বক্তৃতা : চার
কৌশল ও মানবিক প্রকৃতির সংঘাত
নানা দিক দিয়েই মানুষ অন্যান্য প্রাণীর থেকে পৃথক। এর মধ্যে একটি হল–নিজস্ব সত্তায় বিরস এরকম কাজকর্মে সে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে রাজি থাকে, কারণ এগুলো হল তার অভীপ্সা পরিপূরণের মাধ্যমে। জীববিদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়-প্রাণীরা সেই সব কাজ করে, যেখানে তাদের উদ্দেশ্যপূরণের জন্য শ্রমের প্রাসঙ্গিকতা থাকে; পাখিরা বাসা বানায়, এবং ধীবর বাঁধ তৈরি করে। কিন্তু, তারা এসব কাজ করে প্রবৃত্তি থেকে, কারণ এগুলো করার জন্য তাদের মধ্যে এক ধরনের আবেগ কাজ করে, এবং এটা কারণ নয় যে, তারা উপলব্ধির মাধ্যমে জানতে পারে, এগুলো দরকারি। তারা ইচ্ছামাফিক আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, অথবা বিচক্ষণতা অথবা দূরদর্শিতা অথবা আবেগ নিয়ন্ত্রণের অনুশীলন করে না। মনুষ্যজীবেরা এসব অনুশীলন করে। মানুষ যতটা সহ্য করতে পারে, তার চেয়েও বেশি মাত্রায় যখন তারা এসব করে, তখন তারা একটা মনস্তাত্ত্বিক শাস্তির শিকার হয়। সুসভ্য ধারায় জীবনযাপনে এই শাস্তির অংশবিশেষ অপরিহার্য, কিন্তু এর বেশিটাই অপ্রয়োজনীয়, এবং ভিন্ন জাতের সামাজিক সংগঠনের সাহায্যে তার অপসারণ সম্ভব।
মাধ্যম ও প্রেরণার এই সংঘাতের কদাচিৎ অভিজ্ঞতা ছিল আদিম মানুষের। শিকার, সংগ্রাম এবং বংশবিস্তারের প্রয়োজন ছিল অস্তিত্বরক্ষা ও বিবর্তনমূলক প্রগতির জন্য, কিন্তু এসব কাজে নিয়োজিত থাকার কারণ এটা নয়? সে এসবের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখতো কারণ এসব তাকে আনন্দ দিত। শিকার যথাসময়ে অলস ধনী মানুষের বিনোদনে হয়ে দাঁড়ালো। এটা তার জৈব উপযোগিতা হারিয়েছিল, কিন্তু উপভোগ্যতার বিষয়রূপে টিকে রইলো। আবেগ দ্বারা অনুপ্রাণিত সরল আঙ্গিকের যুদ্ধ এখন থেকে শুধুমাত্র স্কুলের ছেলেদের জন্য অনুমোদিত হল, কিন্তু সংগ্রামী মানসিকতা টিকে রইলো, এবং আরও ভাল নির্গমপথ নিষিদ্ধ হলে, যুদ্ধের মধ্যে দিয়েই তার অতি গুরুত্বপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটতো।
অবশ্য পুরনো যুগের মানুষ সম্পূর্ণত সেসব কাজকর্ম ছাড়া থাকত না, যেসব কাজকর্ম স্বাভাবিক আকর্ষণের তুলনায় সে মনে করতো প্রকৃতই প্রয়োজনীয়। মানুষের বিবর্তনের একেবারে গোড়ার দিকে, পাথরের জিনিস তৈরির জাক শুরু হয়েছিল, এভাবে সূচিত হয়েছিল দীর্ঘ অগ্রগতি, যা আমাদের বর্তমান বিস্তৃত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু, প্রাচীন প্রস্তরযুগে, সম্ভবত শৈল্পিক সৃজনের আনন্দ এবং লক্ষ্যপূরণের যাত্রাপথ খুব দীর্ঘ নয়, তখন মাধ্যমগুলো নিজেরাই খুব উপভোগ্য হয়ে থাকে যদি গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টি খুব উৎসাহজনক হয়। অবরোহণকালীন মাত্র কয়েক মুহূর্তের স্বর্গসুখের জন্য কোন বালক একটি স্লেজগাড়িসহ পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পরিশ্রম মেনে নেবে। পরিশ্রমী হওয়ার জন্য তাকে চাপ দেওয়ার প্রয়োজন নেই, এবং যতই সে হাঁফিয়ে যাক বা দম ফুরিয়ে যাক, তবুও সে সুখী। কিন্তু, তাৎক্ষণিক পুরস্কারের পরিবর্তে, যদি সত্তর বছর বয়সে তাকে একটা বার্ধক্য পেনশনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তাহলে তার সব উৎসাহই খুব তাড়াতাড়ি নিস্তেজ হয়ে যাবে।
স্লেজগাড়ির ওই বালকটির প্রচেষ্টার তুলনায় অনেক দীর্ঘতর উদ্যোগকে এক ধরনের সৃজনমূলক আবেগ দিয়ে অনুপ্রাণিত করা যায় এবং তখনও তা স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে পারে। একজন মানুষ এভারেস্ট আরোহণ অথবা দক্ষিণ মেরু পৌঁছানো অথবা কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় দুঃখকষ্ট, বিপদ এবং দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে বেশ কয়েক বছর কাটাতে পারে, এবং একই সঙ্গে, ওই স্নেজগাড়ির বালকটির মতো নিজের আবেগের সঙ্গে নিজেকে সুবিন্যস্ত রাখতে পারে, যদি তার লক্ষ্যপূরণের ইচ্ছাটা থাকে তীব্র এবং বাধাবিঘ্ন অতিক্রমের সঙ্গে তার গর্বকে যদি সমাপতিত করতে পারে। রেড ইন্ডিয়ানরা যেমন বলেছিল, এর মধ্যে রয়েছে গৌরব।
দাসপ্রথার প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল কাজের উদ্দেশ্য ও কর্মীর উদ্দেশ্যসমূহের বিচ্ছিন্নতা-প্রক্রিয়া। ফারাওদের গৌরব বৃদ্ধির জন্য পিরামিড নির্মিত হয়েছিল; যেসব ক্রীতদাস এই কাজ সম্পন্ন করেছিল, ওই গৌরবে তাদের কোন অংশ ছিল না, তারা শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়কের কশাঘাতের ভয়ে কাজ করতো। কৃষিতেও, যখন তা ক্রীতদাস বা ভূমিদাসদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো, একই ভাবে-যারা সেখানে কাজ করতো, তাদের কাছে কোন সন্তুষ্টি নিয়ে আসতো না; তাদের সন্তুষ্টির বিষয় ছিল একটাই-বেঁচে থাকা ও (ভাগ্য ভাল হলে) দৈহিক নির্যাতন থেকে মুক্ত থাকা।
বর্তমান সময়ে শিল্পবিপ্লবের আগে-ভূমিদাসতৃপ্রথার ক্রমাবলুপ্তি ও হস্তশিল্পের সমৃদ্ধির ফলে কাজের লোকের সংখ্যা বাড়লো, যারা নিজেরাই নিজেদের প্রভু ছিল, এবং সেকারণে তাদের উৎপাদিত পণ্যের মধ্য থেকে তারা সামান্য গৌরবও উপভোগ করতে পারতো। এই ধরনের অবস্থা থেকেই উত্থান ঘটলো জেফারসন ও ফরাসি বিপ্লব-অনুপ্রাণিত গণতন্ত্রের, যে গণতন্ত্রের মধ্যে অন্তর্ভুক্তি ঘটেছিল এক বিশাল সংখ্যক কম-বেশি স্বাধীন উৎপাদকের এবং এই অবস্থাটির বিকাশ ঘটেছিল আধুনিক কলাকৌশল-সৃষ্ট বিশালায়তন অর্থনৈতিক সংগঠনের বিপরীত প্রক্রিয়ায়।
ধরা যাক-এমন একটি সুবৃহৎ কারখানা, যেখানে মোটরগাড়ি তৈরি হয়। সংস্থাটির উদ্দেশ্যে হল মোটরগাড়ি তৈরি করা, কিন্তু কর্মীদের উদ্দেশ্যে হল-বেতন উপার্জন করা। বিষয়গত ভাবে, এখানে কোন সাধারণ উদ্দেশ্য নেই। শুধুমাত্র মালিক ও পরিচালকের মধ্যে উদ্দেশ্যের ঐক্য রয়েছে, এবং যারা কাজ করে, তাদের মধ্যে এই ঐক্য সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকতে পারে। কেউ কেউ হয়তো উৎপাদিত গাড়ির গুণ-মান। সম্পর্কে গর্ববোধ করতে পারে, কিন্তু, অধিকাংশেরাই, তাদের ইউনিয়নের মারফৎ, মূলত বেতন ও কাজের ঘন্টা সম্পর্কেই আগ্রহী থাকে।
অন্তত, কিছুদূর পর্যন্ত, এই ক্ষতিকর উপসর্গকে বৃহৎ আয়তনবিশিষ্ট যান্ত্রিকীকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। প্রথমোক্ত কারণে কোন মানুষই একটি গাড়ির কোন বৃহৎ অংশ তৈরি করে না, শুধুমাত্র কোন একটি অংশের একটি ক্ষুদ্রাংশই তৈরি করে; কাজের একটা বড় অংশের জন্য অতিসামান্য মাত্রার দক্ষতার প্রয়োজন হয়, এবং পুরো কাজটাই একঘেঁয়ে। দ্বিতীয়োক্ত কারণে (সংস্থার আয়তনের বিশালতা) যৌথভাবে যে দলটি একটি গাড়ি তৈরি করে, তাদের মধ্যে, কর্তৃপক্ষ বনাম কর্মীবাহিনী-সুলভ কোন ঐক্য এবং সংহতির মনোভাব থাকে না। বেতনভুক কর্মীদের মধ্যে সংহতি থাকে, কর্তৃপক্ষ-পরিচালক তরফেও সংহতি থাকতে পারে। কিন্তু, বেতনভুকদের সংহতির সঙ্গে উৎপন্ন পণ্যের কোন সম্পর্ক নেই; এই সংহতি বেতনবৃদ্ধি ও কাজের ঘন্টা হ্রাসের সঙ্গেই সম্পর্কিত। উৎপাদিত পণ্য সম্পর্কে পরিচালন-কর্তৃপক্ষের এক ধরনের গৌরববোধ থাকতে পারে, কিন্তু যখন কোন শিল্পের আগাপাশতলা বাণিজ্যিকীকরণ ঘটে, তখন শুধুমাত্র মুনাফা সম্পর্কে ভাবনার প্রবণতা গড়ে ওঠে, উন্নত কর্মসম্পর্কের পরিবর্তে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যা সহজেই অর্জিত হতে পারে।
কর্মগঠনপ্রণালীর হ্রাসপ্রাপ্ত গৌরবের পিছনে দুটি বিষয় রয়েছে। প্রথম বিষয়টি হল-মুদ্রাব্যবস্থার আবিষ্কার; দ্বিতীয়টি-গণ-উৎপাদন। মুদ্রাব্যবস্থার ফলে দামের মাধ্যমে কোন বস্তুর মূল্যায়ন প্রচলিত হল, যা ঠিকসহজাত নয়, বরং যা অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে অংশীভূত এক ধরনের আবেশন । বিনিময়ের জন্য তৈরি হয়নি, এমন জিনিসের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যেই মূল্যায়ন হতে পারে-তাদের ক্রয়ক্ষমতার জন্য নয়। গ্রামাঞ্চলে আবাসন বাগিচাগুলো প্রায়শই খুব সুন্দর হয়ে থাকে, এবং হয়তো তা অনেক শ্রমের বিনিময়েই গড়ে উঠেছে, কিন্তু তা কোন আর্থিক পুরস্কার এনে দেওয়ার লক্ষ্যে তৈরি করা হয়নি। কৃষকদের পোশাক-আশাক, যা এখন পর্যটকদের চিত্তবিনোদন ছাড়া দেখা যায় না, তৈরি করতো ওই পোশাক-ব্যবহারকারীদের পরিবারগুলো, যার কোন দাম ছিল না। গ্রিসের নগরদুর্গের মন্দির এবং মধ্যযুগের চার্চগুলো কোন আর্থিক উদ্দেশ্যে নিয়ে নির্মিত হয়নি, এবং সেগুলো বিনিময়ের উপযোগীও ছিল না। খুবই ধীরলয়ে, উৎপাদকের নিজস্ব ব্যবহারের উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতিকে সরিয়ে এল আর্থিক মুদ্রা-ভিত্তিক অর্থনীতি, এবং এই পরিবর্তনের সুবাদে পণ্যসম্ভার আনন্দদায়ক হওয়ার পরিবর্তে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
গণ-উৎপাদন এই প্রক্রিয়াকে এক নতুন দৈর্ঘ্যে প্রসারিত করেছে। ধরা যাক-আপনি একজন বোতাম-উৎপাদক ও আপনার তৈরি বোতাম যত সুন্দরই হোক না কেন, আপনার নিজের ব্যবহারের জন্য সামান্য কয়েকটি বোতামের বেশি আপনার প্রয়োজন নেই। অবশিষ্ট বোতামের বিনিময়ে আপনি খাদ্য ও আশ্রয়, একটি মোটগাড়ি এবং আপনার ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ, এ রকম আরও অনেক কিছু পেতে ইচ্ছুক। এসব বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে বোতামের অর্থমূল্য ছাড়া অন্য কোন সম্পর্ক নেই এবং এমনকী বোতামের অর্থমূল্যের বিষয়টিও আপনার কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল মুনাফা, অর্থাৎ উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে তার বিক্রয়মূল্যের উদ্বৃত্ত, যা বৃদ্ধি করা সম্ভব উৎপাদিত পণ্যের স্বাভাবিক উৎকর্ষের অবনমন ঘটিয়ে। বস্তুত, সাধারণত স্বাভাবিক উৎকর্ষের অবক্ষয় ঘটে, যখন গণ-উৎপাদনের অধিকতর আদিম। প্রক্রিয়ার জন্য বিকল্পের মাধ্যমে অপসারণ ঘটানো হয়।
ইতিপূর্বেই উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও, আধুনিক উৎপাদন-সংস্থায় পণ্য উৎপাদকের স্বার্থ-হ্রাস সংক্রান্ত দু-ধরনের প্রক্রিয়া ঘটে থাকে। একটি হল উৎপাদনকর্মটি থেকে মুনাফা-প্রাপ্তির সম্ভাবনার দূরত্ব; অন্যটি হল-পরিচালন-কর্তৃপক্ষ ও কর্মীর পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা।
মুনাফা-দূরত্ব ব্যাপারটা এইরকম ও ধরা যাক-রপ্তানির জন্য কোন পণ্য উৎপাদনের কোন একটি গৌণ স্তরে আপনি নিযুক্ত রয়েছেন এই মহুর্তে- আবার ধরা যাক, সেই পণ্যটি হল মোটরগাড়ি। বেশ জোর দিয়ে আপনাকে বলা হল- রপ্তানিবৃদ্ধির অভিযান খুবই জরুরি, যাতে আমরা খাদ্য কিনতে সক্ষম হই। আপনার শ্রমের বিনিময়ে যে বাড়তি খাদ্য কেনা হল, তা আপনার কাছে ব্যক্তিগতভাবে পৌঁছায় না, কিন্তু তা ব্রিটেনে বসবাস করে এরকম চল্লিশ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হল। আপনি যদি একদিন কাজে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে জাতীয় অর্থনীতির দৃশ্যত কোন ক্ষতি হয় না। শুধুমাত্র বৌদ্ধিক প্রচেষ্টার দ্বারাই আপনি নিজেকে অবহিত করতে পারেন-কাজ না করার জন্য কী ক্ষতি হয়েছে, এবং একমাত্র নৈতিক প্রচেষ্টা দ্বারাই নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন আপনার চাকরির স্বার্থেই পূর্বের তুলনায় বেশি কাজ করার জন্য। গোটা ব্যাপারটাই পুরোপুরি অন্যরকম, যখন প্রয়োজনের ধরন খুবই স্পষ্ট ও জোরালো, উদাহরণস্বরূপ-জাহাজ ধ্বংসের ঘটনা। পোতধ্বংসের সময়ে নাবিকদল নিজেদের যুক্তি-ভাবনার প্রয়োজনীয়তা ব্যতিরেকেই আদেশ পালন করেন, কারণ তাদের এমন একটি সাধারণ উদ্দেশ্য রয়েছে, যা খুব দূরবর্তী নয়, এবং তা চরিতার্থ করার উপায়গুলো বোঝাও দুরূহ নয়। কিন্তু, যদি ক্যাপ্টেন সরকারের মতো, তাঁর আদেশের সারবত্তা বোঝানোর জন্য মুদ্রাব্যবস্থার নিয়মনীতি ব্যাখ্যা করতে বাধিত বোধ করেন, তাহলে তাঁর বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগেই জাহাজ ডুববে ।
পরিচালন-কর্তৃপক্ষ ও কর্মীদের পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার দুটি দিক রয়েছে, যার একটি হল-মূলধন ও শ্রমের পরিচিত সংঘাত, যেখানে অন্যটি সমস্ত বৃহৎ সংগঠনের পক্ষে যন্ত্রণাদায়ী অধিকতর সাধারণ অসুবিধা । আমি শ্রম ও মূলধনের সংঘাত সম্পর্কে কিছুই বলতে চাই না, কিন্তু, কি রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক সংস্থার ক্ষেত্রে, কি ধনতন্ত্র অথবা সমাজতন্ত্রের অধীনে, সরকারের দূরবর্তিতা কমবেশি সেই একই গতানুগতিক বিষয়, যা সম্যকভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে।
সমাজ যতই সংগঠিত হোক না কেন, সেখানে অনিবার্যভাবেই থাকবে সাধারণ স্বার্থ ও এই-ওই বিভাগীয় স্বার্থ সংঘাতের প্রশস্ত এলাকা। কয়লার দামবৃদ্ধি কয়লাশিল্পের পক্ষে সুবিধাজনক হতে পারে এবং কয়লাখনির শ্রমিকদের বেতনবৃদ্ধিতেও সহায়তা করতে পারে, কিন্তু এছাড়া অন্যসকলের কাছেই কিন্তু এই দামবৃদ্ধি অসুবিধাজনক। যখন সরকার দাম ও বেতন বেঁধে দেন, তখন প্রতিটি সিদ্ধান্তই কিছু মানুষকে অসন্তুষ্ট করবেই। সরকারের সঙ্গে পরিমাপযোগ্য বিষয়গুলো এতটাই সাধারণ ধরনের, এবং শ্রমিকদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে তার অপসারণ এতটাই আপাতধর্মী যে, দৃঢ়প্রত্যয়োৎপাদক রূপে তাদের আবির্ভাব খুবই কঠিন। বিস্তৃত অসুবিধার চেয়ে নিবিড় সুবিধা সর্বদাই প্রশংসিত হয়ে থাকে। এই ধরনের কারণের জন্য সরকারের পক্ষে মুদ্রাস্ফীতি প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন, এবং, যখন তারা এরকম করে, তখন তারা জনসাধারণের অপ্রিয় হয়ে উঠতে বাধ্য, সাধারণ জনস্বার্থে প্রকৃতই আত্মনিয়োজিত কোন সরকার এই ঝুঁকি বহন করে যে, সমাজের প্রতিটি অংশ মনে করে সরকার স্বেচ্ছাচারীভাবে তাদের স্বার্থকে উপেক্ষা করছে। এটা একটা অসুবিধা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যে অসুবিধারও মাত্রাবৃদ্ধির প্রবণতা থাকে।
তাছাড়া, এটাও অযথা আশা করা ঠিক নয় যে, সমস্ত সরকার, এমনকী তা গণতান্ত্রিক হলেও, সর্বদাই যা করবে, তা সবই জনসাধারণের স্বার্থে। আমি আগেই আমলাতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত কিছু খারাপ দিক সম্পর্কে বলেছি; জনসাধারণের সঙ্গে আধিকারিকদের সম্পর্কের বিষয়ে এবার আমি কিছু আলোচনা করতে ইচ্ছুক। কোন সুসংগঠিত সমাজে যারা সরকারি কাজকর্ম পরিচালনা করেন মন্ত্রী থেকে শুরু করে স্থানীয় অফিসের একেবারে নিম্নপদস্থ কর্মচারী, সকলেরই রয়েছে তাদের নিজেদের স্বার্থ, যা কোনভাবেই সমাজের স্বার্থের সঙ্গে সমাপতিত হয় না। এগুলোর মধ্যে, ক্ষমতার প্রতি লোভ ও কাজে অনীহা-এদুটিই হল প্রধান। যে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী কোন প্রকল্পকে ‘না’ বলেছেন, তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর কর্তৃত্ব প্রয়োগ ও অনীহা প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজস্ব সন্তুষ্টি চরিতার্থ করে থাকেন এবং এভাবে তখন তাকে দেখে মনে হয়, এবং আংশিকভাবে যা সত্য, তা হল- তিনি যেন তাদেরই শত্রু হয়ে উঠেছেন, যাদের সেবা করার কথা তার।
দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক-খাদ্যভাব মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসংক্রান্ত বিষয়। যদি কোন আবণ্টন আপনার অনুকূলে মঞ্জুর হয়ে থাকে, তাহলে খাদ্য সংগ্রহের জন্য অসুবিধা আপনাকে কঠোর পরিশ্রমের দিকে চালিত করতে পারে, যদি আপনার রেশনকে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য আপনার উৎপন্ন ফসল ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষকেই তাদের সব খাদ্যদ্রব্য কিনতে হয় যদি না তারা কৃষিতে নিয়োজিত থাকে। সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত অবাধ ব্যবস্থায় দাম বাড়বেই এবং ধনীরা ছাড়া সকলেই গুরুতরভাবে অপুষ্টির শিকার হয়ে দাঁড়াবে। যদিও এই ঘটনা সত্য, আমাদের মধ্যে খুবই অল্পসংখ্যক মানুষ খাদ্য অফিসের মহিলাদের পরিষেবার জন্য কৃতজ্ঞ বোধ করেন, এবং তাই তাঁদের মধ্যে আরও অল্পসংখ্যক হতাশা ও উদ্বেগের মধ্য দিয়ে, পুরোপুরি জনদরদি ভুমিকাকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়ে থাকে । যতই অন্যায় ধারণা হোক না কেন, ওই মহিলাদের সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণা হল-ওরা নির্বোধ, স্বেচ্ছাচারী; আর, ওই মহিলাদের কাছে জনসাধারণ হল-বিরক্তিকর, ব্যস্তবাগীশ ও মূর্খ, যারা সবসময়েই এটা-সেটা হারিয়ে ফেলে ও তাদের ঠিকানা বদলায়। এরকম একটা অবস্থায়, এটা দেখা সহজ নয়, কিভাবে সরকার ও শাসিতদের মধ্যে প্রকৃত সমন্বয় গড়ে ওঠা সম্ভব।
ব্যক্তিগত অনুভূতি ও সমষ্টিগত অনুভূতির আংশিক সমন্বয় গড়ে ওঠার যেসব পদ্ধতি এতদিন পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়েছে, সে সম্পর্কে বহুবিধ আপত্তির অবকাশ রয়েছে।
সবচেয়ে সহজ ও সুস্পষ্ট সমন্বয়সাধক হল যুদ্ধ । কোন কঠিন যুদ্ধের, যখন জাতীয় আত্মমর্যাদা বিপন্ন হয়ে ওঠে, তখন সকলকেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা সহকারে কাজে উদ্বুদ্ধ করা সহজ, এবং জনসাধারণ যদি সরকারকে যোগ্য বলে মনে করে, তাহলে তার আদেশ সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপালিত হয়। এই অবস্থাটা সেই পোত ধ্বংসের মতোই। কিন্তু, নৌ শৃঙ্খলা উন্নয়নের জন্য কেউ-ই জাহাজ ধ্বংসের মতো উপায়ের অনুকূলে ওকালতি করবে না, এবং আমরা এই যুক্তিতেও যুদ্ধের স্বপক্ষে ওকালতি করতে পারব না যে, যুদ্ধের ফলে জাতীয় ঐক্য অর্জিত হয়। সন্দেহ নেই-যুদ্ধের ভয়ে ওই ধরনের ফলদায়ী ঘটনা ঘটানো সম্ভব কিছু যুদ্ধভীতি যদি দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত থাকে, তার ফলশ্রুতিতে আসল যুদ্ধও ঘটে যেতে পারে, একদিকে যেমন তা জাতীয় ঐক্যের অগ্রগতি ঘটাবে, অন্যদিকে তা দৌর্বল্য ও হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মনোভাবের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
প্রতিযোগিতা, যেখানে তার অস্তিত্ব রয়েছে, তা এক দারুণ শক্তিশালী উদ্দীপক বিষয়। সাধারণভাবে, এটা সমাজতান্ত্রিকদের দ্বারা নিন্দিত হয়ে থাকে পুঁজিবাদী সমাজের অন্যতম মন্দ দিক হিসেবে, কিন্তু সোভিয়েত সরকার শিল্পসংগঠনের খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই প্রতিযোগিতার প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছেন। এরকমই একটা দৃষ্টান্ত হল-স্টাকানভীয় পদ্ধতি, যেখানে ব্যতিক্রমী দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য নির্দিষ্ট কিছু শ্রমিককে পুরস্কৃত করা হয়, যখন অন্যদের খামতির জন্য শাস্তি দেওয়া হয়ে থাকে এবং এটা হল সময় আনুপাতিক পারিশ্রমিক প্রথার পুনরুজ্জীবন যার বিরুদ্ধে ট্রেড ইউনিয়নগুলো তীব্রভাবে ও সাফল্যের সঙ্গে প্রচার করেছে। আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ যে, রাশিয়ায় এই ব্যবস্থার উৎকর্ষ পুঁজিবাদীরা দাবি করতো, এবং সেগুলোই খারাপ দিক বলে ট্রেড ইউনিয়নগুলো প্রচার করতো। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সমাধান হিসাবে এগুলো নিশ্চিতভাবেই নিতান্ত অযোগ্য।
যদিও বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রতিযোগিতার বিষয়টি গভীরভাবে আপত্তিকর, কিন্তু, আমি মনে করি-প্রয়োজনীয় উদ্যোগের বিকাশে এবং কোন ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে নির্দোষ প্রবৃত্তিজাত নির্গমের ব্যবস্থাপক, অন্যথায় যা যুদ্ধের কারণও হয়ে উঠতে পারতো-এসব ক্ষেত্রে এই প্রতিযোগিতা একটা প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করতে পারে। ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার অবলুপ্তির স্বপক্ষে কেউ ওকালতি করবে না। চিরকালের দুই প্রতিদ্বন্দী ফুটবল দল যদি, হঠাৎ ভ্রাতৃত্বের ভালবাসায় প্রভাবিত হয়ে সহযোগিতামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, তারা প্রথমে একদিকের গোলপোস্টের বাইরে বল মারবে, তারপর বিপরীত দিকের পোস্টের বাইরে, তাহলে কারও সুখ বাড়বে না। এরকমও কোন কারণ নেই যে, প্রতিযোগিতাসূত্রে প্রাপ্ত উৎসাহ শুধুমাত্র অ্যাথলেটিকসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। বিভিন্ন দল অথবা লোকালয় অথবা সংগঠনের মধ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটা দরকারি উদ্দীপনা হতে পারে। কিন্তু, প্রতিযোগিতা যদি নির্মম ও ক্ষতিকর না হয়ে উঠতে চায়, তাহলে ব্যর্থতার শাস্তি যেন যুদ্ধ বা অনাহারের মতো অনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাজনিত বিপর্যয় না ডেকে এনে শুধুমাত্র গৌরবহানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ফুটবল নিশ্চিতভাবে একটা কাক্ষিত খেলা হিসাবে গণ্য হবে না, যদি পরাজিত দলকে হত্যাদেশ বা অনাহারের আদেশ দেওয়া হয়।
ব্রিটেনে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, কর্তব্যবোধের প্রতি আবেদনের জন্য একটি মহৎ প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। বর্তমান সময়ে কৃচ্ছসাধন অপরিহার্য, এবং উৎপাদনবৃদ্ধিই হল একমাত্র সমাধান এটা অস্বীকার করা যায় না, সংকটের সময়ে এ ধরনের আবেদন নিঃসন্দেহে খুবই জরুরি। কিন্তু, কর্তব্যবোধ, মাঝে মাঝে তা যতই মূল্যবান ও অপরিহার্য বলে মনে হোক না কেন, কোন স্থায়ী সমাধান হতে পারে না, এবং দীর্ঘসময় জুড়ে তার সফল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না। এটার মধ্যে থাকে এক ধরনের মানসিক চাপ এবং স্বাভাবিক প্রবৃত্তির প্রতি অবিরাম প্রতিকূল মনোভাব, যা অব্যাহত থাকলে ক্রমবিলীয়মান ও স্বাভাবিক উদ্যমের ক্রমাবলুপ্তিকে টেনে আনে। যদি এটার ওপর জোর দেওয়া হয়, তাহলে দশটি নীতিনির্দেশের মতো কিছু সরল ঐতিহ্যপূর্ণ নীতিবোধের ভিত্তিতে নয়, বরং জটিল আর্থ-রাজনৈতিক কারণেই সংশ্লিষ্ট যুক্তিবাদের প্রেক্ষিতে আসতে পারে সংশয়বাদ, এবং অনেক মানুষ হয় ভেবে যে, সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছানোর হয়তো কোন সংক্ষিপ্ত রাস্তা আছে। মানুষ আশাবাদের মাধ্যমে উদ্দীপ্ত হতে পারে অথবা ভয়তাড়িত হতেও পারে, কিন্তু আশা ও ভীতি সুস্পষ্ট ও তাৎক্ষণিক হওয়া প্রয়োজন যদি ক্লান্তি-উৎপাদন ব্যতিরেকেই সেগুলোকে কার্যকরী করে তুলতে হয়।
আংশিকভাবে এই কারণেও হিস্টিরিয়াধর্মী প্রচার, অথবা অন্তত হিস্টিরিয়া ছড়ানোর উদ্দেশ্যেমুখী প্রচার সারা বিশ্বে এ ধরনের বিস্তৃত প্রভাব ফেলেছে । সাধারণভাবে সব মানুষই জানে-পৃথিবীর দূর দূর অংশে সংঘটিত ঘটনার সুবাদে তাদের দৈনন্দিন জীবনও প্রভাবিত হয়, কিন্তু মুষ্টিমেয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ ছাড়া, অন্যদের সে ধরনের জ্ঞান নেই যাতে তারা বুঝতে পারে, কিভাবে এগুলো ঘটে। কেন চালের আকাল? কেন কলা এত দুপ্রাপ্য? কেন আপাতভাবে ষাড়েরা ক্রমশ লেজহীন হয়ে যাচ্ছে? যদি আপনি ভারত, অথবা লাল ফিতে, বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতি দোষারোপ করেন, তাহলে মানুষের মনে এমন একটা রূপকথাসদৃশ শয়তানের মন্ত্রমুগ্ধ ধারণার বীজ বুনে দেবেন, যাকে ঘৃণা করা সহজ। প্রতিটি দুর্ভাগ্যের ঘটনায় এটা একটা স্বাভাবিক প্রবণতা এমন একটা শত্রুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা হয়, যার ওপর দোষটা চাপিয়ে দেওয়া যায়; আদিমতা সব দুর্দশার দায়ভার আরোপ করতো শত্রুতাপূর্ণ জাদুশক্তির ওপর। যখন আমাদের কষ্টের কারণগুলো বুঝে ওঠা খুবই কঠিন হয়ে ওঠে, আমরা তখন এই আদিম ধরনের ব্যাখ্যাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করি। যে সংবাদপত্র ডলার ঘাটতির খবর পরিবেশন করে, তার তুলনায় যে আমাদের কাছে ঘৃণাযোগ্য কোন খলনায়কের সংবাদ দেয়, তা পাঠকের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ হয়ে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, যখন জার্মানরা দুঃখকষ্টের মধ্যে পড়লো, তখন তাদের অনেককেই বোঝানো হয়েছিল যে, ইহুদিরাই দোষী।
আমাদের জীবনের যা কিছু যন্ত্রণাদায়ক, তার ব্যাখ্যা হিসেবে কোন কল্পিত শত্রুর প্রতি ঘৃণার আবেদন সাধারণত ধ্বংসাত্মক ও সর্বনাশা হয়ে থাকে; এটা আদিম প্রবৃত্তিজাত উৎসাহকে উত্তেজিত করে, কিন্তু বিভিন্নভাবে এর পরিণতি ঘটে দুঃখময়। ঘৃণার প্রতি আবেদনের গভীরতা কমানোর বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। স্পষ্টতই, সর্বশ্রেষ্ট পদ্ধতি হল-যেখানে সম্ভব, সেসব ক্ষেত্রে কোন শত্রুকে খুঁজে বার করার চেষ্টার মন্দ উপসর্গটিকে নিরাময় করা। এটা যদি করা না-ও যায়, তাহলেও আমাদের দুর্ভাগ্য সৃষ্টিকারী প্রকৃত কারণগুলো প্রচার করা মাঝে মাঝে সম্ভব হতে পারে। যতদিন হিস্টিরিয়াসুলভ উৎসাহে সমৃদ্ধ রাজনীতি ও সংবাদ জগতের সুদৃঢ় চালিকাশক্তির অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন এটা করা কঠিন।
আমি মনে করি না যে, দুর্ভাগ্য নিজেই এক ধরনের ঘৃণা উৎপাদন করে, দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, যার ফলশ্রুতিতে ঘটেছিল নাৎসি উত্থান। হতাশা ও দুর্ভাগ্যের একটা পরিবেশ থাকতে হবে। রবিনসন নামে সুইজারল্যান্ডের একটি পরিবার, নিজেদের দ্বীপভূমিতে প্রচুর কাজের সন্ধান যারা পেয়েছে, তারা ঘৃণা নিয়ে সময় অপচয় করবে না। কিন্তু, জটিলতর কোন পরিস্থিতিতে প্রকৃতই প্রয়োজনীয় কাজকর্ম ব্যক্তি মানুষদের কাজে আবেদন রাখতে অনেক কম সমর্থ হয়ে থাকে। ব্রিটিশদের জাতীয় অর্থনীতির বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা জানি-সমষ্টিগতভাবে কী প্রয়োজন: বর্ধিত উৎপাদন, ভোগুহাস এবং রপ্তানিতে উৎসাহ। কিন্তু এগুলো বড় ধরনের সাধারণ বিষয়, দৃশ্যত সেগুলো সুনির্দিষ্ট পুরুষ ও নারীদের কল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। যদি আপাতভাবে এ ধরনের দুরবর্তী ভিত্তির কাজকর্মকে উদ্দীপনা ও আনন্দের সঙ্গে পরিচালিত করতে হয়, তাহলে জাতীয় অর্থনীতির প্রয়োজনভিত্তিক অধিকতর তাৎক্ষণিক কারণসমূহ উদ্ভাবনের পদ্ধতি বিন্যস্ত করতে হবে । আমি মনে করি, এর জন্য প্রয়োজন নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা-হস্তান্তর এবং নাতিবৃহৎ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বাঞ্ছনীয় কম-বেশি স্বাধীন কর্মধারার সুযোগ ।
বর্তমান যুগের বৃহৎ রাষ্ট্রে যে গণতন্ত্র রয়েছে, তা অতি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্যোগের অনুকূলে উপযুক্ত সুযোগ দেয় না। আমরা এটা বলতে প্রায়শই অভ্যস্ত যে, গ্রিকরা যাকে ‘গণতন্ত্র বলতো, মহিলা ও ক্রীতদাসদের অন্তর্ভুক্তি না থাকার কারণে তাতে ঘাটতি ছিল, কিন্তু আমরা সর্বদা বুঝি না-কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে, যখন সরকারি ক্ষেত্র সুবিস্তৃত, তখন সম্ভাব্য সব কিছুর চেয়ে গ্রিসের গণতন্ত্র অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ছিল। প্রতিটি ইস্যুতে প্রত্যেক নাগরিক ভোটদান করতে পারতো; সে কোন প্রতিনিধিকে এই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারত না। সে জেনারেল সহ প্রশাসনিক উচ্চপদস্থদের নির্বাচিত করতে পারতো, এবং তাদের নিন্দিত করতেও পারতো, যদি তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের বিরাগভাজন হতো। নাগরিকদের সংখ্যা ছিল স্বল্প; ফলে প্রতিটি মানুষ তার গুরুত্ব অনুভব করতো এবং তার নিজস্ব পরিচিতির জোরেই সে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রাখতে সক্ষম ছিল। আমি এরকম মন্তব্য করছি না যে, সামগ্রিকভাবে এই ব্যবস্থা ভাল ছিল; আসলে, এর খুব গভীর অসুবিধাও ছিল। কিন্তু, ব্যক্তি-উদ্যোগকে মঞ্জুর করার মতো একটি ক্ষেত্রে, এই ব্যবস্থা আধুনিক পৃথিবীর বর্তমান যে কোন ব্যবস্থার চেয়ে উৎকৃষ্টতর ছিল।
দৃষ্টান্তের জন্যই ধরা যাক-একজন সাধারণ করদাতার সঙ্গে অ্যাডমিরালের সম্পর্কে বিষয়টি। সমস্ত করদাতাই সমষ্টিগতভাবে অ্যাডমিরালেরই কর্মচারী। পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিরা তার বেতনের স্বপক্ষে ভোট দেয়, এবং সরকারকে বেছে নেয়, এই সরকার আবার বিভাগীয় দপ্তর মনোনীত করে, যারা অ্যাডমিরালকে নিয়োগ করে। কিন্তু, যদি ব্যক্তিগত করদাতা অ্যাডমিরালের অনুকূলে কর্তৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, যা মালিক থেকে কর্মচারী স্তরে প্রথাগত, তাহলে খুব শীঘ্রই তাকে তার স্থানে বহাল করা হবে। অ্যাডমিরাল হলেন একজন মহান মানুষ, যিনি কর্তৃত্ব-চালনাতে অভ্যস্ত; সাধারণ করদাতা তা নয়। সমগ্র গণ-পরিষেবার ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম মাত্রায় এই একই ধরনের ঘটনা সত্য। এমনকী, আপনি যদি ডাকঘরে শুধুমাত্র একটা চিঠি রেজিস্ট্রি করতে চান, তাহলে পদস্থ কর্মচারীটিও তাৎক্ষণিক ক্ষমতা-প্রদর্শনের অবস্থানে থাকেন; তিনি অন্তত এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীন যে কখন আপনার মনোযোগ আকর্ষণকে তিনি লক্ষ্য করবেন। আপনি যদি জটিলতর আরও কিছু চান, তাহলে তিনি বদমেজাজি হলে আপনার যথেষ্ট বিরক্তি ঘটাতে পারেন; তিনি আপনাকে অন্য একজনের কাছে পাঠাতে পারেন, যিনি আবার প্রথম জনের কাছেই আপনাকে ফেরৎ পাঠাতে পারেন; এবং এসব সত্ত্বেও ওই দুইজনই জনগণের ‘ভূত’ রূপেই গণ্য হয়ে থাকেন। সাধারণ ভোটদাতা, এতদিন পর্যন্ত নিজেকে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, এবং অসামরিক প্রশাসনের সমস্ত ক্ষমতার উৎসরূপে বিবেচনা করে অবশেষে নিজেকে তাদের অনুগত প্রজা হিসাবেই অনুভব করে, চীনারা একসময়ে যেমন বলতো কাঁপো এবং মান্য করো। যতদিন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ সুদূর ও বিরল ছিল, যখন সরকারি প্রশাসন ছিল কেন্দ্রীভূত এবং নেতৃত্ব কেন্দ্রবিন্দু থেকে পরিধি পর্যন্ত হস্তান্তরিত হতে, ততদিন ক্ষমতার সামনে এই ধরনের ব্যক্তিগত অক্ষমতার মনোভাব পরিহার করা কঠিন এবং তা সত্ত্বেও, এটা পরিহার করতেই হবে, যদি গণতন্ত্রকে নিছক সরকারি যান্ত্রিকতায় নয়, বরং অনুভূতিতে বাস্তব রূপগ্রাহ্য করে তুলতে হয়।
এই বক্তৃতায় অন্তর্ভুক্ত মন্দ উপসর্গের অধিকাংশ কোন নতুন জিনিস নয় । সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই সভ্য সমাজের বেশির ভাগ মানুষই পরিপূর্ণ দুঃখকষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করেছে; গৌরব, রোমাঞ্চ, উদ্যোগ এ সবকিছুই ছিল কিছু সুবিধাভোগী মানুষদের জন্য, যেখানে সিংহভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল সাময়িক তীব্র নিষ্ঠুরতাযুক্ত এক কঠোর শ্রমসম্পৃক্ত জীবন। কিন্তু, প্রথমে পাশ্চাত্য জাতিগুলো, পরে ক্রমশ সমগ্র পৃথিবী এক নতুন আদর্শের স্পর্শে জেগে উঠেছে। আমরা আর এই ঘটনায় সন্তুষ্ট নই যে, সামান্য কিছু মানুষ সব ভাল জিনিস উপভোগ করবে, যেখানে অসংখ্য মানুষ থাকবে হতভাগ্য। প্রাথমিক শিল্পায়নের মন্দ দিকগুলো থেকে জন্মেছে এক ভীতিজনিত রোমাঞ্চ, যা রোমক সাম্রাজ্যের সময়ে তারা ঘটাতে পারতো। দাসপ্রথার অবলুপ্তি ঘটেছিল, কারণ এটা অনুভূত হয়েছিল যে, নিছক অন্যের সমৃদ্ধির স্বার্থে মানুষকে যান্ত্রিক মাধ্যমে হিসেবে ব্যবহার করা ঠিক নয়। আমরা এখন আর অন্তত তত্ত্বগতভাবেও, সাদা চামড়া বিজয়ীদের দ্বারা ভিন্ন বর্গের জাতির শোষণকে সমর্থন করি না। ধনী ও দরিদ্রের ফারাক কমানোর ইচ্ছা নিয়েই সমাজতন্ত্রকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছিল। অন্যায় অসাম্য এবং কষ্ট ও অবক্ষয়ের ভিত্তির ওপরে একটি চমৎকার উপরিকাঠামো-গঠনে অনিচ্ছার বিরুদ্ধে, সর্বস্তরেই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়ে এসেছে।
বর্তমানে সাধারণভাবে এই নতুন বিশ্বাসকে এতটাই স্বতঃসিদ্ধের মতো ধরে নেওয়া হয়েছে যে, মানবজাতির দীর্ঘ ইতিহাসে এটা কতটা বিপ্লবী হতে পারে, সে সম্পর্কে পর্যাপ্ত অনুধাবন করা হয়নি। এই পটভূমিতে, বিগত এক শত ষাট বছরের পথপরিক্রমা যেন এই ভাবধারা-অনুপ্রাণিত এক ধারাবাহিক বিপ্লবের ইতিহাস । সমস্ত নতুন অথচ প্রভাববিস্তারী বিশ্বাসের মতোই এটাও অস্বস্তিকর এবং কঠিন সমঝোতার দাবি রাখে। এক্ষেত্রে একটা বিপদ রয়েছে-অন্যান্য দৈব নির্দেশেরও যেমন রয়েছে-পাছে মাধ্যমকেই যেন লক্ষ্য হিসেবে ভুল না করা হয়, ফলাফল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লভ্য ভুলে যায়। এখানে এমন একটা ঝুঁকি রয়েছে-সমতার নামে সুষম বণ্টন সহজসাধ্য নয়, ভাল জিনিস রূপে স্বীকৃত না-ও হতে পারে। অতীতের কিছু অবিচারসমৃদ্ধ সমাজ এমন কিছু স্বল্পসংখ্যক সুযোগ উপহার দিয়েছিল, আমরা মনোযোগী না হলে, আমরা যে নতুন সমাজ গড়ে তুলতে চাই, সেই সমাজ উপরোক্ত সুযোগ কাউকেই দিতে না-ও পারে। যখন আমি বর্তমান সময়ের খারাপ দিকের কথা বলি, তা আমি বলি এই কারণে নয় যে, সেগুলো অতীতের তুলনায় বৃহত্তর, বরং আমি এটাই নিশ্চিত করতে চাই যে-অতীতের যা ভাল, তা ভবিষ্যতেও বহন করে নিয়ে যাওয়া উচিত, এবং পরিবৃত্তিকালে যতদূর সম্ভব অক্ষত অবস্থাতেই। কিন্তু, এই লক্ষ্য যদি পূরণ করতে হয়, কয়েকটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যেগুলো স্বপ্নরাষ্ট্রের নীল নকশায় ভুলে যাওয়ার প্রবণতা থাকে ।
গণতান্ত্রিক সাম্যের কাছে যে কয়েকটি জিনিসের অনাবশ্যকভাবে বলিপ্রদত্ত হওয়ার বিপদ রয়েছে, সম্ভবত তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আত্মসম্মান। আত্মসম্মানের মাধ্যমে, আমি বোঝাতে চাই গর্বের অর্ধাংশ-যাকে বলা হয়ে থাকে প্রকৃত গর্ব।’ মন্দ অর্ধাংশ হল উৎকর্ষের মনোভাব। আত্মসম্মান একজন মানুষকে শোচনীয় দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা থেকে রক্ষা করে, যখন সে শত্রুদের ক্ষমতার মধ্যে থাকে এবং তা তাকে এই অনুভূতি এনে দেবে যে, যখন সমগ্র পৃথিবী তার বিরুদ্ধে, তখনও সে সঠিক পথেই থাকতে পারে। যদি কোন মানুষের এই গুণ না থাকে, তার মনে হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমত, অথবা সরকারি মতকেই অভ্রান্ত বলে মেনে নেওয়া উচিত এবং ওই ধরনের অনুভব, যদি তা সাধারণভাবে অভ্রান্ত হয়ে থাকে, নৈতিক ও বৌদ্ধিক-দুই অগ্রগতিকেই অসম্ভব করে তোলে।
এতদিন পর্যন্ত, আত্মসম্মান প্রয়োজনীয়ভাবে সংখ্যালঘিষ্ঠের বৈশিষ্ট্য রূপেই চলে এসেছে। যেখানে ক্ষমতার বৈষম্য রয়েছে, সেখানে অন্যের শাসনাধীন প্রজাদের মধ্যে এর দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। স্বৈরতন্ত্রের চরম বিদ্রোহমূলক বৈশিষ্ট্যের একটি হল-অবিচারের শিকারদের এমনভাবে তারা চালনা করে, যাতে তারা তাদেরই যেন তোষামোদ করে, যারা তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে।
রোমের গ্লাডিয়েটররা সম্রাটদের সেলাম ঠুকতো, যে সম্রাটরা তাঁদের বিনোদনের জন্য গ্লাডিয়েটরদের প্রায় অর্ধাংশকে বলি দিত। জেলবন্দী ডস্টয়েভস্কিও নিকোলাস জার নিকোলাসের শুভকামনার ভান করতেন। সোভিয়েত সরকার কর্তৃক প্রায়শই কোতল হওয়া ব্যক্তিরা পাপবোধের একটা শোচনীয় স্বীকারোক্তি করে তাকে, যখন যারা অভিযোগ থেকে মুক্ত হয়ে পালিয়ে ঘৃণা উদ্রেককর চাটুকারিতায় নেমে পড়ে এবং প্রায়শই সহকর্মীদের দোষারোপ করার চেষ্টায় একটি গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে এরকম বড় ধরনের আত্মহীনমন্যতা পরিহার করার সম্ভাবনা রয়েছে এবং আত্মমর্যাদা সংরক্ষণের সম্পূর্ণ সুযোগও দিতে পারে। কিন্তু তা আবার সম্পূর্ণ বিপরীতটাও করতে পারে।
যেহেতু অতীতে আত্মসম্মান মূলত সুবিধাভোগী সংখ্যালঘিষ্ঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেকারণে প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীবিরোধী ব্যক্তিরা তার অবমূল্যায়ন করতো এবং যারা বিশ্বাস করে যে, মানুষের কণ্ঠস্বরই হল ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর, তারা হয়তো এরকম সিদ্ধান্তে আসতে পারে যে, কোন অস্বাভাবিক অভিমত বা রুচি প্রায় এক ধরনের এবং তা দলের বৈধ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে নিন্দনীয় বিদ্রোহরূপেই প্রতিভাত হবে। এটা পরিহার করা যায়, শুধুমাত্র যদি স্বাধীনতাকে গণতন্ত্রের মতোই মূল্যবান মনে করা হয় এবং যদি এটা উপলদ্ধি করা হয় যে সমাজে প্রত্যেকেই সকলের ক্রীতদাস, তা অপর একটি সমাজের চেয়ে সামান্য ভাল, যেখানে প্রত্যেকেই একজন স্বেচ্ছাচারীর ক্রীতদাস। যেখানে সকলেই ক্রীতদাস অথবা সকলেই স্বাধীন, সেখানে সাম্য বিরাজ করে। এই ঘটনা নির্দেশ করে যে, সাম্য তার নিজস্ব সত্তায় একটা উত্তম সমাজ গঠনের যথেষ্ট শর্ত নয় ।
সম্ভবত, একটি শিল্পসমৃদ্ধ সমাজে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এবং নিশ্চিতভাবেই কঠিনতম জিনিসের একটি, তা হল-কাজকে উপভোগ্য করে তোলা, এই অর্থে কাজ যখন আর নিছক বেতন উপার্জনের মাধ্যমমাত্র নয়। বিশেষত অদক্ষ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়। যে কাজ কঠিন, তা সেই সব মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হওয়ার সম্ভাবনা, যারা তা করতে সক্ষম। শব্দছক ও দাবাখেলা কয়েক ধরনের দক্ষ কাজের কাছাকাছি প্রায় সদৃশ, তা সত্ত্বেও নিছক আনন্দের জন্য অনেক মানুষ এই দুটি বিষয়ে যথেষ্ট প্রয়াস ব্যয় করে থাকে। কিন্তু যন্ত্রের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বেতনভোগীদের আনুপাতিক সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে, যাদের কাজ পুরোপুরি একঘেঁয়ে এবং পুরোপুরি সহজ। অধ্যাপক অ্যাবারক্রোম্বাই তার গ্রেটার লন্ডন প্ল্যান, ১৯৪৪’ শীর্ষক রচনায় ঘটনাক্রমে ও বিনা গুরুত্বে চিহ্নিত করেছেন যে, অধিকাংশ আধুনিক শিল্পের প্রয়োজন নেই বিশেষ ধরনের তীক্ষ্ণতা এবং সে কারণে ঐতিহ্যবাহী দক্ষতাসম্পন্ন জেলাঞ্চলে সেগুলো স্থাপনের প্রয়োজন নেই। তিনি বলেছেন: ‘আধুনিক কর্মপ্রকৃতি কোন বিশেষ শ্রমশক্তির ওপর আর নির্ভর করে না, এই কর্মপ্রকৃতি আপেক্ষিকভাবে দাবি করে অত্যল্প দক্ষতা, কিন্তু উঁচু মাত্রার স্থায়িত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা; বর্তমান সময়ের শ্রমিক-বাহিনীর মধ্যে প্রায় সর্বত্রই এই গুণগুলো দেখতে পাওয়া যায়।’
‘স্থায়িত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা’ নিঃসন্দেহে খুবই প্রয়োজনীয় গুণ, কিন্তু এগুলোই যদি সব হয় একজন কাজের লোকের কাছে, তাহলে এরকম সম্ভাবনাও রয়েছে যে, তার কাজে সে কোন আকর্ষণ খুঁজে পাচ্ছে না এবং এটাও নিশ্চিত-তার জীবন চায়, ওরকম সন্তুষ্টি সে কাজের ঘণ্টার বাইরে থেকে খুঁজে নেবে। আমি বিশ্বাস করি না-এটা পুরোপুরি অপরিহার্য, এমনকী যখন কাজ তার নিজস্ব সত্তাতেই একঘেঁয়ে ও আকর্ষণহীন।
প্রথমেই প্রয়োজন-অতীতে মালিকানার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু অনুভূতি শ্রমিকের কাছে প্রত্যর্পণ করা। যন্ত্র যখন জড়িত থাকে, তখন একজন ব্যক্তিগত শ্রমিকের প্রকৃত মালিকানা সম্ভব নয়, কিন্তু এক ধরনের গর্ববোধ অর্জন করার অনেক পথ থাকতে পারে, যে গর্ববোধের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকতে পারে এরকম অনুভূতি-এটা আমার কাজ, অথবা যে কোন অর্থে আমাদের কাজ, যেখানে এই আমাদের’-এর অর্থ হল-এমন একটা ছোট গোষ্ঠী, যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেককেই চেনে এবং নিজেদের মধ্যে রয়েছে। সংহতির সক্রিয় মনোভাব। জাতীয়করণের দ্বারা এটা অর্জন করা সম্ভব নয়, জাতীয়করণের সূত্রে পরিচালক ও পদস্থ স্তরের ব্যক্তিদের সাধারণ কর্মচারীদের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, যে ধরনের পারস্পরিক ব্যবধান দেখা যায় কোন পুঁজিবাদী শাসনে। যা জরুরি, তা হল সব ধরনের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে স্থানীয় ক্ষুদ্র স্তরের গণতন্ত্র; যাদের ওপর কর্তৃত্ব করতে হবে, তাদের দ্বারাই ফোরম্যান ও ম্যানেজারের নির্বাচন হওয়া উচিত।
একজন সাধারণ কর্মচারীর তরফে, কোন শিল্পসংস্থার কর্তৃত্বের নৈর্ব্যক্তিক ও দূরবর্তী বৈশিষ্ট্য যে কোন মালিকানাভিত্তিক স্বার্থের পক্ষে বিপজ্জনক। মিঃ বার্নহামের ম্যানেজারিয়েল রিভলিউশন’-এ প্রতিফলিত হয়ে রয়েছে, নিকট ভবিষ্যকালীন সম্ভাবনার আনন্দদায়ক ছবির অনেক দূরবর্তী প্রতিচ্ছবি, তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারী নীরস পৃথিবীকে যদি আমরা পরিহার করতে চাই, প্রথম গুরুত্বের বিষয়টি হল-পরিচালন কর্তৃপক্ষের গণতন্ত্রীকরণ। এই বিষয়টি প্রশংসনীয়ভাবে আলোচিত হয়েছে মিঃ জেমন গিলেসপির ‘ফ্রি এক্সপ্রেশন ইন ইন্ডাস্ট্রি’ শীর্ষক রচনায় এবং আমি তাঁকে উদ্ধৃত করা ছাড়া অন্য কিছু করতে পারি না। তিনি বলেছেন, “যখন কোন ব্যক্তি মানুষ অথবা একটি গোষ্ঠী কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং সেই ভার নিয়ে শীর্ষে উঠতে অক্ষম, তখন দেখা দেয় একটা হতাশার মনোভাব। অসামরিক ও শিল্পগত আমলাতন্ত্রে যেমন দেখা যায়-একই ধরনের বিলম্ব দেখা যায়, এক্স অথবা ওয়াইয়ের দৃষ্টান্তক্রমেও নিয়মের বর্ণনা এবং অসহায়তাও হতাশার অভিন্ন অনুভূতি। ‘যদি আমি শুধু প্রধানের কাছে পৌঁছাতে পারতাম, তিনি তাহলে অবশ্যই বুঝতে পারতেন, নিশ্চিতভাবেই দেখতেন…।‘
শীর্ষে পৌঁছাবার এই ইচ্ছাটা খুবই বাস্তব ও গুরুত্বপূর্ণ। কর্মীগোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিদের মাসিক সভা মূল্যহীন নয়, কিন্তু এটা মালিক ও কর্মচারীর মুখোমুখি সম্পর্কের কার্যকরী বিকল্প নয়। পরিস্থিতিটা খুব সুবিধাজনক হয়ে ওঠে না, যখন বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক অথবা একজন অপারেটর কোন সমস্যা নিয়ে ফোরম্যানের কাছে যান এবং কর্তৃত্বে দায়বদ্ধ ফোরম্যান, নিয়ন্ত্রণ-হস্তান্তরের মাধ্যমে, সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে পাঠানো ছাড়া অন্য কিছু করতে পারেন না। পর্যায়ক্রমে তিনি এটা পাঠিয়ে দেন কর্মপরিচালকের কাছে, যিনি তা পরবর্তী সভার কর্মসূচিতে তালিকাভুক্ত করেন। অথবা, বিষয়টি জনকল্যাণ বিভাগেও পাঠানো হতে পারে, বড় কোম্পানিতে থাকে বড় কল্যাণ বিভাগ এবং কল্যাণবিভাগীয় কোন বিকল্প ব্যক্তি অথবা ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা মালিকের বিকল্প স্বরূপ পার্সোনাল ম্যানেজার নিজে বিষয়টি পর্যালোচনা করতে পারেন অথবা তা স্থানান্তরে পাঠিয়ে দিতেও পারেন ।
‘খুব বড় কোম্পানিতে হতাশার মনোভাবের চেয়েও বেশি কিছুর অস্তিত্ব দেখা যায়; নিচুতলার কর্মীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মপ্রক্রিয়ায় একটা অদ্ভুত অর্থহীনতা দেখা যায় । সামগ্রিকভাবে কোম্পানিতে তার কাজের প্রকৃত গুরুত্ব সম্পর্কে সে খুব কমই জানে। সে জানে না, কে তার প্রকৃত ঊর্ধ্বতন প্রশাসক, প্রায়শই সে জানে না, কে-ই বা জেনারেল ম্যানেজার, এবং অধিকাংশ সময়েই প্রধান কর্মপরিচালক তার সঙ্গে কথাই বলেন না। বিক্রয় বিভাগীয় পরিচালক, ব্যয়-বিভাগীয় পরিচালক, পরিকল্পনা-বিভাগীয় পরিচালক, মুখ্য কল্যাণ বিভাগীয় পরিচালক, এবং অন্যান্য আরও অনেকেই হলেন ভাল চাকরি ও সংক্ষিপ্ত কর্মসময়ের মানুষ। তাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই, তারা তার গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়।‘
কি রাজনীতিতে অথবা কি শিল্পক্ষেত্রে-গণতন্ত্র কোন মনস্তত্ত্বমূলক বাস্তবতা নয়, যত দিন পর্যন্ত সরকার বা পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে ‘তারা’ বলে মনে করা হয়, যা একটি দূরবর্তী সংস্থা, যাদের চালচলন রাজসিক এবং যাকে বৈরিতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীতে মান্য করাটাই স্বাভাবিক-যে বৈরিতা অসার যদি না তা বিদ্রোহের রূপ নেয়। মিঃ গিলেসপি নির্দেশিত অভিমত অনুসারে, শিল্পে এই প্রবণতার অনুকূলে যৎকিঞ্চিৎ অগ্রগতি হয়েছে, এবং কিছু বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া পরিচালন-কর্তৃপক্ষ খুব স্পষ্টভাবেই রাজতান্ত্রিক অথবা স্বেচ্ছাচারী গোষ্ঠীতান্ত্রিক। এটা এমন একটা মন্দ দিক, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে যদি তা ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা সংগঠনের ক্রমবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই বাড়তে থাকবে ।
ইতিহাসের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে মানবজাতির সিংহভাগ অতিবাহিত করেছে দারিদ্র্য এবং ক্লেশ ও নিষ্ঠুরতার ভারবাহী ছাতার তলায়, এবং প্রতিকূল অথবা নৈর্ব্যক্তিক ক্ষমতার প্রভাবে নিজেদের অক্ষমতা অনুভব করেছে। সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য এসব অশুভ প্রবণতা আর প্রয়োজনীয় নয়, আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক কৃৎকৌশলের সাহায্যে এগুলোর অপসারণ সম্ভব, যদি অবশ্য মানবিক উদ্দীপনা এবং জীবন ও সুখের ঝর্ণাধারার উপলব্ধি সহকারে এগুলো ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের উপলব্ধি ব্যতিরেকে আমরা অস্বস্তিজনকভাবে একটা নতুন বন্দিশালা তৈরি করে ফেলতে পারি, এবং সম্ভবত কেউই তার বাইরে থাকতে পারবে না, অবশিষ্ট হিসাবে শুধু থাকবে বিষাদ এবং আনন্দহীনতা এবং মৃতবৎ উৎসাহহীনতা। এই বিপর্যয়কে এড়ানো যায়, তা আমি আলোচনা করবো আমার শেষ দুটি বক্তৃতায়।
পুনশ্চ
উৎকর্ষসংক্রান্ত অবক্ষয়ের একটি কৌতূহলোদ্দীপক ও বেদনাদায়ক দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে স্টকল্যান্ডের পশম শিল্পের সূত্রে। সর্বোৎকৃষ্ট গুণমানসম্পন্নরূপে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত হাতে বোনা দীর্ঘকাল ধরে হেব্রিডস এবং ওর্কনে এবং শেটল্যান্ড দ্বীপের মতো, উচ্চভূমিতে উৎপাদিত হয়ে এসেছে, কিন্তু যন্ত্রে বোনা পশম-শিল্প প্রতিযোগিতা হস্ত শিল্পী-তন্তুবায়দের দারুণভাবে আঘাত করেছে, পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে বিতর্কের সূত্রে, ক্রয়করের সুবাদে কিছু দাক্ষিণ্য মিলেছে। এর ফল দাঁড়ালো-হস্তশিল্পের মাধ্যমে যারা আর জীবিকানির্বাহ করতে সক্ষম হচ্ছিল না, তারা শহরে বাস করার জন্য দ্বীপভূমি ও উচ্চভূমি ছাড়তে লাগলো, এমনকী দেশান্তরীও হতে লাগলো।
বার্ষিক ১০,০০,০০০ পাউন্ড থেকে ১৫,০০,০০০ পাউন্ডে ক্রয়করের বৃদ্ধির মতো স্বল্পকালীন লাভের বিনিময়ে যে দীর্ঘকালীন ক্ষতির বোঝা নেমে এল, যা পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
প্রথমত, শিল্পবিপ্লবের অন্ধ ও লোভী স্বর্ণময় দিনগুলোতে প্রাপ্ত ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে যুক্ত হল আরও একটি স্থানিক ও ঐতিহ্যবাতী দক্ষতার ক্ষয়, যে দক্ষতা সংশ্লিষ্ট শিল্পীকে দিত সৃজনের আনন্দ এবং এমন একটা কঠোর জীবনধারা, যা কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতেও, উদ্ভাবনী দক্ষতা ও উদ্যমের মাধ্যমে তাদের কাছে এনে দিত গর্ব, আত্মমর্যাদা ও কৃতিত্বের আনন্দ।
দ্বিতীয়ত, নান্দনিকতা ও উপযোগিতা-উভয়দিক থেকেই দেখা গেল উৎপন্ন বস্তুতে সহজাত উৎকর্ষের ক্রমাবনতি।
তৃতীয়ত, স্থানীয় শিল্পের এই বিনাশের ফলে দেখা গেল এক ধরনের অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নের প্রবণতা, যা আমরা আমাদের নগর-পরিকল্পনায় পরিহার করতে সচেষ্ট হয়েছি। একসময়ের স্বনির্ভর তন্তুবায়েরা পরিণত হল সুবিশাল, বীভঃস এবং রুগ্নতালাঞ্ছিত মনুষ্যস্থূপে। তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আর তাদের নিজস্ব দক্ষতা ও প্রাকৃতিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল রইলো না। এটা মুষ্টিমেয় বৃহৎ সংস্থার মধ্যে তলিয়ে গেছে, যেখানে একটি বা একজনের ব্যর্থতা ডেকে আনে সকলের ব্যর্থতা, এবং ব্যর্থতার কারণগুলোও বোঝা যায় না ।
এই প্রক্রিয়ার পেছনে রয়েছে দুটি বিষয়-এই সময়ে-শিল্পবিপ্লবের উপসৃষ্টি। একদিকে, গোড়ার যুগের শিল্পপতিদের মতো নয়, যারা তাদের কৃতকর্মের ফলাফল দেখতে পায়নি, আমরা ফলাফলজনিত মন্দ দিকগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। অন্যদিকে, উৎপাদনবৃদ্ধির জন্য, বা কর্মীদের জীবনধারণের মানোন্নয়নের জন্য এই ক্ষতিকর দিকগুলো আর ততটা জরুরি নয়। বৈদ্যুতিক শক্তি ও মোটর-পরিবহন ক্ষুদ্র শিল্পগুলোকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবেই বৈধতা নয়, এমনকী বাঞ্ছনীয় করে তুলেছে, কারণ তারা পরিবহন ও সাংগঠনিকতার খাতে বিপুল ব্যয়কে নিয়ন্ত্রিত রাখে। যেখানে একটি গ্রামীণশিল্প এখনও সমৃদ্ধ, ক্রমশ তার যান্ত্রিকীকরণ করা উচিত। কিন্তু তাকে স্থিতাবস্থায় ও ক্ষুদ্র আকারেই রেখে দেওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে শিল্পায়ন এখনও প্রাথমিক অবস্থায়, সেখানে আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ আতঙ্ক পরিহার করার সম্ভাবনা এখনও রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারতের কথা বলা যায়, যে দেশটি ঐতিহ্যগতভাবেই গ্রামীণসমাজে সমৃদ্ধ। এটা খুবই বেদনাদায়ক হবে, যদি সমস্ত কিছু মন্দ দিক নিয়েও ঐতিহ্যবাহী জীবনধারার বিনিময়ে নাগরিক শিল্পায়নের আরও খারাপ উপসর্গসহ আকস্মিকভাবে ও হিংসাত্মকভাবে পরিবর্তন ঘটানো হয়-কারণ এর ফলাফল ভুগতে হবে সেইসব মানুষদের যাদের জীবনধারণের মান ইতোমধ্যেই বেদনাদায়কভাবে নিচু। এসব বিপদের আশঙ্কা করেই গান্ধী উপমহাদেশে হস্তনির্মিত বয়নের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে ঘড়ির কাঁটাকে উল্টো দিকে ঘোরাতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি অর্ধাংশ সঠিক ছিলেন, কিন্তু বিজ্ঞান-প্রদত্ত সুবিধাকে প্রত্যাখ্যান করাও মস্ত ভুল । পরিবর্তে বরং এগুলোকে সাগ্রহে গ্রহণ করা উচিত এবং বৈষয়িক সম্পদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের প্রয়োগ করা দরকার, এবং একই সঙ্গে ক্ষুদ্র জনপদের বিশুদ্ধ বাতাস ও স্থিতাবস্থা, দায়িত্ববোধ ও কর্ম সুসম্পন্ন হওয়ার গৌরব, যা বৃহৎ শিল্পসমৃদ্ধ শহরের কর্মীর ক্ষেত্রে কদাচিৎ সম্ভব-এসবের সংরক্ষণেও তার প্রয়োগ ঘটানো বাঞ্ছনীয়। ভারতের গ্রামীণ শিল্পের ক্রমশ যান্ত্রিকীকরণ ও বাস্তবে ভাল থাকার ক্ষেত্রে অপরিমেয় অগ্রগতির স্বার্থে হিমালয় প্রসূত সব নদনদীর সামগ্রিক জলবিদ্যুতের ব্যবস্থা করা উচিত এবং এসব হওয়া প্রয়োজন শিল্পমন্দাজনিত বিপর্যয় ও সূক্ষ্মতর অবক্ষয় ব্যতিরেকেই, কারণ এসব ফলশ্রুতি অনিবার্য হয়ে থাকে যখন শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যকে নির্দয়ভাবে ভাঙচুর করা হয় ।