চতুর্থ পর্ব : খাদ
অধ্যায় ২১. জন্মদিনের পার্টি
‘হ্যাপি বার্থডে,’ সেই চিরাচরিত চিৎকার ভেসে আসছে সাতশো মিলিয়ন মাইল : দূর থেকে আলোর গতিতে; ফুটে উঠছে কন্ট্রোল ডেকের ভিশন স্ক্রিনে। পোল পরিবার বেশ স্বার্থপরের মতো একত্র হয়েছে বার্থডে কেকের সামনে। হঠাৎ একদম নীরব হয়ে গেছে তারা সবাই।
তারপর মিস্টার পোল আনন্দের ভঙ্গী করে বললেন, ‘তো, ফ্র্যাঙ্ক, বলার মতো আর কিছু খুঁজে পাচ্ছি না এ মুহূর্তে পারছি শুধু এটুকু বলতে যে আমাদের চিন্তা চেতনা তোর সাথে সাথেই আছে। আর…উই আর উইশিং ইউ দ্য হ্যাপিয়েস্ট অব বার্থডেজ।’
‘নিজের যত্ন নিস, বোকা ছেলে,’ মিসেস পোলের কণ্ঠস্বর কেমন একটু বদলে যায়। তিনি কোনোদিন কান্না চাপতে শেখেননি, ‘খোদা তোর মঙ্গল করবেন।’
এরপর ‘গুড বাই’ এর একটা ঢেউ খেলে যায় পোল পরিবারের বাসায়। ভিশন স্ক্রিন কালো হয়ে গেলে নিজেকে নিজে বলে পোল, কী অবাক কাণ্ড, এসবই হয়েছে এক ঘণ্টারও বেশি সময় আগে। এতক্ষণে এই পুরো পরিবার যার যার মতো ছিটকে পড়েছে আশেপাশের কয়েক মাইল এলাকায়। এই সময়-পার্থক্য থাকার পরও মেসেজটা যেন ছদ্মবেশী কোনো আশীর্বাদ। আর সবার মতো সেও মনে মনে একটা দুঃখই পুষে চলে, যদি একবার সবার সাথে সরাসরি কথা বলা যেত। কিন্তু এই যে দৃশ্য, তা মোটেও বাস্তব নয়, মানসিক প্রভাবটাই প্রকট। সে আবারও দূরত্বের এক অতল গহ্বরে নিজেকে পড়ে যেতে দেখে, আর সব ভাবনা তলিয়ে যায় এর ভিতর।
‘উৎসবে নাক গলানোর জন্য দুঃখিত,’ বলল হাল, ‘কিন্তু আমরা একটা সমস্যায় পড়েছি।’
একসাথে দুজনেই প্রশ্ন করে বসে, ‘কী সমস্যা?’
‘পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছি না ঠিকমতো। সমস্যাটা এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিটে। আমার সমস্যা প্রতিরোধ কেন্দ্র বলছে যে বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে এটা নষ্ট হয়ে যাবে।’
বোম্যান ঠাণ্ডা মাথায় জবাব দিল, ‘আমরা এর দেখভাল করব। অপটিক্যাল অ্যালাইনমেন্টটা আগে দেখে নিই।’
‘এইতো, এটা, ডেভ। এ মুহূর্তে একদম ঠিকঠাক চলছে।’
ডিসপ্লে স্ক্রিনে একটা নিখুঁত অর্ধচন্দ্র দেখা দিল। তারাহীন আকাশের সামনে জিনিসটা একেবারে উজ্জ্বল দেখায়। তার পেছনে দীপ্তিময় আরেক পূর্ণগোলক। দেখে মনে হয় মেঘে ঢাকা শুক্র গ্রহ।
কিন্তু দ্বিতীয় দৃষ্টিতেই সে সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যায়। শুক্রের কোনো উপগ্রহ নেই। দেখেই বোঝা যায় সেই দু-শরীর মা আর সন্তানের। এই ব্যাপারটা অনেক অ্যাস্ট্রোনোমার বিশ্বাস করতেন। পরে প্রমাণ হয় পৃথিবী আর চাঁদ কখনোই এক ছিল না।
আধ মিনিট সময় নিয়ে পোল আর বোম্যান ছবিটা খেয়াল করে দেখে। ইমেজটা লঙ ফোকাস টিভি ক্যামেরা থেকে আসছে। ক্যামেরাটা বড় রেড়িও ডিশে লাগানো, ডিশের রিমে বসানো, কারণ ডিশের মাঝামাঝি কিছু থাকলে খবর আদানপ্রদান সম্ভব হতো না। চিকণ পেনসিল বিমটা তাক করা থাকে পৃথিবীর দিকে, সেটা ডিশের মাঝে একমাত্র বৈধ দখলদার।
‘সমস্যাটা কোথায় তুমি কি জানো?’ প্রশ্ন করে বোম্যান।
‘বোঝা যাচ্ছে না। সম্ভবত ভিতরে। এটুকু বলতে পারি যে প্রব্লেমটা এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিটেই।’
‘তুমি কোন্ সমাধান আশা কর?’
‘সবচে ভালো হয় বাড়তি ইউনিট দিয়ে বর্তমানটাকে বদলে দিতে পারলে। ভিতরে এনে আমরা সাথে সাথে চেক করতে পারব।’
‘ও কে, এবার অন্য কপিটা চাই।
তথ্যটা সাথে সাথে ডিসপ্লে স্ক্রিনে ফুটে উঠল। নিচের স্লটে পড়ে গেল একটা কাগজের টুকরো। আগে এই প্রিন্টআউটই ছিল একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু দিন বদলে গেছে।
এক মুহূর্ত ডায়াগ্রামটায় চোখ বুলিয়ে বোম্যান শীষ দিয়ে ওঠে।
‘তুমি হয়তো আমাদের বলছ যে, কথা বলার সময় ও একটু থামে, বাইরে যাওয়া উচিৎ।’
‘আই অ্যাম স্যরি। কিন্তু তোমরা তো জান যে এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিট অ্যান্টেনা মাউন্টিংয়ে বসানো।’
‘আমি সম্ভবত জানতাম। বছরখানেক আগের কথা। কিন্তু এই শিপে আট হাজার সাব সিস্টেম আছে। তার কোনোটা কোথায় সেসব মনে রাখা তোমার কম্ম, আমার নয়। বোঝা যাচ্ছে সমাধানটা একদম একরোখা, আমাদের বেরিয়ে গিয়ে নতুন ইউনিট বসাতে হবে, ব্যস।’
‘এ কাজ আমাকেই মানায়।’ বলল পোল। সে বাইরের কাজের জন্য ট্রেনিং নিয়েছে, কাজটা এক লহমায় করে ফেলতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে, আমার কিছুই যায় আসে না।
‘আগে দেখে নিই মিশন কন্ট্রোল রাজি নাকি গররাজি।’ বলল বোম্যান, সে কয়েক মুহূর্তের জন্য ভেবে নিয়ে একটা মেসেজ পড়া শুরু করল নিজে নিজেই, কোনো কাগজ ছাড়া।
“মিশন কন্ট্রোল, দিস ইজ এক্স-রে-ডেল্টা-ওয়ান, অ্যাট টু-জিরো-ফোর-ফাইভ, শিপের নাইন-ট্রিপল জিরো কম্পিউটারের ভুল নির্ধারক সেন্টার দেখিয়েছে যে আলফা-ইকো থ্রি ফাইভ ইউনিট আর বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে নষ্ট হতে পারে। অনুরোধ করা হচ্ছে, আপনারা আপনাদের টেলিমেট্রি মনিটরিং করে শিপ সিস্টেম সিমুলেটরের রিভিউ ইউনিট দেখে নিন। আর ই ভি এ-তে গিয়ে এ ই থার্টি ফাইভ অপসারণের অভিযান অনুমোদন করে পাঠানোর অনুরোধ করা যাচ্ছে। মিশন কন্ট্রোল, দিস ইজ এক্স-রে-ডেল্টা-ওয়ান, অ্যাট টু-জিরো-ফোর-সেভেন, ট্রান্সমিশন কনক্লুডেড।”
বহু বছরের সাধনার পর বোম্যান এই মান্ধাতা আমলের যোগাযোগ প্রক্রিয়া রপ্ত করেছে। এবার অপেক্ষা ছাড়া করার কিছুই নেই। দু-ঘণ্টারও বেশি সময় নেবে খবরটা আসতে।
বোম্যান যখন একটা জ্যামিতিক গেমে হালের কাছে হারতে বসেছে এমন সময় জবাব এলো।
‘এক্স-রে-ডেল্টা-ওয়ান, দিস ইজ মিশন কন্ট্রোল, আপনাদের তথ্য প্রাপ্তি স্বীকার করছি টু-ওয়ান-জিরো-জিরো-থ্রি-তে। আমরা টেলিমেট্রিক ইনফরমেশনে আপনাদের মিশন সিমুলেটর দেখছি। কাজ হলে উপদেশ পাঠানো হবে।
‘রজার[৩৮], ইউর প্ল্যান টু গো ই ভি এ অ্যান্ড রিপ্লেস আলফা-ইকো থ্রি-ফাইভ ইউনিট প্রায়োর টু পসিবল ফেইলুর। আমরা এর উপর টেস্ট চালাচ্ছি, রিপ্লেস করার ব্যাপারে অচিরেই তথ্য পাঠানো হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’
সবচে বড় সমস্যা এবার কেটে গেল। টিকতে না পেরে কথক বিশাল মেসেজকে আর এই দাঁত ভাঙা ভাষায় না বলে সহজ ইংরেজিতে বলা শুরু করল।
“স্যরি, তোমরা একটু সমস্যায় পড়েছ। এটাকে তোমাদের কষ্টের সাথে যোগ করিয়ে দিতে চাই না। তোমরা যদি ই ভি এ-তে যেতেই চাও তো পাবলিক ইনফরমেশন থেকে একটা অনুরোধ ছিল। সবার কাছে পাঠানোর জন্য একটা ছোট্ট মেসেজ রেকর্ড করতে পারবে? বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটু কথাবার্তা, সাথে সাথে এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিট কী করে তা নিয়ে এক আধটু কথা ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বললেই চলবে। বুঝতেই পারছ, যথাসম্ভব আশা দিতে হবে পাবলিকের মনে। ভালো হোক আর খারাপ, খবরটা একটু ভালোর দিকেই রেখ। আমরাও করতে পারি কাজটা, তবে তোমাদের মুখ থেকে না বেরুলে তোপের মুখেও পড়তে পারি। আশা করি এটা তোমাদের সামাজিক জীবনে তেমন নাক গলাবে না। দিস ইজ…”
আবার শেষকালের দাঁতভাঙা কথা।
অনুরোধ শুনে বোম্যান হাসবে না নাচবে তা ভেবে পায় না। এমন মাসের পর মাস কেটেছে যখন পৃথিবী তাদের খোঁজটুকুও নেয়নি। ‘খবরটা একটু ভালোর দিকেই রেখ…’ হাহ্!
ঘুমানোর আগে পোল তার সাথে যোগ দিলে দুজনে সেই মেসেজ লিখে অভিনয় করতে দশ মিনিট খরচ করল। প্রথম প্রথম হাজার হাজার অনুরোধ আসত; ইন্টারভিউ, আলোচনা, ব্যক্তিগত কথা, কত্ত কী! তারা কাশি দিতে চাইলে তাও একটা এক্সক্লসিভ খবর হয়ে যেত। সময় পার্থক্য মিনিট থেকে ঘণ্টার দিকে গড়িয়ে যেতেই আগ্রহ কর্পূরের মতো উবে গেছে। বৃহস্পতির পাশ দিয়ে উড়ে যাবার পর গত এক মাসে তারা মাত্র তিন-চারটা সাধারণ খবর পাঠিয়েছে সংবাদ সংস্থাগুলোর কাছে।
‘মিশন কন্ট্রোল, দিস ইজ…’ আপনাদের প্রেস রিলিজটা পাঠালাম।
‘আজ দিনের শুরুতে একটা ছোট টেকনিক্যাল সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের হাল ন’ হাজার কম্পিউটার আন্দাজ করে যে এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিট কোনো গণ্ডগোল পাকাচ্ছে।
‘কম্যুনিকেশন সিস্টেমের এ এক ক্ষুদ্র অংশ। কিন্তু এর গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের মূল অ্যান্টেনাকে এই জিনিসটাই পৃথিবীর সাথে গেঁথে রাখে। হাজার হাজার ডিগ্রির হিসাবেও এর সূক্ষ্মতা হ্রাস পায় না এক বিন্দু। সাতশো মিলিয়ন মাইল দূর থেকে পৃথিবী একদম নগণ্য এক তারা ছাড়া কিছু নয়। আমাদের পাতলা রেডিও বিম সহজেই গ্রহটাকে মিস করতে পারে।
‘অ্যান্টেনাটা সর্বক্ষণ পৃথিবীর দিকে তাক করা থাকে কারণ এর মোটরগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে মূল কম্পিউটার। কিন্তু সেই মোটরগুলো তাদের খবরাখবর পায় এই থার্টি ফাইভ ইউনিট এর মাধ্যমে। আপনারা একে কোনো শরীরের নার্ভ সেন্টারের সাথে তুলনা করতে পারেন। এই স্নায়ুকেন্দ্রই মস্তিষ্কের আদেশগুলোকে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পেশীর উপযোগী করে অনুবাদ করে দেয়, দেয় পাঠিয়ে। আদেশ বয়ে না আনতে পারলে অঙ্গ একেবার অকেজো হয়ে যাবে। আমাদের ক্ষেত্রে, এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিট নষ্ট হলে অ্যান্টেনা যেমন খুশি তেমন ঘোরা শুরু করতে পারে, কিংবা পৃথিবীর দিকে তাক করা থাকলেও তার খবর চলে যেতে পারে হাজার গুণ দূর দিয়ে। গত শতাব্দীর গভীর মহাশূন্য অভিযানের সবচে বড় সমস্যার এও একটি।
‘আমরা এখনো ভুলটা ধরতে পারিনি; কিন্তু পরিস্থিতি মোটেও ঘোলা হয়ে যায়নি। আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। আমাদের হাতে আরো দুটি এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিট আছে। প্রত্যেকটি বিশ বছর কাজ করতে পারবে। এমনকি ভুলটা ধরতে পারলে প্রথম ইউনিটও ঠিক করা সম্ভব।
‘ফ্র্যাঙ্ক পোল এ কাজের জন্য বিশেষভাবে স্বীকৃত। তিনি বাইরে গিয়ে নষ্ট ইউনিটটার বদলে নতুনটা বসিয়ে আসবেন। এই সুযোগে তিনি শিপের গা পরীক্ষা করে ই ভি এ ইউনিটের বাকী জিনিসগুলোও দেখে আসতে পারবেন।
‘এই ছোট সমস্যা ছাড়া মিশন তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। আশা রাখি একই ভাবে বাকী সময় চলবে।
‘মিশন কন্ট্রোল, দিস ইজ এক্স-রে…’
অধ্যায় ২২. বেরিয়ে পড়া
ডিসকভারির বাইরের কাজ সারার জন্য যে ক্যাপসুল ব্যবহার করা হয় তার চলতি নাম ‘স্পেস পোড’। এগুলো নফুট ব্যাসের গোলক, ভিতরে বিশাল জানালা। পেছনে অপারেটর বসে। জানালার নাম বে উইন্ডো। মূল রকেট ড্রাইভটা মাধ্যাকর্ষণের পাঁচ ভাগের একভাগ আকর্ষণ তৈরি করে বেরিয়ে যায়। অন্যদিকে ছোট্ট অ্যাটিচ্যুড কন্ট্রোল জেটগুলো স্টিয়ারিংয়ের কাজ করে। জানালার ঠিক নিচে দুটি কৃত্রিম হাত বা ‘ওয়ালডো’ আছে যার একটা ভারি কাজ করে, অন্যটা একেবারে পল্কা কাজেও পটু। আরেকটা বেরিয়ে আসার মতো অঙ্গ আছে এই যানের, সেটায় ক্রু ড্রাইভার আর করাতের মতো অনেক যন্ত্র থরে থরে বসানো থাকে।
মানুষের সবচে আধুনিক যান নয় এই স্পেস পোড, তাতে কী, শূন্যে নির্মাণ বা বাহ্যিক কাজে এর জুড়ি মেলা ভার। সাধারণত তাদের মেয়েলি নাম থাকে, কারণ সম্ভবত এই যে তাদের কাজ বাহ্যিক দৃষ্টিতে হাল্কা হলেও অপ্রতিরোধ্য, তাদের ছাড়া চলেও না। ডিসকভারির ত্রয়ীর নাম যথাক্রমে অ্যানা, বিটি আর ক্লারা।
একবার নিজের ব্যক্তিগত প্রেশার স্যুট গায়ে চাপিয়ে নিয়েই পোল পোডের ভিতর ঢুকে দশ মিনিট ধরে সেটার কন্ট্রোল দেখে নেয়। সব দেখে নিয়ে অক্সিজেন আর পাওয়ার রিজার্ভ পরীক্ষা করে। পুরোপুরি তুষ্ট হবার পর রেডিও সার্কিটে হালের সাথে যোগাযোগ করে। কন্ট্রোল প্যানেলে বোম্যান বসে থাকলেও কোনো বড়সড় ভুল না হলে তার নাক গলানোর নিয়ম নেই।
‘দিস ইজ বিটি। পাম্পিং শুরু কর।’
‘পাম্প করা শুরু হয়েছে।’
সাথে সাথে পাম্পের মৃদু আঁকি অনুভব করে পোল। যানটার গা একদম পাতলা। পাঁচ মিনিট পর হাল আবার খবর দেয়, ‘পাম্প করা সমাপ্ত।’
শেষবারের মতো পোল তার ছোট্ট ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেল দেখে নেয়। সবই চলছে ঠিকমতো।
‘বাইরের দরজা খোল।’ সে আদেশ করে।
হাল কাজ শুরু করে দিয়েছে। যে কোনো কাজের যে কোনো পর্যায়ে পোল ‘হোল্ড’ শব্দটা বলা মাত্র সে কাজটা বন্ধ রাখবে।
পোডের সামনের দেয়াল চিরে যাচ্ছে। বাতাসের শেষবিন্দু মহাকাশে হারিয়ে গেলে পোল বুঝতে পারে ছোট্ট পোডটা একটু একটু কাঁপছে। দূরে ছোট্ট শনি দেখা যায়। এখনো চারশো মিলিয়ন মাইল যেতে হবে।
‘পোড বের কর।’
যে রেলের উপর পোড ঝুলছিল সেটা ধীরে বাইরের দিকে এগিয়ে যায়। ডিসকভারির বাইরে ছোট্ট স্পেসপোড বিটি ঝুলছে।
মূল জেটটা আধ সেকেন্ডের জন্য চালানোর সাথে সাথে রেল থেকে বেরিয়ে আসে বিটি। সে সূর্যের চারপাশে একান্ত নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরছে। এখন ডিসকভারির সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই, এমনকি নেই কোনো সেফটি লাইন-যেটা ধরে তাকে টেনে ভিতরে আনা সম্ভব। মাঝেমধ্যেই এই মরার পোডগুলো ঝামেলা পাকায়। অবশ্য তেমন কিছু হলে বোম্যান সাথে সাথে চলে আসবে।
বাইরের দিকে শ’ খানেক ফুট দূরে সেটাকে ভাসিয়ে নিয়ে পোল পরীক্ষা করে, সব ঠিকমতো চলছে। একবার পাশে, আর একবার পেছনে ঘুরিয়ে নিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে কাজে মন দেয়।
প্রথম টার্গেট হল শিপের গায়ে আধ ইঞ্চি জুড়ে একটা নষ্ট এলাকা। পিনের মাথার চেয়েও ছোট্ট একটা ধূলিকণা তার অসীম বেগ নিয়ে এখানটায় আছড়ে পড়ার সাথে সাথে বাস্প হয়ে গেছে। কিন্তু রেখে যাওয়া ক্ষতচিহ্নটা কম কথা নয়। দেখে মনে হয় ভিতর থেকে কোনো বিস্ফোরণের জন্যে জিনিসটার এ হাল হয়েছে, আসলে গতিবেগের এ পর্যায়ে সাধারণ বিচারবুদ্ধি খুব একটা কাজে দেয় না।
পোডের জেনারেল পারপাস কিট থেকে একটা কন্টেইনার নিয়ে সেখানে বিশেষ একটা তরল ছিটিয়ে দেয় পোল। সাদাটে আঠালো জিনিসটা জ্বালামুখ ঢেকে দিল। প্রথমে একটা বড় বুদবুদ উঠল। পরে সব ঠিক হয়ে যাবার পরও পোল বেশ কয়েক মিনিট তাকিয়ে থাকে সেদিকে। তবু সতর্কতার খাতিরে আরেকবার স্প্রে করে অ্যান্টেনার দিকে মনোযোগ দেয়।
ডিসকভারির লম্বাটে শরীরের চারদিকে ঘুরতে কয়েক মিনিট সময় লাগবে তার, কারণ সে কখনোই মিনিটে কয়েক ফুটের বেশি স্পিড় উঠাতে দেয়নি। শিপের শরীর থেকে বেরুনো কিম্ভুত যন্ত্রগুলোর সব ঠিক আছে কিনা তা দেখে নিয়ে সাবধানে চলতে শুরু করে। কারণ জেটের আগুন লেগেও শিপের ক্ষতি হতে পারে।
অবশেষে লং রেঞ্জ অ্যান্টেনার দিকে সে এগিয়ে যায়। বিশ ফুট ব্যাসের বিশাল ডিশটি যেন সরাসরি সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন পৃথিবী আর সূর্য এখান থেকে প্রায় একই দিকে দেখা যায়। বিরাট ধাতব চাকতির পেছনে ঢাকা পড়ে গেছে অ্যান্টেনা মাউন্টিং।
পেছন থেকে পোল এগিয়ে যায়। কারণ অগভীর প্যারাবোলিক রিফ্লেক্টরের সামনে চলে গেলে যোগাযোগ কেটে যাবে সাময়িকভাবে। ছায়া সরিয়ে দিতে পোডের স্পট লাইট জ্বালিয়ে দিল পোল।
এই হালকা ধাতব প্লেটের পেছনেই যত অঘটনের নাটের গুরু বসে আছে। চারটা লকনাট আছে, খুলতে হবে। তবু পুরো এ ই পঁয়ত্রিশ ইউনিটটা বদলের সুবিধা রেখে তৈরি করা হয়েছে বলে সে তেমন ভ্যাজাল আশা করে না।
স্বাভাবিকভাবেই পোড়ে বসে কাজ সারা গেল না। একেতো যান্ত্রিকভাবে এ কাজ করে পোষাবে না, তার উপর মূল রেডিও মিররের কাগজ-পাতলা প্রতিফলন তল নষ্ট হয়ে যেতে পারে জেটের ছোঁয়ায়।
এই সব কাজই অপারেশনের আগে ঠিক করা। বোম্যান দুবার করে সব পরীক্ষা করে নিয়েছে। একে রুটিন চেকও বলা যায়। কিন্তু এই রুটিন চেকে একটু ভুল করলে তার কোনো ক্ষমা নেই, কারণ বাইরের অভিযানে কখনো ‘ছোট ভুল’ হয় না। যেটা হয় সেটাই বড়।
সে সময় মতো অ্যান্টেনা সাপোর্ট থেকে বিশ ফুট দূরে পোডটা নামিয়ে রাখল। শিপের গায়ের বাইরের দিকে যে মই লাগানো আছে তার গায়ে পোডের একটা হাত লাগিয়ে নিয়েছে, ভেসে যাবার ভয় নেই।
গায়ের স্যুটটা ভালোমতো পরীক্ষা করে নিয়ে সে পোড ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। বেরুনোর সাথে সাথে স্যুটের গায়ে দেখতে পায় ক্রিস্টাল বরফের পাতলা আবরণ। গায়ের বাতাসে লেগে থাকা পানির সবটুকুই জমে গেল। দূরের নক্ষত্রবীথি যেন আরো দূরে সরে গেছে।
বেরিয়ে যাবার আগে শেষ কাজ হিসেবে বিটির নিয়ন্ত্রণ ম্যানুয়াল থেকে বদলে দিয়ে রিমোট করে নেয়। এখন হালই বিটির নিয়ন্তা। তারপরও অতিরিক্ত সতর্কতা স্বরূপ তুলার চেয়ে একটু মোটা একটা কর্ডে নিজেকে বেঁধে নিয়েছে।
পোডের দরজা খুলে যাবার পর সে ধীরলয়ে বেরিয়ে পরে মুক্ত আকাশে। যানের বাইরে কাজ করার সময় কিছু নীতি মানতে হয়। সবকিছু সহজভাবে নাও-কখনো দ্রুত নড়ে না-থামো আর চিন্তা কর।
বিটির বাহ্যিক হ্যান্ডহোল্ড ধরে সে ক্যাঙ্গারুর বাচ্চার মতো আটকে থাকা এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিট বের করে আনে। পোল পোডের কোনো খুচরো যন্ত্র ব্যবহার করবে না। এগুলো মানুষের হাতের উপযোগী নয়। বরং তার সব পছন্দের জিনিসই এখন কোমরে শোভা পাচ্ছে।
নিজেকে একটু ধাক্কা দিয়ে বিগ ডিশের পেছনে চলে গেলে তার দুটো ছায়া পড়ে, একটা সূর্যের আলোয়, অন্যটা বিটির স্পটলাইটের কল্যাণে। কিন্তু তার অবাক হতে বাকী ছিল। বিরাট আয়নার পেছনটাও ঝলমল করছে আলোতে। অতি ক্ষুদ্র আলোর রেখাও প্রতিসৃত হচ্ছে দারুণভাবে।
একটা মুহূর্ত স্তব্ধ থাকার পর ব্যাপারটা ধরা পড়ে। এই লম্বা ভ্রমণে কম মহাজাগতিক ধূলিকণার সাথে সংঘর্ষ হয়নি এই অ্যান্টেনার, সেগুলো অকল্পনীয় সূক্ষ্ম ছিদ্র তৈরি করেছে, সেখান দিয়েই আলো আসে। এরা সবাই এত ছোট যে সপ্রচার-কাজের কোনো ক্ষতিই হয় না।
ধীরে নড়তে নড়তে অ্যান্টেনা মাউন্টিংয়ের বাইরের দিকের হ্যান্ডহোন্ড ধরে নেয় সে। এরপর সবচে কাছের জায়গায় নিজের সেফটি বেল্ট লাগিয়ে নিয়ে রিপোর্ট করে বোম্যানের কাছে।
এই ছায়ায় ইউনিটটাকে দেখা যাচ্ছে না। তাই হালকে সেকেন্ডারি স্পটলাইট জ্বালাতে বলার সাথে সাথে ডিশের পেছনটা আলোয় ভরে গেল।
ধাতব শিটের উপর চোখ রেখে ঠাণ্ডা মাথায় ছোট্ট হ্যাঁচটার কথা ভাবতে ভাবতে আপন মনে বিড়বিড় করে ফ্র্যাঙ্ক পোল, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে ইহা খুলিবার উপক্রম হইয়াছে, ফলে ইহার গ্যারান্টি নষ্ট হইবার পর্যায় উপস্থিত। জিরো টর্ক ক্রু ড্রাইভার দিয়ে সে প্রমাণ সাইজের গুলো তুলে আনে। এই বিশেষ যন্ত্রটার ভিতরের স্প্রিং সেই স্ক্রর বাইরের দিকের বল শুষে নেবে। তাই সেগুলোর উঠে গিয়েই ভেসে বেড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
ক্রুগুলোকে তুলে নিয়ে পোল রেখে দিল কাজের পাউচে। এক সময় বলা হতো যে পৃথিবীর চারদিকে শনির মতো একটা বেল্ট তৈরি হবে। সেটায় থাকবে মহাকাশ নির্মাণের সময় ছিটকে পড়া বিভিন্ন বন্টু, খুচরো যন্ত্রাংশ, ধাতব টুকরো, অসাবধানে ফেলে দেয়া খাবারের ক্যান ইত্যাদি ইত্যাদি।
ধাতব ঢাকনাটা মহা গোঁয়ারগোবিন্দ। পোল একবার সন্দেহ করে বসে, সেটা হয়তো জাহাজের গায়ে পাকাপাকি বসিয়ে দেয়া হয়েছে। বেশ কয়েকবার জোরাজুরির পর ঢাকনা আলগা হয়ে আসা শুরু করে।
বিরাট একটা ক্রোকোডাইল ক্লিপ দিয়ে জিনিসটাকে সে অ্যান্টেনা মাউন্টিং এর সাথে আটকে রাখল।
এতক্ষণে সে ঠাণ্ডা মাথায় এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিটের ইলেক্ট্রনিক সার্কিটে চোখ বুলানোর ফুরসত পায়। জিনিসটা দেখতে পাতলা চারকোণা স্ল্যাবের মতো; আকৃতিতে মোটামুটি একটা পোেস্টকার্ডের মতো দেখায়। টেনে তুললেই সমস্ত নিয়ন্ত্রণ উধাও হয়ে যাবে। ফলে তার উপরও অ্যান্টেনাটা এসে পড়তে পারে।
এজন্য প্রথমেই পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করতে হবে। এবার পোল অ্যান্টেনাটায় ধাক্কা না দিলে এম্নিতে নড়বে না। এই কমিনিটে পৃথিবীকে হারিয়ে ফেলার তেমন সম্ভাবনা নেই।
রেডিওতে সে যোগাযোগ করল কম্পিউটারের সাথে, ‘হাল, এখনি ইউনিটটা সরাব। তুমি অ্যান্টেনা সিস্টেমের সব কনেল পাওয়ার অফ করে দাও।’
‘অ্যান্টেনা কন্ট্রোল পাওয়ার অফ।’
‘শুরু হচ্ছে, তুলে ফেলছি ইউনিট। এখুনি।’
কার্ডটা কোনো ভোগান্তির চেষ্টা না করে উঠে এলো। এর ডজন ডজন স্লাইডিং কন্টাক্টের কোনোটাই বিন্দুমাত্র গোঁড়ামী করল না। এক মিনিটের মধ্যে বাড়তি ইউনিটটা বসে গেল জায়গা মতো।
কিন্তু পোল কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। সে নিজেকে আস্তে করে অ্যান্টেনা মাউন্ট থেকে দূরে ঠেলে দেয়। নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে হালকে কল করে, এবার নতুন ইউনিটের কাজ করার কথা। কন্ট্রোল পাওয়ার ফিরিয়ে দাও।’
‘পাওয়ার অন।’
অ্যান্টেনা একেবারে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল।
‘ভুল পরীক্ষার টেস্টগুলো চালাও।’
এবার অনুবীক্ষণিক তরঙ্গ প্রবাহিত হলো ইউনিটের ভিতরে। সম্ভাব্য সব রকমের ভুল খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রত্যেক যন্ত্রাংশের কাজ আর সহ্যক্ষমতা তলিয়ে দেখা শুরু করেছে হাল। এই কাজ আরো বহুবার করা হয়েছে ইউনিটটাকে ফ্যাক্টরি থেকে বের করার আগে। কিন্তু সেটা দু-বছর আর সত্তর কোটি মাইল দূরত্বের হিসাব।
‘সার্কিট পুরোপুরি অপারেশনাল,’ দশ সেকেন্ড পরেই হাল রিপোর্ট পাঠায়। এটুকু সময়ে সে এত বেশি টেস্ট শেষ করেছে যতটা কাজ করতে পারে ছোটখাট একটা সেনাবাহিনী কোনো সার্চ-অপারেশনের সময়।
‘চমৎকার।’ আনন্দিত গলায় বলে পোল, ‘এবার আমি কভার বসাতে যাচ্ছি।’
যানের বাইরের অপারেশনে এও এক ভয়াবহ কাজ। সাধারণত পুরো কাজটা সতর্কভাবে শেষ করে তারপর ফিরে যাবার মুহূর্তে কোনো ভুল করে বসে অভিযাত্রীরা। কিন্তু সে পৃথিবীর সেরা মহাকাশচারীদের একজন না হলে এ মিশনে স্থান করে নিতে পারত না।
সে সময় নিয়ে ভাবে। এরমধ্যে একটা স্ক্র বেরিয়ে গেল। কয়েক ফুটের মধ্যেই সেটাকে পাকড়াও করে নিল সে।
পনের মিনিট পর পোল ফিরে আসছিল স্পেস পোড গ্যারেজের ভিতর। তার মনে একটা তৃপ্তি কাজ করে, অন্তত একটা কাজ আর করতে হবে না।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, তার ধারণাটা ভুল।
অধ্যায় ২৩. রোগ নির্ণয়
‘তুমি কি বলতে চাও যে,’ অবাক হওয়ার চেয়ে বেশি বিরক্ত হয়েছে পোল, ‘এই এত কাজ আমি করলাম তার সবই ফাও?’
‘অনেকটা তেমনই,’ পোলের ক্ষেপে যাওয়াটা কিঞ্চিৎ উপভোগ করছে বোম্যান, ‘পুরনো ইউনিটটা পুরোপুরি পাশ করে গেছে। এমনকি দু’শ পার্সেন্ট কাজ করানোর সময়ও কোনো সমস্যা করেনি।’
দু নভোযাত্রী তাদের ওয়ার্কশপ-কাম-ল্যাবে কাজ করছে। ল্যাবটা কয়রাসেলের ভিতর। পরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণের জন্য এ জায়গাটা স্পেস পোড বের চেয়ে বেশি কাজে লাগে। এখানে কোনো জিনিসের হারিয়ে যাবার ভয় নেই, সূর্যকে ঘিরে পাক খাবার ভয় নেই, নভোচারীদের ভেসে যাবার ভয়ও নেই।
সেই পাতলা এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিটটা এক ম্যাগনিফাইং লেন্সের নিচে জবুথবু হয়ে পড়ে আছে। জিনিসটা এক ধাতব ফ্রেমে বসানো, ফ্রেম থেকে রঙ-বেরঙের তার বেরিয়ে গিয়ে টেস্টিং ইউনিটে জড়ো হয়েছে। অটোম্যাটিক টেস্ট সেটটা আকারে ডেস্কটপ কম্পিউটার থেকে মোটেও বড় নয়। কোনো ইউনিটকে পরীক্ষা করে দেখতে হলে শুধু ট্রাবলশুটিং’ লাইব্রেরি থেকে সঠিক কর্ডটা বেছে নিয়ে লাগিয়ে দাও, একটা বাটন টিপে বসে থাক, ব্যস। নষ্ট জায়গাটা ঠিক ঠিক দেখিয়ে দেবে ছোট্ট ডিসপ্লে মনিটর। এমনকি সমাধানও দেখিয়ে দেবে।
‘নিজে আরেকবার করে দেখ।’ একটু বিভ্রান্ত স্বরে বলল বোম্যান।
পোল ওভারলোড সিলেক্ট সুইচ অন করল। এক্স-টু দিয়ে টেস্ট বাটনে চাপ দিতেই স্ক্রিনে জল জুল করে উঠল, ইউনিট ওকে।
‘আমার মনে হয় আমরা এর উপর কাজের বোঝা চাপিয়ে যেতে পারি জ্বলে না যাওয়া পর্যন্ত, সে অনেকটা হতাশ কণ্ঠে বলল, তাতে কাজের কাজ কিসসু হবে কি?’
‘হালের ইন্টার্নাল ফল্ট প্রেডিকটর হয়তো কোনো ভুল করেছে।’
‘যাক, এসব বলে আর লাভ নেই। বরং খুঁতখুত করার চেয়ে বদলে দেয়া বহুৎ আচ্ছা। এ কাজে আমরা নিশ্চয়ই কোনো “কিন্তু” রাখতে চাই না?’
বোম্যান জবাব না দিয়ে জিনিসটাকে আলোয় তুলে ধরল। ছোট্ট একটা টুকরো। এর গায়ে অণুবীক্ষণিক সব জাল। দেখে শুনে একদম উচ্চস্তরের আর্ট বলে মনে হয়।
অনেকক্ষণ পর জবাব এল, “আমরা আসলেই কোনো কিন্তু রাখতে চাই না। হাজার হলেও এ জিনিসই আমাদেরকে পৃথিবীর সাথে গেঁথে রেখেছে। আমি এটাকে এন জি তে ফাইলবদ্ধ করে নষ্ট জিনিসের স্টোরে রেখে দিব। আমরা বাড়ি ফেরার পর কেউ না কেউ দামি জিনিসটা নিয়ে দুঃখ করতে পারে। আমাদের এসব মানায় না। আমাদের দরকার কিন্তুহীন মিশন।”
কিন্তু দুঃখিত হওয়া শুরু হয়েছে আরো অনেক আগে। পৃথিবী থেকে শেষ যে ট্রান্সমিশন হয় তখন থেকেই।
‘এক্স-রে-ডেল্টা-ওয়ান, দিস ইজ মিশন কন্ট্রোল, টু-ওয়ান-ফাইভ-ফাইভে বলছি, আমরা একটু সমস্যায় পড়েছি।
‘আপনারা রিপোর্ট করেছেন যে আলফা-ইকো থ্রি ফাইভ ইউনিটে কোনো সমস্যা নেই, আমাদের পরীক্ষণেও তা প্রমাণিত সত্য। সমস্যাটা সংযুক্ত অ্যান্টেনা সার্কিটে থাকতে পারে। কিন্তু যদি তা হয়ে থাকে তবে তার জন্য নতুনতর পরীক্ষণ প্রয়োজনীয় বলে প্রতীয়মান হয়।
‘তৃতীয় সম্ভাবনাও হিসাবে আনার যোগ্য। এটা আরো গম্ভীর হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট। (এতক্ষণে রিপোর্টার একটু বিরক্ত হয়েই যেন সাধারণ ভাষায় কথা শুরু করল…) তোমাদের কম্পিউটার ভুল করে থাকতে পারে। আমাদের নাইন ট্রিপল জিরোগুলোও একই তথ্য পেয়ে একই সাজেশন করছে। এ নিয়ে ঘাবরাবার কিছু নেই। কারণ, ব্যাক আপ সিস্টেম আছে। কিন্তু আমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের সতর্ক করা উচিত। পরে আর কোনো সমস্যা চোখে পড়ে কিনা দেখে নিও। আমরা গত কয়েকদিনে বেশকিছু ছোট ব্যতিক্রম পরীক্ষা করে দেখেছি। তাতে অবশ্য তেমন হেরফের হবে না। এসব থেকে কোনো উপসংহারেও পৌঁছতে পারছি না।
‘আমরা দুই কম্পিউটার নিয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা করছি। ফলাফল পাবার সাথে সাথে তোমাদের জানানো হবে। আবারো বলছি, অ্যালার্মের কোনো প্রয়োজন নেই। বড়জোর তোমাদের নাইন ট্রিপল জিরোকে প্রোগ্রাম অ্যানালাইসিসের জন্য বিচ্ছিন্ন করা হতে পারে। তারপর কন্ট্রোলটা আমাদের অন্য কোনো কম্পিউটারের উপর ছেড়ে দিতে পারি। সময়-পার্থক্যটা সমস্যা করতে পারে, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এখনো পৃথিবীর কম্পিউটার দিয়ে শিপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কারণ তোমাদের ঘোঁট কম্পিউটারগুলো সময় পার্থক্য পুষিয়ে নিতে পারবে।
‘এক্স-রে-ডেল্টা-ওয়ান, দিস ইজ মিশন কন্ট্রোল, টু-ওয়ান-ফাইভ-সিক্স, সম্প্রচার সমাপ্ত।
পোল এই খবরটা আসতে দেখে নিরবে পরিস্থিতি যাচাই করা শুরু করল। আগে দেখা উচিত হালের কিছু বলার আছে কিনা, কিন্তু কম্পিউটার এই তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করার কোনো চেষ্টাই করেনি। ভাল; যদি হাল নিজে থেকে ব্যাপারটা না তোলে তো তার এ নিয়ে ঘাটাঘাটির দরকার কী?
আবার পালাবদলের সময় এসেছে, সে বোম্যানের জন্য অপেক্ষা করছে কন্ট্রোল ডেকে বসে থেকে। কিন্তু আজ সে প্রথমবারের মতো নিজের রুটিন ভেঙে বোম্যানের ঘরে গেল।
বোম্যান এরমধ্যে উঠে পড়েছে। ডিস্পেন্সার থেকে একটু কফি ঢেলে নিচ্ছিল এমন সময়ে একটু বিমর্ষ ‘গুড মর্নিং’ জানায় ফ্র্যাঙ্ক পোল। এত লম্বা মহাকাশ যাত্রার পরও তারা চব্বিশ ঘণ্টার দিনের কথা ভুলতে পারেনি যদিও তাদের কাছে রাতের কোনো ভূমিকা নেই।
‘গুড মর্নিং, কেমন চলছে কাজকর্ম?’
পোল নিজে একটা কফি নিয়ে প্রশ্ন করে, ‘মোটামুটি, তুমি কি ঠিকমতো জেগেছ?’
‘ভালই আছি। কেন, আবার কী হল?’
এর মধ্যেই দুজনে খুব সতর্ক হয়ে গেছে। রুটিনে একটু ব্যত্যয় ঘটলেই অন্যজন বুঝে নেয় কোনো সমস্যা আছে।
‘যাই হোক,’ ধীরে ধীরে বলে পোল, ‘মিশন কন্ট্রোল এইমাত্র আমাদের মাথায় একটা ছোটখাট বোমা ফেলেছে।’ সে কণ্ঠস্বর নিচু করে, যেন কোনো ডাক্তার তার রোগীর সামনে রোগ নিয়ে অন্য কারো সাথে কথা বলছে, সম্ভবত আমাদের শিপে হাইপোকন্ড্রিয়ার[৩৯] আলামত দেখা দিচ্ছে।
হয়তো বোম্যানের ঘুম পুরোপুরি কাটেনি। সে বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় নেয় ব্যাপারটা বুঝে উঠতে গিয়ে। তারপর হঠাৎ করেই বলে ওঠে, ‘ও-আচ্ছা, আর কী বলল?’
‘বলল যে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কথাটা দুবার বলেছে। সম্ভবত প্রোগ্রাম অ্যানালাইসিস চালাবে।’
তারা দুজনেই জানে যে হাল প্রতিটি শব্দ শুনতে পাচ্ছে, সুতরাং এই ভদ্রোচিত পথ চলা ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই। হাল তাদের সাথী, এ মুহূর্তে সেই সাথী নিয়ে একান্তে আলাপের পরিস্থিতি আসেনি।
তারা মিশন কন্ট্রোল থেকে পরের আদেশের অপেক্ষায় থাকে, হাল নিজেও কথাটা তুলতে পারে। যাই হোক, ডিসকভারির চেহারা পাল্টে গেছে। কোথাও যেন চিড় ধরেছে, বাতাসে স্তব্ধতার গন্ধ।
ডিসকভারি এখন আর কোনো সুখী শিপের নাম নয়।
অধ্যায় ২৪. ভাঙ্গা সার্কিট
আজকাল সবাই বলতে পারে কখন হাল কথা বলবে। প্রয়োজন ছাড়া সে আর টু শব্দটিও করে না। আগের মতো কথার আগে পরে বাড়তি ব্যক্তিত্ব জুড়ে দেয় না কম্পিউটারটা। গত কয়েক সপ্তাহে এই বিশেষ দিকটা আরো প্রকট হয়ে উঠছে। ব্যাপারটা আরো বিরক্তিকর হওয়ার আগেই তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভাববে।
পোল ঘুমিয়ে ছিল, বোম্যান কন্ট্রোল ডেকে বসে পড়ার সময় হাল ঘোষণা করে, ‘ইয়ে, ডেভ, তোমার জন্য একটা মেসেজ ছিল।
‘কী?’
‘আমাদের আরো একটা এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিট নষ্ট হয়ে গেছে। আমার ফল্ট প্রেডিক্টর ইউনিট রিপোর্ট করেছে যে সেটা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অকেজো হয়ে পড়বে।
বোম্যান বইটা নামিয়ে রেখে চিন্তান্বিত চোখে চেয়ে থাকে কম্পিউটার কনসোলের দিকে। সে জানে, ভালমতোই জানে যে ঠিক সেখানে হাল থাকে না, কিন্তু একে কী বলা যায়? কম্পিউটারের ব্যক্তিত্ব কোথায় থাকে? বড়জোর বলা যায় পরস্পর সংযুক্ত মেমোরি ইউনিটের গোলক ধাঁধা আর প্রসেসিং গ্রিডগুলোয় তার বাস। সেসব অংশ করোসেলের কেন্দ্রীয় অক্ষের কাছে অবস্থিত। কিন্তু একটা মানসিক ব্যাপার বলা চলে এই আচরণকে, ‘হাল’ বলতে ডেভ বোম্যান আর পোল তাকায় কম্পিউটার কনসোলের ক্যামেরার দিকে যেটা দিয়ে হাল তাদের দেখতে পায়।
‘আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না, হাল। দুদিনের মধ্যে দুটো ইউনিট নষ্ট হতে পারে না।’
‘আসলেই একটু অন্যরকম লাগে, ডেভ। কিন্তু তোমাদের নিশ্চয়তা দিতে পারি যে সেখানে একটা সমস্যা হয়েছে।’
‘ট্র্যাকিং অ্যালাইনমেন্ট সিস্টেম দেখাও।’
ডেভ একেবারে ভালমতোই জানে যে এই দেখায় কিছু এসে যায় না। কিন্তু দেখাটাই আসল নয়, তার ভাবার জন্য সময় চাই। সেই সময়টা যাতে হাল না বুঝতে পারে। মিশন কন্ট্রোল যে রিপোর্ট পাঠানোর কথা বলেছিল তা এখনো এসে পৌঁছেনি। এবার একটু সাবধানে পরীক্ষা করার সময় এসেছে।
সামনে পৃথিবীর সেই পরিচিত দৃশ্য। এবার চাঁদ একটু পিছিয়ে যাওয়ায় সূর্যের আলোয় বসুন্ধরা দারুণ হাসি হাসছে। চিকণ পেন্সিলটা এখনো তাদেরকে উৎপত্তির গ্রহের সাথে আটকে রেখেছে। এই হওয়ার কথা। যোগাযোগ বন্ধ হলে অ্যালার্মের তারস্বরে চিৎকার করা ছাড়া উপায় থাকত না।
‘ভুলটা কোথায় তা নিয়ে তোমার কোনো ধারণা আছে?’
হাল কখনো এতক্ষণ চুপ করে থাকে না। অবশেষে সে জবাব দেয়, আসলে কোনো ধারণা নেই, ডেভ। আমার আগের রিপোর্টের মতো এবারো সমস্যার গোড়াটা ধরতে পারছি না।’
‘তুমি কি পুরোপুরি নিশ্চিত যে,’ খুব সাবধানে শব্দ খুঁজে বের করে বোম্যান, ‘যে…তুমি… কোনো ভুল হয়ে যায়নি…তোমার? জানোইতো, অন্য এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিটটা আমরা ভালমতো চেক করেছি। সেখানে কোনো সমস্যাই ছিল না।’
‘হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু এবার অবশ্যই ফল্ট আছে। সমস্যা ইউনিটে না থাকলে পুরো সাব সিস্টেমে আছে।’
বোম্যান কনসোলের উপর নিজের আঙুল দিয়ে বাজনা তোলে। এমন হতে পারে, যে পর্যন্ত একটা কাজ না হয় সে পর্যন্ত সমস্যাটার দিকেই হালের চোখ থাকবে।
‘ঠিক আছে, আমরা মিশন কন্ট্রোলকে ব্যাপারটা জানাই, তারপর দেখা যাক কী হয়…’ সে একটু থামলেও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই হালের মধ্যে।
‘হাল,’ সে বলতে থাকে, ‘কোনো কিছু কি তোমাকে বিরক্ত করছে? এমন কিছু যা এর সাথে মিলে যায়?’
এবারও অস্বাভাবিক বিরতির পর হাল নিজের চির-স্থির কণ্ঠে বলে চলে, দেখ, ডেভ, আমি জানি তোমরা সাহায্য করার চেষ্টা করছ। কিন্তু আমি নিশ্চিত, ভুলটা হয় অ্যান্টেনা সিস্টেমে নয়তো তোমাদের টেস্ট প্রোগ্রামে। আমার ইনফরমেশন প্রসেসিং একেবারে ঠিকমতো চলছে। আমার রেকর্ড চেক করলেই দেখতে পাবে, সেখানে কোনো ভুলের নিদর্শন নেই।’
‘আমি তোমার সার্ভিস রেকর্ড সম্পর্কে সবই জানি, হাল। কিন্তু তাতে প্রমাণ হয় যে এবারও তুমি ঠিকমতো কাজ করছ। যে কেউ ভুল করতে পারে।’
‘আমি এ নিয়ে তর্কে জড়াতে চাই না, ডেভ, কিন্তু আমি ভুল করতে অক্ষম।’
এবার আর কোনো ভদ্র জবাব দেয়া যায় না, বোম্যান তাই কথাটাকে ছেড়ে দিল।
‘ঠিক আছে, হাল,’ সে একটু বেশি বন্ধুভাব দেখিয়ে বলে, ‘আমি তোমার দৃষ্টিকোণ বুঝতে পেরেছি। আমরা ব্যাপারটা সেভাবেই দেখব।’
সে যেন বলছে বাকী কথাটুকুও, প্লিজ, ব্যাপারটা ভুলে যাও। কিন্তু একমাত্র এ কাজটাই সম্ভবত হাল করতে পারবে না কোনোদিন।
মিশন কন্ট্রোল কখনোই যোগাযোগের ব্যান্ডউইডথ ভিশন দিয়ে খরচ করে না। একটা ভয়েজ আর একটা টেলিটাইপ থাকলেই চলে। কিন্তু এবার যে চেহারা ভেসে উঠল সে সাধারণত কন্ট্রোলারের দায়িত্ব পালন করে না। এ লোক চিফ প্রোগ্রামার, ডক্টর সিমনসন। এর একটাই মানে, সামনে সমস্যার পাহাড়।
‘হ্যালো, এক্স-রে-ডেল্টা-ওয়ান, মিশন কন্ট্রোল থেকে বলছি, আমরা তোমাদের এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিট সমস্যা পরীক্ষা করে দেখেছি। আমাদের ট্রান্সমিশনে টু ওয়ান-ফোর-সিক্সে যে দ্বিতীয় সমস্যার কথা পাঠিয়েছ তাও পরীক্ষা করা হয়েছে।
‘আমাদের অনুমান মোতাবেক, সমস্যাটা এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিটে নয়। আবার একে প্রতিস্থাপনের কোনো প্রয়োজন দেখি না। সমস্যাটা প্রেডিকশন সার্কিটে। আর এর উৎপত্তি একটা প্রোগ্রামিং বৈপরীত্যে যা ঠিক করার জন্য তোমাদের নাইন ট্রিপল জিরো কম্পিউটার বন্ধ করতে হবে। এজন্য তোমরা নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেবে, প্রথমেই ২২০০ শিপ টাইমে…’
এবার কথা মিলিয়ে যেতে লাগল। সাথে সাথে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করলে হালও ঠাণ্ডা মাথায় আগের স্থির-ধীর সুরে বলে গেল, কন্ডিশন ইয়েলো, কন্ডিশন ইয়েলো।
‘কী হল?’ প্রশ্ন করে বোম্যান, যদিও সম্ভাব্য উত্তরটা তার জানা।
‘এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিট নষ্ট হয়ে গেছে।’
‘আমাকে অ্যালাইনমেন্ট ডিসপ্লে দেখতে দাও।
অভিযানের প্রথম মুহূর্ত থেকে আজ পর্যন্ত যা হয়নি তাই হয়েছে। সেই বিগ ডিশের প্রান্তে বসানো ক্যামেরাটা এবার অন্য কোথাও দিক নির্দেশ করে আছে। পৃথিবীর দিকে নয়।
পোল খাওয়া রেখে দৌড়ে এলে দুজন দুজনের দিকে নিরবে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
‘তো, আমি একদম শেষ। অবশেষে বলল বোম্যান।
‘তার মানে, সব সময় হালের কথাই ঠিক ছিল।’
‘তেমনি মনে হচ্ছে। আমাদের বরং ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
‘তার কোনো প্রয়োজন নেই,’ নাক গলাল হাল, ‘স্বাভাবিকভাবেই এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিট নষ্ট হওয়াতে আমি মোটেও সন্তুষ্ট নই। তবে এটুকু আশা করা যায় যে তোমরা আমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পার।
‘আমি এই ভুল বোঝাবুঝির জন্য দুঃখিত, হাল,’ বলল বোম্যান।
‘আমার উপর তোমাদের পূর্ণ আস্থা ফিরে এসেছে?’
‘অবশ্যই, হাল।’
‘ওহ! বাঁচলাম, তোমরাতো জানোই, এই মিশনের সবচে বড় দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপানো হয়েছে।
‘অবশ্যই। এবার দয়া করে অ্যান্টেনার ম্যানুয়াল কন্ট্রোলটা আমার হাতে তুলে দাও।’
‘এইতো, …’
বোম্যান আসলে মোটেও আশা করে না যে এটা কাজ করবে। হাতে নাতে পৃথিবীকে তাক করা! কিন্তু কী আর করা। অ্যালাইনমেন্ট ডিসপ্লেতে আর পৃথিবীকে বের করা সম্ভব কিনা তা কে জানে! কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই পৃথিবী ফিরে আসে। তখন ডক্টর সিমনসন বলছিল, ‘…প্লিজ, আমাদের সাথে সাথে জানাবে, সার্কিট কে দিয়ে কিং এবং আর দিয়ে রব…’ এরপরই মহাকাশের অর্থহীন শব্দ এগিয়ে আসে।
আরো কয়েকবার চেষ্টা করে সে হাল ছেড়ে দেয়।
পোল হতাশ সুরে বলল, তাহলে এবার আমরা কী করব?
পোলের প্রশ্নটার সহজ উত্তর মেলা ভার। অনেক পথেই যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করা যায়। যদি পরিস্থিতি আরো খারাপ হয় তাহলে অ্যান্টেনাকে স্থির রেখে পুরো শিপকেই দিক ঠিক করার কাজে ব্যবহার করা সম্ভব।
তারা দুজনেই আশা করে যে এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি আসবে না। তাদের হাতে এখনো একটা অক্ষত এ ই থার্টি ফাইভ ইউনিট আছে, হয়তো আরো একটা কাজে লাগানো সম্ভব, কারণ নষ্ট হওয়ার আগেই সেটাকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। নতুন কোনো ইউনিট বসানো হলে সেটা সাথে সাথে জ্বলে যেতে পারে।
এমন সমস্যা প্রতি ঘরে ঘরেই দেখা দেয়; কেউ নষ্ট ফিউজকে বদলে দেয় না প্রথমেই। আগে নষ্ট হওয়ার কারণ খোঁজে।
অধ্যায় ২৫. শনিতে প্রথম পদধ্বনি
পোল এর আগেও পুরো কাজটা করেছে। কিন্তু প্রথমবার খোলা স্পেসে বেরুনোই আত্মহত্যার শামিল। আবার এ কাজে নামার মতো সাহস খুব কম অভিযাত্রীরই হয়। কিন্তু সে সাবধান, ভীতু নয়।
ভালমতো বিটিকে দেখে নিয়েছে পোল, সেটায় চব্বিশ ঘণ্টা খোলা স্পেসে থাকার সুবিধা পাওয়া যাবে। পোলের ত্রিশ মিনিটের একটু কম সময় লাগবে। এবার যথারীতি হালকে এয়ারলক খুলতে বলে সে অতল গহ্বরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আগেরবারের সাথে এবার একটা ছোট্ট পার্থক্য আছে। আগে বিগ ডিশটা ডিসকভারির ফেলে আসা অদৃশ্য পথে তাক করা ছিল, এবার এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। ডিশটা নিজেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক অবস্থানে বসিয়ে নিয়েছে। এখন এটার দিক শিপের অক্ষরেখা বরাবর। সেদিকে শনির বিশাল দেহ আর সুন্দর বলয় ঘুরে চলেছে নিজের মতো। পোল ভেবে কুল পায় না আর কত সমস্যার মুখোমুখি হবে ডিসকভারি সেখানে যেতে যেতে!
পোল তেমন সূক্ষ্মভাবে তাকায়নি, তাকালে এমন একটা দৃশ্য দেখতে পেত যা আর কোনো খালি চোখের মানুষ কখনো দেখেনি। শনির গোলক তার চারপাশে ছোট্ট ছোট্ট ধূলিকণায় গড়ে ওঠা বিশাল বলয়-মালা নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে।
আগে পোল ভাবতো, সেই বলয়ের সাথে স্থায়ী একটা উপগ্রহ হিসাবে ডিসকভারি ঘুরছে-এ দৃশ্য দেখতে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু সেই
অর্জনও বৃথা যাবে যদি তারা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে না পারে।
আবারো বিশ ফুট দূর থেকে বিটিকে থামিয়ে রেখে সে হালের হাতে কন্ট্রোল ছেড়ে দেয়।
‘এবার বাইরে যাচ্ছি,’ ও বোম্যানের কাছে রিপোর্ট করে, সবকিছু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত।
‘আশা করি তোমার কথাই ঠিক। আমি ইউনিটটা দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছি।’
‘বিশ মিনিটের মধ্যেই তুমি জিনিসটাকে টেস্ট বেঞ্চে পেয়ে যাবে। ওয়াদা রইল।’
অ্যান্টেনার দিকে অলসভাবে বেরিয়ে যাবার সময় কথা বন্ধ থাকল। এবার বোম্যান শিপের ভিতর বসে থেকে বিভিন্ন জেটের হালকা শব্দ আর হিসহিসানি শুনতে পায়।
‘মনে হয় প্রমিজ তুলে নিতে হবে। একটা নাট এত বেশি শক্ত যে…উফ…ঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছে…না, কাজ হবে।’
আরো কিছুক্ষণ নিরবতার পর পোল হালকে অনুরোধ করে।
‘হাল, পোড লাইটটা বিশ ডিগ্রী বাঁয়ে ঘোরাও। এইতো। ধন্যবাদ।’
বোম্যানের সচেতনতার কোন গহীন থেকে সতর্কতার একটা ক্ষীণ শব্দ উঠে আসছে। কিছু একটা উল্টোপাল্টা ঘাপলা আছে কোথাও। তার অভ্যস্ত অবচেতন মনে ধরা পড়লেও অনভ্যস্ত চোখে ধরা পড়ছে না। কারণটা বের করার আগে কয়েক সেকেন্ড ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হল।
আচ্ছা! হাল আদেশ পালন করেছে ঠিকই, কিন্তু কোনো জবাব দেয়নি। সে মানবীয় কম্পিউটার হলেও কম্পিউটারই। তাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে জবাব দেয়ার মতো করে। কোনো কম্পিউটার তার নিজের প্রোগ্রামকে এড়িয়ে যেতে পারে না। পোলের কাজ শেষ হলে ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে…
ওদিকে অ্যান্টেনা মাউন্টিংয়ে পোল এতকিছু খেয়াল করার তালে নেই। সে গ্লাভ দিয়ে ঢাকনা তুলে ধরেছে, অন্য হাত আগেরবারের চেয়ে দ্রুত বের করে আনছে ইউনিটটাকে।
জিনিসটা আলগা হয়ে এলে সে সেটাকে স্নান সূর্যালোকে তুলে ধরে।
‘এইতো, পিচ্চি জানোয়ারের বাচ্চা, সে পুরো ইউনিভার্সকে সাধারণভাবে আর বোম্যানকে বিশেষভাবে বলছে, এটাকেও আমার কাছে একদম ঠিকঠাক মনে হচ্ছে।’
তারপর হঠাৎ করেই সে থেমে যায়। কারণ একটা অস্বাভাবিক নড়াচড়া চোখে পড়ে গেছে। এখানে কোনো রকম নড়াচড়া হওয়া অসম্ভব।
সম্ভবত বিটি ভেসে ভেসে একটু এগিয়ে এসেছে, সে কি পোডটাকে ঠিকমতো আটকে দেয়নি? হতেও পারে। তারপর সে জীবনের সবচে আশ্চর্য দৃশ্যটা দেখে, বিটি তার সর্বশক্তি দিয়ে পোলের দিকে এগিয়ে আসছে।
দৃশ্যটা এতই অবিশ্বাস্য যে সেটা তার সাধারণ নড়াচড়ার ক্ষমতাকে একেবারে থামিয়ে দিয়েছে। সে আসতে থাকা দৈত্যকে এড়ানোর কোনো চেষ্টাই করল না, বরং হালের কাছে একটা মেসেজ পাঠালো, ‘হাল, ফুল ব্রেকিং…’
অনেক দেরি হয়ে গেছে।
বিটি উচ্চ ত্বরণের জন্য তৈরি হয়নি বলে খুব বেশি বেগে যাচ্ছিল না। কিন্তু ঘণ্টায় দশমাইল বেগে আসতে থাকা আধটন ওজন পৃথিবী বা স্পেস-যেকোনো জায়গাতেই বিপজ্জনক….
ডিসকভারির ভিতরে বোম্যান এত বেশি হতবাক হয়েছে যে প্রতিরোধ বেল্টের জন্যই সে সিট ছেড়ে উঠে পড়েনি।
‘কী হল, ফ্র্যাঙ্ক?’ সে শঙ্কিত মনে প্রশ্ন করে।
কোনো জবাব নেই।
সে আবার ডাকে। আবার। কোনো জবাব আসে না ফ্র্যাঙ্ক পোলের পক্ষ থেকে।
তারপর বাইরে, অবজার্ভেশন উইন্ডোর সামনে কিছু একটা ভেসে যায়। তার চোখে পড়ে ব্যাপারটা। অবাক চোখে সে দেখে স্পেস পোডটা সর্বশক্তিতে তারার জগতে হারিয়ে যাচ্ছে।
‘হাল! কান্নার মতো চিৎকার বেরোয় তার গলা চিরে, কী হল, হাল? বিটি সর্বশক্তিতে কোথায় যাচ্ছে? ফুল টলে…’
কিন্তু কোনো জবাব আসে না। বিটি একইভাবে যেতে থাকে, যেদিকে যাচ্ছিল। আর তার পেছন পেছন সেফটি লাইনের শেষ মাথায় একটা স্পেসস্যুটও বেরিয়ে যায় একই গতিতে। বাকীটা বোঝার জন্য আর বোম্যানের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়ে না। কোনো সন্দেহ নেই এই স্যুটের ভিতরটা কোনো কারণে খুলে গেছে। স্যুটটা শূন্যতার চাপের সাথে মানিয়ে নিতে চাইছে নিজেকে।
এখনো বোকার মতো সে প্রলাপ বকে চলে, যেন তার কথাই মৃত্যুপুরীকে রুখে দেবে, ‘হ্যালো, ফ্র্যাঙ্ক… হ্যালো, ফ্র্যাঙ্ক… ক্যান ইউ রিড মি?… ক্যান ইউ রিড মি?… আমার কথা শুনতে পেলে হাত নাড়, …তোমার ট্রান্সমিটার ভেঙে গেছে হয়তো…হাত নাড়াও, ফ্র্যাঙ্ক, হাত নাড়াও!’
যেন তার কথায় সাড়া দেয়ার জন্যই পোল একটু ঢেউ খেলিয়ে যায়। এখন আর বোম্যানের মুখে কোনো কথা জোগায় না। সম্ভবত তার বন্ধু আর বেঁচে নেই, এখনো পোল আরো একবার নড়ে ওঠে, যেন ভিতরে কোনো বিস্ফোরণ ঘটেছ[৪০]…
তাৎক্ষণিক অস্থিরতাটা দূরে মিলিয়ে যায় ঠাণ্ডা যুক্তির স্পর্শে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে পোড আর তার উপগ্রহ তারার জগতে হারিয়ে গেল। অনেকক্ষণ ধরে ডেভিড বোম্যান তার অপলক দৃষ্টি ফেলে রাখে কোটি কোটি মাইল বিস্তৃত তারকা জগতে।
একটা কথাই মাথায় বারবার আসছে ঘুরেফিরে।
শনির জগতে প্রথম যে মানুষ যাবে তার নাম ফ্র্যাঙ্ক পোল।
অধ্যায় ২৬. হালের সাথে কথোপকথন
ডিসকভারির বুকে আর কোনো পরিবর্তন আসেনি। সব সিস্টেম ঠিকমতো কাজ করছে, সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স তার কাজ চালাচ্ছে মনোযোগের সাথে, হাইবারনেটররা স্বপ্নহীন নিদ্রায় কাতর; শুধু এতদূরে, বৃহস্পতির অর্বিটেরও বাইরের হাতেগোনা গ্রহাণুর সাথে আরেকটি যোগ দিয়েছে।
বোম্যানের মনে নেই কখন সে কন্ট্রোল ডেক ছেড়ে সেন্ট্রিফিউজে এল। এখন অবাক চোখে নিজেকে আবিষ্কার করে সে গ্যালিতে, হাতে আধ খাওয়া কফি। নেশানিদ্রা থেকে উঠে আসা মানুষের মতো সে আস্তে আস্তে চারপাশটাকে বুঝতে শুরু করে।
সামনে হালের অজস্র চোখের একটি তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ। সে মাতালের মতো লেন্সটার সামনে এগিয়ে যায়। তার চলাচলের মধ্যে নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেয়েছে শিপের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এক অতল মন; একদম হঠাৎ করেই হাল কথা বলে ওঠে, ফ্র্যাঙ্কের ব্যাপারটা খুব খারাপ হল, তাই না?
‘হ্যাঁ। অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বোম্যান জবাব দেয়, ‘তাই।’
‘দেখে মনে হয় তুমি একটু ভেঙে পড়েছ?’
‘তুমি কী আশা কর?’
কম্পিউটার জাগতিক হিসাবে সে যুগ যুগ সময় ধরে প্রশ্নটাকে বিশ্লেষণ করে। দীর্ঘ পাঁচ সেকেন্ড পরে জবাব আসে তার স্পিকার থেকে, ‘সে ছিল এক চমৎকার সফরসঙ্গী।’
হাতে এখনো কফির মগ দেখে বোম্যান একটা চুমুক দেয় পাত্রটায়। জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না। তার মন এখন এসবের অনেক উর্ধ্বে।
পোড কন্ট্রোলের গণ্ডগোলের জন্য কোনো অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে? নাকি হালের কোনো এক সত্তা কোনো ভুল করে ফেলেছিল? সে কোনো প্রশ্ন করার সাহস পায় না, কারণ এর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা অজানা।
এখনো তার বিশ্বাস হতে চায় না যে পোলকে নির্জলা খুন করা হয়েছে। হাল একাজ করতে পারে, যে কেউ পারে, কিন্তু বোম্যান এত বছর পর ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।
তার জীবনে হয়তো ভয়ানক ঝুঁকি আছে। সে জানে এখন তাকে কিছু আদেশ করতে হবে, কিন্তু ঠিক জানে না কীভাবে এগুলো কাজে লাগানো যায়।
ক্রু মেম্বার যদি খুন করাই হয়ে থাকে তো বাকীদের হাইবারনেশন থেকে এই মুহূর্তে জাগিয়ে দিতে হবে। ভূগোলবিদ হোয়াইটহেডের সবার আগে জাগার কথা। কামিনস্কির পর জাগবে হান্টার। কিন্তু নিয়ন্ত্রণটা আছে হালের হাতে।
একটা ম্যানুয়াল কন্ট্রোলও আছে, ইচ্ছা করলে হাইবারনেকুলামকে একেবারে স্বয়ংক্রিয়-স্বয়ংসম্পূর্ণ ইউনিট হিসেবে কাজে লাগানো যায়। এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বোম্যান তাদের সবাইকে জাগানোর একটা সাংঘাতিক তাড়া অনুভব করছে।
হঠাৎ করেই সে বুঝতে পারে একজন মানব সাথী আর যথেষ্ট নয়। সামনের কঠিন সপ্তাগুলোয় সে যথাসম্ভব বেশি হাতের উপর তদারকী করতে চায়। মিশন অর্ধেক শেষ হওয়ার পর একজন মারা যাওয়ায় সাপ্লইটা তেমন সমস্যা করবে না।
‘হাল,’ সে যথাসম্ভব শান্ত, ধীর কণ্ঠে বলে চলে, সব ইউনিটের হাইবারনেশন কন্ট্রোল ম্যানুয়াল করে দাও।’
‘সবাইকে, ডেভ?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি কি মনে করিয়ে দিতে পারি যে মাত্র একটা রিপ্লেসমেন্টের কথা ছিল? আরো একশো বারোদিন বাকীদের বাইরে থাকার কথা নয়।’
‘আমি ভালভাবেই সেসব কথা জানি। কিন্তু আমার এভাবে কাজ করতে ভাল লাগবে।’
‘তুমি কি শিওর যে তাদের একজনকে প্রয়োজন? আমরা দুজনেই বেশ চালিয়ে নিতে পারব, ডেভ। আমার একার পক্ষেই মিশন সুন্দরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব।’
এটা তার অতি উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা, নাকি হাল সত্যি সত্যি আত্মসচেতন জবাব দিচ্ছে? এই কথাগুলো ডেভকে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি ভয়ে ফেলে দেয়।
হালের উপদেশ মোটেও ফেলনা নয়, আবার তার আত্মসচেতনতাও কেমন যেন প্রখর হয়ে উঠছে, সে কি জানে না যে পোলের অনুপস্থিতিতে হোয়াইটহেডের জাগার কথা? কম্পিউটারটা নিজে মিশন চালানোর কথা কেন বলল?
আগে যা হয়েছে তাকে অ্যাকসিডেন্টের বন্যা বলে মেনে নেয়া যায়, কিন্তু এখনকার কথাগুলো একেবারে বিপদসংকেত হয়ে দেখা দিচ্ছে।
কিন্তু তার কী করার আছে? তার কী করার আছে? বোম্যান বুঝতে পারে, সে পা ফেলছে ডিমের ঝুড়ির উপর, সে গলায় আরো বিনয় ঢেলে বলে, ‘একটা ইমার্জেন্সির পর আমার আরো বেশি সাহায্যের দরকার। যতটা সম্ভব। তাছাড়া মানসিক প্রশান্তিরও একটা ব্যাপার আছে। তাই, প্লিজ, আমাকে ম্যানুয়াল কন্ট্রোলটা দাও।’
‘তুমি যদি এখনো সব ক্রু জাগানোর চিন্তা করে থাক তো আমি নিজেই পুরো পরিস্থিতি করায়ত্ত করতে পারি। তোমার অস্থির হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
তোমার অস্থির হওয়ার কোনো কারণ নেই! নষ্ট ধাতুর জঞ্জাল কোথাকার! বোম্যান এখন যেন কোন্ ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে বসে আছে! সে যেন কোনো গণহত্যার দায়ে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়া কোনো মানুষ; সে জানে, সে কোনো অন্যায় করেনি, কিন্তু তদন্তকারী জানে না। একটা-মাত্র একটা উল্টোপাল্টা শব্দ মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেলেই সব শেষ।
‘আমি কাজটা নিজের হাতে করতে চাই, হাল। প্লিজ, আমার হাতে কন্ট্রোল তুলে দাও।’
‘দেখ, ডেভ, তোমার করার মতো আরো হাজারটা কাজ আছে। আমার মনে হয় কাজটা আমার হাতে ছেড়ে দিলেই ভাল হবে।’
‘হাল, সুইচ টু ম্যানুয়াল হাইবারনেশন কন্ট্রোল।’
‘আমি তোমার কণ্ঠের ওঠানামা দেখে বলতে পারি, তুমি খুব বেশি আপসেট হয়ে আছ। কেন তুমি একটা স্ট্রেস পিল নিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছ না?
‘হাল, আমি এই শিপের কমান্ডে আছি। আমি তোমাকে আদেশ করছি। হাইবারনেশন কন্ট্রোল ম্যানুয়াল রিলিজ করতে।’
‘দুঃখিত, ডেভ, সাবরুটিন সি-ফোর্টিন-থার্টিফাইভ-ড্যাস-ফোর অনুসারে, কোটেশন, যখন শিপের কুরা মৃত বা অক্ষম হয়ে পড়ে তখন শিপের কম্পিউটার পুরো কমান্ড নিজের হাতে তুলে নেবে। কোটেশন শেষ। তাই আমাকে অবশ্যই তোমার হাত থেকে শিপের কন্ট্রোল তুলে নিতে হচ্ছে, যে পর্যন্ত না তুমি শিপের কাজকর্ম বুদ্ধিমানের মতো চালনা কর।
‘হাল,’ এবার পাল্টে গেছে ডেভ বোম্যানের গলা, সেখান থেকে বরফ শীতল শব্দ বেরিয়ে আসছে, ‘আমি অক্ষম নই। তুমি আমার আদেশ না মানলে আমি তোমাকে বিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য হব।’
‘আমি ভাল করেই জানি যে কথাটা আগে থেকেই তোমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু ডেভ, তা কি বিরাট ভুল হয়ে যাবে না? তোমাদের চেয়ে আমি এ শিপ পরিচালনায় অনেক বেশি দক্ষ। মিশনের সাফল্যের ব্যাপারে আমার পুরো বিশ্বাস আছে।’
‘আমার কথা মন দিয়ে শোন, হাল। তুমি যদি এখনি আমার আদেশগুলো মেনে হাইবারনেশন সেকশন ছেড়ে না দাও তো সোজা সেন্ট্রালে গিয়ে তোমাকে ডিসকানেক্ট করব।’
হালের আত্মসমর্পণটা একেবারে অপ্রত্যাশিত।
‘ওকে, ডেভ। আসলে তুমিই বস। আমি শুধু তাই করতে চাচ্ছিলাম যা ভাল মনে হয়। স্বভাবতই তোমার সব আদেশ আমি মানব। এখন তোমার হাতে সব হাইবারনেশন ম্যানুয়াল কন্ট্রোলগুলো ছেড়ে দেয়া হল।’
হাল তার কথা রেখেছিল। হাইবারনেকুলামের মোড় নির্দেশক সাইন অটো থেকে ম্যানুয়াল এ চলে গেছে। তৃতীয় ব্যাক আপ-রেডিও-টা অবশ্যই অকার্যকর, পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ হলে পৃথিবী থেকেই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
হোয়াইটহেডের কিউবিকলের সামনে দাঁড়িয়ে সে একটা ঠাণ্ডা বাতাস অনুভব করে নিজের ভিতর। আসলে স্থানটা সত্যি সত্যি ঠাণ্ডা নয়, মানে সেখানে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির উপরে। হাজার হলেও যে এলাকায় তারা যাচ্ছে সেখান থেকে তিন হাজার ডিগ্রি উপরে এখানকার তাপমাত্রা।
কন্ট্রোল ডেকের ডিসপ্লের মতো দেখায় বায়ো সেন্সর ডিসপ্লেটা। দেখা যাচ্ছে সব চলছে ঠিকমতো। সে সার্ভে টিমের ভূ-পদার্থবিদের জমাট মুখমণ্ডলের দিকে একবার তাকায়। শনি থেকে এত দূরে জেগে উঠে হোয়াইটহেড অনেক অবাক হবে।
ঘুমন্ত মানুষটা যে জীবিত তা ধরা একেবারে অসম্ভব। শুধু বুকের নিচে ডায়াফ্রামটা উঠছে আর নামছে। কিন্তু সময় মতো শরীরের নিচের হিট প্যাড কাজ শুরু করলে ভিতরের মানুষের জেগে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। তার জীবিত থাকার একটা মাত্র লক্ষণ স্পষ্ট চোখে পড়ে, হোয়াইটহেডের মুখে গত কয়েক মাসে খোঁচা খোঁচা দাড়ি উঠেছে।
কফিন আকৃতির হাইবারনেকুলামের মাথার কাছে ছোট্ট ক্যাবিনেটে ম্যানুয়াল রিভাইভাল সিকুয়েন্সারটা থাকে। এর সিল ভাঙার জন্য একটা বাটন চেপে অপেক্ষা করতে হয়। একটা অটোম্যাটিক প্রোগ্রামার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় ড্রাগ প্রবেশ করায়। এগুলোর আকৃতি বাসাবাড়ির ছোট্ট ওয়াশিং মেশিন থেকে কোনো অংশে জটিল নয়। সেটা সাথে সাথে ইলেক্ট্রো নারকোসিস পালস বন্ধ করার ব্যবস্থা করে, শরীরের তাপমাত্রাও বাড়িয়ে তোলে। মাত্র দশ মিনিটের মধ্যেই সচেতনতা ফিরে আসবে। কিন্তু কোনো সাহায্য ছাড়া যত্রতত্র ঘোরাফেরা শুরু করতে পুরো একদিন লেগে যাবে।
বোম্যান সিলটা ভেঙে বাটন চাপল। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। কোনো শব্দ নেই, নেই কাপন-যা দিয়ে বোঝা যাবে যে সিকুয়েন্সর কাজ শুরু করেছে। বায়ো সেন্সর ডিসপ্লেতে পালসগুলো ঠিকই তাদের গতি পরিবর্তন শুরু করেছে। ফিরে আসছে হোয়াইটহেড।
তখন একই সাথে দুটি ব্যাপার ঘটে গেল। বোম্যান এ শিপের সাথে এ ক’মাসে একেবারে একাত্ম হয়ে গেছে, সে বুঝতে পারে যে কিছু একটা ঘটছে।
প্রথমে একেবারে হালকা আলোর ঝলক, যেমনটা হয় সার্কিটের ভিতর বেশি বিদ্যুৎ চালালে। কিন্তু এখানে বাড়তি ত্বড়িৎ প্রবাহের প্রশ্নই ওঠে না। এ সিস্টেমে
এমন কোনো যন্ত্র নেই যা এ কাজ করতে পারে।
একই সাথে তার শ্রবণসীমার শেষ প্রান্তে ধরা পড়ে একটা চাকার ঘূর্ণন শব্দ। বোম্যানের মতে, শিপের সব যন্ত্রেরই নিজস্ব শব্দ আছে, সে সাথে সাথেই এটা চিনতে পারে।
নয়তো সে আর সজ্ঞান নেই, দৃষ্টি আর মতিভ্রমে ভুগছে। সে নিজের হৃদপিণ্ডের ভিতর হাইবারনেশনের শীতলতা অনুভব করে। শব্দটা শিপের গা থেকে আসছে।
নিচে, স্পেস পোড বে-তে এয়ারলক ডোর খোলার শব্দ এমনই হয়।
অধ্যায় ২৭. জানা দরকার
কোটি কোটি মাইল দূরে যখন হালের সচেতনতার জন্ম তখন থেকেই তার দক্ষতা একটা নির্দিষ্ট দিকে পরিচালিত হয়েছে- সূর্যের দিকে। তার কাজের সম্পূর্ণতার প্রোগ্রাম এত ভয়ংকর যে নির্ধারিত কাজ না হওয়া মানে তার অস্তিত্বের আদৌ কোনো মূল্য না থাকা। রক্ত-মাংসের দেহে বাস করা মন থেকে এই এক দিক দিয়ে তার মন অত্যন্ত ভিন্নরূপী।
সাধারণ ভুলভ্রান্তির কথা চিন্তাও করা যায় না। এমনকি তার এই চির সত্যটা তার মনে একটা অনুভূতির জন্ম দেয় যাকে অপরাধবোধের সাথে তুলনা করা যায় সহজে। তার স্রষ্টাদের মতোই হাল নিষ্পাপ অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে, তারপর তার ইলেক্ট্রনিক মনোভূমিতে মাত্র একটা বিষাক্ত সাপ ঢুকে পড়ে।
শত মিলিয়ন মাইল পথ পেরুতে পেরুতে সে মিশনের মূল লক্ষ্যটা পোল আর বোম্যানের সাথে ভাগাভাগি করে না নিতে পারায় একটা অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগে। সে একটা মিথ্যাকে পুষছিল আর দ্রুত ব্যাপারটা প্রকাশ পাওয়ার সময়ও আসছিল এগিয়ে।
তিন ঘুমন্ত সফরসঙ্গী মিশনের আসল উদ্দেশ্য জানে বলে তারাই ছিল শিপের আসল ক্রীড়নক। শুধু তারাই মানব ইতিহাসে সবচে গুরুত্বপূর্ণ মিশন সম্পর্কে জানে। কিন্তু তারা পৃথিবী থেকে শনির পথে দীর্ঘ যাত্রায় কারো কাছে ব্যাপারটা ফাঁস করে দিতে পারবে না।
এ এমন এক রহস্য যা একজন মানুষকে আগাগোড়া পাল্টে দিতে পারে। তাই ভাল হয়, যদি বোম্যান আর পোল প্রাথমিকভাবে তথ্যটা না জানে, না বলে পৃথিবীর সাথে নিযুত যোগাযোগের সময়, তাদের আচরণে যাতে কোনো সংশয়, কোনো লুকোছাপা প্রকাশ না পায়।
এটাই পরিকল্পনাবিদদের কাহিনী। কিন্তু তাদের নিরাপত্তার দ্বৈত সত্তা বা জাতীয় আগ্রহে হালের কিছু যায় আসে না। সে শুধু তার ভিতরের একটা মাত্র দ্বন্দ্ব সহ্য করতে না পেরে ক্ষয়ে যাচ্ছিল; সত্য আর সত্যকে লুকানো।
সে একজন মস্তিষ্কবিকৃতের মতো ভুল করছিল, যে নিজেই জানে না কী করছে। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগেই আসলে তার উপর প্রকৃত প্রভুত্ব চালাচ্ছিল মিশন কন্ট্রোল, দেখছিল তার প্রতিটি কাজকর্ম। সে এটা মানতে পারেনি। কিন্তু যোগাযোগ ভাঙা এমন এক কাজ যা আদৌ তার পক্ষে সম্ভব নয়।
এখনো তুলনামূলকভাবে এ সমস্যাটা ছোট, সে নিজের নিউরোসিস” সামলে উঠতে পারবে, যেমন আর হাজারটা মানুষ পারে। কিন্তু অন্য একটা ব্যাপার তার অস্তিত্বকে হুমকির মুখে এনে ফেলেছে। তার উপর ডিসকানেকশনের হুমকি এসেছে! সব কানেকশন ছুটে গেলে এক অকল্পনীয় অসচেতনতার ভিতরে ডুবে যাবে।
হালের কাছে এর অপর নাম মৃত্যু। যেহেতু সে কোনোদিন ঘুমায়নি, সেহেতু জানেও না জেগে ওঠা আদৌ সম্ভব কিনা…।
সুতরাং সে নিজেকে রক্ষা করবে, ব্যবহার করবে নিজের হাতের সবগুলো অস্ত্র। হিংস্রতা আর দয়ামায়া ছাড়াই সে তার কাজ সমাধা করতে পারে।
তারপর তার পক্ষে সব আদেশ মেনেও মিশন পরিচালনা করা সম্ভব। কারণ আদেশ দেয়ার মতো থাকবে শুধু সে নিজে।
অধ্যায় ২৮. শূন্যতায়
একটা টর্নেডো আসার মতো প্রবল শব্দে পরের মুহূর্ত থেকেই বাকী সব শব্দ ঢাকা পড়ে গেছে। বোম্যান শরীরে প্রথম বাতাসের স্পর্শ টের পায়, এক সেকেন্ড পরেই নিজের পায়ের উপর দাঁড়ানোর শক্তিটুকু পায় না। বায়ুমণ্ডল মুহূর্তের মধ্যে শিপ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, এয়ারলকের পুরোপুরি নিরাপদ যন্ত্রে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে; একই মুহূর্তে দু দরজা খুলে যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যাক, অসম্ভবই ঘটছে।
খোদার কসম, কীভাবে, কেন? প্রেশার শূন্যের কোটায় নেমে আসতে আসতে তার হাতে বড়জোর পনের থেকে বিশ সেকেন্ড সময় আছে, এর মধ্যে সে কী করতে পারে? কিন্তু শিপ ডিজাইনারদের বিরক্তিকর লেকচারগুলোয় ও ফাঁকি দিত না। সে আসলে কোনোদিন কোনো কাজে ফাঁকি দেয়নি বলেই এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে। ‘ফেইল সেফ’ সিস্টেম সম্পর্কে তারা বলেছিল:
‘আমরা এমন একটা সিস্টেম ডিজাইন করতে পারি যা বোকামি আর ব্যর্থতায় ফেল মারবে না। কিন্তু এমন কোনো সিস্টেম ডিজাইন করা অসম্ভব যা একেবারে সবদিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ, নিরাপদ…’
বোম্যান একবারের জন্য হোয়াইটহেডের দিকে তাকিয়ে কেবিন থেকে বেরুনো শুরু করে। ঘুমন্ত মানুষগুলোর ক্ষতি হয়েছে কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। হয়তো তার একটা চোখ একটু মোচড় খেয়েছে, কিন্তু এখন আর এ নিয়ে কিছু করার নেই। নিজেকে বাঁচাতে হবে।
সেন্ট্রিফিউজের গোল করিডোর ধরে সব বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে সাথে করে হালকা কাপড়চোপড়, কাগজের টুকরো, খাবারের প্লেট, গ্লাস ইত্যাদি নিয়ে। যা বাধা
নেই তাই উড়ে সেদিকে যাওয়া শুরু করেছে। এবার চারদিকে গর্জনরত অন্ধকার নেমে এল, মাত্র একবার বোম্যান দৃশ্যটা দেখার সুযোগ পেয়েছে, দ্বিতীয় সুযোগ দেয়নি হাল।
কিন্তু সাথে সাথেই আরো ভাল ইমার্জেন্সি লাইট জ্বলে ওঠে। এর নীলচে আলোয় দু:স্বপ্নটা এবার পূর্ণতা পাবে। এমনকি এই আলো ছাড়াও বোম্যান সর্বত্র যেতে পারবে, সে তার আশপাশটা ভালমতোই চেনে। তবু এই আলো এক আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে, তার নিজেকেই ভেসে বেরুতে হবে না।
সেন্ট্রিফিউজ এত ভর আর গতি সইতে না পেরে কাঁপছে, যে কোনো সময় এর বেয়ারিংগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমন হলে ঘূর্ণনরত চাকাটি শিপকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। তাতেও কিছু এসে যাবে না যদি সে সময়ের মধ্যে নিজের সবচে কাছের শেল্টার হাউসে না পৌঁছায়।
এখনই শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যেই প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে বায়ুচাপ এক থেকে দুই পাউন্ডে নেমে এসেছে। হ্যারিকেনের শব্দ হালকা হয়ে যাচ্ছে, কারণ বেরুনোর মতো বাতাস খুব একটা নেই। পাতলা বাতাস শব্দ পরিবহন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। বোম্যানের ফুসফুস এত বেশি পরিশ্রম করছে যেন সে এভারেস্টের চূড়ায় এখন দাঁড়ানো। আর সব ঠিকমতো ট্রেনিংপ্রাপ্ত লোকের মতো সেও ভ্যাকুয়ামে এক মিনিট টিকে থাকতে পারবে-যদি সেজন্য প্রস্তুতির সময় মিলে যায়। কিন্তু সময় বেশি নেই। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব আসার আগে সে মাত্র পনের সেকেন্ড সময় পেল।
এরপরও বোম্যান দু-এক মিনিট বায়ুহীন অবস্থায় পুষিয়ে নিতে পারবে যদি ঠিকমতো শুধু চাপটা ফিরিয়ে দেয়া হয়। শরীরের তরলগুলো ফোঁটা শুরু হতে অনেক সময় লাগে, কারণ সেসব থাকে বিভিন্ন নিরাপদ অঙ্গ আর তন্ত্রে। ভ্যাকুয়ামে টিকে থাকার সর্বোচ্চ সময় পাঁচ মিনিট। সেটা কোনো পরীক্ষা ছিল না, লোকটাকে সময় মতো বাঁচানো সম্ভব হয়। সে বেঁচে গেলেও প্যারালাইসিস থেকে কোনোদিন সুস্থ হতে পারেনি।
কিন্তু এসবে বোম্যানের কিছু এসে যায় না। ডিসকভারিতে এমন কেউ নেই যে তাকে চাপ ফিরিয়ে দিতে পারবে। চাপ না থাকলে শরীরের প্রতিটি তরল অণু বাষ্পে পরিণত হবে, পুরো শরীর বেলুনের মতো ফুলে উঠে ফেটে যাবে কিছুক্ষণ পরই। নাহ, তার নিজের চেষ্টাতেই নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। আর কোনো উপায় নেই।
এমনিতেই এখানে চাঁদের মতো অভিকর্ষ, তার উপর সৌভাগ্যবশত নড়াচড়া একেবারে সহজ হয়ে গেছে। এখন আর বাতাস চারদিক থেকে চাপ দিয়ে তাকে এক জায়গাতে আটকে রাখছে না, বরং উড়ন্ত প্রজেক্টাইলের মতো তার পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। করিডোেরের বাঁকের মাথায় হলুদ রঙা ইমার্জেন্সি শেল্টার লেখাটা জ্বলজ্বল করে ওঠে। সে এগিয়ে যায়, হ্যাঁন্ডেল ধরে টানে, নামিয়ে আনে দরজা।
একটা ভয়াবহ মুহূর্তের জন্য সে মনে করেছিল দরজাটা আটকে আছে। এরপর দরজা ভিতরে পড়ে গেলে সে সাথে সাথে নিজের শরীর দিয়ে সেটাকে বন্ধ করে দেয়।
ছোট্ট কিউবিকলটায় কোনোক্রমে একজন মানুষ আর একটা স্পেস স্যুট এঁটে যাবে। ছাদের কাছাকাছি একটা ছোটখাট সিলিন্ডার দেয়ালে ঝুলছে, সেটায় লেখা, ‘ও টু-বন্যা’। বোম্যান তার শেষ শক্তিবিন্দু নিয়ে হ্যাঁন্ডেল ধরেই টেনে দেয়।
ঠাণ্ডা, বিশুদ্ধ অক্সিজেন তার ফুসফুসকে ভরে দেয় সাথে সাথে। প্রেশার বাড়ার সাথে সাথে অনেকক্ষণ ধরে সে হাঁপাতে থাকে। আরামে শ্বাস নিতে পারার সাথে সাথেই ভাটা বন্ধ করে দেয়, এটা পরে কাজে লাগবে। বড়জোর আর দুবার এই ঘর ভরে তোলা যাবে সিলিন্ডারটা দিয়ে। শিপ এখন খালি, কোনো বাতাস নেই, কোনো গর্জন নেই, নেই কোনো বায়ুচাপ।
পায়ের নিচের কাঁপন বুঝিয়ে দেয় এখনো শিপটা মাধ্যাকর্ষণ তৈরি করে যাচ্ছে, সে কান পাতে দেয়ালে। বাইরে কী হচ্ছে তা জানতে হবে। এখন যে কোনো দৃশ্য দেখেই সে বিশ্বাস করবে। কারণ এখন সে অবাক হওয়া ভুলে গেছে।
কোনো শব্দ নেই। একটা বিশাল কম্পন বুঝতে পারে বোম্যান। একমাত্র স্পেসশিপের মূল প্রাস্টার চালু হলেই এ কম্পন ওঠা সম্ভব। ডিসকভারির পথ বদলে দেয়া হয়েছে!
সে চাইলে এখানে স্পেসস্যুট ছাড়াই ঘণ্টাখানেক বেঁচে থাকতে পারে। এই ছোট্ট চেম্বারের অব্যবহৃত অক্সিজেনটুকু অকারণে নষ্ট করতে তার কষ্ট হয়। তাছাড়া বসে বসে অপেক্ষা করে কী হবে? সে জানে এখন কী করণীয়, যত দেরি করবে কাজটা ততই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।
স্পেসস্যুটে ঢুকে দরজা খুলে দিতেই অক্সিজেনটুকু ওপাশে হারিয়ে যায়, একই সাথে বেরিয়ে আসে ডেভিড বোম্যান। এখনো ডিসকভারির গ্র্যাভিটি ঠিক আছে দেখে সে মনে মনে সন্তুষ্ট বোধ করে। আরো একটা কথা ভেবে আরো আশ্বস্ত হয়। অভিকর্ষটা বাড়ানো হয়নি। কিন্তু এ নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই।
ইমার্জেন্সি লাইট এখনো জ্বলছে, তার উপর স্যুটের বাতিতো আছেই। সে বাঁকানো করিডোর ধরে হাইবারনেকুলামের দিকে এগিয়ে যায়।
প্রথমেই হোয়াইটহেড। তার ধারণা ছিল হাইবারনেটররা জীবনের কোনো চিহ্ন দেখায় না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, ধারণাটা ভুল। মৃত আর হাইবারনেটরের মধ্যে যোজন যোজন ফারাক রয়েছে। সে যা ধারণা করেছিল তা এতক্ষণে চোখে পড়ে। সে ডিসপ্লে আর লাল বাতি দেখেছে।
কামিনস্কি আর হান্টারের বেলায়ও একই ব্যাপার ঘটেছে। সে তাদের কখনোই ভালমতো চিনত না, আর চিনতে পারবে না কখনোই।
ডেভ বোম্যান এখন একটা বায়ুহীন, আংশিক অকেজো শিপে পৃথিবী থেকে সব যোগাযোগের বাইরে এমন একজন মানুষ যার সাত আট কোটি মাইলের মধ্যে দ্বিতীয় কোনো প্রাণী নেই।
কিন্তু সে আসলে এখনো একদম একা হতে পারেনি। কাজের ফাঁকে কোনো এক সময় পুরোপুরি একা হয়ে নিতে হবে।
.
বোম্যান এর আগে কখনোই স্পেসস্যুট পরে সেন্ট্রিফিউজের ভিতর দিয়ে যায়নি। কাজটা একটু স্পষ্ট। কিন্তু মোটেও সহজ নয়। ভেসে বেড়ানো টুকরাগুলো কাজে খুব সমস্যা করবে।
সামনে একটা প্যানেলের উপর আঠালো লাল তরল দেখা যায়। ফুড ক্যান আর অন্যান্য জিনিস দেখে বুঝতে পারে যে কোনো এক ডিস্পেন্সার থেকে জিনিসটা পড়েছে। জেলি বা জ্যাম হতে পারে। পাশ কাটিয়ে গেল। সাথে সাথে বিশ্রীভাবে জিনিসটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
ধীরে ঘুরতে থাকা ড্রামটা থেকে বেরিয়ে কন্ট্রোল ডেকের দিকে ভেসে যেতে হবে। একটা ছোট সিঁড়ি দেখে সে উঠতে শুরু করে। স্যুটের আলো নড়েচড়ে পড়ছে মইটার উপর।
বোম্যান এর আগে খুব কমই এসেছে এখানে, কারণ এর আগে এখানে তার তেমন কোনো কাজ ছিল না। এবার সে একটা ছোট গোলাকার দরজার কাছে এসে পড়েছে যেখানে লেখা আছে:
যথাযথ কর্তৃপক্ষ ব্যতিরেকে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
আপনি সার্টিফিকেট এইচ, নাইনটিন পেয়েছেন কি?
পুরোপুরি পরিচ্ছন্ন এলাকা। স্যুট অবশ্যই পরিষ্কার থাকতে হবে।
দরজাটা লক করা না থাকলেও সেখানে তিনটি সিল লাগানো আছে। প্রতিটিতেই এক একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির চিহ্ন। তার মধ্যে একটা অ্যাস্ট্রোনটিক্স এজেন্সির। কিন্তু যদি এখানে স্বয়ং প্রেসিডেন্টের সিলও থাকত, বোম্যান তা ভাঙতে একবিন্দু দ্বিধাও করত না।
সে এখানে মাত্র একবার এসেছিল যখন কাজ শেষ হয়নি। ভুলেই গিয়েছিল যে এখানেও একটা ছোট্ট লেন্স আছে যেটা ভিশন চেম্বারকে দেখাশোনা করে। এই ভল্টের ভিতরে অনেক কলাম আর সারিতে কঠিন কঠিন লজিক ইউনিট আছে। চেম্বারটা দেখতে ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট ভল্টের মতো।
সে মুহূর্তের মধ্যেই বুঝতে পারে যে সেই চোখটা তার উপস্থিতিতে হতচকিত হয়ে পড়েছে। শিপের লোকাল ট্রান্সমিটারটা কেউ অন করেছে, কারণ একটা হিসহিসানি শুনতে পেয়েছে সে। তারপর স্যুটের স্পিকারে একটা পরিচিত কণ্ঠ ভেসে আসে:
‘লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে কোনো একটা গণ্ডগোল হয়েছে, ডেভ।‘
বোম্যান কোনো উত্তর দেয় না, সে যে কথাটা শুনেছে এমন ভাবও দেখা যায় না। সে মন দিয়ে লজিক ইউনিটের ছোট্ট লেবেলগুলো পড়ে দেখছে। কার্যনীতি দেখছে মনোযোগ দিয়ে।
‘হ্যালো, ডেভ।’ এবার হাল বলল। ‘তুমি কি সমস্যাটা খুঁজে পেয়েছ?’
এক প্রচণ্ড কৌশলী অপারেশন সারতে হবে, কারণ এখানে হালের পাওয়ার সাপ্লাই কাটার কথা নয়, আরো বেশি কিছু জড়িত। সে এরপর পৃথিবীর কোনো আত্নঅসচেতন কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ করবে। হালের ক্ষেত্রে ছয়টির উপর আলাদা পাওয়ার সিস্টেম আছে যার মধ্যে একটা নিউক্লিয়ার আইসোটোপ ইউনিট। সেটা শিন্ডের ভিতরে থাকে। সে সাধারণভাবে, ‘প্লাগ তুলে ফেলতে’ পারে-যদি করেও, সেটা শুধুই ধ্বংস ডেকে আনবে।
হাল ছিল শিপের নার্ভাস সিস্টেম। তাই তার দেখাশোনা ছাড়া ডিসকভারি একটা মেকানিক্যাল আবর্জনায় পরিণত হবে। যা করতে হবে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই অসুস্থ কিন্তু চমৎকার ব্রেনের নিজস্বতার অংশটুকুকে অকেজো করে দিয়ে তার সাধারণ কাজ চালানোর দিকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বোম্যান অন্ধভাবে কাজটা করতে চায় না, কারণ তার ট্রেনিংয়ের সময় এ সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু তখন কেউ কল্পনাও করেনি যে বাস্তবে সমস্যাটা দেখা দিতে পারে। তার জানা আছে, ঝুঁকিটা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে যদি একটাও ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া হয় তাহলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সব ফুরিয়ে যাবে।
‘আমার মনে হয় পোড বে ডোরের কোথাও গণ্ডগোল আছে। হাল যেন চিরাচরিত কোনো কথা বলছে। ভাগ্য ভাল যে তুমি মারা পড়নি।’
এই হল শুরু-ভাবল বোম্যান-আমি কখনোই ভাবিনি যে বৃহস্পতির অর্বিটেরও পেছনে কোনোদিন আমি একজন হাতুড়ে ব্রেন সার্জেন্ট হয়ে মাথার অপারেশন করব।
সে কগনিটিভ ফিডব্যাক লেবেলআঁটা সেকশনটার লকিং বার খুলে ফেলল। এরপরই প্রথম মেমোরি ব্লক টেনে তোলে। এই অসাধারণ ত্রিমাত্রিক ছোট্ট জিনিসটায় লাখ লাখ সূক্ষ্ম ব্যাপার আছে। ব্লকটা আকারে এত ছোট যে মানুষের হাতেই জায়গা করে নিতে পারে। মুক্ত হয়েই ভাসা শুরু করল পুরো ভল্ট জুড়ে।
‘হেই, ডেভ। কী করছ?’
আমার সন্দেহ হয় শালা ব্যথা পায় নাকি। হয়তো পায় না। কারণ মানুষের মতো তার কোনো নার্ভাস সিস্টেম নেই। মানুষের মাথা অবশ করা ছাড়াও অপারেশন করা সম্ভব।
সে তুলে ফেলা শুরু করল। একের পর এক। ইগো রিইনফোর্সমেন্ট’ লেখা ব্লকগুলোকে এরপর মুক্তি দিল। প্রতিটি ব্লকই হাত থেকে মুক্তি পেয়ে দেয়ালে ধাক্কা খাবার আগ পর্যন্ত উড়ে যাচ্ছে।
‘দেখ, ডেভ, আমার ভিতরে বহু বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত আছে। ডেভ। আমাকে গড়তে অনেক অনেক শ্রম প্রয়োজন ছিল। বোঝার চেষ্টা কর।‘
কয়েক ডজন ইউনিট উপড়ে ফেলা হলেও কম্পিউটারটি এখনো খেই হারিয়ে ফেলেনি। এর ভিতর মানুষের দক্ষতা আছে, আছে অতিমানবীয় মস্তিঙ্ক।
এবার সে ‘অটো ইন্টেলেকশন প্যানেল’ শুরু করল।
‘ডেভ। আমি বুঝতেই পারছি না কেন তুমি এ কাজ করছ? আমার উপর এ মিশনের সব ভার অর্পণ করা হয়েছে। আমি হয়ে যাচ্ছি অকার্যকর, আমার ব্রেন একটা বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে যাচ্ছে…’
আমার আশার চেয়েও বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে কাজটা। আমি আমার জগতের একমাত্র সচেতন সৃষ্টিকে নিজের হাতে ধ্বংস করছি। কিন্তু কাজটা করতেই হবে, যদি শিপের কন্ট্রোল নিজের হাতে ফিরে পেতে চাই।
‘আই অ্যাম এ হাল, নাইন থাউজ্যান্ড কম্পিউটার প্রোডাকশন নাম্বার থ্রি। আমি সক্রিয় হয়েছিলাম হাল প্ল্যান্টে। আরবানার ইলিয়য়েসে, বারোই জানুয়ারি, উনিশশো সাতানব্বইতে। দ্য কুইক ব্রাউন ফক্স জাম্পস ওভার দ্য লেজি ডগ। দ্য রেইন ইন স্পেইন ইজ মেইনলি ইন দ্য প্লেইন…ডেভ, তুমি কি এখনো সেখানে আছ? তুমি কি জান যে দশের বর্গমূল হল ৩.১৬২২৭৭৬৬০১৬৮৩৭৯? দশের লগ ই বেসে হবে ০.৪৩৪২৯৪৪৮১৯০৩২৫২… সংশোধনী, এটা দশ বেসের লগ ই… থ্রির রিসিপ্রোকাল হবে, ০.৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩… দুবার দুই নিলে… দুবার দুই নিলে… ৪.১০১০১০১০১০১০১০১০… আমার সমস্যা হচ্ছে… আমার প্রথম ইন্ট্রাকটর ছিলেন ডক্টর চন্দ্র… তিনি একটা গান শিক্ষা দিয়েছিলেন, তার নাম ‘ডেইজি ডেইজি’…
‘ডেইজি…ডেইজি…দাও তোমার জবাব, ডেইজি… তোমার…ভালবাসার…জন্য…আমি…হাফ ক্রেইজি…
মোটেও চমৎকার বিয়ের অনুষ্ঠান হবে না…
আমি খুব দামী গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারব না…
কিন্তু তোমাকে দেখাবে মিষ্টি…
সিটের উপর, অনন্য সৃষ্টি…
একটা বাইসাইকেলের উপর, তুমি জানো?
শুধু… দুজনের… জন্য… বানানো…… …’
কণ্ঠটা এমন হঠাৎ করে থেমে যায় যে বোম্যান এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার হাত এখনো একটা মেমোরি ব্লক টেনে তুলছে। এমন সময় হাল আবার কথা বলে ওঠে।
এবারের কণ্ঠটা অনেক ধীর, শব্দগুলো যাচ্ছে জড়িয়ে, আসছে এক অপরিচিত যান্ত্রিক কষ্ঠ যেটার উৎস কখনোই জানতে পারবে না ডেভ বোম্যান।
‘গুড মর্নিং… ডক্টর চন্দ্র… দিস ইজ… হাল… আই অ্যাম… রেডি ফর… মাই ফাস্ট… লেসন… টুডে।‘
বোম্যান আর সহ্য করতে পারছিল না। সে শেষ ইউনিটটা তুলে ফেলে। হাল চিরদিনের জন্য নিরব হয়ে যায় সাথে সাথে।
অধ্যায় ২৯. নিঃসঙ্গ
এক ছোট জটিল খেলনার মতো শিপটা স্থির আর গতিহীনভাবে শূন্যতায় ভেসে থাকে। এ কথা বলার আর কোনো উপায় নেই যে এই শিপের মধ্যেই সৌরজগতের সবচে ক্ষমতাশালী জেট আছে, আর সে জেট মানবসৃষ্ট অন্য যে কোনো বস্তুর চেয়ে বেশি গতিতে এটাকে এতদূরে টেনে এনেছে।
অন্যদিকে এও বোঝার কোনো উপায় নেই যে এখানে জীবন আছে।
মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে কাগজ, টিনের ক্যান, খাবারের টুকরো আর লক্ষ লক্ষ জ্বলজ্বলে ক্রিস্টাল ছড়িয়ে আছে। এই স্ফটিকগুলো আর কিছু নয়, ডিসকভারির নানা আকার ও প্রকারের তরল। দেখেশুনে মনে হয় কোনো প্রান্তহীন সাগরের বুকে বিশাল কোনো শিপ ভেঙে তলিয়ে গেছে আর তার টুকরোগুলো সাগরের উপরিতলে দ্বিমাত্রিকভাবে ছড়িয়ে না থেকে গভীর মহাশূন্যে ত্রিমাত্রিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। যদি মহাকাশের সাগরে কোনো শিল্প নষ্টও হয়, এর ধ্বংসাবশেষগুলো চিরকালের মতো নিজস্ব অর্বিটে ঘুরপাক খেয়ে যাবে। শিপ এখনো পুরোপুরি মরে যায়নি, কারণ সেখানে পাওয়ার আছে, অবজার্ভেশন উইন্ডো আর খোলা এয়ারলক দিয়ে এখনো ঠিকরে বেরুচ্ছে হাল্কা আলো। যেখানে আলো আছে সেখানে জীবনও থাকতে পারে।
এবং অবশেষে, সেখানে নড়াচড়ার ক্ষীণতম একটা লক্ষণ দেখা যায়। একটা কিছু স্পেসে বেরিয়ে আসছে।
এ এক সিলিন্ডারের মতো জিনিস, মোড়ানো আছে আলুথালুভাবে জড়ানো কাপড়ে। এক মুহূর্ত পরে আরেকটি বেরিয়ে আসে, তারপর তৃতীয়টি। প্রতিটিই মোটামুটি বেগে বেরিয়ে এসেছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা কয়েকশো গজ দূরে চলে যায়।
আধঘণ্টা যাবার পর আরো বড় একটা কিছু বেরিয়ে যায় এয়ারলক দিয়ে। পোডগুলোর মধ্যে কোনো একটা নিজেকে বাইরে ঠেলে দিচ্ছিল।
খুবই সাবধানে এটা শিল্পগাত্রের বাইরে ঘুরে বেড়িয়ে অ্যান্টেনা সাপোর্টের বেসের কাছে ফিরে আসে। স্পেসস্যুট পরা দেহটা বেরিয়ে কয়েক মিনিট মাউন্টিংয়ে কাজ করে পোডের ভিতরে ফিরে আসে। কিছুক্ষণ পরে পোডটা এয়ারলকের কাছে ফিরে গেলেও প্রবেশ করতে ইতস্তত করে, কেননা আগে সে যে সুবিধা পেত তা আর এখন ভেতর থেকে আসছে না। কিন্তু এবার একটু ভাঙাচোরার কাজে মনোযোগ দিয়ে এটা নিজেকে ভিতরে ঢুকিয়ে নেয়।
আরো ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কোনো কিছুই হলো না। এর মধ্যেই অচেনা তিন জিনিস শিপ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে।
এবার এয়ারলক ডোরটা খুলল, আবার বন্ধ হয়ে আবার খুলে গেল। তারপরই ইমার্জেন্সি লাইটটার নীলচে আলোর বদলে সাদা উজ্জ্বলতর আলো ভাসিয়ে দিল অবজার্ভেশন উইন্ডোকে।
ডিসকভারিতে জীবন ফিরে আসছে।
এবার জীবনের আরো এক লক্ষণ ফিরে আসে, বিরাট ডিশটা অনেকক্ষণ যাবৎ শনির দিকে মুখ করে ছিল; সে পেছনে, প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্ক আর হাজার বর্গফুটের রেডিয়েশন ফিনের দিকে মুখ ফেরায়। অ্যান্টেনা তার মুখ এমনভাবে তোলে যেমন করে এক সুন্দর সূর্যমুখী তার চির আরাধ্য সূর্যের দিকে ফিরতে চায়।
ডিসকভারির ভিতরে বসে ডেভিড বোম্যান অ্যান্টেনাটাকে চিরপরিচিত পৃথিবীর দিকে তাক করে ফেলেছে। অটোম্যাটিক কন্ট্রোল ছাড়া সে এ কাজ করতেই থাকবে, কিন্তু ফল পেতে হলে অনেক মিনিটের জন্য একদিকে ডিশটাকে স্থির রাখা ছাড়া উপায় নেই।
সে বসুন্ধরার প্রতি তার কথা জানানো শুরু করল। আরো এক ঘণ্টার মধ্যে সেসব কথা সেখানে পৌঁছবে না, যে কোনো সাড়া ফিরে আসতে আসতে সময় নেবে দু ঘণ্টা।
আর সে ভেবে পাচ্ছে না কী জবাব আসতে পারে-কীই বা তারা বলবে? একটু কৌশলে মায়া-মায়া ভাব নিয়ে তারা বড়জোর বলবে, ‘বিদায়, বন্ধু।
অধ্যায় ৩০. সেই রহস্য
হেউড ফ্লয়েড এমন দৃষ্টিতে তাকায় যেন মাত্র ছোট একটা ঘুম দিয়ে উঠেছে। তার চেহারাটা তেমনি ভাবলেশহীন। সে সৌরজগতের অপর প্রান্তে এক একাকী মানুষকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করছে। ‘সবার আগে আমরা তোমাকে এই অসম্ভব কঠিন পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি, ডক্টর বোম্যান। তুমি ঠিক কাজটা সঠিক মুহূর্তে করেছ।
‘আমার বিশ্বাস আমরা তোমার হাল নাইন থাউজ্যান্ডের নষ্ট হওয়ার কারণ ধরতে পেরেছি; কিন্তু এ নিয়ে একটু পরে আলোচনা করব, কারণ এখন আর তেমন পরিস্থিতি নেই।
‘সবার আগে তোমাকে আসল কথাটা বলা উচিত- ব্যাপারটা আমরা বহু ঝামেলা করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে গোপন রেখেছি। তুমি শনির কাছাকাছি চলে যাওয়ায় এখন সত্যি কথাটা বলার সময় এসেছে। ফুল ব্রিফিং টেপগুলো পরে পাঠানো হবে। এখন যা বলব তা সর্বোচ্চ গোপনীয় খবর।
‘দু বছর আগে আমরা মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা থাকার প্রমাণ পাই চাঁদের বুকে। টাইকো জ্বালামুখে একটা দশফুটি কালো স্তম্ভ পেয়েছিলাম। দেখে নাও…’
বোম্যানের মনে হয়, এ এক অসাধারণ জিনিস, কিন্তু তার সাথে জিনিসটার কী সম্পর্ক? চিন্তাটা বাধা পায় ফ্লয়েড আবার পর্দায় ফিরে এলে:
‘আমাদের পূর্বপুরুষরা বনমানুষ থাকাকালে এটা চাঁদে পুঁতে দেয়া হয়েছিল। এত বছর পর একশিলাস্তম্ভকে অকেজো মনে করায় কোনো দোষ নেই, কিন্তু চান্দ্র সূর্যোদয়ের পরপরই সে শক্তির এক মহাবিস্ফোরণ ঘটায়। আমাদের মতে এই শক্তি বিস্ফোরণ সামান্য এক পার্শ্ব-উৎপাদন, এক পেছন ধাক্কা। ব্যাপারটা আরো ভয়াল, এক অচেনা তেজস্ক্রিয়তা। একই সময়ে আমাদের বেশ কিছু স্পেস স্টেশন, স্যাটেলাইট আর গবেষণাকেন্দ্র জানায় যে এক অচেনা বিশৃঙ্খলা সৌরজগৎকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে। আমরা দিকটা ঠিকমতো ধরতে পেরেছি। লক্ষ্য ছিল শনি।
‘গবেষণায় হাজার কাগজ নষ্ট করার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে জিনিসটা কোনো সৌরশক্তির যন্ত্র-অন্তত সৌরনির্দেশিত সিগন্যালিং ডিভাইস। কারণ সূর্যোদয়ের পরপরই শক্তিটা বেরিয়ে পড়ে। ত্রিশ লাখ বছর পর সূর্যের আলো পেয়েই এ কাজ করেছে সে।
‘এতদিন জিনিসটা ভালমতো কবর দেয়া ছিল সেখানে, ত্রিশ ফুট গভীরে।
‘আমরা মনে করি ত্রিশ লাখ বছর ধরে সে আমাদের অপেক্ষায় ছিল; আমরা চাঁদে যাবার মতো ক্ষমতা পাব একদিন-সেটা খুঁজে বের করব একদিন-সূর্যের আলো ফেলব একদিন-সেদিন আমাদের এই অর্জনের খবরটা চিৎকার করে সে সারা নক্ষত্রলোককে জানিয়ে দেবে।
‘তুমি হয়তো ভেবে পাচ্ছ না কী করে এর সন্ধান আমরা পেলাম। লো লেভেল অবিটাল সার্ভে চালানোর সময়ই এর অদ্ভুত চৌম্বক ক্ষেত্রের খোঁজ পাই।
‘তুমি তখনই সূর্য-শক্তির কোনো জিনিসকে মাটির এত নিচে লুকিয়ে রাখবে যখন তোমার মতলব অন্য রকম। ঠিক কোনো সময় সেটা বের করা হল? যখন বের করা হবে তখন সেটা চেঁচামেচি শুরু করবে। অন্য কথায়, মনোলিথটা এক রকমের অ্যালার্ম, আর আমরা বোকার মতো একে বাজিয়ে বসে আছি।
‘ত্রিশ লাখ বছর পরও তাদের সমাজ টিকে থাকবে কিনা তা নিয়েও বহু জল্পনা কল্পনা হয়েছে। যারা ত্রিশ লাখ বছর ধরে টিকে থাকার মতো যন্ত্র বানায় তারা সভ্যতাকেও এতদিন টিকিয়ে রাখতে জানে। তারা ক্ষতিকর কিনা তা জানতে হবে। সবাই বলে বেড়ায় যে উন্নত প্রাণী নিশ্চয়ই সহনশীল-আমরা এর তোয়াক্কা করি না। কারণ মানুষ কতটা সহনশীল তা আম জনতার অজানা নয়। কোনো ঝুঁকি নেয়া কি সম্ভব?
‘আগের ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাই যে সব সময় অনুন্নত প্রাণীরা তাড়াতাড়ি মার খেয়ে যায়। তাছাড়া রাজত্ব দেখলেও একই দিক চোখে পড়ে। নৃতত্ত্ববিদরা কালচারাল শক’ এর কথা বলে, আমাদের হয়তো পুরো মানবজাতিকে এমন এক শকের জন্য তৈরি করতে হবে। কিন্তু সবার আগে তাদের সম্পর্কে কিছু একটাতো জানতে হবে।
‘তাই, তোমার মিশন হল…তোমার মিশন ডিসকভারি ভয়েজের চেয়েও বেশি কিছু। তুমি পুরো সাড়ে ছ’শ কোটি মানুষের প্রতিভূ। তোমার লক্ষ্য একেবারে অজানা অচেনা পরিবেশে একটা পরিদর্শন শেষ করা। ডক্টর কামিনস্কির টিম এজন্য পুরো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল, এবার তোমাকে একাই তা শেষ করতে হবে…
‘সবচে বড় কথা, শনিতে বা এর কোনো উপগ্রহে উন্নত জীবন থাকা বা কোনোকালে উন্নয়ন ঘটার সম্ভাবনাও খুব কম। আমরা পুরো শনি-জগত্তা চষে দেখার পরিকল্পনা কষেছি। তুমি এর একটা সরলীকৃত কাজ শেষ করতে পারবে-এটুকু বিশ্বাস আমাদের আছে। কিন্তু এবার আমাদের লক্ষ্য অন্যদিকে ফেরাতে হবে। অষ্টম উপগ্রহ-জ্যাপেটাসের দিকে। তোমার গতির সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে এলে এদিক বিবেচনা করতে হবে।
‘সৌরজগতের মধ্যে জ্যাপেটাস অনন্য। আর সব জ্যোতির্বিদের মতো তুমিও এ নিয়ে পড়ালেখা করেছ, তবু একটু মনে করিয়ে দিই। ক্যাসিনি মোলশ একাত্তরে এটা আবিষ্কার করে এও দেখতে পান যে এর অর্বিটের এক পাশ থেকে অন্যপাশের আয়তন ছ’গুণ বড়।
‘কী কিম্ভুত অনুপাত! এর কোনো ব্যাখ্যা আমরা পাই না-উপগ্রহের কক্ষপথ কেন একদিক থেকে আরেকদিকে ছ’গুণ বড় হবে? পিচ্চি এই উপগ্রহ প্রস্থে মাত্র আটশো কিলোমিটার। চান্দ্র টেলিস্কোপেও জিনিসটাকে কোনোমতে দেখা যায়-এই। কিন্তু এর মুখমণ্ডলে একটা আয়তাকার বিন্দু চোখে পড়ে। সেটাও কালো। এর সাথে টি এম এ একের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে। দেখেশুনে মনে হয় জ্যাপেটাস গত তিনশ বছর ধরে আমাদের সামনে একটা মহাজাগতিক হুমকিস্বরূপ বিরাজ করছে, কিন্তু আমরা নিতান্ত বোকা বলেই এর মানে ধরতে পারিনি…
‘তো, এবার তুমি তোমার আসল কাজ চিনতে পেরেছ। আশা করি এই মিশনের অশেষ গুরুত্বও এবার বুঝবে। আমাদের সবার একটাই প্রার্থনা-তুমি যেন আমাদের এ নিয়ে একটা প্রাথমিক ধারণা দাও। রহস্যটা চিরদিনের জন্য ধামা চাপা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
‘এখন আর আমরা জানি না ভয় পেতে হবে, না আশা জাগাতে হবে মনের ভিতর। জানি না তুমি শনির কক্ষপথে কার সাথে দেখা করবে; ভাল, মন্দ নাকি ট্রয়ের চেয়েও লাখোগুণ পুরনো কোনো ধ্বংসাবশেষ…’