৪. গল্প চলবে অবিরাম

প্রিয় বকুল,

ঈদ মোবারক। ভালো আছিস তো? অনেক বছর পর লিখছি তোকে। তোর কথা প্রায়ই মনে পড়ে। তোকে বলার মতো ঘটনাও কম ঘটে না। কিন্তু ব্যস্ততায় তোকে নিয়ে বসাই হয় না। ছুটির দিনগুলোতে মন ভরে ঘুমাই। লিখতে বড় আলসেমি লাগে আজকাল। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই ইচ্ছে করল তোর সঙ্গে কথা বলতে।

বিগত বছরগুলোতে আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিস দুটি এসেছে তা হলো ব্যস্ততা আর টাকা। টাকা আমার সুখ আর আরাম কেনে। ব্যস্ততা আমার ভেতরকার একমাত্র শূন্যতাকে ঢেকে রাখে। রাতে একা হলে এখনো মীরাকে আগের মতোই মিস করি। কিন্তু শরীর এত ক্লান্ত থাকে যে নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়ি। তোকে তো বলাই হয়নি, আমরা এখন ঢাকায় থাকি। বছরখানেক আগে সাভারের বিজনেসটা আমি ঢাকায় মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে ট্রান্সফার করেছি। শুরুটা ছিল ছোট একটা দোকান নিয়ে। কয়েকমাস আগে পাশের দোকানটাও নিয়েছি। ব্যবসাটা এত সুন্দর দাঁড় করাতে পারব ভাবিনি। তবে দিনরাত সমানে খেটেছি এ কথাও সত্যি। বেশকিছু কর্মচারী আছে এখন। তবু আমি নিজে ১১-১২ ঘণ্টা সময় দিই এখনো। ব্যবসায় নেমে বুঝেছি প্রথমদিকে নিজে সময় না দিলে ব্যবসায় সফল হওয়া কঠিন।

জানিস ঢাকায় আসার পর থেকে প্রায়ই আমি একটা অদ্ভুত কাজ করি। হঠাৎ হঠাৎ নাখালপাড়া চলে যাই। মীরার বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘুরেফিরে চলে আসি। অন্যরকম একটা প্রশান্তি কাজ করে। মনে হয় এই রাস্তা দিয়েই তো ও হেঁটে বেড়ায়। এই বাতাসেই তো ও নিঃশ্বাস নেয়। ওর বারান্দায় শুকোতে দেয়া কাপড়গুলোর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি কোন কাপড়টা ওর?

একটা কথা যা আমি নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাই না, আজ তোর কাছে স্বীকার করছি… যখন আমি নাখালপাড়া যাই তখন আমার খুব ইচ্ছে করে একদিন মীরার সঙ্গে দেখা হয়ে যাক। কিন্তু দেখা আর হয় না। ভাগ্য সম্ভবত আমার অনুকূলে নেই। হয়তো প্রতিশোধ নিচ্ছে। মীরাকে কষ্ট দেয়ার প্রতিশোধ। কিন্তু তুই তো জানিস, মীরাকে অনেক বেশি কষ্ট দিতে চাইনি বলেই সেই কষ্টটা দিয়েছিলাম?

রাফসান শিকদার
০৭ জুলাই, ২০১৬

আজ অনেকদিন পর মীরাকে দেখলাম। ভালো আছে। ওর ভালো থাকাটাই চেয়েছিলাম। এত প্রশ্ন করিস না বকুল। এত কথা লিখতে ইচ্ছে করছে না। বেশি প্রশ্ন করলে আর কোনোদিন তোর মুখও দেখব না।

রাফসান শিকদার
০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

সামনে কোরবানির ঈদ। ঘরদোর পরিষ্কার করা হচ্ছে। আমার দায়িত্ব পড়েছে। জানালার গ্রিল পরিষ্কার করার। তাই করছি। কিন্তু কাজে মন নেই আমার। কী করছি নিজেও জানি না। আমার মাথায় কেবল মীরার চিন্তা ঘুরছে। ভাগ্যিস রাহি আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। চোখ খুলে দিয়েছে ও আমার। নিজ চোখে না দেখলে কি আমি কখনো বিশ্বাস করতে পারতাম? আমার মীরা এখন প্লে গার্ল! ধুর কী যে ভাবি! মীরা তো আর আমার নেই। আমিই তো পর করে দিয়েছিলাম তাকে।

রাহি গান ছেড়ে ওর ভাগের কাজ করছিল। এতক্ষণ খেয়াল করিনি হঠাই খেয়াল করলাম গানের কথাগুলো ছিল এমন,

তুমি এতো সহজে ভুলতে পারো
অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরো
আমি কেন শুধু ভুলে যেতে পারি না…
আজ অবাক লাগে তোমায় দেখে
আমায় আজ তোমার অচেনা লাগে…

বাকিটা আর শুনতে পারলাম না। নিজেকে সামলাতেও পারলাম না। ছুটে গেলাম রাহির ঘরে। গান চলছিল ওর ল্যাপটপে। ও বিছানার ওপর চেয়ার তুলে তার ওপর দাঁড়িয়ে ফ্যান পরিষ্কার করছিল। আমার কী হলো জানি না! যে ধরনের কাজ আমি কখনো করিনি তাই করলাম। ওর ল্যাপটপটা তুলে একটা আছাড় মারলাম। রাহি অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। আমি বললাম, তুই কি ইন্টেনশনালি এই গান শোনাচ্ছিস আমাকে? মীরা একের পর এক প্রেম করে বেড়াচ্ছে আর আমি এখনো ওকে ভাবি বলে?

নিচে নেমে এসে বলল, কি বলছিস ভাইয়া! আমি কেন তোকে শোনাতে যাব? লিরিকগুলো আমি খেয়ালই করিনি। প্লে লিস্টে ছিল, জাস্ট বেজে উঠল। তবু সরি। আমি তোকে কষ্ট দিতে চাইনি।

ততক্ষণে মা ছুটে এসেছে। মা এই অবস্থা দেখেই বলল, কী সর্বনাশ! তোরা দুই ভাই কি ঝগড়া করছিস?

আমি কিছু বলার আগেই রাহি বলল, না মা। দোষটা আমার। আমি মাফ চেয়ে নিচ্ছি। তুমি প্লিজ যাও। তুমি থাকলে আমরা কথা বলতে পারব না।

মা চলে গেলেন। তবে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ভালোয় ভালোয় দুজনে মিটমাট করে নে। আমার যেন এরমধ্যে জড়ানো না লাগে।

মা চলে যেতেই রাহি দরজা আটকে দিয়ে আমাকে বলল, তোর কষ্টটা বুঝতে পারছি ভাইয়া। প্লিজ মাফ করে দে। আমার হয়তো তোকে এসব বলাই ভুল হয়েছে। আমি আসলে ভেবেছিলাম একরকম, হয়ে গেল আরেকরকম।

আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মীরাকে দেখে ফিরে আসার পর, এমনকি একটু আগপর্যন্তও নিজের রাগ, আবেগ, আক্ষেপ, পেয়ে হারানোর ব্যথা সবকিছু সংবরণ করেই রাখছিলাম। যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু ওই মুহূর্তে সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। আচমকা রাহিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। জীবনে কদাচিৎ কেঁদেছি আমি। কিন্তু কারো সামনে এই প্রথম! রাহি নিজেও বোধহয় খুব অবাক, অপ্রস্তুত এবং অসহায়বোধ করছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে হঠাৎ আমার বড় ভাই হয়ে উঠল যেন। আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, একবার মীরার সামনে গিয়ে দাঁড়া ভাইয়া। একবার বল আজও ভালোবাসিস। কী ক্ষতি? নিজেও তো বুঝিস তোকে হারিয়েই ও এমন হয়েছে!

সত্যি বলতে বুঝি, এটুকু আমাকে বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু মীরাকে কোনো ছেলের সঙ্গে দেখলে এত খারাপ লাগবে এটা কখনো বুঝিনি। যদিও এটাই স্বাভাবিক। একদিন প্রেম না হয় বিয়ে কিছু একটা হবেই। কেউ আসবেই ওর জীবনে। আমি তো সব অধিকার ছেড়েই দিয়েছি। আর তো কথা থাকে না!

রাফসান শিকদার
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

***

রাহির মাধ্যমে আমি চাইলে মীরার সব খবরই পেতে পারি। তবে চাই না। পারতপক্ষে আমি রাহিকে মীরার কথা কিছুই জিজ্ঞেস করি না। কিন্তু মাঝেমাঝে রাহি নিজ থেকেই আমাকে মীরার খবর দেয়। যেমন মীরার বয়ফ্রেন্ড চেঞ্জ হয়েছে কিংবা দারুণ রেজাল্ট করেছে কিংবা কোনো ছেলেকে মেরে মাথা, গাল, নাক ইত্যাদি ফাটিয়ে দিয়েছে। রাহি নিজ থেকে বলতে শুরু করলে অবশ্য না শুনেও পারি না, বরং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে শুনি।

মীরা কেমন বড় হয়ে গেছে না? কত কঠিন হয়ে গেছে! সেদিন আমাদের বাসার ছাদে ওকে যা যা বলেছিলাম সম্ভবত তার সবই মনে রেখেছে। না হয় অত তুলোর মতো একটা মেয়ে এমন পাথর হয় কী করে? অবশ্য যে কষ্ট আমি ওকে দিয়েছি তাতে তো ওর পাথরই হবার কথা।

রাফসান শিকদার
৩১ জানুয়ারি, ২০১৭

এতদিন পর পর কথা বলি বলে কি রাগ করিস বকুল? আসলে এখন এত ব্যস্ত থাকি সবসময় ইচ্ছে করলেও লেখা সম্ভব হয় না। তোকে কিছু সুখবর দিই। পাশের দোকান নিয়ে দোকান বাড়াতে বাড়াতে এখন আমার মোট দোকান ৮টা। এর মধ্যে ৬টা কেনা-বাকিগুলো ভাড়া। সম্প্রতি হাতীরপুলে একটা ফ্ল্যাটও কিনেছি। ফ্ল্যাট কেনার সময় অবশ্য রাহিও শেয়ার করেছে। ব্যবসায় এভাবে সফলতা আসবে কখনো কল্পনাও করিনি। এখনো প্রতিমুহূর্তে আমি অবাক হই। জীবনে এখন সবকিছু আছে, কোনোকিছুর অভাব নেই। কিন্তু বুকের ভেতরটা শূন্য। এটাই হয়তো আমার নিয়তি।

রাফসান শিকদার
১৬ আগস্ট, ২০১৭

আজ রাহির অফিস বন্ধ ছিল। এই সুযোগে আজকের জন্য দোকানের দায়িত্ব। ওকে দিয়ে আমি পালালাম। মাঝেমাঝে বড় ক্লান্ত লাগে। কিছুই ভালো লাগে না। এদিক ওদিক ঘুরছিলাম। হঠাৎ কী হলো জানি না আমি জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি চলে গেলাম। গেটের সামনে থেকে একটা মাস্ক কিনে পরলাম। মাথা জড়িয়ে ফেললাম মাফলারে। তারপর একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম মীরার হলের সামনে। আমি আসলে জানি না আজ মীরা হলে আছে কি না কিংবা বের হবে কি না। আমি আসার আগেই যদি কোথাও বের হয় তো কখন ফিরবে। তবুও দাঁড়িয়ে রইলাম। আজ তো আমার কোনো কাজ নেই। অপেক্ষা ব্যাপারটা অতটাও খারাপ নয় যদি তা হয় কোনো মহামূল্যবান মানুষের জন্য! দুপুরবেলা ক্ষুধা লাগল। ক্ষুধা পেটেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু সন্ধ্যা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন মীরার দেখা মিলল না তখন আমার মনে হলো আজ বোধহয় ভাগ্যটা আমার সুপ্রসন্ন নয়। সন্ধ্যার পর এই জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। প্রচণ্ড মশা ও পোকামাকড়ে ভরা। তা ছাড়া শীত পড়েছে। প্রচণ্ড রকম। আমার গায়ে কেবল পাতলা একটা জ্যাকেট। এতে এই তীব্র শীত মানছে না। আমি ফিরে আসার জন্য হাঁটা ধরলাম। কিছুদূর আসার পরেই দেখলাম মীরা একটি ছেলের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। মীরার মুখটা থমথমে। এর আগেরবার ওকে যখন দেখেছিলাম তখন ও হাসছিল। দেখে ভালোই লেগেছিল কিন্তু আজ ওর মুখটা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। ওর মন খারাপের কারণ কী পাশের ছেলেটা?

ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার ইচ্ছে হলো ছেলেটাকে পিটিয়ে আধমরা করে দিয়ে বলি, আর কখনো মীরার হাত ধরবি না।

হা হা হা খুবই হাস্যকর ইচ্ছে। কাপুরুষোচিত হিরো গিরি! নিজের যোগ্যতা নেই ওদিকে অন্যের হতে দেখলে জ্বলে। আমি সম্ভবত আমার ভেতরের এই রাফিকেই সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি।

রাফসান শিকদার
১৯ ডিসেম্বর, ২০১৭

বিয়ে কর বিয়ে কর বলে মা আমার মাথা খেয়ে ফেলছিল। এদিকে রাহির গার্লফ্রেন্ডের বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ। রাহি পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি করছে। ওর বিয়ে করতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু মা এবং রাহি দুজনেই চায় আমার বিয়ের পর রাহির বিয়ে হোক। এই নিয়ে কত দরবার যে করলাম! অবশেষে অনেক কষ্টে দুজনকে রাজি করিয়ে রাহিকে বিয়ে করিয়েছি।

আমার অবস্থাটা আমি কাউকেই বোঝাতে পারি না। আমি জানি আমি মীরাকে কখনোই পাব না। মীরা অলরেডি অন্য কারো হয়ে গেছে। স্থায়ীভাবে না হলেও আমাকে মন থেকে মুছে ফেলেছে। তবুও এটা জানার পরেও ওর জায়গায় আমি অন্য কাউকে ভাবতে পারি না। কেউ প্রেমের প্রস্তাব দিলে এরপর থেকে তাকে দু চোখে দেখতে পারি না। মনে হয় এই মানুষটা মীরার ক্ষতি করতে চলেছে। কি ছেলেমানুষি চিন্তাভাবনা! অথচ প্রথম ভালোবাসা হওয়া সত্ত্বেও কত সহজেই শান্তনাকে ভুলে গিয়েছিলাম। মীরাকে গ্রহণ করেছিলাম! ভালোবাসা প্রকৃতির মতো, এর এত রূপ এত রং এত বৈচিত্র্য যে বুঝে ওঠা দায়। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেল, মীরা গেল না। আমি নিজেকে যতটা শক্ত মানুষ ভাবি আদৌ কি আমি ততটা শক্ত? তোর কী মনে হয় বকুল?

রাফসান শিকদার
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মীরা তুমি মানুষ নাকি এক কষ্ট?
নাহলে বুকের ভেতর জমাট বেঁধে আছো কেন?
মুক্ত করে দিয়েছি, উড়ে যাও…
আমার বুকের মাঝেই কেন ঘুরপাক খাচ্ছ বারংবার?
এক মুহূর্তের জন্যও সরাতে পারি না
ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছি কালো অন্ধকারের অতলে।
চারপাশে টুনটুনি পাখির মতো উড়ে বেড়ায় সুখ,
ধরে বুকপকেটে রাখতে পারি না
তার খুব কাছেই যে আছো তুমি।
অন্য কেউ ঘেঁষতে পারে না এদিকে!
এ কি তোমার অভিশাপ?
নাকি একচ্ছত্র আধিপত্য?
নাকি তীব্র ভালোবাসা?

রাফসান শিকদার
১৮ মার্চ, ২০১৮

বিয়ের যন্ত্রণায় অনেক বেশিই অতিষ্ঠ। মা আমার বিয়ের জন্য এমনভাবে উঠে পড়ে লেগেছেন যা অবর্ণনীয়। তিনি এরই মধ্যে মেয়ে দেখা শুরু করেছেন। একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনে এভাবে কষ্ট দেয়ার কোনো মানে আছে? স্বামী ভালো না বাসলে ব্যাপারটা যেকোনো মেয়ের জন্যে কষ্টের। স্বামী তার এক্স গার্লফ্রেন্ডকে ভালোবাসলে সেটা আরো কষ্টের। মাকে এই জিনিস বলার সাধ্য যে আমার নেই! কীভাবে যে এভয়েড করছি বোঝাতে পারব না।

রাফসান শিকদার
২২ এপ্রিল, ২০১৮

আমি কিছু প্রশ্নের উত্তর অনেক ভেবেছি। প্রশ্নগুলো আচমকাই মাথার মধ্যে গেড়ে বসেছিল। আমি কেন বিয়ে করছি না? আমি কি আজীবন বিয়ে না করে থাকব? থাকলে কেন থাকব? উত্তর অবশ্য নিজেই খুঁজে বের করেছি। মীরা এখনো বিয়ে করেনি বলেই হয়তো আমি বিয়ে করিনি। ও বিয়ে করে ফেলার পরেই আমি বিয়ে করব। না মীরাকে পাওয়ার কোনো প্রত্যাশা আমি করি না। আমি আসলে চাইও না। তবুও ও বিয়ে করার পরে আমি বিয়ে করব। এতে হয়তো আমি মানসিকভাবে শান্তি পাব। কারণ জানা নেই। খুঁজলে হয়তো পাব কিন্তু খুঁজতে চাচ্ছি না।

রাফসান শিকদার
২৯ এপ্রিল, ২০১৮

***

মা দুদিন পর পর আমাকে জিজ্ঞেস করছেন আমার কোনো পছন্দ আছে কি না। কখনো সরাসরি জিজ্ঞেস করছেন কখনোবা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করছেন। আমি প্রতিবারই না বলছি। আমার উত্তর মায়ের মন মতো হচ্ছে না আবার আমাকে অবিশ্বাসও করতে পারছেন না। কারণ যদি কোনো সম্পর্ক থাকত তাহলে সেটা তিনি বুঝতেই পারতেন। কিছু হলেও টের পেতেন। কারণ যে দুটি প্রেম আমার জীবনে এসেছিল তা আমি এক সপ্তাহও লুকিয়ে রাখতে পারিনি।

কিছুদিন আগে একদিন মাকে ডেকে সামনে বসলাম। বুঝিয়ে বললাম,

মা আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো, এইযে তুমি দুদিন পর পর আমার বিয়ে নিয়ে উঠেপড়ে লেগে যাও এটা আমার একদম ভালো লাগে না। আমার বাসায় ফিরতে আতঙ্ক কাজ করে।

মা অভিমানী গলায় বলল,

ও এখন আমি আতঙ্ক হয়ে গেছি?

উফ মা! মা আমার ভুল বুঝো না আমাকে। আমি বলতে চাইছিলাম বিয়ে বিষয়টা আমার কাছে একটা আতঙ্ক হয়ে গেছে এখন। তবে সারাজীবনের জন্য না। শুধুমাত্র এই মুহূর্তের জন্য। আমাকে এখন জোর করো না। আর মাত্র ৪/৫ বছর সময় দাও।

এখন তোর বয়স কত?

৩১।

বিয়ের বয়স হয়নি?

হয়েছে মা। কিন্তু আমার আরেকটু সময় দরকার।

৪-৫ বছর পর বয়স কত হবে?

এইতো ৩৫/৩৬।

তখন আর বিয়ের বয়স থাকবে?

কী যে বলো না মা তুমি! পুরুষ মানুষের বিয়ের বয়স থাকে ৫০ পর্যন্ত।

এই তথ্য তোমাকে কে দিল?

মা তুমি সম্বোধনে কথা বলতে শুরু করেছেন তার মানে তিনি রেগে গেছেন। মায়ের হাত দুটো ধরে বললাম,

মা রেগে যাচ্ছ কেন! আমাকে বোঝার চেষ্টা করো। আমার কি কোনো সমস্যা থাকতে পারে না?

কী সমস্যা তুই আমাকে বল। আমি সব সমাধান করে দেব।

সময়টাই সমস্যা মা। সময় দাও। সমাধান একা হয়ে যাবে।

মা উঠে চলে গেলেন। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে তর্কযুদ্ধে মাকে পরাভূত করতে পারলাম কি না। বুঝলাম তখন যখন মা আর আমার বিয়ে নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেন না।

রাফসান শিকদার
১৪ মে, ২০১৮

বড় ধরনের এক ঝড় পার করে তোকে লিখতে বসেছি। মা আমার বিবাহ বিষয়ে কয়েক মাস নিভে থাকলেও আবার জ্বলে উঠেছেন। হঠাৎ এক মেয়ে পছন্দ করে বসল আমার জন্যে। বলা নেই কওয়া নেই, মেয়ে দেখতে চল। কিছু বললে আবার গাল ফুলিয়ে বসে থাকে, বাবার কথা টেনে আনে! এই ব্যাপারগুলো আমার মায়ের সঙ্গে ঠিক যায় না। হয় সে আমাকে বশ করার জন্য ইচ্ছে করে সেন্টিমেন্টাল হচ্ছে নাহয় বয়স হয়ে গেছে বলে বোধবুদ্ধি লোপ পাচ্ছে।

আমি বুঝি না মীরা বিয়ে করে না কেন? ও বিয়ে করলেই তো আমি বিয়ে করে মাকে শান্ত করতে পারি। অবশ্য বিয়ে করবেই বা কেন? বিয়ে করলে তো আর দুদিন পরপর নিত্য নতুন দিওয়ানা জোটাতে পারবে না। ফাজিল মেয়ে!

অবশেষে মাকে আর সামলাতে না পেরে মেয়ে দেখতে গেলাম। দেখলেই তো আর বিয়ে করতে হবে না। কোনো একটা ছুঁতো দিয়ে কেটে পড়তে হবে। কিন্তু ছুঁতো দেয়ার মতো কিছু খুঁজেই পেলাম না। মেয়ে বেশ তথাকথিত সুন্দরী। লম্বা, ফরসা। মেয়ের সঙ্গে আমাকে আলাদা কথা বলতে দেয়া হলো। তখন। মনে হলো সে আমার ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী। চিন্তায় আমার মাথা খারাপ। কিন্তু বেশি চিন্তা করতে হলো না। দুদিন পর তারা আফসোসের সহিত জানালো তারা শিক্ষিত পাত্র চায়। আমি আলহামদুলিল্লাহ বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারত কিন্তু হলো না। অনেক রাতে মেয়ে ফোন করে বলল, আমি রাজি থাকলে সে পালিয়ে আসবে। তার পরিবার রাজি না থাকলেও সে রাজি। সে নাকি আমাকে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছে। লাভ এট ফার্স্ট সাইট। সে নাকি আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্নটপ্ন দেখে ফেলেছে। কী সর্বনাশের কথা! আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম এটা সম্ভব না। এই বয়সে এসে আমার মনে কোনো প্রেম নেই। সে তো কিছুতেই বোঝে না। তার জ্বালাতন প্রায় সপ্তাহখানেক চলল। এরপর সে ফোন করলেই দোকানের কোনো ছেলেকে দিয়ে কথা বলাতাম। এসব করার পর অবশেষে থেমেছে সেই মেয়ে।

যাই হোক এবার মূল কথায় আসি। তোর মনে আছে বকুল কেন আমি মীরাকে ছেড়েছিলাম? ঠিক যে ভয় পেয়ে আমি মীরাকে ছেড়েছিলাম সেটাই সত্যি হয়েছে। মীরার ফ্যামিলি না হোক অন্যকোনো মেয়ের ফ্যামিলি তো আমাকে সেই কারণেই রিজেক্ট করল? এই ঘটনার পর আমার আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে গেল। রাহি পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হলো, আমি যা করেছিলাম ঠিক করেছিলাম।

রাফসান শিকদার
১২ অক্টোবর, ২০১৮

এই ঘটনায় আমার মা মোটেও দমে যাননি। তিনি তার মতো করেই মেয়ে দেখে চলেছেন। এবার আর আমি বাঁধা দিচ্ছি না। বরং বিবাহের জন্য বেশ আগ্রহ প্রকাশ করছি। কারণ কোনো মেয়ের পরিবারই অশিক্ষিত ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে না। আর যদি কেউ রাজি হয়ও তবে সেখানে খুঁত ধরার জন্য আমি আছি। আর এই খুঁত ধরাধরি কার্যক্রম চলবে শুধু মীরা বিয়ে করার আগ পর্যন্ত। ও আগে অন্যকারো হোক, তারপর নাহয় আমি অন্যকারো হব কিংবা হওয়ার চেষ্টা করব।

রাফসান শিকদার
১৪ নভেম্বর, ২০১৮

***

ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলাম আমি আজ যখন মীরাকে আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম! তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। তার মাঝে মীরা দাঁড়িয়ে ছিল। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, যেভাবেই হোক ও জেনে এসেছে এটা আমার বাসা। তার মানে আমার কাছে এসেছে। কিন্তু এত বছর পর আমার কাছে কেন এলো? সঙ্গে একটি মেয়ে ছিল, সম্ভবত ওর কাজিন। ওই মুহূর্তে যার সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল মীরা। ওই সুযোগে আমি বাড়িতে ঢুকে যেতে পারতাম। ও আমাকে দেখতোও না। কিন্তু আমি পারলাম না। এত কাছ থেকে ওকে দেখে আমি আউলে গিয়েছিলাম। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে কি সুন্দর যে লাগছিল ওকে! মনে হচ্ছিল প্রতিটি বৃষ্টির কণা ওকে ছুঁতে পেরে মুখরিত আজ!

সঙ্গে ছাতা না থাকায় আমিও ভিজে গিয়েছিলাম। সেই অবস্থাতেই এগিয়ে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বললাম। উত্তেজনায় আমি যে কী কী বলেছি আমার এখন মনেও নেই। নিজেকে যথাসম্ভব হাসিখুশি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার কোনো প্রশ্নের কোনো উত্তর মীরা দিল না। সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর অবাক করে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল।

মাথার ওপর বৃষ্টি, বুকে আমার মীরা। আর কি কিছু লাগে? ৯ বছর ধরে বুকে জ্বলতে থাকা আগুন নিভে গেল এক পলকের সুখে। আবেশে আমার চোখদুটো বন্ধ হয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য আমি পুরো দুনিয়া ভুলে গেলাম। সবকিছুকে তুচ্ছ করে আমি শুধু ওই মুহূর্তটা অনুভব করতে চাইছিলাম। আমি অবশ্য ওকে জড়িয়ে ধরিনি কিন্তু খুব ইচ্ছে করছিল ধরি। কিন্তু তাতে যে আমার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায়!

আমি জানি এই সুখ চিরস্থায়ী না, এই সুখের যোগ্য মালিকও আমি নই। সেই মুহূর্তেই লক্ষ করলাম, মীরা কাঁদছে। নিজেকে আর গলতে দিলাম না। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বললাম। সরিয়ে দিতে চাইলাম। কাজ হলো না। অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরেছিল। শেষপর্যন্ত কী কী বলে ছাড়িয়েছি কিছু খেয়াল নেই। কোনোভাবে ছাড়িয়ে ওদের বাসায় নিয়ে এলাম। আমি আসলে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কী হচ্ছে না হচ্ছে-কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি বেশ কয়েকবার মীরাকে দেখতে গিয়েছি। দূর থেকে দেখে চলে এসেছি। কিন্তু এমন অদ্ভুত ঘোরে আমি কখনো পড়িনি। হয়তো কখনো মীরা এতটা কাছে আসেনি বলেই।

ঘোরে মীরাও পড়েছিল। তাইতো সেও অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারেনি। আমি তাও টুকটাক কথা চালিয়েছি, ও সেটাও পারেনি। অথচ ওর কাজিন বলল ওরা আমাকে খুঁজতে এসেছিল। আমাকে খুঁজতে এসেছে অথচ পাওয়ার পরে কোনো কথা নেই! শুধু বলল, আমার সঙ্গে ওর অনেক কথা আছে, একদিন সময় দিতে। আর কিছুই বলতে পারল না। আমি জানি ওর। মনে হাজারো প্রশ্ন। এবং সেসবের উত্তর এখন আমাকে দিতেই হবে। আমি অবশ্য উত্তর দিতে প্রস্তুত আছি।

ওর এই ঘোরের কারণেই একটা ব্যাপার পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে গেল যে ও এখনো আমাকে আগের মতোই ভালোবাসে। নিজেকে সেই মুহূর্তে একইসঙ্গে ভাগ্যবান এবং দুর্ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। ভাগ্যবান মনে হচ্ছে পাগলিটা আমাকে এখনো পাগলের মতোই ভালোবাসে তাই। দুর্ভাগ্যবান মনে হচ্ছে সেই ভালোবাসা আজও আমি দু হাতে গ্রহণ করতে পারব না তাই।

বহুদিন পর আজ রাতের ঘুম হারিয়ে গেল আমার! এত ক্লান্তির পড়েও ঘুমাতে পারছি না।

রাফসান শিকদার
০৬ জুলাই, ২০১৯

আজ মীরা দেখা করতে চাইল, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে। ওর ইচ্ছেমতো সেখানেই দেখা করে এলাম। মীরার সব প্রশ্ন ছিল আমার হারিয়ে যাওয়া বিষয়ক। মীরা তখন নাবালিকা এবং বোকা ছিল। কিন্তু এখন সাবালিকা এবং বেশ বুদ্ধিমতী। এখন ওর সঙ্গে কথায় পারা মুশকিল। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি তখনকার পরিস্থিতিটা ওকে বোঝানোর। মীরা হয়তো বুঝেছে। কিন্তু আমি অবাক হলাম এটা জেনে যে ও নাকি এই ৯টা বছর ধরে আমাকে খুঁজেছে। এমনকি আমার বাড়ি খুঁজতে নাকি ব্যাংক টাউন পর্যন্তও এসেছে কিন্তু রাস্তা চিনে বাড়ি খুঁজে বের করতে পারেনি। আরো বেশি অবাক হলাম এটা জেনে যে ও এখনো আমাকে চায়! আমার আফসোস যে আরো বেড়ে গেল বকুল। সেই পাগলপারা ভালোবাসা যে এখনো অটুট কিন্তু তা গ্রহণ করার সামর্থ্য আমার নেই। বিধাতা কেন আমাকে এমন অসহায় পরিস্থিতিতে ফেললেন? বারবার কেন আমার ভালোবাসাকে দু হাতে ঠেলে সরিয়ে দিতে হয়? এই এক ভালোবাসায় আর কত পুড়তে হবে?

রাফসান শিকদার
০৮ জুলাই, ২০১৯

আচ্ছা যদি তখন মীরা বাড়ি চিনে চলে আসতে পারত তাহলে আমি কী করতাম? তখনো কি আমি পারতাম ওকে ফিরিয়ে দিতে? নাকি জীবনটা অন্যরকম হতো? সেই অন্যরকমটা আসলে কেমন? অভাব আর সমস্যার সম্মুখীন হতে হতে কি তিক্ততায় ভরে যেত দুজনের মন? নাকি একই কারণে দুজনে আরো আপন হয়ে যেতাম? জানি না তবে এটুকু জানি মীরা ভালো থাকত না। আর এই সম্পর্ক কোনো পরিণতি পেত না শুধু পালিয়ে বিয়ে না করলে। কোনো বাবার মেয়েকে তার থেকে চুরি করে আনা আমার পক্ষে তো সম্ভব না। আমার বাবা যে ভুল করেছে সেই ভুল আমি করব না। যদি কখনো বিয়ে করি আর বাবা হই তাহলে এমনভাবেই করব যাতে আমার সন্তানরা যেকোনো বিপদে দুই পরিবারের সহায়তা পায়।

রাফসান শিকদার
০৮ জুলাই, ২০১৯

মীরা প্রায় প্রতিদিন ফোন করে কেন আমাকে? ও কি সত্যিই এখনো আমাকে পাওয়ার আশা করে? তাহলে তো বলতে হবে ও এখনো বোকাই রয়ে গেছে।

আমি মনে-প্রাণে চাই ও আমাকে আর ফোন না করুক। আমার থেকে দূরে থাকুক। যখন ফোন করে বাধ্য হয়েই ইগনোর করতে হয়। ওকে ইগনোর করতে আমার অনেক কষ্ট হয়। সেই পুরনো কষ্ট! প্রতিমুহূর্তে ভয় হয়! কখন না আবার লোভে পড়ে আত্মসমর্পণ করে ফেলি!

রাফসান শিকদার
২৫ জুলাই, ২০১৯

মীরা আজ আবার এসেছিল দেখা করতে। এবার এলো দোকানে। মেয়েটা যে কী পাগলামি শুরু করেছে! আজ আমাকে কথার প্যাঁচে ফেলে স্বীকার করিয়ে ছাড়ল যে আমি এখনো ওকে ভালোবাসি। ভালোবাসলে বাসি। তাতে কার বাপের কী? আমি কাকে ভালোবাসব কতদিন ধরে ভালোবাসব সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ ব্যাপারে কাউকে কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই!

রাফসান শিকদার
১২ আগস্ট, ২০১৯

***

যে ভয় আমি করছিলাম তা মীরার দুঃসাহসিক কাজের কাছে কিছু না। আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি মীরা আমার বাসায় এসে আমার মায়ের সঙ্গে আমাদের প্রেম- বিয়ে নিয়ে কথা বলবে! জি মীরা তাই করেছে। আমি দোকানে ছিলাম সেই সুযোগে সে এসে মাকে আগাগোড়া সব বলেছে। রাহির বউ আমাকে ফোন না করলে তো আমি জানতেই পারতাম না।

মীরার মতিভ্রম হয়েছে। আমার মাকে বলে কি না ওর বাসায় গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে! আর আমার মা? সেতো ছেলে বিয়ে করানোর জন্য অতি উৎসাহী, সুযোগ একটা পেয়ে মীরার তালে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। একই জিনিস কেন বারবার বোঝাতে হয় আমি জানি না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে আমার। আজ আমি মীরার সঙ্গে প্রচণ্ড খারাপ ব্যবহার করেছি। স্পষ্ট ভাষায় বাসা থেকে বের করে দিয়েছি। আমার কষ্ট হয়েছে কিন্তু এ ছাড়া উপায় ছিল না। যতক্ষণ ও অপমানিত বোধ না করবে ততক্ষণ দূরে সরবে না।

বারবার আমাকে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে কেন পড়তে হয় আমি জানি না। কী এমন পাপ করেছিলাম?

রাফসান শিকদার
১১ আগস্ট, ২০১৯

মীরা,

আমার হাওয়াই মিঠাই, চলো আমরা আবার ৯-১০ বছর পেছনে ফিরে যাই। কথা দিচ্ছি, এবার আর ভালোবাসা শেখাব না তোমায়। তোমার কাকচক্ষু জলের ওই দিঘিসুলভ চোখেও মরব না আর। তোমার প্রেমে মজে পাগল প্রেমিকও হব না আর। রং নাম্বারে কথা বলা অচেনা দূরের মানুষ হয়েই রয়ে যাব আজীবন। ভালোবাসার সুখে ভাসতেও হবে না। বিরহের দুঃখে ডুবতেও হবে না। খুব হিসেব করে পা ফেলব। জীবনটা হয়তো অন্যরকম হবে। নাকি পেছনে গিয়েও আবার আমারই ভালোবাসার জালে জড়াবে? চলো না মীরা… কথা দিচ্ছি, এবার আর জাল ফেলব না। এত কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।

রাফসান শিকদার
১৪ আগস্ট, ২০১৯

বকুল, বকুল রে,

আজকের দিনটা আমার জীবনে ভীষণ আনন্দের দিন। এমন আনন্দের দিন আমার জীবনে এর আগে একবারই এসেছিল, মা যেদিন ফিরে এসেছিল। কী হয়েছে জানিস? মীরার বাবা এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি নিজে মীরাকে আমার হাতে তুলে দিতে চায়। বিশ্বাস হচ্ছে তোর? আমারও প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি। উনার কথাবার্তায় ব্যবহারে একদিনেই আমি উনার ফ্যান হয়ে গেছি।

মা নাকি কিছুদিন আগে আমাদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মীরাদের বাড়িতে গিয়েছিল। আমাদের বিচ্ছেদের কারণে মীরা নাকি অনেক পাগলামি করত, তা দেখে উনি কষ্ট পেতেন। এজন্য আমার ওপর অনেক রেগে ছিলেন কিন্তু সব জানতে পেরে তার রাগ ভেঙে যায়। শুধু তাই না। আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তার নাকি আমাকে পছন্দ হয়েছে, মীরার যোগ্য বলে মনে হয়েছে। আমি জানি না তিনি আমার সম্পর্কে ঠিক কী জেনে আমাকে মীরার যোগ্য বলে মনে করেছেন। তার নাকি মনে হয়েছে আমি মীরাকে সামলে রাখতে পারব। সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল আমি জ্যাকপট পেয়ে গেছি। খুশিতে আমার গলা জড়িয়ে যাচ্ছিল। কথা বলতে পারছিলাম না। আমি এখনো ঠিকঠাক গুছিয়ে লিখতে পারিনি। তুই একটু কষ্ট করে বুঝে নিস। অনেক অনেকদিন পর আমি এত খুশি এত উত্তেজিত যে সব গুলিয়ে ফেলছি।

বাসায় ফেরার আগে অবশ্য নায়িকার সঙ্গে দেখা করে এসেছি। এতদিন ও আমাকে বারবার জড়িয়ে ধরেছে আমি ধরতে পারিনি। প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছি। আজ সব নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দেয়ার দিন। আজ থেকে সব কষ্ট পুষিয়ে নেয়ার কাল শুরু। আজ ওকে একবার জড়িয়ে ধরতেই হবে।

কিন্তু তার জন্য বেশ কাঠখড় পোড়াতে হলো। আজ সুযোগ পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ নাচাল আমাকে। ফোনই ধরছিল না। ছটফট করছিলাম তবে এই শাস্তি আমি মাথা পেতে বরণ করলাম। ওর বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক ঘণ্টা। অবশেষে ফোন ধরলেন তিনি।

কী করেছি জানিস? সেই যৌবনের প্রেমের মতোই দুঃসাহসিক কাজ করেছি। লুকিয়ে ওদের বাসার ছাদে গিয়ে জড়িয়ে ধরে হৃদয় শান্ত করে এসেছি। হৃদয় অবশ্য আরেকটু বাঁধনহারা হতে চাচ্ছিল। কিন্তু ইরা পাহারায় ছিল। তাই আর বাড়লাম না।

রাফসান শিকদার
২৪ আগস্ট, ২০১৯

মীরার বড় ভাই দেশে ছিলেন না। তাই তিনি আসতে পারেন এমন সময়ে বিয়ের তারিখ ফেলা হবে। ভাইয়া ডিসেম্বরে দেশে আসবে। আমি একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলাম। বিয়ের তারিখ ফেললাম ৭ ডিসেম্বর। মা বললেন,

শনিবার কে আসবে তোর বিয়ে খেতে? বিয়ে হয় শুক্রবার। শনিবার কেন?

আমি বললাম,

ঠিকাছে তাহলে অনুষ্ঠান পরের শুক্রবার করো। কিন্তু বিয়ে পড়ানোর। কাজটা ৭ ডিসেম্বরেই হওয়া চাই।

আমার মা বুদ্ধিমতী মানুষ। তাকে এর বেশি বলতে হলো না। সে বুঝে গেল এই দিনটি নিশ্চয়ই বিশেষ। ৭ ডিসেম্বরই বিয়ের ডেট ফাইনাল হলো। কিন্তু দেখ, মীরাই বুঝল না। বিশেষ দিন মনে রাখতে না পারলে সে রাগ করত। অথচ এখন নিজেই ভুলে গেল। তুইও কি ভুলে গেছিস নাকি বকুল? ছি! এসব দিন মানুষ কীভাবে ভোলে? যা তোকে হোমওয়ার্ক দিলাম খুঁজে বের কর ৭ ডিসেম্বর কেন বিশেষ।

রাফসান শিকদার
৩০ আগস্ট, ২০১৯

মীরা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। সত্যিই তো তারিখের ব্যাপারটা বিয়ের সময় তার মাথায় আসেনি। রাফির সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে এই আনন্দে তখন দিন দুনিয়া। ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু তাই বলে এমন দিনটা সে কীভাবে ভুলে গেল? এই দিনেই রাফি তাকে নিজের করে নিল অথচ সে কিছুই টের পেল না। এমনকি বিয়ে হয়ে এতবছর কেটে যাওয়ার পরেও রাফি একটি বার তাকে এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল না! ডায়েরি না পড়লে তো এই সারপ্রাইজ তার কখনোই পাওয়া হতো না।

***

আজ দুপুরবেলা আমি যে খবরটা পেলাম সেটা প্রথমে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। যখন বিশ্বাস হলো তখন আমার মনে হলো আমার এক্ষুণি ধামরাই যাওয়া প্রয়োজন। আমি নিশ্চিত ছিলাম না এই পরন্ত বিকেলে ধামরাই থানায় গিয়েই শান্তনা কে পাব কি না। ও ব্যস্ত মানুষ। তবে থানায় না পেলেও কোয়ার্টারে পেলাম। থানার লোক আমাকে ওর কোয়ার্টার দেখিয়ে দিল। দরজা খুলে আমাকে দেখে শান্তনা একটা চিৎকার দিল,

রাফি! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুই আমার বাসায় এসেছিস?

আমি হেসে বললাম,

কি অসামাজিক আচরণ! এতদূর থেকে এসেছি বসিয়ে চা-পানি দিবিতা দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস!

ও সরে দাঁড়িয়ে বলল,

সরি ভেতরে আয়।

শান্তনা উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছিল না। পাগলের মতো কিসব যে বলছিল! আমি ড্রয়িংরুমে বসে ওর শান্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এর মধ্যে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল,

মা কে এসেছে?

শান্তনা কেমন আমতা আমতা করছিল। আমি ওর মেয়েকে বললাম,

আমি তোমার একটা মামা।

শান্তনা এ কথায় প্রচণ্ড লজ্জা পেল। হাসিও আটকাতে পারছিল না। ওর মেয়ে বলল,

কিন্তু আমি তোমাকে আগে কখনো দেখিনি।

শান্তনা বলল,

ও তোমার রূপ খালামণির ভাইয়া।

সেতো রাহি মামা।

ও রাহির বড় ভাই। ওর নাম রাফি।

আই সি।

এরপর মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

রাফি মামা আমি রূপ খালামণির কাছে তোমার নাম শুনেছি। কিন্তু কখনো দেখিনি তো তাই ভুলে গিয়েছিলাম।

আমি হেসে বললাম,

কোনো সমস্যা নেই মা।

ঠিকাছে আমি এখন খেলতে যাচ্ছি। তুমি থাকো পরে কথা হবে।

মেয়ে চলে গেলে শান্তনা বলল,

তুই কি কোনো বিশেষ কারণে এসেছিস?

হ্যাঁ তোকে ধন্যবাদ এবং ক্ষমা দিতে এসেছি।

ক্ষমাটা বুঝলাম কিন্তু ধন্যবাদ কেন?

কারণ মীরাকে আমার ঠিকানা তুই দিয়েছিস। থ্যাংক ইউ সো মাচ।

কিন্তু এখানে তো আমার কোনো ক্রেডিট নেই। মীরা নিজেই চাচ্চুকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছিল। ও এসে চেয়েছে বলেই দিয়েছি। তেমন কিছুই তো করিনি।

হ্যাঁ ও এসেছিল কিন্তু ধর তুই যদি ঠিকানা না দিতি তাহলে তো ও আমাকে পেত না। অবশ্যই তোর ক্রেডিট আছে। তুই এতবার ক্ষমা চাওয়ার পরেও আমি তোকে ক্ষমা করতে পারিনি। কিন্তু এবার তুই যা করেছিস তা জানা মাত্র ক্ষমা আপনা আপনি চলে এসেছে।

আল্লাহ বাঁচিয়েছে। অবশেষে ক্ষমা পেলাম।

হ্যাঁ একদম মন থেকে।

কত ভালোবাসিস ওকে!

তোর তো অবাক হওয়ার কথা? আমার ভালোবাসা সম্পর্কে তোর চেয়ে বেশি কারো জানার কথা নয়।

দুটো ভালোবাসায় আকাশ পাতাল তফাৎ। আমার পরেও তুই আবার কাউকে ভালোবাসতে পেরেছিস কিন্তু ওর পর তো আর কেউকে ভালোবাসতে পারিসনি।

সেটা আমার ভালোবাসার কারণে নয়। ওর ভালোবাসার কারণে। যে শুদ্ধ এবং তীব্র ভালোবাসা ও আমাকে দিয়েছে তার পর মন আর নড়াতে পারিনি। বিচ্ছেদ আমার দোষে হয়েছে। ওর কিছু দোষ যদি থাকত তাহলে ভুলে যাওয়া সহজ হতো।

বললি ক্ষমা করে দিয়েছিস তারপর আবার খোটাটা ঠিকই দিলি।

না না ভুল বুঝিস না। আমি কথার প্রসঙ্গে কথাটা বলেছি। তোকে ইঙ্গিত করে বলিনি। আমি যদি ক্ষমা না করতাম তাহলে তোর বাসায় এসে সামনে বসে কথা বলতাম না।

রাফি আমি এখন বেশ সুখী মানুষ। কিন্তু এই একটা কষ্ট আমার ভেতর ছিল যে তোর সঙ্গে আমি অন্যায় করেছি। অনুতপ্ত হওয়ার পরেও ক্ষমা পাইনি। কিন্তু আজ থেকে সব কষ্ট মুছে গেল।

আরে হ্যাঁ, তোর খবর শুনে তো আমি অবাক হতাম। আজকে দেখে আরো বেশি অবাক হলাম। কেমন লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে একজনের সঙ্গে এতবছর ধরে সংসার করছিস। আবার এক মেয়ের মা।

শান্তনা হেসে বলল,

আমার মতো লাফাঙ্গা মেয়ের সম্পর্কে এরকম খবর শুনলে অবাক হবারই কথা। কিন্তু বিশ্বাস কর মেয়েটা হবার পর আমি হঠাৎ কেমন বদলে যেতে লাগলাম। এর আগ পর্যন্ত সংসারে আমার মন ছিল না।

আমি হেসে বললাম,

ভাগ্যিস বদলালি।

শান্তনাও হাসল। এরপর আমি ওকে আমাদের বিয়ের কার্ড দিলাম। কার্ড পড়ে সে পুরোনো ঢঙে বলল,

আমার বিয়েতে তো তুই আসিসনি। তোর বিয়েতে কেন যাব?

আমি হেসে বললাম,

তখন তোর প্রতি আমার ঘৃণা ছিল। তার ওপর ওই সময়টা বলতে গেলে আমি দুনিয়ার বাইরে ছিলাম। সেই সময়ের সঙ্গে এখনকার তুলনা চলে না।

হ্যাঁ একটা ঈদেও তো তোকে দাদাবাড়িতে দেখা যেত না। কীসের এত অভিমান তোর সবার ওপর বল তো? চাচ্চু মারা যাবার পর আত্মীয়স্বজন একদম ভুলেই গেলি!

বাপ-চাচাঁদের নির্মম ব্যবহারের কথা শান্তনার শুনতে এবং আমার বলতে ভালো লাগবে না। তাই এড়িয়ে গেলাম। চা খেতে খেতে শান্তনার স্বামী অফিস থেকে ফিরে এলো। তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আবারও অবাক হলাম। কি অমায়িক ব্যবহার! সাচ আ জেন্টলম্যান। ভালো লাগল।

কারো প্রতি রাগ ঘৃণা পুষে রাখার মধ্যেও একটা সূক্ষ্ম কষ্ট আছে। আজ এতবছর পর ওকে ক্ষমা করে দিতে পেরে আমার নিজেরও ভালো লাগছে।

রাফসান শিকদার
০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

যে বউ আমার কপালে জুটতে চলেছে, ব্যবসা লাটে উঠবে। প্রতি শুক্র-শনি অর্থাৎ তার ছুটির দিনে সে দোকানে এসে হাজির। দোকানের ছেলেরা তাকে ভাবি ভাবি বলে ডাকে এতে নাকি সে অত্যাধিক আনন্দ পায়। আমিও অবশ্য মঙ্গলবার অর্থাৎ আমার ছুটির দিনে তার অফিস ছুটির সময় অফিসের সামনে হাজির হই।

শপিংয়ে একদম আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও তার সঙ্গে আমাকে বিয়ের শপিংয়ে যেতে হয়। বিরক্তি লুকিয়ে দোকানের সব শাড়ি এক লাগার পরেও আন্দাজে পছন্দ করে দিই। কারণ আমাকেই নাকি পছন্দ করে দিতে হবে। এই যে শুরু? বাকি জীবন চেষ্টা করব এভাবেই ওর সব ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে। ৯ বছরের কষ্টের ক্ষতিপূরণ ৯ জীবনেও দেয়া সম্ভব না। কিন্তু আমাদের যেহেতু ৯ জীবন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই এক জীবনই তার নামে লিখে দিলাম।

রাফসান শিকদার
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

এই অংশটা পড়ে মীরা হেসে দিল। ৯ জীবন লাগবে না। এই ডায়েরি পড়েই তার ৯ বছরের সব কষ্ট মুছে গেছে।

***

মাত্র চার দিন আগেই গেল সেই মহেন্দ্রক্ষণ। আমি মীরাকে পেলাম। সারাজীবনের জন্য লিখিতভাবে পেলাম। মীরাও এখন এই ঘরের একজন সদস্য। ওকে ফাঁকি দিয়ে তোকে লিখতে বসতেই পারিনি এ কদিন। জানিস বকুল, আমি এক প্রস্ফুটিত ফুলের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু পেয়ে গেছি এক বুনোফুল। এই বুনোফুলকে যত্ন করে সামলাতে হয়। ভাবতেই অবাক লাগে আমার সেই নিষিদ্ধ ইচ্ছেগুলো এখন বৈধ। এখন আমি যেকোনো সময় ঝড় তুফান নামিয়ে ফেলতে পারি আমার মীরাতে। কিসব যে লিখছি! মাথা খারাপ হয়ে গেছে সম্ভবত। আজ বাদ দিই। পরে আবার কথা হবে। ভালো থাকিস প্রিয় বকুল।

রাফসান শিকদার
১১ ডিসেম্বর, ২০১৯

বউ একটা পেয়েছি। সারাক্ষণ ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে। এক সময় আমার দিকে তাকাতো না বলে আমার কত আফসোস ছিল। আর এখন এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যে আমারই লজ্জা লাগে। আজ জিজ্ঞেস করলাম,

এমন ড্যাবড্যাব করে তাকাও কীভাবে?

মীরা বলল,

তুমি এত সুন্দর আমি কী করব?

আমি হেসে বললাম,

৯ বছর আগে সুন্দর ছিলাম না?

৯ বছর আগে তো তোমাকে পাওয়ার এমন তৃষ্ণা ছিল না। কিছু বোঝার আগেই প্রেম হয়ে গেছে। কিছু বোঝার আগেই হারিয়ে ফেলছি। আর এখন তো সব বুঝ হওয়ার পর পেয়েছি।

৯ বছর কষ্ট করলেও এখন নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান বলে মনে হয় বকুল। তোর কী মনে হয় বল তো?

রাফসান শিকদার
১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

মীরাকে ঘামতে দেখলে আমার ইচ্ছে করে দুনিয়া থেকে ইলেকট্রিসিটি তুলে দেয়া হোক। গরমে যখন চুলগুলোকে মাথার ওপর তুলে একটা এলোমেলো খোঁপা করে, মুখটা লাল হয়ে যায়… এত সুন্দর লাগে ওকে! কপাল আর ঘাড় বেয়ে নেমে আসা ঘামের ফোঁটাগুলো আরো সুন্দর করে তোলে ওকে। তারচেয়েও সুন্দর প্রচণ্ড গরমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যখন উফ করে ঘাম মুছে ফেলে সেই দৃশ্যটা। কিন্তু বেচারির গরমে কষ্ট হবে ভেবে আবার শান্ত থাকি। নাহলে কবেই আমি ইলেকট্রিসিটির গুষ্টি উদ্ধার করতাম।

রাফসান শিকদার
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

এই অংশটা পড়ে মীরা একটু লজ্জা পেল। রাফি তাকে কখনো এভাবে খেয়াল করেছে বলে সে মনে করতে পারে না। অথচ করেছে। এই ছেলেটা এত বেশি গুপ্ত যে ওকে বোঝাই যায় না। মীরা আবার পড়তে শুরু করল।

প্রিয় বকুল,

আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুই আবার আমাকে ভুল বুঝিস না। ভাবিস না যেন দুঃসময়ের বন্ধু ছিলি একা তুই। আর এখন সুসময়ে তোকেই ভুলে যাচ্ছি। যদিও জানি তুই এমন ভাববি না। অনেক লম্বা সময়ের বন্ধু তুই আমার। সবচেয়ে কাছের বন্ধু, বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি কখনোই চাই না তোকে বলা কথাগুলো মীরা জানুক। ও যেহেতু এখন এই ঘরেই থাকে তোকে এখানে রাখাটা বিপজ্জনক। তাই তোকে আর সঙ্গে রাখতে চাচ্ছি না। গত পরশুদিন মীরা লিখতে দেখে ফেলেছে। হিসাব বলে চালিয়েছি। কিন্তু লুকিয়ে ফেলেছি বলে ও সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে। সেই বোকা মীরা তো নেই আর। সেয়ানা হয়ে গেছে। তাই তোকে নিরাপদ জায়গায় রাখছি। এত বছর তুই নিঃস্বার্থভাবে আমার সব কথা না শুনলে আমি হয়তো দম ফেটে মারা যেতাম! কোনো মানুষের সঙ্গে সুখ-দুঃখের সব কথা শেয়ার করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল, এখনো আছে। তোর কাছে আমি চিরঋণী। এই ঋণ শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই। সঙ্গে না থাকলেও তুই আমার অন্তরে থাকবি। তোকে আমি অনেক ভালোবাসি বকুল। ভালো থাকিস তুই। খোদা হাফেজ।

রাফসান শিকদার
১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

এরপর পুরো ডায়েরিতে আর একটি লাইনও লেখা নেই। মীরা ডায়েরিটি বন্ধ করে তাতে একটা চুমু খেল। এরপর বুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। মনে হতে লাগল তার অবর্তমানে এই ডায়েরিটিই রাফিকে আগলে রেখেছিল। রাফির কষ্টের কথাগুলো মনে পড়ে সে আবারও কেঁদে ফেলল। ঠিক সেই সময়ে রাফি ঘরে ঢুকল। মীরাকে বকুল নামক সেই ডায়েরিটি নিয়ে বসে কাঁদতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেল। আতঙ্কে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। যে ভয়ে বকুলকে এতবছর দূরে সরিয়ে রাখল তাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো! কিন্তু মীরা ডায়েরিটি পেল কীভাবে! মীরা ডায়েরি রেখে সামনে এসে কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

তুমি মীরাপুকে চুমু খেয়েছো কেন?

রাফি অবাক হয়ে বলল,

আরে কিসের চুমু? কী বলে না বলে!

ডায়েরিতে লিখেছো তুমি। তোমার জ্বরের সময়…

মীরাকে কথা শেষ করতে দিল না রাফি। বলল,

“আরে আমি করিনি, ও করেছিল। আর ওটাকে চুমু বলে না। জাস্ট এক সেকেন্ডের টাচ। তুমি এখন ওইজন্য কাঁদছো নাকি?

মীরা ক্ষেপে গেল,

তুই ওই এক সেকেন্ডের টাচ করতে দিবি কেন? আর এত খুশিই বা হবি কেন?  

কি বলে না বলে পাগলের মতো। তখন তো ও আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল। তখনকার জন্য ওটাই স্বাভাবিক ছিল।

তো আমি তোর গার্লফ্রেন্ড ছিলাম না? আমাকে জীবনেও করছিস?

রাফি হেসে বলল,

অগণিত। হিসাব নেই।

সেটা তো বিয়ের পরে। প্রেমের সময় তো জীবনেও করিস নাই। অথচ এক্স গার্লফ্রেন্ডকে করে একদম গদগদ। কতবড় সাহস!

রাফি এবার শব্দ করে হেসে ফেলল। তারপর বলল,

ওটা যখনকার ঘটনা তখন ও আমার এক্স ছিল না। তা ছাড়া ও অনেক এডাল্ট ছিল। তুমি তো বাচ্চা ছিলে।

চুপ।

ধমক দিল মীরা। রাফি এবার সিরিয়াস হয়ে বলল, আরে বাবারে বাবা। আমার ডায়েরি অনুমতি ছাড়া পড়েছে এজন্য কোথায় আমি একটু বকা দেব তা না উলটো তুমি বকছো আমাকে। উলটো দুনিয়া! কেয়ামত সন্নিকটে বুঝতে পারছ?

মীরা রাফিকে জড়িয়ে ধরে বলল,

এত কষ্ট করেছ অথচ আমাকে বুঝতে দাওনি! এত ভালোবাসো সেটাও তো কখনো বুঝতে দাওনি। এমন কেন তুমি?

রাফি এবার ধরতে পারল কান্নার আসল কারণ। সে মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

কী করব আল্লাহ এমন করে বানিয়েছেন।

মীরা রাফির মুখটা ধরে বলল,

ওই ৯টা বছর আমি যা কষ্ট করেছি তারচেয়ে অনেক বেশি কষ্ট তুমি করেছ রাফি। এই ডায়েরিটা না পড়লে কখনো জানতে পারতাম না।

সব জানলেই তো রহস্য শেষ। এই যে আমার সব দুর্বলতা জেনে গেলে এটা কী কোনো ভালো কথা হলো?

মীরা হেসে বলল,

বকুলকে হিমির কথা বলবে না?

বলব। হিমি জন্মানোর পর থেকেই ভাবছি বলব। কিন্তু তোমার আড়ালে সুযোগ করে উঠতে পারিনি।

এখন বলে দিও। আবার নিয়মিত কথা বলো ওর সঙ্গে। একটা নির্দিষ্ট ড্রয়ারে তালাবন্ধ করে রাখো। চাবি থাকবে শুধু তোমার কাছে। সুযোগ হলেও আমি কখনো পড়ব না। আমার যা জানার ছিল তা জানা হয়ে গেছে। কিন্তু বকুল ফলস সিলিংয়ে বস্তাবন্দি হয়ে থাকাটা ডিজার্ভ করে না। তোমার কাছে থাকাটা ডিজার্ভ করে।

.

রাফি সেদিন রাতেই ডায়েরি লিখতে বসল। প্রিয় বকুল, কেমন আছিস? ভালো তো? এতদিন ফলস ছাদে বন্দি থাকতে কষ্ট হয়েছে? কী বললি মানুষের মতো কষ্ট নেই তোদের? তাহলে তো তোরা ভীষণ সৌভাগ্যবান। এতদিন তোকে না লিখলেও ফলস ছাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তোর সঙ্গে মনে মনে কথা কিন্তু বলেছি। তুই কি শুনতে পেয়েছিস?

জানিস আমার এখন একটা পুতুল আছে। জ্যন্ত পুতুল। আমাকে বাবা বলে । ডাকে। পুতুলটার নাম রেখেছি হিমি। হিমি কী করে জানিস?

.

রাফি ও তার বকুলের গল্প চলবে অবিরাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *