজের চিঠি লিখেছে সে।

হুরোতাসের জন্য তেহুতির বরাদ্দ করা চার পৃষ্ঠার মাঝেই উটেরিকের বিরুদ্ধে নিজের যুদ্ধ পরিকল্পনার বিস্তারিত বিবরণ দিতে সক্ষম হয়েছে সে। দুই পর্যায়ে পরিচালনা করা হবে যুদ্ধ: সাগরে এবং স্থলে। পূর্ব নিয়ম অনুযায়ী অ্যাডমিরাল হুই নেতৃত্ব দেবে নৌবাহিনীর আর হুরোতাস নিজে পরিচালনা করবে রথ বাহিনী এবং পদাতিক সৈন্যদের।

যুদ্ধের শুরুর দিকে রথ বাহিনী অবস্থান নেবে সাজ্জাতু বন্দরে। জায়গাটা নীলনদ যেখানে ভূমধ্যসাগরে পতিত হয়েছে তার থেকে পঁয়ত্রিশ লিগ পুবে অবস্থিত। এটাই হচ্ছে স্থলপথে মিশরে আক্রমণ চালানোর জন্য সর্বোকৃষ্ট স্থান। ইতোমধ্যে হুরোতাস দুই শ ষাটটার মতো যুদ্ধের রথ এবং তাদের চালকদের সাজ্জাতুতে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখানকার শহর এবং অন্য জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে তারা। ওদিকে তাদের নামিয়ে দিয়ে জাহাজগুলো ফিরে গেছে ল্যাসিডিমন আরো একদল সৈন্য এবং রথ নিয়ে ফিরে আসবে আবার। সব মিলিয়ে সাজ্জাতুতে প্রায় নয় শ রথ জমা হবে, যা হবে ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ভয়ংকর রথ বাহিনী।

অন্যদিকে পদাতিক সৈন্যরা আফ্রিকান মাটিতে অবস্থান নেওয়ার পরেই নীলনদে হামলা চালানোর জন্য সুযোগ পেয়ে যাবে নৌবাহিনী। প্রাথমিকভাবে মেম্ফিস শহরের ওপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছে হুই। সেখানেই হুরোতাসের সাথে যোগ দেবে সে। শহরের ওপর নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সেখানে বসেই লুক্সরের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারবে তাদের সেনাবাহিনী।

চিঠির শেষে কেবল একটা শব্দ দিয়েই একই সাথে শুভেচ্ছা এবং বিদায় জানিয়েছে হুরোতাস। এটা আসলে সৈনিকদের নিজস্ব একটা পরিভাষা, যেটা হচ্ছে তরবারি। আমাদের ভেতরে এর অর্থ হচ্ছে: যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত পরস্পরের সঙ্গী।

বত্রিশ পৃষ্ঠার বদলে মাত্র চার পৃষ্ঠা, মাথাটা একদিকে কাত করে আমার উদ্দেশ্যে বলল সেরেনা। এখন কি মনে হচ্ছে আমি বাড়িয়ে বলেছি?

এমন কথা তো কখনো বলিনি আমি। বুদ্ধি খাঁটিয়ে সেরেনার অভিযোগটা কাটিয়ে দিলাম আমি, তারপর তাকালাম রামেসিসের দিকে। খুব সংক্ষেপে নিজের কথা সেরেছে হুরোতাস।

তার কথা শুনে মনে হচ্ছে কাজটা খুব সহজ, প্রতিবাদ জানাল রামেসিস। তাই এবার আবার সেরেনার দিকে ফিরলাম আমি, মনে মনে খুশি যে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে ইতোমধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলতে পেরেছি।

কী মনে হয় তোমার? হাসল সেরেনা, তারপর পরাজয় স্বীকারের ভঙ্গিতে দুই হাত চড়িয়ে দিল দুদিকে।

উটেরিক যখন বুঝতে পারবে যে তাকে আসলে তোমার এবং আমার বাবার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হবে, আমার ধারণা নিজের পেট থেকে বের হওয়া দুর্গন্ধময় পদার্থে সে নিজেই পা পিছলে পড়বে। দক্ষিণে অন্ধকার আফ্রিকার গভীর জঙ্গলের দিকে পালানো ছাড়া কোনো পথ থাকবে না তার। সেখানে গিয়ে নিজের স্বজাতি অর্থাৎ বাঁদরদের মাঝে আশ্রয় নিতে হবে তাকে।

প্রিয় রাজকুমারী, নিজের মতামত প্রকাশের জন্য খুব সুন্দরভাবে ভাষার ব্যবহার করতে শিখেছ তুমি! বলে এক হাতে ওর কাঁধ জড়িয়ে ধরে চাপ দিলাম আমি। কাজটা করলাম ওর কথায় আমার সম্মতি বোঝাতে। তবে এটাও স্বীকার করতে হয় যে, সেরেনার শরীরটা বেশ নরমও বটে।

তুমি খুব ভালো টাইটা, আদুরে গলায় বলে উঠল সেরেনা।

মৃদু হেসে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল রামেসিস। তুমি খুব সৌভাগ্যবতী সেরেনা। দু-দুজন পুরুষ তোমাকে ভালোবাসে।

টাইটার কথা তো আমি জানি। কিন্তু এই দ্বিতীয় পুরুষটি কে বলো তো?

*

ওয়েনেগ ছাড়াও আমার অন্য যেসব গুপ্তচর লুক্সরে ছিল তাদের কাছ থেকে জানা গেল যে, লুক্সর শহরে সেনা তৎপরতার এখন পর্যন্ত কোনো চিহ্ন নেই। তবু তাদের আমি এই বলে সাবধান করে দিলাম যে, খুব শীঘ্রই সেটা শুরু হতে যাচ্ছে এবং সামরিক ব্যস্ততা দেখা দিলেই বুঝতে হবে মিশরের বুকে উটেরিকের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে হুরোতাস এবং তার ষোলোজন মিত্রের সম্মিলিত অভিযানের খবর জেনে গেছে সে।

আমার ধারণা হলো, উটেরিক নিশ্চয়ই তাড়াহুড়ো করে নিজের সৈন্যসামন্ত নিয়ে ছুটে যাবে মেফিস এবং আফ্রিকান উপকূলে। সেখানে নিজের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করবে সে, একই সাথে ঠেকিয়ে রাখতে চাইবে রাজা হুরোতাসের আক্রমণকে।

লড়াই শুরু করার জন্য অধীর হয়ে আছে রামেসিস, যদিও উটেরিক এখনো লুক্সর থেকে নদীর ভাটি ধরে মেফিসের পথে যাত্রা শুরু করেনি। তার মতে, আনন্দের বাগানে ইতোমধ্যে প্রায় চার শ লোকের এক বাহিনী তৈরি করেছি। আমরা এবং এটাই যথেষ্ট। এরা সবাই উটেরিক আর তার চ্যালাদের হাতে নানাভাবে অত্যাচারের শিকার হয়েছে, এবং প্রতিশোধের জন্য পাগল হয়ে আছে তারা।

কিন্তু এই চার শ লোকের ছোট্ট বাহিনী দিয়ে কী করতে পারব আমরা, যেখানে আমাদের প্রতিপক্ষ উটেরিকের সৈন্যসংখ্যা প্রায় চার হাজার? ওকে প্রশ্ন করলাম আমি।

আমরা যদি মাঝরাতের পরে হামলা করি তাহলে উটেরিক নদীবন্দরে যে জাহাজগুলো নোঙর করে রেখেছে সেগুলোর বেশির ভাগে আগুন ধরিয়ে দিতে পারব। তা ছাড়া নদীর পাড়ে যে গুদামগুলো রয়েছে সেগুলোও পুড়িয়ে দিতে পারব আমরা। ওই গুদামগুলোতেই রয়েছে উটেরিকের বেশির ভাগ অস্ত্র আর রসদের সরবরাহ, জবাব দিল রামেসিস।

কিন্তু এটা করতে গেলে একই সাথে আমাদের অবস্থানের কথাও জানাজানি হয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত উটেরিক বিশ্বাস করে যে সেরেনা দুঃখ-দুর্দশার ফটকে একা একা বন্দি হয়ে আছে এবং এ পর্যন্ত তার পাঠানো সকল বন্দির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ডুগ আর তার অনুচররা। আর তুমি এবং আমি রয়েছি অনেক দূরে পৃথিবীর একেবারে উত্তর প্রান্তে। তুমি কি চাও উটেরিকের সেই ভুল ধারণা এত তাড়াতাড়ি ভেঙে যাক? প্রশ্ন করলাম আমি। এবার কিছুটা লজ্জিত দেখাল রামেসিসকে।

আমি ভেবেছিলাম- বলতে শুরু করল সে; কিন্তু আমি থামিয়ে দিলাম তাকে। যা-ই ভাবো না কেন, বেশি দূর ভেবে দেখোনি তুমি। এখন আমাদের যেটা করা দরকার সেটা হচ্ছে হুরোতাসের সাথে যোগাযোগ স্থাপন, তা পায়রার সাহায্যে হোক আর সংবাদবাহক মারফত হোক। তাহলে নিজেদের পরিকল্পনা সাজিয়ে নিতে পারব আমরা। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত নিজেদের সামলে রাখতে হবে আমাদের, অপেক্ষা করতে হবে সেই সময়ের, যখন আস্ত গাড়ল উটেরিকের ওপর হামলা করলে তার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হবে। এতক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে আমাদের আলাপ শুনছিল সেরেনা। এই কথাটা শোনার সাথে সাথেই হাততালি দিয়ে উঠল ও। ওহ টাইটা, দারুণ একটা নাম দিয়েছ! আগে বলো কেন আমাকে?

কথাটা আসলে বলেছিল তোমার বাবা, আমি নই। আর আমি কখনো অপর ব্যক্তির কৌতুককে নিজের বলে চালিয়ে দিই না, গম্ভীর মুখে ব্যাখ্যা করলাম আমি। তারপর আবার ফিরলাম রামেসিসের দিকে। তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আমার কথায় তোমার কোনো আপত্তি নেই রামেসিস।

অগত্যা তলোয়ারে ধার দিতে দিতে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। দিন গড়িয়ে সপ্তাহ বয়ে চলল। তারপর পরবর্তী অমাবস্যায় সাহসী ক্যাপ্টেন পেন্টু তার ছোট্ট জাহাজ আর্টেমিসের শপথ নিয়ে নোঙর করল আনন্দের বাগানের নিচে অবস্থিত গোপন ঘাটলায়। আমার মনে হলো জাহাজের নামটার কারণেই বোধ হয় দেবী আর্টেমিস আমাদের সহায় হয়েছেন এবং তার দয়াতেই এত অল্প সময়ের মাঝেই এই বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে আবার নিরাপদে ফিরে আসতে পেরেছে জাহাজটা। এবার জাহাজের খোলে ভর্তি রয়েছে সেরেনার জন্য রানি তেহুতির পাঠানো বিভিন্ন উপহার। তার মাঝে রয়েছে সেরেনার প্রিয় সুগন্ধীর বারোটা বোতল এবং নানা রঙের অপূর্ব সুন্দর অনেকগুলো পোশাক, যেগুলোর সবগুলোই তৈরি হয়েছে তার প্রিয় দর্জির হাতে। তা ছাড়া প্রতিটি পোশাকের সাথে মিলিয়ে এক জোড়া করে জুতো, মূল্যবান পাথরে খচিত সোনা এবং রুপার তৈরি অনেকগুলো অলংকার এবং পরিপাটি হায়ারোগ্লিফিকসে লেখা অনেকগুলো প্যাপিরাস।

এই চিঠিগুলোর একটায় তেহুতি সবিস্তারে বর্ণনা করেছে যে, তার মেয়ের অনেকগুলো কষ্টের মাঝে একটা ব্যাপারে সে সবচেয়ে বেশি ব্যাকুল হয়ে ছিল। সেটা হচ্ছে নিজের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরতে পারছে না তার মেয়ে সেরেনা। তেহুতির ভাষ্য অনুযায়ী, এই কষ্টের সাথে, এমনকি সন্তান জন্ম দেওয়ার কষ্টেরও কোনো তুলনা হয় না।

এ ছাড়া আর্টেমিসের শপথ, তার ডেকে করে নিয়ে এসেছে পঞ্চাশটা খাঁচাভর্তি পায়রা, যেগুলোর সবই ল্যাসিডিমনের দুর্গে জন্ম নিয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা আকাশে ওড়ার সুযোগ পেলেই রওনা দেবে নিজেদের জন্মস্থানের দিকে। বোঝা যাচ্ছে হুরোতাস এবং তেহুতি আমাদের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যেতে চাইছে।

সূর্য ওঠার আগেই কোডিস ব্রেভাস ব্যবহার করে হুরোতাসের কাছে তিনটি চিঠি লিখে ফেললাম আমি। সেগুলোকে রেশমের ছোট্ট থলেতে ভরে বেঁধে দিলাম পায়রাগুলোর বুকের সাথে। আমি ওদেরকে পাঠানোর জন্য যতটা উদগ্রীব হয়ে ছিলাম ওরাও যেন বাড়ি ফেরার জন্য ঠিক ততটাই আগ্রহী হয়ে ছিল। তবে ওদের পাঠানোর আগে আরেকটু অপেক্ষা করিয়ে রাখলাম এবং সেই অবসরে আরেকটা ছোট্ট চিঠিতে লিখলাম যে, আর্টেমিসের শপথ নিরাপদেই ফিরে এসেছে এবং হুরোতাস আর তেহুতির পাঠানো সব কিছুই আমরা সঠিকভাবে বুঝে পেয়েছি। সকালের সূর্যের প্রথম কিরণে রাতের অন্ধকার দূর হতে শুরু করার সাথে সাথে তিনটি পাখির প্রত্যেকটার মাথায় চুমু খেয়ে তাদের বাতাসে ছুঁড়ে দিলাম আমি। দ্রুত বেগে উড়ে আকাশে উঠে গেল সবাই, তারপর দু তিনটে চক্কর দিয়ে উত্তরমুখী হয়ে উড়তে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে গেল আমার দৃষ্টিসীমা থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *