৪. কয়েকটা মুহূর্ত

কয়েকটা মুহূর্ত সুজিত একলা বসে ছিল। সে যেন অনেকটা চকিত ঘুমভাঙা বিস্ময়ে নিজের জীবনের কথা ভাবছিল। তার সেই ঘুমন্ত জীবনের অস্পষ্টতা সে দেখতে চেষ্টা করছিল, ভবিষ্যৎ তাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়, তা জানবার জন্যেও একটা দুর্নিরীক্ষ কৌতূহল তার চোখে। একরাশ প্রশ্ন তার মনের চারপাশে পাক খাচ্ছিল, এবং সমগ্র জীবনটা যেন তার কাছে, পরের হাতের পুতুলের মতো, অনির্দিষ্ট, অনিশ্চিত এক কৌতুককর অস্পষ্ট রহস্যে জড়ানো মনে হচ্ছিল।

এখন তার জানতে ইচ্ছে করছে মা-বাবার কথা, ছেলেবেলার কথা। বিশ্ব-সংসারের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে, তার জীবনের অতীতেও বাবা-মা, স্নেহ-ভালবাসা, সবকিছুতেই পরিপূর্ণ ছিল। অথচ আজ সে অপরিণত প্রায়-বিকারগ্রস্ত মস্তিষ্কের চিকিৎসালয় থেকে, রিক্তসর্বস্ব একজন একলা মানুষ সংসারে বিচরণ করতে আসছে। সমস্ত অতীতটাই তাই আজ ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে। এই জানার মধ্যে কেমন একটা কান্না-মাখানো সুখ ও শান্তি যেন রয়েছে।

কিরণময়ী ঘরে আসা মাত্র সুজিত বলে উঠল, আচ্ছা বলতে পারেন, আমার মায়ের কী হয়েছিল? কেন মারা গেছলেন?

কিরণময়ী করুণ বিস্ময়ে একটু হাসলেন। বললেন, এ সব ভেবে আর তোমার কী হবে? চোখে তো দেখিনি, শুনেছি, অসুস্থ অবস্থায় একটা ভুল ওষুধ খেয়ে মারা গেছলেন।

কিরণময়ী মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকালেন। উনি কি কিছু গোপন করছেন? সুজিতের মনে মুহূর্তের জন্যে এক বার সন্দেহের ঝিলিক হেনে গেল। বলল, সত্যি ভুল ওষুধ খেয়ে?

মিথ্যে বলব কেন বাবা? সেটাই তো সব থেকে দুঃখের। যে-হিমানীদির সুখের অবধি ছিল না, ভুল ওষুধ খেয়ে সে মারা গেল।

–আর বাবা?

বলা যায়, তোমার মায়ের শোকেই। তোমার বাবার কেমন যেন ধারণা ছিল, তোমার মাকে কেউ বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছে। আবার এমনও ভাবতেন, হিমানীদি আত্মহত্যা করেছেন।

সুজিতের মনের মধ্যে নতুন প্রশ্ন জেগে উঠল। বলল, বাবা কাকে সন্দেহ করতেন যে, বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছে?

কিরণময়ী একটু চুপ করে রইলেন। তারপরে নিশ্বাস ফেলে বললেন, তাঁর সবথেকে অন্তরঙ্গ বন্ধু, আমার দাদা প্রতাপকে। যিনি তোমাকে এত কাল ধরে পালন করে এসেছেন।

–কেন, তাঁকে বাবা কেন সন্দেহ করতেন? কী বলে সন্দেহ করতেন?

 কিরণময়ী ঠোঁটে ঠোঁট টিপে তাকালেন সুজিতের দিকে। কিন্তু সুজিতের চোখে-মুখে, সর্বত্রই এমন একটি শিশুর সারল্য ও কৌতূহল ছিল, তিনি মন্দ কিছু ভেবে চুপ করে থাকতে পারলেন না। বললেন, কী হবে তোমার এ সব জেনে?

সুজিত করুণ-ব্যাকুলতায় বলল, বলুন না, বড় জানতে ইচ্ছে করছে।

–কিন্তু অতীনদার সন্দেহের মধ্যে কোনও সত্যই ছিল না। পোস্টমর্টেমে খুব ভালভাবেই পরীক্ষা হয়েছিল।

সুজিত বলল, তবু বলুন, আমি যাতে তাঁদের সবাইকে বুঝতে পারি। বাবাকে, মাকে, প্রতাপকাকাকে, সবাইকে যেন বুঝতে পারি। জানেন আমি বোকা হলেওআমি অনেক জিনিস বুঝতে পারি।

অনেক ব্যথার মধ্যেও কিরণময়ীর হাসি পেয়ে গেল। বললেন, তুমি বোকা হবে কেন? আমি তো দেখছি তুমি বেশ সরল সহজ।

–আপনার মনে হচ্ছে? সত্যি?

অপলক অবাক চোখে সে কিরণময়ীর দিকে তাকিয়ে রইল। এমন কথা সে কোনওদিন শোনেনি। বলল, কিন্তু কেউ তো তা বলে না।

এ কথার কোনও জবাব খুঁজে পেলেন না কিরণ। একটু হাসলেন। সুজিত বলল, হ্যাঁ, সেই কথা বলুন না।

কিরণ বললেন, তোমার মাকে আমার দাদাও খুব ভালবাসতেন, এমনকী বিয়ে করবারও ইচ্ছে ছিল। তোমার বাবাও সে কথা জানতেন। ঠিকমতো বলতে গেলে এইভাবে বলতে হয়, তোমার মাকে ওঁরা দুই বন্ধুই ভালবেসেছিলেন। দুই বন্ধুই তোমার মামার বাড়িতে একসঙ্গে যাতায়াত করতেন। তারপর যেন দুজনের ইচ্ছানুসারেই, অতীনদার সঙ্গে হিমানীদির বিয়ে হয়েছিল। আমার দাদা আর বিয়ে করেননি, কিন্তু ওঁরা বাইরের জীবনে একই ব্যবসায়ে পার্টনার এবং একই সংসারের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তোমার বাবা বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে কী হত তা জানিনে, কিন্তু আমরা ওঁদের খুবই সুখী দেখেছি।

কিরণময়ী হাসলেন। কিন্তু সুজিত যেন গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। সে ভাবছিল, বাবা নিশ্চয়ই ভুল ভেবেছিলেন। যাকে ভালবাসা যায়, তাকে কি কেউ বিষ মুখে তুলে দিতে পারে? মা কি আত্মহত্যা করেছিলেন? হয়তো আমার বাবার কাছে আত্মসমর্পণ করার পর, প্রতাপকাকার জন্যে তাঁর মন ব্যথায় ভেঙে পড়েছিল। এই মানসিক যাতনার অবসানের জন্যেই হয়তো, তাঁর প্রিয় বন্ধুদের মাঝখান থেকে নিঃশব্দে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

নিজের ওই ধরনের চিন্তায় নিজেই অবাক হল সুজিত। ভাবল, এমন কথা আমার মনে হচ্ছে। কেন? মানুষের যে সমাজ ও সংসারকে আমি সুস্থ স্থিরমস্তিষ্কে কখনও ভাল করে প্রত্যক্ষ করিনি, তাদেরই বিষয়ে এমন অদ্ভুত চিন্তা আমার মাথায় আসে কেন?

নিঃশব্দ চিন্তার ভিতর থেকেই সে হঠাৎ একটু বিষণ্ণ হেসে বলে উঠল, মানুষের জীবনটা খুব আশ্চর্য, না?

বলে সে মুখ তুলতেই দেখল, কিরণময়ীর জায়গায় দোলা দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই কপালে, গালের পাশে নেমে আসা চুল, আয়ত চোখে রুদ্ধ হাসির ছটা চিকচিক করছে। সুজিত বিব্রত বিস্ময়ে ঘরের চারপাশে এক বার দেখে, তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। বার দুয়েক ঢোঁক গিলে বলল, মানে–উনি, মানে আপনার

দোলা হাসি চেপে বলল, মা খাবার টেবিলে, আপনার জন্যে খাবার নিয়ে বসে আছেন।

–ও!

তবু বিস্ময় ঘুচতে চায় না সুজিতের। বলে, আচ্ছা, আমি তা হলে এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলছিলাম?

দোলা তাড়াতাড়ি ওর চুলের গুচ্ছই ঠোঁটের ওপর টেনে নিয়ে এল। বলল, মা-র সঙ্গে।

–ও!

এর পরেও কয়েক মুহূর্ত অসহায় বিস্ময়ে চুপ থেকে, সহসা তার সারা মুখ হাসিতে ভরে উঠল। বলল, উনি কখন এক সময় উঠে চলে গেছেন, না?

হাসিতে দোলার গলার স্বর প্রায় চাপা পড়ে আসছে। কোনও রকমে বলল, আপনি কী যেন ভাবছিলেন, তাই মা খাবার ব্যবস্থা করতে চলে গেছেন।

–ও!

–আর আমাকে ডাকতে পাঠিয়েছেন, আপনাকে খেতে দেওয়া হয়েছে।

ও তাই নাকি? আর আমি ভাবছি, একজনের জায়গায় আর একজনকে কেন দেখছি।

বলে সে একটু হাসতে গেল। তার আগেই দোলার অবরুদ্ধ হাসি, চাপবার শত চেষ্টা সত্ত্বেও, খিলখিল শব্দে ঝংকৃত হয়ে উঠল। সুজিতের আর হাসা হল না, হাসির আভাসটুকুই রইল। বিব্রত হয়ে চোখ পিটপিট করে, অসহায়ের মতো ঢোঁক গিলতে লাগল।

দোলা কোনও রকমে নিশ্বাস বন্ধ করে, প্রায় দাঁতে দাঁত চেপে হাসি রোধ করল এক মুহূর্ত। সুজিতের দিকে তাকালে হাসির তরঙ্গে ভিজে-ওঠা চোখে। কিছু বলার উদ্যোগ করল তাড়াতাড়ি।

সুজিত যেন একটু স্বস্তি পেয়েই এবার নিজেই একটু হাসল, হেঁ হেঁ হেঁ, আপনার

সুজিতের সরল মুখ দেখে ও সেই হাসি শুনে, এবার দোলা প্রায় একটা আর্তনাদ করেই, হাসিতে চৌচির হয়ে পড়ল। কিন্তু সুজিত এবার থামল না। সে বলল, আপনার হাসিটা খুব সুন্দর।

দোলা তা শুনতে পেল না। সে তাড়াতাড়ি হাত তুলে সুজিতকে ডাকল।

সুজিত বলল, আমাকে ডাকছেন?

দোলা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

সুজিত বলল, আমি যাব আপনার সঙ্গে?

দোলা হাসতে হাসতেই, ঘাড় নেড়ে, দ্রুত পিছন ফিরল। দোলার হাসি-তরঙ্গে-উপচানো উচ্ছিত শরীরের দিকে তাকিয়ে আর এক বার অসহায় বিস্ময়ে নিজের দিকে দেখল সুজিত। তারপর তাকে অনুসরণ করল।