গগন গাঙুলী পাশের প্রতিবেশীর দাওয়ায় উঠে এসে বলেন, বুঝলেন মশাই, এখন বুঝছি কলকাতার ওই প্রফেসরটি? ওটি হচ্ছে একটি চরিত্রহীন লোক। কে জানে মশাই নাম পরিচয় সত্যি কি। নইলে—মানে বিশ্বাস করবেন, লোক্টা এই মাসাধিককাল ধরে পড়ে আছে আমাদের ব্রজেনবাবুর—না ব্ৰজেনবাবুর আর বলি কি করে—ব্রজেন গিন্নির হোটলে। আমার সন্দেহ হচ্ছে এই ভদ্রলোকের আগমনে, আর ভাবগতিক দেখেই ব্ৰজেন ঘোষটা মনের ঘেন্নায় সুইসাইড করেছে। এদিকে তো আবার লোকটা ইয়ে, খুব সেন্টিমেন্টাল ছিল তো? আপনার কাছে গল্প করেছিলাম মনে আছে বোধ হয়, সেই যেবার আমার বড়ো শালীর মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সব ওই প্রবাস আবাসে সিট নেওয়ায় ওনাদের স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়ল?…মনে নেই? বলেন কি? আহা হা—সেই যে, আমার বাড়িতে কুটুমরা এসে পড়েছে, অথচ গিন্নির শরীর খারাপ, ঠেলে তাদের পাঠিয়ে দিলাম এই হোটলে। আর আমার নাতজামাইয়ের দিদি এসে প্রকাশ করে দিল, মাগী বিয়ে করা বর বলে যাকে চালাচ্ছে, সে লোকটা আসলে ওর বাবার চাকর! ওকে নিয়ে ফেরার হয়েছে। সেই সেবার দেখেছি তো।
যখন ডাকিয়ে এনে প্রশ্ন করলাম-খবর সত্যি কি না, তখন ব্রজেনের যা অবস্থা দেখেছিলাম। লজ্জায় বুঝি মারাই যায়। দেখে আশ্চর্যই লাগল যে এই লোক এই কাজ করেছে। এখন বুঝছেন তো কে করেছে? ওই মেয়েমানুষটি। এবার এটি বোধ হয় নতুন প্রেমিক জুটিয়েছেন।
প্রতিবেশী ইতস্তত করে বলেন, কিন্তু ভদ্রমহিলাকে দেখলে তো ঠিক তা মনে হয় না।
শুনুন বিত্তান্ত। দেখলেই যদি চেনা যাবে, তবে আর ছেনাল বলছে কেন? ওই দেখতে যেন কতই আরিস্টোক্র্যাট। আরে মশাই, আমরা মানুষ চিনি। বলে কত অ্যারিস্টোক্রেসি ধুয়ে জল খেলাম। ওই আপনার প্রফেসরটিকেও তো প্রথম দেখে তাই মনে হয়েছিল। এখন দেখছেন তো প্রবিত্তি? দুদিন দেখেই হোটেলওলির সঙ্গে মজে গেলেন।…ওই যখনই দেখেছি এ পথ দিয়ে হাঁটা ছেড়েছে, তখনই বুঝেছি ব্যাপার আছে। আমার তো ধ্রুব বিশ্বাস কোনোরকম বাড়াবাড়ি দেখেই হতভাগা ঘোষটা মরে কেলেঙ্কারি করল। কে জানে চাকর ছোঁড়াটাকেও ভবধাম থেকে সরাবার তোড়জোড় চলছিল কি না।…ডাক্তারবাবুকে ধরে পড়েছিলাম। তা ডাক্তারবাবু বললেন, না, না টাইফয়েড। বিশ্বাস হল না। নির্ঘাৎ টাকা খাইয়েছেন।..যাক, ছোঁড়া নাকি এ-যাত্রা বেঁচে গেছে। তা রাখবে না, দেশে পাঠিয়ে দেবে। তারপর বোধ হয় মাগীকে নিয়ে ভাগবে। বয়সের গাছ পাথর নেই মশাই এদের সব, তবু দেখুন কী প্রবিত্তি!
প্রতিবেশীটি গগন গাঙুলীকে ডরান। তাই প্রতিবাদের সাহস পান না। শুধু বলেন, আপনি এত সব জানলেন কি করে?
আমি? জানলাম কি করে বলছেন? হুঁ! ওইটুকুই সম্বল করেই তো বেঁচে আছি মশাই। নইলে এই পলাশপুরে কি মানুষ টিকতে পারে? যাই দেখি শ্রাদ্ধ আর কতদূর গড়ায়।
ব্ৰজেন ঘোষেদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাবার পর থেকে প্রবাস আবাসের খদ্দেরের মন ভাঙানোই পেশা হয়েছে গগন গাঙুলীর। ঠিক যেমন তার আগে পেশা ছিল হোটেলের খদ্দের জোগাড় করবার। নিত্য দুবেলা ট্রেনের সময় স্টেশনে হাজির হতেন গগন গাঙুলী, আর যাত্রী দেখলেই বলতেন, উঠবেন কোথায়? বাড়ি ঠিক করে এসেছেন? বিদেশে বেড়াতে এসে মিথ্যে কেন রাঁধাবাড়ার ঝঞ্ঝাটে জড়াবেন মশাই? গেরস্ত পরিচালিত ভালো বের্ডিং রয়েছে। চার্জ কম খাওয়াদাওয়া ভালো, ঘর কমফর্টেবল–।
কিন্তু ওই তাঁর নাতনীর ননদ দ্বারা পরিবেশিত সংবাদের পর থেকেই পেশা বদলে গেল গগন গাঙুলীর। হঠাৎ তার মাথায় ঢুকল ওই শুটকো ব্রজেন ঘোষ আর ওই দেমাকি মেয়েটা তাকে বেদম ঠকিয়েছে।
তিনি গগন গাঙুলী, তাঁর নাকে দড়ি পরিয়ে ঘুরিয়েছে ওরা! সেই অবধি খদ্দের ভাগানোই পেশা করেছেন।
তা এ-যুগে লোক খুব একটা বিচলিত হয় না ওতে। স্বামী-স্ত্রী নয়, তবু স্বামী-স্ত্রী সেজে ব্যবসা চালাচ্ছে—এ এমন একটা কিছু নতুন কথা নয়।
খাওয়া ভালো, যত্ন ভালো, থাকার ঘর ভালো, চার্জ কম, এ কি সোজা নাকি? খদ্দের ভাঙে না। সিজনের সময় লোক ধরে না। জায়গা পায় না।
.
সেই কথাই বলে করুণাপদ, এখন এই রকম দেখছেন বাবু, সিজিনের সময় ঠাঁই দেওয়া যায় না। একটা ঘরে দু-তিনটে সিট করতে হয়। এমন একটা চালু ব্যবসা তুলে দেবেন?
সিজনের সময় লোক ধরে না? কমলাক্ষ অবাক হয়ে বলেন, তবে তোমার মার এত অর্থকষ্ট কেন?
করুণাপদ ঘাড় নীচু করে বলে, সে আজ্ঞে বলতে গেলে বাবুর কারণেই।
ওরে করুণা গল্প রাখ। দেখ বাইরে বোধ হয় রিকশা এললীলা এসে ডাক দেয়, ছুটে যা। জানি না কে, যদি খদ্দের হয়, বলবি সিট নেই।
বলব সিট নেই!
বলবি বইকি।
তা হলে তুলেই দিচ্ছেন? তবে যে আমায় বললেন, করুণা তুই—
আরে বাবা সওয়াল সাক্ষী রাখ এখন। ছুটে যা–
কিন্তু যেতে আর হল না করুণাপদকে, ততক্ষণে একটি অষ্টালঙ্কারভূষিতা মহিলা বাড়ির মধ্যে ঢুকে এসেছেন। একেবারে কমলাক্ষর সামনা-সামনিই দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
কমলাক্ষ উঠে দাঁড়ান। স্থলিত স্বরে বলেন, এ কী!
মহিলাটি কঠিন মুখে বলেন, আমিও আপনাকে ঠিক সেই প্রশ্ন করছি বাবা!
অন্ধকারের পৃষ্ঠপটে ফুটে উঠেছে আলোকবিন্দু, নিশ্চেতন জড়তার স্তর থেকে উঠে আসছে চেতনার বুদ্বুদ, আতঙ্কের পঙ্ক থেকে জন্ম নিচ্ছে সত্যের শুভ্র কমল।
হঠাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে এল বলে দিশেহারা হলে চলবে না, খুলে ধরতে হবে বন্ধ দরজায়। কমলাক্ষ তার সন্তানকে ভয় করবেন না। তার আর নীরজার।
.
ভর রোদ্দুরে এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যে গগনবাবু? কী ব্যাপার?
গগন গাঙুলী সোলার-হ্যাটটা মাথায় চেপে বইয়ে নিয়ে আত্মপ্রসাদের হাসি হাসেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি একটি রগড় দেখার আশায়।
প্রতিবেশী মৃদু হাসেন।এতও রগড় জোটে আপনার!
জুটবে না মানে? ওই তালেই থাকি যে। দুটি বেলা স্টেশন পাহারা দিতে যাই কি আর বেগার খাটতে? এই পলাশপুরে কে মাথাটি ঢোকালো, তার খবরটি নখদর্পণে রাখি। আজ তো জালে একমুনী রুই–
প্রতিবেশীর কাছাকাছি ঘনিষ্ঠ হয়ে আসেন। বলেন, মেয়ে! বুঝলেন? নিজে এসে হাজির হয়েছে। বাপের চুলের মুঠিটি চেপে ধরে নিয়ে যেতে
কে, কার, কি বৃত্তান্ত শ্রোতার অবিদিত। তাই তিনি বোধকরি রহস্য আরও ভেদ হবার আশায় হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন।
গগন গাঙুলী সোলা-হ্যাট সমেত মাথাটা ঝাঁকিয়ে নেন, কী মশাই, হাঁ হয়ে যে? ধরতে পারেননি? নাঃ, রসবোধ বড়ো কম মশাই আপনাদের। প্রফেসরের মেয়ে! এই এগারোটার গাড়িতে এল? গগন গাঙুলী অকারণেই গলাটা নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন, বাপের টুটিটি টিপে নিয়ে যেতে এসেছে।
প্রতিবেশী অবাক হন। কি করে জানলেন?
হু হু বাবা! বুঝতে হলে ব্রেন চাই। আর সেই ব্রেনের চাষ করছি কি আজ থেকে? পলাশপুর স্টেশনে পা দিয়েই খোঁজ করেছে ফেরবার গড়ি কখন আছে, টাউনের ভেতর রিকশা-টিকশা পাওয়া যায় কি না। রিকশাওয়ালারা সব রাস্তা চেনে কি না। পারলাম না স্থির থাকতে, এগিয়ে গেলাম। বললাম, কোন্ বাড়িতে যাবে মা লক্ষ্মী! তা মেয়ে তো নয়, যেন আগুনের ডেলা। বলল, জেনে আপনার কী দরকার? শুনুন! ভদ্রলোকের কথা শুনুন! তবু মান খুইয়ে বললাম, আমার আর কিসের দরকার? এই একটু পরোপকার করার ব্যাধি আছে তাই
শুনে একটু নরম হল। বলল, প্রবাস-বোর্ডিং বলে কি হোটেল আছে–
মনকে বলি, ওরে মন, যা ভেবেছিস তাই। আহ্লাদ চেপে বললাম, হা জানি বইকি, ওই দিকেই তো এই অধম ছেলের বাস।…তা বলব কি আপনাকে এমন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল, যেন বুকের ভেতর পর্যন্ত সার্চলাইট ফেলল। তারপর কাঠ কাঠ মুখে বলল, ও বুঝেছি। আচ্ছা রিকশাওলাকে জায়গাটা একটু বুঝিয়ে দিতে পারেন তো–
বুঝিয়ে আর কাকে দেব? রিকশাটা তো আমাদের সীতারামের।…তো আমি বলে যাচ্ছি আমিও–
প্রতিবেশী ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে বলেন, প্রফেসরের মেয়ে, একথা কে বলল? কোনো বোর্ডারও হতে পারে।
বোর্ডার! হাসালেন মশাই। ফিরতি ট্রেনের খোঁজ নিচ্ছিল শুনলেন না? আমি বলছি মেয়ে ছাড়া আর কিছু নয়। মুখের সঙ্গে আদল আছে। বলি আর কে হবে? ওই বয়সের মেয়ে তো আর স্ত্রী নয়?..ওই বাপের অধঃপতনের খবর পেয়ে—মানে কানাঘুসো কিছু শুনে থাকবে এই আর কি। তা বলি এই তো ঘণ্টা দেড় বাদেই ট্রেন, যাবে তো এই পথেই। দেখি একা যায়, না সঙ্গে
নমস্কার মশাই আপনার এনার্জিকে—ভদ্রলোক হেসে উঠে চলে যান, এই ঠায় রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে–
কী করি বলুন। কৌতূহল বড়ো বালাই দাদা!
.
শুধু কৌতূহল কেন, গরজও বড়ো বালাই! সবচেয়ে বড়ো বালাই। নইলে উদ্ধতস্বভাব উন্নাসিক মেয়ে সোমা, ব্ৰজেন ঘোষের হোটেলে এসে হাজির হয়?
আকৃতিতে তরুণী, প্রকৃতিতে মহিলা। পাথর কুঁদে বার করা মুখ দেখলে মনে হয় সে-মুখে যেন বাটালির দাগ রয়ে গেছে, পালিশে মসৃণ হয়ে ওঠেনি।…সেই অমসৃণ মুখের প্রলেপিত ঠোঁট দুটোর কপাট দুটো একটু ফাঁক হয়, যার মধ্যে থেকে কথাটা বেরোয়, অনুগ্রহ করে আপনি একটু বাইরে যাবেন?
অনুরোধ নয়, আদেশ। অনুরোধের ছদ্মবেশেই এল। ভদ্রসমাজের যা দস্তুর।
কমলাক্ষর মুখ তাঁর মেয়ের মতো অমসৃণ নয়, পাথুরেও নয়, তবু এখন যেন পাথর পাথরই লাগছে। হঠাৎ এভাবে তোমার আসার কারণ কি সোমা?
কারণটা আপনি নিজেই নির্ণয় করুন বাবা!
নির্ণয় করা শক্ত হচ্ছে বলেই তো জিগ্যেস করছি। ষোলো তারিখে আমার যাবার কথা ছিল, আর আজ মাত্র আঠারো তারিখ, এই দু-দিনেই তুমি এত অস্থির হয়ে উঠলে যে—তা ছাড়া আমি টেলিগ্রামও করেছি।
করেছেন। কিন্তু যেতে না পারার কারণ কিছু দর্শাননি।
কমলাক্ষ গম্ভীর হয়ে গেছেন। দৃঢ় হয়ে গেছেন। বললেন, কারণ দর্শাতে হবে, সেটা অনুমান করিনি। যেতে পারলাম না, সেটাই কি যথেষ্ট নয়?
না নয়! আপনার ভাবা উচিত ছিল, আমরা দুশ্চিন্তায় পড়তে পারি। ধরে নিতে পারি আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন
ইচ্ছে করলে অবিশ্যি সবই পার। কিন্তু চিন্তাকে অতদূর না পাঠালেও পারতে সোমা! সব কিছুরই একটা মাত্রা থাকা দরকার।
দরকার! মাত্র থাকা দরকার। তাই না বাবা? কিন্তু সেটা কি শুধু ছোটোদের বেলা? বড়োরা মাত্রাছাড়া যা খুশি করলেও দোষ নেই?
কমলাক্ষ গম্ভীর হলেন। সোমা তুমি তো জান ছেলেমেয়েদের তিরস্কার করা আমি পছন্দ করি। তাছাড়া তুমি বড়ো হয়েছ।
সোমা বাপের এই সামান্যতম ইঙ্গিতে থামে না। তেমন অভিমানী প্রকৃতির মেয়ে হলে, এই দুঃসাহসিক অভিযানের পথে পা বাড়াত না সে। তাই ইঙ্গিত গায়ে না মেখে বরং নিজের ভঙ্গিতেই আরও অগ্রাহ্যের ভাব আনে।
বড়ো হয়েছি বলেই ছোটোর মতো মুখ বুজে অন্যায় মেনে নেওয়া শক্ত হল বাবা! হাল ধরতেই হল। আমি এসেছি, ফিরতি ট্রেনেই যাব, আপনাকে নিয়ে যাব।
আমাকে নিয়ে যাবে? সহসা হেসে ওঠেন কমলাক্ষ, নিয়ে যাবে কি বল? আমি কি ছেলেমানুষ শিশু, যে তুমি সঙ্গে করে নিয়ে যাবে?
সোমার সেই বাটালির দাগ-থেকে-যাওয়া মুখটা আর একটু অমসৃণ দেখায়। সোমার গলার স্বর প্রায় ধাতব হয়ে ওঠে। বুড়োমানুষরা যখন ছেলেমানুষী করে, সেটা আরও বেশি অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে বাবা, আর তখন তাদের ওপর জোর ফলানো ছাড়া উপায় থাকে না। আমি বলছি আমার সঙ্গে আপনাকে যেতেই হবে। কোথায় আপনার জিনিসপত্র? দেখিয়ে দিন গুছিয়ে নিই।
সোমা ঘরের এদিক-ওদিক তাকায়।
কিন্তু কমলাক্ষ সে ভঙ্গিকে আমল দেন না। শান্ত আর নরম গলায় বলেন, তুমিও বড়ো হয়েছ। সোমা, তোমাকেও আর ছেলেমানুষী মানায় না। একা এসেছ তুমি? না সঙ্গে কেউ আছে?
বৃন্দাবন আছে। তাকে স্টেশনে বসিয়ে রেখে এসেছি।
বিরস ভারী গলায় কথা বলছে সোমা। মনে হচ্ছে, যেন একটা গিন্নি। বুদ্ধিটাও তার গিন্নিদেরই মতো। বৃন্দাবন ওর বাড়ির চাকর। তার সামনে পাছে কোনো দৃশ্যের অবতারণা হয়, তাই তাকে স্টেশনে বসিয়ে রেখে এসেছে।
অতএব দৃশ্যের অবতারণা করে চলে। বিদ্রুপে মুখ কুচকে বাপের মুখের ওপর বলে চলে, আপনি তাহলে কি ঠিক করেছেন? সংসার ত্যাগ করবেন?
সোমা, অসভ্যর মতো কথা বোলো না।
সোমার বুক কাঁপে না। সোমা জাহাবাজ। সোমা তার মায়ের প্রকৃতি পেয়েছে। যে মা তাকে তিন বছরের রেখে মারা গেছে। হ্যাঁ, নীরজাও এমনি জবরদস্ত প্রকৃতির ছিল। অতটুকু বয়সেই
সে-পরিচয় রেখে গিয়েছিল সে।
তাই সোমা বলে, সংসারের সর্বত্র যদি সভ্যতা বজায় থাকে, তা হলে কাউকেই অসভ্য হবার দুঃখ পেতে হয় না বাবা! আপনি যদি–
কথার মাঝখানে করুণাপদ এক গ্লাস চিনির শরবৎ নিয়ে এসে দাঁড়ায়। এবং সাহসে ভর করে এগিয়েও ধরে সোমার দিকে।
সোমা একবার কুলিশ কঠোর দৃষ্টিতে তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে কঠিন স্বরে বলে, দরকার লাগবে না, নিয়ে যাও।
করুণাপদের হাত কেঁপে খানিকটা শরবৎ চলকে মাটিতে পড়ে, করুণাপদ পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়।
কমলাক্ষ ক্ষুব্ধ হেসে বলেন, ছেলেমানুষীতে তো কেউ কম যায় না। রোদে ট্রেনে এসেছ, ওটা খেলেই পারতে।
খাবার মতো মনের অবস্থা থাকলে ঠিকই খেতাম। সে যাক আপনি আমার কথার উত্তরটা কিন্তু দেননি।
কোন কথার? কমলাক্ষ অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন। কমলাক্ষ জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছেন প্রখর দুপুরের আকাশে উড়ন্ত এটা নিঃসঙ্গ চিলের দিকে। চিলটা অবিরত একই বৃত্তে পাক খাচ্ছে।
আশ্চর্য তো! কিন্তু কেন? মানুষের মতো ওরাও কি আপন হাতে বৃত্ত রচনা করে শুধু সেই পথেই পাক খায়? ওদের তো ডানা আছে, ওদের এ-দুর্মতি কেন? আবার ভাবলেন মানুষেরও একদিন ডানা ছিল। সে-ডানা মানুষ নিজেই ভেঙেছে। মানুষ আকাশ হারিয়েছে, কিন্তু তার বদলে কতটা মাটি পেয়েছে?
ভাবছিলেন, তাই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। তাই বলেন, কোন্ কথার?।
সোমা দাঁতে ঠোঁট চেপে ঠোঁটের রঙের অনেকখানি ঘুচিয়ে ফেলে দাঁতে-চাপা স্বরে বলে, আপনি কলকাতায় ফিরবেন কি না, সেই প্রশ্নটার উত্তর পাইনি।
কলকাতায় ফিরব কি না! কমলাক্ষ অবাক গলায় বলেন, এটা একটা প্রশ্ন হল?
ধরুন ওইটাই আমার প্রশ্ন?
কিন্তু ফিরব কি না এমন অদ্ভুত প্রশ্ন তুমি তুলবেই বা কেন? কলকাতায় ফিরব না? আমার কলেজ নেই?
এবার সোমার সেই পাথুরে মুখে এতটুকু একটু অভিমানের কোমলতা এসে লাগে। কি জানি আপনার কি আছে, আর কি নেই। অন্তত এই ছত্রিশ দিনের মধ্যে আপনার মনে ছিল না, আপনার একটা ছেলে আছে, একটা মেয়ে আছে, তাদের মা নেই।
কমলাক্ষ মৃদু হাসেন। বলেন, ছেলেমেয়েদের মা নেইটা এত তামাদি হয়ে গেছে সোমা, যে সত্যিই মনে থাকে না। কিন্তু ছেলেমেয়েরা আছে এটা ভুলে যাচ্ছি, এতদূর ভাবতে বসেছিস কেন বল তো? চিঠিপত্র বিশেষ দিইনি বলে?
বিশেষ বলছেন কেন বুঝছি না।
ওঃ তা বটে। তোকে আদৌ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু জানিস তো চিঠিপত্রের ব্যাপারে আমি চিরদিনের কুঁড়ে।
কমলাক্ষ ভাবলেন, তবে কি যা ভাবছিলাম তা নয়। শুধু অভিমান? চিঠি দিইনি, ফেরার দিন ফিরিনি, তাই রাগে দুঃখে–
সোমা হাত তুলে ঘড়ি দেখে বোধ করি নতুন হাতিয়ার সংগ্রহ করবার আগে অবহিত হতে চায় হাতে কতটা সময়।
ওর ওই ঘড়ি দেখার মুহূর্তে ঘড়ির ওপর ছায়া পড়ে। আর সেই ছায়া কথা কয়ে ওঠে, শরবৎটা ফেরত দিলে কেন? খাও না বুঝি? তা হলে একটু চা–
সোমা বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমাকে তুমি বলবার অধিকার আপনাকে কে দিল শুনতে পেতে পারি?
কমলাক্ষ চমকে উঠলেন। কমলাক্ষ আপন আত্মজার অসভ্যতায় লাল হয়ে উঠলেন। কিন্তু লীলার মধ্যে ভাবান্তর দেখা গেল না। সে শুধু উত্তরটা দিল। সহজ ভাবেই দিল। অধিকার কি আর হাতে করে কেউ তুলে দেয়? তা ধর যদি কেউ দিয়েই থাকে, আমার বয়েসই দিয়েছে।
সোমা কিন্তু ঠিক এমন উত্তরটা আশা করেনি। তাই সোমা এর আগে যার দিকে তাকিয়ে দেখবার প্রবৃত্তি খুঁজে পায়নি—তার দিকে এখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে? কিন্তু তাকিয়ে দেখে সোমা হতাশ হচ্ছে নাকি? বিতৃষ্ণ হচ্ছে?
ওর চোখে মুখে কি এই প্রশ্নই ফুটে উঠছে না—এই! এই একেবারে সাধারণের সাধারণ। না রং, না গড়ন, না মুখশ্রী, এর মধ্যে আকর্ষণীয় কি আছে? যে-আকর্ষণ পাহাড় টলায়?
তবে কি সোমাকে কেউ বোকা বানিয়েছে, কুৎসিত একটা কৌতুক সৃষ্টি করে? আর বোকা সোমা সেই কৌতুকের তালে নেচে-কিন্তু তাই কি? বাবার আচরণ, বাবার চেহারা, কোন্ পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে?
না, সোমা বাবার মুখের সাক্ষ্যই নেবে। তাই সামনের মানুষটার দিকে তীব্র দৃষ্টি হেনে বললে, ওঃ বয়েস! মফঃস্বলের দিকে সেই রকম একটা হিসেব ধরা হয়ে থাকে বটে। যাক কষ্ট করে আর
আপনাকে শরবতের বদলে চা করতে হবে না। আমি এখানে খেতে আসিনি।
আশ্চর্য! আমিই কি তা বলছি? তবু ছেলেমানুষ—রোদে এসেছ—
থাক, এত স্নেহ প্রকাশের দরকার নেই। দয়া করে বারে বারে এসে ব্যাঘাত ঘটাবেন না। আমাকে আমার বাবার সঙ্গে কথা বলতে দিন একটু।
লীলাও তাহলে সোমার মতোই পাথর! তাই এ-কথার পর অপমানে বিবর্ণ হয়ে সরে না গিয়ে সহজেই বলতে পারল কি করে, কিন্তু ওঁর যে এখন খাওয়ার সময় হয়েছে!
ওঃ! সময় হয়ে গেছে! বাবা, আপনি তাহলে খুব যত্নটত্ন পাচ্ছেন। তাই বুঝি আর নিজের সংসারে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না? সত্যি সেখানে আর কে কখন ঘড়ি ধরে খাওয়াচ্ছে! কিন্তু আজ হয় সময়টা একটু উত্তীর্ণই হল।
কমলাক্ষ বিচলিত হন, চঞ্চল হন, উত্তেজিত হন। আর সেই তিনটে অবস্থা একটা স্বরের মধ্যে ফেলে বলে ওঠেন, সোমা, পাগলামীরও একটা সীমা আছে।
সোমা কিছু উত্তর দিত কিনা কে জানে। তার আগেই লীলা শান্ত গলায় বলে, মিস্টার মুখার্জি, আপনার মেয়েকে একটু বুঝিয়ে দিন, এটা বাড়ি নয়, হোটেল। এখানে খাওয়া-দাওয়ার একটা নির্দিষ্ট টাইম থাকে, আর সেটা মেনে চলতে হয়।
লীলা চলে যাবার পর কমলাক্ষ বলেন, সোমা তুমি তাহলে ঝগড়া করবে বলেই কোমর বেঁধে এসেছে? জানি না কেন তোমার এ-দুর্মতি হয়েছে, কিন্তু
জানেন না? কেন তা জানেন না? সোমা বিদ্যুতের দ্রুততায় হাতের ভ্যানিটিটা খুলে একখানা চিঠি বার করে বাপের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, এই চিঠিটা আপনি অস্বীকার করতে পারেন?
চিঠিটা কি বাবদ, কার লেখা এসব প্রশ্ন না করে হাত বাড়িয়ে নিয়ে খুলে চোখের সামনে তুলেই ধরেন কমলাক্ষ। আর মিনিট খানেক চোখ বুলিয়েই সেটা ঠেলে সরিয়ে রেখে সোমার চোখে চোখ ফেলে বলেন, তোমার বাপের নামে কুৎসা করা একটা উড়ো চিঠি তোমাকে এতটা বিচলিত করে তুলেছে এটা আশ্চর্য।
শুধু চিঠি? সোমা তীব্র স্বরে বলে, নিজের চক্ষে দেখলাম না আমি? প্রমাণ পেলাম। আপনি গুরুজন, তবু মুখের ওপরেই বলব, আপনার বয়সের কথা ভেবে আর রুচির চেহারা দেখে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার। তবু আপনার কাছে হাতজোড় করছি বাবা, আপনি এই আবেষ্টন থেকে চলুন।
কমলাক্ষও বুঝি ওদের মতো হয়ে যাচ্ছেন। তাই মেয়ের কাছ থেকে অতখানি অপমান পেয়েও গায়ে মাখলেন না। উল্টে হেসে উঠে বললেন, আমার কাছে হাতজোড় করবে, সেটা আর বাহুল্য কি? আমি তাতে কুণ্ঠিতও হব না। কিন্তু আমি কলকাতায় যাব না, একেবারে চিরকালের মতো এইখানেই থেকে যাব, এমন অদ্ভুত ভয়ে কাতর হবার মানে কি তাই ভাবছি।
বেশ, যাবেন তো আজই চলুন।
তা কি হয়?
তা হয় না?
না। ছুটি শেষ হবার পরও যখন থাকতে হয়েছে—ধরে নাও বিশেষ কোনো কাজে আটকে পড়েছি।
সোমা ছিটকে ওঠে। সোমা চটির মধ্যে পা গলায়। তীব্র স্বরে বলে, আটকে পড়েছেন যে কিসে সে তো চোখের সামনে দেখতেই পেলাম। কিন্তু জীবনে কখনও ধারণা করিনি, আপনি আমাদের মাকে এইভাবে অপমান করবেন।
সোমা, সংযত হয়ে কথা কও।
না কইব না। কইতে পারছি না। বাবা- সোমার ফেটে পড়া রাগ সহসা ফুটন্ত জল হয়ে চোখের স্নায়ুগুলো পুড়িয়ে দেয়, আপনার ছেলে, আপনার মেয়ে, আপনার সংসারের পবিত্রতা, সব কিছুর চেয়ে বড় হল ওই বিশ্রী–
ও বেরিয়ে যাচ্ছিল। কমলাক্ষ ওর ওই ক্রুদ্ধা নাগিনীর মূর্তির দিকে মুহূর্তকাল স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে বলেন, তুমি যদি বিচারকের পোস্ট নিয়ে না আসতে সোমা, হয়তো তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতাম। হয়তো তখন আর তোমার বোঝা শক্ত হত না কোষ্টা বড়ো কোন্টা ছোটো। অভিযোগ করে বসতে না তোমাদের মাকে আমি অপমান করছি।
চলে যেতে উদ্যত সোমা ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজাটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে বলে, বেশ, তবে তাই বোঝন।
কমলাক্ষ মাথা নেড়ে বলেন, আর হয় না। তুমি বোধ করি ফিরে গিয়ে তোমার শ্বশুরবাড়িতেই উঠবে? যদি তা না ওঠো, তো বলে রাখি—আমি কাল ফিরব। আর ওই ভদ্রমহিলা যাবেন আমার সঙ্গে।
.
এ আপনি কী করলেন?লীলা রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করে।
কমলাক্ষ আস্তে বলেন, ঠিকই করলাম।
আর আপনার ঠিকের সঙ্গে যদি আমার ঠিক না মেলে?
কমলাক্ষ সেই সাধারণ—একেবারে সাধারণ শীর্ণ মুখটার দিকে চুপ করে তাকিয়ে থেকে তারপর বলেন, মেলাতেই হবে যে–
লীলা সহসা ভিন্ন মূর্তি নেয়। রুক্ষস্বরে বলে, কিন্তু কেন বলুন তো? আমি আমার নিজের ব্যবসা নিয়ে নিজের জীবন নিয়ে পড়ে আছি, পড়ে থাকব। আপনার কী দরকার ভাবতে বসার—আমার অভিভাবক আছে কি না। আপনি কে? আপনার সর্দারী আমি নেবই বা কেন? যান আপনি কলকাতায় ফিরে যান আপনার মেয়ের সঙ্গে। এখনও ট্রেন ছাড়েনি, এখনও উপায় আছে।
কমলাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, না আর উপায় নেই।
.
উপায় নেই। আর উপায় নেই।
কিন্তু লীলা কি পারবে না উপায় বার করতে? লীলা কি সম্মানের চাইতে সুখকে অধিক মূল্য দেবে? যে-স্বর্গে অধিকার নেই, সে-স্বর্গ শুধু দৈবাৎ হাতের মুঠোর কাছে এসে পড়েছে বলেই তাকে মুঠোয় চেপে ধরবে?
আর হতভাগা ব্রজেন ঘোষ? তাকে শুধু করুণাই করবে লীলা? সম্মান করবে না? সে তার জীবনপাত করে যে-আশ্রয় রচনা করে দিয়ে গেছে লীলার জন্যে, লীলা সে-আশ্রয়কে ভাঙা মাটির বাসনের মতো ফেলে দিয়ে চলে যাবে?
নাঃ, তা হয় না। লীলার সুখের মূল্যে অনেকগুলো সম্মান বিকিয়ে যাচ্ছিল, তা যেতে দেবে না লীলা। ব্ৰজেন ঘোষের সম্মান রক্ষা পাক, রক্ষা পাক কমলাক্ষর পরিচয়ের সম্মান, কমলাক্ষর সন্তানদের আর সংসারের সম্মান।
আর লীলার? না, তার আগে কিছুই রইল না। না সুখ, না সম্মান।
রইল শুধু ভাগ্যের তীক্ষ্ণ ধিক্কার! সে মুখ বাঁকিয়ে বলবে, ছি ছি! হীরের কৌটো এগিয়ে ধরলাম তোর দিকে, আর তুই হাত পিছিয়ে নিয়ে ভাঙা কাঁচের টুকরো খুঁইয়ে আঁচলে বাঁধলি?
তাছাড়া? আরও এটা তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ অহরহ বিকৃত করবে না লীলাকে? বলবে না ভীরু! ভীরু! বলবে না—সাহস দেখে সাহস হল না তোমার?
না, সাহস দেখে সাহস হল না লীলার। ভয় করল।
অথচ লীলা তো ভীরু ছিল না লীলার সাহস দেখে লোকে অবাক হত। লীলাকে কে ভাঙল? কে এমন দুর্বল করে দিল? তাই পালিয়ে গিয়ে সমস্যার সমাধান করতে বসেছে লীলা। সমাধানের আর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
.
করুণাপদ ঘুম ভেঙে উঠে চোখ মুছতে মুছতে বলে, সে কি মা, এই মাঝরাত্তিরে আবার তুমি কোথায় পুজো দিতে যাবে?
যাব রে যাব—। লীলা চুপি চুপি বলে, সে একটা দেবস্থান আছে, একেবারে উষাভোরে পুজো দিতে হয়। এখন থেকে না বেরোলে—দূর তো অনেকটাই—
তা সাতজন্মে তো তোমায় এমন উন্মাদ হয়ে দেবস্থান দেখতে যেতে দেখিনি মা? হঠাৎ আবার কি হল তোমার?
লীলা বলে, চুপ আস্তে আস্তে। মুখুজ্জেবাবুর ঘুম ভেঙে যাবে। পুজো দিচ্ছি—তোর অসুখের সময় মানসিক করেছিলাম বলে। যাক, তুই দোরটা দে।
করুণাপদ কাতর কণ্ঠে বলে, আমার আবার অসুখ, তার আবার মানসিক! আমি একটা মনিষ্যি! তা কাল আমায় কিছু বললে না—এখন হঠাৎ রাত না পোয়াতে বলছ, দোর দে, আমি যাই। একা যাবে তুমি? তাই কখনও হয়?
লীলা ব্যস্তভাবে বলে, হয় হয় খুব হয়। আজ যোগ যে! কত লোক যাচ্ছে! তুই সুন্ধু চলে গেলে মুখুজ্জেবাবুর খাওয়া-দাওয়ার কী হবে? ভাবছিস কেন? মরে যাব? এত কাণ্ডতেও যখন তোর মা ঠিক অটুট থাকল করুণাপদ, তখন একা দেবস্থানে যেতে মরে যাবে না। দে তুই দোর দে। দিয়ে আরও খানিক শুগে যা। এখনও ফরসা হতে দেরি আছে। মানসিক শুধতে যাচ্ছি, বাধা দিসনে। পিছু ডাকলে দোষ হয়।
তা বেশ, ডাকছি না। ফিরবে কখন সেটা শুনি?
ওই যেতে আসতে যা সময় লাগবে! সিল্কের চাদরখানা গায়ে জড়িয়ে অস্ফুট আলোর চাদর গায়ে দেওয়া রাস্তায় হন হন করে এগিয়ে চলে লীলা।
যতক্ষণ দেখা যায় তাকিয়ে থেকে, আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে বসে করুণাপদ। দেবদ্বিজে এত ভক্তি আর কবে দেখেছে লীলার?
এই লক্ষ্মীছাড়া করুণাপদর এতখানি মূল্য? তার অসুখে মানসিক করতে হয়, আবার সে-মানসিক শোধ করতে লীলাকে যেতে হয় ঊষাভোরে পায়ে হেঁটে?
চোখে জল এল করুণাপদর।
.
অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলেন কমলাক্ষ। চোখে ঘুম এল প্রায় শেষ রাত্রে। এল তো বড়ো গভীরই এল।
ভোর রাত্তিরের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া হু হু করে বয়ে চলেছিল ঘরের মশারি উড়িয়ে, আলনায় ঝোলানো জামাকাপড় দুলিয়ে।
রাত্রিজাগা ক্লান্ত দেহে এ হাওয়া যেন একটা নেশার জাদু বুলিয়ে দিল। সে-নেশার আচ্ছন্নতা কাটতে রোদ উঠে গেল সকালের।
করুণাপদর ডাকেই বোধ হয় ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন। দেখলেন গলানো রুপোর স্রোত ঘরের মেঝেয়, বিছানায়, মশারিতে, মাঠে আকাশে।
বললেন, সর্বনাশ! কত বেলা!
করুণাপদ বলল, হ্যাঁ, বেলা দেখেই ডেকে দিলাম বাবু। মা বাড়ি নেই, আপনিও ঘুমোচ্ছেন, প্রাণটা কেমন করতে লাগল। তাই বলি ডেকে দিই–
কমলাক্ষ অবাক হয়ে বললেন, মা বাড়ি নেই!
আজ্ঞে না। সেই শেষ রাত্তিরে উঠে দেবস্থান গেছেন মানসিক শুধতে। কপাল করুণাপদর! তার জীবন আবার জীবন! তার সেই জীবনের জন্যে মানসিক করা, তার জন্যে ক্লেশ স্বীকার করে যাওয়া–
কমলাক্ষ হতাশ গলায় বলেন, আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না করুণাপদ।
করুণাপদ বলে, বুঝতে কি আমিই পেরেছি বাবু? আমাকে ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, করুণাপদ দোরটা দে, আমি একটু পুজো দিতে যাব। যত জেরা করি তত বলেন, চুপ চুপ! মানে আর কি আপনার ঘুম ভাঙার ভয়ে—তা এসে যাবেন বোধ হয় বিকেলের মধ্যে। শুনছি আজ যোগ, যাবে অনেকে। মুখটা ধুয়ে নিন বাবু, চায়ের জল চাপিয়েছি।
মুখুজ্জেবাবু না থাকলে যে করুণাপদও সেই অজানা দেবস্থানটা দেখে আসতে পারত সেই কথা ভাবতে ভাবতে যায় করুণাপদ। মানুষটা বড় গোলমেলে।
একমাসের কড়ারে এসেছিল, তার মধ্যে কত কাণ্ডই ঘটে গেল। কাল আবার বাবুর মেয়ে এসে বকাবকি করে গেল। চলে গেলেই হত। করুণাপদ মায়ের তলায় তলায় থেকে হোটেলটা ঠিকই চালিয়ে যেত। উনি আবার এখন কত ফ্যাচাঙের কথা কইছেন। আরে বাবা, আমরা অভিভাবকশূন্য হলাম তা তোর কি? তুই যদি এ-সময় না আসতিস পলাশপুরে?
.
কমলাক্ষ যদি না আসতেন পলাশপুরে? এই সময় নয়, কোনো সময় নয়? জীবনে তো কখনও পলাশপুরের নামও শোনেননি কমলাক্ষ। কোন গ্রহের চক্রান্তে—কিন্তু গ্রহের চক্রান্ত কি কমলাক্ষর? না লীলার?
অদ্ভুত একটা ইতিহাস নিয়ে অদ্ভুত একরকম জীবনযাপন করছিল যে-লীলা এই অখ্যাত অবজ্ঞাত জায়গাটায়? কমলাক্ষই কি তার জীবনে কুগ্রহের মূর্তি নিয়ে এসে দাঁড়ালেন না? কমলাক্ষ না এলে হয়তো ব্ৰজেন ঘোষ টিকে থাকত। হয়তো তাহলে লীলা তাকে মদ খাবার পয়সা দিত।
হয়তো বাড়িতে একটা ভদ্রলোক রয়েছে বলেই ব্রজেন ঘোষকে শাসন করতে গিয়েছিল লীলা। কমলাক্ষ না এলে হয়তো এসব কিছুই হত না।
আর কমলাক্ষর নিজের? এখানে না এলে কমলাক্ষই কি জীবনে কখনও জানতে পারতেন জীবনের সত্য কি?
চিঠিখানা আর একবার চোখের সামনে তুলে ধরলেন কমলাক্ষ। চিঠি নয়, কাগজের একটু টুকরো। যে টুকরোটুকু কমলাক্ষর মশারির তলায় গোঁজা ছিল।
মিথ্যে একটা বন্ধনে জড়িত হয়ে জীবনকে জটিল করে তুলবেন না। চলে যান, দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। ভগবানের বিধানে কত শত বন্ধন মুহূর্তে ছিঁড়ে পড়ে, তাও তো সহ্য করে নিতে হয় মানুষকে? এও না হয় সেইরকমই মনে করুন। মানুষের গড়া সমাজও তো দ্বিতীয় ভগবান!
ভাববেন না-প্রবাসে আবাস আবার চলবে পুরনো নিয়মে। খদ্দেররা যথারীতিই যত্ন পাবে, অনুষ্ঠানের ত্রুটি হবে না। আর আমাকে দেখা-শোনা? তাতেও নিশ্চিন্ত করেই রাখি। শুনুন, যদি শরণ নিই তা হলে ওই গগন গাঙ্গুলীরাই দেখবেন। তাই নেওয়াই ভালো নয় কি?
তাইতো আমাদের দ্বিতীয় ভগবানের নিয়ম। বেরোবার সময়টা পালিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছি, তাতে ভীরু বলুন আর যাই বলুন। আজই কিন্তু চলে যাওয়া চাই। আর শুনুন—মনে করবেন না কিছু, ছুটিছাটা হলে আর যেন ভুলে কখনও পলাশপুরের টিকিট কেটে বসবেন না।